এই দা দিয়ে এই লোকগুলোকে জবাই করতে পারবে?
১৯৭১ সালের ১৩ শে মে রোজ রবিবার সকাল ১০ ঘটিকার সময় আমি গোসল করার জন্য বাড়ী হতে বের হই। এমন সময় দেখতে পাই দু’খানা খাঁন সেনার গাড়ি এসে আমাদের মহেশপুর টাউন কমিটি ঘরের সম্মুখে থেমে যায়। আমি ঐ গাড়ি দেখার সঙ্গে সঙ্গে গোসল না করে বাড়ী ফিরে যাই। তার ১০/১৫ মিনিট পর টাউন কমিটির চেয়ারম্যান সোজাসুজি আমার বাড়ী চলে আসে এবং আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর আমাকে বলে, চলো টাউন কমিটিতে, মেজর তোমাদের পরিচয় পত্র করে দিচ্ছে। তুমি উহা নিয়ে চলে আসবে। আমি সরল মনে তার সঙ্গে টাউন কমিটির সামনে চলে আসি এবং দেখতে পাই টাউন কমিটি হলের দরজা বন্ধ। তখন চেয়ারম্যান আমাকে বলে এখানে ৫ মিনিট অপেক্ষা কর, মেজর কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসছে। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই দক্ষিন দিক হতে দুটা পাক সেনার গাড়ি এসে আমাদের সামনে থেমে যায়। আমি গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পাই ১০/১২ জন হিন্দু ও মুসলমান বসে আছে। তারপর চেয়ারম্যান মেজরকে আমাকে দেখিয়ে বলে, এ এক মালাউন হায়, অমনি একজন খাঁন সেনা গাড়ি হতে লাফ দিয়ে নেমে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলে, আমি গাড়িতে উঠার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট করে মহেশপুর হতে আধা মাইল দূরে ভালায়পুর নামক একটা ব্রীজ আছে, তার পূর্ব দিকে আম কাঠালের বাগান আছে, সেখানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমাদেরকে গাড়ি হতে নামায়। আমি গাড়ি হতে নেমেই দেখতে পাই, ঐ খানে একটা গাছের নিচে ৪/৫ টা ছাগল আর একটা কাঠাল গাছে একটা যুবক গাছ হতে ঐ ছাগলগুলোর জন্য পাতা পাড়ছে। মেজর তাকে দেখেই ডাকে। লোকটি অমনি মেজরের ডাকে তার কাছে চলে আসে। তার হাতে ছিল একটা দা । মেজর দা খানা তার হাত হতে নেয় এবং ২-৪ মিনিট চেয়ে দেখার পর তাকে জিজ্ঞেস করে ইয়ে কিয়া হায়? সে বলে দা। তারপর দা খানা তার হাতে দিয়ে বলে, এই দা দিয়ে এই লোকগুলোকে জবাই করতে পারবে? লোকটি অস্বীকার করে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন হতে একজন পাক সেনা রাইফেল নিয়ে দৌড়ে তার কাছে চলে আসে এবং তার ঘাড়ে এবং পিঠে দু’টা আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে পড়ে যায়। তার ২-৪ মিনিট পর সে মাজা বাঁকা করে সেখান হতে চলে যায়। তারপর আমাদের সবাইকে লাইন করে দাঁড় করায়। ৮ জন পাকসেনার মধ্যে তিনজন রাইফেল নিয়ে তিন দিকে আমাদের থেকে প্রায় ২০/২৫ গজ দূরে চলে যায় এবং আমাদের দিকে পজিশন নিয়ে থাকে। আর বাকি ৫ জন পাকসেনা প্রত্যেক একটা মোটা লাঠি হাতে করে আমাদের সবাইকে ঘাড়ে এক বাড়ি আর মাজায় দু’বাড়ি মারার পরে শেষে আমাদের সবাইকে পায়ে দড়ি লাগিয়ে হেঁচড়ে টেনে একটা গর্তের ধারে নিয়ে সবাইকে বেয়োনেট চার্জ করে আমাদের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। পরে আমাদেরকে একই গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি চাপা দিয়ে তারা চলে যায়। পাক সেনারা চলে যাবার পর প্রায় মিনিট দশেক পর আমি অতিকষ্টে ধীরে ধীরে ঐ গর্তের উপরে উঠি এবং আমার সঙ্গে আরো একজন লোক ধীরে ধীরে উপরে উঠে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়েই প্রায় ২০/২৫ গজ রাস্তা চলার পর মাটিতে পড়ে যায়। তার কিছু সময় পর সে সেখানে মারা যায়। আমার পেটে একটা বেয়োনেটের খোঁচা গেলে নাড়ি বের হয়ে গিয়েছিল।আমি আমার গামছা দিয়ে পেট বেঁধে ৪০/৫০ গজ চলার পর একটা বাড়ী পাই এবং সেই বাড়ির মালিক আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। আমাকে পানি খাওয়াবার পর আমি সেখানে থাকতে চাইলে বাড়িওয়ালা খান সেনাদের ভয়ে আমাকে রাখতে অস্বীকার করে। তারপর তারা আমাকে ধরাধরি করে ভৌবর নদীর পাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে দেখতে পাই একজন লোক নৌকা নিয়ে জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরছে। লোকটা আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে দেখে নৌকা নিয়ে নদীর তীরে আসে এবং আমার অনুরোধে আমাকে নদী পাড় করে দেয়। আমি অতিকষ্টে রামচন্দ্রপুর নামক এক গ্রামে সন্ধ্যা ৭ টার সময় এক বাড়িতে গিয়ে থাকার জন্য একটু জায়গা চাই কিন্তু ঐ বাড়িওয়ালা খান সেনাদের ভয়ে জায়গা দিতে অস্বীকার করে। আমি বলি আমার আর চলার শক্তি নাই তখন ঐ বাড়ির ৪ জন লোক একটা তক্তায় করে আমাকে নিয়ে রামচন্দ্রপুর স্কুলে রেখে আসার কথা বলে সুন্দরপুর নদীর ঘাটে ফেলে রেখে আসে। আমি সেখানে আধামরা অবস্থায় পড়ে থাকি। তখন রাত্রি ১০-৩০ মিঃ। সেই সময় কোটচাঁদপুর হাট হতে জালাল নামক একটা লোক সুন্দরপুর নদীর ঘাটে আমাকে দেখে তারাতারি করে মহেশপুর চলে এসে খবর দেয়। তৎক্ষণাৎ মহেশপুর হতে জালাল ও আরও চারজন লোক একটা বাঁশের মাচাল নিয়ে সেখানে চলে যায় এবং ঐ মাচালে করে আমাকে মহেশপুর নিয়ে আসে। আমাকে মহেশপুর নিয়ে এসে কোহিনূর বেগমের বাসায় রেখে এবং বজলু নামক একজন ডাক্তারের চিকিৎসায় ১০/১৫ দিন পর আমি সুস্থ হয়ে উঠলে ডাক্তার একটা গরুর গাড়ী ভাড়া করে আমার পরিবারের সকলকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। তারপর আমি ভারতে গিয়ে সিন্দ্রানী হাসপাতালে প্রায় দু’মাস চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়ে উঠি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই বাংলাদেশে চলে আসি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমি জানতে পারি আমি জানতে পারি আমার সঙ্গে যাদেরকে ধরে নেওয়া হয়েছে এবং আমার সঙ্গে যাদেরকে একই গর্তে পুঁতে রাখা হয়েছিল আমি ছাড়া আর সবাই নাকি মারা গেছে।
স্বাক্ষর/-
শ্রী বিনয় কৃষ্ণ দত্ত
মহেশপুর, যশোর
২৭/১/ ৭৩