লীগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্বে ব্রিটিশ রাজের ভূমিকা
রাজনীতির নানা মত নানা পথের বিভিন্ন দর্পণে ১৯৩৭-এর নির্বাচনী ফল বিচার-বিশ্লেষণ করার পর নানা বিশ্লেষকের মতামত এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায় যে বাস্তবিকই নির্বাচনের ফলাফল ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক উপকরণে (বীজে) উর্বর। দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অভাবে এর সদ্ব্যবহার করা যায়নি। পরিণাম নেতিবাচক। বীজের অঙ্কুর দেখা দিলেও ফলেনি ফসল। অথবা ফলেছে বিষাক্ত ফসল। ওই ব্যর্থতা যেমন বঙ্গের ফজলুল হককে কেন্দ্র করে, কংগ্রেস-প্ৰজাপার্টিকে। ঘিরে তেমনি উত্তরপ্রদেশে লীগ-কংগ্রেসকে ঘিরে। বিষয়টা ইতিপূর্বে ইঙ্গিতাকারে বলা হয়েছে। আধুনিক সময়ের ইতিহাস বিশ্লেষকগণ একমত যে অভাবিত জয়ের আনন্দে উৎফুল্ল কংগ্রেসের উত্তরপ্রদেশে মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশনে না যাওয়াটা ছিল আত্মঘাতী ভুল। এর দায় যতটা কংগ্রেস। হাইকমান্ডের তার চেয়েও বেশি সে সময়কার কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল। নেহরুর । যশবন্ত সিং, সুনীতিকুমার ঘােষ, ভি. পি. মেনন প্রমুখ এর বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাদের লেখায় । এ বিষয়ে পরবর্তী কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদ (১৯৩৯-১৯৪৬) তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন যে, উত্তর প্রদেশে লীগের সহযােগিতা প্রস্তাব যদি গ্রহণ করা হতাে তাহলে এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে মিলেমিশে যেত । কিন্তু জওহরলালের ভূমিকা উত্তর প্রদেশে মুসলিম লীগকে নবজীবন দান করে।…
এখান থেকে লীগ নতুন করে সংগঠিত হয়। মি. জিন্না পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে যে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেন তার ফলেই শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাগ নিশ্চিত হয়।’ ভারত বিভাগ বিষয়ক ঘটনাবলীর অনুপুঙ্খ বিচারে দেখা যায়, যেসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশবিভাগের চাকা ঘুরতে শুরু করে তার কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের, বিশেষ করে জওহরলাল নেহরুর অবদান সবার চেয়ে বেশি। যেমন উত্তর প্রদেশে লীগ-কংগ্রেসের কোয়ালিশন, তেমনি এক দশক পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রসঙ্গে নেহরুর বিবৃতি ইত্যাদি ঘটনা জিন্নাকে ভারত বিভাগের হাতিয়ার জুগিয়ে দেয়। তেমনি একই ঘটনা ১৯৩৭-এ প্রজাপার্টির সঙ্গে সমঝােতায় না যাওয়ার ক্ষেত্রে নেহরুর নেতিবাচক ভূমিকা। সব দিক বিবেচনায় ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯- মাত্র দুটো বছরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী দেশ-বিভাগের পক্ষে নিশ্চিত পথ তৈরি করে দেয়। অবশ্য সেই সঙ্গে আরাে একাধিক অনুঘটক শক্তিও ছিল সক্রিয়, যেমন পাঞ্জাব ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীদ্বয়ের লীগকে শক্তিশালী করার ভূমিকা গ্রহণের কথা যা একাধিক বার উল্লিখিত । উত্তরপ্রদেশের লীগনেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সঙ্গে পরে যােগাযােগের চেষ্টা করা হলেও কোনাে সুফল মেলেনি। কারণ ততক্ষণে পাশার দান পড়ে গেছে। সব সম্ভাবনা শেষ । এ সময়ের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হরিপুর কংগ্রেসে (ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮) সুভাষ বসুর কংগ্রেস সভাপতির পদে নির্বাচিত হওয়ার পর জিন্নার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার অশুভ ফল নিয়ে পত্রালাপ । এমনকি সুভাষের এ চেষ্টা পত্রালাপে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সুভাষ-জিন্নার সাক্ষাৎকারও ঘটে। কিন্তু প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে।
জিন্নার দাবি, মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সংগঠন; আয়েশা জালালের ভাষ্যে একমাত্র মুখপাত্র এবং কংগ্রেস হচ্ছে হিন্দু প্রতিনিধিত্বের যা মেনে নেয়া কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ ঐ সময়পর্বে বহু সংখ্যক জাতীয়স্তরের মুসলমান নেতা কংগ্রেসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। তাদের অনুসারীও রয়েছে। তাছাড়া আছে জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামের প্রতিষ্ঠান যারা কংগ্রেসের সমর্থক। আসলে জিন্নার চোখে সবচেয়ে আপত্তিকর ব্যক্তিটি ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, যিনি একসময়কার কংগ্রেস সভাপতি । ঘটনা প্রমাণ করে তাকে কিছুতে সহ্য করতে নারাজ ছিলেন জিন্না। রাজনীতিতে এ জাতীয় অসহিষ্ণুতা অচল, গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী। কিন্তু এ ব্যাপারে জিন্না অনড়। তার মতে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার একক অধিকার রাখেন, অন্য কেউ নয় । মূল কথা হলাে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার সময় জিন্না এগিয়ে এসেছিলেন সমঝােতা প্রস্তাব নিয়ে, যেমন উত্তরপ্রদেশে যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান নিয়ে তখন কংগ্রেস সভাপতি নেহরু ইতিবাচক সাড়া দেননি। এরপর যখন বাংলা ও পাঞ্জাবকে হাতে পেয়ে মুসলিম লীগ শক্তি সঞ্চয় করেছে তখন কংগ্রেসের আহ্বানে সাড়া দিতে জিন্না পাল্টা অনিচ্ছুক । আর সেজন্যই তাকে উপলক্ষ তৈরি করতে হয়। মুসলিম প্রতিনিধিত্ব’ সেই উপলক্ষমাত্র। এক কথায় ‘বােস ফর্মুলা’ কার্যকর করা যায়নি। কারণ এ কালখণ্ড এ কাজের জন্য ছিল অসময়। সময়ের এক ফোঁড় এর আগে যথাসময়ে দিতে পারা যায়নি। দেয়নি কংগ্রেস নেতৃত্ব।
ঘটনার দিক থেকে পুরােপুরি প্রাসঙ্গিক না হলেও সময়ের বিচারে প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনার সূত্রে বলতেই হয় যে, ব্রিটিশ কূটনীতিতে বােধহয় সিদ্ধান্ত নেয়াই ছিল যে ব্রিটেনকে যদি ভারত ছাড়তেই হয় সেক্ষেত্রে দেশটাকে দু-ফালা করে কেটে রেখে আসাই ভালাে, যাতে দুই ভূখণ্ড-রাষ্ট্রের হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরকে শত্রু বিবেচনা করবে এবং দুই সম্প্রদায়-প্রধান রাষ্ট্র পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবে। বাস্তবে তাই ঘটেছে। এ কথা বলার কারণ ভারত বিভাগ প্রসঙ্গে শুধু শেষ ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেনের কূটনীতির কথাই বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ১৯৩৯ সালের প্রথম দিকে (মার্চে) লন্ডনে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সঙ্গে ভারত সচিব জেটল্যান্ডের ভারতের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে স্বতন্ত্র ভূখণ্ড গড়ার আলােচনা রীতিমতাে তাৎপর্যপূর্ণ। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এ বিষয়ে তাদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। গণতন্ত্রের লেবাসে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের পক্ষে এ জাতীয় কূটকৌশলী চাল ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু গণতান্ত্রিক রীতিনীতির স্বভাববিরুদ্ধ। তবে সব দোষই যে ওই কংগ্রেস নামক কালাে ভেড়াটার, বিশেষ করে কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশের তাও ঠিক নয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কার্যকারণ এবং তার প্রতিকারের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, মুসলিম লীগ অবস্থার সুযােগ নিয়েছে মুসলমান জনগােষ্ঠীর মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানাের জন্য। সম্মিলিতভাবে দাঙ্গা প্রতিরােধ তারা দায়িত্ব হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে চায়নি (মুশিরুল হাসান)। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মুসলিম লীগের জন্য শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে এলাে। পাঞ্জাব ও বাংলা থেকে (সিকান্দার হায়াত ও ফজলুল হক) যুদ্ধে ইংরেজ সরকারকে সর্বতােভাবে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। মুসলিম লীগের প্রতি ভারত সরকারের ভােষামােদের মাত্রা আরাে বেড়ে যায় । ভাইসরয় লিনলিথগাের সঙ্গে সাক্ষাতে জিন্নার শর্তসাপেক্ষে সরকারকে সমর্থন : কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলােকে বাতিল করতে হবে। ওরা ‘রাজ’ সমর্থক নয়। এ সাক্ষাতে জিন্না এই প্রথম ভাইসরয়ের কাছে ভারত বিভাগের অর্থাৎ পাকিস্তানের দাবি উল্লেখ করেন।
যুদ্ধ সত্যই মুসলিম লীগের জন্য সুযােগ-সুবিধার পরিবেশ তৈরি করে আর কংগ্রেসের জন্য সঙ্কট। কারণ কংগ্রেস পরাধীন ভারতে ইংরেজের যুদ্ধ-সমর্থক। সঙ্গী হতে রাজি নয়। অথচ যুদ্ধ একটি বাস্তবতা এবং মিত্রপক্ষের এ যুদ্ধ বিশ্ব ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে। কংগ্রেস নীতির দিক থেকে ফ্যাসিবাদবিরােধী। সঙ্কট এখানেই। কারণ সমর্থন বা বিরােধিতা দুটোর কোনােটাই তাদের হিসাবে মেলেনি। কিন্তু জিন্না-লীগের সে সমস্যা নেই। জিন্নার একটাই দাবি- লীগের সঙ্গে সমঝােতার ভিত্তিতে মুসলমানদের সুযােগ-সুবিধা দিতে হবে এবং মানতে হবে মুসলিম লীগই ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। কথাটা ওই সময়ের জন্য সঠিক ছিল না যদিও তবে প্রায় সঠিক হয়ে ওঠে। এক দশক পর । যদি সঠিক হতাে তাহলে সব মুসলমান আসনে মুসলিম লীগ। জয়ী হতাে। কিন্তু তা হয়নি। বরং এ বিষয়ে সুভাষ বসুর বক্তব্য নির্ভুল ছিল যে, লীগ ভারতীয় মুসলমানদের একটি বৃহৎ অংশের প্রতিনিধি । এ ব্যাপারে জিন্নার জেদ ও একগুঁয়েমি ছিল যুক্তিহীন। শাসকশ্রেণীর পৃষ্ঠপােষকতার কারণে অর্থাৎ খুঁটির জোরে জিন্নার ওই যুক্তিহীন জেদ। ইংরেজ শাসকের পক্ষে জিন্নাকে তােষামােদের কারণ একটাই। মুসলিম লীগ কখনই, কোনাে সময়েই ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে রাজপথে নামেনি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগের, আত্মদানের প্রমাণ রাখেনি। এর মূল কারণ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বরাবরই নবাব-নাইট ও ভূস্বামী-প্রধান। জিন্না ব্যতিক্রম, আইনজ্ঞ পেশাজীবী হিসেবে। মাহমুদাবাদের নবাব থেকে নবাবজাদা লিয়াকত আলীদের পরিচয় সবার জানা। প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃত্বে ছিলেন হাড়মজ্জায় ইংরেজ তােষক নবাব সলিমুল্লাহ ও আগা খানের মতাে লােক যারা দেশকে স্বদেশ জ্ঞান করেননি জিন্নাও প্রকৃতঅর্থে স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন না। রাজ’ বিরােধী সংগ্রামী হিসেবে তিনি কখনাে জেলে গেছেন? মনে হয় না।
সেই মুসলিম লীগকে ইংরেজ শাসক তােয়াজ করবে না কেন? অবশ্য কংগ্রেসেও ভূস্বামীদের উপস্থিতি ছিল। তবে সময়ের এ পর্যায়ে তার শীর্ষ নেতৃত্ব ছিল বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীপ্রধান। গান্ধি-নেহরু-আজাদ-প্যাটেল, আনসারিচিত্তরঞ্জন-সুভাষ প্রমুখ নেতা কেউ জমিদার বা ভূস্বামী ছিলেন না। কংগ্রেস শুরুতে ‘আবেদন-নিবেদনের নীতিতে অভ্যস্ত থাকলেও কালক্রমে হয়ে ওঠে সরকারবিরােধী। তার একাংশে বামপন্থা সক্রিয় হয়ে ওঠার। পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ও প্রবল ইংরেজবিরােধী, বিশেষ করে সুভাষ প্রমুখের স্বাধীনতা দাবির উচ্চারণে। তাতে গান্ধি যতই রাশ টেনে ধরুন না কেন। এ বিষয়ে বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা হসরত মােহানীর স্বাধীনতা-প্রস্তাবের প্রসঙ্গ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। লীগ-কংগ্রেসের তুলনামূলক মূল্যায়নে ইতিহাসের এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন ও সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ (কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড) নিয়ে হডসন প্রমুখ ভারত-বিষয়ক লেখকগণ যতই সােচ্চার হােন না কেন এ সংস্কার আইন একদিকে ভারতের সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নষ্ট করতে মস্ত বড় ভূমিকা নিয়ে ছিল। অন্যদিকে শাসনব্যবস্থা ওদের ভাষায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন’ রূপে তুলে ধরা হলেও এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির স্বায়ত্তশাসন ছিল না। থাকার কথাও নয়। ছিল সরকারের তথা গভর্নরের অধীনে এক কার্যনির্বাহী পরিষদ, যদিও করদাতা মানুষের ভােটে নির্বাচিত। কারণ এ ব্যবস্থায় প্রাদেশিক গভর্নর ও গভর্নর-জেনারেলের (ভাইসরয়ের) ছিল বিপুল ক্ষমতা। তারা ইচ্ছা করলে মন্ত্রিসভা বাতিল করতে পারতেন, আইনসভায় গৃহীত কোনাে বিল পছন্দ না হলে ‘ভেটো দিয়ে তা খারিজ করতে পারতেন। তবু হডসনের মতাে কথিত গণতন্ত্রী ইতিহাস-লেখককের ভাষায় এটা ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন’ । হডসন লিখেছেন, গভর্নরগণ সাধারণত এ ধরনের ভেটো’ প্রয়ােগ করতেন ।
তিনি উল্লেখ করেছেন যে প্রাথমিক পর্যায়ে শাসনকর্তাগণ মাত্র ৫টি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থবিরােধী বিলে ভেটো দিয়ে তা খারিজ করেছেন। বিহার ও উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পক্ষে কয়েকজন বন্দির মুক্তি-নির্দেশ কি এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে তাতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পতন ঘটতাে? অথচ ওই দুই প্রদেশের গভর্নর ওই বিলে সই করেননি এবং যথারীতি মন্ত্রিসভার পদত্যাগ। স্মর্তব্য যে, বন্দিমুক্তি দাবির প্রশ্নে কংগ্রেসের অনড় অবস্থানের কারণেই ১৯৩৭ সালে ফজলুল হক তাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কারণ তার জানা ছিল যে এসব দাবি বাংলার গভর্নর মেনে নেবেন না । আর এর পরিণতি হবে নবগঠিত মন্ত্রিসভার পদত্যাগ। কারণ ওই সময়ের সরকারি নীতির চরিত্র সবারই জানা যে, কংগ্রেস তখন আর শাসকের চোখে পছন্দসই পার্টি নয়। যদিও এ পার্টি ১৮৮৫ সালে তাদেরই উদ্যোগে গড়া যেমন গড়া নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ হিসেবে। এর পেছনে ছিল তাদের অনুসৃত বহু পুরনাে নীতি- ‘ভাগ করা ও শাসন করা (ডিভাইড অ্যান্ড রুল’)। আমাদের ভাষায় ওই নীতি হচ্ছে দুই দলকে, দুই সম্প্রদায়কে লড়িয়ে দাও এবং আরামসে ভারত শাসন কর। এসব কারণে হক চেয়েছিলেন বন্দিমুক্তির বিষয়টি ধীরেসুস্থে ফয়সালা করতে। কিন্তু কংগ্রেস তাতে রাজি হয়নি। যুক্তিসঙ্গতভাবেই এ কথা মানতে হয় যে ভারতীয় মুসলিম লীগ কখনই জোরালােভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী, বিশেষভাবে ব্রিটিশ রাজবিরােধী নীতি প্রকাশ্যে গ্রহণ করেনি। দেশের স্বাধীনতার দাবির বদলে মুসলমান অধিকার নিয়েই লীগ এবং জিন্না বরাবর সােচ্চার। কারণ জিন্নার ধারণা ছিল, স্বাধীন ভারতে কংগ্রেসের একাট্টা শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেটা হিন্দুশাসনের নামান্তর।
তাই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে বা পরে হরিপুরা অধিবেশনে উচ্চারিত সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সংগ্রামে মুসলমান রাজনীতির সহযােগিতার আহ্বান জিন্নার মনে দাগ কাটেনি এবং লীগ বরাবরই ইংরেজ শাসন উৎখাতের আহ্বান উপেক্ষা করেছে। দেশের রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ না হলে যে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয় এ কথা একজন সাধারণ মানুষও বােঝে, জিন্নার না বোেঝার কথা নয়। কিন্তু একসময় বুঝেও পরে তিনি তা বুঝতে চাননি। তার শত্রু জাতীয় কংগ্রেস, ইংরেজ শাসক নয়।। পরিস্থিতির জটিলতা এবং শাসকের পক্ষে ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট বক্তব্যের অভাবে কংগ্রেস একতরফাভাবে শাসক-সহযােগিতা ও যুদ্ধে সহযােগিতার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাদের কথা, সমর্থনের আগে স্বাধীনতার ঘােষণা চাই। তাই অক্টোবর, ১৯৩৯-এ বড়লাটের নীতিগত ঘােষণার সমালােচনা করে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পক্ষে সহযােগিতা নয়। সে ক্ষেত্রে প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পক্ষে পদত্যাগ বাঞ্ছনীয়। এখন প্রশ্ন : কংগ্রেসের এ সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল? বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক যেমন তখন তেমনি পরবর্তীকালে। সংখ্যাগুরু অভিমত, সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।
সূত্র : দেশবিভাগ-ফিরে দেখা – আহমদ রফিক