কায়হান পত্রিকার কয়েকটি প্রতিবেদন | ২৭ জুলাই – ২ আগস্ট ১৯৭১
কায়হান ইন্টারন্যাশনালের আমির তেহেরি সম্প্রতি পাকিস্তানের সপ্তাহব্যাপী সফর করেছেন। তিনি উভয় অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। রাষ্ট্রপতি আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানসহ পাকিস্তানি কিছু নেতাদের সাথে তিনি দেখা করেছেন। এখানে তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতকারের একটি বিবরণ দেন। সাম্প্রতিক ঘটনায় এটাই প্রথম লেখা যখন পাকিস্তান গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ দেখতে সাধারণ একটি বাড়ির মতই। দরজার দিকে সতর্ক সেন্ট্রি আছে। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাপা, ধীর পদক্ষেপে ওয়েটিং রুমেনিয়ে গেলেন। কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার সবুজ লম্বা লনে পায়চারি করছে, ওয়েটাররা ভিজিটরদের কালো কফি পরিবেশন করছে। বিশাল করিডোর আর অফিসে কর্মচারিরা স্মিত হাস্যে কাগজপত্র নিয়ে চলাচল করছেন।
লাল রংয়ের মখমলের গৃহসজ্জা সম্পন্ন প্রেসিডেন্সিয়াল অফিস কর্তৃপক্ষের স্থানও রয়েছে। দেয়ালে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি বিশাল প্রতিকৃতি রয়েছে।
হৃদয়ে সৈনিক
এই কক্ষে যিনি কাজ করেন তিনি একজন চার তারকা জেনারেল। আগা মুহাম্মাদা ইয়াহিয়া খান। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু অন্তরে এখনওএকজন খাঁটি সৈনিক। যে কেউ সহজেই বিগলিত হয়ে যাবে। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক তাঁর অবস্থানে যে কেউ খুশি হবে।
এটাই প্রথম পয়েন্ট যার উপর তিনি জোর দিচ্ছেন। তার কাছের সহকারীরা বন্ধুত্তপূর্ন দর্শানার্থিদের জানায় যে প্রেসিডেন্ট এখনো নিজেকে আর্মি সি ইন সি হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালবাসেন – যখন তিনি কোন ক্লাবে ভিজিট করেন – অথবা কোন প্রদর্শনিতে যান ও অথবা কোন অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যান।
আমরা ইয়াহিয়া খানের সাথে অন্য এক দিন সাক্ষাৎ করেছিলাম যখন তিনি কয়েক দিনের জন্য আবত্যাহাদে ছুটিতে ছিলেন। এটি উত্তর-পশ্চিম পাহাড়ি সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি প্রধান অঞ্চলের একটি যেখান থেকে অনেক বীর সৈন্যের জন্ম হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট কিছু সেনাপ্রধানদের সাথে মিটিং করেন এবং গত গৃহযুদ্ধের অশান্ত ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
৫৬ বছর বয়সী একজন পাঠান সৈন্য – যিনি গভীর আনকোরা স্বরে কথা বলেন – যিনি প্রেসিডেন্সি চান নাই – তাকে যখন পিণ্ডি তে পাঠানো হল তখন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন। এটি ছিল দুই বছর আগের ঘটনা। যখন ইয়াহিয়া খান প্রথম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি আশা করেননি যে একসময় তাকে পূর্ব পাকিস্তানে- তার মতে ভারতের উসকানিতে চলা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন থামাতে সেনাবাহিনী পাঠাতে হবে।
তিনি আমাদের বলেন, “ শুরু থেকেই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য দেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং একটি নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। কিন্তু সে উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত রয়ে গেলো।”
অবাধ নির্বাচন
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সত্যিকারের উদ্যেশ্য ছিল রাজনীতির বাইরে থাকা। আইয়ুব খানের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া এবং পুরনো ও নতুন দলের সমন্বয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অনুমতি প্রদান। এরপরে গত বছর সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক মাসের অনিশ্চয়তার পরে মনে হচ্ছিল যেন পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসছে যেখানে গণতান্ত্রিক দলগুলো একে অপরের সাথে লড়াই করে জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসবে।
কয়েক মাস পরে পূর্ব পাকিস্তানের দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছিল যেটা নিষিদ্ধ করা হয় এবং তার প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কে উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি যারা ভৌগলিকভাবে দেশের পশ্চিম শাখার মধ্যের আসনগুলোতে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভবনা খুব কম।
ইয়াহিয়া খান আমাদের বিষণ্ণ সূরে জানালেন যে “আমি পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য সকল প্রচেষ্টাই নিয়েছি।’ “আমি এই চেয়ারের প্রতি আগ্রহী ছিলাম না এবং প্রথম সুযোগ পেলেই আবার সৈনিক জীবনে ফিরে যাব।’
নৈরাশা ভাব নিয়ে তিনি জানালেন তাকে রাজনীতিবিদরাই নিচে নামিয়েছেন যারা নিজেদের কলহই থামাতে অপারগ। এবং পরবর্তিতে যারা দেশ বিভক্তির চিন্তা করছেন।
মুজিবের সাথে সমঝোতা
তিনি স্মরণ করলেন কিভাবে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আপসে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন শেখের সাথে দেখা করার জন্য এবং যদিও তার পিণ্ডিতে আসা উচিৎ ছিল।
“এমনকি আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, আমি বিশ্বাস করি না সে মানুষ সম্পর্কে কি বলা হচ্ছিল এবং ভেবেছিলাম তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চান।’ আমি জানতাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বৈধ ক্ষোভ ছিল এবং আমি আওয়ামী লিগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে পাকিস্তানকে দুটি পৃথক দেশে বিভক্ত করা হবে না।’
ইয়াহিয়া খান আরো বলেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসনের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিমাপে বৃহত্তম একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তাকে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল কারণ শেখ মুজিব বিচ্ছিন্নতার জন্য একটি পূর্ণ পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।
পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রপতিকে অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তবে কিছু মানুষ ও সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মনে করেন এর জন্য কোন প্রচেষ্টা করা হয়নি।
এবং এখনো ইয়াহিয়া খান মনে করেন যে বেসামরিক সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি আমাদের বলেছেন, তিনি আশা করছেন অক্টোবরে ইরানের রাজতন্ত্রের ২৫০০ তম বার্ষিকীর আগেই এ ধরনের একটি সরকার হবে।
“আমি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত আছি। ‘ তিনি জোর দিয়ে বলেন।
পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচন
এই মুহূর্তে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সিরিজ উপনির্বাচনের ব্যাবস্থা করেছেন যার ভিত্তিতে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের শূন্য সদস্যপদ – যে পদের সদস্যরা ভারতে চলে গেছেন – সেগুলো ভরাট করা হবে। আওয়ামী লীগের ডেপুটি যারা ভারতে পালিয়ে গেছেন ধারণা করা হচ্ছে ১৬৮ জনের মধ্যে এরকম সদস্যদের সংখ্যা ৪০ হবে। তাদের কেউ কেউ হয়ত ফিরে আসবে এবং তাদের আসন ধরে রাখতে সক্ষম হবে – যেহেতু তাদের রাজনৈতিক অপরাধের একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে।
শুধুমাত্র উচ্চ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত অথবা “হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, সহিংসতা ও সশস্ত্র ডাকাতি”তে দোষী সাব্যস্ত মানুষদের ব্যতিক্রম ধরা হয়েছে।
অযোগ্য ডেপুটিরা
প্রেসিডেন্ট একথা প্রত্যাখ্যান করলেন যে অনেক আওয়ামী লীগের ডেপুটিদের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে একটি ঘোষণা খুব শীঘ্রই দেয়া হবে। একটি বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
উপনির্বাচন একদিনে সবে না – কারণ তিনি জানান “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে তিনি আর চাপে ফেলে চান না। যেসকল আওয়ামীলীগ সদস্যরা দোষী প্রমাণিত হন নাই তারা সবাই ভোটে দাড়াতে পারবেন । রাষ্ট্রপতি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পরিদর্শন করতে যাবেন ও উপনির্বাচন আগামী আগস্টে হবে।
একবার সব খালি ভরা হয়ে গেলে জাতীয় পরিষদ অবিলম্বে আহূত হবে। সংবিধান প্রণয়ন এর কাজগুলো শুরু করা হবে এবং একটি সরকার গঠন করতে বলা হবে। একটি বিস্তৃত কাঠামো হিসেবে রাষ্ট্রপতির নিজের উপদেষ্টাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত একটি খসড়া সংবিধান পরিষদে জমা দেওয়া হবে। সমাবেশর ভালোর জন্য যে কোন কিছু করা হবে।
ইয়াহিয়া খান জানালেন খসড়া সংবিধান হবে দলগুলোর দাবির উপর ভিত্তি করে। আমি জানি রাজনীতিবিদরা কি চান এবং আমি আমার উপদেষ্টাদের বলেছি তাদের সব দাবি আমলে নিতে। মনে রাখতে হবে দেশের ঐক্য বজায় রাখার জন্য দরকারি সব ব্যাবস্থা আমাদের নিতে হবে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি কিছু অজনপ্রিয় লোকদের দিয়ে কোন “পুতুল বেসামরিক সরকার” উভয় অঞ্চলে গঠন করবেন কিনা? তিনি বলেন, এটি একটি গুজব এবং একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মনে করেন গুজব ছড়ানো “একটি অপরাধ”।
“আমি গুজবে কান দেই না,” তিনি জোর দিয়ে বলেন। “আমি একজন সৈনিক এবং সবসময় খোলা মনে কথা বলতে পছন্দ করি। আমি ওরকম কোন কৌশল ব্যবহার করি না”।
বেসামরিক সরকার
আমরা জিজ্ঞাসা করলাম তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টির সাহায্যে একটি সরকার গঠন করার ব্যাপারে বিবেচনা করছেন কিনা? তিনি বলেন, ভুট্টোর শুধুমাত্র পশ্চিম অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, কিন্তু একটি বেসামরিক সরকারের ‘দেশের দুই অংশে “প্রতিনিধি থাকা দরকার।
যে কোন ক্ষেত্রে, যদি একটি বেসামরিক সরকার গঠন করা হয় তাহলে সব দল আরেক্টু অপেক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, “আমি চাই পুরো জাতির প্রতিনিধিত্বকারীরা একটি পূর্ণ জাতীয় সমাবেশে উপস্থিত থাকুক।’ “আমি প্রতিনিধি সভায় একটি বেসামরিক সরকার দেখতে পেলে খুশি হব। সেটা না হলে কোন বিশেষ দল বা ব্যাক্তির কাছে ক্ষমতা দেয়া ঠিক হবেনা।
এদিকে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনা অব্যাহত রাখার জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছেন। “আমি একটি সুশীল সরকার গঠনের আসায় অর্থনীতিকে ফেলে রাখতে পারিনা।” বলেন তিনি। “রাজনৈতিক অসুবিধার জন্য জাতীয় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পরে থাকলে চলবে না।’
একবার একটি বেসামরিক সরকার গঠিত হয়ে গেলে নতুন সরকার তাদের ইচ্ছা ও পলিসি মোতাবেক পরিবর্তন করতে পারবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
আমরা প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করলাম যদি আওয়ামী লীগ উপনির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সব আসনে জয়ী হয় তাহলে কই হবে? যদি তারা আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং তারা যদি একই নীতি অবলম্বন করে – অর্থাৎ সেনাবাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী তারা যদি দেশ ভাগ্যের পরিকল্পনায় থাকে তাহলে কি হবে?
তিনি জবাব দিলেন যে, আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে “ভীতিপ্রদর্শন, সন্ত্রাস এবং অপকর্ম” করে জয়ী হয়েছিল। আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম শেখ মুজিবের দল যেহেতু সব নষ্ট করছিল তাহলে তখন আপনারা নির্বাচন বন্ধ করেন নাই কেন?
নির্বাচনে প্রতিটি দেশেই দুর্নিতি হয় – এমনকি অনেক আধুনিক দেশেও – প্রেসিডেন্ট জবাব দিলেন। যেকরেই হোক সেই সময়ে তার কাছে আওয়ামীলীগ সম্পর্কে সেরকম তথ্য আসেনি। এখন আমরা বুঝতে পেরেছি প্রত্যেকটা আসনে জয়লাভ করার জন্য মুজিব কি কি করেছেন। বেশিরভাগ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন কারণ তাদের ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস কেউ পায়নি। তিনি মূলত পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভোটে জিতেছেন। ২০% এর বেশি মুসলমান ভোটার তার দলের লোকদের সাথে ছিলনা।
উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা
তিনি বললেন, “মামলা হবার পরেই শেখ মুজিবকে খুব দ্রুত উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।’
আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করা হবে কিনা এবং আহূত নতুন জাতীয় সমাবেশএর আগে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে কিনা। তিনি বললেন, এটি সামরিক আইনের উপর নির্ভর করে। তিনি বিচারের সঠিক কোন তারিখ দিতে পারেননাই। ‘তাকে কোর্ট মার্শালে বিচার করা হবে এবং আমি জানিনা আগামী এসেম্বলির আগে তিনি জীবিত থাকবেন কিনা।’
জিজ্ঞাসা করা হল ভারতে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সম্পর্কে তার সরকারের সিদ্ধান্ত কী? তিনি জানান যে তিনি সবাইকে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। তবে তিনি জানেন না তার বার্তা ঠিক মত পৌঁছে দেয়া হয়েছে কিনা। সরকারি তথ্য মোতাবেক জানানো হয় প্রায় ১০০০০ শরণার্থী ফিরে এসেছে এবং প্রতিদিন প্রায় ১০০০ জন ফিরে আসছে। তবে ইন্দিরা গান্ধি তাদের আস্তে দিচ্ছেন না কারণ তিনি একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করতে চাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ভারত তার এলাকায় বিদ্রোহীদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করেছে। প্রায় ৩৫০০০ বিদ্রোহীকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। এবং যারা চলে গেছে তাদের দিয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে।
আমরা জিজ্ঞাসা করলাম সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি নয়া তাস্খন্দ প্রস্তাব করেছেন – সেই সম্পর্কে। প্রেসিডেন্ট জানালেন এই ব্যাপারে কোন সরকারি তথ্য তার কাছে নেই। তিনি আর বলেন আমি যে কোনো সময় যে কোন স্থানে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত আছি – রাজনৈতিক না, বরং মানবিক কারণে।”কিন্তু তারা আমাদের সব অফার প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য কাজ করছে এবং জাতিসংঘের কাজে স্যাবোটাজ করছে।
তিনি আরো বলেন ভারত প্রকাশ্যে বলেছে যে, শরণার্থীদের তারা ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে পাঠাবে না – মুজিবের বাংলাদেশে পাঠাবে।
চাপের মধ্যে
তিনি বলেন, “এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পষ্ট হস্তক্ষেপ এবং স্পষ্টত, আমরা এটা মানি না”।
তিনি বার বার বলেন যে তিনি একজন সৈনিক ছিলেন এবং কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। “তারা বলে আমি অমুক বৃহৎ শক্তির চাপে আছি। এটা আজেবাজে কথা। যারা এটা বলে তারা আমাকে চেনে না। একজন মানুষ চাপে থাকতে পারেন যদি তিনি এই চেয়ারের প্রতি লোভী থাকেন। আমি তা না। আমি এটা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে আমি দাতাদের মুখের সামনে তাদের সাহায্য ছুড়ে ফেলে দেব যদি তারা সাহায্যের সাথে কোন শর্ত জুড়ে দেন।
ইয়াহিয়া খান বলেন যে সোভিয়েত এবং আমেরিকা সরকার সংকট শুরুর থেকে পাকিস্তানের প্রতি একটি সঠিক নীতি অবলম্বন করেছে তবে তিনিব্রিটেনের ব্যাপারে একই কথা বলতে পারছেননা।
ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ্যে আমাদের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়েছেন এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন। তাদের পররাষ্ট্র সচিব এটা স্পষ্ট করেছেন। কমনওয়েলথ এর সদস্য হিসেবে আমি আশা করেছিলাম ব্রিটেন আমাদের পক্ষ না নিক অন্তত নিরপেক্ষ থাকবে – এভাবে খোলাখুলিভাবে ভারতের পক্ষ নেবেনা।
আমরা আলোচনা শুনেছি আরও অন্তত দুই বছর ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতি থাকবেন।
“আমি আগ্রহী নই,” বলেন তিনি। “আমার কথা স্পষ্ট: আর তা হল দেশের ঐক্য ধরে রাখা এবং এটি একটি বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেয়া এবং তারপর প্রস্থান করা।’
আমরা তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে পিপলস পার্টির পশ্চিম শাখার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, চেয়েছিলেন তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকার জন্য একটি বেসামরিক সরকার গঠিত হয় প্রদান.
“পিপলস পার্টি শুধুমাত্র দেশের একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। জাতীয় সমাবেশে যদি দেশের মানুষের সমষ্টিগত ইচ্ছার আমাকে থাকতে বলে তবে আমি থাকব। অন্যথায় আমি আর্মিতে ফিরে যেতে পারলে খুব খুশি হব।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমাদের সাথে ইরান সম্পর্কে উষ্ণ আলোচনা করেছেন। এটা ৭৫ মিনিট চলে। তিনি এই শাহানশাহ কে পাকিস্তান এর সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণকামী ইদেবে উল্লেখ করেন। এবং বলেন ইরান আমাদের জন্য একটি বড় শক্তির উৎস। “তিনি ইতিহাস জুড়ে পাকিস্তানকে করা ইরানের সাহায্যের কথা স্মরণ করে বলেন, পাকিস্তান গর্ব বোধ করে যে এই এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইরান এখন আমাদের পক্ষে।
তিনি একটি ইরানী শ্লোক বলেছেন যার অর্থ হল আমরা দুই দেহ কিন্তু আমাদের আত্মা একটি।
“আমি নিজেকে একজন ইরানী।” ইয়াহিয়া বললেন। “আমার পূর্বপুরুষ ইরান থেকে উপমহাদেশে আসেন। বাড়িতে আমাদের ভাষা ফার্সি এবং আমরা আমাদের জাতির সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ ইরানের সাথে মিলিয়ে রাখছি। আমি বহিরাগত হিসাবে নয় বরং আমার নিজের ভাই বা ছেলে হিসেবে আপনাদের সাথে কথা বলছি। ইরানের প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে এক পরিবারের পক্ষ থেকে আরেক পরিবারকে সালাম জানানো। আমাদের দেশে বেড়াতে আসার মানে হল আপনি ইরানেরই একটি এলাকায় বেড়াতে এসেছেন। আমরা স্রস্টাকে ধন্যবাদ জানাই ইরানকে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শক্তি দেয়ার জন্য এবং আমরা এই শাহানশাহের সাফল্যের জন্য স্রস্টাকে ধন্যবাদ জানাই – যা ইরান – পাকিস্তান সহ সমস্ত মুসলিম বিশ্বের জন্য মঙ্গলজনক।
কায়হান ইন্টারন্যাশনাল – ২ জুলাই, ১৯৭১
একটি বিয়োগান্তক ঘটনার পাঁচটি মতামত
– আমি তাহেরি
“ওহ।এখন এটা ইতিহাসবিদদের জন্য একটি ব্যাপার,” – বললেন এক পূর্ব পাকিস্তানী বন্ধু। অন্যদিন যখন আমি ঢাকায় ছিলাম তখন এক বন্ধু আমাকে জানাল কিভাবে গত বসন্তের রক্তপাতে একটি অশান্ত দেশের সৃষ্টি হল। সে সম্ভবত ঠিকই বলেছে। কিন্তু সাংবাদিকতা হল বর্তমান মুহুর্তের ইতিহাস লেখার মত। আমি কয়েকজন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছি পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে। কুয়াশা কেটে গিয়ে সঠিক তথ্য উদ্ভাসিত হতে হয়ত অনেক বছর লেগে যাবে। তবুও, বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি সাদামাটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা যেতেই পারে। এই প্রবন্ধে আমরা বসন্তের নাটকীয় ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মতামত দেখতে পাব।
(১) লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান
টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর।যখন সেনাবাহিনীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চরম পর্যায়ে চলছিল তখন তিনি আসেন। তিনি বিস্তৃতভাবে হাসেন, সামান্য স্নায়বিক টিকস আছে এবং তীব্র বেগে কথা বলেন। তিনি ঢাকার কেন্দ্রে তার প্রাসাদে আমাদের গ্রহণ করলেন। তাঁর সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে সভায় উপস্থিত ছিলেন।সে তার খেলনা চাবুক দিয়ে কাল্পনিক মাছিদের আঘাত দিচ্ছিল। আমি প্রশ্ন করার পরে টিক্কা খান নিম্নের জবাবগুলো দিয়েছিলেন। –
আমি এখানে ঘটনা চরম আকার ধারণ করার পরে এসেছি। আমাকে দুটি জিনিস করতে বলা হয়েছে: প্রথমত, সেনাবাহিনীর ঐক্য ধরে রাখা এবং দ্বিতীয়ত মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আরও আলোচনার জন্য দরজা খোলা রাখা। রাষ্ট্রপতি আমাকে পরিষ্কার বলেছেন কোন পরিস্থিতিতেই যেন আমি আলোচনার সব সম্ভাবনা বন্ধ না করে দেই। কিন্তু এটা আমার বুঝতে সময় লাগেনি যে মুজিব দেশভাগের জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে গেছেন। তার দল এবং বন্ধুরা সেই পথেই আগাচ্ছিল।তা সত্ত্বেও, আমি শেষ মূহুর্তের আগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি। আমরা সবাই চেয়েছি একটি সুরাহা হোক।
নির্বাচনী প্রচারণার সময়, মুজিব প্রকাশ্যে এবং বেসরকারীভাবে বলেছিল যে ছয় দফা কর্মসূচি নির্বাচনের পরে বোঝাপড়া করে নেয়া যাবে। ওই পদক্ষেপে দেশ মূলত আলাদাই হয়ে যায় কিন্তু তার পরেও আমরা মুজিবের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেই নাই। পরে দুটি নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে মুজিব প্রকাশ্যে বলেছে যে ছয়দফার সাথে কোনো আপস হবেনা। এটা বলে সে চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
তারপর তিনি একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করলেন যখন আমরা এখানে আছি। তিনি ঢাকায় ন্যাশনাল ব্যাংক বন্ধ করলেন এবং তার দায়িত্ব অন্য একটি ব্যাঙ্ক কে দিলেন। তিনি পাকিস্তানি ব্যাঙ্ক নোট স্ট্যাম্পড করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলে দেন যে তিনিজাতীয় পরিষদে যোগ দেবেন না – যদি সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা থাকেন। তিনি দুইটি পরিষদ চাইলেন।
উপরন্তু, তিনি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারিত করতে থাকেন এবং বলেন তিনি আমাদের সবার বিচার করবেন। তার এজেন্ট এর মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্য ও অফিসারদের বলেন সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ ত্যাগ করতে। যেহেতু তিনি একটি নিজের প্যারামিলিটারি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। বরাবর আমরা আশা করেছি যে তিনি বুঝতে পারবেন যেসেনাবাহিনী তাঁকে পাকিস্তান বিভক্ত করার অনুমতি দেবে না। কিন্তু তিনি আমাদের সংকল্পকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি প্রেস রেডিও এবং পূর্ব পাকিস্তানের টেলিভিশনকে বলেছিলেন পাকিস্তানের কোনো সংবাদ সম্প্রচার না করতে। এবং আমরা যে তথ্যই দেই না কেন সেগুলো প্রচার না করতে। তারপর সব সরকারি ভবন ও ব্যাংক থেকে পাকিস্তানী পতাকা সরানোর আদেশ দেন। একটি অনুষ্ঠানে তার সমর্থকরা পাকিস্তানী পতাকা এবং জিন্নাহ (পাকিস্তান এর প্রতিষ্ঠাতা) এর সব ছবি পুড়িয়ে ফেলা হয়।
আপনি কল্পনা করতে পারছেন যে আমাদের ধৈর্যের সীমা ছিলনা। যখন পাকিস্তান দিবস আসল মুজিব ও তার সমর্থকরা তাকে “বাংলাদেশ দিবস” বলল। তারা টিভিকে বলল পাকিস্তানের পতাকা না দেখাতে। আমি টিভিকে বললাম যদি তারা সেটা করে আমি প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেব। তারা মাঝরাতের পরে কয়েক সেকেন্ড পতাকা দেখাল যার কিছুক্ষণ পরেই পাকিস্তান দিবস শেষ হল। তার পরেই তারা মজা করতে শুরু করল এই বলে যে এখন তাদের বাংলাদেশ দিবস শুরু হল। শেখ মুজিব আসলেন এবং একটি বাংলাদেশের পতাকা ঢেউয়ের মত দোলাতে লাগলেন।
তাঁতেই শেষ নয়। আমরা খবর পেলাম অবাঙ্গালি অফিসারদের হেডকয়ার্টারে আক্রমণ করা হল – গণহত্যা সঙ্ঘটিত করা হল – রেগুলার আর্মির অফিসারররা এতে জড়িত ছিলেন যারা বিহারি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এটা করেছেন।
সেই সময়ে আমার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫০০০ বর্গ মাইল এর মাত্র ২০ বর্গমাইল দখল করে রেখেছিল।মুজিব ও তার ভারতীয় সমর্থক ভেবেছিল আমাদের পক্ষে ছড়িয়ে পড়া এবং এত দ্রুত গতিতে সকল প্রধান অঞ্চলের দখল নেয়া অসম্ভব। যদিও আমরা তা করেছি যখন আমাদের সৈন্যের অনুপাত ছিল ১ এর বিপরীতে ১৮। বিদ্রোহীদের ছিল ৮০০০০ সশস্ত্র মানুষ। তাদের বেশিরভাগ আমাদের থেকে ট্রেনিং করেছে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর সদস্য। ভারতীয়রা তাদের অনেক অস্ত্র দিয়েছে। তারা তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের হত্যা করেছে। তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করেছে। সমস্ত দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
আমার মনে আছে আমাকে যেদিন সেই আদেশ দিতে হয়েছিল সেদিন আমাদের একটা ক্রিকেট ম্যাচ হবার কথা ছিল – কিন্তু আমাকে তা বাতিল করতে হয়। ছেলেরা জানত তাদের অনেক প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছে। এটা তাদের দ্বিগুণ শক্তিশালী করেছে। আমরা বিদ্রোহীদের দ্রুত বিতাড়িত করেছি এবং সীমান্ত সুরক্ষিত করেছি যাতে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নিয়মিত সৈন্যদের প্রবেশ ঘটিয়ে কোন এলাকা দখল করে নিতে না পারে। এবং এটাকে বাংলাদেশ না করতে পারে – যা তারা ভেবে রেখেছে।
আমি বলব না যে পরিস্থিতি আগের মত স্বাভাবিক হয়েছে। তবে সেনাবাহিনী পূর্ন দখল নিয়েছে। কোন যুদ্ধ হচ্ছেনা – যদিও কোথাও কোথাও ছোট খাট বাধা আসছে। অনেক গুপ্ত আক্রমণ হচ্ছে – সেদিন ঢাকাতেই ৩ টি স্থানে বোমা বর্ষন করা হয়েছে যার মধ্যে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। পাটের বাহনে আক্রমণ হচ্ছে বারবার। এখন আমরা পাট চট্টগ্রামে সৈন্য পাহারায় পাঠাই।
ভারতীয়রা যে মিথ্যা কথা বলে তা জেনে আমার হাসি পায়। সমস্যা তৈরির দ্বিতীয় দিনে তারা বলেছিল আমাকে গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। একই দিনে আমেরিকার কনস্যুলেট জেনারেল আমাকে জানালেন তার কথাও বলা হয়েছে যে সে নাকি আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিল।
তারপরে তারা রটাতে থাকে যে আমার মাথার উপর তারা জ্বলছে এবং আমি একটা ক্ষমতা লোভী খুনি। তারা বলেছে আমরা হিন্দুদের শেষ করে দিচ্ছি যেহেতু আমাদের নাকি আর কিছু করার নেই। আমাদের ছেলেরা ঢাকার পাশে একটি গ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে একশন নিতে গেলে দুই জন গ্রামবাসী নিহত হয়। ভারতীয়রা বলেছে আমরা ২০০০ হিন্দু মেরেছি। কিন্তু আসলে ওই দুইজনের একজন ছিল হিন্দু।
এখন ভারতীয়রা মুজিবের তথাকথিত বাহিনী মুক্তিফৌজ (মুক্তিবাহিনী) কে ট্রেনিং দিচ্ছে। আমাদের বর্ডারের চারপাশ দিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো বিস্তৃত। তবে তারা আমাদের গুরুতর খতি করতে পারবে না যতক্ষণ না তারা পূর্ণ সামরিক বাহিনী দিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। সেটা হবে আর্মির সাথে আর্মির যুদ্ধ এবং আমরা সেই ব্যাপারটা দেখব।
আওয়ামী লিগার এম এস
এম এস – যিনি তার পরিচয় দিতে চান না – তিনি আওয়ামীলীগের একজন সক্রিয় কর্মি। আমি তার সাথে গত শীতে ঢাকায় পরিচিত হই। এবং তিনি গত সপ্তাহে আমাকে আবার পূর্ব পাকিস্তানে ডেকে পাঠিয়েছেন। যখন সমস্যা শুরু হয় তিনি প্রত্যন্ত এলাকায় চলে যান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমা ঘোষণার পরে তিনি ঢাকায় আসেন। তিনি আমাকে যা বলেছেন তা নিম্নরূপ –
২৬ মার্চ রাত ঢাকায় ছিল সত্যিকারের ইন্দোনেশিয়ান রাত। সবাই জানত যে আক্রমণ হবে। এবং পাল্টা আক্রমণও হবে। আর্মি আওয়ামীলীগের কর্মীদের তালিকা করে রেখেছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই কারফিউ জারি করে তাদের ধরে ধরে আনছিল। ছাত্রনেতা যাদের বেশিরভাগ নক্সাল কর্মী – যারা পশ্চিম পাকিস্তানের পরিবারগুলোর উপর আক্রমণ করেছিল – তারা ছিল প্রধান টার্গেট। অন্যরা পালিয়ে যাবার সময় তাদের হত্যা করা হয়।
আওয়ামীলীগ চরমপন্থিরা ইতোমধ্যে তাদের প্রতিশোধ নিতে শুরু করে এবং যতটা সম্ভব অবাঙ্গালিদের ধরার চেষ্টা করে। একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ শেষ হয়ে যায়। এত দ্রুততার সাথে শেষ হয় যে আমাদের মত যারা কম্প্রোমাইজের চেষ্টা করছিল তারাও পিছু হটে।
আর্মি একশন শুরু হবার পর আওয়ামিলিগাররা গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শহরে বসবাস করা অবাঙ্গালিদের হত্যা করতে থাকে যাদের তারা গুপচর সন্দেহ করেছিল। যেকারনেই হোক তারা ভেবেছিল যে ওইসব অবাঙ্গালিরা বিদ্রোহীদের আর্মিদের কাছে চিনিয়ে দেবার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। তাই তারা বিহারী, পাঞ্জাবি ও অন্যান্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
শুধু ঢাকায় ১০০০০ জনগণকে হত্যা করা হয় যদিও কিছু কিছু মানুষ সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ বলে। তবে সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয়। অনেক লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছে এবং এখনো অনেকে গ্রামে লুকিয়ে আছে। তাই যাদের বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনরা মনে করছে যে তাঁরা মারা গেছেন। আমার এক বন্ধু আমাকে মৃত ধরে নিয়েছে যখন আমি লুকিয়ে ছিলাম। তাই যাদের মৃত বলে ধরা হয়েছিল তাদের সংখ্যাটা আস্তে আস্তে কমছে।
আমাদের বেশিরভাগ মনে করে যে মুজিব দেশভাগ চেয়েছে। যদিও ছাত্রনেতারা ও তাদের বন্ধু যারা নেতৃত্বে আছে তারা এটা চায়নি। আমার নিজের মত হচ্ছে মুজিব পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলা কে আলাদা করতে চেয়েছিলেন – তবে এখনই নয় – কিন্তু তাকে তার কাজের গতিতে চাপ দেয়া হয়েছে – নক্সাল আর কলকাতায় বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদীদের চাপের মুখে সে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।
আমি বলতে পারছিনা এর পরে কি হবে। কেউ পারবেনা। মিলিটারি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রাজনৈতিক সমস্যা পরেই আছে। সমস্যা হল এত বেশি ঘৃণা ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে যে এই অবস্থায় জনগণ আর আর্মির মধ্যে আলোচনায় বসা সম্ভব না। এমনকি বাঙ্গালি সরকারি কর্মচারী যারা সাহায্য করতে চেয়েছে তারাও সন্দেহে আছে। শত শত সরকারি কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে। এবং তাদের কাজ হল পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কর্মচারিদের দেখে রাখা।
আমি জানিনা ঢাকার বাইরের অবস্থা কি। তবে শুনেছি চট্টগ্রাম ও কক্স বাজারে আর্মি বিমানে বোমা মারা হয়েছে এবং নেভিকে শেলিং করা হয়েছে। সম্ভবত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলেও যুদ্ধ চলছে। কিন্তু যতক্ষণ ভারত সরাসরি প্রবেশ না করছে ততক্ষণ বাংলাদেশ ফোর্সের ক্ষমতা নাই টিক্কা খানের সুশৃঙ্খল ও উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীকে দমাতে পারে। মুজিব ছাড়া আওয়ামীলীগের কোন স্বীকৃত নেতা নাই। এবং ইতোমধ্যে তার দলে রেষারেষী ও হিংসাবিদ্বেষ শুরু হয়ে গেছে। যা কিছু হচ্ছে তা দুই পাকিস্তানের লোকদের ভুলতে অনেক অনেক সময় লাগবে। আমি আশা করি বেশি সময় লাগবে না কারণ দিন যত যাচ্ছে বোঝাপড়ার সম্ভবনা তত কমছে।
পূর্ব পাকিস্তানি নেতাদের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সাথে কথা বলা সহজ। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের কিছু বলার নাই – অন্তত এই সময়ে। তাছাড়া, ভারত নিশ্চই নিজেদের এই পরিস্থিতিতে সমঝোতাকারি হিসেবে দাবি করতে পারে। সেই লক্ষ্যে তারা মুজিবের সাথে কথা বলছে এবং ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ইচ্ছাকে প্রকাশ করছে। বিপদ হল যদি দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা যদি আলোচনায় না বসে তাহলে দ্রুতই আর্মি আর ভারত উভয় পক্ষের হয়ে ব্যাবস্থা নিতে শুরু করবে যা যুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানাবে।
(৩) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি একজন দীর্ঘকায়, বুদ্ধিমান ও নরম ভাবে কথা বলা একজন সৈনিক যিনি মার্শাল ল চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন। তিনি এই এলাকাকে ভালো চেনেন এবং তার মত একজন পেশাজীবী সৈনিকের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থাটা বোঝা একটু অস্বাভাবিক। তিনি যা বলেছেন তা নিম্নরূপ –
প্রথমে আমি যে ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে চাই তা হল, আমরা কি এখনো বুঝতে পারিনি যে মুজিব ও তার দল পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চায়? তা না হলে আমরা এই একশন নিতাম না। আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা চাইতাম না। আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি এবং সকল ভীতি দূর করেছি। যদি আমরা ক্ষমতাই চাইতাম তাহলে আমরা নির্বাচন দিতাম না এবং আর কোন ব্যাবস্থা না নিয়ে অবস্থান করতাম। আপনারা দেখেছেন যে আমরা আওয়ামীলীগকে ভেঙ্গে ফেলেছি। আমরা এটা আরও আগেই পারতাম যখন মুজিব আরও দুর্বল ছিলেন। আমি মুজিবকে অনেক দিন ধরে চিনি। গত কয়েক বছর প্রায় প্রতিদিন আমার তার সাথে যোগাযোগ হয়। সে একজন দুর্বল মানুষে পরিণত হয়ে পারত – হাইপোক্রিটিকাল হতে পারত। সে আমাদের সাথে প্রাইভেটলি যা বলে মানুষের সামনে ঠিক তার উল্টোটা বলে। সে মনে করে সে আমাদের সকল আর্মিকে ঘোরাতে থাকবে – এবং সে আমাদের রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টাকে আমাদের দুর্বলতা মনে করেছে।
এমন অপারেশন চালানো আর্মির পক্ষে গৌরবজনক কিছু নয়। আমরা এটা করতাম না – মুজিবের কারণে যদি না আমরা করতে বাধ্য হতাম। এই মানুষটি নেতৃত্বের জন্য অযোগ্য কারণ সে নিজেকে বড় মনে করে এবং সে নিজের জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে যেকোন ধরনের কাজ করতে পারে। সে মানুষকে ক্ষেপীয়ে তুলতে পারে – যদিও কিছু ঘটনা ঘটেছে – তাকে স্টেটসম্যান হতে জোর করা হয়েছে।
আমি এখন এমন কিছু বলব যা এর আগে আমি কাউকে বলিনি। আমার উপরস্থদের ছাড়া। সমস্যা শুরুর একদিন আগে এবং আর্মি একশন শুরুর আগে আমি মুজিবকে একটি পরিণতিতে আসার জন্য শেষবারের মত ডাকলাম। তিনি বললেন ‘আমার এখন আর বলার কিছু নাই।’ তিনি বলেছেন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তাকে যেকোন মুহূর্তে হত্যা করা হবে।
তিনি বলেছেন – ‘তোমরা যা চাও আমি যদি তা করি তবে ছাত্ররা আমাকে মেরে ফেলবে। তারা যা চায় তা যদি আমি করি তাহলে তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে। যেকন দিক দিয়েই আমি আসলে শেষ।’
এখন আপনার কি মনে হয় একজন স্টেটসম্যানের ক্যারিয়ারের এমন মুহুর্তে একথা বলা সঠিক? আমি কোন রাজনীতিবিদ না এবং কখনো তা হবার কথা ভাবিওনা। কিন্তু একজন মানুষ এত ভীতিতে থাকলে কিভাবে রাজনীতি করে? আমরা মুজিবের থেকে যেকন কিছুই আশা করেছিলাম – কিছুটা দেশভাগের ব্যাপারটাও। সে তার ওই রূপটা দেখাতে চায়নি কারণ সে সবার মাঝে জনপ্রিয় থাকতে চেয়েছে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? আপনি হয়ত বলতে পারেন তাকে দ্বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভালো, সেক্ষেত্রে আমার কথা হল যাকে খুনি হতে জোর করা হচ্ছে – যারা জোর করছে তাদেরই এজেন্ট হিসেবে সে কাজ করছে।
এখন আসুন অন্যদিকে একটু দেখি। ভারতীয়রা বলছে আমরা প্রেসিডেন্ট ও মুজিবের সাথে বোঝাপড়ার কথা বলে সময় ক্ষেপণ করছি মূলত পূর্ব পাকিস্তানে গ্রিন ট্রুপ্স আনার জন্য। আমি সৈনিকের মুখের সন্মান থেকে আপনাকে একটি কথা বলি – এই সময়ে একটি মানুষও এখানে প্রবেশ করেনি। আমরা মার্চ ২৫ এর পর থেকে সেটা শুরু করেছি। আমাদের অফিসারদের অবস্থা শোচনীয় এবং সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ চলছে। প্রথম কিছু দিন আমরা অবস্থার সাথে পেরে উঠছিলাম না। সাহায্যের দরকার ছিল। যদি আমরা আগে থেকে লোক আনতে চাইতাম তাহলে তা এমনিতেই পারতাম।
এছাড়াও ভারতীয়রা বলে, বিদ্রোহীরা প্রায় ৩৫০০০ পাকসেনা হত্যা করেছে গত কয়েক মাসে। আমি আপনাকে বলতে চাই, যদি এই তথ্য সত্যি হত তাহলে এই মুহুর্তে পূর্ব পাকিস্তানে কোন সৈন্যই থাকত না।
তারা আরও বলে যে প্রায় ১০ লক্ষ লোক মারা হয়েছে এবং ৮০ লক্ষ মানুষ শরনার্থি হয়েছে। তার মানে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ লক্ষ মানুষ। এটা কিভাবে একজন বিশ্বাস করে? হাজার হাজার মানুষ নিজ স্থান থেকে শরে গেছে কিন্তু আমি আপনাকে বলতে পারি সমস্যার সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যে মানুষ মারা গেছে তাদের সংখ্যা ১০০০০ এর বেশি হবে না – যাদের মধ্যে অর্ধেক হচ্ছে অবাঙ্গালি যারা মুজিবের ঝোড়ো বাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তান আর্মির বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় উভয় পক্ষের ৩৬৫ জনের বেশি নিহত হয় নাই। এখন ভারতীয়রা বলে এটা ১০০০০ বা কখনো বলে ৫ লাখ। আমি আপনাকে একটা কাজ করতে বলি। ঢাকার পথে পথে মানুষকে জিজ্ঞেস করুন কতজন লোক মারা গেছে। সম্ভবনা আছে তারা বলবে কয়েক হাজার বার তারও বেশি। কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করুন তার নিজের কেউ মারা গেছে কিনা – বা এমন কোন আত্মীয় বা বন্ধু আছে কিনা যে হারিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত সে আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলবে।
একই কথা যেসব মানুষ অন্যত্র শরে গেছে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ঢাকার জনসংখ্যার ১০% পার্শবর্তী গ্রাম-গঞ্জে পালিয়ে গেছে। তাই আপনি দেখতে পাবেন দোকান পাট বন্ধ আছে। কিছু ঘর পরিত্যাক্ত। কিন্তু আমি নিশ্চিত আপনি দেখবেন যে ভারতীয়রা এই সংখ্যাটাও বাড়িয়ে বলবে। প্রশাসন যতটা উদ্বিগ্ন আছে তাতে আমি মনে করি খুব দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। প্রায় ৯০% সরকারি কর্মচারি তাদের চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ভয়ে লুকিয়েছেন। কারণ তারা মনে করেছেন মুজিবের বাহিনীর কারণে তাদের অবস্থা ভয়ানক হতে পারে। তাদের অঞ্চল থেকে আর্মি শরে যাওয়া মাত্রই তারা স্বাভাবিক কাজে যোগ দিচ্ছে। আমরা সৈনিক এবং আমরা সরকারি কাজে যোগ দিতে চাইনা। আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে প্রশাসনের পরিবেশ পুনরুদ্ধার যেখানে দরকার সেখানে। এক্ষেত্রে আমরা আর্মির সুপিরিয়র অর্গানাইজেশন, শৃঙ্খলা ও সম্পদকে ব্যাবহার করে সেবা দিচ্ছি। এর বাইরে আমার প্রশাসনের ব্যাপারে কিছু করার নেই। অর্থনিতি বা কৃষি – এসব ব্যাপারে আমি কি-ই বা জানি?
হাজার হাজার অন্যত্র সরে যাওয়া মানুষ ঘরে ফিরছে এবং আমরা তাদের গ্রামে ফিরে আস্তে সাহায্য করছি এবং তারা যাতে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কাজ পুনরায় শুরু করতে পারে সেই চেষ্টা করছি। সীমান্তে আমাদের ২০ ট রিসিপশন কেন্দ্র আছে – আপনারা দেখতে পারেন। এবং সকল সরে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য আমরা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। তাতে তারা পাকিস্তানের ভেতর থেকে বা অথবা ভারত – যেখান থেকেই আসুক না কেন। যারা ভারত থেকে ফিরে আসছে তাদের অস্বাভাবিক পথে আস্তে হচ্ছে – কারণ ভারতীয় সেনারা তাদের বর্ডার পার হয়ে আসতে দিচ্ছে না। আপনারা জানেন যে প্রেসিডেন্ট সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং সবাই নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারে।
(৫) সাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদী এ এ
এ এ – একজন বিহারী – ঢাকায় থাকেন। গত ফেব্রুয়ারিতে আমি তার সাথে প্রথম সাক্ষাত করি। যখন সে আমাকে বলেছিল পূর্ব পাকিস্তান একটি আলাদা দেশ হওয়া উচিত। সেই সময়ে সে খুব খারাপ ভাবে মুজিবের বিরোধিতা করেছিল। কারণ আওয়ামীলীগের এই নেতা দেশভাগের বিপক্ষে ছিলেন। যখন পূর্ব পাকিস্তানে সমস্যা শুরু হল এ এ গা ঢাকা দিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরে আবার শহরে ফিরে আসেন। তার কথার কিয়দংশ –
আমি এখনো শোকমুক্ত হইনি। একজন বিহারী হিসেবে আমি ঝুঁকিতে ছিলাম যে আওয়ামীলীগের লোকেরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। দেশভাগের পক্ষে থাকায় আমি হিংসুটে সৈনিকদের কাছেও লক্ষ্যবস্তু ছিলাম। তবু দেখুন, আমি এখনো বেচে আছি। বেচে আছি কিন্তু ভয়ে আছি। আমি দেশভাগের পক্ষে ছিলাম কারণ আমি দেখছি এই দেশ মাঝাখানে ভারত দিয়ে প্রায় ১০০০ মাইল দূরে দূরে অবস্থিত – যা অসমর্থনীয়। যখন দেশভাগ হল আমরা ছিলাম উদ্বাস্তু – পাকিস্তান নিয়ে অনেক আশা ছিল। কিন্তু একনায়কতন্ত্র আমাদের আশা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে এবং বাস্তবিক অর্থে পূর্ব পাকিস্তান উভয় পাকিস্তানের কিছু ক্যাপিটালিস্টের হাতে জিম্মি।
আইয়ুবের পতনের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ আমাদের ব্যাপারে সচেতন ছিলনা। দুই অঞ্চল আজ যে ভোগান্তি ভোগ করছে তার জন্য প্রধান দায়ী ব্যাক্তি আইয়ুব। ইতিহাসে একটি জাতিকে বারবার সুযোগ দেয়া হয় না। পাকিস্তান জাতি হিসেবে প্রায় সবগুলো সুযোগ হারিয়েছে আইয়ুবের আমলে।
আমি উভয় অঞ্চলের গণহত্যার ব্যাপারে তেমন জানিনা। আমরা বিহারীরা – যেকরেই হোক – মুজিবের মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত। তারা আমার অনেক আত্মীয় ও বন্ধুদের জবাই করেছে। এবং আমি জানি সেখানে ভারতীয় সৈন্যও ছিল। পশ্চিমবঙের ভলান্টিয়ারও ছিল তাদের তালিকায়। এখন আমি জানি বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে যেমন আমি ভাবতাম আমার হয়ত আজ বেচে থাকার কথা না।
মানুষ মানসিক বিকারে ভুগছে। তারা পরিস্থিতির শিকার। তারা পরাস্ত, তিক্ত, ধ্বংসপ্রায় আর নিতান্ত অসহায় বোধ করছে। সবচেয়ে খারাপ জিনিস তাদের বন্ধু আর আত্মীয়দের মৃত্যু নয়। সেটা হল আশার মৃত্যু। এবং এই মানুষগুলো – এমনি জানেন – আশার উপর নির্ভর করে বেচে আছে। মানুষের দরকার দয়া, উদারতা এবং আধ্যাত্মিক ক্ষতগুলো সারানোর দরকার। যাতে তারা পুরপুরি ভেঙ্গে না পরে। এটা বিষয় নয় যে কে দায়ী। বিষয় হচ্ছে এই মানুষগুলোকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া থেকে বাঁচানো।
আমি বিশ্বাস করিনা যে মুজিব সত্যিকার অর্থে দেশভাগ চেয়েছিলেন। সে রাজনৈতিক চালের খেলনামাত্র। সে কি সত্যিই বাংলাদেশ চেয়েছিল? সে পারত প্রধানমন্ত্রীর আসন নিয়ে সেনাদের ব্যারাকে পাঠিয়ে দিতে এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে। পূর্ব পাকিস্তানের কোন প্রশাসনিক যন্ত্রব্যাবস্থা বা নিজস্ব আর্মি ছিলনা যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের থাকতে হয় – থাকতে হয় তার অস্তিত্বের জন্য। যদি মুজিব বাংলাদেশের জন্ম ঘোষণা দিতেন তাহলে তাকে দিনের পর দিন টিকে থাকার জন্য ভারতের উপর নির্ভর করতে হত। পূর্ব বাংলা হত ভারতের একটি কলোনি। এর অন্য পথটি হতে পারত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বাঙ্গালিদের একত্র করা যেত। এর জন্য পশ্চিম বঙ্গেও অনেক বড় আন্দোলন হয়েছে। সেক্ষেত্রে, অবশ্য ভারত আর পশ্চিম পাকিস্তান মিলে একসাথে হাত লাগাত সংযুক্ত বাংলাদেশ না গড়তে দেবার ব্যাপারে।
এটা কোন বিষয় নয় যে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে থাকবে কিনা। যেকন অবস্থায় এটাই সবচেয়ে ভালো পথ ছিল। আসল কথা হল, পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচতে হবে।
(৫) তাহসিন মুহাম্মাদ
তাহসিন মুহাম্মাদ একজন পি আই এ গোমস্তা। তিনি গত কয়েকমাস ধরে করাচী ও ঢাকা যাওয়া আসা করছেন। তিনি যা বলেছিলেন তা নিম্নরূপ –
যখন সমস্যা আসলো আমরা পাগলের মত ঢাকা যাওয়া আসা করছিলাম। আহত মহিলা শিশুদের ভর্তি করে যেতে হচ্ছিল। বেশিরভাগ বিহারী। হাজারখানেক নিয়ে গেছি আমরা। অনেকের চোখ উপড়ে ফেলেছে বাংলাদেশ ফোর্সের লোকজন। অনেক মহিলার স্তন কেটে ফেলা হয়েছে। নিষ্পাপ শিশুদের সামনে তাদের বাবাকে জবাই করা হয়েছে।
আমি এত বীভৎস দৃশ্য দেখেছি যে তা আমার বাকি জীবন রাতের ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট। জিন্না যখন পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল তখন আমরা ছোট ছিলাম। আমরা ভারতের হিন্দুদের দ্বারা লন্ডভণ্ড হবার ভয়ে ছিলাম। কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি যে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হিটলারের মত জবাই করবে।
কায়হান ইন্টারন্যাশনাল, ১ আগস্ট, ১৯৭১
শেখ মুজিবের উত্থান- পতন
– আমি তেহারি
ঢাকার মাঝখানে ফ্যাশনেবল ধান্মন্ডি এলাকায় একটি ফ্যাকাসে- হলুদ তিনতলা বাড়ি – যেখানে নাকি শোনা যায় বর্ষার রাতে ভুতের আশ্রয় হয়। বেশিরভাগ জানালা ভাঙ্গা। প্রায় সবগুলো দেয়ালে গুলির চিনহ। বৃষ্টিতে ভেজা ইট বিবর্ন হয়ে গেছে। পুরনো গাছের পাতার ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে একটি স্লোগান সাঁটা – ‘জয় বাংলা’।
যারা এই বাড়ীর পাশ দিয়ে যান তারা যথেষ্ট দূরত্ব মেনে চলেন। যা ইতোমধ্যেই কিংবদন্তি হয়ে গেছে।
এই বাড়ীর মালিক শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি আওয়ামীলীগের প্রধান নেতা। যার বিপুল জনপ্রিয়তা ও পতন ও উত্থান সমানুপাতিকভাবে লাখো মানুষকে একাধারে দুঃস্বপ্ন আবার কখনো তার বক্তব্যে বছরখানেক ধরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকে।
একটি ঘরে যা মুজিবের ঘর আমরা দেখতে পেলাম অনেকগুলো চিঠির গাদা – যার বেশির ভাগ এখনো খোলা হয়নি। বিয়ের দাওয়াতের কার্ড, এটা- সেটার অনুরোধ, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বাংলায় লেখা নানান কাগজ পত্র। সব চিঠিই মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এসেছে – কিন্তু শেখ মার্চের ২৬ তারিখে আটক হন – তাই চিঠি খোলার সময় তার নেই।
তার ডেস্কে স্যার আইভর জেনিংস এর ‘পাকিস্তানের সাংবিধানিক সমস্যা’ বইটা পেলাম যা তিনি মুজিবকে উতসর্গ করেছেন – যা একজন প্রাক্তন শিক্ষক হিসেবে উতসর্গীকৃত। কাভারের ভেতরের দিকে আমরা পড়লাম – রাজনীতি ক্ষমতার দিকে ধাবিত হতে সাহায্য করে কিন্তু ‘জ্ঞ্যান’ও ক্ষমতা। এবং মুজিব লিখেছেন এটা এমন একটি বই যা আমি সব সময় পড়ি – যখন আমি জেলে থাকি। কিন্তু এবার বইটা নেবার সময় তার হয়নি।
অন্য রুমগুলোতে প্রচুর বই, রেকর্ডপত্র ছড়ানো আছে – সাথে সাথে অনেক ছিন্ন ফুল, রঙ্গিন বাল্ব, কালো পতাকা ও পার্টী স্লোগান তাতে পূর্ন। পুরো বাড়ীর চেহারা এমন যে একটি বড় দল ঢুকে সব লন্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
স্বাধীনতার শেষ ৪৮ ঘণ্টায় শেখ খুব অস্থির ছিলেন। নির্বাচনে বিপুল বিজয় আর পূর্ব পাকিস্তানে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তিনি নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র ৭৫ মিলিয়ন মানুষের মসিহ মনে করতে পারেন।
জটিল চাল আর পাল্টা চালের পর পাকিস্তানের প্রথম অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ একজন দক্ষ শিল্পীর মত কাজ করেছেন এবং সব সময় ভুল পথে এগিয়েছেন।
তিনি ৬ দফা নিয়ে কাজ করেছেন এবং পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতা চেয়েছেন – সত্যিকার অর্থে তা প্রয়োগ করা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের উপর কোন ক্ষমতাই থাকেনা। পাশাপশি তিনি তার দল আওয়ামীলীগকে একীভূত করতে ও নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন এবং নানা রকম আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা ঠিক করেছেন। তার কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝে প্রো-মাও কমিউনিস্ট, এন্টি-কমিউনিস্ট জমিদার, ধনি ব্যাবসায়ী, বিদ্রোহী ছাত্রসমাজ, পম্পাস মিডল ক্লাস আইনজীবী থেকে শুরু করে প্রান্তিক পাটচাষি পর্যন্ত আছে।
জাতীয় পরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন হয়েছিল – যারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবে। কিন্তু মার্চের শেষ দিকে তিনি তার বিদ্রোহী নেতাদের কথায় মিলিটারি সরকারকে এসেম্বলিতে জরুরি ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেন।
এটা করার জন্য অনেকেই তাকে উৎসাহ দেন যাদের মধ্যে আছেন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা মুসলিম লিগের কায়ুম খান ও অন্যান্য ছোট ছোট ব্যাক্তিত্ত যেমন এয়ার মার্শাল আসগার খান, নাস্রুল্লাহ ও মিয়া মুমতাজ দৌলাতানা। তাই তিনি ভেবেছিলেন তার এই মুহুর্তে মার্শাল ল বন্ধ করা ও এসেম্বলিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃকও সমর্থিত হবে। একমাত্র ব্যাক্তি যাকে তিনি হিসেবে ধরেন নি – সে হল জুলফিকার আলি ভুট্টো – পশ্চিম পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান – এসেম্বলির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল – যে এসেম্বলি এখনো হয়নি।
মুজিব এসেম্বলি বন্ধের কারণ হিসেবে ভুট্টোকে দায়ী করেন। এবং যখন প্রেসিডেন্ট নতুন তারিখ দেন তখন তিনি আর আগ্রহ দেখাননি। তিনি ক্ষমতা চাচ্ছিলেন তখন থেকে। তিনি দেখলেন মিলিটারি প্রধান দুর্বল তবে হয়ত জাতিকে দুর্বল হতে বাধা দেবেন – কিন্তু আসলে এটি একটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সূচনা করবে।
এর পরে কিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৩০০ বাঙ্গালি নিহত হয়। যার প্রেক্ষিতে মার্শাল ল জারি করা হয়।
তার কাজে অনভিজ্ঞতার ছাপ আছে। তিনি চেয়েছিলেন যে জেনারেলরা তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। আসলে তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেবার এছাড়া আর কোন পথ ছিলনা।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তার হরতাল চলছিল যদিও একই সময়ে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে বোঝাপড়া করছিলেন। তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন মনে হয় তিনি ইতোমধ্যে ক্ষমতা পেয়ে গেছেন এবং এটা পরিষ্কার করে দেন যে তখন থেকেই তিনি আসলে মিলিটারি সরকারকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এসেম্বলি মেম্বারদেরকে নির্দেশ দিতে শুরু করে দিয়েছিলেন।
এটা বলার পরিবর্তে তিনি জেরারেলদের বিচারের দাবি জানাতে পারতেন। মুজিব সে সরকার গঠনের পলিসি দিয়েছেন সেখানে ভালো কিছু নেই। তিনি বলেন নাই যে এটা শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাঠামো – নাকি পুরো পাকিস্তানের জন্য এটা প্রযোজ্য হতে যাচ্ছে। প্রথম বিকল্প পথটা বেশি গ্রহণযোগ্য যেহেতু আওয়ামীলীগ ভুট্টোকে সম্পূর্ন এড়িয়ে যেতে পারেনি – সেক্ষেত্রে হয়ত তাদের সরকার গঠনের সম্ভবনা ছিল।
মুজিব তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি তর্ক করলেন যে মার্শাল ল পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার অধিকার হারিয়েছে। এবং তিনি নিজের ইচ্ছা মত করছিলেন সব। তিনি ইয়াহিয়াকে বললেন তার দল নির্বাচনে জিতেছে এবং এভাবে তিনি ক্ষমতা পেয়েছেন। মিলিটারি সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে কি করছে সেটা তার দেখার বিষয় না।
এই পয়েন্টে তিনি আসলে ভাঙ্গনের কথা বলেছেন। কেউ জানত না এর পরের স্টেপ কি হবে। আলোচনার পথ বন্ধ হওয়ায় সেটাকে আওয়ামীলীগের চরমপন্থিরা ‘বিজয়’ হিসেবে দেখল। তারা সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা শুরু করল এবং বাঙ্গালি সৈন্য ও অফিসারদের বলল তাদের পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে।
অন্যদিকে ইয়াহিয়া খানকে শেখের সাথে এসব কাজের ফলাফলকে পুনরালচনা করার সুযোগ দেয়া হলনা। তিনি দেখলেন তার সেনাবাহিনীর এলোমেলো অবস্থা। তিনি দেখলেন তার সরকার শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয় পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে। মুজিব যা করছেন তাতে পশ্চিম অঞ্চলের মিলিটারি কাঠামোও ভেঙ্গে পড়বে। অসহায় হয়ে পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতির জন্য প্রেসিডেন্ট আর্মিকে বেছে নিলেন।
এটা করে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের করা সমস্যার সমাধান করলেন। এরপর কি? মুজিব সফলভাবে হরতাল তুলে নিলেন কিন্তু আর্মিকে নির্মূল করার জন্য দেশের সর্বত্র নির্দয় গুণ্ডা ও নক্সাল বিদ্রোহীদের দিয়ে একটি আইন-কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করলেন। দুইটা লক্ষ্য অর্জন করতে তিনি সমর্থ ছিলেন না । তার কাছে যেহেতু খেলার জন্য আর কোন তাস নেই তাই তিনি সাধারণ পথে এগুতে থাকলেন। আর্মির সাথে আওয়ামীলীগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তিনি তার দলের ধ্বংস থামাতে পারলেন না।
তাকে তার জুনিয়র মিলিটারি অফিসাররা বলল ‘বাংলাদেশে’র স্বাধীনতা ঘোষণা করতে এবং অতি দ্রুত ভারতের কাছে মিলিটারি সহায়তা চাইতে। যদিও তিনি নিশ্চিত নন যে ভারত তার হয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে কিনা। তিনি জানতেন পশ্চিমবঙ্গে একটি ভয়ানক প্রতিবাদ হবে – ভারতীয়রা এটাকে স্বাগত জানাবে না।
তিনি আশা করছিলেন কোন ভাবে জাদুকরী কিছু তাকে দেয়ালে ঠেকে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।
তার মধ্যবর্তী সমর্থকরা ধীরে ধীরে ব্যান্ড-ওয়াগন ছেড়ে যাচ্ছিল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পুরোটা যাবার চাইতে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যে শেয়ার পাবার আশায় যোগ দিচ্ছিল। তারা খুব দ্রুত গৃহযুদ্ধ বাধানোর আশায় শেখের সাথে যোগ দেয় নি। কারণ এতে করে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
সবাই তখন ভয় পেয়ে গেল এবং ‘আইন শৃঙ্খলা’ মেনে নিল। মুজিবের থেকে সমর্থন তুলে নিল। যদিও খোলাখুলিভাবে নয়।মুজিব তাদেরকে বলল আর্মিকে না খাইয়ে রাখতে। কিন্তু ব্যারাকে সাপ্লাই যেতে লাগল। মিলিটারি প্রধানদের সাথে কয়েক দফা গোপন বৈঠক হল।
চরমপন্থি ছাত্ররা মুজিবকে ছেড়ে যেতে শুরু করল – যদিও তাদের কারণ ভিন্ন। তারা তাকে চাচ্ছিল মাও-পন্থি করতে আর তিনি হচ্ছিলেন গান্ধি-পন্থি। তার ক্যারিয়ারের সর্বশেষ সময়ে কিছু অনির্ভরযোগ্য সাধারণ বাঙ্গালিদের সমর্থন ছিল। এগুলো খুব দ্রুত ঘটছিল। এবং দ্রুত তার অথোরিটি তাতে ঢাকা পরে গেল। তাদের মধ্যে আছে তাজউদ্দীন আহমেদ, আওয়ামীলীগের দ্বিভাগের মতে বিশ্বাসী সেক্রেটারি জেনারেল ও নুর-এ-আলম সিদ্দিকি ও এ এস এম আব্দুর রবের মত ছাত্রনেতারা।
অন্যদিকে লে জে টিক্কা খান পাঞ্জাব থেকে উঠে আসা অফিসারদের মধ্যে অন্যতম একজন অফিসার হিসেবে প্রশংসিত হলেন।
রোমান্টিক, সিদ্ধান্তহীন ও কনফিউজড রাজনীতিবিদ অভিনেতা মুজিবের জন্য কোণ যায়গা থাকল না। তখন থেকে ডায়লগের একমাত্র ভাষা ছিল বুলেট।
আওয়ামীলীগের চরমপন্থিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করল যে মুহুর্তে মুজিবুর রহমান তার ধান্মন্ডির বাসায় বসে এরেস্ট হবার অপেক্ষা করছেন।
২৬ মার্চ সকালেই মুজিবকে আটক করে করাচী নিয়ে যাওয়া হয়। প্লেনে সে একঘণ্টার মত ঘুমায়। কারো সাথে কথা বলেনি। করাচী বিমান বন্দর থেকে তাকে কুয়েটার উদ্যেশ্যে প্লেন পরিবর্তন করতে হয়। এটা বেলুচিস্তানের রাজধানী। তাকে ভি আই পি লাউঞ্জে নেয়া হয় এবং ইংলিশ চা পরিবেশন করা হয়। তিনি ব্ল্যাক কফি চান। তারপরে দুইজন পুলিশ তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে।
খুব কম মানুষ এখন মুজিবের অবস্থান জানে। তাকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে নেয়া হচ্ছে। গত মাসে সে অনশনে গিয়েছিল কিন্তু তিনি খেতে রাজি হন যখন তার স্ত্রী ও সন্তানদের তার সাথে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি অনেক লেখালেখি করছেন। কেউ জানেনা তিনি কি লিখছেন – তবে অনেকের ধারনা তিনি তার বিচারের ডিফেন্সের জন্য কাগজপত্র তৈরি করছেন।
গুজব প্রচলিত আছে যে মুজিব মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং কয়েকদিন ধরে এলোমেলো বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু আমার কাছে ফার্স্ট হ্যান্ড তথ্য আছে যে এটা সত্য নয়। আওয়ামীলীগের এই নেতা ভালোই আছেন এবং তাকে কোন রকম নির্যাতন করা হয়নি বা অসন্মান করা হয়নি। বরং পরিস্থিতি এমন যে তিনি একজন ভি আই পি যিনি একটি বারে কিছু সময় পার করছেন।
কিছু আইনজীবী ও মিলিটারি প্রধানদের একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে মামলার কাগজপত্র প্রস্তুত করছেন। তার বিচার কয়েকদিনের মধ্যেই হাই ট্রিজন চার্জে শুরু হবে। সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা।
পশ্চিম পাকিস্তানের কম লোকই বিশ্বাস করে যে মুজিবের মৃত্যুদণ্ড হবে। পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনৈতিক মৃত্যুদণ্ডের এযাবৎ কোন দৃষ্টান্ত নেই। এবং এটা খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করা হয় যে এর অন্যথা হবেনা। বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি মনে করে যে মুজিব দেশ ভাগ চেয়েছেন এবং ভারতের সাথে মিলে চক্রান্তে অংশ নিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে এখনো ধারনা পাওয়া যাচ্ছেনা। খুব কম লোক তার ব্যাপারে কথা বলতে চান। এবং এদের মধ্যে যারা কথা বলতে চান – তারা হলেন দলের সাবেক সদস্য যারা এখন তাকে দায়ী করছেন তাদেরকে ফাঁদে ফেলার জন্য।
তথাপি, মুজিবকে পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী ঘটনার কারণ দর্শাতে হবে। ইসলামাবাদে যখন তার বিচার শুরু হবে তখন তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে – শুধু কোর্ট মার্শালের কাছে নয় – সমস্ত ইতিহাসের কাছে।
কায়হান ইন্টারন্যাশনাল, ২ আগস্ট, ১৯৭১
একটি ক্ষুধার্ত দৈত্যের ভয়ংকর ছায়া
– আমির তেহারি
দুপুর বেলা ঢাকার নদীর পাশের শহরটিতে ছিল কাবাব খাবার সময়। প্রায় ২০ টা টং খোলা হয়েছে টিন আর কাছের গুড়ি দিয়ে। আটার গোলা দিয়ে কিছু একটা বানানো হচ্ছে আর সাথে ভেড়ার ভুঁড়ি ভেঁজে কাবাব হিসেবে দেয়া হচ্ছে। পূর্ন ভিড়ে এই আশ্চার্যজনক মিশ্র খাবারই সবার ক্ষুধা মেটানোর পাথেয়। এখানে হাজার হাজার জেলে, ভেন্ডর, জ্যোতিষী, ক্র্যাপ-সুটার, শুয়ে-বসে থাকা মানুষ, মাঝি, ভিক্ষুক, সবহারা পথিক যারা শহর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রোদে শুকিয়ে যাওয়া অর্ধউলঙ্গ কংকালসাড় মানুষ সবাই লাঞ্চ টাইমে কাবাবের দোকানে ভিড় করে।
সম্পূর্ন খাবারের দাম সিকি রুপি ( প্রায় আড়াই রিয়াল) এবং বেশিরভাগ মানুষ যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজা দেখতে থাকে তাদের বেশিরভাগই এগুলো কেনার ক্ষমতা রাখে না। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতি ১০ জনের মধ্যে এক বয়া দুইজন মাত্র কিনতে পারে। তারা খুব আনন্দের সাথে খায় যেন একটুকরো স্বর্গ হাতে পেয়েছে। ভিড়ের বাকিরা অবাক হয়ে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
সত্য বলা সম্ভব নয় – বলছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ বোর্ডের এক সুদর্শন বাঙ্গালি। এলাকার সমস্যা নিয়ে বলার সময় তিনি একথা আমাদের বলেন। আমরা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ন দেশ আর আমাদের মাথা পিছু আয় সবচেয়ে কম। খুব দুঃখ নিয়ে বললেন তিনি। ৫৫০০০ বর্গমাইল এলাকায় ৭৫ মিলিয়ন লোকের বাস। এই দশক শেষে জনসংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।
পূর্ব পাকিস্তান একটি সমতল ভূমি। একটি খালি গামলার কেন্দ্রের মত নেপাল ও ভারতের সমস্ত উঁচু যায়গার পানি আমাদের দিকে আসে। প্রতি বছর এটা বন্যায় ডুবে যায় – যখন বর্ষায় বিস্তির্ন সবুজের উপর ভারি বৃষ্টি হয়।
পানি ও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান আমাদের জানান যে ৫ বিলিয়ন ডলার দরকার যদি এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং সেচ নেটওয়ার্ক করতে হয়। যদি বর্তমান জীবনযাপন প্রণালির এমন সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে আর আগামী দুই দশকে এটা করতে হয়। এটা পাকিস্তানের প্রতি বছরের জি এন পির প্রায় এক তৃতীয়াংশ। জাতীয় সরকারের আসলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কোন রিসোর্স নেই।
প্রদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল মহামারির ঝুঁকিতে। সাম্প্রতিক সমস্যায় অর্থ, খাবার এবং প্রচুর শ্রমের ক্ষতিসাধন হয়েছে যা পরিস্থিতিকে আরও মারাত্মক অবস্থায় নিয়ে গেছে। দেশের প্রধান ফসল পাটের অধিকাংশ – যা আমাদের প্রধান অর্থকরি ফসল এবং পাকিস্তানের একমাত্র বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রার উৎস – সেটা খুব সম্ভবত আগামী বছর হারিয়ে যাবে। অনেক জমি পরিত্যাক্ত হয়ে আছে এবং খুব কম মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। পরিস্থিতি যতদিন স্বাভাবিক না হবে ততদিন এটা বিরাজমান থাকবে।
আনারস রপ্তানিতেও দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। ভারত তার দেশের উপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাই আকাশপথে আনারস রপ্তানি ব্যায়বহুল হয়ে পরেছে।
পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে গুপ্ত আক্রমণে প্রধান যোগাযোগব্যাবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে – সকল বাণিজ্যিক যোগাযোগকে মিলিটারি অপারেশনের মত ধ্বংস করা হচ্ছে। বগুড়া, সিলেটের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্রোহীরা কর্মরত আছে – তারা সাধারণ জনগণের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে এবং তাদেরকে জমি চাষ ও ফার্মিংএ বাধা দিচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ বসতি ছেড়ে চলে গেছে এবং সরকারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ উন্নয়ন পরিকল্পনা কাগুজে স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে।
এমনি ব্রিটিশ আমলের চেয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি – কলিকাতার দুরবর্তি পরিত্যাক্ত অঞ্চলের মত আমাদের দারিদ্র্যকে তুলনা করা যায়। ওই সময়ে মালথুসিয়ান পদ্ধতিতে বলা ছিল কলেরা ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারলে এখানে জনগণ টিকতে পারবে না। পাকিস্তান সরকারের ২০ বছরের চেষ্টা এবং অর্ধ ডজন বিদেশি রাষ্ট্রের সাহায্যের ফলে এই এলাকার মানুষ জীবিত আছে – কিন্তু বেশিভাগ আধাপেটে থাকে। এই এলাকার পিছুগামিতার জন্য, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অর্গানাইজেশনের অনিয়মের জন্য ধারাবাহিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান পিছনে পরেছে – তাই এর চাইতে বেশি অগ্রগতি সম্ভব ছিলনা।
মুক্ত অর্থনিতিতে এটাই স্বাভাবিক ছিল। এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ নির্ভর করে লাভের পরিমাপের উপর ও পশ্চিম পাকিস্তানের উপর। পূর্ব থেকে কমপক্ষে ২০০ বছর এগিয়ে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানে স্বাভাবিকভাবেই লাভ বেশি হবে। এটা একটা আচ্ছেদ্য চক্রের মত। পূর্ব পাকিস্তানের খরচে পশ্চিম পাকিস্তান যত উন্নত হবে ততই পূর্ব পাকিস্তান আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে।
গত প্রায় ৩ বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বৃহৎ সংখ্যার জনগণ বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু বছরের পর বছর অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানকে আরও নিচে নেমে যাওয়া থেকে ঠেকানো যাচ্ছেনা।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখন এখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে তাদের পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার আন্দোলন শুরু করার আগে। তারা স্বীকার করেছে যে তাদের ২০ বছর আগে মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল যা তারা দুর্নিতি ও একের পর এক অযোগ্য কেন্দ্রীয় সরকার থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কখন পূর্ব পাকিস্তানের সম্পূর্ন শান্তি ফিরে আসবে তা কেউ কল্পনা করতে পারেনা। প্রায় ৩৫০০০ গেরিলারা ভারতে ট্রেনিং নিচ্ছে। একটি বৃহৎ পরিমাণ জনগণ যারা পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে তাদের ফিরে আসার সম্ভবনা কম। শুধুমাত্র বিদ্রোহী আর গুপ্তঘাতকরা ছাড়া। শক্তিশালী ধ্বংস সাধন করার জন্য ফোর্স কাজ করছে। হারকিউলিয়ান এপক্যালিপ্সের চার ঘোড়সওয়ারিদের থেকে পূর্ব অঞ্চলকে রক্ষা করার মত রিসোর্স পাকিস্তানের নাই
মিলিটারি অথোরিটি জানিয়েছে ভারত তাদের পাকিস্তান বিভক্ত করার ক্যাম্পেইন থামানোর পরে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কাজ শুরু করবে।
কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা – যেমন পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টো মনে করেন বেসামরিক শাসন চালু করলে কিছু একটা উপায় হতে পারে। তিনি আরও বলেন মিলিটারি শাসকদের থেকে কোন বেসামরিক সরকার ব্যাবস্থা ক্ষমতা নিলেও পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ঠিক হতে কমপক্ষে ৫ বছর লাগবে।
কিছু ক্ষুদ্র কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যে দারিদ্র্য ও বিদ্রোহীদের সামলানোর যুদ্ধে আমরা ইতোমধ্যে হেরে গেছি। তারা পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থাকে পুরো দক্ষিণ এশিয়া লণ্ডভণ্ড হবার প্রথম সূচনা বলে মনে করেন।
তারা মনে করেন মিলিটারিরা পূর্ব অঞ্চল ধরে রাখতে পারবে না। এতে করে পূর্ব অঞ্চল আলাদা হবে এবং পরবর্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ভারত থেকে আলাদা হবে। তারা একটি পয়েন্ট উল্লেখ করে বলেন যে – পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন চলছে এবং গত দশক ধরে সেখানে ভারচুয়াল মিলিটারি বাহিনী গড়ে উঠেছে। এইসব ঘটনা পাকিস্তান – ভারত যুদ্ধের অবতারণা করবে যা দক্ষিণ এশিয়ার মোজাইক জাতিগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো করে ফেলবে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ক্ষতি ভারত বা পাকিস্তান কেউই এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু উভয় পক্ষে অস্ত্রধারী বাহিনী আছে যারা মনে করে যুদ্ধই হবে এর চূড়ান্ত সমাধান।
ভারতীয়রা মনে করছে যে পাকিস্তানকে দুই টুকরো করতে পারলে তারা তাদের একতা ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তানিরাও সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে এবং ভারতকে তাদের সাথেই টেনে নিচে নামাবে।
এখানে বড় শক্তিগুলোর কিছু করার আছে।
পশ্চিমারা ভারতকে বাফার স্টেট হিসেবে রাখতে চাচ্ছে এই এলাকায় তাদের প্রভাব বজায় রাখার আশায়। এবং সাথে চায়নাও। অন্যদিকে পিকিং বাফার হিসেবে পাকিস্তানকে চায় ভারতের সাথে সমতা রক্ষার কবচ হিসেবে।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ভাগ্য ওয়াশিংটন বা পিকিং নির্ধারন করতে পারবে না। এটা ঠিক করতে পারে দুই বাংলা – যারা দরিদ্র – যারা ভাবে তাদের হারানোর কিছু নাই – কিন্তু তারা তা করবে যখন তাদের মধ্যে চরম অবস্থা বিরাজ করবে।
পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করছে যে দক্ষিণ এশিয়ার অরাজকতা মানব ইতিহাসের সকল দৃষ্টান্তকে হার মানাবে। দেশভাগের সময় লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে এবং আরেকটি বিভক্তি এখন দ্বারপ্রান্তে। সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার ২০ টি ভিন্ন ভিন্ন জাতি এই বিস্তর ধ্বংসলীলা ও গণহত্যায় সামিল হবে।
পুর্ব পাকিস্তানের গত কয়েক মাসের মর্মান্তিক ঘোটনা পাকিস্তান ও ভারতের মিলিটারি কার্যক্রম বাড়িয়ে তুলেছে। মিলিটারি প্রধানরা একশন নেবার জন্য ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছে। তারা ইসলামাবাদ ও দিল্লি উভয় স্থানেই তাদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও দুই দেশেরই মিলিটারি মাথা ক্ষীণকায় দেহের তুলনায় ভারী। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ অস্ত্রে মুখোমুখি অবস্থান করছে এবং আরও কয়েক লক্ষ অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। যদি সঙ্ঘর্ষ বাধে জানিনা তা কতটা নিষ্ঠুর আকার ধারণ করবে।
যখন নক্সাল বিদ্রোহীরা পশ্চিমবঙ্গে পুরো আক্রমণাত্মক ছিল তখন পাকিস্তান তাদের সব রকম সহায়তা দিয়েছিল ভারতকে দুর্বল করার আশায়। বিদ্রোহীরা পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। এবং তারা চায়নার থেকে যত অস্ত্র পেয়েছিল তার বেশিরভাগ এসেছে দিনাজপুর ও রাজশাহী হয়ে। পরিণতিতে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করা দুর্বিসহ হয়ে গেল। এখন ভারতীয়রা তাদের প্রতিশোধ নিচ্ছে। তারা পূর্ব পাকিস্তানি বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিচ্ছে, ট্রেনিং দিচ্ছে ও অস্ত্র দিচ্ছে। তাছাড়া তাদের সম্পূর্ন রাজনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে। এতে করে হতে পারে দুই বাংলা একীভূত হবার সুযোগ পেতে পারে যারা দুই দেশের কাছে আটকা পরে আছে।
ইয়াহিয়া খানের সরকার সম্ভবত শেষ সরকার হতে যাচ্ছে যারা ভারতের সাথে একটি স্বচ্ছ চুক্তিতে আসতে পারে। কিন্তু এই সরকার চাইলেও নয়াদিল্লী তা ছুড়ে ফেলে দেবে। পাশাপাশি মিসেস গান্ধির সরকার মিলিটারি জান্তার কাছে আটকে যেতে পারে যদি অবস্থা আরও খারাপ হয়। পাকিস্তানকে পিছন থেকে ছুড়ি মারতে যেয়ে শেষে না জানি নিজেদের জন্যই আত্মঘাতী না হয়ে যায়।
কিন্তু এগুলো সবই কৌশল পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। এই মুহুর্তে যা দরকারি তা হল পূর্ব পাকিস্তানকে মহামারি থেকে বাঁচানো এবং পশ্চিমবঙ্গকে অর্থনৈতিক ধ্বস থেকে বাঁচানো – যা হচ্ছে শরনার্থিদের আগমনের জন্য। আমেরিকা ইতোমধ্যে পাকিস্তানকে প্রচুর আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দেবার কথা বলেছে। প্রথম চালান গ্রীষ্ম শেষ হবার আগে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আরও দরকার। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা সমস্ত বিশ্বকে অন্যতম গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। এশিয়ান ট্রাজিডির বীজ থেকে উদ্ভাসিত সমস্যা আজ দারিদ্র্য আর ক্ষুধার বিরুদ্ধে