You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966 | ৬ দফার নেপথ্যে কারা? - সংগ্রামের নোটবুক

৬ দফার নেপথ্যে কারা?
::::::::::::::::::::::::::::::::
অলি আহাদ লিখেছেন, “১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক ভারত যুদ্ধ অবসানের পর ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন এবং গভর্নর হাউসে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। সেই বৈঠকে আইয়ুব খানকে দেয়ার জন্য খায়রুল কবীর ইংরেজি ভাষায় রচিত ৭ দফা সম্বলিত একটি দাবিনামা নূরুল আমীনকে প্রদান করেন।”২৩ সেই কপিটি তিনি ভবিষ্যত রেফারেন্সর জন্য নিয়ে আসেন। তারপর তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে ঐ সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের মুজিব বিরােধী মনোভাব বােঝা যায়। তিনি লিখেছেন, খায়রুল কবীরকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন বিবৃতিটি কার লেখা। তিনি বলেছেন, জনা ৫০ ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে রচনা করেছেন। “এই কথিতে বর্ণিত ৬ দফার নিম্নাংশ ও সাত নং দফা বাদ দিয়া যাহা অবশিষ্ট থাকে তাহাই শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা।” তিনি আরাে লিখেছেন, “পরবর্তীকালে ৬ দফা আন্দোলনের ঘটনাবলিতে আমার নিকট প্রতীয়মান হইয়াছিল যে, ইহার নেপথ্যে (ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (খ) আন্তর্জাতিক কারসাজিতাে ছিলই ভারত সরকারের গােপন হস্তও ইহাতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা প্রদান করিয়াছিল।”২৪
অলি আহাদ আরাে জানিয়েছেন, ৬ দফা নতুন কিছু নয়। ১৯৫০ সালের ৫ নভেম্বর “ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহা জাতীয় সম্মেলনে গৃহীত সাংবিধানিক সুপারিশাবলীর অভিন্ন রূপ।”২৫
ষাটের দশকের শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ বিশেষ করে অর্থনীতি বিভাগের, এই বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলােচনা শুরু করেন। এর মধ্যে উলেখযােগ্য ঘটনা হলাে, ২৬ বছরের তরুণ অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রেহমান সাবহান ১৯৬১ সালে লাহােরে ব্যুরাে অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন এর এক সেমিনারে দু’প্রদেশের বৈষম্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়েন যার শিরোনাম ছিল- ‘Indivisibility of the national economy of Pakistan.’
প্রবন্ধটি পরে ঢাকার পাকিস্তান অবজারভারে ছাপা হয়। সােবহানের দুই অর্থনীতি বিষয়ক প্রবন্ধ ব্যাপক সাড়া পেল এবং সারা পাকিস্তান জুড়ে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা শুরু হয়। এরপর এ বিষয়ে তিনি আরাে কিছু প্রবন্ধ লেখেন। বাঙালি অর্থনীতিবিদদের এসব প্রবন্ধ সেই সময়কার রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রভাব ফেলে। এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা নির্মাণে সহায়তা করে। তাঁর ভাষায়-
“… two economies which were lodged within the body politic of the then Pakistan state and the economic deprivation of the Banglis, which originated in this peculiar national constuct. These writings of mine on the economy, along with those of other Bangali economists, were influential in shaping the political debates of the time which culminated in pesentation of the 6 point agenda by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, which became them Magna cartra for the struggle for self rule for Bangladesh.”
পরবর্তীকালে (১৯৭০-৭১) ৬ দফার ভিত্তিতে কীভাবে সংবিধান রচিত হতে পারে তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গােপন আলােচনা শুরু হয়। দলের সিনিয়র কিছু নেতা ও অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম, তরুণ রেহমান সােবহান ও কামাল হােসেনকে এ গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নুরুল ইসলাম লিখেছেন, এসব আলােচনার সময় খন্দকার মােশতাককে কখনও স্বচ্ছন্দ দেখা যায় নি। খসড়া সংবিধান রচিত হলে খন্দকার মােশতাক পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকায় তা ফাঁস করে দেন। বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারণ, বঙ্গবন্ধুর স্ট্রাটেজি শত্রুরা জানলে তারা সেভাবে ব্যবস্থা নেবে। কামাল হােসেন, নুরুল ইসলাম ও রেহমান সােবহান বঙ্গবন্ধুকে তা জানান। তিনি বলেছিলেন ব্যাপারটি দেখবেন। দুই অর্থনীতি ও ৬ দফা রচনার পটভূমি হিসেবে এ ধরনের আরাে আলােচনা তার গ্রন্থে আছে।২৭
রাজনৈতিক নেতারা ৬ দফার এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলি উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন। বরং বিষােদগারে মুখর থাকেন। সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ৬ দফার বিষয়টি জানার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার নিয়ত আলাপ হতাে। একদিন “তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ৬ দফার ওপর একটি সেমিনার করলে কেমন হয়। ‘তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদের এই নপুংসক বুদ্ধজীবীরা ৬ দফার কী বুঝবে রে? আর যদি সেমিনার করতে দেই, যদি না বুঝেই বিরােধিতা করে বসে, তাহলে তাে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি।”২৮
তারপর তিনি মন্তব্য করেছেন, “আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বুদ্ধিজীবীদের কী ভূমিকা ছিল তা এখন আমরা সবাই জানি। যে ন্যাক্কারজনক, লজ্জাকর ও নেতিবাচক ভূমিকা তারা রেখেছে, মুজিব ভাইয়ের সেদিনকার কথায় আমি তার পূর্বাভাস পেয়েছিলাম। তখনকার শিল্পী সাহিত্যিকদের ব্যাপারেও একই কথা। ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে দু’একজন শিল্পী বাদে আর কাউকে আমরা স্বাধীনতার সংগ্রামে সামিল করাতে পারিনি।”২৯
নিজের দেশের মনন সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশাল অজ্ঞতা ছাড়া এ ধরনের মন্তব্য নেয়া যায় না। তার আত্মজীবনীতে এ ভাবটি স্পষ্ট যে ছাত্রলীগ গড়ায়, ৬ দফা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করায় তার ভূমিকা ছিল। নার্সিসাস ছাড়া কারাে পক্ষে এরকম ভাবা সম্ভব নয়। জীবনের শুরু থেকেই শিল্পী সাহিত্যিকদের বা বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সম্পর্ক ছিল। সিরাজুল আলম খানই আবার লিখেছেন ৬ দফা রচনায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিলে সাংগঠনিক রিপাের্টে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের গভীর বাস্তবতাবােধই একদিন আওয়ামী লীগকে জনতা ও পুঁজিজীবীদের সংগঠন করিয়া তুলিয়াছিল।… বর্তমান অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ছাড়াছড়িতে ফ্রান্সের কনভেনসনিস্টদের মত অবস্থা যেন আমাদের না হয়…।২৯ক
৬ দফা কারাে একক রচনা নয়। ১৯৪৯ সাল থেকেই যে ভাবনা অনুচ্চারিত ছিল বিভিন্ন সময় তা আলােচনায় আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ। সে পথে যাবার জন্যে ৬ দফা ছিল একটি মাধ্যম বা কৌশল। তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা বিভিন্ন ফোরামে গােপনে বা প্রকাশ্যে আলােচনা করেন। বিষয়টি কী সে বিষয়ে তাঁর ধারণা ছিল। তবে তা কাগজে কলমে স্পষ্ট ও তীক্ষ্মভাবে আসা প্রয়োজন ছিল। এ কারণে স্থায়ত্তশাসনের নির্যাস কাগজে কলমে রূপ দেয়ার জন্য তার তিন বন্ধু রুহুল কুদুস, আহমদ ফজলুর রহমান ও আতাউর রহমানের সবচেয়ে ছােট ভাই শামসুর রহমানকে ভার দেন। রুহুল কুদ্স ও ফজলুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম ব্যাচের[১৯৪৯] সিএসপি। শামসুর রহমান তার কিছুটা পরে। ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার ব্যাপারটা সমন্বয় করেছিলেন রুহুল কুদুসই। এবং ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ এই তিন জনকেই আসামী করা হয়েছিল। সুতরাং সহকর্মীদের চেয়ে পেশাজীবী বা বুদ্ধিজীবীদের ওপর তাঁর অবস্থা কম ছিল এটা দূরকল্পনা। তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে শুধু তাজউদ্দিন আহমদকে এর সঙ্গে যুক্ত করেন। সিরাজুল আলম লিখেছেন, “শেখ মুজিবের সম্মতিক্রমেই এই ৬ দফা প্রণয়নের কাজটি শুরু হয়। তিনিই তাজউদ্দিন ভাইয়ের এ কাজে ওতপ্রােতভাবে যুক্ত থাকার ব্যবস্থা করেন। উপরিউক্ত সিএসপি কর্মকর্তাদেরও তাজউদ্দিনের এই অন্তর্ভুক্তির কথা জানানো হয়। আরও দু’জনের অন্তর্ভুক্তির কথা শুনেছি। কিন্তু তারা কারা জানতে পারিনি। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার আলাপ হলেও তিনি আমাকে এই তিনজনের বাইরে আর কারও নাম বলেননি। ৬ দফা প্রণয়নকারীরা শুধু যে উচ্চশিক্ষিতই ছিলেন তা নয় জ্ঞান ও মেধার দিক থেকেও অনেক উপরে স্তরের মানুষ ছিলেন তাঁরা। ৬ দফা প্রণয়নকালে মুজিব ভাইয়ের রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা তাদের মাথায় ছিল।”৩০
নুরুল ইসলাম তাঁর বইতে লিখেছেন, “ছয় দফা দাবির খসড়া কে লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তা আমার প্রত্যক্ষভাবে জানা নেই। তবে বঙ্গবন্ধু নিজেই ছয় দফার মূল সূত্রগুলাের খসড়া তৈরি করেছেন, এমনটাই সবাই বিশ্বাস করতেন। বলা হতাে, তিনি তাজউদ্দীনকে মূল বিষয়গুলাে সাজিয়ে দফা হিসেবে লেখার জন্য নির্দেশ দেন। পরে এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাকে দিয়ে এর ইংরেজি অনুবাদ করানাে হয়, যিনি বঙ্গবন্ধুর খুবই নিকটজন ছিলেন এবং প্রথমে আগরতলা মামলার একজন। আসামি ও পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব পদে অধিষ্ঠিত হন।“ 31
৬ দফার খসড়া বঙ্গবন্ধু হয়ত অনেককে দিয়ে করিয়েছেন যার চূড়ান্তরূপ দেন এই চারজন এবং তা মুজিবের অনুমােদনের জন্য পেশ করেন। তিনি তা গ্রহণ করেন। অন্তিমে ৬ দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরই। তিনি দীর্ঘদিন এ বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অ্যাকাডেমিক বিতর্ক থেকে ইনপুট নিয়ে নিজের লক্ষ্য ও ধারণা স্পষ্ট করেছেন এবং তার লিখিত রূপ প্রদানের জন্য এঁদের ওপরই নির্ভর করেছেন।
References:
২৩. বিস্তারিত, অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, ঢাকা।
২৪. ঐ
২৫. ঐ
২৬. রেহমান সােবহানের সেইসব লেখা ও এই উদ্ধৃতাংশের জন্য দেখুন—Rehman Sobhan, From Two Economies to two Nations : My journey to Bangladesh, Dhaka, 2015; দেখুন তাঁর আত্মজীবনী, Untranquil Recollections. The Years of Fulfillment, Kolkata, 2017.
২৭. বিস্তারিত দেখুন, : An Economist’s Tale, Dhaka, 2009.
২৮. শামসুদ্দিন পেয়ারা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮-৬৯।
২৯. ঐ।
২৯ক. নূহ-উল-আলম লেনিন, প্রাগুক্ত।
৩০, ঐ।
31. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – কাছে থেকে দেখা, নুরুল ইসলাম, প্রথম অধ্যায়
৬ দফা স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু – মুনতাসীর মামুন, pp 22-24