You dont have javascript enabled! Please enable it! শেরে বাংলার জন্মদিনে - সংগ্রামের নোটবুক

শেরে বাংলার জন্মদিনে

আবদুল গাফফার চৌধুরী। আজ ছাব্বিশ অক্টোবর। শেরে বাংলা ফজলুল হকের পূণ্য জন্মদিন। প্রায় শতাব্দীকাল পূর্বে এই দিনে বরিশাল জেলার চাখারে ফজলুল হক জন্মগ্রহণ করেন। সেদিন হয়তাে স্বপ্নেও কেউ ভাবেন নি, এই শিশুই এক দিন সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের রূপরেখা তৈরি করবেন। তার ঝক্ষুিব্ধ জীবনই হবে সংগ্রামী বাংলার সত্যিকার জীবনেতিহাস। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে চ্যান্সেলর হিসাবে ভাষণ দিতে গিয়ে এই বয়ােবৃদ্ধ জননেতা বলেছিলেন I arn the living history of Bengal for the last 50 years, অর্থাৎ আমি বাংলাদেশের গত অর্ধশতাব্দীর জীবন্ত ইতিহাস। মধ্যযুগে ফরাসী ম্রাট চতুর্দশ লুই অহঙ্কার করে বলেছিলেন I am State আমিই রাষ্ট্র। আর বর্তমান যুগে একমাত্র ফজলুল। হকই বিনাদ্বিধায় বলতে পেরেছেন, আমিই ইতিহাস। আমি বাংলাদেশের জীবন্ত ইতিহাস। আত্মপ্রত্যয় কতটা গভীর হলে একজন জননায়ক এমন অকুণ্ঠ আত্মপরিচয় দিতে পারেন, তা আজ ভেবে দেখার মত। শেরে বাংলার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রমনার বিশাল জনসভায় দাড়িয়ে এ যুগের বাংলার ইতিহাস, নবীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাই ঘােষণা করেছিলেন, ‘আমি নেতা নই, আমি আপনাদের মুজিব ভাই। বাংলাদেশের নেতা ফজলুল হক এবং সােহরাওয়ার্দী। তারা কবরে শুয়েও আমাদের সংগ্রামের আজ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি সেই সংগ্রামে আপনাদের বন্ধু ও সহকর্মীর ভূমিকা নিয়েছি মাত্র। বঙ্গবন্ধু অত্যুক্তি করেননি। ফজলুল হক মারা গেছেন ১৯৬২ সালে ২৭শে এপ্রিল তারিখে। তারপর দীর্ঘ আট বছরে বাঙ্গালির স্মৃতি থেকে শেরে বাংলা মুছে যাননি। বরং বাংলাদেশের স্বায়ত্ত শাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে বাংলার বাঘ যেন নতুন করে জেগে উঠেছেন এবং বাঙালির প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। বাঙালির কি সৌভাগ্য, ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ১১ ভােট পেয়ে যে শেরে বাংলা নির্বাচনে জিতেছেন, বাংলাদেশের পক্ষে ঐতিহাসিক একুশ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে গিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছ থেকে তিনিই ট্রেইটর খেতাব লাভ করেছিলেন।

তাকে বরখাস্ত করে নজরবন্দি করা হয়েছিল। এমনকি ঈদের দিনেও তাকে জামাতে নামাজ পড়তে দেয়া হয়নি। পুলিশ এবং সৈন্যবাহিনী দিয়ে তার ঢাকার সাতাশ নম্বর কে, এম, দাস লেনের বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছিল। হুমকি দেয়া হয়েছিল; রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে তাকে বিচার করে দরকার হলে ফাঁসি কাঠে ঝোলানাে হবে। ১৯৭১ সালে। ঘটেছে ১৯৫৪ সালের ঘটনারই পুনরাভিনয়। তবে আরাে বড় আকারে এবং গণহত্যার নজিরবিহীন। বীভৎসতার মধ্য দিয়ে। নবীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধুরও অপরাধ তিনি এবার সারা পাকিস্তানের নির্বাচনে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। তিনি তার নির্বাচনী ওয়াদা ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক বঞ্চনা ও অর্থনৈতিক শােষণ থেকে বাচাতে চেয়েছেন। তাই পিণ্ডির খুনী। ইয়াহিয়া-চক্রের চোখে আজ তিনি দেশদ্রোহী-বা ট্রেইটর। গােপনে তার বিচার প্রহসন চালানাে হচ্ছে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের জেলখানায়। ইয়াহিয়ার হিজমাস্টার্স ভয়েসরা প্রচার করে বেড়াচ্ছে, শেখ মুজিব ভারতের এজেন্ট। তিনি ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু। আগেই বলেছি, পিণ্ডির এই প্রচারণা বাঙ্গালির জন্য সত্যই সৌভাগ্যের কারণ। কারণ, বাঙ্গালি আজ বুঝতে পেরেছে যারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য কথা বলেছেন, তারাই করাচী পিণ্ডির বেঈমান ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে ট্রেইটর, ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু আখ্যা লাভ করেছেন। কয়েকটা উদাহরণ দি। ১৯৪০ সালে লাহােরে ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। ১৯৫৪ সালে তাকেই পাকিস্তানী শাসকেরা রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তিনি ভারতের যােগসাজসে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করতে চান এই অভিযােগ প্রমাণ করার জন্য মার্কিন মুলুক থেকে ক্যালহান নামে এক সাংবাদিককে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর উপর অনুষ্ঠিত ভারতের সাধারণ নির্বাচনে যে শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রথম কাতারে মুসলমান নেতা, যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম না করলে বাংলাদেশে নির্বাচনী বিজয় ছিল মুসলিম লীগের কাছে অসম্ভব ব্যাপার, ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তাকে ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুত্তা’ বলে অশােভন ও অশ্লীল গালি দিতে লজ্জাবােধ করেননি।

১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীকে গুলি করে মারার হুমকি দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা। ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে একবার আইয়ুব তথা কথিত আগরতলা মামলার আসামী করে ভারতের যােগসাজসে বাংলাদেশে বিদ্রোহ করার মিথ্যা অভিযােগে সামরিক আদালতে বিচারে সােপর্দ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে সেই আইয়ুবেরই মনােনীত পাকিস্তানের বে-আইনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একই অভিযােগ বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করেছেন এবং ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার নামে মাত্র দশ লাখ বাঙ্গালি। নরনারী শিশুকে হত্যা করেছেন। দুঃখে, ক্ষোভে, ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠি, যখন ভাবি শেরে বাংলা, সােহরাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর মতাে মহান দেশপ্রেমিক জননায়কেরা ট্রেইটর, আর দেশপ্রেমিক হলাে ব্রিটিশের এককালের পা-চাটা বেতনভূক সেপাই আইয়ুব, ইয়াহিয়া, টিক্কা আর নিয়াজির দল। যে ইয়াহিয়ার হাত থেকে চব্বিশ ঘন্টায় এক মিনিটের জন্য মদের বােতল নামে না, সেই ইয়াহিয়া হলাে ইসলামের রক্ষক। ইসলামের সােনালী দিনে এই ভণ্ডামী করেছিল খুনী এজিদের বাবা মাবিয়া। হজরত আলির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য জেনে বর্শার আগায় কোরাণ শরিফ বেধে ইসলামের দোহাই পেড়ে সন্ধি ভিক্ষা করেছিল ইসলাম রক্ষার নামে। তারপর এই মাবিয়ার পুত্রের হাতেই মুসলমান এজিদের হাতেই কারবালার রক্তপাত এবং নবীবংশ ধ্বংস।

আপনাদের কাছে একটা মজার কথা বলি। এই বছর ২৭শে এপ্রিল তারিখে- অর্থাৎ শেরে বাংলার মৃত্যু দিবসে বাংলাদেশ যখন ইয়াহিয়ার বর্বর হত্যাভিযান চলছে, তখন দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে খুব ইনিয়ে বিনিয়ে ফজলুল হক কত বড় পাকিস্তানী ছিলেন, পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য তিনি কি কি করেছেন তার ফিরিস্তি দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু একবারও একথাটা বলা হয়নি যে, ২৭শে এপ্রিল শেরে বাংলার মৃত্যু দিবসে সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করতে ইয়াহিয়া সরকার রাজি হয়নি তার আগে আইয়ুব সরকারও। মৃত্যুর আগে তিনি ছিলেন ভারতের দালাল, পাকিস্তানের শত্রু, এখন মৃত্যুর পরে তাকে ইসলাম ও পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু বলে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করে ফজলুল হকের প্রতি কপট দরদ প্রচার করে বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চলছে। হয়ত আজও শেরে বাংলার জন্মদিনে দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে ভাড়াটিয়া লেখকদের দ্বারা এই কপট দরদ প্রচারের অভিনয় আরাে জোরে জোরে চলবে। (চলবে)

| জয়বাংলা (১) ১: ২৫! ২৯ শে অক্টোবর ১৯৭১

মনের আঙ্গিনায় মহানগরী ঢাকা

– আহমদ ছফা ফুলন্ত নগরী, ফুটন্ত নগরী, মহীয়সী গরীয়সী নগরী, ঢাকা-আহা ঢাকা আমার। অঙ্গে অঙ্গে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের আভরণধারিনী ইতিহাসের স্রোতে স্রোতে নিত্য নতুন রূপে ফুলের মতাে প্রস্ফুটিতা, যুগ যুগান্তের সঞ্চিত রহস্যের মধুভাণ্ড-ঢাকা আহা ঢাকা আমার। অঙ্গে অঙ্গে তুমি বিদ্রোহ বিক্ষোভ ধারণ করছাে, অন্তরে অন্তরে তুমি বিপ্লব লালন করছাে, চন্দ্রালােকে অপরূপ শােভিতা, বুড়ীগঙ্গার ধীর মন্থর স্রোত বিধৌত ঢাকা-আহাঢাকা আমার। কৃষ্ণচূড়ার রক্তলাল রঙে রঞ্জিতা, বর্ষার থৈ থৈ জলে প্লাবিত, নিদাঘের খর রৌদ্রে তৃষিতা, শরতে মােহিনী, শীতে হেমন্তে গৈরিক বসন। ঢাকা আহা ঢাকা আমার। কালাে দুচোখের ভাষায় তুমি ভাস্বরিত চিত্রমালা, মনের গহনে তুমি উজ্জ্বল উজ্জ্বল সুন্দর সুন্দর প্রাণবান স্বপ্নরেখাটাকা আহ ঢাকা আমার । রক্তের স্রোতে স্রোতে তুমি নােত জীবনী শক্তি শ্রবণে অনাদ্যন্ত কাজে তােমার নাম সঙ্গীতের মতাে-ঢাকাআহা-ঢাকা আমার। কতাে নতুন প্রাচীন হর্মমালা বুকে ধারণ করে নীলাকাশের নীচে দণ্ডায়মান গরবিনী, ঢাকা-আহা-ঢাকা আমার। কতাে কতােবার বিদেশী হানাদারের বিরুদ্ধে দর্পিতা শখিনীর মতাে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কতাে কতােবার মুখবুজে চোখের জলে বিদেশী শাসনের শৃঙ্খল পরেছাে। তােমার সে তপ্ত রােদন ধারার উত্তাপ যুগে যুগে বাংলার উর্বর পলিমাটিতে জন্ম দিয়েছে, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, বিপ্লব। সুন্দরবনের তরুণী ক্ষিপ্তাবাঘিনীর মতাে প্রাণপ্রাচুর্যে প্রখর প্রতিহিংসার দন্ত নখর প্রসারিত করা নগরী ঢাকা  আহা ঢাকা আমার। তােমার মাটিতে রক্ত, তােমার রাজপথে লাশ, টহলদার বাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ির তীক্ষ্ম হুইশেলে আতঙ্কিত তােমার কালােরাতের সুন্দর চাঁদের সরােবর। ঢাকা-আহ-ঢাকা আমার ।

তােমার ঘরে ঘরে ভীতি, তােমার নীল নির্মেঘ আকাশে ঝাক বেধে উড়ে বেড়ায় শকুনি, গৃধিনী, মানুষের মাংসে এখন তাদের প্রবল অরুচি, তোমার আকাশে জঙ্গীবিমান সারাদিন, সারারাত মৃত্যুর ছায়া বিছিয়ে রাখে। তােমার ঘরে ঘরে ক্রন্দন, গোঙানী, মৃত্যু, হতাশা, তােমার মর্মে মর্মে ক্রন্দন এখন, উজ্জলিত নাট্যশালা সম, সুরম্য সুন্দরী নগরী ঢাকা-আহা-ঢাকা আমার । তােমার ঘূর্ণি হাওয়া মধ্যযুগের অশ্বখুরের ধ্বনি বাজে, তােমার তরুরাজির ছায়ায় মুখবুজে থমকে আছে সিপাহী যুদ্ধের কালাধলার কলঙ্ক আর গৌরবের ইতিহাস, ঢাকা আহা ঢাকা আমার। তােমার মসজিদ, মন্দিরে প্রাণের কমনীর আতি সুর পেয়েছে, গান পেয়েছে, তােমার বিদ্যাপীঠে গান পেয়েছে, তােমার বিদ্যাপীঠে চিত্ত সাধনার ধারা হত নদীর মতাে বয়ে গেছে দেশ থেকে দেশান্তরে ঢাকাআহা-ঢাকা আমার। তােমার পত্রপুষ্পে জ্বলে ওঠেছে স্বপ্ন থরে থরে । তােমার নক্ষত্র মালা বাংলার প্রাচীন। মনীষীর অন্তরের অম্লান শিখার মতাে জ্যোতিস্মান। তােমার শিরায় ক্রন্দন, তােমার হিয়ার বিদ্রোহ, মােচড় খাওয়া নদীর জলস্রোতের মতাে কতােবার স্বাধীনতা আর স্বাধিকারের নামে বজ্র নির্ঘোষে গর্জে ওঠেছে। তােমার বনরাজীর দীর্ঘায়িত ছায়ায় নিদ্রিত ইতিহাস কতােবার চমকে চমকে ওঠেছে- ঢাকা-আহা-ঢাকা। আমার। তােমার অন্তরের রক্ত মাখান কতাে কতােবার সারা বাংলাদেশে গণ সংগ্রামের ডাক দিয়েছে। বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু, বিদ্রোহের অগ্নিগিরির জ্বালা মুখ, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন মরণের জীয়ন কাটি-ঢাকা-আহা ঢাকা আমার। তােমার মাটিতে জীবন, আকাশে স্বপ্ন, বাতাসে সঙ্গীত, সূর্যালােকে প্রাণের বন্যা । তােমার শরীরে অপমান, হৃদয়ে প্রধুমিত অগ্নি, হাড়ে, মজ্জায় প্রতিরােধের সুদৃঢ় শপথ। তােমার অন্তরে নবযুগের , নবজীবনের স্বপ্ন, নতুন মানুষ নুতন দুনিয়া গড়ার মরণজয়ী প্রেরণা, ঢাকা-আহা-ঢাকা আমার। কলােকাল তােমার মুখ দেখি নি।

দাবানল।১; ৪ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১

যা দেখছি যা ভাবছি

আবদুল গাফফার চৌধুরী। প্যারিসে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লার আকস্মিক যে পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে অপরিণত বয়সে এই মৃত্যু, তাকে অনেকটা নির্বাসিত অথবা দেশত্যাগী কোন রুশ সাহিত্যিকের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা চলে। দেশত্যাগী বা নির্বাসিত কোন রুশ সাহিত্যিকের মৃত্যুর সঙ্গে এই মৃত্যুর উপমা টানলাম এজন্য যে, প্রবাসজীবনে লেখা সৈয়দ ওয়ালিউল্লার দু’টি উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা এবং কাদো নদী কাঁদো পাকিস্তানের আইয়ুব আমলের সরকার নিয়ন্ত্রিত- রাইটার্স গিল্ড এবং এসটালিস্টমেন্টের ছত্রছায়ায় পালিত বুদ্ধিজীবীরা খুব খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেননি। অবশ্য ঢাকার সাহিত্যিক মহলের অনেকেই খুশি হয়েছিলেন। এমনকি বই দুটি প্রকাশ হওয়ার পর কেউ কেউ তা কবুলও করেছিলেন। কিন্তু যে-ই প্রকাশ। পেলাে ফরাসী প্রতীকবাদের আড়ালে চাঁদের অমাবস্যায় আসলে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার হন্তাচরিত্র সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ রয়েছে, অমিন ঢাকার একটি আধাসরকারী পত্রিকা ঝটিতি বইটির প্রেসে দেয়া সমালােচনা প্রত্যাহার করেন। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সরকারী চাকরি করতেন। এই সরকারী চাকরি উপলক্ষ্যেই তার প্যারি-গমন, ফরাসী স্ত্রী গ্রহণ এবং ফ্রান্সে দীর্ঘকাল অবস্থান। ষাট দশকের মাঝামাঝি যখন তিনি ঢাকায় তার প্রকাশকের কাছে চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাঠান, তখন এক কবি বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ফ্রান্স আমার দ্বিতীয় স্বদেশ। বাংলাদেশ প্রথম। এই প্রথম স্বদেশে যখন সকল প্রকার নাগরিক অধিকার ও মনুষ্যত্ববােধের ‘চাদে’ গ্রহণ লাগার খবর পাচ্ছি, তখন চাঁদে অমাবশ্যই আমার কাছে বােধগম্য সত্য।’ তার উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদোতে সাত্রের অস্তিত্ববাদের প্রভাব স্পষ্ট। সম্ভবতঃ গত বছরের ঠিক এই সময়টাতে প্যারিস থেকে সস্ত্রীক ঢাকায় ফিরেছিলেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। আইয়ুব সরকার তখন অপসারিত। তাই সরকারি সংস্থা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ভবনেই তার সাদর সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করেছিলেন ঢাকার সাহিত্যিকেরা।

তখনও কেউ ভাবেনি, এই তার শেষবারের মতাে স্বদেশ ফেরা। মৃত্যুকালে তার বয়স মাত্র পঞ্চাশ হয়েছিল। কিছুদিন আগেও তিনি মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের এক সাহিত্যিকের কাছে চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ফ্রান্সে কিভাবে জনমত তৈরি হচ্ছে। আরও একটা খবর দিয়েছিলেন তিনি সেই চিঠিতে, বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী রশীদ চৌধুরী ঢাকা থেকে পালিয়ে নিরাপদে প্যারিসে গিয়ে পৌঁছেছেন। | ওয়ালিউল্লার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা বেশীর। ভাগ গল্প । তাতে গ্রামীণ চরিত্রের ভীড়। বাঙ্গালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ তখনও তেমন গড়ে ওঠেনি শহুরে জীবনতাে নয়ই। ফলে সাহিত্যে তার প্রতিফলন কম। তিরিশ ও চল্লিশের দিকে কিছুটা বাঙ্গালি হিন্দু মধ্যবিত্তের টাইপ চরিত্রের ছাঁচে মুসলমান মধ্যবিত্ত চরিত্র তৈরি এবং তাতে নতুন নাগরিকতার প্রলেপ দিতে চেয়েছিলেন আবুল ফজল ও আবু রুশদ। তারা খুব সফল হননি। তাদের এই আপাত ব্যর্থতা বাংলাদেশের কথা-শিল্পেও কিছুকালের জন্য ভাটার টান ফিরলাে যুদ্ধ ও মস্তরের যুগে। ফেরালেন মুখ্যত তিনজন কথাশিল্পী, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহু, শামসুদ্দীন আবুল কালাম ও শওকত ওসমান। | শওকত ওসমানের জন্ম পশ্চিম বঙ্গে। তার প্রথম দিকের গল্পে উপন্যাসে ভীড় জমালাে বাঙ্গালি মুসলমান চাষি, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্ত। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তার লেখায় চরিত্র ও পরিবেশের বিস্তৃতি বাংলাদেশের সীমান্ত পেরুলাে। শামসুদ্দীন আবুল কালাম প্রথম দিকে প্রভাবিত হলেন অচিন্ত্যকুমারের দ্বারা। অচিন্ত্যকুমার দীর্ঘকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর ও মহকুমা শহরে জজিয়তি করেছেন। মামলা মােকদ্দমা উপলক্ষ্যে নানারকম বাঙ্গালি মুসলমান-চরিত্রের সংস্পর্শে এসেছেন। এই পরিচয়েরই প্রথম ফসল যতন বিবি” গল্পগ্রন্থ। শামসুদ্দীন আবুল কালামের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘শাহেরবানুতে’ এই যতন বিবির প্রভাব সুস্পষ্ট। সৈয়দ ওয়ালিউল্লার নয়নচারা এদিক থেকে একটি উল্লেখ্য ব্যতিক্রম।

গল্পের নাম নির্বাচনে তিনি ছিলেন তখনকার দিনে অতি আধুনিক, যেমন ‘বক্র চাঁদের খণ্ডতায়। কিন্তু চরিত্র সৃষ্টি ও গল্পের আখ্যানভাগে তিনি ছিলেন বিষয়ানুগ ও চরিত্রের স্বধর্মানুসারী। কোন নির্দিষ্ট ভঙ্গি, স্টাইল বা চরিত্র নির্মাণ-কৌশল দ্বারা তিনি প্রভাবিত হননি। বাঙ্গলা গল্পের যুদ্ধকালীন পরিবর্তনশীল সাধারণ ফরম দ্বারা প্রথম দিকে প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু সর্বত্র যথাযথ ভাবে তা মেনে চলেননি। | সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর সবচাইতে জনপ্রিয় অথচ বিতর্কমূলক উপন্যাস ‘লালশালু।’ ইংরেজি এবং ফরাসী ভাষাতেও এই উপন্যাসটি অনুবাদ হয়েছে।’ বাঙ্গালি মুসলিম নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে ধর্মের ভণ্ডামি এবং তার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রয়ােগের উপকথা এই লালশালু। দেশ ভাগের অব্যবহিত পরে পঞ্চাশের গােড়ায়ঢাকায় গণসাহিত্যের নামে বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনাশ্রেয়ী সাহিত্যের তখন প্রবল প্রতাপ। এই ‘গণ সাহিত্যপন্থা’ কয়েকটি পত্রিকায় রায় দেয়া হল, লালশালু প্রতিক্রিয়াপন্থী রচনা। কারণ, লালশালুতে যে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ‘জঙ্গী জনতা’ তাকে অতিক্রম করে এখন লড়াইয়ের মাঠে নেমেছে। এই উগ্র সমালােচনা অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। বাংলাদেশের পাঠক সাগ্রহে ‘লালশালুকে গ্রহণ করেছে, সমালােচনা-সাহিত্যে উপন্যাসটির বিশেষ স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। তবু লালশালুর’ বিপদ কাটেনি। ১৯৬১ সালে লালশালু ইন্টারমিডিয়েট ক্লাশে স্পেশাল বেঙ্গলির পাঠ্যবই হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল। শিক্ষা কর্তৃপক্ষ অকস্মাৎ বইটির মনােনয়ন বাতিল করেন। অভিযােগ অশ্লীলতা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার একটি ছােট গল্পের বইগোর নাম রেখেছিলেন ‘স্তন’। ঢাকার প্রকাশকের সকাতর অনুরােধে এই নামটিও তিনি বদলে দেন। শুধু গণ উপন’সে নয়, নাটক রচনাতেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার মঞ্চ সফল বেশ ক’টি নাটক সয়েছে । প্যারিদের শিল্পী মহলে তার আঁকা কটি ছবিও উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। লালশালুর ইংরেজি সংস্করণের প্রস্থ তার নিজের আঁকা।।

চল্লিশের গােড়ায় যে তিনজন কথাশিল্পী কথাশিল্পে নবযুগের অগ্রপথিক হয়েছিলেন, তারা সকলেই আজ দখলীকৃত বাংলাদেশ ছেড়েছেন। শামসুদ্দীন আবুল কালাম বহু বছর আগে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে মনান্তর ও মতান্তরের জন্য দেশত্যাগ এবং রােম প্রবাসী। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ চাকরি উপলক্ষ্য করে হলেও এতদিন।  ছিলেন প্যারিসে সম্ভবত স্বেচ্ছা নির্বাসনে। এই তিন বন্ধুর শেষ বন্ধু শওকত ওসমান গত পঁচিশে মার্চের পর ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাই একথা বলা কি আজ অতিশয়ােক্তি যে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি বেগবান ধারাই আজ মুক্তিযুদ্ধে সামিল?

জয়বাংলা (১) : ২৬ ! ৫ নভেম্বর ১৯৭১

স্বাধীন বাংলার বুনিয়াদ

–সঞ্জীব চৌধুরী

অনেকে প্রশ্ন তােলেন, পশ্চিমা হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত হবার পর স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে কি? যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার অর্থনীতি নতুন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ার চাপের ভেঙ্গে পড়বে না তাে? কারও মনে আবার সন্দেহের দোলা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ঘূর্ণাবর্তে না আবার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তলিয়ে যায়। | এ প্রসঙ্গে আলোচনা করার আগে একটা কথা মনে রাখা দরকার, এখনও দেশকে পুরােপুরি শক্রমুক্ত করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ সমান গতিতে চলছে দিনের পর দিন। হয়ত চলবে আরও মাসের পর মাস। কিন্তু এর মধ্যে রাজনৈতিকভাবে আমরা অসংগঠিত নই। স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব সার্বভৌম সরকার রয়েছে, যে সরকারের পিছনে আছে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমর্থন। নির্বাচনে শতকরা আটানব্বইটি আসনের অধিকারী দল আওয়ামী লীগ সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের সরকারি দল। প্রধানত এ দলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে, যে যুদ্ধে আমরা সবাই অংশীদার। বাংলাদেশের অন্যান্য সব দলগুলিও জনতার রায় অনুযায়ী গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারকে জাতীয় সরকার হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। ফলে দেশ পুরােপুরি মুক্ত হওয়ার পর আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত এক সরকার পেতে যাচ্ছি, যা বহু স্বাধীন দেশের কাছে এখনও মরীচিকাই রয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় সরকার ঘােষণা করেছেন গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্র দেশে চালু করা হবে। সরকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের পরিচয়ও আমরা পেয়েছি যুদ্ধকালীন জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ আলােচনার জন্য দেশের প্রধান ধান বিরােধী দলগুলি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে।

তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সকল দলের জন্যই উন্মুক্ত থাকছে, সেই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অন্ধকার বাঙ্গালি জাতিকে গ্রাস করবে এ ধারণা কষ্ট প্রসূত কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। | বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের তিন দিক জুড়ে রয়েছে বন্ধুরাষ্ট্র ভারত। দক্ষিণ ভাগে বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ পূর্বের সামান্য অংশে বার্মার সাথে আমাদের সীমান্ত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ভারত সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আমরা যে স্বতস্ফুর্ত সমর্থন ও সহযােগিতা পাচ্ছি তাতে এ কথাটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারত হচ্ছে আমাদের প্রথম এবং প্রধান বন্ধু রাষ্ট্র । বিপদকালীন অবস্থায় অর্জন করা পারস্পরিক আস্থার ফলে এ কথাটা বেশ জোর দিয়েই বলা যায় যে অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে ভারতে। সাথে আমাদের যুদ্ধের কোনও কারণ নাই, সীমান্ত বিরােধ ত নয়ই। বার্মার সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত নাফ নদী দ্বারা বিভক্ত। এই সীমান্ত নিয়ে কোনাে পক্ষেরই কোনাে দ্বিমত ছিল না বা এখনও নাই। ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক উপায়ে বিভক্ত সীমান্ত নিয়ে বিরােধ বাধার কল্পনা করা বাতুলতা মাত্র। তাছাড়া বঙ্গোপসাগর দিয়ে কোনাে। বিদেশী শক্তি বাংলাদেশে হামলা চালাবার আগে ইয়াহিয়া চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংগ্রামের কথা ভেবে অন্তত তিনবার চিন্তা করবে। মােট কথা পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের বিষদাত চুর্ণ করে দেশকে মুক্ত করার পর যদি কেউ আবার বিদেশী আক্রমণের আঘাতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করার প্রয়াসী হয় তবে শুধু একথাই বলতে হয় যে তারা বাঙ্গালিদের চেনে নাই। | এবার অর্থনৈতিক প্রসঙ্গে আসা যাক। অর্থনৈতিক স্থিতিবস্থা ছাড়া কোনও দেশ টিকতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি যুদ্ধের কারণে নিঃসন্দেহে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমাদের তা পুনরুজ্জীবিত করতে পারব। বলে দৃঢ় আশা পােষণ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি ভিত্তিক। প্রধান রপ্তানীযােগ্য  দ্রব্য ছিল পাট যা বিক্রী করে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিরা অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছে। বাংলার পাট বেচা। পয়সায় পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠেছে বড় বড় মিল কারখানা, একটার পর একটা নগরীর শােভা বর্ধিত হয়েছে। ধরতে গেলে গােটা পাকিস্তানের অর্থনীতিই ছিল পাট নির্ভর। এখন আমরা পাট বিক্রির সমুদয় অর্থ। বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিয়ােগ করতে পারব। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে ভারতের সাথে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা পার্টের প্রধান বাজার হারিয়েছিলাম। ফলে চাহিদার অভাবে পাট উৎপাদন কমে আসতে শুরু করেছিল। ভারতের সাথে বাণিজ্য শুরু হওয়ায় আমাদের পাটের বাজার আবার ভীষণভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

দেশ বাংলা ॥ ১: ৪ ১৮ নভেম্বর ১৯৭১

রূপসী শরৎ

-রূপদর্শী

সৌন্দর্যের এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায় এ শরত কাল। এ ঋতুতে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিতে যে রূপের আলপনা এঁকে দেয়, তা দেখে কবির কণ্ঠে কার না বলতে ইচ্ছে হয়-বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।

প্রতিবারের মতাে এবারেও শরতের শুভ্রাকাশে হাসছে এক ফলি বাঁকা চাঁদ; আকাশময় জ্বলছে আর নিভছে তারকারাজি কতই না অপূর্ব দেখাচ্ছে কাশফুলের বন! জোস্না মাখরাত শরত রাণীর রূপচ্ছটা ঠিকরে পড়ছে এদিক-ওদিক! এ হেনভাবে সেজেগুজে রূপের সুরা পান করতে ডাকছে। কিন্তু সাড়া দেবে কে? | বাংলার বুকে চলছে আজ তুমুল-লড়াই। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রত্যেকেই এক একজন মুক্তিযােদ্ধা; যুবকিশাের শিক্ষা নিকেতন ছেড়ে কলমের বদলে মেশিনগান হাতে হানাদার সৈন্যদেরকে কচু কাটা করছেন। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষই নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছেন এ স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে। সেদিন এক জেলের মুখে শুনেছি-“ওগাে না খাওয়াইয়ে আর ছিপ লইয়া মাছ মারতে যাইমু না, এহনে র্যাইফাল দে পাক হয়তা নগাে শীকার করমু। এক কথায় স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলার মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে। মায়ের জাতও শিশুদেরকে রূপ কথায় স্থলে বলছেন চেগুয়েভার জীবনী । অতিপর বৃদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের কাছে জানতে চান-“আমি কি তােমাদের কোন উপকার করতে পারি? | এহেন জরুরি মুহূর্তে শরতকে তুষ্ট করার মতাে অবকাশ কারই বা আছে। তাই দুর্গা মায়ের পথপ্রান্তে বাংলার হিন্দু দিতে পারেনি শত আকার নির্দশন অঞ্জলি। আর তাকে কেন্দ্র করে বাঙালির স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দে মেলার কথা বলে ফায়দা কি? প্রতিবারই এ দিনগুলিতে ঢাকঢোলের গুড় গুড় আওয়াজ, কঁচি কাচার মুখের জয় উল্লাস, বাজী-বিয়ােগের শব্দ, যাত্রা ভিনয়ের কথা কল্লোল, নৌকা বাইচের দুলাৎ ছল্ ধ্বনি, লাঠি খেলার হৈ-হুল্লাড় মিলে আকাশ মুখরিত হয়ে ওঠে। এবারে আর সে ধুম নেই। কানে বাজছে না দূর দুরান্তের কোন কোন ডিঙ্গি হতে ভেসে আসার ভাটিয়ালি গানের সুর লহরী। তাই, এবারের রূপসী শরত কারাে সাড়া পেয়ে ধুকে ধুকে মরছে-তবু তাকাবার অবকাশ কৈ? প্রত্যেক বাঙালিই একজন মুক্তি যােদ্ধা-বঙ্গবন্ধুর ডাকে সে শুধু সাড়া দেয়-হাতের কাছে যা পেয়েছি-তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করছি-কোরব।

উত্তাল পদ্ম। ১:১। ২৪ নভেম্বর ১৯৭১

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

-রণজিৎ পাল চৌধুরী কয়েকদিন আগে মুক্তাঞ্চলের দুটি আলােকচিত্র দেখেছি। এই আলােকচিত্র দুটি তুলেছেন ঢাকার একটি দৈনিকের একজন ফটোগ্রাফার । ছবি দুটি এখনও কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কিনা জানি না তবে হয়ত অচিরেই প্রকাশিত হবে এবং আলােড়ন সৃষ্টি করবে। | একটি ছবি হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন কমান্ডাে পিঠে রাইফেল কিংবা হালকা মেশিনগান নিয়ে হাল চাষ করছেন।  | বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের কোনও এক অংশে একজন বলিষ্ঠ তরুণ মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেবার  জন্যে বৃদ্ধ পিতার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগে সে পিতার কাছে আশীর্বাদ চাচ্ছে এবং  বাংলার পবিত্র মাটি স্পর্শ করছে। স্পর্শমণ্ডিত কঙ্কালসার বার্ধক্যে নুয়ে পড়া স্নেহশীল পিতা হয়তাে একমাত্র ছেলেকে হাসিমুখে বিদায় দিচ্ছেন। এ হল দ্বিতীয় ছবিটার বিষয়বস্তু। | ছবি দুটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। শুধু আমি নয় যারাই দেখেছে, তাদেরই চোখ চক চক করে। উঠেছে এবং গলা ভারী হয়ে এসেছে। আর কারাে কাছে এ ছবি দুটির মূল্য কি জানি না। অনেকের ধারণা এ ছবি দুটি আন্তর্জাতিক সম্মান পাবে। আবার কারও মতে-ছবি দুটি খুবই সাধারণ। সাধারণ কিংবা অসাধারণ কোনােটাই আমি ভেবে দেখিনি তবে ছবি দুটি আমাকে আলােড়িত করেছে।  শুধু আমি কেন প্রতিটি শরণার্থী কিংবা বাংলাদেশের নিপীড়িত নাগরিক সকলেই এ ছবি দেখে অভিভূত না হলেও আলােড়িত হবে।| মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তােলা এক জাতীয় ছবি সাধারণ ছবির পর্যায়েই পড়ে। একে অসাধারণ বলা যায় না। বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু ছবি দেখিছি। ভিয়েৎনাম, কম্বােডিয়া, আরব দেশগুলাের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন | বিষয় ও মেজাজের বহু অসাধারণ, আন্তর্জাতিকভাবে সম্বর্ধিত এবং পুরস্কৃত বহু ছবি দেখেছি বিভিন্ন পত্রিকায়। বুঝতে পারি সব দিক থেকেই ঐসব ছবি অনেক উচু স্তরের। কিন্তু শুধু মনে হয় এমনটি আর দেখিনি। প্রথম ছবিটার বিষয় বহু মুক্তিযােদ্ধাদের একটি চিরাচরিত আলেখ্য। এই ছবিটাতে নতুন কিছু নেই এবং অসাধারণের পর্যায়েও পড়ে না। ভিয়েত্নামে শুধু ছেলে নয় মেয়েরাও রাইফেল কাঁধে নিয়ে বিভিন্ন কাজ করছে এবং শত্রু নিধন করছে। এতদিন শুধু ভিয়েৎনাম, আরবদেশগুলাের মুক্তি যােদ্ধাদের ছবি দেখে তাদের দুঃখ | দুর্দশা এবং শৌর্য-বীর্য দেখে অভিভূত না হয়ে পারিনি।

কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক এমনটি হবে এটা কোনাে দিন আশা করতে পারি নি। | গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি অনুসারে প্রতিটি নাগরিকই মুক্তিযােদ্ধা। ভিয়েনামের মতাে আমাদের চাষিরাও চাষ করছে, ফসল তুলছে কিন্তু সাথে হাতিয়ার রয়েছে লুক্কায়িতভাবে। অবশ্য বাংলার মানুষ অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এই প্রথম হাতিয়ার তুলে নেয়নি এর আগেও অগ্নিযুগের অগ্নি পুরুষরা বােমা পিস্তলের সাহায্যে বাংলার পবিত্র ভূমি থেকে সাগরপারের বােম্বেটেদের তাড়িয়ে দিয়েছে। সেই অগ্নি পুরুষদের যােগ্য উত্তরাধিকারীগণ বাংলার পবিত্র ভূমি থেকে হানাদারদের চিরতরে বেরিয়ে বিদায় করার জন্যে আজ বদ্ধপরিকর। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি মুক্তিযােদ্ধা। চাষি, শ্রমিক, মজুর, কবি, শিল্পী, ব্যবসায়ী সকলেই আজ মুক্তিকামী বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা হাতের কাছে যে যা পেয়েছি তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। প্রতিটি কন্ঠে শ্লোগান জয়। বাংলা । আমাদের প্রতিটি ঘর আজ দুর্গ, আমাদের ঘর ছিল শান্তির নীড়। এখানে ভালােবাসা ছিল। নির্জনতা। ছিল, গান ছিল, আনন্দ-উৎসব ছিল। আজ সেই ঘরে কোনাে কিছুই নেই। জল্লাদরা সব সম্পদ লুঠ করেছে, বিধ্বস্ত করেছে। প্রেম, প্রীতি ভালােবাসা সব জঞ্জালের মতাে ধুলােয় লুটেছে-আজ প্রতি ঘরে শুধু ঘৃণা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশােধ গ্রহণের জন্যে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের অঙ্গীকার শত্রু উচ্ছেদের জীবনপণ ব্যারিকেড। দ্বিতীয় ছবিটাকে আমার একান্তই বাংলাদেশের ছবি মনে হয়েছে। অন্ধের ছড়ি একমাত্র পুত্রকে হয়ত মৃত্যুর মুখে। পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে। তবু কোনও দুঃখ নেই। কি অনাবিল হাসি সেই অশীতিপর জরাজীর্ণ কঙ্কালসার বৃদ্ধের মুখে। অগ্নিযুগেও বহু দরিদ্র কিংবা ধনী পিতামাতা হাসিমুখে সন্তানকে বিদায় দিয়েছে। তারাই হাসিমুখে ফাসীর মঞ্চে গিয়েও জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন। বৃদ্ধ যেন আমারই পিতা। আমার জন্মভূমি আজ লাঞ্ছিত, নিপীড়িত । আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কোনও খোঁজ নেই। তারা হয় হানাদার জল্লাদ বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে নয় অনাহারে মরেছে। এক কোটি শীতার্ত, ক্ষুধার্ত, বঞ্চিত, অপমানিত, অনিকেত শরণার্থীর সাথে হয়ত কোনও মতে প্রাণে বেঁচে গিয়ে একসাথে ভাগ করে নিচ্ছে দুমুঠো ভিক্ষার চাল। আমি তরুণ, আমি বাংলার ভবিষ্যৎ। আমার দিকে চেয়ে রয়েছে বাংলার নিপীড়িত, ধর্ষিতা মা।  

বােনেরা। কবে আমি শক্রর রক্ত এনে দেবাে তারই প্রতীক্ষায় দিন গুনছেন। আমার বিধবা, বঞ্চিত, শিশুপুত্র হীনা বােনেরা সেই শত্রুর তাজা রক্ত কপালে ফোটা দেবে। সােহাগ সিন্দুরের টকটকে লাল ফেঁাটা আমি কপালে টিপ পরেছি। বাংলার পবিত্র মাটি আমি মস্তকে ধারণ করেছি। | এ আমার রক্ষা কবচ। জানি জানি পৃথিবীতে এমন কোনও শক্তি কিংবা শত্রু নেই যারা আমাকে স্পর্শ করতে পারে। আমি অজেয়, আমি অক্ষয়। আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই আমার কঙ্কালসার বৃদ্ধ পিতার মুখ আর তার উথিত দুহাতের বরাভয় আশীর্বাদ। এই দুর্ভেদ্য বর্ম ভেদ করতে পারে শক্রর এমন কোন শক্তিশালী অস্ত্র নেই।

| ঘৃণা প্রেমকে কখনও পরাভূত করতে পারে নি। বাংলার মানুষের প্রধান অস্ত্র প্রেম, বাংলার মানুষের প্রতি বাংলার নাড়ী নক্ষত্রের সাথে তাদের গভীর সংযােগ রয়েছে। | হতাশা আমারও আসে কিন্তু যখনই সেই তরুণের বৃদ্ধ পিতা তথা আমার পিতার বিদায়কালীন ছবিটা মনে পড়ে তখনই আবার শরীর শক্ত হয়ে উঠে। হাতে অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। চোখে আগুনের হলক ছোটে। আর সেই অত্যাচারিত, নিপীড়িত প্রতিভূর পেছনেই ভাসতে থাকে উজ্জ্বল আলােকচ্ছটার মতাে একটি মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, একটি অগ্নি পুরুষের ছবি-একটি বিপ্লব। | আমি যেন তন্ময় হয়ে যাই। বৃদ্ধ পিতার সেই ছবিটা ছাপিয়ে যেন অগ্নিপুরুষের ছবিটাই আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠে। | পথভ্রান্ত রণক্রান্ত আমি আবার মেতে উঠি। অবসাদ নিমেষে দূর হয়ে যায়। অন্ধকার জলন্ত সূর্যের মতাে আভা ছড়িয়ে সেই মহামানব সিংহের মতাে গর্জন করে ওঠেন। আমি বিস্ময়ে আনন্দে লক্ষ্য করি তিনি বলে দিচ্ছেন আমার পথের ঠিকানা। তােমার ভয় কি সমস্ত বিশ্ব তােমার পেছনে রয়েছে। যাও এগিয়ে যাও আঘাত হানে। আরও জোরে শত্রুকে চিরদিনের জন্য বাংলার পবিত্র মাটি থেকে উচ্ছেদ করাে। ব্ৰহ্ম নদের মতাে সেই কণ্ঠ ফেটে পড়ছে আর আন্দোলিত হচ্ছে সেই দীর্ঘ হাতের বজ্রমুষ্ঠি ।

আমি শুনতে পাই তিনি বলছেন, রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেবাে। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।

সাপ্তাহিক বাংলা ১: ৬ ২৫ নভেম্বর ১৯৭১

মুক্ত এলাকার গ্রামে বন্দরে

–সারােয়ার জাহান

[জয়বাংলা প্রতিনিধি। … প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুরােদমে চালু রেখেছে। এলাকাটা স্বচক্ষে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। একদিন বেলা ১১টায় দখলীকৃত এলাকা থেকে হানাদার সৈন্যের চোখ এড়িয়ে যখন মুক্ত এলাকায় প্রবেশ করলাম তখন সমগ্র এলাকা কর্মব্যস্ত। মাঠে মুক্ত বাংলার বীর কৃষকেরা কাজ করছে, পাশে দাঁড়িয়ে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে সশস্ত্র বীর মুক্তি সৈনিক। বাংলাদেশের আকাশে নতুন নতুন সূর্যের আগমন আসন্ন। এদের সকলের চোখে তারই ইঙ্গিত। বাংলাদেশ কৃষকের দেশ। এই কৃষকের দেশে মুক্তি সেনাদের সাথে। কৃষকের যে সম্পর্ক দেখলাম তা প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। ক্ষেত ভরা ধানশীষ খেলা করছে পথের দু’পাশে। কোথাও কোথাও পাকা ধানে ভরে আছে ক্ষেত। বাড়ির পাশে পুকুরে গা ধুচ্ছেন গায়ের মায়েরা, বধুরা, বােনেরা। কোথাও ক্ষেতের পাকাধান কেটে তুলছেন বাংলাদেশের এই মুক্তাঞ্চলের সংগ্রামী কৃষক। কয়েক জায়গায় দেখলাম সদ্য ফসলকাটা জমিতে হালচাষ করছে চাষিরা। দ্রুত হেটে চলেছি আমরা কয়েকজন। থানার কার্যালয়ে পৌছাব এই-ই লক্ষ্য। ডান পাশের একটা মােড় ঘুরে হঠাৎ দেখলাম রাইফেল কাঁধে দু’জন একজন বৃদ্ধ আর এক তরুণ জমির আগাছা বেছে চলেছে। অদ্ভুত এ’দৃশ্য। বাংলাদেশ ভিয়েৎনামের এমনি একটি দৃশ্য তার নিজের বুকে আশা করেনি। ক্ষুদিরাম, মাষ্টারদা, আসাদের ছবিও যেন। 

এ’দৃশ্যের কাছে ম্লান হয়ে যায়। স্নান হয়ে যায় শত শত মিছিল জমায়েতের কাহিনী । আমাদের বাংলাদেশের কৃষকের ছেলে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য; স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে করছে লড়াই আর এই লড়াইয়ের ফাকে ফাকে তারা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে কর্মরত কৃষকের কাছে, নিজ হাতে করে দিচ্ছে তাদের কাজ। কৃষকের সাথে তারা চাষ করছে হাল, মাড়াই করছে ফসল, মাঝে মাঝে জাল টেনে ধরছে মাছ। তৈরি করছে ছিন্নমূল মানুষের জন্য ঘরবাড়ি। স্বাধীনতা-পিয়াসী, মুক্তিপিয়াসী মানুষ তাদের আত্মশক্তি ফিরে পেয়ে আজ বাংলাদেশে গড়ে তুলছে ইতিহাস। বাংলাদেশের দুর্বার যৌবন মুক্তিসেনারা আজ এই ইতিহাসের স্রষ্টা। বাংলাদেশে লাখাে কৃষক যারা চাষাবাদকে আজ মুক্তিবাহিনীর কাজ বলে মনে করছে, বীর যােদ্ধাদেরকে পথ। চিনে দেওয়াকে মুক্ত এলাকায় স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাওয়াকে, অধিকৃত এলাকায় হানাদারদের সাথে অসহযােগিতা করাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে শরীক হওয়া বলে ভাবতে শিখেছে, চাকুরীজীবী, মিল কারখানার শ্রমিকেরা যারা আজ চাকুরীরও মায়া ত্যাগ করে-সর্বস্ব ত্যাগ করে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য দৃপ্ত শপথে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর শােষণের নাগপাশ ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত শশাষণহীন সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নেমেছে তারাই এই ইতিহাসের স্রষ্টা। | গাঁয়ের পথ ধরে থানা সদরের দিকে এগিয়ে যেতে অনেকের সাথেই দেখা হল। আমাদের সাথে দু’জন মুক্তিসেনা পথ দেখিয়ে চলেছে। আমরা কখনও বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে, কখনও সুপারী বাগানের ধার দিয়ে, নারিকেল গাছের নিচে দিয়ে, পুকুর পাড় ডিঙ্গিয়ে বসতবাটির সদর দরজার ধার দিয়ে এগিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝেই পােড়া ঘরবাড়ি নজরে পড়ছে। কোথাও ঘরে চাল পুড়ে ধ্বসে পড়েছে, কয়েকটি পাকা বাড়িও | দেখলাম পুড়ে পড়ে রয়েছে। এখানে দাড়িয়ে নির্ধারণ চন্দ্র দাস নামে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, এই যে ঘরবাড়ি পােড়া দেখছি এর কারণটা কি বলুন তাে।” বৃদ্ধ যেন আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠল, “সব ঐ পাকিস্তানী মিলিটারির কাজ। আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেয়ে পালিয়ে যাবার সময় কাপুরুষের মতাে নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েদের উপরে যে কি অত্যাচার করেছে তা বলা যায় না। আমার ৮৩ বছর বয়সে এমন কোনােদিন দেখিনি, শুনিওনি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি | ওরা যেন এদিকে আর না আসতে পারে। পাশে দাঁড়িয়েছিল মাথায় গামছা বেধে প্রৌঢ় কৃষক আবদুল করিম। 

জিজ্ঞাস করলাম, মুক্তিবাহিনী আপনাদের বন্ধু, না শত্রু?” সে ফুসিয়ে উঠল, ‘বলেন কি সাব? আমরাইতে মুক্তিবাহিনী। নিজের ঘরবাড়ি সবকিছু দস্যুরা কেড়ে নিয়েছিল। পালিয়ে গিয়েছিলাম ভারতে। আবার সব ফিরে পেয়েছি সেতাে এই মুক্তিবাহিনীর জন্যেই। আমাদের জন্যেই। আমাদের জন্যেই তারা লড়ছে। নিজেকে কি আর তাদের থেকে পৃথক করে দেখতে পারি?” বল্লাম, “আরতাে আমরা হারবাে না । আপনারা জেগেছেন। জাগ্রত জনতাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না।” আমরা আরও এগিয়ে চলেছি। পথে ‘এক বৃদ্ধা সাথে দেখা। বল্লাম, “কি বুড়ীমা, বাংলাদেশ হবে?” বুড়ীমা দ্রুত বলে উঠলেন, “হবে বাবা হবে; দশে যা বলে, তা’ হতেই হবে?” পাশে দাঁড়িয়েছিল ছেলে কোলে এক পিতা। তিনি বলে উঠলেন, ‘বাংলাদেশ না হলি আমাগাে পােলাপানরা বাচবাে কেমনে?” পথ আমরা হেঁটেই চলেছি। আরও কিছুদূর এগিয়ে একখানে দেখতে পেলাম, আমগাছের গােড়ায় বসে কতকগুলাে যুবক জটলা করছে। কাছে গেলাম. জিসা করলাম, “আপনারা কি বরাবরই এখানে ছিলেন, না পালিয়েছিলেন?” একজন বললাে, “সেবার না বুঝে দেশ ছেড়ে পালিয়েছি কিন্তু এবার আর পালাবাে না। এবার সবাই মিলে অস্ত্র ধরে শত্রুকে রুখে দাঁড়াবাে। মুক্ত এলাকায় স্বাধীনতার যে স্বাধ আমরা পেয়েছি তা মুক্ত এলাকার পরিধি বাড়াতেই আমাদের সাহায্য করবে, হানাদার বাহিনীর ক্রীতদাস হতে নয়।” নতুন বাংলার সৃজনশীল যুবকের এ দৃঢ়তা কোনােদিন ভুলব না । বাংলাদেশের যুবকের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।

 প্রায় পৌনে চার ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা থানা সদরে গিয়ে পৌছলাম । হানাদার দস্যুরা পিছু হটে যাবার সময় থানার আশে পাশে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। থানার দক্ষিণ পাশে একটা বিধ্বস্ত ইটের বাড়ি শত অত্যাচারের প্রতিচ্ছবি হয়ে পড়ে আছে। দোতালা ইমারতে ছিল থানার অফিস। নিচতলা উপরতলা মিলে। দুটি ঘর আমরা অনেক প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে দেখলাম। কোথাও কোনাে আসবাবপত্র নেই। এখানে ওখানে  ওয়ারেন্ট আর ডায়েরির বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঠে পড়ে আছে এক ভাঙ্গা স্কুটার। পাশের লােকটিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম থানার শ্রীপুরে মিউনিসিপ্যাল অফিসের কোনাে কিছুই তারা সরাতে পারে নি। থানায় সামনেই স্কুল। জরুরি অবস্থায় স্কুল বন্ধ। স্কুলের উপর সমুন্নত হয়ে উড়ছে বাংলাদেশের শক্তিধর পতাকাসগ্রাম আর জীবনের প্রতিশ্রুতির প্রতীক।

 একটু হেঁটে মিউনিসিপ্যাল অফিসে এলাম। এই মিউনিসিপ্যাল অফিসেই মুক্তিবাহিনী ছােটখাটো প্রশাসনিক কাজ চালায়। এখানেই পরিচিত হলাম মুক্ত এলাকার ভারপ্রাপ্ত অফিসার লে, চৌধুরী, পার্শ্ববর্তী। কয়েকটি থানার ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন হুদা এবং ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডা. শাজাহানের সাথে। সবাই তখন কাজে ব্যস্ত। লােকজন কেউ অধিকৃত এলাকার অবস্থা জানাচ্ছে, কেউ তাদের অভাব অভিযােগের কথা জানাচ্ছে, আবার কেউ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ঠিক করার জন্য চাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর সাহায্য। আমরা যখন কথা বলছি। তখন মুক্ত এলাকার শেষ সীমানা থেকে গােলাগুলির আওয়াজ আসছিল। ক্যাপ্টেন সাহেবের বিশেষ কাজ। থাকায় তিনি বিদায় নিলেন। লে, চৌধুরী আমাকে একটু বসতে বলে বাহিরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এসে বল্লেন, “আমার একটু কাজ আছে, আপনাকে একটু বসতে হবে, আপনাকে পাকহানাদারদের একটি মজবুত ঘাটি দেখাবাে।” অফিসটির পাশেই আছে একটি বাজার আর বাজার থেকে কিছু দূরেই বসে একটি হাট। সেদিন ছিল হাটবার। আমরা বল্লাম, “আপনি আপনার কাজটা সেরে নিন, আমরা একটু হাটটা। ঘুরে আসি।” বেড়িয়ে পড়লাম। বাজারটাকে ডান পাশে রেখে হাটে গেলাম। সেখানে পুরােদমে কেনাবেচা চলছে। সরিষার তেল, চাউল, ধান, লবণ, মসল্লা, তাঁতের কাপড় ইত্যাদি প্রতিটি জিনিসেরই দেখলাম প্রচুর আমদানী। এখানে দু’প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনতে কিনতে সাথের মুক্তি সৈনিক দু’টিকে দেখিয়ে… | এলাকায়? না, মিলিটারি ইচ্ছে করেই আসেনা বলে এটা মুক্ত?” কথার পিঠের সে বলে উঠল, ‘এখানে থাকেন না বলেই কথাটা বলছেন। পাক-পশুরা সবসময়ই এই এলাকা দখল করার চেষ্টা করছে, প্রতিদিনই হানা দেবার চেষ্টা করছে কিন্তু মুক্তিবাহিনীর সাথে তারা কিছুতেই পারছে না। এই এলাকার জোর করেই মুক্ত করা হয়েছে, কারও দয়ার উপরে নয়।” বল্লাম, “মিলিটারি এখান থেকে হটে যাবার পর কি ভেতরে আর ঢােকেনি?” উত্তর পেলাম, “খাস পাক সেনারা ঢুকেনি, কিন্তু বদমাইশ রাজাকাররা একদিন ঢুকেছিল। তারা এই হাটেই এসে লুট করতে চেয়েছিল, কিন্তু মুক্তিবাহিনী হঠাৎ কোথা থেকে এসে এমন হানা দিল যে সাতজনকে মরা রেখেই বাকীরা দৌড়ে পালালাে।

জয়বাংলা (১) ১: ৩১ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১

বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ

(বিশেষ প্রতিনিধি) ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লীর রামলীলা ময়দানে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন। সাধারণত অনেক সময়েই রাজনৈতিক নেতারা দেশের উদ্দেশ্যে অনেক গরম গরম বক্তৃতা ছাড়েন। এগুলি আসলে অন্তরের কথা নয় বলে খেলাপও হয়। রাজনীতি জিনিষটাই নাকি এরকম। কিন্তু যে প্রাচ্যের রীতির জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তার ইতিহাসে এই মিথ্যা ভাষণ রাজনৈতিক চাল হিসেবে সম্মানীয় নয়। যে শেখ মুজিবের আদর্শে আজ বাংলা উদ্বুদ্ধ -তার মুখের কথার খেলাপ কোনােদিন হয় নাই, হবে না। তিনি কি আমাদের চেনা শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক নন? তিনি কি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একমাত্র এক করে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দিলেন। না? বাংলার কোটি কোটি মানুষের পাশে এগিয়ে এল না চীন; মনে পড়ছে বেগম মতিয়া চৌধুরীর রােষদীপ্ত কণ্ঠ : বন্ধুরা আমার, ইতিহাসের পাতায় ইয়াহিয়া খান জল্লাদের সঙ্গে মাও সে তুঙের নাম লেখা থাকবে একই সারিতে-একই পংক্তিতে।” কিন্তু বাংলার মানুষের পাশে গিয়ে হসত ন’ষ্টি ; পাশ, ল’ ফ!মানুষ। খুলে দিলাে ঘর। এল। 

শরণার্থীর স্রোত । ভরে গেল কারাে উঠোন কারাে দালান, কারাে বাড়ির সামনে গাছের তল। এগিয়ে এলেন ভারত সরকার। ইন্দিরাজীর কাজ শুরু হলাে বিশ্বের দরবারে এই শােচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরা। আটমাস, দীর্ঘ আটমাস চলল প্রতীক্ষা। রামলীলা ময়দানে সমস্ত অন্তর ঢেলে ইন্দিরাজী জানালেন- আমরা প্রতীক্ষা করেছি ভারতবর্ষের প্রাচ্য রীতিসম্মত ধৈর্যের সঙ্গে, যে ধৈৰ্য্য নিয়ে গরিব চাষি অপেক্ষা করে গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার জন্য। যে ধৈর্য নিয়ে বর্ষার প্লাবনের মধ্যে সহায়সম্বলহীন মানুষ অপেক্ষা করে জল সরে নতুন পলিমাটি ওঠার অপেক্ষায়। যে ধৈৰ্য্য নিয়ে আমাদের দেশে শীতের শেষের জন্য অপেক্ষা করে দেশের তামাম গরিব। মানুষ- যাদের গায়ে দেবার মত ধুতির খুঁটটুকু পর্যন্ত জোটে না। এ সেই ধৈৰ্য্য যা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে শিবিরে তরুণ যােদ্ধারা অপেক্ষা করেছে কবে তাদের প্রতি অত্যাচারের জবাব তারা দেবে। ছাত্ররা ঘুরে। ফিরেছে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত অবস্থায় কবে তারা যুদ্ধ শিক্ষার সুযােগ পাবে। | কিন্তু আমাদের শিক্ষা শুধু ধৈৰ্য্য ধরে অপেক্ষা করাই নয়। আমাদের দেশেরই মেয়ে ইন্দিরাজী জানালেন আমাদের সর্বংসহা মেয়েরাও শুধুই সহ্য করতে শেখেনি। শত আক্রমণ, শত অনাচার নীরবে সয়ে যাওয়াই আমাদের ইতিহাস নয়। তাই পাকিস্তানের সামরিক শাসকের নিলর্জ ভারত আক্রমণের সমুচিত জবাব আমরা দিচ্ছি । ধৈৰ্য্য ধরে মুক্তিবাহিনী আটমাস যাবৎ যে আঘাত হানছেন তা আজ মিত্রবাহিনীর সহায়তার ঢাকা মুক্তিতে শেষ হতে চলেছে এই সপ্তাহের মধ্যেই। ইন্দিরাজী আরাে বলেছেন রামলীলা ময়দানে। তিনি জানিয়েছেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু বলার নেই। আজ বাংলাদেশের মানুষের মতাে সমস্তটা মানলে তারাও ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলত না, অস্ত্র ধরত না জঙ্গী কুচক্রীদের হয়ে। এই জঙ্গীশাহী তাদের কু প্রচার চালিয়ে মানুষকে ধোকা দিতে চেষ্টা করছে -যে চেষ্টা ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের সামনের সে চালানোর চেষ্টা করেছে।  মুজিব বলেছিলেন বাংলার মানুষকে মুক্তি দেবেন। তিনি কথা রেখেছেন। ইন্দিরাজী কথা দিয়েছিলেন শরণার্থীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা তিনি করবেন। তিনি কথা রেখেছেন। এই দুই নেতার মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত বাংলার সর্বহারা সর্বস্বান্ত মানুষ আজ ভবিষ্যতে নিশ্চিন্ত জীবনের আশা করছেন। এ আশা সত্যি হবেই।

ইন্দিরাজী অত্যন্ত মুল্যবান রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সত্য বিশ্লেষণ করেছেন। দেশের নাম না করে তিনি বলেছেন, যে সমস্ত দেশ পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আধুনিকতম অত্রে সশস্ত্র করেছে তারাই আজকের এই ট্র্যাজেডীর জন্য দায়ী। আজ বাংলাদেশের মানুষের এই যে কষ্ট, আজ শরণার্থীদের কষ্ট মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের ত্যাগ স্বীকার ও প্রাণ দিয়ে শত্রুর মােকাবিলা সমস্ত কিছুর পিছনে আছে এই সামরিক চক্রের মদমত্ততা। সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করে তাদের দাবীদাওয়া আগ্রহ করে মিথ্যা বক্তৃতা ঝেড়ে তারা ভেবেছিল বাজীমাৎ করে দেবে। তাদের অস্ত্র ও তাদের মিথ্যার জোর আজ ঐক্যবদ্ধ দুই দেশের গণতন্ত্র ও শান্তিকামী ৬২ কোটি লােকের ইচ্ছার কাছে হেরে গেল।

 বিপ্লবী বাংলাদেশ ১: ১৮ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় –ড. ইবনে গােলাম সামাদ।

(উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) যুদ্ধ একদিন শেষ হয়। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে গড়ে তুলতে হয় নতুন জীবন, নতুন সভ্যতা। মানুষ যুদ্ধ চায় । চায় শান্তি। তবু যুদ্ধ চলে আসছে মানব অস্তিত্বের আদিকাল থেকে। আমরা যুদ্ধ চাইনি। তবু যুদ্ধ চেপে বসেছিল আমাদের উপর। আট মাস বাইশ দিন পরে বাংলাদেশের সর্বত্র দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। যুদ্ধের শেষ। এখন যা দরকার, তাহলে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়ােগ করা। | বাংলাদেশের পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। এখানে প্রতিবর্গ মাইলে জনসংখ্যা ৯০০ জনের উপরে। জনসংখ্যার চাপ বাংলাদেশে খুব বেশি। আমাদের প্রধান সমস্যা এই বিরাট জনসংখ্যার সাক্ষ্মন্দ বিধান।    বাংলাদেশের মােট আয়তন ৩৫,৩ মিলিয়ন একর। এর মধ্যে আবাদী জমির পরিমাণ হলাে ২২.৫ মলিয়ন একর। এর মধ্যে একাধিকার ফসল উৎপাদক জমির পরিমাণ হলাে ৩ মিলিয়ন একর। মােট আবাদি জমির পরিমাণ একাধিকবার সল উৎপাদক জমির পরিমাণ যােগ করে মােট ফসলি জমির পরিমাণ দাড়ায় ৩৮,৮ মিলিয়ন একর। এটা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় দু’ভাবে: তে, নাদী জমি তল করে; এবং ২। সে মতে বর্তমানে ফসল উৎ’, ১া হয়, তাতে ফসল উৎপাদনের পরিমাণে বাড়ান। | দে, ৭ fখন আবাদ করা হ , কিন্তু কলের লাঙ্গলের সাহায্য কর্ষণ করে ফসল ফলানাের •”। in v. লা যায়, এমন জমির পরিমাণ হলাে মিলিয়ন একরের কিছু বেশি। এই জমিকে চাষ করে ৮’র ‘মাট জমির আয়তন বৃদ্ধি করা চলে। তবে এর দ্বারা ফসল উৎপাদনের পরিমাণ অন্যান্য দেশের মতাে

করা যাবে না। অন্যান্য উন্নয়নগামী দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির খোজ নিলে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে তাদের। ফসল বৃদ্ধির মূল কারণ, অনাবাদী জমিকে আবাদযােগ্য করে ফসল উৎপাদন। যেহেতু বাংলাদেশে কর্ষণ। উপযােগী পতিত জমির পরিমাণ বেশি নয় তাই বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান উপায় হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, বর্তমানে আবাদী জমিতে উন্নত কৃষি পদ্ধতির প্রয়ােগ। ফলে বর্তমান আবাদী জমিতেই অধিক সল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। | বং দেশে খনি শস্যের ফসল মাত্রা খুবই কম। যেখানে বাংলাদেশে ধানের গড় পড়তা ফসল একর। প্রতি ৯০-১০০০ পাউণ্ডের মত, সেখানে জাপানে একর প্রতি ফসলের মাত্রা ২০০০ পাউণ্ড উপর। আমাদের। দেশে ধানের ফসল মাত্রা কমের একটি কারণ জমিতে উপযুক্ত সার প্রয়ােগের অভাব। বাংলাদেশের জমিতে একর প্রতি ৪০ পাউণ্ড নাইট্রোজেন মাটিতে সার প্রয়ােগ করে দেখা গিয়েছে যে এর ফলে আউস ধানের উৎপাদন শতকরা ৩৭ ভাগ আমন ধানের উৎপাদন শতকরা ৪০ ভাগ ও বরাে ধানের উৎপাদন শতকরা ৪৬ * শানো সম্ভব।

|আমলের দেশে মাটির নিচের যে প্রকৃতি গ্যাসের সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে তার পরিমাণ হলাে ৯,৩৪ মিলিয়ন মিলিয়ন কিউবিক ফুট (m.m.cu ft)। এই গ্যাসের সঙ্গে বাতাসের নাইট্রোজেন যুক্ত করে, Tইট্রোজেন ঘটিত সায় আমাদের প্রয়ােজন অনুসারে যথেষ্ট উৎপন্ন করা সম্ভব। | বাংলাদেশের আবাদী জমির কম করে শতকরা ৬০ ভাগ শীতকালে পতিত থাকে। কারণ, শীতকালে মমাদের দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম। উপযুক্ত জল-সেচের ব্যবস্থা করে, শীতকালে রবিশস্যের চাষ বাড়িয়ে আমাদের দেশের খাদ্য সমস্যা বহুল ভাবে সমাধান করা সম্ভব। পাকিস্তানী আমলের সরকারি হিসাব থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের ১.৫ মিলিয়ন একর জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা আছে। এই জমির পরিমাণ। ‘লাে মোট আবাদী জমির শতকরা ৫ ভাগ মাত্র। তাই কেবল সেচব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়ে বাংলাদেশের খাদ্যের ঘাটতি পূরণ করা চলে। | বাংলাদেশের এক বিরাট সমস্যা হলাে না। বন্যার পানি প্রতি বছর যথেষ্ট পলিমাটি বহন করে এনে বাংলার মাটিকে উর্বর করে। কিন্তু বন্যা আবার বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফসলের ক্ষতির কারণ। মাঝারি রকমের বন্যার ফলে, বাংলাদেশ প্রায় ৯ মিলিয়ন একর জমি জলমগ্ন হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যে সব অনুসন্ধান হয়েছে তা থেকে দেখা যায়, ভারতের সহযােগিতা ছাড়া বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোনও স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এতদিন পাকিস্তানী রাজনীতির জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সহযােগিতা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে, এই অসুবিধা আর থাকছে না। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের মাটি থেকে বাংলাদেশের মানুষের। প্রয়ােজশীয় খাদ্য উৎপাদন মােটেই অসম্ভব নয়।

জয়বাংলা (১): ১: ৩৪ ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ 

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও চরিত্র

— আঃ আহাদ

যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিরাজমান কতকগুলাে সমস্যার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। বিরাজিত সমস্যা সমূহের মধ্যে কতক সমস্যা আছে যা তড়িৎ সমাধান দাবী করে এবং অন্য কতকগুলাে সমস্যা সমাধানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়ােজন ধৈৰ্য্য, সহনশীলতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। কিন্তু এই সমস্যার গভীরতা জটিলতা ও চরিত্র অনুধাবন করতে হলে প্রয়ােজন বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও এর মৌল চরিত্রটি বিশ্লেষণ করা: পটভূমি: পঁচিশ বৎসর পূর্বে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেবাদ ভারতবর্ষের তার দখলি সত্ত্ব ছেড়ে গেলে উপমহাদেশের বিশাল বাজার আপন একচেটিয়া কর্তৃত্বে আনয়নের জন্য অবিভক্ত ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি গােষ্ঠী এবং মুসলমান উঠতি ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে ভারত বিভক্ত হয়; সৃষ্টি হয় দুইটি পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের। অবিভক্ত ভারতের মুসলিম ভূ-স্বামী ও উঠতি ব্যবসায়ী পুঁজিপতিরা এদের বিকাশকে তথা শােষককে নিরঙ্কুশ করার। জন্য মুসলিম লীগের পতাকা তলে উপমহাদেশের মুসলিম জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাস ভূমির দাবী তােলে। মুসলিম লীগের অভিপ্রায় সিদ্ধ হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযােগিতায়। একটা। কৃত্রিম সাম্প্রদায়িক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র । | কিন্তু পঁচিশ বছর পূর্বে উপমহাদেশের মুসলিম জনগণ পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দিয়েছিল কেন? কি চেয়েছিল তারা? শতাব্দীর পশ্চাৎপদতা, সামন্তবাদী শােষণ, সীমাহীন দারিদ্র ও নিপীড়নের হাত থেকে তারা মুক্তি চেয়েছিল। জমি, রুটি, শিক্ষা, বাসস্থান, জীবনের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র পাকিস্তান পেলে এগুলাে তারা পাবে। পাবে পরিপূর্ণ প্রকৃত স্বাধীনতা, এই স্বপ্নই দেখেছিল জনগণ । কিন্তু পেয়েছে তার উল্টো। তাহলেও পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায় নি। তখনকার দিনের উঠতি ব্যবসায়ী, পুঁজিপতিরা, বৃহৎভূ-স্বামীর যে জন্য পাকিস্তান চেয়েছিল তাদের সে আশা পূরণ হয়েছে। |

বাংলাদেশসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের জনগণকে শােষণ করে সমস্ত সম্পদের মালিক হয়েছে ২২ টি অবাঙ্গালি পরিবার। সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সহযােগিতায় পরিণত হয়েছে ২২ পরিবার ও সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে। আর ঐ ২২ পরিবারও বিদেশী পুঁজি তথা মার্কিন পুঁজিপতির স্বার্থরক্ষার জন্য পাহারাদরের ভূমিকা পালন করেছে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী। | কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ বিগত ২৫ বছর ধরে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জাতীয় আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের জন্য বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে আছে। দুই অংশের অসমান বিকাশের আন্দোলন জনগণের সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিগত নির্বাচনে জনগণের বিজয়ে স্তম্ভিত ও ভীত শাসকগােষ্ঠী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শেষ সুযােগকে নস্যাৎ করে দেয়। সুতরাং পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকার অর্জনের সমস্ত পথ যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন আপন বাসভূমি পূর্ববাংলায় এই গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন, সার্বভৌম ও শােষণমুক্ত বাংলাদেশ কায়েমের দাবী তােলে। অর্থাৎ বিগত ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রামই পরিণত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। ২৫শে মার্চের পূর্বে এই সংগ্রাম ছিল শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। কিন্তু ২৫ শে মার্চ নিরস্ত্র বাংলাদেশের জনগণের উপর যখন শাসকগােষ্ঠী সশস্ত্র আক্রমণ চালায়, জনগণও তার জবাবে তুলে নেয়। হাতিয়ার। অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র । অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন পরিণত হয় সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপ সশস্ত্র গণযুদ্ধে।

সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, ১৯৭১

 

 

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০