ব্যাস্তত্যাগীরা তাদের সম্পত্তি ফেরৎ পাবেই
বিগত সপ্তাহে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেছেন যার জন্য তারা সমগ্র জাতির অভিনন্দন দাবী করতে পারেন। সিদ্ধান্তটা হলাে বাস্তুত্যাগীদের নিজ নিজ সম্পত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে। স্বাধীনতার জন্য মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত বাঙ্গালি জাতির কাছে মার খেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশবাদীরা আজ নানা ছলাকলার আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশের উপর নিজেদের কায়েমী স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার জন্য তারা সুপরিকল্পিত উপায়ে চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুত্ব বিনষ্ট করার। সেজন্য তারা খুন করেছে কয়েক লাখ লােককে। তারা ভেবেছিল তাদের এ জঘন্য গণ-হত্যার বিষয় বিশ্ববাসী জানতেই পারবে না। কিন্তু ভারতীয় বেতার ও পত্র-পত্রিকা এবং বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের মাধ্যমে তা জানাজানি হয়ে গেল সারা দুনিয়ায়। তাছাড়া, একজন একজন করে কোটি দু’য়েকের মতাে লােক হত্যা করা সহজও নয়, সম্ভব ও নয় । অথবা, অন্তত দুই কোটির মতাে লােক মারতে না পারলে পাকিস্তানে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুত্ব নষ্ট করাও সম্ভব নয়। তাই তারা এখন ভিন্ন পথ ধরেছে। তারা সাধারণভাবে সমগ্র হিন্দু-জনসংখ্যাকে এবং আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বাংলাদেশ থেকে বিতড়নের কর্মসূচি নিয়েছে। সব জায়গায় সৈন্য বাহিনীর যাওয়াআসা সম্ভব নয় বিধায় তারা কাজটা করছে অতি সূক্ষ্ম ভাবে। তারা কনভেনশন-জামাতের দালালদের ডেকে নিয়ে তাদের বক্তব্য বলে দিচ্ছে। তারপর তারা স্থানীয় গুণ্ডা, বদমাশ, চোর, ডাকাতদের সহায়তায় কাজটা সুরাহা করছে। এ চোর, গুণ্ডা, বদমাশের দল হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের বাড়িতে ডাকাতি করছে, লুটপাট করছে। তাতেও বাড়ির না ছাড়লে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে তাদেরকে বাধ্য করছে সীমান্ত পারে চলে যেতে। অতঃপর সামরিক বাহিনীর সহায়তায় কনভেশন-জামাতের গুণ্ডা-বদমাশরা তাদের। পরিত্যাক্ত বাড়িঘর, জায়গাজমিও দোকানপাট নিজেদের দখলে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে বাস্তত্যগীদের পরিত্যাক্ত বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার সম্পত্তি বিশেষে বাস্তত্যাগীদের পরিত্যাক্ত বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার সম্পত্তি সামরিক বাহিনীর দালালরা এক -দু’শাে টাকায় নীলামে কিনে নিচ্ছে। | কিন্তু এ সব নরপিশাচ গুণ্ডা বদমাশের দল জানেনা যে পশ্চিমা সামরিক বাহিনী বেশি দিন তাদের রক্ষা। করতে পারবে না। মরণজয়ী বাঙ্গালি মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাভূত হয়ে তাদেরকে বাংলাদেশের পবিত্রভূমি ত্যাগ করতেই হবে। | পাইকারীভাবে বাংলাদেশ থেকে অমুসলমানদের বিতাড়নের পশ্চাতে অন্য গৃঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে। বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার কবর হয়েছে অনেক আগে। বাঙ্গালিরা এ ক্যান্সার রােগটা আর পুনরুজ্জীবিত করতে প্রস্তুতি নয়। কারণ বাঙ্গালিরা বিগত ২৪ বছরে দেখেছে এবং হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে যে দ্বি-জাতি তত্ত্বের মাধ্যমে পাকিস্তান অর্জন করে ইসলাম ও সংহতির নামে পশ্চিমারা শুধুমাত্র অমুসলমানদেরই শােষণের যাতাকলে নিপিষ্ট করে নি, বাঙ্গালি মুসলমানদেরও সমভাবে করেছে। ওদের দ্বিজাতি তত্ত্ব, ওদের ইসলাম ও সংহতি আসলে নিজেদের শাসনও শােষণের যাতাকল মজবুত রাখার জন্যই। সুতরাং বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয় বলেই পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী। শাসক ও শােষকরা আজ ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে বিভেদের দ্বারা শাসন করাে’ নীতি কার্যকরী করতে চায়।
তারা জানে পাইকারীভাবে বাংলাদেশ থেকে অমুসলমানদের তাড়িয়ে দিতে পারলে তাতে দ্বিবিধ ফল ফলবে। প্রথমত এর ফলে ভারতের সাথে সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটবে। যার দরুণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবাখেলার বাংলাদেশের মূল সমস্যাটাই ধামাচাপা পড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত লাখাে লাখাে মুসলমনাদের বাস্তুত্যাগের ফলে ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা যাবে। এবং এতদুদ্দেশ্যে বাস্তত্যাগীদের ভীড়ের মধ্যে তারা কিছু কিছু ট্রেনিং প্রাপ্ত লােকও পাঠাচ্ছে। আমাদের জানামতে কলকাতায় নিযুক্ত সাবেক পাক-ডেপুটি হাইকমিশনার মেহদী মাসুদের পরিচালনায় তারা বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা সমূহে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির অবিরাম চেষ্টা করছে। তাদের আশা, এ পরিকল্পনা মােতাবেক ভারতে একটা দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধান গেলে সেখান থেকে লাখাে লাখাে মুসলমান হিজরত করে বাংলা দেশে চলে আসবে। তারপর এদেরকে মীরপুর, মােহাম্মদপুরের ন্যায় বাংলা দেশের বিভিন্ন স্থানে চিরস্থায়ী বসতি গড়ে দেওয়া হবে। এরা বংশানুক্রমে পাঞ্জাবীদের সমর্থনে থাকবে। আর ইয়াহিয়ার সর্বশেষ ধাপ্পাবাজী ও কতিপয় বিদেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমাধানের ‘ (political settlement) ঔষধ কার্যকরী হলে এদের ভােটগুলাে পশ্চিমা পুঁজিপতিদের স্থানীয় দালালদেরই পক্ষে যাবে সবসময়। এভাবে দশ বারটা আসন হাত করতে পারলেই ইয়াহিয়ার কল্পিত পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাঙ্গালিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসকরা অনুরূপ ধরণের নানা পরিকল্পনা অতীতে করেছে। ইয়াহিয়া সাহেবও তাই চেষ্টা করে দেখছেন। কিন্তু বাস্তবের রূঢ় আঘাতে ইয়াহিয়া খান সাহেব কয়েকদিন পরেই দেখতে পাবেন তার পরিকল্পনার ‘পরি’ উড়ে গেছে, শুধু পড়ে আছে’ কল্পনা। | সে যাই হােক, ইয়াহিয়া খানরা তাদের পরিকল্পনার প্রথম অংশটুকু বর্তমানে মরিয়া হয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করে চলেছেন। ফলে লাখাে লাখাে হিন্দু-মুসলমান আজ তাদের বাপ-দাদাদের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। |
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ সরকারের আশ্বাসবাণী অত্যন্ত সময়ােচিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই বলেছেন যে হানাদারদের সমূলে উৎখাতের পর বাংলাদেশ সরকার বাস্তত্যাগীদের নিজ নিজ ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন এবং তাদের নিজ নিজ সম্পত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। বাংলাদেশ সরকার এ প্রসঙ্গে কনভেনশন লীগ ও জামাতের গুণ্ডা বদমাশদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে তাদের বিনা ক্ষতিপূরণেই কেবল সম্পত্তি ছেড়ে দিতে হবে না, উপযুক্ত শাস্তির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। | আমরা জানি বাস্তত্যাগীদের অনেকেই তাদের সম্পত্তির দলিল পত্র নিয়ে যেতে পারেন নি। কারাে দলিলপত্র পুড়ে গেছে, কারাে দলিলপত্র লুটতরাজ হয়ে গেছে আবার কারাে দলিলপত্র পথে হারিয়ে গেছে। এতদসত্ত্বেও তাদের নিজ নিজ সম্পত্তি ফিরিয়ে পেতে কোনও অসুবিধে হবে না। বাংলাদেশ সরকার তা হতে দেবে না। প্রয়ােজনবােধে প্রতিটি ক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে প্রতিটি বাস্তত্যাগীকে তার জায়গাজমি ও দোকানপাট ফিরিয়ে দেওয়া হবেই হবে। এতে যেন কারাে মনে সামান্যতম সংশয়ও না থাকে। | উপসংহারে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙ্গালির প্রতি আমাদের আবেদন, আপনারা কোনােক্রমেই ইয়াহিয়া খানদের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার মতাে আত্মঘাতী কাজই করবেন না। ওদের সাম্প্রদায়িকতার ফাদে পা দিলে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ব্যাহত হবে। তাতে আপনি আমি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। তখন বাস্তত্যাগীদের ঘরবাড়ি এবং ফেরৎ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা তাে থাকবেই না, বরং সমগ্র বাঙ্গালি জাতিকেই আরাে একশ দুর গােলামীর জিঞ্জির পরে থাকতে হবে।
জয়বাংলা (১): ১৪ ৮ ০৯ জুন ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০