You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.13 | পাইকারি গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে | সিডনি শনবার্গ | ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বের বড় অংশ নিহত হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ এবং পাইকারি গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে, তা সত্ত্বেও আন্দোলনের হাইকমান্ডের কতক সদস্য বেঁচে আছেন এবং তাঁরা একটি মন্ত্রিসভা অব্যাহত হত্যাযজ্ঞের গঠন করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন শেখ মুজিবের প্রধান সহকারী তাজউদ্দিন আহমদ। ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে ঘুরে এসে নিউইয়র্ক টাইমস-এর দিল্লি সংবাদদাতা এই রিপাের্ট পাঠিয়েছেন। অন্তত ছ’জনবিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা একত্র হয়ে তাঁদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে মনােনীত করেছেন। তাঁরা শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেছেন, তবে অপ্রকাশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা স্বীকার করেন যে, তিনি বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রয়েছেন। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্যাধীন কেন্দ্রীয় সরকার বলে চলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে, অপরদিকে বাস্তব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি ফুটে উঠছে। যুদ্ধ প্রতিদিন বিশ্বস্ত সূত্রে বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিদিনই যুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানির দলে দলে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সেনাবাহিনীর আশ্রয় পেতে কিংবা তাতে। যােগ দিতে। হাজার হাজার উদ্বাস্তু তাদের যৎসামান্য জিনিসপত্র বস্তায় অথবা পিজবাের্ডের সুটকেসে ঠেসে ভারতে চলে  আসছে সাময়িক আশ্রয়ের সন্ধানে। বর্তমান সংবাদদাতা দেখেছে প্রতিরােধ যােদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় কিংবা লুকোবার জায়গা থেকে বঞ্চিত করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কুমিল্লার বহির্সীমায় বাঁশ ও ছনের দগ্ধ ঘর থেকে যখন ধোঁয়া উঠছিল আকাশে, চমণরত শকুনেরা নেমে আসছিল মাটিতে, নিহত কৃষকের লাশের ওপর, যে লাশ নিয়ে ইতিমধ্যে কুকুর ও কাকের মধ্যে টানাটানি চলছে। 

পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির কতজনকে পাক আর্মি হত্যা করেছে নিশ্চিতভাবে তা জানবার কোনাে উপায় নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রের নির্ভরযােগ্য রিপোের্ট অনুযায়ী, তা অন্তত হাজার হাজার তাে বটেই, কেউ কেউ আরাে বেশিও বলে থাকেন। কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ জারি করে পূর্ব পাকিস্তানে সকল বিদেশী সাংবাদিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অধিকৃত গ্রাম এলাকা থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণে জানা যায় যার অনেক কিছুরই পাক আর্মিবিরােধিতা করে থাকে— পাকবাহিনী স্বাধীনতা আন্দোলন দমনকল্পে পূর্ব পাকিস্তানের সকল নেতা ও সম্ভাব্য নেতাদের হত্যা করেছে, গােটা অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছারখার করে দিয়েছে। আদেশপ্রাপ্ত হয়ে আর্মি, এখন যা সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা গঠিত, হত্যা করেছে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও নেতৃত্বের গুণসম্পন্ন অন্যদের, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যােগ থাকুক কিংবা না-ই থাকুক। ২৫ মার্চ সেনা অভিযান শুরুর পর যেসব বাঙালি অফিসার ও সৈন্য ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে গেরিলা দলে যােগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী তাঁদের হত্যা করেছে। বেশির ভাগ অফিসারের পরিবারের লােকজনকে হত্যা করা হয়েছে, পালাতে পেরেছেন মাত্র অল্প কয়েকজন। 

নৌযান ও বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করে আর্মি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, পাটকল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কূপ ধ্বংস করেছে। এর ফলে দেশটি ২৫ বছর পিছিয়ে গেল’, বলেছেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাগিচা থেকে ভারতে পালিয়ে আসা একজন স্কটিশ চা-বাগান ম্যানেজার। পাক আর্মিকে ঠেকাতে মুক্তিবাহিনী রেললাইন ও সড়ক উড়িয়ে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি তাঁরা স্বাধীনতা অর্জন করে তাহলে একেবারে শূন্য থেকে তাঁদের শুরু করতে হবে।” এই ভদ্রলােক এবং তাঁর সঙ্গে পালিয়ে আসা অপর দুই বাগানের ম্যানেজার তাঁদের নাম উল্লেখ করতে নিষেধ করেছেন। সে ক্ষেত্রে এখনও পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বৃটিশ পরিবারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন। ফাঁকা ট্রাকের ওপর আক্রমণ এই তিন দেশত্যাগী জানালেন যে, ভারত থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ বহনকারী যে নয়টি ট্রাক বিমান আক্রমণে ধ্বংস করা হয়েছে বলে রেডিও পাকিস্তান দাবি করেছে আসলে তা ছিল তাদের বাগানের উঠোনে জড়াে করা খালি ট্রাক। 

কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানা যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মতাে শহরগুলাের মােট অধিবাসীর মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এখন সেখানে রয়েছে। ছােট শহরগুলােও প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ, চট্টগ্রামের ৪ থেকে ৫ লক্ষ এবং কুমিল্লার প্রায় ১ লক্ষ। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বাংশে প্রায় সর্বত্র কামানের গােলাবর্ষণের গুরুগম্ভীর শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তিতে অনেক দুর্বল প্রতিরােধ যােদ্ধাদের পরিচালিত প্রতিটি গেরিলা আক্রমণ অথবা উত্যক্তকারী ঘটনার বদলা পাকবাহিনী নিচ্ছে বেসামরিক লােকজনের ওপর। ‘বেজন্মা ভীতুর দল’, বললেন তরুণ বাঙালি লেফটেন্যান্ট, কুমিল্লার ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁর ব্যাটালিয়ন নির্মূল করার প্রচেষ্টাকারীদের ফাঁকি দিয়ে যিনি পালিয়ে বের হয়ে এসেছেন। আমরা তাে তাদের সামনে যুদ্ধের ফ্রন্ট হাজির করেছি। আমরা ইউনিফর্ম পরেই রয়েছি। কিন্তু তারা কেবল বেসামরিক নাগরিকদের আক্রমণ করে চলেছে।’ বিচ্ছিন্নতাবাদী সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসার, অস্ত্র, গােলাবারুদ, যানবাহন ও প্রয়ােজনীয় সরবরাহের একান্ত অভাব। তাঁদের কেউ কেউ নগ্নপদ। সবচেয়ে ভারি যে অস্ত্র তাদের রয়েছে সেটা ৩ ইঞ্চি মর্টার। তবে কিছু ভারি কামান তারা দখল করেছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ব্যবহার করছে জেট জঙ্গিবিমান, ভারি কামান ও গানবােট। এর বেশির ভাগ এসেছে আমেরিকা, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট চীন বাংলা বাহিনীর সঙ্গে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করার জন্য অস্ত্র ও সৈন্য পাঠাচ্ছে বলে পাকিস্তান সরকার যে অভিযােগ করেছে সংবাদদাতাদের কাছে তা সত্য প্রমাণিত হয় নি। পূর্ব পাকিস্তানি ইউনিটগুলােতে কোনাে ভারতীয় সৈন্য দেখা যায় নি। তারা মূলত ব্যবহার। করছে পুরনাে এনফিল্ড ও গারান্ড রাইফেল এবং কিছু চৈনিক অটোমেটিক রাইফেল ও মেশিনগান। বাঙালিরা হয় এগুলাে দখল করেছে অথবা ইউনিট থেকে পালিয়ে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ৩০০,০০০ সদস্য সম্বলিত পাকিস্তান আর্মিতে বাঙালির সংখ্যা ১০ শতাংশেরও কম।

আক্রমণের প্রথম দিনগুলােতে তাঁদের মধ্যে যাঁরা নিহত হওয়ার পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন তাঁরা প্রায় সর্বাংশে বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীতে যােগ দিয়েছেন এবং এঁরাই হচ্ছেন। বাহিনীর একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অংশ। সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গােষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত বাহিনী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৩০০০ সদস্য এবং ভারতের সঙ্গে সীমান্ত প্রহরার কাজে নিয়ােজিত আধা-সামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর। আরাে প্রায় ৯০০০ সদস্য। বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বাদবাকিরা হচ্ছেন সশস্ত্র পুলিশ, সামান্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যান্য মিলিশিয়া ও নবীন রিক্রুট। রাজনৈতিক সঙ্কট শুরুর আগে পাকিস্তান আর্মির ২৫,০০০ সৈন্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানযােগে নিয়ে আসা হয়েছে বিপুলসংখ্যক সৈন্য। কোনাে কোনাে হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের বড় অংশই পাঞ্জাবি ও পাঠান। তারা উভয়ে মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও, বিশেষভাবে পাঞ্জাবিরা, বাঙালিদের অবজ্ঞার চোখেই দেখে থাকে। গড়ে একজন গেরিলা যােদ্ধার ভাগে ৩০ থেকে ৪০ রাউন্ড গুলি জুটলেও তাঁদের মনােবল অত্যন্ত দৃঢ়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে পাকবাহিনী তাঁদের পরিবারের কোনাে সদস্য অথবা গােটা পরিবারকে হত্যা করেছে এবং এটা তাদের সংগ্রামী চেতনায় ইন্ধন যুগিয়েছে। “ওরা আমাকে এতিম করে দিয়েছে,’ বললেন একজন সৈনিক, অনেকের মতােই তাঁর। চোখ ছলছলে এবং যা ঘটেছে বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, আমার জীবনের আর কোনাে মানে নেই। বেশ ক’দিন থেকে যেমন চলছিল দিন দুই আগেও তেমনি পাকবাহিনী কুমিল্লার কাছে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে এক মাইলের মধ্যে গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিমানবন্দরের চারধারে পাঁচমাইল এলাকা জুড়ে গেরিলাদের আশ্রয় নেওয়ার মতাে সবধরনের সুযােগের অপসারণ। খবরে জানা যায়, গােটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়েই তারা। এমন কাজ করে চলছে।

এলাকার গেরিলা কমান্ডার ৩২ বছর বয়স্ক খালেদ মােশাররফ পাকিস্তানি সৈন্যদের হয়রানি করার জন্য ১০ সদস্যের একটি প্যাট্রোল পাঠিয়েছিলেন। বর্তমান সংবাদদাতা এই প্যাট্রোল দলের সঙ্গে ছিলেন। তাঁদের তিনজনের পায়ে কোনাে জুতাে ছিল না। ধান খেতের আড়াল অবলম্বন করে প্যাট্রোল দল পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রায় ২০০ গজের মধ্যে পৌছে গেল। সৈন্যরা তখন ফসফরাস গ্রেনেড ছুঁড়ে কুঁড়েঘরগুলােতে আগুন লাগাচ্ছিল। বাঙালিদের কাছে কয়েকটি চীনা অটোমেটিক বন্দুক ছিল। তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে পাকবাহিনীও ত্বরিত জবাব দিতে লাগলাে। প্রায় ২০ মিনিট ধরে অবিরাম গােলাগুলি চললাে। এরপর বাঙালিরা হামাগুড়ি দিয়ে বাঁধের ওপারে তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে এলাে। গেরিলা দলগুলাের মধ্যে সমন্বয় খুবই দুর্বল, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানবন্দরসহ প্রধান শহর-বন্দরে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাঙালিরা এখন গেরিলা কায়দার লড়াইয়ে মনোেযােগ দিয়েছে। শক্তি বৃদ্ধি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা এখন গ্রামের দিকেও হানা দিচ্ছে এবং মােটরযানের বহর নিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন শহরগুলাের মধ্যে সংযােগ প্রতিষ্ঠা করছে। কতক বহর এ  কাজে সফল হলেও অনেকগুলাে হয় নি, কেননা গেরিলারা প্রায় নিয়মিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে। দিচ্ছে সড়ক, নৌ ও রেল যােগাযােগ।

বিচারের সম্মুখীন শেখ মুজিব

গেরিলারা যখন লড়ে চলেছে তাঁদের নেতারা স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আনীত দেশদ্রোহ মামলায় বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন শেখ মুজিব, বিদ্রোহী আন্দোলনের ৫১ বছর বয়স্ক প্রতীক। সরকার ঘােষণা করেছে ২৫ মার্চ রাত্রে আর্মি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছে। দৃশ্যত আর্মি যুদ্ধের প্রথম পর্বে বিজয়ী হয়েছে এবং বাঙালিরা নির্ভর করছে বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির ওপর, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যা শুরু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের জটিল পথ—গাঙ্গেয় ব্রহ্মপুত্র জলধারা ও সহস্র নদীর আঁকিবুকি পশ্চিম প্রদেশের শুষ্ক ও পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত পাঞ্জাবি ও পাঠানদের কাছে অপরিচিত। যখন বর্ষায় নদী ফুলে উঠবে এবং মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়বে, তখন এই অপরিচিতি আরাে বাড়বে। ‘আমরা এখন বর্ষার অপেক্ষায় রয়েছি’, বললেন এক বাঙালি অফিসার। তারা পানিকে এতাে ভয় পায় যে আপনি ভাবতেই পারবেন না এবং আমরা হচ্ছি জলের রাজা। তারা তখন ভারি কামান ও ট্যাঙ্ক নিয়ে চলতে পারবে না, জঙ্গি বিমান উড়তে পারবে না। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা বিষয়ে অধিকাংশ বাঙালি বেশ তিক্ত। স্বাধীনতা আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাই পাশ্চাত্য-ঘেঁষা এবংতাঁরা ওয়াশিংটনের সমর্থন-প্রত্যাশী। এমন কি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকান অস্ত্র নিয়েও ক্ষোভ বেশ প্রবল। ‘আমরা সাহায্য প্রত্যাশাকরছি’ ‘তুমি কি জাননা ওরা আমাদের হত্যার কাজে ব্যবহার করছে তােমাদের বিমান, তােমাদের রকেট, তােমাদের ট্যাঙ্ক ?’ চোখ কুঁচকে উত্তেজিত গলায় মার্কিন সংবাদদাতাকে জিগ্যেস করলাে এক বাঙালি সৈনিক। ‘যা করে চলেছে তা নয়, আমরা তােমাদের সাহায্য চাইছি, একই অভিমত ব্যক্ত করলেন আরাে অনেকে। পাক সরকারের প্রতি পিকিংয়ের সমর্থন থাকবে ধরে নিয়েছে বলে আর্মির চীনা অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে বাঙালিরা ততাে বিস্মিত নয়। কতক বাঙালি অফিসার মনে করেন চীনের সঙ্গে পূর্ব যােগসাজশে অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাঁরা জোরের সঙ্গে বলতে চান। পিকিংয়ের পূর্ণ সমর্থন লাভের নিশ্চয়তা ছাড়া আমি কখনােই এমন কাজে নামতাে না। এমন কি আক্রমণ ঘটার আগেও বাঙালিরা ভেবে অবাক হতে পশ্চিমী শক্তি ও অন্যরা। কেন তাঁদের দাবি সমর্থন করছে না। তাঁদের হতাশা এখন পরিপূর্ণ। 

“একটা গণহত্যা চলছে এবং দুনিয়ার মানুষ স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে’, বাঙালি এক ছাত্র মন্তব্য করলাে। কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলে নি। দুনিয়া থেকে কি বিবেকবিবেচনা উঠে গেছে? এমনি তিক্ত সমালােচনা দ্বারা অভিযুক্ত হয়নি ভারত। পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের নিন্দা করেছে ভারত এবং হত্যাযজ্ঞ থামাতে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে অন্যান্য দেশকে বােঝাতে চেষ্টা করছে। সীমান্ত এলাকার ভারতীয় নাগরিক ও কর্মকর্তারা উদ্বাস্তু ও অন্যদের সাহায্যসহযােগিতা করছে, তবে এই সংবাদদাতা কোনাে অস্ত্রের চালান সীমান্ত দিয়ে পার হতে দেখেন নি, যেমনটা পাকিস্তান অভিযােগ করছে ও নয়াদিল্লি অস্বীকার করছে। শরণার্থীরা নির্যাতনের বিবরণ দিচ্ছে। শরণার্থী ও দেশত্যাগী বিদেশী উভয়েই বয়ে এনেছে হত্যা ও বর্বরতার নানা কাহিনী। চট্টগ্রাম এলাকার পাটকলের ম্যানেজার এক বিদেশী জানালেন যে তিনি আর্মির হাত থেকে বাঁচতে তিন ঘণ্টা একটা গর্তে লুকিয়ে ছিলেন। তখন দেখতে পেয়েছেন সৈন্যরা রাস্তা দিয়ে একটি ট্রাক বহর নিয়ে চলেছে। সামনের ট্রাকে বন্দুকের মুখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কয়েকজন বাঙালিকে, তাদের বলা হয়েছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে। স্লোগান শুনে লুকনাে জায়গা থেকে অন্য বাঙালিরা বের হয়ে এলে তাঁদের ওপর মেশিনগানের বর্ষিত করা হয়। একজন বাঙালি সৈনিক বললেন, ‘ওরা আমাদের গভীর অতলে টেনে নামাতে চায়, যেন জাতি ফিরে যায় অষ্টাদশ শতকে। যেন দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ এবং আমরা ঘাস খেয়ে বাঁচতে বাধ্য হই। ওরা নিশ্চিত হতে চায় যেন আর কখনাে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।’ প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রিপাের্ট পাওয়া যাচ্ছে যে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালি, বিশেষভাবে ব্যবসায়ীদের, হত্যা করে পাল্টা শােধ নিচ্ছে। তবে বাঙালিদেরকে হত্যা, যা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সেটা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল অনেক আগে। আর্মি ও পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থের সঙ্গে যাদের দীর্ঘকালের দহরম-মহরম, পূর্ব পাকিস্তানে অকার্যকর সেই ধর্মভিত্তিক দল মুসলিম লীগ আর্মিকে সাহায্য করছে ছাত্র ও অন্যান্য সম্ভাব্য নেতাকে খুঁজে বের করতে। স্ত্রী ও এক বছরের পুত্রকে নিয়ে ঢাকা থেকে সাতদিন হেঁটে জনৈক প্রকৌশলী গতকাল ভারতে এসে পৌঁছেছেন। সরকারি চাকুরে এই প্রকৌশলী জানালেন যে, যদিও তিনি আওয়ামী লীগের সদস্য নন কিংবা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও অংশ নেন নি, তা সত্ত্বেও তিনি দেশ ছেড়েছেন, কেননা, শিক্ষিতদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে।’ মৃদুকণ্ঠে তিনি জানালেন, ‘আমি যদি রয়ে যেতাম তাহলে মৃত্যুবরণ করতাম, নিশ্চিত মৃত্যু। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ