২০ মার্চ শনিবার ১৯৭১
সকালে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলােচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দুজন শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১০টায় কঠোর সামরিক প্রহরা পরিবেষ্টিত রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে আলােচনা শুরু হওয়ার পর বাইরে বিপুলসংখ্যক জনতা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকে। সােয়া দুঘণ্টা আলােচনা চলার পর প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এলে অপেক্ষমাণ জনতা সমস্বরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানায়। এ সময় নেতাকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির বাসভবনে প্রত্যাবর্তন করলে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলার নেতাকে ঘিরে ধরেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বলেন, আলােচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কাল আবার বৈঠক হবে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলব না। সময় এলে আমি অবশ্যই সবকিছু বলব। এ সময় আওয়ামী লীগ প্রধানের সঙ্গে দলীয় শীর্ষনেতারা উপস্থিত ছিলেন। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর কাছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে জানতে চান। একজন। প্রশ্ন করেন, আপনি কি আলােচনায় সন্তুষ্ট?
বঙ্গবন্ধু আবার বলছি, কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। আমার এই মন্তব্য থেকেই আপনারা বুঝে নিতে পারেন। প্রশ্ন : কতদিন এই আলােচনা চলবে? বঙ্গবন্ধু : আলােচনা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে। আমরা একটা সমাধানে পৌঁছানাের চেষ্টা করছি। প্রশ্ন : জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ নিয়ে কি আলােচনা হয়েছে? বঙ্গবন্ধু : জয়দেবপুরে নিরস্ত্র জনতার ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি আমার বক্তব্যে বলেছি। প্রেসিডেন্ট ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবেন বলে আমাকে কথা দিয়েছেন। প্রশ্ন : বৈঠকে কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে আলােচনা হয়েছে? বঙ্গবন্ধু আমাদের আলােচনা এগিয়ে চলেছে। আলােচনা শেষ হলেই কর্মপন্থা স্থির হবে। বঙ্গবন্ধু এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পৃথক পৃথকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশের নেতাদের সাথে আলােচনা করবেন। যদি প্রয়ােজন হয় পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দসহ আমরা এক সঙ্গে আলােচনা করতে পারি। অহিংসা ও অসহযােগ আন্দোলনের ১৯তম দিবস। রাজধানী ঢাকায় বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নৌবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রাক্তন নৌ-সেনারা বাঙালি সৈনিকদের কেবল বাংলাদেশে নিযুক্ত রাখার এবং অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে অবাঙালি সৈন্যদের অপসারণ করার জন্য দাবি জানান।
সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষিত মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে সার্বিক সহযােগিতা করার লক্ষ্যে একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনীর কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। সমাবেশ শেষে বাঙালি নৌসেনারা কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে যান এবং বাংলার মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়কের সাথে সাক্ষাৎ করে তার নেতৃত্বে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দানের প্রতিশ্রুতি দেন। সারাদিন বীর বাঙালির দৃপ্ত পদচারণায় রাজধানী টালমাটাল হয়ে ওঠে। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে। সেখানে শপথ অনুষ্ঠানের পর একের পর এক শােভাযাত্রা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে সমবেত হয়। নিজ বাসভবনে সমাগত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সাথে ঘােষণা করেন, মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোনাে শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশকে কলােনি করে বাজার হিসেবে ব্যবহার করার দিন শেষ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সত্যগ্রহ চলবে। আবেগজড়িত কণ্ঠে শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রামী জনতার মুহুর্মুহু ‘জয় বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন ধ্বনির জবাবে বলেন, আমার আর কিছু পাওয়ার নেই। আমি যা পেয়েছি তার কোনাে তুলনা নেই। বাংলার মানুষের এই বিশ্বাস ও ভালােবাসা। নিয়েই আমি মরতে চাই। তবে তার আগে বাংলার মানুষের মুক্তি চাই। অনুগামীদের বঙ্গবন্ধু বলেন, যত বাধাই আসুক বাংলার মানুষের স্বাধীনতা। অর্জনের সংগ্রাম চলবে । আপনারা আন্দোলনে ভাটা পড়তে দেবেন না। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন। রাতে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতিতে বলেন, মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।
বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্ব-দরবারে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে নিজেদের আন্দোলন প্রতিটি গ্রাম-শহর-নগরের নারী-পুরুষ-শিশুকে বাংলাদেশের দাবির পেছনে সুসংগঠিত করেছে। বাংলাদেশের জনগণ সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের হৃদয় জয় করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ বিবৃতিতে সংগ্রামী জনতাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সর্বস্তরের মানুষ, মাঠের কৃষক, কারখানার শ্রমিক, ব্যাংক, অফিস, বন্দর ও সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত কর্মচারী যারা আমাদের নির্দেশাবলির কাঠামাের মধ্যে অর্থনীতি রক্ষা করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাদের সবাইকে আমি অভিনন্দন জানাই। তিনি আরও বলেন, এসব নির্দেশ কার্যকর করার ব্যাপারে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনগুলাের সজাগ দৃষ্টির জন্য তারা বিশেষভাবে অভিনন্দনযােগ্য। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের জনগণ প্রমাণ করেছেন তারা নিজেদের বিষয়গুলাে অত্যন্ত আদর্শ পদ্ধতিতে পরিচালনা করতে সক্ষম। তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকারে বদ্ধপরিকর। তিনি আরও ঘােষণা করেন, তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া। পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। আমি নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধি ও উস্কানিমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করছি । জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, আগামী ২৩ মার্চ লাহাের দিবস’ উপলক্ষে সারা বাংলাদেশে ছুটি থাকবে। গত ১৪ মার্চ ঘােষিত কর্মসূচির পর যেসব নির্দেশ ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ও আগামীতে নির্দেশ দেওয়া হবে সেসব পালন সাপেক্ষে যাবতীয় সংগ্রামী কর্মসূচি চালু থাকবে।
গত সন্ধ্যায় জয়দেবপুরে বলবৎকৃত সান্ধ্য আইন অব্যাহত থাকে গতকাল জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে আহতদের মধ্যে কয়েকজনের হাসপাতালে মৃত্যু হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌসুলী এ, কে, ব্রোহি সকালে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। সন্ধ্যায় হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান হােটেল রূপসী বাংলা) কাউন্সিল মুসিলম লীগ প্রধান। মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা, ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান, জমিয়াতে ওলামায়ে নেতা মওলানা মুফতি মাহমুদ, পাঞ্জাব কাউন্সিল লীগ প্রধান সরদার শওকত হায়াত খান, বেলুচ ন্যাপের প্রধান গাউস বক্স বেজেভো, পীর সাইফউদ্দিন প্রমুখ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা এক ঘরােয়া বৈঠকে মিলিত হন। করাচিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তিনি লন্ডন পরিকল্পনা মানবেন না। কেবল পাকিস্তান পরিকল্পনাই সবাইকে মানতে হবে। তিনি লন্ডন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালী খান ও মিয়া মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা লন্ডনে বসে লন্ডন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, এই পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ প্রধান ঘােষিত ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত। ভুট্টো সাংবাদিকদের জানান, তিনি আগামীকাল ঢাকা আসছেন। তাকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানানাের প্রেক্ষিতে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে যে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন, ঢাকা থেকে সে সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব মেলায় ঢাকা বৈঠকে যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান