২৩ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১
স্বাধীনচেতা বীর বাঙালি নবসূর্যের নবপ্রভাতে নতুন পতাকার দিকনির্দেশনায় অখণ্ড পাকিস্তানের অবসান ঘটায় মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সূর্যোদয়ের সময় ডিফ্যাক্টো আওয়ামী লীগ সরকারের সদর দফতর অর্থাৎ, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডস্থ স্বীয় বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা তােলার সময় ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানান। বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। সূর্যাস্তের সময় স্বেচ্ছাসেবকরা আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা নামিয়ে নেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবন শীর্ষে যথারীতি কালাে পতাকা তােলা হয়। ‘পাকিস্তান দিবস’। বিক্ষুব্ধ বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে দিবসটি বাংলাদেশে নতুন প্রেক্ষাপটে পালিত হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগেই ২৩ মার্চকে ঐতিহাসিক লাহাের দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ উপলক্ষে। তিনি সারা বাংলায় সরকারি ছুটি ঘােষণা করেন। পাকিস্তান দিবসে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনাবাহিনীর সদর দফতর ছাড়া বাংলাদেশে আর কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়েনি। সারা বাংলায় অর্ধচন্দ্র তারকাখচিত সাদা-সবুজ পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে উড়েছে। সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্যের ওপর বাংলাদেশের সােনালি রং মানচিত্রশােভিত স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে লাহাের প্রস্তাব দিবস’ পালনের নামে প্রকৃত প্রস্তাবে উদযাপন করে বাংলাদেশ দিবস’। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েট ভবন, হাইকোর্ট ভবন, পরিষদ ভবন, ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর, ঢাকা বেতার ভবন, ঢাকা টেলিভিশন ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিফোন ভবন, হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, প্রধান বিচারপতি ও মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সমস্ত সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলা হয়। জাতীয় পতাকার পাশাপাশি তােলা হয় শােকের প্রতীক কালাে পতাকাও।
হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলার সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বাধা দিলে ছাত্র-জনতা তা উপেক্ষা করে পতাকা তােলেন। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন ও সােভিয়েট কনস্যুলেটে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলা হয়। চীন, ইরান, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাস ভবনে প্রথমে পাকিস্তানি পতাকা তােলা হয়। পরে জনতা এসব দূতাবাসে সেই পতাকা। নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তােলে। মার্কিন দূতাবাসে কোনাে পতাকাই ভােলা হয় না। | অসহযােগ আন্দোলনের ২২তম দিবসে বীর বাঙালি নবজীবনের বার্তাবাহী। নয়াপতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় নামে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার রাজপথ সংগ্রামী জনতার প্রত্যয়দীপ্ত মিছিলের পদভারে প্রকম্পিত হয়। ভাের থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থান ও শহরতলি থেকে দলে দলে মানুষ অভূতপূর্ব সুশৃঙ্খল মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসতে থাকে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ-শিশুদের ছােট-বড় প্রায় ৭০টি মিছিল আসে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। প্রতিটি মিছিলই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘মহান জাতির মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু লও সালাম’ প্রভৃতি শ্লোগানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘােষণা করে। শােভাযাত্রী সবার হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ প্রতিরােধ দিবস’ পালন করে। এ উপলক্ষে রাজধানীর গণজীবন গণআন্দোলনের প্রবল জোয়ারে পরিণত হয়।
বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণ, পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, নিউ মার্কেট থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত মিছিলে মিছিলে ছেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এলাকা থেকে শুরু করে সুপ্রশস্ত মিরপুর সড়ক উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সারাদিন রাজপথে লাঠি বর্শা-বন্দুকের মাথায় নতুন জাতি ও নতুন দেশের পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ কোটি প্রাণের অমােঘ সঙ্গীত ‘জয় বাংলা’ মন্ত্রে গর্জে উঠতে থাকেন। জনতা ভুট্টো ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে পাকিস্তানের কায়েদে-আজম’ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। ‘প্রতিরােধ দিবস পালন উপলক্ষে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলার পর প্রভাতফেরি বের করা হয়। আজিমপুর কবরস্থানে স্বাধিকার আন্দোলনের বীর শহীদদের মাজার জিয়ারত শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। এরপর আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছাত্রছাত্রী ও প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া। সকাল সােয়া ৯ টায় হাজার হাজার মানুষের করতালি ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলার পর জয় বাংলা বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকার প্রতি অভিবাদন জানান।
এ সময় রেকর্ডে ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ বাজানাে হয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পতাকা তােলার পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃচতুষ্টয় নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ, স, ম, আবদুর রব ও আবদুল কুদ্স মাখন ‘জয় বাংলা বাহিনীর গার্ড অব অনার নেন। মার্চ পাস্ট শেষে বাহিনীর সদস্যরা মনােজ্ঞ সামরিক মহড়া প্রদর্শন করেন। এরপর ‘জয় বাংলা বাহিনীর পাঁচ শতাধিক সদস্য প্যারেড করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। তারা সর্বাধিনায়ককে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানান। সালাম গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু বাম হাতে বাংলাদেশের পতাকা। উর্বে তুলে ডান হাত মুক্তি সৈনিকদের দিকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মার স্পন্দন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে তাদের অভিনন্দিত করেন। জয় বাংলা বাহিনীর উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার মানুষ কারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই আপনারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবেন জয় বাংলা। বাংলার জয় অনিবার্য। সারাদিন দলে দলে মুক্তিপাগল জনতা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে তার হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দিয়ে নিজেরা অগ্নি শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধু সমাগত জনতার উদ্দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা আন্দোলিত করে তাদের অভিনন্দিত করেন। তিনি মিছিলকারীদের উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দান করেন। জনতার উদ্দেশে ভাষণকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় ঘােষণা করেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। যতদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হবে, যতদিন একজন বাঙালি। বেঁচে থাকবে—আমাদের সংগ্রাম চলবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তি আন্দোলনের পটভূমিতে ঐতিহাসিক ২৩ মার্চ আমাদের জীবনে নতুন প্রেক্ষাপটে উপস্থিত হয়েছে। এ অবিস্মরণীয় দিনে আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার শপথ নিন। আপনাদের প্রতি আমার নির্দেশ-শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। সংগ্রাম চালিয়ে যান। আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের দাবির প্রশ্নে কোনাে আপস নেই। অনেক রক্ত দিয়েছি। প্রয়ােজন হলে আরও রক্ত দেব। মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছবই। জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের অতুলনীয় ঐক্য, নজিরবিহীন সংগ্রামী চেতনা ও শৃঙ্খলা দিয়ে আপনারা প্রমাণ করেছেন—শক্তির জোরে আর বাঙালিদের দাবিয়ে রাখা যাবে না। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করে রাখা যাবে না। | বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয় স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলতেই থাকবে। আপনারা প্রস্তুত থাকুন। শোষক, কায়েমি স্বার্থবাদীদের কিভাবে পর্যদস্ত করতে হয় আমি জানি। আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হােসেন প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা বিচারপতি এ. আর, কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা, এম, এ, আহমেদ ও কর্নেল হাসানের সঙ্গে দুদফা বৈঠকে মিলতি হন। বৈঠক দুপুরে এক ঘণ্টা ও সন্ধ্যায় দুঘণ্টা স্থায়ী হয়। বিকেলে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘু দলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা, ওয়ালী খান, জমিয়তে ওলামায়ের প্রধান শাহ আহমদ নূরানী, জমিয়তের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ, পাঞ্জাব কাউন্সিল লীগ প্রধান সর্দার হায়াত খান ও বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেথ্রো উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খােন্দকার মুশতাক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হােসেন সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাই দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি নিস্পত্তি হয়ে যাক। এ সময় বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বলেন, আপনারা ভালাে কামনা করুন, কিন্তু খারাপের জন্যও তৈরি। থাকুন। বিকেলে রংপুরের সৈয়দপুরে সেনাবাহিনী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী জোরপূর্বক সৈয়দপুর শহরের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে কারফিউ জারি করে। রাতে স্থানীয় অবাঙালিদের নিয়ে সৈন্যরা শহরে বিভিন্ন বাঙালি বসতির ওপর হামলা চালায়। লুঠতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও গুলিবর্ষণের মাধ্যমে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
করাচিতে ভুট্টো সমর্থকরা বাঙালি কলােনিতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযােগ, গুলিবর্ষণ ও লুঠতরাজ করে। দাঙ্গাকারীদের হামলায় বেশ কয়েকজন হতাহত ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউসের জনৈক মুখপাত্র বলেন, রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দু-একদিনের মধ্যে উভয় প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হতে যাচ্ছে। একই সাথে সামরিক শাসনও প্রত্যাহৃত হতে যাচ্ছে। আগামীকাল অথবা পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এ ব্যাপারে ঘােষণা দিতে যাচ্ছেন। অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ব্যবস্থা তিন মাসের জন্য কায়েম করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিষদ সদস্যরা উভয় প্রদেশে। প্রথমে পৃথকভাবে এবং পরে যৌথভাবে শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা প্রণয়ন করার জন্য বসবেন। এভাবে শাসনতন্ত্র রচিত হবার পর নতুন সংবিধানের অধীনে নয়া সরকার গঠন করা হবে। উল্লিখিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আইন উপদেষ্টারা প্রয়ােজনীয় আইনানুগ বিধিবিধান প্রণয়নের কাজ ইতােমধ্যে শেষ করেছেন। সকাল সাড়ে ১১টায় ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সেনানিবাসে গিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। তিনি সৈনিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্টের যাওয়া-আসার সময় পথের দুপাশে জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। | পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রায় সারাদিন দলীয় উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করেন। সকালে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি জেনারেল পীরজাদার সঙ্গেও বৈঠক করেন। কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম খান করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় পৌঁছেই তিনি জনাব ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বিকেলে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গেও আলােচনা করেন। কাইয়ুম খান সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণকেই বলতে হবে, দেশকে অখণ্ড রেখে তারা কতটুকু অটোনমি এবং আমাদের সঙ্গে কতটুকু সম্পর্ক বজায় রাখতে চান। যদিও তারা ভােটের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন তারা সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনই প্রত্যাশা করেন। সন্ধ্যায় ওয়ালী খান, মুফতি মাহমুদ, গাউস বক্স বেজেঞ্জো, মিয়া দৌলতানা, শাহ আহমদ নূরানী ও সর্দার শওকত প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে মুফতি-ওয়ালী-বেজেঞ্জো এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে, জেনারেল ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিটের অবসানের পর ‘এক ব্যক্তি এক ভােট’ ভিত্তিতে গঠিত একটি সার্বভৌম পরিষদসহ পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কায়েমের কথা ছিল। কিন্তু দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর জনসাধারণ যখন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন থেকেই সেই সর্বসম্মত পরিকল্পনাটি বানচাল করার জন্য ভণ্ডামিপূর্ণ প্রচেষ্টা শুরু হয়। জাতীয় পরিষদ কর্তৃক একটি জাতীয় সরকার গঠনের পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দেশের দুই অংশে দ্বিধাবিভক্ত করার পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতীয় পরিষদকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এক ইউনিটের সেই মৃত ঘােড়াকে পুনঃজীবিত করাই এর উদ্দেশ্য। ‘প্রতিরােধ দিবস’ পালন উপলক্ষে বিকেলে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যৌথভাবে জনসভার আয়ােজন করে। গণসমাবেশে বক্তৃতাকালে নেতৃবৃন্দ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়ে তােলার আহ্বান জানান। শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি মােহাম্মদ শাহজাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় তােফায়েল আহমদ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, রুহুল আমিন ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান, আ, স, ম, আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্স মাখন ও সায়েদুল হক বক্তৃতা করেন। ন্যাপ ভাসানী স্বাধীন পূর্ববঙ্গ দিবস পালন করে। এ উপলক্ষে ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানীর ভাষণদানের কথা ছিল। কিন্তু তিনি অনুপস্থিত থাকেন। দলের মহাসচিব মশিয়ুর রহমান (যাদু মিয়া) সভায় জানান, অসুস্থতার কারণে মওলানা সাহেব পল্টনে। আসতে পারবেন না। এ উপলক্ষে মওলানা ভাসানী সন্তোষ থেকে একটি বাণী। পাঠান। বাণীতে তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলাকে সরল মনে স্বীকার করে। নেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। | জনসভায় প্রধান বক্তার ভাষণে ন্যাপ নেতা যাদু মিয়া বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্সে ঘােষণা করেছেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। এ স্বাধীনতাকে আজ আমাদের রক্ষা করতেই হবে। | তিনি বলেন, পাকিস্তানের পতাকা আজ কোথাও নেই। একদিকে সামরিক সরকার, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্দেশ জারি করছেন। জনগণ আওয়ামী লীগের নির্দেশই মেনে চলছে । সমস্ত সরকারি কর্মচারীও এ নির্দেশ পালন করছে। ন্যাপ নেতা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান কিছুতেই বাঙালিদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করতে কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। ন্যাপের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান