You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.23 | কেন সংলাপ ভেঙে গেল  কে দায়ী - সংগ্রামের নোটবুক

কেন সংলাপ ভেঙে গেল  কে দায়ী

বহুদিন পর দেশে সাধারণ নির্বাচন, তাও আবার সামরিক শাসনের আওতায়। নির্বিঘ্নে নির্বাচন শেষ। খুশি মূল নায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, খুশি সাধারণ মানুষ এ কথা -ভেবে যে এবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দেশ শাসন করবে, দেশে বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই নির্বাচনের পরপরই সে আমেজ নষ্ট করে যে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয় তা মােটেই প্রত্যাশিত ছিল না। | সঙ্কট দেখা দিয়েছিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নিয়ে এবং সেই সুবাদে কেন্দ্রে সরকার গঠন নিয়ে। এক কথায় এ রাজনৈতিক সঙ্কট হয়ে ওঠে শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট। প্রায় ছয়-সাত সপ্তাহ ধরে অব্যাহত সঙ্কট যখন রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করে, দেশটিকে এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয় তখন সবার অবশেষ দৃষ্টি পড়ে সঙ্কটের ত্রাতা হিসাবে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর। কিন্তু সঙ্কটের সূচনা লগ্ন থেকে পরিস্থিতি যখন ক্রমে জটিল হতে শুরু করেছে তখন থেকেই পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস-অ্যাডমিরাল আহসান এবং মূলত পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে.জে. ইয়াকুব খান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বারবার অনুরােধ জানিয়ে আসছিলেন সঙ্কটের রাজনৈতিক ফয়সালা করে নিতে ঢাকায় এসে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিদেশী সংবাদভাষ্যকারদেরও ছিল প্রায় একই ধরনের কথা। শেখ মুজিবুর রহমান থেকে মওলানা ভাসানী, ওয়ালি। খান থেকে আসগর খান সবার মুখে ঐ একই কথা সদিচ্ছা ও সংলাপ। ঢাকার পত্রপত্রিকাগুলােতেও ছিল একই সুর—তখনকার প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়গুলাের ওপর। নজর বুলিয়ে নিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ভাবটা যেন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলে, আলােচনা শুরু করলেই সব সমস্যার সমাধান—যাকে বলে মুশকিল আহসান। আসলে এরা সবাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সদিচ্ছার ওপর ভরসা করেছিলেন।  শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন, অনেকটা অনিচ্ছা নিয়েই এলেন। প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলােচনাও শুরু করলেন। ডেকে পাঠালেন। পিপিপি-প্রধান ভুট্টোকে।ডাকলেন আরাে আরাে পশ্চিম-পাকিস্তানি নেতাদের। পরে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে জনাদুই আইন-বিশেষজ্ঞও উড়ে এলেন। দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক আলােচনা নেহাৎ কম হলাে না। একাধিক প্রস্তাবও সে আলােচনায় স্থান পেল যা আগে  বলা হয়েছে।

কিন্তু সঙ্কটের সমাধান হলাে না। আলােচনা তথা সংলাপ ভেঙে গেল, আনুষ্ঠানিকভাবে না ভেঙেও প্রকৃতপক্ষে ভেঙেই গেল। কিন্তু কেন? এত তােড়জোর, এত আয়ােজনের পর সংলাপ ভেঙে গেল কেন? মনে রাখা দরকার যে সংলাপের মূল বিষয় ছিল আওয়ামী লীগের শর্ত অনুযায়ী সামরিক শাসন তুলে নেওয়া এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। ঐ হস্তান্তরের পদ্ধতি ও পরিণাম নিয়ে অনেক তত্ত্বগত বিচার-বিবেচনা ও টানাপােড়েনের পর যে প্রস্তাব আওয়ামী লীগ অবশেষে মেনে নেয় তা ছিল প্রকৃতপক্ষে একাধিকবার উত্থাপিত ভুট্টোরই প্রস্তাব। তাতে নীতিগত ভাবে মেনে নেওয়া হয় যে দেশের পরস্পর বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চলে স্বতন্ত্রভাবে দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। আওয়ামী লীগ বরাবর এর বিপরীত কথা— অর্থাৎ সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিক বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে এসেছে। সে হিসাবে এ প্রস্তাব ছিল আওয়ামী লীগের নীতিবিরুদ্ধ এবং তাদের জন্য আত্মঘাতী। এ প্রস্তাব গণতন্ত্রের রীতিসম্মতও ছিল না। প্রস্তাবে বলা হয় যেহেতু পাকিস্তানের দুই স্বতন্ত্র অঞ্চলে (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে) দুই ভিন্ন দলের হাতে আলাদাভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে তাই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুতেই দুটো শাসনতান্ত্রিক স্বতন্ত্র গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আলােচনায় বসবেএকটি পূর্ব-পাকিস্তান, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। এ প্রস্তাবের পক্ষে প্রেসিডেন্টের ঘােষণাপত্র তৈরির প্রয়ােজনে আওয়ামী লীগ উল্লিখিত মর্মে প্রস্তাবপত্র তৈরি করে। প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেয়। রবার্ট জ্যাকসনের ভাষায় “…the Awami League at last embraced Mr. Bhutto’s proposal for the transfer of power to be accomplished separately in the two wings. In their draft of the proclamation to be issued by the President, the Awami League negotiators thus suggested that the National Assembly should meet from the beginning in two constitutional committees, one for each wing” (P.32) 14 fu w atchi হাতে তৈরি তাদের মৃত্যুৰাণ হােক না সে প্রস্তাব ভুট্টোর বা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার।

কারণ ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সামরিক বাহিনীর হাতে গণহত্যার সূচনা এবং নতুন করে। সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর আওয়ামী লীগকে দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করে যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয় তাতে ঐ প্রস্তাবে বিচ্ছিন্নতার উদ্দেশ্য আবিষ্কার করা হয়। প্রস্তাবে নাকি এমন কথাই আদিতে ছিল যে জাতীয় পরিষদ প্রথমে যুক্তভাবে বসবে, এরপর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাংসদদের নিয়ে দুই শাসনতান্ত্রিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলােচনায় বসবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে অধিবেশনের শুরুতেই দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে আলােচনায় বসার প্রস্তাব রাখে, যার অর্থ পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি তথা পাকিস্তান ভেঙে দ্বিখণ্ডিত করা। | পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের শ্বেতপত্রের অভিযােগ সম্পর্কে রবার্ট জ্যাকসনের 783 : “As the Pakistan Government’s White Paper pointed out, this proposal differed from the earlier suggestion that after the assembly had met it shoud divide into committees made up of members from each wing. The Awami  League’s proposal was later represented by the authorities a ‘virtually constitutional formula for secession” (P. 32). | এ ভাবে তাদেরই প্রস্তাব, তাদেরই শিল দিয়ে আওয়ামী লীগের দাঁতের গােড়া ভান্ডার ব্যবস্থা করা হয়। আনা হয় শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিচ্ছিন্নতার অভিযােগ। অথচ বুঝতে কষ্ট হয় না যে সরকারের ঐ অভিযােগে ছিল কথার কূটচাল এবং তার অর্থের আইনি চতুরালি। কারণ জাতীয় পরিষদের প্রথমেই বিভক্ত গ্রুপে বসা আর প্রথমে মিলিত চেহারার বুড়ি ছুঁয়ে তারপরই দুই শাসনতান্ত্রিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বসার মধ্যে কোনাে মৌলিক প্রভেদ নেই পৃথক গ্রুপে বসাটাই এখানে সত্য।

প্রস্তাবে যেখানে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বরখেলাপ ঘটিয়ে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের (পূর্ব ও পশ্চিমের) জন্য দুই স্বতন্ত্র দলের শাসনব্যবস্থা কায়েমের ব্যবস্থা কার্যত সেখানেই দুই পাকিস্তানের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। (মূল প্রস্তাবটা ছিল ভুঠোৱই)। সে ক্ষেত্রে প্রথমে অথবা পরে বিভক্ত হয়ে দুই অঞ্চলের সাংসদদের নিয়ে আলাদা আলাদা বসার মধ্যে কোনাে ভিন্ন তাৎপর্য নেই, কোনাে ফারাকও নেই। অথচ শুরুতে ঐ ভিন্ন গ্রুপে বসার অজুহাতে আওয়ামী লীগের কাধে বিচ্ছিন্নতার অভিযােগ চাপিয়ে দেওয়া হলাে। এমন কি প্রেসিডেন্টের বয়ানে এমন ভুল তথ্যও পরিবেশিত হয় যে ঐ প্রস্তাব আওয়ামী লীগের। এ প্রস্তাবের প্রকৃত হােতা কে এ সম্পর্কেও বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্রে প্রকাশিত অভিযােগের কথা তাে বলাই হয়েছে। এ ছাড়াও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কেউ কেউ এমনকি জুলফিকার আলী ভুঠোও এ সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলেছেন। আবার এদের বিপরীত বক্তব্য রেখেছেন রবার্ট জ্যাকসন প্রমুখ বিদেশী লেখক-সাংবাদিক কেউ কেউ এবং অধ্যাপক রেহমান সােবহান ৫ জুন (১৯৭১) “ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত তার নিবন্ধে। জনাব ভুট্টো তার বই ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি’তে যুক্তি দেখিয়েছেন যে ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত চার শর্তের চতুথ শর্ত (অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর) অনুযায়ী তার দাবি ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের হাতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপিপি’র হাতে পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হােক। কিন্তু ঢাকা-সংলাপে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের দুই শাসনতান্ত্রিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বসার প্রস্তাব আওয়ামী লীগের, তার নয়, যাতে রয়েছে বিচ্ছিন্নতার অভিপ্রায়। আবারও সেই কথার মারপ্যাচ।

আওয়ামী লীগের পূর্বাপর দাবি ছিল সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী দল (৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়ী), কাজেই তাদের ঐক্যবদ্ধ, অখণ্ড পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যুক্তিসঙ্গত অধিকার মেনে নেওয়া হােক। সে ক্ষেত্রে সমগ্র পাকিস্তানের হিসাবে ৮৩ আসনে জয়ী পিপিপি (পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও) সংখ্যালঘু দল, কাজেই তারপক্ষে সরকার গঠন বা সরকারে ক্ষমতার অংশ দাবি করা অযৌক্তিক। আইনজীবী ভুট্টো বরাবর তার আঞ্চলিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথাই বলে এসেছেন, কিন্তু দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় শাসনে অধিকার  এবং তা পাকিস্তানের ভৌগােলিক অবস্থান, পারস্পরিক দূরত্বের অজুহাত দেখিয়ে।  তাই বিচ্ছিন্নতার অভিযােগ যদি আসেই তবে তা রয়েছে ভূট্টোর প্রস্তাবেই (১৫ মার্চ, ১৬ মার্চ প্রকাশিত)। সে হিসাবে জনাব ভুট্টোর প্রথম বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে অভিযুক্ত হওয়া উচিত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দিক থেকে ভুলটা ছিল শেষ পর্যন্ত (সম্ভবত ২২ মার্চ জ্যাকসন) সে প্রস্তাব মেনে নেওয়া এবং সে অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের কাছে ঘােষণার জন্য খসড়াপত্র পেশ করা। বিচ্ছিন্নতার অভিযােগে আওয়ামী লীগ তাই আসে দ্বিতীয় স্থানে, ভুট্টোর পরে। কিন্তু উদ্দেশ্য যেখানে ‘অসৎ, যুক্তি দাঁড় করাতে সেখানে কষ্ট হয় না ঈশপের গল্পের মতাে। বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী কালেও লেখালেখি হয়েছে। ভুট্টোর বই ছাড়াও পিপিপি তথা ভুঠোর বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে আবদুল হাফিজ কারদারের লেখা ‘পিপলুস কমিটমেন্ট: পলিটিকস ইন পাকিস্তান’ বইটিতে। মেজর সালিকের বইতেও আওয়ামী লীগকেই দায়ী করা হয়েছে দুই শাসনতান্ত্রিক গ্রুপে বিভক্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চূড়ান্ত করার জন্য, ভুট্টোকে নয়।  মেজর সালিক আবার এক পা বাড়িয়ে এমন কথা বলেছেন যে ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ নাকি প্রেসিডেন্টের কাছে নতুন প্রস্তাব রাখে। তাতে শাসনতান্ত্রিক কমিটির বদলে শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন (সম্মেলন)-এর কথা বলা হয়। ঐ কনভেনশনের কাজ ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটো পৃথক সংবিধান রচনা। জাতীয় পরিষদ ঐ সংবিধান দুটো একীভূত করবে পাকিস্তানি কনফেডারেশনের আলােকে। ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট তখন এ বিষয় নিয়ে আলােচনায় একমত হন যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থেকে এ প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাকিস্তান ভাঙারই উদ্যোগ নিচ্ছে। কাজেই এরপর আর সংলাপের কোনাে অর্থ নেই। তবু কৌশলগত কারণে প্রেসিডেন্ট সংলাপের অবসান ঘােষণা করেন নি। এ প্রস্তাবের সত্যতা সম্পর্কে অবশ্য আওয়ামী লীগই সঠিক বলতে পারবে, যদিও সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একমাত্র ড. কামাল হােসেন ছাড়া আর কেউ জীবিত নেই। এ ধরনের প্রস্তাবের কথা অন্য কাৱাে লেখায় আসে নি।

এসেছে শুধু ভুট্টোর দুই অঞ্চলে দুই-দলীয় শাসনের কথায়। এ সম্পর্কেও অন্য অনেকেরই মতামত মেজর সালিকের বক্তব্য থেকে ভিন্ন। শুধু রবার্ট জ্যাকসনই নন অধ্যাপক রেহমান সােবহান তার উল্লিখিত নিবন্ধে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে ‘শেখ মুজিব সামরিক আইন প্রত্যাহারের বিপরীতে জাতীয় পরিষদে পৃথক অধিবেশন বিষয়ক ইয়াহিয়ার দাবি মেনে নেন। এমন। কি মেনে নেন অন্তর্বর্তীকালীন বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইয়াহিয়ার দাবি।’ |বলা যায় এ ছিল চাপের মুখে বেসরকারি শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য খেসারত বা ছাড় দেওয়া। অধ্যাপক সােবহানের মতে এ ক্ষেত্রে ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভুট্টোকে সুযােগ দেওয়া। কারণ তা না হলে ভুট্টো করাচি থেকে ঢাকার পথে পা বাড়াতে রাজি হচ্ছিলেন না। ভুঠো যে ঢাকায় আসতে রাজি হচ্ছিলেন না সে কথা মেজর সালিকের বিবরণেও পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং ভুঠো দুজনেরই ভয় ছিল যুক্ত অধিবেশনে শেখ মুজিব পাঠান ও বালুচ নেতা এবং অন্যান্য ভুট্টো-বিরােধী নেতাদের  সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভুট্টোকে কোণঠাসা করে ফেলতে পারেন, এমন কি পারেন পশ্চিমপাকিস্তানে ছয়-দফাও আরােপ করতে। তাই ইয়াহিয়া খান মুজিবের দাবি মেনে নেওয়ার পাল্টা দানে ভুট্টোর জন্য পশ্চিমাঞ্চলে শাসনক্ষমতার সুযােগ আদায় করে নেন।

অধ্যাপক রেহমান সােবহান ঠিকই বলেছেন যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনীকে শাসন পরিচালনা থেকে দূরে রাখতে গিয়ে নৈরাশ্যের টানে অনেকটা বেপরােয়া হয়েই শেখ মুজিব নিজেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার খেলনায় পরিণত করেছিলেন। এর ফলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থন হারালেন। ভূট্টো-মুজিৰ আঁতাতের বেদিতে তিনি বালুচ-নেতা বেজেঞ্জো, পাঠান-নেতা ওয়ালি খান এবং পাঞ্জাবি মমতাজ দৌলতানা প্রমুখ আওয়ামী সমর্থক নেতাকে বলি দিলেন। স্বভাবতই ২৪ মার্চ ঘরে ফিরে গিয়ে ঐসব নেতাকে তাদের আত্মরক্ষার উপায় খুঁজে নিতে হয়েছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক রেহমান সােবহানের বক্তব্যের মূলভাষ্য : “Mujib accommodated Yahya by agreeing to let him stay as an interim civilian President at the centre until the new Constitution emerged. He further accepted Yahya’s demand for separate session in the National Assembly. This, contrary to Yahya’s subsequent posture, was designed to accomodate Mr. Bhutto who feared that in a joint session of the Assembly Mujib might join hands with the Pathan and Baluch and some of the smaller anti-Bhutto parties in Punbjab to neutralise Bhutto and even to impose Six-Points on West Pakistan  এমন কি অধ্যাপক সােবহান এ কথাও বলেন যে “Mujib played into his (President Yahya’s) hands in his desperation to get the army out and in so doing alienated his support in the West wing. When Bizenzo, the Baluch leader, Wali Khan, the Pathan leader, and Daultana flew back on March 24 they had been sacrified on the altar of a Bhutto-Mujib entente and should look to their own defences at home” (Guardian, Manchester, June 5, 1971)  সত্যই ২৫ মার্চের পর পশ্চিম-পাকিস্তানের ভুট্টো-বিরােধী নেতাদের পক্ষে আত্মরক্ষার তাগিদই বড় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ঢাকায় মুজিব-ভুট্টো আঁতাতের পর এরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে এ সমঝোতা-প্রস্তাব থেকে সরিয়ে আনতে। পুনরায় একক গণপরিষদের ঐক্যবদ্ধ অধিবেশনের প্রস্তাবের পক্ষে ফিরিয়ে আনতে।

কারণ সে ক্ষেত্রে ভুট্টোকে ভােটে পরাজিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু তাদের কথায় কাজ হয় নি। আওয়ামী লীগ তার পূর্ব-অবস্থানে ফিরে যেতে চায় নি। রবার্ট জ্যাকসনের ভাষায় “In Dacca the West Wing minority-party leaders made a last attempt to persuade the Awami League leaders to return to the concept of a single Assembly in which Mr. Bhutto’s supporters could be outvoted. They failed their alliance with the Awami League had now been ruptured by the Bengalis. On the 24th they began to pack their bags“ (P. 32). আওয়ামী লীগ ভুল পদক্ষেপের কারণে তার পশ্চিম-পাকিস্তানি বন্ধুদের সমর্থন হারাল। তাদের পক্ষে এ প্রস্তাবে বিরােধিতার মূল কারণ ছিল পশ্চিমে ভুট্টোর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং প্রদেশগুলােকে বিশেষ করে সীমান্ত-বালুচিস্তান-সিন্ধুকে কোণঠাসা করে আইয়ুবি আমলের পাঞ্জাবি-প্রাধান্যের এক ইউনিটের ভূত আমদানি যাতে না হয়। ঢাকায় একযুক্ত বিবৃতিতে সিন্ধুর মুফতি মাহমুদ, সীমান্তের খান আবদুল ওয়ালি খান ও বালুচিস্তানের গউস বক্স বেজেঞ্জো বলেন যে জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে জাতীয় সরকার গঠনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদ এড়িয়ে চলা হচ্ছে। চেষ্টা চলছে ‘এক ইউনিটের মৃত ঘােড়া পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বিভক্ত করে দেবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। তারা বলেন, ‘সিন্ধুসহ পাকিস্তানের ছােট প্রদেশগুলাে ফের এক ইউনিট প্রথার প্রবর্তন মেনে নেবে না’ (মর্নিং নিউজ, করাচি, ঢাকা, ২৫ মার্চ, ১৯৭১)। 

হতাশা-নৈরাশ্যে হােক কিংবা বিকল্প কোনাে পথ না থাকার কারণে হােক ইয়াহিয়াভুয়োর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের বােধহয় আর পেছন ফেরার উপায় ছিল না। পেছন ফিরলে কথার বরখেলাপ এবং সংলাপে সদিচ্ছার অভাব প্রমাণিত হবে। অন্যদিকে প্রস্তাব মেনে নেওয়ার নিহিত অর্থ প্রকারান্তরে দুই পাকিস্তান স্বীকার করা। অবস্থা অনেকটা যেন মহাকাব্যের চরিত্র মারিচের মতাে। হয়তাে তাই ভুল ছক থেকে আওয়ামী লীগ পা সরিয়ে আনতে চায় নি, ঘটনা তথা নিয়তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক চাতুর্য বলে, বিপদ তথা ষড়যন্ত্রের মুখে অবস্থান পরিবর্তনই শ্রেয়। হােক না তাতে কথার ব্যত্যয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের আলােচনায় কি বিপর্যয়ের আভাস একেবাবেই ছিল না? আমার গভীর সন্দেহ তা থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব শেষমুহূর্তের সংলাপে ইয়াহিয়া-ভূট্টোর রাজনৈতিক সদিচ্ছায় বিশ্বাস করেছে, বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ভেবে দেখে নি। হতে পারে আওয়ামী লীগ ভূট্টোর সন্তোষজনক বৈঠক’-এর আপাত মধুর কথাবার্তায় প্রতারিত হয়েছে (“The People’s Party Chief said he had a ‘satisfactory meeting with Sheikh Mujibur Rahman and hoped to meet him again”- The Dawn, Karachi, March 23, 1971) কথাটা আরাে বিশেষভাবে মনে হয় এ কারণে যে সিন্ধি-পাঠান-বালুচ নেতারা। (এমন কি পাঞ্জাবের দৌলতানাও) যখন গণপরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত করার প্রতিবাদে মুখর এবং নতুন প্রস্তাবের ঘােরতর বিরােধিতা করছেন তখনও ভুট্টো একই সুরে বলে চলেছেন যে আলােচনার অগ্রগতিতে তিনি সন্ত্রষ্ট।

আবার একই সঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন : “আমি ভয়ানকভাবে এক অখণ্ড পাকিস্তানের অনুসারী।’ কিন্তু বিপদের ইঙ্গিত ছিল সীমান্তের দুষ্টভূত ভুট্টো-সমর্থক আবদুল কাইউম খানের বক্তব্যে। চবিশে মার্চ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: “যে-প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা চলছে তিনি তা জানেন, তবে এখন খুলে বলবেন না। হয়তাে আগামী ২৪ ঘণ্টার (অর্থাৎ ২৫ মার্চের) মধ্যে এর ফলাফল বেরিয়ে আসবে’ (মর্নিং নিউজ, ২৫ মার্চ, ১৯৭১)। ইঙ্গিতটা ধরতে পারে নি আওয়ামী লীগ। প্রত্যাশার ঘােরে ধরতে পারার   নয় । তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল ঠিকই বেরিয়ে আসে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর। রাতের অন্ধকারে আক্রমণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের ঘােষণা আসছে, ঘােষণাতৈরির কাজ চলছে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার আবহে (গােটা আবহটাই ছিল সযত্নে সুকৌশলে তৈরি) সময় কাটতে থাকে ‘জিরাে আওয়ারে পৌছানাের লক্ষ্যে। এবং একটি অঘটনের অশুভ ইঙ্গিত ও লক্ষণ একটু একটু করে তখন প্রকাশ পেতে শুরু করে। প্রয়ােজন ছিল তা দেখার এবং বােঝার। আওয়ামী লীগ ঘােরের কারণে তা ধরতে পারে নি। ঢাকার বাইরে দেশের অন্যত্র আবার নতুন করে গোলযােগ ও সংঘাত বাড়তে শুরু করেছে। সংলাপের টালবাহানা ঘিরে প্রতিবাদের জঙ্গি মিছিল, আর সেসব মিছিলে টিকাবাহিনীর আঘাত। গুলিবর্ষণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে । চট্টগ্রাম ও রংপুরে আবার কার্ফ জারি। ইতােমধ্যেই ক্ষুব্ধ পশ্চিমা নেতাদের ঢাকা ত্যাগ। মিয়া মমতাজ দৌলতানার ২৫ মার্চ লাহাের বিমানবন্দরে পেীছে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি ইত্যাদি ছিল অঘটনের সর্বশেষ আলামত। আর এ অবস্থায় সংলাপ এবং রাষ্ট্রপতির ঘােষণা জারি অসম্পূর্ণ রেখে রাজনীতিকদের কাউকে কিছু না জানিয়ে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলেন ২৫ মার্চ রাতে গােপনে ঢাকা ত্যাগ করে। অবশ্য যাবার আগে স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে গেলেন। ঢাকাই রাজনীতিকদের কাছে বিষয়টা ছিল অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের।

কিন্তু কেন হঠাৎ করে বিনা ব্যাখ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ যা প্রকৃতপক্ষে পলায়ন, যা একেবারেই প্রেসিডেন্ট-সুলভ কাজ নয়? একজন সামরিক প্রেসিডেন্টের পক্ষে অস্বাভাবিক হতাে না তার নিজস্ব যুক্তি-বক্তব্যের আলােকে সংলাপ ভেঙে দেওয়ার ঘােষণার মাধ্যমে ঢাকা ত্যাগ করা। আর সেটাই হতাে রাজনৈতিক ও নৈতিক দিক থেকে স্বাভাবিক। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তা করেন নি। হতে পারে তার বলার মতাে কিছু ছিল না। ষড়যন্ত্র যেমন অন্ধকারে, গােপনে চলে, তেমনি গােপনে ঘটে এর শেষ পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। সংলাপের পুরাে বিষয়টা ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই এর পরিণতিও ষড়যন্ত্রমূলক অন্ধকারে। সম্পন্ন। একই কারণে ২৫ মার্চ আঘাতের পূর্বক্ষণেও ঘােষণার কাগজপত্র তৈরির মহড়া চলেছে। হিসাব-নিকাশ করেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১৫ মার্চ ঢাকায় আসা, পশ্চিমপাকিস্তানি রাজনীতিকদের ঢাকায় টেনে আনা। উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে ধোকার ধোয়া সৃষ্টি করা। সেদিক থেকে অংশত সফল হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তার কূট চালের কাছে সরল বাঙালি মুজিব হেরে গেলেন। অবশ্য শেষ হারাটা ইয়াহিয়াদেরই। আর ভুট্টোকেও তার উচ্চাকাক্ষার সাময়িক পূরণ সত্ত্বেও অতিচাতুর্যের দাম, উদ্ধত রাজনীতির দাম দিতে হয় অধস্তনের দেওয়া ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে। এসব অবশ্য পরের ঘটনা। কিন্তু ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে ২৫ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন নি। তাদের পরিকল্পিত অপারেশনের সাফল্য দেখে নেওয়ার লােভে।

তাছাড়া একসাথে গেলে ষড়যন্ত্রের বিষয়টা প্রকাশ্য রূপ পেয়ে যেতাে। রাজনীতি নিয়ে, ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ধরে রাখা নিয়ে এ জাতীয় সর্বনাশা খেলা  ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর চিরাচরিত অভ্যাস, বলা চলে ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্য, সে ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ সম্প্রতি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনীর প্রধান পারভেজ মােশাররফের ক্ষমতা দখল। পাঞ্জাবি ধনকুবের-রাজনীতিক হয়েও শরীফ রেহাই পেলেন না। তথাকথিত বিচারে তার চৌদ্দ বছর কারাদণ্ড, তার রাজনীতি করা নিষিদ্ধ হলাে। এ ঘটনারও বেশ খানিকটা মিল রয়েছে দুটোর তৎপরতা ও পরিণতির সঙ্গে। সর্বশেষ খবর, শরীফকে সপরিবার নির্বাসনে পাঠানাে হয়েছে সৌদি আরব-এ। একেই বলে পাকিস্তানি রাজনীতি! | ষড়যন্ত্রটা পরে স্পষ্ট হলেও সে সময় অনেকের কাছে স্পষ্ট ছিল না। আবার কেউ কেউ যেমন রাব্রুক-উইলিয়ামস প্রমুখ সাংবাদিক (‘দ্য ইস্ট পাকিস্তান ট্র্যাজেডি ১৯৭২) ঘটনার দায় অনেকটাই শেষ মুজিবুর রহমানের কাঁধে চাপিয়েছেন। অবশ্য সকল বিদেশী সাংবাদিক এ পথ অনুসরণ করেন নি। বরং ষড়যন্ত্রের আভাস-ইঙ্গিত যেমন তাদের কাছে তেমনি কোনাে কোনাে পশ্চিম-পাকিস্তানি রাজনীতিকের কাছেও মনে হয় অস্পষ্ট ছিল না। হয়তাে টের পেয়েছিলেন পাখতুন, বালুচ ও সিন্ধি নেতারা। তাই শেখ মুজিবুর রহমানকে যথেষ্ট অনুরােধ উপরােধ করেছিলেন বিভক্ত গণপরিষদের প্রস্তাব বাতিল। করতে, একক ও যৌথ অধিবেশনের পূর্বপ্রস্তাবে ফিরে যেতে। তবে পাঞ্জাবি রাজনীতিক, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা যে ভালােভাবেই বিষয়টা অনুমান করেছিলেন (হয়তাে জানতেনও) তা লাহােরে তার প্রেস-বিবৃতিতে স্পষ্ট। | লাহাের বিমানবন্দরে পৌছে (২৫ মার্চ) ঘটনার আগেই তিনি সাংবাদিকদের বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন যে তিনি জাতীয় পরিষদ দ্বিভাজিত করার ঘাের বিরােধী। তার মতে ‘গণপরিষদ পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতীক, জাতির আশা-আকাক্ষার প্রতীক, তাই অবিভাজ্য।’ জনাব দৌলতানা ও শওকত হায়াৎ খান ঐ একই বিবৃতিতে স্পষ্টভাবেই বলেন যে গণপরিষদ দ্বিভাজিত করার প্রস্তাব ঢাকা-সংলাপের মধ্য থেকেই উঠে এসেছে। কিন্তু তারা ঐ মহল বিশেষকে চিহ্নিত করতে রাজি হন নি। বলতে চান নি আওয়ামী লীগ না পিপিপি, কে ঐ প্রস্তাবের উত্থাপক।

 কিন্তু তারা যে ঐ প্রস্তাব ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জানতেন তাদের বক্তব্য থেকে তেমন আভাস মেলে। তাদের ভাষায় প্রধান রাজনৈতিক মহল’ এর জন্য দায়ী। মনে। হয় ভুট্টো-ইয়াহিয়া-মুজিব প্রমুখ ব্যক্তিদের কথাই বলতে চেয়েছেন দৌলতানা। তার মতে অবস্থা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ, টান টান, দেশের সংহতি বিপন্ন। আর এ অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব এবং তিনি পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার কথাই তাদের সঙ্গে বলেছিলেন। তবে এটাও ঠিক যে তিনি উগ্রপন্থীদের চাপের মুখে ছিলেন, আর পরিস্থিতি ছিল অনিশ্চিত’ (..’the situation was extremely tense and the unity of the country was at risk. He said that it had been categorically stated by Sheikh Mujibur Rahman when he and other minority parties had called on him that he wanted to hold Pakistan together. Sheikh Mujibur Rahman was under great pressure from the extremist elements and the situation was unpredictable’ Pakistan Times, Lahore, March 25, 1971)  মমতাজ দৌলতানার বক্তব্য থেকে অনুমান করা চলে যে প্রস্তাব সম্ভবত ইয়াহিয়াভুট্টোর, এবং আলােচনা-সমঝােতা ভেঙে দেওয়া দূরে থাক, সমাধানে পৌছাতে চেয়ে, বিচ্ছিন্নতা এড়াতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের দিক থেকে ঐ বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরিণামে বিচ্ছিন্নতার দায় তার কাঁধেই চাপে এবং দেশও বিচ্ছিন্নতার পথ ধরে। এর কারণ সংলাপ এবং গােটা ঘটনার পেছনে ছিল ষড়যন্ত্র। পরিস্থিতি পূর্বপাকিস্তানি রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ঘটনা-নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি সবই ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং সংশ্লিষ্টদের হাতে।  মনে হয় একেবারে শেষমুহূর্তে বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছিলেন এবং সংলাপের পরিণাম বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বুঝতে পারছিলেন মতৈক্যের পরেও কেন এত দেরি, একটিমাত্র ঘােষণাপত্র তৈরিতে কেন এত বিলম্ব? তাই ২৫ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অহেতুক বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন : ‘এত বিলম্বের পেছনে কোনাে যুক্তি বা কারণ নেই। রাজনৈতিক সমাধানই যদি সংশ্লিষ্টদের কাম্য হয় তাহলে তাদের বােঝা উচিত যে তাদের জন্য বিষয়টা এখনই নিষ্পত্তিতে পৌছানাে দরকার। বিলম্ব দেশকে গভীর সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে।’

(There is no reason or justification for any delay. If a political solution is desired by those concerned they should realise that it is for them to take matters immediately to a conclusion, and that to delay this would expose the country and its people to a great hazardThe Dawn, Karachi, March 26, 1971) | কিন্তু তখন সময় শেষ হয়ে গেছে। নেতার হাতও প্রস্তাবে বাঁধা। টান দেবার মতাে সুতােও হাতে নেই। রয়েছে একমাত্র জনসমর্থন। সে সমর্থনের নায়ক জনগণ তখন সব দফাকে একদফায় একাকার করে নিয়েছে। স্বাধীনতাই তখন স্লোগান হিসাবে সবার মুখে মুখে ফিরছে। মওলানা ভাসানীও এক দফার দাবিতে জনসমুদ্র উত্তাল করে তুলছেন। ছাত্রদের তাে কথাই নেই। অবস্থা দৃষ্টে ১৫ মার্চের ‘নিউজউইক’ ঠিকই লিখেছিল যে পর্যবেক্ষকদের ধারণা : রাজনীতিকরা পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন।’ কথাটা ভুট্টোর জন্য নয়, আসলে সত্য ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি যে ভাঙনের দিকে এগিয়ে চলেছে সে কথা রাজনীতিকগণ বুঝতে না চাইলেও বিদেশী কূটনীতিক এবং সাংবাদিকভাষ্যকারদের কেউ কেউ মনে হয় ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই সে সময় জনৈক পশ্চিমা কূটনীতিক প্রসঙ্গত ‘নিউজউইক’-এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধি জেঙ্কিপ’কে বলেন ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান পৃথক হবে কিনা এটা এখন আর কোনাে প্রশ্ন নয়। এখন প্রশ্ন, এটা তারা কখন করবেন আগামী সপ্তাহে না আগামী মাসে, না এক বছর, দু’বছর পর।” এ বিষয়ে নিউজউইক’-এর সঠিক প্রতিবেদনের সিদ্ধান্ত তাৎপর্যবহ। গত সপ্তাহে | যে সব লক্ষণ দেখা গেছে তার অধিকাংশই পাকিস্তানি ফেডারেল ইউনিয়ন ভাঙনের  

ইঙ্গিতবহ। শেষ মুহূর্তে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করা বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের চোখে পাঞ্জাবি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এর ফলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সপ্তাহব্যাপী হরতাল, বাঁশের লাঠি নিয়ে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ ধ্বনি সহকারে সড়ক প্রদক্ষিণের জবাব দেয় ট্রাকবােঝাই পাক-সৈন্য। সপ্তাহশেষে সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা ১৩০, আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার, মুজিব ছয় দফা নিয়ে নির্বাচনে জিতেছেন। এ কর্মসূচি পাকিস্তান ইউনিয়নকে কনফেডারেশনে পরিণত করবে, প্রতিটি প্রদেশে দিতে হবে স্বায়ত্তশাসন। ইয়াহিয়া এখন উভয় সঙ্কটে’। সত্য বলতে কি সঙ্কট ইয়াহিয়ার নয়। ইয়াহিয়া পরিকল্পিতভাবেই সঙ্কট তৈরি করেছেন। অথচ আশ্চর্য যে এ বিষয়ে এমন কি সংলাপের প্রহসন নিয়েও পশ্চিমা সাংবাদিকদের অনেকে কেন জানি যথেষ্ট অবহিত নন। ( সবকিছু বিচার করে এটা স্পষ্ট যে সংলাপ ভেঙে যাওয়া না-যাওয়া কোনাে রাজনৈতিক বিষয়ই নয়। আসলে সংলাপের কোনাে লক্ষ্য ছিল না, ছিল না কোনাে ফলপ্রসূ পরিণামে পৌছানাের উদ্দেশ্য। কাজেই সংলাপ ভাঙার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। সেজন্যই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নির্বিকার চিত্তে সংলাপটিকে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে রেখে কোনাে ঘােষণা ছাড়াই দায়িত্বহীনের মতাে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিলেন। এবং সংলাপের শেষ দিন পর্যন্ত ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আলােচনার সন্তোষজনক অগ্রগতি হচ্ছে। | অধ্যাপক রেহমান সােবহান এ বিষয়টি প্রায় একই ভাবে দেখেছেন। তার ভাষায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দল কখনো এমন ইঙ্গিত দেয় নি যে আওয়ামী লীগকে নির্দিষ্ট একটি সীমার বাইরে কোনাে সুযােগ সুবিধা দেওয়া যাবে না।

তাই আলােচনা ভেঙে পড়ারও কোনাে অবকাশ তৈরি হয়নি’। (“Yahya’s tea never Indicated that there was a point beyond which they could not accommodate the Awami League. As a result there was no question of any break-down in the talks because Yahya and his team never issued any ultimatum or their minimum basis for a settlement…. The Awami League team waited for the final drafting session of the proclammation on March 25, but the expected call never came” Guardian, June 5, 71) তাই তার বিচারে সংলাপ ভেঙে পড়ার দায় আওয়ামী লীগের ওপর পড়ে না। বরং আরাে অনেকের মতাে তারও দৃঢ়বিশ্বাস যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আলােচনাকে ব্যবহার করেছেন তার সেনাবাহিনীর সমরসজ্জা সম্পূর্ণ করে তুলতে এবং পশ্চিমা সাংসদদের সমর্থন থেকে মুজিবকে বিচ্ছিন্ন করতে। পরিশেষে জেনারেল টিক্কা খানকে ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যার তৎপরতা (‘Operation Genocide’) শুরু করার নির্দেশ দিয়ে ইয়াহিয়া খান। ঢাকা ত্যাগ করেন।’ | কিন্তু মেজর সালিক রবার্ট জ্যাকসন বা অধ্যাপক রেহমান সােবহানদের এ বক্তব্য অগ্রাহ্য করে বলেন যে তার জানামতে মার্চের পঁচিশ দিনে কোনাে সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হয় নি। তার কথা যদি আমরা মেনেও নেই তবু তাে অস্বীকার করা চলে না। যে সৈন্য আনার কাজ এর আগেই শুরু এবং শেষ করা হয়েছে। তারই সাক্ষ্যমতে জেনারেল ইয়াকুব একাধিকবার প্রেসিডেন্টকে ঢাকায় সৈন্য না পাঠাতে, এবং সমস্যার। 

সমতান্ত্রিক সমাধানের বদলে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ঢাকায় এসে আলােচনা শুরু করতে অনুরােধ জানিয়েছেন। আসলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সামরিক সমাধানই একমাত্র গ্রহণযােগ্য উপায় বলে বিবেচনা করেছেন সিদ্দিক সালিকের লেখায় উপস্থিত একাধিক বক্তব্য থেকেও তেমন প্রমাণ মেলে। সংলাপের মাধ্যমে সমাধান বা সঙ্কট থেকে উদ্ধারই যদি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য হয়ে থাকবে তাহলে তিনি (১) জেনারেল ইয়াকুবের পরামর্শ অগ্রাহ্য। করে ঢাকায় সৈন্য পাঠাতেন না, জাহাজে অস্ত্রশস্ত্ররসদ পাঠাতেন না, (২) ঢাকায় আলােচনা শুরু করতে গররাজি হতেন না বা সমর-আয়ােজন পূর্ণকরার ব্রত নিয়ে ঢাকায় আসতেন। কিংবা (৩) ১৭ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া প্রথম রাউন্ড আলােচনার পরই শেখ মুজিবকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে টিক্কা খানকে নির্দেশ দিতেন না যে তৈরি হয়ে যাও।’ এবং টিকা সে অনুযায়ী ১৮ মার্চ সকালেই অধীনস্ত জেনারেলদের আক্রমণের সব ব্যবস্থা সুষ্ঠু করে তােলার জন্য তাগিদ দিতেন না। এমন কি করাচি থেকে ঢাকায় এসে সেদিনই উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত গােপন বৈঠকে প্রেসিডেন্ট তার সামরিক উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতেন না। কিংবা ঐ বৈঠকে দীর্ঘদেহী জেনারেল মিঠুঠার বক্তব্য এখানকার অবস্থা খুবই নাজুক। বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা না হলে অর্থক হাজার হাজার নিরপরাধ নারী-পুরুষ শিশু মারা পড়বে শােনার পরও ইয়াহিয়া নির্বিকার। ভঙ্গিতে বলতে পারতেন না : ‘হ্যা, মিঠা, আমি জানি, আমি জানি।

এবং এটুকু বলেই জেনারেল মিঠাকে বসিয়ে দিতেন না। এমন কি পারতেন না ঐ সৎপরামর্শের জন্য কোয়ার্টার-মাস্টার জেনারেল মিঠঠাকে তার ঐ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে।  উপরের ঘটনাগুলাে মেজর সালিকের বিবরণ থেকে নেওয়া। জেনারেল মিঠা প্রসঙ্গে তার ভাষ্য হল ; নৈতিক সাহসের দায় বহন করা ছাড়া আর কোনাে দায়-দায়িত্ব বা করণীয় কিছু তার (মিঠুঠার) ছিল না। ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে অস্বীকারের উপায় নেই যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিরল হলেও দু’চারজন ‘মানুষ’ অর্থাৎ মানবিকবােধ সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন যাদের জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব-পাকিস্তানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখেন নি। ইয়হিয়া বিশেষ উদ্দেশ্যেই সব ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন জঙ্গি সেনানায়কদের হাতে। আসলে জেনারেল ইয়াহিয়া, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার প্রতিটি পদক্ষেপ, চাপেই হােক বা চাপমুক্ত অবস্থায়ই হােক সজ্ঞানে রেখেছেন, হিসাব-নিকাশ করেই পা ফেলেছেন। তাই এমন ভাবনারও কারণ নেই যে ইয়াহিয়ার জানা ছিল না যে সংলাপ ভেঙে দিয়ে ইয়াহিয়া পাকিস্তান ভাঙারও ব্যবস্থা করেছেন। না, জেনারেল ইয়াহিয়াকে এতটা স্বচ্ছ সরল সামরিক অফিসার মনে করার কোনাে কারণ নেই। ইয়াহিয়া ধরেই নিয়েছিলেন যে তার দুর্ধর্ষ পাক সেনাবাহিনী (তার মতে যা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাহিনী) অনায়াসে আর কাজ সম্পন্ন করবে। তারা ছয় দফা স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবর রচনা করবে পূর্ব-পাকিস্তানের মাটিতে। সমরবিদ্যায় পিছিয়ে থাকা বাঙালির সাধ্য নেই সুশিক্ষিত, দুর্বার পাকিস্তান বাহিনীর মােকাবেলা করা। 

এমন ধারভারসম্পন্ন পাকিস্তান বাহিনী ত্রয়ের সর্বাধিনায়ক, সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কেনইবা শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে একজন আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাকে সমীহ করতে যাবেন? কিংবা যথেষ্ট সুযােগ-সুবিধা ছাড়া কেন তার জন্য কোনাে ব্যবস্থা করতে যাবেন, হােক না সে ব্যবস্থা ন্যায্য গণতসম্মত। মেজর সালিকের মতে এখানেই ছিল সমস্যার মূল কারণ। তাছাড়া এরা দুজন দুই অসম অবস্থানে দাঁড়ানাে, আলােচনাও দুই ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে বলে সমঝােতার অবকাশ ছিল কম, তদুপরি উভয়েরই ছিল রাজনৈতিক স্বার্থের হিসাব-নিকাশ, ছিল ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি আত্মবিশ্বাস। আসলেই বিষয়টা ছিল তত্ত্বগত বিচারে ক্ষমতার লড়াই, রাজনৈতিক বনাম সমরতান্ত্রিক ক্ষমতার লড়াই। এ ধরনের লড়াইয়ে সাধারণত সামরিক শক্তিই জিতে যায়, বিশেষ কোনাে কারণ না থাকলে। সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক শাসক কি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়, না দিতে পারে কখনাে? আর সে ক্ষেত্রে ভুট্টোর মতাে চতুর, রাজনীতির খেলায় পারদর্শী ব্যক্তি যদি সারাক্ষণ পেছনে লেগে থাকে, জঙ্গি জেনারেলদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকে তাহলে তাে আর কথাই নেই। তাই ইয়াহিয়া সরেজমিনে অবস্থা দেখতে ঢাকায় এসেছিলেন। এসেছিলেন সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি স্বচক্ষে দেখে যেতে। আর বিশেষভাবে রাজনৈতিক সংলাপের মঞ্চাভিনয়টা চমক্কারভাবে করে নিতে যাতে বিশ্ব-রাজনৈতিক মতামত ও সংবাদভাষ্যকারদের প্রভাবিত করা যায়, তাদের প্রতারিত করা যায়। তার উপস্থিতিতেই ‘অপারেশন সার্চলাইটের যাবতীয় ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করা হয়, তার এবং চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদের অনুমােদনও নেওয়া হয়।  তাই সংলাপ ভাঙার দায় কোনােভাবেই শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপানাে চলে না, কিংবা চাপানাে চলে না পাকিস্তান ভাঙা বা বিচ্ছিন্নতার দায়। সামরিক সমাধানে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী ইয়াহিয়া এবং তার জঙ্গি জেনারেল গ্রুপই বিচ্ছিন্নতার জন্য দায়ী আর দায়ী ভুট্টোর প্রবল রাজনৈতিক উচ্চাশা। প্রসঙ্গত অধ্যাপক রেহমান সােবহান উল্লিখিত নিবন্ধে বলেছেন ; ইয়াহিয়া নিশ্চিতই জানতেন যে তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ আশাটুকু ধ্বংস করে দিচ্ছেন” (“Yahya must have known that he was destroying the last hope of united Pakistan”)

জেনারেল ইয়াহিয়া তার মেগালােমেনিয়ার কারণে ভাবতেই পারেন নি যে এ অসম শক্তির খেলায় তার হার হতে পারে। এদিক থেকে বরং শেখ মুজিবুর রহমানের ক্রান্তিক্ষণের বােধােদয় ছিল সঠিক যখন ২৫ মার্চ রাতে তিনি তার এক পশ্চিম-পাকিস্তানি অতিথিকে বলেন যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ইয়াহিয়া সামরিক সমাধানের জন্য এতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে এর ফলে পাকিস্তান শেষ হয়ে গেল’ (রেহমান সােবহান)। ভুট্টো এবং পাকিস্তানি সেনানায়কদের বাঙালি-বিরােধী ষড়যন্ত্রের কথা নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা একাধিক বার বলেছেন। বলেছেন   শেখ সাহেবও। তবু তিনি হয়তাে বিষয়টা পুরােপুরি বিশ্বাস করেন নি, সমঝােতার মীমাংসাতেই তার আস্থা ছিল, তা না হলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সদিচছা নিয়ে আলােচনা চালিয়ে যেতেন না। ইয়াহিয়াদের মতাে যতটা সম্ভব বিকল্প ব্যবস্থার দিকে হাত বাড়াতেন। সে সুযােগ ও সুবিধা জননন্দিত নেতা, একচ্ছত্র নেতার ছিল। কিন্তু তিনি তা করেন নি।  আরাে আশ্চর্য যে দু’মাস পরে ‘গার্ডিয়ান’-এ লেখা নিবন্ধে অধ্যাপক রেহমান সােবহান যে তথ্য ও বক্তব্য রেখেছেন তাতে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেন এমন অনুধাবনার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ সাহেবের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ তার মতাে ধীমানরা ঐ যড়যন্ত্রের গুরুত্ব ও বিকল্প ব্যবস্থার জন্য নেতার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন নি। ভাবতে অবাক লাগে, ঐ দ্বিআঞ্চলিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব যে আওয়ামী লীগের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এ ধারণা কেন তাদের হয় নি, বা হয়ে থাকলে নেতাকে এবং নেতৃবৃন্দকে ঐ প্রস্তাব গ্রহণ থেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন নি কেন। তাছাড়া পশ্চিম-পাকিস্তানের ভুট্টো-বিরােধী নেতারা যা আভাস-ইঙ্গিতে বুঝতে পেরেছিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানি নেতারা কেন তা বুঝতে পারেন নি? আজকের ইতিহাস-পাঠকের মনে এ প্রশ্ন দেখা দেবেই। তকালীন নেতাদের বিচক্ষণতা সম্পর্কে তাদের মূল্যায়নও হবে ঐ ভিত্তিতেই। | বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ অদূরদর্শিতার কারণে ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ভাষণে পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার এবং পাকিস্তানকে দ্বিভাজিত করার চেষ্টার । সব দায় আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন। প্রেসিডেন্টের মতে জাতীয় পরিষদে দুই শাসনতান্ত্রিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব ছিল শেখ মুজিবের, যে-প্রস্তাব বাস্তবিকই পাকিস্তানের সংহতি-বিরােধী এবং বিচ্ছিন্নতার পক্ষে।’ সত্য-অসত্য মিলিয়ে এভাবেই পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট তার ২৬ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক দলবিশেষের বিরুদ্ধে অভিযােগ এনেছিলেন দেশদ্রোহিতার।  প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঐ ভাষণে আরাে বলেন যে ‘পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা জাতীয় পরিষদের বিভক্তি প্রস্তাব নিয়ে উদ্বিগ্ন, উকণ্ঠ ছিলেন। তারা উপলব্ধি করেন যে এর ফলে পাকিস্তানের সংহতি বিপন্ন হবে। এমন কি পিপিপি চেয়ারম্যানও একই মতামত প্রকাশ করেছেন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে। তার মতে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত ঘােষণাপত্র ছিল প্রেসিডেন্টের জন্য পাতা ফাদ (দ্য ডন, মার্চ ২৭, ১৯৭১)।

আশ্চর্যের বিষয় যে পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতাদের কেউ ঘটনা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সত্য-মিথ্যায় ভরা ভাষণের (২৬ মার্চ) কোনাে প্রতিবাদ করেন নি। হতে পারে কইর সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু এর কারণ। আরাে অদ্ভুত যে পূর্ব-পাকিস্তানি নেতারাও সুস্পষ্টভাবে ইয়াহিয়া-ভাষণের মিথ্যাগুলাে তুলে ধরে প্রতিবাদ জানান নি। আন্তর্জাতিক ফোরামে। কিন্তু ইতিহাসকে তাে সত্য ঘটনাই লিপিবদ্ধ করতে হয়।  সব তথ্য বিচার করে কেউ কি এরপর রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সদিচ্ছার কথা বলতে পারেন? কিন্তু বলেছেন কেউ কেউ পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক, ভাষ্যকার। তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আপাত-সরল বক্তব্যের ওপর নজর সীমাবদ্ধ রেখেছেন, এর গভীরে প্রবেশ করেন নি। তার মঞ্চাভিনয়ই দেখেছেন, দেখে কখনাে মুগ্ধ হয়েছেন কিন্তু মঞ্চের পেছনে পর্দার আড়ালে অনুষ্ঠিত নাটকের ওপর নজর  ফেরাতে পারেন নি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকের মতাে অন্ধকার থেকে তথ্য তুলে আনতে পারেন নি। সে কাজ কষ্টসাধ্য হয়তাে ছিল কিন্তু খুব একটা অসাধ্য ছিল না।  প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জয় নিশ্চিত জেনেই মাঠে নেমেছিলেন। তার জানা ছিল না যে তার লড়াই একটি দলবিশেষের বিরুদ্ধে নয়, লড়াই একটি জাতির বিরুদ্ধে। আর জাতি যখন আশা-আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে তখন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরােধপ্রতিকারের চেষ্টা অদম্য হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারতের সমরশক্তি সম্পর্কেও মনে হয় প্রেসিডেন্টের সঠিক মূল্যায়ন ছিল না প্রধানত আত্মম্ভরিতার কারণে। তেমনি জানা ছিল না বা জানায় ভুল ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে পরাশক্তির পারস্পারিক দ্বন্দ্ব ও সমঝােতা সম্পর্কে।  চীনা সমর্থনের ওপর হয়তাে বড় বেশি নির্ভর করে থাকবেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। এর পেছনেও আবার সেই ভুঠো-চাতুর্য। চীনা সমর্থন যে মূলত কাশির-কেন্দ্রিক এবং তা মার্কিন-সােভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গিতে কতটা বাস্তবভিত্তিক এবং সে সমর্থন আদৌ পূর্বপাকিস্তান পর্যন্ত পেীছাতে পারে কিনা সেসব জটিলতায় মাথা গলানাের ইচ্ছা বা মেধা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কতটা ছিল তা বিচারের বিষয়। ভারতপাকিস্তানের সংঘাত পরাশক্তিদের কতটা আকাক্ষিত সেটাও ছিল ভেবে দেখার বিষয়। কিন্তু এতসব হিসাব-নিকাশের জটিলতায় না গিয়ে আপাতত যুদ্ধজয়ের আগাম আনন্দের স্বাদ নিতে নিতেই বােধ হয় ২৫ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উড়ে চললেন করাচি বিমানবন্দরের উদ্দেশে। হয়তাে ভাবছিলেন, এবার উদ্ধত বাঙালিদের একটা দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা দেওয়া হবে। ইয়াকুব নয়, টিক্কা কাজটা ভালােই করতে পারবে।

 

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক