ভাষা আন্দোলনে তমদুন মজলিস
যেকোনাে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের তত্ত্বগত ও সাংগঠনিক তৎপরতার দুটি দিক থাকে। ভাষা আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। অনেক সময় আন্দোলনের তাত্ত্বিক দিক লেখালেখির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেমন পেয়েছে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে, অনেকটা বহুকথিত রাম জন্মানাের আগে রামায়ণ লেখার মতাে। ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্বটিকে আন্দোলনের পটভূমিও বলা চলে। সাতচল্লিশ সালের জুন-জুলাই থেকে নভেম্বর অবধি বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লেখা প্রবন্ধাদি ওই পটভূমি তৈরি করে। দৈনিক পত্রিকা ইত্তেহাদ, আজাদ, মিল্লাত বিভাগ-পূর্বকালে ও পরে বাংলার পক্ষে রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক নিবন্ধাদি প্রকাশ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মাসিকপত্র কৃষ্টি ও সওগাত-এ অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। স্থানীয় পত্রিকা ঢাকা প্রকাশ সংবাদ পরিবেশন ও সম্পাদকীয় মন্তব্যের মাধ্যমে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখে। তমদুন মজলিস প্রকাশিত পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উদুর্তে সংকলিত প্রবন্ধ তিনটিও ভাষা প্রসঙ্গে একই কারণে উল্লেখযােগ্য। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পাকিস্তান ও তার স্থপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ঘিরে বাঙালি মুসলমানের মনে ছিল স্বাপ্নিক মুগ্ধতা। পাকিস্তানি নেতাদের সবাই তখন উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কথা বলে চলেছেন। এ অবস্থায় বিপরীত স্রোতে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তােলা সহজ ছিল না। তবু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ শক্তি নিয়ে মুসলিম লীগের প্রবল প্রতাপের মধ্যে ঢাকায় সাতচল্লিশের জুনে কামরুদ্দীন আহমদের চেষ্টায় গঠিত হয় গণ আজাদী লীগ, এরপর চেষ্টা চলে প্রগতিবাদী যুব সংগঠন গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের। সেপ্টেম্বরে গঠিত হয় সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন পাকিস্তান তমদুন মজলিস, মূলত অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে। প্রধানত রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বাংলার ব্যবহার ওই সংগঠনে সর্বাধিক গুরুত্ব পেলেও মতাদর্শগত দিক থেকে পাকিস্তানে ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল। মজলিসের মূল লক্ষ্য।
তবে এ কথাও সত্য যে ভাষার প্রশ্নে গণ আজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক যুবলীগের তুলনায় শুরুতে তমদুন মজলিস ছিল অনেক বেশি সক্রিয়। কিন্তু বিরাজমান রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে মজলিস এককভাবে বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। মজলিসের নেতাদের তৎপরতাও যে শুরুতে আলাপ-আলােচনা ও তাত্ত্বিক লেখালেখিতে সীমাবদ্ধ ছিল, তা মজলিসপ্রধান অধ্যাপক কাসেমের স্মৃতিচারণামূলক লেখা থেকে বােঝা যায়। | আগষ্ট থেকে নভেম্বর। সংগঠনগত কোনাে ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার ব্যবহার ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম প্রতিবাদী বিক্ষোভ ঘটে সরকারি কর্মচারীদের তৎপরতায় । সদ্য প্রকাশিত পােস্টকার্ড, এনভেলাপ, মনিঅর্ডার ফরম ইত্যাদিতে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা না থাকায় মর্মাহত নীলক্ষেত ব্যারাকের সরকারি কর্মচারীদের উদ্যোগে তাদের প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় সভা-সমাবেশ, পরে মিছিল। মিছিলে উচ্চারিত স্লোগান—সবকিছুতে বাংলা চাই’, ‘উর্দুর সঙ্গে বিরােধ নাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি। কিছুসংখ্যক ছাত্রও ওই মিছিলে যােগ দেয়। এ বিক্ষোভ ঘটে ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে। এ ঘটনার গুরুত্ব বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়া সত্ত্বেও উর্দুপন্থীরা ভাষিক তৎপরতার উপলক্ষ জুগিয়ে দেয়। ২৭ নভেম্বর (১৯৪৭) করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর সুপারিশ প্রস্তাব হয়ে ওঠে উপলক্ষ। ঢাকার ছাত্রদের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সভাপতিত্ব করেন মজলিসপ্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেম। মজলিস ও যুবলীগের কর্মীরা এতে যােগ দেন। সভা শেষে ছাত্রকর্মীদের মিছিল ও ভাষার পক্ষে যথারীতি স্লোগান। পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আসার পরিপ্রেক্ষিতে তমদুন মজলিসের অফিসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ডিসেম্বরের শেষ দিকে গঠিত (বশীর আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস) ওই সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনােনীত হন মজলিসের সক্রিয় কর্মী নূরুল হক ভূঁইয়া।
এ সভায় কিছুসংখ্যক অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীসহ গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তমদুন মজলিসের নেতা-কর্মী, ছাত্রলীগের ভিন্ন ধারার কর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হন অধ্যাপক আবুল কাসেম, মহম্মদ তােয়াহা, শামসুল আলম, নঈমুদ্দিন আহমদ, ফরিদ আহমদ, শওকত আলী, আবুল খায়ের, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী প্রমুখ। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদ বহুদলীয় হওয়া সত্ত্বেও তমদুন মজলিসপ্রধান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলার দাবিতে আন্দোলন সংঘটনে সফল হয়নি। আটচল্লিশের প্রথম দিকে নঈমুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হওয়ার পর বাংলার পক্ষে সাংগঠনিক শক্তি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে চেষ্টা ছিল প্রগতিবাদী ছাত্র-যুবনেতাদের, যাতে সম্মিলিতভাবে ভাষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তােলা যায়। এ নীতির প্রকাশ ঘটে ১৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) প্রকাশিত একটি বিবৃতি ও ইশতেহারে, যাতে স্বাক্ষর রয়েছে অলি আহাদ ও সরদার ফজলুল করিম থেকে নঈমুদ্দিন আহমদ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, আবুল কাসেম, নুরুল হক ভূঁইয়া প্রমুখর। ইশতেহারের মূল বক্তব্য ; “আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের নিকট আবেদন জানাইতেছি, তারা যেন বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য আগাইয়া আসেন।…মনে রাখা উচিত বাংলাব্যাপী এক আন্দোলন গড়িয়া তােলা ছাড়া বাংলাভাষা যথাযােগ্য স্থান পাইবে না। তবু মজলিসপ্রধানের বরাবর অভিযােগ : অতিপ্রগতিবাদীরা আন্দোলনে যােগ দেয়নি, বরং আন্দোলন স্যাবােটাজ করার চেষ্টা করেছে।’ এ অভিযােগ যে সঠিক নয়, বিচ্ছিন্ন বা সংগঠিত আন্দোলনে যুক্ত নেতৃস্থানীয় ছাত্র-যুবাদের রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই বােঝা যায়। এমনকি বােঝা যাবে ১১ মার্চে সংঘঠিত ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে সংগ্রাম পরিষদের পুনর্গঠন, মূল আন্দোলনে মজলিস-বহির্ভূত নেতাদের ভূমিকা, জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার পর আন্দোলনে তমদুন মজলিসের অনীহা ও তাদের অযৌক্তিক বামবিরােধিতা ইত্যাদি ঘটনার বিশ্লেষণে।
মার্চের আন্দোলন স্থগিত করার জন্য মজলিসের আগ্রহ এবং আন্দোলন স্থগিত করে বিজয়’ ঘােষণা আর সে উপলক্ষে মজলিসপ্রধানের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ইত্যাদি ঘটনা থেকেও মার্চের আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্বোক্ত ভাষাবিক্ষোভ ও আন্দোলনের অতি সংক্ষিপ্ত বয়ান শেষে বলা চলে যে ভাষা আন্দোলনের একেবারে প্রাথমিক পর্বে তমদুন মজলিসের সক্রিয় ভূমিকা সত্ত্বেও মতাদর্শগত সংকীর্ণতার কারণে আন্দোলনের সম্মিলিত প্রয়াসের ক্ষেত্রে মজলিস পিছিয়ে পড়ে। বামপন্থীদের প্রতি অসহিষ্ণুতাও আরেকটি কারণ। এ বিষয়ে। বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়ে কয়েকটি নির্ভরযােগ্য মতামত তুলে ধরাই বােধ হয় যথেষ্ট। যেমন, ‘সূচনাকালে ভাষাসংক্রান্ত বাস্তবসম্মত ও গণতান্ত্রিক প্রস্তাব রেখেও তমদুন মজলিস যে আন্দোলন থেকে পিছিয়ে পড়েছিল, সে সম্পর্কে বশীর আল হেলাল মনে করেন, ‘সংগঠন হিসাবে তমদুন মজলিস পরে আর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম পর্বের মতাে যুক্ত থাকতে পারেননি’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ১৮৩)। বিষয়টা বােধ হয় পারা না-পারার নয়, যুক্ত থাকতে চাওয়া না-চাওয়ার। এ সম্পর্কে দেওয়ান মােহাম্মদ আজরফ বাংলা একাডেমীকে দেওয়া সাক্ষাত্তারে বলেছেন : ‘ভাষা আন্দোলন ক্রমে বামপন্থী প্রগতিবাদী সমাজতন্ত্রী কর্মী, নেতা ও দলসমূহের হাতে চলে যায়। এই সব দল-নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনকে সমর্থন জুগিয়ে সমাজতন্ত্রীদের স্বার্থকে পােষণ বা সাহায্য করা তাদের আদর্শবিরােধী ছিল, তারা | বিশ্বাস করতেন ইসলামের বিপ্লবী সম্ভাবনায়’ (বশীর, পৃ. ১৮৩)।
প্রথম দিককার সংগ্রাম পরিষদ ও তমদুন মজলিসের ভূমিকা সম্পর্কে আবদুল মতিনের বক্তব্য খুব ভিন্ন নয়। তার মতে, এ সময়ে নেতৃত্বে তমদুন মজলিসের প্রাধান্য আন্দোলন বিকাশের অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে থাকে। কারণ তমদুন মজলিসের লক্ষ ছিল পাকিস্তানে একটি ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং এই উদ্দেশ্য সামনে থাকার কারণে ভাষার মতাে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়কে তাদের সংকীর্ণ। সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার বাইরে নিয়ে যেতে পারেননি’ (ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য, পৃ. ৪৭)। একই বিষয়ে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন : তমদুন মজলিস আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে, বিশেষত যখন তা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তখন। একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কিন্তু মার্চের প্রথম দিক থেকে আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে তমদুন মজলিসের গুরুত্ব এবং তাদের। নেতৃত্বের প্রভাব উল্লেখযােগ্যভাবে কমে আসে’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৬)। দেখা যাচ্ছে, আটচল্লিশের মার্চের আন্দোলন নিয়ে তমদুন মজলিসের কৃতিত্বের দাবি ভিত্তিহীন। এমনকি বায়ান্ন-পূর্ব বছরগুলােতে একুশের প্রস্তুতিপর্বে মজলিসকে বিশেষ কোনাে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। তাই দুঃখজনক যে সম্প্রতি ভাষা আন্দোলনে তমদুন মজলিসের কৃতিত্ব নিয়ে অনেক কিছু লেখা হচ্ছে, যা আসলেই ইতিহাসের বিকৃতি।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক