শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০১। সৈন্য প্রত্যাহার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না
|
ওয়াশিংটন পোস্ট | ২১ অক্টোবর ১৯৭১ |
ঐন্দ্রিলা অনু
<১৪, ১০১, ২৩৯>
ওয়াশিংটন পোস্ট, ২১ অক্টোবর ১৯৭১
সৈন্য প্রত্যাহার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না
নয়াদিল্লী, ২০ অক্টোবর- একজন অফিশিয়াল মুখপাত্র আজ জানিয়েছে যে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে যে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলেই পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান হবে না।
তিনি বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়নি, তবে সীমান্ত থেকে দুই দেশেরই ৬ মাইল পেছনে আসার ধারনাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে ।
তিনি বলেন, এই ধারনাগুলো গ্রহন করা বা প্রত্যাখ্যান করা মূল কথা নয় বরং এটা বুঝতে পারা যে বর্তমান সমস্যার মুলে পূর্ব পাকিস্তান ইস্যু । তিনি আরও বলেন, এই সমস্যার সমাধান করতে হবে ইসলামাবাদের মিলিটারি শাসক, পাকিস্তানের রাজধানী এবং পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা যাদের বেশিরভাগই নিষিদ্ধ আওয়ামীলীগের সদস্য যার নেতা ছিল বন্দী শেখ মুজিবর রহমান।
মুখপাত্র এক প্রেস ব্রিফিং এ বলেন, এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউই ভালো কোন সেবা বা মধ্যস্ততার প্রস্তাব দেয়নি ।
মুখপাত্র বলেন, ভারত আশা করেছিল যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ প্রয়োগ করবে যেন ভারতে অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে পারে ।
তিনি আরও বলেন, যদি তা করা না হয়, তাহলে ভারত তাদেরকে ফেরত পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে । কিন্তু তিনি এটাও নিশ্চিত করেন যে, ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার মতো কিছুই করবে না ।
আজ দিনের শুরুতে প্রেসিডেন্ট টিটোর ৪ দিনের সফর শেষে একটি যৌথ ইশতেহার জারি করা হয়েছে । ভারত এবং যুগোস্লাভিয়া সতর্ক করেছে যে , যদি খুব দ্রুত একটা সমাধান বের করা না যায়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা আরও অবনতির দিকে যাবে ।
ইশতেহারে বলা হয়, তারা সম্মতি জ্ঞাপন করেছে যে এই সমস্যাটা যেটা নিজে অস্থায়িত্ব এবং দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে সেটার জন্য রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন যে, এই বন্দোবস্তের জন্য বন্দী শেখ মুজিবর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি প্রয়োজন ।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০২। দক্ষিন এশিয়ার বিপর্যয় এড়ানোর পন্থা | নিউজ উইক | ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১ |
Aabir M. Ahmed
<১৪, ১০২, ২৪০–২৪২>
নিউজ উইক, ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১
দক্ষিন এশিয়ার বিপর্যয় এড়ানোর পন্থা
– উইলিয়াম পি. বান্ডি
পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সন্ত্রাসী আধিপত্যের ভয়াবহতা এবং এর ফলে ভারতে সৃষ্ট শরণার্থী অবস্থা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রচন্ড রকম ছিলো। সম্ভবত আমি ছাড়া অন্যদের জন্য, এটা সেখানকার ভবিষ্যতের কথা সত্যিকার অর্থে গভীরভাবে ভাবাচ্ছে। তবে এমন চিন্তাভাবনা গুরুত্বপূর্ণ। আগামী তিন মাস খুবই সংকটাপূর্ণ হবেঃ সত্য বলতে, তাদের হয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই আতংক নিয়ন্ত্রনে আসবে কি না এবং এর চেয়েও বড় আতংক ভারত-পাকিস্তান সম্মুখযুদ্ধ ঠেকানো যাবে কি না।
কিন্তু, কি অর্থে সংকটপূর্ণ? এবং আমরা কি করছি ? আমরা অর্থাৎ বিশ্বের জাতিগুলো, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ?
ন্যূনতম লক্ষ্য এখন সুস্পষ্ট। শরণার্থী পরিস্থিতির ইতি টানবে এবং যথাসময়ে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাবে- এমন একটি রাজনৈতিক অবস্থাই শুধুমাত্র পারে পূর্ব বাংলার সমস্ত জনগনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে। বাস্তবিক বা নীতিগত যেভাবেই বলা হোক না কেন, এটা বলতে বোঝায় অন্ততপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফিরিয়ে আনা এবং পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা, মিলিটারি কিংবা সাধারন নাগরিক এর ধারনার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে আরও বেশী মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন এর অনুমোদন দেওয়া । আপাতদৃষ্টিতে এটা যথাসময়ে একটি স্বাধীন বাংলাদেশকে বোঝায়, কিন্তু এখন এক বারেই এর চেষ্টা করা হলে তা নতুন আরেকটি রক্তগঙ্গার সূচনা করবে, এখন তাদের ভাবাবেগের যেমন উত্তপ্ত অবস্থা এমন সময় কেউ চূড়ান্ত পরিণতির জন্য আন্দোলন শুরু করতে পারে না। সময় এবং পাকিস্তান সরকার, ভারত ও পূর্ব বাংলার আওয়ামীলীগ নেতা- এই তিন গোষ্ঠীর ওপর চাপ কমাটাই এখন মূখ্য বিষয়।
ক্রমবর্ধমান চাপঃ
যাই হোক, সঙ্কটের বিষয় এটাই যে তিনটি মূখ্য গোষ্ঠীর জন্যই এখন বিরুদ্ধ সময় চলমান এবং কমে আসার পরিবর্তে চাপ বেড়েই চলেছে। মুজিবুর রহমানের ট্রায়াল চলার সাথে সাথে, অন্তত আরও তিনটি বিষয় অগ্নিতপ্ত হয়ে আছে এবং চলছে, সংকটপূর্ণ তিন মাসে এর যে কোনোটিই কোনোটিরই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। একটি হলো পূর্ব বাংলায় খাদ্য বন্টন। দ্বিতীয়ত, ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, মুক্তিবাহিনী বা স্বাধীনতা যোদ্ধা, ভারত-সমর্থিত গেরিলা যুদ্ধের কার্যক্রম ।
তৃতীয়টি হচ্ছে, ৮ থেকে ১২ মাস ধরে চলমান পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা, যা বৈদেশিক সাহায্যের ওপর প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল। এসব কিছু ছাড়াও, শেষ পর্যন্ত যা সবচেয়ে ভীতিজনক হুমকী হয়ে দাঁড়াবে তা হলো ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর এই সংকটের প্রভাব। শেষ মার্চ মাসে মিসেস গান্ধীর নির্বাচন বিজয় ছিলো সম্মস্যা সমাধানে ভারতে জন্য শেষ সুযোগ। এবং অবিভক্ত ভারতের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে ভারতের এই অগ্রগতি পুনরারম্ভ করা অপরিহার্য।
বাংলার এমন অবস্থায় সৃষ্ট চারটি সমস্যাকে আমরা ক্রমান্বয়ে সাজাই। অপর্যাপ্ত খাদ্য যোগান- যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া পরিমানের প্রায় অর্ধেক খাদ্য এখন পূর্ব বাংলায় পৌছাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে বন্টন/বিতরণ, এবং জনগনকে খাদ্য সরবরাহের চেয়ে রাজনীতি গুরুত্ব পাবে কি না, হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি দ্বারা যারা বিরূপ আচরন করছে অথবা কিংবা গেরিলাদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। দেরিতে হলেও সম্ভবত, বহির্বিশ্বের দেশগুলো ঠিক কাজটিই করেছে এবং কেউই এই প্রার্থনা করতে পারছে না যে ডিসেম্বরের শেষে নতুন ফসল আসবার পূর্ব পর্যন্ত দূর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব হবে।
গেরিলা হুমকীঃ
গেরিলা যুদ্ধের জন্যও একই কথা সত্য। কিন্তু গেরিলাদের জন্য ভারতের সহায়তা এবং এর ফলবশত জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের এর শরণার্থী শিবিরের ব্যাপারে জোর অস্বীকৃতি কূটনীতির বোধগম্য অংশ যারা মাধ্যমে মিসেস গান্ধী এখনো পর্যন্ত সাহসিকতার সাথে সম্মুখ যুদ্ধের চাপ প্রতিহত করেছেন।
সমস্যায় থেকেও আনন্দ করা এবং তা কাজে লাগানো- এর মতো এখানে অপরের দূর্দশায় নিজের আনন্দ খোঁজার মতোই একটি বিষয় আছে, যে যখন ভারত ১৯৬২ এবং ১৯৬৩ সালে চীন দ্বারা অবরূদ্ধ ছিলো, তখন ভারতীয়রা নিজেরাও পাকিস্তানের উপর ক্ষুদ্ধ ছিলো। উপরন্তু, ওই সংঘাতের পূর্বে ভারতে সীমান্ত কার্যকলাপ নিয়ে লেখা নেভিল ম্যাক্সওয়েলের অসাধারণ বইটির পাঠকেরা জানেন যে ভারতীয় সামরিক এবং আধা-সামরিক কর্মকান্ড একই সাথে কঠিন ও অত্যন্ত গোপনীয় এবং অন্য মানুষদের মতোই, তাদের নিজস্ব প্রেরণা ধারণ করে। মিসেস গান্ধীর হয়ত গেরিলাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রনের মতো এমন কিছু নেই, ঠিক এই কারনবশত গেরিলারা পর্যায়ক্রমিকভাবে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে শুধু তাইই নয়, এবং অংশত তাদের নিয়ন্ত্রনে রাখাও সম্ভব হবে না।
এভাবেই পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সিংহভাগই বহির্বিশ্বের সাহায্যের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। যদি, শুধুমাত্র যদি পাকিস্তান এবং ভারত উভয় কর্তৃপক্ষই সংবরনশীল আচরন করে, পরিস্থিতি হয়ত কিছুটা সহনীয় মাত্রায় থাকবে।
সত্যিকার প্রশ্নটা হলো, সংবরনশীল আচরন করতে উভয় দেশকেই বাইরের দেশগুলো সাহায্য করতে পারে কি না। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে, ২৫ মার্চের আগের ছোট-মাত্রার সামরিক সরবরাহগুলো বন্ধ না করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা সুবিধা ধরে রাখতে পারে। কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে চড়া মাশুল গুনতে হচ্ছে, এবং পাকিস্তানের আচরণ নিয়ন্ত্রন করতে আমেরিকার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। (সংজ্ঞানুযায়ী অবশ্যই তা সম্ভব নয়)।
আলোচিত বিষয় হলো, বছরের প্রথম ভাগের পরে, যখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ কমে আসবে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে আর্থিক সাহায্য পাঠানো চলমান থাকবে কি না। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের একইসাথেক করণীয় দুটি বিষয় আছে- একা একা কাজ করবার অবস্থা থেকে সরে আসা যা প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং সামরিক সহায়তার বদলে আর্থিকভাবে পাকিস্তানের উপর বাইরে থেকে সুবিধা ধরে রাখার জন্য চেস্টা চালানো। পাকিস্তানের সাহায্যের মাধ্যম হতে পারে বিশ্বব্যাংক এবং সামরিক সরবরাহ বন্ধের জন্য প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব অনুযায়ী আসন্ন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা গ্রহন করা। কিন্তু একই সময়ে, শুধুমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সাহায্য অনুমোদন করতে ব্যাংক এর কাজে, প্রেসিডেন্টকে এর আনুষঙ্গিক আর্থিক সাহায্য নিষেধাজ্ঞাকে বাতিল করতে হবে (যেভাবে বিলটি অনুমোদন করে)। সম্ভবত এতোসব কিছুর ক্ষুদ্রতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ফাঁদে পড়া পাকিস্তান সরকারের উপর কিছু সুবিধাজনক নিয়ন্ত্রন নিয়ে আসা; বৃহৎটি হলো দুটি মারাত্মক ভুল- পূর্ব বাংলায় আতঙ্ক এবং শরণার্থী শিবির- যৌক্তিকতা প্রমান ছাড়াই তৃতীয়টিঃ পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ধ্বস।
সংকটের আর্থিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক সাহায্যের উপর এমন নতুন নিষেধাজ্ঞা চললে তা হবে এখন পর্যন্ত ভারতের উপর প্রয়োগকৃত এর চেয়েও বড় চাপ। এবছর শরণার্থীদের জন্য ভারতের খরচ হবে প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সাহায্যের চেয়েও বেশি; অবশ্যই এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হবে আন্তর্জাতিক অংশীদারীর অতিরিক্ত বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে যা অন্ততপক্ষে ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার পরিমান হবে। এটি ব্যতিত, এমন কি ভারতও যুক্তিযুক্তভাবে এবং হয়তবা এমনকি দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
এখানের সর্বত্রই আমি কিছুই ক্ষমতার প্রেক্ষাপট থেকে বলিনি। যখন সোভিয়েত রাশিয়া সংবরণশীল আচরন করছে তখন হয় চীন অপেক্ষা করছে চরমপন্থি বাংলার ভাঙা অংশগুলো দখল করতে। ভারত-চীন যুদ্ধের ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, যাদের মূল উদ্দেশ্য ভারতকে অবিভক্ত রাখা এবং পাকিস্তানকে তাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষানুযায়ী অবস্থায় রাখা, তাদের বদলে দক্ষিন এশিয়ার সংঘাত কিভাবে এই সমস্যার একপক্ষীয় সুবিধাবাদীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে।
চূড়ান্ত বিকল্পঃ
মূল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো জনগন, এবং অধিকাংশ পরিস্থিতিতে আরও পরিস্কার ভাবে বলতে, খুবই কঠিন এবং সম্ভবত প্রায় অসম্ভব, শান্তি প্রতিষ্ঠা শুরু হয় জনগনের থেকে। বিশেষত, কংগ্রেসকে অবশ্যই ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের শরণার্থীদের জন্য ২৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের আটকে থাকা সম্পূরক সাহায্য দ্রুত ছাড় দিতে হবে। এরপর, যেমনটা প্রথমেই করা উচিত ছিলো, প্রথমত ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর মাধ্যমে সমস্যাটি একটি নতুন ও বৃহৎ মাত্রায় আন্তর্জাতিকীকরণ, এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিকতর বৃহৎ গঠনমূলক অংশীদারীত্বকে অন্তর্ভুক্তকরণ। যদি এটি আকাশ-কুসুম কল্পনা হয়, তাহলে প্রায় আক্ষরিকভাবে বিকল্প হলো, দক্ষিন এশিয়ার ধ্বংস। সব যুক্তিতর্কের শেষে আমার আনত সিদ্ধান্ত এটাই যে ১৯৪৫ সালের পরে এটাই বিশ্বের দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কট।
চিঠি – পূর্ব পাকিস্তানঃ
সম্পাদক বরাবর ‘বাংলায় বিপর্যয়’ (আগস্ট ২৩) শিরোনামের ৪টি চিঠি এই ইঙ্গিত দেয় যে, আপনাদের দোসরা আগস্টের প্রচ্ছদ শিরোনামের মাধ্যমে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রান্ত ধারনার সৃষ্টি হচ্ছে।
‘গনহত্যা উপেক্ষা করা’ কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সাহায্য সরবরাহে ‘কৃপণ’ হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা ভুল এবং অন্যায্য। অনেকবারই, পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখজনক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং মহাসচিব উ থান্টের আহবানে ভারতের শরণার্থী এবং পূর্ব পাকিস্তানের অভাবগ্রস্ত জনগনের জন্য ত্রাণব্যবস্থায় জরূরী ভিত্তিতে সাড়া দিয়েছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্যে এক চতুর্থাংশ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা অন্যান্য সব রাষ্ট্রের মোট প্রদেয় সাহায্যের চেয়েও অনেক বেশী এবং কর্তৃপক্ষ কংগ্রেসের কাছে আরও এক চতুর্থাংশ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে।
এটি ভুল, যেমনটা একটি চিঠিতে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছেঃ সামরিক খাতে আমরা পাকিস্তানকে কোনো সহায়তা দেইনি।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৩। যুদ্ধের সম্ভবনা | বাল্টিমোর সান | ২৬ অক্টোবর ১৯৭১ |
<১৪, ১০৩, ২৪৩>
দ্যা বাল্টিমোর সান, ২৬ অক্টোবর ১৯৭১
যুদ্ধের সম্ভবনা
দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের সম্ভাবনা একটি জটিলতা থেকে উদ্ভূত হয়, যেগুলির মধ্যে দুটি বর্তমানে বিশেষ ভাবে বিপজ্জনক। কেউ কেউ ভারতের একটি বর্ধিত বর্বরতা বলে মনে করেন। দৃশ্যত মনে হয় যে যুদ্ধ কিছুটা চেপে আসছে, এবং এমন একটি মুহূর্ত আসতে পারে যে পাকিস্তান তীব্র চাপ, খরা ও কার্যকরভাবে যুদ্ধ করতে খুব দুর্বল। অন্যটি হচ্ছে, পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে তিক্ত, হতাশাজনক এবং হতাশার মধ্যে আছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে দমনের প্রচেষ্টায় তার সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এর জন্য তারা নিছক নিকৃষ্টতার সাথে লড়াই করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী গান্ধী ভারতীয় যুদ্ধবাজদের মত নন। তার নিজের অবস্থান দৃঢ়, কিন্তু যুক্তিযুক্ত। তার পশ্চিমা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সফরের প্রাক্বালে তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে তার দেশবাসীকে যে সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাদের সংযত হবার কথা বলেন- যাকে তিনি তার ভাষায় “চ্যালেঞ্জ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন – যে সঙ্কট ২৫ শে মার্চের শেষের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ববাংলায় আঘাত করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। প্রথম এবং সর্বাগ্রে একটি নমনীয় নিরপেক্ষ আমেরিকান মনোভাব তিনি আশা করেন যার ফলে পাকিস্তানে অব্যাহতভাবে আমেরিকান অস্ত্র চালান বন্ধ করা যাবে। তারপর পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরনার্থিদের আগমনের কারণে ভারত যে অর্থনৈতিক ও মানবীয় বোঝার সম্মুখীন হয়েছে – যদিও এর বাইরে সেখানে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা হয়েছে – সেটির ব্যাপারে ওয়াশিংটনের হাল্কা অবস্থানকে পরিবর্তন করার আশা করেন। এবং এটাও হতে পারে যে মিসেস গান্ধী আমেরকার চীনের প্রতি সহমর্মিতার ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন, যারা পাকিস্তানের প্রধান সমর্থক।
সর্বোপরি, ভারতের অবস্থান হলো যে “চ্যালেঞ্জ” এবং সংকট, এক জিনিস থেকে সরাসরি উৎপাদিত হচ্ছে – তা হল শরণার্থী, এবং যে উদ্বাস্তুদের সমস্যা মার্চ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মের সরাসরি ফলাফল। মার্চের পটভূমির জটিলতা ভুলে যাওয়া চলবে না, এটিই মূল কারণ; এবং তাই এটা অবিরত মনে রাখা প্রয়োজন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৪। বাংলাদেশের যুদ্ধে পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি | নিউইয়র্ক টাইমস | ২৭ অক্টোবর ১৯৭১ |
<১৪, ১০৪, ২৪৪>
দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস, ২৭ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশের যুদ্ধে পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি
-মেকল এম ডব্লিউ ব্রাউন
-নিউ ইয়র্ক টাইমস স্পেশাল
করাচী, পাকিস্তান, অক্টোবর ২৬ – পাকিস্তানের রিপোর্ট করেছে যে আজ তার সেনাবাহিনী অব্যাহত চাপে আছে। পূর্ব পাকিস্তানে কুমিল্লা জেলার কসবা এলাকায় “ভারতীয় সৈন্য ও এজেন্ট” নিশ্চিত দাবি করে যে আরও ৭৮ টি “শত্রু” দের লাশ পাওয়া গেছে।
সাম্প্রতিক একটি বিবৃতিতে দাবি, দুই দিনে শত্রু দের ৫৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান।
বিবৃতিতে বলা হয় ভারত বলেছে পাকিস্তানের কসবা এলাকা বিদ্রোহী বাঙ্গালীদের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। পাকিস্তান সরকারের বিবৃতি অস্বীকার করে তারা বলে পূর্ব পাকিস্তানের ঐ অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বিবৃতিতে পাকিস্তানি সামরিক ক্ষয়ক্ষতির কথা বলা হয়নি। সেখানে “ভারতীয় এজেন্ট” শব্দটি ব্যবহার করে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি গেরিলারা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। “ভারতীয় এজেন্ট” বলতে হয়ত গ্রামবাসীদের বোঝানো হয়েছে।
শেলিং চলছে
সরকার বলেছে যে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে শেলিং অব্যাহত থাকছে। সন্দেহ নেই যে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে যে শেল পড়েছে সেগুলো কোথা থেকে আসছে।
পাকিস্তানি সরকার প্রায়ই রিপোর্ট করে যে, কুমিল্লার জেলা শহর সীমান্তে ভারতীয় আর্টিলারি বেষ্টিত এবং তারা সেখানে শেলিং করে – তবে ক্ষয়ক্ষতি পরীক্ষা করে বোঝা যায় যে শেলগুলি সাধারণত ২-ইঞ্চি মর্টার থেকে আসে যেগুলোর নিক্ষেপ সীমা ক্ষুদ্র এবং সীমান্ত থেকে এখানে আসার কথা নয়।
গত মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে গ্রাম ও অন্যান্য শক্তিশালী পয়েন্ট দখল করে। তাদের কাছে আর্টিলারি ব্যারেজ আছে এবং তারা আমেরিকান নির্মিত ও সোভিয়েত-নির্মিত জেট বিমান দ্বারা হামলা করছে।
বর্ষার কারণে পূর্ব পাকিস্তান এর বিশাল ধান এবং পাট ক্ষেত্র ডুবে যাওয়ায় সামরিক এম্ফিবিয়াস অপারেশন চালানো হচ্ছে ৫০ টি লাইট এসাল্ট বোট দিয়ে যা আমেরিকা সাইক্লোন রিলিফ বিতরণের জন্য দিয়েছিল – যেগুলো গত মার্চে আর্মি অধিগ্রহণ করে।
বর্ষা প্রায় শেষ হয়ে গেছে এবং সরকারী বাহিনী সম্ভবত আরও বেশি গতিশীলতা পাবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৫। শান্তির প্রতি নতুন হুমকি | ওয়াশিংটন পোস্ট | ২৭ অক্টোবর ১৯৭১ |
<১৪, ১০৫, ২৪৫-২৪৬>
ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৭ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলার যুদ্ধ শান্তঃ শান্তির প্রতি নতুন হুমকি
পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ সম্পর্কে বিতর্কিত রিপোর্ট
– লি লেস্কেজ
ওয়াশিংটন পোস্ট ফরেন সার্ভিস
চাতক, পূর্ব পাকিস্তান ২৬ অক্টোবর- পাকিস্তান এ ঘটে যাওয়া দীর্ঘতম এবং বৃহত্তম সাম্প্রতিক যুদ্ধের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে এই ছোট সীমান্ত ঘেষা শহরে় সংঘটিত হয়। পাকিস্তান সঙ্কটের সময় অনেক অন্যান্য ঘটনার মত, চাতক এর যুদ্ধ ভারত ও পাকিস্তান থেকে পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন বাড়িয়ে তোলে। প্রকৃতভাবে আলোকপাত করা গেলে, সম্ভাবনা থেকে যায়, যে একটি জাতি নিজেই বিশ্বাস করবে যে তাদের সাথে ভুল হচ্ছে এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে পরিপূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিবে। শত্রুতা দুই দেশের মধ্যে বৃদ্ধি পায় যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মার্চ মাসে, বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্যে একটি স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে যায়। পাকিস্তানে নয়, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল পাঞ্জাবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়, যারা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারত হতে ১০০০ মাইল পশ্চিম থেকে, বাংলা, পার্শ্ববর্তী এলাকা হিসাবে একই। চাতক এর আশেপাশে ঘটা প্রায় সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় ভারতের জাতীয় রেডিও ঘোষণা করে যে পূর্ববাংলার গেরিলা, মুক্তিবাহিনী নামে যারা পরিচিত, তারা ভারত থেকে সমর্থন পেয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের একটা সংখ্যা সম্প্রচার শুনছিলো, যখন তারা তিন দিনের যুদ্ধের পর চাতক সদর দপ্তরে বিশ্রামরত ছিলো। তাদের মধ্যে একজন, লিমিটেড কর্নেল সরফরাজ খান মালিককে হত্যা করা হয়েছে, ভারতীয় রেডিও এ ঘোষণা দেয়। কর্নেল, একটি ভোঁতা ব্যক্তি যিনি বিশ্বাস করেন তার সরকার বাঙালিদের সাথে খুব কোমল আচরণ করছে। এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ভারতীয় সম্প্রচারের দ্বারা আমোদিত হয় নি, “কে বিশ্বাস করতে পারে এমন মিথ্যাবাদীকে? “তিনি জিজ্ঞেস করেন। ” এটা প্রচনফ বিরক্তিকর, আমার স্ত্রীকে টেলিফোন করা লাগবে পূর্ব পাকিস্তানে, শুধু বলতে যে আমি এখনও বেঁচে আছি!” পাকিস্তানি সেনারা চাতক ও পার্শ্ববর্তী ৫ মাইল এলাকা যা শহর ও ভারতের সীমান্তের মধ্যে অবস্থিত, তার দখল নিয়ে রাখায়, আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয় না। গেরিলাদের মনোযোগ জুড়ে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা। অনেক রেল লাইন কাটা হয়, সেনাবাহিনী সড়ক পথ শুধুমাত্র খুলে রেখেছে দ্রুততার জন্য। উড়িয়ে দেয়া সেতু ভবন; পাইলনস এবং বৈদ্যুতিক শক্তি কেন্দ্র অন্তর্ঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গেরিলা আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য এখানে সিমেন্ট কারখানা।পূর্ব পাকিস্তানের মত ৭০ লক্ষ মানুষের একটি অঞ্চলে, টালি কারখানা টি একমাত্র ছিলো, যা বন্ধ। কারখানার বেশ কয়েকটি ভবন এর ছাদ আর্টিলারি শেল দ্বারা ভেঙে গিয়েছে এবং যন্ত্রপাতি কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কারখানার ৫০০ শ্রমিক পালিয়ে যায় হামলার সময় এবং এটা নির্দিষ্ট নয় কতজন ফিরতে ইচ্ছুক।
একটি কারখানা কর্মকর্তা বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে আবার অপারেশন হবে। কিন্তু অফিসের আসবাবপত্র রেল বগির উপর চাপিয়ে রাখা হয়। ম্যানেজারকে প্রশ্নকরা হলে বলেন, বিভাগীয় রাজধানীতে তাদের অফিস স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা সিলেট থেকে ২২ মাইল দূরে। দপ্তরের লোকেরা সন্দেহ প্রকাশ করে এই পদক্ষেপ শ্রমিকদের আস্থার উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু, একজন আর্মি মেজর সন্তুষ্ট নয়, “এটা খুব খারাপ, তোমাদের এখানে থাকতে হবে,” মেজর বলেন। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা এবং কথোপকথন যুদ্ধের বিবরণ এ ফেরৎ গেলো। লাল টেপ প্রত্যাশিত কারখানা একটি সরকারী শিল্প, অন্য একজন পর্যবেক্ষক সেদিকে আলোকপাত করেন। সেখানে ক্ষতি সমূহের রিপোর্ট নেয়া হবে এবং তারপর সেখানে সমীক্ষার রিপোর্ট পুনর্বিবেচনা হবে। এবং খুচরা যন্ত্রাংশ এর জন্য অনুরোধ করা হবে। অবশেষে কেউ একজন কানাডিয়ান বা জাপানি বিশেষজ্ঞ পাঠাবে, তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেন। “এটাতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে।” প্রায় ১০০০ মুক্তিবাহিনী চাতকের উপর হামলায় অংশ নেয় বলে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানান। গেরিলাদের রাতে সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে যায় এবং উভয় পার ঘেষে সুরমা নদীর ধারে অবস্থান নেয়, যা কারখানা থেকে শহর কে আলাদা করেছে। প্রায় আটটার সময়, ১৩ অক্টোবর এ ভারতীয় আর্টিলারি খুলে দেয়া হউ এবং গেরিলারা ছোট পাকিস্তানী দলটির বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করেন। যুদ্ধ পুরো দুইদিন ধরে চলে এবং বিভাগ থেকে আগত পাকিস্তানি সৈন্য এবং আর্টিলারি দলের খুব কাছে থেকে, তৃতীয় দিনের সকালে ৩০০ জন এর একটি দল নদী ক্রস করতে ও গেরিলাদের দল ভারতে ফিরে যেতে সক্ষম ছিল। দেহ গনণা অন্য কোথাকার চেয়ে এখানে বেশি সঠিক হয়। কর্নেল সরফরাজ বলেন, ২৫০ এর বেশি গেরিলা নিহত হয়েছে। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ১৫০ জনেরও বেশি দাবী করেন। আর একটি তৃতীয় সামরিক উৎস রিপোর্ট যখন প্রকাশ করে প্রায় ১০০ আক্রমণকারী মারা যান, একটি বিষয়ে তারা একমত যে, তার চেয়ে তুলনায় ১০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পাকিস্তানি চার্জ ভারতীয়দের ব্রিটিশদের তৈরি বন্দুক এর ক্ষেত্র পরিসর থেকে হিসাব মতে, পাকিস্তানী কমান্ড বুঝতে পারে যে ভারতীয় আর্টিলারির মধ্যে প্রায় ১০০০ গজেরো বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে চাতক যুদ্ধের সময়। তারা ভারতীয় সৈন্যরা যে গেরিলা আন্দোলন পরিচালনা এবং প্রদান সীমান্ত জুড়ে ৫০০০ গজ এ হামলাকারীদের হামানদিস্তা আগুন দিয়্র সাহায্য করে বলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দোষারোপ করে। স্থানীয় গ্রামবাসী পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে ভালভাবেই ভারতীয়দের আনাগোনা দেখে। একজন কর্মকর্তা বলেনন, তারা বিশ্বাস করে ভারতের কৌশলে হচ্ছে, ফ্রন্টলাইন এ বাঙালি গেরিলাদের ব্যবহার করে যেন বাজেয়াপ্ত করা যায় পাকিস্তানের অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক থলে। এ প্রচেষ্টায়, যদি কোনো ধরনের হামলা সফল হয়, কমান্ডার এর ব্যাখ্যানুযায়ী, ভারতীয় সেনা ইউনিট টালি পকেট দখল নিবে, এবং ঘনিষ্ঠ সমর্থনের জন্য একটি দ্বিতীয় গেরিলা হামলার প্রস্তুতি নিবে। যেন তাদেরকে পাকিস্তান এর গভীরে ঠেলে পাঠানো যায়। ” পিছন দিকে থেকে এবং শুধুমাত্র অগ্নি ও লজিস্টিক সহায়তা, আচ্ছাদন প্রদান করে, ভারতীয়রা দখল এড়াতে সক্ষম হচ্ছে বা নিহত ও হচ্ছেনা। এবং এতে করে, পাকিস্তান অনুপ্রবেশ এর প্রমাণ প্রদর্শন করতে পারবে না” – টালি কর্মকর্তা বলেন। তার অভিযোগ সত্য হোক বা না, তারা যুদ্ধের একটি ছোট অংশ স্নায়ুর উপরেও ভারত এবং পাকিস্তান এর রাজধানী হতে তাদের সীমান্তে পরিচালনা করছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৬। যুদ্ধের আলামত | নিউজ উইক | ১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
Aabir M. Ahmed
<১৪,১০৬, ২৪৭-২৪৮>
নিউজ উইক ১ নভেম্বর, ১৯৭১
যুদ্ধের আভাস
পশ্চিম পাকিস্তানের উষর পাঞ্জাব প্রদেশ জুড়ে চলমান ট্যাংকের সারি ধূলোর মেঘ তৈরী করেছে। এবং হাজার মাইল দূরে, ভারত-পূর্ব পাকিস্তানের জলাভূমি সদৃশ সীমান্ত জুড়ে, ভারী অস্ত্রের গর্জনে রাতের নীরবতা ভেঙে পড়ছে। ভারতের শত শত শহর এবং গ্রামে রক্ষীবাহিনিকে সমাবেত করা হয়েছে এবং বিমানবাহিনীর বৈমানিকেরা দু’মিনিটের জরূরী তলবের জন্য সতর্ক অবস্থায় আছে যখন কি না পাকিস্তান জুড়ে গাড়িতে এবং ঘরবাড়িগুলোতে ‘ভারত ধ্বংস করো’ লেখা হাজারো স্টিকার লাগানো হয়েছে। শেষ সপ্তাহে উপমহাদেশের সর্বত্র যুদ্ধের সরঞ্জামাদিগুলোকে সচল করা হয়েছে। এবং যদিও মস্কো, লন্ডন, এবং ওয়াশিংটন এর উদ্বিগ্ন কূটনীতিকেরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার এই অর্থহীন যুদ্ধ থামানোর সম্ভাব্য উপায় খুজছেন, কিন্তু দুই মুখোমুখী বৈরী মনোভাবের সরকার তাদের ক্রমবর্ধমান আতংকের খেলাই যালিয়ে যাচ্ছে। ‘বাতাসে যুদ্ধের আভাস পাওয়া যায়’- একজন উচ্চপদস্ত ভারতীয় কর্মকর্তা একটাই বললেন এবং বস্তুত তা সত্যি।
দুই দেশের সেনাবাহিনী প্রায় মুখোমুখী হবার আগপর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই সেনাদল , ট্যাঙ্ক এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র এর চলাচল বেড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান লাগোয়া ভারতীয় সীমান্ত জুড়ে ১৩ টি পাকিস্তানি ডিভিশন এর বিপরীতে ১৫টি ভারতীয় ডিভিশন অবস্থান নিয়েছে। প্রহরার কাজের জন্য সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী কে দ্রুত ডেকে পাঠানো হচ্ছে । কাশ্মিরে, যেখানে পশ্চিমা গুপ্তচর সূত্র থেকে জানা গেছে যে পাকিস্তানীরা শত শত সশস্ত্র এজেন্টদের সেখানে জমায়েত করাচ্ছে, সেখানে ভারতীয়রা শক্তি বাড়ানোর জন্য দ্রুত দুটি ডিভিশনকে প্রেরণ করেছে। এবং পূর্ব দিকে, প্রায় ৮০০০০ পাকিস্তানি জমায়েত হয়েছে একই সংখ্যক ভারতীয় সেনাদলের বিপরীতে। নয়া দিল্লীর একজন কূটনৈতিক বলছেন, ‘মাত্র একটি ফোন কলই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট’।
ইচ্ছেকৃতভাবে যুদ্ধের পথ বেছে নেওয়া উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৬৫ সালে, ভারত এবং পাকিস্তান ২২দিনব্যাপী অফলপ্রসূ এক যুদ্ধে মুখোমুখী হয়েছিলো কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রন নেবার জন্য। কিন্তু সেই সময়ে যখন দুইটি দেশ সামরিক শক্তিতে প্রায় একই রকম ছিলো, এখন অধিকাংশ তুরুপের তাস ভারতের নিয়ন্ত্রনে। যদিও ভারতের জেটবহরের তুলনায় পাকিস্তানের ৬০টি আধুনিক প্রযুক্তির মিরেজ জেটবহরের ক্ষমতা বেশী, ভারতের আছে অধিক পরিমানের রাশিয়ান অস্ত্র- প্রায় দ্বিগুন বোমারু বিমান এবং প্রায় দ্বিগুন পরিমান ট্যাঙ্ক। অধিকন্তু, পাকিস্তানের ৪৫০০০০ সৈন্যের বিপরীতে নয়া দিল্লী ৯০০০০০ সৈন্য মাঠে নামাতে পারবে। পরিসংখ্যানগত এই অসামাঞ্জস্যতার কারনে ভারতীয় কর্মকর্তা যুদ্ধে দ্রুত ও সহজ জয় এবং চিরতরে বিজয়ের কথা ভাবছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেছেন, ‘ যদি আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের সৈন্যদল এগিয়ে যাবে রবং তাদের শহর দখল করবে। এবং এবার যাই হোক না কেন আমরা আমাদের দখলকৃত এলাকা থেকে সরে আসবো না’।
যাই হোক, ভারতের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো পাকিস্তানের অধিকাংশ সৈন্যকেই পাঠানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সাথে যুদ্ধ করতে। শেষ এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ ইয়াহিয়া খান বিদ্রোহ-প্রবণ বাংলাদেশের বিপক্ষে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা শুরু করবার পরে থেকে, এবং পরবর্তীতে প্রায় ৯ মিলিয়ন শরণার্থীকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করার পরে, বাঙালি গেরিলারা প্রায় ৫০০০০ লোকের বাহিনী প্রস্তুত করেছে। মূলত ভারতে, যেখানে বিদ্রোহীদের জন্য যথেষ্ট সহানুভূতি আছে, প্রশিক্ষন নিয়ে তারা সরকারি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে যথেষ্ট সক্ষম হয়েছে। এবং অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক ধারনা করছেন যে তাদের এই সাফল্য অব্যাহত থাকবে। একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ‘গেরিলাদের মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট বাহিনী সেখানে ইয়াহিয়ার নেই। এবং ভারতীয় কর্তৃত্বের এলাকা থেকে শক্তি না কমিয়ে তিনি সেখানে আরও সৈন্যও পাঠাতে পারছেন না’।
পলায়ন
অধিকাংশ রাজধানীগুলোতে এটাই আশংকা যে ভারত এবং পাকিস্তান হয়ত এমন একটা সংকটাপূর্ণ অবস্থায় পড়বে যেখানে শুধু মাত্র যুদ্ধই হবে সংকট থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ। এই সম্ভবনাকে রুখতে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছিলো যে পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী নিকোলাই ফাইরাইউবিন এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিশেষ আলোচনার জন্য ভারতে যাবে, তখন ব্রিটিশ কূটনীতিকেরা ভারত ও পাকিস্তানের জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এবং ওয়াশিংটনে, নিক্সন প্রশাসন ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব সমর্থন করেন যে, দুই পক্ষই সীমান্ত থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে । ভারত এরকম কিছুই করেনি। ইয়াহিয়ার প্রস্তাবকে ষড়যন্ত্র বলে নাকচ করে দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘হাতের মুঠো পাকিয়ে হাত মেলানো যায় না’।
এই উত্তেজনা প্রশমনে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা না যাওয়া সত্ত্বেও , অন্তত সামনের কটা সপ্তাহে অনেক কূটনীতিকই আশা করছেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কিছু আশার আলো দেখার। প্রথমেই, সপ্তাহের শুরুতে ছয়-দেশ সফরে বের হবার ব্যাপারে মিসেস গান্ধী পরিকল্পনার পরিবর্তন করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘তার অনুপস্থিতিতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আক্রমন শুরু করার সম্ভবনা খুবই কম।’। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরু করার সম্ভবনা রয়ে যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কর্মকর্তারা মনে করছেন সেই সম্ভবনাও ক্ষীণ। ওয়াশিংটনের একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ‘এটা হবে পাগলামির পরিচয়। তারা তাদের সব কিছুই হারাবে’। এখনো পর্যন্ত, হিন্দু ভারত এবং মুসলমান পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক কখনোই যৌক্তিকতার বিচারে চিহ্নিত হয়নি। এবং এই কারনেই, যুদ্ধের সম্ভবনাকে কেউই অস্বীকার করতে চাচ্ছে না। নয়া দিল্লীর একজন কূটনীতিক বলেন , ‘যুক্তি আপনাকে বলবে যুদ্ধ হওয়া উচিত নয়। ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপারে কথা বলতে হলে আপনাকে জানালা দিয়ে যুক্তি ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে’
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৭। বাংলার যুদ্ধ | বাল্টীমোর সান | ২ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১০৭, ২৪৯-২৫০>
বাল্টিমোর সান, ২ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলার যুদ্ধ চলছে
ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তানী দের থামিয়ে দিতে চাইছে
- প্রিম সাভাল দিল্লি ব্যুরো অফ সান
নিউ দিল্লি- নিয়মিত সৈন্য জড়ো হবার প্রথম প্রধান ঘটনা। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি আর্টিলারিকে আক্রমণ করেছে যারা বাংলার সীমান্ত জুড়ে অগ্নিসংযোগ করছিল। একজন মুখপাত্র গত রাতে এ রিপোর্ট করেন।
আজ ভোরে ণয়াদিল্লিতে হেলিকপ্টার সহ আকাশপথে অনেক চলাচল দেখা যায়। এগুলো সব উত্তর ডিকে যাচ্ছিল।
রবিবার রাতে এবং গতকাল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তের একটি ছোট শহর কমলপুরের যা ঘটেছে তাকে কাউন্টারএকশন বলা যায় না।
মন্তব্য করতে রাজি হয়নি
সোর্স ধারণা করেছে যে প্লেনগুলো পশ্চিম সীমান্তে যাচ্ছে – যেখানে পাকিস্তান আক্রমণের হুমকি দিয়েছে – যদি ভারতীয় সৈন্য পূর্বাঞ্চলে আক্রমণ করে তবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাদের কার্যকলাপের উপর মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
কেন্দ্রীয় সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এখান থেকে পূর্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তানে স্বল্প সময়ে যাওয়া যায়। এখানে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে ভারত সমর্থিত গেরিলা বাহিনীর অনেক যুদ্ধ হয়েছে।
ভারতীয় মুখপাত্র আরো বলেন, পাকিস্তানি আর্টিলারি ভারতের ৪ মাইল ভিতরে কামালপুরে ১১ দিন ধরে শেলিং করছে। ভারত সীমান্ত ক্রস করেছে কিনা না জানালেও তিনি বলেন সেখানে কোন বিমান জড়িত হয় নি।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, পাকিস্তানিদের প্রচুর হতাহত হয়েছে তবে কোন বিবরণ পাওয়া যায়নি।
রেডিও পাকিস্তান কামাল্পুরের কথা না বললেও জানিয়েছে “ভারতের সৈন্য এবং তাদের সমর্থকরা” – সমর্থক বলতে বাঙ্গালী বিদ্রোহীরা – ভারতের আর্টিলারির সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করছে।’
রেডিও সিলেট জেলার অংশ, যা ত্রিপুরার কাছে, , পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর ও উত্তরপশ্চিম অংশে রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় কিছু ঘটনার কথা বলে। এতে বলা হয়, ৭২ জন ভারতীয় ও বাঙ্গালী নিহত হয় এবং ৩৯ জনা হত হয়।
চুক্তি লঙ্ঘন
ভারতীয় বিবৃতি সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় রবিবার রাতে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, “পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে এবং সংকট আরো তীব্রতর হয়ে উঠছে।”
১৯৬৫ সালে যুদ্ধের পরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল যে তারা সীমান্তে যথেষ্ট দূরে অবস্থান করবে – কিন্তু সেই চুক্তি ভঙ্গ করে তারা অনেক কাছাকাছি দূরত্বে জড়ো হচ্ছে।
ভারত বলছে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে এবং গত মার্চের সেনাবাহিনীর ক্রাশ একশনের পর থেকে যে ৯ লাখ শরনার্থি ভারতে প্রবেশ করেছে তাদের ফিরিয়ে নিতে।
পাকিস্তান ভারতকে হুমকি দিচ্ছে যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলাদের সাহায্য করে তাহলে পশ্চিম সীমান্তে ভারতকে আক্রমণ করা হবে – সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান তুলনামূলক শক্তিশালী। তারা আরও বলছে গেরিলাদের কিছু অপারেটিং সেন্টার ভারতের ভিতরে অবস্থিত।
এযাবৎ ১৯৬৫ সালে ৩ সপ্তাহকালিন যুদ্ধে পশ্চিম সীমান্তের কাশ্মীরে পাকিস্তান থেকে গেরিলা ভারতে অনুপ্রবেশের কিছু ঘটনা ঘটেছে।
কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের উপর দিয়ে দ্বিতীয়বারের মত গতকাল পাকিস্তানী বিমান উড়তে দেখা যায় । সেটিকে এন্টিএয়ারক্র্যাফট দিয়ে তাড়ানো হয়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৮। বিদেশী সাহায্যের নতুন দিক | নিউ ইয়র্ক টাইমস | ২ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১০৮, ২৫১-২৫২>
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২ নভেম্বর ১৯৭১
বৈদেশিক সাহায্যের নতুন দিক
গতকালের রুদ্ধদ্বার ফরেন রিলেশনস কমিটির বৈঠকের রিপোর্টে যানা যায় সদস্যরা বৈদেশিক সাহায্যের অনুমোদন বিল বন্ধ করার জন্য সিনেট র্যাশ ভোটের ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনা করছেন। আপাত দৃষ্টিতে বিদেশী সহায়তার ব্যাপারে নতুন কোন দিকনির্দেশনা নেই যার ফলে কংগ্রেসের সমর্থন জোরালো হয়।
সিনেটর ফুলব্রাইট এবং অন্যান্যরা অস্থায়ী আইনের কথা ভাবছেন যার ফলে মানবিক প্রোগ্রাম তরান্বিত হবে, বিশেষ করে যেগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত হবে, এবং ব্যাপকভাবে সামরিক উপাদান কমাতে সাহায্য করবে যা এখন প্রশাসনিক বৈদেশিক সাহায্যের প্যাকেজের অর্ধেকের বেশী। এই পদ্ধতির একটি সুবিধা আছে কিন্তু জনাব ফুলব্রাইট এর চাহিদা অনুযায়ী করা বিল এই মুহুর্তে প্রাধান্য পাবে কিনা সেব্যাপারে সন্দেহ আছে। কারণ প্রশাসনের নজর মিলিটারি প্রস্তাবের দিকে – সেটা শুক্রবারের চূড়ান্ত নেগেটিভ ভোটের আগে পরিবর্তন হবে কিনা সেটাই বিষয়।
এটা প্রশাসনের জন্য অবাস্তব হবে যদি বর্তমান ফর্মে বৈদেশিক সাহায্যের বিল সিনেটে নেয়া হয়। যদিও শুধুমাত্র এটাই একমাত্র ফ্যাক্টর না। এইড বিলের ব্যাপারে প্রশাসন এর পরাজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে যে এর সাথে প্রেসিডেন্সিয়াল নীতি জড়িত এবং ভারী সামরিক সমর্থন জড়িত – বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে। যতক্ষণ এটা সংশোধন করা না হবে ততক্ষণ সমর্থনের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকবে। বিদেশী সহায়তা বিষয়ে কংগ্রেশনাল ঐক্যমত হবার সম্ভবনা কম। এমনকি গত বছর দেয়া পিটারসন কমিশন সংশোধন করলেও হবেনা।
বৈদেশিক সাহায্যের পুনর্বিবেচনার ব্যাপারে কংগ্রেস ও প্রশাসন নিজেদের ভুল পথে পরিচালিত করেছে। পরে সেটা প্রেসিডেন্ট ও এ আই ডিএর কিছু সমালোচক তুলে ধরেন।
প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেশনাল সমালোচকদের কঠোর আলোচনা করতে হবে। একই সাথে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ থেকে জাতীয় দুর্যোগএর সম্ভবনা ঠেকাতে হবে। কংগ্রেস বিদেশী সাহায্য অব্যাহত রাখবে অন্য একটি রেজল্যুশনের মাধ্যমে। ১৫ তারিখ পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও সেটা বাড়াবে। কমপক্ষে ৯০ দিন বাড়ানো হবে পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য।
সম্পূরক তহবিলের জন্য দ্রুত ব্যাবস্থা নিতে হবে। প্রশাসন আগেই এই অনুরোধ করেছে। তারা ৯ মিলিয়ন শরনার্থিদের সাহায্যের জন্য তা বলেছেন। এটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। বরং কারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে আর কারা আসবেনা সেটা আলোচনা করা যেতে পারে।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও বৈদেশিক উন্নয়ন কর্মসূচির দাতা দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদানকারী তবে দেশের মোট সম্পদের আনুপাতিক হারে এটি ১৬ টি দাতা দেশের মধ্যে ১২ তম অবস্থানে আছে। এতে আত্মঅহংকার বা আত্মকরুণার কোন বিষয় নেই।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৯। পূর্ব-পাকিস্তানের উপনির্বাচন | নিউ ইয়র্ক টাইমস | ৩ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১০৯, ২৫৩-২৫৪>
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৩ নভেম্বর, ১৯৭১
পাকিস্তান ৫৩ টি আসনে নির্বাচন বাদ দিয়েছে
- ম্যালকম ব্রাউন
পাকিস্তান সরকার আজ (২ নভেম্বর) পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সদস্যদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া জাতীয় পরিষদের ৫৩ টি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এখানে (ঢাকা) যে ঘোষণা দেয়া হল তাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য বড় হতাশার বিষয়। মাত্র ২৫ টি আসনে সামনের মাসে নির্বাচন হবে। এই আসনের সকল প্রার্থীদের সরকার সাবধানে বাছাই করেছে।
জাতীয় পরিষদের ৩১৩ জন সদস্য রয়েছেন যারা ৭ ডিসেম্বর নির্বাচিত হয়েছেন এবং তাদের বেসামরিক শাসনের জন্য পাকিস্তানের সংবিধান লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
অধিবেশন স্থগিত
কিন্তু যখন সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে মার্চ মাসে প্রথম অধিবেশন স্থগিত করা হল, আওয়ামী লীগ ধর্মঘট দিল, যারা ৩১৩ টি আসনের ১৬৭ টি জিতেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সামরিক একশন মার্চের শেষে শুরু হয়, এবং লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরে ঘোষণা করেন যে জাতীয় পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে তবে আওয়ামী লীগের ১৬৭ টি আসন বাতিল ঘোষণা করা হল কারণ তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আসনের ফলাফল স্থগিত রাখা হয় যেহেতু তার বিরুদ্ধে ট্র্যায়াল চলছিল। ৮৮ জনকে বলা হয়েছে তারা স্বতন্ত্র হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারেন যেহেতু আওয়ামীলীগ কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২৭ ডিসেম্বর অধিবেশনের দিন ধার্য
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১২ অক্টোবর ঘোষণা করেন যে পরিষদের সভা ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে এবং একটি নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতা স্থানান্তরের ৮০ দিনের মধ্যে পরিষদ একটি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করতে পারেন যা রাষ্ট্রপতির নির্দেশনায় তৈরি করা হবে।
বাংলার জনগণ পাকিস্তানি সামরিক সরকারের মধ্যবর্তি নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে। তারা পরিষদের সভাকে জালিয়াতি ঘোষণা দিয়েছেন এবং গত ডিসেম্বরের নির্বাচনকে না মানায় সরকারের নিন্দা করেছেন।
ডঃ এ এম মালেক নামক একজন বেসামরিক ব্যাক্তিকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নর হিসেবে সেনাবাহিনী নিযুক্ত করেছে। সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে “উপনির্বাচনের অনেক অসম্পূর্ণতা আছে, কিন্তু একদম কিছু না হবার চাইতে অন্তত সেটা ভালো হবে।”
আওয়ামী লীগের মতাদর্শে বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দলকে উপনির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এবং সম্ভাব্য প্রার্থীকে সরকার-নিয়ন্ত্রিত প্রেস থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
সরকার ডানপন্থীদের মদদ দিচ্ছে
সরকার কঠোরভাবে ধর্মীয় এবং সরকারপন্থী প্রবণতার সঙ্গে মেলে এমন কিছু ছোটখাট ডানপন্থী দলকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে বাঁধা দেয়নি। এই দলগুলোর সাধারণত তাদের প্রার্থীদের বেছে নেয়।
যে দলটি ৫৩ টি আসন থেকে সবচেয়ে বেশী সিট পাবে সেটি হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এটি মোসলেম গোঁড়া দল হিসেবেও পরিচিত। এটি অত্যন্ত ডানপন্থি এবং আজ জানা গেছে যে এরা ১৪ টির মত আসন পাবে।
এই দলের পূর্ব পাকিস্তানে কোন রাজনৈতিক প্রভাব নেই এবং গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে এরা কোন আসনে জয়ী হয়নি।
সরকার পূর্ব পাকিস্তানে যে ৮৮ টি আসন বাতিল করেনি তাদের নির্বাচিতদের সিট গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে। তবে, তাদের অধিকাংশই ভারতের কাছে মিথ্যা কথা বলেছে অথবা গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১০। যুদ্ধ অত্যাসন্ন | নিউজ উইক | ৮ নভেম্বর, ১৯৭১ |
<১৪, ১১০, ২৫৫-২৫৮>
নিউজ উইক, ৮ নভেম্বর, ১৯৭১
যুদ্ধ অত্যাসন্ন
স্বাধীন দেশ হিসেবে বিগত ২৪ বছরে ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান সাধারণ বিষয় নিয়ে বিবাদ করবার সীমাহীন সামর্থ্য দেখিয়েছে। তারা কাশ্মীর এবং র্যান অব কাচ নামে পরিচিত পশ্চিমাঞ্চলের কিছুটা নিয়ে সীমাহীন বিবাদ করে চলেছে এবং ছয় বছর আগে একটি সংক্ষিপ্ত তবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়েছিল। একজন পশ্চিমা কুটনীতিকের ভাষ্য মতে এই দুইদেশ কখনো সত্যিকার অর্থে শান্তিপুর্ন সহাবস্থানে ছিলোনা। এবং অবশ্যই গত সপ্তাহে তারা এমনটা ছিলনা। ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান ৩০০০ মাইলের সীমান্ত জুড়ে ব্যাপক সৈন্য মোতায়েন করেছে। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকই মনে করছেন যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র সফর যা এই সপ্তাহে হবার কথা তা এই ভাষ্যই দিচ্ছে যে ইন্ডিয়া খুব সম্ভব এই যুদ্ধে সাময়িক ভাবে জড়াবে। কিন্তু দুই জাতির মনেই এই অশুভ ভাবনা উঁকি দিচ্ছে যে এই অপ্রত্যাশিত যুদ্ধে আজ হোক বা কাল হোক দুই দেশই জড়িয়ে পরবে।
নিঃসন্দেহে, পাকিস্তান থেকে যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাঁতে অস্থিরতা কমেনি। ইন্ডিয়ার অপ্ররোচিত কামান ও মর্টার হামলায় পুর্ব পাকিস্তানে ১৫০ বেসামরিক লোকের প্রাণ গিয়েছে। এর জবাবে পাকিস্তান সরকার (মোঃ ইয়াহিয়া খান)-এর হামলায় দুইদিনে প্রায় ৬০০ জন ভারতীয় সৈনিক এবং প্রতিনিধি প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, যে সমস্ত মর্টারের আঘাতে বেসামরিক লোকজনের প্রাণ গিয়েছে তা দুই ইঞ্চি মর্টার এবং স্বল্প পাল্লার বন্দুকের আঘাতে হয়েছে, যা কোনভাবেই ইন্ডিয়ার নয়। এবং তারা আরো বলছেন যে, পাকিস্তান ভারতীয় প্রতিনিধি বা চর বলতে পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বিদ্রোহীদের বুঝাচ্ছে, যারা এপ্রিল থেকেই পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। ইন্ডিয়াতে এই দাবি বেশ জুরালো; নয়া দিল্লী থেকে একটি হামলার উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে পাকিস্তানি হামলাকারীদের এবং একটি মর্টার ব্যারেজের আক্রমনে ৬ জন বেসামরিক নিহত হয়েছেন। ভারতে একজন আমেরিকান পর্যবেক্ষকের ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, পাকিস্তানি প্রতিবেদন গুলো আসলে এমন ভাবে সাজানো হয় যাতে তাদের দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধের সপক্ষে একটা উন্মাদনা তৈরি হয়।
পাকিস্তানের জন্য এটা মনে হয় অপ্রয়োজনীয়। পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলোর “সর্বসম্মতি ক্রমে দিল্লী পাকিস্তানকে আক্রমণের জন্য তৈরি” এবং “ভারতকে ধ্বংস করে দাও” এমন শিরোনাম দিয়ে সাজানো। হোন্ডা- মটর সাইকেল, ঘোড়া দিয়ে টানা গাড়ি ইত্যাদিতে ষ্টিকার লাগানো। “ইন্ডিয়া আগুন নিয়ে খেলছে এবং এই আগুনেই সে পুড়ে মরবে”। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একজন কর্মকর্তা নিউজ উইক এর একজন জ্যেষ্ঠ সংবাদদাতা জনাব আরাউদ ডি বর্ছগ্রেইভ কে বলেছেন যে, “এইবার আমরা ইন্ডিয়ার একটা বিরাট অংশ দখল করে নেব”। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সহ অন্যান্য ব্যক্তি সমূহের বিবৃতিতে যুদ্ধে যাবার মত এত জোরালো বক্তব্য পাওয়া যায় না। ইন্ডিয়ার সাথে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে তাদের পতাকা উড়াতে দেখা যাচ্ছেনা, সে স্থানে প্রায় নয়টি ডিভিশনে তাদের সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা ভারতীয় বাহিনীর তুলনায় একেবারে নগণ্য। গত সপ্তাহে নিউজ উইকের ম্যানার্ড পার্কার ভারতীয় সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং সেখানে সৈন্যদের মাঝে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করেছেন, বলতে গেলে তারা যুদ্ধ জয়ের পুর্ভাবাস পেয়ে গিয়েছে এমন মানসিকতা ধারণ করে আছে।
পার্কার–এর প্রতিবেদন
শরতের ধোয়াচ্ছন্ন রোদ গায়ে মেখে পাঞ্জাব অত্যাশ্চর্য সুন্দর হয়ে উঠেছে, যেখানে কৃষকেরা গমের শেষটুকু কেটে ঘরে তুলছে, লেবু কাটছে, এবং ফিরোজা পাখিরা আকাশে মুক্তার মত ঝকমক করছে। কিন্তু সত্যিকার পরিস্থিতি এমন ছিমছাম ও নীরব নয়। এই ভূমি বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য- পাগড়ী মাথায় শিখ, পাঞ্জাবী, কালো বর্নের গুর্খায় ছেয়ে আছে, এবং এই অঞ্চল যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আড়াল করে একটা থমথমে পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। পাকিস্তানি সীমান্তের কাছে ভারতের সবচেয়ে বর শহর অমৃতসরে একটা খড়ের গাদা হটাত করে চলতে শুরু করলে বুঝা গেল ওটা আসলে ছদ্মবেশে থাকা একটা ট্যাকং, এবং এর পেছনে দৃষ্টি পরতেই দেখা গেল মাটির বাংকারের পেছনে একটা ১০৬ মি মি এর কামান বিধ্বংসী গান ও সৈন্য। ছদ্মবেশী সৈন্যরা সীমান্ত এলাকায় ঘুরাঘোরি করছে যাতে পাকিস্তানি অনুচরদের ধরতে পারে, এবং প্রতিটি সেতুতে ডিনামাইট লাগিয়ে রাখা হয়েছে যেন প্রয়োজন হলে পাকিস্তানি অগ্রসরমান সৈন্যদের থামাতে এগুলো দ্রুত গুড়িয়ে দেয়া যায়। “যুদ্ধ অবশ্যই হবে”, এমনটাই বলছিলেন একজন শিখ সার্জেন্ট। “আমরা শুধু সময়টা জানি না।”
ভারতীয়রা আগত এই যুদ্ধে যে জিতবে তাতে শুধু আত্মবিশ্বাসীই নয়, তারা মনে করছে পাকিস্তানকে তারা ভারতীয়দের জন্য সুবিধা হয় এমন কোন চুক্তিতে রাজী করাতে পারবে। “এইবার সীমান্তে আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না”, একজন মেজর এমনটা বলছিলেন, “পাকিস্তানীরা হয়তই একদিকে প্রতিরোধ করতে পারবে কিন্তু আমরা তার বিপরীতে পাঁচ দিক দিয়ে আক্রমণ করব এবং এইবার আমরা জিতব। এটা তাদের জন্য শেষ যুদ্ধ হতে পারে” । পাঞ্জাব যে সুরক্ষিত থাকবে এটা বুঝাবার জন্য তারা চারদিক দিয়ে পাঞ্জাবের গুরুত্বপুর্ন শহরগুলো বিপুল সংখ্যক ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এবং বাদ্য বাজিয়ে ভারতীয় সৈন্যরা রাস্তায় এবং গ্রামের প্রধান জায়গা গুলোতে তাদের বীরত্ব এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাবের ঘোষণা দিচ্ছে, আর আশ্বস্ত করছে এই বলে যে সম্পূর্ণ যুদ্ধ পাকিস্তানের মাটিতে হবে, ভারতের মাটিতে একটি শেলও পরবে না।
যোগাযোগ
ভারতীয়রা যতই যুদ্ধংদেহী হোক না কেন, বর্ডারে একদম বিপরীত- শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফিরোজপুরের কাছে একটা ক্রসিং পয়েন্টে কিছু পাকিস্তানি রেঞ্জার দের ভারতীয় গার্ডদের সাথে মজা করতে দেখা যাচ্ছে, এবং যখন কোন কর্মকর্তা থাকছে না তখন ভারতীয়রা চিনির বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে সিগারেট নিচ্ছে। সীমান্তে ট্রাফিক যথারীতি, যেমন- হয় শরনার্থীরা আশ্রয় প্রার্থনা করছে অথবা ডালিম বোঝাই ট্রাক পারাপার হচ্ছে, এবং ভারতীয় কাস্টমস পরিদর্শক দাবি করছেন যে, “তরুণ পাকিস্তানি অভিবাসীরা শুধু হাশিষেই আগ্রহী”। কিন্তু এই যোগাযোগ শুধু যে চুপিসারে বা শুধুই যে অর্থনৈতিক তা কিন্তু নয়। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার দিলজিত সিং নিয়মিত পাকিস্তানিদের সাথে সীমান্তে মিশছেন এবং প্রকাশ্য চা পান করছেন। উনাকে পাকিস্তানিরা বলেছেন যে, “সাহিব, আমরা যুদ্ধ চাই না। ওদের পুর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করতে দাও, আমরা এখানে যুদ্ধ করতে চাইনা”। দিল্লীতে একজন পশ্চিমা কুটনীতিক অবশ্য বলছেন যে, “এই আশা হয়ত পুরন হবে না, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এটা শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।”
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সাথে কথোপকথন
পুর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহী গেরিলাদের সাথে সংঘাত এবং ইন্ডিয়ার সাথে আরেকটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মোঃ ইয়াহিয়া খান নিউজ উইকের জেষ্ঠ্য সাংবাদিক আরাউদ ডি বর্ছগ্রেইভকে গত সপ্তাহে একটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন। ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের এই সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে উনি উনার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। উনার বক্তব্যের সারসক্ষেপ নিচে দেওয়া হলঃ
যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে
এটা বলার কোন কারন নেই যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে না, কারণ যুদ্ধ আসন্ন। ভারতীয়রা এরমধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেছে, এবং সাধারণভাবে এই মুহুর্তে গতানুগতিক যুদ্ধ চলছে না শুধুমাত্র একটি কারণে, আর তা হল আমরা তাদের পালটা হামলা করছি না। ভারতীয়রা প্রতি ২৪ ঘন্টায় পুর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ১৫০ থেকে ৩০০০ কামান এবং মর্টারের গোলা ছুড়ছে। পুর্ব পাকিস্তানি গেরিলারা সেঁতু, বৈদ্যুতিক খুঁটি ধ্বংস করছে, এমনকি ঐদিন একটি খাদ্যবাহী জাহাজ ধ্বংস করে দিয়েছে। ভারতীয়রা ২৩ টি গ্যারিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছে, বেসামরিক লোকদের সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়েছে, তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমাদের প্রতিদিন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ভারত যদি আমদের ভূমি দখল করতে চায় এবং একটি পুতুল বাংলাদেশী সরকার ক্ষমতায় বসাতে চায় তাহলে তা যুদ্ধে রুপ নেবে।
ভারতের সামরিক শক্তি প্রসঙ্গে
আমরা কিভাবে এমন একটি সামরিক শক্তির (ভারতীয় মিলিটারি) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব যেখানে তারা আমাদের সামরিক শক্তি থেকে পাঁচগুণ এগিয়ে রয়েছে? কিন্তু আমরা যদি আক্রান্ত হই তবে অবশ্যই পাল্টা আঘাত হানব। তাদের (ভারতীয় সামরিক বাহিনী) সামরিক বাহিনী অনেকদিক দিয়েই সয়ংসম্পুর্ন এবং আকারে বিশাল। যদি তারা এই পরিস্থিতিতে দিনে ৩০০০ এর মত শেল নিক্ষেপ করতে পারে তবে বুঝতে হবে যে তাদের হাতে প্রচুর গোলাবারুদ মজুদ রয়েছে। এই মুহুর্তে আমাদের পক্ষে এরকম করাটা বিলাসিতা।
পাকিস্তানকে চীনের সাহায্য প্রসঙ্গে
চীন আমাদের উপর কোন হামলা সহ্য করবে না। আমরা সব ধরনের সামরিক সরঞ্জামাদি-গোলাবারুদ ইত্যাদি পাব, প্রয়োজন হলে তাদের আর্মির শারীরিক উপস্থিতি। আমরা কিছু জিনিস তাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে পাই, আর বিপরীতে আমরা তাদের কিছু দেই। চীনের সাথে আমাদের ২৫ বছরের সুদ মুক্ত ঋণ চুক্তি রয়েছে। গত বছর যখন পিকিং সফরে গিয়েছিলাম, আমি তাদের সাথে ৫ বছরের প্রকল্পের জন্য ২০০ মিলিয়ন অর্থমুল্যের সুদ্মুক্ত সাহায্যের চুক্তি করে এসেছি।
আলোচনা প্রসঙ্গে
আমি তাড়াহুড়া করতে চাই না। আমি চেষ্টা করছি যেন পরিস্থিতি আস্তে আস্তে শান্ত হয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের জন্য আমি বারংবার ইউ থান্ট-এর প্রস্তাব স্বীকার করেছি, এমনকি পুর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসা শরনার্থীদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষন। ৯ মিলিয়ন পুর্ব পাকিস্তানি শরনার্থী হয়েছে এই হিসাব আমি স্বীকার করি না- যদি নিরপেক্ষ গণনা হয় তবে তা ৪ মিলিয়নের অধিক হবে না। তবে, সে সংখ্যা যাই হোক, মার্চের পরে যারা শরনার্থী হয়েছে, তারা যদি পুর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসে, আমি তাদের পাকিস্তানি নাগরিক বলেই স্বীকার করে নেব। তবে তা অতি অবশ্যই জাতিসংঘের মাধ্যমে হতে হবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রসঙ্গে
বাঙ্গালিদের সাথে কেউই ন্যায়সঙ্গত আচরণ করেনি। আমরাও ভুল করেছি, এখানে আমরা বলে আমি পুর্ব পাকিস্তানিদেরও বুঝাচ্ছি, যারা স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান এবং অগ্রজ ছিলেন। পুর্ব পাকিস্তানের অবস্থা নিদারুন এবং নিম্নগামী ছিল, এবং এর উন্নয়নের জন্য আমরা মনোনিবেশ করিনি। এবার আমরা শেষবারের মত চেষ্টা করছি। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ নতুন সংবিধান ঘোষণা করা হবে। তারা আমাদের থেকে ১০০০ মেইল দূরে, তাই এটাই স্বাভাবিক হবে যে, তারা যেন সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার নিজেরাই সমাধান করতে পারে। এটা প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং করারোপ ব্যতীত আর সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে
অনেকেই হয়ত আমাকে বিশ্বাস করবেন না, তবে আমি মনে করি তিনি(মুজিব, যিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের জন্য মামলায় বিচারাধীন) যদি ফিরে যান(পুর্ব পাকিস্তানে) তবে তাঁর নিজের লোকেরাই এত সব দুর্ভোগের জন্য দায়ী করে তাঁকে হত্যা করবে। যে কোন বিচারে, এটা একটা বিবেচনার বিষয়। তিনি আমার সাথে দুই বছর ধরে অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন নিয়ে কথা বলেছেন, তারপর নিজের অবস্থানে ফিরে গিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি সশস্র বিদ্রোহী দল গড়ে তুলেছেন এবং নিজে পরিচালনা করেছেন। এই বিদ্রোহকে দমন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। অন্য যেকোন সরকার হলেও তাই করত। এই ব্যক্তিকে আমি এখন কী করে আলোচনার জন্য ডাকি? এই ব্যক্তি এখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং সামরিক বাহিনীর একাংশকে রাষ্ট্রবিরুদ্ধ কাজে উস্কানি দেবার দায়ে অভিযুক্ত। তাঁর জন্য এ কে ব্রোহী, যিনি সবচেয়ে ভাল আর সন্মানিত আইনজীবী, তিনি লড়ছেন। ব্রোহী এই কেইস নিতেন না যদি তিনি ভাবতেন যে মিলিটারি কোর্টে কোন ধরণের হাংকি-পাংকি হতে যাচ্ছে। আমি মুজিবকে প্রথমে গুলি করে পরে তাঁর বিচার করতে পারতাম না যেহেতু কিছু কিছু সরকার এরকম করে থাকে, আবার তাঁকে হঠাত করে ছেড়েও দিতে পারি না। এটা একটা বিরাট দায়িত্বের ব্যাপার। তবে, জাতি যদি তাঁর মুক্তি চায়, আমি তাঁকে মুক্তি দেব।
একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে
ভারতীয়রা এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পুর্ব বঙ্গ এবং আসাম শীঘ্রই এতে যোগ দেবে, এবং এর মাধ্যমে ভারতীয় ইউনিয়ন-এর ভাঙ্গনের শুরু হবে। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি এই মহিলার (মিসেস গান্ধী) শুভবুদ্ধি হোক।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১১। সন্ত্রাস পূর্বপাকিস্তানের একমাত্র পরিস্থিতি | বাল্টিমোর সান | ১৩ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১১, ২৫৯>
বাল্টিমোর সান, ১৩ নভেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র আইন – ‘ভয়’
একজন তরুণ পাট-কল সুপারিনটেনডেন্ট বলল, কেমন করে ঘন্টা খানেক আগে সে তার গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে যেটা সেনাবাহিনী পুড়িয়ে ফেলেছে এবং একজন তরুণ কলেজ স্নাতক নিহত হয়েছে।
তিনি জানেন না কেন সেনারা এসেছিল।
রাস্তার পাশে আরও ছয়টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং কিছু গেরিলাদের হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনা মুক্তিবাহিনীর দোষে হতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করলে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী মিল সুপারিনটেনডেন্ট ও একজন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক এমন ভাব করলেন যেন তারা নিজেরা অপমানিত হয়েছেন।
তারা বলেন, “না স্যার, না স্যার, এরা পাক বাহিনী! [পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর] পাক বাহিনী! পাক বাহিনী!”
মিল সুপারিন্টেনডেন্ট বলেন, তিনি পালিয়ে এসেছেন কারণ আর্মিরা সব শিক্ষিত বাঙালিকে হত্যা করছে এদেশের নেতৃত্ব শেষ করে দেবার জন্য। শিক্ষক এতে একমত প্রকাশ করলেন।
একই কথা ঢাকায় কিছু কূটনীতিকদের কথায় প্রতিফলিত হয় যারা কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন যে সেনাবাহিনী পর্যায়ক্রমে অধ্যাপক, ডাক্তার, আইনজীবী, ছাত্র এবং অন্যান্য শিক্ষিত বাঙ্গালীদের ধরছে এবং হত্যা করছে বা জেলে দিচ্ছে।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১১২। পরাজয়োন্মুখ যুদ্ধ | নিউজ উইক | ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১ |
<১৪, ১১২, ২৬০-২৬৪>
নিউজউইক, ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
উপমহাদেশ: পরাজয়োন্মুখ যুদ্ধ
রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো সাধারণত মামুলি আলাপ আলোচনা আর সম্ভাষণেই সীমিত থাকে। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউজের সাউথ লনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাগত জানালেন, তিনিও চেস্টা করেছিলেন সেই গৎবাঁধা নিয়মই মেনে চলতে, এমনকি আলোচনার নিয়ে এসেছিলেন ওয়াশিংটনের স্নিগ্ধ আবহাওয়াও। কিন্তু মিসেস গান্ধী ছিলেন অন্য মেজাজে। বাঙ্গালিদের উপর পাকিস্তানীদের অত্যাচার এবং এর ফলে সৃষ্টি হওয়া ৬০ লাখ শরণার্থির ঢলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করে তিনি নিক্সনকে বলেছিলেন যে তাঁর দেশ “এক বিশাল মানবসৃষ্ট বিপর্যয়” এর মোকাবেলা করছে। এদিকে ভারত ও পাকিস্তান যখন পরস্পরের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তিনি বললেন “আমি এখানে এসেছি আমাদের ওদিকের অবস্থার ব্যাপারটা (আপনাদের কাছ থেকে) গভীর ভাবে বুঝতে”। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই ব্যর্থ বলেই মনে হচ্ছে, কেননা প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার এই সমস্যা মেটানো তো দুরের কথা, ওয়াশিংটন আর নয়া দিল্লির মধ্যকার সম্পর্কের টানাপড়েন কিভাবে ঠিক করা যাবে সে ব্যাপারেও একমত হতে পারেননি।
শুরু থেকেই মিসেস গান্ধীর আশা ছিল তিনি হয়ত নিক্সনকে বুঝিয়ে পাকিস্তানীদের উপর চাপ প্রয়োগ করে তারা স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের উপর যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা বন্ধ করাতে পারবেন। তিনি আগের মতই বলেছেন যে কেবল মাত্র আমেরিকাই, যারা এখনও পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে এবং যারা এখনও বাঙ্গালিদের প্রতি পাকিস্তানের দমনমূলক নীতির সমালোচনা করেনি, পারবে ইসলামাবাদের সরকারকে বুঝিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু মিসেস গান্ধীর এই প্রস্তাবে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া, হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলবার এর মতে, “নতুন কোন সম্ভাবনা তুলে ধরেনি”। তেমনিভাবে আমেরিকার তরফ থেকে ভারতকে দেয়া পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়া এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্ততার প্রস্তাবও মিসেস গান্ধীর কাছে হালে পানি পায়নি। “আমার দেশের লোকেরা বুঝতে পারছেনা”, তিনি হোয়াইট হাউজের এক ডিনারে বলেই ফেললেন, “কিভাবে আমাদেরকে, যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি তাদেরকে যারা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী তাদের সাথে এক করে দেখা হচ্ছে”।
সব মিলিয়ে ভারতের নেত্রীর জন্য সপ্তাহটা ভালো ছিল না। একদিকে আমেরিকাকে বুঝানোর ব্যর্থতা, অন্যদিকে তাঁর নিজের দেশে বিশাল ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের ফলে অনেক মানুষ মারা গেছে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী উড়িষ্যার নিম্নভুমিতে প্রায় ১০০০০ মানুষ মারা গেছে। সবাই ধারনা করছে যে এর ফলে ধানক্ষেত নস্ট হবার কারনে এবং নদীতে ভাসমান লাশের কারনে নস্ট হওয়া পানির কারনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
অজেয় এক যুদ্ধ:
ভারতের জন্য বঙ্গোপসাগর তীরের এই বিপর্যয় এর চেয়ে খারাপ কোন সময়ে আসতে পারতো না। কারন এর ভঙ্গুর অর্থনীতি ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি শরনার্থিদের চাপে ধ্বসে পরার মত অবস্থায় চলে এসেছে। তাঁর উপর আবার আছে ক্রমশই অস্থির হয়ে ওঠা পাকিস্তান সেনাবাহিনির সাথে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়িয়ে পরার ভয়। যদিও ভারতের বেশিরভাগ সেনাই মোতায়েন করা আছে পশ্চিম দিকে, কিন্তু যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি আছে পুর্ব দিকেই। যুদ্ধ পরিস্থিতির অবস্থা যাচাই করতে নিউজউইকের সিনিয়র এডিটর আরনাউড ডি বোরশগ্রেভ গত সপ্তাহে পাকিস্তান সফরে গিয়ে এই রিপোর্টটি পাঠিয়েছেন:
“আপনার যেখানে খুশি গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসুন” এমনই বলেছিলেন আমাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। আর ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়ানোর কত কাছাকাছি আছে সেটা দেখার জন্য পুর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা সীমান্তের মত আদর্শ জায়গা কমই আছে। তাই আমি চড়ে বসলাম একটি দুই বগির সাপ্লাই ট্রেনে, যেটা যাচ্ছিল স্থানীয় হেড কোয়ার্টারের দিকে। যদিও সেখানে ভারতীয় গোলাবর্ষনের আশঙ্কা ছিল, সেনাবাহিনীর এক কর্নেল আমাকে নিশ্চিন্ত করতে বললেন “ওদের লক্ষ্যভেদ ভালো না”। নিরাপত্তা হিসাবে ইট দিয়ে ঘেরা এক বগিতে করে, যা কোন এক কালে হয়ত দ্বিতীয় শ্রেণীর কম্পার্টমেন্ট ছিল, আমি নার্ভাস ভাবে ভ্রমন করছিলাম। সীমান্তের সমান্তরালে আমরা ঘটাং ঘটাং করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ট্রেনটা থামানো হল, রেল লাইনের সামনের অংশে রিকোয়েললেস রাইফেলের গুলি বর্ষন চলছে। এই অবস্থায় হেঁটে কাছের কমান্ড পোস্টে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। একজন লম্বা পাঞ্জাবি সার্জেন্ট তার লাল দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল “ এই তো মাইল খানেক দুরেই”।
সেই এক মাইল গিয়ে ঠেকল সাত মাইলে। রেল লাইনের ধারের কর্দমাক্ত ধান ক্ষেতে একটু পরপরই মর্টার শেল এসে পরছিল আর রেললাইনের উচু মাটিতে রাইফেলের বুলেট গুলো এসে বিঁধছিল। ধান ক্ষেতের পানি মর্টার শেলের টুকরোগুলোকে আটকে রাখছিল আর ভারতীয় রাইফেলধারিরা আসলেই লক্ষ্যভেদে অপটু ছিল, সুতরাং প্রায় তিন ঘন্টা পর আমি নিরাপদেই পৌঁছে গেলাম ৩০তম পাঞ্জাব ব্যটেলিয়নের ডেল্টা কোম্পানির হেড কোয়ার্টারে। আশেপাশের নারকেল আর খেজুর কাছের কান্ডে এসে লাগছিল বুলেট আর কলাগাছ ভেদ করে চলে যাচ্ছিল সারাক্ষন। কোম্পানি কমান্ডারের ব্যাটম্যান কিছুক্ষণ আগেই নামাজ পরার সময়ে নিহত হয়েছে। এই ৯ মাইল সীমানা এলাকা রক্ষার দায়িত্বে থাকা এই ১৫০ জন সৈন্য সারাক্ষন দুটো জিনিষের মোকাবেলা করছিল, ভারতীয়দের গোলাবর্ষন আর মুক্তিবাহিনির (পুর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত বিদ্রোহী দল) জন্য চোরাগোপ্তা হামলা।
তবে সম্মুখ সমরে থাকা সেনাদের জন্য যতই ভয়ানক মনে হোক না কেন ভারতীয় বাহিনীর এই গোলাবর্ষন, তা পাকিস্তানি কম্যান্ডারদের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনি দেখা গেল। ‘এসব আমরা হজম করতে পারি’ সহজভাবেই বললেন ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আলিফ, “আমরা এতে ভীত নই, ভারতীয়রা যদি তাদের গোলা খরচা করতে চায়, তো করুক। এই লম্বা ৪৩ বছর বয়স্ক পাঞ্জাবি অফিসারটি, যিনি পাকিস্তান অলিম্পিক হকি দলের একজন সদস্য, এইমাত্র টেনিস খেলে এসেছেন; সীমান্তের যুদ্ধের চাইতে খেলা নিয়েই কথা বলতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। পাকিস্তান সদ্যই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে (ভারত হয়েছিল তৃতীয়) এবং আলিফের কাছে এর আলাদা একটা গুরুত্ব ছিল। সে তার হকি দলকে টেলিগ্রামে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছিল, “ভারতের বিরুদ্ধে তোমাদের জয় আমাদের মনোবল বারইয়ে দিয়েছে এবং এটিকে একটি সুলক্ষণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে এদিকে। তোমাদের নিয়ে গর্বিত।” তারপর সে বলল, পাকিস্তানের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি হকি খেলোয়াড় আছে ভারতে, কিন্তু তারপরেও আমরা ওদেরকে হারাই।” সে আসলে যা বুঝাতে চাচ্ছিল, সেটা ছিল পরিষ্কার, ভারতের বিপক্ষে সামরিক হিসাবে পাঁচ ভাগের একভাগ হওয়া সত্বেও পাকিস্তান হকির মত যুদ্ধেও ভারতের বিরুদ্ধে জয়ী হবে।
এরকম চিন্তাধারা অবশ্য প্রকাশ করে দেয় যে গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে কত কম জানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কারন যতদিন তাদের সৈন্যরা সীমান্তে নিয়োজিত ছিল, মুক্তিবাহিনী দাপট দেখিয়েছে পুরো পুর্ব পাকিস্তানে। সরকার তাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে রাজাকারদেরকে দিয়ে, তারা মূলত স্থানীয় কম বয়সী গুণ্ডাপাণ্ডা, যাদেরকে নিয়ে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন করা হয়েছে। কিন্তু রাজাকাররা সরকারকে সহায়তা করার বদলে ক্ষতিই করছে বেশি। “তারা মনে করে যে যেহেতু তাদের হাতে বন্দুক আছে, তারাই খোদা” এমনটি বলেছিলেন আমাকে এক গ্রামবাসী। তারা সবাইকে বলে যে পাকিস্তানি সেনারা তাদের বিদ্রোহীদের জীবন ঝালাপালা করার জন্যে যে কোন কিছু করার অধিকার দিয়েছে, কিন্তু আসলে তারা তাদের শক্তি দেখায়, যারা তাদেরকে খাবার দাবার দিতে অথবা মেয়েদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের উপর। আমার গাড়িও রাজাকাররা কয়েকবার থামিয়েছে, তাড়াহুড়ো করে বানানো টোল সেতুর সামনে, যেখানে জানালা দিয়ে একটি বন্দুকের নল তাকিয়ে আছে। তারা আমার কাছে “টোল” দাবী করেছে। এরকম অত্যাচার যখন তারা সাধারণ জনগণের উপর চালিয়েছে, তখন বেশির ভাগ বাঙ্গালিই হয়ে গেছে মুক্তি বাহিনীর সমর্থক: তাদেরকে আমি যখন জিজ্ঞাসা করেছি যে তারা কি পাকিস্তানের অংশ হিসাবে থাকতে চায় নাকি নতুন দেশ বাংলাদেশ এ থাকবে, বেশিরভাগই উত্তর দিয়েছে, “বাংলাদেশ”।
এদের বাইরেও অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশকে আশা করছে। রাজধানী ঢাকার অদুরে এক ফেরি পারাপারের সময় আমি সরকারই চাকরিরত একজন যুবককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেশের মানুষের জন্য কি ভালো হবে। শুরুতে সে উত্তর দিল “আমার এসব বলা নিষেধ আছে”। তারপর তাড় নাম না প্রকাশ করার শর্তে সে খুব মৃদু স্বরে বলল “অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া উচিৎ। আমরা সবাই সেটাই চাই”। এবং হাজার হাজার লোক তাইই চায়। যদিও সবুজ শাদা পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে বেশিরভাগ বাড়ির উপর, এবং চাষাভুষোরাও তাদের জাতীয় রঙের পোশাক পরে থাকছে, তাদের অনেকেই ফিসফিস করে আমাকে জানিয়েছে যে তারা এসব করছে শুধু মাত্র রাজাকারদের ভুল বুঝানোর জন্য।
দক্ষিণ ভিয়েতনামে থাকা আমেরিকানদের মতই পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ মনে হচ্ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন ও আনুগত্যের ব্যাপারে ভয়ানক উদাসীন। সরকারিভাবে সবই যে ঠিক থাক আছে সেটা জোর করে বলার চেষ্টা দেখা যায় ইস্টার্ন সেক্টর কমান্ডার জেনারেল এ এ খান নিয়াজির বক্তব্যেও। বিদ্রোহীরা এমন কোন বড় সমস্যা না, “আমাদের রাজাকাররাই তাদেরকে সামাল দিতে সক্ষম”, ভারতের সীমান্তের দিক থেকে আসা গোলাবর্ষনও বড় কোন সমস্যা না, “আমাদের সেনারা বিচলিত না, তারা যতক্ষণ বাঙ্কারের ভেতরে আছে, তারা আরাম করে এমনকি তাস খেলতে পারে”। আর মুক্তিবাহিনীর নেতারা ঢাকার রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য দেশবাসীকে ডাক দিচ্ছে, এমন সংবাদের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, সেরকম হলে ভালই হবে। “আমি চাই তারা সেরকম কিছু করুক”, তিনি আমাকে বলেছেন। “আমার ট্যাঙ্কগুলো শহরের কাছেই আছে”। তারপর গত মার্চে বাঙ্গালী বিদ্রোহ দমনের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন ” তারা দেখেছে আমরা কি করতে পারি, এবং দরকার হলে আমরা আবার করে দেখাব”।
এই জেনারেল যেটা স্বীকার করছেন না সেটা হল ক্রমাবনতিশীল আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক দক্ষতা। গত সপ্তাহের হিসাব মতে সরকার পুর্ব পাকিস্তানের ২৫% পুলিশ থানার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। জেলা প্রশাসকদের একটি বড় অংশ গোপনে গেরিলাদের সহায়তা করছে এবং ঢাকার উত্তরের বড় একটা অংশ এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আমার সাথে মুক্তিবাহিনীর দূত ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছে ঢাকায় আমার হোটেলে উঠার ৩০ মিনিটের মধ্যেই, পুলিসের কঠিন প্রহরা থাকা সত্বেও। মুক্তিবাহিনী মনে হচ্ছে বেশ গোছানো একটা পদ্ধতিতে কাজ করছে, কোন দল হয়ত চাঁদা আদায় করছে, কোন দল ব্যাঙ্ক ডাকাটি করছে, কোন দল হয়ত কাজ করছে অন্তর্ঘাতক হিসাবে, আবার কেউ কেউ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করছে।
বাঙ্গালীদের সংগ্রামের তিক্ত সত্যটা শুধু যে স্থানীয় গভর্নর এ এম মালেকের কাছেই চেপে যাওয়া হচ্ছে তা না, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেও ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। টাদের দুইজনেরই ধারনা যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এখানে কার্যকরভাবে এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেই গেরিলাদের সাথে যুদ্ধও করছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল বিদেশী সংবাদদাতারা সৈন্যদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ এনেছেন। দৃশ্যত বিদ্রোহীদের ধাওয়া করার নামে সৈন্যরা কিছুদিন আগে ডেমরা গ্রাম ঘেরাও করে (যেখানে মুক্তিবাহিনী কখনোই ছিল না) সেখানকার ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব মেয়েকে ধর্ষন করে এবং ১২ বছরের বেশি বয়সের সকল পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে। তার মাত্র কয়েকদিন পরেই পাকিস্তানি গানবোট চালনর কাছে নদীতে টহল দিতে গিয়ে মাছ ধরা নৌকা ডুবিয়ে দেয় ও সাঁতরে পারে উঠতে চাওয়া জেলেদেরকে গুলি করে মারে। এসবের ফলে পুর্ব পাকিস্তানের প্রতিরোধ সংগ্রামই কেবল শক্তিশালী হচ্ছে, আরো নিবেদিত হচ্ছে। জনগণের বেশিরভাগই এখন পাকিস্তান ভেঙ্গে বের হয়ে যেতে অধীর অপেক্ষায় আছে, আর অন্যদিক সেনা কমান্ডাররা যতই বাগাড়ম্বর করুক না কেন, তারা নিজেরাও বুঝতে শুরু করেছে যে তারা এমন এক গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পরছে যেটায় জেতা সম্ভব না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাক্ষাৎকার
দুই সপ্তাহ আগে নিউজউইকের আরনাউড ডে বোরশগ্রেভ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। গতসপ্তাহে, ভারত আর পাকিস্তান যখন প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিউজউইকের ফরেন এডিটর এডওয়ার্ড ক্লাইনকে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেন। নীচে সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ।
পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ:
বেশ একটা লম্বা সময় ধরে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের হুমকি মূলক ভাষণ, কাজ এবং উস্কানির মুখেও ভারত কিছুই করেনি। এখন যদি আমরা নিজেদেরকে হুমকির সম্মুখীন মনে করি, তাহলে তো আমরা আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত রাখতে পারি না। আমি জানি না পৃথিবীর কোন দেশটা বলবে “আমরা আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত রেখে দিই …” আমাদের কি করা উচিত যখন আমাদের সীমান্তে এরকম কিছু হয়? আমরা কি চুপ করে বসে থাকব আর বলব “ তোমাদের যা ইচ্ছা হয় কর, যদিও এসব কাজের গুরুত্ব আমাদের কাছে অসীম?” … আমি বরং এভাবে বলব, ভারতের সাধারন জনগন যুদ্ধ চায় না। আমাদের মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ কিছু লোক অবশ্যই আছে, কিন্তু আমাদের জনগনের মধ্যে পাকিস্তান বিরোধী ধারনা নেই, যদিও পাকিস্তানীদের মধ্যে ‘ভারত ঘৃনা কর’ মতবাদ জনপ্রিয়। আমি মন থেকে আশা করি যে যুদ্ধ হবে না, এবং আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি সেটা নিশ্চিত করার জন্য … যুদ্ধের সম্ভাবনা আমরা অনেকটা কমিয়ে এনেছি পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে সেনা পাঠিয়ে। কিন্তু অবস্থা ঘোলাটে হয়ে উঠছে পুর্ব দিকে, আর সেখানে যুদ্ধের হাতছানি। আমরা মনে করি পর্ব ভারতের উপর বিপদের আশঙ্কা প্রতিদিন বাড়ছে।
বাঙ্গালিদের সমর্থনের ব্যাপারে:
শুধুমাত্র যখন শরণার্থিরা আসা শুরু করলো তখনই কেবল মাত্র ভারত এই পাকিস্তান সঙ্কটে জড়িয়ে পরতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক অত্যাচারের দেখার পরেই আপনি বলতে পারেন “ হ্যাঁ, কিছু গেরিলারা হয়ত ভারত থেকে আসছে” … হয়ত কিছু ট্রেনিং হচ্ছে আমাদের এদিকে, কিন্তু কিন্তু নিশ্চয়ই পুরোটা নয়। এমনকি এখনো গেরিলারা ভারতের উপর নির্ভরশীল নয়। আপনারা জানেন যে গেরিলাদের একটা বড় অংশই পুর্ব পাকিস্তানের প্যারা মিলিটারিরর অংশ … আর এখন তারাই নতুনদেরকে ট্রেনিং দিচ্ছে … বাঙ্গালীদের জনগনের স্পৃহার মর্মমূলে গভীর আঘাত হেনেছে ওরা। আর যতদিন এই স্পৃহা থাকবে, পাকিস্তানী বাহিনীকে পুর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকেই মেরে ফেলতে হবে যদি তারা সে অঞ্চল নিয়ন্ত্রন করতে চায়। ভারত শুধুমাত্র সেই গনহত্যাকে রুখতে পরোক্ষ ভাবে কিছু কাজ করতে পারে। আর আমি দ্ব্যার্থহীনভাবে বলতে পারে যে আজ যদি আমি বাঙ্গালীদের অবস্থানে থাকতাম, তাহলে আমি যুদ্ধ করে যেতাম। কারন আমরা এর আগেও ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ করেছি এবং আমরা পৃথিবীর সর্বত্রই স্বাধীনতাকামীদের সমর্থন করে এসেছি।
বাঙ্গালী শরণার্থিদের ব্যাপারে:
এত শরণার্থিদের আশ্রয় দেয়া মানেই হচ্ছে অনেক খাতে খরচ কমিয়ে দেয়া। এর মানেই হচ্ছে একটু মিতব্যায়িতার সাথে জীবন চলা, সরকারী অনেক খরচ কমিয়ে আনা এবং অনেক পরিকল্পনা আর কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা। এটা অবশ্যই একটি বিরাট এবং ভারী বোঝা। আমি মনে করিনা এর জন্যে আমাদের অর্থনীতি ভেঙ্গে পরবে, আমরা এর জন্যে ভেঙ্গে পরব না, তবে এই বিরাট অর্থনৈতিক বোঝাও আসলে মূল সমস্যা না। কিন্তু এর কারনে কে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলো নিয়েই আমাদের মাথা ব্যাথা। আমাদের নিরাপত্তার জন্য একটা বিশাল ঝুকি আছে বলেই আমরা মনে করছি।
পাকিস্তানের ভাঙ্গন সম্পর্কে:
আমি মনে করিনা যে সুস্থ মস্তিকের কেই চাইবে তার প্রতিবেশি দেশ ভেঙ্গে যাক। আমাদের এমনিতেই অনেক সমস্যা আছে, প্রতিবেশি দুর্বল না হওয়া সত্বেও, এটা একটা সুস্থ অবস্থা না … (কিন্তু) আমাদের মুল্যায়ন হচ্ছে যে পুর্ব বাংলা আর কোনভাবেই আগের মত করে পাকিস্তানের সাথে থাকতে পারবে না।
ভারতে দেয়া সোভিয়েত সাহায্য সম্পর্কে:
আমি কখনই কারো কাছে সাহায্য চাইনি। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনও আমি কাউকে বলিনি “আমাকে কি এই কাজটা করে দেবে, অথবা এটা কি আমাকে দেবে”। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করিনি। আমি তাদের কাছে অন্যান্য দেশের মতই অবস্থাটা আসলে কি সেটা ব্যাখ্যা করেছি। এখন এটা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা অন্যান্য দেশের ভেবে দেখার ব্যাপার যে এই এলাকার জন্য ভারতের স্থিতি গুরুত্বপুর্ন কি না। আমরা যে কোন জায়গা থেকেই সহায়তাকেই স্বাগত জানাই। আমরা সহানুভুতিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমি সারাজীবন নিজের পায়ে দাড়াতে শিখেছি এবং আমি চাই ভারত সব সময়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক। আমরা পৃথিবীর কোন দেশের উপর নির্ভরশীল হতে চাই না।
ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে:
সে হচ্ছে এমন এক লোক যে তার নিজের দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাতে জিততে পারতো না। আমি বলবো, সে এমনকি তার নিজের প্রদেশের নির্বাচনে জিততে পারবে না যদি নির্বাচনটা সুষ্ঠু হয় … গত সপ্তাহের নিউজউইকে দেয়া ইয়াহিয়া খানের সাক্ষতকারের ব্যাপারে কিছু বলতে বলা হলে ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে ইয়াহিয়া তাঁকে “সেই মহিলা” বলে ইঙ্গিত করেছিলেন সেখানে। সেই মহিলা! আমি তার বক্তব্য নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না, কিন্তু এই মতব্য থেকেই বোঝা যায় সে কি ধরনের মানুষ। সে কিভাবে নিজেকে পুর্ব পাকিস্তানকে সামলানোর জন্য যোগ্য ভাবে? সে যদি তার নিজের দেশের একটা অংশকেই ঠিকমত সামলাতে না পারে, তাহলে ভারতের ব্যাপারে তার মতামতের কি গুরুত্ব আছে? সে কি জানে আমাদের ব্যাপারে? এটা তার চেনাজানা গন্ডির বহু বাইরের ব্যাপার।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৩। পাকসেনা আক্রমণের পর একটি শহর | নিউইয়র্ক টাইমস | ১৭ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১৩, ২৬৫>
নিউ ইয়র্ক টাইম, ১৭ নভেম্বর ১৯৭১
আর্মি আক্রমণের পরে পূর্ব পাকিস্তানের শহর
আগুণ আর ধ্বংস
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের একটি টাস্কফোর্স পূর্ব পাকিস্তানের শহর শকহামাগার এসেছিল। তারা ২৭ অক্টোবর আসে এবং এটা ধ্বংস করে। এর জনসংখ্যা ছিল ৮০০০।
দৃশ্যতঃ জানা যায় – বাসিন্দাদের মতে ভুল করেএকটি গেরিলা দল এখানে ছিল, সেনাবাহিনী মোটর লঞ্চ থেকে কোনও সতর্কতা ছাড়াই আক্রমণ করে। ঢাকা থেকে ২০ মাইল দূরত্বের এসে লঞ্চের ইঞ্জিনগুলির শব্দ মানুষকে সতর্ক করে দেয়, ফলে তারা অধিকাংশই কাছাকাছি পুকুর, খাল ও ধান ক্ষেত্রের মধ্যে পালিয়ে যায়।
তারা ঘর এবং কুড়েঘরে গুলি করতে করতে আগাতে থাকে। বাহিনী প্রায় সকল ঘরেই আগুণ দেয়। যারা বেঁচে ছিল তারা কবরস্থান দেখিয়ে বলে যে সেখানে ১৯ জনকে কবর দেয়া হয়েছে।
কংক্রিট স্কুলের আসবাবপত্র এবং দরজা খুলে নিয়ে সন্ধ্যার খাবারের জ্বালানি হিসেবে ব্যাবহার করে সেনাবাহিনী। রাইস মিল ধ্বংস করা হয়। গ্রামবাসীদের সদ্য গুদামজাত চাল পুরীয়ে দেয়া হয় এবং কিছু গরু ও ছাগল জবাই করা হয়।
প্রচুর গম যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে পাঠানো হয়েছিল সেগুলো সৈন্যরা তাদের নৌকায় বোঝাই করে নিয়ে যায়।
ফসফেট সারের একটি গুদাম পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং অধিকাংশ ব্যাগ ধ্বংস করা হয়।
মসজিদের অন্তর্গত বেশ কয়েকটি ভবনে আগুণ জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়- সেখানে প্রায় ৪০০ জন হিন্দু ছিল- সব মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মূর্তিগুলির মাথা গুলি করে ফেলে দেয়া হয়।
স্থানীয় পোস্ট অফিসটিও বরখাস্ত করা হয় এবং গ্রামবাসীরা বলে যে সৈন্যরা সেটার স্ট্যাম্প এবং অর্থ নিয়ে যায়।
একজন গ্রামবাসী বলেন, ‘আপনারা দেখুন, তারা আমাদের ফলও ধ্বংস করেছে। এধরনের কলা গাছ বেড়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগেছে, এবং সৈন্যরা এগুলোর চারপাশে খড় জ্বালিয়ে এগুলো ধ্বংস করেছে।”
অন্য এক ব্যক্তি, কাঁদতে কাঁদতে এই সংবাদদাতাকে বলেছিলেন: “আপনারা আমেরিকানরা সাহায্য দিচ্ছেন – আপনার কি জানেন আমাদের গম এবং তেল ও ওষুধের সাহায্যে কাদের সাহায্য করেছেন? আপনারা কেবল ইয়াহিয়ার হত্যাকারীদের সাহায্য করেছেন।”
শেখরনগরের ভাগ্য সম্পর্কে একজন বিদেশী কর্মকর্তা মন্তব্য করেন: “এটা নিশ্চিতভাবে মনে হয় যে, এই ধরনের ঘটনাগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বাইরের জাতিগুলি মানবিক ত্রাণ ক্রস পারপাসে কাজ করছে। আমরা খাদ্য ও সার নিয়ে আসি এবং সেনাবাহিনী সেগুলো জব্দ করে বা পুড়িয়ে ফেলে।’’
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৪। যুদ্ধ না শান্তি | নিউজ উইক | ২২ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১৪, ২৬৬>
নিউজ উইক, ২২ নভেম্বর, ১৯৭১
ভারত– পাকিস্তান, যুদ্ধ না শান্তি ?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত যুদ্ধ যুদ্ধে রূপান্তরিত হবে কিনা তা নিয়ে ওয়াশিংটন আধা-আধা দ্বিধাবিভক্ত।
এমনকি ক্যালেন্ডার অপমানজনক দেখায়। বর্ষাকাল শেষ হয়েছে এবং তুষার আসছে (যা পাকিস্তানকে দেবে চীনের সাহায্যের হাত) ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। সময়সূচি অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের এটাই সঠিক সময় যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধিকাংশই বেইজে থাকে।
সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতকে সমর্থন করে, এমনকি দিল্লির সমস্ত দাবি প্রমাণিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, গত সপ্তাহে ৭০০০০ রিজার্ভকে নাটকীয় কল আপ করার ব্যাপারটি সম্ভবত শুধুমাত্র ৫০ (এইচ) যুদ্ধ-প্রস্তুত জোয়ান উত্পন্ন করবে। তা সত্ত্বেও ভারত সেনাবাহিনীর সংখ্যা পাকিস্তানের তিন গুন। এবং তার বিমানবাহিনী- যা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ব্যার্থ হয়েছিল – সেটাও অনেক বড় ও উন্নততর সরঞ্জামে সজ্জিত। ভারতীয়রা সোভিয়েত এটাক বোম্বার চালায় এবং এম আই জি – ২১ চালায়; পাকিস্তান অপ্রচলিত ইউএসএফ -৮৬ জেট বিমান এবং চীনা-নির্মিত এমআইজি -১৯ চালায়। তাছাড়া পাকিস্তানের শুধু এক মাসের যুদ্ধের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।
শেষ মিনিটের কূটনৈতিক পদক্ষেপের উপর একমাত্র আশা আছে।রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ইউএসকে বলেন, তিনি তার বাহিনীকে একতরফাভাবে ফিরিয়ে আনবেন- এবং বেআইনী বাঙালি সরকার এবং তার রাজনৈতিক বাহিনী , আওয়ামী লীগের সাথে সাক্ষাত করবেন। ভারত মনে করে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ও শরণার্থী বন্যা বন্ধ নাও হওয়া পর্যন্ত তা প্রত্যাহার করবে না। জেলে বন্দী বাঙালির নেতা মুজিব মুক্তি দিতে হবে ও পূর্ব পাকিস্তানকে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৫। উপমহাদেশের জন্য সাহায্য অপ্রতুল | নিউ ইয়র্ক টাইমস | ২২ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১৫, ২৬৭>
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২২ নভেম্বর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
উপমহাদেশের জন্য সাহায্য অপ্রতুল
জাতিসংঘ ভারতীয় উপমহাদেশে একটি বিধ্বংসী ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কারণ তারা আসলে মরণঘাতী ক্ষততে ব্যান্ড-এইড ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।
ভারত ও পাকিস্তান যখন সর্বাত্মক যুদ্ধের কাছাকাছি চলে এসেছে, বিশ্ব সংস্থা তখন পূর্ববাংলার থেকে ভারতে পালিয়ে আসা আনুমানিক নয় কোটি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে তর্কবিতর্ক করছে এবং বিদ্রোহী বাহিনীর প্রদেশে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বাঙালিদের পিছনে পরে আছে।
একথা প্রশ্নাতীত যে পূর্ববাংলার মানুষের মানবাধিকারের প্রয়োজন। যারা নিরন্তর পালিয়ে গিয়েছে, অথবা যারা নিষ্ঠুর সামরিক দমনের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে তাদের মানবতার বিবেকের উপর ভারী দাবি রয়েছে।
কিন্তু ইউ.এ. কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য থেকে স্পষ্ট হয় যে কেবলমাত্র ত্রাণ সহায়তা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তীব্র মানবিক সংকটের সমাধান করতে পারে না। সহকারী সেক্রেটারি-জেনারেল পল মার্ক হেনরি সাবধান করে দিয়েছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে সামরিক কার্যকলাপের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন। এটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হতে পারে। ইউএন এর হাইকমিশনার প্রিন্স সদরউদ্দীন আগা খান বলেন যে, উদ্বাস্তুদের যারা পালিয়ে গেছে তাদের প্রত্যাবাসন করতে পারলেই কেবল মাত্র বর্তমান সংকটের জন্য একটি “টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান” হবে।
বাঙালিদের মানবিক চাহিদার কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য, এই সমস্যাটির মূল কারণ সরাতে হবে আর তা হল – পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকট। একটি রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য। পাকিস্তান সেখানে সমস্যা শেষ করবে এবং শরণার্থীদের নিরাপত্তা ফিরে আসতে অনুমতি দেবে।
জাতিসংঘ এ পর্যন্ত এই কেন্দ্রীয় ইস্যুটি এড়িয়ে গেছে, যদিও সচিব-জেনারেল ইউ থান্ট কয়েক মাস আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে উপমহাদেশের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শান্তি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে- এই ভবিষ্যদ্বাণী বর্তমান ঘটনাগুলিতে ভারতীয় পাকিস্তানি সীমান্ত বরাবর ক্রমশ বেড়ে উঠেছে। থান্টের মধ্যস্থতা করার প্রচেষ্টা ভারত ফিরিয়ে দিয়েছে এবং সমস্যার উৎসের দিকে মনোনিবেশ করার জন্য পাকিস্তানে নিপীড়নের প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য বলেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই বলেছেন যে, যদি এই মৌলিক সমস্যাটির দিকে নজর দেওয়া হয় তবে ভারত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানবে।
যদি ইউনাইটেড নেশনস উপমহাদেশে শান্তি ও পুনর্বাসনের জন্য একটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে, তবে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতাদের সাথে একটি সমাধানে পৌঁছানোর জন্য বিশ্ব সংস্থা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ঠেলে দেবে। বিশেষ করে কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিষ্পত্তির উন্নয়নের জন্য একটি নির্ধারিত প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘ ভারত-পাক সীমান্ত থেকে বাহিনী প্রত্যাহার এবং নির্যাতিত বাঙালিদের সহায়তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।
শিরনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৬। মধ্যস্থতার সময় এখনো আছে | নিউইয়র্ক টাইমস | ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১৬, ২৬৮>
নিউইয়র্ক টাইমস, ২৭ নভেম্বর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
মধ্যস্থতার সময় এখনো আছে
সীমান্তে সাহসী সংঘর্ষের সময় ভারতীয় সেনারা ‘আত্মরক্ষা’র জন্য পূর্ববাংলায় প্রবেশ করে। ভারত ও পাকিস্তান এর যুদ্ধদশা আসন্ন। আন্তর্জাতিক কূটনীতির এখনো উপমহাদেশের শান্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ আছে।
ভারত পুর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করার জন্য ক্রমাগত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা মনে করে এর ফলে পুর্ব পাকিস্তানের পক্ষে স্বাধীনতা লাভ করা সহজ হবে যার ফলে পাক-ভারত বড় কোন ঝামেলা ছাড়াই ৯ মিলিয়ন শরনার্থি দেশে ফিরে যাবার বিষয়টি তরান্বিত হবে।
এটা হবার সম্ভবনা কম। যদিও পাকিস্তানের চাইতে ভারতের শক্তি ও জনবল বেশী আছে তথাপি ইসলামাবাদের সামরিক সরকার ভারতের সাথে কোন রকম দফারফা ছাড়া পুর্ব অঞ্চলের দখল ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। দ্রুত আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ না হলে বিশেষ করে পশ্চিম অঞ্চলের সীমানায় পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করার সম্ভবনা আছে বলে মনে হয়।
জানা গেছে হোয়াইট হাউস নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ করেছে বিষয়টি দেখতে। জরুরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ভারত উপমহাদেশের সম্ভাব্য পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এটা একটা স্বাগত জানানোর মত পদক্ষপ হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৭। দক্ষিণ এশিয়া | বাল্টিমোড় সান | ২৮ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১৭, ২৬৯>
বাল্টিমোড় সান, ২৮ নভেম্বর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
দক্ষিণ এশিয়া
দক্ষিণ এশিয়ায় তীব্র উত্তেজনা থামানোর জন্য প্রস্তাবিত পদ্ধতিগুলি বেশিরভাগ সন্দেহজনক। যেমন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কিছু প্রস্তাব যুদ্ধকে সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করতে পারে কিন্তু যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টির যে কারণ সেই মৌলিক বিষয়গুলির সমাধান তাতে হয়না।
একইভাবে ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত থেকে তাদের সৈন্য ফিরিয়ে আনতে পারে; এটা যুক্তিসঙ্গত মনে হতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে দীর্ঘ দিন এবং বিভিন্ন সীমান্তের পরিস্থিতিতে এটি গ্রহণ করা হলে কার্যকর হবে না সম্ভবত।
ভারত এর অবস্থান স্পষ্ট – সম্ভবত ভারত বিশ্বাস করে ঘটনা তার অনুকূলে যাচ্ছে।
পাকিস্তান যদিও আন্তর্জাতিক সীমান্তে ভারত দ্বারা আগ্রাসী অভিযানের সম্মুখীন, তবে তার সত্যতার ব্যাপারে অনিশ্চিত, এবং হয়ত সেগুলি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা নাও করতে পারে যেখানে সংকটের কারণগুলিও পরীক্ষা করা হবে।
দুই দেশের সহযোগী বড় শক্তিগুলো নিরাপত্তা পরিষদে এবিষয়ে আলোচনা করতে পছন্দ না করতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সমর্থন করে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এই মুহুর্তে তারা বিশৃঙ্খলা চাচ্ছেনা।
এটি একটি সুস্পষ্ট ধারণা যে, চীন যদিও পাকিস্তানের সমর্থনকারী তবে নিরাপত্তা পরিষদে তাদের প্রথম অংশগ্রহণে এই বিষয় নিয়ে আসতে চায় না যা দীর্ঘ মেয়াদে চীনের পরিকল্পনাকে আপোষ করতে পারে। সেই বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্কের দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কী লাভ হবে? এতে করে তারা ভারত- পাকিস্তান সম্পর্কে কতটা নগ্নভাবে পরিচালিত করছে তা প্রকাশ হয়ে পড়বে।
ব্যক্তিগত কূটনীতি একটি সমাধান দিতে পারে। তবে এটিকে ভাল প্রতিশ্রুতিশীল বলা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকা সম্ভবত পাকিস্তান রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের দ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে আলোচনার বিষয়ে আহ্বান জানাচ্ছে বা জানাবে বলে ভাবছে। এটি যুক্তিযুক্ত মনে হলেও শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কোন অঞ্চলে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দি আছেন। সেটি ইয়াহিয়ার জন্য ব্যার্থতা ও নিষ্ঠুরতার দিকনির্দেশ করে।
এটা মানতে হবে হবে যে বিষয়গুলি এমন ভাবে চালিত হয়েছে যে গত মার্চ মাসের আগে যে পাকিস্তান ছিল তা এখন আর নেই। এবং যদি এটি পুনরায় পুনর্গঠন করা হয় তবে পুনর্গঠনকে অবশ্যই এমন একটি ভিত্তিতে গঠন করতে হবে যা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেবে। — যা ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন। আমরা আশা করি না যে ইয়াহিয়া এখনো “রাজনৈতিক সমাধানের” জন্য আলোচনা করতে প্রস্তুত।
শিরনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৮। ভারত কখন আক্রমণ করবে | টাইম | ২৯ নভেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১৮, ২৭০-২৭১>
টাইম ম্যাগাজিন, ২৯ নভেম্বর ১৯৭১
ভারত – যদি না, কিন্তু কখন?
প্রধানমন্ত্রী তার পশ্চিমের দেশে ৩ সপ্তাহের সফর শেষে প্রথম যে কাজটি করেছেন তা হল পার্লামেন্টে গিয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। পরিস্থিতির আশু সমাধান আপেক্ষিক। নয়াদিল্লীর সরকারি মুখপাত্র বলেন ভারত পাকিস্তান সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়েছিল যখন পশ্চিমবঙ্গে ১৮০০ জন পাকিস্তানি রেগুলার সেনা প্রবেশ করেছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজিবন রাম পার্লামেন্টে বললেন পাকিস্তানের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত। সাড়া দেশ জুড়ে বাজি লাগছিল কখন পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ শুরু হবে।
মিসেস গান্ধি আশাবাদী যে পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে। তিনি বলেন একেবারে সমাধানযোগ্য নয় এমন সমস্যারও সমাধান আছে। তিনি বলেন যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিমারা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত ভারত একা কোন ব্যাবস্থা নেবে না। তিনি আশা করেন যে তারা প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারকে চাপ দেবেন একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যা পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
যদিও ইন্দিরার সফরে শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক সাহায্য এসেছে তথাপি ভারত অনেক বড় অর্থণৈতিক চাপে আছে যার পরিমাণ এই অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত ৮৩০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। ১৯৭০ সালে গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট ছিল মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ৫৬০ মিলিয়ন জনগণের দেশ হিসেবে ভারতের পক্ষে এই চাপ সহ্য করা মুশকিল।
জাতিগত উত্তেজনা
অর্থোণৈতিক ব্যয়ের পাশাপাশি ৯৭০০০০০ জন শরণার্থী সামাজিক টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি করছে এবং জাতিগত উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই আছে ৭০০০০০০ জন শরনার্থি এবং আরও আসছে। ভারত সরকার ভয়ে আছেন যে অনেক হিন্দু শরনার্থি যারা মূলত একা (অর্থাৎ যাদের পরিবারে কেউ নেই) তারা হয়ত পাকিস্তানে মুসলিম মিলিটারির ভয়ে আর নাও ফিরে যেতে পারে।
গত মার্চে যখন সমস্যা শুরু হল তখন সীমান্ত এলাকায় অনেকেই সাহায্যের জন্য এগিয়ে গিয়েছিল। এখন পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের চাপ এত বেশি যে অনেক উত্তেজনা বিরাজ করছে – তাই ক্যাম্পে সশস্ত্র পাহারা দেয়া হয়েছে – এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীরা কাঁটাতার দিয়ে রিলিফ ক্যাম্পের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছেন।
উত্তেজনা মূলত বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আগে পাওয়ার ব্যাপারে এবং অনেকে চাকরি নিয়ে চিন্তিত। ক্যাম্পের ভেতরে শরনার্থিদের বলা হচ্ছে কোন কাজ না খুঁজতে এবং পাশের গ্রামের ভেতরে না যেতে। স্থানীয়দের সাথে এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে যে শরণার্থীরা দিনে ১ রুপি (২৫ সেন্ট) তে কাজ করতে চায় আর স্থানীয়রা দিনে আড়াই রুপি নেয়। ক্ষেতমজুর, দোকানের কর্মচারি এরা এবং নদীয়ার অন্যান্য ওয়ার্কিং ডিস্ট্রিক্ট এর কর্মচারিরা স্থানীয় চাকরিদাতাদের অনুরোধ করছে যাতে তারা শরনার্থিদের চাকরি না দেয়। স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করে যে কেরোসিন, সবজি আর অন্যান্য খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
অনেকগুলো ঘটনা নির্দেশ করে যে স্থানীয় জনগণ নূন্যতম কেয়ার পাচ্ছেনা যা কিনা শরনার্থিদের দেয়া হচ্ছে। কৃষক যোগেন মণ্ডল বলে যে – এই লোকগুলো হল খারাপ লোক। প্রত্যেকের তিনটি রেশন কার্ড আছে। রেশনের কিছুটা রেখে দিয়ে বাকিটা তারা বিক্রি করে দেয়। তারা ফ্রি মেডিকেল চিকিৎসা পাচ্ছে – অথচ তারা অনেকেই আমাদের থেকে ভালো আছে। বাহেন্দ্রনাথ রায় বলেন পূর্ব পাকিস্তানের মনিরামপুর কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল একজন শরনার্থি। আমরা জানি স্থানীয় লোকেরা আমাদের উপস্থিতি পছন্দ করছে না এবং প্রতিদিন ঝগড়া বিবাদ হচ্ছে। ক্যাম্প এর কর্মচারিরা আমাদের তেমন রেশন দিচ্ছেনা। এবং আপনি যদি অভিযোগ কেন্দ্রে যান তাহলে স্থানীয়রা আমাদের মারধর করে।
বড় সমস্যা
যানা মতে হিন্দু মুসলিম দের মাঝে উল্লেখযোগ্য দাঙ্গা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে তথাপি এখন পশ্চিমবঙ্গে অর্থণৈতিক ও জনসংখ্যার চাপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় যখন পূর্ব বাংলা মুলসিম দেশের সাথে থাকতে চাইল তখন সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা ৪০০০০০০ হিন্দুর বিশাল জনসংখ্যার বোঝার কারণে পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্ব রয়েছে এবং সেই অর্থনৈতিক অবনতি থেকে পশ্চিমবঙ্গ এখনো উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। সেই থেকে এই এলাকা সন্ত্রাসীদের জন্য একটি স্বর্গ – ক্রিমিনালরা রাজনীতির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে – অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছেলেরা চাকরির কোন সন্ধান পাচ্ছেনা। কিন্তু কর্মচারিরা তার উপর এত লক্ষ লক্ষ মানুষের চাপ সহ্য করছে – এতে করে অন্যান্য সমস্যা প্রায় চাপা পরে গেছে। মিসেস গান্ধির পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা সিদ্ধার্থ সংকর রায় বলেন, ‘আমার বড় সমস্যা হল শরনার্থিদের থাকতে দেয়া ২৫০০ স্কুল আমি কখন শুরু করতে পারব।’
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৯। পূর্ব পাকিস্তানঃ পুনর্দখলকৃত উপনিবেশ | আটলান্টিক ম্যাগাজিন | ডিসেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১১৯, ২৭২>
আটলান্টিক ম্যাগাজিন, (আমেরিকা) ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানঃ পুনর্দখলকৃত উপনিবেশ
রাস্তার পাশে একজন গ্রামবাসী, বেপরোয়াভাবে উদ্বিগ্ন যে দুই বিদেশী সৈন্যবাহিনীর করা বিপর্যয় দেখতে পাবে, গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে চুপিসারে বলল “জামালপুর যান এবং সবকিছু বুঝবেন।”
জামালপুর একটি শহর যেখানে রাস্তায় কোন শিশু নাই, যে দোকানগুলি আছে সেখানে কোন ব্যাবসা নাই, প্রায় কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছেনা, যা কোলাহলপূর্ন ছিল। বিদেশীদের দেখলে মানুষ সরে যাচ্ছিল, দোকানদারের হাত কাঁপছে যখন তারা অনাকাঙ্ক্ষিত বিদেশী অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছিল এবং একটি যুবক ছেলে শান্তভাবে বলল, “তারা লজ্জা পাচ্ছে কারণ তারা আপনাকে তাদের হৃদয়ের কোথা বলার সাহস পাচ্ছেনা।” ছেলেটির সাথে দশ মিনিট কথোপকথনের পর, সে ভয় পায় এবং চলে যায়। মার্চের আগে জামালপুরে ৫০০০০ জন মানুষ ছিল যাদের মধ্যে ৫০০০ জন হিন্দু। এখানকার বড় মার্কেটপ্লেস ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং একটি ছোট সেনা সদর দপ্তর করা হয় যারা জামালপুর ধ্বংস করেছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে হিন্দুদের শ্মশানঘাঁট ছিল সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের স্থান। মৃতদেহ সেখান থেকে নদীতে ফেলে দেয়া হয় এবং এখন জামালপুরের বাকি বাসিন্দারা নদীর মাছ খেতে চায়না।
– পিটার আর কামী ও লি লেসকেইয
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২০। নিরাপত্তা পরিষদের মূল সমস্যার দিকে তাকানো উচিত | নিউ ইয়র্ক টাইমস |
ডিসেম্বর ৪,১৯৭১
|
<১৪, ১২০, ২৭৩>
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ডিসেম্বর ৪,১৯৭১
নিরাপত্তা পরিষদের মূল সমস্যার দিকে তাকানো উচিত
পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মহাসচিব একমাস আগেই যে সতর্ক বাণী দিয়েছিলেন,নিরাপত্তা পরিষদের এখন আর সেটাকে পাত্তা না দয়া ঠিক হবে না।
এই সঙ্কটে সাড়া দিয়ে সংঘাতের মূল কারনটি চিহ্নিত করা খুবই জরুরি হয়ে পরেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের অসহনীয় নিপীড়ন প্রতিবেশি ভারতের অর্থনীতি,সমাজ ও রাজনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল।
আন্তর্জাতিক মহলের অপারগতা বিশেষ করে আমেরিকার আচরণে নতুন দিল্লী গভীরভাবে মর্মাহত হয়।
এই মৌলিক ব্যর্থতা অবশ্যই সংশোধন করা যেত যদি বিশ্বকে এখনো অন্য ব্যাপক এবং আরো ভয়ানক যুদ্ধ থেকে উদ্ধার করা যেত।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২১। মূল সমস্যার সমাধান করুন | নিউইয়র্ক টাইমস | ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১২১, ২৭৪>
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
মূল সমস্যার সমাধান করুন
কয়েক মাস ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন কূটনীতি বিশ্ব সংগঠনগুলোকে অগ্রাহ্য ও অসাড় করে তুলেছে। নিক্সন প্রশাসন খোলাখুলিভাবে তাদের অবস্থান প্রকাশ করেছে যা ভারতের পাকিস্তান দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে তুলছে। পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের ভারতকে হুমকি দেবার বিষয়টি তারা উপেক্ষা করছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখনো এই কেন্দ্রীয় ইস্যু পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। এবং মুল দায়িত্ব ভারতের এমন কথা বলার চেষ্টা করছেন।
যদি নিরাপত্তা পরিষদ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চায় তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং U.N. কে পূর্ব পাকিস্তানের মূল সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২২। পাকিস্তানের হঠকারিতা | বাল্টিমোর সান | ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১২২, ২৭৫>
বাল্টিমোর সান, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পাকিস্তানের অদূরদর্শিতা
পাকিস্তান অতুলনীয়ভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সে একদম উদ্ধত হয়ে গেছে। বলপূর্বক এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে দাবীয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যার্থ হয়ে এখন রেডিওতে মুসলমানদের জিহাদ বলে ঘোষণা দিচ্ছে – যদিও তারা যাদের হত্যা করছে তাদের বেশিরভাগ মুসলমান এবং কিছু সংখ্যালঘু হিন্দু রয়েছে। এটা আসলে একজন নেতার চরম হতাশার বহিঃপ্রকাশ – যিনি কিছুদিন আগে পাকিস্তানের এক সংকটময় অবস্থায় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং বলেছিলেন পাকিস্তান “হাতে তলোয়ার ও কাঁধে কাফনের কাপড় নিয়ে” ভারতের সাথে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত আছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৩। বাংলায় যুদ্ধ | নিউজ উইক | ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
<১৪, ১২৩, ২৭৬–২৮৫>
নিউজউইক,৬ ডিসেম্বর , ১৯৭১
বাংলায় যুদ্ধঃ ভারতীয় আক্রমণ
যখন বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে নামে তখন তারা প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ সৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধ করছে বলে দাবি করে। গত সপ্তাহে যখন ভারতীয় নেতাগণ নয়া দিল্লীতে অবস্থিত সুউচ্চ গম্বুজের সংসদের কেন্দ্রীয় কক্ষে সভায় মিলিত হন, সেখানে পাকিস্তানে আক্রমণের পক্ষে অনেক টেবিল চাপড়ানো এবং উগ্র দেশপ্রেমের প্রকাশ সূচক অনেক বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম প্রতিশ্রুতি দেন –“যদি আমরা পাকিস্তানী আক্রমণ বন্ধ করতে চাই তাহলে আমরা শুধু সীমান্তেই বসে থাকবো না, বরং আমারা ভেতরে অনুপ্রবেশ করবো। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সীমান্তের যত অভ্যন্তরেই প্রবেশ করা প্রয়োজন হোক না কেন, আমরা তা করবো। এই আদর্শিক চিন্তাধারা নিয়ে হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য পূর্ব-পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে, এবং উপমহাদেশের দুই চিরশত্রুর মধ্যে অনন্ত বৈরিতার তৃতীয় পর্যায়ের সূচনার মঞ্চ এভাবেই প্রস্তুত হয়।
এই দুইটি জাতি অবধারিতভাবে একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের দিকেই ধাবিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যার দায়ভার উভয় দেশকেই সমানভাবে নিতে হবে। গত নয় মাসে পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে দমন করতে নির্বিচারে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নাগরিককে হত্যা করার নৃশংস ও অদূরদর্শী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছেন। এবং ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার পাকিস্তান বিভক্তিকরণের উদ্দেশ্যে, তার পূর্ব সীমান্তকে বাংলাদেশের মত একটি নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে এবং ইয়াহিয়ার ত্রাসের রাজত্ব থেকে পালিয়ে আসা এক কোটি বাঙ্গালী শরণার্থীর চাপ থেকে মুক্ত হতে নামে সুকৌশলে অভিযান পরিচালনা করে। নয়া দিল্লীর একজন কুটনৈতিক কৌতুক করে বলেন যে “কয়েক মাস আগেও যা আমাদের কাছে বোঝা বলে মনে হয়েছে আজকে সেটাই সুযোগে পরিণত হয়েছে”। ক্রমান্বয়ে এই যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাওয়াকে আরও হৃদয়বিদারক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে বাঙ্গালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারাধীন রাখা এবং ইয়াহিয়া খানের তাকে মুক্তিদানে অনমনীয় অনীহা।
আরও দুঃখজনক যে এই সংঘাত থামানোর জন্য বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সমূহের সক্ষমতা এবং এমনকি সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। ইয়াহিয়া সরকারর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ওয়াশিংটন থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন অর্থ –সাহায্য পাকিস্তানকে প্রদান করা হয়, তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এই পাকিস্তানি নেতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এবং, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতের সাথে সাম্প্রতিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করার পরেও মিসেস গান্ধীকে নিরস্ত করতে তেমন কিছু করতে পারেনি। এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় যুদ্ধের জন্য দুই পক্ষের মাঝেই তাড়াহুড়া ছিল যদিও যুদ্ধে দুইটি দেশেরই অনেক কিছু হারাবার ছিল। একজন পাশ্চাত্যের কুটনৈতিক হতাশার সাথে বলেন যে “বেশীরভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মনে করেন তারা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলে সেটা তাদের জন্য উত্তম পুরষ্কার, এবং ইয়াহিয়াও হয়তো তাই চায়”। অপরদিকে ভারতের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর শতকরা ২০ ভাগ মানুষকে নৈরাজ্যের মধ্যে ফেলে সে উপমহাদেশের একচ্ছত্র পরাশক্তি হবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়, এবং এশিয়াতে আধিপত্য বিস্তারে প্রতিপক্ষ চীনের বিপক্ষে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াতে চায়।
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে এই সংঘাত অনিবার্য ছিল। একজোড়া ক্ষিপ্ত বেড়ালের মতো এই দুই সামরিক বাহিনী মাসের পর মাস মুখোমুখি অবস্থানে পরস্পরের প্রতি কাঁদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত ছিল, প্রথম আঘাত আসার আগ পর্যন্ত।
ভারত এবং পাকিস্তানের সীমান্তের ১৩০০ মাইল এলাকা জুড়েই কিছু বিক্ষিপ্ত এলাকা আছে যেখানে উভয় সীমান্তে সেনারা একে অপরের অবস্থান পরখ করছে , উস্কানি দিচ্ছে এবং সেইসাথে দাবী করছে যে তারা কখনোই আক্রমণ করবে না। কিন্তু বাস্তবিকে , ভারত অব্রোধের পরিকল্পনা করেছে। সেকারণেঈ নয়া দিল্লঈর নির্দেশ মতো সীমান্তে সকল প্রতিবেদককে নিষিদ্ধ করা হ্যেছে যাতে তারা ভারতীয় সৈন্যের রণকৌশল সম্পর্কে অবহিত হতে না পারে। নিউজউইক পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সম্পাদক আর্নড দি বোর্শগ্রেভ নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন প্রতিবেদককে সাথে নিয়ে ভারতের এই কঠোর নিরাপত্তার জাল ছিন্ন করতে সমর্থ হন। তার প্রতিবেদন অনুসারেঃ / দি বোর্শগ্রেভ রিপোর্টঃ
আমরা কলকাতা থেকে প্রায় ৫৪ মাইল ভেতরে সীমান্তবর্তী শহর বনগাঁতে এসেছি– এখানে যুদ্ধের কোন চিহ্নই নেই, কোন সৈন্য চলাচল, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কোন ইউনিট বা কামানের গর্জন কিছুই চোখে পড়েনি। পূর্ব দিকের রাস্তাটায় ফলক টাঙ্গানো “পাক সীমান্ত – দুই মাইল” এবং একজন ভারতীয় মেজর আমাদের থামানোর পূর্ব পর্যন্ত আমরা সেটিই অনুসরণ করতে লাগলাম। তিনি জানালেন পাকিস্তানিরা একটু সামনেই রাস্তায় গোলাগুলি করছে। মেজর আমাদেরকে রাস্তার ধারের একটি পরিখায় নিয়ে গেলেন। পথ চলতে চলতে যদিও আমরা অনিয়মিত গোলাবর্ষন এবং বুলেটের শিস শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু এরপরেও এলাকাটি ছিল শান্ত। আমরা জিগ্যেস করলাম “ যুদ্ধ তাহলে কোথায় হচ্ছে?” মেজর উত্তর দিলেন “এই পাড়ে সব কিছুই শান্তভাবে চলছে। রাতের বেলা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কিছু গুলিবর্ষণ এবং কয়েকটি রাঊন্ড মর্টারের শব্দ ছাড়া তেমন কোন উত্তেজনা এখানে নেই আপাতত”। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সৈন্যরা বেশ ভালোভাবেই অবস্থান নিয়েছে এবং একটি মজবুত লাল ইটের দেয়াল দিয়ে পথ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দেয়ালের থাকার অপর দিকে এখনো একটি ফলক দেখা যাচ্ছে যেটায় লেখা “পাকিস্তানে স্বাগতম”।
সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা
যখন আমরা বনগাঁও দিকে ফিরছি হঠাৎ করেই তখন পরিবেশ অশান্ত হয়ে গেলো । দম বন্ধ করা ধূলার ঝড়ের মধ্যে বিরাট এক যুদ্ধবহর সীমান্ত এলাকায় দিকে যাচ্ছিলো। সোভিয়েতে নির্মিত কতগুলো ট্রাক ধীরগতিতে বারোটি ১০৫ মিলিমিটার কামান টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। পাগড়ী–পরা শিখ সেনারা রিকয়েললেস গানে সজ্জিত জীপ নিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, এবং সাথে বিশাল কতগুলো ট্রেইলারের মাধ্যমে অস্থায়ী ব্রিজ নির্মাণের সরঞ্জামাদি টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমরা পূর্ণ যুদ্ধসাজে সজ্জিত সশস্ত্র সৈনিক পরিবহনকারী ট্রাকের আপাতদৃষ্টিতে অন্তহীন মিছিলের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলাম। উভচর সাঁজোয়া যান থেকে শুরু করে কমান্ড পোস্টের জন্য আসবাবপত্র পর্যন্ত সবকিছুই বহরে ছিল, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানে প্রবেশের জন্য অবস্থান নিচ্ছিল। যদিও সীমান্তের একটু আগেই রাজপথ থেকে আমাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের সীমান্তগামী বহর অথবা ভারতের উদ্দেশ্য কোনটাই লুকাবার কোন চেষ্টা করেনি। একজন অফিসারের সাথে চা পানের সময় তিনি বলেন “এক মাস ধরে আমার সৈন্যরা সামনে আগাবার জন্য অপেক্ষা করে আছে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস প্রবল। ”
এই অন্তহীন বহর দেখে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় সেনা অধিনায়কদের সাথে কথা বলে এটা স্পষ্ট বোঝা গেছে যে ভারত অবশেষে তার এতদিনের যাবতীয় প্রচারণার বিপরীতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহীনির গতিবিধি আমরা পর্যবেক্ষণ করার পরপরই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবারের মত স্বীকার করেন যে তার সেনাবাহিনীকে আত্মরক্ষার খাতিরে পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অভিযান মূলত একটি ত্বরিত অভিযান। আমরা এই বহর দেখার আগেই ভারতীয় বাহিনী বনগাঁর উত্তরদিকের সীমান্ত অতিক্রম করে ১৩ টি পাকিস্তানি ট্যাংক ধ্বংস করে দেয়। এবং ভারত যে বাংলার যুদ্ধে তার সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করছে এর আরেকটি পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন ভারতের মন্ত্রীসভার একজন মন্ত্রী আমাকে জানান যে, “ এখন মধ্যবর্তী সমাধান বা আপোষ–রফায় পৌঁছানোর সময় নেই। এখন দরকার দ্রুত অগ্রগতি”।
ভারত আপাতত সবদিক থেকে আক্রমণ থেকে বিরত আছে। তার পরিবর্তে মনে হচ্ছে নয়াদিল্লী উপর্যুপরি কতগুলো দ্রুত ছোট ছোট আক্রমণের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সেনাকে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল নিয়েছে যাতে বাঙ্গালী গেরিলাদের পক্ষে আরও বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। এই লক্ষ্য অর্জনে, ভারতীয়রা একাধারে সিলেট , কুমিল্লা , চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলসহ পূর্ব – সীমান্ত এলাকা এবং সেইসাথে পশ্চিমে যশোরের দিক থেকে প্রবেশ করছে। পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য কৃষির সমৃদ্ধ ভান্ডার যশোরকে বিপ্লবীদের পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ভারতের আক্রমণের ধরন এই সময়সীমার দিকে লক্ষ্য রেখে দ্রুততার সাথে পরিচালিত হচ্ছে । শহরের চারপাশের এলাকা ভারত এবং মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা অবস্থায় নিউজউইকের টনি ক্লিফটন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের বিমানযোগে সেখানে যান এবং নিম্নোক্ত রিপোর্টটি করেনঃ
এটা স্পষ্ট যে ভারতীয় বাহিনী নিয়মিত সমরাস্ত্র , ট্যাংক এবং ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে পাকিস্তানিদের সীমান্তে আক্রমণ চালাতে। যখন আমি যশোর পৌঁছলাম তখন দেখতে পেলাম ভারতীয় সৈন্যরা যশোর এলাকার পশ্চিমাংশের বেশ কিছু অংশ দখল করেছে এবং শহরের মূল বিমান বন্দরে থেমে থেমে গোলা বর্ষণ করছে। আমাকে দ্রুত পাকিস্তানি সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারি আমাকে ভারতীয় আক্রমণ সম্পর্কে অবগত করেনঃ “ তারা পূর্ণ শক্তি নিয়েই মাঠে নেমেছে। তাদের দুটো ব্রিগেড আছে একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং ১৩০ মি মি রাশিয়ান কামান সহ। তারা প্রায় ৬ মাইল ভেতরে প্রবেশ করেছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বেশি তাই আমরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছি এবং তাদের সীমান্ত পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য করেছি।“ যখন আমি জানতে চাইলাম যদি আক্রমণকারীরা বাঙালি গেরিলা যোদ্ধা হত তাহলে কি হত, তখন আনসারি ব্যঙ্গ করলেন “ এরা বিদ্রোহী গেরিলা না। তারা ট্যাংক এবং ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছিল এবং বিদ্রোহীদের এ ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নেই। এসব জিনিস তো আর গাছে ধরে না”। তিনি একটু থামলেন এবং দুরাশা নিয়ে বললেন, “ তা হলে অবশ্য ভালোই হত, কারণ তখন আমরাও কিছু পেতাম”।
একটি বৃথা কাজ
আনসারি দাবী করলেন যে তার বাহিনী শত্রু পক্ষের ২০০ থেকে ৩০০ জন সৈন্যকে হত্যা করেছে এবং আরো বললেন, “আমরা কিছু কাগজপত্র এবং উর্দি পেয়েছি যা প্রমাণ করে যে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্য। তারা চতুর্দশ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সদস্য ছিল।“ যখন তাকে তাদের নিহত সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে জিগ্যেস করা হলো তিনি তা জানাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন, তবে এটা স্বীকার করেন যে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্টই। তিনি বলেন “নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে তারা আমাদের দিকে গোলাপের পাপড়ি ছুঁড়ে মারছিল না” । যদিও আনসারী দাবি করেছিলেন যে তারা ভারতীয়দের সীমান্ত পর্যন্ত পিছু হটাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু কোন পাকিস্তানি কর্মকর্তা অস্বীকার করতে পারেনি যে যশোরের আশেপাশের এলাকা পুরোপুরি শত্রুদের হাতে। এবং গেরিলা অধীকৃত পূর্ব–পাকিস্তানের কোন অংশই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পুনরায় দখল করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। যদিও এখন বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে, বিশাল এলাকা এখনো জলবদ্ধ এবং আক্ষরিক অর্থেই শত শত নদী – নালা , খালবিল জালের মতো ছড়িয়ে আছে এ অঞ্চলে। যেসব রাস্তাঘাট এখন পর্যন্ত ভালো আছে সেগুলো সব ছোটখাটো পথঘাট, যেখানে গেরিলাদের আক্রমণের শিকার হবার সম্ভাবনা প্রবল।
পূর্ব পাকিস্তানের বিপরীত প্রান্তে কুমিল্লা জেলা সরকারের জন্য একই রকম একটি হুমকি হিসাবে বিরাজ করছে। আমি বিমানযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি পাকিস্তানি দপ্তরে গিয়েছিলাম, সেখানে পাকিস্তানি অফিসাররা জানান যে ভারতীয় সৈন্যরা বিরাট প্রতিরোধ গড়েছে। একজন পাকিস্তানি কমাণ্ডার মৃতদেহ ভর্তি রেলরোড ট্রাকের কাছে নিয়ে যান এবং আমি তাদের উদ্ধার করা অস্ত্রসমূহ দেখতে পাই। যদিও আমার পক্ষে কোনমতেই বলা সম্ভব না যে এসব গলিত মৃতদেহ ভারতীয় সেনাদের নাকি বাঙ্গালী গেরিলা যোদ্ধাদের, কিন্তু রাইফেল , স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং হাল্কা মেশিনগান গুলো নিঃসন্দেহে ভারতীয় সেনাদের দ্বারা ব্যবহৃত জিনিস। এই বিগ্রেডিয়ার নিঃসন্দেহ ছিলেন যে তার শত্রুদের সকলেই ছিল ভারতীয় এবং তিনি অত্যন্ত আনন্দের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। “ আমরা প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ হত্যা করেছি , এবং এর তিনগূন লোককে আহত করেছি” তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে আরও বললেন, “আমরা ১৯ তম পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ান্দের পরাস্ত করেছি এবং আরেকটাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছি”।
ব্রিগেডিয়ারের এই রক্তপিপাসু মানসিকতা ভারতীয় এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান যে সম্পর্ক তা বিবেচনা করলে একেবারেই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। ব্রিটিশ–ভারত থেকে ১৯৪৭ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকেই এই দুই দেশ পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এবং তাদের সম্পর্ক স্বস্তিকর নয়। প্রায় ১০০০ মাইল ব্যাপী হিন্দু ভারতের দুপাশে সৃষ্ট বিভক্ত দুইটি মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে পাকিস্তান গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হতে না হতেই রক্তাক্ত ‘দেশবিভাগের দাঙ্গায়’ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। যদিও এরপর প্রায় পঁচিশ বছরের বেশির ভাগ সময় ধর্মীয় এবং প্রথাগত বিভাজন থেকে সৃষ্ট এই ঘৃণার লাগাম টেনে রাখা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮–৪৯ এ ভারত–পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি এটা নিশ্চিত করেছে যে পারস্পরিক এই শত্রুতার অবসান হবার নয়।
ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে যে শত্রুতা সেটাই কিন্তু এই উপমহাদেশের একমাত্র সমস্যা নয়। পাকিস্তানের প্রধান দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একই ধরনের বৈরিতা বিদ্যমান– এক পক্ষ হচ্ছে পাঞ্জাবীরা পশ্চিম পাকিস্তানে যাদের প্রাধান্য এবং যারা সরকার ও সেনাবাহিনী দুটোই নিয়ন্ত্রণ করে, অপরপক্ষে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা যারা তাদের সমৃদ্ধ কৃষিভূমির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক শোষণের প্রতি গভীর তিক্ত মনোভাব পোষণ করে এবং তাদের দমিয়ে রাখা হয়েছে বলে মনে করে। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যখন বাঙ্গালীরা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়, এবং তারা জাতীয় পরিষদে পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন, ফলে সাধারণ ধর্মঘট শুরু হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রাণঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়। ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল নির্মম। তিনি পাঞ্জাবী সেনাদের পূর্ব–পাকিস্তা্নে লেলিয়ে দেন যার ফলশ্রুতিতে ১০ লক্ষের অধিক বাঙ্গালী প্রাণ হারায় এবং প্রায় ৯৮ লক্ষ ভারতে আশ্রয় নেয়। একরকম অনিচ্ছাকৃত ভাবেই তিনি এইদেশ এবং ভারতকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন।
তুরুপের তাস ভারতের হাতে
পাকিস্তানের জন্য ভারতের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ নিজেকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই না। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ (নয় লক্ষ আশি হাজার ভারতীয় সৈন্যের বিপরীতে মাত্র তিন লক্ষ বিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সেনা) এবং পাকিস্তানের ২৮৫ টি যুদ্ধবিমানের বিপরীতে ভারতের প্রায় ৬১৫ টি যুদ্ধবিমান রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে নয়াদিল্লী সব দিক দিয়ে এগিয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা আবহাওয়া, ভৌগলিক রাজনীতি এবং সর্বপরি মুক্তিবাহিনী তাদের সাথে যুক্ত হয়ে যৌথভাবে লড়াই করছে। ভারত পরিসংখ্যানগতভাবে খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে। এর বাইরেও আবহাওয়া, ভূ–রাজনীতি এবং মুক্তিবাহিনী সব মিলিয়ে ভারতকে পুরোপুরি নিরাপদ অবস্থানে এনে দিয়েছে। শীতের তুষারপাতে হিমালয়ের রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এর ফলে পাকিস্তানের সমর্থনে কমিউনিস্ট চীনের আক্রমণের সম্ভাবনা কমে গিয়েছে; বাস্তবে ভারত তার চীন সীমান্ত নিয়ে এতোটাই নিশ্চিন্ত যে সে তার পার্বত্য বাহিনীর একটা অংশকে পাকিস্তান সীমান্তে স্থানান্তরিত করেছে। তাছাড়া ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের জলাভূমির মাধ্যমে একে অপরের থেকে এবং ভারতের মাধ্যমে পশ্চিমের থেকে বিচ্ছিন্ন, যা তার জন্য কৌশলগতভাবে দুঃস্বপ্নের মত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, পূর্ব–পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার আশি হাজার সৈন্যকে একাধারে দুটো শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে– সম্মুখে ভারতীয় বাহিনী এবং পেছনে ক্রমান্বয়ে ভীতিকর হয়ে ওঠা বাঙ্গালী গেরিলাদের দল।
নিঃসন্দেহে এই দ্বিমুখী যুদ্ধই এখন ভারতের বর্তমান রণকৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মিসেস গান্ধীর সরকার মাসের পর মাস মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দিয়েছে। কিন্তু এরপরেও যেহেতু ইয়াহিয়ার তরফ থেকে পূর্ব–পাকিস্তানকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, এবং শরনার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণে বিশাল অর্থনীতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে, ভারত ঝুঁকি নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একজন কুটনৈতিক মন্তব্য করেন “তাদের পক্ষে মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহকে নিজ গতিতে অগ্রসর হতে দেওয়া সম্ভব না”। তিনি আরো বলেন “সে জন্য তারা প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন”। এর ফল হিসাবেই গত সপ্তাহের অনুপ্রবেশ। এবং গত সপ্তাহে মিসেস গান্ধী সীমান্ত বাহিনীতে বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করেন, যার ফলে নয়া আরও সম্ভাব্য নাটকীয়তার গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
যখন ভারত এবং পাকিস্তান পরস্পরের সাথে গুলি বিনিময়ে লিপ্ত ছিল, এবং সামনে আরও বড় যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা বলছিল, তখন বাকি বিশ্ব শুধু কথাই বলছিল। যদিওবা তারা অস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ করে যুদ্ধকে আরও রসদ যোগাচ্ছিল, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো এই সংঘাত থামাতে অক্ষম বলেই মনে হচ্ছিলো। রাশিয়া, যে পশ্চিমাদের বিকল্প হিসাবে ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী, তারা প্রাভদাতে অকার্যকর বুলি আওড়ানোতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল, এর কারণ হয়তো মস্কো ভেবেছিল যে সে আসলে সম্ভাব্য বিজয়ীর সাথেই আছে। প্রাভদার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সামরিক সংঘাত প্রাণ এবং সম্পদের বিনাশের কারণ ঘটাবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে আরও সমস্যা সৃষ্টি করবে”। পাকিস্তানের প্রধান সমর্থক গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার মূলত সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রতিবাদ জানাতেই ব্যস্ত ছিল।
কেউ কারো কথায় কর্ণপাত করছে না
গুরুত্বপূর্ণ একটি পরাশক্তির এমন অসহায়ত্ব ওয়াশিংটনে যতটা নগ্নভাবে দেখা যাচ্ছে তেমনটা আর কোথাও দেখা যায়নি। যদিও নিক্সন প্রশাসন যুদ্ধরত দেশসমূহকে সংযত থাকতে অনুরোধ করেছে, কিন্তু এই আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি। মূলত ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ জাগ্রত হয় কেননা তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করে আসছিলো গত মাস থেকেই তখনো এই পরস্থিতি এতোটা উত্তপ্ত হয়নি। ভারতে এখনো এ ব্যাপারে ক্ষোভ বিরাজ করছে যে যুক্তরাষ্ট্র এক মাস আগে পর্যন্তও পাকিস্তানে অস্ত্রের চালান অব্যাহত রেখেছিল। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ প্রসঙ্গে ক্ষোভের সাথে বলেন, “একদিকে আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে চলার জন্য বাহবা দেওয়া হবে, অপরপক্ষকে অস্ত্র সাহায্য দেওয়া হবে। আপনারা বলছেন যে আপনারা পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবেন। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে আপনারা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছেন”। ইসলামাবাদেও যুক্তরাষ্ট্র কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্যের দেখা পায়নি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের উপর ভর করে ইয়াহিয়া এখনো এই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছেন যে তিনি মুজিবকে মুক্তি না দিয়ে এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে নতিস্বীকার না করেই পাকিস্তান রক্ষা করতে সক্ষম হবেন।
ইয়াহিয়ার একগুঁয়েমি এবং ভারতীয় সীমান্তে ক্রমবর্ধমান উস্কানিমূলক অনুপ্রবেশের প্রেক্ষিতে প্রেক্ষিতে এটা একেবারেই স্পষ্ট নয় কিভাবে একটি ব্যাপক সংঘাত এড়ানো যাবে। নয়া–দিল্লীর অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ এরই মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে এই সপ্তাহের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর হাতে যশোরের পতন ঘটবে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণার প্রেক্ষাপট তৈরি হবে, একই সাথে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। সেটা যদি ঘটে উপমহাদেশে এক অভূতপূর্ব সংঘাতে নিমজ্জিত হবে যাবে যা অতীতে কেউ কখনো দেখেনি। ভারত –পাকিস্তানের মধ্যে অতীতে সংঘটিত অন্যান্য যুদ্ধের মতো না এই যুদ্ধ হয়তো যে কোন একটি পক্ষের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ করবে। একজন আমেরিকান কূটনৈতিক বলেন যে “ বাংলাদেশের জন্মের আকুতিই পাকিস্তানের ধ্বংসের ইঙ্গিত দিচ্ছে যা আগেই আমাদের জানা ছিল। ইয়াহিয়াও তা জানেন, এবং তার সৈন্যরাও এটা জানে। এবং তারা শেষ অব্দি লড়াইয়ের ময়দান ছাড়বে না”।
কেন ভারত নিজেদের ঝুকিপূর্ণ বিপদকে কাটালো না ?
যদি এই পূর্ণ যুদ্ধে যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থও হয়, তারপরেও এটা নিশ্চিত যে এ ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টার অভাবে ছিল না। এটা সত্য যে, এটা কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয় যে নয়া –দিল্লী পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাসমূহকে ত্বরান্বিত করেছে, যার অস্তিত্ব আগে ছিল না। কিন্তু এ ব্যাপারেও কারো সন্দেহ নেই যে প্রথম থেকেই ভারত এই সংকটময় পরিস্থিতিকে সম্ভাব্য সব উপায়ে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে। এটি প্রশ্নাতীত ভাবে সত্য যে “এমন সুযোগ সারাজীবনে একবারই আসে”, যে সুযোগ একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ দাবি করেন এখন তাদের হাতে। নয়াদিল্লী তার স্বপ্নের এক দুর্বল, বিভাজিত পাকিস্তানকে বাস্তবতায় রূপ দিতে তার পক্ষে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি নেবে।
অধিকাংশ ভারতীয়দেরই মত যে আসলে আর কোন বিকল্প ছিল না। শরনার্থীদের ব্যবস্থাপনার জন্য খরচ এত উচ্চমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে যে নয়া–দিল্লীর কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একমত হন যে, আরও এক বছর উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবেলা করার একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধই বরং বেশি লাভজনক হবে। এটা প্রমাণ করার জন্য তারা হিসাবনিকাশও করে ফেলেছেন। তাদের হিসাব অনুসারে, আগামী মার্চ পর্যন্ত শরনার্থী সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত সরকারের প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে যা ১৯৬৫ সালে ভারত – পাকিস্তান যুদ্ধের খরচের প্রায় ১৩ গুণ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, যদি এই সমস্যা প্রলম্বিত হয়, তবে ভারতের বাজেট এই চাপ বহন করতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয়দের সবচেয়ে বড় আশংকা করছে ছিল যাতে প্যালেস্টাইনের মতো অবস্থা সৃষ্টি না হয়, সেক্ষেত্রে সরকারকে উদবাস্তু সমস্যার সাথে সাথে পূর্ব বাংলায় বৈরী পাকিস্তানী সেনাদের ক্রমাগত এবং ব্যয়সাপেক্ষ আক্রমণ দুটোকেই মোকাবেলা করতে হবে। একজন ভারতীয় অফিসার বলেন যে “আমরা যুদ্ধের ঝুঁকি মেনে নিয়েছি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে যে বিপদের সম্ভাবনা আছে তা যুদ্ধের ঝুঁকির চেয়েও অনেক বেশী”।
এই ধরনের মানসিকতা পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে একটি বেদনাদায়ক উভয়সঙ্কটে পতিত হতে বাধ্য করেছে– তাকে পরাজয় মেনে নিয়ে পূর্ব–পাকিস্তান থেকে অপমানজনক প্রত্যাহারে রাজি হতে হবে কিংবা একটা নিজ থেকেই একটি ভয়াবহ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানোর ঝুঁকি নিতে হবে। এই শোচনীয় বিকল্পগুলোর মধ্যেও ইয়াহিয়া একটি সুবিধাজনক মধ্যপন্থী অবস্থান বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পাকিস্তানের তথাকথিত “২২ পরিবার” (যারা দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা, যারা নিজেদের বিনিয়োগ বাঁচানোর জন্য প্রাথমিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে বল প্রয়োগে বিদ্রোহ দমনের পক্ষপাতী ছিলেন, কিন্তু এখন প্রলম্বিত যুদ্ধের কারণে লোকসানের আশংকা করছেন) এর চাপে ইয়াহিয়া এখন গোপনে সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন, এমনকি পূর্ব–পাকিস্তানে গনভোটের সম্ভাবনাও চিন্তা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনৈতিক বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন “এটা পরিষ্কার যে ইয়াহিয়া এতোদিনে কিছু বিষয় অনুধাবন করতে শুরু করেছেন যা মাস খানেক আগেও তার বিবেচনায় আসেনি”।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি
গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছতে ইতোমধ্যে ইয়াহিয়ার বেশ দেরী হয়ে গেছে। তার সমঝোতা করার ইচ্ছার স্বত্বেও এটি প্রতীয়মান হয় যে, তিনি এখনো দিল্লীর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র সমাধান– শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করায় অনাগ্রহী। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মুজিব এখনো পাঞ্জাবের লায়ালপুর শহরের কারাগারে বন্দী। ইয়াহিয়া এখনো পর্যন্ত কোন মতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মত অপমান মেনে নিতে প্রস্তুত নন। যতই ভারতের দিক থেকে চাপ বাড়ছে , ইয়াহিয়া এমন একজন মানুষের মত দম্ভোক্তি যে জানে যে একটি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী তিনি বলেন “যদি তিনি(মিসেস গান্ধী) একটি যুদ্ধ চান, তবে তাকে আমি টা দেব। যদি এই মহিলা মনে করে থাকে যে সে আমাকে ভয় দেখাবে, তবে আমি সেটা পাত্তা দিতে রাজি নই”।
যদি সম্পূর্ণরূপে যুদ্ধ শুরু হয়, তবে বেশীরভাগ লোকেরই ধারনা পাকিস্তান কাশ্মীর বা ভারতের পশ্চিমাংশে প্রথম আঘাত হানবে। এটা মনে করা হয় যে পাকিস্তানের বিশ্বাস, যদি এই মাত্রার একটি সংঘাত উসকে দেওয়া যায় তাহলে এই সঙ্কট জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আমলে নিতে বাধ্য হবে, এমনকি হয়তো ভারত–পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি যুদ্ধবিরতি আরোপ করা যাবে। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা শুরুতেই ব্যর্থ হয়। যার একটি কারণ হলো, উপমহাদেশকে নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বই সে সময় জাতিসংঘের যে কোন পদক্ষেপকে থামিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। আরেকটি কারণ ছিল, একটি পাকিস্তানি আক্রমণ ভারতের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে ইয়াহিয়ার বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে একটি অজুহাত এনে দিত যার জন্য তারা এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিল।
অন্যভাবে বলতে গেলে, ইয়াহিয়া স্বল্প–মেয়াদে যে কৌশলই অবলম্বন করুক না কেনো, পাকিস্তানকে পূর্বাঞ্চল থেকে থেকে পিছু হটতেই হবে বলে মনে হচ্ছে। এতদসত্ত্বেও, এটা কেউ মনে করছে না যে এই অঞ্চলকে দখল করে নেওয়ার কোন ইচ্ছা ভারতের আছে। আপাতত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিদ্রোহীরা সীমান্তের ওপারের ভারতীয় হিন্দুদের সাহায্য গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী হলেও, কোন ধরনের রাজনৈতিক জবর–দখলের ভারতীয় প্রচেষ্টাকে তারা ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে, ভারত তার দরজায় শুধু একটি স্বাধীন বাংলাদেশের উপস্থিতির কারণেই সম্ভাব্য এত সমস্যার সম্মুখীন হবে যে, সেটাই বাংলাদেশকে তার ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখবে।
পূর্ব বাংলা তার সবচেয়ে সমৃদ্ধির সময়েও আন্তর্জাতিক অনুদানের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তার পরিস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। এর দুর্বল যোগাযোগ অবকাঠামো এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শিল্পব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ন্যূনতম স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্যও এই অঞ্চলের প্রচুর ভারতীয় অর্থ ও কাঁচামালের প্রবাহের প্রয়োজন হবে। এই ত্রাণ সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ নৈরাজ্যের মুখে পড়তে পারে, এবং উপমহাদেশে মার্ক্সবাদী উগ্রপন্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। পরিশেষে, যদিও সীমান্তের উভয় পারের সমাজবিজ্ঞানীরাই এই তত্ত্বকে অগ্রাহ্য করেছেন, কিন্তু নয়া দিল্লীর কিছু সরকারি কর্মকর্তা্র আশংকা যে হয়তো একটি স্বাধীন বাঙ্গালি রাষ্ট্র তার সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে আরও রসদ যোগাবে।
ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নের অবকাশ ছিল না যে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ খারাপের তুলনায় অনেক বেশি সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। প্রাথমিক ভাবে, নয়া দিল্লীর পক্ষে অন্তত শরণার্থী সমস্যার কিছুটা সমাধান করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদে, পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে ঐতিহ্যগত বাণিজ্য প্রক্রিয়ার পুনপ্রতিষ্ঠা ভারতের জন্য অর্থনৈতিক সুফল নিয়ে আসবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাকিস্তানের এই বিভক্তির ফলে উপমহাদেশে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত হলো। নিজেদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ, বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ৫০ শতাংশ এবং আয়করের প্রায় ২০ শতাংশ হারিয়ে পাকিস্তান নয়াদিল্লী সরকারের জন্য একটি স্থায়ী হুমকি হিসাবে দাঁড়াবে সে সম্ভাবনা কম, এবং প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মতই পাকিস্তানের একটি কূটনৈতিক জটিলতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়াটা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হচ্ছে।
চীনের প্রভাব
পাকিস্তান পথ থেকে সরে যাওয়ার ফলে ভারত নিঃসন্দেহে উপমহাদেশের বাইরে তার রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবে। বিশেষত এশিয়ায়, মিসেস গান্ধী এবং তাঁর সহকর্মীরা পিকিং এর ব্যাপক প্রাধান্য দূর করার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন। ভারতীয়রা তাদের চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কূটনৈতিক অঙ্গনে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করাকে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষের সাথে দেখছে, এবং চীনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি যেভাবে নিবন্ধ সেটা নয়া দিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য আরও বেদনার কারণ হচ্ছে। ভারতের একজন রাজনীতি বিশ্লেষক মন্তব্য করেন “ নিক্সন কেন চীনকে একটি পরাশক্তি বলতে চাইছেন? তাদের পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলে? ১৯৬০ সালেই আমরা চীনের মতোই এ ধরনের অস্ত্রের ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলাম, কিন্তু সকলের স্বার্থে আমরা সে পথ বেছে নেইনি। আর এখন আমাদের সাথে সৎ–সন্তানের মত আচরণ করা হচ্ছে।“ দৃশ্যত, পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়াই ভারত দ্রুত এই সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানোর আশা রাখে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বাধার সম্মুখীন হচ্ছে । এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্প্রতি পাকিস্তানকে সাম্প্রতিক সংঘাতে সমর্থন দিয়ে ওয়াশিংটন ভুল পক্ষে বাজি ধরেছে। গত সপ্তাহে আমেরিকার একজন কুটনৈতিক বলেন, “যদি পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে ভারতীয়রা ভাববে আমরা তাদের বিপক্ষে এবং পাকিস্তানিরা ভাববে আমরা তাদের সাথে বিস্বাসঘাতকতা করেছি। কেবল রাশিয়াই পেরেছে তাদের হিসাব বরাবর মেলাতে। তারা জানে যে পশ্চিম পাকিস্তানের ৬ কোটি এবং পূর্ব–পাকিস্তানের ৮ কোটি যেভাবেই যোগ করা হোক না কেন, তাতে কখনোই ভারতের ৫৫ কোটির সমান হবে না”।
প্রকৃতপক্ষে ভারতের পরেই বাংলার এই যুদ্ধে যে বিরাট বিজয় পেয়েছিল সে হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। অনেকেই অনুমান করেছিলেন যে মস্কোর ভারতকে সমর্থন করার উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশে এবং ভারত মহাসাগরের চারপাশে ব্যাপকভাবে প্রাধান্য বিস্তার করা। কিন্তু এ বিশ্লেষণ কিছুটা তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে, কারণ রাশিয়া এই অঞ্চলে কেবল তাদের অবস্থানই কিছুটা বৃদ্ধি করেছে তাদের পক্ষে থাকাকে কিছুক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করা হয়ছে। এই সংকটময় পরিস্থি্তির কোন পর্যায়েই অন্য কারো সাহায্য চাননি, এবং তার নিজ লক্ষ্যে উনি দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেছেন। এবং এখন ভারতের এখনকার চরম সুবিধাজনক অবস্থায় এমন আশঙ্কা খুবই কম যে দৃঢ়চেতা এই প্রধানমন্ত্রী বাইরের কারো কথা শুনবেন।
ঘর শত্রু বিভীষণ/ ঘরের চেয়ে পর উত্তম
আজকাল প্রতিদিন সকাল ৬ টায় পি এন লুথরার কলকাতার তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে টেলিফোন বেজে ওঠে। প্রথমবার ফোন বেজে ওঠার সাথেই ৫৪ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কর্নেল লুথরা ,যিনি বাঙ্গালি শরনার্থীদের জন্য ত্রাণকার্য সমন্বয় করছেন, তিনি অসংখ্য নৈমিত্তিক সমস্যার অভিযোগে জেগে ওঠেন। আজ সকালে প্রথম যে ফোন করেন তিনি জানান ভারতের সীমান্তবর্তী পূর্ব– পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলা সংলগ্ন ত্রিপুরা রাজ্যে গতকাল বরাদ্দকৃত ৬৭ –টি খাদ্য পরিবহনকারী গাড়ির বদলে মাত্র ৪৫টি গাড়ী এসেছে। দ্রুততার সাথে তিনি কলকাতার শ্রম মন্ত্রণালয়ের তার অস্থায়ী কার্যালয়ে ছুটে যান। লুথরা তার আসামের জন্য রাখা সামান্য বরাদ্দ থেকে কিছু খাদ্য সরিয়ে নেবার আদেশ দেন। কিন্তু যখন একজন সাহায্যকারী দেখলো যে আসামের সাথে ফোনে যোগাযোগব্যবস্থা এত খারাপ যে সে তার বার্তা বোধগম্যভাবে পৌঁছাতে পারছিল না, তখন একটা টেলিগ্রাফ অর্ডার পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হল। । লুথরা অসহায়ভাবে বললেন, “সেখানে পৌঁছাতে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা লাগবে। আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমি কোন খবর পাবো না”।
সারাদিন জুড়ে ছিল এই সমস্যা শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। ভারতীয় সরকারের তথ্য অনুসারে ইতোমধ্যে প্রায় নয় লক্ষ আশি হাজার বাঙ্গালী শরনার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে এবং প্রায় প্রতিদিন ১২০০০ এর মত লোক পূর্ব–পাকিস্তানের ১৩০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে প্রবেশ করছে। অন্য সব কিছুর সাথে সাথে, তারা লুথরা এবং তার ২৮০ জন সহকর্মীর জন্য যা একটি অবিশ্বাস্য কৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। শীত এর শুরুতে হিমালয়ের পাদদেশে শীতলতম স্থানগুলোতে অবিলম্বে প্রায় ৪০ লক্ষ কম্বল বিতরণ করতে হবে, কিন্তু বাইরে থেকে ৫ লক্ষেরও কম কম্বল এসে পৌঁছেছে। পানীয় জলের জন্য বাংলাতে খননকৃত ৬ হাজার নলকূপের সাথে আরও প্রায় ৫ হাজার নলকূপ বসানো হয়েছে। সাম্প্রতিক খবরে বলা হয়েছে জরুরী ঔষধপত্রের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং খাদ্যসামগ্রীর প্রায় ১৫ শতাংশ ১০০০ টি ত্রাণশিবিরে পৌঁছানোর আগেই খোয়া যায়, এর ভিত্তিতে লুথরা বলেন, “ আমরা আরও কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।“ কিন্তু সহকারী এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন “ আমরা কড়াকড়ি যত বাড়াবো, সমস্যাও তত বাড়বে। এই অনিবার্য চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর চেষ্টার থেকে দ্রুততা এখন বেশি জরুরী”।
শক্তিশালী/ মহৎ সাহায্য
প্রকৃতপক্ষে সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ভারতীয় ত্রাণকর্মীরা তাদের সেবার হাত প্রসারিত করেছে। কলকাতার দমদম এয়ারপোর্টের কাছে সল্টলেক ক্যাম্পের কাছে ১৬ জন ডাক্তার নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি হাসপাতাল। যারা ক্যাম্পের শিশুমৃত্যু হার কমাতে সাহায্য নিরলসভাবে। এবং যেখানে আগে দিনে ৫০ জন শিশু মারা যেতো এখন তা কেবলমাত্র ৩ এ নামাতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া শিশুরা সেখানে খোলা আকাশের নীচে পড়াশোনা করছে এবং তাদের পাঠদান করছেন ১১০ শিক্ষক যারা নিজেরাও পূর্ব–পাকিস্তানের শরনার্থী।
সল্টলেক ক্যাম্পে জনসাধারণের জন্য প্রতিদিনের বরাদ্দ প্রায় ২০০ ট্রাক খাদ্য এবং রসদ– এর মধ্যে জনপ্রতি প্রায় ১০.৫ আউন্স চাল, ৩.৫ আউন্স গম এবং ৩.৫ আউন্স সব্জি বরাদ্দ করা হয়েছে। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পর অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য আলাদা একটি খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় প্রতি শিশুর জন্য প্রতি দিন এক পোয়া দুধ এবং মাল্টিভিটামিন ওষুধ দেওয়া হয়েছে।
এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সল্টলেক ক্যাম্পটি একটি আকর্ষণের জায়গা। এরকম আরো ১৫০ টি ক্যাম্পে যেখানে বিদেশী পর্যবেক্ষকগণ যাবার অনুমতি পেয়েছেন, তারা জানিয়েছেন যে এরকম সব ক্যাম্পেই ১০ টি পরিবার বা ৫০ জন লোকের একটি ৫০ ফুট বাই ২৪ ফুট তাঁবুতে একত্রে গাদাগাদি করে থাকা একটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ছোট শিশুরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কেউ কাঁদছে , কেউ বা বমি করছে এবং মানুষের মল–মূত্রের দুর্গন্ধ ক্যাম্পের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এ এক দুঃসহ পরিস্থিতি। কিন্তু উদ্বাস্তুরা এর সাথেই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, কারণ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এখানের আসার পূর্বে এদের অনেকের অবস্থা বাংলাদেশের গ্রামে এর চেয়েও খারাপ ছিল। বেশীরভাগ ক্যাম্পেই একজন শরনার্থী যদি মাত্র ৩০০ গজের মধ্যে অবস্থিত পার্শ্ববর্তী ভারতীয় একটি গ্রামের দিকে তাকায়, তবে সে দেখবে যে, এই ত্রাণ কর্মসূচীর কল্যাণে সে ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি খেতে পাচ্ছে, এবং উন্নততর চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছে।
তীব্র অসন্তোষ
সঙ্গত কারণেই উদ্বাস্তুদের প্রতি ভারত সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গী ভারতের স্থানীয় জনসাধারণের মনে দিন দিন ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন পূর্ব–পাকিস্তান থেকে স্রোতের মতো প্রায় ২০ হাজার শরনার্থী হঠাৎ করে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত বালাত গ্রামে প্রবেশ করে, তখন লুথরার ত্রাণকর্মীরা তৎক্ষণাৎ ৪০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতালের ব্যবস্থা করে এবং সেইসাথে একটি ভ্রাম্যমান এক্স–রে ইউনিট, একটি ইলেকট্রিক জেনারেটর এবং শল্য চিকিৎসার যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করে। বালাত গ্রামের তিন হাজার স্থায়ী অধিবাসীরা, যাদের অনেকেই এর আগে কখনো হাসপাতালই দেখেনি, তারা শরণার্থীদের প্রতি এত নিবিড় যত্নে বিস্মিত হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে প্রশ্ন জাগে হাসপাতালে তাদের চিকিৎসারও ব্যবস্থা কেন করা হচ্ছে না। একইভাবে কলকাতা শহরে, যেখানে শহরের ৮০ লক্ষ লোকের মধ্যে অন্তত পাঁচ লক্ষ লোক বেকার এবং প্রায় ৭০ ভাগ পরিবার মাসে প্রায় ১২ ডলার মাত্র উপার্জনের উপর ভিত্তি করে বেঁচে আছে, সেখানে এমন অভিযোগ উঠেছে যে শরণার্থীরা দিনপ্রতি মাত্র ১ রুপীতে কাজ করতে রাজি হয় অথচ অদক্ষ শ্রমিকদেরই মজুরী যেখানে ৩ রুপী। কর্তৃপক্ষের কঠোর ব্যবস্থার কারণে কলকাতার বস্তিবাসী এবং একই মাত্রায় দরিদ্র উদ্বাস্তুদের মধ্যে যেকোন মূল্যে কাজ পাওয়ার জন্য দাঙ্গা পরিস্থিতি প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে।
এই ধরনের সামাজিক সঙ্কট এবং দোদুল্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ভার ভারতের বহনক্ষমতার ঊর্ধ্বে। পূর্বাভাস থেকে জানা গেছে যে , এই কর্মসূচীতে আগামী মার্চের মধ্যে ৯০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে, যার মধ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য এবং অনুদান থেকে পাওয়া গেছে। ভারতের বর্তমান মোট বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ শরনার্থী সমস্যার সমাধানে ব্যয় হয়ে গেছে, এবং গত দুবছর সুফলা হওয়ায় দুঃসময়ের জন্য একটু একটু করে গড়ে তোলা সংরক্ষিত শস্যভাণ্ডার দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ কর আরোপের পাশাপাশি সরকার অন্যান্য খাতেও রাতারাতি খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে যেটা এমনকি দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। নিউজউইক প্রতিবেদক আর্নড দ্য বোর্শগ্রেভকে একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন “৭২ সালে এই উদ্বাস্তু সমস্যায় আমাদের ঠিক কতো টাকা ব্যয় হবে আমরা এখনো অবগত নই। এর প্রভাব এত ভয়াবহ হতে পারে যে বিষয়ে আমাদের ভাবতেও ভয় লাগছে”।
দুঃস্বপ্নের সূচনা
কিন্তু ভারতকে অবশ্যই ভাবতে হবে যে ক্রমবর্ধমান ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে পূর্ব–পাকিস্তান থেকে আসা শরনার্থীদের অনেকেই পূর্ব–পাকিস্তানে এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও ফিরতে চায়না। শরনার্থী শিবিরেরে ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠী হিন্দু যারা পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তাক্ত নিপীড়নের স্বীকার হয়েছে, এবং এখনে ভারতে অবস্থানকালে তাদের অনেকেই ভেবে পাচ্ছে না কেন তাদের পূর্ব পুরুষরা ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় মুসলিম প্রধান বাংলা থেকে তাদের বের করে নিয়ে যেতে পারেনি। যদিও তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে যেখানে সকলের সমান অধিকার থাকবে, কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক হিন্দুই বিশ্বাস করেন যে এই ক্রমোন্বতিশীল ত্রাণ শিবির ছেড়ে তাদের পূর্ব বঙ্গের নিজ নিজ দুর্যোগপ্রবণ গ্রামে ফিরে যাওয়া সুফলদায়ক হবে। বোর্শগ্রেভকে একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বলেন যে শরণার্থীদের যদি দ্রুত ফেরত পাঠানো না যায়, তবে ভারতীয় সেনাদের হয়তো বেয়নেটের মুখে তাদেরকে বাড়ি পাঠাতে হবে। নয়া দিল্লীর জন্য এমন একটা কিছু হবে একটি দুঃস্বপ্নের মতো, এবং সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের মাধ্যমে যে ভারতীয় প্রচেষ্টা তার পেছনে এটাই অন্যতম কারণ।
দারুণ প্রচেষ্টা
যদিও এর প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে পাকিস্তান সরকারের দ্বারা বিচারাধীন অবস্থায় আছেন, কিন্তু এরপরেও স্বঘোষিত বাংলাদেশের জনগণ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের একটি সরকার গঠন করেছে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে তার দেওয়া প্রথম সাক্ষাতকারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিউজ উইকের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক Arnaud de Borchgrave এর সাথে আলাপ করেন। সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশ নিচে দেওয়া হলঃ
সংগ্রামী অভিযান
আমার ছেলেরা খুবই চমৎকার কাজ করেছে। আমরা এখন সুসংগঠিত এবং কার্যকর। জনসাধারণের দেশপ্রেমও এখন সামরিক গোয়েন্দা তথ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস, সব শিক্ষিত মানুষই আমাদের পক্ষে আছেন। আমার মনে হয় না আর বেশি সময় লাগবে। দখলকৃত এবং মুক্ত সব এলাকাতেই আমার পক্ষে কি পরিমাণ সমর্থন, তা আপনি নিজেই দেখেছেন।
বাইরের রাষ্ট্রের প্রভাব
এটি পুরোপুরি আমাদের নিজস্ব আন্দোলন, এবং ভারতের তরফ থেকে আমাদের উপর কোন চাপ নেই। বামপন্থীরাও আমাদের সমর্থন করছেন এবং আমার সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য দেখিয়েছেন । কিন্তু তারা খুব বড় কোন প্রভাব রাখেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম কিছু মৌলিক বিষয়ে আলোকপাত করেছে। এই কাহিনী এখন সবার জানা। ফলশ্রুতিতে, তোমাদের কংগ্রেসও আমাদের সমর্থন করছে। কিন্তু আমরা এখনো বুঝতে পারছি না কেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের বিপক্ষে।
যুদ্ধের শেষ প্রান্তে
যদি ইয়াহিয়ার এটা অনুধাবন করার দূরদর্শিতা থেকে থাকে যে স্বাধীনতা অনিবার্য তাহলে আমরা বিনা রক্তপাতে এই সংগ্রাম স্থগিত করার ব্যাপারে আলোচনা করতে পারতাম। প্রথমত তাকে মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে হবে । তখনি লড়াই থামানো হবে এবং সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। যদি ইয়াহিয়া আপোষ–রফা করতে চান এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী হন, তবে শুধু মুজিবকে মুক্তি দেওয়াই তার জন্য যথেষ্ট। যদি তিনি শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরে আগ্রহী না হন, তবে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবো।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৪। মুক্ত যশোরে বাঙালিদের উল্লাস | নিউ ইয়র্ক টাইমস |
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
|
<১৪, ১২৪, ২৮৬>
নিউইয়র্ক টাইমস, ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
মুক্ত যশোরে বাঙালিদের উল্লাস
যশোর, পাকিস্তান ৮ ডিসেম্বর। বাঙালিরা বাসের ছাদের উপরে নৃত্য করছিল। তারা রাস্তায় চিৎকার করে স্বাধীনতার স্লোগান দিচ্ছিলো। তারা আলিঙ্গন করছিলো, তারা উল্লাস প্রকাশ করছিলো, অন্যান্য জায়গা থেকে আগতদের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে হাতে হাত মিলাচ্ছিলো।
বাঙালিদের জন্য আজ (৮ ডিসেম্বর) -কৌশলগত পূর্ব পাকিস্তানের যশোরের “স্বাধীনতা দিবস” ছিল। গতকাল (ডিসেম্বর ৭) পর্যন্ত আট মাসের জন্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে ,যারা গত বসন্ত এ এসেছিলো বাংগালিদের বিদ্রোহ দমন করতে।
“মুক্তিদাতা” হিসেবে ভারতীয় সেনারা কাজ করেছে। তারাও বাংগালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মত খুশি। যারা ভারতকে সমর্থন করে, কিন্তু তাদের হাতে উদযাপন করার মত তেমন সময় ছিল না, কেননা তারা পশ্চিম পাকস্তানিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে অব্যাহত তাড়া করে খুলনার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো।
ভারতীয়রা খুব হিল্লোলিত এবং হেসে ছবি তুলার জন্য ভংগিমা দিচ্ছিল। তাদের সাঁজোয়া কর্মিবৃন্দ বাহক ট্যাংক এর উপর থেকে পোজ দিচ্ছিল। এবং তারা যশোর থেকে চার মাইল দূরে অপেক্ষা করছিল পুনরায় খুলনার রাস্তায় নামার জন্য।
সপ্তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি পদাতিক অধিনায়ক পাকিস্তানি সেনাদের বলেন “তারা আতঙ্কে পালিয়ে যাচ্ছে””তারা ভাল সরঞ্জাম এবং প্রতিরক্ষা পেয়েছে, কিন্তু তাদের মনোবল ভেংগে গেছে”।
ভারতীয় বাহিনীর অধিকাংশই যেমন বাঙালিদের থেকে আলাদা তেমনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবি সৈন্য আলাদা ছিল। কিন্তু বাংগালি বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের ভারতীয় সমর্থকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ফাঁক সাময়িকভাবে মুছে ফেলা হয়েছে।
উৎফুল্ল বাঙালিরা ভারতীয় সৈন্যদের সাথে পন্টুন সেতু দিতে এক সাথে কাজ করে, কারণ স্থায়ি সেতু গুলো আগেই পাকিস্তানীরা চলে যাবার সময় উড়িয়ে দিয়েছে।
এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সেতু। খুব অভিজ্ঞতার সাথে ধ্বংস করা হয়। এটি ভারত-যশোর সীমান্তে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে ২৩ মাইল পর্যন্ত ছিল। ছয়টির মধ্যে পাঁচটি ইস্পাতের এবং কাবাথানি নদীতে
কংক্রিট সেতু ছিল, রেলসেতু ২০০ গজ ছিল।
পাকিস্তানিরা এই সেতুগুতারা যশোর থেকে পিছু হটার দুই রাত আগেই জ্বালিয়ে দেয়।
ঝিকরগাছা শহর , যা যশোলো
র থেকে ৯ মাইল দুরে, আজকের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে যেন একটি সৈনদল এবং পিরামিড ভবনের মধ্যে একটি ক্রস চিহ্ন।
সড়ক সেতু নিচের তীরে কাদার ভেতরে বাঙালির শত শত দীর্ঘ সারি দেখে মনে হচ্ছে যেন নতুন সেতুর জন্য সারিবদ্ধ তক্তা।
তারা যেন মেশিনের মত কাজ করছিল,যেমন সেনাবাহিনীর অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ পেশিবহুল ব্যক্তির মত প্রকৌশলীরা অনেক গুলো খেয়া নোকা বাতাস দিয়া ফুলিয়ে এগুলোকে হাটুপানিতে নিয়ে গেল এবং তারপর এগুলোতে অ্যালমিনিয়াম চুম্বক স্থাপন করলো। চার ঘন্টার মধ্যে সেতুটি তৈরি হয়ে গিয়েছিলো।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৫। হর্ষোৎফুল্ল বাঙালিরা ভারতীয় সৈন্যদের বীরের বেশে স্বাগত জানাচ্ছে । | বাল্টিমোর সান | ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
<১৪, ১২৫, ২৮৭>
দ্য বাল্টিমোর সান , ডিসেম্বর ৯, ১৯৭১
যশোরে হর্ষোৎফুল্ল বাঙালিরা ভারতীয় সৈন্যদের বীরের বেশে স্বাগত জানাচ্ছে ।
যশোর, পূর্ব পাকিস্তান: ভারতীয় সেনাদের স্বাগত জানাতে হর্ষোৎফুল্ল জনতা গতকাল (ডিসেম্বর ৭) জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা বাড়িতে বাড়িতে লাল-সবুজ এবং সোনালী রঙের বাংলাদেশের পতাকা উড়াচ্ছে, যা কিনা তারা পরম যত্নে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল এবং মহিলারা যারা কিনা পাকিস্তানী সেনাদের ভয়ে এতদিন প্রত্যন্ত গ্রামে কর্দমাক্ত ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, তারা বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে।
বজ্রাঘাতের মতো মিত্র বাহিনীর তীব্র আক্রমনের মুখে বিধ্বস্ত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী পালিয়ে যাবার পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী মঙ্গলবার যশোরে প্রবেশ করে। ট্যাঙ্ক আর সামরিক লোকজন শহরের মধ্যে দিয়ে রাস্তাঘাট, দোকানপাট অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে, বেশিরভাগ দোকানপাট অবশ্য জীর্ন, বন্ধ এবং তালাবদ্ধ।
পাগড়ি পরিহিত শিখ সৈন্যরা এবং বাদামীমুখো গুর্খা রাইফেলস এর সদস্যরা জনতার সাথে উৎসবে মেতে উঠেছে, যার সম্মুখভাগ থেকে মুহুর্মুহ স্লোগান ভেসে আসছে , “জয় বাংলা”- বাংলা দীর্ঘজীবী হোক !
যশোরে যেসব বাঙালি এখনো বেঁচে আছে, তাদের কাছে অবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশ দেখতে পাওয়া কোন স্বপ্নে দেখা স্বর্গরাজ্য থেকেও যেন বেশি কিছু।
মুক্তিবাহিনী যারা কিনা একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী গেরিলা বাহিনী এবং গত আটমাসে প্রেসিডেন্ট এ.এম. ইয়াহিয়া খান এর পাকিস্তান বাহিনীকে গেরিলা লড়াইয়ের মাধ্যমে নানাভাবে পর্যদুস্ত করেছে , তারাও আজকের এই বিজয়ের দিনে রাস্তায় নেমে এসেছে। ভারতের সরবারহ করা আধুনিক রাইফেল এবং লাইট মেশিনগান তাদের কাঁধে উঁকি দিচ্ছে।
যশোর যুদ্ধে তাদের অবদান মুখ্য ছিল না। কিন্তু আজ তারা গৌরবদীপ্ত পায়ে হেটে চলেছে, যেন এই কাঙ্খিত বিজয়ের প্রতিটা মুহূর্ত তারা অভূতপূর্বভাবে উপভোগ করছে।
মেজর-জেনারেল দলবীর সিং, যার ডিভিশন শহরে এই শক্তিশালী পাকিস্তানী বাহিনীর পতন ঘটিয়েছে, তিনি বললেন “শত্রু বাহিনী যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিকমতো লড়াই করতো , তাহলে আমাদের এখানে অন্তত আরো এক মাস লড়াই করতে হতো। “
ভারতীয় সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের কম্যান্ডার জেনারেল সিং বলেছিলেন, একটি এন্টিট্যাংক বাহিনীসহ তার ডিভিশন যশোরকে ঘিরে রেখেছে, কিন্তু অবরোধের পরে অবশেষে তারা যখন যশোরে প্রবেশ করল, তারা পাকিস্তানিদের থেকে কোন ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। তার বক্তব্যের সাথে কলকাতায় সামরিক মুখপাত্রের সংবাদ ব্রিফিংয়ে খুব অল্পই মিল আছে। কলকাতার ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছিল, যশোরে তুমুল লড়াই হয়েছে।
বেশিরভাগ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে শহরের বাইরে, জেনারেল সিং পাকিস্তানিদের সম্পর্কে বললেন, “তারা এপ্রিল থেকে যুদ্ধ করছে এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল ” শেলের আঘাতে কিছু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে , কিন্তু এছাড়া মিত্র বাহিনীর হামলায় যশোর শহরের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। বেশিরভাগ পাকিস্তানী কলকারখানার জন্য বিখ্যাত এবং বন্দরনগরী চালনার দিকে পলায়নরত।
জেনারেল সিং আরো বললেন, “তাদের অনেককে আমরা বিভিন্ন জায়গায় আটক করেছি, বাকিদের ও পালানোর খুব একটা পথ নেই। আমি তাদেরকে মেরে ফেলতে চাইনা। কিন্তু আমি তাদেরকে ধরতে চাই। আমি হিংস্র স্বভাবের নই। “
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১২৬। উচ্ছ্বসিত বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা উদযাপন | ইভনিং স্টার | ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
Orgho Zaber
<১৪, ১২৬, ২৮৮–২৮৯>
দ্যা ইভিনিং স্টার, ওয়াশিংটন, ডিসেম্বর ১৯৭১
উচ্ছসিত বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা উৎযাপন
যশোর, পূর্ব পাকিস্তান: যখন পূর্ব বাংলার উচ্ছসিত জনতা তাদের উপর এতদিন অত্যাচারকারী প্রতিপক্ষ দলের মৃতদেহগুলোকে ঘিরে আনন্দ করছিল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ১০০০ সৈনিকের একটি দল শোচনীয় পরাজয়ের পর তাদের পরিবারসহ, ইন্ডিয়ান মিত্রবাহিনীর হাতে মারা পরা অথবা আটক হওয়ার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল সমুদ্রের দিকে।
যশোর থেকে বেড়িয়ে আসার প্রধান সড়কটি ইন্ডিয়ানরা কোন প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই তিনদিন আগেই দখল করে নেয়, গতকাল (৮, ডিসেম্বর) পাকিস্তানী সৈন্যদের মৃতদেহ, পুড়ে যাওয়া জীপ, ট্রাক, ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র রাস্তার উপর পরে থাকতে দেখা যায়।
আত্মসমর্পন অথবা মৃত্যু
পালিয়ে যাওয়া পাকিস্তানিরা তাদের স্ত্রী সন্তান নিয়ে যদি সাগর পর্যন্ত যেতেও পারে তাও তাদের বাকি পথটুকু অতিক্রম করার জন্য সমুদ্রে সাঁতার কাটতে হবে কারন সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে ভারতীয় নৌবাহিনী, পালিয়ে যেতে পারা পাকিস্তানী জাহাজগুলো পরিণত হবে ভারতীয় বিমানবাহিনীর নির্ভুল লক্ষ্যে, যারা ইতোমধ্যেই আকাশে তাদের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
জল স্থল আর আকাশ সব দিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে আটকে পরা ৬০,০০০ পাকিস্তানী সৈন্যকে পূর্ববাংলার জনগণের প্রতিহিংসার মুখে আত্মসমর্পন অথবা মৃত্যু এ দুটির একটিকে এখন বেছে নিতে হবে।
পূর্বে যশোর আর পশ্চিমে কুমিল্লার মত দুটি প্রধান ও শক্ত ঘাটিতে পরাজয়ের পর ঢাকায় পাকিস্তানিরা আদৌ কোনও যুদ্ধ করতে পারবে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। যদিও ঢাকা তাদের রাজধানী এবং ত্রিভূজ প্রতিরক্ষা বূহ্যের শীর্ষ বিন্দু।
ভয়ংকর বলে বিবেচিত পাকিস্তানি যোদ্ধাদের সহজেই পরাস্ত করতে পারায় ভারতীয় সেনাক্রর্মকর্তাদের একটু বিব্রতই দেখাচ্ছিল। তারা জানায় তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই শত্রুদের পিছনে ধীরে ধাওয়া করছিল।
“আমরা তাদের আত্মসমর্পন করতে অনুরোধ করছি” আর্টিলারি অফিসার মেজর সাবু সিং বলেন, “তাদের সামনে এখন আর কোনও রাস্তা খোলা নেই, আর আমরা আকাশপথ ব্যবহার থেকে বিরত আছি শুধুমাত্র নারী এবং শিশুদের কথা ভেবে।“
কাল চামড়ার বাঙ্গালীরা রাস্তার পাশে দাড়িয়ে অগ্রবর্তী ইন্ডিয়ান বাহিনীকে স্বাগত জানায় “জয় বাংলা” চিৎকারে, তাদের আত্মস্বীকৃত নতুন দেশকে ইতোমধ্যেই নয়াদিল্লী সমর্থন করেছে।
যশোর এবং খুলনার মধ্যবর্তী রাস্তার একটি অংশে, বিদেশি টেলিভিশন ক্যামেরার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একদল বাঙালি ডজনখানেক মৃত পাকিস্তানি সৈনিকদের ঘিরে নাচতে থাকে আর “জয়বাংলা” চিৎকার করতে থাকে।তাদের কেউই কখনো টিভি, দেখেনি এমনকি তাদের কোনও বিদ্যুৎ সংযোগও নেই।
ইন্ডিয়ান মুক্তিবাহিনীর প্রতি খানিকটা রক্ষণশীল মনোভাব পোষন করলেও বাঙ্গালীরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছথেকে মুক্ত হতে পেরে যে এখন উৎফুল্ল এ বিষয়টি পরিষ্কার। কারণ গত আটটি মাস অহংকারে অন্ধ পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিসত্বাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হাজারে হাজারে বাঙ্গালী জবাই করে হত্যা করেছে।
গণহত্যার অভিযোগ
পিছু হটে যাওয়া পাকিস্তানিরা তাদের চলার পথের ব্রীজগুলোকে ধ্বংস করে দেয়ার পাশাপাশি আর কিছু গণহত্যার কাহিনী রেখে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা প্রশংসনীয় দক্ষতার সাথে পন্টুন ব্রীজগুলোকে জুড়ে দিয়ে বড় নদীগুলো পার হতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার কাহিনী গ্রামে গ্রামে উত্তেজিত বাঙ্গালীদের মুখে মুখে ফিরছে। একজন বাঙ্গালী বলছিল- কিভাবে পাকিস্তানিরা বিল্লাল (যা এই অঞ্চলের একটি অতি প্রচলিত নাম) নামের মুক্তিবাহিনীর একজন নেতা কে খুঁজতে তাদের গ্রামে আসে। যখন তারা তাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো তখন এই নামে ঐ গ্রামে যে ১০ জন লোক ছিল তাদের সবাইকে তারা গুলি করে মারে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৭। নিক্সন এবং দক্ষিণ এশিয়া | নিউ ইয়র্ক টাইমস | ৯ ডিসেম্বর , ১৯৭১ |
<১৪, ১২৭, ২৯০–২৯১>
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস , ডিসেম্বর ৯, ১৯৭১
মি: নিক্সন এবং দক্ষিণ এশিয়া
– জন পি. লুইস
প্রিন্সটন, নিউ জার্সি – নিক্সন প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়া নীতি , যা গত আটমাস ধরে সেখানকার পরিস্থিতিকে একটা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে, সেটা গত সপ্তাহে একেবারে খাদের কিনারায় গিয়ে ঠেকেছে । আশঙ্কা ছিল, অন্তত আপাত সময়ের জন্য এই নীতি থেকে নিক্সন প্রশাসন সরে আসবে না । স্বার্থপরের মত একজন মার্কিন হিসেবে যা আমাকে এখন বিচলিত করছে সেটা হলো, ভারতীয় নেতারা মার্কিন প্রশাসনের এই হঠকারী অবিবেচক অবস্থানকে যা কিনা বিচক্ষণ এবং অভিজ্ঞ মার্কিন জনগণের মতামত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটা কে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করবে। পারিপার্শিক সব সাক্ষ্য প্রমান থেকে মনে হচ্ছে এই হঠকারী অবিবেচক অবস্থানের দায় প্রাথমিকভাবে শুধু প্রেসিডেন্ট নিক্সন এর নিজের উপরে সরাসরি এককভাবে বর্তায়। স্মরণকালের মধ্যে কোন সভ্য মানব সম্প্রদায়ের উপরে চলা বর্বরতম এবং পরিকল্পিত নৃশংসতম গণহত্যা নিয়ে তিনি গত আটমাস ধরে সরকারিভাবে অন্ধ অবস্থান নিয়ে থেকেছেন। তিনি আনুগত্য দেখিয়ে চলেছেন তার বন্ধু ইয়াহিয়া খান এর প্রতি, যিনি কিনা এই গণহত্যার মূলনায়ক। দৃশ্যত, পূর্ব বাংলার কোন রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তিনি সরাসরি বা গোপনে পাকিস্তানী জান্তার উপরে কোন রকমের চাপ দেননি।
অপ্রত্যাশিত শরণার্থীর চাপ এবং নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতীয় সরকারের জন্য একটা নৈতিক এবং মানবিক দায়িত্ব থাকা সত্বেও তারা এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত দুর্দান্ত সংযম প্রদর্শন করেছে। কাজের মধ্যে মি: নিক্সন বলতে গেলে শুধু তাদেরকেই সংযম প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়ে গেছেন। মাসের পর মাস ধরে তিনি এর সমাধানের জন্য কোন নৈতিক সমর্থন তো দেননি বরং আগুনে ঘি ঢালার মতো অব্যাহতভাবে পাকিস্তানকে অস্ত্রের যোগান দিয়ে গেছেন। পূর্ব বাংলার বিষ্ফোরম্মুখ রাজনৈতিক অবস্থার জন্য ভারতের পশ্চিম বাংলায় সৃষ্ট শরণার্থী সমস্যা এবং যেভাবে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ভারতের জন্য বিরাট একটা সুযোগ তৈরী করেছে , উভয় সম্পর্কে পাকিস্তান সম্পূর্ণ অবগত।
ক্রমবর্ধমান এই অক্ষমতা এবং কর্মতৎপতা নিয়ে ইতিহাসবিদরা বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং খুব সাধারণ একটা নৈতিক প্রশ্নে আমাদের একের পর এক পদক্ষেপ আমাদেরকে ভুল পক্ষের সাথে যুক্ত করেছে , যেখানে এক মিলিটারি একনায়ক পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে , যারা কিনা আবার ঘটনাচক্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ সবচেয়ে বেশি ধারণ করে। আমরা এমন এক পক্ষের সাথে জোট বেঁধেছি, যারা উপমহাদেশের এই ক্রান্তিকালে নিশ্চিতভাবে পরাজিত হবে এবং এই ভুল অবস্থান ভবিষ্যতের জন্য মজবুত ইন্দো-আমেরিকা সম্পর্ককে অহেতুক ক্ষতিগ্রস্থ করবে।
এটা ঠিক যে আমাদের ভারতীয় বন্ধুদের কাছে বলা ভুল হবে যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন মার্কিন জনমতের প্রতিকূল দিকে সাঁতরে চলেছেন। সত্য কথা হলো, উপমহাদেশ নিয়ে আমাদের জনগণের খুব অল্প অংশেরই কোন রকমের মতামত আছে। আর উপরে উপরে আমাদের জনমতের যা কিছু প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, তার অনেকটাই যেকোন প্রেসিডেন্ট এর কথা ও কাজ দ্বারা প্রভাবিত হতো। তাছাড়া বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে এবং কলামে যুদ্ধের যেই ভয়াবহ চিত্র যা ছাপা হচ্ছে , তা উস্কানিমূলক এবং সমাধানের অন্য সব সম্ভাব্য রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে, এই সময়ে যেটা ঠিক হচ্ছে না।
আমি একটা পয়েন্টে জোর দিতে চাই, যা অন্য তেমন কেউ বলছে না , কেননা কেউ এটা বলে ধরা খেতে চাচ্ছে না যে যুদ্ধের বিকল্প যুদ্ধের থেকে খারাপ পরিণতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে। আমার পয়েন্ট হচ্ছে, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ পূর্ব বাংলার জন্য শুধুমাত্র একটাই বাস্তব সমাধান খোলা আছে, যা কিনা দশ মিলিয়ন শরণার্থীর বেশিরভাগকে ফিরিয়ে আনতে পারে এবং পূর্ব বাংলার পুনর্গঠনে সাহায্য করতে পারে, সেটা হলো, আর তা হলো, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা লাভ। ২৫শে মার্চ থেকে যে দুর্বিষহ বীভৎস পরিস্থিতি সেখানে তৈরী করা হয়েছে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো বর্তমানের অবস্থা ,এবং সেখান থেকে পিছনের দিকে হাঁটার কোন রাস্তা এখন আর খোলা নেই। সুতরাং ১) অন্তত গত পাঁচ মাস ধরে আমেরিকার নীতি যেই অবিভক্ত পাকিস্তান এর প্রতি সমর্থন দিয়েছে, তা ব্যর্থ হয়েছে ২) গতবারের নির্বাচিত বাংলাদেশের সরকারের দ্বারা চালিত সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ভারতের যেই অকুন্ঠ সমর্থন, সেটা এখন শুধু মানবিক দিক থেকেই বোধগম্য নয়, বরং এটাই এখনকার পরিস্থিতিতে একমাত্র গঠনমূলক রাস্তা যা এখন খোলা আছে।
আমি মনে প্রাণে মনে করি ভারতীয়রা তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থন একটু কম করলে এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে এটা সমাধানের চেষ্টা করলে হয়তো ভালো হতো । কিন্তু সত্যি কথা বলতে এখানে কোন পক্ষ যদি সবচেয়ে কম ধৈর্য দেখিয়ে থাকে, যা এই পরিস্থিতিকে আরো গভীর হতাশার দিকে নিয়ে গেছে, সেটা হলো নিক্সন প্রশাসন। বল এখন ভারতের কোর্টে এবং তাদের দেখাতে তে হবে যে, তারা মুখে যা বলছে অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশই শুধু তাদের লক্ষ্য, যেখান থেকে এই শরণার্থীরা এসেছে, তারা যেন আবার সেখানে ফেরত যেতে পারে এবং এটা ছাড়া তাদের অন্য কোন উচ্চাভিলাষ নেই। ভারতীয় নেতাদের উপরে একটা গুরু দায়িত্ব আছে এবং সেটা হলো নিচিত করা এই যুদ্ধ যেন দীর্ঘ মেয়াদে না চলে এবং পূর্ব বা পশ্চিম হোক, বড় আকারে যেন চারদিকে ছড়িয়ে না পরে। আর ইতিমধ্যে পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিয়েছে, ওয়াসিংটন এর দায়িত্ব হবে অন্তত চুপচাপ থাকা।
***জন পি. লুইস ডিন – উডরো উইলসন স্কুল অফ পাবলিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার , প্রিন্সটন, প্রাক্তন ডিরেক্টর – ইউ এস এ.ই.ড , ভারত ১৯৬৪-৬৯
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৮. পশ্চিম বঙ্গের চিঠি | দ্যা নিউ ইয়র্কার | ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
<১৪, ১২৮, ২৯২-২৯৯>
দ্যা নিউ ইয়র্কার, ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পশ্চিম বঙ্গের চিঠি
৩রা ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে ধরণের উস্কানিই দেয়া হোক না কেন, এটা সবার কাছেই বোধগম্য যে এই যুদ্ধের মূল কারণ মার্চ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়া ৯ মিলয়ন উদ্বাস্তু- যা বিশ্বের ইতিহাসে একক একটি সেনাবাহিনী দ্বারা জোরপূর্বক উচ্ছেদের সবচেয়ে বড় ঘটনা। কিন্তু এত বড় মানবিক দূর্যোগ বিশ্ববাসীর মধ্যে কোন বিকারের সৃষ্টি করেছে বলে মনে হচ্ছেনা। কেউ যদি এমন একটি সমাজের বাসিন্দা হয়, যেখানে অনাহার, কোন রকমে বেঁচে থাকা এই শব্দগুলো অপরিচিত- যেখানে খাবারের পুষ্টিগুণ, উন্নত জীবনযাত্রা, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, সামাজিক সমতা, মানবিকতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময় আছে; সেই ব্যাক্তির পক্ষে একজন শরণার্থীর দুঃখ উপলব্ধি করা আসলেই কঠিন। যদিও এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ কেউ ডাক্তার, আইনজীবী, অধ্যাপক, ছাত্র বা ব্যাবসায়ী ছিল, কিন্তু তাদের বেশীরভাগেরই তেমন কোন সহায়-সম্বল ছিলনা। তারা দরিদ্র অবস্হায় জন্ম নিয়েছিল এবং এবং দরিদ্র অবস্হাতেই মৃত্যুবরণ করা ছিল তাদের ভবিতব্য। পারিবারিক বন্ধন, কিছু সুখ স্মৃতি- এই ছিল পৃথিবীতে তাদের সবকিছু। কিন্তু এখন তাদের বেশিরভাগের পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের সম্মান-মূল্যবোধ কলঙ্কিত করা হয়েছে, তাদের সামান্য সম্বলটুকু কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং তাদের স্মৃতিগুলোকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করা হয়েছে। বাস্তুহারা হবার আগে এই লোকগুলো একটা নির্দিষ্ট জায়গার বাসিন্দা ছিল, হয়তো তাদের বড় কিছু হবার আশা ছিলনা, হয়তোবা বেঁচে থাকারও কোন অনুপ্রেরণা ছিলনা। এখনো তাদের কিছু নেই। তাদের কি কোনভাবে পশুদের থেকে আলাদা করা যায়? গান্ধী একবার বলেছিলেন, ” আমি যতই গ্রামের মানুষদের দেখি, তাদের চোখের শূণ্য দৃষ্টি দেখে আমি ততই অবাক হই। ক্ষেতে কাজ করা ছাড়া তাদের জীবনে আর কিছুই নেই। সারা দিন হালের বলদগুলোর সাথে পাশাপাশি কাজ করতে করতে তারা তাদের মতই হয়ে গিয়েছে। যদি সব শরণার্থীদের একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মারা যায়, সেই ঘটনার মুখোমুখি হওয়া কি বিশ্ববাসীর জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ হবে? এই শরণার্থীদের অবস্হা দেখে মনে হচ্ছে বিবর্তন প্রক্রিয়া উল্টোদিকে হাঁটছে। তবে এই মুহূর্তে এটাই সত্য যে সব রাস্তাই এখন কলকাতায় শেষ হয়েছে, যার ব্যাপারে রুডইয়ার্ড কিপলিঙ লিখেছিলেন যে কলকাতায় শুধু কলেরা, সাইক্লোন আর কাকেরা আসে আর যায়। এছাড়াও তিনি কলকাতাকে নর্দমার সাথে তুলনা করেছিলেন। কিপলিঙ কলকাতা নিয়ে লিখেছিলেন আশি বছর আগে, তারপর শহর আরো বিস্তৃত হয়েছে এবং শরণার্থীদের বাদ দিয়েও এই শহরে সাত মিলিয়ন মানুষ থাকে। পূর্বভারতের যে অংশে শরণার্থীরা প্রায় হাজার খানেক শিবির বানিয়ে বসবাস করছে, তারা দেশে ফেরত যেতে না পারলে শরণার্থী শিবিরগুলোর জনসংখ্যা বাড়ার কারণে সেই অঞ্চলের জনসংখ্যা একসময় ৩০ মিলিয়নে পৌছাবে এবং এলাকাগুলো একসময় কলকাতা শহরের অংশে পরিণত হবে। ভারতের এই অংশে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ থাকে, যাদের বেশীরভাগই অত্যন্ত গরীব এবং এই এলাকায় দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং সাইক্লোনের উৎপাত লেগেই থাকে।
শরণার্থীদের হারানোর কিছু নেই, তারা বাঁচার জন্য যেকোন কিছু করতে প্রস্তুত। পূর্ব ভারতের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রন করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে এবং এর প্রভাব সারা দেশের উপরই পড়ছে।
কাজের খাতিরে আমাকে অনেকগুলো শরণার্থী শিবিরে যেতে হয়েছে। শরণার্থীদের বর্ণণাতীত দূর্দশা যেকোন মানুষকেই স্পর্শ না করে পারেনা। কাগজে-কলমে তাদের অবস্হার বিবরণ দেয়ার মত মানসিক অবস্হা আমার নেই। প্রতিটি শিবিরই একটির চেয়ে অন্নটি ভিন্ন। একটিতে ১ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষ থাকছে তো আরেকটিতে ১০ হাজার। কোথাও টিউবয়েল আছে, কোথাও পানি সরবরাহের কোন ব্যাবস্হাই নেই। কোন কোনটি তারপুলিন দিয়ে ঢাকা আবার কোন কোনটিতে মানুষ খোলা আকাশের নীচে থাকছে। কোথাও পুরো শিবির হাঁটু পানীর নীচে তো অন্য কোথাও ধূলো-বালি।
এক বর্গ মাইলের মত এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা একটা শরণার্থী শিবিরে আমি গিয়েছিলাম, যেখানে এক লক্ষের বেশী মানুষ থাকে। বৃদ্ধ পুরুষ, মহিলা, শিশুরা কোন রকমে বানানো একটি আশ্রয় কেন্দ্রে থাকছে। তারা অপুষ্ট এবং দূর্বল, আবর্জনা পূর্ণ একটি নর্দমার পাশে অসহায়ভাবে বসে আছে। দূর্গন্ধে সেখানে টেকা দায়।
পাশে থাকা একজনকে আমি বলেছিলাম, ” দেখে মনে হচ্ছে এখানে কোন কম বয়সী পুরুষ বা মহিলা থাকেনা।”
সে উত্তর দিল, ” অল্প বয়সী মেয়েরা প্রায় কোন সময়েই সীমান্ত পেরিয়ে আসতে পারেনা। সেন্যরা প্রথমে তাদের ধর্ষণ করে, এবং পরে আবার ধর্ষনের জন্য সেনা পতিতালয়ে পাঠিয়ে দেয়। আর অল্প বয়সী ছেলেদের আমরা ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দেই। আমরা নর্দমার পাশে বসে থাকা কিছু বৃদ্ধার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম, যাদের স্পষ্টই কোন রকমের আত্মচেতনা নেই। তাদের পাশেই কিছু মহিলা নর্দমার মধ্যেই কাপড় এবং থালা-বাসন ধুচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে তারা কি নর্দমার দূষিত জলের ব্যাপারে অজ্ঞ, নাকি এতই দূর্বল যে তারা পরিষ্কার পানির খুঁজতে দূরে যেতে পারছেনা নাকি তাদের ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে যাবার অনুমতি নেই। এই ব্যাপারে তাদের প্রশ্ন করা হলে তারা কোন উত্তর না দিয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ক্যাম্প কর্মরাতাও এই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেলেন।
সামনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, “এদের সবারই আমাশয় হয়েছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ” তাদের কিছু ল্যাট্রিন খুঁড়তে দেয়া হচ্ছেনা কেন?”
তিনি বললেন, “তাহলে রায়ট লেগে যাবে। উদ্বাস্তুদের হাতে কোদাল দেখলে এলাকার মানুষেরা মনে করবে তাদের কাজ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
” টিউবয়েল?”
” আমরা ঠিকাদারদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি। তারা যেকোন সময় কাজ শুরু করে দেবে।”
আমরা বিক্ষিপ্তভাবে বসে থাকা কিছু শিশুর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। তাদের মধ্যে শিশুদের স্বাভাবিক চাঞ্চল্যের লেশ মাত্র নেই। বাইরের মানুষ দেখলে শিশুরা সাধারণত তাদের ঘিরে ধরে, আমাদের দেখেও এই শিশুদের মধ্যে কোন বিকার দেখা গেলনা।
আমি আরেকটি ক্যাম্প দেখেছি, যেটি কোলাহলে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানকার জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার এবং সেটি নিরাপত্তারক্ষী ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আমি যখন গাড়ি চালিয়ে ক্যাম্পে গেলাম, এক দল শিশু আমার গাড়ির পিছন পিছন আসতে থাকল। ক্যাম্পের ভেতর কিছু ব্যাবসায়ী ঝুড়ি ভর্তি পঁচা ফল ও শাকসবজি নিয়ে নিয়ে বসে ছিল। একজন নিরাপত্তারক্ষী আমাকে ক্যাম্প সদর দপ্তরে নিয়ে গেল, যেটি মূলত তারপুলিন আচ্ছাদিত একটি ঘর। হাত মুঠিবদ্ধ করে চিৎকার করতে থাকা একদল লোক সেই ঘরটা ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। নিরাপত্তারক্ষী সাবধানতার সাথে তাদের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে ক্যাম্পের কমানডেন্ট একটি খালি ডেস্কের সামনে চুপ করে বসে ছিলেন। আমাদের দেখে চিৎকার থেমে গেল।
আমি কমানডেন্টকে কি সমস্যা সেটা জিজ্ঞেস করলাম।
” রেশন আসতে একদিন দেরী হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। শরণার্থীরাও এটা জানে। কিন্তু আজ সকালে নকশালীরা এসেছিল। তারা যেখানেই আসে, সেখানেই সমস্যা সৃষ্টি করে। নকশাল মাওবাদী সন্ত্রাসীদের একটা সংগঠন। তাদের কারণে শরণার্থীরা এখন মনে করছে যে ত্রাণ তাদের প্রাপ্য অধিকার, অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করে আনা ভারত সরকারের দেয়া কোন উপহার নয়।
” আপনি কি সাধারণত রাজনৈতিক কর্মীদের ক্যাম্পে আসতে দেন?”
” আমি কি করতে পারি? আমার বড়কর্তা নকশালীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। তিনি আমাকে নকশালীদের কর্মকান্ডে কোন বাঁধা দিতে বারণ করেছেন। কিন্তু আমি তাদের দয়া করে ক্যাম্প থেকে চলে যেতে হাত জোড় করে অনুরোধ করেছি। আমি সরে না গেলে তারা আমাকে মেরেই ফেলত। পুলিশ, প্রশাসন এবং সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই অবস্হা এখন ছন্নছাড়া, কে ক্ষমতায় আসবে সেটা কিছুতেই বলা যাচ্ছেনা। সুতরাং কেউ ঝুঁকি নিয়ে কোন দলের বিরাগভাজন হতে চাইছেনা। নকশালীরা এখন পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় শক্তি। তারা সন্ত্রাস ও অরাজকতায় বিশ্বাস করে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গে আসছে। সংখ্যালঘু হিসাবে নির্যাতিত হবার ভয়ে মুসলমানেরা নিজেদের জন্য আলাদা একটি আবাসভূমির দাবী তুলে। সেই দাবী পূরণের জন্যই হাজার মাইল দূরে আবস্হিত দুটি ভুখন্ড, পশ্চিম পান্জাব এবং পূর্ব বাংলাকে এক করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন করা হয়। এসময় সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুধু এক মিলিয়নের বেশী মানুষের জীবনই নেয়নি, হিন্দু-মুসলমান দুটি রাষ্ট্রের বাইরে দেশবিহীন আরেকটি জনগোষ্ঠীও সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতার পর প্রথম দুই-তিন বছরে প্রায় ৬ মিলিয়ন হিন্দু এবং শিখ ভারতে পালিয়ে এসেছে এবং প্রায় সমপরিমাণ মুসলমান পাকিস্তানে চলে গিয়েছে। কিন্তু এর পরেও, পাকিস্তানে প্রায় ১০ মিলিয়ন হিন্দু, যার বেশীরভাগই পূর্ব পাকিস্তানে এবং কয়েকগুণ বেশী মুসলমান ভারতে রয়ে যায়। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লেই এই সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। এর ফলে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ অব্যাহত থাকে, যদিও ৫০ এবং ৬০ এর দশকে মূলত ভারতে আসার হারই অনেক বেশী। ভারতে আসা আনুমানিক তিন থেকে চার মিলিয়ন হিন্দু মূলত পশ্চিমবঙ্গেই আবাস গাঁড়ে, যাদের অনেকেই বেকার এবং আত্নীয়-স্বজনের দয়ার উপর নির্ভরশীল। এখন আবার নতুন করে ৯ মিলিয়ন উদ্বাস্তু এসে এদের সাথে যোগ হয়েছে। এখনো প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ হাজার করে নতুন শরণার্থী আসছে। পূর্ব পাকিস্তানে এখনো দুই থেকে তিন মিলিয়ন হিন্দু রয়ে গিয়েছে। ভারতে এখন অন্ততপক্ষে সাত মিলিয়ন মুসলমান বাস করে। এদের মধ্যে এখন হয়তো অনেকেই পাকিস্তান চলে যেতে চাইবে, কারণ তাদের হিন্দু প্রতিরোধের টার্গেট হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের সতর্কতার কারণে এখনো ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যায়নি, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু নির্যাতন এবং উদ্বাস্তু সমস্যা যদি চলতে থাকে, তাহলে তাহলে তার ঝাঁঝ নিরপরাধ ভারতীয় মুসলমানদের উপর পড়তেই পারে। এরকম কিছু হলে পাকিস্তানকে ভারত অপেক্ষা অনেক বড় আকারের শরণার্থী সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে।
যেহেতু দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানেরই পাওয়ার চেয়ে হারানোর আশঙ্কা বেশী, পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন যে পাকিস্তান কি এই পরিস্হিতি এড়াতে পারতোনা, বিশেষত এটা যেহেতু এটা পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম দুই অংশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ধের ফলাফল। পশ্চিম পাকিস্তানের পান্জাবী এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের মধ্যে অমিল অনেক বেশী। তারা শুধু ভৌগলিক দিক দিয়েই আলাদা নয়, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক সবই ভিন্ন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র মিল হচ্ছে ইসলাম ধর্ম- কিন্তু এটা অন্যান্য অনেক মুসলিম দেশও বুঝতে পারছে যে শুধু ধর্ম দিয়ে রাজনৈতিক বিভেদ আড়াল করে রাখা সম্ভব নয়। পান্জাবীরা বাঙালীদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশী অগ্রসর এবং তারা সামরিক বাহিনী, গণপ্রসাশন, শিল্প সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। তারা সামরিক ঘাঁটি থেকে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের জান-মাল ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু এগুলো দখল করে শাসন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তার উপর গেরিলা যোদ্ধারা সহজেই ভারতে প্রবেশ করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য লুকিয়ে থাকতে পারে।
এই যুদ্ধে ভারতের জড়িত হওয়া সময়ের ব্যাপার ছিল। কারণ বাঙালীর উপর পাকিস্তানের আক্রমণ শেষ পর্যায়ে যেয়ে হিন্দু নিধনযজ্ঞে পরিণত হয়েছিল। ভারতে আসা ৯ মিলিয়ন মানুষের ৯০ ভাগই হিন্দু ( চেহারা দেখে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য করা কঠিন, পাকিস্তানী সেনারা তাই মানুষের কাপড় খুলে তার খৎনা আছে কিনা তা পরিক্ষা করে দেখত। কিছু হিন্দুদের সহযেই চেনা যেত, তারা ব্যাবসায়ী অথবা জমির মালিক ছিল এবং ইহুদিদের মত সহযেই তাদের বলির পাঁঠাতে পরিণত করা হয়েছিল।)। ভারতের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ১৩৫০ মাইল ব্যাপী বিশাল সীমান্ত, পলায়নরত হিন্দুদের জন্য যেটা ছিল একটি বিশাল সুবিধা। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে এই শরণার্থীদের একটা অংশকে যদি বন্দুকের মুখে সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেয়া হত, তাহলে শরণার্থী সমস্যা এত প্রকট আকার ধারণ করতোনা। অন্য দেশের নাগরিকদের গ্রহণ করার জন্য ভারতের কোন আইনী বাধ্যবাধকতা নেই।
কেউ কেউ মনে করেন প্রধাণনমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উচিত ছিল শুরুতেই পাকিস্তানের উপর আচমকা হামলা চালানো। এর ফলে শরণার্থী আসা বন্ধ হত। আরো আগে যুদ্ধ শুরু না করা সরকারের ব্যার্থতা এবং প্রথম থেকেই শরণার্থী ঢুকতে দিয়ে আরো শরণার্থী আসাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে সাহায্যের জন্য অনুপ্রেরণা মানবিক ছিল, কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে ভারতের রাজনৈতিক হিসাবের মধ্যে পাকিস্তানকে ভাঙা- এমনকি ভারত-পাকিস্তান পুন:সংযুক্ত করাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের কথা অনুসারে পাকিস্তানে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ সবসময়ই অনিশ্চিত ছিল এবং কোন না কোন সময় ভারত সরকারকে এদের দায়িত্ব নিতেই হত। ভারত পাকিস্তানের অস্তিত্ব কখনো মেনে নেয়নি, এখন শরণার্থীদের সামনে রেখে পাকিস্তানের উপর প্রচন্ড রকমের অন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ এসেছে। ( পাকিস্তান সবসময় দাবী করে এসেছে যে ভারত শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সব ত্রাণ সংস্হাই ভারতের হিসাবই সঠিক বলে মেনে নিয়েছে।)
ভারতের উদ্দেশ্য যাই হোকনা কেন, শরণার্থীদের দূর্দশা সবার বিবেচনায়ই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমেরিকা, রাশিয়া, চীন- বড় শক্তি গুলোর রাজনীতিতে সেটা হয়নি। আমেরিকা তাদের পুরোনো নীতি অনুযায়ী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে সামরিক জান্তাদের সমর্থন করছে। তারা কখনোই ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি এবং মিসেস গান্ধীর সফরের আগ পর্যন্ত তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। সরবরাহকৃত অস্ত্রের দাম হয়তো খুব বেশী নয়, কিন্তু এই অস্ত্র ও খুচরা যন্ত্রাংশ পাক সামরিক বাহিনীর জন্য অপরিহার্য এবং এই ঘটনা ভারতীয় জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তীব্র অবিশ্বাসের সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি, যদি সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়- তা হচ্ছে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ইয়াহিয়া খানের পাশে থেকে তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা। তীব্র আমেরিকা বিরোধী মনোভাবের ভেতর দিয়ে ভারত-রাশিয়ার মদ্ধ্যে যে চুক্তি অনুমোদিত হয়েছে, সেটি মূলত সামরিক গুরুত্ব বহন করে।চুক্তি সাক্ষরের পেছনে রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল নিরপেক্ষ বলয় থেকে ভারতকে বের করে নিজের দিকে টেনে নেয়া এবং রাশিয়ার আশা ছিল যে ভারত আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ শুরু করে এর মধ্যে রাশিয়াকে টেনে আনবেনা। চীন পাকিস্তানকে কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা কেউ জানেনা, গত গ্রীষ্মে কিসিন্জারের চীন সফরের মাধ্যমে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে, নিশ্চিত করে কিছু বলার মত তথ্য পাওয়া যায়নি। আসছে শরতে ভুট্টো চীন সফর করবেন, আর জাতিসংঘে চীন ভারতকে হুমকি-ধামকি দিয়েই যাচ্ছে।
যদিও ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, আমেরিকা, চীন – সবাই শরণার্থীদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, কিন্তু তাদের দুঃখ-দূর্দশা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। বাস্তবিকভাবে রাজনীতি এবং কূটনীতির জালে তাদের দুঃখ-কষ্ট অনেকটাই আড়াল হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় সরকার বলেছে যে উদ্বাস্তুদের জন্য সহানুভূতি, সাহায্য ঠিক আছে, কিন্তু কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। এবং এই সমাধানের পথ হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ভারত মনে করে যে ইয়াহিয়া বাহিনীর অত্যাচারের ফলে শরণার্থীরা আর তার অধীনে ঘরে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করবেনা। শেখ মুজিব, ধারণা করা হচ্ছে যাকে বন্দী করে রেখে গোপনে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার চক্রান্ত চলছে, তাকে মুক্ত করে দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান নেই। মুজিবকে মুক্তি দিলেও তাঁর পক্ষে এখন একা অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবেনা। যুদ্ধের এই কয়েক মাসে বাংলাদেশে আরো কয়েকজন নেতার আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের বাদ দিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া মুজিবের পক্ষে সম্ভব হবেনা। এটাও অনেকের আশঙ্কা যে বাংলাদেশ আদৌ এই শরণার্থীদের ফেরত নেবে কিনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও হিন্দুরা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সংখ্যালঘু হিসাবে থাকবে- পুনরায় উছ্ছেদ অথবা নিশ্চিন্হ হয়ে যাবার অপেক্ষায়। শরণার্থীরা যদি ফিরেও যায়, বাংলাদেশ কি পশ্চিম বঙ্গের বাঙালীদের জন্য একটি আকর্ষণ হয়ে থাকবেনা? বাঙালী জাতী কি এক তৃতীয়াংশ বাঙালীকে ভারতে রেখে পরিপূর্ণ হবে? শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান আসলে এবং ভারত কিছু জায়গা শরণার্থীদের রাখার জন্য দখল করে নিলে ( এমনকি পুরো বাংলাদেশকে ভারতের অংশ বানিয়ে নিলে) সেটা ভবিষ্যৎে খন্ডিত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে বাঁধা হয়ে দাড়াবে। এ সমস্ত জল্পনা-কল্নার কিছু অংশ ভারতীয় সরকারের অন্দর মহলেও প্রবেশ করেছে এবং সেটা আরো নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেন ভারতীয় সরকার শরণার্থী সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মত জটিল সমাধানের পথ বেছে নিচ্ছে? এর যুক্তি সঙ্গত উত্তর হচ্ছে ৯ মিলিয়ন শরণার্থীদের ভরণ-পোষনের ব্যায় বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৭০০ মিলিয়ন ডলার-যা ভারতের বার্সিক বাজেটের ছয় ভাগের এক ভাগ। এই বিপুল ব্যায় বহন করা ভারতের জন্য অসম্ভব এবং বিকল্প কোন সমাধানের রাস্তা না পেয়ে ভারত মনে করছে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে এই শরণার্থীদের ভরন-পোষণের ভার তাকে আর নিতে হবেনা।
শরণার্থী শিবিরে যাবার আগে আমার আশা ছিল যে সেখানকার অবস্হা কলকাতার চেয়ে খারাপ হবেনা। আমার ধারণা ছিল যে মানুষের দুঃখ-দূর্দশার একটা সীমা থাকে, একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের পর মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারেনা। আমার ধারণা ভুল ছিল। কলকাতার গরীবেরা কিছুটা হলেও ভাল আগামী দিনের আশায় থাকতে পারে। কলকাতার একজন কুষ্ঠরোগী মৃত্যুশয্যায় বসে ব্যাথায় কাঁতরাতে পারে। শরণার্থী শিবিরে মানুষের সেই অবস্হাও নেই। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণরুপে ভারতের সাথে বাণিজ্য এবং পশ্চিমের দয়ার উপর নির্ভরশীল। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নানা রকম ভাবে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্হার অবসানে আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের দৃশ্যত কিছু চেষ্টা ছিল। পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার স্বার্থে তিনি ৬৯ সালে সিদ্ধান্ত নেন যে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং ১৯৭০ সালে ২৩ বছর পর পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনী প্রচারের সময় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধিনন আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যেই অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে প্রচারণা চালায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব আসনেই জয় লাভ করে। অন্য দিকে পান্জাবী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি কোন রকমে পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের পর পরই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং তার ভিত্তিতে সরকার গঠন করবে। ভুট্টো সরাসরি জানিয়ে দেন যে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির সমান অংশিদারিত্ব না থাকলে তার দল সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবেনা। শেখ মুজিব ভুট্টোর এই বক্তব্যকে পূর্ব পাকিস্তানে ঔপনিবেশিক শাসন চালুর প্রচেষ্টা হিসাবে অভিহিত করেন। ইয়াহিয়া খান গণতান্ত্রিক শক্তির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাইলেও এটা আশা করেননি যে গণতান্ত্রিক দলগুলো এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। নির্বাচনে দেশ স্পষ্টতই স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে মত দেয় এবং ইয়াহিয়া খান উপলব্ধি করেন যে জনরায় মেনে নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানী হিসাবে ভুট্টোর মত তার পক্ষেও বাঙালীর হাতে ক্ষমতা চলে যাবে এটা মেনে নেয়া কঠিন ছিল, কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন এর ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরবে। সাধারণ পরিষদের অধিবেশন স্হগিত করে তাই তিনি অবস্হান নরম করার জন্য মুজিবের উপর চাপ প্রয়োগ করেন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভ দমনে ইয়াহিয়া সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেন এবং তাদের মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালানোর অনুমতি দেন। প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ফলশ্রুতিতে কয়েক মাসের মধ্যে দুই লক্ষ হিন্দু-মুসলমান প্রাণ হারায় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুৎ হয়।
এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে যেতে আমি আমি শুনছিলাম এবং পড়ছিলাম যে কেন এবং কিভাবে ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধানের পথ বেছে নিলেন। কেউ কেউ ভুট্টো এবং তার সহযোগীদের নিষ্ঠুরতাকে এর জন্য দায়ী করেন, সেনাবাহিনীতে ভুট্টোর ব্যাপক সমর্থন ছিল। অন্যরা মুজিব এবং তার সহযোগীদের ধৈর্যের অভাবকে দায়ী করেন, যারা একটি রাষ্ট্রের শক্তিকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব না দিয়ে স্বাধীনতার দাবীতে রাস্তায় নেমে গিয়েছিল।অনেকেই এটা মনে করেন যে পশ্চিম পাকিস্তান বিনা প্রতিরোধে নিজেদের ক্ষমতা ছেড়ে দেবে, এরকম চিন্তা করাটাই ছিল অবাস্তব।আরেকটি মতবাদ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ক্ষোভ এতই বেশী ছিল যে ৭০ সালে প্রলয়ঙ্করী একটি সাইক্লোনে ২,৫০,০০০ মানুষ মারা যাবার পরেও তারা নির্বাচন থেকে পিছনে হটার কথা চিন্তা করেনি। তারপরেও অনেকেই ইয়াহিয়াকে পরিস্হিতির গুরুত্ব অনুধাবণ করতে না পারার জন্য এবং বাঙালীদের সাথে স্বায়ত্বশাসনের রুপরেখা নিয়ে আরো আলোচনা চালানোর চেষ্টা না করে সরাসরি তাদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য দায়ী করেন। যদিও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার পর সেনাবাহিনীর কাছে ফেরত যাওয়া ছাড়া ইয়াহিয়ার আর কোন উপায় ছিলনা। সামরিক অভিযান চালানোর পেছনে যেই কারণই থাকুক না কেন ভারত মনে করে এর কারণে পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে। সামরিক অভিযানের কারনেই বাঙালীর স্বায়ত্বশাসনের দাবী স্বাধীনতার দাবীতে রুপান্তরিত হয়েছে এবং বাঙালী গেরিলাদের বিজয় এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার।
—————-
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৯. হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের ঢাকা প্রবেশ |
ওয়াশিংটন পোস্ট | ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
<১৪, ১২৯, ৩০০-৩০২>
ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
পূর্ব–বাংলার যুদ্ধের সমাপ্তি– হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের ঢাকা প্রবেশ
ঢাকা, ডিসেম্বর ১৬- হাজারো বাঙালীর “জয় বাংলা” (বাংলার জয়) ধ্বনির মধ্য দিয়ে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী আজ ঢাকায় প্রবেশ করেছে।
মেজর-জেনারেল গান্ধার নাগরার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানী গেরিলা এবং ভারতীয় সৈন্যদের মিত্রবাহিনী আজ ঢাকার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একটি সেতু আক্রমণ করেছে এবং এরপরই খবর পেয়েছে যে এখানকার পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ ভারতের দেওয়া আত্মসমর্পণ এর প্রস্তাব মেনে নিয়েছে।
নাগরা বলেছেন তিনি স্থানীয় সময় সকাল ৮.৩০ টায় (পূর্বাঞ্চলীয় বুধবার রাত ১০টা) শহরের অপর প্রান্তে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং সাথে সাথেই প্রত্যত্তরে তাঁকে জানানো হয়েছে এরপর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আর কোন বাঁধা দেওয়া হবে না। এরপর তিনি তার সৈন্যদল নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন।
সকাল প্রায় ১০টার দিকে তিনি এখানকার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজীর সাথে দেখা করেন। “আমরা পুরনো বন্ধু”, বলেন নাগরা, “কলেজের দিনগুলো থেকেই”।
ভারতীয় জেনারেল এরপর ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জে.এফ.আর জ্যাকব এর আগমণ এর অপেক্ষা করেন, যিনি তাঁর কলকাতার সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টারযোগে আসেন।
বিমানবন্দরে, জেনারেল মাত্র তিনজন ভারতীয় সৈন্য পাশে রেখে দাঁড়িয়ে তাঁর কাঠের তৈরী হাঁটার লাঠিটি ঘোরাচ্ছিলেন, একই সময়ে রানওয়ের দূরবর্তী প্রান্তে পাকিস্তানি বিমানবন্দর রক্ষী বাহিনী তাদের আত্মসমর্পণ এর স্থানে যাওয়ার জন্য একত্রিত হচ্ছিল।
রাস্তায় পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী সংখ্যায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি ছিল, কয়েক ঘন্টা ধরে বিচ্ছিন্ন গোলাগুলি হয়েছে, এবং বেশ কিছু পাকিস্তানি এবং ভারতীয় সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছে, যার মধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বাইরে গুলি করে হত্যা করা একজন ভারতীয় কর্মকর্তাও আছেন।
মুক্তিবাহিনী- পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যরাও উৎসবমুখর সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে আনন্দ উল্লাস করতে থাকে এবং তাদের বন্দুক থেকে বাতাসে গুলি ছুঁড়তে থাকে।
নাগরা ৯৫তম মাউন্টেন ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এইচ. এস. ক্লারকে নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে “রেড ক্রস” দেওয়া ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পাঠান বিদেশি এবং প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানি সরকারী কর্মকর্তাদের রক্ষার চেষ্টা করতে, যারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ক্লার এর গাড়ি যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার গাড়ির উপরে বারবার উৎসুক বাঙালীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে তারা গাড়ির চালককে ঝটকা টান দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে এবং ক্লার নেমে আসেন, শুধুমাত্র বাঙালীদের তাঁকে আলিঙ্গনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য, যাদের মধ্যে একদন তাঁর হাতে কিছু গাঁদা ফুল গুঁজে দেয়।
“ধন্যবাদ, ধন্যবাদ” বাঙালীরা চিৎকার করতে থাকে তার দিকে।
নাগরা এবং ক্লার মাত্র দুইটি সৈন্যদলের চেয়ে কিছু বেশী সৈন্য নিয়ে ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সীমানা অতিক্রম করে উত্তর প্রান্ত থেকে যুদ্ধ করে এসে ঢাকায় প্রবেশ করেন।
তাঁরা ১৬০ মাইল ধরে শুধুমাত্র ষাঁড় দিয়ে টানা গাড়ি এবং পায়ে হেঁটে এসেছেন, যার মধ্যে প্রতিটি শহরেই তাঁদের যুদ্ধ করতে হয়েছে।
“বড়দিনের আগে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা আপনার উপর ভরসা করছিলাম”, বিমানবন্দরে একজন সাংবাদিক নাগরাকে বললেন। “এবং আমরা তা করে ফেলেছি”, নাগরা জবাব দেন।
নাগরা বলেন তিনি যে পথে ঢাকা এসেছেন সে পথে পুরোটা জুড়েই বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের মৃতদেহ। “এটি খুবই করুণ ছিল”, তিনি বলেন, “আমরা তাদের কবর দিতে পারি নি। আমাদের হাতে সময় ছিল না।”
“আমরা পুরো পথ জুড়েই হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে এসেছি”, নাগরা বলতে থাকেন, “ময়মনসিংহে আমার সব ব্যাজ উৎসুক জনতা ছিঁড়ে নিয়ে যায়।”
“আশা করছি সবকিছু শান্ত এবং শান্তিপূর্ণ আছে”, জ্যাকব বলেন, “আমরা নিশ্চয়তা দিয়েছি যে সৈন্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্ষা করা হবে, এবং আমরা আমাদের কথা রাখতে চাই।”
প্রায় আটজন বাঙালী বিমানবন্দরের ফটক দিয়ে জোড় করে রানওয়েতে ঢুকে যায় জ্যাকবকে অভিবাদন জানাতে। “আমি কি আপনার সাথে করমর্দন করতে পারি?”, তারা একজন এর পর আরেকজন জিজ্ঞেস করল। নয় মাস ধরে তারা আমাদের ইঁদুরের মত মেরেছে”, একজন জ্যাকবকে বলল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে।
একজন সাংবাদিক এর দিকে ফিরে একজন বাঙালী বলল, “আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?”, “আমেরিকা”, সাংবাদিক জবাব দিলেন।
বাঙালী থুতু ফেলল, করমর্দন করতে অস্বীকার করে বলল, “আমরা আমেরিকার প্রতি খুশি নই”।
বাঙালীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করল পুরো যুদ্ধ জুড়ে রাষ্ট্রপতি নিক্সন এর পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সমর্থন এর ব্যাপারে, যা আজকের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ডেকে এনেছে।
এতদিন ধরে যে বাংলাদেশ (বাঙালী জাতি) এর স্বপ্ন তারা দেখে আসছিল তা আজ জন্ম নিল। জেনারেল বিমানবন্দরে দাঁড়ানো অবস্থায়ই জেনারেল এর সাহায্যকারীদের মধ্যে একজন বাংলাদেশ এর একটি পতাকা বহন করে নিয়ে আসেন।
পুরো রাস্তা জুড়ে সাধারণ মানুষের হাতে বাংলাদেশ এর পতাকা উড়ছিল, যারা রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে করমর্দন করছিল এবং স্লোগান দিচ্ছিল।
রাস্তার কিনারা দিয়ে তখনো পরাজিত পাকিস্তানি সৈনিক এবং পুলিশরা সারিবদ্ধভাবে অস্ত্র জমা দিতে যাচ্ছিল। তাদের হাতে তখনো অস্ত্র ছিল- কিন্তু বাঙালীদের আনন্দ যেন তাদের অস্ত্রকে গ্রাহ্যই করছিল না।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ এবং ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর আগমণ যেন হঠাৎ হল, জনশূন্য সকালে যখন মনে হচ্ছিল পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ শম্বুক গতিতেই এগুচ্ছে, সাথে তীব্র যুদ্ধ এবং নতুন করে বিমান আক্রমণ, যার ফলে ঢাকায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
শহরের উপরে ভারতের বিমান আক্রমণের বিরতি স্থানীয় সময় সকাল ৯.৩০টার ( পূর্বাঞ্চলীয় সময় বুধবার রাত ১০.৩০টা) দিকে শেষ হবার কথা, এবং সকাল ৯টার কিছু আগে জাতিসংঘ এবং রেডক্রস কর্মকর্তারা জানতে পারেন পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং তারা নয়াদিল্লিতে তাদের আত্মসমর্পণ এর সম্মতিপত্র পাঠাতে পারছে না।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরে জেনারেল নিয়াজীর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালনরত মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান এক জরুরী সভায় সৈন্যদের প্রতি অস্ত্র সংবরণের আদেশ দেন, এবং জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের জানান তারা বিনা শর্তাধীনে আত্মসমর্পণ করবেন। এই বার্তা এরপর জাতিসংঘের বিশেষ বেতারবার্তার মাধ্যমে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে নয়াদিল্লিতে পাঠানো হয়, গোলা বর্ষণ পুনরায় শুরু হবার ১০ মিনিট আগে।
আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় (পূর্বাঞ্চলীয় সময় সকাল ৬টা), রেসকোর্স ময়দানে, সাথে আশপাশের এলাকায় চলতে থাকে তুমুল হর্ষধ্বনি এবং বাতাসে গুলি বর্ষণ।
ভারতীয় সৈন্যভর্তি বাসগুলো সিক্ত হচ্ছিল বাঙালীদের ধন্যবাদের চিৎকারে, বাংলাদেশ এর পতাকাগুলো বেরিয়ে আসছিল লুকোনো জায়গাগুলো থেকে, যেখানে সেগুলো সযত্নে লুকোনো ছিল সেই ২৫ মার্চ থেকে, যেদিন থেকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী এখানে শুরু করেছিল নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।
লি লেস্যাজ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩০। বিজোয়ল্লাস | নিউইয়র্ক টাইমস | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ১৩০, ৩০৩>
নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বিজোয়ল্লাস
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১,ঢাকা-পাকিস্তান। চারিদিকে শ্লোগান উঠছে “জয় বাংলা!”। ইন্ডিয়ান সেনারা ট্রাক এবং বাসের বহরে করে শহরের উত্তর দিকে পাকিস্তানী ক্যাম্পের দিকে দৃপ্তরথে এগিয়ে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত শর্ত মেনে নিয়েছে।
শহরে তখন ভীষণ ভিড় যানবাহনের। ইন্ডিয়ান সেনারা তাদের গোলাবারুদের ব্যারেলে গাঁদাফুল ভরে পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্প পেরিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানী সেনারা তাদের স্যালুট দিচ্ছিলো। দু-পক্ষের সেনাদের মধ্যে অনেকেই ছিলো সতীর্থ, সহপাঠী। তারা করমর্দন করে কুশল বিনিময় করছিলো। জিজ্ঞেস করছিলো পরচিতজনদের কথা।
ঢাকার রাস্তায় অফুরন্ত আনন্দ এবং উদযাপন চলছিলো বিরতিহীন! ইন্ডিয়ার পাঞ্জাবী সৈন্য এবং দেশী বিদ্রোহী সেনাদের বাঙালি জনগণ বরণ করে নিচ্ছিলো চুম্বন এবং ফুলের মাধ্যমে। তবে সৈন্যদের বেশিরভাগই ছিলো নিরানন্দ, এবং তাদের চোখে ছিলো শূন্যতা।
গাড়িগুলোতে উত্তোলিত হচ্ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তরীণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, যিনি মার্চ মাস থেকে বন্দী ছিলেন। বাঙালি তার ছবিকে ঘিরে জয়োল্লাসে চিৎকার করছিলো, “জয় বাংলা”, “শেখ মুজিব”!
শোনা যায়, বাঙ্গালিরা উন্মত্ত হয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলো ঢাকায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিহারীদের ওপর, তখন একজন বিদ্রোহী নেতা তাদের থামিয়েছিলেন এই বলে, “হ্যাঁ তারা এখন আমাদের বন্দী, তাই বলে আমরা সভ্যতার সীমা অতিক্রম করতে পারি না!”।
শহরে তখন ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবার অপেক্ষা। ইন্ডিয়ান কমান্ডার কর্তৃক বেঁধে দেয়া সময়ের আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। এসময় জাতিসংঘের রেডিও চ্যানেল মারফত খবর ছড়িয়ে পড়লো, পাকিস্তানের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি আত্মসমর্পণের শর্ত মেনে নিয়েছেন।
এর মাঝে জাতিসংঘ আশঙ্কা প্রকাশ করলো যে শহরের বর্তমান অবস্থা ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে মোড় নিতে পারে, ভেঙে পড়তে পারে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। জরুরী ভিত্তিতে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ওয়াকি টকির মাধ্যমে খবর চলে গেলো সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থার জন্যে। মিনিট খানেক পরে কিছু ইন্ডিয়ান সেনা কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ঘোষণা জানালেন।
আত্মসমর্পণের ব্যবস্থাপনা সেরে নেয়ার জন্যে প্রাথমিক কথাবার্তা ওয়াকিটকির মাধ্যমে সেনানিবাসে সেরে নেয়া হলো। তবে দুজন ইন্ডিয়ান জেনারেল আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন, মেজর জেনারেল গন্ধর্ভ নাগরা এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারদাভ সে ক্লার। এই দুজনই শহরের উত্তর অংশে বিজয় ডঙ্কার সূচনা করেছিলেন।
বেলা ৩টার সময় ইন্ডিয়ান কর্মকর্তারা স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তের কথা জানান। তবে তখনও বিক্ষিপ্ত ভাবে গোলাগুলি চলছিলো। আত্মসমর্পণের শর্ত মেনে নেয়ার পরেও সেদিন সকালেই পাকিস্তানী সেনা দূর্গে ভারি গোলার আক্রমণ হয়েছিলো। এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন কমান্ডের মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। তিনি পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বকর সিদ্দিকীকে জানান, তার সেনাবাহিনীর কিছু অংশ যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে জানতো না বলে এই অনভ্রিপেত ঘটনা ঘটেছে।
জেনারেল ক্লার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে বলেন, “তারা ভালো লড়েছে, তবে শেষ হাসি হাসার মত যথেষ্ট শক্তিমত্তা তারা দেখাতে পারে নি”।
শিরনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩১। যুদ্ধের গর্ভ থেকে একটি জাতির জন্ম | টাইমস | ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
<১৪, ১৩১, ৩০৪-৩১৬>
টাইম ম্যাগাজিন, ডিসেম্বর ২০, ১৯৭১
বাংলাদেশঃ যুদ্ধের গর্ভ থেকে একটি জাতির জন্ম
‘জয় বাংলা; জয় বাংলা’: মহান গঙ্গা থেকে বিস্তৃত ব্রহ্মপুত্র, পান্না ক্ষেত্র থেকে গ্রামের সরিষা রঙের পাহাড়, অগণিত গ্রামের অগণিত প্রান্তর থেকে ডাক উঠেছে – ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা।’। তারা বাসের ছাদের উপরে নাচছিল এবং শহরের তাদের সংগীত সোনার বাংলা গাইতে গাইতে রাস্তায় নেমে মিছিল দিচ্ছিল। তারা ভবন থেকে অবাধে গোপন গোপন জায়গা থেকে বাংলার সবুজ, লাল এবং স্বর্ণ রঙের ব্যানার এনে উড়াচ্ছিল, তাদের কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি উড়াচ্ছিল, রাতারাতি ট্রাক, হাউস ও পথনির্দেশক স্তম্ভে উঠে গেল। যেহেতু ভারতীয় সৈন্য প্রথমে যশোর, তারপর কুমিল্লা, তারপর রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে গেছে, ছোট শিশুরা ট্রাক ধরে ঝুলছিল, বাঙ্গালিরা সর্বত্র তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছিল তাদের স্বাধীন করতে সাহায্য করায়।
এভাবে গত সপ্তাহেএকটি যুদ্ধ শেষ বাংলাদেশ নামক নতুন জাতির জন্ম হয়। এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ভারত ও ভুটান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত দিয়েছে। কিন্তু এটা জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ১৪৮ টি দেশের মধ্যে অষ্টম। জনসংখ্যা (৭৮ মিলিয়ন), যা চীন, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউ এস, ইন্দোনেশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলের পিছনে। এর জন্ম অনেক জটিলতার মাঝে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে, রাজনৈতিক উত্থান হয় এই পরাজয় এবং বিভাজনের পর। ভারতের নিজস্ব পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পাশে একটি আলাদা বঙ্গরাজ্য সৃষ্টি হওয়ায় ৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে এখন সেখানে একটি উদ্যমী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তানের বিভক্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যখন দুই সপ্তাহ আগে ইসলামাবাদ ভারতের কমপক্ষে তার বিপরীতে ভারত দুই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের এয়ার ফোর্স ধ্বংস করে আকাশের দখল নেয়। বঙ্গোপসাগর আর ডেলটা গঙ্গায় ভারতীয় নেভি অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে দখলে আছে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর দখলে রাখায় নতুন রসদ দরবরাহ, সৈন্য আগমন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পালিয়ে যাবার রাস্তা বন্ধ – যাদের সংখ্যা ৮০০০০ – এর বিপরীতে ভারতের আছে ২০০০০০। পাকসেনারা তাদের বসতি ঘাটি থেকে ১০০০ মাইল দূরে আটকে আছে।
সেখানে আরও বড় যুদ্ধ হচ্ছে যার মধ্যে আছে পাঞ্জাবি প্লেইন আর ট্যাঙ্কের সংঘর্ষ, দক্ষিণের মরুভূমিতে ১৪০০ মাইল বর্ডার জুড়ে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে লোরাই চলছে – যেখানে দুই বাহিনীর প্রায় ২৫০০০০ জন যুদ্ধরত। সাধারণ জনগণ সীমান্ত এলাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এবং করাচী, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ মূলত অবরোধ হয়ে আছে এবং অহোরাত্র মাথার উপর দিয়ে ভারতীয় প্লেন ভোঁ ভোঁ করে যাওয়ায় ভীতির সঞ্চার তৈরি হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধ থামানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।কিন্তু তার সর্বোচ্চ চেষ্টা তেমন ভালো ছিলনা। তিন দিনের দহরররম মোহররম শেষে তাঁর সোভিয়েত ‘নিয়েটস’ এ থিতু হল, কাউন্সিল তখন নিরাপত্তা পরিষদে আরও বৃহৎ অথচ স্বল্প কার্যক্ষম রেজুলেশন মেনে নিল। যুদ্ধবিরতি দেয়া এবং পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ সীমান্ত থেকে যাতে তাদের সৈন্য ধীরে ধীরে সরিয়ে নেবে এমন রেজোল্যুশন ১০৪ বাই ১১ ভোটে পাশ হয়।
পাকিস্তানিরা তাদের সৈন্যবাহিনী পেছানোর সঙ্গে সঙ্গে বলেছে ভারত যদি যুদ্ধবিরতি দেয় তাহলে তারা সেটাকে স্বাগত জানাবে। ইন্ডিয়ানরা বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে বলেছে তারা “বিবেচনা করছে” – তারা বলেছে পাকিস্তান তাদের সংখ্যা কমালেই আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে এবং আমরা তা করব। এসেম্বলিতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী জোর করে বলার জন্য এর বাইরে আর কিছু করার ছিলনা। ভারত এই ব্যাপারে ততটা গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ তারা সব সময় জাতিসঙ্ঘকে বলে তারা শুধু অন্য দেশকে নানারকম আদর্শের উপদেশ দিয়ে থাকে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যারা ভারতকে প্রতিরক্ষা বাড়াতে বলেছে – তারাও ইসরায়েলকে জাতসঙ্ঘের দেয়া আরব এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব না মানতে উপদেশ দিতে কার্পণ্য করেনা।
আশাহীন কাজ
যাই হোক, এই মুহুর্তে যুদ্ধবিরতি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অবস্থার পরিবর্তন করবে না। ভারতীয় বাহিনী গত সপ্তাহে ঢাকার ২৫ মাইলের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে যে প্রায় ৫০০০ ভারতীয় প্যারাট্রুপার অবরুদ্ধ রাজধানীর পূর্বকোণগুলিতে অবতরণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ ভয় পালিয়েছে এই ভেবে যে পাকিস্তানি সেনারা বড় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দৈনিক এবং প্রায়ই ঘনঘনভারতীয় প্লেন ঢাকা, করাচী এবং ইসলামাবাদের এয়ার পোর্টের উপর দিয়ে উড়ে যায়। ঢাকা এতিম খানার উপরে একটি পিস্টন ইঞ্জিন প্লেন ভূপতিত হওয়ায় প্রায় ৩০০ জন মারা যায়। ৭৫০ পাউন্ড বোমা নিয়ে এয়ারপোর্টের কাছে রহমত ই আলম ইসলামিক মিশনে একটি বিমান ভূপতিত হওয়ায় ৪০০ শিশু মারা যাবে। (পাকিস্তান বলে যে প্লেনটি ভারতের। কিছু বাঙ্গালি ও বিদেশিরা মনে করে এটি পাকিস্তানি। কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ বলেন পিস্টন ইঞ্জিন শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীর কাছেই আছে।) এই সপ্তাহের শুরুতে নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক আবাসনে দুইটি বড় বোমা পড়ায় ২৭৫ জন নিহত হয়।
চল্লিশজন শ্রমিক মারা যান এবং আরও ১০০ জন আহত হন। তাড়া বিমানের রানওয়েতে বোমার কারণে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত মেরামতে নিযুক্ত ছিলেন। ভারত গত সপ্তাহে বিমান হামলা নেভিগেশনের উপরে একটি অস্থায়ী স্থগিত ঘোষণা করে। যাতে করে রানওয়ে মেরামত করা যায় এবং ৪০০ জাতিসঙ্ঘ রিলিফ কর্মি ও অন্যান্য কিছু বিদেশি ফিরে যেতে পারেন। এটা ঠিক করা হল – কিন্তু পাকিস্তানিরা তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাল। তারা জাতিসঙ্ঘের কর্মিদের ঢাকায় অবতরণ করতে দিবে না। তারা মূলত আটকে আছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস হলি ফ্যামিলির পাশে অবস্থিত ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে আহতদের রিসিভ করা ও বিদেশিদের জন্য নিউট্রাল জোন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
পাকিস্তানি সেনারা কিছু বাঙালিদের ভারতের তথ্যদাতা বা সাহায্যদাতা সন্দেহে হত্যা করেছে। কিন্তু প্রতিহিংসামূলক প্রতিক্রিয়া তেমন ব্যাপক স্কেলে ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক ও সামরিক উভয় প্রকারের হতাহতের পরিমাণ মোটামুটি হাল্কা ধরা হয়েছে – কারণ ভারতীয় বাহিনী শুধুমাত্র বড় শহরে এবং জনবহুল এলাকায় আক্রমণ করেছে এবং তারা ছোট খাট যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে।
প্রথম হারানো শহর হোল যশোর। টাইমসের উইলিয়াম স্টুয়ার্ট যিনি ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে প্রধান রেলপথ জংশনে ছিলেন তিনি রীপোর্ট করেন – যশোর; ভারতের প্রথম কৌশলী পুরষ্কার। দির্ঘ গ্রীষ্মে আম পাকার মতোই সহজ মনে হোল। যুদ্ধের তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। আসলে ভারতের আক্রমণের কিছুদিন আগে যশোর থেকে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সেনারা হেডকোয়ার্টার ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। শুধু চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য ছিল কিছু আক্রমণ মোকাবিলায়।
“তা সত্ত্বেও, দুইটি পাকিস্তানি বাহিনী দূরে পালিয়ে যায় আর অন্য দুইটি খারাপ ভাবে আক্রান্ত হয়। ভারতীয় সেনারা সর্বত্র ছিল আর বাঙ্গালিরা তাদের শুভেচ্ছা জানায়। তারা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে এবং বলেন ‘ইন্দিরা গান্ধি জিন্দাবাদ।’ ঝিঙ্গরগাছায় শহরের অর্ধেক মানুষ – প্রায় ৫০০০ জন একত্রিত হয়ে শুভেচ্ছা জানায়। একজন বৃদ্ধ মানুষ বললেন ‘পাকিস্তানিরা যখন আমাদের উপর চিৎকার করেছিল তখন আমরা বুঝতে পারিনি।’ ‘কিন্তু তারা উর্দুতে বলছিল আর আমরা বাংলায় বলছিলাম।’
মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা
গত সপ্তাহে পূর্ববাংলা পাকিস্তানি শাসন মুক্ত হয়। পাকিস্তানি সেনারা দুইটি নদী বন্দর দিয়ে ফিরে যাবে। নারায়ণগঞ্জ আর বরিশাল। ধারনা করা হয়েছিল তারা সেখানে একটি অবস্থান নেবে অথবা পালানোর অন্য কোন পথ বের করবে। তারা ব্যাটালিয়ন দিয়ে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা করেছিল। আর শহরে তিনটি গ্যারিসন করেছিল। সেখানে ভারতীয় সেনারা তাদের ঘিরে রেখেছিল। ভারতীয়রা এখনো চট্টগ্রাম আর দিনাজপুরের বড় বড় শহরের দখল নেয়নি। আর্মি সাংবাদিকদের যুদ্ধরত এলাকায় যাবার অনুমতি দেয়নি। তবে কয়েকটি স্থানে ভারতীয় মিলিটারি সাংবাদিকদের তাদের সাথে নিয়ে গেছে। ত্রিমুখী ভারতীয় সাঁডাশি আক্রমণ অনেক দ্রুত ছড়িয়ে গেছে। যা আগে ভাবা যায়নি। তাছাড়া আকাশ পথ ও নৌ পথেও দ্রুত আগানো গেছে।
মনোবলহীন ও ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানের সেনাদলকে আন্তসেনা রেডিও কলে বারবার ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ আত্মসমর্পণ করার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন , ‘তোমরা আমার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন না করে পালানোর উপক্রম কর তাহলে আমি সতর্ক করে দিচ্ছি তোমাদের জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে।’ তিনি আরও বলেন যদি তারা আত্তসমর্পন করে তাহলে তাদেরকে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরা হবে। মুক্তিবাহিনীও যাতে জেনেভা কনভেনশন মেনে চলে সেই প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে। ভারত অফিসিয়ালি মুক্তিবাহিনীকে তাদের সেনা কমান্ডের আওতায় এনেছে।
পাকিস্তানি বন্দীদের অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন বলে রিপোর্ট করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে গ্রামাঞ্চলের মধ্যে মুক্ত চলাচল করছেন – সম্ভবত সাধারণ মানুষের সাথে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। কিছু শহরে শক্ত প্রতিরোধ করা হয়েছে। একজন ভারতীয় সংবাদদাতা একথা জানান। যদিও শত্রুরা আত্তসমর্পন করতে চাইছে তথাপি মুক্তিবাহিনী তাদের শোধ নিচ্ছে। সময় নিন। আরও বড় কিছু হতে পারে। অপেক্ষা করুন। তিনি রহস্য করে বললেন হতে পারে যে পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপ্রধান একটি নিশ্চিনহ করার একশন শুরু করতে পারেন।
পুরো সপ্তাহ জুড়ে পাকিস্তান তাদের জিহাদ বা পবিত্র যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। একজন কর্নেল বলেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই। তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন ‘জিহাদে কারো মৃত্যু হয়না। তারা চিরজীবন বেচে থাকেন।’ পাকিস্তানের রেডিও ও টিভিতে কিছুক্ষণ পরপর গান প্রচার করা হচ্ছে – ‘পুরো পাকিস্তান জেগে আছে’ এবং ‘শহিদের রক্ত বৃথা যেতে পারেনা।’ একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন যে পাকিস্তান ভারতের ১২৩ টি বিমান ভূপতিত করেছে আর তার বিপরীতে তাদের ৭ টি বিমান ধ্বংস হয়েছে। আর মৃত্যুর অনুপাত ১৮ জনের বিপরীতে একজন। ইসলামাবাদ জানায় যে পাকিস্তান এখনো যশোর তাদের দখলে রেখেছে যদিও স্বাধীনতার কিছুক্ষণ পরে সেখানে সাংবাদিকরা ঘুরে এসেছেন।
গত সপ্তাহে অবশ্য প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সরকার তার দেশের মানুষকে প্রস্তুত করতে যাচ্ছেন যে তারা পূর্ব অঞ্চল হারাতে যাচ্ছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা প্রথমবারের মত বলেন পাকিস্তানি বিমান বাহিনী পূর্ব অঞ্চলে আর অপারেটিং করছে না। পাকিস্তানি বাহিনী আরও শক্তিশালী যুদ্ধ যন্ত্রের কাছে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এবং সংখ্যার তুলনায় যা ভারতীয়দের ৬ জনের বিপরীতে ১ জন এবং সরঞ্জামের আধুনিকতা একটু বাড়ীয়ে বলা হয়েছে।
শিখ ও গুর্খা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভাগ্য পূর্ব অঞ্চলে নির্ধারিত হবে। ভারত ও পাকিস্তান বাহিনী একে ওপরের জন্য কষ্টদায়ক স্ল্যাব করার চেষ্টা করছে সীমান্তের ১৪০০ মাইল জুড়ে। এটি কাশ্মীরের উঁচু শহর থেকে শুরু করে পাঞ্জাবের সমতল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর অন্যদিকে পশ্চিম ভারতের মরুভূমি এলাকা। সেখানে দাঁড়ীয়ালা খাকি তুরবান পরিহিত শিখ – কঠিন সমান মুখের গুর্খা যাদের কাছে বাঁকা ছুরি থাকে নিজেদের বেল্টের কুক্রিতে। এছাড়াও সেখানে আরও অনেক উপজাতি আছে। সীমান্তের একশনে উভয় অঞ্চল শুনশান আছে আর প্রতিরক্ষা দেয়া কঠিন।
যুদ্ধে একে অপরের বিরুদ্ধে প্লেন, ট্যাংক, আর্টিলারি ব্যাবহার করছে এবং উভয় পাশে সম্পদ আর হতাহত হচ্ছে প্রচুর – মনে হচ্ছে তা পূর্ব অঞ্চলের চেয়ে বেশি। বেশিরভাগ অঞ্চলে দুই বাহিনী জড়ো হয়ে শেষ করেছে ১৯৬৫ সালেই। তারপরেও সেখানে আক্রমণাত্মক পরিবেশ ছিল। ভারতীয় সেনাদের কৌশল ছিল আত্মরক্ষামূলক – তারা কোন আক্রমণ করেনি যতক্ষণ তারা আক্রান্ত হয়েছে।
ওল্ড বয় এটিচিউড
সবচেয়ে রক্তাত যুদ্ধ হয়েছিল চাহাম এলাকায়। যুদ্ধবিরতি এলাকা থেকে ৬ মাইল দূরের একটি উপত্যক্যা এলাকা। এটি ১৯৪৯ থেকে কাশ্মীরকে প্রায় সমান দুই ভাবে ভাগ করে রেখেছে। পাকিস্তানিরা চরম ঘাতের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একথা বলেছিলেন একজন ভারতীয় মুখপাত্র – তিনি জানান এখানে ভারতের হতাহত অনেক বেশি। তবে তিনি জানান পাকিস্তানের হতাহত আরও বেশি। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল ভারতের জম্মু শহরে আক্রমণ করা। এবং ২০০ মাইল লম্বা জম্মু শ্রীনগর রাস্তায় আক্রমণ করা যা ভারতের সাথে কাশ্মীর উপতক্যার সংযোগপথ। ভারতীয়দের মুনাওয়ার রবি নদির তির এলাকা থেকে ভারতীয়দের সরিয়ে দেয়া হয় – এটি তারা দখলে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল।
চাহাম এবং অন্যান্য বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ ছাড়া উভয় পক্ষ ‘ পুরনো বালক” সুলভ মনোভাব দেখাচ্ছে। তুমি যদি আমার গুরুত্তপূর্ন বেইজে আক্রমণ না কর তাহলে আমি তোমারটায় আক্রমণ করব না। এসবকিছুর পেছনে অনেক পাকিস্তানি ও ভারতীয় অফিসাররা আছে। এদের মধ্যে দুই দেশের কমান্ডিং জেনারেল একসাথে স্যান্ডহার্স্ট বা দেরাদুনের স্কুলে গিয়েছিল। ভারতের পূর্ব অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা কমান্ডিং অফিসার লে জে জাগজিত সিং অরোরা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ক্লাসমেট। একজন ভারতীয় অফিসার বললেন আমরা একসাথে স্কুলে গিয়েছিলাম কিভাবে একে অপরকে হত্যা করা যায়।
টাইমসের মারাহ ক্লার্ক পশ্চিম সীমান্ত থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছেন বাইরে থেকে দেখলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে একটি সুনির্দিষ্ট পুরানো ঢঙের এবং বিবেকী বাহিনী বলে মনে হয়। একজন আমেরিকান প্রতিনিধি জানান আপনি যত ভিতরে প্রবেশ করবেন ততই আরও নিত্য নতুন তথ্য পাবেন। কিন্তু কিছু কাজ সাড়তে হবে। কনভয় দ্রুত উপরে উঠানো হল, আর্টিলারি অফিসাররা তাদের কামান তাক করল। তাদের মনোবল অত্যন্ত উচ্চ এবং ভারতীয় কর্মকর্তারা সবসময় পাকিস্তানীদের সম্পর্কে প্রসন্নভাবে বলে ‘ওইসব বন্ধুরা’’
পরিত্যক্ত কাপড়চোপড়
পাকিস্তানের অন্যতম শহর সেহজ্রা – যা ভারতীয় এলাকা দিয়ে লাহোরের পুর্ব সীমান্ত বরাবর – ভারতীয় সৈন্যরা সেখান আগাচ্ছে। ক্লার্ক সেখানে মাঠে কাজ করা পুরুষদের সাথে কথা বললেন। তাদের মাথার উপর দিয়ে জেট বিমান উড়ে যাচ্ছিল। আর দূরে কামানের গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি জানালেন রাস্তার পাশে বিনামূল্যের স্টল আছে। উঠতি বয়সের ছেলেরা কমলা, বাদাম ও কলার ব্যাগ গাড়ি থেকে ফেলে যায় – যে গাড়িতে করে সৈন্যরা এদিক দিয়ে যায় এবং চিৎকার করে উৎসাহ দিয়ে যায়। যখন আমাদের জিপ থামে, তারা আমাদের ঘিরে রাখে এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে – তারা চায় যে আমরা কোন গল্প লিখি যে তাদের গ্রাম স্বাধীন – এবং আমরা ধরা পড়িনি – যা সব সময় পাকিস্তানি রেডিওতে প্রচার করা হয়।
আমরা সীমান্তে আসার পড় ভারতীয় কমান্ডার আমাদের গ্রহণ করলেন। তিনি রাত ৯ টায় তার গুর্খা সৈন্যরা কিভাবে অপারেশন জিতেছিল এবং পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করেছিল সেটা বর্ননা করছিলেন। “আমি মনে করি আমরা আশ্চর্যজনকভাবে তাদের পরাজিত করেছি” তিনি বলেন ‘এবং আমাদের একজন পাকিস্তানি এলাকা ঘুরে নিশ্চিত করেছেন।’ তার বিছানায় একটি সুটকেস আছে এবং এটা তড়িঘড়ি করে আটকানো হয়েছে। এতে কয়েকটা জামা, কিছু মোজা, ট্রাউজার আছে। ট্রাউজারটি ফ্লানেলের তৈরি ও অনেক সুন্দর – লেভেল লাগান আছে – এম আব্বাস টেইলার্স – যা রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত। কর্নেল – শহর ছেড়েছেন – এটা নিশ্চিত এবং তার কাপড়চোপড় এখানে রেখে গেছেন।
সেহজ্রার দক্ষিণে ভারতীয় সাঁজোয়া ইউনিট পশ্চিম পাকিস্তানেড় সীমান্ত পেরিয়ে বালির উপর দিয়ে চলাচল করছে। এখানে শত শত বর্গমাইল মরুভূমি অবস্থিত। তাদেরকে বলা হোল যেখানে অন্তত দুইটা তাল গাছে আছে ও অগভীর ব্রাকিশ পানির জলাধার আছে। শত্রুদের যেসব জিনিসপত্র জব্দ করা হয়েছে তার মধ্যে উট ও আছে। এই অভিযানের কারণ হোল ধারনা করা হচ্ছে যেহেতু পূর্ব বাংলার পরিবর্তে এই অঞ্চলে ভারতের কিছু যায়গা দখলে নেয়া। সেটা এখন অসম্ভব মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন জাতি হোক – ভারত চায় পশ্চিমের কিছু এলাকায় দরকষাকষি করতে।
ভারতের পশ্চিম অংশে পূর্ণ যুদ্ধকালীন সতর্কতা চালু আছে। সমস্ত শহর সম্পূর্ণরূপে রাতে ব্লাক আউট করে দেয়া হয়।প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তা যে সামনে একটি লম্বা, অন্ধকার ডিসেম্বর আছে। বিমান আক্রমণ সাইরেন প্রায় একটানা বাজছে। পাঞ্জাবে আই এস এর সময় সেখানে ১১ টি বিমান আক্রমণ সাইরেন বেজেছিল। যদিও এই দু শহরেরে উত্তেজনায় বোমা বিস্ফোরণে অনেকে হতাহত হয় যখন পাকিস্তানি বিমান বাহিনী বারবার সীমান্তে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের মধ্যে ছিল অমৃতসর – যেখানকার স্বর্ন মন্দির শিখদের কাছে অন্যতম পবিত্রতম স্থানের মধ্যে একটি। পাকিস্তানের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় আগ্রা – সেখানে তাজমহলকে জঙ্গলে টুইগ ও পাতার সাথে তুলনা করা হয় এবং কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় কারণ মাঝরাতে এর মার্বেল পাথর চন্দ্রপ্রভার মত আল দিতে থাকে।
ভারত পূর্ব অঞ্চলে বড় কোন আঘাত হানতে চায় না কারণ নয়া দিল্লি চায়না বড় কোন জটিলতায় জড়াতে। যদিও দুই দেশ আরে আগে আরও দুইবার মুখোমুখি হয়েছে। অফিসিয়ালি সেগুলো জল জম্মু আর কাশ্মীরের স্লেট যা দুই দেশের কেউ দখলে নিতে পারেনি ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতি দেয়ার আগ পর্যন্ত। এই এলাকাটি দখলে নেয়াড় জন্য নয়াদিল্লীর চাপ না দেয়াড় পেছনে অনেক কারণ আছে।
প্রথমে একটি সন্দেহ যে আজাদ কাশ্মীরের মানুষ, যা পাকিস্তানের অংশ – এটিকে যদি ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয় সেক্ষেত্রে ভারত বিব্রতকর বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হলো ১৯৬৩ সালে চীনের সঙ্গে ভারতের সংক্ষিপ্ত কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধের পর পাকিস্তান, চীনের সাথে একটি প্রাথমিক সীমান্ত চুক্তি করে। কাশ্মীর থেকে চিন পর্যন্ত এটি ১৩০০ বর্গমাইল বিস্তৃত। পিকিং পুরাতন সিল্ক রুট হাইওয়ে লিঙ্কড করছে যেটা পাকিস্তানের কাশ্মীরের গিলজিত থেকে শুরু। পুরো রাস্তা মোটর হাইওয়ে। এটি অস্ত্রবিরতি লাইন লাদাখ দিয়ে গিয়েছে। যদি কোন কারণে তখন ভারত চায়নার রাস্তা বয়া কাশ্মীরের একটি অঞ্চল দখল করে তখন স্বভাবতই নয়াদিল্লীর সাথে পিকিং এর সম্পর্ক্টা হয়রানির মুখোমুখি হবে।
ধারাবাহিক হয়রানি
অন্য দিকে পাকিস্তানের অনেককিছু পাবার আছে।যদি এটা তারা ভারতের থেকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে – বিশেষ করে উপত্যকাটা – তাহলে তাদের জন্য কৌশলগত কারণে অনেক লাভ হবে। এটা অনেক গুরুত্তপূর্ন কারণ এর সাথে চিন, আফগানিস্তান সহ ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত বিরাজমান। তাছাড়া এই এলাকার লোক মূলত মুসলমান।
এখনো এই যুদ্ধের ফল পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে ব্যে বেড়াতে হচ্ছে। প্রায় সব সময় ইসলামাবাদ, করাচী আর অন্যান্য শহরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানের শব্দ মানুষকে সব সময় ভীতির মধ্যে রাখছে। টাইমসের লুইস করার রাওয়ালপিন্ডি থেকে তারবার্তায় জানান এখানে বড় কোন বোমা বর্ষন হচ্ছে না – তবে চলমান আক্রমণ চলছে – সেখানে শত শত হটা হত হচ্ছে। এভাবে যখন মাথার উপর দিয়ে বিমান যায় – শহরের জীবন একদম থেমে যায়। মানুষ দৌড়ে ট্রেঞ্চের নিচে আশ্রয় নেয়। মাথায় উলের শাল নেধে দরজার আড়ালে দাঁড়ীয়ে থাকে উটপাখির মত। কাশ্মীরের পাহাড়ের জন্য রাডারে ভারতের বিমান ধরা পড়ে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলো ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আসে।
পাকিস্তানিরা তাদের অটোগুলো কাঁদা দিয়ে মুড়ে রেখেছে যাতে ভারতীয় বিমান সেগুলোকে চিহ্নিত করতে না পারে। রাতের আক্রমণে কোন আলো ছাড়া রাস্তার ট্রাফিক মেনে চলতে হয়। এবং এতে করে বিমান আক্রমণে মরার চেয়ে ট্রাফিক দুর্ঘটনায় মরার ভীতি আরও তৈরি হয়। সরকার মটর চালকদের বলেছে শুধু তাদের আলো ঢেকে রাখতে – গত সপ্তাহে পাকিস্তান তাদের নিজেদের স্যাবর জেট বিয়ান ভূপতিত করেছে। একটি পয়েন্টে মিলিটারিরা একটি এন্টি ক্র্যাফট মেশিন গান রাওয়ালপিন্ডি ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের উপরে সেট করেছে – কিন্তু সেখানকার গেস্টরা এটাকে ঠিকই বিপদজনক মনে করে।
সোভিয়েত বিমান
নয়া দিল্লিতে মেজাজ তেমন আনন্দময় কারণ ভারতের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলায় একটি সরকার প্রতিষ্ঠার পরে শরনার্থিরে খুব দ্রুতই ফিরে যাবে। যখন প্রধানমন্ত্রী গান্ধী গত সপ্তাহে উভয় হাউজে বললেন ভারত হবে প্রথম সরকার যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে – এতে সবাই তেমন বিস্মিত হয়নি। তবুও সদস্যরা তাদের চাপড়ে উত্সাহ যোগান আমোদ প্রকাশ করেন। ‘বাংলাদেশের জনগণের বিরতপূর্ন সংগ্রাম স্বাধীনতা আন্দোলন ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় খুলেছে,” মিসেস গান্ধী বলেন। ‘সমগ্র বিশ্বের মানুষ দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ তাদের ইচ্ছাকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যেভাবে মত দিয়েছেন তা অনেক দেশের সরকারেই দেখা যায়না।’
নয়াদিল্লিতে অল্প আনন্দ ছিল তবে নিক্সন প্রশাসন দ্রুতগতিতে ঘোষণা করেন যে উপমহাদেশে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরির জন্য ভারত দায়ী। জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশও এমন মন্তব্য করেছেন। ভারতের কর্মকর্তারা আশ্চর্য হয়েছে যে দ্রুততায় সাধারণ পরিষদে এই রিপোর্ট করা হয়েছিল যা তাদের মর্মাহত করে। সেখানে এক পক্ষীয়ভাবে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণের জন্য ভোট চাওয়া হয়।
যুদ্ধোপকরণের জন্য আহবান
এদিকে এখনও বিপদ হল অন্যান্য জাতির জড়িত হতে পারে। পাকিস্তান তুরস্কের উপর চাপ দিচ্ছে বলে যানা যায়। তবে তারা নিজেরা নিজেদের ঝামেলায় আছে। তাদের কাছে জাহাজ, ট্যাংক, বাজোকা এবং ছোট অস্ত্র এবং গোলাবারুদ চাওয়া হয়েছে। যেহেতু তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করে তাই এগুলো পাকিস্তানকে দিতে হোলে তাদের আমেরিকান অনুমোদন লাগবে। এছাড়া যানা যায় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতে রসদ পাঠানোর জন্য কায়রোতে বিমানে জ্বালানি ভরার জন্য স্টেশন হিসেবে ব্যাবহার করছে। প্রায় ৩০ টা আটোনভ- ১২ ট্রান্সপোর্ট যেগুলোর প্রত্যেকটা দুইটি ডিজমেন্টেল্ড এম আই জি অথবা দুইটি এস এ এম ব্যাটারি বহন করতে পারে – এগুলো গত সপ্তাহে এসেছে। বিমান আক্রমণে মিশর নাখোশ হয়েছে বলে যানা যায় । ওয়াশিংটন জানিয়েছে যে সেয়াটো ও সেন্টো চুক্তি পাকিস্তানে রসদ সরবরাহের বিপক্ষে যায় না।
যদি বাংলাদেশ সরকার সপ্তাহের শেষ নাগাদ রাজধানী ঢাকাতে শেষ না হয়ে থাকে তাহলে এটা ধরে নিতে হবে যে তাদের ভিত্তি শক্ত। যেমনটা মিসেস গান্ধি পার্লামেন্টের বক্তব্যে বলেছেন যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নেতারা তাদের গণতন্ত্রের কৌশল, আদর্শ, সামাজিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং একটি অনবদ্য সমাজ গঠনের উপর মুল্যায়িত হবেন। এখানে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ অথবা ধর্মমত ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা হবে না। বাংলাদেশ সরকার তাদের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে তাদের সংকল্প প্রকাশ করেছেন যেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ বিরোধী অবস্থা , বর্ণবাদ বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদিতার বিরুদ্ধে অবস্থান সহ একটি নীতি অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বপ্ন দুইবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। চব্বিশ বছর আগে, বাঙালি পাকিস্তান নামক নতুন জাতির জন্য ভোট দেয়। যা ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া থেকে একটি আলাদা মুসলিম দেশ হবার লক্ষ্যে। তার পর অনেক দিন ধরে ধর্মীয় ঐক্য জাতিগত ও আঞ্চলিক সংকীর্ণতার মধ্যে ভাঙ্গা গড়া হচ্ছিল। যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে স্বৈরাচারী মোসলেমরা পূর্বে তাদের বাঙ্গালি ভাইদের শোষিত করছিল। এক বছর আগে গত সপ্তাহে, বাঙালি পাকিস্তানের প্রথম দেশব্যাপী নির্বাচনে অবাধ নির্বাচনে ভোট দেয়। শুধুমাত্র তদের নেতা মুজিবকে বিজয়ী করতে। কিত্নু তা নৃশংসভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে শেষ হয়ে যায়। সেই আঘাতে সম্ভবত ১০০০০০ মানুষ মারা যায় ও ১০ মিলিয়ন শরনার্থি অন্য দেশে চলে যায়। আর হাজার হাজার অবর্ণনীয় গৃহহীন ক্ষুধার্ত এবং অসুস্থ মানুষ পরে থাকে।
যারা ভারতে আসার কর্দ্মাক্ত পথে কলেরায় মারা গেছেন অথবা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে অনির্বচনীয়ভাবে নৃশংসতার শিকার হয়েছেন সেই স্মৃতি এখনো স্মৃতিতে কাঁচা হয়ে আছে। আর সেখানে ছিল শিশু, অন্ধ এবং মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, যারা তাদের জীবনের বাকিটা অপুষ্টির ক্ষত বহন করবে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে থেকে প্রথম নতুন দেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন খোলার হয় নয়া দিল্লিতে। স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু আপনারা জানেন কোটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
নতুন জাতি অর্থনৈতিকভাবে কতটা স্থিতিশীল? বাংলাদেশের উপরে যাওয়া ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল হলেও সে সমস্ত দেশের ৫০% অবদান রেখেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০% আয় তাদের। কিন্তু বিনিময়ে শুধুমাত্র একটি ছোট শতাংশ পেয়েছে। পূর্ববাংলার অর্থনীতির বিপদ হল এটি প্রচন্ডভাবে পাট ও পাটজাত-কাপড়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু এবং সিন্থেটিক এর পরিপূরক হচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু হয়ত সে তার নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ধরে রাখতে পারবে না। এখন নির্মাতারা শিল্প ও রপ্তানীকারকদের বিকাশ করতে সক্ষম হবেন। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু হবে, এবং ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পরিবর্তে নয়া দিল্লির সঙ্গে যৌথ বিপনন নীতিমালা প্রণয়ন করিতে পারিবে। ভারতও আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যায় সাহায্য করতে ইচ্ছুক।
বাংলাদেশকে ভারতের সমর্থন করার প্রধান কারণ হল যে বাংলাদেশ উদ্বাস্তুদের দ্রুত সরিয়ে নিতে পারবে। এবং তাদের জমি ও জিনিসপত্র পুনঃস্থাপন হবে। বাংলাদেশ সরকারও পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য সচেষ্ট হতে পারবে।
পশ্চিম পাকিস্তানে কি আসে যায়? পূর্ব পাকিস্তানে হারা, কোন সন্দেহ নেই, তাদের মনোবলের জন্য একটি আঘাত ও রাজনীতিতে একটি বড় পতন। কিন্তু ইসলামাবাদ সরকারের পক্ষে এমন একটি অঞ্চল যা রাজনৈতিকভাবে লজিস্টিকালি ও সামরিকভাবে পরিচালনা করা কঠিন ছিল এবং জনসংখ্যা কমে ৫৮ মিলিয়ন হয়েছিল যারা সজাতি। সে অর্থে এই ব্রেক আপ একটি আশীর্বাদ হতে পারে। তবে তাদের অনুভূতি তাদের ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট বৈদেশিক সাহায্য পেতে আশা করা যেতে পারে।
নেতৃত্বশূন্যতা
গত সপ্তাহে ইয়াহিয়া বেসামরিক সরকারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ৭৭ বছর বয়সী বাঙালি নুরুল আমিন কে নিয়োগের ঘোষণা দেন। যার কাছে তিনি তার সামরিক শাসন ক্ষমতার কিছু অংশ দিবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের বিয়োগান্ত নাটকের পর আমিন আসলেন। ঐ নির্বাচনে মুজিবের আওয়ামী লীগ পরিষদের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি জিতেছে; আমিন, যিনি একজন দেশপ্রধানের সন্মান পেয়েছেন তিনি ছিলেন অন্য দুইটি আসনের একজন। কিন্তু তিনি মূলত একটি ফিগারহেড, এবং তার ডেপুটি হিসেবে দেয়া হয়েছে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যার মানে তিনি সম্ভবত ক্ষমতার সিংহ ভাগ পাবেন। এটা আশাতীতভাবে দ্রুত হয়েছে। গত সপ্তাহে রিপোর্ট হয় যে ইয়াহিয়ার পতন আসন্ন হতে পারে। ভুট্টো একজন ঘৃণাপূর্ণ, প্রো চীনা রাজনীতিবিদ যিনি ইয়াহিয়াকে অসুস্থভাবে প্রভাবিত করে নির্বাচনের ফলাফলকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে মুজিবকে দূরে রাখতে সফল হয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রধান অসুবিধা নেতৃত্বের শূন্যতা। ইয়াহিয়া কি মুজিবকে মুক্তি দেবেন? – সেই জাদুকরী নেতা যিনি দেশভাগের পর থিক বাঙ্গালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সকল নেতা যারা বাংলাদেশের সরকার গঠন করার পর গত এপ্রিল থেকে নির্বাসিত আছেন তারা মুজিবের পুরোনো সহকর্মী এবং তার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পরিচালনার জন্য দায়বদ্ধ – যেহেতু তিনি কারারুদ্ধ। কিন্তু একটি দুর্বল নতুন জাতি শাসন করা একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনার চেয়ে আরো কঠিন। তার চাইতে বড় ব্যাপার হল মুজিবের মত ক্যারিজমা আর কারো নেই যে এত মিলিয়ন শক্তিশালী জনতা কে আকৃষ্ট করে রাখবে। শীর্ষ নেতাদের যারা গত গত ডিসেম্বরের বাতিল করা জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অপ্রতিরোধ্য মার্জিন দ্বারা আসন জিতেছেন তাদের মধ্যে আছেন: – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৪০। তিনি মুজিবের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন আইনজীবী যিনি অতীতে শেখের সহকর্মি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় সক্রিয় ছিলেন, এবং যখন মুজিব জেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তখন তিনি বিরূপ সময়ে পার্টির নেতৃত্ব দেন। – তাজউদ্দীন আহমদ, ৪৬, প্রধানমন্ত্রী, একজন আইনজীবী যিনি ১৯৪৯ থেকে আওয়ামী লীগের প্রধান সংগঠক। তিনি অর্থনীতির একজন বিশেষজ্ঞ এবং দলের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের একজন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ , ৫৩, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, একজন আইনজীবী যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ স্থাপনে সাহায্য করেছেন।
সবচেয়ে আশু সমস্যা হল অবাঙালি ও বাঙ্গালিদের মধ্যে যে রক্তযুধ সেটা থামানো। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে অবাঙ্গালিরা সহযোগিতা করছিল। এর পরে , পূর্ববাংলার সরকারি কর্মকর্তাদের যারা যুধ চলার পরেও বাংলাদেশে থাকতে চেয়েছেন তাদেরকেই স্বাধীনতার পরে নতুন প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভারতীয় স্বীকৃতি আগেই পাওয়া গেছে। একটি কারন জাতিসঙ্ঘের কাছে উদীয়মান ছিল যে ভারত যুদ্ধে এসেছিল এটাকে তাদের প্রদেশ বানানোর আশায়। আরেকটি ছিল বাংলাদেশ সরকার যাতে আর্মির থেকে দেশ স্বাধীন করার পরে দ্রুত সরকার গঠন করতে পারে। যেহেতু নয়া দিল্লি পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ এর বিনিময়ে ভারতীয় উপনিবেশবাদ তৈরি করতে চায়না তাই তারা বাংলাদেশ সরকারকে তাদের নিজস্ব পথে চলতে দিয়েছে।
পিছনে হাঁটা
এমন কোন পথ কি আছে যে পাকিস্তানিরা এখনো একটি উল্টো মোড় নিতে পারে? ভারতীয়দের পূর্ব অঞ্চল থেকে সরিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রকে তার সদ্য ভুমিস্ট অবস্থাতেই শেষ করে দিতে পারে? কার্যত পারেনা। জানালেন – প্রতিবেদক ক্লার্ক। তিনি তারবার্তায় একথা জানান। টাইমসের দুইজন সাংবাদিক সম্প্রতি পাকিস্তান সফর শেষ করেছেন। ক্লার্ক পশ্চিম থেকে আর স্তিওার্ট পূর্ব থেকে সংবাদ দেন। যারা পাকিস্তান ও ভারতের মাঝখান থেকে সুবিধা আদায়ের আশা করেছিলেন তারা তা করতে পারবেন না।
তাই সপ্তাহের শেষে যেসকল উদ্বাস্তুরা এত দূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে ভারতে আসছিলেন তারা আবার বাড়ীতে ফিরে আসার জন্য দির্ঘ পথে রওনা দিয়েছেন প্রাণের টানে। কারো জন্য এটা ছিল আত্মীয় এবং বন্ধুদের নিয়ে খুশির পুনর্মিলন আর কারো জন্য অশ্রু। এবং যারা আর ফেরত আসবে তাদের জন্য অনুভূতি ছিল অন্যরকম। কিন্তু সেখানে নতুন ঘরবাড়ি বানাতে হবে, নতুন জাতি তৈরি করতে হবে। সেখানে জমি ও পরে আছে – সবুজ এবং মায়াবী।
নোবেল জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন “মানব ইতিহাস ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে অপমানিত মানুষের জয়জয়কার দেখার জন্য।’ উত্থান হয়েছে – তবে অনেক দামের বিনিময়ে। উপমহাদেশের যুদ্ধ এবং নতুন জন্মগ্রহণকারী হাড় ফাটা দারিদ্র্যের দেশ – বাংলাদেশের বিজয় – দুঃখপূর্ন।
যুক্তরাষ্ট্র: কসাইখানা নীতি
নিক্সন প্রশাসন গত সপ্তাহে ভারত ও পাকিস্তানের উপর তার নীতির জন্য সমালোচিত হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে যখন যুদ্ধ দুই ঐতিহ্যগত শত্রুদের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র একটি অস্বাভাবিক ভোঁতা বিবৃতি জারি করল, তারা ভারতকে দোষী করল। তার পরেই জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ ভারতের কাজকে “আগ্রাসন” বলে উপাধি দিলেন। এমন একটি শব্দ যা ওয়াশিংটন পরবর্তীকালে কোনমতে একটা কিছু বুঝিয়েছে।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ঘোষণা করেন যে প্রশাসন গত আট মাসের পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ববাংলার নৃশংস এবং নিয়মানুগ নিপীড়নের সময় বধির হয়ে ছিলএবং এখন ভারতের তাদের নিজেদের পূর্ববর্তি সীমান্তের অস্থিতিশীলতায় নেয়া পদক্ষেপকে দোষী করা হচ্ছে। সিনেটর এডমন্ড মুস্কি এবং হুবার্ট হামফ্রে কেনেডির কথাই প্রতিধ্বনিত করেন।
সমালোচনা শুধু উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকদের দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিলনা। নিউ ইয়র্ক টাইমসে জন পি লুইস – এক সময়কার ইউ এস এইডের ভারতীয় পরিচালক (১৯৬৪-৬৯) এবং এখন প্রিন্সটন এ জন এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স উইডরো উইলসন বিদ্যালয়ের ডিন -লিখেছিলেন: “আমরা বিশ্বে আমাদের অবস্থান দাঁড় করিয়েছি। আমাদেরকে সম্প্রতি বিশ্ব লক্ষ্য করেছে এমন একটি নৈতিক ব্যাপারের বিপক্ষে দাঁড়াতে হচ্ছে। এটি অনেক বড় ও সাধারণ ইস্যু। আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতির বিপরীতে একটি ছোটখাট সামরিক স্বৈরশাসনের পক্ষ নিয়েছি। ব্রিটেনে রক্ষণশীল লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফ এ ওয়াশিংটন কে একটি ভণ্ড কূটনৈতিক কাজ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে যা সমান্তরাল থাকতে পারে না।
মার্চ থেকে যখন পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব বাংলায় রক্তাক্ত নাটক মঞ্চস্থ করেছে, বেসামরিক হাজার হাজার হত্যা করেছে ও প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে – সেই সময়ে মার্কিন সরকার নৃশংসতার তেমন সমালোচনা করে নাই এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান-একজন মানুষ যাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পছন্দ করেন। ওয়াশিংটন পাকিস্তানের সাথে তার সখ্যতার জন্য যা করার করেছে। তার উপরে ওয়াশিংটন প্রশাসন ইসলামাবাদের প্রশংসা করেছিল যখন গত জুলাইতে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন চায়না সফরে তারা সাহায্য করেছিল। ভারত তার ঐতিহ্যগত শত্রুদের এভাবে সাহায্য করতে দেখে ওয়াশিংটনের উপর আকস্মিক হতবাক হয়েছিল – কারণ চীন তাদেরও সাথে ১৯৬২ সালে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। লোকচক্ষুর অন্তরালে অনেক স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্মকর্তার আহ্বান নিরর্থক হয়ে যায়। কারণ সরকার ইয়াহিয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেন – মানবিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই।
গত পাঁচ বছরে, চীন পাকিস্তানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বাস্তুচ্যুত করেছে। ভারত, ক্রমবর্ধমানভাবে সামরিক সাহায্যের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল।অবশেষে মস্কোর সাথে গত গ্রীষ্মে বন্ধুত্বপূর্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পন্ন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত শিবিরের মধ্যে ভারতীয়দের সরানোর জন্য একমাত্র দায়ী সরকার না। কিন্তু ইয়াহিয়ার সাথে নোংরাভাবে থাকার যে কৌশল তার কারণে ভারত সোভিয়েত ক্যাম্পের দিকে ধাবিত হয়েছে। এবং তারা আমেরিকার কাছে নৈতিক সমর্থন আশা করেনি। চুক্তির ফলে ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল।
প্রশাসনের বর্তমান রাগ আরো সাম্প্রতিক একটি ঘটনা থেকে ছড়িয়েছে। গত মাসে ইন্দিরা ওয়াশিংটনে তার সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সঙ্কে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন যে তার দেশের যুদ্ধে যাবার কোন ইচ্ছে নেই। পরবর্তীতে, ভারতীয় সেনা যা করল তাতে মনে হল তারা এটা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল।
ওয়াশিংটন কর্মকর্তারা জানালেন মিসেস গান্ধীর সফর ছিল বৃহদায়তনের যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য একটি ধোঁয়াশা তৈরি করা। রিচার্ড নিক্সন অগ্নিশর্মা ছিলেন এবং সরকারি বিবৃতিতে ভারতকে আগ্রাসক হিসেবে ব্র্যান্ডিং করেছে।
গত সপ্তাহে, ইউ এস নীতির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা কিসিঞ্জার একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। (মন্তব্য পটভূমি হিসেবে ব্যাবহার করা যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত সিনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার কংগ্রেশনাল রেকর্ড থেকে ব্রিফিংয়ের একটি প্রতিলিপি মুদ্রণ করেন। ) কিসিঞ্জার জোর দিয়ে বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না, কিন্তু একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য শান্তভাবে এবং নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। বস্তুত, ভারতীয় হামলার সময় তিনি দাবি করেন, ইউ এস কূটনীতিকরা ও কলকাতা ভিত্তিক বাংলাদেশ নেতৃত্ব ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা করে সমাধানের কথা বলেছে। নয়া দিল্লি বলেছে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে ওয়াশিংটন বিশ্বাস করে ও যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান করেছে কারণ তারা পূর্ববাংলা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বিতাড়িত করতে চেয়েছে।
এটা বলা যেতে পারে যে ওয়াশিংটন দোষী কারণ ভারতীয় এবং পাকিস্তানীদের ঐ অবস্থা চলাকালেও সে ভেবেছে যে একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। এটা তাদের সরলতা ও দুর্ভাগ্য। পূর্ব বাংলায় ক্রমাগত ক্ষমতাশূন্যতা থাকার পরেও এটা ভারতীয়দের কাছ থেকে আশা করা অবাস্তব যে তারা তাদের প্রধান শত্রুর সাথে যুদ্ধবিরতি দেবে। এবং একটি স্থায়ী ঘা দেয়া হয়েছে যেমনটি ইজরায়েলের কাছে আশা করা হয়েছিল যখন ১৯৬৭ সালে সিনাইয়ে অগ্রসর হতে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল।
এটা সত্য যে চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির কারণে ভারতীয়দের সঙ্গে রণকৌশলে যেতে ওয়াশিংটনের সীমাবদ্ধতা বেড়েছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রশাসন যেভাবে পরিচালনা করেছে সেখানে এই ব্যাখ্যা বা অজুহাত খাটেনা। কারণ তাদের কাজ ও কথা এক প্রকারের প্রতারণা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১) যখনি পূর্ব এশীয় সংঘাত নিরপেক্ষ করার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে তখন তারা সেখানে বাধা দিয়েছে; (২) রাশিয়া-ভারত, চায়না- পাকিস্তান লাইন-আপ শক্তিশালী করা দিকে ঝুঁকেছে; (৩) আপাতদৃষ্টিতে একটি বিশেষ শাসক যাদের শাসন প্রক্রিয়া পাশবিক এবং যারা প্রায় পরাজিত তাদের পক্ষে আদর্শগত ও রাজনইতিকভাবে অবস্থান নিয়েছে;(৪) উপ-মহাদেশে একজন কসাইইয়ের মত তার অবস্থান তৈরি করেছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩২। ট্যাঙ্কের দ্বারা বিদ্রোহ দমন | ডেইলি টেলিগ্রাফ |
৩০ মার্চ, ১৯৭১
|
<১৪, ১৩২, ৩১৭-৩২৩>
ডেইলি টেলিগ্রাফ লন্ডন, মার্চ ৩০, ১৯৭১
ট্যাঙ্কের দ্বারা বিদ্রোহ দমন
৭০০০ মানুষ নিহত: বাড়ি–ঘর ভস্মীভূত
সাইমন ড্রিং, ব্যাঙ্কক থেকে
যিনি যুদ্ধের সময় ঢাকায় ছিলেন
সৃষ্টিকর্তার নামে আর অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ একটি বিধ্বস্ত এবং ভীত নগরী। গণহত্যা চালানোর উদ্দেশ্যে ঠান্ডা মাথায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৪ ঘন্টা গোলাবর্ষণ চালিয়ে গিয়েছে এবং এর ফলে ঢাকা নগরীর ৭ হাজার মানুষ নিহত, বিশাল বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইকে নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যদিও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দাবি করছেন যে পরিস্থিতি এখন শান্ত তবু রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে গ্রামমুখী হাজার হাজার মানুষ। শহরের রাস্তাঘাট এখন ফাঁকা, দেশের অন্যান্য স্থানে হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে।
এব্যাপারে সন্দেহ নেই যে ট্যাংকের বলে বলীয়ান সৈন্যদল শহর এবং অন্যান্য বৃহৎ লোকালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ নেই বললেই চলে।
তুচ্ছ কারণে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বাড়িঘর নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৩ মিলিয়ন মানুষের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা বদ্ধ পরিকর।
ঠিক কতো নিরীহ মানুষকে এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে সে হিসাব করা খুবই কঠিন। তবে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এবং ঢাকার হিসাব যোগ করলে এ সংখ্যা ১৫ হাজারের কম হবেনা।
হতা-হতের সংখ্যা সঠিক ভাবে পরিমাপ করা না গেলেও সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা সহজেই উপলব্ধি করা যাচ্ছে । ছাত্রদের নিজের বিছানায় হত্যা করা হয়েছে , নিজের ছোট্ট দোকানটিতে কসাইয়ের লাশ পড়ে আছে , নারী ও শিশুদের ঘরের ভিতর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানিদের একসঙ্গে জড়ো করে গুলি করে মারা হয়েছে, বাড়িঘর, বাজার, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আর পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে সব ভবনের শীর্ষে।
সরকারি সৈন্যদের দিকে হতাহতের সংখ্যা স্পষ্ট নয়। তবে অন্তত একজন অফিসার নিহত এবং ২ জন সৈন্য আহত হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে পাকবাহিনী বাঙালির অভ্যুত্থান সাফল্যের সাথেই দমন করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী অবস্হায় দেখা গিয়েছে এবং আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাঁজোয়া বাহিনীর হামলা
শীর্ষস্থানীয় সব রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য অনেককেই হত্যা করা হয়েছে এবং শেখ মুজিবের আন্দোলনের সমর্থক দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার অফিস ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
তবে ২৫ মার্চ রাতে বের হওয়া ট্যাংক বহরের প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা।
ঢাকা আক্রমণে তিন ব্যাটালিয়ন সৈন্য ব্যবহৃত হয় – একটি সাঁজোয়া, একটি গোলান্দাজ আর একটি পদাতিক। রাত ১০টার কিছু পরে তারা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে।
১১টার দিকে গুলিবর্ষন শুরু হয় এবং পাক বাহিণীর প্রথম হামলার শিকার হয় উল্টানো গাড়ি, গাছের গুড়ি, আসবাব পত্র, কনক্রিট পাইপ দিয়ে দ্রুত ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টায় এগিয়ে আসা মানুষগুলো।
কেউ একজন ফোনে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দেন যে, শহরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং তিনি যেন বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করেন। তবে তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আমি যদি আত্মগোপন করি তবে তারা আমার সন্ধানে নেমে সারা ঢাকা শহর ধ্বংস করে দেবে।
২০০ ছাত্র নিহত
ছাত্রদেরকেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পাকসেনাদের হামলার পরও বেঁচে যাওয়া ছাত্রদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, তারা ভেবেছিল তাদের কেবল গ্রেপ্তার করা হবে। এ রকম হত্যাকান্ডের কথা কারো কল্পনায়ও আসেনি ।
মাঝ রাতের ঠিক পরপরই আমেরিকার দেওয়া স্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম-২৪ ট্যাংক বহর এক কলামে সাজিয়ে সেনা দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে। সৈন্যরা ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে সেটাকে ঘাঁটি বানিয়ে ছাত্রাবাসগুলিতে গোলাবর্ষণ করতে থাকে।
সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি বলে পরিচিত ইকবাল হলে গোলা নিক্ষেপ আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিতে ২০০ ছাত্র নিহত হয়। এ ধরনের অতর্কিতে হামলায় নিরস্ত্র ছাত্ররা সম্পূর্ণ আপ্রস্তুত অবস্হায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
দুদিন পরও দেখা যায় পোড়া রুমের মধ্যে পড়ে থাকা লাশ, বারান্দায় আর মাঠে লাশ। তবে সবচেয়ে বেশি লাশ দেখা গেছে হলের পাশের লেকে। চিত্রকলার এক ছাত্রের লাশ উপুড় হয়ে পড়েছিল তার ক্যানভাসের ওপর।
কোয়ার্টারে বসবাসকারী ৭ জন শিক্ষক নিহত হন। কোয়ার্টারের বাইরে লুকিয়ে থাকার চেষ্টারত ১২ সদস্যের একটি পরিবারকে গুলি করে মারা হয়। হত্যাজজ্ঞের পর পাক বাহিনী অনেক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়। সেকারণেই ইকবাল হলের মেঝেতে পড়ে থাকা ৩০ টি লাশ দেখে পুরো ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
অন্য একটি হলে ছাত্রদের মেরে দ্রুত কবর খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে তারপর ট্যাংক দিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারী অন্য সাধারণ লোকজনকেও রেহাই দেওয়া হয় নি। রেললাইনের পাশে শান্তি হাউজের ২০০ গজ এলাকার সমস্ত ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
পাক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে থাকা একটি মার্কেটও পুড়িয়ে দেয়। দোকানের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা লোকজন মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ হারায়। কাঁধ পর্যন্ত টেনে দেওয়া কম্বলের তলায় মনে হচ্ছিল তারা যেন ঘুমিয়েই আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বাজুকা ছোড়া হয় এবং এলাকার একটি মসজিদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর আক্রমণ
পাক বাহিণীর ট্যাঙ্কবহরের এক অংশ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণরত, তখন আরেক অংশ শহরের অন্য প্রান্তে অবস্হিত পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদর দপ্তর রাজারবাগ আক্রমণ করে।
ট্যাংক প্রথমে গোলাবর্ষণ করে এবং পরে সৈন্যরা ঢুকে ঘুমন্ত পুলিশের ব্যারাক মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। এই হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক হিসাব যদিও জানা যায় নি তবে ধারণা করা হয়, ঐ সময়ে সেখানে অবস্থানকারী ১১০০ পুলিশের মধ্যে অল্প কজনই রেহাই পেয়েছিল।
এই অবস্থার মধ্যে সেনাবাহিনীর অন্য ইউনিটগুলো শেখ মুজিবের বাসভবন ঘিরে ফেলে। রাত ১টার ঠিক আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় যে , তিনি অনেক আগেই এ ধরনের হামলার আশংকা করছিলেন এবং কয়েকজন কাজের লোক ও দেহরক্ষী বাদে বাড়ির অন্য সদস্যদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছিলেন।
শেখ মুজিবের এক প্রতিবেশী পরে জানান যে, রাত ১টা ১০ মিনিটে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাক বোঝাই সৈন্যরা গুলি করতে করতে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে এগুতে থাকে।
বাড়ির সামনে এসে একজন অফিসার রাস্তা থেকেই ইংরেজিতে চেঁচিয়ে বলেন, ” শেখ, আপনি বাইরে আসুন। “
ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে শেখ মুজিব বলেন, “হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। এতো গোলাগুলির দরকার ছিল না, আমাকে টেলিফোন করে দিলে আমি নিজেই হাজির হতাম।”
অফিসারটি তখন বাড়ির বাগানে ঢুকে বললেন, “আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।”
তিনজন কাজের লোক, একজন সহকারী আর দেহরক্ষীসহ শেখ মুজিবকে নিয়ে গেল তারা।
দলিল–পত্র সরিয়ে নেয়া
শেখ মুজিবকে যখন সেনা সদরদপ্তরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আরেক দল সৈন্য বাড়ির ভিতর ঢুকে। তারা বাড়িতে রক্ষিত দলিলপত্র নিয়ে যায়, সবকিছু ভেঙে-চুরে তান্ডবলীলা চালায়, বাগানের সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের লাল, সবুজ, হলুদ পতাকা গুলি করে নামিয়ে শেখ মুজিবের বাড়ি ত্যাগ করে।
রাত ২টা নাগাদ ঢাকা একটি জ্বলন্ত নগরীতে পরিণত হয়। সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকা দখল করে নেয় এবং লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের গুলি করে মারতে ও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার বদলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যদিও কোনো কোনো এলাকা থেকে মাঝে মাঝে ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, তবুও এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, যুদ্ধের তীব্রতা কমে এসেছে। ইতিমধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উল্টোদিকে অবস্থিত খালি পড়ে থাকা ‘পিপলস’ পত্রিকার অফিসে এক প্লাটুন সৈন্য ঢুকে সেটিকে জ্বালিয়ে দেয় এবং সে অফিসের একমাত্র নৈশ প্রহরীকে গুলি করে হত্যা করে।
ভোরের ঠিক আগে গোলাগুলি প্রায় থেমে যায়।বেলা যত বাড়তে থাকে, মৃত নগরী অদ্ভুত নিস্তব্ধতা তত প্রকট হতে থাকে। থেমে থেমে কাকের ডাক আর সামরিক গাড়ির চলাচলের শব্দ ছাড়া শহরে আর যেন কিছুই ছিল না। তবে সবচেয়ে খারাপটা তখনও বাকি ছিল।
দুপুর নাগাদ বিনা নোটিশেই কয়েক কলাম সৈন্য ঢাকার পুরোনো অংশে অতর্কিত হামলা চালায়। পুরোনো ঢাকার রাস্তাঘাট অতন্ত সংকীর্ণ এবং সেখানে ১ মিলিয়নেরও বেশী লোক বসবাস করে। পরবর্তী ১১ ঘন্টা ধরে পাকসেনারা যেসব এলাকা শেখ মুজিব সমর্থকদের শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত, সেসব জায়গায় পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
ইংলিশ রোড, নয়া বাজার, ফ্রেঞ্চ রোড, সিটি বাজার এলাকায় হাজার হাজার লোকের বাসস্থান পুড়িয়ে দেওয়া হয় ।
ফ্রেঞ্চ রোড-নয়া বাজার এলাকায় এক বৃদ্ধের ভাষ্যে জানা যায় যে, পাক সেনারা হঠাৎ যেন গলির মাথায় উদয় হতো আর ঐ গলির সবকিছু পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিত।
সৈন্যরা দুইভাগে ভাগ হয়ে আসত। প্রথমে থাকতো অস্ত্রধারী সৈন্যরা। তাদের অনুসরণ করতো পেট্রোলের ক্যান হাতে আরেক দল, যারা নির্বিচারে বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতো। যারা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতো তাদের গুলি করে মারা হত। আর যারা ভিতরেই থাকতো তারা জীবন্ত দগ্ধ হত। সেদিন বেলা ২টার মধ্যে ঐ এলাকার ৭০০ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়।
একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় অন্য আরো তিনটি এলাকায়, যেগুলোর প্রত্যেকটির আয়তন কম-বেশী আধা বর্গ মাইল।
সৈন্যরা একটি এলাকা থেকে চলে যাওয়ার সময়ে যতটুকু পারতো , লাশগুলো ট্রাকে তুলে নিয়ে পরবর্তী টার্গেট এলাকার দিকে রওয়ানা দিত। পুরোনো ঢাকার পুলিশ স্টেশনগুলোতেও তারা নির্বিচারে হামলা চালায়।
শনিবার সকালে পুরোনো ঢাকার একটি বাজারের ধ্বংসস্তূপে এক পুলিশ আফিসার কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি আমার কনস্টেবলদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার অধীনে ২৪০ জন ছিল, এ পর্যন্ত ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি-যাদের সবাই মৃত।”
পাক সেনাদের এই অভিযানে সবচেয়ে বড় হত্যাকান্ডটি ঘটানো হয় পুরোনো ঢাকার হিন্দু এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের করে এনে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয়।
হত্যা করার পর পুরো এলাকাও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছার-খার করে দেয়া হয়।
২৬ মার্চ রাত ১১টা পর্যন্ত সৈন্যরা পুরোনো ঢাকায় বাঙালী ইনফর্মারদের সহায়তা নিয়ে অভিযান চালিয়ে যায় ।
সৈন্যরা ফ্লেয়ার ছুড়লে বাঙালি ইনফর্মাররা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি দেখিয়ে দিত। তারপর সৈন্যরা ট্যাংকের গোলায়, রিকয়েললেস রাইফেলের গুলিতে অথবা পেট্রোল জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে ঐসব বাড়ি ধ্বংস করে দিত।
টঙ্গী এবং নারায়ণগঞ্জ ছিল শেখ মুজিবের সমর্থক বামপন্থীদের ঘাঁটি। সেই এলাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেকে মোতায়েন করা হয়। শহর এলাকায় রোববার সকাল পর্যন্ত গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। তবে বড় ধরনের অভিযানগুলো ২৬ তারিখ রাতে, আক্রমণ শুরু হবার ঠিক ২৪ ঘন্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
সৈন্যদের শেষ টার্গেটগুলোর অন্যতম ছিল দেশের প্রধানতম বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস। হামলা শুরু হওয়ার পরপরই সেখানে প্রায় ৪০০ সৈন্য অবস্থান নেয়।
২৬ মার্চ বিকেল ৪টা নাগাদ চারটি ট্যাংক এসে দাঁড়ায় ইত্তেফাক ভবন সংলগ্ন এলাকায়। আর সাড়ে ৪টায় ঐ ভবনটি পরিণত হয় একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে। শনিবার সকালে ঐ ভবনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
যতো দ্রুত সৈন্যরা শহরের রাস্তায় নেমেছিল, ঠিক সেই রকম দ্রুততার সাথেই তারা তাদের ব্যারাকে ফিরে যায়। শনিবার সকালে রেডিওতে ঘোযণা দেয়া হয় যে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কার্ফ্যু তুলে নেওয়া হবে।
রেডিওর ঘোষণায় বার বার সামরিক আইনের ধারাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে বলা হয় এবং ব্যক্তিগত অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাজার হাজার মানুষের পলায়ন
যাদুমন্ত্রের মত নগরীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরো ঘনীভূত হয়। এখানে-সেখানে কুন্ডুলীভূত কালো ধোঁয়া এবং সৈন্য দলের উপস্হিতি সত্বেও বেলা দশটা নাগাদ রাস্তাগুলো ভরে ওঠে পলায়নপর মানুষের ভিড়ে।
কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায় কেউবা হেঁটে। সবার সঙ্গে মালপত্রের বহর, ঢাকার মানুষ পালাচ্ছে হাজারে হাজারে। আর কখনো কখনো শোনা যাচ্ছিল করুণ আর্তনাদ-” আমি বৃদ্ধ মানুষ, দয়া করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান।” “আল্লাহর ওয়াস্তে আমার বাচ্চাটিকে আপনাদের সাথে নিয়ে যান।”। এই ধরণের আহাজারীতে ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এর পাশ দিয়েই অন্য দিকে তাকিয়ে পলায়নপর মানুষ হেঁটে যাচ্ছিল।
নীরবে মাথানত করে পলায়নরত মানুষ ধ্বংসস্তুপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। পাকবাহিনীর তান্ডবলীলার প্রমাণ পদে পদেই দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল কি নিপুণ পরিকল্পনায় সৈন্যরা মানুষ হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
একটা বাজারের পাশে হঠাৎ গুলির শব্দ হল। মুহূর্তের মধ্যেই ২০০০ মানুষ দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু এটি ছিল শুধুমাত্র অস্ত্র জমা দিতে চাওয়া কোন এক মানুষের বন্দুকের শব্দ।
সরকারী অফিসগুলো ফাঁকা। বেশীরভাগ কর্মচারীই পালিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের দিকে।
আর যারা শহরেই রয়ে গেছে তারা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসব ধ্বংসস্তূপের মাঝে, এক সময়ে যা ছিল তাদের বাসস্থান। তারা খুঁজে দেখছিল ধ্বংসস্তুপের ছাইয়ের মাঝ থেকে কোন কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা।
যেসব গাড়িগুলো ছুটছিল, সেগুলো ছিল হয় গ্রামমুখী পলায়নপর মানুষে বোঝাই অথবা রেডক্রসের পতাকা লাগিয়ে মৃতদেহ অথবা আহতদের বহনকারী গাড়ি।
আর মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছিল সৈন্যদের গাড়ি, জনতার দিকে বন্দুক তাক করে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে ছিল তারা।
শুক্রবার রাতে যখন তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তখন তারা চিৎকার করে বলছইল নারায়ে তাকবির-একটি পার্সিয়ান শব্দ যার অর্থ আমরা যুদ্ধে জিতে গিয়েছি।
শনিবারে তাদের স্লোগান দিচ্ছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ- যার অর্থ পাকিস্তান দীর্ঘজীবি হোক।
বেশিরভাগ মানুষই পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করছিল। পেট্রোল ছাড়া পাকিস্তানি পতাকাই ছিল বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য।পালিয়ে যাওয়ার সময় নিজেদের বাড়িঘর সম্পদ রক্ষার জন্য মানুষ দরজায় তালা দিচ্ছিল আর ছাদে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াছ্ছিল।
চারটা নাগাদ রাস্তা আবার ফাঁকা হয়ে পড়ল। রাস্তায় রাস্তায় সৈন্যরা অবস্থান নিলো। আর সারা শহরে নেমে এলো সুনসান নীরবতা।
কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই গুলির শব্দ আবার নীরবতা ভেঙে দিল। রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া হলো কেউ ঘরের বাইরে এলেই গুলি করা হবে। কার্ফ্যু বলবত হবার ঠিক দুই মিনিট পরে একটি ছোট্ট ছেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল। তাকে আটক করা হয়, একজন অফিসার তাকে জোরে জোরে চড় মারেন এবং তাকে জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢাকা ক্লাবের নাইট গার্ড ক্লাব ভবনের গেট লাগাতে এসে সৈন্যদের গুলিতে মারা যায়।
রেসকোর্সের মাঝখানে মন্দিরের আশপাশের বাসিন্দা একদল হিন্দুকে গুলি করে মারা হয়। তাদের অপরাধ ছিল এই যে তারা খোলা জায়গায় ঘোরাফেরা করছিল।
সৈন্যদের অবরোধের মুখে পালাতে না পেরে অনেক মানুষকেই ঢাকা ফিরে আসতে হয়। তাদের একজনের মুখ থেকে শোনা যায় যে পালানোর চেষ্টারত কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
রাস্তায় রাস্তায় দেয়া সৈন্যদের ব্যারিকেডের অন্যপাশ ছিল পুরোপুরি ফাঁকা। একমাত্র সেনাবাহিনী ছাড়া কারো পক্ষেই বলা সম্ভব ছিলনা যে আসলে কি ঘটছে।
সড়ক পথের ভিড় এড়াতে গ্রামের দিকে যাওয়ার জন্য অনেকেই বেছে নিয়েছিল নদীপথ। নৌকার জন্য নদীর তীরে অপেক্ষা করতে করতেই আবার শুরু হয়ে গিয়েছিল কার্ফ্যু। পরদিন সকালে সেখানে দেখা যায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ
ঢাকা অথবা পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোথাও সংগঠিত কোনো প্রতিরোধ খবর পাওয়া যায় নি। পশ্চিম পাকিস্তানি কোন অফিসারও তাদের অভিযানের পথে কোন ধরণের প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করেন নি। একজন পাঞ্জাবি লেফটেন্যান্টের ভাষায়, “এই মানুষগুলো চাইলেও আমাদের ওপর পাল্টা আঘাত করতে পারবে না।” অন্য আরেক অফিসার জানান যে পরিস্হিতি এখন অনেক ভালো।
“কেউই একটি শব্দ উচ্চারণ করতে বা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। আসলে আমরা তাদের হত্যা করব। তাদের অনেক কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তারা বিশ্বাসঘাতক, আমরা তা নই। আমরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য আল্লাহর নামে লড়াই করছি।”
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের পরিকল্পনা এবং পরিচালনায় এই অভিযান বাংলার মানুষের সর্বশেষ প্রতিরোধের ক্ষমতা পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
শুধুমাত্র ভারতীয় সরকারের প্রোপাগান্ডা এবং ঢাকার বাইরের কোনো এক গোপন স্থান থেকে পরিচালিত বামপন্থীদের বাংলাদেশ রেডিও ছাড়া কোথাও চলমান যুদ্ধের কোনো খবর পাওয়ার উপায় ছিল না।
পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক দেশে সমঅধিকারের সাথে বসবাস করা। এই স্বপ্নভঙ্গের ভয়াবহ ক্ষত সময়ের ব্যবধানে তা শুকিয়ে গেলেও গত সপ্তাহে চালানো নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসযজ্ঞের যে স্মৃতি তা প্রজন্মান্তরেও ভোলা সম্ভব হবে না।
শেখ মুজিবের আন্দোলনের ধ্বংসস্তূপ থেকে যদি কিছু বেরিয়ে আসে তা হলো এই যে, সেনাবাহিনীকে কখনোই ছোট করে দেখা যাবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যতই জনগণকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলুক না কেন, তিনিই কখনোই কোনো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন না – সেই নির্বাচন বৈধভাবেই জেতা হোক আর না হোক।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৩। পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড | গার্ডিয়ান | ৩১ মার্চ, ১৯৭১ |
<১৪, ১৩৩, ৩২৪>
দ্যা গার্ডিয়ান, লন্ডন, ৩১ মার্চ ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড
“এখন আমরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি পাকিস্তান কীভাবে এক ভয়াল ত্রাসকে লালন করছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রবলভাবে এসবের মদত দিয়ে যাচ্ছেন। তার মিথ্যাচারে ভারী হয়ে গেছে বাতাস, বিদেশী সাংবাদিকদের তিনি বিদেয় হতে বাধ্য করেছেন। তবে কিছু সাহসী সাংবাদিক তার এই জালে আটকা পড়েন নি। তারা সত্য কথাটা বলে যাচ্ছেন, বলে যাচ্ছেন বিদ্যমান ভয়াবহ অবস্থার কথা। তারা লিখছেন নির্বিচারে মেশিনগান দ্বারা গুলিবর্ষণের কথা, ছাত্রনিবাসে গোলাঘাত এর কথা, ছোট্ট শহর এবং গ্রাম পুড়িয়ে, গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা, লিখছেন নিজ বিছানায় নাগরিকদের মৃত্যুবরণের কাহিনী। আমরা এখনও জানি না পূর্ব প্রান্তের আটকদের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে, কতটুকু প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম তারা। শুধু জানি এই সত্য, হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালি মারা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে।
এখন থেকে পুরো ঘটনাটির রূপ বদল হচ্ছে। সেনা নামার আগে অনেক নেতাই দায়িত্ব বন্টন করে শেখ মুজিবকে দুষেই ক্ষান্ত ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এসবের তোয়াক্কাই করলেন না। হত্যাকে দিলেন বৈধতা। মুজিবের সাথে কথা বলার ছলে জেনারেলদের সুযোগ দিলেন এই ম্যাসাকার চালিয়ে যাওয়ার। তিনি ভাব দেখিয়েছিলেন যে গণতন্ত্রের প্রতি তার অখণ্ড আস্থা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাটাই তার দায়িত্ব। শিঘ্রই প্রকাশিত হলো তার মিথ্যা। অত:পর প্রতিষ্ঠিত হলো সামরিক একনায়কতন্ত্র। আরো অনেকের মত গার্ডিয়ানও ভেবেছিলো যে ভারসাম্যের সুবিধা পূর্ব পাকিস্তানে বজায় থাকবে। কিন্তু হত্যা আর ধবংস দিয়ে কি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায়! পূর্ব পাকিস্তানের পরিচয় হয়ে রইল পশ্চিম পাকিস্তান অধ্যুষিত এবং শোষিত প্রদেশ হিসেবে। বাঙ্গালির অবিশ্বাস আর সন্দেহ ক্রমশ সত্য হিসেবে প্রকাশ পেতে লাগলো। একজন জাতীয় নেতা হয়েও ভুট্টো ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন এই বিভৎস হত্যালীলার জন্যে। পাকিস্তানের বন্ধু হয়ে যারা মানবিকতা এবং দয়া প্রদর্শনের অনুরোধ জানালেন, তাদের কারো কথায় ইয়াহিয়া কর্ণপাত করলেন না।
কিন্তু তাকে শুনতেই হবে। বিয়াফ্রার সাথে তুলনা করলেই বোঝা যায় পূর্ব পাকিস্তানে কী ভুলটাই না করা হচ্ছে! আমেরিকা-যারা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মদত যোগাচ্ছে, তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে কী অনাচারটা ঘটছে। চিনা এবং সিংহলরা, যারা তাদের অভ্যন্তর দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীকে এগুতে দিচ্ছে, তাদের বুঝতে হবে, এই বাহিনী কী করতে যাচ্ছে! বৃটেন- যারা আত্ম অহমিকা এবং প্রভাবের দ্বন্দ্বে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে, তাদের মন খুলে এগিয়ে যেতে হবে, প্রয়োগ করতে হবে শক্তি! ঢাকার ভাগ্যে যে পরিণতি অপেক্ষা করছে, মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, মধুর ভাষা দিয়ে তা কখনই ঠেকানো যাবে না!”।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৪। বাংলার দুর্যোগ | ডেইলি টেলিগ্রাফ | ২ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১৪, ১৩৪, ৩২৫>
ডেইলি টেলিগ্রাফ, ২ এপ্রিল ১৯৭১
বাংলার ট্রাজেডি
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। তারা গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলকে বানচাল করার চেষ্টা করছে যেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সেনাবাহিনীর প্রথম কাজ ছিল সব বিদেশী সংবাদদাতাদের বের করে দেয়া। শুধুমাত্র ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেইলি টেলিগ্রাফ এর সাইমন ড্রিং কিছুদিন অবস্থান করতে পেরেছেন। তার কাছ থেকে পাওয়া সেনাবাহিনীর নির্মমতার ও নিষ্ঠুরতার খবর আমরা গত মঙ্গলবারের সংস্করণে ছেপেছি। তার পর থেকে সেখানে কি ঘটছে সে ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোন সংবাদ আমরা পাচ্ছিনা। পাকিস্তান সরকার যদি ভুল রিপোর্ট সম্পর্কে প্রতিবাদ করেন তাহলে পুরোটাকেই ভুল বলতে হবে।
এটা সম্ভাব্য মনে হচ্ছে যে; সেনাবাহিনী পুর্বঅঞ্চলের রাজধানী ঢাকা সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং অন্যত্র বাঙ্গালীদের প্রতিরোধ ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। যেহেতু বাঙালিরা সামরিক লোক নয় তারা গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আদেশে পূর্ব বাংলায় কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পাঞ্জাবি সেনা পাঠানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে আরও রক্তপাত হতে যাচ্ছে; হয়ত দ্রুত নয় তবে কখনো কখনো। আমাদের আজকের প্রাপ্ত রিপোর্টে জানা যায় পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা তাদের সংলগ্ন ভারতের পশ্চিম বঙ্গে অলোড়ন তুলেছে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৫। বাংলার জন্য কাঁদো | নিউ স্টেটসম্যান | ২ এপ্রিল , ১৯৭১ |
<১৪, ১৩৫, ৩২৬-৩২৮>
বাংলার জন্য কাঁদো
সুত্রঃ নিউ স্টেটসম্যান
তারিখঃ ২ এপ্রিল , ১৯৭১ , মারভেইন জোন্সঃ
নিউ স্টেটসম্যান , লন্ডন , বাঙ্গালির জন্য কাঁদো , সেন্সরশিপ এবং সরকারী মিথ্যাচারের স্বত্বেও রিপোর্টগুলি ঢাকা থেকে বেরিয়ে আসছে, এমনকি এমন সব খবর যা পাঠককে আতঙ্কিত করে তুলবে । ‘ নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ‘ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞের আদেশ দেওয়া হয়েছে যাতে কোনও বাধা নেই এবং আদেশগুলো কঠোর । তাদের যুক্তিতে , শত্রু গন্য করা হবে পুরো দেশের জনগন কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বশাসন দাবি করেছে ।
” এই মুহূর্তে, কাউকে না কাউকে এই ট্র্যাজেডির জন্য চিন্তা করতে হবে ,সৈন্যরা ঘরবাড়ি পুরিয়ে দিচ্ছে , তাদের পেট্রোলের ক্যান হাতে সজ্জিত দেখা যাচ্ছে , যাদের সামান্য কিছু ছিলো তারা সব হারিয়ে ফেলেছে। হাজার হাজার লোক ট্যাঙ্কের এলোপাথারি গোলা থেকে বাচতে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু গ্রামঞ্চলে লোকজনেরা খুব কম সমই পেট ভরে আহার করতে পারে । । ক্ষুধা এবং রোগ হঠাৎ মৃত্যুর কারন হতে পারে । এবং, প্রায় ২00 বছর ধরে দরিদ্র থাকা মানুষদের ইতিহাসে এটি একমাত্র তিক্ত অভিজ্ঞতা । তারা নিপীড়ন ও শোষণ এর শিকার হয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের হাতে, উপমহাদেশের অন্যান্য অংশ থেকে আসা ভুমিদস্যুদের কাছে এবং ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের অহংকারী আধিপত্যের মধ্য দিয়ে ।
নেহেরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া ( যা কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি লিখেছিলেন ) বইয়ে প্রতিফলিত হয় , ভারতবর্ষের দারিদ্র্যকে মেনে চলার সময়কালের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে- বাংলায় গভীরতম দুর্দশা এবং পাঞ্জাবের একটি কার্যকর অর্থনীতির সবচেয়ে কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ যেখানে ব্রিটিশরা ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিখ শাসনকে পরাজিত করে রেখেছিলো ।অবশ্যই, অন্যান্য কারণও রয়েছে । তবুও, ইতিহাসের দুঃখ সময় সঙ্গে ভারী হবে এবং প্রতিটি প্রজন্ম শেষ পর্যন্ত তা বহন করে যাবে । এবং এটি পরিষ্কার করে বলা দরকার যে বাংলায় সাম্রাজ্যবাদের আদিম পর্যায়ের ডাকাতি এবং সেটার ধ্বংসাবশেষ সহ্য করেছিল ।
” দারিদ্র্যের চরম অবনমন বাংলার অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি প্রধান বিষয় : মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা যা বাকি বিশ্ব আগেই জানতো , গ্রামাঞ্চলে হয় প্রান্তিক জীবিকা চাষ , ঢাকার বস্তিগুলোতে কলকাতা থেকে আসা অনেকে বসবাস করছিলো , ১৮৯১ ও ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ হয় । অন্য অভিজ্ঞতাটি ছিলো মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ করা এবং রাজনৈতিক সহিংসতা ।
” পেছনের ছবিটিতে বাংলাকে অবশ্যই একটি জাতীয়তাবাদী চরিত্র হিসাব গ্রহণ করতে হবে । এবং কাউকে সাবধানতার সঙ্গেই এই ধারণাকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে । অবশ্যই, সম্মান এবং আত্ম সচেতনতা দুটোই বাস্তবিক প্রতিক্রিয়া । এটাকে তারপর এভাবে সাধারণীকরণ করা যায় যেঃ বাঙ্গালিরা স্বতঃস্ফূর্ত ,কথাপ্রিয় , আবেগী , নির্দিষ্ট বিষয়ে সংবেদনশীল , কারো সাথে হাত মেলায় বা আলিঙ্গন করে দ্রুত কিন্তু সেটি ছুরি দিয়েও । মহিলাদের মধ্যে রয়েছে , মূল্যবোধ ও কবিতা এবং সঙ্গীত চর্চা , আলংকারিক শিল্পে দক্ষতা , মুখরোচক খাবার তৈরি , এবং সৌন্দর্য । বাইরের লোকেরা তাদের মজার বা যোদ্ধা হিসেবে গন্য না করে চিহ্নিত করে বিশৃঙ্খল হিসেবে (ব্রিটিশরা তাদের ‘মার্শাল রেস’ থেকে বাদ দেয় এবং নির্মাণ এবং খনির কাজের জন্য একটি রেজিমেন্টে নিযুক্ত করে )ঃ এইসব বিরক্তি থেকেই তারা বীরত্তের কাজ প্রদর্শনপ্রবন হয়ে উঠে । তারা দক্ষ এবং উদ্ভাবক কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক নয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আবার এই সবের বিপরীত । বর্বর পাকিস্তান রাস্ট্র হচ্ছে কিছুটা ফ্রান্সের সাথে যুক্তরাজ্য ও ইতালির জোরপূর্বক গঠন করা ইউনিয়নের মতো ।
“পাকিস্তান একটি মুসলিম রাস্ট্র , । ইতিহাস বলে , পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমানরা আংশিকভাবে একটি গোস্টহির উত্তরাধিকারী, ইরানী ও আফগান বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের দ্বারা সেখানে বসতি স্থাপন হয়েছে । বাংলায় ইসলামের রূপান্তর ছিল একটি নির্বাচনের মাধ্যমে । বাংলায় ইসলামের রূপান্তর ছিল দরিদ্রদের বর্ণপ্রথা বিলোপের একটি মাধ্যমের ফলে । মুসলিম বা অমুসলিম , বাঙালিরা এখনও আবেগপূর্ণভাবে বাংলাকে অনুভব করে, যাতে তারা তীব্রভাবে প্রতিবাদ করে যখন ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জোন প্রদেশকে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত করার চেষ্টা করে। এটি একটি বিরল নিদর্শন ছিল যখন একটি ভাইসরয় তার পোষা প্রকল্প বাতিল করেছিলো । কিন্তু এভাবেই ১৯৪৭ সালে বাংলাকে বিভাজ্য করে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং তা ছিলো একপ্রকার ঐতিহাসিক বিদ্রুপ । জিন্নাহ , যিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি ছিলেন একজন উচ্চশ্রেনির বোম্বের মুসলিম যিনি অভ্যাসের ছিলেন ইংরেজ দের মতো এবং খুব ধর্মীয় ছিলেন না যেমনটি ছিলেন কারসন যিনি ছিলেন উচ্চ শ্রেণীর ডাবলিন প্রটেস্টান্ট । নতুন রাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন একচেটিয়াভাবে হয় ভূস্বামী এবং স্যান্ডহুরস্ট এর মতো চিন্তাধারার জেনারেলদের দ্বারা যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তাণী এবং যাদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কোন অভিজ্ঞতা নেই। পাকিস্তানের এধরনের চিন্তাধারার কারনে , নেহেরুর মত ভারতীয়রা ত তাদের অপছন্দ করতো ।
শুরু থেকে, গণতন্ত্র তৈরির কোন উদ্দেশ্য তাদের ছিল না , যেমনটি ছিলো একই ভাবে রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের । এটি সত্য যে বাঙ্গালিরা ছিলো অধিকাংশ মুসলিম কিন্তু তাদের ভারতের সাথে আবার একাত্ত হবার কোন সম্ভাবনা ছিলোনা ( যদিও ভারা প্রতিবেশী দেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের দাবি করে এবং কাশ্মিরের বিশৃঙ্খলা বিষয়ে তাদের কোন ইন্টারেস্ট ছিলোনা ) । উল্লেখ্য যে তারা ছিলো পশ্চিমাদের কাছে অবিশ্বস্ত , বিশ্বস্ততার বৃত্তর বাইরে। সিভিল সার্ভিসের প্রধান প্রধান পদ এবং পুলিশের চাকরি পশ্চিমের লোকরা পেয়েছিলো । অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোথাও খুব চিত্তাকর্ষক ছিলোনা যার প্রতি ইতিমধ্যে ধনী হয়ে যাওয়া পশ্চিমা প্রদেশেগুলো পক্ষপাতী ছিলো । দুই অংশে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা ছিলো হতাশাজনক । যখন সরকার খোলাখুলিভাবে স্বৈরশাসক ছিল না, তখন সীমিত লোকজন , ১০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৮০০০০ জন নাগরিক রাষ্ট্রপতির পক্ষে ভোট দিতে পারত । ভয়ভীতি ও ঘুষের মাধ্যমে সব নিয়ন্ত্রিত হতো । কিছু ঘটনা পূর্ব পাকিস্তানে ঘটেছিলো যখন আইউব খান পুনরায় নিরবাচিত হন । যখনই আমরা নতুন মোটরসাইকেলে চড়ে কাউকে যেতে দেখছিলাম আমাদের আমেরিকান বন্ধু চিৎকার করে বলছিলো সেখানে একজন ভোটার আছে ।
যখন সত্যিকারের নির্বাচন হয় , শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ পূর্ব পাকিস্তানে জয়লাভ করে যা শুধুমাত্র ১৮১৮ এর সিনফিনির প্রলয়ংকারী ঝড়ের সাথেই তুলনা করা চলে । পার্থক্য হলো যে তিনি শুধুমাত্র সায়তবশাসন দাবি করেছিলেন । তিনি সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং এর কঠোর ভয়ঙ্কর পরিণতি উভয় সম্পর্কেই অবগত ছিলেন ।যদি একটি স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি হতাশ হতে হবে যদি তা অর্জন করা যায়, তা হবে তার দারিদ্র্য । জনপ্রিয়তা এবং ইয়াহিয়া খান এর হঠকারিতা তাকে সঙ্কটের মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষনা করতে বাধ্য করেছিলো । আমি আন্দাজ করতে পারি যেকেউ একটি আকর্ষণীয় বিতর্ক শুনতে হবে সন্দেহ নেই যদি সে ওয়াশিংটনে টেবিলের নীচে ইঁদুর হয়ে অবস্থান নেয় । গ্রীস থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত অনুরূপ শাসনব্যবস্থার সমতুল্য “স্বতন্ত্র ব্যক্তি” হিসাবে অলিগার্চারের পক্ষে প্রচারিত হবে । তর্ক হতে পারে যে বাংলাকে দাবিয়ে রাখা যাবেনা এবং মুজিব একজন জনপ্রিয় নেতা কিন্তু বিল্পবী নয় – কিন্তু তিনি একটি অনিয়ন্ত্রিত বাহিনীর বিপক্ষে সেরা বীমা ।
যদিও সেনাবাহিনী নিছক নৃশংসতায় ভর করে প্রথম রাউন্ড জিতেছে ৭৩ মিলিয়ন মানুষের উপর ঘৃণ্য অভিশংসন বজায় রেখে । পূর্ব সীমান্ত ব্যতীত বাংলায় কোন বড় বন বা পাহাড় নেই কিন্তু তা সত্তেও এটি অদ্ভুত ভাবে এটি সূক্ষ্ম গেরিলা যুদ্ধ করার মতো দেশ । গ্রেট গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ডেল্টা থেকে যে কোনো সময় পানি ছড়িয়ে পড়ে যখন মৌসুমি বায়ু বয় জুনের প্রথমদিকে। বিশাল জালাধারের উপরে প্রধান সড়কগুলো বাঁধের মতো জেগে থাকে । আমি কেবল শুষ্ক মৌসুমেই ছিলাম, কিন্তু আমি দেখেছি গ্রীষ্মের সূর্যের মধ্যে নৌকাগুলোর ডুবিয়ে রাখা নাক যা ইঙ্গিত দেয় বৃষ্টি শুরু হলে এগুলোই চলাচলের একমাত্র উপায় । যুদ্ধের উষ্কানি দেয়ার ফলে ইহায়হিয়া যে অপরাধ করেছে তা হয়তো এখন নয় ,তবে কিছু সময় পরে তার জন্য আতঙ্কের কারন হবে । আমরা কঙ্গো ও বিফ্রফার কাছ থেকে জানি যে ক্ষুদ্র জীবনযাত্রার সাথে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বীজ বপনের সম্পর্ক এবং শস্য বপন , বিপনন ও ক্রয়ের কোন ঝামেলার ফলে কোন দেশ দুর্ভিক্ষের তলদেশে নিমজ্জিত হতে পারে । গত বছর টাইফুনে যেখানে রয়েল নেভী ছুটে গিয়েছিলো এবং সেখানে প্রায় ২০০০ জন মৃত্যুবরণ করেছিলো । একটি যুদ্ধ লক্ষ লোকের প্রান নিতে পারে । একটি ক্ষুধার্ত শিশু এর ফল কম ভোগ না কারণ সেও নিরাপদ নয় কারন যুদ্ধের শেষে তার দেশের সম্পদ্গুলোর সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা হয়না ।
শিরোনামঃ | সূত্রঃ | তারিখঃ |
১৩৬। পূর্ব পাকিস্তানে হত্যালীলা
|
টাইমস
|
৩ এপ্রিল, ১৯৭১
|
অনুবাদঃ মোঃ রাশেদ হাসান
<১৪,১৩৬, ৩২৯-৩৩০>
দ্যা টাইমস লন্ডন, এপ্রিল ৩, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব পাকিস্তানে হত্যালীলা
পূর্ব পাকিস্তান থেকে যত বেশী খবর সংগ্রহ করা হচ্ছে, তত বেশী তা আতংকজনক হয়ে উঠছে। নির্লজ্য হত্যাকাণ্ড ঐতিহাসিক নিষ্ঠুরতা এবং মৃত মানুষের স্তূপের মাঝে দিয়ে স্রোতেরমত ভেসে বেড়ানো কতটা নির্মম হতে পারে। দূরে থেকেও একজন এসব অনুধাবন করতে পারেন যদিও প্রচার হওয়া কিছু ঘটনার বিষয়ে পাকিস্তান সরকার আপত্তি জানিয়েছে।
প্রথম দিকে পাকিস্তানি আর্মিকে যখন শৃঙ্খলা রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয় তখন বলা যায় তাদের হাতে একটা সুযোগ ছিল। যখন নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোন খবর পাওয়া যায়না তখন অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া খবর প্রকাশের লোভ সামলানো কোঠিন। এবং যখন পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম, ব্রডকাস্ট এবং সংবাদপত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম হয়ে ওঠে তখন আপত্তি আরও জোরদার হয়। প্রথম দিকে গুলি করে হত্যা করা মানুষের সংখ্যা যেকারও গণনা বা কল্পনার থেকে বেশী ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে আলোচনা চলা কালে ঐক্যবদ্ধ পূর্ব বাংলার আশাছিল, কিন্তু অস্ত্রের ব্যাবহারে তা এখন যুদ্ধের দারে গিয়ে পৌছেছে যেখানে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকেনা।
এখন এ অবস্থার ছবিটা আরও বেশী পরিষ্কার এবং অনেক বেশী অসস্তিকর। ঢাকা থেকে এবং অন্যান্য বড় শহর গুলো থেকে যথেষ্ট পরিমাণ প্রত্যক্ষ রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, যা ঘোটছে তা ধারণার থেকেও অনেক বেশী মর্মান্তিক। পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক বাহিনীর সাথে স্বাধীনতার জন্য এখন যুদ্ধ করছে। প্রাপ্ত খবর গুলো থেকে যে ছবিটি ফুটে উঠছে তা শুধু ভারত ভাগের সময় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার হত্যাযজ্ঞের সাথেই মেলানো সম্ভব। আগুনের স্ফুলিঙ্গ একেরপর এক জ্বলে উঠছে। এখানে হত্যা হচ্ছে তো ওখানে প্রতিশোধের আগুণ জ্বলে উঠছে। এবং যখন একপক্ষে শৃঙ্খলা রক্ষার বাহিনী, মিলিটারি অথবা পুলিশ থাকে অথবা যারা অপর পক্ষের ঘৃণার বস্তু হয়ে ওঠে তখন ভয় এবং হত্যা মহামারী আকারে দেখা দেয়। এসবের পরেও কিছু দিক বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তানে চলমান হত্যাযজ্ঞকে নিকৃষ্টতম বলতে হবে। হিন্দু এবং মুসলমানেরা সব সময় আলাদা আলাদা কমিউনিটিতে বাস করত, কারণ তারা একে অপরের থেকে ভিন্ন বলে বিবেচন করে। তাদের মাঝে সংঘাত শুরু হওয়া নতুন কিছু ছিলনা, হিন্দুরা যারাকিনা বর্তমান হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে তারা ছাড়া পাঞ্জাবী বা বাঙালির মাঝে ধর্মিয় অনুভূতিতে কোন পার্থক্য নেই। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেখানে এখন ভয় আর উত্তেজনার ভিত্তিতে পার্থক্য করা যাবে। সুতরাং কোন পশ্চিম পাকিস্তানী বাঙালিদের মাঝে এখন মারা পড়তে পারে। প্রতিশোধের আগুণ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং কেউ জানেনা সে কখন এর শিকারে পরিণত হতে পারে।
এই অবস্থার জন্য পাকিস্তানী আর্মির উপর শৃঙ্খলা পুনর্বহালের নির্দেশকে কতটা দায়ী করা উচিৎ? ধারণা করা যাচ্ছে যে, এমন ভাবে নির্দেশ পালন করা হয়েছিল যেন তা সুপরিকল্পিত ভাবে সকল পক্ষের মাঝে ভয় এবং ঘৃণার জন্ম দেয়।
প্রাপ্ত প্রমাণাদি থেকে যে কেউ এই সিধান্তে উপনীত হতে পারবেন যে, লক্ষ্য ছিল আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব সমূলে ধ্বংস করার, যেন কোন কার্যকরি নেতৃত্ব বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর কতজন অনুসারীকে হত্যা করা হয়েছে তা বলা অসম্ভব। ধারণা করা যায়, ঢাকাতে ছাত্রদের গণহত্যা করা হয়েছে গেরিলা অপারেশনের সম্ভাব্য অর্গানাইজার হিসেবে। কেউ যদি এখন এই অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করে, অন্তত গণহত্যার বিস্তৃতি কমাতে, যে সকল নেতারা বাঙালিদের দিকের অবস্থা মডারেট করতে পারতেন তারা এখন সংখ্যায় অপ্রতুল হবেন। এতকিছুর পরেও পাকিস্তান রেডিও থেকে বারবার বলা হচ্ছে সব কিছু স্বাভাবিক আছে এবং সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে আছে। এমন কিছুই তারা বলছে না বা করছেনা যা শ্বাসরুদ্ধকর-ভীতিকর অবস্থা বন্ধে সহায়ক হবে। এই চলমান গণহত্যা এবং বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলতে দেওয়ার মত খারাপ আর কিছু হতে পারেনা।
পাকিস্তান সরকারের প্রচারণা মতে, ঢাকা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং সিভিল সার্ভিসের কর্মচারিরা কাজে যোগ দিচ্ছেন, দোকানপাট খুলছে এবং স্বাভাবিক জীবন যাত্রা পূণর্বহাল হচ্ছে, আসা করা হচ্ছে আর কিছু দিনের মাঝে পূর্ব বাংলার জনবহুল এলাকা গুলো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। অথচ পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট সমূহ বলছে, পাকিস্তান আর্মির পক্ষে প্রধান শহর গুলোছাড়া এমন অবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট লোকবল নেই। এছাড়া জনপ্রিয় মুক্তিবাহিনী গ্রাম গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে, শহর এবং গ্রামের মাঝের বিস্তির্ণ এলাকা অঘোষিত নো ম্যান্স ল্যান্ড হয়ে যাবে। এটা হয়ত কোন রকমের একটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থা হবে। কিন্তু এমন অবস্থার ভবিষ্যৎ কি হবে? গতবছরের নির্বাচনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কার্যক্রম তাকে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য করে তোলেনি। অবশ্যই কোন এক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সংলাপ পুনরায় শুরু করতেই হবে। গত কিছুদিনের ভীতিকর অবস্থা বিবেচনায় এটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৭। অস্ত্রের মুখে একতা | ইকনমিস্ট | ২ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৩৭, ৩৩১–৩৩৩>
দি উইকলি ইকনমিস্ট লন্ডন, ৩ এপ্রিল, ১৯৭১
অস্ত্রের মুখে একতা
পূর্ব পাকিস্তানের শেখ মুজিব কে আজ পরাজিত মনে হচ্ছে, কিন্তু তার থেকে বড় কথা হল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে বেসামরিক যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে তা সে জিততে পারবেনা।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উন্মত্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি শেখ মুজিবর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অচলাবস্থা ভাঙাকে বেঁছে নিয়েছেন। কেউ চিন্তা করেনি তিনি এটা করার সাহস করবেন এবং তাতে কোনভাবে বিজয়ী হবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর জোরালো ও রক্তাত্ত কর্তৃত্ব গ্রহণে উপরের হাত আছে। বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে যাদের সেনারা বহিষ্কারে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে দ্রুত সময়ে ঢাকায় সেনা নিয়ন্ত্রনের দাবি সঠিক ছিল। এবং একটি দীর্ঘ যুদ্ধের পরে চিটাগাং মেইন পোর্টের ব্যাপারেও হয়ত একই ঘটনা সত্য হবে। সেখানে আর কতটুকু প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে সে ব্যাপারটি এখনো পরিস্কার নয়। সেনারা আপাত জয়ে তাড়িত হয়ে আকস্মিক ভাবে কিছু সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করেছে সেই সাথে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সংগঠনের অগোছালো অবস্থার মধ্যে গোলাগুলি করেছে।
সে হয়ত প্রধান শহরকে ঠাণ্ডা করেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ধ্বংস করেছে এবং অনেক বাঙ্গালিকে আতঙ্কগ্রস্থ করেছে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সমস্যার কেবল শুরু। তাকে গ্রামাঞ্চলের পুলিশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানের বেশীরভাগ এলাকাই অসংখ্য জলপথ দ্বারা বেষ্টিত, এ ধরণের ভূখণ্ড প্রাত্যাহিক সৈন্যদের জন্য অসুবিধাকর হলেও গেরিলা যোদ্ধাদের প্রিয়।
পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বাংলার মত পূর্ব বাংলারও চাষি বিপ্লবীর প্রচারক অংশ রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ মুজিবর রহমান আলাপালচনার মাধ্যমে শায়ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি ধরে রাখছে ততক্ষন পর্যন্ত তারা হয়ত শেখ মুজিবের ছায়াতলে চুপ থাকবে। কিন্তু সেই সাথে সেনারা যে রক্তক্ষয়ী যুক্তির সাথে এগোচ্ছে যে জুলুমকে শুধু জুলুম দিয়েই মেটাতে হবে তা হয়ত অকাট্য রয়ে যাবে। সম্ভবত এর সংখ্যা শুধু বাড়বে। সেই সাথে মে ও জুনে বর্ষার আগমনের সাথে সাথে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানির লেভেলও বাড়বে যা যে কোন সেনাবাহিনীর জন্যই দুর্গম কিন্তু স্থানীয়দের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে। গেরিলারা সক্রিয় হয়ে উঠবে এতে কোন সন্দেহ নেই কারন সেনারা তাদের অনেক নেতাকে হত্যা করেছে। কিন্তু পূর্ব প্রদেশের ৭০,০০০ সেনাবাহিনীর অধিকাংশকে ঘিরে ধরার জন্য একটি অসংগঠিত প্রতিরক্ষার ছড়িয়ে পড়াটা যথেষ্ট। এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লজিস্টিক সাপ্লাই ও অতিরিক্ত শক্তি পেতে সমস্যা হবে।
গেরিলা কর্মকাণ্ডের হুমকির পাশাপাশি আরো সমস্যা রয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার। তাকে প্রদেশের জীবন পেতে হবে, যা খুবই ধীর গতিতে আবর্তিত হচ্ছে এবং এর তিক্ত বিরক্ত জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা শাসনের আচ্ছাদনে আনতে হবে। এই তিক্ততার সাথে বেসামরিকদের প্রতি সেনাদের অবজ্ঞাও মিশ্রিত হয়েছে। অবশ্যই কিছু বাঙালি পাওয়া যাবে যারা সেনাশাসন মেনে নেবে কিন্তু বেশীরভাগই এর বিপক্ষে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হয়ত পাঞ্জাবিদের নিয়ে আসবে বেসামরিক চাকরি পরিচালনার জন্য এবং সেনাদের দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় কাজ করাবে। কিন্তু সে কোন গ্যারান্টি দিতে পারবেনা যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাতে চুপ থাকবে। এটা সম্ভবত হবে। কিন্তু সংখ্যালঘু বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ইতিমধ্যেই শেখ মুজিবের প্রদেশের সায়ত্তশাসনের ধারনায় সমর্থন দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে সম্ভবত সামরিক শাসন চলতে থাকবে এবং মিঃ ভুট্টো হয়ত এইসব পরিস্থিতে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন যা তাকে যেকোন মাপের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখবে।
যে বক্তব্যে শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেই একই বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, তার উদ্দেশ্য একই আছে- ‘অবস্থা অনুমতি দিলে’ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির উপরে ক্ষমতা স্থানান্তরিত হবে। কিন্তু এই অনুমতি কবে মিলবে? এবং পূর্ব পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত প্রতিনিধিই বা কে হবে? যদি শেখ মুজিবের কথা ওঠে তাহলে প্রেসিডেন্ট হয় তার সাথে আপোষে যাওয়ার আশা করতে পারে অথবা তাকে নতুন নির্বাচন করতে হবে। সায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতার টিকেট ছাড়া এবং কোনরকম নির্বাচন কারচুপি ছাড়া এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে কাউকে ভোট জিততে দেখা কষ্টকর। এতে করে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যদি পাকিস্তানের একতা ও সততার ব্যাপারে তার বর্তমান উক্তি না পাল্টায় তাহলে সে সেই দপ্তর কখনোই ছাড়তে পারবেনা যা সে মনেপ্রাণে ছাড়তে চায়।
আশা করা যায় একটি কঠোর সেনাশাসন জারি করে পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা করে সেই অবস্থায় নেয়া সম্ভব যেখানে প্রাদেশিক সায়ত্তশাসনের আলোচনা আবার শুরু করা যাবে। এই আশা নির্ভর করে আপনি কতখানি বিশ্বাস করেন তার উপর যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় বিশ্বাসের সাথেই আলোচনায় বসেছে নাকি সেনাবাহিনী তৈরি করার জন্য সময় কিনেছে। তার দুটোই করার প্রমাণ আছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যদি মনে না করেন, আলোচনা সবকিছু ঠিক করে দেবে তাহলে তার সাথে অমতে যাওয়া কষ্টকর হবে। শেখ মুজিবের জাতীয় সমাবেশে যোগদানের অবস্থা নিয়েই শুধু আলোচনা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শেখ মুজিবের ছয়-দফা দাবির আসল বিষয় নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। এই ছয়-দফা অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবকে আজ অথবা কাল আলাদা করবে। ভারতের সাথে বিদেশি বানিজ্যের নিয়ন্ত্রণ পূর্ব পাকিস্তানে যেতে পারে যার প্রধান গুণই হচ্ছে স্বাধীন বানিজ্য নীতি। শেখ মুজিবের স্বায়ত্তশাসন চাহিদার কোন অর্ধেক পথ নেই। সুতারাং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে একমত হওয়া কঠিন নয়, আলোচনার মাধ্যমে হয় শেখ মুজিবের দাবীই সবকিছুর সমাধান অথবা কোন সমাধানই নেই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সমাধানহীনতাকেই বেঁছে নিয়েছেন।
বাঙালি সহ্যের বাঁধ সেনারা সহজেই ভেঙ্গে দিতে পারে, এটাও একটা কারন বাইরের কেউ বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে অসম্মতি জানাতে পারে। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে গেরিলারা লক্ষণীয় সাহায্য পাবে। বুধবারে ভারতীয় সংসদে মিসেস গান্ধীর পরিচালনায় পূর্ব পাকিস্তানে জোর প্রয়োগের নিন্দা করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পূর্ব পাকিস্তানি “মুক্তি যোদ্ধাদের” পশ্চিম বাংলা ইতিমধ্যেই অস্ত্র ও আশ্রয় প্রদান করেছে, এর থেকে অধিক আগানোয় মিসেস গান্ধীর উপর চাপ রয়েছে। কিন্তু সরকারি সহযোগিতায় প্রকাশ্যে মিসেস গান্ধী ভারতীয়দের সতর্ক করে বলেন, “একটি ভুল পদক্ষেপ বা একটি ভুল শব্দ আমরা যা করতে চেয়েছি তার পুরো অর্থকে বদলে দিতে পারে”। কাজ ও কথার ব্যাপারে তার সচেতন থাকা উচিত। ভারতের সম্পৃক্ততা সন্দেহ করা হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালীদের প্রতি আরো কঠোর হয়ে পড়বে।
এতে কোন সন্দেহ নেই পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার গেরিলা সহযোগিতার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে মিসেস গান্ধী ভয় পাচ্ছেন। হিন্দু-মুসলিম এর জায়গায় যদি মাওবাদি ধারনা এসে পড়ে তাহলে তা পুরো যুক্ত বাংলার ভীত নড়িয়ে দিতে পারে এমনকি ভারতের স্বাধীনতাকেও। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভারতীয় ৯০০ মাইলের সীমান্ত সিল করে দেওয়াটাও মিসেস গান্ধীর জন্য কষ্টকর; এবং বেসরকারি ভারতীয় সমর্থন পূর্ব পাকিস্তানি গেরিলাদের সাথে ক্লাসিক গেরিলা পদ্ধতি তৈরি করে ভারতীয় পশ্চাদভূমিকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করতে পারে।
আশ্চর্যজনক নয়, এই সঙ্কটাবস্থায় পিকিং থেকে কোন কথা নেই। সিদ্ধান্ত নিতে চাইনিজরা মনে হয় খুব কঠিন সময় পার করছে। একদিকে তারা কাশ্মির দখলে সেনা প্রস্তুতে সাহায্য করেছে, যে পন্থায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তারা উষ্ণ প্রশংসা পেয়েছে বিশেষ করে মিঃ ভুট্টোর কাছ থেকে। চাইনিজদের পশিম পাকিস্তানের সাথে কাছের লিঙ্ক রয়েছে হিমালয়ের মধ্য দিয়ে যা সম্প্রতি খোলা হয়েছে এবং সেটা বজায় রাখায় তাদের কৌশলগত আগ্রহ আছে, এই এলাকায় সবচেয়ে অনুকূল অবস্থা পাবার জন্য, যেখানে চারটি দেশ এক হয়েছে। অন্যদিকে, বাঙালি বিদ্রোহ “স্বাধীনতা যুদ্ধে” পরিণত হতে পারে যা পিকিং সাধারনত সমর্থন যুগিয়ে আসছে। অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলা প্রচারণায় মাওবাদী একটি বড় ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। কিন্তু চাইনিজদের বাঙালি সমর্থন মানে একটি আন্দোলনকে সমর্থন করা যেটা ভারতের সাথে তাদের কাছের সম্পর্ক তৈরি করবে যা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে চায়নার বিশেষ সম্পর্ককে বিপন্ন করতে পারে।
এই মুহূর্তে পিকিং জাতীয় স্বার্থ ও ভাবাদর্শগত স্বার্থের মধ্যকার পছন্দের মুখোমুখি হয়েছে। পুরো বিষয়টিকে উপেক্ষা করলে চায়না উভয়সঙ্কটে পড়তে পারে। আরো কষ্টসাধ্য হবে যদি বাঙালীদের কাছ থেকে সাহায্যের কল আসে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাইরের সাহায্য শুধুমাত্র একটি বেসামরিক রক্তাত্ত যুদ্ধকে টানতে সাহায্য করবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতিশীল বিদেশি সহানুভূতিশীলেরা তাদেরকে একটি ভালো পরামর্শ দিতে পারে যে, তার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কে তাড়া দিতে পারে একটি অমীমাংসিত গেরিলা যুদ্ধে পড়ার আগে বাঙালির সাথে আলোচনা পুনরায় আরম্ভ করার প্রস্তাব করতে।
শিরোনামঃ | সূত্রঃ | তারিখঃ |
১৩৮। পাকিস্তানের রক্তাক্ত পথ | টেলিগ্রাফ | ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৩৮, ৩৩৪>
দ্যা টেলিগ্রাফ, ৪ এপ্রিল, ১৯৭১
পাকিস্তান’স পাথ টু ব্লডশেড
পৈশাচিক দক্ষতার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মি গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংগ্রামকে নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে যারা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চায়েছিল। পাকিস্তানী জেনারেল এবং কলোনিয়ালদের গত দুই বছরের নিবিড় পরিকল্পনার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে। তাদের অনেকেই বৃটিশ আমলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং অনেকেই বাহ্যিক ভাবে বৃটিশদের থেকেও বেশী বৃটিশ হলেও মেধা ও মননে বৃটিশ হতে পারেনি।
এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পাকিস্তানের কট্টর সমাজ ব্যাবস্থার এলিট শ্রেণী এবং সামরিক নেতৃত্বের কেদ্রিয় নিয়ন্ত্রক যারা গত দুই বছরে আগে আর্মি কমান্ডার ইন চীফ জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে জোরপূর্বক প্রেসিডেট বানিয়েছিল। ইয়াহিয়ার সূচনা করা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এদের কোন রকম আস্থা ছিলনা।
তারা গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় আস্থা রাখেননি কারণ স্বভাবগত বা পারিবারিক বা বিশ্বাসের দিক থেকে তারা কখনও গণতান্ত্রিক ছিলেন না। তারা ছিলেন দাম্ভিক শাসক, পিতৃপ্রধান এবং অভিজাত শ্রেণী যারা ‘নিম্ন শ্রেণীর’(সাধারণ মানুষের) ঘৃণার পাত্র ছিলেন অনেকটা ১৮শতকের সমাজ ব্যাবস্থার মত।
তারা বিশ্বাস রাখেননি কারণ তারা দেখেছেন কীভাবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সে বছর মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়েছিল। তারা তখন এটা বুঝতে পেরেছিল- যদি এই প্রবল জাতীয়তাবাদী মহিরুহুকে বন্দী করা না যায় তবে অচিরেই তা তাদেরও ঠেলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিবে।
তারা অনুধাবন করেছিল পাকিস্তানের ডমিন্যান্ট গ্রুপ হিসেবে তাদের ভবিষ্যৎ অচিরেই হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে, গতমাসের আরেক গণঅভ্যুত্থান বা শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে (যা কখনও সম্ভব হয়নি)।
তাদের কাছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং তার সিভিলিয়ান ক্যাবিনেটের গঠনকরা প্রক্রিয়া মূলত পাকিস্তানের প্রকৃত খমতার কাঠামো ঢেকে রাখার জন্য একটা ছদ্মবেশ ছাড়া কিছু ছিলনা।
তারা গত ডিসেম্বর নির্বাচনের দিকে একটা অমীমাংসিত ফলাফলের আশায় তাকিয়ে ছিল। সামরিক শাসন দির্ঘায়িত করার এটাই সবথেকে সম্ভাব্য এবং গ্রহণযোগ্য কারণ হতেপারে।
তা না হয়ে, এটা একজন ব্যাক্তি পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পার্টি আওয়ামী লীগকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনেদেয়। ৬ ডিসেম্বরের সেই দিন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট সমাজ এবং জেনারেলরা জানতো যে খমতা টিকিয়ে রাখতে তাদের এখন কি করতে হবে।
এরপর থেকে এটা ছিল শুধু উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা।
যদিও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে সংলাপে বসেছিলেন তবুও নিশ্চিত ভাবেই তিনি সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতির ব্যাপারে জানতেন। ঘটনা প্রবাহের প্রমাণাদির উপর নির্ভর করে চরম বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে নির্দোষ প্রমাণ করা কষ্ট সাধ্য হয়ে যাচ্ছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৯। একটি সাহায্যের আবেদন | দ্যা গার্ডিয়ান | ৪ এপ্রিল ১৯৭১ |
Ashik Uz Zaman
<১৪,১৩৯,৩৩৫–৩৩৭>
দি গার্ডিয়ান সাপ্তাহিকী, ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১
একটি সাহায্যের আবেদন
মার্টিন উললাকট কর্তৃক
দিন কে দিন বাংলাদেশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, এবং এটি একটি মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য, কেননা বিংশ-শতাব্দীর এমন কোনো স্বাধীনতা আন্দোলন খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে যেটির প্রতি সর্বস্তরের জনগণের সর্বসম্মতি রয়েছে বলে দাবী করতে পারে, কিন্তু নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে এতটা অ-প্রস্তুত এবং সাজ-সরঞ্জামহীন অবস্থায় কখনো ছিল।
পূর্ব বঙ্গের অভ্যন্তরে ২০০-মাইল যাত্রার পর, গঙ্গার তীরে অবস্থিত ফরিদপুরে পৌঁছে, যেটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে আনুমানিক ৯০ মাইল দূরে, মূল অনুভূতি হচ্ছে এই যে এই জনগোষ্ঠীর সবধরণের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও দুঃখজনক ভাবে সফল হবার খুব কম সম্ভাবনা নিয়ে, তারা খুব বেশী দেরী হয়ে যাবার আগেই আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছে। এবং সেটা, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বল্প-মেয়াদী সম্ভাবনা সম্পর্কিত, হয়তো প্রকৃতপক্ষে অচিরেই ঘটতে পারে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, যার আনুমানিক শক্তি পাঁচটি ডিভিশনের চেয়ে বেশী, এই মুহূর্তে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশী বাহিনীর দখলে থাকা শহরগুলো উদ্ধার করতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, এবং তারা এই লক্ষ্যে পৌঁছুতে সক্ষম হবে বলে মনে হচ্ছে।
তিন-দিন ব্যাপী সফরে বাংলাদেশের যেখানেই আমি গিয়েছি, সেখানেই আমি একই আবেদন শুনেছি – শহরগুলোর চত্বরে, প্রশাসকদের কার্যালয়ে, ব্যারাকগুলোতে, রাস্তার পাশের ফার্মেসী এবং দোকানগুলোতে; “বিশ্ববাসী আমাদেরকে সাহায্য করছে না কেন?”।
মাগুরাতে, যশোর এবং ফরিদপুরের মাঝখানে অবস্থিত, এক মধ্য-বয়সী আইনজীবী, মিঃ নাসির-উল-ইসলাম, যিনি কার্যত এই এলাকার প্রধান বেসামরিক প্রশাসক হয়ে উঠেছেন, চমৎকার আদর্শলিপিতে একটি দীর্ঘ “স্বাধীনতা প্রেমী মানবতার প্রতি আবেদন” লেখার ব্যপারে জোর দেন, যার শুরুটা এমন “আমরা মানবতার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি আমাদের এই চরমতম বিপদের সময়ে আমাদের সাহাজ্জার্থে এগিয়ে আসতে যখন আমরা, পুরো বাংলাদেশের মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি পাঞ্জাবী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা আমাদের সভ্যতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে যা কিছু করা দরকার তার সবই করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে”।
কয়েকশ মানুষের সামনে, নিজেকে বুজরুক মনে হওয়াতে, আমি সারম্বরে এই লেখাটি আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি।
শিক্ষিত বাঙালীদের ফুলেল ভারতীয় ইংরেজী শুনে প্রাথমিকভাবে মজা পেলেও তা অচিরেই ভুলে যেতে হয় যখন দেখা যায় যে তারা আসলেই কতটা দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। মাগুরার একপ্রান্তে একটি সেতু অতিক্রম করার পর আমাদের দেখা হয় সাদা পোশাকে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলা একদল তরুনের সাথে, .৩০৩ রাইফেল হাতে সশস্ত্র। তারা থেমে দাঁড়ায়, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গর্বে তাদের বুক ফুলে আছে, অনুমোদিত ব্রিটিশ সামরিক কায়দায় তাদের পিঠ খাড়া, এবং তাদের স্যান্ডেল পড়া পা মাটিতে এমন ভাবে ঠুকেছে যা কিনা ভারী বুট পড়া সৈন্যদের জন্য অভিপ্রেত, যাতে করে আমার সাথে থাকা ডেনিশ সাংবাদিক তাদের ছবি তুলতে পারে।
মাগুরাতে অন্তত তাদের অর্ধেক কোম্পানিকে দেয়ার মতো রাইফেল আছে। আরো ভেতরের এক নদী তীরবর্তী শহরে, প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রাক্তন পাকিস্তানী বিমানসেনা আমাকে জানান তাদের চারটি লী এনফিল্ড রাইফেল এবং দুটি নকল রাইফেল আছে।
ঝিনাইদহ এবং যশোরে সম্ভবত মুক্তি “বাহিনী”-এর সবচেয়ে বড় দলটি রয়েছে। এই দলটি সম্ভবত ৭৫০ লোক নিয়ে গঠিত যার মধ্যে মাত্র ২০০ জনের মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য রয়েছে যারা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিল। বাকিরা অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য এবং মুক্তি যোদ্ধা। জোড়াতালি দিয়ে তৈরী করা বাংলাদেশ প্রশাসনে বৈচিত্রের কোন অন্ত নেই। সর্বত্র বিদ্যমান প্রশাসনিক কর্মকর্তারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করেন, এবং কিছু শহরে এখনো তাঁরা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
অন্যান্য শহরগুলোতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি বা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা দায়িত্বে রয়েছেন। ঝিনাইদহতে, এক সেচ প্রকল্পের সদরদপ্তরে, এক প্রাক্তন পুলিশ প্রধান সামরিক অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।
দীর্ঘদেহী, ডোরাকাটা শার্ট পরিহিত সুদর্শন এক পুরুষ, ওয়েবিং বেল্ট এবং কোমরে পিস্তল ঝোলানো, আমি যেদিন ওখানে ছিলাম সেদিনই তিনি যশোর “যুদ্ধক্ষেত্র” থেকে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ফিরে আসেন। “আমরা ওদেরকে ঘিরে ফেলেছি এবং ওরা বের হওয়ার চেষ্টা করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো। একটি ব্যাটালিয়ান সামলানোর মতো ক্ষমতা আমাদের থাকার কথা”, তিনি বলেন।
সন্ধ্যা নামার পর নীরবতায়, একটি প্রতিলিপি মেশিন চলার শব্দ শোনা যায়, যেটি ছেপে চলেছে মজুতদারি বন্ধ করার নির্দেশ, সরকারী এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের তাদের নির্ধারিত পদে ফিরে যাবার আদেশ, সকল ছাত্রদেরকে নিকটবর্তী অধিনায়কের সদরদপ্তরে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কাজে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ। উঠানে একটি লন্ঠন ঘিরে ক্যাপ্টেন মাহবুবুদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর সহকারীরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
“আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতেই হবে, এমনকি সমাজতান্ত্রিক স্বাধীনতা কিন্তু চীনের মতো স্বাধীনতা নয় যেখানে সবার কথা বলার স্বাধীনতা নেই এবং সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত”। আরেকজন বলেনঃ “আমরা যখন পাকিস্তানের অংশ ছিলাম তখন আমরা আমাদের বাঙালী সত্ত্বাকেই ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি জানো, ওরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করেছিল, যিনি কিনা বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ, শুধুমাত্র তিনি হিন্দু বলে”।
নৃশংসতার গল্প বিরতিহীনভাবে প্রচারিত হচ্ছে, এবং ওগুলোর মধ্যে কিছু অবধারিতভাবেই সত্য ঘটনার বিবরণ। ফরিদপুর জেলার স্পোর্টস ক্লাবে, যেটি বর্তমানে শহরটির সামরিক সদরদপ্তরে পরিণত হয়েছে, খুলনার একজন তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে জানান যে “বিনা উস্কানিতে” প্রতিবাদ মিছিলের উপর মেশিন-গান দিয়ে গুলি চালাতে সে নিজে দেখেছে।
কোন সামরিক অফিসারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে করে, সে তাঁর জীপগাড়িতে করে দ্রুত জেলার সামরিক সদরদপ্তরে উপস্থিত হয় এবং পাঞ্জাবী কর্নেলের মুখোমুখি হয়। উক্ত কর্নেল বলে “আমার অভিযোগ ভিত্তিহীন, এবং এরপর যখনই জনগণের উপর গুলি চালানো হবে এই ম্যাজিস্ট্রেট আমিই সবার প্রথমে মারা পড়বো”।
এক তরুণকে আনা হয় যশোরে এক ক্যাথলিক মিশনারির মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করতে কেননা বাঙালীদের মধ্যে এমন এক দুঃখজনক বিশ্বাস রয়েছে যে এধরণের মৃত্যু অনেক মুসলমানের মৃত্যুর চেয়েও বেশী গুরুত্ব বহন করে। উত্তেজিতভাবে, সে বর্ননা করে উক্ত পাদ্রীকে তাঁর মিশনেই গুলি করে হত্যা করা হয়, আরো কয়েকজন স্থানীয় খৃষ্টানদের সাথে, এবং পরবর্তীতে একজন পাঞ্জাবী বিগ্রেডিয়ার সেখানে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, এই বলে যে এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল।
“অন্য আরেকজন পাদ্রী তাকে বলেন এটা কিভাবে দুর্ঘটনা হয় যেখানে মিশনের ছাদে রেড-ক্রস এর চিহ্ন আছে”, এই গল্পে সত্যের সুর রয়েছে।
মৃতের সংখ্যা নিয়ে ফোলানো-ফাঁপানো গল্প গুলো মেনে না নিলেও, এটুকু অনেক বেশী পরিস্কার যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন এগিয়ে আসবে তখন আরো অনেক মানুষ নিহত হবে, এবং তাদের মধ্যে শুধুমাত্র পথরোধ করে থাকা বা রাস্তার পাশের ঝোপের ভেতর নিজেদের তৈরি গর্তে লি এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে ওঁত পেতে থাকা তরুণরাই থাকবে তা নয়।
এবং আগামীকাল যদি যুদ্ধ থেমেও যায় তাহলেও যারা যুদ্ধ করছিল তারা ছাড়াও আরো মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খাবার, পেট্রোল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের সরবরাহ একেবারেই কমে গেছে, এবং পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যঘাত জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
কোলকাতায় রহস্যজনক উদ্দেশ্যে, অস্থায়ী সরকার গঠনের সাথে জড়িত, আগত একদল যুবকের সাথে ফরিদপুর থেকে চুয়াডাঙ্গা ফিরে আসার পথে আমরা পাকিস্তানী বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের অত্যন্ত বাস্তব দৃষ্টান্তের সম্মুখীন হই। একটি ছোট নৌকায় করে গড়াই নদী পার হওয়ার সময় পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর স্যাবর জেট বিমান থেকে আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীর তীরের ইটের স্তূপের পেছনে আড়াল নিতে গিয়ে, আমরা খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারি যে এধরণের আক্রমণের সাথে লি এনফিল্ড রাইফেল নিয়ে কখনই পাল্লা দেয়া যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে, নদী পার হচ্ছে এরকম একটি দেশী নৌকাকে কোনোভাবেই সামরিক লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করা যায় না।
অনেক শহর অর্ধেক খালি হয়ে গেছে এবং গতকাল পাবনা শহরটি দখল হয়ে যাওয়াতে আরো অনেক শরনার্থি কুষ্টিয়া ও কুমারখালির দিকে রাস্তায় নেমে এসেছে। ঢাকার পথে মূল ফেরী পারাপারের মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ফরিদপুর জেলাতেও মূলত যুবকেরা রয়ে গেছে কিছুটা নীতিগত কারণে আর কিছুটা এই জন্যে যে তারা এটা বন্ধ করতে পারেনি। মহিলা, শিশু এবং বয়স্করা শহর ছেড়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা সেখানে নিরাপদে থাকবে কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়।
স্বাধীন এলাকার তুলনামুলক বাস্তববাদী নেতারা আশা করে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার উপর। ফরিদপুরের এক তরুণ হিসাবরক্ষক, যে সাম্প্রতিককালে পাট চাষ না করে তার পরিবর্তে ধান চাষ করার পরিকল্পনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে, আমাকে জানায়ঃ “ওদের অর্থনীতি এই মাত্রার কার্যক্রম ছয় মাস বা এক বছরের বেশী চালিয়ে নিতে পারবে না। ওরা ভুলে গেছে যে ১০ দিনব্যাপী পাক-ভারত যুদ্ধে ওদের অর্থনীতি চুরমার হয়ে গিয়েছিল”।
কিন্তু সেটা করতে হলে, পশ্চিমা দেশগুলোকে পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান করা বন্ধ করতে হবে এবং কাউকে একজন রাষ্ট্রদূতের মতো বা পুর্নক্ষমতা প্রাপ্ত কোনো একজন রাজদুতের মতো নিশ্চিত করতে হবে অন্তত যুক্তরাজ্য যাতে করে সাহায্য প্রদান করা বন্ধ করে।
সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী অনুভূতি হচ্ছে এই যে বাঙালীরা ১৯৪৭ সালে একটি দুঃখজনক ভুল করেছিল যখন তারা পাকিস্তানের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। “আমরা সাম্প্রদায়িকতার আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম”, মাগুরার মিঃ নাসির-উল-ইসলাম বলেন। “আমিও এই ভুল করেছিলাম। আমরা সবাই এই ভুল করেছিলামঃ এখন আমরা এর মূল্য পরিশোধ করছি”। যে মূল্য দিতে হয়েছে তা ইতিমধ্যেই অনেক বেশী, আর যদি না আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা অন্য কোনো অলৌকিক ঘটনায় বাঙালীরা রক্ষা পেয়ে যায়, তাহলে আগামী মাসগুলোতে এই মূল্য আরো বেশী দিতে হবে।
শিরোনাম | সুত্রঃ | তাংঃ |
ক্ষমতার সীমানা
|
দ্যা টাইমস, লন্ডন
|
এপ্রিল ১০, ১৯৭১
|
<১৪, ১৪১, ৩৩৮–৩৪০>
ক্ষমতার সীমানা
পিটার হেজেলহারস্ট
যশোর, ৯ এপ্রিলঃ এ এমন এক যুদ্ধ যা কারো পক্ষে জেতা সম্ভব নয়। আমার বামে নিজেদের ব্যারাকে আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে এক ডিভিশন সশস্ত্র সৈন্য, আর অন্যদিকে প্রায় ২০০০ মুক্তিযোদ্ধা আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর ৫০০ সদস্য তাদের ঘেরাও করেছে।
আধমাইল দূরে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে ছোড়া একটা শেলের বিস্ফোরনের শব্দ ভেসে আসলো, আরো একটি ঘর পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে।
একজন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বোল্ট একশন রাইফেল থেকে এক রাউন্ড গুলি ছুরলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কিছু হালকা মেশিনগান আর পাকিস্তানীদের কাছে থেকে লুট করা মরটার ও রয়েছে।
আজ সকালে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গোলাগুলি হয়েছে। কিন্তু দুই পক্ষই নিদেজের গোলাবারুদ সংরক্ষনের চেষ্টা করছে, যার ফলে এখন শুধু বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি চলছে।
বাঙ্গালিরা চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। যশোরে সেনাবাহিনীর এই ব্যারাক খুবি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর অবস্থান ভারতীয় সীমানার খুব কাছেই, আর এর মধ্যে অবস্থানকারী পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা সকলেই যথেষ্ট প্রশিক্ষন ও ভারী অস্ত্রসজ্জিত। তাদের সংখ্যাও অনেক। এখন পশ্চিম পাকিস্তানিরাও সচেতন যে আসলে মুখোমুখি হয়েছে ৭.৫ কোটি বাঙ্গালীর। তারা জানে তাদের হাতে সময় খুব কম। যদি সবাই একসাথে পশ্চিমাদের উপর ঝাপিয়ে পরে, তবে তাদের সামনে একটাই পথ খোলা থাকবে। গত সপ্তাহেই তাদের ছোট ছোট দলে ব্যারাক থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যারাকের বাইরে বের হলেই উন্মত্ত জনতা তাদের আক্রমন করছে, হত্যা করছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদের পরিমাণও খুব বেশি না, তারাও আশংকায় আছে, যশোর এয়ারপোর্ট এখনও পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মিদের দখলে আছে, এবং আকাশপথে যদি সাহায্যের জন্য আরো লোক পাঠানো হয়, তবে তারা ত্রিমুখি আক্রমনের সম্মুখীন হবে। কিন্তু এর ফলে আর্মির কোন লাভ হবেনা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হয়ত বড় বড় শহরগুলি নিজের দখল রাখতে পারবেন, কিন্তু গোটা দেশ তিনি কিভাবে নিয়ন্ত্রন করবেন!
এই প্রদেশে বেশ লম্বা সময় ধরে ভ্রমন করে আমার মনে হচ্ছে, পূর্বাংশে এই অঞ্চলকে এখন বৃহত্তর বার্মার অন্তর্গত হিসেবে ছেড়ে দেয়াই হবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য সরবোত্তম পন্থা। সরকারি আদেশ বলবত থাকবে শুধু এ প্রদেশের রাজধানীতে।
ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া নিকটবর্তী ১০০ মাইলের মধ্যে এখন একজন সেনাও বাইরে খুজে পাওয়া যাবেনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায়, সকল বাঙালি এখন এক হয়ে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। সীমান্তের রক্ষী থেকে শুরু করে সাধারন পুলিশ বা জনগন, সকলেই এখন এক হয়ে অস্ত্র ধরছে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন আছে ও তাদের সাথে এক হয়ে এই বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন প্রায় ১৯০০০ বাঙালি। বিদ্রোহ দমনের লক্ষে তারা বিভাগীয় কমিটি গঠন করে কাজ করলেও কেউ জানেনা, প্রেসিডেন্ট কিভাবে বা কখন এমন একজন ব্যক্তিকে খুজে পাবেন যিনি এই দেশ শাসন করতে পারে।
গোটা পুলিশ বাহিনী মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছে। সীমান্ত রক্ষীরা ভারতীয়দের জন্য সীমানা খুলে রেখেছে, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের মতন ব্যাক্তিরাও এখন গ্রামে গ্রামে গেরিলা যুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন।
কিন্তু যদি বড় শহর ও বন্দরগুলোতে সেনাদের দখল থেকে যায়, তবে কল্কারখানাগুলো অচল হয়ে পড়বে, থেমে যাবে অর্থনীতির চাকা, আর অন্যদিকে জালানিসহ প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের অভাবে পড়বে মুক্তিযোদ্ধারা। খাদ্য সরবরাহে সমস্যা থাকার কারনে কিছু শরণার্থী ভারতীয় অঞ্চলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।
চারদিকে ঘেরাও অবস্থায় থাকা যশোর শহরের ২২ মাইল পশ্চিমে বেনাপোল সীমান্ত অবস্থিত, যেখান দিয়ে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে যাওয়া আসা করলেও বাঙ্গালিরা ভ্রুক্ষেপ করেনা। সীমান্ত পার হওয়ার সময় দেখা যায়, যুদ্ধের সাজে সজ্জিত ভারতীয় সেনাদল সীমান্তের নিকটবর্তী অবস্থানে ক্যাম্প করে আছে। তারপর অল্প কিছুক্ষন হাটলেই পূর্ব পাকিস্তান। কখনও কখনও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধারা যশোর যাওয়ার পথে সাংবাদিকদেরও নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের স্টেশন ওয়াগনে চড়ে চাকার কর্কশ আরতনাদ শুনতে শুনতে আমরা যশোর এর দিকে এগিয়ে যাই। একেকটি গাড়িতে উরদিপরা দুইজন সশস্ত্র পাহারাদার অবস্থান করে। কোন গ্রামের পাশ দিয়ে গেলে গ্রামবাসী মুক্তিযদ্ধাদের হাত নেরে শুভেচ্ছা জানায়, কিংবা ‘জয় বাংলা”স্লোগান দেয়। যশোরের ৭ মাইল পশ্চিমে, ঝিকরগাছা গ্রামে এসে গারিটি থামল। জাতীয় আওয়ামী পার্টির লোকেরা শুনেছে যে পাকসেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে এইদিকে আসতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহ মজুদ বিষয়ে তল্লাসি করতে।
যেসকল গ্রামবাসির আছে অস্ত্র নেই, তারা ভিতসন্তস্ত্র হয়ে আছেন। রিকশা করে চালের বস্তা সরিয়ে নেয়া হচ্ছে আরো পশ্চিমে, সীমান্তের কাছাকাছি। সেখান থেকে আমাদের নতুন একটি বাহন দেয়া হল। আমরা যশোরে পৌছলাম একটি জিপে করে। রাস্তা থেকে মিলিটারি হটিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের বামে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে তারা অবস্থান করছে। শহর থেকে ফিরে আসার পথে আমাদেরকে গত সপ্তাহে আর্মিদের হামলা পরে নিহত বাঙ্গালীদের একটি গনকবর দেখানো হল। কারো পক্ষে মৃতের সংখ্যা আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন সংগঠক, মিঃ কাশি আব্দুল শহিদ আমাদের জানান যে তিনি গত সপ্তাহে পাক বাহিনীর হামলায় প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হতে দেখেছেন। যশোরের অনেক রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন এবং তাদের ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে এ অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ আঘাত হানার পর প্রায় ১৫০০ জন মানুষ হতাহত হয়েছেন বলে তিনি জানান।
একজন আওয়ামী কর্মী একটি পরিত্যাক্ত ঘরের দিকে দেখিয়ে বলল- ৫০০ থেকে ৬০০ ঘরবাড়ি পুরিয়ে দিয়েছে পাকবাহিনী, শেলের আঘাতে ধংস হয়েছে আরও ১০০ ঘরবাড়ি।
উত্তর দিকে অবস্থিত কুষ্টিয়া অঞ্চলে আমাকে দেখানো হল কিছু পাঞ্জাবি সৈন্যদের পচে-গলে যাওয়া লাশ। সেনাদের তিনটি কোম্পানি গত সপ্তাহে এই অঞ্চলে আসার পর প্রায় ৪০,০০০ উন্মত্ত মানুষের আক্রমনের মুখে পরে।
কুষ্টিয়া জেলার আওয়ামী লীগের সংগঠক সচিব জনাব শামসুল আলম দুদু আমাদের বর্ণনা দেন যে কিভাবে সর্বদলীয় লিবারেশন ফ্রন্ট সেনাদের উপর ঝাপিয়ে পরে।
“৩ মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্যরাতে প্রায় ৩০০ পাঞ্জাবি সেনা কুষ্টিয়া শহরে ঘাটি গারে। সাথে সাথেই তারা সকল প্রধান স্থাপনা, টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্তৃত্ব সব নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তারা কাউকে না জানিয়েই কারফিউ জারি করে এবং পরদিন সকাল থেকে নারী পুরুষ নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করতে শুরু করে যেন তারা মানুষ নয় পশুপাখি হত্যা করছে। জনাব দুদুর মতে ঐদিন তারা প্রায় ২০০ মানুষ হত্যা করে। এখানেও অন্য সকল শহরের মত পাকিস্তানি সেনাদের প্রথম টার্গেট ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সৈন্যরা। তারা রাজনীতিবিদ ও উদীয়মান নেতাদের গ্রেফতার করে শহরে এনে বন্দী করে রাখতে শুরু করে।
জনাব দুদু বলেন, তারা সোমবার সকালে পাল্টা আক্রমনের পরিকল্পনা করেন। প্রায় ৩০,০০০ লোক, লাঠি আর পাথর হাতে জেলা স্কুল ঘেরাও করে যেখানে এই ৩০০ সেনাদের ঘাটি ছিল। জেলার প্রায় ৩০০ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর জওয়ান ও আনসার বাহিনীও এই আক্রমনে রাইফেল হাতে যোগ দেয়। পাকিস্তানি সেনারা জনতার উপর কামান ও মর্টার আক্রমন চালায়। কিন্তু প্রায় ২৮ ঘন্টা ধরে গোলাবর্ষণ করার পর তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়।
জনতা স্কুলে প্রবেশ করা মাত্র কিছু সৈন্যকে হাতেনাতে ধরে সেখানেই হত্যা করে। কিছু সেনা রাতের অন্ধকারে সাধারন পোষাকে ঘাটি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও, গ্রামবাসীরা পাঞ্জাবিদের ঠিকই চিনতে পেরে ধরে ফেলে ও তাদের মৃত্যু হয় গণধোলাইয়ে। কিন্তু, এখন অবস্থা অতটাও ভালনা, যতটা লিবারেশন ফ্রন্ট দাবি করছে। জনাব দুদ স্বীকার করেন যে তাদের রসদ ফুরিয়ে আসছে এবং ফ্রন্টের কাছে যথেষ্ট ঔষধ সরবরাহও নেই। কিন্তু, তারচেয়েও গুরুতর বিষয় হচ্ছে, এধরনের প্রতিরোধ এখনও অঞ্চলভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক ভাবেই হচ্ছে, এবং এখনও পর্যন্ত এই লরাইকে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য কোন কেন্দ্রিয় পর্যায়ের নেতা আসেননি। তিনি আরো বলেন- “পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা আর প্রধান শহরগুলো নিয়ন্ত্রন করছে, যার কারনে আমাদের কাছে কেন্দ্রিয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করার মত কোন উপায় নেই’।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪২। পরিকল্পিত হত্যা | সানডে টাইমস | ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৪২, ৩৪১-৩৪৪>
সানডে টাইমস, ১১ এপ্রিল,১৯৭১
হত্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঢাকার পর যশোর, চট্টগ্রাম…
নিকলাস টোমালিনের প্রতিবেদন,
পূর্ব পাকিস্তানের শহর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।
যে সময়ের মাঝে এই কথাগুলো ছাপানো হবে যে “মুক্ত বাংলাদেশ” তার মাঝেই দিনাজপুর শহরটি অব্যশই নিশ্চিতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনী দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে যাবে এবং সার্জেন্ট-মেজর আব্দুর রব যিনি এর প্রধান প্রতিরক্ষক সম্ভবত তিনি এর মাঝে মৃত।
পূর্ব পাকিস্তানের দূরবর্তী প্রদেশ উত্তর-পশ্চিমাঞ্ছলীয় অঞ্চল ছিল বাংলাদেশ প্রতিরোধের কেন্দ্র যা মাত্র ৩৫০ জন স্বল্প-অস্ত্রের সৈন্যদের দ্বারা শহরের চারপাশ খনন করে রেখেছিল। শক্রবার যখন আমি সেস্থান থেকে চলে আসি তখন অধিকাংশ যুদ্ধই অনভিজ্ঞ ছিল এবং তাদের গোলাবারুদের সরবরাহ যা দিনাজপুরের পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের অস্তাগার থেকে এসেছিল তার অর্ধেক ডজন মর্টার শেল, রকেট এবং মেশিনগানের বুলেটের বাক্স প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানী সীমান্তের শক্তিশালী সৈন্যদলের প্রায় কয়েকশত শক্তিশালী সৈন্যদল সৈয়দপুরের নিকটবর্তী এলাকায় ছিল এবং আরও কয়েক শতের বেশি সৈন্যবাহিনী ছিল রংপুরে। তারা প্রচণ্ড ভাবে সশস্ত্র এবং পাক-ভারত যুদ্ধের দ্বারা অভিজ্ঞ ছিল। তাদের কাছে চীনের তৈরি হালকা ট্যাংক ও ছিল। এই ট্যাংকগুলি সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল একটি নির্ধারিত বলপূর্বক প্রবেশের জন্য এবং তা এক ঘণ্টার মাঝেই দিনাজপুরে থাকতে পারে।
সার্জেন্ট-মেজর রব এবং তার বাহিনী কোন ধরনের বিভ্রান্তিতেই ছিল না যে যখন শত্রু আক্রমন হবে তখন কি ঘটতে পারে। তারা ইতিমধ্যে হাই কমান্ড রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার জন্য নির্বিচারে হত্যা, নির্বিচারে ধ্বংস এবং সর্বোপরি সামরিক, নাগরিক এবং বুদ্ধিজীবী নেতাদের হত্যার ঘটনা শুনেছিল। “এটি একটি গণহত্যা হতে পারে”- যা সার্জেন্ট-মেজর বলেছিলেন। এটা হিটলার যা করেছিল তার থেকেও খারাপ কিছু হবে। “এটা ইচ্ছাকৃত গণহত্যা।”
গণহত্যা একটি অতি ব্যবহৃত শব্দ। কিন্তু সুস্পষ্ট সামরিক আদেশের আলোকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদলের পক্ষে আমার স্বতন্ত্র কারনে মনে হয় সার্জেন্ট- মেজর রবের নির্ভুল প্রতিবেদনটি সমর্থনযোগ্য। আমার গত কয়েকদিনের পূর্ব পাকিস্তান পরিদর্শনের আলোকে এটা যথাযথ মনে হয়েছে। সেখান থেকে খুব দ্রুত প্রচুর বাঙ্গালী হত্যা ছাড়া ইয়াহিয়া খানের আর কোন নীতি দেখতে পাওয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য। এবং হত্যার মাধ্যমে পরবর্তী ১৫ বছরের মাঝে বাংলাদেশ সমর্থকারীদের প্রতিরোধ বিলুপ্ত করা হবে। গণহত্যা আমারা আমাদের নিজের চোখেই দেখেছি এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তা প্রমান করার জন্য রেডিও বার্তায় তা প্রদর্শিত হচ্ছে।
শুধু মাত্র একটি রহস্য ছিল কেন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অগ্রগতি ছিল না। যখন আমাদের দুই দিন দিনাজপুরে অবস্থান ছিল তখন সম্মুখ অবস্থান থেকে দুইবার তারা সার্জেন্ট-মেজরকে আক্রমন করে। এবং তারা খুব সহজেই তাদের পুরো প্রতিরক্ষা গুড়িয়ে দিতে পারত কিন্তু তারা তা থেকে প্রতিসংহৃত থাকে।
সম্ভবত তারা তাদের নিজস্ব প্রচারনা বিশ্বাস করে যে ভারতের সেনাবাহিনী এবং তাদের গোলাবারুদ বাঙ্গালীদের রক্ষায় দিনাজপুরে তাদের সাহায্য করছে যা ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরে অবস্থিত।
যদি আমরা সাক্ষী হতে পারি যে তারা অন্যায় করছে। সীমান্তের গাড়ির চাকার দাগযুক্ত লেজ কার্যত নির্জন রয়েছে। অস্বাভাবিক ভাবে বাংলাদেশকে ভারতে যোগদানের দিকে ধাবিত করেছে ডাকের পেট্রোল সংগ্রহের জন্য এবং হয়তবা একটি অথবা দুটি পিস্তল সীমান্তবর্তী শহর সহানুভূতিশীল গঙ্গারামপুর থেকে আসবে। সর্বোপরি এটা একটা ঐতিহ্যগত পাচারকারীদের পথ। স্বাভাবিক সময়ে তা নামমাত্র সুরক্ষিত থাকতো। কিন্তু ভারতের পুলিশ এবং সেনাদলের সতর্ক প্রচারনাময় আক্রমনের চিন্তায় তাই এখন সেখানে মনুষ্যবাহী পোস্ট আছে যে কোন ধরনের আন্দোলন রোধ করার জন্য। বিবিসির পরিদৃশ্য দল এবং আমি সাময়িকভাবে ভারতের সৈন্যদল দ্বারা গ্রেফতার হয়েছিলাম যেখান থেকে আমরা বের হই।
পাকিস্তানী প্রতিবেদ অনুযায়ী ভারতের ছয়টি বিভাগ সীমান্তের জন্য হুমকি স্বরূপ। এইগুলি অর্থহীন এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সীমান্ত বন্ধ করতে অগ্রসর হচ্ছে । সেখান থেকে নামমাত্র কোন সেনাদল অথবা সাংবাদিকের চলাচল হবে।
এদিকে “মুক্ত দিনাজপুর” হল পাকিস্তানের নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে উৎসাহিত হওয়ার স্থান পরিদর্শনের জন্য। আঞ্চলিক বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী হল ১০০ শতাংশ বাংলাদেশের ।এবং যারা পাঞ্জাব অথবা অন্য অ-বাঙ্গালি তারা হয় পলায়ন করেছে অথবা তাদের জবাই করা হয়েছে। এবং অসদৃশ দক্ষিণের যশোর যা আমরা ১০দিন আগে পরিদর্শন করেছি। দিনাজপুর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সংগঠিত। নতুন পাওয়া পাওয়া দেশপ্রেম এবং সামরিক উদ্দিপনা যা বাঙ্গালীর চরিত্রগত ঐতিহ্যবাহী মশলা যা হলো সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী।
৬০০০০ অধিবাসী যারা তাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম ছেড়ে এসেছে, তারা শান্ত। সেখানে সকল ব্যাংক এবং প্রায় অর্ধেক দোকান স্বাভাবিক ভাবে কাজ করছে, মানুষ রেশন বইয়ের জন্য সু শৃঙ্খল লাইন ধরছে ( যদিও দিনাজপুরের বিতরণ এলাকা হলো ধানের কেন্দ্র যেখানে এখনো খাবারের অভাব দেখা দেয়নি) যা কঠোর নিষ্প্রদীপ আইন দ্বারা পরিচালনা করা হচ্ছে।
সার্জেন্ট – মেজর রবের অধীনে তরুন লোকটি লোকাল স্টেডিয়ামে দৈনিক অন্যান্য সামরিক নেতাদের সঠিক ভাবে বালুময় বনানীতে আচ্ছাদিত রাইফেল এবং চীনে তৈরি স্টেনগান দ্বারা অনুশীলন করাচ্ছে। মার্চের জন্য ইতস্তত সামরিক কণ্ঠে উৎসাহিত করছে যাতে তাদের একদম সৈনিকের মতো লাগে- মাথা উচু, চিবুক ভিতরে এবং বুক সম্মুখে এগিয়ে তারা নতুন নির্মিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত প্রফুল্লতার সাথে সমর্থনের জন্য গাচ্ছে এবং এমনকি বৃহৎ সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মিটিং ধরে রাখা হয়েছে তাদের পুরো উত্তর পশ্চিমীয় অঞ্চল কে বলা হচ্ছে তারা কোন ধরনের চাপে যুদ্ধ করচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের এই অংশটি ঐতিহ্যগতভাবে বামপন্থি মূলস্থ নেতা মাওলানা ভাসানী দ্বারা প্রভাবিত যে কার্যতই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান কমিউনিস্ট নেতা শেখ মুজিবকে অদ্ভুত অবস্থায় ধরে রেখেছিল। কিন্তু আজ রাজনৈতিক ঐক্য আশ্চর্যজনকভাবে নয় বরং সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ।
দুই সপ্তাহ আগে যখন পাকিস্তানী গৃহ যুদ্ধ শুরু হয় দিনাজপুর সে সময় খুবই ভিন্ন অবস্তায় ছিল। শহরটির সৈন্য সরবরাহকৃত এবং নিয়ন্ত্রিত ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তের শক্তিশালী রেজিমেন্ট চাঙ্গা হয় পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলসের পাঞ্জাবী অফিসার দ্বারা।
যে দিন ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ঢাকা আক্রমন করে- ২৫শে মার্চ, বৃহস্পতিবার ঐ দিন স্থানীয় সৈন্যরা শহরটিতে আধিপত্য করার জন্য পদক্ষেপ নেয়। পদক্ষেপটি পরিস্কারভাবেই পরিকল্পিত ছিল দেশব্যাপি সামরিক অভ্যুথান সমশ্রেণী ভুক্ত করার জন্য।
প্রথমে পদক্ষেপটি কৌতুকপ্রদ ভাবে যথেষ্ট যা একটি দলের আমন্ত্রন ছিল। পাঞ্জাবী কমান্ডিং অফিসার বিনীতভাবে দিনাজপুরের বাঙ্গালী সৈন্যবাহিনীকে তাদের ঐতিহ্যগত কথক এবং লুথি নৃত্য দেখার জন্য অসামরিক পোশাকে আসার জন্য আমন্ত্রন করেছিল।
কিন্তু সার্জেন্ট- মেজর রব, বাঙ্গালী ফোরসের সিনিয়র কর্মকর্তা হঠাৎ খেয়াল করেন সহকর্মী অতিথিরা সশস্ত্র হয়ে এসেছে। এটা পরিস্কার ভাবেই সকল স্থানীয় বাঙ্গালী সৈন্যদের হত্যা অথবা গ্রেফতার করার পরিকল্পনা ছিল। আমন্ত্রণটি বিনীত ভাবে অস্বীকার করে বলা হয়েছিল যে পাঞ্জাবী সৈন্যরা দর্শকবৃন্দ ছাড়াই নেচেছিল।
সেই রাতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা দিনাজপুরের রাস্তার মাঝে দিয়ে ধাবিত হয়েছিল। তারা সতর্কতার সাথে সামরিক যোগাযোগ ব্যতীত শহরের গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন আদান প্রদান বিচ্ছিন্ন করে। আর গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় বাঙ্গালী নেতাদের পরিদর্শন করে এবং তাদের বলা হয়ে ছিল তাদের গুলি অথবা কারারুদ্ধ করতে। দুই দিন যাবত সেখানে স্নায়ুবিক সন্ধি ছিল। উভয় পক্ষই অর্থাৎ পাঞ্জাবী অফিসার এবং সৈন্যরা তাদের বন্ধুভাবাপন্নতা রণকৌশলের সাথে ধরে রেখেছিল।“যদি আমি পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেল তুলে না ধরতাম তুমি হয়ত আমাকে মেরে ফেলতে পারতে।” বলেন কমান্ডিং অফিসার লেফটানেন্ত কর্নেল তারেক কোরেশী এবং পরবর্তীতে প্রকৃত পক্ষেই তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েহিল।
২৭শে মার্চ, শনিবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ঢাকার গণহত্যার কানাঘুষো ছড়িয়ে পরলে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ঘাবড়ে ব্যারাকে পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেল তুলে ধরেছিল এবং কমান্ডিং অফিসারদের বাসভবনের তালিকা করেছিল। সার্কিট হাউজ যেখানে পুরনো দিনের রাজ বিচারকের আবাসস্থল ছিল সেখানে তারা পরিখা খনন করে এবং রাইফেল ব্যারেকে তাদের বন্দুক সারিবদ্ধ করে। যার ফলে বাঙ্গালিরা প্রথমে আঘাত করে এবং পরবর্তী তিন দিন প্রচণ্ড ক্রোধে যুদ্ধ হয়েছিল। উভয় পক্ষ থেকেই গোলাগুলি শহরের মাঝে পরছিল যার ফলে অনেকে হতাহত হয়েছিল।
সার্জেন্ট- মেজর রব তার বাহিনীকে হুকুম করতে পারেননি কারন তিনি তার বাড়িতে দাবানলের মাঝে গ্রেফতার ছিলেন। রবিবার ছয়জন রাইফেলধারী সৈনিক ব্যারেকে হানা দেয় এবং প্রতিরক্ষামূলক তোপের মাঝে তিনি তাদের সাথে পিছিয়ে যান। বিশেষ সৌভাগ্যের সাথে তা ঘটেছিল যে এই রাইফেল ইউনিট যদিও তা শুধুমাত্র একটি পুলিশ বাহিনী যাদের মাঝে তিনজন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সৈন্য রয়েছিল। আব্দুর রব হলো তাদের মাঝে একজন এবং বাকি দুইজন অত্যন্ত দক্ষ কামান চালনাকারী।
দুই দিনের জন্য তাদের গুলি বর্ষণ সার্কিট হাউজে দৃঢ়ভাব অবতরণ করে। অবশেষে পাঞ্জাবীদের তেজের সাথে আঘাত করে। তারা প্রথমে পার্শ্ববর্তী বাঙ্গালী কমিশনারের বাড়িতে পলায়ন করে। “যদি তোমার বন্ধুরা আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করে তাহলে তা বাঙ্গালিদেরও হত্যা করবে।”
তারপর তাদের আতঙ্কের মাঝে তারা হঠাৎ করে সিধান্ত নিয়েছিল যে গোলাগুলি শুধুমাত্র বাঙ্গালী পুলিশ থেকে আসতে পারে না। ডেপুটি কমিশনার আহমেদ বলেন, “তারা আমাকে বলেছিল যে তারা জানে অব্যশই তারা ভারতীয় সৈন্যবাহিনী দ্বারা বেষ্টিত। যা কিনা তারা চিন্তা করেছিল সীমান্ত অতিক্রান্ত হস্তক্ষেপ হিসাবে। তারপর তারা নিজেদের সেনাপতিকে গুলি করে যে বাঙ্গালী ছিল এবং তারপর সৈয়দপুর শহর থেকে তারা পশ্চাদপদ হয়।
সুতরাং, ৩৫ পূর্ব পাকিস্তানী রাইফেলসের একটি শক্তি দিনাজপুর শহরে পাঞ্জাবীদেরকে পরবর্তী ১০ দিনের জন্য দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রনে রেখেছিল। তথ্য অনুযায়ী তা বাঙ্গালীর অধীনে রয়েছে। আমরা তাই অসতর্ক সীমান্ত পার হয়ে গত বুধবার তা পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। এমনকি তারপরও শহরটি একটি মিশ্র আবহাওয়ায় স্বাধীনতা উদযাপন করছিল কিন্তু এর সাথে দুর্যোগের আশঙ্কাও করছিল। সার্জেন্ট- মেজর রব যিনি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিরক্ষা শক্তির সেনাপতি তিনি পরিসীমার লাইনের মাঝে সর্বোত্তম পাহারা নির্গত করেছিলেন।
এতদূর পর্যন্ত স্থানীয় পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী কাপুরুষের মতো অভিনয় করেছে কিন্তু গত সপ্তাহে তারা তাদের ট্যাংক সম্মুখে অগ্রসর করে। তারা অব্যশই শহরটিতে ধ্বংসের জন্য ফিরে আসছে। আমরা দেখেছিলাম অর্ধ ডজন র্যাব সৈন্য “দশ মাইল জংশন” এ বিস্তার করেছিল যেখানে সৈয়দপুর রোডে। দিনাজপুরের উত্তর দিক থেকে সৈয়দপুর রোডে মিলিত হচ্ছিল। যা শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত। তাদের একটি বিরোধী ট্যাংক বন্দুক ছিল ( তাদের অবশিষ্ট শেষ কামান ) দুইটি রকেট চালিত গ্রেনেড লঞ্ছাচার এবং চারজন রাইফেল চালক।
শরণার্থীরা তাদের সাথে ছাগল এবং বাছুরকে সাথে নিয়ে কদমের চালে চালে পিছনে ফেলে চলছে এবং মাথায় অতীতের সকল বাস্প সাথে নিয়ে যাত্রা করেছে। তারা বলে যে পাঞ্জাবিরা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। সব শস্য ধ্বংস করেছে, পাইকারি হারে লুটপাট করেছে এবং ধর্ষণ করেছে। যদিও গৃহ যুদ্ধের মাঝে এমনকি সব যুদ্ধের মাঝেই অবিরত অতিরঞ্জন থাকে। তারা তাদের দণ্ডের হিসাব বহন করছে। সৈন্যরা শান্ত, নিঃশব্দ এবং দুঃখিত ছিল। তারা জানত তারা শুধুমাত্র সেখানে স্বল্প সময়ের জন্য জয়ী।
তারপর আমরা অন্য একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান পরিদর্শন করি যা গভীর বাঁশের উপবনের মাঝে অবস্থিত। এখানে সৈন্যরা অনন্য উজ্জ্বল এবং অনেক আশাবাদী ছিল। স্থানীয় জনগন বিশাল বালতিতে চাল নিয়ে এসেছিল। “ডাল” এবং পপাদম সৈন্যদের জন্য দুপুরের খাবার। সম্ভবত ইতিহাসে কোন সৈন্য বাহিনী স্থানীয় জনগণের সম্পূর্ণ অকপট সমর্থন পেয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ এবং সন্ত্রাসীদের গণহত্যার কারনে তারা উভয় পক্ষ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছে।
এটা ছিল একটি সর্বোত্তম গেরিলা যুদ্ধের বিস্তার। এক ডজন লোক কাছাকাছি জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে তৈরি হচ্ছিল সর্বাধিক ধ্বংসের জন্য এবং তারপর সেখান থেকে পালানোর।
এটা হলো সার্জেন্ট- মেজর রবের মৌলিক কৌশল। প্রথমে গতানুগতিক প্রতিরক্ষা সময় জয়ের জন্য। তারপর পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের মাঝে একটি ছত্রভঙ্গ যা দিনাজপুরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য আত্মতুষ্টমূলক টোপ ছিল। তারপর একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা। আমরা স্থানীয় রাজনীতিবিদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম যারা সাড়ম্বরে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ বাংলাদেশের নকশা করছে। কিন্তু কেউই গুরুত্তের সাথে ভান করছে না যে তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারবে। যশোর ইতিমধ্যে আক্রান্ত, দিনাজপুরও লাঞ্ছনার মাঝে আছে। ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো যে সার্জেন্ট- মেজর রবের এই গেরিলা সংগ্রামের কৌশল সঠিক ভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে ধরে রাখতে হবে।
তাদের পক্ষে স্থানীয় জনগণের অভিভূত সমর্থন এবং বিশ্বের মতামতের চাপ এখন ইয়াহিয়া খানের উপর। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে না-সামরিক বাঙ্গালীদের চরিত্র এবং তাদের হতাশাজনক রকমের গোলাবারুদের ঘাটতি।
দিনাজপুর এখন পর্যন্ত তুলনামুলকভাবে অক্ষত। কিন্তু এখন এটা অন্যান্য কেন্দ্রীয় শহর ঢাকা চিটাগাংএর মত যন্ত্রণা ভোগ করবে।
এদিকে সার্জেন্ট- মেজর রব যদি সামনের দিকে নিহত না হন আমরা তাহলে বাঁশের উপবন থেকে পালাবো ছোট গ্রামগুলোতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। তার খাস্তা পুলিশ ইউনিফরম এবং তার ব্রিটিশ রাজের উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া রীতিনীতি তাকে বাংলাদেশের অভাবনীয় চে গুয়েভারা বানাবে। কিন্তু যদিও তার মত অনেকে পূর্ব পাকিস্তানে আছে ,যা পূর্ব পাকিস্তানের গৃহ যুদ্ধকে একটি দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে নিয়ে যাবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৩। হাজারো সন্তন্ত্র মানুষ এখনো ঢাকা থেকে পালাচ্ছে। | টাইমস | ১ এপ্রিল,১৯৭১ |
<১৪, ১৪৩, ৩৪৫–৩৪৬>
টাইমস, লন্ডন, এপ্রিল ১৩, ১৯৭১
হাজারো সন্তন্ত্র মানুষ এখনো ঢাকা থেকে পালাচ্ছে।
ডেনিস নিলড থেকে
ঢাকা, এপ্রিল মাস। এই ভীত এবং বিনয়ী শহরের বনের উপর সবুজ এবং সাদা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার ঝাপটানি শুনা যায়। বাংলাদেশের পতাকা, পাকিস্তানের পূর্ব অংশের ৭৫ মিলিয়ন মামুলী বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার ইচ্ছা হয় নিমজ্জিত অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। একটি পতাকার দর্শন এখন সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি হবে।
ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা শহরে জীপ এবং ট্রাক নিয়ে ইচ্ছামত টহল দিচ্ছে এবং তাদের রাইফেলস এবং সাব-মেশিন গান তৈরি রয়েছে। জেলায় পরিপূর্ণ শ্রমিক শ্রেণী কালো মরুভুমির ছাই এবং দগ্ধ বাঁশ স্ট্যাম্পের মাঝ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে।
২৫শে মার্চ রাতে বিচ্ছিন্নবাদী আওয়ামীলীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন দমন করার জন্য দিয়াশলাইয়ের কাঠের মত কুঁড়ে ঘরগুলো দগ্ধ করা হয়েছে।
ঢাকার কূটনৈতিকদের অনুমান অনুযায়ী সুন্দরভাবে প্রস্তুত হয়ে প্রায় ৬০০০ মানুষের উপর প্রবল আক্রমন চালানো হয়েছে।
সৈন্যবাহিনীর রাইফেলের আকস্মিক আঘাত রাতে এখনো স্বরাঘাত করছে আওয়ামীলীগের অফিসার, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য বিশিষ্ট বাঙ্গালীদের উপর। “এটা গেস্টাপো নিয়ম।” একজন পশ্চিম কূটনৈতিক মন্তব্য করেন, “সেনাবাহিনী গণহত্যা সংঘটিত করার অঙ্গীকার করেছে।”
পশ্চিম পাকিস্তানের মামুলী অবাঙ্গালীদের দ্বারা পরিচালিত লুটপাতের সময় সেনাবাহিনী অন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার পরিবার এখনো শহর থেকে তাদের গ্রামে পালিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে। ছত্রাবাসগুলোতে সহিংসতা এবং গুলির গর্ত আকীর্ণ ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। নিরপেক্ষ পযবেক্ষকদের অনুমান অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৫০০ ছাত্রকে গুলি অথবা মেরে ফেলা হয়েছে যখন সেনাবাহিনী শহরটি দখলের সময় তারা প্রতিরোধ করেছিল।
প্রত্যক্ষ দর্শীদের দাবী অনেককে সারিদদ্ধভাবে দেয়ালের বিপরীতে দাঁড়া করান হয়েছিল এবং মেশিন গানের গুলির দ্বারা কেটে ফেলা হয়েছিল। অন্তত আটজন অনুষদের বিশিষ্ট অধ্যাপকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশদের নিরস্ত্র করা হয়েছিল। বেঁচে যাওয়া পূর্ব বাংলা রেজিমেন্ট এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস যারা প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। অনেককেই বন্দী করা হয়েছিল।
ঢাকাকে রাত ৯ টা থেকে ভোর পাঁচটার কারফিউ দিয়ে আটকানো হয়।
সেনাবাহিনী এবং অবাঙ্গালি লুটপাট কারী দলের মনোযোগ এড়াতে অনেক বাঙ্গালী পরিবাররাতে তাদের ঘরে বাতি বন্ধ করে বাড়িতে বসে ছিল।
সবচেয়ে সিনিয়র আমলারা তাদের ডেস্কে ফিরে এসেছে যদিও তাদের কর্মীরা কাজ থেকে অনেক দূরে ছিল। দোকান গুলি পুনরায় খোলা হয়ে ছিল এবং অপরিহার্য সেবা সমূহ স্বাধীনভাবেই কাজ করছিল।
সৈন্য অভিযান জোরদার করতে সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে সিনিয়র আমলাদের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান যোগে অব্যাহতভাবে আনা হচ্ছিল যাতে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা যায়।
যখন থেকে ইয়াহিয়া খানের দেশ অটুট রাখার সিধান্তের নেয়া হয় তারপর বিশ্বাস করা হয় যে প্রায় ১০০০০ সৈন্য আনা হয়েছে। আনুমানিক ৩৫০০০ সৈন্য আনা হয়েছে। পূর্ববর্তী রিপোর্ট অনুযায়ী ৭০০০০ সৈন্য ছিল।প্রদেশের পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে অন্যায়ভাবে যত্ন করা হয়েছিল।
রাস্তার হকারদের পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা বিক্রির দুম বাণিজ্য চলছে যা আত্মসমর্পণের প্রতীক বহন করে। একজন বাঙ্গালী কৃষক বলেন,“ বাংলাদেশের কেউই ফিস ফিসের উপরে শব্দ করে না। আমরা পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করেছি শুধুমাত্র বন্ধুকের ভয়ে।” “বীর বাংলাদেশ এখনো আমাদের অন্তরে রয়েছে।”
এ পি মাইকেল হরন্সবাই লিখেছেনঃ
পাকিস্তান বাহিনীর ইউনিট ক্রমাগতভাবে পূর্ব বাংলা পশ্চিম সীমান্তবর্তী শহর বরাবর আজ প্রচণ্ড চাপ দিয়ে চলছে। “বাংলাদেশ” স্বাধীনতা আন্দোলনের কার্যক্রম কৃশ নিয়ন্ত্রনের জন্য। সেনাবাহিনীর এই অঞ্ছলে নিজস্ব প্রতিপাদন করা শুধুমাত্র কিছু দিনের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলোর কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করতে করতে পিছনে যাচ্ছে।
বিমান আক্রমন এবং আর্টিলারি গোলাবর্ষণ ভারতীয় গোয়েন্দা দ্বারা আজ রিপোর্ট করা হয়েছিল উভয় দিনাজপুর, মধ্য উত্তর, এবং কুষ্টিয়া ও আরো দক্ষিণে। রাজশাহী এবং পাবনা শহর সেনাবাহিনীর চাপে রয়েছে। একমাত্র নিয়মিত প্রতিরোধ বাহিনী হলো পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট যারা খুবই কম সংখ্যক এবং দুর্বল ভাবে সজ্জিত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইউনিট যশোর থেকে পশ্চিমের প্রায় এক মাইল দূরের ভারতীয় সীমান্তের থেকে রিপোর্ট করেছে। গত সপ্তাহে কয়েক হাজার শরণার্থী সীমান্ত পাড় হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাৎক্ষনিক সরবরাহ সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে না যদিও তারা তাদের বাড়ির ১০০০ মাইল দূরে থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ঢাকা ও যশোরে সেই সাথে সিলেট ও কুমিল্লার পূর্বাঞ্চলীয় শহর গুলোতে সরবরাহ এবং শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে বিমান দ্বারা। সেনাবাহিনী জলপথও নিয়ন্ত্রণ করছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৪। বাগাড়ম্বর ও বাস্তব | গার্ডিয়ান | ১৪ ই এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৪৪, ৩৪৭- ৩৪৮>
গার্ডিয়ান, লন্ডন, এপ্রিল ১৪ ১৯৭১
সম্পাদকীয়
বাগাড়ম্বর ও বাস্তব
নোংরা রক্তপাতের তিন সপ্তাহ পরে পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? ভাসা ভাসা ভাবে তারা উন্নতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের নানা স্থানের “ স্বাধীনতা যোদ্ধারা” কখনোই এবং ভবিষ্যতেও কখনোই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর শক্তির সাথে পারবে না। শহরের এই শক্তি প্রতিরোধ চ্যাপ্টা করার জন্য মোতায়ন করা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান খুব শীঘ্রই প্রায় সমস্ত শহরগুলোকেই কঠিন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসবে । তিনি আরও বেশি উড়ার জন্য চীনের খুচরা যন্ত্রাংশ আনবে এবং যত বেশি নেয়া যায় সেই পরিমান ভাড়াতে অলংকারশাস্ত্র ক্রয় করবে। যেই মুহূর্তে আওয়ামীলীগের “ দুর্বৃত্তরা ” মৃত, বন্দী অথবা উপেক্ষনীয় হবে তাতে পাকিস্তান আতঙ্কগ্রস্ত হবে কিন্তু ঐক্য বদ্ধ নয়।
তা সত্ত্বেও হিসাব নিকাশ পত্র সত্যিই খুবই ভিন্ন রকমের সম্ভবত ( আদর্শ ভাবে এবং বিভিন্ন খরচের বিষয়ে) পাকিস্তান পৃথক হওয়ার চেয়ে একসাথে থাকাটা উত্তম। সম্ভবত ক্রমাগত সামরিক শাসন রাষ্ট্রে বজায় রাখতে পারে এবং দুর্ভিক্ষ প্রান শক্তির মাঝে বিদ্রোহ করে ধিকি ধিকি আকারে নতজানু করেছে। কিন্তু ইয়াহিয়ার অব্যশই একটি বিস্তৃত দৃশ্য দেখা উচিত। হয়তবা সমন্বিত বাঙ্গালীর প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করতে বছর লাগবে কিন্তু বাঙ্গালীর এই সময়ের মাঝে পৃথিবীতে সবচেয়ে জনবহুল মানুষ হয়ে থাকবে। সবসময়ই অভিভূত ভাবে প্রস্তুত থাকবে অল্প ফুটন্ত অবস্থায় টহল বধ অথবা সঙ্গিহীন অবস্থায় থাকা পাঞ্জাবী সেনা বধ করার জন্য। প্রদেশটির সংখ্যা গরিষ্ঠ পাকিস্তানী যারা মাথার বিনিময়ে মাথা প্রদান করেছে আর যা ট্যাংক, প্লেন এবং বিশাল সৈন্য বাহিনী কেন্দ্রীভূত করে ধরে রাখা হয়েছে যতক্ষণ না পর্যন্ত কোন দৈববাণী ঘোষণাকারীকে না দেখা যায়। সেখানে কোন বেশভূষাসক্ত ব্যক্তির পক্ষে বেসামরিক বাহিনীর কোন আশাই নেই। ফলত প্রায় প্রতিটি প্রাচীন বেসামরিক রাজনীতিবিদ বাঁধার মাঝে আছে। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুর্বল ভাবে নুরুল আমিন ধ্বংস হয়েছিল। ইসলামাবাদের সহযোগীদের কোন গণতান্ত্রিক আত্মপক্ষ সমর্থন নেই এবং তারা জনসম্মুখে প্রাণসংশয় ছাড়া আবির্ভাব হতে পারবে না।
সংক্ষেপে পশ্চিমীয়দের প্রত্যাশা দীর্ঘ ক্লান্ত বিষাদ পূর্ণ অর্থনৈতিক স্থবিরতা অনাহার এবং চরমপন্থিদের হত্যার মাধ্যমে তাদের প্রবৃদ্ধি বিলম্বিত করা। এমনকি চীনের বন্ধুতের আলিঙ্গনের মাঝেও বিষাক্ত ছোঁয়া রয়েছে। পিকিং হয়তও মাওবাদি বাঙ্গালী যেমন মাওলানা ভাসানিদের মত মানুষদের উপর ইয়াহিয়ার বেয়নটের খোঁচাকে ভুল হিসাবে তদারক করে। যদিও প্রো- আমেরিকান শেখ মুজিব যে কোন কিছুর চেয়ে নিকৃষ্ট। কিন্তু একবার আওয়ামীলীগ বিলুপ্ত এবং পূর্ব পাকিস্তানের উন্মত্ত মানুষের উপর বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পর মূর্খ জেনারেলরা গুপ্ত ভাণ্ডারে চায়নিজ অস্ত্র খুজে পেয়ে খুবই বিস্মিত হবে। এবং পশ্চিমের অবস্থানেও নগ্নতা থাকবে। জনাব ভূটো হয়তো আজকের এই সেনাবাহিনীর আক্রমন দেখে আনন্দিত হতে পারে কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন এই আনন্দ ধরে রাখতে পারবেন না । যদি ভোটপত্র থেকে পাওয়া শক্তি তার কাছ থেকে ধরে রাখা হয়। পাকিস্তান জাতি বিশ্ব ব্যাংক এর কাছে বন্ধক আছে এবং বিশ্বের কাছে তারা আশ্রয় দাতা । তারা ইতিমধ্যে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষার নীতি দ্বারা বর্বরতার গুরুভোজ করে ফেলেছে ( এবং জেনারেলদের পুরো অস্তিত্ব ) এবং বাকিরা ভারতের সাথে কাশ্মীর নিয়ে মোকাবিলা করেছে। পাকিস্তানের অভিযোগ ভারত প্রেমময় কাশ্মীরকে ইস্পাতের মত দমন করে রেখেছে। এটা এখনের সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনা। যেমন ইসলামাবাদের জানতা খোলাখুলি ভাবে ৭৫ মিলিয়ন আন্তরিক পাকিস্তানীর উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। যদি কাশ্মীর বিষয়টি আবারো সম্মুখে আসে জাতিসংঘ নিশ্চয়ই তির্যক হাসিতে ভেঙ্গে পড়বে। এই বিষয়টি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মত মৃত।
কেউ সঠিকভাবে বলতে পারেনি তিন সপ্তাহ আগে ইয়াহিয়া গোপনে কি কৌশল ইঙ্গিত করেছিলেন। কেউই বলতে পারে না কিন্তু যে কেউই তা অনুমান করতে পারে। অবিকল বিপরীতভাবে তারা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মাথা কেটে তা বিনষ্ট করার চিন্তা করতে দেখা যায়। তারা বিশ্বের মতামত সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছে বলে মনে হয়। তারা সবচেয়ে অন্যায্যভাবে ভারতের উপর শাসন করার জন্য সামরিক হিসাব নিকাশ ছাড়াই আবির্ভূত হচ্ছে। যাতে অনিয়ন্ত্রিত সীমান্ত এবং যা কূটনৈতিক জটিলতার গলা বর্ধিত করতে পারে। আবারো তা পুনরাবৃত্তি করছি। বাংলাদেশের বিষয় দ্বিতীয় বায়াফ্রাতে নয় অথবা অন্তহীন ফল যা দিল্লী এবং রাওয়ালপিন্ডির মাঝে তার মত কিছু। এটা শুধুমাত্র তখনই উঠে আসে যখন ভালো ভাবে শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত নির্বাচনের ফল যা সেনাবাহিনী সহ্য করতে পারে নি। শেখ মুজিব নিজে কোন নিশ্চিত দৃশ্যে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি।
তিনি বৈধভাবে নির্বাচন জেতার পরও প্রোগ্রাম পরিচালনার কথা বলেন নি। অব্যশই সেখানে ধুসর রঙের মত্রা ছিল। অব্যশই হত্যা কাণ্ডের দায়িত্ব ভাগ করা হয়। কিন্তু পশ্চিমের প্রভাবশালী এবং বুদ্ধিমানরা আগামীকাল হত্যা কাণ্ড বন্ধ করতে পারবে যদি তারা তাদের হিসাব নিকাশ পত্র সঠিক ভাবে এবং তাদের সৈন্যদের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার মাঝে রাখে। এটা সিনো- সোভিয়েতের গালাগালির ম্যাচ নয় বরং মার্ক্সবাদী পরিভাষা। এটা রুট, স্বাধীনতা, নৈতিকতা এবং মানবতার একটি সহজ বিষয়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৫। বাংলাদেশে রক্তপাত | নিউ স্টেটসমেন | ১৬ই এপ্রিল, ১৯৭১ |
Saniyat Islam
<১৪, ১৪৫, ৩৪৯–৩৫০>
নিউ স্টেটসমেন, ১৬ই এপ্রিল, ১৯৭১
বাংলাদেশে রক্তপাত
যদি রক্তকে ধরে নেয়া হয় জনগণের স্বাধীনতার অধিকারের মূল্য হিসেবে, বাংলাদেশ তাহলে স্মরণাতীতকালের সংগ্রামগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে চড়া দাম পরিশোধ করেছে শুধুমাত্র সরকারপতন এবং ভৌগোলিক সীমারেখা পরিবর্তনের জন্য। স্বাধীনতার লক্ষ্যে এতো অল্প সময়ের একটি সংঘর্ষে এ পর্যন্ত এতো রক্তপাত এবং ক্ষয়ক্ষতিতে বাঙালিদের দুঃখদূর্দশা একটি রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হবে।যদি তাদের এই আন্দোলন কয়েকদিন বা সপ্তাহের মধ্যেই অবদমিত হয়ে যায় তবে এটি কেবলমাত্র তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে অস্থায়ীভাবে পরাজিত হওয়া হিসেবে গণ্য হবে এধরণের ঘটনাগুলোতে সাধারণত প্রশাসনের স্বপক্ষেই মতামত যায় এবং সে কারণে যে কোনও বিশ্ব শক্তির বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ঘোষণার সম্ভাবনা কম। সব নিয়মতান্ত্রিক ভাবে চলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য “বাঙালিদের” এই দাবি একদমই অযৌক্তিক নয়, কিন্তু এটি অন্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটি মাথাব্যথার কারণ নয়। তাই এই মুহূর্তে আমরা এবং অন্যান্য রাষ্ট্র গুলোর বিবেচনা করার সময় এসেছে যে জাতিসংঘের সনদে ‘জনগণের আত্মনির্ধারণের অধিকার’ বলতে আসলে আমরা কি বোঝাই, নাকি এই শব্দ গুলো অবাস্তব বা বিষয়ভিত্তিক? ইংরেজি কিংবা চাইনিজে, পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক শ্রেণীতে যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন পূর্ববাংলার মানুষের এই দাবি কোনোভাবেই ফেলে দেয়া যায় না যেমনটা বরদাস্ত করা যায় না বিশ্বশক্তিগুলোর বাংলাদেশের ব্যাপারে উন্নাসিকতা।
নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পশ্চিমের দেশগুলোতে যেটা স্বীকৃত, বাঙালিরা তাই করেছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের দাবি জানায় ব্যালটবাক্সের মাধ্যমে, নির্বাচনে পুরো পাকিস্তানের এসেম্বলিতে তারা পরম সখাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।এটি ছিল দেশটি অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং ফলাফল একটি উল্লেখযোগ্য ধাক্কা হিসাবে এসেছে, যদিও বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদের দীর্ঘ ইতিহাসকে তুলে ধরলে, যার ব্যাপ্তি পঞ্চাশের দশকের ভাষা এবং সংবিধানবিরোধী আন্দোলন থেকে আজ পর্যন্ত এটি এত বিস্ময়কর হওয়া উচিত নয়। আনুগত্যের চেয়ে মতাদর্শ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা তারই প্রমান।
এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে , ইয়াহিয়া খান এর ইসলামাবাদ সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে, যার শক্তি হচ্ছে একটি সেনাবাহিনীর উপর ভিত্তি করে (যেখানে বাঙালিরা অপাঙতেয়)। ইসলামাবাদের অস্থিরতার প্রতিক্রিয়া হয়েছে অত্যন্ত হিংস্র । আমরা টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি পশ্চিম পাকিস্তানিরা ‘ঐক্য পুনঃস্থাপন’ নাম দিয়ে কি করছে, আর পূর্বাঞ্চল এটিকে বলছে গণহত্যা। সত্যটি হয়তো এই দুই দাবির মধ্বর্তী কিছু, কিন্তু নিকটবর্তী ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি সমাধানের কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
‘বিয়াফ্রার’ ঘটনার সাথে এই ঘটনার তাল মিলিয়ে পশ্চিমের অনেক আবেগী বামপন্থীরা তাদের চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে এই ভেবে যে অ-সাদা মানুষ একে অপরকে হেয় করতে পারে না , যেটা কিনা স্বভাববিরুদ্ধ, এবং মানবিকতার দিকে নিজেদের মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। কিন্তু কথিত সমস্যাটি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষার সীমা অতিক্রম করে আরো জটিল হয়ে ওঠা একটি সমস্যা। একই ছাঁচে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানকে সত্যিই ‘বিচ্ছিন্ন’ রাষ্ট্র বলা যাবে না, যেখানে ‘শোষণ’ একটি ভিন্ন অর্থ নিয়েছে। পূর্ববাংলাবাসীরা দাবি করে আসছে যে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের ভর্তুকি দেওয়ার জন্য নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি অনেক আগে ১৯৪৮ সালের পার্টিশনের মধ্যে দিকে শুরু হয়েছিল। নিজেদের উত্থানের জন্য প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ পার্টিশনের পর বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারপেক্ষি পদক্ষেপ নেন, যেখানে প্রদেশগুলোর নিজেদের আয় এবং বিক্রয় কর নেবার অধিকার প্রত্যাহার করা হয়, এবং তাদের আমদানি এবং রপ্তানি আয়ের প্রধান অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য রাখা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান এই পদক্ষেপের ফলে বিশেষ বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, কেননা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তাদের আয় তদনুসারে বরাদ্ধ কোনওভাবেই বর্ধিত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, গত দুই দশক ধরে পাকিস্তানের ৭০শতাংশ বিনিয়োগযোগ্য তহবিল পশ্চিমে এবং পূর্ববাংলায় মাত্র ৩০ শতাংশ। পশ্চিমাঞ্চলে রাজস্বের ৭৫শতাংশ এবং পূর্বদিকে মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যয় হয়। বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্ধ হয় জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে, তবে পূর্ব পাকিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ জনগণের মধ্যে নগদ অর্থের মাত্র ২০ শতাংশ বরাদ্ধ পাওয়া যায়। পূর্বপাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের অনুমানে স্বাধীনতার পর থেকে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রকৃত সম্পদ স্থানান্তর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ড। এই যুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ অবশ্যই আরও বেশি হবে আর্থিক ভাবে নিজের উপর নির্ভরযোগ্য এবং রাষ্ট্রগঠনের জন্য আরেকটি মৌলিক যোগ্যতা পূর্ণ করলো বাংলাদেশ।
বৈদেশিক সহায়তার প্রশ্নটি ক্ষমতার রাজনীতির দিকে পরিচালিত করে। পূর্ববাংলা সম্ভবত সুস্পষ্টভাবে ঠান্ডা যুদ্ধের প্যাটার্নের মধ্যে পরে না এবং এর ব্যাপারে পূর্বগৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ এবং অবস্থানগত জটিলতা বিশেষভাবে লক্ষনীয়। ব্রিটিশরা সেন্টোতে (Cento) এবং সিয়াটো-মেরে (Seato-mere) পরিকল্পনা সংগঠনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের সাথে সংযুক্ত এবং নিশ্চিতভাবেই যার মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করা যেতে পারে। তবে ইয়াহিয়া খানের সাথে চীনের সম্পর্ক আরো কাছাকাছি এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ। গুজব ছড়িয়েছে যে পেইকিং ইন্দ-চায়নার সীমান্তে মনোযোগ আকর্ষণকারী কার্যকলাপ তৈরি করবে যদি ভারত (রাশিয়ানদের দ্বারা সমর্থিত) বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করে। চীন পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্টদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যারা সীমান্তের অপরপাশের বাংলাভাষাভাষী ভাইদের সাহায্যের চেয়ে ভালো কিছু চাইতে পারে না কিন্তু এক তাদের পক্ষে এটা সম্ভবপর হবে না (সম্ভবত এই অবস্থানটি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে চীনের বৈশ্বিকভাবে বড় ক্ষমতা অবস্থান অর্জন করেছে)। আমাদের সরকার কি অবস্থান নেয় তার উপর ব্রিটেনের অবস্থান নির্ভর করছে, যেখানে সিঙ্গাপুর এর ঘটনার ব্যাপারে সবার অবজ্ঞা ছিল কঠোরভাবে নিন্দনীয়।
যাইহোক, এই ঘটনা চলতে থাকবে এবং রীতি অনুসরণ করে অনুসন্ধান হবে এবং এ থেকে এখনো অনেককিছু জানবার আছে। ঘটনাপ্রবাহ আইজেএনকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ৭৫ মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানি মনে করেন যে জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে তাদের ততটাই অধিকার আছে যতটা আছে ৪৫মিলিয়ন পশ্চিমা পাকিস্তানির, এবং এই ধরনের পরিস্থিতিতে তারা দাবি করছে যে অস্ত্র সরবরাহ, বৈদেশিক ত্রাণ এবং সাহায্য বন্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা প্রণয়ন। এই জরুরি দাবিগুলো কেউ গ্রাহ্য করবে না যেমন কনর ক্রুজ ‘ও’ ব্রিয়েন বলেছেন যে জাতিসংঘ হচ্ছে ডেলফির ওরাকলের মতো, এটি দ্বন্দে সবসময় শক্তিশালীর পক্ষে কথা বলে এবং যথারীতি এখন তারা নিশ্চুপ আছে।
কিন্তু এই অবস্থা চলতে পারেনা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পরবর্তী এটাই সবচেয়ে নবীন ফেডারেশন যেটাকে ভাঙা যাবে। মাউন্টব্যাটেন যখন ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করেছিলেন ভৌগোলিকতার চেয়ে তিনি ধর্ম আঁকড়ে ধরাদের প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছিলেন। আমরা অসুখী এবং সমস্যা জর্জরিত আয়ারল্যান্ড এর ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা কাজে লাগাইনি যেটা ভারতবর্ষ ভাগের বিষয়ে ছিল একটা চরম ব্যর্থতা। পাকিস্তানের মূল ভিত্তি যেখান থেকে সৃষ্ট, তেমন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, মালয়েশিয়া, রোডেশিয়া এবং আরবীয় ফেডারেশন সব ভেঙ্গে গেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, তাদের প্রত্যেকেই পাকিস্তানের মত ছিল, একটি রাজনৈতিক কারণে ‘রাষ্ট্র’ বানানো হয়। সহজ কথা হচ্ছে যে এরকম রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট কৃত্রিম কাঠামো বেঁচে থাকতে পারে না। এই সত্যটি সবাই গ্রহণ করার আগে আর কত মানুষের প্রাণ যাবে ?
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৬। হত্যা ও প্রতিরোধের যুদ্ধ একই সাথে চলছে | টেলিগ্রাফ | ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৪৬, ৩৫১-৩৫৪>
সানডে টেলিগ্রাফ, ১৬ এপ্রিল,১৯৭১
হত্যা বয়ে চলছে যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানিরা জীবনের জন্য যুদ্ধ করছে।
ডেভিড লোশাক, সিলেট, পূর্ব পাকিস্তান
পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন জেলায় মূল শহরের নিয়ন্ত্রনের জন্য অসভ্য যুদ্ধ চলছে। গতকাল কেন্দ্রীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেও “বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর” কাছ থেকে নিয়ন্ত্রন গ্রহন করতে পারেনি।
পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দৃঢ় প্রতিজ্ঞভাবে চেষ্টা করছে আগামি দুই সপ্তাহ অর্থাৎ বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করতে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ চলছে। এবং উভয় পক্ষই গুরুতর রকমের ক্ষতির শিকার হয়েছে।
গত রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একাত্মতা প্রকাশ দেখে মনে হয়েছিল তারা উপরের দিকে রয়েছে কিন্তু আমি ক্রমাগত দুই দিন ধরে কামান দাগান দেখার ফলে এটা পরিষ্কার যে যুদ্ধ শেষ হতে অনেক দেরি আছে।
“মুক্তি ফৌজের” অপ্রশিক্ষিত এবং নাম মাত্র সংগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের “স্বাধীনতা বাহিনী” তারা তাদের শেষ ইচ্ছা শক্তি দ্বারা শহর রক্ষায় যুদ্ধ করে যাবে। এখন তা একটি ধংসপ্রাপ্ত শেল। তারা প্রায় ১০০ পাঞ্জাবিকে মেরেছে যা ছিল ৮০০ এককের সম্পূরক।
তাদের নিজেদের ক্ষতি আরও মারাত্মক কিন্তু হাজার হাজার বাঙ্গালী যুদ্ধ করতে তৈরি এবং তারা ধারাবাহিকভাবে তাদেরকে মৃতদের জায়গায় প্রতিস্থাপিত করছে। আমি তাদের এই চরম অবস্থায় সন্দেহাতীত ভাবে দৃঢ় মনোবল দেখেছি। তারা যুদ্ধ করে মরার জন্য তৈরি।
গ্রামাঞ্ছলে নিয়ন্ত্রন
এখন মুক্তি ফৌজ প্রায় সম্পূর্ণ গ্রামাঞ্চল নিয়ন্ত্রন করছে। খাদিমনগর সেনানিবাস যা শহরের পূর্বে অবস্থিত তা নিয়ন্ত্রনে আনার পর সালুতিগার বিমানবন্দর যা সিলেটের পাঁচ মাইল উত্তরে অবস্থিত তারা সেখানের সেনাবাহিনীকে অবরুদ্ধ করেছে।
বিজয় আনতে হলে মুক্তি ফৌজের জরুরিভাবে অস্ত্র এবং গোলাবারুদের সরবারহের প্রয়োজন।
প্রায় চার দিন পাহাড়, ভারতের আসামের জঙ্গল এবং সিলেটের উত্তর প্রদেশ এবং তারপর নিম্ন সমভূমি, চা বাগান এবং ধান ক্ষেতের মাঝে দিয়ে যাত্রার পর আমি গতকাল খাদিমনগর পৌঁছেছি।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাবী যে ভারতের সীমান্ত বন্ধ এবং সীমানা পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ তা সত্ত্বেও দৃষ্টি আচ্ছন্নকারী পরিপূর্ণ বৃষ্টির মাঝে আমি সিলেটের উত্তর-পশ্চিম থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরের সীমান্ত পার হয়েছি।
রুট বন এবং লতা গুল্মের জঙ্গলের মাঝে দিয়ে গ্রামাঞ্ছলের পথ ঘুরে প্রবেশ করেছি যা কাঁঠাল পাকা ভারি গাছ এবং গ্রীষ্ম প্রধান সবুজ আগাছায় বেষ্টিত।
তারপর হুমড়ি খেতে খেতে শুকিয়ে যাওয়া নদী গর্ভের পথের সাথে সাথে দীর্ঘ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পাহারের পাদদেশে যা বর্ষার বিশাল জলপ্রপাতে স্ফীত এবং সবশেষে প্রসারিত এবং কর্কশ নলখাগড়ার মাঝে দিয়ে আমি এসেছিলাম প্রায় একটি পরিস্কার জঙ্গলের বসতিহীন বন্দোবস্তে। সেখানে আমি প্রথমে সেই অঞ্চলের মুক্তি ফৌজের সাথে যোগাযোগ করি। বাংলাদেশের পশ্চিম দিক যা ভারতের পশ্চিম বাংলার সীমান্ত বরাবর অবস্থিত সহযোগীদের থেকে অসম্পূর্ণ অসদৃশ এই মানুষগুলো ইতিমধ্যে যুদ্ধ কঠিনীভূত ছিল।
সম্মুখে বিপদ
বাংলাদেশের কেউই তার আসল নাম দেয়নি এবং আমি প্রতিহিংসা এড়াতে আমি সব জায়গার নামই রিপোর্ট করছি না। স্থানীয় কমান্ডার যিনি নিজেকে ক্যাপ্টেন দুদু মিয়া উল্লেখ করেন। তিনি বলেন এখনের চেয়ে আগের দিনগুলো আরও বিপদজনক ছিল।
আমি আসামে আগে যা দেখেছি তিনি তা নিশ্চিত করেন। সেখানে নিচের দিকের সমভূমিতে আমি বিস্তৃত ভুদৃশ্য জুড়ে আগুন জলতে দেখেছি। সেখানে মেঘের নিচে ধোঁয়ার স্তর ছিল।
ক্যাপ্টেন মিয়া বলেন , সিলেটে ভারী যুদ্ধ চলছে। অঞ্চলটি ধারাবাহিক ভাবে ৩ ইঞ্ছি মর্টার এবং ৬ ইঞ্ছি কামান হামলার অধীনে রয়েছে। সেইসাথে চীনা এম আই জি এস এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর আমেরিকান সৈন্য বলের জেট হামলাও রয়েছে।
উপরোক্ত ছালুতিগুর বিমানবন্দর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পুনরাবৃত্তিকভাবে আক্রমন চালিয়ে গ্রাম এবং চা বাগান জ্বালিয়ে দিচ্ছিল।
অন্ধকারে ভ্রমন আত্মঘাতী হবে তাই আমি গ্রামের আদর্শস্বরূপ “পুঞ্জি” যা গ্রামের সাধারণ খড়ের ঘরে বসবাসকারীদের বাঁশের তৈরি “চঙ্গ” এর প্লাটফর্মে ঘুমাই।
রাতটি ছিল মৃতের মত নীরব ছিল আর যা বিশৃঙ্খল স্থানীয় কুকুরের ঘেউ ঘেউ অথবা ইস্পাতের মত শক্ত মশার আঘাতে নীরবতা ভাঙ্গছিল ।
সকালে আমি সশস্ত্র সহচরের সঙ্গে সিলেটে যাত্রা করেছিলাম। বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে অতি কৃশ যোগাযোগ হয় এবং আমাদের দেখা হতে পারে কিনা তা জানার কোন উপায় ছিল না।
বাঁশের খুটি দ্বারা ঘেরা গ্রামের পর আমার জীপ পুরু কাঠের ঘেরা ব্রিটিশ মালিকাধীন চা এস্টেটের মাঝে দিয়ে পার হয়। তা মূলত মানবহীন, ঘন সবুজ ঝোপ যা পরিচর্যাহীন এবং অ-বাছাইকৃত ছিল।
বাগানের শ্রমিকেরা তাদের ঘর থেকে ভীত, বুদ্ধিভ্রষ্ট ও উদাসভাবে তাকিয়ে ছিল।
ভারী লোকসান সত্ত্বেও “স্বাধীনতা যোদ্ধাদের” উদ্দিপনা অনেক ছিল। কৃষকদের মনোবল প্রায় ভাটার মত মনে হচ্ছিল।
তাদের অবস্তা ভয়াবহ। এক পাউনড চাল ছাড়া তাদের কাছে আর কোন খাবার ছিল না। বর্তমান অবস্থায় তারা খুব বেশি ধান চাষ করতে পারে নি। মজুদ দুই সপ্তাহের বেশি চলবে না। সেনাবাহিনী বেশিরভাগ গুদামঘর হয় লুটপাট করেছে আর না হয় জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন লবন, কেরোসিন তেল কেনার মত অর্থও তাদের কাছে নেই। এমনকি এই সব সীমানা পার হয়ে আনা যেতে পারে যা খুবই কঠিন।
ছোট গুটি বসন্ত এবং কলেরা
অসুস্থতা মহামারী আকারে ধারন করেছে। একজন গ্রাম্য ডাক্তার আমাকে বলেন সেখানে নিশ্চিত ১০জন গুটি বসন্তের এবং ৪জন কলেরার রুগী রয়েছে। স্ক্রামের সরবরাহ ফুরিয়ে গেছে।
আমাকে জীপ দিয়ে সিলেটে নামানো হয়েছে। তাদের উদ্দিপনা সত্ত্বেও মুক্তি ফৌজের লোকেরা সামরিকভাবে সরল। এমনকি তারা সবচেয়ে প্রাথমিক আত্মরক্ষামূলক প্রতিরক্ষাও সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখেনি। খোলা রাস্তা বরাবর আকস্মিক আক্রমনের এবং তারা তাক করার জন্যও প্রস্তুত ছিল না।
তারা দুঃখদায়ক ররকমের সজ্জিত। তাদের কাছে খুবই সেকেলে একটি ভাণ্ডার আছে। যেখানে ছোট অস্ত্র এবং সম্ভবত একটি বা দুটি লুণ্ঠিত মর্টার আছে। অন্যথায় বর্শা, তীর ধনুক এবং স্থানীয় দা, ছুড়ি যা গুরখা “কুকারট” এর মত; এগুলো ছাড়া ভরসা করার মত কিছুই নেই।
অন্যান্য বেসামরিক জনগণের মত তাদের খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং এর সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ যেমন পেট্রোলের ঘাটতিও রয়েছে। আমি সিলেটের কাছাকাছি তাদের একটি গুদামঘরের ডিপো পরিভ্রমন করেছি যাতে অসফল ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল। শেষ কয়েকশত গ্যালন সরবরাহ নিচে চাপা পড়েছে।
সকল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে মুক্তি ফৌজ সেনাবাহিনীকে ধরে রাখতে পেরেছে। যাদের কাছে তাদের তুলনায় উচ্চতর অস্ত্রশক্তি এবং দক্ষ বাহিনী রয়েছে এবং তা ক্রমাগত আকাশ পথে পুনরায় সজ্জিত করা হচ্ছে।
বেসামরিক নাগরিকদের জবাই
মুক্তি ফৌজের নেতারা বলেছেন এটা হচ্ছে কারন তারা একটি কারনে যুদ্ধ করছে।
সেনাবাহিনীর একমাত্র কৌশল হলো বেসামরিক জনগণকে সর্বোচ্চ রকমের যন্ত্রণা দেয়া এবং এই অঞ্ছলে দীর্ঘস্থায়ী ধ্বংস বিদ্যমান রাখা। সৈন্যদের লক্ষন দেখলে বুঝা যায় তারা নির্দিষ্ট আদেশ অনুযায়ী অন্ধভাবে পরিপূর্ণ বাড়িগুলিতে গুলি বর্ষণ করছে, সম্পূর্ণ গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং বাসিন্দাদের জবাই করছে যাতে তারা পালিয়ে যায়।
তারা ছত্রাকে বৃহত্তর স্থাপনা যেমন আলোক শিল্প ধ্বংস করে ফেলেছে এবং ১০ টি প্রধান পূর্ব পাকিস্তানের জুট কারখানা যা শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানেরই নয় সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তিও।
পরিষ্কারভাবেই সেনাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল প্রথম হামলার ৪৮ ঘণ্টার মাঝেই জনগণের মনোবল ভেঙ্গে ফেলা।
এটা ব্যর্থ হয় কিন্তু সরকার এই অকার্যকর কৌশলের সাথেই চলতে থাকে। যা সিলেটের মত পূর্ব পাকিস্তানে অন্যান্য প্রধান শহরগুলোকে ভূত প্রেতাত্মাময় নগরে পরিনত করে।
প্রায় সম্পূর্ণ ৭০০০০০ জন জনগণ পার্শ্ববর্তী গ্রামে পালিয়ে গেছে। রাস্তাগুলিতে অসহায় বৃদ্ধ, পঙ্গু ও লাশ ফেলে রেখেছে বন্য কুকুর ও শুকুনের সাথে।
স্ফীত লাশগুলো সিলেটের মাঝে দিয়ে সুরমা নদীতে বয়ে চলেছে যা ২৬শে মার্চ রাতের প্রমান বয়ে চলছে যখন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা শহরের মাঝে ফেটে পড়ে এবং লুটপাট এবং জবাইয়ের প্রচারাভিযান শুরু করে।
বিশেষ ইউনিটকে ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং অন্যান্য পেশাদার মানুষকে হত্যার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রতিরোধের লিংক
কিং ব্রিজটি নিয়ে এখন যুদ্ধ হচ্ছে যা সিলেটকে দুই অর্ধেকে সংযুক্ত করে। যদি সৈন্যরা ব্রিজটি ধ্বংস করতে সফল হয় তাহলে তা বাংলাদেশের প্রধান প্রতিরোধের লিংক ছিন্ন করতে পারবে।
যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য তার মান ছোট মনে হতে পারে যার শক্তি মনে হচ্ছে বাকি রয়ে গেছে যা মুক্তি ফৌজকে কম চাপ দিবে।
গ্রামাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ আনার সেনাবাহিনীর কোন আশাই নেই। ইতিমধ্যে ভারী বর্ষাকালীন বৃষ্টি চলাচল কঠিন করেছে এবং জনগণও তাদের প্রতিকূলে রয়েছে।
গত মাসে যখন বৃষ্টি সত্যি সত্যি শুরু হয় যা পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বৃষ্টিপাত নিয়ে আসবে আর তা সপ্তাহেও শেষ হবে না তখন সেনাবাহিনী পুরোপুরি কাদায় নিম্মজিত হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৭। শেখ মুজিবের দল সামরিক প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত ছিল না | টেলিগ্রাফ | ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৪৭, ৩৫৫-৩৫৭>
দ্যা সানডে টেলিগ্রাফ, ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১
শেখের সমর্থকরা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে ব্যার্থ হয়েছিল
সাইমন ড্রিং
পুর্ব পাকিস্তানে অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালিদের কার্যকর এবং দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিরোধ প্রক্রিয়া যে শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাবে, এ নিয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই। যদিও তথাকথিত “বাংলাদশ মুক্তিবাহিনী” অনেক সফলতার খবর শোনা যাচ্ছে, তবে এরকম কিছুর অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না সন্দেহ।
যেসব স্থান থেকে প্রতিরোধের খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো মূলত যেসব স্থানে এখনও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সমন্বিতভাবে অগ্রসর হয়নি, অথবা যেসব স্থানে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী অথবা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের কিছু সেনা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
কিন্তু পুরো দেশব্যাপি একটি সমন্বিত প্রতিরোধ পরিকল্পনা, যা কি না একটি দৃঢ় সামরিক আক্রমনের সম্মুখে কিছু হলেও দাঁড়াতে পারে, চোখে পরছে না।
শেখ মুজিবের সমর্থকরা যদিও গতমাসের এই সেনা অভিযান শুরুর আগে তারা কিভাবে যুদ্ধ করবেন সেসব নিয়ে অনেক কথাই বলেছিলেন, কিন্তু তারা আসলে প্রায় কিছুরই প্রস্তুতি নেননি। তারা অনেক সরব ও আক্রমণাত্মক মিছিল করেছে বটে, কিন্তু তাদের কোন সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছিল না, তাদের কোন ট্রেনিং ছিল না, ছিল না কোন অস্ত্র, এবং পাক সেনারা ঢাকায় যেটা প্রমান করেছে, তাদের যুদ্ধ সামাল দেবার কোনই প্রস্তুতি ছিল না।
পাকিস্তানি সেনা বাহিনী যখন যথেষ্ট পরিমান সৈন্য আর অস্ত্রপাতি এনে ফেলবে, তখন তারা এই বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ প্রচেষ্টাগুলোকে ঢাকাকে তারা যেভাবে দমন করেছে, একইভাবে দমন করে ফেলবে।
গেরিলাদের স্বর্গ
যদিও মনে হচ্ছে না যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য গ্রাম অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রন করা খুব জরুরী। তারা সম্ভবত জনবহুল এলাকাতে ঘাঁটি গেঁড়ে বসে থাকার চেয়ে বেশি কিছু করবে না।
এদেশের গ্রামাঞ্চল হচ্ছে নিচু ধানক্ষেত, কলাগাছের জঙ্গল, পাটক্ষেত, চা বাগান, নদী আর জঙ্গলে ভরা এক গোলকধাঁধা এবং গেরিলা যুদ্ধের জন্য আদর্শ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও সেটা জানে।
কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে কোন নেতার উদ্ভব হয়, অথবা যেটা আরো গুরুত্বপুর্ন, কেউ তাদেরকে অস্ত্রের সরবরাহ না দেয়, ততক্ষন পর্যন্ত বাঙ্গালীরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
মার্চের উত্তাল প্রথম তিন সপ্তাহে, যখন মনে হচ্চিল বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা অর্জন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র, শেখ মুজিব ও তাঁর দল গ্রামে গ্রামে যোদ্ধা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন বটে। পুর্ব পাকিস্তানীদের স্বপ্ন এমন নাটকীয় ও রক্তাক্তভাবে ভেঙ্গে চৌচির হবার মাত্র কয়েকদিন আগেই আমি ঢাকার বাইরে এরকম কয়েকটি জায়গায় গিয়েছিলাম।
এরকম একটি গ্রামে, যেখানে প্রায় ১,০০,০০০ এর বেশি লোক থাকে, প্রায় ৩০০ জনকে বেছে নেয়া হয়েছিল। একজন ধুসর দাঁড়িওয়ালা প্রাক্তন ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনীর এনসিও এর নেতৃত্বে তারা গ্রামের চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে অতি উৎসাহের সাথে আলোচনা করতো তারা কি করবে সেসব নিয়ে।
কিন্তু এটা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছিল যে তারা আসলে তাদের চোখা করা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আর যুদ্ধ বিদ্যা শেখার চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে প্যারেড করার ইচ্ছা দিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারবে না।
“আমরা রাস্তাঘাট আর ব্রিজ কেটে(ভেঙ্গে) দেব, আর শত্রুর কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেব” একজন বলেছিলেন। তবে মনে হয় না ঢাকায় তার সমগোত্রীয়রা যা করতে পেরেছেন তাঁর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা তার আছে।
স্বপ্নের জগৎ
রাজধানীতে ছাত্ররাও, যাদেরকে সেনারা আওয়ামী লীগের চরম সমর্থক হিসাবে মনে করে, এরকমই একটা স্বপ্নের জগতে বাস করছিল। তারাও সারাক্ষন আমৃত্যু যুদ্ধ করে যাবার ইচ্ছার কথা বলত।
কিন্তু তাদের কাছে ১৯৩০-৪৫ সালের যুদ্ধের সময়ের অল্পকিছু কিছু পুরনো রাইফেল, একই বয়সী কিছু পিস্তল, আর হাতে বানানো কিছু বোমা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, এবং মার্চের ২৫ তারিখে যখন সেনাবাহিনী নামলো, তখন এগুলোর ব্যবহার দেখা যায়নি।
গোলাগুলি যখন শুরু হল, তখন সব ধরনের ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ, চিল্লাপাল্লা, এবং পাকিস্তানি সরকারের সামরিক শক্তির প্রকাশ্য অবাধ্যতা সবই দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল। এবং এই একই নমুনা দেখা যাচ্ছে সারা দেশেও।
যখন আমি শহরের বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে গিয়ে মানুষজনকে প্রতিরোধ যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করেছি, বেশিরভাগই কাঁধ ঝাকিয়ে অন্য দিকে চলে গিয়েছে।
এরাই ছিল সেই ছাত্ররা, সেই বুদ্ধিজীবীরা, ব্যবসায়ীরা, যারা মাত্র কয়েকদিন আগেই তাদের বাসাবাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন, যারা মাত্র আগেরদিন বিকালেই সরকার বিরোধী মিছিলে অংশগ্রহন করেছিলেন।
এখন যেখানে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ গনহত্যার শিকার হয়েছে, স্বাভাবিক ভাবেই তাদের এখন “অস্ত্রের মুখে আমরা কিই বা করতে পারি” বলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
এখন সম্ভবত যাদের পক্ষে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব তারা হচ্ছে গোপন বামপন্থী দল ও সমাজতান্ত্রীক দলগুলো। এখন পর্যন্ত তাদের নেতাদের গ্রেফতারের কোন খবর পাওয়া যায়নি।
এদের মধ্যে তিনটা প্রধান দল আছে যারা হয়ত সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছু হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এরা সবাই পিকিংপন্থী।
আমি এদের অনেকের সাথেই ঢাকায় মার্চের প্রথম দিকে গোপনে দেখা করেছি। তারা স্বীকার করেছে যে তাদের দল এখনও ছোট, আর তাদের হাতে অস্ত্র আছে সীমিত পরিমান।
তাদের একমাত্র সরবরাহ আসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশাল বিপ্লবিদের কাছ থেকে, আর হয়ত কিছু আসে বার্মিজ বিদ্রোহিদের কাছ থেকে। তারা কাজ করে মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামের শিল্প এলাকাগুলোতে, এবং উত্তরাঞ্চলের গ্রামের দিকেও তাদের অল্প উপস্থিতি আছে। তাদের সহায়তা আসে প্রধানত ট্রেড ইউনিয়নগুলো থেকে।
এদের নেতারা সাধারণত হচ্ছে ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী মধ্যবিত্ত শ্রেণির কেউ যারা স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা নিজ নিজ আদর্শে নিবেদিতপ্রান, কিন্তু আদর্শগত পার্থক্যের কারনে তারা বেশিরভাগ সময়েই নিজেদের মধ্যেই ঝগড়াঝাঁটিতে ব্যস্ত থাকে।
পুর্ব পাকিস্তানে মার্চ মাসের গোলযোগের সুযোগে তারা দুই শহরেই মিছিল বের করেছিল, এবং সেই মিছিল থেকে “রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন” করার ডাক দিয়ে লিফলেট বিলি করেছিল।
প্রতিরোধের বীজ
“আমরা যোদ্ধা নই” আমাকে এমনটাই বলেছিলেন একজন বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী ঢাকায় সেনাবাহিনী নামার পরদিনই। “আমরা কথাই একটু বেশি বলি”।
“কিন্তু প্রেসিডেন্ট এখন আর আমাদের জন্য কোন উপায় রাখলেন না। এমনও যদি হয় যে তারা আগামী ১০ বছর আমাদের শাসন করতে পারলো, তবুও তারা টের পাবে তারা যতটুকু হজম করতে পারবে, তারচেয়ে বেশি খেয়ে ফেলেছে। আসল প্রতিরোধের বীজ রোপণ করা হয়ে গেছে, এবং শেষ পর্যন্ত আমরা প্রত্যাঘাত করবই”।
হয়ত এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমানিত হবে। কিন্তু সেটার জন্য লম্বা সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। আর যদি সেটা হয়ও, সেটা খুব সম্ভবত পাইপ খেয়ে অভ্যস্ত মধ্যমপন্থী শেখ মুজিবুর রহমানের মত কারো হাতে না হয়ে হবে কমিউনিস্টদের হাতে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৮। বাংলাদেশের স্বপ্ন মিলিয়ে যাচ্ছে | অবজারভার | ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১৪, ১৪৮, ৩৫৮–৩৬৪>
অবজারভার, লন্ডন, ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বপ্ন মিলিয়ে যাচ্ছে
[কলিন স্মিথ, প্রথম ব্রিটিশ নিউজ পেপারম্যান যিনি বিদেশী প্রেস বহিষ্কৃত হওয়ার পর প্রথম ঢাকা পৌঁছেন। তিনি তার পাকিস্তানি রাজধানী তে বিপজ্জনক যাত্রার ব্যাপারে রিপোর্ট করেন। আবদুল রশিদ তার সাথে গাইড হিসেবে কাজ করেছিলেন।]
কলকাতা, ১৭ এপ্রিল- দেশের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অনুগত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা সৈন্যদল এখন বাংলাদেশের মানচিত্র চষে বেড়াচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন কিছুটা সময়ের জন্য শেষ হয়ে গেছে।
তাদের উত্সাহী আশা সত্ত্বেও, নিরীহ বাঙালিরা ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক নির্মম যোদ্ধা- পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা সৈন্যদের সাথে কোনও মিল খুঁজে পায়নি।
কিন্তু বাংলাদেশের দু: খজনক ভূমির মধ্য দিয়ে ২00 মাইলের যাত্রা শেষ হওয়ার পর আমি নিশ্চিত যে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া এখন থেকেই তার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটি বলপূর্বক ধরে রাখবে এবং তার শাসনকে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা দ্বারা প্ররোচিত করা হবে, তবে তা অযৌক্তিক এবং অকার্যকর। বাঙালিরা গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনার কথা কখনো ভুলবে না বা ক্ষমা করবে না।
শুক্রবারের মধ্যাহ্নভোজনের সময় আমি ইয়াহিয়া খানের আদেশে বিশ্বের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন, পূর্ব পাকিস্তানের দখলকৃত রাজধানী ঢাকাতে পৌছলাম। আমার সাথে লন্ডনে অবস্থিত ইতালীয় ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার রমারা ক্যাগোনী ছিলেন।
ভারতীয় সীমান্ত থেকে ১০০ মাইল দূরে জীপ, ট্রাক, গরুর গাড়ি, ক্যানোজ এবং টাট্টু দিয়ে স্মরণীয় ৩-মাইল ভ্রমণ করছি আমরা চারদিন ধরে। ২5 শে মার্চের সময় একজন ইটালিয়ান সাংবাদিকের বুকে গুলি করা হয় এবং অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার করা হয়। তার পড় থেকে আমরা প্রথম সাংবাদিক যারা পক্ষকালের বেশি সময় ধরে শহরে ছিলাম। ক্যাগনি দুইটি বিছিন্ন বিস্কুট প্যাকেটে তার ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিল। আমরা পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জন্য কাজ করে এমন টেকনিশিয়ান ছিলাম বলে আমাদের দাবীকে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদানের জন্য আমরা একটি মিশনারি থেকে নেওয়া পরিষ্কার শর্টেড শার্ট পরলাম।
আমরা ঢাকা এবং সপ্তাহজুড়ে গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করেছি এবং আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি এই মুহুর্তে রাজধানীতে কোন বড় বিদ্রোহ হবে না। সৈন্যদের বন্দুকের কির্তি খুব সাম্প্রতিক।
অস্ত্র লুকাচ্ছে
প্রথম পর্বের যুদ্ধ শেষ হয়েছে – জাতীয় সংগ্রাম, দেশপ্রেম সব রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠেছে এবং আওয়ামী লীগ ও মাওবাদীরা তত্ত্বগতভাবে পার্থক্য থাকেলও কাঁধে কাঁধ রেখে এক লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। বামপন্থিরে ক্লাসিক গেরিলা যুদ্ধ করছে।
অবশ্যই বুর্জোয়া আওয়ামী লীগ – যাদের স্টক ইতোমধ্যে নিম্নগাম, তারা জনগণকে রক্ষা করার জন্য দুঃখজনকভাবে অক্ষম – এই কারণে প্রথমেই তারা ভুক্তভোগী হবে। কিছু গ্রাম ইতিমধ্যে অস্ত্র রাখার পরিকল্পনা করছে এবং ভারতের পুলিশ বলছে পূর্ববঙ্গে সীমান্তে ভারতীয় মাওবাদী চরমপন্থীরা যুদ্ধ করছে কারণ গত দুই সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবঙ্গে কোন নক্সাল নেই।
ঢাকায় আমাদের প্রথম কল ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল। আমাদের বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার – একটি মোটর স্কুটার দ্বারা টানা একটি রিক্সা- ভুল করে ব্রিটিশ হাই কমিশনে চলে যায়। দরজায় একটি বড় ইউনিয়ন জ্যাক ছিল, যা আমরা পরে শিখেছি, চারজন পুলিশ রক্ষী আমাদের গুলির জন্য থামায়নি।
যখন আমরা হাই কমিশনের কাছে পৌঁছলাম, তখন মেজাজ কিছুটা খারাপ ছিল। কালো চশমা পড়া একজন সিনিয়র ব্রিটিশ কর্মকর্তা চিৎকার করে বলেছিলেন যে আমাদের আগমন তাদের সবাইকে হত্যা করবে এবং সম্ভবত নিজেদেরকেও।
আরেকজন মানুষ বলেছিলেন যে এখানে যা ঘটছে তাতে ব্রিটেনের লোকেদের জন্য কোন স্বার্থ ছিল না। তারা জানত কি ঘটছে যেটুকু প্রয়োজনীয় তার সবটাই তারা জানত।
ঢাকার সাথে বাইরের বিশ্বের মধ্যে সব টেলেক্স এবং টেলিফোন যোগাযোগ কাটা হয়েছে এবং কমিশনের কর্মীদের অধিকাংশ তাদের পরিবারকে সরিয়ে ফেলেছে , শুধুমাত্র ছয় সপ্তাহের জন্য তারা প্রথম মেইল পায়।
পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান একমাত্র বেসামরিক বিমান যা ঢাকাতে অবতরণ করে। প্রত্যেকটিতে ১৭৫ জন যুবক রয়েছে যারা হোয়াইট শার্ট এবং খাকি ট্রাউজারে ভ্রমণ করে, কিন্তু পরে নাম্বার সময় তারা তাদের ইউনিফর্মের বাকিটা পরে। যেসব লোক করাচি থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য বুকিং করার চেষ্টা করছে তাদের বলা হয়েছে সম্পূর্ণ বিমান অফিসিয়াল লোকে পূর্ন হয়ে গেছে। – জানিয়েছে বিমানটি কর্মকর্তারা।
আমেরিকান কনস্যুলেটে, ব্যাপারটি আরেক্তু শিথিল মনে হল। ঠান্ডা বিয়ার এবং একটি প্রাচীর মানচিত্র দেয়া হল। বেশিরভাগ কূটনীতিকের মতো আমরা আমেরিকানদের সাথে কথা বলেছি – তারা সাধারণভাবে সায় দিয়েছে। তারা স্বীকার করে যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় ৬০০০ জন পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ৩০০ থেকে ৫০০ জন ছিল শিক্ষার্থী।
কিছু পশ্চিম পাকিস্তান ইউনিট পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সাথে রক্তবন্যা খেলেছেন। এটি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ের ম্যাসাকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। মুসলমানি না করানো থাকায় বেশিরভাগ হিন্দুদের লাশের লিঙ্গ কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়।
ঢাকা করুগেটেড লোহা, বাঁশ, কাদা এবং পাথরে নির্মিত একটি পুরানো শহর। কিছু অংশ এতই লজ্জাকর হয়ে যায় যে, সম্ভবত এটিতে আধা ঘন্টা ধরে শেলিং করা হয়েছে। একটি ফসফরাস গ্রেনেড বা ফায়ার বুলেট বাঁশের এক বস্তিতে মেরে আশপাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এভাবে ২৫ টি ব্লক, সম্ভবত আরও বেশি, ধ্বংস হয়ে গেছে।
জবাই করার পরের দিন শহরে কাক, কড়া-ময়লা, চর্বি, ধূসর পাখির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যদিও লাশগুলো দ্রুত সরানো হয়েছে তথাপি পাখিগুলো উপড়ে চক্কর মারছে আর মরুভূমিসম রাস্তা দিয়ে ডেকে বেড়াচ্ছে।
৮০০ টি মসজিদের শহর ঢাকা শহরের স্বাভাবিক জনসংখ্যা দুই মিলিয়ন; দুই তৃতীয়াংশ গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গেছে এবং বাকিরা সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসের মাঝে বাস করছে। সবুজ ও সাদা পাকিস্তান পতাকাগুলি সর্বত্র বাঙ্গালি শহরের উপর উড়ছে। শুধু পরাজয়ের এবং আত্মসমর্পণের টোকেন হিসেবে। কিছু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা সম্ভবত কোড অব অনার মেনে চলেন না।
হত্যাকাণ্ড শুরু হয় একদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আবাসিক হলের ছাত্ররা বিছানায় থাকা অবস্থায় বাইরে আর্মির গাড়ির শব্দ শুনে। তাদের বেশিরভাগই মনে করে সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তারের জন্য আসছে।
কয়েকজন জঙ্গি নিশ্চিত করেছেন যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা শহরবাসী থেকে সংগ্রহ করা রাইফেলগুলি ভালভাবে লুকিয়ে রেখেছে। কেউ ভাবেননি সে লড়াই করতে পারে। যদিও কারো কাছে অল্প কয়েক রাউন্ড গোলাবারুদ ছাড়া কিছু নেই।
হঠাৎ করেই দেখি জানালায় সার্চলাইটের আলো। তারা ছাত্ররা বিছানায় পড়ে থাকে এবং মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। পাঞ্জাবি এবং বেলুচি সৈন্যরা তাদের চীনা এ কে – ৪৭ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলস নিয়ে এসেছিল। তারা বুট দিয়ে জানালার গ্লাস ধাক্কা দিয়ে খুলে এবং ডরমিটরিতে আগুন দেয়।
কয়েকজন শিক্ষার্থী ছাদে গিয়ে পৌঁছান, যেখানে তারা তাদের পুরোনো বোল্ট-অ্যাকশন রাইফেলের দিয়ে এক বা দুইটি শট গুলি করে। তার কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ধরা পরে এবং তাদের হত্যা করা হয়। অন্যরা চিৎকার করে বেরিয়ে আসছিল, তাদের হলের দেয়ালের পাশে দাঁড় করা হল এবং ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়িগুলি থেকে মেশিনগানের সাহায্যে শেষ করে দেয়া হয়। যারা তবুও টিকে ছিল তাদের বেয়নেট দিয়ে শেষ করে দেয়া হয়।
হামলায় নিহতদের মধ্যে ছিল: ড জি ডি দা, দর্শন বিভাগের প্রধান; পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ড এ এন মনিরুজ্জামান; এবং ড অবিনশ্বর চক্রবর্তি, ইংরেজি বিভাগের রিডার এবং জগন্নাথ হলের প্রোভোস্ট, যেটি একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল। পাঁচজন অন্যান্য শিক্ষক, যাদের নাম আমি সংগ্রহ করতে পারিনি, তাদেরও মৃত বলে ভাবা হচ্ছে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড ইনাস আলী গুরুতর আহত হন।
পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (সীমান্ত পুলিশ) হেড কোয়ার্টারের প্রতিরোধ এবং শহরের পুলিশ স্টেশনগুলি রক্তাক্ত ছিল, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী ছিল। তবুও, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যুদ্ধের মারাত্মকতায় আশ্চর্য হয়েছে। ব্রিটিশভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিজাত ব্যক্তিরা এখন পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করে এবং তারা জানে শৈল্পিক বাঙালিরা ইম্পেরিয়াল ইংলিশম্যানের কন্টেম্পট শেয়ার করে, যারা সাধারণত যখন ভীত ও রাগ হয় তখনি মানুষ হত্যা করে।
রাতের অন্ধকারে ধর্ষণ, লুটপাট এবং হত্যা
‘সেনাবাহিনী তার লাঠি নিয়ে নিয়েছে, একজন কূটনীতিক আমাদের বলেছেন। কুষ্টিয়া নামে একটি স্থান যেখানে গঙ্গা নদীর তীরে একটি রেলপথ রয়েছে- সামরিক বাহিনী শত্রুকে অবহেলা করার জন্য কড়া মূল্য দিতে হয়। তখন প্রায় ৮০ জন বেলুচি পদাতিক বাহিনী স্বয়ংক্রিয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জে, পুলিশ স্টেশনে এবং অন্যান্য স্থানে অবস্থান করছিল। গ্রুপগুলি এক সময়ে টুকরো টুকরো হয়ে হ্যাক হয়ে যায়। তাদের অধিকাংশই মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করে।
ঢাকার জনাকীর্ণ বাজারের মধ্যে রাস্তা দিয়ে আমাদের গাইড ক্রমাগত আমাদের চারপাশে জড়ো হওয়া জটলার দিকে মনোনিবেশ করছিলেন। এবং আর্মির গার্ডের দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষন করানোর চেষ্টা করছিল। রেডিও পাকিস্তান বলেছিল ‘ ব্যাবসা স্বাভাবিক আছে’ – একথা যুক্তিযুক্ত মনে হল। আমরা কিছু গাটেড ভবনে আসলাম, কিন্তু ধ্বংসাবশেষের ইউরোপীয় মান দ্বারা এখানকার ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি নয়।
আমরা যখন নতুন কেন্দ্রীয় অংশে পৌছালাম আমরা প্রায় সব মোড়ে মেশিনগান পোস্ট দেখতে পেলাম – হিন্দু এলাকায় খালি বাড়ীর শাড়ী পরে আছে – যেখানে ইসলামের নামে অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড হয়েছিল বলে শোনা যায়।
কিন্তু এমন এলাকা যেখানে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে বিস্ময়কর গতির সাথে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সড়কের পাশে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের কর্মীদের আবিষ্কৃত পচা লাশ ভয়াবহতার সত্যিকারের কিছু ধারণা দেয়।
কেরোসিন থেকে খাদ্য পর্যন্ত সবকিছুই প্রায় অপ্রতুল ছিল। কিছু পণ্য মূল্য প্রায় দ্বিগুণ ছিল। শহরটির হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, যা আমেরিকান মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত, সেটি এক সপ্তাহ আগে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যেহেতু এটার মজুদ অর্থ শেষ হয়ে গেছে।
এই মুহূর্তে ট্যাংকগুলি শহর ছেড়ে চলে গেছে। দৃশ্যত তারা এক পথে অনেক বার যাওয়া আসা করত এবং এগুলো ট্রান্সপোর্টারে সরানো হবে। রাত ৯ টা পর্যন্ত কারফিউটি শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ নাগরিক অন্ধকারের পরে রাস্তায় হাঁটতে অনিরাপদ বলে মনে করে, কারণ পশ্চিমা পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দুকের মুখে লোকেদের লুট করে এবং তাদের ঘড়ি ও ওয়ালেট ছিনিয়ে নেয়।
দিনের বেলায় সৈন্যরা জিপ ও ট্রাকগুলিতে রাস্তায় পেট্রোল দেয়। এছাড়াও অস্ত্রধারী যানবাহনগুলিতে সশস্ত্র বিহারীর স্বেচ্ছাসেবক দেখা যায়। যদি পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনও বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে মানবতার নামে তাদেরকে বিহারীদের সাথে নিয়ে যেতে হবে; অন্যথায় বাঙালিরা অবশ্যই তাদের গণহত্যা করবে।
ভারতবর্ষের বিহার থেকে এই উর্দুভাষী মুসলমানরা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় হিন্দু নির্যাতনের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে পূর্ববাংলায় শরণার্থী হিসেবে আসে। বিহারিরা বেশিরভাগ ব্যবসায়ী, শীঘ্রই হিন্দুদের ছেড়ে চলে যাওয়া খালি দোকানগুলি তারা নিয়ে নেয়। এখন বিহারীরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য স্কাউটস এবং গাইড হিসাবে কাজ করে- যারা উর্দুভাষীও এবং যাদের সাথে তারা আরও বেশি সংহতি অনুভব করে।
ঢাকার সর্বত্র আর্মি চেকপয়েন্ট আছে, সৌভাগ্যক্রমে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অফিসার ইংরেজি বুঝতে পারেন। একজন সৈনিক আমাকে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট অফিসের বাইরে থামিয়ে দেয় এবং পরিচয়পত্র দাবি করে। তিনি আমার পাসপোর্টটি যথোপযুক্তভাবে গ্রহণ করেন যদিও এতে পূর্ব পাকিস্তানের এন্ট্রি স্ট্যাম্প নেই। এটি একটি লম্বা মুহূর্ত ছিল।
১৯ বছর বয়সী এক ছাত্র আমাকে জানায় যে একজন উগ্র বেলুচি সেনা তাকে তার বাইসাইকেল থেকে থামায়। তার বয়স তার মতোই। তাকে জিজ্ঞেস করে কেন সে সাইকেলের হ্যান্ডেলবারে পাকিস্তানের পতাকা লাগায় নাই। সৈন্য তাকে যেতে দেয় – তবে যাবার আগে তাকে শার্টে রক্ত দিয়ে ক্যাপিটাল লেটারে পাকিস্তান শব্দটি লিখতে বলে। আমি বেলুচিকে বললাম, আমার কাছে ছুরি নেই এবং আমি আমার বাহু তার বেয়নেটের কাছে ধরলাম। সে আমাকে যেতে দিল।
এখন রাজধানীতে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা সন্ধ্যা হলে ঘরে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ, লুটপাট এবং হত্যা চালাতে থাকে। মেয়েদের অনেক সময় ছেড়ে দেয়া হয় যদি তারা মুসলমানের নামাজ পড়তে পারে। পুরুষদের থেকে তাদের মুসলমানি করা হয়েছে কিনা সেটা প্রমাণ করতে বলা হয়।
একজন ইউরোপিয়ান যিনি আমাদের পানীয়ের জন্য রাস্তার পাশে তার বাংলোতে নিয়ে যায় – সে পাশে একটি বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন যে, সেখানে গত রাতে দুটি শিশুসহ চারজন হিন্দুকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
ভারতীয় সীমান্তের কৃষ্ণনগর থেকে আমরা ঢাকার উদ্যেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু করেছি। এখানে আমরা ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গের সাপোর্টার পাই যারা মুক্তিফৌজের সমর্থক। তারা বাংলাদেশের লাল, সবুজ ও স্বর্ণের পতাকা উড়িয়ে পূর্ব-জার্মানীর তিনচাকার পিক-আপ ভ্যানে করে পেট্রোলের ড্রাম নিয়ে যাচ্ছে।
ট্রাক থেকে জ্বালানী বাঁশের তৈরি গরুর গাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়, যা পূর্ব পাকিস্তানের কুসুমপুর গ্রামে যাবে। আমরা তাদের সাথে গিয়েছিলাম। কোনও সীমান্তের চেক ছিল না এবং শুধুমাত্র কনিকাল আকৃতির পাথর নির্দেশ করছিল যে আমরা রেডক্লিফ রেখাটি অতিক্রম করেছি।
ভারতীয় গোলাবারুদ সহ ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর ছদ্মবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে -তেমন কঠিন না – কারণ তাদের উভয়ের পোশাক পুরাতন ব্রিটিশ পোশাকের অনুরূপ প্রায়। শুধু কাঁধের উপরের শোল্ডার-ফ্ল্যাশ টা পাল্টে দিলেই হল।
আমি পশ্চিমবঙ্গবাসীদের সাথে গিয়েছিলাম, জিজ্ঞেস করলাম তারা কি করতে যাচ্ছে। তারা বলেছিল যে তারা তাদের সমর্থন প্রদর্শন করতে এসেছিল। নিশ্চিতভাবেই, এক ঘণ্টার পর তারা আমাদের ছেড়ে চলে গেল এবং ভারতে ফিরে গেল। সব সময় সীমান্ত অতিক্রম একটি অত্যন্ত আবেগময় জিনিস হয়। কারণ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ থেকে এটি বন্ধ করা হয়েছে।
আমাদের প্রথম রাতে আমরা পুলিশ স্টেশনে কাটিয়েছি যেখানে তারা তাদের গার্ডের চৌকিগুলো পোস্ট করেছে এবং তাদের গাড়িগুলিতে ছদ্মবেশী জাল ফেলেছে। গত সপ্তাহে যশোরের যুদ্ধের সময় আমরা যে বিভ্রান্তি দেখেছি, তা খুব আশাপ্রদ। পরে আমরা জানতে পেরেছি যে লিবারেশন আর্মি এর দক্ষতা সাধারণত দূরত্বের উপর নির্ভর করে। এটি প্রকৃত যুদ্ধ থেকে দূরে ছিল। এই ঘটনা যশোর রাস্তার প্রায় ২০ মাইল দূরে ছিল।
ঢাকা আসার পুরো পথ বাঙালিরা আমাদের আতিথেয়তা করেছে। যে কোনও সাংবাদিক (নিউজ ক্যারিয়ার) যে গত সপ্তাহগুলোতে এই এলাকায় দিয়ে যাবে তাদের গ্রামবাসীরা খাবার ওঁ পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন না করিয়ে যেতে দেয়না। এবং তারা তাদের যুদ্ধের কথা বলে।
এমনকি কুষ্টিয়ার কাছে একজন বালুচি বন্দীকেও হত্যা করার আগে ডাব (সবুজ নারকেল) খেতে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন যে তার একটি ছোট ছেলে আছে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাকে যুদ্ধে জিত বাধ্য করেছে । কিন্তু এক ব্যক্তি বলেছিলেন যে তারওঁ একটি ছোট ছেলে আছে, আর এখন সে মারা গেছে। তারা তাকে প্রার্থনা করতে বলেছিল এবং তিনি আল্লাহর কাছে তার শান্তি কামনা করেন। তারপর তিনি তার শার্ট খুললেন এবং তার বুক উন্মুক্ত করেন এবং দেখান গ্রামবাসীর শরীরে এখানে সেখানে বর্শার দাগ।
কিছুক্ষণের জন্য আমরা এমন পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম যেদিক দিয়ে ৪৮ ঘণ্টা আগে পশ্চিম পাকিস্তানি মোটরচালিত যান চলে গিয়েছিল। রাস্তার উভয় পাশে পোড়ানো কুঁড়েঘর ছিল এবং কালিগঞ্জের কাছে একটি ফিলিং স্টেশন গ্লাস বুথে আমরা ৩২ টি বুলেটের গর্ত গুণে পেলাম।
কয়েকটি শহরে আমরা ঝাঁকুনি খেতে খেতে আসা কিছু বৃদ্ধ মানুষ দেখেছিলাম যিনি লাঠি দিয়ে ইংরেজিতে জোরে জোরে যুবকদের একটি দলকে কমান্ড দিচ্ছিল। তারা বাম থেকে ডানে গাছের কলামের মাঝ দিয়ে ড্রিল করছিল। তারপর তারা গাছের নিচে লুকাবে যেখানে আরেকজন বৃদ্ধ সৈন্য একটি ২৫ বছরের পুরনো লি-এনফিল্ড রাইফেলের নানান অংশের নাম বলতে লাগল।
অনেককে হত্যা করতে হবে আমাদের
কিন্তু ঝিনাইদহে বাজারে আমরা ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করি – ২৬ বছর বয়সী সাবেক সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট চতিনি। তিনি একজন বাঙালি তবে লম্বা ছিলেন এবং তার পুলিশ রিভলভারের কাঁধের সাথে রেখে একটি বোতামযুক্ত শার্টের কলার থ্রেড করে রেখেছিলেন যাতে তাকে প্লেবয়ের মত দেখাচ্ছিল। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার এলাকার প্রতিরোধ শুরু করার জন্য প্রশংসার দাবিদার। যখনি তিনি ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের কথা শুনলেন তিনি তার আর্মারি খুললেন এবং রাইফেল বের করে দিলেন।
তার একটি সুন্দর শৈলী ছিল, স্থানীয় সরকার অফিসে একটি চামড়ার আর্মচেয়ারের পা ফ্লপ করে বসে তিনি তার সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন এবং বলেছিলেন: “ওইসব জঘন্য পাঞ্জাবি এবং ওইসব বিচ্ছিন্ন বিহারি- আমাদের অনেক হত্যা করতে হবে।’’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তিনি কোথায় তাঁর চমৎকার ইংরেজী শিখেছেন এবং তিনি তখন কিছু তার দেশ ধ্বংস সম্পর্কে কিছু মাওবাদী মন্তব্য করেন যা ২০০ বছর ধরে দেশকে নষ্ট করছে।
তাঁর লোকরা ১২ -বোরের শটগান থেকে এ.কে. এসাল্ট রাইফেলে সজ্জিত যার সাথে পূর্ববাংলা রেজিমেন্ট যোগ হয়েছে। তারা L- আকৃতির খাত খনন করেছে এয়ার এটাক থেকে বাঁচতে এবং তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সুসংগঠিত দল হিসাবে অবস্থান করছে।
প্রথম ৯০ মাইলের পথ ধরে গঙ্গার পাশে জেলেদের গ্রাম ও গোয়ালন্দ কাঠের ব্রিজ আগুনে পুরীয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তায় বড় বড় গাছের গুড়ি ফেলে ব্লক করে দেয়া হয়েছে। হাইওয়েতে এন্টি ট্যাঙ্ক ডিচ করা হয়েছে। এক সময়ে আমাদের ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে বহু মাইল হেঁটে আসতে হল। বর্ষা সন্নিকটে। আর্মি এর আগে আর অপারেশন চালাতে পারবেনা।
আমরা পাকসেনাদের সামরিক অভিযান প্রথম দেখলাম যখন আমরা গোয়ালন্দ থেকে গঙ্গা পার হচ্ছিলাম বিলাশপুরের দিকে যাবার জন্য। আমরা একটি পুরাতন মোটর লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম যেটা চালচ্ছিলেন সাদা দাঁড়ির একজন চালক। সে চাকার পাশে একটি বেঞ্চে পা ক্রস করে বসে ছিল। যখন আমরা মাঝনদিতে ছিলাম একটি আর্মি হেলিকপ্টার – দেখতে ওয়েস্টারল্যান্ড ওয়েসেক্স এর মত – সেটি আমাদের খুব কাছাকাছি আসল – এবং আমরা চালকের সাথে ইঞ্জিনরুমে ঢুকে গেলাম।
ফিরে আসার পথে পাঁচ ঘন্টা যাত্রায় আমরা একটি বাসের আশ্রয়ে ছিলাম সারাক্ষণ। আমরা যখন ফরিদপুর পৌঁছলাম, তখন আমরা শুনেছিলাম যে গোয়ালন্দে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। আমরা সরাসরি সেখানে গিয়েছিলাম এবং দেখলাম তাই হয়েছিল। আসলে এখানে কামান ও রকেট ফায়ার করে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়েছে। গ্রামবাসী আমাদের রকেটের এলুমিনিয়াম বিট দেখাল। আক্রমণ হয়েছে ইস্টার রবিবার দুপুর আড়াইটায়। চারজন নিহত এবং আটজন আহত হয়েছে।
তিন মাস ধরে রাতের বেলা এই জায়গার কুটিরগুলো এতটা নিশ্চুপ থাকে যে মনে হয় সবাই মারা গেছে। ছিদ্রওয়ালা ছাই রঙের ছাদ ও মাঝে মাঝে সস্তা মোটা রবারের স্যান্ডেল যা বেশিরভাগ বাঙালি কৃষকই পরে। সর্বত্র মাছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কারণ কয়েকজন গ্রামবাসী সরাসরি বন্দুকের শেল থেকে আঘাত পেয়েছিল এবং তাদের কিছু টুকরো অংশ এখনো মাটিতে ছিল।
একজন মুক্তিফৌজ একটি ধূসর-মুখের যুবককে একটি কম্বলে জড়িয়ে কাঁধে করে নিয়ে এলো এবং তার শার্টটি উঁচু করে দেখাল যেখানে একটু ধারালো শার্পনেল ঢুকেছে। মাথায় ক্ষততে একটি ব্যান্ডেজ ছিল। আমরা তাকে আওয়ামী লীগের ফরিদপুর শাখার কাছ থেকে নেওয়া পিক-আপ ট্রাকের পেছনে নিয়ে রাজবাড়ী হাসপাতালে নিয়ে গেলাম,। সেখানে সাদা টুপি পড়া নার্সিং বোনরা আমাদের দেখে বিস্মিত হয়েছিল। ফিরতি পথে আমরা অর্ধ ডজন নিরস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানি পুলিশদের ধরলাম এবং হঠাৎ বুঝতে পারলাম বিমানের জন্য একটি ছোট্ট টার্গেটে পরিণত হতে পারি।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৯। পাকিস্তানঃ কথা বলার সময় এসেছে | সানডে টাইমস | ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১৪, ১৪৯, ৩৬৫-৩৬৬>
সানডে টাইমস, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১
পাকিস্তান: কথা বলার সময় এসেছে
সানডে টাইমসের গত দুই সংখ্যায় আমরা পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। এর সাথে অন্যান্য সোর্স থেকে পাওয়া খবরে এটাই প্রমাণিত হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের জোর করে চাপানো সিদ্ধান্ত সেখানে একটি ভয়ানক সাম্প্রদায়িক রক্তগঙ্গা সৃষ্টি করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের গণতান্ত্রিকভাবে প্রকাশিত অভিলাষকে বুলেট দিয়ে দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরবর্তি পাতায় একই সংবাদদাতা পশ্চিম পাকিস্তান ভিজিট করার পরে সেখানকার প্রভাব ও তাদের কাজ সমপর্কে উল্লেখ করেছেন। সন্দেহ নেই যে একটি ভয়াবহ ভুলের জন্য ভয়াবহ ট্রাজেডি সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ নির্মম্ভাবে প্রত্যক্ষ করছে কীভাবে একটি জাতি আরেকটি জাতিকে হত্যা করছে। কিন্তু উপমহাদেশে বা তার বাইরে এমন কেউ নেই যে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারকে হত্যাকাণ্ড থেকে ফেরাবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ন্যায়বিচার করতে যেয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। পাকিস্তানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য তার দেয়া নির্বাচন প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল। সেই নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তার দল পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ জয়যুক্ত হয়। রাজ্য প্রধান হিসেবে ইয়াহিয়া খানের দায়িত্ব ছিল পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতাবাদ নির্মুল করতে সেখানকার একতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু মুজিব আলোচনার চূড়ান্ত পর্বে সহমত হননি।
তাছাড়াও এটা অনুমেয় যে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে সিদ্ধান্তই নিক তাতে সামরিক শক্তি প্রদর্শন বাড়বে এবং বাঙ্গালীর আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হবেনা। রক্তপাতের বাইরে ইয়াহিয়া খানের অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে মাওবাদীদের পথ খোলা। এদিকে নকশাল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাচ্ছে। কিন্তু মুজিব যৌক্তিকভাবেই তার অবস্থান ধরে রেখেছেন।
ইসলামাবাদের উপর এখন শোচনীয় মেঘ জমে আছে। এখন অন্যান্য সরকার – এমনকি ব্রিটিশ সরকারেরও দায়িত্ব আছে এটাকে সমাধান করার। স্যার স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বলেছিলেন ‘এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ – শুধু এটা বলেই শেষ করা যাবেনা। আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে কিন্তু এখানে আছে অন্যায় আর মানবতাবিরোধি অপরাধ। যেখানে ভারত, চীন ও রাশিয়া জড়িত সেটাকে আভ্যন্তরীণ বলার কোন মানে নেই।
সময় এসেছে। এখন ব্রিটিশ সরকারকে প্রকাশ্যে পুর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলির বিরুদ্ধে তার বিতৃষ্ণা প্রকাশ করতে হবে। অধিক প্রথাগত, এবং ব্যক্তিগত, কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে, ইয়াহিয়া খানকে জানাতে হবে যে (যদি ইতিমধ্যে না করা হয়) তার পলিসি কতটা বিপজ্জনক এবং ভুল। দরকার হলে পাকিস্তানে বৈদেশিক সাহায্যের সরবরাহকারীদের এইড দেয়া বন্ধ করার ব্যাবস্থা করতে হবে। সবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করতে হবে। যত দ্রুত ইয়াহিয়া বুঝতে পারবেন যে আলোচনার জন্য মুজিবকে ঢাকায় পাঠাতে হবে ততই মঙ্গল।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫০। বিশ্বের সাম্প্রতিকতম শরনার্থী
|
গার্ডিয়ান |
৭ই মে,১৯৭১
|
Saiful Arefin Borshon
<১৪, ১৫০, ৩৬৭>
দ্যা গার্ডিয়ান,লন্ডন, ৭ই মে,১৯৭১
বিশ্বের সাম্প্রতিকতম শরনার্থী
পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রুক্ষ সামরিক কর্মের প্রভাব সহ্যসীমার বাহিরে। তার সামরিক বাহিনী তারই দেশের অনেক মানুষের মৃত্যুর কারন। আর এই শক্তি প্রদর্শনের প্রভাবে শরণার্থী হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। কয়েক হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন ক্ষুধা এবং আশ্রয়স্থলের অভাবে। ভারতীয় সুত্রমতে, নিজেদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যাসহ প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ ভারতে চলে গিয়েছে। সন্দেহাতীতভাবেই কিছু বাংলাদেশ সৈনিক সেনাবাহিনী থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু এদের মধ্যে বেশিরভাগ সাধারন মানুষই আশ্রয় নিচ্ছে এই আশা নিয়ে যে তারা আবার ফিরে যাবে এবং আগের মতো বসবাস করবে। এদিকে ভারত, যারা উদ্বাস্তুদের কারনে বিপাকে, রাজনৈতিক দন্দে লিপ্ত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান নিয়ে।উন্নত বিশ্বকে এই অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে এবং বন্যার আগেই খাবার এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে বেশি করে ত্রানের প্রয়োজন। সবচেয়ে অর্থহীন হচ্ছে এই যে, যে ভারত তাদের নিজেদের বিশাল জনগোষ্ঠী এবং এই শরণার্থীদের নিয়ে বিপাকে, সেই ভঙ্গুর অর্থনীতির ভারতকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। এমনকি সীমান্তের পাশেই বাড়ি থাকায় পরিস্থিতি শান্ত হলেই বাড়ি যেতে ইচ্ছুকদের ফেরত যাওয়া নিয়ে ভারত সরকারকে যাতে সেই ধকল সইতে না হয় সেই জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রয়োজন।
সবচেয়ে বেশি অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে, যেখানে তারা সবসময় থেকে এসেছে। উদাহরন স্বরূপ যাদের পক্ষে সীমান্ত অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। গত নভেম্বরের সাইক্লোনে যাদের ফসল ভাল হয়নি বলে পাকিস্তান সরকার সাহায্য দিবে বলেছিল, হয়তোবা তাদের অবস্থাই সবচেয়ে করুণ। তাদের এই দুরাবস্থা ছরিয়ে পড়ছে যুদ্ধের কারনে স্থানচ্যুত হবার ফলে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অপ্রতুল। এখন যদি খাবার সরবরাহ করা কষ্টকর হয়, বৃষ্টি শুরু হলে তা আরও বেশি কষ্টকর হবে। আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ খুব দ্রুত প্রয়োজন এই ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে এবং প্রতিরোধ করতে। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগা মানুষের জন্য এই অবশ্যই খাবার এবং আশ্রয়স্থল সরবরাহ করা প্রয়োজন।
শিরোনাম | সুত্রঃ | তারিখ |
স্তব্ধ বিবেক
|
দ্যা গার্ডিয়ান | ১৩ মে, ১৯৭১ |
<১৪, ১৫১, ৩৬৮–৩৬৯>
স্তব্ধ বিবেক
সুত্রঃ দ্যা গার্ডিয়ান
তাঃ ১৩ মে, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
আগামিকাল, বেশ কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে, অবশেষে সংসদে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা হতে যাচ্ছে। এর ফলে পরিস্থিতি সকলেই বুঝতে পারবে বা এই আলোচনায় খুব কাজ হবে, এমনটা আশা করা উচিত হবে না কারোই। বাঙালির স্বাধীনতার দাবীর যে আন্দোলন তা দমনের জন্য ছলনা শুরু হয়ে গেছে। একদিকে ভারতের কাছ থেকে প্রচুর ও বিভিন্নমুখী সতর্কবার্তা, অন্যদিকে স্যার অ্যালেক ডগলাসের প্রচুর সংখ্যক নীরস ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ক্ষমতার এই খেলায় নানা মাত্রা যোগ করে যাচ্ছে। সাত সপ্তাহ আগে, সপ্তাহান্তের শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়। আগামিকালের বিতর্কে যারা অংশগ্রহন করবেন, তারা চান এইচ এম জি যেন অবিলম্বে শান্তিস্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেয়, যদিও ৭০,০০০ বেয়নেটের আঘাতে শান্তি পালিয়ে গেছে।
বেশিরভাগ কূটনৈতিক নীতি অনুযায়ী, এখন জোরাল তদবির বা নৈতিকতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা, কিংবা যুদ্ধ প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা গ্রহন করার সময় চলে গিয়েছে। ইসলামাবাদের আর্মি জেনারেলদের কেউ পরোয়া করেনা, কিন্তু একিসাথে এত নির্দয় একটি বাহিনী এশিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে থাকবে, তা কোন সরকারের জন্যই হাল্কাভাবে নেয়া উচিত হবে না। সেখানে একজন বিদেশী কর্মকর্তা হয়রানির স্বীকার হলে কি করেন? নীরবতা পালন করেন, রাওয়ালপিন্ডির কারো জন্য এখন চট্টগ্রামের কাউকে সাহায্য করা সাহসিকতা নয় বরং লজ্জার বিষয়। এসকল বিষয় ভুলে যেয়ে শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ পীড়িত জনগনের ত্রাণ নিশ্চিতকরনের দিকে মনোনিবেশ করা কি যথার্থ? শরণার্থীদের জন্য কর্মসূচী দেয়া বা বিমানে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করেই কি আমরা মুল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যেতে থাকব?
এর মধ্যে অনেকগুলোই অত্যন্ত জরুরী হলেও, প্রতিটি কর্মসূচিরই একটি দৃঢ় উদ্দেশ্য থাকতে হবে, এবং সে উদ্দেশ্যটি অবশ্যই নৈতিক এবং যুক্তিযুক্ত হতে হবে। পার্লামেন্ট এখনও হোমের সদস্যদের এই বার্তাটি বুঝিয়ে উঠতে পারেনি। সাত সপ্তাহ আগে, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা, যিনি নির্বাচনে জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান তথা সমগ্র পাকিস্তান শাসনের ক্ষমতা পেয়েছিলেন, তিনি একজন অনিরবাচিত সামরিক প্রেসিডেন্ট এর সাথে সমঝোতা আলোচনায় বসার কিছুদিন পর গ্রেফতার হন। এই আলোচনা কোন সমাধানের দিকে যাচ্ছিল না। মুজিব নির্বাচনে জয়ী হয়ে কিছুটা দাম্ভিক হয়ে উঠেছিলেন এবং কিছু আদর্শগত অবস্থান থেকেও চাপের মুখে থেকেও তার দাবিগুলো আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, ইয়াহিয়া কেবল ভুট্টোর সাথেই কথা বলে যাচ্ছেন, যাকে তিনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ধরেই নিয়েছিলেন। পশ্চিমের ভুট্টো, পূর্বে তেমন গুরুত্ব না পেয়ে যেভাবে যখন সম্ভব, আলোচনায় কেবল বিঘ্নই ঘটাচ্ছিলেন। তারপর হঠাত করেই তা স্থগিত হয়ে যায়। জাহাজে করে সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে এসে পুরোদমে হামলা শুরু করে ঢাকায়। মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়, তার অনেক সহযোগীকে হত্যা করা নিজের বাড়ির আঙ্গিনাতেই। কয়েক সপ্তাহ টানা এলোপাথাড়ি সংঘর্ষ চলে, যেন একদিকে প্রতিপক্ষের যুদ্ধ বিমান আর অন্যদিকে তীরধনুক, কেননা অন্যান্য অস্ত্রধারী বাঙালি বাহিনীদের উপর সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন চালানো হয়।
এর ফলে ঠিক কতজন নিহিত হয়েছে? বাঙ্গালীদের কথা অনুযায়ী সংখ্যাটি প্রায় দশ লক্ষ। অন্যদিকে ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি বলছেন সম্ভবত ১৫,০০০। যদি তাও হয়, তারপরও যদি যুক্তি দিয়ে বিচার করা হয়, তবে ধারনা করা যেতে পারে যে ১৫,০০০ নিহতের বিনিময়ে যদি পাকিস্তানের এই দুই প্রদেশ আবার একত্রিত হয়, তবে সেই ঐক্য খুব বেশি দৃঢ় হবেনা।
পূর্বের বাঙ্গালিরা যদি পশ্চিমের সাথে কোনভাবে সংযুক্ত থাকতো, তবে ক্ষতির চেয়ে তাদের লাভই বেশি হত কিনা সে বিতর্ক তুলছেন অনেকেই, দ্যা গারডিয়ানের মতে তাদের লাভই হত। মুজিব ও বেশিরভাগ প্রচার মাধ্যমে এমনটিই বলেছিলেন। তিনি কখনও গনতান্ত্রিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তিনি কেবল শোষণের হাত থেকে বাঙ্গালীকে রক্ষা করতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী স্বায়ত্বশাসনের দাবী করে যাচ্ছিলেন, এবং সেই অবস্থানেই অনড় ছিলেন। তার এই দাবীতে তিনি জনগনের কাছ থেকেও বিপুল সারা পেয়েছিলেন। যতক্ষন পর্যন্ত ইয়াহিয়া এবিষয়ে দরকষাকষি করছিলেন, তার কর্মকাণ্ড সম্মানজনক পর্যায়ে ছিল। ঠিক যে মুহূর্তে তিনি আলোচনা বন্ধ করে দিলেন, সে মুহূর্ত থেকেই তিনি মূর্খের মত অপকর্মের পথ বেছে নিলেন। তিনিই নির্বাচন দিয়েছেন। এখন তিনিই সেই নির্বাচনের মুল উদ্দেশ্য ও নির্বাচিত মানুষদের বিরোধিতা করছেন। তিনি যে আসলে গনতন্ত্রের পক্ষপাতি নন, কেন্দ্রিয় সরকারের এমন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের জন্য সঠিক হবে না ভুল, তা উপলব্ধি করতে আসলে কারো আওয়ামীলীগের সমর্থক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো খেয়াল করলেই তা সহজেই বুঝতে পারবে যে কেউ।
স্বাভাবিকভাবেই কিছু মৌলিক বিষয়ে অসংখ্য সমস্যা সকলকেই ভাবিয়ে তুলছে। পাকিস্তান আর ভারতের বহুবছর ধরে চলে আসার শত্রুতার জালে আটকা পরেছে বাংলাদেশ। ইয়াহিয়া প্রকাশ্যে (এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সময় প্রচ্ছন্নভাবে) মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি আসলে মিসেস গান্ধীর সাহায্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রধান হতে চেয়েছিলেন। ২০ লক্ষ বাঙালি সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর সেই সাথে অনাহারে থাকার প্রস্তুতিও।
শরণার্থীদের ত্রাণ যদি আরও বিলম্বিত হয় তবে প্রচুর মানুষ অনাহারে মারা যাবে ও আরও বেশি দুর্যোগের কবলে এ অঞ্চল পড়বে বলে মত দিয়েছেন ত্রাণ কর্মকর্তারা। চায়না জল ঘোলা করে তুলছে, অন্যদিকে আমেরিকা সহ অন্যান্য আতঙ্কিত দেশগুলো পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেবার কথা ভাবছে, যদিও তারা জানেন যে এর ফলে অশিক্ষিত দরিদ্র জনগণই দুর্ভোগে পরবেন, ফিটফাট পোশাকের জেনারেলরা নয়।
এমন একটি সময়ে সবাধিনতায় বিশ্বাসী কোন সরকার কি ধরনের আচরন করবে? সেটি নিশ্চয়ই “অভ্যন্তরীণ বিষয়” এর মত কূটনৈতিক বুলি দিয়ে সবকিছুকে আড়াল করতে চাইবে না। তাদের মনোভাব হবে উদার। ইয়াহিয়ার লোকেরা যখন মুজিবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছিল, তখন তা থামানোর মত সঠিক কাজটা করাই যথার্থ ছিল (শেষ কবে একজন অসৎ বিদ্রোহী নেতা নিজের বাড়িতে বসে বন্দী হবার জন্য সেনাদের আসার অপেক্ষায় ছিলেন?)
একটি উদার প্রশাসনের উচিত দ্রুত বিচারের জন্য চাপ দেয়া, যত দ্রুত সম্ভব এবং যতখানি সম্ভব ত্রাণ পাঠানো (যদিও নভেম্বরের পরে যথেষ্ট ত্রাণ পাঠানো হয়েছিল)। নিজ থেকেই এখন পাকিস্তান প্রশাসনের কাছে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া ছাড়াও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর পলিসি পরিবর্তন করে পাকিস্তানের অস্ত্র ক্রয় ও প্রতিরক্ষার জন্য বরাদ্দ সকল সাহায্য বন্ধ করে দেয়া উচিত। একটি উদার মনা সরকারের উচিত উপ্রোক্ত সকল সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে কেবল ত্রাণ এর কাজ করা, শুধু মাত্র ত্রাণ পাঠানো, সেইসব লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য যাদের বেচে থাকার জন্য এখন ত্রাণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পরেছে।
এই মুহূর্তে কোন গনতান্ত্রিক কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজন নেই, যেমন ধরা যাক এই তাবেদার পূর্বাঞ্চলীয় রাজনীতিবিদদের কাছে এই চলমান অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অনিবার্য স্থানান্তর, কেননা তাতে ইয়াহিয়ার রাষ্ট্র বলতে কিছু থাকবে না। সবচাইতে বড় কথা, এধরনের কাজের ক্ষেত্রে কোন দেরি বা অনীহা দেখানো চলবেনা।
বাংলাদেশের ভাগ্যে আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে আজ কিছু পন্ডিত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, চরমপন্থিদের কারনে বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনের দাবিতে এই অঞ্চল দীর্ঘদিনের জন্য যুদ্ধাবস্থায় জড়িয়ে পড়বে। আওয়ামী লীগ কার্যত এখন ভেঙ্গে পরলেও সত্যিকারের গেরিলা যোদ্ধাদের একত্রিত করে তাদের যুদ্ধে নামতে হবে, তাতে মাস, বছর কিংবা লাগতে পারে এক দশক ও। কিন্তু কালকের সংসদিয় বিতর্ক, বা কোন সরকারের মুখপাত্রই এই হতাশাজনক স্থবির অবস্থা নিয়ে কথা বলেন না, তারা এখনও ভান করেন যে তারা বিশ্বাস করেন ইয়াহিয়ার রাষ্ট্র মুখ থুব্রে পড়বে না এবং আবার পাক্সিতান একত্রিত হয়ে উঠতে পারবে। যেখানে তাদের ভেঙ্গে যাওয়াটা এখন কেবলি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই ভেঙ্গে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি কিছুটা শান্তিপূর্ণ ও কম রক্তপাত দ্বারা সম্ভব হত যদি মুজিবকে মুক্ত করে এর ভার দেয়া হত (কেননা, মুজিব এখন পর্যন্ত নিজেকে একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবেই প্রকাশ করে এসেছেন, কখনও কখনও তা ক্লান্তির উদ্রেক করলেও)। এর ফলে শরণার্থীরাও বাড়ি ফেরত যেতে পারবেন, কারখানগুলোকে আবার সচল করে তোলা সম্ভব হবে, নতুন দিনের বীজ বপন হবে। ইসলামাবাদ কোন দুর্ভেদ্য দুর্গ নয়, নিছকই কিছু মরিয়া লোক একে দুর্ভেদ্য কল্পনা করেন। তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব না, কিন্তু ইতিমধ্যেই তারা মিঃ ভুট্টোর কাছে পরাজিত হচ্ছেন এবং ব্যাবসায়ীরাও তাদের এই ভ্রম ধীরে ধীরে ভুল প্রমানিত করে দিচ্ছেন। সংসদ কি সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে আসলে কতজন এমপি এই আলোচনায় অংশ নেবেন। আগামি ছয় মাস ব্রিটেন কিধরনের আচরন করবে তা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের মতামতের উপর প্রভাব ফেলবে, এবং সেটিই জরুরী কেননা এই পাকিস্তানের মতামতের কারনেই গত দুই মাসে এমন সব ক্ষতি হয়ে গেছে যা চাইলেও আর পুরন করা সম্ভব নয়।
শিরোনামঃ | সূত্র | তারিখ |
অবিশ্বাস্য দুর্ভোগ | দ্যা টাইমস,লন্ডন, | ১৫ই মে,১৯৭১ |
<১৪, ১৫২, ৩৭০–৩৭২>
অবিশ্বাস্য দুর্ভোগ
পিটার হ্যাজেলহারস্ট
উত্তর- পূর্ব ভারতের কলকাতার ৫০ মাইলের বনগাঁ শহরে ১৪ই মে একজন ক্লান্ত চিকিৎসক পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের দিকে আশাহত ভাবে তাকান। উদ্বাস্তুদের কারনে জনসংখ্যা প্রায় দিগুণ হয়েছে। তাদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন,‘মৌসুমি বৃষ্টি শুরু হলে এদের পরিণতি কি হবে?কুঁড়ে ঘর বানানোর জন্য তাদের খড়ও নেই এবং আমরা সন্ধিহান যে আমরা কলেরার হাত থেকে এই অবস্থায় নিয়ন্ত্রন করতে পারব কি না। তারা মাছির মত মারা পর্বে’।
এটা অনুমান করা হয় যে গত কয়েক সপ্তাহে সীমান্ত দিয়ে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ অনুপ্রবেশ করেছে এবং এর মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ বনগাঁ ও এর আশে-পাশের এলাকায় অবস্থান করছে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে গৃহযুদ্ধ, খাদ্যাভাব এবং দারিদ্রের হারত থেকে মুক্তি পেতে তারা অসহায় এবং নিঃস্ব ভারতে প্রবেশ করছে।
ভাগ্যবানরা বনগাঁ’র অদুরে ভারত সরকার এবং আন্তর্জাতিক ত্রান সংস্থানের নির্মাণ করা আশ্রয়স্থলে জায়গা পাচ্ছে কিন্তু বিদ্যালয়,সরকারি ভবন এবং ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তাই নতুন্দের ভাগ্যের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
যাদের কাছে অল্পকিছু টাকা আছে তারা ঘাসের মাদুর কিনেছে এবং তা দিয়েই করুনভাবে রাস্তার পাশের পরিত্যেক্ত জায়গায় ঘর বানিয়ে থাকছে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ পুরুষ,শিশু এবং নারীসহ যারাই এসেছে তারা সবাই পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের মানুষ যাদের বছরে আয় মাত্র ৩০ পাউন্ড এবং তারা শুধু কিছু ছেঁড়া জামা-কাপড় ছাড়া আর কিছু নিয়েই আসেনি।
শুকনো মুখ এবং অন্তঃসারশূন্য চোখ নিয়ে তারা দক্ষিন-পশ্চিমের জনাকীর্ণ শহর কলকাতায় প্রবেশ করতে চাইছে যেখানে কয়েক লাখ মানুষ ফুটপাতে থাকা নিয়েই ধাক্কাধাক্কি করছে।
আমরা যখন উদ্বাস্তুদের অতিক্রম করছিলাম তখন সেন্ট পল কলেজের ছাত্র Daniel Dolui যে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সি.এ.এস.এ এর সাথে সম্পৃক্ত সে বলছিল, ‘এর শেষ কোথায়? জেলা শহরে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার উদ্বাস্তু প্রবেশ করছে। ২ দিন আগে তাবু ছিল ১১টি। এখন ২২টি’।
দুঃখ ও দারিদ্রতা এখানে অবিশ্বাস্য। ভারত সরকার একটি মহৎ কাজ করেছে কিন্তু এটি হঠাৎ করেই করা এবং এর সম্পদও সীমিত।
আমরা গ্রামের একটি বিদ্যালয় অতিক্রম করেছি যা এখন শিশু ও মহিলাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপাসনালয়গুলোর রান্নাঘরের বাহিরে ছিল বিশাল লাইন। কেউ কেউ ৫ ঘন্টা ধৈর্য ধরবে রান্না করা ভাতের জন্য।
কিছু ভাগ্যবান শিশু গির্জার বিতরণের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে খাবার জন্য দুধ পাবে।
সেখানে আর কোন ক্যানভাসের ব্যবস্থা নেই, বেশিরভাগ আশ্রয়স্থল বাঁশের কাঠামো দিয়ে পাতলা ঘাসের আবরণ দিয়ে তৈরি। তবে বেশিরভাগ মানুষই খোলা আকাশের নিচেই থাকছে। সরকারি ভবনের সিঁড়ি, বারান্দা এবং পরিত্যক্ত জায়গায় যারা একটু ঘুমানোর জায়গা পেয়েছে, সেটাই তাদের কাছে অনেক মূল্যবান।খাবারের জন্য নারী এবং পুরুষের লাইনে দেখা গিয়েছে একচতুর্থাংশ শিশুদের।
কয়েক লাখ বাঙালি যারা আশ্রয়ের খোঁজে আছে তাদের মাঝে একজন হচ্ছেন যশোরের দিনমজুর ২৫ বছর বয়সী Kati চন্দ্র দে। বনগাঁয়ের উপকণ্ঠে বাচ্চা কোলে পরিবারের সাথে তাকে পাওয়া গিয়েছে। আশ্রয়ের জন্য তিনি এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে তিনদিন হেঁটেছেন কিন্তু এখানেও কোন জায়গা পাননি।
কেন তিনি পূর্ব পাকিস্থান ছেড়েছিলেন? ‘যখন পাকিস্তান আর্মি তাদের অভিযান শুরু করে তখন আমাদের ধারণা ছিল তারা মূলত হিন্দুদের হত্যা করবে। তারা পেট্রোল দিয়ে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আমরা পালিয়ে এসেছি’। পশ্চিম বাংলায় যেসকল উদ্বাস্তু রয়েছে তাদের বর্ণনা অনুযায়ী পাকিস্তানী বাহিনী হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানদেরকেই মূলত আক্রমণ করেছে।
একজন বাঙালি স্বেচ্ছাসেবক আমাকে জোর দিয়ে জানিয়েছে, ‘এইখানে কোন বিহারী উদ্বাস্তু নেই’। ‘দুইদিন আগে ১৪ জন পশ্চিম বাংলায় আসতে চেয়েছিল কিন্তু রাস্তায় বাঙ্গালিরা তাদের লাঠি আর পাথর মেরে হত্যা করে’।
আর্মিরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং বেশিরভাগ উদ্বাস্তুই এই বিশাল হত্যা ও খুনের পরই দেশ ত্যাগ করেন।
২৫ বছর বয়সী হাসান আলী যশোরের একজন চাষি। তিনি বনগাঁয়ের উপকণ্ঠে সিএএসএ এর হাসপাতালে ছিলেন যা স্যালভেশন আর্মির প্রধানকেন্দ্র। তিনি বলেন যে পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্বাস করতে চায়নি যে তিনি মুসলিম এবং তাকে ক্ষেতের মাঝেই গুলি করা হয়।
তিনি তাঁর ঘাড়ের বড় গর্ত এবং কাঁধের ক্ষত দেখিয়ে বলেন যে অবিশ্বাস্যভাবে তিনি মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছেন।
‘আমি যখন মাঠে কাজ করছিলাম তখন পাকিস্তান বাহিনী পিছন থেকে আসে। ৭০ জন সৈন্য আমাদের ৩ জনকে ঘিরে ফেলে। তারা জানতে চাইছিল আমরা হিন্দু নাকি মুসলমান।
তারা বিশ্বাস করতে চাইছিল না যে আমরা মুসলমান। তারা আমাদের হাত মাথার উপরে করতে বলে এবং আমরা আমাদের ছেড়ে দিতে বলি। তারপর তারা গুলি শুরু করে আর আমি জ্ঞান হারাই’।
সেই যশোরের ৭০ বছরের হিন্দু শ্রমিক বিনোদ বিহারী শাহ্ও আমাদের একই গল্প শুনিয়েছেন। তিনি তাঁকে ছেড়ে দিতে বলেন কিন্তু গুলি তাঁর হাতের আঙ্গুলকে ক্ষত-বিক্ষত করে। তাই তিনি হাত বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘দুইজন সৈন্য আমার বাড়িতে এসে আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে বলে। মুল সড়ক থেকে আমার ঘর ২০ গজ দূরে। প্রথমে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি বাঙালি নাকি বাঙালি না। তারপর জিজ্ঞেস করে আমি হিন্দু নাকি মুসলিম’।
‘যখন আমি বলি আমি হিন্দু,তখন তারা আমাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বলে এবং তাদের বন্দুক প্রস্তুত করে। আমি বুকের কাছে হাত জোর করি এবং আমাকে গুলি করতে না করি কিন্তু তারা গুলি করে। গুলি আমার হাত ভেদ করে এবং আমার বুকের উপরের অংশে লাগে। আমি মাটিতে পড়ে যাই এবং মারা যাওয়ার ভান করি’।
ভারতীয় সীমান্ত থেকে ১৭ মাইল পূর্বের দিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা ২৫ বছর বয়সী আহমেদ আলী। তিনি চাষাবাদ করতেন। তাঁর ডান পা এবং বাম হাত প্লাস্টার করা। তিনি বলেন,‘প্রায় দুই সপ্তাহ আগে সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে এবং সব যুবকদের আটক করে ১ মাইল দুরের মহাদেবপুর গ্রামে নিয়ে যায়।
তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা বাঙালি নাকি বাঙালি না এবং আমাদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে। তারা আমাদের ঘিরে ফেলে এবং গুলি করা শুরু করে। একটি গুলি আমার হাতে আঘাত করে কিন্তু আমি তখন শুয়ে থাকি। যাওয়ার আগে তারা বেয়োনেট দিয়ে আমার কুঁচকিতে আঘাত করে এবং আমার পায়ে আঘাত ও ভেঙ্গে দেয়’।
জনাব আলী বলেন যে তিনি এবং আরো তিনজন আহত অবস্থায় পালাতে সক্ষম হন এবং তাদেরকে ভারতীয় সীমান্তের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়।
সিএএসএ এর ছোট্ট হাসপাতালে ছিলেন যশোরের চায়ের দোকানের মালিক নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা আটক করে এবং বাজারের কেন্দ্রে নিয়ে যায় যেখানে বাঙালি পুলিশ অসংখ্য পশ্চিম পাকিস্তানি এবং যারা বাঙালি নয় তাদের গতমাসে হত্যা করে।
আর্মিরা ধারণা করে চায়ের দোকানি পুলিশের লোক এবং হিন্দু। তাঁকে হাঁটু গেঁড়ে বসানো হয় এবং সৈন্যরা তাঁকে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে। তিনি তাঁর ক্ষত-বিক্ষত পাকস্থলি এবং বুক দেখান। তারপর তিনি জ্ঞান হারান। সৈন্যরা তাঁকে মৃত ভেবে চলে গেলে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে উদ্ধার করেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫৩। বাঙলার পীড়িত জনগণ | টাইমস |
১লা জুন,১৯৭১
|
<১৪, ১৫৩, ৩৭৩>
দ্যা টাইমস,লন্ডন, ১লা জুন, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
লাখো বাঙ্গালীর দুর্ভোগ
গত ছয় সপ্তাহ ধরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তুদের অনুপ্রবেশ ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে পূর্ব দিকে ত্রিপুরায়, উত্তর দিকে আসামে এবং সবচেয়ে বেশি পশ্চিম বাংলায়। ভারত সরকারের এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টায় এতোটুকু আশা করাই যায় যে ভীষণ অভাবে থাকা মানুষগুলোর জন্য এতটুকু হলেও কিছু করা সম্ভব। প্রথম এবং জরুরী হচ্ছে খাদ্য। আর এই মৌসুমে যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হতে পারে এবং তখন আশ্রয়স্থল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আশে-পাশের রোগ-শোক নিয়ে। আমাদের প্রতিবেদন অনুসারে সেখানে কলেরার প্রকোপ দেখা দিয়েছে যা মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে। অন্যদিকে কলকাতার মত ভঙ্গুর কাঠামোর শহরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বিরাজ করে সেখানে উদ্বাস্তুদের অনুপ্রবেশও উদ্বেগজনক।
উদ্বাস্তুদের সামনে এখন অনেক বড় সমস্যা যা তারা গত শরতের সাইক্লোনেও অনুভব করেনি। তা ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানদণ্ডের হিসেবে খুব কমই সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল। তখন মূলত সাহায্য প্রয়োজন ছিল তাদেরই যারা তাদের ঘর হারিয়েছিল এবং যাদের নিজেদের জমি-জমা পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সবারই নিজস্ব শক্তি ছিল এবং মনের মধ্যে ছিল আশা যে তারা তা করতে পারবে। আর ভারতে প্রবেশকারী উদ্বাস্তুরা মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগে ভুক্তভুগি। আমাদের সংবাদদাতাদের সীমান্তের সেইসব অঞ্চল থেকে পাঠানো প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার কোন কারন নাই।
উদ্বাস্তুদের ভারতে প্রবেশ পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর দাবির সত্যতা নিশ্চিত করে না এবং স্বাভাবিক অবস্থায় জীবন ফিরে যাবে তাও বলা যাচ্ছে না। গ্রামগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যহীনভাবে আক্রমনের বিভিন্ন গল্প বলার রয়েছে উদ্বাস্তুদের। অতিরঞ্জিত কিছু গল্প থাকলেও সবগুলোই শুরু হয়েছে নৃশংসতা এবং মাত্রাজ্ঞানহীনতা দিয়ে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ছাড়া পাকিস্তান সরকার উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সমঝোতারও কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অনেকদিন নিশ্চুপ থাকার পর ইয়াহিয়া এক সপ্তাহে বিবৃতি দিয়েছে এবং তার ২-৩ সপ্তাহ পরে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে কিভাবে সে তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এদিকে বিরোধী শক্তিকে নিঃশেষ করে দিতে কি করা হচ্ছে? দমন-নিপীড়ন কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে? খাদ্য ও ওষুধ বিতরনে পাকিস্তান সরকারের উচিত জাতিসংঘের সাহায্য নেয়া। সীমান্তের দুই পাশেই এদিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।