২১ মার্চ রবিবার ১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষিত মুক্তিসংগ্রামের বিংশতিতম দিবসে হাজার হাজার মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় বিদ্রোহী বাংলার রাজধানী ঢাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। নারী-পুরুষ-কিশােরের সম্মিলিত মিছিলে ঢাকা যেন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত সেসব মিছিল দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে। সেখানে মুক্তি অর্জন না। করা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করার পর মিছিল যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। সারাদিন ধরে ধানমন্ডির ৩২ নং রােডস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে একের পর এক মিছিল আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধু কোনাে মিছিলকেই উপেক্ষা করেন না। ব্যস্ততার মাঝেও তিনি বার বার। এসে মিছিলকারীদের স্বাগত জানিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তৃতাকালে সুস্পষ্ট ঘােষণা করেন, মৌলিক প্রশ্নে কোনাে আপস হতে পারে না। আপনারা চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত হােন। বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবি আদায় না। হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। আমরা অনেক রক্ত দিয়েছি। প্রয়ােজন হলে চরম ত্যাগ স্বীকার করব। তবু দাবি আদায় করে ছাড়ব। বঙ্গবন্ধু বলেন, জনতার জয় অবধারিত। যত নির্যাতন-বুলেট চালানাে হােক না কেন জনতাকে স্তব্ধ করা যাবে । তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বে যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তা যাতে কলঙ্কিত না হয় সেজন্য অবশ্যই আন্দোলন সুশল ও শান্তিপূর্ণ হতে হবে। বিভিন্ন সংগঠন আগামী ২৩ মার্চ প্রতিরােধ দিবসের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘােষণা করে। মগবাজারে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক মহিলা সমাবেশে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে একটি প্যারা মিলিটারি গঠনের আহ্বান জানানাে হয়। নারায়ণগঞ্জে মহিলারা একটি নৌ-মিছিল বের করেন। সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষুব্ধ লেখক ও শিল্পীরা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। সারাদেশে যথারীতি সভা-সমাবেশশােভাযাত্রার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানানাে হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকারি অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সরকারি ও বেসরকারি ভবন শীর্ষে কালাে পতাকা উড়ানাে সকালে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে পঞ্চম দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন। বৈঠক দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এর আগে বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে বিশিষ্ট আইনজীবী এ, কে, ব্রোহির সাথে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মিলিত হন। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বিকেলে সদলবলে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। ভুট্টোর সঙ্গে এ, এইচ, কারদার, মমতাজ ভুট্টো, গােলাম মােস্তফা জাতেই, হায়াত মােহাম্মদ খান শেরপা, তালেবুল মওলা ও রউফ তাহের প্রমুখ দলীয় নেতা ঢাকায় আসেন। ভুট্টোর আগমন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে সেনা মােতায়েন করা হয়। সাংবাদিকদের বিমানবন্দরে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। ভুট্টোর দলকে সামরিক বেষ্টনী দিয়ে বিমানবন্দর থেকে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে আসার সময় রাস্তার দুপাশের পথচারীরা ভুট্টো-বিরােধী শ্লোগান দেয়। ভুট্টো হােটেলে প্রবেশের সময় হােটেলের সামনে অপেক্ষমাণ জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সামরিক বাহিনীর লােকজন ও ভুট্টোর সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে ঘিরে হােটেলের ভেতরে নিয়ে যায়। এ সময় সাংবাদিকদের ভুট্টোর কাছে পৌঁছুতে দেওয়া হয় না। ভুট্টো হােটেল লাউঞ্জে প্রবেশের পর সেখানেও একদল বিক্ষোভকারী প্রাকার্ডসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ভুট্টোর অবস্থান উপলক্ষে হােটেলের চারপাশে কড়া সামরিক প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়।
ভুট্টো যখন হােটেলে প্রবেশ করেন তখন হােটেলের শীর্ষে শোকের প্রতীক কালাে পতাকা উড়ছিল। সৈন্যরা হােটেলে ঢুকেই সেই পতাকা নামিয়ে ফেলে। কিন্তু জনতার প্রতিবাদের মুখে তারা পুনরায় হােটেল ভবনে কালাে পতাকা তুলতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যায় পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো কড়া সেনা প্রহরায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। দুঘণ্টারও বেশি সময় তারা রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলাপ-আলােচনা করেন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক শেষে হােটেলে ফিরেই জনাব ভুট্টো তার। উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। এর আগে হােটেল লাউঞ্জে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, এ মুহূর্তে আমি এটুকু বলতে পারি যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভুট্টো সাংবাদিকদের আর কোনাে সময় না দিয়ে সরাসরি লিফটে চড়েন। সাংবাদিকরা তাঁর সহগামী হতে চাইলে ভুট্টোর ব্যক্তিগত প্রহরীরা সঙ্গিন উঁচিয়ে বাধা দেয়। | সন্ধ্যায় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ খান মােহাম্মদ দৌলতানার কক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ এক ঘরােয়া বৈঠকে মিলিত হন। এটি ছিল তাদের দ্বিতীয় দফা বৈঠক। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মিয়া মমতাজ খান মােহাম্মদ দৌলতানা, ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান, জমিয়তে ওলামায়ের মহাসচিব মুফতি মাহমুদ, ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও সর্দার শওকত হায়াত খান প্রমুখ। এর আগে সকালে মিয়া মমতাজ দৌলতানা পিডিপি প্রধান নূরুল আমিনের সঙ্গে তার বাসভবনে আলােচনা-বৈঠকে মিলিত হন। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার জন্য পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে মালদ্বীপের ব্রিটিশ ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করেন। গত ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জারিকৃত কারফিউ দুপুর ১২টায় ৬ ঘণ্টার জন্য। প্রত্যাহার করা হয়। পরে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুনরায় কারফিউ বলবৎ করা হয় । ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ আগামী ২৩ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্য বর্জন সপ্তাহ পালনের কর্মসূচি ঘােষণা করে এবং তা সার্থক করে তােলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানায়।
ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিকেলে চট্টগ্রামের পােলাে। গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় ঘােষণা করেন, আলােচনায় ফল হবে না । এদেশের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে চাপরাসি পর্যন্ত যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে মানে না, তখন শেখ মুজিবুর রহমানকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সুযােগ দেওয়া উচিত। তবে এ সরকার পাকিস্তান শাসন করার জন্য নয়, কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার পাওনা আদায়ের জন্য গঠিত হবে। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে শাসন ও সংবিধান প্রণয়নের সমস্ত দায়িত্ব অর্পণের জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ তাদের মুক্তিসংগ্রামে শেখ মুজিবের পেছনে কাতারবন্দী। জেনারেল ইয়াহিয়ার বুদ্ধিমানের মতাে কাজ হবে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সরে পড়া। মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর উদ্দেশে বলেন, ইসলামের ভাওতা দিয়ে আর আমাদের শাসন করাে না। আমাদের ও তােমাদের ধর্ম এক হলেও ভাষা, সংস্কৃতি, বেশভূষা প্রভৃতিতে আমরা একটি সম্পূর্ণ পৃথক জাতি। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার মানুষ দেশকে স্বাধীন করার জন্য সমুদ্রের তরঙ্গের মতাে। আজ জেগেছে। নিজেদের মুক্তির আন্দোলনে তারা যে ঐক্য দেখিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোনাে তুলনা নেই। আমরা এ দেশকে স্বাধীন করবই ।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান