বাসের ছাদে বাঙালিরা নৃত্যপর। রাস্তায় তারা জোরগলায় স্বাধীনতার স্লোগান দিচ্ছে। তাঁরা পরস্পর আলিঙ্গন করছে, উল্লাস ধ্বনি দিচ্ছে এবং বিদেশী দেখলে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশের জন্য এগিয়ে এসে হাত চেপে ধরছে। বাঙালিদের জন্য আজ (৮ ডিসেম্বর) হচ্ছে যশােরের মুক্তি দিবস’—বিগত আট মাস যাবৎপূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ যে শহর ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে, বাঙালি বিদ্রোহ দমনের জন্য গত বসন্তে এইসব সৈন্য এখানে। এসেছিল। ‘মুক্তিদাতা’ হচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী, যে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারত সমর্থন করছে তাঁদের মতােই উলুসিত এই সেনাবাহিনী। তবে অগ্রগতি থামিয়ে আনন্দউৎসব করার মতো সময় তাঁদের নেই। পশ্চাদপসরণরত পাকবাহিনীর পিছু ধাওয়া করেচলেছেতাঁরাদক্ষিণ-পুবে খুলনার দিকে। যশাের থেকে চার মাইল দূরে খুলনা রােড ধরে এগােবার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। ভারতীয় বাহিনী। ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ির ওপর বসে ভারতীয়রাও হাসছে, হাত নাড়ছে, ছবির জন্য পােজ দিচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্য সম্পর্কে সপ্তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক পদাতিক ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ওরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালাচ্ছে। ওদের হাতে ভালাে অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভালাে। কিন্তু মনের জোর একেবারেই নেই।’ প্রধানত পাঞ্জাবিদের নিয়ে গঠিত পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের থেকে যতাে আলাদা, অধিকাংশ ভারতীয় সৈন্যও তেমনি। কেননা ভারতীয় বাহিনীতেও পাঞ্জাবিদের আধিক্য। তবে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও তাঁদের সমর্থক ভারতীয়দের মধ্যে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ফারাক সাময়িকভাবে মুছে গেছে। সােৎসাহী বাঙালিরা ভারতীয় অগ্রাভিযানবহাল রাখতে সৈন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছে নদীর ওপর পন্টুন সেতু স্থাপনায়, পশ্চাদপসরণকারী পাকিস্তানিরা স্থায়ী সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২৩ মাইল ভেতরে যশােরের পথে একটি প্রধান সেতু কুশলী হাতে ধ্বংস করা হয়েছে। ইস্পাত ও কংক্রিটের সেতুর ছয়টি স্প্যানের পাঁচটিই মুখ থুবড়ে কপােতাক্ষ নদে পড়ে আছে। পাশের রেল সেতুরও একই দশা। দুই রাত আগে যশােরের দিকে পিছু হটে যাওয়ার সময় পাকিস্তানিরা এই কাজ করেছে।
যশাের থেকে নয় মাইল দূরে ঝিকরগাছায় এখন যে দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছে সেটাকে বালতি-ব্রিগেড ও পিরামিড নির্মাণ কাজের সমন্বয় বলা যেতে পারে। বিধ্বস্ত সেতুর নিচে কাদাভর্তি নদীর পাড়ে লম্বা সারিতে দাঁড়ানাে শত শত বাঙালি নতুন পন্টুন সেতু পাতার কাঠের গুড়ি এগিয়ে দিচ্ছে। তাদের মেশিনের মতাে নিখুত কাজের পাশাপাশি আর্মি প্রকৌশলী দলের তামাটে সৈন্যরা হাঁটুজলে নেমে ফোলানাে বিশাল পন্টুন ভাসিয়ে দিচ্ছে এবং এর ওপর বসিয়ে দিচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের স্প্যান। চার ঘণ্টার মধ্যে সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হলাে। সবাইকে মনে হচ্ছে অত্যন্ত খুশি—ভারতীয় সৈনিক, বাঙালি শ্রমিক, মায় পথিপার্শ্বের তদারককারীরাও। পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিকে যাঁরা পালিয়ে গিয়েছিল এবং এখন ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, সেইসব বন্ধু ও আত্মীয়ের হর্ষোৎফুল্ল পুনর্মিলনে মুখর হয়ে উঠছে ঝিকরগাছা। কেউ কেউ ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, অন্যরা লুকিয়েছিল দেশের আরাে ভেতরে। পুরনাে বন্ধু পুরননা সেতুর অক্ষত একটি স্প্যানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাকালে বর্তমান সংবাদদাতারও এক পুনর্মিলনী ঘটে। ইংরেজিতে শােনা গেল কণ্ঠ, “আমাকে আপনার মনে আছে কি ? নিশ্চয় মনে আছে। ইনি হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট আখতার-উজ-জামান, বাঙালি বিদ্রোহী, মুক্তিবাহিনীর একটি কম্পানির কম্যান্ডার। একমাস আগে তাঁকে দেখি যশােরের দক্ষিণ-পশ্চিমে গেরিলাদের দখলকৃত একটি এলাকায়। তিনি তখন বলেছিলেন যে, যুদ্ধে জয়ী হতে মুক্তিবাহিনীরঅন্তত দুই বৎসরসময় লাগবে। আজ তিনি বললেন, সেটা হতাে যদি আমরা একা লড়তাম। এখন তাে আমরা বিরাট সাহায্য পাচ্ছি। হঠাৎ তিনি বললেন, এটা আমার জন্য একটা ঐতিহাসিক সেতু, জ্যোৎস্নারাতে বান্ধবীকে নিয়ে আমি এখানে আসতাম নদীতে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াবার জন্য।’ পুরনাে স্মৃতি মনে করে তিনি হাসলেন।
বাস থেকে চিৎকার
যশােরের পরিস্থিতি আরাে উল্লাসমুখর। কয়েক মাইল দূরের যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ভারতীয় সাঁজোয়া বহর যখন এগিয়ে চলছে মানুষ-ভর্তি বাস থেকে চিৎকার ভেসে আসছিল, ‘স্বাধীন বাংলা শেখ মুজিব’—পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী পূর্ব পাকিস্তানি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য উল্লাসধ্বনি। | রাস্তায় নাচছে কতক বাঙালি বালক। অনেক ভবন ও বাড়ির ছাদে পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের লাল, সবুজ ও সােনালি পতাকা। আনন্দে-উদ্বেল হৈ-হট্টগােলের মধ্যেও একটা বিষন্নতার সুর লেগে রয়েছে। রাস্তায় যত ভিড়ই হােক এটা হলাে শহরের আদি ৩০,০০০ মানুষের এক ভগ্নাংশ মাত্র। নিখোঁজদের কেউ কেউ আর ফিরবে না। অন্যরা। নিহত হয়েছে। মিশনারি ও অন্যান্য নির্ভরযােগ্য সূত্রমতে পাকবাহিনী যশােরের ৫০০০ মানুষকে হত্যা করেছে। | যাচাই-করা-কঠিন বিভিন্ন খবর পাওয়া যাচ্ছে যে পশ্চাদপসরণরত পাক বাহিনী হত্যা ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এক ভারতীয় অফিসার বললেন যে, যশােরের এক শহরে পাকিস্তানিরা একজন বালককে জীবন্ত কবর দিয়েছে। ঝিকরগাছায় লােকজন জানালেন যে, কিছু স্কুল ছাত্রকে গুলি করে মারা হয়েছে। | যশাের শহরের ঠিক বাইরে রাস্তার ধারের মাঠে একটি মৃতদেহ পড়ে ছিল। লাশের বাঁ হাত কাটা, বুকে দগদগে ক্ষতচিহ্ন। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানালেন যে, পাকিস্তানি অবস্থান সম্পর্কে ভারতীয়দের কাছে তথ্য পাচারের জন্য পাকবাহিনী একে খুন করেছে। ভারতীয় অভিযানে যশাের এবং এর সামরিক ক্যান্টনমেন্টের সামান্যই ক্ষতি হয়েছে। দৃশ্যত এর কারণ হলাে মূল লড়াইটা হয়েছে শহরের উত্তরে, দুর্গাবতী নামক স্থানে। * নর্থ-ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল দলবীর সিং যাঁর বাহিনী যশাের দখল করেছে, বললেন যে, দুর্গাবতীতে পাকিস্তানিরা প্রায় উন্মাদগ্রস্তের মতাে সাহসী লড়াই করেছে। কিন্তু তাঁর সৈন্যরা একবার যখন পাক-প্রতিরােধ ভেঙে দিল তখন তারা দ্রুত পিছু হটতে থাকে। এরপর ক্যান্টনমেন্টে অথবা শহরে রুখে দাঁড়াবার আর কোনাে চেষ্টা তারা নেয় নি ।
ক্যান্টনমেন্টে তাঁর হেডকোয়ার্টারে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি বলেন যে, গতকাল দুপুরের মধ্যে গােটা এলাকার অবরােধ তিনি সম্পন্ন করে ফেলেন। একদল পাকিস্তানি সৈন্য খুলনার পথে ১৫ মাইল হটে গেছে। তবে৩০০ সৈনিকের আরেকটি দলকে যশাের থেকে চার মাইলের মধ্যে তাঁর সৈন্যরা বিচ্ছিন্ন করে ঘেরাও করে ফেলে। যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে গাড়িতে করে এবং হেঁটে-ঘুরে-বেড়িয়ে দেখা পাওয়া গেল মাঝারি আকারের ১৪টি ট্যাঙ্ক ও ৪০টি সাঁজোয়া গাড়ির বহর, যাতে প্রায় ৪০০-৫০০ সৈন্য হবে। এরা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরুর নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে। পাশে কতকগুলাে অ্যাম্বুলেন্সও দাঁড় করানাে রয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বেশ জোরের সঙ্গে বলছেন যে, তাঁদের ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে খুব সামান্য, তবে যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে এসে এটা পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে পাকিস্তানি পক্ষে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ঘটলেও ভারতীয়দের ক্ষেত্রেও এর মাত্রা সরকারি হিসেব থেকে যথেষ্ট বেশি। | ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বহর থেকে সামান্য দূরে, যেখান থেকে শােনা যাচ্ছে মেশিনগান ও মটারের গােলাগুলির শব্দ, একজন আর্মি ডাক্তার তাঁর সহযােগীকে বলছিলেন, ‘সবকিছু ঠিক করে রাখা। ৪০-৫০ জন আহত এসে হাজির হবে।’ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছে একজন আহত পাকিস্তানি সৈন্যকে। তার বুকে ও বাঁ হাতে গুলি লেগেছে এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ভারতীয় সৈন্যরা স্ট্রেচারে করে যখন তাকে নিয়ে যাচ্ছিল মুসলিম সৈন্যটি গােঙাচ্ছিল, ‘আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ।
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ