You dont have javascript enabled! Please enable it! আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - সংগ্রামের নোটবুক

আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ, ভারত ও পাকিস্তান ডােমিনিয়ন সৃষ্টি, ঢাকায় পূর্ববাংলার রাজধানী প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার লড়াই, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিন্ন কর্মচারী ধর্মঘট এবং ওই দুই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বদান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পাকিস্তানে এই প্রথম পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় ছাত্রকর্মীদের ওপর লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তার, জেলজুলুম ও মামলাৰাজি এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগের প্রেক্ষাপটে সরকারবিরােধী প্রথম ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। ১৯৫০ সালে দেশবিভাগের পর প্রথম ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাে হয় হিন্দু বিতাড়ন এবং ঢাকার ব্যবসাকেন্দ্র নবাবপুর, পাটুয়াটুলী প্রভৃতি অঞ্চল ভারত থেকে আগত অবাঙালি ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য। পঞ্চাশের ওই দাঙ্গা প্রতিরােধের জন্য অবিলম্বে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র মুস্তফা নূরউল ইসলাম ও আলাউদ্দিন আল আজাদের সম্পাদনায় দাঙ্গাবিরােধী গল্পসংগ্রহ প্রকাশ করা হয় । প্রগতিশীল দাঙ্গাবিরােধীদের ওপর প্রতিক্রিয়াশীল দাঙ্গাবাজরা হামলা চালায় দাঙ্গাবিরােধী শান্তি মিছিলে, যেমন চালিয়েছিল তারা ‘৪৮ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে শােভাযাত্রার ওপর। দেশবিভাগের পর থেকেই বাংলা ভাষা আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনা-সচেতন হয়ে উঠতে থাকে, যা ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী।

উল্লিখিত পটভূমিকায় ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে একটি প্রগতিশীল যুব সংগঠন গঠনের উদ্দেশ্যে যুবকর্মীদের এক সম্মেলন আহূত হয়; কিন্তু সভা শুরু হওয়ার আগেই সম্মেলনস্থলে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী সভাকক্ষ দখল করে অবস্থান নেয়। বাধ্য হয়ে সম্মেলনের উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল মতিন, অলি আহাদ, আবদুস সামাদ, মােহাম্মদ সুলতান, কামরুজ্জামান, ইমাদুল্লাহ প্রমুখ সদরঘাটে গিয়ে একটি বড় নৌকা ভাড়া নিয়ে বুড়িগঙ্গা  নদীতে ভাসমান অবস্থায় গঠন করেন পূর্ববাংলার প্রথম সরকারবিরােধী প্রগতিশীল যুব সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ’ । যুবলীগের ১৯৫১ সালের কর্মকর্তাদের মধ্যে সভাপতি মাহমুদ আলী ছাড়া অন্যান্য নেতা, যেমন সহ-সভাপতি মােহাম্মদ তােয়াহা, কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান মাহবুব আলী, সম্পাদক অলি আহাদ, যুগ্ম সম্পাদক ইমাদুল্লাহ, দপ্তর সম্পাদক আনিসুজ্জামান সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বালীন বা পরবর্তী সময়ের ছাত্র। ১৯৫২ সালে যুবলীগের সভাপতি হন মােহাম্মদ তােয়াহা, সহ-সভাপতি অলি আহাদ এবং সম্পাদক মুহাম্মদ ইমাদুল্লাহ। ১৯৫১ সাল থেকে মুসলিম লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে যুবলীগের গৌরবময় সংগ্রামী ঐতিহ্য রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান। মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সংগঠন হলেও ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকালীন ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই পাকিস্তানে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এভাবেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের ফলে পূর্ববাংলা থেকে বহু অমুসলমান শিক্ষক ও ছাত্র দেশত্যাগ করে পশ্চিম বাংলায় চলে যান। এই দেশত্যাগ ব্যাপক আকার ধারণ করে ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পর থেকে। অপরদিকে একই সময় ভারত থেকে দলে দলে অবাঙালি সরকারি কর্মচারী, বিশেষত রেলকর্মী। পূর্ববাংলায় হিজরত এবং বিভিন্ন রেলওয়ে জংশন দখল, রেল কলােনি ও জেলা শহরগুলােতে মােহাজের কলােনি গড়ে তােলে, যেমন মােহাম্মদপুর, মিরপুর, সৈয়দপুর, পার্বতিপুর, পাহাড়তলী প্রভুতি | অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় বাংলা সরকারের মুসলমান কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অধিকাংশের দেশের বাড়ি ছিল পূর্ববাংলায়, তাদের। প্রায় সবাই সপরিবারে দেশবিভাগের সময় পূর্ববাংলায় চলে আসেন। অবিভক্ত বাংলার পার্ক সার্কাস অঞ্চল ছিল ওই সরকারি আমলা ও কর্মীদের আবাসিক এলাকা। তাদের। মধ্যে যাদের কলকাতায় নিজস্ব বাড়িঘর ছিল, তারা ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে অমুসলমানদের সঙ্গে বাড়িঘর, জায়গা-সম্পত্তি বিনিময় করেন। গণভােটের পর সিলেট পাকিস্তানভুক্ত হওয়ার ফলে আসাম সরকারের বেশকিছু উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাকিস্তানে ‘অপশন দিয়ে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। দেশবিভাগের পর যেসব বাঙালি পশ্চিমবঙ্গ বা আসাম থেকে পূর্ববাংলায় আসেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। অপরদিকে ভারত থেকে আগত অবাঙালি মুসলমান যারা পূর্ববাংলায় আসেন, তাদের অধিকাংশই ছিল রেলকর্মী, কিছু ব্যবসায়ী । দেশবিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, ইডেন, ‘ঢাকা মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি সরকারি কলেজ এবং সেন্ট গ্রেগরিজ, কলেজিয়েট, আরমানিটোলা ও বিভিন্ন জেলা স্কুলে পশ্চিমবঙ্গ-আসাম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন শ্রেণীতে ভর্তি হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি কলেজ, বিশেষত ইসলামিয়া কলেজ থেকে আসা সরকারি অধ্যাপকগণ ঢাকা, ইডেন, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেট এমসি কলেজে  যােগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদানকারী শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক প্রফেসর আবু মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। কয়েকজন অবাঙালি অধ্যাপকও ভারত থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক ওজায়ের । তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর জনক মওলানা আবদুল আলা মওদুদীর শিষ্য। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের মধ্যে প্রথম মওলানা মওদুদী তথা জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য সংবলিত পুস্তকপুস্তিকা বিতরণ করতে শুরু করেন । তিনি এসেছিলেন এলাহাবাদ থেকে, পরে তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। অন্যদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক আবু মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদানের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগটি একটি যথার্থ ইতিহাস শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। কলকাতার কোনাে এক সরকারি কলেজের অংকের অধ্যাপিকা মিসেস ফজিলতুন্নেসা (জোহা) ইডেন কলেজে যােগদান করেন। বাঙালি মুসলমান ছাত্রীদের মধ্যে প্রথম এমএ এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত মিসেস জোহা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৫২-৫৩ সালে তিনি ইডেন কলেজের ছাত্রীদের বাংলাভাষা আন্দোলনে যােগদানে প্রচণ্ডভাবে বাধা দিয়েছিলেন। অথচ বিশের দশকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বিজ্ঞানী কাজী মােতাহার হােসেনের মতাে ব্যক্তিত্ব তার গুণগ্রাহী ছিলেন। মিসেস ফজিলতুন্নেসা জোহা তার মান রাখতে পারেননি। ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ১৯৫৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা ও ইডেন কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নির্মীয়মান শহীদ মিনার। ভেঙে দেয়ার ঘটনার তিনি অন্যতম পুরােধা ছিলেন।  দেশ বিভাগের পর পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলকাতা থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরাই আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার মূল ধারাটি ঢাকা তথা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলা শহরে নিয়ে আসেন। ওই তরুণ সমাজ কলকাতায় পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত ছিলেন।

শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে মুকুল। ফৌজকে কেন্দ্র করে তাদের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা গড়ে উঠেছিল। দেশবিভাগের পর কামরুল হাসান মুকুল ফৌজ আন্দোলনকে ঢাকা তথা পূর্ববাংলায় নিয়ে আসেন। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার যে ধারা গড়ে ওঠে, আদর্শগত দিক থেকে তা দেশবিভাগ-পূর্ব ‘গণনাট্য সংঘ’ এবং ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে’র নবনাটক ও গণসংস্কৃতি চর্চার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল । ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সংসদ’ প্রতিষ্ঠা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত। সংস্কৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের চারজন। প্রগতিশীল শিক্ষক অমিয় চক্রবর্তী, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, খান সারওয়ার মুরশিদ। এবং মুনীর চৌধুরী ছিলেন প্রেরণাদাতা। বস্তুত সংস্কৃতি সংসদ গঠনে যেসব ছাত্র মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের বাপ-চাচাদের অধিকাংশই ছিলেন নতুন পূর্ববাংলা   সরকারের আমলা এবং তারা কৃত্রিম উর্দু শরাফতি চাল-চালনে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য প্রাণপণ সাধনায় ব্রতী ছিলেন। কিন্তু এই আমলাদের অধিকাংশই যেহেতু বেঙ্গল বা আসাম সিভিল সার্ভিস থেকে আগত বা কলকাতা/শিলং সচিবালয়ের আপার ডিভিশন। কেরানি থেকে প্রমােশন পাওয়া নতুন ‘অ্যাসিসট্যান্ট বা ডেপুটি সেক্রেটারি’, সে কারণে উত্তর প্রদেশ বা পাঞ্জাবের সামন্ত পরিবার থেকে আসা সাবেক আইসিএস। এবং তদানীন্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের এলিট সদস্যদের অবজ্ঞার পাত্র ছিলেন। উর্দু শরাফতি তাদের হীনমন্যতারই বহিঃপ্রকাশ ছিল, বিশেষত তাদের অধিকাংশই ছিলেন পূর্ববাংলার কৃষক পরিবারের গ্রামীণ সন্তান; কিন্তু সর্বদা সেই ঐতিহ্য অস্বীকার করার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট। ঘটনাচক্রে পাকিস্তানের পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাদের বাপ-চাচাদের ওই কৃত্রিম তাহজীব, তমদুন ও শরাফতি শ্বাসরুদ্ধকর মনে হতাে। তারা নতুন রাষ্ট্রে আবহমান স্বদেশী সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মুক্তভাবে নিঃশ্বাস গ্রহণের চেষ্টা করছিলেন আর তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। কলকাতা থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের একাংশের মধ্যে যে পাকিস্তানি তথা উর্দু তাহজীব, তমুদুন ও শরাফতির প্রভাব ছিল না তা নয়; কিন্তু তা দেশবিভাগপরবর্তী সংস্কৃতি চর্চার মূলধারা হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষত বাংলাভাষা আন্দোলনের ফলে বহিরাগত তাহজীব-তমুদুনের বৃক্ষ এদেশের মাটিতে কখনাে শেকড় বিস্তার করতে পারেনি, তা বড়জোর টব বা প্লাস্টিকের ফুলের গাছই থেকে গেছে।

পঞ্চাশ দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে বামপন্থী মনােভাবাপন্ন ছাত্র। আজিজুল জলিল, হাফিজুর রহমান চৌধুরী, কামাল আহমেদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান, কাজী আবদুল মুকিত, আনওয়ারুল আজিম চৌধুরী প্রমুখ ‘সংস্কৃতি সংসদ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করেন। অপরদিকে ইসলামি ও পাকিস্ত নি আদর্শে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ব্যারিস্টার এ. টি. এম, মুস্তাফার প্রেরণায় ইবরাহিম মাে, তাহা, ইশতিয়াক আহমেদ, মােস্তফা কামাল, সৈয়দ মােহাম্মদ আলী প্রমুখ ‘ইসলামি ভ্রাতৃসংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্মরণীয় যে, মিশরে মুসলিম মৌলবাদীদের সংস্থার নাম ছিল ‘ইসলামিক ব্রাদারহুড’।  এছাড়া অধ্যাপক হাসান জামানের শিষ্যদের মধ্যে বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মােজাফফর আহমদ ছিলেন তমদুন মজলিসের কর্মী। সারওয়ার মুরশিদ খানকে সভাপতি, আজিজুল জলিলকে আহ্বায়ক ও হাফিজুর রহমান চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে সংস্কৃতি সংসদের প্রথম কমিটি গঠিত হয়েছিল। বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবুল হােসেন, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন আর পঞ্চাশের দশকে গড়ে উঠল ‘সংস্কৃতি সংসদ’ একই ধারায় । বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ছিল সামাজিক গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আর সংস্কৃতি সংসদ হয়েছিল প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি চর্চার জন্য । ‘সংস্কৃতি সংসদের আহ্বান’ নামে এক পাতার একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়েছিল;  অপরদিকে ইসলামি ভ্রাতৃসংঘের আওয়াজ’ নামে পাল্টা একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। সংস্কৃতি সংসদের আহ্বান প্রচারপত্রটিতে সুস্থ সংস্কৃতির প্রতীক শিল্পী শফিউদ্দিন আহমদের একটি উডকাট’ ছবি ছাপা হয়েছিল, সংস্কৃতি সংসদের প্রথম অনুষ্ঠান ছিল বাধার মুখে ‘রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী’ আর দ্বিতীয় অনুষ্ঠান ‘নজরুল জন্মবার্ষিকী’  সংস্কৃতি সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও তেতাল্লিশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত বিজন ভট্টাচার্যের গণনাট্য ‘জবানবন্দি’ মঞ্চস্থ করা । তখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক মঞ্চায়নে সহ-অভিনয় প্রথা চালু হয়নি, ছেলেদের হলে নাটকে ছেলেরা স্ত্রী-চরিত্রে মেয়ে সাজতাে আর উইমেন্স হােস্টেলে মেয়েরা নাটকে পুরুষ-চরিত্রে ছেলে সাজতাে।

সংস্কৃতি সংসদ ‘জবানবন্দিতে প্রথম সহ-অভিনয় প্রথা চালু করে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে মিলনায়তনে অনুমতি না পাওয়ায় নবাবপুর রেলক্রসিং সংলগ্ন রেলওয়ে ইনস্টিটিউট মঞ্চে, তখন ঢাকায় নাটক হতাে ওই মঞ্চেই । জবানবন্দি’ নাটকে পুরুষ-চরিত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কামাল আহমেদ, কাজী আবদুল মুকিত, আজিজুল জলিল, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আর মেয়েদের চরিত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে মিসেস লায়লা সামাদ ও রােকেয়া কবীর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নুরুন্নাহার অভিনয় করেছিলেন। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন সে সময়ের ঢাকার আধুনিক নাট্য পরিচালক হাবিবুল হক, সহ-পরিচালক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র শরফুল আলম। নাটকটির রিহার্সেল হতাে নীলক্ষেত এলাকায় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর বাসায় । নাটকটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছিল, ‘তবে বিহারি ও একশ্রেণীর ঢাকাবাসীর হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রহরায় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরপর থেকে সহ-অভিনয় প্রথা চালু হয়ে যায় । সংস্কৃতি সংসদ নাটকটি আবার ১৯৫২ সালে কুমিল্লা সাংস্কৃতিক সম্মেলনে মঞ্চস্থ করেছিল। অপরদিকে ইসলামিক ব্রাদারহুড ইব্রাহিম তাহা রচিত ‘কাশ্মীর নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে, তাতে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে ভারতের দালাল হিসেবে দেখানাে হয়েছিল। শেখ আবদুল্লাহর ভূমিকা রূপায়িত করেছিলেন ইশতিয়াক আহমেদ। সংস্কৃতি সংসদ থেকে পঞ্চাশের দশকেই ডাকসু নাট্য দল এবং ড্রামা সার্কেল’ গঠিত হয়েছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাভিনয়ে সহ-অভিনয় এবং গণনাট্য চালুর কৃতিত্ব সংস্কৃতি সংসদের প্রাপ্য। তদানীন্তন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সাংবাদিক এস, এম, আলী জবানবন্দি’ নাটকটির পর্যালােচনা ও প্রশংসা করেছিলেন। ইংরেজ আমলে অভিভক্ত বাংলায় বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছিল ছাত্র ফেডারেশন’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, বিভিন্ন শ্রমিক ফেডারেশন এবং প্রগতি লেখক সংঘের ওপর প্রচণ্ড দমনীতি চালানাে হয় ফলে ঐসব বামপন্থী সংগঠন ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যেতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা কর্মী গ্রেফতার হন বা আত্মগােপন করতে বাধ্য হন।  এদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র সাদেক খান এবং ইংরেজির ছাত্রী নাদেরা বেগম দীর্ঘদিন আত্মগােপন করে থেকেও সক্রিয়ভাবে বামপন্থী তৎপরতা চালিয়ে যান। 

সূত্র : স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – রফিকুল ইসলাম