১৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ১৯৭১
পরাজয় অনিবার্য জেনে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে ওঠে। রাতে একমাত্র ঢাকা শহরেই শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শিল্পীসহ প্রায় দেড় শ জন বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে গুপ্ত ঘাতক বাহিনী অপহরণ করে ঢাকার শহরতলীর বিভিন্ন বাকভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৗধুরী, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনােয়ার পাশা, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক রশিদুল হাসান, ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, রিডার ড, আবুল খায়ের ও গিয়াসউদ্দিন আহম্মদ, শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের ড. সিরাজুল হক খান ও ড. ফয়জুল মহী, চক্ষুরােগ বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, ডা. ফজলে রাব্বী ও ড. মােহাম্মদ মর্তুজা উল্লেখযােগ্য। তাদের রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাতের আঁধারে গণবুদ্ধিজীবী হত্যার কাজটি সমাধা করেছিল ১০ থেকে ১৪ তারিখ জামায়াতের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলশামস ও আলবদর নামের দুটি কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট গ্রুপ। পাকিস্তানিরা এই ঘৃণ্য গ্রুপ দুটি গঠন করেছিল মূলত বিশিষ্ট বাঙালিদের বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য দীর্ঘ ন’মাসে এরা সারাদেশে শত শত চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, শিল্পী ও সাহিত্যিক, সংগঠক, সমাজকর্মী, রাজনীতিক, ছাত্র, অসামরিক কর্মকর্তা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিসহ বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনী নদীপথের প্রধান বাধাগুলাে ডিঙ্গিয়ে ঢাকা। শহরের চারদিকে নিশ্চিদ্র বেষ্টনী গড়ে তােলে। ক’দিন বিরতির পর সকালে ঢাকার আকাশে আবার দেখা দেয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর বােমারু বিমানগুলাে। আবালবৃদ্ধবনিতা রাস্তায় এসে ও বাড়ির ছাদে উঠে হাত নেড়ে নেড়ে বিমানগুলােকে অভিনন্দন জানায়। বেলা এগারােটায় গভর্নর ডা, মালিক তার মন্ত্রিপরিষদ ও সামরিক-বেসামরিক উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) । ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতীয় বিমানগুলাে উড়ে এসে গভর্নর হাউজের উপর রকেট হামলা শুরু করে। ডা, মালিক প্রাণ বাঁচানাের জন্য ট্রেঞ্চে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরে ডা, মালিক নিরপেক্ষ এলাকা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং পদত্যাগের কথা ঘােষণা করেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি কমান্ডারদের আত্মসমর্পণের জন্য শেষবারের মতাে নির্দেশ দেন। তার এ নির্দেশ আকাশবাণী থেকে সারাদিন ধরে প্রচার হতে থাকে। জেনারেল মানেকশ’র নির্দেশ ছিল, আমি আবার বলছি আর প্রতিরােধ করা নিরর্থক। ঢাকা গ্যারিসন এখন সম্পূর্ণভাবে আমাদের কামানের আওতায়।’ নিয়াজী দ্বিধাদ্বন্দ্বে, বৃহৎ শক্তির হস্তক্ষেপের আশায় তখনও পথ চেয়ে বসে। কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে প্রতিশ্রুত সামরিক সাহায্য না আসায় নিয়াজী হতাশ হয়ে পড়েন। রাতে ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়ে তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। বৈঠকে শেষে হতাশ ও হতভম্ব নিয়াজী সেনানিবাসে ফিরে এসে রাও ফরমান আলীকে যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি মুসাবিদা করতে বলেন। ইসলামাবাদ থেকে ইয়াহিয়া গভীর রাতে তার মনােভাব পাল্টিয়ে নিয়াজী ও রাও ফরমান আলীকে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। রণাঙ্গনে রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সৈন্যরা দলে দলে অন্ত্রসংবরণ করতে শুরু করে। দুপুরের দিকে বগুড়ার পাকিস্তানি ডিভিশন হেডকোয়ার্টার ও ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের পতন হয়। আত্মসমর্পণ করে পরাজিত বাহিনীর ১৭০০ সৈন্য ও অফিসার ।
এখানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ যৌথবাহিনীর হস্তগত হয় । যৌথবাহিনী ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতি পার হয়। তাড়াতাড়ি ঢাকা পৌঁছানাের জন্য মিত্রবাহিনীর দুটি ব্রিগেড শক্রর অবস্থান এড়িয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়ে মধুমতি পার হয়। এ কাজে স্থানীয় জনগণ সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে। মিত্রবাহিনীর পারাপারের জন্য শত শত নৌকা বন্দোবস্ত করে দেয়। সারারাত ধরে তাদের পারাপার করে। যৌথবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড মানিকগঞ্জে অভিযান চালায় এবং মুক্ত করে। দিবাগত রাতে সাভারের উদ্দেশে যাত্রা করে। | যৌথবাহিনী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগের পারে পাকিস্তানিদের মুখােমুখি হয়। শত্রুরা এখানে শক্তিশালী প্রতিবন্ধক গড়ে তুলেছিল। কেননা টঙ্গী হচ্ছে উত্তরদিক থেকে ঢাকার প্রবেশ পথ । অপরদিকে, ঢাকা পশ্চিম-উত্তর সীমানা বরাবর চন্দ্রা-সাভার-মিরপুর অঞ্চল ধরে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে যৌথবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড । ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শীতলক্ষ্যার পারে ডেমরা যৌথবাহিনী পাকিস্তানি প্রতিরােধব্যুহের ওপর আঘাত হানে। আরেকটি দল শীতলক্ষ্যা পার হয়ে রূপগঞ্জ মুক্ত করে। হেলিকপ্টারের সাহায্যে যৌথবাহিনী গােমতী পার হয়ে মেঘনা তীরবর্তী বৈদ্যের বাজারে অবস্থান নেয়। চট্টগ্রাম সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কুমিরা ঘাঁটির পতন ঘটিয়ে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে। হানাদার বাহিনীর একটি ব্রিগেড কক্সবাজার হয়ে স্থলপথে বার্মার দিকে পালাবার সময় মুক্তিবাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়। দিনানপুর, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাট সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হল।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান