শিরোনাম |
সূত্র |
তারিখ |
৬৯। একটি বিভক্ত দেশ |
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল |
২৩ শে জুলাই, ১৯৭১ |
<১৪, ৬৯, ১৫৭–১৬২>
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউ ইয়র্ক, জুলাই ২৩, ১৯৭১
একটি বিভক্ত দেশ
ধর্ম, বর্ণ ও দারিদ্র্য নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ দ্বিধাচ্ছন্ন, কোন আসন্ন সমাধান এ মুহূর্তে আসা করা যাচ্ছেনা, নাগরিকরা কোনরকমে বেচে আছেন, বাঙ্গালিরা সামরিক শাসন নিগৃহীত হচ্ছে, অথচ, কি সমস্যা, সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
পূর্ব পাকিস্তানের একটি শহরে, একজন ডাক্তার তার রাস্তার পাশের চেম্বারে বসেন রোজই, মাঝে মাঝে রোগির আশায় বাইরে তাকান, যেখনে এখন ধুলাবালি, লুটপাট হওয়া দোকান আর ঘরবারির কিছু অংশ পরে আছে কেবল।
মাঝে মাঝে রাস্তায় ইউনিসেফ এর চিনহ আকা, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা বোঝাই কিছু গারি রাস্তায় টহল দেয়, এছাড়া গোটা রাস্তায় কোন জনমানুষের চিনহ নাই। ডাক্তার নিজেও এখনও পযন্ত চেম্বারে বসে আছেন, কারন তাকে এমন্টাই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার পরিবার শহরের বাইরে কোথাও লুকিয়ে আছে। তিনি ফিস্ফিশিয়ে কথা বলেন, কেননা, রাস্তার যেকোন পথিক গুপ্তচর হতে পারে। রাতের বেলা যখন আর্মিরা বিভিন্ন বাড়ির দরজার কড়া নাড়ে, তিনি ভয়ে থাকেন যে যেকোন দিন তার নামও ঐ তালিকায় থাকতে পারে।
নগরে এখন কি হচ্ছে, রাস্তায় পড়ে থাকা পচাগলা দেহাবশেষ, ঘরে ঘরে আগুন, লুটপাট, ধর্ষণ আর চলতে থাকা সন্ত্রাসের কথা ডাক্তার বলছিলেন, ফিসফিসে গলায়। “ আমরা সত্যি কথা বলতে ভয় পাই। যারা সত্যি বলে, তারা শাস্তি পায়, আর একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু”, তিনি বললেন। এই ডাক্তার একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হবার কারনেই তার প্রাক্তন সহকর্মীদের জন্য আরো বেশি চিনহিত হবার ভয়ে আছেন। কিন্তু তার আসল অপরাধ, এমন একটি ভুখন্ডে জন্মগ্রহন করা, যা বাঙ্গালীদের ভুখন্ড হিসেবে পরিচিত, এবং তা পাকিস্তানের একটি অংশও বটে। এখন এই ভুখন্ড কেবলি মৃত্যু আর ভীতির এক রাজ্য।
যেখানে যুদ্ধের কারন মুছে গেছে রক্তের বন্যায়
চার মাসেরো কম সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, কিন্তু এতদিনে এই যুদ্ধের কারন মোটামুটি পুথিগত হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের ভৌগলিক, ঐতিহাসিক উৎস, নিতিগত বা বিবেকগত কারন- সবি যেন ধুয়ে গেছে রক্তের বন্যায়। ২৫শে মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ঠিক কত মানুষ মারা গেছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই। পশ্চিমা কূটনৈতিকরা বলছেন সংখ্যাটি কমপক্ষে ২ লক্ষ থেকে সরবোচ্চ ১০ লক্ষ।
ঘটনাগুলোকে মোট তিনভাগে ভাগ করা যায়
প্রথমে এটি ছিল বাঙ্গালীদের করা একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, যার মুলে ছিল পশ্চিম পাক্সিতানিদের প্রায় দুই শতক ধরে চালিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের বিরোধিতা। মার্চে তা আরো প্রকট আকার ধারন করে, যখন বাঙালি আওয়ামী লীগ দল নির্বাচনে জয় লাভ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু ২৫শে মার্চ রাতে, বাঙ্গালিরা স্বাধীনতার দাবী করছে এই ভয়ে, পাকিস্তানি আর্মি (যাদের বেশিরভাগি পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য) পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানি ঢাকার উপর হামলা করে। বাঙালি ছাত্রদের তারা হত্যা করে, রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে এবং আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায় কোন রুপকথার চেয়ে কম নয়, যেখানে বাঙালিরা নিজেরাই নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করল ও তা পালন করতে শুরু করল। এ সময়ে হাজারখানেক অবাঙ্গালিকে হত্যা করা হয়েছে, যার ফলে, সাবধানতাবশত সেনাবাহিনী রাজধানির বাইরে বা মিলিটারি ক্যাম্পের বাইরে গমন করেনি। কিন্তু এই স্বাধীনতার স্বপ্ন আপ্রিলের মাঝামাঝি আসতেই সেনা অভিযানের আঘাতে চুরমার হয়ে গেল। শহরের পর শহর পুনরায় দখল করে নিল তারা, যার ফলে দশ হাজারের বেশি বাঙালিকে হত্যা করা হল, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ বেড়ে গেল। তাদের খুব কমই প্রতিরোধ এর সম্মুখীন হল। প্রায় ৬০ লক্ষ বাঙালি, যাদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু হিন্দু গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ও সেনাবাহিনিদের আক্রমনের স্বীকার হয়েছে বেশি, তারা ভারতে পালিয়ে যেতে শুরু করল।
এখন চলছে তৃতীয় পর্যায়
তৃতীয় ও বর্তমান পরযায়ে cসেনাশাসন বলবত আছে- আতংকিত বাঙালি শাসিত হচ্ছে সেনা বাহিনী ও কঠোর সামরিক দমন আইনের আওতায়। পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষগন বলেই যাচ্ছেন যে সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। কিন্তু, আর্থিক অবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত, কলকারখানাগুলো অচল, স্কুল বন্ধ, রাস্তাঘাট বেশিরভাগই ফাকা, শহরবাসীরা বেশিরভাগই শহর ছেড়ে চলে গেছে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু ও মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার গ্রামে লুকিয়ে আছেন। এখনও প্রতিদিন ৫০,০০০ শরণার্থী পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। বাঙ্গালীদের প্রবল সমর্থনপুষ্ট মুক্তি বাহিনী বা বাঙালি গেরিলা বাহিনী প্রতিনিয়তই সেনাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। গেরিলাদের মধ্যে এখনও যথেষ্ট প্রশিক্ষন বা সঙ্ঘবদ্ধতার অভাব রয়েছে, কিন্তু সীমান্তে আশ্রয় বা রসদ সরবরাহ তারা প্রতিনিয়তই পাচ্ছে ভারত থেকে।
প্রায় ১০ দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানে ভ্রমন ও বিভিন্ন স্তরের লোকের সাথে কথা বলে এটাই মনে হচ্ছে যে এই অবস্থার চতুর্থ পরযায়ে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের, বাংলাদেশের বা বাঙ্গালীর স্বাধীনতা। যদিও তা অর্জন করতে আসন্ন দিনগুলোতে আর কত বাঙ্গালিকে প্রান দিতে হবে, তার কোন সঠিক ধারনা নেই। যদিও কোন সমাধান, এমনকি স্বাধীনতাও, পুরব পাকিস্তানের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বয়ে আনবে বলে মনে হয়না, যারা আজো মহানবী মুহম্মদের বানি অনুযায়ী “মুখ দিয়েছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি” জীবনযাপন করে যাচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে আরো বেশি দরিদ্র, অনাহারি জাতিতে পরিনত হচ্ছে। ৭.৫ কোটি মানুষের এই জনবসতি ইতিমধ্যে গড়ে প্রতি বর্গমাইলে ১৬০০ জনে দাড়িয়েছে, এবং আগামি ২৫ বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণ আকার ধারন করবে। গত শরতের শেষদিকে সাইক্লোনে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৫ লক্ষ বাঙালি। অন্যদিকে ৫ লক্ষ নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে মাত্র ৮৭ দিনে। পূর্ব পাকিস্তানে এই সাইক্লোনের মত একটি দুর্যোগকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতই ভয়াবহ এই গৃহযুদ্ধ- যা সঙ্ঘটিত হল মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই।
প্রাচীন ধারায় প্রতিহিংসার অনুশীলন
দারিদ্র্য, অবহেলা, আর হতাশার ফলে এমন যুদ্ধের সুচনা করেছিল কঙ্গো আর আলজেরিয়াতেও। মানুষ শুধু রাজনৈতিক কারনে না, ধর্ম ও বর্ণের নামেও হত্যা করছে পরস্পরকে। মুসলিম দর্শন অনুযায়ী চোখের বদলে চোখ কিংবা দাতের বদলে দাতের মত প্রাচীন ধারনাও এমন গোষ্ঠীবদ্ধ অনুতাপের কারন বলা যায়। সেনাবাহিনী হত্যা করছে বাঙ্গালিকে, প্রায় ২০ লক্ষ সংখ্যালঘু অবাঙ্গালী (যাদের সাধারনত বিহারী বলা হয়) এই সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে। সুতরাং বাঙ্গালিরা হত্যা করছে বিহারীদের। প্রায় ১ কোটি সংখ্যালঘু হিন্দু নিশ্চিত ভাবেই সেনাবিহিনির হাতে বলি হচ্ছে। এমনকি কিছু বাঙালি মুসলিমও এই হত্যাযজ্ঞে সানন্দে যোগদান করছে। এই বিক্ষিপ্ত গোলযোগের সুযোগ নিয়ে অনেক গ্রাম, বাহিনী বা ব্যাক্তি আর্থিক লাভের আশায় বা ব্যাক্তিগত প্রতিহিংসায় আক্রমন করছে একে অপরকে।
এ তথ্যগুলো পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর থেকে ঘুরে এসেছেন, এমন ব্যাক্তিদের কাছ থেকেই শোনা। এই ডাক্তারের মতই, বাঙ্গালীরা মুছে ফেলছন তাদের পূর্ব পরিচয় বা শহরে বসবাসের ঠিকানা। বাঙ্গালিরা সাংবাদিকদের সাথেও কথা বলেন না প্রান হারানোর ভয়ে। বেশিরভাগই মুখ খুলেন না, এমনকি অপরিচিতের কাছে সাহস করে ভিক্ষার আবেদন করেনা কোন ভিক্ষুকও। স্বাভাবিকভাবে বিশ্বের অন্যতম দরাজ কন্ঠের এই বাঙ্গালিরা, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাব আদান প্রদান করেন চোখের চাহনির মাধ্যমে, ভিতসন্তস্ত্র বাঙালি চোখে চোখ রেখে কথা বলে না- অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, লজ্জায় অবনত চাহনি মিশে থাকে মাটির সাথে, আর নয়ত চুপিচুপি ইশারাতেই তারা প্রকাশ করতে চান নিজেদের অনুভুতি।
একজন আইনজীবী ও তার ছেলের ভাগ্য বেশ ভাল বলতে হবে। এই সময়ে, কোন বাঙ্গালিকে কেমন আছেন বলে প্রশ্ন করলে, তারা উত্তর দেন- বেচে আছি। এই আইনজীবী ও তার ছেলে কেবল মাত্র প্রানে বেচে আছেন, তা নয়, তারা নিজেদের বাড়িতেই বাস করছেন। যদিও, তারা নিজেদের বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন, কালেভদ্রে বের হন। আইনজীবী বললেন- রাস্তা থেকে গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, এমনকি সাত বছরের কোন শিশুও যদি আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলে আমি একজন দুর্বৃত্ত, তাহলেও আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে’।
পাকিস্তান বিরোধী প্রতিটি বাঙ্গালিই এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে দুর্বৃত্ত। আইনজীবীর কনিষ্ঠ ছেলেটি বলছিল, “ সব বাঙ্গালিই এখন দুর্বৃত্ত”। সে আইনের ছাত্র। সেনাবাহিনিরা ছাত্রদেরই বিশেষভাবে নিশানা করে, ফলে তাদের বেশিরভাগকেই লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ। ছেলেটি প্রশ্ন করছিল- “ যে দেশে আইন বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই, সেদেশে আইন পরে কি হবে”?
আইনজীবীর বাড়িতে বসেই আলাপচারিতায় সন্ধ্যা হয়ে আসলো। কথা বলার আগে তিনি কাঠের জানালার কপাটগুলো শক্ত করে আটকে নিলেন। তারপরি তার মাথায় ফের চিন্তা হল যে পথচারিদের কেউ এখানে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ করতে পারে- তাই কপাটগুলো পুনরায় খুলে সামান্য ভিরানো অবস্থা রাখলেন।
তারা ‘গন্ডোগোলের” কথা বলছিলেন, কখন কিভাবে এই শহরে ২৫ শে মার্চে ঢাকায় সেনাবাহিনীর হামলার খবর আসলে, আওয়ামীলীগ নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে তুলে নেয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকার আওতাধীন ছিলেন তারা, আর তারপরি বিমান হামলায় শহর ধ্বংসাবশেষে পরিনত হয়। মানুষ আতংকিত হয়ে পরে। আওয়ামীলিগ এর লোকজন কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীও পলায়নপর হাজার মানুষের স্রোতে সামিল হতে থাকে। সেনাবাহিনী এখানে আসার অনেক আগেই তারা পালিয়ে যায়। পালানোর আগে যে উত্তেজনা সারা শহরে বিরাজ করছিল, তার ধারাবাহিকতায় প্রায় শতাধিক বিহারিকে বাঙ্গালিরা দল বেধে আক্রমন ও হত্যা করে।
এর ফলশ্রুতিতে, অন্য সকল এলাকার মতই আর্মিরা এখানে এসেই প্রতিরোধ শুরু করেন। শহরের বেশিরভাগ অংশ অক্ষত থাকলেও, সেনাবাহিনী ও তার অনুসারীরা লুটপাট চালিয়েছে সবখানেই। মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই শহরে ফিরে এসেছেন। অনেক দোকানপাটও পুনরায় খুলেছে, যদিও তাদের মালিকানায় আর আগের ব্যাক্তিরা নেই। হিন্দু দোকানদাররা পালিয়ে গেছে, বিহারি কিংবা আর্মিদের সমর্থকরা সেগুলো দখল করে নিয়েছে। সর্বত্র এখনও গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলমান।
পাকিস্তানিদের একটি সড়ক অবরোধে চার খ্রিস্টান বাঙালি গ্রেফতার হন। পূর্ব পাকিস্তানের সরকগুলোতে এখন খুব কম সংখ্যক বাসই চলাচল করে। রাস্তায় চলমান এই গুটিকয়েক বাসগুলোকে কিছুক্ষন পরপরি থামানো হয়, যাত্রিদের নামিয়ে লাইনে দাড় করানোর পর পাকিস্তানি আর্মি তাদের উপর তল্লাসী চালায়। এই চেকপয়েন্টে যেসব সেনারা অবস্থান করেন, তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই বাংলা শব্দ বলতে পারেন (পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু), সুতরাং, তল্লাসি করে দুর্বৃত্তদের খুজে পাবার একটি জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে তাদের লুঙ্গি উঠিয়ে দেখা। মুসলিমদের মুসলমানি করা হয়ে থাকে, হিন্দুদের তা থাকেনা। কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা যখন এদেশে এসেছিলেন, তখন তারা ভাবতেন, সব বাঙ্গালিই হিন্দু। আরো বেশি অভিজাত সেনাদের মতে সব হিন্দুই ‘দুর্বৃত্ত”। কিন্তু বাঙালি মুসলিমদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় সেনারাও দ্বন্দ্বে পরে গেছেন। যার ফলে এই চার খ্রিস্টান বাঙ্গালিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
খ্রিস্টানদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়না
যারা পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষায় কথা বলতে পারেন না, তাদের মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং ঘন্টাখানেক সময় ধরে জেরার নামে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। একজন পশ্চিমা খ্রিস্টানদের গ্রেফতারের কথা শুনে এর প্রতিবাদ করেন। সুতরাং এ বিষয়টি এখন আর্মি মেজরকে জানানো হলে, তিনি বন্দী চার খ্রিস্টানকে তলব করেন ও তাদের কাছে ক্ষমা চান। তিনি ব্যাখ্যা করেন- কোন খ্রিস্টানকে শারীরিক নির্যাতন করার কথা আমাদের বিধিমালায় নেই।
মোটা ফ্রেমের চশমা পরে একজন চর্মসার বাঙালি দোকানদার দোকানে বসে দেখছিলেন দুইজন অপরিচিত ব্যাক্তি ফাকা রাস্তা ধরে হেটে আসছেন। তারা দোকানে এসে শহরের গন্ডগোলের কথা জিজ্ঞেস করলেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দোকানদার উত্তর দিলেন, আমি কিছু বলতে পারবোনা, বলতেই বলতেই তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত দালান, ভাঙ্গা রাস্তাঘাটের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন- “চারদিকে তাকিয়ে দেখেন”, ঐ দুই ব্যাক্তিরা দোকান থেকে চলে যেতেই, তিনি ভাঙ্গা গলায় বললেন- আমি লজ্জিত যে আমি পারিনা…’।
একটু দুরেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন তরুন এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলতে শুরু করে- সৈন্যরা শহরটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বহু বাঙালি গ্রেফতার হচ্ছে, প্রতি রাতে তাদের গুলি করে হত্যা করে নদিতে লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। আমরা এখন আর নদির কোন মাছ খাইনা। তরুন পথিকদের পথ দেখিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেল একজন সার্জন এর সাথে কথা বলার জন্য। এই সার্জন বাঙালি হলেও সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার কারনে বেশ চাপের মধ্যে আছেন। তাকে শহরে হত্যাযজ্ঞের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন- “ হত্যা, কিসের হত্যা? কে হত্যা করছে? তার কাছে শহরের সাধারন সমস্যার কথা জানতে চাইলেও তিনি একি ভঙ্গিতে উত্তর দেন- সমস্যা? কিসের সমস্যা? এখানে কোন সমস্যা নেই’।
স্বাভাবিক অবস্থার বিশ্লেষণ
এক সময় দর্শনার্থীরা সার্জনের কাছ থেকে বিদায় নেন। হাসপাতালের বাইরে এসে তরুণটি আবারো ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে। “ আপনারা ডাক্তারের সাথে কথা বলেছেন। তিনি সত্য গোপন করছিলেন, কারন তিনি সত্য বলতে ভয় পান। এতেই বোঝা যায় আসলে কি ঘটছে।
অগাস্টের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার খুলে দেয়া হলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফেরত যাবে কিনা, সে বিষয়ে কথা হচ্ছিল একজন অধ্যাপক ও তার ছাত্রদের সাথে। তারা খুব একটা আশাবাদী নন এবিষয়ে। কিছু শিক্ষার্থী লুকিয়ে আছেন, নিজ বাড়িতেই, কেউ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন, আবার কেউ পালিয়েছেন ভারতে। কেউ কেউ মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করেছেন। ক্যাম্পাস এখন সৈন্যদের ক্যাম্পে পরিনত হয়েছে, আর সেনারা বসবাস করছেন ছাত্রাবাসগুলোতে, সেনারা রান্না করার সময় আগুন জালান ছাত্রদের বইয়ের কাগজ পুড়িয়ে। অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন- ‘এই অবস্থায় আপনি ফিরে আসার কথা ভাববেন’?
একজন ছাত্রী, বলছিলেন, তিনি যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, তার একটি কক্ষ থেকে আর্মিদের জিজ্ঞাসাবাদের কেন্দ্রটির ভেতরে দেখা যায়। ‘সারাদিনই সেখানে ছাত্র, কমবয়সী ছেলেদের ধরে নিয়ে এসে মারধোর করা হয়। তিনজন সৈন্য ক্রমাগত তাদের বুট দিয়ে ছাত্রদের আঘাত করতে থাকে। সারা রাত তাদের চিৎকার শোনা যায়। আমি ঘুমাতে পারিনা। এই দৃশ্য এবং শব্দ সহ্য করার মত না’।
অধ্যাপক বললেন-“ আমাদের সেনাবাহিনীর ভাল নামডাক ছিল। আমাদের সেনাবাহিনী সত্যি গর্ব করার মত ছিল। কিন্তু, দেখুন আজ তারা কি করছে। কোন সেনাবাহিনী সত্যি মহৎ হলে কি করে অন্যায়ের পক্ষে অস্ত্র ধরতে পারে”?
পদ্মার ফেরি পারাপারের ঘাটে দুইজন আর্মি মেজর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের একজন ছিলেন ডুবুরি, অপরজন নিয়োজিত ছিলেন ঊটের বাহিনীতে। তাদের দুইজনকেই বেশ সভ্য ও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। তারা ব্যাখ্যা করলেন যে তারা দেশ রক্ষার জন্যই যুদ্ধ করছেন, দেশের অখণ্ডতা অক্ষুন্ন রাখতে তারা লড়াই করছেন ভারতীয় চর, দুর্বৃত্ত আর বিপথগামি ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে। ‘ তাদের অরাজকতা দেখে রাগে আমাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। যদি আপনি দেখতেন, আপনিও তাদের হত্যা করতে চাইতেন”। তারা কোন এক শহরের কথা বলছিলেন। গুজব ছিল যে সেখানে বাঙ্গালিরা বিহারিদের হত্যা করেছে। (পরে সেই শহরকে সৈন্যরা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে, বাঙালি হত্যা করেছে আরো অনেকগুন বেশি।)
মেজরদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন এত বাঙালি পালিয়ে গেল, বিশেষ করে হিন্দু বাঙ্গালিরা। উত্তরটা বেশ কল্পনাপ্রসুত বলেই বলা যায়। তারা উত্তরে বললেন- এপ্রিলে সেনারা আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার আগে, হিন্দুরা এদেশের মুসলিমদের বলছিল যে- “পবিত্র কুরআন পুরনো হয়ে গেছে। ফলে মুসলিমরা তাদের কুরআন রক্ষার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে আর তারপরি অনেক হিন্দুরা পালিয়ে যায়”। ঊট বাহিনীর সৈন্যটি স্বীকার করে যে অনেক বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পদ্মার দিকে তাকিয়ে ডুবুরি বললেন- “কুমিরগুলো মোটা হয়ে গেছে। ”
কিন্তু, তারপরও তারা বলেন সব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে এবং বাঙ্গালিরাও এখন আর সৈন্যদের ভয় পায়না। একটা ফেরি এসে পাড়ে ভিরল, সেনাদের নির্দেশে একটি পাটকল পুনরায় সচলের কাজ করতে নিয়োজিত একদল শ্রমিকদের নিয়ে। একসারিতে মেজরদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিটি শ্রমিক মেজরদের দিকে কুরনিশের ভঙ্গিতে অবনত মস্তকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
সব আর্মি অফিসাররা এই মেজরদের মত সহমর্মী না। একটি শহরের অবস্থানকারী একজন পশ্চিমা বলছিলেন কিভাবে একজন আর্মি ক্যাপ্টেইন একজন হিন্দু তরুণীর উপর আক্রমন করার সময় মেয়েটিকে তার বন্দুকের ব্যারেল ধরে দেখতে বলে। “অনেক হিন্দু মারার কারনে দেখ, বন্দুক এখনও গরম হয়ে আছে”- কথাগুলো হাসতে হাসতে বললেও সে বানিয়ে কৌতুক বলছিল না।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে বহু বছর আগে বেয়ারার কাজ করতেন এমন একজন বৃদ্ধ বিহারি এখন এই অর্ধেক ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর একপ্রান্তে অবস্থিত এক হোটেলে পরিচারকের কাজ করেন। তিনি সৈন্যদের সমর্থন করেন, তাই কথা বলতে ভয় করেন না। তিনি বলছিলেন- এপ্রিলের বেশ কিছুদিন যাবত, সৈন্যরা এসে পৌছানর বহু আগে, আওয়ামীলীগের লোকজন পালিয়ে যাওয়ার পরপরি বিহারিদের জন্য খুব খারাপ একটা সময় কেটেছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইন্ডিয়ান আর্মির ইংরেজিতে উনি বর্ণনা করছিলেন কিভাবে বাঙ্গালিরা দল বেধে বিহারিদের তাড়া করত রাস্তায় আর চিৎকার করে বলত, “বিহারি চোরদের মারো, বিহারি চোরদের পুড়িয়ে ফেলো’। কিছু বিহারিকে হত্যা করে হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগই প্রানে বেচে গেছেন। তারপর আর্মিরা আসলো। তার ভাষ্যমতে- “আর্মিরা অনেক বাঙালি, হিন্দু চোরদের হত্যা করেছে। এখন তারা ভারতে পালিয়ে গেছে, সময় খুব খারাপ সাহেব’।
এই গন্ডগোলের আগে একজন ধনবান ও নিজ সমাজে গন্যমান্য একজন হিন্দু ব্যাক্তি, সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করতেন। নিজের এলাকার প্রান্তিক মুসলিমদের জন্য তিনি স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণ, সেচের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাঙালি হলেও, নিজেকে তিনি একজন খাটি পাকিস্তানি নাগরিক মনে করতেন। একজন বাঙালি হয়েও, তিনি আওয়ামীলীগের সমর্থক ছিলেন না, বরং কট্টর মুসলিম লীগের সমর্থন করতেন।
শিকারিই যখন শিকার
এই গৃহযুদ্ধ শুরু হবার প্রায় এক মাস পরে, যখন পাক আর্মিরা তার এলাকাতে প্রবেশ ও করেনি, (এবং বিহারিরা বাঙ্গালীদের জন্য বিপদে দিন কাটাচ্ছিল), এই হিন্দু ব্যক্তিটি তার বাড়িতে দুইজন বিহারিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। যখন বাঙ্গালীদের দল তাদেরকে খুজতে এসেছিল, উনি তাদের বাচিয়েছিলেন। কিন্তু, আর্মিদের আশার পর দৃশ্যপট পুরোই উলটে গেল, আর বাঙ্গালিরা- বিশেষ করে হিন্দু বাঙ্গালিরা শিকারে পরিনত হলো।
সৈন্যরা হিন্দু গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, লোকজনদের উৎসাহিত করেছে, হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, হামলা চালাতে। আর্মিদের নির্দেশে স্থানীয় হিন্দু মন্দিরটি মানুষ হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।
উল্লেখ্য এই হিন্দু ব্যাক্তি পালিয়ে তার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন, দুই মাস সেখানে লুকিয়ে ছিলেন তারা। সেই লুকানোর আস্তানা থেকে প্রথম তিনি আলোর মুখ দেখলেন দুইজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে গিয়ে। বিকেলের দিকে একজন কৃষকের বেশে তিনি হেটে যাচ্ছিলেন ধান খেতের আল ধরে, একটা কালো ছাতা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। তিনি অন্য হিন্দুদের মত ভারতে পালিয়ে যাননি, কারন তিনি আশায় বুক বেধে আছেন যে একদিন এই আর্মিরা চলে যাবে, তাদের জীবন আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু আর্মিরা রয়েই গেছে, হিন্দুদের খুজে খুজে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, এমনকি সীমান্তের দিকে যাওয়াও অনেক বেশি ঝুকিপুরন হয়ে গেছে।
মাত্র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যাক্তি জানতেন তিনি কোথায় লুকিয়ে আছেন। তাদের একজন ছিলেন মুসলিম লীগের কর্মকর্তা, একজন বেশ প্রভাবশালী নেতা, কেননা মুসলিম লীগ বহুদিন ধরেই আর্মিদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু ব্যাক্তিটি বলছিলেন- “সে জানে আমি কোথায় লুকিয়ে আছে, কিন্তু সে ভুলেও আমাকে সাহায্য করার সাহস করবে না”। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রায় সকল মুসলিম লীগ নেতারাই হিন্দুদের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করেন, তাই বললেন- “তারাই বা কি করবে বলেন? তারাও তো বিপদে আছে, ভয়ে আছে”।
আর্মিদের লিস্টে সকল হিন্দুদের সম্পত্তিই এখন “বহিরাগতদের সম্পত্তি”। অন্যান্য এলাকায় একে শত্রুদের সম্পত্তি বলেই ধরে নেয় সবাই। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই এই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা নিলাম করা হয়। এই হিন্দু ব্যাক্তি সাক্ষাতকারে নিজের জীবনের বিপদের চেয়ে বেশি, তার হারানো সয়সম্পত্তি নিয়েই কথা বলছিলেন। ছাতাটা আবার মাথার উপরে ফেলে দিয়ে খেতের মধ্য দিয়ে হেটে নিজের লূকানোর আস্তানায় ফিরে যাওয়ার আগে তিনি বললেন- “ আমার মুসলিম বন্ধুরা আমাকে বলে, যখন কোন হিন্দুর লাশ নদী থেকে তোলা হয়, দেখা যায় তাদের দেহ প্রচন্ড নির্যাতনে এতই ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে
যে বেশিরভাগেরি চেহারাও সনাক্ত করা সম্ভব হয়না”।
শেখানো বুলি আউড়ে যাওয়া এক প্রধানশিক্ষক
পরিদর্শকরা ভারত সীমান্তের কাছেই একটি শহর পরিদরশন করেন। আর্মিদের পুনরায় দখল করে নেয়া শহরগুলোর মধ্যে এটিই ছিল সর্বশেষ। এই শহরেও বিপুল ধংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে এবং বেশিরভাগ এলাকাই পরিত্যাক্ত। স্থানীয় শান্তি কমিটিতে কাজ করছেন কিছু বিহারি আর ডানপন্থী বাঙালি মুসলিম লীগার। এরাই এলাকায় আর্মিদের চোখ ও কান হিসেবে ভুমিকা পালন করে যাচ্ছেন। পরিদর্শকদের পথ চেনানো ও অনুসরন করার জন্য তারা দুইজন তরুণকে নিয়োজিত করলেন। তরুন দুইজন আমাদের বললেন- এখানকার স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারের সাথে কথা বলেন।
হেডমাস্টার লোকটি মধ্যবয়স্ক, ডেস্কে বসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন। তার মুখোমুখি চেয়ারে বসেছিল দুই সাংবাদিক আর তাদের পেছনেই দাঁড়ানো দুই তরুন শান্তি কমিটির চর। ভাঙ্গা গলায় হেডমাস্টার স্কুলের ভরতির হার, স্কুলের স্থাপনকাল এসব বিষয়ে মুখস্ত পাঠ আবৃত্তি করে গেলেন, কোন বিতর্কিত আলোচনা ছাড়াই। প্রতিটি কথা শেষে তিনি ভয়ে ভয়ে সাংবাদিকদের মাথার উপর দিয়ে ওই চরদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, যেন হাতে বেত সমেত কোন এক রাগী শিক্ষকের সামনে পড়া দিচ্ছে কোন স্কুল বালক।
সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলেন- এই বিদ্যালয়টি এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হল কি করে? তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন- “কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছিল” তারপরই পেছনে দাঁড়ানো দুই কিশোর চরদের দিকে তাকিয়ে তিনি দ্রুত আগের কথার সাথে নতুন কিছু কথা যোগ করে বললেন- “খুব সম্ভবত দুর্বৃত্তরাই এই হামলা চালিয়েছে। ”
যখন সাংবাদিক ও সেই দুই চর বেড়িয়ে আসছিল, শিক্ষকটি বিড়বিড় করে বললেন- “ আমরা আবার একতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি” আর তারপর একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
পিটার আর। কামি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭০। পাকিস্তানের উপর একটি প্রস্তাব
|
ওয়াশিংটন পোস্ট | ৩০ জুলাই ১৯৭১ |
<১৪, ৭০, ১৬৩-১৬৪>
সম্পাদকীয়ঃ পাকিস্তানের উপর একটি প্রস্তাব
সুত্রঃ ওয়াশিংটন পোস্ট
তারিখঃ ৩০শে জুলাই , ১৯৭১ ।
পাকিস্তানে হিটলারের পরে সংগঠিত হওয়া সবচেয়ে বড় হত্যাকান্ডের সাক্ষী হচ্ছে আজকের বিশ্ব ।হ্যালোকাস্ট এর ফলে যখন শত সহস্র লোক মারা গেছে এবং কোটি লোক পালিয়ে গেছে, তখন পৃথিবী এইসব আতঙ্কের দিকে শুধু তাকিয়েই দেখেছে প্রতিবন্ধীদের মতো কিন্তু তাদের জন্য করেছে সামান্যই । এই বেদনাদায়ক ঘটনাট সমুহের প্রতি অসঙ্গতিপূর্ণ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গীকে উন্নত করার জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তারা নিহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং বেঁচে থাকা লোকদেরকে জন্য ভিক্ষাবৃত্তি প্রদান করতে চেয়েছে পাশাপাশি তারা পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্য ভারতীয় বাহিনীকেও দায়ী করেছে । নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের বিপর্যয়ের পর, একজন হয়তো আশা করেছিলেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়তো যে কোনও উপায়ে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকবে, কিন্তু তা হয়নি ।
উপমহাদেশের দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থের জন্য স্বার্থে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি সাধারন মানুষের দুঃখের পরিণতি হ্রাসের জন্য তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করা বন্ধ করতে অনিচ্ছুক ছিল। রাশিয়ানদের সম্ভবত, দোষারোপ করা এভাবে যে ; তাদের পাকিস্তানে কোন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল না এবং তারা ভারতে তাদের অবস্থান সুসংহত করার জন্য পাকিস্তানের প্রতি তাদের ঐ বিদ্বেষকে ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে চীনারা এ ব্যাপারে পুরোপুরি পাগলের মতো নীতি গ্রহণ করেছে। তারা বাঙালিদের প্রত্যাখ্যান করেছে কারণ তাদের আন্দোলন হলো বিপথগামী অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে একটি জনপ্রিয় বিপ্লব, এবং তারা পাকিস্তানি সরকার দ্বারা বাঙালিদের নিপীড়নকে উৎসাহিত করেছে এমনকি বাইরের বাহিনীর (ভারতীয় অর্থে) হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কে রক্ষা করার প্রস্তাবও দিয়েছে।
আমেরিকার নীতি আমেরিকানদের জন্য “কৌশলগত” এবং এর কারণগুলি আরও দুঃখজনক, যার ফলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে তাদের পেশাগত কর্মকাণ্ড থেকে আরো নীচে নামিয়ে আনে এবং তারা মার্কিন অস্ত্রও বহন করে এবং কংগ্রেস তাদের নতুন অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে (যা এ পর্যন্ত অস্বীকার করা হয়েছে) এবং এই সবই পাকিস্তানী বাহিনীকে একটি মধ্যপন্থী অবস্থানে থাকতে প্রলুব্ধ করে।
এসব অভিযোগ প্রমানের জন্য একবিন্দু প্রমাণও নেই। যাইহোক, পাকিস্তানিরা আমেরিকান যে সকল প্রস্তাবের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গোপনভাবে প্রকাশ করা হতে পারে। বিপরীতে বহির্বিশ্বে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বেড়েই চলছে যার সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজারের বেশী এবং যুক্তরাষ্ট্রে কে এজন্য ব্যাপকভাবে দোষারোপ করা হয়।
এর বিকল্প কি হতে পারে? একটি হলো ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ, দুই দেশের সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ অসম্ভব কিছু নয়। পাকিস্তান সীমান্তে তার নাগরিকদের বহিষ্কারের নীতি এবং বাংলার বিদ্রোহের আন্দোলনকে সহায়তা করার জন্য ভারতের নীতিটি যেকোনো মুহূর্তে একটি বিস্তৃত যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ প্রদান করতে পারে। এই যুদ্ধ উপমহাদেশে হতাশার নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং এটি মস্কো পিকিং-ওয়াশিংটন ত্রিভুজে রাজনৈতিক খেলা তীব্রতর করবে।
একটি যুদ্ধ উ থান্ট এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাদের তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন , পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার একটি দ্বার উন্মোচন করবে। সবাই অনাহারে বা কলেরা দ্বারা যে কোন সংখ্যার মৃত্যুর মিছিল দেখতে পাবে, এবং সম্ভবত আধুনিক ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক আন্তঃ সীমান্ত অভিবাসনের এবং যুদ্ধের আসন্ন হুমকি দেখতে পারছে। এইসব সমস্যার সসম্ভাবনাও উ থান্ট ও জাতিসংঘের তৎপরতা জোরদার করার জন্য পর্যাপ্ত নয়, কিন্তু যদি এক জাতির কয়েকজনকে অন্য জাতির কয়েকজন সৈনিকের দ্বারা গুলিবিদ্ধ করা হয়, তবে নিরাপত্তা পরিষদ সম্ভাব্যভাবে বৈঠকে বসবে সেই সাথে সংঘাত নিরসনে আন্তর্জাতিক তৎপরতার গতি বৃদ্ধি পাবে।
এর বিকল্প হিসেবে, আমরা যা দেখতে পাই, কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং চীনের জনগণের কাছ থেকে তাত্ক্ষণিক আবেদন অথবা এই তিনজনের কাছ থেকে পৃথক কিন্তু সমান্তরাল আবেদন আসতে পারে। পাকিস্তানকে সমস্যাগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় পুনরুদ্ধারে তাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার জন্য বলা যেতে পারে, যা এখন কঠিন কাজ বলে মনে হয়। তবে আমেরিকান-সোভিয়েত চীনের চাপের কৌশলগুলি বাইরের মানুষের কল্পনা করা কঠিন। তবুও এটি স্পষ্ট যে তিনটি দেশ একত্রে কাজ করলে পাকিস্তানক অবশ্যই তার নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে এবং সমস্যাটি হলো এটি করার জন্য একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
সেখানে. অবশ্যই, এক ডজন কারণ কূটনীতিক এবং রাজনীতিবিদ আপনাকে ব্যখ্যা করবেন কেন এই প্রস্তাব অবাস্তব অসমর্থনীয় বা অকার্যকর। মূলত, এখানে তিনটি অত্যন্ত সতর্ক পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে, যেমন তারা কখনো করেনি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাকে সহযোগিতা করার জন্য। যদিও প্রস্তাবটি নেহাতই চেষ্টা করার কন্য, তবে এটি বেশ সহজঃ এটা না হলে ১০, ২০ বা ৮০ মিলিয়ন মানুষ কে ভয়ানক অতিরিক্ত কষ্ট বহন করতে হবে, তাদের অনেকের জীবনও বিপন্ন হতে পারে। পাকিস্তান ট্র্যাজেডির প্রভাব সীমিত করার এই সম্ভাবনাকে হাতছাড়া করা উচিৎ হবে বলে মনে হয় না। এবং যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি একটি বাস্তব এবং ইতিবাচক ভূমিকা না রাখেতে পারে, তাদের উচিত হবে কমপক্ষে পাকিস্তানের জন্য বর্তমান সাহায্য নীতি কে সীমিত করা।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭১। যন্ত্রণা এবং বিপদ (সম্পাদকীয়) | ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর | ৩১ জুলাই ১৯৭১ |
<১৪, ৭১, ১৬৫–১৬৭>
যন্ত্রণা এবং বিপদ (সম্পাদকীয়)
ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর – ৩১ জুলাই ১৯৭১
আমরা যতদিন সম্ভব আশা রেখেছিলাম যে কোনভাবে হয়তো সরকার এবং পাকিস্তানের জনগন তাদের যুদ্ধপীড়িত ও দগ্ধ দেশের দুটি পৃথক অংশের মধ্যে একটা সহনীয় সম্পর্কে ফিরে যাবে, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে যে সমন্বয় সাধনের সেই সময় অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
চার মাস আগে পাকিস্তানের সরকার পুর্ব পাকিস্তানের লোকজনের উপরে সামরিক উন্মত্ততা ছড়িয়ে দেয়। ফলে ইতিহাসের ভয়ংকর এক ঘটনা সংঘটিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতার হাত থেকে বাঁচতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় এককোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। দশ লক্ষ মানুষের অন্তত চার ভাগের একভাগ মারা গেছে। ধারনা করা হচ্ছে এই সংখ্যা দশ লাখের কাছাকাছি। কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে আশ্রিত শরণার্থী এবং এখনো যারা জীবন ও ঘরবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ আকড়ে আছে, উভয়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ মহামারীর আকার নিয়েছে। ভারতের শরণার্থী সমস্যা ভারতের ক্ষমতার বাইরে।
যেখানে এতসব ঘটছে সেই অঞ্চলকে মানুষ বারবার বাংলা বলে ডাকছে, এসবের কারন ওই অঞ্চলকে ১৯৪৭ সালের পর থেকে এখনো অব্দি যুগ যুগ ধরে এই নামেই ডাকা হয়, মাঝের কয়েক বছর ছাড়া।
একটি তত্ত্ব ছিল ১৯৪৭ সালের দিকে, যে ভারত সরকারের অধীনস্ত ১১০০ মাইল এলাকা দ্বারা পৃথক হওয়া সত্ত্বেও, পাঞ্জাব ও বাংলার অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ার কারনে উপমহাদেশের এই দুইটি অংশ হয়তো একটা একক জাতিতে পরিণত হতে পারে।
পাকিস্তানের প্রস্তাবিত নতুন রাষ্ট্রের দুটি অংশের মানুষের ভাষা, জাতি এবং সংস্কৃতি তাদের ধর্মের মতই এক হওয়ার কারণে হয়তো এটা হয়েছে। কিছু পাঞ্জাবী আছে যারা আরো বেশি বাঙালীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ সরকার এবং দুই প্রদেশ ভাগাভাগি করতে ইচ্ছুক, বাস্তবে এটাই হওয়ার কথা।
কিন্তু বাস্তবে পাঞ্জাবীরা সরকারের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং বাংলার সম্পদের সিংহভাগ নিয়ে যাচ্ছে পাঞ্জাবে। পাকিস্তান নামের একের মধ্যে দুই রাষ্ট্রকে একত্র করার চেষ্টার অর্থ ৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর উপর ৫৬ মিলিয়ন পাঞ্জাবীর (অথবা, পশ্চিম পাকিস্তানি) কর্তৃত্ব ও শোষণ।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলার আচার-ব্যবহারে যৌক্তিক অগ্রগতি ছিল। আজকের পশ্চিম পাকিস্তানিরা ফার্সি, আফগান, এবং পাঠানদের পাহাড়ি উপজাতির উত্তরসূরি যারা প্রায় ৮০০ বছর আগে উত্তর-পশ্চিম পর্বত থেকে নেমে আসে এবং গঙ্গার বদ্বীপ ও উপত্যকায় বাস করা শারীরিকভাবে ছোট-খাটো ও কম যুদ্ধপ্রিয় জাতির উপর জোরপুর্বক তাদের নিয়মনীতি ও মুসলিম ধর্ম চাপিয়ে দেয়।
কিন্তু দুই জাতি কখনোই ধর্ম ছাড়া অন্য কিছুতে এক হতে পারেনি। পাঞ্জাবীরা সবসময় জয়ী হয়েছে, জয় করেছে বাঙালীদের।
গত মার্চ মাসে জয়ী এবং পরাজয়ীদের অবস্থা পরিক্ষা (নির্বাচন) করা হয়। নির্বাচনে বাঙালিরা পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার অধিকার লাভ করে। তাদের ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট। কিন্তু এটাকে সাংবিধানিক পরিণতি দেওয়ার সময় পাঞ্জাবীরা তাদের সেনাবাহিনীকে মাঝরাতে মুক্ত করে দেয় এবং ইতিহাসের বড় একটা গণহত্যা সংঘটিত হয়। বিজয়কে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটা ছিল ৮00 বছর পুর্বের প্রচেষ্টা।
চার মাস পর, বর্তমানে বাংলার প্রধান শহরগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চল এখনো পারেনি। প্রতিরোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গেরিলা বাহিনী রাজধানী ঢাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে দুইবার। তারা ঘন ঘন ঢাকা থেকে অন্যান্য শহরে যাওয়া রেল লাইন কেটে দিচ্ছে। আমেরিকার ব্যাপক হস্তক্ষেপে থিউ শাসকরা দক্ষিন ভিয়েতনামে যেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, দখলদার পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী (পশ্চিম পাকিস্তান) বাংলায় একই পরিস্থিতির মুখোমুখি – শান্তিসংস্থাপন কর্মসূচির প্রত্যাশা অন্তহীনভাবে ভবিষ্যতে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
এই দুঃখজনক এবং ভয়ঙ্কর অবস্থা যে কাওকে দুটি সমস্যার (নিয়ে উদ্বিগ্ন করবে) মুখোমুখি করবে। কিভাবে বাংলায় ভয়াবহ এবং দুর্বিপাকের আশু সমস্যার সমাপ্তি টানা যায়। পাঞ্জাবীদের আদিম, স্ব-পরাজিত সামরিক নিপীড়ন নীতি থেকে সরে আসতে হবে এবং দুটি পৃথক বাংলার অস্তিত্বকে বাস্তবায়ন করতে হবে যা রোধ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
কিন্তু মনে হচ্ছে এটা শুধুমাত্র তখনই ঘটতে পারে যদি বড় সমস্যা সমাধানের দিকে কিছুটা অগ্রসর হওয়া যায়; অর্থাৎ সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে পাকিস্তানের সমস্যা।
বাংলায় সন্ত্রাস নিরসণে ইসলামাবাদের তুলনায় পাকিস্তান সরকারের উপর কার্যত কোন চাপ নেই কারন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করার ঝুঁকি নিতে চায়না যেহেতু রাশিয়া ভারতের প্রধান বহিঃ বন্ধু হয়ে উঠছে। ওয়াশিংটন এমন কোন কিছু করতে প্রত্যাখ্যান জানিয়েছে যা জেনারেল আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খানের বিপক্ষে যায়, যিনি যুগান্তকারী চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। চীন স্বভাবতই পাকিস্তানে তাদের স্বার্থের পেছনে লেগে আছে। এবং স্বাধীন বাংলার বিবাদের বিষয় কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সেটা সম্পর্কে সবাই সচেতন। এটা রাশিয়া ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে।
এর তাত্ত্বিক সমাধান সহজ। শুধু রাশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে এরকম একটা চুক্তির প্রয়োজন যাতে চীন অথবা রাশিয়া কতৃক বাংলা মুক্ত এবং ঝামেলামুক্ত থাকে।
শুধু এটুকুই প্রয়োজন কিন্তু মনে হচ্ছে বর্তমানে সেটা অসম্ভব, ভারত মহাসাগরে সংযুক্ত একটি নালিকার সঙ্গে গঙ্গা অববাহিকার নিয়ন্ত্রণ জয়ের সম্ভাবনায় চীন ব্যাপকভাবে প্রলুব্ধ হয়েছে, এটা প্রতিরোধ করতে রাশিয়া নিশ্চয়ই বহুদুর পর্যন্ত যাবে।
এদিকে যেকোনো মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবার যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। সীমান্তের ওপাশে পাঞ্জাবী মুসলিম কতৃক ভারতের স্বজাতি হিন্দুদের হত্যা ভারতের সহ্যসীমার মধ্যে থাকলেও এটা তার থেকেও বেশি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার নিজের সংযম এবং তার জেনারেলদেরকে সংযত রাখার জন্য সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার যোগ্য।
কিন্তু যে ক্ষনস্থায়ী শান্তি পার্শবর্তী শক্তির (দেশগুলোর) মধ্যে বিরাজমান তা কেনা হচ্ছে বাংলার জনগনের দুর্ভোগের মুল্যে।
স্বার্থসংশ্লিষ্ট ওইসব দেশের মধ্যকার বৈঠকের ফলাফল হিসাবে আমরা শুধুমাত্র একটি দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তির ক্ষীন আশা দেখতে পাচ্ছি। ভিয়েতনাম সমস্যা বিবেচনায় চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এনলাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটা সমাবেশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এমন একটা সম্মেলন হয়তো বাংলা ও পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কিছুটা কাজ করতে পারে।
দুঃখদূর্দশা ও বিপর্যয় অসীম ক্ষমতার জন্য নতুন একটা পারস্পরিক চুক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এমন অনুপাত ও জটিলতার সমস্যাকে পরিচালনা করতে পারে তেমন কিছু এখনো উদ্ভাবিত হয়নি।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭২। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব |
সেন্ট লুই পোষ্ট ডিসপ্যাচ বাংলাদেশ (ডক্যুমেন্ট ১ম খন্ড) |
১ আগস্ট, ১৯৭১ |
<১৪, ৭২, ১৬৮-১৬৯>
সেন্ট লুই পোষ্ট–ডিসপ্যাচ, আগস্ট ১, ১৯৭১
পাকিস্তানে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) দায়িত্ব
সম্পাদকীয়
পুর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির উপর করা প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক উচ্চ কর্মকর্তা বলেন, “পোল্যান্ডে নাৎসিদের সময়ের পর থেকে হিসাব করলে এটা সবথেকে অবিশ্বাস্য”। পরিসংখ্যান খুব মর্মান্তিকঃ কমপক্ষে দুই লক্ষ এবং সম্ভবত সাত লক্ষের মত মৃত; পঁয়ষট্টি লক্ষের বেশি ভারতে শরনার্থী, পাশাপাশি আরো লক্ষ লক্ষ পুর্ব পাকিস্তানে বাস্তুচ্যুত; প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি ভারত পাড়ি দিচ্ছে; ক্ষুধা ও রোগের শিকার এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেয়োনেটের খোঁচায় এখনো মারা যাচ্ছে হাজার হাজার।
চার মাস হয়ে গেলো, যখন থেকে পূর্বের একটা বিদ্রোহ দমন করতে বিভক্ত দেশের প্রভাবশালী পশ্চিম অংশের সামরিক বাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতৃক বছরধরে সরবরাহকৃত অস্ত্র হাতে নিয়েছে। প্রথমে বিদ্রোহীরা নায্য সরকার গঠনের থেকে সামান্য বেশি চেয়েছিল। এখন বিদ্রোহীরা ভারতের সাহায্য পাওয়ায় গেরিলা প্রতিরোধ বাড়ছে সেখানে এবং পাকিস্তান আবার এক হতে পারবে কিনা সে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো পুর্ব পাকিস্তান ও ভারতের বাঙালীরা মিলে “বাংলাদেশ” নামক একটা নতুন প্রদেশ তৈরি করবে।
অনেক আশা থাকলেও এশিয়ার এই সংকট নিরসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুমিকা বলতে গেলে সবথেকে কম। যেমন একজন পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন, মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা বাঙালিদের শত্রুতা অর্জন করার জন্য যথেষ্ট হলেও, পাকিস্তানের বন্ধুত্ব জয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। বাকচাতুরী নীতির মাধ্যমে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের পুর্ব পাকিস্তানে তাদের কৃতকর্মের জন্য কড়া সমালোচনা করছি, এমনকি অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করেছি যখন দেশ অনাহারে ভুগছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অস্ত্র পাঠানো বহাল রেখেছি এরকম একটা বিকৃত ভাবনা থেকে যে এসব করা এই দেশের “কৌশলগত স্বার্থ”।
কৌশলগত স্বার্থই যদি প্রধান চিন্তার বিষয় হয় তাহলে এই দ্বন্দ্বের অবসান এবং পুর্ব পাকিস্তান পুনর্গঠনে ওয়াশিংটনের সম্পদ ব্যায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ক্রমাগত অস্ত্র প্রেরণে শুধু ধ্বংস সাধিত হবে। ওয়াশিংটনের অজুহাত যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হওয়ার আগে পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চুক্তির শর্তাবলী পূরণই জাহাজ প্রেরণের মুল লক্ষ্য (যা প্রকৃতপক্ষে যা নিষ্পত্তি মূলক ছিলনা)। যেমন সিনেটর সিমিংটন বলেছেন, “আমরা তাদের থামাতে পারবো না সেজন্য নয়, কিন্তু যেহেতু আমরা তাদের না থামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি এজন্য এই জাহাজ পাঠাচ্ছি”। অন্যথায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমেরিকার প্রেসে মানুষের দুর্দশার প্রতিবেদন মনে করিয়ে দেয়, পুনরাবৃত্তির জন্য মানুষকে ইতিহাস ভুলে যাওয়ার দরকার নেই যা স্যান্টায়ানার সতর্কবানীর পরিপন্থী। লক্ষ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক যখন নাৎসিদের হাতে প্রান হারিয়েছিল, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সেই নীরবতা এখনো স্মরণ করে। অজুহাত আছে যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কি ঘটছে সেটা কেউ জানতো না। পুর্ব পাকিস্তানিদের উপর যে হত্যা ও নিপীড়ন চলছে সেটাকে হয়তো পরিকল্পিত ভাবে ইহুদী ধ্বংসের সাথে তুলনা করা যাবেনা, কিন্তু এটা যথেষ্ট খারাপ। এবং কেউ বলতে পারবে না “আমি জানতাম না”।
আমাদের কাছে মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুর্ব পাকিস্তান ও ভারতীয় সীমান্ত জুড়ে দুর্ভাগা মানুষদের আরো সহায়তা দেওয়ার জন্য এবং পুর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী উঠিয়ে নিতে বাধ্য। গঠনমূলক পদক্ষেপের জন্য এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে যেটা সপ্তাখানেক আগেও নেওয়া যেতো; এমনকি এই দ্বন্দ্ব বৃহত্তর সংগ্রামে পরিণত হলেও সেটা প্রতিরোধ করতে হয়তো দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃস্থদের সাহায্য করতে নিশ্চয়ই দেরি করা যাবেনা।
সেন্ট লুইস পোষ্ট–ডিসপ্যাচ, আগস্ট ১, ১৯৭১
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
৭৩। ভিয়েতনাম যুদ্ধের মত | নিউইয়র্ক টাইমস | ১ আগস্ট, ১৯৭১ |
<১৪, ৭৩, ১৭০-১৭১>
নিউইয়র্ক টাইমস, রবিবার, আগস্ট ১, ১৯৭১
পুর্ব পাকিস্তানঃ ভিয়েতনাম যুদ্ধের মত
ম্যালকম ডাব্লিউ ব্রাউনি
ঢাকা, পাকিস্তান – সরকারী সেনাবাহিনী মূলত শহর এবং রাস্তাগুলিতে সীমাবদ্ধ। গ্রামাঞ্চলে গেরিলা বিদ্রোহীরা সীমান্তের ওপাশ থেকে সাহায্য পাচ্ছে। একটা গোপন রেডিও বার্তায় মুক্তি বাহিনীর সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ বিজয় সম্পর্কে বলা হয়।
একজন পরিদর্শক কোন অস্বাভাবিকতা ছাড়াই পুর্ব পাকিস্তানের বেশীরভাগ এলাকার মধ্য দিয়ে চলতে পারেন। তবুও অনেক বিদেশী কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক বাঙালীদের অবস্থাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় এবং এরকম কিছু ঘটনার সাথে তুলনা করতে প্রলুব্ধ হয়েছেন যেগুলোর নির্ভুল তালিকা উপরে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত শুরু থেকেই বাঙালি বিদ্রোহীদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগীতা করছে, যেমনটা উত্তর ভিয়েতনাম ভিয়েতকংদের জন্য করেছিল। এমনকি ঘন, ধান জন্মানো গঙ্গা নদীর বদ্বীপ ভূখণ্ড নিয়ে পুর্ব পাকিস্তানের অনেকাংশ গঠিত যেটা ভিয়েতনামের মেকং নদীর বদ্বীপের অনুরূপ। মুক্তি বাহিনীরা নিষ্ঠুর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার আগে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে সংক্ষিপ্ত পোস্টার ছড়িয়ে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করেছে।
কিন্তু পুর্ব পাকিস্তানে যদি একটা গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়, এটাকে পুর্ব এশিয়ায় কয়েক দশকে দেখা কার্যকারী ধাপে পৌছানোর পূর্বে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সব পক্ষের অপপ্রচারের পরিমাণে, খুব বেশি কিছু ঘটছে বলে মনে হয় না।
পুর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্ততপক্ষে কিছু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেকেই কষ্টে ভুগছে। কিন্তু এই আবেগ-তাড়িত দেশে এর সত্যতা নিরুপণ করা, চলমান বর্ষার মৌসুমে দাঁড়ানোর মত শুষ্ক জায়গা খুঁজে পাওয়ার মতই কঠিন।
পুর্ব পাকিস্তানের পুর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত জুড়ে, পাকিস্তান ও ভারতীয় কামান পরস্পরের দিকে বজ্রধ্বনিতে বেজে উঠছে, এবং গত সপ্তাহে এসব অঞ্চলে উভয়পক্ষ তাদের বাহিনী বৃদ্ধি করেছে। সামরিক লোকজন এবং সাধারণ জনগন আশা করছে আগামী কয়েক সপ্তাহে সহিংসতা বাড়বে, সম্ভবত ১৫ আগষ্ট পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে একসাথে ঘটবে।
ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যবর্তী ৬০ মাইল রাস্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা সীমান্ত সৈন্যবাহিনী উন্মুক্ত আছে। এই কৌশলগত সংযোগ বজায় রাখতে সরকারের কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটা দেখানোর তেমন কিছু নাই। এই রাস্তায় সম্প্রতি একটা বিস্ফোরক বসানো হয়েছে, এবং বিদ্রোহীরা রাস্তার একটা প্রধান সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু যানবহন ঘুরপথে কয়েকশ গজ দুরের দুর্বল কাঠের সেতু হয়ে যাচ্ছে।
গত দু সপ্তাহে ঢাকায় গেরিলারা তাদের উপস্থিতি জানান দিতে শহরের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ও বিদ্যুৎ সরবরাহের এমন ভাবে ক্ষতি করে যাতে ঘনঘন লোডশেডিং হয়। রাতে বিস্ফোরণ আর গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। আশপাশের যেসব মার্চ মাসে জ্বলেপুড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তা এখনো সেভাবেই আছে। কিন্তু ঢাকা আবারো মানুষ, রিকশা ও বাণিজ্যে পরিপূর্ণ এবং যেন আগের মতই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলের অনেক জনবহুল এলাকায় ফসল ফলছে, এবং গুরুত্বর খাদ্যাভাব থাকলেও সেটা স্পষ্ট নয়।
এই শত্রুতার রাজনৈতিক পটভূমি খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট সহজ। পরস্পর থেকে ৯০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা পৃথক পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী কিন্তু অন্য সবকিছুতে ভিন্ন। পুর্বাঞ্চলের বাঙালীরা পশ্চিমাঞ্চলের ভাষা উর্দু থেকে ভিন্ন ভাষায় কথা বলে, তাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য আলাদা, এমনকি তারা দেখতেও ভিন্ন। বাঙালীরা বহুদিন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবীদের পুর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক শোষক হিসাবে গণ্য করে আসছে।
বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসনের সুপ্ত বাসনা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গত মার্চ মাসে একটা পর্যায়ে আসে এবং কিছু বাঙালী নেতৃবৃন্দ সরাসরি প্রত্যাখ্যান ও নতুন বাঙালি জাতি নিয়ে বাংলাদেশ গঠনের আহ্বান জানান। ২৫শে মার্চে, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পুর্ব পাকিস্তানি সামরিক ইউনিট বিদ্রোহীদের সাথে একযোগ হয়ে বাংলার আক্রমণাত্মক শক্তি হয়ে ওঠে। সেই থেকেই তারা এসব অঞ্চলের প্রশাসনকে কঠোর হস্তে দমন করছে।
এর ফলে ঠিক কতজন মানুষ নিহত হয়েছে সেই বিতর্ক এখনো অমীমাংসিত। সরকারী বাহিনীরা কখনো তাদের নিজস্ব হিসাব প্রকাশ করেনি, “তারা শুধু বলেছে শত্রু মৃত্যু গণনা করা হয় না; তারা নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে”। ধারণামতে দশ হাজার থেকে কয়েক শত হাজার লোক নিহত হয়। যেকোন ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তিনটি নিয়মিত বিভাগ এখন পুর্ব পাকিস্তানে জীবনের প্রতিটা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করছে, ঝামেলায় জড়াতে চায়না এমন কিছু পশ্চাদভূমি ছাড়া।
এবং প্রচলিত ধারণায়, চ্যালেঞ্জ নয় বরং বাঙালীদের জন্য একটা হতাশা রয়ে গেলো। এখানের অনেক পর্যবেক্ষকের জন্য, সবথেকে দুঃখজনক এবং উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সাত মিলিয়ন মানুষ ভারতে পালিয়েছে এবং শরনার্থী সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ম্যালকম ডাব্লিউ ব্রাউনি
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৪।জাতিসংঘের সাহায্য দল | নিউইয়র্ক টাইমস | ১ আগষ্ঠ, ১৯৭১ |
<১৪, ৭৪, ১৭২-১৭৩>
দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস,রবিবার,১ আগষ্ঠ,১৯৭১
জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তানে দল পাঠাবে
যুক্তরাষ্ট্র ১৫৩ জনের রিলিফ ইউনিট পাঠানোর পরিকল্পনায়
থান্ট এবং ইয়াহিয়ার স্বীকৃতি
বেঞ্জামিন ওয়েলস স্পেশাল
দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস
ওয়াশিংটন, ৩১’ই জুলাই -কর্মকর্তারা আজ বলেছেন, ওয়াশিংটন, ৩১’ই জুলাই- জাতিসংঘের অধীনে ১৫৬ জন বেসামরিক ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞদের একটি আন্তর্জাতিক দল পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান ও জাতিসংঘ উভয়ই।
তাছাড়া তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে অবগত করেছেন দল সংগঠিত করা এবং প্রয়োজনীয় সরজ্ঞাম আকাশ পথে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাথমিক ভাবে দশ লক্ষ ডলার খরচ হবে।
সংবাদদাতা বলেন, জাতিসংঘের কর্মীদের মধ্যে ৭৩ জন পর্যবেক্ষক থাকবে তার মধ্যে চারজন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার অফিসে সংস্থিত হবে এবং বাকী ৬৯ জন অন্য স্থানে। তবে প্রত্যেক পর্যবেক্ষক ঢাকায় সদর দপ্তরের সঙ্গে রেডিও দ্বারা সংযুক্ত থাকবেন।
“জাতিসংঘের ৭৩ জন পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে , প্রত্যেকে নিজ এলাকার অবস্থার উপর প্রতিবেদন দিবেন। এটি হয়ত সামরিক প্রতিহিংসা ও ক্রোধ শান্ত এবং নিরস করতে পারবে” সাংবাদিক আরো বলেন, “এটি যদিও জাতিসংঘের কর্তব্য নয় কিন্তু এইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে”।
২৫’শে মার্চ। রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় সৈন্য নিয়ে প্রবেশের এবং দাবী দমনের আদেশ দেন। তখন থেকে সেনাবাহিনীর আক্রমণে জীবন এবং সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং অর্থনৈতিক ধ্বস সহ প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ সংলগ্ন ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘ দলের প্রস্তাবে জনাব থান্ট এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার চুক্তিতে এক জন কর্মকর্তা আজকে একে “বিষাদ অবস্থায় একমাত্র সূর্যকিরণ” হিসেবে ব্যাখা করেছেন।
জাতিসংঘ দলের চুক্তিতে পাকিস্তানের সম্মতিকে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরব কিন্তু একটানা চাপের ফল বলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, যুক্তরাষ্ট্র এক বছরে বিশ্ব ব্যাংকের অধীনে আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেবে দেওয়া ৪৫ কোটি ডলারের মধ্যে ২০ কোটি ডলার পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সাহায্যে দিয়েছে।
পাকিস্তান থেকে অনুরোধ
২৪’শে মে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া জাতিসংঘের সুপারিশ চেয়েছেন। পরিকল্পনায় তাঁর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন প্রতিমুহূর্তে আশা করা হচ্ছিল।
বিশ্ব ব্যাংক এবং অন্যান্য সূত্র আজকে জানিয়েছে, নতুন দলে নিয়োগ কাজ বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে।এই সূত্র মতে, সদরদপ্তরের স্টাফদের মধ্যে ৩৮ জনের গঠন করা প্রথম সম্ভাব্য দল ঢাকা পাঠানো হবে।
বিশেষ সংস্থা থেকে ৪৫ জনের সম্ভাব্য দ্বিতীয় দল গঠন করা হবে। যেমন, জাতিসংঘের শিশুদের সংস্থা ইউনিসেফ ১৮ জন, খাদ্য এবং কৃষি সংগঠন ২ জন, বিশ্ব খাদ্য কার্যসূচী ১৩ জন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন ১২ জনকে পাঠাবে। তৃতীয় সম্ভাব্য দলের রেডিও- সজ্জিত পর্যবেক্ষক হবেন ইসমত কিত্তানি যাকে জাতিসংঘের “মাঠ পর্যায়ের ব্যক্তি” বলা হয়।একজন ইরাকী যিনি আন্তঃসংস্থার সহকারী মহাসচিব। নিউ ইয়র্কে জাতি সংঘের সদর দপ্তর থেকে দল নিয়োগ এবং দ্রূত সম্পাদনের জন্য জনাব থান্ট সহকারীর দায়িত্বে আছেন। বাগ হাত এল- তাওয়াল, একজন মিশরীয় যিনি ঢাকায় জনাব থান্টের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি, পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশন পরিচালনা করবেন।
থান্ট “ সীমার বাইরে ”
এক সূত্র জানিয়েছে, “জাতিসংঘের ত্রাণ অভিযানের জন্য কোন যন্ত্রপাতি এবং বাজেট নেই। উ থান্ট “সীমার বাইরে”। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রজেক্টের পরিচলনার জন্য দশ লক্ষ ডলার অনুমোদন দেওয়ার জন্য সম্মত হয়েছেন।”
অন্যান্য সূত্র জানিয়েছে, এই দলের প্রথম ৬ মাসের খরচ ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাবে। এই অনুদানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণ আশা করছে।
পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন গ্রহণের সাথে সাথে আকাশপথে রেডিও ও অন্যান্য সরঞ্জাম পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাকে বলা হয়। সংস্থার ৬ কর্মী ঢাকায় আছে এবং রিপোর্ট করে জাতিসংঘ দলের প্রয়োজনীয় কারিগরি সহয়তা দিতে প্রস্তুত আছে।
সংবাদদাতা জোর দিয়ে বললেন, জাতিসংঘ দল প্রাথমিক ভাবে পাকিস্তান কতৃপক্ষের সাহায্যে অনাহার এবং রোগের হুমকি উপশম করবে সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা সেনাবাহিনীর প্রতিহিংসা এড়াতে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছে বা যাদের বাড়ী ধ্বংস হয়েছে তাদের বাড়ী এবং আশ্রয় পুনর্বাসন করবে।
তারা পাকিস্তানকেও যোগাযোগ পুনঃস্থাপন এবং প্রদেশের দ্রূতগামী বেসরকারী ৪০,০০০ নৌবহর এবং ১০,০০০ ট্রাক মেরামত করবে।
এক সংবাদদাতা বলেন, “জাতিসংঘ কোন অপেরেশন না চালালেও প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনে আস্থা পুনরূদ্ধার করতে সাহায্য করবে।”
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৫। একটি জাতিকে হত্যা করা হয়েছে | সংবাদ সপ্তাহ | অগাস্ট ২, ১৯৭১ |
<১৪, ৭৫, ১৭৪-১৮১>
সংবাদ সপ্তাহ, অগাস্ট ২, ১৯৭১
বাংলাঃ একটি জাতিকে হত্যা
এটা একটা বাঁধা ধরা অনুরোধের মতো যথেষ্ট মনে হচ্ছে । পূর্ব পাকিস্তানের হালুর ঘাট গ্রামের কতগুলো যুবককে একত্র করা হয়েছে। একজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রধান তাদের অবিহিত করে যে তার আহত সৈন্যদের জন্য জরুরী ভাবে রক্তের প্রয়োজন । তারা কি দাতা হতে চায় ? যুবকেরা ক্ষণস্থায়ী খাটে শুয়ে পড়েছিল, সুঁই তাদের শিরাতে ঢোকান হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তাদের শরীর থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মারা গিয়েছিল ।
গোবিন্দ চন্দ্রা মণ্ডল ভুলে গিয়েছেন কে তাকে প্রথম এই খবর দিয়েছিল কিন্তু যখন তিনি রাজক্ষমার কথা শুনেন যা সকল শরণার্থীদের কাছে অঙ্গীকার করা হয়েছে । তিনি তৎক্ষণাৎ তার কিশোরী কন্যাদের সাথে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্য দীর্ঘ পদব্রজে যাত্রা শুরু করেন । চন্দ্রা মণ্ডল ক্লান্ত পায়ে বর্ষার প্লাবিত জলা জমি এবং পোড়া গ্রামের মাঝে দিয়ে চলতে থাকেন। যখন তিনি তার বর্জিত এক টুকরো জমির কাছাকাছি আসেন তখন সৈন্যরা তাকে থামায়। তারপর তিনি অসহায় যন্ত্রনার মাঝে তার কন্যাদের ধর্ষিত হতে দেখেন ।
সে প্রায় দুই বছরের ছিল এবং মা তার কিশোরী কন্যাদের সাথে ছিল। তারা মাটিতে বসে যা গ্রীষ্মের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারনে কর্দমাক্ত ছিল। শিশুটির পেট ছিল হাস্যকর রকমের ফাঁপা, পা ছিল ফোলা , তার বাহু মানুষের আঙ্গুলের মতো ছিল। তার মা তাকে কিছু ভাত এবং শুকনো মাছ দিয়ে তুষ্ট করতে চেয়েছিল। অবশেষে শিশুটি দুর্বল ভাবে তা খায় এবং সাঁ সাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে মারা যায় ।
কিছু লোক পাকিস্তানিদের তুলনায় পশ্চিমাদের বেশি বর্বর মনে করে। যখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের দেশে হাজার হাজার লোক প্রান হারায় যা নিয়মিত সংক্রামক মহামারীর মাধ্যমে, সংবাদপত্র গুলো একটি অবাস্তব কৌতূহলের মাধ্যমে তাদের দুঃখ কষ্টের হিসাব করে। আজ পর্যন্ত কেও পাকিস্তানের দুঃস্বপ্ন থেকে পালাতে পারে না। এক মিলিয়ন বাঙ্গালির এক চতুর্থাংশ মৃত এবং ছয় মিলিয়ন অথবা আরও বেশি জনগন মারিয়াভাবে নির্বাসিত করে যার ফল হলও ইচ্ছাকৃত ভাবে সমগ্র জাতির মাঝে ভয় দেখানো। এটা ছিল বন ( জার্মানির ) এর আয়তনের, যা ধ্বংস করা হয় এবং হঠাৎ করে লন্ডনের জনগণকে গৃহহারা করা হয় কিন্তু কষ্টের মাপকাঠিতে তা আজও অসুস্থকর আঘাত ।
এবং এখানে এর চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে। প্রত্যাশার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু আছে । পাকিস্তান নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে আর এর দ্বারা পাকিস্তানের মুসলমান এবং তার খিলান শত্রু ভারতের হিন্দুদের মাঝে অন্য আরেকটি বৃহৎ গৃহযুদ্ধের স্ফুলিংগ দেখা দিচ্ছে। গত সপ্তাহে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ক্রুদ্ধ ভাবে ঘোষণা করেন যে যদি বাংলাদেশের প্রতি ভারতে গোপন সমর্থন বিস্তৃত করে যারা বিচ্ছিন্নবাদী বাঙ্গালী জাতি হিসেবে পরিচিত। “ আমি ঘোষণা করব যে পকিস্তানের মিত্র চীন এবং ভারতের মিত্র রাশিয়াকে সম্পৃক্ততা এড়াতে দৃঢ়ভাবে চাপ দেয়া হবে। এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র কোন পক্ষের সাথে থাকবে তার মুখোমুখি হতে পারে।
ইতিমধ্যে ভৌগোলিক রাজনীতির কারনে কৌশল এবং মানবিক বিচার এর মাঝামাঝি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র তার অকৃতজ্ঞ কর্মের মুখোমুখি হয়েছে ।ইয়াহিয়া সরকারের সাথে তার প্রভাব সংরক্ষনের জন্য তাকে আলিঙ্গন করেছে । এখন তারা উদ্বিগ্ন বাঙ্গালিদের দুর্ভোগে সাহায্যের বিষয়ে। আর আমেরিকা শুধুমাত্র একটি তিক্ত বিতর্কের মাঝে নিজেকে জড়াতে পেরেছে। গত সপ্তাহে এই বিতর্ক তীব্র আকার ধারন করে যখন সেন এডওয়ারড কেনেডি পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকদের কাছে গোপনীয় বার্তা প্রকাশ করে।“ পূর্ব পাকিস্তানের উপর দুর্ভিক্ষে অপ্রিতিকর পরিনাম প্রত্যাশা করে ” -এক তারের বার্তা। “ বিস্তৃত ক্ষুদা, কষ্টভোগ এবং সম্ভবত অনাহার প্রতিহত করা; পুনরাবৃত্তি ভালো নয় ।” কেনেডি পরিস্কারভাবে সংশ্লেষণ করেছিল যে নিক্সন প্রশাসন বাঙ্গালীর বিশাল দুর্ভোগ দামাচাপা দেওয়ার উপায় খুজচ্ছে এবং এখানেই সন্তুষ্ট না। তিনি অন্তরঙ্গভাবে পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশ টীম পাঠানোর পরিকল্পনা করছিলেন যারা ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবি সৈন্যদের বাঙ্গালিদের প্রতিরোদ দমন করার জন্য সাহায্য করবে।
দুইটি বিপথগামী সংস্কৃতি
একটি ঠাণ্ডা মাথার পদক্ষেপ অব্যশই তা অতিক্রম করে যাওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক সংঘাতের ফাঁদে রয়েছে। শারীরিক এবং জাতিগতভাবে পাকিস্তান বিশ্বের অন্যান্য জাতিদের মাঝে অনন্য। এর জনবহুল পূর্ব অঞ্চল থেকে পশ্চিম অঞ্চল প্রায় ১০০০ মাইল ভারতের অঞ্চল দ্বারা আলাদা। এটা দুটি আমূল বিপথগামী সংস্কৃতির একটি জাতি। দুটি পুরোপুরি ভিন্ন জাতি ইতিহাসের মাধ্যমে যারা একে অপরকে ঘৃণা করে। পশ্চিম পাকিস্তানের হালকা রঙয়ের উদ্ধত পাঞ্জাবী যারা বাঙ্গালীদের ঘৃণা করে অথচ তাদের উর্বর ধানের জমি এবং আকর্ষণীয় পাট ফসলের বিল দিয়ে ১৯৪৭ সাল অর্থাৎ যখন থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকে তাদের অর্থ দিয়েই বিল পরিশোধ করছে। বাঙ্গালিরা তাদের বর্বর হিসাবে গণ্য করে এবং আরও খারাপ দিক হোল ; অত্যাচারী বর্বরদের একচেটিয়া পাকিস্তানী সরকার এবং সৈন্যবাহিনী আছে। এক বাঙ্গালী নেতা বলেছিলেন, “ আমরা পশ্চিমাদের কাছে উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই না ।”
বধ করার পরিকল্পনা
ইয়াহিয়ার আদেশের কয়েক ঘণ্টার মাঝেই মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ঘোষণা করেন। এই দিনে পাকিস্তান সরকারীভাবে এবং ইয়াহিয়া ব্যক্তিগতভাবে মুজিবের কাছে আপস করার জন্য আপীল করে যা হয়ত জাতির আঘাতটাকে আরোগ্য করবে। কিন্তু অধিকাংশ পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করত যে ইয়াহিয়ার অন্য কোন পরিকল্পনা রয়েছে। আসলেই সপ্তাহ পূর্বে ইয়াহিয়া – মুজিব মিটিং এ বসেছিল। রাষ্ট্রপতি এবং তার ডান হাত লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ইতিমধ্যে মুজিবকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করে ফেলেছিল এবং আওয়ামীলীগের সাথে সাথে জাতীয়তাবাদ বধ করারও ।
“বেলুচিস্থানের বোমারু বিমান ” তার বায়ুর যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য পরিচিত এবং কামানের আঘাতের মাধ্যমে স্থানীয় উপজাতীয় বিদ্রোহীদের আঘাত করে ১৯৬৬ সালে। টিক্কা খান দৃশ্যতই ইয়াহিয়া খানকে রাজি করান কিছু সময় কিনার জন্য যাতে তার সেনাবাহিনীকে তৈরি করতে পারেন। তদনুসারে ইয়াহিয়া আলোচনার জন্য মুজিবকে প্রস্তাব করেন। যখন দুই নেতারা আলোচনায় ছিল এবং বাঙ্গালীদের সাথে সাথে বিশাল বিশ্ব আপসের টুপির জন্য অপেক্ষা করছিল যা সম্ভবত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লজিস্টিক আঘাতের লাগাম টানবে। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স এর বোয়িং ৭০৭এস ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের দীর্ঘ পথ উড়ে দখল করে। সেনাবাহিনী প্রায় দ্বিগুণ ৬০০০০ সেনা বাংলায় জড়ো করে। যখন টিক্কা জানান যে সব কিছু তৈরি; ইয়াহিয়া ঢাকার বাইরে চলে আসে এবং সেই রাতেই বেলুচিস্থানের বোমারু বাহিনীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নির্দেশ অনুযায়ী নির্মমভাবে আঘাত করা হয় এই তত্ত্বের উপর যে অসভ্য অতর্কিত আক্রমনের দ্বারা প্রতিরোধকে দ্রুত মেরে ফেলা যাবে। সেনাবাহিনী তা প্রতিহিংসার সাথে পালন করে। ট্যাংক পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় আঘাত করে নির্বিচারে মানুষ এবং বাড়িঘরের উপর বিস্ফোরণ করে। নিষ্ঠুর হিংসার সাথে পাঞ্জাবী সৈন্যরা নাগরিকদের মেশিনগান দ্বারা গুচ্ছ গুচ্ছ গুলি করে। অন্যরা তখন রাজধানীর বুকের বস্তিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শীগ্রই শহরটি জুড়ে লাশ ছড়িয়ে থাকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর একটি রক্তাক্ত বিছানা বানানো হয়েছিল যা ছিল একটি রক্তাক্ত কসাইখানা।
রক্ত প্লাবিত রাত এবং দিন এবং সপ্তাহ যাবত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে । গণহত্যা শুধুমাত্র ঢাকার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না , তার সাথে সাথে গ্রামাঞ্চল জুড়ে চলতে থাকে। একজন গভীর আতঙ্কিত বাঙ্গালী সাংবাদিক ভারতের সীমান্তের নিকটবর্তী তার গ্রামে বেপরোয়া সাক্ষাতের পর জানান কি রকম ভাবে জমি বিধ্বস্ত হয়েছে। “আমি এক ডজনের উপর গ্রাম পার হয়ে আসার সময় দেখেছি কিভাবে তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পরিত্যক্ত হয়েছে এবং সর্বত্র দেহ ছড়িয়ে রয়েছিল যা কাক খাচ্ছিল। গন্ধ ! আতঙ্ক ! আমি প্রার্থনা করছিলাম যাতে আমার গ্রামটিও এই রকম না হয় কিন্তু তা হয়েছিল। গ্রামটি শুধুমাত্র ধ্বংস স্তূপের এবং লাশের একটি ভর ছিল। আমার স্ত্রী এবং সন্তানেরা নিখোঁজ ছিল। সেখানে মাত্র একজন বৃদ্ধ মহিলা জীবিত ছিল এবং সে কথা বলতে পারেনি। তিনি শুধু মাটিতে বসে কাঁপছিলেন এবং বিলাপ করছিলেন।
সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হত্যা কাণ্ডের খবরের মাত্রা কমে আসছিল। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মাঝে বর্বরতা কমানোর কোন বিষয় ছিল না। গত সপ্তাহে, সংবাদ সপ্তাহের লরেন জেনকিন্স যে কিনা জেনারেল টিক্কা খানের সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড আরম্ব করার রাতে ঢাকা ছিলেন। নিম্নলিখিত রিপোর্টটি পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থানের উপর পাঠানো তারবার্তা –
রক্তক্ষরণের চার মাস পরেও পূর্ব পাকিস্তান এখনও ভয়ের মাঝে বাস করে। কিন্তু ভয় গুড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, সেনাবাহিনী লজ্জাকরভাবে ভয় ধীরে ধীরে প্রবেশ করানোর পথ খুঁজছে। এটা একটা অন্ধকারাচ্ছন ভয় যা কিঞ্চিৎ রঞ্জিত হচ্ছে প্রকাশ্যও অবাধ্যতা এবং ঘৃণার মাধ্যমে। এটা একটা কঠিন বাস্তব উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে এই ভয়। এটা সেই ভয় না যা মানুষের আত্মাকে চিহ্নিত করে। সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় একাকী হাঁটার সময় আমার এক সংবাদিকের সাথে দেখা হয়েছিল যাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। আমাদের চোখা চোখি হওয়ার পর সে মাথা নেড়েছিল কিন্তু তিনি বিব্রত ভাবে হাজির হন। ঘাবড়ে চারপাশে তাকিয়ে সে বিড় বিড় করে বলে, “ হে আমার আল্লাহ, হে আমার আল্লাহ; যে ধরনের ভয়াবহ কাজ হয়েছে কোন সভ্য মানুষের পক্ষে তার বর্ণনা করা সম্ভব না। ” ঘণ্টা খানেক পর আরেকজন বন্ধু ব্যাখ্যা করেন; “ আমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে যাতে কোন বিদেশী সাংবাদিকের সাথে কথা না বলি। আমরা আতঙ্কিত, আমরা মধ্যরাতের দরজায় কড়া নাড়ার (০১১) ভয়ে বসবাস করি। অনেক মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। আরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে এবং প্রতি রাতে আরও নিখোঁজ হচ্ছে।
মুজিব যে কিনা রাতের মাঝে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। সে এখন জনশ্রুতি অনুযায়ী পশ্চিমের মিয়ানওয়ালি গ্রামে আটক রয়েছে। পূর্বে যে একজন নায়ক ছিলেন এখন তিনি একজন শহীদে পরিনত হয়েছেন। তার সুস্পষ্ট ভুল ছিল যে তিনি বাঙ্গালী দেশ প্রেমিকের প্রতীক হয়ে হয়ে উঠেছিলেন। তবুও ইয়াহিয়া বুক ঠুকে সম্প্রতি একজন প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “ আমার জেনারেলরা মুজিবকে সামরিক আদালতে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য চাপ প্রয়োগ করচ্ছে। আমি সম্মতি প্রদান করেছি যে বিচার খুব শ্রীঘ্রই সম্পন্ন হবে। কোন নীতিই অদূরদর্শী এবং বাঙ্গালীর সহ্য করার ক্ষমতাকে কঠিন করবে। একজন পশ্চিমা কূটনৈতিক আমাকে বলেছিলেন, “ ইয়াহিয়া সহজেই তার জ্ঞান বুদ্ধি হারিয়েছেন। ইনি এমনকি বুজতেই পারছেন না তার সেনা বাহিনী কি কাজ শেষ করেছে। সে মনে করে তারা হয়ত হাজার খানেক মানুষকে মেরেছে। মুজিবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা, জোর করে তাদের শৃঙ্খলাড় মাঝে ফিরিয়ে আনলেই সব কিছু ভুলে যাবে । যা সম্পূর্ণই অর্থহীন। মানুষ তা কখনোই ভুলবে না।
গেরিলা প্রতিরোধ
প্রকৃতপক্ষেই বাঙ্গালীর মনে উচ্চ প্রশংসার সাথে এই মাসগুলোর সন্ত্রাসের স্মৃতিগুলো মনে থাকবে। সন্ত্রাসের চিহ্ন থাকা সত্তেও সেনাবাহিনী সর্বত্র হামাগুড়ি দিচ্ছিল। ঢাকার রাস্তায় লোকাল দুরন্ত ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে হস্তলিখিত বা টাইপ করা সরকারী ইস্তাহার নির্বাসিত করা হচ্ছিল সংবাদপত্রের মাধ্যমে। গ্রামঞ্চলের খেয়া নৌকাগুলোর মাঝে যেখানে সকল যাত্রীগন সেনাবাহিনীর সতর্ক পর্যবেক্ষণে ছিল; সেখানে অপরিচিতরা উঠে পরত এবং ফিসফিসিয়ে তাদের গণহত্যার কথা বলত আর না হয় মধুপুরের ঘন জঙ্গলের মাঝে কোথায় “ মুক্তিবাহিনী ” অথবা স্বাধীনতার বাহিনী লুকিয়ে আছে তা ইঙ্গিত করত। সর্বত্র দেশজুড়ে দ্রুত অতুলনীয় গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধের চিহ্ন ছড়িয়ে পরেছিল। এবং পূর্ব পাকিস্তান হল আদর্শ গেরিলা খণ্ডের স্মারক হিসাবে পরিচিত দক্ষিন ভিয়েতনাম মেকং ব-দ্বীপের মত গোলকধাঁধা, যার নিম্মজিত ধানক্ষেত, পাটক্ষেত এবং কলার উপবন রয়েছে।
মুক্তি বাহিনী তাদের দৈনন্দিন বাড়িতে কিনে আনা অল্প সম্পদের ভিত্তিতে মূলধনরুপে তা প্রয়োগ করত। তারা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা যাওয়ার রেলপথ কেটে ফেলে এবং সাথে সাথে তার সমান্তরাল রাস্তাগুলোও ছিন্ন করে। ঐ পথগুলো দিয়ে অভ্যন্তরীণ ৬০% খাদ্য সরবরাহ করা হতো এবং তা পুনরুদ্ধার করার কার্যতই কোন প্রত্যাশা নেই যতক্ষণ না শান্তি পুনরদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি ঢাকার তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আঘাতের অভ্যুথানের মাধ্যমে সাফল্য অর্জিত হয়। যে কোন শহর বা গ্রামই প্রচারনার দিকে অর্থনৈতিক ভাবে স্থবির নয়। সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হল বিদ্রোহ জয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে মনে হচ্ছিল ,যা কিনা প্রত্যেক গেরিলার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। দুই মাস আগে নোয়াখালী প্রদেশের গ্রামবাসী মুক্তি বাহিনীর সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে তার একটি সেতুও উড়িয়ে দিবে না কারন এটা সেনাবাহিনীর প্রতিশোধ বহন করে নিয়ে আসবে । গত সপ্তাহে ঐ গ্রামবাসীরাই গেরিলাদের খোঁজ করছিল এবং তাদের সেতুটি ধ্বংস করতে বলে।
নিশ্চিত ভাবে, গেরিলারা কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী নয়। প্রায় ২০০০০ বাঙ্গালী যোদ্ধা তাদের নিজস্ব কারনে জড় হয়েছে। (এবং নতুন করে আরও ১০০০০০ পরবর্তী মাসের জন্য নিয়োগ করার প্রত্যাশা কড়া হচ্ছে পরবর্তী মাসে ভারতে গোপন প্রশিক্ষন নেয়ার জন্য।) ইচ্ছাকৃতভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের এখনও ৬০০০০ সুসজ্জিত পেশাদার সৈন্য রয়েছে। এবং সভার এই সাহায্যের সত্ত্বেও, ভারত সতর্কতার সাথে বাংলাদেশ সরকারের নির্বাসনের বিষয়ে দোলায়মান। সংযমের একটি প্রকৃত কারন হলো এটি একটি ব্যয়বহুল সমস্যা এবং নিউ দিল্লীর সরকারকে ৬ মিলিয়ন বাঙ্গালী শরণার্থীর যত্ন নিতে হচ্ছে যারা এখন ভারতে আছে। “সংবাদসপ্তাহ ” –এ টনি ক্লিফটন যে পাকিস্তানী গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শরণার্থীদের যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন। প্রতিবেদনটি গত সপ্তাহে কোলকাতায় প্রকাশিত হয়েছে।
এই ধকল ভারতের জন্য প্রায় অসহনীয়। শরণার্থীরা প্রায় প্রতিদিন দলে দলে দঙ্গল বেধে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে যা প্রতিদিন ৪০০০০ এর বেশি এবং পি এন লুথার সাবেক ভারতীয় কর্মসূচির দায়িত্তপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আমাকে বললেন, “ আমি এখন একটি ছোট দেশের যত্নের বিষয়ে দায়ী।” যার প্রতিদিনের খাবারের জন্য ভারতকে ৩ মিলিয়ন অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বস্ত্র, ঘর এবং অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বাঙ্গালীদের প্রদান করতে হচ্ছে যা ভারতের প্রান্তিক অর্থনীতিকে খোঁড়া করে দিচ্ছে। তহবিলের অভাবে শরণার্থী শিবিরে কার্যত সব কিছুর ঘাটতির কারনের অনিবার্য ফলাফল হলো দুর্দশা, রোগ এবং মৃত্যু। লুথার এর মতে, একমাত্র অনুমেয় দুর্দশার সমাধান হলো, পাকিস্তানের উপর বিশ্বের চরম চাপ প্রয়োগ করা যাতে পাকিস্তান বাঙ্গালীদের হত্যা কাণ্ড বন্ধ করে। এবং বাঙ্গালিরা নিরাপদ বোধ করলেই বাড়ি ফিরবে।
এতো দুঃখ কষ্টের পরও বাঙ্গালিরা তাদের বৈরাগ্য বজায় রেখেছে। এটা ভারতে এখন বর্ষাকাল কিন্তু এখানে বর্ষাকাল হলিউডের মতো মহান বর্ষাকাল নয়। গর্জন এবং বজ্রপাতের পরিবর্তে নমনীয় এবং স্থির ভাবে পড়ে। তাবুর পালের উপর বৃষ্টি ঝরার ফলে তাতে শরণার্থীরা সিক্ত হয়। পৃথিবীর মেঝে কাঁদা হয়ে যায় এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনের কারনে বন্যা হয়। কিন্তু শরণার্থীরা গোড়ালি পর্যন্ত পানিতে ধৈয সহকারে দাঁড়িয়ে থাকে। আগ্রহ নিয়ে তাদের ঘটনা বলে যাতে আমি অন্যদেরকেও তা শুনাতে পারি। আমার কাছে একটি নোটবুকে ভয়াবহ ধর্ষণ, খুন এবং অপহরনের ঘটনা লেখা রয়েছে। তারা বলে কি করে তাদের নিজেদের সন্তানদের ছুড়ির আঘাত পেতে দেখেছে, তাদের স্বামী অথবা ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড কি করে কার্যকর করা হয়েছে, কি করে তাদের স্ত্রীরা ক্লান্তি অথবা রোগে ধসে পরেছে। প্রত্যেকটি ঘটনাই নতুন এবং সব একই রকমের । আমার লুথারের দুঃখজনক প্রশ্ন মনে আছে , “ আমরা কি করে মনে করি যে মানব জাতি একটি উচ্চ স্তরে বিবর্ধিত হচ্ছে অথচ যখন আমরা এই ঘটনা ঘটে যেতে দেই ??? ”
সামরিক দমন এবং গেরিলা অন্তর্ঘাত চলছিল। এটা সর্বদা পাকিস্তানের নিজস্ব ভবিষ্যতের হুমকি বাড়িয়ে চলছিল। ইতিমধ্যে, বিশেষজ্ঞরা বলে দেশের অর্থনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। যখন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে , রপ্তানি নিচে পরে গেছে। অত্যাবশ্যকীয় পাট ফসল যা পাকিস্তানের সর্বচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল সংগ্রহের অভাবে পচন ধরেছে এবং পূর্বাঞ্চলের যারা পশ্চিম পাকিস্তানের কারখানার উপর নির্ভর করে বসবাস করত তারা এখন শরণার্থী অথবা বিদ্রোহীদের সাথে সাথে নিখোঁজ হয়ে গেছে। সংক্ষেপে, ইয়াহিয়া সরকার প্রকৃত পক্ষে দেওলিয়া হয়ে গেছে; যা ঢাকায় একজন অর্থনীতিবিদ সতর্ক করেন। সমানভাবে তিনি আরও বলেন যে প্রকৃত ভাবেই অনাহারের বিশাল দুর্যোগ হবে “ যদি না শীঘ্রই কিছু করা হয়।” একই অর্থনীতিবিদ আরও যোগ করেন যে এখানে একটি দুর্ভিক্ষ হতে চলছে যা পূর্বের কষ্টের তুলনায় কিছুই নয়। ” কিন্তু পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো সমুজ্জ্বল ঘৃণা যা ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী উৎপাদন করেছে। করাচীর একজন সম্পাদক বলেছেন, “ পাকিস্তান মার্চেই মারা গেছে। ” “এই জমি একত্তে ধরে রাখার উপায় হলো বেয়নেট এবং মশাল । কিন্তা তা ঐক্য নয় বরং দাসত্ব। ভবিষ্যতে আর কখনোই তা একটি জাতি হতে পারবে না, হবে শুধুমাত্র দুই শত্রু। ”
যুদ্ধের হুমকি
এলাকায় ইতিমধ্যে যথেষ্ট শত্রু রয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহে , নয়া দিল্লী এবং ইসলামাবাদ হতবুদ্ধিকর হারে একে অপরকে অপমান এবং অভিযোগের বাণিজ্য করেছে এবং একটি বাস্তব সম্ভবনা যে এই রাগন্বিত শব্দগুলো যুদ্ধকে তরান্বিত করতে পারে। প্রকৃত পক্ষেই কিছু ভারতীয় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের দাবি করছে। নিউ দিল্লীর নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলার লাখো শরণার্থীর অবিরত যত্ন নেওয়ার জন্য চেয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ ভারতের জন্য সস্তা হবে। এটা এখনো আসেনি। একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী কর্মকর্তা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গত সপ্তাহে বলেন; গুরুতর ভাবে ভারত সেনাবাহিনীর চাপ অনুভব করছে। এবং পাকিস্তানও মুক্তিবাহিনীকে ভারতের সাহায্য করার কারনে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিবেশীর উপর বল প্রয়োগ করতে চাচ্ছে।
আরো গুরুতর বিপদের সম্ভবনা হলও এতে যদি কোন সাম্যবাদী দেশ চীন এবং রাশিয়া জড়িত হয়। চীনের প্রধানমন্ত্রী , চৌ- এন- লাই নিন্দা করে বলেন “ ভারত সম্প্রসারনবাদী ” এবং পিকিং পাকিস্তানের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন ; “যে তাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এটা ন্যায্য সংগ্রাম। ” এবং চৌ তার প্রতিজ্ঞা রুপান্তর করতে পারেন । ভারতীয় সীমান্তে চীনাবাহিনীর ঘাটিকে দাঙ্গার মাধ্যমে উত্তেজিত করে অথবা পাকিস্তানী বাহিনীতে “উপদেষ্টা ” নিয়োগের মাধ্যমে বাহিনীকে শক্তিশালী করে । পাকিস্তান পিকিং থেকে কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়েছে। যখন তাদের নিজস্ব যুদ্ধ শুরু হবে তখন সামরিক ব্যবস্থা গ্রহন করবে; আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকেরা তা সতর্ক করে। অন্যদিকে ভারতের কূটনৈতিকেরা বিপরীতভাবে সাম্যবস্থা তৈরির জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা আদায়ের চেষ্টা করে। যা বিপর্যয়কে নেতৃত্ব দিবে।
একটি পীড়াদায়ক মনোনয়ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নিষ্ঠুর উভয়সংকটের মুখোমুখি হবে যদি কোন ভাবে দুটি সাম্যবাদী মহাশক্তিরা কোন ধরনের সম্প্রক্ততার মুখোমুখি হয়। বাঙ্গালীদের প্রতি পাকিস্তানের অনস্বীকার্য বর্বরতার সত্ত্বেও আমেরিকার দীর্ঘকাল ধরে যে কোন ধরনের সাহায্যের নিদারুন চেষ্টা , পিকিং গোলকের বাইরে রাখা তা যে কোন দেশই বুজতে পারবে। এবং একই সময় ভারত এশিয়ার সবচেয়ে বড় জাতি যার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে, গান্ধী এবং নেহেরুর আগের সময়ে তা দেখতে পাওয়া যায়। এবং বন্ধুত্বপূর্ণ জাতি হিসাবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টফলিওতে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাই দুটি জাতির মাঝে একটিকে পছন্দ করা যন্ত্রণাদায়ক হবে। একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বিষয়ের বিশ্লেষক মনে করেন উপমহাদেশে যুদ্ধ বিরতির উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যশই কাজ করা উচিত। তিনি আরও মন্তব্য করেন; “আমাদের প্রথম পদক্ষেপ অব্যশই শান্তিস্থাপক হিসাবে হওয়া উচিত, যা কিনা রাশিয়া তাসখনদে ১৯৬৬ সালে ভারত- পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় করেছিল। যদি তা ব্যর্থ হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এখানে অংশগ্রহন না করা । রাশিয়া এবং চীন দুই যোদ্ধাদের সাথে শুধুমাত্র সরবরাহকারী হিসাবে সংযুক্ত হতে পারে। কিন্তু যদি সরাসরি তারা জড়িত হয় তাহলে তখন ওয়াশিংটনের পক্ষে নির্লিপ্ত থাকা অসম্ভব হবে। আমাদের যে কোন একপাশে জুয়া খেলতে হবে । তাদের অন্তত যৌক্তিক সাহায্য দেওয়া দরকার যা তাদের প্রয়োজন এবং আশা করি আমরা বিজয়ী নির্বাচিত করব।
অলঙ্কার শাস্ত্র এবং ঘটনা নির্ভর পরিকল্পনা বাদে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশসমূহ ভারত উপমহাদেশের সামরিক ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চায় না। কিন্তু তা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এই সময়ের মাঝেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ এবং এশিয়ার সম্ভাব্য মিলিয়ন মানুষের জীবন ইয়াহিয়া খানের হাতে নির্ভর করছে। এবং যে মুহূর্ত থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সম্ভাব্য মূল সাম্যবাদী বিদ্রোহকে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন আর তার কারনেই জাতীয়বাদী গেরিলা সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য দুঃখজনক ঘটনা হোল ইয়াহিয়া তার কর্ম ভুলে গেছে । ভুলে গেছে তার কর্মের ফল কি হতে পারে। ইসলামাবাদের একজন কূটনৈতিকের গত সপ্তাহের মন্তব্য হলো , “মাত্র একজন ব্যক্তি জীবিত আছে যে এখনও পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারে। তিনি হলেন মুজিব ।” ইয়াহিয়া প্রতিজ্ঞা করেছেন, মুজিবকে অবশ্যই মরতে হবে। কিন্তু যেই দিন তিনি ঝুলে পড়বে তার সাথে সাথে পাকিস্তানও ঝুলে পড়বে ।
স্বস্তির রাজনীতি
যদি আমেরিকা কিছুটাও অস্পষ্টভাবে বাঙ্গালী শরণার্থীদের বিষয়ে সচেতন হন। এই সপ্তাহে বিটলসের জর্জ হারিসন এবং রিঙ্গো স্টার এই বার্তা সবাইকে পৌঁছানোর মনস্থ করেন । যখন থেকে এই বিখ্যাত রক গ্রুপ বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারপর এটাই তাদের প্রথম উপস্থিতি। জর্জ এবং রিঙ্গো নিউ ইয়র্কের মাদিসন স্কোয়ার গার্ডেনে মঙ্গল অনুষ্ঠান করেন বাঙ্গালী গৃহহীন শিশু যাতে এগিয়ে যেতে পারে ।আর তা হলো অনেক চেষ্টার মাঝে কেবল একটি যা আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি, ক্যথলিক মুক্তি সেবা, ইউনিসেফ এবং শিশু মুক্তি বাচ্চাদের জন্য সাথে আরও যারা পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের গণহত্যার উপর বিবেকের আলোড়নের নকশা করেছে।
অনেক বেসরকারি নাগরিক বাঙ্গালীর ত্রাণের জন্য জড়িত হচ্ছে যারা ২ বছর আগের “ বিয়াফ্রান ” দুর্ঘটনার সাথে অভিজ্ঞ ছিল। সবচেয়ে বড় ভয় হল বিয়াফ্রান শিশুদের উদ্ধারের সাথে অসদৃশ যে , বিশ্বব্যাপী তখন ব্যাপক সহানুভুতি জাগ্রত হয়েছিল কিন্তু তাদের তুলনায় বাঙ্গালী শরণার্থীদের জরুরী বিষয়ে তার উদাসী। পরিহাসের বিষয় হলো, কিছু অংশ পূর্ব পাকিস্তানের এই দুর্ভোগের মাত্রার জন্য তাদেরকেই দায়ী করে। “ বাঙ্গালী শরণার্থীরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থানচ্যুত ব্যক্তি। ” ডঃ ডেনিয়েল এল উয়িনার যে কিনা সম্প্রতি আই আর সি এর জন্য সত্য অনুসন্ধানী সফর থেকে ফিরে বলেন। “ এটা এমন একটি সমস্যা যে আন্তর্জাতিক মাত্রায় মোকাবিলা করতে হবে। কোন বেসরকারি চেষ্টাই এই সমস্যা মোকাবিলা করতে পারবে না । বেসরকারি সংস্থা শুধুমাত্র জগাখিচুড়ি দিক উপশম করতে পারে। কিন্তু সমস্যার আকার দেখে মনে হচ্ছে অসাড় মানুষের এই অনুপায় অনুভুতির ক্ষেত্রে আগ্রহ কম আছে।’’
ব্যস্ত
এ ধরনের অভিযোগের ধারনা পাওয়া যাচ্ছে যে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে তার নীতি সহনীয় পর্যায় আনার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন কিছুটা সাফল্যে প্রভাবিত করতে পেরেছে। যদি নিক্সন প্রশাসন ইয়াহিয়ার রাজত্বে সাহায্যের ক্ষেত্রে প্রধান ভিত্তি হল ইসলামাবাদের ওপর ওয়াশিংটন উদ্দেশ্য সাধনের সুবিধা দিবে। পটভূমির নীতির স্বদেশী সমালোচনার মুখে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক বক এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে।আগামি বছর পাকিস্তানকে ১৩১.৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিজ্ঞা বাজেটে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি কংগ্রেস এই প্রতিজ্ঞা ধরে রাখবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে যতক্ষণ না পাকিস্তান তার লক্ষাধিক গৃহহারা নাগরিকের মন্ত্রী না হয়। কিন্তু সন্দেহপ্রবন পর্যবেক্ষকেরা স্মরণ করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একই রকমের একটি ০১১ সামরিক সাহায্য নিসিদ্ধ করছিল গত এপ্রিলে। কিন্তু পাকিস্তানী মালবাহী জাহাজে সরবরাহকৃত গোলাবারুদ ও খুচরা যন্ত্রাংশ ছিল এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পূর্বেই জাহাজের গতি পরিবর্তন করা হয় করাচীর দিকে। এবং গত সপ্তাহে সিনেটর স্তুয়ারট সিমিঞ্জটনকে অভিযুক্ত করা হয় নিষেধাজ্ঞায় খাদ থাকার কারনে। প্রশাসন সিমিঞ্জটনকে বলেন, শব্দার্থিক ও দ্ব্যর্থকবোধক বিবৃতি দিয়েছেন। পাব্লিক রেকর্ডের উপর কোন প্রমান ছাড়াই এবং যতক্ষণ না প্রকৃত ঘটনা উপস্থাপন করতে পারেন সে পর্যন্ত এই আরোপ অক্ষত থাকবে।
কৌশল
ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা স্বীকার করেন যে, সব কিছুর উপরে ওয়াশিংটন কৌশলগত বিবেচনার বাহিরেও পাকিস্তানের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। একজন কূটনৈতিক পাকিস্তানের উপর আমেরিকার প্রভাব শেষ করতে সতর্ক করে দিয়েছেন। “ আমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়েছে। ” তিনি যুক্তি দেখান, “এই এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের জন্য খেলার মাঠ হতে পারে।” একজন সহকর্মী বিস্ময়কর রকমের অল্প বুদ্ধির সাথে যুক্ত করেন, “ আমরা এই মুহূর্তে নৈতিকতার চেয়ে স্থায়িত্তের বিষয়ে বেশি আগ্রহী …… এখন স্থায়িত্তের এতই ক্ষীণ যে তা ইয়াহিয়ার সাথে থাকারই সমান।
যদিও ঠাণ্ডা রাজনৈতিক মূল্যায়ন সত্ত্বেও সমস্যা থেকে নিজেকে প্রমান করা তা একটা জিনিসের জন্য শেষ পর্যন্ত অগ্রহণযোগ্য হবে। ওয়াশিংটন পূর্বনির্ধারিত ভাবে অনিচ্ছুক ইসলামাবাদের জন্য সাহায্য বন্ধ করে চাপ দিয়ে বিশ্ব ব্যাংক এবং এগার জাতির সাথে মতভেদ করা। প্রত্যেকের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রোগ্রাম রয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামাবাদ পূর্ব অঞ্চলের সাথে “ রাজনৈতিক সমঝোতা ” না করে। এমনকি বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত পাকিস্তানের এই বিতর্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, পালিয়ে যেতে পারছে না। পরে বিশ্ব ব্যাংকের রাষ্ট্রপতি রবার্ট ম্যাক নামারা একটি সমলোচনামূলক প্রতিবেদন দমন করার চেষ্টা করেন যা সম্প্রতি পাকিস্তান সফর শেষে একটি দল তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস নথিটি ধারন করে এবং প্রথম পাতায় ছাপায়। পরবর্তীকালে ম্যাকনামারা পাকিস্তানী সরকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেন লিখেন খবরটি প্রকাশ হওয়ার জন্য।
তাছাড়া ওয়াশিংটনের দ্ব্যর্থক ব্যক্তব্যের কারনে ভারত ইতিমধ্যে যেখানে প্রায় সব কর্মকর্তার বিশ্বাস যে বাইরের সাহায্য ছাড়া ইয়াহিয়া নির্যাতনের নীতি অব্যাহত রাখবে না। “ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোন দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার মানে হলও বাংলাদেশের গণহত্যা না দেখার ভান করার শামিল।” ভারতে পররাষ্ট্রপতি সত্তরাম সিং অভিযোগ করেন, এটা ভারত- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে। ” এইভাবে সঠিকভাবে বা ভুলভাবে পাকিস্তান প্রশ্নে প্রশাসনের বাস্তবমুখী বাঁধা দেওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের অন্তরবেদনার উপর জমি- শত্রুতার প্রভাব উন্নীত করে । আর এই ছাপ সকরুন আমেরিকার ছবি কে সতর্ক করে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৬। সোনার বাংলা ধ্বংস অভিযান
|
ইমস ম্যাগাজিন | ২ অগাস্ট, ১৯৭১। |
<১৪, ৭৬, ১৮২-১৯১>
সোনার বাংলা ধ্বংস অভিযান
সুত্রঃ টাইমস ম্যাগাজিন
তারিখঃ ২ অগাস্ট, ১৯৭১।
নদী, সড়ক অথবা বন্যপথ ধরে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগন ভারতের দিকে ধাবিত হয়েই যাচ্ছে। হাতে কিছু টিনের বাসন কোসন, কার্ডবোর্ডের বাক্স; মাথার উপর কাপরের বেধে রাখা বান্ডিল, কোলে অসুস্থ শিশু বা বৃদ্ধ আত্মীয়দের বহন করে চলা এই মানুষের স্রোতধারার যেন কোন শেষ নেই। তারা এগিয়ে চলে কর্দমাক্ত খালি পায়ে। এই মিছিলের অনেকেই অসুস্থ, সারা শরীরে ঘা হয়েছে কারো কারো। কেউ কেউ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছেন। চলতে চলতেই কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলে তাদের দেহ সৎকার করারও কেউ নেই। হিন্দুরা, যদি সম্ভব হয় তাদের মৃত আত্মীয়ের মুখাগ্নি করেন, অথবা পুড়িয়ে দেন। বাকী দেহাবশেষগুলো পড়ে থাকে কাক, শকুন অথবা কুকুরের খাদ্য হয়ে। পচাগলা মৃতদেহদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শরণার্থীরা কেউ কেউ নাকে কাপড় চাপা দেন, তবুও এই মিছিল, এই চলমান জনতার সারি চলতেই থাকে, দিবারাত্রি, কোন বিরাম নেই।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকালীন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল চারমাস আগে, শরণার্থীর মিছিল সেই থেকে এখনও পর্যন্ত চলছে। তাদের সংখ্যা ঠিক কত, তা সঠিক কেউ জানেনা, যদিও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন রেজিস্টার করার হার দেখে বলছেন প্রতিদিন ৫০,০০০ শরণার্থী ভারত সীমান্তে প্রবেশ করে। গত সপ্তাহে ানুমানিক সাড়ে সাত লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। মনে হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের যা অবস্থা, তাতে খুব দ্রুতই দুর্ভিক্ষ শুরু হবে। ভারত আশংকা করছে যে এই মিছিল শেষ হতে হতে শরণার্থীদের সংখ্যা বর্তমানের দ্বিগুণ হবে।
শত শত, হাজার হাজার মানুষ এখনও উদ্বাস্তু হয়ে দেশটির গ্রামাঞ্চলগুলোতে ঘুরছেন, তাদের কোন আশ্রয় নেই, নেই কোন খাবার। সীমান্তের কাছাকাছি স্কুলগুলোতে কেউ কেউ রাত্রিযাপন করেন, কেউ গ্রামবাসীদের বাড়িতে আশ্রয় নেন, কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে মাঠে কিংবা কোন গাছতলায়ই ঘুমিয়ে পড়েন। বেশিরভাগ শরণার্থীকেই শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়, খাবারের জন্য রেশন কার্ড আর মাথা গোজার জন্য ছাউনি, যার চারপাশে বাঁশের চাটাই এর বেড়া আর মাথার উপরে প্লাস্টিকশিট কিংবা চটের ছালা। শিবিরগুলোতে মানুষ অনাহারে না থাকলেও, খাবার বেশ অপর্যাপ্তই বলা যায়, বিশেষ করে গুড়ো দুধ এবং শিশুখাদ্য।
ফুরিয়ে গেছে চোখের পানিও
বর্ষার বৃষ্টিতে অনেক শিবিরই ছোটখাট জলাশয়ে পরিনত শরণার্থীদের জীবন আরো বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে। কলকাতার বাইরে অবস্থিত একটি ক্যাম্পে কাজ করছেন, জার্মান চিকিৎসক ডঃ মেথিস ব্রম্বারগার। তার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বৃষ্টির মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে ভিজতে হয়। তাদের মধ্যে ছোট ছোট শিশু এবং তাদের মায়েরাও আছেন। তারা ছাউনিতে ঘুমাতে পারছেন না, কেননা সেখানে হাটুসমান পানি জমে আছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে, রোজ সকালেই অনেক শরণার্থী অসুস্থ হয়ে পরছেন কিংবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। কোন গুরুতর কলেরা রোগিকেই হাস্পাতালে নেয়া সম্ভব হয়নি। এবং মৃতদেহগুলো নিয়ে যাওয়ারও কেউ নেই। সেগুলো ওখানেই খোলা মাটিতে বা পানিতে পড়ে আছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রতিষেধক দিয়ে কলেরার মাত্রা অনেকাংশেই কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও, ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী এপর্যন্ত ৫০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রায় ৩৫,০০০ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগত বমি ও ডায়রিয়ার সাথে লড়াই করে যাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ আশংকা করছেন যে, নতুন করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শরণার্থীদের মাঝে নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া ও যক্ষা ছড়িয়ে পোরতে পারে। একজন ডাক্তার বললেন- “মানুষ এখন আর কাঁদছেও না।” খুব সম্ভবত এর চেয়েও ভিতীকর অবস্থা থেকে তারা পালিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের মনেই পাকবাহিনীর চালানো ধর্ষণ, খুন বা অন্যান্য অরাজকতার আতংক অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্তমান। বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলনকে থামিয়ে দিতেই হানাদার বাহিনী এ অত্যাচার চালাচ্ছে। একজন দম্পত্তি আমাদের বলছিলেন যে কিভাবে পাকবাহিনী তাদের তরুন দুই ছেলেকে বাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে পেটে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে আঘাত করেছে, আহত ছেলেদের কাছে কাউকে যেতে দেয়নি, কিভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে রক্তক্ষরণ হয়ে তারা মৃত্যুবরন করে। আরেকজন নারী বললেন, সেনারা তার বাড়িতে এলে তিনি তার ছেলেমেয়েদের খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন, কিন্তু কম্বলের নিচে দিয়ে তাদের দেখতে পেয়ে সেনারা গুলি চালিয়ে তার দুই সন্তানকে হত্যা করে ও অন্যজনকে আহত করে। ভারতের প্রেস ট্রাস্ট রিপোর্ট (পিটিআই) এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি একদল শরণার্থী পাকিস্তানী আর্মি পেট্রলের ধাওয়া খেয়ে ভারত সীমান্তের কাছেই একটি পাটক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন। পিটিআই প্রতিবেদনে বলছে- “এসময় হঠাত একটি ছয় মাস বয়সী শিশু মায়ের কোলে কেদে ওঠে, মা’টি অনেক চেষ্টা করেও শিশুটিকে থামাতে ব্যর্থ হয়। পাকসেনারা কান্না শুনে ফেললে বাকী শরণার্থীরাও আক্রান্ত হতে পারে সেই আশংকায় মা নিজেই শিশুটিকে গলা টিপে মেরে ফেলে।
আগুনের বেষ্টনীঃ
গোটা পূর্ব পাকিস্তান যেন আজ রক্তস্নাত, আর তার চিনহ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। শহরগুলোর সর্বত্র শেল আর বিমান হামলার ধংসযজ্ঞ। খুলনার উত্তরে খালিশপুর নামক আবাসিক এলাকায় এখন আর কোন বাসভবন নেই, শুধু বোমার আঘাতে গুড়িয়ে যাওয়া ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষগুলো পরিষ্কার করতে দেখা যায় কিছু জীর্ণশীর্ণ নারী ও নগ্ন শিশুদের যারা একসময় এই ঘরগুলির বাসিন্দা ছিলেন। চট্টগ্রাম এর হিজরি লেন ও মৌলানা শওকত আলি রোডের সব চিনহ সমুলে মুছে গিয়েছে। যশোরের কেন্দ্রীয় বাজার বলতে এখন কিছু দুমড়ানো মুচড়ানো টিন আর ভাঙ্গা দেয়াল। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এর একটি টিম এর মন্তব্য অনুযায়ী কুষ্টিয়া শহরটিকে দেখলে একটি পারমানবিক বোমা আঘাত হানার পরের সকালটির কথা মনে পরে যায়।
ঢাকা শহরের পুরানো ঢাকা পরিচিত নামের অঞ্চলটিকে সেনারা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে প্রথমে অগ্নি সংযোগ করে এবং তারপর আগুন থেকে পালতে চাওয়া বাংগালীদের উপর গুলি চালায়। প্রায় ২৫ টি গলিতে বুল্ডোজার চালিয়ে সেখানকার সব স্থাপনা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। চারদিকের গায়ে গায়ে লাগানো বস্তির ঘরগুলোর সাথে ওই ফাকা জায়গাগুলো একদমি বেমানান ও প্রকট হয়ে উঠছে। বিদেশী দরশনারথীদের জন্য পাকা সেনারা ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের দেয়ালে তৈরি হওয়া অনেক শেলের গরত বুজিয়ে ফেললেও, সেখানে আজো শত শত শিক্ষার্থীকে হত্যা করার চিনহ রয়ে গেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, যেখানে প্রায় ১০০০ পুলিশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছেন, সেস্থানে বিস্ফোরিত হওয়া একটি ট্যাঙ্ক আজো সে অবস্থায় রয়ে গেছে।
লক্ষ লক্ষ একর জমি পতিত হয়ে পড়ে আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শস্য পাট আবাদের পর এখন মাঠে পড়ে আছে, পচন ধরছে, কেবল মাত্র সামান্য কিছু পাটই মিল অব্দি পৌছাতে পেরেছে। এবছর চাও সামান্যই উৎপাদিত হয়েছে। প্রায় ৩০০,০০০ টন আমদানি করা শস্য এখনও পরে আছে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে। ঢাকা এবং অন্যান্য শহরগুলোতে কাচা বাজার এখনও বসে, কিন্তু গত ৪ মাসে চালের দাম প্রায় ২০% বেড়ে গেছে।
বাঙ্গালিদের সবার মধ্যেই এখন ভয় এবং প্রচন্ড ঘৃণা বিরাজ করছে। সামনাসামনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলবে, এমন লোক খুব কমই আছে, কিন্তু ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এর মেইল বক্সে রোজই অসংখ্য চিঠি আসে অরাজকতা ও নতুন নতুন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার খবর নিয়ে। বাঙালি একজন আমলা, তার গৃহে দেয়া এক গোপন সাক্ষাতকারে বলেন, অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে, দীরঘ সময় ধরে এ সংগ্রাম চলবে, হয়ত ভিয়েতনামের চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয় আমাদেরই হবে।
আর্মিদের এই হামলায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে নানান রকম ধারনা আছে, দুই লক্ষ থেকে শুরু করে দশ লক্ষ পর্যন্ত। কম সংখ্যক ধারনাটাই আমাদের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য, কিন্তু সঠিক সংখ্যাটি জানা সম্ভব নয়। এর কারন, অসংখ্য লাশ নদীতে, কুয়ায় অথবা গনকবরে ফেলে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানিদের কাছে থেকে পাওয়া সংখ্যার উৎসকেই এক্ষেত্রে সবচেয়ে অনির্ভর যোগ্য বলে ধরা হচ্ছে। এমনটি হওাটাই স্বাভাবিক ছিল, কেননা শরণার্থীরা আসা শুরু করার আগে আয়তনে ফ্লোরিডা রাজ্যের সমান এ অঞ্চলে প্রায় ৭৮০ লক্ষ মানুষ ছিল, যাদের ৮০ ভাগই নিরক্ষর।
নির্মম প্রতিহিংসা
মুসলিম সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রোশ হিন্দু বাঙ্গালীদের উপর, আর সেকারনেই নিহত বা শরণার্থীদের তিন- চতুর্থাংশই এ সম্প্রদায়ের। এখনও রাস্তায় রাস্তায় সেনাবাহিনী চেকপোস্টে বাঙ্গালীদের লুঙ্গি ছিনিয়ে নিয়ে খতিয়ে দেখা হয় যে তাদের খৎনা হয়েছে কিনা, মুসলিম পুরুষদের জন্য যা বাধ্যতামুলক। খৎনা ছাড়া কাউকে পাওয়া মানেই মৃত্যুদণ্ড। সারি বেধে দাড় করিয়ে বাকিদেরও গুলি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একজন উচ্চ পরযায়ের কর্মকর্তা গত সপ্তাহে মন্তব্য করেন- পোল্যান্ডে নাজিদের হত্যাযজ্ঞের পর এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সুনিপুন পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরোধ ও গড়ে তোলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর্মি ও তাদের সহযোগীদের হামলার জবাবে প্রথমে গেরিলা হিট এন্ড রান পদ্ধতি, নাশকতা এবং গুপ্তহত্যার মতন আক্রমন চালানো শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন বাঙালি মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা শত শত ব্রিজ ও কাল্ভারট উরিয়ে দিচ্ছে, রেললাইন ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই গেরিলাদের মুল অংশ ভারতীয় সীমান্তের ওপার থেকেই আসছে, যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার একটি বৃহদাকার যুদ্ধ প্রশিক্ষন ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ এর কার্যক্রম চালাচ্ছে। পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ও প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া খান গত মাসে দাবী করেন যে ভারতে এধরনের প্রায় ২৪টি ক্যাম্প রয়েছে। ভারতও এখন আর অস্বীকার করার প্রয়োজন মনে করছে না যে স্থানীয় ভারতীয়রা এবং ভারতীয় সীমান্তে নিয়োজিত কিছু সেনাবাহিনীর ইউনিটও এই ক্যাম্পগুলোতে বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই মুক্তি বাহিনীর অর্ধাংশ প্রায় ৫০,০০০ যোদ্ধা এসেছেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পার্লামেন্টারি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী থেকে। তরুন যোদ্ধারা, যাদের অনেকেই ছাত্র এখনও, তাদেরকেও ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে যেন তারা সাধারন জনগনের সাথে মিশে যেতে পারে। সাধারন জনগণই তাদের খাবার দাবারের ভার নিচ্ছে, তাদের জন্য খবরাখবর আনা নেয়া, রাস্তা চেনানো বা নাশকতায় হিট এন্ড রান হামলা করতে সাহায্য করছে. গেরিলারা ঢাকার বিদ্যুৎ সংযোগ দুইবার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, এবং সপ্তাহখানেক ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েটিকেও অকেজো করে রেখেছে। যেখানেই পারছে তারা লাল-সবুজ আর সোনালী রঙের বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করছে। তারা দাবী করছে যে তারা এপর্যন্ত ২৫,০০০ পাকিস্তানী সেনা হত্যা করেছে, যদিও সংখ্যাটি ২৫,০০ এর বেশি হবেনা এবং আরো ১০,০০০ সেনা আহত হয়েছে (নিরভরযোগ্য পশ্চিমা সুত্র থেকে)। প্রতিরোধকারী বাহিনী ইতিমধ্যে রাতের বেলা শহরের বাইরের এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রন করছে, এবং দিনের বেশির ভাগ সময়টিতেও। কেবল্মাত্র সময় আর এই অগ্নি পরীক্ষাই বলে দিবে যে এই গেরিলাদেরকে মুক্তিবাহিনীর নেতারা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ শক্তিতে পরিনত করতে পারবে কিনা। বর্তমানে এই বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হচ্ছে একজন অবসর প্রাপ্ত কর্নেল এ। জি। ওসমানী, যিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের একজন সদস্য। কিন্তু অনেকেরই ধারনা যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পুরবেই এই অপেক্ষাকৃত পরিমার্জিত নেতৃত্ব চলে যাবে আরো বেশি মৌলবাদীদের হাতে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধের কোন মতাদর্শগত ভিত্তি নেই, কিন্তু তা পরিবর্তিত হয়ে যেতেও পারে। একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা বলেন- “যদি গনতান্ত্রিক দেশগুলো দ্রুত এ সমস্যা নিরসনের জন্য পাকিস্তানকে চাপ না দেয়, তবে তার পরিনতি কি হতে পারে, ভাবতেও ভয় হচ্ছে। যদি এই সবাধীনতার সংগ্রাম অনেক দীরঘায়িত হয় তবে গনতন্ত্রের বিষয়গুলো বিযুক্ত হয়ে যাবে, কেবল সমাজতান্ত্রিকদের কথাই মুল হয়ে দাঁড়াবে। এখনও পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিকরা কোন শক্ত ভিত্তির উপরে দাড়াতে পারেনি। কিন্তু আমরা যদি জনতার পাশে প্রয়োজনের সময় না দাড়াতে পারে, তবে তারা দল পরিবর্তন করবে।
তবে এ প্রতিশোধের পুরোটাই পাক সেনাবাহিনীর উপর দিয়ে গেছে তা নয়, প্রায় ৫০০ বাঙ্গালীকেও পাকিস্তানীদের সহযোগী সন্দেহে হত্যা করেছে মুক্তিবাহিনী, যেমন ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক দল জামাতে ইস্লামি ও অন্যান্য ছোটখাট পারটিসমুহের সদস্যদের। বিহারি, অবাঙ্গালি মুসলিম, যারা ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর এদেশেই রয়ে গিয়েছিল, তারাই ছিল মুল টার্গেট এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্দোষ টার্গেট। সহযোগী রাজাকার বলে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছিল, গেরিলারা তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থাতেই তাদের হত্যা করেছে, কিংবা জবাই করেছে যেন অন্যান্য গ্রামবাসীরাও সতর্ক হয়ে যায়। আরো আশংকাজনক হচ্ছে যে ১৩০০ মাইল সীমানা জুড়ে দিন দিন সংঘর্ষ বেড়েই যাচ্ছে যেখানে প্রায় ৭০,০০০ পাকিস্তানী সেনা ভারত থেকে আসা বিদ্রোহীদের আক্রমন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। আরেকদিকে তারা ভারতীয় জওয়ানদেরও মুখোমুখি হচ্ছে। একটি বিক্ষিপ্ত গুলিও ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের কারন হয়ে যেতে পারে এবং তার ফলাফল ১৯৬৫ সালে কাশ্মিরে যে ১৭ দিনের যুদ্ধ হয়েছিল তারচেয়ে বিধ্বংসী হয়ে পরবে।
একটি অনিয়ন্ত্রিত গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পরে, সংঘর্ষ যতবেশি ছরিয়ে পরছে পাকিস্তানিরা ততবেশি মনোবল হারাচ্ছে। দুই জাতি স্বেচ্ছায় আবার কখনও এক হবে তার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু, ইয়াহিয়া খান এবং অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী জাঁদরেল নেতাগন, যারা এই মুহূর্তে পুরব-পসচিম মিলিয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহদাকার রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের কাছে বিভক্ত হওয়ার প্রস্তাব সম্পূর্ণ অবাস্তব। পাকিস্তানকে অবিভক্ত রাখার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান গত মাসে জাতির উদ্দ্যেশ্যে ভাষণে বলেছেন- “এর চেয়ে মহৎ কোন ত্যাগ হতে পারেনা”। যে একতার সবপ্ন তিনি দেখছেন, তা কেবল মাত্র পূর্ব পাকিস্তানকে একটি অনুগত অঙ্গরাজ্যই বানিয়ে রাখতে পারবে। বাঙালি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে এমনকি রাস্তার নামগুলো পর্যন্ত বদলে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার শাখারি বাজার রোডের বর্তমান নাম টিক্কা খান রোড, এই নামকরন করা হয়েছে এমন একজনের নামে যিনি বর্তমানে মার্শাল ল এর অধীনে পুরব পাকিস্তানে শাসন করছেন এবং যাকে অত্যন্ত কঠিন একজন কমাণ্ডার বলে ধরে নেয়া হয়।
মধুর হাসি
গর্বিত বাঙালি জাতি সহজে হাল ছারেনা। একটি আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ কিন্তু পরিবরতনশীল জাতি, যাদের দুটি প্রধান আগ্রহের জায়গা হচ্ছে রাজনিতী ও কবিতা, যার একটি নিজস্ব সংস্কৃতি তারা তৈরি করে নিয়েছে। আড্ডা হচ্ছে তাদের অবসর কাটানোর সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম, এবং ঘন্টার পর ঘন্টা গ্রামের বটতলায় বা ঢাকার কফিহাউসগুলোতে বাঙ্গালিদের আড্ডা দিতে দেখা যায়।
স্বভাবতই বাঙালি তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কোন বিপ্লবী সঙ্গীত না বরং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙ্গালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার বাংলা” কবিতাকে বেছে নিয়েছে।
…ও মা,
ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে–
মরি হায়, হায় রে
ও মা,
অঘ্রানে তোর ভরা খেতে,
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।।
যে ভয়াবহ পরিনতি এদেশের মানুষকে মেনে নিতে হয়েছে, তা স্বত্বেও এই দেশ বিস্ময়কর সৌন্দর্যমন্ডিত, যত দূর চোখ যায় শুধু ধান আর পাট খেত দিগন্তজুড়ে, গঙ্গার মোহনাতে মিশে গিয়েছে। মাটি এতই উর্বর যে বীজ ফেল্লেই যেকোন শস্য ফলে, যদিও তা বাঙ্গালীকে দারিদ্র্যের আঘাত থেকে বাচাতে পারেনি। প্রক্রিতি যেমন দিয়েছে, তেমনি ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় সব ভাসিয়েও নেয়। বন্যায় গঙ্গা বা ব্রক্ষ্মপুত্র নদী থেকে ভেসে আসা পলিমাটিতেই বাংলার মাটি এত উর্বর।
অসঙ্গত পরিণয়
এই যুদ্ধের আগেও, দেখা যাচ্ছিল যে পাকিস্তানের এই দুই ব্যাতিক্রম এবং দূরবর্তী অংশের মুসলিম জাতির মাঝে ইসলামিক ধর্ম বিশ্বাস ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স ছাড়া আর কোন বন্ধন ছিল না। না তাদের সীমান্ত এক না সংস্কৃতি, আর মাঝখানে ১১০০ মাইল জুড়ে ভারত। পাকিস্তান যেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের এক অসংগত পরিণয়। খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় সহস্রাব্দে আরযরা এই উপমহাদেশে প্রথম আসে, যাদেরি বংশধর এই দীরঘাঙ্গী, গৌরবর্ণ পাঞ্জাবি, পাঠান, বেলুচ ও সিন্ধি পশ্চিম পাকিস্তানিগন। কালো রঙের বাঙ্গালীরা বেশিরভাগই ছিল দ্রাভিদ জাতির যারা আরযদের দ্বারা শোষিত হয়েছিল। এই পশ্চিমারা গম ও মাংস খায়, কথা বলে উর্দুতে যা আরবিতে লেখা হলেও উৎপত্তি পার্সি ও হিন্দি ভাষা থেকে। অন্যদিকে পূর্ব অংশের এই জাতি খায় ভাত আর মাছ, কথা বলে বাংলায় যা ইন্দো-আরয ভাষার একটি অংশ।
পুবাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও অত্যন্ত বেশি পশ্চিমের তুলনায়। ৭৮০ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ১০০ লক্ষ হিন্দু আর অইদিকে ৫৮০ লক্ষ জনতার মধ্যে মাত্র ৮ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করে পশ্চিম অংশে। ব্রিটিশ আমলে, পশ্চিম পাকিস্তানীরাই ছিল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর মুল অংশ আর শক্তিশালী পাঞ্জাবী আর পাঠানদের ব্রিটিশরা প্রশিক্ষন দিয়ে দক্ষ শ্রমিকে পরিনত করেছিল। ‘লুঙ্গি’- একটি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ান ধাচের ঝুলওয়ালা পোশাক যা মুলত বাংগালীরা পরিধান করে, পশ্চিমাদের কাছে একটি অবজ্ঞার পোশাক, তারা বলে যে “সেখানে পুরুষরা সায়া পরিধান করে আর মেয়েরা প্যান্ট। পশ্চিমে এমন না, বরং সেভাবেই সবকিছু থাকে যেভাবে করা উচিত’।
বিশটি পরিবার
দেশ চালানোর প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সবসময়ি মুল চালিকাশক্তি নিজেদের হাতে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। একসময় বাঙ্গালীরা নিজেদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ববোধ করত, উর্দুতে যেই দেশের নাম “পবিত্রদের ভুমি”। পশ্চিমের মুসলিম জনগনের মতই তারা দেশবিভাগের পূর্বে ভারতীয় হিন্দুদের আধিপত্যে অতিষ্ঠ ছিল। ১৯৪০ সালে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা পিতা, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, একটি আলাদা ইসলামিক রাষ্ট্রের দাবী করেন। ভারত এই বিভক্তি রুখে দেবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু ১৯৪৭ সালে পশ্চিম বংগসহ পাঁচটি মুসলিম রাষ্ট্র বিভক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। এর ফলাফল ভৌগলিকভাবে কৌতুহল জাগানো এক দেশের উদ্ভব, যা পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিকভাবে অর্থহীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে।
এই বিভক্তি শান্তি, প্রগতি আর স্বাধীনতা আসবে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা শুধুই ধ্বংস বয়ে এনেছে, যেখানে হিন্দু মুসলিম হত্যা করেছে, আর মুসলিমরা হত্যা করেছে হিন্দুদের। মহাত্মা গান্ধীজিকে হত্যা করার কিছুদিন আগেই তিনি এই রক্তপাত বন্ধের জন্য শেষ অনশনটি করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দু মুসলিমের সকল সঙ্ঘাতের উৎপত্তি তখনি হয়েছে যখন একজন আরেকজনের উপরে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিতে চেয়েছে”।
প্রথম থেকেই পূর্বাঞ্চল পাকিস্তান এর কাছ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। যদিও দেশের ভুভাগের মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ এই অঞ্চল, এর জনসংখ্যা মুল জনসংখ্যার (১৩৬ মিলিয়ন) অর্ধেকের চাইতেও বেশি। প্রথমদিকে দেশটির বৈদেশিক আয়ের ৭০% এরো বেশি আসত পূর্বাঞ্চল থেকে। কিন্তু পাঞ্জাবি আর পাঠানদের আধিপত্যে পশ্চিম পাকিস্তান একাই দুই দশক ধরে এই বৈদেশিক সাহায্যের চার ভাগের তিন ভাগ ও রপ্তানি আয়ের ৬০% ভোগ করে। পূর্ব পাকিস্তানকে একটি বঞ্চিত অবরুদ্ধ চাষের জমির মত ফেলে রাখা হয়। এই গৃহযুদ্ধের পূর্বে পাকিস্তানের সরকারী চাকরির মাত্র ১৫ ভাগ আসনে ছিল বাঙ্গালীরা আর ২৭৫,০০০ সেনা সম্বলিত সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা মাত্র ৫%। মাত্র বিশটি মাল্টি মিলিয়নিয়ার পরিবার, যাদের প্রায় সবাইই পশ্চিম পাকিস্তানের, এখনও পাকিস্তানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থের সবচাইতে বড় অংশটি (দেশের মোট ইন্ডাস্ট্রির দুই-ত্রিতিয়াংশ ও পাচ ভাগের চার ভাগ ব্যাঙ্কিং ও ইন্সুরেন্স জাতীয় সম্পদ) নিয়ন্ত্রন করে (সুত্রঃ একটি অফিসিয়াল স্টাডি)। সম্পূর্ণ পাকিস্তানে জনপ্রতি আয় অত্যন্ত কম, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রতি আয় (৳৪৮) পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতি আয়ের প্রায় দ্বিগুণ (৳৩০)। এই আক্রোশকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে গত নভেম্বরে বঙ্গোপসাগরে হয়ে যাওয়া এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস, যা প্রায় ৫০,০০০ মানুষের প্রানহানি ঘটায়। এর আগে পুরবাংশের প্রতি পসচিমের অবজ্ঞা এত প্রকট হয়ে ধরা দেয়নি। ঘটনার প্রায় ১৩ দিন পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুর্গত অঞ্চল পরিদরশন করেন, যেখানে কিছু পরিদর্শক বলছেন যে আক্রান্ত অঞ্চল্গুলোকে দ্বিতীয় হিরোশিমার মত মনে হয়েছে। পাকিস্তানি নেভি দুর্গত মানুষদের উদ্ধারে একদমি মাথা ঘামায়নি। সবকিছু থাকা স্বত্বেও ত্রাণ বিতরন ব্যবস্থা অবসন্ন ছিল, কেননা বিপুল আকারে খাদ্য ওয়ারহাউসে সংরক্ষিত থাকলেও পাকিস্তানি আর্মি হেলিকপ্টারগুলো হেলিপ্যাডে অলস বসে ছিল।
আত্মত্যাগ
এর তিন সপ্তাহ পর, একটি দেশে পরিনত হবার ২৩ বছর অতিক্রান্ত হবার পরে পাকিস্তানে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল একটি সংবিধান অনুসারে সংসদ গঠন করা যারা দেশের জন্য নতুন করে দিকনির্দেশনা দিবে। কিন্তু নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের আধিপত্য জিতে যায়, তারা শেখ মুজিবর রহমানকে ৫১ শতাংস ভোটে নির্বাচনে জয়ী করে, যিনি আওয়ামীলীগ দলের নেতা ও পূর্বাঞ্চলের স্বায়ত্বশাসন এর দাবীর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বহুদিন ধরে। বাঙ্গালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রায় ১০ বছরের ও বেশি জেল খেটেছেন এই মহান নেতা। জাতীয় এসেম্বলির ৩১৩ টি আসনের ১৬৯ টি পূর্ব পাকিস্তানে আর তার মধ্যে ১৬৭টিতেই শেখ মুজিব জয়লাভ করেছেন, যা স্পষ্টতই বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে জয়লাভ। এই জয়লাভের অর্থ এই ছিল যে শেখ মুজিবই হবেন অখন্ড পাকিস্তানের পরবরতী প্রধানমন্ত্রী।
এই জয় কোনভাবেই ইয়াহিয়ার কাম্য ছিলনা। তিনি এবং তার জেনারেলরা অনুমান করেছিলেন শেখ মুজিব কোনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের ৬০ ভাগের বেশি সিট পাবে না এবং তারপর ক্ষুদ্র পার্টিগুলো একটি জোট গঠন করবে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে, ফলে ক্ষমতা ইসলামাবাদের হাতেই থাকবে। মুজিব কিছুটা বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা করেছিলেন। ফলে এক ঘোশনায় তিনি বলেন যে, যদি নির্বাচনে তিনি পরাজিত যা পরবরতীতে মানুষকে প্রচন্ড নাড়া দেয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগন ৭০ এর জলোচ্ছাসে জীবন দেয়া লক্ষ মানুষের দায় বহন করছে যেন তাদের এই দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাধীন নাগরিকে পরিনত করার আত্মত্যাগে পরিনত হয়।
মার্চে সংসদীয় অধিবেশন ও সরকার গঠনের একটি সময় বেধে দিয়ে ইয়াহিয়া গোপনে সেনাবাহিনীর দল পূর্বাঞ্চলে সংগঠিত করতে থাকেন, প্রতিরাতে তারা সাধারন মানুষের বেশে আকাশপথে পূর্বাঞ্চলে এসে সেনাবিহিনির শক্তি বৃদ্ধি করছিল। এরপর উনি অধিবেশন আরো পিছিয়ে দিলেন, কারন হিসেবে বললেন যে মুজিব পুরবাংশে ঠিক কতখানি ক্ষমতা ও স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছেন তা নির্ধারিত হবার পূর্বে অধিবেশন সম্ভব নয়। মুজিব যদিও পূর্ণ স্বাধীনতা চাননি, কিন্তু দুইটি স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের দাবী জানিয়েছেন, যারা রাজ্য সরকারের কাছে কর প্রদান করবে, এবং তাদের বানিজ্য ও বিদেশী মুদ্রা স্থানীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের কাছে এটা প্রায় অসম্ভব। ২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া মিটিং ভেস্তে দেন এবং ইসলামাবাদে চলে যান। তার ৫ ঘন্টা পরে সৈন্যরা কামান, ট্যাংক আর রকেট লঞ্চার নিয়ে ঢাকার এক ডজনেরো বেশি অঞ্চলে সাধারন মানুষের উপর ঝাপিয়ে পরে। এর ফলে যুদ্ধ শুরু হয়। ইয়াহিয়া আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করে ও সৈন্যদের নির্দেশ দেন তাদের ‘দায়িত্ব’ পালন করতে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকদের গ্রেফতার করা হয়, শেখ মুজিবসহ, যিনি এই মুহূর্তে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে ১২৫ মাইল দক্ষিন-পশ্চিমাংসে অবস্থিত প্রত্যন্ত অঞ্চল সাহিওয়ালে বন্দিদশা ভোগ করছেন বিচারের অপেক্ষায়। এই বিচার অগাস্টে শুরু হতে পারে, এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দাওয়া হতে পারে।
নাগালের বাইরে
যুদ্ধ শুরু হয়েছে অনেক মাস হয়ে গেল, এখনও ইয়াহিয়া বিন্দুমাত্র নমনীয়তা প্রদর্শন করছেন না। বরং, এই প্রলম্বিত যুদ্ধ, যার ফলে ভারতের সাথে যুদ্ধ বেধে যাবার সমুহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, এবং প্রচুর মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে যেকোন প্রশ্নে তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে কথা বলছেন। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা বন্ধ করবে কিনা সে বিষয়ে তিনি গত সপ্তাহে হুমকি দিয়ে বলেন- “আমি হয়ত একটি যুদ্ধ ঘোষণা দিতে পারি, এবং আমি সারা পৃথিবীকেই সে বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছি। তিনি আরো হুমকি দিয়ে বলেন, যেসব দেশ প্রতি বছর প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পাকিস্তানকে দিয়াসছে, তাদের চাপও এক্ষেত্রে কোন কাজে আসবে না। প্রয়োজনে তিনি সাহায্য ছাড়াই এগিয়ে যাবেন। এরি মধ্যে তিনি কিছু সাহায্য খুইয়েছেন। গত মাসে পূর্ব পাকিস্তান পরিদরশনের পর ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক মিশন এর এগার দেশীয় জোটকে সুপারিশ করে যেন তারা একটি রাজনৈতিক সমাধানে পাকিস্তান না আসা পর্যন্ত আর কোন সাহায্য দেশটিকে না দেয়ার জন্য। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা এই রিপোর্টকে সরবসমক্ষে প্রকাশ করছেন না, এই আশংকায় যে তা বিদ্যমান পরিস্থিতিকে আরো বিগ্রে দিতে পারে। রিপোর্টে সাধারন জনগনের নিকট পাকিস্তানি সেনাদের ভিতী আর ধবংসযজ্ঞ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে সে বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছে। এতে কুষ্টিয়ার অবস্থা বর্ণিত হয়েছে, যার ৯০% ই ধ্বংস হয়ে গেছে, রিপোর্টে বলা হয়েছে মনে হচ্ছে পাকিস্তানি আরমিরা এখানে ভিয়েত্নামের “মাই লায়” এর মতন ধংশযজ্ঞ চালিয়েছে। একজন মধ্যপদস্থ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা এ রিপোর্টের কিছু অংশ প্রকাশ করে দেয়, যার কারনে ম্যাকনামারা ইয়হিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তার চিঠিতে তিনি বলেন যে তার মনে হয়েছে প্রতিবেদনটি পক্ষপাতিত্বযুক্ত এবং উত্তেজক।” যদিও একজন ওয়ার্ল্ড ব্যাক কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলছেন যে প্রতিবেদনটিকেই পুনরসংশোধন করা এবং পরিবর্তন করার পরো এর সংবেদনশীলতা কমে যায়নি। তিনি বলেন- “আমাদেরকে শুধু একটু সহমর্মিতা কমিয়ে দিতে হয়েছে, কিন্তু এর প্রভাব একি রকম রয়েছে”।
এবিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বেশ অস্পষ্ট, বলা যায়। নিক্সনের প্রসাশন পাকিস্তানকে সব্রকম সাহায্য বন্ধ করতে নারাজ। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে হোয়াইট হাউস পাকিস্তানকে ১১৮ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কংগ্রেসকে, যা বলা হচ্ছে যে মুলতবি করে রাখা হবে। নিজের করমস্থল ও কংগ্রেস থেকে যথেষ্ট চাপ আসা স্বত্বেও নিক্সন বলে যাচ্ছেন যে, সকল সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হলে পাকিস্তান চায়নার বেশি বন্ধুবৎসল হয়ে যাবে, যেদেশ তাদের ১৯৬৫ থেকে সামরিক সাহায্যের প্রধান উতস হয়ে যোগান দিয়ে যাচ্ছে এবং এই অবস্থাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দ্যেশ্য সাধনের সকল পথ বন্ধ ধ্বংস করে আসছে। যাই হোক, চায়নাতে কিসিঞ্জারের সফরের বরাত দিয়ে বলা যায়, প্রশাসনের এই নমনীয়তার অন্যকোন কারন ও থাকতে পারে, পাকিস্তান ই হচ্ছে সেই গোপন পথ যার মাধ্যমে কিসিঞ্জার চায়নায় পা রাখবেন।
যাই হোক, সমালোচনা বেরেই যাচ্ছে, বিশেষ করে সিনেট অধিবেশনে। ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট সমর্থকরাও দিন দিন পক্ষ ত্যাগ করছেন। সিনেটর এডওয়ার্ড, এম কেনেডি অভিযোগ করছেন যে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর সারভে ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রিপোর্ট দুটিই একটি ভয়াবহ অনুপাতে দুর্ভিক্ষের আশংকা করছে, এসময় এধরনের নমনীয়তা যেন রাষ্ট্রীয় নিতীমালার উপহাস করছে। আরো দুই সপ্তাহ আগে, ফরেন এফেয়ারস কমিটি পাকিস্তানের জন্য সকল রকম সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করে। বিলটি একনো হাউস এবং সিনেটে পাশ হয়নি, কিন্তু পাশ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ১৯৫২ সাল থেকে এই বিশালাকার সাহায্য প্রদান চলে আসছে, যার ফলে এখন পর্যন্ত পাকিস্তান প্রায় ৪.৩ বিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। তার উপরে, ১৯৬৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সাহায্য ও পরিচালনের ভারও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আসছে। তারপর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী যুদ্ধের কারনে অস্ত্র বিক্রয় বন্ধ হয়ে যায়। গত অক্টবরে তা আবার চালু হয় এককালীন সাহায্যের ভিত্তিতে। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর বলা হয়েছিল যে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা হবে। কিন্তু যখন দেখা গেল অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে তিনটি যুক্তরাষ্ট্রীয় জাহাজ পাকিস্তানের দিকে রওনা হয়েছে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট যুক্তি দিল যে সেগুলো যাচ্ছে, কেননা সেগুলোর লাইসেন্স ইতিমধ্যে পাশ হয়ে গিয়েছে এবং চুক্তি ঠিক রাখতেই তারা এ অস্ত্র পাঠাচ্ছে। এত বছরে, বলা যায় প্রায় ১ বিল্লিওন ডলার সাহায্য পাকিস্তান পেয়েছে মিলিটারি খাতে। যুক্তরাষ্ট্রকে হয়ত পাকিস্তান এর বিষয়ে পলিসি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সম্প্রতি একটি সাক্ষাতকারে প্রাক্তন ফ্রেঞ্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আন্দ্রে মালরো সাবধানবানী দেন, তিনি বলেন- যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিনের মধ্যেই একটা বড় সমস্যার সম্মুখীন হবে, আর তার নাম বাংলাদেশ। এটি ভিয়েতনামের মত একটি সমস্যাই হয়ে দাঁড়াবে, ব্যাতিক্রম শুধু এই যে এখানে প্রায় ৭৮০ লক্ষ বাঙ্গালী আছে (পাকিস্তানে)। বাঙ্গালীরা জাতীয়তাবাদী্, মাওবাদী না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে তার শান্তিপূর্ণ আচরনে পরিবর্তন আনতে হবে।
উপেক্ষিত গনহত্যা
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পলিসিকে কেন্দ্র করে ভারত বেশ ক্রোধান্বিত এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এ মাসে হেন্রি কিসিঞ্জার নিউ দিল্লী সফরকালে জোর গলায় যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার প্রতিবাদ করেন। তাদের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী শরন সিং গত সপ্তাহেই অভিযোগ করে বলেন যে- “ যেকোন দেশই যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, তার মানে তারা প্রকাশ্যে একটি গনহত্যাকে উপেক্ষা করছে”। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির জন্য একদিকে কঠোরভাবে সেনাবাহিনী দিয়ে আক্রমন চালানোর চাপ, আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাপ যা তার দেশকে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে দিতে পারে। হতে পারে যে প্রতিটি রিফিউজির জন্য ভারত প্রতিদিন খরচ করছে ১.১০ রুপি, কিন্তু সেটাই একসাথে যোগ করলে দেখা যায় ভারত একদিনে রিফিউজিদের খাবারের জন্য খরচ করছে প্রায় ১০ লক্ষ ডলার। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বার্তা অনুযায়ী, শুধু প্রথম ৬ মাসেই খরচ হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে একতৃতীয়াংশ খরচ এসেছে বাইরের দেশের সাহায্য থেকে ( যুক্তরাষ্ট্র ৭৩ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে), যদিও বেশির ভাগ সাহায্য এখনও পাঠানো হয়নি। তবুও যেভাবে কিছু অভিজাত ভারতীয় প্রকাশ্যে যুদ্ধের উপদেশ দিচ্ছেন, সেরকম একটি যুদ্ধ এরচাইতে কম ব্যায়বহুল হবে না। ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করার সাথে সাথে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক আর বাহিনী ভারতের পশ্চিম সীমানার দিকে জড় হবে। তার উপর, এই যুদ্ধ গোটা উপমহাদেশেই ছড়িয়ে পরতে পারে। ভারতীয়দের এই অবস্থানে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তার বক্তব্যে বলেন- ভারত যতই আন্তরিক থাকুক বাংলাদেশ, তার গনতন্ত্র ও তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি, নিউ দিল্লী কোনভাবেই পশ্চিম বঙ্গের আর্থিক খতির ভার নেবেনা। নিউ দিল্লী মনে করছে, এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সমাধান যার ফলে শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে। সবিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ পশ্চিম পাকিস্তানকেই দেখাতে হবে। এটি এখনও অনিশ্চিত যে তারা আসলেই এত দূর থেকে একটি প্রলম্বিত যুদ্ধ চালাতে চায় কিনা। এখন পর্যন্ত, পশ্চিমের লোকদের কাছে এ যুদ্ধকে ভুল্ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা হয়েছে এগুলো কেবল কিছু দুস্ক্রিতিকারীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান। কঠোর প্রহরার কারনে কোন বৈদেশিক সংবাদ মাধ্যম সেখানে পৌছুতে পারেনি যুদ্ধের খবর নিয়ে। অবশ্য, যেহারে আহত সৈন্যদের অঙ্গহানি ঘটার পর দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তরুন সৈন্যরা কফিনে বাড়ি ফেরত আসছেন (তালিকাভুক্তদের পুরবেই দাফন করা হয়), তাতে বিরোধীদল প্রতিভাদী জোট বাধতে পারে। অর্থনৈতিক চাপ ইতিমধ্যেই প্রভাব ফেলছে। শিল্পকারাখানাগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে, কেননা তারা বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কাচামাল আমদানী করতে পারছেনা। ইতিমধ্যে, পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যমজুদ আরো কমে যাচ্ছে, অবস্থার কোন উন্নতি ও নেই যাতে বলা যাবে যে শিঘ্রই চাষাবাদ বা আমদানি
শুরু হবে এই গন অনাহারের পরিমাণ কমিয়ে আনতে। সাধারনত অগাস্টে সবচেয়ে বেশি ফসল ঘরে তোলা হয়, কিন্ত এপ্রিলে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একরের পর একর জমিতে কোন আবাদ হয়নি। এখন বৃষ্টিস্নাত রাস্তার পাশে শুধু ক্রিষকের ক্রিশ মুখ আর তাদের শুন্য দৃষ্টি দ্রিশ্যমান। ক্রিশকায় তাদের হাত পা, অপুষ্টিতে আক্রান্ত। লক্ষ লক্ষ বাঙালি গ্রামগুলোতে খাবারের সন্ধানে ঘুরছে। কিছু আক্রান্ত এলাকায় স্তানীয় লোকজনদের খাদ্যের অভাবে গাছের শিকড় বা কুকুরের মাংস খেতে দেখা গেছে। এই অনাহারের হুমকি আরো অনেক মানুষকেই ভারতে যেতে বাধ্য করবে। আগামী কয়েক মাসে অসংখ্য ও লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারেই মৃত্যুবরণ করবে, যদি একটি বিশালাকার ত্রাণ কর্মসূচি অবিলম্বে চালু না হয়। তবে এই উদ্যোগ ইয়াহিয়ার সরকারের অরথায়নে করবে না। গত সপ্তাহে তার সরকার যে বাজেট প্রনয়ন করেছে, তাতে প্রতি ১০ ডলারের মধ্যে ৬ ডলার পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। গত ৫ বছরে বাঙ্গালীদের জন্য এটাই সবচাইতে কম বাজেট। ইয়াহিয়া পিকিং এর সাথে বন্ধুত্ব করায় যুক্তরাষ্ট্র কিঞ্চিত রাগান্বিত অবস্থায় আছে, এমতাবস্থায় মনে হয়না তারা এধরনের কোন প্রোগ্রামকে সমর্থন করেছে। এক সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- “মানুষের দেহ এত ক্ষুদ্র, অথচ তা কত কষ্ট সহ্য করতে পারে”। কিন্তু, সোনার বাংলায় মানুষের এই ক্ষুদ্র দেহ চূর্ণ- বিচূর্ণ করতে কত শক্তি সংগ্রহ করতে হবে?
ইয়াহিয়া খান- একজন আদর্শ সৈনিক
পাকিস্তানের জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান রাওাল্পিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট এর পদ পাওার এক বছর পর বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে প্রেস সম্মেলন করতে সম্মত হন। তিনি যখন লোকে লোকারন্য সেই বসার ঘরটিতে প্রবেশ করেন ১৪ মাস আগে, সাথে সাথেই উচ্চ তাপ বিশিষ্ট টিভি লাইটগুলোর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন। একজন টেকনিশিয়ান কাঁপতে কাঁপতে সামনে এসে সেগুলো বন্ধ করে দেয়। তারপর তিনি সাংবাদিকদের ধমকানো শুরু করেন। তার স্বভাবজনিত বিষাদময় চেহারা নিয়ে রাগের সাথে তিনি টেবিল চাপড়ে তাদের বলেন- আমার সাথে রাজনীতির খেলা খেলতে এসনা, কেননা আমি তোমাদের সাথে রাজনীতি নিয়ে খেলব”।
৫৪ বছরের ইয়াহিয়া তার দেশও কম বেশি একি ভাবে চালাচ্ছেন, সেই অধৈর্য, ছলনা, বেসামরিক মানুষের দক্ষতার প্রতি অবমাননা, এবং তারচেও বেশিএই রাজনীতি ক্ষেত্রে তাকে সংযুক্ত করার ক্ষোভ নিয়ে। যখন আইয়ুব খান তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন দুই বছর আগে, শুধুমাত্র তখনি ইয়াহিয়া খাকি পোশাক বাদ দিয়ে কালো রঙের বিজনেস স্যুট পরিধান শুরু করেন, এবং এখনও তিনি তা পরে আছেন অস্বস্তি নিয়ে। সৈনিক ব্যারাকের জীবনের প্রতি তার আসক্তি জানাতে তিনি এখনও সৈন্যদের লাঠি হাতে বহন করেন এবং একজন সাধারন সোজা কথা সৈনিকের ভুমিকা পালন করার কোন সু্যোগ হারিয়ে যেতে দেন না। গত শীতে যখন পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ পৌছাতে বিলম্ব হল, তিনি বললেন- “আমার সরকার ফেরেশতা দিয়ে তৈরি নয়’। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়ে তিনি বলেন- “আমি উত্তরাধিকার সুত্রে অর্থনৈতিক মন্দা পেয়েছি এবং আমি এটাকে কাটিয়ে উঠব’। পূর্ব পাকিস্তানের এই মিশন সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘পাকিস্তান বিভক্ত হলে আমি শেষ হয়ে যাব’। জনতার প্রতি দায়িত্ব বিষয়ে বলেন- মানুষ আমাকে ক্ষমতায় বসায়নি, এখানে আমি নিজ যোগ্যতায় বসেছি।”
দুই বছর আগে যখন ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে চিন্তা করা হয়, তখন কেবল কিছু মানুষই তাকে চিনত। এই মোটা ভুরুর পাঠান জওয়ান ১৯৬৬ সাল থেকে আর্মি চিফ অফ স্টাফ পদে আছেন। অন্তত অর্ধ-ডজন উচ্চপদস্থ জেনারেল অস্বস্তি বোধ করেছিলেন যখন আইয়ুব খান পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কথা বলছিলেন, যেখানে তিনি নিজেই বলেছিলেন যে রাজনীতিবিদদের অবস্থা দেখলে মনে হয় পাচটি বিড়াল একসাথে লেজ বেধে দেয়া হয়েছে। ১৯৬৯ সালে বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষা সংস্কার এবং অন্যান্য কারনে ছাত্র আন্দোলন, সংগ্রামের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাড়াতে বাধ্য হন, সেদিন সেই জেনারেলরা দ্রুত আবারো মার্শাল ল ফিরিয়ে নিয়েসেছিল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম বক্তব্যে ইয়াহিয়া বলেন যে তিনি আনন্দিত যে দেশ রসাতলে যাওয়ার আগেই তার জওয়ান ভাইয়েরা সামরিক শাসন ফিরিয়ে এনেছে, আসলে জেনারেলদের মুল উৎকণ্ঠা ছিল যে দেশ হয়ত পুরোপুরি সাধারন মানুষের ক্ষমতায় চলে যাবে, যা সেনাদের খমতার জন্য সমুহ বিপদ ডেকে আনবে।
এক মাসের মধ্যে ইয়াহিয়া শিল্প কারখানার বেতন ৩০-২৬% বৃদ্ধি করলেন, যেখানে সেনারা দায়িত্ব ভালভাবে পালন করছিলেন না, সেখানে বেসামরিক মন্ত্রীদের বসালেন, এবং সরকারী দুরনিতী কমানোর উদ্যোগ নিলেন। তার কোনভাবেই আবার বেসামরিক শাসনে ফেরত যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না, এমনকি তিনি ক্ষমতালিপ্সু ও নন- যদিও পাকিস্তানিদের ভাষায় যে সেনা যত জোরে ঘোড়া দৌড়ায় সে তত ধীরে অবতরন করে। ধিরে ধিরে তিনি একটি নতুন সংবিধান ও নতুন করে ইলেকশন দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। যদিও, পরে তিনিই বলেছেন যে আমার দেশের কিছু মানুষের এই পরিকল্পনাটা ভাল লাগবেনা, তারা বলবে এসব কি হচ্ছে, এসব করে আরো ঝামেলা হবে।
কিন্তু যাই হোক না কেন, ইয়াহিয়া রাজনীতির হাওয়ার দিক বুঝতে ভুল করেছিলেন। ডিসেম্বরের ইলেকশনে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জাদুকরী নেতা শেখ মুজিবর রহমান প্রচুর ব্যবধানে নির্বাচনে বিজয়ী হলেন, তখনি ইয়াহিয়ার উপরে চাপ প্রয়োগ শুরু হল যে তারা আগেই ভেবেছিলেন যে এমনটি হবে। ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, বর্তমান চিফ অফ স্টাফ সহ আরো ছয়জন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল এবং টিক্কা খান, একজন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার খুনি হিসেবে পরিচিত কমান্ডার পূর্বাংশের এই বিশ্বাসঘাতকতা কঠোরভাবে দমন করতে ইয়াহিয়াকে সাহায্য করেছেন। ইয়াহিয়া নিজেকে একজন যোদ্ধা বংশের উত্তরাধিকার হিসেবে দাবী করেন যারা নাদির শাহ এর বিশেষ বাহিনীর অংশ হয়ে যুদ্ধ করেছিল এবং যাদের মাধ্যমে পারসিয়ানরা ১৬শ শতকে প্রথম দিল্লী দখল করে। ইংল্যান্ডে বড় না হলেও, ইয়াহিয়া দেহ্রাদুনে একটি ব্রিটিশদের পরিচালিত মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন আর তাই চালচলনেও তিনি পাক্কা সাহেব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে তিনি নর্থ আফ্রিকা ও ইতালিতে যুদ্ধ করেন। দেশ ভাগের পর, উপমহাদেশের অন্যান্য সেরা সৈনিকদের মতই তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন (বলা হয়ে থাকে যে ভারত বেশিরভাগ আমাদেরই পেয়েছিল)। শুরু থেকেই আইয়ুব খান ছিলেন তার গুরু, এবং খুব দ্রুতই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। মুসলিম ধর্মের অনুসারী ইয়াহিয়া তার স্ত্রী ফাখ্রা এবং দুই বিবাহিত সন্তানদের সর্বসমক্ষের আড়ালেই রাখেন। সেনাজীবনের বাইরে তার একমাত্র শখ সকল প্রজাতির পাখি নিয়ে। প্রেসিডেন্ট হাউসে তিনি অস্ট্রেলিয়ান তোতা পোষেন, এবং একটি বিশেষভাবে নির্মিত পুলে প্রচুর সারস ও রাজহাঁস বাস করে। তার ঢেউ খেলানো কাচা পাকা ঘন চুল নিয়ে তিনি অত্যন্ত ব্যাতিব্যাস্ত হন, এবং বলেন যে স্যামসনের মত আমারো সকল শক্তি লুকিয়ে আছে আমার চুলে।
পশ্চিমারা যারা ইয়াহিয়াকে চিনেন, তারা প্রত্যেকেই বলেছেন ইয়াহিয়া একজন যুক্তি দ্বারা পরিচালিত মানুষ, কিন্তু অসম্ভব জেদি, গর্বিত এবং নিয়মতান্ত্রিক। দুর্নীতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ হিসেবে তিনি গত বছর সকল জ্যেষ্ঠ্যপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাদের তলব করেন এবং সবার সাম্নে তাদের চোরের দল বলে অভিহিত করেন। আমলারা দ্রুতই আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়, যার ফলে ইয়াহিয়া তার অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু বাংগালিদের ক্ষেত্রে তার নমনীয় হওয়ার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছেনা, যাদের তিনি উর্দুতে “মচ্ছর”-মশা বলে সম্বোধন করেন।
একজন পরিচিত আমেরিকান আমাদের বলেন- ইয়াহিয়া কোন নিষ্ঠুর ব্যক্তি নন। তিনি একজন ভালো সৈনিক। কিন্তু তিনি জাতীয়তাবাদের ঘোরে আক্রান্ত এবং প্রায় অন্ধ। তিনি বিশ্বাস করেন যে তার দেশের নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। তিনি লিঙ্কনের মতই পাকিস্তানকে অবিভক্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যদিও তার কোন পদ্ধতির ধার ধারছেন না। পূর্ব বাংলার নীতিসম্মত সায়তবসাশনের দাবী যদি তিনি মেনে নিতেন, তবে হয়ত তিনি সফল হতেন, কিন্তু তার এই কঠোর আক্রমন এটাই নিশ্চিত করছে যে এই দেশ দুইভাগে ভাগ হবেই, যাদের মধ্যে খুব সামান্যই মিল আছে, এবং তা আর কখনই জোড়া লাগবে না।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৭। পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যস্ত মানুষ | নিউইয়র্ক টাইমস | ৫ আগস্ট ১৯৭১ |
<১৪, ৭৭, ১৯২-১৯৩>
নিউইয়র্ক টাইমস, ৫ আগস্ট ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যস্ত মানুষ
এশিয়ায় বিপর্যয় সংঘটিত হচ্ছে। মানব দুর্যোগ এত বড় যে এটি ভবিষ্যতকে রক্তেস্নাত করে ফেলতে পারে। শুধু এশীয়দের জন্য নয়, সেই সাথে পশ্চিমেরও। তবুও বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া ন্যূনতম এবং নৈতিকভাবে একেবারেই নিকৃষ্ট।
আমি শুধু কলকাতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ফিরে এসেছি, যেখানে আমি পাকিস্তানে পাকিস্তানি গণহত্যার আক্রমণের ফলে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বোমা মেরে, পুড়িয়ে দিয়ে হত্যা করে এবং তাদের গ্রামগুলোতে লুটপাট করে এবং তাদের নিজের এলাকা থেকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
আমি কিছু সময় একটি কানাডিয়ান সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভ্রমণ করেছিলাম। আমরা দেখেছি ত্বক শুকিয়ে যাওয়া শিশুদের, শরীরের হাড় বেরিয়ে আছে, মহিলারা কান্নাকাটি করছে। তারা আমাদেরকে বলেছিল যে তারা এখানে মারা যাবে তবু তাদের দেশ পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবেনা কারণ সেখানে তারা যেসব দুক্ষজন ঘটনাগুলো দেখেছে তার পরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি শরণার্থী শিবিরের মানুষের হতাশা এবং অবিশ্বাস্য মাত্রার মানব ঢল- চার মাস্যা ৬.৭ মিলিয়ন শরণার্থী ভারতে ঢুকে পড়েছে।
আমি দেখলাম ভারতীয় গ্রামগুলি নিঃস্বার্থ উদ্বাস্তুতে পুর্ন। প্রতিটি ইঞ্চি মানুষে পূর্ন যারা আঝোড় বৃষ্টি আর খরা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য আশ্রয় খুঁজছেন। আমি দেখেছি শরনার্থীরা এখনও রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কোন বিশ্রামস্থল খুঁজে পাচ্ছে না। আমি দেখেছি ভারতীয় গ্রামবাসীরা তাদের সামান্য খাবার ওইসব ভীত এবং ক্ষুধার্ত মানুষদের সাথে ভাগ করে খাচ্ছে। আমি দেখেছি হাজার হাজার পুরুষ, নারী ও শিশু লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, তারা রোদের ভেতর ঘণ্টার পড় ঘণ্টা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে তাদের রেশনের জন্য। সামান্য কিছু চাল, গম এবং ডাল দেয়া হচ্ছে যা দিয়ে হয়ত তাদের পুষ্টির নূন্যতম চাহিদা মেটান যাবে না। পুষ্টির পরিমাণ এত কম যে এটি অনিবার্যভাবে প্রোটিন ভাঙ্গা, যকৃতের অসুস্থতা এবং কলেরা, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস সৃষ্টি করবে যা অন্যান্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করবে। আমি দেখেছি ভারতীয় ত্রাণ কর্মকর্তাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং অবাধ ব্যক্তিগত সহানুভূতি, তারা মানুষের জোয়ারের তরঙ্গের সঙ্গে মোকাবেলা করছে – এবং তার জন্য তাদের বাজেট দিনে মাত্র এক রুপি – প্রতি জনে মাত্র ১৩ সেন্ট।
এটা এখন স্পষ্ট যে দুর্ভিক্ষ পূর্ব পাকিস্তানকে আরও ধ্বংস করবে এবং লক্ষ লক্ষ লোক ভারতে আশ্রয় নেবে যেখানে ভারত ইতিমধ্যে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকান নীতির নির্মমতা এবং নির্বুদ্ধিতা প্রতিবাদ করতে মানুষ বাধ্য হবে। এক দিকে আমরা ভারতে ত্রাণ তহবিলে ৭০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। অন্যদিকে, আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলদের অস্ত্র সরবরাহ করছি যারা রক্তক্ষয় শুরু করেছে, যাতে তারা সন্ত্রাস করে ভারতীয়দের সীমান্তে পালানোর জন্য আরও বেশি সংখ্যক লোককে পাঠাতে পারে। এই সপ্তাহে হাউজে সামরিক সামরিক সহায়তা সহ অন্যান্য সহায়তা স্থগিত করার জন্য ভোট হয়।
প্রকৃত রাজনীতির ক্ষেত্রে, পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক সহায়তা অব্যাহতভাবে আমাদের শাসক জান্তার উপর প্রভাব বিস্তার করবে এবং রেড চীনের প্রভাবকে দূরে রাখতে সহায়তা করে। (বিস্ময়করভাবে, লাল চীনারাও পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলদের সহযোগিতা করছে।)
তবুও শরণার্থীদের সর্বাধিক প্রবাহ পশ্চিমবঙ্গে আসছে, যা কেবলমাত্র ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য নয় বরং রাজনৈতিকভাবেও সবচেয়ে অস্থির। সীমান্তে কলকাতা ও বনগাঁের মাঝামাঝি প্রায় ৫০ মাইল দূরবর্তী স্থানে আমি এমন একটি বাড়ি দেখেছিলাম যেটিতে একটি হাতুড়ি এবং কাস্তে আঁকা ছিল। মাওবাদীরা, অরাজকতাবাদীরা এবং প্রচলিত মার্কসবাদীরা একে অপরকে এখানে আক্রমণ করে এবং সহিংসতা, স্ট্রাইক, বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ইতিমধ্যেই এখানে একটি দৈনন্দিন ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে ক্রমাগত শরণার্থীদের প্রবেশ ঘটছে তা প্রায় বিস্ফোরিত হবে বলে মনে হচ্ছে।
পশ্চিম পাকিস্তানীদের অস্ত্র চালান পাঠানোর মাধ্যমে আমরা আংশিকভাবে সেখানে লাখো ক্ষুধার্ত, রুগ্ন ও রাগান্বিত উদ্বাস্তুদের টেন্ডার বক্সে ঢোকানোর জন্য দায়ী। এতে ভারতের সীমান্তে রক্তক্ষয়ী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে – পাশাপাশি মাওবাদী আন্দোলনকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। সুতরাং এমনকি যদি কেউ নিঃসন্দেহে চীনা কমিউনিস্টদের প্রভাব বিস্তার থামাতে চায় তবে সেই লক্ষ্যে আমাদের এই পদক্ষেপ বোকামিই বটে। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রভাব বিস্তারের বিনিময়ে ভারতের উপর প্রভাব হারাচ্ছি। ভিয়েতনামের চাইতেও খারাপ, বড়, রক্তাক্ত পরিস্থিতি এশিয়ায় তৈরি করতে যাচ্ছি।
কিন্তু খুব সহজ কারণেই আমাদের সাহায্য নীতি পরিবর্তন করা আবশ্যক – যার একটি কম রাজনৈতিক উপায় আছে। সহজ মানবতার ভিত্তিতে, আমাদের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক জনসাধারণের প্রতি আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার কারণ ইসলামাবাদের অগণতান্ত্রিক জেনারেলদের সাথে জোট, এবং হত্যাকারীদের আরো বেশি অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারটি নৈতিকভাবে বিরক্তিকর।
পূর্ব পাকিস্তানের জরুরী অবস্থা সামান্য প্রতিক্রিয়ার চেয়ে বেশি দাবি করে। অবিলম্বে আমাদের সেখানে জীবন বাঁচানো শিশুর খাদ্য, গুড়ো দুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, , এন্টি কলেরা টিকা এবং ভারতে অনুরূপ সরবরাহ দিতে হবে। কিন্তু এর চেয়েও বেশি দরকারি হল নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুসারে অস্ত্র চালান অবিলম্বে বন্ধ করা।
– এলভিন টফলার।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৮। কূটনীতিকদের পাকিস্তানী পক্ষ ত্যাগ | নিউইয়র্ক টাইমস | ৫ আগস্ট, ১৯৭১ |
<১৪, ৭৮, ১৯৪-১৯৫>
দি নিউইয়র্ক টাইমস, বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট, ১৯৭১
১৪ পাকিস্তানী সাহায্যের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশন শেষ
ইয়াহিয়া সরকারের অপরাধের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের অভিযোগ– কিছু
আশ্রয় প্রার্থনা
বেঞ্জামিন ওয়েলেস
বিশেষ প্রতিনিধি নিউইয়র্ক টাইমস
ওয়াশিংটন, ৪ আগস্ট- ১৪ পাকিস্তানী কূটনীতিক যার সবাই বাঙ্গালী, আজ এখানের দূতাবাসে পদত্যাগ করেছে বা জাতিসংঘের মিশন থেকে তাদের কৃতকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে ‘মানবতা বিরোধী দুর্নীতি’ নামে, যা পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খানের সরকার করেছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন ও নাগরিকতা প্রদানকারীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, পদত্যাগকারী কয়েকজন পাকিস্তানী কূটনীতিক এদেশের রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার জন্য আবেদন করেছে।
মুখপাত্র বলেছেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কূটনীতিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাকবে। যদিও স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র এ ব্যপারে কোন মন্তব্য করেননি, কিন্তু এটা ইঙ্গিত দেয় যে বাঙ্গালী কূটনীতিকদের উপর কংগ্রেসের শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে যা হয়তো তাদের এখানে থাকার অনুমতি দেবে।
এ এম এ মুহিথ, পাকিস্তানী দূতাবাসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও দলের নেতা জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তিনি ও তার সহকর্মীরা পাকিস্তান সরকারের ‘সভ্য আচরণ বিরোধী ও মানবতা বিরোধী দুর্নীতি’ তে আর চুপ থাকবেনা।
দলটি ঘোষণা করেছে তারা তাদের আনুগত্য ‘বাংলাদেশ সরকার’ বা ‘বাঙ্গালী জাতি’ তে স্থানান্তর করবে যা ‘পাকিস্তানের হয়ে থাকা’ বেশিরভাগ মানুষের ‘আশা ও বিশ্বাস’ তুলে ধরে।
পাকিস্তান আর্মি গত মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রাশ আন্দোলন করে। যার কিছু কিছু আন্দোলনের নেতারা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা প্রচার করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
পূর্ব পাকিস্তান যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারত অঞ্চলের উপর দিয়ে ১০০০ মাইল দূরে বিভক্ত, যেখানে সাত কোটি বিশ লক্ষ মানুষের বাস যাদের বেশীরভাগই বাঙ্গালী। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ যাদের বেশীরভাগই পাঞ্জাবি ও পাঠান।
এই পদত্যাগে পাকিস্তানী দূতাবাসের কর্মী কমে অর্ধেক হবে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের তালিকা অনুযায়ী ১০ জন কূটনীতিকদের মধ্যে ছয় জন পদত্যাগ করেছে।
নৃশংসতার অভিযোগ
জনাব মুহিথ ঘোষণা করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা সেনাদের নির্যাতনের শিকার। তিনি বলেন, গ্রামবাসী নির্যাতিত হয়েছে, মহিলারা অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার আর যুবকরা শিকার হয়েছে ‘বায়োনেট ও মৃত্যুর’।
“শুধুমাত্র একটি সন্ত্রাসী এলাকাই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, দিন দিন এটা তিব্র হচ্ছে”। জনাব মুহিথ বলেন, “বাঙ্গালির প্রশ্নে ইয়াহিয়ার চূড়ান্ত জবাব বাংলার খাদ্য ঘাটতিতে যুক্ত হওয়া অশুভ মাত্রাকে অস্বীকার করছে। ধারণার বাইরে একটি দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের জন্য হুমকি দিচ্ছে, যেটা হলে এখানের কম হলেও ত্রিশ শতাংশ জনগন খাদ্য ঘাটতির স্বীকার হবে”।
আজ যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে ছিলেন এস এ করিম, জাতিসংঘের ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধিত্বকারী; ই করিম, দূতাবাসের একজন মন্ত্রী যে অসুস্থতা রিপোর্ট করে; এ এম এস কিবরিয়া, শিক্ষা কাউন্সিলর; এ আর চৌধুরী, দূতাবাসের অর্থ ও হিসাব কর্মকর্তা এস এম আলি, তৃতীয় সচিব।
সাহায্যে নিষেধাজ্ঞা
পদত্যাগকারী কূটনীতিকরা গতকালের প্রতিনিধির ঘরে জড় হয়, জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সেনাখাতে বিদেশী সাহায্যের প্রায় ৬.৯ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য পাকিস্তান ও গ্রীসে পরবর্তী দুইবছরে নিষেধাজ্ঞার ব্যপারে ভোট দিতে।
“এই মুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতি ও সেনাখাতে কোন ধরণের সাহায্যের কোন প্রশ্নই ওঠেনা”, তারা বলেন। “এ ধরণের সাহায্য শুধু গনহত্যা স্থায়ী করতে ভূমিকা পালন করবে”।
কূটনীতিকদের সংবাদ সম্মেলনের এক ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, স্টেট সেক্রেটারি উইলিয়াম পি রজার্স ও প্রেসিডেন্টের জাতীয় সিকিউরিটির উপদেষ্টা হেনরি এ কিসিঞ্জার একটি মিটিং এ পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন এবং ডিসিশন নেবার জন্য সিনেটে পাঠান।
রজার্সের বৈঠক পরিকল্পনা
জনাব নিক্সন বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থীদের ত্রাণ সমস্যা ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। তিনি বললেন এটা পাকিস্তানের সাথে জাতিসংঘের কাজ করার সামর্থ্যকে ব্যাহত করতে পারে “যেমন বর্তমানে নির্দেশিত হয়েছে এটা খাদ্য সরবরাহ বিতরণ করতে ইচ্ছুক”।
পাকিস্তানে চলমান অর্থনৈতিক ত্রাণ ভারতীয় উপমহাদেশের “ঘটনাচক্রকে প্রভাবিত করছে”। জনাব নিক্সন ঘোষণা করেছেন, সেক্রেটারি রজার্স পরবর্তী সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনার প্রিন্স সাদরুদ্দিন খান ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে জাতিসংঘে বৈঠক করবেন।
পাবলিকের চাপ নয়
পূর্ব পাকিস্তানে কংগ্রেস ও পাবলিকের উঠতি চাপকে প্রত্যাখাত করায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিন্দা করে জনাব নিক্সন ঘোষণা করেছেনঃ
“আমরা পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের পাবলিকের চাপের সাথে যুক্ত হবনা। সেটা হবে পুরোপুরি অনুৎপাদনশীল। এসব ব্যাপারগুলো আমরা শুধু ব্যক্তিগত চ্যানেলে আলোচনা করব”।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৯। ভারতের সাথে চুক্তিঃ সোভিয়েতের যুদ্ধ এড়াবার চেষ্টা |
নিউ ইয়র্ক টাইমস
|
১৩ আগস্ট, ১৯৭১ |
Raisa Sabila
<১৪, ৭৯, ১৯৬-১৯৮>
ভারতের সাথে চুক্তিঃ সোভিয়েতের যুদ্ধ এড়াবার চেষ্টা
নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৩ আগস্ট, ১৯৭১, শুক্রবার
রচনায় ট্যাড জুল, নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশেষ সংখ্যা
ওয়াশিংটনঃ ১২ই অগাস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সরকারী কর্মকর্তা বলেছেন যে তারা ধারনা করছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ৩ দিন আগে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে ভারতের সাথে যে মৈত্রীচুক্তিতে সাক্ষর করেছে তার মাধ্যমে তারা ভারতে নিরুতসাহিত করতে সফল হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা দিতে।
ভারত এখন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যে বিলম্ব করছে, তার মুল্য হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী আন্দ্রেই এ গ্রমিকোর উপস্থিতিতে ২০ বছরের শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার একটি চুক্তি নিউ দিল্লীতে সাক্ষরিত হয়। মাত্র দুইদিনের নোটিসে মিঃ গ্রোমিকো এ চুক্তিতে সাক্ষর করার জন্য সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যেই ভারতের রাজধানীতে গমন করেন।
সোমবার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে দেয়া ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে বলা হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে ভারত সরকার যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তবে তা পাকিস্তান ও ভারত মধ্যে যুদ্ধের সুচনা করবে।
দমন–নিপীড়নের শুরু ২৫শে মার্চঃ
বাংলাদেশ নামটি ভারতের সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙ্গালি জনগনের দাওয়া। ২৫শে মার্চ থেকেই পাকিস্তান এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ঠেকাতে মিলিটারি অভিযান চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের গৃহীত অনুমান অনুযায়ী ইতিমধ্যে এই মিলিটারি হামলায় ২ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং ৭ লক্ষের বেশি শরণার্থী হিসেবে দেশ ত্যাগ করেছেন।
পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য অনেকাংশে দায়ী ভারতের উপর চেপে বসা লক্ষ লক্ষ শরনারথীর দায়। দুই দেশ একে অপরকে ইতিমধ্যে যুদ্ধের হুমকিও দিয়েছে।
ওয়াশিংটনের রিপোর্ট বলছে যে ভারত গত সপ্তাহের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়েছিল যে তারা ৯ অগাস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নেতাদের দল পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতে অবস্থান করছে। জানা যায় যে, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের সমর্থনপুষ্ট।
রিপোর্ট অনুযায়ী স্বীকৃতি দেয়ার এই পরিকল্পনা গত ২রা অগাস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদুত এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দুত হিসেবে কর্মরত শ্রী দুর্গা প্রসাদ ধরের মাধ্যমে মস্কোতে জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ ও কুটনৈতিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী মিঃ গমিকো শ্রী ধরকে বলেছেন ভারতের আরো সাবধানী হওয়া প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতি একটি যুদ্ধাবস্থার অবতারনা করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যসুত্রমতে, পরবরতী ধাপ হিসেবে মিঃ গোমিকো অনতিবিলম্বে নয়া দিল্লীতে গমন করে শ্রীমতী গান্ধী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরন সিং এর সাথে আলোচনা করার প্রস্তাব দেন। গত শুক্রবার এই ভ্রমনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দাওয়া হয় এবং মিঃ গোমিকো রবিবার পৌছান।
রিপোর্ট অনুযায়ী মিঃ গমিকো ভারতীয় প্রতিনিধিকে মস্কোতেই জানিয়েছিলেন যে তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শ্রীমতি গান্ধিকে নিরুৎসাহিত করবেন, এবং প্রয়োজনে যেকোন ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যসুত্রমতে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে ভারতকে যেকোন বাড়তি আর্থিক ও সৈন্য সহায়তা দিতে মস্কো প্রস্তুত আছে। কিন্তু একি সাথে তারা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয় এমন কোন বেপরোয়া পরিস্থিতি তৈরি করা থেকে ভারতকে বিরত করতে বদ্ধপরিকর।
কর্মকর্তারা আবারো স্মরন করিয়ে দিয়েছেন যে, প্রেসিডেন্ট আগা মোঃ ইয়াহিয়া খান সম্প্রতিই ঘোষণা দিয়েছেন যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাকা দাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি বলেন যে যদি ভারত অবৈধ ভাবে রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের সাহায্য করে তবে পাকিস্তান এটাকে ভারতের হামলা বলে ধরে নিবে এবং তারা যুদ্ধের ডাক দিবেন।
সম্প্রতি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যের বৈরিভাব কমাতে ও যুদ্ধাবস্থাকে প্রশমিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চায়না, সকলেই কাজ করে যাচ্ছে। ওয়াশিংটন সকলের সম্মুখেই দুই দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রন করার পরামর্শ দিয়েছে।
কুটনৈতিকদের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র চায়নাও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সাবধানতার সাথে আগানোর পরামর্শ দেন। আমেরিকান অফিসিয়ালরা ধারনা করছেন যে মিঃ গোমিকো এই মৈত্রীচুক্তি সাক্ষর করতে সম্মতি দিয়ে ভারতের মতপরিবর্তন করাতে সক্ষম হয়েছেন। এই চুক্তিটি বেশ কয়েক মাস ধরেই আলোচিত হচ্ছিল, কিন্তু মস্কো এত দ্রুত এ চুক্তিতে সাক্ষর করতে প্রস্তুত ছিলনা।
কর্তৃপক্ষীয় সুত্র থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের যে পটভুমি তৈরি হয়েছে তাতে ভারত ও এ চুক্তিতে সাক্ষর করতে একবাক্যে সম্মত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। ভারত তার বর্তমান নিরাপত্তা হিসেবে এই সোভিয়েত চুক্তিকে গন্য করছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। সোভিয়েতদের মধ্যস্থতার মাধ্যমেই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে নতুন করে অর্থ ও সামরিক সাহায্য করবে কিনা তা এখনও জানা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যায় যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পরিকল্পনা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আগে থেকে কিছু জানায়নি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এ তথ্য ওয়াশিংটনে পাঠানোর কোন উদ্যোগ নেয়নি।
এ অধিদপ্তরের মুখপাত্র মিঃ রবার্ট জি ম্যাকগলস্কি আজ বলেছেন যে ভারত-পাকিস্তানের বিবাদের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোন যোগাযোগ হয়নি। আজকের সংবাদ ব্রিফিং এর সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন এবং তিনি সেখানে কোন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেননি।
ভারত সরকার গতকাল তার অবস্থান বদল করে স্টেট ডিপার্টমেন্ট সচিব উইলিয়াম পি রজারসকে জানিয়েছে যে এটি শুধুই একটি নতুন চুক্তি ও মৈত্রীগঠন। ভারতের রাষ্ট্রদূত লক্ষীকান্ত ঝা এ প্রতিবেদন মিঃ রজারস এর কাছে নিয়ে যান এবং তিনি তা গ্রহন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাগণ আশংকা করছেন যে নিউ দিল্লী যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি স্থগিতও রাখে, তবুও অদুরভবিষ্যতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ বিবাদের শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
গোয়েন্দা বিভাগ আরো বলছে যে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়া এবং গেরিলাদের আরও বেশি সাহায্য করার জন্য সংসদ সদস্যগন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
গেরিলাদের কর্মকাণ্ড ও শরণার্থী সমস্যা যত বৃদ্ধি পাবে, এই চাপ ততই আরো বেড়ে যাবে বলে মনে হয়।
পুরব পাকিস্তানের এ সমস্যার সমাধান তখনি হবে যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এ প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন অনুমোদিত করবেন, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের সাথে একমত। প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম একটি গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে কোন প্রেসিডেন্ট তা করবে?
মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগঃ
নিউ দিল্লী, ১২ই অগাস্ট (রয়টার্স) আজ ভারতীয় একজন নেতা তার দেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সাথে বিসবাসঘাতকতা করেছে বলে অভিযোগ করেন।
জনসঙ্ঘ পার্টির ডানপন্থীদের নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী আজ একটি র্যালীতে বলেন যে আজকে সোভিয়েত-ভারত ইস্যুতে বাংলাদেশের কোনোই উল্লেখ নেই। মিঃ বাজপেয়ী বলেন, বরং এ চুক্তি পাকিস্তানের সকল লোকের স্বার্থরক্ষার কথাই বলছে। তিনি ঘোষণা দেন যে এটি আসলে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং পাকিস্তানের অখন্ডতাকে সমর্থনের সামিল।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮০। সিদ্ধান্তের সময় | নিউজউইক | ১৬ই আগস্ট-১৯৭১ |
<১৪, ৮০, ১৯৯>
নিউজউইক, ১৬ই আগস্ট-১৯৭১
পাকিস্তানঃ সিদ্ধান্ত নেবার সময়
গত সপ্তাহের সংবাদ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তান সরকারের প্রতি আমেরিকার সাহায্য-সহায়তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তবে সেই সংহতি ছিলো কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে। সে সময়টায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলন নির্মম ভাবে দমন করে যাচ্ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু তা প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মনোভাবে কোন পরিবর্তন আনে নি। তার বক্তব্য ছিলো, “আমরা মনে করি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি আমাদের অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত করে ঘটনাপ্রবাহে যথাযথ প্রভাব রাখা উচিত”।
মিস্টার নিক্সনের এই বক্তব্যে নতুন এক সিদ্ধান্তের উপসংহারে এলেন চৌদ্দ জন বাঙালি কূটনীতিবিদ।
হোয়াইট হাউজ থেকে মাত্র তিন ব্লক দূরত্বে অনুষ্ঠিত একটি কনফারেন্সে তারা পাকিস্তান এ্যাম্বেসি এবং জাতিসংঘের চলমান মিশন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। জাতিসংঘ মিশনের সহকারী স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ এফ করিম বলেন, “ নীরব দর্শক হয়ে থেকে পাকিস্তানের এই বর্বর নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করে চলা সম্ভব নয়। তারা বাংলাদেশকে পরিণত করেছে এক ভয়ার্ত মৃত্যুপুরীতে। এইবার আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার পালা!”
এই চৌদ্দ জন বাঙালির জন্যে সম্ভবত অপেক্ষা করছে আমেরিকার রাজনৈতিক আশ্রয়। বিদ্রোহী কূটনীতিবিদের মনের ভেতর তখন আশার প্রদীপ দেদীপ্যমান; পৃথিবীর সকল প্রান্তের পাকিস্তানী মিশনের দায়িত্ব পালন করা বাঙালিরা এই উদাহরণে উদ্দীপ্ত হয়ে পদত্যাগ করবেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮১। বাংলায় কি চরম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে? | নিউ ইয়র্ক টাইমস | ১৯ আগস্ট, ১৯৭১ |
<১৪, ৮১, ২০০-২০১>
নিউ ইয়র্ক টাইমস, বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ১৯৭১
বাংলায় শেষ সমাধান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব সাহায্যের ছদ্মবেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করছে
-এলিস থর্নার
প্যারিস-আমরা কি বুঝতে পারছি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব বাংলায় একটি “চূড়ান্ত সমাধান” করার জন্য পাকিস্তানের উপর নিরব অথচ ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছে?
১৫৬ জনের একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও পূনর্বাসন দল পূর্ব বাংলায় অবস্থান নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে নিক্সন প্রশাসন একটি প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাবে পাকিস্তানের সম্মতি আমাদের কাছে একেবারেই বিস্ময়কর ছিল না। ইউএনএর দল পাঠানোর প্রকল্পটি মানবিক সাহায্যের ছদ্মবেশে পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের নড়বড়ে শাসন বাঁচানোর জন্য একটি প্রক্রিয়া।
আসুন আমরা ত্রান প্রস্তাবনার প্রকৃত চেহারার দিকে লক্ষ্য করি। যেখানে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী ‘খাদ্য সংকট এবং রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশংকা কমানোর জন্য পাকিস্তানি প্রশাসনকে সাহায্য’ করার জন্য নিয়োজিত দলের তত্ত্বাবধায়নে থাকবে। যে পাকিস্তানি প্রশাসন ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ দলকে সহযোগিতা করবে বলে আশা করা হচ্ছে, তারা কারা? সঠিকভাবে বলতে গেলে, জেনারেল টিক্কা খানের সামরিক (মার্শাল ল’) প্রশাসনের সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে মজুদ খাদ্য নষ্ট করেছে, বাজারে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং চাষীদের গ্রাম থেকে বিতাড়িত করেছে যাতে করে ধানের বীজ বোনা হয়।
একই সামরিক নেতৃত্বের অধীনে থেকে একই সেনারা ইউনিসেফ এর জীপগাড়িগুলো নিজেদের কাজে এবং দীর্ঘ পরিসরে কলেরার মাঠসমীক্ষা ভন্ডুল করার উদ্দেশ্যে যেসব চিকিৎসক নৌকায় করে গ্রামবাসীদের দেখতে যেত, তাদের নৌকা ছিনিয়ে নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হত।
একইভাবে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত যে নীতি অনুসরণ করেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় ও ঘরবাড়ি্ পুনর্বাসনকারি জটিল করে তুলছে। সেনারা শুধু হাজার হাজার গ্রাম ও শহরের আবাসই ধ্বংস করেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা অবাঙালি অথবা তাদের সহযোগীদেরকে হিন্দু, খ্রিস্টান, আওয়ামীলীগের মানুষের ঘরবাড়ি ও সম্পদ অধিকার করার জন্য এবং বুদ্ধিজীবীদের তাদের ঘর থেকে বিতাড়িত করার জন্য প্ররোচনা দিয়েছে। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরী সহায়তার অপর লক্ষ্য হলো পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসনের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের উপর যত কাজের ভার ছিল তার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুণর্গঠন, ৪০০০০ নৌযান ও ১০০০০ ট্রাকের প্রাদেশিক নিজস্ব বহর একত্র করাই ছিল প্রধানতম প্রকাশিত দায়িত্ব। এটা সত্যি যে বাঙ্গালি গেরিলারা পরিবহন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছিল। তারা ভারতীয় সীমান্তের ওপাড়ের অভয়ারণ্য থেকে, তাদের ছোট্ট স্বাধীনকৃত ছিটমহল থেকে, এই বদ্বীপের বনজঙ্গলের নিরাপদ আবাস থেকে আক্রমণ করে রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, নৌযান ডুবিয়ে দিয়েছে, নদীপথ মাটি ফেলে ভরিয়ে দিয়েছে, জাহাজ মেরামত কারখানা ধ্বংস করেছে। কারন পরিবহন পূর্ব বাংলার সেনাবাহিনীর প্রাণশক্তি। যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের মাঝে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে, শেষে গিয়ে তাদের বিতাড়িত করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ত্রাণ প্রকল্পের নামে কিছুটা হলেও যোগাযোগ মাধ্যম পুনঃরুদ্ধার করতে পারবে যাতে করে পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত হয়।
যদিও প্রস্তাবিত পুনর্বাসন দলকে সতর্কভাবে ‘আন্তর্জাতিক’ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিক সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পরিস্কারভাবে বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ব্যবস্থা করা ও ঢাকায় উড়িয়ে আনতে বিশেষজ্ঞ দলকে সাহায্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব করে। যখন মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্মতি লাভ করে সাথেসাথেই রেডিও ও অন্যান্য সামগ্রী উড়োজাহাজে করে দ্রুত প্রেরণের জন্য তৈরি করা হয়। সংস্থাটির কয়েকশত কর্মী পূর্ব বাংলায় দায়িত্ব পালন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীনে এই কাজে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না এই মর্মে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমেরিকান পুর্ব বাংলা ছেড়ে চলে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণদাতা দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদানের প্রায় অর্ধেক পাকিস্তানে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তাদের প্রস্তাবে রাজি করাতে পেরেছিল। ১৯৫১ সাল থেকে পাকিস্তানে অজনপ্রিয় জান্তা সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য বড় ধরনের আর্থিক ও সামরিক সাহায্য এই মতবাদকেই সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রকল্প নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল তা সাময়িকভাবে হয়ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছিল। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় প্রকৃত শৃঙ্খলা ফিরে আসার সম্ভাবনা পিছিয়ে গেছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়া না হয় এবং বাঙালী তাদের নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণকারী না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সত্যিকারের ত্রাণ অ পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়।
(অ্যালিস থ্রোনার প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত বিষয়ক প্রভাষক এবং তাঁর ভারত উপমহাদেশের উপর গবেষণাধর্মী অনেকগুলো লেখা আছে। তিনি ১৯৭১ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন।)
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮২। আমরা সাহায্য করতে পারি তবে অস্ত্র দিয়ে নয়।
|
নিউ ইয়র্ক টাইমস | ১৯ আগস্ট ১৯৭১ |
<14,82,202-203>
নিউ ইয়র্ক টাইমস, বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট ১৯৭১
আমরা সাহায্য করতে পারি তবে অস্ত্র দিয়ে নয়।
যদিও পুরো পরিস্থিতি আমাদের নাগালের মধ্যে নাই
– জন কেনেথ গালব্রেইথ
কেম্ব্রিজ – ম্যাস
বাংলার এই দুঃখজনক অবস্থায়, চারটি উপাদান নিয়ন্ত্রন করছে। তাদের তালিকা: শরণার্থী সমস্য এবং অসহনীয় পরিস্থিতি অবিলম্বে হ্রাসকরণের জন্য প্রতিটি প্রচেষ্টা করা আবশ্যক। কিন্তু সহনশীল সমাধান না হলে এই মানুষগুলো তাদের গ্রাম এবং জমিতে ফিরে আসতে পারবেনা। এই বিপুল সংখ্যক লোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পে থাকবে অথবা নিকটবর্তী ভারতের কোন প্রদেশে থাকবে যা প্রচন্ড নিষ্ঠুর ও অচিন্ত্যনীয়।
উদ্বাস্তুরা শুধুমাত্র একটি শান্তিপূর্ণ এবং সুরক্ষিত দেশে ফিরে আসবে। এই বছরের শুরুতে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ব্যাপক ভোট পরে এবং এই ঘটনাগুলি থেকে এটি নিশ্চিত যে পূর্ব পাকিস্তান তথা ইস্ট বেঙ্গল কেবল শান্তিপূর্ণ হবে যদি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব সরকারব্যাবস্থা দেওয়া হয়।
স্বায়ত্তশাসনের চাপ যেসকল জনগণ দেশ ছেড়ে চলে যায়নি তারা ভোটের মাধ্যমে দিয়েছে, এবং তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন এবং নিজস্ব সরকার পশিম পাকিস্তানের জন্যও ভালো। পশ্চিম পাকিস্তান ভারতের তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভালো সম্ভাবনা দেখা যাবে । সামরিক শাসনের কারণে সেই সম্ভবনা ভেস্তে যাবে। আরও খারাপ হল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা ও পাঞ্জাবিরা।
সেনাবাহিনীতে থাকা পাঠান এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী কাজ চালাচ্ছে বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমে তারা নিষ্ঠুর আর শোষক হিসেবে পরিচিত হবে। ভিয়েতনামের মত হয়ে যাবে তাদের অবস্থা।
ভারতবর্ষের একটি সামরিক সমাধান উপমহাদেশের দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করবে।
আমেরিকান নীতি যা অনুসরণ করে:
এটা আশা করা হয় যে, উপমহাদেশের দুটি ইসলামী সাম্রাজ্য এখনও এমন একটি সম্পর্ক খুঁজে পেতে পারে যেমন একটি কমনওয়েলথের দুটি অংশের মধ্যে থাকে যা তাদের স্বাধীন সহাবস্থানে বসবাসের অনুমতি দেবে। তবে পূর্ববাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং -সরকার অবশ্যই থাকতে হবে। তাই আমাদের কোনও পদক্ষেপকে- পশ্চিমে পূর্বের সামরিক কর্তৃত্বকে হতাশ করতে বা উৎসাহিত করতে উৎসাহিত করা উচিত নয়।
এর অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো ধরনের সামরিক সহায়তা করা যাবে না। এবং এর মানে হল যে সমর্থন বা প্রস্তাব দেওয়ার মত এমন ছোট বা প্রতীকী সহায়তা যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিকর হতে পারে। পূর্ববর্তী বিষয়গুলো যেকোনো অর্থনৈতিক সাহায্যকেও নিষেধ করে, যাতে তারা বাঙালির স্ব-শাসন বা স্বাধীনতার দমনের জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কাজ করতে পারে।
চীনাদের কোন গুপ্ত কৌশল নীতি সমর্থনযোগ্য নয়। অবশ্যই এই বিষয়গুলি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কোন উদ্যোগ এবং ভারতের জন্য অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করে। অন্যদিকে, শরণার্থীদের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে সাহায্য করতে আমাদের অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে উদার হতে হবে।
গত কয়েক বছরে এটি স্পষ্টভাবে পরিষ্কার যে তৃতীয় বিশ্বে আমাদের (হস্তক্ষেপের) ক্ষমতা সীমিত। আমরা হয়তো পূর্ববাংলার সমস্যা সমাধানে সক্ষম নই কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই, যেভাবে রাশিয়ানরা আপাত দৃষ্টিতে করেছে, সেভাবে সহমর্মী হয়ে জোরপূর্বক ভুল কাজ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে সক্ষম।
[জন কেইনথ গালব্রাইট ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত।]
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮৩। মার্কিন বিমানে বাঙলায় সৈন্য পাঠানো হচ্ছে | ওয়াশিংটন পোস্ট | ১৯ আগস্ট ১৯৭১ |
<১৪, ৮৩, ২০৪-২০৫>
ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৯ আগস্ট ১৯৭১
মার্কিন বিমানে বাঙলায় সৈন্য পাঠানো হচ্ছে
পাকিস্তানি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের সাথে এক মার্কিন কোম্পানি থেকে ভাড়া নেওয়া দুটি জেট বিমান পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ফ্লিটে একত্রিত করা হয়েছে, যা পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় সরকার সৈন্যবাহিনী আনা-নেয়া এবং বঙ্গপ্রদেশের অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করছে, এটি সরকারি সূত্র থেকে জানা যায়।
বোয়িং ৭০৭-র উভয় প্লেন, ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজের কাছ থেকে লিজে নেয়া, এটি নিজেকে আমেরিকা সবচেয়ে বড় ইউএস চার্টার বিমান হিসেবে নিজেদের বর্ণনা করে। তার ব্যাবসার অর্ধেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে।
এই লিজ স্টেট ডিপার্টমেন্ট, কমার্স ডিপার্টমেন্ট এবং সিভিল এ্যারোনটিক্স বোর্ডের জ্ঞ্যাতসারে এবং স্পষ্ট অনুমোদন দিয়ে করা হয়েছিল।
সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে পিআইএ জেটলাইনার আহত সৈন্যদের বহন করার জন্য এবং প্রতিস্থাপন করতে ব্যবহৃত হয়।
পিআইএ, পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার। তাদের নিজস্ব সাতটি বোয়িং ৭০৭ এর পাশাপাশি দুটি ভাড়া দেওয়া বিমান আছে। বিমানটি পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক রুটগুলির পাশাপাশি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক রুটগুলিও পরিচালনা করে।
দুইটি ভাড়া করা বিমানের জন্য পিআইএ ওকল্যান্ড, ক্যালিফ বেইজড বিশ্বব্যাপী এয়ারওয়েজকে মাসে এক ১৭০০০০ ডলার দিচ্ছে। তারা পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সেবা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূর্ণ করার প্রচারাভিযান চালানোর জন্য দরকারি মিলিটারি কার্যক্রম চালানোর জন্য তাদের এটা দিচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ ইউএস মিলিটারি এয়ারলিফট কমান্ডের চুক্তির অধীনে রয়েছে এবং ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকান সৈন্যদের আনানেয়ার একটি প্রধান বিমান।
ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তিতে গত বছরে প্রায় ২৬ মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৬৯ সালে ৫১ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি ছিল – কোম্পানির কর্মকর্তা একথা জানান।
জুন মাসে পাকিস্তানকে ওয়ার্ল্ড এয়ারঅয়েজ যে দুটো প্লেন দিয়েছে তা গত গ্রীষ্মে নতুন রিলিজ হয়। এটি দুটি ৭০৭ -এর পরিবর্তে প্রতিস্থাপন হয়। সিএবি সূত্রে জানা গেছে, এগুলো যাত্রীদের পাশাপাশি মালামাল পরিচালনা করতে সক্ষম।
পিআইএ তাদের স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সেবা বৃদ্ধি করার জন্য গত গ্রীষ্মকালে এটি ব্যাবহার শুরু করে। জুনের শুরুতে চুক্তি নবায়নের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রায় দুই মাস পর বাণিজ্য অধিদপ্তর ১৮ জুন একটি নতুন লাইসেন্স প্রদান করে। এটা স্পষ্ট ছিল যে অতিরিক্ত প্লেন পাকিস্তানকে বাণিজ্যিক কাজের পাশাপাশি সামরিক পরিবহনের জন্য ব্যাবহার করবে।
বাণিজ্য বিভাগের সূত্র জানায় লাইসেন্সটি প্রত্যাহারের কোথা ছিল এবং লাইসেন্সগুলি ছাড়া ইজারা অবৈধ হবে।
যেহেতু লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্লেনগুলি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সেই বিষয়ে কোম্পানির কর্মকর্তা কেবলই বলেছিলেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চিত নন।
তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজের বিমানগুলির আমেরিকান ক্রুরা বিভিন্ন সময়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের ক্রুদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের লোকদের বলেছেন যে সেগুলোতে সৈন্য আনা-নেয়া করা হয়না।’’
যাইহোক, তিনি যোগ করেন, “আমি বুঝতে পারি যে কেন সেটা বলেছেন। যাই হোক না কেন”
পাকিস্তানি এয়ারলাইনের এয়ার ট্রাফিক লাইন অনুসারে এগুলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এবং বিদেশে ভ্রমণের অধিকার রাখে। ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রের’ মধ্যে উড়ানোর কারণে পিআইএ তাদের চুক্তির শর্তগুলি ভঙ্গ করছে।
“যদিও পূর্ব পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে একটি যুদ্ধক্ষেত্র তা আসলে আমি বলতে পারি না।” তিনি যুক্ত করেন।
দুই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি লোক যারা সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা থেকে বেরিয়ে এসে বলেছেন তারা দেখেছেন যেপিআইএ বোয়িং ৭০৭-এর থেকে সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের নামানো হচ্ছে এবং বোমা বিস্ফোরণে আহত সৈন্যদের সেটিতে করে ফেরত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তাদের কেউ বলতে পারেননি যে এগুলো সেই লিজ নেয়া প্লেন কিনা। ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা বলেন যে কোম্পানির লোগো সরানো হয়েছে এবং পিআইএ সনাক্তকরণ লোগো দ্বারা সেগুলো প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
“কিন্তু এটা সত্যিই একটি গৌণ বিষয়,” সোর্সদের একজন বলেন। “আসল বিষয় হল যেহেতু তারা দুটি আমেরিকান-মালিকানাধীন প্লেন পেয়েছে যা তারা বাণিজ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি জেটগুলিকে সামরিক কাজেও ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। এবং আপনি যেভাবেই দেখুন না কেন আমরা তাদের সাহায্য করছি।”
স্টেট ডিপার্টমেন্ট সূত্রে বলা হয়েছে যে মার্কিন সরকার চুক্তিটি “বাণিজ্যিক বিষয় হিসেবে” দেখেছে। তিনি বলেন, বিমানের ব্যবহারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
“আমরা ধারণা করতে পারিনা যে এই প্লেন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ছাড়া অন্যান্য উদ্যেশ্যে ব্যবহার করা হবে না,” উৎস বলেন। “যদি আমরা অন্য তথ্য পাই তবে আমাদের বিষয়টি আবার পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু আমি জানি না আসলে আমরা কি করব।”
– লুইস এম সাইমন্স।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮৪। ঘনিষ্ঠ বন্ধু | নিউজ উইক | আগস্ট ২৩, ১৯৭১ |
<১৪, ৮৪, ২০৬-২০৮>
নিউজ উইক, আগস্ট ২৩, ১৯৭১
ঘনিষ্ঠ বন্ধু
যখন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমইকো গত সপ্তাহে নয়াদিল্লী গেলেন, স্থানীয় কূটনীতিক গোষ্ঠী বলতে গেলে খেয়ালই করেনি। কিছু ভিনদেশী দূতদের ভারতীয় কর্মকর্তাগণ আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে গ্রোমইকোর সফরে তেমন বিশেষ কিছু ফলতে যাচ্ছেনা। আবার দূতদের অনেকেই তীব্র গরম আর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে (ভারতের) পাহাড়ি উত্তরাঞ্চলে গিয়েছিলেন চাঙ্গা হতে। তবে আগমনের এক দিনের মধ্যেই রাশিয়ার এক নম্বর কূটনৈতিক সমস্যা সমাধানকারী (গ্রোমইকো) সাফ জানিয়েছেন যে তিনি ভারতের রাজধানীতে জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছেন। নয়াদিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পতাকা-খচিত টেবিলে বসে গ্রোমইকো সফল স্বাক্ষর করেন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার বিশ বছরের শান্তি, বন্ধুত্ব, ও সহযোগিতার এক চুক্তিতে।
বাহ্যিকভাবে চুক্তির কথাগুলো এত স্থুল ছিল যে, এক পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতে, এটি “কার্যতঃ যেকোনো কিছুই” বোঝাতে পারে। তবে এই চুক্তির গুরুত্ব অল্পই নির্ভর করছে এতে কি বলা হয়েছে বা এর দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে তার উপর। আরেকটি পরাশক্তির সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ভারত তার জোটবদ্ধ না হওয়ার নীতি থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসেছে। দৃঢ়ভাবে ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসে রাশিয়া পাকিস্তানকে যেকোনো বেপরোয়া পদক্ষেপ নেয়ার বিরুদ্ধে সাবধান করে দিলো (আর এভাবে, মনে হয় আপাতত উপমহাদেশের দুই তিক্ত শত্রুর মধ্যে যুদ্ধের হুমকি হ্রাস পেয়েছে )। অবশ্য, এর মাধ্যমে মস্কো খোলামেলাভাবে চীনের (যে দেশটি পাকিস্তানের বিশ্বস্ত পৃষ্ঠপোষক) বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করলো, এবং দক্ষিণ এশিয়াতে হঠাৎ করেই শক্তির ভারসাম্য বদলে দিলো। একই ধারাবাহিকতায়, এ চুক্তি এতদাঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার প্রতিফলন, এমন একটা সময়ে যখন অনেক ভারতীয় রিচার্ড নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জারকে ঘোর খলনায়ক হিসেবে দেখছেন। আর সেই অর্থে, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি পিকিং আর ওয়াশিংটনের মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্কে আজ অবধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিপর্যয় বলে গণ্য করা যেতে পারে।
আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হলেও এ চুক্তি অকস্মাৎ তৈরি হয়নি, কারণ মস্কো এবং নয়াদিল্লী কমপক্ষে দু’বছর ধরে এই অভিপ্রায় পর্যবেক্ষণ করে আসছিলো। অবশ্য কিছুদিন আগ পর্যন্ত কোনো সরকারই ব্যাপারটি এগিয়ে নেয়ার তাগিদ অনুভব করেনি। অতঃপর এ বসন্তে পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত সহসা ঘটনার পট পরিবর্তন করেছে; যখন কয়েক মিলিয়ন বাঙালী শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং সীমান্তে সংঘর্ষ চরমে উঠেছে। ফলে দুই দেশের মধ্যবর্তী সম্পর্ক অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়েছে। খবর রটেছিল যে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে ডানপন্থীদের পাহাড় সমান চাপের মুখে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশকামী বিদ্রোহীদের প্রতি কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রসারিত করতে উদ্যত হয়েছিলেন—এমন একটি পদক্ষেপ যা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান “যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য” বলে সতর্ক করেছিলেন। এরকম জরুরী পরিস্থিতিতে, মস্কো-দিল্লী চুক্তির প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আর মস্কোতে প্রায় দুই সপ্তাহ গোপন আলাপ-আলোচনার পর, আন্দ্রে গ্রোমইকো কাজ সমাধা করতে নয়াদিল্লীর পথে পাড়ি জমান।
বারো অনুচ্ছেদের এই চুক্তির অনেকটুকু নিয়োজিত হয়েছে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সংস্কৃতি বিনিময়ের নিরীহ অঙ্গীকারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অনুচ্ছেদ ৯, স্বাক্ষরকারী দেশের উপর তৃতীয় পক্ষের হামলা হলে তাৎক্ষণিক “পারস্পরিক পরামর্শের” প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (সর্বসমক্ষে, স্বাক্ষরকারীরা জোর দিয়ে বলেন যে তারা কোনো বিশেষ তৃতীয় পক্ষের কথা মাথায় রেখে এ চুক্তি করেন নি; তবে কারো তেমন সন্দেহ নেই যে এ বর্ণনা প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান, এবং কিছুটা পরোক্ষভাবে চীনকে উদ্দেশ্য করে রাখা হয়েছে )। শব্দচয়ন যদিও নির্দিষ্ট নয়, তথাপি এ অনুচ্ছেদে “পরামর্শের” প্রতিশ্রুতি অবধারিতভাবে অস্ত্র সহায়তার দিকেই জোরাল ইঙ্গিত করে। একজন পর্যবেক্ষক বলেন, “ভারত নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যাতে যুদ্ধ শুরু হলে গোলাবারুদের সরবরাহ ঠিক থাকে।”
মুল্যঃ
এই প্রত্যাশার আশ্বাসে আনন্দে উদ্বেল হচ্ছে ভারত। “আমাদের জন্য এটা নতুন যুগের সূচনা,” একজন ভারতীয় কর্মকর্তা তার উচ্ছাস ব্যক্ত করেন, “জাপান এক পরাশক্তিতে পরিণত হতে পেরেছে কারণ মার্কিনীরা তাকে সুরক্ষা দিয়েছিল, তাই জাপানকে অস্ত্রের জন্য নিজের সংস্থান অপচয় করতে হয়নি। আমরা যেহেতু রাশিয়ার ছাতার নিচে আশ্রয় পেয়েছি, আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে।” কিন্তু আসলেই কি তাই? এ জন্য কি ভারতকে তার “জোটবদ্ধ না হওয়ার নীতি” বিসর্জন দিতে হবে? যদিও মিসেস গান্ধি জনসমক্ষে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থানের উপর এই চুক্তি প্রভাব ফেলবে না; বাস্তবতা হচ্ছে প্রথম বারের মতো ভারত এবং বিশ্বের অন্য একটি পরাশক্তি এমন একটা চুক্তির সমঝোতায় পৌঁছেছে যাতে স্বতন্ত্র সামরিক আভাস রয়েছে। “যেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেটা হলো, ভারত সবসময় নিরপেক্ষ থাকার গর্ব করে এসেছে” দিল্লীতে একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বিশ্লেষণ করেন, “এবার রাশানরা যে অভূতপূর্ব সাফল্য পেল, এভাবে তারা এখানে আরো অনেক মিত্র পেতে পারে।”
তবে স্পষ্টতঃ মস্কো যে কেবল ভারতের কল্যাণেই আগ্রহী তেমন নয়। যেমন গ্রোমইকো স্বয়ং গত সপ্তাহে সোভিয়েতের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে ইঙ্গিত দেন, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির অন্যতম প্রধান কারণ হলো গণচীন। মস্কোতে পশ্চিমা কূটনীতিকদের দৃষ্টিতে, চীন ও আমেরিকার মধ্যেকার “পিং পং কূটনীতি[1]” রাশানদের হতচকিত করেছে, আর রাষ্ট্রপতি নিক্সনের পিকিং সফরের পরিকল্পনা তাদের স্তম্ভিত করেছে। এর মানে এই যে, এশিয়ায় সকল বাজীর পথ রুদ্ধ হলো, এবং ওয়াশিংটন-পিকিং লেনদেনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিলো—এটা রাশানদের অবরুদ্ধ করে ফেলবে এমন একটা অঞ্চলে (এশিয়ায়) যেখানে তারা (প্রতিবেশি দেশের সাথে) খাতির জমানোর অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়েছে। তাই দরকারী মুহূর্তে ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে রাশানরা উপমহাদেশে প্রভাবশালী শক্তি হওয়ার দর হাঁকিয়েছে। অধিকিন্তু এমন একটি পদক্ষেপ সম্ভবতঃ সোভিয়েত নৌবহরকে ভারত মহাসাগরে বিস্তৃত হতে সহায়তা করবে।
পরাজিত পক্ষঃ
গত সপ্তাহে সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় বিজয়ের সামনে আমেরিকাকে অনেকখানি পরাজিত দেখাচ্ছে। আমেরিকার চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা ভারতের রাশান শিবিরের প্রতি পরিচালিত হওয়ার জন্য আংশিকভাবে দায়ী। গত মাসে গোপন মিশনে পিকিং যাবার পথে ভারতে কিসিঞ্জারের যাত্রাবিরতির প্রতি ইঙ্গিত করে নয়া দিল্লীর একজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, “আমরা ভেবেছিলাম উনি (কিসিঞ্জার) স্বাধীনতার পর থেকে উপমহাদেশ যে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেদিকে দৃষ্টি দিতে এই এলাকায় এসেছেন। তিনি আমাদের কথা যত্ন নিয়ে শুনলেন। অথচ পুরোটা সময় জুড়ে তার মাথায় ছিল চীন। তার সফরটাই ছিল একটা ছল।”
উপরন্তু, পাকিস্তানকে আমেরিকার অব্যাহত সাহায্য ও অস্ত্র প্রদান ভারতে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। “আপনি যদি জানতে চান কেন (ইন্দো-সোভিয়েত) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে,” মস্কোতে একজন ভারতীয় কূটনীতিক জানান, “আমি আপনাকে বলবো, মার্কিনীরা (পাকিস্তানকে) অস্ত্রের চালান দিয়ে আমাদের এর দিকে ঠেলে দিয়েছে।” বর্তমানে সত্যিই ভারত আমেরিকার কৌশলগত হিসাব নিকাশে পাকিস্তানের চেয়ে কম গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে যদিও নিক্সন প্রশাসন ইয়াহিয়া খানের সাথে সৌজন্য সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ বাড়িয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে, পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি একেবারেই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না।
বাঙালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার স্থগিত করা বা বাদ দেয়ার মার্কিন আহ্বান স্বত্বেও ইয়াহিয়া গত সপ্তাহে দক্ষিণ পাঞ্জাবের বস্ত্র নগর লিয়ালপুর[2]-এর কাছে এক কারাগারে তিন সদস্য বিশিষ্ট সামরিক আদালতে গোপন বিচার সম্পাদনে অগ্রসর হন। ইয়াহিয়া এর মধ্যে জনসমক্ষে বলেছেন যে মুজিব বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত। একজন পাকিস্তানী সম্পাদক মন্তব্য করেন, “একইসাথে রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক প্রশাসনের প্রধান এমন একটা লোক যখন কাউকে দোষী বলে সব্যস্ত করে, তখন আপনি আশা একরকম ছেড়ে দিতে পারেন যে কয়জন সামরিক কর্মকর্তা তাকে নির্দোষ পাবে”। এটা ব্যাপকভাবে ভাবা হচ্ছে যে, আদালত মুজিবকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করবে, যাতে করে ইয়াহিয়া ইচ্ছেমতো রায় বহাল রাখা অথবা মহান সেজে শত্রুকে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ পান।
তবে মুজিবের সমব্যথীরা আশাবাদী হতে পারছেন না। “এই মানুষটাকে হত্যা না করা যৌক্তিক হতো—আশেপাশে রাখা যেত যদি কখনো মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে”, বলেন ইসলামাবাদের একজন পশ্চিমা কূটনীতিক, “কিন্তু তাকে বিচারের সম্মুখীন না করাটাও যৌক্তিক ছিল, যেমন যুক্তিসংগত ছিল শুরুতে তাকে গ্রেফতারই না করা। তবে এ সরকার এতদিন যৌক্তিক ও ন্যায্য উপায় প্রত্যাখ্যানে যেমন লক্ষণীয় কৃতিত্ব দেখিয়েছে, আবারো সেটা করতেই পারে।”
ইয়াহিয়ার কর্মকাণ্ড একজন মার্কিন কূটনীতিককে খেপিয়ে তুলেছে; “ইয়াহিয়া একটা বোকার হদ্দ!” আমেরিকা বর্তমানে যে পথে চলছে, হোয়াইট হাউজের নির্দেশ অনুযায়ী সে পথেই চলবে এমনটাই এখনো শোনা যাচ্ছে। “আমরাই একমাত্র পশ্চিমা সরকার যাদের ইয়াহিয়াকে প্রভাবিত করার কোনো রকম আশা আছে,” স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর একজন কর্মকর্তা যুক্তি দেখান, “খোলাখুলি বলতে গেলে, আমি মনে করি একটা পরিবর্তনের জন্য আমাদের যথেষ্ট বাস্তবধর্মী কর্মপন্থা আছে।” এরপর তিনি বিষন্ন কন্ঠে যোগ করেন, “কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এ নিয়ে কাজ করা কঠিন হবে।”
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮৫। শরণার্থীরা বলেন সৈন্যরা হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে | নিউইয়র্ক টাইম্স |
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
|
<১৪, ৮৫, ২০৯-২১০>
নিউইয়র্ক টাইম্স, ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাঙালি শরণার্থীরা বলেন, সৈন্যরা হত্যা, লুটতরাজ, এবং অগ্নিসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে
সিডনী এইচ. শ্যানবার্গ
কুঠিবাড়ী, ভারত। সেপ্টেম্বর ২১। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক শরণার্থীরা জানান যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের অসামরিক সহযোগীরা হত্যা, লুটতরাজ, ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রেখেছে; যদিও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার এবং বাঙালীদের আস্থা অর্জনে ইচ্ছুক।
এই প্রতিবেদক আজ বেশ কিছু শরণার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, যারা সবাই গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে এসেছেন। তাদের বর্ণনায় পাকিস্তানী সেনাসদস্য (যাদের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানই) কর্তৃক অসামারিক গণহত্যা, ধর্ষণ, এবং অন্যান্য নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে।
যখন সীমান্ত থেকে চার মাইল, আর কলকাতা থেকে ৬০ মাইল উত্তরপূর্বের এই গ্রামে জনাকীর্ণ, অর্ধ-প্লাবিত উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে শরণার্থীরা এসব কথা বলছিলেন, তখনো দিগন্ত থেকে বোমা বর্ষণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। এটা বলা সম্ভব ছিল না যে, ঠিক কারা গোলাবর্ষণ করছে–পাকিস্তানী বাহিনী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী, না কি তথাকথিত “বাংলাদেশ” এর মুক্তিবাহিনী। এই নামটি বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পূর্ব পাকিস্তানকে দিয়েছে মার্চ মাস থেকে, যখন তাদের আন্দোলনকে রুদ্ধ করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল।
সাক্ষাৎকার নেয়া অধিকাংশ শরণার্থী এসেছেন ফরিদপুর অঞ্চল থেকে, যেখানে বাঙালীর কারারুদ্ধ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের পারিবারিক নিবাস।
প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী
শরণার্থীরা বলেন, যদিও সব মিলিয়ে জীবনযাপন পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কঠিন ছিল, গণহত্যা না হলে তারা সেখানেই থেকে যেতেন। সম্প্রতি আগমনকারী প্রায় সবাই হিন্দু। তারা জানান, সামরিক সরকার হিন্দু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করেছে।
তারা আরও বলেন, তাদের এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা সক্রিয় ছিলেন, এবং প্রত্যেক গেরিলা হামলার পর সেনাবাহিনী অসামারিক লোকজনের উপর কঠিন প্রতিশোধ নিয়েছে।
নিরা পদ সাহা, ফরিদপুর জেলার একজন পাট ব্যবসায়ী, তার নিজের গ্রামের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে নির্যাতনের বিবরণ দেন। গ্রামটি গেরিলা যোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল। পাঁচ দিন পূর্বে তিনি পালিয়ে আসার আগে আগে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামে হানা দেয়, প্রথমে গোলাবর্ষণ করে এবং পরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
“গ্রামের কিছু মানুষ যথেষ্ট তাড়াতাড়ি পালাতে পারেনি”, তিনি বলেন, “পাকিস্তানী সেনারা তাদের ধরে ফেলে, এবং হাত পা বেঁধে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে।”
জনাব সাহা জানান, গ্রামে প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু। এখন আর কোন ঘরবাড়ি অবশিষ্ট নেই।
নোংরা কাজগুলো করে অন্য কিছু মানুষ
শরণার্থীদের বর্ণনা অনুযায়ী, পাক সেনারা বেশিভাগ “নোংরা কাজ” ছেড়ে দিত তাদের অসামরিক দোসর রাজাকার (তথা, দেশরক্ষী)- যাদেরকে অস্ত্রও দেয়া হতো– এবং তাদের সমমনা ডানপন্থী ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের জন্য (যেমন, মুসলিম লীগ এবং জামায়াত-ই-ইসলামী, যারা সামরিক শাসন সমর্থন করেছিল)।
এসব সহযোগীরা গুপ্তচরবৃত্তি এবং সৈন্যদের নির্দেশ পালনে নিয়োজিত ছিল। শরণার্থীরা বলেন, এরা সৈন্যদের দেখিয়ে দিত যে কোন বাড়ি, গ্রাম, বা ব্যক্তি গেরিলা যোদ্ধাদের সহায়তা করেছে। অনেক সময়, শরণার্থীরা যোগ করেন, এই সহযোগীরা কোন কারণ ছাড়াই ইচ্ছেমত যাকে তাকে ধরে নিয়ে যেত।
দীপক কুমার বিশ্বাস, বরিশালের একজন বেতার মেরামতকারী, উল্লেখ করেন, “রাজাকার এবং অন্যরা একটা গ্রামে আসে, যেকোনো বাড়ি নির্বাচন করে, এবং সেখানকার সমর্থ যুবকদের ধরে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর সৈন্যরা তাদের কি করে জানিনা, তবে তারা আর কখনো ঘরে ফেরত আসেনা।”
শরণার্থীরা আরো জানান, নির্যাতন এবং গুপ্তচরদের ভয় থাকা সত্বেও স্থানীয় লোকজন গেরিলা যোদ্ধাদের খাবার, তথ্য, এবং আশ্রয় দেয়া অব্যাহত রেখেছে।
মাখন লাল তালুকদার, একজন ধানচাষি, জানালেন কিছুদিন পূর্বে তিনি পালিয়ে আসার আগে কয়েকজন রাজাকার একটি সাপ্তাহিক বাজারে জমায়েত মানুষের উপর হামলা করে এবং সরাসরি গুলিবর্ষণ করে। এতে ছয়জন মানুষ মারা যায় এবং অনেকে আহত হয়।
শরণার্থীদের আগমন থেমে নেই
জনাব তালুকদার তার আট সদস্যের পরিবার নিয়ে ভারত চলে এসেছেন, কিন্তু তার বাবাকে দেশে লুকিয়ে রেখে আসতে হয়েছে। দীর্ঘ পথ হাঁটার মতো বয়স তার নেই।
জনাব তালুকদার বলেন, বাজারের সেই ঘটনার পর তার এলাকা থেকে প্রায় পনের হাজার মানুষ ভারতে পালিয়ে আসেন। মোটামুটি বিশ থেকে ত্রিশ হাজার শরণার্থী প্রতিদিন ভারতে অনুপ্রবেশ করছেন এবং ইতিমধ্যে সেখানে অবস্থানকারী (সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী) ৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন শরণার্থীদের সাথে যোগদান করছেন।
পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, শরণার্থীদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ফেরত যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গেরিলা যোদ্ধাদের সাধারণ ক্ষমা করারও প্রস্তাব দেন।
কিন্তু তার এই প্রতিশ্রুতি শরণার্থীদের কেবল তিক্ত হাস্যরসের উদ্রেক করে। “আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পালিয়েছি,” বলেন রাজেন্দ্র দাস, আরেকজন কৃষক, “ওরা এখনো আমাদের হত্যা করে চলেছে। পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ না করা পর্যন্ত আমরা আর ফেরত যাচ্ছি না।”
উদ্বাস্তু এলাকায় যদিও চালের কিছুটা সংকট বিরাজমান যা এর ৪০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে, অন্যান্য খাবার অঢেল রয়েছে বলে বলা হচ্ছে। তথাপি শরণার্থীরা জানান, কাজ এবং অর্থের অভাবে অনেককে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।
পাক সেনাদের আক্রমণের শুরু থেকেই অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কঠিন আঘাত করেছে কৃষি শ্রমিক এবং সরকারি গণপূর্ত প্রকল্পের অধীন মজুরদের। এসব প্রকল্পের অধিকাংশই থমকে গিয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮৬। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা | বাল্টিমোর সান | ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
<১৪, ৮৬, ২১১>
বাল্টিমোর সান, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা
পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণের ছয় মাস হয়ে গেছে। এই বর্বরতার ফল প্রবল ভাবে অনুভূত হচ্ছে, এবং অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এই অভ্যন্তরীন জটিলতা জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ব্যাপারটি তাদের আলোচ্যসূচিতে স্থান করে নেয়ার পাশাপাশি সাধারণ সভার অন্যতম মূল বিতর্ক হিসেবে আবির্ভূত হলো।
সোমবার বিতর্ক রীতিমত বাকযুদ্ধে রূপ নিলো ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরণ সিং এবং পাকিস্তানের আগা শাহী ও মোহাম্মদ আলির মধ্যে। সরণ শিং তীব্রভাবে আক্রমণ করলেন তাদের। পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলায় (আদতে তখন সেটা ছিলো পূর্ব পাকিস্তান) ভয়াল এবং কড়াল এক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে দায়ী করলেন, এবং তাদের ভয়ানক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিলেন। পূর্ব বাংলার জন গণ নির্বাচিত সরকারকে মেনে না নেয়া, এবং জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাসন দণ্ড দেয়া পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারকে তিনি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অবিহিত করেন, এবং যথারীতি পশ্চিম পাকিস্তানী মহল তা মেনে নিতে অস্বীকার করে।
আগা শাহী দাবী করেন সরণ সিংয়ের বক্তব্য বাতিল করা হোক, কারণ তিনি অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। এদিকে মোহাম্মদ আলি তা বলেন আরো কেতা মেনে, আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে। তার অভিযোগ ছিলো ইন্ডিয়া পূর্ব বাংলাকে একটি সুপরিকল্পিত সামরিক প্রচেষ্টা দ্বারা বিভক্ত করতে চাচ্ছে।
এসব কথার মাধ্যমে প্রকারান্তরে পশ্চিম পাকিস্তান নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ করছিলো। এ কথা সত্য যে, মার্চের ঘটনার পর ইন্ডিয়ার কিছু অংশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশ করেছিলো। এও সত্য, পরবর্তী মাসগুলোতে কিছু আকস্মিক সামরিক পরিকল্পনাও তাদের তরফ থেকে এসেছিলো। কিন্তু এসব কিছু থেকে ইন্ডিয়াকে পাকিস্তানের সরকার পতনের চক্রান্তে লিপ্ত বলে দাবী করাটা ছিলো একদমই অর্থহীন । প্রায় আশি লক্ষ উদ্বাস্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়ে নিরাপত্তার আশায় ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলো; এটাই ছিলো তাদের পাকিস্তানবিরোধী অবস্থানের প্রধান কারণ।
এসব কারণেই ইন্ডিয়া এবং বহির্বিশ্বের আরো অনেক দেশের কাছে পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্রেফ “অভ্যন্তরীণ দন্দ্ব” হিসেবে গণ্য হয় নি, এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনাপ্রবাহকে বদলাতে পারে নি।
<১৪, ৮৯, ২৪৭–২৪৮>
দ্যা সানডে স্টার (ওয়াশিংটন) ৩রা অক্টোবর, ১৯৭১
ভারতে, তারা নিরাপদ এবং অবস্থা করছে , তারা কি থাকবে নাকি ফিরে যাবে
নিউ দিল্লী থেকে জন ই ফ্রেজার
পুর্ব পাকিস্তান থেকে ভীত সন্ত্রস্ত শরনার্থীদের প্রথম দলটি আসার ৬ মাস হয়ে গেছে। ছয় মাস পরে, মার্চে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলো, “‘তারা ফিরে যাবে, তারা অবশ্যই ফিরে যাবে””। কিন্ত বাস্তবতা এখন ভিন্ন। ৮৩ লক্ষ শরনার্থীদের মধ্যে প্রায় ১,৫০,০০০ জন ফিরে যাচ্ছে না, এবং তারা আরো ৬ মাস বা তারও পরে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
এমনকি, এখনো অনেকেই সড়ক এবং নদী পথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে, যার বর্তমান সংখ্যা প্রতি দিন গড়ে ১৪ হাজার করে অব্যাহত আছে, ক্ষুদা, ভয়, এবং গেরিলা যুদ্ধের ভয়াবহতা তাদের এদিকে আসতে বাধ্য করছে।
স্পম্প্রতি, আমি ভারতের একটা উচু ভুমি থেকে পূর্ব পাকিস্তানের একটি ছোট নদীর দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম যে আরো নতুন একদল আসছে।
৩০০ গজের মতো দূরেও নয়, এমন জলাভুমি তে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম এক মাঝি একটি লম্বা দেশি নৌকা বেয়ে এদিকে আসছে। বিবর্ণ নৌকায় গাদাগাদি করে বসা এক হিন্দু পরিবার, যেখানে ১০-১২ জন মহীলা, বাচ্চা কাচ্চা, ২ জন পুরুষ লোক, একটি টিনের ট্রাংকে তাদের কাপড়, কিছু ঝুলন্ত তৈজসপত্র এবং জলাভুমির ভেতর দিয়ে পালিয়ে আসার কারনে মহীলাদের পরনের শাড়ি গুলো ছিল কোমর পর্যন্ত ভেজা।
শিক্ষা এবং পশ্চিম বঙ্গ বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রয় কিছু দিন আগে কলকাতায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন “আমরা একজন মানুষকেও রাখার কথা ভাবছি না”।
কিন্তু সবুজ ধানক্ষেতের পাশে খড়ের কুঁড়ে ঘরে অথবা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে পলিথিনে মোড়ানো তাঁবুতে বসবাসকারী সেই হিন্দু পরিবারেরা আর লাখ লাখ শরণার্থীরা অন্যভাবে চিন্তা করছে,তারা থেকে যাবে।
সেগুলো মোটেও আরামদায়ক ছিল না, তারা ক্যাম্পের মধ্যে সার্ডিন মাছের মত গাদাগাদি করে থাকতো আর স্বাস্থ্যব্যাবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। কিন্ত, খাওয়ার জন্য তাদের ( শুধুমাত্র প্রোটিনের দরকার এমন শিশু ও দাই মা ছাড়া) পর্যাপ্ত পরিমানের খাবার ছিলো, আসলে যা ৫০ লক্ষ ভারতীয়রা খায় এবং তারা নিরাপদ।
এই কারনেই তারা ভারতে থাকতে চায় এবং তারা এখানে নিরাপদ।
কিন্তু এমন অবস্থার মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য ৮৩ লক্ষ বহিরাগতদের আশ্রয় দেয়ার পরিনতি মোকাবেলা করার সাহস ভারতের নেই। শুধু একলাই এই অর্থ খরচের পরিমান ( এর কিছু অংশ জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উৎস থেকেও সংগৃহিত) মোটামুটি ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি যা ভারতের ১ বছরের সম্পদের ও বেশি ।
আর সরকার আক্রান্ত ৪ এলাকার পশ্চিম বঙ্গ,আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের সব জায়গায় কাজ করেছিলো, তা স্থগিত করে দেয়া হয়েছে।
“আমাদের ১৯৭১-৭২ সালের উন্নয়ন কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি” – বললেন পশ্চিম বঙ্গ সরকারের প্রধান সচিব এন সি গুপ্ত। “সবাই এখন শরনার্থীদের নিয়ে কাজ করছে”
আজ হোক কাল হোক , ভারত কে একটা কঠিন সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
প্রথমত পালিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে হবে, অনভিপ্রেত সত্য হচ্ছে এই যে, পাকিস্তান ভারতের প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষের উপর অত্যাচার করতে সক্ষম হয়েছে, যার শতকরা ৯০ জনই হচ্ছে হিন্দু, যাদের অনেকেই কোনদিন ফিরে যাবে না, অনেক বছর আগে ইউরোপের পোল এবং হোয়াইট রাশিয়ান দের সাথে যেমনটা হয়েছিলো, এরাও ভারতের ২৮ টি অংগরাজ্য ও সার্বভৌম ভুখন্ডের সাথে মিশে গেলেই ভালো হবে।
প্রকাশ্যে, ভারত এই সমস্যা সমাধান করতে রাজি নয়।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা, ভারত প্রচ্ছন্ন ভাবে মুক্তি বাহিনী কে সাহায্য করবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তানী সেনাদের উৎখাত করে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করাএবং এটাই হবে শরনার্থীদের দ্রুত ফিরে যাবার পথ পরিষ্কার করা।
এবং জনসম্মুখে কেউ এটা বলে নাই যে এটাই ভারতের লক্ষ্য। যাই হোক, লক্ষন এমন নয় যে, ভারত এমন কোন সমাধানে আসবে।
এটা একটা ওপেন সিক্রেট যে, মুক্তি বাহিনীর জন্য অস্ত্র এবং প্রশিক্ষন ভারতের একটি অংশ থেকেই আসছে। নিউ দিল্লী তে ৩রা সেপ্টেম্বর প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন যে, কোন শক্তির পক্ষে বাংলাদেশের ( বাঙালি জাতির) এই আন্দোলন দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়/
এই মাসের প্রথম দিকে, এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর এবং বৈদেশিক নীতি মন্ত্রনালয়ের সাবেক প্রধান সচিব আর কে নেহেরু বলেছিলেন, “ব্যাক্তিগত কণ্ঠগুলো খুব জোরালো। বাংলাদেশের এই বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি আদর্শ সুযোগ এনে দিয়েছে পাকিস্তান কে আলাদা করে ফেলার।
স্বভাবতই যে, পাকিস্তান কখনোই এরকম বিকল্পের জন্য বসে থাকবে না, মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধ যত বাড়বে, তত বেশী ভিয়েতনামের মত গেরিলা যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা তত বাড়বে আর ভারতে নিত্য নতুন শরনার্থী প্রবেশের সংখ্যাও বাড়বে।
সেখানে এখনো ৩য় একটি সম্ভাবনা ও আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি একটি মীমাংসার মাধ্যমে সম্পূর্ন স্বাধীনতা প্রাপ্তির সংক্ষিপ্ত রুপ” দুই মাস পূর্বে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একজন কর্মকর্তা একথা বলেন।
কখনো কখনো সম্ভবত বিশৃংখলার পূর্বে এমনটা হতে পারে। কিন্তু তারপরেও কি শরনার্থীরা ফিরে যাবে? এই বিষয়ে, কেউ কিছুই জানে না।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯০। পাকিস্তান ভারতের উপর যুদ্ধের ছায়া | নিউজ ডে | ১০ অক্টোবর ১৯১৭ |
<১৪, ৯০, ২১৭-২১৮>
নিউজ ডে ১০ অক্টোবর ১৯৭১
পাকিস্তান ভারতের উপর যুদ্ধের ছায়া
পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে প্রায় ছয় মাস। এবং এর ফলাফল ঐতিহাসিক। কয়েক লক্ষ বেসামরিক বাঙালি নিহত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ধ্বংস চলছে। এবং প্রায় ৮ মিলিয়ন উদ্বাস্তু ভারতের ওপর অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত চাপ তৈরি করেছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ অবস্থা প্রায় আসন্ন।
পাকিস্তান বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করেছে – তারা আবেদন করেছে যাতে তাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি সুরাহা হয়। দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্য কিছু দেশে এই দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্ততায় ভূমিকা রাখবে।
মাহমুদ আলী – জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রধান প্রতিনিধি – বুধবার অভিযুক্ত করেন যে ভারত ইতিমধ্যে তার দেশের বিরুদ্ধে একটি গোপন যুদ্ধ আবহ তৈরি করেছে । ওদিকে ভারত বলেছে পাকিস্তান ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় শেলিং করছে।
তিনি অভিযোগ করেন ভারতীয় বাহিনী সিলেট জেলার সীমান্ত গ্রামে “প্রায় ১০০০ সেল” নিক্ষেপ করেছে যাতে ২৮ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছে। আরও বলা হয় ভারতীয়রা খাদ্য বহনকারী জাহাজের উপর বিস্ফোরক চার্জ স্থাপন করেছে যেখানে ৭০ মিলিয়ন লোক দুর্ভিক্ষ মুখে পড়েছে।
ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগে তিনি শরনার্থি সমস্যা নিয়ে কোন কথা না বলে কীভাবে সেনাবাহিনী দিয়ে দুই পাকিস্তানকে এক রাখা যায় সেটা নিয়ে কথা বলেন।
১৯৪৭ এ ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, মাঝে ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে ১০০০ মাইলের দূরত্বে অবস্থিত, যারা মুসলমান ধর্ম দ্বারা আবদ্ধ আছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশই বাঙালি, এবং জাতিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে ভিন্ন। এবং ১৩৭ মিলিয়ন এর অর্ধেকের বেশী জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তান এই অংশের প্রাধান্য বজায় রেখেছে। এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
গৃহযুদ্ধ আর গণহত্যার ফলে, এই অঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধ্বসের দিকে যাচ্ছে। এবং ভারতের উপর উদ্বাস্তু সমস্যা আরোপিত হচ্ছে যারা নিজেরাই নিজেদের জনসংখ্যার বোঝা নিয়ে সমস্যায় আছেন। এখানে ইরান এবং সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আসা উচিৎ।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি ১ দিনের সফরে তেহরান গিয়েছেন – সেখানে তিনি শাহ রিজা পেল্ভি কে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সমঝোতা করানোর কথা বলেন – ইয়াহিয়া বলেন তার সাথে ইন্দিরা গান্ধী সাক্ষাত করতে অস্বীকৃতি জানান। কিছু সূত্র বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ইতিমধ্যে মধ্যস্থতার এ প্রচেষ্টায় ইরানকে সহায়তা করছে। এবং ধারণা করা হয় যদি ইরান শান্তিরক্ষায় অবদান রাখার চেষ্টা করতে পারে তাহলে বড় বড় ক্ষমতাশীল দেশগুলোও সেই আওতায় পরে এবং তাদেরও এগিয়ে আসা উচিৎ।
এদিকে ইয়াহিয়া সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার কাজ করে যাচ্ছে যদিও তার কোনটাই ভালো পথ নয়।
সে তার দমন নীতি চালিয়ে যেতে পারেন তবে অধিকাংশ বিদেশী পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে সেগুলো ব্যর্থ হবে। এর ফলে ভারতের সাথে যুদ্ধ হতে পারে – যাতে তারা প্রায় নিশ্চিতভাবে হারবে। তারা বাংলার স্বাধীনতা অস্বীকার করতে পারেন এবং নিজস্ব সেনা দিয়ে প্রতিরোধ করতে পারেন – তবে এতে শুধু জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্রোধ জাগিয়ে তোলাই হবে। পূর্ব পাকিস্তানীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার এখন আর তেমন সুযোগ নাই – অনেক রক্ত গিয়েছে- অনেক ক্রোধ জমেছে।
ভয়ানক দৃশ্যের পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন যে, সমস্ত বিকল্প পথের মধ্যে প্রথমটাই ইয়াহিয়ার সরকার অনুসরণ করবেন। তৃতীয়টা বিবেচনার সম্ভবনা কম। কিন্তু দ্বিতীয়টা, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ সমগ্র এশীয় উপমহাদেশকে জ্বালিয়ে দেবে – যা একটি বড় হুমকি। এই ধরনের দ্বন্দ্বে শুধুমাত্র ভারত ও পাকিস্তান নয় বরং তাদের পেছনের বিশ্বশক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়বে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯১। পূর্ব পাকিস্তানের বীভৎস অবস্থা সব আশা ধ্বংস করেছে | নিউইয়র্ক টাইমস | ১১ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯১, ২১৯–২২৩>
নিউইয়র্ক টাইমস, ১১ অক্টোবর, ১৯৭১
ভীতি এবং হতাশায় নিমজ্জিত পূর্ব পাকিস্তানের আশার আলো
ম্যালকম এম. ব্রাউনি
ঢাকা, ১০ অক্টোবর – পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবনে আতঙ্ক স্থায়ী রূপ ধারণের সকল সংকেতই দেখাচ্ছে, এবং সবাই না হলেও বেশির ভাগ ভিনদেশী নাগরিকগণ যারা তাদের সাহায্য করার আশায় এখানে এসেছেন তারাও প্রায় হতাশাগ্রস্ত।
বিশেষ করে ভারতের অবস্থানরত লাখ লাখ নিঃস্ব শরনার্থীর স্রোত পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা বেশ দূরবর্তী বলেই মনে হচ্ছে। বেশির ভাগ সরকার এই শরনার্থী সমস্যাকেই এই উপমহাদেশে বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
ভারত দাবী করেছে , ২৫শে মার্চ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিচ্ছিন্নতাকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে বিদ্যমান সামরিক আতংকের কারণে তার সীমান্ত জুড়ে প্রায় নয় লক্ষ শরনার্থীর স্রোত নেমেছে। ভারতীয়দের মতে এই জনস্রোত ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এর কারণে হয়তো রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
নয়া দিল্লি সরকার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে শরনার্থী সমস্যার জের ধরে শেষ চেষ্টা হিসাবে তারা বলপ্রয়োগে শরণার্থীদের, যাদের সংখ্যাকে পাকিস্তান ভারতীয় সংখ্যার একতৃতীয়াংশ বলে দাবি করেছে, বল প্রয়োগে ভারত ত্যাগে বাধ্য করে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারে। পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য ত্বরিত গতিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে ব্যাপক সৈন্য সমাগমের খবর এখানে এবং ভারতে প্রচারিত হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ এই বিষয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করছে জনদুর্ভোগ কমানো যায় এবং বিশেষত যাতে একটি যুদ্ধ প্রতিহত করা যায়।
ডজনখানেক সরকার তাদের বিশেষজ্ঞ , টেকনিশিয়ান এবং কুটনৈতিকদের নিয়ে পূর্ব –পাকিস্তানের ওপর কাজ করছে। ত্রানকার্য পরিচালনার জন্য কেবল জাতিসংঘেরই ৭৫ জন কর্মকর্তা এখানে আছেন।
শরনার্থীদের পুনরায় দেশে পুনর্বাসনের কৌশল নিয়ে শতাধিক বিদেশী কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে সকলে একটি বিষয়ে একমত যে, পূর্ব-পাকিস্তানকে তার এই সীমাহীন দুর্ভোগ এবং ভীতিকর পরিস্থিতি হতে অবশ্যই উত্তরণ ঘটাতে হবে।
এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ইসলামাবাদে পূর্ব-পাকিস্তানে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনতে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সেসবের মধ্যে অন্যতম –
No Real Progress Discerned
হাজার হাজার রাজনৈতিক সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এবং লাখ লাখ অমুসলিম জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পুলিশ এবং সামরিক আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।
ঢাকায় একটি যৌক্তিক ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যারা ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের ওপর পূর্ব-পাকিস্তানের আস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সম্ভব হবে।
বিশেষ করে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালী জনগোষ্ঠী বন্যা, সাইক্লোন এবং যুদ্ধের কারণে গত বছর সামগ্রিকভাবে দৃশ্যত যে সমস্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেটি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় সরকারের আরও অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।
এখানে কর্মরত অধিকাংশ বিদেশী কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একমত যে এইসব বিষয়ে বাস্তবিকপক্ষে কোন উন্নতিই হয়নি।
বাঙ্গালীদের সাথে গোপনে আলাপে জানা গেছে যে দখলদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যারা অংশ নিয়েছে তাদের বেশির ভাগই পশ্চিম-পাকিস্তানি এবং তাদেরকে সিংহভাগ জনগণ ঘৃণা করে।
বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত একটি প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে ৫৬৩ জন নারীকে সেনাবাহিনী মার্চ এবং এপ্রিল মাসে অপহরণ করে এবং সামরিক বাহিনীর পতিতালয়ে তাদের রাখা হয়। কিন্তু তারা প্রত্যেকে গর্ভবতী হওয়ায় এবং গর্ভধারণের এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় যখন আর গর্ভপাত সম্ভব নয়, তাদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না।
সরকারের একজন মুখপাত্র এই ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করেন এবং যে স্থানে মহিলাদের রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে সে স্থানের নাম প্রকাশ করতে অভিযোগকারীদের চ্যালেঞ্জ জানান। অপরদিকে জানা গেছে অনেক বাংগালী প্রসূতিবিদ এরকম অনেক মেয়ের গর্ভপাত করিয়েছেন যারা পাক হানাদার বাহিনী দ্বারা অপহৃত হয়েছিল এবং তাদের পরে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তিপ্রাপ্ত- দুইজন নাকি তিনজন
উক্ত সংবাদ প্রতিনিধিকে একটি গোপন বৈঠকে একজন কৃষক এমন একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানায়। সামরিক নজরদারি এড়াতে বৈঠকটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে অনুষ্ঠিত হয়। গভীর অস্বস্তির সাথে, পুলিশের ফাঁদে তাকে ফেলা হয়েছে কিনা এই ভয়ে চারদিকে বারবার তাকাতে তাকাতে কৃষকটি জানায়,
“সেনাবাহিনী ১১ এপ্রিল রাতে গ্রামে প্রবেশ করে। একটা টহল দল আমাকে আমার বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে যায় কিছু একটা সনাক্তকরণের জন্য, কিন্তু যখন আমি ঘরে ফিরে আসি, তখন দেখলাম যে আমার বোন নিখোঁজ। আমার প্রতিবেশীর কন্য্, অন্য আরেকজন মেয়েও নিখোঁজ ছিল, এবং সেখানে অন্য একটি হিন্দু পরিবারও ছিল যাদের মেয়েও নিখোঁজ হয়”।
“ মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা আমার বোন এবং প্রতিবেশীর কন্যাকে মুক্ত করে দেয় কিন্তু সেই হিন্দু মেয়েটি আর ফিরে আসেনি। যে দুজন মেয়ে ফিরে এসেছে তারা গর্ভবতী ছিল এবং তাদের সন্তান প্রসব হবে। যে খোলা জায়গায় তাদের রাখা হয়েছিল যেখানে সর্বমোট ২০০ বা ৩০০ মেয়ে ছিল তাদের প্রত্যেকেরই একই পরিণতি হয়েছিল। তারা কাপড় ধোয়ার কাজ করতো এবং দিনে দুই থেকে তিনবার সৈন্যদের মনোরঞ্জন করতে হত”।
কৃষকটি আরো জানায় যে –“ আমার বোনকে কোথায় রাখা হয়েছে সে জানতো না”।
ভিনদেশী নাগরিকরা এবং ঢাকা নিবাসী অনেকে জানিয়েছে যে, তারা স্বচক্ষে দেখেছেন , কোনরকম সনাক্তকরণ ছাড়াই হানাদার বাহিনীর পুলিশেরা যুবতী মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে।
অন্যন্য লোকজনকে গণহারে নির্বিচারে গ্রেফতার করা হচ্ছে যদিও গত মাসে রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেছেন রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য। পাকিস্তানে রাজনৈতিক আস্রয় প্রত্যাশী বিদেশী কূটনৈতিকগণ তার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। যেসব কূটনৈতিকগণ এখন বলছেন সর্বসাধারনের জন্য যে সাধারণক্ষমা তা নিতান্তই লোকদেখানো, তারা আরও জানিয়েছেন, সরকার শুধু গুরুত্বপূর্ণ বন্দীদের মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়নি কেবল, বরং রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, আইনজীবীসহ আরো অনেকের গ্রেফতার প্রক্রিয়া জারী রেখেছে।
একাধিক প্রতিবেদন এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজক্ষমার আওতায় থাকার পরেও অনেককে গ্রেফতারের পর হত্যা করা হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজবন্দী
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজবন্দী, যিনি বিশ্বস্বীকৃত পূর্ব- বাংলার শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা, তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের আওামী লীগ গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন এবং তাঁরই সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা।
বেশীরভাগ কুটনৈতিক এবং বিদেশীদের মতে , যদি শেখ মুজিবের হাতে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় যার জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন তাহলেই পূর্ব-পাকিস্তানের সমস্যাসমূহের জন্য স্থায়ী সমাধানে আসা সম্ভব। কিন্তু তিনি রাজবন্দী অবস্থায় সামরিক বিচারাধীন আছেন যেখানে হয়তো তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
তাঁর পরিবারবর্গ যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ কার্যক্রমের অভিযোগ নেই তাদেরকেও এখানে একরকম অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
এই ধরনের রাজনৈতিক দমন-নীপিড়ন শুধু আওামী লীগের উপরই কেবল না, অন্যান্য রাজনীতিবিদ বা দল যারা সামরিক জান্তার জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে তাদের উপরও বিস্তার করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে অবসরপ্রাপ্ত একজন বিমান বাহিনীর প্রধান কর্তৃক এটি নাটকীয়ভাবে সবার সামনে এসেছে যে তিনি সরকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হবার উদ্দেশ্য বিষয়ক ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রতিনিধি হবার জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন।
অফিসারটি হলেন আসগর খান নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল, যিনি পাকিস্তানের একজন দেশ প্রেমিক এবং রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৫ সালে ভারত- পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধের সময় তিনি বিমান বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন এবং তিনি সবসময় অবিভক্ত পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন।
কর্মসূচি রদ
জনাব আসগর খান , যিনি পশ্চিম-পাকিস্তানি এবং ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আইয়ূব খান সরকারের প্রায় পতনের পেছনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক উন্নয়ন এবং এর জনগণের প্রকৃত রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য একটি শান্তি প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন, কিন্তু তার এই প্রস্তাবনা পুরোপুরিভাবে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন কোন প্রার্থীর পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব না যদি না তিনি গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়ে সর্বসাধারনের কাছে পৌঁছাতে পারেন , তাই তিনি তার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
“আজ পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য একটি কালো দিবস”- তিনি বলেন। “যখন এমনকি আমাকেও একটি সামান্য কর্মসূচীর জন্য মার্শাল ল ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।”।
যখন সামরিক বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তান দখল করে এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে, তখনই নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে অকার্যকর হয়ে যায়। কয়েকজন নির্বাচিত সাংসদ সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সংসদসদস্য পদ ধারণ করেন কিন্তু বেশির ভাগই ভারতে পালিয়ে যান বা গেরিলা যুদ্ধে যোগদান করেন।
জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ঘোষনা দেন যে শুন্য আসনসমূহের জন্য পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকার যোগ্য দল এবং প্রার্থীদের অনুমোদন দিয়েছে যাদের বেশীরভাগ ডানপন্থী এবং মৌলবাদী। পূর্ব –পাকিস্তানে ইতোমধ্যে মুসলমানরা এবং সৈন্যসহ সজ্জিত নানা দল বক্তৃতা প্রদান শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রিত প্রেস রিপোর্টে এটাও বলা হয় যে তারা দুষ্কৃতিকারী এবং ভারতীয় এজেন্টদের ধ্বংস করার জন্য তাদের বক্তৃতায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, এই শব্দগুলো সরকার সাধারণত বাঙ্গালী গেরিলা যোদ্ধাদের বোঝাতে ব্যবহার করে থাকে।
গেরিলারা স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যদের হত্যা করছে, যে কমিটিগুলো মূলত অবাঙ্গালীদের সমন্বয়ে গঠিত এবং যাদের দখলকৃত এলাকার সামরিক প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় রিপোর্টে বলা হয়েছে যে যখন হানাদার বাহিনী কিংবা শান্তিবাহিনীরা আক্রমণের শিকার হয়েছে, সেনাবাহিনী এর প্রতিশোধ হিসাবে সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে, এবং স্থানীয় রিপোর্টে বেশির ভাগ সময় ব্যাপক প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বেশীরভাগ বিদেশী পর্যবেক্ষক এই অভিমত দেন যে, শরনার্থী সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যা সমূহহের কোন সমাধানে আসা যাচ্ছে না এরপরেও প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য এখানে দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে এই সম্ভাবনা খুবই কম যে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘু যারা মার্চ এর ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ হবে, তারা আদৌ ফিরে আসবে।
হানাদার বাহিনীর মূল লক্ষ্য মূলত হিন্দুরা। সেনাদের জ্বালিয়ে দেওয়া হিন্দু পাড়া এবং দোকানপাট গুলো জনশুন্য অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের মন্দিরগুলোও বিধ্বস্ত হয়েছে।
সরকার এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যে, হিন্দুত্বকে আর বেশীদিন পূর্ব-পাকিস্তানে সহ্য করা হবে না। এবং এই সিদ্ধান্তকে আরও পাকাপোক্ত করতে ডঃ এ এম মালিক তার অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রীসভায় কোন হিন্দুকে নিয়োগ প্রদান করেননি।
কেন্দ্রও পরিদর্শন করেননি।
একজন বিদেশী ত্রাণ কর্মী সরকারের সাধারণ ক্ষমার ব্যার্থতার বিষয়ে বলেন যে , “আমরা সরকারের প্রায় ৬০ টির মত উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে আর আগ্রহী নই। এটা স্পষ্ট যে তারা কিছু কিছু এলাকায় অত্যন্ত অল্প সংখ্যায় ফিরে আসছে”।
তিনি আরো যুক্ত করেন “ এক জায়গায় আমরা আবিষ্কার করলাম , উদ্ববাস্তদের মধ্যে সরকারের লোক আছে যারা কি ঘটছে সে সম্পর্কে জানতে যখনি কোন পরিদর্শক আসেন তারা সামনে এসে বাধা প্রদান করে”।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, সামরিক কর্তৃপক্ষ হয়তো আপনাকে বলবে যে ক্যাম্পে ২০০০ উদ্বাস্তু আছে, তারপর আপনি ক্যাম্পে গেলেন এবং দেখা যাবে যে প্রকৃতপক্ষে সে সংখ্যা হয়তো এতোই নগণ্য যে, যদি কর্তৃপক্ষকে উপর্যুপরি প্রশ্ন করা হয় তবে এক পর্যায়ে তারা স্বীকার করবে যে এই সংখ্যা ২০০ এর বেশি নয়।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সার্বজনীন অভিযোগ যে তারা সকল ট্রাক, মোটরগাড়ি , মোটর–লঞ্চ এবং নৌকা দখল করে নিয়েছে যেগুলো খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিদেশী ত্রাণসামগ্রী পরিবহনের যানবাহন না আনা হচ্ছে।
দোষ চাপানো হলো ভারতের উপর
সরকার দাবী করেছে যে সব অথবা বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান হবে যদি ভারতীয়রা পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে আর উস্কানি না দেয় এবং অস্ত্র এবং সৈন্যের অনুপ্রবেশ বন্ধ করে।
পাকিস্তান দাবী করেছে যে, ভারতের যুদ্ধের মনোভাব এই আচরণেই স্পষ্ট যে তারা জাতিসংঘকে পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে একটি শান্তি রক্ষা বাহিনী স্থাপন করতে দিতে আগ্রহী নয় যে বাহিনির মাধ্যমে শরনার্থীরা তাদের ইচ্ছানুযায়ি ভ্রমণ করতে পারে। দুটো দেশ এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
বিদেশী পর্যবেক্ষকগণের মধ্যে বিরাজমান হতাশা অত্যন্ত ভীতিকর।
একজন ত্রাণকার্য্য পরিচালনা বিষেশজ্ঞ অভিমত দেন যে, “পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আসলে কোনভাবেই কারো পক্ষে যে কোন পরিমাণ অর্থ দিয়েই কিছু করা সম্ভব নয়।“ “এই উপমহাদেশের জনসংখ্যা প্রতি প্রজন্মেই দ্বিগুণ হচ্ছে এবং এই পরিস্থিতি দিনদিন খারাপই হবে।“
“এটা আমার একান্ত অনুভূতি”- তিনি আরো যোগ করলেন “আমি জানি আমাদের অনেকেই এমন ভাবেন যে বহির্বিশ্বের এখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া উচিত এবং এখানকার সবকিছুকে তার অনিবার্য পথেই চলতে দেওয়া উচিত”।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯২। সিনেট কতৃক পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব | বাল্টিমোর সান | ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯২, ২২৪–২২৫>
বাল্টিমোর সান, ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
“সিনেট কতৃক পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের প্রস্তাব”
ওয়াশিংটন – সব জায়গায় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বৈদেশিক সাহায্যের অনুরোধ থেকে মিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে, গতকাল সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটি পাকিস্তানকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান স্থগিত রাখতে সম্মত হয়েছে।
ইসরাইলের জন্য একটি বিশেষ ৮৫ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য তহবিল কমিটির নজরে এসেছে। কিন্তু যুদ্ধ সংশোধনী সমাপ্তির উপর আগামী সপ্তাহে সংসদে মতপ্রদান পর্যন্ত ৩৫ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন আইনের চূড়ান্ত কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে।
স্বতন্ত্র সদস্যরা সাংবাদিকদের কাছে তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু সিনেটর জে ডব্লিউ ফুলব্রাইট (ডি. আর্ক), চেয়ারম্যান, এবং কমিটি সহযোগীরা একটি চূড়ান্ত অধিবেশন না হওয়া পর্যন্ত সঠিক পরিমাণ নিশ্চিত করতে অস্বীকার করেছেন, যেটা পরের সপ্তাহে কোন একসময় হতে পারে।
সিনেটরদের সম্পৃক্ততা থাকায় কমিটি সকল ক্ষেত্র তথা সামরিক সহায়তা প্রোগ্রাম, উন্নয়ন ঋণ ও সমর্থন সহায়তায় ২০ শতাংশ বাদ দেয়ার জন্য ভোট দেয়।
সিনেটর ইয়াকুব জাভিটস (আরএনওয়াই) প্রতিবেদন করেন, কমিটি তার নিজস্ব সাধারন ভাগের পর ইসরাইলের জন্য ৮৫ মিলিয়ন ডলার সমর্থন সহায়তা ঋণ যোগ করে।
তিনি এবং সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ (ডি ইডাহো) বলেন, অগ্রগতির লক্ষ্যে মিত্রতার জন্য লাতিন আমেরিকায় ১৫ শতাংশ তহবিল হ্রাসেও কমিটি ভোট দেয়।
চার্চ বলেন, যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসে এই মর্মে প্রত্যায়ন করছেন যে, পাকিস্তান ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি স্থাপন এবং ভারত থেকে শরনার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে তাদের দেশে শান্তিপূর্নভাবে ফিরে যেতে সহযোগিতা করছে, ততক্ষন পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সামরিক, অর্থনৈতিক, অনুদান, ঋণ ও বিক্রয়োত্তর সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার বিধান করা হোক।
জনাব চার্চ বলেন, কেটে নেওয়া অর্থ পাকিস্তান পাইপলাইনের সাহায্যার্থে প্রযোজ্য হবে পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য বরাদ্দ থাকবে।
পাকিস্তানি সাহায্যের ১১৮ মিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহায়তা কর্মসূচির জন্য এবং ৫ মিলিয়ন ডলার অস্ত্রের জন্য।
কম্বোডিয়ার সহয়তায় সর্বোচ্চসীমা বেধে দিতে কমিটি মত প্রদানের একদিন পর ভোট হয়, রাষ্ট্রবিভাগ বলেন এমন পদক্ষেপ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতিদের নিজেদের রক্ষায় সত্যিকার অর্থে হুমকি হতে পারে।
ধারাবাহিক সমভোট
কার্যক্রম কমানোর প্রচেষ্টার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতৃক অন্যজাতিদের সামরিক সাহায্য ৭০৫ মিলিয়ন ডলার থেকে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলারে কমিয়ে নিতে কালকের কর্মসূচি ৬-৬ ধারাবাহিক সমভোটে পরাজিত হয়ে পুনরায় ব্যর্থ হয়।
টাইব্রেকার সিনেটর ক্লিফোর্ড কেস (আরএনজে) বলেন, এই টাকা কেটে নেওয়াতে প্রকৃতপক্ষে লোভীদের বিজয় সূচিত হয়েছে।
“সেখানে এমনও মানুষ আছেন যারা আরও বেশি টাকা কাটতে চেয়েছিলেন”, জনাব কেস বলেন।
“আমি মনে করি দেশের অনুভুতিতে এটা একটা সহনীয় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে, যা সারা পৃথিবীতে খুব বেশী কিছু করার চেষ্টা করতেছিল”, জনাব কেস বলেন।
শতাংশ কেটে নেওয়া বিদেশী সুবিধাভোগীদের তালিকায় কোথায় হ্রাস করতে হবে সে ব্যাপারে পেন্টাগনকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।
ব্যতিক্রম হবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু হ্রাসের ক্ষেত্রে যা পূর্বে কমিটি কতৃক নির্ধারিত হয়েছে।
রাষ্ট্র বিভাগের প্রেস অফিসার, রবার্ট জে ম্যাকক্লোস্কি বলেন, কংগ্রেস অনুসারে সাহায্য তহবিল অথবা কম্বোডিয়ায় আমেরিকান কর্মকর্তার সংখ্যা উপর আরোপিত সর্বোচ্চসীমায় প্রশাসনের মাথা ঘামানো উচিত নয়।
বুধবার কম্বোডিয়াকে এই অর্থবছরে দেওয়া ২৫০ মিলিয়ন ডলার সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য সংক্রান্ত কমিটির মতপ্রদানে সমভোট প্রতিক্রিয়া ছিল।
কম্বোডিয়ায় আমেরিকান বেসামরিক এবং সামরিক ব্যক্তিদের সংখ্যাসীমা ২০০ করার পক্ষে ভোট দিয়েছে কমিটি।
কমিটিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্র সচিব কতৃক বুধবার পাঠানো একটি চিঠির উল্লেখ করে, জন আরউইন ও জনাব ম্যাকক্লোস্কি বলেন, প্রশাসনের মতানুযায়ী ন্যূনতম ৩৩০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রয়োজন।
জনাব ম্যাকক্লোস্কি বলেন, “কাম্বোডিয়ার স্বাধীনতা সুসংহত করতে এই পরিমাণ সাহায্য অপরিহার্য”।
জনাব ম্যাকক্লোস্কি বলেন, জরুরী অবস্থায় প্রয়োজনে আরো সাহায্য প্রদানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কর্তৃত্ব বজায় থাকা আবশ্যক, জনাব আরউইন এ ব্যাপারে তার চিঠিতে তুলে ধরেছেন।
পেন্টাগন সর্বমোট ৪৬টি দেশের কাছে সামরিক সাহায্য তহবিলের জন্য অনুমোদন চেয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯৩ পাকিস্তানের অবস্থা সংকটজনক | ওয়াশিংটন পোষ্ট | ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯৩, ২২৬-২২৭>
ওয়াশিংটন পোষ্ট, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১
“পাকিস্তানের অবস্থা সংকটজনক”
অ্যান্থনি এস্ট্রাচ্যান
জাতিসংঘ, ১৬ই অক্টোবর – ইউএন সুত্রানুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তান সংকটে মানবিক সমস্যা সমাধানে কিছুটা অগ্রগতি হলেও রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে হয়নি, এবং সেখানে এখনো “উন্মত্ত” অবস্থা বিরাজমান।
এই সপ্তাহে শেষ হওয়া রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য ডাকা বার্ষিক ইউএন সাধারন বিতর্কে সাতচল্লিশ জন বক্তা ছিল কিন্তু তাদের কেউই সাধারণ সমাবেশে বা নিরাপত্তা পরিষদের আলোচ্যসূচিতে এই সমস্যাকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
ইউএন কর্মকর্তারা এর পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করেন। এক, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে চীনাদের প্রতিনিধিত্বে জড়িত থাকার সামষ্টিক ক্লান্তি এবং অন্যটা হলো মহাশক্তি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ভয়। গত আগস্টে, “শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য হুমকি” মহাসচিব উ থান্ট এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যক্তিগত আলোচনা থেকে দেখা গেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সমর্থন করছে এবং আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে এবং পরিষদ উ থান্টের উদ্বেগ অনুমোদন করতেও প্রত্যাখ্যান করে।
১১ই অক্টোবর পর্যন্ত, ভারতের হিসাবে অনুমানিক ৯.৩ মিলিয়ন উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। যখন প্রতিদিন আরও হাজার হাজার সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে, পাকিস্তান শরনার্থী সংখ্যা বলছে ২ মিলিয়ন, ইউএন কর্মকর্তারা ৬.৫ থেকে ৮.৫ মিলিয়ন শরনার্থীর পরিপ্রেক্ষিতে ত্রাণসামগ্রী হিসাব করছে।
এখানের কূটনীতিক ও ঢাকায় বিদেশিদের মতে, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের পূর্বশর্ত হলো, ঢাকায় একজন প্রতিনিধি সরকার, পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশ ও সামরিক সন্ত্রাসের পরিসমাপ্তি, এবং সঙ্কটের ক্ষতি নিরাময়ে পাকিস্তান সরকার কতৃক আরো কার্যকর প্রচেষ্টা।
একই সূত্র মতে, ক্ষমার প্রতিশ্রুতি এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান কর্তৃক রাজনৈতিক জীবনের পুনর্জাগরন সত্ত্বেও এসব পূর্বশর্ত পূরণ করা হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে এখানের সূত্রানুযায়ী, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন এতই কম যে এটাকে অতিক্ষুদ্র প্রবাহ বলাও যায়না।
এখানের পর্যবেক্ষকরা সম্প্রতি দু’দেশের মধ্যে সাধারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার ভয় পাচ্ছে। একই সময়ে তারা উল্লেখ করেছেন যে, ভারত এখন পর্যন্ত যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে এমন কিছু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, এটা সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়ন কতৃক বাধা পাওয়ার কারণে। এটা ভারতের মাটি কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারকে আইনসম্মত স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে, এবং এটি গেরিলাদের যৌক্তিক সমর্থন এবং আকাশপথ রক্ষায় অস্বীকৃতি জানায় যা তাদের পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের একটা অংশ বাজেয়াপ্ত করতে সক্ষম হবে।
ভারতীয়রা দৃশ্যত গেরিলাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। গেরিলা মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রেললাইন বিছিন্ন করেছে। প্রতি সপ্তাহে তারা সড়ক এবং সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে। ফ্রগম্যানেরা (ডুবসাতারুরা) পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরে থাকা প্রদেশের জলপথ চলাচলকারী বিদেশী জাহাজ এবং নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এটি পাকিস্তানি অসহায় মানুষদের কাছে ত্রাণ সরবরাহ করতে বাধা দেয়। ঘটনাস্থলে থাকা ইউএন কর্মকর্তাদের মতানুযায়ী, গেরিলারা ইউএন কর্মী বা তাদের কাজে আক্রমন করছেনা, কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে যে ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করা অনুচিত। বিদ্যালয়গুলোতে প্রায়ই ভালো খাবার বিতরণ করা হয়; এটা হয়তো শীঘ্রই আঞ্চলিক খাদ্য ও শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে মৌলিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাহায্য করবে।
ইউএন রিপোর্ট ত্রাণ কার্যক্রমে পাকিস্তান সরকারের সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছে। তবু যখন ইউএন ইস্ট পাকিস্তান রিলিফ অপারেশন (ইউএনপিআরও) প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং ত্রাণসামগ্রীর অবস্থান জানতে বহনযোগ্য রেডিও আনতে চেয়েছিল, উভয়পক্ষের বেসামরিক নাগরিক অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে। তারা ভয় পান যে মুক্তিবাহিনী হয়তো রেডিও কেড়ে নেবে।
ইউএন কর্মকর্তাদের পরিবহন ছাড়া এবং গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে নিতে হয়েছিল, কিন্তু ইউএনইপিআরও (ইউনাইটেড নেশনস ইস্ট পাকিস্তান রিলিফ অপারেশন) পূর্ব পাকিস্তানে ৯০ জন ইউএন কর্মিবৃন্দের মধ্যে মাত্র ১৪ জনকে স্থায়ীভাবে ক্ষেত্রে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানের মার্টিন উলাকুট ঢাকা থেকে রিপোর্ট করেন, খাদ্য বহন করতে আনা ১০০ ইউএনইপিআরও ট্রাকের মাত্র ৩০টি চট্টগ্রাম অংশ ছেড়ে চলে গেছে কারণ অধিকংশ অঞ্চলে যাওয়ার রাস্তা ব্যবহারযোগ্য ছিলনা। তিনি রিপোর্ট করেন যে, ১৭টি উপকূলীয় জাহাজের মাত্র পাঁচটি এবং নয়টি “মিনিবুল্ডার” এর মধ্যে মাত্র সাতটি পৌঁছেছে কিন্তু ইউএন কর্মকর্তারা এখানে দাবি করছে যে সবগুলাই পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছেছে।
ভারত সরকার বিদেশী সাহায্য ছাড়া ত্রাণকার্য (তহবিল বাদে) পরিচালনায় নিজস্ব প্রচেষ্টার দিকে জোর দিচ্ছে। আইজেএন কর্মকর্তারা প্রতিবেদন করেন যে, শরণার্থী শিবিরে তারা লোকজনের জন্য প্রদত্ত খাদ্য এবং আশ্রয় উপকরণ পরিদর্শন করা সুযোগ পেতো যদিও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল নিদারুণ।
কর্মকর্তারা সন্দেহজনক, অবশ্য সেইসব এলাকায় অবস্থা আরো খারাপ যেখানে তাদের পরিদর্শন করতে দেয়া হয়নি। কেউ কেউ উদাহরণও দিচ্ছে এটা দেখানোর জন্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের মত পশ্চিম বাংলায়ও একই সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, ইউএন কতৃক সরবরাহকৃত ১০০০ ট্রাক চালানো এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য ভারতীয়রা মধ্যে প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯৪। বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ | নিউইয়র্ক টাইমস | ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯৪, ২২৮-২২৯>
নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১
“বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ”
সিডনী শনবার্গ
নয়া দিল্লী – বাঙালী বিদ্রোহীদের যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে যেটাকে তারা বাংলাদেশ (বাংলার জাতি) নাম দিয়েছে, বিদেশী কূটনীতিক সেই মুক্তিবাহিনী (মুক্তিবাহিনী) নিয়ে বলেছিলেন, “ভিয়েতকং যদি ছয়মাস পর থেকে ভালো করতে পারে, তাহলে তারা এটাকে একটা উল্লেখযোগ্য সূচনা হিসাবে বিবেচনা করতো।
গত মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাংলা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিল, একটি বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাতখন মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যারা কার্যকর পদক্ষেপে নেমেছে এবং যাদের ভালো যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও অন্ততপক্ষে একটি যুক্তিসঙ্গতভাবে সমন্বিত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে কার্যকর গেরিলা বাহিনীর চেয়ে বেশি।
ভারত অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে এবং পরিষ্কারভাবে, ভারতীয় সাহায্য ছাড়া বিদ্রোহী কার্যক্রমের মাত্রা কখনোই বর্তমান অবস্থায় পৌছাতে পারতোনা। কিন্তু জনগন এবং প্রেরণা পূর্ব পাকিস্তানি এবং এমনকি যদি তারা তাদের নিজেদের মত থাকতো তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদল কতৃক বাংলা প্রতিরোধ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হতো কিনা এটা অনিশ্চিত।
আনুমানিক ৮০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়, পাশাপাশি কয়েক হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ। তারা প্রায় ১০,০০০ রাজাকার নামে পরিচিত অবাঙ্গালী রক্ষিবাহিনীকে জরুরী প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
এই বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা আনুমানিক ৮০,০০০ থেকে ১০০,০০০ এই পরিসীমার মধ্যে; বিদেশী পর্যবেক্ষকরা মনে করেন কম সংখ্যা সম্ভবত বেশি বাস্তবসম্মত। ১৫,০০০ বাঙালি নিয়ে গঠিত হয় পেশাদারি সৈন্যদের প্রধান গ্রুপ, যাদের মধ্যে কিছু উচ্চ-প্রশিক্ষন প্রাপ্ত নয়, তারা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (আধাসামরিক সীমান্ত প্রহরীদল) এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (একটি ভাল প্রশিক্ষিত নিয়মিত ইউনিট বাহিনী) থেকে বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষত্যাগ করেছে। উপরন্তু, আনুমানিক ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ নতুন যোগদানকারীদের বেশিরভাগই বয়স ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে এবং বেশিরভাগই কলেজ শিক্ষার্থীর সাথে অনেক গ্রাম্য ছেলেদেরকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
অনেকে বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও ঘাঁটি এলাকা ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চলে, কিন্তু বাঙালি সৈন্যদলের একটা ক্রমবর্ধমান সংখ্যা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের “স্বাধীন এলাকা” থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এই অঞ্চলগুলো বড় নাহলেও বিস্তৃত হচ্ছে।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু সৈন্যকে নিয়মিত সৈন্যদের মত এবং অন্যদের গেরিলাদের মত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শেষোক্ত দলটি গ্রাম্য পোশাক গ্রহন করেছে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে আছে। যাহোক, প্রাথমিকভাবে অস্ত্রের স্বল্পতা এবং একটা বিরাট সংখ্যক ছেলেরা তাদের অপূর্ণাঙ্গ মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়েই যুদ্ধে অংশগ্রহন করে যা বস্তুত শারীরিক ব্যায়াম ও প্রাথমিক ড্রাইভিং এর তুলনায় কমই এসব কারণে মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি স্বেচ্ছাসেবক আছে।
মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রগুলো অনেক মলিস আছে। কিছু স্টেনগান আছে। হাল্কা মেশিনগান ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, এবং অনেক পুরানো সিঙ্গেল-শট রাইফেলও আছে। ভারি অস্ত্রশস্ত্র হলো হালকা ও মাঝারি মর্টার এবং তারা সংখ্যায় খুবই কম। এসব অস্ত্র বিভিন্নভাবে তৈরি এবং বিভিন্ন সময়ের, কিছু পাকিস্তানী সৈন্যদের থেকে কেড়ে নেওয়া এবং কিছু ভারতীয়দের কতৃক প্রদত্ত – যদিও বাঙালিদের অভিযোগ সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
তবুও এইসব সমস্যা নিয়েও মুক্তিবাহিনী কার্যকরভাবে কিছু এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের উত্ত্যক্ত করেছে এবং এটা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে দিয়েছে। নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানি হতাহত বাড়ছে। গেরিলাদের স্থানীয় অবাঙালি নিয়ে গঠিত “শান্তি কমিটির” সদস্য ও অন্য সহযোগী যারা সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বে এলাকার প্রশাসন চালায় তাদের হত্যা কড়ছে। গেরিলা হতাহতের কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি, কিন্তু ধারণা করা যাচ্ছে সেরকম সংখ্যা কম। তবে, প্রতিটি গেরিলা অভিযানে প্রতিহিংসামূলকভাবে সৈন্যরা পল্লী পোড়াচ্ছে এবং গ্রামবাসীদের হত্যা করছে।
সেতু, সড়ক ও রেল লাইন ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল রেখে সেনাবাহিনীর চলাচল কমাতে সক্ষম হওয়াই গেরিলাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য। এছাড়াও গেরিলা ফ্রগম্যানেরা (ডুবসাতারুরা) প্রায় এক ডজন সমুদ্রগামী জাহাজ, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদেশী, ডুবিয়ে দিয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, যেগুলো বন্দরে নোঙর করেছিল। সাতটি ব্রিটিশ শিপিং লাইন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সকল চলাচল স্থগিত করেছে।
যদিও মুক্তিবাহিনী ছয় মাস আগের থেকে এখন অনেক সমন্বিত, এটা কোন একপাক্ষিক যুদ্ধদল নয়। কিছু প্রো-পীকিং সাম্যবাদি সহ স্প্লিন্টার গ্রুপ তাদের নিজেদের মত করে অপারেশন শুরু করেছে। এক গ্রুপ, ঢাকা থেকে অসাম্যবাদি জঙ্গি ছাত্রদের নেতৃত্বে, ভারতীয় সীমান্তের ত্রিপুরা অঞ্চলে ১৫০০ জনের একটা ঘাটি স্থাপন করেছে। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ আন্দোলন বা বাম আন্দোলনের মধ্যে কোনো গুরুতর বিভক্তির কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
মৌসুমী বৃষ্টিপাত শেষ হবার সাথে সাথে আশা করা যাচ্ছে, মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা উভয়ই পূর্ব পাকিস্তানে তাদের কার্যক্রম বাড়াবে। প্রচন্ডভাবে প্রহরারত মালবাহী ট্রেনের রেলপথ দিয়ে কলকাতা গেছে, পূর্বনির্দিষ্ট মুক্তিবাহিনীর জন্য সামরিক সরবরাহ বহন করে নিয়ে গেছে। এটা ইঙ্গিত করে যে, ভারত সরকার গেরিলাদের অস্ত্র সহায়তার বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছে।
কিন্তু মুক্তিবাহিনী কমান্ডার পূর্ব পাকিস্তানের একটি বৃহদাকার অংশ, যেখানে বাংলাদেশ সরকার (বর্তমানে কলকাতা ভিত্তিক) গঠন করা যেতে পারে, বাজেয়াপ্ত করার সম্মুখ সমরে এর থেকেও বেশি ভারতীয় যৌক্তিক সমর্থন এবং আকাশপথ রক্ষার জন্য চাপ দিতে থাকে। ভারতীয়রা এখনো পর্যন্ত দ্বিধান্বিত কারণ তারা ভাবছে এটি তাৎক্ষনিকভাবে পাকিস্তানের সাথে একটা সাধারন যুদ্ধ সৃষ্টি করবে। গেরিলা যুদ্ধের সকল কার্যকারিতার জন্য বাংলাদেশী নেতাবৃন্দ যুক্তি দেখান, এটার অত্যল্পকালস্থায়ী প্রকৃতি অবশেষে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি প্রতিহিংসার কারণে জনপ্রিয় সমর্থনের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যহত করবে।
“আমরা অনেক গ্রামবাসীর সহানুভূতি হারাবো”, এক উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তা বলেন। “তারা আমাদের বলেন, যদি আপনি আমাদের সমর্থন চান, আপনাকে অবশ্যই পূর্ণদ্যোমে আসতে হবে এবং আমাদের রক্ষা করতে হবে”
—————– সিডনি এইচ শনবার্গ
শিরোনামঃ | সূত্রঃ | তারিখঃ |
৯৫। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতকে সংযত হতে বলেছে।
|
নিউইয়র্ক টাইমস।
|
১৯ অক্টোবর, ১৯৭১।
|
<১৪, ৯৫, ২৩০-২৩১>
দ্য নিয়ইয়র্ক টাইমস। অক্টোবর ১৯, ১৯৭১
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে সীমান্তের প্রতিরোধক কূটনীতিতে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে
– বার্নাড গ্যুরিজম্যান
নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রতি বিশেষ প্রতিবেদন
ওয়াশিংটন, অক্টোবর, ১৮ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয়-পাকিস্তানি সীমান্তের দৃশ্যমান উত্তেজনার এবং দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাল্টাপাল্টি অবস্থানের ব্যাপারে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র, তৃতীয় চার্লস ডব্লিউ ব্রে বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের প্রতিই সীমান্তে বর্তমান পরিস্থিতিতে সংযম প্রদর্শনের জন্য আহ্বান জানিয়েছিল এবং অন্যদেশের সাথেও ‘প্রতিরোধক কূটনীতির একটি ধরণ’ চর্চা করছিল।
কর্মকর্তারা বলেছেন মার্কিন কূটনীতিরা সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, বৃটেনে পৌঁছেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের, তার এবং ভারতের উভয় সীমান্ত থেকে সৈন্যবাহিনী উঠিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেওয়ার, একদিন পরই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
এসোশিয়েটেড প্রেস-পাকিস্তানের একজন প্রতিনিধির বরাতে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান থেকে তখনই সরিয়ে আনবেন যদি ভারত তার সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে উঠিয়ে নেয় এবং সমস্ত অনুপ্রবেশ ও শত্রুতামূলক আচরণ স্থগিত করে। ভারত বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলাদের পূর্ব পাকিস্তানে সাহায্য করছে বলে পাকিস্তান অভিযোগ করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা আছে, পাকিস্তানি নেতা গেল সপ্তাহে ইরানে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি, নিকোলাই ভি পডগর্নি’র সাথে একটা মিটিং এ এই প্রস্তাব পেশ করেছেন।
ওয়াশিংটনে থাকা কর্মকর্তারা যদিও এটা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থাকা ভারতের সীমান্তে তাদের সৈন্যবাহিনীর আকার কতটা বড় তবে এদিকে ইঙ্গিত করেছে যে বাহিনীটা বেশ বড় এবং পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।
“উপমহাদেশে বিরাজমান উত্তেজনা সাথে সাথে সীমান্তের উভয়পাড়ে প্রস্তুত রাখা সৈন্যবাহিনীর ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন আছি”, বলেছেন মিঃ ব্রে।
“আমরা সীমান্তে যেকোনো পরিস্থিতিতে উভয় দেশকে সংযত রাখতে তাদের সরকারের সাথে যোগাযোগ রেখেছি ও রেখে চলেছি।” তিনি বলেন “আমরা অনান্য দেশের সরকারের সাথের এই বিষয়ে যোগাযোগ রাখছি”।
ইয়াহিয়া’র প্রস্তাব গুরুত্ব দিয়েছে
মিঃ ব্রে, ইঙ্গিত করেছেন যে এই অঞ্চলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট শান্তি পরিকল্পনা নেই, তিনি বলেন যে “আমরা এই উত্তেজনা কমানোতে প্রভাব রাখতে সক্ষম যেকোনো পদক্ষেপকেই সমর্থন করি”।
অন্য কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ‘প্রত্যাহার প্রস্তাব’ এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।
তারা ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী করা একটি বিবৃতিকে উল্লেখ করেছে ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, জগজীবন রাম, যিনি বলেছেন যে যদি ভারত আক্রান্ত হত, সে সৈন্যবাহনীর দ্বারা দখলকৃত পাকিস্তানি এলাকাগুলো থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে প্রত্যাহার করত না”।
“যদি পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়েও দেয় আমাদের সৈনিক দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাবে এবং তাদের শহরগুলোকে দখল করে নেবে, এবং কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা তাদের সেসব অধিকৃত জায়গা এলাকা থেকে আমরা তাদের প্রত্যাহারও করব না” মিঃ রাম আরও উল্লেখ করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে চলা এই সংঘর্ষ থামার আগ পর্যন্ত ভারত সীমান্ত থেকে সরে আসবে না, তিনি বলেন।
“ভারত এই ব্যাপারে বৈশ্বিক চাপের কাছে নতী স্বীকার করবে না”।
দুই দেশের মুখপাত্ররাই সতর্ক করে দিয়েছেন যে যুদ্ধের সম্ভাব্যতা বাড়ছে যা পাকিস্তান স্বায়ত্বশাসিত সরকারকে ভেঙ্গে দিতে পারে।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে লাখ লাখ শরনার্থী পাড়ি জমিয়েছে এবং তাঁর সম্পদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। যদিও এখনও ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় নি- কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ওপর তা করার ব্যাপারে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বেশ চাপ আছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯৬। এশিয়ার নাজুক পরিস্থিতি | বাল্টিমোর সান | ১৯ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯৬, ২৩২>
বাল্টিমোর সান, ১৯ অক্টোবর, ১৯৭১
“এশিয়ার নাজুক পরিস্থিতি”
আমরা আশা রাখছি যে, ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবশ্যম্ভাবী দুঃখজনক পরিস্থিতি শুধুমাত্র দৃশ্যত হবে (কার্যত হবেনা) এবং দুটি জাতি পুনরায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অলাভজনক কোন যুদ্ধের মুখোমুখি হবেনা। কিন্তু অবস্থা বিশেষ প্রয়োজন অনুযায়ী নয়া দিল্লী এবং রাওয়ালপিন্ডি যেমন সামরিক প্রস্তুতির ব্যবস্থা গ্রহন করছে তাতে অশুভ লক্ষন দেখা যাচ্ছে।
ভারত কোন যুদ্ধ চায়না কারণ যুদ্ধে খরচ ও মানুষের দুর্ভোগের নতুন অসহনীয় বোঝার সৃষ্টি হয়। যুগোশ্লাভিয়ার পরিদর্শক টিটোর প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি দেন যে, ইন্দিরা যুদ্ধ চায়না কিন্তু নিজেকে রক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, শুধু কার্যত নয় বরং বাস্তব অবস্থান থেকেও, যদিও এটা উল্লেখ করা আবশ্যক ভারতে কেউ কেউ মনে করেন যুদ্ধ এড়ানো যাবে না, এবং যেহেতু অনিবার্য সেহেতু এমন চাওয়াটাই উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই, “পাকিস্তানি সামরিক মহল থেকে যদি আমাদের উপর যুদ্ধ নেমে আসে, আমাদের বাহিনীও সামনে আগাবে এবং শিয়ালকোট ও পশ্চিম সীমান্তের লাহোর শহর দখল করবে, এবং পাকিস্তান অঞ্চল থেকে এই অবস্থা আমরা প্রত্যাহার করবোনা, যাই ঘটুক না কেন” ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর এরুপ মন্তব্য দ্বারা প্রভাবিত নয়।
যেকোন ব্যাপারে, জনাব রাম বলেন, যতদিন বাংলাদেশ বা পূর্ব বাংলা হুমকির সম্মুখীন হবে ততদিন পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী থাকবে। অন্তরের গহীন থেকে আজকের টানাপোড়নের প্রকৃত কারণ হলো নৃশংস পশ্চিম পাকিস্তানি কতৃক গত মার্চে পূর্ব পাকিস্তানিদের দমন, এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সমস্যা যেটা হলো ভারতে নয় মিলিয়ন শরনার্থীর উপস্থিতিসহ প্রতিদিন চল্লিশ হাজার হারে যারা আসছে।
ভারত জোরাজুরি করছে, পাকিস্তান একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে পৌঁছাতে বাধ্য যার অধীনে উদ্বাস্তুদের নিরাপদে ফিরে আসতে পারে। সে ধরনের কোন বন্দোবস্ত দূরবর্তী। উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগ বাঙালি হিন্দু এবং খুব সম্ভব যে শুধুমাত্র এই একটি কারনেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক তাদের প্রস্থানকে অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে অব্যাহতি হিসাবে বিবেচনা করছে। এছাড়াও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের খুব চমৎকার একটা আপোষের প্রস্তাব আছে, যদি ভারত তার নিজস্ব বাহিনী এবং অনুপ্রবেশ ও অন্যান্য প্রতিকূল কর্মকান্ড, যা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে প্রতিকূল কাজ বলে গন্য হবে, থেকে অব্যাহতি দেয় তাহলে সীমান্ত থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সরিয়ে নিবে।
চরনভূমির কারনেই পাকিস্তান যুদ্ধ করতে চায় না। এমনকি শীতকালের আগে যুদ্ধ আসলেও কি হিমালয় বন্ধ করা যাবে, এসব কারণ চীন সীমান্ত নিয়ে ভারতকে অতিরিক্ত ভাবাচ্ছে, পাকিস্তানের নেতাদের অবশ্যই জানা উচিত ভারতের সামরিক বাহিনী কতটা উন্নত, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিখ্যাত শহর (প্রকৃত ও রূপক) লাহোরকে দখল ও ধরে রাখতে প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সেনাবাহিনী কতটা সম্ভাবনাময়। লাহোরের পতনে খুব ছোটখাটো বিশৃঙ্খলা হবে। পশ্চিম পাকিস্তান যদি মরিয়া হয়েও ইচ্ছুক হয়।
ধারনানুযায়ী প্রত্যাশা করা যাচ্ছে এই মুহুর্তে যুদ্ধে জয় আসছেনা। কিন্তু সামরিক বাহিনীর হালচাল যেভাবে বাড়ছে এবং উভয় পক্ষের ক্রম্বর্ধমান উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করছে যেখানে দৈবক্রমে ঘটা যুদ্ধ বন্ধ করা যাবেনা।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯৭। সাহায্য কমিয়ে দেয়া একটি নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত | নিউইয়র্ক টাইমস | ২০ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯৭, ২৩৩>
নিউইয়র্ক টাইমস, ২০ অক্টোবর, ১৯৭১
“সাহায্য কমিয়ে দেয়া একটি নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত”
সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটি আজ থেকে বৈদেশিক সাহায্যের অনুমোদন বিল চিহ্নিত করার চূড়ান্ত কার্য্যক্রম শুরু করেছে যা একটা আক্রমণাত্মক কাজ যেটাকে আরও উপযুক্তভাবে বললে বৈদেশিক সাহায্য কমানোর কাজ। ইতিমধ্যে কমিটি প্রশাসনের ৩.৩ বিলিয়ন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা অনুরোধের ২৫ শতাংশ কমিয়েছে।
সহজলভ্য বিদেশী সাহায্যের মোট তহবিলের ১০ শতাংশ ছেটে ফেলাই হবে কার্যত চলতি অর্থবছরে পরীক্ষামূলক কমিটি বিলের সবচেয়ে নির্দয় বিধান। নিয়মিত সহয়তা জমা হবার পর অন্যান্য বিদেশী সহায়তা কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্রপতি কতৃক পাকিস্তানি শরনার্থীদের জন্য অনুরোধকৃত জরুরী ত্রান থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের উপর ক্রুদ্ধ ও সতর্ক হবার উপযুক্ত কারণ আছে কনগ্রেসের। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান এবং উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনকে বিচারাধীন করার ক্ষেত্রে কমিটির আরেকটি সংশোধনীর ভালো ভিত্তি আছে যা পাকিস্তান সরকারকে সামরিক এবং উন্নয়নমূলক সহয়তা বন্ধের আদেশ দিয়েছে।
কিন্তু ভারতে নয় মিলিয়ন শরনার্থীর অভূতপূর্ব প্রবাহ এবং পূর্ব পাকিস্তান রাজনীতির অভ্যন্তরীণ শত্রুতার ধ্বংসলীলা জন্য মানবিকতা তৈরি হওয়া উচিত। এই চরম দুঃখজনক মানবিক পরিস্থিতি সমস্ত জাতির কাছে অসাধারণ প্রতিক্রিয়া দাবী রাখে। আমেরিকার প্রতিক্রিয়া অকপট এবং উদার হতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদী বৈদেশিক সাহায্যের মাত্রা এবং পরিচালনা নিয়ে কংগ্রেস ও প্রশাসনের মধ্যকার চলমান ঝগড়ার সাথে এধরনের প্রতারনাপূর্ন যোগসাজশ দ্বারা আপোষ করা উচিত হবেনা।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯৮। পাকিস্তান ও ভারতের সৈন্য মুখোমুখি | নিউইয়র্ক টাইমস | ২০ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯৮, ২৩৪-২৩৫>
নিউইয়র্ক টাইমস, ২০ অক্টোবর, ১৯৭১
“পাকিস্তান ও ভারতের সৈন্য মুখোমুখি”
সিডনী শনবার্গ
(নিউইয়র্ক টাইমস’এর বিশেষ সংখ্যা)
নয়া দিল্লি, ১৯শে অক্টোবর – ভারত ও পাকিস্তান সৈন্যরা এখন তাদের সীমান্তে পরস্পর মুখোমুখি। অধিকাংশ পশ্চিমা কূটনীতিকরা এক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে আগ্রহী যে, অন্ততপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদল প্রথম পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয়রা সরে যাচ্ছে।
উচ্চ ভারতীয় সূত্রমতে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে গতমাসে, এবং গত বৃহস্পতিবারের মধ্যে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের সকল পদাতিক সৈন্যবাহিনী এবং সাঁজোয়া বিভাগ সীমান্তে অথবা সীমান্তের লক্ষণীয় দূরত্বের মধ্যে ছিল।
বাধার কারণে কিছু সীমান্ত এলাকায় খালগুলো প্লাবিত হয়েছে এবং আতঙ্কে পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকরা বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা খালি করে দিয়েছে, সেনাবাহিনী ও তাদের নিজস্ব লোকজন কতৃক কয়েকজনকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, সূত্রমতে তাই জানা গেছে।
প্রতিবেদন বলছে, ১৯৬৫ সালে তিন সপ্তাহব্যাপী কাশ্মীর যুদ্ধে পাকিস্তানিরা যেখানে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করেছিল সেখানে বেশকিছু ভারি সেনাদল একজায়গায় জড় হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে ধারণা করা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে চার বা পাঁচটি বিভাগ জোরদার করা হয়েছে
ভারতীয়দেরকেও সীমান্তে তাদের পাশ বরাবর চার বা পাঁচটি বিভাগ রাখতে বলা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান অভিযোগ করেন যে ভারতীয়দের আটটি বিভাগ আছে।
উপরন্তু, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলনে ক্রমবর্ধমান সক্রিয় বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদলকে মানিয়ে নিতে হবে যারা ভারতে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয়স্থল পাচ্ছে।
মার্চ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা আগমন এবং বাংলা বিচ্ছেদ আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় থেকে আনুমানিক মোট সাড়ে নয় মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানি ভারতে পালিয়ে গিয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় ১০০০ মাইল দূরত্বে পশ্চিম পাকিস্তান সংলগ্ন সীমান্তে ভারতের ১২ বা ১৩ বিভাগের স্থান আছে বলে ধারণা করা হয়।
নয়া দিল্লিতে, কোন যুদ্ধ হিস্টিরিয়া বা ভীতি না থাকায় কিছু পরিবার সীমান্ত শহর থেকে বেরিয়ে ব্ল্যাকআউট সহ বেসামরিক প্রতিরক্ষা মহড়া শুরু করেছে।
“তাদের তুলনায় আমরা শক্তিশালী” এটুকু ছাড়া সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে ভারতীয় সূত্র কিছুই প্রকাশ করবেনা। সূত্র জানায়, সীমান্তে ভারতীয় আন্দোলন হয় সম্পূর্ণ অথবা কার্যত সম্পূর্ণ ছিল।
“আমরা এখন বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুত” একজন প্রধান কর্মকর্তা জানান।
এক ভারতীয় সূত্র জানায়, ১৪ই অক্টোবর “ভয়ঙ্কর একটা রাত পার করেছি”। পাকিস্তানিরা ওই রাতে আক্রমনে যেতে পারে এরকম একটা প্রতিবেদন দিনের বেলায় এসেছিল।
“সাধারণ কর্মীরা সারারাত জেগে কাটিয়েছেন, সূত্র জানিয়েছে। প্রতিবেদনটা হয়তো তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে বা পাকিস্তানীরা পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে পারে। আমরা এখন একটু বেশি ঘুমিয়ে নেই, কিন্তু অবস্থা এমন যে এরকম যেকোনো রাতে হতে পারে”।
ভারতীয় সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তারা যেটাকে পাকিস্তান সীমান্ত “উস্কানির” তথা ভারতীয় সীমান্তে শিলিং এবং খনি পোতা, বলে মনে করে সেটার বিরুদ্ধে তাদের সরকার কঠিন অবস্থান নিচ্ছে।
“আমরা ব্যাপক উপস্থিতি দেখিয়েছি কিন্তু সেখানে সরকারে একটা অদম্য প্রতিক্রিয়া আছে”, এক কর্মকর্তা জানান।
যদি এই প্রতিক্রিয়া সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে আসতে পারে, এবং এর ফলে যদি পূর্নমাত্রায় যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হয়, এরুপ জিজ্ঞাসা করা হলে সে বললো, “যদি তাই হয় তাহলে আমাদের এর পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে”।
বিপুল জনগনের উপস্থিতিতে আজ সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে শক্তিশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকে সংযত হবার আহ্বানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।
“পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করবে এটা খুব স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক মনে হচ্ছে” তিনি বললেন। কিন্তু পাকিস্তান তাদের ভারত বিদ্বেষী প্রচারনা ও জিহাদের (পবিত্রযুদ্ধ) আহ্বান জানিয়ে এবং সীমান্ত জুড়ে সৈন্য মোতায়েন করে অবস্থার অবনতি ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করছে। এটা একতরফা ব্যাপার নয়। আপনি মুষ্টিবদ্ধ হাতের সঙ্গে করমর্দন করতে পারবেন না”।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯৯। গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভারত সৈন্য পিছু হটাবে না | লস এঞ্জেলেস টাইমস | ২১ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯৯, ২৩৭-২৩৮>
লস এঞ্জেলেস টাইমস, ২১ অক্টোবর, ১৯৭১
“গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভারত সৈন্য পিছু হটাবে না”
উইলিয়াম জে ড্রামন্ড
নয়া দিল্লি, ১৯শে অক্টোবর – আজ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নৃশংসতা বন্ধ না করা পর্যন্ত ভারত তার সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন কমাবে না।
গত মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে আত্মবিরোধ শুরুর পর থেকে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে, মিসেস গান্ধী ১০০ জনেরও অধিক সাংবাদিকদের জানান যে, তিনি একটি সীমান্ত সেনা প্রত্যাহারের বিষয় অথবা নয় মিলিয়ন উদ্বাস্তু তাদের দেশে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার বিরোধিতা করেছেন।
মিসেস গান্ধীর অবস্থান সীমান্তে সৈন্য জমায়েত কমানো এবং ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে অন্তরায় মুকাবিলা করার কোন পন্থা রাখেনি।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বারবার করে তার বাহিনী কমাতে চেয়েছেন যদি ভারতও অনুরূপ কাজ করে এবং “অনুপ্রবেশ এবং অন্যান্য প্রতিকূল কার্যক্রম বন্ধ রাখে”।
যদিও মিসেস গান্ধী যেমন সীমান্ত পরিস্থিতিকে “গুরুত্বর” হিসাবে বর্ণনা করেন। তিনি ২৪শে অক্টোবর তার বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “আমি বলতে পারি সেনাবাহিনীর এবং ভারতীয় জনগণের হাতে দেশ পুরোপুরি নিরাপদ”।
তিনি ৪ঠা নভেম্বর ওয়াশিংটন পৌছানোর পর, পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতায় কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রচেষ্টায় বিপক্ষে। “কোন দেশ কি বিষয়ে মধ্যস্থতা করবে?” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। যা ইঙ্গিত করে, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদজর্নি দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার সঙ্কট সমাধানের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ভারত সীমানা থেকে তার বাহিনীর কিছু সরাতে সম্মত হবার আগে পাকিস্তানকে কি করতে হবে, জানতে চাইলে মিসেস গান্ধী বললেন।
“প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বাংলাদেশে তাদের নৃশংসতা বন্ধ করতে হবে”।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানকে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যেখানে অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ কার্যালয় চালাবে। তিনি আরো বলেন, গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, ফলাফল হিসাবে এটাকে উপেক্ষা করা যাবে না”।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে মুজিবুর বন্দী এবং একটি গোপন ট্রায়াল হওয়ার কথা জানা যাচ্ছে। পাকবাহিনী ২৫শে মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে ধ্বংস সাধনের পর থেকে তাঁর জঙ্গি অনুসারীরা পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে রত।
মিসেস গান্ধী বলেন, গেরিলা বাহিনীর প্রতি বাংলাদেশের সমগ্র জনসংখ্যার সমর্থন ছিল। তিনি “বাংলাদেশ” (বাংলা জাতি) শব্দটি নিয়মিত ব্যাবহার করছেন, পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের যেটা ব্যবহার করছে।
তিনি দাবি করেন, ভারত “পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া” হিসাবে সঙ্কটে জড়িত ছিল এবং এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ এখন ভারতীয় মাটিতে জীবন যাপন করছে। তিনি বলেন, অতএব, ভারত শরণার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সমাধান দিতে পারেনি।
“সমস্যা পাকিস্তানি সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে। এর সমাধান অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের সাম্প্রতিক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সন্তুষ্ট করতে হবে”, প্রধানমন্ত্রী বলেন। এই সম্পৃক্ততা থেকে ভারতকে সরিয়ে নিতে মিসেস গান্ধীর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এটা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলা অপারেশন চালাচ্ছে ভারতের সাহায্যে এবং সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে।
এদিকে, পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর কমান্ডার “যথাযথ ব্যবস্থা” গ্রহণ করার হুমকি দিয়েছেন। যদি ভারতীয় বিমান “পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন অব্যাহত রাখে”, এপি রিপোর্ট।
বিমান বাহিনীর মুখপাত্র বলেন ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধানের এক বার্তায় এয়ার মার্শাল এ রহিম খান বিবৃতি দেন। শনিবারে রহিম দাবি করেন, ভারতীয় বিমানবাহিনী ক্যানবেরা ভাওয়ালনগরে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে, প্রায় চার মাইল পাকিস্তানের ভেতর ঢুকে পড়ে। এলাকাটি রাজস্থান মরুভূমির কাছে যেখানে উভয় পক্ষ সৈন্যদল মোতায়েন জোরদার করেছে।
বিবৃতি অনুযায়ী বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, ভারত কিছুকাল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে কিন্তু “এই ধরনের লঙ্ঘন আরো বেশি ইচ্ছাকৃত এবং উস্কানিমূলক হয়ে উঠেছে”।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০০। শান্তির প্রতি হুমকি | ওয়াশিংটন পোস্ট | ২২ অক্টোবর ১৯৭১ |
<১৪, ১০০, ২৩৮>
ওয়াশিংটন পোস্ট, ২১ অক্টোবর ১৯৭১
সম্পাদকীয়
শান্তির জন্য হুমকি
এটি একটি পারশপরিক ঘটনা যেখানে এক দিকে, পাকিস্তান প্রায় সম্পূর্ণরূপে অশান্তির জন্য দায়ী, এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে অস্ত্র সরবরাহ, রাজনৈতিক সমর্থন, ত্রাণ সব কিছু দিচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত পার্থক্যের জন্য উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত নয়। বরং পাকিস্তান তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার ফলে সৃষ্ট শরনার্থিদের ভারতে প্রবেশ করার কারণেই এই অশান্তির উদ্ভব।
[1] পিং পং কূটনীতি বলতে সত্তরের দশকের শুরুতে মার্কিন ও চীনা টেবিল টেনিস খেলোয়াড়দের আদান-প্রদানের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের উন্নয়ন বোঝানো হয়েছে। (-অনুবাদক)
[2] বর্তমানে ফয়সালাবাদ (-অনুবাদক)