বাংলার বাণী
২২শে জুলাই, রবিবার, ১৯৭৩, ৬ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
মজুরী কমিশনের রিপোর্ট
শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং শিল্প প্রসারের সেই গোড়া থেকেই শ্রমজীবী মানুষ লগ্নীকারকের ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। মুনাফার মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখেই শিল্প মালিকেরা শ্রমিকের মজুরী নির্ধারণ করে এসেছে। যত কম মজুরীতে যত বেশী উৎপাদন করিয়ে নেয়া যায় মুনাফার পাল্লা তত বেশী ভারী হয়। এটা মহাজনী সূত্র। যুগের পর যুগ সেই সূত্র অনুসারিত হয়ে এসেছে। সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর রূপ বদলেছে, মূল সূত্র থেকেছে অক্ষত। এটা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অনুসৃত নীতি।
আমরা নিজেরাও সেই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উত্তরসূরী। স্বাধীনতা পূর্বকালে ব্যক্তিপুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে যে শিল্প গড়ে উঠে সেখানে শ্রমজীবী মানুষ মজুরী প্রাপ্তিতে কোন নতুন ব্যবস্থা লক্ষ্য করেনি। এটা সম্ভবও নয়। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে সে ব্যবস্থার কবর রচনায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আর সেই প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখেই আমরা আমাদের অগ্রাভিযান শুরু করেছি। মূল শিল্প সমূহ জাতীয়করণ করা হয়েছে, ব্যক্তি মালিকানা থেকে তা নিয়ে আসা হয়েছে সামাজিক মালিকানায়। পাশাপাশি অবশ্য রয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা। দু’ধরনের শিল্পেই শ্রমজীবী মানুষ কর্মরত, সরকারের দায়িত্ব এদের কারো প্রতিই কম নয়।
স্বাধীনতার পর পরই আমাদের দেশে শিল্প শ্রমিকদের মজুরীর ব্যাপারে কোন স্থায়ী নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। সময় অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকান্ড কিছুটা সংহত হওয়ায় সরকার শিল্প শ্রমিকদের মজুরী নির্ধারণের ব্যাপারে মনোনিবেশ করেন। এরই এক পর্যায়ে গঠিত হয় শিল্প মজুরী কমিশন। শিল্প শ্রমিকদের মজুরী নির্ধারণের বিষয়ে তারা সরকারকে পরামর্শ দেবেন। গত ২০ তারিখে তেজগাঁ আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন আগামী ২০শে আগস্টের মধ্যে উক্ত কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করবেন। সেই রিপোর্ট সরকারের বিবেচনার পর শ্রমিকদের জন্যে যে মজুরী নির্ধারণ করা হবে তা কার্যকরী হবে এ বৎসরের পহেলা জুলাই থেকেই।
শিল্প শ্রমিকদের জন্যে এটা সুসংবাদ। মজুরীর ব্যাপারে একটা নির্দিষ্ট হার নির্ধারিত না হওয়ায় তারা তাদের জীবন যাপনের কোন পরিকল্পনাই গ্রহণ করতে পারছেনা। এছাড়া বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দক্ষতা অথবা অভিজ্ঞতার দিকটা বিবেচনা না করে শুধু চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নানা ধরনের মজুরী হার সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও বহু অভিযোগ রয়েছে। এসবের সমাধান থাকবে, শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণ এবং অধিকারের প্রশ্নটিকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েই মজুরী নির্ধারিত হবে এটাই সবাই আশা করেন।
সমস্যা দেখা দেবে মজুরী কমিশনের। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়, আমরা কেবল সমাজতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা করছি। বিচ্ছিন্নভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। একদিনে তার অবলুপ্তিও সম্ভব নয়। তাই সমাজতান্ত্রিক দেশে শ্রমিকের আয় নির্ধারণে বা তাদের ভোগের ক্ষমতাদানে যে নিয়ম নীতি অনুসৃত হয়ে থাকে সে নিয়ম নীতিও পরিপূর্ণভাবে আমাদের দেশে বর্তমান অবস্থায় অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প শ্রমিকদের আয় নির্ধারণ যেমনভাবে করা হবে তা ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কতটুকু কার্যকরী হবে অথবা কার্যকরী করার ব্যাপারে সরকার কতটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন সেটাও ভাববার বিষয়। প্রচলিত আইন সরকারকে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প পরিচালনায় হ্স্তক্ষেপে কতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে সেটা ভেবে প্রয়োজনবোধে আইন পরিবর্তন অথবা সংশোধনের পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। যাই হোক আমরা মজুরী কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষায় রইলাম। এর গুরুত্ব সম্পর্কে মজুরী কমিশন সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল বলে আমাদের বিশ্বাস।
তল্লাশী অভিযান
ভুয়া রেশন কার্ড, টেলিফোন উদ্ধার, বিভিন্ন সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার বকেয়া বিল এবং সরকারী বাড়ী-ঘর বেআইনী দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্যে সরকার এক ব্যাপক কর্মসূচী নিয়েছেন। ঢাকা শহরে আগামী সপ্তাহে এই উদ্ধার অভিযান শুরু হবে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সান্ধ্য আইন জারী করে তল্লাশী চালানো হবে। অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সহযোগিতায় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এই কর্মসূচী কার্যকরী করার জন্যে সরকার দেশের জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেছেন। এ কর্মসূচীর সার্বিক সমন্বয় সাধন করবেন প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারী। অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে।
ঘরে ঘরে ব্যাপক খানা তল্লাশী চালাবার জন্যে যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছেন তা যে অত্যন্ত সময়োপযোগী এতে কোন সন্দেহ নেই। জনসাধারণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ব্যাপারে নিশ্চয় সহযোগিতা করবে। কেননা, দেশের বিশেষতঃ ঢাকা শহরে এখনো পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। এখনো দিনে-দুপুরে ব্যাপক ডাকাতি, গাড়ী হাইজ্যাক ও খুন-খারাবী হচ্ছে। তাছাড়া সরকারী নির্দেশের তোয়াক্কা না করে একশ্রেণীর মানুষ বেআইনীভাবে বাড়ী দখল, টেলিফোন সেট সংরক্ষণ ও বকেয়া বিল পরিশোধ করেননি। এটা যে একটা নাগরিক দায়িত্ব এ বিষয় অনেকেই গুরুত্ব আরোপ করছেন না। সম্প্রতি ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার অভিযান কালে এটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছাত্রসমাজ ও সংশ্লিষ্ট কর্মীরা ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার অভিযান চালানোকালে নানান হুমকি ও হামলার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ঢাকা শহরে এখনো অনেক বাড়ী রয়েছে যা বেআইনীভাবে দখলকৃত। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নোটিশ পাওয়ার পরও তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। সুতরাং যারা জেগে ঘুমোয় তাদের ঘুম ভাঙানোর প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা উল্লেখ করতে চাই ইতিপূর্বেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সান্ধ্য আইন জারী করে ব্যাপক খানা তল্লাশী চালানো হয়েছিলো। সে সময়ে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা ও সাহায্য করেছিলেন। তারপর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও আবার যেইকে সেই অবস্থাই হয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হলো, ঘন ঘন সান্ধ্য আইন জারী করে খানা তল্লাশী চালালে জনসাধারণ খানিকটা অসুবিধার সম্মুখীন হবেন—এ অসুবিধার সম্মুখীন হতে আপত্তি নেই যদি দেখা যায় যে তার একটা সুদূরপ্রসারী ফলাফল রয়েছে। তাই আমরা বলবো, যা করা হয় তা যেন আটঘাট বেঁধেই করা হয়। সব বিষয়টা যাতে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোতে পরিণত না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে।
বন্ধুত্বের সেতু-বন্ধনের আরেক নিদর্শন
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ভৈরব সেতু চালু হবে বলে মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি ভৈরব সেতুর পুনর্নির্মাণ কাজ সরেজমিনে তদারক করে এসে যোগাযোগ মন্ত্রী এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। প্রমত্তা মেঘনা নদীর উপরে মিটারগেজ লাইনের এই ২,৩৩৭ ফিট দৈর্ঘ্য সেতুটির তিনটি স্প্যান বিগত মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চাদপসরণকারী পাক হানাদার বাহিনী বিনষ্ট করে দেয়। ফলে দেশের বৃহত্তর বাণিজ্যিক এলাকা সমুদ্র বন্দরের দেশ চট্টগ্রামের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা দারুণভাবে ব্যাহত হয়। আর এর ফলে গোটা দেশে অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা বিরাট চাপের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের প্রধান এবং বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে অবস্থিত। ফলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্যে বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী সহ পুনর্গঠনের জন্যে প্রমত্ত জিনিসপত্রের সিংহভাগ বিদেশ থেকে আসে এই বন্দরে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্যে বাংলাদেশের রপ্তানীজাত যে দ্রব্য বিদেশে যায় তার সিংহভাগও রপ্তানী হয় এই বন্দর দিয়েই। কিন্তু ভৈরব সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় বন্দর শহর চট্টগ্রামের সঙ্গে গোটা দেশের যোগাযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার ফলে বিদেশ থেকে আগত সাহায্য সামগ্রী জরুরী ভিত্তিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়নি। সময়মতো সাহায্য দ্রব্য জনগণের হাতে না পৌঁছানোর ফলে জনগণকে নানা অভাবের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং সেই অভাবের পথ ধরে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বহু। সুতরাং এই সেতুটির পুনর্নির্মাণ যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেকথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং সে কারণেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সরকার উক্ত সেতুটির মেরামতের কাজ হাতে নিয়েছেন।
মুক্তিসংগ্রামে নৈতিক, মানবিক সমর্থনসহ বন্ধুরাষ্ট্র ভারত সশস্ত্র সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে যেভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছেন, তেমনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজেও তারা বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করেছেন বিভিন্ন দিক থেকে। তাদের আর্থিক এবং কারিগরী সাহায্য সহযোগিতার ফলে ইতিমধ্যে পাকশীস্থ হার্ডিঞ্জ সেতু মেরামত কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। ভারতীয় মুদ্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্নিমিতব্য এই সেতুটি মেরামতের জন্যে ১৬ জন প্রকৌশলী, ৬২০০ জন ভারতীয় শ্রমিক এবং ৬০ জন বাঙালী কর্মী দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। অক্টোবর মাসে এই সেতু চালু হলে বন্দর নগরী চট্টলার সঙ্গে শুধু রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থারই উন্নতি হবে না উপরন্তু সেই সাথে সারাদেশে অর্থনৈতিক অবস্থারও কিছুটা পরিবর্তন আসবে বলে আমরা মনে করি।
বিপদে যে সাহায্য করে সেই না প্রকৃত বন্ধু। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রয়োজনে যে সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছে সেই সাথে এই ভৈরব সেতুর পুনর্নির্মাণ কাজটিও ওঁদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনের কথাই নতুন করে প্রমাণ করবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক