ইয়াহিয়া খানরা বলছে, বাংলাদেশে সব শান্ত | জয়বাংলা | ২৬ মে ১৯৭১
পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে কান্নার রােল বাঙলা দেশের আসল ঘটনাবলীর কিছুই এতদিন পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে জানতে দেওয়া হয়নি। গোয়ে বঙ্গীয় প্রচারনার দ্বারা তাদের বােঝানাে হয়েছিল, কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। বাঙলাদেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সামরিক বাহিনী কেবল তাদেরই সায়েস্তা করছে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ ততই বুঝতে পারছে বাঙলাদেশে যা ঘটছে তাকে কেবল দুস্কিতিকারীদের কাজ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ হচ্ছে বাঙালীদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঞ্চিত বাঙলাদেশের সমস্ত মানুষই রয়েছে এই সংগ্রামের পশ্চাতে। সমস্ত বাঙলা দেশকে ঐকবদ্ধ করে তুলেছে এই সংগ্রাম। এই যুদ্ধ তার লক্ষ্যে না পেীছে থামবে না। সামরিক বাহিনী বিরাট ভুল করেছে, আপােষ রফা ও আলােচনার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে, নির্বিকার গণহত্যা চালিয়ে।
বাঙলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তানের অর্থ নীতিতে দেখা দিচ্ছে মারাত্মক সঙ্কট। পশ্চিম পাকিস্তানের কল কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের তিন ভাগের দুইভাগ বিক্রি হত বাঙলাদেশে। এই মাল এখন বাঙলাদেশে রপ্তানী হতে পারছে না। মাল জমে যাচ্ছে গুদামে। ফলে অনেক কলকারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে বেকার সমস্যা। শ্রমিক অসন্তোষ। অন্যদিকে তাদের কলকারখানার জন্য প্রয়ােজনীয় বহু জিনিষ আনতে হত বিদেশ থেকে। এই সব জিনিষ পত্র আমদানী করবার জন্য প্রয়ােজন পড়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার। কিন্তু পাকিস্তানের সঞ্চিত বিদেশী মুদ্রার পরিমান প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। যা আছে তাও লাগবে গােলা বারুদ কিনতে। বাঙলাদেশ স্বাধীনতা ঘােষণা করবার আগে, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত উপার্জিত হত বাঙলা দেশের বিভিন্ন কৃষি জাত দ্রব্যের মাধ্যমে। বাঙলাদেশ প্রতিদিন উপার্জন করত। প্রায় পঞ্চান্ন লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এখন পণ্য রপ্তানী বন্ধ। তাই পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি রােধের কোন সম্ভাবনাই নেই। | বিশ্বের বাজারে পাকিস্তানী টাকা কেউ আর নিতেই চাচ্ছে না। যুদ্ধের আগে পাকিস্তানী সাড়ে ৪ টাকায় এক মার্কিন ডলার পাওয়া যেত। এটা ছিল বিনিময়ের সরকারী হার। কিন্তু গত দেড় মাসে বিদেশে পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্য এত হ্রাস পেয়েছে যে, বর্তমানে ১০ টাকার বিনিময়েও কেউ এক ডলার দিতে চাচ্ছেন
। কোন কোন ক্ষেত্রে এক ডলার পেতে হলে ১৫১৬ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। বর্তমান যুদ্ধ আর বেশী দিন। চললে বিশ্বের বাজারে ইয়াহিয়া সরকারের টাকার কানাকড়ি মূল্যও থাকবে না। প্রকাশ, ইয়াহিয়ার অর্থ। নৈতিক উপদেষ্টা এম, এম, আহমদ বিভিন্ন দেশের কাছে ঋণ চাইতে গেলে তারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন এ ঋণের জন্য দায়ী থাকবে কে? | পূর্ব-বাংলা স্বাধীন হয়ে গেলে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে একা সমস্ত ঋণ পরিশােধ করা সম্ভব হবে কি না? তিনি এ সব প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি।
পশ্চিম পাকিস্তানের এ সব দুরারােগ্য ব্যাধির পাশাপাশি দেখা দিয়েছে আর একটি উপসর্গ। ২৬শে মার্চ থেকেই ইয়াহিয়া-টিককা তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বুঝাতে চেয়েছে যে ‘বাংলাদেশের সে সব ঠিক হ্যায়।’ তারা এখন জানতে পেরেছে বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের হাতে কমসে কম ১০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে এবং আরও ২০ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। গত দেড় মাসে অনেক মা সেনাবাহিনীতে নিয়ােজিত তাদের সন্তানদের কাছ থেকে চিঠি পাননি, টাকা পাননি, অনেক স্ত্রী স্বামীর পত্র পান।ন, অনেক ভাই ভাইয়ের কোন খোঁজ পাননি। এ সব কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে। বিশেষ করে পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে কান্নার রােল। তাদের বােঝা হয়ে গেছে আসল ব্যাপার। জঙ্গী চক্র শত চেষ্টা করেও আজ ‘] চাপা দিতে পারছে না। কেননা সত্য আপন গুণে প্রকাশ হয়ে পড়বেই। এ প্রসঙ্গে তাদের মনে পড়ছে ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের কথা। সে সময় আইয়ুব সরকারের গােয়েবলস করিত্বৰ্মা আলতাফ গওহর সাহেব বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে বুঝাতে চেয়েছিলেন যে যুদ্ধে বীর পাকিস্তান সেনা বাহিনী’ শুধু এগিয়েই চলেছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা
ভারতের কয়েকশত মাইলের ভেতরেও ঢুকে গিয়েছে। সারা কাশীর পাকিস্তানের দখলে এসে গেছে। কিন্তু হায়। ১৯৬৬ সালের ৪ঠা জানুয়ারী আইয়ুব খান যখন নাকে খত দিয়ে তাসখন্দ চুক্তিতে সই করলেন তখন দেখা গেল কাশ্মীর পূর্বে যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বরং ভারতীয় সেনা বাহিনী দখল করে আছে খােদ পাঞ্জাবেরই কয়েকশত বর্গ মাইল এলাকা। মাঝখানে পাকিস্তানের বীর সেনাবাহিনীর আট সহস্রাধিক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। তা ছাড়া যুদ্ধে নিহত হয়েছে আরও প্রায় ১০ হাজার বীর পাকিস্তানী সৈন্য’। শুরু হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে ঘরে কান্নার রােল। পত্র পত্রিকা ও জননেতারা। প্রশ্ন তুললেন ঃ আইয়ুব খান যদি এই অসম্মান জনক যুদ্ধ বিরতিতে রাজী হবে, কাশ্মীর যদি ভারতেই থেকে যাবে তবে কি প্রয়ােজন ছিল এত লােকক্ষয়ের? ভুট্টো সাহেব কয়েকদিন লাফালাফি করলেও ভুলে গেলেন তার হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করার কথা।
তাই তারা আজ ভাবছে বাঙালীরা যে ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে তাতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সেখান থেকে হাত গুটোতেই হবে। তবে কেন এত লােকক্ষয়?ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক গগনে দেখা দিয়েছে নানারূপ অশুভ লক্ষণ। অতি চালাক ভুট্টো। ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার পর তাকে বসানাে হবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের গদিতে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার মােহমুক্তি ঘটতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের রক্তগঙ্গা প্রবাহের তথা পাকিস্তানের অপমৃত্যুর জন্য কেউ কেউ যত দোষ নন্দ ঘােষ অর্থাৎ সমস্ত দায়িত্ব একতরফা ভাবে ইয়াহিয়া খানের ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করছে। যে আব্দুল হামিদ খান এ নরহত্যার পরিকল্পনা এটেছিলেন তিনিও নাকি আজ ইয়াহিয়ার উপর টেক্কা মারর চেষ্টা করছেন। তার বক্তব্য আইয়ুবের পর ইয়াহিয়া যদি। প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তবে ইয়াহিয়ার পর তিনি সেই গদিতে বসতে পারেন না কেন? ওদিকে অপর কিছু সংখ্যক জেনারেল (পাকিস্তানে মােট জেনারেলের সংখ্যা ৬২) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে। প্রেসিডেন্টের গদিতে বসানাের চেষ্টা করছেন। প্রকাশ, ভুট্টোকে চির তরে খতম করাই নাকি এদের উদ্দেশ্য। আইয়ুব খানকে পুনরায় গদিশনিন করার চক্রান্তটা ওয়াশিংটনে কিনা তা জানা যায় নি। তবে তিনি এখন মার্কিন রাজধানীতে আছেন। | অন্যদিকে বর্তমান সংকট মুহূর্তে পাকিস্তানকে সাহায্যকারী একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ সাহায্যের সর্ত হিসাবে তাদের পছন্দ সই কোন জেনারেলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী করছে। পরস্পর বিরােধী দু’টি রাষ্ট্রের স্বার্থের টানাপােড়েন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কোন লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায় কিনা তা দেখার জন্য অনেকে অপেক্ষা করছেন। ভূট্টো সাহেব এ দু’দলের ফ্রীস্টাইলে’ কোন পক্ষ নেবেন তাও দেখবার বিষয়। তবে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে তার দলে মারামারি শুরু হয়ে গেছে। পাঞ্জাবী চক্রের সমর্থক মামুদ আলী কাসুরীসহ বেশ কিছু সংখ্যক পি-পি-পি নেতা ভূট্টোর রাজনৈতিক বেঈমানীর প্রতিবাদের ইতিমধ্যেই দল ত্যাগ করেন।
এসব কারণে সিন্ধু সীমন্ত প্রদেশে, এমন কি প্রতিক্রিয়া ও চক্রান্তের দুর্গ পাঞ্জাবেও সৃষ্টি হয়েছে তীব্র গণঅসন্তোষ। আর তা দমন করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে এগিয়ে আসতে হয়েছে সামরিক আইনের অস্ত্র নিয়ে । ইতিমধ্যেই সিন্ধুর বিখ্যাত বয়ােবৃদ্ধ নেতা জনাব জি, এম, সৈয়দ এবং পাঞ্জাবের মালিক গােলাম জিলানীসহ কয়েকশত রাজনৈতিক নেতাও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চারটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকরকে সম্মুখীন করা হয়েছে সামরিক আইনের বিচারে।
জয়বাংলা (১) #১: ৩ ২৬ মে ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধ liberation war of bangladesh