নিজের বাপ ও পরের মা
হাফিজ আবদুল্লাহ
জনৈক বিলাতফেরৎ পি এইচ ডি ডিগ্রিওলা বাঙালি অধ্যাপক আইয়ুব-মােনেম খান চক্রের অনুগ্রহ ও খেতাব লাভের জন্য ভাষাতত্ত্বের তাবৎ পুঁথি-কেতাব ঘেঁটে প্রমাণ করেছিলেন মুসলমানরা কখনাে কোনাে কারণে দেশকে মাতৃভূমি বলতে পারেন না। বলা বাহুল্য, দ্রলােক আধুনিক ভাষাতত্ত্বে তাঁর ডিগ্রি পেয়েছিলেন। স্বয়ং জবরদস্ত গভর্নর মােনেম খান সাহেবের হুকুমে রচিত হয়েছিল এই মহান থিসিস। অবশ্য এই কথাগুলাে সেই বাঙালি অধ্যাপক স্বমুখে প্রচার করতে পারেননি, অর্থাৎ সাহস পাননি। কিন্তু মােক্ষম থিসিসটি যত্রতত্র আওড়েছিলেন গভর্নর বাহাদুর মােনেম খান। মুসলমানরা, বিশেষত: সেমিটিক রক্তধারী মুসলমানরা নাকি মাতৃভূমি কথাটা ব্যবহার করতেন। রেডিও পাকিস্তান মাতৃভূমি শব্দটিকে যমের মতাে ভয় করতাে, কারণ কোন শব্দের মাধ্যমে কখন হিঁদুয়ানি ঢােকে তার তাে ঠিক নেই। যাই হােক, পাকিস্তানে মাতৃভূমি নয়, পিতৃভূমি শব্দটিই স্বদেশের পরিবর্তে ব্যবহৃত হতে থাকে সরকারি সার্টিফিকেটের জোরে।
এখন পূর্ব পাকিস্তান নেই। বাঙলাদেশের লােকেরা এখন দেশকে মা বলে ডাকছেন। সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাঙলা আমি তােমায় ভালােবাসি। বাঙলাদেশের আপামর জনগণ এমন ‘মা’ ‘মা’ বলে দেশকে আর কখনাে ডাকেনি। এমন আর্ত কণ্ঠে তারা মা বলেছেন যে বিশ্ব তার উদাহরণ পাওয়া যাবে না। যখনই ‘আমার সােনার বাঙলা’ শুনতেন শেখ মুজিব তখনই অশ্রুসজল হয়ে উঠতাে তার চোখ এবং শুধু মুজিব নয়, বাঙলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষ আমার সােনার বাঙলা’কে মা বলে মেনে নিলেন কোন আশ্চর্য প্রভাবে। মুজিব সেমিটিক নন, না, বাঙলাদেশের কোন মানুষ সেমিটিক রক্তের কাছে ঋণী নয়। যে-অধ্যাপক নিজ স্বার্থকে চরিতার্থের জন্য দেশকে পিতৃভূমি বলে অভিহিত করবার জন্য ওকালতি করেছিলেন তিনি আজ বেঁচে আছেন কিনা জানি না। কেননা ইয়াহিয়ার হিংস্র বন্দুক বাঙালি পেলেই নির্দ্বিধায় খুন করেছে।
কিন্তু থাক সেসব কথা। ওদের নিজের বাপকে ওরা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করুক, কিন্তু আমাদের মা দীর্ঘজীবী হােন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মাতৃভূমি বাংলাদেশ অজেয় অমর হােক। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজের বাপকে রক্ষার জন্য আমাদের মাকে অজস্র নির্মম আঘাতে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। পরের মায়ের জন্য কারই বা দরদ থাকে। মায়ের কথা বলি। আমি যেমন দেখছি। আমার ছােট্ট মেয়ে না। সবার আগে বিছানা ছেড়ে ওঠে এবং গাইতে থাকে আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি। আমার দোতলার পড়ার ঘরে পাড়ার সবগুলাে ছেলেমেয়ে একত্রিত হয়ে গায় সেই গান। সকাল, দুপুর এবং বিকেলে যখনই যাবেন, দেখবেন শিশুদের মিছিল হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। শেখ মুজিবের নির্দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ভাের চারটে থেকে মিছিল শুরু হয় এবং রাত বারােটা অবধি চলতে থাকে । সমগ্র বাঙলাদেশ তখন রূপান্তরিত হয়েছে এক সুবিশাল মিছিল-নগরীতে। শ্লোগানে স্লোগানে মুখরিত দিকদিগন্ত। আপিস-আদালত, কোর্ট-কাছারি বন্ধ। সামরিক আইন জারি হচ্ছে, ধারা-উপধারা যুক্ত করে সামরিক শাসন পাকা করা হচ্ছে। একদিকে মার্শাল ল রেগুলেশন এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ রেগুলেশন। এম এল আর পরাজিত হচ্ছে এ এল আর-এর কাছে। ব্যর্থ হয়েছে ইয়াহিয়ার সমস্ত নির্দেশ। ঘটনার শুরু ৩ মার্চ থেকে। পরিণতি ২৩ মার্চ তারিখে। রেসকোর্সের ময়দানে মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘এ সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মৌলানা ভাসানী এবং অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ মুজিবকে জানালেন অকুণ্ঠ সমর্থক। আতাউর রহমান খানও এগিয়ে এলেন। মতামতের ভিন্নতা সত্ত্বেও সবাই এক হলেন। বাঙালির এই একতা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
আমি কাপড় বদলাতে গিয়ে কালাে ব্যাজ পরতে ভুলে গিয়েছি হয়তাে। আমার ছােট্ট মা-মণি লুনা অমনি বলেছে, “ওমা তােমার কি ভুলাে মন আব্বা, কালাে ব্যাজ পরনি। ছােট্ট দুটি হাতে ও কত যত্নে পরিয়ে দিয়েছে ব্যাজ। সমগ্র শহর যেন কালাে পতাকার নগর। সাইকেল, রিকশায়, গাড়িতে, বাসায় আপিসে সর্বত্র উড়ছে কালাে পতাকা। মুজিবের নির্দেশ অমান্য করে কে। চারিদিকে অতন্ত্র প্রহরা। ২০ মার্চ কালাে পতাকার সঙ্গে উড়লাে স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হলাে। আপিস-আদালতে, স্কুলে-কলেজে, সেক্রেটারিয়েট ভবনে এবং বিদেশি দূতাবাসগুলােতে উড়িয়ে দেয়া হলাে স্বাধীন বাঙলার পতাকা। ছেলে-মেয়েরা বুকে এবং জামার হাতায় ছােট্ট পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াল। বুকে গুলি লেগে পতাকা রক্তে ভিজে গিয়েছে, কিন্তু পতাকা ফেলেননি বাঙলাদেশের অজেয় সন্তানেরা।
একদিন বাসা থেকে বেরােবার সময় লুনা বললে, ‘আব্বা, তুমি কিন্তু কী একটা’। বললাম, কেন রে? ওর ছােট্ট হাতের তালুতে ধরা এক টুকরাে মুদ্রিত পােস্টার। তাতে রয়েছে ।
আমার বুকে ওটা পিন দিয়ে আটকে দিয়ে ও আমাকে বলেছিল, ওটা কোথাও খুলে রেখাে না কিন্তু। না, খুলে আমি রাখিনি। যেদিন সীমান্ত পার হয়ে আসি তখন লুনার জামাতেও ওটা লাগানাে ছিল। এপারের লােকেরা সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেছে, ওটার অর্থ কী? অর্থ আমি সবাইকে বােঝাতে পারিনি। লুনা যে পেরেছে তাও মনে হয়নি। তবে প্রতিটি বাঙলা বর্ণ সেদিন ছিল বাঙালির ঐক্যের প্রতীক। একটি বর্ণ একটি বিশাল পােস্টার। এই বর্ণও ওরা রক্তে ভিজিয়ে দিয়েছে। ওপার বাংলার লােকেরা রক্ত দিয়ে কিনেছে প্রতিটি বাঙলা বর্ণ। রবীন্দ্রনাথও আমরা অর্জন করেছিলাম ঐ রক্ত দিয়ে। আমার সােনার বাঙলা’ গাইতে গাইতে প্রাণ দিয়েছে বাঙলা মায়ের বিদ্রোহী সন্তানেরা। ঐ গান গাইতে গাইতে মিলেছি মােরা মায়ের বুকে।
নিজের বাপকে ওরা রক্ষা করতে চাচ্ছে পরের মাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, বলি দিয়ে, দুনিয়া থেকে তার শেষ চিহ্নটুকু মুছে দিয়ে। সেই নির্মম গণহত্যা, অত্যাচার এবং লুঠতরাজের বর্ণনা করা যায় এমন ভাষা আমার জানা নেই। কিন্তু সকলের জানা উচিত ওপার বাংলায় কী হচ্ছে। বন্দুকের গুলির সঙ্গে বাঙলাদেশের মানুষের পরিচয় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে। অবশ্যই এটাই স্বাভাবিক। পরের ছেলে এসে আমাদের মায়ের সেবা করবে, এটা আশা করা যায় না।
মনে করবার ন্যায়সঙ্গত কারণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী বাঙলাদেশকে কখনও একই ভূখণ্ডের আর-একটি মহান অংশ বলে মনে করেনি। ওরা সবাই পরের ছেলে। সােজা এবং পরিষ্কার কথা। এবং আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে, ওরা বাঙলাদেশকে লুণ্ঠন করবার উপযােগী একটি চমৎকার উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই ভাবেনি। উপনিবেশের প্রতি যেমন আচরণ করা উচিত ঐ পরের ছেলেরা তার বেশি কিছু করেনি। একদিন সামরিকবাহিনীর ট্রাক যাচ্ছে, একদল ছােট শিশু কৌতূহলবশত ট্রাকের পাশে গেলে পাকি-সেনারা নেমে এসে প্রত্যেকের পেটে বুটসুদ্ধ লাথি মেরে রাস্তায় পাশে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল। পাড়ার মা-বােনেরা সবাই বেরিয়ে এসে ট্রাকভর্তি পাকি-সেনাদের ঘিরে ফেলে প্রশ্ন করেছিল, কেন মারছে। নিরপরাধ শিশুদের? জবাব দিয়েছিল ওরা রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজ করে । মা-বােনেরা হটে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। এর কদিন পরের ঘটনা। সে পাড়ার সমস্ত মা-বােনেরা, রাইফেল আর বন্দুক তুলে দিলেন সন্ত নিদের হাতে। বললেন, হয় মারবি আর না হয় মরবি।
এ পাড়ার সব কটি তরুণ কিশাের যােগদান করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। একজন মায়ের কথা মনে পড়ছে তিনি তার তিন ছেলেকেই পাঠালেন লড়াই করবার জন্য। বাঙালি মায়ের এই চেহারা এর আগে এমনভাবে কখনাে দেখিনি।
তেসরা মার্চ। রাজশাহী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকের মিছিলে গুলি চালালাে পাকি সেনারা। এক তরুণ ছাত্র বুলেটের আঘাতে আহত হয়ে এক বন্ধুর সাহায্যে পাশের একটি ব্যাঙ্কের বারান্দায় নিজের নিজের রক্ত দিয়ে রচনা করলাে এক দুর্জয় রক্তাক্ত পােস্টার-বাঙলাদেশকে মুক্ত করাে। আজও সে লেখা রয়েছে ব্যাঙ্কের গায়ে। ঐ দিনই ওখানে শহিদ হয়েছিলেন আটজন। আহত হয়েছিলেন আঠারােজন। এই আহতদের অনেককেই পরে হাসপাতালে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিনের আর একটি ঘটনা। মুজিবের ডাকে ধর্মঘট অব্যাহত। আহতদের নিয়ে যাবার রিকশা পর্যন্ত নেই। এমন সময় বিশু রিকশাওয়ালা বিদ্যুৎ গতিতে তার রিকশা নিয়ে এল। একই রিকশায় চারজন। পেছন থেকে ঠেলছে অন্যেরা। এভাবেই বিশু আহতদের নিয়ে এল হাসপাতালে। কিন্তু বিকেলবেলা বিশু যখন পুরনাে হাসপাতালের মােড়ে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ একটি সামরিক গাড়ি এসে বিশুকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লাে গুলি। এফোঁড় ওফোড় হয়ে গেল বিশু।
তেসরা মার্চ থেকে আজ অবধি গুলি চলছে। বােমা পড়ছে। গােলা ছুটাছে। বাড়িঘর ধ্বংস করছে। পুলিশ। নেই। সীমান্তে প্রহরা নেই। শান্তিরক্ষার জন্য আনসার বাহিনী নেই। দিনের বেলা শহরগুলাে জন-মানবহীন। রাতে সেখানে নামে শ্মশানের নিস্তব্ধতা ! রাতের অন্ধকারে আসে চোর-ডাকাত আর সামরিক বাহিনীর সাঙাতেরা। জন-মানুষহীন বাড়িগুলাে ওরা লুট করছে। দু-একটি বাড়িতে লােক থাকলে তাদেরকে ছুরিকাঘাতে নিহত করছে। ভালাে ভালাে বাড়িগুলাে অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানিরা দখল করছে। দরজায় লিখে রাখছে নিজেদের নাম। ধান-চালের আড়তগুলাে পুড়িয়ে দিচ্ছে অথবা লুট করছে। মাছ-ভরা পুকুরগুলােতে রকেট মেরে মাছ ধরার উৎসব চালাচ্ছে। দুধেল গাইগুলােকে হত্যা করে পেট ভরাচ্ছে পাকি-সেনারা ঘরে ঢুকে নিষ্ঠুরভাবে লােক মারছে বাপের সামনে ছেলেকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, ছেলে-মেয়েদের সামনে বাপ-মাকে। আহত লােকেরা মৃতদেহের পাশেই পড়ে থাকছে। কেননা তাদের দেখার লােক নেই। রাতের বেলা শেয়াল-কুকুর এসে আহতদের গা থেকে দাঁত বসিয়ে খুলে নিচ্ছে খাবলা খাবলা মাংস। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স নেই। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি আর আপিস নিশ্চিহ্ন। আগুন নেবানাের ব্যবস্থা নেই। যুবকদের দেখলেই সেনাদলের নির্ঘাত সীমা তাদেরকে হত্যা করছে। বাপ-মায়ের চোখের সামনে একজন যুবতীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হলাে। সতীত্ব নাশ করেও ক্ষান্তি নেই। এক মসজিদের একজন ইমাম পাকি-সেনাদলের মেজরের কাছে এঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। মেজর সাহেব বলেছিলেন—আওয়ামী লীগকে যারা ভােট দেয়, তাদের আবার সতীত্ব কিসের। ইমাম সাহেব ফিরে আসছিলেন, পেছন থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করা হলাে। ঘটনার সাক্ষী রাখতে চায় না পাকি-সেনারা। একজন মহিলা তার কিশাের-পুত্রকে হত্যা না করার জন্য মেজরের পা জড়িয়ে ধরেছিলেন। উত্তরে দুজন সেনা বেয়নেট দিয়ে সেই মায়ের দুই স্তনই কেটে নামিয়ে দিলে। কিশাের পুত্রের লাশের উপর সংজ্ঞা হারিয়ে পড়লেন সেই মা। না শুধু সেই মা নয়, আমার বঙ্গ-জননী ধর্ষিতা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আমার মা, তােমার মা, সকলের মা।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ মে ১৯৭১