1972.09.02 | নির্যাতিতা নারী পুনর্বাসন উৎসাহজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে | বাংলার বাণী
(বাংলার বাণী রিপোর্ট)
সমস্যা অনেক, অর্থাভাব আরও বেশী তবুও সবার অলক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের নির্যাতিতা নারীদের পুনর্বাসন কাজ বর্তমানে এক উৎসাহজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
পরিকল্পনা ১০ কোটি টাকার; কিন্তু এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ১২ লাখ টাকা, তা হলেও কাজ যা হয়েছে তা অর্থের পরিমাণে বিচার করা যাবে না, এ ব্যাপক ও মহৎ পরিকল্পনার প্রাথমিক সাফল্য উপলব্ধি করতে হলে চাক্ষুষ দেখতে হবে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বর্বর পাক-বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের যে অসংখ্য নারী নির্যাতিতা হয়েছিলেন, সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলাদেশ জাতীয় নারী পুনর্বাসন বোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারী এই বোর্ড গঠন করেছেন। বোর্ডের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তা মহিলাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ক্ষতিগ্রস্তা শিক্ষিতা মহিলাদের জীবিকা অর্জনের উপায় খুঁজে দেয়া, অল্প শিক্ষিতদের হাতে-কলমে নানা ধরনের শিক্ষা দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়াও বোর্ডের অন্যতম উদ্দেশ্য।
বিচারপতি জনাব কে.এম. ছোবহান ও অন্যান্য বিশিষ্ট সমাজসেবীকাদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই বোর্ড। প্রত্যেক জেলায় এর জেলা বোর্ড রয়েছে।
গোটা দেশের পুরো সমস্যাটিকে সামনে রেখে বোর্ড ব্যাপক কার্য্যপ্রণালী গ্রহণ করেছে। এই ব্যাপারে বোর্ড দ্বিমুখী কার্যপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তা মহিলাদের চিকিৎসার উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্তা মহিলাদের পুনর্বাসন পরিকল্পনা।
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা সহ দেশের প্রতিটি জেলায় ক্লিনিক খোলা হয়েছে। ভোলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত মহকুমায়ও ক্লিনিক খোলা হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে পাক-বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলাদের এই সকল ক্লিনিকে চিকিৎসা করা হয়। নির্যাতিতা মহিলাদের চিকিৎসার জন্য বোর্ডকে অনেক অসুবিধারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। তার কারণ প্রধানতঃ নির্যাতিতা মেয়েরা নিজেদের সমাজে আত্মপ্রকাশ করতে চায় না। বোর্ডের কর্মচারীর গ্রামাঞ্চলে তাদের খোঁজ করে করে গোপনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। বোর্ডের বিভিন্ন ক্লিনিকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫শ’ ৩ জন মহিলাকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে। ক্লিনিকে বর্তমানে অত্যাচারজনিত নানা ধরনের সংক্রামক রোগের চিকিৎসার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
নির্যাতিতা মহিলাদের চিকিৎসার পর বোর্ড তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। পুনর্বাসনের ব্যাপারে বোর্ড শুধু পাক-বাহিনীর হাতে প্রত্যক্ষভাবে নির্যাতিত মহিলাদের ব্যবস্থা করছে না।
পাক-বাহিনীর দ্বারা যে কোনো রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্তা মহিলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই তাদের অভিভাবক, স্বামী, বাবা এমনকি ভাইকে হারিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে প্রশিক্ষণরত সকল মহিলাদেরিই ‘ক্ষতিগ্রস্তা’ বলা হয়।
পুনর্বাসন পরিকল্পনাকে কার্যকরী করার জন্য ঢাকায় একটি সেক্রেটারিয়েল শিক্ষা কোর্স খোলা হয়েছে। এই কোর্সে ৮০ জন মহিলা ছাত্রী রয়েছেন। শিক্ষা প্রদানের সুব্যবস্থার জন্য তাদের ২টি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। নয় মাসের এই শিক্ষা কোর্সে টাইপ রাইটিং, শর্ট হ্যান্ড প্রভৃতি শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই শিক্ষা কোর্সে ক্ষতিগ্রস্তা মহিলা ছাড়াও বাইরের মহিলা রয়েছে। মাসিক বেতন দিয়ে ওরা কাজ শেখেন। অবশ্য এই শিক্ষাকোর্সের ৮০ জনের মধ্যে ৪০ জন ক্ষতিগ্রস্তা। ক্ষতিগ্রস্তাদের মাঝে অশিক্ষিতদের জন্য পুতুল বানানো, সেলাই, বাঁশের ও বেতের কাজ এবং পাটের নানা ধরনের কারুকাজ শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। বোর্ড এই শিক্ষাকোর্সে ক্ষতিগ্রস্তাদের মাসিক পঞ্চাশ টাকা হারে যাতায়াত বাবদ ভাতা দিয়ে থাকে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সাহায্য সংস্থা ‘ইউনিসেফ’ বোর্ডকে ৫০টি টাইপ রাইটিং মেশিন, ৩ শত সেলাই কল প্রদান করেছে। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি বেইলী রোডে অবস্থিত।
বোর্ডের একটি আবাসিক মহিলা জীবিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মোহাম্মদপুরে স্থাপন করা হয়েছে। গত ১লা আগস্ট থেকে এই কেন্দ্রে কাজ শুরু হয়েছে। এখানে মোট ৫০ জন মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ২৯ জন আবাসিক ও ২১ জন অনাবাসিক। সেলাই, শাড়ীতে ছাপ দেয়ার কাজ, বিভিন্ন রন্ধন প্রণালী, পুতুল বানানো, প্রাথমিক লেখাপড়া ইত্যাদি বিষয়ে অনভিজ্ঞ মহিলাদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে জীবনে যে কোনো অবস্থায় উপার্জনের ব্যবস্থা করা ও নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা।
বাংলাদেশের এই ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এটাই প্রথম। ভবিষ্যতে এই কেন্দ্র উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে কাজ করবে।
শিক্ষাকোর্স সমাপ্ত করে মহিলারা ইচ্ছা করলে বোর্ডের তত্ত্বাবধানে সমবায় ভিত্তিতে এই সব কেন্দ্রে কাজ করতে পারবেন। বোর্ড কেন্দ্রে উৎপাদিত দ্রব্যাদির বিক্রি ও অধিকতর উৎপাদনের জন্য সরবরাহ অর্ডার সংগ্রহ করবেন।
বোর্ড দেশের ক্ষতিগ্রস্তা ২ হাজার পরিবারের জীবিকা অর্জনের পথ হিসাবে হাঁস-মুরগী পালনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। এরই মধ্যে গাজীপুরে ৫টি পরিবারকে পরীক্ষামূলকভাবে ২০টি হাঁস ও ২০ মুরগী দিয়েছেন।
রাজধানীতে বোর্ডের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ছাড়াও দেশের প্রত্যেক জেলায় বোর্ডের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে মহিলাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিভিন্ন জেলার স্থানীয় শিল্পকর্মের প্রশিক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যেমন—রংপুরে সতরঞ্চি তৈরী, রাজশাহীতে কাঁঠের ক্ষুদ্র শিল্প, সিরাজগঞ্জে তাঁতে কাজ ও দিনাজপুরে মৃৎশিল্পের কাজ প্রভৃতি।
পুনর্বাসন পরিকল্পনার মধ্যে এ সমস্ত প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বৃত্তি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তা মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, নার্সিং ট্রেনিং গ্রহণের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিতা মহিলাদের চাকুরীর ব্যাপারে যোগাযোগ করা ইত্যাদি। সারাদেশে বোর্ড এ পর্যন্ত ৩ হাজার মেয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তাদের মধ্যে ৩ শত মেয়েকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর ব্যবস্থা করেছে।
প্রশিক্ষণের পরবর্তী পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তা মহিলাদের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নিয়োগ করা বোর্ডের দায়িত্ব। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের এককভাবে বা দলগতভাবে কিছু মূলধন বা যন্ত্রপাতি দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতেও বোর্ড আশাবাদী।
বোর্ডের বিভিন্ন কর্মচারী ও প্রশিক্ষণরত মহিলাদের সকলের দৃঢ় আশা, নারী সমাজের মুক্তি ও অগ্রগতির জন্য এই বোর্ড সফল হবে। কিন্তু প্রয়োজন অর্থের। পরিকল্পনামাফিক অর্থ নেই। বোর্ডের মোট ১০ কোটি টাকার পরিকল্পনা রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ১২ লক্ষ টাকা বোর্ড পেয়েছে। প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে বোর্ডের কার্যক্রম সুচারু ও ব্যাপকভাবে চলছে না। তবুও সবার প্রবল নিষ্ঠা আর মানবতাবোধ এই পরিকল্পনার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে কতদিন এভাবে চলা সম্ভব হবে তা অনিশ্চিত। তাই সরকারের সাথে সাথে দেশী-বিদেশী দানশীল ও সমাজ কল্যাণে আত্মনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সুদৃষ্টি এই মহৎ পরিকল্পনার বিশাল প্রয়োজনের দিকে আকর্ষণ করা প্রয়োজন। তাহলে বিদেশী অনেক সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দরাজ হাতে এগিয়ে আসবেন বলে সবার বিশ্বাস।
Reference : ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, ‘বাংলার বাণী’
০০০