You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.10 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | লহো অভিনন্দন | বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম | চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১০ এপ্রিল মঙ্গলবার, ২৭শে চৈত্র, ১৩৭৯

লহো অভিনন্দন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। জাতীয় জীবনে এটা অত্যন্ত শুভ সংবাদ। গোটা দেশের মানুষ রাষ্ট্রপতি রূপে যেন জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীকেই আশা করেছিল। জনাব চৌধুরীর রাষ্ট্রপতি রূপে পুনর্নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুশি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আরো বলেছেন “আমার প্রিয় জনগণ আপনাকে রাষ্ট্রপতি রূপে অসীম আনন্দিত।” জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমরা জনাব চৌধুরীকে স্বাগত জানাই।
বাংলাদেশের উদ্ভব ও বিকাশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্বকালে গণতন্ত্রের পরম পূজারী হিসেবে খ্যাতিমান। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে জনাব চৌধুরী ছিলেন সোচ্চারিত প্রাণ। সর্বোপরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তিনি যে দক্ষতা ও প্রিয় অভিভাবকত্বের নিদর্শন স্থাপন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর তা কোনদিন ভুলতে পারবে না। ছাত্র সমাজ তাদের প্রিয় উপাচার্যের সারল্য অদক্ষতা কোনদিন বিস্মৃত হতে পারবেনা।
তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে যে ষড়যন্ত্র চলছিল তখন দেশের গোটা আন্দোলনের সঙ্গে জনাব চৌধুরী একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের সেই নিদারুণ দিনে জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে অসহযোগিতা ও পরবর্তী বৃহত্তর আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে সুদূর বিঁভুইয়ে থেকেও কাজ করেছিলেন। পরপর স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জনাব চৌধুরী তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দেশ-বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এক বিরাট সুনাম অর্জন করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়ই সেদিন সারা ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বীরত্ব বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। দখলদার বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের কাহিনী তিনি সেদিন বিশ্বের বিবেকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের স্বপক্ষে জনমত তৈরি করার জন্যে তিনি সেদিন অক্লান্ত সংগ্রাম করেছিলেন।
স্বাধীনতাত্তোরকালে নতুন সরকার গঠনের পর জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। এতদিন তিনি তাঁর সুমহান দায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু তার যোগ্যতা ও দক্ষতার সুনাম করেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি দেশের প্রায় প্রত্যেকটি মানুষই তার সুনামে উন্মুখ। নতুন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হাওয়ায় তাই সারা দেশের জনগণ অত্যন্ত আনন্দিত। আমরা বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর উত্তরোত্তর সম্মান ও যোগ্যতা বৃদ্ধি কামনা করি। দেশের সেবা করার মহান ব্রতে তিনি যথার্থ আত্মোৎসর্গ করতে প্রয়াসী হন এটাই আমাদের একান্ত কাম্য।

বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ২৯ তম অধিবেশন সমাপ্ত হয়েছে। ছয় সপ্তাহ ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনে বর্ণবৈষম্যবাদী এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। জাতিসংঘের এই অধিবেশনে অধিকৃত আরব ভূমিতে ইসরাইল যেভাবে মানবাধিকার লংঘন করছে তার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং জাতিসংঘের সনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশ্বের দেশে দেশে লাঞ্ছিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশন খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। বর্ণবৈষম্যবাদ, জাতিভেদ, ঔপনিবেশিকতা এবং যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে এই প্রথম সুস্পষ্ট ভাষায় দোষারোপ এবং শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। মানবাধিকার অধিবেশনে জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্যবাদ এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য দশ বছরের একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। অধিবেশনের এক প্রস্তাবে বর্ণবৈষম্যবাদকে অমানবিক, জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী এবং বিশ্ব নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বশান্তি অক্ষুন্ন রাখার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের এই অধিবেশন নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আজকের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার কে যেভাবে খর্ব করা হচ্ছে এবং বর্ণবৈষম্যবাদ এর করাল ছায়া যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তাতে মানবপ্রেমী প্রতিটি মানুষকেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমেরিকা, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ায় বর্ণবৈষম্যবাদ দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। বর্ণবৈষম্যবাদীদের নির্মূল করার জন্য বিশ্বের দেশে দেশে নানা রকম সংগ্রামও দানা বেঁধে উঠছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বিশ্বের বুক থেকে বর্ণবৈষম্যবাদিতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে আশা করা যায়, মানবতাবিরোধী এইসব কার্যাবলীর অবসান হবে। সমগ্র বিশ্বব্যাপী আজ মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ এতো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, এতে শান্তিময় বিশ্বের প্রতি রীতিমত একটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তি ও মানবতার স্বার্থে জাতিসংঘের এই সংগ্রামের সাফল্য আমরা অবশ্যই কামনা করব। বিশ্বের প্রতিটি দেশে মানবতার জয় হোক, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত এবং সার্থক হোক এই আমাদের ঐকান্তিক কামনা।

চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দরের অচলাবস্থা সম্বন্ধে পূর্বেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং গতকালও বেশ কয়েকটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় এই সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছে।
খবরে প্রকাশ, বন্দরের বিভিন্ন গুদাম ও খালি জায়গায় সোয়া লাখ টনেরও অধিক মাল জমা পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বাণিজ্য কর্পোরেশন (টি.সি.বি) এর ৪৯ হাজার টন মাল বন্দরের গুদাম ও খোলা জায়গায় পড়ে রয়েছে। মাল গুলোর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, ঢেউটিন, শিশুখাদ্য, তুলা, সুতা, ও কিছু ওষুধ। ত্রাশ ও পুনর্বাসনের ১৬ হাজার টন ঢেউটিন, কৃষি কর্পোরেশনের সাড়ে সাত হাজার টন পাইপ ও যন্ত্রপাতি সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সর্বমোট ৮২ হাজার টন এবং বেসরকারি খাতে আমদানি ৪০ হাজার টন মাল এই অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বন্দরে পৌঁছানোর পর যথাসময়ে মাল খালাসের ব্যবস্থা না হলে জাহাজগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রায় ডেমারেজ দিতে হয়। এই ডেমারেজ হয় সরকারি সংস্থা, নয়তো বেসরকারি সংস্থা কি দিতে হয়।
আবার মাল খালাস হওয়ার পর বন্দরে তা পড়ে থাকলে তার জন্য বন্দর কতৃপক্ষ কে ডেমারেজ বা স্পেস রেন্ট বা ভাড়া দিতে হয়। অর্থাৎ এও একটা জাতীয় ক্ষতি। অন্য দিকে এই অচলাবস্থার নেপথ্যে কারণ হ’ল হাইস্পিড ডিজেল তেলের অভাব। তেলের অভাবে শুধু চট্টগ্রাম বন্দরে নয় দেশের সর্বত্র কলকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাম্প, মেশিন, যানবাহন সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ হয়ে যেতে বসেছে, কোথাও কোথাও স্তব্ধও হয়ে গেছে।
পরিবহনের ক্ষেত্রেও ওই একই সমস্যা। ডিজেলের তীব্র অভাবে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা তাদের সংখ্যা কমাতে বাধ্য হয়েছে। ফলে দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুতরাং পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য যে মূল্য ব্যয় করে খাদ্য আনা হচ্ছে, তা সময়মতো খালাস ও বন্টন না করতে পারায় খাদ্য সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।
চট্টগ্রাম বন্দর হল সমগ্রদেশের প্রাণকেন্দ্র। এই বন্দরে খাদ্য তথা সমস্ত প্রয়োজনীয় মাল এসে পৌঁছে এবং সেখান থেকেই দেশের অভ্যন্তরের যথাস্থানে যায়। ইতিপূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে একাধিকবার এই বন্দরের অচলাবস্থা দূরীকরণের জন্য দেওয়া হয়। তার ফল কি হয়েছে আমরা জানিনা। তবে যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই অচলাবস্থা দূরীকরণে এগিয়ে না আসেন তবে সমগ্র দেশে ব্যাপক খাদ্য সংকট ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম গগন চুম্বী হয়ে যাবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন