বাংলার বাণী
২১শে মার্চ, ১৯৭৩, বুধবার, ৭ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
বাস্তব অর্থেই এ সমস্যার সমাধান হোক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত পরশুদিন। দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি আড়াই ঘন্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। দেশের বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে কমিটি ব্যাপক আলোচনা করেন এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধের জন্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন। আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহক কমিটি অবিলম্বে দেশ থেকে মওজুতদারী, চোরাকারবারী, মুনাফাখোরদেরকে উচ্ছেদ করার জন্যেও সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করার ব্যাপারে সরকার ইতিমধ্যে তার কর্মসূচীর কথা ঘোষণা করেছেন এবং চোরাকারবার ও মওজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। সরকার কর্তৃক গৃহীত সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে যে কোন পদক্ষেপের সঙ্গে জনগণকে সহযোগিতা প্রদান করার কথাও বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলেছিলেন। দেশবাসী অত্যন্ত সচেতন সহযোগিতা প্রদান করার জন্যে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করার জন্যে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হলে জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য। বঙ্গব্ন্ধু বার বার জনগণকে একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বস্তুতঃপক্ষে দেশের বর্তমান সমস্যাবলীর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিকতাই অন্যতম। দ্রব্যমূল্যের মধ্যে আবার খাদ্যদ্রব্যের মূল্য আরো প্রকট। সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যদ্রব্যের আগুন মূল্যে দুঃসহ জীবন যাপন করছে। তাদের জীবনের যা কিছু দুঃখ কষ্ট তা দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিকতার দ্বারাই সৃষ্ট। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আরাম আয়েসে জীবন অতিবাহিত করতে অভ্যস্ত নয়, তারা কোনমতে পেটে ভাতে জীবন যাপন করতে পারলেই খুশী। এমতাবস্থায় আমাদের সরকারকে খাদ্য সমস্যা সমাধানের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব অর্পণ করতে হবে। দেশে বর্তমানে খাদ্যাভাব রয়েছে। এর জন্যে সরকারকে বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য এনে অবস্থার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ঠিক এই নিদারুণ অবস্থায় যে সকল চোরকারবারী ও মুনাফাখোরীরা সুযোগ গ্রহণ করছে তাদের উৎখাত করার ব্যাপারে অবশ্যই সরকারকে দৃঢ় ও বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। বহুদিন ধরে এ প্রসঙ্গে সরকার পক্ষ থেকে নানা কথা ও বিবৃতি দেশবাসী শুনেছে—এবার তারা সত্যিকার অর্থে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চায়। সমাজবিরোধীদের সমূলে উৎখাত করার জন্যে সরকার যত বেশী কঠোরই হোক না কেন জনগণ তা অবশ্যই মেনে নেবে এবং সহযোগিতা প্রদান করবে। প্রকৃতপক্ষে একটি বিষয় আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ, বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যত বেশী কঠোর ব্যবস্থা নেবে জনগণ তত বেশী সরকারকে সমর্থন জানাবে। মূলতঃ দেশের সার্বিক সাধারণ মানুষ আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দরুণ। অন্যদিকে রয়েছে দেশে বেআইনী অস্ত্র। যা দিয়ে চুরি-ডাকাতি, হত্যা ও রাহাজানি চলছে। জনসাধারণ ঘুমুতে পারছেনা নির্বিঘ্নে। নবগঠিত সরকারকে দেশবাসী তাদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রদান করেছেন। এই ক্ষমতা সদ্ব্যবহারের দ্বারা সরকারকে তার যোগ্য নেতৃত্ব প্রমাণ ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার যদি দেশের খাদ্যসংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে এবং চোরাকারবার ও মওজুতদারদের হাত থেকে খাদ্যদ্রব্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সরকারের বিপুল জনসমর্থন হ্রাস পেতে বাধ্য। আর তা হলে সেটা জাতির জীবনে চরম দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসবে। খাদ্যসংকট দূর করে ও খাদ্য মওজুত এবং খাদ্য চোরকারবারের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হেনে সরকারকে তার ভিত্তিমূল সংহত করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার তার সকল শক্তি দিয়ে এই বিরাট সমস্যা সমাধানের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাবেন।
উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে
সংবাদটি এমন কিছু নতুন নয়। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়বে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হবার সংবাদ। এমনি একটি সংবাদই প্রকাশিত হয়েছে গতকাল বাংলার বাণীতে। প্রকাশ, বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে খুলনা জেলার ১৪টি জুট মিলে গত ফেব্রুয়ারী মাসের পহেলা সপ্তাহ থেকে নিয়মিতভাবে কাজ হচ্ছে না। ফলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। জুট মিল কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে যে, মিলগুলোতে দৈনিক ১৬ ঘন্টা করে সাপ্তাহিক ৯৬ ঘন্টার স্থলে মাত্র ৬০ ঘন্টা কাজ হচ্ছে। বাকী ৩৬ ঘন্টা কোন কাজই হচ্ছেনা। গোয়ালপাড়া পাওয়ার প্রজেক্ট বিদ্যুৎ সরবরাহ না করার ফলে সপ্তাহে একদিন মিলগুলোতে পুরো কাজ বন্ধ থাকছে। এছাড়াও সপ্তাহের অপর পাঁচদিনে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দৈনিক চার ঘন্টা বিদ্যু সরবরাহ না থাকার ফলে কাজ বন্ধ থাকছে।
কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী মিলগুলোতে কাজ না হওয়ার ফলে গত এক মাসে উৎপাদন ছয় হাজার টন কম হয়েছে। বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রায় এই ক্ষতির পরিমাণ হবে আনুমানিক দুই কোটি টাকা।
উৎপাদন ব্যাহত হবার কারণ নাকি জ্বালানী তেলের অভাব। জ্বালানী তেলের ব্যবস্থা করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিলো। পাওয়ার বোর্ডের সাথেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয়েছিলো। গোয়ালপাড়া পাওয়ার প্রজেক্টে জ্বালানী তেলের সরবরাহ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন চালু করার দায়িত্ব পাওয়ার বোর্ডের। এবং গোয়ালপাড়া প্রজেক্টে জ্বালানী তেলের অভাবের কথা পাওয়ার বোর্ড সম্পূর্ণ অবগত আছেন। জুট কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, জ্বালানী তেলের সরবরাহের ব্যাপারে বোর্ড পূর্বাহ্নে উদ্যোগী হলে এই সংকটের সৃষ্টি হতো না।
এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে আতঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বৈকি! যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে যেখানে যুদ্ধকালীন জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে কাজ চালিয়ে যেতে হবে সেখানে জ্বালানী তেলের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে এবং তারই ফলশ্রুতিতে এ পর্যন্ত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রায় এই ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি টাকা।
সব কিছু দেখে শুনেই বলতে হয় কি বিচিত্র এই দ্যাশ সেলুকাস! স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হলো, নির্যাতিতা হলেন দু’লক্ষেরও বেশী মা-বোন, শতকরা চল্লিশটি বাড়ী-ঘর ধ্বংস হলো—এত রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বপ্ন দেখেছে সোনার বাংলা গড়ার। অথচ বৃটিশ আর পাকিস্তানী আমলের মানসিকতায় পরিপুষ্ট আমলারা সোনার বাংলা যাতে শ্মশানে পরিণত হয় সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন বহাল তবিয়তে।
বাংলাদেশের বয়স্ক দূরে থাকুক একজন বালকও জানে যে, উৎপাদন ব্যাহত হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বুকে নেমে আসবে চরম সংকট ও সমস্যার কালোছায়া। এমতাবস্থায় সামান্য জ্বালানী তেলের অভাবে খুলনায় ১৪টি জুট মিলে উৎপাদন প্রায় মাসাধিককাল পর্যন্ত ব্যাহত রয়েছে একথা ভাবতে অবাক লাগে।
পরিশেষে আমরা একথাই বলবো যে, খুলনার ১৪টি মিলে উৎপাদন ব্যাহত হবার নেপথ্য কাহিনী জানার জন্যে দেশবাসী উৎসুক নয়। দেশবাসী উৎসুক উৎপাদন বৃদ্ধির প্রতি। আশা করি সংশ্লিষ্ট দফতর এদিকে দৃষ্টি দেবেন। অন্যথায় উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে কোন লাভ হবে না।
পাকিস্তানে মার্কিনী তেল
অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি করুণাপরবশ হয়ে ৫১ লক্ষ ডলার মূল্যের তেল সরবরাহ করবে বলে এক চুক্তি সম্পাদন করেছে। এ তেল যাচ্ছেতাই তেল নয়, একেবারে যাকে বলে বনস্পতি তেল। ভয়েস অব আমেরিকা এ জবর খবরটি দিয়েছে।
বর্তমান মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমরাস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য আবার নতুন করে বিপুল অস্ত্রসম্ভার সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত পাকিস্তানকে সর্বমোট ত্রিশ কোটি ডলার খয়রাতি সাহায্য করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কান্ড-কারখানা দেখে মনে হচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি তার দয়া দাক্ষিণ্য প্রদর্শনের আর অন্ত নেই। যে কোন উপায়েই হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্রবলে বলীয়ান রাখতে প্রয়াসী। পাকিস্তানকে সাহায্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে উপমহাদেশে নাশকতামূলক কার্যকলাপের পৃষ্ঠপোষকতা করছে এবং উপমহাদেশের শান্তি ও উন্নতি বিঘ্নিত করারই কূটকৌশল অবলম্বন করছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নানাভাবে মদদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার পাঁয়তারা কষেছিলো। এমনকি, বঙ্গোপসাগরে ‘সপ্তম নৌবহর’ পাঠিয়েও আমাদের মিত্ররাষ্ট্র ভারতকে চরম হুমকি প্রদর্শন করেছিলো।
কিন্তু নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম কখনো পরাভূত হয় না। অত্যাচারী ও শোষকের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানের নতি স্বীকার করতে হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেও যুক্তরাষ্ট্র হার মেনেছে। কিন্তু তবুও যুক্তরাষ্ট্র এই উপমহাদেশে তার প্রভুত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য বিভিন্নমুখী কারসাজি অবিরত অব্যাহত রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যতো অস্ত্র আর যতো বনস্পতি তেলই দিক না কেন, এতে করে আর যাই হোক পরাজয়ের কালিমা অপনোদন হবেনা। যুক্তরাষ্ট্রের পাঁয়তারা শুধু বাংলাদেশেই নস্যাৎ হয়নি, ভিয়েতনাম থেকেও যুদ্ধবাজ মার্কিন শাসকশ্রেণীকে লেট গোটাতে হয়েছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধে ৪৬,০০০ মার্কিন সৈন্য জীবন দিয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক লক্ষ। আর অর্থ ব্যয় হয়েছে এক লক্ষ কোটি ডলার।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও হয়েছে তথৈবচ। এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রসারণবাদী হাত কিছুতেই গোটাতে রাজী নয়। বাংলাদেশ-ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও নানারকম উস্কানিমূলক কার্যকলাপ তাই সে জিইয়ে রাখতে চায়। এজন্যেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র ও বনস্পতি তেল সাহায্য দিতে উৎসাহী হয়েছে। কিন্তু এতেও কি সাম্রাজ্যবাদ শিরোমণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভুত্ব এই উপমহাদেশে টিকে থাকবে? যে পাকিস্তান আজ আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক শক্তির জোয়ারের মুখে খন্ড খন্ড হবার উপক্রম হয়েছে, সেই পাকিস্তানের নিভু নিভু প্রদীপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দান খয়রাত করে কতো কাল আর টিকিয়ে রাখতে পারবে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক