তেপ্পান্নর শহীদ দিবস ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী
মিছিলে-সমাবেশে অবিস্মরণীয় প্রথম শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির সব আবেগ এবার সংহত হয়ে ঝরে পড়ে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের মধ্য দিয়ে, শপথে ও স্লোগানে। প্রথম শহীদ দিবস পালন বলেই আবেগের এতটা প্রাধান্য। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আতাউর রহমান খান দিনটিকে শহীদ দিবস’ হিসেবে যথাযােগ্য মর্যাদায় পালনের আহ্বান জানান। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজে শহীদ দিবস পালনের জন্য বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এই প্রথম শহীদ দিবস পালিত হতে যাচ্ছে, অথচ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নেই। মেডিকেল কলেজের রাজনৈতিক ছাত্ররা মিলে বিলুপ্ত স্মৃতিস্তম্ভের স্থানটিতে কালােকাপড় আর লালকাগজ দিয়ে তৈরি করেন এক প্রতীকী শহীদ মিনার। হুবহু প্রথম মিনারের প্রতিকৃতি। তেমনি একটি প্রতীকী মিনার গড়ে ওঠে কার্জন হল প্রাঙ্গণে। ঢাকা কলেজের সংগ্রামী ছাত্ররাও চেষ্টা করেছিলেন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে; কিন্তু কর্তৃপক্ষের বাধার মুখে কাজ সম্পূর্ণ হয় নি। এ সম্পর্কে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন : ইডেন কলেজের ছাত্রীরা এবং ঢাকা কলেজের ছাত্ররা মিলে ঠিক করলাে যে, তারা কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার গড়বে। …ঢাকা কলেজের ছাত্র ইকবাল। আনসারী খান, আতিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার তৈরি হতে থাকে। সেখানে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষা মিসেস ফজিলাতুননেসা, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম। এবং উর্দুর অধ্যাপক আহসান আহমদ আস্ক গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধা দেন। …ছাত্ররা শহীদ মিনার সম্পূর্ণ করতে পারেনি, তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। …সন্ধ্যায় ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে যে অনুষ্ঠান হয় সেখানেই প্রথম “আমার সােনার বাংলা’ গানটি গাওয়া হয়। আবদুল লতিফের সুরে আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি ঐ অনুষ্ঠানে প্রথম গাওয়া হয়। এই ঘটনার পর আতিকুল ইসলাম, এনাম আহমদ চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান প্রমুখ প্রায় ১০ জনকে দু’বছরের জন্য রাসটিকেট করে দেওয়া হয়। ২০১ একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উপলক্ষে সেবারই প্রথম প্রভাতফেরি, আজিমপুর গােরস্তানে সুর্যহীন ভােরে খালি পায়ে শহীদদের কবর জিয়ারত ও ফুল দেয়ার রেওয়াজ শুরু হয়।
মেডিকেল কলেজ হােস্টেল, ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল থেকে প্রভাতফেরির শােক-মিছিল ছিল ঢাকার জন্য নতুন এক দৃশ্য। আজিমপুর কলােনির বাসিন্দারা এমনকি মহিলাদেরও অনেকে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের চোখে যেমন বিস্ময় তেমনি ভােরের শিশিরের মতাে অশ্রুকণা। পরে ছাত্রছাত্রী ও জনসাধারণের খণ্ড মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। সেখান থেকে ছাত্র-জনতার মিছিল মেডিকেল হােস্টেলে শহীদ মিনারের সামনে কিছুক্ষণ শ্রদ্ধা নিবেদন করে পথে নেমে আসে। এরপর মিছিল মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে হাইকোর্ট-কার্জন হল পেরিয়ে ইডেন বিল্ডিং বায়ে রেখে নওয়াবপুর, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, চক, জেলগেট, বংশাল, মাহুতটুলী হয়ে আরমানিটোলা ময়দানে পৌঁছায়। | সে বছর মিছিলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন ঢাকা শহরের বাসিন্দা বিভিন্ন বয়সী মানুষ। ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে তাদের বুকে বা বাহুতে আটকে দেয়া হয় কালাে ফিতা, কালাে ব্যাজ। বাড়িতে বাড়িতে উড়ছিল কালাে পতাকা। কোথাও কোথাও মেয়েরা বাড়ির ছাদ থেকে মিছিলের ওপর ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। প্রতিটি বাড়ির ছাদে দাঁড়ানাে নানা বয়সী মেয়েরা। বাহান্নর ৫ মার্চের হরতাল বানচাল করতে সরকার ও নবাববাড়ির যৌথ ষড়যন্ত্র এবার ঢাকাই বাসিন্দারা মনে রাখেন নি। এবারের মিছিল ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত যােগদানের ফলে ক্রমে বিশালকায় হয়ে উঠেছে। তা সত্ত্বেও মিছিল ছিল খুবই সুশৃঙ্খল । এ দৃশ্য যে না দেখেছে তাকে ঠিক বােঝানাে যাবে না। মিছিলের সামনে ছিলেন আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুস সামাদ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিগণ। স্বেচ্ছাসেবকগণ মিছিলের শৃঙ্খলার দিকে নজর রাখছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের এম.এ. ওয়াদুদ পাটোয়ারি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাকিস্তান অ্যামবুলেন্স কোর-এর গাড়িতে অন্যান্যের। সাথে বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন মেডিকেল ছাত্র সিরাজুল ইসলাম আবদুল মজিদ। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও অ্যামবুলেন্স গাড়ি মিছিলের সঙ্গে এবং পরে আরমানিটোলা ময়দানের বিশালকায় সমাবেশেও উপস্থিত ছিল। এত বড় মিছিল, কিন্তু সুশৃঙ্খল শান্তিপূর্ণ মিছিল এর আগে বড় একটা দেখা যায় নি।
সর্বদলীয় পরিষদের আহবায়ক আতাউর রহমান খানের সােৱাৰীঘাটের বাসায়। কয়েকদিন আগেই এই উপলক্ষে স্থাপিত অফিসে তখন সর্বক্ষণ ছাত্র-যুব কর্মীদের। আনাগোনা। হলগুলো থেকে তাে বটেই, মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল স্কুল, জগন্নাথ কলেজ থেকেও ছাত্র প্রতিনিধিদের সেখানে অৰিৱম আনাগােনা, বৈঠকে যােগদান, কাজের দায়িত্ব গ্রহণ বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছিল। শহরের স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, বাজাৱঘাট, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাস্তার যানবাহন সব বন্ধ। এমনকি সেদিন বন্ধ ছিল ব্যাঙ্ক, রেল, সিনেমা হল ইত্যাদি। সরকারি অফিস আদালত প্রায় কর্মচারী-শূন্য। সেখাৱেৱ শহীদ দিবসের দিনটি ছিল বাহান্নর বাইশে ফেব্রুয়ারির মতাে, তবে শােকার্ত ও প্রশান্ত। | বিকেলে আরমানিটোলা ময়দানের বিশাল জনসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন | আতাউর রহমান খান। অনেকেরই ধারণা, এৰাৱ সত্যই এই সমাবেশে প্রায় লক্ষ লােকের উপস্থিতির অর্থ ছিল ভাষা সম্পর্কিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। মিছিলের সেই স্লোগান রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর। হােক’, ‘গণপরিষদ ভেঙে দাও’, ‘জালেমশাহী ধ্বংস হােক’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ ‘লীগশাহীর দালাল মর্নিং নিউজ-জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও ময়দানের জনসমুদ্র থেকেও ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ময়দানের আশপাশে সব রাস্তা, অলিগলি জনাকীর্ণ; এমনকি চারপাশের বাড়ির ছাদও লােকে ভর্তি। এর অর্থ, শহীদ স্মৃতি তখনও মানুষের মনে অম্লান। সেই ঐতিহাসিক সভায় বক্তারা যখন লীগশাহীর জুলুমের বিরুদ্ধে আগুন ঝরাচ্ছেন তখন কারাগারে বন্দি মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, মওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, ওসমান আলী, অলি আহাদ, আবদুল মতিনসহ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যান্য রাজবন্দি শুধু যে মুক্তির অপেক্ষায় ছিলেন তা নয়, তারা একদিনের জন্য প্রতিবাদী অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং একদিনের খােরাকির টাকা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা তহবিলে জমা দিতে জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ময়দানের সমাবেশে বক্তৃতা করেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী। গােলাম মাহবুব, আবদুস সামাদ, মাহমুদ আলী, সৈয়দ আবদুর রহিম প্রমুখ। সভায় গৃহীত প্রস্তাবের মধ্যে ছিল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি, পুলিশী সন্ত্রাসের নিন্দা, সকল রাজবন্দির অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি, নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য কালাকানুন প্রত্যাহার এবং বিশেষভাবে অসুজননেতা। মওলানা ভাসানীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বেগ। তেইশে ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’-এ শহীদ দিবস পালনের পূর্ণ ও বিন্ধারিত বিৰৱণ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার মতে ঢাকাস্থ বিদেশী দূতাবাস, বিশেষ। করে ইদ-মার্কিন কূটনৈতিক বিভাগের লােকদের বিশেষ তৎপরতা ছিল লক্ষ্য।
করার মতো। করাচির ফরাসি ও মার্কিন দূতাবাস থেকে বিশেষ প্রতিনিধি ঢাকায় পাঠানাে হয়েছিল। তারা এসেছিলেন শহীদ দিবস সম্পর্কে সরেজমিনে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে, এৰ মৌল অভিঘাত বিচার করে দেখতে। একুশের প্রভাৰ : সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় বাঁকফেরা। ভিন্ন ধাৱাৰ উপস্থিতি সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়, চল্লিশের দশক প্রগতিবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে নিশ্চিতই এক দামাল দশক। কবিতা গল্প উপন্যাস। নাটক গান ইত্যাদি নানা শাখায় সৃষ্টিকর্ম ও পরিবেশন-শিষ্টের যে উজ্জ্বলতা তা ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরােধিত্য ও সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিবেদিত। ঐতিহাসিক কারণে এ প্রবল স্রোতে মুসলমান মেধাজীবীর অংশগ্রহণ ছিল সীমিত সংখ্যায়। তখনকার স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতি ও পাকিস্তান আন্দোলনের প্রবলতা মুসলমান শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বৃহত্তর অংশকে সাহিত্য সংস্কৃতি-চর্চার ক্ষেত্রেও ঐ ধাৱাতেই টেনে নিয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই জন্ম নিয়েছে রেনেসা সােসাইটি’ বা ‘পাকিস্তান সাহিত্য পরিষদের মত পাকিস্তানবাদী সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার সংগঠন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সাতচল্লিশ আগস্টে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে পাকিস্তানবাদীদের অতি-উৎসাহে জোয়ারি আবেগ সৃষ্টি করেছিল। চল্লিশের প্রগতিবাদীদের সৃষ্টিকর্ম স্তব্ধ না হলেও তাদের ঠিকই কিছুটা পিছু হটতে হয়েছিল। একুশের আগে তাদের এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল, নবীনদের সাহস ও উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। এক কথায় একুশের ভাষা আন্দোলন তাৎক্ষণিকভাবেই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার বাক ফেরায় সাহায্য করে। সে বাকফেরা ছিল উদৱগণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিবাদী চরিত্রের। এ চরিত্রে চল্লিশের পূর্ব চেতনার আভাস অনেকাংশেই দেখা গেছে। স্বভাবতই পাকিস্তানবাদী সাহিত্যচেতনার আবেগ ক্রমশ থিতিয়ে আসতে থাকে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে সরকারি দমননীতির চাপ সত্ত্বেও একুশের আগলভাঙ্গা জোয়ার সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চায় নয়া পলির সঞ্চার ঘটায়। মার্চে আন্দোলন শেষ হতে না হতে ২৭ এপ্রিল ঢাকায় নয়া রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে প্রাদেশিক ভিত্তিতে রাষ্ট্রভাষা সম্মেলনের অনুষ্ঠান ঐ নয়া চেতনার ব্যাপক বিস্তার ঘটায়। এর সাংস্কৃতিক প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালেরই আগস্ট মাসে কুমিল্লা শহরে অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে। ভাষা থেকে সাহিত্য বিষয়ক আলােচনা, নাটক ও নৃত্যের অনুষ্ঠান, রবীন্দ্র-নজরুল-ইকবালের গান, কবিয়াল রমেশ শীল ও ফণী বড়য়ায় কবিগানে (যুদ্ধ ও শান্তি) এবং লােকসঙ্গীত ও আঞ্চলিক গানের রাতভর আসরে যে সাংস্কৃতিক চেতনার প্রকাশ তা ছিল মূলত প্রতিবাদী ও প্রগতিবাদী, সেই সঙ্গে অসাশ্ৰদায়িক জাতীয়তাবাদী। | একই বছর থেকে আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতিচর্চায়ও সাহসী পালাবদলের সূচনা। এর প্রকাশ ঘটে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তকে নিয়ে আয়ােজিত একাধিক অনুষ্ঠানে। ঘটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-ভিত্তিক উদার যুক্তিবাদী আলােচনায়, সর্বোপরি বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন অনুষ্ঠানে। সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ধারাবাহিকতা নিয়ে ১৯৫৪ সালে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত হয় শ্রোতা-দর্শক উপচে-পড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলন। এ সম্মেলনেও যথারীতি সবিশেষ হয়ে ওঠে মানবিক চেতনার মহৎ উদ্ভাস, প্রগতিবাদী সমাজচেতনার প্রকাশ এবং তা যেমন শিল্পীদের পরিবেশনে, সাহিত্যিকদের আলােচনায় তেমনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মত ধীমানদের ভাষণে ও জননেতা ভাসানী ও ফজলুল হক সাহেবের বক্তব্যে। একুশের প্রভাবে ১৯৫৩ সালের শহীদ দিবস উপলক্ষে পত্রপত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্রে ও একুশে সংকলনে যেসব কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি প্রকাশ পায় তা সর্বাংশে ছিল পূর্বোক্ত চরিত্রের। একুশের চেতনা ও একুশের আবেগ ধারণ করে এগুলাে পরবর্তী পর্যায়ে চিহ্নিত হয়ে ওঠে একুশে সাহিত্য’ হিসেবে। বছরের পর বছর শহীদ দিবস উপলক্ষে তরুণদের চেষ্টায় স্মরণিকা প্রকাশ এক ধরনের ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এগুলােতে ছিল প্রতিবাদী ও প্রগতিবাদী কবিতার প্রাধান্য।
একুশে উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম স্মরণিকা সম্ভবত ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাসের চটি সংকলন ‘শহীদের স্মরণে’, প্রকাশ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে। শুরুতে মুদ্রিত হয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই’-এর দুই চরণ এবং পরে নজরুলের নির্বাচিত কবিতার অংশ বিশেষ উদ্ধৃতি : ‘বন্দী থাকা হীন অপমান হাঁকবে যে তরুণ’ ইত্যাদি। এতেই ছাপা হয় আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারী।’ মনে হয় তখনকার অবস্থা বিবেচনায় কবির নাম মুদ্রিত হয় নি। এমন কি প্রকাশকের নামও ছাপা হয় নি। অবশ্য এক মাস পর প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন গ্রন্থে এ ধরনের লুকোছাপা কমই ছিল। ঐতিহাসিক এ সংকলনের সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান, প্রকাশনায় যুবলীগ নেতা মােহাম্মদ সুলতানের পুঁথিপত্র, প্রচ্ছদ ও স্কেচ আঁকায়। যথাক্রমে আমিনুল ইসলাম ও মূর্তজা বশীর। লেখকদের নামও যথারীতি ছাপা হয়েছে, যদিও সম্পাদকীয় ছিল নামহীন। কবিতা-প্রধান এ সংকলন গ্রন্থটি যাদের রচনায় ঋদ্ধ হয়ে ওঠে তাদের প্রায় সকলেই তখন ছাত্র। প্রতিবাদী এ প্রকাশনার রাজনৈতিক চরিত্র ছিল ভাষিক জাতীয়তার সুর নিয়ে প্রগতিবাদী। স্বভাবতই সংকলনটিকে সরকার নিষিদ্ধ ঘােষণা করে, পুলিশ প্রকাশকের আস্তানায় তল্লাশি চালায়। | একুশের চেতনা সে সময় সর্বাধিক প্রকাশ পেয়েছিল কবিতায়, সম্ভবত এর পরেও সাহিত্য সৃষ্টির নয়া ধারায়। শিমুল পলাশি কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম প্রতীক কবিতায় নিয়মিত ব্যবহারের বিষয় হয়ে ওঠে, মূলত প্রতিবাদী প্রকরণ হিসেবে। তারুণ্যের, যৌবনের রােমান্টিকতাও তাতে যুক্ত হয়। একুশের প্রথম কবিতা মাহবুবউল।
আলম চৌধুরীর ‘কাদতে আসিনি ফাসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচনা বাহান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, রাত ৭টায়। এ কবিতাটিও নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয় এবং কবিকে গ্রেফতার এড়াতে সাময়িক আত্মগােপন করতে হয়। এরপরই লেখা হয় (কবির ভাষ্যমতে) ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ মিনার ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনার কবিতা ‘স্মৃতির মিনার। আলাউদ্দিন আল আজাদের এ কবিতা ছাপা হয় ১৯৫৩ সালে হাসানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে। ঐ সংকলনে আরাে ছাপা হয় শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ফজলে লােহানী, আনিস চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গণি হাজারী, জামালুদ্দিন প্রমুখের কবিতা ।। প্রাকরণিক ভিন্নতা ছাড়া কবিতাগুলাের প্রতিবাদী চরিত্রে কোনাে হেরফের ছিল না। একই বছর রচিত “ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য’ গ্রন্থটির অন্যতম লেখক আহমদ রফিকের একুশে বিষয়ক কবিতা জেগে আছে ব্যথার স্নায়ুতে’ এবং চিত্রশিল্পী মূর্তজা বশীরের ছােট্ট, কিন্তু অনুভূতিঋদ্ধ একটি একুশের কবিতা।
কবিতার পাশাপাশি একুশের গানও ছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। একুশের প্রথম গান, বলতে গেলে প্রভাতফেরির গান বােধ হয় ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল/ ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে।’ রচয়িতা ন্যাপনেতা মহিউদ্দীন আহমদের বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার (তখন সরকারি কর্মকর্তা) মােশারেফউদ্দিন আহমেদ। তেপ্পান্ন সনে প্রথম শহীদ দিবসের প্রভাতফেরিতে এ গান যে গাওয়া হয় অভিজ্ঞতা (আহমদ রফিকের) তাই বলে। তবে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে গাজীউল হকের ‘ভুলবােনা, ভুলবােনা’ গানটি শােনা গেছে। প্রথম গানটি সম্পর্কে গীতিকার-সুরকার মােমিনুল হকের বক্তব্যও ভিন্ন নয়। এরপর অবশ্য আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রধানত আলতাফ মাহমুদের দেয়া সুরের কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিয়মিত গাওয়া হতে থাকে। হাসানের সংকলনে (১৯৫৩) ছাপা তােফাজ্জল হােসেনের ‘রক্তশপথে আমরা আজিকে তােমাদের স্মরণ করি/ একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিও কিন্তু মাঝে মধ্যে গাওয়া হয়েছে। | প্রথম শহীদ দিবস থেকে প্রতি বছর একুশের স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানত ছাত্রসংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং স্কুল-কলেজ-ছাত্রাবাসের পক্ষ থেকে। এ উন্মাদনা তরুণদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলেছে, সৃষ্টি করেছে একুশে সাহিত্যের ঐতিহ্য। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত সেখানকার গ্রন্থাগারের সাবেক উপপরিচালক আমিরুল মােমেনীন-এর ‘একুশের সংকলন : গ্রন্থপঞ্জির বিশালায়তন থেকে একুশে সংকলনের ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতা অনুমান করা। যায়। বুঝতে পারা যায় আমাদের সাহিত্য সৃষ্টির চরিত্রবদল ও বাঁকফেরায় এবং বিশেষভাবে আধুনিক চেতনার প্রকাশে একুশের গুণগত প্রভাবের ছাপ। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারির পর উল্লেখযােগ্য সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ডি.এ. রশীদ ও মহিউদ্দীন আহমদ সম্পাদিত এবং প্রথম শহীদ মিনারের ছবি সংবলিত এ সংকলনে ছিল তােফাজ্জল হােসেনের নতুন লেখা গান (‘একুশের গান’)। এ গান ১৯৫৬ সালে শহীদ। দিবসের প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়। ঐ সংকলনে আরাে অনেকের সঙ্গে জহির। রায়হানের গল্প (একুশের গল্প’) ছাপা হয়েছিল।
একুশের সংকলনগুলােতে কবিতা ও আবেগের তাৎক্ষণিক প্রাধান্য থাকলেও। সাহিত্যের একাধিক শাখায় একুশের প্রভাব ছিল ধীরস্থির গভীরমূলীয়। বিশেষ করে কথাসাহিত্যে ও গদ্যভাষায় আধুনিকতাসম্পন্ন এ প্রভাব সাহিত্যকে জীবনমুখী হতেও সাহায্য করেছিল। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ (১৯৫৩) নাটকের পর দীর্ঘদিন এ ধারায় উল্লেখযােগ্য সৃষ্টির প্রকাশ না ঘটলেও সত্তরের দশকে পৌঁছে নাটকের যে মহৎ পালাবদল তার প্রেরণা তাে একুশে। প্রবন্ধ বা গবেষণামূলক সাহিত্যের কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। একুশে প্রভাবিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সম্বল করে একুশে-উত্তর আমাদের সাহিত্য যে নতুন পথের যাত্রিক হয়ে ওঠে। সংস্কৃতিচর্চার নানা ক্ষেত্রেও সে সুপ্রভাব আকর্ষণীয় শিল্পরূপের জন্ম দেয়। একুশেপরবর্তী সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনগুলােতে তেমন প্রমাণ মেলে। তেপ্পান্ন সাল। থেকে শুটিকয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক সেই যে একুশের সাহিত্যপাতার প্রকাশ ঘটায় পরবর্তীকালে তা গুণে ও আয়তনে ক্রমেই সমৃদ্ধ রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সে ধারা এখনাে অব্যাহত। এ সময়ের আরাে কিছু ঘটনা আগেকার মতাে ১৯৫৩ সালেও যথারীতি ১১ মার্চ পালিত হয়; কিন্তু একুশের আবির্ভাবের পর আটচল্লিশের আকর্ষণ স্বাভাবিক নিয়মেই কমে আসে। এ সময়ের উল্লেখযােগ্য ঘটনা বন্দিমুক্তি আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং বিশ্ববিদ্যালয় কালাকানুনবিরােধী আন্দোলন। এ সময় পাকিস্তানের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উত্তরবঙ্গ সফরে এলে তাকে কালাে পতাকা দেখানাে হয়। তিনি ২ মার্চ বগুড়ায় এসে মন্তব্য করেন যে, যাহারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে চায়, তাহারাই রাষ্ট্রের শত্রু।’ তার এই উদ্ধত অর্বাচীন মন্তব্যে যথেষ্ট উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং বিশাল এক জনতা তাকে প্রতিবাদী ধ্বনিসহ কালাে পতাকা প্রদর্শন করে। এ সময়ে পাকিস্তানি রাজনীতিতে সংঘটিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলাে, ১৮ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনকে সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বরখাস্ত করে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মােহাম্মদ। আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ। এ বছরই মৌলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, খয়রাত হােসেন, মমতাজ বেগম, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, অধ্যাপক পুলিন দে প্রমুখ অনেকে জেল থেকে ছাড়া পান।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক