৫ মার্চ শুক্রবার ১৯৭১
ঢাকাসহ সারাদেশে পূর্ণ হরতাল, স্বাধিকারকামী জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল, গণজমায়েত ও বস্ত্র শপথের মধ্য দিয়ে বাংলার মুক্তি আন্দোলনের পঞ্চম দিন। অতিবাহিত হয়। সকালে হরতাল পালনকালে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় ৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু ও ২৫ জন আহত হয়। টঙ্গীতে শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের সংবাদে ঢাকায় জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগের উদ্যোগে ছাত্র-জনতার এক বিরাট সমাবেশ টঙ্গীর নিহত শ্রমিকদের লাশ নিয়ে রাজধানীতে মিছিল বের করে। চট্টগ্রামে গুলিবর্ষণে ৩ জন নিহত হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরও ১৪ জন আহত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। চট্টগ্রামে আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা ১৩৮-এ উন্নীত সন্ধ্যায় সরকারিভাবে ঘােষণা করা হয়, ঢাকায় সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
টঙ্গী ও চট্টগ্রাম ছাড়াও গুলিতে খুলনায় ২ জন, রাজশাহীতে ১ জন নিহত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতালের পর ব্যাংক খােলা থাকে। মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদানের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মােনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ সভা ও শােভাযাত্রার আয়ােজন করা হয়। লাহােরে দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বিভিন্ন মসজিদে সংকটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিশেষ মােনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। | পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড, এ, ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ৫ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আলােচনা করেন। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকেলে করাচি থেকে ঢাকায় পৌছান। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকেলে কবি-সাহিত্যিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলকারী ছাত্রছাত্রীদের হাতে ছিল লাঠিসােটা। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ)-এর উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক ছাত্র গণজামায়ায়েত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা নগরে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খােলা হয়। এগারাে দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তােফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান। রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে।
অবিলম্বে এই নরহত্যা বন্ধ করতে হবে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার লােকের হতাহত হবার খবর আসছে। আমরা সেনাবাহিনীর এই গর্হিত আচরণের তীব্র নিন্দা করছি। কেবল বিদেশি আক্রমণের মােকাবিলার জন্যই সেনাবাহিনী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর নয়। তিনি আরও বলেন, ক্রমাগত সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এটাই অনুমান হচ্ছে যে, বাংলাদেশে বেসামরিক জনগণের ওপর নির্যাতনমূলক নীতি আরও জোরদার করা হবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিশ্ববাসী জেনে রাখুন বাংলাদেশের জনগণের ওপর আজ যে নির্যাতন নেমে এসেছে তারা বীরের মতাে তা প্রতিরােধ করছে । আজ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ মুক্তি অর্জন এবং একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব জনাব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনাে বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির অনুরােধ জানানাের কথাও সরাসরি অস্বীকার করেন। | রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পিপলস্ পার্টি প্রধান ভুট্টোর আলােচনা বৈঠক শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হােক না কেন, অত্যন্ত অবাঞ্ছিত। তা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি বলেন, অধিবেশন স্থগিত রাখার জন্য পিপলস পাটিকে দায়ী করা সঙ্গত হবে । সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, দেশের ২৩ বছরের ইতিহাসে এমন চরম সংকট কখনাে দেখা যায়নি। এই প্রেক্ষিতেই পিপিপি নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা করেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাথে আলােচনার জন্যই পিপিপি জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখার অনুরােধ জানিয়েছিল। অধিবেশন স্থগিত রাখার অর্থ এই নয় যে, জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে। সেজন্য আমরা দায়ী নই। বাংলাদেশে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত । পিপিপি মনে করে বর্তমান সংকট যতই গুরুতর হােক না কেন শেখ সাহেব উপলব্ধি করতে পারবেন যে, অখণ্ড পাকিস্তান সত্যি বসবাসের যােগ্য। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে তার দল যে ভূমিকা নিয়েছে জনসাধারণ একদিন তার যৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে পারবেন। তবে পাকিস্তান এক থাকবে, না দুই পাকিস্তান হবে সে সম্পর্কে এখন আওয়ামী লীগকেই সিন্ধান্ত নিতে হবে। পিপিপি মনে করে, আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা হয়তাে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করতে পারবে না। এ প্রেক্ষিতেই জনাব ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছিলেন।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান