বাংলার বাণী
ঢাকা: রোববার ২৮শে মাঘ, ১৩৭৯ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩
সন্তোষজনক সমাধানের পথ
জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ ওয়াল্কহেইম বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার রাজনৈতিক সমস্যা, পারস্পারিক স্বীকৃতি, মানবিক প্রশ্ন, বেসামরিক লোক বিনিময় ও যুদ্ধবন্দী ইত্যাদি সমস্যার একটা সন্তোষজনক সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দু’ঘণ্টা ব্যাপী আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সমস্যা অনুধাবনের পক্ষে এই আলোচনার সহায়ক হয়েছে বলে তিনি জানান।
পাকিস্তানি আটক বাঙ্গালীদের ফেরত আনার ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব বলেন পাকিস্তান সরকার ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে। এ সমস্যার সমাধানের পক্ষে তারা মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর ধারণা, যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহী। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অধিক আস্থার ভাব সৃষ্টি করা এবং এটা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে এ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসুক এটা সকলেই কামনা করেন। ডঃ ওয়াল্কহেইমই স্থায়ী শান্তি সম্পর্কে আশাবাদী। তিনি ‘অধিক আস্থার ভাব সৃষ্ট করার’ উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো, পারস্পরিক আস্থা অর্জন একতরফাভাবে অর্জিত হতে পারে না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ঘোষণা করেছে যে কারও সঙ্গে শত্রুতা নয় সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সহৎ অবস্থানের নীতি কে অবলম্বন করে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। জোট-নিরপেক্ষতাই হবে বৈদেশিক নীতির বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে স্বদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা সুখে থাক। নজিরবিহীন নির্যাতন ভোগ করার পর সত্যিকারের মানবতাবাদী ও উদারচেতা ব্যক্তির পক্ষে এ ধরনের উক্তি করা সম্ভব। সেই মানবিক ও উদারতার বেদীমূলে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু পরেও একই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী সেপথে যাননি। তিনি গোলকধাঁধার পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি একদিকে বলেছেন, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয় তাহলে বিশ্বের দরবারে এক ঘরে হতে হবে। অন্যদিকে আবার চীনের সঙ্গে আঁতাত করে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য ভুক্তির বিষয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। জেনারেল টিক্কা খানের ভাষায় ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারনা মেতে উঠেছেন। বিশ্বের নিরানব্বুইটিরও বেশি দেশ বাংলাদেশকে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বীকৃতি দিলেও চীন ও পাকিস্থানে এখনো বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়নি। শুধু তাই নয় সত্য, ন্যায় ও মানবতা কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে পাকিস্তানের এখনো পর্যন্ত চার লক্ষ বাঙালি কে আটকে রাখা হয়েছে।
ভুট্টো সাহেব বাহাত্তর সালের মধ্যভাগে ভারতের সঙ্গে একটা হৃদাতাপূর্ণ সমঝোতা সৃষ্টির জন্য সিমলা চুক্তিতে স্বাক্ষর করলো পরবর্তী সময়ে ‘আন্তর্জাতিক প্রভুদের’ অদৃশ্য ইঙ্গিতে চুক্তি কে বাস্তবায়িত করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী সম্প্রতি পাকিস্তানের মনোভাব ও মানসিকতা বদলায়নি বলে জানিয়েছেন। অথচ এ কথা কে না জানে যে, এ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ও ভারত সকল বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সকল বিরোধের মীমাংসা সম্ভব বলে উভয় দেশের সরকার বিশ্বাস করেন। অথচ পাকিস্তান সরকার বক্তৃতা-বিবৃতিতে সে কথা বললেও বাস্তবে ঠিক তার বিপরীত কাজটুকুই করে চলেছেন। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জনাব ভুট্টো সাহেবের পক্ষে নিজস্ব মত ও পথ অনুসরণ করে ‘সর্বজনবিদিত বিরোধ’ মিটিয়ে ফেলার জন্য এগিয়ে আসা মুশকিল।
আজকের দিনে পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্তা হলেন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মিঃ চৌ-এন-লাই ও মিঃ নিক্সনই হলেন জনাব ভুট্টো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপদেষ্টা। জনাব ভুট্টো পক্ষে তখনই এগিয়ে আসা সম্ভব যখন তিনি ‘প্রভুদের’ অদৃশ্য ইঙ্গিত পাবেন। ‘সর্বজনবিদিত বিরোধ’ মিটিয়ে ফেলার পক্ষে এই হল প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের মহাসচিব এর সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত আছেন।
সকল বিরোধের সন্তোষজনক মীমাংসা হোক এটা এ উপমহাদেশে শান্তিকামী জনতা মনেপ্রাণে কামনা করে। আমরাও চাই পাকিস্তানের জনসাধারণ সুখে শান্তিতে থাকুক। এ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনায়নের দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশ, ভারতের নয়-পাকিস্তানেরও।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব ভুট্টো যদি সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সত্যিসত্যি আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন তাহলে তাঁকে এগিয়ে আসতে হবে সম্পূর্ণ ‘খোলা মন’ নিয়ে এবং ‘প্রভুদের’ নৈপথ্য চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে। যদি তা করতে পারেন তাহলে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা পথে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক