You dont have javascript enabled! Please enable it! কী পেয়েছি একুশের আন্দোলন থেকে - সংগ্রামের নোটবুক

কী পেয়েছি একুশের আন্দোলন থেকে

এ দেশে ভাষা আন্দোলনের সূচনা সুস্পষ্টভাবে আটচল্লিশের মার্চ থেকে হলেও এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ ও লেখার মাধ্যমে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সচেতন প্রয়াস আন্দোলনের সহায়ক পটভূমি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে পাকিস্তান নামের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন থেকেই মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে বলতে থাকেন, উর্দুই হবে ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ধরনের বক্তব্যে উদ্বিগ্ন কিছুসংখ্যক বাঙালি সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী যুক্তি ও তথ্যের ভিত্তিতে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে সােচ্চার হন। সাতচল্লিশের শেষ দিকে একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে যে বিক্ষোভ, তাতে সীমাবদ্ধ পরিধিতে হলেও ভাষিক চেতনার প্রকাশ বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। পাকিস্তান সরকারের পূর্বোক্ত বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে যে ভাষিক বিক্ষোভ আটচল্লিশের মার্চে আন্দোলনে পরিণত, সেই ধারাবাহিকতায় বায়ান্নর ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। গােটা পূর্ববঙ্গ উত্তাল হয়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। বলা যায়, এটা ছিল এক ধরনের ভাষিক উপপ্লব। ফলে সরকারকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে বাংলার পক্ষে সুপারিশ প্রস্তাব পাস করতে হয়। কিন্তু গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য নূর আহমদের বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে আনা প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায় ।

স্বয়ং নুরুল আমিন, নাজিমুদ্দিন ও দলের অন্য সবাই বাংলার বিরুদ্ধে ভােট দেন। ভাষিক বিশ্বাসঘাতকতার চমৎকার নজির রাখেন তারা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে একাধিকবার এ ধরনের প্রতারণা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন মুসলিম লীগ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।  একুশের আন্দোলন বাংলার দাবি আদায়ে তাৎক্ষণিক জয় পায়নি। তবু এর ধারাবাহিক তৎপরতা ওই দাবির পক্ষে জোরালাে পটভূমি তৈরি করে। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সম্মেলন এর প্রমাণ। পরবর্তী বছরগুলােতে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ দিবস পালন দেশের রাজনৈতিক  সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে গণতান্ত্রিক ও ভাষিক চেতনার বিস্তার ঘটায়, বাংলার পক্ষে যে জনসমর্থন তাতে প্রকাশ পায়, সে প্রভাবে পূর্ববঙ্গের সাধারণ নির্বাচনে (১৯৫৪) যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার এককাট্টা বিজয় এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি নিশ্চিত হয়ে ওঠে। মুসলিম লীগের পক্ষে জনসমর্থন প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়ায়। পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। | কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসকদের ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অকালমৃত্যু হলেও একুশে-উত্তর প্রভাবে জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিবাদী চেতনার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রকাশ ক্রমেই বাড়তে থাকে। হয়তাে এসব লক্ষ করে পাকিস্তান গণপরিষদে ২৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৬) ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের নতুন সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ও বাংলা।’ কিন্তু বাংলার ব্যবহার ঠেকাতে এই বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যে সরকারি কাজে আরও ২০ বছর ইংরেজি ব্যবহৃত হবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। বাংলা রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক ওই অর্জনের বাইরে একুশে আমাদের জাতীয় জীবনে যা দিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ভাষা ও সাহিত্যক্ষেত্রে এক নয়া চেতনার প্রকাশ, যা একাধারে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিবাদী চরিত্রের। একইভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনুরূপ চেতনার প্রকাশ ঘটেছে এবং তা নানামুখী। বাধা সত্ত্বেও। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জনস্বার্থনির্ভর স্লোগান এখন পর্যন্ত পুরােপুরি অর্জিত না হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

এ ছাড়া বাঙালির জাতীয়তাবােধক আত্ম-অন্বেষা ও আত্মচেতনার ধারা। একান্তভাবে একুশের দান। এ ধারায় সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী মনােভাবের প্রকাশ ক্রমেই বিস্তার লাভ করে, বিশেষ করে শিক্ষিত মহলে। এমন এক ইতিবাচক জাতীয়তাবােধের প্রকাশ ঘটেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরােধী উচ্চারণে ; পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও’। ওই আহ্বান দাঙ্গা রােধে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং এ ক্ষেত্রে আমির হােসেন চৌধুরীর শহীদ হওয়ার ঘটনাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ওই মানবিক চেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ বিস্মিত ও বিচলিত করেছিল পাকিস্তানের অবাঙালিপ্রধান কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠীকে। তাই ষাটের দশকের অধিকাংশ সময়জুড়ে চলেছে সামরিক শাসন। আর পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর বরাবর চেষ্টা ছিল পূর্ববাংলায় ক্রমবর্ধমান গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ধর্মীয় চেতনার প্রভাবে বিনষ্ট করে দেওয়ার। তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। | আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ কথা সত্য যে পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকজুড়ে একুশের চেতনা ‘শহীদ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আধিপত্যবাদী পাকিস্তানি শাসক শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রেরণা জুগিয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের প্রকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছে। স্বৈরশাসন বা সামরিক শাসনও তা রুখতে পারেনি। তাই একুশের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার  অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল না, ছিল গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের নেপথ্য শক্তি। এ শক্তির ধারাবাহিকতায় সম্ভব হয়েছিল উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, এমনকি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ। আর ওই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন ভাষিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ।  একুশে এভাবে আমাদের জাতীয় জীবনের নানামাত্রিক অর্জনে অবদান রেখেছে। একুশের স্মারক স্থাপত্য শহীদ মিনার এখনাে স্বাধীন বাংলাদেশে হয়ে আছে সব ধরনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক ও প্রেরণা। তাই দলমত-নির্বিশেষে সব গণতান্ত্রিক শক্তিরই যাত্রা শুরু করতে হয় শহীদ মিনার থেকে। তা ছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এদিক থেকে ভিন্ন মাত্রার অর্জন একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ১৯৯৯ সালে একটি বৈশ্বিক সংস্থার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি, যা আমাদের জন্য গর্ব ও অহংকারের বিষয়।

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক