You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.23 | ভারত-পাকিস্তান তারা যুদ্ধের কথা বলছে তারা যুদ্ধ বাধিয়ে দিতেও পারে নয়াদিল্লি ভারত - সংগ্রামের নোটবুক

তারা কি এটা ঘটাবে অথবা ঘটাবে না ?’ ভারত পাকিস্তান আবারও যুদ্ধ ঘটাতে যাচ্ছে কিনা সেটা বিবেচনাকালে এখানকার বিদেশী কূটনীতিকদের আলােড়িত করছে এই প্রশ্ন। প্রতিদিনই বাজির রকমফের  হচ্ছে। চলতি সপ্তাহান্তে এর সম্ভাবনা ছিল। ৫০: ৫০। সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে খুব বেশিকিছুর আর দরকার নেই। গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ  পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় দুই দেশের সৈন্যরা যার যার অবস্থান নিয়ে বসেছে। অন্তত পশ্চিম প্রান্তে এটা পরিষ্কার দেখা গেছে যে পাকিস্তানই প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিল। ভারত তার রিজার্ভ বাহিনীকে তলব করেছে। | সাত মাসব্যাপী সীমান্ত-অঞ্চলীয় টেনশনের জের হিসেবে এই সৈন্য সমাবেশ ঘটেছে। এর সূচনাগত মার্চে, যখন পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনদমনে ঝাঁপ দেয়। পরবর্তী সামরিক নিপীড়ন্ত্রে কারণে দলে দলে পূর্ব পাকিস্তানি উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করে (বর্তমান হিসেবে এই সংখ্যা প্রায় ৯.৫ মিলিয়ন)। এর ফলে ভারতের আর্থিক ও সামাজিক বাতাবরণের ওপর বিরাট চাপ পড়ে। ইতিমধ্যে ভারত বাঙালি বিদ্রোহীদের অস্ত্রশস্ত্র ও নিরাপদ আশ্রয় যােগাতে শুরু করেছিল, পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যাদের গেরিলা যুদ্ধ ক্রমেই কার্যকর হয়ে উঠছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা নিলে তিনি এটাকে ভারতের আক্রমণ হিসেবে গণ্য করবেন এবং এর মােকাবেলায় যুদ্ধ ঘােষণা করবেন। প্রত্যুত্তরে ভারতীয়রা জানিয়েছে যে, তারা কোনাে যুদ্ধের সূচনা ঘটাবে না। তবে পাকিস্তান চাইলে যে-কোনাে যুদ্ধের জন্য সে প্রস্তুত রয়েছে।

ইদানীংকালে সীমান্ত সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে বাগাড়ম্বরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১২ অক্টোবর জাতীয়ভাবে প্রচারিত এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রভূত পরিমাণে জেহাদি বুলি আউড়ে হিন্দু ভারতকে ‘উত্তুঙ্গ সামরিক প্রস্তুতির জন্য অভিযুক্ত করেন এবং সতর্ক করে বলেন, ‘১২০ মিলিয়ন ইসলামি মুজাহিদ নিয়ে গঠিত এই জাতি পাকিস্তানের পবিত্র জমির প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে।’ ভারতের দিক থেকে গেল সপ্তাহে জবাব দিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, যাঁকে বলা যায় ইন্দিরা গান্ধী সরকারের কটুভাষী স্পিরাে এগনিউ। ঐতিহাসিকভাবে সামরিক মনােভাবাপন্ন পাঞ্জাবে এক বক্তৃতায় তিনি শপথ নিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে যুদ্ধ হবে পাকিস্তানের মাটিতে এবং তার সৈন্যরা যে এলাকা দখল করবে ভারত সেটা ছেড়ে দেবে। । দুই দিন পরে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রীমতী গান্ধী কিছুটা নম্র ভাষায় জগজীবন রামের কথাটা পুনর্ব্যক্ত করেন। তাঁকে যখন জিগ্যেসা করা হলাে শান্তি আলােচনা ও পারস্পরিক সৈন্য প্রত্যাহার সম্পর্কিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘােষণা সম্পর্কে, সরকারি পাকিস্তানি বার্তা সংস্থা যা প্রচার করেছে, তিনি চটজলদি জবাব দিলেন, ‘মুঠো করা হাতের সঙ্গে তাে আপনি করমর্দন করতে পারেন না।’ নয়াদিল্লিতে অনেক ধরনের বিমর্ষ আলােচনা চালু আছে। গড়পড়তা ভারতীয়রা মনে করেন যুদ্ধ লেগে যাওয়া খুবই সম্ভব, তবে কোনােরকম যুদ্ধ-উন্মাদনা ছাড়া আটপৌরেভাবে তাঁরা এ বিষয়ে আলাপ করেন। গড়পড়তা বিদেশী কূটনীতিকরা এখনই কোনাে দেশ যুদ্ধে যেতে চাচ্ছে কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহ পােষণ করেন। কেউ কেউ মনে করেন ভারতের ওপর সােভিয়েত প্রভাব এবং পাকিস্তানের ওপর মার্কিন প্রভাব পক্ষদ্বয়কে সংযত করতে সাহায্য করবে। গত শুক্রবার রুশিরা তাদের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিনকে ঝটিতি নয়াদিল্লি পাঠিয়েছিল। কিন্তু দুই দেশের সৈন্যবাহিনী যখন পরস্পরের মুখােমুখি অবস্থানে, কোথাও কোথাও মাত্র কয়েক শত গজ ফারাকে, তখন যুদ্ধের ঝুকি অত্যন্ত বাস্তব এবং কোনাে বিদেশী পর্যবেক্ষকই নির্দ্বিধায় শান্তির ভবিষ্যদ্বাণী করছেন না। 

কলরবমুখর কূটনীতিক মহলে যত কূটনীতিক রয়েছেন, তত্ত্বও রয়েছে ততাে। এক তত্ত্ব অনুযায়ী ভারত সিদ্ধান্ত নেবে যে উদ্বাস্তুর বােঝা অসহনীয় হয়ে উঠেছে ও পূর্বাংশে পাকিস্তানি শাসন অবসানের জন্য চাপ প্রয়ােগ করবে এবং স্বাধীন দেশে শরণার্থীদের প্রত্যাগমন সম্ভব করে তুলবে। অপর তত্ত্ব অনুসারে বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব ভূখণ্ডে সামরিক দখল বহাল রাখা অসম্ভব বুঝতে পেরে মরিয়া-হয়ে-ওঠা পাকিস্তান আক্রমণ করবে ভারতকে—এই ভরসায় যে তৎক্ষণাৎ ভারত-পাক শান্তির জন্যে বিশ্বজনীন চাপ সৃষ্টি হবে এবং ফল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। | কতক মহলে ‘বানজাই’ নামে পরিচিত আরাে একটি তত্ত্ব রয়েছে যার অনুসরণে বাঙালি গেরিলাদের হাতে তাদের অসম্মানজনক পরাজয় আসন্ন উপলব্ধি করতে পেরে অহঙ্কারী পাক জেনারেলরা বেছে নেবে শক্তিমান সামরিক শক্ত ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে হার মানার   সুযােগ। এছাড়া রয়েছে আরাে এক তত্ত্ব, যে তত্ত্বের বক্তব্য হলাে পাকিস্তানি সৈন্য মােতায়েনের পুরাে ব্যাপারটাই হচ্ছে সযত্নে প্রণীত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ, যার লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বসমাজ, বিশেষভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে ভীতসন্ত্রস্ত করে হস্তক্ষেপে বাধ্য করা। এমনি চিন্তাধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের উদ্দেশ্য হচ্ছে গােটা সমস্যাটিকে ভারত-পাক বিরােধে রূপ দেয়া এবং এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট সামরিক সন্ত্রাস থেকে বিশ্বের মনােযােগ সরিয়ে নেওয়া। পাশাপাশি আরেকটি লক্ষ্য হতে পারে বিশ্বজনীন চাপের দ্বারা ভারতকে বাঙালি। বিদ্রোহীদের সামরিক সহায়তাদান থেকে বিরত রাখা। | এই সমস্ত বহুমুখী তত্ত্বের প্রাচুর্য সত্ত্বেও একটি বিষয়ে কূটনীতিকরা সবাই মনে হয় একমত—সৈন্যবলে অস্ত্রবলে পাকিস্তানিদের ছাপিয়ে গেছে ভারতীয়রা এবং পাকিস্তানি আক্রমণ তাই আত্মঘাতী হবে। | এক কূটনীতিক বললেন, ‘পরিস্থিতি এখনও নাজুক। একে অপরের পরিমাপ নিচ্ছে। সীমান্ত সংঘর্ষ এমনিভাবে অব্যাহত থাকতে পারে মাসের পর মাস, নিয়মিত বিরতি দিয়ে মাঝেমধ্যে বেজে উঠবে বিপদসঙ্কেত।

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ