You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.12.02 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বস্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টি করছে কারা? | সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন! | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২রা ডিসেম্বর, সোমবার, ১৬ই অগ্ৰহায়ণ, ১৩৮১

বস্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টি করছে কারা?

একদিকে বাজারে সুতিবস্ত্রের অভাব এবং এর ফলে ক্রমাগত তার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি; অপরদিকে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সুতা যোগাড় করতে না পারায় সাধারণ সুতি বস্ত্রের যোগানদার বাংলার তাঁত শিল্পের চরম দুরবস্থা – সবমিলিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে আজ নিদারুণ সংকটের মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করতে হচ্ছে; এটা যেহেতু আমরা সকলেই নির্লজ্জভাবে ভুক্তভোগী সেই প্রেক্ষিতে বস্ত্র শিল্প সংস্থার গুদামে ১০ কোটি টাকার কাপড় শুধুমাত্র উইপোকা আর ইঁদুরে কেটে ফেলেছে বা আরো ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার সুতা ও কাপড় নিত্যান্ত অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে ধরনের খবর শুনবার মতো এই সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের সংবাদপত্র পাঠকের বর্তমানে নেই। আর নেই বলেই বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে এই পত্রিকার পাতায় বারান্তরে উচ্চারিত সতর্কবাণীর মতো আজও উদ্বিগ্ন ভাবে ভাবতে হচ্ছে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাবোটাজকারীরা আজ কতখানি সক্রিয় এবং সুশৃংখলভাবে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। গতকালকের বাংলার বাণীর প্রথম পৃষ্ঠার গুরুত্বসহকারে যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে খবরটির সত্যতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তরফ থেকে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালানো সম্ভব হতে পারে; উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু আমরা জনগণ অতশত বিতর্কের মধ্যে যেতে চাই না। যাবার প্রভৃতিও আমাদের নেই, আমাদের শুধু বক্তব্য বাংলাদেশের আর দশটা জিনিসের মত এটাও একটা বড় ধরনের ঘাপলা এবং এই ঘাপলা বাজির কবলে পড়ে বাংলার কোটি কোটি টাকার সম্পদ এই ভাবে আরো দশটা ঘটনার মতো নিত্যান্ত অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।
বাজারের সারিসারি দোকানগুলো বস্ত্রের অভাবে আজ শুন্য। একখানা সাধারণ গামছায় হাত দিলেই তা সরবরাহের অজুহাত তুলে দোকানীর ১০ টাকা দাম হাঁকা, ৫ টাকার লুঙ্গি ৩৫ টাকায় উঠা, একখানা ২০ টাকার ঢাকাই বিটির দাম সোয়াশ’ থেকে দেড়শ’র মধ্যে উঠা নামা- এ সবই তো সুতা আর বস্ত্রের অভাবের ফলশ্রুতি! স্বাধীনতার ঊষালগ্নে থেকে ঘাড়ে চেপে বসা এই গুরুতর সমস্যা উত্তরণের জন্য প্রাথমিকভাবে বিদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় আমাদের বস্ত্র ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। নিজেদের যেহেতু তুলা হয় না; দেশের বস্ত্রকল গুলি ও তাঁতীদের চাহিদা পূরণ ও স্বনির্ভরতা লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিদেশ থেকে কাপড় আমদানির পরিবর্তে কোটি কোটি টাকার তুলা আমদানি করা হয়েছে। অধিক মূল্যে আজ যারা কাপড় কিনতে পারছে না বাংলার সেই অগণিত সাধারণ মানুষের হাতে স্বল্পমূল্যে কাপড় তুলে দেয়ার মহৎ প্রচেষ্টাকে বানচাল করে এক শ্রেণীর কর্মচারী কোটি কোটি টাকার কাপড় বিনষ্ট করে এবং বাজারের না ছেড়ে অকারণে সেগুলো মজুদ করে বড় বড় মজুতদার, আড়তদার আর মুনাফালোভীর সাথে হাত মিলিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে-জনগণের এমনই ধরনের আতঙ্ক কি ভ্রান্ত? আগে বলা হতো সরকার তুলা আনছেন না, সরাসরি শুধু আমদানিতেও খরচ বিস্তর। সুতরাং তুলা আমদানি করা হচ্ছে, বস্ত্রকল গুলো এবং তাঁতীদের চাহিদা পূরণের জন্য সে সুতা কেন বস্ত্র শিল্প সংস্থার গুদামে পড়ে অকারণে নষ্ট হচ্ছে, গুদাম ভাড়া বাবদ কেন রাশি রাশি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে? সময়মতো তৈরি কাপড় আর সুতা বিতরণের মাধ্যমে অর্জিত পয়সায় যেখানে নতুন করে অর্থ লগ্নি করা যেত, সে কাপড় আর সুতা কেন সরবরাহের অভাবে এত কোটি কোটি টাকা আটকা পড়ল এবং তার ফলে বস্ত্রকল গুলোকে উচ্চসুদে ওভার ড্রাফটের মাধ্যমে কাজ চালাতে হচ্ছে। এসব প্রশ্নের উত্তর আজ তাদেরই কাছে যারা বেনিয়া শ্রেণীর অর্থপুষ্ট হয়ে নানাবিধ ভিত্তিহীন অজুহাত খাড়া করে কোটি কোটি টাকার উই ও ইঁদুরে কাটা সুতা এবং বস্ত্র মাটির নিচে পুঁততে সহায়তা করছেন। প্রকাশিত খবরটিতে অভিযোগ তোলা হয়েছে প্রধান বণ্টনকারী কর্তৃপক্ষ ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা নানাবিধ অজ্ঞাত কারণে এই সব সুতা ও কাপড় তুলছেন না, বিসিকের সুতা গ্রহণের পরিমাণ অনেক অল্প। সমবায়েরও একই অবস্থা। আবার বস্ত্রশিল্প সংস্থাকেও সরাসরি বস্ত্র বিতরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ফলে সৃষ্ট অচলাবস্থায় এবং পাকানো যায় পরে একদিকে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট অপরদিকে বাজারে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট মোকাবেলায় ক্রেতাসাধারণের প্রাণান্তকর অবস্থা। সৃষ্ট অচলাবস্থায় আর সম্পদ বিনষ্ট যে কারণেই ঘটুক না কেন, পাকানো জট সম্পর্কে সরকারকে সময় মত অবহিত না করায় যে অর্ধেক সম্পদ বিনষ্ট হল – দায়ী ব্যক্তিরা তার জন্য অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। সরকার অবিলম্বে তদন্ত কমিটি গঠন করে এর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস রয়েছে।

সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন!

ভুয়া সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বগুড়ায় হাজার হাজার গ্যালন জ্বালানি ডিজেল তেল কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে পত্রিকান্তরে প্রতিবেদন সূত্র জানিয়েছে। ওই একই সূত্র আরো জানিয়েছে যে, রোপা আমন ধান কাটা-মলা শুরু হওয়া সত্ত্বেও টি, আমন সেচ প্রকল্পের নাম করে পাওয়ার পাম্প ও জ্বালানি তেল বরাদ্দ এবং পি,পি,ডি (পাওয়ার পাম্প পরিচালক) নিয়োগ করা হচ্ছে। এবং গত টি, আমন মৌসুমে জেলায় একটি সম্পূরক সেচ প্রকল্প কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠিত হবার পর তাদের দ্বারা জেলার কোন স্থানে কৃষি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে মৌসুমী সেচের কাজ চলছে বলে জানা যায়নি। অথচ সেই টি, আমন সম্পূরক সেচ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এখনো পাম্প ও তেল বরাদ্দ পাওয়ার পাম্প পরিচালক নিযুক্ত করেই চলেছেন। ওয়াকিবহাল মহলের থেকে আরো জানা গেছে যে, গত মৌসুমে সম্পূরক সেচ প্রকল্পে বিভিন্ন থানায় ১২৩টি পাওয়ার পাম্প এবং প্রায় দেড়শ জন পি,পি,ডি নিয়োগ করা হয়েছে।
অঞ্চল বিশেষে পাওয়ার পাম্প নিয়ে কাগজের সেচ প্রকল্প যেখানে এমনি লীলায় মত্ত তখন অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি পাওয়ার পাম্প এর ভাড়া বাড়িয়ে ৩০০ টাকা ৬০০ থেকে টাকা করা হয়েছে। এছাড়া ড্রাইভার এর বেতন, পাম্প মেরামত ও জ্বালানি খরচও পাম্প গ্রুপকেই (?) নাকি বহন করতে হবে। আরও বলা হয়েছে যে, সরকারী সাবসিডির বোঝা কমানোর জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরিবেশিত দুটি সংবাদই সচেতন নাগরিককে আন্দোলন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রথমতঃ পাওয়ার পাম্প ও সেচ প্রকল্প এসবই কৃষকদের স্বার্থে তথা সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নের স্বার্থেই নিয়োজিত থাকবে- এমনটাই আমরা আশা করি। এবং একথাও ঠিক যে, কৃষকদের চাষবাসের সুবিধা, ইরি-বোরো ধানের সেচের ব্যবস্থা ও তৎসহ সার্বিক সাহায্য দিয়ে কৃষিকাজে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যেই আঞ্চলিক সেচ প্রকল্প গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে- কৃষকদের সাহায্য করা বা কৃষি কাজে সহযোগিতা দেওয়াকে বহু দূরে রেখে কাগুজে সংস্থাগুলি (এগুলো কাগজেই বা কেন হয়) চৌর্যবৃত্তিতে তৎপর হয় এবং পাম্প বরাদ্দের মাধ্যমে বরাদ্দ ও পি,পি,ডি নিয়োগ করে সবাই মিলে দরিদ্র কৃষকদের ভাত মেরে কালো টাকার পাহাড় বানিয়ে তোলে।
শুধু এই নয় টি, আমন সেচ প্রকল্পের কর্মকর্তারা কোথাও বা আমনের পরিবর্তে মরিচের জমি সেচ করেছেন, কোথাও বা পাওয়ার পাম্প চালু করাই হয়নি আবার কোথাও বা আমনের জমি সেচের জন্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পরিবর্তন সম্প্রতি সেচ কাজের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যেন সেচ প্রকল্প তথা পাওয়ার পাম্প ও সবুজ বিপ্লবের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা তামাশা।
একথা সংশ্লিষ্ট মহলের স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, গণতান্ত্রিক কাঠামো ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সকল কাজের কৈফতৎই জনগণ চাইতে পারে। তাই সরকারি সূত্রের যখন বলা হয়- প্রতি পাওয়ার পাম্প এর ভাড়া বাড়ানোর পর পাম্প গ্রুপকে আনুষঙ্গিক ড্রাইভারের বেতন, পাম্প মেরামত ও জ্বালানি খরচ বহন করতে হবে তখন প্রশ্ন উঠবেই যে, এই পাম্প গ্রুপ কথাটার অর্থ কি? এটা কি কোন সমবায় সংস্থা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিজস্ব গ্রুপ? এরা কি কৃষকদের স্বার্থানুকূল্যে কাজ করবে না ওদের নাম ভাঙিয়ে এন্তার তেল চুরির সুযোগ সৃষ্টি করে আত্মস্বার্থটি উদ্ধার করবে? আমরা জানি খাদ্যঘাটতির মোকাবেলায় এবং বলতে গেলে আশঙ্কাজনক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এর প্রেক্ষিতে জীবন-মরণের প্রশ্নের আমাদেরকে বাড়াতে হবে খাদ্য উৎপাদন। আর উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে সেচ সার কীটনাশক ঔষধ ইত্যাকার প্রসঙ্গ অপরিহার্য। সেখানে সরকারি সাহায্যের দিকেই আমরা বেশি প্রত্যাশী হব। তবে শেষ প্রকল্পের দিকে সরকারের যত্ন ও আগ্রহের পরিচয় আমরা পাচ্ছিও। অঞ্চল বিশেষে সেচের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে সেচ প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব ও তারা কাগজে-কলমে সম্পাদন করেছেন। আমাদের বক্তব্য হলে – সমস্যা বাড়ছেই সেই সূত্র ধরেই। কারণ একথা বলা বাহুল্য যে, কার্যকরীভাবে যে কোন সংস্থার মাধ্যমে কাজ আশা করতে হলে যথোপযুক্ত তদারকি রাখতেই হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে সেদিকে যেতে চান না -ঘটনা পরম্পরার তথা সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিই তার প্রমাণ। একে তো আমাদের দেশের কৃষকদের কৃষি অর্থনীতির মুহুর্মুহু প্লাবনও ঝড়ঝঞ্জা তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে প্রায় প্রতিটি বছর। সে ক্ষেত্রে দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে প্রতিটি পাওয়ার বাম্পের ভাড়া ৬০০ টাকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অপর পক্ষের রেজিস্টার্ড চোরদের তথা প্রকল্পভিত্তিক কর্মকর্তাদের অর্থ আত্মসাতের অপকৌশল- চক্রান্ত তাদের বুকে শেল হানছে। তাই অফুরন্ত কর্মোদ্যম ও উৎপাদন বৃদ্ধির ঐকান্তিক বাসনা থাকলেও তারা অসহায় ও অকর্মণ্য হয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এবং প্রকৃতির দয়াকে সম্বল করেই কৃষি কাজ করছে। তাহলে আমাদের দেশের সবুজ বিপ্লব কি স্বপ্ন হয়েই থাকবে চিরকাল? আর ওইসব কাগজি সংস্থাগুলো চালিয়ে যাবে চৌর্য শিল্পের অনুপম প্রদর্শনী? এসব প্রশ্নের জবাব নয় – প্রত্যক্ষ ও দৃশ্যগোচর জবাব আমরা চাইছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন