You dont have javascript enabled! Please enable it! হক-জিন্না দ্বন্দ্বের নেপথ্যে ক্ষমতার চক্রান্ত - সংগ্রামের নোটবুক

হক-জিন্না দ্বন্দ্বের নেপথ্যে ক্ষমতার চক্রান্ত

গান্ধী-সুভাষ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পর হক-জিন্না দ্বন্দ্বের সূচনা। উভয়ের ক্ষেত্রেই বিষয়টি রজনৈতিক ও সংগঠনগত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। গান্ধি চাননি কংগ্রেসে সুভাষের আধিপত্য। একইভাবে জিন্না চাননি মুসলিম লীগে ফজলুল হকের প্রভাব বাড়ুক। সে জন্য তার বিরােধিতায় সংশ্লিষ্ট হক-সিকান্দার হায়াতের জুটি থেকে তিনি শেষােক্তজনকে বের করে আনেন।  যেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে হক-জিন্না দ্বন্দ্ব তা দ্বন্দ্বের প্রকৃত কারণ নয়। প্রকৃত কারণ রাজনৈতিক অঙ্গনে দুই ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, অনেকটা অসমপ্রকৃতির দ্বন্দ্ব- যে দ্বন্দ্বে ফজলুল হকের জয়ী হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না। কারণ জিন্না ইতিমধ্যে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কেন্দ্র ও প্রদেশে নিজের অবস্থান এতটা সুসংহত করেছিলেন যে তার একনায়কসুলভ আচরণ মেনে নেয়াটাই লীগ সংগঠনে নিয়মে পরিণত হয়েছিল। ব্যতিক্রম বঙ্গদেশ হডসন থেকে শীলা সেন- সবাই তাদের লেখায় জিন্নার উদ্ধত একনায়কী আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি যশবন্ত সিং, যিনি জিন্না মূল্যায়নে নমনীয় তিনিও ভিন্ন কথা বলেননি। ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগ দেয়ার ঘটনা অজুহাত মাত্র। কারণ জিন্নার ইচ্ছামতাে ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশ পাওয়ার পর হক কাউন্সিল থেকে। পদত্যাগ করেন। তবে সিকান্দার হায়াতের মতাে নিঃশর্তভাবে নয়, করেন নীতিগত আপত্তি জানিয়ে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগদান করা মুসলিম লীগের নীতিবিরােধী নয়। তবু সর্বভারতীয় মুসলমানদের ঐক্যের কথা বিবেচনা করে তিনি কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেছেন।  কিন্তু একই সঙ্গে জিন্নার অযৌক্তিক আচরণের প্রতিবাদে তিনি মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ও কাউন্সিল থেকেও পদত্যাগ করেন। প্রসঙ্গত তিনি জিন্না ও শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অভিযােগ উত্থাপন করেন। মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশের নেতারা সংগঠনের সর্বোচ্চ পদগুলাে ধরে রেখেছেন এবং যেভাবে মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশের (যেমন- বাংলা ও পাঞ্জাব) স্বার্থ নষ্ট, করছেন তা মেনে নেয়া যায় না। এ বিষয়ে তার শেষ কথা, তিনি অবাঙালি।  

কাউকে বাঙালি মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে দেবেন না। কারণ তারা। বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে কখনাে ভাবেন না । শেষ কথা দুটোই ছিল মূল কথা এবং মারাত্মক কথা । এ সত্য হক বুঝেছেন। দেরিতে, মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে । কিন্তু নিজ দল বিভক্ত করে নিজের সর্বনাশ তিনি নিজেই করেছেন। এরপর প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সেক্রেটারি নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের কাছে লেখা দীর্ঘ চিঠিতে তিনি মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক যুক্তিতথ্য দিয়ে। এমনকি একথাও বলেন, লীগের শীর্ষনেতারা যে কোনাে বিষয়ে ঘটনার কার্যকারণ না জেনেই অন্ধভাবে জিন্নাকে সমর্থন করে থাকেন। | অভিযােগ কোনােটাই মিথ্যা বা ভুল ছিল না। অবাঙালি লীগ নেতারা শুধু বিভাগপূর্ব সময়ে নয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও যে পূর্ববঙ্গের ওপর কর্তৃত্ব। ফলিয়েছেন তেমন প্রমাণ বাঙালির অভিজ্ঞতায়ই ধরা আছে, ইতিহাসে তাে বটেই। কিন্তু ফজলুল হকের জন্য ট্র্যাজেডি হলাে- এ সত্য যখন তিনি বুঝেছেন তখন জিন্না রাজনৈতিক-সাংগঠনিক দিক থেকে প্রবল-পরাক্রমী, অন্যদিকে ফজলুল হকের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান খুবই দুর্বল। প্রজাপার্টি বিভক্ত, অনুসারীদের অনেকে তার একদা নির্দেশেই লীগ সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত। লীগ সেক্রেটারির কাছে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪১) ফজলুল হকের লেখা চিঠি শীলা সেনের মতে ঐতিহাসিক দলিল। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে একইভাবে এ চিঠির বক্তব্য উল্লেখ করে ফজলুল হকের বাংলাপ্রীতি এবং রাজনৈতিক সাহস ও দৃঢ়তার প্রশংসা করেছেন। সাহস তার বরাবরই ছিল কিন্তু সমস্যা হল তা হক সাহেবের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কাছে প্রায়ই হার মেনেছে । পরবর্তীকালের ঘটনা উল্লেখ করে বলা যায়, ১৯৪৮ সালে ঢাকা সফরে জিন্নার বাংলা ভাষাবিরােধী বক্তব্যের প্রতিবাদ একমাত্র ফজলুল হকই করেছিলেন, অন্য কোনাে রাজনৈতিক নেতা নন। জিন্নাকে চ্যালেঞ্জ জানানাে একমাত্র বাংলার শের-এর পক্ষেই সম্ভব ছিল। হক-জিন্না দ্বন্দ্বের বিষয়টি শুধু বঙ্গেই নয়, সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফজলুল হক তখনাে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। জিন্নার একমাত্র লক্ষ্য ফজলুল হককে ক্ষমতাচ্যুত করে বঙ্গে নাজিমুদ্দিন বা সােহরাওয়ার্দীকে দিয়ে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ব্রিটিশ শাসকদেরও নজর ছিল। এ দুই নেতার রাজনৈতিক লড়াইয়ের দিকে। কারণ ভারতীয় প্রেক্ষাপটে পাঞ্জাবের মতাে বঙ্গের রাজনৈতিক গুরুত্ব কোনাে দিক থেকে কম ছিল না। বঙ্গীয় গভর্নরেরও পছন্দসই ছিলেন না ফজলুল হক, যদিও তিনি যুদ্ধের শুরুতে এক পা বাড়িয়ে সরকারের ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগ দিয়েছিলেন।  

বঙ্গীয় রাজ সরকারের এ বিষয়ে স্পর্শকাতরতার কারণ তাদের কাছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর ছিল যে, ফজলুল হক বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা বিশেষ করে তাদের মহা-অপছন্দের বাম ঘরানার নেতাদের সঙ্গে (যেমন- শরৎ বসু) যােগাযােগ রেখে চলেছেন। সরকারের লক্ষ্য তাদের পছন্দসই মন্ত্রিসভা গঠন, যেমন নাজিমুদ্দিনকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদে বসিয়ে অথবা সােহরাওয়ার্দীকে। উদ্দেশ্য কংগ্রেস যেন কোনােমতে ক্ষমতার অন্দরমহলে পা রাখতে না পারে। কারণ বিশ্বযুদ্ধবিষয়ক প্রশ্নে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। ফজলুল হক নিজেও জানতেন, মুসলিম লীগের সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। শেষ সুতােটা ছিন্ন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘর গুছিয়ে নেয়া দরকার। মাওলানা আকরম খাঁর পত্রিকা। দৈনিক আজাদ’ তখন উঠে পড়ে লেগেছে হক নিন্দার ঢাকঢােল পেটাতে। তেমনি পেটাচ্ছে ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’। এ একাজটা অবশ্য মাওলানা সাহেবের পত্রিকা পরবর্তীকালে বরাবর চালিয়ে এসেছে পরম নিষ্ঠাভরে।  যাই হােক পূর্ব কথায় ফিরি। ফজলুল হকের গােপন প্রচেষ্টার কথা সম্ভবত লীগ নেতাদেরও অজানা ছিল না। তাই ফজলুল হকের বিরুদ্ধে মুসলমানজনমত সংহত করতে সােহরাওয়ার্দীও প্রতিযােগিতায় নেমে পড়েন। তিনি ১১ সেপ্টেম্বর (১৯৪১) কলকাতা ময়দানে আয়ােজিত এক মুসলমান জনসভায় লীগ সভাপতি জিন্নার প্রতি ফজলুল হকের কিছু মন্তব্যের তীব্র সমালােচনা করে বক্তব্য রাখেন । কারণ ইতিমধ্যে কলকাতার কাগজগুলােতে লিয়াকত আলীকে লেখা ফজলুল হকের চিঠির গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রকাশিত হয়, বিশেষ করে যেখানে ছিল জিন্নার অযৌক্তিক হক-বিরােধিতা ও হঠকারিতার সমালােচনা।  সােহরাওয়ার্দীর সমালােচনার জবাব দিতে দেরি করেননি ফজলুল হক। তিনি বলেন, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য। মুসলিম লীগ সেক্রেটারির কাছে লেখা চিঠিতে আমি ব্যক্তিবিশেষের একনায়কী মনােভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছি রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলােচনা প্রসঙ্গে’ (অমৃতবাজার পত্রিকা, ১২.০৯.১৯৪১)। কংগ্রেসের অন্দরমহলেও এ বিষয়ে চলেছে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও চিঠি চালাচালি। যেমন- তেজবাহাদুর সাকে লেখা শিব রাওয়ের চিঠি। এ ক্ষেত্রে মূল কথা, সাম্প্রদায়িক পরিবেশের বিষয় বিবেচনা করে কংগ্রেস যেন ফজলুল হকের সঙ্গে সমঝােতার চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে কংগ্রেসের হাইকমান্ড যাতে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে। সাও অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করেন।

জিন্নার সঙ্গে ফজলুল হকের আর সুসম্পর্ক তৈরি হওয়ার নয়, যা হবে তা সাময়িক ও কৌশলগত।   ইতিমধ্যে সিন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতা আল্লাবও জিন্নার ঔদ্ধত্যপূর্ণ নেতৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এদিকে পরিস্থিতি বিচারে হক-জিন্না দুজনই এক ধরনের তাৎক্ষণিক সমঝােতায় আসেন। আসলে দুজনই জানতেন, এ সমঝােতা সাময়িক। লীগ ওয়ার্কিং কমিটির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সমঝােতার চিঠি লিখতে হয় হক সাহেবকে। তিনিও খানিকটা সময় কিনতে চেয়েছিলেন সমঝােতার বিনিময়ে। জিন্না যে ফজলুল হককে বিশ্বাস করতেন না তার প্রমাণ তিনি হক সাহেবের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য তার ব্যক্তিগত দূত হিসেবে হাসান ইস্পাহানিকে নিয়ােগ করেন। ইস্পাহানিরও প্রজাপার্টির নেতা হককে পছন্দ করার কথা নয়। সত্যি বলতে কি রাজনীতিতে ব্যক্তিগত ভালােলাগা-মন্দলাগার বিষয়গুলাে ঘটনার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক ইতিহাস তেমন প্রমাণই দেয় । স্বভাবতই ইস্পাহানি ফজলুল হক সম্বন্ধে জিন্নার কাছে বিরূপ প্রতিবেদনই পেশ করেন (অমলেন্দু দে)।  জিন্না সাহেবও আর সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তার নির্দেশে ১ ডিসেম্বর (১৯৪১) বাংলার হক মন্ত্রিসভার মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরা একযােগে পদত্যাগ করেন। তাদের ধারণা ছিল, ফজলুল হক মুসলিম লীগের সহায়তা ছাড়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবেন না। কিন্তু অন্তত এ ক্ষেত্রে তাদের হিসাব সঠিক ছিল না। কারণ হাওয়া বুঝে ফজলুল ইতিমধ্যে শরৎ বসু ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসে সম্ভাব্য এমন এক সঙ্কটে করণীয় ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। । তারা গঠন করে রাখেন প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি ফজলুল হক, শরৎ বসু। ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রতিনিধিত্বে। তারিখ ২৮ নভেম্বর, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ। দলগতভাবে এ কোয়ালিশনে ছিলাে প্রজাপার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, হিন্দুমহাসভা ও স্বতন্ত্র তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। এবারাে কংগ্রেস পুরনাে ভুলের পুনরাবৃত্তি করে। হিন্দুমহাসভার মতাে হিন্দুত্ববাদী দলের সঙ্গে মিলে মন্ত্রিসভা গঠনের কারণে মুসলমান জনমানসে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, বিশেষ করে লীগের প্রচারের ফলে।  কংগ্রেস দল কোয়ালিশনে এগিয়ে এলে হিন্দুমহাসভার সঙ্গে ঐক্যের প্রয়ােজন হতাে না। কারণ হিন্দু মহাসভার সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১২। দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে হিন্দু মহাসভার মতাে সম্প্রদায়বাদী দলের সঙ্গে ঐক্য ফজলুল হকের জন্য ছিল অশুভ আঁতাত । তাছাড়া শাসকসরকারও ছিল হকবিরােধী যে জন্য বঙ্গীয় গভর্নর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহ্বান জানাননি।

তার প্রত্যাশা তাদের প্রিয়পাত্র নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ যদিবা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারে, সে ক্ষেত্রে লীগ নেতাকেই মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানানাে হবে। ঘটনা কাকতালীয় হলেও প্রগ্রেসিভ ফ্রন্টের জন্য, ফজলুল হকের জন্য বিরাট আঘাত যে ওই দিনটিতেই ভারতরক্ষা আইনে শরৎ বসুকে গ্রেফতার করা হয়। আমার বিশ্বাস এটা সরকারের পরিকল্পনাপ্রসূত। উদ্দেশ্য হককে সঙ্কটে ফেলা। জিন্না-লীগও বসে থাকেনি। ফজলুল হককে জিন্নার তারবার্তা । অশােভন ভাষায় হককে বিশ্বাসঘাতক ও ভারতে মুসলিম স্বার্থ বিনাশের হােতা অপবাদ দিয়ে, কৈফিয়ৎ চেয়ে শেষ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর মুসলিম লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে ফজলুল হকের শূন্যস্থান পূরণ করা হয় হাসান ইস্পাহানিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এভাবেই হক-জিন্না বিরােধের নিষ্পত্তি প্রথমােক্ত জনের মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার মধ্য দিয়ে।  বস্তুত ফজলুল হককে তার রাজনৈতিক জীবনে একাধিক বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এ পর্বের প্রধান প্রতিপূহ্ন মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্না এবং পরােক্ষ প্রতিপক্ষ (কিন্তু শক্তিমান প্রতিপক্ষ) শাসক রাজ। রাজশক্তি নানাভাবে ফজলুল হককে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। শুধু চেষ্টা নয়, বাস্তবে করেছেও। যেমন- বাংলার গভর্নর সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির নেতা ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানাতে বড় একটা ইচ্ছুক ছিলেন না।  যদিবা তাকে ডাকা হলাে সেদিনই ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা শরৎ বসুকে গ্রেফতার করা হয়, যে শরৎ বসু ছিলেন সম্ভাব্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টিকে দুর্বল করা। একই কথা আইনসভায় দুঃখ করে বলেন ফজলুল হক।

জেল থেকে শরৎ বসু লেখেন : হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক শান্তি পুনরুদ্ধার করা এবং বাংলার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অনেক বছর এই সম্ভাবনা কার্যকর করার জন্য পরিশ্রম করেছি। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যূপকাষ্ঠে আমাকে বলি দেয়া হয়েছে’ (ঘােষ)। কথাটা মিথ্যা ছিল না। অন্যদিকে ছিল শরৎ বসুর অবর্তমানে শ্যামাপ্রসাদের অধিকতর গুরুত্ব এবং এর ফলে মুসলিম লীগের পক্ষে সাম্প্রদায়িক প্রচারের সুবিধা হয়। মনে পড়ে শহরের মুসলিম লীগ নেতাদের তিক্ত ও বিদ্রুপাত্মক সমালােচনা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা’কে কেন্দ্র করে। এর প্রভাব পড়েছিল মুসলিম মানসে। অবশ্য আবুল মনসুর আহমদ বলেছিলেন, জিন্না ও লীগের বিরুদ্ধে  বিদ্রোহ করে ফজলুল হক দুর্জয় সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন মুসলিম বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্দেশ্যে। আর আবুল হাশিমের মতে, ‘ফজলুল হক কখনাে অবাঙালিদের বশ্যতা স্বীকার করেননি। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নার লেজুড়বৃত্তি করেছেন। ফজলুল হক ছিলেন খাটি বাঙালি। | লেওনার্ড গর্ডন তার “ডিভাইডেড বেঙ্গল’ (বিভাজিত বাংলা) বইতে সঠিক কথাই বলেছেন, ব্রিটিশরাজ, জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতাে সংগঠন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে বঙ্গীয় সম্প্রদায়গুলাের মধ্যে সহযােগিতার প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। উল্লিখিত ঘটনাবলী থেকে স্পষ্টই বুঝতে পারা যায় যে মাত্র এক দশক সময়ের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অসাম্প্রদায়িক চেতনার বঙ্গীয় রাজনীতির সম্ভাবনা ওই ত্রিশক্তির টানে গঙ্গায় ভেসে যায় । ঘটনাটি পরের, তবু প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করছি। বাংলায় প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টির মন্ত্রিসভা গভর্নর জন হার্বাটের একেবারে পছন্দসই ছিল না। তাই মুসলিম লীগকে দিয়ে নানাভাবে ওই মন্ত্রিসভার পতন ঘটানাের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে গভর্নর হার্বার্ট শেষ পর্যন্ত অনৈতিকভাবে, প্রায় জোর করেই ফজলুল হকের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর আদায় করেন। পরিণামে এক সময় হক মন্ত্রিসভার পতন এবং নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন। এ সম্বন্ধে ব্লুমফিল্ড খােলামেলা ভাষায়ই বলেছেন, শাসকরাজ তাদের ইচ্ছানুযায়ী ইউরােপীয় ব্লকের সাহায্যে হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়েছিল ।  যে সােহরাওয়ার্দী ইউরােপীয় ব্লকের সদস্য হামিলটনের উত্থাপিত খাদ্যসামগ্রীর মজুতদারি ও কালােবাজারির অভিযােগের পক্ষে আবেগময় বক্তৃতা দিয়ে হাততালি কুড়ান, সেই সােহরাওয়ার্দীই কিন্তু নাজিম মন্ত্রিসভার খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে ৫০ লাখ দরিদ্র গ্রামবাসী বাঙালির মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠেন পঞ্চাশের (১৯৪৩) মহামম্বস্তরে। তখন ফজলুল হকের পক্ষে সঠিক পদক্ষেপ হতাে আইনসভায় তাকে হস্তারক হিসেবে চিহ্নিত করা। কিন্তু ফজলুল হকের স্বভাবে তা ছিল না । সেসব অবশ্য পরের ঘটনা।

 

সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক