You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.14 | বিচ্ছিন্নতার অভিযােগে গণহত্যার আয়ােজন - সংগ্রামের নোটবুক

বিচ্ছিন্নতার অভিযােগে গণহত্যার আয়ােজন

জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হিসাবে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘােষণা দেন, হােক না তা বিশেষ নিয়মকাঠামােয় (এল,এফ,ও’র অধীনে) তখন দেশে-বিদেশে সর্বত্র এ উদ্যোগ প্রশংসিত হয় গণতান্ত্রিক মনােভাবের প্রকাশ হিসাবে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে ছয় দফা তথা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একতরফা নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয়। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামী সমাজতন্ত্র ও নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে ভূমি বণ্টনের স্লোগান তুলে এবং ভারতের সঙ্গে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার লৌহকঠিন অঙ্গীকারের মাধ্যমে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্বাচনী বিজয়, অর্থাৎ পশ্চিমে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। জমিদার থেকে মন্ত্রী, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে জমিদার রাজনীতিক হিসাবে সফল ভুট্টো আবার রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রত্যাশী হয়ে ওঠেন।  কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলেই বুঝি যত গলদ। দুই অঞ্চলের প্রতিটিতে একক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় দলের গােটা পাকিস্তান-ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়ে ওঠে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জাদুকাঠি। বিষয়টি ইতিপূর্বে আলােচিত। সত্যই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল ৬-দফা তথা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে। ভুট্রোর এতে মহাআপত্তি। তার বিচারে ছয় দফায় রয়েছে অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য অশুভ ইঙ্গিত, বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা। কিন্তু ৬-দফার দাবি, দুই অঞ্চলের বৈষম্য নিরসনের জন্য ঐ ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সূচনা ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। এটা নতুন কিছু নয়। খাটের দশক জুড়ে পূর্বাঞ্চলে ক্রমশ এ আন্দোলনের জনভিত্তি তৈরি হয়েছে। এতে বিচ্ছিন্নতার অবকাশ ছিল না, অন্তত আওয়ামী নেতৃত্বের মধ্যে তাে নয়ই। মূল নেতৃত্বের কাছে এ দাবির রাজনৈতিক চরিত্র স্পষ্ট অখণ্ড পাকিস্তান কাঠামােয় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে। উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানাে। এ বিষয়টিও পূর্ব-আলােচিত। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে সংশ্লিষ্ট প্রত্যাশার আলােয় ভুট্টো ঐ বিচ্ছিন্নতার অজুহাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে দিতে রাজি হন নি। তার মতে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতিনিধিত্ব চাই সরকারে, প্রয়ােজনে গঠিত হােক কোয়ালিশন সরকার এই দাবি নিয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন ভূট্টো।

সমর্থন মেলে সামরিক বাহিনীর জঙ্গি অংশের, বেশ কিছু সংখ্যক জেনারেলের। তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে প্রচলিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মানা অসম্ভব হয়ে ওঠে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় সমস্যা, জটিলতা ও বাধা।  আর যাই হােক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে ক্ষমতাবান জঙ্গি জেনারেল গ্রুপের দাবি খারিজ করে দেওয়া সম্ভব হয় নি। তাই যড়যন্ত্রে হাত মেলাতে হয়। ষড়যন্ত্রের মূল কথা, হয় ক্ষমতা ভাগ কর, নয়তাে বিদায় হও। বিদায় সােজা রাস্তায় করা চলে না, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্ব বলে একটা কথা আছে। তাই রাজনৈতিক সমঝোতার উপলক্ষ তুলে আলােচনার সূচনা, আলােচনায় ঐ স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে জটিলতা সৃষ্টি, টানাপােড়েন, অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা, প্রতিক্রিয়ায় পূর্বাঞ্চলে আইন অমান্য তথী অসহযােগ আন্দোলন। শেষপর্যন্ত ঐ আন্দোলনের জের হিসাবে বিচ্ছিন্নতার অভিযােগ, অভিযােগ আলােচনায় পশ্চিমী স্বার্থ মেনে না নেওয়ার কারণে। তাই বিচ্ছিন্নতার অভিযােগ সংখ্যাগরিষ্ঠের মাথায় চাপিয়ে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সামরিক অপারেশনের সিদ্ধান্ত। সংক্ষেপে এই ছিল ২৫ মার্চ পূর্ব-পাকিস্তানে পাক-সামরিক বাহিনীর অভিযান তথা ‘অপারেশন পরিচালনার প্রেক্ষাপট, সামরিক শাসকদের যৌক্তিক ভিত্তি। কিন্তু পূর্ববর্তী আলােচনায় বিষয়টা যুক্তিসঙ্গতভাবে স্পষ্ট যে বিচ্ছিন্নতার কোনাে ইচ্ছা পূর্বাঞ্চলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ছিল না যদিও তাদের দলের বা অন্য জঙ্গিদের চাপ ছিল এদিক থেকে। সে চাপের কাছে আওয়ামী লীগ প্রধান নতি স্বীকার করেন নি। কিন্তু পশ্চিমী স্বার্থের চাপের মুখে সরকারি আলােচনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্রমশ পিছু হটতে হয়েছে, অবশেষে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।  উপরের বক্তব্য এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ পশ্চিমা সংবাদভাষ্যকারদের। তাদের মতে শেখ মুজিবের ওপর একদিকে জনগণের আশা-আকাক্ষার চাপ অন্যদিকে ভুয়োইয়াহিয়া প্রমুখের মাধ্যমে পশ্চিম-পাকিস্তানি স্বার্থের চাপ। এ অবস্থায় মানসিক স্থৈর্য। ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বজায় রাখা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠে ছিল। হয়তাে সে কারণেই, যেমনটা অধ্যাপক রেহমান সােবহানও বলেছেন, ‘শেখ মুজিব ভুট্টোইয়াহিয়ার প্রস্তাবের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। আর ঐ প্রস্তাবের ভিন্নার্থক সরকারি ব্যাখ্যায় বিচ্ছিন্নতার দায় তার মাথায় চাপানাে হয়। সম্ভবত ঐ কৌশলের কারিগর ভুট্টো এবং জঙ্গি জেনারেল গ্রুপ। 

এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সমঝােতা আলােচনা কতটা সদিচ্ছাজনিত, কতটা উদ্দেশ্যমূলক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কোনাে কোনাে পশ্চিমা সাংবাদিক, বিশেষ করে ২৫ মার্চের সামরিক তৎপরতার পর । প্রথম দিকে সংলাপ চলাকালে তাদের অধিকাংশই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সদিচ্ছা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন তােলেন নি, তখন চাপটা ছিল মুজিবভুট্টোর ওপর। পরে ২৫ মার্চের ঘটনাবলী সাংবাদিকদের কাছে অনেক কিছুই স্পষ্ট করে দেয়। সাংবাদিক-ভাষ্যকারদের অনেকেই তখন ঐ সংলাপে ষড়যন্ত্রের আভাস পান। তাদের কেউ কেউ এমন অভিযোগও রাখেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সামরিক প্রস্তুতি। সম্পূর্ণ করার সময় পাওয়ার জন্যই আলােচনা শুরু করেন, নানা প্রস্তাবে শেখ মুজিবকে ব্যস্ত রাখেন। সময় নেন আক্রমণের কালক্ষণের জন্য। অর্থাৎ সংলাপ ছিল নিছক ভনিতা। অবশ্য পাক-সামরিক প্রশাসনের যুক্তি ছিল, পূর্বাঞ্চলে সরকারের আইনসঙ্গত তথা বৈধ শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই সেনাবাহিনীকে আক্রমণের পথ বেছে নিতে হয়েছে। কিন্তু যেভাবে এবং যে তীব্রতায় আক্রমণ চালানাে হয় তার ধরন নিজদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার মতাে ছিল না। এতে প্রবল জাতিগত ঘৃণা এবং প্রতিশােধ স্পৃহাই প্রকাশ পেয়েছিল। এ মতামত ২৫ মার্চের পর একাধিক সাংবাদিকের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। তাদের হিসাবে বৈধশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে অতিরিক্ত, অপ্রয়ােজনীয় শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল দেখার অভিজ্ঞতা এবং সেইসব বিবরণের ভিত্তিতে সাংবাদিকদের উপলব্ধি এ ধরনের মতামত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। কারাে কারাে বিচারে স্বদেশী জনতার ওপর স্বদেশী সামরিক বাহিনীর “নির্বিকার আক্রমণের ভয়াবহতা গণহত্যা বা জেনােসাইড’-এর পর্যায়ে পড়ে।  রাজনৈতিক বিরােধিতার সামরিক প্রতিকার করতে গিয়ে সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণ দলবিশেষের ওপর সীমাবদ্ধ রাখতে পারে নি, পারে নি চাপ স্বাভাবিক মাত্রায় সীমাবদ্ধ রাখতে । বরং বিরােধী দলকে শায়েস্তা করার নামে সেনাবাহিনী তাদের রাজনৈতিক আক্রোশ ঢেলে দেয় বাঙালি জাতি নামীয় জনসংখ্যার ওপর। এর প্রমাণ ওরা রেখেছে ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে সূচিত অপারেশন সার্চলাইট’ নামক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কর্মকাণ্ডে। বিশেষভাবে রেখেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক আক্রমণে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক হত্যা, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের মতাে ছাত্রাবাসে ‘আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক সংখ্যায় ছাত্র হত্যা, পুড়িয়ে, গুলি করে হত্যার মতাে ঘটনার তাণ্ডৰে যে হিংস্র সহিংসতা তাতে গণহত্যার চরিত্রই প্রকাশ পেয়েছে। যেমন পেয়েছে রেললাইন বা ফুটপাতের পাশে ভাসমান শ্রমজীবী বাসিন্দাদের ঝুপড়ি পুড়িয়ে তাদের একসারে হত্যার ঘটনায়। তেমনি রাজারবাগে পুলিশের ওপর এবং পিলখানায় আধাসামরিক বাহিনী ই.পি.আর সদস্যদের ওপর আক্রমণে একই মনােভাব প্রকাশ পেয়েছে। যে মনােভাব আবার সর্বাধিক বর্বরতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে পুরনো ঢাকার হিন্দুমহল্লায় ও সেখানকার অধিবাসীদের ওপর আক্রমণে ভিনদেশী সাংবাদিকদের ভাষায়ও যা গণহত্যার শামিল। এ ধরনের আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের নজির একদা দেখা গেছে ফ্যাসিস্টদের কর্মকাণ্ডে, প্রতিপক্ষের প্রতি তাদের আক্রমণের অমানবিক বর্বরতায়। সে প্রতিপক্ষ কখনাে রাজনৈতিক দলবিশেষ, কখনাে জাতি বা ধর্মসম্প্রদায় বা নিছক নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণ। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রেণীর বাঙালি। জনসাধারণের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে ঐ ফ্যাসিস্টসুলভ মনােভাবের পরিচয় রেখেছে। নিষ্ঠুরতা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তাদের তৎপরতায় প্রকাশ পেয়েছে। আইন অমান্য আন্দোলন দমন বা বৈধ সরকারি শাসন প্রতিষ্ঠা অন্যতম লক্ষ্য নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রধান আরাে একটি লক্ষ্য ছিল বাঙালি জনসংখ্যাকে এমন শিক্ষা দেওয়া যাতে তারা আর কখনাে বাঙালি, বাঙালিয়ানা ও স্বশাসনের কথা না বলে। পাক-শাসকদের এ মনােভাবের কথা শুধু বাঙালিদের কাছেই সত্য নয়, পরিস্ফুট হয়েছিল পশ্চিমা সাংবাদিক   কারাে কারাে বক্তব্যে।

জেনােসাইড’ (গণহত্যা) শব্দটা তাদের লেখাতেই এসেছে। আর সামরিক কর্তারাও বাঙালি-হত্যার ইচ্ছাটা গােপন করেনি। ‘জেনােসাইড’ (গণহত্যা) শব্দটা পশ্চিমা সাংবাদিক ও ভাষ্যকারগণ খুব ভেবে-চিন্তে, দেখে-শুনে, হিসাব-নিকাশ করেই ব্যবহার করেছিলেন। শুরুতে তাদের লেখায় গৃহযুদ্ধ শব্দটাই বারবার এসেছে। পরে ঐ পঁচিশে মার্চের ঘটনাবলীর বিচার এবং পাক-বাহিনীর পরবর্তী কর্মকাণ্ডের চুলচেরা মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ‘গণহত্যা’ শব্দটির ব্যবহার। প্রকৃতপক্ষ গণহত্যা সূচনাতেই নয়, পরবর্তী মাসগুলােতেও চলেছে, যা তখনকার সংবাদভাষ্যে মেলে।  কিন্তু সত্যকে সত্যমূল্যে, বাস্তবকে যুক্তিবাদিতায় গ্রহণ করতে পশ্চিমা সংবাদভুবনের দ্বিধার কারণ সম্ভবত পাকিস্তান সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী মনােভাবের সমান্তরাল ধরনের কিছুটা দুর্বলতা, এবং তা বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে। হয়তাে তাই ডেভিড হােলডেন প্রকৃত অবস্থা জেনে বা না-জেনে ঐ ‘জেনােসাইড’ শব্দটির ব্যবহার সম্পর্কে সামান্য তির্যক মন্তব্য করেন ভারতীয় রাজনীতিক-কূটনীতির কৃষ্ণ মেননের উদ্দেশ্যে।  তার মতে ভারতীয় রাজনীতিকদের সহজাত পাকিস্তান-বিরােধী প্রবণতার কারণে তারা প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে সর্বদাই চরম মন্দ ভেবে নিতে আগ্রহী হয়ে থাকেন। আর সে জন্যই কিছু সংখ্যাক ভারতীয় রাজনীতিবিদ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার কথা জোর গলায় বলতে শুরু করেছেন এবং দাবি করছেন অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের । (“…the instinctive Indian temptation to believe the worst about her neighbour has been given full reign. Some Indian Parliamentarian are already talking about ‘genocide’ and that passionately anti-Pakistan old warhorse Mr Krishna Menon, has called for immediate Indian recognition of Bangladesh”– ‘The Sunday Times, 28 March, 1971)। ডেভিড হােলডেনের মতাে লেখকদের এমন ধারণাও ছিল যে দলীয় এবং দলের বাইরে বিপ্লবী চরমপন্থীদের সৃষ্ট গত কয়েক মাসের অনাকাক্সিক্ষত চাপই শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দিয়েছে’ ufocus “Some of them (extremists) are in his own party, the Awami League, and were probably responsible in the last few months for pushing him further along the road to secession than he may have wanted to go. Others are outside the League in more revolutionary organiations.” ভাবটা হল বিচ্ছিন্নতা। এবং সে সূত্রে গণহত্যার দায় শেখ মুজিবের, সেই সঙ্গে বিপ্লবী সংগঠনগুলাের।

এমনি বিচিত্র কারণে পশ্চিমা সংবাদ-ভুবনের পক্ষে গণহত্যার মতাে চরম সত্য। ঘটনাও মেনে নিতে শুরুতে বেশ কিছুটা দ্বিধা ছিল— ছিল তথ্যনির্ভর যথেষ্ট সংবাদ ও সচিত্র প্রতিবেদনের পর্যাপ্ত যুক্তি সামনে না থাকার কারণেও। একমাত্র সাইমন ড্রিং এবং অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস ফোটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্টের ঘটনা-নির্ভর কিছু লেখা এবং  ছবিই ছিল পাক-সামরিক অভিযানের তথ্য-নির্ভর প্রাথমিক পরিচয়। ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’, (২৭ মার্চ) এবং ‘দ্য টাইমস’-এ (৩০ মার্চ) প্রকাশিত যথাক্রমে সাইমন ও মাইকেলের প্রতিবেদন এবং অনুরূপ দু’একটি সংবাদ-নিবন্ধে ঘটনার বিবরণ ছিল যথেষ্ট স্পষ্ট। তবু তা প্রত্যয়-গ্রাহ্য হয়ে উঠতে সময় নিয়েছে। অন্তত সপ্তাহ খানেক তাে বটেই। ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস। অবশ্য সাইমনের প্রতিবেদন ‘টেলিগ্রাফ’ থেকে তুলে নিয়ে ওয়াশিংটন পােস্ট’ ছেপে ছিল ৩০ মার্চ (১৯৭১)। ‘টাইমস’ পত্রিকায় ‘পূর্ব-পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার যুদ্ধ’ (“War of Genocide Against East-Pakistanis) বিষয়ক বিবরণ গণহত্যায় চিহ্নিত হয়ে লুইস। হেরেন-এর নিবন্ধে প্রথম প্রকাশ পায়। এ নিবন্ধে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয় যে পাকসামরিক বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যার কথিত যুদ্ধ শুরু করেছে। উদ্দেশ্য। সেখানকার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের অবসান ঘটানাে …হাজার হাজার। হিন্দু বাসিন্দা মুসলমান সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছে।’ এ নিবন্ধের বিবরণেও বিষয়গত মিল চোখে পড়বে সাইমন ড্রিং-এর বিবরণের সঙ্গে। জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ড এখানে আরাে স্পষ্টভাবে চিত্রিত, যেমন রয়েছে পুরনাে ঢাকায় বাজার ধ্বংস করার বিবরণ। রয়েছে রাজারবাগ ও পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের কাহিনী।

ঢাকা থেকে লন্ডনে পালিয়ে-আসা এক যুবকের অভিজ্ঞতা এ বিবরণের উৎস। সঙ্গত কারণে লেখক তার নাম গােপন রেখেছেন। নিবন্ধকারের ভাষায় “The Pakistan army is alleged to have waged in war of genocide in East Pakistan. The objective is said to be the elimination of the political and intellectual leadership. …”Tank tracks led to the wall of the compound (Jagannath hall), which had been blasted down. Outside the building there was a fresh massgrave. Inside blood streamed from every room. There were bodies of six savagely-killed men in the servants’ quarters nearby…. In two of the old city’s largest bazars, one entirely Hindu and the other predominantly so, the stench of dead and burning bodies was so overpowering that the survivors walked about with cloths over their noses. Atleast seven of eight bodies were seen in the rubble of ruined buildings and on refuse dumps” (The Times, 2 April, 1971)। এখানে পুরাে বিবরণ দেওয়া হয় নি। বড় কথা হলাে একদিন পরের (২৭ মার্চ) বিবরণে হত্যাযজ্ঞের সম্পূর্ণ চিত্র ধরা পড়ার কথা নয়। কারণ সৈন্যরা যেমন ছাত্রাবাসের সামনে মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়েছে তেমনি স্থানীয় মুসলমান প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ওরা যতটা পারে লাশ ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে গেছে। | ‘টাইমস’-এর ঐদিনেরই আরেকটি প্রতিবেদনে প্রকাশ যে হত্যাকাণ্ড ঢাকাতেই। সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রদেশের অন্যান্য শহরেও সেনাবাহিনী হত্যার নেশায় লিপ্ত ছিল। যে কারণে ঢাকা থেকে যেমন ২৭ মার্চ কার্ফ তুলে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা অবসরে মানুষ পাগলের মতাে শহর থেকে ছুটে পালিয়েছে গ্রামের দিকে, তেমনি সীমান্ত সংলগ্ন শহরগুলাে থেকে আতংকিত মানুষ অনুরূপ অবকাশের সুযােগে ভিটামাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছে (কলকাতা থেকে পিটার হ্যাজেলহাস্ট, দ্য টাইমস ২ এপ্রিল, ১৯৭১)।

টাইমস’ পত্রিকায় পরদিন প্রকাশিত প্রতিবেদনে (‘পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ) সরাসরি জেনােসাইড’ শব্দটি ব্যবহার করা না হলেও তাদের বক্তব্য গণহত্যার পরিচয়ই তুলে ধরে। প্রতিবেদকের মতে প্রত্যক্ষদর্শনের অস্পষ্টতা পেরিয়ে এখন ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যান্য শহর থেকে যে সব খবর পাওয়া যাচ্ছে তা শুধু ভয়াবহই নয় বরং যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়েও অনেক গুরুতর। ঢাকায় ছাত্র হত্যার বিবরণ এখন প্রমাণিত (“By now the picture is a little more clear and a great deal more gruesome, enough first-hand reports from Dacca itself and from some of the major towns have come in to confirm that what is happening is far worse than what might have been expected in a war of East-Pakistanis resisting the forces of the central government in their demand for independence. The slaughter of students in Dacca seems well attested. (‘The slaughter in East-Pakistan’- The Times, 3 April, 1971)। প্রতিবেদক এ ঘটনাগুলােকে দেশবিভাগকালীন দাঙ্গা ও হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। | দিনাজপুর থেকে নিকোলাস টোমালিন জনৈক সার্জেন্ট-মেজর রবের সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তার প্রতিবেদনে লিখেছেন : “জেনােসাইড (গণহত্যা) একটি অতিব্যবহৃত শব্দ। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রদত্ত সুস্পষ্ট নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে শব্দটার ব্যবহার যুক্তিসঙ্গত। গত কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে আমার তিন তিন বার যাতায়াতের পরিপ্রেক্ষিতে তা যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়। যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ সমর্থকদের হত্যা করা ভিন্ন ইয়াহিয়া খানের আর কোনাে উদ্দেশ্য আছে এমন মনে করা কঠিন। তার উদ্দেশ্য যাতে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে সেখানে আর কোনাে প্রতিরােধ তৈরি হতে না পারে। হত্যাকাণ্ড তাই চলছেই। আমরা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছি।”

effocano (“Genocide is an over-used term. But, in the light of explicit military orders to West-Pakistan troops….it seems justified. From difficult to see Yahya Khan’s policy as anything other than an effort to kill swiftly so many Bangladesh supporters that resistance will vanish for next 15 years. The killing is taking place. We have seen the massacres with our own eyes.” (Murder Has been Arranged’, The Times, 11 April, 1971) 241403 ভাষায় বলেছেন যে স্থানীয় স্বাধীনতা কর্মীরা আপাতত নিজদের সহায়-সম্পদ নিয়েই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি প্রচার যত কথা বলুক না কেন এখন পর্যন্ত কোনাে ভারতীয় সামরিক সাহায্য যে আসে নি সে কথা নিসংশয়ে বলা চলে। | নর্দার্ন ইকো’ কাগজের সম্পাদকীয় ভাষ্যে (‘Civil War in Pakistan’) কিছুটা অনুচ্চকণ্ঠে, কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় পাক-বাহিনীর নির্মম কসাইগিরি এবং সে সম্পর্কে পশ্চিমা শক্তির আত্মপ্রতারণামূলক নির্বিকারত্বের কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত স্পেনের গৃহযুদ্ধের পরিণাম এবং স্পেন ও বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধের তুলনামূলক বিচারও আলােচনায় স্থান পেয়েছে। এসেছে সামরিক একনায়ক ‘ফ্রাংকোর কথা এবং সেই সূত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কথা, পরিণামে যাকে প্রতিদিন বেসামরিক মানুষ হত্যার কলঙ্কভার বহন করতে হবে। আর সেসব ঘটনা প্রেস সেন্সরশিপও চেপে রাখতে পারেনি।’ মূল ভাষায় বক্তব্য নিম্নরূপ: (“Let us not delude ourselves with thoughts that the Pakistan butchery is too far away to concern us. Some may  remember feeling the same way about the early days of Spain’s civil war. We all know what that led too. And there are similarities in the struggle for a Bangladesh, a Bengal nation….President Yahya Khan eventually must bear the shame of a daily massacre’ of civilians that even censorship cannot conceal” (The Nothern Echo, 13 April, 1971).

এমন কি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডে সূচিত গৃহযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান যে বিশ্বপরিসরে আর একটি স্পেন কিংবা ভিয়েতনাম হয়ে উঠতে পারে তেমন আশংকাও সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রকাশ করা হয়েছে। আর ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়েছে, যাতে তারা এ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। পরিশেষে পাকিস্তানকে সাহায্যদাতা দেশগুলােকেও অনুরােধ করা হয়েছে যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিতে বলে (১৩,৪,১৯৭১)। আগুনে-ধোয়ায় কালাে ও অঙ্গের বর্বরতায় রক্তাক্ত বাংলাদেশে পাকবাহিনীর অভিযান যে গণহত্যার পরিচয় রেখে চলেছে সে সম্বন্ধে মার্চ মাসের অবশিষ্ট কটা দিন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সংবাদ ভুবনের সন্দেহ সংশয়েরও অবসান ঘটে। মাকিনি কাগজগুলাে তাদের অন্যান্য পশ্চিমা সহযােগীর সঙ্গে একটু দেরিতে হলেও একই সুরে কথা বলে, অভিযােগ আনে পাক-সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে, কখনাে সরাসরি কখনো প্রচ্ছন্ন বক্তব্যে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নাগরিকের বক্তব্যে বিষয়টি প্রকাশ পায়, পৌছায় তাদের সেনেটেও। ঢাকায় ইউএসএইড (‘USAID’) সংস্থায় কর্মরত চিকিৎসক ডা. জন রােড ১৭ এপ্রিল (১৯৭১) এক চিঠিতে সেনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি’কে তার অভিজ্ঞতার কথা লেখেন। তার অভিজ্ঞতা সাংবাদিকদের থেকে খুব একটা ভিন্ন ছিল না, তাই বাস্তবতা বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। ডা. জন রোড অবশ্য প্রচ্ছন্ন অভিযােগের সুরে মার্কিন প্রশাসনের নীরবতা এমন কি করাচিস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেলের অনীহার কথাও বলেছেন ঢাকা থেকে মার্কিন কনসালের নিত্যদিনকার বাস্তব প্রতিবেদন করাচিতে ও স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাের পরিপ্রেক্ষিতে। হয়ত বিবেক-তাড়িত হয়েই ঐ চিকিৎসক সেনেটরকে চিঠি লেখেন।

তার ভাষায় “আমার স্ত্রী ও আমি আমাদের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে ২৫ মার্চ রাতে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে-আসা ট্যাংকগুলােকে তাদের নিক্ষিপ্ত আলােকবর্তিকা ও আগুনের লাল আভায় চলতে দেখেছি। শহরে তখন গােলাবর্ষণ চলছে, মর্টার ছােড়া হচ্ছে জনাকীর্ণ। বস্তিগুলােতে ও বাজারে। দুদিন ধরে সশব্দ বিস্ফোরণ ও মেশিনগানের অব্যাহত কটকট আওয়াজের পর কার্টু-বিরতির সুযােগে আমরা গাড়ি নিয়ে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ি। গুলশান থেকে মহাখালী ক্রসিং-এ পেীছানাের পথে উদ্বাস্তু জনস্রোত পাশ কাটিয়ে এসে চোখে পড়েছে রেললাইনের ধার বরাবর সারিসারি বস্তির পােড়া-অবশেষ।” (“My wife and I watched from our roof the night of March 25th as tanks rolled out of cantonment illuminated by the flares and red glow of fires as the  city was shelled by artillary, and mortars were fired into crowded slums and bazars. After two days of loud explosions and the continual chatter of machineguns, we took advantage of a break in the curfew to drive through the city. Driving past streams of refugees we saw burned out shacks of families living by the railroad tracks, coming from Gulshan to Mahakhali crossing.”) মহাখালীর বাসিন্দা তার এক বন্ধু দেখেছেন ; “সৈন্যরা বস্তিতে আগুন ধরিয়ে অপেক্ষা করেছে, যেই ভেতর থেকে লােকজন ছুটে বেরিয়ে এসেছে অমনি তাদের কুকুরের মতাে গুলি করে মেরেছে।” পুরনাে ঢাকায় এই চিকিৎসক দম্পতি নয়াবাজার, শাঁখারিবাজারের মতাে এলাকার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেয়েছেন। তখনাে সেখানে হত্যাযজ্ঞ শেষ হয় নি। তাদের সেখানে পৌছানাের কিছুক্ষণ আগেও কয়েকজন বাসিন্দা। গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং আর একজন পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাত্র আধঘণ্টা আগে মারা গেছে। অন্যদের লাশ ঐ রাস্তায়ই পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। বােমার আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত ঐ মহল্লায় তখনাে কিছু লােক রয়ে গেছে, তারা ঐ চিকিৎসক দম্পতির কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়।’ 

ঢাকা থেকে চলে যাবার আগের দিন সেখানে গিয়ে ডা, রােড দেখতে পান। শাখারিপট্টির ভাঙাবাড়ির কয়েকটির গায়ে উর্দুতে লেখা মুসলমান নাম। অথচ পুরাে মহল্লাটাই ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। রমনা রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়ানাে পুরনাে কালীবাড়ির স্থানেও ঐ চিকিৎসক দ্রলােক দেখেছেন পাক-সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের আলামত। গােলাগুলির আঘাতে বিধ্বস্ত এবং আগুনে পোড়া কালীমন্দিরের ধ্বংসস্তুপ, ইতস্তত ছড়ানাে নারীপুরুষ ও শিশুর মৃতদেহের অবশেষ। এসবের ছবিও তুলে নেন তিনি। আরাে দেখেছেন রায়েরবাজার, নয়াবাজার, ঠাটারিবাজার এলাকায় পাকসৈন্যদের কীর্তিকলাপের ভয়াবহ নমুনা। পরিশেষে ডা,জন সেনেটর স্যাক্সবিকে অনুরােধ করেছেন পাকিস্তানের মার্কিন কনসালের গােপন রিপাের্ট পুরােপুরি পড়ে নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘটিত পাক-বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য যাতে তারা পাকিস্তানি শাসকদের ঐ অন্যায়, অনাচারী পদক্ষেপ সমর্থন না করেন, অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য না দেন। তার মতে জীবনের মূল্য ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি মর্যাদাবােধ অক্ষুন্ন রাখতে চাইলে মার্কিন কংগ্রেসের উচিত এ বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। তার শেষ কথা : পূর্বপাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের ঐ শােকাবহ হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সােচ্চার হওয়ার জন্য আমরা আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাই’ (“We urge you to speak out actively against the tragic massacre of civilians in East-Pakistan.” Bangladesh Documents, pp 349-51), বলা দরকার যে সেনেটর স্যাক্সবি ২৯ এপ্রিল মার্কিন সেনেটের অধিবেশনে এ বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্য রাখেন। কিন্তু পাকদের প্রতি সমর্থনে অন্ধ নিক্সনকিসিঞ্জার প্রশাসনের তাতে বােধােদয় ঘটে নি, চোখ খােলে নি। অনুরূপ চিঠি ঢাকা-ফেরত একাধিক বিবেকবান মার্কিন নাগরিকও সেনেটসদস্যের কাছে বা পত্রপত্রিকায় পাঠিয়েছেন।

অনুরােধ করেছেন পূর্ব-পাকিস্তানে পাকবর্বরতার বিষয়টি যাতে মার্কিন প্রশাসন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আর সেজন্য গর্ডন অ্যালটের কাছে ১৯ এপ্রিল জেমস র্যাগিনের লেখা চিঠি। মার্কিন সেনেটের অধিবেশনে ১৪ জুলাই পূর্ব-পাকিস্তানে পাকবর্বরতার ওপর তথ্যসমৃদ্ধ এক দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন সেনেটর গর্ডন অ্যালট। কিন্তু তাতেও মার্কিন প্রশাসন নড়েচড়ে বসে নি। অনুরূপ পাকবর্বরতার বিবরণ ডেনভার পােস্ট কাগজে পাঠিয়েছিলেন ঢাকা থেকে তেহেরানে পৌছে জনৈক মার্কিন নাগরিক মিসেস এডােয়ার্ড প্যাট। তার চিঠিতেও হত্যাকাণ্ডের বিবরণ মেলে যা তার ভাষায় ‘গণহত্যা’ বই কিছু নয় (“we have been witness to what armounts to genocide.”)। মিসেস প্যাট প্রসঙ্গত ঘটনার চমৎকার তুলনা টেনেছেন এই বলে যে মার্কিন নির্বাচনে নিক্সন জয়ী হওয়ায় প্রেসিডেন্ট জনসন যদি নিক্সনের অভিষেক অনুষ্ঠান স্থগিত করে দিয়ে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ছুটে যেতেন নিক্সনের সঙ্গে আলােচনার জন্য, এবং পরে সেখানে সেনাবাহিনী মােতায়েন করে নিক্সনকে গ্রেফতার, রিপাবলিকান পার্টিকে বেআইনি ঘােষণা এবং রিপাবলিকান নেতাদের খুন করতেন তাহলে ঘটনা কেমন দেখাতাে? পরিশেষে তার বক্তব্য : “সম্ভবত ভিয়েতনামের ‘মাই লাই’ ও লেফটেন্যান্ট কেলি বিষয়ক ঘটনার বিব্রতকর অবস্থা থেকেই আমাদের এই অনীহা”। | ‘নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রতিনিধি সিডনি শ্যানবার্গের পাঠানাে বিবরণে দেখা যায় ২৫ মার্চ রাতে এবং ২৬ মার্চ দিনভর পাক-সেনাবাহিনীর বর্বর তৎপরতা যা ঢাকার বাসিন্দা বাঙালি জনগােষ্ঠীর নির্বিচার হত্যার কারণ হয়ে ওঠে। তার ভাষ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাতে পাক-সেনাবাহিনী নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে চারিদিক প্রকম্পিত করে মেশিনগান, অটোমেটিক রাইফেল, রিকয়েললেস আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গােলাগুলি বর্ষণসহ ভবনে ভবনে আগুন লাগানাের কাজে নেমে পড়ে। | ‘রাত দুটোর পর মেশিনগান সজ্জিত একটি সৈন্যবাহী জিপ তার হােটেল সংলগ্ন একটি দ্বিতল শপিং বাজার’ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।

তাদের সঙ্গে যােগ দেয় এক ডজন পদাতিক সৈন্য। এদের সঙ্গে ছিল রকেট জাতীয় বস্তু। ভবনের দ্বিতল থেকে স্লোগান ওঠে ‘বাঙালি এক হও। অমনি সেদিকে চলে মেশিনগানের অব্যাহত গুলিবর্ষণ। স্লোগান উচ্চারণের দিক থেকে কোনাে গুলির আওয়াজ আসে নি, ওরা ছিল নিরস্ত্র, প্রতিবাদী উচ্চারণে মুখর। এরপর সেনাবাহিনী ঐ ভবন ও পেছনের গ্যারেজে আগুন ধরিয়ে দেয়, তার আগে ঐ ভবন লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। তারা পেছনের ও আশপাশের দোকানগুলােও পুড়িয়ে দেয়। তখন পশ্চিম দিকের আকাশে দেখা দেয় বিরাটকায় আগুনের শিখা। কত লােক যে সব মিলিয়ে মারা গেছে তা হিসাব করাই কঠিন। রাতভর মাথার ওপর শােনা গেছে হেলিকপ্টারের গর্জন। আশপাশে শুধু আগুনের ধোঁয়া। পরদিন বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দেখা গেল পাকসেনারা গরিব বাঙালিদের কাঁচা বাড়িগুলাে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। বিমাবন্দরে পেীছেও শােনা যাচ্ছিল দূর থেকে গােলাগুলির আওয়াজ’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৮ মার্চ, ১৯৭১)। | গার্ডিয়ান পত্রিকায় ৩১ মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয় স্তঙ্কে পাকিস্তানে এক হত্যাযজ্ঞ (“A Massacre in Pakistan’) শিরােনামে মন্তব্য ; ইয়াহিয়া ঘটনা চাপা দিতে চাইলেও সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঠিকই জানা যাচ্ছে কাক নির্বিচারে মেশিনগানের গুলিতে বিদ্ধ, ছাত্রাবাস শেলের আঘাতে বিধ্বস্ত, বস্তি-শহরতলি গােলাবর্ষণে ও আগুনে   ধ্বংস, বেসামরিক লােকজন তাদের বিছানায় গুলিতে নিহত। নির্ভরযােগ্য সূত্রের সরাসরি খবরে জানা গেছে যে বহুসংখ্যক নিরস্ত্র বাঙালি সৈন্যদের হাতে মারা গেছে।…ঢাকার এ পরিণতি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, মানবিক আশা-আকাঙ্কার বিরুদ্ধে অপরাধ (“The fate of Dacca is a crime against humanity and human aspirations”. The Guardian, March 31, 1971)

‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ ৩১ মার্চ তারিখে (১৯৭১) প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধেও (“আল্লাহ ও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নামে তৎপরতা” “Acting in the name of God and a united Pakistan”) ইয়াহিয়ার পশ্চিম-পাকিস্তানি ফৌজের বাঙালি জনতার ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে মারভিন জোন্স “নিউ স্টেসম্যান’-এ বাংলার জন্য কাঁদো’ (Weep for Bengal’) শীর্ষক প্রতিবেদনে ঐ গণহত্যামূলক ‘ট্র্যাজেডি’র কথাই বলেছেন। বিবরণ দিয়েছেন কিভাবে পাকসেনারা পেট্রোল ছিটিয়ে বস্তিগুলাে পুড়িয়ে দিয়েছে, ওখানকার বাসিন্দাদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। আর সে জন্যই হাজার হাজার মানুষ আতংকে দিশাহারা হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু পালিয়ে গিয়েও সবাই রক্ষা পায় নি, বিশেষ করে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দারা। গণহত্যার পরবর্তী পর্যায়ে তাই দেখা গেছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও পূর্ব-পাকিস্তানে পাকসেনাবাহিনীর গণহত্যার বিবরণ পশ্চিমা সাংবাদিকদের কল্যাণে বিশ্ববাসীর সামনে পৌছে যায়। শুধু ব্রিটেন বা আমেরিকার পত্রপত্রিকাতেই নয়, ইউরোপের একাধিক দেশে এমন কি কানাডার সংবাদপত্রেও যথাযথ গুরুত্বে প্রকাশ পায় পূর্ববাংলায় পাক-সেনাদের নিষ্ঠুরতার কাহিনী। সংবাদপত্রগুলাে বাস্তবিকই যুক্তিসঙ্গত মানবিক অবস্থান নিতে ভুল করে নি।

সুইডেনের স্টকহােমস্থ একটি কাগজে তাই শিরােনাম ছিল বাংলায় গণহত্যা (‘Mass Murders in Bengal’)। এ প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণের ঘটনা গােপন করার চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে কি ঘটছে তা আমাদের জানতে বাকি নেই। শরণার্থীদের কাছ থেকে জানা গেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক বােমাবাজি, নির্বিচার আক্রমণ ও গণহত্যার কাহিনী। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।… সরকারের এ নীতি অবশ্যই নিন্দনীয়। (“We now know what is happening inspite of the attempts by the military regime to hide the facts. Refugees have testified to massive bombings, reckless rampages of West-Pakistani troops and mass murders. Hundreds of thousands of people are fleeing from their homes. Starvation threatens… This is a policy that must be condemned.” Expressen, 12 April, 1971.) | পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যার বিবরণ পশ্চিমা সংবাদভুবনের অংশ বিশেষকে এতটা বিচলিত করে যে “নিউ স্টেটসম্যান’ ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশের রক্ত” (The Blood of Bangladesh) শীর্ষক নিবন্ধটি প্রথম পৃষ্ঠায় রক্তের প্রতীক লালকালিতে ছাপে। ‘পূর্ববঙ্গের ঘটনাকে তার রক্তাক্ত ও সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ’ হিসাবে চিহ্নিত করে। ইভনিং স্টার’ পত্রিকায় ‘পূর্ব-পাকিস্তানে মৃত্যু’ (‘Death in East-Pakistan’) শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধেও এমন কথাই বলা হয় যে পূর্ব-পাকিস্তানে এখন সৰ বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটেছে তবে মৃত্যু,  আগুন, যন্ত্রণা ও হত্যার অবসান ঘটে নি।

সরকারি বাহিনীর হাতে হাজার হাজার লােকের মৃত্যু ঘটেছে; কোনাে কোনাে প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সংখ্যা লক্ষাধিক। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’এর অকুস্থল ঘুরে-আসা সাংবাদিকের মতে পাক-সেনাবাহিনী চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপক এবং ছাত্রসহ বহু সংখ্যক মানুষজনকে হত্যা করেছে’ (দ্য ইভনিং স্টার, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১)।  ‘বাল্টিমাের সান’ পত্রিকার সম্পাদকীয় ভাষ্য অবশ্য একটু সংযত। সেখানে বলা হয়েছে। খবরের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অ্যাসােসিয়েট প্রেসের সংবাদদাতার ব্যাংকক থেকে পাঠানাে প্রতিবেদন থেকে মনে হয় গােটা ঘটনা যেন ঘৃণা ও আতঙ্কের নিষ্ঠুর এক গৃহযুদ্ধের। সংবাদদাতার আনুমানিক হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ লক্ষের মতাে হতে পারে। ধ্বংস বিশ্বাসের অতীত।’ এ নিবন্ধে বাঙালি ও অবাঙালির পরস্পরকে হত্যা করার ঘটনা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে (দ্য বাল্টিমাের সান, 14 May, 1971)। স্বনামখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিন-এ (এপ্রিল ৫, ১৯৭১) পূর্ব-পাকিস্তানে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাকে (তাদের ভাষায় গৃহযুদ্ধ) বঙ্গোপসাগরের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে যে এ ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অর্থাৎ মৃত্যুর সংখ্যা ও ধ্বংসের মাত্রা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে তাদের সংবাদদাতা ড্যান কগিনের বরাত দিয়ে সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্র ও সমর তৎপরতার একটি ভয়াল চিত্র আঁকা হয়েছে এ বিবরণে। | ঐ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনেরই ১২ এপ্রিল (১৯৭১) সংখ্যায় পাকিস্তানি ট্যাংক ও ধ্বংসস্কৃপের সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘গত সপ্তাহে পূর্ব-পাকিস্তানে কর্মরত জনৈক বিদেশী কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন যে “বিরাজমান অবস্থা সম্পর্কে হত্যাযজ্ঞ (‘ম্যাসাকার’) শব্দটি নিঃসন্দেহে ব্যবহার করা চলে।” আরেকজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেছেন : “এটা বাস্তবিকই রক্তস্নানের মতাে ঘটনা। সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে অতীব নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে”।

(There is no doubt, said a foreign diplomat in East-Pakistan last week, “that the word massacre applies to the situation”. Said another Western official: “It’s a veritable bloodbath. The troops have been utterly merciless.”) গােড়াতে পূর্ব-বাংলায় পাক-সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মার্কিনি পত্রপত্রিকার (হতে পারে তাদের প্রশাসনের প্রভাবে) বক্তব্য ছিল অনেকখানি নিরুত্তাপ ও সংযত । পরে অন্যান্য পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের বাস্তবতা সম্ভবত তাদের বােধােদয় ঘটাতে সাহায্য করে। | উল্লিখিত প্রতিবেদনে আরাে বলা হয় : গত সপ্তাহে সংঘটিত পাকিস্তানি গৃহযুদ্ধের তিক্ত প্রথম দফা শেষ হওয়ার পর দৃশ্যত শক্তিমান পশ্চিম-পাকিস্তান সেনাবাহিনীই পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত তাদের ৮০,০০০ পাঞ্জাবি ও পাঠান সেনাসদস্য নিয়ে জয়ী। পূর্বপাকিস্তান থেকে বিভিন্ন সূত্রে (কূটনীতিক, আতংকিত শরণার্থী ও গােপন বেতারবার্তার সুবাদে) প্রাপ্ত খবরের মধ্যে বৈসাদৃশ্য যথেষ্ট। আনুমানিক হিসাবে মৃতের সংখ্যা ধরা যেতে পারে তিন লক্ষের কাছাকাছি। অবশ্য একাধিক পশ্চিমা সরকারের হিসাবে এ সংখ্যা দশ হাজার থেকে পনেরাে হাজারের মতাে। কিন্তু এ বিষয়ে কারাে পক্ষে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। (“As round 1 of Pakistan’s bitter civil war ended last week the winner-predictably was the tough West-Pakistan army, which has a force  of 80,000 Punjabi and Pathan soldiers on duty in East-Pakistan. Reports coming out of the East (Via diplomats, freightened refugees and clandestine broadcasts) varied wildly. Estimates of the total dead ran as high as 300,000. A figure of 10,000 to 15,000 is accepted by several Western governments, but no one can be sure of anything.”) অর্থাৎ সংখ্যাটা বড় হওয়াই স্বাভাবিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আতংকিত জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী। পশ্চিমা কর্মকর্তার মন্তব্য কাগজটিতে প্রকাশ পেয়েছে এই মর্মে : “এতাে এক চেঙ্গিসখানি কারবার। তাছাড়াও কাগজে বিবরণ রয়েছে গণকবরের। ‘নিউজ উইক’ সাপ্তাহিকীর। ১৯ এপ্রিল সংখ্যায় (১৯৭১) ‘পাকিস্তান : আতঙ্কের রাজত্ব’ এই শিরােনামে পূর্ব-পাকিস্তান। থেকে আগত আমেরিকান নাগরিকদের লােমহর্ষক অভিজ্ঞতা অর্থাৎ সেনাবাহিনীর। হত্যাকাণ্ডের বর্বরতা সম্পর্কে কিছু কিছু মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। “নিউজউইকের সংবাদদাতা টনি ক্লিফটন চট্টগ্রাম-ফেরত জনৈক মার্কিন নাগরিকের। কাছ থেকে শুনেছেন সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার ঘটনাবলী । তেমনি মার্কিন পর্যটক ভিকটর। চেন এবং একাধিক মার্কিন নাগরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত পাকবর্বরতার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তারা জানিয়েছেন কীভাবে ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। নিউজউইকের সংবাদদাতা মিলান কুবিক জানিয়েছেন কয়েক ডজন বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহের কথা যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। (‘Literally dozens of dead bodies were strewn allover the place, Imany of then were kids, all of them riddled by bullets.”) ঘটনায় বিরক্ত এক তরুণ আমেরিকানের মন্তব্য : ‘এ ধরনের কাজ করতে পারে তেমন এক সরকারকে কেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করছে বুঝে ওঠা কঠিন। চার সাতাশে মার্চ বাণ্ডিল বেঁধে পশ্চিমা-সাংবাদকিদের ঢাকা থেকে বের করে দিয়েও শেষ রক্ষা হয় নি পাকিস্তান সামরিক সরকারের। পাক-সেনাবাহিনীর বর্বর কর্মকাণ্ড এবং গণহত্যার বেশ কিছু বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার ফলে বিবেকবান বিশ্ববাসী। হতবাক, মর্মাহত। পাকিস্তানের সমর্থক পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলাে অনেকটাই বিব্রতকর অবস্থায়। “অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে অমানবিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়া আর সম্ভব হচ্ছে । আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে পাকিস্তান বিভিন্ন মহল থেকে সমালােচনার সম্মুখীন। হয়তাে এজন্যই এবং সম্ভবত পশ্চিমা বন্ধু রাষ্ট্রগুলাের পরামর্শ-মাফিক পাকিস্তান সরকার দু’জন বিদেশী সংবাদদাতাকে একসঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তান ঘুরে দেখার অনুমতি দেয়। হয়তাে এ কথা ভেবে যে গণহত্যার প্রাথমিক আলামত তাে সব শেষ, কাজেই ভয়ের কি আছে। তাছাড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে থাকছে সেনাসদস্যদের গ্রুপ। তবে এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের আপত্তির মুখে তাদের সঙ্গী সেনাসদস্যরা দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছে যাতে কথাবার্তা কানে না যায়। এতসব সতর্কতা সত্ত্বেও হাঁড়ি যে কিছুটা ভেঙেছে তার প্রমাণ মেলে ‘গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। পূর্ব-পাকিস্তানের এক রােমান ক্যাথলিক মিশন হাসপাতালে। 

সাংবাদিকদের কাছে সন্ত্রস্ত পাদ্রিরা ফিসফিস করে জানায় যে গত মাসে ফাদার মারিও ভেরােনিজকে পাকসৈন্যরা গুলি করে মেরেছে। এমন বহু সংখ্যক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র চারদিনেই সাংবাদিকদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে পাকবাহিনী পূর্ববঙ্গে হাজার হাজার মানুষ খুন করেছে। | ‘হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের এক ভয়াবহ ছবি সাংবাদিকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মাত্রা কল্পনার অতীত। পূর্ণাঙ্গ সত্য কেউ কখনাে জানবে না, কিন্তু প্রামাণ্য সূত্র মাফিক নিহতের সংখ্যা ৩ লক্ষের মতো, কিন্তু অন্যদের দৃঢ় বিশ্বাস এ সংখ্যা সম্ভবত ৫ লক্ষের কম নয়। (“Priests speak in a whisper at a Roman Catholic mission hospital in East-Pakistan where Father Mario Veronese was gunned down… Repeat the experience scores of times over four days and it conjures up the fear that… tens of thousands of people have been put to death. “A horrifying picture of slaughter and destruction met the journalists on an official visit over the past week. The scale of it went beyond imagintion. No one will ever know the full truth but authoritative sources put the figure of dead at 300,000 and others asserted that it was perhaps as high as half a millon.” (The Guardian, 14 April, 1971). | এভাবে বিভিন্ন স্থানে থেকে সংগৃহীত তথ্যে গণহত্যার একটা চিত্র তৈরি হয়। পঁচিশে মার্চ যে গণহত্যার সূচনা ক্রমে তার বিস্তার ঘটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যেমন কথিত ‘বিহারি’ অবাঙালিদের হত্যা করেছে তাদের বাঙালি বিরােধিতার জন্য, তেমনি বিহারি অবাঙালি যেখানে সম্ভব প্রতিশােধ নিয়েছে বাঙালি হত্যার মাধ্যমে। আর পাকবাহিনী এ কাজটি করেছে তাদের রুটিন কর্তব্য হিসাবে। এ দুই বিপরীতধর্মী তথ্যই সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। তবে পাকবাহিনাই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী বলে তাদের মনে হয়েছে । যেমন যশাের থেকে প্রামাণ্য সূত্রের বিবরণে প্রকাশ যে সেনাবাহিনী সেখানে নির্বিচার হত্যার অপরাধে দায়ী। স্থানীয় জনৈক অধিবাসীর মতে সেনাবাহিনীর আক্রমণে সেখানে নিহতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।’ (“According to well authenticated accounts available there, the army itself was guilty of indiscriminate killing. One resident said over 5000 died in army attack”) এই যশােরেই ফাদার মারিওকে পাকসেনারা হত্যা করে। তার গায়ের রেড ক্রস আঁকা শার্ট রক্তে ভিজে যায়। তার অপরাধ তিনি পাকসেনাদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন।

পাকসেনাবাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি ছিল বড় অদ্ভুত। আর সেজন্যই নিহতের সংখ্যা এতটা বড় হয়ে ওঠে। খুলনা জুট মিল এলাকায় কর্তব্যরত এক সিনিয়র পাকঅফিসার ঐ সাংবাদিকদের বলে : “যারাই আমাদের সামনে পড়েছে তাদেরই আমরা খুন করেছি। লাশ গুণে দেখার ঝামেলা আমরা করি নি।” (“We killed everyone who came our way. We never bothered to count the bodies”.) এ প্রতিবেদন। ছিল রয়টার্স প্রতিনিধির। প্রকাশিত হয় ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১।  ঐ একই দিনের গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও গণহত্যার বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়েছে। নিবন্ধটির শুরু এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে যে তিন সপ্তাহ ধরে।   নৈরাজ্যিক রক্তপাত ঘটানাের পর পাক-সামরিক শাসকগণ কোথায় এসে দাড়িয়েছেন? আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কেটেকুটে নির্মূল করে দেশে স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠার আপাত তৃপ্তির পর ‘সত্যকার স্থিতিপত্র (‘ব্যালেন্স শিট)টা খুবই ভিন্ন। তাদের হয়তাে ধারণা বাঙালি জাতীয়তাবাদের গলা কেটে ফেলে দিলেই ওটা একেবারে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ঘটনা এর ঠিক বিপরীত ।… বাংলাদেশ আরেক বায়াফ্রা নয়’ (দ্য গার্ডিয়ান, ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১)। | ডােনাল্ড সিম্যানের ডেইলি এক্সপ্রেস’-এ পাঠানাে প্রতিবেদনে পাক-বাহিনীর প্রাথমিক পর্বের গণহত্যার উল্লেখ রয়েছে। সিলেট এলাকায় পাক-বর্বরতার বিবরণ দিতে গিয়ে ডােনাল্ড লিখেছেন যে ঢাকার মতাে করে এখানেও যুদ্ধ শুরু হয় পাকবাহিনীর নিয়মতান্ত্রিক ধরপাকড় ও হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ওরা কসাইয়ের নিষ্ঠুরতা নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সম্ভাব্য নেতা, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, পুলিশ অফিসার, ঈস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্য এবং তাদের পুরাে পরিবারবর্গকে হত্যা করেছে। পরে উন্মাদের মতাে লুটপাট করেছে। শুধু সিলেট শহরেই বাঙালি নিধনের সংখ্যা এক হাজারের কম নয়’ (দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস, ১৫ এপ্রিল, ১৯৭১)। 

অন্যদিকে নিউ স্টেটসম্যান’-এর এক প্রতিবেদন শুরু করাই হয়েছে এ কথা বলে যে ‘স্বাধীনতায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল্য যদি হয়ে থাকে রক্তদান তাহলে বলতে হয় বাংলাদেশ তা অতিরিক্ত পরিমাণে দিয়েছে।’ পত্রিকাটির মতে এ ক্ষেত্রে বাঙালিদের আত্মত্যাগ রক্তদান ও কষ্টভােগ সব মাত্রা অতিক্রম করেছে। সম্প্রতি যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের হিসাবে তা দেশের অখণ্ডতা রক্ষার প্রযােজনে, আর পূর্ববঙ্গীয়দের বিচারে তা গণহত্যার শামিল। সত্য হয়তাে এ দুই হিসাবের মাঝামাঝি রয়েছে’ (‘দ্য ব্লাড অব বাংলাদেশ’, নিউ স্টেটসম্যান, ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১) ‘সানডে টাইমস’-এ পাঠানাে নিকোলাস টোমালিনের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভিন্ন কথা বলে নি। তির্যক ও ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক কৃতিত্বের উল্লেখ করে এ প্রতিবেদক তীক্ষ ভাষায় বলেছেন যে জেনারেল ইয়াহিয়া এখনাে জানে যে তার সামরিক কর্মকাণ্ড বর্তমান সময়ের একটি খুব মন্দ সামরিক অপরাধ এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুতর এক রাজনৈতিক ভুল।’ (“He (General Yahya) is still unaware that his attempted coup was the worse military crime of recent years; and probably the biggest political blunder” (‘Far from the Holocaust’, The Sunday Times, 18 April, 1971) প্রসঙ্গত উদ্ধৃত হয়েছে জনৈক কূটনীতিকের অকুটনৈতিক মন্তব্য যে কাজটা নিতান্তই এক জঘন্য নির্বুদ্ধিতা’ (“Sheer bloody stupidity”, was the undiplomatic phrase one diplomat was driven to use”.)

আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাওয়ার টানেই হােক কিংবা আপন ভাবমূর্তি কিছুটা পরিচ্ছন্ন করে তােলার ইচ্ছাতেই হােক সাংবাদিকদের সম্পর্কে পাকিস্তানি নীতি ইতিমধ্যে কিছুটা শিথিল হতে শুরু করা সত্ত্বেও পাকিস্তানিদের মূল উদ্দেশ্য সফল করে তােলার দিকে তাদের নজর এতটুকু নমনীয় হয় নি। পার্থক্য এই যে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এসে দু’একজন করে পশ্চিমা সংবাদিকের পূর্ব-পাকিস্তানে আনাগােনা শুরু হয়। রয়টার্স গ্রুপের পর ব্রিটিশ সাংবাদিক কলিন স্মিথ বিশেষ উদ্দেশ্যে কলকাতা হয়ে  ঢাকা আসেন অবস্থার একটা বাস্তব হিসাব-নিকাশ করতে। আর ঘুরে ফিরে সব দেখে শুনে একটা কথাই তার মনে বড় হয়ে উঠেছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর তৎপরতা নিয়ে যত খুশিতেই থাকুন এ কথা সত্য যে গত কয়েক সপ্তাহে যা ঘটে গেছে সেই ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির ঘটনাবলী বাঙালি কখনাে ভুলবে না বা সংশ্লিষ্টদের ক্ষমা করবে না’ (এ রােমান্টিক চিন্তা বা মূল্যায়ন কি বাঙালির জন্য সঠিক ছিল বা আছে? পূর্বাপর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গত ভাবেই আসে)। | কলিনের বিবেচনায় “যুদ্ধের প্রথম পর্যায় বাস্তবিকই শেষ হয়ে এসেছে জাতীয় সংগ্রামের প্রথমপর্বে আওয়ামী লীগপন্থী এবং মাওবাদী যােদ্ধারা ‘কমন’ শক্রর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, এখন দ্বিতীয় পর্ব—গেরিলা যুদ্ধের সূচনা”। আসলে শুরুতে আকস্মিক আক্রমণের মুখে লড়াইটা ছিল মূলত প্রতিরােধের, বলা যেতে পারে আত্মরক্ষার লড়াই। ঐ আকস্মিকতার কারণে এবং পাক-সেনাবাহিনীর সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও নীতির কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ভয়াবহ যা গণহত্যার পর্যায়ে পৌছাতে পেরেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়েও ভিন্ন কারণে গণহত্যা একেবারে বন্ধ হয় নি, চরিত্রটা ভিন্ন ছিল এই যা। বিষয়টা পরবর্তী অধ্যায়ে বিবেচ্য। | কিন্তু ঢাকায় পেীছে কলিন ও তার ফোটোগ্রাফার সঙ্গী রােমানাে প্রথম ধাক্কা খান ব্রিটিশ কাউনসিলে পেীছে এবং পরে ব্রিটিশ হাইকমিশন দূতাবাসে পেীছে। ইতিপূর্বে সংঘটিত ভয়াবহ ঘটনাই তাদের প্রতিক্রিয়ার কারণ। তদুপরি দূতাবাসে পাওয়া অভ্যর্থনার রকমসকমে। ওখানকার একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বেশ উচ্চকণ্ঠেই জানালেন যে তাদের আসার ফলে সবারই একসঙ্গে শেষ হয়ে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। 

মার্কিন দূতাবাসের পরিবেশ অবশ্য ছিল উত্তেজনামুক্ত। তাদের হিসাবে পশ্চিমপাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে হাজার ছয়েক নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ থেকে ৫০০ জন ছাত্র। সেনাবাহিনীর কোনো কোনাে ইউনিটে রক্তলালসার প্রকাশ দেখা গেছে ঠিকই, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি। কোনাে কোনাে পাকিস্তানি অফিসারের আচরণ ছিল নিয়মনীতি বহির্ভূত হুন আত্তিলার মতাে। কলিনের মতে নারায়ণগঞ্জে রাস্তার পাশে তখনাে পচা লাশের অস্তিত্ব ঘটনার প্রকৃত চেহারা বুঝতে সাহায্য করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্তমান কাজ রাত্রির অন্ধকারে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণ, খুন ও লুট করা, বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে। এ ছাড়া সেনাবাহিনী যে পথ দিয়ে গেছে যাত্রাপথের দু’ধারে হাটবাজার বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়া ছিল ওদের স্বাভাবিক রীতি’ (দ্য অবজার্ভার, ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১)। ইতােমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকই সংঘাতের | গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ সুনির্দিষ্ট রূপ নিয়ে সংহত হওয়ার পথ ধরে। তবু এর মধ্যে যথারীতি চলেছে পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড। সাধারণভাবে এসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ডেইলি মিরর’-এ জনৈক সাংবাদিকের উদ্দীপক ঘােষণা চমকপ্রদ : ‘পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যা সত্ত্বেও কেন আমরা স্তব্ধ হয়ে আছি? কেন প্রতিবাদ জানাচ্ছি না’ (The Daily Mirror, 23 April, 1971) | একই বক্তব্য ‘দ্য স্যোশালিস্ট ওয়ার্কার’ পত্রিকারও (২৪,৪,৭১)। 

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক