বাংলার বাণী
২৮শে মার্চ, ১৯৭৩, বুধবার, ১৪ই চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
জাতিকে দেশগড়ায় আত্মনিয়োগ করতে হবে
সারা দেশব্যাপী স্বাধীনতার দ্বিতীয় বার্ষিকী উদযাপিত হয়ে গেলো গত রোববার। এই মহান দিবস উপলক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী দেশবাসীর উদ্দেশে বাণী প্রেরণ করেছিলেন। জাতির জনক তাঁর বাণীতে দেশবাসীকে সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে শপথ নেবার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বিধ্বস্ত বাংলার পুনর্গঠন ও ক্ষেতে-খামারে-কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা বলেছেন। তিনি মুক্তি সংগ্রামের ন্যায় ঐক্য, সংহতি ও উদ্দীপনা নিয়ে প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার জন্যে জনসাধারণকে অনুরোধ করেছেন। অন্ন-বস্ত্রের সমস্যার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এই সকল মৌলিক সমস্যার সমাধান আমাদের করতেই হবে। পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কেও তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী, বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দুঃখী মানুষের স্বপক্ষে আমরা জোট বহির্ভূত নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী।’ রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর বাণীতেও দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্যে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদেরকে ন্যায়নীতি, ঐক্য শৃঙ্খলা আর মরণপণ ত্যাগের আদর্শ নিয়ে দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ তিনি শিল্প-কারখানায়-ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার প্রতি জোর আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের বর্তমান বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেছেন—‘জাতিকে সকল শক্তি দিয়ে এ সকল সমস্যা সমাধানের জন্যে নিরলস পরিশ্রম করে যেতে হবে।’
জাতির জনক ও রাষ্ট্রপতি উভয়ের স্বাধীনতা দিবসের বাণীতেই একটি বিষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে তা হলো জাতিকে সকল শক্তি নিয়োগ করে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত জাতিকে যে করেই হোক বাঁচবার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বস্তুতঃ দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বার্ষিকীতে আমাদের একটি কথা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, তা হলো এই নবপ্রতিষ্ঠিত সম্ভাবনাময় দেশকে পুনর্গঠিত করা। দেশের নানাবিধ সমস্যাবলীর মধ্যে থেকেও জাতিকে কাজ করতে হবে অধিক ফলনের জন্যে, অধিক উৎপাদনের জন্যে। দেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মাহুতির কারণে। তাঁদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে ভবিষ্যত নাগরিকদেরকে সোনার মানুষরূপে গড়ার প্রত্যয়ে আজ প্রতিটি মানুষকে কাজ করে যেতে হবে। স্বাধীনতা গুটিকয় মানুষের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে আসেনি। সার্বিক বাঙালী জাতিকে নতুন প্রত্যয়ে গড়ে তুলবার জন্যে এসেছে। সবাইকে সমমর্যাদায় সমাসীন করতে হবে। দেশ স্বাধীন হবার পর দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের ভিতর এবং রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সর্বত্র কেমন যেন একটা গা ভাসিয়ে দেবার মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একশ্রেণীর মানুষ যেন স্বার্থোদ্ধারের ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠেছে। এই সকল অশুভ লক্ষণ বন্ধ হওয়া আশু প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষকে দেশের পুনর্গঠনের কাজে এক একজন সৈনিক ভেবে অংশ গ্রহণ করতে হবে। জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্যে প্রত্যেকটি মানুষকে যেমন কাজ করতে হবে তেমনি প্রত্যেকের মনে দেশাত্মবোধের স্ফূরণ ঘটাতে হবে। যদি এই নব্প্রতিষ্ঠিত দেশের উন্নয়নের কাজে সবাই অনাবিল উৎসাহ আর প্রেরণা নিয়ে না এগিয়ে আসে তাহলে সোনার বাংলা গড়ার মহান সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমরা আশা করি, সেই আত্মত্যাগী মানুষের অভাব হবেনা দেশে।
যুগোশ্লাভ-বাংলা বন্ধুত্বের নতুন দিগন্ত
যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রী মিঃ জেমাল বিয়েদিচ বলেছেন বাংলাদেশে তাঁর সফর ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ফলে বাংলাদেশ ও যুগোশ্লাভিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রেতো বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার বিস্তৃত দিগন্ত উন্মোচিত হবেই, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সহযোগিতার নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। মিঃ বিয়েদিচের সম্মানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ভোজসভায় যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন যে, আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ ভূমিকা উপমহাদেশের পরিস্থিতি সুসংহত ও বিশ্বশান্তি সংরক্ষণে সাহায্য করবে।
ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে এবং বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিলেই উপমহাদেশের অধিকাংশ সমস্যার নিষ্পত্তি হতো, উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতো, বঙ্গবন্ধু আরো বলেছেন, মহান নেতা মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে যুগোশ্লাভিয়া স্বাধীনতা পেয়েছে। বাংলাদেশও রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অতএব, এই দুই দেশের বন্ধুত্ব স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। ভোজসভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটকে পড়া তিন লাখ নিরপরাধ বাঙালীকে স্বদেশে ফিরিয়ে দিয়ে এই মানবিক সমস্যার সমাধানকল্পে বিশ্ববিবেকের সাহায্য কামনা করেন। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞাসিত হয়ে যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, ‘এ বিষয়টিতে যদি আমার কিছু করণীয় থাকে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই তা করবো।’ যুগোশ্লাভিয়া বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনী যেদিন থেকে নিরীহ বাঙালীদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করেছিলো, সেদিন থেকেই সমাজতান্ত্রিক যুগোশ্লাভিয়া নির্যাতিত বাঙালীদের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণসমর্থন দিয়ে বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে উৎসাহিত করেছিলো। বাংলাদেশ হানাদার কবলমুক্ত হওয়ার পরও যুগোশ্লাভিয়ার সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রশ্নে বাংলাদেশ ও যুগোশ্লাভিয়া এক ও অভিন্ন নীতি পোষণ করে। শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান বিশ্বশান্তি সংরক্ষণ, দল নিরপেক্ষতা ও জোট বহির্ভূত স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির প্রতি এ দু’টি দেশ গভীরভাবে আস্থাশীল। ফলে এ দু’টি সমাজতান্ত্রিক দেশের বন্ধুত্বের ব্যাপারে কোনই প্রতিবন্ধকতা নেই।
বাংলাদেশ সরফরকালে যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই স্বাভাবিক বন্ধুত্বের কথা উচ্চারণ করেছেন এবং বাংলাদেশকে সর্বতোরকম সাহায্য দানের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা জানি বিপদেই প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে যুগোশ্লাভিয়া যে পরম বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়েছে তাতে যুগোশ্লাভিয়ার বন্ধুত্বের প্রতি আমাদের কোন রকম সংশয় নেই। বরং আমরা বিশ্বাস করি, যুগোশ্লাভিয়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো তাতে এই দুই দেশের মৈত্রীবন্ধন আরো সুদৃঢ়তো হলোই উপরন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তা আরো তাৎপর্যমন্ডিত হলো।
বিদ্যার জাহাজ!
সংবাদে প্রকাশ, ঢাকা পৌরসভার শিক্ষা বিভাগের চব্বিশে মার্চ তারিখের এক আদেশ অনুযায়ী ‘এই মর্মে জানানো হয় যে, ‘আগামী পঁচিশে মার্চ তারিখে পৌর প্রাথমিক বালক বিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্র ও শিক্ষকদের ‘বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্টের’ আগমন উপলক্ষে বেলা ১২টার সময় সমস্ত ছাত্র ও শিক্ষকদের রবিবার ছুটির দিন থাকা সত্ত্বেও নিজ নিজ স্কুলে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে।’
ঢাকা পৌরসভার শিক্ষা বিভাগ যে আদেশটি জারী করেছেন তাতে কিন্তু আর যাই হোক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যে এক একজন বিদ্যার জাহাজ এতে কোন সন্দেহ নেই। সেই বিদ্যার জোরে লিখেছেন ‘বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট’। অথচ পঁচিশে মার্চ তারিখে বাংলাদেশ সফরে বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসেননি, এসেছেন যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিঃ জেমাল বিয়েদিচ। ব্যাপারটা আপাতঃদৃষ্টিতে এমন কিছু নয় বলে মনে হতে পারে। এ আর এমন কি! একটি লিখিত বিজ্ঞপ্তি মাত্র। ছিঁড়ে ফেললেই লেঠা চুকে গেলো। এমনতো কতই যায়। কিন্তু ব্যাপারটিকে যদি আমরা একটু গভীরে তলিয়ে দেখি তাহলে দেখা যাবে যে, এমনি ভুলের পরিণতিতে জাতীয় জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। প্রসঙ্গতঃ স্বর্গত আশুতোষ মুখার্জির সঙ্গে জনৈক শিক্ষিত যুবকের সাক্ষাৎকার কাহিনীর উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। যে যুবকটি উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও ‘আইল্যান্ড’কে ‘আইসল্যান্ড’ বলে বারংবার ভুল করেছিলো।
পৌরসভার শিক্ষা বিভাগের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি বালকরাও কিন্তু ঐ একই ভুলের শিকারে পরিণত হয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভুলে ভুলে সয়লাব করে যাবে। ফলে স্বাধীন দেশের আগামী দিনের নাগরিকদের যে চেহারাটি দাঁড়াবে তা কল্পনা করলেও আঁৎকে উঠতে হয়। ভুল যে শুধু পৌরসভার শিক্ষা বিভাগে হয়েছে এমন নয়—এমনি ভুল সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে। আর সে ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে আজকের কোমলমতি বালক-বালিকাদের।
যারা দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন—যাদের মুখের একটি কথার মূল্য অনেক তাদের এদিকে সচেতন হতে হবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই। আর তা যদি না হয় তাহলে আমাদের কোমলমতি বালক-বালিকারা এক একটি বিদ্যার জাহাজে (!) পরিণত হয়ে দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে তুলবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক