You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.12 | পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থকরা শহরে ঢুকছে কলকাতা ভারত - সংগ্রামের নোটবুক

বিদেশীদের ঢাকা ত্যাগের ওপর আরােপিত বাধা পাকিস্তান আজ শিথিল করেছে এবং ভারতে এসে পৌছনাে উদ্ধারকৃতরা জানাচ্ছেন যে, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী যতই এগিয়ে আসছে বাঙালিরা দলে দলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তারা আরাে জানান, বাঙালিদের ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সাড়ে আট মাসব্যাপী বাঙালি-পীড়নে পাকবাহিনীর সহযােগী বিহারি ও অন্যান্য অবাঙালি শহরে এসে ঢুকছে, তাদের সঙ্গে রয়েছে আর্মির দেয়া অস্ত্র। | যে ৪২০ জন উদ্ধারকৃত বিদেশী আজ কলকাতা এসেছেন তাঁদের একজন বললেন, ‘শেষ মুহূর্তে যে-সব কথাবার্তা পাকিস্তানিরা বলছে তাতে যদি সিরিয়াস হয় তবে তারা শহর দগ্ধ করে ফেলবে তবু আত্মসমর্পণ করবে না। | নয়দিন আগে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারতীয় বিমানের প্রায় বিরামহীন’ হামলার বর্ণনাও দিয়েছেন উদ্ধারকৃতরা। তাঁরা তুলে ধরেছেন আরাে চিত্র, গতকাল থেকে জারিকৃত সার্বক্ষণিক কারফিউ, নিষ্প্রদীপ রাতে কোনাে জানালায় আলাে দেখা গেলে সেনাবাহিনী প্রশিক্ষিত হােমগার্ডদের গুলিবর্ষণ, গতকাল অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি কর্তৃক মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে ঘটানাে বিস্ফোরণ এবং হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রায় আটক অবস্থায় থাকা বিদেশী সাংবাদিকদের রিপাের্টিং ও চলাচলের ওপর আরােপিত ক্রমশ-কঠোর-হয়ে-ওঠা বিধিনিষেধ। আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়ােগ আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষভাবে বৃটেনের পক্ষ থেকে কঠোর চাপ প্রয়ােগের পরই  গতরাতে পাকিস্তান তিনটি বৃটিশ সি-১৩০ পরিবহন বিমানের অবতরণ-সুযােগ দিতে স্বীকৃত হয় এবং আজ স্নায়ুচাপ-পীড়িত বিদেশীদের ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয়। ইতিপূর্বে প্রদত্ত পাকিস্তানের সম্মতি সত্ত্বেও গতকাল বিমান যােগে উদ্ধার পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায় যখন কলকাতা থেকে আগত প্রথম বিমানকে ঢাকার কনট্রোল টাওয়ার ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

গত সপ্তাহে কানাডীয় বিমানের নেওয়া দু’টি উদ্ধার-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় যখন ঢাকার আকাশপথে বিমানটি গােলাগুলির মুখে পড়ে। এখানকার অনেক কূটনীতিক মনে করেছিলেন যে, কোনাে নিষিদ্ধ সামরিক বস্তু বিমান বহন করছে না অথবা কোনাে উর্ধ্বতন পাকিস্তানি কর্মকর্তা গােপনে পালিয়ে যাচ্ছে না এটা নিশ্চিত করতে কলকাতা থেকে এবং কলকাতা হয়ে বিমানযােগে পরিচালিতব্য উদ্ধার পরিকল্পনা পাকিস্তান গতকাল বাধাগ্রস্ত করেছে, কেননা তারা বিদেশীদের সম্ভাব্য জিম্মি হিসেবে রাখতে চায়, সম্ভবত এর দ্বারা ঢাকা আক্রমণ থেকে ভারতীয়দের বিরত করা যাবে। পাকিস্তানের ওপর চাপ তবে গত রাতে, খবরে প্রকাশ, বৃটিশ ও অন্যরা পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়ােগ করে যে তারা (পাকিস্তানিরা) যদি এমত ভাবনা করে থাকে তবে আগামী দিনগুলােতে কূটনীতিক ও অন্য কোনােরকম সহায়তাই আর পাবে না। | যে ৪২০ জন বিদেশী আজ ঢাকা থেকে বিমানে এসেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ১৮০ জন বৃটিশ ও ১২০ জন আমেরিকান এবং অন্যরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক। এদের অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসারত বেসামরিক নাগরিক। ঢাকাস্থ বিভিন্ন কনসুলেটের স্রেফ কাঠামােটুকু বহাল রাখতে যে গুটিকয় কূটনীতিক ব্যক্তি রয়েছেন তাঁরা ঢাকাতেই অবস্থান করছেন। আমেরিকান কনসুলেটের কূটনীতিক ব্যক্তিবর্গ রয়ে গেছেন, তবে মিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাহায্য এজেন্সি ইউএস এইড-এর কতক কর্মকর্তা চলে গেছেন। আট মাস আগে ক্র্যাকডাউনের পরপর চলে গেছেন দূতাবাস কর্মকর্তাদের স্ত্রীপুত্রপরিজন। | বেলা দুটোয় ভারত ও পাকিস্তান উভয় পক্ষ স্বীকৃত সাময়িক আকাশযুদ্ধ-বিরতি সমাপনের আগে রাজকীয় বিমান বাহিনীর পরিবহন বিমান ঢাকায় চারবার আসা-যাওয়া করতে পেরেছিল। এই চারটি ফ্লাইটে দেশত্যাগে ইচ্ছুক সবাইকে নিয়ে আসা সম্ভব হয় নি।

রয়ে গেছেন প্রায় পঁচিশ ব্যক্তি, এঁরা সবাই অবিবাহিত। উদ্ধারকৃতদের প্রায় সবাই, কলকাতায় তল্লাশি অবতরণের পর, চলে গেছেন সিঙ্গাপুর, বিমানবহরের মূল ঘাঁটি যেখানে অন্যরা সাময়িকভাবে কলকাতায় রয়ে গেছেন। আক্রান্ত অনাথ আশ্রম সরকারি পদাধিকার অথবা ব্যবসায়িক কারণে উদ্ধারকৃত সকলের নাম-পরিচয় গােপন  রাখতে বলা হয়েছে। তাঁদের একজন বললেন যে, ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানক্ষেত্রে পাকিস্তানি আক্রমণের পর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্ট ও আশপাশের এলাকায় | ভারতীয় জঙ্গিবিমান বিরামহীনভাবে আঘাত হেনে চলেছে। ঢাকার দশ মাইল দক্ষিণে। নারায়ণগঞ্জে বিমান আক্রমণে কয়েকটি তেলের ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়েছে। | তাঁরা আরাে জানান যে, নৈশকালীন আক্রমণ, যা সাধারণত রাত দুটো থেকে শুরু হয়ে | চলতাে ঘণ্টা আড়াই, ছিল সবচেয়ে ভয়ের, কেননা এসব ছিল বেশ খামখেয়ালিপূর্ণ। উদ্ধারকৃতরা জানান, কয়েক রাত আগে আক্রান্ত হয়েছিল একটি অনাথ আশ্রম। কোনাে কোনাে খবর থেকে জানা যায় এখানে মৃতের সংখ্যা শতাধিক। | তাঁরা আরাে জানান যে, সকাল পাঁচটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি বলবৎ কারফিউ গতকাল ২৪ ঘণ্টার জন্য চালু হয়েছে। | তারা বলেন, এই চব্বিশ ঘণ্টার কারফিউ নিয়ে অনেক ধরনের গুজব রয়েছে। একটি মত হলাে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের পাকিস্তানি বাহিনী পাকড়াও করতে চায় এবং কারফিউর কারণে লােকজন ঘরে থাকবে বলে কাজটি সহজতর হবে।

আরেকটি মত হলাে বাঙালিদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক ও শহর-ত্যাগ-প্রবণতা হ্রাস করতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিদের ভয়ে অস্ত্র-নিয়ে-চলা অবাঙালিদের শহরে আগমনের তোেড় তাদের ও বাঙালিদের ভেতরকার বহু বছরের বৈরিতার চরম পরিণতিকে প্রকাশ করছে। বাঙালিদের দ্বারা ঘৃণিত এটা অনুমান করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন লােকের মধ্যে সম্ভবত ২ মিলিয়ন হচ্ছে অবাঙালি। এরা মূলত ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ ও উড়িষ্যা রাজ্য থেকে আগত মুসলমান, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর যারা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। সাধারণভাবে তাদের সবাইকেই বলা হয় বিহারি এবং তারাসবসময় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে নিজেদের সত্তা-পরিচয় মিলিয়ে দেখেছে ও বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের অবজ্ঞাভাবেরও অংশী হয়েছে। শুধু যে একারণেই বাঙালিরা তাদের দেখতে পারে না, তা নয়, আরাে কারণ হলাে, বিহারিরা হচ্ছে বেনিয়ারজাত এবং বাঙালিদের চাইতে অধিকতরসচ্ছল। গত মার্চে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন ক্র্যাকডাউন শুরু করে, পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডে তাদের সাথে হাত। মেলায় বিহারিরা। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন বাঙালিরা এখন বিহারিদের ওপর প্রতিশােধ নিতে চাইবে। এ কারণেই বিহারিরা দলে দলে আসছে ঢাকায়, সেনাবাহিনীর শেষ শক্ত ঘাঁটিতে  নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।  বেশির ভাগ কূটনীতিক মনে করেন যে, এখন পূর্ব পাকিস্তানে রক্তমান এড়াবার একমাত্র  পথ হলাে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং তাদের সৈন্যদের  নিরাপদে ভারতে পৌছুবার নিশ্চয়তা পাওয়ার চেষ্টা করা। সেইসঙ্গে বিহারিদের জন্য কোনাে ধরনের রক্ষা-ব্যবস্থা অথবা নিরাপদে পাড়ি দেওয়ার নিশ্চয়তা আদায় করা। কিন্তু নিজেদের ইমেজ উন্নত করতে কোনাে প্রচেষ্টা বিহারিরা নিচ্ছে না। উদ্ধারকৃতরা জানিয়েছেন যে, বিহারি অনিয়মিত সৈন্যরা নিষ্প্রদীপের সময় ঢাকার রাস্তায় টহল দেয় এবং কোনাে বাড়ির জানালার ফাঁক গলিয়ে সামান্য আলাে বের হয়ে এলে যথেচ্ছ গুলি চালায়।  একজন উদ্ধারকৃত বললেন যে, ভারতীয় সৈন্যরা যখন এগিয়ে আসছে সেই সময়েও, মাত্র কয়েকদিন আগে, পাকিস্তানি সৈন্যরা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রাম এবং হত্যা করেছে। কতক এলাকার অধিবাসীদের। উদ্বারপ্রাপ্তদের একজন জানালেন গতকাল ঢাকায় সটিত এক ঘটনার কথা, স্টেনগান হাতে এক ব্যক্তি ইউসিস (মার্কিন তথ্য কেন্দ্র) ভবনে ঢুকে সবাইকে সরে যেতে বলে। তীরা সে আদশ পালন করলে লােকটি একটি বােমা বসিয়ে কেটে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গােটা রাস্তা ধ্বংসাবশেষে ভরে যায়। কাঠামাে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভবনটি ব্যবহারের অনুপযােগী হয়ে ওঠে।

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ