তেইশে ফেব্রুয়ারি অব্যাহত গণবিক্ষোভ ও নানামুখী প্রতিক্রিয়া
প্রতিবাদী তৎপরতার চালচিত্র তেইশে ফেব্রুয়ারি শনিবার শহর ঢাকা আগের দিনের বেঁধে দেয়া পথ ধরেই চলতে থাকে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী আগের মতােই টহল দিতে থাকে। সামরিক উপস্থিতি এবং ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাজপথে জনস্রোতের ঢল নামে। মিছিলে স্লোগানে স্পন্দিত ও মুখরিত হয়ে ওঠে শহর ঢাকা। এই দিনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাকা শহরে হরতাল পালিত হয়। দৈনিক আজাদ’এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুলিশ নাজিরাবাজার পশু হাসপাতালের সামনে সমবেত জনতার ওপর লাঠিচালনা করে। ফলে চার ব্যক্তি আহত হন। এদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকা রেলস্টেশনের কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে অধিকাংশ ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। সবসুদ্ধ মাত্র চারটি আপ-ডাউন ট্রেন চলে। মেডিকেল হােস্টেলের মাইক ছিনিয়ে নেয়ার পর সেখানকার কন্ট্রোল রুমের তৎপরতা কমে যাওয়ার পটভূমিতে সলিমুল্লাহ হলের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব। বহুগুণ বেড়ে যায়। ফজলুল হক হলেও কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয় এবং মাইকে প্রচার কাজ চলে। কিন্তু সলিমুল্লাহ হলের প্রচারই প্রধানত জোরালাে হয়ে ওঠে। তেইশে ফেব্রুয়ারি হরতাল এবং অন্যান্য ঘােষণায় এরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আর সলিমুল্লাহ হলের কন্ট্রোল রুমের কৃতিত্ব অর্জন মূলত ইকরামুল আমিনের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি সলিমুল্লাহ হল ঘেরাও এবং তল্লাশির পূর্ব পর্যন্ত নিষ্ঠাভরে তার কাজ চালিয়ে গেছেন আমিন। তেইশে ফেব্রুয়ারি বেলা প্রায় দুইটায় সলিমুল্লাহ হল প্রাঙ্গণে গায়েবি জানাজা অনুষ্ঠিত হয় । অজানা-অচেনা শহীদদের উদ্দেশে অনুষ্ঠিত এই জানাজায় আজাদ’-এর হিসেব মতে প্রায় চার হাজার লােক সমবেত হন।
বিকেলে এ,কে, ফজলুল হক সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রদের সাথে মিলিত হয়ে একাত্মতা ঘােষণা করেন। কথাটা আমরা আগেও বলেছি যে, সলিমুল্লাহ হল এক পর্যায়ে ‘একলা চলার নীতি গ্রহণ করেছিল, যা আন্দোলনের শক্তি খর্ব করেছে বলা যায়।। তেইশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন চরিত্র বিচার কোন দিক থেকেই বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকে ভিন্ন ছিল না। সেই সাধারণ হরতালের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, রাজপথে মিছিলের দৃপ্ত পদযাত্রা এবং কালাে ব্যাজ ধারণ, ঘরে ঘরে কালাে পতাকা এবং সর্বোপরি শহরময় পুলিশ, ই.পি.আর ও সামরিক বাহিনীর অব্যাহত টহলের মধ্য দিয়ে শনিবারের এই দিনটিও অতিবাহিত হয়। এইদিন হরতালমিছিল ইত্যাদির বাইরে অন্য কোন কর্মসূচি গ্রহণ বা তা প্রচার করা হয় নি। অলি আহাদের বক্তব্য অনুযায়ী মেডিকেল হােস্টেলে অনুষ্ঠিত এক সভায় হরতাল অব্যাহত রাখার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এবং তা মেডিকেল হােস্টেল এবং হল দুটোর কন্ট্রোল রুমের মাইকে প্রচারিত হতে থাকে। এই আহ্বান শুধু ঢাকার জন্যই ছিল না, ছিল গােটা দেশের জন্য। কিন্তু যােগাযােগ স্থাপনের বিষয়টি ছিল | এই আন্দোলনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও বাধা। | ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষায়তনে ও ছাত্রাবাসে পুলিশী জুলুমের নিন্দা ও অন্যান্য দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে পৃথকভাবে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেমন ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, ঢাকা কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ইউনিয়ন, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ, তমব্দুন মজলিস ও ব্যাঙ্ক কর্মচারীবৃন্দ অনুরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করে। বণিক সমিতি শহীদদের প্রতি সমবেদনা জানায়। আন্দোলন অব্যাহত থাকা এবং সেখানে নতুন কোন কর্মসূচি দিতে না পারার প্রশ্নে এই রূঢ় সত্য স্বীকার করে নেয়া প্রয়ােজন যে আন্দোলনের হাল তখন বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে। চলমান কর্মসূচির ওপর নতুন কোন কিছুর সংযােজন সক্রিয় ছাত্র-যুব নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তাই আন্দোলন তার নিজস্ব গতিতে চলেছে এবং এক সময় তা স্তিমিত হয়ে এসেছে। দুঃখের বিষয় সঠিক তথ্যের বিকৃতি ও সত্যের অপলাপ ঘটিয়ে কেউ কেউ আজকাল এই আন্দোলন সম্পর্কিত কৃতিত্বের নিত্যনতুন দাবি পরিবেশন করে চলেছেন এবং এই প্রবণতা ইদানীং বেড়ে চলেছে।
প্রসঙ্গত একটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়ােজন যে, আন্দোলন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যােগাযােগের দুর্বলতা সত্ত্বেও, এরি মধ্যে অতি দ্রুতপায় দেশময়। স্ফুলিঙ্গপাত ঘটাতে ঘটাতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক্ষেত্রে বাইশের তরঙ্গভঙ্গের স্তরগত উচ্চতার ব্যাপ্তি ও প্রসাৱই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু সাংগঠনিক শক্তির সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব সেই ৰাতি যাত্রায় বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল। আর বাস্তব সত্য এই যে তেইশে এবং চব্বিশে ফেব্রুয়ারির পর। থেকে আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ কমে আসতে থাকে, যদিও ঢাকার বাইরে এই ব্যাপ্তি ও তীব্রতা তখনও অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু নেতৃত্ব তার নানামূখী দুর্বলতার জন্য । এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে পারে নি। ঢাকার বাইরে প্রধান শহরগুলােতে সরাসরি উপস্থিতির মাধ্যমে আন্দোলনের জন্য কেন্দ্র স্থাপন এবং সেখান থেকে উপস্থিত গণজাগরণের ঢেউ গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা নেতৃত্বের ছিল না, সম্ভবত সে ক্ষমতাও ছিল না। তা সত্ত্বেও মফস্বলের শহরে, গঞ্জে, গ্রামাঞ্চলে প্রতিবাদ সভা ও মিছিল ছিল এ সময়ের প্রাত্যহিক ঘটনা। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, জামালপুর, যশাের, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত মিছিল ও প্রতিবাদ সভার প্রধান বিষয়ই ছিল মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি; সেই সঙ্গে প্রশাসনের শাস্তিবিধান এবং ভাষা সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া । | ঢাকা শহরেও বিভিন্ন মহল্লায় সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং সভাশেষে পুলিশ-সেনাবাহিনী উপেক্ষা করে নির্ভয় মিছিলের পথযাত্রা। অফিসে-আদালতে উপস্থিতি ছিল অতি সামান্য, যার প্রধান অংশ অবাঙালি। রেল ধর্মঘট এই দিনের বিশেষ একটি ঘটনা। একুশের ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের অভিঘাতে মুসলিম লীগ সংগঠনের একাধিপত্যে ভাঙনের লক্ষণ দেখা দেয়ার কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাপক গণঅসন্তোষ ও গণআন্দোলনের মুখে এই প্রক্রিয়ার বিভাজন রেখা ক্রমেই বড় হতে থাকে। উল্লিখিত পদত্যাগগুলাের পর অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলাে তেইশে ফেব্রুয়ারি মৌলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের সংসদীয় দল থেকে পদত্যাগ।
তার পদত্যাগের যৌক্তিকতা দেখিয়ে জনাব তর্কবাগীশ যে বিবৃতি দেন তা অনেকাংশে একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিকেল হােস্টেল কন্ট্রোল রুমের মাইকে প্রদত্ত তার ভাষণ এবং পরবর্তীকালে আমাদের কাছে ‘টেপ সাক্ষাৎকারে প্রদত্ত বক্তব্যের অনুরূপ। তিনি বলেন : বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করিতে হইবে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এই সর্বাত্মক দাবির আওয়াজ তােলার অপরাধে নুরুল আমিন সরকার বিগত ২১শে ফেব্রুয়ারি হইতে রাজধানী ঢাকার বুকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর দ্বারা বেপরােয়াভাবে গুলিবর্ষণ করাইয়া শিশু, কিশাের, যুবক, প্রৌঢ় নির্বিশেষে যে হত্যাকাণ্ড চালাইয়াছেন সভ্যজগতের ইতিহাসে এইরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। আমার বিবেচনায় জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে এই সরকার গদিতে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে পারে না। সেই অধিকার আর তাহাদের নাই। এই সম্পর্কে পরিষদ ভবনে আমি যে প্রতিকার দাবি করিয়াছিলাম, সরকারপক্ষ তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই। কাজেই এই সরকারের সমর্থক সদস্য হিসাবে নিজেকে যুক্ত রাখিতে আমি আর ইক্ষুক নহি। ঢাকার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ পরিষদ দল হইতে অদ্য পদত্যাগ করিলাম।১৫৩ মৌলানা তর্কবাগীশের এই পদক্ষেপের ওপর আমরা বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করতে চেয়েছি এই জন্য যে, মুসলিম লীগের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ভাষার অধিকারের প্রশ্নে মুসলিম লীগ দলীয় রাজনীতিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে ওঠেন এবং নির্ভীক বিরােধিতার পথে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন; কিন্তু পরবর্তীকালে এই সুবাদে তাকে কোন রাজনৈতিক সুযােগ-সুবিধা নিতে দেখা যায় নি, সংসদীয় বিরােধী রাজনীতির যা প্রচলিত ধারা। এরপর অবশ্য একে একে অনেকেই লীগ রাজনীতির স্বৈরাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দলত্যাগ করেছিলেন; কিন্তু ঐ পথে যাত্রার সূচনা ঘটিয়েছিল কয়েকজন রাজনীতিকের সাহসী পদক্ষেপ। এখানেই তাদের গুরুত্ব।
অবাক হতে হয় দেখে যে মাত্র দুইদিনের আন্দোলন দৃঢ়মূল লীগশাহীর শিকড় মাটি থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে যে এই অল্প সময়ের মধ্যে লীগ শাসনের একাধিপত্যের খণ্ডাংশ থেকে জন্ম নেয় পরিষদে নতুন বিরােধী গ্রুপ, নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ। শামসুদ্দিন আহমদ ও আলী আহমদ চৌধুরী এই নব প্রতিষ্ঠিত দলের যথাক্রমে নেতা ও সহকারী নেতা নির্বাচিত হন। গণআন্দোলনের পটভূমিতে সংসদীয় রাজনীতির সুবিধা অর্জন সম্ভবত একটি সর্বকালদৃষ্ট বিষয়। আমাদের দেশে এমন সুবিধাবাদী ঘটনা রাজনীতির অঙ্গনে এতাবৎ বরাবরই ঘটেছে। এই প্রবণতা শ্রেণীস্বার্থের কারণে বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক উভয়ের মধ্যেই প্রবল। আন্দোলনের সাফল্য জনগণের রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে পরিচালনায় এদের আগ্রহ বরাবরই কম থাকে। সেই ঝোঁক এতকাল পর এখনও লক্ষ্য করা যায়। আন্দোলনের সুফল শুধু পূর্ববঙ্গেই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সংসদীয় রাজনীতিতেও কিছুটা প্রভাব রেখেছিল। ফলে সেখানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শাসনের বিরুদ্ধে বাম গণতন্ত্রীদের রাজনৈতিকভাবে সম্মিলিত হওয়ার মতাে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সম্পর্কে চব্বিশ ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এর প্রতিবেদন উদ্ধার করা গেল ; “মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, মানকী শরীফের পীর, পাঞ্জাব আহরার নেতা, সিন্ধুর হারি নেতাগণ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পীর এলাহি বকস, শেখ আবদুল মজিদ সিন্ধী ও জি,এম, সৈয়দসহ সম্মিলিত যুক্তফ্রন্ট করার সিদ্ধান্ত নেন। পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় এই রকম যুক্তফ্রন্ট গঠন করার প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। মােছলেম লীগকে এ সময়ে পরাজিত করিতে হইবে বলিয়া সম্মেলন দৃঢ়মত পােষণ করেন।’ পশ্চিম পাকিস্তানে না হলেও পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে (১৯৫৪) এই অসাধ্যসাধন সবাইকে হতবাক করে দেয়, মুসলিম লীগের নির্বাচনী ভরাডুবি এত অল্প সময়ে নিতান্তই অবিশ্বাস্য ছিল। বাহান্নর ভাষা বিষয়ক গণ আন্দোলনের সম্ভাব্য পরিণামে এইসব সম্ভাবনা দূরদর্শীদের অনেকেই আঁচ করতে। পেরেছিলেন।
একুশের আন্দোলন উপলক্ষে ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পরপর দুইদিন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। পত্রিকাগুলাে ছিল ‘ডন’, ইভনিং টাইমস’, ‘খাইবার মেইল ইত্যাদি। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইনসাফ’-এর সূত্রে জানা যায়, পুলিশী হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ‘ডন’-এ বিশেষ প্রাধান্য পায়। চব্বিশে ফেব্রুয়ারির ‘আজাদ সূত্রে জানতে পারা যায় কয়েকটি বাম সংগঠনের প্রতিক্রিয়া। তেইশে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সমাজতন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদকের বিবৃতিতে এবং করাচির গণতন্ত্রী ছাত্র ফেডারেশনের সভায় ঢাকার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং অবিলম্বে পুলিশী জুলুম সম্পর্কে তদন্তের দাবি জানানাে হয়। লাহােরে ছাত্রদের একাংশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে অনুকূল মনােভাবের আভাস পাওয়া যায়। | তেইশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের তৃতীয় দিনেও লাগাতার মিছিল-হরতালবিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। এরই মধ্যে সরকার পরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে তাদের কূটচালটি সম্পন্ন করেন।
এবার ছাত্র-যুব নেতৃত্ব আন্দোলনকে কোথায় কতদূর নিয়ে যাবেন তাই নিয়ে মনে হয় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। কারণ, পরবর্তী নতুন কোন পদক্ষেপ বা কর্মসূচি তাদের হাতে ছিল না। দ্বিধা, সংশয় ও সঙ্কটের মধ্য দিয়ে আন্দোলন যেন বহুধাবিভক্ত নেতৃত্বের কাছে কর্তব্যের এক ভারি দায় হয়ে দাঁড়ায়। সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ এই বিশ্লেষণে ক্ষুব্ধ হলেও অবস্থা এ পর্যায়েই পেীছেছিল এবং আন্দোলন সম্পর্কে এই হতাশার মনােভাব ২৩ ফেব্রুয়ারি হােস্টেলে (এক নম্বর শেডের এক নম্বর রুমে) অনুষ্ঠিত বৈঠকে অলি আহাদের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পূর্বাপর জঙ্গি মনােভাবসম্পন্ন অলি। আহাদ সেদিন বলেন : স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সম্ভাব্য চরম সীমায় পৌঁছিয়াছে এবং আন্দোলনে ভাটার চিহ্ন দেখা দিয়াছে। তদুপরি অবিরাম আন্দোলন চালাইয়া যাইবার মত সাংগঠনিক শক্তি এই পর্যায়ে আমাদের নাই। সুতরাং সন্তোষজনক পশ্চাদপসরণই আমার দৃঢ় মত’ (প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৭৩)। এই চিন্তার মধ্যেই ছিল নেতৃত্বের সঙ্কট ও দুর্বলতা, যেজন্য তারা নুরুল আমিনের কৌশলী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নতুন মাত্রার সংযােজন ঘটিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন নি। আন্দোলন বস্তুনিষ্ঠভাবে চালিয়ে যাওয়ার মতাে কৌশল তাদের হাতে ছিল না। জনস্বার্থমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে দেশব্যাপী গণআন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার মত রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ছিল না বলেই ‘সন্তোষজনক পশ্চাদপসরণই সঠিকনীতি’ বিবেচিত হয়। প্রকৃতপক্ষে অলি আহাদের এ মূল্যায়ন সঠিক ছিল না। কারণ ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ও আন্দোলনের গুণগত বিচারে জোয়ারিটান ঠিকই ছিল এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে সদ্য তৈরি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সে জোয়ারে নয়া গতিবেগ সঞ্চার করে। অন্যদিকে ঐ বৈঠকেই আবদুল মতিনের প্রস্তাব ছিল মফস্বলে ছাত্রকর্মী পাঠিয়ে যােগাযােগ স্থাপনের, যাতে আন্দোলন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে পারা যায়। তহবিল সংগ্রহের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মফস্বলে ছাত্রকর্মীদের যাতায়াতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এ পথে জনগণের জন্য কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের মধ্য দিয়ে আন্দোলন নতুন মাত্রা অর্জন করতে পারতাে, কিন্তু সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানাে হয় নি, হয়তাে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অলি আহাদ প্রমুখ।
নেতা উপলব্ধি করতে পারেন নি। নেতৃত্বের বহুধা-বিভক্তি সম্পর্কে যেকথা আগে বলা হয়েছে হয়তাে তাই আন্দোলনে তাত্ত্বিক পিছুটানের বা স্থবিরতার পক্ষে কাজ করেছে। তাই দেখা যায়, সলিমুল্লাহ হল মূল নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব পথ ধরে চলেছে; সর্বদলীয় পরিষদের একেকজন নেতা এক এক দিকে,—আবুল হাশিম মেডিকেল হােস্টেলে নতুন পরিষদের সাথে যােগাযােগ রেখে চলেছেন, আবার কামরুদ্দিন আহমদ নাগরিক কমিটি’ নিয়ে কিছুটা দূরের অবস্থানে, কাজী গােলাম মাহবুব সর্বদলীয় পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে আপন ইচ্ছানুযায়ী ‘একলা চলরে’ পথের অনুসারী, বাদবাকি অর্থাৎ অলি আহাদ, আবদুল মতিন, জাহেদী, মােহাম্মদ সুলতান প্রমুখ নেতা মেডিকেল ছাত্রদের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলন কিছুদূর টেনে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা নিয়ে পরদিন রবিবার ছুটির দিন বিধায় তার পরদিন সােমবার হরতালের আহ্বান জানানাে হয়। আর ৫ মার্চ সারাদেশে হরতাল, মিছিল, সভা ইত্যাদির কর্মসূচি নেয়া হয়। আবার পাশাপাশি পরদিন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকেও সােমবার হরতাল পালনের আহ্বান জানানাে হয়।১৫৪ পরদিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি আরেক বিজ্ঞপ্তিতে ৫ মার্চ প্রদেশের সর্বত্র শহীদ দিবস ও শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানায়।১৫৫ অর্থাৎ যে-যার মত চলার নীতি ও পরিস্থিতি দেখা দেয়। অলি আহাদ তার বক্তব্যে যাই বলুন না কেন, বাইশে ফেব্রুয়ারির গণআন্দোলনের জোয়ার পরদিনও অব্যাহত ছিল বরং সেখানে জোয়ারা কল্লোলের জন্য নতুন একটি মাত্রা সংযােজিত হয়েছিল যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে আবেগ-উত্তেজনার নতুন এক প্রকাশ ঘটে। সদ্যনির্মিত শহীদ মিনার এই নয়া আবেগ-উত্তেজনার উৎস হয়ে ওঠে। শহীদ স্মৃতির প্রতীক ও আন্দোলনের উৎস শহীদ মিনার। তেইশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সংগ্রামী তৎপরতার এক বিচক্ষণ প্রকাশ মেডিকেল হােস্টেলে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, যা পরে মুখে মুখে শহীদ মিনার নামে খ্যাতি অর্জন করে। স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির পরিকল্পনা থেকে এর সমাপন সবটুকুই মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের অবদান। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ২৩ ফেব্রুয়ারি এই ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন এ দেশের জাতীয় রাজনীতিতে যে মহৎ অবদান রেখেছে, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উৎস ও ধারা সজীব রাখতে যে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে এবং সংগ্রামী উদ্দীপনার প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে, তা সম্ভব হয়েছে প্রধানত দুটো কারণে। প্রথমত, একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যেজন্য বিক্ষুব্ধ ও রক্তাক্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আন্দোলন সাময়িকভাবে হলেও জনমানসের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত এই রক্তাক্ত আন্দোলনের সাহসী স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে শহীদ মিনার নির্মাণ। শহীদ মিনার শুধু শহীদের স্মৃতিকেই অমরত্ব দেয় নি, প্রতিষ্ঠিত করেছে এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য এক ঐতিহ্যবাহী উদ্দীপনার উৎস। _ শহীদ মিনার তৈরি হয় তেইশে ফেব্রুয়ারি শনিবার, আন্দোলনের জোয়ারী। পর্যায়ে। একরাত্রির সমষ্টিগত শ্রমে কাজটি শেষ করা হয়। মেডিকেল কলেজ। হােস্টেলে অবস্থানকারী রাজনীতিসচেতন ছাত্রগণ এই অভিনব দুঃসাহসী কাজে নেমে এসেছিল। আন্দোলনের জন্য কোন নেতা বা কর্মীর তরফ থেকে এ সম্পর্কে কোন পরিকল্পনা বা পরামর্শ আসে নি। সেদিনও শহরে রাত আটটা থেকে ভাের পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ ছিল। হােস্টেলের কয়েক গজ দূরে রাস্তায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী টহল দিচ্ছে, এমনি এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে রাতভর একটানা শ্রমে এবং বহু হাতের তৎপরতায় তৈরি হয় মেডিকেল ছাত্রদের অভিনব চিন্তার ফসল শহীদ মিনার।
আর এই মিনারের নির্মাণ-স্থানটিও ছিল হােস্টেলের দক্ষিণ-পূর্বদিকের গেট থেকে কয়েক গজ ভেতরে যাতে স্মৃতিস্তম্ভটি সামনের রাস্তা ফুলার রােড থেকে একনজরেই চোখে পড়ে। আন্দোলনের অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে যেমন আমরা এ পর্যন্ত দেখেছি বিস্তর তথ্যগত ভুলভ্রান্তি ও বিকৃতি, তেমনি ঐতিহাসিক শহীদ মিনার সম্পর্কে ও আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণকেও নানাভাবে ঘটনা বিকৃত করতে দেখা যায় এবং তা হয়তাে প্রতারক স্মৃতির টানে, তবে সেই সঙ্গে বিশেষ উদ্দেশ্যের কারণেও। তথ্য বিকৃতির রকমফের থেকে তা বােঝা যায়। এ সম্পর্কে দৈনিক ‘আজাদ’-এর প্রতিবেদন দিয়েই শুরু করা যাক। পঁচিশে ফেব্রুয়ারির ‘আজাদ’-এর প্রতিবেদন : ‘শহীদ বীরের স্মৃতিতে (স্টাফ রিপাের্টার)’। “ রভাষা আন্দোলনের যেসব শহীদ বীর গত ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের নিষ্ঠুর গুলির আঘাতে বুকের রক্তে ঢাকার মাটি রাঙ্গাইয়া গিয়াছেন, তাহাদিগকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের
ছাত্রগণ তাহাদের কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে নিজ হস্তে একরাত্রির মধ্যে ১০ ফুট | উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়াছেন।’ স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করা হয় রাস্তার অদূরে অবস্থিত ১২ নম্বর শেডের দক্ষিণ পূর্বদিকে হােস্টেল গেটের কাছাকাছি শহীদ আলীম চৌধুরীর (একাত্তরে আল বদরদের হাতে নিহত) কক্ষটি থেকে সামান্য দূরে, এবং হােস্টেলের দুই গেটের সংযােগকারী সুরকির রাস্তার প্রায় গা ঘেঁষে। উদ্দেশ্য, যাতে স্মৃতিস্তম্ভটি বাইরের রাস্তা থেকে সহজেই চোখে পড়ে এবং যেকোন ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে হােস্টেলের ভেতরকার কোনাকুনিভাবে প্রসারিত রাস্তার ওপর দাঁড়ালেই চোখে পড়ে। এখনকার অবস্থান বিবেচনায় বলা যায়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান আউটডাের ডিসপেনসারি ভবনটির নিচে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে এককোণে চাপা পড়ে আছে প্রথম শহীদ মিনারের অবস্থান। শহীদ আবুল বরকতের রক্ত যেখানে ঝরেছিল তার নিকটতম স্থানটি বেছে নেয়া হয়েছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য। অথচ ঐতিহাসিক তথ্যের দিক থেকে সুস্পষ্ট ও জটিলতাহীন এই ঘটনাটি নিয়েও যে-যার খুশিমত কথা বলেছেন, এমনকি বলেছেন ইতিহাস লেখকদেরও কেউ কেউ। যেমন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক বশীর আল হেলাল এ প্রসঙ্গ শুরু করেছেন এভাবে, ‘কিন্তু এই শহীদ-মিনার কবে নির্মিত হয়? এই নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে’ (পৃ. ৪২৮)। আসলে এই নিয়ে ইতিহাস লেখকের পক্ষে “বিভ্রান্তির সুযােগ বড় একটা ছিল ; সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং মেডিকেল কলেজের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় যে কোন ছাত্রকর্মরি সংশ্লিষ্ট বক্তব্য মিলিয়ে নিলেই শহীদ মিনার তৈরির দিন-ক্ষণ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকতাে না। তাছাড়াও, স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সংবাদ “আজাদ’ পত্রিকায় ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়, অর্থাৎ ২৪ তারিখে সংবাদদাতার পাঠানাে খবর; স্বভাবতই তেইশে ফেব্রুয়ারি রাতে অথবা চব্বিশ তারিখ ভােরে তৈরি। বস্তুত ‘বিভ্রান্তি ঘটেছে অলি আহাদ ও মােহাম্মদ সুলতানের বক্তব্য দিয়ে শুরু করার কারণে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন রাজনৈতিক ছাত্রদের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে এই কারণে যে, একুশের আন্দোলনে তাদের ব্যাপকসংখ্যায় অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিকসাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই ভূমিকা অত্যন্ত অবহেলার চোখে দেখা হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট লেখায়, স্মৃতিচারণে কদাচিৎ মেডিকেল ছাত্রদের ভূমিকা এবং শহীদ মিনার তৈরিতে তাদের একক কৃতিত্বের কথা উল্লিখিত হয়ে থাকে। অথচ প্রথম শহীদ মিনার তৈরি না করা হলে জাতি আজ শহীদ মিনারের গৌরবময় ঐতিহ্য থেকে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি বলিষ্ঠ প্রতীক থেকে বঞ্চিত হতাে এমন ধারণাই স্বাভাবিক।
এই অনীহা, এই অবহেলার মনােভাব শহীদ মিনার সংক্রান্ত সে সময়ে প্রকাশিত খবরাদিতেও পরিস্ফুট। শহীদ মিনার তৈরির মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৈনিক আজাদ’ সামান্য কয়েকটি ছত্র ব্যবহার করেছে; এমনকি প্রতিবেদকের বয়ানেও অমনােযােগের লক্ষণ এতই পরিস্ফুট যে তিনি স্মৃতিস্তম্ভ সম্বন্ধে সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে এটি তৈরির দিন-ক্ষণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখের প্রয়ােজন অনুভব করেন নি। হিসাব-নিকাশ করে তবেই তারিখ বের করতে হয়। সংবাদ-প্রতিবেদকের পক্ষে এ ধরনের অমনােযােগ ও অবহেলা পেশাগত দক্ষতার পরিচয় বহন করে না। এমনকি এরপরও ২৪ থেকে ২৬—এই আড়াই দিনে স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশে শােকার্ত মানুষের যে ঢল নেমেছিল, আবেগে-মমতায়-শ্রদ্ধায় কিছু না-কিছু নিবেদনে মানুষ যে উন্মুখ হয়েছিল, সেসব সংবাদচিত্রের অতি সামান্যই পত্রপত্রিকায় স্থান পেয়েছিল। তাই দেখি, শহীদ মিনার উদ্বোধনের সংবাদটি পর্যন্ত পত্রিকায় স্থান পায় না। এমনকি পরিষদ সদস্যপদে ইস্তফাদানকারী “আজাদ’ সম্পাদক কর্তৃক উদ্বোধন সত্ত্বেও। | স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার সংবাদ আজাদ’ ধরে রাখে দুই-তিন ছত্রের ছােট্ট একফালি পরিসরে। স্বভাবতই এর নির্মাণের বিবরণ এবং কারিগরদের পরিচয় সংবাদপত্রে কখনােই প্রকাশ পায় নি। অথচ পাশাপাশি অনেক সাদামাটা খবর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের দীর্ঘ কায়া নিয়ে প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। শহীদ মিনার সম্পর্কিত বিবরণ প্রকাশে অন্যায়-অবহেলার এখানেই শেষ নয়। ভাষা আন্দোলনের প্রখ্যাত ইতিহাস লেখক বদরুদ্দিন উমর তার পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তর্কালীন রাজনীতি’ নামীয় গ্রন্থমালার অন্তর্গত পাঁচশ’ পৃষ্ঠা সংবলিত তৃতীয় খণ্ডে শহীদ মিনারের জন্য প্রায় দেড় পৃষ্ঠার মতাে পরিসর ব্যয় করেছেন। অথচ ঐ একই খণ্ডে বহু গৌণ বিষয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আলােচনা বা বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। শহীদ মিনার সম্পর্কে উমর তৎকালীন মেডিকেল কলেজের ছাত্র সাঈদ হায়দারের একটি সংক্ষিপ্ত বয়ান পেশ করেই কর্তব্য শেষ করেছেন। যাই হােক, শহীদ মিনার সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর বিবরণের কয়েকটি এবার উদ্ধার করা যাক। শুরুতেই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক অলি। আহাদের বক্তব্য : সেইদিনই অর্থাৎ ২২শে ফেব্রুয়ারি সূর্যাস্তের সময় মাে, সুলতান কয়েকজন। যুবলীগ কর্মীসহ আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং যেখানে পূর্ববর্তী দিবসে (২১শে ফেব্রুয়ারি) প্রথম গুলি চালনা করা হইয়াছে সেখানে শহীদ মিনার। নির্মাণের প্রস্তাব রাখেন।… আমি সানন্দে সম্মতি দিলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, ২৩ ফেব্রুয়ারী রাত্রে পুলিশ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া দেয়’ (প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ. ১৬৭-৬৮)।
তাঁর মতে ‘আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৩শে ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বােধন করেন, এসব তথা আদৌ ঠিক নয়। | এই বক্তব্যের কোথাও ইতিহাস নেই, আছে কল্পকাহিনী। শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয় তেইশ তারিখ রাতে, শেষ হয় চব্বিশ তারিখ ভােরে এবং পুলিশ সেটি ভেঙে ফেলে ২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ বিকেলে। ঐ দিনই বেলা দশটায় আবুল কালাম শামসুদ্দিন শহীদ মিনার উদ্বােধন করেন। ভারতে অবাক লাগে, অলি আহাদ। কেমন করে এধরনের উদ্ভট ভুল তথ্য লিপিবদ্ধ করতে পারেন। এবং তা একাধিক সূত্রে। এ বিষয়ে মােহাম্মদ সুলতানের বক্তব্যও সঠিক নয়। তার মতে, একুশ তারিখ রাত বারােটার মধ্যে মেডিক্যাল ছাত্রাবাসের ১নং ওয়ার্ডের পাশেই তারা ছাত্ররা একটি পাকা শহীদ মিনার তৈরি করে ফেললেন। চব্বিশ তারিখ পুলিশ সেটা ভেঙে ফেলে।’ এমনি উদ্ভট কাহিনী আরাে অনেকেই লিখেছেন, যেমন গাজীউল হক, এম,আর, আখতার মুকুল, কে.জি মুস্তাফা প্রমুখ। সম্ভবত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাবে এধরনের বিপত্তি ঘটেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত উদ্ধৃতির প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় না।
প্রকৃতপক্ষে শহীদ মিনার তৈরির ইতিহাস এককভাবে মেডিকেল ছাত্রদেরই আবেগ ও তৎপরতার কাহিনী। তাই সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং মিনার তৈরির কারিগরদের ভাষ্য মিলিয়ে তবেই শহীদ মিনারের প্রকৃত ইতিহাস তৈরি হতে পারে। কিন্তু লেখকগণ এ বিষয়ে সচেতন নন। আর নন বলেই ‘৫২ থেকে দীর্ঘ সময় শেষে নব্বইয়ের ফেব্রুয়ারিতে এসে কলকাতার স্বনামখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় এম.আর, আখতার মুকুল শহীদ মিনারের ইতিকথা’য় পুরনাে সব ভুল তথ্য নির্বিচারে ব্যবহার করেছেন।১৫৬ তথ্যগুলাে সংশােধনের শ্রম-স্বীকার পর্যন্ত করেন নি। শহীদ মিনারের প্রসঙ্গে পৌঁছাতে গিয়ে ঐ রচনার শুরুতে একুশের গুলিবর্ষণ সম্পর্কেও তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুল তথ্য সরবরাহ করেছেন এই বলে যে, ‘মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে নিহত দু’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হচ্ছেন আবদুল জব্বার আর রফিকুদ্দিন। সে রাতে হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ। করলেন বাদামতলীর একটা ছাপাখানার কর্মচারী সালাম।’ এই কয়েক ছত্রে একাধিক তথ্যগত ভুলের সমাবেশ প্রমাণ করে বিস্তৃতি বা অবহেলা ইতিহাসের জন্য কী ভয়ঙ্কর হতে পারে। জব্বার বা রফিকুদ্দিন কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন। আর সালাম ছাপাখানার কর্মচারী নন এবং সেদিন মারাও যান নি। এ সম্পর্কে সঠিক বিবরণ ও তথ্য আগেই পরিবেশিত হয়েছে। শহীদ মিনার তৈরি সম্পর্কে তার বক্তব্য : ২২শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত্র থেকে। শুরু করে চব্বিশে ফেব্রুয়ারি ভােররাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। বিবরণ শেষে তিনি মন্তব্য করেছেন, এটাই হচ্ছে ইতিহাসের বাস্তব তথ্য। আবার অন্যত্র এ বিষয়ে বলেছেন : ‘বাইশে ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল।
কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে রাতরাতি শহীদ মিনার নির্মাণ’১৮ অর্থাৎ বাইশ তারিখেই কাজ শেষ। শহীদ মিনার তৈরি সম্পর্কে তৎকালীন মেডিকেল ছাত্র সাঈদ হায়দার, যিনি মিনারের পরিকল্পনা ও নির্মাণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, লিখেছেন : ‘মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা শহীদ মিনার তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় ।… এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা করে।… ২৩ তারিখ বিকেল থেকে শুরু করে সারারাত সেখানে কাজ হয় (কার্ফ থাকা সত্ত্বেও) ….শরফুদ্দিন…শহীদ মিনার নির্মাণে যথেষ্ট যত্ন নিয়েছিল ।…শহীদ মিনার উদ্বোধন বিষয়ে বিতর্ক আছে। শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে এনে ২৪শে ফেব্রুয়ারি মিনারটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেব নাকি উদ্বােধন করেছিলেন।…আমি তা দেখিনি, কারণ আমাকে সেসময় পালিয়ে যেতে হয়েছিল।১৫৭। জনাব সাঈদ হায়দার শহীদ মিনারের তদারকের কাজে নিয়ােজিত যে শরফুদ্দিনের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি ছিলেন তখনকার মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (এনজিনীয়ার’ ডাকনামে পরিচিত) এবং চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। শহীদ মিনার সম্পর্কে তার বক্তব্য নিম্নরূপ : একুশ-বাইশ দুইদিনের ভয়াবহ রক্তঝরা স্মৃতি নিয়ে আমরা সবাই খুবই উত্তেজিত। তেইশ তারিখ সকালে তিন নম্বর শেডের বারান্দায় বসে এসব আলােচনাই হচ্ছিল। উঠেছিল পুলিশের লাশ গায়েব করার কথা, শহীদদের কথা। ঠিক এমন সময় আমাদের মধ্যেই কে একজন কথাটা তােলেন এই বলে যে, শহীদদের জন্য একটা স্মৃতিস্তম্ভ বানালে কেমন হয়? এ কথায় কেউ হেসে উঠেনি। বরং সবাই বলে উঠল : “তাই হােক।’ কেউ কেউ বলল : “আজই হােক।’ প্রশ্ন উঠল নক্শার, মাল-মসলার। নতুন কলেজ ভবন তৈরির জন্য ইট-বালি সবই জমা আছে কলেজ চত্বরে, সিমেন্ট গুদামে। কিন্তু নকশা? মাওলা ভাই বললেন, বদরুলের আঁকার হাত ভাল, সেই পারবে। নকশা আঁকার ভার পড়ল বদরুল আলমের ওপর।
প্রথম নক্শাটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। দ্বিতীয়বার করা হলাে, সঙ্গে আরাে দুই একজন যােগ দিলাে। হায়দার। | ভাইও বােধহয় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত যে নকশাটা দাঁড় করানাে হলাে সেটাই মনােনয়ন পেল। এরপর কাজ শুরু। তাই বলি, পরিকল্পনা সমষ্টিগত, যেমন কাজের শুরুতে, তেমনি কাজের শেষে। মনে আছে, আবুল হাশিম খুব খেটেছিল।’১৫৮ | মেডিকেল কলেজের আরেকজন ছাত্রকর্মী আলী আসগর শহীদ মিনার তৈরি সম্পর্কে একই কথা বলেছেন; বলেছেন একাধিক তৎকালীন ছাত্রকর্মী (যারা পরবর্তীকালে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতী ব্যক্তিত্ব), যেমন হুমায়ুন কবির আবদুল হাই, ফজলে রাব্বী, আবদুস সালাম, কবীরউদ্দিন এবং আরাে অনেকে যাদের সাথে আমরা কথা বলেছি। এরা সবাই মনে রেখেছেন তেইশে ফেব্রুয়ারি রাতে কাজ শুরু করার কথা, রাততর কাজ করার কথা এবং একমাত্র কলেজ হােস্টেলের ছাত্রদের একটি বিরাট সংখ্যার কাজে অংশ নেবার কথা। এমন কি কেউ কেউ মনে করেছেন, হােস্টেলের বয়-বেয়ারা-বাবুর্চিদের মাটি খুঁড়তে সাহায্য করার কথা। সে রাতে এই কাজে অন্য কোন শিক্ষায়তনের ছাত্র বা নেতা কেউ উপস্থিত ছিলেন না।১৫৯
আগেই বলেছি, কলেজ প্রাঙ্গণে জমা ছিল বিস্তর ইট আর বালি, আর ঠিকেদার পিয়ারু সর্দারের গুদামে সিমেন্টের বস্তা। সে রাতে কোন কাজই অসম্ভব মনে হয় নি। পাশাপাশি দাঁড়ানাে সব ছাত্র; হাতে হাতে ইট চলে আসছে সেই দীর্ঘ মানবশৃঙ্খল বেয়ে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে হােস্টেল চত্বরে, মিনারের জন্য নির্ধারিত স্থানে। আসছে হােস্টেল আর কলেজ-হাসপাতালের মধ্যবর্তী ছােট খুপরি গেট দিয়ে, যে সংক্ষিপ্ত পথে ছেলেরা যাতায়াত করত হােস্টেল থেকে কলেজে বা হাসপাতালে, বড় রাস্তা তথা ফুলার রােড দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়ােজন হতাে না। ইট হাতে হাতে এলেও বালি আর সিমেন্ট এসেছে হাসপাতালের স্ট্রেচারে ওঠে। আর রাজমিস্ত্রি? তাও পূর্বাঙ্গে যােগাড় করা ছিল। মিনার তৈরির কাজ শুরু হলাে। বদরুল আলম আর সাঈদ হায়দারের আঁকা নকশা মােতাবেক। কাজ তদারক করতে থাকেন শরফুদ্দিন আহমদ তথা এনজিনীয়ার । মজবুত শরীর আবুল হাশিম আর মঞ্জুর হােসেনের শ্রমের শক্তি ছিল সেদিন চেয়ে দেখার মতাে। হােস্টেলের আরেকজন স্বাস্থ্যবান কর্মী ছাত্র আলী আজমল তখন জেলে, একুশ তারিখে আমতলার মিছিল থেকে গ্রেফতার হয়ে। | রাতভর শ্রম আর উত্তেজনা। বাইরে রাস্তায় কারফিউ, সশস্ত্র প্রহরীদের। ক্লান্তিহীন টহল । রাস্তার খুব কাছেই কাজ চলছে। তবু সেদিন কেউ ভয় পায় নি। সেই ঠাণ্ডা রাতেও শরীর থেকে ঘাম ঝরেছে। ইট টানতে গিয়ে অনেকেরই হাতে ফোস্কা পড়েছে, তবু কেউ নিরস্ত হয় নি। সারারাতের শ্রমে শহীদ স্মৃতি অমর হােক’ এই স্লোগান সার্থক করে তুলতে তৈরি হলাে ছােটোখাটো একটি শহীদ মিনার, স্মৃতির মিনার। শহীদ স্মৃতির প্রতীক সেই স্মৃতিস্তম্ভটি ছিল প্রায় সাড়ে দশ ফুট উচু এবং ছয় ফুট চওড়া। মাথাটা ছিল অসম্পূর্ণ। তখন ভাের হয়ে এসেছে। কাজও প্রায় শেষ। বদরুল আলমের হাতে অতিযত্নে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ লেখা কাগজের ফলকটি সাবধানে সেঁটে দেয়া হয়। মিনারের গায়ে। পলেস্তারার কাজ শেষ করে সাবধানে একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হলাে স্মৃতিস্তম্ভটি, মনে হতে পারে যেন কাফনে ঢাকা কোন শহীদের লাশ। চারদিকে ছােট ছােট খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে বেশ চওড়া করেই ঘিরে দেয়া হয় শহীদ মিনার, অনেকটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে। দড়ির গায়ে মিনারের চারপাশ ঘিরে ঝুলিয়ে দেয়া লাল পােস্টারের মেলায় উৎকীর্ণ স্লোগান : রাষ্ট্রভাষা।
বাংলা চাই’, শহীদ স্মৃতি অমর হােক’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’ এবং একটি তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনের উচ্চারণ রাষ্ট্রভাষা তহবিলে মুক্তহস্তে দান করুন’। বাহান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে লীগ শাসনের বর্বরতার প্রতীক এবং সেইসঙ্গে প্রতিরােধ সংগ্রামের সাহসী প্রতীক প্রথম শহীদ মিনারের পরিকল্পনা যেমন ছিল বাস্তবিকই মেডিকেল হােস্টেলের রাজনীতিসচেতন ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত এক আকস্মিক চিন্তার যৌথ ফসল তেমনি এর সমাপনও সমষ্টিগত শ্রমের এক সার্থক ফসল।১৬০ শুক্রবার-শনিবারের মিছিলে প্রথম উচ্চারিত স্লোগান ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক এবার বাস্তবের মুখ দেখতে পেল এবং চব্বিশে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিটি মিছিলে এই উচ্চারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি সকালে হঠাৎ-জেগে-ওঠা ছােটোখাটো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি একুশের ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যােগ করে দেয়। শহরবাসীদের কানে কেমন করে যেন এই নয়া স্থাপত্যের বার্তা পৌঁছে যায়। দলে দলে লােক ছুটে আসে একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলের চেয়েও অধিকতর সংখ্যায় শহীদদের বদলে তাদের স্মৃতির প্রতীক মিনারটিকে একনজর দেখে নিতে। বিভিন্ন বয়সী নারীপুরুষ, ছেলেমেয়ে। সত্যি সারা শহর আবার ভেঙে পড়ে মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে, এক মুহূর্তের জন্য স্থানটি জনহীন থাকে না। এ দৃশ্য যে দেখে নি তার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। ফুলের ভারে, চোখের জলে, শশাকের ছায়ায় এবং শ্রদ্ধার অর্থে শহীদ মিনার হঠাৎ করেই এক অভাবনীয় প্রতীকী মর্যাদা পেয়ে যায়। এর নির্মাতারা অবাক হয়ে দেখেছে, কেমন করে শহীদ মিনার হয়ে ওঠে নতুন প্রেরণার উৎস, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক। এমনটি তারা ভাবেন নি, ভাবতে পারেন নি। অথচ এই অভাবিতকেই তারা প্রত্যক্ষ করেছেন চোখের সামনে, প্রতিদিন। দিনটি ছিল চব্বিশে ফেব্রুয়ারি, রবিবার ছুটির দিন। ঘটনার বিবরণ শুনে শাসকদের বিশ্রামের আরাম হারাম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের আনাগােনায় হােস্টেল প্রাঙ্গণ আবার জমজমাট। ফুল, মালা, টাকা-পয়সা এমনকি অলঙ্কার, যে যা পারে সযত্নে রেখে যাচ্ছে মিনারতলে বিছানাে চাদরের ওপর। উদ্গত নিশ্বাসে ছড়িয়ে পড়ে শাসকের বিরুদ্ধে ঘৃণার ঢেউ। শহীদ মিনার নয়, যেন এক প্রতিবাদী মাজার, ভক্তিতে মুক্তি খোঁজার আশ্রয়কেন্দ্র।
চব্বিশ, পঁচিশ, ছাব্বিশ—মাত্র আড়াই দিনের পরমায়ু নিয়ে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ আশ্চর্য এক প্রতিবাদী দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিল। প্রতিটি মানুষের মনের কথার প্রতীকীরূপে শাসকশ্রেণী, বিশেষ করে লীগ শাসনের অগণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ, জুলুম আর ভাষা-বৈরিতার বিরুদ্ধে ঘৃণা আর প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে মাত্র এই ক’টা দিনে। মানুষ নতুন করে আবার শাসক-বিরােধিতার ঢেউ অনুভব করতে শুরু করে। এমন নির্বাক শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বড় কঠিন, বিজয় অসম্ভব। তাই নুরুল আমিন-আজিজ আহমদ চক্র নতুন করে ভাবতে থাকে এবং আন্দোলনে। ভাটার টান লাগতেই আঘাত পড়ে স্মৃতিস্তম্ভের পাঁজরে। তড়িঘড়ি করে চব্বিশ তারিখেই শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে উদ্বােধনের জন্য, যদিও সেটা ঠিক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ছিল না। এবং নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তা করা হয় নি। এই উদ্বোধনের কথা লিখেছেন। সাঈদ হায়দার, অন্য সবাই তার বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন মাত্র। এ বিষয়ে আহমদ। রফিকের সাথে আলােচনায় সাঈদ হায়দার একমত হয়েছেন যে, এই উদ্বোধন আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ছিল না। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি সকালে।১৬১ | উদ্বোধনের বিষয় নিয়ে এত কথা বলার কারণ এ সম্পর্কেও যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে এবং একসময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। এমনকি এ সম্পর্কে বশীর আল হেলাল তার ইতিহাস গ্রন্থে অনেক যুক্তিজাল। বিস্তার করে বলতে চেয়েছেন যে ‘আজাদ’-সম্পাদক সম্ভবত শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন নি। তার ভাষায় : ‘কাজেই তিনি যে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন এমন কথা প্রমাণ করা যাচ্ছে না, যদিও অনেকে বলেছেন তিনি এ-কাজ করেছিলেন।
এমন হতে পারে, ২৬ তারিখ থেকে পুলিশ ভাষা-আন্দোলনের বিরুদ্ধে নতুন হামলা শুরু করেছিল, কিংবা সরকারের চাপও ছিল, তাই তার ওই উদ্বোধনের ঘটনাটির সংবাদ আর আজাদে’ প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। কিংবা, এমন হতে পারে, উদ্বােধন করবেন এই সংবাদ আজাদে’ প্রকাশিত হওয়া থেকেই ভুল করে ধরে নেয়া হয়েছে, তিনি উদ্বোধন করেছিলেন। অবশ্য শহীদ শফিউর রহমানের পিতা যে ২৪ তারিখে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই’ (পৃ.৪৩১)। উপরের দীর্ঘ বয়ান গভীরভাবে অনুধাবন করে দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, বশীর আল হেলাল সুস্পষ্ট কোন তথ্য ছাড়াই শুরুতে আজাদ-সম্পাদক কর্তৃক শহীদ মিনার উদ্বোধনের ঘটনাটিকে নাকচ করে দিয়েছেন। এরপর সেই সম্ভাবনার ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয়দিকই দেখিয়েছেন এবং সবশেষে আবার নতুন কোন যুক্তি বাদেই সূচনার সিদ্ধান্তে পৌঁছে ধরে নিয়েছেন যে শফিউর রহমানের পিতাই মিনার উদ্বোধন করেছিলেন, আবুল কালাম শামসুদ্দিন নন। মুশকিল হলাে, শফিউর রহমানের পিতার উদ্বোধনের পক্ষে একমাত্র যুক্তি একজন ভাষাসৈনিকের সাক্ষ্য; কিন্তু শামসুদ্দিন সাহেবের পক্ষেও অনুরূপ সাক্ষ্যের যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন হুমায়ুন কবির হাই, যিনি এখনও জোর দিয়ে বলেন যে, ছাব্বিশ তারিখে আবুল কালাম শামসুদ্দিন কর্তৃক মিনার উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন এবং সেই অনুষ্ঠানের আলােকচিত্র তার কাছে দীর্ঘদিন ছিল, যা একসময় ইত্তেফাক’-এ প্রকাশিত হয়। তিনি আরাে বলেন, আলােকচিত্রটিতে।
তার নিজের ছবিও ছিল।১৬২ আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও হুমায়ুন হাইয়ের বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। স্বভাবতই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। | প্রকৃত ঘটনা হলাে, আন্দোলনে ভাটার টান লক্ষ্য করে এবং শহীদ মিনারের প্রতি জনতার প্রবল আকর্ষণের কারণে আরেকটি জোয়ারী ঢেউ জাগিয়ে তােলার চেষ্টায় মেডিকেল ছাত্রদের সংশ্লিষ্ট অংশ মিলে ব্যবস্থা পরিষদ থেকে ইস্তফাদানকারী সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিনকে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া। এবং তিনি যথারীতি বেলা দশটার দিকে উদ্বোধনের কাজ সম্পন্ন করেন। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’-এ এই মর্মে ছােট একটি খবরও প্রকাশিত হয় যে : ‘অদ্য (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে নয়টায় মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ‘আজাদ’ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ উদ্বােধন করিবেন।’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের খবর পৃথকভাবে ‘আজাদ’-এ ছাপা না হওয়ার কারণ ঐ দিনই সন্ধ্যায় পুলিশ বাহিনী কর্তৃক শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা। স্বভাবতই ‘আজাদ” সেই ভাঙার খবরই ছেপেছে, হাওয়ার দিক পরিবর্তনের ফলে উদ্বোধনের খবর ছাপা যুক্তিযুক্ত মনে করে নি। উদ্বোধনের খবর না ছাপা থেকে প্রমাণ হয় না যে, শামসুদ্দিন সাহেব শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন নি। বরং ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত শহীদ মিনার ভাঙার খবরটিতেই সেদিন উদ্বোধনের পক্ষে বাস্তব সূত্র লুকিয়ে আছে, যা খবরটির সতর্কপাঠেই বােঝা যায়। সাতাশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ-এর ছােট্ট একটি বার্তায় বলা হয়েছে : গতকল্য (অর্থাৎ ২৬ তারিখ মঙ্গলবার—লেখকদ্বয়) মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে শহীদানের যে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করা হইয়াছিল, পুলিশ সন্ধ্যায় তাহা ভাঙিয়া ফেলিয়াছে। | এই ছােট্ট খবরেই স্পষ্ট যে ছাব্বিশ তারিখ শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়েছিল।
সেক্ষেত্রে পূর্ব ঘােষণা অনুযায়ী আবুল কালাম শামসুদ্দিন ছাড়া কে আর তা উদ্বোধন করতে পারেন? সম্ভবত পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘আজাদ’ কর্তৃপক্ষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে উদ্বোধনের সংবাদটি ‘কিল’ করে দেয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। হয়তাে দীর্ঘকাল পরে লেখা অতীত দিনের স্মৃতি’ গ্রন্থে নিতান্ত বিস্মৃতির কারণে শামসুদ্দিন সাহেব শহীদ মিনার উদ্বোধনের কথা উল্লেখ করেন নি। | সে যাই হােক ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি সকালে উদ্বোধনের পর জনমানসে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী শক্তিশেল’ শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও তার প্রশাসন। সেদিন শেষ বিকেলে ছাত্ররা যখন নানা কাজে নানা দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ঠিক তখনই ওরা হােস্টেল ঘিরে ফেলে। মাত্র গুটিকয় ছাত্র তখন হােস্টেলে উপস্থিত। পুলিশ নির্বিবাদে হােস্টেলের ভেতরে ঢােকে। প্রত্যক্ষদশীর বিবরণে প্রকাশ, প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মিনারের বুকে মােটা দড়ির প্যাচ আটকে ট্রাক দিয়ে টেনে এটি ভেঙে ফেলা হয় এবং শেষ পর্যন্ত খণ্ড খও করে সব ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে যায় ।১৬৩ একাত্তরে ভয়ার্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা এমনি করেই শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে সেখানে মসজিদের পরিচয় বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার পর এই ধর্মপ্রাণ দেশেও সেই মসজিদ টেকে নি। শহীদ মিনার আবার সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, হৃত মর্যাদা উদ্ধার করেছে।
এতসব নিপীড়ন সত্ত্বেও দেশবাসীর মন থেকে শহীদ মিনারের স্মৃতি মুছে যায়। নি। বাহান্ন সালে শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার প্রতিক্রিয়ায় গােটা দেশের স্কুলকলেজ ও অনুরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে ‘মিনিয়েচার শহীদ মিনারে ছেয়ে যায়। শহীদ মিনারকে ঘিরে তখনকার সেই ভাষা-চেতনা মানুষের মনে এখনও সজীব এবং সম্ভবত জাতিসত্তার প্রতীকী উপস্থিতি হিসেবেই তা জ্বলজ্বলে। | শহীদ মিনার সম্পর্কে কিছুটা দীর্ঘ এই বিবরণের কারণ জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব। বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক এই স্মৃতিস্তম্ভ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনারও প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং একাধারে বিজয় ও আত্মত্যাগের দিন হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন শহীদ দিবসরূপে চিহ্নিত তেমনি গােটা বিষয়টির প্রতীক চিহ্নরূপে দাড়িয়ে আছে একুশের স্থাপত্য শহীদ মিনার। এককথায় শহীদ মিনার এখনও বিজয়ের প্রতীক এবং জাতিসত্তার অস্তিত্বের ধারক হিসেবে স্বীকৃত। বাঙালি জাতীয়তাবােধের প্রতীক এই শহীদ দিবস, এই শহীদ মিনার। গােটা বাঙালি জাতি এই দিনে শহীদদের স্মরণে সমবেত হয় একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্যময় শােক দিবসের অনুষ্ঠানে, যদিও উৎসবের চরিত্র দিন দিন প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু বাঙালির জীবনে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, এমনকি সামাজিক দিক থেকেও এমন একটি দিনের উপস্থিতি বিরল। জাতীয় জীবনে এই দিনটির গুরুত্ব আরাে বেশি এই কারণে যে এই দিন, এই প্রতীক তাদের নিজেদের হাতে গড়া। ইচ্ছায় হােক, অনিচ্ছায় হােক একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস জাতীয় দিবস হিসেবে, জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে একসময় শাসক সরকারের মাধ্যমে ঘােষিত হয়েছে। শহীদ দিবসে সবাই নিজের অজান্তে হলেও, একদিনের জন্য হলেও ভাষিক ও জাতিসত্তার চেতনায় নিজকে তুলে ধরেন; ধরেন শুধু বহিরঙ্গেই নয়, ভাবাবেগের কারণেও বটে। শহীদ দিবস সংস্কৃতি অঙ্গনে স্থায়ী আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হলেও রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিবাদের উত্তাপ যুগিয়ে থাকে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে অমন এক শহীদ মিনার অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল হােস্টেলের ছাত্রদের একরাতের শ্রমে গড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতি বা বিভ্রান্তি কম নয়, যেমন বাহান্নর পর থেকে তেমনি ২০০৪ সালে পৌঁছেও। একুশের অন্যান্য ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি তাে আরে বেশি, তথ্য বিকৃতি তদনুরূপ।
প্রথম শহীদ মিনারের নকশা তৈরি প্রসঙ্গে প্রথম আলাে’ ১৪ ফেব্রুয়ারি (২০০৪খ্রি:) সংখ্যায় জনাব এম,এ বার্ণিক লিখেছেন যে “তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের হাউস সার্জন ডা. মীর্জা মাজহারুল ইসলাম ঐ কলেজের ছাত্র বদরুল আলমের সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য এক সিনিয়র ছাত্র সাঈদ হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে তিন জনে মিলে স্মৃতিস্তম্ভের নকশা দাড় করিয়ে ফেলেন। এ তথ্য যে সঠিক নয় তা তখনকার মেডিকেল হােস্টেলের ছাত্র মাত্রেরই জানা। এ বিষয়ে প্রতিবাদের মুখে কৈফিয়ৎ হিসেবে জনাব বার্ণিক যে সূত্র উল্লেখ করেছেন তা ডা. মীর্জা সম্পর্কে প্রযােজ্য নয়, তা মূলত তমদুন মজলিসের ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। জনাব বার্ণিকের লেখার প্রতিবাদে নকশা তৈরির তথ্য ভিত্তিহীন দাবি করে ডা. সাঈদ হায়দার প্রথম আলাে’তে চিঠি লেখেন যা প্রকাশিত হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি। একই বিষয়ে তৎকালীন মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ আরাে স্পষ্টভাবেই জানান যে নকশাটি বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দারের আঁকা (প্রথম আলাে’ ২৪ ফেব্রুয়ারি)। ব্যক্তিগত আলাপে তিনি আমাদের বলেন যে “ডা. মীর্জা সাহেব এসব কর্মকাণ্ডের ধারে কাছেও ছিলেন না। | তথ্যটি জনাব বার্ণিক যে সূত্রেই পেয়ে থাকুন, এতকাল পর প্রথম শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ’ সম্পর্কে নতুন কিছু লেখার আগে এ সম্পর্কে নির্ভরযােগ্য ইতিহাসগ্রন্থগুলাে দেখে নিলে ভালাে হতাে, অন্তত এমন ভুল হতাে না। তাছাড়া এ বিষয়ে ডা. সাঈদ হায়দার, ডা. (কর্নেল) এস.ডি, আহমদ এবং অন্য কারাে কারাে প্রকাশিত রচনাও কম নয়। সেগুলােতে একুশের ঘটনার সঠিক তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের জেনে রাখা দরকার যে সে সময় সরকারের চণ্ডনীতির কারণে হাসপাতালে কর্মরত কোনাে সরকারি চিকিৎসকের পক্ষে সরাসরি আন্দোলনে বা সংশ্লিষ্ট কোনাে ক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। তারা আপন কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে একুশের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। এ অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই। শহীদ মিনার : নতুন নির্মাণ । আমরা জানি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চুয়ান্ন সালে হক-ভাসানীসােহরাওয়ার্দির যুক্তফ্রন্ট ঐতিহাসিক একুশ দফার (একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতীক হিসেবে) ভিত্তিতে শুধু নির্বাচনী বিজয়ই নয়, জাতিসত্তার প্রতীকী বিজয়ও সংঘটিত করেছিল (যদিও সে বিজয় কেন্দ্রীয় পাকিস্তানি সরকারের ষড়যন্ত্রে টেকে নি)। ভাষা আন্দোলন বিষয়ক এর প্রধান দফাগুলাে ছিল শহীদ মিনার নির্মাণ, একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘােষণা, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা এবং স্বৈরাচারী নুরুল আমিন-নাজিমুদ্দিনের সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউস’কে বাংলা একাডেমী হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘােষণা।
কিন্তু পূর্ববঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে ভেঙে গিয়েছিল। অন্তর্কলহের কারণে পরে শরিক দলগুলাে আর যুক্ত হতে পারে নি। একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা করা সত্ত্বেও সময়ের অভাবে তা কার্যকর করা যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় নি। পরে কৃষক শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে যথাক্রমে শহীদ মিনারের ভিত্তি ও মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল।১৬৬ ছাপ্পান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এ সম্পর্কে সংবাদ’-এর প্রতিবেদন : “সকাল নয়টায় মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের পাশে মওলানা ভাসানী, প্রধানমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মাতা যুক্তভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৬৫। অবশ্য এর আগে বিশে ফেব্রুয়ারি রাতে জনতার দাবিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ আবদুল আউয়ালের ৬ বছর বয়স্ক কন্যা বসিরণকে দিয়ে শহীদ মিনারের ভিত্ স্থাপন করা হয়।১৬৬ আশ্চর্যে যে স্থানীয় সরকারগুলাের শাসনকালেও শহীদ মিনার গড়ে তােলার কাজ আকাঙিক্ষত গতিতে সম্পন্ন হয় নি। শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা অনুসারে সাতান্ন সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং তা আংশিকভাবে শেষ হয়; শেষ হয় শিল্পী নভেরা আহমদের ভাস্কর্যের কাজ। এরপর সামরিক শাসনের প্রথমদিকে কাজ বন্ধ থাকে। আটান্ন থেকে বাষট্টি—এই পাঁচ বছর অসম্পূর্ণ শহীদ মিনারেই মানুষ ফুল দিয়েছে, সভা করেছে, শপথ নিয়েছে। পরে বাষট্টি সাল থেকে শুরু করে তেষট্টি সালের বিশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের একটি ছােটোখাটো সংক্ষিপ্ত নমুনা সম্পূর্ণ করা হয়। এবার মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম। এরপর একাত্তরে পাক সামরিক বাহিনীর হাতে শহীদ মিনার ধ্বংসের কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। বাহাত্তর সালে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মূল শহীদ মিনার নির্মাণের দায়িত্ব হাতে নেয়া হলেও সে সম্পর্কে কাজের কোন অগ্রগতি হয়। নি। এ সম্পর্কে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন : ইতিমধ্যে অর্থাৎ তেহাত্তর সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর আগে বাংলাদেশ। সরকারের ‘সি এন্ড বি বিভাগ ইয়াহিয়া-টিকা বাহিনীর ধ্বংস করা শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলাে তাড়াহুড়া করে নির্মাণ করেন, যে শহীদ মিনার এখন পর্যন্ত বিরাজ করছে। জোড়াতালি দিয়ে নির্মিত এই শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলি পূর্বতন মিনারের স্তম্ভগুলির চেয়ে খাটো এবং সামনের দিকে বেশি বুকে পড়া।…এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি জাতির স্বপ্ন ও কল্পনার শহীদ মিনার আলো বাস্তবে রূপায়িত হয় নি। সৰটা মিলিয়ে আনুপাতিক সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় নি।১৬৮
এই আক্ষেপের সঙ্গে আরাে একটি কথা যােগ করা যায় যে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাভাষার ব্যবহারিক প্রয়ােগও অনুরূপ অবহেলার সম্মুখীন। বাহান্নর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’ এখন শুধু কল্পকথার বিষয়ই নয়, রীতিমত বিরােধিতার সম্মুখীন। আমাদের বিশ্বাস, বিষয়টির মূলে রয়েছে শ্ৰেণীস্বার্থভিত্তিক রাজনীতির মতাদর্শগত কারণ। বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক তাৎপর্যের আত্তীকরণ সম্পূর্ণ হয় নি বলেই এ অবস্থা দেখা দিয়েছে। | এই পরিস্থিতিতেও অবাক হতে হয় লক্ষ্য করে যে, আজকাল কেউ কেউ জোর গলায় দাবি শুরু করেছেন যে ভাষা আন্দোলনে তখনকার জাতীয়তাবাদী সংগঠনই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। তাত্ত্বিক বিচারে তাই নেয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এর বিপরীত ঘটনাই আমরা দেখতে পাই। বাহান্ন সালের বিশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার যে বিষয়টি ছিল জাতিসত্তা ও তার গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের পথে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং রাজনৈতিক অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ, সেই ১৪৪ ধারা ভাঙার বিরুদ্ধেই দাড়িয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ, গণআজাদী লীগ নামীয় সংগঠনগুলাে। তাই কাজী গােলাম মাহবুব কিংবা খালেক নেওয়াজ খান মুসলিম লীগপন্থী হল-ইউনিয়নের ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে মিলে আওয়ামী মুসলিম লীগের শামসুল হক কিংবা মুসলিম লীগের প্রাক্তন নেতা আবুল হাশিম, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখের সাথে ঐকমত্যে ১৪৪ ধারার সাথে আপােস রফার জন্য জেদ ধরেছিলেন। এই পদক্ষেপ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী চেতনার অনুকূল ছিল না, বলাই বাহুল্য।
| শহীদ মিনার পূর্ণাঙ্গ স্থাপত্যে গড়ে তােলার বিষয়েও পাক আমলে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সরকার এবং পরে স্বদেশী সরকারগণও একই মনােভাবের পরিচয় রেখেছেন, যেজন্য এতকাল পরেও শহীদ মিনার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। প্রথম মনােনীত মূল নকশা-স্থাপত্য এখনাে বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। একে আর যাই হােক ভাষিক বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা বলা কঠিন। শহীদ মিনার নির্বাক, তাই সে কথা বলে না। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন থেকেই যায়। কেন জাতীয়তাবাদী নামে পরিচিতি প্রতিটি সরকারই শহীদ মিনার নির্মাণের ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখিয়েছেন সে প্রশ্নের জবাব মেলে না।। | এছাড়াও একুশে বিষয়ক নানাবিধ প্রচার এবং আন্দোলনে ব্যক্তি ও সংগঠনের ভূমিকা সম্পর্কে একটি কথা বলাই যথেষ্ট হবে যে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সংগঠক নেতৃত্ব ও কর্মীদের রাজনৈতিক চরিত্রের একটি সঠিক পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ এ সম্পর্কে সত্য-মিথ্যার শেষ রায় উচ্চারণ করতে পারবে, যা অনেকের ভুল ধারণারও নিরসন ঘটাতে পারবে। তাই বৃথা বিতর্কে না যেয়ে আমাদের উচিত ঐ গবেষণামূলক কাজটি হাতে নেয়া এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌছা। তাতেই বােঝা যাবে ভাষা আন্দোলনে তমদুন মজলিস থেকে বামপন্থী। সংগঠনগুলাে এবং মধ্যপন্থী আওয়ামী মুসলিম লীগ ও তার ছাত্র সংগঠনে সংশ্লিষ্ট নেতাদের মধ্যে কার কতটা ভূমিকা রয়েছে। এবং তা কতটা ইতিবাচক, কতটা। নেতিবাচক। বিশ্লেষণ ও পরিসংখ্যানমূলক এ কাজটি সত্যই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের জন্য খুব জরুরি।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য – আবদুল মতিন, আহমদ রফিক