মূল পরিকল্পনার শহীদ মিনার গড়ে তােলা হােক
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের মুসলিম লীগ সরকার মেডিকেল ছাত্রদের হাতে গড়া ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে খুঁড়িয়ে ফেলে। কিন্তু শহীদ স্মৃতির প্রতীক মরেনি। দেশের সর্বত্র গড়ে উঠেছিল শহীদ মিনার নামে শহীদ স্মৃতির প্রতীক ছােটবড় স্থাপত্য। একুশের আন্দোলন যেমন গণতন্ত্রমনা রাজনীতিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবসের মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে এবং অনুকূল। পরিবেশে ওই দিন সরকারি ছুটি ঘােষণা করতে, তেমনি আড়াই দিন স্থায়ী প্রথম শহীদ মিনার পথ তৈরি করেছিল জাতীয় পর্যায়ে শহীদ মিনার তৈরির দায় পূরণ করতে অস্বীকার করা কঠিন, স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় ওই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি না হলে শহীদ। স্মৃতির স্মরণে শহীদ মিনার তৈরি হতাে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জনের পর ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীর। যুক্তফ্রন্ট সরকার ওই সব দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছিল। কারণ, ওগুলাে ছিল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার, ২১ দফার অংশ। কিন্তু কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রে ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল এবং পূর্ববঙ্গে ৯২-ক ধারার আধা-মার্শাল ল জারি হওয়ার পর ওই সব প্রতিশ্রুতি পূরণের সম্ভাবনায় বাধা পড়ে। কিন্তু ১৯৫৬ সালে কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হােসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয় এবং ওই দিন মিনারের বর্তমান অবস্থানের স্থানটিতে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় । এতে অংশ নেন আবু হােসেন সরকার, মওলানা ভাসানী ও শহীদ বরকতের মা। হাসিনা বেগম। মন্ত্রিত্বসংকট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সরকার সাহেবের আমলে শহীদ মিনারের কাজে হাত লাগানাে সম্ভব হয়নি। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান শহীদ মিনার তৈরির কাজ হাতে নেন। শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি ছিল বিশাল ও আকর্ষণীয়, সঙ্গে ছিল নভেরা আহমদের ভাস্কর্যের সংযােজন। সন্দেহ নেই, পরিকল্পিত নকশা ও মডেল পুরােপুরি বাস্তবায়িত হলে শহীদ মিনার শিল্পগুণে দেশবিদেশে অনেক সমাদর পেত।
এত বড় কাজের জন্য দরকার পড়ে পর্যাপ্ত সময় । পরবর্তী তিন মাস কঠিন পরিশ্রমের ফলে তৈরি হয় মিনারের ভিত, মঞ্চ ও তিনটি স্তম্ভ। এ ছাড়া হাজার বর্গফুটের একটি ম্যুরাল চিত্রের দুই স্তরের কাজও শেষ হয় এবং নভেরা আহমদ তিনটি ভাস্কর্যের কাজও এ সময়ের মধ্যে শেষ করেন। বাংলা বর্ণমালা দিয়ে সাজানাে রেলিং এবং অন্যান্য কাজে যে রােমান্টিক বাস্তবতা ধরা ছিল, বর্তমান লেখার ছােট্ট পরিসরে তা বিশদ বলা সম্ভব নয়। মূল পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু হলেও সরকারি হস্তক্ষেপে সংক্ষেপে দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা চলে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। মিনারের কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায় ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খার সামরিক শাসনের কারণে। শহীদ মিনার সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ এতটাই প্রবল ছিল যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন থেকে শুরু করে এ সময় অসম্পূর্ণ স্থাপত্যেই প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাপ্রেমী মানুষ ফুল দিয়েছে, আনুষ্ঠানিক কর্তব্য শেষ করেছে। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর আজম খানের আগ্রহে ১৯৬২ সালে অসমাপ্ত শহীদ মিনারের কাজ শেষ করার জন্য ১৪ সদস্যের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যে কমিটি গঠিত হয়, তাতে সংস্কৃতি অঙ্গনের নামীদামি ব্যক্তি অনেকে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। দুঃখজনক যে ওই কমিটি গােটা পরিকল্পনা হেঁটেছুটে সংক্ষিপ্ত আকারে কাজ শেষ করার যে সুপারিশ করে, তাতে একটি সুন্দর ও সম্ভাবনাময় স্থাপত্য-ভাস্কর্যের অপমৃত্যু ঘটে। তড়িঘড়ি করে সংক্ষিপ্ত আকারে শহীদ মিনারের কাজ শেষ হওয়ার পর ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন এবারও হাসিনা বেগম। এটাই আমাদের বহু পরিচিত শহীদ মিনার, যা হয়ে উঠেছে আমাদের। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আদর্শিক কেন্দ্রবিন্দু। তাই একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে ধ্বংস হয় শহীদ মিনার। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শহীদ দিবস উদ্যাপিত হয় ওই ধ্বংসস্তুপেই। এরপর স্বাধীন বাংলার কারিগরদের হাতেও শহীদ মিনারের কাজ শেষ হয় জোড়াতালি দিয়ে (১৯৭৩)। মূল পরিকল্পনার দিকে ফিরে তাকানাের সময় হয়নি কারও। এমনকি রাষ্ট্রপতি এরশাদ কিছুটা সংস্কারে হাত দিলেও মূল কাজ অধরাই থেকে যায় । শহীদ মিনারটিকে মূল পরিকল্পনায় গড়ে তােলার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিটি সরকারের অবহেলা দুঃখজনক। অথচ শহীদ মিনার নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। তাই আমাদের দাবি, হামিদুর রহমানের মূল পরিকল্পনা, মডেল ও নকশামাফিক শহীদ মিনার নতুন করে নান্দনিক স্থাপত্যে গড়ে তােলা হােক। জাতীয় চেতনার প্রতীক বলে বর্তমান সরকারেরও এটা দায় এবং কর্তব্য।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক