শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৭। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহায্যে ‘মুক্তি সংগ্রামে সহায়ক সমিতি’ গঠিত |
দৈনিক যুগান্তর | ৬ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ১০৭, ৩১২–৩১৩>
মুক্তি সংগ্রামে সহায়ক সমিতি
সর্বাধিক সাহায্যের ব্যাপক ব্যবস্থা
(স্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা, ৫ই এপ্রিল-বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি আগামী রবিবার, ১১ই এপ্রিল, সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় যে জনসভা ডেকেছেন, বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের কয়েকজন নেতা তাতে বক্তৃতা করতে চেয়েছেন। সমিতির সভাপতি শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় ঐ জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন।
ঐদিন সকালে সমিতির চাঁদা সংগ্রহের জন্য দক্ষিণ ও উত্তর কলকাতা দু’টি মিছিল বার হয়। মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী এই দু’টি মিছিল পরিচালনা করবেন। বিশিষ্ট শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী এই মিছিলে থাকিবেন। একটি মিছিল শ্যামবাজার পাঁচ মাথা থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার এবং অন্যটি গরিয়াহাট থেকে চৌরংগীর দিকে যাবে।
আজ সমিতির এক জরুরী বৈঠকের পর সভাপতি শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় সাংবাদিকদের জানান তাঁরা কৌটো করে চাঁদা সংগ্রহ পছন্দ করে না। এভাবে সংগৃহীত অর্থের অপব্যয় হতে পারে। তাঁরা চান দাতারা মনিঅর্ডার অথবা চেকে অর্থ পাঠান। ৩৪নং ইণ্ডিয়ান মিরার স্ট্রিটে (ফোন ২৪-২০২০) তাঁদের অফিস খোলা হয়েছে। সেখানে রসিদ দিয়ে দান গ্রহণ করা হবে।
নির্ধারিত কোন দিন কৌটো করে চাঁদা সংগ্রহ করা হলে আগে তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানান হবে। রবিবার এইভাবে চাঁদা সংগৃহীত হবে।
শ্রী মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁরা রাজ্যের জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করবেন। মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, পর্থ প্রভৃতির ব্যবস্থা করবেন এবং চিকিৎসকদের দ্বারা সাহায্য দেবেন। আহত মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য রক্ত (প্লাজমা) সংগ্রহ করবেন। সীমান্ত এলাকায় চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল ইউনিট স্থাপন করবেন। মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য বস্ত্র প্রভৃতি প্রেরণ করবেন। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সীমান্তের এপারে চলে আসতে বাধ্য হবেন তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন। স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করবেন এবং বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনা এবং পাকিস্তানী সামরিক চক্রের পৈশাচিক নির্যাতনের বাহিনী সংগ্রহ করে তা প্রচারের ব্যবস্থা করবেন।
২। সহায়ক সমিতি আজকের সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনসাধারণকে তাঁদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য অভিনন্দন জানান হয় এবং পাকিস্তানী সামরিক চক্রের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যা ও নির্যাতনের তীব্র নিন্দা করা হয়।
প্রস্তাবে অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট দাবি জানানো হয়েছে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর গণহত্যা ও নির্মম অত্যাচার বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রসংঘকে অনুরোধ করার জন্য এবং এই ব্যাপারে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র বিশেষ করে আফ্রো-এশীয় রাষ্ট্রগুলি যাতে উদ্যোগী হয় তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সচেষ্ট হতে অনুরোধ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে তাঁদের সর্বতোভাবে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে এবং বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি জানিয়ে এই রাজ্যের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন রাজ্য শাখা রক্ত দানের ডাক দিয়েছেন।
ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান অ্যাণ্ড আফ্রিকান রিলেশনস-এর সভায় বাংলাদেশ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে গণহত্যা চালাচ্ছে আজ তার নিন্দা করা হয়েছে।
কলকাতা বন্দরের শ্রমিক, জাহাজের মালিক, নিয়োগকর্তা, অফিসার এবং কর্মীদের এক সভায় আজ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সাহায্য দানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। পোর্ট কমিশনার্সের চেয়ারম্যান শ্রী কে কে রায় সভাপতিত্ব করেন।
ব্যাংক কর্মীরা একদিনের বেতন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবেন বলে বংগীয় প্রাদেশিক ব্যাংক কর্মী এসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে বলেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে কলকাতা পোর্ট শ্রমিক ইউনিয়ন সামিল হয়েছে। ]
কলকাতার একদল মেডিক্যাল ছাত্র চুয়াডাংগা-দর্শনায় মেডিক্যাল মিশনে গিয়েছিল। তাঁদের মারফৎ চুড়াডাংগা মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্পাদক মোহাম্মদ তাহের উদ্দিন একটি লিখিত পত্রে এ বাংলার সংগ্রামী যুব-ছাত্রদের কাছে সকল প্রকার সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সফল করার উদ্দেশ্যে চাই সহযোগিতা।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৮। সাহায্যের আহবান জানিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিক- বুদ্ধিজীবী সমিতির বিবৃতি |
দৈনিক যুগান্তর | ৮ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ১০৮, ৩১৪–৩১৫>
বাংলাদেশের সাহায্যে শিল্পী–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবী সমিতির আবেদন
বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি নামে একটি সংস্থা সম্প্রতি গঠিত হয়েছে। ঐ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন শ্রী তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, এবং সম্পাদক হিসেবে আছেন, শ্রী মণিন্দ্র রায়, শ্রী নররেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও শ্রী দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। সমিতির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছেন ডাঃ মণীন্দ্রলাল বিশ্বাস এবং সহ-সভাপতিমণ্ডলীতে আছেন-সর্বশ্রী অজিত দত্ত, অন্নদা শংকর রায়, অমলাশংকর, উদয়শংকর, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, গোপাল হালদার, জ্যোতি দাশগুপ্ত, দক্ষিণারঞ্জন বসু, ডাঃ নীহার কুমার মুন্সী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান যুদ্ধ-পরিস্থিতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত আবেদন প্রচার করা হয়েছেঃ
ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বাধিকারবোধ ও মানবিক মর্যাদার পবিত্র অনুভবকে ট্যাংকের চাকায় পিষে ফেলতে চাইছে। প্রকৃতির আশীর্বাদ, কবির স্বপ্ন নদী-মেঘলা-শোভিতা এই শ্যামল ভূখণ্ড ও তার সাড়ে সাত কোটি মানব সন্তানকে আধুনিকতম মারণাস্ত্রের সাহায্যে একদল নরপিশাচ ঝলসে মারতে চায়।
নাপাম বোমার আগুনে তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শনগুলি, বহু স্মৃতি ঘেরা জনবসতি অঞ্চল, এমনকি গায়ের সবুজ মাটিকে পর্যন্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে। গোটা জাতির স্বপ্ন, শ্রম আর সম্পদে নির্মিত সেতু, বাঁধ ও প্রকল্পগুলিকে তারা বেছে বেছে ধ্বংস করছে। শাশ্বত-সাধনার পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এই জংগী চক্র কামান দেগে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বিখ্যাত কারমাইকেল কলেজ এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মূল্যবান গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার ঘাতকেরা ধ্বংসা করেছে। সংবাদপত্রের কার্যালয়কে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। বোমা ফেলে মর্টার ছুড়ে হাসপাতাল ভবনে জ্বেলেছে নরকের ভয়াবহ আগুন। মন্দির-মসজিদ-চার্চের পবিত্রতাটুকুও ঐ যুদ্ধোন্মাদ রাক্ষসদের নখ এবং দাঁতের কামড় থেকে রক্ষা পায়নি।
হত্যা ও রক্তের নেশায় জঙ্গী ইয়াহিয়া চক্র উন্মাদ হয়ে গেছে। খবর এসেছে কয়েক লক্ষ লোক মারা গিয়েছে-নিজেদের দেশে মানুষের অধিকারে মায়ের ভাষায়, কথা বলে যারা শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিল। অতর্কিত আক্রমণের শিকার, কামানোর খোরাক, কয়েক লক্ষ অমৃতের সন্তান পচা গলা শবদেহ হয়ে শহরে বন্দরে গ্রামে শুকুনির খাদ্য হচ্ছে। তাদের কবর দেবার, দাহ করবার কোন ব্যবস্থা হয়নি। ইয়াহিয়ার উদ্যত সংগীন কয়েক লক্ষ শবেদেহকে নিয়ত পাহারা দিচ্ছে, দেশবাসী যাতে শহীদদের প্রাপ্ত মর্যাদাটুকু দিতে না পারে।
নর-নারী শিশু-বৃদ্ধ কে মরেনি? শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবী চাকুরে ব্যবসায়ী-কে মরেনি? শিল্পী, সাহিত্যিক সাংবাদিক অধ্যাপক, কে মরেনি?
দানবরা মায়ের দুই স্তন কর্তন করে রক্তের উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার মধ্যে অবোধ শিশুর মুখ চেপে ধরেছে। আড়াই বৎসরের বাচ্চাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে গোলা ছুড়েছে। ইজ্জত লুট করে তারপর বাংলাদেশের মা ও বোনদের সংগীন দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান আচার্যদের সারিবন্দি দাঁড় করিয়ে গুলি ছুড়েছে। হাসপাতালের প্রত্যেকটি রোগীকে গুনে গুনে খুন করেছে।
কিন্তু নতুন মর্যাদাবোধে উদ্ধুদ্ধ সত্য ও সুন্দরের উপাসক বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৃত্যুঞ্জয় প্রতিরোধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বীর রোশেনারা বেগম বুকে মাইন বেঁধে জল্লাদের ট্যাংকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের কিশোরী দেহের সংগে একটা আস্ত প্যাটন ট্যাংকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ফৌজীদের হাত থেকে একের পর এক ঘাঁটি কেড়ে নিচ্ছে। গোটা বাংলাদেশ আজ একটিই অস্তিত্ব হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করছে। বাংলাদেশ জিতছে।
পশ্চিম বংগের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী আমরা, রবীন্দ্রনাথের উত্তর পুরুষ আমরা, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে নীরব বা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা ভুলিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এবং ভারতবর্ষের ভূমিকা। আমরা আমাদের মহান ঐতিহ্যকে কিছুতেই ভুলতে পারি না।
তাই আমরা ‘বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’ গঠন করছি।
আমাদের নিজ নিজ ক্ষেত্র ও নিজ নিজ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা এক ভাবগত আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই। আমরা চাই শুধু পশ্চিম বংগ নয়, শুধু ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবিক শুভবুদ্ধি বাংলাদেশের নবজাত সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং সর্ববিধ সাহায্য নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য এক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরু করুক।
সেই সঙ্গে আমরা বিপন্ন মানবতার পক্ষে বাস্তব ও প্রত্যক্ষ সাহায্যও সংগ্রহ করতে চাই। সীমান্তের ওপারে এই মুহূর্তে দরকার ঔষধ, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, গুঁড়ো দুধ ও বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাদ্য। আর তা কেনার জন্য দরকার টাকা পয়সা।
পশ্চিম বংগের মানুষ। রাজপথ, বস্তি, কুটির অথবা অট্টালিকা-যেখানেই আপনি বাস করুন, অবিলম্বে আপনার যতখানি সামর্থ্য তার থেকেও বেশি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসুন। ১৪৪ লেলিন সরণি, কলকাতা-১৩ (টেলিফোন : ২৪-৩৯৩০)-এই ঠিকানায় সমিতির কার্যালয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উপযুক্ত রসিদের বিনিময়ে আপনার সাহায্য ধন্যবাদের সংগে গৃহীত হবে।
সীমান্তের ওপারে এই মুহূর্তে দরকার রক্ত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজপথ, বৃতি, কুটির অথবা অট্টালিকা-যেখানেই আপনি বাস করুন অবিলম্বে ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের কার্যালয়ে (৬৪ লেলিন সরণি, কলকাতা-১৩। সময় : বেলা ২টা থেকে ৬টা) গিয়ে রক্ত দান করুন। আপনার এই ভালবাসা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গৃহীত হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ-বাংলাদেশের আহবানে সাড়া দিন। সেই শিশুটিকে স্মরণ করুন-মায়ের বুকের রক্তের ফোয়ারায় যার মুখ গুঁজে ধরা হয়েছিল। ওর খাদ্য দরকার। সেই জননীকে স্মরণ করুন-পশুরা যার অংগচ্ছেদ ঘটিয়েছে। মা’র চিকিৎসার দরকার। সেই কিশোরটির কথা স্মরণ করুন-ফ্রন্টে আহত যে বীর ক্যাম্পে শুড়ে আছে, দুই চোখে অধীর প্রত্যাশা নিয়ে যে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, পশ্চিমবঙ্গের দিকে। ওর রক্ত দরকার। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আপনি যেই হোন, যেখানেই থাকুন, একবার বিপন্ন বাংলাদেশের কথা ভাবুন। তার দরকার টাকা। কারণ ঔষধ আর খাদ্য কিনতে হবে।
আমাদের মনুষ্যত্ব জাগ্রত হোক। আমাদের বিবেক শুভবুদ্ধির আহবানে সাড়া দিক। যেন ভুলে না যাই ইতিহাসের অগ্নি পরীক্ষায় আমাদেরও উত্তীর্ণ হতে হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৯। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে কোলকাতায় অধ্যাপকদের বিক্ষোভ মিছিল |
দৈনিক যুগান্তর | ৯ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ১০৯, ৩১৬>
বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে
অধ্যাপকদের বিক্ষোভ মিছিল
(স্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা, ৮ই এপ্রিল-পরাস্ত বেসামাল ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশে যে বেপরোয়া গণহত্যা চালাচ্ছে তার প্রতিবাদে আজ পশ্চিম বাংলার অধ্যাপকরা মহানগরীতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তার আগে রাজা সুবোধ মল্লিক স্বোয়ারে একটি প্রতিবাদ সভাও হয়।
সভার পর রাজ্যের অধ্যাপকদের বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন পথ প্ররিক্রমা করে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন এবং পরে বর্মার দূতাবাসের সামনে যায়। অধ্যাপক সমিতির পক্ষ থেকে দুই দূতাবাসের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে দু’টি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান হয়।
শিক্ষক সমিতি
বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি বাংলাদেশের সাহায্যে দেশবাসীকে এগিয়ে আসতে আহবান জানিয়েছেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১০। কোলকাতায় ছাত্র যুবকদের বিক্ষোভ মিছিল | দৈনিক যুগান্তর | ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ১১০, ৩১৭>
কলকাতায় মিছিলঃ পাক জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে ধিক্কার
(স্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা, ১০ই এপ্রিল-বাংলাদেশে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলন অদম্য মুজিব সেনাদের জয়ধ্বনিতে আর মরীয়া জঙ্গীশাহীর বেপরোয়া হত্যালীলা ও বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঘৃণায় ধিক্কারে এই শহরের রাজপথ আজ মুখরিত ছিল।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন এবং গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের ডাকে এদিন ছাত্র যুবকরা মহানগরীয় পথে পথে বিক্ষোভ মিছিল করে।
তার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে এক বিরাট সমাবেশে একটি প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে দাবি জানান হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত রকম সাহায্য পাঠান হোক সীমান্তের বেড়া তুলে দিয়ে মুক্তি সংগ্রামকে সাহায্য করা হোক।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে যে, ইয়াহিয়া খাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকচক্র একদিকে যেমন মার্কিন, অস্ত্রগুলি ব্যবহার করছে বাংলাদেশের জনসাধারণের বিরুদ্ধে। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক রুশ ও চীনের অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রী দীনেজ মজুমদার, এমএলএ। প্রস্তাব পেশ করেন শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য। বক্তা ছিলেন সর্বশ্রী বিমান বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী প্রমুখ।
বিশ্ববিদ্যালয় লনে স্থানাভাব হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে ট্রাম লাইনে এসেও জমায়েত হয়।
সভায় বক্তারা দুই বাংলার সীমান্তে গিয়ে অহেতুক ভিড় না করার জন্য সবার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
সভার পর যুব ছাত্রদের মিছিল বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে এসপ্লানেড ইস্টে যায়। সেখান থেকে রাজ্যপালের উদ্দেশ্যে একটি স্মারকলিপি পাঠান হয়।
পাক ডেঃ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ
পত্রিকা গ্রুপের সাংবাদিক এবং অসাংবাদিকরা আজ এখানে পাক ডেপুটি হাইকমিশনের অফিসের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বাংলাদেশে অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানাতে থাকেন।
অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর এবং অমৃতের কর্মীরা যে স্মারকলিপি দিয়ে আসেন, তাতে শ্রী দীপক বন্দোপাধ্যায় (অমৃতবাজার পত্রিকা) এবং শ্রী সুরজিত ঘোষালের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করা হয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১১। বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নঃ ভারত সরকারের এত দ্বিধা, এত ভয় কেন? বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লিখিত নিবন্ধ | দৈনিক যুগান্তর | ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ১১১, ৩১৮–৩২০>
ভারত সরকারের এত দ্বিধা, এত ভয় কেন?
-বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়
আমাদের চোখের সামনে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এক আশ্চার্য নাটক অভিনীত হইতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ধাপ্পাবাজী, শঠতা এবং গণতন্ত্র হত্যার বর্বরতার অবসান হইতে চলিয়াছে। জাতি-বিদ্বেষ ও সম্প্রদায়-বিদ্বেষে অন্ধ রাওয়ালপিণ্ডি যে শয়তানি চক্র একদিকে ভারতবর্ষ এবং অন্যদিকে বাঙালির জাতীয় সত্ত্বা ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করিবার জন্য গত ২৪ বৎসর ধরিয়া নিরন্তর শত্রুতা করিয়া আসিতেছিল, আজ তার প্রতিরোধের পালা শুরু হইয়াছে। আজ ইতিহাসের চাকা বিপরীত দিকে ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঘাত প্রতিঘাত সম্পর্কে যারা অজ্ঞ, উদাসীন একমাত্র তারা ছাড়া আর সকলেই উপলব্ধি করিতেছেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের তরঙ্গ শুরু হইয়াছে, আসন্ন দিনগুলিতে সেই তরঙ্গ উত্তাল হইয়া সমগ্র মহাদেশে নতুন প্লাবন ডাকিয়া আনিবে। গত ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরের আম্রকুঞ্জে এক অনাড়ম্বর উৎসবের মধ্যে স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী বাংলা রাষ্ট্রের যে উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সংশয়বাদীরা তাকে তাচ্ছিল্য করিতে পারেন, অতি বুদ্ধিমানেরা তাকে উপহাস করিতে পারেন। কিন্তু অগ্নিগর্ভ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে তাকাইয়া আমরা বলিতে পারি যে, রাষ্ট্র স্বাধীনতার যে বীজ মুজিবনগরে উপ্ত হইয়াছে, আজ থেকে কাল থেকে-পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে কিম্বা তার আগেই সে বিরাট মহীরুহে পরিণত হইবে। কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, বোমারুর দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জয়যাত্রাকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদারেরা ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না। কারণ যে স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করিতেছে সাত কোটি বাঙালী তাকে বুকের রক্ত দিয়া রক্ষা করিবে। জননীর মমতা এবং জনকের শক্তি দিয়া এই নবজাতকে জীবনের পথে অগ্রসর করিয়া দেওয়া হইবে। এই বিষয়ে কাহারও সন্দেহ ও সংশয় থাকা উচিত নয়। এই পুরোনো পৃথিবী ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এই সেই ধ্বংস, হত্যাকাণ্ড ও রক্ত হইতে নতুন পৃথিবী জন্মলাভ করিতেছে। ভুট্টো-ইয়াহিয়া খান এবং ধনিক-বণিক-সামরিক চক্র অবশ্যই ক্ষেপা কুকুরের মতো যত্রতত্র কামড় বসাইবে, কিন্তু ইতিহাস এই ক্ষিপ্ত জানোয়ার আগাইয়া যাইবে।
বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র পল্লীর এক নিভৃত ভূমিতে জন্মলাভ করিয়াছে। গ্রামময় বাংলাদেশের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। নিভৃত পল্লীর এই দীপশিখা ইতোমধ্যেই জ্বলন্ত মশালের রূপ ধারণ করিতে চলিয়াছে। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলার রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিসভা এবং সশস্ত্র বাহিনী নতুন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। দেশ-বিদেশে এই বার্তা সংবাদপত্র ও রেডিও মারফৎ ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সর্বত্র নিদারুণ ঔৎসুক্য ও উত্তেজনা। এই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম বিদেশী দূতাবাস ভারতবর্ষ-এই কলিকাতায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। গত ১৮ই এপ্রিল কলিকাতায় পাক-ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামাইয়া ফেলা হইয়াছে এবং স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের নতুন জাতীয় পতাকা উড্ডীন হইয়াছে। ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলী এবং তার সহকর্মী বাঙালী অফিসারবৃন্দ নতুন বাংলা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছেন। অর্থ্যাৎ স্বাধীন বাংলা সরকারের কূটনৈতিক প্রধানরূপে জনাব হোসেন আলী তাঁর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। ইতিপূর্বেই নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশন থেকে দুইজন বাঙালি কুটনীতিক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া ভারতবর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন এবং নতুন বাংলা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিয়াছেন। পাকিস্তানের অন্যান্য বাঙালি অফিসার এবং কর্মীরা, নাবিক ও লস্কররাও একে একে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিতেছেন। ওদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ সার্বভৌম অধিকার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে এক নূতন রাষ্ট্রিক ঐক্যের মধ্যে সংহত করিতে চলিয়াছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধিবাসীর অন্ততঃ শতকরা ৯৫জন এই নূতন রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। তারা পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীকে এবং তার নৃশংস নরঘাতী শাসনকে অপরিসীম ঘৃণায় উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করিয়াছেন। অর্থ্যাৎ এতটি সংহত স্বাধীন নতুন রাষ্ট্রের রূপরেখা বাস্তব মূর্তি ধারণ করিয়াছে।
উপরে পর পর এই নাটকীয় ঘটনাবলীর কথা আমরা উল্লেখ করিলাম এই জন্য যে, একটি নতুন সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে, যে অবস্থার উদ্ভব প্রয়োজন, সীমান্তের গুলি দেখা গিয়াছে। সুতরাং ভারত সরকার কেন অবিলম্বে এই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতেছে না, এটাই আমাদের সবচেয়ে জরুরী জিজ্ঞাস্য। নয়াদিল্লীর কর্তারা কি এখনও তীরে দাঁড়াইয়া আরব সাগরের ঢেউ গুনিবেন? বাংলাদেশে যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে খুন করা হইতেছে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ এবং বুদ্ধিজীবি নির্বিশেষে পাইকারি নরঘাতন পর্ব চলিতেছে এবং মুক্তিফৌজ যখন অমিত বিক্রম সত্ত্বেও শহরে শহরে মারণাস্ত্র সজ্জিত মডার্ন আর্মকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিতেছেন না, তখন যদি ভারত সরকার কেবল দ্বিধা, দ্বন্ধ এবং সংকোচ ও ভয় নিয়া কালহরণ করিতে থাকেন, তবে সীমান্তের বিপদ আরও ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিবে। ভারত সরকার এবং বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেন মনে রাখেন যদি বাংলাদেশ এই জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে চূড়ান্ত পরাজয় মানিয়া লইতে বাধ্য হয়, তবে আগামী একশ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর কোনদিন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না। সেখানে সমস্ত গণতন্ত্রবাদী অসাম্প্রদায়িক মানুষের এবং বিশেষভাবে মাইনরিটিরা একেবারে শেষ হইয়া যাইবে এবং তারপর পাকিস্তান ও চীন একজোট হইয়া ভারতবর্ষের ঘাড় মটকাইবার চেষ্টা করিবে-যে চেষ্টা চলিতেছে গত এক যুগ ধরিয়া। এই নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিভাবে উপেক্ষা করিতে পারেন এবং কিভাবেই বা ভুলিয়া যাইতে পারেন যে, গত ১৯৪৬ সাল হইতে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চলিতেছে, যার ফলে ভারতবর্ষকে কাটিয়া দুই টুকরা করিতে হইল এবং তারপর থেকে ২৪/২৫ বছর ধরিয়া আমরা নিরন্তর যে যন্ত্রণায় ভুগিতেছি, আজ সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তানী উৎপাত ও শয়তানীকে বধ করিবার জন্য বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের প্রতি হাত বাড়াইয়া দিব না- সেই শক্ত হাতি কি আমরা কামান, বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্র তুলিয়া দিব না? কিসের ভয়, কিসের দ্বিধা, কিসের এত সংকোচ? আজ যদি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকার নূতন বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন, তবে আগামীকাল সোভিয়েট রাশিয়া অগ্রসর হইয়া আসিবে-কিন্তু ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কি আশা করেন যে, আমাদের কর্তব্য ও দাযিত্ব আমরা পালন করিব না কিন্তু আশা করিব যে সোভিয়েট রাশিয়া ও আমেরিকা আসিয়া আমাদের উদ্ধার করিবে? যে সাহসী, যে বীর তাকেই পৃথিবীর লোকে সম্মান করে আজ আন্তর্জাতিক জগতে ভারতবর্ষের চেহারা নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ভারত সরকার যদি বাংলাদেশের পাশে আজ সাহসের সঙ্গে দণ্ডায়মান হন তবে সেই শক্তিমান ও সাহসী ভারতবর্ষকে পৃথিবীর লোকে আবার সম্মান করিবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার সরণ সিং যেন মনে রাখেন তার এই দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির গোজালি কোথাও শ্রদ্ধা উদ্রেক করিতেছে না। আজ যদি তিনি ও তার দপ্তর বাংলাদেশের সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেন তবে কালই আফ্রো-এশীয় দেশগুলিতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে নতুন মমত্ববোধ শুরু হইবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র পরিস্থিতি সহানভূতির সঙ্গে বিবেচনা করিবে। আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী বগজীবন রামের উদ্দেশ্যে বলিতেছি-পার্টিশনের পর থেকেই ভারতবর্ষ দুই ফ্রণ্টের বেকায়দায় পড়িয়াছে। একদিকে পাকিস্তানী এবং অন্যদিকে চৈনিক আক্রমণের আশঙ্কা (তাঁরা নিজেরাই মাঝে মাঝে এজন্য হাঁক-ডাক ছাড়িতেছেন)-এই দুই ফ্রন্টের বিপদ কাটিয়া যাইবে যদি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। পাকিস্তান ও চীনের একত্র যোগসাজশে ভারতবর্ষের উপর বিষম চাপ সৃষ্টি হইতেছে এবং হাজার কোটি টাকা মিলিটারি বাবদ ব্যয় হইতেছে। এই নুইসেন্স এবং এই সামরিক বিপদ হইতে উদ্ধার পাওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় স্বাধীন বাংলাদেশের নিজের পায়ে দাঁড়াইতে সাহায্য দেওয়া-যে সাহায্য কূটনৈতিক এবং সামরিক উভয় প্রকার।
সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরণ সিং এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের উদ্দেশ্যে জনসাধারণের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নামে যে গণতন্ত্র স্বাধীনতাকে বর্বরেরা আজ নির্মমভাবে হত্যা করিতেছে আমরা আবেদন জানাইতেছি অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দল, সমস্ত আইনসভা এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমস্বরে ওই দাবি উত্থাপন করিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামে ভারতীয় জনতার নিকট শপথ গ্রহণ করিয়াছেন এবং ভারতীয় জনতা তাহাকে বিশ্বাস করিয়া নির্বাচনে জয়মাল্য অর্পণ করিয়াছেন। ইন্দিরাজী কি সেই শপথ পালন করিবেন না? তিনি যেন মনে রাখেন রাষ্ট্রচালনা ও রক্ষা করতে হইলে কূটনৈতিক বুদ্ধি ও চাতুর্থ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সাহসের এবং সংকল্পের। সেই কূটনৈতিক বুদ্ধি ও সাহস মুহূর্ত আজ উপস্থিত। এক শতাব্দীর মধ্যেও এমন সুযোগ আর আসিবে না- রাওয়ালপিণ্ডির ফ্যাসিস্ট দুশমনদিগকে ঘায়েল করিতে হইবে। শত্রুর শেষ রাখিতে নাই, প্রাচীন কূটনৈতিক মন্ত্রী মহোদয় যেন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে ভুলিয়া না যান। সুতরাং ভীতি ও সংকোচ তারা কাটাইয়া উঠেন।
নয়াদিল্লী প্রভুদের উদ্দেশ্যে আর একটি কথাও সবিনয়ে নিবেদন করিতে পারি। চীন ইয়াহিয়া খানের পক্ষ হইয়া যত তর্জন-গর্জনই করুক না কেন শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতির স্বাধীনতাকে হাতে-কলমে দমন করিবার জন্য তারা হিমালয় পার হইয়া সমতল ভূমিতে নামিয়া অস্ত্র ধারণ করিবে না।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১২। বাংলাদেশের সমর্থনে দিল্লিতে সর্বভারতীয় সাহায্য সংস্থা গঠিত | অমৃতবাজার পত্রিকা | ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ |
Jayanta Sen Abir
<১২, ১১২, ৩২১–৩২২>
বাংলাদেশের জন্য জাতীয় সাহায্য সংস্থা
(আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাপ্ত)
নয়াদিল্লি, এপ্রিল ১৩ – বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান ও একই লক্ষ্যে গঠিত অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় বজায় রাখতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা তৈরির লক্ষ্যে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। আজ প্রফেসর সমর গুহ, এম পি, এর ঘোষণা দেন।
তাঁর কমিটি দ্রুতই কোলকাতায় বাংলাদেশের স্বপক্ষে এক জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করবে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্ভব সবরকম সহযোগিতা প্রদানেরও চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কমিটিতে আছেনঃ অনারারি সভাপতি – জনাব এম সি চাগলা; দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি – জনাব কারপুরি ঠাকুর, মুখ্যমন্ত্রী, বিহার; সচিব – প্রফেসর সমর গুহ। বাকিদের মাঝে আছেন বিনা ভৌমিক, পান্নালাল দাশ গুপ্ত, জাহাঙ্গীর কবির, কৃষ্ণ কুমার শুক্লা, সুশীল ধারা, প্রফেসর দিলীপ চক্রবর্তী এবং সরদার আমজাদ আলী।
পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যেমন পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং নাগাল্যান্ড এই সবকটির মুখ্যমন্ত্রীকে কমিটির সদস্য/পরামর্শক হবার জন্যে আহ্বান জানানো হয়েছে।
আজ এখানে এক সংবাদ সম্মেলনে বিবৃতি দানের সময় প্রফেসর সমর গুহ, এম পি, বাংলাদেশের জন্য জাতীয় সমন্বয় সংস্থার আহ্বায়ক-সচিব বলেন যে “ভারত ও রাশিয়ার সরকারের উচিৎ কোন কালবিলম্ব না করেই বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং অন্যান্য বিশ্বশক্তির দ্রুত স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে এই সরকারের পক্ষে জোরদার কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমনে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন প্রদান এবং ভারতীয় সাহায্যকে শ্লথ করার লক্ষ্যে ভারতীয় সীমান্তে ১০ ডিভিশন সেনা নিয়োজিত করার মাধ্যমে চীন তাদের কদর্য রূপের প্রকাশ ঘটিয়েছে। বর্ষা আরম্ভ হবার আগেই বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণকে ধ্বংস করে দেবার লক্ষ্যে ভারতে আসবার পথগুলোতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের বর্বর আক্রমণ শুরু করেছে। ”
তিনি আরো উল্লেখ করেন যে জাতিসংঘ এক মৃতপ্রায় সংস্থায় পরিণত হয়েছে বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো তাদের বিবেক হারিয়ে ফেলেছে।
রাজস্থান ১০ লাখ রুপি সাহায্য করবে
জয়পুর, এপ্রিল ১৩ – রাজস্থানের মন্ত্রীসভা আজ বাংলাদেশ রিলিফ ফান্ডে ১০ লাখ রুপি সাহায্য প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আজ রাজস্থান আইন পরিষদের অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী জনাব মোহনলাল শুখাদিয়া এই ঘোষণা দেন। পরিষদের উভয় পক্ষই এই সিদ্ধান্তকে উল্লাসধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানান।
জনাব শুখাদিয়া আরো যোগ করেন যে রাজ্য সরকার একটি সুসজ্জিত মোবাইল সার্জিক্যাল ইউনিটও পাঠাবে যার সম্পূর্ণ খরচও রাজ্য সরকারই বহন করবে।
জনাব শুখাদিয়া আরো বলেন যে সংঘর্ষ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিষদের মন্ত্রী ও সদস্যেরা প্রতিমাসে তাদের একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণের সাহায্যে দান করবেন, এমন একটি প্রস্তাবনাও বিবেচনাধীন আছে (পিটিআই)।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৩। রাষ্ট্রসংঘ থেকে পাকিস্তানকে বহিষ্কারের দাবী জানিয়ে বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতির প্রস্তাব | দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড | ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ |
Jayanta Sen Abir
<১২, ১১৩, ৩২৩–৩২৪>
বাংলার বুদ্ধিজীবীদের সহায়ক সমিতি গঠন
বুধবার ড. এস. এন. সেন, উপাধ্যক্ষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর সভাপতিত্বে সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি (বাংলার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমর্থন প্রাপ্ত) এর পরিচালনা পর্ষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আরো সভাপতিত্ব করেন সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি, প্রফেসর নির্মল ভট্টাচার্য।
সমিতির সাধারণ সচিব কমিটির সামনে খসড়া আহ্বান এবং কর্মসূচির তালিকা উপস্থাপন করেন যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কমিটির পক্ষ থেকে জনাব সুব্রত মুখার্জী, এমএলএ “সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি” এবং মুখ্যমন্ত্রী জনাব অজয় কুমার মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়ক কমিটি” এর মাঝে সংযোগ রক্ষা করবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
ড. সুনীল কুমার চ্যাটার্জি, কনাব তদ্র শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, জনাব তুষার কান্তি ঘোষ, বিচারপতি সুন্দর প্রসাদ মিত্র, বিচারপতি এস. এ. মাসুদ, ড. শৈলেন্দ্র নাথ সেন, ড. রমা চৌধুরী, জনাব অশোক কুমার সরকার, জনাব শুধাংশু কুমার বসু, শ্রী বিবেকানন্দ মুখার্জী, জনাব সুকোমল কান্তি ঘোষ, জনাব মনোজ বোস, জনাব প্রবোধ কুমার স্যানাল, প্রিন্সিপাল পি. কে. বোস, ড. প্রবীর বসু মল্লিক, জনাব সাইবাই গুপ্ত, প্রফেসর নির্মল চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং অন্যান্যরা এক আহ্বানে বলেনঃ
নিরস্ত্র বেসামরিক নারী-পুরুষ-শিশুর যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ড, নারীদের উপর অত্যাচার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রেমী জনগণের ওপর পাকিস্তানী সামরিক জান্তার চালানো অন্যান্য নৃশংসতার খবর দৈনিক পত্রিকাগুলোর পৃষ্ঠায় নিয়মিতই উঠে আসছে, তার জন্যে কোনরূপ বর্ণনার প্রয়োজন পড়ে না। যখন ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা অমানবিক ও স্বৈরাচারী শাসক কর্তৃক লাখো বাঙালি অবর্ণনীয় শোষণের স্বীকার হচ্ছে তখন সীমান্তের এপারের জনগণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যেতে পারে না। “বাংলাদেশ” এর জনগণের এই ধর্মযুদ্ধ দীর্ঘকাল ধরে চলবে। সুতরাং ভারতীয় জনগণের জন্য বাংলাদেশের জনগণের সুবিধার্থে ত্রাণ ও অন্যান্য সহযোগিতার ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যকীয় যাতে করে তারা যে আদর্শের জন্য লড়াই করছে তা অর্জনের লক্ষ্যে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে।
এই প্রচেষ্টার সফলতার জন্য স্বার্থত্যাগী তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের দরকার হবে যারা প্রয়োজন পড়লে যেকোনো সহযোগিতা প্রদানে প্রস্তুত থাকবে।
আমরা সাধারণভাবে জনগণের কাছে এবং বিশেষভাবে উৎপাদনকারীদের নিকটে টাকা বা দ্রব্যসামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে এই সহযোগিতা প্রকল্পে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। ত্রাণকার্যের জন্যে এইসকল দ্রব্যাদি এখন খুবই জরুরিভাবে দরকারঃ পেট্রল অথবা মবিলের টিন, সাইকেলের টায়ার এবং টিউব, টর্চ ও ব্যাটারি, পানির বোতল, রাবারের জুতা, ম্যাচকাঠি, গুঁড়ো দুধ, লবণ, সরিষার তেল, কেরোসিন প্রভৃতি। ওষুধের মধ্যে দ্রুত যেগুলো প্রয়োজন সেগুলো হলঃ টি.এ.বি.সি. ইনজেকশন, ভ্যাকসিন, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দরকারী সবরকম ওষুধ।
আমরা সকলের কাছে টাকা অথবা দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে প্রদেয় তাদের সহযোগিতাগুলো জনাব সন্তোষ কুমার ঘোষ, কোষাধ্যক্ষ, সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি (১০৭/সি, আশুতোষ মুখার্জী রোড, কলকাতা, ফোনঃ ৪৭-৪০২০৩১, সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে) এর নিকট পৌঁছে দিতে আহ্বান জানাচ্ছি।
স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদানের জন্যে যোগাযোগ করুন জনাব বিনয় সরকার, সাধারণ সচিব, “সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি” এর সাথে (আইএ কলেজ সারি, কলকাতা-৮, ফোনঃ ৩৪-৭৩১১) এর সাথে, রাত আটটা থেকে নটার মধ্যে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৪। পাকিস্তানী নৃশংসতার বিরুদ্ধে কোলকাতার শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ | অমৃতবাজার পত্রিকা | ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ১১৪, ৩২৫>
পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে কোলকাতার শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ
অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
পিটিআই এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কোলকাতার শিখ সম্প্রদ্রায় বুধবার বাংলাদেশের মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছে।
খালসা পান্থ এর ২৭৩ বছর পূর্তিতে জগত সুধার গুরুদুয়ারার বৃহৎ সভাতে শিখ সম্প্রদ্রায় বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বাংলাদেশের নিরীহ এবং নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু, তাদের শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উঠতি শিল্প ধংসের নিন্দা জানান। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে বাঁধা দিচ্ছে বলে জানানো হয়।
সভায় সকল শিখদের কাছে মানবতার খাতিরে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সামর্থ্যমত অনুমোদিত মাধ্যমে সাহায্য করার আহ্ববান জানানো হয়।
সভাপতি সরদার মাহের সিং গরীব এবং শ্রী গুরু সিং সাবহা কোলকাতার শিখদের পক্ষ থেকে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রি আজয় কুমার মুখারজির কাছে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ৫১০০ রুপি প্রদান করেন।
স্বাক্ষর সংগ্রহ
ইউআই এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের ‘অভিযাত্রী’ ক্লাবের পরিচালিত গণস্বাক্ষর সংগ্রহ আয়োজন করা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন করা হচ্ছে।
এই প্রচারাভিজানের উদ্বোধন করেন প্রথিতযশা শিল্পি জামিনি রায়। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রি এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট যে পিটিশন উপস্থাপন করা হবে, তাতে স্বাক্ষর করেন।
পিটিশনের কপি নিয়ে ক্লাবের সদস্যরা শহরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েন। সমগ্র রাজ্য জুড়ে এই প্রচারাভিযান চলবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৫। বাংলাদেশ তহবিলে সাহায্য দানের জন্য ক্ষুদ্র শিল্প সমিতির আহবান | অমৃতবাজার পত্রিকা | ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ১১৫, ৩২৬>
বাংলাদেশের তহবিলের জন্য ক্ষুদ্রশিল্পগোষ্ঠীর আহ্ববান
(স্টাফ রিপোর্টার)
ভারতের ক্ষুদ্রশিল্প সমিতি পশ্চিমবঙ্গের সব ক্ষুদ্রশিল্প মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সমিতির তহবিলে বাংলাদেশে যুদ্ধরত সীমাহীন দুঃখী মানুষদের সাহায্য করার জন্য।
আঞ্চলিক সচিব ক্ষুদ্র শিল্পপতিদের কাছে আবেদন করেন তারা যেন স্বেচ্ছায় সাহায্য করেন এবং পূর্ব আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঠিকানা পি- ৩১ সি টি আই রোড ক্যালকাটা- ১৪ তে তাদের অনুদান প্রেরণ করেন।
হুগলীতে ভাদ্রেশ্বর সারাদাপালি এর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মদিন উদযাপন কমিটি রামকৃষ্ণ মিশনে বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগে সাহায্য ও সহোযোগিতা করার জন্য ১০০ রুপি প্রদান করেছে।
আনন্দ মারগা-এর ত্রাণ সচিব বুধবার ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যের জন্য রান্না করা খাবার বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে বিতরন করা হবে। এই ক্যাম্পগুলো হরিদাসপুর টাকি, পশ্চিমবঙ্গ ও বিলোনিয়া এর Gede, খোয়াই, ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা এবং কোচবিহার এর দিনহাটার সীমান্তগুলোতে পরিচালনা করা হচ্ছে। আসামের গোয়ালপাড়ার হিলি এবং মানিক চকে দুটি নতুন কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
৮ এপ্রিল রায়টার্স বিলডিং এ কলকাতা মোটর ব্যবসায়ী সমিতি ১০০০০ টাকা মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে হস্তান্তর করে। টাকাটা বাংলাদেশের সংগ্রামী দুঃখী মানুষদের জন্য তহবিলে প্রদান করা হয়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৬। মসজিদের উপর বোমাবর্ষনের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়
|
অমৃতবাজার পত্রিকা | ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ১১৬, ৩২৭>
মসজিদের উপর বোমা হামলায় পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের প্রতিবাদ
বাংলাদেশে পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর ধর্মীয় স্থান, মসজিদ এবং নিরীহ মানুষের উপর বোমা হামলার নিন্দা করে শুক্রবার পশ্চিম বাংলার মুসলিম নেতারা একে বর্বরোচিত ও অনৈসলামিক বলে আখ্যা দেন।
সর্বভারতীয় কলকাতার মওলানা আজাদ সমাজকল্যাণ মিশন দ্বারা আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ মোতাওয়াল্লি সম্মেলনে নেতারা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে সাধুবাদ জানান এবং যুদ্ধে নিয়োজিত মুক্তিবাহিনীকে তাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি জানান।
তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে তাদের দ্বারা সংঘটিত গনহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দাবি জানান। বিশ্বের অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশগুলোকেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ করেন।
চীনের পাকিস্তানকে একরকম খোলা সমর্থনের নিন্দা করে তারা বলেন, এতে করে বিশ্ব শান্তি নষ্ট হবে। বাংলাদেশে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশকে ‘ভিত্তিহীন এবং অপপ্রচার’ বলে তারা মত দেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৭। শরনার্থিদের সাহায্যের জন্য বুদ্ধিজবিদের আবেদন | অমৃতবাজার পত্রিকা | ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ১১৭, ৩২৮>
বাংলার মানুষের জন্য ত্রাণের আবেদন বুদ্ধিজীবীদের
(নিজস্ব সংবাদদাতার বরাত দিয়ে)
পশ্চিম বঙ্গের ১৩ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী তাদের এক আবেদনে ভারতের জনগনের কাছে অনুরোধ করেছেন তারা যেন বাংলা দেশের মানুষের আদর্শের লড়াইয়ে সহায়তা করার জন্য ত্রাণ এবং অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করে।
এই আবেদনে সাক্ষর করেন সর্বজনাব তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তুষার কান্তি ঘোষ, বিবেকানন্দ মুখারজী, মনোজ বোস, প্রবোধ কুমার সান্যাল, শৈবাল গুপ্ত, নির্মাল চন্দ্র ব্যানারজি, প্রিন্সিপাল পি. কে. বোস, ডঃ প্রবীর বসু মল্লিক, ডঃ সত্যেন্দ্র নাথ সেন, জাস্টিস সুন্দর প্রসাদ মিত্র, জাস্টিস এস. এ. মাসুদ এবং ডঃ রমা চৌধুরী।
তারা বলেন বাংলা দেশের মুক্তিকামী মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যে নৃশংসতা চালিয়েছে তা আর বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। সীমান্তের এপারের জনগণ শুধুমাত্র দর্শক হয়ে চুপ থাকতে পারে না, যখন লাখ লাখ বাঙালী অকল্পনীয় নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে স্বেচ্ছাচারী এবং অমানবিক স্বৈরশাসকের দ্বারা। বাংলা দেশের মানুষের এই ধর্মযুদ্ধ আরো দীর্ঘদিন চলাই নিয়তি।
এই আবেদন করা হয় সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে পণ্য উৎপাদনকারীদের প্রতি তাদের অবদান নিয়ে এগিয়ে আসতে, হয় টাকা বা জিনিসপত্র নিয়ে। নিম্নে বর্ণিত সামগ্রীগুলো ত্রাণকাজ পরিচালনা করার জন্য এই মুহূর্তে জরুরীভিত্তিতে প্রয়োজন – টিনভর্তি পেট্রোল ও মবিল, সাইকেল, টায়ার ও টিউব, টর্চ ও ব্যাটারি, পানির বোতল, রাবারের জুতো, দিয়াশলাই, গুড়ো দুধ, লবন, সরিষার তেল ও কেরোসিন, টি.এ.বি.সি, ইনজেকশন, টীকা এবং সবধরণের ওষুধ, যেগুলো প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন।
টাকা বা জিনিসপত্র যাই হোক না কেন তা পাঠানো যাবে মিঃ সন্তোষ ঘোষের কাছে, কোষাদ্ধ্যক্ষ (১০৭/সি, এ.এম. রোড, কোলকাতা-২৫, ফোনঃ ৪৭-৪০২০), সংগ্রামী স্বাধীন বাংলা দেশ সহায়ক সমিতি। সেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে যোগাযোগ মিঃ বি সরকার, সচিব, সংগ্রামী স্বাধীন বাংলা দেশ সহায়ক সমিতি (১এ, কলেজ রো, কোলকাতা, ফোন ৩৪-৭২১১) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৮। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য ভারতের মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের আহ্বান | অমৃতবাজার পত্রিকা | ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ |
<১২, ১১৮, ৩২৯–৩৩০>
অনুবাদ
মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতির আবেদন
(দিল্লী দপ্তর থেকে)
এপ্রিল ১৮-এখানকার মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা আজ ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং অন্যান্য দেশের সরকারকেও বোঝাতে যেন তারাও একই কাজ করে।
ওখলার জামিয়া রুরাল ইন্সিটিউট-এ অনুষ্ঠিত এই সভায়, আরো উপস্থিত ছিলেন সোভিয়েত দ্বিতীয় সচিব, মিঃ বরিস রোমানোভ যিনি সামনের সাড়িতে বসেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম নিয়ে করা এই সম্মেলনে পুরোটা সময় উপস্থিত ছিলেন। ডঃ এস. আবিদ হুসাইন সভাপতিত্ব করেন।
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে, ডঃ কে. জি. সাইয়াদিন, প্রাক্তন শিক্ষা সচিব, বলেন যে পূর্ব বঙ্গে যা ঘটছে তা মুসলমানদের দুই পক্ষের মধ্যে বা পাঞ্জাবী ও বাঙালীদের মধ্যেকার কোনো যুদ্ধ নয়, বরং এটা স্পষ্ট এবং সোজাসাপটা গণহত্যা। এটা প্রত্যেক স্বাভাবিক মানুষের দায়িত্ব এর প্রতিবাদ করা, তিনি বলেন।
মিসেস সালেহা আবিদ হুসাইন, একজন স্বনামধন্য উর্দু লেখক, বলেন পূর্ব বঙ্গে যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটছে তা বলার মতো ভাষা তার নেই। তিনি অনেকবারই মুসলমানদের বলতে শুনেছেন যে হিন্দুদের প্রভাব কমানোর জন্য একটা আলাদা মুসলমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, কিন্তু পাকিস্তানের সৃষ্টির পরেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি, তিনি আরো বলেন।
আমাদের বিশেষ প্রতিবেদকের বরাত দিয়ে জানা যায়, পশ্চিম বঙ্গের খাদ্য মন্ত্রী, মিঃ কাশী দন্ত মৈত্র, আজ ঘোষণা দেন যে “এখন সময় এসেছে” বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার এবং যদি, তা করতে আরো দেরি হয় তাহলে “পশ্চিম বঙ্গের (নিরাপত্তা) পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে”।
তিনি বলেন “গনপ্রজাতন্রী বাংলাদেশ” সরকারের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব “আইনি নিয়ামক”-ই রয়েছে। নিয়ামক হিসেবে তিনি তালিকায় উল্লেখ করেন জনসংখ্যা, ভূমি, সরকার বা সংগঠন এবং সার্বভৌমত্ব, অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক।
মিঃ মৈত্র বলেন যে পশ্চিম বঙ্গে যে বাংলা দেশী শরণার্থীরা আছেন তাদের মধ্যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ৪০০ গ্রাম করে এবং প্রত্যেক শিশু ২০০ গ্রাম করে রেশনের চাল পান প্রতি সপ্তাহে (চাল দেয়া হয়, কেননা শিবিরে অন্য কিছু রান্না করা কষ্টসাধ্য হবে) যেখানে রাজ্যের অন্যদের সরকারী রেশন হিসেবে দেয়া হয় ৯২৮ গ্রাম করে প্রতি সপ্তাহে। পশ্চিম বঙ্গের সাহায্যের জন্য গভীর নলকূপ, মোবাইল হাসপাতাল পরিচালনা এবং সীমান্ত এলাকার শরনার্থীদের জন্য তিনি কেন্দ্রের কাছে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মানের আহবান জানান।
অল ইন্ডিয়া সিভিল লিবার্টিজ কাউন্সিলের এর সভাপতি এবং প্রাক্তন সাংসদ জনাব এন সি চ্যাটার্জী, ভারতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জনাব কেনেথ কেটিং এর সাহসী এবং সুস্পষ্ট বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানান, তার বক্তব্য ছিলো, পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগ এর বিষয়, যাকে কোন ভাবেই পাকিস্তানের “আভ্যন্তরীন সমস্যা” হিসেবে কঠোর ভাবে গন্য করা যাবে না।
ইউ এন আই আরো যোগ করলোঃ- সি পিঁ আই লিডার, জনাব জয়তী বসু কেন্দ্র কে আজ সতর্ক করে দিয়েছে, যদি অবিলম্বে বাংলাদেশ কে স্বীকৃত দেয়া না হয় এবং শেখ মুজিবর রহমান কে অস্ত্র সহ যাবতীয় বস্তুগত সাহায্য প্রদান করা না করা হয়, পশ্চিম বাংলা ভয়াবহ পরিনতির সম্মুখীন হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৯। বোম্বেতে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ গঠিত | দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ | ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ১১৯, ৩৩১>
বোম্বাই-এ বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
(বোম্বাই অফিস)
বোম্বাই, ২৪ এপ্রিল- বোম্বাই-এ বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি গঠিত হয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হচ্ছেন এই কমিটির সদস্য। কমিটির উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষদের সাহায্য করা।
এই কমিটির চেয়ারম্যান হচ্ছেন শ্রী হরিশ মহীন্দ্র। বেগম মহবুব নসরুল্লা এই সমিতির সম্পাদিকা এবং শ্রী সলিল ঘোষ হলেন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক।
এই কমিটি বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। আগামী ৭ মে থেকে ১৪ মে পতাকা দিবস সপ্তাহ উদযাপিত হবে। পাঁচ লক্ষ পতাকা মুদ্রিত হয়েছে।
প্রখ্যাত তথ্য চিত্রকার শ্রী এস সুখদেব বাংলাদেশ-এর উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। ইয়াহিয়া সরকারের বর্বর অত্যাচারের চিত্র এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। নানারকম প্রাচীর পত্র ও পোস্টকার্ডেও বাংলাদেশের নির্যাতনের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
শ্রী কবি বন্দোপাধ্যায় একটি কাওয়ালীর ব্যবস্থা করছেন।
শ্রী সুপ্রিয় বসু একটি চ্যারিটি শোর আয়োজনে ব্যস্ত।
শ্রীমতি ওয়াহিদা রহমান ও শ্রীমতি শর্মিলা ঠাকুরও ভাইস চেয়ারম্যানরূপে কমিটিতে যোগ দিয়েছেন।
আগামী ১৩ মে যে মুশারিয়ার আয়োজন করা হয়েছে তাতে অন্যান্যের মধ্যে শ্রীমতি মীনাকুমারীও যোগ দেবেন। বোম্বাই-এ গঠিত বাংলাদেশ সহায়ক কমিটির ঠিকানা হচ্ছে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বিল্ডিং, স্যার ফিরোজশা মেটা রোড, বোম্বাই-১।
‘পরিদর্শক শিক্ষক’
(স্টাফ রিপোর্টার)
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের যেসব অধ্যাপক পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তাঁদের অন্তত ছ’মাসের জন্য ‘পরিদর্শক শিক্ষক’ হিসাবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে যে অর্থের প্রয়োজন হবে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারি ‘পুনর্বাসন’ দফতরের কাছে আবেদন জানানো হবে। উপাচার্য ডঃ সত্যেন সেনের প্রস্তাবমত সিন্ডিকেট এই সিদ্ধান্ত নেন।
ইতিমধ্যেই কয়েকজন খ্যাতনামা অধ্যাপক এপারে চলে এসেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও নাকি দু’একদিনের মধ্যে আসছেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২০। ইয়াহিয়া খানের বর্বরতার বিরুদ্ধে ভারতের মুসলিম নেতাদের বিবৃতি | দৈনিক ‘যুগান্তর’ |
২৯ এপ্রিল, ১৯৭১
|
<১২, ১২০, ৩৩২>
বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার অমানুষিক বর্বরতা মুসলমান নেতাদের ধিক্কার
নয়াদিল্লী, ২৮শে এপ্রিল (ইউএনআই)- জনাব জুলফিকার আলী খান এমপি, আজ মুসলিম জাহানের নেতাদের- বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রসমূহের নেতাদের প্রতি বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে একজোটে দণ্ডায়মান হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন।
একটি বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনসাধারণ- বিশেষ করে মুসলিম দেশসমূহের জনসাধারণ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি মুসলমান সম্প্রদায়ের এই আক্রমণ ও নিষ্ঠুরতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন।
বসিরহাট থেকে পিটিআই জানাচ্ছেনঃ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন মুসলমান নেতা, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও এডভোকেট বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরোচিত আক্রমণের নিন্দা করেছেন।
এইসব নেতাদের মধ্যে আছেন জনাব এ কে এম ইসাক এমপি, জনাব আমজাদ আলী (প্রাক্তন এমপি) এবং জনাব গোলাম মহীউদ্দীন, এমএলএ (পশ্চিম বঙ্গ সংখ্যালঘিষ্ঠ কমিশনের সদস্য)। তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
একটি বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক গোষ্ঠী বাংলাদেশের জনসাধারনের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। সেখানকার নিরীহ ও অসহায় জনসাধারণ পাকিস্তানী বর্বরতার শিকার হচ্ছেন। এপারের মুসলমানদের ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে একজোট হওয়া ও বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনসাধারণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য এগিয়ে আসা উচিৎ। ’
এইসব তো বাংলাদেশকে সাহায্য সমর্থনের উপায় নির্ধারণের জন্য ৩০শে এপ্রিল কলকাতায় একটি সভা আহবান করেছেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২১। গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাংলাদেশের সমর্থনে রাষ্ট্র সংঘ ও বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত | দৈনিক ‘যুগান্তর’ | ২৯ এপ্রিল, ১৯৭১ |
<১২, ১২১, ৩৩৩>
বাংলাদেশের সমর্থনে রাষ্ট্রসংঘ ও বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিদল প্রেরণের সিদ্ধান্ত
নয়াদিল্লী, ২৮ শে এপ্রিল (ইউএনআই)- ভারতে গান্ধীবাদী সংস্থাগুলি বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য রাষ্ট্রসংঘ ও বিভিন্ন দেশের রাজধানীসমূহে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মনস্থ করেছেন।
গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশনের সম্পাদক শ্রী রাধাকৃষ্ণ আজ একটি বিবৃতিতে বলেন যে, গতকাল কলকাতায় সর্বোদয় কর্মীদের এক সভায় এই প্রস্তাবটি করা হয়। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সম্বন্ধে যথাশীঘ্র সম্ভব একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবানেরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
সানফ্রান্সিস্কো-মস্কো অভিযান অথবা দিল্লী-পিকিং অভিযানের মত একটি আন্তর্জাতিক শান্তি অভিযান শুরু করারও একটি প্রস্তাব করা হয়েছে। ভারতীয় শান্তি সংস্থাগুলি এই প্রস্তাবটির উদ্যোক্তা। এতদুদ্দেশ্যে যুদ্ধ-প্রতিরোধকারী লীগ, আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি এবং আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ ও শান্তি কনফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে আগত যুবকদের অহিংস প্রতিরক্ষা সম্বন্ধে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শিবির খোলারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী মাসে বনগাঁয়ে ১শ’ যুবকের জন্য প্রথম শিবিরটি খোলা হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২২। পাকসেনাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে কলকাতার মুসলমান সমাজের প্রভাব | স্টেটসম্যান | ১ মে ১৯৭১ |
<১২, ১২২, ৩৩৪–৩৩৫>
পাকসেনাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে কলকাতার মুসলমান সমাজের প্রভাব
(স্টাফ রীপোর্টার)
পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মি দ্বারা বাংলাদেশের জনগণের উপর অমানবিক অত্যাচারের প্রতি নিন্দা ও বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য শুক্রবার কলকাতায় মুসলিম নাগরিকদের এক সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এতে আরো বলা হয়, ভারত সরকার যেন জাতিসংঘে বাংলাদেশে সংঘটিত এই গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। গোলাম মহিউদ্দিন (এম.এল.এ) এর সভাপতিত্বে এই সভায় আরো বক্তব্য রাখেন এ.কে.এম ইসহাক (এমপি) এবং জনাব আমজাদ আলী।
বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে হুগলির আঞ্জুমানে মহা সিনিয়া একটি মিছিল সার্কাস অ্যাভিনিউ এ বাংলাদেশ মিশনে যায়, যেখানে তারা জনাব হোসেন আলীর সাথে দেখা করে তাদের সমর্থন জানায়। অভিযাত্রী ক্লাব, যারা মিশনের কাছাকাছি একটি ক্যাম্প চালায়, প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়ে স্বাগত জানায়।
ক্লাবের সভাপতি মিহির সেন সকল বাঙালি মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান যেন সবাই বাংলাদেশকে তাদের সমর্থন জানান। তিনি ধনিক মুসলমানদের প্রতি আবেদন জানান, তারা যেন তাদের সামর্থ্য মত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য কিছু নতুন ক্যাম্প খুলেন এবং দেখা-শুনা করেন।
অন্যদিকে ভারতীয় মজদুর সংঘ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানায় তারা যেন বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানি “উপনিবেশবাদীদের’ দ্বারা নৃশংস হামলার নিন্দা জানায়। এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটি থেকে বলা হয় যে, স্বল্প মেয়াদি প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কোর্স কলকাতার এলগিন রোডের নেতাজি ভবনে সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৮ টা পর্যন্ত চলবে।
ইউ.এন.আই এবং পি.টি.আই থেকে আরো বলা হয়, সিপিআই নেতা এন কে কৃষ্ণান এবং রমেশ চন্দ্র সামনের মাসেই মস্কো যাবেন বাংলাদেশের পক্ষে সেখানে জনমত সৃষ্টির জন্য। শুক্রবার নয়া দিল্লীতে দলে সাধারন সম্পাদক রাজেশ্বর রাও এইসব কথা বলেন।
এইদিকে জাতীয় কাউন্সিলের সভায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন করা হয় এবং আরো বলা হয়, ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামীদের প্রতি তাদের ‘পূর্ণ সমর্থন’ আছে।
পশ্চিমবঙ্গ জনসংঘের সভাপতি হারিপদ ভারতী দাবি করেন, ভারত শুধু বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিলেই হবে না, পাকিস্তান থেকে প্রতিদিন যে বৃহৎ আকারে উদ্বাস্তু বর্ডার অতিক্রম করে আসছে তাদের থাকার জন্য পূর্ব বর্ডারে কিছু জায়গা চাইবে।
এই ‘কঠিন’ সময়ে রাজ্যের সকল বিভাগের সকল শ্রেণির মানুষকে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আসাম আইন পরিষদে সর্বসম্মতভাবে একটি আইন পাশ হয়।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৩। বাংলাদেশের প্রশ্নে আচার্য বিনোবার সাক্ষাতকারঃ ডেমোক্র্যাসি এন্ড মিলিটারিজম আর ইঙ্কম্পিটেবল | পিপলস একশন | মে ১৯৭১ |
<১২, ১২৩, ৩৩৫–৩৩৭>
বিনোবা বলেন–
গণতন্ত্র ও সমরবাদ হচ্ছে পরস্পরবিরোধী
৪ঠা এপ্রিল শ্রী দেবেন্দ্র কুমার গুপ্তের নেতৃত্বে সর্বদয়া – এর এক দল কর্মী আচার্য বিনোবার সাথে তাঁর পাওনারস্থ আশ্রমে দেখা করেন এবং বাংলা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। উক্ত আলোচনার প্রভাস যোশীর করা ভাবানুবাদ নিম্নে দেয়া হলোঃ
বিনোবাঃ আজ সকালে অলইন্ডিয়া রেডিও সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের একটি সমবেদনার বাণী প্রচার করেছে। আমি এতে খুশি হয়েছি। শেখ আব্দুল্লাহ এবং খান আব্দুল গাফফার খান কি করছে? তারা কি কিছু বলেছে?
দে.কু.গুপ্তঃ না।
বিনোবাঃ ওরা চুপ করে আছে কেন? শুধুমাত্র মানবতার খাতিরেই ওদের উচিত বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ করা। গাফফার খান কোথায়?
দে.কু.গুপ্তঃ তিনি হয়তো পাকিস্তানের বিভাজন পছন্দ করেন না।
বিনোবাঃ বাংলা দেশের নেতা ছিল মুজিব। তারা (সামরিক বাহিনী) তাঁর সাথে আলোচনার প্রহসন চালিয়ে গেছে এবং এরপর চালিয়েছে সর্বাত্মক আক্রমন। ওরা বোমাও ব্যবহার করছে। আর যখন বোমা হামলা হয়, তখন মৃত্যুও হয়। বোমার তো আর হিন্দু – মুসলিম ভেদাভেদ নাই, বয়োবৃদ্ধ সকলেই আক্রান্ত। বাংলা দেশে যা চলছে তাকে সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা ছাড়া আর কিই বা বলা যায়। ওরা যদি পণ করেই থাকে যে বাংলা দেশের মানুষের মনে আতংক সৃষ্টি করে তাদের ওপর ওদের স্বেচ্ছাচারিতা চাপিয়ে দেবেই, তবে গনতন্ত্রের নামে এই প্রহসন কেন?
দে.কু.গুপ্তঃ লোকে বলে পশ্চিমবঙ্গে ভারতও তো সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।
বিনোবাঃ তাতে কি হয়েছে? ভারতীয় সেনাবাহিনী কি গণহত্যায় মেতে উঠেছে? পশ্চিমবঙ্গে সীমান্ত প্রতিরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। আমি একে ‘বোতলের গলা’ বলি, যদি ভারতের সেনাবাহিনী থাকে তাহলে সেটিকে সীমান্তে মোতায়েনের প্রয়োজন রয়েছে।
পাকিস্তানও পূর্ব বঙ্গে সেনা মোতায়েন করেছে। কিন্তু ওরা চায় জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলতে। তাই ওরা সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য নিয়ে এসেছে সাঁজোয়া যান (ট্যাঙ্ক), বোমারু বিমান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র।
দে.কু.গুপ্তঃ কিন্তু বিয়াফ্রা-তে (নাইজেরিয়া) এধরণের গণহত্যা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে এবং কেউ তা থামাতে পারেনি।
বিনোবাঃ ব্রিটিশরা এর প্রতিবাদ করেছে। এমনকি এখানেও সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র মানবিক কারনে এক বাণী দিয়েছেন। কিন্তু আমেরিকা একে বলছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যপার। আমেরিকার বিদ্যার দৌড় এটুকুই।
পশ্চিম পাকিস্তানীরা সুচারুরূপে পূর্ব বঙ্গের মানুষদের শাসন ও শোষণ করে এসেছে। বেশিরভাগ মানুষ পূর্ব বঙ্গে বসবাস করতো কিন্তু সেনাবাহিনীতে এবং প্রশাসনে তাদের সঠিক মাত্রায় প্রতিনিধিত্ব ছিলোনা। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। উন্নয়নের সুফল মূলতঃ পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছেই যেত। পূর্ব বঙ্গ দরিদ্রই থেকে যায় এবং এমনকি আজও তারা এই পুরো উপমহাদেশের সবচে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। নির্বাচনে, মুজিবের আওয়ামী লীগ ৯৮ শতাংশ ভোট পায় এবং পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু তাদেরকে ধোঁকা দেয়া হয় এবং গণতান্ত্রিক শাসন থেকে বঞ্চিত করা হয়।
গাফফার খান যখন এখানে এসেছিল, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলামঃ পাখতুনিস্তান সামরিক জান্তার হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। তুমি কি চাও ভারত এই ব্যপারটা জাতিসংঘে তুলুক? সে জবাব দিয়েছে, “এটা সময়োপোযোগী হবে না। পাকিস্তানে গনতন্ত্র আসছে এবং আমাদের দেখতে হবে যে আমরা নিজেরা কি করতে পারি”। গনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। এখন যখন পূর্ব বঙ্গে গনতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়েছে, তখন সে নিশ্চুপ কেন?
দে.কু.গুপ্তঃ কিন্তু আমরা তাহলে কিভাবে একজন আক্রমনকারীকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করতে পারি একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের খোঁজে?
বিনোবাঃ নৈতিক চাপেই কাজ হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্বমত তৈরিতে তোমাদের একত্রে কাজ করতে হবে।
দে.কু.গুপ্তঃ পাকিস্তানের দুই অংশ কি তবে একত্রে থাকতে পারবে?
বিনোবাঃ এটা তখনই সম্ভব হবে যখন এবিসি ত্রিভুজ বাস্তবে রূপান্তরিত হবে (এবিসি ত্রিভুজ হচ্ছে আচার্য বিনোবার কল্পনায় পাক-ভারত উপমহাদেশের সাথে আফগানিস্তান, বার্মা ও শ্রীলংকার একীভূত হওয়ার ধারণা)। কিন্তু আজকের দিনে এমনকি পাক-ভারত একীভূত হওয়াও সম্ভব নয়। ৪৮ এবং ৬৫ সালের যুদ্ধের পর জনগন এই লাইনে চিন্তা করতেও ভুলে গেছে।
সামরিক জান্তার হাতে যেভাবে তারা নির্যাতিত হয়েছে এরপরে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কোনদিনই থাকতে চাইবেনা, যদি বাংলা দেশের সামান্যতম জ্ঞানও অবশিষ্ট থাকে। এছাড়াও, দুই অংশের মধ্যে কোনো বিষয়েই কোনো মিল নেই। ইসলাম ধর্ম তাদেরকে একত্রে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পুরো ইউরোপ মহাদেশই খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী, কিন্তু খ্রিস্টধর্ম তাদেরকে একটি জাতিতে একীভূত করেনি। ধর্ম এখন সেকেলে। ক্ষুধাই এখন মূল বিষয়বস্তু। কে ক্ষুধার্ত? অবশ্যই বাংলা দেশ, এবং ক্ষুধার্ত মানুষের কোনো ধর্ম নেই।
দে.কু.গুপ্তঃ তাহলে কি বিশ্বমত তৈরিতে আমাদের উচিত একটি এশীয় সম্মেলন ডাকা?
বিনোবাঃ হ্যাঁ, এটা করা যেতে পারে। এবং এর বন্দোবস্ত করাও বেশ সহজ হবে।
পায়ে হেঁটে দেশ ভ্রমণের সময়, আমি ১৮ দিন পূর্ব বঙ্গে ছিলাম। সেইসময় আমি দেখেছি যে বাংলা দেশের মানুষ তাদের ভাষা নিয়ে খুবই গর্বিত। তারা বলতো যে কোলকাতায় যে বাংলা বলা হয় সেটা শুদ্ধ বাংলা নয়। তাদের বাংলা ভাষা হচ্ছে খাঁটি ‘সোনা’। এবং তাদের বাংলা ভাষায় ভারতের যেকোনো ভাষার চেয়ে বেশি সংস্কৃত শব্দ রয়েছে। ভারতীয় ভাষার মধ্যে ‘মালায়ালাম’ ভাষায় সবচে বেশি সংস্কৃত শব্দ আছে কিন্তু পূর্ব বঙ্গের বাংলা ভাষায় তারচেয়েও বেশি সংস্কৃত শব্দ রয়েছে।
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করতামঃ “বাংলার মনন তৈরিতে কাদের ভূমিকা সবচে বেশি? ” এবং তারা সবসময়ই চারটি নাম বলতোঃ বুদ্ধ, মোহাম্মেদ, চৈতন্য এবং ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। এঁরা হচ্ছেন চারজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব যারা বাংলা মননের রুপায়ক। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান আমার সোনার বাংলা দেশ কে জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা এতটাই পছন্দ করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকেরা তাদের বেতারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পাঠ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
দে.কু.গুপ্তঃ মানুষের মনে এই শঙ্কাও আছে যে পূর্ব বঙ্গ হয়তো আলাদা হয়ে যাবে এবং স্বাধীনতা অর্জন করবে।
বিনোবাঃ আমাদের সেই দুশ্চিন্তার কোন প্রয়োজন নেই। মুজিব কখনই স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি। সে সবসময়ই স্বায়ত্তশাসন চেয়ে এসেছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রের নামে প্রহসন করে তাকে বঞ্চিত করেছে এবং তাদের বুটের নিচে সেই গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছে। সে কারনেই মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছে।
দে.কু.গুপ্তঃ আমরা কি তবে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করতে পারি তারা যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়?
বিনোবাঃ (হাসতে হাসতে) আমরা অবাস্তব প্রস্তাব দেয়ার ব্যপারে বিশেষ পারদর্শী। তবে আমারও একটা প্রস্তাব আছে। ভারতের উচিত তার সৈন্য বাহিনী ভেঙে দেয়া। যে গণতন্ত্র সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল সেটি সত্যিকার গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশে এটা প্রমানিত হয়েছে। বিশ্বের সামনে এই উদাহরণ সৃষ্টি করে, ভারতের ঘোষণা দেয়া উচিত যে গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে আমরা আমাদের সেনাবাহিনী ভেঙে দিচ্ছি। এতে শুধু পাকিস্তানই নয় বরং বিশ্বের সকল দেশের উপরই মারাত্মক এক নৈতিক চাপের সৃষ্টি হবে। কেউ যদি তার সেনাবাহিনী ভেঙে দেয় তাহলে অন্য কেউ তাকে আক্রমন করার সাহসই পাবে না। এবং এরপরেও যদি কেউ তাকে আক্রমন করে, বিশ্বের পরাশক্তিগুলো তা ঘটতে দেবে না।
দে.কু.গুপ্তঃ তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের জনগণকে রক্ষা করবো?
বিনোবাঃ (হাসতে হাসতে) জনগণ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সুরক্ষিত আছে কেননা কেউই সেনাবাহিনীর উপর খুব একটা নির্ভর করছেনা। সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়ার প্রস্তাবটা যতটা অবাস্তব মনে হচ্ছে আসলে ততটা নয়। স্বাভাবিক সময়ে যা করা সম্ভব নয় কিন্তু ক্রান্তিলগ্নে তা করা সম্ভব। এই মুহূর্তে তোমার সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে এবং তারা এটা করার মতো অবস্থানেও রয়েছে। তারা যদি এটা করতে পারে, তাহলে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
দে.কু.গুপ্তঃ তাৎক্ষনিকভাবে আমরা কি করতে পারি?
বিনোবাঃ তোমাদের উচিত শুধু ভারতেই নয় বরং অন্যান্য দেশেও জনমত তৈরিতে কাজ করা। তোমরা আমেরিকার জনগণকে বলতে পারো যে তাদের সরকারের দেয়া অস্ত্রই পূর্ব বঙ্গের গণহত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা তাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে এবং তাদের সরকার তখন অন্যান্য দেশগুলোকে, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোকে, প্ররোচিত করবে যাতে তারা বাংলা দেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন না করে। তোমরা তোমাদের নিজের সরকারকেই বলতে পারো বিষয়টা জাতিসঙ্ঘে তুলতে।
ভারতে, জনমত তৈরি করতে তোমরা সর্বদলীয় সভার আয়োজন করতে পারো। তোমরা ত্রাণকাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারো। তোমরা সীমান্তে চিকিৎসক দল পাঠাতে পারো।
দে.কু.গুপ্তঃ বাংলা দেশের মানুষ কিভাবে অহিংসভাবে সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করবে?
বিনোবাঃ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলা দেশের মানুষ সম্পূর্ণ অসহযোগিতার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু তারা এখনো অহিংস আন্দোলনের শক্তি দেখাতে পারেনি। সত্যি বলতে, কোনো দেশই তা করতে পারেনি। বিশ্বে অনেক অসহযোগ আন্দোলনের উদাহরণ রয়েছে। এবং এমনকি ভারতেও অহিংস আন্দোলনের শক্তি ব্যবহৃত হয়নি। আমি আশা করেছিলাম যে মুজিব হয়তো এটা সৃষ্টি করতে পারবে। কিন্তু তাকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে এবং সর্বাত্মক আক্রমণের মাধ্যমে এর শেষ আশাটুকুও সেনাবাহিনী নিঃশেষ করে দিয়েছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৪। সকল দেশের প্রতি ভারত- বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির আহবান | প্রচারপত্র | ২ মে ১৯৭১ |
<১২, ১২৪, ৩৩৮–৩৩৯>
ভারত–বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি
একটি নতুন দেশের উদ্ভবকে সকল দেশের স্বাগত জানানো উচিত।
আগে আমাদের এই সংগঠনের নাম ছিল ইন্দো-পাক ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের উত্থানের পর আমরা আমাদের সংগঠনের নাম পরিবর্তন করেছি। আমাদের সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল দুই দেশের সংস্কৃতিকে আরো উন্নত করা।
২৫শে মার্চ ‘কাল রাত্রি’ তে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা যেভাবে রক্তের নেশায় উন্মত্ত হয়ে পড়েছিল, তারও প্রায় ২৪ বছর আগে থেকেই পাঞ্জাবি এবং সিন্ধি ব্যবসায়িক পরিবারগুলো দ্বারা নিপীড়িত এবং শোষিত হয়ে আসছিল। আর এখন দেশটি তাদের ইতিহাসের অন্যতম খারাপ সময় পার করছে।
শেখ মুজিব একজন ঐতিহাসিক নেতা। গত নির্বাচনেই তিনি প্রমান করেছেন তার নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা। তার দল আওয়ামীলীগ রাজ্যসভা এবং কেন্দ্রীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা আওয়ামীলীগের হাতে হস্তান্তর না করে ক্ষমতার লোভে অন্ধ ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালানোর নির্দেশ দেয়। সারা পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ এ রুপ নিয়েছে। যে সকল অত্যাধুনিক অস্ত্র তাদের হাতে রয়েছে, এর সবই বিদেশ থেকে সংগৃহীত। ফ্যাসিবাদী একনায়ক ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা ছিল ‘কসাই’ জুলফিকার আলী ভুট্টো। মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, গ্রামের মানুষ, দিনমজুর এবং কৃষকসহ প্রায় ১০ লক্ষ বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। প্রভাষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, বযবসায়ি, লেখক এবং সকল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী এই যুদ্ধে জিততে বদ্ধপরিকর। সমগ্র দেশ আজ প্রতিবাদী। যদিও লাঠি, বর্শা এবং আরো ছোট ছোট আদিম অস্ত্রগুলো যুদ্ধে অনেকটাই পরাভূত। পশিম পাকিস্তানি সৈন্যদের মূলনীতি হচ্ছে তারা গনতন্ত্র এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে।
আমাদের সংগঠন থেকে আমরা নিন্ম লিখিত দাবিগুলো উপস্থাপন করছিঃ
১. সভ্য দেশগুলোর দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা দরকার। সভ্যতা, স্বাধীনতা এবং গনতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশগুলোর উচিত সামনে এগিয়ে আসা।
২. আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কে দ্রুত বাংলাদেশে প্রেরণ করা দরকার। ইসলামাবাদের অস্বীকৃতি এর গুরুত্ব বুঝাতে সাহায্য করে। ইউ.এন.ও এর নিরবতা অবশ্যই কাম্য না।
৩. দ্রুত বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং সময়ক্ষেপণ ছাড়াই পশ্চিম পাকিস্তানকে যুদ্ধ বিরতি দিতে হবে।
৪. আমাদের সংগঠন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া সরকারকে তাদের সাহসী বিবৃতির জন্য ধন্যবাদ জানায় এবং অনুরোধ করছে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। আমরা একটি জাতির উপর পাকিস্তানের নিপীড়ন ও শোষনের প্রতি পিকিং এর সমর্থনের নিন্দা জানাচ্ছি।
৫. পশ্চিমা দেশগুলো যারা গনতন্ত্রের চর্চা করে, তাদের উচিত দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এবং পরিকল্পিতভাবে সাধারন মানুষ হত্যা বন্ধ করা। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি এবং ফ্রান্স এর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে এই গণহত্যা বন্ধ করার।
৬. আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলো, যারা নিরপেক্ষ, তাদের উচিত উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া। যুগোস্লাভ এবং ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক, যারা সবসময় নিপীড়িত আফ্রো-এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাদের অবিলম্বে একটি কনফারেন্সে মিলিত হতে হবে।
৭. এই নতুন দেশটির পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং অন্যান্য সহযোগিতা। একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি এইরকম ভাবে হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকে, তাহলে ইউ.এন.ও এর কি দরকার?
৮. পশতুন নেতা বাদশা খানের এগিয়ে আসা উচিত। এক কোটি সীমান্তবর্তী মানুষ এবং বেলুচিস্তান পাঠানরা এই ভয়ংকর পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে পারে না।
৯. মুক্তিবাহিনী এই দ্বি-জাতিতত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছে। এর থেকেই প্রতিয়মান হয় যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রয়েছে নিজস্ব স্বকিয়তা। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে পৃথিবীর সভ্য দেশগুলোর উচিত নিজেদের সম্পৃক্ত করা। তাদের উচিত ‘বাংলাদেশ’ কে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে মেনে নেয়া।
১০. বর্বর পাকিস্তানকে ইউ.এন.ও থেকে বহিষ্কার করা উচিত।
ধীরেন ভৌমিক
সম্পাদক
ভারত – বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১২৫। বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটির সমাবেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবী | দৈনিক “আনন্দবাজার” | ৬ মে ১৯৭১ |
Sharfuddin Bulbul
<১২, ১২৫, ৩৪০–৩৪১>
বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান ভারত সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য
শহীদ মিনার জনসমাবেশ ঘোষনা
(ষ্টাফ রিপোর্টাস)
বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটির ডাকে সারা ভারত বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিবস উপলক্ষে বুধবার বিকেলে শহীদ মিনার ময়দানে গৃহিত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দেওয়া আজ ভারত সরকারের অপরিহার্য্য কর্তব্য। প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের জাতীয় জীবনের সামনে অগ্নিপরীক্ষা স্বরূপ। এই অপূর্ব সুযোগ ব্যর্থ হলে ভারতের বর্তমান জাতীয় জীবন বিকৃত হবে এবং ভাবী জীবনও হবে চরমভাবে বিপন্ন ও বিড়ম্বিত। ওই মর্মে একটি স্মারকলিপিও রাজ্যপাল সমীপে পেশ করা হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার। তিনি অসুস্থতার জন্য সভা ত্যাগ করলে বিচারপতি শ্রী শঙ্কর প্রসাদ মিত্র সভার কাজ পরিচালনা করেন।
সভার প্রারম্ভে শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্র বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” গানটি গেয়ে সভার সূচনা করেন। বাংলাদেশের পতাকা শোভিত সভামঞ্চের দুই দিকে নেতাজী ও বঙ্গবন্ধু মজিবুর রহমানের আলোকচিত্র শোভা পায়।
সভায় শ্লোগান দেয়া হইয়, বাংলাদেশকে জিততে হলে এপার বাংলার শান্তি চাই, ‘পিন্ডি-পিকিং চক্রান্ত যুঝবো যুঝবো’ জয় বাংলা জয় হিন্দি ইত্যাদি।
সভাপতির ভাষনে ডঃ রমেশ্চন্দ্র মজুমদার বলেন বাংলাদেশের সমস্যাটি হল মনুষত্বের প্রশ্ন। এর একটা প্রতিবিধান হওয়া উচিত যাতে হত্যাকান্ড বন্ধ হয়, তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়ে ভারতের আপত্তি থাকা উচিত নয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলন জয়যুক্ত করবার জন্য প্র্যোজন হলে সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধ করতে হবে।
শ্রী সুশীল ধাড়া বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃই দেবার ব্যাপারে ভারতই আগে পথ প্রদর্শক হোক। কারন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে শুধু বাংলাদেশের স্বার্থ নেই ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গেরও আছে। তিনি দেশের তরুন সমাজকে প্রস্তুত থাকবারও আহবান জানান।
অধ্যাপক হরিপদ ভারতী বলেন, এতো দিনও ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে নীরব থেকে প্রকারান্তরে পাকিস্তানের জঙ্গী শাহীকে সমর্থন জানাচ্ছেন। তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা দেবার দাবী জানান। সর্বশ্রী পান্না লাল দাশগুপত, বীনা ভৌমিক, দক্ষিণারঞ্জন বসু মৈতেয়ী দেবী, জনাব লালজান প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তৃতা করেন। অধ্যাপক সমর গুহ এমপি সভায় প্রস্তাবটি পাঠ করেন। সভাশেষে শ্রী সতোশ্বর মুখার্জী জাতীয় সঙ্গীত গান। বাংলাদেশের শিল্পী অধ্যাপক সুকুমার বিশ্বাস কয়েকটি গান গেয়ে শোনান।
“যেতে নাহি দিব“
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
পাকিস্তানের জন্য গম বোঝাই দুটি জাহাজের একটিকে যাত্রার জন্য পোর্ট কমিশনারস বুকিং দিয়েছেন।
সেও অনুসারে ওই জাহাজ ‘মারলিনের’ আজ বৃহস্পতিবার কলকাতা ছেড়ে চট্টগ্রাম অথবা করাচীর উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১২৬। বাংলাদেশে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য ভারতের ৪৪ জন অধ্যাপক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীর আবেদন | পুস্তিকা | ৭ মে ১৯৭১ |
<১২, ১২৬, ৩৪২– ৩৪৪>
আবেদন
বিশ্ববিবেকের নিকট
ভারতীয় চিন্তাবিদ এবং লেখকবৃন্দের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নির্মমবেদনার প্রেক্ষিতে
সীমান্তে ঘটমান মর্মভেদী ঘটনায় আমরা গভীরভাবে বিচলিত এবং বিস্মিত, সামরিক জান্তা দ্বারা পশ্চিম বঙ্গের নিরস্ত্র জনগণের উপর নির্যাতন চালিয়ে যে অপরাধ করেছে সে প্রেক্ষিতে আমরা বেদনা প্রকাশ করতে আমাদের কন্ঠ তুলেছি।
দেশের অখন্ডতা রক্ষার নামে। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের হুকুমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিতাড়িত করা হয়েছে। কিন্তু আইনী ছদ্মবেশে ও রাজনৈতিক মিথ্যা কূটতর্কে এবং তাদের সহস্রাধিককে পঙ্গু করে রেখেছেঃ শুধু সাহসী পশ্চিম বঙ্গের মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও গোটা নীরিহ সাধারণ মহিলা ও শিশু, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, যাদের একমাত্র অপরাধ ছিল একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক জাতির, অভিন্ন অংশীদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা। ইহা আমাদের গভীর বিশ্বাস যে তারা যে বলিদান করতেছে এবং যে ভোগান্তি সহ্য করছে তা নিরর্থক হবে না।
এমনকি এই যুগে যখন মানব জাতির বিবেক নৈতিক মূল্যবোধের পতনে মূক হয়ে গেছে, তখনও এখানে অগণিত পুরুষ ও নারী আছে গোটা পৃথিবীতে যারা মূল্যবোধ লালন করে মানুষদের মর্যাদাসম্পন্ন করেন। আমরা তাদের পশ্চিম বঙ্গের মানুষদের শ্বাসরোধ করা কান্না শুনার আহবান জানাই। মানবতার নামে, আমরা তাদের নিকট আবেদন করতেছি যে আমাদের সাথে যোগদান করে বিশ্ব মতাবাদকে সুসংহত করে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদেরকে এই কান্ডজ্ঞানহীন হত্যাকান্ড বন্ধ করতে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহকে সম্মান প্রদর্শন করতে বাধ্য করা। |
এস. নুরুল হাসান সংসদ সদস্য; এডভান্স ইতিহাস শিক্ষার কেন্দ্রীয় পরিচালক, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং খন্ডকালীন পরিদর্শন সহকর্মী, অল-সলস কলেজ অক্সফোর্ড।
আব্দুল আলেম, উপাচার্য, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এস. মকবুল আহমেদ পশ্চিম এশিয়া শিক্ষার কেন্দ্রীয় পরিচালক আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়
রঈছ আহমেদ পদার্থবিদ্যা বিভাগ প্রধান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়
এস.এ.এইচ আবিদি অধ্যাপক ফার্সি, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ড. এস. হুসাইন জহির প্রাক্তণ সাধারণ পরিচালক। কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ইন ইন্ডিয়া, এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স।
|
এ. আল কাজী পরিচালক, জাতীয় নাট্য স্কুল, এবং এশিয়ান থিয়েটার ইন্সটিটিউট।
ড. ওয়াহিদুদ্দিন খান অধ্যাপক দর্শন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. কে. জি. সাইয়াদেইন প্রাক্তন শিক্ষা সচিব।
ফ্র্যাংক মোরাইস প্রধান সম্পাদক, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। কে.পি.এস মেনন প্রাক্তন বৈদেশিক বিষয়ক সচিব, এবং চেয়ারম্যান, ইন্দো সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমাজ। ড.ডি.এস. কোঠারী চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং পদার্থবিদ্যার অবৈতনিক অধ্যাপক, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়। ড. স্বরুপ সিং উপাচার্য, দিল্লী দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়।
জনাব মোহাম্মদ আলী কারিম ছাগলা। প্রাক্তন শিক্ষা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এবং প্রাক্তন বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রী। জনাব মোহাম্মদ হিদায়াতুল্লাহ প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি। অধ্যাপক এম. মুজিব উপাচার্য, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, নয়া দিল্লী।
জনাব বদর-উদ-দিন ত্যাবজিত প্রাক্তন উপাচার্য, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাক্তন সচিব, বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রনালয়। |
ভি.কে.আর.ভি রাও প্রাক্তন শিক্ষা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং প্রাক্তন উপাচার্য, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়।
সফিক চৌধুরী অধ্যাপক, স্কুল অফ সোশ্যাল সায়েন্স, জয়হরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। নয়া দিল্লী।
ড. রমিলা থাপড় অধ্যাপক, জয়হরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় নয়া দিল্লী। এ.এম খুশরু পরিচালক, ইন্সটিটিউট অফ ইকোনোমিক গ্রোথ, দিল্লী। সুখমাই চক্রবর্তী অধ্যাপক ইকোনোমিক্স, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়। ড.পি.বি. গাজেন্দ্রগাদকার উপাচার্য, বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ইন্ডিয়া। ড. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি জাতীয় অধ্যাপক মানবিক। ড.স. গোপাল কেন্দ্রীয় প্রধান ইতিহাস শিক্ষা জয়হরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। নয়া দিল্লী, এবং অধ্যাপক দক্ষিন এশিয়ান শিক্ষা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ড. রানজিনী কোঠারী পরিচালক, সেন্টার ফর ডেভেলপিং সোসাইটিজ, দিল্লী। জনাব জি. পার্থসারাথী উপাচার্য, জয়হরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়া দিল্লী, এবং জাতিসংঘের প্রাক্তন ইন্ডিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি। জনাব রাজকাপুর ফিল্ম ডিরেক্টর, বম্বে। |
প্রফেসর রাশিউদ্দিন খান সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রধান, জয়হরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়া দিল্লী।
জনাব এম.এফ হুসাইন্ন শিল্পী, নয়া দিল্লী।
ড. আন্দ্রেবাতেল্লে অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়।
ড. এস.এন বোস জাতীয় অধ্যাপক পদার্থবিদ্যা।
ড. দেবী প্রসাদ ছাতোপা ধ্যায়া সংসদ সদস্য।
প্রফেসর তপন রায় চৌধুরী অধ্যাপক ইকোনোমিক্স ও ইতিহাস দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রফেসর সি. ডিউবে সামাজিক নৃবিদ্যা বিভাগ প্রধান, সাগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ড.ভি.পি দত্ত প্রো-উপাচার্য এবং অধ্যাপক চাইনিজ শিক্ষা, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়। |
প্রফেসর নীহার রঞ্জন রায় প্রাক্তন পরিচালক, ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ এডভান্স স্টাডিজ, সিমলা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শিল্পের ইতিহাস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রফেসর জি. তালওয়ার অধ্যাপক বায়ো-কেমিস্ট্রি, অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স নয়া দিল্লী।
ড. তারা চাদ প্রাক্তন শিক্ষা সচিব। প্রাক্তন উপাচার্য, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, এবং প্রাক্তন ইন্ডিয়ান রাষ্ট্রদূত ইরান।
ড. মুলক রাজ আনন্দ লেখক।
জনাব ভি.ভি. জন উপাচার্য, জুদপুর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রফেসর এম.এস ভেনকাটরামানি ডীন স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ জয়হরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়া দিল্লী।
জনাব দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লেখক এবং দার্শনিক
জনাব সুভাস মূখোপাধ্যায় লেখক।
|
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১২৭। রাষ্ট্রসংঘ মহাসচিবের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আবেদন | দৈনিক আনন্দ বাজার | ৭ মে ১৯৭১ |
<১২, ১২৭, ৩৪৫–৩৪৬>
বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে বৌদ্ধ থানন্টের কাছে বাঙ্গালী বৌদ্ধদের তার
(বিশেষ প্রতিনিধি)
ইয়াহিয়া ফৌজের কোপানল থেকে বাংলাদেশের ৫ লাখ বৌদ্ধও বাদ পড়েনি। চট্রগ্রাম ও কুমিল্লা জুড়ে পাক ফৌজ বৌদ্ধ গ্রামগুলিতে ঢুকে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে দিয়েছে।
পাক হানাদারের অত্যাচার থেকে বাঙ্গালী বৌদ্ধ শ্রমণ ও ভিক্ষুরাও নিস্কৃতি পাচ্ছেন না। কুমিল্লা পূর্ণানন্দ মহাস্থবির গুরুতর আহত। পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রসার সংঘের সভাপতি জ্যোতিপাল মহাস্থবির কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে বরইগাঁও বিহার থেকে পালিয়েছেন। চট্রগ্রামের রাঙ্গামাটি রোডের ধারে রাউজান বৌদ্ধ গ্রাম বিলুজড়ির ওপর নেমে এসেছে মধ্যাহ্নের অন্ধকার। পাক ফৌজ সেখানে ঢুকে বারো হাত উচু দীর্ঘ মূর্তি চুড়মার করে ফেলেছে।
চট্রগ্রাম মহাবিহারের অধ্যক্ষ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পাক ফৌজের অত্যাচারের ভয়ে কিছু বৌদ্ধ শস্ত্র নিয়ে চলে গেছেন দূরে এক গ্রামে।
বাংলাদেশ থেকে বৌদ্ধরা আসছেন ত্রিপুরায়। ত্রিপুরা হয়ে কয়েকশত পরিবার ইতিমধ্যেই কলকাতায় এসেছেন। কলকাতায় বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর মহাসভার কিছু দূর্গত বৌদ্ধ পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন।
বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর মহাসভার মন্দিরে বসে কথা হচ্ছিলো ধর্মধার মহাস্থবিরের সঙ্গে। পীত বসন পরা এই প্রবীণ সন্যাসীর বাড়িও চট্রগ্রামে। চট্রগ্রামে মানুষের দুঃখে তিনি অভিভূত। সারা বাংলাদেশ জুড়ে বৌদ্ধ নির্যাতনের খবর দিয়ে তিনি বললেন, আমরা বাঙ্গালী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উথান্টকে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছি। উথান্টাক নিজেও বৌদ্ধ। মানবতার এতো বড় বিপর্যয়েও তিনি কি কিছু করবেন না?
মহাস্থবির বললেন, শ্রমণদের ছেড়ে ভিক্ষুরা দেশ ত্যাগ করতে চাইছেন না। কুমিল্লার আলিশ্বরে পূর্ণানন্দ মহাস্থবিরের ওপর এতো অত্যাচার স্বত্বেও তিনি আসেননি। তবে আব্দুল্লাপুর ফটিকছড়ি থানা, চট্রগ্রাম জেলা থেকে দুইজন ভিক্ষু এসেছেন। এসেছেন, কুমিল্লার ধর্মরক্ষিত আর প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু।
কলকাতার মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন দিনাজপুরের সাব জজ শীলব্রত বড়ুয়া আর চট্রগ্রামের অধ্যাপক অরবিন্দ বড়ুয়া। এরা দুজনেই বৌদ্ধ।
আর কয়েকটি পরিবারকে দেখলাম। বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভায় আশ্রয় নিয়েছেন। দেখা হলো গহিরা (চট্রগ্রাম) গ্রামের শ্রীমতি নিরুপমা বড়ুয়ার সঙ্গে। ১২ এপ্রিল ১১ টায় যখন পাক ফৌজ ওদের গ্রামে এলো তখন ওরা পালিয়ে পাঁচ-ছয় মেইল দূরে এক বৌদ্ধ মন্দিরে আশ্রয় নেন। তখন ওদের গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছে। তারপর দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার শেষে রামগড় থেকে ফেনী পেরিয়ে সাবরুম। সেখান থেকে কোলকাতা।
ব্রিটেন প্রবাসী প্রায় দেড় লাখ বাঙ্গালীর অধিকাংশই এসেছেন পূর্ববঙ্গ থেকে। তাদের অনেকেই চলনসই ইংরেজী বলতে পারলেও রেডিও টেলিভিশনের ইংরেজী যথাযথ বুঝতে পারেন না। এই সত্যটা উপলব্ধি করে গত বছরের ঘূর্ণিঝড়ের পর অনেকদিন বিবিসি, বাংলায় বিশেষ সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন। টাইমস পুনরায় সুপারিশ করা সত্ত্বেও বিবিসি কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সে রকম কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তদুপরি, করাচী থেকে প্রচারিত বাংলা সংবাদও কেবল পাঞ্জাবী অপপ্রচার। এমতবস্থায় আমার অনুরোধ অল ইন্ডিয়া রেডিও তাদের ওভারসীজ সার্ভিসে ইংরেজী খবরের সঙ্গে যেনো বাংলায়ও খবর প্রচার করেন। পূর্ব বাংলার এই দূর্দিনে ভারতীয় বেতার কতৃপক্ষ আশা করি এই অনুরোধটি রক্ষা করবেন।
শ্রী ধন রায়, বার্মিংহাম।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৮। বাংলাদেশ কে স্বীকৃতির প্রশ্নে “বাংলাদেশ” প্রবলেমস অফ রিকাগনিশনঃ বি এল শর্মার পর্যালোচনা |
অমৃত বাজার পত্রিকা
|
৭ই মে ১৯৭১। |
<১২, ১২৮, ৩৪৭–৩৪৯>
রাজনৈতিক ফোরামঃ
বাংলাদেশঃ প্রবলেমস অফ রিকগনিশন
– বাই বি এল শর্মা
একমাস এর বেশি সময় ধরে ধরে পাকিস্তানি বাহীনি সারা বাংলাদেশে হিংস্র কার্যকলাপ চালাচ্ছে। তারা মানুষকে গুলি করছে, মহিলা ও শিশুদের উপর বেয়নেট চার্জ করছে এবং বাসাবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করছে।
আক্রান্ত এলাকাসমুহে পাকিস্তানী বিমান বাহীনি দ্বারা আক্রমন করছে এবং গানবোটের সাহায্যে কামানের গোলা ছুড়ছে। কেউই হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানেনা তবে যতদুর হিসাব করা হয়েছে এর সংখ্যা কয়েক শত হাজার।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গনগত্যা হয়েছে এবং চলছে একটি নির্বাচিত সরকার কে বাতিল করার জন্য এবং ভারত মনে করছে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দরকার। বেশ কিছু দেশ যেমন ব্রিটেন এই ঘটনাকে নাকচ করে বলেছে এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সমস্যা। পিকিং আরো এক ধাপ এগিয়ে, তারা ইসলামাবাদকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার কথা বলেছে। এটা সত্যি যে প্রদগনি ইয়াহিয়া খান কে একটি শক্তিশালী পত্র পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তার ফলাফল ছিলো নেতিবাচক। এবং এখনো বিশ্ব জনমত তাদের সরকারের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। একটি পরিকল্পিত গনহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের নেতৃত্ব ও অর্থনীতিকে ধ্বংস ও জনগনের উদ্দিপনাকে দমন করার জন্য পাকিস্তান দ্বিধা করেনি।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের সীমান্ত জুরে চলা ভয়াবহতা ও রক্তপাত বন্ধ করতে ভারত সরকার কি করতে পারে? পরামর্শ দেয়া যায় যে, ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশ বিষয়ে কোন ভাবে হস্তক্ষেপ করা।
ভারতের উচিৎ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া। দুরভাগ্যজনক এই যে স্বীকৃতির বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন অনেক জটিল একটি ব্যাপার। কোন দেশকে স্বীকৃতি দেয়া অনেক ঝামেলার বিষয়। উদাহারন হিসেবে বলা যায়, যেমন বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য স্বীকৃতির উভয় ধরনের রুপই জড়িত, এখানে বিধিসম্মত ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন নেই এবং এখানে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও সাক্ষর হতে পারে যেমন ভারত ও পূর্ব জার্মানির মধ্যে সাক্ষরিত হয়েছে বানিজ্য চুক্তি। বহুজাতিক রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে যোগ দিতে খুব বেশি স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই।
শর্তসমূহ
একটি রাস্ট্র কে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আইনবিশারদরা নানা শর্ত প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে আছে নির্দিষ্ট অঞ্চলের দখল এবং একটি স্বাধীন সরকার দ্বারা অর্থনৈতিক, কারিগরি ও সামরিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও অধীনস্ত অঞ্চলের জনগনের উপর পূর্ণ কতৃত্ব। বিপরীতে, একটি সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য শুধুমাত্র এর দখলকৃত অঞ্চল ও ঐ এলাকার জনসাধারনের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন করাকেই বোঝায় না তা রক্ষা বা স্থিতিশীল রাখার ক্ষমতাকেও বোঝায়, সুতরাং এটা আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা প্রবেশ করতে পারে এবং বৈধতা দেয়ার শর্তসমুহ পুরন করতে পারে। বাস্তবে, কিছু শক্তিশালী দেশ এইসব বিবেচ্য বিষয় গুলোকে মেনে চলছে না। যেমন আমেরিকা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবার পর ইসরায়েল নিজের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে। একইভাবে যখন প্রেসিডেন্ট কাসাভুবু জেনারেল মোবুতুর কাছে সরকার পরিচালনার ভার প্রদান করেন তখন ফ্রান্স ও বেলজিয়াম জেনারেল বোবুতু কে স্বীকৃতি দেয়।
লেখক ভারতীয় সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ও পরে সরকারে বহিঃসম্পর্ক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ভারত যদি বাংলাদেশকে তখন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতো তাহলে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হতো তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
উপরোক্ত দুটি ক্ষেত্রেই সমস্যাগুলো ছিলো রাজনৈতিক, এগুলো ন্যায়সঙ্গত ছিলোনা। আমেরিকার প্রতিনিধি ইসরায়েলের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, এটি ছিলো স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে ” একটি উচ্চ রাজনৈতিক আয়িন বা পন্থা”। কঙ্গোতে বেলজিয়াম ও ফ্রান্স তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছে রাজনৈতিক নীতির আড়ালে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমটিও রাজনৈতিক। যদি এটি ঘোষনা করা হতো তবে নিম্নোক্ত ঘটনাগুলো ঘটতে পারতো বলে অনুমান করা যায়।
ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তো এবং এরপর অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া সহ নানা ধরনের সমস্যার সুত্রপাত হতো।
ভারত ও পাকিস্তান রাস্ট্র দুটি পরষ্পরের সাথে মারাত্তক যুদ্ধে জড়িয়ে যেতো এবং যা থেকে হতে পারতো অর্থনৈতিক সংকট। এমনকি যুদ্ধের ফলে দুটি দেশের মধ্যে বৈরিতার অবসান কখনোই হতোনা। ভারতও বাংলাদেশে অস্ত্র সরবরাহ করা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করতে পারতো না যেমন আমেরিকা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ দেয়াটা প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। আজ হোক কাল হোক এটি নিয়ে একটি সশস্ত্র সংঘাত তৈরি হতো।
এর ফলে পাকিস্তান ঠিক যা চাচ্ছিলো তাই সেই সুযোগ পেয়ে যেতো। তারা নিরাপত্তা পরিষদে এই ব্যাপারটি উত্থাপন করতো শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয় তারা কাশ্মীর ইস্যু নিয়েও দাবী তুলতো। ভারত নিরাপত্তা পরিষদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং এটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়াও দুষ্কর হয়ে যেতো। এর ফলে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সহায়তা করার পথ বন্ধ হয়ে যেতো।
এটি প্রস্তাব করা হয়েছে যে ভারত নিরাপত্তা পরিষদে বা সাধারণ পরিষদে এই বিষয়টি উত্থাপন করার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া জাতিসংঘের কতগুলো সদস্য দেশ বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের সমর্থন দেয়া নিয়ে কথা বলেছেন? এর কারন হলো সরকারগুলো যতটা না রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত হয় ততটা মানবিকতার স্বার্থে পরিচালিত হয়না।
মুসলিম দেশগুলো সম্ভবত একটি মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে ভেঙ্গে যাওয়াটা ঘৃণার চোখে দেখছে তবে তারা এটা ভুলে গিয়েছে এর ফলে আরেকটি মুসলিম দেশের জন্ম হচ্ছে। কিছু কিছু বিশ্ব শক্তি এই অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্যের এর পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত এবং তারা ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের দুর্বল হয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছেন না। অনেক দেশই অন্যত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ে দুঃস্বপ্নে ভোগে। কিন্তু তারা এটা ভুলে যায় যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু লোকেরা নয় সংখ্যাগুরু জনগন স্বাধীনতা চাচ্ছে যা একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনে প্রমান হয়েছে।
একথাও ঠিক যে এই প্রস্তাবগুলো কোনটাই খুব শক্তিশালী নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশে যে নৃশংসতা করছে এটা তারা দর্শক হিসেবে নিরবে দেখে যেতে পারেন না। একমাত্র পন্থা যা ভারত গ্রহন করতে পারে বাংলাদেশেকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে না যেয়ে এবং তা হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া।
একটি নতুন হুমকি
ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ নিয়ে আমাদের অর্থনীতি ও প্রশাসন একটি নতুন হুমকির সম্মুখীন। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে যারা আছেন তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন দারিদ্রকে সমূলে উৎপাটন করবেন এই কর্মসূচির ঘোষনা দিয়ে। পূর্বে অবস্থিত ভারত পাকিস্তান বর্ডারে ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে যে সম্পদ ব্যয় হচ্ছে তা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হবার কথা ছিলো। আমাদের ভুলো যাওয়া উচিত নয় যে আমাদের নিজেদের দরিদ্র জনগনের জন্য আমাদের প্রয়োজন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসালয়, রান্নাঘর, উলঙ্গদের প্রয়োজন কাপড় গৃহহীনদের জন্য প্রয়োজন বাসস্থান।
এখন সময় এসেছে ভারতের বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বড় আকারে সহায়তা নেয়ার এর সাথে বিশ্বের বড় বড় সাহায্য প্রদানকারী সংস্থা যেমন, এফ এ ও, ডব্লিও এইচ ও, রেড ক্রস, ইউনেস্কো কেয়ার সহ অরো অনেকের সহায়তা নেয়ার। কিন্তু কি বিশেষ উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তি ও তথাকথিত আফ্রো এশিয়ান দেশগুলো এই সাহায্য পাওয়া থেকে আমাদের বাধা দিচ্ছে?
রিলিফ অপারেশনে আইনি এবং রাজনৈতিক বিষয় জড়িত না। যদি হাজার হাজার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত জীবন মেরামত করতে হয়, বিশ্বের সব দেশ তো ভারতের উপরে এর বোঝা চাপিয়ে দিতে পারেনা এবং বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে পারেনা। এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিকা করার জন্য আমরা কেন আমাদের এসব তথ্য সবাইকে জানাচ্ছি না এবং আমাদের কূটনৈতিক যন্ত্রগুলো সচল করছি না!
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৯। বিরোধী নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকঃ বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দানের সম্ভাবনা নেই।
|
স্টেটসম্যান
|
৮ মে ১৯৭১
|
<১২, ১২৯, ৩৫০–৩৫১>
অনুবাদ
বিরোধী নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকঃ বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দানের সম্ভাবনা নেই।
নয়াদিল্লী, ৭ই মে সন্ধ্যায় বিরোধীদের বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি প্রদানের জোরালো দাবীর বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় একটি অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ছিলো বিস্তারিত ও খোলামেলা, কিছু সদস্যের বিশ্বাস ছিলো তারা তাদের দাবী আদায় করতে পারবে। কিন্তু কোন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়নি।
সরকার কেন দ্রুত স্বীকৃতি দেবেনা তা কিছু ইঙ্গিতের মাধ্যমে ব্যখ্যা করা হয়েছে।
সরকার পাকিস্তানের একটি প্রচারনা উল্লেখ করেছে যেখানে পাকিস্তানিরা বলছে, ১৫ মিলিয়ন উবাস্তু যারা ভারতে প্রবেশ করেছে তারা আসলে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ছিলো যাদের ফেরত যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
ইতিপূর্বে, বিরোধীদলের চাপ থাকা স্বত্বেও, সরকার বাংলাদেশের সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেছে যেখানে সরকারের কাছে আধিক ভালো মনে হয়েছে “অপেক্ষা করা এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা”।
মিসেস গান্ধীর বিরোধী দলের নেতাদের সাথে ৩ ঘন্টার আলোচনায় এটি স্পষ্ট হয় যে, আজকের আলোচনায় তাদেরকে প্রবাসী সরকারের সর্বশেষ উন্নতি সম্পর্কে ধারনা দেয়া হয় এবং এই বিষয়ে আরো চিন্তা করতে বলা হয়। ” সরকারের সিদ্ধান্তগুলো দুর্বলতা থেকে আসছে “বা প্রভাবিত হচ্ছে পাকিস্তানীদের থেকে আসা যুদ্ধের হুমকি বা চীনের সাথে নতুন সংঘাতে জড়ানর ভয় থেকে বিরোধীদের এধরনের বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়। মিসেস গান্ধী বলেন ” এরচেয়ে গুরতর কারন রয়েছে ” কিন্তু তিনি কারগুলো ভেঙ্গে বলেন নি। মিসেস গান্দী বলেন, ভারতে থেকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার রয়েছে কিন্তু অবিলম্বে এই ব্যবস্থা নিলেও তা কোন প্রভাব ফেলবেনা। তার এই ইঙ্গিতই এ বিষয়ে সরকারের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরেছে।
এটি জানা যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যারা অন্যতম বন্ধুত্বপূর্ণ শক্তি ও যাদের সাথে নয়াদীল্লির সম্পর্ক ঘনিষ্ট এবং মস্কোও পূর্ব বাংলা সম্পর্কে ভারতের মুল্যায়নকেই গ্রহন করেছে। জানা গেছে তা ছিলো বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি মঞ্জুর না করার ব্যাপারে।
প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান থেকে বুঝতে পারা যায় বিরোধীদলের এই অবস্থান তাদের প্রত্যাশিতই ছিলো। বিকানের ডাঃ কামি সিং ও মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব মোহাম্মদ ইসমাইল ছাড়া প্রায় সব বিরোধী নেতা অবিলম্বে স্বীকৃতি চেয়েছিলেন এবং এটি বিলম্বিত করার জন্য সরকারকে তিরষ্কার করেছিলেন। জন সংঘের সভাপতি জনাব অটল বিহারী বাজপেয়ী ছিলেন এ ব্যাপারে সবচেয়ে সপ্রতিভ যেখানে ডিএমকে এর জনাব মনোহরন ছিলেন সতর্ক। সমালোচকরা চেয়েছিলো, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে সরকার অন্য সরকারগুলোর নেতৃত্ব দেবে। ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারন ছাড়াও যেহেতু পূর্ববাংলায় পাকিস্তানিদের দ্বারা গনহত্যা সংগঠিত হচ্ছে। ভারতের এখানে বিশেষ দায়িত্ব আছে, তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া অনুভুতি গুলো প্রকাশ পেয়েছে জনাব বাজপেয়ির কথায়। তিনি অভিযোগ করেছেন ভারত বাংলাদেশের জনগনকে হতাশ করে দিচ্ছে।
অপরদিকে ডাঃ কামি সিং ও জানাব ইসমাইল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে যে জটিলতাগুলো হতে পারে তা নিয়ে কথা বলছেন। জনাব মনোহরন এই পদক্ষেপের প্রভাব নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষনার প্রস্তাব দেন।
আন্তর্জাতিক নীতি
মিসেস গান্ধী বাংলাদেশ ইস্যুটিকে শুধুমাত্র স্বীকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে আরো বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরতে চান। তিনি বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আচরণের মধ্যে থেকেই সম্ভাব্য সকল উপায়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে পূর্ববাংলার জনগনকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পাকিস্তান মিথ্যাচার করেছে ভারতকে কলঙ্কিত করার জন্য এবং পূর্ববাংলায় বাস্তবতা সম্পর্কে বিশ্বকে ভুল ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছে। তিনি দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার জন্য পাকিস্তানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিরোধী নেতাদের সতর্ক করেন ও এধরনের সমস্যা মোকাবিলায় তাদের সাহায্য কামনা করেন।
শরণার্থীদের পুনর্বাসন, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিকটে সাহায্য চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়। মিসেস গান্ধী ১৫০০০০০ শরণার্থীর ভারতে প্রবেশের ব্যাপারে তথ্য প্রদান করেন। এদের ৫০ শতাংশকে ইতিমধ্যেই ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং অবশিষ্টরা খোলা জায়গায় অবস্থান করছে। উপরে প্রকাশিত সংখ্যাটিতে যারা বিহার বা অন্যান্য রাজ্যে গিয়েছেন তাদের সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, সরকার এই ধরনের বিশাল সংখ্যার উদ্বাস্তুদের আন্তপ্রবাহের আর্থ-সামাজিক প্রভাব নিয়ে সচেতন ছিলো এবং সবচেয়ে ভালোভাবে তাদের দেখাশোনা করার কাজটি করেছে।
তারা শরণার্থী নয় উদ্বাস্তু
তিনি এটি পরিষ্কার করে বলেছেন যে, যারাই ভারতে এসেছে প্রত্যেককেই যুদ্ধের পরে দেশে ফিরে যেতে হবে। এই কারনেই তিনি তাদের শরণার্থী না বলে উদ্বাস্তু বা উৎখাতের শিকার হওয়া বলে উল্লেখ করেছেন। জনাব শরন সিং ও বাংলাদেশকে এখনই স্বীকৃতি না দেয়ার ব্যাপারে সরকারের মতামতকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ” অপেক্ষা করা ও দেখা ” ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। তিনি পরামর্শ দেন ভারতের এই বিষয় জাতিসংঘে তোলা উচিত। মিসেস গান্ধী অন্যান্য দেশের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য তার সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের বিষয় তুলে ধরেন এবং এটি করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্য।
এই আলোচনায় মিসেস গান্ধী, জনাব শরন সিং, জনাব জাগজিবান রাম, জনাব চেভান, জনাব ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ, জনাব রাজ বাহাদুর, জনাব আর কে খাতিলকার ও জনাব ওম মেহতা ভারত সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সতন্ত্র দলের প্রতিনিধিরা ছাড়া সকল বিরোধী দল এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। স্বতন্ত্র পার্টির প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই সভায় উপস্থিত হতে না পারার অপারগতা জানিয়ে একটি পত্র প্রেরন করেন এবং তাদের অন্যত্র ব্যস্ত্যতা রয়েছে বলে জানান। বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সিপিএল থেকে জনাব ইন্দ্রজিত গুপ্তা এবং এস এম ব্যানারজি, সিপিএল (এম) থেকে ছিলেন জনাব এ কে গোপালান, পিএসবি থেকে ছিলেন, জনাব এম জি গোরাই ও জনাব সমর গুহ, ডিএমকে থেকে ছিলেন জনাব মনোহরন, আইএনডি থেকে ছিলেন জনাব ফ্রাঙ্ক এন্থনি, জে এস থেকে ছিলেন জনাব বাজপেয়ী, এবং উপস্থিত ছিলেন ডাঃ কামী সিং ও জনাব ইসমাইল।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩০। বাংলাদেশ দি ট্রুথ | কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি প্রকাশিত পুস্তক | ৯ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৩০, ৩৫২–৩৬১>
এই ছোট প্রচারপত্রে বাংলাদেশের আন্দোলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যখন জনাব জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের দাবির উপর পাকিস্তান গঠন করা হয় এই দুই দেশের মাঝে ধর্ম ছাড়া আর কোন বিষয়ে সাদৃশ্য ছিলোনা। ধর্ম কদাচিত জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎস হতে পারে। অন্যথায়, সমস্ত খ্রিস্টান ও মুসলমানরা একই রাষ্ট্রের অধীনে বাস করতে চাইত। তাদের ভাষা সংস্কৃতি ভিন্ন ছিল। যদিও পূর্ব অংশের জনসংখ্যা বেশী ছিল কিন্তু অপর অংশটি সব সময় অগ্রাধিকার ভোগ করেছে। পুর্ব অংশের ভাগ্যবিড়ম্বিত জনগণকে শুধুমাত্র ব্রিটিশ থেকে পাঞ্জাবের প্রভুদের নেতৃত্ব বরন করে নিতে হয়েছে। একমাত্র বিষয় ছিল যে উভয় অংশের মানুষের একই ধর্ম ছিল। কিন্তু এটা খুব ক্ষুদ্র সান্তনা-যুক্তি হিসেবেই প্রতীয়মান হল। বাংলা ভাষাভাষী লোকদেরকে মাঝে মাঝে সামান্য কিছু দেয়া হত। কিন্তু অধিকাংশই বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য। এই অন্যায়ের জন্যই সম্পদের সমান অধিকার নিশ্চিতকল্পে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবী অনিবার্য হয়ে ওঠে।
এই চাহিদা শুধুমাত্র একটু বিচক্ষণতা ও সহানুভূতি দিয়েই সমাধা করা যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব অংশের দরিদ্র মানুষদের কাঙ্ক্ষিত সাম্যতা ও স্বায়ত্তশাসনের বদলে পেতে হয়েছে বুলেট। এই চেঙ্গিস খান-নাদির শাহ-হিটলার চিকিত্সায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ডাক দেয়।
বাংলাদেশের এ কাহিনী ইতিহাসে নতুন নয়। অনেক দেশ যারা এখন স্বাধীন হয়েছে তারা অন্য দেশের অংশ ছিল। পরবর্তিতে তারা আন্দোলন করেছে এবং অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন একবার শুরু হলেও কখনো কখনো তা স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিরদিনই তা অর্জিত হয়েছে। কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা আজ বা কাল অর্জন করেই নেবে। তবে অন্যান্য দেশের অর্জিত স্বাধীনতার সাথে এটার স্বাতন্ত্র্য হচ্ছে এখানে দখলদার বাহিনীর দ্বারা ঘটানো অসভ্যতা, খুন ও ধ্বংসলীলা। আর দ্বিতীয় সবচেয়ে দু: খজনক সত্যটা হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সরকারের এই যুদ্ধে সাড়া না দেওয়ার মনোভাব। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে এবং আমরা ভারত সরকার তাদের সাথে থাকতে পেরে গর্বিত। আমাদের মানুষ সবসময় বিশ্বের প্রতিটি অংশে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, বা রাজনীতি নির্বিশেষে স্বাধীনতাকামী মানুষকে সমর্থন দিয়েছি। ফ্রান্স যেভাবে অ্যামেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে পাশে ছিল আমরাও একইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। যখন একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে তখন সেটা শুধু সেখানকার অগণতান্ত্রিক সরকার নয় বরং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক, স্বাধীনতা প্রেমী মানুষের জন্য ভাবনার বিষয়।
বাংলাদেশের এ গল্প লিখেছেন ডঃ বাগেন্দু গাঙ্গুলী এবং ডঃ মীরা গঙ্গোপাধ্যায়। তারা অনেক কষ্ট করে স্বল্প সময়ের মধ্যে এটা লিখেছেন এবং আমরা সত্যিই তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কোলকাতা বৈশাখ ২৫, ১৩৭৮ রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিন, ৯ মে ১৯৭১
|
এস সেন উপাচার্য
|
বিশ্বের বিবেক পাকিস্তানের বর্তমান শাসকদের অহংকারী অধার্মিক আচরণে শোকাহত। দীর্ঘদিনের ভীতি প্রদর্শন, অর্থনৈতিক শোষণ ও গণহত্যার ধারাবাহিকতায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
ভারতীয় ভূখণ্ডের এক হাজারেরও বেশি মাইল ভৌগলিকভাবে পৃথকীকৃত কিন্তু ইসলামী বিশ্বাসের দ্বারা একত্রে বাঁধা দুই দূরবর্তী অঞ্চল মাত্র তেইশ বছর আগে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই বছরগুলোতে দুই অংশ কাছাকাছি আসেনি। বরং তাদের মধ্যকার পার্থক্য বেড়েছে আরও অনেক বেশী। এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা পশ্চিম পাকিস্তান গত দুই দশক ধরে অর্থণৈতিকভাবে নাটকীয় উন্নতি লাভ করলেও তুলনামূলকভাবে জনবহুল পূর্ব অংশ বিশ্বের অন্যতম পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এবং পূর্ব অংশকে শুষে নিয়েই পশ্চিমের এই উন্নতি।
অর্থনৈতিক অসমতা
পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পুর্ব পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। কিন্তু সত্যিকারের মাথাপিছু আয় বৈষম্য ছিল ৪০ এবং ৫০ শতাংশের মাঝামাঝি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় এই অংকটা এত বেশী দেখা যায়। তাছাড়া পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদের আহরণ এবং বিদেশী ঋণের কারণে এটা আরও বেড়ে যায়।
স্থানীয়ভাবে ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স ডিপোজিট হিসেব করলে এবং এটাকে মোট জাতীয় আয়ের ব্রেকডাউন বের করে মিলিয়ে দেখলে যে কেউ সেটা সহজেই অনুমান করতে পারবে। এতে দেখায় যায় পুর্ব পাকিস্তানের অবস্থান পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে তিন গুণ উপরে। কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ের বিপরীতে জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় শ্রমশক্তির প্রাদেশিক বন্টন ডাটা ব্যবহার করে দেখলে এই সম্পর্কে ধারনা করা যেতে পারে। এখানে দেখা যাবে পশ্চিম পাকিস্তানে এর পরিমাণ পুর্বের চাইতে তিন গুণ।
কিন্তু শুধু মাথাপিছু আয় দেখেই এই ধারনা করা যাবেনা। দুই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও এক ছিল না। দ্বিতীয় ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা দেখলে জানা যায় একই পণ্যের দাম পুর্ব পাকিস্তানে বেশী ছিল। তাছাড়া পরিবহন ও বণ্টনের ক্ষেত্রেও এই পার্থক্য দেখা যায়। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় মূল্য পার্থক্য আরও বেশী বাড়ানো হয়েছে। ১৯৫৯-৬০ থেকে ১৯৬২-৬৩ সালের আঞ্চলিক মূল্য সূচক দেখলে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানে ১০০ থেকে ১১২ ভাগ বেড়েছে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে মাত্র ১০০ থেকে ১০২ ভাগ বেড়েছে। তৃতীয় ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার (১৯৬৫-৭০) মিডপ্ল্যান রিভিউ (মাঝামাঝি পুনরালোচনা) করে দেখা যায় সেখানেও একই ধারাবাহিকতা রয়েছে।
দুই অঞ্চলের অর্থনীতির মধ্যে কাঠামোগত পার্থক্য দেখলেও মাথাপিছু আয় বৈষম্য সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রথম দিকে দেখায় যায় দুই পাকিস্তানের শিল্প অবকাঠামো প্রায় একই ছিল। বরং ব্যাংকিং কার্যক্রম পূর্বে বেশী ছিল। বিভিন্ন সেক্টরে পুর্ব পাকিস্তানের তুলনামূলক অবদান দেখলেও সেই সময়ের অর্থনীতি সম্পর্কে ধারনা পাওয়া সম্ভব। কৃষিতে পুর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল ৭০ ভাগ আর পশ্চিমের ছিল ৫০-৫৫ ভাগ। উৎপাদন খাত সে তুলনায় কিছুটা নিচে ছিল। আর আঞ্চলিক খাত ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম।
সময়ের সাথে সাথে কাঠামোগত পার্থক্য আরও বেড়েছে। “কাঠামোগত উন্নয়ন” এর উচ্চ হারে বৃদ্ধির কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের মোট (এবং মাথাপিছু) আয় যায় বেড়ে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি পুর্ব পাকিস্তানের শেয়ার কৃষিতে নেমে যায় ৬০ ভাগে যা পশ্চিমে হয় ৪৬ ভাগ। উৎপাদন খাতে পুর্ব পাকিস্তানের অবদান হয় মাত্র ৭-৮ ভাগ যা পশ্চিমে দাঁড়ায় ১৪-১৫ ভাগ। স্থানীয় উন্নয়ন ও বিপুল বেগে পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়ে যেতে থাকে পূবের তুলনায়। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালে পুর্ব পাকিস্তানে সাধারণ কৃষি শ্রমিকের পরিমাণ ৮৩.২ থেকে বেড়ে ৮৫.৩ ভাগে পৌঁছায়। পশ্চিম পাকিস্তানে তা কমে গিয়ে ৬৫.১ থেকে ৫৯.৩ ভাগে পৌঁছায়।
এই কাঠামোগত পার্থক্যের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্বে বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে বেকারত্বের হার ২০ ভাগ বাড়ে আর পশ্চিমে তা ছিল ৮ ভাগেরও কম। তার পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল আরও জটিল উন্নত শিল্প ও যন্ত্রপাতি।
পশ্চিম পাকিস্তানের আরও উন্নত আন্তঃকাঠামো ছিল। পরিবহন ব্যবস্থা আরো উন্নত ছিল। ১৯৬০ সালে উচ্চ মাইলেজসম্পন্ন মহাসড়ক ছিল ছয় গুণ বেশি। রেলওয়ে মাইলেজ ছিল ৩ গুণ বেশী। ট্রাক ও বাসের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে ৫ গুণ বেশী ছিল। ১৯৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্ট ও টেলিগ্রাফ অফিস ও যোগাযোগে অনেক বেশী ছিল – টেলিফোনের সংখ্যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে ৫ গুণ বেশী। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় ৫/৬ গুণ বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রকৌশল, শিল্প এবং প্রযুক্তি কর্মীদের সংখ্যা বেশী ছিল। সর্বপরি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনে তাদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশী।
ফেডারেল সরকারের আসন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসারদের বেশিরভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। যে মন্ত্রণালয় থেকে সব গুরুত্তপূর্ন বরাদ্দ হয় – অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুটি গুরুত্তপূর্ণ পদ (সচিব এবং যুগ্ম-সচিব) প্রায় একচেটিয়াভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সিভিল সার্ভেন্টরা (১৯৬০ সালে ছিল ৫৩ জনের মধ্যে ৫২ জন) দখল করে রেখেছিল। ১৯৬০ সালে ১৭৭৯ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মচারিদের মধ্যে ৮০ ভাগ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। অর্থাৎ একটি দেশের অর্ধেকের বেশী জনগণ যে অঞ্চলে বাস করে তাদের মধ্যে মাত্র ১৩ ভাগ ছিলেন গুরুত্তপূর্ন পদে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান – যারা উভয়েই সম্পদের বরাদ্দে ক্ষমতা রাখেন – তাদের কেউই কখনোই পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়োগ পান নাই।
ফেডারেল সরকারের আসনের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং ও শিল্প ক্ষেত্রে আকৃষ্ট করানো। পশ্চিম পাকিস্তান শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ নয় – বরং ফেডারেল গভমেন্টের ৯০ ভাগ পদ দখল করে রেখেছিল। এভাবেই পুরো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সকল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও কৌশলগত উন্নয়ন ও বরাদ্দ সম্পর্কিত দপ্তরের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানীরা দখল করে রেখেছিল।
যদিও পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আঞ্চলিক আয় বেশী ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি অবকাঠামো পশ্চাদপদ ছিল তবুও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবনমানের বৈষম্য তার চাইতেও বেশী ছিল। এর একটি অন্যতম কারণ পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বৈদেশিক সম্পদ প্রবাহ বেশী ছিল। এর দুটি অন্যতম উৎস হল (ক)স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে (দৃশ্যমান) সম্পদের স্থানান্তর এবং (খ)বৈদেশিক সাহায্যের অনেক বড় প্রবাহ পশ্চিম অঞ্চলে সরবরাহ।
স্বাধীনতার প্রথম দশকে পুর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ স্থানান্তরের একটি প্রমাণ হচ্ছে সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ও আন্তঃআঞ্চলিক আয় উদ্বৃত্ত ছিল। বাকি বছরগুলোতে এটা নির্নয় করা যেত যদি বৈদেশিক মুদ্রা এলোমেলোভাবে স্থানান্তর না করে অফিসিয়াল দামে করা হত। সম্পদের এই দৃশ্যমান স্থানান্তর ছাড়াও বৈদেশিক সহায়তার সিংহভাগ সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানেই নিয়ে যাওয়া হত।
এভাবেই অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান সুবধা নিতে থাকায় – পূর্ব পাকিস্তান – যারা কিনা সমস্ত দেশের ৫৪% জনগণ – তারা এই অনিয়মের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে শুরু করে।
স্বায়ত্তশাসনের দাবি
পাকিস্তানের দাবিতে পূর্ববাংলার জনগণ সমর্থন দিয়েছিল কারণ তারা আশা করেছিল যে নতুন রাষ্ট্র হলে তা তাদের অগ্রগতির জন্য মঙ্গলজনক হবে ও নতুন সুযোগ বয়ে আনবে। কিন্তু এই আশা পূর্ণ হয়নি। এবং পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাভাবিকভাবেই এতে ক্ষুব্ধ। ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ – এ একজন সদস্য গণপরিষদে বলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে কারণ তারা অবহেলিত হচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ হিসেবে তাদের দেখা হচ্ছে। ’ এই ক্ষোভ থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠে। জনগণ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের করা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করতে থাকে। এখানে উল্লেখ করা ছিল যে পাকিস্তানের উভয় সাংবিধানিক অংশ “স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম” হবে। তারা উল্লেখ করেন যে পাকিস্তান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বদলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে।
পূর্ববাংলায় বিশ্বাসঘাতকতা চরমে ওঠে ভাষা প্রশ্নে। মার্চ, ১৯৪৮, জিন্নাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে আসলে শিক্ষার্থীদের দাবি ওঠে যে বাংলাকে উর্দু সঙ্গে সাম্যাবস্থা দিয়ে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শ্রোতাদের বলেছিলেন: “আমি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে যাচ্ছে, এবং অন্য কোন ভাষা নয়”।
বাঙালি দেখল তাদের উপর শুধুমাত্র সংস্কৃতিক হুমকি নয় বরং প্রশাসনিক চাকরী থেকে শুরু করে সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের নিকৃষ্ট অবস্থায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছিল – এবং পাঞ্জাবিদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছিল। ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন জব্বার, সালাম, রাফিউদ্দিন, বরকত ও আরও বাইশ জন অন্যান্য তরুণ তাদের প্রিয় মাতৃভাষার সমর্থনে বের হয়ে রক্ত দেয়। এই শহীদদের রক্তদানের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ববাংলার লীগ সরকার রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণার জোর দাবি জানায়। তাদের দাবী সে সময় দাবীয়ে রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তিতে সংবিধানে ১৯৫৬ সালে গৃহীত হয়: “পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা। “
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুসলিম লীগ আন্দোলন করে যার ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পরিণতি পায়। যুক্তফ্রন্ট যারা নির্বাচনে ক্ষমতায় বসে তারা তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিল। নতুন মন্ত্রণালয় ৭ দফা প্রোগ্রাম দিয়েছিল যেখানে একই বিষয় ছিল। সেখানে স্পষ্ট ছিল “প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি ও মুদ্রা ব্যাতীত পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকবে। উল্লেখিত বিষয়গুলি শুধুমাত্র কেন্দ্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। কিন্তু এক পক্ষকাল সময়ের ভেতর মন্ত্রী ব্যার্থ হন কারণ কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে যেনতেনভাবে শেষ করে দেন।
সময়ের সাথে সাথে দুই পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং তাই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা বাড়ছিল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ১৯৫৮ সালে শুরু হয় এবং প্রায় সাড়ে দশ বছর ধরে চলে। সামরিক শাসন হবার কারণেই আইয়ুব খানের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বোঝার সুযোগ হয়নি। বেশ স্বাভাবিকভাবেই, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সমস্যা নতুন মাত্রা পায় এবং ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সরকারের একটি ফেডারেল ফর্ম যা সংসদে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের দ্বারা নির্বাচিত হয় তারা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য সব কিছু পূর্ব পাকিস্তানের ফেডারেটিং সরকার দেখবে। দুই দেশের মুদ্রা স্থানান্তর না করে তার পরিবর্তে আলাদা মুদ্রা ও মুদ্রানীতি করা হবে। যুক্ত সরকার খরচ মেটানোর জন্য ট্যাক্স এর অর্থ নিতে পারবে তবে তাদের কোন করারোপ করার ক্ষমতা থাকবেনা। প্রতিটি ফেডারেট সরকার বিদেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে এবং তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ফেডারেল রাষ্ট্রের তাদের নিজস্ব মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী থাকবে।
ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার মাত্র দুই মাস পর মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করা হয় এবং দেখানো হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সামরিক ও বেসামরিক উচ্চ পদমর্যাদার অফিসার ভারতের কূটনৈতিক কর্মী দের সাথে জড়িত হয়ে একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল।
আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলন ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে চরম আকার ধারণ করে। এবং এর আসল নেতৃত্বে ছিল ছাত্রদের ‘জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’ যেখানে সব রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে সরকারকে বাধ্য হয় এবং ১৯৬৯ এর শুরুতে মুজিবুর মুক্তি লাভ করেন। এবং তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য আইয়ুব খান আমন্ত্রণ জানান। সম্মেলনে মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে জাতীয় প্রশ্ন টি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ক্ষমতায় যারা এসেছে তারা পাশ কাটিয়ে গেছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিক পৃথক সত্তা রয়েছে। এসব বিষয় রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠানের স্বীকার করতে হবে। তিনি ছয় দফার জন্য চাপ দিতে থাকেন।
আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ কয়েকদিনের মধ্যেই ধসে পড়ে। সেখানে একটি দ্বিতীয় সামরিক কর্তৃত্ব শুরু হয়। ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসীন হন।
নতুন শাসকদের লক্ষ্য ছিল ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়ার তিন ঘোষণা যা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে ৩০ মার্চ পাশ হয়। ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কোনো সরাসরি অঙ্গীকার করে নাই। শুধু বলেছেন তিনি প্রদেশগুলোকে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন দেবেন কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা ও কাজের অসুবিধা যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকটা লক্ষ্য রেখে।
লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে ১২০ দিনের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভা ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি তে জয়লাভ করে। এবং এইভাবে হাউসের ১৩১ এর মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে ভোটারদের একই রকম ফলাফল পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়াহিয়া খান মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তার সফর শেষে ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন যে ক্ষমতা দ্রুত তাঁকে স্থানান্তরিত করা হবে। কিন্তু তিনি সে সময় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জন্য একটি তারিখ ঠিক করতে অস্বীকৃতি জানান। অনেক বিলম্বের পরে, এসেম্বলি ৩ মার্চ ডাকা হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো, যার নেতৃত্বের পিপলস পার্টির নির্বাচনে ৮৫ টি আসন পেয়েছিল, তিনি হুমকি দেন আওয়ামীলীগ ৬ দফা প্রত্যাহার না করলে তিনি এসেম্বলিতে যাবেন না। তিনি করারোপণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমতা চেয়েছিলেন। মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, পূর্ববাংলার জনগণ ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষেই তাদের স্পষ্ট রায় দিয়েছিলেন যেখানে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এর কথা বলা হয়েছে এবং এই রায়কে সন্মান দেখাতে হবে। দেশের সংবিধান ছয়দফার উপর ভিত্তি করেই করতে হবে।
ভুট্টোর হুমকি সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছিল। এবং আওয়ামী লীগের ত্রিশ সদস্যের কমিটি ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে প্রস্তুত করা খসড়া সংবিধান পর্যালোচনা করতে বসল। ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলল এবং হুমকি দিল যে যদি তার দল ছাড়া ন্যাশনাল এসেম্বলি হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে বড় রকমের আন্দোলন হবে। হঠাৎ করে ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। তিনি “ভারাক্রান্ত হৃদয়ে” এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বলেন, দুই পাকিস্তানের নেতাদের মনোভাব ও ভারতের আচরণ নিতান্তই পরিতাপের বিষয় বলে তিনি তা বন্ধ ঘোষনা করছেন। ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, পাকিস্তান চরম সঙ্কটের মুখোমুখি এবং এই অবস্থায় অধিবেশন স্থগিত করার প্রয়োজন ছিল এবং এই সঙ্কটের কিছু সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশে অবিলম্বে নিজ নিজ এলাকার জন্য সামরিক আইন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিযুক্ত করা হল এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নতুন সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।
এক সংবাদ সম্মেলনে মুজিবুর রহমান এটিকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে নিন্দা করেন এবং পরদিন ঢাকায় হরতাল এবং তার পরের দিন থেকে সারাদেশে সাধারণ অবরোধ ঘোষণা করেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন রাষ্ট্রপতি এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে পরামর্শ না করেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন। ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয় এবং কয়েক হাজার মানুষ সংবাদ সম্মেলনের ভেন্যুর বাইরে মিছিল করতে থাকে।
বিক্ষোভকারীদের চিৎকার ও প্রতিরোধের মুহুর্তে মুজিবুর ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেন “আমরা একটি শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করব”। কিন্তু পরদিন ঢাকায় সহিংসতার সূত্রপাত হয় এবং পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী জনগণের ওপর গুলি ছোড়ে। পরদিন ঢাকা এবং অন্য দুটি শহরে কারফিউ জারি করা হয় এবং সামরিক আইন প্রশাসন একটি ডিক্রি জারি করে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেস সেন্সরশীপ চালু করে। ৩ মার্চ, মুজিবুর একটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরুর ঘোষণা করেন যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত হবার আগ পর্যন্ত বলবত থাকবে বলে ঘোষনা করেন। একই দিনে ইয়াহিয়া খান সংবিধান প্রণয়নের উপর ঢাকায় ১০ মার্চ একটি সম্মেলন করার জন্য দুই অংশের নেতাদের আমন্ত্রন জানান। সৈন্যরা রাস্তায় জনবিক্ষোভের উপর গুলি করে শত শত মানুষকে হত্যা করে। মজিবুরের অনুরোধ তারা গ্রাহ্য করেনা। পরবর্তি কিছু দিনে আরও অনেককে হত্যা করা হয়। ইতোমধ্যে সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে প্লেন এবং জাহাজে করে আরো সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন সেনাবাহিনী পাকিস্তানের “সম্পূর্ণ এবং পরম” অখণ্ডতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, তার দল অধিবেশনে যোগ দেবার ব্যাপারটি বিবেচনা করবে যদি যদি ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন, সেনা প্রত্যাহার করে বেসামরিক শাসন বলবত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের তদন্তের আদেশ দেন।
অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। সমস্ত পূর্ববাংলা মুজিবুর ও তার আওয়ামী লীগের পিছনে ছিল। এমনকি প্রধান বিচারপতি এবং ঢাকা হাইকোর্টের বিচারকরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। এটা একটি বিস্ময়কর এবং সত্যিই অতুলনীয় আন্দোলন ছিল। ১৫ মার্চ, মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, তিনি জাতীয় পরিষদে ও প্রাদেশিক পরিষদে তার দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি ৩৫ দফা ঘোষণার একটি সেট প্রস্তুত করেন এবং ইয়াহিয়া খান ১৬ মার্চ ঢাকায় এসে আলোচনা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ভুট্টো ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা আলোচনায় যোগদান করেন।
কোন পর্যায়ে আলোচনা সমাপ্ত হচ্ছিল না। এমনকি ইয়াহিয়া খান বা তার দল কোনো ইঙ্গিত বা অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন নাই। পরিশেষে চার দফার একটি চুক্তিতে আসেন তারা। এগুলি হলো: সামরিক আইন ও প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার দ্বারা একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর; সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের জন্য প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর; ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন; এবং পূর্ব ও পশ্চিম অংশে জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক অধিবেশন ব্যাবস্থা। পশ্চিম পাকিস্তান প্রস্তুতিমূলক একটি যৌথ অধিবেশনে সংবিধান চূড়ান্ত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। নীতিগতভাবে এই চুক্তি মুজিবুর এবং ইয়াহিয়ার মধ্যে হবার পরে প্রশ্ন ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতা কার হাতে থাকবে।
কিন্তু হঠাৎ করে, ২৫-২৬ মার্চ ইয়াহিয়া রাতের অন্ধকার ঢাকা ত্যাগ করেন। একই সাথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তাদের একশন শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুজিবকে এই ব্যারথতার জন্য দায়ী করে। এবং ২৬ মার্চ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। ২ দিন পর বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার গঠন ঘোষণা করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এটা এখন স্পষ্ট যে, ইয়াহিয়া খান ও তার দলের শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের কোন ইচ্ছাই ছিলোনা। তারা শুধুমাত্র আধুনিক অস্ত্র দিয়ে সৈন্য শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য সময় ক্ষেপণ করছিল। অসহযোগ আন্দোলনের অসাধারণ সাফল্যের জন্য পাকিস্তানী শাসকদের ঔপনিবেশিক শোষণের দিন চিরতরে চলে গেল। অত: পর পাকিস্তান সরকার ২৫ মার্চ গণহত্যার সামরিক আদেশ দেন।
বাংলাদেশের সাহসী মানুষ তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করল, শহীদের রক্তে তাদের মাতৃভূমির প্রতি একর সবুজ জমি লাল রঙে রঞ্জিত হল।
বাংলাদেশের যুদ্ধ
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপক হামলা ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে শুরু হয় এবং এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তান সরকার শুধুমাত্র জনগণের ম্যান্ডেট নয় বরং সভ্যতার সব অনুশাসন ভঙ্গ করেছে। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সংঘটিত নৃশংসতার পূর্ন চিত্র এখনো পাওয়া যায় নাই। কিন্তু ভারতীয় ও বিদেশী কিছু সংবাদপত্র ও লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু যারা ভারতে পালিয়ে এসেছেন তাদের বক্তব্য থেকে জানা যায় পাকিস্তানী শাসকেরা বাংলাদেশে কি পরিমাণ গণহত্যা চালাচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে কার্যত একটি বড় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তারা ব্যাপক বিমান হামলা ও বোমাবর্ষণ করে শহর ও গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিল। গণহত্যার জন্য তারা ট্যাংক, কামান, মর্টার ও মেশিনগানের মত অত্যাধুনিক ভারী-মারনাস্ত্র ব্যবহার করছে। তারা আগ্নেয় বোমা ও জনশ্রুতি আছে যে এমনকি তারা নাপাম বোমা ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তান সরকার ধারাবাহিকভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও জননেতাদের একটা বড় অংশকে হত্যা করছিল। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বৃহৎ সংখ্যক শিক্ষক ও ছাত্রদের হত্যা করেছে এবং তারা সব কর্মক্ষম বাঙালিকে বেছে বেছে হত্যা করছে। গণহত্যার একটি বেলেল্লাপনা চলমান ছিল।
পাকিস্তান সরকার ক্রমেই আন্তর্জাতিক আইনের সব নীতি লঙ্ঘন করেছে। তারা ইন্টার আলিয়া, ইউ এন সনদের প্রস্তাবনা ও প্রবন্ধ নং ১, ৫৫ ও ৫৬ ধারা, ১৯৬৬ সালের মানবাধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি, ১৯৬৬ সালের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ঘোষনা, ১৯০৭ সালের হেগ রেজোল্যুশন, ১৯৪৯ এর জেনেভা কনভেনশনের ধারা ৩ এর ধারা ২৩ (জি), ১৯৪৮ এর যুদ্ধরত আক্রমণ থেকে অযোদ্ধাদের অনাক্রম্যতা মতবাদ এবং জেনোসাইড কনভেনশন আইন ভঙ্গ করেছে।
২৫ মার্চ ১৯৭১ এ যুদ্ধের প্রথম রাত হতে শারীরিক ও মানসিক ধ্বংসের একটি নিয়মিত ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি শীঘ্রই স্পষ্ট হয় যে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপকে টার্গেট করে তাদের শেষ করার কার্যক্রম চলছিল। এদের মধ্যে ছাত্র এবং শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ অন্তত ৯ জন শিক্ষাবিদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তি কয়েক দিনে আরও অনেককে হত্যা করা হয়। ২৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষাবিদকে একটি দেয়ালের সাথে লাইনে দাড় করিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঢাকা, খুলনা, যশোর, রাজশাহী, পাবনা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ফায়ারিং স্কোয়াডে অনেক বিশিষ্ট শিক্ষক, কবি ঔপন্যাসিক, চিকিত্সক ও আইনজীবীদের হত্যা করা হয়। এমনকি স্কুলের বাচ্চারাও রেহাই পায়নি। যশোরে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপর সৈন্যরা মেশিন-গান চালায়।
ঢাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। তিন তলা ইকবাল হলের প্রত্যেকটি রুম তছনছ করা হয় এবং ভিতরের সব মানুষকে হত্যা করা হয়। একই রকম হামলা জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ হল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের আবাসিক হল এ চালানো হয়। এসব স্থানের প্রতিটি মানুষকে হত্যা করা হয়।
সেনা আক্রমণ শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্রী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অনেক ছাত্রীদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং জোর করে অনেককে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। শহীদ মিনার, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্থাপনা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়। ফ্যাকাল্টি স্টাফদের আবাসস্থলে ঘুমন্ত শিশুদের পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করা হয়।
জন রোড নামে একজন আমেরিকান এইড কর্মী সম্প্রতি ঢাকায় ছিলেন এবং তিনি সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা সৃষ্ট ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরবর্তিতে তিনি U.S.A. সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির প্রকাশিত চিঠিতে বর্ণনা করেন কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে সেনাবাহিনীর ট্যাংক দ্বারা শেলিং করা হয়েছে এবং সব বাসিন্দাদের হত্যা করা হয়েছে। তিনি “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অধ্যাপক সহ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অনেককে পরিকল্পিতভাবে করা হত্যাকাণ্ডের বর্ননা দেন। তাঁর মতে পূর্ব বাংলায় জঙ্গলের আইন চলমান আছে – সেখানে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সমূলে হত্যা করা হচ্ছে।
সাইমন ড্রিংক, ডেইলি টেলিগ্রাফ এর একজন সংবাদদাতা। তিনি ঢাকা হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন ২৬ মার্চ সকালে সেনাবাহিনী এগারো ঘন্টার জন্য ধারাবাহিকভাবে ঢাকার সমগ্র পুরাতন শহর ধ্বংস করে। মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ভিতরে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। যদি কেউ পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে সৈন্যরা তাদের ধাওয়া করছিল। দৃক বর্ননা করেন কিভাবে একটি বাজারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের উপর গুলি করা হয়েছে এবং সকালে যেন তারা সেখানে ঘুমাচ্ছিল।
পুরাতন শহরের সর্ববৃহৎ ডুটি বাজারে মৃতদেহ এবং জ্বলন্ত দেহের দুর্গন্ধ এতোই মাত্রাধিক ছিল যে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তারা কাপড় দিয়ে নাক চেপে ধরে চলাফেরা করছিলেন। পচা লাশের দুর্গন্ধ ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকার বাতাসে ছড়িয়ে গেছিল। পাকিস্তানি সেনারা লাশগুলো ট্রাকে করে এনে নদীর তীরে ডাম্প করছিল। জগন্নাথ হল ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রোকেয়া হলের মধ্যবর্তী খোলা মাঠ একটি সমাধিস্থলে পরিণত হয়েছে। মানুষকে কবর খুঁড়তে সৈন্যরা বাধ্য করছিল এবং যখন তারা কাজ শেষ করছিল সৈন্যরা তাদেরকেও হত্যা করছিল। সামরিক অভিযান শুরুর থেকে পক্ষকাল পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় দুর্গন্ধযুক্ত পচা লাশ পরে ছিল।
রাজশাহীতে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উপর বারবার বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। টি বি হাসপাতাল ও মুসলিম স্কুলের উপরেও করা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী আসার পথে যা কিছু পাচ্ছিল তাঁর সবকিছুই ধ্বংস করছিল। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ইউনিফর্ম ছাড়া তারা ১৩ এপ্রিল রাজশাহী ও সংলগ্ন গ্রাম ছারখার করে দেয়। তারা বেসামরিক নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করে এবং শহরে অগ্নি সংযোগ করে। ভীতগ্রস্ত সাধারণ জনগণ পদ্মা নদী পার হয়ে পালাবার চেষ্টা করার সময় সেখানে অপেক্ষারত সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের নির্মমভাবে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মর্টার শেল ও মেশিনগানের গুলিতে নারী ও শিশুরা নদীতে মারা গিয়ে ভেসে যেতে লাগল।
অন্যান্য এলাকায় পলায়নপর উদ্বাস্তুদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কয়েকদিন ধরে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স খুব নিচু দিয়ে বিমান চালিয়ে সিলেট-চুরখাই-সুতারকান্দি রাস্তায় আশ্রয়রত উদ্বাস্তুদের উপর গুলিবর্ষন করে। তাছাড়া বিমানগুলো আশেপাশের এলাকাগুলো প্রদক্ষিণ করছিল। যখন তারা পলায়নপর কাউকে দেখছিল তখন তারা তাদের দিকে এসে ঝর্না-গুলি (shower bullets) নিক্ষেপ করছিল। আর কিছুক্ষণ পরপর গ্রামবাসী ও পথিপার্শ্বস্থ গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
একজন ডেনিশ স্টুডেন্ট যে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছিল সে সেখানে বেসামরিক জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের সংঘটিত নৃশংসতার কাহিনী বর্ণনা করে। চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে একটি গ্রামে মাতি দিয়ে বানানো কিছু ঘরে সেনারা কয়েকটি মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়ে অনেক মানুষ ও শিশুদের হত্যা করে। শহরেও তারা অনেক মানুষ হত্যা করে। একটি দোকানে প্রায় পনের জন মানুষ খাদ্য কেনার ছিল দাঁড়িয়ে দিল। সৈন্যরা তাদের সবাইকে বাইরে আসতে আদেশ দেয় এবং লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তাদের একজন জীবিত ছিল – সে দুইটি বুলেটবিদ্ধ ছিল। অন্য সবাই নিহত হয়। ডেনিশ ছাত্র বলল যে ৩১ মার্চ থেকে পরবর্তি ৩ দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা এবং ঢাকা রোড বরাবর সব কিছু জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জাহাজের একজন অফিসার ছাত্রটিকে বলেছিল কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ৪০০ লাশ ভাসছিল।
চট্টগ্রামের একটি পাটকল ম্যানেজার জানান যে তার সব কর্মচারীকে মেরে ফেলা হয়েছে। পিটাসবার্গের একজন প্রকৌশলী যিনি চট্টগ্রামে ছিলেন তিনি জানান যে সেনারা মানুষকে বেঁধে গুলি করে হত্যা করছিল। তাদের কোন প্রশ্ন করা হচ্ছিল না। যদি কেউ দৌড়াতে শুরু করে তাহলে তাদের কুকুরের মোট পেছন দিক থেকে গুলি করে মারা হচ্ছিল। প্রকৌশলী বলেন, হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হচ্ছিল। যদি তারা কোন মানুষকে না পায় তখন তারা বাড়িগুলোর জানালার দিকে মর্টার নিক্ষেপ করছিল। মৃত শত শত শিশুদের লাশ পরে ছিল। ওই মৃতদেহগুলি রাস্তায় জমে উঁচু হয়ে ছিল এবং পচছিল।
এমনকি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী রাস্তা ব্যারিকেড দেবার জন্য লাশগুলোকে ব্যাবহার করছিল।
পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর হত্যাকাণ্ড ও গ্রাম ও শহরাঞ্চলে পরে থাকা লাশ নাৎসি নৃশংসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনকি শিলাইদহে যেখানে কবি রবীন্দ্রনাথ তার অধিকাংশ সৃষ্টিশীল সময় অতিবাহিত করেছিলেন সেটাও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। তারা খাদ্য গুদাম এবং গ্রেনারি লুটপাট করছিল এবং পার্শবর্তি ফসল রাসায়নিক দিয়ে জ্বালিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছিল যাতে করে ভবিষ্যতেও এখানে কোন ফসল না হয়।
পাকিস্তানি সেনারা নারীদের শ্লীলতাহানি করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক তরুণী মেয়েদের জোর করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়েছিল। এমনকি বাঙ্গালী সেনাদের স্ত্রী ও কন্যাদের অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান কিভাবে কুমিল্লা-চাঁদপুর রোডে এক গ্রামের সব নারীকে স্ট্রিপ করে সামনে আগন্তুক একটি ট্রাকের সামনে মিছিল করে এগিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। এরা সবাই হয় গুলিতে অথবা ট্রাকের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়।
সৈন্যরা নির্দোষ, বিশ্বাসপ্রবণ লোকদের উপর নারকীয তামাশা করছিল। বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে মানুষকে আসতে বলছিল এবং তাদের মাসিক বেতন সংগ্রহ করতে বলছিল। মানুষ সরল বিশ্বাসে সেখানে গেলেই তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছিল। অন্য এক জায়গায় মানুষকে এসে দোকান থেকে তাদের রেশন সংগ্রহ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাদের নিশ্চিত করা হয় যে তাদের কোন ক্ষতি করা হবেনা। কিন্তু যখন মানুষ দোকানে আসে তখন সৈন্যরা ওপেন ফায়ার করে একশো জনকে হত্যা করে।
একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর ডায়েরী কলকাতা ডেইলিতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যায় বিদেশীরাও সৈন্যদের থেকে রক্ষা পায়নি। তিন ব্রিটিশ কে একটি সেনা ইউনিট ২৯ মার্চ গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যায় – তারা পুরোনো ঢাকায় সেন্ট থমাস চার্চ এর উপর বোমাবর্ষণ এর ছবি তুলেছিল। তাদের একজন ব্রিটিশ কাউন্সিল এর নিযুক্ত অফিসার ছিলেন এবং অন্য দুই জন ব্রিটিশ পরিচর্যা সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক সদস্য ছিলেন। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী এটা আমেরিকান কনস্যুলেটদের জানালে একজন মার্কিন কর্মকর্তাকে ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়। তিনি গিয়ে দেখেন যে ঐ তিন ব্রিটিশকে ফায়ারিং স্কোয়াডে লাইন ধরিয়ে দাড় করানো হয়েছে মেরে ফেলার জন্য। শুধুমাত্র সময়মত যাবার কারণে তারা প্রাণে রক্ষা পায়। এমনকি পাকিস্তান সরকার ঢাকায় উড়ে আসা একটি রেড ক্রস বিমানকে প্রবেশ করার অনুমতি দেয় নাই। ২ দিন ধরে করাচীতে রিলিফ নিয়ে অপেক্ষা করার পরে সেটা ফেরত চলে যায়।
পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা সংঘটিত নিষ্ঠুরতার ভয়ানক বর্ণনা দেয়া কোন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া বিক্ষিপ্ত প্রতিবেদন থেকে যথেষ্ট ভালো ভাবেই বোঝা যায় অবস্থা কি ভয়াবহ ছিল। আতঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড এখনও অব্যাহত আছে – তবুও মানুষ বীরত্বের সাথে প্রতিরোধের চালিয়ে যাচ্ছে। বর্বরদের কাছ থেকে এই সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য আর কত বাংলাদেশীকে প্রাণ দিতে হবে কে জানে।
বাংলাদেশের জনগণের এই দুর্ভোগের মধ্যে আমরা মানবতার বিবেকের কাছে আপীল করছি। বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামে সাহায্য করুন, জনগণের সরকারকে সাহায্য করুন, লাখো কণ্ঠে প্রতিবাদ জানান, গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসুন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির রক্ষার পথে এগিয়ে আসুন।
(উৎস:
১। মোঃ আনিসুর রহমান, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, এ প্রবলেম ইন দ্যা পলিটিকাল ইকোনমি অব রিজিওনাল প্ল্যানিং, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর ইন্টেরন্যাশনাল এফেয়ার্স, জুলাই, ১৯৬৮;
২। গুনার ম্যরডাল, এশিয়ান ড্রামা, ভলিউম ১, এলেন লেন সয়া পেঙ্গুইনে প্রেস, লন্ডন, ১৯৬৮
৩। দ্যা স্টেটসম্যান – কলিকাতা
কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
সেক্রেটারির রিপোর্ট
কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। এখানে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র, কর্মকর্তা ও শিক্ষক, কর্মচারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহের শিক্ষক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সংস্থার সদস্যরা। কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ সেন, ভাইস-চ্যান্সেলর, সহসভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ছিলেন প্রফেসর পি কে বসু, একাডেমিক বিষয়ক প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর, এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন শ্রী হিরেন্দ্রমোহন মজুমদার, ব্যবসা এবং অর্থনিতি বিষয়ক প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর।
প্রাথমিকভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া ৫০০০ রুপি হল এই কমিটির কেন্দ্রীয় তহবিল। এবং এই কমিটি অতিসত্বর কার্যক্রম শুরু করে।
জন্মলগ্ন থেকেই এই কমিটি উদ্বাস্তুদের সহায়তা শুরু করে। এছাড়া খাবার প্যাকেট থেকে ঔষধ এবং ফার্স্ট এইড সরঞ্জাম দেয়া হয়। প্রচুর উদ্বাস্তু প্রবেশ করার জন্য – যার সংখ্যা ইতোমধ্যে ১৫ লাখে পৌঁছেছে – আমাদের এই ক্ষেত্রে আরও কয়েক হাজার রুপি ও শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। শ্রী বিনা ভৌমিক (বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী) আরও কয়েকজনের সহায়তায় একটি ছোট্ট দলে এই বিষয়ে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাদের হাত লাগিয়েছে।
আমাদের প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলকে ৫ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে টেলিগ্রাম দিয়েছেন। টেলিগ্রামে আমাদের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলকে বাংলাদেশের উপর মারাত্মক আক্রমণ এবং ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস ও সেখানকার শিক্ষক ও ছাত্রদের উপর পরিচালিত গণহত্যার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষন করেন। এছাড়া তিনি পাকবাহিনী যে গণহত্যা চালাচ্ছে সে ব্যপারে জানান। মহাপরিচালক টেলিগ্রাফের প্রাপ্তি স্বীকার করে গণহত্যার শিকারদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীও টেলিগ্রামের প্রাপ্তিস্বীকার করেন।
আমাদের একটি লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব শিক্ষক ও ছাত্র ভারতে এসেছেন তাদের সাহায্য করা। আমরা তাদের অস্থায়ী আর্থিক সহায়তা দেব এবং একটি রেজিস্টার খুলব। স্নাতকোত্তর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ডঃ অনিরুদ্ধ রায়, পোস্ট-গ্রাজুয়েট কমার্স এর শ্রী অনিল সরকার ও শ্রী পীযুষ দাশ, শ্রী অংশুমান মল্লিক, ও শ্রী অনিল বসু এই বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ভিজিটিং অধ্যাপকের/লেকচারশিপের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এই প্রকল্প সমগ্র ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা যেতে পারে। প্রকল্প ইতিমধ্যে লিখিত আকারে বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করি এতে করে কিছু ফল হবে।
এর পাশাপাশি আমরা বাংলায় শেখ মুজিবের ছয় দফা কর্মসূচি নিয়ে একটি প্রকাশনা করতে চাচ্ছি। শ্রী অজিত মোহন গুপ্ত (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র) এই বিষয়টি দেখছেন। ভারত প্রোটোটাইপ স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী শ্রী স্বরাজ ভট্টাচার্য, চিত্রাঙ্গদার স্টাফ ফটোগ্রাফার আমাদের অনেক মূল্যবান ফোটোগ্রাফ দিয়ে সাহায্য করেছেন।
আমাদের সভাপতি সমিতির তহবিলে উদার অনুদানের জন্য সবাইকে – বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদের কাছে (বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায়) লিখিত আবেদন করেছেন। খুব উতসাহজনক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম যিনি দান করেছেন তিনি আমাদের জাতীয় অধ্যাপক শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। অন্যরা যারা দ্রুত দান করেছেন তাদের মধ্যে আছে কৃষ্ণনগরের উইমেন্স কলেজ, সরোজিনী নাইডূ কলেজ, উইমেন্স কলেজ, কলকাতা লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ, বেথুন স্কুল, ড, বি সি রয় মেডিসিন ইনস্টিটিউট এর শিক্ষক ও কর্মকর্তা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর বিভাগের ৬১ জন শিক্ষক, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, মডার্ন হিস্টোরি, ও ইংরেজি বিভাগ, ভারত চ্যারিটি ট্রাস্টের এন এল তোদি, মেসার্স প্রেস এজেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, মেসার্স এলাইড এজেন্সি, পাস্তুর গবেষণাগারের স্টাফ, সিদ্ধেসর হেসারি কারখানা, গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস কলেজ, উমেশচন্দ্র কলেজ, বাংলাদেশ এইড কমিটি, বোম্বে শ্রী এইচ পি. লোহিয়া, অ্যাংলো-ভারত জুট মিল (কর্মকর্তা ও শ্রমিক), শ্রী অজিত কুমার দত্ত, সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, অধ্যক্ষ মমতা আশিকারি ও সর্বস্তরের আরও অনেকে। ফ্রি ঔষধ সংগ্রহ করেছেন শ্রী উৎপল চৌধুরী ও এস এম সোমা চ্যাটার্জি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ছাত্র সমিতির পক্ষ থেকে তহবিল সংগ্রহ করছে। আমরা আশা করি দাতাদের সংখ্যা দৈনন্দিন বাড়তে থাকবে যাতে করে আমরা আমাদের কাজ মোকাবেলা করতে পারি।
অধ্যাপক জেইনদের পত্রনবিস, যতীন চ্যাটার্জি, দীপক হাজরা এবং পি সেন শর্মা কার্যালয়ের সার্বিক দায়িত্বে আছেন। সমিতির অফিস, দ্বারভাঙ্গা ভবনের দ্বিতীয় তলায় সকাল ১১ টা থেকে ৫-৩০ টা পর্যন্ত এবং বিধান সরণির দ্বিতীয় তলায় সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
আমাদের কাজগুলো শেষ করতে তহবিল প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও শিক্ষক ভাইস-চ্যান্সেলর এর তহবিল থেকে কিছু সময়ের জন্য মাসিক অবদান রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা অন্যদের কাছেও উদাত্ত আহ্বান জানাই। চেক পাঠাতে পারবেন – কোষাধ্যক্ষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি – এই ঠিকানায়।
৯ মে, ১৯৭১
ডি কে চক্রবর্তি
সেক্রেটারি
কোলকাতা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি
বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের আজকের এই সংগ্রাম। অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বন্দুক, বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধ করা যাবেনা। কেনোনা জনতা আর ঐক্যবদ্ধ।
লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায় সঙ্গত। তাই আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত।
জয় বাংলা।
শেখ মুজিবুর রহমান
১৯/০৩/১৯৭১
(শেখ মুজিবুরের ভাষণের ইংরেজি ভার্শন ৩৫ পাতায়)
প্রকাশক – প্রফেসর দিলিপ চক্রবর্তি, সেক্ররটারি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি, সিনেট হাউজ, ধারভাঙ্গা বিল্ডিং, কলিকাতা- ১২
প্রিন্টেড বাই – জনাব অজিত মোহন গুপ্ত, ভারত প্রোটোটাইপ স্টুডিও, ৭১/১ কলেজ স্ট্রিট, কলিকাতা – ১২
দাম – — রুপি মাত্র
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৩১। ঈদ-ই মিলাদুন্নবীর সমাবেশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবী | দৈনিক “আনন্দবাজার” | ৯ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৩১, ৩৬৭– ৩৬৮>
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান
জনমত গড়ে তুলতে জয়প্রকাশ বিদেশ সফরে যাবেন
নাসিক -, ৮ মে- স্বাধীন বাংলাদেশকে তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ন বিশ্বের সব দেশের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এক সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ায় সময়ে শ্রী নারায়ন বলেন – বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি বিদেশে সফরে যাবেন বলে স্থির করেছেন। শ্রী নারায়ন জানান তিনি কায়রো, রোম, মসকো, বারলিন, নিউইয়র্ক, জাপান এবং দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে যাবেন। -পি টি আই
পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করুন
-ইয়াহিয়া
নয়াদিল্লী, ৮ মে-জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন পুনরায় উৎসর্গ করতে তাঁর জনগনের উদ্দেশ্যে আবেদন করেছেন।
পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে পাক প্রেসিডেন্ট যে আবেদন করেন তাতে তিনি এই বলে স্মরণ করিয়ে দেন যে, উপমহাদেশের মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, মানবিকতা ও ন্যায়পরয়নতা ইসলামের সুমহান নীতি অণুসারে নিজেদের বসবাসের জন্য একটি বাসভূমি তারা গড়ে তুলেছেন। তাঁর এই আবেদনের মধ্যে ইসলাম বিপন্ন এই সূর যেন ফুটে উঠেছে।
আজ ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী দিবস উপলক্ষে তাঁর এই বাণী।
পাক বেতারে বলা হয় জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ বলেন, পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে অবিনশ্বর। পাকিস্তান আমাদের আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক এবং আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের দুর্ভেদ্য প্রাচীর।
পাক বেতারে আরও বলা হয় আজকের এই দিনটি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে এবং পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরেও উদযাপিত হচ্ছে। -পি টি আই
পয়গম্বরে জন্মদিবসে সভায় “বাংলাদেশের” স্বীকৃতি দাবী
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
শনিবার শহীদ মিনার ময়দানে ইসলামের ধর্মগুরুপয়গম্বরের জন্মদিবসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবী জানানো হয়। প্রস্তাবে ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলা হয় যে, বাংলাদেশকে শুধু স্বীকৃতি নয়, অন্যান্য সাহায্যের সঙ্গে অস্ত্র সাহায্যও দিতে হবে। ভারত ও পাকিস্তান সরকারের কাছে সভা অণুরোধ জানায়-অবিলম্বে পাক ফৌজের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ ও দরগা মেরামতের ব্যবস্থা করুন এবং তার পবিত্রতা রক্ষা করুন। পয়গম্বরের জন্মদিবসটি ছুটির দিন ঘোষনার জন্যও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী জানানো হয়।
সভাপতিত্ব করেন পশ্চিমবঙ্গের বিচারমন্ত্রী শ্রী অজিতকুমার পাঁজা। বক্তৃতা দেন সরদার মাহতাব সিং, মওলানা মহম্মদ নসির আলি আজাদ প্রমুখ।
সর্বধর্মের সভায় নিন্দা
এদিন কলকাতায় সর্বধর্মের এক সম্মিলিত সভায় বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগনের উপর পাক ফৌজের বর্বর রাষ্টপুঞ্জের সেক্রেটারী জেনারেল ও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে আবেদন জানিয়ে বলেন এই নৃশংসতা বন্ধে আপনারাও তৎপর হোন।
সর্বশ্রী গোলাম আহমেদ কাদের, এস বাকর, অমর গাঙ্গুলী প্রমুখ বক্তৃতা দেন।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৩২। বাংলাদেশ স্বীকৃতির প্রশ্নে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় | দৈনিক “আনন্দবাজার” | ১০ মে, ১৯৭১ |
<১২, ১৩২, ৩৬৯–৩৭০>
স্বীকৃতিতে অস্বীকৃতি কেন?
সেই পুরাতন স্বীকৃতির প্রশ্নটা মাঝে মাঝে চকিতে আশার রেখা দেখাইয়াই যেন মরীচিকার মতো মিলাইয়া যাইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ প্রবল প্রায় সমস্ত বিরোধী দল বারে বারে একবাক্যে বলিতেছেন, “বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দিন”। এই দাবী নানা রাজনৈতিক দলের কন্ঠে, এমন কি একাধিক রাজ্যের বিধানসভাতেও ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। শুক্রবার পশ্চিমবংগ বিধানসভার সর্বসম্মত প্রস্তাবটি ঐতিহাসিক নিদর্শন তো বটেই। ইহার বয়ান বাংলাদেশের সার্বভৌম গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি সৌভ্রাত্বের নিদর্শন তো বটেই, সেই সংগে বলিয়া দিয়াছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশের এই সংকটে তাহার কি প্রত্যাশা এবং কি প্রয়োজন।
দিল্লী তবুও মনে হয় এখনও মন স্থির করিয়া উঠিতে পারেনাই। কারন ভয় নয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই কথা ঘোষনা করিয়াছেন। ভয় যদি না হয়, দ্বিধার মূলে তবে কী? মুক্তি আন্দোলনের প্রতি এই দেশ পূর্ণ সমর্থন জানাইবে অথচ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিবে না- এই দুইটা মেলানো একটূ কঠিন। যেন দ্বিধার সংগে কোথাও দ্বন্ধ ঢুকিয়াছে। স্বীকৃতি আদৌ দেওয়া হইবে না, শ্রীমতি গান্ধী একথা অবশ্য বলেন নাই, শুধু অপেক্ষা করিতে বলিয়াছেন। অপেক্ষা আরও কতকাল অপেক্ষা? আরও কত নরবলির পরে?
ভারতের দ্বিধার উৎস-সন্ধানে বাহির হইয়াছে প্রথমেই আমরা সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন তুলিয়া ধরিতে চাই। স্বীকৃতির শর্ত কী, কোন কোন উপচার, উপাদান পূর্ণ হইলে একটি রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র বলে। রাষ্ট্র মানে কি শুধুই একটি ভৌগোলিক সত্তা, আর জনতা? রাষ্ট্র তাহার চেয়েও কিছু বেশী-সুসংগঠিত এবং আইনসংগত একটা সরকারও চাই। তাজউদ্দিন সরকারকে ভারত এখনই মানিয়া লইতে পারিতেছে না- উত্তম। কেননা ভারতের মতে ওই সরকারের হাতে কোনও স্থিতিশীল ভৌগলিক বিভাগ নাই। কিন্তু ইয়াহিয়া শাহীর হাতে আছে তো? জংগীবাহিনী গায়ের জোরে শহরের পর শহর দখলে রাখিয়াছে বা আনিয়াছে ইহা ঠিক। কিন্তু ইহাও একই রকম ঠিক যে, ওই মুলুকে অসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সরকারের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যে যদি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়, তবে পূর্ববঙ্গে আজ পাক সরকারের কোনও প্রকার অস্তিত্ব নাই- দাপট আছে মাত্র। দাপটকেই কি দিল্লী অস্তিত্বের একমাত্র লক্ষন বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে? সবার উপরে সত্য তবে বাহুবল?
নইলে আজ এই প্রশ্ন তোলা যাইত যে, ইয়াহিয়া সরকারকেই বা দিল্লী তথা সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়াছিল কবে? আয়ুবের বদলে ইয়াহিয়া ব্যাপারটা যদি নিছক সরকার বদল হইত তবে নতুন করিয়া স্বীকৃতির কথা উঠিত না অবশ্য। কিন্তু ১৯৬৯ সনে ইয়াহিয়া যেভাবে ক্ষমতা গ্রাস করেন, ভাঙিয়া দেন বিধানসভা, বরখাস্ত করেন মন্ত্রীদের, বাতিল করেন সংবিধান-তাহাতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির মৌল চরিত্র একেবারে বদলায়া যায়। মিশনে নাগিব যখন এইভাবেই গদি দখল করেন, হইয়া উঠেন সর্বেসর্বা ডিক্টেটর, তখন কিন্তু ব্রিটেন তাঁহাকে নূতন করিয়া স্বীকৃতি দিয়াছিল। সেই স্বীকৃতি ছিল “ডিফাক্টো”। অর্থাৎ মিশর রাষ্ট্রের চরিত্র একেবারে বদলাইয়া আইনের চোখে আমূল বদলাইয়া গিয়াছিল বলিয়াই নতুন স্বীকৃতির প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল। সেই দিক হইতে ইয়াহিয়াশাহী আজও অস্বীকৃত রহিয়াই গিয়াছে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র যেভাবে পয়দা হইয়াছিল, এ পাকিস্তান ঠিক সেই পাকিস্তান নহে। দুনিয়া চুপ করিয়া রহিয়াছে শুধু কি পেশীশক্তির প্রতি সম্ভ্রমবোধে? একটি অবৈধ সন্তান সকলের কাছে দিব্য জলজল হইয়া গেল, কিন্তু বৈধতার বিচার উঠিল সে সরকার সম্পর্কে, বাংলাদেশ শাসন করার যাহার গণতান্ত্রিক অধিকার। এই সরকারের পিছনে জনতা আছে, আছে বিপুল জনসমর্থন, শুধু ভৌগোলিক ভাগটা বিরূপ বলিয়াই সে অসিদ্ধ হইয়া যায়। এইভাবে বোধ হয় স্বয়ং ঈশ্বরও অসিদ্ধ হইয়া যান প্রমাণাভাৎ।
ইহার পর কেহ যেন গণতন্ত্রের নামে কথায় কথায় শপথবাক্য উচ্চারণ না করেন। শক্তই একমাত্র শর্ত- গণতন্ত্রের এই তো অর্থ দাঁড়াইতেছে। পিণ্ডি সরকারও যে পাকিস্তানকে আজ এক জাতি বলিয়া মনে করে না তাহার স্বীকৃতি পিণ্ডি-ফোমের আচরনেই আছে। বিশেষ করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার বাঙালী জাতির নিধন-উৎসাদনে যখন মাতিয়াছে তখন ধরিয়া লইতে হইবে ওই দেশে জাতি আসলে দুইটা, দুইটা জাতিকে এক রাষ্ট্রের অন্তরালে বাঁধিয়া রাখিতে হইবে ইহা কোন দেশী জবরদস্তি?
কুটনৈতিক বিধিবিধান ছাড়াও এই প্রসংগে অন্তত ভারতের আরও কয়েকটি দিক ভাবিবার আছে। নানা রাজ্য আর নানা দল সমস্বরে যে দাবী তুলিয়াছে, যে আহবান জানাইয়াছে তাহাকে উড়াইয়া দেওয়া সরকারের পক্ষে প্রাজ্ঞজনোচিত হইবে না, ন্যায়সংগতও না। কেননা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণতন্ত্র মানে সকল দল। ইহা ছাড়া আজ বাংলাদেশের বিপুল প্রত্যাশা ভারতের প্রতি যে শুভেচ্ছা জাগাইয়া অতিমাত্রার বিলম্ব ঘটিলে তারা ধীরে ধীরে লয় পাওয়ারও বিলক্ষন ভয়। সেই হতাশা আর তিক্ততার পটুভূমিতে চীনের ছায়াটি দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইয়া যাইতে কতক্ষণ? আর আগানো কঠিন ভারত হয়তো শুধু এইটুকুই তাকাইয়া দেখিয়াছে? কিন্তু এখনও খেয়াল করিতে পারে নাই যে পিছানো অসম্ভব। সময় আর স্রোত কাহারও জন্য অপেক্ষা করে না কথায় বলে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত বাংলাদেশের আক্রান্ত জনগণের আহত মুখচ্ছবি হয়তো একদিন নীরস তিরস্কারে ভারতকে বলিয়া দিবে-চিরতরে অপেক্ষা করিয়া রহে যার প্রত্যাশী একটি জাতির ভালবাসা একটি শুভেচ্ছাও।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৩। গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশনের সভায় বাংলাদেশ প্রশ্নে জয় প্রকাশ নারায়ণের ভাষন | দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া | ১৩ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৩৩, ৩৭১–৩৭২>
অনুবাদ
শরণার্থী পুনর্বাসন একটি গুরতর সমস্যাঃ জয় প্রকাশ
( স্টাফ রিপোর্টার )
নয়াদিল্লী, ১৪ই মে, সর্বদয়া নেতা জনাব জয়প্রকাশ নারায়ন আজকে বলেছেন আরো ১০ মিলিয়ন শরণার্থী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে পারে যেখানে ইতিমধ্যে ২৫ মিলিয়ন শরণার্থী এসে আশ্রয় নিয়েছে।
গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশনে বক্তৃতা দেবার সময় জনাব নারায়ণ বলেন, যেসব শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তানের নৃশংসতা থেকে পশ্চিম বাংলায় পালিয়ে এসেছে তাদের পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। শীঘ্রই বর্ষা শুরু হবে এবং তখন ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
তিনি আরো বলেন, এটি দুঃখের বিষয় যে যখন ১.৫ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন কার্যক্রম চলাকালে সারা বিশ্বের নজর সেদিকে ছিলো কিন্তু এটি দুর্ভাগ্য যে পূর্ব বাংলার দুর্ভাগা মানুষের খোজ নেয়ার জন্য কাউকে দেখা গেলো না। এই শরণার্থীদের বেশীরভাগই মুসলিম কিন্তু আরব দেশগুলো এমনকি মুসলিম নেতারাও তাদের দুর্দশার সময় নীরবতা পালন করেছে।
সর্বদয়া নেতা আরো বলেন, তিনি রবিবারে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, জাপান ও দক্ষিন – পূর্ব এশিয়ান দেশগুতে যেয়ে বাংলাদেশের গৃহহীনদের জন্য জনমত সংগঠিত করার জন্য একটি সফর শুরু করবেন। তিনি একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে দেশগুতে যাচ্ছেন এই আশার সাথে যে সেখানে এই নির্মম বর্বর ঘটনার শিকার মানুষের জন্য কিছু করার মতো সোচ্চার লোকজন থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেছেন, তিনি গেলে অবশ্যই তা ভালো কিছু হবে। জনাব নারায়ণ বলেছেন, তার সফরের পৃষ্ঠপোষকতা করবে গান্ধী সেবা সংঘ, গান্ধী স্মৃতি সংঘ এবং আমেরিকার একজন শান্তিবাদী মানুষ। তিনি এই ব্যাপার নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথেও বৈঠক করেছেন।
মাও এর চাল ( নেতা মাও সে তুং )
জনাব নারায়ণ বলেন, ২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাও সে তুং জেনারেল ইয়াহইয়া খানকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সমর্থন করেছেন। তিনি ব্যাপকভাবে পাকিস্তানের কার্যক্রম কে সমর্থন করেছেন কারন তিনি ভাবেন দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে ভারতের প্রভাব রয়েছে এবং যদি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে ও ভারত এ অঞ্চলে একটি প্রভাবশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
কিন্তু পিকিং পাকিস্তানের উপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করবে যখন চীনাপন্থি সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসবে। এক্ষেত্রে চায়না বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থন করবে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে। পুরো অঞ্চলটি তখন আরেকটি সাউথ ভিয়েতনামে পরিনত হবে।
শুধুমাত্র চীনই নয় অন্যান্য দেশগুলোও চায়না ভারত দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় তার ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালন করুক। জনাব নারায়ণ বলেন, অতীতে উভয় সুপার পাওয়ারই পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা করেছিলো ভারতকে শুধুমাত্র ছোট বা বড় যুদ্ধে জড়ানোর জন্য।
সর্বদয়া নেতা আরো বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা যে পরিসর ও মাত্রায় নৃশংসতা চালানো হচ্ছে তা বিশ্বাস করাও কঠিন। পূর্ব বাংলা থেকে ঘুরে আসার পর এক সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক ধারনা করেছেন সেখানে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন লোককে হত্যা করা হয়েছে। এটি অসম্ভব কিছুনা যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগন যদি অনুধাবন পারতো তাদের সৈন্যরা পূর্ব বাংলায় কি করছে পশ্চিম অংশেও আরেকটি বিদ্রোহের সূচনা হতো।
পাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের ঐক্য কে চুরমার করেছিল। আর এসবের জন্য দায়ী হলো দুই কালপ্রিট জেনারেল ইয়ায়ইয়া ও ভুট্টো। তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তানে বিভেদ দেখতে চাইনি, কিন্তু যা ঘটেছে তা সম্পর্ক মেরামতের অযোগ্য”।
বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি-সমর্থনে প্রশ্ন উত্তর পর্বের পর জনাব নারায়ণ বলেন, আমি এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মতামতের সাথে একতম নই। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির জন্য ১০ মিলিয়ন স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে আবেদনের জন্য নাশিকে একটি সর্বদয়া সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব সি ডি দেশমুখ বলেন, বাংলাদেশের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে, আধুনিক বিশ্ব নৈতিক বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তারা বেশিরভাগই জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু তাদের জনগনের জনমতে পরিবর্তন আনলেই তাদের নীতি পরিবর্তন হতে পারে। যেমন ইউরোপীয় এবং অন্যান্য দেশ থেকে জনাব নারায়ণের প্রস্তাবিত সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৩৪। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে ভারতের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের অভিমত অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত | দৈনিক “আনন্দবাজার” | ২০ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৩৪, ৩৭৩>
বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের মত
(বিশেষ সংবাদদাতা)
নয়াদিল্লী, ১৯ মে- কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দানের জন্য জোরালো যুক্তি খাড়া করেছেন।
এই আইনজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে আছেন শ্রী এম সি চাগলা, শ্রী এম সি কে দকভরি, শ্রী ভে কে কৃষ্ণ মেনন ও ডঃ এল এ সিংভী। আর একজন বিশিষ্ট আইনবিদ শ্রী এম সি শীতলাবাদ অবশ্য এ ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে বলেছেন। বাংলাদেশের উপর সংবিধান ও সংসদ বিষয়ক গঠন সংস্থা একটি বই বার করেছেন। তাতে প্রকাশিত নিবন্ধনগুলিতেই এই যুক্তি দেওয়া হয়েছে।
শ্রী চাগলা স্বীকৃতির পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছেন নৈতিক, আইনগত, রাজনৈতিক এবং অপরাপর দিক থেকেও ভারতের উচিত তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া। যখন আমি মাঝে মাঝে সরকারী মহল থেকে বলতে শুনি আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে অপরাপররা কী করছেন, তখন আমার রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠে। এই একটি মহান কারনে ভারতেরই উচিত এগিয়ে গিয়ে সব কিছু করা।
প্রাক্তন বহির্বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, আমাদের সময়ে এই সবচেয়ে বড় সংকটের দিনে, আমরা যদি সঠিক কাজ করতে না পারি তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ মেনন বলেন, স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি এটা আইনসম্মত কি না তা নিয়ে যুক্তিতর্ক করার ব্যাপার নয়। যারা জনসাধারণের স্বাধীনতাকে দলন করে তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করার দিন চলে গেছে। একটা বিপদের সময় আইন বা বিধির প্রশ্ন উঠতে পারেনা। তাহলে ফরাসী শাসন থেকে আলজেরিয়া মুক্ত হতে পারত না। বৃটিশদের তাড়াবার সময়েও আমরা আইনের কচকচিত মাথা ধরাইনি।
ভারতের একজন এটর্নি জেনারেল শ্রী শীতলবাদ অবশ্য বলেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধতে পারে, এমন একটা অবস্থায় আমাদের টেনে নেওয়া যেতে পারে কিনা, তা সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখতে হবে।
আর একজন প্রাক্তন এটর্নি জেনারেল শ্রী সি কে দফতরী তাঁর সঙ্গে একমত হননি।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৩৫। কায়রোতে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ জয়প্রকাশ নারায়নঃ দেরী হলে পূর্ববঙ্গ ভিয়েতনাম হবে | দৈনিক “আনন্দবাজার” | ২০ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৩৫, ৩৭৪>
দেরী হলে পূর্ববঙ্গ ভিয়েতনাম হবে
- জয়প্রকাশ
কায়রো ১৯ মে- পূর্ববঙ্গে রক্তপাত বন্ধ করে সেখানে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সংযুক্ত আরব ও মিত্র মুসলিম দেশগুলি ইয়াহিয়ার উপর চাপ দেবে বলে ভারত আশা করেছিল। আরব দুনিয়ার বন্ধু হিসেবেই ভারত এই আশা করেছিল। সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ আজ রাতে মিশরের একদল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে একথা বলেন। তিনি বলেন দ্রুত পূর্ববঙ্গ সংকটের সন্তোষজনক সমাধান না হলে চীনের জড়িয়ে পড়ার বিপদ রয়েছে। অনিশ্চয়তা চলতেই থাকবে। বৃহৎ শক্তি নাক গলাবে। সেখানে অবস্থা ভালোর দিকে না গেলে পূর্ববঙ্গ দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিনত হবে।
ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী বাহদূর সিং শ্রী নারায়নের জন্য এক সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় শ্রী নারায়ন এই কথাগুলি বলেন। পূর্ববঙ্গের জরুরী অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। এখানে তিনি দু দিনের সফরে এসেছেন।
শ্রী নারায়ন প্যালেষ্টাইনের গেরিলা নেতা বশের ও আরব লীগের সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ হাসুনার সঙ্গে দেখা করেছেন। রাজনৈতিক কারনে সংযুক্ত আরবের নেতৃবৃন্দ ব্যস্ত থাকায় তাঁদের সঙ্গে শ্রী নারায়নের দেখা হয়নি। আগামীকাল তিনি ভ্যাটিকানের পোপের সঙ্গে দেখা করবেন। পি টি আই
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৬। কোলকাতায় আর্চবিশপের বিবৃতিঃ শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তণের ব্যবস্থা করতে হবে | হিন্দুস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড | ২২ মে ১৯৭১ |
<১২, ১৩৬, ৩৭৫–৩৭৬>
অনুবাদ
কোলকাতায় আর্চবিশপের বিবৃতিঃ
শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তণের ব্যবস্থা
করতে হবে
পরম শ্রদ্ধেয় এল.টি. পিচাচী, কোলকাতার আর্চবিশপ, মনে করেন যে পশ্চিম বঙ্গ থেকে শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন জনগণের আগমন বৃদ্ধি সমস্যার প্রকৃত উত্তর। বিবৃতিতে, তিনি বলেন যে বিশ্বের দেশগুলোর কর্তব্য মানবিক দিক দিয়ে কর্তৃপক্ষকে পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা এবং প্রত্যেকের নিরপত্তার নিশচয়তা প্রদান করতে প্ররোচিত করা।
বিবৃতিতে বলা হয় যে যদিও ভুক্তভোগীদের জন্য অবিলম্বে ত্রাণ প্রয়োজন, এটাই মর্মান্তিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান নয়। ইউএন কর্মীদল দেখেছে যে শরণার্থীরা যত দ্রূত সম্ভব সেখানকার শান্তিপূর্ণ অবস্থা পূনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়া মাত্রই তাদের আকাঙ্খিত আশ্রয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছুক, কিন্তু প্রত্যাবর্তণ অসম্ভব যদি না পশ্চিম বঙ্গে দ্রূত স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর্চবিশপ বলেন যে বিশ্বের দেশগুলো পশ্চিম বঙ্গের জনগণের ভয়ানক ভোগান্তিতে জড়িত হতে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং দায়িত্বে ভ্রূক্ষেপ না করেই নির্মমভাবে মন্তব্য করেছেঃ “এটা সম্পূর্নভাবে অভ্যন্তরীন ব্যাপার”। এই কঠোর মনোভাব আমাদের বিশ্বের অংশে বিস্ময় ও দুঃখের কারণ হয়েছে। যখন আমরা দেখি ত্রিশ লক্ষ আক্রান্ত ও গৃহহীন মানুষকে কঠোরভাবে জোড়পূর্বক তাদের দেশত্যাগ করে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে তখন আমরা তাদের কল্যানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের দাবী জানাই।
গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ গোটা বিশ্বব্যাপি সমর্থনীয় এবং সুরক্ষিত। যদিও সেখানে সত্তর লক্ষের উপরে মানুষ যারা নিজ দেশের সামরিক পদতলে পিষ্ঠ এবং এর একমাত্র কারন তারা সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনে সন্দেহাতীত ভোটে জয় লাভ করা। “বিবৃতিতে উল্লেখিত।
আনুষ্ঠানিক ভাবেই ইহা নিশ্চিত যে তিনজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক পশ্চিম বঙ্গে নিহত হয়েছেন।
বিশপের এলাকাভুক্ত শিলং, শীলচর, কোলকাতা, দার্জিলিং, দমকা, জলপাইগুড়ী, এবং কৃষ্ণনগর গীর্জাগুলো প্রতিবেশি দেশের রাজনৈতিক দন্দ্বের উচ্চস্বর সম্পর্কে অবহিত আছে। কিন্তু নিরপেক্ষতা হয়ত কখনই পরিত্রাণের দাবির কন্ঠরোধ করবে না। ধর্মীয় যাজক এবং বিশপের এলাকাভুক্ত সকল অপেশাদারী লোকজনেরা অটলভাবে সাহায্যের ঘোষনা দিয়েছেন।
প্রার্থনা সভা এবং অনুতাপসূচক সেবা আয়োজিত হয়েছিল। ৪ এপ্রিলে কোলকাতা আর্চডিওসেসে প্রার্থনার দিন ছিল। ১৮ এপ্রিলে সেইন্ট তেরেসা এবং ফাতেমার যাজকপল্লী। ঢাকার আর্চবিশপ টি.এ. গাংগু্লী ও অন্যান্য যাজকবৃন্দ, পাদ্রীবর্গ, সন্ন্যাসী এবং পূর্ব বঙ্গের বিশপের এলাকার সাধারণ নিরাপত্তা কামনার জন্য আমাদের ফাতেমা মঠের মহিলারা কোলকাতা আন্দোলনে গিয়েছেন। সভাটি ব্যক্তিগত নোটে আয়োজিত হয় যেহেতু পূর্ব ভারতের হাজারো ক্যাথলিকদের সাথে পূর্ব বঙ্গের এখনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এখানে তাদের স্বল্প অথবা কারো কোন সংবাদই নেই, বিবৃতিতে উল্লেখিত।
ব্যাপ্টিস্ট মিশন ছাত্র হলে বাঙালী খ্রিষ্টান কাউন্সিল আয়োজিত সাম্প্রতিক সভায়, কোলকাতা বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কাউন্সিলটি বিশ্ব চার্চ কাউন্সিলকে প্রতিটি দেশের মধ্যে কূটনীতিক প্রনালীর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করার অবস্থা তৈরীর এবং বড় শক্তির মাধ্যমে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবারহ প্রতিরোধ করারও অনুরোধ জানায়। কাউন্সিলটি তাদের সদস্য গীর্জা এবং ইন্সটিটিটগুলোর নিকট মানবিক কারনে অকৃপণ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসার আবেদন জানায়। সব ধরণের অর্থিক অথবা সদয় দান বাঙালী খ্রিষ্টান কাউন্সিলের কোষাধ্যক্ষের নিকট প্রেরণ করা যাবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৭। ‘অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে’ – অধ্যাপক সমর গুহ এমপি’র নিবন্ধ | যুগান্তর |
২৩ মে, ১৯৭১
|
<১২, ১৩৭, ৩৭৭– ৩৮১>
১। বাংলাদেশের জাতীয় অভ্যুত্থান ভারতের জনমতকে যে কী প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে তার জাতীয় প্রতিফল ঘটেছে ভারতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত সর্বসম্মত ঐতিহাসিক প্রস্তাবে। সমগ্র ভারতীয় জনতা এই আশা করেছিল যে এই প্রস্তাবকে যথার্থভাবে কার্যকরী করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী সরকারকে আশু স্বীকৃতি দিয়ে। কিন্তু ৭ই মে বিরোধী দলের বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এরূপ স্বীকৃতি দানে অক্ষমতা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সমগ্র বিরোধী পক্ষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই মত প্রকাশ করেছেন যা সংসদ গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কার্যকর সাহায্য দেওয়ার জন্য অবিলম্বে এই দেশের স্বীকৃতিদান ভারত সরকারের পক্ষে এক অপরিহার্য জাতীয় কর্তব্য।
২। সরকার পক্ষ মনে করেন যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে এখনও যথাযোগ্য সময় আসেনি এবং এরূপ স্বীকৃতিদান বর্তমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সহায়কও হবে না। পক্ষান্তরে বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে প্রায় ঐক্যবদ্ধভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেছে যে, বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতিদান একান্ত আবশ্যক এবং এরূপ স্বীকৃতি-দানের পন্থায়ই বাংলাদেশের সংগ্রামীদের কার্যকর সহায়তা দিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই সংগ্রামকে সম্পূর্ণ করা সম্ভব।
৩। শুধু বিরোধী পক্ষই নয়-বহু রাজ্যের বিধানসভা, ভারতের অগণিত গণ-প্রতিষ্ঠান এবং শাসক কংগ্রেসের বুহু প্রতিষ্ঠিত নেতা বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতিদানের দাবী জানিয়েছেন। এখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার সরকারী নীতি শুধু অস্পষ্ট, অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অযৌক্তিকতাই নয়-গণতান্ত্রিক দিক দিয়েও সরকার আজ ভারতের জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন। কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এখন সে দেশের পক্ষে সহায়ক নয়, কারণ যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ প্রকাশ্যে বা নেতৃবর্গের বৈঠকে ভারত সরকার উপস্থিত করতে সক্ষম হন নি। অথচ, বাংলাদেশের প্রতিটি দেশ-প্রেমিক বাঙ্গালী প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের সদ্যগঠিত জাতীয় সরকার সর্বসম্মতভাবে শুধু ভারত সরকারের কাছেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন তাঁদের সরকারের আশু স্বীকৃতিদানের জন্যে।
………… নীরব কেন?
৪। তবু বিশ্বের ছোট-বড় রাষ্ট্র আজ বাংলাদেশের প্রশ্নে এরূপ নীরব ও নিস্ক্রিয় কেন? বহুবার নগ্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বের কোন রাষ্ট্রেরই আজ আন্তর্জাতিক স্বাধীনতা বা গনতন্ত্র রক্ষার দিকে দৃষ্টি নেই – বড় রাষ্ট্রগুলি তো বটেই, ছোট রাষ্ট্রগুলিও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারন করে সম্পূর্ণরূপে জাতীয় স্বার্থের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গীতে। তাছাড়া বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই চায় না যে পাক-ভারত সমস্যায় সমাধান হোক এবং তাঁর ফলে ভারত একটি শক্তিশালী ও প্রধান রাষ্ট্ররূপে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হোক এবং পাক-ভারতের পারস্পারিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে সব কয়টি বৃহৎ রাষ্ট্রকেই ভারতীয় উপ-মহাদেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য সদা-সচেষ্ট হতে দেখা গিয়েছে।
সবারই এক রা
৫। একথা আজ সুস্পষ্ট যে রুশ, মার্কিন, বৃটেন বা ফ্রান্স পাকিস্তানের বিখন্ডন চায় না, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় এই রাষ্ট্রগুলি উদগ্রীব তাই এই রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশের জাতীয় অভ্যুত্থানকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যার অতিরিক্ত গুরূত্ব দিতে রাজী নয়। সে জন্যে পাক বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবিক অধিকারের প্রশ্নটি রাষ্ট্রসংঘ পরিষদে উত্থাপন করে পাকিস্তানকে বিব্রত করতে পর্যন্ত এই রাষ্ট্রগুলি রাজী নয়। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার উদ্দেশ্যেই রাশিয়া ও বৃটেন বাংলাদেশের স্বাধিকারের একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি সিথিল কনফেডারেশন গঠন করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা। শোনা যাচ্ছে যে পিন্ডিশাহীও এই প্রস্তাবে রাজী এবং এরূপ প্রচেষ্টায় রুশ উদ্যম গ্রহণেও অসম্মত নয়।
জনতার রায়
৬। রুশ মার্কিন-বৃটেন- এই রাষ্ট্রত্রয় এই ঘটনাকে স্বীকার করতে রাজী নয়। যে বাংলাদেশের স্বাধিকারের প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধান বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তায় অধিকারী জন সাধারণই করে দিয়েছে। ৯৯.৬ শতাংশ গণভোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিজেদের সার্বভৌম স্বাধীনতা ঘোষনা করে একটি নিজস্ব প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করেছে। বাংলাদেশের সমগ্র জনতা এই সরকারের প্রতি কিরূপ সক্রিয় আনুগত্য জ্ঞাপন করেছে বাঙালীর বর্তমান সামগ্রিক গনঅভ্যুত্থান তার সুস্পষ্ট ও তাথ্যিক স্বাক্ষর। কিন্তু জাতীয় স্বার্থান্ধ আন্তর্জাতীয় রাষ্ট্রগোষ্ঠীয় কাছে এই প্রমাণ ও বাস্তব ঘটনার কোন মূল্য নেই।
৭। বাংলাদেশ সার্বভৌমিকতার যে শর্ত গুলি পূরণ করেছে তার চেয়ে অনেক কম শর্ত পূর্ণ করেও বিশ্বের বহু বিদ্রোহী জাতি বহু বিশ্বরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব নাম, নিজস্ব পতাকা, নিজস্ব জাতীয় সংগীত এবং স্বদেশের জাতীয় ভাষার প্রবর্তন ছাড়াও গণভোটে নির্বাচিত প্রায় সমগ্র প্রতিনিধির সমর্থন, বে-সরকারী ও বাঙালী সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর আনুগত্যলাভ এবং এই দেশের মুক্ত অঞ্চল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের নৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা – এই শর্তগুলি বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তার স্বীকৃতির পক্ষে শুধু যথার্থই নয়-পর্যাপ্তও বটে। তাই সার্বভৌমিকতার শর্ত পূর্তির প্রশ্ন ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষে বিশেষ কোন যুক্তিযুক্ত বাধা নেই। রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামান্য শর্ত পূরণের ক্ষেত্রেও অনেক স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রকে যে স্বীকৃতি দিয়েছে তার অনেক নজীর রয়েছে আন্তর্জাতিক ইতিহাসে।
জাতীয় স্বার্থ
৮। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটবে কিনা এবং পরবর্তী অধ্যায়ে এই সংঘর্ষ ভারত অ পিন্ডি-পিকিং চক্রের প্রত্যক্ষ সামরিক দ্বন্দ্বে পরিণত হবে কিনা – সেই প্রশ্নের বাস্তব বিশ্লেষণের আগে এ কথাটি বিচার করে দেখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ভারতের জাতীয় স্বার্থ কতখানি জড়িত।
৯। এ কথা আজ পরিস্কার যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দায়িত্ব শুধু এ দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি আদলনৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের ভাগ্যের সঙ্গে পূর্বাঞ্চল ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আর্থিক রাজনৈতিক এবং দেশ রক্ষার ভবিষ্যৎ সমস্যাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু পূর্বাঞ্চল ভারতের স্বার্থেই নয়- সমগ্র ভারতের ভবিষ্যৎ প্রগতির জন্যও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে।
১০। এ কথা বিশ্লেষণের আজ আর প্রয়োজন নেই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক ও সামরিক সংগঠন এবং পিন্ডি জংগী শাসনের স্থায়িত্ব বাংলাদেশের শাসন ও শোষনের উপরে একান্তভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বিচ্ছিন্ন হলে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক সামরিক অ রাজনৈতিক ভিত্তির উপরে যে প্রচণ্ড আঘাত পড়বে এবং তার পরিণামে পাকিস্তানে যে অনিবার্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তার গতিও হবে সুদূর প্রসারী।
১১। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষ ভারত ভাগের পরেও বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ডের জনজীবনকে মর্মান্তিকভাবে বিষাক্ত করে রেখেছে। লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশুর অশ্রুজলেও এই নিত্য স্বাক্ষর নিশ্চিহ্ন হয়নি। বিধাতার এক মহান আশীর্বাদরূপে বাংলাদেশে যে নতুন জাতীয়তাবাদের আহবান দিয়েছে – সেই ঐতিহাসিক ডাক সফল হলে ভারতীয় উপ-মহাদেশ এই প্রাণক্ষয়ী বিষের প্রকোপ থেকে মুক্ত হবে।
শরণার্থী
১২। বাংলাদেশের স্বদেশ বিতাড়িত গৃহচ্যুতরা অধিকাংশই হিন্দু- সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে এদের সংখ্যা এক কোটির মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এখনও এদের পরিচয় বাঙালীরূপে এবং এরা স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক। কিন্তু দীর্ঘদিন শরণার্থী শিবিরে থাকলে- গৃহচ্যুতের দল পূর্বাগত উদ্বাস্তুর দলে পরিণত হবে। এই শরণার্থীর অবিরাম আগমন পূর্বাঞ্চল ভারতের সামাজিক, আর্থিক ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলবে এবং পূর্বাঞ্চল ভারতের দেশরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তুলবে। ভারতের আর্থিক কাঠামোর উপরেই যে এই শরণার্থীরা প্রচন্ড আঘাত হানবে তাই নয়- ভবিষ্যতে শরণার্থীর সমস্যা মুখ্য সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনের কর্তব্যকে গৌণ করে তুলবে।
১৩। বাংলাদেশের স্বদেশ-প্রেমিক মানুষ আজ ভারতের উপরে গভীরভাবে নির্ভরশীল। দীর্ঘায়িত সংগ্রামের পরিস্থিতি এবং পিন্ডিশাহীর বর্বর অভিযানে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের উপরে বিশ্বাস হারিয়ে হয়তো চীনমুখী হয়ে যাবে। ভারতের বন্ধুত্বে বিশ্বাসী মৌলানা ভাসানীকে ভারতের প্রত্যঘাতেই যে পিকিংপন্থী করে তুলেছে- সেই ঘটনাও অজানা নয়। এরূপ পরিবর্তন ঘটলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে চীনা – নীতির আমূল পরিবর্তনেও যে বিব্লব ঘটবে না, তা বলা যায় না।
গেরিলা যুদ্ধ
১৪। বাংলাদেশের দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে? গেরিলা যুদ্ধের সাফল্যের প্রধান উৎস রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বদানের মানসিক প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের নেই। আওয়ামী লীগের মানসিক গঠন ও সংগ্রামের প্রস্তুতি ছিল পাক-স্বাধীনতা যেগের কংগ্রেসের ন্যায়। তাই আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করেছিল গান্ধীপন্থি অসহযোগ আইন অমান্যের। এই সংগঠাত্মন বৈপ্লবিক মানসিকতার রূপান্তরিত করার জন্য নেতাজী সুভাসচন্দ্রের ন্যায় নেতৃত্ব এদের মধ্যে নেই। উপরন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতাদের গেরিলা সংগ্রাম পরিচালনার সম্ভাবনা পিন্ডিশাহী চরমভাবে দূরূহ করে তুলেছে। তাই অধিকাংশ আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী আজ দেশ ত্যাগী হতে বাধ্য হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে গেরিলা র সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব বদল এবং ভারত-বিরোধী নেতৃত্বের আবির্ভাবের বিশেষ আশংকা রয়েছে। এরূপ নেতৃত্বের নির্ভরতা অনিবার্যভাবে হবে ভারত-বৈরী চীনের উপরে নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশের দীর্ঘায়িত গেরিলা সংগ্রাম গোটা পূর্বাঞ্চল ভারতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গৃহযুদ্ধের সংকট যে সৃষ্টি করতে পারে, তা নিছক অতি দূরদর্শী কল্পনা নয়।
পাক–ভারত সংঘর্ষ
১৫। বাংলাদেশকে এককভাবে স্বীকৃতি দিলে ভারতকে অনিবার্যভাবে পাকিস্তান বা পাক চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হবে, এরূপ আশংকা ও সবল যুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়।
১৬। রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামরিক- কোনদিক থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের সঙ্গে বর্তমানে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। পূর্বাঞ্চলে একটি গোটা জাতি বিদ্রোহ করেছে পাক-ফৌজের বিরূদ্ধে। পাক-ফৌজ রণনৈতিক স্ট্রাটিজির দিক থেকে শুধু যে একটি সামগ্রিক বৈরী জনতার ঘেরাওয়ে আবদ্ধ রয়েছে তাই নয়- এই ফৌজ গণ সংগ্রামে- দমনের উদ্দেশ্যে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বাঞ্চল সরবরাহ ও যোগাযোগের ব্যবস্থাও পাক-ফৌজের অনূকূল নয়। পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিবিশন সৈন্য পূর্ববাংলায় পাঠাবার সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তেও এ ফৌজের আক্রমণ ক্ষমতা ব্যাহত হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও যদি পাক ফৌজ কোন আক্রমনাত্বক দুঃসাহস দেখায় তাহলে দুই সীমান্তেই এই ফৌজের আশু বিপর্যয় সুনিশ্চিত। পূর্বাঞ্চলে পাক-ফৌজের পক্ষে এ সপ্তাহ টিকে থাকাও সম্ভব নয়। পূর্বাঞ্চল পতনের পরে ভারতীয় ফৌজকে পশ্চিমাঞ্চলে পাঠিয়ে পশ্চিম প্রান্তকে শক্তিশালী করা ভারতের পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে না। পাক ফৌজের পক্ষে এরূপ সম্ভাব্য পরিণতির কথা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় বলেই এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে আত্ম হত্যার পথ বেছে নেওয়ার অ্যাডভেঞ্চার করতে উদ্যত না হলে, পাকিস্তানের পক্ষে বর্তমান অবস্থায় প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়।
চীন আসেনি
১৭। রাশিয়ার সম্মতি ও সাহচর্যে চীনা ফৌজ কোরিয়ায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম, লাওস বা ক্যাম্বোডিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চীনের জাতীয় স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষভাবে চীন এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। অস্ত্র সরবরাহ চীন এদেশগুলিকেও করেছে- পাকিস্তানকেও করেছে। চীন বার বার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের কোন অঞ্চলের সামরিক সংঘাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার হয়নি। তা ছাড়া চীন জানে যে, আসন্ন বর্ষার সময়ে পূর্ব বাংলায় বা পূর্বাঞ্চল ভারতের কোন প্রান্তে বড় রকমের সৈন্য চলাচল করা এক দুঃসাধ্য প্রচেষ্টায় পরিণত হতে বাধ্য। চীন একথাও জানে যে ভারত বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে রুশ-মার্কিন সমর্থন ও সহযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও চীন যদি –পাকিস্তানের খাতিরে ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয় তা হলে রুশ বা মার্কিন রাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে দূরে সরে থাকতে পারবে না। চীন- মার্কিন সমঝোতার সম্ভাবনাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চীন পাকিস্তান রক্ষায় নিজের স্বার্থকে বিপন্ন করবে, এরূপ আন্তর্জাতিক ঔদার্য আদর্শবাদী প্রতিচ্ছবি যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিভাবে কলঙ্কিত হবে, সে কথাও চীনকে বিবেচনা করতে হবে।
১৮। তাই সমগ্রভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অযৌক্তিক নয় যে, পাকিস্তান বা পাক-চীনের পক্ষে ভারত-বিরোধী আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্র বর্তমানে অনুকূল নয়।
১৯। বিরোধী পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে একজন মন্ত্রী বলেন যে, স্বীকৃতি না দিয়েও বাংলাদেশকে সাহায্য দেওয়া যায়। হ্যাঁ সাহায্য দেওয়া যায় অপ্রকাশ্যে গোপনে। কিন্তু ভারতের ন্যায় গণতান্ত্রিক দেশে এরূপ সাহায্য গোপন রাখা সম্ভব নয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যায় বিরাট কাজে এরূপ প্রচেষ্টা সাহায্যদাতা ও গ্রহীতা কারও পক্ষেই যথার্থ কার্যকর করা যায় না।
২০। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েই এই দেশের পক্ষে সরকার আন্তর্জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হবে না। এ কথা সত্য হলে সেই সঙ্গে অন্য কথাও সত্য হবে যে একটা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করার ফলে বাংলাদেশের সরকার যে মর্যাদা লাভ করতে তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতীয় প্রচার চালিয়ে ভারতে মতামত স্থাপন করে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জনের পথও সুগম করতে সক্ষম হবে।
২১। ভারত সরকারের স্বীকৃতি লাভ করলে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে প্রকাশ্যে এই দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণ গ্রহণ করে, ভারতের সামরিক সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দ্রুত সম্পূর্ণ করা সহজতর হবে।
২২। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করার এবং ভাবী বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রস্তুত করার জন্যও ভারতেরই বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেওয়া কর্তব্য। ভারত যদি, এককভাবে হলেও, এই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও নির্ভীকতা দেখাতে পারে তাহলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠা ও কর্তৃত্ব হবে অদ্বিতীয় এবং অদূর ভবিষ্যতেই ভারত বিশ্ব সমাজে প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশসের স্বীকৃতি দানে ভারত অন্য যে কোন রাষ্ট্রের অনুবর্তী হওয়ার অপেক্ষায় থাকলে ভারত আন্তর্জাতীয় ক্ষেত্রে পরনির্ভরতা ও পরমুখাপেক্ষিতার বর্তমান অবস্থা থেকে ভবিষ্যতেও উত্তীর্ণ হতে পারবে না।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৮। বাংলাদেশের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের দাবী | কালান্তর |
২৩ মে, ১৯৭১
|
<১২, ১৩৮, ৩৮২>
পূর্ববঙ্গে অত্যাচার বন্ধের জন্য বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের দাবি
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা, ২১ মে- বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মিঃ মরিয়াস ডেলসাল ‘‘পাকিস্তানের সামরিক শাসন জনগনের ও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও গণতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থার জন্য সংগ্রামকে দমন করার জন্য যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি সামরিক শাসনের সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা’’ করে এক বিবৃতি দিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সম্পাদক শ্রী মৃন্ময় ভট্টাচার্য জানান যে, সমিতির কাছে লিখিত চিঠিতে মিঃ ডেলসাল এই কথা জানিয়েছেন।
গত ১০মে তারিখে প্রচারিত এই বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানের গুরুতর পরিস্থিতিতে বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সেখানে সাম্প্রতিক কঠোরতর সামরিক আইনের আওতায় শ্রমিক ও জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার উপরে নির্মমভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছে।
‘‘গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার উপরে সামরিক শাসনের এইসব আক্রমণের মোকাবিলা পাকিস্তানের শ্রমিক ও জনসাধারণ বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক ও জনসাধারন সাধারণ ধর্মঘট ও অন্যান্য প্রতিবাদমূলক কার্্যক্রমের মধ্য দিয়ে করেছেন। এই দমননীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার নির্দোষ প্রাণ বলি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
‘‘বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সামরিক শাসন কর্তৃক এই সন্ত্রাসের রাজত্ব ও উৎপীড়নের তীব্র নিন্দা করছে এবং জনপ্রিয় দাবি পূরনের জন্যও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য শ্রমিক ও জনগনের সংগ্রামের বিরূদ্ধে দমন-পীড়নমূলক ব্যবস্থার অবিলম্বে অবসান ঘটানোর জন্য দাবি জানাচ্ছে।’’
এই ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত জাতীয় শিক্ষক সমিতিগুলির সভ্য সংখ্যা ৭০ কোটিরও বেশী।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩৯। বাংলাদেশকে সহায়তার উদ্যেশ্যে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা গঠিত | হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড | ২৬ মে, ১৯৭১ |
<১২, ১৩৯, ৩৮৩>
অনুবাদ
“বাংলাদেশকে সহায়তার উদ্দেশ্যে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা গঠিত”
আমাদের বিশেষ প্রতিবেদক
নয়া দিল্লী, ২৪শে মে – বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে মত-বিনিময়ের জন্য সভাপতি ডঃ মৈত্রী বসুর সাথে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সব ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা প্রতিনিধিদের সাথে একটা ৩এ-সদস্য বিশিষ্ট কমিটি আলোচনায় বসে।
সম্ভবত এটা বিরল ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা, যেখানে সকল প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন পাশাপাশি কাজ করতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতির জন্য ভারতের জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কমিটি নামে পরিচিতি লাভ করা কমিটি বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন এবং অন্য দেশের ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করবে।
কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয় অল-ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়নের (এআইটিইউ) জনাব এস. এস. মিরাজকার এবং জনাব এস. এ. ডাঞ্জি; সেন্টার অফ ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়নের (সিআইটিইউ) জনাব পি. রামা মুন্সি এবং জনাব মনোরঞ্জন রায়; হিন্দু মজুর সভার (এইচএমএস) জনাব শান্তি প্যাটেল এবং জনাব মহেশ দেশাই; ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (ইউটিইউসি) জনাব যতিন চক্রবর্তী এবং জনাব শ্রীকান্ত নায়ার; হিন্দু মজুর পঞ্চায়েতের জনাব জর্জ ফার্নান্দেজ; ইউটিইউসি’র (লেনিন সরণি) জনাব সুবোধ ব্যানার্জী; এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়নের (আইএনটিইউসি) জনাব এ. পি. শর্মা এবং ডঃ মৈত্রী বসু। ডঃ মৈত্রী এই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
ডঃ মৈত্রী বসু আজ সাংবাদিকদের বলেন যে, কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৯শে জুন হবে সমগ্র ভারত বাংলাদেশ দিবস যেদিন প্রকাশ্যে শান্তিপূর্ণভাবে “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” স্বীকৃতির দাবী সংগঠিত হবে এবং বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের হাতে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবী করা হবে।
কমিটি ভারতের শ্রমিকদের আহ্বান জানাবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের সাহায্য করার লক্ষ্যে তাদের এক দিনের মজুরি দান করার জন্য। শ্রমিকদেরকে তাদের দান কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে পাঠানোর জন্য বলা হবে।
ডঃ বোস বলেন, দেশের সব প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থার কাছ থেকে “বাংলাদেশের সাথে সংহতি” ব্যাপারে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। তিনি জুন মাসে জেনেভা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সমস্যা তুলে ধরার আশা ব্যক্ত করেন।
জনসংঘ সংসদীয় দল আজ সকালে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দলের প্রতিটি সদস্য বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের পুনর্বাসন করতে একদিনের ভাতা হিসাবে ৫১ রুপি চাঁদা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪০। বাংলাদেশের জন্য এগিয়ে আসুন – ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিনেশ সিং এমপি – এর নিবন্ধ
|
অমৃতবাজার | ২ জুন ১৯৭১ |
<১২, ১৪০, ৩৮৪– ৩৮৬>
অনুবাদ
বাংলাদেশের জন্য এগিয়ে আসুন
দিনেশ সিং এমপি
(প্রাক্তন পররাষ্ট বিষয়ক মন্ত্রী)
ভারতীয় উপমহাদেশের উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানুষের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আলোচিত হবে। ভারত, পাকিস্তান এমনকি সিলনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমুহ লক্ষ করলে এ বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকেনা যে মানুষের সম্পূর্ণ সমর্থন গণতন্ত্র, পরিবর্তন এবং স্থিতিশীলতার পক্ষে। এমনকি সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের মাঝেও তারা তাদের রাজনৈতিক দল ও নেতা নির্বাচনের সময় নির্ভুলভাবেই গণতান্ত্রিক শাসনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। একি সাথে তারা তাদের সমাজে আনতে চায় ব্যাপক কিন্তু শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন এবং যারাই তাদের এ আকাঙ্ক্ষা পুরনে সক্ষম তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।
যখন মনে হচ্ছিল যে সিলন সরকার তাদের জনগনের মতামত প্রকাশের অধিকারকে রুখে দিতে চাইছে, তখনও ভারত সরকার এ প্রেক্ষাপটের বিপক্ষে তাদের সমর্থন করেনি। সুতরাং এটা খুবি স্বাভাবিক যে পাকিস্তানেও যখন একি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, ভারত সরকার পুনরায় একি অবস্থান নিবে। বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা ও সমর্থন দেওয়ার আমাদের যে সংসদীয় অঙ্গীকার এই বিষয়গুলোকে বিবেচনা করেই নেওয়া হয়েছে। গনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন দিতেই হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে এর কোনই বিকল্প নেই। ২৪শে মে, লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে বক্তৃতা দিয়েছেন তা আর কিছুইনা বরং এই সংসদীয় অঙ্গীকারেরই ধারাবাহিকতা এবং একে আমাদের স্বাগত জানানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এই অঞ্চলের সকল মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রদর্শনী। সামরিকজান্তার দমনের শাসনকে উপড়ে ফেলার জন্য পাকিস্তানের মানুষের যে আন্দোলন তারই প্রতিচ্ছবি আজকের বাংলাদেশ। গনতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন এটি। সামরিক প্রশাসনের শাসনেই কিছুদিন আগে যে নির্বাচন হয়েছে, তাতেই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্বে ১৬৯ এবং পশ্চিমে ১৪৪, জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩ আসনের এ নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমান ও তার পার্টি মোট ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে।
তাদের ছয়দফা আন্দোলন অবশ্যই বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির জন্য ছিলনা। কেন একটি সংখ্যাগুরু শক্তি সংখ্যালঘু শক্তির কাছে থেকে আলাদা হতে চাইবে। এবং, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পাকিস্তান ফেডারেশন গড়ে তোলাই ছিল শেখ মুজিবর রহমানের এর ছয়দফার প্রথম দাবী। একি সাথেই এটিই ছিল প্রথম কারন, যার কারনে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীরা নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তানের অক্ষুন্নতা বিনষ্ট করার জন্য ঝাপিয়ে পরল।
গনঅভ্যুত্থানঃ
একটি উপনিবেশবাদী মনোভাব থেকে সামরিক বাহিনী যে একনায়কতন্ত্র পাকিস্তানের জনগনের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, এই অভ্যুত্থানের উৎপত্তি মুলত সেখানেই। আমাদের সমর্থন জনগনের এই গন অভ্যুত্থানের প্রতিই আছে, আমরা কোন বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করছিনা, যদিও পাকিস্তান সরকার আমাদেরকে তাই বলেই দায়ী করে থাকে। যদি প্রশ্ন আসে, আমরা কাকে সমর্থন করবো, তবে আমরা পাকিস্তান সরকারের তৈরি করতে চাওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদকে নয় বরং পাকিস্তানের মানুষের একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য অভ্যুত্থানকেই সমর্থন করবো।
আমরা এভাবেই আমাদের পররাষ্ট্র নীতি পালন করে এসেছি। ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে যেসব দাবীর সমর্থন আমরা জানাচ্ছি, তা আদায়ের জন্য সীমান্তের ওপারের মানুষ যখন প্রতিনিয়ত লড়াই করছে, তখন তাদের প্রতি সাহাজ্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া কি আমাদের কর্তব্য ছিল না? যেখানে আমরা দক্ষিন আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছি, দক্ষিন রোডেসিয়ায় সমর্থনলঘু শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র হস্তক্ষেপকে আমরা সমর্থন দিয়েছি, পর্তুগিজ দমন পীড়নের বিরোধিতা করে তাদের জনগনের স্বাধীনতার জন্য চাপ দিয়ে আসছি; সেখানে আমরা কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে এই হত্যাযজ্ঞ, দমন-পীড়ন দেখে নীরব থাকতাম? তাদের কি মানবাধিকার নেই? আমরা কি তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবনা?
স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শ কখনই এভাবে একি বিন্দুতে মিলিত হয়নি, যেমনটি এখন বাংলাদেশের সাথে একিভুত হচ্ছে।
আমাদের কাছেই এখন সকল শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে। এই মুহূর্তে সংখ্যাটি ৪০ লক্ষ। কাল হয়তো ৭০ লক্ষ হবে এবং পরশু হয়তো সংখ্যাটি ১ কোটিতে গড়াবে। কেউ জানেনা কত মানুষ আসবে, তাদের ভরনপোষনে আমাদের কত ব্যয় হবে, এবং সেটা কতদিনের জন্য।
কিভাবে এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়? যখন একটি দেশের মানুষ গনহারে সে দেশ ত্যাগ করে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে আসে, তখন সেটি কোনভাবেই আর অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকেনা। সেটিকে আগ্রাসন, অন্য দেশের এলাকা দখল এর একটি প্রক্রিয়া বলে মনে হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থানের সংখ্যার যে পার্থক্য, তা কমিয়ে আনতেই সে দেশের মানুষকে সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য করা হচ্ছে? একটি বুলেটও কি ছোড়া হয়নি, যার ভয়ে এই মানুষগুলো দলে দলে পালিয়ে আসছে?
বাংলাদেশ আজকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু, মানবাধিকারকে উড়িয়ে দিয়ে ঘটমান একটি জেনোসাইড আর প্রতিবেশীর সীমান্তে বিঘ্ন সৃষ্টির ইস্যু। আমরা এম্নিতেই কল্পনার রাজ্যে মগ্ন থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম তিন সপ্তাহ মিস করে গেছি। আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল যে পাকিস্তানের এ নিপীড়ন ভারতে শরণার্থীদের বন্যা বইয়ে দিবে। যদি আমরা মুক্তিবাহিনীকে একি স্থানে সম্মিলিত করতে সাহায্য করতে পারতাম, তবে হয়ত শরণার্থীদের ভারতে আসতে হতোনা। আর যদি তাড়া আসতও, পরবর্তীতে তাদের স্বাধীন এলাকাগুলোতে পাঠানো যেত। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্য পেলে, পাকিস্তান সরকার বিষয়টি মীমাংসা করার চাপে থাকতো। কিন্তু চাপ আজকে আমাদের উপর। কারন পাকিস্তানে কোন শরণার্থী নেই।
স্বীকৃতিঃ
কবে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, তা সরকারই ঠিক করবে। নিশ্চয়ই, এধরনের স্বীকৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে আরো শক্ত করে, এবং এখানে কোন আইনগত বা সাংবিধানিক বাধা নেই। ভবিষ্যতে কি করা হবে, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।
যদি মুক্তিবাহিনী বাস্তবিকভাবেই একটি নির্দিষ্ট এলাকা পাকিস্তানী আর্মিদের কাছ থেকে রক্ষা করে রাখতে পারে, তবে সেখানে শরণার্থীদেরকে সরিয়ে ন্যা যেতে পারে। বিকল্প উপায়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির চেষ্টায় এই শরণার্থীদের ফিরতে বাধ্য করা যেতে পারে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাড়া কখনই যেতে চাইবে না। তাদেরকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে নিরাপত্তা প্রদান করতেই হবে।
আন্তর্জাতিক কমিউনিটিতে প্রতিটি পদক্ষেপ ইতিবাচক হতে হবে। আমরা অর্থসাহায্য চাইতে পারি। কিন্তু এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেলের প্রতিক্রিয়া আমাদের হতাশ করছে। হয়ত আমরা আরো কিছু অর্থ পাব, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হবেনা। শরণার্থীদের জন্য আমাদের যা ব্যয় হয়েছে, পাকিস্তানের উচিত সে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং জাতিসংঘ তাদের সে ক্ষতিপূরণ করার জন্য চাপ দিতে পারে। বরতমানে ভারতে অবস্থান করছেন বা ভবিষ্যতে আসবেন এমন শরণার্থীদের নিরাপত্তা প্রদান করার দায় আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে উপলব্ধি করতেই হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য কোন সমাধান দাওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তাদের বর্বরোচিত কৃতকর্মের কথা ঢাকতে বারবার ভারত-পাকিস্তান ইস্যু বা এর মধ্যেকার বিরোধের কথা তুলে ধরে। আমাদের কখনই এমনটি হতে দেওয়া উচিত নয়। প্রয়োজন পরলে আন্তর্জাতিক কোন কার্যালয়ে, বাংলাদেশের সরকার ও পাকিস্তানের সামরিক সরকার আলোচনায় বসে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই পূর্ণ সমর্থন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি থাকবে।
পাকিস্তান সরকার বারবারই জাতিগত বিদ্বেষ ছড়াতে চাইছে। এটিকে অত্যন্ত কঠোরভাবে দমন করতে হবে। সেজন্যই পূর্ববাংলায় জাতিসংঘের তৈরি শরণার্থী শিবিরে অতিদ্রুত শরণার্থীদের প্রেরন করা প্রয়োজন।
পাকিস্তানের কূটনীতি এখন পর্যন্ত ভারতের হস্তক্ষেপ সফলতার সাথে এড়িয়ে যেতে পেরেছে, সফলতার সাথে সমশক্তির চায়নাকে পাশে রেখেছে, কৌশলে জাতিসংঘ ও অন্যান্য পরাশক্তিদের দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছে। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের এ মিথ্যার পাহার ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে আমাদের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের বিষয়ে অবশ্যই দ্রুত সারা পৃথিবীকে এগিয়ে আনতে হবে।
যতই সময় লাগুক না কেন, হতে পারে কিছু সপ্তাহ, বা কিছু মাস কিংবা বছর, পাকিস্তানের মানুষের অবশ্যই অধিকার আছে, সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার, এবং বাংলাদেশের মানুষকে অবশ্যই তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে, কিংবা অন্য কোন মীমাংসা করতে হবে। আমরা তাদের সফলতা কামনা করি।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৪১। জয়প্রকাশ নারায়ণ কর্তৃক বাংলাদেশ প্রশ্নে লন্ডনে বিশ্ব সফরের অভিজ্ঞতা বর্ননা | দৈনিক “যুগান্তর” | ৫ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪১, ৩৮৭–৩৮৮>
বাংলাদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনতে বিশ্ব সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা
(বিশেষ প্রতিনিধি সুন্দর কাবাদি)
লন্ডন, ৪ঠা জুন- সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণ গতকাল বিকেলে এখানে এসেই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বৃটিশ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। প্রথমেই তিনি দেখা করেন কমনওয়েলথ রিলেশনস অফিসের মিঃ এন্থনী কেরশার সঙ্গে। মিঃ কেরশা ভারত-পাক সমস্যা সম্বন্ধে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল।
শ্রী নারায়ণ বলেছেন, পাক সামরিক বাহিনীর গনহত্যার ফলে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী ভারতে চলে আসায় যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সেই ব্যাপারে বৃটিশ সরকারের যথেষ্ট সহানুভুতি রয়েছে। মিঃ কেরশা ভারতের এই সমস্যায় বৃটিশ সরকারের অকুন্ঠ সহানুভুতি প্রকাশ করেছেন।
শ্রী নারায়ণের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করার ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তিগুলির অনিচ্ছার কারন আছে দুটি। একটি হল পশ্চিমী শক্তিগুলি মনে করছে সাহায্য বন্ধ করলে পাকিস্তানের কাছে আগেকার পাওনা টাকা হয়তো ফেরৎ পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়তঃ প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য না পেলে পাকিস্তান সাহায্য লাভের জন্য চীনের দ্বারস্থ হবে।
শ্রী নারায়ণ এর আগে কায়রো, রোম বেলগ্রেড, মস্কো, হেলসিঙ্কি, বন এবং প্যারিস ঘুরে এসেছেন। রবিবার শ্রী নারায়ণ লন্ডন ত্যাগ করেছেন। তিনি এরপর ওয়াশিংটন এবং অটোয়া সফরে যাবেন। তাঁর সফরের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সমস্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহানুভুতি প্রতিষ্ঠা এবং সেখানকার জনগনের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করা।
সমাজতন্ত্রী নেতাদের মনোভাব
গত সপ্তাহে শ্রী নারায়ণ হেলসিঙ্কি সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তখন আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র সম্মেলন হচ্ছিল। এই সুযোগে শ্রী নারায়ণ বহু দেশের সমাজতন্ত্রী নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পেরেছেন। যাঁদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ছিলেন পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলার উইলি ব্রান্ট, বৃটেনের বিরোধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসন নরওয়ে ও সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় এবং ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃবর্গ।
এই নেতৃবর্গের সঙ্গে শ্রী নারায়ণএর আলাপ-আলোচনা বেশ সন্তোসজনক হয়েছে। মিঃ ব্রান্ট বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভুতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি জানিয়েছেন পশ্চিম জার্মানী পাকিস্তানের উপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে অক্ষম।
শ্রী নারায়ণ এই নেতৃবর্গের সঙ্গে সম্মেলনের বাইরে দেখা করেছেন এবং কথাবার্তা বলেছেন। এরপর তিনি বনে যান এবং সেখানে পার্লামেন্ট সদস্য এবং ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাট পার্টির সদস্যদের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলেন। এরা বেশ সহানূভূতিশীল বলেই শ্রী নারায়ণের মনে হয়েছে। ভারতের আগত শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য পশ্চিম জার্মানীর পার্লামেন্টে শীঘ্রই একটি বাড়তি বাজেট পেশ করা হবে।
শ্রী নারায়ণ যেদিন প্যারিসে গিয়েছিলেন সেদিন সেখানে ছুটির দিন। তাই তিনি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী নেতৃবর্গের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। তবে তাঁর ধারনা ফরাসী নেতৃবর্গ বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন। তাঁকে ফরাসী সরকারী সূত্র থেকে জানানো হয়েছে যে, পাকিস্তানকে কোনও অস্ত্র সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। তবে ফরাসী অস্ত্র ব্যবসায়ীদের পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়নি।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৪২। ‘স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন’ – একটি সম্পাদকীয় | দৈনিক “যুগান্তর” | ৫জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪২, ৩৮৯–৩৯০>
স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন
আজ শনিবার পাঁচই জুন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আসবেন কলকাতায়। কি দেখবেন তিনি? সীমান্তে নেই তিল ধারনের স্থান। কলকাতার উপকন্ঠে এসে পৌঁছেছে শরণার্থীর ঢেউ। পাক লুটেরা রাস্তায় কেড়ে নিয়েছে তাদের সর্বস্ব। প্রানে মরেছে অনেকে। নিঁখোজ হয়েছে স্ত্রী-কন্যা। এপারে এসেও স্বস্তি নেই। মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে কলেরা। রাজ্য সরকার দিশাহারা। শরণার্থীর সংখ্যা চার লক্ষ ছাপিয়ে উঠেছে। অন্যান্য রাজ্যে না পাঠালে বাঁচবেনা এই হতভাগ্যের দল। দু মাস অপেক্ষা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কি পেয়েছেন তারা? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর চরম ঔদাসীন্য এবং রাষ্ট্রসংঘের অসহনীয় নীরবতা। ইয়াহিয়া আগের চেয়ে বেশী বেপরোয়া বাংলাদেশে জ্বালাচ্ছে তিনি সাম্প্রদায়ীকতার আগুন। পুড়েছে অনেকে। যারা কোনমতে বেঁচেছে তারা আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। যতদিন যাবে শরণার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। ওদের ফেরার পথ বন্ধ। বন্দুক উঁচিয়ে আছে ইয়াহিয়ার বাহিনী। তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে স্থানীয় ধর্মান্ধের দল। গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকারকে যদি স্বীকৃতি দিতেন নয়াদিল্লী তবে ঘটত না অবস্থার এমনিতর অবনতি। মুক্তিযোদ্ধারা পেতেন দ্বিগুন মানসিক বল। বাড়ত সংগ্রামের তীব্রতা। গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠত প্রতিরোধ ব্যৃহ। সাম্প্রদায়িক নেতাদের মধ্যে দেখা দিত সন্ত্রাস। কমত লুটপাটের ব্যাপকতা। বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীরা হয়ত ভিড় করত না। ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের “দেখি কি হয় নীতি” এনেছে নৈরাশ্য। বাড়িয়েছে ইয়াহিয়ার স্পর্ধা এবং ভারতকে নিয়েছে আর্থিক সংকটের মুখে।
বন্ধ হবেনা শরণার্থীর স্রোত। পূর্ব বাংলায় থাকতে পারবেনা অসাম্প্রদায়ীক সাধারন মানুষ। কিসের আশায় দিন গুনছেন প্রধানমন্ত্রী? বৃহৎ শক্তিগুলো কি লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর হাত ধরে তাদের নিজেদের বাড়ী-ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসবে? তারা কি এদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে? আর্থিক চাপে ইয়াহিয়ার নাকে খত আদায় করবে? গত দু মাসের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি কি বুঝতে পারেননি জল কোথায় গড়াচ্ছে? জিইয়ে রাখবে তারা ইসলামাবাদকে। শক্তি সাম্য ভাঙ্গতে দেবে না। এশিয়ার এ অঞ্চলে কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। অখন্ড পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটেছে। পূর্ব এবং পশ্চিমের বোঝাপাড়া অসম্ভব। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়া শরণার্থীরা ফিরতে পারবেনা নিজেদের বাড়ী-ঘরে। এই সহজ সত্য মেনে নিতে কর্তৃপক্ষের দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবই সৃষ্টি করছে যত জটিলতা। শ্রীমতি গান্ধী আশায় আশায় অনর্থক সময় কাটাচ্ছেন। এখন যে অবস্থা চলছে তার ব্যাতিক্রম না ঘটলে ছ মাস কেন, ছ বছরেও শরণার্থীরা ছাড়বেন না ভারতের মাটি। পূর্ব বাংলায় শক্তি সংহত করবে ইসলামাবাদ। মুক্তিসংগ্রামীরা পাবেন প্রচন্ড বাধা আর ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর বোঝা নিয়ে ভারত খাবে হাবুডুবু। সমূহ বিপদ সামনে দেখেও মনস্থির করতে পারছেন না কেন্দ্রীয় সরকার। গোটা জাতিকে কোন অন্ধকার গুহায় টেনে নিচ্ছেন তাঁরা।
বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থীদের অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়া খুবই দরকার – সন্দেহ নেই। এ ব্যাবস্থা অবশ্যই সাময়িক। তাতে পাওয়া যাবেনা সমস্যার স্থায়ী সমাধান। গোঁজামিল দিয়ে সময় কাটাবার পালা শেষ হয়েছে? দেশবাসীর ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জবাব দিন নয়াদিল্লী-শরণার্থীদের নিয়ে তাঁরা কি করবেন? কি করে থামাবেন বন্যার স্রোত? কিভাবে পাঠাবেন, তাঁদের বাংলাদেশে? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর কাছে নয়াদিল্লীর আকুতি-মিনতি ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রীর ব্যাক্তিগত পত্রে এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় যাঁদের টনক নড়েনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের সম্ভাব্য সফরে তাঁদের ঘুমের নেশা কাটবেনা। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বুকে ধরে অনন্তকাল বসে থাকতে পারেনা ভারত। নিরাপত্তা এবং বাঁচার তাগিদেই কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে নিজস্ব পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার প্রাথমিক অঙ্গ-স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান। বাড়ান দরকার তাঁদের সংগ্রামী শক্তি। ওঁদের জয় ত্বরান্বিত হলেই স্বদেশে ফিরবেন শরণার্থীরা। নইলে তারা থাকবেন ভারতে। একথা সত্য কোন শান্তিবাদী রাষ্ট্র সহজে বল প্রয়োগ করতে চায় না। ইয়াহিয়া খান নয়া দিল্লীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছেন না। বাংলাদেশে সমস্যার সংগে ভারতকে তিনি জড়িয়ে ফেলেছেন। চারদিকে দেখা যাচ্ছে অশান্তির দুর্লক্ষণ। মুখ বুজে থাকলেই বিপদ এড়ান যাবেনা। বাস্তব অবস্থার মোকাবিলা করুন কর্তৃপক্ষ। অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন স্বাধীন বাংলাদেশকে। প্রশস্ত করুন ইয়াহিয়ার চরম পরাজয়ের পথ। এতেই আসবে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ শান্তি। শরণার্থীরা পাবেন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রেরনা।
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৪৩। লন্ডনে জয়প্রকাশ নারায়ণঃ বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বকে সক্রিয় হাবার আহবান | দৈনিক “যুগান্তর” | ৭ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪৩, ৩৯১>
জয় প্রকাশের হুঁশিয়ারী
বাংলাদেশের ঘটনায় বিশ্ব সক্রিয় না হলে ভারত কড়া ব্যবস্থা নেবে
লন্ডন, ৬ই জুন(পিটিআই)- সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বিশ্বের যে সমস্ত রাজনীতিবিদ এবং সরকারী প্রতিনিধিদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, বিশ্ববাসী যদি দ্রুত উপলব্ধি না করেন, তাহলে ভারতবর্ষ পরিস্থিতির মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনে বাধ্য হবে।
গতকাল শ্রী নারায়ণ এখানে বলেন, তিনি তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন, অবস্থা যদি ক্রমেই খারাপ হতে থাকে এবং বিশ্ববাসী সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপে ব্যর্থ হয় তাহলে ভারতে তার স্বার্থেই ব্যবস্থা গ্রহনে বাধ্য হবে। ঠিক কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা না বললেও সেটি খুবই কঠোর হবে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
তিনি বলেন এ সম্পর্কে ইতিমধ্যে জনগন, রাজনৈতিক দল এবং পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছে।
পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকে অবহিত করানোর জন্য বিশ্ব সফরে বহির্গত শ্রী নারায়ণ শুক্রবার লন্ডনে এসে পৌছান। এখানকার কাজ শেষ করে আজ তিনি ওয়াশিংটনে রওনা হয়েছেন।
লন্ডনে চারদিন অবস্থানকালে তিনি শ্রমিক, উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল দলের কিছু সংসদ সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করেন।
শ্রী নারায়ণ দুটি বাংলাদেশ সংগ্রাম সমিতির (একটি অবাঙ্গালীদের সমিতি) সভায় উপস্থিত হন, ছাত্র সভায় বক্তৃতা দেন এবং দুটি বৃটিশ টেলিভিশন সংস্থা বিবিসি ও আইটিভির প্রতিনিধিরা তার সাক্ষাৎকার গ্রহন করে।
ভারতীয় সংবাদ প্রতিনিধিকে তিনি জানান, শ্রমিক দলের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতি রয়েছে- রক্ষণশীল দলের কিছু এমপিও সহানুভূতিশীল। তাছাড়া তিনি যে সমস্ত সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
তাঁদের এ উপলব্ধি হয়েছে যে, পাকিস্তান অন্যায় করছে এবং নিজেদেরই ক্ষতি করছে।
লন্ডনে আলোচনায় তিনি লক্ষ্য করেছেন, কেউ কেউ মনে করেন আরো দুর্গতি ও সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে চলে মুক্তিসংগ্রাম স্তব্ধ হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের অবস্থা আবার স্বাভাবিক হবে।
পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের আন্ডার সেক্রেটারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে শ্রী নারায়ণ তাঁকে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদসহ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর এই ধারনা হয়েছে যে, তাঁদের সার্বভৌমত্ব ছাড়া আর অন্য কিছু মেনে নেবার কোন সম্ভাবনা নেই।
এটা মেনে নিতে বৃটিশ সরকার কিভাবে পাকিস্তানকে বাধ্য করবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সব রকম সাহায্য বন্ধ করলেই এটা হবে। কেননা এখন যে সমস্ত সাহায্য করা হবে তা যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হবে এবং স্বভাবতই সাহায্যকারী দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলির জন্য দায়ী হবেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৪। ‘ইয়োথ ফর বাংলাদেশ’- এর একটি আবেদন | প্রচারপত্র | ১০ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪৪, ৩৯২–৩৯৪>
‘ইয়োথ ফর বাংলাদেশ‘- এর একটি আবেদন
বর্ণনাতীত একটি মানবিক দুর্যোগ ধীরে ধীরে পশ্চিম বাংলার উপর ডাল-পালা বিস্তার করছে। পশ্চিম বাংলা বাদে অবশিষ্ট ভারত হয়তো এই ব্যাপারে ইতিমধ্যে পড়েছে বা শুনেছে। কিন্তু অভূতপূর্ব এই সংকট রাজ্য এবং সমগ্র দেশে দিনে দিনে আরও ঘনীভূত হচ্ছে এবং উপমহাদেশবাসী এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে আন্তরিকতা প্রদর্শন এবং সংকট নিরসনে ব্যাক্তিগত ও স্বতন্ত্র উদ্যোগ গ্রহনে ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছে।
পূর্ব বাংলায় ঘটে যাওয়া এই নৃশংস ঘটনাবলীকে আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে না দেখে বরং সহমর্মীতার সাথে আমাদের নিজেদের ব্যাপার হিসাবে বিবেচনা করতে চাই। পাকিস্তানীদের অব্যাহত সন্ত্রাসের ফলে গত ছয় সপ্তাহে ৫০ লক্ষ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিয়েছে। এই সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ১০% এরও বেশী। এখনো প্রতিদিন ৬০, ০০০ করে মানুষ আসছে এবং এই সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কোন লক্ষণদেখা যাচ্ছেনা। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সংখ্যা ১ কোটিতে যেয়ে ঠেকতে পারে।
এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে এই বিপুল পরিমাণ মানুষের আগমনের প্রভাব এই শতাব্দী জুড়ে বিরাজমান থাকবে।
এই বিশাল সংখ্যাক মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে এখানে এসেছে এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ অনাহারে থেকেছে। তাদের মর্মভেদী যন্ত্রণা উপলব্ধি করা এবং তাদের আগমনের ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার দায়িত্ব সমগ্র জাতী, বিশেষ করে তরুণ সমাজের উপর পড়েছে।
এবার আগাম বর্ষাকাল এসেছে এবং এই ৫০ লক্ষের মধ্যে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ উন্মুক্ত মাঠে, গাছের নীচে থাকছে। প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভেজা এবং হীমশীতল রাতের ঠান্ডা মোকাবেলা করা এইসমস্ত মানুষের দূর্ভোগ সহজেই কল্পনা করা যায়। বিশেষ করে শিশুদের, যারা পাকবাহিনীর গুলি অথবা মহামারীতে মা-বাবার একজন বা উভয়কেই হারিয়েছে তাদের অবস্হা বর্ণনা করার অপেক্ষা রাখেনা।
খাদ্য, ওষুধ, স্হানাভাব এবং সেবা করার মানুষের অভাবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভয়াবহ অবস্হা বিরাজ করছে।
এর উপরে আবার কলেরা মহামারী আকার ধারন করেছে এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষ্ণনগর থেকে শিকারপুর এই ৫০ মাইলের সীমানায় শুধু মৃত এবং মৃতপ্রায় মানুষ। বাতাসে পঁচা মাংসের গন্ধ। আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর রাস্তায় দেখা যাচ্ছে বীভৎস সব দৃশ্য। শিশু মৃত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে, সদ্যবিধবা মহিলা মৃত স্বামীকে এখনো বাতাস করে যাচ্ছে, কুকুরের দল প্রতিরোধশক্তিহীন মানুষকে জীবন্ত ছিঁড়ে খাচ্ছে। সদ্য এতিম শিশু পিতা-মাতার মৃতদেহের পাশে বসে আছে- এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য রাস্তার আশেপাশে অহরহই দেখা যাচ্ছে।
কলেরার কারণে এখন পর্যন্ত কম করে হলেও ৩০০০ মানুষ মৃত্যুবরন করেছে। এটাতো মাত্র শুরু! মহামারী চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এবং সদ্যই কলকাতায় জরুরী অবস্হা ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ বহুবছর কলকাতায় কলেরার প্রাদূর্ভাব দেখা যায়নি! বর্ষাকাল যত পার হবে, টাইফয়েড এবং গুটিবসন্ত মহামারীর নতুন কারন হিসাবে যুক্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত ইউনিয়নগুলোর প্রত্যক্ষ সহায়তায় রাজ্যসরকার উদ্বাস্তু সমস্যা সামাল দিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন পরিস্হিতি ভারত সরকারের পক্ষেও সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। বিদেশী সাহায্য চাওয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে কিছু সাহায্য আসতেও শুরু করেছে।
কিন্তু আমাদের এখনো ব্যাক্তিগত এবং সামষ্টিকভাবে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। এই পত্র মারফত সমগ্র দেশের তরুণ সমাজকে সামনে এগিয়ে এসে দায়িত্ব গ্রহণ করার অনুরোধ করা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন:
১. শরণার্থী শিবিরগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক।
২. প্রত্যেকের নিজের এলাকাতে সাংগঠনিক সেবা।
৩. আর্থিক অনুদান।
সেবা:
১. এই মুহূর্তে দরকার কয়েকশ ডাক্তার ( অন্তত শেষ বর্ষের ছাত্র হতে হবে, কিন্তু ইন্টার্ন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে), নার্স, কম্পাউন্ডার অথবা ফার্মাসিস্ট।
২. আরও দরকার নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক, বিশেষ করে যাদের উদ্বাস্তুশিবির ও অন্যত্র শরণার্থী এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
স্বেচ্ছাসেবকদের অন্তত ৩ মাস কাজ করতে হবে। কর্মস্থলে থাকা ও খাওয়ার ব্যাবস্হা করা হবে।
সাংগঠনিক: :
তরুণদের সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষে আমরা সবাইকে রাজ্য, জেলা, থানা এমনকি পাড়া পর্যায়ে সংগঠন করতে উৎসাহ দিচ্ছি। এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আমরা জনমত গড়ে তোলার জন্য;
১. পাকিস্তানের হত্যা-নৃশংসতা এবং শরণার্থীদের কষ্ট তুলে ধরার জন্য আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং জনসভার আয়োজন করা হবে।
২. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য একটি পিটিশনে স্বাক্ষর সংগ্রহ ( কলকাতায় আমরা ইতিমধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি) করে সেটি প্রধানমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
৩.নিম্নলিখিত জরুরী জিনিষগুলো সংগ্রহ করা হবে;
খাদ্য: শিশুখাদ্য, টিনজাত খাবার, চাল, ডাল, লবণ, চিনি, চা ইত্যাদি
তাবু বানানোর জন্য তারপুলিন অথবা পানি নিরোধক কাপড়।
কাপড় (নতুন বা ব্যাবহৃত), ধূতি, লুঙ্গি, শাড়ি, ভেষ্ট, শিশুদের জন্য কাপড়।
বিছানার চাদর, কম্বল।
ছাতা, বর্ষাতি অথবা বৃষ্টিনিরোধক যেকোন কিছু।
ক্যানভাসের জুতা, চপ্পল (সব ধরনের মাপের)।
ওষুধ: সবধরনের ভিটামিন, ঠান্ডা-জ্বর-কাশির ওষুধ, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, শিশুদের টিকা, এন্টি-সেপটিক, ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডার, ডিটারজেন্ট, সাবান এবং ব্যান্ডেজ।
নগদ অর্থ।
অনুদান: :
যারা সরাসরি অর্থ সাহায্য করতে চান, তাদেরও আমরা স্বাগত জানাই।
ইতিমধ্যে ‘অক্সফার্ম’ এবং ‘ ওয়ার এগেইন্সট ওয়ান্ট’ এর মত আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এখানে এসে পৌছেছে এবং কাজ শুরু করেছে। ‘ইয়াং ব্রিটিশ’ ডাক্তাররা অক্লান্তভাবে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে ভারতীয় তরুণদের কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা এখনো কোন সাড়া পাইনি। ভারতীয় তরুণ সমাজ সময়ের প্রয়োজনের সর্বদাই এগিয়ে আসে। এখনই এই মহৎ উদ্দোগে সামিল হবার, চ্যালেঞ্জ নেবার সুযোগ। আমি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে ভারতীয় যুবসমাজের কাছে আবেদন করছি যেন তারা সময়ের প্রয়োজনে জেগে ওঠে। আমাদের তরুণ সমাজ শুধু এই ৫০ লক্ষ মানুষের নির্বিঘ্ন অবস্হানই নিশ্চিত করবেনা, তারা যেন তাদের দেশে ফেরত যেতে পারে এবং নিরাপদে থাকতে পারে সেই লক্ষেও কাজ করবে।
চেয়ারম্যান মিহির
ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ চেয়ারম্যান
১৪ ইজরা ম্যানশন
কলকাতা-১
তারিখ জুন ১০, ১৯৭১
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৫। গারো পাহাড়ের কেন্দ্রীয় ত্রাণ সংস্হা কতৃক প্রধাণমন্ত্রীর কাছে পেশকৃত স্মারকলিপি | প্রচারপত্র | ১২ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪৫, ৩৯৫–৩৯৬>
অনুবাদ
গারো পাহাড়ের কেন্দ্রীয় ত্রাণ সংস্হা কতৃক প্রধাণমন্ত্রীর কাছে পেশকৃত স্মারকলিপি
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
প্রধানমন্ত্রী, ভারত।
মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী,
আমরা গারো পাহাড়ের অধিবাসীদের পক্ষ থেকে এই জেলায় আপনার আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছি। আজ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই সীমান্তবর্তী জেলায় আপনার আগমন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও প্রতীক্ষিত, সম্ভবত আগে কখনো আমরা এত অধীরভাবে আপনার আসার জন্য অপেক্ষা করিনি।
সমগ্র দেশবাসী ভাই-বোনদের সাথে সাথে আমরাও আপনার প্রগতিশীল নেতৃত্বের জন্য গর্ববোধ করি এবং দেশকে একটি শক্তিশালী ইমেজে গড়ে তোলা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনার অঙ্গীকারকে অন্তর থেকে সমর্থন করি। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আপনি সবসময় আন্তরিক উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও বন্ধুত্ব প্রদর্শন করেছেন, আমরা প্রার্থনা করি এখানকার মানুষের জন্য আপনার ভালবাসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
যাই হোক, আজ পূর্ব বাংলার মানুষের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের নারকীয় নির্যাতন এবং আমাদের সীমান্তে তাদের নগ্ন আগ্রাসনের কারণে এই জেলায় একটি জটিল পরিস্হিতির উদ্ভব হয়েছে। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর ধ্বংসলীলা শুরু হবার পর থেকেই আমাদের জেলার ১৪৪ মাইল সীমান্ত জুড়ে মানুষ আসছে। মানুষের এই ঢল এখনো অব্যাহত আছে এবং এখন পর্যন্ত ২ লাখ উদ্বাস্তু এই জেলায় ঢুকেছে, যার ফলে জেলার জনসংখ্যা ৪ লক্ষ থেকে বেড়ে ৬ লক্ষে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৬৪ সালে আগত উদ্বাস্তুদের একটা অংশ এখনো জেলার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আছে, এদের সাথে নতুন উদ্বাস্তুরা যোগ হয়ে প্রশাসন এবং যোগাযোগ ব্যাবস্হার উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করছে।
সামগ্রিকভাবে আমাদের জেলার প্রায় পুরোটাই পাহাড়ী, সীমান্তের কাছে অল্প কিছু সমতলভূমি আছে যা কৃষিজমি হিসাবে ব্যাবহৃত হয়। আমাদের কমিটি শরণার্থীদের জন্য সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মান এমনকি তাবু খাটানোর জন্য জায়গা খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে।
আমাদের জানামতে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন সাংমা ইতিমধ্যে জেলার সমস্যা সমূহ আপনার সামনে তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে সমভূমির অভাব, অত্যন্ত দূর্বল যোগাযোগ ব্যাবস্হা, প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর বেশীরভাগই জেলার বাইরে থেকে আমদানি করার প্রয়োজনীয়তা এবং বর্ষাকালে বন্যা ও ভূমিধসের কারনে যোগাযোগ ব্যাবস্হা ব্যাহত হওয়া উল্লেখযোগ্য। এসব কারণে মোট জনসংখ্যার প্রায় সমপরিমাণ উদ্বাস্তু আশ্রয় দেয়া এই জেলার জন্য অত্যন্ত কঠিন। শরণার্থীদের সাময়িক অবস্হানের কারনে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, তাই অধিকাংশ উদ্বাস্তুকে খুব দ্রুত এই জেলা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়াটা খুবই জরুরী।
এই বিপুল পরিমাণ শরণার্থী আসার কারনে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও পাকিস্তানী বাহিনী সীমান্ত এলাকায় বারবার হামলা করছে, যার ফলে সীমান্ত অঞ্চলের গ্রামবাসীদের বাড়ি-ঘর, জমির ফসল ফেলে পালিয়ে আসতে হচ্ছে। তারা নিজের দেশেই উদ্বাস্তুতে পরিনত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো হতে বাস্তুচূত আমাদের এই ভাই-বোনদের জন্য বিশেষ ব্যাবস্হা নেয়ার এবং প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও আন্যান্য সহযোগীতার দেয়ার জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি।
সংসদে, বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য দেবার সময় আপনি বর্তমান সংকটের ব্যাপারে যে অবস্হান নিয়েছেন, আমরা বিনীতভাবে তার প্রতি আমাদের সমর্থন পুনব্যাক্ত করছি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু সমস্যা এবং পাক বাহিনীর বার বার সীমান্ত লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ ভারতের সীমিত সম্পদের উপর চাপের সৃষ্টি করছে, অনাবশ্যক রাজনৈতিক বোঝা তৈরি করছে এবং উন্নয়নের গতি ব্যাহত করছে। উদ্ভুত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার লক্ষে আপনার ঐকন্তিক প্রচেষ্টা এবং পরাশক্তি ও বিশ্ববিবেকের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য সমূহের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
এখন স্হানীয় সমস্যার দিকে নজর দেবার সময় নয়, সেগুলো যত গুরুত্বপূর্নই হোক না কেন। তারপরেও আপনার উপস্হিতির সুযোগে সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং কৃষি শিল্পের অবকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে সীমান্তে ব্যাবসা-বাণিজ্য বন্ধ, বার বার সীমান্ত অতিক্রম করে আসা শরনার্থীদের ঢল এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কারনে আমাদের এই অঞ্চল অর্থনৈতিক ভাবে অনুন্নত রয়ে গিয়েছে। কৃষি শিল্পের অবকাঠামো শক্তিশালী করলে সেটা এই এলাকার উন্নয়নের গতি অনেক গুনে বাড়িয়ে দেবে।
আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি যেন লম্বা সময় আপনার হাতে আমাদের দেশ পরিচালনার ভার ন্যাস্ত করা হয়, আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে আমাদের শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় এবং আমরা শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
জয় হিন্দ
আপনার সেবায়
টুরা, গারো পাহাড় গ্রহণসিং এ. মারাক
জুন ১২, ১৯৭১ ডেপুটি স্পিকার, মেঘালয় বিধানসভা এবং চেয়ারম্যান,
সেন্ট্রাল রিলিফ কমিটি, টুরা।
মোদি কে. মারাক
চীফ এক্সিকিউটিভ মেম্বার,
গারো পাহাড় জেলা পরিষদ, টুরা।
সিংজান ডি. সাংমা এম.এল.এ
প্রেসিডেন্ট, গারো পাহাড়
জেলা কংগ্রেস কমিটি (আর)
এবং ভাইস-চেয়ারম্যান,
সেন্ট্রাল রিলিফ কমিটি, টুরা।
আলবিনস্টোন এম. সাংমা
কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য,
গারো পাহাড় জেলা পরিষদ
এবং ভাইস-চেয়ারম্যান,
সেন্ট্রাল রিলিফ কমিটি, টুরা।
শিরো্নাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৬। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য মি.এম.সি চাগলার দাবি | টাইমস অফ ইন্ডিয়া | ১৩ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪৬, ৩৯৭–৩৯৮>
অনুবাদ
চাগলা চায় ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করবে
“দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়া” পত্রিকা সংস্থা
বম্বে, জুন ১২- পূর্ব পাকিস্তান থেকে পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থী দেয়ায় ইন্ডিয়ার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশের চারজন নেতা ইন্ডিয়ান সরকারের নিকট গতকাল তাদের দেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন করেছে।
এখানের এক গণসভায় তারা আবেদনটি করেন এবং এতে জনাব এম.সি. চাগলা শক্তভাবে সমর্থন জানান, তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান না করে ইন্ডিয়া বিশাল ভুল করেছে। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
জনাব চাগলা সভার সভাপতিত্ব করেন, বলেন যে যদি ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে, তাহলে ইহা দ্বিজাতি তত্বকে মারাত্বকভাবে ঘা দিবে, যে নোংরা ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল।
জনাব ফনী ভূষণ মজুমদার, বর্তমানে ইন্ডিয়া ভ্রমণরত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বলেন যে যদি বাংলাদেশ মুক্তিফৌজকে স্বীকৃতি মঞ্জুর করেন তাহলে তা মানুষিক উতসাহ দেয়া হবে।
তিনি প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যদের বলেন, জনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসাইন, জনাব কে.এম ওবায়দুর রহমান এবং মিসেস নুরজাহান মুর্শেদ অনুভব করেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করতে ইন্ডিয়ার দ্বিধা করা উচিত নয় যেহেতু উভয়পক্ষই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে।
জনাব মজুমদার বলেন যে পাকিস্তানের গোড়া থেকে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উভয়ভাবেই শোষিত হয়ে আসছে। এমনকি শতকরা ৫৬ জন মানুষ বাংলায় কথা বললেও, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আরোপিত করা হয় এবং বাঙ্গালী ছাত্ররা উর্দুকে প্রতিহত করতে তাদের জীবন পর্যন্ত উতসর্গ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যুত্থান স্বঃস্ফূর্ত ছিল, তিনি বলেন। আওয়ামিলীগ লড়াই করেছে এবং শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয় লাভ করে। যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবর রহমানের আলোচনা চলছিল, জনগণের কোন ধারণাই ছিল না যে ইয়াহিয়া খান বিশ্বের ইতিহাসে সব থেকে বড় গণহত্যার পরিকল্পনা করতেছে।
জনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন যে পাকিস্তানের গঠন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র সংযোগ হচ্ছে ধর্ম, সাংস্কৃতিকভাবে, তাদের মধ্যে কোন কিছুরই মিল নেই। অনেকেই অনুভব করেছে যে বাঙালীদের সেখানে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে শোষিত এবং, যদিও বিশাল পরিমাণ অর্থ নতুন রাজধানী গঠনে ব্যয় হতো, পূর্ব পাকিস্তানে কিছুই ব্যয় হতো না।
তিনি বলেন যে জেনারেল ইয়াহিয়া, জনাব ভুট্টো, আর্মি এবং পাকিস্তানের পুজিবাদীরা ছিল যারা পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলেছিল, শেখ মুজিবুর রহমানকে নয়, একসময় যাকে বর্তমান শাসনকালে শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
পাকিস্তানের তরুন প্রজন্ম জানে যে পাকিস্তানের গঠন ভুল ছিল এবং ইহার কার্যকারীতা ছিল অসম্ভব।
যে হাতে অপরাধগুলো করা হয়েছিল, সে হাত নাদির শাহ, চেঙিস খান এবং হিটলারের থেকেও ভয়ানক ছিল, তিনি বলেন। মার্চের একদিনেই, ১০, ০০০ জনগণ হত্যা করা হয়। “গোটা সৈন্যদলকে বাংলাদেশের নিষ্পাপ ঘুমন্ত জনগণের উপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল”।
তিনি বলেন তাকে তিনবার গুলি করা হয়েছে এবং নারীদের ধর্ষিত হতে দেখেছেন। তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার অপরাধগুলোর বিচার দাবি করেন।
জনাব কে.এম. ওবায়দুর রহমান বলেন, সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে, ইন্ডিয়ার বাংলাদেশের গণতন্ত্রে দায়িত্ব রয়েছে।
মিসেস মুর্শেদ শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি, সকল কারাবন্দীদের মুক্তি এবং বাংলাদেশ থেকে সকল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানান।
দ্বিজাতি তত্ত্বের মৃত্যু
জনাব চাগলা বলেন যে বাংলাদেশ দ্বিজাতি তত্ত্বকে চিরতরে হত্যা ও নিখাত করে ফেলল। আমি বলেছিলাম যে এটা ধর্মীয় বিষয় ছিল না বরং সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত ব্যাপারই একটি দেশ গঠন করে।
পাকিস্তান, যারা ইসলাম প্রচার করতে চেয়ে, হাজার হাজার মুসলিম হত্যা করেছে।
জনাব চাগলা বলেন যে যদি ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে, তাহলে বাংলাদেশে অস্ত্র সরবারহ করা হতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করার অধিকার সংরক্ষণ করে।
তিনি সরকারের নিকট আবেদন করে, জাতির স্বার্থ, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করতে দ্বিধা করবেন না
তিনি বলেন, বাংলাদেশ, স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোন আপোষ করবে না এবং পাকিস্তানকে এটা স্বীকার করতে হবে। তিনি অনুভব করেন যে ইন্ডিয়ায় যদি গণভোট আয়োজিত হয়, তাহলে শতকরা ৯৫ ভাগ জনগণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পক্ষে ভোট দিবে। তিনি হুশিয়ার করেন যে যদি স্বীকৃতি অস্বীকৃতি করা হয়, তাহলে বাংলাদেশে হয়ত নতুন নেতৃত্ব আবির্ভাব হবে যা চীনের পন্থী হবে।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৭। শরণার্থীদের দায়িত্ব সকল রাজ্যকেই নিতে হবে” বলে কমিউনিস্ট নেতা রাজেশ্বর রাজেশ্বর রাওয়ের মন্তব্য | হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড | ১৩ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪৭, ৩১৯>
অনুবাদ
সকল রাজ্যকেই বোঝা ভাগ করে নিতে হবে
রাজেশ্বর রাও
গৌহাটি, জুন ১২-জনাব সি সিপিআইয়ের সাধারণ সচীব রাজেশ্বর রাও আজ বলেন যে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা ইন্ডিয়ার জন্য জাতীয় সংকট সৃষ্টি করেছে এবং শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করার মত অধিকার কোন রাজ্যের নেই, পিটিআই বলেন।
সকালে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে, সিপিআই নেতা কেন্দ্রীয় সরকারকে শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় দেওয়ার জন্য সকল রাজ্যকে চাপ দেয়ার অনুরোধ জানান।
জনাব রাও বলেন কেন্দ্র শরণার্থী সমস্যার গুরুত্বতার অনুভব এখনো উদিত হয় নি এবং সীমান্তবর্তী রাজ্য এর বোঝা ধারণে ভারাক্রান্ত, এটা কেবল সীমান্তবর্তী রাজ্যদেরই একার দায়িত্ব ছিল না অথচ গোটা ইন্ডিয়ার প্রতিটা রাজ্যের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়া উচিত।
সিপিআই নেতা রাজ্যদেরকে এই দেশে আশ্রয় ও নিরাপত্তার জন্য পালিয়ে আসা মানুষ এবং বাংলাদেশের আন্দোলনে তাদের সংহতি প্রকাশ করতে সীমান্তে শরণার্থীদের জন্য ২০০ থেকে ২৫০ শয্যা ধারন ক্ষমতার হাসপাতাল খোলারও পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন সীমান্তে লাখ লাখ শরণার্থী প্রবেশের সাথে সাথে একটি বিস্ফোরক অবস্থার অবনতি হচ্ছে এবং প্রতিদিনই অধিক থেকে অধিকতর আসতেছে। সরকারি ক্যাম্পগুলোয় মাত্র শতকরা ৫ জন আশ্রয় পাচ্ছে এবং শতকরা ২৫ জন রেশন পাচ্ছে। বাকিরা যেখানেই সম্ভব আশ্রয় এবং খাদ্য অনুসন্ধান করতেছে। এই ব্যাপারটি উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। সেখানে কলেরাও মহামারীতুল্য হয়েছে যা অবস্থা আরো প্রকোপ করেছে।
সিপিআই নেতা বলেন পার্টি সকল রাজ্য ইউনিটকে নিজ-নিজ রাজ্যকে জাতীয় বোঝার অংশের ভাগ গ্রহণ করার চাপ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং শরণার্থী সমস্যাকে দলীয় ইস্যু বানাতে নিষেধ করেছেন। যতদূর পার্টি উদ্ধিগ্, আমরা এটাকে দলীয় সমস্যা তৈরী করব না এবং আশা করি অন্যান্য পার্টিও এমন করবে না, তিনি বলেন।
জনাব রাও আশা করেন স্বাধীনতা আন্দোলন খুব দ্রুতই বাংলাদেশে সফলভাবে সমাপ্তিতে আসবে এবং বলেন, “আমরা বাংলাদেশে মানুষের কৃতজ্ঞ কারন তারা গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতার নিশান তুলেছেন। বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্য্মে আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা জোরদার হয়েছে”।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৮। সার্ভেন্ট অফ ইন্ডিয়া সোসাইটির সভাপতি কর্তৃক রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকার সমালোচনা | টাইমস অফ ইণ্ডিয়া | ১৪ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪৮, ৪০০–৪০১>
অনুবাদ
পূর্ব বঙ্গের ঘরোয়া সমস্যার পাশে দাঁড়িয়েছে
কুনয্রু আসালিস জাতিসংঘের লিউকওয়ার্ম
“দ্যা টাইমস অফ ইণ্ডিয়া” সংবাদপত্র সেবা”
পুনা, জুন ১৩- ডা. কে.এ কুনয্রু, সার্ভেন্ট অফ ইণ্ডিয়া সোসাইটির সভাপতি গতকাল “আমাদের করণীয়” কাজের উপর “গুরুত্বপূর্ন সভা” ডাক দেন যদি পাকিস্তান নিরাপত্তা এবং এই শরণার্থীদের আশ্রয় পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপদে ফেরার অবস্থা তৈরী না করে।
সংকট বিকসিত হলে কেউই পছন্দ করবে না, কিন্তু যদি তা সত্ত্বেও ইণ্ডিয়া দ্বারা প্রত্যাবর্তন সামলানো না যায় “ইহার সম্মুক্ষিন হওয়ার যাবতীয় প্রস্ততি আমাদের নিতেই হবে” তিনি যোগ করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা বার্ষিকির বাতসরিক পাব্লিক বক্তৃতায়……..
ডা. কুনয্রু জাতিসংঘের কঠোর সমালোচনা করেন। বিশেষত শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের সন্ধিঘ্ন এবং লিউকওয়ার্ম, এখন শরণার্থী সমস্যার দিকের মনোভাবের জন্য।
তা সত্ত্বেও তিনি জাতিসংঘের সাধারন সচীবের বিলম্বিত আবেদনকে ইঙ্গিত করেন, এখন পর্যন্ত কোন সারগর্ভ আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়া যায় নি।
তিনি ইহাকে ১৯৫৬ এর হাঙ্গেরিয়ান সংকটের সাথে তুলনা করেন এবং বলেন যে যখন “হাঙ্গেরিয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের দেশ ত্যাগ করতে হচ্ছিলো তখন জাতিসংঘ এবং আমেরিকা উভয়ই তাদের সংকট নিবারণে উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থীদের জন্য তাদের ত্রান বিধান “অত্যন্ত অপর্যাপ্ত” প্রেরনে ধীরগতি ছিল।
পূর্ব পাকিস্তান ইতিহাসে উল্লেখিত অন্যতম সবথেকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। “পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিজীবী নেতৃত্ব ধ্বংস করতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উপড়িয়ে ফেলা অথবা পূর্ব বঙ্গ হতে তাড়িয়ে দেয়া এবং গোটা জাতিকে ভীতসন্ত্রস্ত করার “পাশবিক বর্বরতায়” অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে, ” তিনি বলেন।
অস্ত্র সরবারহ
তিনি বলেন বিয়োগান্তক ঘটনাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার হিসেবে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা আখ্যায়িত করেছে যেন গোটা মানবতা অধিকার লঙ্ঘনে তাদের এবং জাতিসংঘের কোন মাথাব্যথাই না।
আমেরিকা, যারা কিনা পাকিস্তানে অস্ত্র সরবারহের “মূল যোগানদাতা” ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক কর্মকান্ডগুলোর শক্ত বিরোধীতা প্রকাশ করে নি। না তারা সেই দেশের অর্থনৈতিক সাহায্যে অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর নিকট সরবারহ বন্ধ করেছে।
ড. কুনয্রু ইঙ্গিত করেন যে পূর্ববঙ্গ দ্বন্দ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার হওয়ার স্পর্ধা অতিক্রান্ত করেছে।
তিনি ভাবেন, ইন্ডিয়ার মুখোমুখি পশ্চিমা বিশ্ব, “তাদের নিজস্ব আগ্রহে” প্রস্তুত হয় নি যে পদক্ষেপ পাকিস্তানকে দূর্বল করবে।
জিডিআর ত্রান প্রেরণ
কলকাতা, জুন ১৩ঃ ছয় টনের কলেরা ভ্যাক্সিন, এন্টিবায়োটিক, ভিটামিন এবং পাচ টনের শয্যা, তাবু, কম্বল ইত্যাদি গঠিত জিডিআর সরকারের প্রথম সাহায্য, দুম দুম বিমানবন্দরে, পূনর্বাসনইউনিয়ন মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচীব কর্ণেল আর.এন লুথরার নিকট হস্তান্তর করা হয়। জনাব ওয়ার্নার হোরনি, জিডিআরের রেড ক্রস সোসাইটির সভাপতিমন্ডলীর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, পিটিআই।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪৯। বাংলাদেশ প্রশ্নে পাশ্চাত্যের প্রতি জয়প্রকাশ নারায়ণের আহবান | টাইম অফ ইণ্ডিয়া | ১৪ জুন, ১৯৭১ |
<১২, ১৪৯, ৪০২–৪০৩>
অনুবাদ
জয়প্রকাশের পাশ্চাত্য হস্তক্ষেপের আহবান
জাতিসংঘ, জুন ১৩ঃ বিশ্বনেতাদের এখনো সময় আছে, যদিও বেশি সময় নেই, বাংলাদেশের সমস্যা নিরসনে এবং শান্তি পূনরুদ্ধার করার, সারভোজায়া নেতা জনাব জয়প্রকাশ নারায়ণ, গতকাল জাতিসংঘের এক র্যালির উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলেন।
যদি তারা হস্তক্ষেপ না করে, গোটা উপমহাদেশ সমস্যায় উত্তেজিত হয়ে উঠবে এবং সবার জন্য অজানা বিপাকে পড়বে, তিনি হুশিয়ারী দেন।
প্রায় ১০০০জন মানুষ নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্ক থেকে জাতিসংঘ পর্যন্ত বাংলাদেশ রক্ষা কমিটি সংগঠিত মিছিল প্রদর্শন করতে আসেন। আসার পথে তারা নিউ-ইয়র্কের পাকিস্তানি মিশনের সামনে প্রদর্শন করে।
(পূর্বে ৩০জন পশ্চিম পাকিস্তানি জাতিসংঘ থেকে ইন্ডিয়ান মিশন পর্যন্ত মিশিল করে এবং ইন্ডিয়ার হস্তক্ষেপের প্রতি নিন্দা প্রদর্শন করে।
প্রায় ২৫০জন মানুষ মিশিলে অংশ গ্রহণ করেন। যদিও, বৃষ্টি সংখ্যা কমিয়ে দেয়, কিন্তু কিছু মানুষ অন্যান্যদের মাধ্যমে শুনতে পিছনে থেকে যায়, জনাব জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং জনাব ইকবাল আহমেদ, একজন পাকিস্তানি আমেরকায় অধ্যাপনা করছেন এবং বেরিগান ব্রাদার্স ষড়যন্ত্র মামলার একজন অভিযুক্ত।
জনাব নারায়ণ, বিশ্বভ্রমণে একজন নতুন বলেন যে, পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডা বলেছিল যে পূর্ব-বঙ্গের সমস্যা ইন্ডিয়া-পাকিস্তান সমস্যা অথবা হিন্দু-মুসলিম সমস্যা।
কিন্তু বিদেশি সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানায়, বিশ্ব ধীরে হলেও প্রকৃত ইস্যুর ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানি প্রোপাগানিস্টদের বিশ্বকে বোকা বানানোর এবং তাদের অপরাধ বরদাস্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
ইতিহাসের সমস্যা বিশ্লেষন করে এবং বর্তমান অবস্থা যা পাচ লক্ষ মানুষ হত্যা এবং ছয় লক্ষেরও অধিক মানুষকে ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে, জনাব নারায়ন বলেন, “এই সকল ঘটনা পশ্চিমের কিছু সাংবাদিক ব্যতিত পশ্চিমা বিশ্বকে উদাসীন ফেলে রেখেছে এবং আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের, প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তুচ্ছে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিশ্বের বি্বেক মৃত্যূ বরণ করেছে”
জনাব নারায়ণ কথায় “মুক্ত বিশ্ব” উল্লেখ করেন এবং প্রশ্ন করেন কেন “মুক্ত বিশ্ব” এবং এর নেতাবৃন্দ স্বাধীনতার হামলায় চুপ করে আছেন।
জনাব নারায়ণ যোগ করেন, “ইহা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পোডগোর্নির উপর বরতায়” বন্দি পৃথিবীর নেতাদের ডাকেন তার ডাককে জোড়ালো করার জন্য এবং গণহত্যা সমাপ্ত করার প্রকাশ্য আবেদন জানায়। কিন্তু না প্রেসি্ডেন্ট নিক্সন, না প্রধান মন্ত্রী, জনাব এডওয়ার্ড হিথ, প্রেসিডেন্ট পম্পিদো কোন কিছু প্রকাশ্যে বলেন নি।
জনাব নারায়ন বাংলাদেশের তরুন যোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শন করেন যারা পশ্চিম্ম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি এবং বিমানে বিরুদ্ধে সাহস দেখিয়েছেন।
“শরণার্থীসহ বিভিন্ন মানুষ, এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বদের সাথে কথা বলার পরে আমার অনুভূতি এবং দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, যে গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। আমার মনে কোন সন্দেহ নাই যে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই তাদের স্বাধীনতা জয় করবে।
পাকিস্তানকে সাহায্য
জনাব নারায়ন বলেন পাকিস্তানকে দেয়া কোন সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক অস্ত্রে ব্যয়িত হবে এবং যারা পাকিস্তানকে সাহায্য করছে তারা পূর্ব বঙ্গের গণহত্যার জন্য দায়ী হবে।
বিশ্ব নেতাদের কাজ করতে আবেদন জানান, যদিও এখনো সেখানে সময় আছে, জনাব নারায়ণ বলেন যে মুক্ত বিশ্বের নেতাদের অবশ্যই প্রকাশ্যে এই অপরাধগুলোকে নিন্দা জানাতে হবে। তাদের অবশ্যই ইসলামাবাদে সাহায্য প্রেরণ বন্ধ করতে হবে। তাদের উচিত ইয়াহিয়ার শাসনকে লড়াই বন্ধ করতে, সেনাবাহিনীদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনার, সকল শেখ মুজিবুর রহমান সহ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে চাপ দেয়া এবং তাদেরকে রাজনৈতিক সমঝোতা করতে বলা।
জনাব নারায়ণ বলেন যে বিশ্বের বিস্মিত হওয়ার উচিত হবে না যদি শেখ মুজিবর রহমান এবং এমনকি অন্যান্যরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলানো প্রত্যাখ্যান করে যেহেতু তার হাত হতে বাঙ্গালীদের রক্ত ঝরতেছে।
কিন্তু এটা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের বাংলাদেশের নেতাদের সাথে শান্তিপূর্ন সমঝোতার মধ্যস্ততা করার জন্য ছিল, তিনি বলেন- পিটিআই।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৫০। বাংলাদেশ কে স্বীকৃতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের বিলম্বের সমালোচনা | টাইমস অফ ইন্ডিয়া | ১৬ জুন ১৯৭১ |
<১২, ১৫০, ৪০৪–৪০৫>
অনুবাদ
স্বীকৃতি দিতে দেরি হওয়ায় কেন্দ্রের প্রতি অসন্তোষ
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
নিজস্ব প্রতিবেদক, মাদ্রাজ, ১৫ই জুনঃ যদিও তামিলনাড়ু থেকে পশ্চিমবাংলা অনেক দূরে অবস্থিত কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নজিরবিহীন প্রবাহকে অব্যাহত আছে। এখানকার মানুষ ও ইয়াহিয়া খানের হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
এখানকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে ভারত সরকারের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিলম্বের কারনে প্রত্যেহ রুষ্ঠ নেতাদের নানা উপস্থাপনা উপস্থাপিত হচ্ছে।
রাগান্বিত নেতারা স্থানীয় দৈনিকগুলোতে প্রতিদিন ডজনের উপরে চিঠি প্রকাশিত করছেন যেখানে ” বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের নিষ্ক্রিয়তা” নিয়ে তাদের ভাবনা উঠে এসেছে।
ফণীভূষণ এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বাংলাদেশী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের মর্মান্তিক পরিস্থিতি এখানকার মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য তিন দিনের সফরে এই শহরে এসেছেন। জনাব মজুমদার আশা প্রকাশ করেছেন যে শরণার্থীদের এই প্রবাহ ভারতের সচিব পরিষদে উত্থাপিত হবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের আরেকজন শাহ মোয়াজ্জেম বলেছেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিনিধি রয়েছেন। শরণার্থীর সংখা আরো উন্নত করা সম্ভব যদিনা ভারত সরকার বাংলাদেশ এবং শরণার্থীদের স্বীকৃতি প্রদান করেন।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের তৃতীয় জন উল্লেখ করেন যে, ভারতের জন্য ইয়াহিয়া খান ও তার রক্তপিপাসু সৈন্যদের আক্রমনের শিকার এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীদের ভরনপোষন করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
তিনি আরো উল্লেখ করেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইয়াহিয়ার লোকদের ক্যাম্প তৈরির আছে যেখানে জনসাধারনকে বিভিন্ন ধরনের প্রতারনা ও ফাঁদে ফেলা হয় যা মানুষজনকে ভারতের দিকে চলে যেতে বাধ্য করে।
ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নের জেনারেল কাউন্সিলের সাধারন সম্পাদক জনাব পি রামামূর্তি কোম্বাটুরের কেন্দ্রে চার দিন ব্যাপি বৈঠকের উদ্বোধনের সময় বলেন, বেতনে ভারসাম্য আসবেনা যতদিন না পর্যন্ত ভারত সরকার তার মুদ্রাস্ফীতি নীতি পরিত্যাগ করে।
তিনি সব স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রন করতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস কামনা করেন।
তিনি বর্ণনা করেন, “সরকারের মুদ্রাস্ফীতি নীতি জনগনের সাথে প্রকাশ্যে ডাকাতির ন্যায়”।
জনাব রামামূর্তি ভারতের সকল ট্রেড ইউনিয়ন ইউনিটের প্রতি সকল কেন্দ্রীয় শ্রম সংগঠনের সাথে একাত্ম হতে আহ্বান করেন। তিনি প্রধান কিছু শ্রম সংগঠনের প্রতিনিধিদের উত্থাপন করা আট দফা দাবিকে স্বাগত জানান এবং তিনি মনে করেন এটি সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ভাবে প্রতিবাদ করতে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করবে।
এই আট দফা দাবিগুলো হলো, সম্পত্তি অধিকার বিলুপ্তি, ক্ষতিপুরন ছাড়া পুঁজি সংগঠন একচেটিয়া ভাবে জাতীয়করন, সাধারন ভুমি সংস্কার, পূর্ণ কর্ম সংস্থান ও বেকারত্ব দূর করার জন্য একটি যৌক্তিক মজুরি নীতি তৈরি, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি জনগনের নাগালে রাখা, জনগনের কাছ থেকে সকল ঋণ আদায় স্থগিত রাখা শিল্প ও অর্থনীতিতে বৈদেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য আর্থিক নীতিতে পরিবর্তন আনা।
উক্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, জনাব পি সন্দারায়া, জনাব জ্যোতি বসু, জনাব উমানাথ, জনাব কে রামানি, জনাব এ বালাসুবারমানিয়াম এবং জনাব বিশ্ব পুণ্যাহ। এই সম্মেলনে অন্তত ১২০ জন শ্রমিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর এটিই সাধারন পরিষদের প্রথম বাৎসরিক বৈঠক।
বরাবরের মতোই জনাব রামামুরতি লিখিত আকারে থাকা একটি বড় প্রতিবেদন পড়ে শোনান। তিনি জাতীয় বাজেটের বিশ্লেষন করেন এবং বলেন যে যদিও ঘাটতি ৩২০ কোটি রুপি দেখানো হয়েছে এটি আসলে ৫০০ কোটি রুপি হতে পারে।
দ্রব্যসমুহের পাইকারি দাম বিশ্লেষন করে জনাব রামামুরতি ভারতীয় অর্থনীতি সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে বলে কতৃপক্ষের দাবীর সাথে দ্বিমত পোষন করেন। ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থানকে একটি উন্নয়নশীল দেশের উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে তিনি তুলে ধরেন যেখানে বিগত বছর এবং তার আগের বছরে ভারতে কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে অবনতি ঘটছে বলে ফলাফল প্রকাশ করেন।
ভারতীয় চেম্বার অফ কমার্সের রিপোর্টেরর উধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, দেশে ১৯৭০-৭১ এর প্রথমার্ধে বেকারের সংখ্যা ১৩ মিলিয়ন যেখানে ১৯৬৯ সালে বেকারের সংখ্যা ১৯৬৭-৬৮ সালের ১৭ মিলিয়ন থেকে বেড়ে দাড়িয়েছিলো ১৯ মিলিয়নে আর এগুলো হয়েছিলো যখন বলা হচ্ছিলো দেশের অর্থনীতি সংকট কাটিয়ে উঠেছে।
‘সবুজ বিপ্লবের ‘ বিরুদ্ধেও জনাব রমামুরতির শ্লেষাত্বক সমালোচনা করেন। ১৯৬৪-৬৫ সালের ৮৯.৩৪ মিলিয়ন টন উৎপাদনের সঙ্গে ১৯৬৭-৬৮ সালে উৎপাদিত ৯৫.০৫ মিলিয়ন টনের তুলনা করে তিনি বলেন এটি বার্ষিক তিন শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।