বাংলার বাণী
২২শে মার্চ, ১৯৭৩, বৃহস্পতিবার, ৮ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
দেশ গড়ার কারিগর
মহাবিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হবার পর আহসানুল্লাহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ বছর কেটে গেছে। এ দশ বছরে সেখান থেকে পাশ করে বেরিয়ে এসেছেন দু’হাজার পাঁচশত এগারোজন প্রকৌশলী। গত পরশুর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিগত দশ বছরে পাশ করা এই সকল প্রকৌশলীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিগ্রী প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী ডিগ্রীপ্রাপ্ত এই প্রকৌশলীদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য তাদের শিক্ষাকে কাজে লাগাবার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন ও তার প্রয়োগ ব্যতিরেকে দেশের আপামর জনসাধারণের উন্নতি তথা সমাজতন্ত্র অর্জন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, প্রকৌশলীদের ক্ষমতা ও নিষ্ঠার উপর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি, জাতীয় অর্থনীতির উৎপাদন ক্ষমতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাঁরা শুধু নীল নকশাই প্রণয়ন করেন না বরং উদ্যোগ এবং আন্তরিকতার সাথে তার বাস্তবায়নেও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
প্রকৌশলীরা একটা দেশের সম্পদ। উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় এবং আন্তরিকতা ও সাধুতার সঙ্গে তারা তাদের কর্তব্যকর্ম পরিচালনা করেন তবে উন্নয়ন কোন দূরের জিনিস হয়ে থাকেনা। আমাদের দেশে কিন্তু বিপুল সংখ্যক এই কারিগরি জ্ঞানপ্রাপ্ত জনশক্তিকে আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করার নজির সৃষ্টি করতে পারিনি। কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী অনেক ব্যক্তিকে তাই দেখা যায় প্রশাসনিক বিভাগে ফাইলপত্রের নোট লিখতে। অনেকে আবার বেকার পড়ে থেকেছেন মাসের পর মাস। এ সবই একটা দিক। শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ একটি রাষ্ট্রের সমস্যা ও বাস্তব অসুবিধের দিক। ভিন্নদিকে কিন্তু আবার একশ্রেণীর প্রকৌশলীকে খুব একটা সাধুতা আর আন্তরিকতার পরিচয় দিতে দেখা যায় না। পাকিস্তানী আমলে এই অভিজ্ঞতা এমন একটা তিক্ততার পর্যায়ে গিয়ে পড়েছিলো যে, বিশেষ কোন কোন পেশার সঙ্গে প্রকৌশলীদের পেশাটাকেও দুর্নীতির কালো রঙে মাখা একটা পেশা বলে বিবেচনা করা হতো।
স্বাধীনতা উত্তরকালে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। খুব বেশীদিন হয়নি বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা যে দেশপ্রেম নিয়ে বিধ্বস্ত সম্ভুগঞ্জ সেতুটি মেরামত করেছেন এবং আরো পিছিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকালে তারা সশস্ত্র সংগ্রামে যে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাতে করে দেশবাসীর শ্রদ্ধা তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই ভাবমূর্তি তারা অক্ষুন্ন রাখতে পারবেন বলে আমরা আশা করি। আমরা আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীলাভ যেন সমাজের মূল অংশ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে না ফেলে। গণজীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ডিগ্রীপ্রাপ্ত এই প্রকৌশলীরা দেশগড়ার সংগ্রামে অনলস কর্মী হিসেবে অগ্রণী থাকবেন তাদের কাছে দেশবাসীর এই কামনা।
অভিযান শুরু হয়েছে
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে দেবার কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেই অভিযান শুরু হয়ে গেছে। গণদুশমন ও দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু দেশের ছাত্র সমাজের প্রতি আবার আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে জনগণের পরিপূর্ণ সাহায্য চেয়েছেন। গত মঙ্গলবার এস.এম. হলের ছাত্র প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা কালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকল্পে ছাত্রদের সহযোগিতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন যে, দুষ্কৃতিকারী ও সকল প্রকার সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করতে হলে ছাত্র সমাজের এগিয়ে আসতে হবে।
দুষ্কৃতিকারীদের ধরার জন্য গতকাল থেকে প্রধানমন্ত্রী তদন্ত ও পরিদর্শন টিমও তোপখানা রোডে একটি তথ্যকেন্দ্র খুলেছেন। দুষ্কৃতিকারী দমন অভিযানে জনগণ যাতে সক্রিয় সহযোগিতা করতে পারে এ জন্যেই এ তথ্য কেন্দ্রটি খোলা হয়েছে। এ তথ্যকেন্দ্র দুষ্কৃতিকারী, চোরাকারবারী, মুনাফাখোর ও লুকানো অস্ত্র সম্পর্কে খোঁজ নেবে এবং দুষ্কৃতিকারীদের হাতে-নাতে পাকড়াও করে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মালেক উকিল বিপিআই প্রতিনিধির কাছে জানিয়েছেন যে, সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী, কালোবাজারী, চোরাচালানী, মওজুতদার ও মুনাফাখোরদের উৎখাত করার জন্য গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত বারোটার পর থেকে ব্যাপক অভিযান শুরু করা হয়েছে। নাগরিক জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সেই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালনের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। দুষ্কৃতিকারীদের ধরার দায়িত্ব শুধু সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোরই নয়, এ ব্যাপারে জনসাধারণেরও পবিত্র দায়িত্ব রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু ছাত্রসমাজ ও জনগণের প্রতি বারংবার আহ্বান জানাচ্ছেন। দুষ্কৃতকারী ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্যে দেশের মানুষের জীবন আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এই দুঃসহ অবস্থা থেকে জনগণ যেমন অব্যাহতি চান, সরকারও তেমনি এদের নির্মূল করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। কাজেই জনসাধারণকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দান করা একান্ত বাঞ্ছিত। কারণ, জনসাধারণের মাঝেই দুষ্কৃতকারী ও সমাজবিরোধী গণদুশমনরা মিশে রয়েছে। এদের খুঁজে বের করার জন্য জনগণই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণের সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দুষ্কৃতকারীদের ঘাঁটি সমূলে নির্মূল করতে পারবে না। নাগরিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাই জনসাধারণকে সরকারের সঙ্গে সর্বতো রকম সাহায্যকল্পে এগিয়ে আসতে হবে।
দুষ্কৃতকারী দমন অভিযোগে সরকারের এ কঠোর ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছে। সরকারের এ দৃঢ় অভিযানকে সফল করে তোলার জন্য আমরা তাই জনসাধারণের সহযোগিতার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত অপর এক খবরে জানা গেছে যে, সরকারের বিভিন্ন দফতরের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিসহ ১৮ জন উচ্চ পদস্থ কর্মচারীকে বরখাস্ত এবং তাদের অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হচ্ছে।
গত ১৮ই মার্চ শপথ দিবসের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্টভাষায় হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘আমি বারবার ওয়ার্নিং দেবো না। ২০শে মার্চের পর লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে দেবো।’
উপরোক্ত ১৮ জন সরকারী কর্মচারী সেই লাল ঘোড়ারই প্রথম চালান বলে আমাদের ধারণা। প্রশাসন ব্যবস্থাকে দুর্নীতি মুক্ত করার জন্য আওয়ামী যুবলীগ যে শুদ্ধি অভিযানের ডাক দিয়েছে, এই বরখাস্তকারীরা সেই শুদ্ধি অভিযানের আদর্শানুযায়ীই কর্মচ্যূত হচ্ছেন বলে আমরা মনে করি।
আমরা বিশ্বাস করি, দুর্নীতি দমন ও দৃষ্কৃতকারী উৎখাত অভিযান যখন একবার শুরু হয়েছে, তখন এবার আর দুর্নীতিবাজ ও দুষ্কৃতকারীদের রক্ষা নেই। এ ব্যাপারে দেশের জনসাধারণেরও পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। বঙ্গবন্ধু জনগণকে ভালোবাসেন, জনগণও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন। তাই আমাদের বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর এ অভিযানকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য দেশের আপামর জনসাধারণ দ্বিধাহনি চিত্তে দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিতে অবশ্যই সহযোগিতা করবেন। নইলে দেশে শান্তি ও জীবনের নিরাপত্তা বিধানের পথ প্রশস্ত হবে না।
আশার ছলনে ভুলি…
ঘটনার নায়ক এক জন শ্রমিক। গ্রীসের রোভেশ দ্বীপের অধিবাসী। নায়িকা হলেন সুইডেনের একজন ধনী মহিলা। মহিলাটি হলেন সুইডেনের জনৈক শিল্পপতির উত্তরাধিকারিণী। নায়িকার বয়স প্রায় চল্লিশের কোঠায়।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, সুইডেনের ধনী মহিলাটি গ্রীসের একজন শ্রমিকের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়েছিলেন। তিন সন্তানের জনক এই শ্রমিকটিকে মহিলাটি সুইডেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। নিয়ে যেতে পারেননি। অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে শ্রমিকটির স্ত্রীর কাছে প্রার্থনা জানালেন। বলেন, “আমি তোমার স্বামীকে কিনতে চাই। তার জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ দেবো। তোমার সন্তানদের যত্ন নেব।” কিন্তু শ্রমিকটির স্ত্রী সোজা জবাব দিলেন- ‘না।’
সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঘটনাটি খুবই চমকপ্রদ। ঘটনার নায়িকায় রয়েছে অজস্র অর্থ। যে অর্থ দিয়ে তিনি আরাম-আয়াসে দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু বিত্ত থাকলে কি হবে, চিত্তের সুখ তো আর বিত্ত দিয়ে আসেনা। বিত্তের সঙ্গে চিত্তের কোন সম্পর্ক নেই। ঘটনার নায়িকা বাস্তবতায় আঘাতে বুঝতে পারলেন বিত্ত আর চিন্ত সম্পূর্ণ দুটো আলাদা জিনিস। এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে অহিনকুল সম্পর্ক।
অন্ধকার কাটিয়ে পথিবীতে প্রথম আলোর পরশ যেদিন মানুষ পায় সেদিন তার সঙ্গে থাকে চিত্ত বিত্ত থাকেনা। বিত্তের সন্ধান পায় বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে। পারিপার্শ্বিক তার প্রভাবে মানুষ তখন উপলব্ধি করে জীবনে বেচে থাকার জন্যে চাই বিত্ত। তাই সে চিত্তকে হারিয়ে চিত্তের মায়া মরীচিকার পেছনে ছোটে সামান্য আপেল তার কাছে তখন আপেল থাকে না। তখন তার মনে হয় আপেলটা যদি সোনার হোত। তারপর সত্যি সত্যি যেদিন আপেল সোনার আপেলে পরিণত হয় সেদিন তার জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। সেদিন সে হাঁপিয়ে ওঠে। বিত্তের সন্ধানে ছুটতে ছুটতে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মানুষ আবার ফিরে যেতে চায় আগের জীবনে। যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেখানে। কিন্তু আর সময় থাকে না। মানব জীবনের এই হলো চরম ট্রাজেডী। ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’-এ সত্যকে মানুষ বুঝতে পারে চরম মূল্যের বিনিময়ে। ঘটনার নায়িকা সুইডেনের মাহিলাটিও বাস্তবতার আঘাতেই বুঝতে পেরেছেন বিত্ত থাকলেই চিত্ত পাওয়া যায় না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক