১৩ এপ্রিল মঙ্গলবার ১৯৭১
ঢাকায় শান্তি কমিটির উদ্যোগে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলের পুরােভাগে ছিলেন খান এ সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন, মাহমুদ আলী, গােলাম আজম, এ, কে, এম, শফিকুল ইসলাম, এ, টি, সাদী, আবুল কাসেম, আবদুল জব্বার খদ্দর, সৈয়দ আজিজুল হক, এ. এস, এম, সােলায়মান, মেজর আফসার উদ্দিন, এ. কে, রফিকুল হােসেন, আতাউল হক, এডভােকেট শফিকুর রহমান, জুলমত আলী খান, কবি বেনজির আহমদ, পীর মােহসেন উদ্দিন আহমদ প্রমুখ। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মােহাম্মদ শহীদুল্লাহ, নগর মুসলিম লীগের ডা. নূরুর রহমান, মােবারক হােসেন, দেওয়ান আবদুল কাদের, নগর কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি মােহাম্মদ ফয়েজ বখশ, জাতীয় যুব পরিষদের সভাপতি ও ঢাকা হাই কোর্টের এডভােকেট মাহবুবুর রহমান, জমিয়তুল ইত্তেহাদের মওলানা মফিজুল হক, ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের মওলানা সৈয়দ মােহাম্মদ মাসুদ ও জুলফিকার আহমদ কিসমতি পৃথক পৃথক বিবৃতিতে বলেন, কোনাে ভাষাগত বা ভৌগােলিক জাতীয়তাবাদের প্রচারণার বা এই ভাবধারা অনুযায়ী কোনাে রাষ্ট্র গঠনের সুযোেগ এখানে নেই। জনসাধারণ আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়েছিল দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে, পাকিস্তান দিবসে প্রতিরােধ দিবস পালন করে তথাকথিত বাংলাদেশের পতাকা তােলার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালনার জন্য নয়। সিনেটর ফ্রেড হেরিস মার্কিন সিনেটে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক খুন ও অসামরিক লােকদের যথেচ্ছ হত্যার খবরে আমি আতঙ্কিত। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদেশি সংবাদদাতাদের বহিষ্কারের যে নীতি পাকিস্তান সরকার অনুসরণ করছেন তার ফলে কংগ্রেসের সদস্যবর্গ ও বহির্বিশ্বের পক্ষে সেখানে কি ঘটছে তা জানা অসম্ভব। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক লােকদের পাইকারি হত্যা ও নির্বিচারে খুন-খারাপির খবরগুলাে যদ্দিন পর্যন্ত না অসত্য প্রমাণিত হচ্ছে তদ্দিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আমি অনুরােধ জানাচ্ছি।
১৪ এপ্রিল বুধবার ১৯৭১
প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার কসবা পাকিস্তান সেনাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে। ভাের থেকে পাকশী সেতুর কাছে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনার মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনী ভেড়ামারা দখল করে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এক বেতার ভাষণে (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সফরের জন্য বিশ্বের সকল বার্তাজীবী এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানান। বেতার ভাষণে তিনি সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার ও জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, যথা রেডক্রস ইত্যাদির প্রতি সরাসরি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ করার অনুরােধ জানান। তিনি অবিলম্বে শত্র সৈন্যদের বিতাড়িত করার জন্য অস্ত্র সাহায্যের আবেদন করেন এবং ঘাতক পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে কোননা প্রকার অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ না করার জন্য অনুরােধ জানান। ঢাকায় নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান মৌলবী ফরিদ আহমদের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে পাকিস্তানের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানিকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানাে হয়। নিউইয়র্ক টাইমস লেখে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার মতাে শহরে এখন সম্ভবত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লােক রয়েছে। সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে গঠিত সেনাদলের সামরিক আক্রমণে যারা বেঁচে গেছেন তারা প্রায় সবাই প্রতিরােধকারীদের দলে যোেগ দিয়েছেন।
১৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১
মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কুমিল্লার গঙ্গাসাগর পুনরুদ্ধার করে। ভৈরব সেতুর কাছে মেথিকান্দায় উভয় দলের মধ্যে দিনব্যাপী প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনী এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর বিমান ও কামান হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী চুয়াডাঙ্গা থেকে সরে এসে মেহেরপুরে নতুন প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলে। কয়েকদিন ধরে প্রতিরােধ যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁও শহরের অবস্থান ছেড়ে দেয়। ঢাকায় নাগরিক শান্তি কমিটির নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি” রাখা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর ও খাজনা। পরিশােধ করার জন্য জনসাধারণের প্রতি নির্দেশ দেয়। করাচিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, সরকার ন্যায়সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করেছে। সংবাদ সংস্থা এএফপি খবর দেয় ঢাকা এখন মৃতপুরী । রাস্তায় খুবই কম লােক দেখা যায়। অনেক লােক শহর ছেড়ে গেছেন। যারা ঢাকা থেকে পালাতে চাচ্ছেন তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। সৈন্যরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে। তরুণদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্যের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করছে। নিউজিল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী মি. মার্শাল এক বার্তায় বলেন, আমরা আশা করি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান গৃহযুদ্ধ অবসানের ব্যবস্থা করবেন।
১৬ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১
পঞ্চগড় দখলের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুর জেলার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে জনপদের পর জনপদ অগ্নিসংযােগ, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চালায়। দুদিন ধরে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিসেনারা নিরাপদ আশ্রয়ে গেলে পাকবাহিনী কুষ্টিয়া ও লাকসাম শহরের কর্তৃত্ব লাভ করে। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘােষণা করা হয়। এরা হচ্ছেন খাজা খয়েরুদ্দিন-আহ্বায়ক, নূরুল আমিন, এ. কিউ. এম শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গােলাম আজম, মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, মওলানা সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া), মওলানা সৈয়দ মােহাম্মদ মাসুম, আবদুল মতিন, অধ্যাপক গােলাম সরওয়ার, ব্যারিস্টার আফতাব উদ্দিন, পীর মােহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া), এ. এস, এম, সােলায়মান, এ. কে. রফিকুল হােসেন, মাওলানা নূরুজ্জামান, আতাউল হক খান, তােয়াহা বিন হাবিব, মেজর (অব.) আফসার উদ্দিন, দেওয়া ওয়ারেসাত আলী ও হাকিম ইরতাজুর রহমান খান। সন্ধ্যায় নূরুল আমিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ গভর্নর টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনর্দখল নিয়ে সারাদিন মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলে। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দখল প্রতিষ্ঠা নিয়েও উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কুমিল্লা-ত্রিপুরা সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনীর হামলা প্রতিহত করে। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, বেনাপােল ও কসবা সীমান্তে সারাদিন ধরে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। ঢাকায় কারফিউ’র মেয়াদ সকাল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবিলম্বে কাজে যােগদানের নির্দেশ দেন। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা খবর দেয় বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের মুক্তি আন্দোলন খুব কমই দেখা যায়, যার প্রতি সর্বশ্রেণীর জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। আবার এ ধরনের আন্দোলন খুবই কম দেখা যায়, যেখানে অধিকার আদায়ের জন্য অস্ত্রশস্ত্রের এত অভাব। প্রতিটি জায়গায় পুরাে প্রশাসন ব্যবস্থা একান্তভাবে মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে। কয়েকটি শহরে মুক্তিসংগ্রামীরা এখনও প্রশাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
১৭ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১
কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার মুক্তাঞ্চল ভবেরপাড়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় সকাল ১১ টার পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ করেন আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এই আনুষ্ঠানিক ঘােষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, তা সাংগঠনিক রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ছয় সদস্যের বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-রাষ্ট্রপতি। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ. এইচ, এম, কামরুজ্জামান ও খন্দকার মুশতাক আহমদ মন্ত্রিসভার সদস্য। জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। স্বাধীনতার সনদ ঘােষণা ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মুক্তিবাহিনীর দুটি প্লাটুন সামরিক অভিবাদন জানায়। এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন গণপরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরান শরিফ থেকে তেলােওয়াত শেষে আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।
বাংলাদেশ গণপরিষদের পক্ষে চিফ হুইপ অধ্যাপক এম, ইউসুফ আলী পঠিত স্বাধীনতার সনদে বলা হয় : “যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সনের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং | “যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিলেন এবং “যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩ মার্চ শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন” এবং “যেহেতু আহুত এই লােকসভা স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করেন এবং | “যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করবার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সাথে পারস্পরিক আলােচনাকালে ন্যায়নীতি বহিভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘােষণা করেন এবং | “যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান” এবং
“যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে” এবং “যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নৃশংস অত্যাচার চালানাের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করে তুলেছে” এবং “যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে” এবং “যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন, সেই ম্যান্ডেট অনুসারে আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপআলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য “সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি এবং তার মাধ্যমে পূর্বাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন করছি।” “এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।” “রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপতি সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন। রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ােগ করার ক্ষমতা। থাকবে। তার কর নির্ধারণ ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে। রাষ্ট্রপতির গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও অধিবেশন মুলতবি ঘােষণার ক্ষমতা থাকবে। বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সকল ক্ষমতার অধিকারী হবেন রাষ্ট্রপতি।” “বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, কোনাে কারণে যদি রাষ্ট্রপতি না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপতি কাজে যােগ দিতে না পারেন তাহলে তার কর্তব্য ও তাকে প্রদত্ত সমস্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতি পালন করবেন।” “আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। আমরা তা যথাযথভাবে পালন করব।”
“আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, আমাদের এ স্বাধীনতার ঘােষণা ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।” “আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, আমাদের এ সিদ্ধান্ত ঘােষণা কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।” শপথ গ্রহণ শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম ঘােষণা করেন। পরে তিনি সমবেত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, বিদেশি পর্যবেক্ষক, মুক্তিযােদ্ধা ও জনতার উদ্দেশে ভাষণে বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার ধারাবাহিকতা ধরে আজ সেই বাংলাদেশের সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে এ আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের ও স্বাধীনতার জয় চাই।। | সৈয়দ নজরুল বলেন, আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব চেয়েছিলেন বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে এ অধিকার আদায় করতে চেয়েছেন। গত ২৩ বছর ধরে তিনি সব কিছু ত্যাগ করে। আন্দোলন করেছেন। জাতির সঙ্কটের সময় আমরা তার নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি, পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের সূচনা হলাে তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোনাে শক্তি তা মুছে ফেলতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে আজ যে ব্যাপক গণহত্যা চলছে পাকিস্তান সরকার তার সত্যতা গােপন ও বিকৃত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশ আজ যুদ্ধে লিপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ। এ সংগ্রাম আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রাম, জীবনমৃত্যুর সংগ্রাম। এ ছাড়া আমাদের আর কোনাে উপায় ছিল না। তিনি বলেন, অখও পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের নিচে তার কবর রচিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের অজেয় মনােবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে । দুনিয়ার কোনাে শক্তি এ নতুন জাতিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হােক কাল হােক ছােট বড় সব রাষ্ট্রকেই স্বাগত জানাতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে জাতিসংঘে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজনীতি ও মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের জেনারেল ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। আমাদের সংগ্রামকে সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করব। তিনি বলেন, আমরা গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও অনুরূপ সমর্থন আশা করি। | তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে জেনারেল ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপের ওপর একটি নতুন দেশ গড়ে তােলা। এ উদ্দেশ্যেই আমাদের জনগণ ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে । তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে—সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। সে জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনাে বাধা-বিপত্তি টিকতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার এ সংগ্রামে আমরা বিশ্বের প্রতিটি ছােট-বড় জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। আমরা কোনাে শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভক্ত হতে চাই না। আমরা আশা করি, শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনােভাব নিয়ে সবাই নিঃসঙ্কোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। আমাদের এ জাতীয় সংগ্রামে আমরা তাই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আবেদন, আর দেরি না করে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। বিশ্বের আর কোনাে জাতি আমাদের মতাে স্বীকৃতি লাভের দাবিদার হতে পারে না। কেননা আর কোনাে জাতি আমাদের মতাে কঠিন সংগ্রাম করেনি, এত ত্যাগ স্বীকার করেনি।
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষের হ্যান্ডআউটে বলা হয় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, চট্টগ্রাম, যশাের, খুলনা, কুমিল্লা, সিলেট, পাবনা, লালমনিরহাট, সৈয়দপুর, রংপুর ও রাজশাহী শহর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কার্যকর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী সকালে বরিশাল শহরের ওপর বিমান হামলা চালায়। বহু বেসামরিক লােক হতাহত হয়। পিডিপি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট মৌলবী ফরিদ আহমদ ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতীয় এজেন্টরা তথাকথিত সাংস্কৃতিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, আমি কর্তৃপক্ষকে ঘরে ঘরে তদন্ত চালিয়ে তার প্রমাণ সংগ্রহের জন্য অনুরােধ জানাচ্ছি। যারা নিজেদের বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বলে। দাবি করছে তারা আসলে ভারতের সাহায্যপুষ্ট গুণ্ডা। এ গুণ্ডাদের হাত থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য সেনাবহিনী ত্রাণকর্তারূপে হাজির হয়েছে। ভারতে উপস্থিত বাঙালি শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১, ১৯, ৫৬৬ জন। ঢাকায় শান্তি পরিষদের মহাসচিব মাওলানা নূরুজ্জামান এক বিবৃতিতে দুষ্কৃতকারী ও দেশদ্রোহীদের (মুক্তিযােদ্ধা) গােপন খবর জানানাের জন্য ঢাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি জানান, এ জন্য নগরীতে ৯টি তথ্য কেন্দ্র খােলা হয়েছে। তথ্যকেন্দ্রের ঠিকানা ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম অবসর প্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার মােহাম্মদ আলী সরকার (রামপুরা), মৌলবী ইদ্রিস আহমদ (২৭১ মালিবাগ), মােহাম্মদ আলী সরকার (ঢাকা স্টেডিয়াম), শান্তি পরিষদের সদর দফতর (১২ ধানমন্ডি, সড়ক নং ৫) মওলানা শাহ ইসলামুল্লাহ চিশতী (১২ গােবিন্দ দাস লেন, আরমানিটোলা), হাকিম মৌলবী তাসওয়ার হােসেন খান (বাসাবাড়ি লেন, ইংলিশ রােডের কাছে), আবদুল মজিদ (৬৬ পাতলা খান লেন), হাজী মােহাম্মদ ইসহাক (১৯ উর্দু রােড) এবং ১২ নবদ্বীপ বসাক লেন, ঢাকা ।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান