You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.09 | ৯ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১ দিনপঞ্জি - সংগ্রামের নোটবুক

৯ মার্চ মঙ্গলবার ১৯৭১

আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা হয়। মওলানা ভাসানী সকালে পল্টনের জনসভায় ভাষণদানের উদ্দেশে সন্তোষ থেকে ঢাকা পৌঁছার পরই বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোন করেন। টেলিফোনে দুই নেতা আলােচনার পর আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রায় আড়াই ঘণ্টা এক বৈঠকে মিলিত হন। বিকেলে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে অশীতিপর বৃদ্ধ ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানী ঘােষণা করেন ইয়াহিয়া সাহেব অনেক হয়েছে, আর নয়। তিক্ততা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। লাকুম দ্বীনুকুম অলইয়াধীন’ (তােমার ধর্ম তােমার আমার ধর্ম আমার) নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। | আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু ঘােষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়সহ সারাদেশে সমস্ত সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কেবল সেসব চালু থাকে। বাস ট্যাক্সি রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন চলাচল করে। দোকানপাট ও হাটবাজার খােলা থাকে। বাসগৃহে স্বাধীন বাংলাদেশের (সবুজ জমিনের মাঝে পূর্ণ সূর্যের ওপর বাংলাদেশের মানচিত্র) পতাকা উড়ে। সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, ভবন ও যানবাহনে কালাে পতাকা উড়ানাে হয়। লঞ্চ ও ট্রেন স্বাভাবিক চলাচল করে তবে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারাদেশে ব্যাংকিং কাজকর্ম চলে। মুক্তি আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারবর্গের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে অর্থদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ইসলামাবাদে সরকারিভাবে ঘােষণা করা হয়, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে আসবেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করেন।

রাজশাহীতে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন নৈশ কারফিউ জারির পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘােষণার পর রাজশাহীতে হঠাৎ সান্ধ্য আইন জারির কারণ বােধগম্য নয়। এই সান্ধ্য আইন জারি জনসাধারণের জন্য উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয় । বিবৃতিতে এ জন্য নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানাে হয় । সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলাে ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি  নুরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে, গত ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এ ছাত্র জনসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘােষণার প্রস্তাব অনুমােদন করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বালাদেশে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অনুরােধ জানানাে হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সকালে পিআইএ-র বাঙালি কর্মীরা তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলে তিনি তাদের সাক্ষাদান করেন।

গভীর রাতে ইসলামাবাদে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলের (বাংলাদেশ) সামরিক শাসক নিয়ােগ করা হয়। এই নিয়ােগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে ঘােষণা করা হয়। আজ তার গভর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকা হাইকোর্টে হরতাল চলাকালে কোনাে বিচারপতি নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন।  জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট প্রয়ােজনে বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘের উপআবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। জাপানের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠাননার সিদ্ধান্ত নেয়।  করাচিতে সাংবাদিকদের সাথে আলােচনাকালে ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলােচনার জন্য ঢাকায় আসার কথা ঘােষণা করেন। জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার আমীর অধ্যাপক গােলাম আজম এক বিবৃতিতে দেশকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান।

 রাজধানীতে দিনের উল্লেখযােগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা আন্দোলন সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভা। জনসভায় ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বাংলা লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বক্তৃতা করেন। মওলানা ভাসানী বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মতাে আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোনাে কিছু না করা হলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতাে তুমুল গণআন্দোলন শুরু করব। মওলানা সাহেব বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকারের জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান  স্বাধীন হবে। পাকিস্তান অখও থাকবে না। অখণ্ড রাখবও না। ইয়াহিয়া, তােমার বাপেরও ক্ষমতা নেই, ঠেকায়। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের ভালাে চাও, তাহলে কালই বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। মজলুম নেতা তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেন, জালেমের সঙ্গে কোনাে সহযােগিতা নাই । যে জুলুম করে সে যেমন পাপী, যে জুলুম সহ্য করে সেও তেমনি পাপী। কামানের গােলাকে বাঙালি ভয় করে না। বাঙালির হাতে তীরধনুক, দা-কুড়াল-বল্লম আছে। আমি সহিংসায় বিশ্বাস করি না। আল্লাহ ও তাঁর রসুল এই শিক্ষা দেয়নি। মওলানা ভাসানী তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে বলেন, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে শেখ মুজিবুর রহমান আপস করতে পারে। খামাখা, কেউ মুজিবকে অবিশ্বাস করবেন না। শেখ মুজিবকে আমি খুব ভালাে করে চিনি। তাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি। আমি শেখ মুজিবকে আমার তিন পুত্রের চেয়েও ভালােবাসি।  আতাউর রহমান খান বলেন, বঙ্গবন্ধু, আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আপনি স্বাধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘােষণা করুন। আপনার হাতে ক্ষমতা। হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র চলছে।

সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান