You dont have javascript enabled! Please enable it! শহীদ মিনার স্মৃতির মিনার - সংগ্রামের নোটবুক

শহীদ মিনার স্মৃতির মিনার

২৪ ফেব্রুয়ারি রােববার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। মিষ্টি রােদের সকালে মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে সদ্য তৈরি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের পাশে দাঁড়ানাে মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র। গায়ে পাতলা চাদর। কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে ওরা চেয়ে আছে ওদেরই তৈরি সৃষ্টিকর্মের দিকে। ভাবতে পারছে না বিনা উপদ্রবে কীভাবে কাজটা শেষ হলাে। বেলা বেড়ে যেতে তারা দেখে, দু-চারজন করে মানুষ আসছে স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে। তাদের চোখে বিস্ময় আর বিনম্র শ্রদ্ধার প্রকাশ। এত তাড়াতাড়ি কী করে ওরা খবর পেয়ে গেল কে জানে? যেভাবেই হােক খবর তাদের কাছে পৌছে গেছে। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে মানুষ আসছে, মানুষ যাচ্ছে। দেখতে দেখতে স্মৃতিস্তম্ভ ঘিরে মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতলে ফুল, টাকা-পয়সা, এমনকি কখনাে অলংকার। মানুষের হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা-ভালােবাসার প্রকাশ ঘটায়। উপস্থিত দর্শনার্থীদের মধ্যে পুরান ঢাকার বাসিন্দাই বেশি। হতে পারে তারা বিগত দিনের ভুল শুধরে নিচ্ছে। একদিকে ভাষার প্রতি মমতা ও আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, অন্যদিকে সরকারের প্রতি ঘৃণা ও বিরূপতার প্রকাশ। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যােগ করে। জনমনে শাসকদের প্রতি ঘৃণা। নতুন করে বেড়ে ওঠে। ২৪, ২৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি—এ তিন দিন ব্যারাক প্রাঙ্গণ আবার জনতার ভিড়ে ভিন্ন চেহারা পেয়ে যায়। এসব খবর নিশ্চয়ই সরকার ও প্রশাসনিক কক্ষে পৌছে থাকবে। ২৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির খবরটা এভাবে ছাপে ; ‘শহীদ বীরের স্মৃতিতে/রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যেসব শহীদ বীর গত ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের নিষ্ঠুর গুলিতে বুকের রক্তে ঢাকার মাটি রাঙাইয়া দিয়াছেন তাহাদিগকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রগণ হােস্টেল প্রাঙ্গণে নিজ হস্তে এক রাত্রির মধ্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়াছেন।’  নিজেদের কৃতিত্বে উদ্দীপ্ত মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের দু-একজনের উদ্যোগে তড়িঘড়ি শহীদ সফিউর রহমানের বাবাকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করানাে হয়।

পরে সর্বজনীন সিদ্ধান্তমাফিক আইন পরিষদ থেকে ইস্তফা দেওয়া আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন। উপস্থিত মেডিকেলছাত্রদের দু-একজন ওই অনুষ্ঠানের ছবিও তােলেন। দু-তিন দিনের মধ্যেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে ওঠে আলােচনার অন্যতম বিষয়—ঘরে-বাইরে, অন্দরমহলে। হয়ে ওঠে আন্দোলনের জন্য নতুন প্রেরণা। তখনাে ঢাকায় হরতাল চলছে, পথে পথে মিছিলও চলছে। এসব দেখেশুনে হয়তাে শাসকশ্রেণীর টনক নড়ে। আন্দোলনে নতুন করে উদ্দীপনার উৎস স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় নুরুল আমিন প্রশাসন। শক্তিমান এ শত্রুকে তারা নিশ্চিহ্ন করার তাগিদ অনুভব করে। কারণ, জীবিত শত্রুকে গুলি করে মারা যায় কিন্তু ইটের পাঁজরে গুলি লক্ষ্য ভেদ করে না। তাই ঠিক আড়াই দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার কাজ শেষ করে সশস্ত্র পুলিশ।

সেদিন শেষ বিকেলে হঠাৎ আসা একদল সশস্ত্র পুলিশ মেডিকেল হােস্টেল ঘিরে ফেলে। অন্যরা ট্রাক ভর্তি সরঞ্জাম নিয়ে ভেতরে ঢােকে। রাইফেল হাতে কয়েকজন পুলিশ উপস্থিত ছাত্রদের দিকে তাক করে বসে থাকে। এবারও সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে নিরস্ত্র ছাত্রদের পক্ষে লড়াই করা সম্ভব ছিল না। তাই বাঁচানাে যায়নি। মমতায় গড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি। অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না তাদের। তাদের চোখের সামনে স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে টুকরাে টুকরাে করে ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে যায় পুলিশ। মাটি খুঁড়ে শেষ ইটটিও তুলে নেয় তারা। পেছনে পড়ে থাকে ধোয়া আর ধুলাে। সেই সঙ্গে স্মৃতি।  পরদিন দৈনিক আজাদ-এ ছােট্ট এক টুকরাে খবর ছাপা হয় : গতকল্য মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে শহীদানের যে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করা হয়েছিল পুলিশ সন্ধ্যায় তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে।’ ব্যস, এটুকুতেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের নিশ্চিহ্ন হওয়ার বার্তা সম্পন্ন। কিন্তু নুরুল আমিন সরকার বুঝতে পারেনি যে ইটের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলা গেলেও একুশের প্রতীক এ স্মৃতিস্তম্ভ মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ঠিকই ব্যর্থ হয়েছিল সরকার। | কারণ, এ স্মৃতিস্তম্ভের আদলে এবং পরে অন্য চেহারায় দেশময় ছােট-বড় নানা আকৃতির শহীদ মিনার গড়ে উঠেছিল। যেমন শিক্ষায়তন প্রাঙ্গণে, তেমনি অন্যত্র । শহীদ মিনার স্মৃতির মিনার হয়ে স্থায়িত্ব পেয়েছে। বলা দরকার, প্রথম শহীদ স্মারক স্থাপত্যটি স্মৃতিস্তম্ভ’ নামে গড়া হলেও মানুষের মুখে মুখে তা শহীদ মিনার নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। পরে এ নামটি স্থায়ী হয় এবং সরকারি পরিকল্পনায় নতুন করে শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংস করেছিল শহীদ। মিনার। তবু ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে কালজয়ী হয়ে রয়েছে একুশের সংগ্রামী চেতনার প্রতীক শহীদ মিনার, যা জাতীয় চেতনারও প্রতীক। স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙা প্রসঙ্গে আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতাটির আবেগ ও উদ্দীপনা কখনাে ভুলে যাওয়ার মতাে নয়।

 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক