১২ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১
জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সঙ্গে আলােচনা না করে আকস্মিক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘােষিত অসহযােগ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি-আধাসরকারি কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্ত কর্মস্থল বর্জন করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝােলে। সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ এবং যানবাহনে কালাে পতাকা উড়ে। সারাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে সভা, সমাবেশ ও শােভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সারা বাংলায় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য দুর্জয় শপথ নেওয়া হয়। বগুড়া জেলখানা ভেঙে ২৭ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। এখানে কারারক্ষীদের গুলিতে ১ জন কয়েদি নিহত ও ১৫ জন আহত হয় । জাতীয় পরিষদ সদস্য মােহাম্মদ জহিরউদ্দিন পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জন করেন। রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারি ঘােষণায় আগামী ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের নির্ধারিত সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান ও পাঞ্জাবের কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা পীর সাইফুদ্দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন। চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকাল প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। পূর্ব রেলওয়ে কর্মচারীবৃন্দ এবং চারু ও কারুশিল্পীরা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সংসদের এক জরুরি সভায় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির এক সভায় সকল ইউনিট ও ইউনিয়নকে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয় । ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমি জানি শেখ মুজিবুর রহমান কখনােই জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আপনারা শেখ মুজিবের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখুন।
মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের উদ্দেশে জনসভায় বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা বাঙালিদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না। লাহােরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দোষ করা হলাে লাহােরে কিন্তু বুলেট বর্ষিত হলাে ঢাকায়। যারা শক্তিবলে বাঙালিদের দমিয়ে রাখার কথা বলছেন—তারা কি বলছেন নিজেরাই জানেন না। এ ধরনের কথা নিছক পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণ সমান অধিকার নিয়ে থাকতে চায়, পশ্চিমাঞ্চলের দাস হিসেবে নয়। পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য এখন একটিই মাত্র পথ খােলা রয়েছে, আর তা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর । তিনি বলেন, দেশের শাসনক্ষমতা অবিলম্বে হস্তান্তর করতে হবে এবং সেনাবাহিনীকে গণশক্তির সহায়ক শক্তি হতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আপন পথে চলতে দিতে হবে। বাঙালিরা আজ নিরাপত্তা চায় এবং এ জন্যই তারা শ্রেণী ও মত নির্বিশেষে একজন মাত্র নেতার পেছনে কাতারবন্দী হয়েছে।
তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রথম ফ্লাইটে ঢাকা যাবার পরামর্শ দিয়ে বলেন, হাতে সময় খুবই কম। আপনি ঢাকা গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসুন। লারকানা থেকে লাহাের যাবার পথে মুলতান বিমানবন্দরে পিপলস পাটি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, আমার দল এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে চায় যাতে জনগণের আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। আমি চাই জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হােক। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার জন্য আমার দল সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত। আমি ক্ষমতালােভী নই। লাহােরে ন্যাপের মহাসচিব সি, আর আসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, দেশের বর্তমান সংকটের জন্য একচেটিয়া পুঁজিপতি ও আমরাই দায়ী। জনাব ভুট্টোও এ ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। জনাব ভুট্টোর হুমকিপূর্ণ মনােভাব ও ক্ষমতার লিন্সই রাজনৈতিক সংকটকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে। প্রদেশের ক্ষমতা সংক্রান্ত প্রশ্নটির সাথে দেশের অস্তিত্বের কোনাে বিরােধ নেই । শক্তি প্রয়ােগের নীতি অব্যাহত থাকলে বিচ্ছিন্নতার মনােভাব শক্তিশালী হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের চার দফাকে কোনাে গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষই বিরােধিতা করতে পারে না। প্রেসিডেন্টের অবিলম্বে চার দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিত। লাহােরে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকসহ ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। করাচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খলিল আহমদ তিরমিজি এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকদের প্রতি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু আহূত গণআন্দোলনে শরীক হবার আহবান জানান।
রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রের খ্যাতনামা বাংলা খবর পাঠক সরকার কবীর উদ্দিন বেতারে বঙ্গবন্ধুর খবর প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরােপের প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্য পাঠানাে খাদ্য বােঝাই মার্কিন জাহাজের গতিপথ বদল করে করাচি প্রেরণের ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা প্রকাশ করেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্থানীয় কয়েকটি ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি হুশিয়ারি দেওয়া হয়, তারা অবিলম্বে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানে মুদ্রা পাচার বন্ধ না করলে এজন্য কোনাে দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী থাকবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম বানচাল প্রয়াসী বৃহৎ ব্যবসায়ী ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অপর এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য কোনাে জ্বালানি সরবরাহ না করতে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীদের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, গণদুশমনদের কোনােভাবে সাহায্য করা। হলে তেল কোম্পানিগুলাের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান