পালাভার উইকলি | ঘানা, ৮ জুলাই, ১৯৭১ | সাহায্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানিদের আহাজারি
২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতের অন্ধকারে রচিত হয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধে এক চিত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের পঁচাত্তর মিলিয়ন জনগণের বিরুদ্ধে একটি রক্তপিপাসু সামরিক জান্তা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বহু সংবাদপত্র ফটোগ্রাফ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ননা দিয়ে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ গণহত্যার রিপোর্ট প্রামাণিক আকারে প্রকাশ করে।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ এম পি, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য রাষ্ট্রযন্ত্রের লোক ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সহ অনেকে সরাসরি এই অপরাধের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ করেন।
সমস্ত প্রমাণ ও রিপোর্টে এটিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্বারা নির্মমভাবে সম্পাদিত ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পিত ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানব ইতিহাসে এমন নৃশংসতার অন্য কোনো নজির নেই। পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী, প্রখ্যাত অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার ও ছাত্রসহ সকলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে।
এটা সবার জানা যে এই মানুষগুলোর একমাত্র অপরাধ ২৩ বছরের ইতিহাসে দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তারা প্রায় এক বাক্যে তাদের নেতা হিসেবে আওয়ামীলীগের শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে রায় দেন।
শেখ মুজিব ও তার দলের একমাত্র অপরাধ যে তারা গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের ওপর নেমে আসা তৎকালীন ঔপনিবেশিক অবস্থা শেষ করতে চেয়েছিলেন – একটি বিশিষ্ট ও সম্মানিত পর্যায়ে দেশকে নিতে চেয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা আবশ্যক যে পূর্ব পাকিস্তানের ট্রাজেডি বায়াফ্রার মতন নয়। সমান্তরাল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা বা রোডেশিয়ার সাথে তুলনা করা যায় যেখানে অল্প কিছু মানুষ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপর ক্ষমতা ফলাচ্ছে।
যদিও এটা খুব সামান্যই মিলে যায়। এমনকি ভ্রষ্টার বা ইয়ান স্মিথ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার মত সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারেনি। তবুও বলা হচ্ছে এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়। আসলেই কি তাই?
এর উত্তর হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৬ মিলিয়ন সন্ত্রাস-পীড়িত মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রবেশ করেছে যারা এসব ট্রাজেডির ‘সাক্ষী’ হয়ে আছে।
পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মানবিক কারণে ভারত নিজের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের চাপ মাথায় থাকার পরেও এইসব উদ্বাস্তুদের আশ্রয় এবং খাবার দিচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে যাবার সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে এবং এখন তা দিনে ৫০০০০। যদি কোন সরকার জোর করে তাদের জনগণকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেয় তাহলে সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কি অধিকার থাকতে পারে।
এখন যে রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তাতে এইসব শরণার্থীদের ফিরে যাবার আশা ক্ষীণ।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নতুন সাংবিধানিক প্রস্তাব পরিষ্কারভাবে সংখ্যালঘুদের শাসন চিরস্থায়ী করার পন্থা। এখন সময় এসেছে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের সকল স্বাধীনতা প্রেমী জাতির এগিয়ে আসার। তাদের উচিৎ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামীলীগের শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেয়া। শুধুমাত্র তখনই ভারতে অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ শরণার্থী নিজের দেশে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করবে।
ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া বিপজ্জনক এবং ভয়ানক পরিবেশকে আরও বিধ্বংসী অবস্থায় যাওয়া ঠেকাতে এটাই একমাত্র পথ।
পালাভার আরও একবার বিশ্বের সুচিন্তাসম্পন্ন মানুষকে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় লোকদের উপর পাকিস্তানের সামরিক জান্তা দ্বারা ঘটিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে একসাথে সোচ্চার হবার আবেদন জানাচ্ছে।