শিরোনামঃ – ১। জাতির উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণ
সূত্রঃ – ডন, করাচী, ২৭ মার্চ; পাকিস্তান সরকার প্রচারিত পুস্তিকাঃ ‘ব্যাকগ্রাউন্ড রিপোর্ট-৪’
তারিখঃ – ২৬শে মার্চ, ১৯৭১
ইয়াহিয়ার ভাষণ এর লিখিত রুপ
২৬ মার্চ, ১৯৭১
আমার প্রিয় দেশবাসী
আসসালাম-উ-আলাইকুম
আমি এই মাসের ৬ তারিখে ঘোষণা দিয়েছিলাম জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার নতুন তারিখ ২৫ মার্চ এই আশায় যে,সার্বিক পরিস্থিতি যথাসময়ে এই অধিবেশন আয়োজনের অনুকূলে থাকবে। বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ সে আশা সফল হতে দেয় নি। জাতি এখনও গভীর সংকটের সম্মুখীন।
পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ অসহযোগ এবং বিক্ষোভপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল এবং পরিস্থিতি দ্রুত সংকটাপূর্ণ হয়ে ওঠেছিল। পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে থাকে এবং একে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করি এবং পরবর্তীকালে ১৫ মার্চ ঢাকা গমন করি।
আপনারা অবগত আছেন যে, এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা অবসানের লক্ষ্যে আমি শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে একাধিক বৈঠকে মিলিত হই। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার পর সেখানেও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি যাতে করে মতৈক্যে পৌঁছানো এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা সম্ভব হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার আলোচনা বেশ কিছুদূর এগিয়েছিল, তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে ঢাকাতে আরেক দফা আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।
জনাব জেড. এ. ভুট্টো ২১ মার্চ সেখানে পৌঁছান এবং তার সাথে আরও কয়েক দফা আলোচনা করি।
আপনারা অবগত আছেন, আওয়ামী লীগের নেতা দাবি জানান সামরিক শাসন তুলে নেয়ার জন্য এবং জাতীয় পরিষদের বৈঠকের পূর্বেই ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য। আমাদের আলোচনায় তিনি প্রস্তাব রাখেন যে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য আমাকে একটি ঘোষণা দিতে হবে যেখানে বলা থাকবে সামরিক শাসন তুলে নেয়ার কথা, প্রাদেশিক সরকার গঠনের কথা এবং জাতীয় পরিষদের শুরু থেকেই দুটি কমিটি থাকার কথা,যার একটিতে থাকবেন পুর্ব পাকিস্তানের সদস্যবৃন্দ, অপরটিতে পশ্চিম পাকিস্তানের।
**একটি শর্ত**
উক্ত প্রস্তাবনায় আইনী এবং অন্যান্য বিষয়ে বড় ধরণের ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বার্থে আমি নীতিগতভাবে তার এই পরিকল্পনায় সম্মত হতে রাজি ছিলাম – কিন্তু এক শর্তে। শর্তটি, যা আমি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম তা হল, সর্বপ্রথমে এই পরিকল্পনাতে সমস্ত রাজনীতিবিদদের সুস্পষ্ট সমর্থন প্রয়োজন।
আমি অবিলম্বে এই বিষয়টি নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করি। তাদের প্রত্যেককেই আমি এই বিষয়ে একমত হতে দেখি যে, প্রস্তাবিত ঘোষণাটির কোন আইনী বৈধতা থাকবে না। না এতে সামরিক শাসনের সমর্থন থাকবে, না এর পক্ষে দাবি করা সম্ভব হবে এটা জনগণের ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত। যার ফলে এক প্রকার শূণ্যতা দেখা দিবে এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তারা আরও মনে করেন যে, ঘোষণার মাধ্যমে জাতীয় পরিষদকে দুটি ভাগে ভাগ করা হলে যে কোন ধরণের বিচ্ছিন্নতাবাদ কে উতসাহ দেয়া হবে, যার অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা আরো বলেন যে, সামরিক শাসন তুলে নেয়া এবং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসা উচিত এবং যথাযথ অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান বিল তৈরি করে আমার অনুমোদন এর জন্য উপস্থাপন করা উচিৎ। আমি এর সাথে সম্পূর্ণ একমত এবং তাদের অনুরোধ করি তারা যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্যাপারটিকে যুক্তিসঙ্গত মনোভাব নিয়ে দেখার জন্য বলেন।
আমি নেতাদের বলি তারা যেন তাদের চিন্তা ভাবনা শেখ মুজিবুর রহমান’কে বুঝিয়ে বলেন, যে, একদিকে সামরিক শাসন সহ যেকোন ক্ষমতার উৎস বিলুপ্ত করলে এবং অপরদিকে জনগণের ইচ্ছা এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ছাড়াই এর বিকল্প সমাধান খুজতে গেলে কেবলই চরম অরাজকতার সৃষ্টি হবে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া জাতীয় পরিষদের মাধ্যমেই হবে-এ ব্যাপারে সম্মতি আদায় করার জন্য চেষ্টা করতে রাজি হন।
জাতীয় পরিষদকে শুরু থেকেই দুটি ভাগে ভাগ করার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দগণ অত্যন্ত বিচলিত ছিলেন। তাদের মতে, এমন একটি পদক্ষেপ পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার সম্পূর্ণ বিপক্ষে যাবে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ও একই মতামত দিয়েছেন তার, আমার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার এক বৈঠকে।
২৩ শে মার্চ বিকেলে, যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ মুজিব এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তারা আমাকে জানান যে তিনি তার পরিকল্পনার কোন পরিবর্তন আনতে রাজি নন। তিনি শুধু চান আমি যেন একটি ঘোষণা দেই, যেখানে আমি সামরিক শাসন তুলে নেব এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবো।
শেখ মুজিবুর রহমান যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন তা এক ধরণের দেশদ্রোহীতা। তিনি এবং তার দল তিন সপ্তাহ ধরে বৈধ কর্তৃপক্ষকে অমান্য করে চলেছেন , পাকিস্তানের পতাকার অমর্যাদা করেছেন এবং জাতির পিতার ছবিকে বিকৃত করেছেন। তারা আলাদা আরেকটি সরকারব্যবস্থা গঠন করতে চেয়েছেন। তাদের জন্য দেশে অশান্তিপূর্ণ, ভীতিকর এবং নিরাপত্তাহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এর মাঝে আন্দোলনের নামে বেশ কিছু হত্যাকান্ড হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা লাখ লাখ বাঙ্গালী ভাইয়েরা এখন এক ধরণের আতঙ্কের মাঝে দিনযাপন করছেন, এবং তাদের একটি বড় অংশকে প্রাণভয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সশস্ত্র বাহিনী সমূহ, যারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের বিদ্রূপ এবং অপমানের সম্মুখীন হয়েছেন, শত প্ররোচনার মাঝেও তারা প্রবল সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। এজন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। তাদের শৃংখলাবোধ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
**যুক্তিপূর্ণ সমাধান**
আমার আরও আগেই মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি পরিস্থিতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য যাতে করে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ঝুকির মুখে না পড়ে। এভাবে একের পর এক বেআইনী কাজ হতে থাকলেও এই লক্ষ্য পূরণের আশাতেই এসব সহ্য করতে থাকি। একই সাথে একটি যুক্তিসঙ্গত সমাধানে আসার জন্য সব রকম চেষ্টা করতে থাকি। আমি এর মাঝেই উল্লেখ করেছি শেখ মুজিবুর রহমানকে যুক্তিতে বোঝানোর জন্য আমার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চেষ্টার কথা । কোন কিছুই আমরা বাদ রাখিনি। কিন্তু তিনি কোন গঠনমূলক পদ্ধতিতে সমাধানে আসতে ব্যর্থ হন, উপরন্তু, আমি ঢাকায় থাকাকালীন সময়ই তিনি এবং তার অনুসারীরা সরকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি অবজ্ঞাসূচক আচরণ করতে থাকেন। যে ঘোষনাটি তিনি প্রস্তাব করেছিলেন তা ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি জানতেন এর কোন মূল্যই থাকবে না এবং সামরিক শাসন তুলে নেয়ার ফলে যে শূণ্যতা তৈরি হবে এর মাঝে তিনি যা খুশি করে ফেলতে পারতেন। তার একগুয়েমি, জেদ এবং যুক্তিযুক্ত আলোচনাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা শুধুমত্র একটি জিনিসই নির্দেশ করে- তিনি এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে দেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যেতে চায়। তিনি এই দেশের সংহতি এবং অখন্ডতার উপর আঘাত করেছেন- এই অপরাধ ক্ষমা করা হবে না।
আমরা কোন ভাবেই কিছু ক্ষমতালোভী এভং দেশদ্রোহী লোককে এই দেশকে ধ্বংস করতে অথবা ১২ লাখ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেব না।
৬ মার্চ, জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া আমার ভাষণে আমি আপনাদের বলেছিলাম,এ দেশের অখন্ডতা, সংহতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্ব। আমি তাদের আদেশ দিয়েছি তাদের কর্তব্য পালনের জন্য এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।
দেশের এই গভীর সংকটময় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আজ থেকে দেশে সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই সাথে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা
হলো। এছাড়াও আমি সংবাদ মাধ্যমের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ সমস্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য খুব শীঘ্রই সামরিক আইনের নীতিমালা জারি করা হবে।
**লক্ষ্য অপরিবর্তিত থাকবে**
আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে আমার আসল উদ্দেশ্য অপরিবর্তিতই থাকবে, যা হলো, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।যখনই পরিস্থিতি অনুকূলে থাকবে তখনই আমি যথাশীঘ্র সম্ভব এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেব।
আমি আশাবাদী যে, পূর্ব পাকিস্তানে আইন-শৃংখলা শীঘ্রই পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে এবং আবার আমরা কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করতে পারব।
আমি আমার দেশবাসীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করার চেষ্টা করার জন্য-যার জন্য সম্পুর্ণ দায়ী পাকিস্তান বিরোধী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা; এবং একজন দায়িত্ববান নাগরিকের মত আচরণের জন্য, কেননা ,এর মাঝেই রয়েছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা এবং এই অচলাবস্থা থেকে পরিত্রান।
ঈশ্বর আপনাদের সহায় হউন। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।
.
.
শিরোনামঃ ২। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের ওপর একটি প্রতিবেদন সূত্রঃ উইটনেস টু সারেন্ডার- সিদ্দিক সালেক
তারিখঃ ২৬ মার্চ- ২ মে
অপারেশন সার্চলাইট -১
২৫ শে মার্চ সকাল এগারটার দিকে সবুজ টেলিফোনটি বেজে উঠে। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন তখন রাজনৈতিক সংলাপের ফলাফল নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তামগ্ন ছিলেন। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান। তিনি বললেন ‘খাদিম, আজ রাতেই’।
এই খবরটি খাদিমকে উত্তেজিত করেনি। বরং এই আদেশটির জন্যেই তিনি অপেক্ষা করছিলেন। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তটি এমন একটি দিনে এসেছিল যেদিন ছিল তার ক্ষমতা গ্রহনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। জেনারেল খাদিম আদেশটি তার স্টাফদের বাস্তবায়ন করতে বললেন। খবরটি যত নিচে যাচ্ছিল তত বেশী প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছিল। আমি কতিপয় জুনিয়র অফিসারদেরকে কিছু পরিমান অতিরিক্ত স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও গোলাবারুদ তাড়াহুড়ো করে জড়ো করতে দেখলাম। ট্যাংক ক্রু’রা রাতে ব্যাবহারের জন্যে ৬টি বিবর্ণ এম-২৪ ট্যাংকে তেল ভরে নিল, যাদেরকে আগে থেকেই রংপুর থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। ঢাকার রাস্তায় আওয়াজ তোলার জন্যে সেগুলো যথেষ্ট।
জেনারেল স্টাফ অফ হেডকোয়াটার্স, ১৪ ডিভিশন থেকে ফোন মারফত সকল সৈন্যদলকে অপারেশনের সময় জানানো হয়। ম্যাসেজটি ছড়ানোর জন্যে একটি বিশেষ কোড উদ্ভাবন করা হয়েছিল। সব সৈন্যদলকে একই সময়ে অপারেশন শুরু করতে নির্দেশ দেয়া ছিল। অপারেশনের সময় নির্ধারিত হয় ২৬শে মার্চ এর প্রথম ঘন্টা। এটা হিশেব করেই অপারেশনের সময় নির্ধারিত হয়েছিল যে ততক্ষনে প্রেসিডেন্ট নিরাপদে করাচী পৌছে যাবেন।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর পরিকল্পনা দুটি হেডকোয়ার্টার তৈরির ব্যাপারটিকে দৃশ্যমান করে। ঢাকা শহর ও তার আশেপাশের অপারেশনের দায়িত্ব ছিল ৫৭ ব্রিগেডের অধীনে, যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল ফরমান ও বিগ্রেডিয়ার আরবাব। অন্যদিকে প্রদেশের বাকী অংশের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম। উপরন্তু, লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও তার সহকর্মীরা ঢাকার ভেতর ও বাহিরের অপারেশনের অগ্রগতি পর্যবেক্ষনের জন্যে রাত্রি যাপন করছিলেন দ্বিতীয় রাজধানীর মার্শাল ল’ হেডকোয়াটার্সে।
খাদিম এবং ফরমান এই ‘ক্র্যাক ডাউন’ এর সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করতে পারে এই সম্ভাবনার বশবর্তী হয়ে কিছুদিন আগেই জেনারেল ইয়াহিয়া তাদের বদলি হিশেবে মেজর জেনারেল জাঞ্জুয়া ও মেজর জেনারেল মিট্টা’ কে বদলি হিশেবে ঢাকা পাঠিয়েছিলেন। তদুপরি তারা জেনারেল ইয়াকুব এর টিমকেও তৈরি করেছিলেন এবং তিনি হয়ত তার আইডিয়া শেয়ারও করেছেন। এমনকি জেনারেল হামিদ এই অপারেশনের ব্যাপারে খাদিম এবং ফরমানের স্ত্রী’দের কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুই জেনারেল ই হামিদকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে আদেশ যথাযথ ভাবে পালন করা হবে।
রাত দশটা নাগাদ আমার মত জুনিয়র অফিসার’রা মার্শাল ল’ হেডকোয়াটার্স এ জড়ো হতে শুরু করল। তারা বাগানে সোফা ও আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা করেছিল, সারা রাত কাটানোর জন্যে চা-কফির ব্যবস্থাও ছিল। যে কোন সময়ের জন্যে প্রস্তুত থাকা ছাড়া আমার আর কোন কাজ ছিল না। ‘আউটডোর অপারেশনস রুম’ এর পাশেই ওয়্যারলেস লাগানো একটি জিপ পার্ক করা হয়েছিল। সারা শহর ছিল নক্ষত্রের আলোয় আবৃত এবং সবাই ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বসন্তে রাতের ঢাকা যতটা সুন্দর হতে পারে, রাতটি ছিল ঠিক ততটাই সুন্দর। যে কোন কাজের জন্যেই সকল প্রস্তুতি ছিল একেবারে নিখুঁত, কিন্তু এটা ছিল রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞ।
সেনাবাহিনী ছাড়াও সেই রাতে কতিপয় লোক ব্যস্ত সময় পার করছিল। তারা ছিল আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ এবং তাদের বেসামরিক বাহিনী- যেখানে ছিল বাংগালী সৈন্য, পুলিশ, অবসরপ্রাপ্ত চাকুরিজীবিগণ, ছাত্র এবং বিভিন্ন দলের স্বেচ্ছাসেবক। তাদের সাথে মুজিব, কর্ণেল ওসমানী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাংগালী অফিসারদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তারা সর্বোচ্চ প্রতিরোধের জন্যে তৈরি হচ্ছিল। ঢাকা শহরে সেনাবাহিনীর যাত্রা রোধ করার জন্যে প্রচুর রোড ব্লক তৈরি করা হয়েছিল।
জিপ গাড়িতে যেই ওয়্যারলেস সেট স্থাপন করা হয়েছিল সেটা প্রথম আওয়াজ করে উঠে রাত ১১:৩০ মিনিটে। ঢাকার লোকাল কমান্ডার সেই কাং্খিত সময়ে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি চাইল, কেননা অপরপক্ষ তখন কঠোর প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সবাই ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রেসিডেন্ট তখনো পৌছাননি, বরং ছিলেন কলম্বো (শ্রীলংকা) ও করাচীর মাঝামাঝি। জেনারেল টিক্কা আদেশ দিলেন- ‘ববি’কে (আরবাব) বল যত বেশিক্ষন সম্ভব অপেক্ষা করতে।
উল্লেখিত সময়ে ব্রিগেডিয়ার আরবাব এর ব্রিগেড নিম্নলিখিত ভাবে কাজ করে-
-১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এ রিজার্ভ হিশেবে অবস্থান করতে বলা হয় এবং প্রয়োজন হলে ক্যান্টনমেন্টকে রক্ষা করবে এই মর্মে নির্দেশনা দেয়া হয়।
-আকাশসীমা ব্যবহারে ভারতের প্রতি নিষেধাজ্ঞা ছিল বিধায় ৪৩- হালকা বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্ট’কে বিমানবন্দরে স্থাপন করা হয়, বিমানবন্দর এলাকায় নজরদারীর জন্যে।
-২২ বেলুচ, যারা আগে থেকেই পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর ব্যারাকে অবস্থান করছিল, প্রায় ৫০০০ ইপিআর সদস্যের অস্ত্র এবং ওয়্যারলেস বাজেয়াপ্ত করে।
-৩২ পাঞ্জাব, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স এ প্রায় ১০০০ পুলিশ সদস্যকে নিরস্ত্র যারা স্বাধীনতার চেতনায় অত্যন্ত অনুপ্রাণিত এবং আওয়ামীলীগের সশস্ত্র জনবল হিশেবে তীব্র সন্দেহভাজন ছিল।
-১৮ পাঞ্জাব নিয়োজিত ছিল নওয়াবপুর এবং পুরোন শহরে। কথিত আছে সেখানে প্রচুর হিন্দু বাড়িতে অস্ত্রের মজুদ করা হয়েছিল।
-ফিল্ড রেজিমেন্ট ছিল দ্বিতীয় রাজধানী ও তদসংলগ্ন বিহারী এলাকা (মোহাম্মদপুর, মিরপুর) নিয়ন্ত্রনের দায়িত্বে।
-১৮ পাঞ্জাব, ২২ বেলুচ, ও ৩২ পাঞ্জাব এর প্রতিটি থেকে একটি করে কোম্পানী নিয়ে তৈরি একটি মিশ্র বাহিনী আক্রমন চালায় বিশ্ববদ্যালয় এলাকায় বিশেষত ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে, যেখানে ছিল সবচেয়ে বেশী সং্খ্যক আওয়ামীলীগের বিদ্রোহীরা।
-একটি স্পেশাল কমান্ডো প্লাটুন মুজিব’কে জীবিত ধরতে তার বাড়িতে হানা দেয়।
-এক স্কোয়াড্রন এম-২৫ ট্যাংক সূর্যোদয়ের আগে রাস্তায় নামে, মূলত শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। তবে প্রয়োজন হলে গোলা ছুড়বার অনুমতি তাদের ছিল।
উল্ল্যেখিত সেনাদের মূল দায়িত্ব ছিল তাদের নিজেদের স্থানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাহাড়া দেয়া, পথে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেটাকে ধ্বংস করা এবং চিহ্নিত রাজনৈতিক নেতাদেরকে তাদের বাসা থেকে গ্রেফতার করা।
রাত একটার আগেই সৈন্যদের লক্ষ্যস্থানে পৌছে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। সৈন্যদের কোন কোন দল পথে দেরী হবার ধারনা থেকে রাত সাড়ে এগারটা নাগাদ ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা দেয়। যারা আগে থেকেই শহরের ভেতরে অবস্থান করছিল তারা আক্রমনের জন্যে উল্ল্যেখিত সময়ের আগেই রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুত কেন্দ্র, স্টেট ব্যাংক ইত্যাদি এলাকায় পাহাড়ার জন্যে পৌছে যায়।
সৈন্যদের প্রথম দলটি প্রথম প্রতিবন্ধকতার সম্মূখীন হয় ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক কিলোমিটার দূরে ফার্মগেইট এলাকায়। দলটি প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয় রাস্তায় ফেলে রাখা গাছের গুড়ির কারনে, যেগুলো কিছুক্ষন আগেই কাটা হয়েছে। রাস্তার পাশের ফাকা স্থানে নষ্ট হওয়া কিছু গাড়ি এবং একটি অকেজো স্টিম-রোলার রাখা ছিল। রাস্তার ব্যারিকেডের পাশে শত শত আওয়ামীলীগার দাড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছিল। জেনারেল টিক্কা’র হেডকোয়ার্টার এর বারান্দায় দাড়িয়ে আমি তাদের সাহসী চিতকার শুনছিলাম। হঠাতই রাইফেলের শব্দ জয় বাংলা শ্লোগানের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছোড়া আগুনের গোলা বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেখা গেল। তারপর শুধু ছিল গোলাগুলি আর আগুনের শ্লোগান, যার উতস হালকা মেশিনগান। ১৫ মিনিট পর সকল অস্ত্র আর শ্লোগানের আওয়াজ ঝিমিয়ে গেল। এটা মূলত ছিল অস্ত্রের জয়ধ্বনি। সৈন্যদল শহরের ভেতর এগোতে শুরু করল।
এভাবেই আক্রমন শুরু হয়ে গিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। এখন আর সেই নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অপেক্ষা করার কোন মানে নেই। জাহান্নামের দরজা এখন খোলা। যখন প্রথম গুলিটি ছোড়া হয়েছিল, ঠিক সেই মুহুর্তে শেখ মুজিবর রহমানের কন্ঠস্বরের একটি দুর্বল তরংগ পাকিস্তানের অফিসিয়াল রেডিওতে ধরা পড়ে। সেখানে ছিল একটি প্রি-রেকোর্ডেড ম্যাসেজ, যেখানে শেখ ইস্ট পাকিস্তান কে ‘পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ বলে ঘোষণা করেন। পূর্ণাংগ ঘোষণাটি পরবর্তীতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কতৃক ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’ এ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়-‘এটা হয়ত আমার শেষ আদেশ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের সব মানুষকে আদেশ দিচ্ছি যে যেখানে আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত শত্রু-সৈন্যের মোকাবিলা করবে। তোমাদের যুদ্ধ ততক্ষন পর্যন্ত চলবে যতক্ষন পর্যন্ত না শেষ সৈন্যটি দেশ থেকে বিতাড়িত হয় ও বিজয় অর্জিত হয়।’
আমি এই বেতারবার্তাটি শুনি নাই। বরং আমি শুনেছিলাম কমান্ডোদের ছোড়া রকেট লাঞ্চার এর তীব্র আওয়াজ, যেগুলো তারা ছুড়ছিল মুজিবের বাসায় যাওয়ার পথের বাধা দূর করতে। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জেড এ খান, কমান্ডিং অফিসার ও মেজর বিল্লাল, কোম্পানী কমান্ডার, এই সৈন্যদলের দায়িত্বে ছিলেন।
কমান্ডো দল মুজিবের বাসায় পৌছুনোর সাথে সাথে বাড়ির সকল গার্ডদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হল। দ্রুতই তারা নিরস্ত্র হয়ে পড়ল। প্রায় ৫০ জন শক্তিশালী সৈনিক ক্ষিপ্রতার সাথে বাড়ির চার ফুট উচু দেয়াল বেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সৈন্যরা তাদের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্যে স্টেনগান থেকে গুলি করে এবং চিতকার করে মুজিবকে বেরিয়ে আসতে বলে। কিন্তু সেখানে কোন সাড়াশব্দ ছিল না। বারান্দা এবং সিড়ি পেরিয়ে সৈন্যরা মুজিবকে তার শোবার ঘরে খুজে পায়। ঘরটি ছিল বাহির থেকে তালাবদ্ধ। একটি বুলেট তালাটি ভাংগার জন্যে ছিল যথেষ্ট। সেখানে মুজিবকে আত্মসমর্পণ এর জন্যে আহবান জানানো হয়। মনে হচ্ছিল তিনি এর জন্যে প্রস্তুত ই ছিলেন। সৈন্যদল বাড়ির সকলকে গ্রেফতার করে দ্বিতীয় রাজধানী তে নেয়ার জন্যে জিপে তুলল। মিনট খানেক পর রেডিওতে আসল ৫৭ ব্রিগেড এর ব্রিগেড মেজর, মেজর জাফর। আমি তার শক্ত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম যেখানে সে বলছিল- ‘বিগ বার্ড ইন দ্য কেইজ… আদার’স নট ইন দেয়ার নেস্টস… ওভার।’
ম্যাসেজটি শেষ হওয়া মাত্রই আমি দেখলাম সাদা জামা পরিহিত সেই ‘বিগ বার্ড’ কে নিয়ে একটি আর্মি জিপ নিরাপদ জিম্মায় নেবার উদ্দ্যেশ্যে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকল। কেউ একজন তাকে জেনারেল টিক্কা’র সামনে নিয়ে আসার অনুমতি চাইলে তিনি শক্ত ভাবে জবাব দেন ‘আমি তার মুখ দেখতে চাই না।’
নিশ্চিত হবার পর মুজিবের বাড়ির চাকর-বাকরদের সেই রাতেই ছেড়ে দেয়া হয়। আর মুজিবকে সেই রাতের জন্যে নেয়া হয় আদমজী স্কুলে। পরদিন তাকে পতাকাবাহী স্টাফ-হাউজে স্থানান্তর করা হয়। যেখান থেকে পরবর্তীকালে মুজিবের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তিনদিনের মাথায় তাকে করাচী পাঠিয়ে দেয়া হয়। গ্রেফতারের সময়ই কেন তাকে মেরে ফেলা হল না- এই কথা জানতে চাইলে আমার মেজর বন্ধু জবাব দিয়েছিল ‘জেনারেল মিঠঠা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তাকে জীবিত ধরতে আদেশ করেছিলেন।
মুজিবকে আদমজী স্কুলে আটক রেখে ঢাকা শহরকে একটি গৃহযুদ্ধের মুখে ফেলা হয়। আমি চার ঘন্টা যাবত সেই রাতের বীভতস দৃশ্য বারান্দায় দাড়িয়ে দেখছিলাম। সেই রক্তাক্ত রাতের সবচাইতে সাধারন দৃশ্য ছিল আকাশ ছোয়া আগুনের ফুলকি। সেই সময়ে শোকাতুর ধোয়ার মেঘ আর আগুনের গোলা ছিল মিলেমিশে একাকার, কিন্তু দ্রুতই তারা নতুন আগুনের গোলায় আবিষ্ট হয়ে যায়, যেগুলো আকাশের তারা ছুতে চাচ্ছিল। মানুষের তৈরি সেই বৃহত আগ্নিকান্ডের সামনে রাতের চাদের আলো ছিল একেবারেই ম্লান। আগুন ও ধোয়ার সবচেয়ে বড় কুন্ডলীটি উঠছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে। অন্যদিকে শহরের অন্য অংশ, যেখানে সবসময় হাজারো মানুষের আনাগোনা থাকে, সেখানে এই ভয়াল অগ্নিকান্ডের কোন ছিটেফোটাও ছিল না।
রাত দুইটা নাগাদ জিপে স্থাপিত ওয়্যারলেস সেটটি আবার আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করে। আমাকে ফোন কলটি ধরার জন্যে আদেশ দেয়া হয়। অপর প্রান্ত থেকে একজন ক্যাপ্টেন জানায় তারা ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল থেকে প্রচন্ড প্রতিরোধের সম্মূখীন হচ্ছে। ততক্ষনাত একজন সিনিয়র স্টাফ আমার হাত থেকে হ্যান্ডসেটটি ছিনিয়ে নিয়ে চিতকার করে বলেন- ‘সবাইকে প্রতিরোধ করতে তোমার কত সময় লাগবে?… ওকে, প্রত্যেককেই ব্যবহার করে আগামী দুই ঘন্টার মধ্যেই পুরো এলাকা দখল করে নাও।’
ভোর চারটা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় বিল্ডিং দখল করা যায়। কিন্তু বাংগালী জাতীয়তাবাদের যে আদর্শ বছরের পর বছর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তা দমনে আরো সময় প্রয়োজন। সম্ভবত আদর্শকে জয় করা যায় না।
শহরের বাকী অংশে বাহিনী তার উদ্দ্যেশ্য সম্পাদন করে, এর মাঝে ছিল রাজারবাগ এর সকল পুলিশ ও পিলখানা ইপিয়ার এর সকলকে নিরস্ত্র করা। শহরের বাকি অংশে তারা শুধুমাত্র ভীতি প্রদর্শনের জন্যে এখানে সেখানে ফাকা গুলি ছোড়ে ও আগুন দেয়। সৈন্যদল শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট বাড়ি (রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে) বা যে সকল জায়গা দুস্কৃতিকারীদের আশ্রয়স্থল হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন জায়গা ছাড়া অন্য কোন বাড়িতে প্রবেশ করে নি।
২৬শে মার্চ ভোরের আলো ফোটার আগেই সৈন্যদল তাদের মিশন পূর্ণ হবার রিপোর্ট করে। জেনারেল টিক্কা খান ভোর পাচটার দিকে তার আসন ত্যাগ করে কিছুক্ষনের জন্যে তার অফিসে প্রবেশ করেন। তিনি রুমালে তার চশমা পরিস্কার করতে করতে পায়চারী করতে থাকেন। বারান্দায় দাড়িয়ে তিনি বোলেণ- ‘আহ, একটি প্রাণও নাই সেখানে।’ আমি তার স্বগতোক্তি শুনে নিশ্চিত হবার জন্যে আশেপাশে তাকালাম। সেখানে শুধু একটি দলছাড়া কুকুর তার লেজটি দুই পায়ের মাঝে গুটিয়ে শহরের দিকে পালাবার পথ খুজছিল।
পরদিন সকালে ভুট্টোকে হোটেল থেকে সেনা পাহাড়ায় বিমানবন্দরে পৌছে দেয়া হয়। বিমানে ওঠার পূর্বে তিনি সেনাবাহিনী’কে আগের রাতের কাজের জন্যে ধন্যবাদ ও তাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। সেনা প্রহরা’র প্রধান বিগ্রেডিয়ার আরবাব’কে তিনি বলেন- ‘ উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ। পাকিস্তান রক্ষা পেল।’ করাচী পৌছবার পর তিনি আবার তার বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
ভুট্টো যখন তার আশাবাদী মন্তব্য করছিল, আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরের মাপজোক করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি গণকবর দেখলাম যার প্রতিটি ছিল ৫ থেকে ১৫ মিটার ব্যাসার্ধের। সেগুলো সদ্য চাপা দেয়া মাটি দিয়ে পূর্ণ ছিল। কিন্তু কোন অফিসারই হতাহতের সঠিক সং্খ্যা জানাতে আগ্রহী ছিল না। আমি বিভিন্ন বিল্ডিং, বিশেষ করে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের আশেপাশে ঘুরতে লাগলাম। ইকবাল হলে স্পষ্টত দুটো এবং জগন্নাথ হলে চারটি রকেট ছোড়া হয়েছিল। রুমের বেশীরভাগই ছিল দগ্ধ কিন্তু অক্ষত। কিছু ডজন খানেক আধপোড়া রাইফেল এবং ইতস্তত কাগজপত্র থেকে তখনও ধোয়া উড়ছিল। ক্ষয়ক্ষতি ছিল ভয়াবহ, কিন্তু ততটা ভয়াল নয় যতটা আমি দেখেছিলাম হেডকোয়ার্টারে জেনারেল টিক্কা খানের বারান্দা থেকে।
বিদেশী সংবাদমাধ্যম কয়েক হাজার মৃত্যুর (বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়) খবর ছাপল। সেখানে আর্মি অফিসাররা শ’খানেক এর কথা জানায়। অফিসিয়ালি, মাত্র ৪০ জন।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে আমি ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলো ঘুরতে থাকি। সেখানে দেখলাম ফুটপাত ও রাস্তার মোড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাশ পড়ে আছে। সেখানে লাশের কোন স্তুপ ছিল না, যেমনটা পরবর্তীতে দাবী করা হয়। তবে আমার এক অদ্ভুত ও অশুভ অনুভূতি হতে থাকে। আমি জানি না সেটা কেন হচ্ছিল, কিন্তু সেখানে আর বেশিক্ষন থাকতে পারি নি। আমি গাড়ি নিয়ে অন্য এলাকায় চলে আসি।
পুরোনো শহরে তখনও ব্যারিকেড দেয়া ছিল, কিন্তু জনমানবশূন্য। সবাই নিজ নিজ বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে ছিল। রাস্তার পাশে আমি একটি ছায়া দেখলাম, দ্রুতই সেটা অন্যদিকে সরে গেল। শহর একবারপ প্রদক্ষিনের পর আমি ধানমন্ডি পৌছে সেখানে মুজিবের বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়িটি জনমানবশূন্য। বাড়ির বিক্ষিপ্ত অবস্থা দেখে বোঝা যায় এখানে তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর একটি দীর্ঘকায় ছবি ব্যাতীত মনে রাখার মত আর কিছু সেখানে আমি পাই নি। ফ্রেমটি কয়েক কয়েক টুকরো থাকলেও ছবিটি ছিল অক্ষত।
বাড়ির বাহিরের গেইটটিও তার সৌন্দর্য্য হারিয়েছে। মুজিবের সময় তারা বাংলাদেশের একটি রেপ্লিকা মানচিত্র টানিয়েছিল যেখানে তারা ছয়টি তারকা চিহ্নও স্থাপনে করেছিল। ছয়টি তারকা আওয়ামীলীগের ছয় দফা’কে নির্দেশ করে। কিন্তু এখন সেখানে ছিদ্র হওয়া কিছু লোহার শিক ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নাই। গৌরবের যে ইতিহাস শুরু হয়েছিল তা দ্রুতই নি:শেষ হয়েছে।
দুপুরের খাবারের জন্যে আমি দ্রুতই ক্যান্টনমেন্ট ফিরে আসি। সেখানে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশ দেখতে পেলাম। সারা শহরের ট্রাজেডী সেনাকর্মকর্তা ও তাদের অধীনস্তদের কে স্বস্তি দিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছিল তা অবশেষে শেষ হয়েছে। কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ক্যাপ্টেন চৌধুরী বলে ‘বাংগালীদের উপযুক্তভাবে শায়েস্তা করা গিয়েছে- কমপক্ষে একটা প্রজন্ম পর্যন্ত।’ ‘ হ্যা, তারা শুধু শক্তির ভাষা জানে, তাদের ইতিহাস তাই বলে’- মেজর মালিক যোগ করলেন।
অপারেশন সার্চলাইট – ২
যদিও ঢাকা রাতারাতি অসাড় হয়েছিল, প্রদেশের অন্যান্য অংশও সময়ের সাথে স্বাভাবিক হতে থাকে। নির্দিষ্ট ভাবে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও পাবনা এই তিনটি অঞ্চল এর জন্যে আমরা কিছুদিন পর্যন্ত উদ্বিগ্ন সময় কাটাই।
চট্টগ্রামে বাংগালী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যসং্খ্যা ছিল যথাক্রমে প্রায় ৫০০০ এবং ৬০০। আগেই গঠিত হওয়া ইস্ট বেংগালী সেন্টার (২৫০০), নতুন গঠিত ৮ ইস্ট বেংগল, ইপিআর এর একাংশ ও সেক্টর হেডকোয়ার্টার এবং পুলিশ। অন্যদিকে আমাদের সৈন্যদলের মূল অংশ ২০ বেলুচ এর একাংশ, যাদের অগ্রবর্তী দলটি পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত গিয়েছিল। একজন সিনিয়র অ-বাংগালী অফিসার, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফাতিমি, তাকে আদেশ দেয়া হয় কুমিল্লা থেকে সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত যেন দখল ধরে রাখা হয়।
বিদ্রোহীরা প্রাথমিকভাবে প্রচুর সাফল্য পায়। ফেনীর কাছাকাছি শুবাপুর ব্রীজ ধ্বংস করে কুমিল্লা থেকে আগত সৈন্যদলের যাত্রা সার্থকভাবে প্রতিহত করে। চট্টগ্রাম শহর ও ক্যান্টনমেন্ট এর অধিকাংশ এলাকাও তারা নিয়ন্ত্রন করছিল। সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীন একমাত্র জায়গা ছিল ২০ বেলুচ এলাকা ও নেভাল বেইজ। বিগ্রেডিয়ার মজুমদার (যাকে উদ্দ্যেশ্যমূলক ভাবে কিছুদিন আগেই ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়) এর অনুপস্থিতিতে মেজর জিয়াউর রহমান, ৮ম ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট এর সেকেন্ড ইন কমান্ড, বিদ্রোহীদের নেতৃত্বভার গ্রহণ করে। সরকারী সৈন্যদল যখন রেডিও স্টেশনের বিল্ডিং পাহারা দেবার জন্যে ঘিরে রেখেছিল, মেজর জিয়া তখন কাপ্তাই রোডে আলাদাভাবে স্থাপিত ট্রান্সমিটার এর দখল নিয়ে নেয়। সেখানে সে সহজলভ্য সব যন্ত্রপাতি দিয়ে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষনা’ প্রচার করে। চট্টগ্রামে সাহায্য পৌছোনোর আগ পর্যন্ত আর কিছুই করার ছিল না।
জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেইন সেনাদের অগ্রগতি থেমে যাবার খবর পান পরদিন মাঝরাত থেকে আরো ৫০ মিনিট পর। তিনি বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শফি’কে জলপথ ধরে, ব্রীজ ছেড়ে দ্রুততম সময়ের মাঝে চট্টগ্রাম অভিমূখে অগ্রসর হতে বলেন। কেননা এলাকাটি ছিল প্রচন্ড শত্রুভাবাপন্ন। কিন্তু বিগ্রেডিয়ার শফি অগ্রসর হতে পারেন নি। তিনি পরদিন সকাল ১০ টা নাগাদ এগোতে শুরু করেন। কিন্তু পুনরায় কুমীরা’য়, চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে গোলাগুলির সম্মূখীন হন। অগ্রগামী দলের কমান্ডিং অফিসার সহ প্রায় ১১ জন হতাহত হয়। সেনাদলটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার (কুমিল্লা) ও ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার (ঢাকা) উভয় স্থানের সাথেই যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে।
সৈন্যদলের ব্যাপারে তথ্যের ঘাটতি ঢাকায় প্রচন্ড উদ্বেগের জন্ম দেয়। তাদেরকে কি নৃশংস ভাবে হত্যা করা হল? যদি তাই হয় তাহলে চট্টগ্রামের ভবিষ্যত কি? এটা কি বিদ্রোহীদের দখলেই থাকবে? শত্রুদের দখলেই যদি থাকে, তাহলে কি পাওয়া গেল ‘অপারেশন সার্চলাইট’ থেকে?
পরদিন জিওসি আর্মি হেলিকপ্টার নিয়ে নিজেই হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদলটি খুজতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম যাবেন সেখান থেকে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রোড অনুসরন করবেন। এর মাঝে সেনাদলটি যদি অগ্রসর হতে পারে, সেটা হয়ত তিনি চট্টগ্রামের আশপাশে দেখতে পাবেন। তার হেলিকপ্টারটি উড়ে ২০ বেলুচ এলাকায়, চট্টগ্রামে পাহাড়ের উপর নামার মুহুর্তে বিদ্রোহীদের অস্ত্রের সম্মুখীন হয়, যারা উচু স্থানে অবস্থান নিয়েছিল। হেলিকপ্টারটি আঘাতপ্রাপ্ত হলেও কোন ক্ষতি হয় নি। এটি নিরাপদেই অবতরণ করে। জিওসি’কে নামিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফাতিমি চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে দ্রুত ব্রিফ করেন। কর্ণেল বিজয়ীর মত ইস্ট বেংগল সেন্টারে তার সাফল্য বর্ননা করতে থাকেন, যেখানে প্রায় ৫০ জনকে হত্যা ও ৫০০ বিদ্রোহীকে আটক করা হয়। যদিও চট্টগ্রামের বাকী অংশ বিদ্রোহীদের সাথেই ছিল।
জিওসি যখন খোজ চালানোর উদ্দ্যেশ্যে হেলিকপ্টারে ফিরছিলেন তখন বাচ্চা কোলে নিয়ে এক ভয়ার্ত মহিলাকে দেখেন। মহিলাটি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের একজন অফিসার এর স্ত্রী, যিনি উদ্ধার পেয়ে ঢাকা যেতে চাচ্ছিলেন। তাকে সাথে নেয়া হয়।
হেলিকপ্টারটি ছিল অন্যতম সেরা পাইলট মেজর লিয়াকত বোখারী’র দক্ষ হাতে, আর তার সহকারী ছিল মেজর পিটার। তারা জিওসি’কে নিয়ে কুমিল্লা রোড বরাবর উড়ে যায়, কিন্ত মেঘের কারনে নিচে কিছুই দেখা যায় নি। কুমীরা’র ঠিক উপরে পৌছানোর পর জিওসি একটি কোয়ার্টার ইঞ্চি ম্যাপ হাটুর উপর বিছিয়ে নিয়ে পাইলটকে আদেশ দেন হেলিকপ্টারটিকে মেঘের নিচে নামানোর জন্যে। হেলিকপ্টারটি নিচে নামার সময় জিওসি তার ঘাড় বাহিরে বের করা মাত্রই একঝাক বুলেট নীচ থেকে ছুটে আসে। পাইলট অভ্যাসবশতই উপরে উঠে আসে। যদিও তার যানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি বুলেট কপ্টারটির লেজ ঘেষে চলে যায়, অন্যটি ঠিক পেট বরাবর এসে লাগে, যেটা ছিল ফুয়েল ট্যাংক থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। মেজর বোখারী এই ঘটনায় একেবারেই অবিচলিত থেকে জিওসি’কে জিজ্ঞেস করলেন- ‘স্যার, আপনি কি আমাকে আরেকবার চেষ্টা করতে বলবেন?’ ‘না, সরাসরি ঢাকা ফিরে চল।’ মিশনটি ব্যার্থ হয়েছে। সেনাদলটিকে খুজে পাওয়া যায় নি।
অন্যদিকে জেনারেল মিট্টা একটি কমান্ডোদল (পুরোনো ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়ন) আকাশপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে প্রেরণ করেন, যাদের উদ্দ্যেশ্যে ছিল সেই সেনাদলটির সাথে একত্রিত হওয়া। তারা হারিয়ে যাওয়া সেনা বা বিদ্রোহীদের অবস্থান, কারো সম্পর্কেই জানত না। এ কারনে তাদেরকে শুধু নিজেদের সংবাদ দাতাদের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছিল। হঠাতই ক্যাপ্টেন হামিদ নামে একজন বাংগালী অফিসার উদয় হয়। সে এসে কমান্ডো দলের কমান্ডিং অফিসারকে বলে ‘আমি আমার বাবা-মা’র খোজে এসেছি। তারা চট্টগ্রামে থাকেন। আমি ঐ এলাকাটা ভাল ভাবে চিনি। আমি কি গাইড হিশেবে আপনাদের সাথে যেতে পারি?’ তার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
২৭ শে মার্চ কমান্ডোদল লিংক আপ অপারেশন শুরু করে। জিওসি তার ট্যাকটিকাল হেডকোয়ার্টার চট্টগ্রামে স্থানান্তর করেন। সেখান থেকেও ২০ বেলুচ এর একটি দলও একই উদ্দ্যেশ্যে পাঠানো হয়, কিন্তু ভিন্ন রাস্তায়। তিনটি সৈন্যদলের একত্রিত হবার উপরেই এই অপারেশনের সাফল্য নির্ভর করছিল। ২০ বেলুচ তাদের নিজেদের এরিয়া ছাড়ার কিছুক্ষনের মাঝেই বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কমান্ডোদল উদ্দ্যেশ্যের কাছে গিয়ে প্রচন্ড সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাদের সাথে বাংগালী অফিসারটিও ছিল। তবে চট্টগ্রাম কুমিল্লা রোডে পাহার থেকে গুলি শুরু হবার পর তারা আর বেশী অগ্রসর হতে পারে নি। কমান্ডিং অফিসার সহ ১৩ জন সেখানে নিহত হয়। এর মাঝে ছিল ২ জন ইয়াং অফিসার, ১ জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, ও ৯ জন অন্যান্য র্যাংক এর সদস্য। অপারেশনটি প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়।
অন্যদিকে কুমীরা ঘটনার পর বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শাফি সেনাদলের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। কুমিল্লা থেকে প্রেরিত মর্টার তার কাছে পৌছায় ২৭শে মার্চ। ২৮শে মার্চ ভোরে তিনি আক্রমনের পরিকল্পনা করেন। সেই আক্রমনটি সফল হয়েছিল। তিনি সকল বাধা ভেংগে চট্টগ্রামে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। শেষপর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের প্রান্তে হাজী ক্যাম্পে তিনি তার উপস্থিতি জানান দেন, যেখানে হজযাত্রার উদ্দ্যেশ্যে আগে থেকেই জাহাজ প্রস্তুত ছিল।
হাজী ক্যাম্পের পাশেই ছিল ইস্পাহানী জুট মিলস। সেখানে আমাদের সেনারা পৌছবার আগেই বিদ্রোহীদের দ্বারা রক্তের এক নির্মম খেলা মঞ্চায়িত হয়ে যায়। তারা সেখানে ক্লাব বিল্ডিং এর ভেতরে অ-বাংগালী পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের জড়ো করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। আমি কয়েকদিন পর সেই বীভতস দৃশ্য পরিদর্শন করে সেখানে দেয়াল ও মেঝেতে রক্তের দাগ দেখেছিলাম। মহিলাদের পরিধেয় বস্ত্র ও শিশুদের খেলনা সেখানকার রক্তে ভিজে চুপসে গিয়েছিল। পাশের বিল্ডিং এ আমি জমাট বাধা রক্তে শক্ত হয়ে যাওয়া বিছানার চাদর ও ম্যাট্রেস দেখতে পাই।
এতসব ঘটনা যখন ঘটছিল, পাকিস্তান আর্মি তখনও তিনটি সেনাদলের একত্রিত হবার চেষ্টায় রত ছিল। শেষপর্যন্ত ২৯ শে মার্চ তারিখে তারা একত্রিত হয়। এই সুখবরটি রেডিও মারফত ঢাকা পৌছলে অপারেশন রুমে সবার মাঝে স্বস্তির ফিরে আসে। কিন্তু ইস্পাহানী মিলে নির্যাতন হাউজে হতাহতদের জন্যে এটা ছিল অনেক দেরীতে।
চট্টগ্রামে এতক্ষন পর্যন্ত একমাত্র সাফল্য হল আওয়ামীলীগ এর নেতাকর্মীদের দ্বারা ঘেরাও করে রাখা জাহাজ থেকে প্রায় ৯০০০ টন গোলাবারুদ আনলোড করা। ঢাকা থেকে আসা বিগ্রেডিয়ার এম এইচ আনসারী হাতের কাছে থাকা সকল রিসোর্স একত্রিত করেন। এর মাঝে ছিল একটি ইনফ্যান্ট্রি প্লাটুন, কিছু মর্টার, ও দুটি ট্যাংক। এদের সকলকে নিয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। নেভী একটি ডেস্ট্রয়ার ও কিছু গানবোট দিয়ে সাহায্য করে। অবিশ্বাস্য দক্ষতার মাধ্যমে তিনি এই সাফল্য অর্জন করেন। পরবর্তীতে আরো একটি ব্যাটালিয়ন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে যোগ দেয়।
যদিও রিসোর্স জড়ো করার ব্যাপারে অবস্থার উন্নতি ঘটছিলি, চট্টগ্রামের মূল যুদ্ধ এখনও বাকী রয়ে গিয়েছে। কেননা তখনও রেডিও ট্রান্সমিটারস, ইপিআর সেক্টর হেডকোয়াটার্স ও জেলা জজ এলাকায় রিজার্ভ পুলিশ লাইন খালি করা বাকি ছিল। এই এলাকাগুলোতে পুলিশ, সাবেক চাকুরিজীবিগণ ও সশস্ত্র নেতাকর্মীরা জড়ো হয়েছিল।
জেনারেল মিট্টা প্রথম ব্যাক্তি যিনি ট্রান্সমিটার বিল্ডিং এ যাবার প্রয়োজনীতা অনুভব করেন। বিল্ডিংটি উড়িয়ে দেবার জন্যে তিনি একটি কমান্ডো দল পাঠান। তার দলটি লক্ষ্যের উদ্দ্যেশ্যে নদীপথে পাশ থেকে অগ্রসর হয়। নৌকায় থাকা অবস্থায়ই তারা প্রচন্ড গোলাগুলির সম্মুখীন হন। ১৬ জন সেখানে মারা যায়। মিট্টা’র দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও ক্ষয়ক্ষতির সম্মূখীন হয়ে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়।
এরপর মেজর জেনারেল খাদিম, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফাতিমি’র নেতৃত্বে ২০ বেলুচ এর একটি দল প্রেরণ করেন। ফাতিমি যাত্রাপথে আবারও বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পরে আর কখনই তিনি ট্রান্সমিটার বিল্ডিং এ পৌছুতে পারেন নি। অবশেষে ঢাকা থেকে আসা এফ-৮৬ এর সাহায্যে সেটা উদ্ধার করা হয়। আমি কয়েকদিন পর স্থানটি পরিদর্শন করেছিলাম। I found the building well fortified with pillboxes and foxholes-all are interconnected with a fine network of trenches. বিল্ডিংটি অক্ষত ছিল।
আরেকটি অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস হেডকোয়ার্টার, যেখানে প্রায় ১০০০ সশস্ত্র বিদ্রোহী সুরক্ষিত অবস্থানে ছিল। জমি থেকে উচু স্থানে ঢাল বরাবর আড়ায়াড়ি ভাবে হালকা অস্ত্র ব্যবহারের উপযোগী ছিদ্র করে তারা দুর্দান্ত ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আমাদের বাহিনী এ ব্যাপারটি জানত, তাই তাদের প্রতিহতের জন্যে সর্বোচ্চ প্রস্তুতিই নিয়েছিল। আক্রমনের জন্যে বাহিনীটি ছিল প্রায় এক ব্যাটালিয়নের সমপরিমান শক্তিশালী। তাদের সাথে সাপোর্ট হিশেবে ছিল নেভাল ডেস্ট্রয়ার, দুটি গানবোট, দুটি ট্যাংক ও একটি হেভী মর্টার। বেপরোয়া সেই বিদ্রোহীদের দমন করতে প্রায় তিনঘণ্টা যুদ্ধ করতে হয়। এটা ঘটে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর ৬ষ্ঠ দিন, ৩১শে মার্চ তারিখে।
আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল রিজার্ভ পুলিশ লাইন্স, যেখানে বিদ্রোহীদের ব্যবহারের জন্যে প্রায় ২০,০০০ হাজার রাইফেল সংগ্রহ করার খবর পাওয়া যায়। সেখানেও একটি পূর্ণাংগ ব্যাটালিয়নের সমপরিমান শক্তি নিয়ে আক্রমন করা হয়। এক্ষেত্রে বিদ্রোহীরা ইপিআর সদস্যদের মত দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে নি। দ্রুতই তারা কাপ্তাই রোড বরাবর পিছিয়ে যায়।
উল্ল্যেখিত স্থানগুলোতে প্রতিরোধ দমনের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন বিগ্রেডিয়ার আনসারী। তার এই সাহসীকতার জন্যে তাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্বের পদক ‘হিলাল-ই-জুরুত’ পদকে ভূষিত করা হয়। এবং পরবর্তীতে তাকে পদোন্নতি দিয়ে ‘মেজর জেনারেল’ করা হয় (যদিও ইতোপূর্বে তাকে দমিয়ে রাখা হয়েছিল)।
চট্টগ্রামের মূল অপারেশন শেষ হয় মার্চ এর শেষ নাগাদ, কিন্তু পুরো একশন চলে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত। কুষ্টিয়া ও পাবনা ছিল অন্য দুটি শহর যেখানে তখনও বিদ্রোহীদের প্রাধান্য ছিল। চলুন দেখা যাক সেখানে আমাদের সেনারা কিভাবে অগ্রসর হয়েছিল।
কুষ্টিয়া, যশোর থেকে প্রায় ৯০ কিমি দূরবর্তী, সড়ক ও রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। আমাদেএ সেনারা সেখানে স্থায়ীভাবে ছিল না। আমাদের অবস্থান সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে পরদিন ২৭-বেলুচ একটি কোম্পানি সেখানে পাঠানো হয়। আমাদের কোম্পানি তখন শুধুমাত্র কিছু হালকা অস্ত্র, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও সীমিত পরিমান গোলাবারুদ সাথে নেয়। তারা ভেবেছিল এটা ছিল শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটি। সেনাদের কেউ ভারী সংঘর্ষে জড়ানোর কথা চিন্তা করেনি।
কোম্পানি কমান্ডার তার জনবলকে দুটি ছোট ভাগে ভাগ করে দেন। এবং তাদেরকে রেডিও স্টেশন ও ভিএইচএফ স্টেশন পাহাড়ায় পাঠান। এছাড়া একটি ছোট দলকে তিনি স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাদের গ্রেফতার করতে পাঠান, যদিও সেই সব নেতাদের সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিনেই পাচজন বিদ্রোহীকে হত্যা করে তিনি তার উপস্থিতি জানান দেন। পরবর্তীতে শুধুই কার্ফিউ প্রয়োগ ও বেসামরিক লোকদের কাছ থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। দুই দিন শান্তিপূর্ণভাবে কেটে গেল।
২৮শে মার্চ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে স্থানীয় পুলিশের সুপারিটেন্ডেন্ট ভয় ও আতংকে ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে কোম্পানী কমান্ডার এর নিকট হাজির হয়। মেজর শোয়েব জানায় বিদ্রোহীরা কুষ্টিয়া থেকে ১৬ কিমি দূরে সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলায় জড়ো হয়ে আক্রমনের পরিকল্পনা করছে। এমনকি তারা সহযোগীদেরকেও হত্যার হুমকি দিচ্ছিল। কোম্পানী কমান্ডার এই খবর তার প্লাটুনের সবার মাঝে পৌছে দিলেও সেনারা এটাকে গুরুত্ব দেয় নি। এমনকি তারা তাদের নিরাপত্তা পরিখাও খনন করে নি।
আক্রমনটি শেষ পর্যন্ত করা হয় ভোর পৌনে চারটায় (২৯শে মার্চ), সাথে ছিল ভারী মর্টার এর গোলা। এই ঘটনা আমাদের সেনাদের নিরাপত্তা বিভ্রমকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়।
দ্রুতই তারা বুঝতে পারে আক্রমনকারীরা আর কেউ নয় বরং ১ম ইস্ট বেংগল। তাদেরকে কিছুদিন আগেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাঠানো হয়। তারা চুয়াডাঙ্গা গিয়ে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর সাথে যোগ দেয়। (যশোর ও সিলেটের কাছ থেকে যথাক্রমে ৪জন ও ২ জন বিএসএফ সদস্যকে আটক করা হয়)
যুদ্ধের চেহারা এমন ছিল যে আমাদের সেনারা আগেই পুলিশ অস্ত্রাগার দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা পাশেই স্থানীয় জজের তিন তলা লাল বিল্ডিং বেয়ে উঠে পড়ে, এবং সেটাকেই একটা সুবিধাজনক অবস্থান হিশেবে ব্যবহার করে। সেখান থেকে তারা পুলিশ বিল্ডিং এর দিকে একনাগাড়ে গুলি ছুড়তে থাকে। ভোর হতে হতে পাচ জন নিহত হয়। সকাল ৯টা নাগাদ নিহতের সং্খ্যা দাড়ায় ১১তে। পরবর্তী আধঘন্টায় মারা যায় আরো ৯জন। অল্প কয়েকজন তখন সেখান থেকে হাফ-কিলোমিটার দূরে কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে বেচে ফিরতে পেরেছিল। গোলাবারুদের স্বল্পতা ও সাহায্যের অভাবই ছিল এই ক্ষয়ক্ষতির মূল কারন।
অন্যদিকে কুষ্টিয়া শহরেও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও ভিএইচএফ এক্সচেঞ্জ একইভাবে প্রচন্ড আক্রমনের সম্মূখীন হয়। তাই কোন অংশই অপর দলকে সাহায্য করতে পারেনি। কোম্পানি হেডকোয়াটার্সে এক জায়গায় ১১ জন ও অন্য জায়গায় ১৪ জন মারা যায়। সর্বোপরি ৬০ জন সেনার মাঝে ২৫ জন নির্মমভাবে মারা যায়। যশোরের উদ্দ্যেশ্যে তীব্র সাহায্য এমনকি এয়ার স্ট্রাইক’ও চেয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু কুষ্টিয়ায় কিছুই পৌছে নি। যশোর থেকে সর্বশেষ যেই ম্যাসেজটি আসে তার শেষ কথাগুলো ছিল- ‘এখানকার সেনারা এখন দৃড়প্রতিজ্ঞ। আপাতত কোন সাহায্য সম্ভব নয়। পরিস্কারভাবে দেখা না যাবার দরুন এয়ার স্ট্রাইক বাতিল করা হয়েছে… খোদা হাফিজ।’
মেজর শোয়েব তার সেনাদের বাকী সকলকে জড়ো করেন। তিনি দেখতে পেলেন তার ১৫০ জন সেনার মাঝে মাত্র ৬৫ জন বেচে ফিরতে পেরেছিল। তিনি কুষ্টিয়া ছেড়ে বেচে ফেরত আসা সকলকে নিয়ে যশোর যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তার সাথে একটি ৩টনী ট্রাক, ১টি ডজ ও ৬টি জিপ সাথে নেন। বহরটি রাতে রওনা দেয়, আর তার নেতৃত্বে একদম প্রথম জিপে অবস্থান নেন কোম্পানি কমান্ডার। বহরটি কেবলমাত্র ২৫ কিমি যাবার পরই, মেজর শোয়েবকে বহনকারী গাড়িটি সহ সামনের সারির গাড়িগুলো একটি কালভার্টে গিয়ে আটকে পড়ল। কেননা সেটি আগে থেকেই বিদ্রোহীরা কেটে রাখে। বহরটি থামামাত্রই এটি প্রচন্ড গুলির সম্মূখীন হয়। আমাদের সেনারা সাথে সাথে মাটিতে নেমে লুটিয়ে পড়লেও বৃষ্টির মত গুলি আসতেই থাকে। ৬৫ জনের মাঝে মাত্র ৯জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও তাদের অধিকাংশদের পরে আটক করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।
অন্যদিকে পাবনায় ঘটনার অনেক কিছুই কুষ্টিয়ার ক্ষয়ক্ষতির সাথে মিলে যাচ্ছিল। এখানে ২৫ পাঞ্জাব এর একটি কোম্পানি পাঠানো হয় রাজশাহী থেকে। তাদের প্রধান কাজ ছিল শুধু নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়া। তিন দিনের রেশন আর ফার্স্ট লাইন কিছু অস্ত্র নিয়ে ১৩০ জনের একটি দল পাবনা পৌছে। পাবনা পৌছেই কোম্পানিটি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পাওয়ার হাউজ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এর মত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় অবস্থান নেয়। তারা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় হানা দিলেও কাউকেই খুজে পায় নি। কোম্পানিটি কোন প্রতিরোধ ছাড়াই সেখানে অবস্থান নিশ্চিত করেছিল, আর প্রথম ৩৬ ঘন্টা নিরাপদেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু ২৭শে মার্চ সন্ধ্যা ৬টার দিকে সকল পোস্টের উদ্দ্যেশে প্রচন্ড গুলি শুরু হয়। বিদ্রোহীদের দলে ছিল ইপিআর (৯০০জন), ৩০ জন পুলিশ ও আওয়ামীলীগের ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক। তারা আমাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানত না। তাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তারা আমাদের উপর আঘাত করতে থাকে। আমাদের পক্ষ পাল্টা জবাব দিলেও গোলাবারুদের স্বল্পতার কারনে সে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল। একজন এনসিও (নন কমিশন্ড অফিসার) ও অন্য র্যাংকের আরো দুইজন প্রাথমিক সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে আহত হয়।
ক্যাপ্টেন আসগর’কে অনবরত একজন বিদ্রোহী হালকা মেশিনগান থেকে গুলি করে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন তাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকজনকে সাথে নিয়ে সে তার অবস্থান পরিবর্তন করে। সে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়ার চেষ্টা করলে সেটি পোস্টের ভেতরেই বিস্ফোরিত হয়। একইসাথে মেশিনগান এর একটি গুলি তাকে আঘাত করে। মারাত্মকভাবে আহত হয়ে গেইটের পিলার এর পেছনে আশ্রয় নিলে সেটি তার উপরই ভেংগে পড়ে। আক্রমনটি গুটিয়ে ফেলা হয়। লেফটেন্যান্ট রশিদ এর এমন আরো একটি প্রচেষ্টাও তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ব্যার্থ হয়ে যায়।
এদিকে একমাত্র টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ব্যাতীত সকল পোস্টই আক্রমনের শিকার হয়। বিদ্রোহীরা পুনরায় একত্রিত হয়ে সেখানে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমন করে। আমাদের প্রতিরোধকারী সেনারা তাদের বোকামী বুঝতে পারলেও ততক্ষনে অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। তাদের মারাত্মক মূল্য দিতে হয়েছিল সেখানে। ২জন অফিসার, ৩ জন জেসিও ও অন্যান্য পদবীর ৮০ জন সেখানে প্রান হারায়। আরো একজন অফিসার ও অন্যান্য পদবীর প্রায় ৩২ জন মারাত্মক আহত হয়। বারবার সাহায্য চাইবার প্রেক্ষিতে আহতদের উদ্ধারে একটি হেলিকপ্টার আসলেও সেটি মাটিতে নামতে পারেনি। অন্যদিকে মেজর আসলাম সাহায্য করতে কোনরকমে রাজশাহী থেকে পাবনা আসতে সক্ষম হন। ১৮ জন সৈন্যসহ তার সাথে ছিল একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, একটি মেশিনগান এবং কিছু গোলাবারুদ। আহতদেরকে তিনি একটি গাড়িতে তুলে রাজশাহীতে অন্য পথে পাঠিয়ে দেন। আর সুস্থ-সবল বাকী সেনাদের তার সাথে নিয়ে নেন রাজশাহীতে ফেরার সময় পথে তার সাথে যুদ্ধ করার জন্যে। কিন্তু পথে প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে তিনি তার দল নিয়ে গ্রামের পথ বেছে নেন, যেখানে তাদেরকে তিনদিন কোন খাবার ও পানি ছাড়া কাটাতে হয়েছিল। সৈন্যদলটি শেষপর্যন্ত পহেলা এপ্রিল সকাল দশটায় রাজশাহীতে পৌছে। তবে মাত্র ১৮ জন সৈন্য ব্যারাকে ফিরতে পেরেছিল। মেজর আসলাম সহ বাকি সেনারা পথেই নিহত হন।
এভাবেই চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ও পাবনা শহরে আমরা সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হই। এই শহরগুলো যথাক্রমে ৬, ১৬ ও ১০ই এপ্রিল দখলে আসে। অন্যান্য এলাকা যেখানে আমাদের শক্তি বেশি ছিল, সেখানে কোন ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই আমাদের সেনারা দখল নেয়।
বিদ্রোহীরা শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের হত্যা করেই ক্ষান্ত দেয় নি। বরং তারা বেসামরিক লোকজনদের উপরেও চরম নির্মমতা দেখায়। এখানে সব বলা সম্ভব না হলেও এই বিষয়ে অন্তত একটি ঘটনা আমি উল্ল্যেখ করতে চাই।
২ ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট এর অবস্থান তখন ছিল ঢাকা থেকে ৩০ কিমি উত্তরের স্থান জয়দেবপুরে। সেখানে তখন বেশ কিছু প্রতিভাবান অফিসার,জেসিও ও এনসিও (টেকনিক্যাল ট্রেডস) কর্মরত ছিলেন। সাধারন পরিকল্পনার অংশ হিশেবে তখন ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে দূরে রাখা হয়। কেননা তাতে পশ্চিম পাকিস্তানি ইউনিটের সাথে ঝামেলায় জড়ানোর সম্ভাবনা ছিল। ২ ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট এর তিনটি কোম্পানি ট্রেনিং এর জন্যে টাংগাইল, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ চলে যায়। চতুর্থ কোম্পানিটি জয়দেবপুরে একটি প্রাসাদ ভবনে অবস্থিত ব্যাটালিয়ন হেডকোয়াটার্সে রয়ে যায়। এইটা সেই একই জায়গা যেখানে আমি ‘৭০ এর ফেব্রুয়ারীতে বর্ণিল পুরস্কার বিতরণ দেখেছিলাম।
২৮শে মার্চ, অন্যান্য বাংগালী ইউনিট থেকে খবরের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নটি বিদ্রোহ করে বসে। আদর্শগত অবস্থান পরিবর্তনের পরই তাদের প্রথম কাজ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্মম ও অবৈধভাবে হত্যা করা। একজন সুবেদার, সুবেদার আইয়ুব যিনি প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিল, কোনরকমে তাদের নির্যাতন থেকে পালিয়ে এসে ২৮শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছায়। সেই প্রথম সবাইকে এই খবর দেয়। হেডকোয়ার্টারে পৌছুবার পর আমি তাকে দেখলাম। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ছিল। সেই সাথে তার শুকনো ঠোটের দুই পাশটাও সাদা হয়ে ছিল। সবাই তাকে অনবরত প্রবোধ দিতে থাকলেও কোন পরামর্শ শোনা বা এক কাপ চা নেবার জন্যেও সে তৈরি ছিল না। সে সাহায্যের জন্যে প্রার্থনা করতে থাকল, তাতক্ষনিক সাহায্য।
পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এর কোম্পানি পাঠানো হয়। শক্তিবৃদ্ধির জন্যে প্রেরিত সেই সৈন্যদলের সাথে কিছু তরুন অফিসার স্বপ্রনোদিত হয়ে যোগ দেয়। কিন্তু সেনাদল ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে প্রবেশের পর জীবনের সবচেয়ে লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে। ময়লার একটি ঢিবির মত করে পাচটি শিশুর মৃতদেহ পড়ে ছিল। তাদের সবাইকে অংগহানি করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বেয়নেট দিয়ে তাদের পেট খোঁচানো পাওয়া যায়। সেই বাচ্চাদের মা’দের লাশ অন্য একটি ঢিবিতে জবাই করা ও বিকৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সুবেদার আইয়ুব সেইসব লাশের মাঝ থেকে তার পরিবারের সদস্যদের সনাক্ত করে। এই ঘটনার পর মানসিক ধাক্কায় সে আক্ষরিক অর্থেই পাগল হয়ে যায়।
প্যালেস কম্পাউন্ড এর ভেতরে ওয়্যারলেস সেট সহ একটি জিপ পার্ক করা ছিল। কিন্তু জিপের টায়ার ছিদ্র ছিল আর গাড়ির সিটগুলো ছিল রক্তে চুপসে যাওয়া। ওয়্যারলেস সেটের উপরেও ছিল ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। বিল্ডিং এর ভেতরে খোঁজাখুঁজি শুরু করার পর একটি বাথরুমে রক্তমাখা কাপড় পাওয়া যায়। পরবর্তীতে এই কাপড় গুজরানওয়ালা’র ক্যাপ্টেন রিয়াজ এর বলে চিহ্নিত হয়। অন্যান্য র্যাংকের ফ্যামিলি কোয়ার্টার এর ভেতরে তারা একটি নারীকে মৃত পরে থাকতে দেখে, যেখানে একটি শিশু সেই নারীর বুকের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছিল। অন্য একটি কোয়ার্টারে চার বছর বয়সী ভয়ার্ত একটি মেয়েকে পাওয়া যায়। সেনাদের পাশে বসেই ‘আমাকে মেরে ফেল না, আমার বাবা বাসায় আসার আগে দয়া করে আমাকে মেরে ফেল না’ বলে মেয়েটি কান্নাকাটি করছিল। তার বাবা আর কোনদিন বাসায় ফিরে আসে নি।
সব স্টেশন থেকেই এমন একই রকম খবর আসছিল। তাদের কিছু কিছু শুনতে খুবই অতি-নাটকীয় শোনালেও তার সবই ছিল নির্মম সত্য।
কয়েক মাস পর পাকিস্তান আর্মি’র চীফ অফ স্টাফ জেনারেল হামিদ আমাকে বলেন এরকম সকল ফলাফলের দায়ভার অবশ্যই লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব এর উপর বর্তায়। কেননা সে মার্চের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের এখানে পৌছুনোর বিরোধিতা করে। সে যদি আমাদের সময়মত সৈন্যদের প্রস্তুত করতে দিত, তাহলে প্রধান শহরে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা নি:সন্দেহে এমন বন্য হত্যা প্রতিরোধ করতে পারত।
উল্ল্যেখ করা যেতে পারে জেনারেল ইয়াকুব কোন প্রকার বাধা না থাকা সত্ত্বেও কুতসিত ভাবে আর্মি ক্র্যাক ডাউন এর বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন। এভাবেই অপারেশন গ্রেট ফ্লাইন খুব দ্রুত শুরু হয়ে যায় (২৬শে মার্চের আগে নয়)। আগত সেনাদের চাপের মুখে দ্রুতই বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মূল শহরের অবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে রাজ্যের অন্যান্য শহরেও শক্তিশালী সেনাদের দল পাঠানো শুরু হয়। এখানে আমি একটি দলের যাত্রা সম্পর্কে বলতে চাই, যেই দলটি পহেলা এপ্রিল ঢাকা থেকে টাংগাইল যাচ্ছিল। আমি তাদের সাথে ছিলাম। ট্রাকভর্তি সেনাদের মূল দলটি মেশিনগান সমেত রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে, যেখানে অন্যদুটি কোম্পানী প্রায় ৫০০ মিটার দূরত্ব রেখে রাস্তার দুই ধার দিয়ে তাদের অনুসরণ করতে থাকে। জীবিত বা মৃত বা সম্ভাব্য যে কোন কিছুর জন্যেই তারা প্রস্তুত ছিল। তাদের ক্রোধ থেকে কোন কিছুরই রেহাই ছিল না। ইনফ্যান্ট্রি দলটির পেছনে স্থাপিত হালকা কামান থেকে যাত্রা অভিমুখে কিছুক্ষন পরপর গোলা নিক্ষেপ করা হয়। কামানের এই গর্জন রাস্তা থেকে বিদ্রোহীদের ভীত সন্ত্রস্ত করে সরিয়ে দেবার জন্যে ছিল যথেষ্ট।
ইনফ্যান্ট্রি দলটি সামান্যতম অজুহাত বা সন্দেহ হলেই আর চুপ থাকে নি। গাছের নড়াচড়া অথবা আশপাশের বাড়ি থেকে আসা সামান্য আওয়াজই তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র অথবা অন্তত রাইফেলের গুলি ছোড়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। আমি করতোয়া থেকে একটু আগে টাংগাইল রোডের একটি ঘটনা মনে করতে পারি। সেখানে খুব ছোট একটি জনবসতি ছিল, যার আদৌ হয়ত কোন নাম ছিল না। কয়েকজন সেনা সেখানে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে খড়ের তৈরি কুঁড়েঘর ও তদসংলগ্ন বাশাঝাড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর তারা কিছুদুর সামনে এগোতেই গরমে উত্তপ্ত হয়ে প্রচন্ড শব্দে বাশগুলো ফাটতে শুরু করে। কিন্তু সবাই এই শব্দকে লুকিয়ে থাকা কোন ‘শয়তান’ এর রাইফেলের গুলি বলে ধরে নেয়। ফলাফল সরুপ গোটা সেনাদলের মনযোগ সেই গ্রামের মধ্যে নিবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং সকল প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছোড়া হয়। হুমকির উতস দমন হবার পর আদেশ দেয়া হয় সাবধানে পুরো এলাকা খোজার জন্যে। এলাকাটা খোঁজাখুঁজির সময় সেনারা দেখামাত্রই সেই ‘শয়তান’কে গুলি করার প্রস্তুতি নিয়ে ছিল। কিন্তু সেখানে জীবিত বা মৃত কোন জনমানুষের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। এটা ছিল আসলে বাশ থেকে আসা শব্দ যার কারনে সেনাদের অগ্রসর হওয়া প্রায় ১৫ মিনিট থেমে যায়।
করতিয়া ছিল ঘন ও বণ্য গাছে ঘেরা একটি লাজুক শহর। সেখানের উল্ল্যেখযোগ্য জিনিস হল একসারি দোকানের স্থানীয় বাজার। মানুষজন তাদের বাড়ি ফেলে চলে গিয়েছে। তারা সবাই কোথায় গেল? এটা তদন্ত করা কঠিন ছিল। সেনারা সেখানে থেমে এলাকাটা ঘুরে দেখে, ফিরে আসার সময় তারা বাজারটা পুড়িয়ে দেয় এবং কিছু কেরোসিন এর ড্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। দ্রুতই এটা অগ্নিকান্ডে রূপ নেয়। ধোয়ার কুন্ডলী সবুজ গাছের শাখাপ্রশাখা ভেদ করে উপরে যেতে থাকে। সেনারা তাদের প্রচেষ্টার ফল দেখতে অপেক্ষা না করে দ্রুতই সামনে অগ্রসর হয়। শহরের অন্য প্রান্তে এসে আমি দড়ি দিয়ে বাধা একটি মেষশাবক দেখতে পাই,যার ঘর আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। সে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে অনবরত চেষ্টা করলেও কোন ফল হচ্ছিল না কেননা তার ঘাড়ের চারপাশে দড়ি দিয়ে আটকানো ছিল। উপরন্তু প্রতিবার চেষ্টায় সেটা আরো শক্তভাবে তার গলায় আটকে যেতে থাকে। ও অবশ্যই নিজেই নিজেকে শ্বাসরোধ করে মারবে।
আরো কিছু কি.মি. সামনে এগোনোর পর আমরা রাস্তার পাশে ভি-আকৃতির দুটি তাবু দেখতে পাই, যেগুলো কেবলই খোড়া হলেও দ্রুতই ছেড়ে যাওয়া হয়েছে। সম্ভবত বিদ্রোহীরা এখানে আমাদের মুখোমুখি হবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল কিন্তু গোলাগুলির শব্দে এলাকা ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ যাই হোক না কেন, সেনারা এলাকাটি পরিস্কার না করে এগোতে পারে না। সেনারা যখন এলাকাটি’তে তল্লাশি চালাচ্ছিল, আমি তখন এখানকার মানুষ কিভাবে বাস করে তা দেখার জন্যে একটি মাটির তৈরি কুড়েঘরে ঢুকলাম। সেখানে দেখি ঘরের ভেতরের দেয়ালটা হালকা ধূসর রংের পরিস্কার মাটির আবরন দিয়ে আচ্ছাদিত। ঘরের দেয়ালে দুটি বাচ্চার ছবি ঝোলানো ছিল, সম্ভবত তারা ভাই-বোন। আর ঘরের ভেতর আসবাব বলতে শুধু ছিল একটা চারপায়া আর খেজুর পাতার পাটি। পাটির উপরে একমুঠো সেদ্ধ ভাত পড়ে থাকতে দেখলাম, যেখানে তখনও কারো হাতের ছাপ ছিল। তারা এখন কোথায়? তারা কেন চলে গেল?
আমি হঠাত একটি তর্কের আওয়াজ শুনে এই এলোমেলো ভাবনা থেকে জেগে উঠলাম। তর্কটি হচ্ছিল একজন সৈনিক ও এক বাংগালী সিভিলিয়ান বৃদ্ধের মাঝে, যাকে তারা একটি কলাগাছের নিচে খুজে পায়। সহায়তা না করলে বারবার মেরে ফেলার হুমকি দেয়া সত্ত্বেও বৃদ্ধ লোকটি দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে কোন ধরনের তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। কি ব্যাপার সেটা দেখতে আমি সেদিকে এগিয়ে যাই।
কংকালসার লোকটির কোমরের চারপাশে ময়াল তালিদেয়া একটি লিনেন জড়ানো ছিল। তার দাড়িভর্তি মুখে ছিল ভয়ার্ত চাহনি। আমার চোখ তার অর্ধনগ্ন শরীরের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষন করে ময়লা পা’র ফুলে ওঠা শিরা-উপশিরায় এসে স্থির হল। আমাকে প্রচন্ড কৌতুহলী দেখতে পেয়ে সে আমার দিকে ঘুরে বলতে লাগল “আমি একজন গরীব মানুষ। আমি জানি না আমার কি করা উচিত। কিছুক্ষন আগে তারা (দুর্বৃত্ত’রা) এখানে ছিল। আমি যদি কিছু বলি এই জন্যে তারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যায়। আর এখন আমি যদি কিছু না বলি তাহলে আমাকে আবারও সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি এনে দাড় করাচ্ছ।” এর দ্বারাই সাধারন বাংগালীদের উভয় সংকট অবস্থা স্পষ্ট হয়।
সেনারা তাদের পরিশ্রমী যাত্রা অব্যাহত রাখে। অবশেষে সন্ধ্যায় তারা টাংগাইল পৌছে। সেখানে তারা সার্কিট হাউজে বাংলাদেশের পতাকা পরিবর্তন করে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা টানিয়ে দেয় এবং তাদের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্যে বাতাসে আটটি গোলা ছুড়ে। রাতের জন্যে সেনারা সেখানেই থেকে যায়। আমি ঢাকা ফিরে আসি।
এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ অত্যন্ত উতসাহের সাথে শত্রুপক্ষের একটি বিশ্ব-সংবাদ এ প্রচার হয়, যদিও ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ওর প্রাথমিক সময়ে এমন কিছুই ছিল না। পরবর্তীতে প্রলম্বিত সিভিল ওয়ার এর বিভিন্ন সময়ে এটা বারবারই ঘটতে থাকে। লক্ষ্য অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে ইনফ্যান্ট্রি সেনাদলকে কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সিলেট ও কিছু অন্য এলাকা থেকে পাঠানো হয়েছিল। সেনারা মূলত পাকা রাস্তা ধরে অগ্রসর হয় যেন বিদ্রোহীরা গ্রামের ভেতর দিয়ে সীমানা পার হয়ে যেতে পারে, ফলশ্রুতিতে যেন তারা তাদের ভারতীয় রক্ষাকর্তার হাতে গিয়ে পড়ে। সেনা ও সরঞ্জাম পাবার উপর ভিত্তি করে অভিযানগুলোর দ্রুততা নির্ভর করেছিল।
২৬শে মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল এর মধ্যবর্তী সময়ে অতিরিক্ত লোকবল ও সরঞ্জাম হাতে এসে পৌছে। এই সময়ের মাঝে দুটি ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার (৯ ও ১৬ ডিভিশন), ৫ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারস, ১ কমান্ডো, ১২ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন এসে পৌছে। তারা তাদের সকল ভারী সরঞ্জাম পশ্চিম পাকিস্তানে ফেলে আসে, কেননা তারা মূলত এসেছিল বিদ্রোহ দমন করতে, যুদ্ধ করতে নয়। আরো তিনটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ও দুটি মর্টার ব্যাটারি এসে পৌছে যথাক্রমে ২৪শে এপ্রিল ও ২রা মে। ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস ও ওয়েস্ট পাকিস্তান রেঞ্জার্স এর প্রতিটি থেকে দুটি করে উইং নিয়ে গঠিত প্যারামিলিটারী বাহিনী এসে পৌছে ১০ই এপ্রিল থেকে ২১শে এপ্রিল এর মধ্যবর্তী সময়ে। পাশাপাশি ছিল নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারের উল্ল্যেখযোগ্য সং্খ্যক স্কাউট। তারা মূলত আসে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশের শূণ্য স্থান পূরণ করতে।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সেনাদের দ্বারা শক্তিবৃদ্ধি সম্পন্ন হলে তাদেরকে অপারেশন সার্চলাইট পুরোপুরিভাবে শেষ করার কাজে লাগানো হয়। যদিও সেটা আনুষ্ঠানিক ভাবে কখনই সমাপ্ত হবার ঘোষণা দেয়া হয় নি। এপ্রিল এর মাঝামাঝি সময়ে প্রদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর সুরক্ষিত হবার পর এর উদ্দ্যেশ্য অর্জন হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।
গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো নিম্নবর্ণিত তারিখে সুরক্ষিত হয়:
পাকশী (১০ এপ্রিল), পাবনা (১০ এপ্রিল), সিলেট (১০ এপ্রিল), ঈশ্বরদী (১১ এপ্রিল), নরসিংদী (১২ এপ্রিল), চন্দ্রঘোনা (১৩ এপ্রিল), রাজশাহী (১৫ এপ্রিল), ঠাকুরগাঁও (১৫ এপ্রিল), কূষ্টীয়া (১৬ এপ্রিল), লাকসাম (১৬ এপ্রিল), চুয়াডাঙ্গা (১৭ এপ্রিল), ব্রাক্ষনবাড়িয়া (১৭ এপ্রিল), দর্শনা (১৯ এপ্রিল), হিলি (২১ এপ্রিল), সাতক্ষীরা (২১ এপ্রিল), গোয়ালন্দ (২১ এপ্রিল), দোহাজারী (২২ এপ্রিল), বগুরা (২৩ এপ্রিল), রংপুর (২৬ এপ্রিল), নোয়াখালী (২৬ এপ্রিল), শান্তাহার (২৭ এপ্রিল), সিরাজগঞ্জ (২৭ এপ্রিল), মৌলোভীবাজার (২৮ এপ্রিল), কক্সবাজার (১০মে), হাতিয়া ১১ মে।
এতক্ষন যাবত বর্ণিত অপারেশন সার্চলাইটের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মাঝে ঠিক কত সং্খ্যক মানুষ হতাহত হয়েছে বা নির্যাতন সহ্য করেছে তার সং্খ্যা আমি জোগাড় করতে পারি নি। কিন্তু আমি আমার অনুমানের জোরে সাক্ষ্য দিতে পারি যা সংঘর্ষের ফলে মৃতের সং্খ্যা বড়জোর চারঘর স্পর্শ করতে পারে। এটা বিদেশি বার্তাসংস্থা যারা পৃথিবীকে বিশ্বাস করিয়েছে কয়েক মিলিয়ন মানুষ সেই রাতে মারা গিয়েছে। এর দায় নিতে হবে তাদেরকে যারা ২৬ শে মার্চ সন্ধ্যায় বিদেশি প্রেসকে ব্যাখ্যা করেছে এবং তাদেরকে ভারতীয় প্রচারমাধ্যম বা একগুয়ে পর্যটকদের খামখেয়ালিপনার উপর নির্ভর করতে বাধ্য করেছে। যদি ২৫ শে মার্চের পরে বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করতে দেয়া হত তাহলে তারা দেখতে পেতেন তাদের মাঝে সবচেয়ে পক্ষপাতদুষ্টের বর্ণনায় যে ভয়াবহতা ও লোমহর্ষক ঘটনা উঠে এসেছে, প্রকৃত ঘটনা ছিল তার চাইতে অনেক কম।
.
অনুবাদঃ রাইসা সাবিলা
<৭, ৩, ১৯-২০> ৫০১৪-৫০১৫
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩। সামরিক আইনের দুটি বিধি জারিঃ (রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ও সংবাদপত্রের উপর কঠোর সেন্সরশীপ) | পাকিস্তান অবজার্ভার উদ্ধৃতিঃ ডন( করাচী, ২৬ মার্চ) | ২৯ মার্চ, ১৯৭১ |
সিএমএলএ কর্তৃক প্রচারিত এমএলআর নং ৭৬ এবং ৭৭
করাচী,মার্চ ২৭
সিএমএলএ আজ সামরিক আইনের ৭৬ এবং ৭৭ ধারা জারি করে।
উক্ত ধারাটি মূলত রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং সংবাদ প্রচারণা নিয়ন্ত্রন সম্পর্কিত।
নিম্নলিখিত সামরিক আইনটি পাকিস্তান সিএমএলএ কতৃক গতকাল প্রচার করা হয়।
সিএমএলএ, পাকিস্তান কর্তৃক জারি কৃত এমএলআর, ধারা নং–৭৬
১। প্রকাশ্যে কোন ধরনের সভা বা ধর্মীয় সমাবেশ অথবা কোন ধরনের শোভাযাত্রা বা মিছিল এমনকি বিবাহ শোভাযাত্রা কিংবা শবযাত্রা আয়োজন করা যাবেনা।
২। কেউ এমন কোন সভা, শোভাযাত্রা অথবা মিছিলে অংশগ্রহন বা যোগদান করবেনা যা উল্লেখিত
১ নং বিধিমালা লঙ্ঘন করে।
ব্যাখ্যাঃ এখানে প্রকাশ্যে বলতে যে সকল স্থানের কথা বোঝান হয়েছে সেগুলো হলঃ
ক) কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিল, কারখানা, হাসপাতাল, ক্লাব অথবা অন্য কোন স্থান যেখানে সাধারন মানুষ নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে অথবা বিনামুল্যে প্রবেশ করতে পারে।
খ) সভা অথবা শোভাযাত্রা আয়োজনের উদ্দেশ্যে নির্মিত কোন তাবু অথবা অস্থায়ী কোন ধরনের স্থাপনা।
গ) নির্মাণাধীন ভবন কিংবা ছাদবিহীন কোন স্থাপনার বেষ্টনী অথবা প্রাঙ্গন।
৩। সিএমএলএ কর্তৃক সামরিক আইনের ধারা নং-৬০ এবং ৬১ বাতিল করা হল।
উক্ত বিধিমালা লঙ্ঘন এর সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ বছর সশ্রম কারাদণ্ড.
এ এম ইয়াহিয়া খান
প্রধান জেনারেল কমান্ডার
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং সিএমএলএ
স্থানঃ করাচি।
তারিখঃ ২৬ মার্চ, ১৯৭১।
উল্লেখিত সামরিক আইনটি গতকাল করাচীতে সিএমএলএ, পাকিস্তান কতৃক জারি করে।
সিএমএলএ কর্তৃক প্রচারিত এমএলআর, ধারা নং ৭৭
১। কোন ব্যক্তি অথবা সংবাদপত্র কোন অবস্থাতেই এমন কোন তথ্য অথবা বিশেষ প্রবন্ধ ছাপানো অথবা প্রচার করবে না
ক) যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অথবা বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করে।
খ) যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক আইন জারি, কার্যক্রম বা ধারাবাহিকতার সমালোচনা করে।
গ) যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগনের জন্য সতর্কতা বা নিরাশা সৃষ্টি করে বা করবে বলে বিবেচিত হয়।
ঘ) যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগনের মধ্যে সামরিক বাহিনী, পুলিশ কিংবা সরকারের কোন প্রতিনিধির প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করে বা করবে বলে বিবেচিত হয়।
ঙ) যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের নাগরিকদের কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়, গোষ্ঠী অথবা শ্রেণীর প্রতি বিরোধিতা, বিরাগজনিত উত্তেজনা, বিদ্বেষ অথবা ঘৃণা সৃষ্টি করে বা করবে বলে বিবেচিত হয়।
চ) যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসলাম ধর্মের প্রতি আক্রমণাত্মক বলে বিবেচিত হয়।
ছ) যা প্রত্যক্ষভাবে কায়েদ-ই-আজম এর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
২। কোন ব্যক্তি অথবা সংবাদপত্র কোন অবস্থাতেই এমন কোন তথ্য অথবা বিশেষ প্রবন্ধ ছাপানো অথবা প্রচার করবে না
ক) যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানি কোন রাজনৈতিক দল, নেতা অথবা সদস্যের প্রতি বিদ্বেষ অথবা ঘৃণা সৃষ্টি করে বা করবে বলে বিবেচিত হয়।
খ) এমন কোন রাজনৈতিক বিষয়ে সংবাদ অথবা তথ্য প্রকাশ অথবা প্রচার করবেনা যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনগনের মধ্যে কোন আন্দোলন, উত্তেজনা, হুজুগ, সতর্কতা বা নিরাশা সৃষ্টি করে বা করবে বলে বিবেচিত হয়। এধরনের লিখিত তথ্য বা সংবাদ প্রথমে প্রাদেশিক সরকারে নিয়োজিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনার জন্য দাখিল করতে হবে এবং উক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে বিবেচনা পরবর্তী ছারপত্র আদায় করতে হবে।
৩।সিএমএলএ কর্তৃক জারিকৃত এমএলআর নং ৬, ১৭ এবং ১৯ হতে “লিখিত” এবং “লিখিতভাবে” শব্দসমুহ বাদ দেওয়া হল।
৪। সিএমএলএ কর্তৃক জারিকৃত এমএলআর নং ৫১ নাকচ করা হল।
৫। উক্ত বিধিমালা লঙ্ঘন এর সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।
এ এম ইয়াহিয়া খান
জেনারেল কমান্ডার ইন চীফ
পাকিস্তান আর্মি এবং সিএমএলএ
স্থানঃ করাচী
তারিখঃ ২৬শে মার্চ, ১৯৭১
.
.
শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
৪। পাকিস্তান ভারতের কাছে প্রতিবাদ করেছে | পূর্বদেশ।
উদ্ধৃতিঃ পাকিস্তান টাইমিস (লাহোর) |
৩১ মার্চ, ১৯৭১ |
পাকিস্তান ভারতের কাছে প্রতিবাদ করেছে
২৭শে মার্চঃ- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত এখন যে ভিত্তিহীন ও উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত প্রচার অভিযান চালাচ্ছে, পাকিস্তান এ প্রচারণা বন্ধের দাবী জানিয়েছে। এদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকেও বিরত থাকতে নয়াদিল্লীর প্রতি দাবী জানানো হয়েছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লী বেতারের বর্তমান উদ্দ্যেশ্যমূলক প্রচারণায় পাকিস্তান দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উদ্দ্যেশ্যমূলক ও নগ্ন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করেছে।
আজ সকালে ভারতীয় হাই কমিশনার মিঃ বি,কে,আচার্যকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে পাঠানো হয়।
হাই কমিশনারকে জানানো হয় যে, ভারতীয় পার্লামেন্টে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা করায় পাকিস্তান খুবই আপত্তি জানাচ্ছে। গতরাতে ভারতীয় বেতার বলেছে যে, পার্লামেন্টারী বিষয়ের মন্ত্রী, মিঃ রাজ বাহাদুর পার্লামেন্টকে জানিয়েছেন যে, তাঁর সরকার খুব শিগগিরই পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে বিবৃতি দেবেন।
হাই কমিশনারকে বলা হয়েছে যে, দিল্লীর এসব খবর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক ঘটনার সৃষ্টি করবে। তাঁকে আরও বলা হয়েছে যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন প্রকার হস্তক্ষেপকে পাকিস্তান সতর্কতার সাথে এড়িয়ে গেছে, একথা নয়াদিল্লীর মনে থাকা উচিত।
পশ্চিম বাংলা, নাগাভূমি ও মিজোল্যান্ডের পরিস্থিতির ফলে পাকিস্তানে ব্যাপক মোহাজের এসেছে এবং তাতে করে দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিতেও অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে, এসব ঘটনা সত্ত্বেও এই নীতি মেনে চলা হয়েছে।
ভারতীয় হাই কমিশনারকে এটাও বলা হয়েছে যে, নয়াদিল্লী সরকারের একটা সরকারী প্রতিষ্ঠান হলো ভারতীয় বেতারকেন্দ্র। এ থেকেই পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলক, অতিরঞ্জিত ও প্ররোচনামূলক সংবাদ প্রচার করছে। এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, একদিকে ভারতীয় সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান বলছে যে, তাদের পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানবার কোন যোগসূত্র নেই এবং অন্যদিকে পাকিস্তানকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসে পরিকল্পিত বিস্তারিত খবর প্রচার করছে।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন বিষয়ে ভারত কেমন করে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে এটা দেখানোর জন্যে এ প্রসংগে ভারত সরকারকে লিখিত ১৩,২০ ও ২৪ শে মার্চ প্রেরিত পাকিস্তানী নোটের প্রতি ভারতীয় দূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এবং সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রমাণও হাজির করা হয়।
–পাকিস্তান টাইমস (লাহোর)
.
.
অনুবাদঃ রাইসা সাবিলা
<৭,৫,২২-২৩> ৫০১৭-৫০১৮
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৫। পাকিস্তান ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করেছে
|
পাকিস্তান অবজার্ভার উদ্ধৃতিঃ ডন |
২ এপ্রিল, ১৯৭১ |
পাকিস্তান ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করেছে
৩০ মার্চ, ইসলামাবাদঃ আজ পাকিস্তানি সরকার দেশটির অন্তর্বর্তী বিষয়ে বারবার ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের নিকট তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছে। এই নিয়ে এক সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মত প্রতিবাদ জ্ঞাপন করল পাকিস্তান সরকার এ মর্মে যে, এই হস্তক্ষেপকে একটি বিপদজনক নজির হিসেবে গন্য করা হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।
ইসলামাবাদে অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশনারকে আজ সকালে আবার পররাষ্ট্র কার্যালয়ে তলব করে জানানো হয় যে ভারত সরকার এবং তাদের প্রচার সংস্থা গুলো পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতা স্বত্বেও ক্রমাগত পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে বিদ্বেষপরায়ণ এবং ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে, এবং তাদের এহেন আচরন পাকিস্তান সরকার বিরক্ত ও বিব্রত হচ্ছে।
এপিপি এর এই রিপোর্টে আরও বলা হয়ঃ এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত উদাহরণ উদ্ধৃত করা হয়েছে :১। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কথিত বোমা বর্ষণ।২। এক লক্ষ মানুষ হত্যা।৩। জেনারেল টিক্কা খান গুলিতে নিহত হয়েছেন।৪। শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়নি। ৫। বেলুচিস্তান ও এনডাব্লিউএফপি এর একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা। ভারতীয় সংসদে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিও হাই কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানানো হয় যে তাদের দেওয়া বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নীতি ভঙ্গ করে এবং এধরনের বক্তব্য পাকিস্তানের অন্তর্বর্তী বিষয়ে চরম হস্তক্ষেপের সামিল। ভারতের দুতকে জোরালভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয় যে এধরনের আচরন খুবি বিশ্ময়কর। সরদার স্মরন সিং বলেছেন, ভারতীয় সরকার আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সদস্য বা মানবাধিকার সংস্থাগুলিকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহন করেছে যেন তারা এই সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্থদের ত্রান সরবরাহ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধিও সংসদে বলেছেন যে- “ভারত সমসাময়িক সিধান্ত নিবে, কেননা সময়ের পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন লাভ নেই”। তার এ বক্তব্য উল্লেখ করে জানানো হয় যে এধরনের বক্তব্য অত্যন্ত বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভারতীয় হাই কমিশনারকে আরো জানানো হয়, যে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দীপনা ও উৎসাহেই তাদের সংবাদ মাধ্যম কোলকাতা থেকে সশস্ত্র সেচ্ছাসেবীদের পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত মুক্তিবাহিনিকে সাহায্য করার জন্য পাঠানো অথবা নৌবাহিনী দ্বারা অবরোধ সৃষ্টি করে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাগর পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবার মত চমৎকার সব পরামর্শ প্রতিনিয়ত প্রদান করে চলছে। উপরন্তু, ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল নয়াদিল্লী, কোলকাতা এবং বোম্বেতে অবস্থিত পাকিস্তানি দুতাবাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন করছে এবং সেখান থেকে পাকিস্তানি সরকার ও নেতাদের বিরুদ্ধে চরম মর্যাদাহানিকর স্লোগান দাওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে একি ধরনের ঘটনা পাকিস্তানেও ঘটতে পারে। হাই কমিশনারকে আরো জানানো হয় যে হুগলি নদীমুখে কিছু চোরাগোপ্তা প্রেরকযন্ত্রের কার্যক্রম ধরা পড়েছে, যা হতে পুরো বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য সম্পূর্ণ মিথ্যা রিপোর্ট প্রেরিত হচ্ছে। পাকিস্তানি সরকার আশা প্রকাশ করে যে ভারতীয় সরকার এধরনের আচরন সংবরন করবে এবং প্রতিবেশি দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত সকল নিয়ম মেনে চলবে।-ডন।. অনুবাদঃ রাইসা সাবিলা<৭,৬,২৪> ৫০১৯
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৬। সামরিক বিধান সমুহ পরীক্ষা করে দেখতে পাকিস্তানের আপত্তি নেইঃ অস্ত্র পরিবহনের অভিযোগের জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিভাগের বিবৃতি | পাকিস্তান অবজার্ভার উদ্ধৃতিঃ ডন |
২ এপ্রিল, ১৯৭১ |
সামরিক বিমানের পর্যবেক্ষণের জন্য পাকিস্তান প্রস্তুত কলম্বো, ৩০ মার্চঃ পাকিস্তানী পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সংবাদ সুত্র হতে আজ জানানো হয় যে, সিলনের বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জ্বালানি নেয়ার জন্য অবতরনকারী পাকিস্তানের দুই অংশে যোগাযোগ রক্ষাকারী বিমানসমুহ কেউ অনুসন্ধান করতে চাইলে তারা সাগ্রহে আমন্ত্রন জানাবে। কিছু সংবাদ প্রতিবেদনে গুজব ছড়ানো হচ্ছে যে উক্ত বিমানবন্দরটি পাকিস্তানী সামরিক বিমানবাহিনী অস্ত্র পরিবহনের ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করছে, যেন সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে উঠা প্রতিরোধ সমূলে উৎপাটিত করতে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার এই আহবান জানায়। সিলন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদানকৃত ছাড়পত্রে উল্লেখ করেছে যে, উক্ত সামরিক বিমানগুলো কোন ধরনের অস্ত্র বা গোলাবারুদ বহন করছেনা। -ডন।
.
.
শিরনাম | সূত্র | তারিখ |
৭। রেডিও পাকিস্তানের নয়া ডিরেক্টর জেনারেল | দৈনিক পাকিস্তান
উদ্ধৃতিঃ সরকারি প্রেসনোট |
৭ এপ্রিল, ১৯৭১ |
রেডিও পাকিস্তানের নয়া ডিরেক্টর জেনারেল
রাওয়ালপিন্ডি, ৬ই এপ্রিল। পাকিস্তান সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে, জনাব এস হায়দার জায়েদী টি কিউ এ, সি এস পি সীমান্ত প্রদেশের সরকার থেকে বদলী হয়ে রেডিও পাকিস্তানের নয়া ডিরেক্টর জেনারেল পদে নিযুক্ত হয়েছেন।
রেডিও পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল জনাব মফিজুর রহমান টি কিউ এ, সি এস পি কে পাকিস্তান সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারীর পদমর্যাদা ও বেতনে তথ্য ও জাতীয় বিষয়ক দফতরে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি পদে নিযুক্ত করা হয়েছে।
এ বদলী অবিলম্বে বলবত হবে।
.
.
শিরোনামঃ ৮। পদগর্নির বাণীর জবাবে ইয়াহিয়াঃ অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দেব না
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৭ এপ্রিল, ১৯৭১
.
পদগর্নির বাণীর জবাবে ইয়াহিয়া
“অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দেব না”
ইসলামাবাদ, ৬ই এপ্রিল এপিপি- প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ এম ইয়াহিয়া খান আজ পুনরুল্লেখ করেন যে, পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন দেশকে হস্তক্ষেপ করতে না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প।
সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট এন পদগর্নির ৩রা এপ্রিলের বাণীর জবাবে তিনি বলেন পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত খোলাখুলি ও নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের একটিই মাত্র উদ্দেশ্য- গোলযোগ সৃষ্টির জন্য মুষ্টিমেয় লোককে উসকানি ও বৈষয়িক সাহায্য দিয়ে পরিস্তিতিকে প্রজ্বলিত করে তোলা। কোন শক্তির পক্ষেই এই উদ্যোগকে সমর্থন বা ক্ষমা করার অর্থ হচ্ছে জাতিসংঘ সনদ ও বান্দুং নীতি খেলাপ করা। পাকিস্তানের দিক থেকে পাকিস্তান সর্বদাই এই নীতিগুলি মেনে চলছে।
প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নিজস্ব পথে চলতে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তার নিজের চাইতে বেশী কেউ সচেতন নন এবং এই নীতির প্রতি তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নসহ কোন দেশই জাতিবিরোধী ও অ-দেশপ্রেমিক ব্যাক্তিদের দেশকে ধ্বংস করার ব্যাপারে অগ্রসর হতে দিতে পারে না বা কখনও দেয়নি কিংবা নাশকতামূলক কর্ম সমর্থন করতে পারে না।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে নয়াদিল্লীকে বিরত করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতি ভারতে তার অভ্যন্তরীণ প্রভাব ব্যবহার করার আহ্বান জানান। কারণ উপমহাদেশে শান্তি বজায় ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সোভিয়েট আগ্রহের সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
প্রেসিডেন্টের বাণীর পূর্ণ বিবরণ
আপনার বাণী আমাকে ৩রা এপ্রিল প্রদান করা হয়েছে। স্পষ্টতঃ প্রধান মন্ত্রী কোসিগিনের বাণীর জবাবে প্রদত্ত আমার বাণী আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি এবং আপনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন তা প্রাসঙ্গিক বলে আমি পুনরুল্লেখ করছি।
উক্ত বাণীতে আমি বলেছিলামঃ গত ২৮শে মার্চ করাচীতে নিযুক্ত সোভিয়েট কনসাল জেনারেল আপনার মৌখিক বাণী আমাকে জানিয়েছে। ইতিপূর্বে ঢাকায় নিযুক্ত আপনাদের কনসাল জেনারেল আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলী নিরসনের ব্যাপারে আমার প্রচেষ্টা সম্পর্কে তাকে অবহিত করি।
আপনার বাণীতে বলা হয়েছে যে তা অসমাপ্ত খবরভিত্তিক। আমি আশা করি, মিঃ প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের রাষ্ট্রদূত আপনাকে আমার ২৬শে মার্চের বিবৃতির বিবরণ অবহিত করেছে। উক্ত বিবৃতিতে আমি যে ঘটনাবলীতে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা পাকিস্তানের জনগণের কাছে পেশ করেছি। পাকিস্তানে গনতান্ত্রিক পদ্ধতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা আমার অবিরাম প্রচেষ্টা এবং আমাদের পথে যে সকল অসুবিধা সৃষ্টি হয় সেগুলো নিরসনের জন্য আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। একই সঙ্গে পাকিস্তানের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য রক্ষার জন্য জাতির প্রতি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে আমি সচেতন।
মিঃ প্রধানমন্ত্রী, আমি নিশ্চিত, আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন যে আমি অন্য কোন পথ নিতে পারতাম না। ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে উক্ত লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার কারণে আমি বিশদভাবে বলেছি। পাছে এই বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ আপনি না পান তাই আমার রাষ্ট্রদূতকে আমার বিবৃতির একটি কপি আপনার হাতে দেবার জন্য আমি নির্দেশ দিচ্ছি।
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভালবাবেই নিয়ন্ত্রণ আছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কোন কোন বাইরের সূত্র, বিশেষ করে ভারতীয় তথ্য মাধ্যমে প্রচারিত বিবরণে সঠিক পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয় না এবং বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করাই এর উদ্দেশ্য।
আমি আপনার সাথে একমত যে, এশিয়ার কতিপয় শক্তি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে নিজেদের পক্ষে অনুকূল মনে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও অখন্ডতার প্রতিকূলে বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। সুতরাং সর্বতোভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যাতে কোন হস্তক্ষেপ না ঘটে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো অতীব গুরুত্বপূর্ণ।।
ভারতীয় হুমকি
এই ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারছি না যে, আমরা যখন আমাদের অখন্ডতা রক্ষার জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তখন ভারতীয় মনোভাব আমাদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতৃবর্গ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রকাশ্য বিবৃতি দিচ্ছেন যা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপের সামিল। এইরুপে ভারত এক বিপজ্জনক নজীর স্থাপন করছে যা আন্তর্জাতিক সমাজের সরাসরি উদ্বেগের বিষয়।
আরো গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের অনতিদূরে প্রায় ছয় ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন। এই বাহিনীর মধ্যে গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ছত্রী ব্রিগেড আছে। পশ্চিম বাংলার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা তিন সপ্তাহ পূর্বে সমাপ্ত নির্বাচনের প্রয়োজনের সঙ্গে এর সঙ্গতি নেই।
আমাদের সীমান্ত বরাবর ভারতের সৈন্য সমাবেশ আমাদের নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি হুমকি স্বরূপ। এমত পরিস্থিতিতে আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা ভারতের ওপর আপনাদের অনস্বীকার্য প্রভাব খাটাবেন এবং তাদেরকে (ভারতকে) পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে তেমন কাজ থেকে বিরত থাকার প্রয়োজনটা বুঝিয়ে দেবেন।
পাকিস্তানের ঘটনাবলীতে আপনার উদ্বেগকে অনুধাবণ করে পরিশেষে একটা কথা বলবো যে, আমার লক্ষ্য অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রথম সুযোগেই আমি পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তিবাদী ব্যাক্তিদের সাথে আলাপ শুরু করার ইচ্ছা পোষণ করি।
মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমি আরো বলব যে, যে কোন সরকারই সেই দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতার ওপর আক্রমণকারী ধ্বংসাত্মক ব্যাক্তিদের ক্ষমা করতে পারে না কিংবা পাশ কাটাতে পারে না।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দেশকে খন্ডিত করার কোন ম্যাণ্ডেট পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে পায়নি। তথাপি তারা সক্রিয় শত্রুতায় লিপ্ত এক প্রতিবেশীর বৈষয়িক সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্র বিরোধী ব্যাক্তিদের পাকিস্তানের ঐক্য বিনাশকারী কাজকে উৎসাহ দিয়েছেন।
এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, ক্রমন্বয়ে আইন-শৃংখলা ভেঙ্গে পড়ছিল, নির্দোষ লোকদের সস্ত্রস্ত করা হচ্ছিল, ব্যাপকভাবে ঘরবাড়ি জ্বালানো, লুটতরাজ ও হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। পরিস্থিতির মোকাবেলা করা ছাড়া কোন বিকল্প পথ ছিল না। সরকার যে সব ব্যবস্থা গ্রহন করছেন তা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিকের জান-মাল ও সম্মান রক্ষার জন্যই করেছেন। কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা যে ফ্যাসিবাদী তৎপরতা চালাচ্ছিলেন সে সম্পর্কে কেউই দ্বিমত পোষণ করবেন না।
গণতন্ত্রকে তার নির্ধারিত পথে এগোতে দেওয়ার ব্যাপারে আমার চেয়ে কেউ বেশি সচেতন নন। এবং আমি এই নীতিতে অবিচল রয়েছি। কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নসহ কোন দেশই রাষ্ট্র বিরোধী দেশপ্রেম বিবর্জিত লোকদের দেশ ধ্বংস করার সুযোগ কিংবা নাশকতামূলক কাজ চালানোর সুযোগ কখনো দেয়নি, দিতে পারে না।
আমার দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের মাত্র একটাই লক্ষ্য রয়েছে। তা হলো গোলযোগ সৃষ্টিকারী সামান্য কিছু লোককে উৎসাহ এবং বৈষয়িক সমর্থন দিয়ে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করে তোলা। কোন শক্তি যদি এ রকম তৎপরতাকে সমর্থন করে কিংবা ক্ষমা করে তবে সেটা হবে জাতিসংঘ সনদ ও বান্দুং নীতির পরিপন্থী। পাকিস্তান সব সময় এসব নীতি মেনে চলেছে এবং পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন দেশকে হস্তক্ষেপ করতে না দেয়ার প্রশ্নে দৃঢ় সংকল্প।
তাই আবার সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে আমার আহ্বান, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলান থেকে ভারতকে যেন বিরত করার ব্যাপারে সোভিয়েট ইউনিয়নে ভারতের উপর তার অনস্বীকার্য প্রভাবকে ব্যবহার করে। বস্তুতঃ সেটাই হবে এই উপমহাদেশে শান্তি, শৃংখলা এবং বাধাহীন অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখার সোভিয়েট ইউনিয়নের ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
.
.
শিরোনাম | সুত্রঃ | তারিখ |
৯।জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনার পর আগাশাহীর বিবৃতি | দৈনিক পাকিস্তান | ৭ এপ্রিল, ১৯৭১ |
আগাশাহীর সাথে আলোচনা- পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারঃ থান্ট
জাতিসংঘ, ৬ই এপ্রিল (এ পি পি)। গতকাল জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহীকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বলে মনে করেন। সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের সাথে এক ঘন্টাকালীন আলোচনার পর আগাশাহী এই তথ্য প্রকাশ করেছেন।
গত সপ্তাহে ভারত মৌখিকভাবে যে নোট সদস্য রাষ্ট্রদের জানিয়েছে তিনি তার জবাব দিয়েছেন কিনা- জনাব আগাশাহী সাংবাদিকদের উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেলেন।
আগাশাহী বলেন, তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তিনি ভারতীয় হস্তক্ষেপের কোন দৃষ্টান্ত দিয়েছেন কিনা, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে আগাশাহী বলেন, তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টের ৩১ শে মার্চ (১৯৭১) তারিখের প্রস্তাব, সশস্ত্র ভারতীয়দের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ, পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রবিরোধী লোকদের গোপন অস্ত্রসস্ত্র চালান দেয়ার ব্যবস্থা এবং ভারতীয় নৌবাহিনী কর্তৃক পাকিস্তানের জাহাজ ওসেন এন্ডুরেন্সকে হয়রানির প্রতি উথান্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
সাহায্য সামগ্রী বহনকারী রেডক্রস বিমান (যা করাচী থেকে বৈরুত ফিরছে) সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন , সেক্রেটারি জেনারেল পুরো ব্যাপারটাই অবহিত আছেন। তিনি তাকে বলেছেন, রেসক্রস বিমানটি তার পাকিস্তানে প্রবেশের আবেদনপত্র পাকিস্তান সরকারের হস্তগত হওয়ার আগেই করাচীতে অবতরণ করেছিল।
………………………………
.
.
শিরোনামঃ ১০। পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতি: বে-আ্ইনী অনুপ্রবেশের সকল দায়িত্ব ভারতকেই বহন করতে হবে
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৯ এপ্রিল, ১৯৭১
.
সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানো হচ্ছে
বে-আ্ইনী অনুপ্রবেশের সকল দায়িত্ব ভারতকেই বহন করতে হবে
ইসলামাবাদ, ৮ই এপ্রিল, (এ পি পি)- পাকিস্তান ভারতের কাছে ভারতীয় নাগরিকদের পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ এবং ধ্বংসাত্বক কার্যে লিপ্ত হওয়া অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। এটা যদি না হয়, তাহলে পরিণতির সকল ঝুঁকি ভারতীয় নাগরিকদেরই বহন করতে হবে।
পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার মি: বি, কে, আচার্যকে আজ পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে এনে একথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
এক সরকারী বিবৃতিতে বলা হয়, ধ্বংসাত্বক কাজ করার জন্য পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাস্থ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজশে ভারতীয় নাগরিকদের পাকিস্তানী এলাকায় বে-আইনী অনুপ্রবেশের প্রশ্নে পাকিস্তানের ঘোরতর আপত্তির কথা ভারতীয় হাইকমিশনারকে জানানো হয়।
ভারতীয় হাইকমিশনারকে আরও জানানো হয়, চিকিৎসা ও সাহায্য সামগ্রী নাম দিয়ে সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানো হচ্ছে- এটা পাকিস্তান সরকার জানতে পেরেছে।
পাকিস্তান সরকার পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাস্থ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে পাকিস্তানী এলাকায় ভারতীয় নাগরিকদের বে-আইনী অনুপ্রবেশের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের অব্যাহত হস্তক্ষেপ, ভারতীয় বেতার এবং অন্যান্যা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মারফত পূর্ব পাকিস্তানের পবিস্থিতি সম্পর্কে মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের গভীর উদ্বেগের কথা ভারতীয় হাই কমিশনারকে জানানো হয়।
আজ পররাষ্ট্র দফতরে ভারতীয় হাই কমিশনারকে ডেকে এনে এই প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তাকে আরো জানানো হয়েছে যে, চিকিৎসা ও রিলিফ সামগ্রী নাম দিয়ে সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর বিষয়টি পাকিস্তান সরকারের গোচরে এসেছে।
তাকে বলা হয়েছে: ভারতীয় নাগরিকদের পাকিস্তানী এলাকায় অনুপ্রবেশ এবং সেখানে তাদের ধ্বংসাত্বক তৎপরতা অবিলম্বে ভারত সরকারের বন্ধ করা উচিত। তা না করা হলে, যেসব ভারতীয় নাগরিক এভাবে অনুপ্রবেশ করবে তারা সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বেই করবে। একথাও তাকে বলা হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদপত্রগুলো পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকাসমূহে ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবকদের চলাফেরা এবং সেখানে রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাতের ফলাও বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সংবাদদাতা দুই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের ১০০ মাইল এলাকা ভ্রমণ করেছেন বলে দাবী করেছেন।
অনুরুপভাবে তথাকথিত অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার খবর ভারতীয় সংবাদপত্র ও বেতারে প্রচার করা হয়েছে। ভারতীয় হাই কমিশনারকে এ সব কথাও বলা হয়েছে।
ওষুধ এবং সাহায্য সামগ্রীর নামে সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশের লোকের জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ পাঠানো হচ্ছে। এপিপির কূটনৈতিক সংবাদদাতা এ খবর জানিয়েছে। তিনি লিখেছেন, ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র চালান এবং লোক পাঠানোর কাজটি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেই করা হচ্ছে। এর জন্য পাক-ভারত সীমান্তে এগারোটি প্রবেশ ঘাঁটি খোলা হয়েছে।
গত ৫ই এপ্রিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের চীফ সেক্রেটারীর কথাতেই এর স্বীকৃতি মিলেছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত মোহাজেরদের অভ্যর্থনার সুবিধার্থে ১১টি প্রবেশ পথ খোলা হয়েছে। এছাড়া ৯টি শিবির খোলা প্রকৃত পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে উল্টো দিকে চলাচলের জন্য এসব ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে অনিবার্য ভাবেই ভারত সরকারের দ্বারা অনুপ্রানিত হয়ে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলোতে বর্ষার আগে পূর্ব পাকিস্তানে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবারহের জন্যে ওকালতি করা হচ্ছে।
এদিকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের জনগণের জন্য তহবিল ও সাহায্যে সামগ্রী সংগ্রহের জন্য দিল্লী, কলকাতা, শিলং এ সংস্থা গঠন করা হয়েছে।
গত সোমবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণকে সাহায্য করার কোন ব্যবস্থা আছে কিনা,- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তিনি প্রকাশ্যে কিছুই বলতে পারেন না। অবশ্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ সমর্থন করেছেন- কেননা এগুলো মোহাজেরদের সাহায্য করার কাজে ব্যয় করা যাবে।
শিরোনামঃ ১১। আগাশাহীর প্রতিবাদ: ভারত পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করার চক্রান্ত করছে।
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৯ এপ্রিল, ১৯৭১
.
আগাশাহীর প্রতিবাদ: ভারত পাকিস্তানের
জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করার চক্রান্ত করছে।
জাতিসংঘ, ৮ই এপ্রিল, (এ পি পি)- পাকিস্তান গতকাল ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী রাষ্ট্রের জাতীয় সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা বানচালের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ করে।
পাকিস্তান সরকার এটাকে দুঃখজনক মনে করে যে, ভারত জাতিসংঘ সনদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা সত্ত্বেও সদস্য রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি লংঘন করে জাতিসংঘের অন্যতম ভিত্তিই ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তনী রাষ্ট্রদূত আগাশাহী জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে এক মৌখিক বার্তায় একথা জানান।
ভারতীয় লিপির জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ব সংস্থায় উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম বা পূর্বভারতীয় পরিস্তিতি ওঠার আগে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি উঠতে পারে না। ভারতীয় লিপিতে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি দেশের ভেতরকার আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সমস্যা ন্যায়সংগত ভাবে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্বেগের বিষয় হতে পারে না।
মৌখিক বার্তা প্রদানের মধ্যেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের চেষ্টা সীমাবদ্ধ থাকলে পাকিস্তান সেটা উপেক্ষা করতে পারত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা নষ্ট করার দুরভিসন্ধি ভারতের রয়েছে। জনাব আগাশাহী বলেন, ভারতীয় তথ্য মাধ্যম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে উগ্র প্রচার অভিযান চালিয়েছে এবং কখনো পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্ভট বানোয়াট খবর প্রচার করেছে।
গত ৩১শে মার্চ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয়া হয়। একই দিনে পার্লামেন্টে পূর্ববাংলার প্রতি ভারতের অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়ে এক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
ভারতীয় নেতাদের উস্কানী ও উৎসাহ দানের সরাসরি ফল হিসাবে কলকাতার সরকারী কর্মচারীগণ পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী পাঠাবার ব্যাপারে খোলাখুলি ভাবে উৎসাহ দিচ্ছে। অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই ৯টি ভারতীয় যানবাহনের একটি কনভয়কে পাকিস্তানী এলাকায় শমশেরনগরের দিকে যেতে দেখা যায়। পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনী কনভয়টি ধ্বংস করে দিয়েছে।
জনাব শাহী বলেন যে এমনকি পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে নৌযোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর অবরোধ সৃষ্টির বিষয়ও ভারতীয় সরকারী মহলে আলোচনা হয়। একটি পাকিস্তানী বাণিজ্যতরী যখন পূর্বাঞ্চলে যাচ্ছিল, তখন ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলো তাকে হয়বানী করে। পাকিস্তানী জাহাজটি করাচী ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
গতকাল একটি পাকিস্তানী হাজীবাহী জাহাজ মক্কা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নৌ-বন্দর চট্রগ্রাম যাচ্ছিল। উক্ত জাহাজটিকে ভারতীয় রণতরীগুলো একইভাবে হয়রানী করে।
পাকিস্তানী প্রতিনিধি বলেন যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের নিকটে ছয় ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করেছে। একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় আসার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রচেষ্টার বিবরণ দিয়ে জনাব শাহী বলেন যে, শেষ দফা আলোচনার পর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে কিছুসংখ্যক লোক দেশকে বস্তুতপক্ষে টুকরো টুকরো করতে চেয়েছিল।
দেশকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পূর্ব পাকিস্তানের ১২ জন রাজনৈতিক নেতার এক প্রতিনিধি দল প্রদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় প্রচারণাকে ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, জাতিবিরোধী শক্তিসমূহকে সাহায্য করার জন্য ভারত থেকে যে সকল সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী সাদা পোষাকে এসেছিল, পূর্ব পাকিস্তানের শান্তিপ্রিয় ও দেশপ্রেমিক জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করায় তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গ্রাম থেকে ঢাকায় সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্যের উপর অভিনন্দনযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
.
.
শিরনাম | সূত্র | তারিখ |
১২। ৭৮ নং সামরিক বিধি জারি | পাকিস্তান অবজার্ভার | ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ |
মার্শাল ল রেগুলেশন ৭৮
রাওয়ালপিণ্ডি ৯ এপ্রিল, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক শাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আজ নিম্নে বর্ণিত সাময়িক আইন অধ্যাদেশ জারি করেন, তথ্যসূত্র এপিপি এর।
মার্শাল ল রেগুলেশন ৭৮
১) চিফ মার্শাল ল সুপারভাইজার বা মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অথবা ডেপুটি মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর প্রত্যেকে নিরাপত্তা, জনগণের সুরক্ষা বা স্বার্থরক্ষা, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা পালন, অন্যান্য শক্তির সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক, পাকিস্তানের যে কোন অংশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখা, অত্যাবশ্যকীয় সেবা-সরবরাহ বজায় রাখার পরিপন্থী আচরণের প্রমাণসাপেক্ষে যে কোন ব্যক্তিকে মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্ষমতাবলে প্রয়োজনবোধে নিম্নলিখিত আদেশ প্রদান করতে পারেন।
- উক্ত ব্যক্তিকে তিনি নির্দেশেউল্লেখসাপেক্ষে যে কোন সময়ের মধ্যে,যে কোন পথে, যে কোন উপায়ে পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ দিতে পারবেন এবং উক্ত ব্যক্তির পাকিস্তানে ফিরে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবেন।
- উক্তব্যক্তি কে বন্দী করতে পারবেন।
- যেকোনো ব্যক্তির উপর নির্দেশেউল্লেখসাপেক্ষে পাকিস্তানের যে কোন এলাকায় বা অঞ্চলের ভেতরে চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবেন, যদি নির্দেশে বর্ণিত শর্ত বা নির্দেশেবর্ণিত কর্তৃপক্ষের শর্ত লঙ্ঘিত হয়।
- উক্ত ব্যক্তিকে নির্দেশে উল্লেখসাপেক্ষে পাকিস্তানের যেকোনো অঞ্চলে বাধ্যতামূলক অবস্থান করার অথবা প্রয়োজনীয় নির্দেশ মত যেকোনো জায়গায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পৌঁছার আদেশ দিতে পারবেন।
- উক্ত ব্যক্তিকে যথাযথ সময়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নিজ গতিবিধি জানাতে, অথবা সশরীরে উপস্থিত হতে, অথবা উভয়েরই আদেশ দিতে পারবেন।
- নির্দেশে উল্লেখসাপেক্ষে উক্ত ব্যক্তির চাকুরি, ব্যবসা, অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে তাঁর যোগাযোগ বা সম্পর্ক, যে কোন মতবাদ উত্থাপন ও প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবেন।
- নির্দেশে উল্লিখিত যে কোন বস্তুসামগ্রীর মালিকানার বা ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবেন।
- নির্দেশে উল্লেখসাপেক্ষে যে কোন ব্যাপারে উক্ত ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। উপরের অনুচ্ছেদ (a) অনুযায়ী পাকিস্তানের কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে কোন নির্দেশ প্রদান করা হবে না।
২) অনুচ্ছেদ ১ এ বর্ণিত কারণে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদেশ জারি হলে তিনি শর্তসাপেক্ষে জামিন অথবা বন্দি অবস্থায় নিষেধজ্ঞা এবং নজরদারি তে আবদ্ধ হবেন।
৩) যদি অনুচ্ছেদ ১ এর আওতায় কোন নির্দেশের লঙ্ঘন করে কোন ব্যক্তি কোন অঞ্চলে অবস্থান করে অথবা ঐ অঞ্চল ত্যাগ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাকে পুলিশ বা চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর বা মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর বা অথবা মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ডেপুটি মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর কর্তৃক ওই এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হবে।
৪) এ আইনের আওতায় আটক ব্যক্তিকে নির্দেশে উল্লেখসাপেক্ষে যে কোন স্থানে যে কোন নিয়মভঙ্গের শাস্তি প্রদানের নিমিত্তে আটক রাখা যেতে পারে; এ সব নিয়ম চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর বা মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর বা মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ডেপুটি মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর যে কোন সময়ে নির্ধারণ করতে সক্ষম।
৫) চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর বা মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর বা মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ডেপুটি মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটরের যদি এরুপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, অনুচ্ছেদ I এর ধারা (B) এর আওতায় কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্দেশ জারি করা হয়েছে, এবং উক্ত ব্যক্তি ধারা অমান্য করে পলাতক রয়েছেন বা লুকিয়ে রয়েছেন – সেক্ষেত্রে:
- যে অঞ্চলে উক্ত ব্যক্তি বসবাস করে আসছিলেন, সে অঞ্চলের বিচারিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে বিষয়বস্তু গুলোর উপর একটি রিপোর্ট পাঠাতে পারেন, যার ফলে, ম্যাজিস্ট্রেটের ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে এবং উক্ত ব্যক্তি পলাতক, এ মর্মে , ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৮৭, ৮৮ এবং ৮৯ নং ধারা উক্ত ব্যক্তির এবং তাঁর সম্পত্তির উপর প্রযোজ্য হয়।
- উক্ত ব্যক্তিকে নির্দেশে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে নির্দেশিত স্থানে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। যদি উক্ত ব্যক্তি এরুপ নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা সহ অথবা জরিমানা ছাড়া সর্বোচ্চ সাত বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে, যদি উক্ত ব্যক্তি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন যে তাঁর পক্ষে এ নির্দেশ পালন করা সম্ভব ছিল না এবং তিনি নির্দেশে উল্লিখিত সময়ের মধ্যেই উক্ত কর্মকর্তাকে এর কারণ দেখিয়েছিলেন।
৬) যদি কোন ব্যক্তি অনুচ্ছেদ ২ এর আওতায় কোন মুচলেকা প্রদান করে থাকেন, এবং ঐ মুচলেকায় উল্লিখিত শর্তের লঙ্ঘন করেন, সেক্ষেত্রে শর্তভঙ্গকারী ব্যক্তির বিচারিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত আদালত মুচলেকায় অঙ্গীকারবদ্ধ যে কোন ব্যক্তিকে অর্থদণ্ড পরিশোধ করার নির্দেশ দিতে পারেন, অথবা সেই ব্যক্তি ‘কেন এ অর্থ পরিশোধযোগ্য হবে না’ এ মর্মে কারণ দর্শাতে পারবেন; যদি পর্যাপ্ত কারণ দর্শানো না হয় এবং অর্থদণ্ড শোধ না করা হয়, সেক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী আদালত মামলা পরিচালনা করে অর্থদণ্ড আদায় করতে পারেন।
পক্ষে,
জেনারেল কমান্ডার ইন চিফ
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন
স্থান: রাওয়ালপিণ্ডি
তারিখ: ৯ এপ্রিল, ১৯৭১
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৩। সিনেটর হ্যারিসকে লিখিত ওয়াশিংটন দুতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারির চিঠি | পাকিস্তান দূতাবাসের দলিলপত্র | ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ |
পাকিস্তান দুতাবাস
২৩১৫ ম্যাসাচুসেটস এভিনিউ, এন ডাব্লিউ
ওয়াশিংটন ডিসি, ২০০০৮
এপ্রিল ১৪, ১৯৭১
প্রিয় সিনেটর হ্যারিস,
এপ্রিল ১, ১৯৭১ এর প্রকাশিত সিনেটসভা নথিতে আপনার বক্তব্য সম্পর্কে অবগত হয়েছি। আমরা দুঃখিত বোধ করছি যে আপনি আপনার বক্তব্য প্রদানের আগে বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করার কোন সুযোগ আমাদের দেননি, যেখানে আমরা অন্তত আপনাকে আপনার প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে সাহায্য করতে পারতাম। যাইহোক, আমি আশা করি এ পত্রের মাধ্যমে অনেক বিষয় সম্পর্কে আপনার ধারনা সুস্পষ্ট হবে।
আপনি বলেছেন যে পাকিস্তানি সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের অত্যন্ত হেয়পূর্ণ ভাবে বহিষ্কার করে দেয় যেন পাকিস্তানি সেনারা বিঘ্নহীন ভাবে মানুষ হত্যা চালিয়ে যেতে পারে। আমি আপনাকে জানাতে চাই যে বিদেশি সাংবাদিক এবং আমেরিকান দুতাবাস থেকে দেশটির নাগরিক ও দুতাবাসে কর্মরত নাগরিকদের ফেরত পাঠানো কোন অপমানজনক উদ্দেশ্য নয়, বরং তাদের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস এবং ইভেনিং স্টার সংবাদে পাঠানো এক বার্তায় পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে তাদের ম্যানেজিং এডিটরকে অবগত করেন। রাষ্ট্রদূত আরো বলেন যে বিগত সপ্তাহে যখন ইয়াহিয়া-মুজিব এর মধ্যকার সমঝোতা আলোচনা সভা বিফল হয় তখন পাকিস্তানি সেনাদেরকে ঢাকায় অবস্থানকারী সন্ত্রাসী দলগুলো যারা লম্বা সময় ধরে পূর্বপাকিস্তানের শান্তিপ্রিয় নাগরিক, বিশেষত উর্দুভাষী নাগরিকদের উপর অত্যাচার এবং হত্যাকর্ম চালিয়ে আসছিল, তাদের দমন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করতে হয়। আমাদের প্রশাসন মনে করে যে এমন সময় বিদেশি সাংবাদিকদেরকে উক্ত এলাকায় অবস্থান তাদের নিজেদের জীবনের জন্যই বিপদজনক ছিল। এমতাবস্থায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকার রাস্তায় ঘুরে তথ্যসংগ্রহ করার অনুমতি প্রদান করার কোন প্রশ্নই আসেনা। আপনি অবশ্যই একমত হবেন যে, সরকারের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধ একটি বাস্তব এবং আকাংখিত সিদ্ধান্ত ছিল।
এই মুল উদ্দেশ্যের পাশাপাশি আমি আরো একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যা হয়তো আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও কোন আমেরিকান সংবাদপত্রই পাকিস্তানে তাদের সংবাদদাতা প্রতিনিধি অফিস স্থাপন করতে চায়নি। আমরা কখনই আমেরিকান সংবাদমাধ্যমগুলোকে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝাতে সক্ষম হইনি। অন্যদিকে সকল সংবাদদাতা অফিসগুলোই নয়া দিল্লী থেকে কাজ করছে, এবং আপনি অবশ্যই অবগত আছেন যে উক্ত দেশটি অতীতে কখনই আমাদের প্রতি তেমন সহযোগিতাপূর্ণ আচরন করেনি, এবং বর্তমানেও করছেনা। সংবাদদাতারা অবশ্যই মানুষ এবং তাদের পরিবেশিত সংবাদে অবশ্যই তারা তাদের আশেপাশে যেসব কথা শুনে আসছিলেন তার প্রভাব পড়েছে। অতিপ্রাসঙ্গিকভাবেই আমি আপনাকে গত বছর নভেম্বরে ঘটে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানে সাইক্লোন বিষয়ক পরিবেশিত সংবাদের উদাহরন দিতে চাই, যা ছিল মুল ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীলতা উদ্রেককারী এবং স্পর্শকাতর। কেউই একবারের জন্য উল্লেখ ও করেনি যে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও কত দ্রুত আমরা এ সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করেছিলাম। কেউ এই বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেনি যে সমগ্র পূর্ববাংলা স্থানীয় প্রশাসন, যেখানে একজন ও পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা নেই, (গভর্নরও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন), নিজেরাই সম্পূর্ণভাবে এই সাইক্লোনের ত্রান বিতরনের কাজে নিযুক্ত ছিল। অথচ, বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি একচ্ছত্রভাবে অভিযোগ তুলে গেছে এবং ঢাকা হোটেল এর বিলাসবহহুল লবিতে বসে থেকে তারা একই সংবাদ পুনরাবৃত্তি করে গেছে। আপনাদের দেশের দাতাসংস্থাগুলো এবং অন্যান্য সংবাদ পত্রের সম্পাদকদের চিঠির মাধ্যমে আমরা বারবার এ ভুল সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে এসেছি।
আপনারা বললেন যে, আপনারা কিছুই জানেন না, আবার একি সাথে এও বলেন যে কিছু তথ্য আপনাদের হাতে আছে, যা অবশ্যই সত্যি। আমি এ বিষয়ে আর বিশেষ কিছু বলতে চাইনা, তবে এ বিষয়ে প্রতিবাদ না করলেই নয় যে আপনি অপ্রতিষ্ঠিত এবং অনির্ভরশীল সংবাদসুত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদ উল্লেখ করে সিনেট সভায় জানিয়েছেন যে, নির্দিষ্ট তথ্যদাতাদের সাহায্যে সুপরিকল্পিতভাবে পূর্বপাকিস্তানি বুদ্ধিজিবি নেতাদের খুজে বের করে মৃত্যুদণ্ড দাওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানি সরকার বারবার এ বিষয়টি বলে আসছে যে তাদের পাঠানো সেনাবাহিনীকে কোন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন সংবাদসুত্র যেমন নয়া দিল্লী হতে এধরনের ভিত্তিহীন সংবাদ রেডিও মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে যেন একটির পর একটি অতিনাটকীয় আবহ তৈরি করা যায়। দয়াকরে এই চিঠির সাথে সংযুক্ত নয়া দিল্লীর একটি প্রধান সংবাদপত্রের ৩১ মার্চে প্রকাশিত প্রথম পাতার সংবাদের ফটোকপিটি লক্ষ্য করবেন। এটি সারা পৃথিবী জানে যে, ঐ তারিখে বা অন্য কোন তারিখে ঢাকা কোন তথাকথিত মুক্তিবাহিনি দ্বারা দখলকৃত হয়নি এবং পাকিস্তানি সরকার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা থেকে অন্য কোথাও স্থাপিত করেনি। দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে, এধরনের মিথ্যা সংবাদ শুধুমাত্র ভারত সংবাদমাধ্যম নয়, বরং উক্ত দেশটিতে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম প্রচার করে যাচ্ছে এবং এধরনের মিথ্যা সংবাদের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে। একই রকম ভাবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রচার করে যাচ্ছে যে কমপক্ষে দশ হাজার পূর্বপাকিস্তানি আমাদের আর্মিদের হাতে নিহত হয়েছে। উক্ত সংবাদটির গুজব ছড়িয়ে যাওয়ার পর সংখ্যাটি শুধু বেড়েই যাচ্ছে, এবং গত ১২ই এপ্রিলের ওয়াশিংটন ডেইলি এর সংবাদে দেখা যায় যে সংখ্যাটি এখন দশ লক্ষাধিকে পৌছে গেছে।
জনাব সিনেটর আপনি দাবি করেছেন যে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ যেন পাকিস্তানে সামরিক এবং আর্থিক সাহায্য প্রদান বন্ধ করে দেয়। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে আমেরিকান সামরিক সাহায্য সেই ১৯৬৫ সালেই স্থগিত করা হয়েছিল, যখন আমরা ভারতীয় শক্তির চাপিয়ে দাওয়া একটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র (আমাদের মিত্রবাহিনীর তিনবার অনুরোধ করা স্বত্বেও) সকল ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়, এমনকি সেইসব সাহায্যের ক্ষেত্রেও এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য করে, যার জন্য আমরা নির্দিষ্ট মুল্য পরিশোধ করেছিলাম। এই সিধান্ত শুধুমাত্র রণক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান পুরোপুরি বদলে দেয়, এবং তা শুধু আমাদের সেনাবাহিনী নয়, সাধারন দেশপ্রেমিক মানুষদের অবদানকে অস্বীকার করে আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। আপনার সরকার অবশ্যই অবগত আছে যে ভারত ধ্বংসাত্মক অস্ত্র নির্মাণের বিপুল পরিমান ক্ষমতা অর্জন করেছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। (বর্তমানে ভারত যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধজাহাজ এবং প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ নিজেরাই তৈরি করতে সক্ষম)। এছারাও তাদের আছে রাশিয়াসহ বিভিন্ন পশ্চিম ইউরোপিয়ান দেশের অস্ত্রসরবরাহের মাধ্যম। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নেয়া সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের কারন হয়েছিল। আপনার নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে এক পর্যায়ে জনাব কুশ্চেভ আমাদেরকে হুমকি প্রদান করেছিল যে যদি আমরা পাকিস্তানে অবস্থানকারী যুক্তরাষ্ট্রীয় ঘাটিগুলি থেকে কোন আমেরিকান ইউ-২ বিমান উড্ডয়ন করতে দেই, তবে তারা আমাদের দেশে রকেট হামলা চালাবে। আমরা তাদের হুমকিস্বত্বেও পিছিয়ে যাইনি।
আমি আপনাকে বর্তমানে পূর্বপাকিস্তানে উদ্ভুত রাজনৈতিক সঙ্কটের বিষয়ে জানাতে চাই। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্যতম একটি দল আওয়ামীলীগ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে যোগদানের উদ্দেশ্যে এমন একটি প্লাটফর্মে নির্বাচন করে যা পূর্বে ছিলনা এবং তারা অকস্মাৎই নির্বাচনের পূর্বে এটি পরিবর্তন করে। উক্ত প্লাটফর্ম সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের আদর্শ হতে বিচ্ছিন্ন এবং তাদের ম্যান্ডেট ছিল নির্বাচকমণ্ডলীর অনুমোদনবিহীন। দলের শীর্ষ জান্তারাও লম্বা সময় ধরে গোপনে অস্ত্র সংগ্রহ করে আসছিল, যেন তারা তাদের শিষ্যদের মাধ্যমে দেশে একটি অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারে এবং অবাঙ্গালিদের নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এসকল অবাংগালি মুসলিমগণ ভারত থেকে পূর্বপাকিস্তানে অবস্থান শুরু করে এবং গত ২৩ বছর ধরে তারা শান্তিপূর্ণ ভাবেই এইস্থানে বসবাস করে আসছে। এমতাবস্থায় আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার খাতিরে সামরিক বাহিনীর কঠোর উদ্যোগ নাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিলনা। কোন অবস্থাতেই কোন দেশের সরকার দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে দেখেও চুপচাপ বসে থাকতে পারেনা, যেখানে তাদের শতসহস্রাধিক নাগরিকের জীবন বিনাদোষে চরম হুমকির সম্মুখীন। বিষয়টি অবশ্যই দেশের সামরিকবাহিনীর তত্ত্বাবধানের অন্তর্গত এবং তারা শুধুমাত্র তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
আমার সন্দেহ যে আপনার দেশে বিপুল পরিমান সংবেদনশীলতা এই কারনে উদ্ভুত হয়েছে যে আপনার আওয়ামীলীগ এর আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত নন, বরং আপনারা ভেবে যাচ্ছেন যে দলটি শুধুমাত্র প্রাদেশিক সরকারের আরো বেশি স্বায়ত্তশাসনই দাবি করে আসছে, যা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রাদেশিক সরকার ব্যাবস্থার মতই। বিষয়টি অবশ্যই তা নয়। আওয়ামীলীগ নেতা মুজিবর রহমান তার আলাপ-আলোচনার শেষাংশে পাকিস্তানি রাষ্টপতির কাছে একটি আলাদা দেশ এবং সার্বভৌমত্ব দাবি করেন, এবং একি সাথে হুমকি দেন যে তা না করলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। রাষ্ট্রপতি যথেষ্ট ধৈর্যধারন করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথেও আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন যেন একটি সর্বাত্মক রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে জাতীয় অধিবেশন আহবান করা এবং দেশটির সংবিধান রচনা করার লক্ষ্য অর্জিত হয়। এধরনের একটি চুক্তি পূর্ব পাকিস্তানকে যেকোন জোটের অধীনেই একটি পরিমেয় পরিমান স্বায়ত্তশাসনের এখতিয়ার প্রদান করত। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, শেষ আলোচনায় এটি ভালভাবে স্পষ্ট হয় যে আওয়ামীলীগ এর লক্ষ্য তা না হয়ে বরং অখণ্ড পাকিস্তানের বিভাজন ছিল। এমতাবস্থায় দেশটির ঐক্য এবং অখণ্ডতা অক্ষুন্ন রাখাটাই মুল বিবেচ্য ছিল। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তার এক বার্তায় রাষ্ট্রপতি পডগরনিকে জানানঃ
“কোন সরকারেরই দেশের সার্বভৌমত্ব এবং প্রাদেশিক ঐক্যতে আঘাত হানে এমন কোন ক্ষতিকর শক্তিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা কিংবা আপোষে তাদের ছেড়ে দাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আওয়ামীলীগ এর কাছে পাকিস্তানের জনগন দেশ বিভাজনের ম্যান্ডেট দেয়নি, তারা প্রতিবেশি শত্রুভাবাপন্ন একটি দেশের পৃষ্ঠপোষকতায় অরাজকতার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল যা দেশটির অখন্ডতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করত। এমন একটি পরিস্থিতিতে যখন আইনের শাসন সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছিল, সাধারন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, খুন-রাহাজানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছিল, তখন সরকারের কাছে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সোচ্চার হতেই হয়েছে। সরকারের নেওয়া উদ্যোগসমুহ পূর্ব পাকিস্তানী বিশাল জনপদের জানমাল রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই গৃহীত হয়েছে যারা আওয়ামীলীগের কিছু নেতাদের ফ্যাসিস্ট মনোভাবের সাথে একমত নয়।”
আমেরিকান সংবাদমাধ্যম পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি আর্থিক শোষণ এরও অভিযোগ আনে। এই অভি্যোগের ক্ষেত্রেও মুল ঘটনার থেকে আবেগীয় সংবেদনশিলতাই বেশি দায়ী, কেননা যদি বর্তমান বছরগুলির দিকে খেয়াল করেন, তবে দেখবেন আমাদের দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তিত হচ্ছে এবং দুরভাগ্যজনকভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তনের সময়টুকুতে কিছু ভুলত্রুটি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যদি শিল্পবানিজ্যে একটি প্রদেশ আরেকটি থেকে দ্রুত এগিয়ে যায়, তার মানে এই নয় যে প্রবৃদ্ধিশীল প্রদেশটি অপর প্রদেশকে শোষন করে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং আইনী সংস্থায় বরাবরি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধির অংশগ্রহন উল্লেখযোগ্য হারে ছিল। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে, ২৪ বছরের এই সংক্ষিপ্ত শাসনামলে আমরা দুইজন পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি (নাজিমুদ্দিন এবং ইস্কান্দার মির্জা) এবং তিনজন প্রধানমন্ত্রী (নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলি এবং সোহরাওয়ারদী) পেয়েছি যারা পূর্ব পাকিস্তানি ছিলেন। তারা কোনভাবেই কম দেশপ্রেমিক ছিলেন না, এবং পুরো শাসনামলে তারা কখনই রাষ্ট্রের বিভাজন চাননি।
পূর্ব এবং পশ্চিম দুই প্রদেশ ই একটি অনুন্নয়নশীল দরিদ্র রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে যাত্রা শুরু করে। বিদেশি সাহায্য এবং আমাদের নিজেদের চেষ্টায় আমরা যখন একটি কর্মঠ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছি, তখন কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিবিদ খেয়ালী দাবিদাওয়া করে আমাদের অধপতন সুনির্দিষ্ট করতে চাচ্ছে। অথচ তাদেরকে একটি অখন্ড রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার রূপরেখা তৈরি করতে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের জনগন নির্বাচন করেছিল। আমরা অবশ্যই গণতন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার অক্ষুন্নতা, সকলের স্বাধীনতা ও কর্মপ্রচেষ্টার প্রতি সম্মান দেখাতে বদ্ধপরিকর, এবং যত যা কিছুই হোক না কেন আমরা এই সম্মান বজায় রাখব।
নিবেদনে,
আপনার একান্ত
এস ডি
এফ এস এন কুতুব
ফার্স্ট সেক্রেটারি
(তথ্য বিভাগ)
মাননীয়
ফ্রেড আর হ্যারিস
কক্ষ নং- ২৫৪
পুরাতন সিনেট কার্যালয় ভবন
ওয়াশিংটন ডিসি, ২০৫১০।
.
.
শিরনামঃ – ১৪। পাকিস্তান সরকারের বিবৃতিঃ ভারতীয় সৈন্য অপহরন সম্পর্কিত নোট প্রত্যাখ্যান
সুত্রঃ – দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ – ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১
.
পাকিস্তান সরকারের বিবৃতিঃ
ভারতীয় সৈন্য অপহরণ সম্পর্কিত নোট প্রত্যাখ্যান
ইসলামাবাদ, ১৫ই এপ্রিল (এপিপি)।- গত ৯ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকজন কর্তৃক ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর তিনজন সৈন্য অপহৃত হয়েছে বলে একটি ভারতীয় নোটে যে অভিযোগ করা হয়েছে, পাকিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
গত ১১ই এপ্রিল নয়াদিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশনে প্রদত্ত এক নোটে ভারত যে অভিযোগ করেছে আজ এক সরকারী বিবৃতিতে তাকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয় যে, এই সিপাইগুলো তাদের নিজেদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সেই ভারতীয় কোম্পানীটির সদস্য যেটা পাকিস্তানী অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করেছিল। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকাকালে তাদেরকে আমরা আটক করেছি।
পূর্ব পাকিস্তানে জাতি-বিরোধী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দুটো কোম্পানীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। মোহনলাল ও পঞ্চরাম নামে দু’জন সৈন্যকে জীবিত অবস্থায় আটক করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকে চাপা দেবার জন্যই ভারত তাদের সৈন্যকে অপহরণের অভিযোগ করেছে অথচ তাদের পাকিস্তানের অনেক অভ্যন্তরে বন্দী করা হয়।
পাকিস্তান সরকার এই সমস্ত অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে এই মর্মে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এগুলা বন্ধ না হলে অনুপ্রবেশকারীদের নিজেদেরকেই পরিণামের ঝুঁকি নিতে হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ভারত সরকারকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপমূলক এই সমস্ত কার্যকলাপ থেকে বিরত হওয়ার জন্য পুনরায় সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
———-
শিরনামঃ – ১৫। পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের কয়েকটি পদক্ষেপ
সুত্রঃ – দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ – ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
প্রদেশে অর্থনৈতিক তৎপরতাঃ
ষ্টেট ব্যাংক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে
করাচী, ১৬ই এপ্রিল (এপিপি) – আজ এখানে সরকারীভাবে বলা হয়েছে যে, ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করায় পূর্ব পাকিস্তান ব্যাংকিং তৎপরতা বেড়েছে এবং জোরদার হয়েছে।
প্রদেশের ষ্টেট ব্যাংকের সকল শাখায় স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে। কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোও তাদের কাজ শুরু করেছে।
ষ্টেট ব্যাংকের গভর্নর করাচী থেকে একদল বিশেষজ্ঞকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছেন। এই বিশেষজ্ঞ দল পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করবেন এবং ব্যাংকিং তৎপরতা পুরাদস্তুর চালু করার জন্য আরো কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে সে সম্পর্কে সুপারিশ জানাবেন।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির অর্থের চাহিদা মিটানোর তাগিদে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোর তৎপরতা বাড়ানোর জন্য সরকার ও ষ্টেট ব্যাংক সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য দিচ্ছেন।
কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোতে উপস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে।
ঢাকাস্থ ষ্টেট ব্যাংকের অফিসগুলো রফতানীমূল্য নিয়ন্ত্রণ ফর্ম অনুমোদন করছে এবং রফতানীর জন্য বোনাস ভাউচার ইস্যু করছেন। পুরনো বোনাস ভাউচারসমূহ পুনরায় বৈধ করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ষ্টেট ব্যাংকে ব্যাংকার, পাট ব্যবসায়ী এবং জুটমিল মালিকদের প্রতিনিধিদের সভায় প্রদেশ থেকে পুরা দস্তর রফতানি শুরু করার উপায় ও পথ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ব্যাংকগুলো, জুটমিলগুলো চালু করার ব্যাপারে সাহায্য করতে এবং তাদের ক্রেতাদের পক্ষে করাচীতে বোনাস ভাউচার বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
ঢাকায় ব্যাংকারদের ক্লীয়ারিং হাউস প্রতিদিন চালু রাখা হচ্ছে।
———-
শিরনামঃ – ১৬। নয়াদিল্লীর কাছে পাকিস্তানের কড়া প্রতিবাদ
সুত্রঃ – দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ – ২০ এপ্রিল, ১৯৭১
নয়াদিল্লীর কাছে পাকিস্তানের কড়া প্রতিবাদঃ
পাকিস্তানী ফাঁড়ির উপর সশস্ত্র ভারতীয় হামলা
ইসলামাবাদ, ১৯ই এপ্রিল (এপিপি)- গত ১৬ই এপ্রিল কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝে অবস্থিত কসবায় পাকিস্তানী সীমান্ত ফাঁড়ির উপর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ভারত সরকারের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ভারতীয় এলাকা থেকে গোলন্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ করে এ হামলায় সাহায্য করে।
আজ এখানে ভারতীয় হাইকমিশনের কাছে প্রদত্ত একটি লিপিতে বলা হয়, এ ঘটনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের সমতুল্য।
লিপিতে এ ধরনের ঘটনার যাতে আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য প্রোয়জনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্যে ভারত সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। নীচে লিপিটির পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হলোঃ
কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যে কসবার তিন মাইল উত্তরে অবস্থিত একটি পাকিস্তানী সীমান্ত ফাঁড়ি গত ১৬ই এপ্রিল ভোর চারটায় সীমান্তের অপর পার থেকে সশস্ত্র ভারতীয়দের দ্বারা আক্রান্ত হয়। হানাদারদের গোলন্দাজ নাহিনীর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে সাহায্য করা হয় যা কেবলমাত্র ভারতীয় এলাকা থেকেই সম্ভব।
পাকিস্তান সরকার ভারত সরকারের কাছে এ ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এ ঘটনায় পাকিস্তানী এলাকায় অনুপ্রবেশ করা হয়েছে এবং এতে একটি পাকিস্তানী সীমান্ত ফাঁড়ির উপর সশস্ত্র ভারতীয় নাগরিকেরা অহেতুক হামলা চালিয়েছে।
ভারত সরকারের উচিত, এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় অবস্থা গ্রহন করা।
—————-
শিরনামঃ – ১৭। কলকাতাস্থ পাকিস্তানী দূতাবাস বন্ধের সিদ্ধান্ত
সুত্রঃ – দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ – ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১
কলকাতাস্থ পাকিস্তানী দূতাবাস বন্ধের সিদ্ধান্তঃ
ঢাকাস্থ ভারতীয় মিশন গুটাতে বলা হয়েছে
ইসলামাবাদ, ২৩শে এপ্রিল (এপিপি) – আজ এখানে সরকারীভাবে বলা হয় যে, পাকিস্তান আগামী ২৬শে এপ্রিল থেকে কলকাতাস্থ তার মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ঐ তারিখ থেকেই ঢাকাস্থ ডেপুটি হাই কমিশন বন্ধ করে দেয়ার জন্যও ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে।
পারষ্পরিক ভিত্তিতে গৃহীত ব্যবস্থায় মিশন দুটোর কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গ স্ব স্ব দেশে ফিরে যাবে।
কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব মেহদী মাসুদকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুবিধাদি দেওয়া হয়নি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়নি বলে পাকিস্তান এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। জনাব মাসুদ কলকাতা পৌঁছার পর তাঁকে হয়রানী করা হয়েছে এবং তাঁকে দৈহিক প্রহারেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
ভারতের অস্থায়ী হাইকমিশনারকে আজ পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে এনে তার কাছে এ সম্পর্কে একটা নোট দেয়া হয়। নোটটির পূর্ণ বিবরণ নীচে দেওয়া হলোঃ
নয়াদিল্লীস্থ আমাদের হাই কমিশনার জানিয়েছেন যে, কলকাতাস্থ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জনাব মেহদী মাসুদকে কলকাতাস্থ পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনের ভবন, সম্পত্তি ও দলিলপত্রের দায়িত্ব নেবার প্রোয়জনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইসলামাবাদের ভারতীয় হাই কমিশনার মিঃ আচার্য ও নয়াদিল্লীতে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের জয়েণ্ট সেক্রেটারি মিঃ রায় আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ভারত সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করবে এবং জনাব মেহদী মাসুদকে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে। পাকিস্তান সরকার দুঃখের সাথে জানাচ্ছেন যে, ঐ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। পক্ষান্তরে জনাব মাসুদকে কলকাতায় হয়রানী করা হয়েছে এবং দৈহিক মারপিটের হুমকি দেওয়া হয়েছে। কলকাতায় তাকে বাসস্থানও দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায় কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনারের পক্ষে তার কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে ১৯৭১ সালের ২৬শে এপ্রিল দুপুর বারোটা থেকে কলকাতাস্থ পাকিস্তানী মিশন বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত ভারতে না জানানোর ছাড়া গত্যন্তর নাই।
দুই সরকারের মধ্যে পারষ্পরিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে কলকাতাস্থ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বলে পাকিস্তান সরকার ঐ তারিখ থেকে ঢাকাস্থ ডেপুটি হাই কমিশন বন্ধ করার অনুরোধ জানাচ্ছে।
ভারত সরকার ইতিমধ্যে তাদের ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গকে দেশে ফিরিয়ে দেবার অনুরোধ জানিয়েছেন। মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাব করা যাচ্ছে যে, নিম্নলিখিত পারষ্পরিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে তাদের ফিরিয়ে নেয়া যেতে পারেঃ-
(ক) ভারত সরকার কোন আন্তর্জাতিক পরিবহনে কলকাতাস্থ পাকিস্তানী মিশনের সকল কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গকে করাচী পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারে।
(খ) এই সঙ্গে ঢাকাস্থ ভারতীয় কর্মচারী ও পরিবারবর্গকে পি-আই-এ বিমানে করাচী আনা হবে।
(গ) করাচীস্থ ভারতীয় মিশন তখন ঐ সমস্ত কর্মচারীদের নয়াদিল্লীতে প্রেরণের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
পাকিস্তান সরকার নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তানী হাইকমিশনকে পাকিস্তান সরকারের কলকাতাস্থ ভবন, সম্পত্তি, দলিলপত্র ও তহবিলের দায়িত্ব নেবার পূর্ণ সুযোগ দানেরও অনুরোধ জানিয়েছেন। কলকাতা থেকে রয়টার পরিবেশিত পূর্ববর্তী খবরে বলা হয়, কলকাতায় নিযুক্ত নয়া পাকিস্তানী ডেপুটি হাইকমিশনার যে হোটেলে অবস্থান করছেন, পশ্চিম বাংলার জনতা সেই হোটেলটিতে হামলা চালায়। নয়া ডেপুটি হাইকমিশনার তাঁর দায়িত্ব ভার গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের কর্মী ও ছাত্রদের কলকাতার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের লবি তছনছ ও হোটেল রক্ষীদের সাথে সংঘর্ষের পর নয়া ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব মেহদী মাসুদকে হোটেল থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।
বিক্ষোভরত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। সংঘর্ষে একজন বিক্ষোভকারী ও হোটেলের একজন রক্ষী আহত হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছেন। জনাব মাসুদকে হোটেল থেকে কড়া প্রহরায় নিয়ে যাওয়া হয়। জনৈক পুলিশ অফিসার জনাব মাসুদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় যে, হোটেলে জায়গা না পাবার দরুণ তিনি নাকি নয়াদিল্লী ফিরে যাবেন।
হিন্দুস্তান হোটেল কর্মচারী ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র বলেছেন যে, ইউনিয়ন সদস্যরা পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনারকে খাদ্য পরিবেশন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
———-
শিরনামঃ – ১৮। ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হিশেবে আরশাদের ইউরোপ সফর
সুত্রঃ – দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ – ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে আরশাদের ইউরোপ সফর
ইসলামাবাদ, ২৬শে এপ্রিল (এপিপি)- পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আরশাদ হোসেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতে নগ্ন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বক্তব্য রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে বিদেশ সফরে গিয়েছেন বলে আজ এখানে বিশ্বস্ত সূত্র জানা গেছে।
জনাব আরশাদ হোসেন এখন লন্ডন, মস্কো ও প্যারিস সফর করছেন।
অন্যান্য কতিপয় দেশেও অনুরূপভাবে দূত পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
ইতিমধ্যে মস্কো থেকে তাস পরিবেশিত খবর প্রকাশ, সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনি আজ ক্রেমলিনে জনাব আরশাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করেছেন। বৈঠকে সোভিয়েট ইউনিয়নে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন।
———
শিরনামঃ – ১৯। নিউওয়ার্কে নিযুক্ত পাকিস্তানের ভাইস কন্সাল সাসপেন্ড
সুত্রঃ – দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ – ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
মাহমুদ আলীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে
ইসলামাবাদ, ২৭শে এপ্রিল (এপিপি)- পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র আজ এখানে বলেন যে, নিউইয়র্কে নিযুক্ত পাকিস্তানের ভাইস কন্সাল জনাব মাহমুদ আলীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে তাকে ঘানায় পাকিস্তানী হাইকমিশনে বদলী করা হয়েছিলো। তিনি বদলীর আদেশ পালন করতে অস্বীকার করলে তাকে সাসপেন্ড করা হয়।
মুখপাত্রটি জানান যে, নিউইয়র্কে জনাব মাহমুদ আলীর কার্যকাল শেষ হয়েছে এবং স্বাভাবিক প্রণালীতেই তাকে নতুন পদে বদলী করা হয়। তিনি বদলীর আদেশ পালন করতে অস্বীকার করেন। অতএব তাকে বরখাস্ত করে ইসলামাবাদ পররাষ্ট্র দফতরে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
————–
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০। ডঃ ডর্ফম্যানের কাছে লিখিত ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের চিঠি | পাকিস্তানি দূতাবাসের দলিলপত্র | ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১ |
পাকিস্তান দূতাবাস
২৩১৫ ম্যাসাচুসেটস এভিনিউ এনডব্লিউ
ওয়াশিংটন ডিসি ২০০০৮
২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
প্রিয় ডঃ ডর্ফম্যান,
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বরাবর আপিলের কপি সংযোজিত ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখের আপনার চিঠিটি আমরা পেয়েছি। ১২ এপ্রিল ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের একটি কপি আমি আমার সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।
২.আমি দুঃখ প্রকাশ না করে পারছি না যে আপনি এবং আপনার কো স্বাক্ষরকারীরা আমাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার চেয়ে রাজধানীর জনপ্রিয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়াকে বেশি শ্রেয় মনে করেছেন। আপনি জানেন যে এই দেশে এই ধরনের পাব্লিকেশন এই দেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও শত্রুতা তৈরি করবে। আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে আমরা আপনাদের কিরূপ শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখি। আমাদের উপর বিজ্ঞাপিত আপীলের প্রভাব একটি জনসম্মুখে দেয়া বিবৃতির থেকে বেশি কিছু নয়।
৩. আমরা আরো দুঃখ পেয়েছি যে আপনি উপসংহার টেনেছেন এই মর্মে যে পাকিস্তান সরকার শান্তিপূর্ণ আলোচনা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ পরিত্যাগ করেছে। আপনি অবশ্যই অবগত আছেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বারবার বলেছেন যে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই তার প্রধান লক্ষ্য। তিনি ইতিমধ্যে এক ব্যক্তি এক ভোট ভিত্তিতে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম দেশব্যাপী নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, যার ফলে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রেসিডেন্টের অভিপ্রায় প্রমাণিত হয়েছে।
৪. রাষ্ট্রপতি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নে একটি গণপরিষদ এবং এর আহ্বায়ক সংক্রান্ত একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক চুক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশেষ আলোচনার পূর্ণ প্রতিবেদন প্রেস প্রকাশ করেছে। এ ধরনের একটি চুক্তি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রার্থিত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করবে যা নজিরবিহীন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রকাশ্যে জাতীয় অখণ্ডতা এবং দেশের সংহতি ক্ষতিসাধন না করে পাকিস্তানের দুই অংশের সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অন্য ভাষায়, পাকিস্তান এক জাতি এবং এক দেশ থাকবে।
৫. প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জাতীয় সংবিধান বিষয়ে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। কিন্তু এটিও জানুন যে, তারা অনমনীয় ছিল।
এমনকি তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে এসে প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করেছেন। এরপর প্রেসিডেন্ট ১৫ মার্চ ২য় বারের মত ঢাকা সফর করেন আওয়ামী নেতাদের সাথে আলোচনা করার জন্য। এগারো দিন ধরে তিনি এবং তার উপদেষ্টারা শেখ মুজিবুর রহমানকে আশ্বাস দেন যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি গ্রহণ করা হবে কিন্তু তাঁর স্বীকার করা উচিত অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অঞ্চলের নেতাদেরও কিছু অধিকার আছে। কিন্তু এই সব প্রচেষ্টা নিরর্থক প্রমাণিত হয় কারণ শেখ মুজিবুর রহমান শুধু অন্য দলগুলোর বা অন্যান্য অঞ্চলের অধিকার স্বীকার করতে না অস্বীকৃতি জানালেনই না, তিনি এমনকি অবৈধ উপায়ে তার ইচ্ছার বাস্তবায়ন এবং অন্যদের বাধ্য করতে হুমকি দেন। খুব শীঘ্রই যেমন ২ মার্চ , পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক এবং রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে অগ্রাহ্য করে তিনি তার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন এবং প্রদেশের বেসামরিক প্রশাসন এবং তার পুলিশ এবং সরকার আইনানুগ কর্তৃপক্ষ সহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা জারি করে একটি সমান্তরাল সরকার শুরু করেছেন। মার্চের শুরুর দিকে উত্তেজিত জনতা শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন হয়রানি করতে শুরু করেছে এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং প্রদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এমনকি ধ্বংসাত্নক কার্যকলাপের মাধ্যমে রাস্তাঘাটে জনজীবন ও জানমালের ক্ষতি চোখের সামনে ঘটলেও প্রেসিডেন্ট যথেষ্ট ধৈর্য ধারন করেছেন। কারণ তিনি তখনও শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় সমস্যা সমাধানে বিশ্বাস করেছেন। এটা ছিল আওয়ামী লীগ যারা যৌক্তিক এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ পরিত্যক্ত করে অসহযোগ বিজ্ঞাপনের মুখে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল একটি এবং একটি সমান্তরাল সরকারও প্রতিষ্ঠিত করেছে? প্রেসিডেন্ট সহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সফল দলের নেতারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগ নেতারা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তারা স্বাভাবিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য কাজ করেনি বরং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি ফেডারেশন তৈরি করে দেশে বিভাজন তৈরি করতে চেয়েছে। সংক্ষেপে তারা পাকিস্তানের প্রতিকূল শক্তির সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানে একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করতে চেয়েছিল।
৬. এই পরিস্থিতিতে, ঐক্যের সংরক্ষণ এবং দেশের অখণ্ডতা সবার আগে বিবেচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট বার্তায় বলেন,
” কোনো সরকারই তার সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার উপর আক্রমণ প্রশ্রয় দেয় না বা নাশকতামূলক কর্মকান্ড মোকাবেলা করার ব্যাপারে যুদ্ধ করতে নমনীয় থাকে না ……”
৭. এটা অবশ্যই দুঃখজনক যে , সশস্ত্র ও শৃঙ্খলহীন প্রদেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারি বাহিনী বল প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তার ঘোষিত অন্তর্বর্তী প্রশাসন প্রতি আওয়ামী লীগের সদস্যদের দ্বারা দেওয়া ঘোর উস্কানীর মুখে তার সামরিক প্রশাসনের সহনশীলতা শুধুমাত্র সম্পূর্ণরূপে দেশের নাগরিকদের দিকেই ছিল না সব বিদেশীরা যারা ঐ তারিখ থেকে পূর্ব পাকিস্তান সফর বা বসবাস করে আসছে তাদের প্রতিও ছিল। যেভাবে দেশের জাতীয় সেনাবাহিনীর সরল, দেশপ্রেমিক ও সুশৃঙ্খল সদস্যদের প্রতি আওয়ামী লীগের সদস্যদেরা আচরণ করেছে, নির্দোষ আইন মান্যকারী পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ মনের মধ্যে শত্রুতা ও তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বাড়াতে যে প্রচেষ্টা হয়েছে, এগুলো সবার এতো বেশী জানা যে পুনরায় উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।
এমনকি ঢাকায় আওয়ামী নেতাদের সাথে আলোচনা চলাকালেও যখন বড় ছোট নানান উচ্ছৃঙ্খল লোকজন ও দুষ্কৃতিকারীরা হত্যা এবং লুটপাট চালাচ্ছিল প্রেসিডেন্টের সামনে তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে বলা ছাড়া আর কিইবা উপায় ছিল।
৮. আর আশ্চর্যের ব্যাপার, আপনি এবং আপনার সহকর্মীরা বলেছেন পাকিস্তান সরকার “নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে” “আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে।” সেনাবাহিনীকে যে আইনবিরুদ্ধতা মোকাবেলা করতে হয়েছে, সেটি ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত শহরের রাস্তায় হোক বা ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলোতে , গ্রামাঞ্চলে হোক সেখানে অবশ্যই “নিরস্ত্র মানুষের” ছিল না। এখানে দেশের শত্রুদের সাহায্যপ্রাপ্ত বিশ্বাসঘাতকরা দেশের সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। যখন এই দেশদ্রোহীদের এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে, এটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের কাছে বেশ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনার আগে থেকে রাষ্ট্র বিরোধীরা ভারত থেকে অনুপ্রবেশকারী থেকে অস্ত্র এবং সহায়তা পেয়ে আসছিল।
৯. যখন আর কোন উপায় ছিল না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী মাঠে নামানো হয়েছে। একই সময়ে সেইলন (Ceylon) একই রকম পদক্ষেপ নিয়েছে এমনকি ইংল্যান্ডও উত্তর আয়ারল্যান্ডে একই কাজ করছে। জোর করে জনসংখ্যার কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে আয়ত্তে আনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সেনাবাহিনী সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় যারা ক্রমাগত আইন ভঙ্গ করেছে। এই গোষ্ঠী পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগনকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
১০. আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশনেয়া দলগুলোর একটি। আমরা জানি যে তারা পূর্ব পাকিস্তানে অসাধারণ বিজয় পেয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রদেশের অন্যান্য দলগুলো বেশ ভোট পেয়েছে। এটিও সত্য যে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের পাচটি প্রদেশের একটি এবং অন্যান্য প্রদেশে আওয়ামী লীগের কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নাই এবং সেখানে অন্যান্য দলগুলা সম্মিলিত বিজয় পেয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক দল হিসেবে সফল, এটি সত্য, কিন্তু তারা পাকিস্তানের পাচটি প্রদেশের একটিতেই ক্ষমতাশালী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে অবশ্যই আওয়ামী লীগের অধিকার ছিল, কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রে বিরোধী দল এবং ছোট দলগুলোরও অধিকার আছে এবং বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে অন্য চারটি প্রদেশে একটি অথবা একাধিক দল নিজ নিজ প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং একত্রে তারা পশ্চিম অংশের জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে যা পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, তাদের অধিকার আছে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলার।
১১. এটি ভুলে গেলেও চলবে না যে নির্বাচন হয়েছিল সমগ্র পাকিস্তানের সংবিধানের জন্য, একটি বা দুটি অংশের জন্য না। সংবিধান একটি মৌলিক আইন যা সমগ্র জাতির ঐক্যমত্য এবং তার সব উপাদানকে উপস্থাপন করে। সাধারণ আইন একটি সহজ সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা গৃহীত হতে পারে, কিন্তু সংবিধান সাধারণত দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা অন্তত তিন চতুর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা অনুমোদিত হয়। তাছাড়া, কোনো যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান, টেকসই হতে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ইউনিটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পেতে হয়। আওয়ামী লীগ ৫৩% এর বেশি সীট পায় নি এবং অন্য চার প্রদেশে তাদের কোন প্রতিনিধি ছিল না।
১২. যেহেতু জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর দায়িত্ব ছিল সংবিধান রচনা করার, সকল অঞ্চলের স্বার্থকে জায়গা দেয়াটা অবশ্যই জরুরি ছিল। আওয়ামী লীগের জন্য দায়িত্ব ছিল দেশের অন্য অংশের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা এবং তাদের মতামত ও আকাংখাকে বিবেচনায় আনা। অবশ্যই আওয়ামী লীগ জান্তা এগুলির পরোয়া করেনি এবং সকল আলোচনা তাদের আক্রমণাত্নক আচরনের সামনে ভেস্তে গেছে। আওয়ামী লীগ শুধু তাদের দলীয় স্বার্থকেই বিবেচনায় রেখেছিল, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট শুধু পাকিস্তানের কথাই চিন্তা করননি, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া নিয়েই তার চিন্তাভাবনা ছিল।
১৩. এটা বলা অবিচার এবং অন্যায় যে পাকিস্তান সরকার তার ইচ্ছাকে একটি বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে যারা একত্রে বলেছে এবং যাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল যৌক্তিক যা আওয়ামি লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি প্রেসিডেন্টের বার্তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের আলাদা হবার দাবি করার ম্যান্ডেট দেয় নি। জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, একজন পূর্ব পাকিস্তানি নেতা যিনি ১৯৫৫-৫৬ তে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, ঢাকাতে তিনি বলেছেন সমগ্র ভোটাররা গত বছরের ৭ই ডিসেম্বর ভোট দিতে গিয়েছিল শুধু একটি দেশের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচনের জন্য এবং সংবিধান রচনার জন্য, দুটি দেশের জন্য নয়। এই নির্বাচন পাকিস্তান কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানে থাকতে চায় নাকি আলাদা হতে চায়, এরূপ কোন গণভোট ছিল না। নির্বাচন একক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে সংগঠিত হয়েছিল। যে মুহূর্তে আওয়ামী লীগ জান্তা কাঠামো ভেঙে ফেলে এবং দেশকে আলাদা করার জন্য একটি চাহিদা তৈরি করে, রাষ্ট্রের অধিকার আছে তাদের নিষিদ্ধ করার এবং তার নেতাদের গ্রেফতার করার। দেশের একটি অংশের জনগণের আলাদা হওয়ার দাবি এবং নিজেদের স্বাধীন ঘোষনা করা পৃথিবীর কোন দেশেই যুক্তি সংগত মনে করা হয় না। এ ধরনের প্রথা কিংবা অধিকার বহাল থাকলে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল ও সম্পর্কের ভারসাম্য থাকে না।
১৪. অবশেষে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানে বৈধ এবং কার্যকরী সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আপনার আবেদন রেফারেন্স সম্পর্কে, আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ২৬ মার্চ তার সম্প্রচারে যে শব্দগুলোর মাধ্যমে অঙ্গীকার করেছেন তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করছি,
“আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি আমার লক্ষ্য অপরিবর্তিত আছে যেটি হল জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে, আমি এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাব। আমি আশা করি যে পূর্ব পাকিস্তানে আইন শৃঙ্খলা খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং আমরা পুনরায় লক্ষ্য অর্জনের দিকে আগাতে থাকব।”
আবারো, ৫ই এপ্রিল, সোভিয়েট প্রেসিডেন্টের ভাষণের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করেনঃ
“মান্যবর, পরিশেষে আপনাকে আমি জানাতে চাই যে আমার লক্ষ্য এখনো অবিচল রয়েছে এবং যত দ্রুত সুযোগ আসবে আমি পূর্ব পাকিস্তানের বিবেচক গোষ্ঠীদের সাথে আলোচনায় বসতে চাই।”
১৫. আমি যেটি পূর্বেই বলেছি যে, আপনার বিজ্ঞাপন পাকিস্তানের ভাবমূর্তিতে দাগ ফেলেছে। এটি দুঃখজনক যে, আপনার মত ব্যাক্তি যার শুভ বুদ্ধি নিয়ে কোন সন্দেহ নাই, এমন কাজ করেছেন যা করার কথা এমন ব্যাক্তিদের যারা আমাদের এবং পাকিস্তানকে ঘৃণা করে।
পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা আমাদের সকলকেই ব্যথিত করেছে এবং আমাদের নিজেদের লোকজনের যে প্রাণহানী এবং সম্পদহানী ঘটেছে তাতে আমরা আসলেই দুঃখিত। যাইহোক, এটি আমাদেরই দায়িত্ব এই দুঃখজনক পারিবারিক সংঘাত বন্ধ করা এবং বাইরের কারো এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নাই। আমাদের দেশের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব এবং আপনার এর উন্নতি কামনাকে আমরা গভীরভাবে মূল্যায়ন করি। কিন্তু আমাদের অধিকার এবং আমাদের একত্রে দেশে থাকার আকাঙ্ক্ষা উপর নৈতিক রায় চাপিয়ে না দেয়ার অনুরোধ করছি আমরা, কারণ এটি এখনো আমাদের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা।
আপনার অনুগত,
স্বাক্ষরিত
(এ. হিলালী)
ড. রবার্ট ডর্ফম্যান
প্রযত্নে, আমেরিকান ফ্রেন্ডস অফ পাকিস্তান
৮১, কিলবার্ন রোড,
বেলমোন্ট, ম্যাস. সি ২১৭৮
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২১। পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী দ্বারা সাহায্য বিতরণ সম্পর্কে ওয়াশিংটনস্থ রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রেরিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি | সূত্রঃ সরকারী দলিলপত্র
|
তারিখঃ২৯ এপ্রিল,১৯৭১ |
গোপনীয়
জরুরী
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
ইসলামাবাদ।
No. IC-9/1/70 April 29,1971
মাননীয় রাষ্ট্রদূত,
অনুগ্রহ পূর্বক এপ্রিল ২৯,১৯৭১ এ আমার পাঠানো ত্রাণ সহায়তা বিষয়ে সম্পর্কিত টেলিগ্রামটি (নং ৩০১৪) পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ রইল। এর সাথে সম্পর্কিত টেলিগ্রাম নং ২২৪৬, তারিখ এপ্রিল ২৪,১৯৭১ এবং বিজ্ঞপ্তি নং IC-9/1970 ,তারিখ ২৪/৪/৭১- এগুলোর প্রতিও আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
২. উপরে উল্লেখিতসূত্র সমূহেও আমরা যেমনটি বলতে চেয়েছি, সরকার বাইরের রাষ্ট্র হতে আগত শত শত ‘স্বেচ্ছাসেবী’ দের ত্রাণ সহায়তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ছেড়ে দেওয়ার বিপক্ষে। এর কারণ হিসেবে প্রথমত বলা যায়, এভাবে উনাদের দেখাশোনা এবং তত্ত্বাবধান করা বেশ কঠিন হয়ে যাবে। আমরা ঘূর্ণিঝড় এর সময়কার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, বেশিরভাগ বিদেশী মেহমানদের কিছু ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন, এবং এই সময়ে তার ব্যবস্থা করার মত অবস্থায় আমরা নেই। এছাড়াও নিরাপত্তা জনিত কিছু সমস্যা ও রয়েছেঃ একটি দিক হচ্ছে বিদেশী নাগরিকরা যে কোন সময় দুর্বৃত্তদের হামলার সম্মুখীন হতে পারেন, যাদের অনেকেই এখনো সশস্ত্র। আরেকটি দিক আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত, কারণ এ সমস্ত ‘স্বেচ্ছাসেবী’দের সদিচ্ছা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে তারা সবাই সত্যিকারের সমাজকর্মী, তারপরও তাদের ঠিকমত দেখাশোনা ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে না পারার বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে যা তাদের মাঝে শুধু হতাশাই তৈরি করবে এবং যার ফলে এক ধরণের নেতিবাচক প্রচারনার সৃষ্টি হবে। সরকার এ সমস্ত ত্রাণ কার্যক্রম তার নিজস্ব সংস্থার মাধ্যমেই পরিচালনা করতে ইচ্ছুক। আর আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, এ বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো সশস্ত্র বাহিনীকেই দেওয়া হবে।
৩. তবে আমরা এমন কোন প্রকার সমস্যা তৈরি করতে চাই না যা এড়ানো সম্ভব, সে জন্য যখন আপনি আমাদের আমাদের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করবেন তখন অনুগ্রহ পূর্বক এই বিষয়টির উপর জোর দিবেন যে, এই মুহূর্তে জরুরী সরবরাহের কোন ঘাটতি নেই। উপরন্তু, সরকার বর্তমানে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত, এবং আমরা যথাসময়ে বিভিন্ন সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের নিকট বিভিন্ন সামগ্রী এবং আর্থিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করবো, যা আমাদের নিজস্ব সংস্থার মাধ্যমেই বিতরন করা হবে কারণ বিদেশী নাগরিকরা এ সমস্ত কাজ করতে গেলে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হবেন। যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে, তাহলে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ তাদের মতামতও নেয়া হতে পারে। সংক্ষেপে আমরা বলতে চাই যে, আমরা মানবতার খাতিরেই ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার বিপক্ষে নই এবং যখন প্রয়োজন হবে তখন বন্ধুভাবাপন্ন যে কোন রাষ্ট্র এবং সংগঠন হতে যে কোন ধরণের সাহায্য নিতে প্রস্তুত। সেই সাথে এটাও বলতে চাই যে, বর্তমান সময়ে ত্রাণ বিতরন কর্মসূচি শুধুমাত্র সরকারী উদ্যোগেই পরিচালনা করা হবে, এ নিয়ে জোর করা উচিত হবে না।
৪. আপনার টেলিগ্রাম পাওয়ার কিছুক্ষন পর আমি আজ জনাব ফার্মল্যান্ড এর সাথে দেখা করি এবং ত্রাণ বিতরন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশী নাগরিকদের নিকট দিলে কি কি অসুবিধা হতে পারে তা বুঝিয়ে বলি। তিনি আমাকে জানান যে সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তিনি ভাল করে বুঝতে পেরেছেন এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট বরাবর এ বিষয়ে চিঠি লিখবেন। বর্তমান অবস্থায় আমাদের নিজস্ব লোকই যে এ কাজের জন্য উপযুক্ত সে ব্যাপারেও তিনি একমত প্রকাশ করেন।
ধন্যবাদান্তে
Sd.
(সুলতান এম. খান)
H.E. জনাব এ. হিলালী, HQA, SPK, PFS
পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত
পাকিস্তান দূতাবাস
ওয়াশিংটন ডিসি
তথ্য এবং দিকনির্দেশনার জন্য অনুলিপি যাবেঃ
- H.E. Mr. J. G. Kharas, PFS
Embassy of Pakistan, Bad Godesberg
- H.E. Mr. M. Masood, PFS
Embassy of Pakistan, Brussels
- H.E. Mr. M. Aslam Malik, PFS
Pakistan High Comission, Canberra
- H.E. Mr. Salman A. Ali, SQA, PFS
Pakistan High Comission, London
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২২। জনৈক অধ্যাপকের কাছে লিখিত ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের চিঠি | পাকিস্তান দূতাবাসের দলিলপত্র | ৩০এপ্রিল,১৯৭১ |
পাকিস্তান দূতাবাস
ওয়াশিংটন ডিসি ২০০০৮
এপ্রিল ৩০,১৯৭১
মাননীয় অধ্যাপক,
আপনার অনুরোধক্রমে আমি আপনাদের সম্মিলিতভাবে স্বাক্ষরিত উদ্বেগ প্রকাশকারী বিবৃতিটি আমার সরকারের নিকট পৌঁছে দিয়েছি। যারা আমার কাছে বিবৃতিটি নিয়ে এসেছিলেন -অধ্যাপক রিগিনস(কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) এবং অধ্যাপক হুইলার , তাদের সাথে আমি কিছু বিষয় নিয়ে বলেছি যা আমি আপনাকেও জানাতে চাই।
২. রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এর সাথে ঢাকায় রাজনৈতিক আলোচনায়(যা শুরু হয় ১৫ মার্চ এবং শেষ হয় ২৫ মার্চ) বসার আগেই মার্চ এর ২ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান তার অনুসারীদের আইন অমান্য করার আদেশ দেন এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দেন । এতে এক ধরণের অরাজকতার সৃষ্টি হয়, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়ানো এসব সশস্ত্র দলগুলো লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি বাংলা বলতে না পারা নিজ দেশের নাগরিকদেরও খুন করছে। যদিও ওই সময় আলোচনা চলছিল,তারপরও এসব লুটতরাজ এবং খুন কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আওয়ামি লীগের বানানো সমান্তরাল সরকার ব্যবস্থাই মার্চ এর ২ তারিখ থেকে শুরু হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের এই অরাজকতা এবং বিশৃংখলার জন্য দায়ী-যা দমন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
৩. সেনাবাহিনী তার উপর দেয়া দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করেছে, আইনের শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছে। আর আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি পরিমাণে বাড়িয়ে বলা হয়েছে,এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। এ সমস্ত প্রতিবেদনসমূহের উৎস একটিই-ভারত, যার প্রায় সবগুলো নিশ্চিতভাবেই বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি ওয়াশিংটন পোস্টের নয়া দিল্লী প্রতিনিধি Mr. Lee Lescaze এর ২ এপ্রিল,১৯৭১ এ লিখা প্রতিবেদন থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি,
“ পূর্ব পাকিস্তানে চলমান অবস্থার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়ার পিছনে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম যে ভূমিকা পালন করেছে তাতে করে একে আর নিরপেক্ষ বর্ণনাকারী হিসেবে অভিহিত করা যায় না, বরং বলা যায় যায় চলমান ঘটনাবলীর ই একটা অংশ। শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব বাংলার মানুষের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক বিজয়ের কথা বলতে যেয়ে একজন ভারতীয় কর্মকর্তা সংবাদপত্রের খবরগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এটা সাংবাদিকতা ছিল না। এটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’।
৪. বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের সব জায়গাতেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে, যার জন্য রেড ক্রস বা অন্য কোন আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে সরকারের সাহায্য চাওয়ার প্রয়োজন নেই, এছাড়াও সেখানে প্রায় ৭০০ হাজার টন খাদ্য শষ্য এবং প্রচুর ঔষধ পত্র মজুদ রয়েছে যা গত বছরের নভেম্বর এ ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগ এর পর নিয়ে আসা হয়েছিল। উপরন্তু, যখন প্রয়োজন দেখা দিবে তখন আমাদের সরকার বন্ধুভাবাপন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন হতে সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে সম্পুর্ণ আন্তরিক।
৫.আপনার মত যারা আমাদের দেশ এর পরিস্থিতি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন-এমন প্রত্যেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ত্বের নিকট আলাদাভাবে চিঠি পাঠানোর ইচ্ছা ছিল,যাতে সব কিছুর সবিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকবে। কিন্তু বর্তমানে অত্যধিক কাজের চাপে তা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আপনার আপত্তি না থাকে, এই চিঠির সাথে আমি আপনাকে আরেকটি চিঠির প্রতিলিপি পাঠাতে চাই,যা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ ডর্ফম্যান এর নিকট পাঠানো হয়েছিল। আশা করি এ থেকে আপনি দেশ এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আরো ভালো ধারণা পাবেন।
৬. পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষ যাতে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে একসাথে বসবাস করতে পারে এবং নিজের ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষ্যে একসাথে কাজ করতে পারে সেজন্য আমাদের সরকার আঞ্চলিক অখন্ডতা এবং একাত্মতা বজায় রাখার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি এবং আপনার বিজ্ঞ সহকর্মীগণ আমাদের এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাবেন। আমারা বিশ্বাস করি, শক্তিশালী এবং অখন্ড পাকিস্তান শুধুমাত্র এর দুই অংশের জনগণের স্বার্থরক্ষায় অবদান রাখবে তা নয়, বরং তা সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়ক হবে।
ধন্যবাদান্তে
Sd.(এ. হিলালী)
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৩। জেনারেল হামিদের উত্তরবঙ্গ সফর | পূর্বদেশ | ১ মে, ১৯৭১ |
জেনারেল হামিদের উত্তরবঙ্গ সফর।
ঢাকা, ৩০শে এপ্রিল (এ পি পি)- পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী চীফ অব ষ্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান আজ পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে সৈন্য বাহিনীর সাথে কর্মব্যস্ত দিন যাপন করেন।
পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার ও জিওসি তাঁর সাথে ছিলেন। জেনারেল হামিদ হেলিকপ্টারের সাহায্যে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখেন। তিনি নাটোর, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁ ও রংপুরে অবতরণ করেন। পাকিস্তানী সৈন্য কিভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে দুষ্কৃতিকারী, রাষ্ট্রবিরোধী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তিনি তার বিবরণ শ্রবণ করেন। পাকিস্তানী বাহিনী পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত সম্পূর্ন বন্ধ করে দিলে ভারতীয় সৈন্যরা রাষ্ট্রবিরোধীদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য সীমান্তের ওপার থেকে কামান ও মর্টারের গুলী বর্ষণ করে বলে তাঁকে জানান হয়।
স্থানীয় কমান্ডার জেনারেল হামিদকে বলেন, দুষ্কৃতিকারীরা পাকিস্তানী সৈন্যদের চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল কিন্তু এ সড়ক-প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হলে অনুপ্রবেশকারীরা তেমন কোন বাধা দেয়নি ও অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের উৎখাত করা হয়েছিল। এদের অনেকে বেসামরিক পোশাক পরে নিজেদের জীবন রক্ষা করেছিল।
একস্থান থেকে অন্যত্র সময় জেনারেল হামিদ কৃষকদের ক্ষেতে চাষ করতে দেখেন। এছাড়া অন্যান্যরা তাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা পালন করে চলেছে। এছাড়া তিনি যে কয়েকটি শহরে অবতরণ করেন সেখানে তিনি স্বাভাবিক জীবন যাত্রাও লক্ষ্য করেন।
সশস্ত্র বাহিনীর আগমনের আগে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা সীমান্তবর্তী শহরগুলো থেকে কয়েক লাখ টন খাদ্য শস্য নিয়ে উধাও হয়। শুধুমাত্র দিনাজপুর থেকেই তারা তিন লাখ টন চাল, গম ও অন্যান্য খাদ্য শস্য নিয়ে পলায়ন করে। জেনারেল হামিদ প্রত্যেক স্থানে সৈন্যদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। তিনি সন্ধ্যায় আবার ঢাকা ফিরে আসেন।
এয়ার মার্শাল রহীম খানের ঢাকা ত্যাগ।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল এ রহীম খান তিন দিনের পূর্ব পাকিস্তান সফরান্তে আজ ঢাকা থেকে করাচী রওয়ানা হয়ে গেছেন।
এখানে অবস্থানকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বিমান বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও ছাউনী পরিদর্শন করেন।
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৪। জেনারেল হামিদের সিলেট সফর | পূর্বদেশ | ৩ মে, ১৯৭১ |
জেনারেল হামিদের সিলেট সফর।
ঢাকা, ২রা মে (এ পি পি)- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব ষ্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান পি আই এর একটি ফকার বিমানযোগে আজ সিলেট সফর করেন। জেনারেল হামিদ বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকার সেনাবাহিনীর অবস্থানগুলো পরিদর্শন করছেন। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার এবং জিওসি ও জেনারেল হামিদের সাথে ছিলেন।
সিলেট পৌঁছলে স্থানীয় কমান্ডার উক্ত এলাকা থেকে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেসব অভিযান পরিচালনা করেন সে সম্পর্কে সেনাবাহিনীর চীফ অব ষ্টাফকে অবহিত করেন।
জেনারেল হামিদকে জানানো হয় যে, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা সাধারণত সোলা হেলু এবং ছাতক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে। অনুপ্রবেশকারীরা এবং রাষ্ট্রবিদ্রোহীরা একত্রিত হয়ে সাধারণত শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং যুদ্ধের সময় ব্যবহারযোগ্য পুল সমূহ ধ্বংস করার চেষ্টা করেন। হেলু এবং ছাতকে তাদের কারখানা ধবংসের প্রচেষ্টাকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সময় মতো অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ করে দেয়।
মেশিনগান, মর্টার, রাইফেল এবং আনুষঙ্গিক জিনিষপত্রসহ বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। জেনারেল হামিদের পরিদর্শনকালে আটককৃত ভারতীয় অস্ত্র কারখানার চিহ্ন সমেত অস্ত্রশস্ত্র তাঁকে দেখানো হয়।
জেনারেল হামিদকে আরো জানানো হয় যে, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা সীমান্ত শহর থেকে প্রচুর পরিমাণ পেট্রোল ও খাদ্যশস্য নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী উক্ত এলাকায় পৌঁছানোর আগে তারা শুধুমাত্র হেলু এলাকা থেকেই ১০ হাজার গ্যালন পেট্রোল নিয়ে উধাও হয়।
জেনারেল হামিদ সেনাবাহিনীর জোয়ানদের সাথেও আলাপ করেন। জোয়ানদের সাথে আলাপকালে তিনি ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ভাব লক্ষ্য করেন।
জেনারেল হামিদ অপরাহ্নে ঢাকা ফিরে আসেন।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৫। ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত কর্তৃক সিনেটর ফুলব্রাইটকে লিখিত চিঠি | পাকিস্তান দূতাবাসের দলিলপত্র | ৪ মে, ১৯৭১ |
পাকিস্তান দূতাবাস
ওয়াশিংটন, ডিসি ২০০৮
মে ৪, ১৯৭১
মাননীয় জে. ডব্লিউ. ফুলব্রাইট
সিনেট অফিস ভবন
ওয়াশিংটন, ডিসি
প্রিয় সিনেটর ফুলব্রাইট,
আমি রয়টারে মিচেল ক্রাফটের একটি রিপোর্ট দেখতে পেলাম, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত একজন প্রাক্তন আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবক মি. রোড পূর্ব পাকিস্তানে গনহত্যা এবং পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবি হত্যার অভিযোগ সম্বলিত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।
২. আমি আপনাকে জানাতে চাই, দূর্ভাগ্যবশত মিঃ রোড কখনোই নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী বিচার করেন নি। পহেলা মার্চ থেকে সৃষ্ট বর্তমান সংকটের বহু পূর্বেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধাচারন করে আসছেন। ১৩ নভেম্বর ১৯৭০ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পরেই এর সূত্রপাত যখন মিঃ রোড ঘূর্নিঝড়-বিধ্বস্ত অঞ্চলে সাহায্য প্রদানের জন্য বিদেশী কর্মকর্তাদের একটি টীমকে নেতৃত্ব দেন। আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা প্রান্ত হতে আরো অন্যান্য বিদেশী সংস্থাও একই সময়ে একই জায়গায় সাহায্যকারী টীম পাঠায়। কিন্তু অন্যান্য টীমের মত পাকিস্তানী সিভিল ও মিলিটারি কর্তৃপক্ষের সাথে একত্রে কাজ না করে এবং শুধুমাত্র সাহায্য প্রদানে মনোযাগ না দিয়ে, মিঃ রোড প্রকাশ্যে বাঙালি জাতীয়বাদের সমর্থন শুরু করেন এবং প্রতিনিয়ত সরকারী বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সাথে কলহে লিপ্ত হন। এমনকি তিনি তার কাজের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল, মনপুরার বাসিন্দাদের নিয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ধর্মঘটও করেন। এতে সন্তষ্ট না হয়ে, তিনি বিবিসির এলেন হার্টকে দেয়া এক ইন্টারভিউতে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার এবং সেনাবাহিনীকে পূর্ব-পাকিস্তানে “গনহত্যা”র দায়ে অভিযুক্ত করেন। যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি গুলি ছোড়েনি (নভেম্বর ১৯৭০), তখন এরকম অভিযোগ তার অসহযোগিতামূলক আচরনেরই প্রমান। এই ইন্টারভিউটি ব্রিটেনে “প্যানারোমা” প্রোগ্রামে গত বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রচারিত হয়। আমি বিবিসির কাছে এই প্রোগ্রামের ভাষ্য জানতেচেয়ে আবেদন করেছিলাম। এই ইন্টারভিউ ব্রিটিশ দর্শকদের একটি পরিষ্কার ধারনা দেয়, মি রোড অন্যান্য সাহায্য সংস্থার ন্যায় সাহায্য কার্যক্রমের চেয়ে সাইক্লোন পরবর্তী ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার প্রতিই অধিক মনযোগী ছিলেন।
৩. মি. রোড এরপর ৭ই ডিসেম্বরের নির্বাচনের পূর্বে ও পরে, আওয়ামী লিগের বিছিন্নতাবাদী অংশের সাথে যুক্ত ছিলেন। এরুপ কর্মকান্ডের মাধ্যমে একটি বন্ধু রাষ্ট্রকর্তৃক প্রদত্ত সুবিধাদির অপব্যবহার করেছেন। আমেরিকাসহ আরো বিদেশী সাহায্য সংস্থার সাহায্যকর্মসূচীর পাশাপাশি বিদেশী সাহায্যের উদ্দ্যেশকেই ব্যহত করেছেন। তাই এটি আশ্চর্য নয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনেরাল ই. থান্টকে দেয়া সাম্প্রতিক চিঠিতে, স্পষ্টত উল্লেখ করেছেন, যদিও পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য সাহায্য প্রয়োজন কিন্তু সাহায্য বন্টনে শুধুমাত্র পাকিস্তানী সংস্থা কাজ করবে, বিশেষত যারা সাইক্লোনের পর সুসজ্জিত এবং প্রস্তুত এ ধরণের কাজ করার জন্য। স্পষ্টতই পাকিস্তান সরকার সাইক্লোন-পরবর্তী বৈদেশিক সাহায্যকারী মি. রোডের ন্যায় তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনারাবৃত্তির আশংকায় শংকিত। নাইজেরিয়ার ঘটনার পর, যেখানে কিছু সাহায্য সংস্থা বায়ফ্রান বিছিন্নতাবাদিদের সাথে রাজনৈতিকভাবে যু্ক্ত হয়ে পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সরকার এ ব্যাপারে খুব সাবধানতা অবলম্বন করবে।
৪. আমি সিনেট পররাষ্ট্র কমিটিকে আশ্বস্ত করতে চাই, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান তার অনুসারীদের অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার নির্দেশ প্রদানের পর যে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তা দমনে, অস্ত্রধারী জনতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করেনি। অস্ত্রধারী জনতা লুট-তরাজ এবং নিরীহ নাগরিকদের হত্যাকান্ড লিপ্ত হয়। মি. রাহমান পহেলা মার্চের পর সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠার পর, পূর্ব-পাকিস্তানে বিরাজমান অরাজক পরিস্থিতি দমনে এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে, সেনাবাহিনীকে আদেশ প্রদান ছাড়া আমার সরকারের আর কোন পথ ছিলোনা। এছাড়া দেশের ঐক্য এবং হাজারো শান্তিপ্রিয় নাগরিক যারা বিছিন্নতা চায়নি, তাদের রক্ষা করা সম্ভবপর ছিলো না।
৫. সেনাবাহিনীর পদক্ষেপের দরুন হতাহতের সংখ্যা অতিরন্জিত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় বেসামরিক প্রশাসনের সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হলেই, আমার সরকার বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের পূর্ব-পাকিস্তানে আমন্ত্রন জানাবে যাতে তারা বর্হিবিশ্বে ঘটনাবলি সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, তার আগ পর্যন্ত আপনার কমিটির সম্মানিত সদস্যরা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনে বিরত থাকবেন। একই সময়ে, আমি প্রফেসর ডর্ফম্যানকে লিখিত একটি চিঠির কপি প্রেরন করছি যা আমার সরকারের অবস্থান বর্ননা করে।
শুভেচ্ছান্তে,
একান্তই আপনার
এ. হিলালী
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৬। পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের উদ্যোক্তা সিনেটরদের কাছে পাক রাষ্ট্রদূত আগা হিলালীর টেলিগ্রাম | পাকিস্তান দূতাবাসের দলিলপত্র | ৫ মে, ১৯৭১ |
৫ মে, ১৯৭১
প্রেস রিলিজ
পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, আগা হিলালী দশজন সিনেটরকে টেলিগ্রাম পাঠান, যারা একটি সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে জাতিসংঘের সেক্রেটারি অফ স্টেট, জনাব উইলিয়াম পি. রজার্সকে পাকিস্তানে সকল সাহায্য স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
টেলিগ্রামের বক্তব্য নিচে বর্নিত হলো।
আমি উদ্বেগের সাথে উইলিয়াম পি. রোজার্সকে প্রেরন করা আপনাদের টেলিগ্রামটি পর্যবেক্ষন করেছি। আপনারা, পূর্ব-পাকিস্তানে বৃহদাকার সাহায্য কার্যক্রম শুরু এবং সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কর্মকর্তাদের প্রবেশাধিকার প্রদান না করা হলে, আমার দেশে সকল অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করার জন্য রজার্সকে অনুরোধ করেছেন।
আমি নিশ্চিত করতে চাই, আমার সরকার পূর্ব-পাকিস্তানীদের দুরবস্থা এবং দুর্দশা বিষয়ে পূর্ন সচেতন কেননা তারা আমাদেরই নিজস্ব লোক এবং আমার সরকার ইতিমধ্যে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থার সাহায্য গ্রহনে আগ্রহী। আমাদের মজুত শেষ হবার পূর্বেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হতে যে সাহায্য প্রয়োজন, তা গ্রহনে আমরা ইচ্ছুক। আপনাদের সরকার অবগত আছে যে, পূর্ব-পাকিস্তানে বর্তমানে যথেষ্ট পরিমান খাদ্যদ্রব্য, কাপড় এবং ঔষুধ মজুত আছে। সরবারহ ঘাটতি নয়, বরং পরিবহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা পুর্নস্থাপনের মাধ্যমে সমগ্র প্রদেশে বন্টন করাই এ মুহূর্তে প্রধান সমস্যা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী, শাসন ব্যবস্থা স্থাপন ও অস্ত্র-সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের স্থান, ভারত-সীমান্ত বন্ধ করার পর বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুর্নস্থাপন এবং হাজার খানেক লরি ও বোট সম্বলিত পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনাতে ব্যস্ত। একই সময় সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় সাহায্য কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। পূর্ব-পাকিস্তানের জনপ্রশাসন সম্প্রতি কার্যক্রম শুরু করেছে এবং সেনাবাহিনীকে সহায়তা করছে। বিদেশী সংস্থাদের কাছে অনুরোধ করার জন্য সাহায্য সামগ্রীর তালিকা এই মুহুর্তে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভবিষ্যত প্রয়োজন নির্ধারন শেষ হলেই, সাহায্যের আবেদন করা হবে। সাইক্লোন-পরবর্তী সময়ে অপরিকল্পিত এবং অপ্রয়োজনীয় সাহায্য সামগ্রী নষ্ট হওয়ার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তাই এ পদ্ধতি গ্রহন করা হয়েছে। সাহায্য কার্যক্রম শুরুর পূর্বে এবং প্রয়োজন ছাড়া আন্তর্জাতিক সাহায্যকর্মীদের আমাদের দেশে আগমনের যৌক্তিকতা নেই।
একথা সুস্পষ্ট, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগনের জন্য সাহায্য কর্মসূচীর বিষয়ে, আপনার ও আপনার সহকর্মীদের উদ্দেশ্য এবং আমার সরকারে উদ্দেশ্যে কোন পার্থক্য নেই। আশা করি আপনারা একমত হবেন, আমাদের উদ্দেশ্যকে ব্যহত করে এমন কিছুই এখন করা সমীচিন হবে না। শর্তপূরন না হলে মার্কিন সাহায্য বন্ধের অনুরোধ-সম্বলিত টেলিগ্রামটি একটি বন্ধু সরকারে প্রতি হুমকি সমতুল্য এবং তা আমাদের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে বাঁধা সৃষ্টি করবে। ক্ষমা করবেন আমায় এটা বলার জন্য যে, কোন আত্ম-অহংকারী সার্বভৌম দেশই শর্তাধীন সাহায্য গ্রহন করতে পারেনা তা যতই মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে করা হোকনা কেন। আমি আপনার এবং আপনার সহকর্মীদের অনুরোধ করবো, আপনারা সমস্যাটির প্রতি আপনাদের অভিগমন পুনর্বিবেচনা করুন যাতে আমরা আমাদের যৌথ উদ্দেশ্য সাধনে একসাথে কাজ করতে পারি।
আগা হিলালী
পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৭। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত কর্তৃক কংগ্রেসম্যান গ্যালেঘারকে লিখিত চিঠি। | পাকিস্তান দূতাবাসের দলিলপত্র | ১২ মে, ১৯৭১ |
পাকিস্তান দূতাবাস
ওয়াশিংটন ডি সি ২০০০৮
১২ই মে, ১৯৭১
প্রিয় মিঃ গ্যালাঘার,
পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমি আপনার বিবৃতি দেখেছি, যাতে এক কোটি থেকে তিন কোটি মানুষের অনাহারে মৃত্যু হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আমি আমার দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য আপনার মানবিকতার উদ্বেগের প্রশংসা করি এবং আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ভয় যাতে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণের আশঙ্কা করা হয়েছে তার যথাযথ কোনো ভিত্তি নেই। দুর্ভাগ্যবশত, শত্রুরা পাকিস্তানকে নিয়ে সব ধরনের মিথ্যা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। এ কারনেই অবস্থান পরিষ্কার করা গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান আর্মিবাহিনী আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রাথমিক কাজ পুনঃস্থাপন সম্পূর্ণ করার পর এখন ত্রাণ সহায়তা ও পুনর্বাসনের কাজে যুক্ত। পাকিস্তান সরকার তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ, যা হল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। খাদ্য মজুদ ও বিতরণের একটি ব্যাপক জরিপ পূর্ব পাকিস্তানে প্রয়োজন হওয়ায় এটি প্রস্তুত করা হয়েছে। অনুরূপ একটি ব্যাপক জরিপ ১৯৭১ এর ২৬শে এপ্রিল ইউএস এআইডি এর কর্মকর্তা কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে সম্পন্ন হয়েছিল। এটা পরিষ্কার ভাবে স্বীকৃত হয়েছে যে, এখানে কোন খাদ্য ঘাটতি নেই। কিন্তু সেখানে বিতরণের প্রকৃত অসুবিধা হয় যা সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবেলা করছে।
মার্চ এর শেষে পূর্ব পাকিস্তানের গুদামগুলোতে ৬,৮৬,০০০ টন খাদ্যশস্য মজুদ ছিল যা কিনা আমাদের সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। উপরন্তু, সেখানে ৮,০০,০০০ টন খাদ্যশস্য পাইপলাইনের মধ্যে আছে। তার মধ্যে উদ্বৃত ৩,০০,০০০ টন চাল পূর্ব পাকিস্তানে সহজলভ্য, যা কিনা ৭দিন সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পৌছতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত গুদামগুলোর মজুদ আগামী তিন মাসের খাদ্য চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত। পাইপলাইনেও পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য আছে এবং সরকার এরই মধ্যে পরবর্তী মাসগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্যোগ নিয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান পয়েন্ট চিটাগাং ও খুলনা বন্দরে যন্ত্রপাতির কোন গুরুতর ক্ষতি হয় নি এবং এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শ্রমশক্তি যা মার্চ এর অসহযোগ আন্দোলন এবং এর পরবর্তী বিশৃঙ্খল অবস্থার সময় গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গেছে, ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। অন্তত ৫০% শ্রমিক এরই মধ্যে ফিরে এসেছে এবং আমরা আশা করি যে অতি দ্রুতই বন্দরের ১০০ভাগ স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে। এটা সত্য যে চিটাগাং থেকে অভ্যন্তরীণ রেলপথ ভেংগে পড়েছে কেননা একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলব্রীজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এটির সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে যেসব পণ্য চিটাগাং অবতরণ করছে, উপকূলীয় স্টিমার ও বারজ দ্বারা সমান্তরাল সমুদ্র ও নদী পথে নারায়ণগঞ্জ পাঠানো হচ্ছে, যেখান থেকে অভ্যন্তরীণ ভাগে পরিবহনের জন্য সড়ক ও রেল সুবিধা সহজেই পাওয়া যায়।
সরকার সড়ক ও রেলপথের ক্ষতি মেরামতের জন্যও জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা হচ্ছে, ঐসব এলাকার খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে যেখানে সড়ক ও রেলপথ এখনও অনধিগম্য।
তাছাড়া, সরকার তার গ্রামীণ কার্যক্রম তীব্রতর করছে যা কিনা আগামী বছরের জন্য ২৪৮ মিলিয়ন রুপি থেকে ৩১০ মিলিয়ন রুপি হচ্ছে, যাতে পূৃর্ব পাকিস্তানের জনগণের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা সহজ হয়।
এছাড়াও যে কোন সম্ভাব্য ক্ষুদ্র এলাকাসমূহের জন্য জরিপ তৈরি হচ্ছে যেখানে খাদ্যের বিনামূল্য বিতরণের প্রয়োজনীয়তা হতে পারে। এবং এই বিনামূল্য বিতরণ কার্যক্রম সন্দেহাতীত ভাবে গৃহীত হবে।
১৯৭১ এর ৪ই মে, পূর্ব পাকিস্তানের একজন এআইডি কর্মকর্তা একটি রিপোর্ট প্রেরণ করেন যেখানে তিনি এক কোটি থেকে তিন কোটি মানুষের দুর্ভিক্ষ পীড়নের ঝুঁকির গুজব প্রত্যাখ্যান করেন। তার সিদ্ধান্ত এমন হয় যে, একটি রক্ষণশীল অনুমানের ভিত্তিতেও আমাদের উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থায় দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা খুবই কম। দেশের ভয় খাদ্যশস্য উৎপাদন, আমদানি ও বিতরণের সবচেয়ে হতাশা পূর্ণ অনুমানের উপর ভিত্তি করে। যেখানে কদাচিৎ সবকিছু একই পদ্ধতিতে একই সংগে ভুল হওয়ার কোন কারন অনুমান করা যায় না।
আমরা নিশ্চিত যে আমাদের বন্ধুদের সহায়তায় এবং আমাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি কার্যকারী ভাবে দূরীভূত হতে পারে। পাকিস্তান সরকার এই পরিস্থিতিতে তার দায়িত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। এটা তার জনগণের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করবে।
আপনার অনুগত
স্বাক্ষরিত
(এ হিলালী)
মান্যবর
কমেলিয়াস ই গ্যালাঘার
ইউনাইটেড স্টেট কংগ্রেস
২৩৫, ক্যানন হাউস অফিস ভবন
ওয়াশিংটন ডি সি ২০৫১৫
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৮। শরণার্থীদের ফিরে আসার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার আবেদন।
|
ওয়াশিংটনস্থ পাক- দূতাবাসের প্রেসরিলিজ। | তারিখ: ২১মে,১৯৭১ |
PRESS RELEASE
ISSUED BY THE
EMBASSY OF PAKISTAN
Washington D.C. 20008
Karachi, May 21, 1971
“শরণার্থীদের ফিরে আসার আহ্ববান”
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আজ পাকিস্তানি নাগরিক যারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্তি সংক্রান্ত কারনে তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়েছে, তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য জরুরী নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্টের সম্পূর্ণ বিবৃতি নিম্নে প্রদান করা হল:
চলমান রাষ্ট্র বিরোধী সহিংসতায় গত মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের একটি অংশ নিকটবর্তী এলাকায় আশ্রয় নেয়ার জন্য তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এছাড়াও অনেক দুর্বৃত্ত ও অনুপ্রবেশকারী ভারতে পালিয়ে গিয়ে তাদের কৃতকর্মের পরিণামের অব্যাহতি দিয়েছে । সেখানে আরও অনেকে আছে যারা ভারত কর্তৃক উৎসাহিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থায় অব্যাহতি দিয়ে তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে চলে যেতে।
ভারত সরকার ঘটনা অতিরঞ্জিত ও বিকৃত করে প্রচার করছে যা কিনা তাদের সীমান্ত পারাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগণ যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের বেকার ও গৃহহীন জনসংখ্যার সাথে যুক্ত হয়ে স্ফীত হচ্ছে।
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এই যে, একটি মানবিক শাখার ভিত্তিতে প্রকৃত শরণার্থী প্রশ্নে প্রয়োজনীয় সেবার পরিবর্তে ভারত এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রচারণা চালু করেছে। ভারতের এই অবস্থান শুধু মাত্র পাকিস্তানের জন্য হুমকিস্বরূপই নয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তার অব্যাহত হস্তক্ষেপের ন্যায্যতার প্রশ্নও আছে। ভারত সরকার কখনও লক্ষাধিক মুসলমানকে নিয়ে কোন উদ্বেগ দেখায়নি যারা কিনা তাদের বাস্তুভিটা থেকে বিতারিত হয়েছে এবং পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। ১৯৫৪ সাল থেকে আরও অর্ধ মিলিয়ন মুসলিমকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আশ্বাস সত্ত্বেও ভারত সরকার তাদের কোন না কোন অজুহারে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পাকিস্তান সরকার এখনও আশা করে যে, ভারত এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব পূরণ করবে।
সাধারণ পাকিস্তানি নাগরিক যারা এই বিভক্তি অবস্থা এবং অন্যান্য কারনে বাড়িঘর ছেড়ে গিয়েছিল তাদের স্বাগত জানানো হচ্ছে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসার জন্য। আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং জনজীবন দ্রুতই স্বাভাবিক হচ্ছে। আমি তাদের অনুরোধ করব রাষ্ট্রবিরোধী কোন উপাদান দ্বারা, মিথ্যা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন গ্রহণে ফিরে আসার জন্য। যেসব নাগরিক তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এসে পাকিস্তানের আইন মেনে চলবে, তাদের প্রতি সহিংসতার কোন প্রশ্নই আসে না।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৯। করাচিতে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তৃতা | ওয়াশিংটন দুতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা- ব্যাকগ্রাউন্ড রিপোর্ট-৪ | ২৪ মে, ১৯৭১
|
প্রেসিডেন্টের সাংবাদিক সম্মেলন
তাং- মে ২৪, ১৯৭১।
(নিম্নোক্ত সারাংশটি পাকিস্তান টাইমে প্রকাশিত প্রেসিডেন্ট মহোদয়ের ৭২ মিনিট দীর্ঘ সাংবাদিক সম্মেলন হতে নেয়া হয়েছে।)
করাচি, মে ২৪ঃ প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আজ সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছেন।
আজ সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানান যে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই তার মুল লক্ষ্য এবং তিনি কখনই তার মুল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি।
প্রেসিডেন্ট আরো জানান যে পূর্ব পাকিস্তানে যে বিদ্রোহ চলছে, তা তার ক্ষমতা হস্তান্তরে একটি বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করেছিল, যদিও তা ছিল একটি অস্থায়ী সমস্যা।
সেই সাথে তিনি বলেন যে গত দুই বছর ধরে চলমান পরিস্থিতিতে দেশে নির্বাচন দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তিনি বলেন- “আমি এই নির্বাচন ব্যর্থ হতে দিতে পারি না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসা মাত্রই আমি আমার লক্ষ্য পুরন করব। যদিও তিনি আবারো একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেন যে – “আমি কোন অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করবোনা।
এই ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টাতে কোনও পরিবর্তন ঘটেছে বা সম্ভাবনা আছে কিনা তা জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন- একজন সৈনিক হলে আপনি বুঝতে পারতেন যে সেনাবাহিনীতে লক্ষ্যপূরণ হল যুদ্ধের অন্যতম নীতি, এবং আমার লক্ষ্য এখনও আগের মতই অটুট আছে আর তা হল ক্ষমতার হস্তান্তর।
তিনি বলেন যে তিনি গত দুই বছর ধরেই এই কথা বলে আসছেন, কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে না। কিন্তু, তিনি এখনও এটি করার আশা করেন।
তিনি বলেন- এমনকি আমার নিজের অনেক জনগনের এই বিষয়টি পছন্দ নয়, কিন্তু তারপরো আমি এটা করবো, কেননা আমি তাদের সাথে একমত নই। আমার বিশ্বাস যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ক্ষমতার যোগ্য এবং তারা তা পাবে।
রাজনৈতিক বিদ্রোহঃ
তার ৭০ মিনিটের সাংবাদিক সম্মেলনের বেশিরভাগ সময়টিতেই প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের ঘটে যাওয়া বিপর্যয় নিয়ে কথা বলেন। “পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা ছিল একটি বিশাল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং ব্যাক্তিগতভাবে এই ঘটনা আমাকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে।
তিনি বলেন যে- সমগ্র জাতির জন্য আমি যে বিশয়গুলি পরিকল্পনা করেছিলাম এবং করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, তা একটি বিশাল বড় বাধার মধ্যে পড়ে গিয়েছে এবং এটি আমার সরকার এবং আমার জন্য একটি প্রবল পরিতাপের বিষয়।
তিনি বলেন- দেশের পূর্বাংশের মানুষের জীবনেও এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিদ্রোহের কারনে অনেক দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে আমার ভবিষ্যত সকল পরিকল্পনার মূলে থাকবে আমার পূর্ব পাকিস্তানের নীরিহ মানুষগুলির জীবনযাত্রার উন্নয়ন।
প্রেসিডেন্ট বলেন- আমি বিশ্বাস করি যে এই মানুষগুলি নিরপরাধ।একইসাথে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার জন্য সারা পৃথিবীর কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের আহবানের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই সবাইকে। আমি এই আহবান গ্রহন করছি এবং সকল ধরনের সাহায্যকে স্বাগতম জানাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা গত বছরের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, বরং এটি হচ্ছে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় এবং এটি রাজনৈতিক পরিবেশের দারুন ক্ষতিসাধন করেছে।
যথেষ্ট পরিমান খাদ্যমজুদের নিশ্চয়তাঃ
রাষ্ট্রপতি আরো ঘোষণা দেন যে পূর্ব পাকিস্তানে আগামী তিন মাসের জন্য যথেষ্ট পরিমান খাদ্য মজুদ রয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ফলে খাদ্য কর্মসূচী বাধাগ্রস্ত হলেও তা আবারো চালু হচ্ছে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যাবস্থা পুনঃনির্মাণে সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানের বিপর্যয় মোকাবেলায় বিশ্ববাসীর সাহায্য গ্রহন করার কথা আবারো উল্লেখ করে তিনি বলেন যে এ বিষয়ে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এর সাথে কথা বলেন এবং তার কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি আরো বলেন যে উ থান্ট তাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানে কোন খাদ্যের ঘাটতি হবেনা। তিনি বলেন- “আমি কোন পাকিস্তানীকে অনাহারে মরতে দেবনা। তিনি আরো বলেন যে এছাড়াও আরো অনেক দেশ সাহায্যের আহবান জানিয়েছে, এবং তিনি কৃতজ্ঞতার সাথে তা গ্রহন করবেন।
তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানে গৃহহীন মানুষদের পুনর্বাসন করতে হবে। সবচেয়ে বেশি চিন্তার কথা এই যে, তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ কোষাগার এবং ব্যাংক লুট হয়েছে এবং এই বিপুল পরিমান অর্থ গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। আমাদের এই মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হবে।
শরণার্থীঃ
ভারতীয় সীমান্তে শরণার্থীদের ঢল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রেসিডেন্ট বলেন যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মানুষ হুজুগে পড়ে সীমান্তের ওপাড়ে চলে গিয়েছে। তিনি বলেন যে বিশ্বের দরবারে এই শরণার্থীর বিষয়টি একটি মুল আলোচ্য বিষয় হয়ে দারিয়েছে। তিনি বলেন যে শরণার্থীদের যেকোন সময়ে তাদের নিজ দেশে ফিরে আসার জন্য, নিজের ঘরে ফিরে আসার জন্য আহবান জানানো যাচ্ছে।
ভারতের বিষয়ে তিনি বলেন যে, তাড়া বিভিন্ন ছুতোয় দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অন্তর্বর্তী বিষয়ে নাক গলাচ্ছে, এবং তারা নাক না গলালেই বরং পরিস্তিতি আরো ভালোর দিকে এগোবে।
প্রেসিডেন্ট গত শুক্রবারে দেওয়া তার ঘোষনার আবারো পুনরাবৃত্তি করে বলেন যে সত্যিকারের পাকিস্তানী নাগরিকদের দেশে শান্তি এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার সাথে সাথে গৃহে প্রত্যাবর্তন করা উচিত। তিনি বলেন, যেকোন পাকিস্তানী নাগরিক যারা চাপে পড়ে, হুমকির মুখে পড়ে অথবা সঙ্ঘাতের কারনে পাকিস্তান ছেড়েছেন তাদের অবশ্যই নিজ দেশে ফেরত আনা হবে। কোন উপায়ে তাদের ফেরত আনা হবে তা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, পাকিস্তানী নাগরিক কিনা তা অনুসন্ধান করার পরই তাদেরকে দেশে ফেরত নেয়া হবে।
ক্ষমাঃ
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আরো বলেন যে তিনি যারা পথভ্রষ্ট এবং ভুল নেতৃত্বের ফলে দেশে রাষ্ট্রের ক্ষতি করে এমন কর্মকাণ্ড সমর্থন বা অংশগ্রহণ করেছে, তাদের ক্ষমা করে দিতে প্রস্তুত আছেন কিন্তু যারা দেশদ্রোহী এবং যারা লুটতরাজ, খুন-খারাবি ও ধর্ষণ চালিয়েছে, তাদের তিনি কখনই ক্ষমা করবেন না।
তিনি বলেন- প্রতিটি দেশেরই অধিকার আছে অপরাধীদের শাস্তি দাওয়ার এবং আমি তাদের ন্যায্য শাস্তি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবো।
নিষিদ্ধ দল আওয়ামীলীগের কেউ জাতীয় পরিষদে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা তা জানতে চাওয়া হলে প্রেসিডেন্ট জানান, জনগন তাদের প্রতিনিধি হিসাবে ব্যাক্তিকে নির্বাচন করেছে, কোন দলকে নয়। তিনি বলেন, কাজেই আওয়ামীলীগ দল হিসেবে অকার্যকর থাকলেও দলের অন্তর্ভুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অবশ্যই জাতীয় পরিষদে অংশগ্রহণ করতে পারেন, যদি না তাদেরকে অপরাধ কমিশন অযোগ্য বলে ঘোষণা না করে থাকে। যারা রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকান্ডের জন্য অপরাধ কমিশনে দোষী সাব্যাস্ত হয়েছেন তাদের এলাকায় পুনরায় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হবে। যদিও এই সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত নয়, কেননা তিনি এখনও এই বিষয়ে তার আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেননি বলে তিনি জানান। একি সাথে তিনি এ বিষয়েও জোর দেন যে একটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার তত্ত্বাবধানে এবং প্রতিটি পাকিস্তানীর এ বিষয়ে গর্ব হওয়া উচিত। তিনি কখনই এই নির্বাচন বিফলে যেতে দিবেন না।
নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামীলীগ এর শেখ মুজিব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন সময় হলে পাকিস্তান সরকার তার মুখোমুখি হবে এবং তার প্রাপ্য অংশ তাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দাওয়া যুদ্ধের হুমকির কথা উল্লেখ করে পাকিস্তান ভারতের সাথে কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে কিনা তা জানতে চাইলে প্রেসিডেন্ট তা সম্পূর্ণভাবে উরিয়ে দেন এবং বলেন, আশা করি এমন কিছুই ঘটবে না। যুদ্ধ কখনই সমাধান হতে পারেনা। নিশ্চয়ই তিনিও (ইন্দিরা গান্ধী) তা মন থেকে চান না। পাকিস্তান সবসময়েই তার প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। যুদ্ধ কোন কিছুর সমাধান করতে পারেনা। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই নতুন পলিসি চালু করবেন বলে জানান তিনি। আইনানুগ নীতিমালায় পরিবর্তন আসছে কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন করা হয় তাকে।
সংবাদ মাধ্যমঃ
সংবাদমাধ্যমগুলির উপর আরোপিত সেন্সরশিপ তুলে দাওয়ার যে দাবি জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো তুলেছেন সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় এ সংবাদ সম্মেলনে। উত্তরে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া বলেন- বর্তমানে সংবাদপত্র গত দুই বছর ধরে সর্বাপেক্ষা স্বাধীন অবস্থায় আছে। তবে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এ স্বাধীনতায় কিছুতা নিয়ন্ত্রন প্রনয়ন করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন- আমরা শুধু কিছু সাধারন নিয়মাবলী অনুসরন করতে বলেছি সংবাদ মাধ্যমগুলিকে। একি সাথে তিনি জানান যে বিদেশি সাংবাদিকদের সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগটি তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই নেয়া হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, শেখ মুজিব এবং নিষিদ্ধ আওয়ামীলীগ দল চেয়েছিল ঢাকা এবং চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট দখল করা এবং প্রেসিডেন্ট এবং তার সতীর্থদের গ্রেফতার করা। কিন্তু শেখ মুজিব ভুলে গিয়েছিল যে তারা এমন একটি সেনাবাহিনির মুখোমুখি হবে যারা দ্রুতগামী এবং তীব্র শক্তিতে আক্রমণকারী। এমতাবস্থায় সেখানে বিদেশি সাংবাদিকদের অবস্থান নিরাপদ হবে বলে আমাদের মনে হয়নি। উপস্থিত বিদেশি সাংবাদিদের উদ্দেশ্য তিনি আরো বলেন- যদিও এখন আবারো সব খুলে দেয়া হয়েছে। আপনারা যেকোন সময়ে গিয়ে দেখে আসতে পারেন যে পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে আছে।
একজন প্রতিনিধি প্রশ্ন করেন, আওয়ামীলীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিগন বাংলাদেশ এর প্রতি অনুগত থাকবে বলে অঙ্গীকার করেছে, তাহলে তারা কিভাবে পাকিস্তানের অনুগত নাগরিক হয়? উত্তরে তিনি বলেন আওয়ামীলীগের করা ছয় দফা দাবি পাকিস্তানের মুল উদ্দেশ্যের সাথে যায়না। কিন্তু শেখ মুজিব সমঝোতায় রাজি ছিলেন, এবং আমরা তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তিনি আরো বলেন যে একটি প্রদেশের নাম বাংলাদেশ হলে তার কিছু আসে যায়না, কিন্তু তিনি কখনই বুঝেননি যে তারা বাংলাদেশ বলতে পাকিস্তানের অংশ নয়, নতুন দেশ বুঝাচ্ছে।
আরো একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সামগ্রিকভাবেই খারাপ যাচ্ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের এ সকল ঘটনা পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি ঘটানর জন্য কি উদ্যোগ নিয়েছেন জানতে চাইলে প্রেসিডেন্ট বলেন, ২৪ দিন পর্যন্ত শেখ মুজিব একটি প্যারালাল সরকার ব্যাবস্থা চালিয়েছে সেখানে, এর পর আর্থিক অবস্থা উন্নতির আর কত খানিই বা আশা করা যায়?
আমাদের প্রথম কাজ হবে খাদ্য, চিকিতসা, বাসস্থান নিশ্চিত করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা।
বিদ্রোহ ঘটার পড়ে আমি একদিনও শান্তিতে দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। অতি দ্রুতই পাকিস্তান তার পূর্বাংশে আইন এর শাসন ফিরিয়ে আনবে এবং আবারো সবকিছু নতুন করে গড়ে তুল্বে। তিনি আরো বলেন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ক্ষমতার বন্টন এবং দেশের অরথনৈতিক অবস্থান একে অপরের পরিপুরক। একটির উন্নতি অপরটি গড়ে তুলতে আরো বেশি সাহায্য করবে। তিনি বলেন- সেকারনেই আমি চাই ক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ফিরে যাক। যেহেতু তিনি একজন সৈনিক কাজেই অর্থনৈতিক অবস্থার পুনরুদ্ধারে তিনি সকল বিশেষজ্ঞদের সাহায্য কামনা করেন।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে তিনি মনে করেন কিনা যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গত তেইশ বছর ধরে শোষণের স্বীকার হয়েছে, উত্তরে তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে হ্যা, কিন্তু তার দায়টা ঐতিহাসিক, এর জন্য কেউ দায়ী নয়। তিনি বলেন, দেশ বিভাগের আগে পূর্বপাকিস্তান ছিল অবিভক্ত বাংলার অংশ। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মুসলিম জনগন পেশায় ছিলেন শ্রমিক, দিনমজুর এবং কৃষক। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে প্রায় ১০০ বছর ধরে। যার ফলে পাকিস্তানের দাবীর আন্দোলন ও তারাই শুরু করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর চলে আসা এ শোষণের দায় ঐতিহাসিক, পাকিস্তানে এর মুল রচিত হয়নি।
বাঙ্গালির এমন নিপীড়নের দায় ইতিহাসের। কিন্তু একজন সৈনিক হিসাবে, যিনি পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন, তিনি খুব ভাল করেই জানেন যে দেশ বিভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতির লক্ষ্যে কি দারুন সব উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছিল। তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে থেকেই যাত্রা শুরু করেছিলো, যার কারনে পশ্চিম পাকিস্তান এগিয়ে গেছে, এবং কোন সন্দেহ নাই যে পশ্চিম পাকিস্তান অনেক দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়েছে কেননা তারা উত্তম প্রশিক্ষনে শিক্ষা লাভ করেছিল।
বেআইনি হিসেবে ঘোষিত আওয়ামীলীগ দলের সকল নেতাকর্মীকে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করা হবে কিনা জানতে চাইলে প্রেসিডেন্ট নেতিবাচক উত্তর দেন। তিনি বলেন যে এই দলটির মাঠে নিয়োজিত কর্মীদের অংশগ্রহনের বাইরেও একটি অন্তর্বর্তী সার্কেল ছিল। এছারাও অনেক মানুষ আছেন যারা স্বায়ত্তশাসন এবং নিপীড়নের অপসারণের শপথ নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তারা কেন শাস্তি পাবেন? তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষই ভালো। তারাই আমাদেরকে সাহায্য করবে অপরাধীদের খুজে বের করতে।
মুজিবের পরিকল্পনাঃ
আরও একটি প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে তিনি শেখ মুজিবকে প্রধান মন্ত্রী হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আগ্রহী ছিলেন না। মুজিব দুইটি জাতীয় পরিষদ, দুইটি সংবিধান এবং ক্ষমতার হস্তান্তরের দেশের পূর্বাংশে করার দাবি জানিয়েছিলেন যে তিনি দুই দেশের বিভক্তিকে একটি আইনসিদ্ধ প্রক্রিয়ায় রুপ দিতে পারেন। “যখন তিনি তা করতে পারেননি, তিনি সঙ্ঘাতের মধ্য দিতে বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিলেন এবং আমি সেটা রুখে দিয়েছি”-তিনি বলেন।
আমি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথেও শেখ মুজিবের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছি এবং তারা এধরনের চুক্তিতে রাজি হয়নি। আমি তাদেরকে মুজিবের কাছে পাঠিয়েছিলাম যেন তিনি তার মত পরিবর্তন করেন, উলটো আমার নেতারাই মুজিবের অনড় অবস্থানের মুখে দুই ঘন্টার মাথায় আমার কাছে ফিরে এসেছে।
তিনি বলেন, আমি কোন দ্রুত সিধান্তে পৌছাইনি। আমার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানকে উদ্ধার করা, ধ্বংস করা নয়।
জনাব এম এম আহমাদ সাহেবের ওয়াশিংটন এবং লন্ডন যাত্রার বিষয়ে প্রশ্ন করলে রাষ্ট্রপতি জানান যে এই উদ্যোগটি অত্যন্ত উপকারী এসেছে এবং এ সফরের ফলে বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনাসহ, কাঠামোগত পুনঃনির্মাণেও সকলের সাহায্য পাওয়া যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি আরো জানান যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার লেখা চিঠির জবাব দিয়েছেন, এবং সেটি ছিল অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ একটি চিঠি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় সম্পর্কে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সাহায্যের আহবান জানান।
-এ পি পি।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩০। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নাগরিকদের ইচ্ছাকৃত বহিস্কার প্রসংগে ভারতীয় নোট প্রত্যাখ্যান | পাকিস্তান ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাস প্রকাশিত সংবাদ বুলেটিনঃ ১ জুন, ১৯৭১ | ২৪ মে, ১৯৭১ |
ভারতের অভিযোগ মিথ্যা
পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করল স্মারকলিপি
এম. এ. মানসুরি
ইসলামাবাদ, মে ২৪: পাকিস্তান সরকার আজ ভারত সরকারের ১৪ই মে এর পূর্ব পাকিস্তানের জনগনকে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাসিত’ করার অভিযোগ এবং পাকিস্তানকে ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান ও জঙ্গিবাদমুলক কার্যকলাপ পরিচালনা হতে বিরত হওয়ার দাবিতে প্রদত্ত স্মারকলিপি “সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য” বলে প্রত্যাখ্যান করে।
পাকিস্তানের মন্তব্য নিম্নে লিখিত হল।
পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের ভারত হাই-কমিশনকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেছে এবং নয়া দিল্লিতে পাকিস্তান হাই কমিশনকে পাঠানো ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মে ১৪, ১৯৭১ তারিখের পত্র নং ডি৪৬২২-পিআই/৭১ এর উত্তরে জানায়ঃ
উল্লেখিত স্মারকলিপিতে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে করা দাবির প্রকৃতি অত্যন্ত অস্বাভাবিক। শরণার্থীদের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশের ভেতর দিয়ে ভারত সরকার অন্যায়ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন বিচারে কর্তৃত্ব ফলাবার চেষ্টা করছেন এবং পাকিস্তান সরকারকে কপিতয় বিষয়ে নির্দিষ্ট কর্মকান্ডের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন যেসকল বিষয় একান্তই পাকিস্তানের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
একইভাবে, সন্ত্রাস প্রচারের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাসিত করার অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে ভুল, বিদ্বেষপরায়ণ এবং অন্যায্য।
পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগসমূহ এবং ভারতের দাবিসমূহ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ সৃষ্টি করে। পাকিস্তান সরকার, অতএব, সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হিসেবে উল্লেখিত স্মারকলিপি প্রত্যাখ্যান করে।
এই সূত্রে, অন্য রাষ্ট্রের ব্যাপারে অযথা মাথা ঘামানো হতে বিরত থেকে সদস্য রাষ্ট্রদের সংঘবদ্ধ থাকার জন্য জাতিসংঘের দলিল এবং আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালার অনুগত হওয়ার জন্য ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল যা তারা মেনে চলতে বাধ্য ।
স্মারকলিপিতে উল্লেখিত শরণার্থী সংখ্যা অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত এবং বাস্তবতার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
পক্ষান্তরে, যত সংখ্যক শরণার্থী ভারতে অবস্থানরত আছে, তার জন্যে ভারত সরকারকে তার বিশাল দায় স্বীকার করতেই হবে। এই সকল মানুষ শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী অনুপ্রবেশ, ভারতের মিথ্যা ও বিকৃত প্রজ্ঞাপন এবং এআইআর ও ভারতীয় প্রেসের দ্বারা অতিশয় অতিরঞ্জিত সংখ্যক ঘটনার জন্য যেসব ঘটনার সত্যতা এখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
অনুপ্রেরণা
ভারতীয় নেতাদের দ্বারা জনগণকে উৎসাহ প্রদান তাও এই জনস্রোতে ভূমিকা রেখেছে। এই সূত্রে, মার্চ ২১, ১৯৭১ এ ভারতীয় প্রধানমমন্ত্রীর বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে তাকে বলতে শোনা যায় যে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তার সীমানা যেকোন আগত শরণার্থীকে বরণ করে নিতে খোলা রাখবে।
এমতাবস্থায়, পাকিস্তান সরকার মনে করে যে শরণার্থী সমস্যাকে ভারতীয় সরকার কিছু নিগূঢ় উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট মাত্রায় নিতে চেয়েছে।
শরণার্থী সমস্যাকে মানবিক ভিত্তিতে বিবেচনা না করে বরং ভারতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহানুভূতিহীন প্রচারণা এই ধারনাকে আরও নিশ্চিত করে ।
এই সূত্রে, উল্লেখিত স্মারকলিপি এবং রানীক্ষেতে মে ১৯, ১৯৭১ এ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর শরণার্থী সমস্যা নিয়ে দেয়া বক্তব্যে তাকে লড়াইয়ের (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে) কথা বলতে শোনা যায় যদি পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে,” যা অশুভ।
ইয়াহিয়ার প্রস্তাব
এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের দিক থেকে সম্ভ্রান্ত এবং আইন-মান্যকারী নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরা রহিত করা বিষয়ে কখনই কোন প্রশ্নই ওঠেনি। এই সূত্রে, ভারতীয় সরকারকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতির মে ২১, ১৯৭১ এর বক্তব্যে মনযোগ আকর্ষণ করতে বলা হচ্ছে যেখানে তিনি পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছেন।
অথচ ভারত পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় নাগরিক যাদের আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বাংলা থেকে উচ্ছেদ করে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল তাদের ফিরিয়ে নিতে অবিরত অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এই শরণার্থীগণ গত দশ বছর ধরে পাকিস্তান সরকারের উপর বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা রূপে বিরাজ করছে। পাকিস্তান সরকার দাবি জানাচ্ছে যে তাদের অতি শীঘ্র ফিরে যাওয়া এবং তাদের নিজ সম্পত্তিতে পুনর্নিবার্সনের জরুরি ব্যবস্থা ভারতের নেয়া উচিৎ।
সর্বশেষে, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে অন্য নামে সম্বোধন বরদাশত করবে না। পাকিস্তান সরকার দাবি করছে যে ভবিষ্যতে ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে তার স্বীকৃত নামে সম্বোধন করবে।
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩১। দিল্লীর প্রতি পাকিস্তানের বিনা উস্কানিতে সশস্ত্র সংঘর্ষের হুমকীর প্রতিবাদ | পাকিস্তান ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাস প্রকাশিত সংবাদ বুলেটিনঃ ১ জুন, ১৯৭১ | ২৫ মে, ১৯৭১ |
দিল্লীর প্রতি তীব্র প্রতিবাদ
ইসলামাবাদ, মে ২৫: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দেয়া এইদেশের সাথে অস্ত্র যুদ্ধের “বিনা উস্কানিতে হুমকি” এর জন্যে পাকিস্তান কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং নতুন দিল্লিকে এই ধরনের ভয়ানক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
গতকাল ভারতীয় হাই কমিশনকে উদ্দেশ্য করে একটি স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে যে ভারতের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের সাথে সংঘর্ষমূলক একটি অবস্থার সৃষ্টি করা যাতে সে নিজের অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে।
আজকের প্রেসে যে স্মারকলিপি প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে: পাকিস্তান রাষ্ট্রের মানচিত্রগত সংহতি নষ্ট করার পরিষ্কার উদ্দেশ্য নিয়ে কিছুদিন ধরে ভারত সুকৌশলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে । পূর্ব পাকিস্তানে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং রাষ্ট্র বিরুদ্ধ কার্যক্রমে সাহায্য জোগাতে ভারত অস্ত্রধারী অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়েছে। এটি রাষ্ট্রীয় বেতার এবং খবরের কাগজের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মিথ্যা ও অতিশয় বিকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক নানান ঘটনা প্রচার করছে। সে তার মাটিতে শুধুমাত্র রাষ্ট্র বিরোধী উপাদানেরই স্থান দেয়নি, তথাকথিত “বাংলাদেশ সরকার” এর সদস্যদের অবিরত তার বেতার এবং অন্যান্য গণমাধ্যমগুলো ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে যাতে দেশের বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আলোড়ন জাগাতে পারে। এই সকল ঘটনা পাকিস্তান সরকারের দ্বারা ভারতীয় সরকারের নজরে আনা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বারবার। দুর্ভাগ্যবশত, এই সকল কর্মকান্ড বন্ধ না করে বরং ভারত সরকার তার ভয়ানক নীতি অব্যাহত রেখেছে।
ভারতীয় লক্ষ্য
এটি খুবই স্পষ্ট যে ভারতীয় লক্ষ্য পাকিস্তানের সাথে সংঘর্ষ অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে সে তার অশুভ রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, মে ১৯, ১৯৭১ এ রানী-ক্ষেতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী একরকম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে ভারত “লড়াইয়ের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত (পাকিস্তানের বিপক্ষে), যা বিশেষ গুরুত্ব ধারণ করে।
পাকিস্তান সরকার ভারতীয় প্রধানমমন্ত্রীর পাকিস্তানের সাথে অস্ত্রযুদ্ধের এই অনর্থক হুমকির তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাকিস্তান সরকার আশা করছে যে ভারতীয় সরকার এরকম নীতির ফলাফল উপলব্ধি করবে। উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিরতার স্বার্থে এবং দুই দেশের মানুষের কল্যাণে ভারত সরকারকে এরকম ভয়ংকর কার্যধারা থেকে বিরতি ঘোষণা করা উচিৎ।
নিবেদক
পাকিস্তান দূতাবাস
ওয়াশিংটন ডি. সি. ২০০০৮
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩২। বিভিন্ন দেশের কাছে পাকিস্তানের নোট | পূর্বদেশ | ২৮ মে, ১৯৭১ |
বিভিন্ন দেশের কাছে পাকিস্তানের নোট
ইসলামাবাদ, ২৭ শে মে (এ পি পি)- পুর্ব পাকিস্থানে সাহায্য ও পুর্নগঠন কর্মসূচীর জন্য পাকিস্তান বিশ্বব্যাংক সাহায্য কনসোর্টিয়ামভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রসহ সমস্ত বন্ধু ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের কাছে নোট প্রদান করেছে।
সরকারী মহল থেকে আজ বলা হয় যে, জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট এবং প্রেসিডেন্ট অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম,এম,আহামদের মধ্যে আলোচনার পরেই এ নোট প্রদান করা হয়। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে জনাব এম,এম,আহমেদ পুর্বাঞ্চলের সাহায্য ও পুর্নগঠন কাজে পাকিস্থানের প্রয়োজনের পরিমান সম্পর্কে উথান্টকে আভাস দেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা সাহায্যদানের ব্যাপারে নিজেদের পরিকল্পনা তৈরী করব এবং আমাদের নিজস্ব বিতরন মাধ্যমেই সাহায্য বিতরণ করবো তবে, জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা করবেন বলে আমি মনে করি।
কি কি প্রয়োজন
পাকিস্তানের কি কি জিনিস একান্ত জরুরী তার উল্লেখ করে সরকারী মহল বলেন, এর মধ্যে রয়েছে টেলিযোগাযোগের ও যানবাহনের সরঞ্জাম, উপকূলীয় জাহাজ, নৌকা ও খাদ্য। তিন মাস কিংবা তার পরে এগুলোর প্রয়োজন হবে। তবে কত টাকা মূল্যের জিনিসপত্র প্রয়োজন হবে তার এখনো হিসাব করা হয়নি।
অফিসারদের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী আড়াই টন খাদ্যের প্রয়োজন হবে। ইতিপূর্বে পি এল ৪৮০ অনুযায়ী পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সরবরাহের যে চুক্তি হয়েছিল সে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রকে এখনো দু’লাখ টন খাদ্যশস্য সরবরাহ করতে হবে।
যা আভাস ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যে দেড় লাখ টন খাদ্যশস্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে জানিয়েছে যে, গত বছর নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত দুর্গতদের জন্য দেড় হাজার টন খাদ্যশস্য সরবরাহ করবেন। পাকিস্তান আশা করছে যে,অবিলম্বেই এ সব সাহায্য পাওয়া যাবে।
.
.
শিরোনামঃ ৩৩। প্রত্যাবর্তনকারী নাগরিকদের জন্য ২০ অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন
সূত্রঃ ওয়াশিংটন দূতাবাসের দলিলপত্র
তারিখঃ ৩১ মে ১৯৭১
.
সংবাদ লিপি
৩১ মে, ১৯৭১
ফিরে আসা শরণার্থীদের জন্য অভ্যর্থনাকেন্দ্র সমূহ:
পাকিস্তান সরকার দেশে ফিরে আসা পাকিস্তানীদের পুনর্বাসন সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানে বিশটি উদ্বাস্তু অভ্যর্থনাকেন্দ্র স্থাপন করেছে ।
নিন্মোল্লেখিত স্থানে শরণার্থী কেন্দ্রগুলো স্থাপন হয়েছে :
খুলনা জেলার সাতক্ষীরা
যশোরের বেনাপোল
কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর
রাজশাহীর গোদাগাড়ী, রহনপুর ও ধামরিহাট
দিনাজপুরের খানপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়
রংপুরের কালীগঞ্জ
ময়মনসিংহের নালিতাবাড়ী ও দুর্গাপুর
সিলেটের জইন্তাপুর, কুলাউড়া ও চুনারুঘাট
কুমিল্লার আখাউড়া ও বিবিরা বাজার
নোয়াখালীর ফেনী এবং
চট্টগ্রামের টেকনাফ
গোলযোগের সময় এ শহর থেকে তাদের পূর্বপুরুষের গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষদের একটি বড় সংখ্যা তাদের শহুরে বাড়িগুলো আসতে শুরু করেছেন।
এ কথা স্মরণ করা যেতে পারে যে ২১ মে তারিখে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সকল সম্মানিত পাকিস্তানি নাগরিকদের তাদের ঘরে ফিরে আসার আবেদন জানিয়েছিলেন ।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৪। সিনেটর কেনেডিকে লিখিত পাক রাষ্ট্রদূত আগাহিলালীর চিঠি | ওয়াশিংটন দূতাবাসের দলিলপত্র | ৪ জুন, ১৯৭১ |
পাকিস্তান দূতাবাস, ওয়াশিংটন ডি.সি. ২০০০৮
৪ জুন, ১৯৭১
প্রিয় সিনেটর কেনেডি:
আমি ২ জুনে ভারতে আমাদের রিফিউজি সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কংগ্রেশনাল রেকর্ডে আপনার দেয়া বিবৃতি পড়লাম। আমি আপনাকে আশ্বাস দিয়ে লিখছি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই বহিঃপ্রবাহ বন্ধে আমার সরকার ভারতের সরকারের মতই উদ্বিগ্ন এবং গত কয়েক দিনে শুধুমাত্র দেশ ছাড়তে চাওয়া ব্যক্তিদের থামানোরই উদ্যোগ নেয় নি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার জন্য তাদের প্ররোচিত করার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এতদপ্রসঙ্গে,আমি এই ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে ২১ মে তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে অস্থিতিশীল অবস্থার জন্য যে সকল পাকিস্তানের নাগরিক ঘরবাড়ি ছেড়েছেন তাদের দেশে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের রেডিও নেটওয়ার্ক এবং পাকিস্তানের সকল ধরনের প্রেসে এই আহ্বান প্রকাশিত হয়েছে যাতে করে রিফিউজিরা যেখানেই থাকুক তারা যেন এটা জানে এবং ফিরে আসে।
তাঁর প্রকাশ্য আবেদনের তিন দিন পর রাষ্ট্রপতি ২৪ মে করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে যারা অস্থির পরিস্থিতি, হুমকি, ভয়ে বা সত্যিকারভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে দেশত্যাগ করেছে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার বাস্তবায়নের জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের এগারোটি সীমান্ত জেলায় কুড়িটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে শরণার্থীদের অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারে। এই কেন্দ্রগুলি রাষ্ট্রপতির সাধারণ নির্দেশনার অধীনে চালিত হয় “এখানে পাকিস্তানের সব আইনানুগ নাগরিকদের তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফেরত আসতে অনুমতির প্রশ্নই ওঠে না।” সেন্টারে মোতায়েন বেসামরিক কর্মীরা সম্ভাব্য সব উপায়ে, বাড়িতে ফিরতে, কর্মসংস্থান এবং জীবন পুনরায় শুরু করতে উদ্বাস্তুদের সাহায্য করবে। আমরা বুঝতে পারি যে কিছু শরণার্থী ফিরতে শুরু করেছেন, কিন্তু আমরা রাষ্ট্রপতির আবেদনের বিপরীতে পূর্ণ সাড়ার জন্য অপেক্ষা করছি এবং তাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের সুবিধার জন্য সরকার কর্তৃক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। আমরা মনে করি যে উপরে বর্ণিত ব্যবস্থা বর্তমানে পরিস্থিতির চাহিদা পূরণ করতে পারে, যদি না আমাদের প্রতিবেশী দেশের কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানকে পরাজিত করার রাজনৈতিক হাতিয়ারস্বরূপ রিফিউজিদের দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে কোনো ধরণের বাধা আরোপ না করে। আমরা আশাবাদী যে এই কাজটিতে আমরা সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য ও সহানুভূতি প্রাপ্ত হব, যাতে আমরা একটি মানবিক সমস্যা যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করতে পারি।
পূর্ব পাকিস্তানে ২ হতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামি লীগের নৈরাজ্য এবং সহিংসতার জন্য যে অস্থিতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল তা শেষ হওয়ার পর এবং আইন শৃঙ্খলার পুনর্প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে যোগাযোগ মাধ্যম পুনঃস্থাপনের জন্য , যাতে প্রদেশের দুর্গত এলাকাসমূহে যতো দ্রুত সম্ভব খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। সাহায্য প্রদানের আন্তর্জাতিক প্রস্তাব কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে এবং জাতিসংঘ খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যা অদূর ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ হিসেবে প্রয়োজন হতে পারে তার একটি তালিকা দিয়েছে। ইউ এন এর মহাসচিব ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন।
আপনি দাবি জানিয়েছেন যে বিভিন্ন সরকার ও জাতিসংঘের শক্তিশালী প্রচেষ্টা করা আবশ্যক আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার এবং আপনার বর্ণিত “পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তির” মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থান সহজতর করার। যে রাজনৈতিক ইস্যু পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক অশান্তি সৃষ্ট করেছে সেটি জনসাধারণের প্রতিনিধিদের নিকট থেকে এই ব্যাপারে একটি স্পষ্ট ম্যান্ডেটবিহীন প্রশ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে যে আন্দোলন দমন করা হয়েছিল, সেটার উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমগ্র জনগোষ্ঠী হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদর্শন নয়, এবং কারো এটা মনে করা উচিত নয় যে, একটা বিশ্বাসঘাতকদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কাজটি যখন দেশেই করা হয়, তখন তা বিদেশ হতে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। যেই নেতাদের হুকুমে তাদের সংগঠকদের দ্বারা ম্যান্ডেট ছড়ানো হয়েছে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার তাদের জন্যে যারা এখন পথভ্রষ্ট হয়েছে কিন্তু দেশে রয়ে গেছে এবং যারা ছেড়ে যায় নি কিন্তু বিচ্ছিন্নতা চায়নি এবং দেশের বাকি লোকদের সঙ্গে, যেটিকে পশ্চিম পাকিস্তান বলা হয় তাদের সাথে আপস করে প্রদেশের ভবিষ্যত নির্ধারন করতে চেয়েছিল। এই সমস্যা এখন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে তিনি প্রদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আগামী দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যে তাঁর পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন। এই স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য সরকারগুলো বা সংগঠন দ্বারা কোন প্রচেষ্টার মাধ্যমে (এমনকি যদি ভাল উদ্দেশ্য থাকে)হস্তক্ষেপ করা ইউ এন সনদ বিধানাবলীর বিপরীত হবে যা সম্পূর্ণই আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। সুতরাং আমরা বিস্মিত না যে ভারত সবচেয়ে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য পাঠিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ত্রাণ সংক্রান্ত কার্যক্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে আপনার উদ্বেগের প্রশংসা করি। তবে বর্তমানে সাধারণ আমেরিকান অর্থনৈতিক সাহায্যের কোন প্রয়োজন নেই, কারণ সেই সহায়তা হবে আমাদের পূর্ববর্তী কার্যক্রমের একটি প্রতিফলন মাত্র, যা ত্রাণ কার্যক্রমের ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপের শর্তাধীন। আমাদের নিজস্ব মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার আমাদের দিতে হবে, এবং ইতিমধ্যে দিচ্ছি। আমেরিকান অর্থনৈতিক সাহায্যের ওপর অপ্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করার প্রচেষ্টা শুধুমাত্র নিঃস্বার্থ লক্ষ্যসমূহ হতে বিচ্যুতই করবে, এবং আমি নিশ্চিত , এই দেশের মহান মানুষজন পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ হতে উন্নয়নশীল দেশসমূহে সহায়তার প্রবাহ নিশ্চিত করতে চায়।
আপনি একটি দাবি জানিয়েছেন যে ভারতে যে সকল রিফিউজি সাময়িক ভাবে আছে তাদের সহায়তা প্রদানের ব্যয় নির্বাহের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ কর্তৃক ভারতকে সহায়তা করতে হবে যতোদিন পর্যন্ত তারা ভারতের সীমানায় বসবাস করছে। আমরা আপনার মতামতকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি এবং আপনার সরকারকে একই সাথে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থাকেও আমরা এটি জানিয়েছি।
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর ব্যাপারে আমরাও আপনার সাথে সমভাবে উদ্বিগ্ন। রিফিউজিদের ফিরিয়ে আনা এবং ভারত অথবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপারে আমাদের সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলো আমি আগেই উল্লেখ করেছি। মিঃ সিনেটর, আমি আশা করি আপনিও এ ব্যাপারে একমত হবেন যে আমাদের প্রতিবেশী অথবা বন্ধু দ্বারা এমন কোন কিছু বলা বা করা উচিত হবে না যা বর্তমান সমস্যাকে আরো উস্কে দেয় অথবা আরো নতুন সমস্যা যোগ করে।
এই ব্যাপারে আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে নির্দেশ করতে চাই যে বর্তমানের উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে উস্কে দিতে এমন কোন দিন নাই যে ভারত সরকার কিছু না কিছু করছে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ইতিমধ্যে উপমহাদেশে একটি গুরুতর অবস্থা তৈরি হয়েছে এবং ভারত যদি এভাবেই আমাদের বর্তমান দুরবস্থার সুযোগ নেওয়া অব্যাহত রাখে, সেখানে একটি বিরুদ্ধ ব্যবস্থা না নিলে বিপদ বাড়বে। আমাদের রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবকে আরো উস্কে দেয়ার জন্য তাদের জাতীয় দৈনকগুলোকে সর্বোচ্চভাবে আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে ব্যবহার করে, পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগ্যজনক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে এবং খোলাখুলিভাবে আমাদের ভূমিতে অনুপ্রবেশ করেছে সকল প্রকার আন্তর্জাতিক আইন ও কানুনকে অগ্রাহ্য করে, তাদের সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় এনেছে এবং সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রেখেছে। যুদ্ধাভাবাপন্নতার একটি ধুয়া তুলে ভারতীয় নেতারা এবং প্রেস একসঙ্গে প্রকাশ্যে দাবী তুলেছে শরণার্থী সমস্যা সমাধান করা উচিত “স্থানিক ক্ষতিপূরণ” এর মাধ্যমে। বলপ্রয়োগ করার এই ভারতীয় হুমকি এখনও পর্যন্ত আমার সরকার দ্বারা শান্তভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং আমরা পরম সংযম চর্চা করেছি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর ২৪মে তারিখের সংবাদ সম্মেলনে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে মিসেস গান্ধী যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান করার কথা চিন্তা করছেন না। কিন্তু এই ধরনের মারমুখো চাপের শুধুমাত্র একটাই ফলাফল হতে পারে, যুদ্ধ, যা এই অঞ্চলের শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। সবচেয়ে খারাপ হলো, এই ধরনের হুমকি কোনো শরণার্থীকে দেশে ফিরে আসতে বা পুনর্বাসনের ব্যাপারে সাহায্য করবে না। বরং এগুলো তাদের ভয় ও উদ্বিগ্নতা বাড়াবে যা প্রকৃতপক্ষে তাদের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে বিলম্বিত করবে। ভারত এই শরণার্থীদের লালন পালনের বোঝা হ্রাস করতে পারে শুধুমাত্র যদি ‘সে হুমকি দেওয়া বন্ধ করে আমাদের এবং জাতিসঙ্ঘের সংস্থাসমূহকে সহযোগিতা করা শুরু করে যাতে করে শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে গৃহীত উপরোক্ত ব্যবস্থাসমূহ (যেগুলো উন্নততর)কার্যকর করা যায়। যদিও আমি এই পরিস্থিতির প্রতি আপনার প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে চাই না, তবে আমি এই ব্যাপারে জোর দিতে চাই যে, যদি পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে হয় এবং রিফিউজিদেরকে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতে হয়, আমাদের পাকিস্তানের অধিবাসীদের অনেক বেশি সময় ও সমঝোতা এবং কম উদ্বিগ্নতা ও চাপ প্রয়োজন।
২৭ মে মার্কিন সরকার সচিবকে দেয়া আপনার চিঠিতে “পাকিস্তানে বিবৃত প্রয়োজন অনুযায়ী অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ দ্রব্যমূল্য বিতরণের জন্য, খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ এবং জল পরিবহনের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত” শীর্ষক আপনার মন্তব্য করার জন্য আমরা খুব কৃতজ্ঞ। আমি শুধুমাত্র এই বলতে চাই যে আপনার সরকার ইতিমধ্যে খুব উদার পরিমানেই এই কাজটা করছে এবং আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে আমাদের শরণার্থীদের ফিরে আসা এবং পুনর্বাসন সুরক্ষিত করতে আমাদের আরও বেশি সহায়তা করা হবে। এখন যেটা দরকার তা হল আপনার মত ভাল বন্ধুর যিনি ভারতে গোলযোগ হ্রাস করতে পারে যেন আমাদের পক্ষে সে কাজটা করা সম্ভব হয় যেটি আপনার ভাষায় “ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা কমাতে” , উত্তেজনা, যেটি আপনি সঠিকভাবে ধরতে পেরেছেন, যা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অপ্রয়োজনীয় কিন্তু বড় ধরনের ক্ষমতার দ্বন্ধের সূচনা করতে পারে। যদি আগে বলে থাকি তাহলে আবার বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, যখন আমরা জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে মগ্ন, তখন আমাদের প্রত্যাশা যে আমাদের বৈদেশিক শুভাকাঙ্ক্ষীরা ধৈর্য ধরবে এবং বোঝার চেষ্টা করবে যে ফিরে আসা এবং পুনর্বাসনের সকল কাজ সম্পন্ন করতে সময় দরকার কারণ এই সংখ্যা অনেক বড়।
আমি আশা করি, জনাব সিনেটর, এই চিঠির কপি অন্যান্য সিনেটরদের এবং লোকসভার সদস্যদের পৌছে দিতে এবং কংগ্রেসনাল রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে আপত্তি করবেন না।
আপনার একান্ত অনুগত,
এ। হিলালী
মাননীয়
এডওউয়ার্ড এম কেনেডি
ইউ এস সিনেট
রু নং ৪৩১
পুরাতন সিনেট বিল্ডিং
ওয়াশিংটন ডিসি, ২০৫১০
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৫। পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার মেহদী মাসুদের স্বদেশের প্রত্যাবর্তনে ভারতীয় বাধা সম্পর্কে পররাষ্ট্র দফতরের একটি প্রেস রিলিজ | ওয়াশিংটনস্থ পাক দূতাবাসের দলিলপত্র | ৪ জুন, ১৯৭১ |
প্রেস রিলিজ
জুন ৪, ১৯৭১
পাকিস্তানের সরকার এই নজিরবিহীন ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে নিয়েছে
কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনের পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের ভারতে তাঁদের ইচ্ছার বিরদ্ধে আটকে রাখা এবং পাকিস্তান এ ফিরে না যেতে দেবার নজিরবিহীন ঘটনাটি পাকিস্তান সরকার গুরুত্বের সাথে নিয়েছিল।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভারতের সরকার এখন পর্যন্ত পাকিস্থানের ডেপুটি হাই কমিশানার, মেহেদি মাসুদ এবং কলকাতায় কর্মরত পূর্ব পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো বৈঠক এর ব্যবস্থা করেনি, যেটা করার কথা ছিল। তিনি আরো বলেন “এটা পরিষ্কার যে ভারতের সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এই দীর্ঘসূত্রিতার কৌশল প্রয়োগ করছে।”
নীচে মে এর ২৭ তারিখে ইসলামাবাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত পররাষ্ট্র অফিসের মুখপাত্রের বক্তব্য উদ্বৃত করা হলো।
কলকাতাস্থ পাকিস্থানী দূতাবাসের ডেপু্টি হাই কমিশনার জনাব মেহেদী মাসুদকে কলকাতায় পূর্ব পাকিস্থানের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করার জন্য কোন সুবিধা দেয়া হয়নি এবং পাকিস্থানে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নিজেদের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেছে। তবে এই ব্যাপারে ভারত সরকার যে নিশ্চয়তা দিয়েছিলো, তা পূরণ হয়নি।
কলকাতাতে যখন পূর্ব পাকিস্থানের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক হবে, তখন পাকিস্থান ভারতকে অনুরোধ করেছে, সেখানে যেন সুইশ সরকারের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকে, যে বৈঠকটা হবার ব্যাপারে ভারত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করছিলো। কিন্তু তখন পযন্তও পাকিস্থানের সেই অনুরোধের ব্যাপারে কোন সাড়া দেয়নি এই কারনেই পাকিস্থানের সেই খায়েশ পূরণটা অনিশ্চিত হয়ে পড়লো, সেই সাথে তাদের পাকিস্তানে প্রত্যাবাসানও দেরী হয়ে গেলো।
এটা প্রতীয়মান যে ভারতের সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে দীর্ঘসূত্রিতার পন্থা অবলম্বন করছে। যদি ভারত রিপোর্ট করে যে আমাদের কলকাতা মিশনের পূর্ব পাকিস্থানি সদস্যদের অবস্থান পরিবর্তনের ব্যপারটা সঠিক, তাহলে এই অফিসার দের জনাব মাসুদের সাথে আলাদা করে দেখা করার ক্ষেত্রে এবং পাকিস্তানে ফেরত যাবার ব্যাপারে তাঁদের অসম্মতির কথা জানাতেও আর কোনো বাধা থাকবে না।
যদিও তা আর হয়ে ওঠেনি। ভারতের সরকার চাইছে অজুহাত দেখিয়ে তার অঙ্গীকার এড়াতে এই বলে যে, এটা ভারতের জন্য আফসোসের কারন যে তারা পূর্ব পাকিস্তানের অফিসার দের কে কোনো ভাবে রাজি করাতে পারছে না পাকিস্থানের ডেপুটি হাই কমিশনারের সাথে দ্রুত দেখা করাতে। এই ব্যখ্যা টা পাকিস্তানের কাছে গ্রহণ যোগ্য ছিল না। যদি ভারতের দাবি অনুযায়ী এই অফিসার রা রাজাকার হয়ে থাকে, তাহলে তাঁদের আর কোনো ধরনের কূটনৈতিক সুবিধা পাওয়ার কথা না এবং ভারতের ভূখন্ডে থাকাটাও তাঁদের জন্য অবৈধ হয়ে যাবে।
অধিকন্তু এটা ভারতের সরকারের দায়িত্ব ও হবে যে পাকিস্তান স্বীকৃত এই প্রতিনিধিদের অনুমতি দেওয়া যে তাঁদের উপর আনা দল বদলের অভিযোগটা সঠিক কিনা সেটাও নিরূপণ করতে দেয়া। অবশেষে পাকিস্তানী সরকার বাধ্য হল এই উপসংহারে আসতে যে কলকাতা মিশনের পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতে আটকে রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র যে জনাব মেহেদী মাসুদ কে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল দেখা করার ক্ষেত্রে তা নয়, বরং মিশনের পূর্ব পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের কেও অনুমতি দেয়া হচ্ছিল না তাঁদের পূর্ব পাকিস্তানী সহকর্মীদের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করতে যাদের বাসার উপর কড়া নজর রাখা হয়েছে।
ভারতের কর্তৃপক্ষের পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের আটকে রাখা এবং তাঁদের পাকিস্তানে ফিরে যাবার অনুমতি না দেবার এই নজীরবিহীন ঘটনাটি পাকিস্তানী সরকার যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই দেখছে। কলকাতা মিশনের পূর্ব পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের পরিবার, পাকিস্তানী সরকারের সাথে যোগাযোগও করেছে এ ব্যাপারে, এই কর্মকর্তাদের বর্তমান অবস্থা এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর জানতে। পাকিস্তানী সরকার এ ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক তথ্য দিতে পারেনি এই কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন পরিবারগুলোকে, কারণ কলকাতায় অবস্থিত পূর্ব পাকিস্থানী অফিসারদের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করাই সম্ভব হচ্ছিল না।
এটা খুবই হতাশাব্যাঞ্জক যে, ভারত সরকার এইসব কর্মকর্তাদের কলকাতা ও ঢাকা থেকে সরে যাওয়াকে স্রেফ মানব সংকটের দৃষ্টিতে দেখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো, যেটা পারস্পরিকতা এবং আন্তজার্তিক রেওয়াজ অনুসারে মিমাংসা হওয়া উচিত ছিলো।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে এই ইস্যুটাকে যথাযথভাবে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কাজে লাগানোর ব্যাপারে খুবই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হলো, এতটাই যে তারা ঢাকা ও কলকাতায় দুই দেশের কর্মকর্তাদের ভোগ করা অপ্রতুলতা আর অনিশ্চয়তার ব্যাপারে অভিন্ন ছিলো। সাধারনত এটা আশা করা হয়েছিলো যে, ঢাকাস্থ ভারতীয় কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেবার কাজটি তরান্বিত করতে ভারতীয় সরকার কলকাতায় অবস্থানরত পাকি ডেপুটি হাই কমিশনার ও তার অধস্তনদের দ্রুতই অঙ্গীকারকৃত সুযোগ সুবিধা প্রদান করবে।
ভালভাবে পুরস্কৃত করা এটা প্রমান করে যে, ঢাকা ও কলকাতার কর্মকর্তাদের পারস্পারিক সরিয়ে নেবার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ভারত সরকারের যে দায় ছিলো, সেটার ব্যাপারে তারা যথেষ্ঠ আন্তরিক ছিলো না। এই বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় এইভাবে যে, যখন চূড়ান্ত প্রত্যাবাসনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া সম্পন্ন হলো, ভারত বারবার তাদের অবস্থান বদলাচ্ছিলো ঢাকা থেকে তাদের কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেবার ধরনের ব্যাপারে। ভারত তাদের কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেবার প্রক্রিয়া শুরু করলো নেপালি একটা ফ্লাইটে করে কাজটি করার প্রস্তাব দানের মাধ্যমে।
পরবর্তীতে, তারা পরামর্শ দিলেন যে, সরিয়ে নেবার প্রক্রিয়াটি রাশিয়ান বিমান দ্বারা বিঘ্নিত হতে পারে। তখন তারা আবারো তাদের অবস্থান বদলালো। এবং প্রস্তাব করলো যে, ভারতের কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেবার ব্যাপারে একটি ইরানিয়ান বিমান ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রত্যাবাসন জন্য ব্যবস্থা অবশেষে সম্পন্ন হয় যখন কর্মীদের ঢাকায় দৃঢ় উদ্যোগ দেখা দেয়। ভারতের পরিকল্পনা টা আসলে কি সেটা ঠিক স্পষ্ট নয়। ভারতের করা তিনটি ধারাবাহিক প্রস্তাব দ্রুততার সাথে মেনে নেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানী সরকার ভারতকে জানায় যে, যত তাড়াতাড়ি ভারত এবং ঢাকা থেকে স্থনান্তরকামী কর্মকর্তাদের তালিকা পাকা করা হবে, তত তাড়াতাড়ি তাঁদের জন্যে উপযুক্ত ব্যাবস্থা নেয়া হবে। যদিও ভারতীয় সরকার তখন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার কে জানায়নি যে তারা জনাব মেহেদী মাসুদের সাথে কলকাতা অবস্থিত পূর্ব পাকিস্থানী কর্মকর্তাদের একটা বৈঠকের ব্যবস্থা করবে যাতে তারা তাঁদের নিজ নিজ ইচ্ছা স্বাধীন ভাবে জনাব মাসুদের কাছে জানাতে পারে।
—————————————
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৬। দেশত্যাগী নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনে নিরাপত্তা বিধান সম্পর্কিত একটি সরকারী প্রেস রিলিজ | ওয়াশিংটনস্থ পাক দূতাবাসের দলিলপত্র | ৯ জুন, ১৯৭১ |
প্রেস রিলিজ
জুন ৯, ১৯৭১
ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত পাকিস্থানের দূতাবাস কর্তৃক ইস্যুকৃত
১. পাকিস্তান সরকার, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আপিল সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা দেওয়া হবে, এখন জাতিসংঘের হাইকমিশনকে পূর্ণ সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে উদ্বাস্তুদের সুরক্ষিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন করার জন্য।
২. জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার, প্রিন্স সাদরুদ্দিন ইসলামাবাদ এ যান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, তাঁর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব এম এম আহমেদ (যিনি সম্প্রতি ওয়াশিংটন পরিদর্শন করে এসেছেন) এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সাথে জুনে এর ৬ এবং ৭ তারিখে বৈঠক করেন, ভারতে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্থানী শরণার্থীদের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন এবং পূনর্বাসন ব্যবস্থার ব্যাপারে কথা বলার জন্য।
পাকিস্তানের সরকার ইসলামাবাদে একটি বিজ্ঞপ্তি তে জানান যে প্রিন্স সাদরুদ্দিন কে তাঁর কাজের জন্য পূর্ণাঙ্গ সহায়তা দেবার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকার তাদের দেশের নাগরিক দের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে ইসলামাবাদ পরিদর্শন করেন এ ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা করার জন্য।
৩. এটা স্মরণ করা হবে যে, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সব সীমান্ত জেলায় বেসামরিক সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত বিশটি রিসেপশন সেন্টার স্থাপন করেছে, যেগুলো দ্রুত আবাসন সংকট পূরণ করবে ফিরে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য, যেটা রাষ্ট্রপতি ইয়াহ ইয়ার নির্দেশের ফলোআপ হিসেবে, যেটা সে প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিলো যাতে করে শরনার্থীদের যথাসম্ভব সাহায্য গ্রহন ও প্রদান করা হয়।
৪. ইতিমধ্যেই কিছু প্রতিবেদন আমরা পেলাম, সেখানে যুদ্ধ হচ্ছে পুরোদমে। যেখানে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ভারতের সীমান্ত দ্বারা নিগৃহীত শরনাথীদের জামিন দেয় যারা সীমান্ত পার হতে চায় তাদের নিজেদের দেশ পাকিস্থানে ফিরে যাবার জন্য।
—————————————
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৭। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা আশ্বাসঃ একটি সরকারী প্রেস রিলিজ | পাক দূতাবাসের দলিলপত্র | ১৯ জুন, ১৯৭১ |
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি(প্রেস রিলিজ)
জুন ১৯, ১৯৭১
পাকিস্তান দূতাবাস কর্তৃক জারিকৃত
ওয়াশিংটন, ডি সি ২০০০৮
১৮ই জুন পাকিস্তান রেডিওতে প্রচারিত এক বক্তব্যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, “সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিন্দুমাত্রদ্বিধা না করে, পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ঘরে ফিরে আসা উচিৎ। কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া পাকিস্তানের যোগ্য নাগরিক হিসেবে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং সুবিধাদি প্রদান করা হবে।”
২১মে প্রচারিত তার আবেদনের বিষয় উল্ল্যেখ করে, তিনি সকল গৃহচ্যুত ব্যক্তিকে, ঘরে ফিরে আসার আহবান জানান। তিনি বলেন, “জাত-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানির জন্যই আমার এই অনুরোধ।“
প্রেসিডেন্টের পূর্ণ বক্তব্যের লেখ্য নিম্নে উল্ল্যেখিত হলঃ
“২১শে মে এক ব্যক্তিগত বার্তায় আমি সকল পাকিস্তানি নাগরিকদের, যারা নানা কারনে ভারতে গিয়েছেন, পূর্ব-পাকিস্তানে তাদের ঘরে ফিরে এসে দৈন্দদিন কার্যক্রম শুরু করা আহবান জানিয়েছিলাম। ২৪শে মে করাচীতে আমার প্রেস ব্রিফিংএ, আমি আমার বক্তব্য পুর্নব্যক্ত করি এবং নিশ্চিত করি গৃহচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তন ও পুর্নবাসন প্রয়োজনীয় সুবিধাদি প্রদান করা হবে। আনন্দের বিষয়, সুযোগ-সন্ধানী পক্ষের বাধা স্বত্বেও, অনেক পাকিস্তানি ফিরে আসছেন এবং বর্তমানে তাদের ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। আমি নিশ্চিত আরো অনেকেই ফিরে আসবেন। আমি আগেই উল্ল্যেখ করেছি, আমাদের নাগরিদের ফিরে আসার ক্ষেত্রে স্থগিত-অনুমতির প্রশ্নই আসে না।পূর্ব-পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যে তাদের অভ্যর্থনা এবং পুর্নবাসনের জন্য সম্পূর্ন সহয়তা প্রদানে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আমার অনুরোধ জাতি-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানির জন্যই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে, পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ঘরে ফিরে আসা উচিৎ। কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া পাকিস্তানের যোগ্য নাগরিক হিসেবে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং সুবিধাদি প্রদান করা হবে। আমি তাদের অনুরোধ জানাবো, যেনো তারা পাকিস্তানের বাইরে থেকে পরিচালিত কোন অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হোন।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৮।জাতির উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষন | পাকিস্তাব এ্যাফেয়ার্স ওয়াশিংটন দূতাবাসের বিশেষ সংবাদ বুলেটিনঃ ৩০শে জুন | ২৮ জুন, ১৯৭১ |
২৮শে জুন ১৯৭১ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের পূর্ণ ভাষ্য
আমরা সকলেই পূর্ব-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে ব্যথিত। ব্যক্তিগতভাবে এই দুঃখজনক ঘটনায় আমি মর্মাহত এবং হতাশ। বিগত আড়াই বছরে আমার লক্ষ ছিলো, দেশে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলের জন্য সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষত পূর্ব-পাকিস্তানের ন্যয়সংগত দাবির প্রতি আমি সচেতন ছিলাম। দাবিপূরনে নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুর্নস্থাপনে গ্রহনকৃত আমার ব্যবস্থাদির প্রতি, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জনগন ও তাদের নেতাদের সমর্থন ছিল। ১৯৭০ এর আইন কাঠামো আদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেতারাসকলেইঅংশগ্রহনকরে। যে কাঠামো সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাষন, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম পরিচালনের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি প্রদান করে।
আওয়ামী লীগও নির্বাচনে এই আইন কাঠামো আদেশের ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করে, এবং তাই সেসময় ধারনা জন্মে, তারাও এক পাকিস্তান নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের নেতৃত্ব ধীরে ধীরে আইন কাঠামো আদেশ থেকে দূরে সরে যায় এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রতি ঘৃনা, উত্তেজনা বৃদ্ধির চেষ্টা এবং দুই অঞলের ভুল বোঝাবুঝির ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রচারনা পরিচালনা করেছে।
ছয়দফা
মুজিবর রহমানের সাথে আলোচনার সময়, আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিশ্চিত করেন, ছয় দফা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তিনি পরিষ্কার করে উল্ল্যেখ করেন, সংবিধানের সকল গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংসদের বাইরে, রাজণৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহনে মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে। তিনি নিশ্চিত করেন, এরকম মীমাংসা রাজনীতিবিদের মধ্যে সাধারন বিষয়। নির্বাচনের পরযখন পাকিস্তানের ভবিষ্যত সংবিধান নিয়ে দলগুলোকে ঐক্যমতে আসার আহবান জানানো হয়, তখন বোঝা যায়, মুজিবর রহমান তার অবস্থান পরিবর্তন করবেন নাহ যা ছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদেরই সমতুল্য। বারবার অনুরোধ স্বত্বেও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে এসে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান – যা তার দূরাভিসন্ধির ইংগিত বহন করে। সমগ্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা হিসেবে, দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক আচরন করার কোন ইচ্ছা তার ছিলো না। তিনি ইতিমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছিলেন, চাতুর্য বা সহিংস উপায়ে তিনি দেশকে দুইভাগে ভাগ করবেনই।
আমি আমার ২৬শে মার্চের ভাষনে উল্লেখ করেছি, ১৫ই মার্চ পরবর্তী আমার ঢাকা সফরের সময়, মুজিবর রহমান ও তার উপদেষ্টাদের সাথে একাধিক বার আলোচনায় বসি। আমাদের সাথে আলোচনার সময়, সে ও তার অনুসারীরা গোপনে সহিংস উপায়ে চূড়ান্ত ভাঙ্গনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আলোচনার শেষ পর্যায়ে, পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যায়, এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে মীমাংসায় পৌছানো, মুজিবর রহমান ও তার অনুসারীদের উদ্দেশ্য নয়। বরং তারা আমার কাছ থেকে একটি ঘোষনাচায়, যা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় অধিবেশনকে দুইটি প্রাদেশিক অধিবেশনে বিভক্ত করে ফেলবে, কনফেডারেশনের জন্মদিবে এবং জরুরী অবস্থা (মার্শাল ল) অপসারণের মাধ্যমে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে, পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন তার উদ্দেশ্য ছিলো। যা বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতির পিতার তৈরী পাকিস্তানের শেষ পরিনিতি ডেকে আনবে।
অকার্যকর আওয়ামী লিগের বিবেকবর্জিত ও বিচ্ছিন্নতাবাদি অংশ দেশকে ভাঙনের কিনারায় নিয়ে এসেছে। উপমহাদেশের মুসলিমদের আশা ও ক্লান্তিহীন সংগ্রামের ফসল, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ ভাঙনের আশংকায়। শেখ মুজিবর রহমান ও তার সমর্থক গোষ্ঠীর তিন সপ্তাহের তীব্র (সহিংস) অসহযোগ আন্দোলনের সুযোগে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দল লুটতরাজ, অগ্নি সংযোগ ও হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়েছে।
ভোটের উদ্দেশ্য প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাষন, স্বাধীনতা নয়
পূর্ব-পাকিস্তানের জনগন প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাষনের জন্য ভোট প্রদান করেছে, দেশের ভাঙনের জন্য নয়। বিতর্কিত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয় জাতীয় স্বার্থে পারস্পারিক আলোচনা ও আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমাধান না করে, অকার্যকর আওয়ামী লিগের কিছু নেতা বিদ্রোহ, অসহযোগ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের পথ বেছে নেয়। আমার সকল প্রচেষ্টা স্বত্তেও, অকার্যকর আওয়ামী লিগের কিছু নেতাদের অসহযোগিতার জন্য গ্রহনযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যমতে আসতে ব্যর্থ হয়। একদিকে আপোষহীন ও অনমনীয় অবস্থানের মাধ্যমে তারা আলোচনাকে থমকে দেয়, অন্যদিকে সরকার-বিরোধী দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকান্ড তীব্রতর করে তোলে।আমাদের হাজারো ভাইয়ের জীবন এবং লক্ষ মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগের ফলশ্রুতিতে জন্ম যে রাষ্ট্রের, তার অস্তিত্বই ঝুকির মুখে। এমতাবস্থায় আমি সেনাবাহিনীকে সরকারের কর্তৃত্ব পুনারোদ্ধারের নির্দেশ প্রদান করি। কোন সরকারই দেশকে সশস্ত্র রাষ্ট্রবিরোধি বিদ্রোহিদের কাছে ধ্বংস হতে দেবে না।
সর্বদাই জাতির সেবায় নিবেদিত সাহসী পাকিস্তান সেনাবাহিনী, দুর্বৃত্তদের দমনের দৃঢ় সংকল্পে অভিযান শুরু করে। তাদের কাজ সহজ ছিলো নাহ। দুখজনক, আমাদের প্রতিবেশী, যারা সর্বদাই আমাদের দেশকে দুর্বলতর বা বিকল করায় সচেষ্ট, পরিস্থিতিকে আরো উসকে দিতে, দ্রুত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহয়তায় এগিয়ে আসে– যা ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। আমাদের বাহিনীর অভিযানের ফলে আওয়ামী জংগী, বিদ্রোহী এবং আমাদের বৈরী প্রতিবেশীর ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, বিচ্ছিন্নতাবাদি, দুর্বৃত্ত, বিদ্রোহী ও সীমান্ত পারের অনুপ্রবেশকারীরা দীর্ঘ সময় ধরে সর্তকতার সাথে পরিকল্পনা করেছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধবংস আর পূর্বাঞ্চলকে বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য।দুর্বৃত্ত, বিদ্রোহী ও সীমান্ত পারের অনুপ্রবেশকারীরা যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন ভারতীয় বেতার ও সংবাদ মাধ্যম পৃথিবীবাসীকে বিভ্রান্ত করতে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়। ভারতীয় সরকার কূটনৈতিক আক্রমন, সশস্ত্র অনুপ্রবেশ, ও আক্রমনের হুমকি সহ প্রতিটি দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে। আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে এরকম প্রকাশ্য হস্তক্ষেপের পরিনতি ভয়ংকর হতে পারতো; কিন্তু খোদার ইচ্ছায়, আমাদের সেনাবাহিনী দেশ-বিরোধীদের দমন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে। জাতি সেনাবাহিনীর ভূমিকায় গর্বিত। আমারা সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরন করি, যার জন্য আমাদের দেশ ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেয়েছে।
নতুন নির্বাচন নয়
আমার শেষ ঘোষনায়, আমি আশ্বস্ত করেছিলাম, আমার লক্ষ্য ক্ষমতা হস্তান্তর এবং আমি আরো আশ্বস্ত করেছিলাম, লক্ষপূরণে আমি নতুন পদক্ষেপ নিবো। আমি স্পষ্টভাবে প্রথমেই বলতে চাই, কোন নতুন নির্বাচনের প্রশ্নই উঠে নাহ। কিছু বিপথগামী ব্যাক্তির দুস্কৃতির জন্য বিপুল অর্থ, সময় ও শক্তি ব্যয়ে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম নির্বাচনের ফলাফলকে সম্পূর্নরুপে বাতিল ওঘোষনা করা হবে নাহ। যদিও আওয়ামী লিগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে, আমি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছি, কিন্তু এই বাতিলকৃত দলের সদস্য যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তাদের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে। যদিও যেসকল নির্বাচিত-সদস্য রাষ্ট্রবিরোধী বা অপরাধমূলক বা সমাজবিরোধী কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন, তাদের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ আমি বাতিল ঘোষনা করবো। এখন পর্যন্ত আমি বাতিল ঘোষনা করা হবে এমন সদস্য সংখ্যা নিরুপন করিনি। আমূল তদন্তের পর, এই রূপ ব্যাক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
তারপর শূণ্য আসনে, প্রচলিত নিয়মে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইতিমধ্যে, আমি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে, বাতিলকৃত আওয়ামী লিগ হতে নির্বাচিত সদস্যদের, যারা দলের নেতৃস্থানীয়দের বিচ্চিন্নতাবাদি নীতির সাথে জড়িত নন এবং যারা উক্ত নীতির সমর্থনে কোন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে দোষী নন বা যারা অন্য পাকিস্তানীদের প্রতি কোন সহিংস আচরন করেন নাই, তাদের আহবান জানাবো যেনো তারা পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো পূর্নগঠনে অংশগ্রহণ করেন।
নিবিড় ও সতর্করুপে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন, বিশেষত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, সংবিধান প্রনয়নের দায়িত্ব, পরিষদের হাতে ন্যস্ত করা সমীচিন নয়। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে সংবিধান প্রনয়নের ইতিহাস সুখকর বা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সংবিধান প্রনয়নে দুইটি পরিষদ নয় বছর সময় নিয়েছে (১৯৪৭-১৯৫৬)। পরিষদের সভায় দেশের নেতৃবৃন্দ সংবিধান প্রনয়নে মাত্রারিক্ত সময়ক্ষেপন করেছে, অথচ জরুরী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা অনালোচিত ও অবহেলিত রয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের সবথেকে দুঃখজনক ঘটনা হল এটি সবরকমের প্রাদেশিক অনুভূতি ও সংকীর্নতাকে বিকশিত করেছে। সব’চে আক্ষেপের বিষয়, সংবিধান প্রনয়ন পাকিস্তানে নোংরা রাজনৈতিক কলহ ও চক্রান্তের জন্ম দিয়েছে যার ফলে দেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। এবং অবশেষে ১৯৫৬ সালে তারা যে সংবিধান প্রনয়ন করেছে; তা ছিলো নানা ধরনের সাংঘর্ষিক আপোষ ও সুবিধার ফলাফল। ফলশ্রুতিতে, অচিরেই সংবিধান লুপ্ত করে অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে জুন ১৯৬২ পর্যন্ত দেশে মার্শাল ল জারি হয়। পরবর্তীতে যে সংবিধানের অধীনে দেশ শাষন করা হয়, তা বোধগম্য কারনেই জনপ্রিয় ছিলো নাহ। ১৯৬৯ এ সংবিধানের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃনা ও রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়। তাই, আমি চেয়েছিলাম, জনগনের প্রতিনিধিরাই সংবিধান প্রনয়ন করুন, কিন্তু পাকিস্তানে সংবিধান প্রনয়নের পূর্ববর্তী ব্যার্থতার পুনরাবৃত্তি রোধে, আমি ১২০ দিনের সময় বেধে দেই। এবং আমি আমার আইনি কাঠামো আদেশে সংবিধানের জন্য কিছু মূলনীতি ও নির্ধারন করে দেই। মুজিবর রহমান সহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষেই, ১২০ দিনের সময়সীমা নির্ধারন করা হয় এবং আশা করা হয়েছিলো, সংবিধান গঠনেই তারা পূর্ণ মনোযোগ দিবে ও সাধারন পরিষদের বাইরেই সংবিধানের প্রধান বিষয়গুলোতে ঐক্যমতে আশা যাবে যাতে নির্ধারিত সময়ে সংবিধান প্রনয়ন শেষ হয়। কিন্তু বাতিলকৃত আওয়ামী লিগের আপোষহীন ও দেশপ্রেমহীন মনোভাবের কারনে আমার আশা ও পরিকল্পনা ধুলিস্যাত হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞবৃন্ধ কর্তৃক খসড়া সংবিধান প্রনয়ন
এই পরিস্থিতে ও বর্তমান অবস্থার নিরিখে, বিশেষজ্ঞদের দ্বারা খসড়া সংবিধান প্রনয়ন ছাড়া আমি অন্যকোন বিকল্প দেখছি না। জাতীয় পরিষদ এই সংবিধানে বর্ণিত সংশোধনবিধি অনুসারে সংবিধানের সংশোধন করতে পারবে। একাধিক সংবিধানের নিবিড় পর্যালোচনা এবং বিগত দুই বছরে আমার দেখা পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এই সংবিধান প্রনীত হবে। ইতিমধ্যে গঠিত সংবিধান কমিটি তারা খসড়া সংবিধান প্রনয়ন শুরু করছে।খসড়া সংবিধান প্রনয়ন সমাপ্ত হলেই, আমি জাতীয় পরিষদের নেতাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করবো। বিশেষজ্ঞ ও নেতাদের পরামর্শ ও আমার সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধান চূড়ান্ত করা হবে।
আমি আরো উল্ল্যেখ করতে চাই, ১৯৭০ এর আইন কাঠামোতে ভবিষ্যত সংবিধানের বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো, যা জনগনের ও পছন্দ ছিলো। প্রথমত, পাকিস্তানের সংবিধানের ভিত্তি হবে ইসলামী আদর্শ, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠন করা হয়েছিলো এবং যা আজো পাকিস্তানের চালিকাশক্তি। এ সংবিধান হবে প্রকৃত পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধান।
সংবিধান সমাজের সকল শ্রেনীর জন্য পূর্ণ সামাজিক ও আর্থিক ন্যায়বিচার ও নিশ্চিত করবে। সংবিধানের প্রকৃতি হবে কেন্দ্রীয় চরিত্রের। আইন কাঠামোতে যেমন উল্ল্যেখ করা হয়েছিলো, প্রদেশগুলো আইনগত, প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়াদী সহ সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাষন পাবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের আইনগত, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসহ, বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীন দায়িত্ব পালন ও দেশের স্বাধীনতা ও ভূ-তাত্তিক অখন্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা থাকবে।
শূন্য ঘোষিত আসনে উপ-নির্বাচন
আমি কমিটিকে জানিয়েছি, দেশের অখন্ডতার স্বার্থে, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে আবদ্ধ ও বাস্তবঅর্থে জাতীয় নয় এমন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করতে। আবার, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে একই দলের মধ্যে একাধিক উপদলের সৃষ্টি যেনো না হয়। সংক্ষেপে আমার আশা, আমাদের রাজনীতিকে ভংগুর, অস্থির, নিরাপ্ততাহীন ও দেশবিরোধী করে তোলে এমন সবকিছুকে এ সংবিধান উচ্ছেদ করবে এবং রাজনীতিবিদ ও সাধারন মানুষের মধ্যে সঠিক চেতনার উম্মেষ ঘটাবে। সংবিধান কোন বিশেষ ব্যাক্তি বা দলের নয় বরং সমগ্র পাকিস্তানের উদ্দেশ্য সাধন করবে। সংবিধান, কেন্দ্রের শক্তি হ্রাস না করে ও জাতির অখন্ডতা বজায় রেখে, প্রতিটি প্রদেশের সঠিক পন্থায় উন্নয়ন নিশ্চিতকরবে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন থেকেই এই সংবিধান কার্যকর হবে।উপ-নির্বাউন জাতীয় নির্বাচনের ন্যায়, ১৯৭০ এর অধ্যাদেশ অনুসারেই অনুষ্ঠিত হবে।
ভবিষ্যত সংবিধান সম্পর্কে আপাতত এতটুকই, এখন আমি ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসন পূরনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জনগনের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে, আমি নিশ্চিত উপ-নির্বাচনের প্রচারনা, আইন কাঠামো অধ্যাদেশ অনুসারেই হবে। পাকিস্তানে অখন্ডতার প্রতি হুমকিজনক কোন প্রচারনাই কেউ সহ্য করবেনা। আমি মনে করি, প্রচারনা সংক্ষিপ্ত হওয়াই বাঞ্চনীয়। এসকল নির্বাচনের পর, যথাসময়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সভা আহবান করা হবে এবং দেশের সর্বত্র জাতীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হবে। জাতীয় পরিষদকে সংবিধান-গঠনের জন্য কাজ করতে হবেনা বরং শপথ গ্রহনের পর থেকেই তারা কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ হিসেবে কাজ করবে।
জাতির সাম্প্রতিক ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা বিবেচনা করে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিছু সময়ের জন্য জাতীয় ও প্রাদেশিক সরকার, সামরিক শাসনের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। বাস্তবে, বর্তমানের ন্যায় সামরিক শাষণ না থাকলেও, আমরা দেশের কোথা বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে দিতে পারি না। এবং পরিস্থিতি শান্ত হবার আগে সরকারের শক্তি বৃদ্ধির ও প্রয়োজন রয়েছে।
নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে, আইন কাঠামো অধ্যাদেশের যথাযথ সংশোধন করা হবে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়কাল
আমি এখন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়কাল সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। একথা পরিষ্কার যে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা এখনই সম্ভবপর নয় কেননা ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে চিন্তার পূর্বে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসা জরুরী। কিন্তু অন্যদিকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অযথা কালক্ষেপন ও কাম্য নয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে প্রধান বিবেচ্য, আইনের শাসন পুনরোদ্ধার, বিধস্ত প্রশাসনিক কাঠামোর পুর্নস্থাপন এবং অর্থণৈতিক পুর্নবাসন।
আইনের শাসনের ক্ষেত্রে, আমি আনন্দের সাথে জানাতে চাই, পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে আছে। তারা দুস্কৃতিবাজ, ষড়যন্ত্রকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের ধ্বংস করে দিয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ন স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে। জনগন ও দেশপ্রমিক নেতাদের সহায়তায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলমান আছে। দুস্কৃতিবাজ ও অনুপ্রবেশকারীদের দমনে সেনাবাহিনীকে সহায়তার মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগন দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের চেতনার প্রকাশ করেছে।
অসহযোগ আন্দোলনের ফলে, পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। অবাধ লুটতরাজ, আওয়ামি লিগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হুমকি, দুস্কৃতিকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের জন্য নির্দোষ মানুষদের অবর্ননীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তাদের অনেকেই আতঙ্কিত ও নিজেদের সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদের স্বীকার। তাদের জন্য পুরো জাতি ও আমার পূর্ন সমবেদনা। তাদের দ্রুত পুর্নবাসনকে প্রাপ্য অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব না দেয়া হবে অমানবিক।আমি পুর্নব্যক্ত করতে চাই, ধর্ম, বর্ন, জাত নির্বিশেষে যে সকল পাকিস্তানি বিদ্রোহী, দুর্বৃত্ত ও অন্যদের মিথ্যা প্রচারনায় আতংকগ্রস্থ হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছেন, তাদের অবশ্যই তাদের ঘরে ফিরে আসতে হবে।পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারের তাদের অভ্যর্থনা ও পরিবহনের জন্য সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছেন। আমি ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাবো, যেনো এসকল ভাগ্যহীন লোক যারা নিজেদের ঘরে ফিরে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে ও নিজেদের আত্মীয়স্বজনের সাথে পুনরায় একত্রিত হতে ইচ্ছুক, তাদের কোন বাধা দেয়া না হয়। এসকল গৃহ-হারা মানুষের পাকিস্তান প্রত্যার্পনে জাতিসংঘের যেকোন সহায়তা, আমরা আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহন করবো।
জনগনের অংশগ্রহন
আমি একটি মত শুনেছি, যা প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার পূর্বে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সমীচিন মনে করে নাহ। আমি এই মত সমর্থন করি নাহ কেননা তা অবাস্তব ও অকার্যকর। প্রশাসনে জনগনের পূর্ণ অংশগ্রহন ছাড়া স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে পারেনা, জাতীয় জীবনের এই গুরুত্বপূর্ন দিকটি এই মতামতে বিবেচিত হয়নি।
চার মাসে ক্ষমতার হস্তান্তর
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আইনের শাসনের মৌলিক কাঠামো এবং প্রশাসনিক কাঠামোর স্তরগুলো শক্তি অর্জন সক্ষম হলেই, আমি আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করতে পারবো। বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন ও নিকট ভবিষ্যতের অনুমানে, আমার আশা ও বিশ্বাস আমি চার মাসের মত সময়ে আমার লক্ষ্য পূরনে সফল হবো। স্বভাবতই প্রকৃত সময়কাল, আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে। আমি সম্পূর্ণরুপে নিশ্চিত, দেশের অখন্ডতা ও মঙ্গল, এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের মধ্যেই নিহিত।
আমি এখন অর্থনীতির সম্পর্কে বলতে চাই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েছে। নির্বাচনের আগের ও পরের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতি চাপের মুখে। মার্চে পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনীতি দৃশ্যত স্থবির হয়ে পড়ে।
সেনাবাহিনীর সাফল্যজনক হস্তক্ষেপে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে ও প্রদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনর্জীবিত হয়। আমি নিশ্চিত প্রদেশের দেশপ্রমিক নাগরিকগন পূর্ন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ও পাকিস্তানে অর্থনীতি গঠনে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনীর পাশে দাড়াবেন।
অর্থনৈতিক পুর্নবাসন ও অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এজন্য আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি যা শীগ্রই আশানুরূপ ফলাফল দিবে।
পূর্ব-পাকিস্তান হতে তীব্রহারে রপ্তানী হ্রাসের ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে গিয়েচে যা ইতিমধ্যে তীব্র চাপের সম্মুখীন।রাজস্ব আদায় ধুকছে, দেশের অখন্ডতা ও অর্থনীতির গতি সঞ্চরনশীল রাখতে, আমাদের সকল সম্পদের প্রয়োজন।
অর্থনীতির কঠিন সময় মোকাবেলা করার জন্য, সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহন করেছে যা সবসময় সুখকর নয়। আমাদেরকে অধিকতর সীমাবদ্ধতার সাথে সম্পদ ব্যবহার করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন কৃচ্ছতা ও ত্যাগ। কিন্তু এছাড়া গত্যন্তর নেই। অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের এই একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায়।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি আমদানি নীতি পুর্নবিবেচনা করতে আদেশ করেছি। সকল অপ্রয়োজনীয় বা বর্তমানে যে সকল পন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়, এমনকি অতিরিক্ত কোটার অধীনেও নিষিদ্ধ করেছি। সংশোধিত আমদানি নীতিতে অতিরিক্ত কোটায় উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কাচামাল ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি করা হবে।
মিতব্যায় ও কৃচ্ছতা
আভ্যন্তরীণ খরচের ক্ষেত্রে ও সর্বোচ্চ ব্যায়হ্রাসের নীতি গ্রহন করা হয়েচে। আগামী বছরের জন্য মধ্যম মাত্রার উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে, যা আমাদের আশু ও অবশ্যম্ভাবী চাহিদার যোগান দিবে। অর্থনীতিরে পুর্নবাসন বিশেষত পূর্ব-পাকিস্তানের উপর জোর দেয়া হবে।
আমি চাই দেশ দ্রুত স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাক। আমাদের সম্পদ থেকেই আমাদের চাহিদা মেটাতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই ব্যয়সংকোচন। এ লক্ষে সরকার অর্থনৈতিক নীতিমালাতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করছে, কিন্তু এর সাফল্য জনগনের স্বতস্ফূর্ত সমর্থনের উপরনির্ভরশীল। চলুন জাতি হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধাপে আমরা মিতব্যয়ী জীবন যাপন করি এবং সকল ধরনের আড়ম্বরতাকে পরিহার করি।
বহু বছর ধরে আমাদের উন্নয়ন প্রোগ্রামের জন্য সাহায্য-প্রদানকারি দেশগুলো থেকে আর্থিক সহয়তা পেয়ে আসছি, যা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরন করি।কিন্তু দু:খের সাথে বলতে হয়, ইদানীং আর্থিক সহয়তার ক্ষেত্রে রাজনীতির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এবং পাকিস্তানের জনগনের মনে হচ্ছে, এসকল আর্থিক সহয়তা শর্তাধীন।যদি তাই হয়, তাহলে,আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি এমন কোন আর্থিক সাহায্য গ্রহণযোগ্য নয়।আর্থিক সাহায্য ছাড়া চলার জন্য আমাদের সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি,পাকিস্তানের নিজস্ব সম্পদ উন্নয়নেবেসরকারী খাত সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসবে। নিজস্ব সঞ্চয়ের অর্থ থেকে বেসরকারী বিনিয়োগ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বহিরাক্রমণ বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য পূর্বে নানান সময়ে আমরা যে সংকল্প ও দৃঢ়তা দেখিয়েছি,জাতির এই সঙ্কট কালে,আমাদের সেই একই সংকল্প ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে হবে।
আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব কঠোর পরিশ্রম ও অর্থনীতির পুনর্নির্মানের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ উৎপাদন।প্রতিটি শ্রমিক ও চাষী উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে জাতীয় প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে পারেন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষায় অবদানরাখতে পারেন।
উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি
আসুন আমরা আজ সঙ্কল্প করি, আমারা সমষ্টিগত ও ব্যাক্তিগত পর্্যায়ে অধিক উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য চেষ্টা করবো। আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে ও স্বল্পতম সময়ে পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। এই লক্ষ্যপূরনে দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতির জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।সম্পর্ক ভাল রাখার জন্য আমি, শ্রমিক ও মালিক উভয়কেই অনুরোধ জানাবো।
ঝগড়া ও শত্রুতার বদলে আমরা পাস্পারিক সৌহার্দ্য ও বোঝা-পড়ার উপর জোর দেই। যেকোন মূল্যে হরতাল ও লক-আউট এড়াতে হবে।জাতীয় জীবনে এই ক্রান্তিলগ্নে দেশের উৎপাদনশীল সম্পদের এমন অপচয় সম্পূর্ণই দেশদ্রোহী আচরন। এমন দেশদ্রোহী আচরনকে ছাড় দেয়া হবে না এবং তা দমনে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
আমাদের কৃষিবিদরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসাধারণ কাজ করেছেন।১৯৬৫ সাল থেকে খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধির মাধ্যমে, খাদ্যে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রান্তে নিয়ে এসেছেন। খাদ্যশস্য উতপাদনে তারা আরো উন্নতি করুক এবং একই সময়ে রপ্তানি ফসল উৎপাদনে মনোযোগ দিক, যেখানে উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ আছে। এই উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা প্রদান করতে প্রস্তুত।
আজ আমি অকপটে আমাদের সমস্যাগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি।কিন্তু আমরা যেনো হতাশ না হই। সমস্যার একটি বড় অংশই অস্থায়ী প্রকৃতির। এটা অর্থনীতির মৌলিক শক্তিকে প্রভাবিত করেনি। কৃষি ও শিল্প উভয়ক্ষেত্রেই উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ আছে। আমাদের আজ প্রগতিশীল কৃষিবিদ, শিল্প উদ্যোক্তা ও মধ্যবিত্তের বিনিয়োগকারীদের বড় গোষ্ঠী রয়েছে।এরাই একটি দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতির মূল ভিত্তি। জাতি তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আগে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে. আমি কোন আছে আমার কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমান অসুবিধা অতিক্রম করতে সক্ষম এবং একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়পরায়ন সমাজ জন্য নির্মাণ আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।
বৈদেশিক প্রতিক্রিয়া
এখন আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে বিদেশী প্রতিক্রিয়ার উপর আলোচনা। সন্তুষ্টির বিষয় যে, গত কয়েকমাসের কঠিন পরিস্থিতিতে, বিশালসংখ্যক দেশের প্রতিক্রিয়া ছিলো সহানূভূতির;আমারা যে সমস্যা ভোগ করছি ও সমাধানের চেষ্টা করছি, তা তারা বুঝতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি আমাদের বিদেশী বন্ধুদের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।একই সময়ে তারা, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপকারীদের বিরত থাকতে সতর্ক করেছেন।আমি এই সুযোগে, সরকার ও পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে এবং আমার পক্ষ থেকে তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানতে চাই।
আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুকূল প্রতিক্রিয়ায় আপ্লুত বিশেষত জাতিসঙ্ঘ ও এর সংস্থাসমূহ যারা পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষতি পূরনে আমাদের চাহিদামত যৌথ সহয়তায় সাড়া দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্রাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য বিষয়ে আমরা বন্ধু সরকার এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে বর্তমানে আলোচনা করছি।
আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে ভারতের অব্যাহত হস্তক্ষেপের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনীতির পুনর্গঠন ও প্রাথমিকরা জনৈতিক কর্মকান্ডের পুনরারম্ভ হুমকির সম্মুখীন। ভারতের সশস্ত্র অনুপ্রবেশ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রকাশ্য উৎসাহ ও সহায়তার ফলে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এছাড়া ও ভারতের নির্ভরযোগ্য সুত্র হতে একাধিক অবন্ধুসুলভ বক্তব্যে, দাবি না মানলে, পাকিস্তানের প্রতি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েচে। এই মুহূর্তে এসকল বক্তব্য ও কর্মকান্ড হতে বিরত থাকা উচিৎ যাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি না পায়।সংঘাত নয়, সংলাপের মাধ্যমেই কলহের মীমাংসা সম্ভব। রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরন দাবি করে সতর্ক ও সাবধানতা যাতে সমস্যা আরো ঘনীভূত না হয়।
আমরা শান্তিতে থাকতে চাই
আমি আগেই বলেছি, সশস্ত্র সংঘাতের ফলে কিছুর সমাধান হবেনা। আমাদের পক্ষ থেকে, আমরা চাই সব আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতিতে বসবাস করতে। আমরা কারো আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না এবং অন্য কেউ আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলেও সহ্য করবো না। তবে, যদি আমাদের উপর জোর করে পরিস্থিতি চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে আমরা আমাদের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সংহতি বজায় রাখার জন্য আমাদের দৃঢ়সংকল্পের বিষয়ে কোন ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।
.
আমার প্রিয় দেশবাসী, শেষ পর্যন্ত আমি আবার আপনাদের স্মরন করিয়ে দিতে চাই, জাতির এই ক্রান্তিকালে আমাদের সততা ও নিষ্ঠা সাথে কাজ করে যেতে হবে, যাতে আমাদের প্রিয় দেশ প্রগতির পথে এগিয়ে যায়।কোন আত্মাহুতিই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনোরুদ্ধার ও পাকিস্তানের ঐক্য থেকে বড় হতে পারে না। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, যে উৎসাহ ও আত্মিক শক্তির বলে আমরা পাকিস্তান প্রতিষ্টা করেছিলাম, তা পুর্নজীবিত করতে হবে এবং সংকল্প ও অটল ইচ্ছায় প্রদর্শণ করতে হবে যার ফলশ্রুতিতে আমরা আগে একাদিকবার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকি থেকে দেশকে রক্ষা করেছি।
আমাদের শত্রুরা আমাদের জনগনের মধ্যে অনৈক্যের মিথ্যা আশায় আন্দোদিত।তারা আমাদের প্রিয় দেশকে ধ্বংস করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, কিন্তু তারা আছে ভুলে গেছে, তারা এমন জনগোষ্ঠী সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত যারা সর্বশক্তিমানের ঈশ্বরের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আমার যেনো এই কঠিণ সময়ে আমাদের প্রমাণ করতে পার, আমাদের জাতির জনকের প্রত্যাশা পূরন করতে পারি, এবং আমাদের শত্রুদের প্রমান করে দিতে পারি, আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র, যা তাদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাত ও অশুভ উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করতে করতে সদা-প্রস্তত, এবং আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা, তাদের জন্যই দুর্যোগ ডেকে আনবে।
আমার জনগণের দেশপ্রেম পূর্ণ বিশ্বাস আছে এবং আমি নিশ্চিত যে প্রতিটি পাকিস্তানী আমাদের লক্ষ্যপুরনে যথা – দেশে গণতন্ত্র পুন: প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতিরক্ষা এবং সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আমাকে সর্বান্তকরণে আমাকে সহযোগিতা করবে। ঈশ্বর আমাদের প্রচেষ্টাকে সাফল্যমন্ডিত করুন। ঈশ্বর আপনাদের সকলের মঙ্গল করুন।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩৯। পাকিস্তানের কড়া প্রতিবাদ জ্ঞাপনঃ ভারতীয় বিমান আক্রমন | দৈনিক পাকিস্তান | ৪ জুলাই, ১৯৭১ |
পাকিস্তানের কড়া প্রতিবাদ জ্ঞাপনঃ ভারতীয় বিমান আক্রমণ
ইসলামাবাদ, ৩রা জুলাই (এপিপি)।- ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান আজ পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার অমরখানায় হামলা চালায়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর দ্রুততার সঙ্গে ভারত সরকারের নিকট এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ভারতের অস্থায়ী হাই কমিশনারকে আজ সন্ধ্যায় এখানে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাকে জানানো হয় যে, পাকিস্তান এটাকে অত্যন্ত মারাত্মক ঘটনা বলে মনে করে এবং কোনরুপ উস্কানী ছাড়া পাকিস্তানী এলাকায় এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা না হলে তা উপমহাদেশের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে।
তাঁকে আরো জানানো হয় যে, আজ দুপুর সাড়ে বারটায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর চারটি জঙ্গী বিমান ও একটি অস্ত্র সজ্জিত হেলিকপ্টার পাকিস্তানের আকাশসীমার ৬ মাইল ভেতরে অনুপ্রবেশ করে এবং দিনাজপুর জেলার অমরখানায় বিমান থেকে মেশিনগানের গুলীবর্ষণ করে।
এছাড়া আজ বিকেলে ভারতের দিক থেকে ১২০ মিলিমিটার মর্টারের সাহায্য আমরখানায় প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হয়।
কোনরুপ উস্কানী ছাড়াই পাকিস্তান এলাকায় ভারতীয় বিমানের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং এই ঘটনায় পাকিস্তানের বিশেষ উদ্বেগের কথা জানিয়ে পররাষ্ট্র দফতরের ডিরেক্টর জেনারেল ভারতীয় দূতকে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রোয়জনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তার সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাতে বলেন।
সীমান্ত লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ইসলামাবাদ, ৩রা জুলাই (এপিপি)।- ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বার বার সীমান্ত লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং দুঃখ প্রকাশ করেছে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলীবর্ষণ ও পাকিস্তানী এলাকায় অনধিকার প্রবেশের প্রাত্যহিক ঘটনাসমূহ বন্ধ করার জন্য ভারত সরকার এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করেনি। ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে জানমালের যে ক্ষতি হচ্ছে পাকিস্তান সরকারের তার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করার অধিকার রয়েছে।
গত ১লা জুলাই বৃহস্পতিবার এখানে ভারতীয় হাই কমিশনে প্রদত্ত এক প্রতিবাদ লিপিতে গত ২১শে জুন থেকে ২৫শে জুনের মধ্যে পাকিস্তানে ভারতের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের ১৮টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়ঃ
১। ১৯৭১ সালের ২১শে জুন ভারতীয় সেনাবাহিনী রাত সোয়া আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত সিলেট জেলার তেলিয়া পাড়া এলাকায় (আর এম ৫৪৭৩) সীমান্তের ওপার থেকে ভারী মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করে।
২। ১৯৭১ সালের ২২শে জুন কোনরুপ উস্কানী ছাড়াই ভারতীয় সৈন্যরা কুষ্টিয়া জেলার মহেশখণ্ড (কিউ ও ৬২৬৫) সীমান্ত ফাঁড়ির উপর ভারী মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করে।
৩। ১৯৭১ সালের ২২শে জুন নোয়াখালী জেলার ফেনী এলাকায় (আর আর ৭৭৩৮) কোনরুপ উস্কানি ছাড়াই পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর গুলীবর্ষণ করা হয়। ফলে তিন জন আহত হয়।
৪। ১৯৭১ সালের ২২শে জুন সকাল আটটায় ভারতীয় সৈন্যরা যশোর জেলার বেনাপোল এলাকায় (কিউ টি ৭৪৪১) একটি অবস্থানের উপর মেশিনগানের গুলীবর্ষণ করে এবং ভারী মর্টারের সাহায্যে ৩০ রাউণ্ড গোলা নিক্ষেপ করে। ভারতীয় ফিল্ড কামান থেকে পাকিস্তানী এলাকার অনেক ভেতরে ৩০০ রাউণ্ড গোলাবর্ষণ করে। এই যথেচ্ছ কার্যকলাপের ফলে উক্ত এলাকায় চারজন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও তিনটি বাড়ী বিধ্বস্ত হয়।
৫। ১৯৭১ সালের ২২শে জুন সকাল পাঁচটার সময় প্রায় ৫০০ ভারতীয় সৈন্য বেসামরিক পোশাকে স্বয়ংক্রিয় ও ছোট অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং কুমিল্লা জেলার রাজপুরে (ও আর এম ২৮০৭) সীমান্ত ফাঁড়ির উপর হামলা চালায়। ভারতীয় ফিল্ড কামানের গোলাবর্ষণ করে এই হামলায় সহায়তা করা হয় হয়। কোনরুপ উস্কানী ছাড়াই এরুপ তৎপরতা চালানোর ফলে চার ব্যক্তি নিহত হয়।
৬। ১৯৭১ সালের ২৩শে জুন কোনরুপ উস্কানী ছাড়াই ভারতীয় সৈন্যরা যশোর জেলার বেনাপোল এলাকায় (পি কিউ টি ৭৬৪৪) মেশিনগান ও ভারী মর্টারের সাহায্যে দু’বার গোলাবর্ষণ করে। এই এলাকায় প্রায় প্রত্যহই ভারতীয় গোলাগুলি বর্ষিত হয়।
(অসমাপ্ত).
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪০। কমনওয়েলথ এর সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কচ্ছেদ | পুর্বদেশ | ৪ জুলাই, ১৯৭১ |
রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটির সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কচ্ছেদ
ইসলামাবাদ, ৩রা জুলাই (এপিপি)।- পাকিস্তান লণ্ডনের রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটির সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
উক্ত সোসাইটির সুযোগ-সুবিধা পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণায় ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকার বৃটেনস্থ পাকিস্তানী হাই কমিশনারকে উক্ত সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র আজ এখানে বলেন যে, তথাকথিত “বাংলাদেশে”-এর একজন প্রতিনিধি কর্তৃক পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণার জন্য সোসাইটির প্লাটফর্ম ব্যবহারের বিরুদ্ধে উক্ত সোসাইটি এবং বৃটিশ পররাষ্ট্র দফতরের নিকট লণ্ডনস্থ পাকিস্তানী হাই কমিশনার বার বার প্রতিবাদ জানানো সত্বেও সোসাইটি তা অগ্রাহ্য করে।
মুখপাত্রটি বলেন যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কমনওয়েলথের একটি সহযোগী সার্বভৌম রাষ্ট্রকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলার পক্ষে প্রচারণার জন্য উক্ত সোসাইটির প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে দেওয়ার বিষয়টিকে খুব কম করে বললেও একটা অবন্ধুসুলভ কার্যক্রম বলতে হবে।
পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য সোসাইটির প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে উদ্দেশ্যমূলক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটি রাণীর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। এর ভাইস প্রেসিডেন্টের মধ্যে রয়েছে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রী।
কাজেই সোসাইটির তৎপরতা বৃটিশ সরকারের নীতির দ্বারা সরাসরি প্রভাবান্বিত।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪১। সেনাবাহিনী থেকে হেডকোয়াটার্সে নির্দেশ | দৈনিক পাকিস্তান | ৮ জুলাই, ১৯৭১ |
সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশ
রাওয়ালপিন্ডি, ৭ই জুলাই (এপিপি)।- সরকারী বিভাগ ও কলকারখানার যেসব যোগ্য ব্যক্তি সিলেকশন বা ইন্টারভিউর জন্য ন্যাশনাল সার্ভিস ডাইরেক্টরেট থেকে হাজির হওয়ার নির্দেশ পেলে তাদের সে উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেবার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে সকল সরকারী বিভাগ প্রধান, প্রাইভেট মিলস, ফ্যাক্টরী ও ফার্মকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আন্তঃসার্ভিস জনসংযোগ ডাইরেক্টরেটের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে যে, জাতীয় সার্ভিস প্রদানের উপযুক্ত এমন যে সব ব্যক্তি সরকারী বিভাগ, প্রাইভেট ফার্ম, ফ্যাক্টরী ও মিলে চাকুরী করছে সিলেকশনের উদ্দেশ্যে তাদের হাজির হওয়ার নোটিশ দেওয়া হলে তাদের মালিকগণ তাদের ছাড়ছেন না বলে রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেড কোয়ার্টারস্থ ন্যাশনাল সার্ভিস ডাইরেক্টরেট জানতে পেরেছেন।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪২। কিসিঞ্জার ও এম এম আহমেদ এর বৈঠকঃ পাক-ভারত পরিস্থিতি ও উদ্বাস্তু সমস্যা আলোচিত হয়েছে | দৈনিক পাকিস্তান | ৯ জুলাই, ১৯৭১ |
কিসিঞ্জার-এম এম আহমেদ বৈঠকঃ
পাক-ভারত পরিস্থিতি ও উদ্বাস্তু সমস্যা আলোচিত হয়েছে
ইসলামাবাদ, ৩রা জুলাই (এপিপি)।- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম এম আহমেদ ও পররাষ্ট্র সেক্রেটারী জনাব সুলতান মোহাম্মদ খান আজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারের সাথে ৬২ মিনিট স্থায়ী বৈঠকে মিলিত হন। তারা এই বৈঠকে উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে।
পাকিস্তানের এই দু’জন উর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা আজ বিকেলে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্টের অতিথিশালায় ডঃ কিসিঞ্জারের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জনাব আগা হিলালী ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ জোশেফ এম ফারল্যান্ড আলোচনাকালে উপস্থিত ছিলেন।
ভারতে যে সব পাকিস্তানী উদ্বাস্তু রয়েছে তাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থার জন্য পাকিস্তান সরকার নিজে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন বৈঠকে তারা সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক গোলযোগের সময় যারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেছেন তাদের মধ্যে যে সব প্রকৃত পাকিস্তানী নাগরিক তাদেরকে দেশে ফিরে আসার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গত ২১শে মে থেকে বারবার ব্যক্তিগতভাবে আবেদন জানিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এরপর সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণা দেন। সীমান্ত বরাবর এলাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ অনেকগুলো অভ্যর্থনা শিবির স্থাপন করা হয়। যা হোক ভারত স্বীয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মতলবে উদ্বাস্তু সমস্যাকে কাজে লাগাবার জন্যে উদ্বাস্তুদের পাকিস্তানে ফিরে আসতে বাধা দিচ্ছে বলে জানা গেছে। আরো জানা গেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পূরণের প্রয়োজনীয়তা বিষয়েও পর্যালোচনা করা হয়েছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুষ্কৃতিকারী, বিদ্রোহী ও রাষ্ট্রদোহীদের নির্মূল করার পর ক্রমে ক্রমে সেখানকার অর্থনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
ডঃ কিসিঞ্জারের সাথে পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের এই বৈঠকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পরিস্থিতিও আলোচিত হয়েছে।
ডঃ কিসিঞ্জার পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার পর পাকিস্তানের সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়ে তুলতে পারবেন এবং তা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জানাতে পারবেন বলে এখানকার পর্যবেক্ষক মহল আশা করছেন।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪৩। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রশ্নে পাকিস্তান পররাষ্ট্র সেক্রেটারীর সংগে কেলীর আলোচনা | দৈনিক পাকিস্তান | ৩০ জুলাই, ১৯৭১ |
উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রশ্নে পাকিস্তান পররাষ্ট্র সেক্রেটারীর সংগে
কালীর আলোচনা
ইসলামাবাদ, ২৯শে জুলাই।- জাতিসংগের উদ্বাস্তু সম্পর্কিত হাই কমিশনারের বিশেষ প্রতিনিধি, মিঃ ডি আর কেলী আজ পররাষ্ট্র সেক্রেটারীর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
তাঁদের এই বৈঠকে গৃহত্যাগীদের দেশে প্রত্যাবর্তন ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাবলি ও সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করা হয় বলে এক সরকারী হ্যাণ্ড আউটে জানানো হয়েছে।
প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী এই বৈঠকে মিঃ কেলীকে জানান হয় যে, গৃহত্যাগী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার তার দায়িত্বটুকু সম্পাদনে অত্যন্ত আগ্রহী। কিন্তু এর বিরাট একটি অংশ নির্ভর করে ভারত সরকারের মনোভাবের উপর। এবং বর্তমানে ভারত সরকার এ ব্যাপারে কোনই সহযোগিতা করছে না।
মিঃ কেলীকে এই মর্মে আশ্বাস দেয়া হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর দায়িত্ব পালনে পাকিস্তান সরকার তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।
———-
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪৪। বৃহৎ শক্তির কাছে নতি স্বীকার করব নাঃ ইয়াহিয়া | দৈনিক পাকিস্তান | ৩ আগস্ট, ১৯৭৪১ |
বৃহৎ শক্তির কাছে নতি স্বীকার করব নাঃ ইয়াহিয়া
শর্তযুক্ত সাহায্য প্রত্যাখ্যান করব
রাওয়ালপিন্ডি, ২রা আগষ্ট (এপিপি)।- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন, কোন দেশ সাহায্যের সঙ্গে শর্ত জুরে দিলে তিনি ঐ সাহায্য সাহায্যদাতার মুখের উপর ছুড়ে ফেলবেন।
কায়হান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি আমীর তাহেরীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সাহায্য সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট উক্ত স্পষ্ট উক্তি করেন। জনাব আমীর তাহেরী কিছুদিন আগে পাকিস্তান সফর করেন।
পাকিস্তান সফর সম্পর্কে জনাব আমীর তাহেরী তাঁর পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখছেন। প্রথম লেখাটি গত ২৭শে জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের ‘চাপ’ সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে প্রশ্ন করেন।
প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি সৈনিক। কোন চাপের কাছে তিনি নতি স্বীকার করবেন না। কোন না কোন বৃহৎ শক্তি আমাকে চাপ দিচ্ছে, এটা অসঙ্গতঃ। যারা এসব কথা বলে তারা আমাকে চিনতে পারেনি। যার গদির প্রতি লোভ আছে সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে পারে। গদির লোভ আমার নেই।
প্রেসিডেন্ট বলেন, সোভিয়েট ও মার্কিন সরকার গোড়া থেকেই পাকিস্তানের ব্যাপারে সঠিক নীতি অনুসরণ করছে। কিন্তু বৃটেনের ক্ষেত্রে এ কথা বলা চলে না। বৃটিশ সরকার প্রকাশ্যে আমাদের ব্যাপারে বৈরী ভূমিকা অনুসরণ করছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তারা নাক গলানোর চেষ্টা করছে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় এই মনোভাব প্রকাশ করেছেন। কমনওয়েলথ সদস্য হিসেবে আমরা আশা করছিলাম, তারা অন্ততঃ পক্ষে নিরপেক্ষ থাকবে এবং এতটা খোলাখুলিভাবে ভারতকে সমর্থন করবে না।
ভারতের সমালোচনা করে প্রেসিডেন্ট বলেন, উদ্বাস্তু সমস্যার মত মানবিক সমস্যাকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে।
ভারত উদ্বাস্তুদের পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনে বাধা দিচ্ছে। তারা খোলাখুলি বলছে, উদ্বাস্তুদের তারা ‘ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে’ যেতে দেবেন না, যেতে দেবেন ‘মুজিবের বাংলাদেশে’।
তিনি বলেন, ভারত তার ভূখণ্ডে ট্রেনিং শিবির খুলেছে। সেখানে ৩৫ হাজার বিদ্রোহীকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে এবং উদ্বাস্তুদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চাপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তানের বৈঠকের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে প্রেসিডেন্ট বলেন, ভারতীয় নেতাদের সংগে যে কোন স্থানে যে কোন সময় আলোচনা করতে আমি প্রস্তুত। তবে উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে আমরা আলোচনা করব এবং তা মানবিক প্রশ্ন হিসাবে নয়, রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসাবে।
কিন্তু আলাপ-আলোচনার জন্য আমাদের সকল প্রস্তাব তারা নাকচ করেছে এবং এ ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ প্রচেষ্টাকে তারা নস্যাৎ করে দিয়েছে। তারা পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে চায়। তারা মনে করেছে আমাদের সাথে আলোচনা করার কোন প্রয়োজন নেই।
ক্ষমতা হস্তান্তর
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ৭৫ মিনিট ব্যাপী সাক্ষাৎকারে ক্ষমতা হস্তান্তর, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন এবং পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়।
প্রেসিডেন্ট বলেন, বেসামরিক সরকার গঠনের সিদ্ধান্তে তিনি অটল রয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র প্রধান থাকার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরে যেতে আগ্রহী। সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ণরুপে জাতীয় পরিষদ অনুরোধ করলেই শুধুমাত্র তিনি প্রেসিডেন্টের কার্যভার চালিয়ে যাবেন।
আমার ম্যাণ্ডেট স্পষ্ট। তা হচ্ছে দেশকে একত্রিত রাখা আর বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা।তাঁবেদার বেসামরিক সরকার গঠনের জন্য তাঁকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে যে, গুজব ছড়িয়েছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা পুরোপুরি ভুল। সৈনিক হিসাবে তিনি গুজবকে অপরাধ মনে করেন। আমি এইরুপ কৌশল অবলম্বন করি না।
পিপলস পার্টিকে নিয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, জনাব ভুট্টোর দেশের এক অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। কিন্তু দেশের উভয় অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বেসামরিক সরকার গঠন হওয়া উচিত। যাই হোক, কয়েক মাসের মধ্যেই বেসামরিক সরকার যখন গঠিত হচ্ছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারে। আমি সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিষদ চাই। এইরুপ একটি পরিষদ গঠিত বেসামরিক সরকার গ্রহণ করতে আমি প্রস্তুত আছি। কিন্তু তার পূর্বে কোন ব্যক্তি বা দলের কাছে আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব না।
উপনির্বাচন
আওয়ামী লীগের বিজয় এবং নতুন পরিস্থিতিতে উপনির্বাচন সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে কতিপয় প্রশ্ন করা হয়। প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগের বিজয়কে ভীতি প্রদর্শন, ত্রাস সৃষ্টি ও দুর্নীতির ফল বলে আখ্যায়িত করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, সেই সময় তিনি আওয়ামী লীগের তৎপরতা সম্পর্কে সঠিক খবর পাননি। এখন আমরা বুঝতে পারছি প্রত্যেক আসনে জয়ের জন্য মুজিব কি করেছিল। তার অধিকাংশ লোক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে কারণ আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করতে জনগণ ভীত ছিল।
———-
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪৫। শেখ মুজিবের বিচার করা হবেঃ ৩আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন সাক্ষাতকারে জেনারেল ইয়াহিয়া | দি ডন, করাচী | ৫ আগস্ট, ১৯৭১ |
.
.
মুজিবকে বিচারের আওতায় আনা হবেরাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বলেন যে বিলুপ্তপ্রায় আওয়ামী লীগের দলপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কে বিচারের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন যে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দেশের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গতরাতে পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনের সকল স্টেশন হতে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন যে তিনি যেহেতু পাকিস্তানের নাগরিক সুতরাং পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া উচিত।
যখন রাষ্ট্রপতিকে শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় তখন তিনি বলেন, বিলুপ্তপ্রায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব তার নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বিচ্যুত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছেন।
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া বলেছেন যে নির্বাচিত হবার পর শেখ মুজিব এবং তার দলের কিছু লোকজন তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় এবং নিজেদের অপসারণ দাবি করে। অর্থাৎ তার মতে শেখ মুজিব বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছেন, সরাসরি বিদ্রোহের পক্ষে কাজ করেছেন এবং তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ উসকে দিয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহমান কোনভাবেই তার প্রতিপক্ষ নন। রাষ্ট্রপতি বলেন তিনি শুধু মাত্র তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তার দায়িত্বপালন করছেন এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার কোনো বিরোধিতা নেই।
রাষ্ট্রপতি পরিষ্কার করে বলেন যে তার কোন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। তিনি বলেন একজন সেনাসদস্য হিসেবে তিনি কেবল জনগণের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সাময়িক দায়িত্ব পালন করছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন যে শেখ মুজিবুর রহমান যা করেছেন তার জন্য তিনি অত্যন্ত দুঃখ বোধ করছেন এবং দেশের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করলে অন্যরা যেই শাস্তি পায় তিনিও ঠিক একই শাস্তি পাবেন। সাক্ষাৎকারে উপস্থিত বিদেশী সংবাদমাধ্যম কর্মীদের কাছে তিনি একটি প্রশ্ন রাখেন, “আপনারা কিভাবে আপনাদের দেশের শত্রুদের সাথে আচরণ করতেন?” (দ্য ডন, করাচী- আগস্ট ৫, ১৯৭১)..
শিরোনামঃ ৪৬। করাচীতে টিভি সাক্ষাৎকারে জেনারেল ইয়াহিয়া
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৫ আগস্ট, ১৯৭১
তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ
প্রেসিডেন্টের টিভি সাক্ষাৎকারঃ তিন সপ্তাহের মধ্যে অযোগ্য
এম এন এ’দের নাম ঘোষণা
করাচী ৪ঠা আগস্ট (এ পি পি )- প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তিন থেকে চার মাসের মধ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছেন।
গত ৩০শে জুলাই শুক্রবার করাচীতে আন্তর্জাতিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এর প্রতিনিধিদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বলেন যে, দু’ থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যদের মধ্যেকার যাদের আসন থাকবে এবং অপরাধমূলক ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার জন্য কোন কোন সদস্যের আসন বাতিল হয়ে যাবে, তাদের নাম ঘোষণা করবেন।
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নেটওয়ার্কের সাক্ষাৎকার নামক ৮৪ মিনিট ব্যাপী সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটি আজ রাতে পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনের ৪টি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।
জাতির উদ্দেশ্যে গত ২৮শে জুন প্রদত্ত তাঁর বেতার ভাষণের উল্লেখ করে, প্রেসিডেন্ট বলেন যে, উক্ত ভাষণে তিনি জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তাঁর রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে এবং কি ঘটতে পারে তিনি তার সঠিক বিবরন দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, যত শীঘ্র সম্ভব সরকার পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের নিকট হস্তান্তর করতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
তিনি বলেন যে, তার নিজের ধারণা অনুসারে তিনি বিষয়টি বিবেচনা করেছেন এবং তাতে তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেন যে, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আসন বহাল থাকবে এবং স্বল্প সংখ্যক সদস্য তাদের আসন হারাবেন। তিনি বলেন যে, বাতিল আসনগুলোতে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট বলেন যে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যে যারা জাতীয় পরিষদের আসনে নির্ধারিত হয়েছেন তাদের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত ব্যক্তিগণ ছাড়া অন্যান্যদের আসন বাতিল করা হয় নি।
তিনি বলেন যে, জাতীয় পরিষদে যে সমস্ত সদস্যকে তাদের আসন রাখতে দেয়া হবে, তিনি তাদেরকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন যে, যারা সীমানা পেরিয়ে গেছে এবং কোনরূপ অপরাধমূলক কাজ করেননি তাদের মধ্যেও কিছু সংখ্যক সদস্যকে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানানো হবে এবং তাদের আসন বহাল রাখতে দেয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, সীমান্ত এলাকা ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে। সীমান্তের অপর পার থেকে উক্ত এলাকাগুলোতে গোলযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, সীমান্তে বরাবর দিনরাত প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে এবং এই সংঘর্ষের পরিণামে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।
তিনি বলেন যে, সীমান্ত বরাবর গোলযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। উপনির্বাচনের পর অবিলম্বে তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করবেন বলে জানান।
প্রেসিডেন্ট সুস্পষ্ট ভাষায় জানান যে, পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না। তিনি বলেন, যুদ্ধ সমস্যাদির সমাধান করতে পারে না। যুদ্ধে কেবল বিপুল ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয় এবং মানুষের জীবন যাত্রা ও যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি ব্যাহত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, তিনি একাধিকবার ঘোষণা করেছেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে যেকোনো পর্যায়ে আলোচনা করতে রাজী আছেন। কিন্তু তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন যে, ভারত এ ব্যাপারে কোন সাড়া দেয় নি।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধের খুবই কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। কিন্তু তিনি যথেষ্ট ধৈর্যের সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, এর চাইতেও অনেক কম গুরুতর পরিস্থিতি পৃথিবীতে যুদ্ধের কারন হয়েছে। তিনি বলেন যে, পাক-ভারত উপ মহাদেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা অত্যন্ত পরিবর্তনশীল, বিস্ফোরন্মুখ ও বিপদজ্জনক।
তিনি বলেন, আমার সরকার ও আমি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছি, মূলতঃ সে কারনে আমরা এখনো যুদ্ধে জড়িয়ে পরিনি।
প্রেসিডেন্ট এটা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে কোনরুপ তৎপরতার মাধ্যমে যদি পাকিস্তানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে যুদ্ধ হবে।
বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন যে, যারা সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে, তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পাকিস্তান বিশেষভাবে আগ্রহী।
তিনি বলেন যে, বাস্তুত্যাগীদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে এবং তাদের ফিরে আসার সুযোগসুবিধা দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় অনেকগুলো অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়েছে।
তিনি বলেন যে, বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের সাহায্যকে পাকিস্তান স্বাগত জানিয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, বাস্তুচ্যুতদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাই কমিশনের পর্যবেক্ষকদের গ্রহণ করতে রাজী হয়েছে, কিন্তু অপর পক্ষের এই প্রস্তাব গ্রহণের উপরই তার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে।
প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন করেন যখন সশস্ত্র অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে এবং যখন বাস্তুচ্যুতদের চারপাশে ফিল্ডগান ও মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ চলছে বাস্তুচ্যুতরা কিভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ফিরে আসতে পারে?
এক প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্ট বলেন যে, পাকিস্তানে যারা ফিরে আসছেন, অধিকাংশই অনুমোদিত পথ দিয়ে আসতে পারছেন না, কারণ ভারত তাদের ফিরতে বাধা দিচ্ছে। তিনি বলেন যে, এ সমস্ত বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি অনুমোদিত পথে পাকিস্তানে ফিরে আসছেন।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানের তাদের বাড়িঘরে ফিরে এসেছেন এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ জন হচ্ছে হিন্দু। প্রেসিডেন্ট বলেন যে, ভারত বাস্তুচ্যুতদের যে সংখ্যা দাবী করছে তা সম্পূর্ণ ভুল। তিনি বলেন যে, ভারত সীমান্ত এলাকায় যে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে, তা বাস্তুচ্যুতদের ফিরে আসার ব্যাপারে বাধা স্বরূপ। তিনি বলেন যে, যদি ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে বাস্তুচ্যুতদের সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে এবং বাস্তুচ্যুতরা নিরাপদে তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসতে পারবেন। নিরাপত্তার অভাবে জনগণের এখনো পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যাওয়ার বিষয় প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হাত থেকে দেশের পূর্বাঞ্চলের সাত কোটি জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন যে, বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ এই বিদ্রোহের উস্কানি দিয়েছিল।
তিনি বলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে বিক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বন্ধ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কোনরূপ গণহত্যা চালানোর খবরকে প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে বর্ণনা করেন। ভারতে পালিয়ে যাওয়া বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী সদস্যগণ কর্তৃক মিথ্যা কাহিনী রটনার ফলে এই ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে মুজিবুর রহমানের কোটারি ও বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী সদস্যরাই তাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারীদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে।
তিনি বলেন যে, সীমান্তের ও-পারের বন্ধুদের উস্কানিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেছে।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, একটি রাজনৈতিক সমাধানের আশায় তিনি ধৈর্যের সঙ্গে এ সমস্ত সহ্য করছিলেন। কিন্তু তিনি যখন শেখ মুজিবুর রহমানের একগুয়েমি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন, তখন সশস্ত্র বাহিনীকে সরকারের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এবং বিপদাপন্ন জনগণের জীবন রক্ষা করার নির্দেশ দিলেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ পূর্ব পরিকল্পিত থাকার বিষয় প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, যদি এই ব্যবস্থা পূর্বপরিকল্পিত হতো তাহলে আওয়ামী লীগের এতো বেশী সংখ্যক সদস্য ভারতে পালিয়ে যেতে পারতেন না।
পূর্বপাকিস্তানে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালানোর বিষয়ও প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, হিন্দুরা যদি পূর্বপাকিস্তানে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেই থাকে তবে সীমান্তের ওপারের চক্রান্তের ফলেই তারা এরূপ বোধ করছে।
স্বচক্ষে সবকিছু দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্বপাকিস্তানে সফরের আমন্ত্রণ জানান।
প্রেসিডেন্ট একজন সাংবাদিককে বলেন যে, পূর্বপাকিস্তানে অভ্যুত্থান চলাকালে আড়াই লাখ লোককে হত্যার খবর অত্যন্ত অতিরঞ্জিত।
তিনি বলেন, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় এবং সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, সশস্ত্র বিদ্রোহীরা হতাহত হয়েছে। জাতির প্রতি কর্তব্যবোধের তাগিদে ও জনসংখ্যার বাকী অংশকে রক্ষা করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন যে, বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যার মত হতাহতের সংখ্যাকেও বিশেষভাবে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট উভয় সংখ্যাকে সম্পূর্ণ ভুল বলে বর্ণনা করেন।
(অসমাপ্ত)
.
.
শিরোনামঃ ৪৭। অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ দেয়া হবেঃ সরকারী প্রেসনোট
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৮ আগস্ট, ১৯৭১
অন্যান্যদের অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ দেয়া হবে:সরকারী প্রেসনোট- বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের ৮৮ জন এম এন এ’র আসন থাকবে রাওয়ালপিন্ডি, ৭ই আগস্ট (এ পি পি)- বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের আসন বহাল থাকবে এবং অন্যান্যদের তাঁদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ দেয়া হয়।আজ এখানে এক সরকারী প্রেসনোটে এ কথা ঘোষণা করা হয়। প্রেসনোটে বলা হয়ঃ এখানে উল্লেখযোগ্য ১৯৭১ সালের ২৮শে জুন তারিখে প্রেসিডেন্ট তাঁর বেতার ভাষণে বলেন যে, তিনি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তবে যারা অপরাধমূলক কাজ করেছেন তারা ব্যতীত এ বিলুপ্ত পার্টির নির্বাচিত অপর এম এন ও এম পি এ-গন ব্যক্তিগতভাবে তাদের আসনে বহাল থাকবেন।সেই হেতু পাকিস্তান সরকার আজ বিলুপ্ত আওয়ামী লীগের যেসব নির্বাচিত এম এন এ জাতীয় পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্য হিসেবে তাদের আসনে বহাল থাকবেন তাদের তালিকা ঘোষণা করেছেন।বিলুপ্ত আওয়ামী লীগের অপর সকল এম এন এ যাদের নাম এই তালিকায় উল্লেখিত হয় নি, তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহনের পূর্বে তাদেরকে দণ্ডনীয় অপরাধমূলক কাজ সংক্রান্ত তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিজেদের খণ্ডনের সুযোগ প্রদান করা হবে। নবনির্বাচিত এম পি দের ব্যাপারে পরে ঘোষণা করা হবে। বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ দলের নিম্নলিখিত নবনির্বাচিত এম এন এ গণ তাদের আসনে বহাল থাকবেনঃ১। এন ই ১ রংপুর-১ জনাব মজাহার হোসেন। ২। এন ই ৩ রংপুর-৩ জনাব সাদাকাত হোসেন। ৩। এন ই ৪ রংপুর-৪ জনাব মোঃ লুৎফুর রহমান। ৪। এন ই ৫ রংপুর-৫ শাহ আবদুল হামিদ। ৫। এন ই ৬ রংপুর-৬ ডঃ মোঃ আবু সোলেমান মণ্ডল। ৬। এন ই ৭ রংপুর-৭ জনাব মোঃ আজিজুর রহমান। ৭। এন ই ৮ রংপুর-৮ জনাব মোঃ নুরুল হক। ৮। এন ই ১২ রংপুর-১২ জনাব আফসার আলী আহমদ। ৯। এন ই ১৮ দিনাজপুর-৬ ডাঃ মোঃ ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল । ১০। এন ই ২১ বগুড়া-৩ জনাব আকবর আলী খান চৌধুরী। ১১। এন ই ২২ বগুড়া-৪ জনাব মোঃ হাবিবুর রহমান। ১২। এন ই ২৩ বগুড়া-৫ ডাঃ মোঃ জাহিদুর রহমান। ১৩। এন ই ২৫ পাবনা-২ মাওলানা এ, রশিদ তর্কবাগিশ।১৪। এন ই ২৭ পাবনা-৪ জনাব সৈয়দ হোসেন মনসুর। ১৫। এন ই ২৯ পাবনা-৬ জনাব মোঃ আমজাদ হোসেন। ১৬। এন ই ৩১ রাজশাহী-২ জনাব আজিজুর রহমান। ১৭। এন ই ৩৪ রাজশাহী-৫ আলহাজ রাইসুদ্দিন আহমদ। ১৮। এন ই ৩৭ রাজশাহী-৮ জনাব মোঃ নজমুল হক সরকার। ১৯। এন ই ৩৮ রাজশাহী-৯ ডাঃ মোঃ শেখ মোবারক হোসেন। ২০। এন ই ৫০ যশোর-৩ জনাব এম মশিহুর রহমান। ২১। এন ই ৫০ খুলনা-১ জনাব এম, এ খায়ের বি, এ । ২২। এন ই ৫২ খুলনা-৩ জনাব লুৎফুর রহমান। ২৩। এন ই ৫৫ খুলনা-৬ জনাব সালাদউদ্দিন ইউসুফ । ২৪। এন ই ৫৬ খুলনা-৭ জনাব মোঃ আবদুল গফফার। ২৫। এন ই ৫৭ খুলনা-৮ সৈয়দ কামার বখত । ২৬। এন ই ৫৯ বাকেরগঞ্জ-২ জনাব সালেহ উদ্দিন আহমদ । ২৭। এন ই ৬১ বাকেরগঞ্জ-৪ জনাব মোঃ আব্দুল বারেক। ২৮। এন ই ৬৪ বাকেরগঞ্জ-৭ ডাঃ আজহার উদ্দিন আহমদ। ২৯। এন ই ৬৫ বাকেরগঞ্জ-৮ জনাব এ কে ফয়জুল হক। ৩০। এন ই ৬৭ বাকেরগঞ্জ কাম পটুয়াখালী- জনাব এম সামসুল হক। ৩১। এন ই ৬৮ পটুয়াখালী-১ জনাব গোলাম আহাদ চৌধুরি। ৩২। এন ই ৬৯ পটুয়াখালী-২ আলহাজ আবদুল তালুকদার। ৩৩। এন ই ৭০ পটুয়াখালী-৩ জনাব আসমত আলী সিকদার। ৩৪। এন ই ৭২ টাঙ্গাইল-২ জনাব এম শওকত আলী খান। ৩৫। এন ই ৭৪ টাঙ্গাইল-৪ জনাব হাতেম আলী তালুকদার। ৩৬। এন ই ৭৬ ময়মনসিংহ-১ মোঃ এ, সামাদ। ৩৭। এন ই ৭৭ ময়মনসিংহ-২ জনাব করিমুজ্জামান তালুকদার। ৩৮। এন ই ৭৯ ময়মনসিংহ-৪ মোঃ আনিসুর রহমান। ৩৯। এন ই ৮০ ময়মনসিংহ-৫ আবদুল হাকিম সরকার। ৪০। এন ই ৮১ ময়মনসিংহ-৬ মশারফ হোসেন আকন্দ। ৪১। এন ই ৮২ ময়মনসিংহ-৭ জনাব ইব্রাহিম। ৪২। এন ই ৮৪ ময়মনসিংহ-৯ সৈয়দ আব্দুস সুলতান। ৪৩। এন ই ৮৬ময়মনসিংহ-১১ মোঃ সামসুল হুদা। ৪৪। এন ই ৮৭ ময়মনসিংহ-১২ জনাব সাদিরুদ্দিন। ৪৫। এন ই ৮৯ ময়মনসিংহ-১৪ জনাব জাবেদ আলি। ৪৬। এন ই ৯০ ময়মনসিংহ-১৫ জনাব আসাদুজ্জামান।৪৭।এন ই ৯৪ ফরিদপুর-১ এ বি এম নুরুল ইসলাম । ৪৮।এন ই ৯৫ ফরিদপুর-২ সৈয়দ কামরুল ইসরাম মোঃ সালেহউদ্দিন । ৪৯।এন ই ৯৮ ফরিদপুর-৫ জনাব মোঃ আবুল খায়ের । ৫০।এন ই ১০০ ফরিদপুর-৭ মাওলানা আদেলুদ্দিন আহমদ। ৫১।এন ই ১০১ ফরিদপুর-৮ জনাব আমজাদ হোসেন খান। ৫২।এন ই ১০২ ফরিদপুর-৯ জনাব আবিদুর রেজা খান। ৫৩।এন ই ১০৩ ফরিদপুর-১০ ডাঃ এম এ কাসেম । ৫৪।এন ই ১০৪ ঢাকা-১ জনাব মোঃ নুরুল ইসলাম। ৫৫।এন ই ১০৫ ঢাকা-২ জনাব মোসলেম উদ্দিন খান । ৫৬।এন ই ১০৬ ঢাকা-৩ খন্দকার নুরুল ইসলাম । ৫৭।এন ই ১০৯ ঢাকা-৬ জনাব আশরাফ আলী চৌধুরী ।৫৮।এন ই ১১০ ঢাকা-৭ জনাব জহিরুদ্দিন । ৫৯।এন ই ১১৪ ঢাকা-১১ জনাব আফতাব উদ্দিন ভুঁইয়া । ৬০।এন ই ১১৬ ঢাকা-১৩ জনাব মোঃ শাহার আলী মিয়া । ৬১।এন ই ১১৮ ঢাকা-১৪ জনাব কফিল উদ্দিন চৌধুরী । ৬২।এন ই ১২৪ সিলেট-৫ জনাব আবদুল মুনতাকিম চৌধুরী । ৬৩।এন ই ১২৬ সিলেট-৭ জনাব আবদুর রহিম । ৬৪।এন ই ১২৮ সিলেট-৯ জনাব আবদুল খালেক এডভোকেট । ৬৫।এন ই ১৩০ সিলেট-১১ ডি এম এইচ, ওবায়দুর রাজা চৌধুরী ।৬৬।এন ই ১৩৩ কুমিল্লা-৩ দেওয়ান আবদুল আব্বাস । ৬৭।এন ই ১৩৪ কুমিল্লা-৪ জনাব সিরাজুল হক । ৬৮।এন ই ১৩৭ কুমিল্লা-৭ এ, এম, আহমদ খালেক। ৬৯।এন ই ১৩৯ কুমিল্লা-৯ হাজি আবুল হাশেম । ৭০।এন ই ১৪০ কুমিল্লা-১০ জনাব মোঃ সুজাত আলী । ৭১।এন ই ১৪১ কুমিল্লা-১১ জনাব আবদুল আওয়াল । ৭২।এন ই ১৪২ কুমিল্লা-১২ হাফেজ হাবিবুর রহমান । ৭৩।এন ই ১৪৫ নোয়াখালী-১ জনাব মোঃ ওবায়েদুল্লাহ মজুমদার । ৭৪।এন ই ১৪৮ নোয়াখালী-৪ আবদুল মালেক উকিল । ৭৫।এন ই ১৪৯ নোয়াখালী-৫ জনাব দেলওয়ার হোসেন । ৭৬।এন ই ১৫২ নোয়াখালী-৮ জনাব মোঃ আবদুর রশিদ । ৭৭।এন ই ১৫ চট্টগ্রাম-২ জনাব এম এ, মজিদ । ৭৮।এন ই ১৫৬ চট্টগ্রাম-৪ সৈয়দ মোঃ ফজলুল হক বিএসসি । ৭৯।এন ই ১৫৭ চট্টগ্রাম-৫ জনাব মোঃ খালেদ । ৮০। এন ই ১৫৯ চট্টগ্রাম-৭ জনাব আতাউর রহমান খান। ৮১। এন ই ১৬০ চট্টগ্রাম-৮ জনাব আবু সালেহ। ৮২। এন ই ১৬১ চট্টগ্রাম-৯ জনাব নুর আহমদ। ৮৩। এন ই ১৬৪ ঢাকা বিভাগের ময়মনসিংহ জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা -মিস রাফি আক্তার ডলি। ৮৪। এন ই ১৬৫ চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ও কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর মহকুমা -মিসেস সাজেদা চৌধুরী। ৮৫। এন ই ১৬৬ চাঁদপুর মহকুমা বাদে কুমিল্লা জেলা এবং চট্টগ্রামবিভাগের সিলেট জেলা -প্রফেসর মিসেস মমতাজ বেগম।৮৬। এন ই ১৬৭ কুষ্টিয়া জেলা এবং যশোর জেলার ঝিনাইদহ, মাগুরা মহকুমা বাদে খুলনা বিভাগ -মিসেস রাজিয়া বানু। ৮৭। এন ই ১৬৮ রাজশাহী বিভাগের রংপুর জেলা,দিনাজপুর জেলা ও বগুড়া জেলা -মিসেস তসলিমা আবিদ। ৮৮। এন ই ১৬৯ রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলা এবং খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলা ও যশোর জেলার ঝিনাইদহ ও মাগুরা মহকুমা -মিসেস বদরুন্নেসা আহমদ। ———-..
শিরোনামঃ ৪৮। “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য” মুজিবের বিচার হবে – সরকারী তথ্য বিবরণী
সূত্রঃ দি ডন – করাচী
তারিখঃ ১০আগষ্ট,১৯৭১
“পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য” মুজিবের বিচার হবে
সরকারী তথ্য বিবরণী
৯আগষ্ট,১৯৭১
অদ্য ৯ আগষ্ট, প্রধান সামরিক আইন সদরদপ্তর প্রশাসক কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে , বিলুপ্ত আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমানকে “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা” এবং অন্যান্য অপরাধের হেতু একটি বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
প্রেসনোটে বলা হয়, ১১ আগষ্ট বিচারকার্যটি একটি গুপ্ত কক্ষে শুরু হবে এবং এরকার্য ধারা গোপন রাখা হবে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির যথাযথ সুযোগ দেয়া হবে এবং এও বলা হয় যে, আইন অনুমতি সাপেক্ষে তার পচ্ছন্দানুসারে সকল সুবিধা দ্বারা উপলব্ধ পাকিস্তানের নাগরিককে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দান করা যাবে।
সরকার ব্যাবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষে পাকিস্তান আর্মি আগ্রসর হবার পর ২৬ মার্চ শেখ মুজিবর রহমানকে খুব ভোরে তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তাকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয় যেখানে সে আটকাবস্থায় ছিলেন।
.
.
শিরোনামঃ ৪৯।“ জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিবাদ”
সূত্রঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস
তারিখঃ ১০আগষ্ট,১৯৭১
.
শেখ মুজিবর রহমানের বিচার নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিবাদ লিপি।
১০ আগস্ট, ১৯৭১।
মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্টি হওয়া মানবেতর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগকে পাকিস্তান সরকার স্বাগত জানিয়ে আসছে। সরকার এই বিষয়ে যেকোনো ধরণের মনোভাব পোষণ যা ক্ষমতার রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত নয় এবং পাকিস্তানের সীমাবদ্ধতাকে উৎসাহ দিয়ে প্রকাশ করা হয় সেগুলোকে উষ্ণভাবে গ্রহণ করে। এটি সর্ববজনবিদিত ছিল যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদিত সাধারণ মানুষকে আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবকর্তৃক করা বেশ কিছু উপদেশ পাকিস্তান সরকার অতিদ্রুত গ্রহণ করেছে।
এই সমঝোতাকে কোনোভাবেই পাকিস্তানীদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে পাকিস্তানকে নির্দেশের প্রচেষ্টার দিকে বাড়ানো যাবে না যা পূর্বাঞ্চলে পৌছাতে পারে। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল দুঃখপ্রকাশ জানাচ্ছে যে, গত ১০ই আগষ্ট জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে মহাসচিবের মুখপাত্র তার পক্ষে শেখ মুজিবের আসন্ন বিচারের উপর মন্তব্য করেছেন যা একই সাথে মানবিক উদ্বেগের সীমা লঙ্ঘন করে এবং জাতিসংঘের দলিলানুসারে জাতিসংঘের পারদর্শিতা অতিক্রম করে।
আমাদের দুঃখ সচেতনতা এটি দ্বারা আরও গভির হয় যে,অনেক বিচারের ক্ষেত্রেই এমনকি বিনা বিচারের কারাদন্ডে এবং বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের রায়ের পর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কখনো কোনো মনোভাব জানিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করা হয়নি।
পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের কোনো মামলায় বিচারিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পাকিস্তানের সীমানার বাইরের কোনো প্রস্তাব মেনে নেবে না।
এমন কোনো প্রতিক্রিয়াই অপরিহার্য না যতক্ষণ না পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী ইন্ডিয়া এই ব্যাপারে উসকানি না দিচ্ছে।
.
.
শিরোনামঃ ৫০। দিল্লী-মস্কো চুক্তির মর্মার্থ ও যুক্ত বিবৃতি পরীক্ষা করা হচ্ছে: সরকারী মুখপাত্রের ঘোষনা
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ১৩ আগষ্ট, ১৯৭১
দিল্লী-মস্কো চুক্তির মর্মার্থ ও যুক্ত বিবৃতি পরীক্ষা করা হচ্ছে: সরকারী মুখপাত্রের ঘোষনা
ইশতেহারে রাজনৈতিক সমাধানের উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়।
অকারণ উপদেশ
ইসলামাবাদ, ১২ আগষ্ট (এ পি পি)।–পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতর ভারত সোভিয়েত প্রতিরক্ষা চুক্তির মর্মার্থ এবং ভারতীয় নেতাদের সাথে সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রী গ্রোমিকোর আলোচনা শেষে প্রকাশিত ইশতেহার পরীক্ষা করে দেখছেন। আজ একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন, আমরা এসব দলিল পরীক্ষা করে দেখছি। ভারত-সোভিয়েত যুক্ত ইশতেহারে পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধানের যে কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাওয়া হলে মুখপাত্রটি বলেন, এটা হলো অপ্রয়োজনীয় ও অকারণ উপদেশ।পাকিস্তানের কেউই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধান চায়নি বা চাচ্ছে না।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর মধ্যেই একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী ঘোষনা করেছেন যা বাস্তবায়িত হচ্ছে। মুখপাত্র বলেন, যে বিচ্ছিন্নবাদীরা ভারতের উৎসাহ এবং সক্রিয় সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানকে খন্ডবিখন্ড করার পরিকল্পনা করছে পাকিস্তান সরকার তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ সব সময়েই পাকিস্তানের ঐক্য ও অখন্ডতা চেয়েছে এবং এখনো তাই চাচ্ছে।
তিনি অবশ্য একথা স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, ভারতীয় চর ও অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেননা পূর্ব পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণ অবস্থার ব্যাঘাত সৃষ্টি করাই তাদের লক্ষ্য। এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। পাকিস্তান কিভাবে বিদ্রোহীদের দমন করবে কিংবা আইন-শৃংখলা রক্ষা করবে সে ব্যাপারে পাকিস্তানকে উপদেশ দেওয়ার অধিকার কারো নেই।
মুখপাত্রটি বলেন, তার মনমত একটি সমাধান পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতই সামরিক শক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করছে। ভারত সরকার এবং এর নেতারা স্বীকার করছেন যে, পাকিস্তানকে খন্ডিত করার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যে দেওয়া হচ্ছে। ভারত নানা সুবিধা দিয়ে গেরিলাদের পূর্ব পাকিস্তানী উদ্বাস্ত্তদের জন্য সাহায্যের নামে ভারত অন্যান্য দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে সেই অর্থ বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলনের প্রচার ও সাহয্যে অকাতরে বিলানো হচ্ছে।
মুখপাত্রটি আরো বলেন, কাজেই পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সামরিক সমাধান এড়ানোর যে উপদেশ ভারত আমাদের দিচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে ভারতের বেলাতেই প্রযোজ্য।
জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা জোরের সাথে ভারত-সোভিয়েত চুক্তির নিন্দা করছে। পিপলস পার্টি প্রধান বুট্টো, কাউন্সিল লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা, জামাতে ইসলামীর আমীর মওলানা মওদুদী এই চুক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এই চুক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই পরিচালিত।
.
.
শিরোনামঃ ৫১। এ নির্যাতন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নজিরবিহীন: মাসুদ
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ১৩ আগষ্ট, ১৯৭১
এ নির্যাতন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নজিরবিহীন: মাসুদ
রাওয়ালপিন্ডি, ১২ আগষ্ট (এ পি পি)- অধুনালুপ্ত কলকাতাস্থ উপমিশনের ডেপুটি হাই কমিশানার জনাব মেহেদী মাসুদ আজ এখানে বলেন যে, ভারত সরকার তাকে এবং মিশনের অন্যান্য সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গকে যেভাবে উৎপীড়ন ও হয়বানী করেছেন তার নজির কূটনৈতিক ইতিহাসে নেই।
জনাব মাসুদ ইসলামাবাদ বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা করার সময় একথা বলেন।
সুইস মধ্যস্থাতায় দু’দেশের সরকারের মধ্যে একই সাথে প্রত্যার্পণের ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি ইরানী ৭০৭ বোয়িং বিমান জনাব মাসুদ এবং ১৫০ জন পাকিস্তানী কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারবর্গকে নিয়ে আসে। বিমান বন্দরে পৌঁছালে তাদের স্বাগত জানানো হয়।
জনাব মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন যে, তাদের উপর সম্ভাব্য সব রকম পন্থায় সারাদিন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। তিনি বলেন, এসব নির্যাতন ও হয়রানির মধ্যে কল্পনা করা যায় এমন সব অভিযানই রয়েছে এগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্জন কারাবাস, দৈনিক বিক্ষোভ, চার মাস ধরে গৃহে অন্তরীণ রাখা প্রভৃতি। এছাড়া তারা দিল্লীতে আমার পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ করতে দেয়নি, এমনকি আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে দিতেও অস্বীকৃতি জানানো হয়। সংবাদপত্র, ঔষধ ও অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহ বিঘ্নিত করা হয়
জনাব মাসুদ বলেন, আমাদের দৃঢ় সংকল্পের দরুনই আমরা ডেপুটি হাই কমিশনের কর্মচারীদের প্রত্যার্পণের ব্যাপারে পাকিস্তানের সিন্ধান্ত গ্রহন না করা পর্যন্ত অনড় থাকতে সক্ষম হই। বস্তুত: আমরা সর্বক্ষণই আমাদের মাথা উঁচু রেখেছি।
তিনি বলেন তাঁকে, মিশনের সর্বক্ষণই আমাদের এবং তাঁদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের পুরোপুরি অন্তরীণ রাখা হয় এবং তাঁরা কেউ কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেনি।
ভারতীয় মিশন কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগ
ঢাকাস্থ ডেপুটি হাই কমিশনের কর্মচারীদের পরিবারের ২৫৭ সদস্য গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকাস্থ সুইস দূতাবাসের তদারকে ঢাকা ত্যাগ করেছেন বলে পি পি আই এর খবরে প্রকাশ।
.
.
শিরোনামঃ ৫২। পূর্ব বাংলায় নির্যাতন সম্পর্কে পাকিস্তানী দূত আগা হিলালীর বক্তব্য
সুত্রঃ এ.বি.সি. টিভির সাক্ষাৎকার, ওয়াশিংটন।
উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস।
তারিখঃ ১৫ আগস্ট, ১৯৭১
পূর্ব বাংলার নির্যাতন সম্পর্কে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত
আগা হিলালীর বক্তব্য
ওয়াশিংটন এর এ. বি. সি. টিভি নেটওয়ার্ক এর সাক্ষাৎকার থেকে প্রতিলিপিটি বাছাই কৃত ।
১৫ই আগস্ট, ১৯৭১
জনাব বব ক্লার্ক : আপনি কি স্বীকার করবেন যে আপনার সৈন্যরা অবাধে বেসামরিক জনতার হত্যার জন্য দায়ী ?
জনাব আগা হিলালী : এমন কিছু হয়ে থাকলে তবে তা খুবই সামান্য।
জনাব বব ক্লার্ক :খুবই সামান্য !!!
জনাব আগা হিলালী : খুবই সামান্য, যদি হয়ে থাকে । কারন আপনি দেখেছেন যখন কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করা হয়েছিল তখনই আমাদের বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল; প্রায় একশ ষাট হাজার সশস্ত্র কর্মী যারা আওয়ামীলীগের জন্য প্রচারণা করছিল তাদের প্রতিহত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সৈন্যদের প্রেরণ করেছিল।
২৫ শে মার্চে এই একশ ষাট হাজার সশস্ত্র জনগণকে প্রতিহত করার জন্য সেনাবাহিনীকে বলা হয়েছিল। এখন তারা কিভাবে এটা করবে? তাদের অবশ্যই শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল। আর এই শক্তি প্রয়োগকালে বেশ কিছু বেসামরিক জনতা গুলি বিনিময়ের মাঝে হতাহত হয়। কিন্তু সামান্য কিছু বেসামরিক জনতার নিহত হবার ঘটনাটি সম্পূর্ণই সেনাবাহিনীর অনিচ্ছায় ঘটে। নিরস্ত্র জনতার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
জনাব বব ক্লার্ক : জনাব রাষ্ট্রদূত বিভিন্ন উৎস থেকে এই হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে বিশদ আকারে প্রতিবেদন এসেছে – বিদেশী কূটনৈতিক, ধর্ম প্রচারক, সাংবাদিক যারা ঐ সময় ঘটনাস্থলে ছিল- তাদের প্রতিবেদন কি পাকিস্তান থেকে গণহারে বের হয়ে যাওয়া শরণার্থীদের বক্তব্যের বিশ্বস্ততাকেই সমর্থন করে না?
জনাব আগা হিলালী : বৈদেশিক কূটনৈতিকরা ঢাকার কোথাও এই মাত্রার হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে দেখতে পায়নি।
জনাব টেড কোপেল : জনাব রাষ্ট্রদূত,যথোচিত সম্মানের সাথে বলছি ,আমি মার্চের সময় ঢাকাতে ছিলাম এবং যখন আক্রমন শুরু হয় তখন আমাকে অভ্যন্তরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি, ২৫ শে মার্চ রাতে গুরুতর নির্যাতনের প্রমান আমরা দেখেছি, বেসামরিক লোকের বিরুদ্ধে ট্যাঙ্ক ব্যাবহার করা হয়েছিল , বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ভারি কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল। আমার মনে হয় না এতো দৃষ্টান্তের পরও আপনি দাবী করবেন যে এটা কেবলমাত্র ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যর লড়াই ছিল। ওখানে বেসামরিক লোক হত্যা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে যখন হত্যা করা হয়েছিল তক্ষণ তাদের অক্রমণ প্রতিহত করার সুযোগও ছিল না।
জনাব আগা হিলালী : হ্যাঁ, আমি বলিনি যে কোন বেসামরিক লোক হতাহত হয়নি।
গ্রামও ধ্বংস করা হয়নি। কিছু বাড়িঘর পোড়ান হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে…………।।
জনাব বব ক্লার্ক : প্রতিবেদনের দৃশ্য থেকে দেখা যায় যে সম্পূর্ণ গ্রাম ব্যাপকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
জনাব আগা হিলালী :দেখুন, আপনাদের সাথে আমরা ঘটনাটি ভিন্নভাবে দেখছি। এটা এতো ব্যাপক নয় যে পুনর্নির্মাণ করা যাবে না। কিছু নিশ্চিত ধ্বংস হয়েছে । কিন্তু তা ঐ মাত্রার নয় যা আমাদের পুনর্নির্মাণের ক্ষমতার বাইরে এবং আমরা শরণার্থীদেরও পুনর্বাসিত করতে পারব।
.
.
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৫৩। নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যস্থতা কমিটি গঠনের জন্যে পাকিস্তানের প্রস্তাব | দৈনিক পাকিস্তান | ১৯ আগস্ট, ১৯৭১ |
পাকিস্তানের প্রস্তাবঃ নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যস্থতা কমিটি গঠনের প্রস্তাব
ইসলামাবাদ, ১৭ ই আগস্ট ( এপিপি )- ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনাকর এলাকাগুলো সফর করে সেখানকার আশংকাজনক পরিস্থিতি নিরসনের উদ্দ্যেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি মধ্যস্থতা কমিটি গঠনের জন্য পাকিস্তান প্রস্তাব করেছে।
আজ এখানে এক সরকারী বিবৃতিতে জানানো হয় যে, নিরাপত্তা পরিষদের চলতি মাসের প্রেসিডেন্ট ইটালীর রাষ্ট্রদূত মিঃ ভিনসির নিকট গত ১১ই আগস্ট প্রদত্ত এক চিঠিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব আগা শাহী উপরোক্ত প্রস্তাব করেন।
প্রস্তাবে উক্ত প্রতিনিধিদলের পাকিস্তান ও ভারত বিশেষ করে উভয় দেশের উত্তেজনাপূর্ণ এলাকাগুলো সফর করার প্রস্তাব করা হয়।
চিঠিতে বলা হয় যে, পাকিস্তান সরকার তার অভ্যন্তরীন বিষয়ে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না। তবে ভারত যাতে সৌহার্দ্য ও শান্তির পথে অগ্রসর হয় তার উদ্দেশ্যে ভারতকে পরামর্শ দেবার জন্যে চিঠিতে পাকিস্তান ও ভারত উভয়ের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যে কোন স্থানে যে কোন সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এটা দূর্ভাগ্যজনক যে উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
চিঠিতে আরো বলা হয় যে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কতিপয় প্রশ্নে বিরোধ বহুদিন যাবত অমীমাংসিত থাকায় উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে পড়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্পর্কের এতদূর অবনতি হয়েছে যাতে এমন একটি সংঘর্ষের আশংকা দেখা দিয়েছে যা হয়ত এই এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
চিঠিতে বলা হয় যে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হয়েছে এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তনের জন্য সম্ভাব্য সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।