স্বাধীন সার্বভৌম বাংলদেশের পক্ষে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক জনাব আবুল হাশিমের প্রেস বিজ্ঞপ্তি
মর্নিং নিউজ, ২৯ শে এপ্রিল ১৯৪৭। সূত্রঃ শীলা সেন, মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল। পৃষ্ঠা – ২৮১ ২৯ শে এপ্রিল, ১৯৪৭
খ. আবুল হাশিম, সম্পাদক, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ, কলকাতা -এর সংবাদ বিবৃতি, ২৯ এপ্রিল, ১৯৪৭
সময় হয়েছে সত্যি বলার। সস্তা জনপ্রিয়তা ও সুযোগসন্ধানী নেতৃত্বের মতন কুরুচিপূর্ণ চিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করা মেধাগত পতিতাবৃত্তির নামান্তর। ১৯০৫ সালের দিকে বাংলা ছিল ভারতবর্ষের মননশীল নেতা এবং সাফল্যের সহিত তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতাকে প্রতিহত করে। দুঃখের বিষয় আজকের বাংলা বুদ্ধিবৃত্তিতে দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং বিদেশী নেতাদের কাছে চিন্তাভাবনা ও দিক-নির্দেশনা ভিক্ষা ও ধার করে বেড়াচ্ছে। আমি বিস্ময়বোধ করি, বাঙালি হিন্দুরা, যারা একসময় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অশুতোষ মুখার্জী, চিত্তারঞ্জন দাস এবং সুভাষ চন্দ্র বোসের মতন মানুষের জন্ম দিয়েছেন তাদের আজ কি হোল।
ভারতবর্ষের বর্তমান বৈপ্লবিক চেতনার জন্ম বাংলায়। সত্যিকার বিপ্লব ভয়ংকর খুনোখুনিতে নয়, বরং চিন্তা-চেতনার বিপ্লব তৈরিতে নিহত। বাংলাকে অবশ্যই তাঁর হীনমন্যতা ও পরাজিত মানসিকতা ঝেড়ে ফেলতে হবে, অতীতের ঐতিহ্য পুনোরুদ্ধার করতে হবে, নিজ শিখরে আবারো উঠে দাঁড়াতে হবে। নিজ লক্ষ্য গড়ে তুলতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ চিন্তায় আবেগ অনুভূতির কোন স্থান নেই। সাময়িক পাগলামীকে আমাদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলতে দেয়া যাবে না।
বাঙালি আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যার একটি চলে গেছে স্বাধীনতা ও গৌরবের পথে, আরেকটি চলেছে আজীবন দাসত্ব ও সমূহ গ্লানির দিকে। বাঙালিদের অবশ্যই এই মূহুর্তে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। প্লাবনে ভেসে যাওয়া মানুষের জন্যে কিছু ঢেউ সৌভাগ্য নিয়ে আসে। একবার হারানো সুযোগ জীবনে আর নাও আসতে পারে।
বাংলাকে শোষণ করে যে সমস্ত ভারতীয় ও অ্যাংলো-আমেরিকান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে, তার প্রতিটি পাই খরচ করা হচ্ছে পশ্চিম বাংলায়। আমাদের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সমাজতান্ত্রিক প্রবণতা আমাদের বিদেশী শোষকদের মনে বাজেয়াপ্ত হবার ভয় তৈরি করেছে। স্বাধীন একত্রিত বাংলার সমস্যার ব্যাপারে তারা সতর্ক। বৈদেশিক মুদ্রা লাভের উদ্দেশ্যে তারা বাংলাকে বিভক্ত করতে চায়, পঙ্গু ও অক্ষম করতে চায় যাতে এর কোন অংশই ভবিষ্যতে প্রতিবাদ করার মত যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে।
বাংলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ধরণ থেকে আমি এই মতামত দিতে পারি, এসমস্ত দাঙ্গার সূত্রপাত ও বিস্তার হয়েছে ইংরেজ ও তাদের ভারতীয় দোসরদের ইচ্ছায়। সম্মানিত ও নির্ভরযোগ্য দলগুলোর সাধারণ প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য নিরাপদ লাইসেন্স পেতে বেগ পেতে হয়। অথচ বিপুল পরিমাণে বিপজ্জনক ব্রিটিশ ও আমেরিকান আগ্নেয়াস্ত্র ভারতে পড়ে আছে যা হিন্দু-মুসলমান গুণ্ডাদের ও বাংলা বিভাজনের সচেতন অসচেতন প্রতিনিধিদের মাঝে বিপুল পরিমাণে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্যে আপত্তিকর নেশায় আসক্ত বাংলার এক বড় মাথা একবার আমাকে এ কথাগুলো বলেছিলেন, যেহেতু তার কোন ভবিষ্যৎ নেই এবং তাঁর সমস্ত কিছুই ছিল অতীত তাই সে তার সুবিধাবাদ মনোভাবকে সঠিক মূল্যায়ন করেছিল। বাংলার জীবাশ্ম এই বিভক্তিকরণ হতে তাৎক্ষণিক লাভ অর্জন করতে পারে, কিন্তু বাংলার তারুণ্যের কি হবে যার সম্পূর্ণ লক্ষ্য ভবিষ্যতের ওপর নির্ভরশীল? তারা কি পরিস্থিতির শিকারে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সুযোগসন্ধানী মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের জন্য তাদের ভবিষ্যৎ বিলিয়ে দিবে?
বাংলার বিভক্তিকরণের সাথে ভারতবর্ষের বিভক্তিকরণের কোন সাদৃশ্য নেই। চিন্তার অসন্তোষজনক বিকৃতি ধারণা দেয় যে, বঙ্গভঙ্গের জন্য যেই আন্দোলন তা প্রচন্ড অবহেলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জেগে উঠার প্রতি উপযুক্ত জবাব। এটা লাহোর প্রস্তাবের প্রতিরূপও বটে। ভারতীয় মুসলমানেরা শুধুমাত্র এই বিশ্বাসের ওপরই আনুগত্য রাখে, অন্য কোন ব্যাখ্যাই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই প্রস্তাব কখনই কোন অখন্ড মুসলিম রাষ্ট্র অথবা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় বানানোর জন্য অনুশীলন করেনি। প্যালেস্টাইনের মত জোর করে বিদেশী সামগ্রী দেশে আনা হয়নি, আবার অসংখ্য জনসংখ্যার স্থানান্তরকরণও হয়নি যেমনটি হয়েছিল তুর্কী ও গ্রীসের মধ্যে।
এটা বিশ্বের বুকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর জন্য পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দাবি করেনি, বরং ভারতের সমগ্র জাতি ও প্রদেশের জন্য পূর্ণাঙ্গ সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির প্রতিই ইঙ্গিত করে। এটা বাংলা ও ভারতের অন্যান্য সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দেয় এবং একই সাথে সকলের সুবিধার জন্য আন্তর্জাতিক-করনের সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখতে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে।
পাকিস্তান কখনই দাবি করে না যে, বাঙালি বা পাঞ্জাব মুসলমানেরাই কেবল শাসকগোষ্ঠী হবে এবং অন্যদের পরাধীন করে রাখা হবে। মুম্বাইয়ে জিন্নাহ-গান্ধী বৈঠকের ব্যর্থতার পর, কায়েদ-এ-আযম স্পষ্ট ও দ্ব্যার্থহীন চিত্তে ঘোষণা দেন যে, সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের মাধ্যমে সমগ্র জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা ও সম্মতি অনুযায়ী স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র শাসিত ও পরিচালিত হবে। আমি যোগ করতে চাই যে, যৌথ নির্বাচকমন্ডলী ব্যবস্থার মাধ্যমে এটা করা হবে, যদি সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে পৃথক নির্বাচকমন্ডলী দাবি না করে।
অসাধারণ নেতৃত্বের অভাবে, অমার্জিত সৌভাগ্য সন্ধানীরা দেশকে ভেঙে ছারখার করে ফেলছে। বাংলার হিন্দু-মুসলমান যুবকদের অবশ্যই একত্রিত হতে হবে, বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের লাগাম হতে দেশকে মুক্ত করতে হবে, বাংলার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য বাজি ধরতে হবে এবং ভারতবর্ষের ও একই সাথে বিশ্বের বুকে ভবিষ্যৎ জাতিগুলোর কমিটিতে সম্মানজনক পদে আসীন হতে হবে। বাংলার যুবকদের তাদের অতীত ঐতিহ্য হতে চরিত্র গঠন করতে হবে এবং ভবিষ্যতের গরিমার জন্য বর্তমান সমস্যা সমাধানে অনুপ্রেরণা যোগাতে হবে।
বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা, তাদের নিজ সত্ত্বা বজায় রেখে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিজ ভূমির প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত প্রভাবের সাথে পূর্ণাঙ্গ মিলবন্ধন রেখে একটি চমৎকার সার্বজনীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। মানুষের বিবর্তনে পৃথিবীর যেকোন জাতির অংশীদারিত্বের সাথে ইহা নিঃসন্দেহে তুলনাযোগ্য।
বাংলা নামক স্বাধীন দেশে হিন্দু-মুসলমানদের নিজেদের জন্য একচেটিয়াভাবে সংরক্ষিত কোন অধিকার থাকবে না। তবে মুসলিমদের তাদের নিজ শরীয়ত অনুযায়ী নিজ সমাজ পরিচালনার অধিকার থাকবে, তেমনি হিন্দুদের তাদের শাস্ত্রানুযায়ী তাদের নিজ সমাজ পরিচালনার অধিকার থাকবে। এই অধিকার পাকিস্তানের প্রতি মুসলিমদের আধ্যাত্মিক চাহিদা মেটায় এবং হিন্দুদের একটি সত্যিকার বাসভূমি দেয়, যেখানে তারা তাদের আদর্শের মুক্তচর্চা ও জীবন সম্বন্ধে তাদের সূক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব অনুধাবন করতে পারবে। এটা অভাবনীয় যে, স্বাধীন বাংলায় প্রশাসনিক কাজে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাঙালি হিন্দুদের ন্যায্য অংশীদার অস্বীকার করা হবে এবং দেশের বস্তুগত সম্পদ ভোগে বাঁধা দেয়া হবে। বাংলার হিন্দু-মুসলমান জনগণ প্রায় সমান। কোন গোষ্ঠীই অন্যটিকে শাসন করার মত অবস্থানে নেই। যদি বাংলাকে তার সমস্ত সম্পদ তার মাটিতে জন্মানো সন্তানদের স্বতন্ত্র কাজে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয়া হয়, তবে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সামনের শতাব্দীগুলোতে সুখ-সমৃদ্ধিতে থাকবে।
কিন্তু বিভক্ত বাংলায়, পশ্চিম বাংলা বিদেশী ভারত সাম্রাজ্যবাদের দূরে নিক্ষিপ্ত প্রদেশ, এমনকি উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে বাধ্য। বিভক্তিকরণ নিয়ে তাদের যতই উচ্চাকাংখা থাকুক না কেন, এটা আমার কাছে কাঁচের মত স্বচ্ছ যে, বাংলার হিন্দুদের বৈদেশিক পুঁজিবাদের দৈনিক মজুর হিসেবে দমিয়ে রাখা হবে।
বিদ্বেষপূর্ণ বর্তমান দাসত্ব ও গোলামির ভিত্তিতে ভবিষ্যতকে কল্পনা করা একটি মর্মান্তিক ভুল। বাংলায় দশ বছর ধরে একপক্ষীয় মুসলিম মন্ত্রিত্ব হতে বাংলার হিন্দুদের মাঝে সন্দেহপূর্ণ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ন সততার সাথে বলা যায় যে, বাংলা কিংবা অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কেউই বাংলার সত্যিকার হিন্দু প্রতিনিধিদের সাথে কখনো জোট তৈরি করেনি। আইনসভায় মুসলিম লীগ পার্টি এমন একটি জোট গঠনের জন্য অবিচল প্রচেষ্টা করেছে। কিন্তু কংগ্রেস উচ্চাপদের হস্তক্ষেপে তা সফল হয়নি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর মন্ত্রিসভা গঠনের পূর্বে সৎ প্রচেষ্টা করেছিলেন কংগ্রেসের সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য।
আমার বিক্ষিপ্তভাবে মনে পড়ে, গান্ধীজী নোয়াখালীতে যাওয়ার পূর্বে ৪০ নম্বর, থিয়েটার রোডে আমাদের সাথে আলাপচারিতার সময় বলেছিলেন, “আমি জোটের পক্ষপাতী নই। আমি একদলীয় সরকারে বিশ্বাসী। এজন্যে আমি বাংলার জোট গঠনে জোর দেই না”। আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, তখন বাংলাই ছিল একমাত্র স্থান যার মুসলিম মন্ত্রিসভা ছিল। এখানে কোন প্রকার জোট হলে সমস্ত ভারত-ই জোট সরকার গঠনের সম্মুখীন হতো। এজন্যে বাঙালি হিন্দুদের পরিত্যাগ করা হয়েছিল, যেমনটি অন্যত্র করা হয়েছে মুসলিম লীগকে।
বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের যদি নিজেদের মত থাকতে দেয়া হতো এবং ভারতকরনের ভীতি হতে মুক্ত রাখা হতো, তবে তারা শান্তিপূর্ণ ও আনন্দের সাথে তাদের মধ্যকার ব্যাপারগুলো মিটিয়ে নিতে পারতো। দূর্ভাগ্যবশতঃ, মুসলিম সাংসদেরা মন্ত্রিসভায় সর্বদাই তাসের প্যাকেটের মত অদলবদল হচ্ছে। তারা ভাল-মন্দ নিরপেক্ষ কোন নীতি ও কর্মপন্থায় সহজে মনোযোগ দিতে পারছে না।
আমার দুর্ভাগ্য যে আমি ১৯৩৫ সালের আইনের আওতাধীন হতভাগ্য সরকারকে সমর্থনে ব্যর্থ হচ্ছি। যেহেতু যুক্তিসংগত কারনে অথবা যে কারনেই হোক হিন্দুদের মনে মুসলমানদের নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, তাই এখন মুসলিমদের দায়িত্ব হোল এই সন্দেহ দূর করা এবং হিন্দুদের মানানো। এটা কেবল বক্তৃতা কিংবা সংবাদ বিবৃতি দিয়ে নয়, বরং তারা হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নয় তা কাজে দেখাতে হবে। বর্তমান অস্থির বিকৃত চিন্তা-ভাবনা ও আত্মঘাতী পদক্ষেপ সামাজিক অবয়বে ব্যাধির সৃষ্টি করছে। একটি স্বাধীন দেশের সমস্ত গুণাবলী সহ একত্রিত ও সার্বভৌম বাংলা গঠনে তীব্র দেশপ্রেমই হোল সমাধান, দেশভাগ সমাধান নয়।
সি. আর. দাশ আজ মৃত। গৌরবজ্জল ভবিষ্যৎ গঠনে তাঁর আদর্শ আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাক। বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগে তাঁর ৫০:৫০ নীতিতে সম্মত হোক। আমি আবারও বাংলার যুবসমাজকে তাদের অতীত ঐতিহ্য ও সোনালী ভবিষ্যতের নামে একত্রিত হওয়ার জন্য আহবান জানাবো। সকল প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা অপসারণে এবং আসন্ন গ্লানি হতে বাংলাকে রক্ষায় তারা একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিক।