You dont have javascript enabled! Please enable it! গােলটেবিলে নয়-রণাঙ্গনেই সমাধান-জনযুদ্ধের জনশিক্ষা - সংগ্রামের নোটবুক

গােলটেবিলে নয়-রণাঙ্গনেই সমাধান

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকার ও পাকিস্তানের একনায়কত্ববাদী জঙ্গীশাহীর মধ্যে এক আলােচনা বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য রাজতন্ত্রী ইরান উদ্যোগ নিচ্ছে বলে সম্প্রতি এক খবরে জানা গেছে।  গত ২৫ শে মার্চের রক্ত স্নানের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ যে বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছেন এবং নিশ্চিত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন, অপরদিকে মুক্তিসেনানীদের ব্যাপক তৎপরতার | বর্বর ইয়াহিয়ার পাকফেীজের মধ্যে বিভীষিকার সৃষ্টি হয়েছে (গত পাঁচ মাসে প্রায় ত্রিশ সহস্রাধিক হানাদার  নিহত) ঠিক সে মুহূর্তে রাজতন্ত্রী ইরানের স্বেচ্ছা প্রণােদিত (!) এ বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ কিসের ইঙ্গিত বহন করে? বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সর্বকালের বীভৎসতম ও ভয়াবহতম মানবতা বিদেশী অপরাধ বলে ইতিহাসে গণ্য হবে। বাংলাদেশে নির্বিচার গণহত্যায় ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জঙ্গীশাহীর সামরিক ও শান্তিকামী জনগণের ইয়াহিয়া চক্রকে ধিক্কার ও তীব্র প্রতিবাদ জানালেও পার্শ্ববর্তী রাজতন্ত্রী ইরান এখনাে রহস্যজনকভাবে নীরব। গণহত্যা ও শক্তির জোরে বাংলাদেশের দখলে রাখার জন্য ইয়াহিয়াচক্রকে শুধু সাম্রাজ্যবাদ আমেরিকা ও বিশ্বাসঘাতক চীনা নেতৃত্বই অস্ত্রশস্ত্র সহ বিভিন্ন প্রকার সামরিক ও ভারত বিরােধ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করার এক ষড়যন্ত্র বিশেষ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট উভয়দেশের সদাজাগ্রত জনগণ ও সরকারের প্রবল বিরােধিতায় ঐ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নতুন ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। ইরানের বৈঠকের উদ্যোগ এ ষড়যন্ত্রের অংশ বিশেষ ছাড়া আর কিছুই নয়।  বাঙলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে অস্বীকার এবং স্বাধীনতা যযাদ্ধাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, দুস্কৃতিকারী ও ভারতের অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়াচক্র বাংলাদেশ সরকার বা প্রতিনিধিদের (তথাকথিত দুষ্কৃতিকারী) সঙ্গে কেমন করে একই টেবিলে বসতে পারেন? মার্কিনী প্রভুর গােপন চোখ ইশারায় তাদেরও আপত্তি নেই। এ সম্পর্কে পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ইরানের রাজধানী তেহরানে ঝটিকা সফর এবং সেখানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও উচ্চপদস্থ ইরানী কর্মকর্তাদের সঙ্গে গােপন বৈঠক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আলােচনা বৈঠক সম্পর্কে ও পাকিস্তান-নীরব-অর্থাৎ মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। 

মুক্তিবাহিনীর প্রবল গেরিলা তৎপরতায় যখন হানাদার পাক ফৌজরা প্রতিদিনই পর্যদস্ত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে দখলকৃত অঞ্চল থেকে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে-ব্যর্থতার ফলে পাক-ফৌজের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি  হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ পাঠান-সিন্ধীসহ নিপীড়িত জাতি সমূহের মাঝে জঙ্গীচক্রের বিরুদ্ধে চাপা আগুন জ্বলছে, বিদেশে অর্থনৈতিক সাহায্য যুগিয়ে চলছেন তা নয়-এদের সঙ্গে বেনামীতে ‘রাজতন্ত্রী ইরাণ ও সামিল হয়েছেন।  সামরিক একনায়ক ইয়াহিয়াচক্র বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করে সারা পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন ও চীনের সহায়তায় রাইফেল ধরেছে। আর মার্কিনের তাবেদার ইরান পূর্বেই স্বদেশে গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করে জনমতের তােয়াক্কা না করে বলপূৰ্ব্বক রাজতন্ত্র’ চালাচ্ছে। শুধুমাত্র ভৌগােলিক নয়-রাজনৈতিকভাবেও এ দুটি দেশ বেশ নিকটে। এক দেশে চলছে ‘সামরিক একনায়কত্ব অপর দেশে রাজতন্ত্র। পাকিস্তানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হ’লে সে ঢেউ ইরানেও লাগতে পারে-এ ভয়ে ইরানী শাসকগােষ্ঠী পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকগােষ্ঠীকে বরাবর সর্বক্ষেত্রে অন্ধভাবে সমর্থন করে এসেছে।

বাংলাদেশের জনগণের চিরশত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত এখনাে চলছে। সাড়ে সাত কোটি  জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমনের জন্য একদিকে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখে অপরদিকে তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের টোপ দিয়েছে। ইতিপূর্বে মার্কিনীরা বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে জাতিসংষ্মের মাধ্যমে পর্যবেক্ষক মােতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছিল। আসলে উহা ছিল, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মােতায়েনের মাধ্যমে মুক্তি সেনাদের তৎপরতা হ্রাস করা। স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাক নিযুক্ত পাকিস্তানী কূটনীতিবিদগণ একের পর এক বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে চলেছেন, পাকিস্তানে বিদেশী  সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ, বিশ্বের রাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের পাশে আরাে ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসছে এবং ঘরে-বাইরের সমস্যার জঙ্গীচক্র যখন ‘একঘরে হয়ে পড়ছে : না- সে মুহূর্তে কোনাে প্রকার আপােষ আলােচনা এদেশের জনগণ মেনে নেবে না-নিতে পাচ্ছে না। নিশ্চিত এবং চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারে এসে কোনাে বৈঠকের প্রশ্নই আসে না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামের কণ্ঠে জনতার বাণীই প্রতিধ্বনিত হয়েছে : ‘আপােষ নয়-রণাঙ্গনেই হানাদারদের সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়া হবে…..।’ যাঁরা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন, তাঁরাও জেনে রাখুন, রাজনৈতিক সমাধান একটি অর্থই বহন করে, তা’ হলাে বাংলাদেশের পূর্ণস্বাধীনতা অগণিত জনতার পূত-পবিত্র তাজা রক্ত দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের যে মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছে- তা’ চির অম্লান হয়ে থাকবে। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আবেদন : কোনাে প্রকার রাজনৈতিক সমাধানের টোপ দিয়ে নয়, আসুন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে হানাদারদের কবল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে রত সাত কোটি জনগণের পাশে দাঁড়ান। বিশ্বশান্তি স্থাপনের প্রয়াস যে এতে আরাে সুদৃঢ় হবে। তাতে কোনাে সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ ১: ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

জনযুদ্ধের জনশিক্ষা

জনযুদ্ধের দুটি দিক আছে। একটি হলাে যারা সরাসরি লড়াই করবে, অর্থাৎ ‘কম্ব্যাট ফোর্স’ বা ‘কম্যাণ্ডো’ । সংখ্যায় তারা জনগণের সামান্য আর জনগণের বৃহদাংশ হলাে ‘মােটিভেশনাল আর্মি’ । তারা জনগণকে বিপ্লব সম্বন্ধে সচেতন রাখে, জনগণের মনােভাব অবিচল রাখতে সাহায্য করে, শত্রুপক্ষকে ভুল বােঝায়, শত্রুপক্ষ সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করে এবং সর্বোপরি, কম্যান্ডোরা যাতে সবরকম সাহায্য পায় তার চেষ্টা করে। এইসব কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে মােটিভেশনাল আর্মি জনগণের বিপ্লবী মনােভাব গড়ে তােলে। ফলে বিপ্লবের কাজ আরও দ্রুততর হয়। আর মােটিভেশনাল আর্মির কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে এগােতে থাকে কম্যান্ডােদের যুদ্ধ এবং অন্তর্ঘাতমূলক ব্যবস্থা।  বাংলাদেশের জনযুদ্ধের তথা মুক্তিযুদ্ধেরও এই দুটি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে কম্যান্ডাে অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধারা; অপরটি হচ্ছে জনগণের বাকি অংশ অর্থাৎ মােটিভেশনাল আর্মি। মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। কিন্তু এ সবই বিফল হবে, যদি জনগণ প্রস্তুত না হয়। আর এই প্রস্তুতির জন্যই চাই মােটিভেশনাল আর্মি। মােটিভেশনাল আর্মি কারা এবং তাদের ঠিক কি কি করতে হবে? মােটিভেশনাল আর্মিকে বলা যায়। প্রস্তুতি বাহিনী। তাদের মােটামুটি কাজ হলাে জনগণকে প্রস্তুত করা। এ প্রস্তুতি বাহিনী গঠন করতে হবে আমাদের মধ্যে থেকেই। এতে আপনিও আছেন, আমিও আছি, সমগ্র বাংলাদেশ আছে। মােটিভেশনাল আর্মি তৈরি করা এবং তার কার্যপদ্ধতির কিছু কিছু অংশ এখানে দেওয়া হলাে। এগুলির মধ্যে আপনি যা যা করতে পারেন সেগুলি করতে আরম্ভ করুন।  মােটিভেশনাল আর্মি বা প্রস্তুতি বাহিনীর গোড়াপত্তন হবে তাদের দ্বারাই যারা ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও আদর্শবাদী হবে এবং হাজার বিপদেও ভেঙে পড়বে না। প্রস্তুতি বাহিনীর মনােবল খুবই বেশি। হ ৫? আবশ্যক, কারণ তারাই সাধারণ লােকদের সাহস জোগাবে। প্রস্তুতি বাহিনীর প্রশাসন সম্বন্ধেও জ্ঞান থাকা। প্রয়ােজন, যেহেতু অনেক সময়েই হয়তাে তাদের ওপর প্রশাসনের দায়িত্ব পড়বে। তাদের হতে হবে কষ্টসহিষ্ণু এবং জনগণের সঙ্গে মিলে যাবার গুণ থাকা দরকার। সর্বোপরি তাদের থাকবে চারিত্রিক দৃঢ়তা, সেবাপরায়ণতা এবং সাবধানতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করার ক্ষমতা। এই প্রস্তুতি বাহিনীর সামনে তিনটি দায়িত্ব রয়েছে। প্রথমত প্রস্তুতি, দ্বিতীয়ত মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা করা এবং তৃতীয়ত সংযােগ ও সংবাদ সরবরাহ করা। প্রথমে জনপ্রস্তুতি সম্বন্ধে আলােচনা করা যাক। জনপ্রস্তুতি বলতে আর কিছুই নয়, মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব ও দায়িত্ব সম্বন্ধে জনপণক সবিহণ তােলা। তাদের বােঝানাে যে এ লড়াই তাদেরই মুক্তির লড়াই।

মুক্তি যােদ্ধাদের সাফল্য হবে জনগণের সাফল্য। তাই বাংলাদেশের একমাত্র উপায় হলাে মুক্তি সংগ্রামীদের সর্বপ্রকারে সহায়তা করা। তাছাড়া জনগণের দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের জানাতে হবে যে, তারা শুধু স্বাধীন বাংলার আশা করবে। তাই নয়, তারা সােনার বাংলা তৈরি করবে। বিগত ২৪ বছরের ইতিহাস পর্যালােচনা করে তাদের বােঝাতে হবে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুরা বাংলাদেশে একটানা অত্যাচার চালিয়েছে। এবং বিশ্বের অন্যান্য। মুক্তিযুদ্ধের ফলে কীভাবে অত্যাচারী শাসকদের পতন হয়েছে তাও জনসাধারণকে জানাতে হবে; বােঝাতে হবে যে বাংলাদেশও সেইভাবে অত্যাচারী শাসকের পতন ঘটাতে চলেছে। এসব কাজ করার জন্য গ্রামে ও শহরে প্রস্তুতি বাহিনী তৈরি করা আবশ্যক। এ দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালির। আপনিও এগিয়ে আসুন। প্রথমে আপনার প্রতিবেশীকে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ সম্বন্ধে বােঝান। পরে আস্তে আস্তে সমস্ত অঞ্চলবাসীকেই বুঝিয়ে দলে আনুন। দেশাত্মবােধক সঙ্গীত, বিগত শােষণের ইতিহাস, পাক সৈন্যের সাম্প্রতিক বর্বরতার কাহিনী এবং তার বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের জয়যাত্রা-ইত্যাদি বলে জনগণের দেশপ্রেম জাগ্রত করুন, পাক জঙ্গীশাহীর উৎখাত আরও দ্রুততর করুন। আর লক্ষ্য রাখুন যে আপনার অঞ্চলের প্রতিটি লােক যেন মুক্তিযােদ্ধাদের যথাসাধ্য সাহায্য করে। প্রস্তুতি বাহিনীর দ্বিতীয় কাজ হলাে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা।

তার জন্য প্রস্তুতি বাহিনীকে জানতে হবে কোথায় মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে, রসদই বা কোথায় পাওয়া যেতে পারে এবং কোন পথে নিরাপদে চলাফেরা করা যায়, ইত্যাদি। | এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের তৃতীয় দায়িত্ব, অর্থাৎ সংযােগ ও সংবাদ সরবরাহের কথা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এর ওপরেই মুক্তিফৌজের জয় নির্ভর করবে। এ কাজটি হলাে নানা জায়গায় যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপন করা, শত্রুসৈন্য সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযােদ্ধাদের তা দেওয়া এবং মুক্তি ফৌজের গুরুত্বপূর্ণ বিজয় বার্তাগুলাে জনগণের কাছে পৌছে দেওয়া। এসব ছাড়াও প্রশাসন চালানাে, আহতদের সেবা শুশ্রুক্ষ, অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রস্তুতি বাহিনীর সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক এবং প্রয়ােজন হলেই প্রস্তুতি বাহিনীকে এসব করতে হবে। আবার জানাচ্ছি, প্রস্তুতি বাহিনীর মনােবল হওয়া উচিত অত্যন্ত দৃঢ়। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি থাকেই, কাজেই তাৎক্ষণিক জয়-পরাজয়ে প্রস্তুতি বাহিনী বিচলিত হবে না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, তারা জনগণকে বােঝাবে যে সত্যের জন্য ন্যায়ের জয়, মুক্তিযুদ্ধের জয় অবশ্যম্ভাবী। মনে রাখবেন, আপনার স্বাধীনতা আনবার জন্য মুক্তেযােদ্ধারা যুদ্ধ করছে, হাসিমুখে জীবনদান করছে। তাদের সাহায্যের জন্য আপনার কর্তব্য হলাে প্রস্তুতি বাহিনী তৈরি করা। সােনার বাংলার সােনার বাঙালি হতে গেলে আপনার এই কর্তব্যের কথা ভুলবেন না।

| বিপ্লবী বাংলাদেশ ১:৪। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের প্রতি

বাংলার সংগ্রামী সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। সাম্প্রতিক সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট স্বাধীনতার সংগ্রামকে এক নতুন মােড় দিয়েছে। নতুন রূপ পেয়েছে সংগ্রামী। আন্দোলন। এর সাথে সাথে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্বে ও বাংলাদেশ এক নতুনতর, উজ্জলতর রূপ পেল। বিশ্বের বুকে একটি বলিষ্ঠতম জাতি হিসাবে, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে বাংলাদেশ শীর্ষ সম্মানের, উপযুক্ত মর্যাদার দাবীদার। সাম্রাজ্যবাদ, মানবতা-বিরােধী চক্রকে নস্যাৎ করার ব্যাপারে, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে এ সূচনা নতুন দিগন্ত উন্মােচিত করলাে। পক্ষান্তরে বাংলার সংগ্রামী জনগণ অতি গভীর আগ্রহভরে লক্ষ্য করছে যে, তাদের নিয়ে, তাদের জীবন নিয়ে, মান-ইজ্জত নিয়ে লােলুপ সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠী, মানবতা বিধ্বংসী চক্র নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তাদের এই যড়যন্ত্র দিনের পর দিন অতি সূক্ষ্মতর পদ্ধতিতে জাল বিস্তার করে চলছে। আগামী দিনের বাঙ্গালি  জাতিকে পঙ্গু করার জন্য, বিধ্বস্ত করার জন্য, পদানত করে রাখার জন্য এই ষড়যন্ত্র সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে। অতি দুঃখের সাথে সাড়ে সাতকোটি মানুষ এও লক্ষ্য করছে যে, এই ষড়যন্ত্রকারী গােষ্ঠীর সাথে বাংলার মিরজাফরের দল তলে তলে কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যেও একটি জাতিকে সমূলে নষ্ট করার জন্য তাদের এই হীনতম কাজ অতি জঘন্য, ঘূণ্য।। | এদিকে জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই চক্রান্তকারী গােষ্ঠী সম্পর্কে সচেতন থাকলেও এই হীন, জঘন্যতম প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার ব্যাপারে কোনও বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে আসছেন কিনা তা বাংলার জনগণের জানা নেই। কুখ্যাত জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং তাদের লেজুড় রাজাকার বাহিনীকে বাংলার সােনার মাটি থেকে আগাছার মতাে উপড়ে ফেলার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে, এ বড় আনন্দের কথা।

কিন্তু স্বাধীনতা। সংগ্রামের নামে তলে তলে একশ্রেণীর ছদ্মবেশী কাজ করে যাচ্ছে এবং সমাজের শীর্ষস্থানে থেকে তাদের কাজের গতিধারা প্রতিটি সচেতন ও স্বাধীনবিবেক সম্পন্ন নাগরিককেই ব্যথিত করে তুলেছে। | স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে আজ পর্যন্ত কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক বাংলাদেশ থেকে বাইরের বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি সাম্প্রতিককালের একটি খবরে জানা যায় যে, আমেরিকার একটি বিশেষ ফাউন্ডেশন তাদের সামরিক আর্থিক সাহায্য দানে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা দান করেছে। এই দানের কারণ হিসাবে জেনারেল ইয়াহিয়ার অত্যাচার, নির্যাতনের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অতি সাধারণ সচেতন নাগরিকও জানেন যে, আমেরিকার এই ফাউন্ডেশন আমেরিকার প্রশাসনে তথাকার কুখ্যাত গােয়েন্দা বিভাগের পরেই প্রভাব বিস্তার করছে। যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসন বাংলার বুকে হত্যালীলায়, বাংলাকে বিধ্বস্ত করার কাজে জেনারেল ইয়াহিয়াকে সরাসরি সমর্থন এবং প্রয়ােজনীয় আর্থিক ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে আসছে তারই অঙ্গ হিসাবে এই ফাউন্ডেশন বাংলার শিক্ষাবিদ, পণ্ডিতদের গবেষণায় আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। আর এইসব হতভাগ্য গবেষণা বিশারদরা, পণ্ডিতরা ইতিপূর্বেও সাম্রাজ্যবাদ গােষ্ঠীর দালালী করেছে, ক্রীড়নক হিসাবে কাজ করেছে, একথা সর্বজনবিদিত।

আজ তারাই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ দূরে থাকুক যারা স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য, হত্যাযজ্ঞকে ব্যাপকতর করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে তাদেরই অর্থানুকূল্যে বিলাসাপূর্ণ জীবন যাপন করার কাজে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের এই জীবন-ঐতিহ্য, বহু পুরানাে। বাংলার সংগ্রামী জনতা, জননেতারা তাদের ভালাে করেই জানেন। কিন্তু আজ পর্যন্তও এইসব জাতি বিধ্বংসীদের ব্যাপারে কোনাে ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নি। আজো যদি করা না হয় তা হলে বাংলার আগামী দিনের স্বাধীনতা কোনপথে মােড় নেবে তা প্রত্যেকেরই জানা আছে।। | বঙ্গবন্ধু আজ সংগ্রামী বাংলার জনগণের সাথে না থাকলেও তার বাণী রয়েছে, দিক নির্দেশনা রয়েছে। আজ যারা জনগণের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কাছ থেকে জনগণ বলিষ্ঠ ও সুষ্ঠু নেতৃত্ব আশা করার সাথে সাথে মনে করছেন যে; নেতৃবৃন্দ আজ দৃঢ়হস্তে কুচক্রী গােষ্ঠীর মােকাবিলা ও তাদের অশুভ আতাতকে নস্যাৎ করে না দিলে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। মুক্তি সংগ্রাম দুর্বরগতিতে যেভাবে এগিয়ে চলছে তা সাফল্য-সুনিশ্চিত করে তুলেছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সচেতনতার পূর্ণ পরিচয় অবশ্যম্ভাবী। এই সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের পথ সামান্যতম কারণে বাধাগ্রস্ত হলে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আজকের নেতৃবৃন্দকে সমালােচনার বাইরে রাখবেন না। এ হলাে নেতৃবৃন্দের প্রতি স্বাধীনতা সংগ্রামী বাংলার একান্ত অভিমত।

বাংলার মুখ ১৬ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সােভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রতিক মস্কো সফর শেষে প্রকাশিত সােভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতিটি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের প্রতি সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের গভীর ভ্রাতৃত্ববােধ ও দৃঢ়  সমর্থনের পরিচায়ক। দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের ভনিগণ ইহাকে সঠিকভাবেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সপক্ষে একটি মস্তবড় ঘটনা হিসাবে গণ্য করিয়াছেন এবং এই যুক্ত বিবৃতির প্রতি স্বার্থহীন। অভিনন্দন জানাইয়াছেন । প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ সােভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতিতে সন্তোষ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন যে, ইহার মধ্য দিয়া বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে সােভিয়েত সরকারের গভীর উপলব্ধির। পরিচয় ফুটিয়া উঠিয়াছে। বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের বরাত দিয়া কোনও কোনও স্বার্থসন্ধানী মহল সােভিয়েত ভারত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকার হতাশ হইয়াছেন-এই মর্মে ইতিপূর্বে যে -প্রচারণা চালাইয়াছিল। বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র প্রকাশ্য বিবৃতি দ্বারা উহাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় খণ্ডন করিয়াছেন।

অশ্য একথা ঠিক যে, সােভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতিতে প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা এবং স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার আর কোনাে গ্রহণযােগ্য সমাধান যে নাই তাহা স্পষ্ট বলা হয় নাই। কিন্তু ইহা হইতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পূর্ণ। স্বাধীনতার দাবির বিপক্ষে কিম্বা বাংলাদেশের উপর সােভিয়েত সরকার যেমন-তেমন ধরনের একটা রাজনৈতিক সমাধান চাপাইয়া দিতে চায় বাস্তব অবস্থাও তাহা নয়। প্রথমত, সােভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতিতে প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধানের চরিত্র সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। এই রাজনৈতিক সমাধানকে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের “ইচ্ছা, অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে। ভাষ্যকারদের মতে ‘অনপহরণীয় অধিকার” বলিতে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারও বুঝায়। বিশেষত বাংলাদেশের জনগণ তথা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ এবং বাংলাদেশ সরকার ও সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ যখন অপরিবর্তনীয়রূপে ঘােষণা করিয়াছেন যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনও ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান তাহাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, সেক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে মীমাংসা করিতে হইলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়াই। উহা করিতে হইবে। 

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সমস্যা ও ভারতে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তুর আশ্রয় গ্রহণ প্রভৃতির জন্য কর্তৃপক্ষ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীকে দায়ী করিয়াছেন এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানার্থে। আয়ােজিত ভােজসভায় সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কমরেড কোসিগিন ইয়াহিয়া-চক্রকেই এই অবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বলিয়াছেন। ইয়াহিয়া-চক্র বিশ্ববাসীকে ধোকা দেওয়ার। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় বেসামরিক “গভর্নর নিয়ােগ, “সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা প্রভৃতি যেসব পদক্ষেপ নিয়াছে সােভিয়েত কর্তৃপক্ষ পরিষ্কারভাবে সেগুলিকে উপেক্ষা করিয়াছেন। তৃতীয়ত, সােভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ সংক্রান্ত বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি যে অনড়-অচল নয়, গত কয়েক মাসে উহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। এপ্রিল মাসে সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান কমরেড পদগনি ইয়াহিয়া। সরকারকে শক্তি প্রয়ােগের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য আবেদন জানাইয়া ছিলেন। উহার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের জন্য গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পাইলেও তখনকার তুলনায়। সােভিয়েত ইউনিয়নের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট ও বাংলাদেশের পক্ষে আরও অনুকূল। এমনকি সােভিয়েত ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের পর নয়াদিল্লীতে স্বাক্ষরিত গ্রোমিকো শরণ সিং যুক্ত। ইশতেহারের সহিত যুক্ত বিবৃতিকে মিলাইয়া দেখিলেও সােভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গির গতিশীলতার প্রমাণ পাওয়া যাইবে। ঘোমিকে শরণ সিং যুক্ত ইশতেহারে বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান” বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছিল। আলােচ্য যুক্ত বিবৃতিতে তদস্থলে পূর্ব বাঙলা’ ব্যবহৃত হইয়াছে। যুক্ত ইশতেহারে সারা পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হইয়াছিল। সেখানে যুক্ত বিবৃতিতে পূর্ব বাঙলার জনগণের “ইচ্ছা, অপহরণীয় অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের” ভিত্তিতে সমাধানের কথা বলা হইয়াছে। কাজেই সােভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতির রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাবকে যাহা বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া বলিয়া প্রচারণা চালাইয়া সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতবিরােধী জিগির তুলিতেছেন তাঁহারা হয় অন্ধ, না হয় মতলববাজ। 

সােভিয়েত -ভারত যুক্ত বিবৃতি নিছক কথা কিম্বা বাংলাদেশের প্রতি লােক-দেখানাে সহানুভূতি নয়। জাতিসংঘে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন ইয়াহিয়া-চক্রের প্রতি ধিক্কার জানাইয়া বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমতকে সংগঠিত করিতেছে। সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মস্কোতে সাংবাদিকদের নিকট খোলাখুলিভাবে যাহা বলিয়াছিলেন (“আমাদের সহানুভূতি পূর্ব বাঙলার নিপীড়িত জনগণের প্রতি, উৎপীড়কের প্রতি নয়”) জাতিসংঘে ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে উহার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ বাস্তব কার্যক্রম দেখা যাইতেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মুক্তির যে-দাবি যুক্ত বিবৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করিয়াছে, সােভিয়েত ইউনিয়ন সে দাবিতে বিশ্ব জনমত গড়িয়া তুলিতেছে । সােভিয়েতের বিভিন্ন গণসংগঠন যথা শান্তি পরিষদ, ট্রেড ইউনিয়ন, আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন, মহিলা সংস্থা প্রভৃতি গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের প্রতি সংহতি জানাইয়া যে-সব বিবৃতি প্রকাশ। করিয়াছে উহাও তাৎপর্যহীন নয়। সােভিয়েত ইউনিয়ন আজ নয়, একেবারে প্রথম হইতে এবং দৃঢ়চিত্তভাবে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রকাশ করিয়া আসিয়াছে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে -যখন একমাত্র ভারত ছাড়া অন্য কোনাে দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে মাথা ঘামাইবার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে নাই-তখনই সােভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রপ্রধানের আবেদন জ্ঞাপনের ন্যায় সর্বোচ্চ কুটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে। কাজেই সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে যাহারা জল্লাদ ইয়াহিয়া-চক্রের দোসর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত এক বলিয়া প্রচার করে তাহাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলিয়া পারা যায় না।  পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা প্রতিহত করিয়া বিশ্বের এই এলাকায় শান্তি অব্যাহত রাখার প্রশ্নটিও। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শান্তি অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে শুধু যে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতই আগ্রহী তাহা নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থেও ইহা প্রয়ােজন। পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইয়া জাতিসংঘ মারফত- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদিগকে হস্তক্ষেপের সুযােগ দেওয়া এবং বাংলাদেশ প্রশ্ন হইতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি পাক-ভারত বিরােধের প্রতি সরাইয়া নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া-চক্রই কেবল পাকভারত যুদ্ধ বাধাইতে আগ্রহী হইতে পারে। বস্তুত পাকিস্তানী শাসকচক্র মুক্তিবাহিনীর হাতে ক্রমাগত মার খাইয়া পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইবার ফিকিরই খুঁজিতেছে। কাজেই যুক্ত বিবৃতিতে যুদ্ধ প্রতিহত করিয়া শান্তি রক্ষার যে-কথা বলা হইয়াছে উহা বাংলাদেশের স্বার্থের সহিত সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। বাংলাদেশের দুই অকৃত্রিম সুহৃদ ভারতও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযােগিতা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অনুকূলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সৃষ্টি করিতেছে। ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি এই ফলপ্রসূ সহযােগিতারই একটি অমূল্য দলিল। আমরা ইহাকে মুক্তকণ্ঠে অভিনন্দন জানাইতেছি।

মুক্তিযুদ্ধ ১:১৪ ১০ অক্টোবর ১৯৭১

দেশদ্রোহী

বাংলাদেশ আজকের দুনিয়ার এক চরম যুদ্ধে লিপ্ত। বাঙালি জাতির লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা । ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্রের শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানি অর্জন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা । ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্রের শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিও সামস্তগােষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাঙালি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে গণতন্ত্রকে পৃথিবীর এ অংশ থেকে চিরবিদায় দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর। বাচা মরার ও সংগ্রামে বাংলার সকল মানুষ কিন্তু ঐক্যবদ্ধ। কৃষক মজদুর থেকে আরম্ভ করে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী যিনি যখনই সুযােগ পাচ্ছেন জালেম পাকিস্তান সরকারে সহিত সকল সম্পর্ক সুযােগ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে জাতির এ জীবন-মরন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান সরকারকে ধিক্কার দিয়ে বাংলাদেশের এই গৌরবজনক সংগ্রামে কাতারবন্দি হচ্ছেন। বাংলাদেশের অধিকৃত। এলাকায় সনাতন মুসলিম লীগ পন্থী বা গোড়াপন্থী বলে এতকাল যাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্ধসমর্থক বলে ধরে নেয়া হতাে তাদের ও এখন চৈতন্যোদয় হয়েছে এবং মুক্তিফৌজের বিজয় ও পাঞ্জাবিদের কবল  থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দেয়ার জন্য গােপনে আল্লার দরবারে দোআ-দরুদ পাঠের সংবাদ ও আমাদের কাছে এসে পৌছছে।

কিন্তু আজ ও কিছু সংখ্যক বিপথগামী সুবিধাবাদী উচ্চাভিলাষী বাঙালিদের কার্যকলাপ আমাদেরকে লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন করছে। জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে সত্যিকার পরিস্থিতিটা পৃথিবীর ১৩০টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের সম্মুখে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ থেকে একদল সুযােগ্য প্রতিনিধি জাতিসংঘে গিয়েছেন। এবং ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্নদেশ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাই জাতিসংঘে সমবেত দুনিয়ার ১৩০ টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার সাহস পান নি খুনী ইয়াহিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহী। ওদের দরকার হলাে একজন বাঙালি শিখণ্ডীর। খুঁজে বের করলাে মাহমুদ আলীকে। জনাব মাহমুদ আলীর বর্তমান অবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার রাজনৈতিক জীবনের গােড়া থেকেই শুরু করতে হয়। মাহমুদ আলীর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম ও প্রধান শুরু মাওলানা ভাসানী। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাহমুদ আলীর ভূমিকার বিভিন্ন রূপ বহুবার আমরা দেখেছি। মাহমুদ আলীর ‘নওবেলাল-পত্রিকা এককালে পূর্ববাংলার অন্যতম প্রগতিশীল পত্রিকা ছিল। পূর্ববাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) যুবলীগের সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী। পাকিস্তানের সর্ব প্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘গণতন্ত্রীদলের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি এবং সাবেক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সেক্রেটারি মাহমুদ আলীকেও আমরা দেখেছি। আমাদের স্পষ্ট স্মরণ আছে ১৯৫৩ সালে পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে যখন গলা টিপে হত্যা করার অপচেষ্টায় রত এবং ছাত্র-জনতা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম লিপ্ত তখনই ঢাকার তৎকালীন অন্যতম অভিজাত চা-ঘর ‘ও-ক’ রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক কনফারেন্স এ যুবলীগ সভাপতি মাহমুদ আলী বলেছিলেন, ধর্মের বন্ধনই যদি রাষ্ট্রগঠনের প্রধান ভিত্তি হয় তাহলে পূর্ববাংলা তার নিকটতম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া অথবা মালয়েশিয়ার সঙ্গে ফেডারেশনে থাকতে পারে। আর আফগানিস্তান ও ইরানকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান আরেকটি ফেডারেশন গড়ে তুলুক। ওতে আপত্তি কোথায়? এবং এখানেই ট্রাজেডি।

যে মাহমুদ আলীকে আমরা এতকাল গণতন্ত্রী প্রগতিশীল ও আত্ম-নিয়ন্ত্ৰাধিকারে প্রবক্তা বলেই বিশ্বাস করে এসেছি সেই মাহমুদ আলীর আসল রূপটা যে অমন বীভৎস,-সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের তিনি এক নিকৃষ্টতম দালাল-সেটা আমরা আদৌ জানতাম না। বাঙালি জাতির জীবন-মরণ সংগ্রাম তার প্রকৃত চেহারটাকে বাংলাদেশের জনগণ তথা বিশ্বমানবের কাছে সহসাই তুলে ধরলাে। | পাকিস্তানের জন্মের দীর্ঘ ২৪ বছরের মধ্যে কোনাে বাঙালিকে জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিত্বের নেতারূপে পাঠানাে হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই- মাহমুদ আলী তাে দূরের কথা। এবার বড়ো ফ্যাসাদে পড়ে পৃথিবীকে ধােকা দেবার জন্যই একটা পুতুলের প্রয়ােজন হলাে ইসলামাবাদের জল্লাদদের। আর সেই পুতুল- নেতার ভূমিকায়ই ধরা দিয়েছেন মাহমুদ আলী। জাতির মুক্তি লাভের মহান সংগ্রামে যখন বৃদ্ধ। জননেতা জনাব ভাসানী থেকে শুরু করে দলমত নির্বিশেষে ছােটো বড়াে সকল রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মী মাত্রেই জীবনপণ করে কাজ করে যাচ্ছেন তখনই মাহমুদ আলী গিয়েছেন জাতিসংঘে স্বজাতি ও নিজ দেশের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিম পাকিস্তানীদের দালাল হয়ে ওদের পক্ষে সাফাই গাইতে এবং স্বজাতির কুৎসা রটনা করার জন্য বিশ্বরাষ্ট্র সভায়। মাহমুদ আলী জাতি সংঘে নিজেকে পূর্ববাংলার অধিবাসী বলে জাহির করেছেন এবং সেটাইতাে বর্তমান পরিস্থিতিতে তার আসল যােগ্যতা। তার দালালীসুলভ বক্তৃতায় বাংলাদেশ ঘটনাবলীর জন্য আওয়ামী লীগ, মুক্তিফৌজ ও ভারতকে দোষারূপ করে সারা দুনিয়ায় ধিকৃত খুনী ইয়াহিয়া ও টিক্কাদের পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন তিনি। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্ৰীসমর সেন ও নিজেকে পূর্ববাংলার সাবেক অধিবাসী বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার বক্তৃতায় বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের নরপশু সৈন্যবাহিনী কর্তৃক যে অকথ্য ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে তার করুণ বর্ণনা দিয়েছেন। শ্রীসেন বর্তমানে শুধু ভারতের নাগরিক নন-বিশ্বসভায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধিও। কিন্তু মাহমুদ আলী বাংলাদেশেরই বাসিন্দা। বাংলাদেশ  সম্পূর্ণ মুক্ত হলে মাহমুদ আলীর মতাে পথভ্রস্ট দালালদেরকে পাঞ্জাবিরা সংগে নিয়ে যাবে না হেঁড়া জুতাের মতাে প্রয়ােজন শেষে বাংলাদেশেই ফেলে যাবে-সেকথাটা আমাদের জানা নেই। তবে ইতিহাস যে মাহমুদ আলীদের ক্ষমা করবে না একথাটা আমরা দৃঢ়চিত্তেই বলতে পারি। মীরজাফর বাংলা বিহার ও উড়ষ্যার নবাবীর লােভে সিরাজদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কিন্তু মাহমুদ আলী জীবনে মাত্র একটিবার। তুচ্ছ সাময়িক ভাবে ‘নেতা’ বনার লােভে স্বজাতি এবং নিজের অতীত জীবনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। করলেন। ভারতের দালাল, কমুনিস্ট’ ও ‘রাষ্ট্রবিরােধী’ বলে এই মাহমুদ আলীই কয়েকবার পাকিস্তানী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আজ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চরমমুহূর্তে তার ভূমিকা সত্যিই অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখন তিনি দেশদ্রোহীর ভূমিকা পালন করছেন। তার অপমৃত্যু ঘটেছে। তাই আমাদের পরিচিত মাহমুদ আলীর অমন অপমৃত্যুর জন্য আমরা গভীর শােক প্রকাশ করছি এবং ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটর। ইয়াহিয়া খানের দালাল বর্তমান মাহমুদ আলীকে জানিয়ে রাখছি :

‘…..তােমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা।’

মুক্তবাংলা ১:৪। ১১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০