You dont have javascript enabled! Please enable it! ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমিতে নির্বাচন  প্রত্যাশার উৎস - সংগ্রামের নোটবুক

ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমিতে নির্বাচন  প্রত্যাশার উৎস

দেশবিভাগের পর পূর্ববঙ্গের নয়া রাজনৈতিক ইতিহাস সময়ের বিচারে দীর্ঘ নয়, কিন্তু খুবই বর্ণময় আর ঘটনাবহুল। এ অল্প সময়েই ইতিহাসের পাতায় নানা রঙে নানা লেখার আঁকিবুকি । দুর্ভাগ্য পাকিস্তানের যে জন্মলগ্ন থেকেই কথিত গণতন্ত্রের স্বৈরশাসনে তার সময় কেটেছে। অন্যায় অনাচার অপশাসন— ‘আবার এ সবই পাকিস্তানের নামে, ধর্মের নামে। মুসলিম লীগের সেই স্বৈরশাসনই সামরিক শাসনের রকমারি লােকভােলানাে রূপ নিয়ে দেশ শাসন করেছে। বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নামে সামরিক গণতন্ত্র কিংবা পাকিস্তানি জাতীয়তার নামে ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন থেকে আধা-সামরিক বা আধা-বেসামরিক শাসনে প্রায় দুই যুগের অবসান।  এর মধ্যেই ষাটের দশকে সামরিক শাসন, গণ-অসন্তোষ, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যদি নিয়ে আন্দোলন বা প্রতিবাদের মুখে ঢাকার রাজপথে অনেক রক্ত ঝরেছে। কিছু কিছু ঝরেছে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে কোনাে শহরে। ঢাকায় গণআন্দোলনের মুখে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খার পতন ঘটলেও ক্ষমতার দড়িদড়া তুলে দেওয়া হয় জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে। আন্দোলনের চেহারা দেখে হােক বা অন্য কোনাে গঢ় কারণে হােক এই সেনানায়কের মনে হয়েছিল :সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাক। ‘ তাই সামরিক শাসনের মেয়াদ আর টেনে লম্বা না করে নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু নিয়ন্ত্রক আইন জারির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া । ঐ নিয়ন্ত্রক আইন (‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ = “এল.এফ.ও.’)-এর মূল বক্তব্যে তথা ওর পঞ্চ দফায় ছিল ইসলামী মতাদর্শ, ভূখণ্ডের স্বাধীনতা-সংহতি, গণতন্ত্র, প্রকৃত ফেডারেল শাসন ব্যবস্থা ও সব অঞ্চলের জনগণের জন্য পরিপূর্ণ সুযােগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা। সংবিধান এই পাঁচ দফার ভিত্তিতেই রচিত হবে। (মর্নিং নিউজ, করাচিঢাকা, ২৯.৩,৭০)।  এই সঙ্গে এল,এফ,ও, ‘র হুকুমনামায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথাও ছিল (১৪ নম্বরে) যে ‘নির্বাচন-শেষে প্রেসিডেন্ট সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করবেন। এখানে দুটো বিষয় লক্ষ্য করার মতাে। ঐ হুকুমনামার বয়ানে ছিল অধিবেশন আহ্বানের বাধ্যবাধকতাবােধক ‘shall’ শব্দটি, এবং সে অধিবেশনের উদ্দেশ্য  শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, অর্থাৎ অধিবেশনে বসে শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান রচনা। (রাওয়ালপিন্ডি ৩০ মার্চ, প্রেসিডেন্টের দুই নম্বর হুকুমনামী, ১৯৭০)। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে ভুট্টো বা ইয়াহিয়া কেউ এ কথাগুলাের তাৎপর্য মনে রাখেন নি। হয়তাে রাখেন নি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক খসড়া সংবিধান অনুমােদনের (authentication) ২৪ নম্বর ধারাটিও। 

সেই যাই হােক পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পত্তনের নয়া সম্ভাবনা শুভ সম্ভাবনা হিসাবেই সর্বত্র অভিনন্দিত হয়। পশ্চিমা বিশ্ব তথা গণতান্ত্রিক বিশ্বও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সদিচ্ছার প্রতি সমর্থন জানায়। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ববঙ্গে সামরিক শাসন বা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন চলেছে অনেক বেশি। তাই ৭ ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠান এ ঘােষণা বাঙালি জনসাধারণের জন্য ছিল শুভ সংবাদের মতাে। কারণ দুই দশকেরও বেশি সময়ের পাকিস্তানি শাসনে দেশে গণতন্ত্রের কোনাে ভিত বা ঐতিহ্য তৈরি হয় নি। হয়তাে তাই রাজনীতিকদের চেয়েও রাজনীতি-সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল যে এ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে গণতষের ভিত তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। সব দিক বিচারে এ নির্বাচনের গুরুত্ব ছিল তুলনামূলক হিসাবে অনেক বেশি। একই কারণে গণতান্ত্রিক শাসন ও জনপ্রতিনিধিদের শাসন ঘিরে স্বপ্নও তৈরি হয়। পূর্ববঙ্গে সে স্বপ্নটা এক আশ্চর্য কুহকে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। ছড়িয়ে যায়, হঠাৎ বাঁধভাঙা স্রোতের মতাে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্বাচন-বিষয়ক আইন কাঠামাের প্রথম শর্তই ছিল, পাকিস্তান। হবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র (ইসলামিক রিপাবলিক’)। সেই শর্তে নির্বাচন, সেই শর্তে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও (‘মেনিফেস্টো) স্পষ্টই উল্লেখ ছিল যে কোরান ও সুন্নার বিরােধী কোনাে আইন শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (বাংলাদেশ। ডকুমেন্টস, পৃ. ৬৭-৬৮)। পাকিস্তানি শাসকদের তাই ভয় পাবার কিছু ছিল না। পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিয়েও নানা মহলে সংশয়ের অবকাশ ছিল বলেই হয়তাে রমনা রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অভিযানের সূচনা ঘটাতে গিয়ে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে ‘পাকিস্তান টিকে থাকতেই এসেছে। কোনাে শক্তিই একে ধ্বংস করতে পারবে না (ডন, ৮,৬.৭০)। (‘পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে’ কথাটা জিন্নাহ-লিয়াকত-নাজিমুদ্দিন প্রমুখ সব পাকিস্তানি নেতাই সাতচল্লিশের আগস্টের পর থেকে বারবার উচ্চারণ করেছেন, হয়তাে তাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর করে তুলতে।) | শেষ পর্যন্ত ৭ ডিসেম্বরের (১৯৭০) নির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয় সামরিক শাসনের তত্ত্বাবধানে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদও জানালেন। ভাষ্যকারদের হিসাবে কিছুটা গরমিল ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের ধসনামা বিজয় পূর্ব-পাকিস্তানের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়, গােটা পাকিস্তানের মােট ৩০০ (মহিলা আসন বাদে) আসনের মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। আর পশ্চিম পাকিস্তানের চার প্রদেশে (উপজাতীয় এলাকাসহ) ১৩৮ আসনের মধ্যে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির ৮৩ আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিন্তু ৩০০ আসনের হিসাবে তারা হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু দল। অন্যান্য  দলের আসন সংখ্যা ছিল ৪৮, সেই সঙ্গে উপজাতীয়দের ৭টি আসন যােগ করে নিলে তাদের মােট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ আসন।  তাই সব মিলিয়ে বিচার করে দেখলে পিপিপি’র অবস্থান খুব একটা আহামরি ছিল। কারণ কাইউম মুসলিম লীগের ৯টি আসন ভূট্টোর পক্ষে গেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের অবশিষ্ট আসন সংখ্যার সমর্থন পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিনিধি হিসাবে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে যুক্ত হলে (যে সম্ভাবনা যথেষ্টই ছিল) জাতীয় পরিষদে এদের প্রতিনিধিত্বমূলক (পাকিস্তানভিত্তিক) সার্বিক অবস্থান অগ্রাহ্য করার মতাে নয়। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঙ্কটের মুখেও ভুট্টোবিহীন এ সংখ্যাতাত্ত্বিক অবস্থান মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনাে গঢ় কারণ ছিল। আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক জলাশয়ের উপরিতল মসৃণ মনে হলেও এর ভেতরটা। মােটেই সহজ স্বচ্ছ ছিল না। সেখানে ছিল ঘাত-প্রতিঘাতের খেলা। হতে পারে জেনারেল ইয়াহিয়া কোনাে বিশেষ কারণে (হয়তাে বা বিশেষ উদ্দেশ্যে) সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা। করা সত্ত্বেও তার অন্দর মহলে তা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল না। সেখানে মহলবিশেষে কাজ করেছে ক্ষুব্ধ অসন্তোষ। চলেছে ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি, ক্ষমতাবদলের চেষ্টা। এদিক থেকে উপমহাদেশে পাকিস্তানের তুলনা মেলা ভার। নভেম্বরের শেষ দিকে ‘গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ম্যাক্সওয়েল ব্রেম-এর। এক চমকপ্রদ প্রতিবেদন। তার মতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক অদ্ভুথান প্রচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। দেশব্যাপী আসন্ন নির্বাচনের প্রক্রিয়াও তাই বেঁচে গেছে বলতে হয়। প্রেসিডেন্ট যদিও এই প্যালেস কু’ তথা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কথা অস্বীকার করেছেন তবু পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, জেনারেল ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। সামরিক শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এক শক্তিশালী জেনারেল গ্রুপ, বলা যেতে পারে নিয়ন্ত্রক জুন্টা’।

সেখানে জেনারেল ইয়াহিয়া নখদন্তহীন রাজা। তার পুরনাে বন্ধু চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খানও ঐ জঙ্গি জেনারেলদের পক্ষে (দ্য গার্ডিয়ান, ২৯.১১.৭০)। (“President Yahya Khan of Pakistan has apparently survived an attempt to topple him from office and cancelled the nation-wide elections scheduled for tomorrow. …The President strongly denied that he had lost effective control of the army in a palace coup. … Yet reports persist that the martial law administration has passed to a ruling junta of generals with President Yahya reduced to a figurehead. Certainly the President is plainly under the close observation of army hawks supported by General Abdul Hamid Khan, the chief of staff and an old friend.” The Guardian, 29 November, 1970) | গুজৰ যে মিথ্যা ছিল না নানা আলামতে তা স্পষ্ট। আর একথাও স্পষ্ট যে তাদের। চাপেই ইয়াহিয়াকে ভুট্টোর অযৌক্তিক আবদার মেনে নিতে হয়েছিল। হয়তাে সেজন্যই ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণা ইয়াহিয়ার কণ্ঠে শােনা যায় নি, অন্য কেউ তা পাঠ করেছেন। সংশ্লিষ্ট জেনারেলদের হাতেই ঐ ঘােষণার খসড়া তৈরি এবং তাতে। ইয়াহিয়ার সম্মতি-স্বাক্ষর বসানাে হয়। মেজর সালিকের বিবরণ অনুযায়ী এটা দুই  মেজর জেনারেলের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কীর্তি; ইয়াহিয়া স্বাক্ষরদাতা মাত্র। সম্মতি না দিয়ে তার উপায় ছিল না।

অধ্যাপক রেহমান সােবহানের বক্তব্যেও অনুরূপ ষড়যন্ত্রের আভাস স্পষ্ট। তার বিবরণে প্রকাশ, লে, জে, উমর একাধিক পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাকে ভুঠোর সমর্থনে দাড়িয়ে অধিবেশন বর্জন করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। পরে ঐ নেতাদের কাছ থেকেই এ তথ্য জানা গিয়েছিল। এমন কি আরাে পরের ঘটনা সম্পর্কে অধ্যাপক সােবহান জানিয়েছেন যে ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যখন একগুচ্ছ জেনারেল সঙ্গে নিয়ে আর অন্যদিকে ঐ সব জেনারেল ক্যান্টনমেন্টে বসে ২৫ মার্চের যুদ্ধ-পরিকল্পনায় শেষ আঁচড় টেনেছেন (ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান, ৫ জুন, ৭১)। শুধু অধ্যাপক রেহমান সােবহানই তার লেখায় রক্ষণশীল পাক জুন্টার কর্তৃত্বের কথা উল্লেখ করেন নি, মাস কয়েক পর সাংবাদিক ক্লেয়ার হােলিংওয়র্থও বিষয়টা স্পষ্ট করেছেন ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ লেখা তার প্রতিবেদনে। পাকিস্তানে বিরাজমান। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামরিক পরিস্থিতির পর্যালােচনা করে ঐ প্রতিবেদক সেখানকার বিপর্যয়ের জন্য দক্ষিণপন্থী সেনা ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন। তার মতে ঐ চক্রই ‘পাকিস্তান শাসন করছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাদের মুখপাত্র বই কিছু নয় এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও ঐ চক্রের নেই।’ (“But perhaps the most important single reason in the eyes of foreign observers is that the Right-wing military clique in Islamabad who rule the country, for whom the President is spokesman, have no real intention of relinquishing an iota of power,”The Daily Telegraph, 13 September, 1971)। হামুদুর কমিশন রিপাের্টেও বিষয়টা স্পষ্ট। হােলিংওয়র্থের খবর মাফিক ঐ কুচক্রে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের অন্যতম মেজর-জেনারেল মােহাম্মদ আকবর খান (পাকিস্তান গােয়েন্দা দফতর আই,এস,আই,-এর পরিচালক), মেজর-জেনারেল গুল হাসান (চিফ অব স্টাফ), মেজর-জেনারেল ওমর খান (গোয়েন্দা অধিকর্তা), লে. জেনারেল টিক্কা খান প্রমুখ এবং একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি রােয়েদাদ। তাণ্ডব গােপন রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত অনেক সিনিয়র বেসামরিক কর্মকর্তার জানা নেই পূর্ব পাকিস্তানে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলেছে। (“Many senior civil servants today have no idea how ruthlessly the army behaved, nor are they aware that villages are still being burnt as reprisals when they are near to the scene of action by Muktifouz guerrillas.”) 

এতাে অনেক পরের ঘটনা। ততােদিনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পুরােপুরি বিকিয়ে গিয়ে ভুট্টো ও তার সমর্থক জেনারেলদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এর অনেক আগে গার্ডিয়ান’-এর ঐ ২৯ নভেম্বরের বিবরণে প্রকাশ, সামরিক বাহিনীর জঙ্গি জেনারেলরা তাদের ভবিষ্যত বিবেচনা করেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা তৈরি করেন। পূর্ববঙ্গে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে জানমালের অবিশ্বাস্য ক্ষয়ক্ষতি এবং সামরিক প্রশাসনের পক্ষে এর মােকাবিলায় সুস্পষ্ট অবহেলার মতাে একাধিক কারণে আওয়ামী লীগের ব্যাপক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং নির্বাচনে মােট আসনের অর্ধেক তাদের দখলে চলে যাওয়ার জনরব সামরিক জুন্টাকে বিচলিত করে তােলে। অন্যদিকে তাদের পক্ষে এমন সন্দেহের কারণ ঘটেছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সম্ভাব্য অবস্থা বিবেচনায় পূর্ব-পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনায় বসে তাদের মধ্যকার মতভেদ দূর করার মতাে সমঝােতায় পৌছানাের চেষ্টা করছেন। এ আঁতাতের উদ্দেশ্য হবে নির্বাচনে বিজয়ী শেখ মুজিবের প্রতি সমর্থন যুগিয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইয়াহিয়ার উচ্চাভিলাষ পূরণ। এমন সম্ভাবনা জঙ্গি জেনারেলদের মনঃপূত হতে পারে না। হয়ও নি। | এছাড়াও পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাধান্য মেনে না নেয়ার একাধিক কারণ ছিল সামরিক শাসনের পক্ষে। সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান ব্যয়ভার (জাতীয় বাজেটের ৬০ শতাংশ) পাকিস্তানের মতাে গরিব দেশের বেসামরিক সরকারের পক্ষে কতটা মেনে নেওয়া সম্ভব— এমন প্রশ্নও তাদের মাথায় ছিল। আরাে লক্ষ্য করার মতাে যে ঐ বিশাল সামরিক বাহিনী রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় বিপুল অর্থের সিংহভাগ আসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। অথচ প্রতিরক্ষা-ব্যয়ের প্রায় সবটুকুই যায় পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগে। এ বৈষম্য যে বাঙালি শাসকের চোখে পড়বে না এমন তাে নয়। আবার পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার ভৌগােলিক দূরত্বের কারণে নিকট প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য লাভজনক বিবেচিত হতে পারে, বিশেষ করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর জন্য এটা ছিল ভয়ের, অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সমস্যা। এ অবস্থা কি উচ্চাভিলাষী পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব?

ভাষ্যকারদের মতে সম্ভাব্য বিজয়ী শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষেও সমস্যার দুই দিক সামলানাে অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে— একদিকে শক্তিমান সামরিক প্রশাসনের ‘ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অন্যদিকে স্বদেশে ৭ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ (দ্য গার্ডিয়ান, ২৯.১১.৭০)। দূরদর্শী এ প্রতিবেদনটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, অনেকটা ভবিষ্যত দর্শনের মতাে। নির্বাচন ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা যেমন ছিল বেসামরিক শাসন তথা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার তেমনি অর্থনৈতিক উন্নতির । দুই দশকের পর বাঙালিমাত্রেই একটা পরিবর্তনের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে একতরফা ভােগে অভ্যস্ত পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক শাসকশ্রেণীর পক্ষে হঠাৎ পরিবর্তন মেনে নেয়াও সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গি সেনানায়কেরা যখন ভারত-বিদ্বেষী রাজনীতিক ভুয়োকে পেয়ে যায় তখন তার সঙ্গে তাদের সমঝােতা ও আঁতাত গভীর না। হয়ে পারে না। “গার্ডিয়ান’-এ পিটার প্রেস্টনও প্রায় একই ধারায় বিচার-বিশ্লেষণের পর মতামত রাখেন যে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থিতি বড়ই সমস্যা-জটিল বিষয়। যেমন রাজনৈতিক দিক থেকে তেমনি অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়। বাস্তবিকই এদেশে রাজনৈতিক মতাদর্শে এত বৈপরীত্য, বিরােধী স্রোতের টান এত বেশি যে এর মধ্যে কোনাে সুসংহত ঐক্যে পৌছানাে (স্বদেশের স্বার্থে হলেও) প্রায় অসম্ভব। গণতন্ত্রের  স্বপ্ন দেখা সহজ, কথাটা শুনতেও চমকার, কিন্তু এর বাস্তবায়ন সমস্যা-জটিল এ দেশটিতে খুবই দুরহ কাজ। তাছাড়া রয়েছে সামরিক শাসনের দীর্ঘ ঐতিহ্য, এর ওপর আবার রয়েছে দেশের দুই দূর অঞ্চলের মধ্যে নানামুখী দ্বন্দ্ব। যেমন বাংলা বনাম উর্দু তথা বাঙালি বনাম অবাঙালির দ্বন্দ্ব তেমনি ৬-দফার স্বায়ত্তশাসন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সন্দেহ। সন্দেহ বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা নিয়ে।  এমন একটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের বাস্তবতা ও সম্ভাবনা সামনে রেখে গার্ডিয়ান’ প্রতিবেদকের প্রশ্ন : ‘এই ছােট্ট দেশটিতে কত যে মতাদর্শ আর কত যে ভেদরেখা! দক্ষিণ, বাম, মধ্য— রক্ষণশীল, প্রগতিশীল, উদারনৈতিক। এতসব বিপরীতকে এক বিন্দুতে টেনে আনা আদৌ কি সম্ভব। এর ওপর রয়েছে শক্তিমান সামরিক বাহিনী এবং তেমনি শক্তিমান আমলাতন্ত্র।’ এ দুয়ের মিলে কি সর্বনাশের কথা ভেবেছিলেন সংবাদ-ভাষ্যকার? কারণ এ দুয়ের সমন্বয় যে দেশের জন্য দুর্গতির কতটা কারণ হতে পারে তা এদেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষ কারাে অজানা নয়।

তবে উক্ত প্রতিবেদকের প্রধান প্রশ্ন ৬-দফা নিয়ে। কারণ আওয়ামী লীগ তাদের ঘােষিত ৬-দফা ভিত্তিক আসন্ন নির্বাচনে যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তাহলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বা উগ্রপন্থী জেনারেলরা কি তা মেনে নেবেন? এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিবের বক্তব্য ; আমলাতন্ত্র ও কায়েমি স্বার্থের যােগসাজশে ষড়যন্ত্র চলছে ঠিকই, কিন্তু নির্বাচনে পরিস্ফুট জনগণের ইচ্ছা কি এত সহজে বাতিল করা যাবে?’ (এটা ছিল নৈতিকতার কথা। কিন্তু রাজনীতিতে যুক্তিবাদী ও নীতিবাদী চিন্তার স্থান, বিশেষ করে আত্মস্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে নেই বললেই চলে। অন্তত এসব দেশে তাে নেই-ই)। | এরপরও জননেতাকে তার প্রশ্ন : সবদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক— এই নীতির ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে নমনীয় নীতি কি পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন পছন্দ করবে?” এক্ষেত্রেও নেতার জবাব ঐ একই ধারায়। সামরিক বাহিনী তো এ মাটিরই সন্তান। দেশের পক্ষে যা উপযােগী বা উপকারী তাদের জন্যও তাই। বড় কথা হল সদিচ্ছা। উদ্দেশ্য সৎ হলে সব কিছুই সম্ভব। আমার উদ্দেশ্য সর্বদাই সৎ।’ এতসব কথার পরও ভাষ্যকারের মতে মানুষের সাধারণ ধারণা এমনই যে উল্লিখিত বিষয়ের যে কোনাে একটি নিয়ে ইসলামাবাদ পেশীশক্তির প্রকাশ ঘটাতে পারে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে ঠিক কোন পথ ধরা শেখ মুজিবের পক্ষে সঙ্গত হবে?’ (দ্য গার্ডিয়ান, ৪,১২,৭০) দেশের পরিস্থিতি আসন্ন নির্বাচনের আগেভাগেই এমন সব গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। সােজা কথায় সামরিক প্রশাসনের মধ্যেই রাজনৈতিক নৈরাজ্যের ভূত বাসা বেঁধেছিল। এর পরিণাম কি কখনাে শুভ বা মঙ্গলকর হতে পারে? তা জনগণ যতই মঙ্গল চান না কেন। সুষ্ঠু নির্বাচন সত্ত্বেও পরিণাম যে শুভ হয়নি তার প্রমাণ পঁচিশে মার্চ এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলী, যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে বিভক্ত করেছে। যে বিভাজনের সম্ভাবনা নিয়ে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী ও রাজনীতিকদের এত ভয়, ভীতি, আশঙ্কা ছিল অবশেষে তাদের হাত দিয়েই তা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ, বাঙালি  জাতীয়তাবাদ বা শেখ মুজিবুর রহমান নিমিত্ত মাত্র।  পশ্চিমা সাংবাদিকদের কেউ কেউ মনে হয় কথিত যষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে তকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক সমস্যার চরিত্র বুঝতে চেষ্টা করছিলেন, চাইছিলেন সঙ্কটের উৎসমুখে পৌছতে  করাচি থেকে গ্যাভিন ইয়াং অবজার্ভার’-এ ৫ ডিসেম্বর লেখেন : “মুজিবের সমস্যা নির্বাচনে জয়লাভ করা নয়, বরং সমস্যা জয়লাভের পর। করণীয় বিষয় নিয়ে।’ এর অর্থ নেতার সামনে রয়েছে সমস্যার খাদ।

সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র, আত্মমুখী বা রক্ষণশীল রাজনৈতিক নেতার মতাে বহুজনার সৃষ্ট সমস্যার নিরসন ঘটিয়ে তবে তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব?  আরাে অনেকের মতােই গ্যাভিনের ধারণা যে ‘মুজিবের ৬-দফা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে গ্রহণযােগ্য মনে হবে না। এমন কি হবে না ঐসব পশ্চিম পাকিস্তানিদের। কাছেও যারা সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাস না করেও তাদের ভারতবিরােধী পরাক্রমী কার্যক্রম অনুমােদন করে থাকে। কাজেই সামরিক শক্তিকে দুর্বল করার মতাে কাজ তারা সমর্থন করবে না। এসব প্রশ্নে মুজিব ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে। সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে বিশেষ করে যখন নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। শুরু হবে।’ অবস্থা বিচারে বুঝতে কষ্ট হবার নয় যে পাকিস্তানে রাজনীতির পথ, গণতন্ত্রের যাত্রা মােটেই মসৃণ নয়, ফুলে-ঢাকা তাে নয়ই। বরং বলা যায়, পথ সমস্যার খাদে ভরা যা পার হওয়া যে কোনাে লােকের পক্ষেই কঠিন। কারণ সেনাবাহিনী তাদের খুশীমতাে সংবিধান না পেলে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। (“Mujib’s problem is not how to win, but what to do when he has won. His platform insists on six points for provincial autonomy. … This President Yahya Khan, a stern, no-nonsense military man, will not accept; nor even those West-Pakistanis who mistrust the army politically but passionately approve of it as a bulwark against India and resent anyone claiming the right to tinker with its budget.”)। সম্ভবত এ কারণেই ভূট্টো তার উগ্র ভারত-বিরােধী স্লোগানের সাহায্যে ভােটার-চিত্ত জয় করতে পেরেছিলেন। (“There is room for a clash between Mujib and the army on this point when the newly-elected Assembly meets to evolve a new Constitution. The Army is not giving up power until it has a Constitution it approves.”) 1C পর্যন্ত গ্যাভিনের হিসাব-নিকাশই সত্যে পরিণত হয়। পাকসেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করে নি। এমনকি ষড়যন্ত্র করে গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানই অসম্ভব করে তােলে। নির্বাচনের একদিন আগেও তাই জল্পনা-কল্পনা— কে জিতবে, কত আসন নিয়ে। জিতবে ইত্যাদি। তার চেয়ে বড় হিসাব বিদেশীদের কাছে : পাকিস্তানে কি অবশেষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? সেক্ষেত্রে পাকিস্তান হবে তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দেশ। পশ্চিমাদের চোখে তখন এর মর্যাদাই আলাদা।

অবস্থাদৃষ্টে ভাষ্যকারদের ধারণা “পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আধাজাতীয়তাবাদী’(Quassi-nationalistic Awami League) আওয়ামী লীগ দল নিঃসন্দেহে।  জয়ী হতে যাচ্ছে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থাটা অনিশ্চয়তার। এখানে নানাস্রোত, নানামত। এর মধ্যে আইয়ুব খার প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর অবস্থান কিছুটা নিশ্চিত বলা চলে। ভুট্টো ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা, সেই সঙ্গে নৈরাজ্যেরও। তার ভূমিবণ্টনের প্রতিশ্রুতি ও সমাজ পরিবর্তনের বুলিতে শহর-গ্রামের দরিদ্র জনতা আকৃষ্ট, যদিও তিনি নির্বাচনী প্রচারে শহর থেকে শহরে বিমানেই যাতায়াত করে থাকেন।’ | পিটার প্রেস্টনের উপযুক্ত বিচারে জুলফিকার আলী ভুট্টো (…”lately Foreign Minister to Field Marshal Ayub Khan and currently leader of the Pakistan People’s Party, proponents of Islamic socialism’ and pandemonium. Mr. Bhutto’s campaign has been unique in Pakistan history: a bland, youthful panache and antique cunning. Socialism is a magic word to the slum-bound masses. Mr. Bhutto flitting from town to town by plane and promising everything from Pakistan’s own.” The Guardian, 7 December, 1970)

ভুট্টো ভালাে বক্তা। তেমনি ধূর্ত। তিনি জানেন, জনতাকে কিভাবে বশে আনতে হয়। তার ভারত-বিদ্বেষ সব স্তরের মানুষের কাছে ধারে কাটে যেমন শিক্ষিত সমাজে কাটে স্বদেশ রক্ষায় আণবিক বােমা তৈরির অঙ্গীকার । ভুট্টো সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কথা তার দুর্বোধ্য চরিত্র, তার চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটা কিছু স্পষ্ট হলেও তার পথ চলা সম্পর্কে কারাে কোনাে ধারণা নেই। তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতে “ক্ষমতালােভী এ রাজনীতিক (ভুট্টো) এমনই মতাদর্শহীন এক ব্যক্তি ক্ষমতা হাতে পেলে আইয়ুবের চেয়েও নিকৃষ্ট নব্য ফুয়েরার তথা একনায়কে পরিণত হতে পারে। এখন দেখার বিষয় জমিদার ভুট্টো, ইসলামী সমাজবাদের প্রবক্তা ভুট্টো কতটা কি করতে পারেন। (দ্য। গার্ডিয়ান, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০)  ভুট্টো সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়াই ছিল বাস্তব। সত্য। হয়তাে তাই রাজধানী ইসলামাবাদের মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিচারে “ভুট্টো এক পুরােপুরি দুশ্চরিত্র ব্যক্তিত্ব।” (“Ministers in Islamabad consider Bhutto a total reprobate. One former close friend thinks that his quest for power is so committed and so completely devoid of any real ideological belief that this man could be the new Furer-much worse than Ayub was.”-The Guardian, 7 December, 1971)। ভুট্টো সম্পর্কে তার বন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী যে মিথ্যা হয় নি পাকিস্তানের পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাস তা প্রমাণ করে। প্রসঙ্গত নওয়াব কাসুরি হত্যার ঘটনা কারাে কারাে মনে পড়বে।

অবশেষে নির্বাচন প্রায় শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে, হিসাব-নিকাশে কিছু এদিকওদিক করে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের একতরফা বিজয় ১৬০ আসন নিয়ে। এ বিজয় প্রত্যাশিত হলেও এতটা পশ্চিমা ভাষ্যকারদের হিসাবে ছিল না। তবে এটা ঠিক যে এ বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের, সেই সঙ্গে ৬-দফার এবং পশ্চিম পাকিস্তান বিরােধিতারও। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো প্রধানত পাঞ্জাবি সমর্থন এবং অংশত  সিন্ধি সমর্থন নিয়ে ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৩টি আসনে জয়ী— অনেকটা অপ্রত্যাশিত বিজয়। তার চেয়ে বড় কথা এ বিজয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্যা। এর কারণ এই দুই বিজয়ী নেতার বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি। হাতে সময় মাত্র ১২০ দিন। এর মধ্যেই সাংসদের অধিবেশনে বসতে হবে। আর পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্রের খসড়াও দাঁড় করাতে হবে? কতটা সম্ভব হবে এ কাজ- প্রশ্ন ‘টাইমূস’ পত্রিকার (৯ ডিসেম্বর, ১৯৭০)। পাকিস্তানের এ নির্বাচন, নির্বাচনের ফলাফল বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি, সমস্যা ইত্যাদি ঘিরে পশ্চিমা ভাষ্যকারদের সন্দেহ সংশয় বরাবরই ছিল। অর্থাৎ ছিল। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগে থেকেই। নির্বাচনী প্রচার, বক্তৃতা, বিবৃতি ইত্যাদি থেকেই তাদের ঐ ধারণার জন্ম। সামান্য কিছু মতভেদ সত্ত্বেও প্রায় প্রত্যেকে একই সুরে কথা বলেছেন, লিখেছেন তাদের প্রতিবেদন। সেই ধারায় নির্বাচনের ঠিক পরদিনই ‘টাইমস’ পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের নির্বাচনে জয়ী দুই নেতার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করে বিশেষ মন্তব্যসহ রাওয়ালপিন্ডি থেকে লেখেন ; এই দুই মুকুটহীন রাজার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য-বৈষম্য তাদের দুই দূর-ভূখণ্ড থেকেও অনেক দূরত্বব্যঞ্জক।’

সংবাদদাতার বিচারে “মি, ভুট্টো ঘােরতর ভারত-বিরােধী এবং ভারতের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে বিশ্বাসী (মূলত গােটা কাশ্মিরের অধিকার অর্জনের জন্যই তার এ ভূমিকা— লেখক)। সেই সঙ্গে তিনি মার্কিন-বিরােধীও (এ মূল্যায়ন কতটা সঠিক ভেবে দেখার মতাে লেখক)। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলার বিশ্বাসে ভুট্টো আন্তরিক। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ভুট্টো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে। ক্ষমতায় গেলে দেশে ইসলামী সমাজতন্ত্র কায়েমের কথাও তিনি বলে থাকেন। অথচ জমিদার পরিবারের সন্তান ভুট্টো পুরােপুরি পশ্চিমি কেতার মানুষ। তার শিক্ষাও পশ্চিমে। কাশ্মির ইস্যু তার বরাবর শিরঃপীড়ার কারণ।’  অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সন্তান। রাজনীতিই তার জীবন। বঙ্গীয় রাজনীতির টালমাটাল দিনগুলােতে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় । রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় তার জেলে কেটেছে। বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্যও তাকে জেলে যেতে হয়েছে। মূলত পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থক শেখ মুজিব দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় বিশ্বাসী। আবার পাকিস্তানকে সিয়াটো-সেন্টো জোট বন্ধন থেকে সরিয়ে আনার নীতিতেও বিশ্বাসী (৯.১২.৭০)। | ‘টাইমস’ সংবাদদাতা-ভাষ্যকারের উল্লিখিত বিশ্লেষণে যা অনুক্ত তা হলাে আইনজীবী-রাজনীতিক ভুট্টো পশ্চিমা কেতায় শিক্ষিত হয়েও গণতন্ত্রের নীতি-নৈতিকতায় আস্থাহীন যা তার কাজকর্মে কথাবার্তায় পরিস্ফুট। গণতন্ত্র তার রাজনৈতিক প্রয়ােজনের হাতিয়ার। আবার পশ্চিমা আধুনিকতা আত্তীকরণ সত্ত্বেও বা আচার-আচরণে পুরােপুরি পশ্চিমা হয়েও তিনি জিন্নাহর মতােই প্রয়ােজনে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করায় উৎসাহী (আসলে ক্ষমতার জন্য যে কোনাে কিছুই তার হাতিয়ার হতে পারে)। তাই জমিদার ভুট্টো, পশ্চিমা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ভুট্টো রাজনীতিতে ইসলামী  সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা। আসলে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙক্ষার সঙ্গে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে তার ব্যক্তিত্ব-বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলেছে। নব্য রাজনৈতিক নেতা ভুট্টো এ লক্ষ্যেই তার শিক্ষা, বুদ্ধি, মেধা, বাগ্মিতা সবকিছুই নির্ধিধায় ব্যবহার করে থাকেন, করেন সর্বোপরি আইনি চাতুর্য।

অন্যদিকে বাঙালি মধ্যবিত্ত-সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান এর ঠিক বিপরীত। তার রাজনৈতিক উত্তরণ অভিজ্ঞতার পায়ে পায়ে হেঁটে। সে চলা কখনােই মসৃণ ছিল না। ভুট্টোর মতাে তিনি হঠাৎ রাজনীতিক নন। যদিও জিন্নাহ সাহেবের প্রচারিত দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু তবু অভিজ্ঞতা এক সময় তাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসে পৌঁছে দিয়েছে। তেমনি মার্কিনি গণতন্ত্রের অনুরাগী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য হয়েও এক পর্যায়ে ঐ পথ থেকে সরে এসে তিনি সিয়াটো-সেন্টো সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পেরেছেন। এক কথায় নেহেরু-সুকার্নো-নাসের প্রমুখের নির্ভেটি অবস্থানের কাছাকাছি তার অবস্থান।  তবে পূর্ববঙ্গের প্রতি পাকিস্তানি রাজনীতির বৈষম্যমূলক আচরণই তার রাজনৈতিক রাজনৈতিক শক্তি। তার রাজনৈতিক অস্তিত্বের মূল পুঁজি পূর্ববঙ্গের আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি (তার ভাষায় ‘সােনার বাংলা’র) আকাক্ষায় উদ্ভাবিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন তথা ৬দফা। তাই এখানে ছাড় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, যেমন নীতিগত দিকে থেকে তেমনি বাস্তব প্রয়ােজনের ক্ষেত্রে। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির বিচার-বিবেচনায় এদিকটা বুঝে দেখা জরুরি। মিল সত্ত্বেও এরা দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। যেমন ব্যক্তিত্ব-বৈশিষ্ট্যে তেমনি রাজনৈতিক মতাদর্শে ও তৎপরতায়। ভুট্টোর রাজনৈতিক জেদ যেখানে চাতুর্যে পরিস্ফুট, মুজিবের জেদ সেখানে আবেগে ধৃত। ভুট্টোর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ তার শক্তিশালী। কেন্দ্রের ধারণার মতােই প্রান্তিক জাতিসত্তা অস্বীকার করে, অন্যদিকে মুজিবের জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানের প্রাদেশিক জাতিসত্তাগুলাের অস্তিত্ব স্বীকার করে তাদের সমাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তিতে। মুজিব যেখানে অবিশেষিত সমাজতন্ত্রের প্রয়ােজন মেনে নেন জাতীয়তাবাদের সঙ্গী হিসাবে, ভুট্টো সেখানে বলেন ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা। স্বভাবতই বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই দুই রাজনৈতিক নেতার পক্ষে রাজনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সমঝােতার সুরে কথা বলা খুবই দুরূহ, বলা চলে। প্রায় অসম্ভবই।

এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্কা তাহলে মীমাংসা বা সমঝে, তার কোনাে পথই খােলা থাকে না। সাধারণ নির্বাচনে প্রকাশিত ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থাটা তেমনই হয়ে দাঁড়ায়। উভয়ে নিজ নিজ যুক্তিতে ভর করে দৃঢ়পায়ে যার যার স্বতন্ত্র অবস্থানে দাড়িয়ে থাকেন। সেখান থেকে সরে আসার কোনাে সম্ভাবনাই দেখা যায় না। তাই তৈরি হয় এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা। প্রকৃতপক্ষে অচলাবস্থার অবসান ঘটানাে প্রেডিডেন্ট ইয়াহিয়ার সদিচ্ছাতেই সম্ভব ছিল, যে-সদিচ্ছা নিয়ে তিনি দেশে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও কারাে কারাে মতে প্রেসিডেন্টের এ পদক্ষেপের পেছনে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোপন উদ্দেশ্য। নিহিত ছিল, তবু অস্বীকারের উপায় নেই যে তার পূর্বসূরির জুতােয় পা গলিয়ে অন্তত আরাে বছর কয় রাজত্ব করা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না, বিশেষ করে যেখানে উগ্রপন্থী জেনারেলরা এ বিষয়ে একপা এগিয়ে ছিলেন।  ঐ সদিচ্ছা নিয়েই তার পক্ষে সম্ভব ছিল নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নীতিসম্মত অবস্থান। নিয়ে দুই প্রতিপক্ষকে সমঝােতার অবস্থানে টেনে আনা। সে রাজনৈতিক শক্তি ও সামরিক শক্তি পদাধিকার বলে তার ছিল। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া বা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সে সদিচ্ছার পরিচয় দেন নি বা দিতে পারেন নি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ইত্যাদি প্রশ্নে । শাসক হিসাবে নিরক্ষরেখায় অবস্থান ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। মনে হয় ভেবে-চিন্তে বা হিসাবনিকাশ করে বা বিশেষ কোনাে কারণে কথিত সমস্যাটিকে তিনি জটিল করেছেন, সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। পরবর্তী ঘটনাবলী তা প্রমাণ করে।  নির্বাচনের ফলাফল তাই দেশ ও দশের জন্য আকাক্ষিত শুভ পরিণামের পথ ধরতে পারে নি। বরং শাসনক্ষমতার প্রশ্ন নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরােধ-বিরূপতাই বড় হয়ে উঠেছে। মানুষের আকাক্ষা সেই চাপে ক্রমে পিছিয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে পশ্চিমা ভাষ্যকারদের হিসাব-নিকাশ, ব্যাখ্যা-বিচার অনেকটাই সত্যে পরিণত হয়েছে। আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সুতাে টানাটানির অবস্থা দেখে মানুষের মনে হয়েছে : ‘এ কী দুর্যোগের আভাস-ইঙ্গিত!’ তবে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে বেশি দেরি হয় নি সামরিক স্বার্থের কল্যাণে। 

সূত্র : একাত্তরে পাকবর্বরতার সংবাদভাষ্য – আহমদ রফিক