অবিশ্বাস্য দুর্ভোগ
দ্যা টাইমস,লন্ডন, ১৫ই মে,১৯৭১
পিটার হ্যাজেলহারস্ট
উত্তর- পূর্ব ভারতের কলকাতার ৫০ মাইলের বনগাঁ শহরে ১৪ই মে একজন ক্লান্ত চিকিৎসক পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের দিকে আশাহত ভাবে তাকান। উদ্বাস্তুদের কারনে জনসংখ্যা প্রায় দিগুণ হয়েছে। তাদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন,‘মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হলে এদের পরিণতি কি হবে?কুঁড়ে ঘর বানানোর জন্য তাদের খড়ও নেই এবং আমরা সন্ধিহান যে আমরা কলেরার হাত থেকে এই অবস্থায় নিয়ন্ত্রন করতে পারব কি না। তারা মাছির মত মারা পর্বে’।
এটা অনুমান করা হয় যে গত কয়েক সপ্তাহে সীমান্ত দিয়ে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ অনুপ্রবেশ করেছে এবং এর মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ বনগাঁ ও এর আশে-পাশের এলাকায় অবস্থান করছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে গৃহযুদ্ধ, খাদ্যাভাব এবং দারিদ্রের হারত থেকে মুক্তি পেতে তারা অসহায় এবং নিঃস্ব ভারতে প্রবেশ করছে।
ভাগ্যবানরা বনগাঁ’র অদুরে ভারত সরকার এবং আন্তর্জাতিক ত্রান সংস্থানের নির্মাণ করা আশ্রয়স্থলে জায়গা পাচ্ছে কিন্তু বিদ্যালয়,সরকারি ভবন এবং ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তাই নতুন্দের ভাগ্যের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
যাদের কাছে অল্পকিছু টাকা আছে তারা ঘাসের মাদুর কিনেছে এবং তা দিয়েই করুনভাবে রাস্তার পাশের পরিত্যেক্ত জায়গায় ঘর বানিয়ে থাকছে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ পুরুষ,শিশু এবং নারীসহ যারাই এসেছে তারা সবাই পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের মানুষ যাদের বছরে আয় মাত্র ৩০ পাউন্ড এবং তারা শুধু কিছু ছেঁড়া জামা-কাপড় ছাড়া আর কিছু নিয়েই আসেনি।
শুকনো মুখ এবং অন্তঃসারশূন্য চোখ নিয়ে তারা দক্ষিন-পশ্চিমের জনাকীর্ণ শহর কলকাতায় প্রবেশ করতে চাইছে যেখানে কয়েক লাখ মানুষ ফুটপাতে থাকা নিয়েই ধাক্কাধাক্কি করছে।
আমরা যখন উদ্বাস্তুদের অতিক্রম করছিলাম তখন সেন্ট পল কলেজের ছাত্র Daniel Dolui যে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সি.এ.এস.এ এর সাথে সম্পৃক্ত সে বলছিল, ‘এর শেষ কোথায়? জেলা শহরে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার উদ্বাস্তু প্রবেশ করছে। ২ দিন আগে তাবু ছিল ১১টি। এখন ২২টি’।
দুঃখ ও দারিদ্রতা এখানে অবিশ্বাস্য। ভারত সরকার একটি মহৎ কাজ করেছে কিন্তু এটি হঠাৎ করেই করা এবং এর সম্পদও সীমিত।
আমরা গ্রামের একটি বিদ্যালয় অতিক্রম করেছি যা এখন শিশু ও মহিলাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপাসনালয়গুলোর রান্নাঘরের বাহিরে ছিল বিশাল লাইন। কেউ কেউ ৫ ঘন্টা ধৈর্য ধরবে রান্না করা ভাতের জন্য।
কিছু ভাগ্যবান শিশু গির্জার বিতরণের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে খাবার জন্য দুধ পাবে।
সেখানে আর কোন ক্যানভাসের ব্যবস্থা নেই, বেশিরভাগ আশ্রয়স্থল বাঁশের কাঠামো দিয়ে পাতলা ঘাসের আবরণ দিয়ে তৈরি। তবে বেশিরভাগ মানুষই খোলা আকাশের নিচেই থাকছে। সরকারি ভবনের সিঁড়ি, বারান্দা এবং পরিত্যক্ত জায়গায় যারা একটু ঘুমানোর জায়গা পেয়েছে, সেটাই তাদের কাছে অনেক মূল্যবান।খাবারের জন্য নারী এবং পুরুষের লাইনে দেখা গিয়েছে একচতুর্থাংশ শিশুদের।
কয়েক লাখ বাঙালি যারা আশ্রয়ের খোঁজে আছে তাদের মাঝে একজন হচ্ছেন যশোরের দিনমজুর ২৫ বছর বয়সী Kati চন্দ্র দে। বনগাঁয়ের উপকণ্ঠে বাচ্চা কোলে পরিবারের সাথে তাকে পাওয়া গিয়েছে। আশ্রয়ের জন্য তিনি এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে তিনদিন হেঁটেছেন কিন্তু এখানেও কোন জায়গা পাননি।
কেন তিনি পূর্ব পাকিস্থান ছেড়েছিলেন? ‘যখন পাকিস্তান আর্মি তাদের অভিযান শুরু করে তখন আমাদের ধারণা ছিল তারা মূলত হিন্দুদের হত্যা করবে। তারা পেট্রোল দিয়ে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আমরা পালিয়ে এসেছি’। পশ্চিম বাংলায় যেসকল উদ্বাস্তু রয়েছে তাদের বর্ণনা অনুযায়ী পাকিস্তানী বাহিনী হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানদেরকেই মূলত আক্রমণ করেছে।
একজন বাঙালি স্বেচ্ছাসেবক আমাকে জোর দিয়ে জানিয়েছে, ‘এইখানে কোন বিহারী উদ্বাস্তু নেই’। ‘দুইদিন আগে ১৪ জন পশ্চিম বাংলায় আসতে চেয়েছিল কিন্তু রাস্তায় বাঙ্গালিরা তাদের লাঠি আর পাথর মেরে হত্যা করে’।
আর্মিরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং বেশিরভাগ উদ্বাস্তুই এই বিশাল হত্যা ও খুনের পরই দেশ ত্যাগ করেন।
২৫ বছর বয়সী হাসান আলী যশোরের একজন চাষি। তিনি বনগাঁয়ের উপকণ্ঠে সিএএসএ এর হাসপাতালে ছিলেন যা স্যালভেশন আর্মির প্রধানকেন্দ্র। তিনি বলেন যে পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্বাস করতে চায়নি যে তিনি মুসলিম এবং তাকে ক্ষেতের মাঝেই গুলি করা হয়।
তিনি তাঁর ঘাড়ের বড় গর্ত এবং কাঁধের ক্ষত দেখিয়ে বলেন যে অবিশ্বাস্যভাবে তিনি মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছেন।
‘আমি যখন মাঠে কাজ করছিলাম তখন পাকিস্তান বাহিনী পিছন থেকে আসে। ৭০ জন সৈন্য আমাদের ৩ জনকে ঘিরে ফেলে। তারা জানতে চাইছিল আমরা হিন্দু নাকি মুসলমান।
তারা বিশ্বাস করতে চাইছিল না যে আমরা মুসলমান। তারা আমাদের হাত মাথার উপরে করতে বলে এবং আমরা আমাদের ছেড়ে দিতে বলি। তারপর তারা গুলি শুরু করে আর আমি জ্ঞান হারাই’।
সেই যশোরের ৭০ বছরের হিন্দু শ্রমিক বিনোদ বিহারী শাহ্ও আমাদের একই গল্প শুনিয়েছেন। তিনি তাঁকে ছেড়ে দিতে বলেন কিন্তু গুলি তাঁর হাতের আঙ্গুলকে ক্ষত-বিক্ষত করে। তাই তিনি হাত বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘দুইজন সৈন্য আমার বাড়িতে এসে আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে বলে। মুল সড়ক থেকে আমার ঘর ২০ গজ দূরে। প্রথমে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি বাঙালি নাকি বাঙালি না। তারপর জিজ্ঞেস করে আমি হিন্দু নাকি মুসলিম’।
‘যখন আমি বলি আমি হিন্দু,তখন তারা আমাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বলে এবং তাদের বন্দুক প্রস্তুত করে। আমি বুকের কাছে হাত জোর করি এবং আমাকে গুলি করতে না করি কিন্তু তারা গুলি করে। গুলি আমার হাত ভেদ করে এবং আমার বুকের উপরের অংশে লাগে। আমি মাটিতে পড়ে যাই এবং মারা যাওয়ার ভান করি’।
ভারতীয় সীমান্ত থেকে ১৭ মাইল পূর্বের দিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী আহমেদ আলী। তিনি চাষাবাদ করতেন। তাঁর ডান পা এবং বাম হাত প্লাস্টার করা। তিনি বলেন,‘প্রায় দুই সপ্তাহ আগে সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে এবং সব যুবকদের আটক করে ১ মাইল দুরের মহাদেবপুর গ্রামে নিয়ে যায়।
তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা বাঙালি নাকি বাঙালি না এবং আমাদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে। তারা আমাদের ঘিরে ফেলে এবং গুলি করা শুরু করে। একটি গুলি আমার হাতে আঘাত করে কিন্তু আমি তখন শুয়ে থাকি। যাওয়ার আগে তারা বেয়োনেট দিয়ে আমার কুঁচকিতে আঘাত করে এবং আমার পায়ে আঘাত ও ভেঙ্গে দেয়’।
জনাব আলী বলেন যে তিনি এবং আরো তিনজন আহত অবস্থায় পালাতে সক্ষম হন এবং তাদেরকে ভারতীয় সীমান্তের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়।
সিএএসএ এর ছোট্ট হাসপাতালে ছিলেন যশোরের চায়ের দোকানের মালিক নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা আটক করে এবং বাজারের কেন্দ্রে নিয়ে যায় যেখানে বাঙালি পুলিশ অসংখ্য পশ্চিম পাকিস্তানি এবং যারা বাঙালি নয় তাদের গতমাসে হত্যা করে।
আর্মিরা ধারণা করে চায়ের দোকানি পুলিশের লোক এবং হিন্দু। তাঁকে হাঁটু গেঁড়ে বসানো হয় এবং সৈন্যরা তাঁকে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে। তিনি তাঁর ক্ষত-বিক্ষত পাকস্থলি এবং বুক দেখান। তারপর তিনি জ্ঞান হারান। সৈন্যরা তাঁকে মৃত ভেবে চলে গেলে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে উদ্ধার করেন।