শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবান |
মুক্ত বাংলা ১ম বর্ষ ঃ ৩য় সংখ্যা |
০৪ অক্টোবর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
প্রধানমন্ত্রীর আহবান
গনপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্ব জনমত এবং পশ্চিম পাকিস্তানী মজলুম জনতার বিবেকের কাছে একখানা আবেদনপত্র পেশ করেছেন। আবেদন পত্রে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে অবাধ গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুটতরাজ ও গৃহদাহের করুণ বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের গণবিবেককে আহবান জানিয়েছেন মানবতার এ জঘন্য অপমানকে বন্ধ করতে রক্ত পিয়াসী ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য।
বিশ্বের গণবিবেক ইতিমধ্যেই জেগেছে। ৫ টি মহাদেশের গণকন্ঠেই বজ্রস্বরে আজ আওয়াজ তুলছে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের তান্ডবের বিরুদ্ধে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা এখনো চুপ কেন? স্বাভাবিক ভবাবেই প্রশ্ন জাগেঃ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের অবাধ নরহত্যা তথা ব্যাপক অরাজকতা সম্পর্কে ওরা কি ওয়কিবহাল নয়? অথবা জেনে শুনেই তাদের এই উদাসীনতা?
কিন্তু আমরা জানি তারা উদাসীন কিংবা বাংলাদেশ সমপর্কে সম্পুর্ন অজ্ঞ নয়। তাঁরা বাকশক্তিহীন। স্বাধীনতা তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রসৃষ্টি হওয়ার পরেও তারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। সামন্তচক্র, তাদের দোসর পুঁজিবাদী –মহল ও সৈরাচরী শাসকগোষ্ঠির স্বার্থে মোল্লাদের মাধ্যমে ধর্মের দোহাই দিয়ে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলো থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে রাখা হয়েছে তাদেরকে। স্বাধীনতার ২৪ বছরে বাংলাদেশে লুটপাট করে যা ধনসম্পদ ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার সবকিছুই ব্যয়িত হয়েছে সর্দার, পীর, মীর, সাহেবজাদা প্রভৃতি বিভিন্ন খেতাবে পরিচিত মসাজচক্র ও তাদের দুস্কার্যের দোশর পুঁজিপতি মহল এবং সৈরাচারী শাসকগোষ্ঠির আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখেই, গরীব জনসাধারন তাতে একটুও উপকৃত হয়নি। তারা দিন আনে দিন-খায়।
পাকিস্তানী গণতন্ত্রের শেষ ভরসা ছিল বাংলাদেশ। তাই পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত গোষ্ঠী, পুঁজিপতি, সৈরাচারী শাসকচক্রের বাংলাদেশকে এত ভয়। আর সেই হেতু পাকিস্তানে জন্মলগ্ন থেকেই ওরা ডিভাইড এন্ড রূল এর আশ্রয় নিয়ে সুকৌশলে পশ্চিম পাকিস্তানী সরলমনা জনগণের কানে কানে বাঙ্গালী মুসলমানেরা খাঁটি মুসলমান নয়, নিম্নমানের হিন্দু সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে তাই ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানগুলো পালন করেনা। ধর্মের জন্য সত্যিকারের মহব্বত বাঙ্গালী মুসলমানদের নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সেদিন ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচন পূর্বমুহুর্তে ইসলামের ধ্বজাধারী ‘মাওলানা’ নামে পরিচিত ফ্যসিস্ট রাজনৈতিক দলের ডিরেক্টর মওদুদি সাহেব (পান্জাবে দশ হাজার কাদিয়ানী হত্যা করানোর নায়ক) বাংলাদেশ সফর করে লাহোরে পৌছেই বলেছিলেন, বাঙ্গালী মুসলমানেরা কালিপুজা করে থাকে।
কিন্তু মওদুদী সাহেবের ঐ নতুন আবিষ্কারে বাঙ্গালী মুসলমানেরা মনে কোন আঘাত পায়নি। শুধু কৌতুক অনুভবই করেছে। কারন তাদের জানা আছে ইসলাম ধর্মের মূলগ্রন্থ করআন শরীফে মহানবী মুহাম্মদ (দঃ) কে ‘খাতেমুন-নবী’ বা সর্বশেষ নবী বলে উল্লেখ করে নবীদের আবির্ভাবের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও পান্জাবে নতুন নবী আবির্ভুত হয়েছিলেন। এমনকি ‘পারভেজ’ নামক জনৈক ব্যাক্তি খোদায়ী দাবি পর্যন্ত করেছিলো। এবং ওদের উত্তরাধীকারীরাই তো পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণকে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলো থেকে সযত্নে দুরে সরিয়ে রাখা তাদের রাজনৈতিক চেতনাবোধকে জেগে উঠতে বাধার সৃষ্টি করেছে। জনশক্তিকে ওদের বড় ভয়। কিন্তু আর কতদিন ঐ বিরাট শক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভবপর হবে? কারণ ওরা এখন জাগতে শুরু করেছে যে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ওঁদেরকে আলো দেখাবে। গনপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আকুল আহবানও তাদের কানে যেয়ে পৌছেছে। সাড়া দেবার জন্য ছটফট করছে তাদের বিবেক। কারণ দুনিয়ার মজলুম জনগণ একাত্ববোধেরই প্রতীক।
পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্তগোষ্ঠী, পুঁজিবাদী মহল ও সৈরাচারী শাসকচক্র আত্মস্বার্থ বজায় রাখার কুমতলবে এখন উন্মাদপ্রায়। তাদের উন্মত্ততার ঘোর যখন কাটবে তখন দেখতে পাবে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন নাটক অভিনীত হচ্ছে। কুশীলবগণ তাদের অপরিচিত অথচ সুদক্ষ এবং তাহারা নিজেরা পড়ে রয়েছে বহু নিচে। নিচে থেকেই করুন নয়নে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে উপরের দিকে তারা তাকাবে। কিন্তু কেউই টেনে তোলার জন্য এগিয়ে আসবেনা, বলবেনা উঠে এসো।
তাই আমাদের বিশ্বাস পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আহবান নিস্ফল হবে না।
————–
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৮৪,৩১৮>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
*কেন বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগাম *ভেবে দেখুন কর্ত্যব্য পালন করুন |
মুক্ত বাংলা ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা |
০৪ অক্টোবর ১৯৭১ |
কেন বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগাম
১। পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার হরন করেছে।
২। জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করেছে অর্থনৈতিক দুঃসহ যাতন।
৩। বাংলার মানুষকে ওরা ক্রীতদাস করেই রাখতে চায়।
খুনী ইহাহিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বজনগণের রায়ঃ
১। ইহাহিয়া খান হিটলারকেও লজ্জা দিয়েছে।
২। বাংলাদেশে এই বিভৎস নিধনযজ্ঞ, এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সামনে অন্য সব হত্যাকান্ডই ম্লান হয়ে গেছে।
৩।গণহত্যা ও ধ্বংশলীলা কলংকময় ইতিহাস খুজলে হিটলারের নিধন শিবির অথবা চেঙ্গিস খান বা তৈমুরলঙ্গের নৃশংসতার কাহিনীতে এরূপ হত্যাকান্ডের মিল পাওয়া দুষ্কর হবে।
ভেবে দেখুন কর্ত্যব্য পালন করুন
১। বাংলাদেশের লোকসংখা সাড়ে সাত কোটি।
২। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্য রয়েছে ৫০ হাজার। কাজেই প্রত্যেকটা পাকিস্তানী সৈন্যকে একা ১৫ হাজার বাঙ্গালীর সাথে যুদ্ধ করতে হবে।
তা কি সম্ভব?
৩।সিলেট জেলার লোকসংখ্যা ৫০ লক্ষ।
৪। সিলেট জোয় পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। সুতরাং প্রত্যেকটি পাকিস্তানী সৈন্যকে ১০ হাজার লোকের সঙ্গে লড়তে হবে।
সেটা সম্ভব নয় কি?
৫। বাংলাদেশে গ্রামের সংখ্যা ৬৮ হাজার। অতএব একটি গ্রামের ভাগে পড়ে ১ জন সৈন্য।
৬। বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলে প্রায় ৪০ লক্ষ যুবক ঘোরাফেরা করছে।
৭।পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে প্রায় ৩ হাজার মাইল দূরত্ব ভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে আসতে হয় বাংলাদেশে।
ওদের নির্মুল করতে হলে চাই –
ঐক্য শৃঙ্খলা ও দেশাত্মবোধ সুষ্ঠু সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে দেয়া। এ পর্যন্ত আমরা ৩০০ অফিসার সহ ২৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য খতম করেছি। তাদের তুলনায় আমাদের নিহতদের খুবই সামান্য, ১.৪০ ভাগ মাত্র।
অঅপনি নিজের কর্তব্য পালন করছেন কি?
.
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৮৫,৩১৯>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের সমর্থনে মহামান্য পোপ, মাওলানা মাদানী, মাওলানা মোহাম্মদ তাহের |
মুক্ত বাংলা ১ম বর্ষ ঃ ৩য় সংখ্যা |
০৪ অক্টোবর ১৯৭১ |
বাংলাদেশের সমর্থনে মহামান্য পোপ,
মাওলানা মাদানী, মাওলানা মোহাম্মদ তাহের
বিাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন জানিয়েছেন ক্রীশ্চান জগতের ক্যাথলিক শাখার ধর্মগুরু মহামান্য পোপ পল। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা জনাব মাওলানা আসাদ মাদানী ও জনাব মাওলানা মোহাম্মদ তাহের। সম্প্রতি পশ্চিমম বঙ্গ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কনভেনসনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণে করিমগন্জের সুসন্তান মাওলানা মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ইহাহিয়া খান ও তার মীরজাফর গোষ্ঠী বাংলাদেশের যে ব্যাপক গণহত্যা, নারী ধর্ষন, শোষন ও লুন্ঠন চালাচ্ছেন ইসলাম ধর্মে তার কোন স্থান নেই। আমাদের মহানবী (দঃ) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন ‘যে রাষ্ট্রনায়ক বা সরকার প্রজা সাধারনের কল্যানের চেষ্টা করেনা, তার ন্যায্য অধিকার হরন করে, তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, নিশ্চয় তার স্থান হাবিয়া দোযখ ‘। সপ্ত দোযখের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দোযখটার নামই হচ্ছে হাবিয়া। মাওলানা সাহেব আরো বলেন ‘ জালেম রাষ্ট্র নায়কের সামনে সত্যকথা ঘোষণা করা শ্রেষ্টতম জিহাদ এবং নিজেদের প্রাণ, ধন, মান রক্ষার জন্য যে নিহত হয় তাঁর মৃত্যু শহীদের মৃত্যু।
————-
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,১৮৬,৩২০-৩২১>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় দেশদ্রোহী |
মুক্ত বাংলা ১ম বর্ষ ঃ ৭ম সংখ্যা |
১১ অক্টোবর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
দেশদ্রোহী
বাংলাদেশ আজকের দুনিয়ায় এক চরম যুদ্ধে লিপ্ত। বাঙ্গালী জাতির লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ডিক্টেটর ইহাহিয়া খান গণতন্ত্রের শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও সামন্তগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরুপে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে গণতন্ত্রকে পৃথিবীর এ অংশ থেকে চিরদিনের মত মুছে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর।বাঁচা মরার এ লড়াইয়ে বাংলার সকল মানুষ কিন্তু ঐক্যবদ্ধ। কৃষক মজদুর থেকে আরম্ভ করে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী যিনি যখনই সুযোগ পাচ্ছেন জালেম পাকিস্তান সরকারের সহিত সকল সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের অধীন কর্মরত কূটনীতিকগণও সুযোগ পাওয়ামাত্র খুনী পাকিস্তান সরকারকে ধিক্কার দিয়ে বাংলাদেশের এই গৌরবজনক সংগ্রামে কাতারবন্দী হচ্ছেন। বাংরাদেশের অধিকৃত এলাকায় সনাতন মুসলিম লীগ পন্থী বা গোঁড়াপন্থী বলে এতকাল যাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্ধ সমর্থক বলে ধরে নেওয়া হতো তাদেরও এখন চৈতন্যদয় হয়েছে এবং মুক্তিফৌজের বিজয় ও পান্জাবীদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দেওয়ার জন্য গোপনে আল্লাহর দরবারে দোয়া-দুরদ পাঠেরও সংবাদ আমাদের কাছে এসে পৌছেছে।
কিন্তু আজও কিছু সংখক বিপথগামী সুবিধাবাদী, উচ্চাভিলাষী বাঙ্গালীদের কার্যকলাপ আমাদেরকে লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মুক্ষীন করছে। জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে সত্যিকার পরিস্থিতিটা পৃথিবীর ১৩০ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের সম্মুখে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ থেকে একদল সুযোগ্য প্রতিনিধি জাতিসংঘে গিয়েছেন। এবং ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন বিভিন্ন দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাই জাতিসংঘে সমবেত দুনিয়ার ১৩০ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণেরসামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার সাহস পাননি খুনী ইয়াহিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহী।ওদের দরকার হল একজন বাঙ্গালী শিখন্ডীর। খুঁজে বের করলো মাহমুদ আলীকে ।
জনাব মাহমুদ আলীর বর্তমান অবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার জীবনের গোড়া থেকেই শুরু করতে হয়। মাহমুদ আলীর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম ও প্রধান গুরু মাওলানা ভাষানী। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাহমুদ আলীর ভূমিকায় বিভিন্ন রুপ বহুবার আমরা দেখেছি। মাহমুদ আলীর ‘নও বেলাল’ পত্রিকা এককালে পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রগতিশীল পত্রিকা ছিল। পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) যুবলীগের সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী। পাকিস্তানের সর্বপ্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘গণতন্ত্রীদলের’ প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী এবং সাবেক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সেক্রেটারী মাহমুদ আলীকেও আমরা দেখেছি। আমাদের স্পষ্ট স্মরন আছে ১৯৫৩ সালে পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে যখন গলা টিপে হত্যা করার অপচেষ্টায় রত এবং ছাত্র জনতা তাদের বিরুদ্ধে সংগামে লিপ্ত, তখনই ঢাকার তৎকালীন অন্যতম ‘ও-ক’ রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক কনফারেন্সে যুবলীগ সভাপতি মাহমুদ আলী বলেছিলেন, ধর্মের বন্ধনই যদি রাষ্ট্র গঠণের প্রধান ভিত্তি হয় পূর্ব বাংলা তার নিকটতম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া অথবা মালয়েশিয়ার সংগে ফেডারেশনে থাকতে পারে। আর অফগানিস্তান ইরানকে নিয়ে পাকিস্তান আরেকটি ফেডারেশন গড়ে তুলুক। ওতে আপত্তি কোথায়? এবং এখানেই ট্রাজেডী যে, মাহমুদ আলীকে আমরা এতকাল গণতন্ত্রী, পগতিশীল ও আত্মানিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রবক্তা বলেই বিশ্বাস করে এসেছি সেই মাহমুদ আলীর আসল রুপটাও অমন ও পুঁজিবাদের তিনি এক নিকৃষ্টতম দালাল সেটা আদৌ আমরা জানতামনা। বাঙ্গালী জাতির জীবন মরন সংগ্রাম তাঁর প্রকৃত চেহারাটাকে বাংলাদেশের জনগণ তথা বিশ্বমানবের কাছে সহসাই তুলে ধরলো।
পাকিস্তানের জন্মের দীর্ঘ ২৪ বছরের মধ্যে কোন বাঙ্গালীকে জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা রুপে পাঠানো হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই- মাহমুদ আলীতো দুরের কথা। এবারে বড় ফ্যাসাদে পড়ে পৃথিবীকে ধোকা দেবার জন্যই একটা পুতুলের প্রয়োজন হলো ইসলামাবাদের জল্লাদদের। আর সেই পুতুল নেতার ভূমিকায়ই ধরা দিয়েছেন মাহমুদ আলী। জাতির মুক্তিলাভের মহান সংগ্রামে যখন বৃদ্ধ জননেতা জনাব ভাষানী থেকে শুরু করে দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মী মাত্রই জীবনপণ করে কাজ করে যাচ্ছেন, তখনই মাহমুদ আলী গিয়েছেন জাতিসংঘে স্বজাতি ও নিজ দেশের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানীদের দালাল হয়ে ওদের পক্ষে সাফাই গাইতে এবং স্বজাতির কুৎসারটনা করার জন্য বিশ্বরাষ্ট্র সভায়।মাহমুদ আলী জাতিসংঘে নিজেকে পূর্ব বাংলার অধীকারী বলে জাহির করেছেন এবং সেটাইতো বর্তমান পরিস্থিতিতে তার আসল যোগ্যতা। তার দালালী সুলভ বক্তৃতায় বাংলাদেশের ঘটনাবলীর জন্য আওয়ামিলীগ, মুক্তিফৌজ ও ভারতকে দোষারপ করে ধীকৃত খুনী ইহাহিয়া ও টিক্কাদের পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে প্রানপণ চেষ্টা করেছেন তিনি। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী সমর সেনও নিজেকে পূর্ব বাংলার সাবেক অধিবাসী বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার বক্তৃতায় বাংলাদেশে ইহাহিয়া খানের নরপশু সৈন্যবাহিনী কর্তৃক যে অকথ্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে তার করুণ বর্ণনা দিয়েছেন। শ্রী সেন বর্তমানে শুধু ভারতের নাগরিক নন – বিশ্বসভায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধিও। কিন্তু মাহমুদ আলী বাংলাদেশেরই বাসিন্দা। বাংলাদেশ সম্পুর্ন মুক্ত হলে মাহমুদ আলীর মত পথভ্রষ্ট দালালদেরকে পান্জাবিরা সংগে নিয়ে যাবেনা। ছেঁড়া জুতোর মত প্রয়োজন শেষে বাংলাদেশেই ফেলে যাবে – সে কথাটা আমাদের অজানা নেই। তবে ইতিহাস যে মাহমুদ আলীদের ক্ষমা করবেনা, একথাটা আমরা দৃঢ়চিত্তেই বলতে পারি। মীরজাফর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবীর লোভে সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কিন্তু মাহমুদ আলী জীবনে মাত্র একটিবারই তুচ্ছ সাময়িকভাবে ’নেতা’ বনার লোভে স্বজাতি ও নিজের অতীত জীবনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। ‘ভারতের দালাল’ ‘কমিউনিষ্ট’, ও রাষ্ট্রবিরোধী বলে এই মাহমুদ আলীই কয়েকবার পাকিস্তানী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আজ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চরম মূহুর্তে তার ভূমিকা সত্যিই অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখন তিনি দেশদ্রোহীর ভূমিকা পালন করছেন। তার অপমৃত্যু ঘটেছে। তাই আমাদের পরিচিত মাহমুদ আলীর অমন অপমৃত্যুর জন্য আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খানের দালাল মাহমুদ আলীকে জানিয়ে রাখছি
’তোমাদের বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে এই জনতা’
—————
.
.
শিহাব শারার মুকিত
<৬,১৮৭,৩২২-৩২৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় পাকিস্তানি সেনা নারী নির্যাতন ও আলেম সমাজ |
মুক্তবাংলা ১ম বর্ষঃ ৭ম সংখ্যা |
১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
পাকিস্তানি সেনা
নারী নির্যাতন ও আলেম সমাজ
বাংলাদেশটি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিল একমাত্র ধর্মীয় প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়েই। নইলে দ্বিতীয় কোন যুক্তি ছিল না যদিও বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ হানাফী মতালম্বী এবং পাকিস্তান কাদিয়ানি, শিয়া, হানাফী, শাফেয়ী ও মালিকীদের আবাসভূমি।
ইসলাম ধর্মের কট্টর শত্রুও স্বীকার করেছেন যে, নারীজাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম ধর্ম। সাধারণ গৃহকোণ থেকে সিংহাসন পর্যন্ত নারীর মর্যাদা স্বীকৃত। মহাপুরুষ হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর বাণী সন্তানের বেহেস্ত জননীর পদতলে। ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদ মহাগ্রন্থ কুরআন মাজিদে পুরুষ জাতির প্রতি কড়া নির্দেশ রয়েছে নারী জাতিকে যথোপযুক্ত সম্মান দেওয়ার জন্য। নিজের বিবাহিতা স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারী নিষিদ্ধ করা হয়েছে পুরুষের জন্য। পৈতৃক সম্পত্তিতে পুত্রসন্তানের মতো কন্যাসন্তানেরও ওয়ারিসী স্বত্ব স্বীকৃত। একদা দিল্লীর সিংহাসনে সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়া ও দক্ষিণাত্যের বিজাপুরে বীরাঙ্গনা চাঁদ সুলতানা তারই ফলশ্রুতি। হাল জমানায় অবশ্য সভ্য জগতের সর্বত্রই নারী জাতির সমঅধিকার স্বীকৃত।
কিন্তু বাংলাদেশ ধ্বংস করার জন্য প্রেরিত স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী ইসলাম ধর্মের অবশ্য পালনীয় নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন শিবিরে অন্যূন ২০ হাজার নারী আটক করে রেখেছে নিজেদের পাশবিক বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দ্যেশ্যে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, চাকুরীজীবী মহিলা, কুলবধূ কেউই ওদের হিংস্র থাবা থেকে রেহাই পাননি।
ইসলাম ধর্মের অনুশাসন বেপরোয়াভাবে অগ্রাহ্যকারী মুসলমান ধর্মীয় পরিভাষায় ‘কাফের’। এবং নারীজাতির সতীত্বের প্রতি সম্মান দেখানো ইসলাম ধর্মের একটি কড়া অনুশাসন। সুতরাং বাংলাদেশে আগত ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী মুসলমান নয়, কাফের।
এই কাফেরদের বিরুদ্ধে কিন্তু আমাদের আলেম সমাজ আজ পর্যন্ত একটা টুঁ-শব্দও উচ্চারণ করেননি। সম্প্রতি যে ভাগ্যহীন মেয়েগণ খান সেনাদের শিবির থেকে পরিত্যাক্তা হয়েছেন ওরা মৈথুনকার্যে অনুপযুক্ত, রোগে ভুগে জীর্ণশীর্ণ এবং গর্ভবতী। এবং সেই হেতু পরিত্যাক্তা। ইহার পরিপ্রেক্ষিতে আলেম সমাজের প্রতি আমাদের জিজ্ঞাসাঃ ঐ ভাগ্যহীনরা যদি আপনাদেরই স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ হতেন তাহলে আপনারা কি করতেন?
অবশ্য আমরা জানি আপনারা বসে নাই। ইয়াহিয়া খানের ঔপনিবেশিক শাসনকে বাংলাদেশে কায়েম রাখার জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আপনাদের অনেকে। বর্তমান জগতের অন্যতম অশ্চর্য বস্তু বাংলাদেশের উপ-নির্বাচনী প্রহসনকে বাস্তবে পরিণত করার অপচেষ্টায় আপনারা গলদ্ঘর্ম। কিন্তু আমরা ভুলিনি মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ অবদান গনতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল আপনাদেরই পূর্বসূরীদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলো উমাইয়া রাজবংশ। ওদের সমর্থনে আপনাদের পূর্বসূরী আলেমগণ আবিষ্কার করেছিলেনঃ ‘আসসুলতানু জিল্লুল্লাহ’ (শাসক আল্লাহর ছায়া)-এর মতন একটা স্তোকবাক্য ইসলামের নামে। এবং এখন আপনারা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন ‘আগা রাজবংশ’। এখনও ভাবছেন আমরা বিশ্বাস করি ‘আসসুলতানু জিল্লুল্লাহ’?
সতর্ক হউন! ঐ পশ্চিম কাফেরদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। যে ধর্মের গ্রন্থি আমাদেরকে জুড়ে দিয়েছিল ওদের সঙ্গে, ওদের আচরিত ধর্ম থেকে আমাদের সেই ধর্মের রূপ ভিন্ন, আলাদা। কাজেই বিবেকের চাবুকের তীব্র আঘাতে আপনারা সোচ্চার হয়ে উঠুন ওদের বিরুদ্ধে। ওরা আপনাদের ২০ হাজার নিষ্পাপ মেয়ের ধর্ম নষ্ট করেছে, জীবন নষ্ট করেছে এবং ওদের গর্ভে রেখেছে অপসৃষ্টি।
.
.
শিহাব শারার মুকিত
<৬,১৮৮,৩২৪-৩২৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় সাঙ্গ হোক এই কীর্তনের পালা |
সাপ্তাহিক বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা |
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
[**সাপ্তাহিক বাংলাঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। সম্পাদক- মাইকেল দত্ত। রূপসী বাংলা প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স এর পক্ষে বিজয় কুমার দত্ত কর্তৃক মুদ্রিত এবং মুজিবনগর ও সিলেট থেকে একযোগে প্রকাশিত।]
সাঙ্গ হোক এই কীর্তনের পালা
ইতিহাসের এই ঘৃণ্যতম সামরিক বর্বরতার শিকার সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পাগল বাঙালীর প্রাণ-ফসলের জ্বলন্ত প্রতীক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে। নিউয়র্কের জাতিসংঘ ভবনে সমবেত বিশ্বের ১৩০ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সামনে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি জানাতে গেছেন বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। মানবাধিকারের নিশানবরদার, শোষিত-নিপীড়িত জাতিসমূহের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বিঘোষিত আদালত জাতিসংঘের আজ চরম পরীক্ষা। বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি কোন পথ অবলম্বন করেন, তাঁরা শোষিত-নির্যাতিত মানবতার শৃঙ্খলমুক্তিতে এগিয়ে আসবেন নাকি রক্তপিপাসু দানবের সাম্রাজ্যবাদী রনলিপ্সার কাছে মাথা নত করবেন বিশ্বের সাড়ে তিনশ কোটি মানুষ তা দেখার জন্য আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। জাতিসংঘ একটা কর্মক্ষম জীবিত প্রতিষ্ঠান নাকি ক্ষুদ্র ও মাঝারী রাষ্ট্র এবং জাতিসমূহের ভাগ্য নিয়ে পরিহাসে রত বৃহৎ শক্তিবর্গের দাবা খেলার ছক মাত্র, বাংলাদেশ প্রশ্নে এবারকার জাতিসংঘ অধিবেশনের কার্যকলাপে তারও চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে।
দেশের মাটিতে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হামলা যতই তীব্র হয়ে উঠেছে, আকস্মিক আঘাতে হতভম্ব বাঙ্গালী জোয়ানরা ততই সুসংবদ্ধ ও সুদক্ষ হয়ে উঠেছে। ইয়াহিয়া জঙ্গি সরকারের মুরব্বি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ততই বেসামাল হয়ে আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশ সমস্যাটিকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের বিজয় অত্যাচার, অনাচার এবং জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার বিজয়- এই বাস্তব সত্যটি কোন সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী, নয়া উপনিবেশবাদী কিংবা নয়া সাম্রাজ্যবাদী চক্রের নিকট সুখকর হতে পারে না- তা বলাই বাহুল্য। বিশ্বময় জাতিগত নিপীড়ন, বর্ণবৈষম্য এবং ক্ষুদ্রের উপর বৃহতের পীড়নমূলক কর্তৃত্ব যেভাবে ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে চলেছে- এবং সে ব্যাপারে জাতিসংঘ এতকাল যে নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে এসেছে, বাংলাদেশ প্রশ্নে হঠাৎ করে বদলে যাবে, নির্জীব বিতর্কসভা হঠাৎ করে দৃঢ়সংকল্পে, কর্মমুখরতায় ভরে উঠবে, তেমন আশা সম্ভবত কেউই করেন না। কিন্তু তবু বাংলাদেশের ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা একথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। একদিকে নজিরবিহীন বর্বরতা, রক্তের প্লাবন, বাস্তুত্যাগী মানুষের স্রোত এবং নিজদেশে পরবাসী কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণা, আরেকদিকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাস্তব কঠিন সত্য। পৃথিবীর প্রায় সব জাতিকেই রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে, এমনকি আজকের বিশ্বের শক্তির আধার যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনকে সম্ভবত তুলনামূলক অনেক বেশী কঠোর ও কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের রক্তের মুল্য দিতে আজ বিশ্ববিবেকের অনীহা বিস্ময়কর বইকি।
সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম মিত্র বিশ্বের বিভিন্ন গণতন্ত্রমনা দেশ ও জনসমষ্টির সুতীব্র ঘৃণা এই ষড়যন্ত্রের নায়কদের পাপ অন্তঃকরণে সাড়া জাগাতে পারছে না। জাতিসংঘ তাই আজও মূক, বধির। কেবল লোক দেখানো তৎপরতা আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে- কর্তার ইচ্ছায় কির্তন। মানবতার দুশমনদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কোন শক্তিই যদি না থাকে এই ‘বিশ্বসরকারের’ ভিয়েতনাম, কঙ্গো, বিয়াফ্রা, ফিলিস্তিন, লাতিন আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের সর্বত্র পশুশক্তির বর্বর হামলায় ক্ষতবিক্ষত স্বাধীনতাকামী জাতিসমূহের মত বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যদি জাতিসংঘ কেবল নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকাই গ্রহণ করে চলে তবে আজ নিশ্চিতরূপে বিশ্বমানবতার কণ্ঠে উচ্চারিত হবে চূড়ান্ত ঘোষণা- এমন কাঠের পুতুল জাতিসংঘের কোন প্রয়োজন নেই। অতএব সাঙ্গ হোক এই কীর্তনের পালা।
.
শিহাব শারার মুকিত
<৬,১৮৯,৩২৬-৩২৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ইয়াহিয়ার শক্তির উৎসে আঘাত কর |
সাপ্তাহিক বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা |
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
ইয়াহিয়ার শক্তির উৎসে আঘাত কর
ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক বীর যোদ্ধাদের অবিশ্বাস্য রণনৈপুণ্যে প্রতিটি রণাঙ্গনে আজ ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী মৃত্যুর বিভীষিকায় আতঙ্কের দিন গুনছে। একদিকে বিশ্বময় সাধারণ মানুষের হৃদয় নিংড়ানো সমর্থন ও সহানুভূতিধন্য সংগ্রাম, আরেকদিকে সভ্যতার ও মানবতার তীব্রতম ঘৃণায় কলঙ্কিত পেশাদার দস্যু বাহিনীর লোমহর্ষক বর্বরতা! সত্যের বিরুদ্ধে অসত্যের, ন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায়ের শক্তি মদমত্ততার নগ্ন আস্ফালন ইতিহাস কোনদিন ক্ষমা করেনি। ক্ষুদে ডিক্টেটর ইয়াহিয়ার সাধ্য কি প্রকৃতির সেই অমোঘ বিধান পাল্টে দেয়?
কিন্তু তবু আত্মতৃপ্তি কিংবা অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের আনন্দে কর্তব্যকর্মে শিথিলতা প্রদর্শনের কোন অবকাশ নেই। একথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও উচ্ছ্বাসের পর্ব শেষ হয়ে গেছে। এখন নিরেট, কঠোর ও বাস্তব বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা পর্ব। কেবল রণাঙ্গনেই নয়, এ যুদ্ধ সমভাবে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনীতিতেও চালিয়ে যেতে হবে। সেজন্য কেবল প্রয়োজন সর্বাগ্রে শত্রুর শক্তি ও শক্তির উৎসগুলির সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং জাতিসংঘের রুদ্ধদ্বার কক্ষের কূটনৈতিক প্রভুরা বাংলাদেশ প্রশ্নে কি ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে সম্পর্কে কেউ কেউ অতিমাত্রায় আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। এ থেকে মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ এবং ক্ষুদ্র দেশ ও জাতিসংঘের প্রতি বৃহৎ শক্তিবর্গের কসাই সুলভ নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে বাংলাদেশের এমনকি ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিপূর্ণভাবে সচেতন নয়। ফলে একদিন যেমন কোন কোন রাষ্ট্রের সমর্থনের ও সদিচ্ছার উপরে মাত্রাতিরিক্ত ভরসা করা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ইয়াহিয়া খানের জঙ্গি সরকারের শক্তিকেও অনাবশ্যকভাবে খাটো করে দেখানো হয়েছে। বিদেশ বাংলাদেশ প্রশ্নে সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী মহলে যে সহানুভূতি ও দ্যার্থহীন সমর্থন পাওয়া গেছে, তাকেই চূড়ান্ত ধরে নেওয়া হয়েছে এবং সেই সাথে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার সাফল্য সম্পর্কে একটা আন্ততৃপ্তিবোধও জন্ম নিয়েছে। সেই মুক্তি বাহিনীর সাফল্যে আত্মস্ফীত হয়ে ইয়াহিয়ার আসন্ন পতনের তারিখ ঘোষণার ব্যাপারেও কেউ কেউ রীতিমত প্রতিযোগিতা দিয়ে চলছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব চিন্তা ভাবনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু দায়িত্বশীল এবং নীতিনির্ধারণে নিযুক্ত ব্যক্তিরাই যদি এমনিভাবে উটপাখির মত বালিতে মুখ গুঁজে রেখে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করেন, তবে সে পরিকল্পনার গোড়াতেই গলদ থেকে যেতে বাধ্য।
জাতিসংঘে কি হতে পারে তার আভাস পাওয়া গেছে পূর্বাহ্নে ইয়াহিয়ার হানাদার সৈন্যরা যে পৈশাচিক বর্বরতায় সভ্যতার ইতিহাস কলঙ্কিত করেছে, বিশ্ববিবেকের অভিভাবকত্বে সমাসীন জাতিসংঘের কর্মকর্তার এবং বিভিন্ন স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিরা ততোধিক হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতায় বাংলাদেশ সমস্যাটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। ইয়াহিয়া খুনি, তবে তার খুনটা কিছুটা “hot blooded” কিন্তু যারা বিশ্বের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা সেজে বসেছেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের ক্ষমাহীন শীতলতা “cold blooded” এবং নিশ্চিতরূপেই ষড়যন্ত্রমূলক। এই ষড়যন্ত্র কেবল বাংলা ও বাঙালীর বিরুদ্ধেই নয়- মানবতার বিরুদ্ধে, জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে, সর্বোপরি মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে।
ইয়াহিয়া খা কয়েক মাসেই দেনার দায়ে কাবু হয়ে যাবে, আভ্যন্তরীণ কলহে আপনা থেকেই তার তাসের ঘর ভেঙ্গে যাবে, যুদ্ধ খতম হতে হতে তার সৈন্যবাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, অথবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে ইয়াহিয়াকে বাংলার বুক থেকে হাত গুটিয়ে নিতে হবে, এসব চিন্তার একটিও যে পুরোপুরি বাস্তব বুদ্ধিজাত নয়- ইতিমধ্যেই তা কিছুটা প্রমাণিত হয়েছে। ইয়াহিয়ার দেনার দায় যতই থকুক, যতই বাড়ুক, একথা মনে রাখা দরকার যে, তার পিছনে ‘মহাজন’ মুরব্বীও আছে, যারা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী ও বেনিয়া স্বার্থেই ইয়াহিয়ার পরমুখাপেক্ষী সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে এবং পাকিস্তানের ‘ঋণনির্ভর’ অর্থনৈতিকে তারা বেশ কিছুকাল অতিরিক্ত (প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ) ঋণের অক্সিজেন তাঁবুতে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
ইয়াহিয়ার ঘর একান্তভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানকার জনসাধারণকে বাংলাদেশের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়নি (বা করা সম্ভব হয়নি)। ফলে আজো সেখানকার রাজনীতি একান্তভাবে সামন্ত প্রভাবান্বিত এবং বাংলাদেশ প্রশ্নে সেখানকার সামরিক ও বেসামরিক প্রভুদের মনোভাব মোটামুটি এক। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রশস্ত হবে এমন কোন আভ্যন্তরীণ কলহে সেখানে দল উপদলগুলি বেশিদূর এগুবে তেমন আশা অন্তত এই পর্যায়ে করা চলে না। আমাদের মুক্তিবাহিনী এখন নিঃসন্দেহে আগের চাইতে অনেক বেশি দৃঢ়তা ও কার্যকারিতার সাথে ইয়াহিয়ার পেশাদার সৈন্যদের মোকাবিলা করছে। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীর বাস্তবিকই বেকায়দা অবস্থা।
সম্ভবত তা অনুমান করতে পেরেই ইয়াহিয়া এখন তার রণকৌশল বদলে নিয়ে ‘বাঙ্গালাইজেন’ নীতি গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশেরই জনগণের একাংশকে ভয়ভীতি-প্রলোভনে কিংবা ব্যক্তিগত রেষারেষির সুযোগে উস্কানি দিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে এখন মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত ও আহতদের মধ্যে এসব দেশীয় ‘কোলাবরেটরদের’ সংখ্যাই বেশী। এটা খুব শুভ লক্ষণ নয়। অনুরুপভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ইয়াহিয়া খান একঘরে হয়ে পরবে এবং তার রক্তমাখা হাতের সাথে কেউ হাত মেলাবে না, এই আশাও বাস্তবের ধোপে টিকে না- কারণ, বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্রগুলির বেশির ভাগের হাতই যে রক্তমাখা। এক্ষেত্রে বরং চোরে চোরে মাসতুতো ভাই হবারই সম্ভাবনা বেশি।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পরিচালনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার উপর বর্ণিত অন্ধকার দিকটি সামনে রেখে তারই মোকাবিলার জন্য আজ আমাদের তৈরি হতে হবে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে ইয়াহিয়া সরকারকে কাবু রাখার জন্য দরকার মুক্তিবাহিনীর তৎপরতাকে জোরদার করা। সেজন্য আরও গভীর, আরও ব্যপক ও বিরাটভাবে আঘাত হানা দরকার। এ ব্যপারেও আমাদের এখনো অনেক কিছু করণীয় আছে। যুদ্ধের কৌশলগত ও নীতিগত দিক আলোচনা করা অনুচিত বিধায় এ সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না।
কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের পাশাপাশি যদি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ে আমরা সমান সাফল্য অর্জন করতে না পারি, তবে চূড়ান্ত বিজয় অসম্ভব হয়ে পরতে বাধ্য।
রাজনৈতিক পর্যায়ে “Isolate the enemy” এই নীতি অবলম্বন করে দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত শক্তিকে সংহত করা অত্যাবশ্যক। বিলম্বে হলেও কয়েকটি দলের সমন্বয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন এব্যপারে একটি শুভ পদক্ষেপ হয়েছে। এই পরিষদকে সম্প্রসারিত করে দল এমনকি গ্রুপগুলিকেও অঙ্গীভূত করে নেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এমনকি যারা দোটানায় আছে কিংবা ভয় ভীতিতে শত্রুর সহযোগিতা করছে, বাংলাদেশ সরকারের আশু কর্তব্য তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেও দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে তাদের মনে আস্থা সৃষ্টি করা এবং শত্রুকে তাদের সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা। ইয়াহিয়া সরকার যেভাবে সর্বপ্রকার চেষ্টা চালিয়ে বাংলাদেশ থেকেই সমর্থন সংগ্রহের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকেও সেইভাবে তাদের কোণঠাসা করে রাখতে এবং প্রতিটি বাঙ্গালীকে স্বাধীন বাংলার পতাকার নিচে জমায়েত রাখার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে, কিংবা অবহেলাভরে একটিমাত্র মানুষকেও শত্রুশিবিরে ফেলে দেওয়া এই পর্যায়ে আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে ইয়াহিয়া যেভাবে , divide and rule এর চেষ্টা চালাচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে এমনকি ইয়াহিয়া-সমর্থক বাঙ্গালীদের মধ্যেও রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো দরকার। বাংলাদেশ আজ হোক কাল হোক স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবেই এ বিশ্বাস সবার মনে বদ্ধমূল করে দিতে হবে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ইয়াহিয়ার শক্তির প্রথম উৎস। এই উৎসে আঘাত হানার সুযোগ এখনও আছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কায়েমীস্বার্থের সিংহাসনে ফাটল ধরাবার নিরন্তর চেষ্টা চালাতে হবে। কোন ব্যর্থতাকেই ব্যর্থতা মনে করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজনবোধে একটি বিশেষ দল গঠন করা যেতে পারে।
পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষত ইয়াহিয়া সামরিক বাহিনীকে অদ্যবধি ঐক্য বজায় রাখার জন্য ধর্মোন্মাদনা, আঞ্চলিক স্বার্থচেতনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অবলুপ্তির সম্ভাবনাজনিত ভিত্তিকেই বেশী করে কাজে লাগানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানে জনমত খুবই বিভ্রান্ত। তবে এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পৃথিবীর মুসলিম রাষ্ট্রগুলির দ্ব্যর্থহীন সমর্থনেই আজ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতীক একান্তভাবেই ইয়াহিয়ার হস্তগত হয়েছে। দেশের বৃহত্তর অংশ হয়েও বাংলাদেশে সেই প্রতীকের উপর স্বীয় দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
মুসলিম দেশগুলি ইয়াহিয়াকে সমর্থন করছে কেন? কেউ কেউ এ নিয়ে বিশ্বের মুসলমান জনসাধারণ এবং তাদের ধর্মীয় চেতনার প্রতি কটাক্ষ করেই তৃপ্ত হয়েছেন। বিষয়টি গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেননি। বস্তুত ইয়াহিয়া খাঁর প্রতি মুসলিম রাষ্ট্রযন্ত্রগুলির সমর্থনের মূল কারণ, এসব দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের অধিকাংশের অগণতান্ত্রিক ও ক্ষেত্রবিশেষে গণবিরোধী চরিত্র। তার চাইতেও বড় কথা পাকিস্তান সম্পর্কে এ সব দেশের জনসাধারণের, এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের সীমাহীন অজ্ঞতা। এসব দেশে পাকিস্তানি কূটনীতিক সাফল্যও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। মুসলিম দেশগুলির মধ্যে পাকিস্তান বৃহত্তম, যে হিসেবে এসব দেশে পাকিস্তানি কূটনীতিকরা বরাবর বিশেষ মর্যাদা ভোগ করেছে। এসব কূটনীতিকরা পাকিস্তান সম্পর্কে বরাবরই একতরফা চিত্র তুলে ধরেছে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের সংখ্যা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব, বাঙ্গালীদের স্বকীয়তা, এসব সম্পর্কে এসব দেশের মানুষকে কিছুই জানতে দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এসব দেশে একতরফাভাবে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার পাশাপাশি বাংলাদেশের মুসলমানদের পক্ষ থেকে এসব দেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়নি। ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের কথা বলায় কার্যত হিতে বিপরীত হয়েছে, এমনকি জয়প্রকাশ নারায়ণের মত সজ্জন ব্যক্তির সফরও এসব দেশে বিকৃত ছাপ ফেলেছে। তাতে করে কেবল বাংলাদেশ সমস্যা ভারতের সৃষ্টি- এ ধারণাকেই জোরদার করা হয়েছে।
পাকিস্তানের পশ্চাতে মুসলিম দেশগুলির ঢালাও সমর্থনের অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে এ ব্যাপারে আশু কর্তব্য নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরী। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায় ৩০টি দেশের শর্তহীন সমর্থন মোটেই অবহেলার বিষয় নয়। বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার না করে কূটনীতির প্রয়োজনের নিরিখেই বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান। ইয়াহিয়ার নির্বিচার গণহত্যা, উৎপীড়নের শিকার হয়েছে এই মুসলমানরাই। ইসলামের দৃষ্টিতে সংখ্যালঘুর জানমাল রাষ্ট্রের পবিত্র আমানত। সে ব্যাপারে কি নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতার প্রকাশ ঘটেছে, কিভাবে আবাল-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নারীর উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, এমনকি কোরআন পাঠরত মহিলাকেও রেহাই দেয়া হয়নি, কিভাবে হানাদার সৈন্যরা বোমার আঘাতে মসজিদের মিনারও পুড়িয়ে দিয়েছে- এসব কথা মুসলিম দেশগুলির সাধারণ মানুষের কাছে পৌছায়নি। বাংলাদেশ যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কায়রোর মুফতিরও নাকি সেকথা জানা ছিল না।
ইয়াহিয়ার শক্তির এই উৎসমুখ বন্ধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দরকার। মুসলিম দেশগুলির সমর্থন বাংলাদেশের জন্য জরুরী। কারণ, একমাত্র তাহলেই ইয়াহিয়ার শাসনযন্ত্রের শেষ নৈতিক খুঁটিটি ধসে পরবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে ইয়াহিয়ার মুখোশ উন্মোচিত হতে পারে। একমাত্র তাহলেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুসলিম দেশগুলির ভাবনার কিছুই নেই, বরঞ্চ আরেকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রকে অভিনন্দন জানানোই তাদের কর্তব্য- এই সত্যটি তুলে ধরতে হবে।
পাকিস্তান সরকারের তৈরি বহুদিনের ভুল ধারণা নিরসন অতি সহজে হবে আশা করা যায় না। তবে এ ব্যাপারেও আপাত ব্যর্থতায় মুষড়ে পরলে চলবে না।
.
.
সৌ রভ
<৬,১৯০,৩৩০-৩৩১>
শিরোনামঃ স্বাধীনতাঃ ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ
সংবাদপত্রঃ সাপ্তাহিক বাংলা ( ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা )
তারিখঃ ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
স্বাধীনতাঃ ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ
এটা আজ অস্বীকার করে লাভ নেই, বৃহৎ শক্তিবর্গ ‘বাংলাদেশ’ সমস্যার ব্যাপারে পাকিস্তানের উপর বিশেষ কোন চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি, বা ইচ্ছে করেই করেননি। কোন দেশই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। খুব কম রাষ্ট্রই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন বলে খোলাখুলি মত প্রকাশ করেছে। সরকারীভাবে অনেকেই ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের সম্পর্কে গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন, অনেক রাষ্ট্র সাহায্যও করেছে, কিন্ত প্রত্যেক ক্ষেত্রেই শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশ সমস্যা সম্বন্ধে বক্তব্যের ব্যাপারে বিরাট ব্যবধান লক্ষ করা গেছে।
রাষ্ট্রসংঘের বর্তমান অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক শক্তিশালী দল পাঠান হয়েছে। তারা সেখানে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য তুলে ধরবার চেষ্টা করবেন। কিন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রসংঘের সদস্য নয়। উপরন্তু পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। অধিকন্তু পাকিস্তান এখনও দাবী করে বাংলাদেশ পাকিস্তানেরই অঙ্গ এবং পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র আজও পর্যন্ত তাই সরকারীভাবে বিশ্বাস করে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলকে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তদুপরি রাষ্ট্রসংঘের বর্তমান অধিবেশনের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার ডঃ আদম মালিক সরাসরি বলেছেন যে, বাংলাদেশ সমস্যা রাষ্ট্রসংঘে আলোচিত হোক তিনি তা চান না।
সরকারীভাবে বক্তব্য বলার সুযোগ না পেলেও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বেসরকারীভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ-আলোচনা চালাতে পারেন। কিন্ত তাতেও বিশেষ ফল হবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশন শুরুর প্রাক্কালে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশগুলির মন্ত্রিপর্যায়ের সম্মেলনে ভারতে বাংলাদেশ সমস্যা তুলেছিল। কিন্ত আলোচনা ফলপ্রসূ কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। পাকিস্তান বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে সারা বিশ্বে ইসলাম বিপন্ন হয়ে পরবে। তারা এখন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে নিজেদের মত পালটাবেন বলে মনে হয় না।
বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূমিকায় বাংলাদেশ সরকারের আনন্দিত হওয়ার কিছুই নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে গেলে যে টাকা সে পাকিস্তানকে ধার দিয়েছে তা ফেরত পাবে না। বরং পাকিস্তান যদি টিকে থাকে তবে পাক-ভারত সমস্যাও থাকবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় রাষ্ট্রেই অস্ত্র ব্যবসায় নানাভাবে আর্থিক-দিক দিয়ে লাভবান হবে। তদুপরি তার ভয় বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিক্ষুব্ধ রাজনীতির শিকার হবে এবং ক্রমশ বামপন্থী রাস্তা ধরবে। তারচেয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হয়ে থাকলে সব সময় সেখানে একটা পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব প্রবল থাকবে। যার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়বাদীরাই সম্মুখভাগে থাকবে। চরম বামপন্থীরা কিছুতেই তাদের ঠেলে এগিয়ে আসতে পারবে না। এর ভিত্তিতে বিচার করলে বাংলাদেশ সরকারের যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় প্রায় অসম্ভব।
চীনের ভয় আবার অন্য দিক থেকে। সে মনে করে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন হলে জাতীয়বাদীদের ক্ষমতা চলে যাবে। বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে জাবে।তার চেয়ে যদি পাকিস্তান টিকে থাকে এবং পাকিস্তান বন্ধুত্বের সুযোগ চীনপন্থীরা বাংলাদেশ সংগঠিত হবার সুযোগ পায় মন্দ কি ? না হয় <ভাসবদিতকতাক> বাংলাদেশের ব্যাপারে দ্বিতীয় বার চিন্তা করা যাবে না। তাই বাংলাদেশের আই মুহূর্তে চৈনিক সমর্থনের আশা করা বৃথা।
রাশিয়া বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখানো আর সক্রিয় সমর্থন করা এক কথা নয়। রাশিয়ার বর্তমান স্ট্রেটেজিই হলো কারো সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়িয়ে চলা। মোট কথা কোন বিদেশী শক্তি যে আমাদের জন্য বড় রকমের কিছু করে বসবেন সেই সম্ভাবনা আদৌ কিছু দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন যে নিজেদের ভেতরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার চাপেই ইয়াহিয়া সরকার ভেঙ্গে পরবে। কিন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিরাট মতবিরোধের যে কথা এতদিন বলা হচ্ছিল তার অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। তবে মুক্তিবাহিনীর হাতে ব্যাপকভাবে নিজেদের লোক হতাহত হওয়ার ফলে নিম্ন পর্যায়ের সামরিক অফিসারদের মধ্যে কিছুটা মনকষাকষি দেখা দিতে পারে।
পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টোই এখন ইয়াহিয়া সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক সমস্যা। তিনি ঘন ঘন ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানাচ্ছেন। তাঁর দলই এখন জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং পাকিস্তান শাসন করার অধিকার তাঁরই। ইয়াহিয়া খান কিন্ত এখন ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নন। তিনি কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও কনভেনশন মুসলিম লীগের সংযুক্তি ঘটিয়ে তাঁর অনুগত একটি দল গঠনে সমর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে পুনঃনির্বাচন প্রহসন চালিয়ে তিনি এই দলকে ক্ষমতায় আনতে চাইছেন। উপরন্তু ভুট্টো সাহেবের দল এখন প্রায় দ্বিধাবিভক্ত।
ওয়ালী খান পালিয়ে গেছেন। তাঁর দলের অনেকেই এখন বন্দী। বিগত নির্বাচন ও তার পরবর্তী রাজনীতির ধারা দেখে মনে হয় না, তিনি এমন কিছু করতে পারবেন যা ইয়াহিয়া খানের কাছে মারাত্মক হতে পারে।
বহু রাষ্ট্রই প্রকাশ্য ও গোপনে পাকিস্তানকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার আর্থিক চাপও কিছুটা লাঘব হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদন যেমন বন্ধ, উন্নয়নমূলক কাজও তেমনি বন্ধ। মোট কথা পাকিস্তান তার ভিতরকার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আপনা থেকেই কেটে বলে যে ধারণা আমরা করেছিলাম, তা সহসা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে না।
আমরা এখন পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের উপর নির্ভর করে বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব। সুতরাং আমাদের স্ট্রেটেজি নির্ধারণের ব্যাপারে একটা ভাবাবেগ সামনে রাখলে আমরা ভুল করবো। আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ নয়। নিজেদের কোন আত্মকলহ নয় বরং বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণই পশ্চিম পাকিস্তানী ইয়াহিয়া সরকারকে দিন দিন কাবু করে আনছে। আর এটা অত্যন্ত পরিষ্কার কথা, যে পথে চললে ফল পাওয়া যায় সে পথেই চলায় বুদ্ধিমানের কাজ।
দেশে ঘুরে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য হাতে পায়ে ঘরে বেড়ানোর চেয়ে অথবা নিজের দেউলেপনায় অসহায় হয়ে কবে আমাদের ডেকে নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীনতা বুঝিয়ে দেবে তার অপেক্ষায় বসে থাকার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ তিব্রতর করার দিকেই এখন সমস্ত যুক্তি কেন্দ্রীভূত করা উচিত। ভিক্ষুকের মনোবৃত্তি নিয়ে অপরের সাহায্যের আশায় বসে না থেকে যেদিন আমরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠবো, একমাত্র সেদিনই দেশ থেকে শত্রুদের চিরতরে বিতাড়িত করা যাবে।
বিশ্বের ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভিক্ষার মাধ্যমে কোন জাতির কোন ন্যায্য দাবী আদায় হয়নি। সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন সর্বাত্মক সংগ্রাম।
– সঞ্জীব চৌধুরী
.
.
কম্পাইলারঃ সৌ রভ
<৬,১৯১,৩৩২-৩৩৩>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ( অসুর নিধন উৎসব)
সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
অসুর নিধন উৎসব
বাংলার ঘরে ঘরে শারদীয় বাঁশি উঠেছে। এই আনন্দের আহ্বান বাঙালী মাত্রের মনই সাড়া না দিয়ে পারে না। এই উৎসবের সঙ্গে বাঙালী জাতির নাড়ীর টান অত্যন্ত নিবিড় এবং গভীর। একদিন সমাজ বিবর্তনের ধারা এই উৎসবের আঙ্গিক হয়ত পালটাবে। কিন্তু এর অন্তর্নিহত প্রীতির বাণী একভাবে না একভাবে বাঙালী চিত্ত সঞ্জীবিত করে রাখবে।
এবার বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বিস্তৃত অংশ দেশের বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছেন; ইয়াহিয়া সরকারের নেকড়ে বাহিনী তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে, প্রিয় মাতৃভূমি থেকে, জীবনের নাট্যমঞ্চ থেকে প্রচণ্ডতম পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করে দেশের বাইরে ছুড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সেই পুরাতন সাম্প্রদায়িকতা আবার বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে তার স্বাভাবিক পরিণতি স্বরূপ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এক খাট্টা হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তাদের বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ-অতীতের রক্তাত্ত স্মৃতি বড় করুন এবং বেদনাদায়ক। এক মাত্র উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নই তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই সংবাদ শুনার জন্য শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার শ্রবণ উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণতরঙ্গমুখর এই উত্তরণ মুহূর্তের দেবীর বোধন গীতি ভেসে উঠেছে। এইবার পূজা আর পুষ্পে নয়, বিল্প পত্রে নয়, দূর্বাদলে নয়। এবার রক্তে রক্তে মাংসে মাংসে মগজে মজ্জায় দেবীর আবাহন গীতি বেজে উঠেছে, এই সুর নতুন, এই প্রাণস্পন্দন অভিনব, এই আত্মত্যাগ অভূতপূর্ব। এবার শারদীয় উৎসব শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে নয়, বাঙালী জাতির অন্তর্গত প্রতিটি সম্প্রদায়ের কাছেই নতুন তাৎপর্যে ধরা দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে শোষণ পুঁজিবাদ- এর সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক ক্ষমাহীন সংগ্রাম, এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতি স্বাধীন হবে। বাংলাদেশে তারা সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িক কলুষমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ সৃজন করবেন। এই সময়ে এই মহান ঐতিহ্যময়ী উৎসব উপলক্ষে আমরা একটি কথা স্পষ্ট ভাবে জানাতে চাই- তা হলো শারদীয় উৎসব বাংলাদেশের সমাজের একাংশের ধর্মীয় উৎসব হলেও গোটা বাঙালী জাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, বিশেষ করে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিতে সাহিত্য সৃজনলোকে এই উৎসবের অবদান অনেক বেশি। আমরা বলতে চাই যারা ধর্মীয়ভাবে নিজেদের ভক্তিপিপাসা এই উৎসবের মাধ্যমে মেটাতে চান- তারা সেভাবেই এই উৎসবকে বরণ করে নিন। যাদের ধর্মীয় উৎসব নয়, তারাও এই উৎসবের ক’টি দিন জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং শিল্প চর্চারদিন হিসেবে গ্রহণ করুন। বাংলাদেশের যে মহান জাতি গঠনে দীপ্ত সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে,তাতে করে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে না। একটি প্রাণবন্ত জাতি গঠনের এই দ্রুত শক্তিশালী প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে এক সম্প্রদায়কে গ্রহণ করতে হবে। তা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। জাতির মাত্র কঠিন অগ্নিপরীক্ষার দিনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে প্রতিটি সংগ্রামী বাঙ্গালীর কাছে আমার এই আহ্বান আমাদের কাগজের মারফত, দেশের ভেতর প্রতিটি ঘরে, মুক্তি সংগ্রামীদের প্রতিটি ব্যারাকে এবং প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলে দিতে চাই- এবারের শারদীয় উৎসবের একটি মাত্র রঙ্গ তা হলো সমরঙ্গ। বাংলাদেশের যুবক, যুবতী, ছেলে, জোয়ান, বুড়ো এই সময় রঙ্গেই উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠুক। এটাই এবারের শারদীয় উৎসবের দাবী, বাঙালী মরবে, মরতে বাঁচার পথ পরিষ্কার করবে, সুতরাং সকল বাঙালী ভাই বোন, ছেলে মেয়ে, মা- বাবা যে যেখানে আছেন এই পরম লগ্নে প্রাণ খুলে গেয়ে উঠুন- জয় স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৯২,৩৩৪-৩৩৫>
শিরোনামঃ পাকিস্তানে নয় বাংলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরবেন
সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ সেপ্টেম্বর,১৯৭১
পাকিস্তানে নয় বাংলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরবেন
(ভাষ্যকার)
নির্বিচারে গণহত্যায় যাদের হাত রক্তাক্ত হয়েছে তারা যদি মিথ্যের বেসতি করেন- অপপ্রচারের আত্মতৃপ্তি নিয়ে তারা তৃপ্ত হতে পারেন, আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী তাতে মোটেও বিভ্রান্ত হইনা। ওরাও জানে এরা বিভ্রান্ত হবে না। হতে পারেনা- তবু ও অপপ্রচার চলছেই। এটাও নাকি নিয়ম খুনীর কন্ঠ থেকেই নির্গত হয় সুন্দর শব্দ আর নিরাপদ আশ্রয়ের প্রলোভন।
আজ আর বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হয়না এ কথাগুলো তার বর্বরতাকে নিন্দা করে উচ্চারিত হচ্চে- ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্যতম খুনী ইয়াহিয়ার রক্তপিপাসু মুখায়ব আজ প্রতিটি ঘৃণিত শবদের পেছন থেকেই উকি দিয়ে ওঠে। সেই সব রক্তপিপাসু পাক বাহিনীর হাতে নিয়ন্ত্রিত ঢাকা বেতার থেকে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন যে অপপ্রচার অনুষ্ঠানই চলবে- এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া রেডিও পাকিস্তান এ কথা তো বারবারই স্বীকার করেছেন যে অবস্থা স্বাভাবিক। দীর্ঘ ছয় মাস ধরেই স্বাভাবিক কথাটি বারবার শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, যেন পাকিস্তান গত ২৫শে মার্চের পর থেকেই কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে, এর আগেই যেন অস্বাভাবিক ছিল। যে অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে আমাদের আজন্ম সংগ্রাম।
মাঝে মধ্যে যদি কখনও পাকিস্তান বেতার অনুষ্ঠান শুনেন তাহলে লক্ষ করবেন রেডিও পাকিস্তান কিছুটা খেই যেন হারিয়ে ফেলেছে আজকাল। তাদের মতে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সতর্ক চোখকে ফাঁকি দিয়ে, নির্যাতিত শরণার্থীরা নদী, পাহাড়-পর্বতের দুর্গম পথ অতিক্রম করে পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছেন। প্রত্যেক দিনই হাজার হাজার নির্যাতিত শরণার্থী ইয়াহিয়ার আহবানে সাড়া দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন পাকিস্তানে।
বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে যে ভারতে শরণার্থী হয়েছেন- রেডিও পাকিস্তান সেটা স্বীকার করলেও আপাতত অনেক শরণার্থী ফিরে গেছেন বলে পাকিস্তান রেডিও দাবী করেছে।
যেহেতু রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব উথান্ট তার সাম্প্রতিক ভাষণেও বলেছেন যে, জেনারেল ইয়াহিয়ার আহবানে শরণার্থীরা কেউ ফিরে যায়নি। সুতরাং সাম্প্রতিকালে ফিরে যাবার সংখ্যা রেডিও পাকিস্তানের কল্যাণে ফুলে ফেঁপে দিনকে দিন বাড়ছেই। ফিরতে ফিরতে এতো বেশি যাচ্ছে যে ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত নব্বই লক্ষ সংখ্যাকেও অতিক্রম করে যাচ্ছে। প্রশ্ন আসে, এতো তো আসেনি, এতো ফিরছে কি করে?
দুদিন আগেও পাকিস্তান বেতার থেকে অস্বীকার করা হয়েছিল বাঙ্গালীদের দেশত্যাগের কথা- তারপর কিছুটা স্বীকার করে নিয়ে বলা হয়েছিল সামান্য কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী ভারতে পালিয়ে গেছে- কিন্তু একদিকে বিশ্বচাপ আর অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে একটা রাজনৈতিক সমাধানের আশা নিয়েই হয়তো পাকশাহী স্বীকার করে নিলেন শরণার্থী সমস্যা। এমনকি খুনী তার কন্ঠস্বর পাল্টিয়ে সাদর আহবানও জানালেন- কিন্তু দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তেই থাকলো। ফলে অপপ্রচার ছাড়া পাকশাহীর আর কিছুই থাকলো না। তারপর এলেন অসামরিক গভর্ণর ডাঃ মালিক। তিনি ব্যাপক দেশত্যাগের কথা স্বীকার করলেন- দেশত্যাগীদের দেশে ফিরে গেলে জমি ঘর ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু কেউ ফিরলো না।
.
সম্প্রতি পাক বেতার থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে অন্যরকম- শরণার্থীদের মধ্যে ভারত বিদ্বেষ ছড়ানো। তাদের মতে- শরণার্থীরা দলে দলে ফিরছেন ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে। সীমান্তে যারা ধরা পড়েছেন গুলি করে নাকি তাদের হত্যা করা হচ্ছে। অপপ্রচার শুনে শুনে এক একবার মনে হয় ওরা সত্যিই বলছে। মানুষ তার নিজের দেশে ফিরে যাবে নিজের ঘরে, নিজের ভিটেয় এই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু কিছুদিন পরের জন্যে যা সত্য এই মুহূর্তের জন্যে তাই আমাদের স্বপ্ন। ফলে সত্য যা তা হলো এ রকম যে দলে দলে শরণার্থীরা একদিন ফিরে যাবেই। তবে পাকিস্তানে নয়, বাংলাদেশে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। আর ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কেন, পৃথিবীর কোন বাহিনীর চোখকেই ফাঁকি দিয়ে নয়। ওরা বলেছেন, শরণার্থীরা দুর্গম পথ অতিক্রম করে তাদের জন্মভূমিতে ফিরে আসছে। ইয়াহিয়া সাহেব আপনি বলুনতো পৃথিবীর কোন দেশের স্বাধীনতার পথ এতো সুগম হয়েছিল? স্বাধীনতার পথই দুর্গম। এই পথই অতিক্রম করেই আমাদের ফিরতে হবে স্বাধীন বাংলার সোপানে।
জেনারেল সাহেব, আজ বাঙ্গালীদের কাছে সবচাইতে নির্মম ও ভয়াবহ যে শব্দ সেই শরণার্থী শব্দটির আপনিই তো নির্মাতা। ভারত শুধু বন্ধুর মতো এই একান্ত অনাথ শব্দটিকে আশ্রয় দিয়েছেন- ধর্ষিত, লুন্ঠিত, নিপীড়িত নব্বই লক্ষ মানুষের আপনার বর্বর সেনাবাহিনীর লোককে ফাঁকি দিয়ে ভারতে এসেও রক্ষা পায়নি, সীমান্তের ওপার থেকেও আপনার বাহিনীই শরণার্থী শিবিরগুলোকে লক্ষ করে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। উদ্দেশ্য ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বিশ্বের চোখ পাক-ভারতের যুদ্ধের দিকে ফিরিয়ে মুক্তি সংগ্রামকে বিভ্রান্ত করা।
এই তো সেদিনও মেঘালয় সীমান্তবর্তী এক ক্যাম্প থেকে আমার নিজের ভাই চিঠি লিখে আপনার সেনাবাহিনীর কি নিষ্ঠুর হামলার বিবরণ পাঠিয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে শরণার্থী শিবির লক্ষ করে ছোড়া মেশিনগানের গুলীতে নিহত হয়েছে আট জন। এদের মধ্যে দুধের শিশু, উদ্দাম যুবক- আপনার বর্বরতার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল যারা আপনার বর্বরতা সেই অসীম সীমান্তকেও অতিক্রম করে তাদের হত্যা করতে উদ্যত। এই দোষ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাঁধে চাপিয়ে আমাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া যাবেনা। আজ আমরা যুদ্ধের বদ্যভূমিতে একটা সত্যের চূড়ান্ত মীমাংসায় লিপ্ত-আপনি তো নিশ্চয় জানেন অপপ্রচারে কিছুদিন মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়- এক একজনের খুনের অপরাধ সাময়িকভাবে চাপানো চলে অন্যের কাঁধেও কিন্তু চূড়ান্ত জয়ের জন্য চাই সত্য, সে সত্য আপনার নেই। আপনি বলুন সৈনিকের গুলীগুলো নিরপেক্ষ না হয়ে যদি কোন কথা বলতে পারতো? ২৫শে মার্চের পর থেকে আজ অব্দি নিহত দশ লক্ষাধিক মানুষের অমর আত্মার মধ্যে যদি খুনীর নাম লেখা থাকতো তাহলে আপনিই জেনারেল ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক, আপনি কোথায় মুখ লুকোতেন?
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৯৩,৩৩৬>
শিরোনামঃ মুক্তিবাহিনীর সমস্যা ও অভাব অভিযোগ
সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
মুক্তিবাহিনীর সমস্যা ও অভাব অভিযোগ
||নিজস্ব সংবাদদাতা||
দাবানলের আত্মপ্রকাশের প্রথম সংখ্যা থেকেই আমরা বাংলাদেশের মুক্তি সেনাদের সমস্যা ও অভাব অভিযোগের চিত্র তুলে ধরছি। এটা সরকারী প্রচেষ্টাকে সমালোচনা কিম্বা নিন্দা করার জন্য নয়, বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করার জন্যও নয় কেননা আমরা জানি বাংলাদেশ সরকার সব সময়ই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নজর ও সশ্রদ্ধ দৃষ্টি রাখছেন। তবুও দেশের মুক্তির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা স্থির করেছি এই কলমে মুক্তিসেনাদের অভাব অভিযোগের চিত্র তুলে ধরব। আমাদের মুক্তিসেনাদের অভাব অভিযোগ ও আত্মত্যাগের প্রতি দেশ বিদেশে মানুষ সহানুভূতিশীল হবেন- বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসবেন এই আশায়।
.
খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর অনেক সৈনিক যাঁরা জীবনের বিনিময় শত্রু হননে অপারেশনে গিয়ে বুলেট বিদ্ধ হয়েছে তারা ভাল চিকিৎসা দূরে থাক ন্যূনতম আধুনিক ঔষধপত্রও পাচ্ছেন না। আহত সৈনিকরা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাবে ভুগছেন। বাংলাদেশে মুক্ত এলাকায় এই হাসপাতালের আহত সৈনিকদের কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেছেন যে তারা পকেট খরচের মতো সামান্য অর্থও পাচ্ছেন না। সৈনিকদের জন্য বরাদ্দ মাসিক ভাতা অপর্যাপ্তই শুধু নয় অনেক সময় বিলম্বিত হচ্ছে।
.
শোনা যাচ্ছে, প্রাক্তন সৈনিক যারা যুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন তারা তাদের জরুরী ভাতা পাচ্ছেন না। অনেক ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও একই অভিযোগ করেছেন।
.
আমাদের বক্তব্য যাঁরা বাংলাদেশকে শত্রু কবল থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছেন মনে রাখতে হবে তাঁরাই আমাদের ভরসার স্থল। এদের সুখ সুবিধার জন্য প্রয়োজনবোধে আমাদের সুখ বিসর্জন দিতেই হবে। অনতিবিলম্বে এই অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করতে বাংলাদেশ সরকার এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা জানি আমাদের অর্থের অভাব সবচেয়ে প্রকট কিন্তু এই প্রয়োজনীয় অর্থ দাবী করছেন না। তাই অর্থাভাব মোচনের জন্য প্রয়োজন হলে অন্য কোন অপ্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে পরিষদ সদস্য ও সরকারী কর্মচারীদের ভাতা ও বেতন কমিয়ে হলেও আমাদের প্রিয় মুক্তিসেনাদের আর্থিক সেবায় এই অর্থ বিনিয়োগ করতেই হবে। এই সমস্যা সমাধানে সরকার যত দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন ততই মঙ্গল। মুক্ত এলাকায় বিভিন্ন শিবিরে এখন শীত নেমে এসেছে। এখন থেকেই শীত উপযোগী পোশাক-পরিচ্ছদের বন্দোবস্ত না করলে পরে অসুবিধা দেখা দিতে পারে।
.
মুক্তিসেনাদের এই সব অভাব অভিযোগ ও অসুবিধার প্রতি সামরিক কর্তৃপক্ষ ও সরকার সময়োচিত দৃষ্টি দিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর মনোবল অটুট রাখতে অবিলম্বে এগিয়ে আসবেন- এটাই আমাদের কাম্য।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৯৪,৩৩৭-৩৩৮>
সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
(১)
আরো জোরে আঘাত হানো
ইয়াহিয়া খানের সাধের আশা পূরণ হয়নি। বাহাত্তুর ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবীকে চূর্ণ করতে পারেনি তাঁর লেলিয়ে দেয়া সামরিক বাহিনী। যদিও বাংলাদেশে তারা নির্মমতা এবং নিষ্ঠুরতা, হত্যা, লুন্ঠন এবং ধর্ষণের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তবু বাংলাদেশের জনগণকে এক ইঞ্চি নোয়াতে পারেনি। চূড়ান্ত সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলার জনগণ ন্যায়ের নামে, শোষিত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের নামে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বয়স দশ মাস পুরো হতে চলছে। এর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে সাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানের পরাজয় স্বীকার করে নেয়া ছাড়া গন্তব্য নেই। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ নানা রণাঙ্গনে দূর্বার হয়ে উঠেছে। আমাদের সুশিক্ষিত দেশপ্রেমিক গেরিলাদের উপর্যুপরি আক্রমণের মুখে দেশের অভ্যন্তর প্রায় কাবু হয়ে এসেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। যে ক্যান্টনমেন্টগুলোর উপর ভরসা করে ইয়াহিয়া খান গোঁফে তা দিতে দিতে ভেবেছিলেন, শক্তিবলে বাংলাদেশকে পদানত করে রাখতে পারবেন সে ভরসার কেন্দ্রবিন্দুগুলো জঙ্গীলাটের চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়ছে। এ পর্যন্ত আমরা খবর পেয়েছি যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন আসন্ন। মুক্তি সেনানীরা বীর বিক্রমে ধাওয়া করছে সিলেট অভিমুখে। চট্টগ্রাম অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে, ঢাকা মহানগরী গোটা প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কুমিল্লাতে জোড় লড়াই চলছে, খুলনা জেলা প্রায় মুক্ত হয়ে এসেছে। অনেকগুলো বিমানবন্দর মুক্তিযোদ্ধারা কামান দাগে তছনছ করে দিয়েছে। তার ফলে স্যবরজেট থেকে মার্চ এপ্রিল মাসের মতো গুলী, বোমাবর্ষণ করারও সুবিধা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলোতে এখন আর বিদেশী জাহাজ ভিড়তে সাহস করছে না। মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামে ও বন্দরে অনেকগুলো বিদেশী জাহাজ জখম করেছেন অথবা একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছে। বিদেশ থেকে নয় শুধু, পশ্চিম-পাকিস্তান থেকেও জলপথে সমর সম্ভার আমদানীর পথ একেবারে বন্ধ হয়ে পড়েছে। বস্তুতঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বন্দী। আমাদের সাহসী সেনানীরা তাদেরকে চারদিক থেকে তাড়া করে একবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে। আজ তারা আহত বন্য পশুর মতো-তারা জানে তাদের পালাবার কোনো পথ খোলা নেই। প্রদীপ যেমন নিভবার আগে দপ করে জ্বলে উঠে, শত্রুও তেমনি চূড়ান্ত পরাজয়ের পূর্বে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখছে। কিন্তু তারা ভালভাবে জানে যে, তাঁদের বাঁচবার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে আমাদের আক্রমণ আরো জোরদার করে তুলতে হবে, শত্রুর মনোবল একেবারে ভেঙ্গে দিতে হবে। কোন রকমের সাহায্যে তারা বলীয়ান হয়ে উঠার রাস্তা একেবারে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে ফেলতে হবে। সামান্য অবহেলায় শত্রু শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। জোড়ায় জোড়ায় আঘাত করে ইয়াহিয়ার যুদ্ধাস্ত্রটাকে একেবারে অকেজো করে ফেলতে হবে। কোন দয়া, কোন অনুকম্পা নয়। দশ লক্ষের মতো বাঙ্গালী জনগণকে তারা যে নৃশংসতায় হত্যা করেছে, একই নৃশংসতা আজ তাদের ফেরত দিতে হবে। ইয়াহিয়া খানের হুকুম বরদার সৈন্যদের এই ভাগ্যলিপি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে- অত্যাসন্ন হয়ে আসছে সে দিন। সুতরাং শত্রুর উপর আঘাত, আঘাত তীব্র আঘাত হানো।
.
(২)
ঈদ দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিভা নিয়ে এসেছে
বাংলাদেশে এবারের ঈদ এসেছে সম্পূর্ণ এক নতুন রুপে। এক মর্মান্তিক পরিবেশ। আমাদের জীবন থেকে এবার ঈদের সকল আনন্দ ধুয়ে মুছে গেছে, আছে শুধু সন্তানহারা জননীর আকুল ক্রন্দন, সদ্য বিধবার দীর্ঘশ্বাস, ধর্ষিতা মা বোনদের তীব্র আর্তনাদ, আর স্বজন হারানোর শোক। অন্যদিকে মাতৃভূমির শৃংখল মোচনের জন্য আছে দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প। লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে বিদেশে ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের ভিতরেও সাধারণ মানুষ সর্বক্ষণ আতংকের অস্থিরতায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। আনন্দ করার প্রিয়জনরা আজ পরস্পর থেকে দূরে। আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, এবারের ঈদ বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে না পারলেও আমরা বিশ্বাস করি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল সমাপ্তি বাঙ্গালী জীবনে বয়ে আনবে পরিপূর্ণ মুক্তির আনন্দ। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন আগামী ঈদের পূর্বে সমস্ত বাংলাদেশকে মুক্ত করে ঈদের আনন্দ উৎসব উপভোগ করতে পারবো।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৯৫,৩৩৯-৩৪০>
শিরোনামঃ গণচীন ও বাংলাদেশের সংগ্রাম
সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ নভেম্বর,১৯৭১
.
গণচীন ও বাংলাদেশের সংগ্রাম
(দাবানল পর্যবেক্ষক)
রাষ্ট্রসংঘে চীনের অন্তর্ভুক্তির ফলে বিশ্বের প্রতিক্রিয়া স্বভাবতই উৎসাহব্যঞ্জক। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ চীনের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের সঠিক ভূমিকা পালনের জন্যে আশা প্রকাশ করেছেন। এদ্বারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শেরই বিজয় সূচিত হয়েছে। উপস্থাপিত হয়েছে মহাচীনকে। আহবান জানিয়েছেন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য। আমরাও বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে গণচীনকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
.
পঁচিশে মার্চ তারিখ থেকে পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদী চক্র বাংলাদেশের জনগণের উপর বর্বর আক্রমণ চালান। প্রতিরোধ করার পর থেকে ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করবে এবং তার জন্যে বাংলাদেশে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়েছে এই বলে জঙ্গীচক্র চীৎকার করতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণচীন পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। সরাসরিভাবে গণচীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা না করলেও, বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও অসংহতি রক্ষাকল্পে আমরা পাকিস্তানের পাশে থাকবো-চীনের এই বক্তব্য বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত পাকিস্তান বিবাদ প্রতীয়মান করতে পাকিস্তানী উদ্যেগকে সহায়তা করেছে।
.
বাংলাদেশে সামরিক জান্তার উৎপীড়ন ও ব্যাপক গণহত্যায় যখন ডানপন্থী ও বামপন্থী উভয়েই বিপন্ন,এই ব্যাপক অত্যাচার, হত্যা, লুন্ঠন যখন বিশ্ববিবেককে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল দেশে দেশে ধিক্কার উঠেছিল জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে তখন একটি বিশেষ মতাদর্শে পীঠস্থান এবং এশিয়ার সর্ববৃহৎ শক্তি গণচীনের মৌনতা তারই অনুসৃত আদর্শের ব্যতিক্রম। গণচীণ, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইনের মুক্তিযুদ্ধের সর্বান্তকরণে সমর্থন করে যাচ্ছে এবং যুদ্ধাস্ত্র থেকে শুরু করে সবরকম প্রয়োজনীয় সাহায্য করে যাচ্ছে। অথচ সেই জনগণতান্ত্রিক চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি সমর্থন করছে না।
.
পৃথিবীর অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশেও এর প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত। এমনকি চীন অনুসৃত আদর্শে অনুপ্রাণিত বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক শিবিরে চীনের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে মতভেদ দেখা দেয় এবং ক্রমশঃ প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। গণচীনও এই প্রতিক্রিয়ার সাথে সম্পূর্ণ অবহিত। সেই কারণেই বোধ করি গণচীনও বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঠিক তাৎপর্যকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছে।
.
এরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রতিভাত হয় গত ৭ই নভেম্বর ভুট্টোর নেতৃত্বে পাক-সামরিক সর্দারদের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় ভারপ্রাপ্ত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক বাংলাদেশে ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য পাকিস্তানকে উদ্যেগী হতে আহবানের মধ্য দিয়ে। এই আহবানে বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনা নীতির নবমূল্যায়নের স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। সঙ্গে সঙ্গে চীনা মন্ত্রী এ অভিযোগও রেখেছেন, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।
.
বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো গণচীনের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থেকে কোনো সার্থক সিদ্ধান্তে পৌঁছান সম্ভব নয়। এটি শুধুমাত্র উভয় কূলকে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা বলে মনে হয়।
.
সুদীর্ঘ সাত মাস অতিক্রম হবার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে এবং বীর যোদ্ধারা সাফল্যের পর সাফল্য অর্জন করে চলেছে তখন বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের স্বপক্ষে জনমত ক্রমশঃ জোরদার হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ও মুক্তিকামী জনগণ। মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন নিজ নিজ সরকারের ওপর। তখন গণচীনসহ বিভিন্ন বৃহৎ শক্তির কাছে আমাদের আহবান আপনারা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঠিক তাৎপর্যকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করুন, নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্রকে অর্থ ও অস্ত্রদান বন্ধ করুন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী বিজয়কে ত্বরান্বিত করার জন্য সর্বতোভাবে সাহায্য করুন।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,১৯৬,৩৪১>
শিরোনামঃ মুক্তিবাহিনীর সমস্যা ও অভাব অভিযোগ
সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ নভেম্বর,১৯৭১
.
মুক্তিবাহিনীর সমস্যা ও অভাব অভিযোগ
আমাদের মুক্তিবাহিনী ভাইদের তাদের আশ্রয়ের জন্য কতকগুলো বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে আমরা অনেক জায়গা থেকে জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ আজ নানাবিধ অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। ওদের বাড়ীঘর, সহায় সম্বল যা ছিল সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার পশুরা পুড়িয়ে দিয়েছে ও লুট করে নিয়েছে। তাই মুক্তিবাহিনীর প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন মুক্তিবাহিনী ভাইদের আশ্রয় দিয়ে রাখার মত অর্থনৈতিক অবস্থা এখন আর তাদের নেই। সেজন্য মুক্তিবাহিনী ভাইদের এখন এমনভাবে আশ্রয় নিতে হবে যার ফলে বাংলার দরিদ্র মানুষের উপর যেন অর্থনৈতিক চাপ না পড়ে। আমরা এও জানতে পেরেছি, কতকগুলো জায়গায় ভুল করে আশ্রয় নেওয়ার জন্য অনেক ছেলেদের জীবনের উপর ঝুঁকি এসে পড়েছে। সেজন্য আশ্রয়ের ব্যাপারে নিম্নলিখিত দৃষ্টিভঙ্গি নিলে কিছুটা সুবিধা করা যেত বলে মনে হয়।
(১) এমন এলাকায় আশ্রয় নিতে হবে যেসব এলাকা কিছুটা দুর্গম
(২) আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামী দলের যেসব এলাকায় প্রতিপত্তি রয়েছে এবং যেসব এলাকায় দালাল, রাজাকারদের সংখ্যা কম।
(৩) নদীপথ ও বন-জঙ্গল সবচেয়ে ভাল স্থান। এর ফলে গরীব মানুষদের বাড়ী-ঘরে আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন থাকবে না।
(৪) যেসব বাড়ীতে লোক সমাগম কম।
(৫) আশ্রয়দাতার আত্মীয়স্বজন স্বাধীনতার সমর্থক কি না সেটাও জেনে নিতে হবে।
এবার তথাকথিত রোমান্টিক বিপ্লবীদের সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে। কারণ এই তথাকথিত বিপ্লবীরা স্বাধীনতার সংগ্রামে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টায় মেতেছে। আমরা পাবনা, যশোর, খুলনা প্রভৃতি জেলা হতে এরুপ সংবাদ পেয়েছি। চীনের সমর্থক বলে স্বঘোষিত তথাকথিত বামপন্থীরা উক্ত সমস্ত জেলায় ধীরে ধীরে পাক সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কার্যে প্রবল বাধার সৃষ্টি করেছে। তারা মুক্তিবাহিনী সদস্যদের গোপন ঘাঁটি, আশ্রয়স্থলের সংবাদ সামরিক বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়া তারা মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়দাতা ও সমর্থকদের নিরীহ আত্মীয়স্বজনের খোঁজ করে তাদের নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করছে। এর ফলে মুক্তিবাহিনী ভাইদের প্রবল অসুবিধা হচ্ছে। সেজন্য সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবো তারা যেন অবিলম্বে খোঁজখবর নিয়ে সেখানে উক্ত তথাকথিত সুযোগসন্ধানী বিপ্লবীদের উৎখাত করার জন্য বিশেষ বাহিনী প্রেরণ করেন।
.
উপরে বর্ণিত তথাকথিত বিপ্লবীরা নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা নাকি মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের নিজের হাতে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে নেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছেন, আমরা তাদের শক্তি সম্বন্ধে অবশ্য সচেতন। আমরা জানি মুক্তিবাহিনীর পিছনে রয়েছে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি। সেজন্য সামান্য শক্তি নিয়ে তারা কিছু করতে পারবেনা সেটাও জানি। তবুও আমাদের তাদের প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখতে হবে। গত মার্চ-এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের অনেক জেল খুলে দেওয়ার ফলে অনেক চোর, ডাকাত, মুক্ত হয়ে এসেছে তারা এখন মূলতঃ সামরিক বাহিনীর সাথেই সহযোগিতা করছে। তাদেরকে দমন করার জন্যও বাংলাদেশ সামরিক কর্তৃপক্ষের এখন থেকেই দৃষ্টি দিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এরা প্রবল অসুবিধার সৃষ্টি করবে।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১৯৭,৩৪২-৩৪৩>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ইয়াহিয়া-ভুট্টো ক্ষমতা দ্বন্ধ
সংবাদপত্রঃ প্রতিনিধি ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
[প্রতিনিধিঃ সাপ্তাহিক স্বাধিন্তাকামী বাংলার মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র। শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের কোন জায়গা হতে সম্পাদক, আহমেদ ফরিদ উদ্দীন কর্তৃক রক্তলেখা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।]
সম্পাদকীয়ঃ
নাটকের প্রথম অংকঃ
ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস
সম্প্রতি মুলতানে দলীয় কর্মীদের এক সমাবেশে পিপলস পার্টির প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর (ভুট্টোর) দলে ভাঙ্গন সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ করেন । অভিযোগ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, এ ব্যাপারে সরকারী তহবিল থেকে প্রচুর অর্থও ব্যয় করা হচ্ছে এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিকে উস্কানি দেয়া হচ্ছে ।
খবরটি ক্ষুদ্র এবং সংক্ষিপ্ত । কিন্তু ক্ষুদ্র এবং সংক্ষিপ্ত হলেও খবরটির একটি বিশেষ রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে । পর্বতের ধুয়ো দেখে যদি আগুনের অস্তিত্ব অনুমান করা যায় তাহলে এই ক্ষুদ্র সংবাদ থেকেও পাকিস্তানী রাজনীতিতে একটা ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাবে । ইয়াহিয়া- ভুট্টোর ক্ষমতা দ্বন্দের একটা চিত্র প্রস্ফুটিত হবে । ক্ষমতার এই দ্বন্ধ আমাদের কাছে কিছুমাত্র অপ্রত্যাশিত কিংবা অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না । এমনটি হবারই কথা । না হলেই বরং অস্বাভাবিক মনে হতো । পাকিস্তানী রাজনীতি সম্বন্ধে সাধারণ একটু ধারণা থাকলেই ব্যাপারখানা সবিস্তার বোঝা যাবে ।
ইয়াহিয়া ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান । দেশ রক্ষাই ছিল তার একমাত্র দায়িত্ব । কিন্তু পূর্বসুরীদের মতোই শুধু দেশ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না । পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবার একটা রঙ্গিন স্বপ্নও দেখতেন নাদির শাহের উত্তর পুরুষ ইয়াহিয়া । স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার সুযোগও এসে গেল । আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দেখা দিল আন্দোলন। ওরা পাঞ্জাবী শাসন থেকে অব্যাহতি পেতে চায় । ওরা স্বায়াত্তশাসন চায় । তীব্র গণজোয়ারে আইয়ুব ভেসে গেলেন । প্রেসিডেন্ট হলেন ইয়াহিয়া । হাতে পেলেন দেশের সর্বময় ক্ষমতা । কিন্তু ইয়াহিয়া এটাও জানতেন, বাংলার মানুষ আর ঘুমিয়ে নেই । তারা আগের চেয়ে অনেক সচেতন । ওরা দুর্বার । কিন্তু ক্ষমতায় যে তাঁকে থাকতেই হবে । যেভাবেই হোক । তাই তিনি ভোল পাল্টে ধরলেন নতুন সুর । ধরলেন নতুন গান । বললেন, তিনি রাজনীতি বোঝেন না। বোঝবেনও না । ওটা রাজনীতিকদের কাজ । তাই দিলেন নির্বাচন । আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই তুলে দেবেন দেশের শাসনভার । পাঞ্জাবী শাসকচক্রের ধারণা ছিলো, যতো পপুলারই হোক না কেন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না । ক্ষমতা পাবে না শেখ মুজিব । বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবীও অনুচ্চারিত থেকে যাবে । কিন্তু তাদের সব ধারণা, সমস্ত বিশ্বাস সমস্ত সম্ভাবনাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো । অসম্ভব সম্ভব হলো । পক্ষান্তরে ভুট্টোর পিপলস পার্টি রইলো দ্বিতীয় স্থানে । ইয়াহিয়া-ভুট্টো-পাঞ্জাবী চক্র প্রমাদ শুনলেন ঠিক হলো, কিছুতেই মুজিবকে ক্ষমতা দেয়া চলবে না । বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে না । যেমন করেই হোক, যেভাবেই হোক ভুট্টোকেই দেয়া হবে দেশের শাসন ভার । কর্মসূচী হোক ভুট্টোকেই দেয়া হবে দেশের শাসন ভার । কর্মসূচী অনুসারে সবই হলো । জাতীয়- পরিষেদের অধিবেশন বাতিল হলো । সৈন্যবাহিনী রাস্তায় নামলো । আলোচনা চললো । অবশেষে ২৫শে মার্চ থেকে ব্যাপক গণহত্যা চললো । শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হলো । আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হলো । সবই পরিকল্পনা অনুযায়ী হলো । সবই কথা মতো, সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবী নিয়ে ভুট্টো ক্ষমতা চাইলেন । ইয়াহিয়াও ক্ষমতা ছাড়বেন বলে এতো কিছু করেননি । তিনি দেশের জরুরী সংকটময় পরিস্থিতির কথা তুলে ভুট্টোকে নিরস্ত করতে চাইলেন । ভুট্টো তা মানবে কেন ? তারও ক্ষমতা পাবার অধিকার রয়েছে। তাই শুরু হলো ক্ষমতার দ্বন্ধ । টাগ অব ওয়ার । এটা নাটকের প্রথম অংক । আমরা উৎসাহী দর্শকরা নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১৯৮,৩৪৪>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় এবং একটি প্রবন্ধ
সংবাদপত্রঃ মুক্তি* ১ম সংখ্যা
তারিখঃ ১ কার্তিক, ১৩৭৮ (অক্টোবর, ১৯৭১)
[মুক্তিঃ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মাসিক সাহিত্যপত্র। সম্পাদকঃ শারফুদ্দীন আহমেদ। প্রদীপ্ত সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। পত্রিকাটি শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ হতে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত।]
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশে আজ যুদ্ধ । যুদ্ধের পটভূমিতে সাহিত্য রচনা আজ বাংলার লেখক-লেখিকাদের অবশ্যকর্তব্য । অধিকৃত বাংলার প্রগতিবাদী সাহিত্যিকরা যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র ধরেছে । অস্ত্রের ভাষায় কলম ধরেছে । তারই কলম এই “মুক্তি” পত্রিকা ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে গণসাহিত্য
বাংলাদেশের পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যের মুক্তি অবশ্যম্ভাবী । দেশে এখন যুদ্ধ চলছে । এটা মানুষের মুক্তির যুদ্ধ । অনেক বছরের শোষণের প্রতিবাদে শান দেওয়া হাতিয়ার চকচকে । জনতার সাগরে জাগবে বাংলার এক প্রান্ত-পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অন্য প্রান্ত পঁচাগড়া পর্যন্ত জনবসতি মুখরিত । তাই সাহিত্যের অঙ্গনে একটা সুস্পষ্ট পরিবর্তন যুদ্ধের অস্ত্রের মত প্রয়োজনীয় । কেননা সংস্কৃতি হচ্ছে বিপ্লবের হাতিয়ার । তবে সেই সংস্কৃতি নয় যা গণমানুষের প্রগতি বিমুখী ।
সাহিত্য সংস্কৃতির একটি অংশ । তাই বর্তমান অবস্থাতে সাহিত্য মূল্যবোধ অনস্বীকার্য । আর সেই সাহিত্য হতে হবে গণসাহিত্য । জনতার প্রয়োজনে অগ্রগতির জন্য যে সাহিত্য তাই গণসাহিত্য ।
বাংলাদেশের মানুষ এখন মুক্তি চায় । সমস্ত পরাধীনতার আবদ্ধ থেকে সে মুক্তির দাবী । বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে তারই একটি বলিষ্ঠ আভাষ যাকে স্পষ্টতর করার জন্য সাহিত্যের দরকার । এ দেশের যুবকের শিক্ষা অঙ্গন ছেড়ে দিয়ে মাঠে নেমেছে । এ মাঠ যুদ্ধের মাঠ যাকে অতিক্রম করতে অসীম ধৈর্য্য আর সুস্থ মানসিকতার প্রয়োজন । সুস্থ্য মানসিকতা শিক্ষা আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে । সে শিক্ষা গণসাহিত্যের শিক্ষা । গণসাহিত্য জনতার বিপ্লবের পথকে বাতলে দেয় । বাস্তবতাকে আশ্রয় করে গণসাহিত্য গড়ে ওঠে । এটা প্রয়োগধর্মী বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাসী। গণসাহিত্যের ধারা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের ওপর নির্ভরশীল । আমরা জানি আমাদের সমাজে জড়বাদ মজবুত করে শিকড় গেড়ে আছে । মানুষের রক্ষণশীল চিন্তা সমাজের প্রগতির পথ ব্যাহত করেছে । ধর্মের সুন্নাহ- রক্ষণশীলবাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে যাকে ভেঙ্গে ফেলতেই হবে । আর এ দায়িত্বের একটা অংশ গণসাহিত্যের ।
আজকের তরুণদের মন ও মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না । আর এই পরিবর্তনের দায়িত্বটা নেবে গণসাহিত্যিক ।
সূর্য্যের আলোর মত গণসাহিত্য গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি তরুণ মনে ছড়িয়ে পড়ুক । মোহমুক্তি হোক তাদের মন ও মানসিকতার । দেখি কে আমাদের মুক্তিকে অবদমিত করে ?
.
.
কম্পাইলারঃ দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১৯৯,৩৪৫-৩৪৭>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় সংগ্রামী বাংলার ডাক
সংবাদপত্রঃ সংগ্রামী বাংলা* বিপ্লবী আলী আসাদ সংখ্যা
তারিখঃ ১৮ অক্টোবর, ১৯৭১
[সংগ্রামী বাংলাঃ বাংলাদেশের মুখপত্র। প্রধান পৃষ্ঠপষকঃ মওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানী। প্রধান সম্পাদকঃ আবদুর রহমান সিদ্দীক। সংগ্রাম বাংলা প্রেস, ঢাকা হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।]
সংগ্রামী বাংলার ডাক
সংগ্রামী বাংলা ডাক দিচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ডাক, জনযুদ্ধের ডাক । পশ্চীম পাকিস্তানী শাসক, শোষক, অত্যাচারী, জালেম, জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে মরণপণ মহাসংগ্রামের ডাক ।
এ সংগ্রাম রক্তলোলুপ দানব বাহিনীর বিরুদ্ধে-পরস্পদ হরণকারী নরপিশাচদের বিরুদ্ধে, নারী ইজ্জতহন্তা জল্লাদের বিরুদ্ধে, দেশী-বিদেশী শোষকদের বিরুদ্ধে, জঙ্গী শাসকদের দেশী দালাল ও বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে এ এক দুর্বার অভিযান । এ অভিযান চলছে, চলবে । যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় ।
বাংলা আমাদের দেশ, আমাদের জন্মভূমি, মাতৃভূমি । আমাদের শৈশবের লীলাভূমি, আবাল্যের ক্রীড়াভূমি, সারাজীবনের কর্মস্থল, আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, বর্ণনীতির প্রাণকেন্দ্র । বাংলার মাটি আমাদের কাছে তীর্থক্ষেত্রের মত পবিত্র, পুণ্যভূমি । বাংলার শোষিত, লাঞ্চিত, নির্যাতীত, বঞ্চিত, উৎপীড়িত, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান আমাদের সংগ্রামের আশা-ভরসা । বাংলার প্রকৃতি, বাংলার আকাশ-বাতাস, জল-স্থল, নদী-প্রান্তর, বাংলার শহর-বন্দর-গ্রাম, আমাদের কাছে স্নেহময়ী স্বপ্নরাজ্যের মত, আমাদের প্রেরণার উৎস । আমাদের সেই প্রিয় জন্মভূমি আমরা প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসি বাঙালী জাতিকে । এ দেশে আমাদের পিতা, পিতামহ, পূর্বপুরুষেরা জন্মগ্রহণ করেছেন, আবার দেশের মাটিতেই তাদের শেষ শয্যা রচিত হয়েছে । পূর্ব পুরুষদের রক্তে গড়া এই বাংলা, তাদের ত্যাগের দুঃখ-কষ্টের, ব্যথা বেদনা, সুখ-দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত, আমাদের এই সাধের বাংলাদেশ । বাঙালী আমাদের আশা-ভরসার প্রতীক । বাংলা আমাদের কাছে স্বপ্নের দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ, সৌন্দর্যের লীলাময় সুন্দর দেশ । বাংলার ভাষা আমাদের সংগ্রামের প্রেরণা, বাংলার মুক্তিই আজকে আমাদের আদর্শ, আমাদের সাধনা । বাংলার সূর্য উঠে সংগ্রামের বাণী নিয়ে, বাংলার চলে যায় নতুন দিনের আগমনী গান গেয়ে ।
সকল দেশের চাইতে সেরা আমাদের এই বসুন্ধরা । এই বাংলায় এসেছে মোগল পাঠানেরা ভাগ্য বিধাতা হয়ে । এসেছে পর্তুগীজেরা ডাকাত আর দাস ব্যবসায়ীরূপে-ইংরেজ ফরাসীরা বণিকের বেশ, এসেছে এই বাংলাদেশ । অবশেষে এসেছে বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক, শোষক, ধনিক, পুঁজিপতি, শিল্পপতি আর তাদের লোকলস্কর- সৈন্য সামন্ত, সরকারী কর্মচজারী, পাকিস্তানের নামে ইসলামের নামে । লুণ্ঠনে, লুণ্ঠনে, শাসনে-শোষণে, কূশাসনে নিষ্পেষণে, অত্যাচারে – অবিচারে জর্জরিত হয়েছে পাকিস্তানোত্তর বাংলাদেশ । পাঠান রাজত্বে যা হয় নাই, মোগলরা যা করে নাই, যা করতে বিদেশী বিজাতী ইংরেজদের হৃদয় কেঁপেছে, শেষ পর্যন্ত তার চাইতেও জঘন্যতম অপকর্ম সাধন করেছে আজকের পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খাঁর জঙ্গীবাহিনী । তাদের রোষানল থেকে নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধা, রুগ্ন, গৃহপালিত জীব, ঘর বাড়ী, দোকান পাট, মন্দির মসজিদ গীর্জা কিছুই রক্ষা পায় নাই । মৃত্যু আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলার মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ । জঙ্গী বাহিনী মানবতাকে হত্যা করে, ন্যায়নীতিকে বলি দিয়ে, ধর্মের আদর্শকে পদদলিত করে, মুক্তিকামী জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়েছে । যার নজীর মধ্যযুগেও বিরল । নাদির শাহ তৈমুর বা চেঙ্গিশের নৃশংসতাকেও লজ্জা দিয়েছে পাকবাহিনীর বর্বরতা । এত চোখের জল ঝরেছে যার নজীর বিংশ শতাব্দীতে খুব বিরল ।
বাঙালীর অপরাধ তারা স্বাধীনতা চায়, সর্বপ্রকার বিদেশী শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে চায় । বাঙালী জাতি সেই মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ- এ সংগ্রাম বাঙালীর বাঁচার সংগ্রাম; এই পৃথিবীতে তারা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে বাঁচতে চায় । বাংলার ভাষা, বাংলার কৃষ্টি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সবই আলাদা, স্বতন্ত্র । এই বাঙালী তাদের নিজস্ব দেশ, আবাসভূমি এই পৃথিবীর মানচিত্রে এঁকে দিতে চায় । কোন বিদেশী বহিরাগত জালেমদের শাসন বাঙালী মানতে চায় না, মানতে পারে না কোনদিন ।
বাংলার ক্ষেতখামার, নদনদী, জলবায়ু, বন-জঙ্গল, শহরগ্রাম, ঘরবাড়ী, অট্টালিকা, কলকারখানার সমুদয় সম্পত্তির মালিক বাংলার জনসাধারণ । তাতে সকলের সমান অধিকার । বাঙালী আমাদের ভাই, আমাদের বন্ধু, আমাদের আপনজন- তারা স্বদেশে বিদেশে যেখানেই বাস করুক না কেন । বাঙালীর সুখে আমরা সুখী, তাদের দুঃখে আমরা দুঃখী, ব্যথায় ব্যথিত, সকলের তরে সকলে আমরা । বাঙালীর রক্ত এক ও অভিন্ন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম- সমগ্র বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রাম । এ বাংলা নেতাজী সুভাষের পিতৃভূমি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জন্মভূমি , রবীন্দ্রনাথের কবিতার উৎস, নজরুলের শৈশবের লীলাভূমি, আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহার জন্মস্থান, বিপ্লবী শহীদ সূর্য্য সেন, প্রীতিলতা, প্রফুল্ল, তীতুমির, শহীদ বরকত, সালাম, আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল, রওশনরা ও অন্যান্য মুক্তিকামী, বীর সন্তানদের আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল, ভাস্বর এক অপরূপ দেশ ।
যারা আমাদের ২৩ বছর ধরে অবিরাম শোষণ করেছে । নির্মম শাসনেই ষ্টীমরোলার চালিয়েছে, তাদের প্রতি কোন দয়া নাই, যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে বাংলার মাটি লাল করে দিয়েছে, তাদের সংগে কোন আপোষ নাই । যারা মা বোনের মান সম্ভ্রব ভূলণ্ঠিত করেছে তার প্রতিশোধ আমাদের নিতে হবেই । বাংলার শিশুদের আর্তক্রন্দন, বৃদ্ধের দীর্ঘ নিঃস্বাস, মা বোনের চোখের জল আমাদের মোছাতেই হবে । গৃহ-হারাদের নিজ গৃহে ফিরিয়ে নিতেই হবে । হতাশা হবেন না শরণার্থীরা নিরাশার কারণ নাই, পিতৃহারাদের মাতৃহারাদের বেদনার বোঝা বইতে হবে না । মা বোনদের মুক্তির দিন আগত । মনে বহু ব্যাথা আছে, বেদনা আছে, অনেক দুঃখ জমা হয়ে আছে প্রতিটি হৃদয়ে । আছে প্রতিহিংসার আগুন । যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক, শোষক, ধনি, বণিক, সওদাগরের পৃষ্ঠপোষিত সামরিক সরকার । যে সমস্ত বীর যোদ্ধারা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না, তাদের আমরা আর ফিরে পাব না কোনদিন । কিন্তু তাদের জীবনের ত্যাগের বিনিময়ে কি পাব আমরা আমাদের নিজের দেশ, দুঃখী বাংলাকে ত্যাগ, দুঃখ, কষ্ট, রক্তদান ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রাম হয় না-হতে পারে না ।
তাই আমাদের আহবান, যত বেশী ত্যাগ ও যত বেশী রক্ত দেব তত তাড়াতাড়ি আমাদের জয়ের দিন এগিয়ে আসবে । রক্ত দিতে শিখেছে বাংলার কৃষকেরা, কারখানার শ্রমিকেরা, স্কুল কলেজের ছাত্ররা, ত্যাগ স্বীকার করতে শিখেছেন বাংলার মা বোনের, দুঃখ বরণ করেত শিখেছে বাংলার শিশুরা । তাই স্বাধীনতার দিন নতুন বাংলার দিন আগত । জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী ।
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এই যুগ সন্ধিক্ষণে সর্বপ্রকার ত্যাগের ব্রত নিয়ে সংগ্রামের বাণী নিয়ে, মুক্তির আদর্শ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে “সংগ্রামী বাঙালী” । শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধের হাতিয়াররুপে । সকলের হাতে হাত মিলিয়ে জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়ে অবিশ্রাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিচ্ছে-সংগ্রামী বাংলা সকলের সাহায্য ও সহযোগীতাই আমাদের মূলধন ।
মুক্তিকামী জনগণকে জানাই সংগ্রামী অভিনন্দন ।
“সংগ্রামী বাংলা” জিন্দাবাদ
স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,২০০,৩৪৮-৩৪৯>
শিরোনামঃ সংগ্রামী বাংলার বসন্ত চলে যায়
সংবাদপত্রঃ সংগ্রামী বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১
সংগ্রামী বাংলার বসন্ত চলে যায়
পাকিস্তান ২২ বছর ধরে সংগ্রামী বাঙ্গালী জাতিকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে, উদ্যত সঙ্গীনের সামনে । তাই আজ শোষিত, অত্যাচারিত, জনগণের সংগ্রামী আদালত পাকিস্তান মৃত্যুদন্ডের রায়ে স্বাক্ষর করেছেন ।
পাকিস্তানের নামে নির্মম শাসন, ইসলামের নামে নির্লজ্জ শোষণ, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের নামে অন্যায় অত্যাচার, অবিচারকে চিরতরে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য বাংলার জনগণ আজ বদ্ধপরিকর । সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত । সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের শোষিত জনগণও পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির জন্য রণসাজে সজ্জিত । পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে স্বাধীনতার জন্য এই যে মহাজাগরণ, এই যে রক্তক্ষয়ি যুদ্ধ তা রোধ করার ক্ষমতা পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের নাই । পাকিস্তান নিজের হাতে নিজের কবর রচনা করেছে যে কবরে সমাহিত করতে চেয়েছিল বাংলা, সিন্ধু, বেলুচ ও পাখতুনদের ন্যায়সঙ্গত জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ।
অন্তিম মুহূর্তে পাকিস্তান মৃত্যুর বিভীষিকাই চোখের সামনে দেখছে । পাকিস্তান আজ ঘাতকের বেশে দেশবাসীর সামনে দেখছে । পাকিস্তান আজ ঘাতকের বেশে দেশবাসীর সামনে উপস্থিত আর বাংলা, সীমান্ত, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু তার বধ্যভূমিতে পরিণত । পাকিস্তান আজ স্বাধীনতাকামী জনগণের সামনে ভীতি ও অভিশাপস্বরূপ । এখন আমরা ইতিহাসের এক চরম বৈপ্লবিক অধ্যায়ের দ্বারদেশে উপনীত । বাঙালীরা স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে কি না । যদিও কোন কোন বাঙালী চিরদিন শাসক-শোষকদের গোলামী করেছে । ভাই হয়ে ভাইয়ের বুকে ছুরি বসিয়েছে । দেশের স্বার্থ কেউ কেউ বিদেশীদের কাছে বিক্রিও করেছে । এই বাংলায় মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছে আবার সিরাজ, মোহনলালেরও জন্ম হয়েছে । কুচক্রীও আছে, আবার মহানুভবতাও আছে এ বঙ্গভূমিতে । ভীরু হৃদয়ও যেমন আছে তেমনি সিংহ হৃদয়, মহৎ হৃদয়েরও অনেক লোক আছেন । এই বাংলায় সুবিধাবাদীও আছে আবার পরম বিশ্বাসী দেশপ্রেমিকের অভাবে নাই । এই বাংলাদেশ বহু আন্দোলন, বিদ্রোহ ও বৈপ্লবের জন্ম দিয়েছে আবার অনেক গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থও হয়েছে । অনেক ত্যাগ, অনেক সাধনা, অনেক প্রতিভা, অনেক জীবন সংগ্রাম, অনেক রক্তদান বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে । তা সত্ত্বেও সংগ্রামের মহামন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণকারীরা চিরদিন বলেছেন oh motherland with all thy faults we love still thee অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। রুশ বিপ্লব, চীন স্পেনের গৃহযুদ্ধ নাইজেরিয়া, বায়াফ্রা, কঙ্গো-কাতাঙ্গার মর্মান্তিক কাহিনী । রাজনৈতিক বিভেদ, হিংসাদ্বেষ দলমত নির্বিশেষে সমস্ত মুক্তিকামী জনগণ আজ একান্ত-অভিন্ন । সংগ্রামী জনসাধারণ সবাই সমান । সকলের ত্যাগের ও সংগ্রামের মর্যাদা অনস্বীকার্য । love begets love ’ ভ্রাতৃত্ব, প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধনে আজ আবদ্ধ সমস্ত স্বাধীনতাকামী জনগণ । অসংগঠিত মুক্তিযুদ্ধ- নির্মম গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় কোন কোন সময় । কেননা মুক্তিযুদ্ধ মূলতঃ রাজনৈতিক যুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্তব্য নিষ্ঠা, চরম ত্যাগ, অসংখ্য রক্তদানের বিনিময়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব । বিদেশী হানাদারদের চিরদিনের জন্য বাংলার বুক থেকে নির্মূল আমাদের করতেই হবে ও আমাদের জাতীয় আদর্শের ডাক- প্রানপ্রিয় জন্মভূমির জ্বালাময়ী আহবান, সন্তানহারা মায়ের অশ্রুজল মিনতি, মাতৃহারা শিশুদের প্রতিহিংসান্মোত্ত আহবান, স্বামীহারা লাঞ্চিতা নারীর করুণ আবেদন, ভূমিহারা বঞ্চিত লুণ্ঠিত কৃষকের উদাত্ত আহবান, সর্বহারা শ্রমিকের বজ্রকঠোর শপথ, সংগ্রামী ছাত্র যুবকের পবিত্র সংকল্প সমস্ত মুক্তিকামী রাজনীতিকদের ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা, “ কে আছ বাংলার বীর সন্তান রক্ত নিতে হবে, রক্ত দিতে হবে, এগিয়ে যাও” অস্ত্র নাও “ বাংলার বুক থেকে বিদেশী অত্যাচারী জালেমশাহী হটাও । বাঙ্গালীরা, কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক জনগণ মুক্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ সদা জাগ্রত সৈনিক । নিষ্ঠুর মৃত্যুর সংগে লড়াই করছে দিনের পর দিন রাতের পর রাত । “ দানবের সাথে সংগ্রামের তরে সবাই প্রস্তুত ঘরে ঘরে” তবে নাগ নাগিরা চারিদিকে ফেলছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস সংগ্রামী গণঐক্যে ফাটল সৃষ্টি যেন না হয় । লক্ষ লক্ষ নরনারী পশুর মত জীবন বিসর্জন দিয়েছে কোটি কোটি লোক গৃহহারা, সম্পদহারা পথের কাঙ্গাল হয়েছে । অসংখ্য নারী তার সতীত্বের মর্যাদা হারিয়েছে, বাংলার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে । লক্ষ লক্ষ বাড়ি ঘর ভস্মীভূত হয়েছে সেই মহাশ্মাশানের বুকে দাঁড়িয়ে সংগ্রামী বাংলার নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদের উপর । পুরাতনের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে তুলতে হবে আমাদের নতুন স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জাতি, সার্বভৌম রাষ্ট্র দানবের নির্মমতা, কুচক্রীর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে স্বাধীনতার অগ্নি পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে । স্বাধীনতা, দুঃখ, কষ্ট, ত্যাগ সাধন , সংগ্রাম, আর রক্ত সব এক মিছিলে একাকার হয়ে এগিয়ে চলেছে ভাবী কালের দিকে । ভাবী বংশদধরদের জন্য একটি নতুন ইতিহাস নতুন দেশ উপহার দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে- আর দেরী নয় । সংগ্রামী বাংলার বসন্ত চলে যায় । গণবিপ্লবের সময় বহিয়া যায় ।
.
.
দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,২০১,৩৫০>
শিরোনামঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে
সংবাদপত্রঃ সংগ্রামী বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে
বাংলাদেশে ঈদ হয় নাই
রিপোর্ট – দুরমুজ আলী
যে উৎসব, যে আনন্দ, যে মহামিলনের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর ঈদের আবির্ভাব মানুষের ঘরে, সে বার্তা অশ্রুসজল নয়নে ফিরে চলে গেছে । বাংলার ঘরে ঘরে বিষাদের ছায়া, প্রতি ঘরে কান্নার রোল, প্রতিটি মানুষের চোখের জলে এবারের ঈদ বেদনাহত হয়ে ফিরে গেছে । ঈদ উৎসবের ভাষা স্তব্ধ । আনন্দের ভাষা কণ্ঠরুদ্ধ । মহামিলনের বদলে মহাবেদনা নিয়ে ফিরে গেছে সবাই নিজ নিজ আশ্রয়ে । এবার আবার কিসের ঈদ? সমগ্র বাংলা জুড়ে নর কঙ্কালের মিছিল । শকুনী গৃহিনীর রাজত্ব । এখানে পুত্রহারা মায়ের আকুল আর্তনাদ । মাতৃহারা শিশুর মর্মভেদী হাহাকার । গৃহহারা, সম্পদহারা, সর্বহারাদের দীর্ঘশ্বাসে আকাশ বাতাস ব্যথিত । বাংলার প্রকৃতি বেদনায় ক্ষত বিক্ষত । মানুষ লড়াই করছে মৃত্যুর সঙ্গে, দারিদ্রের সঙ্গে, নিষ্ঠুর পাক ফৌজ ও তার অনুচরদের সঙ্গে । শুধু ঈদ নয় বাংলায় শরৎও এসেছিল কিন্তু শারদীয় উৎসব হয় নাই । আনন্দ হয় নাই । জগজ্জননী দুর্গা বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িতা লাঞ্ছিতা হয়েছেন । বাংলায় মন্দিরও নেই দেবতাও নেই । আজ বাংলায় গৃহবধূ সান্ধ্যদ্বীপ জ্বালে না বিগ্রহ দেবতাকে প্রণাম জানাবার কেউ নাই আজ বাংলায় বাংলায় উলধ্বনি আর হয় না, কাঁষার ঘন্টাও বাজে না । মন্দিরের দ্বারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার জন্য কোন লোক ভক্ত পূজারী পাক অধিকৃত বাংলায় নাই । বাংলায় ফুল হয়ত আছে তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার কোন লোক নাই । বাঙ্গালী বাড়ীঘর চাকরী ব্যবসা সব ছেড়ে সর্বহারায় পরিণত হয়েছে, লাঞ্ছিত মানবতা কেঁদে ফিরে সর্বত্র । বাংলার সুখ শান্তি নির্মমভাবে নিহত । বাংলায় আছে পাক ফৌজের পাশবিক অত্যাচার আর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের রাইফেল মেশিনগানের গোলাগুলি । আজ বাংলাদেশ এক বিশাল রণক্ষেত্র । ৭ মাস ধরে বাংলার মানুষে রাতে ঘুমুতে পারে নাই । আহারের কোন প্রেরণা পায় নাই । বাংলার চাষীরা মেঠো গান ভুলে গেছে । রাখালেরা আর মাঠে মাঠে বাঁশী বাজায় না । শিশুদের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেছে । মাঝিদের ভাটিয়ালী গানে নদী মাতৃক বাংলা আর মুখরিত হয়ে উঠে না । যাত্রা থিয়েটার বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছে । পল্লীগীতি, লোকগীতি, বাউল, মুর্শিদী কীর্তনের জন্মভূমি বাংলা আজ প্রতিহিংসাপরায়ণ । অত্যাচারী জালেমশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৈনিক । বাংলায় লুন্ঠনকারী আর ডাকাতেরা বড়লোক হয়েছে, লক্ষপতি হয়েছে, আবার অনেক ধনী পথের কাঙ্গাল হয়েছে । নির্বিচারে নিরাপরাধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, আর অপরাধীরা রাজাকার হয়েছে । এখনও বাংলায় গঙ্গা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র, মেঘনা ধলেশ্বরী, তিস্তা প্রবাহিত হয় কিন্তু তার পানি লাল । বাংলার শ্রমিকেরা চাকরী হারিয়েছে, কৃষকরা জমি ছেড়ে চলে গেছে । ছাত্র সমাজ স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়েছে । বাঙ্গালী দোকানদার দোকান ছেড়েছে । বাংলা আর মুক্তিযোদ্ধা ।
.
.
কম্পাইলারঃ শাহজালাল
<৬,২০২,৩৫১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সংগ্রামী জনসাধারণের দায়িত্ব |
সংগ্রামী বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা |
২৭ নভেম্বর , ১৯৭১ |
সংগ্রামী জনসাধারণের দায়িত্ব
পুরাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধে বিপ্লবে বা রাজনৈতিক বিদ্রোহে কতিপয় পবিত্র নিয়ম ও ধর্মীয়নীতি পালিত হয়ে আসছে নিষ্ঠার সঙ্গে-
১) নারী, শিশু, বৃদ্ধ রুগ্ন কাউকে হত্যা করতে নেই।
২) নিরাপরাধ কাউকে বা একের অপরাধে অপরকে হত্যা করা ঠিক নয়।
৩) শত্রু আত্মীয় হলেও তাকে ক্ষমা করা যায় না।
৪) চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, নারী হরণ বা নারী ধর্ষণ গুরুতর অপরাধ।
৫) স্কুল কলেজ, হাসপাতাল, মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, কলকারখানা ( এখানে কলকারাখানা), লাইব্রেরী পুরাকীর্তি, ঐতিহাসিক কীর্তি, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, বাগান, ক্ষেত খামার, গৃহপালিত জীব ধবংস করা জাতীয় সম্পদ নষ্ট করার সামিল।
৬) আশ্রিত বা অতিথি বা আত্মসমর্পণকারীকে হত্যা করা ধর্মনীতি বিরোধী।
৭) সেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মী, স্থপতি, ডাক্তার, শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সাংবাদিক, বিদেশী বা রাষ্ট্রদূত অবাধ্য ( অবধ্য)
৮ ) কারো বাড়ীঘরে আগুন দেওয়া অন্যায়, কেননা একজনের অপরাধে, অন্য কয়েকজন নির্দোষ ব্যক্তি গৃহহারা হতে পারে।
৯) ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্যে বিপ্লবের সুযোগে কাউকে হত্যা করা বা তার সম্পত্তির ক্ষতি করা বিরাট অপরাধ।
১০) বিষ, রোগজীবাণু দ্বারা কাউকে হত্যা করা বা কারো সঙ্গে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হানি করা অন্যায়।
১১) নিরপেক্ষ সরকারী কর্মচারী বা কোন নিরপেক্ষ লোককে হত্যা করা অন্যায়।
( সাধারণতঃ মহাযুদ্ধে, বিদ্রোহের বা গৃহযুদ্ধে এসব নিয়ম কদাচিত পালিত হয়।)
.
.
শাহজালাল
<৬,২০৩,৩৫২>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় |
অগ্রদূত ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা |
২০ অক্টোবর , ১৯৭১ |
[অগ্রদূতঃ স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চলের সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদকঃ আজিজুল হক। ব্যবস্থাপকঃ সাদাকাত হোসেন এম এন এ ও নুরুল ইসলাম এম পি এ। প্রধান পৃষ্ঠপোষকঃ জে রহমান মুক্তিফৌজ অধিনায়ক। প্রকাশকঃ মোহাম্মদ আলী। রওমারী, রংপুর হতে সাইক্লোষ্টাইলে প্রকাশিত।]
সম্পাদকীয়
বৃহস্পতিবার, ১৪ই অক্টোবর মতে বাংলা ২৭ শে আশ্বিন দুপুর ১২ ঘটিকায় গায়েবী বাণী থেকে প্রচারিত হল বাংলার ভাগ্যাকাশের ( এখানে ভাগ্যকাশের) দুষ্টগ্রহ জাতির অভিশপ্ত- কুখ্যাত ডিকেডী শাসনের নায়ক ও জল্লাদ ইয়াহিয়ার পথিকৃৎ আয়ুবের পদলেহী কুকুর আঃ মোনেম খাঁ আহত ও ঢাকা হাসপাতালে শায়িত হয়। সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা রেডিও থেকে প্রচারিত হলো কোন দুইজন দুঃসাহসী বঙ্গবীরের দুর্বার অভিযানের শিকার বাংলার ভূতপূর্ব কুখ্যাত সুবাদার আঃ মোনেম খাঁ আহত ও মৃত এবং তার প্রতিধবনি শোনা গেলে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতার কেন্দ্রগুলি থেকে। গত প্রায় সাত মাস থেকে বাংলার জল স্থল মাঠ ঘাট পথ প্রান্তর থেকে আরম্ভ করে বাংলার জীর্ণ কুটিরের অভ্যন্তরে পর্যন্ত হত ও আহতের লীলা ক্ষেত্র পূতে গন্ধে ও আর্তনাদে এ শ্যামল বঙ্গভূমির আকাশ বাতাস বিষাক্ত ও ভারাক্রান্ত। এর পরশ খেলে ইথারের অনন্ত তরঙ্গমালার প্রত্যেকটির সঙ্গে। বাংলার বুকে সময়ের প্রবাহে হত আর আহত যেন আজ একটি অমানবিক প্রাকৃতিক নিয়মের নির্ঘটন বলে প্রতীয়মান। এই অগণন হত ও আহতের মধ্যে ব্যক্তিবিশেষের উপর মন্তব্য ও আলোচনা অতি বিরল ও অনাকর্ষণীয়। কিন্তু তবুও সেদিন মোনেমীদের যে আলোচনা শোনা গেলে শুধু এদেশের মানুষের কণ্ঠ থেকে নয়, দেশ-বিদেশের নানা বেতার যন্ত্রের মধ্য থেকে তা যেমনি কলঙ্কয় ও লজ্জাকর, তেমনি দৃষ্টান্তমূলক ও এদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত মীরজাফরদের এক করুণ পরিণতির হুঁশিয়ারী সংকেত। গত ২৩ বৎসরে বাংলার সুবাদারী মসনদে পাক শাসকচক্র অনেককে বসিয়েছিল কিন্তু এ মসনদে কেউ স্থায়ী হতে পারেনি- এ যেন ছিল তাদের রঙ্গমঞ্চের আসন কিন্তু সুবাদারদের মধ্যে সবচেয়ে যে সুযোগ্য বলে বিবেচিত সে হয়েছিল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। কারণ প্রভুদের তুষ্ট করার জন্য স্বজাতির সর্বনাশের পথকে সে সুপ্রশস্ত ও সুগম করতে এক সময় এ দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশীল ও প্রতাপশালী ছিল সেও কালের স্রোতে তাল না পেয়ে ছিটকে পড়েছিল পার্শবে। তবুও কি সে শেষ পর্যন্ত পারল নিজেকে ধরে রাখতে ? না- ইতিহাসের গতি রোধ করবে কে ?
.
.
শাহজালাল
<৬,২০৪,৩৫৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুক্ত অঞ্চলের পৌর সংস্থাগুলি পুনর্বিন্যাস রৌমারী, ১৯ শে অক্টোবর (জোনাল অফিস সূত্র) |
অগ্রদূত ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা |
২০ অক্টোবর , ১৯৭১ |
স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চলের
পৌর সংস্থাগুলি পুনর্বিন্যাস
রৌমারী, ১৯ শে অক্টোবর
(জোনাল অফিস সূত্র)
স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চল রৌমারী থানার ইউনিয়নের পূর্ব পৌর সংস্থাগুলিকে ভেঙ্গে দিয়ে উহার পুনর্বিন্যাস সাধনকল্পে বাংলাদেশ সরকার সামরিকভাবে ( সাময়িকভাবে ?) নিন্মলিখিত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ কর্মীকে চেয়ারম্যান হিসাবে মনোনীত করেছেন বলে সংবাদ প্রকাশ-
১) মিঃ আবদুল জলিল- দাতভাঙ্গা ইউনিয়ন
২) মিঃ দিদার হোসেন মোল্লা- শৌলমারী ইউনিয়ন
৩) মিঃ এবাদুল্যা মণ্ডল- বন্দবেড় “
৪) মিঃ নওশের আলী আকন্দ- রৌমারী “
৫) মিঃ মতিয়ার রহমান- যাদুরচর “
৬) মিঃ ছলিম উদ্দিন- রাজিবপুর “
প্রকাশ যে মিঃ এবাদুল্যা মণ্ডল ও মিঃ ছলিম উদ্দিন এর পূর্বেও চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউনিয়নের প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে একজন করে সভ্যকে মনোনীত করা হয়েছে। এইসব মনোনীত চেয়ারম্যান ও সভ্য মহোদয়গণ অতিশীঘ্র বাংলাদেশ সরকারের কার্যে সহায়ত করার জন্য ও স্থানীয় পৌর সমস্যা সমাধানের জন্য শপথ গ্রহণ করেছেন বলে প্রকাশ।
.
.
শাহজালাল
<৬,২০৫,৩৫৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় |
অগ্রদূত ১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা |
২৭ অক্টোবর , ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স এখন মাত্র সাত মাস পেরিয়ে আট মাসে পড়েছে। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে আমাদের যুদ্ধের গতি, প্রকৃতি ও প্রসার দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে আরও অধিক পরিমাণে সাবলীল, দৃঢ় ও বহুল বিস্তৃতি লাভ করছে। আজ সারা বাংলার জল ও স্থল সুবিস্তৃত রণপ্রশস্তির এবং প্রতিদিন প্রতি প্রান্তর থেকে আমরা পাচ্ছি আমাদের দুর্বার সাহসী, মুক্তিপাগল জোয়ানদের সাফল্য , রণনৈপুণ্য আশার আলোকে নতুন নতুন সংবাদ। প্রতিটি সংবাদ দেশবাসীর মনে স্বাধীনতার আশার আলোকে করে তুলেছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর আর চরম বিজয়ের মুহূর্তটিকে করে চলেছে নিকট থেকে অতি নিকটতর।
যে কোন যুদ্ধে, বিশেষ করে মুক্তি যুদ্ধে রণনৈপুণ্য ও গোলাবারুদের চেয়েও অধিক প্রসারিত ভূমিকা রয়েছে দেশের জনগণের উপর নিরোপিত নীতিসমূহের উপর। কারণ বর্তমান যুগের যুদ্ধের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত জনগণের মনস্তাতবিক কাঠামোর উপর। আমাদের এ যুদ্ধ মুক্তির যুদ্ধ, জনগণের যুদ্ধ এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত ও এককণ্ঠে সমর্থিত এ যুদ্ধ।
পক্ষান্তরে বর্বর পাক সেনাদের এ যুদ্ধ ঔপনিবেশিকতাকে বজায় রাখার জন্য ও শোষণ ও নিপীড়নকে স্থায়ী করা রজন্য, তাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত তাদের পাশবিক শক্তি ও মুষ্টিমেয় দালালদের সমর্থনের উপর। এ ভিত্তি অত্যন্ত ক্ষীণ ও ক্ষণস্থায়ী।
শত্রু পক্ষের গৃহীত ব্যবস্থাবলীকে পরোক্ষভাবে আমাদের গৃহীত ব্যবস্থাবলী ও সংগ্রামের পরিপূরক বা সম্পূরক হিসাবে ধরে নেয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তাদের নিপীড়ন, দহ, হত্যা ও অবিশ্বাসের নীতিকেই উল্লেখ করা যেতে পারে। যখনই আমাদের মুক্তিবাহিনী কোথাও হানা দেয় তখনই তার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে তারা নিরীহ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য নির্য্যাতন ( নির্যাতন) , নিপীড়ন, দহন ও হত্যাযজ্ঞের তাণ্ডবলীলার অবতারণ করে। তাদের এ নীতি ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের থেকেই অনুসৃত । আর বাঙ্গালী হলে তাকে সন্দেহের চোখে দেখা। তাদের এই সব নীতি নিশ্চিতভাবে আমাদের সংগ্রামের ভিত্তিকে আরও মজবুত ও সংগ্রামকে দ্রুত করে তুলেছে। কারণ তাদের অনুসৃত নীতিসমূহ আমাদের জনগণের মনে যে প্রতিক্রিয়া ও মানসিক প্রস্তুতির প্রেরণা দিচ্ছে তা আমাদের সংগ্রামে বিশেষভাবে সহায়ক বলে প্রতিপন্ন।
.
.
শাহজালাল
<৬,২০৬,৩৫৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
দুইজন কুখ্যাত পাক দালালের মৃত্যুদণ্ড |
অগ্রদূত ১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা |
২৭ অক্টোবর , ১৯৭১ |
দুইজন কুখ্যাত পাক দালালের মৃত্যুদণ্ড
রৌমারী ২৬শে অক্টোবর-
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ অদ্য চিলমারীর কুখ্যাত পাক দালাল পঞ্চু মিয়া ও ওয়ালী মোহাম্মদ মুক্তিফৌজ অধিনায়ক কর্ত্রিক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় এবং রৌমারীতে বিকাল সাড়ে চার ঘটিকার সময় মুক্তিফৌজের আঞ্চলিক সদর দপ্তর প্রাঙ্গণের শেষ সীমান্তে মুক্তিফৌজের ফায়ারিং স্কোয়াডের সম্মুখে এই দালাল দুইজনকে হাজির করা হলে হাজার হাজার লোক তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ পালন দেখতে হাজির হয়। বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে তারা স্বেচ্ছায় স্বীকার করে চিলমারী ও উলিপুর থানার অধিকৃত অঞ্চলের শত শত লোকের জীবন নাশ, ধন সম্পদ লুন্ঠন ও ঘরবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ এবং অবলা নারীর অমূল্য সতীত্ব নষ্ট করতে তারা পাক বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে। তাই তাদের আজ মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এ থেকে সকল বঙ্গ বৈরী পাক দালালদের শিক্ষা পাওয়া উচিৎ যে, তাদের কৃতকর্মের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এ দণ্ডাদেশ থেকে পাক দালালদের রক্ষা করার ক্ষমতা দুনিয়ার কোন শক্তির নেই।
.
.
এফ এম খান
<৬,২০৭,৩৫৬>
সংবাদপত্রঃ আগ্রদূত ১ম বর্ষঃ ১৩শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১
.
ঈদুল ফেতর উদযাপন
.
রৌমারী।। ২২শে নভেম্বর
আমাদের প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদ প্রকাশ চাঁদ বিভ্রাটে গত ২১শে ও ২২শে নভেম্বর রোজ শনিবার ও রবিবার উভয় দিবস ঈদুল ফিতরের উৎসব উপলক্ষে উদযাপিত হয় এবং উভয় দিনে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।তবে প্রথম দিনের চেয়ে দ্বিতীয় দিনই অধিকসংখ্যাক লোক জামাতে শরিক হন।
.
রৌমারী ও তদসংলগ্ন মুক্ত অঞ্চলে অন্যান্য বৎসরের ন্যায় ও বৎসরেও স্বাভাবিক ধুমধামের সংগে মুসলমানদের বিশেষ পর্ব ঈদুল ফেতর উৎসব উদযাপিত হয়।এ দিবস দুটিতে কোথাও থেকে কোনরূপ অপ্রীতিকর কোন ঘটনার সংবাদ পাওয়া যাই নাই।নামাজ শেষে ময়দানে জামাতের লোকজন এক বিশেষ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি,পবিত্র মাতৃভূমির শত্রু কবল থেকে সর্বাঙ্গীণ মুক্তি,মুক্তিযুদ্ধরত আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর আশু সাফল্য কামনা করা হয় এবং ঐ সঙ্গে যে সব মুক্তিযোদ্ধা প্রিয় মাতৃভূমির জন্য শাহাদাত বরণ করেছেন ও বাংলার অসংখ্য জনগন যারা বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তাদের আত্মার পরিত্রাণ ও শান্তির দোয়া কামনা করা হয়।
.
.
এফ এম খান
<৬,২০৮,৩৫৭>
সংবাদপত্রঃ অগ্রদূত ১ম বর্ষঃ ১৪শ সংখ্যা
তারিখঃ ১লা ডিসেম্বর
.
নজিম খাঁ হাই স্কুলের হেড মাষ্টার
মিঃ শাহ আলমের মৃত্যুদণ্ড
.
উলিপুর ৩০শে নভেম্বর
আমাদের উলিপুর প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ নজিম খাঁ ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ সংসদের সেক্রেটারী ও নজিম খাঁ হাই স্কুলের মাষ্টার মিঃ আলিমকে গত ২৭শে নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর লোকেরা ধৃত করে পাক সেনাদের হস্তে অর্পণ করলে তারা এই বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ কর্মী ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদকে নির্মমভাবে গুলিকরে হত্যা করে।ঐ দিবসেই এই অঞ্চলের আরও সাতজন আওয়ামীলীগ কর্মীকে হত্যা করা হয়।
.
স্বদেশপ্রেমের অপরাধে যুবক মিঃ আলমের মৃত্যুদণ্ডে এই অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে অত্যন্ত ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে।বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মার সঙ্গে আমাদের সহ কর্মী মিঃ আলমের আত্মার শান্তি আমরা কামনা করি।
.
.
এফ এম খান
<৬,২০৯,৩৫৮>
সংবাদপত্রঃ মুক্তবাংলা
তারিখঃ ২৩ অক্টোবর, ১৯৭১
.
[মুক্তবাংলার সম্পাদক ‘দ-জ’। মুক্তবাংলা প্রকাশনী, বাংলাদেশ। পত্রিকাটি শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত কোন স্থান থেকে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত এক পাতার ক্ষুদে পত্রিকা। সম্পাদকের নাম সাংকেতিক ভাবে ব্যাবহার করা হয়েছে এবং প্রকাশকের ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে। এটা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বলে প্রতীয়মান হয়। বর্ষ ও সংখ্যা অনুল্লেখিত।]
.
আত্মসমর্পনের হিড়িক
২০শে অক্টোবর মনোহরদিস্থিত পাক বাহিনীর ঘাঁটি হইতে পলায়ন করিয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২২ জন ও ৭ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। সাক্ষাতকারে তাহারা আমাদের প্রতিনিধিকে জানান যে,মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার পবিত্র দায়িত্বে অংশগ্রহণ করার জন্য অনেকদিন হইতেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।সুযোগ পাইলেই পাক বাহিনীর বাঙ্গালী সৈন্যগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিবে। ইতিমধ্যে কাপাসিয়া, কালিগঞ্জ,জয়দেবপুর, শিবপুর, রায়পুর থানা সহ বিভিন্ন স্থান হইতে আত্মসমর্পণের খবর আসিয়াছে।
“তোমরা আমাকে রক্ত দাও-আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব”
.
.
এফ এম খান
<৬,২১০,৩৫৯>
সংবাদপত্রঃ মুক্তবাংলা
তারিখঃ ১ নভেম্বর, ১৯৭১
.
মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী থেকে
আমি মুক্তিযোদ্ধা-গোটা বাংলা আমার রণাঙ্গন, বাংলার প্রতিটি ঘর আমার একান্ত আপনার বাংলার পবিত্র মাটি আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। আজ কোন দল নেই মত নেই; একদল যাত্রী স্বাধীনতা সংগ্রামী একই আদর্শ শেখ মুজিব একই নদ,বাংলার মুক্তি বাংলার স্বাধীনতা। তাই খুনী ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া কুত্তাদেরকে হত্যা করে বাংলার মানুষের উত্তপ্ত তাজা রক্তের প্রতিশোধ নিতে আমি বদ্ধপরিকর। বাংলার সংগ্রামে আমি সূর্যসেন তীতুমীর প্রীতিলতার সংগ্রামী উত্তরাধিকারী। রক্তের বিনিময়ে বন্ধুর কণ্টকাকীর্ণ পথের অন্ধকার যবনিকা ভেদ করে রক্ত ঊষার রক্ত আলোকে উদ্ভাসিত করব শোষিত বাংলার নির্যাতিত মানুষেরে।
“শত্রুর সাথে কোন আপোষ নেই-চুড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মুক্তি সংগ্রাম চলবেই” – তাজউদ্দীন
.
.
এফ এম খান
<৬,২১১,৩৬০>
সংবাদপত্রঃ মুক্তবাংলা
তারিখঃ ২৯ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
সসাগরা রত্নসম্ভার বিশ্বের মণিকোঠায় রক্তাক্ষরে দেয়া একটি নাম,একটি পরিচয়-স্বাধীন বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক সভ্য বিশ্বের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বীকৃত গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার আজ একটি বাস্তব সত্য-সত্য চিরঅম্লান চিরঞ্জীব। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায় বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-বাংলার মানুষ অধিকার চায়,তাই লাখো শহীদের রক্তে গড়া বাংলাদেশ সরকার ও রক্তের শপথে দীপ্ত বাংলার মুক্তিপাগল প্রতিটি মানুষ বর্বর ইয়াহিয়ার হানাদার পশুদের হত্যা করে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে আসন্ন মুক্তির দেকে।
.
যাত্রাপথ যতই দুর্গম হউক না কেন বাংলাদেশ সরকার বাংলার বুদ্ধিজীবী, চাকুরীজীবী, ছাত্র শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি জনতা রক্তের বিনিময়ে সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ, টাউট -বাটপার ও পা-চাটা দালালদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়ে ” মুক্ত বাংলার” বিমল আলোতে দশদিক উদ্ভাসিত করে শোষিত নির্যাতিত বাংলার মানবাধিকার স্থাপন করবেই,করবেই করবেই।
“জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু-জয় মুক্তিযোদ্ধা”
*
‘জনগনের ইচ্ছাশক্তির পতন নেই পূর্ণ মুক্তি ও স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য”-তাজউদ্দীন
.
.
এফ এম খান
<৬,২১২,৩৬১>
সংবাদপত্রঃ মুক্তবাংলা
তারিখঃ ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
আমি মুক্তিযোদ্ধা। বিশ্বের অত্যাচারিত শোষিত-নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের যুদ্ধে আমি একান্ত আপনার হয়ে জনগণের পাশে ছিলাম-আছি,থাকবো।
.
জল্লাদ ইয়াহিয়ার হানাদার পশুদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হিংস্র থাবা আজও চলছে বাংলার পথে ঘাটে মাঠে।তাজা মগজের রক্তপিণ্ড আজও লেগে আছে ঘরের দেয়ালে দেয়ালে। আজও চলছে নারী-পুরুষ আবাল বৃদ্ধা-বনিতার জীবন্ত সমাধি,ধর্ষিতা হচ্ছেন বাংলার মা বোন।ছিনিয়ে নেয়া দুধের শিশুর আর্তনাদে দিশেহারা হচ্ছেন বাংলার দুঃখিনী মা।আমি পশু শক্তির সম্মুখে-জীবন্ত সন্ত্রাস। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিবাদের মুখে হারিকেন,টর্নেডো-সাইক্লোন। আমি হত্যা করবো ধ্বংস করবো জল্লাদ ইয়াহিয়ার পশু শক্তিকে।রক্তের বিনিময়ে গেয়ে যাবো জীবনের জয়গান।
.
স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের ইস্পাতদৃঢ় মনোবল রয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত পর্যায়ে আমরা উপনীত। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। “জয়-বাংলা,জয় মুক্তিযোদ্ধা-জয় শেখ মুজিব”
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো-এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বোই ইনশাল্লাহ। -বঙ্গবন্ধু’
.
.
লাল কমল
<৬,২১৩,৩৬২-৩৬৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় রাজাকার দর্পণ |
জাগ্রত বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা |
৩০ অক্টোবর, ১৯৭১ |
[ জাগ্রত বাংলাঃ মুক্তিফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র। ময়মনসিংহ জেলা ও উত্তর ঢাকার বেসামরিক দপ্তর আসাদ নগর (ডাকাতিয়া) থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত। প্রত্রিকাটি শত্রু সেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ হতে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত। সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হাফিজউদ্দিন আহমেদ।]
সম্পাদকীয়
রাজাকার দর্পণ
হানাদার জঙ্গীশাহী বাংলাদেশে পঁচিশে মার্চে অতর্কিত বর্বর হামলায় লক্ষ লক্ষ নিরীহ বাঙ্গালী হত্যা করিয়াও যখন কোন প্রকার কুলকিনারা করিতে পারিল না তখন জোর জবরদস্তি করিয়া বেয়নেটের আগায় ভয় দেখাইয়া দালালদের সহায়তায় হাজার হাজার বাঙ্গালী যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করিতে থাকে। বাঙ্গালী দিয়া বাঙ্গালী হত্যা, বাঙ্গালী দিয়া বাঙ্গালীদের সহায় সম্পদ লুট ও ঘরবাড়ী জ্বালান এবং বাংলার মা-বোনদের বেইজ্জত করিবার মৌল উদেশ্যে বহুসংখ্যক রাজাকারকে তাহাদের মা-বোন স্ত্রীদিগণকে পশ্চিমা নরপশুরা ভোগের জন্য সরবরাহ করিতে বাধ্য করিয়া আসিতেছে। অনেক যুবকের সম্মুখেই মা বোন স্ত্রীকে পাশবিক অত্যাচার চালাইয়াছে এবং যুবকদের ধরিয়া লইয়া বলপূর্বক রাজাকারে ভর্তি করিয়াছে। চোখের জল ফেলিয়া এমন আক্ষেপ উক্তি করিয়াছেন বহুসংখ্যক পলাতক রাজাকার।
প্রাণের ভয়ে অবস্থার বেগতিক পরিবেশে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বহুলোক রাজাকার হইয়াছে। কিন্তু অত্যাচারের ভয়ে ও রাজাকার হইয়াও যখন অত্যাচার হইতে রক্ষা পাওয়া যায় না লাঞ্জনা-গঞ্জনা বা নির্যাতন চালাইতেছে সমান হারে তখন কি করার থাকে? তাই মরিয়া হইয়া প্রতিদিন বহু রাজকার বিভিন্ন এলাকা হইতে পালাইতেছ। তাহারা অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া মরিতে চায়। দেশমাতৃকার নামে প্রাণ বলি দিত সুযোগ বুঝিয়া অস্ত্রসহ অনেকেই মুক্তিবাহিনীতে যোগদানও করিতেছে।
অত্যাচারীর একই মাত্র পরিচয় সে নির্মম নির্যাতনকারী। মানুষের আকার হইলেও আসলে পশুত্বপূর্ণ তাহার আচরণ। তাই রাজাকাররাও রেহাই পাইতেছেনা জল্লাদদের নির্যাতন হইতে। পলাতক রাজাকারদের বাড়ীঘর পুড়াইয়া নিশ্চিহ্ন করিতছে বাড়ীতে ছেলে বুড়ো মা বোন-স্ত্রী, যাহাকে পাইতছে ধরিয়া নিয়া চালাইতেছে অমানুষিক নির্যাতন ও পাশবিক অত্যাচার। এমনকি বহু রাজাকারের বাড়ীতে কোন লোকজন গ্রেফতার করিতে সক্ষম না হইয়া তাহাদের প্রতিবেশী যাহাকে পাইতেছে তাহাকেই ধরিয়া নিয়া যাইতেছে। ভাইকে দিয়া ভাইয়ের বুকে গুলী চালাইবার জন্যই বাঙ্গালীদিগকে রাজাকারে ভর্তি করা হইতেছে। অন্য কথায় বলা যাইতে পারে শাক দিয়া শাক নিপাত করা। তাতে রাজাকারদের যদি বিবেক জাগ্রত হয়-আর কথায় আত্মা, বলিয়া ওঠে না, আর নয়, ভাই হইয়া ভাইকে আর হত্যা করিব না। মা বোনের ইজ্জত বিদেশী পশুদের এমনি করিয়া আর নষ্ট করিতে সাহায্য করিব না।
পশু শক্তির নির্মম আঘাতে একটি জাতির জাগ্রত বিবেককে ধ্বংস করা যায় না। যে রাজাকারকে স্বাধীনতা রক্ষাকারী বাঙ্গালী হত্যা করিবার হাতিয়ার করিয়াছে, তাহারাই অবশেষে নরপশু পশ্চিম কসাইদিগকে হত্যা করিয়া বাংলার মা বোনের ইজ্জত ধন মান সহায় রক্ষা করিতে অগ্রসর হইবে এটা তাহাদের ন্যায়ের পথে সুষ্ঠু মানবিকতারই বিকাশ ও অন্ধকার হইতে আলোর পথে পদক্ষেপ। যাহার কান্ডারী তাহাদের ধৈর্য্যশীল হইতে হইবে। আর ভুল পথের যাত্রীরা চাহিয়া দেখ, এই শ্যামল বাংলা-এদেশ আমার এদেশ তোমার। দেশের শ্যামল প্রান্তরে জল্লাদের হিংস্র আক্রমণে রক্তের উত্তাল তরঙ্গ বহিতেছে। পশু শক্তির লেলিহান শিখা দাউ দাউ করিয়া জ্বালাইয়া পুড়াইয়া শেষ করিতে চাহিয়াছে একটা জাতিকে। দেখ, তোমার আমার রক্তে একই ধারা বহিতেছে। বিবকের আগুনে দগ্ধ কর তোমার আত্মাকে। বিদ্রোহ কর। হানাদারদিগকে রুখ। হত্যা কর। বাংলা মায়ের কলিজা ঠান্ডা কর নরপশুদের তাজা রক্তে। দেখিবে তাহাতে মরণেও সুখ; মরিয়াও আবার জন্ম নিবে বাঙ্গালীর ঘরে। মুক্তি বাংলার সূর্যালোক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিবে হাসি ভরা মুখ; জয়টীকা আঁকা থাকিবে তোমার ললাটে।
.
.
কম্পাইলারঃ লাল কমল
<৬,২১৪,৩৬৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
নিয়াজীর গোপন রিপোর্ট ফাঁস |
জাগ্রত বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা |
৩০ অক্টোবর, ১৯৭১ |
নিয়াজীর গোপন রিপোর্ট ফাঁস
মুজিবনগর ৮ই কার্তিক। তথাকথিত পাকিস্তানের ‘খ’ এলাকার সামরিক প্রধান লেঃ জেঃ এ, কে, নিয়াজী ইসলামাবাদের ইয়াহিয়ার নিকট এক গোপন রিপোর্ট প্রেরণ করেছেন। উক্ত রিপোর্টে মুজিবনগরের প্রকাশ করা হয়।
(স্টাফ রিপোর্টার)
নিয়াজী লিখেছেন, আমরা ইজ্জত বাঁচানোর জন্য লড়ছি সৈন্যগণ দীর্ঘদিনের ব্যস্ততায় বড় ক্লান্ত, সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে; অত্যাদিক দৌড়াদৌড়িত স্বাস্থ্যও ভেঙ্গে পড়েছে, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীরা পরিদর্শনে এলে সৈন্যরা স্বস্তি বোধ করে কিন্তু কেউ আসছে না। নিয়াজী লিখেছেন বিদ্রোহীরা এখন খুবই তৎপর। আর নতুন সৈন্য পাঠালে ভাল হয়। রাজাকারদের উপর নির্ভর করা যায় না। ওরা প্রথম সুযোগেই বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসর্পন করতে শুরু করেছে। জনসাধারণের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, মালিকের মন্ত্রীসভার উপরও আস্থা স্থাপন করা যায় না। বিদ্রোহীরা পুল ধ্বংস করে নৌপথে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এখন শুধু বিমান বাহিনীর উপরই যা ভরসা কিন্তু সীমান্ত পরিস্থিতি খুবই জটিল; ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে বিমান হামলাও সম্ভব হবে না।
.
.
লাল কমল
<৬,২১৫,৩৬৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
জনসভা |
জাগ্রত বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা |
৩০ অক্টোবর, ১৯৭১ |
জনসভা
টাঙ্গাইল, ২৩শে অক্টোবর। অদ্য টাঙ্গাইল জেলার মুক্তাঞ্চলে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথির আসন গ্রহন করেন ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, পাবানা জেলার মুক্তিবাহিনীর প্রধান তত্ত্বাবধায়ক বাংলার বীর সন্তান জনাব আবদুল কাদের সিদ্দিকী সাহেব। সভায় বক্তৃতা করেন টাঙ্গাইলের বেসামরিক প্রধান ও ছাত্রনেতা জনাব আনোয়ার উল আলম শহীদ ভাই। শহীদ ভাই তার বক্তৃতায় বলেন, যে ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করে আমরা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি এ মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমন্ডিত করতে এর চেয়ে বেশী ত্যাগ তিতিক্ষার প্রয়োজন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির কথাও উল্লেখ করেন। শহীদ ভাইয়ের ভাষণের পর প্রধান অতিথি তাঁর ভাষণ দেন। প্রধান অতিথি তাঁর ভাষণে বিভিন্ন সহকর্মীদের নাম উল্লেখ করে বলেন, আমি জীবনে যা চেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশী পেয়েছি। তিনি দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দুটি পর্যন্ত দান করবো। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের সকলকেই অস্ত্র হাতে নিতে হবে। এখনও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। অল্প দিনের মাঝেই আমাদের মার শুরু হয়ে যাবে। পাক সরকারের অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে কাদের সাহেব বলেন, অত্যাচারীরা অত্যাচারের প্রতিফল পাবেই। তিনি বলেন, বাঙ্গালীরা পূর্বের কোন ইতিহাসে হারেননি, জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসেও আমরা হারব না, ৭০ হাত মাটির নীচেও যদি জঙ্গী চক্রেরা বঙ্গবন্ধুকে লুকিয়ে রাখে তবে সেই ৭০ হাত মাটির নীচ হতেও আমরা বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করব; তাঁকে না উদ্ধার করে হাতিয়ার ছাড়বো না। যেদিন আমরা স্বাধীন হব, সেদিন মুজিব আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন সেদিন আমারা অস্ত্র ছাড়ব।
পরিশেষে তিনি রাজাকারদেরকে অচিরেই আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। যদি আত্মসমর্পণ না করে তবে তাদেরকে সমূলে উৎখাত করা হবে এ মর্মে হুঁশিয়ারী জানান।
.
লাল কমল
<৬,২১৬,৩৬৬>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দী |
জাগ্রত বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা |
৩০ অক্টোবর, ১৯৭১ |
জবানবন্দী
শফিকুল ইসলাম
সংগ্রাম আমাকে ডাক দিয়েছে। তার ডাকে সাড়া না দিয়ে আমি থাকতে পারি না। মুক্তির গান গাওয়ার আমার খুব ইচ্ছা। আমি বাংলাকে ভালবেসেছি, বাংলা প্রত্যেকটি তৃণলতার সাথে আমার আজন্ম পরিচয়; কিন্তু বাংলা আজ পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ। তাই বাংলার দুর্যোগের দিনে আমি আপন স্বার্থে লিপ্ত থাকতে পারি না। বাংলার শ্যামলিমা আমাকে ডাক দিয়েছে। পদ্মা, মেঘ্না, যমুনার উচ্ছল তরংগমালা আমাকে উৎসাহিত করেছে, কালবৈশাখীর উদ্দামতা আমাকে সমর্থন দিয়েছে। তাদের এ সম্মিলিত আহবাঙ্কে আমি অগ্রায্য করতে পারি না।
আমি একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে সত্য সুন্দরের নামে শপথ করেছিলাম এদেশের মানুষকে মুক্ত করে শোষণ্মুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম করার। আজ সেদিন এসেছে কিন্তু বন্দুক কামানের শব্দ শুনে ভীত হয়ে পিছিয়ে পড়লে শহীদরা আমাকে পরিহাস করবেন, ধীক্কার দিবেন আমার মানুষ্যত্বকে।
আমি বাংলার একজন জাতীয়তাবাদী ছাত্র। কিন্তু আজ বাংলার মাটিতে জঙ্গীচক্র যে হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচার চালিয়েছে তা বায়াফ্রা মাইলাই এর হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচার থেকে ভয়াবহ, হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হতেও পাশবিকতায় বীভৎস। এরা বাংলার মানুষকে পথে নামিয়েছে, বাংলার মানুষকে রিক্ত করেছে, মাকে সন্তানহারা করেছে, বোনকে স্বামীহারা করেছে, বোনের সতীত্বকে নষ্ট করেছে; এরা বাংলার মাটির পবিত্রতা নষ্ট করেছে, বাংলার সবুজ শ্যামল প্রান্তর রক্তে রঞ্জিত করেছে, সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে। জাতীয়তাবাদী ছাত্র হিসাবে কি করে আমি জঙ্গীচক্রের এ হেন হীন কার্য্যকে সমর্থন করব? আজ যদি সংগ্রাম মুখর দিনে আমি অংশগ্রহন না করি তবে কোথায় থাকবে আমার জাতীয়তাবোধ? বাংলার শ্যামলিমা আমাকে অভিশাপ দিবে, বোনের আর্তক্রন্দন আমার ভবিষ্যত জীবনকে দুর্বিসহ করবে, বাংলার মানুষের শহীদী আত্মা আমাকে উপহাস করবে।
মরতে একদিন হবেই। তবে মৃত্যুকে কেন এত সংশয়? আমি সে মৃত্যুর পক্ষপাতী যে মৃত্যু গৌরব ডেকে আনবে। পরপারের ডাক যার আসবে সেদিন তার চলে যেতেই হবে; কিন্তু যখন শহীদী মৃত্যু লাভ করা যায় তখনই মরাটা ভাল। কেননা, যে মৃত্যু ফুল হয়ে দীপ্তিতে ভাস্কর হয়ে থাকবে। পঁচিশের রাতে (মার্চ) ভয়াবহতায় অনেকেই মৃত্যুকে আকড়িয়ে ধরেছিলেন। তারা জানতেন আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে যারা আদর্শভ্রষ্ট হয় তাদেরকে ইতিহাস ক্ষমা করে না। তাই মহান ব্রতকে সামনে রেখে কালরাত্রিতেই তারা পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছেন। আমি আদর্শবাদী মুক্তিকামী শহীদদের রক্ত স্পর্শ করে শপথ নিয়েছিলাম, আজ কেমন করে আমি বিস্মৃত হই?
.
.
লাল কমল
<৬,২১৭,৩৬৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় যুদ্ধ ও শান্তি |
জাগ্রত বাংলা ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা |
১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
যুদ্ধ ও শান্তি
আপাতদৃষ্টে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্টকেই অত্যন্ত শান্তিকামী বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে অনতিবিলম্বে যুদ্ধরত ভারত ও পাকিস্তানকে নিজ নিজ সৈন্য প্রত্যাহার এবং অস্ত্রসংবরণের প্রস্তাবটিতে সমর্থন জানানো হইয়াছে। যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাব নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য, আমরাও যুদ্ধের বিরোধিতা করি। আমরা জানি, যুদ্ধ মানুষের প্রগতি ও কল্যাণের পথে অন্তরায়। কিন্তু যুদ্ধেরও রকমফের রহিয়াছে; সমস্ত যুদ্ধ এক সারিতে পড়ে না। কোন জাতির উপর যুদ্ধ চাপাইয়া দেওয়াকে আমরা অন্যায় বলি। অন্যায়কে সুদৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করিতে গিয়া যে সংগ্রামের অবতীর্ণ হওয়া প্রয়োজন, তাহকে বলি ন্যায়যুদ্ধ। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মোড়ল, ঐশ্বর্য্যশালী আমেরিকা যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়েছে দরিদ্র ভিয়েতনামীদের ওপর। তাই ভিয়েতনামের মুক্তির লড়াই একটি ন্যায় যুদ্ধ। পৃথিবীর সত্যিকার শান্তিকামী মানুষেরা ভিয়েতনামবাসীদের পক্ষে সংবেদিত।
তেমনি বঞ্চিত, নির্যাতিত বাঙ্গালীদের ওপরও যুদ্ধ চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। সেইদিন ধর্ষিতা বোন ও নিহত ভাইয়ের রক্ত ছুঁইয়া দেশকে মুক্ত করার শপথ নিয়াছিল যুগযুগের তন্দ্রাচ্ছন্ন নিরীহ বাঙ্গালী। বিশ্বের নেতৃবৃন্দের কানে এইসব সংবাদ পৌছায় নাই বলিলে ভুল হইবে; যে কোন দেশের সাধারণ মানুষের কাছেও বেতার ও সংবাদপত্রের বদৌলতে বিপুলা ধরনী অতি ক্ষুদ্র একটি গালফ বই কিছুই নহে। তবুও সকলে হঠাৎ আজ যুদ্ধের নামে এত উদ্বিগ্ন কেন?
পাকিস্তানের জঙ্গীচক্র প্রায় এককোটি বাঙ্গালীকে শরণার্থীরূপে ভারতে পাঠাইয়া দিয়া ঐ দেশের অর্থনীতির উপর বিপুল চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে একটি যুদ্ধেরই সুত্রপাত করে। উপরন্তু কিছুদিন যাবত ভারত সীমান্তে গোলাগুলি করিয়া বিশ্ববাসীকে সে এই বলিয়া ধোঁকাও দিতে চাহিয়াছিল যে, তাহার যুদ্ধ ভারতেরই সহিত, বাংলাদেশের সহিত নহে। অবশেষে সে পুরোদমেই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়া গেল। উহারই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে নিজ স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের সাহার্য্যার্থে যুদ্ধে নামিতে হইয়াছে। এতদিন যাবত মিসেস গান্ধী যে সংযম দেখাইয়াছেন তাহা ইতহাসে দৃষ্টান্তবিহীন।
এইদিকে আমেরিকা তাহার তাবেদার রাষ্ট্র গোয়ারগবিন্দ পাকিস্তানকে চরম পতনের হাত হইতে বাঁচাবার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়াছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাহা ভেটো প্রয়োগে বাতিল করিয়া দেয়। পরে বিষয়টি আমেরিকারই ইঙ্গিতে সাধারণ পরিষদে স্থান পায়। মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলি ইহাতে সমর্থন জানাইয়াছে। অবশ্য প্রস্তাবটি একান্তই পালনীয় নহে; এবং ভারত জাতিসংঘের চোখ রাঙ্গানীকে ভয় পায় না। অতএব পাকিস্তানের ধ্বংস অনিবার্য।
তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক গণচীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-নাই পাকিস্তানের বিজয় কামনা করিয়াছেন। আমরাও ভুলিয়া যাই নাই সাম্রাজ্যলিপ্সু চীন ১৯৬২ সালে আক্রমন করিয়াছিল ভারতকে। এবং মাত্র কিছুকাল আগেও মানবতার অকৃত্রিম বন্ধু বৃহৎশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তে বাধাইয়াছিল সংঘর্ষ।
পরিশেষে আমরা পৃথিবীর শান্তিবাদী রাষ্ট্র ও ব্যক্তিবর্গকে আহবান জানাই, তাঁহারা যেন নিরপেক্ষতার ভান করিয়া অন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করা হইতে বিরত থাকেন।
.
.
কম্পাইলারঃ সহুল আহমদ মুন্না
<৬,২১৮,৩৬৮-৩৬৯>
শিরোনামঃ জনসভা
সংবাপত্রঃ জাগ্রত বাংলা, ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১১ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জনসভা
আঙ্গার বাজার,২৬শে নভেম্বর।
বিকেল ৫টায় কমিউনিটি সেন্টার প্রাঙ্গনে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মেজর আফসার উদ্দিন আহমেদ। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, সর্বহারা বাংলার স্বাধীনতার জন্যে আমরা যুদ্ধকরছি,যুদ্ধ করে যাব; দুর্ভাগা বাংলাদেশকে প্রাণের বিনিময়ে হলেও মুক্ত করব।
এক ঘোষণায় মেজর আফসার বলেন, শহীদদের পবিত্র নামের স্মরণে, আমলীতলাকে মমতাজ নগর, মল্লিক বাড়িকে মান্নান নগর, ঢালুয়াকে জহির নগর বলে ডাকা হবে।
মজুতদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে মেজর আফসার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, সমাজের মুষ্টিমেয় ধনিক ব্যাক্তি যারা মুনাফাবৃত্তি নিয়ে ৪০/৫০ টাকা দরে ধান বা টাকা লগ্নি করছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে সমুচিত ব্যবস্তা গ্রহণ করা হবে। তাদের দিন শেষ হয়ে গেছে। এখনও নিবৃত্ত না হলে কঠিন শাস্তির হাত থেকে এদেরকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।
রাজাকারদের অচিরেই আত্মসমর্পণ করার নিরদেশ দিয়ে তিনি বক্তৃতা সমাপ্ত করেন।
জনসভা
ভালুকা
১০ই ডিসেম্বর। চারটায় স্কুল প্রাঙ্গনে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিচালনা করেন অধিনায়ক আফসার উদ্দিন আহমেদ। সভায় বক্তৃতা করেন ‘জাগ্রত বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি জনাব কুতুবুদ্দিন আহমেদ, ভালুকা থানার সি,ও, (রেভ) সাহেব ও জনাব ওমর আলী এবং আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যাক্তিগণ।
জনাব হাফিজউদ্দিন শহীদদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, বাঙ্গালীর এ সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে। মায়ের ভাষাকে সরকারী ভাষায় প্রতিষ্ঠীত করার দাবী নিয়ে তারা পাকিস্তানী শাসকদের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল বুলেট ও বেয়নেট। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাঙ্গালী রক্ত দিয়েই চলেছে। আর এর ফলেই জন্ম নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ।
তিনি জনগণকে হুঁশিয়ারি জ্ঞাপন করে বলেন, আমাদের এই স্বাধীনতা যেন পাকিস্তানের মত পর্যবসিত না হয়। ৪৭ সালে আমরা পাকিস্তান চেয়েছিলাম শোষণের অবসানকল্পে, আমাদের মধ্যেই অপর এক শ্রেণী স্বাধীনতা চেয়েছিল শোষণের রাজত্ব বহাল ও মজবুত করার জন্যে। আজ সে সব চোর গুন্ডা বদমায়েশদের আমরা নির্মূল করছি সত্যিকার স্বাধীনতার আশায়,শোষনহীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের উদ্যেশ্যে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, অর্থনৈতিক মুক্তিই প্রকৃত মুক্তি। যে বৈষম্যের পাহাড় পাঞ্জাবী শোষকেরা গড়ে তুলেছিল, তাদের কবর হল তাঁরই নিচে। এটা ইতিহাসের কাছ থেকে শিক্ষনীয় বস্তু। জনগণ যে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে সংগ্রাম করে, যে লক্ষ্য থেকে সামান্যতম বিচ্যুতিও পতন ঘটায় স্বৈরাচারী পশুশক্তির।
জনাব হাফিজউদ্দিন বলেন, আমরা এখন স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে; কিন্তু আসলে এটাই আমাদের শুরু, দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে গড়ে তুলতে হবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। এর জন্যে প্রয়োজন আরও চেতনাশীল হওয়া।
পরিশেষে তিনি দৃষ্টান্তসরূপ ভালুকার তথাকথিত ‘বাঘ’-এর ল্যাজ গুটিয়ে কুক্রের ন্যায় পশ্চাদপসরণের ব্যাপারটি উল্লেখ করেন। জনগনের সম্মিলিত শক্তি এইভাবে চারিদিকে পতন ঘটিয়ে চলেছে অত্যাচারীর। তারা পিছনে ফেলে যাচ্ছে মানুষকে শোষণ করে জমিয়ে তোলা বিপুল ধন সম্পদ। কিন্তু তবু তারা রেহাই পাচ্ছে না,কারণ গণ-আন্দোলনের প্রখর সূর্যালোক প্রতিটি চুলেরও ছায়া পড়ছে।
মেজর আফসারউদ্দিন সভাপতির ভাষণে জনগণকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বিভাগের সাথে অসামরিক জনতার অবিচ্ছেদ্য সম্পরকের ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন।
——————————————————————–
বিপুল হর্ষধ্বনি, স্লোগান ও করতালির মাধ্যমে সভার কাজ সম্পন্ন হয়। সবশেষে শহিদদের আত্মার মাগফেরাত ও চুড়ান্ত বিজয়ের জন্যে পরম করুণাময়ের কাছে মুনাজাত করা হয়।
* * * * * * * * *
কয়েকটি নির্দেশ
১। মুক্তিবাহিনি ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীকে সাহায্য করুন।
২। কালবাজারির আশ্রয় নিবেন না; বাংলাদেশ সরকার কালবাজারিকে কোনদিন বরদাশ্ত করবেনা।
৩। পশ্চিম পাকিস্তানি জিনিসপত্র পরিহার করুন।
৪। অপরাধীদের শাস্তির ভার কোন অবস্থাতেই নিজের হাতে নেবেন না। বাংলাদেশ সরকারি অপরাধিদের বিচার করবেন।
৫। বংলাদেশ বেতার শুনুন।
-বাংলাদেশ সরকার
.
.
সহুল আহমদ মুন্না
<৬,২১৯,৩৭০>
শিরোনামঃ জনমত
সংবাপত্রঃ জাগ্রত বাংলা, ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১১ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জনমত
অগ্রদূত
সংগ্রামের শেষ মুহূর্ত উপস্থিত। সুদীর্ঘ সংগ্রামের পর নিশ্চিত সাফল্য আজ আমরা অর্জন করতে চলেছি। এ চূড়ান্ত সময়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। এ সময়ে সংগ্রামকে আমাদের এমনভাবে চালিয়ে যেতে হবে যাতে এতটুকু ত্রুটি না হয়। সামান্যতম ভুলের জন্যেও ভবিষ্যতের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন বলেছেন, শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানুন, পরবর্তী বংশধরেরা যেন না বলতে পারে উপযুক্ত সুযোগ ও আহ্বান পেয়েও তার সদ্ব্যবহার হয় নি।
আজ বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের দুঃসাহসী সেনারা আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে তরান্বিত করার জন্যে বর্বর হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। মৈত্রী ভাবাপন্ন এ উদ্যোগ সংগ্রামের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এটা আমাদের পরম সুযোগ। এ সুযোগ মিত্রবাহিনীর কাঁধে কাধ মিলিয়ে অগ্রসর হলে শিগগির আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌছে যাব। এখন কাজ হবেঃ শত্রুর সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দিয়ে তার উপর সর্বশেষ আঘাত হানা।
অপরাধীদের শাস্তি ও বিচারের ভার বাংলাদেশ সরকার নিয়েছেন তাই ভেজালমুক্ত হয়ে একমুখো চলার এ সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দেশবাসীদের পক্ষ থেকে আমাদের আবেদন, আপনারা শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানুন। পদ্মফুল তুলতে গেলে যেমন কাঁটার আঘাতটি খেতে হয় তেমনি স্বাধীনতা অর্জন করতে বহু কষ্ট ও আত্নত্যাগ করতে হয়; এটাকে কেউ হাতে তুলে দেয় না। যারাই এ শেষ মুহূর্তের মহান মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে চায় তাদেরকে সহাস্য বদনে সে সুযোগ দিবেন; কেননা আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশবাসীকে এক নির্দেশে বলেছেন, সংগ্রামের এ শেষ মুহূর্তে আপনারা মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর কাঁধে কাধ মিলিয়ে শরীক হউন। গৌরব আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে – জয় বাংলা।
.
.
সহুল আহমদ মুন্না
<৬,২২০,৩৭১-৩৭২>
শিরোনামঃ শত্রুপরিত্যাক্ত ভালুকা
সংবাপত্রঃ জাগ্রত বাংলা, ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১১ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
শত্রুপরিত্যাক্ত ভালুকা
বাংকার, বাংকার, শুধু বাংকার। যেদিকে তাকানো যায়, চোখে একটা না একটা বাঙ্কার পড়বেই। ভালুকার কুলাঙ্গার চান মিয়ার বাড়ির উঠোনে তেমনি একটা বাংকার চোখে পড়লো। এতো চমৎকারভাবে তৈরী এ বাংকারটি যে, দিনের পর দিন এতে আশ্রয় নিয়ে থাকলেও বিপদের এতটুকু সম্ভাবনা নেই। বাড়ীটির পশ্চিমদিকেও চারখানা বড় বড় বাঙ্কার। এ সবের মধ্যে থাকা খাওয়া সবকিছুই চলতে পারে। এ থেকে বেরিয়ে নিরাপদে পালাবার পথও তৈরী রয়েছে। এক কথায় বাড়ীটি এতো সুরক্ষিত যে, একে একটা দূর্গ বলা চলে; ছাদের উপরও বাঙ্কারের অস্তিত্ব তারই প্রমাণ।
বাড়ীটি থেকে বেরুলেই সামনে নদী। খেয়াঘাটের উপর রাস্তার মুখে বাঙ্কার। দূর থেকে বুঝা যায় না ওখানে কোন শত্রু ঘাটি আছে কিনা। এর একটু পেরিয়েই কিছু বেড়ার ঘর, সেখানে রাজাকাররা থাকতো তাদের পরিবার নিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর, সাবরেজিস্ট্রার অফিস এ সমস্ত ঘরগুলোও একই কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে চাল, ডাল, মরিচ। কোন জায়গায় পড়ে আছে রান্না করা খাবার, খেয়ে নেবার সময়টুকুও পায়নি – পালাতে হয়েছে পাক সেনাদের পা চাটা পোষা কুকুরের মত।
বাজারের পশ্চিম অংশে বহু বাঙ্কার আর শেল্টার। দক্ষিণে ঈদগাহ মাঠটিও বিরাট বাংকারে পরিপূর্ণ। মসজিদের দক্ষিণ পাশে দু খানা বাঙ্কার জোড়া লাগানো; এক একটাতে গোটা পরিবার নিয়ে বাস করা যেতে পারে। বাজারের পর থানা। থানার পশ্চিম দিকে সুউচ্চ মাটির বাঁধ, বাঁধের আড়ালে বাঙ্কার। মাত্র কদিন পূর্বেই একটি দালান তৈরী হয়েছে দশ ইঞ্চি পুরু দেয়ালে; পশ্চিম দেয়ালটায় গুলি করার জন্যে ফোঁকরা রাখা হয়েছে। শুধু থানাটিকে ঘিরেই পশ্চিমে বড় বড় ১০ খানা, দক্ষিণে ৭ টা, পূর্বেও ১০ খানা ও উত্তরে ৪ টি বাঙ্কার। থানা এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে মাটির নিচে একটি ঘর। ঘরটিতে চেয়ার, টেবিল, তক্তপোষ সবই পাতা রয়েছে। শোনা গেল পাক হানাদারেরা ওখান থেকে ওয়ারলেসে খবর পাঠাত। একটা ব্যাপার খুব অবাক হবার মত – পালিয়ে যাবার পূর্ব মুহূর্তে ওরা প্রতিটি অফিসের কাগজগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। থানার অফিস কক্ষেও একই কান্ড, কাগজপত্র নষ্ট অবস্থায় ইতস্ততঃ ছড়ানো।
থানার পূর্ব পাশ দিয়ে হাইওয়ে। গোটা হাইওয়েটাই বাঙ্কার ও ট্রেন্সে একাকার। এসব দেখে স্বভাবতঃই মনে ভয় জাগে, নিরাপত্তার এতো সুন্দর বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও শত্রুরা পালিয়ে গেলো কেন? মেজর আফসারের কাছে এ প্রশ্নের জবাব মিললো। তিনি বলেন,এক মাস যাবৎ আমরা তাদের এমনভাবে অবরোধ করেছিলাম যে, তাদের খাদ্য, পানীয় এবং সকল রকম সরবরাহের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ওপর প্রচন্ড আক্রমনণ এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক – সামরিক পট পরিবর্তনের সামনে ওরা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
শত্রুর তৈরী একটা বাংকারে বসে বিষয়টি লেখা চলছিল। ভালুকা থানার রেভিনিউ সার্কেল অফিসার বললেন, পাক সেনারা ভালূকায় আসার দু দিন পর আমাকে জোর করে ধরে এখানে আনা হয়। এরপর এখানে যা দেখেছি তা প্রকাশ করতে সংকোচ করতে লাগে। চান মিয়ার সুযোগ্য পুত্র ধনু মিয়া এখানে না থাকলে এ – অঞ্চল এতোটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো না। ধনু ও তার সঙ্গীরা একদিন ১৯ জন নারীর ওপর পাশবিক উৎপীড়ন চালায়।
চান মিয়া যাকে লোকে একসময় সমীহ করে কর্তা বলতো, পাক জঙ্গী চক্রের সেই বিশ্বস্ত কর্তা আজ নেই। তার বিশাল বাড়ী সমস্ত কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ঐশ্বর্য আর আসবাবপত্র গড়ে উঠেছিলো বাড়ীটিতে, যে ঐশ্বর্যের পরতে পরতে মানুষের রক্ত, ভারী ভারী গদিজোড়া আসন, যাতে গা রাখিলে আবেশে চোখ আপনি বুজে আসে – আলমারী ভর্তি পোষাক – অগণিত ট্রাঙ্ক, সুটকেস – প্রতিটি কক্ষের একই সাজ। সবগুলো টেবিলের ওপর বিদেশী ম্যাগাজিন, অবসর বিনোদনের জন্যে বই, যেন সবাই একটুখানি বাইরে গেছে এক্ষুণী এসে পড়বে।
কিন্তু তারা আর আসবে না। মুক্তিবাহিনীর ক’জন বীর জোয়ান সদর্পে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে বাড়ীটাতে।
কিছু রাত হতেই শোনা গেল দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। একজন শাস্ত্রী মেজরের সামনে এসে স্যালুট জানিয়ে বলল, একদল রাজাকার এসেছে। জানা গেলো, ওরা ধীতপুরে সকালের দিকে আত্নসমর্পণ করেছে। মেজর তাদেরকে নিরস্ত্র করে আনতে বললেন। ৮০ টা রাইফেল, ১টা স্টেনগান, একখানা এল. এম. জি. সহ বিপুল পরিমাণ গোলারুবাদ পাওয়া গেলো ওদের কাছে। মেজর আফসারের কাছে অবশ্য এ ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। মাত্র ক’দিন আগে তিনি ‘জাগ্রত বাংলা’র প্রতিনিধির কাছে ব্যাক্ত করেছিলেন, আর তিন দিন পর আপনারা মুক্ত ভালুকায় বসে রিপোর্ট লিখবেন।
মেজর আফসারের এ – দূরদর্শিতাই তাঁর যথার্থ পরিচয়। তাঁর প্রতিটি কথার পিছনে থাকে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার পিছনে কর্মের একটা প্রয়াস। সামরিক পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ ভুলভ্রান্তি হয়তো তাঁর কখনও হয়েছে কিন্তু অদম্য নিষ্ঠা তাঁকে একের পর এক এনে দিয়েছে সাফল্যের বিজয় গৌরব। চারিত্রিক দৃঢ়তায় মেজর আফসারের প্রকৃত সৈনিকের ন্যায়ই অনাড়ম্বর।
.
.
সহুল আহমদ মুন্না
<৬,২২১,৩৭৩-৩৭৪>
শিরোনামঃ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মৈত্রী
সংবাপত্রঃ জাগ্রত বাংলা, ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মৈত্রী
সম্পাদকীয়
মনে হইতেছে, অনেক শব্দের যথাযথ অর্থ আমাদের জানা নাই। বিশেষ করিয়া বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর হইতেই যে শব্দের যে অর্থ হওয়া উচিত, কিংবা আমাদের যাহা জানা ছিল, তাহা বাস্তবের সাথে ঠিক মিলিতেছে না।
কথাটি আরও ব্যাখ্যা করিয়া বলার দরকার। বিশ্ব রাজনীতিতে বৃহৎ শক্তির বিশেষ ভূমিকা রহিয়াছে। ছোট বড় সব রাষ্ট্রেরই আইনগত অধিকার সমান হইলেও ক্ষমতা অনুযায়ী প্রভাব ইহাদের বেশী। ইহারা নিজেদের রাজনীতি তথা অর্থনীতিসমূহের একেকটি নাম দিয়াছে। কথা হইতেছিল ঐ সকল নাম লইয়া।
আমেরিকা দাবী করে তাহার নীতি শুদ্ধ গণতান্ত্রিক; চীন বলে যে সমাজতান্ত্রিক; এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বলা হয় সমাজতান্ত্রিক দেশ। যতদূর জানি গণতন্ত্র কথাটার তাৎপর্য রাজনৈতিক; সমাজতন্ত্র মূলতঃ অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি আদর্শ বিশেষ। গণতন্ত্রে মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারসমূহ – যেমন, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার – ইত্যাদি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সমাজতন্ত্র মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণ হইতে মুক্ত করে। প্রসঙ্গত বলা যায়, মানুষের দ্বারা মানুষের উপর যতরকম রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অবিচার ও উৎপীড়ন, তাহা একমাত্র অর্থনৈতিক শোষণের ভিত্তি ভূমির উপরই দন্ডায়মান। সেহেতু সত্যিকার সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্রও নিহিত থাকে।
আমেরিকায় সমাজতন্ত্র নাই। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমেরিকার চিরাচরিত যুদ্ধ ঘোষণার কথা কে না জানে। তথাপি মার্কিনী অপপ্রচারের বদৌলতে অনেকের একটা ধারণা জন্মিয়াছিল, হয়ত সেই দেশে গণতন্ত্র আছে কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার উলঙ্গ গণবিরোধী ভূমিকা দেখিয়া তাহারা নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তে আসিবে যে, হয় আমেরিকা মিথ্যাবাদী, নতুবা গণতন্ত্র ইহাকেই বলে। আমরা বলিতে চাই, শেষোক্ত অনুমানটি ভুল নহে। কারণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সহিত সংশ্লিষ্ট না থাকিলে ‘নির্ভেজাল’ গণতন্ত্রের ইহাই চেহারা।
গণচীনের ভিতরের খবর বাইরের পৃথিবী খুব কমই জানিতে পারে। পিকিং বেতারের যে সকল গালিগালাজ শোনা যায় এবং পিকিংয়ে প্রকাশিত যেইসব বিপ্লবী পুস্তকাদি পাওয়া যায়, তাহাতে অবশ্য না বুঝিয়া উপায় নাই যে, চীন একটি বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দেশ; শোষিত, অনুন্নত জাতি এবং সর্বহারার সংগ্রাম সর্বত্রই তাহার সমর্থন উন্মুক্ত। কিন্তু এইবার আমাদের একটু খটকা লাগিয়াছে এই জন্য যে, বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে চীন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলিয়া অভিহিত করিয়াছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বলিয়াছে দুষ্কৃতিকারী, তদপুরি ‘সম্প্রসারণবাদী’ ভারতকে দিয়াছে হুমকি।
চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় যতটা জানা যায় তাহাতে দেখি, ব্যাক্তিপূজাই চীনা নীতির বিশেষত্ব। ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইতে গিয়া লিও শাউচী’র ন্যায় অসংখ্য সৎ ও প্রবীণ কমিউনিস্ট মাও সে তুংয়ের নিজস্ব বাহিনী লাল রক্ষীদের হাতে লাঞ্চিত। লাল রক্ষীরা চীনের সবচেয়ে সুবিধাভোগী একটি দল। মাও ও তাহার চীনা সমাজতন্ত্রকে টিকাইয়া রাখিবার জন্য উহারা যে কোন কাজ করিতে পারে। মাওয়ের এই বাহিনী তাঁহার দুর্বলতারই পরিচায়ক। নিশ্চয়ই চীনা অর্থনীতিতে এমন কোন ত্রুটি রহিয়াছে যাহা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ হইতে কঠোর সমালোচনার যোগ্য; এবং এই সমালোচনাকে মাও সে তুং ভয় পান বলিয়াই সেইখানে গণতন্ত্র পর্যদুস্ত।
সুতরাং ইহাই প্রমাণ হয় যে, আমেরিকার সমাজতন্ত্রহীন গণতন্ত্র যেমন একটি ভাঁওতা। উভয় দেশের নীতিই প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদ। আজ গণচীন ও আমেরিকা যে বিশ্ব – রাজনীতিতে হাতে হাতে মিলাইয়াছে তহা নূতন হইলেও বিচিত্র কিছু নহে।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২২২,৩৭৫>
শিরোনামঃ জনসভা
সংবাদপত্রঃ জাগ্রত বাংলা (১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা)
তারিখঃ ১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
জনসভা
১০ই ডিসেম্বর। সদ্যমুক্ত গফরগাঁও যাওয়ার পথে দীশা গ্রামের জনসমাবেশে মেজর আফসার এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দান করেন। দীঘা স্কুলে বহুসংখ্যক রাজকার বন্দি অবস্থায় ছিল। মেজর আফসার সেখানে যেয়ে পৌছুতেই স্বতঃস্ফুর্ত জনতার ভীড় জমে যায়। স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এ সভাটিতে ‘জাগ্রত বাংলা’র সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি জনাব হাফিজউদ্দীনও বক্তৃতা করেন।
অতঃপর ঐ দিনই অপরাহ্নে গফরগাঁও কলেজ প্রাঙ্গণে মেজর আফসারকে বীরোচিত সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্যে জনাব আরফানের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাবেশে মেজর আফসার ও জনাব হাফিজউদ্দীন বক্তৃতা করেন।
মেজর আফসার দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন শেখকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমরা থামব না; প্রয়োজনবোধে পিন্ডি পর্যন্ত যেয়ে হলেও আমরা তাঁকে ছিনিয়ে আনব। জনাব হাফিজ স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্পূর্ণ ইতিহাস জনগনকে অবহিত করান। আফসার সম্পর্কে তিনি বলেন, মাত্র ১টি রাইফেল নিয়ে যাত্রা শুরু করে এক বিরাট বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে তিনি কালিয়াকৈর (ঢাকা) ও উত্তর ত্রিশাল পর্যন্ত রাণাঙ্গন পরিচালনার দূরুহ ক্ষমতা অর্জন করেছেন; এ রকম শত শত আফসারের সমষ্টিতেই সম্ভব হতে চলেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
১১ই ডিসেম্বর। ত্রিশাল থানা আওয়ামী লীগ সভাপতির সভাপতিত্বে ত্রিশাল ডাকবাংলো মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মজর আফসার।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২২৩,৩৭৬>
শিরোনামঃ জনমত
সংবাদপত্রঃ জাগ্রত বাংলা (১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা)
তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
জনমত
সেদিন আমাদের মুক্তিবাহীনির জনৈক উচ্চপদস্থ মুক্তিযোদ্ধা অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রুঢ়ভাবে ধমাকাচ্ছিলেন। যাঁকে ধমকনো হচ্ছিল তিনি নাকি সেন্ট্রির দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে পারেননি।
ঘটনা সামান্য। কিন্তু সামান্য ঘটনার সম্বন্ধেই জন্ম নেয় বৃহৎ ঘটনা। আজকের স্বাধীনতা সংগ্রাম এমনি সব সমন্বয় ঘটনার প্রতিবাদে বিদ্রোহ সংগ্রাম ব্যাপারটাও সামান্য কিছু ঘটনারই সমাবেশ-পোষ্টার বক্তৃতা একটা বুলেট, ছোট এ কথা না বোজার পিছনে ‘পজিশন’ ট্রিগার সামান্য চাপ-এ করেই সম্ভব। চলছে এক বিরাট পরিবর্তন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি। কাজেই সামান্য এবং সাধারণ ঘটনাগুলোকে উড়িয়ে দেয়াটা নির্বুদ্ধিতার পরিমাণ-পতন।
মুক্তিবাহিনীতে যে কোন সেনাবাহিনীর মতি যোগ্যতা অনুযায়ী পদ কিংবা পদবী থাকবে এইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ সেনাবাহিনীর চেয়ে মুক্তিবাহিনীর গঠন আলাদা। তরুণরা এখানে নেহায়েত চাকুরির জন্য আসেননি। তবু ইয়াহিয়ার সৈন্যর মত ভাড়ার সৈন্য নয়; তাদের অনুপ্রেরণার মূলে রয়েছে দেশাত্নবোধ।সুতরাং এখানে উচ্চপদস্থকে কর্কশ স্বরে ধমকাচ্ছে- এই যে একটা অগণতান্ত্রিক দৃশ্য, এটা একবারেই খাপ খায় না। বাংলাদেশের অর্থ পাকিস্তান থেকে আলাদা একখন্ড জমি নয়, পাকিস্তান আমলের কলুষিত ভাবধারা থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হবার জন্যই বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক আমলাসুলভ। আপনি হয়ত কারো সাথে প্র্যোজনীয় কাজে দেখা করতে চাইলেন-তিনি আপনাকে সহজেই দেখা দিতে পারেন, কিন্তু আপনাকে ‘প্রপার চ্যানেল’ নামের একটা বূহ্য পেরিয়ে আসতে হবে। মানুষে মানুষে এই যে কৃত্রিম দূরত্ব, একটা কনমতেই স্বাধীন দেশী রীতি হতে পারে না; সমাজতান্ত্রিক দেশের তো নয়ই।
ধরা যাক সেই সেন্ট্রিটা কর্তব্য পালনে ভুল করেছিল। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এতো স্বল্প সময়ের ফৌজে জীবনে ভুল না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক। সেইজন্য একজন বুদ্ধিমান যোদ্ধা তার সহযোদ্ধাকে ধমক দিয়ে অপ্রস্তুত করে দিবে না, কিংবা তাকে খুব চড়া গলায় শাসিয়ে দিয়ে মজা পেতে চাইবে না, বরং তার ত্রুটিগুলো ঠান্ডা মাথায় শুধরে দিতে প্র্যাস পাবে। যেমন, এদিকে এসো, তোমাকে দেখিয়ে দিই কী ক’রে সেন্ট্রি দিতে হয়। এই যে আমি রাইফেল নিয়ে সোজ়া হয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি ওদিক থেকে আসতে থাকা-হল্ট। ঠিক আছে? লোকটা একটু দূরে থাকতেই হল্ট বলবে। বেশী কাছে এসে গেচলে যদি ওর সাথে মারাত্নক অসুখ থাকে তবে কী দশাটা হবে নিশ্চয় বুঝতে পারছো। এইটেই সবচেয়ে সুন্দর ও কার্যকরী পন্থা; কারণ এরপর তার আর ভুল হতে পারে না। এবং যা ইছু সুন্দর তাই গণতান্ত্রিক।
মানুষের পারস্পারিক আচার-ব্যবহারের মধ্যে সামরিক অসামরিক ব’লে কিছু নেই। সেনা বিভাগ গোটা সমাজের একটা বিরাট অংশ। কৃষি, শিল্প, পরিবহন ইত্যাদি বিভাগ যেমন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাজের প্র্য়োজনীয়তা পূরণ করে সেনাবিভাগের বেলায়ও তাই। কিন্তু এটা অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ এজন্যেই যে, যখন কোন পশুশক্তির অবির্ভাব ঘটে, তখন তা বল প্রয়োগে বিচ্ছেদ করার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া পথ থাকে না। এবং হিক এজন্যই সৈনিককে হতে হয় সব রকম অসুন্দর ও অন্যায়বিরোধী মানুষ। সবচেয়ে গণতান্ত্রিক মানুষ।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২২৪,৩৭৭>
শিরোনামঃ বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম সৃষ্টির অপচেষ্টা প্রতিরোধ করুন
সংবাদপত্রঃ রণাঙ্গন*
তারিখঃ ৩০ অক্টোবর, ১৯৭১
[রণাঙ্গনঃ বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদক- মুস্তফা করিম কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত। প্রধান উপদেষ্টা মতিইয়র রহমান এম,এন,এ। প্রধান পৃষ্ঠপোষকঃ করিমউদ্দিন আহমেদ এম,পি,এ। ]
বাংলাদেশকে ভিয়রতনাম সৃষ্টির অপচেষ্টা প্রতিরোধ করুন (কে, জি মুস্তফা)
বাংলাদেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বে দ্রুতগতিতে রাজনীতির পট-পরিবর্তন হয়ে গেছে। কম্যুনিষ্ট, সমাজের ঘোড় শত্রু সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠির সঙ্গে আতাঁত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে দুই শত্রু সমাজ। একই সঙ্গে বসবাস করার রঙ্গীন স্বপ্ন দেখছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্টের সর্বাধিনায়ক নিক্সন চীন দেশ সফর করার যাবতীয় পরিকল্পনা প্রণনয়ন করার জন্য তার প্রতিনিধিকে চীনে পাঠিয়েছেন এবং অদূরভবিষ্যতে তিনি চীন সফর করে তাদের দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব স্থাপন করার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে স্পষ্ট আভাস পাওয়া গিয়াছে। এই মৈত্রী স্থাপন হলে হয়তো ভিয়েতনামের দীর্ঘদিনের অশান্তি অরিস্থিতির অবসান ঘটবে এবং সেখানে শান্তি বিরাজ করবে।
কিন্তু একদিকে একটি দেশে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে যেখানে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ের অন্য একটি দেশের বুকে নতুন করে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার যে অশুভ ইঙ্গিত প্রদান করা হচ্ছে তা পৃথিবীর যে কোন বিবেকস্মপন্ন ব্যক্তিকেই একবাক্যে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠা আবশ্যক।
বিশ্বে রাজনীতির অঙ্গনে-আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব একটি লক্ষণীয় বিষয়। কোটি কোটি ডলার খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র যে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ স্থাপন করে বিশ্বের রাজনীতিতে নাক গলিয়ে থাকেন তা তাদের ধূর্তপনারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। নিজের দেশের প্রস্তুতকৃত উদবৃত্ত সামরিক সাজ-সরঞ্জাম বিক্রি করার মানসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পৃথীবির বুকে সব সময় অশান্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থেকে কাজ চালিয়ে যায়। আর তাদেরই শিকারে পরিণিত হয় পৃথীবির নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের বুকের রক্তে এই হোলিখেলায় সামিল হয়।
অথচ বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন জাতিসমূহ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এই গর্হিত কাজের প্রতিবাদ না করে তাদেরই খপ্পরে পড়ে অযথা হয়্রানি ভোগ করে আসছেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ঘটনায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যে সাপ খেলায় মেতেছেন তার পরিণাম শুভ নয় তা প্রতিটি মানুষরই অনুধাবন করতে পারেন। বাংলাদেশের নীল আকাশে কালো মেঘের আবরণ ঢেকে এক অনিশ্চয়তা অতল গহবরে বাংলাদেশকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
অপর পক্ষে কতিপয় সমাজবাদের ধারক বাহক কম্যুনিষ্ট দেশ বাংলাদেশের ঘটনা কে নতুন চাল ঢেলে যাচ্ছেন। একদিকে ভিয়েতনামে যুদ্ধ থেমে যাবার শুভ ইঙ্গিত-অন্যদিকে বাংলাদেশে কতিপয় আন্তর্জাতিক দেশের অশুভ হস্তক্ষেপে নতুন ভিয়েত্নাম সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দল এই এই ডুগডুগি বাজনায় মেতে গিয়ে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে কম্যুনিষ্ট প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাই বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ধারা যাতে অন্যদিকে প্রবাহিত না হয় তার প্রতি গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের সর্বদা সজাগ থাকা প্রয়োজন। কোন প্রকারেই বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ভিয়েত্নাম সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। এই শপথই হতে হবে আজকের মুক্তিপাগল মানুষের প্রধান শপথ।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২২৫,৩৭৮>
শিরোনামঃ প্রশাসনিক কাজ শুরুর দ্বিতীয় পদক্ষেপ
সংবাদপত্রঃ রণাঙ্গন
তারিখঃ ৩০ অক্টোবর, ১৯৭১
বাংলাদেশের বিস্তির্ণ এলাকায়
প্রশাসনিক কাজ শুরুর ২য় পদক্ষেপ
.
বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাজ পুরাদমে চলছে। রংপুর জেলার পাটগ্রাম ও হাতিবান্দার বিস্তীর্ণ এলাকায় তার যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং সরকারী কর্মচারী নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় জনসাধারণ বাংলাদেশ সরকারের কর, খাজনা ইত্যাদি পারিশোধ করেছেন।
.
এই এলাকায় প্রশাসনিক কাজ চালুর দ্বিতীয় পদক্ষেপস্বরুপ সরকার ১ টি হাই স্কুল ও ১৩ টি অবৈত্নিক প্রাথমিক বিধ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শেখার জন্য স্কুলসমূহ খুলে নিয়মীত ক্লাশে যোগদান করে বলে খবর পাওয়া গেছে।
.
সত্বর এখানে কয়েকটি ডাকঘর প্রতিষ্টা করা হবে বলেও খবরে প্রকাশ।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২২৬,৩৭৯-৩৮০>
শিরোনামঃ সাক্ষীগোপাল মন্ত্রীদের প্রতি একটি খোলা চিঠি
সংবাদপত্রঃ রণাঙ্গন
তারিখঃ ৩০ অক্টোবর, ১৯৭১
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার
সাক্ষীগোপাল মন্ত্রীদের প্রতি একটি খোলা চিঠি
.
মহামান্য মন্ত্রী মহোদয়গণ।
আপনারা আমাদের রক্তমাখা ছালাম গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল প্রান্তরে গ্রাম্য-চাষিদের ঘরে পান্তাভাত খেয়ে আপনারা মানুষ হয়েছেন। জন্মের পর থেকে মাতৃভাষা বাংলার মাধমে লেখাপড়া শিক্ষা করেছেন। আপনাদের মাতা অথবা পিতা কেহই পশ্চিমা বেনীয়ারা ঔরষজাত নন। অথচ আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীতা করে গণহত্যার নায়ক জঙ্গী ইয়াহিয়া খানের উচ্ছিষ্ঠ অর্থের লোভে দালাল সেজে নিজেদের বিবেককে পশুর বিবেকে পরিণত করেছেন। কিন্তু আপনারা কি কখনো ভেবেছেন আপনাদের দিয়ে শুধু বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞেই সহায়তা করে নেওয়া হবে? ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মাটি থেকে যখন ইয়াহিয়া গোষ্ঠীকে পাততাড়ি গুটে নিয়ে সুদূর ১২শত মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে হিজরত করতে হবে তখন আপনারা বাঙ্গালী গাদ্দার বলে তাদের দয়া থেকে পরিত্যাক্ত হবেন। সেই সময় আওনারা কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করবেন? পৃথিবির কোন দেশই বাংলাদেশের গণহত্যার নায়কদের ভবিষ্যত কোন আশ্রয় দিবে না বলে ভবিষ্যতে বাণী দানকারী পন্ডিত ব্যাক্তিরা মতামত ব্যক্ত করেছেন।
.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশের সাত কোটি অধিবাসীর আন্দোলন। পাকিস্তান প্রতিষ্টার ২৪ বছর পাঞ্জাবী পুঁজিপতি গোষ্ঠীর শাসন-শোষণ অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এ আন্দোলন বাংলাদেশে বসবাসকারী কোন বাঙ্গালী অথবা অবাঙ্গালীব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। কিন্তু সে সত্বেও কতিপয় ব্যক্তি ধর্মের দোহাই দিয়ে পাঞ্জাবী গোষ্ঠীর যে দালালী করে আসছেন সে সম্পর্কে আমাদের মতামত হচ্ছে ধর্ম একটি মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ইচ্ছা করলে একটি মানুষ তার ধর্ম ত্যাগ করতে পারে কিন্তু ভাষা ত্যাগ করতে পারে না। তাই ধর্মের বড়ি দিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে।
.
অধিকৃত এলাকায় সাক্ষীগোপাল মন্ত্রীসভার শ্রমমন্ত্রী জনাব এ, এস,এম সুলায়মান সাহেব আপনি তো পেশাদার দালাল। আপনার দালালী করার অভ্যাস নতুন নয়, পুরাতন? আপনি তো ঢাকায় অধুনালুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানে একটী দালাল (বীমা) কোম্পানীর প্রধান ছিলেন। সে সময় থেকেই আপনি দালালী ব্যবসায় পাকা হয়ে উঠেছেন। অপরপক্ষে নিজেকে শ্রমিক দরদি বলে পরিচয় দিয়ে একজন শ্রমিক নেতা রূপে বড় বড় কলকারখানার মালিকদের ও পয়সায় আপনি শান শওকত গাড়ী-বাড়ী করে আরাম আয়াসেই বসবাস করতেন। কিসের দুঃখে আপনি ইয়াহিয়া খানের দালালীর খাতায় নতুন করে নাম লিখালেন?
.
বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত মরহুম নেতা শেরেবাংলা এ, কে ফজলুল হক সাহেবের নাম ভাঙ্গিয়ে নেতার গড়া কৃষক-শ্রমিক পার্টির সর্বেসর্বাও বলেছিলেন এক সময় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন পুরোভাগের নেতা বলে জাহির করার জন্য বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর সভায় উপস্থিত থেকে সোচ্চার কন্ঠে নিজেকে স্বাধীনতার অগ্রনায়ক বলে দাবী করেছিলেন। কিন্তু, কোথায় আপনার সেই মাতৃভূমির দরদ, আজ যখন লক্ষ লক্ষ কৃষক-শ্রমিক বেকার এবং নতঘাতক এহিয়ার হাত শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত তখন আপনি কি করে এহিয়ার সাক্ষীগোপাল মন্ত্রীসভার শ্রম মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করলেন?
.
তাই আপনাদের প্রতি আমাদের সৎ উপদেশ-আপনারা যদি নিজেকে এবং আপনাদের বংশধরদের কুখ্যাত গভর্ণর মনেম খাঁর ন্যায় নিশ্চিহ্ন করতে না চান তবে দালালীর পথ পরিহার করে স্বাধিনতার পথে এগিয়ে আসুন। অন্যথায় ইতিহাসের লিখন আপনাদের ক্ষমা করবে না।
.
“জয় বাংলা”। আমাদের খেদমতে-
“বাংলাদেশের ছিন্নমূল জনসাধারণ”
.
.
হিমু নিয়েল
<৬,২২৭,৩৮১-৩৮২>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা
তারিখঃ ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
[বাংলাদেশঃ সাপ্তাহিক। সম্পাদকঃ কীর্তি। মুদ্রণে তড়িৎ। সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। পত্রিকাটি শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের কোন স্থান হতে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত। সম্পাদকের নাম ছদ্ম এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে।]
মুক্তি পথের যাত্রী সশস্ত্র বাঙালী
//অত্যাচারের উদ্যত ধ্বজা রক্তে করিয়া স্নান
আমাদের পরে বৈরী সাধিতে হয়েছে অধিষ্ঠান ।
শুনিছ কি সবে কী ভীষণ রবে কাঁপে জল স্থল,
দন্তের ভরে গর্জন করে শত্রু সৈন্য দল ।
তারা যে আসিছে কেড়ে নিবে বলে তোমার সকল ধন,
গ্রাসিতে শস্যক্ষেত্র, নাশিতে পুত্র ও পরিজন ।
মোদের শোণিত হবে কি সিক্ত মোদের ক্ষেত্রতল ।//
.
রুদ্যলিলের বিখ্যাত সমর গীতি দিয়ে শুরু করলাম । এ গীতি আজ বাংলা মায়ের প্রতিটি নির্ভীক সৈনিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে । স্বাধীনতা প্রিয় ফরাজী জনগণ একদিন অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অত্যাচার আর জুলুম থেকে নিজেদের মুক্ত করেছিল । নৃপতি নিষ্পেষণ আর বর্বর শোষণ থেকে মুক্ত হওয়াই ছিল তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য । তারা মানব জাতির বন্ধু রূপে নিজেদের জীবন বাজী রেখে নৃশংস বর্বর সামন্তবাদী শোষণ আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে । আজ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তিপাগল জনগণের পথ প্রদর্শক ফরাসী দেশের রবিকর দীপ্ত দেশপ্রেমিকেরা । সেই একই ধারায় পাঞ্জাবী একচেটিয়া পুজিতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার মাটি আজ গর্জে উঠেছে । মহাবিদ্রোহের উদ্দীপনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলার জনগণের রক্ত, শিরায় শিরায় এসেছে অগ্নিশিখার শিহরণ । বাংলার জনগণ আজ মুক্তি চায়-পরাধীনতা আর বিজাতীয় শোষণের বিষাক্ত ছোবল থেকে নিজেদের মুক্তির দুর্বার অভিযানে উন্মত্ত । বাংলা আজ বিপন্ন, শত্রুর বিষাক্ত নখরে ক্ষতবিক্ষত । এ যুগে বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের পথের দিশারী বাংলা মায়ের নির্ভীক জনগণ আজ সশস্ত্র বিপ্লবে লিপ্ত । বিশ্বের সকল পরাধীন ও নিপীড়িত জতিগুলিকে বাংলার জনগণ আজ নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে । বিশ্বের জনগণের কাজে আমাদের এ বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত । বাংলার জনগণ বিশ্বজনগণের বন্ধু । এক জল্লাদ রক্তপিশাচ বর্বর ঔপনিবেশিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য বিশ্বের জঘন্যতম সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছে ।
.
সাম্রাজ্যবাদ আর ঔপনিবেশিক বাদের জারজ সন্তান পাকিস্তান দিশেহারা হয়ে তার ঘৃণ্য বর্বর দস্যু বাহিনীকে বাংলার নীরিহ নিরস্ত্র জনগণের উপর লেলিয়ে দিয়ে বাজীমাত করতে চেয়েছিল । কিন্তু বাংলার বিপ্লবী জনগণ ট্রাম্প করে নিজেদের সঠিক পথ বেছে নিয়েছে । এ রক্তপিছল পথের শেষ প্রান্তে আছে স্বপ্ন গড়ার সৌধ ।
.
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যত চেষ্টা করুক না কেন জনতার এ বিদ্রোহ আর স্তব্ধ করতে পারবে না । বিদ্রোহের অগ্নিশিখা আরো প্রজ্বলিত হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে । বাঙ্গালীর কণ্ঠে আজ মুক্তিমন্ত্র আর হৃদয়ে প্রতিরোধের দূর্জয় সাহস । বাংলার জনগণ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নির্ভীক সৈনিক বঙ্গবন্ধুর মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত । প্রতিরোধ দূর্গের নির্ভীক সৈনিক বাংলার মুক্তিবাহিনী তাদের কণ্ঠে আজ ধ্বনিত হচ্ছে-জন্মভুমির নির্মল প্রেম । ওগো চিরসম্বল । তোমার শত্রুনাশে উদ্যত এ বাহুতে দেহো বল ।
ওগো স্বাধীনতা ! প্রিয় স্বাধীনতা ! হও ত্বরা পরকাশ
আমাদের সাথে মিলিয়ে আপন শত্রু করহ নাশ ।
.
.
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,২২৮,৩৮৩>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
কেন আমি মুক্তিযোদ্ধা |
বাংলাদেশ ১ম বর্ষ ঃ ১ম সংখ্যা |
৩১ অক্টোবর ১৯৭১ |
কেন আমি মুক্তিযোদ্ধা
বরুন
এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আমার মানসচক্ষে ভেশে উঠে বাংলা মায়ের নির্যাতিত, নিপীড়িত নিস্পেষিত মলিন মুখানি। কেন আজ বঙ্গমাতার এই এ নিদারুন অবস্থা। কারা এর জন্য দায়ী? সুজলা সুফলা সোনার বাংলাকে শম্মানে পরিণত করছে কারা! গত তেইশ বছরের ইতিহাস বাংলার শুধু শাসন শোষন নির্যাতন বেয়নেট আর নপীড়নের ইতহাস। যখনি আমরা কোন ন্যায্য পাওনার দাবি তুলেছি, তখনি ওরা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে বুলেট আর বেয়নেট নিয়ে। কারাগারের লৌহকপাটের অন্তরালে চিরদিন ওরা আমাদের কন্ঠকে রোধ করতে চেয়েছে। তথাকথিত পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই ওদের এ হীনমন্য অভিলাষ চরিতার্থ করে এসেছ্ স্বাধীনতার নামে আমা যা পেয়েছি তা পরাধীনতারই চরম গ্লানী। বাংলাকে ওরা কখনো এতটুকু অনুকম্পার চোখে সহিত ভেবে দেখেনি। তথাকথিত পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থার সূচনাতেই আমাদের প্রানের চেয়ে অধিক প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ওরা আমাদের জাতীয় জীবনে চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ট আমরা বঙ্গভাষী দাবি জানালাম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে। ওরা তাতে কর্ণপাত করলোনা। শুরু হলো আমাদের দুর্বার সংগ্রাম। বজ্র শপথ নিয়ে আমরা ধ্বাণ তুললাম “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষাণ সবার মুখে একই কথা “ আমাদেরদাবি মানতে হবে”। ওরা নরখাদক পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর বুলেট আর বেয়নেট নিয়ে। (চলবে)
পরবর্তী সংখ্যা সংগৃহীত হয়নি বলে অসমাপ্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,২২৯,৩৮৪>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় সাম্প্রদায়িকতা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থী |
বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা |
০৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
সাম্প্রদায়িকতা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থী
বর্তমানে বাংলাদেশের যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে তা কোন শোষক শ্রেনী বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়। এ যুদ্ধ সাড়ে সাতকোটি নির্যাতিত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। পান্জাবী শোষকগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত একচেটিয়া পুঁজিতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক নিষ্পেশন থেকে এ যুদ্ধের জন্ম। এ যুদ্ধ বাংলার জনগণের যুদ্ধ অর্থ্যাৎ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। তাই এ যুদ্ধ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব বিস্তার করবে না বা করতে পারে না। কিন্তু দখলদার বাহিনীর সর্দার ইহাহিয়া যুদ্ধের শুরু থেকে ঘৃন্য এক রাজনৈতিক চক্রান্তের মাধ্যমে এ যুদ্ধকে একটি সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে বাংলার নিরিহ জনগণকে হত্যা করে চলেছে এবং সেই জন্য সাম্প্রদায়ীকতায় বিশ্বাসী এবং সাম্প্রদায়ীক শিক্ষা প্রচারণা দ্বারা প্রতারিত কিছুসংখ্যক মানুষ ইহাহিয়ার চক্রান্তের শিকার হয়ে এখনো সম্প্রদায়ের বিষ ছড়াচ্ছে। আমরা জানি সাম্প্রদায়ীকতায় এ জাতীয় মানুষের কোন লাভ হয়না। তবুও তারা গোপনে গোপনে এরূপ জঘন্য কাজ করে চলছে। যেমন আফিমের নেশায় মানুষের চিন্তাশক্তি থেকে শুরু করে সকল প্রকার শক্তিই স্তিমিত হয়ে আসে। তেম সাম্প্রদায়ীকতাবাদীরা কুশিক্ষা আর অসৎ প্রচারনার বশবর্তী হয়ে তাদের সত্যদর্শনের ক্ষমতা লুপ্ত হয়।যাক যা বলতে যাচ্ছিলাম, এ যুদ্ধে যখন সাম্প্রদায়ীকতার স্থান নেই তখন কোন একক সম্প্রদায় এরূপ মহান যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে পারেনা। এ যুদ্ধের ঝুঁকি আমাদের সকলের অর্থাৎ সমগ্র বাংলার জনগণের। তাই যারা হানাদারদের এই চক্রান্ত বুঝতে পারেননি, বাস্তব অবস্থা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করবেন এবং জনবিরোধী সাম্প্রদায়ীকতাবাদ পরিহার করবেন। কারন গত ২৪ বছর ধরে সাম্প্রদায়ীকতার দ্বারা বাংলার জনগণের কোন উপকার হয়নি। সাম্প্রদায়ীকতার দ্বারা কারা উপকৃত হয়েছে সে প্রশ্ন এখন থাক। আসল কথা হলো এই মুক্তিযুদ্ধে যে সমস্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে হানাদার বাহিনী পথে বসিয়েছে সেই সমস্ত ব্যক্তি বা পরিবারের দুঃখ কষ্ট আমাদের সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে। একটা সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার চলবে আর অন্য সম্প্রদায় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম সমবেদনা জানাবে সেটা এই জাতীয় যুদ্ধের পরিপন্থী এবং বাংলার জনগণের তা কাম্য নয়।
————–
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,২৩০,৩৮৫>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর বিরূদ্ধে আঘাত হানার দৃড় সংকণ্প |
বাংলাদেশ ১ম বর্ষ ঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা |
০৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর বিরূদ্ধে আঘাত হানার দৃড় সংকণ্প
মুজিবনগর, গত ৬ই এবং ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্তী তাজউদ্দীনের সভপতিত্বে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সভায় উপরোক্ত সংকল্পের কথা পুনরায় ঘোষনা করা হয়। বৈঠক জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করিয়া সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহন করা হয়।
কমিটি মনে করে যে, ইহাহিয়ার যুদ্ধবৎ প্রস্তুতি ও ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বাধানোর প্রকাশ্য পাঁয়তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন ও দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের ক্রমবর্ধমান সাফল্য হইতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোরই একটি কুমতলব। কমিটি শত্রুর স্পষ্টতঃ দৃশ্যমান দুর্বলতাসমূহের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ এবং শত্রুর পতন দৃততর করার উদ্দেশ্যে তাহার উপর ঐক্যবদ্ধ ও চরম আঘাত হানার জন্য সকল শ্রেনীর ও সম্প্রদায়ের মানুষ এবং সকল স্তরের মুক্তিসেনানীদের প্রতি আহবান জানাইতেছে।
কমিটি পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যকে দ্রুতবাস্তবায়িত করার সংকল্প পুনরায় ব্যক্ত করিতেছে এবং স্বাধীনতার কমে সমাধানের নিমিত্ত সকল বক্তব্য ও ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করিতেছি।
স্বাধীনতার জন্য যাহারা জীবন জীবন দিয়াছেন, তাহাদের ত্যাগ স্মরন করার সঙ্গে সঙ্গে কমিটি ঐসব নিহত বীরদের সহিত সংহতি ঘোষনা করিতেছে এবং সপথ গ্রহণ করিতেছে যে, যে কারনে তাঁহারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, উহার সঙ্গে কখনো বিশ্বাস ভঙ্গ করা হইবে না।
————
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,২৩১,৩৮৬>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
বিশ্ব মানচিত্রে নতুন চিত্র বাংলাদেশ |
বাংলাদেশ ১ম বর্ষ ঃ ৭ম সংখ্যা |
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
বিশ্ব মানচিত্রে নতুন চিত্র বাংলাদেশ
ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতি দান
আমাদের মহান বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের লোকসভায় গত ৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং বাংলাদেশ সরকারকে বৈধ বলে ঘোষনা করেছেন। ভারত সরকারে সময়োপযোগী এই স্বিদ্ধান্ত সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের এক বিজয় ঘোষিত হলো। শ্রীমতি গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ভারতের লোকসভায় বিশাল হর্ষধ্বনি ও করতালির মাধ্যমে মিসেস গান্ধীর এই ঐতিহাসিক ঘোষনাকে সংসদের অধিকাংস সদস্যবৃন্দ সমর্থন জানান। এই ঘোষনার পর সভার সদস্যগণ আনন্দের প্লাবনে এমনভাবে আত্মহারা হয়ে পড়েন যে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সবার কাজ স্থগিত হইয়া যায়। এরপর লোকসভার সদস্যবৃন্দ নয়াদীল্লিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধির সহিত করমর্দনের মাধ্যমে বাংলার জনগণ ও তার জনক শেখ মুজিবকে অভিনন্দন জানান। ভারতের এই দৃষ্টান্ত অনুসরন করে পৃথিবীর অন্যান্য স্বাধীনচেতা জাতিগুলি এগিয়ে আসছে ও আসবে। আর ভারতের এই দৃষ্টান্ত অনুসরন করলো ভুটান। ভূটানের মানবপ্রেমিক রাজা মিঃ জিগনে ওয়ানচুক বাংলাদেশের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং বাংলাদেশ সরকারকে বৈধ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
——————
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬,২৩২,৩৮৭-৩৯০>
শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় মুক্তিযোদ্ধারা হুঁশিয়ার |
স্বাধীন বাংলা ১ম বর্ষ ঃ ৩য় সংখ্যা |
০১ নভেম্বর ১৯৭১ |
[স্বাধীন বাংলাঃ কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের পাক্ষিক মূখপত্র। সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও মুদ্রিত ]
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আকাশে অশুভ কালো মেঘের ছায়া!
মুক্তিযোদ্ধারা হুঁশিয়ার!
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আজ এক বিশে ক্রান্তিলগ্নে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এই সংগ্রাম যাতে তাহার ইস্পিত লক্ষ্যে না পৌছাইতে পারে, তাহার জন্য দেশী –বিদেশী ষড়যন্ত্রের সীমা পরিসীমা নাই। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘমেয়াদী টরিত্রটি বিভিন্ন স্বার্থবাদী মহলের চক্ষুশূল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কারণ, লড়াইয়ের মেয়াদ যতই দীর্ঘ হইয়া উঠিতেছে, ততই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ নিজের পাঁয়ে দাঁড়াইয়া নিজের শক্তিকে সুসংহত করিয়া এবং নিজের শক্তিতে বলীয়ান হইয়াছে এই মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের তোরণশীর্ষে লইয়া যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করিতে পারিতেছে। আমরা গত সম্পাদকীয়তে এই কথা উল্লেখ করিয়াছিলাম যে বহু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সত্বেও বর্তমান সংগ্রামে জনযুদ্ধে বিপ্লবী উপাদানগুলি সঞ্চালিত হওয়ার বাস্তব ভিত্তি সৃষ্টি হইতেছ। বাংলাদেশে জনযুদ্ধের আসল চেহারা কি, তাহা আমাদের সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করিতে হইবে। জনযুদ্ধের বৈশিষ্ট হইতেছেঃ জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের সহেত একটি জাতীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ট অংশ মেহনতী মানুষের বিশেষ করিয়া কৃষকের শোষণ মুক্তির সংগ্রামকে যুক্ত করা। জনযুদ্ধে পরিণত কবার জন্য ইহা একান্তভাবেই প্রয়োজন, কারন তাহা না হইলে সোম্রাজ্যবাদ বিশেষ করিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রমবর্ধমান সাহায্যপুষ্ট, আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত একটি বিসাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রস্তুত, অসংগঠিত এবং প্রায় নিরস্ত্র জনতার অসম যুদ্ধ চলিতে পারেনা। বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ইহা নির্ভুলভাবে প্রমাণিত করিয়াছে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া শত্রুর শক্তিকে ক্রমান্বয়ে ক্ষয় করিয়া এবং জনতার শক্তিকে ক্রমবর্ধমান হারে সংহত ও বৃদ্ধি করিয়াই মুক্তিযুদ্ধ চুড়ান্ত সাফল্য লাভ করিতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধকে টিকাইয়া রাখার জন্যই প্রয়োজন শত্রুর দুর্বলতম স্থান বাংলাদেশের বিশাল বিস্তীর্ন গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র সংগামের ঘাঁটি স্থাপন করা। এই সশস্ত্র সংগামের ঘাঁট অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং তাহাতে মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর অবাধ সঞ্চারনে আত্মরক্ষা এবং হানাদার বাহিনীকে আক্রমন করার শক্তি সঞ্চয় এবং বৃদ্ধি করার জন্যই গ্রামের জনসমষ্টির বৃহত্তর অংশ কৃষকের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহা ছাড়া ইহা বলাই বাহুল্য যে, বাংলাদেশের মত একটি আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ যেখানে কৃষকেরা হইতেছে দেশের জনসমষ্টির শতকরা ৮৬ জন, সকলে মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী মুলত কৃষকদের লইয়াই গঠন করিতে হইবে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক সমাজ বর্তমান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করিতেছে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে এই সংগ্রামে অংশগ্রহন করিতেছে? নিশ্চয়ই এখনো নয়। প্রশ্ন হইতেছে জাতীয় স্বাধীনতার মধ্য দিয়া কৃষকের বুক হইতে জোতদার মহাজনের প্রত্যক্ষ শাষনের জগদ্দল পাথর যে সরিয়া যাইবে, এই কর্মসূচী স্বাধীনতার কর্মসূচীর সহিত যুক্ত না হইলে তাহারা কেন এই সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে ঝাঁপাইয়া পড়িবে? শুধুমাত্র নিছক স্বাধীনতার ফাঁকা আওয়াজের আবেদন কৃষক সমাজের মধ্যে কতটুকু রহিয়াছে? তাহারাতো গত ২৪ বছর ধরিয়া তথাকথিত ‘স্বাধীনতার’ বিষাক্ত আস্বাদ পাইয়াছে!
আর একটি কথা শুধু কর্মসূচি গ্রহন করিলেই চলিবেনা। শুধু এই কথা বলিলেই চলিবেনা যে ‘স্বাধীনতার’ পর তোমাদের জীবনে আমরা সুখ সম্পদের বন্যা বহাইয়া দিব। তাই আজ বাংলাদেশের বুক হইতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে উৎখাত করার সংগ্রাম একদিকে যেমন চলিবে আবার অন্যদিকে এই লড়াইকে জনযুদ্ধের মাধ্যমে সফল করিয়া তুলবার স্বার্থেই গ্রামাঞ্চলে জোতদার মহাজনের যে সমস্ত গরীব ও ভূমিহীন কৃষক বর্গাচাষ করে, তাহাদের ফসল পূর্বের তুলনায় বেশী দেওয়া মহাজনের নির্মম শোষন বন্ধ করা, জমির সিলিং নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া, জাতীয় শত্রুদের সম্পত্তি সমপুর্ন বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরন করা প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা একান্তভাবেই প্রয়োজন। তাহা হইলেই কৃষকের মধ্যে এক প্রচন্ড উৎসাহ ও উদ্দিপনা সৃষ্টি হইবে এবং তাহারা বাধভাঙ্গা শ্রোতের মত স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপইয়া পড়িবে।
তাই ইহা পরিষ্কার যে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করিয়া তুলিতে হইলে ইহাকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে পরিণত করা আবশ্যক, আবার অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালাইয়া যাইতে হইলে কৃষকের শোষণ মুক্তির কর্মসূচি গ্রহণ এবং তাহাকে কার্যকরী করার প্রক্রিয়া মুরু করার মাধ্যমে কৃষকের মধ্যে জাগরণের উত্তাল জোয়ার সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এই জন্যই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ এবং জনযুদ্ধ একটি অপরটির সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত।এই জন্যই আমরা এই কথা বলি, বর্তমান সংগাম যতই দীর্ঘমেয়াদী হইতেছে, ততই জনযুদ্ধের বিপ্লবী উপাদান ইহার মধ্যে ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারায় সঞ্চারিত হইয়া চলিতেছে।
এই কারনেই বাংলাদেশের বর্তমান লড়াইকে মাঝপথে থামাইয়া দিয়া একটি ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ গগনভেদী আওয়াজ উঠিয়াছে। ইহা অত্যন্ত সহজ কথা যে, বাংলাদেশের বর্তমান লড়াই দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া জনযুদ্ধে পরিণত হইলে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাকে’ প্রতিহত করার ক্ষমতা পাক হানাদার বাহিণী কেন, দুনিয়ার কোন শক্তিরই থাকবেনা। ভিয়েতনামই তাহার উজ্জলতম প্রমাণ। শুধু তাই নয়, জনযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা আসিবে, সে স্বাধীনতার চেহারাই হবে আলাদা। ইহা হবে কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত এবং জাতীয় দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেনী তথা সমগ্র জনতার স্বাধীনতা, যেখানে থাকিবে প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নূন্যতম নিশ্চয়তা। কিন্তু বোধগম্য কারনেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের পুরাতন ’প্রভু’ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যান্য কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাহা পছন্দ করিতে পারেনা।
সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের সংগামের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়াছে। কিন্তু ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাজতন্ত্র উত্তরন’ কিংবা একটি স্ফুলিঙ্গই বিশ্বযুদ্ধের দাবানল সৃষ্টি করিয়া দিতে পারে’- এই তত্বে বিশ্বাসী বলিয়া তাহারা স্বভাবিক ভাবেই আমাদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন প্রদান করা সত্বেও ইহাকে ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ পথে লইয়া যাইতে চায়। ভারতের জনগন ও সরকার আমাদের নৈতি ও বৈষয়িক সাহায্য প্রদান করিতেছে। কিন্তু ভারত সরকার প্রথম হইতেই এই প্রশ্ন তুলিয়া ধরিতেছে যে তাহারা এককোটি শরনার্থীর বোঝা আর কতদিন বহন করিবে? আর ইহাতো অনস্বীকার্য সত্য যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপর সম্পুর্ণ নির্ভরশীল হইয়া একটি দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলিতে পারেনা। তাই বিভিন্ন মহল হইতে বাংলাদেশ প্রশ্নটির একটি রাজনৈতিক সমাধানের বেপরোয়া চেষ্টা শুরু হইয়াছে। এখন প্রশ্ন হইতেছে কোন পথে এই ‘রাজনৈতিক সমাধান’ কার্যকরী করার প্রচেষ্টা চলিতেছে? শান্তিপূর্ণ পথে এই ‘রাজনৈতিক সমাধানে ‘ জন্য ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং মস্কোতে ব্যাপক সুক্ষ কুটনৈতিক তৎপরতা শুরু হইয়াছে। ইতিমধ্যে এই সমস্ত রাষ্ট্রের কুটনৈতিক প্রতিনিধিদের রাওয়ালপিন্ডি, দিল্লী ও মুজিবনগরে ব্যাপক আনাগোনা চলিয়াছে বলিয়া বিদেশী সংবাদপত্রগুলিতে খবর প্রকাশিত হইয়াছে। বলা বিাহুল্য ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ অর্থ হইতেছে পাকিস্তানর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ স্বায়ত্বশাষনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রশ্নটির ‘রাজনৈতিক সমাধান’। কিন্তু এই ধরনের ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ পথে বাধা হইতেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনতা, মুক্তিফৌজ ও গেরিলা বাহিনী, এই জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এই অভিমত প্রকাশ করিতেছেন যে বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিস্ট মহল পাক ভারত যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের একটি জোর প্রচেষ্টা শুরু করিয়াছে। এই সমস্ত রাজনৈতিক ভাষ্যকারের বিশ্ণেষন হইতেছে পাক ভারত যুদ্ধ সংঘঠিত হওয়ার সাথে সাথে এই সমস্ত স্বার্থ সংশ্লিস্ট মহল আন্তর্জাতিক সালিশীর নামে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে নাক গলাইবার সুযোগ পাইবে, তাসখন্দ চুক্তির অনুরূপ যুদ্ধবিতি চুক্তি সম্পাদন করাইতে পারিবে এবং পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে রাখিয়াই শিথিল কনফেডারেশনের ধুয়া তুলিয়া ‘রাজনৈতিক সমাধানের কুইনাইন’ গিলাইতে পারিবে। তাহা ছাড়া তখন এই কথা বলা যাইবে যে, ‘বাংলাদেশ ইস্যুটির মীমাংসার জন্য সকল রকম প্রচেষ্টা চালানো হইয়াছে, এমনকি শেষ পর্যন্ত পাক ভারত যুদ্ধও হইয়া গেল, তাই এখন রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া উপায়ই বা কি? এইভাবে বাংলাদেশের জনগনকে বিভ্রান্ত করা যাইবে বলিয়া এই সমস্ত স্বার্থবাদীরা মনে করে। অন্যদিকে একই কারনে পাকিস্তানের শাষকগোষ্টীর পক্ষেও এই ধরনের একটি যুদ্ধ বাধাইবার প্রচেষ্টা চালানো স্বাভাবিক। পাকিস্তানের শাষকগোষ্টীর ক্রমাগত উষ্কানীর মুখে এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে ভারতেরও এই ধরনের একটি যুদ্ধে জড়াইয়া পড়িবার আশংকা রহিয়াছে বলিয়া এইসব রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা মনে করেন। এই সমস্ত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত যাহাই হউকনা কেন এবং পাক ভারত যুদ্ধ হউক বা না হউক রাজণৈতিক সমাধানের যে জোর প্রচেষ্টা চলিয়াছে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই বলিয়া আমরা মনে করি। তাই আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আকাশে ঘণকালো মেঘের অশুভ ছায়া দেখা দিয়াছে। আগামি দুটি মাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অত্যন্ত জটিল ও কঠিন সময়। এই জন্যই বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা সকল, স্বাধীনতাকামী শক্তি. মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আজ হুঁশিয়ার হওয়া ঐতিহাসিক কারনেই মহান দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
আমরা তাই পুনরায় বাংলাদেশের সরকার ও আওয়ামীলীগসহ সকল সংগামী শক্তিকে নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ব্যাপক জনতার আশা আকাঙ্খার পরিপূরক একটি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানাই। আমরা সকল সংগামী শক্তি, মুক্তিফৌজ, বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর প্রতি পারস্পরিক সংযোগ ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিকে সুসংহত করার আকুল আবেদন জানাই। সকল বামপন্থী শক্তির প্রতিও আমরা সংগ্রামের মধ্যদিয়া চিন্তাধারা ও কাজের ঐক্যের ভিত্তিতে শ্রমিক শেনীর বিপ্লভী আদর্শে উদ্ধুদ্ধ একটি সুসংহত বিপ্লবী পার্টি গড়িয়া তোলার উদাত্ত আহবান জানাই। আমরা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি, সংগামকে প্রকৃত জনযুদ্ধে পরিণত করিয়া বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে শক্তি মূল উৎস করিয়া আত্মনির্ভরশীল হইতে পারিলেই একমাত্র দেশী বিদেশী এই ষড়যস্ত্র ব্যর্থ করা সম্ভব – ইহার বিকল্প কোন পথ নাই।
উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বাংলাদেশের সকল সংগ্রামী শক্তি, মুক্তিফৌজ, বামপন্থী প্রগতিশীল মহল ও বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর নিকট নিম্নোক্ত আশু করনীয় কর্তব্য উপস্থিত করিতেছি।
১। জনগণের পাশে যাইয়া দাঁড়ান
আর এক মূহুর্তও দেরী না করিয়া আমাদের শক্তির একমাত্র উৎস বাংলাদেশের জনগণের পাশে যাইয়া দাঁড়াইতে হইবে। ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ যে অশুভ তৎপরতা শুরু হইয়াছে, সে সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে। রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগঠনের উপর আমাদের বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে। জনতাকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে।
২। জাতীয় সংগ্রামের সহিত কৃষকের শোষণ মুক্তির সংগ্রাম যুক্ত করুন
গ্রামে গ্রামে জনতার বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি লইয়া সর্বদলীয় গণমুক্তি পরিষদ গঠন করিয়া নিম্নোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে এই সংগ্রামে কৃষককে প্রত্যক্ষভাবে নামাইতে হইবে। ক) জাতীয় শত্রুদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরন করিতে হইবে। খ) যে সকল জোতদার মহাজন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে রহিয়াছে তাহাদের প্রতি নমনীয় মনোভাব গ্রহন করিতে হইবে। কিন্তু সাথে সাথে এই সমস্ত জোতদারদের নিকট হইতে জাতীয় মুক্তির বৃহত্তর স্বার্থে কৃষকদের সুযোগ সুবিধা আদায় করিতে হইবেএই জন্য বর্গাচাষীরা পূর্বের তুলনায় ফসলের অংশ বেশী করিয়া যাহাতে পায় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। স্থান ও অবস্বথা বিশেষে এই সমস্ত জোতদারদের জমির সিলিংও নির্দিষ্ট করিয়া দিতে হইবে। মহাজনের চড়া হারে সুদ আদায় বন্ধ করিতে হইবে। মজুতদারদের প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্যশস্য গরিব সাধারনের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ক্ষেতমজুরদের মজুরী বৃদ্ধির ব্যবস্থা করিতে হইবে। যাহারা স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ফেলিয়া দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহাদের সম্পত্তি গণমুক্তি পরিষদের প্রত্যক্ষনিয়ন্ত্রনে আনিতে হইবে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ইহা কৃষকদের নিকট চাষাবাদের জন্য দিতে হইবে এবং এইভাবে গ্রামে টাউট বদমাইশদের হাত হইতে শরনার্থীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি রক্ষনাবেক্ষণ করিতে হইবে।
৩। নীচের দিক হইতে সংগ্রামী ঐক্য গড়িয়া তুলুন
সকল স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল, গণ ও শ্রেনীর সংগঠন, মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী তাহাদের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমকে সমন্বিত করুন এবং পরস্পরের মধ্যে অন্তরঙ্গ সংগ্রামী সম্পর্ক গড়িয়া তুলুন। মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী পরস্পরের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া শত্রুকে আঘাত করার ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করুন। মুক্তিফৌজকে অশ্রয়, খাদ্য ও রসদ দিয়া সাহায্য করুন। এইভাবে সংগ্রামের ময়দানে মুক্তিসংগ্রামের সকল শক্তি নীচের দিক হইতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করিয়া জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়িয়া তোলার দৃড় ভিত্তি প্রস্তুত করুন।
৪। পূর্ণ জাতীয় মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াইকে অব্যাহত রাখুন
যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের শাষকগোষ্টীর জল্লাদ হানাদার বাহিনীর দস্যু সৈন্য বাংলাদেশের মাটি হইতে উৎখাত না হইতেছে, যতদিন সম্পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম জনতার স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হইতেছে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধকে যে কোন মূল্যের বিনিময়ে অব্যাহত রাখার লৌহ কঠিন সপথ গ্রহন করুন এবং আপেষহীন সংগ্রামের আঘাতের পর আঘাতে মুক্তিযুদ্ধকে আরও দূর্বার করিয়া তুলুন্ কৃষক জনতাকে সশস্ত্র করুন, গ্রমাঞ্চলে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাদের ঘাঁটি প্রস্তুত করুন, গণযুদ্ধকে ক্রমান্বয়ে বিস্তীর্ন গ্রামাঞ্চলে এবং বিশাল জনতার মধ্যে ছড়াইয়া দিন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরো বেশী করিয়া লড়াইয়ের পশ্চাদভূমি (Rear Base) এবং রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্র স্থাপন করুন। হানাদার বাহিনী যে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটাইবে এবং সীমান্ত সংঘর্ষ যত বেশী আত্মস্থ (Absorbed) হইবে, তত বেশী করিয়া শত্রুকে পশ্চাতদিক হইতে আক্রমন করার সুযোগ সৃষ্টি হইবে- এই সুযোগের প্রতিটি অণু পরমাণুর সদ্ব্যবহার করুন।
৫। কৃষক জনতার মধ্য হইতে মুক্তিফৌজের সহায়ক শক্তি হিসাবে বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী গড়িয়া তুলুন
কৃষক জনতার মধ্য হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলা দল গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক ঘাঁটি এলাকাকে কেন্দ্র করিয়া বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী গড়িয়া তুলুন এবং গেরিলা যুদ্ধকে ধাপে ধাপে বিকশিত করুন। গেরিলা যুদ্ধের নীতি ও কৌশলকে লড়াইয়ের বর্তমান পর্যায়ে প্রধান নীতি ও কৌশল হিসাবে গ্রহন করুন। মুক্তিফৌজ ও বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী পরস্পরের পরিপূরক ও সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করার কার্যকরী পন্থা গ্রহন করুন।
.
.
কম্পাইলারঃ শফিকুল ইসলাম
<৬,২৩৩,৩৯১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
দেশবাসীরা সাবধান! -ভাসানী |
স্বাধীন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা |
১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
মীমাংসার জন্য ষড়যন্ত্র চলিতেছে
দেশবাসীরা সাবধানঃ ভাসানী
গত মাসে বাংলাদেশের অশীতিপার বৃদ্ধ মজলুম জননেতা মাওলনা ভাসানী বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধকে বানচাল করিবার জন্য দেশী-বিদেশী সকল আপোষ চক্রান্ত্রের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবার জন্য তাঁহার প্রিয় দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাইয়া যে বিবৃতি দিয়াছেন তাহার অংশবিশেষ আমরা গত সংখ্যা ‘স্বাধীন-বাংলায়’ প্রকাশ করিয়াছিলাম। নিম্নে মাওলানা সাহেবের বিবৃতির অবশিষ্টাংশ দেওয়া হইলঃ “বাংলাদেশের জনগণের লড়াইয়ের শক্তি যখন সংগঠিত এবং তাহারা যখন গৌরবজনক সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছেন তখন সেই জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে ব্যাহত করিবার জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের একটি অশুভ রাজনৈতিক চক্রান্ত শুরু হইয়াছে। এই চক্রান্ত সম্পর্কে আমর দেশবাসীকে সচেতন থাকিতে হইবে এবং সমস্ত শক্তি দিয়া ইহাকে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। কারণ আমরা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্য হইতে বিচ্যূত হইতে পারিনা। কয়েকটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক শক্তি বাংলাদেশ সংগ্রামের মীমাংসা ও বুঝাপড়ার যে চক্রান্ত করিতেছে তাহার মধ্য দিয়া আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তি আসিবে না। এত শহীদের রক্ত, মা-বোনের ইজ্জত ও ঘর-বাড়ী ছারখার হওয়া সবই বিফলে যাইবে। তাই পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের বাঁচিয়া থাকিবার জন্য সশস্ত্র লড়াই চালাইতে হইবে”।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,২৩৪,৩৯২-৩৯৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় অনিবার্য সমাধি |
দেশ বাংলা*[1] ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা |
৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
অনিবার্য সমাধি
ইয়াহিয়া খাঁ গভীর গাড্ডায় পড়েছেন। বলা বাহুল্য এই গাড্ডা তিনি নিজেই খুঁড়েছিলেন অবশ্য নিজের পাপ ঢাকার জন্য। বাংলাদেশের জনগণের রায়কে নস্যাৎ করতে হলে যে পাশবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাইতেই হয়, তার দায়দায়িত্ব প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চাপাবার জন্য ফাঁদ বানিয়েছিলেন। ভাবেছিলেন তাঁর সে ফাঁদে আটকা পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বাংলার স্বাধিকারকামী নেতৃত্ব। আর তিনি তাঁর লাঠিয়ালদের নিয়ে মনের সুখে রাজত্ব চালাবেন।
কিন্তু কথায় আছে অতি চালাকের গলায় দড়ি। ইয়াহিয়াও সম্ভবতঃ একটু বেশী চালাকী করতে গিয়েছিলেন। আর তাতেই পতন-স্বখাত সলিলে।
গত তেইশ বৎসর ধরে বাংলার মানুষকে সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত করে পাঞ্জাবের উদরপূর্তির যে প্রচেষ্টা হয়েছে তাতে বাধ সাধতে গেলেই এই ফাঁদ অতি সন্তর্পণে গুটিয়ে আনা হয়েছে। বাংলার মানুষ সরল বিশ্বাসে হাত মেলাতে গিয়ে সে ফাঁদে আটকা পড়েছে। একবার দু’বার নয় অসংখ্যবার। তথাকথিত পাকিস্তানের ইতিহাস ঘঁটাইলেই তা চোখে পড়বে।
ফাঁদ পাতা হয়েছিল ১৯৪৬-এর নির্বাচনে। বাংলার মানুষ জেনেছিল এ নির্বাচনে জয়ী হলে তারা স্বাধীন বাংলার মালিক হবে। মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের মর্মকথাও ছিল তা-ই। বাংলার মুসলমানরা অবিভক্ত ভারত চায়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলা চেয়েছিল। এর পেছনেও হয়তো বা বাংলাদেশে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাহির করার আকাঙ্ক্ষাই প্রবল ছিল। কিন্তু তা ছিল একান্তই স্বাভাবিক এবং প্রকৃতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা মাত্র। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ইস্যু ছিল দু’টি। সমগ্র উপমহাদেশের একটি মাত্র রাষ্ট্র হবে, না-কি একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হবে। কংগ্রেস ছিল একক জাতীয়তার ধারক, মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্বের। কিন্তু মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্বের ব্যাখ্যা বাংলার মুসলমানদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু এবং মুসলমানদের জন্য দু’টি পৃথক রাষ্ট্রে উপমহাদেশকে ‘ভাগ’ করার চিন্তা করেনি বাংলার মুসলমান। বাঙালী ফজলুল হকের মুসাবিদা করা ‘লাহোর প্রস্তাব’ই তার প্রামাণ্য দলিল। সোহরাওয়ার্দীর যুক্তবাংলা গড়ার শেষ চেষ্টাও তারই বহিঃপ্রকাশ।
বাংলার মুসলমান উপমহাদেশে একাধিক রাষ্ট্রের সমন্বয় চেয়েছিল। আর বঙ্গভঙ্গ বাঙালী হিন্দুর কাছে ছিল মাতৃহত্যার তুল্য। এ জন্যই কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব আজো বাংলার মানুষের কাছে পালিয়ে যাওয়া সোনার হরিন।
কিন্তু ’৪৬ সালের নির্বাচনের পর মুস্লীম লীগের নেতৃত্ব নির্বাচনী কর্মসূচী ভুলে গিয়ে নির্বাচনের ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের দিকে মন দিয়েছিল। সে নেতৃত্ব ছিল স্পষ্টতই অবাঙালী নেতৃত্ব। বাংলাকে ভাগ করে অথর্ব করে দিতে না পারলে অবাঙালী কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী করা যেতো না, করাচীতে বসে সঙ্খ্যালঘুরা সঙ্খ্যাগরিষ্ঠের উপর শাসন শোষন চালাতে পারতো না। ’৪৬-এ মুসলিম লীগকে জয়যুক্ত করে জিন্নার নেতৃত্ব দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিয়ে বাংলার আনুষ যে ফাঁদে পা দিয়েছিল তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বাধীন বাংলার কবর, ইউনিটারী পাকিস্তানের উদ্ভব। অবশ্য জিন্না এবং আর অবাঙালী নেতাদের বাঁচার আর কোন পথ ছিল না। ইউনিটারী পাকিস্তানে বাঙাল মারা কল বসাতে না পারলে তাঁদের সর্দারী কায়েম রাখা যেতো না কিছুতেই। সে ব্যাপারে তাদের হিসাব ছিল একেবারেই নির্ভুল।
এরপর এই তেইশ-চব্বিশ বছরে সেই একই খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শাসন্তন্ত্র ছাড়াই দেশ চলেছে দশ বছর। ‘দুই পরিষদে’র ভূত চাপাবার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে পৃথক নির্বাচন বহাল রাখার। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে ‘বাঙ্গাল’কে পাকিস্তানী বানাবার কোশেশ হয়েছে। সে অবশ্য ধোপে টেকেনি। কিন্তু ’৫৪ সালের নির্বাচনের পর বাংলার মানুষ আবার ফাঁদে পড়েছে। মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে জয়ী হবার অল্প দিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট ভাংগন ধরালো। আওয়ামী লীগ বের হয়ে এলো যুক্তফ্রন্ট থেকে। নৌকার মাঝি হক সাহেব মাল্লাবিহীন হয়ে সমুদ্রে ভাসলেন। মাল্লার একের হাত-পা অপরে ভাংলো ‘দাঁড়া-দাঁড়ি করে। মারীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে কোরান শরীফের পাতার মার্জিনে স্বাক্ষরিত হলো পাঁচদফা চুক্তি, পশ্চিমা নেতাদের সাথে।এক ইউনিট আর সাংখ্যাসাম্য মানলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর বিনিময়েপেলেন চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসা-বানিজ্য, উন্নয়ন, সর্বক্ষেত্রে দুই অংশের সমান সমান বখরা কায়েম করার এবং গণতান্ত্রিক শাসন্তন্ত্র চালু রাখার অঙ্গীকার। কিন্তু এটাও ছিল আরেকটি ফাঁদ। বাংলাদেশ পরিষদের অভ্যান্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালো, পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র দেশগুলি হারালো তাদের স্বকীয়তা। সোহরাওয়ার্দী উভয়ের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকলেন। কিন্তু বিনিময়ে পেলেন না কিছুই। পশ্চিম পাকিস্তানিরা চুক্তির আর সব ধারা বেমালুম চেপে গেল। কোরান শরীফের পাতায় লেখা ওয়াদাও তারা ভাংতে পারেন কারণ ধর্মটা শোষকের খোলস, বিশ্বাসের অঙ্গ নয়। এক বিশ্বাসঘাতকতারই চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল বাংলার অধিকার নিয়ে চাপ সৃষ্টির পর আকস্মিকভাবে পাঞ্জাবী চক্রের সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত সুচতুর ও সুদক্ষ রাজনীতিকও নাকি সেদিন অসহায় শিশুর মত বলে উঠেছিলেন, ‘আমি মানবতার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি’।
তারপর ’৫৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ফলাফল পূর্বাহ্নে আঁচ করে সামরিক শাসন জারী থেকে শুরু করে, ’৬২-র শাসন্তন্ত্র জারী, ’৬৫-র নির্বাচন, ’৬৯-এর গোলটেবিল বৈঠক ’৭০-এর নির্বাচন, একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি। প্রতিবারই বাংলার মানুষ নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। প্রতিবারই প্রতারিত হয়েছে।
’৬৯-র গোলটেবিল বৈঠকে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং পার্লামেন্টারী শাসনে প্রত্যাবর্তনের ঘোষনায় বিশ্বাস করেছে বাঙালী। সে বিশ্বাসের পরিণতি দ্বিতীয় দফা সামরিক শাসন, আয়ুবের গদীতে ইয়াহিয়ার অভিষেক। ’৭০-এর নির্বাচনের জন্য ইয়াহিয়া যখন ‘আইনগত কাঠামো আদেশ’ জারী করে, তখন বাংলাদেশের দু’একটি দল তাতে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর জনসমষ্টি তামেনে নেয়, ইয়াহিয়ার ‘সদিচ্ছায়’ বিশ্বাস স্থাপন করে। ইয়াহিয়া সে বিশ্বাসের মূল্য তার স্বনিয়মেই দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে।
কিন্তু কথা আছে, সাতদিন চোরের আর একদিন গৃহস্থের। এবার গৃহস্থের দিন এসেছে। ইয়াহিয়া এবং তার মুরব্বীদের সমস্ত হিসাব ভন্ডুল করে দিয়ে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিশোধের স্পৃহায়। ২৪ বছরের বিশ্বাসঘাতক তার জবাব সে আজ দেবেই। ইয়াহিয়ার প্রতিটি অস্ত্র ফিরে গিয়ে তার নিজের বুকে বিধছে। বাংলাকে এবং বাংলার মানুষকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য যে চোরাবালির ফাঁদ পাতা হয়েছিল, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক জান্তা তাতেই আটকা পড়েছে।
এ চোরাবালি থেকে তাদের নিস্তার অনিবার্য সমাধিতে।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,২৩৫,৩৯৪-৩৯৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
রাজনৈতিক সমঝোতা সোনার পাথরটি | দেশ বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা |
৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
রাজনৈতিক সমঝোতা সোনার পাথরটি
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
পর পর কয়েকটা আলোচনা শেষে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে, বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদদের বিবৃতিতে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে উদাসীন এমন অনেকগুলো দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের বিবৃতি ও সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কারো কারো মতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা হতে হবে। আবার কারো কারো মতে, ইদানিং সে মতটাই প্রাধান্য পাচ্ছে, ’৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিগণ আর বর্তমানের একনায়কত্ববাদী সামরিক জান্তার মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই সে রাজনৈতিক সমাধান পেতে হবে। এ ব্যাপারে ভারতের বক্তব্য স্পষ্ট। বাংলাদেশ সমস্যা ভারত পাকিস্তান থেকে উদ্ভুত নয়। কাজেই ভারতের এ ব্যাপারে আলোচনায় বসার প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে আলোচনা যদি হতেই হয় তা হতে পারে কেবল বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে ইয়াহিয়া চক্রের। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, রাজনৈতিক ‘সমাধান’টা কি হতে পারে তা কেউই উল্লেখ করছেন না। অর্থাৎ প্রস্তাবকদের মতে কোন রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই দু’পক্ষকে আলোচনায় বসতে হবে এবং সমাধানের সূত্র বের করতে হবে। অর্থাৎ ২৫শে মার্চের আগে ব্যর্থ দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় ফিরে যেতে হবে।
আমরা ধরে নিলাম রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা বসলেন। তখন তাঁদের সামনে আলোচ্যসূচী কি হতে পারে এবং দু’পক্ষের দেওয়া নেওয়ার সুযোগ কতটা বিদ্যমান রয়েছে তা ভেবে দেখা যাক।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী পর্যায়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যে সব জটিলতা দেখা দিয়েছিল এবং পরবর্তী ২৩ বৎসরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বারংবার যেভাবে বিপর্যয় এসেছে তার মূল কারণগুলি অনুসন্ধান করলে নিম্নলিখিত কয়েকটি সত্য পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়বে।
ক) পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫৬ জন, পশ্চিমাঞ্চলের শতকরা ৪৪ জন। স্বভাবতই এ দেশে নিয়মতান্ত্রিক পার্লামেন্টারী রাজনীতি চালু থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের প্রাধান্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে।
খ) সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষতঃ পাঞ্জাব, ঐতিহাসিক কারণে প্রশাসন, অর্থনিতি এবং দেশরক্ষা বিভাগে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধিকারী। দেশে নিয়মতান্ত্রিক পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা চালু হতে দিলে সংখ্যালঘিষ্টের একচেটিয়া কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হতে বাধ্য। এমতবস্থায় পাঞ্জাবী নেতৃত্বের পক্ষে সম্মিলিত পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হতে দেওয়া আত্মহত্যার সামিল।
গ) দুই অঞ্চলের জন্য ছয়দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন কায়েমরেখে কেন্দ্রের জন্য সমতার ভিত্তিতে ফেডারেল শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যে দাবী মুজিব ১৯৬৬ সালে পেশ করেছিলেন পশ্চিমা রাজনীতিকরা এখন পর্যন্ত তাকেই মেনে নিতে পারেন নি। এমতবস্থায় কনফেডারেশন গঠনের তাদের প্রস্তাব সম্মত হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। কারণ তাহলে তাঁদের স্বদেশে তাঁরা এতদিনের গোয়ার্তুমীর পরিণতির জন্য ধিকৃত হবেন এবং প্রত্যেকেরই সমাধি রচিত হবে।
ঘ) সম্মিলিত পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে এক ইউনিট বাতিল হয়ে চারটি প্রদেশ হয়েছে। এখন বাংলাদেশ যে অধিকার ভোগ করবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদেশগুলিও তাই ভাগ করবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিপরীতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ ধরনের একটি সম্মিলিত কাঠামো খাড়া না রাখলে কোন সমাধানই কার্যকর হবে না। কিন্তু তা হবে এক ইউনিট ব্যবস্থারই পুনঃপ্রবর্তন, যেটা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্রতর প্রদেশগুলি মানবে না। আর এক ইউনিট পুনর্বহাল করার অর্থ হবে প্যারিটিতে ফিরে যাবার পায়তাঁরা, বাংলাদেশের মানুষ বহু পূর্বেই যা ডাষ্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় যে কোনভাবেই হোক পাকিস্তানের প্রতি বাংলার মুসলমানদের পূর্ণ আনুগত্য আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। সে আনুগত্য এমনই ছিল যে সেদিনের বাঙালী মুসলমান ফজলুল হক সোহরাওয়ার্দীর মত নিজ দেশের নেতাদের দূরে হটিয়ে দিয়ে জিন্না-লিয়াকত আলীর পায়রবি করেছে। কিন্তু সেই আনুগত্যকে বশ্যতা হিসাবে ধরে নিয়ে পাঞ্জাবী রাজনীতি যেভাবে ২৪টি বছর দেশটাকে ব্যক্তি মালিকাধীন সম্পত্তির মত ব্যবহার করেছে তাতে করে পরিস্থিতির এখন আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ইতিমধ্যে পদ্মা-মেঘনা ও সিন্ধু নদীতে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। আর সম্ভবতঃ পাকিস্তান নামক দেশটির রাষ্ট্রীয় ভিত্তিও তাতেই ভেসে গেছে।
কিন্তু সে কথা বাদ দিলেও যেটা মৌল প্রশ্ন তা হচ্ছে এই-পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালীদের অবস্থান সম্ভব করে তোলার জন্য যে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং ‘বহাল রাখার নিশ্চয়তা’ প্রয়োজন, পাঞ্জাবী শাসকচক্র তাতে কোন অবস্থাতেই রাজী হতে পারে না। পাঞ্জাবীরা আপাততঃ যদি অবস্থার চাপে পড়ে, কোন প্রকার নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেও তবে তা বাঙালীদের নিকট বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কারন, পাঞ্জাবীচক্রের অতীত কার্যকলাপ এবং বর্তমানের মানসিকতা সন্ধেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, তারা কেব পরবর্তী সুযোগেরই অপেক্ষায় থাকবে। এবং নিজেদের সুবিধাজনক ষ্ট্রাটেজী কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে পা রাখার জায়গাটুকু নিতে পারলেই পুনরায় নগ্নরুপে ফিরে যেতে দ্বিধা করবে না।
কাজেই আন্তর্জাতিক চাপ যতই আসুক, পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান মিলবে না। দু’টি পরস্পরবিরোধী স্বার্থের এবং পরস্পর বিদ্বিষ্ট মনোভাবের ধারক অঞ্চলকে এক জোয়ালে বেধেঁ রাখার চেষ্টা করে লাভ নেই। এটা অবাস্তব এবং প্রকৃতির ধর্মের বিরোধী। বর্তমান যুগে রাষ্ট্রযন্ত্র হচ্ছে নির্দিষ্ট জনসমষ্টির সর্বাধিক কল্যাণের জন্য নির্মিত স্বেচ্ছামূলক সংগঠন। যে ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারনা, সামাজিক চেতনা ও সংস্কৃতিক উত্তরাধিকার অপর অঞ্চলের চাইতে সম্পূর্ণ পৃথক, যে ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তির উন্মেষ অপর অঞ্চলের উপর বেনিয়া শোষনের পথ প্রশস্ত করে, যে ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশ অঞ্চল বিশেষের প্রাধান্য অনিবার্য করে তোলে, সে ক্ষেত্রে একই রাষ্ট্রীয়তা অবৈজ্ঞানিক। শ্যামদেশের সেই যমজ ভ্রাতৃদ্বয়ের মত একের পিঠের সাথে অপরের সংযুক্ত অবস্থা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
কাজেই অপারেশনের কাজ যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই মঙ্গল।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,২৩৬,৩৯৬>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় সাড়ে সাত কোটি হোসেন আলী |
দেশ বাংলা ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা |
১১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
সাড়ে সাত কোটি হোসেন আলী
নয়া দিল্লীর পাকিস্তানী দূতাবাসটি এখন বাঙালীশূন্য। না, অন্ততঃ একজন বাঙালী এখনো সেখানে আছেন। তিনি জনাব হোসেন আলী, হাই কমিশনারের একান্ত সচিব।
রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহে দিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশন ভবনের কোন একটি চোরা কুঠুরীতে তিনি অসহ্য উৎপীড়নের শিকার হয়ে রয়েছেন। দিল্লীর ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। অবুঝ ছেলে দুটি পিতার মুক্তির জন্য ধরনা দিতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। অসহায় সহকর্মীরা চুটোছুটি করছেন। কিন্তু কুটনীতির কূট প্রভুরা নীরব নইথর। আইনের দৃষ্টিতে তিনি পাকিস্তানের ‘নাগরিক’,যে নাগরিকত্ব তিনি ঘৃনাভরে ছুড়ে ফেলেছেন তাঁর আর আর সহকর্মীদের সাথে। কিন্তু তথাকথিত সভ্য জগতের আন্ত্ররজাতিক আইনের কীটদষ্ট পুস্তকের ভাষ্য তাঁরনুকুলে নয়। সাড়ে সাত কোটি স্বজাতির সাথে একাত্ম হয়ে যে পৃথক জাতীয় সত্তার গৌরব মাথা তুলে দাড়াঁতে চেয়েছেন তিনি, তার স্বীকৃতি মেলেনি সভ্যতার মুরব্বীদের কাছে। অতএব পাকিস্তানী বন্দীশালায় নিষ্ঠুরতম মৃত্যুকেও যদি বরণ করতে হয় তাঁকে, কুটনীতির ঠান্ডা মস্তিস্কের কসাইদের কাছে তার বুঝি কোন প্রতিকারই পাওয়া যাবে না।
জনাব হোসেন আলীর অপরাধ তিনি তাঁর লক্ষ লক্ষ স্বদেশবাসীর দুঃখ যন্ত্রনার দিকে চোখ বুঁজে থাকতে পারেন নি। নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী দূতাবাসটির অভ্যান্তরে দিনের পর দিন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হতে দেখে স্থির থাকতে পারেননি। চাকুরীর মায়া ত্যাগ করে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যত্মাথায় করে সর্বস্বান্ত স্বদেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়াতে চেয়েছেন।
নয়া দিল্লির দুতাবাসে তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সমাসীন। পাকিস্তানী জঙ্গি চক্রের ষড়যন্ত্রের গোপন তথ্যাবলী তাঁর জানা থাকার কথা। সম্ভাবতঃ সেই কারণেই ইয়াহিয়া চক্র ক্ষেপা কুকুরের মত তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কিন্তু ইয়াহিয়া চক্রের জিন্দাখানায় হোসেন আলী একা নন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ পাকিস্তান নামক বন্দীশালায় এমনিভাবে অত্যাচারের অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। তাঁদের সবার পিঠেই আঘাতের চিহ্ন, সবার বুকেই বিক্ষোভের আগুন, সবার চোখেই ঘৃনার বিচ্ছুরণ। তাদেরও অপরাধ তারা ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের নাগরিকত্বে পদাঘাত হেনে নয়া নাগরিকত্বের সদস্য ঘোষনায় কন্ঠ দিয়েছে।
দুনিয়ার মানুষ জেনে রাখুক, সাড়ে সাত কোটি হোসেন আলী প্রিয়তম স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য এই মৃত্যুযন্ত্রনাকে বরণ করেই নিয়েছে। এই যন্ত্রণার এই নিপীড়নের আগুনে পুড়েই সোনার বাংলা ‘সোনার চেয়েও খাটি’ হয়ে উঠেছে। অত্যাচারেই বাংলার উন্মেষ। অত্যাচারই বাঙালীর ঐক্যের ভিত। অতএব, মাভৈঃ হোসেন আলীর মুক্তির আর বিলম্ব নেই!
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন জন ?
|
দেশ বাংলা ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর , ১৯৭১ |
.
.
শাহজালাল
<৬,২৩৭,৩৯৭-৩৯৮>
সম্পাদকীয়
হিন্দু না ওরা মুসলিম
জিজ্ঞাসে কোন জন ?
পশ্চিম পাঞ্জাবী দস্যুবৃত্তির শিকার হয়ে বাংলাদেশ থেকে যারা ( চন্দ্রবিন্দু) ভারতে চলে গিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু, এই ধুয়া তুলে জনৈক পশ্চিমা সাংবাদিক দিল্লীতে মিসেস গান্ধীকে প্রস্তাব দিয়েছেন, এদের সবাইকে ভারতের নাগরিক করে নিলে কেমন হয় ?
প্রস্তাবটি ওই সাংবাদিকের নিজস্ব হলে ক্ষতি ছিল না। শোনা যায়, মহল বিশেষ থেকে পরিকল্পিতভাবে এই “ফিলার” পরিবেশন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের নব্বই লক্ষ মানুষ গৃহহারা, সর্বহারা হয়ে প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেছে। তাঁদের অপরাধ তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকতে চায়নি। তাদের অপরাধ তারা তাঁদের স্বদেশের মাটিতে বিদেশী বেনিয়া প্রভুত্ব মেনে নিতে পারেনি। সেই অপরাধের খেসারত দিতেই তাদের আজ স্বদেশ স্বজন থেকে দূরে অপরিসীম দুঃখ- দুর্দশাকে বরণ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু দূর-দুরান্তে বসে যারা চিরকাল এই উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিন খেলছে, তারা কি এই পরিস্থিতিতেও নতুন করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের স্বপ্ন দেখছে ? বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে বিদেশী বানিয়ে, তথাকথিত পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে চিরদিনের মত ভারত- পাকিস্তান সংঘাত জিইয়ে রাখার নতুনতর ফন্দি আঁটা হচ্ছে কি ?
শরণার্থীরা বেশীর ভাগ হিন্দু। বিভেদকামী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ( এখানে সামাজ্যবাদ) সঠিক জায়গাতেই ঘা দিয়েছে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিৎ আজকের বাংলাদেশ ১৯৪৬-এর বাংলাদেশ নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মুক্ত বাঙালী জাতীয়তার মূর্ত পীঠস্থান এই বাংলাদেশ। বাংলার মুসলমান, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার আদিবাসী তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবে সন্দেহ নেই, কিন্তু জাতীয়তা এবং রাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নে তাদের একমাত্র পরিচয় তারা বাঙালী, বাংলাদেশের নাগরিক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রমাণ করে দিয়েছে ধর্ম জাতীয়তার একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না, ভাষা- সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক একাত্মতাই জাতীয়তার মৌল ভিত্তি। এই নবলব্ধ অভিজ্ঞতা কেবল এই উপমহাদেশের জন্য নয়, গোটা পৃথিবীর জন্যই এক অভিনব শিক্ষা। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপন ইচ্ছায় আপন শক্তিতে শক্তিমান হয়ে স্বাধীনতার পতাকা উর্ধেব তুলে ধরেছে। আজও গোটা পৃথিবীর তাবৎ বৃহৎ শক্তির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা শত্রুর সাথে অসমযুদ্ধে পাঞ্জা লড়ছে। এ যুদ্ধে তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেই কি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন নতুন ফন্দি আবিষ্কারের চেষ্টায় মেতেছে ?
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, শরণার্থীদের সকলকেই স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। শরণার্থীরাও দ্যার্থহীন ভাষায় বলেছেন, তাঁদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ভারতে তাঁদের অবস্থান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনেই। অধিকৃত বাংলা থেকে হানাদার সৈন্যরা বিতাড়িত হলে দেশে ফিরে যেতে তাঁদের এতটুকুও বিলম্ব হবে না। মনে রাখতে হবে, বাঙালী শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেবার অধিকার ভারতেরও নেই । তারা হিন্দু, না মুসলিম, সে প্রশ্নের সমাধি রচিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। এ প্রশ্ন নতুন করে যারা তুলতে চাইবে, তাঁদের “লাল মুখ” কারো করে দেবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ইস্পাত ঐক্য। অতএব, সাধু সাবধান !
.
শাহজালাল
<৬,২৩৮,৩৯৯-৪০১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র চাই কি ? |
দেশবাংলা ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর , ১৯৭১ |
বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র চাই কি?
আওয়ামী লীগেকে মন স্থির করতে হবে
(দেশবাংলা বিশেষ নিবন্ধ)
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং অধিকৃত বাংলার পরিসর সংকুচিত হয়ে আসছে। মুক্তিবাহিনীর শক্তিও সুসংহত হয়ে উঠছে। এক কথায় স্বাধীনতার চরম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছে।
এই ক্রান্তিলগ্নে দেশের রাজনীতিক ক্ষেত্রেও আসছে বিপুল পরিবর্তন। দক্ষিণপন্থী দলগুলি ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ছে। বামপন্থী ও আধাবামপন্থী দল-উপদলগুলিতেও পোলারাইজেশন শুরু হয়েছে নতুনভাবে।
বিগত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে এখন দল না বলে “প্লাটফর্ম” বলাই ভালো। মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগে এখন বামপন্থী “প্রায়-নক্সাল” চিন্তাধারা থেকে শুরু করে বুর্জোয়া উদার নৈতিকতাবাদ পর্যন্ত সব রকমের চিন্তাধারা পাশাপাশি কাজ করছে। বিভাগ পূর্বকালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের এই অবস্থার তুলনা হতে পারে।
স্বভাবতঃ বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগ এবং তার অনুগামীদের প্রাধান্য থাকবে। ন্যায়সংগতভাবেই আজ তাই প্রশ্ন উঠতে পারে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ দেশকে কোন পথে চালাবে ?
অনেকে বলে থাকেন, আগে স্বাধীনতা আসুক, তারপর সে সব কথা চিন্তা করা যাবে। বিভাগ পূর্বকালে মুসলিম লীগ এ ধরনের কথাই বলতো। প্রকৃত সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের নাকের ডগায় মুলা বেঁধে এগিয়ে নেবার অভিসন্ধি চাড়া এটা আর কিছুই নয়।
বস্তুতঃ যারা (চন্দ্রবিন্দু হবে) আজ স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে তাঁদের সবার সামনেই স্বাধীনতা পরবর্তীকালের একটি সুনির্দিষ্ট চিত্র থাকা অত্যাবশ্যক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে তথাকথিত “স্বাধীনতা” অর্জিত হয়েছিল, গত ২৪ বৎসর তার বিষময় ফল ভোগ করার পর পুনরায় কোণ অজানার পথা পা বাড়ানো বাঙালী জাতির জন্য নির্বুদ্ধিতারই নামান্তর হবে।
সংগ্রামের গতি প্রবাহ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকে এমন এক স্তরে এনে দিয়েছে যখন সংগ্রামকে সঠিক খাতে পরিচালনার খাতিরেই আজ কতগুলি বিষয়ে মনস্থির করার প্রয়োজন জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেই আজ এসব প্রশ্নের মোকাবিলায় বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসতে হবে। দেশবাসীর সামনে সুস্পষ্ট ভাষায় তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরে তদনুযায়ী সর্বশ্রেণীর মানুষের মানসিক প্রস্তুতির জন্য কাজ করে যেতে হবে।
আওয়ামী লীগকে প্রথমেই স্থির করতে হবে স্বাধীনতা বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী রাজনীতি চালু থাকবে কি-না, না-কি সেখানে তাঁরা একদলীয় শাসন চালু করবেন।
বাংলাদেশের মানুষ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এবং বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতার রদবদল আনতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনচক্র এই শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পথ আগলে দাঁড়ায় এবং নজিরবিহীন নৃশংসতার মাধ্যমে নির্বাচনের রায় বানচাল করতে প্রয়াসী হয়। অতঃপর বাংলার ছাত্র- তরুণ ও স্বাধিকারকামী জনতা অস্ত্র ধরেছে এবং সশস্ত্র সংরামের পথে পা’ বাড়িয়েছে একান্ত বাধ্য হয়ে।
এ থেকে অনেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়মতান্ত্রিক পার্লামেন্টারী রাজনীতির ব্যর্থতার প্রামাণ্য উদাহরণ এবং এ থেকেই প্রমাণিত ( এখানে প্রামাণিত) হয় যে “সশস্ত্র” বিপ্লব ছাড়া জাতীয় মুক্তি অসম্ভব।
আওয়ামী লীগের তরুণদের একাংশ সংগ্রামের যৌক্তিকতা প্রচার করেছিলেন পূর্ব থেকেই। এবার তাঁরা হাতে- কলমে তা’ প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছেন। অতঃপর পার্লামেন্টারী রাজনীতির “বিলাসিতা” চিরদিনের জন্য দেশ থেকে দূর করার কথা তাঁরা চিন্তা করছেন কিনা আমাদের জানা নেই।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বর্তমান সংগ্রামকে তাঁদের নির্বাচনের বিজয়েরই চূড়ান্ত পরিণতি মনে করেছেন। তাঁদের মতে বর্তমান সংগ্রাম সশস্ত্র হলেও তা প্রকৃত প্রস্তাবে নিয়মতান্ত্রিক। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সংগ্রাম চলছে। কাজেই এ সংগ্রাম অন্যান্য দেশের সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং একে কোন অবস্থাতেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান বলা যেতে পারে না। তাঁরা মনে করেন, ইয়াহিয়া নিয়মতান্ত্রিকতার পথ থেকে সরে গিয়ে যে অনিয়মের পথ বেছে নিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সেই অনিয়মকে উৎখাত করে নিয়মতান্ত্রিকতাকেই পুনর্বহাল করতে চান। শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে তাঁরা গণপরিষদের অধিবেশন ডাকতে মুহুর্তও বিলম্ব করবেন না এবং যথারীতি পার্লামেন্টারী রাজনীতি কায়েম করবেন, এ কথা তাঁরা বলছেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এ ধরনের বক্তব্য যদি দলের স্থির সিদ্ধান্তের পরিচায়ক হয়ে থাকে তবে কার্যক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটা দরকার বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল সন্দেহ নাই । বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় পার্লামেন্টারী রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ হয় এবং আস্থা দুই-ই বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহে গনমনে বিভ্রান্তি এসেছে। সে বিভ্রান্তি এখন বাড়ছে বই কমছে না।
পাকিস্তানে কোনকালেই পার্লামেন্টারী রাজনীতি পরীক্ষিত হয়নি। শুরু থেকেই কায়েমী সার্থ ( বানান) এবং সামরিক বাহিনীর অন্যায় প্রভুত্ব দেশে পার্লামেন্টারী রাজনীতির বিকাশ স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে নস্যাৎ করে দেওয়া, ১৯৫৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ভয়ে সামরিক শাসন জারী, আয়ুবের “মৌলিক গণতন্ত্র” এবং সর্বশেষ ইয়াহিয়ার ডিগবাজী সেই অন্যায় প্রভুত্ব কায়েম রাখার অপকৌশলেরই বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ ।
স্বাধীন বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম বারের মত সেখানে গণতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হবে। বলা বাহুল্য এট একান্তভাবেই এখন আওয়ামী লীগের উপরে নির্ভরশীল। সেজন্যে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই কয়েকটি ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
(১) দলীয় পরিধিতে নিয়মতান্ত্রিকতা কায়েম করতে হবে এবং সংগ্রামের সর্বস্তরে নিয়মতান্ত্রিক গণপ্রতিনিধিত্বকে ঊর্ধেব তুলে রাখতে হবে। বিগত নির্বাচনে যারা ( চন্দ্রবিন্দু হবে) নির্বাচিত হয়েছেন , সরকার গঠন এবং সরকার পরিচালনায় তাঁদের সম্মিলিত ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং বর্তমান জরুরী অবস্থাতেও পার্লামেন্টের সুপ্রিমেসীর নিশ্চয়তা বহাল রাখতে হবে।
(২) মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মনেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি তথা, পার্লামেন্টের প্রতি আনুগত্য গড়ে তুলতে হবে এবং ভবিষ্যতে দেশের বেসামরিক নাগরিকদের অস্ত্র সমর্পণের কথা মনে রেখে তদনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে।
(৩) বিরোধী দলের অস্তিত্ব মেনে নিতে হবে। বিশেষ করে যে সব দল ভবিষ্যত পার্লামেন্টের সুপ্রিমেসী মেনে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ নেবে সে সব দলকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত বিরোধী দল পার্লামেন্টারী রাজনীতির সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই ভবিষ্যতে পার্লামেন্টারী রাজনীতি কায়েমের অভিলাষী হয়ে থাকে তবে এ ধরনের বিরোধী দল গড়ে ওঠার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করা তো চলবেই না, বরঞ্চ সরকারী ভাবে আনুকূল্য দেখাতে হবে।
(৪) মুক্তিবাহিনীকে একক কমান্ডে সংগঠিত রাখতে হবে এবং সামরিক বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে, যাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব বাংলাদেশে “পাকিস্তানী রাজনীতি”র পুনরাবৃত্তি না ঘটতে পারে।
(৫) এডমিনষ্ট্রেসশনকেও দলনিরপেক্ষ ভাবে গড়ে তুলতে হবে। এমনকি রাজনৈতিক মতাবলম্বী ব্যক্তিদেরও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন দলনিরপরেক্ষ থাকার অভ্যাস “করাতে” হবে।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে এ সব পদক্ষেপ আওয়ামী লীগের জন্য “ত্যাগ” স্বীকার । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, পরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং কর্মী বাহিনীর “নিজেদের প্রয়োজনেই” এ ব্যাপারে তাঁদের উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, কেবলমাত্র পার্লামেন্টারী সুপ্রেমেসী বহয়াল রেখে বিগত নির্বাচনের রায় কার্যকরী করার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের হাতে আগামী দিনের বাংলাদেশের কর্তৃত্ব আসতে পারে। অন্যথা মাঝপথে নৌকার গতি পরিবর্তন এবং হাত বদলের সম্ভাবনাই যে বেশী , পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে তাকিয়ে তা বিনা দ্বিধায় বলা যায়।
যারা (চন্দ্রবিন্দু প্লিজ) পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন, এতে অবশ্য তাঁদেরও হতাশ হবার কিছু নেই। আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগের পথেই রাজনীতি করতে হবে অন্যদের নিজ নিজ পথে। ইতিহাস আপন নিয়মেই তার পথ করে নেবে, সে ভবিষ্যতবাণী এখনই করা যাবে না।
তবে আমাদের প্রতিবেশী ভারতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি রাজনীতির স্বীকৃত মাধ্যম। সেক্ষেত্রে ভারত সরকারও সম্ভবতঃ চাইবেন না তাঁদের বাড়ীর পাশে একটি সামরিক একনায়কত্ব বা ফ্যাসিবাদী একদলীয় শাসন খাড়া হোক। কারণ ভারতের রাজনীতিতে, বিশেষতঃ তার পূর্বাঞ্চলের নাজুক পটভূমিতে তার প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হোক এবং একদলীয়ে কর্তৃত্বের স্থলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমঝোতা স্থাপিত হোক ভারত সরকারের পক্ষে সেটা কামনা করাই বেশী স্বাভাবিক । আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র কায়েম করতে চাইলে এই অনুকূল পরিবেশে খুবই সহায়ক হবে সন্দেহ নেই।
.
.
কম্পাইলারঃ বুটেবল ঈশরাক
<৬,২৩৯,৪০২-৪০৩>
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা
তারিখঃ ১৮ই নভেম্বর,১৯৭১
অধিকৃত বাংলায় চাকমারা দমে গেছেঃ বিদ্রোহী মিজো লালডেঙ্গা
পাক ছাউনিতে
পার্বত্য চট্রগ্রাম এলাকার উপজাতীয়দের নানাভাবে প্রলব্ধ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি। আমাদের চট্রগ্রাম সংবাদদাতা চট্রগ্রাম থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছেন যে, পার্বত্য চট্রগ্রামের চাকমা উপজাতির প্রধান রাজা ত্রিদিব রায় এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য আউংশে এলাকাকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে চাকমা নেতারা সে ফাঁদে পা-ও দিয়েছিলেন এবং সে অনুযায়ী কিছু সংখ্যক চাকমাকে ট্রেনিংও দেওয়া হয়।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা একাধিক কারনে মোটেই কাজে আসেনি। প্রথমত” চাকমারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। সমগ্র পার্বত্য চট্রগ্রামে উপজাতীয়দের সংখ্যা আশি হাজার। দক্ষিণের বোমং ও উত্তরে মং রাজার অনুগামিরা চাক্মাদের কোনকালেই সুনজরে দেখেনি। কারণ, চাকমারা তুলনামূলকভাবে কিছুটা উন্নত এবং অন্যান্য উপজাতীয়দের ঘৃনার চোখে দেখে থাকে।
এদিকে রামগড়ের মং রাজা মুক্তিবাহিনীর পক্ষ নিয়েছেন। এপ্রিল-মে মাসে রামগড় যখন মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল, তখন তিনি সর্বতোভাবে সহায়তা করেছেন। তাঁর ধনুকধারী টিপরা বাহিনী পাহাড়ে-জঙ্গলে পাহারাদারের কাজ করেছে। রামগড়ে পাক-বাহিনীর প্রবেশের পর তিনি সপরিবারে মুক্তাঞ্চলে চলে যান এব্বং তাঁর অনুগামীরা গভীরতর জঙ্গলে আশ্র্য নেন।
বোমং উপজাতীয়রা তুলনামূলকভাবে আরো অনুন্নত ও অসংহত।
পার্বত্য চট্রগ্রামের অবস্থানগত কারণে এবং উপজাতীয়দের সংখ্যাল্পতা ও বিচ্ছিন্ন অবস্থানের ফলে তাদের কার্যকলাপ নিজ নিজ এলাকাতেই সীমাবদ্ধ। ফলে এই মুহূর্তে তাদের নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন মুক্তিবাহিনীর আদৌ আছে বলে মনে হয় না। মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক বিজয়ের পথে উপজাতীয়দের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা পাক-বাহিনীর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। কারণ আজ হোক কাল হোক, মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক বিজয়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসলে অস্ত্রধারী উপজাতীয়রা তাদের অস্ত্র গুড়িয়ে ধরবে নিজেদের প্রয়োজনেই। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে তাদের পৃথক অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব। আর একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশেই উপজাতীয়রা তাদের পরিপূর্ন নাগরিক অধিকার এবং উপজাতীয় স্বার্থের রক্ষা কবচ পেতে পারে, এ সত্য উপজাতীয় নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। এতদসত্বেও যে দু’একজন উপজাতীয় নেতা বর্তমানে পাক-বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছে, তারা চিরদিনই স্রোতের শেওলার মত এধার ওধার করে এসেছে। উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে নয়, ব্যক্তিগত লোভ লালসা থেকেই এরা পাক-সরকারের পক্ষ নিয়েছে। বলাবাহূল্য সে জন্যই এদের ভূমিকার কোন রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। চাকমা নেতা ত্রিদিব রায় স্বতন্ত্রপ্রাথী নিসাবে নির্বাচিত হয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগের মন্ত্রি হয়েছিলেন। গতবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে তিনি জয়ী হয়েছেন। জয়ী হবার পর আওয়ামী লীগের দুয়ারে ধরনা দিতে দেরী করেন নি। কিন্তু ২৫শে মার্চের পর পুনরায় ভোল পালটে ফজলুল কাদেরের বৈঠকখানায় হাজিরা দিয়েছেন। সংগতভাবেই বলা যায়, পাক-বাহিনীর গাত গুটাবার লক্ষ্ণ দেখা দিলে তিনি আবারও ডিগবাজী খেতে দেরী করবেন না।
ভারতের মিজোদের নিয়ে পাক-সরকার কিছুটা জটিলটা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। মিজোদের মনে স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে উঠেছিল বেশ কিছুকাল পূর্ব থেকে এবং তার পেছনে পাক-উস্কানীও ছিল। পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের সীমান্তবর্তী মিজো এলাকা থেকে বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সেখানে তাদের সামরিক শিক্ষা দেওয়া হয়। পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিজোরা দেশে ফিরে নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হলে ভারত সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। বিদ্রোহী মিজোদের নেতা লালডেঙ্গা এখন বাংলাদেশের ভেতরে পাক-সামরিক ছাউনীতে বেশ কিছুসংখ্যক অনুগামীসহ অবস্থান করছেন। মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্রগ্রামে হামলা পরিচালনার সময় পাক বাহিনী কয়েকশত মিজো পরিবারএকে কয়েকটি মাত্র বন্দুক হাতে নিয়ে অগ্রবর্তী বাহিনী হয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। তাদের গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগুতে বলা হয়, যাতে করে পাল্টা জবাব থেকে মুক্তিবাহীর অবস্থান নির্ণয় করা যায়। তাদের পিছু পিছু পাক-বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে এগুতে থাকে। ফলে এই হতভাগ্যরা অধিকাংশই সপরিবারে ক্রস ফায়ারিং-এর শিকার হয়।
ভারত সরকার কতৃক কেন্দ্র শাসিত মিজোরাম ষ্টেট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার পর মিজোদের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব দূর হতে চলেছে। বিদ্রোহীদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দিয়েছে অনেক দিন থেকে, স্বায়ত্বশাসিত মিজো ষ্টেট পেলেই তাঁদের অনেকে খুশী। লালডেংগার সমর্থন তাই দিন দিনই কমে আসছে এবং তাকে নাগা নেতা ডঃ ফিজোর ভাগ্যই বরণ করে নিতে হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। পাকিস্তানি ছাউনিতে পাক-বাহিনীর বর্বরতার নমুনা দেখে লালডেঙ্গার ঘনিষ্ঠ সহচরদের তিনজন হতাশ হয়ে স্বদেশে ফিরে গেছেন। তাঁদের মধ্যে তথাকথিত স্বাধীন মিজোরাম সরকারের “পররাষ্ট্রমন্ত্রী” লালমিনখাংগা এবং “অর্থমন্ত্রী” লালথাওলিয়া রয়েছেন। মিজো জেলাকে “ইউনিয়ন টেরিটরি”তে রূপান্তরিত করা এবং আসাম সরকার কর্তৃক গণ-ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণায় তাঁরা সন্তুষ্ট হয়েছেন। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, মিজো জাতীয় ফ্রন্টের সহ-স্বভাপতি লালনুনমাউইয়ার নেতৃত্বে চমরপন্থীদের একাংশ পূর্বেই বিচ্ছিন হয়ে এসেছেন।
পাক-ছাউনীতে লালডেঙ্গার অনুগামীদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে। পাকবাহিনী তাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করছে। মিজোদের স্বাধীনতা”র প্রশ্নটি চাপা দিয়ে, পাক-বাহিনী তাদের ভারত ও বাংলাদীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এ সব ব্যাপারে মতভেদ হওয়ায় লালডেঙ্গা আটজন কমান্ডারের ছয়জনকে সম্প্রতি বরখাস্ত করেছেন।
কেন্দ্রশাসিত মিজো ষ্টেটের আনুষ্ঠানিক উদ্ভোদনের সাথে লালডেঙ্গার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে তা” এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায়; সেই সাথে ঘটবে পূর্বাঞ্চলের উপজাতীয়দের নিয়ে পাক-বাহিনীর দীর্ঘ দিনের ষড়যন্ত্রেরও অবসান।
.
.
বুটেবল ঈশরাক
<৬,২৪০,৪০৪-৪০৬>
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা
তারিখঃ ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১
শত্রুশিবিরে ভুট্টোর উভয় সংকটঃ ইয়াহিয়ার “পিঠাভাগঃ” ষড়যন্ত্রের “”শাসনতন্ত্র“
“ডন” পত্রিকার কুম্ভীরাশ্রু ইয়াহিয়া সরে দাঁড়াবে? (রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
গত ১২ই নভেম্বর কারাচীতে এক জিনসভায় ভাষন দিতে গিয়ে পাকিস্তান পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনের বিজয়ীদের নিয়ে সরকার গঠন করা হলে ৪০ দিনের মধ্যেই আমরা তা উল্টে দেবো। সংবাদটি পরিবেশন করেছেন রয়টার। পিকিং ফেরত ভুট্টোর পশ্চিম পাকিস্তানে বতৃতা সফরের এটি ছিল শেষ সভা।
.
বাংলাদেশের ৭৮ জন গণপ্রতিনিধিকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁদের আসনের “উপনির্বাচনের” ব্যবস্থা হয়েছে। ছয়টি দক্ষিণপন্থি দল জোট বেঁধে সব ক”টি আসন নিজেদের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে এবং ইয়াহিয়া সরকারের পরোক্ষ সমর্থনে তাঁদের সফল হবার সম্ভবনাই বেশী। ইতিমধ্যে ৫২টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় এই ছয় জোটের মনোনীত প্রার্থী “নির্বাচিত” হয়েছে। ৩টি আসন পি,ডি,পি’র জৈনক নেতা ভুট্টোর কাছে “বিক্রী” করে দিয়েছেন। বাকী ২০টি আসনের ব্যাপারের চাপাচাপি চলছে। ইয়াহিয়ার এক নয়া নির্দেশে নির্বাচনের ৪দিন পূর্ব পর্যন্ত যে কোন প্রার্থীকে সরে দাঁড়াবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে নিশ্চিত ফলাফলের সম্ভাবনা রয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যদি একটি আসনেও “নির্বাচন” অনুষ্ঠানের প্রয়োজন না হয়, তবে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
.
ভুট্টো এক্ষেত্রে খুবই বেকায়দায় পড়েছেন। “উপনির্বাচনে”র বিরুদ্ধে যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ইথচ এই “উপনির্বাচন” তাঁর মেজরিটি দলের নেতা হবার সুযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে, চোখের সামনে তা’ তা দেখেও তিনি কিছু করতে পারছেন না।
.
নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ডানপন্থীরা একজোট হয়ে ভুট্টোকে কোণ্ঠাসা করে রাখতে চাইছে। “উপনির্বাচনের”র পর এই দক্ষিণপন্থী জোটই ইয়াহিয়ার তথাকথিত পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে এবং নূরুল আমীনের সেই জোটের নেতা হিসাবে “সরকার গঠনে” আমন্ত্রিত হবার সম্ভাবনাই বেশী। ক্ষমতালিপ্সু ভুট্টো তা মেনে নেবেন কেমন করে?
.
ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হয়ে ভুট্টো পিকিং গমনের পাশাপাশি নূরুল আমীনের পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক সফর এবং ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাৎকারদৃষ্টে এক্তহা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ইয়াহিহা-ভুট্টো-নূরুল আমীন সমঝোতা স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা ছাড়া আর কোন ব্যাপারেই সমঝোতার প্রশ্ন ওঠে না। তিনজন তিনটি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার প্রতিভু। কাজেই এদের মধ্যে মিল-অমিল-মিল নাটকীয়তায় অবাক হবার কিছু নেই।
* * *
নুরুল আমীনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হলে ভুট্টো কি মেনে নেবেন?
শেখ মুজিবের সাথে উপ-প্রধানমন্ত্রি হতে ভুট্টোর আপত্তি ছিল না। কিন্তুন নূরুল আমীনকে তিনি মানবেন কেন? সুকৌশনে কলকাঠি ঘুরিয়ে তিনি সামরিক বাহিনীর মাধ্যে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছেন- তবে কি নূরুল আমীনকে গদিতে বসবার জন্য ইয়াহিয়ার সাথে ভূট্টোর সমঝোতা হতে পারে, নূরুল আমীনেরও। দু’জনকেই একই সাথে নাচাবার খেল ইয়াহিয়ার ভালভাবেই জানা আছে। কিন্তু নূরুল আমীন, ভুট্টো, দুজনকেই একই সাথে খুশী রাখার কোন তেলেসমাতী দাওয়াই ইয়াহিয়ার মদের আলমারীতে লুকানো আছে কি? আয়ুবের হাত থেকে ক্ষমতা নেবার পর ইয়াহিয়াকে বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে কেবল ব্যক্তিগতভাবে আলোচনায় মিলিত হতে দেখা যেতো। প্রত্যেকের সাথেই এই হুঁশের পাগল এমন একটি ভাব দেখাতো যেন অন্য নেতাদের কানাকড়িও দাম নেই, কেবল ওই নেতাদের উপরই যা কিছু ভরসা। একইভাবে ইয়াহিয়া বিভিন্ন দলকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। এমন কি ডানপন্থী দলগুলিও ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন।
.
সুচতুর ইয়াহিয়া এবার ভুট্টো এবং নূরুল আমীনকেও কি সেই একই কায়দায় খেলাচ্ছে?
শ্যাম্পেন পূজারী ইয়াহিয়াকে শুরুতে হাবা গোবা মনে হতো। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ইয়াহিয়াকে “ভালো মানুষ” বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। ইয়াহিয়া ক্ষমতায় থাকতে চায় না, গণতন্ত্র কায়েম করে ব্যারাকে ফিরে যেতে চায়, এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করতেন। ইয়াহিয়া নিজেও সেরকম ভাবসাব দেখিয়ে এসেছে।
.
কিন্তু সময়ে প্রমানীত হয়েছে যে, ইয়াহিয়া শেয়ানের শেয়ান। বিশ্বকে ধোঁকা দেবার জন্য তার সর্বশেষ “পদক্ষেপ” সম্পর্কে যা কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তার “পাতায় পাতায় বেড়ানো” শয়তানী বুদ্ধির আরো কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে।
.
শোনা যাচ্ছে, ইয়াহিয়ার শাসনতন্ত্রে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ হিন্দুকে আলাদা রেখে দেখাবার চেষ্টা হবে যে, “পাকিস্তানে” বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা অবাঙালীদের চাইতে বেশী নয়। আর যেহেতু পাকিস্তান “ইসলামিক” রাষ্ট্র, সেহেতু মুসলমানদের সংখ্যা দিয়েই “গুরুত্ব” যাচাই হবে।
.
বিগত সাইক্লোন, গৃহযুদ্ধ এবং বিপুলসংখ্যক আদিবাসীর দেশত্যাগের কারণ দেখিয়ে এবারকার জনগণনায় বাঙালীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ দেখিয়ে আগামীদেতে তদনুযায়ী ভাগ বাঁটোয়ারার নীতিও তাতে লিপিবদ্ধ থাকবে।
.
ইয়াহিয়া তার “শাসনতন্ত্র” পরিষদে পেশের আগে সাধারণ্যে প্রকাশ দূরের কথা, এমনকি বিভিন্ন দলের নেতাদের দেখতে দেবে না। এ ব্যাপ্রে নূরুল আমীনের অনুরোধও প্রত্যাখাত হয়েছে। অর্থাৎ উপনির্বাচনের প্রহসন শেষ হবার পর “আপনি মোড়ল”দের নিয়ে যে পরিষদ গড়া হবে তাতে এই “শাসনতন্ত্র” কেবল পড়েই শোনানো হবে এবং তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের একমাত্র কর্তব্য হবে হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করা।
* *
এই মেকী গণপরিষদেও যাতে বাঙালীদের কর্তৃত্ব না থাকে, ইয়াহিয়া সে ব্যাপারেও সজাগ। ৮৭ জন আওয়ামী লীগ নেতার সদস্যপদ বহাল রাখার পেছনেও হয়তো সেই অভিসন্ধি কাজ করেছে। কারণ, তাঁদের অনুপস্থিতিতে পরিষদে “উপস্থিত” সদস্যদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা বেশী থাকছে এবং আর্ডিনান্সের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইন জারী করে এই বিপুলসংখ্যক সদস্যে অনুপস্থিতিতেই ইয়াহিয়া তার কাজ হাসিল করে নিতে পারবে।
***
সম্প্রতি করাচীর “ডন” পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে এ ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। “ডন” এর মতে এভাবে বাঙালীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে রেখে পরিষদের অধিবেশনে বসানো হলে তা গনতন্ত্র সম্মত হবে না। “ডন” পত্রিকা তবে গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়ে সংগ্রামে নেমেছে? তাও কি সম্ভব?
.
আসলে “ডন” পত্রিকার দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ। “ডন” এর মুরব্বি ইউছুফ হারুণের স্বার্থ মার্কিন জোয়ালে বাঁধা। পশ্চিম পাকিস্তানের ডানপন্থী মার্কিন কর্তাভজার দল এইভাবে পরোক্ষ চাপ দিয়ে পাকিস্তানের অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার আসনগুলিও শুণ্য ঘোষণা করাতে চায়, যাতে করে সেগুলিও আবার নির্বাচন হয় এবং তাঁরা সেগুলি আপোষে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে বগল বাজাতে পারেন। এতে তাঁদের ডবল লাভ। একদিকে শূন্য খোঁয়াড়ে আরো কিছু মেষ কিংবা মোষের আমদানী, অন্যদিকে ভুট্টোর সংখ্যাগরিষ্ঠকে চাপা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে নিজেদের হারানো সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ।
.
ইয়াহিয়া কি সরে দাঁড়াবে? এ নিয়ে কিছু জল্পনা-কম্পনা দেখা যাচ্ছে। প্রধানতঃ পশ্চিমা দেশগুলিতেই এ ধরনের খবর রটেছে বা রটানো হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, ইয়াহিয়ার স্থলে ওমর বা অন্য কেউ ক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশের নেতাদের সাথে আলোচনা শুরু করবে।
.
স্পষ্টতঃ এটি একটি রাজনৈতিক “ফিলার”। ইয়াহিয়াকে সরিয়ে দিলে বাঙালীদের মনোভাব কি দাঁড়ায় পশ্চিমা শক্তিবর্গ তা বুঝে দেখতে চায়। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। পাক-সামরিক বাহিনীকে বাঙালীরা এখন আর বিচ্ছিন্নভাবে দেখছে না, এ সত্য পশ্চিমারা বুঝে থাকবে। ফলে এ ব্যাপারে খুব বেশীদূর অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তারা পাচ্ছে না।
.
.
বুটেবল ঈশরাক
<৬,২৪১,৪০৭-৪০৮>
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা
তারিখঃ ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১
শরণার্থী শিবিরে
(শিবির প্রতিনিধি)
এখনো শরণার্থীরা আসছেনঃ ৫ লক্ষ শিশু মারা যাবে?
শবণার্থীরা বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন
ভারত সরকার “ইসিএমে”র সাহায্য চেয়েছেন
করিমপুর শিবিরবাসীদের জন্য হাসতাপাল
পশ্চিম বাংলার সীমান্তবর্তী জেলাসমূহের শরণার্থী শিবিরগুলিতে এখনো প্রতিদিনই হাজার হাজার নতুন শণার্থী এসে পৌছাচ্ছেন। ওদিকে পাকিস্তানি কতৃপক্ষ দাবী করছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি “শান্ত” এবং শরণার্থীরা ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও পৈতৃক ভিটামাটির আকর্ষণে কিছু কিছু শরণার্থী ফিরে যাবার চেষ্টা যে করছেন না, তা নয়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই মাঝপথ থেকে তাঁদের ফিরে আসছে হচ্ছে। যারা কোন প্রকারে নিজ নিজ গ্রামে পৌছাতে পেরেছেন তাঁদেরও অধিকাংশকে পুনরায় ভারতে চলে আসতে হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ধরণের ঘটনা নিত্যই ঘটছে। তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্র বিষেষে অভ্যন্তর ভাগেরও বহূ থানা, ইউনিয়ন এমনকি মহকুমা এখন কার্যতঃ মুক্তাঞ্চল। কিন্তু পাক-বাহিনীর দূর পাল্লার কামান ও বিমান হামলায় এ সব এলাকার সাধারণ মানুষ যারা এতদিনও কোনপ্রকারে ভিটেমাটি আঁকরে থেকেছে তারা এখন নিরাপদ আশ্র্যের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে আসছেন।
.
বাংলাদেশের ভেতর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষাবাদ বন্ধ থাকায় এবং বাড়তি এলাকা থেকে ঘাটতি এলাকায় খাদ্যশস্যাদির সরবরাহ না থাকায়, স্থানে স্থানে চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বানিজ্যের অচলাবস্থা দেখা দেওয়ায় দিনমজুর ও বেসরকারি সংস্থার কর্মচারীরা অধিকাংশই এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। এ ধরণের ব্যক্তিরা নেহাৎ পেটের তাড়ায় দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন এবং স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে শরনার্থী শিবিরগুলিতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, নদীয়া, চব্বিশপরগনা প্রত্যেক জেলায় দৈনিক কয়েক হাজার নতুন শরণার্থী আসছেন। এদের অধিকাংশই মুসলমান চাষী ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর। গত সপ্তাহে কেবলমাত্র নদীয়া জেলাতেই দশহাজার নতুন শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসেছেন।
***
শরণার্থী শিবিরগুলিতে শিশুখাদ্যের অভাব ক্রমেই বাড়ছে। কতিপয় বিদেশী ত্রানসংস্থা এবং ভারতীয় রেডক্রস-এর পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে কিছু পরিমাণ শিশুখাদ্য সরবরাহ করা হলেও, তা প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। শিবিরবাসীরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাঁদের প্রাপ্য শিশুখাদ্য সঠিকভাবে বিতরণ করা হয় না। বিভিন্ন শিবিরে অপুষ্টিজনিত কারণে শিশুমৃত্যের হার মারাত্বক রকমে বেড়েছে। কিছুদিন পূর্বে জাতিসংঘের জনৈক বিশেষজ্ঞ শিবিরগুলি পরিদর্শন করে বলেছিলেন, যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হলে অচিরেই কমপক্ষে ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যুমুখে পতিত হবার সম্ভবনা রয়েছে।
.
পশ্চিম বাংলার বাজারে শিশুখাদ্য এমনিতেই দুষ্প্রাপ্য। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত এখানেও একশ্রেনীর ব্যবসায়ী শিশুর খাদ্যের কালোবাজারিতে লিপ্ত রয়েছে এবং শরণার্থী শিবিরের জন্য প্রাপ্ত শুরু খাদ্যেও কোন কোন ক্ষেত্রে কালো গুদামে চলে যাবার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। ছাত্রপরিষদ এবং যুব কংগ্রেসের সামপ্রতিক দ্রব্যমূল্যবিরোধী আন্দোলনের জের হিসাবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে এবং শিশুখাদ্য বিক্রীর ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। এর সুফল শরণার্থী শিবিরগুলিতে পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা অনুভূত হতে পারে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
.
শরনার্থী শিবিরগুলিতে শিশুদের প্রয়োজনের দিকে ত্রাণসংস্থাগুলির আরো কিছুটা বেশী নজর দেওয়া দরকার এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির যথাযথ বিতরণ হচ্ছে কি-না সেদিকেও আরো বেশী দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।
***
শরণার্থী শিবিরগুলি সীমান্তের খুব কাছাকাছি থাকায় এখানে মারাত্বক রকমের যুদ্ধাতংক বিরাজ করছে, এ ব্যাপারে আমরা গতবারেও আলোচনা করেছি। যুদ্ধ হোক বা না হোক, শরণার্থীরা যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে ক্ষেত্রবিষেষে রাত কাটাচ্ছেন, শিবিরগুলিতে ঘুরে এলেই তা হৃদরঙ্গম হবে।
.
যে ভীতি-সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য শ্রণার্থীরা পিত্রপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে এসেছেন, সেই একই ভীতি-সন্ত্রাস এখানেও তাঁদের তাড়া করছে। “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়”, শরণার্থীদের অবস্থাও তথৈবচ। তা ছাড়া সীমান্ত এলাকাগুলিতে যুদ্ধ এক রকম লেগেই গেছে বলা যায় না কি?
.
শরণার্থী শিবিরগুলি সীমান্ত এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নতুন করে নির্মাণের খরচা এবং ঝক্কি বিরাট হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্ষেত্র বিষেষে তা” করাই হয়তো বাঞ্ছনীয় হবে। সীমান্ত থেকে বেশী দূরে সরিয়ে নিলে শরণার্থীরা ভারতের জনসাধারণের সাথে মিশে গিয়ে ভারতের জনস্নগখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে, এ আশংকা কেউ কেউ করছেন। কিন্তু এভাবে ভয়-সন্ত্রাসের মধ্যে থাকতে হলে ক্রমাগত অধিকসংখ্যক শরণার্থী শিবির ছেড়ে যাবার পথ খুঁজবে এবং তার ফল আও মারাত্বক হতে বাধ্য।
.
ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের জন্য কতিপয় খদ্যদ্রব্যাদির প্রয়োজন মেটাবার জন্য ‘ইউরোপীয় কমন মার্কেটের’ নিকট আবেদন জানিয়েছেন।
.
এ যাবৎকাল বিভিন্ন সূত্রে যে পরিমাণ সাহায্য প্রতিশ্রুত হয়েছে তা” হিসাবে ধরার পর ১৯৭১-“৭২ সালে কি পরিমাণ অতিরিক্ত সাহায্য দরকার হবে, ভারত সরকার তার একটি তালিকাও সেই সাথে পেশ করেছেন।
.
ভারত সরকারের হিসাবে ১৯৭১-‘৭২ সালে শরণার্থীদের জন্য আরো ৩১১,০০০ টন চাল, ১৭৫,০০০ টন গম, ৫০,০০০ টন চিনি, ১৮৭,০০০ টন ডাল, ৪০,০০০ টন লবন, ৮,৩০০ টন গুঁড়া দুধ প্রয়োজন হবে। শরণার্থীদের জন্য সর্বমোট ৪,৩৪,০০০ খানা কম্বল দরকার বলে হিসাব ধরা হয়েছে এবং এ ব্যাপারেও ই,সি, এম এর সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
.
সম্প্রতি করিমপুরে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার কোরের উদ্যোগে একটি ১৫ বেডের হাসপাতাল প্রতিষ্টিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের পরিচালনাধীন এই হাসপাতালটিতে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এই হাসপাতাল থেকে কয়েক লক্ষ শরণার্থী উপকৃত হবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
.
.
কম্পাইলারঃ আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২৪২,৪০৯>
শিরোনামঃ মুক্ত বাংলায়-
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা (১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা)
তারিখঃ ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১
.
রংপুরের মুক্ত এলাকায় প্রাণের স্পন্দন (নিজস্ব সংবাদদাতা)
রংপুরের জেলার ৮টি জেলা এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রয় ১২০০ বর্গামাইল এলাকা জুড়ে স্থানগুলিতে ৭ লক্ষ মানুষের বাস।
মুক্ত থানাগুলিতে এখন বাংলাদেশ সরকারের গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রশাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছেন। উত্তরাঞ্চলীয় জোনাল কাউন্সিলের তত্বাবধানে আইন ও শৃংখলা রক্ষার জন্য পুলিশ বাহিনী যথারীতি কাজ করে যাচ্ছে, যদিও অপরাধের সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রতি থানায় কার্যাদি পরিচালনার জন্য ম্যাজিষ্ট্রিট নিয়োগ করা হয়েছে। একটি জেলখানাও স্থাপিত হয়েছে। ডাক তার ও টেলিফোন যোগাযোগ নিয়মিত ভাবে চলছে।
প্রাইমারী পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরাদমে চালু রয়েছে। সাব রেজিষ্ট্রার অফিস, বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন অফিস ও শুল্ক অফিসগুলিতে স্বাভাবিক কাজ চলছে।
প্রত্যেক থানায় একটি করে ডিস্পেন্সারি স্থাপিত হয়েছে এবং হেলথ অফিসারদের তত্ত্ববধানে ব্যাপকহারে কলেরা-বসন্তের টীকা দেওয়ার কাজ চলছে।
পাকিস্তানী লুণ্ঠনে হৃতসর্বস্ব এ সব অঞ্চলে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে যথাবিহীত ব্যবস্থা করেছেন এবং টেষ্ট রিলিফের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করছেন।
সমগ্র মুক্তাঞ্চলটিতে এখন করে প্রাণের স্পন্দন জাগছে। সম্প্রতি পূর্বাঞ্চলীয় জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জনাব মতিউর রহমান এম, এস, এ, অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সহকারে পাটগ্রাম, ফুলবাড়ি, সোনাহাট, হাতিবান্ধা প্রভৃতি থানা সদর সফর করেন। সর্বত্রই তারা বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন এবং সর্বশ্রেণীর জনসাধারণ ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২৪৩,৪১০-৪১১>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় কাল রাত্রির অবসান নতুন সূর্যের অভ্যুদয়
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা (১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ-৭ম সংখ্যা)
তারিখঃ ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
কাল রাত্রির অবসানঃ নতুন সূর্যের অভ্যুদয়
স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন ভারত সরকার। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর অকৃত্রিম সুহৃত ভাত প্রতিবেশির প্রতি, মানবতার প্রতি, সর্বোপরি গণতন্ত্রের প্রতি তার দায়িতে পালন করেছে পরিপূর্ণভাবে। দেশ বিভাগের ডামাডোলে বাংলার শ্যামল মাটিতে সাম্রাজতবাদী প্রতিক্রিয়ায় যে বিষবৃক্ষটি শিকড় গেড়ে বসেছিল, দীর্ঘ চব্বিশটি বছর সকল ন্যায়নীতি,সকল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পদলদলিত করে উপ-মহাদেশের বুক হিংসার রাজনীতি, দস্যুতার রাস্ট্রনীতি এবং শোষণের অর্থনীতি কায়েক রাখার চক্রান্ত চালিয়ে এসেছে, বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা এবং সংগ্রামরত মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে গিয়ে ভারতের বীর সেনাবাহিনী আজ তার গোড়া ধরে টান দিয়েছে। এই উপমহাদেশের শান্তি আর সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাই একটি অন্ধয়ার যুগের অবসান, আরেকটি আলোকজ্জ্বল নতুন যুগের উদ্বোধন।
পাকিস্তানী দস্যুবৃত্তির বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলার সাথে সাতগে ভারত বাংলা উপমহাদেশের আগামি দিনেও শান্তি ও সমৃদ্ধির নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হলো। গত চব্বিশ বছর এই দরিদ্র উপমহাদেশের সীমিত সম্পদের অংশ যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং পরস্পারিক হানাহানির মাশুল জোগাতেই নিঃশেষ হয়ছে।
এখন থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পারিক হৃত্যতা, সহযোগিতা ও পরস্পর নির্ভরশীলতার পটভুমিতে পটভুমিতে উওমহাদেশের সক সম্পদ শান্তিও সমৃদ্ধির কাজে লাগানো সম্ভব হবে। বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশংকামুক্ত পরিবেশে দু’দেশেও নিজ নিজ জাতীয় সম্পদের পরপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। ভিক্ষাপাত্র হাতে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদেরর দ্বারে দ্বারে ঘুড়ে বেড়াতে হবে না।
বলা বাহুল্য কেবল ভারত-বাংলা উপমহাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রেও উপমাহদেশের আভ্যন্তরীণ সংঘাতের অবসান এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা যুগান্তকারী তাৎপর্য রয়েছে। আগামী দিনের বিশ্বরাজনীতিতে এই উপমহাদেশ অন্যতম প্রধান “বৃহৎশক্তি” হসেবে গণ্য হবে, একথা আজ নিশ্চিত রূপেই বলা চলে।
.
আজকের দিনে আমরা স্বরণ করি তাদের যাঁদের প্রানের মূল্যে, ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত হয়েছে স্বাদীনতার এই স্বর্ণফসল। স্মরণ করি তাঁদের যাঁরা আজো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে স্বাধীনতাকে বাস্তব্ রুপে দেবার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করে চলেছেন। সর্বোপরি স্মরণ করি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, বাংলার মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা, প্রেসিডেন্ট মুজিবকে, যিনি আজও স্বদেশ-স্বজন থেকে ভু দূরে দস্যুশিবিরে বন্দীদশায় রয়েছেন। তাঁর সোনার স্বদেশ মুক্ত হয়েছে। তিনিও মুক্ত হবেন। সেদিন আর দূরে নয়।
এই মহাল্গনে আমরা ভারত সরকার, ভারতের জনগণ, সোভিয়েট সরকার সোভিয়েট জনগ্ণ এবং বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্রকামী মানুষ, যাঁরা আমাদের দুঃখদিনের সাথী হয়েছেন, সাহায্য সহানুভুতি দিয়ে আমাদের সংগ্রামকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন তাঁদেরসবাইকে ‘দেশবাংলা’র পক্ষ থেকে এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশের জনগণ স্বাদীনতার, সার্বভৌমত্ব এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত উন্মেষের জন্য হাজারে হাজারে, লাখে লাখে প্রান দিয়েছে। আগামী দিনেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য তারা এমনিভাবে চিরজাগ্রত প্রহরী হয়ে থাকবে। কিন্তু শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য, মানবতার জন্য এবং বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, সংগ্রামরত জাতি সমূহের শৃংখল মুক্তির জন্য বাংলাদেশ সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই সংগ্রাম করবে। আজকের দিনে এই হোক আমাদের ব্জ্র কঠিজ শপথ।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২৪৪,৪১২-৪১৩>
শিরোনামঃ পাকিস্তান নামে কোন দেশ থাকবে না
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা (১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ-৭ম সংখ্যা)
তারিখঃ ৯ নভেম্বর, ১৯৭১
ভারত-বাংলা উপমহাদেশে নতুন যুগের সূচনা পাকিস্তান নামে দেশে থাকবে না )দেশবাংলা বিশেষ নিবন্ধ)
জাতিসংঘের মাঋকন দালালরা যে কণ সিদান্তই নিক না কেন অথবা ইয়াংকি সাম্রাজ্যবাদ এবং চোইনিক সুবিধাবাদ শেষ রক্ষার যত চেষ্টাই করুক না কেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্যের উদয়কে রোধ করার সময় পার হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ভারতএ আক্রমণকারী অয়াখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু বাংলার ও ভারতের মানুষ সাম্রাজ্যবাদাদের এই শেষ ভরসাস্থলটির উপর আস্থা হারিয়েছে অনেক আগেই। বর্তমান সংকটকে কেন্দ্র করে যদি ভারত জাতিসংঘ ত্যাগ করে তাহলে ভারতের মানুষ বিন্দুমাত্র অখুশী হবে না। চীন এতকাল জাতিসংঘে ছিল না। ইন্দোনেশিয়াও কিছুকাল আগে জাতিসংঘ ত্যাগ করেছে, তাতে দু’শের অস্তিতে বিপন্ন হয়নি। ভারতেরও হবে না। বাংলাদেশেরও না।
তা’ছাড়া এই জাতিসংঘের তথাকথিত পুরোহিতরাই জাতিস্ংঘের সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধাচরণের পথ প্রদর্শক।
.
দক্ষিণ আফ্রিকায়, রোডেশিয়ায় জাতিসংঘের সুস্পষ্ট নির্দেশ কি মানা হয়েছে? রোডেশীয়ায় ৫০ লক্ষ আফ্রিকানের উপর ২ লক্ষ শ্বেতাংগের শাসন ও শোষণের পক্ষে মদত দিচ্ছে বৃটেন ও তার সহযোগীরা জাতিসংঘের বিধিনিষেধ অমান্য করেই। আর আজ যদি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর উপর গুটি কতক পেশাদার সৈন্যের নৃশংস অত্যাচার বন্ধ করার জন্য ভারত এগিয়ে গিয়ে থাকে, জাতিসংঘের তথাকথিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই, তাহলে বা দোষটা কোথায়?
বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী এখন সর্বময় ক্ররতৃত্বে। ঢাকার সর্বশেষ পকেটটিও শিত্রুমুক্ত হবে দু’ একদিনেই। তখন আর বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের কোন দখলই থাকবে না। নূরল আমীনের মত বাঙ্গালী কুইসলিংকে প্রধানমন্ত্রী হিসাব দাঁড় করানো সত্বেও।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে হাত গুটাবার পর পশ্চিম পাকিস্তানকে ঘিরে “পাকিস্তান” নামটি টিকিয়ে রাখাও ক্রমেই দু;সাধ্য হয়ে পড়বে। পাঠান ও বেলুচিস্তানীরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে কেবল সেজন্যই নয়, নিছক নির্বুদ্ধিতা এবং গোয়ার্তৃমীর দরুন কায়েমী স্বার্থের দুধের হাঁড়িটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য এখন পশ্চিমাদের মারাত্নক কলহ বেধে গেছে। বাদতে বাধ্য। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিকে একত্রে রাখার প্রাধনত যোগসূত্র ছিল বাংলাদেশের উপর শোষণের সুযোগ। উপনিবেশের ফায়দা লুটবার জন্য সিন্ধু-পাঞ্জাবের ভূস্বামী এবং ধনকুবেররা নিজেদের মধ্যে আপোষ রক্ষা করে নিয়েছিল। এখন তাদের আপোষ হবে ইসের ভিত্তিতে? তা’ছাড়া লন্ঠিত সম্পদের ছিটে-ফোঁটা বিলিয়ে এবং বাহ্যিক উন্নয়নে শানশওকত দেখিয়ে এতকাল সেখানকার সাধারণ মানুষকেও বশে রাখা সম্ভব হয়েছে। বিরাট এক সেনাবাহিনী পোষা হয়েছে যাতে করে প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকেই কেউ না কেউ সৈনিক হয়েছে। এখন আর তা সম্ভব হবে না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকুরী সর্বক্ষেত্রেই ছাঁটাই এর পালা শুরু হবে। বাংলাদেশের বিরাট বাজার হারিয়ে ইতিমধ্যেই শত শত কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো যাবে।
“দেশবাংলার” প্রথম সখ্যায় আমরা পাখতুনিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতির কথা বলেছিলাম এবং এই শীতের পরেই সেখানে অভ্যূথানের সম্ভাবনার আভাস দিয়েছিলাম। অতি সম্প্রতি বেলুচিস্তানের ও সীমান্ত প্রদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করা থেকে প্রমানণিত হয়েছে ঘটনাপ্রবাহ সঠিক খাতেই প্রনাহিত হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক ভেদ-বৈষম্যে এই উপমহাদেশের যে রাজনৈতিক ইংসা-প্রতিহিংসার উদ্ভব ঘটেছিল বাস্তবের কঠোর আঘাতে তা ধীরে ধীরে দূরভীত হতে চলেছে। বাংলাদেশের অভ্যূদওয়ের পাশাপাশি পশ্চিমে পাখতুনিস্তান।সিন্ধু, এমনকি পাঞ্জাবেও কালক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার ভিত্তিতে একাধিক “নেশন ষ্টেট” গড়ে উঠবেই। এই উপমহাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য তা’হবে যুগান্তকারী ঘটনা। এখন থেকেই সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই বাংলাদেশ ও ভারতকে এগুতে হবে।
.
.
আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২৪৫,৪১৪-৪১৫>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় (পাকিস্তান থেকে শিক্ষা নিতে হবে)
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা (১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা)
তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পাকিস্তান থেকে শিক্ষা নিতে হবে
বাংলাদেশ তার স্বাধীন ক সার্বভৌম সত্তা নিয়ে আত্নপ্রকাশ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবে রুপায়িত হয়েছে লাখো শহীদের প্রাণের মূল্যে, আযূত কর্মীর নিরলস সংগ্রামে, প্রতিটি পরিবারের সীমাহীন দূঃখভোগ এবং অবিশ্বাস ত্যাগস্বীকারে। স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতেই হয়, কিন্তু বাঙ্গালী জাতি মূল্যের অধিক দিয়েছে।
পৃথিবীর বুজে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এ শিশুর তোলপাড় হয়েছে অনেক বেশী। জন্মের আনুষঙ্গিক গর্ভযন্ত্রণায় সারা বিশ্ব কেঁপে উঠেছে। জন্মকে ত্বরান্বিত করার জন্য “অপারেশন” ও চালাতে হয়েছে। এক অর্থে বাংলাদেশ “সিজারিয়ান বেবী”। আর সে জন্যই সম্ভবতঃ এই শিশুর প্রতিপালনে প্রথম থেকেই খুব বেশি সতর্ক হওয়া দরকার।
ঔপনেবেশিক এবং কায়েমী স্বার্থের শোষণে বাংলাদেশে কোনকালেই সুস্থ অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠতে পারেনি। বৃটিশ শাসনামলে আজকের বাংলাদেশ ছিল কলিকাতার ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি মহলের শোষণের প্রশস্ত তম ক্ষেত্র। রাজধানী শহর কলিকাতারকে কেন্দ্র করে সেদিন যে পুঁজিচক্র গড়ে উঠেছিল, তাতে বাংলার মানূষের অংশিদারিত্ব ছিল না। পাকিস্তানি শাসনের চব্বিশ বছরে এই শোষণের হার আরো বহু গুনে বেড়েছে। তারপরও যা ইছু অস্থি চর্ম অবশিষ্ট ছিল, এবারকার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং পালায়মান শত্রুসেনাদের “পোড়ামাটি” নীতির জন্য তা’ও ধুলিস্মাৎ হয়ে গেছে।
অর্থাৎ নবজাতকের জন্ম ঘটেনি সোনার পালংকে, রূপার চামচ মুখে। ঘটেছে খোলা আকাশের নিচে, অপরসীম দুঃখদুর্দশায়, শত-সহস্য সমস্যার বেড়াজালে।
তাই আজ যাঁর জন্মলগ্নে এই নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই নিজেদের এই গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
পাকিস্তান এই ব্যাপারে আমাদের সামনে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম-বৃত্তান্ত যা-ই হোক না কেন, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি পাকা-পোক্ত আসন নিয়েই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুতেই আভ্যন্ত্রীণ ঐক্যের্ব অভাব ছিল না, বৈদেশিক সহায়তারও কমতি ছিল না। রাষ্ট্র হিসেবে এটিছিল পৃথিবীড় “পঞ্চম বৃহত্তর রাষ্ট্র”। তা সত্ত্বেও মাত্র ২৪ বছরেই তার রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে চ্রমার হয়ে গেল। কিন্তু কেন?
এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে পাকিস্তানী রাজনীতির দিকে চোখ ফেরাতে হবয়। দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানে অগণতান্ত্রিক গণবিরোধী কায়েমী স্বার্থ চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসে এবং ধাপে তা রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র থেকে, আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠিতন্ত্র এবং সর্বশেষ সামরিক হটারীতায় পর্যবসিত হয়।পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল জনগণের নামে। কিন্তু সেই জনগণের কোন ভূমিকাই থাকেনি অয়াকিস্তানের রাষ্ট্রীয় জীবনে।
জনসমর্থনের বদলে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের লেহুড়ে বৃত্তিকেইরাষ্ট্র-ক্ষমতার নিয়ামক করে তোলা হয়েছে। তারই অবশ্যম্ভাবি পরিণিতিতে একদিকে চলেছে সাধারণ মানুষের উপর সীমাহীন শোষণ, অন্যদিকে চলেছে জাতিগত নিপীড়ন। এই শোষণ ও নিপীড়নের পরিণতি আজ চোখের সামনে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অশ্রু আর রক্তের ফসল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সমানাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে এই আশা নিয়েই বাংলার মানুষ এত ত্যাগ স্বীকারে এগিয়ে গেছে।আগামী দিনে বাংলাদেশকে সেই প্রত্যাশা অবশ্যই পূরণ করতে হবে, নতুবা বাংলাদেশ ও ইতিহাসের ব্যতিক্রম হবে না। মৃত পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকেই সে শিক্ষা দিতে হবে।
.
.
কম্পাইলারঃ লাল কমল
<৬,২৪৬,৪১৬-৪১৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত |
দেশ বাংলা ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা |
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতির উৎজ্জ্বল সম্ভাবনা
সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত
(দেশবাংলা রিপোর্ট)
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ ঘোষনা করেছন, বাংলাদেশে অতঃপর কোন সাম্প্রদায়িক দল থাকবে না। জামাতে ইসলামী, তিন মুসলিম লীগ, পিডিপি ও নেজামে ইসলাম দলকে বেআইনী ঘোষণা করে জনাব তাজউদ্দিন যশোরে স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, এখন থেকে আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।
বলা বাহুল্য প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষনা সর্বত্র অভিনন্দিত হয়েছে। বিগত বছর যাবৎ বাংলাদেশকে পদদলিত করে রাখার ব্যাপারে পশ্চিমা চক্র ধর্মের লেবাসধারী এই দলগুলিকে সর্বপ্রকারে মদত দিয়েছে এবং বাংলাদেশে একটি প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ-স্বর্বস্ব দালাল শ্রেনী সৃষ্টি করার কাজে এই দলগুলিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। গনতন্ত্রের টুটি টিপে ধরে, সর্বপ্রকারের প্রগতির পথ আগলে দাঁড়াবার ব্যাপারে এই সব রাজনৈতিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলি যথেষ্ট ‘সংগ্রাম’ও করেছে।
২৫শে মার্চ বাংলাদেশের উপর নারকীয় দুর্যোগ নেমে আসার পর এই দলগুলির গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল নেতৃবৃন্দ নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ‘শান্তি(?)কমিটি’ গঠনের জন্য টিক্কা খাঁর কাছে ধর্ণা দেয়। তারপর থেকে এই সব শান্তি সৈনিকেরা ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের কামানের খোরাক এবং কামনার শিকার সন্ধানের জন্য শিকারী কুকুরের ভূমিকা পালন করে এসেছে। তারই ইনাম হিসাবে তাদের ভাগ্যে জুটেছিল ‘উপনির্বাচন’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হাতের গ্রাস হাতেই থেকেছে, মুখে পৌছাবার আগেই কম্ম-কাবার হয়ে গেছে।
অতীতে দক্ষিণপন্থী ধ্যান ধারনা পোষণ এবং সাম্প্রদায়িক চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের পিছনে অন্ততঃ এইটুকু যুক্তি ছিল যে জনগণকেই ভালোমন্দ বিচার করতে দেওয়া হোক। গণতন্ত্রে কোন মতকে জোর করে শুদ্ধ করে দেওয়া চলে না। কিন্তু গত আট মাসে এই তথাকথিত দলগুলি দেশ ও জাতির সাথে যেভাবে বিস্বাসঘাতকতা করেছে এবং দেশের মাটি রক্তে রঞ্জিত করার কাজে শত্রুকে সর্বপ্রকারের সহায়তা করেছে, তার প্রেক্ষিতে আজ সে ব্যপারে কোন শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নাই। পঞ্চমবাহিনীকে দেশের বুকে রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না, এ সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণভাবেই গণতান্ত্রিক।
এই দলগুলি বেআইনী ঘোষিত হবার পর বাংলাদেশের ছোট-বড় মিলিয়ে যে সব দল-উপদল জীবিত থাকবে বলে মনে হয়; যেগুলি কম-বেশী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশীদার থেকেছে, সেগুলিকে এভাবে সাজানো যেতে পারে
(১) আওয়ামী লীগঃ বৃহত্তম এবং বলতে গেলে বর্তমান পর্যায়ে একক রাজনৈতিক দল। সহযোগী ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, শ্রমিক সংগঠন, জাতীয় শ্রমিক লীগ।
(২) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর পন্থী) ও বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টি। সহযোগী ছাত্র সংগঠ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড-ইউনিয়ন সেন্টার। সংগঠনগত ও জনসমর্থনের দিক
থেকে বর্তমানে এই দল্টির স্থান দ্বিতীয়। ন্যাপ ও কম্যুনিষ্ট পার্টি দু’নামে সংগঠন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হবে বলে মনে হয়, তেমন অবস্থায় কোনটি রেখে কোনটি ভেঙ্গে দেওয়া হবে, তা সম্ভবতঃ পরিস্থির উপর নির্ভর করবে।
(৩) বাংলা জাতীয় লীগ (সভাপতি, আতাউর রহমান খান) সহযগী ছাত্র সংগঠন, বাংলা ছাত্রলীগ। সংগঠনগত ও জনসমর্থনের দিক থেকে এই দলের স্থান হবে তৃতীয়; আতাউর রহমান খান সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় কিন্তু তিনি ঢাকাতেই থেকে যান। তাঁর দলের কর্মী মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন।
(৪) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী পন্থী)। বেহুধা বিভক্তির পর এবং চরম বামপন্থী উপদলগুলির পৃথক পৃথক সংগঠন গড়ে তোলার ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন এক কালের বিরাট সংগঠনটি এখন পূর্ব জৌলুষ হারিয়ে ফেললেও, মওলানার ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। মওলানার পরবর্তী কার্যক্রমের উপর এর ভবিষ্যত নির্ভর করবে।
(৫) বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস। পূর্ব পাকিস্তানের এককালীন অর্থমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর এবং প্রবীন কংগ্রেস নেতা ভবেশ নন্দীর নেতৃত্বাধীন এই দলটি এযাবৎকাল ‘সংখ্যালঘু’দের দল হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসলেও, বর্ত্মান সংগ্রাম ও মনোরঞ্জন বাবুর বাংলাদেশ সরকারের কন্সালট্রেটিভ কমিটির সদস্য হওয়ার প্রেক্ষিতে এই দলটি এখন গুরুত্ব অর্জন করেছে। দলের ভবিষ্যত কার্যক্রম বিশেষভাবে লক্ষোণীয়।
(৬) বামপন্থী কম্যুনিষ্ট উপদলসমূহ। বামপন্থী কম্যুনিষ্ট উপদলগুলির একাংশ মুক্তি সংগ্রামের অনুকুলে বক্তব্য পেশ করেছে, অপর অংশ বিরোধিতা করেছে। এই সব সংগঠনের অনেকগুলি হয়তো ভবিষ্যতেও ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সংগঠন হিসাবেই কাজ চালাবে। আইনসিদ্ধ প্রকাশ্য কম্যুনিষ্ট পার্টি করারও চেষ্টা হতে পারে। এ সম্বদ্ধে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। পিকিং-এর সাম্প্রতিক ভূমিকা এঁদের পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক হয়েছে।
(৭) এ ছাড়াও শ্রমিক কৃষক-সমাজবাদী দল এবং অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগের উপদলটিও পৃথক দলীয় অস্তিত্ব বজায় রাখবে বলে মনে হয়। উভয় দলেরই কয়েকটি শ্রমিক এলাকায় প্রভাব রয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আগামী দিনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরো কয়েকটি দল মাঠে থাকছে। তন্মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর পন্থী) ছাড়া অন্য দলগুলির সাংগঠনিক অবস্থা ভালো নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে নাম-সর্বস্ব। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্চিতভাবেই পার্লামেন্টারী রাজনীতি চালু হতে যাচ্ছে এবং যেহেতু স্বাধীনতার প্রশ্নে এসব দলেরও কমবেশী অবদান রয়েছে, সেহেতু আগামীতে এরাই হবে বিরোধী দল। পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিরধীদলের ভূমিকা থাকে মুখ্য। কাজেই কালক্রমে এইসব দলও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
তবে আওয়ামী লীগের বিরাট শক্তির মোকাবিলায় ক্ষুদ্র দলের কাজের সুযোগ যে খুবই সীমিত তা এ সব দলের কর্মকর্তাদের না বোঝার কথা নয়। এমতাবস্থায় ক্ষুদ্রতর দলগুলির কয়েকটি একত্রিত হয়ে শক্তিশালী দলে রুপান্তরিত হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কম্পাইলারঃ লাল কমল
<৬,২৪৭,৪১৮-৪১৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
এবার দেশ গড়ার পালা |
দেশ বাংলা ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা |
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
এবার দেশ গড়ার পালা
দেশবাংলা বিশেষ নিবন্ধ
‘আর কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী স্থানান্তরিত হবে। সম্প্রতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ কথা ঘোষনা করেছেন।
মুক্তিবাহিনী এবং ভারতিয় বাহিনীর সম্মিলিত অগ্রাভিযানের মুখে পাকিস্তানী জংগী চক্রের পশ্চাদপসরণ এবং একের পর এক শত্রু ঘাঁটিগুলির পতন দেখে তাঁর এ আশাবাদে বিশ্বাস স্থাপন না করার কোন কারণ আমারা দেখি না। ইতিমধ্যেই মুক্ত জেলাগুলিতে পুরাদমে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা এখন বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর প্রভৃতি কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনী এখন কার্যতঃ আত্মসমর্পণের দিন গুনছে।
একের পর এক বিভিন্ন এলাকা বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বে আসার সাথে সাথে এখন স্বভাবতই পুনর্গঠনের প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গার পর্ব শেষ হয়েছে। এবার দেশ গড়ার পালা।
চার প্রদেশ
বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা প্রশাসন ও উন্নয়ন তৎপরতায় প্রতিটি অঞ্চলের প্রতি যথাযোগ্য গুরুত্ব আরোপের দাবী উঠেছিল ২৫শে মার্চের আগেই। এখন এ ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেছন জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি ‘কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লি’ গঠন করা হবে। এই এসেমব্লিকে চার প্রদেশের কাঠামো এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্ক নির্ধারণের ভার দেওয়া যেতে পারে। এ সব প্রদেশ কেবলমাত্র প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনে গড়তে হবে। এক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন ওঠার কোন কারন নেই। আপাততঃ চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেহসের মর্যাদা দিলেই চলবে। এতে করে ঢাকা শহরের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ কমবে এবং দেশে আরো কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর শহর গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তবে মনে রাখা দরকার, কোন অবস্থাতেই ‘দুই’ প্রদেশ গঠনের কথা চিন্তা করা চলবে না। কারন সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক রেষারেষিতে জাতীয় ঐক্য দুর্বল হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
গনহত্যা ঠেকাতে হবে
শত্রুর চর এবং সহযোগীদের শাস্তি দেবার ভার জনগনের উপর বা স্থানীয় নেতৃত্বের উপর ছেড়ে দেওয়া চলবে না। কারণ, তেমন অবস্থায় ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য অনেক নিরীহ ব্যক্তিরও লাঞ্জিত হবার সম্ভাবনা থাকবে। তা’ছাড়া শত্রু সহযোগী অবাঙ্গালী দেরকেও’ হ্ত্যা করার লাইসেন্স কাউকে দেওয়া চলবে না। এ ব্যাপারে সরকারের সময়োচিত ঘোষণা সুবিবেচনার কাজ হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে যথাবিহিত বিচার করে তবেই অপরাধীকে যোগ্য শাস্তি দিতে হবে। বাংলার মাটিতে অনেক রক্ত ঝরেছে, আর এক ফোঁটা রক্তও অনাবশ্যক ঝরান উচিত হবে না।
ঋণভিত্তিক অর্থনীতি চাই না
বাংলাদেশে প্রায় সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকেই ব্যাপকভাবে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে তড়িগড়ি ‘সোনার বাংলা’ বানাবার কথা বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া দরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে কৃষিভিত্তিক। কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য হতে হবে। ঋণভিত্তিক তথাকথিত ‘শিল্পপতিদের অর্থনীতি’ নয়। তাই অনাবশ্যক ঋণ পরিহার করে সুস্থ ভিত্তিতে জাতীয় অর্থনীতেকে ধাপে ধাপে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য দেশবাসীকে কৃচ্ছসাধনার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে এখন থেকেই।
ঋণ করা যার অভ্যাস, তার ঋণের অভাব হয় না। বিশেষ করে বিশ্বে জখন ‘মহাজনী রাজনীতি’ পুরাদমে চালু রয়েছে। কিন্তু ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ পরিণতি পাকিস্তানে আমরা দেখেছি, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখেছি। বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেওয়া যাবে না।
.
কম্পাইলারঃ লাল কমল
<৬,২৪৮,৪২০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় জয় আমাদের হবেই |
দুর্জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
[*দুর্জয় বাংলাঃ ‘সংগ্রামী বাংলার কন্ঠস্বর’। সম্পাদক তুষার কান্তি কর। সিলেট সুরমা প্রকাশনীর পক্ষ হতে তুষার কান্তি কর কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। বিদেশস্থ যোগাযোগের ঠিকানাঃ রফিকুর রহমান, পুরাতন ষ্টেশন রোড, করিমগঞ্জ।]
সম্পাদকীয়
জয় আমাদের হবেই
সাত কোটি মানুষের আবাসভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ষষ্ঠ মাসে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে জয়যুক্ত করার শপথ নিয়ে ‘দুর্জয় বাংলা’ আত্মপ্রকাশ করলো। বাংলাদেশের প্রবিত্র মাটি থেকে খুনি সর্দার ইয়াহিয়ার পশু সৈন্যদল কে নিশ্চিহ্ন করে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার মহৎ ও কঠিন কাজের ব্রত ঘোষনা করেছে।
“দুর্জয় বাংলা” মনে করে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীণের সাহায্যপুষ্ট ইয়াহিয়ার বর্বর বাহীনীকে খতম করার জন্য সব চেয়ে বড় প্রয়োজন হলো বাংলাদেশের সমস্ত জনগণ এবং সংগ্রামী গণতান্ত্রিক শক্তির একতা। একতার শক্তি দিয়েই আমরা শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করবো।
আমাদের বীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা দুর্জয় সংকল্প নিয়ে শ্ত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিসহ বিশ্বের প্রগতিশীল জনগণও খুনি ইয়াহিয়ার গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে সোচ্চার।
এ মুহূর্তে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে কে আমাদের শত্রু ও কে আমাদের মিত্র। মিত্রদের এক হয়ে শত্রুদের আঘাত হানতে হবে, রুখতে হবে ইয়াহিয়ার সকল দুরভিসন্ধি ও ছলচাতুরী।
জয় আমাদের হবেই। আমরা সুনিশ্চিত।
.
.
কম্পাইলারঃ লাল কমল
<৬,২৪৯,৪২১-৪২২>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় |
স্বাধীন বাংলা মুজিব নগরঃ ৫ম সংখ্যা |
৬ নভেম্বর, ১৯৭১ |
[*স্বাধীন বাংলাঃ বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি-খোন্দকার সামসুল আলম দুদু কর্তৃক মুজিবনগর হতে প্রকাশিত ও স্বাধীন বাংলা প্রেস হতে মুদ্রিত।]
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার জাতিয় মুক্তি আন্দোলন সফল হবে কি-না এই সংশয় জড়ান প্রশ্নে দ্বিধা-গড়তার মেঘ ক্রমশঃ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে, রাজনীতির আকাশ মেঘমুক্ত ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম পর্যায়ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে একটা সুসংবদ্ধ রুপ পরিগ্রহ করছে অন্যদিকে বিশ্ববিবেক তার ঔদাসীন্য আর নৈর্ব্যত্তিক ভাব পরিত্যাগ করে ক্রমাগত বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই শুভ লক্ষণ স্বাভাবিকভাবে ও সহজেই পরিলক্ষিত হয়নি। সামগ্রিকভাবে বর্তমানে অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত বিরাট ত্যাগ তিতিক্ষা এবং জীবনপণ সংগ্রাম সাধনা অন্যদিকে তেমনি বন্ধু ও দরদী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জনগণের উল্লেখযোগ্য সক্রিয় ভূমিকা। ভারতের জনগণ বাংলাদেশের এই গণ আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকভাবে শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। ভারতের সর্ববস্তরের মানুষ কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, কেরানী, কর্মচারী, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন বিধানসভা ও আইনসভার সদস্যগণ সকল দেশের সংগ্রামের সমর্থনের অনুকূলে প্রস্তাব গ্রহন করেছেন। এতদিন যে সহমর্মিতার জোয়ার ভারতের জনসমুদ্রকে আন্দোলিত চঞ্চল করে তুলেছিল আজ তার ব্যপ্তি বহুদূর প্রসারিত। তারই প্রতিভাস আমরা লক্ষ্য করেছি। সুদূর লন্ডন, প্যারীস, মস্কো ও ভিয়েতনামে সেখানকার প্রগতিশীল গণতন্ত্রে ও স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ বাংলাদেশের এই সংগ্রামকে সমর্থন করে জোরালো বক্তব্য রেখেছন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গণসংগঠনের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করেছেন আর মুক্তিযুদ্ধকে মদত দিতে ব্যাপক জনমত গঠন করে চলেছেন।
বেহায়া খাঁন সাহেব (ইয়াহিয়া খাঁন না বেহায়া খাঁন) মার্কিন সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর সুযোগ নিয়ে এক অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা আন্দোলনকে আড়াল ও ক্ষুণ্ণ করার জন্য অবিরাম মিথ্যা অপপ্রচার ও নির্লজ্জ চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বিশ্বের জনমতকে ধোঁকা দিতে চাইছে এই অজুহাতে যে- বাংলাদেশের যা কিছু ঘটেছে তার পিছনে ভারতের চক্রান্ত ও হাত আছে এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। আর এই উছিলায় পুরো ঘটনাকে পাক-ভারত বিরোধের আকার দিতে চাইছে এবং সীমান্তে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করে ভারতের প্রতি রণহুংকার ছাড়ছে। আশ্চর্য এই বেহায়া খাঁন। নির্লজ্জতারও একটা সীমা থাকা উচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাবলীর অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা সদ্য মহাচীনের রাষ্ট্রপুঞ্জে আসন লাভ। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপুঞ্জে স্থায়ীভাবে প্রতিনিধিত্ব করার পরিপ্রেক্ষিতে এই আশা প্রকাশ করা যায় যে এবার হয়ত রাষ্ট্রপুঞ্জে তার নৈর্বত্তিক নির্লিপ্তভব ত্যাগ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে।
রাজনৈতিক সমাধানের রূপরেখা অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান্মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আরোপিত চারটি মৌল দাবির উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হবে। যেমন –প্রথমতঃ স্বাধীন বাংলাদেশ, দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের প্রিয়তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি, তৃতীয়তঃ বিনা শর্তে সমস্ত সৈন্য অপসারণ। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা ও মুক্তিবাহিনী এ বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে বহিপ্রচেষ্টা যতই প্রতিকূল কিংবা অনুকূলেই হোক না কেন বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ও জাতীয় মুক্তি একমাত্র নিরলস একনিষ্ঠ সংগ্রামের মাধ্যমে সম্ভব। কারন স্বাধীনতা অর্জিত হয়, প্রদত্ত হয় না।
–জয় বাংলা
.
.
কম্পাইলারঃ সাহুল আহমেদ মুন্না
<৬,২৫০,৪২৩>
শিরোনামঃ পাক সামরিক চক্রে বিরাট ভাঙ্গন
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা, মুজিব নগরঃ ৯ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৩ নভেম্বর, ১৯৭১
পাক সামরিক চক্রে বিরাট ভাঙ্গন
আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে পাক সামরিক চক্রে বিরাট ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে বলে লন্ডস্থ পাক সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল মনে করেছেন। ঐ মহলের খবরে পাক সামরিক সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল মনে করেছেন। ঐ মহলের খবরে প্রকাশ পাক সামরিক সরকারের প্রাক্তন বৈদেশিক দপ্তরের সচিব মুহঃ ইউসুফ, ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব আহম্মদ এবং জেনারেল টিক্কা খানের চাপে বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়ে পিকিং – এ দৌত্য করতে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু সিন্ধুর গভর্ণর গুল রহমান এবং পাঞ্জাবের গভর্ণর মেজর জেনারেল আতিকুর রহমান ইয়াহিয়ার এই সিদ্ধান্তের ঘোরতর বিরোধী। ফলে পর্দার আড়ালে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠছে। ভুট্টোর পিকিং সরকারের সমর্থন সংগ্রহের জন্য সদ্য সমাপ্ত চীন সফরের ফলাফল সম্বন্ধে দুই মহলের অবস্থান দুই মেরুতে।
জনাব ভুট্টো বলেছেন তাঁর সফর সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। পক্ষান্তরে সিন্ধু ও পাঞ্জাবের গভর্ণর মনে করেছেন ভুট্টো খালি হয়াতে চীন থেকে ফিরে এসেছেন। তারা আরও বলেছেন, বৃটেন ভারতের প্রতি যেমন প্রকাশ্য সমর্থন জানাচ্ছেন তার ভগ্নাংশ পর্যন্ত সীন সরকার পাকিস্তানের প্রতি জানাচ্ছে না।
পাকিস্তানকে ঢালাও অস্ত্র সাহায্যের জন্য চীনের প্রতিনিধিদের নিকট জনাব ভুট্টো যে করুন আবেদন জানিয়েছিলেন তার প্রত্যুত্তরে চীনের সরকারী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ভুট্টোকে নাকি বলা হয়েছে যে, অস্ত্র সরবাহ পশ্চিম পাকিস্তানে না দিয়ে চীন পূর্ববঙ্গে দিতে ইচ্ছুক। ওয়াকিবহাল মহল চীনের উপরোক্ত অভিমত থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মূল চীনে চিয়াং কাইশেককে প্রদত্ত আমেরিকান অস্ত্র যেমন মাও সে তুং দখল করে বিপ্লবী কৌশল প্রয়োগ করে চিয়াং কাইশেককেই উৎখাত করেছিলেন তেমনি পূর্ববঙ্গে চীন যদি অস্ত্র সরবাহ করে তবে সে অস্ত্র শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পৌছাবে এবং ইয়াহিয়া সরকারের উচ্ছদের জন্যই ব্যবহৃত হবে। চীনের এই সিদ্ধান্তের গূঢ় উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ইয়াহিয়া বেশ সতর্ক হয়েছেন।
অন্যদিকে আবদুল গাফফার খাঁনের পুত্র ওয়ালি খানের জাতীয় আওয়ামী দল উত্তর পশ্চিম সীমান্তে এবং বেলুচিস্তানে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ঐ দল ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী করার সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী। সিন্ধু ও পাঞ্জাব দুটো প্রদেশে ভুট্টোর প্রভাব যেমন বেশী তেমনি বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্তে ওয়ালিপন্থী জাতীয় আওয়ামী দলের প্রভাব সর্বজনবিদিত। ফএল সামগ্রিকভাবে ইয়াহিয়া সরকারের অভ্যন্তরে এক ঝড়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সে ঝড় শীঘ্রই উঠবে এবং নিঃসঙ্গ ইয়াহিয়া তার শিকার হতে বাধ্য।
.
.
কম্পাইলারঃ সাহুল আহমেদ মুন্না
<৬,২৫১,৪২৪-৪২৬>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা, মুজিব নগরঃ ১০ম ও ১১শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
‘একদা এক ব্যাঘ্রপ্রবর বৃদ্ধ ও অর্থব হওয়ায় খাদ্য সংগ্রহে অসমর্থ হইয়াছিল। কিন্তু স্বপ্রচেষ্টায় খাদ্য সংগ্রহ করিতে না পারিলে ক্ষুধায় প্রাণ যায়, ফলে সেই ব্যাঘ্র তৎকর্তৃক নিহত এক ব্যাক্তির সুবর্ণ কঙ্কণদ্বয় লইয়া এক পঞ্চপল্বল সমাচ্ছন্ন দীর্ঘিকা সংলগ্ন পথিপাশ্বে সাত্বিকভাবে আহার্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে লোভী পথিকের আশায় বসিয়া রহিল”। … ইত্যাদি ইত্যাদি…। কথামালার গল্পে এই ধরনের গল্পকথা পড়িতে পাওয়া যায়। কিন্তু মনুষ্য সমাজও যে এ ধরণের বহু ভেকধারী হিংস্র শ্বপদের বিচরণক্ষেত্র তাহার উৎকৃষ্ঠতম প্রমাণ বর্তমান ভুট্টো – ইয়াহিয়া সামরিক জান্তা ও তাহাদের দালাল বাংলাদেশবাসী মুসলিমলীগ পন্থী বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকের দল।
কয়েকদিন পূর্বে মুক্তাঞ্চল ও ফিল্ড হাসপাতাল পরিভ্রমণে গিয়া উপরোক্ত গল্পটি ও পরিণাম পাশাপাশি চোখের সম্মুখে পড়িয়া গেল। মুক্তাঞ্চলের বুকে নেকড়ের ফেউদের রাতের অন্ধকারে ছিটাইয়া যাওয়া একখানি ইস্তাহার একজন গ্রামবাসী আমাদের হাতে দিল। ইস্তাহারে লিখা ছিল – ‘ইসলাম পাকিস্তানের প্রানকেন্দ্র” , “পাকিস্তান ইসলামের দূর্গ” সে সঙ্গে ধর্মের জিগির দিয়া বাঙ্গালী মুসলমানদের মার্শাল ‘ল’ কর্তৃপক্ষের নিকট আত্নসমর্পনের জন্য অনুরোধ ও প্ররোচণা। স্বাক্ষর ছিল জনৈক আহম্মদ আলি বিশ্বাস, চেয়ারম্যান আলমডাঙ্গা শান্তি কমিটির। সেই শান্তি নিদর্শন পাওয়া গেল বি, ভি, এ, সি ফিল্ড হাসপাতালে। উক্ত অঞ্চলের দুইজন গ্রামবাসী মুক্তিফৌজের ঠিকানা না বলিতে পারার শান্তি কমিটি চাবুকের আঘাতে সমগ্র পৃষ্ঠদেশের চামড়া তুলিয়া এবং সবুট পা এর লাথিতে পাজরার হাড় ভাঙ্গিয়া দিয়া শান্তি নমুনা দেখাইয়াছে।
কিন্তু ইহা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ও তাহার পদলেহী কুত্তার দল মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ডভাবে মার খাইয়া আজ শান্তিবাহিনী প্রচারকের মুখোশ পরিতে বাধ্য হইয়াছে। কিন্তু পর্দার অন্তরালে তাহাদের বাঙ্গালীর তাজা খুনের লোভে স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। তাই তাহারা একাধারে প্রচার চালাইতাছে বাংলা শান্ত (?) কেবল মাঝে মাঝে দুষ্কৃতিকারী (!) দের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চলিতেছে; অপরদিকে যত্রতত্র যখন তখন কারফিউ জারী করিয়া মুক্তিফৌজ গেরিলাদের সন্ধান গৃহে গৃহে তল্লাশী ও জনসাধারণের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাইতাছে। দোসর হইয়াছে শান্তি কমিটির ভেকধারী, বাঙ্গালীর কলঙ্ক মুসলিম লীগ পন্থী ভাড়াটিয়া দালালগণ।
শুধুমাত্র প্রশাসনই নহে মুক্তিফৌজের আক্রমণ ও বাঙ্গালির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অসহযোগিতার ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ প্রচন্ডভাবে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। বাংলার অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ও প্রশাসন সুষ্টভাবে চলিতেছে ইহার প্রমাণ করিতে না পারিলে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ঋণ দিতে অস্বীকার করিয়াছে। মুক্তিবাহিনীর নিরলস, বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করিবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম ও তৎসহ নৌবাহিনী ও গানবোটের নিশ্ছিদ্র প্রহরার ফলে বিদেশী সাহায্য দ্রব্যসহ কোন জাজাহ পাকিস্তানের বন্দরে যাইতে পারিতেছে না। ফলে বর্হিবাণিজ্য এবং সাহায্য প্রাপ্তির আশা সুদূরপরাহত। কোন বাঙ্গালীর নিকট হইতে তাহারা একটি পয়সাও কর বা খাজনা পাইতেছে না। ফলে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠিয়াছে জঙ্গীশাহী ও তাহার দালালদের মধ্যে। বাঙ্গালীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিবার জন্য তাহারা নানারূপ ছলনা ও তৎসহ বিনীত প্রার্থনার আশ্রয় লইয়াছে। উক্ত ইস্তাহারে এও লেখা আছে, “ আমাদের একান্ত অনুরোধ আপনাদের ছেলেমেয়ে স্কুল ও কলেজে পাঠাইয়া শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করুণ। খাজনা ও বিভিন্ন প্রকারের করদান করিয়া পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত করুন”।
এত প্রলোভন, প্ররোচনা বা নিরযাতন সত্ত্বেও আজ এ কথা স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে,পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নাই, যে জাগ্রত বাঙ্গালীর প্রাণে যে স্বাধীনতা সূর্যালোক দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা বিনষ্ট করিতে পারে- বিনষ্ট করিতে পারে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ় শপথবদ্ধ সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর সংগ্রামী ঐক্যকে। দিকে দিকে মুক্তিবাহিনীর বলদীপ্ত অগ্রগতি, ১৭-১১-৭১ সকাল সাড়ে পাঁচটা হইতে ঢাকার বুকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ, পাক বাহিনীর যত্রতত্র মুক্তিফৌজের ভুতদর্শন প্রভৃতি ইহার স্বাক্ষর বহন করিয়া চলিতেছে।
তবুও আত্মসন্তষ্টির সময় নয়। আজ ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর সম্মুখে কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হইয়াছে। যে কোন বাঙ্গালীর সামান্যতম ভুলের জন্যও জাতির জীবনে নিদারুণ সংকট নামিয়া আসিতে পারে। তাই প্রতিটি বাঙালীকেই আজ প্রতিটি পদক্ষেপ করিতে হইবে সুচিন্তিতভাবে। যাহাতে বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বেঈমান দলের আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ না ঘটিতে পারে তাহার জন্য প্রখর দৃষ্টি রাখিতে হইবে। তৎসহ সর্বপ্রকারে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করিতে হইবে মুক্তিফৌজে যোগ দিয়া, তাহাদের আহার্য ও আশ্রয়ের ত্বরান্বিত এবং আমরা লাভ করিব আমাদের ইপ্সিত ফল শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ।
* * * *
মোহাররম আর রমজান। পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিকট পবিত্রতম দুইটি মাস। রমজান মাসের প্রথম দিন হইতে প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান সূর্যোদয়ের পূর্বে শয্যাত্যাগ করিয়া পবিত্র শুচিশুদ্ধভাবে আল্লাহ পাক-এর উদ্দ্যেশে নামাজ পড়ে। সমস্ত দিন সর্বপ্রকার আহার্য মাদক দ্রব্য বর্জন করিয়া সাত্ত্বিকভাবে সংসার তথা পৃথিবীর কল্যানের জন্য খোদা তায়ালার নিকট নির্দিষ্ট ওয়াক্ত অনুযায়ী মোনাজাত করে। রমজানের শেষে সমস্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ঈদ্গাহ ময়দানে একত্রিত হয় নামাজ পড়ে কোরান শরিফ পাট শোনে। রমজান মাসের ঐতিহ্য লইয়া আলোচনা করে গোটা মাস ধরিয়া হিংসাদ্বেষ বর্জন করিয়া সংযম শিক্ষা করিয়া শাস্ত্রের অনুশাসন পালন করে পৃথিবীর প্রতিটি মুসলমান।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বুকে রমজান মাস পালিত হইতেছে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের রক্তের হোলঈখেলার দ্বারা। অথচ নরমুণ্ডের দ্বারা গোন্ডুয়া তথা বাঙালীর খুনে হোলীখেলার সুদক্ষ ক্রীড়াবিদ ইয়াহিয়া ভুট্টো এবং তাদের সামরিক জুন্টা ও দালালরাই প্রচার করিতেছে বাংলার মুসলমানরা নাকি কাফের হইয়া গিয়াছে, তাহারা পবিত্র ইসলামের অবমাননা করিয়াছে। শুধু তাহারাই নহে বাঙালী কাফের মুসলমানদের জন্য তাহাদের তাহজীব তমদ্দুন বিপন্ন হইয়াছে। শুধু তাহাই নহে, বিপন্ন অবস্থা হইতে ত্রাণলাভের জন্য পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রের দরবারে করুণ আকুতি জানাইয়াছে। এবং কতিপয় রাষ্ট্রও পরের মুখে ঝাল খাইয়া, বাংলাদেশের সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া মন্তব্য করিয়া দূর হইতে গোঁফে তা’ দিতেছে।
কিন্তু সরাবের পেয়ালায় চুমুক দিয়া বাঙ্গালীর রক্তে হস্তরঞ্জিত করিয়া জঙ্গীশাহী কোন ইসলামের অনুশাসন পালন করিতেছে। কোন হাদিসে লেখা আছে নররক্তোশ্মান করিলে ধর্ম্রাজ্য স্থাপিত হইবে।,বেহেস্ত নামিয়া আসিবে মর্তের বুকে? নারী ধর্ষন, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করিয়াই একমাত্র ইসলাম ধর্ম পালন করা যায় এ কোন নবীর উপদেশ? কোন আল্লাহ-পাক’এর নির্দেশ? এ কথা একবারও কি সেই ইসলামের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রনায়কগণ চিন্তা করিয়াছেন! এবারো কি তাহারা সেই এজিদ সিমারের উত্তরসূরী ইয়াহিয়া ও তাঁর সামরিক জুন্তাদের জিজ্ঞাসা করিয়াছে, রাতের অন্ধকারে ট্যাঙ্ক, মর্টার, কামানের গোলায়, বিমান কর্তৃক বোমাবর্ষনের দ্বারা গ্রাম, নগর, জনপদ শ্মশানে রূপান্তরিত করার নীতি কোন জঙ্গনামায় লিখিত আছে? আমরা জানি তা’ তাহারা করেন নাই। কারণ তাহারাও জানেন আর আমরা বাঙালীও জানি এর পশ্চাতে আছে সাম্রাজ্যবাদী শোষনের হীন কলাকৌশল। আছে নয়া উপনিবেশ কায়েম রাখিবার জন্য বিংশ শতাব্দীর সীমারদের হিংস্র থাবা।
তাই আজ এ কথা স্পষ্ট বলিয়া দেওয়ার সময় আসিয়াছে যত জমকালো আবরণেই হোক না তাহা ধর্মীয় জিগির, হোক না তাহা বিচ্ছিন্নতাকামীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান সেই আবরণকে ভেদ করিয়া তোমাদের স্বরূপ আজ বাঙ্গালীর দৃষ্টিতে প্রকাশিত হইয়া গিয়াছে। রমজান মাসের শেষ আকাশে ঈদের পবিত্র চাঁদ দেখা গিয়াছে। সাবধান এজিদ সীমারের দল, এ চাঁদ শুধুমাত্র পবিত্র ঈদের চাঁদ নহে। এ চাঁদ পরাধীনতার আমাকে নিশ্চিত করিয়া স্বাধীনতার চন্দ্রোদয়। অদূরভবিষ্যতে বাঙালী মুক্তি্যোদ্ধারা তোমাদের নিশ্চিহ্ন করিয়া স্বাধীনতার পুর্ণচন্দ্রকে ছিনাইয়া আনিবে। কোন ভেদ নীতি বা সহসা প্রতিবন্ধক আমাদিগকে দমাইয়া রাখিতে পারিবেনা। কারণ আমরা প্রথমে বাঙালী তারপরে হিন্দু বা মুসলমান ।
.
.
কম্পাইলারঃ সাহুল আহমেদ মুন্না
<৬,২৫২,৪২৭-৪২৮>
শিরোনামঃ শান্তির পারাবাত
সংবাদপত্রঃ আমার দেশ** বাংলাদেশঃ ১১শ সংখ্যা
তারিখঃ ১১ নভেম্বর, ১৯৭১
[** আমার দেশঃ সাপ্তাহিক। সম্পাদকঃ খাজা আহমদ। মুক্ত বাংলার কোন এক অঞ্চলে “আমার দেশ” মুদ্রনালয় হতে মুদ্রিত ও “আমার দেশ” কার্যালয় হতে খাজা আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত।]
শান্তির পারাবাত
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী উপমহাদেশের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির মুখে পাশ্চাত্য দেশগুলোর সফর শেষ করিয়া স্বদেশে ফিরিয়া আসিতেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আজীবন গণতন্ত্রের পূজারি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কি পরিস্থিতিতে শান্তির সন্ধানে বাহির হইয়াছেন। তা প্রণিধানযোগ্য। ২৫শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে এশিয়ার খুদে হিটলার ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়ার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ লোকালয় জনপদ ধ্বংস ও নারী নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্রের জলস্রোতের মত বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত পার হইয়া ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মানবতার খাতিরে সীমান্ত পথ বন্ধ করিয়া দিয়া ছিন্নমুল ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি শরণার্থীদের নরখাদক ইয়াহিয়ার জল্লাদ সৈন্যদের কামানের মুখে ঠেলিয়া দিতে পারেন নাই। বরং পাক বাহিনীর গণহত্যা, গণতন্ত্র হত্যা ও নারী নির্যাতনের মত পৈশাচিক বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবতাকে বাচাইবার প্রয়োজনে তিনি বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাইয়া গণতান্ত্রিক মুল্যবোধ ও মানবিক আদর্শের উজ্জ্বল স্থাপন করিয়াছেন। বর্বর ইয়াহিয়া পাকিস্তানের ‘সংহতি ও অখন্ডতা’র নামে ‘ইসলাম’ রক্ষার ছদ্মাবরণে বাংলাদেশকে পশ্চিমা কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করিবার জন্য বাংলাদেশ ১০লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করিয়া, তিন কোটি বাঙ্গালীকে গৃহহারা করিয়াছে, এক কোটি বাঙ্গালীকে ভারত ভুখন্ডে বিতাড়িত করিয়া ভারতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করিবার অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত হইয়াছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়া অনগ্রসর একটি দেশের পক্ষে এই বিপুল বোঝা বহন করা এককভাবে অসম্ভব ব্যাপার। স্বভাবতঃই আশা করা গিয়াছিল বিশ্বগোষ্টী এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ও তজ্জনিত ব্যাপক সংকট রোধে সক্রিয়ভাবে আগাইয়া আসিবেন। কিন্তু বাংলাদেশে গণহত্যা ও গণতন্ত্র হত্যা থেকে ইয়াহিয়াকে বিরত করার জন্য এবং শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়ার মানবিক কাজে বিশ্বগোষ্টীর কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় নাই। বরং কোন কোন গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র জল্লাদ ইয়াহিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা ও জনপদ উচ্ছ্যেদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করিয়াছে। এমনকি কোন কোন রাষ্ট্রের তর্জনি সংকেতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো গংরা ভারতের সার্বভৌমত্তের উপর আঘাত হানিবার জন্য সীমান্ত সৈন্য মোতায়েন করিয়া যুদ্ধোন্মদনায় মাতিয়া উঠিয়াছে। শুধু তাহাই নয়, ভারত বিরোধী প্রচারণা, উগ্র সাম্প্রদায়িক ভেদভুদ্ধিতে উস্কানি দিয়া ভারতের রাজনইতিক,সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করিবার চক্রান্ত চালানো হইতেছে। এমনি এক দুর্বিসহ সংকট ও চাপের মুখেও ভারত মানবতার খাতিরে প্রশংসনীয়ভাবে এহেন সমস্যার মোকাবিলা করিতেছে। সাথে সাথে ভারত বাংলাদেশে পাক বাহিনীর নৃশংস বর্বরতা বন্ধ করিয়া বাংলাদেশে নির্বাচিত সদস্যদের ইচ্ছানুযায়ী জনগণের আশা-আকাংক্ষার পরিপূরক একটই ন্যাসঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বগোষ্ঠীর প্রতি আবেদন জানান। কোন কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষের কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধুকে বিনাশর্তে মুক্তি দিয়া তাহার সাথে সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানান। কিন্তু দুর্বিত্ত ও কপট ইয়াহিয়া বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে পাক-ভারত বিরোধ রূপে চিত্রিত করিবার দুরভিসন্ধি নিয়া দখলীকৃত বাংলাদেশে ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করিয়া কোন কোন উপনিবেশবাদী প্রভুর উৎসাহে ও প্রেরণায় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধাইবার সর্বনাশ খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে।
এমনি এক অবস্থায় একদিকে এক কোটি শরনার্থীর চাপে সৃষ্ট ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা, অন্যদিকে মুরব্বিদের আশীর্বাদপুষ্ট ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়ার রণহুংকার জনিত উপমহাদেশে শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বিচলিত করিয়া তোলে। তদপুরি কোন কোন বৃহৎ শক্তির বাংলাদেশে ফ্যাসিষ্ট বর্বরতাকে দীরঘায়িত করিয়া এবং শরণার্থী সমস্যাকে জিয়াইয়া রাখিয়া উপমহাদেশে ‘বরের পিসি ও কনের মাসী’ সাজিবার নিষ্ঠুর চক্রান্তে শ্রীমতি গান্ধী উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়া সফরে গিয়া এই সব দেশের সরকার ও জনগণকে বাংলাদেশ সংকটের মূল কারণ এবং শরণার্থী সমস্যা সমাধানের গুরুত্ত বুঝাইয়া বলিয়াছেন। তিনি এই কথাও স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করিতে হইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বুঝাপড়া করিতে হইবে-ভারতের সঙ্গে নহে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হইয়াছে। বাংলার বিস্তীর্ন এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। তদপুরি রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকার চারটি পুর্বশর্ত ঘোষণা করিয়াছেন। উপরোক্ত শর্তের আলোকে শ্রীমতি গান্ধী বৃহৎ শক্তিগুলোকে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের মূল সূত্র কোথায় তা বুঝাইতে সক্ষম হইয়াছেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। পাকিস্তানের যুদ্ধোন্মদনা ও অব্যাহতভাবে ভারত ভুখন্ডে গোলাগুলিবর্ষণের মুখে শ্রীমতি ইন্দিরার পাশ্চাত্য দেশ সফরের গুরুত্ব বিশ্ববাসী উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন বলিয়াও আমাদের ধারণা। স্বদেশে ফিরিয়া আসিয়া শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সংকট সমাধানে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবর্গের মনোভাব সম্পর্কে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে পর্যালোচনা করিয়া বাংলাদেশ প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন বলিয়া ওয়াকেবহাল মহলের ধারণা। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের ৭০ কোটি মানুষের আশা-আকাংক্ষার পরিপূরক হিসাবে শ্রীমতি গান্ধী কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাহাই দেখিবার জন্য আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করিতেছি।
.
.
কম্পাইলারঃ এফ এম খান
<৬,২৫৩,৪২৯>
সংবাদপত্রঃ আমাদের বাংলাদেশ
তারিখঃ ১১ নভেম্বর, ১৯৭১
মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু
পরশুরাম থানার বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।মুক্তাঞ্চলের জনসাধারণের সুবিধার প্রতি নজর রেখে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।মুক্তাঞ্চলের জনসাধারণের অভাব অভিযোগ স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করার জন্য বাংলাদেশ সরকার আহবান জানিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন ও জীবনযাত্রা পুর্নগঠনের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
.
.
কম্পাইলারঃ এফ এম খান
<৬,২৫৪,৪৩০-৪৩১>
সংবাদপত্রঃ আমার দেশ
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
আঘাতের পর আঘাত হানুন
ক্ষুধিত বাংলায় রক্তের আবিরে রাঙ্গানো স্বাধীনতা সূর্য উদিতপ্রায়।পাক জঙ্গী চক্রের পাশবিক তাণ্ডবের প্রতিশোধ নেয়ার দুর্বার স্পৃহার আঘাত-জর্জর বীর মুক্তিবাহিনী রক্তাক্ত বাংলার সর্বত্র শত্রু হননের মহোৎসব শুরু করিয়া দিয়াছেন।শত্রুদের হাত হইতে কাড়িয়া নেওয়া অস্ত্র দিয়া পাক জানোয়ারদের বিষদাঁত ভাঙ্গিয়া দিয়া বাংলার পবিত্র মাটিকে শত্রুমুক্ত করিতেছেন।পবিত্র ঈদুল ফিতরে বিক্ষুব্ধ বাঙ্গালীরা শোকার্ত জীবনের জমাট বাঁধা পাষাণকে ইস্পাত রুপান্তরিত করিয়া করিয়া পাষণ্ড ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর উপর সর্বাত্মক আক্রমণ ভালাইয়া তাহাদের যুদ্ধোন্মাদনার খায়েশ চিরতরে মিটাইয়া দিতেছে।ক্ষিপ্তগতিতে সুসংগঠিত হইয়া মুক্তিবাহিনী দুর্বার গতিতে শত্রুদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া শত্রুদের শক্ত ঘাঁটিগুলি নাস্তানাবুদ করিয়া দিতেছে।ফাঁদে পড়া জন্তুর মতো স্থুলবুদ্ধি ইয়াহিয়া ও তাহার জঙ্গী জেনারেলরা বাংলাদেশে সন্মুখে ও গেরিলা যুদ্ধে আটকা পড়িয়া নতুন নতুন চালবাজী করিয়া পরাজয়ের গ্লানিকে চাপা দিবার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হইয়াছে।তাই বাংলাদেশের কেদো মাটিতে আটকা পড়া পাক জঙ্গীশাহীকে টানিয়া তুলিবার জন্য ইয়াঙ্কি নিক্সন ও তাহার সাঙাতরা তলে তলে দিশেহারা ইয়াহিয়া ও তাহার সাগরেদদের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ও পশ্চিম পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করিয়া ভারতের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ চালাইয়া যাইবার পরামর্শ দিয়াছে।তাহাদের পরামর্শ অনুযায়ী ইয়াহিয়া সীমান্তে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করিয়া ভারত ভূখণ্ডে অনবরত গোলাগুলি নিক্ষেপ করিতেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে কপাট ইয়াহিয়া জঘন্য মিথ্যর বোসাতি করিয়া ‘ ভারতীয় হামলা’ জিগির তুলিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও পাক বাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধকে পাক-ভারত অঘোষিত যুদ্ধ বলিয়াখেঁকি কুকুরের মতো তার স্বরে চীৎকার করিতেছে।সঙ্গে সঙ্গে গণহত্যা ও গণতন্ত্র হত্যার আন্তর্জাতিক নায়ক নিক্সন ও তাহার গেঁউরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ বলিয়া উত্তেজনা প্রশমনের জন্য উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের অযাচিত উপদেশ বর্ষণ করিতে শুরু করিয়াছেন।
.
ইহদের এইরূপ অযাচিত উপদেশের মধ্য যে হীন চক্রান্তের জড়াইয়া রহিয়াছে তাহা সহজেই অনুমেয়।বাংলাদেশে দীর্ঘ আট মাস ধরিয়া ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ড যখন বিনা বাধায় সংগঠিত হইয়াছে তখন এই সব উপদেশ বর্ষণ করা হয় নাই।বরং অর্থ অস্ত্র ও পরামর্শ দিয়া ইয়াঙ্কি নিক্সন বাংলাদেশকে চূর্ণবিচূর্ণ ও ধ্বংস করার প্রত্যক্ষ মদত দিয়াছে।মাও-নিক্সন এশিয়ার ভারসাম্য রক্ষার যূপকাষ্ঠে বাংলাদেশকে বলি দিয়া উপমহাদেশের পানি ঘোলা করিয়া তাহাদের হীন জাতীয় স্বার্থ লুটিবার তালে মত্ত হইয়াছে।ইহাদের কাছে মানবতা ও বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
.
এদিকে মুক্তিবাহিনীর মৃত্যু-ভাবনাহীন যোদ্ধাদের অব্যর্থ ও শানিত অস্ত্রের আঘাতে বাংলাদেশে পাষণ্ড ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী যখন কদলী বৃক্ষের মতো ঢলিয়া পড়িতেছে তাহাদের সমর বূহগুলো যখন ফুঁৎকারে উড়িয়া যাইতেছে তখন ইয়াহিয়ার প্রভুদের মধ্যে কেউ কেউ আন্তর্জাতিক আমলাদের বৈঠকখানা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী অধিবেশন ডাকার তোড়জোড় করিতেছে।যদি নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ভারতকে জড়িত করিয়া মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত সংঘর্ষ হিসাবে রূপ দিয়া বিরোধ মীমাংসার নামে কাল হরণ করিয়া দিশাহারা ও পতনোন্মুখ পাক বাহিনীকে দম ফেলিবার সুযোগ দেওয়া যায় তাহা হইলে বাংলার স্বাধীনতাকে ঠেকানো সম্ভব হইবে।
.
আন্তর্জাতিক চক্রান্তের এই সন্ধিক্ষণে সারা বাংলাদেশের মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা আজ এক বিরাট অগ্নিপরীক্ষার সন্মুখীন। অতীতে আমরা বহু আন্তর্জাতিক চাল ও চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছি।এইবারকার সর্বশেষ আন্তর্জাতিক চক্রান্তকেও আমাদের যে কোন মূল্যে ব্যর্থ করিয়া দিতে হইবে।তাই বাংলার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভিতরে ও বাহিরে সম্মুখ সমরে ও গেরিলা পদ্ধতিতে এবং প্রতিরোধ ও অসহযোগিতায় ক্লান্ত ও হীনবল শত্রুবাহিনীকে আঘাতে আঘাতে লণ্ডভণ্ড করিয়া লাখ লাখ বাঙালী হত্যার প্রতিশোধ নিতে হইবে এবং সমগ্র দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে যাতে করিয়া আন্তর্জাতিক কুচক্রীর বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কোন রকমেই ঠেকানোর সুযোগ না পায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চার পর্যায়ে এখনো যাহারা বাধ্য হইয়া শত্রুর সঙ্গে সহযোগীতা করিয়া চলিয়াছেন তাহাদের এখন মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইবার সময় আসিয়াছে।শত্রুরা আজ চারদিক দিয়া কোণঠাসা ও অবরুদ্ধ। এই মহেন্দ্রক্ষণে শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়া শত্রুদের নড়বড়ে ও ভঙ্গুর প্রশাসন ব্যবস্থাকে বানচাল করিয়া দিন।অনুতাপহীন রাজাকার ও দালালদের প্রতি আমাদের কো বক্তব্য নাই। তাহাদের বিদেশী প্রভুদের মতো তাহাদিগকেও একই পরিণতি বরণ করিতে হইবে এবং তাহাদের সেই পরিণতি হইলো গ্লানিকর মৃত্যু-একথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেন।সুতারাং আমাদের আবেদন-শত্রুদের উপর আঘাতের পর আঘাত হানুন, ওদের নিশ্চিহ্ন করিয়া দিন।
.
.
কম্পাইলারঃ এফ এম খান
<৬,২৫৫,৪৩২-৪৩৩>
সংবাদপত্রঃ আমার দেশ বাংলাদেশঃ ১৩শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
পাক তাসের ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে
যশোর-খুলনা-কুষ্ঠিয়া ও ফরিদপুরের ৮০ ভাগ মুক্তঃসকল জেলা থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্নঃকিশোরগঞ্জ শহর অবরুদ্ধঃফেনীর কাছে বহু শত্রুসেনা হতাহত ও ধৃতঃপ্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারঃ
ছাগলনাইয়া মুক্ত
ফেনীর দিকে মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
লাখো মানুষের রক্তস্রোত পেরিয়ে আজ আমরা মুক্তির নবদিগন্তে উপনীত হতে চলেছি।হানাদার ‘নজি’রা পৃথিবীর জাগ্রত বিবেকের ঘৃণা ও আক্রোশ এবং বাংলার মরণজয়ী বীর মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিপাগল জনতার দুর্বার আঘাতে তৃণখণ্ডের মতো ইতিহাসের অন্ধকার আবর্তে তলিয়া যাচ্ছে।নদী মেখলা বাংলার নরম মাটিতে জল্লাদ ইয়াহিয়ার কসাই বাহিনী লাখ লাখ বাঙ্গালীর তাজা রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করে যে শোষণ-সৌধ নির্মাণ করেছিল মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আঘাতে তা আজ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।রক্তাক্ত বাংলার চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী পাক নরপশুদের অবরুদ্ধ করে ঘায়েল করে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছেন রাজধানী ঢাকার দিকে।তাদের পেছনে হানাদারমুক্ত এলাকাগুলোতে রক্তখচিত বাংলার পাতাকা পত পত করে উড়ছে। মুক্ত স্বদেশের মানুষের মনে বয়ে চলছে বিজয়ানন্দের হিল্লোল।
ফেনীর তিন দিকে মুক্তিবাহিনী
গত তিনদিন মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ছাগলনাইয়া থানা সমপূর্ণরূপে মুক্ত করে দুর্বার গতিতে ফেনী শহরের দিকে এগিয়ে গেছেন।ছাগলনাইয়া থানার দক্ষিণাংশে চাঁদগাজী ও মুন্সিরহাটে দুটি প্রচণ্ড সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী বহুখানসেনা ও রাজাকারকে হতাহত করেছেন।মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণের প্রচণ্ডতায় ভীত সন্ত্রস্ত পাক পশুরা অনবরত পিছু হটতে হটতে এখন ফেনীতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাবার সময় তারা বহু অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ ফেলে যায়। এখন ফেনী শহর ছাড়া-সমগ্র মহাকুমা কার্যত মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন।
পার্বত্য চট্রগ্রামের পূর্বাংশ মুক্তঃপাক হেলিকপ্টার ভুপাতিত
গত কয়েকদিন মুক্তিবাহিনী পার্বত্য চট্রগ্রামের রামগড়ের উত্তর পূর্বাংশ ও তবলছড়ি এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে বহু খানসেনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে উক্ত এলাকা মুক্ত করেছেন।মীরেরশরাইতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন খান সেনাকে হত্যা ও বেশ কয়েকজন খান সেনাকে আহত করেছেন।চট্রগ্রাম শহরে গেরিলা তৎপরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমপূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে।রামগড় এলাকায় একটি পাক হেলিকপ্টারকে মুক্তিবাহিনী গুলি করে ভূপাতির করেন।
এ সাপ্তাহে দিনাজপুরের অমরখানা,জগদ্দলহাট ও হিলি এলাকা মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী অভ্যন্তরভাগে এগিয়ে চলছেন। এখানে বহু পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়েছে।রংপুর জেলার আলোক দীঘি ও আগ্রা পুকুরে ১২ জন খান সেনাকে মুক্তিবাহিনী হত্যা করেছেন।
.
.
সাতক্ষীরা মহাকুমা মুক্ত
মুক্তিবাহিনী গত ২২ শে নভেম্বর খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহাকুমা মুক্ত করেছেন।এখনকার আক্রমণে বহু খান সেনা নিহত ও আহত হয়।শত্রুদের বহু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। সাতক্ষীরা মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনী বীর বিক্রমে খুলনা শহরের দিকে চলেছেন। বিলম্বে পাওয়া এক খবরে বলা হয়েছে,গত ১৪ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী বাগেরহাটে ১০ জন ও বাখেরগঞ্জে ৫ জন খান সেনাকে হত্যা করেন।মুক্তিবাহিনী গত ২৩ শে নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে পাক পশুদের অনেককে হত্যা করেন।বাকীরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলে কানাইঘাট মুক্ত হয়।
ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহাকুমায় শহর ছাড়া চারিদিক মুক্ত করা হয়।মুক্তিবাহিনী কিশোরগঞ্জ শহরে খান সেনাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।
.
.
এফ এম খান
<৬,২৫৬,৪৩৪>
সংবাদপত্রঃ আমার দেশ বাংলাদেশঃ ১৩শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
পরশুরাম-ছাগলনাইয়া-পার্বত্য চট্রগ্রামের মুক্তাঞ্চলে
পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তাদের সফর
( বার্তা পরিবেশক)
ছাগলনাইয়া থানার দেড় শতাধিক বর্গমাইল, পরশুরাম থানার শতাধিক বর্গমাইল এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম জিলার ছয় শতাধিক বর্গমাইল এলাকা সফর করে আসছেন-বাংলাদেশ সরকারের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসন বিভাগের প্রতিনিধিবৃন্দ।মুক্তাঞ্চলের জনগণ “জয় বাংলা” ধ্বনি সহকারে প্রতিনিধিকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।প্রতিনিধিগণ জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেনঃসেদিন আর বেশি দূরে নয় যে দিন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে।বাংলার নয়নমণি ‘ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ গঠন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুণ। সরকার আপনাদের সকল অভাব অভিযোগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন।
প্রতিনিধিগণ দেশের চাষী,কামার-কুমার প্রত্যেককে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের আহবান জানান এবং কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশকে সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলার আহবান জানান।
উক্ত প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী এম,এন,এ অর্থ দফতরের চেয়ারম্যান জনাব খাজা আহমদ এম,এন,এ সাহায্য ও পুনর্বাসন দফতরের অস্থায়ী চেয়ারম্যান জনাব ফজলুল হক বি,এস,সি,এম,এন,এ প্রচার দফতরের চেয়ারম্যান জনাব এ,বি,তালেব আলী এম,পি,এ এবং এ্যডমিনিষ্ট্রেটিভ অফিসার জনাব এম,এ সামাদ সি,এস,পি প্রমুখ।
.
.
মুক্তাঞ্চলের জনগণের প্রতি পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসনের বক্তব্য |
আমার দেশ বাংলাদেশঃ ১৩শ সংখ্যা |
২৫ নভেম্বর, ১৯৭১ |
সজীব বর্মণ
<৬,২৫৭,৪৩৫-৪৩৭>
.
মুক্তাঞ্চলের জনগণের প্রতি পূর্বাঞ্চলীয়
প্রশাসনের বক্তব্য
বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা বর্তমানে বীর বাংলার মুক্তিপাগল সেনারা দখল করে নিয়েছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও গেরিলাদের মাত্র খেতে খেতে পাক বর্বর সেনারা দিন দিন মনোবল হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। সেদিনও হয়ত বেশী দূরে নয় যেদিন সমস্ত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত এবং স্বাধীন সার্বভৌম ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রুপে বিশ্বের মানচিত্রে সোনালী অক্ষরে “সোনার বাংলা” স্থান পাবে।
বাংলাদেশের যে সকল এলাকা পূর্বে মুক্ত হয়েছে, সদ্যমুক্ত এলাকার সম্মুখে শত্রু সেনাদের বিবর ঘাঁটি অবস্থিত, সে সকল এলাকার জনসাধারণ নানা অসুবিধার মধ্যে দিনযাপন করছেন। তাদের সুষ্ঠু জীবনধারণ, স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধ কার্যে অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশের সরকার মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসন ব্যাবস্থা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রশাসন ব্যবস্থার সহিত মুক্তাঞ্চলের জনগণের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনীয়। প্রশাসন ব্যাবস্থার যে অস্থায়ী কাঠামো এবং কার্যকরী হতে যাচ্ছে তাঁর বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরুপ।
বিচার বিভাগঃ- জনগণ নানাবিধ সমস্যার মধ্যে জীবন যাপন করছেন। নিজেদের মধ্যে কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করবেন না। আপনাদের নানাবিধ সমস্যা সম্পর্কে সরকার সম্পূর্ণরুপে সচেতন, আপনার নিকটস্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বানহ্লাদেশ সরকারের প্রতিনিধির নিকট আপনার সমস্যাবলী পেশ করুন। মনে রাখসেন, এ সরকার আপনার দ্বারা গঠিত, আপনার জন্য।
পুলিশ বাহিনীঃ- যুদ্ধকালীন অবস্থায় নিরীহ গ্রামবাসীদের দুষ্কৃতিকারী ও অশান্তি সৃষ্টিকারীদের সম্মুখীন হতে হয়। মুক্তিবাহিনী নামধারী কতিপয় দুষ্কৃতিকারী জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারে। আপনার নিকটেই পুলিশ বাহিনী রয়েছে- আপনারই শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য। সুতরাং যখনই কোন দুষ্কৃতিকারী ও অশান্তি সৃষ্টিকারী টাউটের সম্মুখীন হবেন তখনই পুলিশ বাহিনীর হাতে তাদেরকে সমর্পন করুন।
স্বাস্থ্য বিভাগঃ- যুদ্ধকালীন অবস্থায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মতি সেনা ও গেরিলা বাহিনী ছাড়াও মুক্তাঞ্চলের জনগণ অসাবধানতা বশতঃ যে কোন মুহুর্তে শত্রু দ্বারা আহত হতে পারে। যে যেখানেই যখনই কোনরুপ গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখনই তাকে নিকটস্থ বাংলাদেশ সরকারের হাস্পাতালে প্রেরণ অথবা নিকটবর্তী ডাক্তারকে সংবাদ দিতে সচেষ্ট থাকবেন। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা যেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধা তেমনি আপনিও একজন মুক্তি সংগ্রামী। সুতরাং আপনার ক্ষতি দেশের ক্ষতি।
উন্নয়ন, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও সাহায্যঃ- দীর্ঘ আট মাস যাবৎ শত্রুসেনারা সোনার বাংলাকে মরণ কামড় দিয়ে শ্মশানে পরিণোত করে চলেছে। তদুপরি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর যান-বাহন চলাচল এবং জনসাধারণের স্বল্প সময়ে সহজতর উপায়ে সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সহিত যোগাযোগ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের পুনর্বাসন ও সাহায্য করার জন্য উক্ত উন্নয়ন বিভাগের সহিত সহযোগিতা রক্ষা করে চলুন।
ক্ষতি নিরুপণঃ- পাক সামরিক বাহিনীর বর্বর সেনা, বাংলাদেশের মীরজাফর গোষ্ঠীর দালাল, শান্তি কমিটি ও শেষ পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতক বাঙালী রাজাকারের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ যে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন ও সর্বশেষে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত তা আজ সর্বজনবিদিত। বাড়ীঘর লুট-পাট থেকে শুরু করে অগ্নিসংযোগ করতে তারা দ্বিধা করেনি। তদুপরি বর্বর বাহিনীর অসংখ্য গোলাগুলির আঘাতে আজ বাংলাদেশ মুক্তাঞ্চল কেন, অধিকৃত অঞ্চলের দিকে তাকালেও, তার পূর্বের স্বরুপ এর অংশও পাওয়া যায় না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আপনার ক্ষতি নিরুপণের দায়িত্ব উক্ত বিভাগের গোচরীভূত করুন।
ব্যবসা বাণীজ্যঃ- যুদ্ধকালীন অবস্থায় সাধারণতঃ উৎপাদন, আমদানী রপ্তানী ইত্যাদি কাজ প্রায়ই বন্ধ। জনসাধারণ অন্যান্য জিনিসপত্র পাওয়া দূরে থাকুক দৈনন্দিন জীবন ধারণের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উচ্চ মূল্য দিয়েও পাচ্ছে না। তাই সরকার জনসাধারণ যাতে ন্যায্য মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেতে পারেন তার একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেছেন। ন্যায্য মূল্যের চেয়ে অধিক দাম দিয়ে জিনিসপত্র কিনবেন না- কালোবাজারী বন্ধ করুন। কালোবাজারীকে ধরিয়ে দিন। মনে রাখবেন কালোবাজারী সামাজিক অপরাধী। শত্রুদের কোন পণ্য ব্যবহার করবেন না।
সংযোগ রক্ষাকারী (বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সহিত)ঃঃবাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা ও গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা রাত দিন বাঙ্কারে, বনে-জঙ্গলে দিন কাটাচ্ছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য শত্রু সেনাকে খতম করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। তাদের এই অগ্রগতির পিছনে আপনাদেরও সাহায্য প্রয়োজন আছে। শত্রু সেনাদের গোপন খবর আপনার নিকটবর্তী মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরে অবিলম্বে পাঠীয়ে দিন। ভ্রান্তিমূলক খবর দিয়ে শত্রুদের বিপর্যস্ত করুন। গোলাবারুদ, খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি তাড়াতাড়ি সরবরাহ করে মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধ জয়ে এগিয়ে দিন। তারা আপনাদেরই ভাই-এ দেশ আপনাদেরই- শত্রুকে তাড়াতেই হবে, এই পণ নিয়ে যে যেভাবেই পারেন সাহায্য করুন, এর জন্য রয়েছে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সহিত বেসামরিক সংযোগ রক্ষাকারী-অবিলম্বে তাদের সাথে যোগাযোগ করুন, এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিবেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামের আপনিও একজন সৈনিক।
তথ্য ও প্রচারঃ- যুদ্ধকালীন অবস্থায় শত্রু সেনাদের গোপন খবর সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আপনার নিকটে যদি কোন মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর না থাকে তা হলে তথ্য ও প্রচার দফতরে সামরিক সামরিক বিষয়ের গোপন খবরাদি সরবরাহ করুন। গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দেবেন না। মনে রাখবেন দেওয়ালেরও কান আছে। জনগণের মনোবল বাড়িয়ে তুলুন। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীন নাগিরিক হিসেবে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করুন।
কৃষি ও সেচঃ- দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্ত করতে প্রয়োজন হলে প্রথমে প্রোয়োজন কৃষিজাত দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা। বাংলাদেশের কিছু অংশও এখনও শত্রু কবলিত। অধিক পরিমাণে ধান, পাট, ইত্যাদি উৎপাদনে এগিয়ে আসুন।
বেসামরিক প্রতিরক্ষাঃ- অসাবধানতাবশতঃ নিরীহ জনসাধারণ যে কোন সময়ে শত্রুর শিকার হতে পারেন। অবিলম্বে বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের শরণাপন্ন হউন-সাবধানের মার নেই।
শিক্ষাঃ-অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস। অবিলম্বে প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায় চালু করা হবে। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ এখনও বিবেচনাধীন। ছোট ছোট শিশুরা যাতে বইপুস্তক নাড়াচাড়া করতে পারে তাতে এগিয়ে আসুন। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।
ডাক বিভাগঃ-মধ্যাঞ্চলে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য সরকার অনতিবিলম্বে ডাক বিভাগ চালু করেছেন। বাংলাদেশের নতুন আঙ্গিকের ডাক টিকিট, খাম, পোষ্ট কার্ড জনগণের ব্যবহারের জন্য প্রচার করা হবে।
শুল্ক– অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানী করে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করুন এবং সীমান্ত চৌকিতে শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে নিন।
উপরোক্ত বিভাগগুলি ছাড়াও কোষাগার ও রাজস্ব বিভাগও কাজ করতে থাকবে। সময়মত জনগণের নিকট ইহার বিস্তারিত কার্যবিবরণ প্রচার করা হবে।
মুক্তাঞ্চলের জনগণের দায়িত্ব স্বাধীনতার জন্য অনেক। তাই-যে যে ভাবেই পারেন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিন। দুর্নীতিমূলক কাজে লিপ্ত হবেন না। কাউকে করতেও দেবেন না। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীন বাঙালী জাতি হিসেবে নিজেকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরবার জন্য তৈরি হউন।
.
.
সজীব বর্মণ
<৬,২৫৮,৪৩৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় এবারের ঈদ সংগ্রামের নব চেতনা |
সংগ্রামী বাংলা* ঈদের বিশেষ সংখ্যা |
নভেম্বর,১৯৭১ |
[ *সংগ্রামী বাংলাঃ সাপ্তাহিক। সম্পাদকঃ মোঃ এমদাদুল হক। সংগ্রামী বাংলা প্রেস, তেতুলিয়া হতে এমদাদুল হক কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।
প্রধান উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক সিরজুল ইসলাম এম, পি, এ।]
সম্পাদকীয়
এবারের ঈদ
সংগ্রামের নব চেতনা
প্রতি বছরের মত এবারেও বাংলার বুকে ঈদোৎসব নেমে এসেছে কিন্তু অন্য বছরের চেয়ে এবারের উৎসব সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র। এবারের ঈদের চাঁদ বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত। এবারের চাঁদ সন্তানহারা মায়ের, ভাই হারা বোনের, স্বামীহারা বিধবা নারীর আর পৈশাচিক বর্বর হামলার সাক্ষ্য বহন করে উদয় হয়েছে। এই চাঁদ প্রতিজ্ঞা করার আর একতাবদ্ধ হয়ে হানাদার শত্রুনিধনের মন্ত্র বয়ে এনেছে।
এবারের ঈদকে আমরা বরণ করেছি ‘ঈদ মোবারক’ হিসেবে নয় বরং ‘সংগ্রামী ঈদ’ হিসেবে। কারণ দেশের ভেতর আজ মা বোনদের ইজ্জত নিয়ে চলছে ছিনিমিনি খেলা, জীবনে নাই নিরাপত্তা। এক কোটির মত বাঙালী জনতা দেশ ছাড়া।
বাংলার বুকে ঈদগাহে আজ মানুষ নাই কারণ পশুর সাথে মানুষের একত্রে নামাজ হতে পারে না। গত বছর এই ঈদ উৎসবে জনগণ তাঁদের নেতা শেখ মুজিবকে পেয়েছিল কিন্তু এবার তিনি পশুদের কারাগারে। তাঁর আশু মুক্তির জন্য তাঁর দেয়া স্বাধীনতার মন্ত্রকে বাস্তবে রূপদানের জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়েছে। সাত কোটি বাঙালী তাঁদের নেতার মুক্তি আর বাংলার স্বাধীনতার জন্য বিশেষ মোনাজাত করেছে।
দেশ মাতার বুক থেকে জল্লাদ খানসেনাদের তাড়ানোর জন্য প্রতিটি মুক্তিবাহিনী এবারের ঈদোৎসবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং ৪জন ছাত্রনেতা এজন্য পৃথক পৃথক বাণীতে বলেছেন যে, যেদিন বর্বর খানসেনাদের এদেশ হতে তাড়াতে পারব আর সমস্ত দেশকে মুক্ত করতে পারব সেই দিনই আমাদের নতুন ঈদ নেমে আসবে। আজ এদিন সবার কাছে সংগ্রামের বীজ বপনের দিন হিসাবে দেখা দিয়েছে অন্য কোন আনন্দ উৎসব হিসেবে নয়।
.
.
সজীব বর্মণ
<৬,২৫৯,৪৩৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ঐ নতুনের কেতন উড়ে |
সংগ্রামী বাংলা ১ম বর্ষঃ৮ম সংখ্যা |
৮ডিসেম্বর,১৯৭১ |
ঐনতুনের কেতন ওড়ে
(সংগ্রামী বাংলার রিপোর্ট)
চটল তথা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এক ডাকে সমস্ত মুক্তিবাহিনী জেগে উঠেছে। উত্তরের দিকে ঠাকুরগাঁ মহকুমা সম্পূর্ণ মুক্ত। আগামী ২/১ দিনের মধ্যে দিনাজপুর জেলা আমাদের দখলে আসবে তাতে কোন ভুল নাই। খানসেনারা এখানে দারুণভাবে মার খেয়ে সৈয়দপুর ঘাঁটি কাঁহা হ্যায় বলতে বলতে দৌড়িয়েছে। ফরিদপুর জেলা সম্পুর্ন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে। সেখানকার নদীগুলোর প্রতিটি নৌকার মাঝিই মুক্তিবাহিনীর একজন বীর সেনা। টাঙ্গাইল জেলার সম্পুর্ণ, কুমিল্লা, ফেনী, মাগুরা প্রভৃতি এলাকায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে পত পত করে। খান দস্যুসেনাদের তাড়িয়ে দিয়ে আজ বাংলা ধন্য। প্রতিটি এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। দেশকে আবার নতুন করে গড়ার কাজে দেশের ছাত্র জনতা ও নেতৃবৃন্দ দিবা-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। “আমরা বাঙালী” এই মন্ত্রে একতাবদ্ধ হয়ে সমস্ত জাতি আজ দেশ গঠনের কাজে ব্যস্ত, বর্বর খানসেনারা পিছু হটার সময় আশে পাশের ঘরবাড়ী দোকান-পাট কিছুই ভাল রেখে যায়নি। যেভাবে সমস্ত এলাকাগুলো একের পর এক মুক্ত হয়ে চলেছে তা সত্যিই আশাব্যঞ্জক। আমরা আরো আশা করছি, যেভাবে মুক্তিবাহিনীর বীর জোয়ানেরা দৃঢ় সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ তাতে আর দশ দিনের ভেতর সমস্ত বাংলা ভূমি মুক্তি পাবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্রিক বিজয়ের সাথে সাথে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা জনতার ধন, মাল , জানের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য জনতা আজ একতাবদ্ধ। বাংলার মাটিতে সমস্ত হানাদার দস্যুরা একে একে নির্মুল হয়ে পড়েছে। ভাঙা পাকিস্তানের উপর মুক্তিবাহিনী একটি করে নতুন গাছের চারা লাগিয়ে দিচ্ছে। তা হচ্ছে, “স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ”। তর তর করে বেড়ে উঠবে এই গাছ। অচিরেই ডালপালা মেলে ফুলে ফলে ভরে উঠবে এই নতুন চারাটি।
.
.
সমীরণ বর্মণ
<৬,২৬০,৪৪০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় অভিযান |
অভিযান ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর,১৯৭১ |
[অভিযানঃ বাংলাদেশ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র, ঢাকা। সম্পাদকঃ সিকান্দার আবু জাফর। ঢাকা নিউজপেপার প্রাইভেট লিমিটেড থেকে মুদ্রিত।]
সম্পাদকীয়
অভিযান
ফরাসী বিপ্লবের সময় এক মনীষী মন্তব্য করেছিলেন, বিপ্লবের এই সুবিশাল এবং জটিল কর্মকাণ্ড রচনা করার ফরাসী দেশের প্রতিটি মানুষকে অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয়েছে। প্রতিটি জাতি যখন মোহ নিদ্রা থেকে প্রাণ শক্তির প্রবল জোয়ারে জেগে ওঠে, নতুন ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয় তখন গোটা জাতিকে সহস্র ধারায় আপনাকে বিকাশ করতে হয় এবং প্রতিটি কর্মই তার দুঃসাহসিক অভিযান হয়ে দেখা দেয়। এই অভিযানে দুঃখ আছে, বেদনা আছে-লাঞ্ছনা, বঞ্চনা তাও আছে, কিন্তু আরো নিহিত থাকে মর্মমূলে- সূর্যলোকের মতো উজ্জ্বল-আনন্দ সৃষ্টি করার আনন্দ, মঙ্গলকর কল্যাণের কর্মে নিজকে ক্ষয় করার আনন্দ। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর স্বর্ণ-সন্ধানী সে কোদাল পেটানো শ্রমিকেরা যেমন বলে, ‘কে কোদাল চালাই, আমরা কোদাল নাচ নাচি’। একই কথা একটু ঘুরিয়ে আমাদের বাংলাদেশের মানুষেরাও বলতে পারে, আমেরা সংগ্রাম নাচ নাচছি। আমাদের এই সংগ্রাম আনন্দের সংগ্রাম। কেননা আমাদের পিত্র ভূমিতে আনন্দের বাঁচা বাঁচাবার জন্য আমরা লড়াইয়ের ডাক দিয়েছি, আমাদের মুখ বুজে থাকা ইতিহাসের শিরায় শিরায় আনন্দ শোণিত প্রবাহিত করিয়ে জীবন্ত প্রাণবন্ত এবং শৃঙ্খলিত দাসের ইতিহাসকে স্বাধীন মানুষের ইতিহাসে রুপ দেয়ার জন্য আমরা কষ্ট ভোগ করছি, আমরা মরছি।
ভাসাভাসা ভাবে দেখলে আমাদের দুঃখ কষ্ট তার সীমা নেই। আমরা অনেক মরেছি অনেক চলে এসেছি, অনেকে ঘাতকের গুলির মুখে দেশের অভ্যন্তরে স্তব্ধ-বাক এবং অনেকে লড়েছি। আমাদের ক্ষয় ক্ষতির তুলনা নেই। রণক্ষেত্রে বলুন, শরণার্থী শিবিরে বলুন, অপরিচিত পরিবেশে প্রতিটি দৈনন্দিন কর্মই আমাদের কাছে সত্যি সত্যি অভিযান। আমরা হাসি মুখে এই অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি এবং আরো বৃহত্তর অভিযানের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। প্রাণ ধারনের সংক্রমিত আনন্দ ধারা আমাদের পাথরের বাঁধা ভাঙতে সামনে আরো সামনে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা রক্তদা কোনো দিন বৃথা যাবে না। আমাদের দেশে একদিন বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশির তলা অব্ধি রাঙিয়ে সূর্য উদিত হবে। সে দিনের আর দেরী নেই।
নতুন ইতিহাস সৃজনের প্রখর আনন্দে আমাদের জাতি অসম্ভবকে সম্ভব করার অভিযানে নেমেছে। আমরা জাতির অগ্রযাত্রার স্পন্দন ধারণ করতে চাই, জাতির আনন্দ ধারার বাহন হতে চাই। আমরা নিজেদেরকে জাতির সর্বাঙ্গীণ সংগ্রামের সহযাত্রী বলে ঘোষণা করেছি। শুধু আজ নয়, শুধু কাল নয়, সুদূর ভবিষ্যতেও আমরা বাংলাদেশে তথা বিশ্ব মানবের অধিকার আদায়ের অভিযানে শিকার বাজ পাখির মতো চক্ষু তীক্ষ্ণ এবং দৃষ্টি সজাগ রাখবো। স্বাধীন মানুষের চিন্তা, কর্ম, জীবিকা এবং কল্পনায় শৃঙ্খল পরাবার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে চলবে অভিযান- এ আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
.
.
সমীরণ বর্মণ
<৬,২৬১,৪৪১-৪৪৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
শ্রীমতি গান্ধী পশ্চিম সফরান্তিক সাফল্য |
অভিযান ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর,১৯৭১ |
শ্রীমতি গান্ধী পশ্চিম সফরান্তিক সাফল্য
তিন সপ্তাহকালে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ সফর করে ভারতের প্রধান্মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী গত ১৩ই নভেম্বর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তা সফরসূচির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো ছিল বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, বৃটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানী। বর্তমান সফর পশ্চিমের দেশের রাষ্ট্রনায়কের সাথে বাংলাদেশ প্রশ্ন আলোচনায় মোটামুটিভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে শেঈমতি গান্ধী পালাম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন।
পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, যে সমস্ত দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এতোদিন পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করে আসছিল শ্রীমতি গান্ধীর সফরে সে সমস্ত দেশগুলো এখন অন্ততঃ নিরপেক্ষ থাকবে বলে আশা করা যায়।
শ্রীমতি গান্ধীর পশ্চিম দেশ সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কিত প্রশ্ন আলোচনার পূর্বে আমাদের জানা দরকার প্রশ্ন প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য কি রকম।
শ্রীমতি গান্ধী প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে, বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং ভারত তাতে হস্তক্ষেপ করার বিরোধী। কিন্তু বাংলাদেশে গণোহত্যা পরিস্থিতির ফলে লক্ষ লক্ষ লোক যে ভারতে শরণার্থী হয়েছেন এটাও একটি বাস্তব সত্য। ভারত মানবতার খাতিরেই তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তা ভারতের অর্থনীতিতে একটা প্রচণ্ড আঘাত। সুতরাং এই বাংলাদেশ সমস্যা এদিক দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বাংলাদেশে এখনও জঙ্গীশাহী গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। এমতাবস্থায় শরণার্থীদের ভারত পুনরায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে না। তাহলে মানবতা কথাটা হয়ে পড়বে অর্থহীন। শরণার্থীও এই পরিস্থিতিতে স্বদেশে ফিরে যেতে মোটেই রাজি নন। বাংলাদেশে তাই প্রয়োজন আশু রাজনৈতিক সমাধান।
এই বক্তব্যের আলোকেই এখন বিচার করে দেখতে হবে বর্তমান সফরের উদ্দেশ্য।
এটা বুঝতে কারুরই কষ্ট হওয়া উচিত নয় যে, বাংলাদেশ সমস্যার সঠিক যোক্তিকতা পশ্চিমী দেশগুলোকে অনুবাধন করাবার প্রচেষ্টাতেই শ্রীমতি গান্ধীর এই সফর।
পাকিস্তান এতোদিন ধরে প্রক্সার করে বেড়িয়েছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সর্বৈব মিথ্যা এবং ভারতের কারসাজীতেই বিচ্ছিন্নতাবাদীর অনুপ্রবেশকারীদের সাথে পূর্ব বাংলায় নানারকম নাশকতামূলক কাজে অংশ নিয়েছে।
পাকিস্তানী প্রচারের এই ধুম্রজালসৃষ্টি হয়ত বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোকে বিভ্রান্ত করেছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান পেয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক কাজ সরঞ্জাম।
কিন্তু সামরিক সাজ সরঞ্জাম পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক বিজয় অর্জন করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিপুলসংখ্যক পাকসেনা খতম ও জখম হওয়ার ফলে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এখন ভাঙনের মুখোমুখি।
এই ভাঙনকে ঠেকাতে বিকল্প কর্মসূচী অবশ্যই ইয়াহিয়া খাকে পেশ করতে হবে। ইয়াহিয়া খা ইতিমধ্যেই বিকল্প পন্থা হিসাবে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছেন। রণহুংকার ছেড়েছেন ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে বাংলাদেশ প্রশ্ন চাপা পড়ে পাক-ভারত সমস্যার উদ্ভব হবে। তাহলে সামরিক বাহিনীর ভাঙনও রোধ হবে উপরন্তু বাংলাদেশ সমস্যার হবে অবসান।
কিন্তু আমরা জানি ভারত একটি শান্তিকামী দেশ। যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে ভারত সদাসচেষ্ট। আর এই সম্ভাব্য যুদ্ধকে এড়িয়ে উপমহাদেশ শান্তি অক্ষুন্ন রাখতেই শ্রীমতি গান্ধী পশ্চিমা দেশগুলো সফরে যান।
উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলোকে মনে রেখেই এবার বর্তমান সফরের মূল্যায়ন করে দেখা যাক।
অষ্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামে শ্রীমতি গান্ধীর সফর খুবই সার্থুক হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এটাও সত্যি যে পাকিস্তানের উপর দুটো দেশের প্রভাব খুবই কম। তবে কোন দেশ থেকে সাহায্য না পেলেও তাঁদের কাছে অস্ত্রের জন্য ধর্ণা দেওয়া ইয়াহিয়ার পক্ষে মোটেই বিচিত্র নয়। কাজেই এই পথটিও এবার রুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ দুটো দেশই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয় নীতিকে পুরোপুরি সমর্থন জানানো হবে। এবং পাকিস্তানকে কোনরকম অস্ত্রই সাহাজ্য করা হবে না।
এ দুটো দেশের পর শ্রীমতি গান্ধী যান বৃটেনে। সেখানে আলোচনা হয় প্রধানমন্ত্রী হীথ এবং পরাষ্ট্রমন্ত্রী হিউমের সাথে। বৃটেনের এই দুই নেতা পাকিস্তানের পক্ষে মত প্রকাশ করলেও তাঁদের পুরনো রক্ষণশীল নীতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। বৃটেনের এই দুই রাষ্ট্র শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আগ্রহ প্রকাশ করলে শ্রীমতি গান্ধী স্পষ্টই বলেছেন যে পূর্ব বাংলায় উপযুক্ত পরিস্থিতি ফিরে না এলে শরনার্থীরা সেখানে ফিরে যেতে পারে না। আর এজন্যে দরকার বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধান। বাংলাদেশ প্রশ্নে পাক-ভারতে আলোচনার কোন প্রশ্নই ওঠেই না। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথেই আলোচনায় বসতে হবে।
শ্রীমতি গান্ধীর এই সঠিজ বক্তব্যের পর বৃটেনের মনোভাব যে কিছুটা বদলেছে তাঁর কারণ তাঁরা বলতে শুরু করেছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে কার্যকরী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বৃটেন সচেষ্ট হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শ্রীমতি গান্ধীর সফর ফলপ্রসু হয়েছে; নিক্সন সরকার স্পষ্টই বলেছেন, পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য করা হবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক সমাধানে তাঁর সরকার পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দেবেন।
অস্ত্র সাহায্য সত্যিই কি বন্ধ হবে- এ ব্যাপারে অনেকের মতই হয়ত সংশয় আছে। তাঁর কারণ ভারতের পরাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আমেরিকা সফর শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য করবে না। কিন্তু এর পর পরই আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র পাঠায়।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, একবার অস্ত্র সাহায্য বন্ধের কথা স্বয়ং নিক্সনই ঘোষণা করেছেন। সুতরাং সরাসরি ঘোষণা বরখেলাপের সম্ভাবনা খুবই কম।
কাজেই এদিক দিয়ে গান্ধীর সফর অনেকখানি সার্থক হয়েছে বলা যায়।
ফ্রান্সের নেতৃবৃন্দও রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিদু শ্রীমতি গান্ধীর সম্মানে প্রদত্ত ভোজসভায় বলেছেন যে পূর্ব বাংলার সংকট মূলতঃ রাজনৈতিক। বাংলাদেশের জনগণের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান করতে হবে। তা না হলে পাক-ভারত উপমহাদেশে অশান্তির ঝড় বইবে, যার ফল হবে খুবই মারাত্মক।
পম্পিদুর বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গী যে ভারতের অত্যন্ত কাছাকাছি সেটাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
সবশেষে শ্রীমতি গান্ধী যে-দেশ সফর করেন তাহলো জার্মানী। এই পশ্চিম জার্মানীতেই শ্রোমতি গান্ধীর সবচেয়ে বেশী ফলপ্রসু হয়েছে। পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলার উইলি ব্রান্টের বক্তব্য হলো, পূর্ব বাংলা সমস্যাটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং তাঁর সমাধানও তাকেই করতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যাকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত উপমহাদেশে সৃষ্টি হয়েছে চরম উত্তেজনা। এই উত্তেজনা উপশমকল্পে ব্রান্ট তাঁর সীমিম ক্ষমতা ও প্রভাব খাটাতেও রাজি হয়েছেন।
পূর্ব বাংলার সংকট নিরসনে শেখ মুজিবের মুক্তিকে প্রাথমক করণীয় হিসেবে বিবেচনা করে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার প্রয়োজন বলে চ্যান্সেলার ব্রান্ট অভিমত প্রকাশ করেন। এ উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে একটি চিঠি দেবেন বলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন।
উইলি ব্রান্টের এই উদ্যোগ সফল হতে পারে। কেননা পশ্চিমের বহু সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রই পশ্চিম জার্মানির সাথে অনেক দিন পর্যন্ত কোন সম্পর্ক রাখেননি। কিন্তু ব্রান্ট ক্ষমতাধীন হবার পর থেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে লেনদেনের সম্পর্কও গড়ে ওঠে। আমরা জান বহুদিন ধরেই জার্মান সমস্যা একাধিকবার তৃতীয় বিশ্বযদ্ধের হুমকী দিয়েছে। কিন্তু সেই জার্মান সংকটও উইলি ব্রান্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ফলে সমাধা হয়েছে।
উইলিই ব্রান্ট অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু একটি বারের জন্যেও তিনি বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেননি। বৃটেন আমেরিকার মত পাক-ভারত আলোচনা কিংবা ভারিতের মাটিতে রাষ্ট্রসংঘ পর্যবেক্ষক স্থাপনের পরামর্শও ব্রান্টের মুখ দিয়ে বেরোয়নি।
সবগুলো দেশের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে এটুকু বলা যায় যে শ্রীমতি গান্ধীর এই সফর বৃহৎ শক্তিবর্গের চোখ খুলে দিয়েছে। খোদ আমেরিকা এবং বৃটেনও অনুধাবন করতে পেরেছে, প্রায় এক কোটি লোক যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তা কিছুতেই ভারতের অভিসন্ধিমূলক প্রচারণা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মুক্তিযোদ্ধারা সত্যি সত্যিই স্বাধীনতাসংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এটা বোঝা যায় যে বৃহৎ শক্তিবর্গ এখন সত্যি সত্যিই পাকিস্তানের সমর নায়ক ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন যাতে করে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসেন এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এ ব্যাপারে পশ্চিমী রাষ্ট্রবর্গ সকলেই একই সুরে গাইতে শুরু করেছেন। শ্রীমতি গান্ধীও পশ্চিমা শক্তির কাছে এরকম কিছুরই প্রত্যাশা করেছিলেন।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,২৬২,৪৪৪-৪৪৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
“প্রয়োজন হলে দেবো এক নদী রক্ত” | অভিযান ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর, ১৯৭১ |
“প্রয়োজন হলে দেবো এক নদী রক্ত-
হ’ক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,
অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে
একদিন সে পাহার টলবেই;
আমাদের সংগ্রাম চলবেই”
বাংলাদেশের অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সকল অস্তিত্বে যেন তাদেরই আকান্ত সান্নিধ্যে অনুভব করেছিলেন যারা নিঃশেষে রক্ত বিসর্জনের ভেতর দিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে দখলদার পাকিস্তানী দুশমনের শৃঙ্খলমুক্ত করবে।
তাই ৭ই মার্চ তারিখে বাংলাদেশের বৃহত্তম জনসভায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষনা করেছিলেন, ‘আমরা যখন রক্ত দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো-কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়বো’।
রক্ত দিয়েছে-আরও অনেক রক্ত দিয়েছে শিশু-বৃদ্ধ নরকারী বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র অগণিত মানুষ।
কত রক্ত দিয়েছে বাঙালী, জানতে চাও যদি ইতিহাসের তথ্য-লিপিকার, জিজ্ঞাসা ক্রো বাংলার তৃণ-মাঠ পথ-ঘাট নদীস্রোতের কাছে। রক্ত দিয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান। এ রক্ত আমাদের আত্মপরিজনদেরই শুধু নয়- এ রক্ত আমাদের পিতৃ-পিতামহের। বাংলাদেশের শত শত বদীধারা সফেন তরঙ্গ-ললাটে সন্তানবিধুরা চিরক্রন্দনময়ী বঙ্গজননীর জর্জরিত হৃৎপিন্ডের সহস্র ক্ষতমুখে উৎসারিত রক্ত চুম্বন মেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছে, যুগান্তকালের নিস্তব্ধ কন্ঠে সূর্যশীর্ষ মহিমার কম্বুধ্বনি তুলে প্লাবন হয়ে ছুটে গিয়েছে সাগর থেকে সাগরে, সমুদ্র থেকে সমুদ্রে। মহামানুষের অবিশ্রান্ত প্রান-প্রবাহে একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছে অনন্ত ভবিষ্যতের শুভাশীষ নিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর আশ্বাসদীপ্ত বাংলাদেশের নির্ভয় ছাত্র-তরুণেরা স্বাধীনতার যে পতাকা সেদিন বস্তবায়িত করেছিল, ২৩শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তান্তরে যে পতাকার বর্ণে বর্ণে তারা নীলাম্বরের উদার স্পর্শ মাখিয়েছিল সে পতাকা আজ বিশ্বের বিস্ময়ের প্রতীক। আমরা জানি সারা বিশ্বের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে যুদ্ধজয়ী বাঙালীর জাতীয় পতাকার উদ্দেশ্যে নতশির শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে।
২৫শে মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর সহকর্মী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তার ছায়ানুগামী-প্রখর দেশপ্রেমের অগ্নমন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্র-তরুণ এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার পাকিস্তানী
বাহিনীর হাত থেকে লক্ষ লক্ষ প্রানের মূল্যে নির্দ্বিধায় তুলে নিইয়েছেন প্রতিজ্ঞার গুরুভার। সেই প্রতিজ্ঞার অস্ত্রমুখে প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতিরোধ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিধ্বস্ত অর্থনীতি, উপস্থিত রাষ্ট্রনীতি এবং ধিকৃত সমরনীতির ফলে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তান আজ করুণার কাঙালী। কিন্তু এই ঘাতকচক্র নিজেদের সত্য পরিচয় কেনো মুখোশেই আড়াল রাখতে পারেনি। তাই একদিকে তার বিশ্বের ভৎর্সনা যেমন কুড়োচ্ছে অন্যদিকে বাংলাদেশের মাটিতে জমে ইয়ঠছে তাদের লাশের স্তুপ। আগামী ২৭শে ডিসেম্বরের আগেই সেদিনের সূর্যোদয় হবে বলে আমরা অনুমান করি, যেদিন বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী ঘাতকদের শেষ লাশটির উদর বিদীর্ণ করতে গিয়ে শবভুক শৃগালের চোখ দুটিও বুঝি আর্দ্র হয়ে উঠবে।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,২৬৩,৪৪৬>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ঢাকায় আবার গণহত্যা | অভিযান ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর, ১৯৭১ |
ঢাকায় আবার গণহত্যা!
গত ১৩ই নভেম্বর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে পাকিস্তানের জঙ্গীচক্র পুনরায় কার্ফিউ জারী করে। মুক্তিসংগ্রামীদের আক্রমণে নাজেহাল হয়ে জঙ্গীশাহী দুটো শহরেই ২৫শে মার্চের কায়দায় জনসাধারনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোনো একটি দালালী সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে মুক্তিসংগ্রামীদের নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করে তারা বাড়ী বাড়ী তল্লাসী চালায়। প্রকাশ তাদের না পেয়ে পাক সৈন্যরা বহুসংখ্যক বিরীহ লোককে হত্যা করে, অনেকের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং বেশ কিছুসংখ্যক নির্বিরোধ নাগরিক ও স্কুল কলেজের ছাত্রকেও ধরে নিয়ে যায়। ফলে কার্ফিউ তুলে দেবার প পরই জনসাধারণ নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন। এবারকার অভিযান শত্রুদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। সরাসরি সংঘর্ষে দু’পক্ষেই প্রচুর হতাহত হয় বলে জানা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে মুক্তিসংগ্রামীরা বহু এলাকাকেই শত্রুকবলমুক্ত করেছেন। নোয়াখালীতে একটি এক-৮৬ পাকিস্তানী জেট প্লেনো মুক্তিবাহীনীর আক্রমনে ধ্বংস হয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে, জঙ্গীশাহী বিশ্বজনমতকে ধাপ্পা দেয়ার জন্যে ২৭শে ডিসেম্বর ইসলামাবাদে জাতীয় পরিষদের যা গোঁজামিল অধিবেশন বসানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে সেটা পুরোপুরি বাঞ্চাল করে দিয়ে তার আগেই বাংলাদেশের সর্বত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু করার জন্যে মুক্তিবাহিনী যে দুর্বার অভিযান চালিয়েছেন ঢাকার এই সরাসরি সংঘর্ষ তারই একটি অংশ।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,২৬৪,৪৪৭-৪৪৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ব্যর্থ মনোরথ ভুট্টোর প্রত্যাবর্তন | অভিযান ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর, ১৯৭১ |
ব্যর্থ মনোরথ ভুট্টোর প্রত্যাবর্তনত
(অভিযান রাজনৈতিক পর্যালোচক)
পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে ৫জন সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল সম্প্রতি পিকিং সফর করেন। সফর সম্পর্কে পাক পররাষ্ট্র দপরের বক্তব্য, অস্ত্র সাহায্য এবং দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বলিষ্ঠতর করার জন্যি এই প্রতিনিধি দলের চীনের রাষ্ট্রনায়কদের সাথে আলাপ আলোচনা।
পররাষ্ট্র দফতরের বক্তব্য ছাড়াও এই সফরের আরো কতকগুলো সম্ভাব্য দিক আছে। কামান, ট্যাংক আর মেশিঙ্গান দিয়েও যখন বাংলাদেশের আন্দোলনকে রোধ করা গেলো না তখন ইয়াহিয়া খাঁ নয়া ফন্দি আটতে শুরু করে। সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপথগামী করার জন্য এই সমস্যায় ভারতকে জড়িয়ে ফেলতে সচেষ্ট হয়। আর সে জন্যই সে ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধাবার পাঁয়তারা করে। এই যুদ্ধের হুমকীর পেছনেও জঙ্গীশাহীর দুটো মতলব ধরা পড়ে। ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে স্বভাবতঃই বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র এসে মধ্যস্ততা করবে। তখন এই বাংলাদেশ সমস্যা চাপা পড়ে তার জায়গায় পাক-ভারত সমস্যা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে আলোচনায় স্থান পাবে।
দ্বিতীয়তঃ পাক জঙ্গীশাহী এখন মুক্তিবাহিনীর আক্রমনে ব্যতিব্যস্ত। বাংলাদেশকে যে আর নিজেদের কবলে রাখা যাবে না এব্যপারেও জঙ্গীশাহীর মনে নেই কন রকম দ্বিধা। কিন্তু এই মুক্তিবাহিনীর দ্বারা বিতারিত হলে খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেও সমূহ বিপদ দেখা দেবে এবং এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে একমাত্র পথ ভারতের সাথে যুদ্ধ। ভারত যুদ্ধ করলে জঙ্গীশাহী পরাজিত হবে সন্দেহ নেই কিন্তু এই পরাজয়ের মধ্য দিয়েও একটা সুদূরপ্রসারী সুফল পাওয়া সম্ভব। ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে মুক্তিবাহিনী সুযগের সদ্ব্যবহারে বাংলাদেশকে করবেন শত্রুকবলমুক্ত। আর জঙ্গীশাহী মুক্তিবাহিনীর কাছে এই পরাজয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ভিন্নভাষাভাষী জাতির জনগণকে বোঝাতে ভারতই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। এই ষ্টেশনেই সে পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্র রাখতে পারবে।
কিন্তু পাকিস্তানের এই উদ্দেশ্য বুঝি সফল হলো না। সীমান্ত যখন উত্তেজনা বিরাজ করছে ঠিক সেই সময়ে ভারত সোভিয়েট রাশিয়ার সাথে এক পারস্পরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
ভারত রাশিয়া চুক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করেই ইয়াহিয়া খাঁ পিকিং-এ প্রতিনিধিদল পাঠায়। সে চায় ভারত রাশিয়া চুক্তির পালটা হিসেবে পাক চীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হোক। তাহলেই সর্বনাশ থেকে কিছুটা রাহাই পাওয়া যাবে।
পিকিং সফরের পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে ইয়াহিয়া খাঁর একটি সূক্ষ্ম অভিমানও পরিলক্ষিত। এ অভিমান আর কিছুর জন্যই নয়, শুধুমাত্র অস্ত্রের জন্যে সবাই হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিক্সনের সাথে ভারতের প্রধান্মন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর দীর্ঘ আলোচনার পর নিক্সন সরকার ঘোষনা করেছেন যে পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য পাঠানো হবে না। এই ঘোষনা যখন ইসলামাবাদে পৌছে, পাক প্রতিনিধি দল তখন পিকিং-এ। প্রতিনিধি পাঠিয়ে পাকিস্তান আবার ইঙ্গিতে এটাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বোঝাতে চেয়েছে যে, তোমরা যদি অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করো তাহলে আমরা পুরোপুরি চীনের দিকে চলে যাবো। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য যে ১৯৬৫ সালেও পাকিস্তান অনুরুপ চাল ছেড়ে বেশ কিছুটা সুবিধা আদায় করেছিল।
এবার দেখা যাক ভুট্টোর পিকিং সুফরে আলোচ্য উদ্দেশ্যগুলো সাধিত হলো কিনা।
পিকিং-এ ভুট্টোর মিশন পৌছানোর পরই আলোচনা শুরু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সফরের আগেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক্মহল মনে করেছিলেন যে চীন জরুরী তলব করাতেই প্রতিনিধি দল্টি পিকিং-এ যায়।
অবশ্য এই সম্ভাবনাটিকেও যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না তার প্রমান চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য। তাঁর বক্তব্যে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় বাঙ্গাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের উপর। অস্ত্রের ব্যাপারে চীন সম্পূর্ণ নীরব। পূর্ব বাংলার গণহত্যা সম্পর্কে কিছু না বললেও চীন এটুকু বলেছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার অন্যায় সুযোগ নিয়ে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।
পাক-ভার যুদ্ধ বাধলে চীন সরাসরি জড়িয়ে পড়বে না বলেও চীনের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়।
চীনের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের নীতি বর্তমান সময়ে অনেক পালটেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশে নজীরবিহীন গণহত্যা শুরু হবার পর পাক জঙ্গী সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও চীন বাংলাদেশে তার অনুগামীদেরকে জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবারই নির্দেশ দেয়।
বর্তমান সফর সম্পর্কে জঙ্গীশাহী জোরগলায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও সত্যিকারভাবে তারা মোটেই খুশী হতে পারেনি। নিউজ উইকের সাংবাদিকের কাছে ইয়াহিয়া চীন সম্পর্কিত ঘোষণাও অসার প্রমানিত। উপরন্তু যে অস্ত্রেই ভিক্ষার এই পিকিং সফরে সে অস্ত্রের প্রশ্নে পিকিং পুরোপুরি নিশ্চুপ।
সুতরাং যে অকল উদ্দেশ্য নিয়ে ভুট্টোর পিকিং সফর তার কোনটাই ত হলো না উপরন্তু বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে পুনরায় ধর্না দেয়ার পরও সম্পর্ক রুদ্ধ হয়ে গেলো। কেননা ভুট্টো আগেই বলেছেন যে জাতিসংঘ থেকে সমস্যা সমাধানের পথ কোন দিনি খঁজে পাওয়া যাবে না। আর সে জন্যেই আমরা পিকিং এসেছি।
.
.
শফিকুল ইসলাম
<৬,২৬৫,৪৪৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ-পাকিস্তান আলোচনা প্রসঙ্গে প্রচারিত সংবাদ ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ | অভিযান ১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ-পাকিস্তান আলোচনা প্রসঙ্গে
প্রচারিত সংবাদ ‘দুরভিসন্ধিমূলক’
বাংলাদেশের পরাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমেদ সম্প্রতি ইউ পি আই এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা সংক্রান্ত প্রচারিত সংবাদ মিথ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারী কোন স্তরের নেতৃবৃন্দই কলিকাতা বা অন্য কোন দেশস্থিত মার্কিন কূটনীতিকদের মাধ্যমে কোন রকম প্রস্তাব বা আশ্বাস কখনও পাননি। কাজেই ইয়াহিয়া খাঁ বা তার প্রতিনিধির সাথে আলাপ আলোচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
পরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর পূর্ব ঘোষনার পুনরুক্তি করে বলেনঃ পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য। যারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে নিয়োজিত তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আমাদের জন্য যদি কিছু না করতে পারেন তবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের অন্ততঃ মৃত্যুবরণ করতে দিন।
.
.
কম্পাইলারঃ নোবেল
<৬,২৬৬,৪৫০-৪৫২>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
খেলা সমাপ্তির শেষ ঘণ্টাধ্বনি
সুদির্ঘ আট মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সংগঠনগুলো বাংলার মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে পাকিস্তানী শাসন-শোষণের অবসানকল্পে করেছেন মরনপণ সংগ্রাম, অন্যাদিকে তেমনি জামাত, পিডিপি, মুসলিম লীগ প্রভৃতি রঙবেরঙের পার্টিগুলো ইয়াহিহার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ণ হয়েছে।
.
বাংলাদেশের এই সব পার্টি গুলোর বর্তমান ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে একটু বেমানান ঠেকলেও এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। ঐতিহাসিক ভাবে এই পার্টি গুলো তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করছে মাত্র।
.
আজ ২৩ বছরের শাসন- শোষণের ফলে যে ঘৃণা বাঙ্গালীর মনে জমে উঠেছে তারই শেষ পর্যায় হলো আজকের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানের বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব বাংলাকে তাদের শোষণের আবাসভূমি হিসেবে রাখতে চেয়েছে। আর তার জন্যই তারা পূর্ব বাংলায় তাদের নিজেদের বাছাই করা লোকদের ব্যাবহার করছে। এই বাছাই করা লোকেরাই হচ্ছে নুরুল আমীন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, গোলাম আজম, ফরিদ আহমেদ, মোনেম খাঁ, মাহমুদ আলী, সবুর খান, অয়াহিদুজ্জামান প্রভৃতি লোকেরা।
.
এরা কখন কখন খোদ সরকারী পক্ষ নিয়েছে আবার কখনও বা বিরোধী দল হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তান এক রাখার ব্যাপারে এরা সকলেই একমত। ধর্মের দোহাই তুলে পূর্ব বাংলার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে কেউবা। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তাদের এই ভূমিকা প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ ভাবে ধরা পড়েছে। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং সবশেষ বর্তমান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যেকটিতেই তাদের ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত ঘৃণার সাথে স্মরণ করে।
.
১৯৫২ সালে প্রথম আঘাত আসে পূর্ববাংলার জনগণের উপর। বাঙলার মানুষের নিজস্ব বিকাশ যাতে না হয় তার জন্য পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীলরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার সম্মানে ভূষিত করবার সংকল্প নেয়। বাঙলার মানুষ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তদানীন্তন নুরুল আমীন সরকার একে কঠোর হাতে দমন করার জন্য ঢাকার মিছিলে লেলিয়ে দেয় তাদের পিটুনি বাহিনী। এ দিকে অন্যান্য লোকেরা তখন এর মধ্যে হিন্দুয়ানী গন্ধ পেতে শুরু করে। আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙলার জনগণ তাদের এই অপকৌশল বুঝতে পারায় সেই সময়টাতে এরা খুব সুবিধা করে উঠতে পারে না।
.
১৯৫২ সালের আন্দোলনে সুবিধা করতে না পারলেও তারা নিষ্ক্রিয় বসে রইল না। হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তারা তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করলো। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করার জন্য তারা ৯২ (ক) ধারা জারী করে। সাথে সাথে যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গন সৃষ্টির কাজে এই সব দলগুলোকে সক্রিয় করে তোলা এবং পরবর্তিকালে তথাকথিত বাঙ্গালী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে দিয়ে নয়া মন্ত্রীসভা গঠন করে। কিন্তু ধামাচাপা দেয়া মন্ত্রীসভার আসল চরিত্রও জনগণের কাছে ফাঁস হয়ে যায়।
.
কোনমতেই যখন পূর্ব বাঙলার জাতীয়তাবাদী জনগণকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না তখন তারা শেষ অস্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হয়। দেশে সামরিক শাসন জারী করে মুসলিম লীগকেই আবার চাঙ্গা করে তোলে। ১৯৬২ সালে নয়া শিক্ষানীতি পূর্ব বাংলার উপর চাপিয়ে দিতে গেলে বাংলার ছাত্র সমাজ রুখে দাড়ায়। শিক্ষানীতির পিছনে একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, পূর্ব বাংলার জনগণকে শিক্ষার আলো থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখা। এই শিক্ষানীতি চালু করার জন্য তার তাদের দুটি লেজুড় ছাত্র সংগঠন এস,এস,এফ এবং ইসলামী ছাত্র সংঘকে কাজে লাগায়। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব বাংলার সবচেয়ে সচেতন অংশ ছাত্রসমাজের উপর পর পর আক্রমণের কারণ হলো এই যে, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র খুব ভালভাবেই জানতো যে বাংলার ছাত্র সমাজই পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং এদের আমল দিলে অচিরেই পাকিস্তান রাষ্ট্র অবলুপ্তি ঘটবে। তাই ছাত্র তরুণের প্রাণ বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত কোন দাবীই তারা মেনে নেয়নি।
.
১৯৬৪ সালে চন্ড মোনায়েম খাঁকে দিয়ে সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলে সাধারণ ছাত্র সমাজ আবার রুখে দাঁড়ায়। তখন মুসলিম লীগ ও জামাত ইসলাম তাদের ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে এই উৎসব সফল করে তোলার জন্য পাল্টা উদ্যোগ নেয় কিন্তু স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছাত্রসমাজ এই উদ্যোগে সাড়া না দিয়ে সমাবর্তন বর্জন করে। তখন শাসকচক্রের দালাল ছাত্র সংগঠন ও ভাড়া করা গুন্ডা নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
.
এই ঘটনার পর পরই মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম প্রভৃতি দলগুলো জনগণের সংগ্রামী ধারাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার জন্য এই পুর্ব বাংলার বুকে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাধায়। নিরিহ হিন্দুদের বাঁচাতে গিয়ে এ সময় অনেক রাজনৈতিক কর্মীও প্রাণ হারান। দাঙ্গার পরপরই তারা কাশ্মীর সমস্যার ধুঁয়া তুলে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব জনগণের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। এভাবে পুরো দশটি বছর একেরপর এক আক্রমণ চালিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে প্রতিরক্ষামূলক আন্দোলনে ব্যাপৃত রাখে। কিন্তু প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনই পূর্ব বাংলার জনগণকে রাজনইতিকভাবে অনেক বেশী সচেতন করে তোলে।
.
তাই যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করা হয় তখন বাঙলার মানুষ আর চুপ করে বসে থাকে না।
.
১৯৬৯ সালে পূর্ববাংলার ছাত্র সমাজ ১১ দফার ভিত্তিতে ব্যাপক গণআন্দোলনের আহবান জানালে পূর্ববাংলার জনগণ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সিময় পিডিপি, জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ যৌথভাবে ১১ দফার পাল্টা হিসাবে আট দফা দাবী জনগণের সামনে পেশ করে। আন্দোলনের নামে পূর্ব বাংলার জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই এই আট দফা উত্থাপন। কিন্তু সকল আন্দোলনে এদের ভূমিকা সম্পর্কে জনগণ সচেতন হওয়ায় আট দফা জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে সম্পূর্নরূপে ব্যার্থ হয়।
.
এই ভাবে প্রতিটি আন্দোলনেই তাদের নির্লজ্জ ভূমিকা জনগণকে অনেক বেশী সচেতন করে দিয়েছে। তাই যখন নুরুল আমিনের মুখে উত্তরবঙ্গের স্বায়ত্বশাসনের দাবী উঠতে দেখা যায়, জনগণের পক্ষ থেকে তখন তেমন কোনরূপ সাড়া পরিলক্ষিত হয় না।
.
পূর্ব বাংলার বিগত আন্দোলনে পিডিপি, জামাত, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলগুলো যেমন একদিকে জনগণের থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অন্য দিকে তেমনি তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
.
২৩ অছরে যে ঘৃণা আস্তে আস্তে জমে ঊঠেছে তারই চরম পর্যায় হচ্ছে আজকের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানী শাসন শোষনের অবসানকল্পেই এই যুদ্ধ। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায় অন্যান্য স্বাধীন জাতির মতোই। তারা যেমন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাঙ্গালীদেরকেও তাই করতে হচ্ছে। যতো দিন যাচ্ছে, স্বাধীনতাযুদ্ধ তত জোরদার হচ্ছে। পাকিস্তানের পতনও অনুরুপভাবে ঘনিয়ে আসছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ‘পাকিস্তান’ থাকবে না। তার রাজনিতিও থাকবে না। সুতরাং এই সব দলের অস্তিত্বও বিলুপ্ত হবে।
.
এমতাবস্থায় নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখাতে হলে পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে হবে, বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অতএব এরা সরকারী বা বিরোধী পক্ষ নয়, এবার সব রকম ক্ষমতার কামড়াকামড়ি ভুলে গিয়ে সবাই এক হয়ে অর্থাৎ সবাই আসল চেহারা নিয়ে সামরিক বাহিনীর সাথে একাত্ম হতে এগিয়ে এসেছে।
.
এই অন্তর্নিহিত সত্যকে উপলব্ধি করেই আজ নুরুল আমীন, গোলাম আজম, ফজলুল কাদির চৌধুরী, ফরিদ আহমেদ শ্রেণীর লোকেরা বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সামরিক বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পূর্ব বাংলার সকল অঞ্চলে তাদের এজেন্টরা হত্যা ধর্ষন আর লুটতরাজ। কিন্তু খেলা সমাপ্তির শেষ ঘণ্টাধ্বনি তাদের কানে কি পৌছায়নি এখনও।
.
কম্পাইলারঃ নোবেল
<৬,২৬৭,৪৫৩-৪৫৬>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশঃ ইতিহাস থেকে ইতিহাসে
সিকান্দার আবু জাফর
বাঙলা আর বাঙালীর সাথে
অন্তরঙ্গ হবে যদি- পূর্ববঙ্গে এসো,
মনে মনে আমন্ত্রণ পৃথিবীর কাছে
কতবার কত লগ্নে ছড়িয়ে দিয়েছি।
.
গৌরবের দেহভরা প্রয়ারের ক্ষত
শৌর্যের প্রলেপে ঢেকে- আশ্রুরক্তে ধুয়ে
বাঙালীত্ব করেছি নির্মল ,
মনে মনে তাই বড় অহঙ্কার ছিলো।
.
শত শত বছরের সুপ্রস্ত রাজপথে হাঁটা
মধুসূদন বঙ্কিম থেকে
রবীন্দ্র নজরুল জীবনানন্দ- বাঙালীর যা কিছু সুন্দর,
মহতের বৃহতের বিচিত্রভঙ্গিম
যত কিছু আত্মজ প্রত্যয়
এখানেই উচ্চারিত প্রত্যেকের কলকণ্ঠস্বরে।
.
এখানেই বাঙালীর মন
ওতপ্রোত বারোমাস ছায়াছায়া রৌদ্ররেণু মাখা
যেখানে ফুলের লজ্জা লুকানো সুঘ্রাণে;
মাঠভরা সবুজের শান্তি কণাকণা
হৃদয় জড়িয়ে নিতে প্রমত্ত যেখানে
সহস্র নদীর প্রেম আঁকাবাঁকা নিরন্তর পথে,
উৎকীর্ণ ঋতুর দর্পণে
প্রসাধিত প্রকৃতির অঙ্গসজ্জা ইন্দ্রজাল দেখে
এখানেই বাঙালীর প্রাণ-
বারম্বার গেয়ে ওঠে সহজ সন্তোষে
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ ……
দুষপ্রাচ্য নীতির পথে বিকারের ধূলিকণা মেখে
এখানে বিভ্রান্ত নয় বাঙালীর মন।
.
নতুন মূল্যায়নের নামে
একদিকে চেতনার শূন্য সিংহাসন
হতমানে মানবিক সুকুমার বৃত্তির বিদায়,
নতুন আলোর পথে দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর অন্যদিকে
এখানে এখানো নয় দিনান্তের আতঙ্ক-প্রহার;
অনুভূতি মৃত টিকটিকি হয়ে আজো
ঝুলছে না কীটদষ্ট হৃদয়ের কপট দেয়ালে
এই পূর্ববঙ্গে।
.
এখানে এখনো বাঙালীর মন
চড়ুইয়ের অনর্গল দুর্বোধ্য কলহ
বাবুইয়ে ইমারতে ঝড়ের নিশ্চয় দাপাদাপি
টুনটুনি শালিকের শ্রীহীন কুটিরে মুখরিত শান্তিনিকেতন
হিমহিম শিশিরের কোলে
শেফালীর গন্ধমাখা সুখশয্যা ধুসর চাঁদের
মেঘনার কালোজলে গাঙচিল মেঘ
আকস্মাৎ ইলিশের দু চোখের বিস্ময়ে আঁকা
সুচিত্রিত পদ্মার অঞ্চল
নদীর নির্জন ঘাটে কিশোরীর কলসের নিটোল সঙ্কেত
হয়ত বা গোক্ষুরের পম্পট তর্জন
রজনীগন্ধার ঘ্রাণে উল্লসিত জোনাকী নর্তকী
ঈর্ষা ঘৃণা ভালোবাসা অনুরাগ বিরাগের কারুকার্য কত
.
মনে মনে তাই
পৃথিবীকে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিয়েছি কতবারঃ
ইতিহাস ভূগোলের স্মারক মিলিয়ে
বাঙালীর আত্মার আত্মীয় হবে যদি
পূর্ববঙ্গে এসো।
.
আকস্মাৎ মাঝ রাত্রে কোনো
ঘুম ভেঙ্গে অপ্রস্তুত চোখের প্রদীপ চেয়ে দেখি
বাঙালী ও বাঙ্গালীত্ব রক্তস্রোতে ভাসমান ভেলায় নিশ্চল
নগর বন্দর গ্রাম,সহস্র যোজন
প্রান্তরের যত শব্দ পলাতক মৃত্যুর সন্ত্রাস।
.
এবং দক্ষিণে বামে পশ্চাতে সম্মুখে
আমার প্রাণের প্রাণে বঙ্গজননীর
প্রতি অঙ্গ জর্জরিত অগ্নির চাবুকে।
জননী বাঙলা যেন জ্বেলেছে নিজের দেহ
সিবিশাল ধর্ষণের চিতা।
.
আর সেই হাহাকার কোটি কোটি
মূঢ় দীর্ণ হৃদয়ের ব্যার্থ হাহাকারঃ
হে সময়, কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাও
হাজার বছরের লেখা বাঙালীর দীপ্ত ইতিহাস?
.
কেই নেই-কেউ নেই- বধির সময়
কে দেবে উত্তর!
মুছে দিতে অপারগ যারা
বাঙালীর নামের সঙ্কেত,
তাদের মিছিলে ভিড়ে বাঙলার মানচিত্র থেকে
নিষ্ক্রান্ত আমিও।
তারপর অনিশ্চিত পথে
তাদের সবার সঙ্গে আমিও পথিক
বারম্বার অচেনার দাক্ষিণ্য প্রত্যাশী।
হৃদপাত্রে নঈরাশ্যের লাঞ্ছনা জমিয়ে
মাঝে মাঝে ভাবি এই ব্যাধিজীর্ণ দেহ টেনে নিয়ে-
ফিরে যেতে পারব না পূর্ববঙ্গে
আমার বাঞ্ছিত বাঙলা দেশে,
মনে মনে পৃথিবীকে আমন্ত্রণ
বুঝি আর জানানো হবে না।
তখনি সহসা বেজে ওঠে
জীবনের সুরভগ্ন সমস্ত বাঁশীতে
যৌবনের বীর্যোদ্ধত কন্ঠের আশ্বাসঃ
তারা বলে, ভয় নাই আমার ত’ আছি,
এই ঘৃণ্য আঁধারের কণ্ঠনালী আমরা দুহাতে
ছিঁড়বোই জেনো।
.
বিনিময়ে শত শত নদী
রক্তে যদি ভরে যায় যাক,
রক্তের অভাব নেই বাঙলার কোটি কোটি তরুণের দেহে
বাঙলার মানচিত্রে তোমরাও ফিরে যাবে
আমাদের সাথে
আশক্ত দেহের ভর কাঁধে কাঁধে ভাগ করে নেবো
তবু ফিরে যাবো-
বাঙলার কোল থেকে নিরুদ্দিষ্ট তাবৎ সন্তান
সাথে নিয়ে সুনিশ্চিত তবু ফিরে যাবো
.
ফেলে আসা বাঙলার নগরে নগরে রাজপথে
গ্রামে গ্রামান্তরে
নতুন সড়কে;
যে- সড়ক সুপ্রশস্ত রাজপথ হবে
মৃত্যুঞ্জয় কালের তোরণে।
.
তাই হ’ক, তবে তাই হ’ক
বীর্যশুল্কে বাঙলার তরুণেরা- কেড়ে নাও জয়ের মুকুট।
আমি ততদিন শুধু প্রাণপণে প্রাণধারণের
ক্লান্তি বয়ে চলি।
.
সাড়ে সাত কোটি মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গ- সন্তানের
ইতিহাস থেকে আরো দীপ্ত ইতিহাসে
যখন সগর্ব উত্তরণ,-
দু’চোখের সর্বশেষ রশ্মিরাগে যেন
আমি শুধু এঁকে যেতে পারি
সেই ক্রান্তি- লগ্নটির দীপ্ত মুখচ্ছবি।
.
.
কম্পাইলারঃ হিমু নিয়েল
<৬,২৬৯,৪৫৭>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
.
প্রতিধ্বনি
(রাজনৈতিক পর্যালোচনা)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ গত ২৩শে নভেম্বর বেতার ভাষণে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত পাকিস্তান বিবাদে পরিণত করার পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষক সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি দুরভিসন্ধি বাংলার জনগণের ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মুখে বানচাল হয়েছে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন ‘বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য ব্যবস্থা একটিই- আর তা হলো পূর্ণ স্বাধীনতা।’ এই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে বাংলার জনগণ লড়েছে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করেই ছাড়বে।
.
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে আরো বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগর্ভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় আমরা কি মূল্য দেই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যাবহার করি তার উপর।’ তাঁর বক্তব্যের নির্গলিতার্থ, আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রচুর আত্মত্যাগ করেছি এ জন্য যে তার বিনিময়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধশালী সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করবো। একটি সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা রচনা করার আত্মত্যাগ, যে ক্লেশ ভোগ প্রয়োজন তা আমাদের আবশ্যক করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য সম্প্রসারণ করে আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশের কতিপয় মানুষ (যদিও তারা সংখ্যায় অল্প) যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের কাছ থেকে যা প্রত্যাশিত ছিলো সে ধরণের কর্ম কিম্বা আচরণ করেননি। এতো এতো রক্তপাত, এতো আত্মত্যাগ, এতো বীরত্বব্যঞ্জক সংগ্রামেও তারা ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা ভুলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের প্রয়াস প্রযত্ন জড়িত করেননি। এখনও অনেকের কর্ম এবং চিন্তাধারা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের বদলে ক্ষুদ্র আত্মসার্থের খাতেই প্রবাহিত হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখের বিষয়। যারা এ ধরণের কাজ কর্ম করে যাচ্ছেন, তাঁরা হয়তো মনে করে থাকতে পারেন, সংগ্রাম এবং নৈরাশ্যের ডামাডোলে অনেকের অনেক অপকীর্তিই ধামাচাপা পড়ে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এর জন্য তাদের কোনরকম জবাবদিহি করতে হবে না। এ ধারণা পোষণ করে যদি তাঁরা নিশ্চিন্তবোধ করতে চান, তা হলে ভুলতে হয়, সময় সবকিছু ফাঁস করে দেবে। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হওয়া ভাল।
.
আমাদের সংগ্রামের লক্ষ্য স্বাধীনতা। স্বাধীনতা পেলেই আমাদেরকে শান্তি সম্প্রীতিতে ভরপুর একটি সমৃধ্যশালী সমাজ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। শুরু থেকেই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ সে লক্ষ্যে ধাবিত করা উচিৎ। চিন্তার একমুখিতা কাজে শৃঙ্খলা আনবে। নচাৎ এলোমেলো চিন্তা বিশৃঙ্খলা ডেকে আনবে। তার ফলে সমাজে একটা অরাজকতা আসা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। শুরুতেই বিচার বিশ্লেষণ না করে সামাজিক শক্তিগুলোকে যদি আপন গতিবেগে বাড়তে দেওয়া হয়, তা হলে সামাজিক শান্তির আশা সুদূরপরাহত। এখন থেকেই রণাঙ্গনে, গেরিলা একশানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ মানুষের প্রতি আচরণে, রাজনৈতিক শক্তি এবং সামরিক শক্তির মধ্যে সামাঞ্জস্য বিধানের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা, প্রীতি, যংযম এবং বিচার বোধ জাগরিত করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা আজকের যুদ্ধচলাকালীন অবস্থার মধ্যে আমরা যে বীজ রোপণ করছি, ভবিষ্যতে সেই বৃক্ষই গজাবে তা থেকে।
.
হানাদার পাকিস্তানীরা আমাদের অসহায় প্রিয় পরিজনদের কাপুরুষের মত হত্যা করেছে। সাত কোটি বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা চলুন আমরা প্রত্যেকটি ঘাতকের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলি।
.
কম্পাইলারঃ হিমু নিয়েল
<৬,২৬৯,৪৫৮-৪৬০>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
.
মার্কিন বৈদেশিক নীতি ও বাংলাদেশ
(অভিযান রাজনৈতিক পর্যালোচনা)
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্নেহপুষ্ট একদল মার্কিনী বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সমস্যার গভীরতা খতিয়ে দেখার জন্য ভারত আসবেন। খবরে আরো বলা হয়েছে যে, তাঁরা বাংলাদেশের ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং সত্যিকারভাবে সমস্যার গুরুত্ব কতখানি তা দেখার জন্য বিচিন্ন শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শন করবেন।
.
ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত আর এক খবরে জানা গেল যে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ শিং এই ধরণের ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বই অস্বীকার করেছেন এবং এ ব্যাপারে সরকারীভাবে তিনি কিছু জানেন না বলেও সংবাদ জানিয়েছেন।
.
এখন প্রশ্ন হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ আট মাস পরে, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তার ইস্পিত লক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে চলেছে তখন হঠাৎ বাংলাদেশ সমস্যার গুরুত্ব কতখানি অথবা তার গভীরতা পরিমাপের জন্য এত ব্যাস্ত হয়ে পড়ল কেন ?
.
মার্চ মাস হতে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার নরখাদক বাহিনী যে ধ্বংস নাট্য মঞ্চস্থ করেছে এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালী সেই অমানুষিক দানবীয় আগ্রাসনকে যে ভাবে প্রতিহত করেছে- আর যার ফলে এককালের পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মানচিত্রের পরিবর্তন সূচিত হয়ে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ- তা আর যাই হোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অজানা থাকার কথা নয়।
.
মানবতার এ লাঞ্ছনা- জাতি হিসেবে বাঙালীকে একদিকে যেমন তার অস্তিত্ব রক্ষার কঠিনতম সংগ্রাম ও চূড়ান্ত আত্মপরীক্ষার দরজায় ঠেলে দিয়েছে তেমনি অন্যদিকে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্টি করেছে মানবতার মুমুর্ষ দেহে প্রাণ সঞ্চারের অংকুর। কঙ্গোর হত্যালীলা প্রতক্ষ্য করে, এঙ্গেলো মোজাম্বিকে মনুষ্যত্বের অবমাননা দেখে, ভিয়েতনামে ঘন্টাচুক্তি মৃত্যু আর বায়াফ্রার রক্তাক্ত শ্মশান ভূমির জ্বলন্ত স্মৃতি মনে রেখেই বুঝি বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ববিবেক আর চোখ বুজে থাকতে পারেনি। অনেক দেরিতে হলেও মৃত দেহে প্রাণসঞ্চারের মত অতি ধীরে বিশ্ববিবেকের জাগৃতি আমরা লক্ষ্য করছি। তাই আজ শত কোটি মানুষের ভালোবাসা আর মমত্ববোধের প্রতিধ্বনি শোনা যায় ‘প্রাভদা’ আর ব্রান্টের কন্ঠে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ এশিয়া আর আফ্রিকার মানবদরদী আসংখ্য কন্ঠের প্রতিধ্বনি খোদ অ্যামেরিকান সিনেটের সদস্য গালাঘার আর কেনেডির মুখেও আমরা শুনছি।
.
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ ও তাঁদের সরকার ( চিহ্নিত কয়েকটি দেশ বাদে) বাংলার এই চরম সর্বনাশের মুখে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন- দাঁড়াবার আশ্বাস দিয়েছেন। ৭০ এর নভেম্বরে বাংলাদেশে সামুদ্রিক জলচ্ছাস ও মহাপ্লাবনের পর সারা পৃথিবী যে গভীর মমত্ববোধের পরিচয় দিয়েছিল দশ লক্ষাধিক মৃত বাঙালী আত তাদের বাত্যাবিধ্বস্ত পরিজনদের প্রতি যেভাবে বিশ্ব মানবগোষ্ঠী সাহায্য আর সহানুভূতির উদার হাত এগিয়ে দিয়েছিল ঠিক অনুরূপভাবে ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিবাদী আক্রমণে বিধ্বস্ত বাঙ্গালীকেও পৃথিবীর মানুষ সাহায্য করেছে এবং সহানুভূতি জানিয়েছে আন্তরিক মমত্বে।
.
পৃথিবীর টেলিভিশন কেন্দ্রসমূহ, তাবৎ রেডিও ষ্টেশনগুলি থেকেও বারবার প্রচারিত হয়েছে- হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যা ও তদসংক্রান্ত সকল পরিস্থিতির।
আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় সমঝতা কেন্দ্র জাতিসংঘের সাহায্য ও ত্রাণ কমিটির সাহায্য পেয়েছে বাঙ্গালীরা। খোদ আমেরিকা থেকেই ঐ সংঘের ত্রাণ কমিটি প্রধান প্রিন্স সদ্রুদ্দীন আগা খাঁ স্বয়ং তদন্তে এসেছিলেন ভারতে। অধিকৃত বাংলাদেশ যাকে ইয়াহিয়ার প্রচারযন্ত্র আজও পূর্ব পাকিস্তান বলে প্রচারে সরগরম, তাও পরিভ্রমণ করেছেন প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খাঁন। তাঁর এই পরিভ্রমণ এবং তদন্তের পর জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরে এবং সাংবাদিক সম্মেলনে কি কি বলেছিল তা এত বেশিদিনের কথা নয় যে আমরা ভুলে যাব। পৃথিবীর সমস্ত লোক প্রিন্সের মুখে শুনেছে যে, বাংলাদেশ থেকে এত ব্যাপক সংখ্যক শরনার্থি ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন যে, তার দায়িত্ব ভারত সরকারের একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়- পৃথিবীর মানবতাবাদী প্রতিটি সরকারেরই বাঙালীদের ত্রাণ কার্যে এগিয়ে আসা উচিৎ। স্বয়ং রাষ্ট্র সংঘের সেক্রেটারী জেনারেল বলেছেন, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসের কলঙ্কিততম অধ্যায় হল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী। তিনি বলেছেন, আরও অধিক হারে এই দুর্দশাগ্রস্থ জাতিকে সাহায্য করতে হবে এবং সেটাই আজকের পৃথিবীর নৈতিক দায়িত্ব। তদন্ত শেষের রিপোর্টে প্রিন্স সদরুদ্দীন আরো বলেছেন, সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধান ও নিরাপত্তার অটুট আশ্বাস না পেয়ে শরনার্থিরা দেশে ফিরে যাবেন না। শুধু প্রিন্স সদরুদ্দীন নয় পৃথিবীর মানবতাবাদী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা সাংবাদিকরা যারাই শরনার্থি শিবির পরিদর্শনের জন্য ভারতে এসেছেন তাঁরা সবাই একবাক্যে বলেছেন যে, উপযুক্ত সময়ে সম্মানজনক পরিস্থিতিতেই শুধু মাত্র বাঙালিরা তাঁদের দেশে ফিরে যাবেন, তার আগে নয়। উপরোক্ত মন্তব্য তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের স্ব-স্ব স্বার্থের নিশ্চয়তা বিধানের সূত্র হিসেবে উপস্থিত করেননি এবং শরনার্থীরা যা তাঁদেরকে বলেছেন, বিশ্বের বিবেকবান এই মানুষগুলি তাই বিশ্বের কাছে আকপটে তুলে ধরেছেন মাত্র।
এতসব ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তদন্ত কমিশন নিয়োগ করে বাংলাদেশ সমস্যার গভীরতা মাপার প্রশ্ন তোলেন তখন কি একটি প্রশ্ন সংগত ভাবেই করা চলে না যে, তাহলে বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপি এই ডামাডোলের বাজারে আমেরিকা গত ক’মাস শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি প্রবাহ কিন্তু এই তথ্য স্বীকার করে না। বরং ঘটনার পরস্পর এই কোথাই বলে যে, বাংলাদেশ সমস্যায় যারা বিশেষ ভাবে বিচলিত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যে অন্যতম।
পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে, না তা ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নেবে এই প্রশ্ন বিশ্বব্যপী জনমত দু-টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেছে। কিছু কিছু স্বার্থপন্থী, যারা পাকিস্তানের অখন্ডতায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উপাদান দেখেন, তারা বাঙালীদের প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধের আয়ুষ্কাল বেঁধে দিয়ে তার ব্যার্থতার কারণগুলি বিশ্লেষণ করতে যাওয়ার শখের মত, বোকার স্বর্গে বাস করছেন না এমন নয়। অবশ্য এক বৃহৎসংখ্যক ইতিহাস সচেতন মানুষ এর প্রতীবাদ করেছেন। তাঁরা বলেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ নিশ্চিত। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র মার্চ পরবর্তিকালে নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের পক্ষে এমন সব কাজ করেছে যাতে করে দিবালকের মত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, মার্কিনিরা আর যাই হোক পাকিস্তান ভেঙ্গে যাক তা চায় না। আর তা চায় না বলেই সে পাকিস্তানী জল্লাদদের হাতে তুলে দিয়েছে ব্যাপক হারে মানুষ মারার অস্ত্র।
একথা অবশ্য ঠিক যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর গোটা পাকিস্তানে এমন কোন রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক উত্থানপতনের ঘটনা নেই যাতে মার্কিনিদের স্বার্থ জড়িত ছিল না- বিশেষ করে খাজা নাজিমুদ্দিনের পতনের পর কার্কিনী পেটুয়া বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর গদীতে বসার পর । এরপর থেকে মার্কিন সরকার পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। এ প্রসঙ্গে পূর্ব বাংলার ঐতিহাসিক ৫৪- এর সাধারণ নির্বাচনত্তর কালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার কুখ্যাত সাংবাদিক কলহন- এর নাম উল্লেখযোগ্য।
সে যাই হোক আমেরিকা যে কোটি কোটি বাঙালীর এই চরমতম বিপদের দিনে পাকিস্তানী বৃহৎ পুঁজিপতিদের পক্ষে দাঁড়াবে তা পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান ও তার অর্থনীতিতে অ্যামেরিকান লগ্নী পুঁজিই বলে দেয়। এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। আর তাই আমরা দেখি- আমেরিকা তার তাঁবেদারদের দিয়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে একটা রাজনৈতিক আপোষ- মিমাংসার কথা বিভিন্ন সময়ে বারবার উত্থাপন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার, বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা তা বারবার প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধের পতাকাকেই উর্ধে তুলে ধরেছেন।
ইতিমধ্যে জল্লাদ ইয়াহিয়া তার সাধের পাকিস্তান বাঁচাতে গিয়ে বড় বেশী দিয়ে ফেলেছে। ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে সে এখন ভারত আক্রমণ করে এটা পুষিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক ভারত সমস্যা হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টায় নিয়োজিত। আর এতে তার বড় মদতগার হল বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকা এর আগে রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের মাধ্যমে সীমান্তে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাবও অবশ্য এই উদ্দেশ্যে করেছিল বলে মনে করার যুক্তিসংগত যথেষ্ট কারণ আছে।
এদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি যা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরুপ বিদ্যমান তা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ প্রশ্নে বেশ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে। আমেরিকান সিনেটে ক্রমাগত বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ হ্রাসের দাবী সোচ্চার হয়ে ওঠে। ফলে ৮ই নভেম্বর সিনেটে যে বৈদেশিক সাহায্য বিলের অবলুপ্তি ঘটে তাতে আর বৈদেশিক অর্থ সাহায্যের ক্ষেত্রেও বেকায়দায় পড়ার লক্ষণ স্পষ্ট। ( অবশ্য পরে এই বিলটি অনুমোদিত হয়েছে।)
আন্তর্জাতিক বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক পটভূমিকায় তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ তার ঐতিহ্যবাহী দুমুখো পররাষ্ট্রনীতি অব্যাহত রাখতে অসমর্থ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরনার্থীদের সাহায্যদান ও বাঙ্গাল হত্যায় দস্যু ইয়াহিয়া চক্রের সাহায্য কার্যক্রম যে আর পাশাপাশি চালানো যাবে না তা বিশ্বজনমত ও সংগ্রামী বাঙালীর সোচ্চার কন্ঠ স্পস্টভাবে বলে দিয়েছে।
তার ফলেই ক্ষমতাসীন নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের নিজস্ব অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে চায়। কিন্তু তা করতে গেলে হয় মার্কিনিদের সরাসরি ইয়াহিয়ার পক্ষে নয়ত বাংলার মুক্তিকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবার প্রশ্ন ওঠে। অথচ এর কোনটাই হোয়াইট হাউজ তার নিজস্ব শ্রেনী চরিত্রের কল্যাণে করতে পারে না। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাথে চীনা নেতৃত্বের দহরম- মহরম, পশ্চিম ও দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সর্বশেষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি আমেরিকানদের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে বিশেষ বাধার কাজ করেছে বলে অনুমান করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অশুভ শক্তি আজ বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তি ঘটিয়ে এই নাজুক পরিস্থিতি হতে মুক্তি পেতে চায়। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়ার গোপন আপোষ প্রস্তাব তাদেরকে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে বলে অনুমান করা যেতে পারে।
তাই দীর্ঘদিন বাংলাদেশ প্রশ্নে কোন বক্তব্য না রেখে, খুনী ইয়াহিয়া চক্রের মারণাস্ত্র সরবরাহ করে আজ হঠাৎ নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশ সমস্যার গভিতরা পরিমাপের প্রয়োজনে এদেশে পাঠাচ্ছে বিশেষজ্ঞ দল, যাদের একমাত্র কাজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের খুঁজে বের করে গোটা আন্দোলনকে আপোষের চোরাগলিতে নিক্ষেপ করে পাক- ভারত উপমহাদেশে মার্কিন অবস্থানকে অক্ষত রাখা।
কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছে, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, কপোতাক্ষ দিয়ে- নিক্সন প্রশাসন তা বুঝলেও হয়ত স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু বাংলার আপামর জনগণ এই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছে। তাঁরা যা বলতে চান তা প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের মন্ত্রী সর্দার শরণ সিংহের মুখেই শুনে রাখুন মার্কিন বিশেষজ্ঞ দল ‘এ দেশে আপনাদের কোন প্রয়োজন নেই’।
.
.
হিমু নিয়েল
<৬,২৭০,৪৬১-৪৬২>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
পৃথিবীর এক একটি রাষ্ট্র অথবা জাতিকে ধ্বংসের জন্য একটিমাত্র শক্তিদর্পী মূর্খের প্রয়োজন এ যুগের তেমন একটি মূর্খ পাকিস্তানী চন্ড চক্রের চন্ডতম নায়ক ইয়াহিয়া
দখলীকৃত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনী ধিরে ধিরে পিছু হটে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি সীমান্তে একের পর এক এলাকা মুক্তিবাহীনির দখলে আসছে। প্রায় আট মাসে নির্যাতন শিবিরতুল্য দখলীকৃত এলাকায় অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন পশু শক্তি হতে নৃশংসভাবে উৎপীড়িত বাঙালী নারী- পুরুষ। তাঁরা আশা করছেন আর কতদিনে দখলীকৃত গোটা বাংলাদেশ পাকিস্তানী দুশমনের কবল মুক্ত হবে। আমরা জানি সেদিনের খুব বেশী আর বিলম্ব নেই কয়েক সপ্তাহেরই মাত্র ব্যাবধান।
এই উজ্জ্বল বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়েও কিন্তু পাকিস্তানী জঙ্গীচক্রের আস্ফলন কিছুমাত্র হ্রাস পায়নি। তাঁদের প্রচারণার সুরে এবং বক্তব্যেও কিছুমাত্র তারতম্য ঘটেনি। সেই একই বস্তাপচা অজুহাত ভারতীয় চক্রান্ত এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। লক্ষাধিক সুশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধার হাতে বস্তুতঃ গোটা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধার হাতে বেধড়ক মার খেয়েও ইয়াহিয়া চক্র তা স্বীকার করতে পারছে না। কারণ খেলা শেষ হয়েছে এই সত্য মেনে নেবার আগে মুখ রক্ষার মত একটা বিরাট অজুহাত সৃষ্টি করতেই হবে তাদের।
.
তাই ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুধেরই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীনা প্রতিনিধি দলের ভোজসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া খাঁ যে কথাগুলি বলেছেন তা থেকেও সে কথাই প্রমাণ হচ্ছে। ইয়াহিয়া বলেছে, ‘দিন দশেকের ভিতরেই নিজের হাতে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমি যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাবো’। শ্রীমতি গান্ধীর কাছে পাঠানো মৈত্রী প্রস্তাবে উপেক্ষিত হওয়ায় ক্রুদ্ধ ইয়াহিয়া বলেছে ‘ঐ মেয়ে মানুষটা যদি মনে করে থাকে আমাকে ভয় দেখিয়ে ঘায়েল করা যাবে তাহলে সে জেনে রাখুক, আমি সে পাত্র নই’। আমরা বারবার লক্ষ করে আসছি দেশে বিদেশে যে কোন প্রসঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর নাম উল্লেখ করতে হলে ইয়াহিয়া তাকে সেই মেয়ে মানুষটি, ঐ মেয়ে মানুষটি সূচক অশালীন বিশেষণেই চিহ্নিত করে, তাঁর মত অমার্জিত লোকের মুখে হয়ত সেটাই শোভা পায়। কিন্তু তার পক্ষে এটাও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় যে বাংলাদেশ প্রশ্নে শ্রীমতি গান্ধীর ভারতের ষাট কোটি মানুষের মুখপাত্র। তাহলে শ্রীমতি গান্ধীর নাম উল্লেখেও তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার কারণটি কি এই যে ভদ্রমহিলার সামনে তার মত একজন জবরদস্ত জঙ্গী জেনারেল কোন রকমেই হালে পানি পাচ্ছে না। ফলে ধিকৃত পৌরুষের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে সাধারণ সৌজন্য এবং ভদ্রতার লেবাস ফেলে দিয়ে ইয়াহিয়া খাঁ গোটা বিশ্বের সামনে অমন প্রগলভ হয়ে উঠছেন?
এই বক্তৃতায় প্রসঙ্গান্তরে ইয়াহিয়া উক্তিঃ ‘সে (শ্রীমতি গান্ধী) যদি যুদ্ধ চায় আমি তার যুদ্ধ সাধ অবশ্যই মিটিয়ে দেব’ অর্থাৎ পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাচ্ছে। কিন্তু কেন? কিছুদিন আগেও ইয়াহিয়া বলেছে ‘ পাঁচগুণ বেশী শক্তিশালী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া পাকিস্তানের পক্ষে বাতুলতা’ তবু সেই বাতুল প্রয়াসে কেন জড়িয়ে পড়তে চাইছে পাকিস্তানী জঙ্গিচক্র সেটাই বিবেচ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে একটি স্বীকৃত সত্য সে কথা আজ বৃহৎ শক্তিবর্গসহ পৃথিবীর সকলেই এক রকম মেনে নিয়েছেন। চীনের বিশ্বাসও তা থেকে আলাদা নয় বলেই আমরা মনেকরি। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকচক্রও এ কথা জানে। বিশ্বের দরবারে নানাভাবে ধর্ণা দিয়ে ব্যার্থ হয়ে তাদের সে ধারণা এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট। তারা জানে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তা থাকতে হবে। টিকিয়ে রাখতে হবে সেনাবাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানে অন্ততঃ অটুট রাখতে হবে শাসন ক্ষমতা। ফলে জঙ্গী সরকার যে নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে গোটা পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিরুদ্ধমত সোচ্চার হয়ে উঠছে। গত কিছুকাল থেকে এই বিরুদ্ধমত যাতে দেশব্যাপী একটা জনমত সৃষ্টি করতে না পারে তার অন্যতম প্রতিরোধ ব্যাবস্থায় জঙ্গী চক্র ওয়ালী ও ভাষানী ন্যাপকে রাজনৈতিক দল হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জনমতের কণ্ঠরোধ বর্তমান পর্যায়ে প্রথম শুরু হল। কিন্তু অপর দিকে ইয়াহিয়া এখনো বলে চলেছে যে জনগণের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন এ ভাঁওতা সে কাকে দিচ্ছে তা অবশ্য অনুমান করা শক্ত। কারণ যত দালালি করুক ইয়াহিয়ার হাত থেকে গণপরিষদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্ষমতা গ্রহণের সাহস যে কারও হবে এমন মনে হয় না। প্রমাণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের গনপরিত্যাক্ত যাবতীয় দালাল নেতারা এখন পশ্চিম পাকিস্তানেই ভীড় জমিয়েছে এবং তারা হয়ত লাশ না হয়ে আর বাংলাদেশে ফিরবে না।
পশ্চিম পাকিস্তানে জনমতের কন্ঠরোধ জঙ্গীচক্রের পক্ষে একটা মামুলী ব্যাপার হলেও বর্তমানে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ প্রশ্নে দুটি রাজনৈতিক মতের দ্বন্দ পশ্চিম পাকিস্তানে ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। একদল এই মত পোষণ করেছিলেন যে বাংলাদেশ যখন ছেড়ে আসতেই হবে তখন আরও ক্ষতিগ্রস্থ না হয়ে মানে মানে সড়ে পড়া ভাল। কিন্তু ক্ষমাতাসীন জঙ্গীজোটের ধারণা। তাতে মুখরক্ষা হবেনা বলে সেনাবাহিনী ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। কাজেই ৬০ কোটি ভারতের বিরুদ্ধে ৫ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানের লড়ে যাওয়াই সর্বদিক দিয়ে সমিচিন। কয়েক দিন যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তারপর জাতিসংঘ ত’ হস্তক্ষেপ করবেই। তখণ বাঙালী সকলে না মরলেও পাকিস্তানী লাঠীটা অন্ততঃ অটুট নিয়ে ফেরা যাবে। ইতিমধ্যে বেপরোয়া বোমাবাজী করে ভারতের সীমান্ত এলাকা এবং শিবিরে শরনার্থী বাঙ্গালীদের বেশ কিছুটা ঘায়েল করা যাবে।
এই পরিকল্পনা অনুসারেই পাকিস্তানের জঙ্গীচক্র কাজ করে যাচ্ছে এবং হয়ত দু’ চারদিনের ভেতরেই তারা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করে বসবে।
.
.
লাল কমল
<৬,২৭১,৪৬৩-৪৬৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
পাক দূতাবাসগুলিতে শয়তানের অনুচর |
অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা |
২৫ নভেম্বর, ১৯৭১ |
পাক দূতাবাসগুলিতে শয়তানের অনুচর
পাকিস্তানের সমরনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া তখত তাউস টলমল করে উঠেছে। তাই তার মেজাজ সবসময় চড়ে থাকে। এক বৃটিশ সংবাদদাতার মতে গত তিন মাস ধরে তিনি নাকি ভয়ংকর রকম চটে আছেন। এ সময়ের মধ্যে একবারও নাকি শান্ত অবস্থায় তাঁকে দেখা যায়নি। এই মনোবৈকল্যটা তাদের বাঙ্গালীবিদ্বেষ হিসাবে ভারী উদ্ধত এবং অশোভনভাবে মার্চের পঁচিশ তারিখের পর থেকে প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছে। প্রতিটি নাজী যেমন হিটলার বলে মনে করতো নিজেকে, তেমনি ইয়াহিয়ার প্রতিটি অনুচরও নিজেকে ইয়াহিয়া বলে ভাবতে শুরু করেছে। তাদের ভাবভঙ্গী, আচার-আচরণ সবকিছুই জেনারেল ইয়াহিয়ার মতো।
নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা দিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশনের জনৈক ব্রিগেডিয়ার গোলাম হাসানের কাহিনী প্রকাশ করেছেন। এই গোলাম হাসান লোকটির নামের আগে ব্রিগেডিয়ার দেখে যে কেউ তাকে সামরিক বাহিনীর লোক মনে করতে পারে। আসলে সে হচ্ছে পাকিস্তান হাইকমিশনের এট্যাচি। কয়েক সপ্তাহ আগে দিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশনের বাঙ্গালী কর্মচারীরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় হাইকমিশনের পাকিস্তানী কর্মচারীরা তাঁদের সামনে নানা বাধার সৃষ্টি করে এবং প্রলোভনে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করে। তা সত্ত্বেও বাঙ্গালী কর্মচারীরা খুনি ইয়াহিয়া সরকারের কাজ করবেন না বলে দূতাবাস ছেড়ে চলে আসেন। প্রকাশ, তখন এই হাসানই বাঙ্গালী কর্মচারীদের বলেছিলো, মনে রাখবে আমি পাঠান, দরকার হলে তোমাদের গুলী করে মারবো। বাঙ্গালী জনাব হোসেন আলীকে পাকিস্তান হাইকমিশনে গুম করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর মুক্তির জন্য বার বার আবেদন নিবেদন করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান হাইকমিশন এই আবেদন নিবেদন এবং বিক্ষোভে কোনরকম কর্ণপাত করেননি বললেই চলে। পিতার মুক্তির জন্য জনাব হোসেন আলীর দুই শিশু পুত্রের প্রার্থনাও বৃথা গেছে। বস্তুতঃ বাঙ্গালী কর্মচারী হোসেন আলী পাকিস্তান হাইকমিশনের জিন্দানখানায় বন্দী। তাঁকে মুক্ত করা এখনও সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘোষণার পর থেকে প্রতিটি দূতাবাসের বাঙ্গালী কর্মচারীবৃন্দ একে একে দূতাবাস ছেড়ে চলে এসেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদান করেছন। জনাব হোসেন আলীর ভাগ্য এবং হাসেনের পাশবিক কীর্তির কথা প্রকাশ হওয়ার পরে, কারো অনুমান করতে অসুবিদা হওয়ার কথা নয়, দূতাবাসগুলোতেও পাকিস্তান ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। যে সকল বাঙ্গালী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদান করতে ব্যাগ্রভাবে ইচ্ছুক তাঁদেরকে অনেক ক্ষেত্রে জোর করে আটক রাখা হয়েছে। নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশনের ঘটনাই তার প্রমাণ।
নয়াদিল্লী পাক হাইকমিশনের এই নব্য নায়ক গোলাম হাসান কেমন অমানুষ তার চাকরীজীবনের নথিপত্র ঘাঁটলেই তার বিস্তর প্রমাণ পাও্যা যাবে বলে প্রকাশ। বাঙ্গালীবিদ্বেষই ছিল তার পদোন্নতির মুখ্য সোপান। ১৯৬৯ সালের জংগীলাট আয়ুবের আমলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পর্দার অন্তরাল থেকে যারা কলকাঠী নেড়ে ছিল এই গোলাম হাসান তাদের একজন। আগরতলা মিথ্যা মামলার ঠেলায় আয়ুব খানকে সিংহাসন ছাড়তে হয়। কিন্তু গোলাম হাসান ইয়াহিয়ার সুনজরে পড়ে যায়।
এই গোলাম হাসান এবং তার মতো মানুষেরা কতদূর কাপুরুষ একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই তা পরিষ্কার হবে। গত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ বিজয় অর্জন করেছিলেন এবং ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছিল, তিনিই দেশের “ভাবী” প্রধানমন্ত্রী, তখন গোলাম হাসান তাঁর কাছে করজোড়ে দারিয়ে বলেছিল, ‘স্যার আমি একজন সরকারের সামান্য নওকর মাত্র।’ পাকিস্তানের দূতাবাসগুলিতে বাঙ্গালী কর্মচারী গোলাম হাসান শ্রেণীর লোকদের হাতে এতকাল কিভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য।
.
.
লাল কমল
<৬,২৭২,৪৬৫-৪৬৬>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বিশ্বাসঘাতকতার পথ এখনও পরিহার করুন |
অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা |
২৫ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বিশ্বাসঘতকতার পথ এখনও পরিহার করুন
তা না হলে মৃত্যুর গ্লানিকর শাস্তিই হবে
একমাত্র অবশ্যম্ভাবী পরিণতি
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ গত ২৩শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে বলেছেন, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর পর্যায়ে উপনীত, যে কোন স্থানে যে কোন জায়গায় এমন কি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে।
একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুরা যেমন মার খাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনও ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ পশ্চিম পাকিস্তানও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙনের মুখে। এ থেকে নিস্তার পাবার জন্য পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, এর দ্বারা বাংলাদেশের পাক জংগীশাহী সুনিশ্চিত পরাজয় এড়াতে পারবে না অথচ তাদের ভ্রান্তি, অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে, পরিণামে তাদের আত্মবিনাশ সুনিশ্চিত হবে।
পাকিস্তানের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক যারা বাংলাদেশের সংগ্রামকে ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষে চিহ্নিত করতে উদ্দ্যোগ নিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটি- তা হলো পূর্ণ স্বাধীনতা। সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের সংকল্পে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আর স্বাধীনতা রক্ষার অপরাজেয় শক্তির মধ্য দিয়ে।
ভারতকে যথেষ্ট অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের পাকাপাকিভাবে ভারতে বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্য কোন একটি দেশের প্রস্তাব উল্লেখ করে বলেন, “এর দ্বারা পর্বতপ্রমান অবিচার অন্যায়কে বিনা বাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে।” তাদেরকে হুঁশিয়ার করে তাজউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, “শরর্ণাথী অস্থাবর সম্পত্তি নন যে অর্থের বিনিময়ে তাঁদেরকে হাত বদল করা যাবে।” তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, শরর্ণাথীরা সম্মান ও মর্যাদার সাথে জন্মগত অধিকার নিয়ে স্বদেশ ফিরে যাবেন, সেদিন প্রত্যাসন্ন। তাজউদ্দিন আহমদ প্রশ্ন করেন, উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেহসের কূটনীতিক ও আইন সভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি তথ্য জানতে চান? ব্যাপক গণহত্যাকে যারা নিন্দা করেননি, তারা তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল লাভ করতে চান, তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “তাতে আমাদের সংকল্পের ব্যত্যয় হবে না, সে সংকল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা লাভের দিনটি আজ নিকটতর হয়েছে, তাই আজ শত্রু সংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সাথে সাথে শহীদের রক্তের মর্যাদার উপযুক্ত সমাজ গঠনে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব।”
বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমাঙ্কে পাকিস্তানী জংগী সরকার মুক্তি না দিলে বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হবে। আর তখনই ইয়াহিয়া ক্রুর সত্যের মুখোমুখি হবে বলে তিনি মনে করেন।
পরিশেষে বাংলাদেশের বীর শহীদ ও অকুতোভয় যোদ্ধা, সংগ্রামী জনগণকে যথাক্রমে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চুড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন।
যে সব রাজাকার, পুলিশ বা সরকার কর্মচারী বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তাদেরকে বিদ্রোহের সুযোগ গ্রহণ করবারও আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী। যারা শত্রু পক্ষের সাথে স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছে তাদের কে তিনি শেষবারের মত হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, বিশ্বাসঘতকতার পথ পরিহার কারুন, তা না হলে পরিণতি একটিই, তা হল গ্লানিকর মৃত্যু।
.
.
কম্পাইলারঃ লাল কমল
<৬,২৭৩,৪৬৭-৪৬৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় পাকিস্তানের কবর খোঁড়া শুরু হয়েছে |
অভিযান ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা |
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
পাকিস্তানের কবর খোঁড়া শুরু হয়েছে
দশ দিনের ভিতর যুদ্ধে যাবার ওয়াদা অনুযায়ী পাকিস্তানের জঙ্গীলাট ইয়াহিয়া খাঁন তার সেনাবাহিনী নিয়ে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ঝাপিয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে আমরা বলেছিলাম পাকিস্তান জঙ্গীচক্র ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধই লাগিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ হাতছাড়া হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে শাসন ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখার জন্য এবং সেনাবাহিনীর কাছে মুখ রক্ষার জন্যে তারা এটাই করতে পারে বলে অনুমান করা যাচ্ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা পাকিস্তানী জঙ্গীচক্রকে কতখানী উৎসাহিত করেছে সেটাই আগামী কয়েক দিনের ভিতরই বুঝা যাবে। এ প্রসঙ্গে আমেরিকা ও চীনের ভূমিকার যেকোন জটিলতা নেই গত দশ দিনের ঘটনাই তা প্রমাণ করেছে। এই সময়ের ভেতরে উভয় বৃহৎ রাষ্ট্রই পাকিস্তানকে দ্রুত অস্ত্র সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। পক্ষান্তরে আমেরিকা ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
এই অবস্থা ভারতীয় রাষ্ট্রনীতিকদের মনে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে, কিছুমাত্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে যে পারেনি সে কথা সেদিন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ভাষাতেই প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বাংলাদেশ প্রশ্নে নিক্সন সরকারের অভিসন্ধিমূলক মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছেন যে ভারতকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে কারও মতলব হাসিল করার দিন শেষ হয়েছে। ভারত তার নিজের অনুসৃত মানবিক এবং গণতান্ত্রিক নীতির পথে অটল থাকবার জন্যে কারও সহায়তার মুখাপেক্ষী নয়। সুতরাং বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে নির্বিঘ্নে পুনর্বাসনের যে নীতি ভারত প্রথম ঘোষণা করেছে, শেষ পর্যন্ত সেই নীতিই সেই অনুসরণ করবে। এর বিরুদ্ধে যে কোন আঘাতকে সে নিজের ওপর আঘাত বলে গন্য করবে এবং সেই বিচারেই তার জবাব দেবে। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানী হামলার জবাব ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পাকিস্তানী ভূখন্ডে ঢুকেই প্রতিঘাতের আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং সেনাবাহিনী তৎপরতার সঙ্গে সে আদেশ প্রতিপালনের জন্যে অগ্রসর হয়েছে। ফলে পাকিস্তান এতদিন ধরে যে উসকানি দিয়ে চলছিল সেই ভারত পাকিস্তান সংঘ্ররষই দানা বেঁধে উঠেছে।
কিন্তু সংঘর্ষ যেভাবেই জটিল হয়ে উঠুক, তার ফলে বাংলাদেশ প্রশ্ন যে চাপা পড়ে যাবে না-যেতে পারে না, শ্রীমতি গান্ধী সে কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন। এদিকে বাংলাদেশের স্থির প্রতিজ্ঞ মুক্তি সংগ্রামীরা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রত্যেকটি রণক্ষেত্রে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বড় বড় কয়েকটি শহরকেন্দ্রীক সেনানিবাসে একরকম অবরুদ্ধভাবে গোলাবাজী করা ছাড়া তাদের ব্যাপক গতিবিধির ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। অবরুদ্ধ সৈন্যদের জন্য নতুন সাহায্য আমদানী সম্ভাবনাও তাদের বন্ধ। এ অবস্থায় বাংলাদেশ দখলদার পাকিস্তানী দস্যুদের সমূলে ধ্বংস হবার বিলম্ব নেই।
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারতীয় এলাকায় বিমান হামলা চালাবার ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের জমিতে ঢুকেই পাকিস্তানী সামরিক যন্ত্র ধ্বংস হুকুম পেয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, এবার যুদ্ধ বাঁধলে পাকিস্তানের যে অংশ
ভারতের দখলে আসবে ভারত তা ছেড়ে দেবে না। আর কোন ‘তাসখন্দ’ চুক্তি করা হবে না। এ থেকে অনুমান করা চলে দু’দিকে কঠোর বিপর্যয়ের মুখে পাকিস্তানের অস্তিত্বি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে।
এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী পাকিস্তানের বন্ধুরা তাকে কি সাহায্য দিতে পারবেন? ভারতকে ধমক দিয়ে যে নীতিবিচ্যুত করা চলবে না সেকথা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী বলে দিয়েছেন। তা হলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আপাততঃ যে ব্যবস্থা করার পথ এখনও একেবারে রুদ্ধ হয়নি বলে আমাদের বিশ্বাস, তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া এবং বাংলাদেশ থেকে মানে মানে পাততাড়ি গুটাবার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা ভিক্ষা করা। আমাদের মনে হয় পাকিস্তানী জঙ্গীচক্রের সুহৃদ্ররা সেই ব্যবস্থাই করছেন। অন্ততঃ সেটা করলে তাঁরা বিবেচকের কাজই করবেন।
.
.
কম্পাইলারঃ আব্দুল্লাহ আল নোমান
<৬,২৭৪,৪৬৯-৪৭১>
শিরোনামঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর ঐতিহাসিক পুরস্কার
সংবাদপত্রঃ অভিযান (১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা)
তারিখঃ ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর দেশপ্রেমে উদীপ্ত দুর্জয় পৌরুষের ঐতিহাসিক পুরস্কার
এক নদী রক্ত, অশ্রু এবং হাহাকারের আওতলান্তে কবে পাকিস্তানী হানাদার জঙ্গী দস্যুদের সর্বশক্তি চিরকালের মত সমাধিস্থ হয়েছে। গতকাল বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে শত্রুকবল মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সমস্ত অঞ্চল। ঢাকা শহরের আনন্দ হাজার হাজার নাগরিকের কণ্ঠে ধবনিত হয়েছে “জয় বাংলা” “বঙ্গবন্ধু জন্দাবাদ” ইন্দিরা গান্ধি জিন্দাবাদ” বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী জিন্দাবাদ”। এই বিশাল জনতার সামনে রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে নতশীরে সসৈন্যে আত্নসমর্পণ করেছে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক বর্তমান লেঃ জেনারেল নিয়াজী। সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকা শহরে চালু হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রশাসন।
.
তোমার আসন শূন্য আজি হে বীর পূর্ণ করো
রাজধানী ঢাকা শহরে আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যখন আপন গৌরবে উড্ডীন, তখন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়কে বিষাদে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।
যে মানুষটি মুখের একটি কথায় তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত উচ্ছাসের মত কেঁপে কেঁপে উঠতো, তিনি আজ বাংলার সবুজ, নরম, মায়ের মত স্নিগ্ধ মাটি থেকে হাজার মাইল দূরে, কক্ষ, উষর বান্ধভীন নির্জন নিঃসঙ্গ পরিবেশে বর্বর পাকিস্তানী ফ্যাসিষ্ট চক্রের কারাগারে বন্দী। তাই স্বাধীনতার কোন উৎসবই আজ আনন্দমুখর হয়ে উঠবে না যতক্ষণ বঙ্গবন্ধুকে আমাদের ভিতরে ফিরে না পাবো।
* * *
“বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে এটাই প্রমাণ হ’ল বেয়নেট দিয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রাখা যায় না। আজকের দিনে আমাদের মন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে উদগ্রীব। আমি আশা করব ইয়াহিয়া খান পরাজয় মেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে দেবেন।”
-সৈয়দ নজরুল ইসলাম
“ভারত আমাদের মিত্র হিসাবে আমাদের অনুরোধে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ মুক্ত করার জন্যে-দখল করবার জন্যে নয়”
তাজউদ্দিন আহমেদ
“সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের অন্তে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্রের আর্দশে বলীয়ান হয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য এক নবসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। নতুন সমাজ ব্যবস্থা, নতুন মূল্যবোধ হড়ে তোলার জন্যে দেশবাসীকে আত্ননিয়োগ করতে হবে। রচনা করতে হবে পরস্পরাগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এবং অসৎ বৃত্তিকেন্দ্রিক উচ্চাভিলাষের সমাধি।
স্বাধীনতা কেবল নিশান বদলানো নয়। রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও এর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে সমভেতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারীত হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতক ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোকে চাপ সৃষ্টি করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি স্বাধীন রাষ্ট্র ভুটানকে”।
–খোন্দকার মোশতাক
‘মুক্তিবাহিনীর বীর তরুণ এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জওয়ানদের বীরত্বে আমরা অভিভূত।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েচ আমাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আমারা সোভিয়েট রাশিয়া, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাছেও কৃতজ্ঞ’।
-কামরুজ্জামান
“বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তুলতেই আমরা আত্ননিয়োগ করব।”
-মনসুর আলী
“ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। বিজয়ের এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণকে আমরা অভিনন্দন জানাই। জয়ধ্বনি দিই মুক্তিবাহিনীর তরুণ বীরদের শৌর্য ও নিবেদিত চিত্ততার জন্যে।
বাংলাদেশের জনগণ এবং মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করা; সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে তাঁদের দেশকে রক্ষা করাই ছিল ভারতের উদ্দেশ্য। প্রয়োজনের বেশি সময় আমাদের বাহিনী বাংলাদেশে থাকবে না।
আমরা আশা করি এবং প্রার্থনা করি, নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান জগগণের মধ্যে তাঁর যথাযোগ্য অভিনন্দন গ্রহণ করবেন এবং শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
আমরা বাংলাদেশের জনগনকে শুভেচ্ছে জানাই, সোনার বাংলায় তাদের জন্য যেন সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ে ওঠে।
এ-জয় তাঁদের একার নয়, যে সব জাতি মানবতার মূল্য দেয় তাঁদের সকলের জন্যে এ-জয় অশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
—শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী
.
.
কম্পাইলারঃ জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,২৭৫,৪৭১-৪৭২>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিণতি
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ৪র্থ সংখ্যা
তারিকঃ ১৭ ডিসেম্বর,১৯৭১
সম্পাদকীয়
অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিণতি
ইয়াহিয়া হিটলারী কায়দায় যুদ্ধের আগে যথেষ্ট হুমকি এবং হম্বিতম্বি করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই মহাপ্রভুর কাছ থেকে অবারিত অস্ত্র পাবার ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে সত্যিসত্যিই এক হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত আক্রমণ করে বসল। কিন্তু অস্ত্র দিয়েই শুধু যুদ্ধ হয়না, আসল শক্তি আসে যোদ্ধাদের ন্যায়বোধ, দেশাত্মবোধ সর্বোপরি জনসাধারণের সমর্থনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান এগুলোর কোনটিই পায়নি, তাছাড়া সামরিক বাহিনী একবার রাজনীতির আসরে নেমে পড়লে যুদ্ধ করার তেজস্বীতা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। গত এক যুগ ধরে শাসন ক্ষমতার থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘাতক অত্যাচারীই কেবল হয়ে উঠেছে।
এদিক থেকে আদর্শবাদী গণতান্ত্রিক ভারতের সেনাবাহিনী অনেক বেশী শক্তিশালী। সে কারণেই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানেও পাক সৈন্যদের পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে গত ৮ মাস ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রচন্ডভাবে মার খেয়ে জনগণের কাছ থেকে বৈরী আচরণ পেয়ে পাক সেনারা বিপর্যস্ত, অবসন্ন এবং ক্লান্ত। দীর্ঘ আট মাসের যুদ্ধে তারা মুক্তি যোদ্ধাদের দমন করতে পারেনি বরং দিনে দিনে তা বেড়ে উঠেছে। যতদিন যাচ্ছিল পরাজয় আসন্ন হয়ে আসছিল। এ নিশ্চিত পরাজয়ের প্রতি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি পাক জোয়ানদের না থাকলেও উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের অনেকে তা অনুমান করতে পেরেছিল।
জুন মাসের শেষের দিকে বিদেশী এক সাংবাদিকের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশে উপ-পাক সামরিক অধিকর্তা স্বীকার করেছিল- We are fighting a lost battle’ এ বক্তব্য শুধুমাত্র একটি জেনারেলের বক্তব্য নয়, হাজার মাইল দূর থেকে বিদেশে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে প্রতিটি পাক জোয়ান ও অফিসারদেরই আকুতি।
নৃশংসতম আচরণ করে, লোভ দেখিয়ে পাক বাহিনী জনগণকে তাদের দৃঢ়তা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফলে তারা বাংলাদেশের আশা গোড়া থেকে ছেড়ে দিতেই শুরু করে।
গত পনের দিন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যুক্ত আক্রমণের মুখে পাকসৈন্যরা কোন বাধা না দিয়ে কেবল পশ্চাদপসরণ করে চলে। রুখে দাঁড়ালে এত কম সময়ে আমাদের এ বিরাট বিজয় সম্ভব হতো না। কিন্তু আট মাস যুদ্ধে লিপ্ত ভাড়াটিয়া সৈন্যদের এ শক্তির মোকাবিলা করা অসম্ভব।
তাছাড়া পাক সেনারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছে জনগণের জন্য তারা যুদ্ধ করছে না। তারা যুদ্ধ করছে গুটি কয়েক সামরিক জেনারেশনের জন্য। জনগণ কর্তৃক ঘৃণিত হচ্ছে, ফলে যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা, মনোবল, কোনটাই তারা পাচ্ছে না। কাজেই তারা পশ্চাদপসরণ করে বাঁচার পথ নেয়াটাই সমীচিন মনে করেছে।
বড় বড় প্রভুরা ভয় দেখিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে রাষ্ট্রসংঘের হস্তক্ষেপ ঘটিয়ে পাকিস্তানকে এ থেকে মুক্ত করার এ সম্ভাবনাও এখন সুদূরপরাহত।
কেননা ন্যায়বোধ ও আত্মবিশ্বাসে অটুট ভারত বাংলাদেশ দুটি বৃহৎ রাষ্ট্রের হুমকিতে ভীত নন। কারণ তারা জানেন বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত রাশিয়া ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনতা তাদের পাশেই আছেন।
এ সমস্ত ঘটনার আলোকে এটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল যে এই প্রাণভয় এবং বাঁচার আশাতেই হয়ত অবরুদ্ধ সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে। তাছাড়া নিশ্চিত এ পরাজয়কে যে এড়ানো সম্ভব নয়। তাদের বিষদাঁত যে উপড়ে গেছে সেটা তারা নিজেরাও উপলব্ধি করেছে।
কার্যতও তারা তাই করেছে, প্রাণ নিয়ে বাঁচবার জন্য বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর হাতে।
.
.
জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,২৭৬,৪৭৩-৪৭৪>
শিরোনামঃ (মার্কিন সপ্তম নৌবহর) ভয় পাইয়ে দেবার কারসাজী মাত্র
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ১৭ ডিসেম্বর,১৯৭১
ভয় পাইয়ে দেবার কারসাজী মাত্র
বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর এগিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভারতবিরোধী বক্তব্য, অন্যদিকে ভারত সীমান্তে চীনা সৈন্যর তৎপরতা প্রভৃতি পাকিস্তানে দুই প্রভু, গণচীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতবিরোধী যৌথ উদ্যোগ বলে মনে হয়।
খবরে প্রকাশ, সপ্তম নৌবহরের আণবিক শক্তিসম্পন্ন বিমানবাহী জাহাত ‘এন্টারপ্রাইজ’ হংকং-এর কাছে অবস্থান করছে। নির্দেশ পেলে সেটি ঢাকাস্থিত গুটিকয়েক আমেরিকানকে উদ্ধার করার জন্য বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হবে।
কিন্তু ঢাকা, করাচী ও রাওয়ালপিন্ডি থেকে বৃটিশ ও অন্যান্য দেশের নাগরিক ও রাষ্ট্রসংঘের সদস্যদের বেসামরিক বিমানে করে তাঁদের স্বদেশে নিয়ে আসবার ব্যবস্থা হয়েছে। অথচ গুটি কয়েক নাগরিকের জন্য সপ্তম নৌবহরের প্রেরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরভিসন্ধিমূলক আচরণ বলে মনে হয়।
নিক্সনের পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ পক্ষপাতিত্ব থাকা সত্ত্বেও মার্কিন জনমত ও বিশ্ব জনমত বিরুদ্ধাচরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে সামিল হবার ঝুঁকি নেবার সম্ভাবনা এখনও অবধারিত হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু প্রশ্ন হল জনগণকে উদ্ধারের জন্যে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী নৌবহরের প্রয়োজন কি?
অনেকে মনে করছেন যে সপ্তম নৌবহরের এই অগ্রাভিযানের প্রসঙ্গটি ১৯৫৪ সনের পারস্পরিক পাক মার্কিন সামরিক চুক্তির সাথে সংগতিপূর্ণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও এ ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রেখেছেন গত ১২ই ডিসেম্বর। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শুনতে পাচ্ছি কিছু দেশ আমাদের হুমকি দিচ্ছে এবং বলছে, তাদের সাথে পাকিস্তানেরও কিছু চুক্তি রয়েছে। এ ইঙ্গিতে তিনি নাম না করলেও মার্কিন দেশকেই উদ্দেশ্য করে বলেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, এ যুক্তি ছিল, যতদূর তিনি জানেন, কম্যুনিজম রোধ করবার জন্য, গণতন্ত্র ও ন্যায়বোধের বিরুদ্ধে নয়।
আর যদি এর জন্যই হয়ে থাকে তাহলে এ দেশটি এতদিন ধরে বড় বড় মিথ্যা কথাই বলে আসছে।
পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাক-ভারত সমস্যায় নিজেকে জড়িত করে বিশ্বযুদ্ধকে ডেকে আনবার চেষ্টা করবে না। করলে সোভিয়েত রাশিয়াসহ মার্কিনবিরোধী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চুপ করে থাকবে না, তারা সবাই মার্কিনবিরোধী যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। শক্তির ভারসাম্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের সম্ভাবনাই বেশী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন পক্ষ নিয়ে এতদূর এগিয়ে এলে আদর্শবাদের দিকে থেকে সে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। বিশ্বজনমত তার বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরতে কুন্ঠা করবে না। কারণ বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের মুক্তিকামী ও গণতান্ত্রিক দেশের বাঁচার প্রশ্নটাই প্রধান হয়ে ঊঠবে। চীনও আত্মঘাতী যুদ্ধে এগোবে না বলেই আমাদের ধারণা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কেউই বিশ্বযুদ্ধের ঝুকি নিতে অগ্রণী হবে না। কেননা এতে তাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে বাধ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ও চীনের আসল উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে অখন্ড রাখা ও রক্ষা করা পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে। ভারতকে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত ও কাবু করবার জন্যই চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রণ পায়তারা।
বাংলাদেশ সংগ্রামের প্রতি ও ভারতের দৃঢ় ন্যায়বোধের প্রতি সহানুভূতিশীল বৃহৎশক্তি সোভিয়েত রাশিয়া এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবগত। মার্কিন চীনের রাষ্ট্রসংঘে যৌথ চক্রান্তমূলক তৎপরতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছেন। এর জন্যে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ কর্তৃক সোভিয়েত রাশিয়া অভিনন্দিত। এ মার্কিন চীনের এই রণপায়তারা সম্বন্ধে সোভিয়েত রাশিয়া পূর্বেই মন্তব্য করেছিল যে তারা ভারতের বিরুদ্ধে কোন হঠকারী পদক্ষেপ নিলে রাশিয়া চুপ করে বসে থাকবে না। তাস সোভিয়েত মহলের উদ্ধৃতি দিয়ে ৭ম নৌবহরের খবরটিকে ভুয়া ভয় প্রদর্শন জনিত ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। সোভিয়েত রাশিয়া মনে করে এই হুমকি ভারতকে ব্লাকমেল করারই এক অপচেষ্টা মাত্র।
.
.
শিহাব শারার মুকিত
<৬,২৭৭,৪৭৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুক্তাঞ্চলে অসামরিক প্রশাসনে সরকারী নির্দেশ |
অভিযান ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা |
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
মুক্তাঞ্চলে অসামরিক প্রশাসনে সরকারী নির্দেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ তার সহকর্মীদের সাথে মুক্তাঞ্চলে সুষ্ঠু অসামরিক প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য ক্রমাগত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। মুক্তাঞ্চলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকার সাহায্য করবেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে সহায়তা করার জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে কিছু সরকারী কর্মচারী বাংলাদেশ সরকার পাবার আশ্বাস পেয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে এরা বাংলাদেশে বিভিন্ন কাজ নিয়ে যাবেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা পুনরায় ভারতে চলে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ মন্ত্রী পরিষদ, মুক্ত অঞ্চলের প্রয়োজনীয়তার সামগ্রিক পরিচয় না পাওয়াতে সঠিক পন্থা গ্রহণ করতে সমর্থ হচ্ছে না। এ ব্যাপারে গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে যে জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে তাদের কাছ থেকে এগুলি সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এ সমস্ত খবর সরাসরি পৌছাতে বিলম্ব হচ্ছে; কারণ মুক্তাঞ্চলগুলি প্রায়ই যোগাযোগ ছিন্ন।
মুক্তাঞ্চলে অগ্রাধিকারভুক্ত প্রশাসনিক বিষয়গুলো নিয়ে সরকার ইতিপূর্বেই কর্মপন্থা গ্রহণ করেছেন। এগুলোর উল্লেখযোগ্য হলঃ
১। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
২। পাকসৈন্য ও রাজাকার বাহিনী যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গেছে সেগুলো উদ্ধার করা।
৩। ছিন্নমূল জনসাধারণকে পুনর্বাসন করানো।
৪। পূর্ণ সরকারী প্রশাসন ও গঠনমূলক তৎপরতা চালানো।
বাংলাদেশ সরকার চালানোর জন্য সে পরিমান অভিজ্ঞ অফিসারের প্রয়োজন তার অভাব বোধ করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার সমস্ত সরকারী অফিসারদের যেখানে তারা অবস্থান করছেন, যেভাবে তাদের পক্ষে সম্ভব সেভাবে তারা যেন কাজে যোগ দেন।
যারা এখনও বিচ্ছিন্ন এবং আত্মগোপন করে আছেন তাদের কাছে এ নির্দেশ আশাব্যঞ্জক হবে। এ ছাড়াও সরকার তথ্যানুসন্ধান কমিটি নিয়োগ করেছেন। এ কমিটি লক্ষ্য রাখবেন কোন কোন অফিসার শত্রুদের হয়ে কাজ করছেন।
স্বাভাবিকভাবেই পূর্ণ সরকারী ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সাহায্য অতি প্রয়োজন। সঠিক মালিককে সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে মুক্তিবাহিনীকে সরকারকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে। যে লোক নিজের সম্পত্তি থেকে অবৈধভাবে দখলীকৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে না তাদের শাস্তি দেয়া হবে।
পুনর্গঠনের ব্যাপারে পরিকল্পনা পরিষদ যে ব্লু-প্রিন্ট পেশ করেছে সরকার তা অনুমোদন করেছেন বলেও মুজিবনগর থেকে খবর পাওয়া গিয়েছে।
.
.
কম্পাইলারঃ শিহাব শারার মুকিত
<৬,২৭৮,৪৭৬-৪৭৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
কারও করুণা নয়- একটি জাতি রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে |
অভিযান ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা |
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
কারও করুণা নয়– একটি জাতি রক্তের
বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে
(অভিযান রাজনৈতিক পর্যালোচক)
বাংলাদেশে পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট অবরোধ সমাপ্তির সময় আসন্ন হয়ে এসেছে। পাকিস্তানি জঙ্গিচক্র, নয় মাসেরও আগে বাংলাদেশের নিরীহ গণতন্ত্রকামী মানুষের উপর এই যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি সৈন্য কিংবা সমরসম্ভারের প্রাচুর্যে ভয় না পেয়ে বীরের মত যুদ্ধ করার পথ বেছে নিয়েছে। সেদিন বাংলাদেশের এ যুদ্ধ ঘোষণাকে অনেক সমর বিশেষজ্ঞ অবিমৃষ্যকারিতা বলে উপহাস করেছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের সেদিন সত্যি সত্যি ভরসা প্রদানকারী কোন বন্ধু ছিল না, বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছ থেকে সাহায্যের কোন প্রতিশ্রুতি ছিল না, সর্বোপরি নিজেরাও ছিল চূড়ান্তভাবে অসংগঠিত। তবু তারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কারণ বাংলার জনগণের সংগ্রামী অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাসের বলে তারা ঐতিহাসিক সত্যে আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল যে একটা গোটা সংগ্রামী জাতির দাবী ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর নেই।
বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, ত্যাগ, সাহস এবং জ্বলন্ত দেশপ্রেম পৃথিবীর দেশগুলোর ও বিশ্বমানবের শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি আকর্ষণ করেছে। ভারতের মহান জনগণ এবং ভারত সরকারকে ধন্যবাদ। তাঁরা বাংলার জনগণের এই মুক্তিসংগ্রামকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। বাংলার স্বাধীনতার দাবী যে ন্যায়সঙ্গত দাবী তা মেনে নিয়ে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকমের সহযোগিতা প্রদান করেছেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। অপরপক্ষে পাকিস্তানের শক্তিশালী মিত্ররা পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টার কসুর করেনি। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের প্রতিটি মার্কিন তল্পিবাহক দেশ এবং তথাকথিত মুসলিম দেশসমূহ পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে অথবা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। জিন্নাহর কিংখাবে মোড়া পাকিস্তানের খসে পরা অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইনজেকশনে যে টিকে থাকতে পারে না, বাংলার সংগ্রামী জনগণ, মুক্তিযোদ্ধারা তাই প্রমাণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এতদিনে নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছে, অস্ত্র নয় মানুষের সংগ্রাম এবং শুভেচ্ছাই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারন করে। বাংলাদেশে এই ঐতিহাসিক সত্য প্রমাণিত হতে যাচ্ছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করার পূর্বমুহূর্তে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের পরামর্শে ভারতের উপর নগ্ন হামলা চালায়। সীমান্ত অতিক্রম করে নিরীহ জনসাধারণের উপর গোলাবর্ষন করে, নগরে জনপদে বোমা ফেলে এবং এইভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধে ভারতকে জড়িয়ে ফেলে। এরই মধ্যে ভারত দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে। পাকিস্তান নিশ্চয়ই অস্ত্র ও সেনাবলে বহুগুণ শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে এঁটে ওঠা তার পথে স্বপ্নেরও অগোচর। তবু ভারতকে আক্রমণ করে তাকে সম্মুখযুদ্ধে নামতে বাধ্য করেছে। এটা পাকিস্তানি সমরনায়কদের ঘোলা জলে মৎস্য শিকার করার আরেকটি ফন্দী। এ সম্বন্ধে বাংলাদেশের জনমত বহুদিন আগে থেকেই সজাগ ছিল। কয়দিন যুদ্ধ চালিয়ে জাতিসংঘের সাম্রাজ্যবাদী মামা-কাকাদের ডেকে বলবে আমরা আর পারলাম না, এবার তোমরা ঠ্যালা সামলাও। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হবে এবং মাঝখান থেকে বাংলার জনগণের স্বাধীনতার দাবী ফসকে যাবে। পাকিস্তান বাস্তবে করেছেও তাই। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভুল করেছিলেন, তাসখন্দ একবারই হয়, বার বার না। আমেরিকা যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলো। তার তল্পীবাহকরা প্রস্তাব সমর্থন করেছে, বলেছে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিসন্ধি ভন্ডুল করেছে রাশিয়ান ভেটো। রাশিয়ান প্রতিনিধি বলেছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত পাকিস্তান বিরোধের প্রশ্ন আলোচনার সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিকেও বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেয়া হোক। সব মিলিয়ে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ভেতরে বাইরে পাকিস্তানের অস্তিত্ব আজ চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখোমুখি। গোটা বাংলাদেশ ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর করতলগত প্রায়ই হয়ে এসেছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের দুর্ধর্ষ আক্রমণের মুখে পাকিস্তান মারের পর মার খাচ্ছে। বাংলার পাললিক মাটিতে একটি নতুন দেশ একটি নতুন শক্তি প্রবুদ্ধ স্বাধীন জাতি মাথা তুলেছে। ভারত এই জাতিকে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। শিগগির আমরা আশা করছি বিশ্বের অন্য দেশগুলো স্বীকৃতি জানাতে বাধ্য হবেন। এটা অনুকম্পা বা করুণা নয়, বৈদেশিক নীতি কূটনীতি নয়- একটি জাতি মেরে মরে, প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে স্বাধীন হতে পারে, শক্তি বলে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে বিশ্ব রাষ্ট্রগুলো এই সহজ সত্যটি স্বীকার করে নিবেন, এটুকু শুভবুদ্ধি তাঁদের আছে বলে আমরা মনে করি।
.
.
কম্পাইলারঃ জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,২৭৯,৪৭৮-৪৭৯>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা
তারিখঃ ১৭ ডিসেম্বর,১৯৭১
বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আজ আমাদের হাতে
(অভিযান রাজনৈতিক পর্যালোচক)
অবশেষে যা হবার তাই হলো। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর চোখের জল আর রক্ত স্নানের সমাপ্তি ঘটলো। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নিল একটি নতুন রাষ্ট্র- স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
এই স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীদের নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে তেমনি পঞ্চান্ন কোটি ভারতবাসীর আত্মার সাথে সংযুক্ত করেছে বাংলাদেশের জনগণকে।
মহান ভারত এবং ভুটান এই নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি জানিয়ে বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অনেক দেশই এখনো স্বীকৃতি জানায়নি।
কিন্তু তাতে ক্ষোভ করার কিছু নেই। কারণ আমাদের প্রচুর সম্পদ না থাকতে পারে, না থাকতে পারে প্রভাব কিংবা প্রতিপত্তি কিন্তু বাংলার আপামর জনতার দৃঢ়মনোবল আমাদের রয়েছে। জনগণতান্ত্রিক চীনকেও অনেক দিন পর্যন্ত বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র মেনে নেয়নি। কিন্তু তা বলে তাঁর প্রগতি কিংবা সমৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যায়নি। সাত কোটি চীনা জনগণ নিজস্ব সম্পদের উপর নির্ভর করে জনগণতান্ত্রিক চীনকে তার যোগ্য আসনে আজ প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ধর্ষিতা, লুন্ঠিতা বাংলাকে নবসাজে সজ্জিত করার দায়িত্ব আজ আমাদের হাতে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ কথাটার সঠিক মর্যাদা দেবার দিন আজ উপস্থিত।
নবজাত রাষ্ট্রকে নতুন ছাঁচে গড়ে তোলার আগে কতকগুলো বাস্তব সত্যকে আজ উপলব্ধি করতে হবে, যে উপলব্ধি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তোলার পথে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আমরা যেন ভুলে না যাই যে ২৫শে মার্চ যখন পাক জঙ্গীচক্রের বর্বর পশুরা আমাদের উপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তখন অজ পাড়াগাঁয়ের খেতের কিষাণ, যারা রাজনীতির মারপ্যাচ থেকে সব সময় নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতো, লড়াই এর ময়দানে তারাই প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে। রোজকার মতো কারখানার ভোঁ সেদিনও বেজেছিল, কিন্তু খেটে খাওয়া মজুর তার আগেই শুনতে পেয়েছিল বাংলা মায়ের করুণ আর্তনাদ। মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে সে শরীক হয়েছিল শত্রুহননের মিছিলে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত ছাত্র শিক্ষক সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে সঠিক নেতৃত্ব এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তি মিছিলে।
আমাদের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস। আমরা মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষায় সংগ্রাম করেছি, নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবীতে। প্রত্যেকটি সংগ্রাম আমাদের সামনে নতুন নতুন শিক্ষা নিয়ে হাজির হয়েছে। আমরা আরও জেনেছি সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের চোয়াল থেকে মুক্ত হতে না পারলে একটা জাতির সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। বাঙ্গালীর আত্মার সাথে যাদের নাড়ীর যোগ সেই সব মহাজ্ঞানী মহাজনদের অত্যন্ত কাছাকাছি যেতে আমরা তখনই সক্ষম হয়েছি যখন আমাদের কৃষ্টির উপর আঘাত এসেছে, সংস্কৃতির উপর আঘাত এসেছে। এই কথাগুলো বলার পেছনে একটি মাত্রই উদ্দেশ্য সেটি হলো আমরা আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছি সত্যি, কিন্তু আমাদের আরো অনেক অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তার যোগ্য আসনে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ সম্প্রতি এক বেতার ভাষণে বলেছেন যে অপরাধীকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা একমাত্র সরকারেরই রয়েছে। আজ যদি কেউ ধর্ম কিংবা বর্ণের মাপকাঠিতে লাঞ্চিত হন তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতি চরম অবমাননা। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। নির্বাচনের প্রাক্কালে ঢাকার একটি জনসভায় তিনি বলেছিলেন যে যারাই বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন তাদেরকেই বাংলাদেশের জনগণ বলে পরিগণিত করা হবে।
এই কথা আমাদের অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। আজ যদি বাঙ্গালী বিহারী প্রশ্ন ওঠে কিংবা সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয় তাহলে বাংলাদেশের সমৃদ্ধিই বিঘ্নিত হবে, বিগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো থেকে আমরা যে শিক্ষা নিয়েছিলাম তার কোন মূল্যই থাকবে না। আমরা যে অনেকদূর এগিয়েছি সেটাও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে।
ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতির মধ্য দিয়ে বিশ্বের কাছে আমাদের এটাই প্রমাণ করতে হবে যে গোটা বাঙ্গালী জাতি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে পচা আবর্জনার মতো ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছে।
সাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করেই আমাদের ক্ষান্ত হলে চলবে না। আমাদের এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা সংগ্রাম করেছি সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানে জঙ্গীচক্র মার্কিন সমর্থনপুষ্ট হয়ে আমাদের উপর যে শোষণ চালিয়েছে তাতে সবচেয়ে বেশী নিগৃহীত হয়েছে বাংলার কৃষক সমাজ। মৌলিক গণতন্ত্র চালু করে গ্রামে গ্রামে নিজেদের দালাল তৈরী করা হয়েছিল। এই দালালরাই ছিল সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদী শোষকদের আশা ভরসা। সরকারী সুযোগ সুবিধা গুলো ছিল একমাত্র দালালদেরই প্রাপ্য। আর এই সুযোগে গ্রামের ধনী কৃষক হয়েছে মাঝারি কৃষক, মাঝারি কৃষক হয়েছে গরীব কৃষক আর গরীব কৃষক হয়েছে ভূমিহীন। গ্রামের সমস্ত সম্পদ জমা হয়েছে গুটিকয়েক লোকের হাতে।
এই সত্যগুলো সামনে রেখে আমরা যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণ করি তাহলে যে সত্য আমাদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় সেটি হলো এই গুটিকয়েক লোকের কঠোর বিরোধিতা। অন্যদিকে সাধারণ কৃষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে জড়ো হয়েছিল মুক্তির মিছিলে।
সুতরাং এইসব দালালদের উপড়ে ফেলবার সময় এসেছে। উপড়ে ফেলতে বলছি এই কারণে যে কতকগুলো আগাছা যেমন সমস্ত জমিটাই নষ্ট করে দেয় তেমনি এই গুটিকয়েক আগাছা সমস্ত দেশকে ধ্বগসের পথেই নিয়ে যায়। কৃষক তাই প্রথমেই জমি থেকে আগাছা উপড়ে ফেলে দিয়ে জমিকে ফসলে ভরপুর করে তোলে। আমাদেরকেও তেমনি এইসব দালালদের নিশ্চিহ্ন করে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে। শুধু নিশ্চিহ্ন করলেই হবেনা, সাথে সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে আর যেন এই সব দালালদের সৃষ্টি না হয়।
এই দুটো মৌলিক প্রশ্নকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করেই আমাদের এগোতে হবে। এই উপলব্ধির উপর ভর করেই নির্ধারণ করতে হবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা। যার বাস্তব প্রয়োজন জন্ম দিবে এক সুখী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বপরিসরে প্রতিষ্ঠিত হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
.
.
মুজিবনগর সংবাদপত্রঃ ইংরেজি
অনুবাদঃ নোবেল
<৬,২৮০, ৪৮০-৪৮১>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ১৪ জুলাই, ১৯৭১
.
পাকিস্তান গণহত্যার অপরাধী
পাকিস্তান আর্মির ‘ বাঙালীদের হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলার মিশন’ মানুষের মর্যাদা এবং সভ্যতার মৌলিক নিয়ম এর প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করে এখনো চলমান আছে। এই পরিকল্পিত গণহত্যা হচ্ছে এক পৈশাচিক পরিকল্পনার অংশ যা হিন্দু অথবা মুসলিম অথবা খ্রিষ্টান অথবা বোদ্ধ নির্বিশেষে বাঙালী হত্যার জন্য করা হয়েছে। লক্ষ হচ্ছে একটা দেশকে ধ্বংস করে ফেলা যার জনগণ জাতিগত ও বর্ণগত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা।
.
বাঙালীদের ‘দোষ’ ছিল এই যে তারা বাঁচার অধিকার চেয়েছিল। নির্মম অর্থনৈতিক শোষণ পরিচালনা করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও সম্পদের উপর। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার জন্য এটা বন্ধের প্রয়োজন ছিল। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সংখ্যালঘু অংশের মানুষের হাতে অধ্যুষিত হয়ে থাকা আর মেনেনিতে পারছিল না। দীর্ঘদিন ধরে এই অসহ্য অনুভূতি জন্মন নিচ্ছিল এবং সহ্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছিল কিন্তু প্রতিকারের কোন পথ দেখা যাচ্ছিল না কারণ ইচ্ছাকৃতভাবে বাঙালীদের ক্ষমতার মূল করিডরের বাইরে রাখা হচ্ছিল।
.
আইয়ুব খানের পতনের পর, জেনারেল ইয়াহিয়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা দিয়ে খমতায় আসেন। দেশ ব্যাপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় কিন্তু যখন ঐ উদ্দেশ্য প্রয়োগের সময় আসে, তা এক নিমিষেই ভেঙে পড়ে। ভুট্ট এবং মিলিটারি জান্তার কেঁউই গণতন্ত্রের সার কথা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন মেনে নিতে রাজী ছিল না। যখন ইয়াহিয়া এবং ন্যাশনাল এসেম্বলির মেজরিটি পার্টির নেতা শেখ মুজিবের মধ্যে আলোচনা চলমান ছিল, হঠাৎ করে সংগঠিত সেনাবাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্র সমেত নিরস্ত্র নিষ্পাপ সিভিলিয়ানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা হত্যা করে এবং জ্বালিয়ে দেয়, ধর্ষণ এবং লুট করে একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে আর তা সে মানুষ গুলোকে নিঃশেষ করে দেওয়া যারা আর কোন অপমান এবং শোষণ সহ্য করার মত অবস্থায় ছিলনা।
.
মার্চ ২৬ ইয়াহিয়া খানের ভাষণ পরিষ্কার ভাবে পরিকল্পনাটি ইঙ্গিত করে যার উপর ভিত্তি করে গণহত্যার সম্পূর্ণ অপারেশন লঞ্চ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব এবং তার পার্টি ছিল পাকিস্তানের শত্রু এবং সে কারণে তাদের নির্মূল করতে হবে। ডিসেম্বরের নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায় পূর্বের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের কাছথেকে আওয়ামীলীগ ১৬৯ টি আসনের মাঝে ১৬৭ টি আসন পেয়েছিল। এটা সুস্পষ্ট যে পুরো জাতী শেখ মুজিব সাংবিধানিক ভাবে যা অর্জন করতে চাচ্ছিলেন তাতে পুর্ন সমর্থন দিয়েছিল।
.
সুতরাং আর্মি পুরো জাতীকেই তাদের টার্গেট হিসেবে গ্রহণ করে এবং হত্যা করে এবং জ্বালিয়ে দেয় কোন বাছবিচার ছাড়া। কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মাঝে তারা তাদের আক্রমণ সীমিত রাখার কোন কারণ খুঁজে পায় না সুতরাং একটি পূর্ণ মাপের আক্রমণ লঞ্চ করা হয় মানুষের মাঝ থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ নিশ্চিহ্ন করার জন্য। এটা এখন পরিষ্কার যে পাকিস্তান আর্মি হিন্দু বা মুসলিম যেই হোকনা কেন কোন বাঙালিকে বাঁচতে দিবে না।
.
জার্মানিতে হিটলারের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শাষন ৮ মিলিওনের অধিক মানুষকে নির্মূল করেছিল। পরবর্তীকালে দেশ সমূহ ১৯৪৮ সালে গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও শাস্তির জন্য কনভেনশন গ্রহণ করে এবং এটাকে এ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যে ‘ কার্যকলাপ, যা করা হয়েছে ধ্বংসের অভিপ্রায়ে, সম্পূর্ণভাবে অথবা আংশিক ভাবে, একটি জাতের মতের বর্ণের অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে হত্যা অথবা মারাত্মক ভাবে শারীরিক আঘাত করা বা এমন কোন গ্রুপের সদস্যকে মানসিক আঘাত করা।‘ কনভেনশন আরো ঘোষণা করে যে এই অপরাধ আন্তর্জাতিক আইন এর আওতায় শাস্তিযোগ্য এবং শাসক ও সরকারী কর্মকর্তাদের উপর প্রয়োগ যোগ্য।
.
এর সাথে মৌলিক মানবাধিকার সমূহ যুক্ত আছে যা কনভেনশন এবং জাতিসংঘ উভয় দ্বারা স্বীকৃত। যদি মানবতা বিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনের মতে অপরাধ হয়, বাংলাদেশে পাকিস্তানী আর্মির কার্যক্রম কনভেনশনের আর্টিকেল ৪ এর আওতায় পেনাল ট্রাইবুনালে তোলা সম্ভব।
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গণহত্যার এমন পরিষ্কার কেস আর নেই যেটা আজ বাংলাদেশে পাকিস্তানী শাসক করছে। পাশবিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানী আর্মি বাংলাদেশে ডাবল গণহত্যা করছে একটি হচ্ছে জাতী হিসেবে বাঙালী নিধন এবং অপরটি হচ্ছে ধর্মীয় গ্রুপ হিসেবে হিন্দুদের নিধন। নিযেকে বাঙালী দাবী করার দুঃসাহস হিন্দু বা মুসলমান যেই দেখাকনা কেন তাঁকে তৎক্ষণাৎ গুলি করা হচ্ছে এবং কেউ নিজেকে হিন্দু স্বীকার করলে তাঁকে বেয়নেট চার্জ করে মারা হচ্ছে। সহজ ভাষায় এটা গণহত্যা এবং ঠিক এটাই পাকিস্তানী আর্মি এখন করছে। যদি বিশ্ব বিবেক কিছু করতে চায় তবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার থেকে বড় আর কিছু হতে পারে না। গণহত্যা এমন একটি অপরাধ যাতে শাস্তি অবধারিত।
.
অনুবাদঃ নোবেল
<৬,২৮১, ৪৮২-৪৮৩>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৪
তারিখঃ ২১ জুলাই, ১৯৭১
.
গণপ্রতিনিধিদের শপথ
.
বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা শপথ গ্রহণ করেছেন এই মর্মে যে তারা পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশের সীমানা মুক্ত করবেন এবং আওয়ামীলীগ ও এর নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও চেতনা অনুসরণ করবেন। তাঁরা ইসলামাবাদের সাথে কোনরকমের রাজনৈতিক সমঝোতার ধারণা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছেন।
.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম ক্ষমতা দৃঢ় করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কোন এক জাগায় আয়োজিত দুই দিনের অনফারেন্স আলোচনায় নির্বাচিত ৩৭৪ জন জনপ্রতিনিধি (সদ্য বিলুপ্ত পাকিস্তানের জাতীয় এবং প্রাদেশিক সভার মেম্বাররা) দৃঢ় সংকল্প ব্যাক্ত করেন।
.
১৩৫ জন এমএনএ ২৩৯ জন এমপিএ ৬ জুলাই,১৯৭১ এক কনফারেন্সে মিলিত হন। ৭ জুলাই, ১৯৭১ কনফারেন্স সমাপ্ত হয়। উল্লেখ্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রীগণ, যাদের নাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ (প্রধানমন্ত্রী), জনাব খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ (পররাষ্ট্র মন্ত্রী), জনাব মনসুর আলী (অর্থমন্ত্রী), এবং এএচএম কামারুজ্জামান(ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী) সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
.
সৈয়দ নজরুল ইসলাম উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে সভা শুরু করেন এবং কিছু প্রস্তাবনা গ্রহণের মাধ্যমে সভা সমাপ্ত হয়। জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ (প্রধানমন্ত্রী) এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানী, কমান্ডার ইন চিফ, মুক্তিবাহিনী( লিবারেশন ফোর্স) যেকিনা জাতীয় পরিসদেরও একজন সদস্য, সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন এবং অনেক মেম্বাররা আলোচনায় অংশনেন।
.
দুই দিন ব্যাপী এই সভাতে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে শত্রু হঠানর জন্য সরকারের সকল প্রচেষ্টার সমর্থনে মেম্বাররা শক্তভাবে সরকারের পিছনে আছেন। এছাড়া এই কনফারেন্স পরিষ্কার প্রশ্নোত্তর এবং নির্ধারিত মতামতের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে ইয়াহিয়ার খুনে বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের উপরদিয়ে কোন সমঝোতা হতে পারে না। দখলদার বাহিনীর সম্পূর্ণ নির্মূলই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার একমাত্র পথ। এ সকল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, কনফারেন্সে সিধ্যান্ত নেওয়া হয়েছে আরো অধিক গতি ও শক্তি দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে।
.
এই কনফারেন্সের এক প্রস্তাবনায় বিশ্বের সকল দেশের কাছে বাংলাদেশে ইসলামাবাদের শাসক গোষ্ঠীর গণহত্যা বন্ধ্যের জন্য চাপ প্রয়োগের আহবান জানানো হয়। অপর এক প্রস্তাবনায় সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নিঃশর্ত মুক্তির এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ইসলামাবাদের উপর চাপ প্রয়োগের অনুরোধ করা হয়। কনফারেন্সে পাক আর্মির হাতে নিহত একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির জন্য শোক প্রকাশ করা হয় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত সকল শহীদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়।
.
কনফারেন্স বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর আস্থা পুনর্ব্যাক্ত করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বত ভাবে সহযোগীতার নিশ্চয়তা দেন।
.
অপর এক প্রস্তাবনায়, মেম্বাররা ইসলামাবাদে আমেরিকান অস্ত্র সরবরাহের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ইয়াহিয়া বাহিনীকে বাংলাদেশে গণহত্যা চলমান রাখার জন্য দেওয়া এই সহযোগিতার তীব্র নিন্দা জানান।
.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ২৮২,৪৮৪-৪৮৫>
শিরোনামঃ প্রথম বাংলাদেশ মিশন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নম্বর ৪
তারিখঃ ২১শে জুলাই, ১৯৭১
.
বিশ্বের প্রথম বাংলাদেশী দূতাবাস
এ বছরের ১৮ই এপ্রিল কলকাতায় পাকিস্তানী দূতাবাসের সহকারী রাষ্ট্রদূত, দূতাবাসের কার্যালয় থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে সবুজ, সোনালী ও রক্তিম লাল বর্ণের বাংলাদেশী পতাকা উত্তোলন করেন। জনাব হুসেইন আলী এবং দূতাবাসের ৬৪ জন বাঙালী সদস্য মিলে মাতৃভূমির প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তাণ্ডব থেকে মুক্ত করার শপথ নেন।
পাকিস্তানী বর্বরতার প্রতিবাদে দূতাবাসের সামনে আগে থেকে জড় হওয়া জনতা এই ঘটনায় উল্লাস, আনন্দের কান্না ও “জয় বাংলা” স্লোগানে চারপাশ মুখরিত করে তোলে।
জনাবা আলী বলেন, ” শহীদের রক্ত কখনোই বৃথা যেতে পারে না, বাংলাদেশী জনগণের বিজয় অবশ্যই হবে “।
তাঁর স্বামী, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রীয় কাজে ২২ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জনাব আলী তাঁর এক বক্তব্যে জানান, পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে, যেই বাংলাদেশের জনগণ এত বছর ধরে তাদের ভাতৃসম ছিল। ১৯৪৭ থেকে পাকিস্তানীরা প্রচার করে আসছে ভারত আমাদের ১ নম্বর শত্রু, কিন্তু এখন ভারতই আমাদের লক্ষাধিক শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে।
মানুষের বিবেক বোধের যতটুকুই বেঁচে আছে তা জাগিয়ে তুলে সমগ্র বিশ্বকে সম্ভবপর সকল উপায়ে বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্য তিনি আবেদন করেন।
পাকিস্তানী সরকার কলকাতায় ঘটে যাওয়া নাটকীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দাবী জানায়, জনাব হুসেইন আলী এবং অন্যান্য বাঙালী কূটনীতিকরা ভারতীয় চাপ প্রয়োগে তাদের আনুগত্য পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে।
এখন সুইস প্রতিনিধি ডক্টর বন্নারড সকলের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং প্রমিত হয় যে, তাদের কেউই পাকিস্তান ফেরত যেতে আগ্রহী নন। তারা সকলেই দেশপ্রেমী এবং পাকিস্তানের সহযোগিতা করে নিজেদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ধ্বংস করার কোন ইচ্ছা তাদের নেই।
কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের জন্য মিনতি জানান
কলকাতায় রবিবার দুপুরে পাকিস্তানের সহকারী রাষ্ট্রদূতের কার্যালয়ে বাংলাদেশী পতাকা উত্তলনের পর সহকারী রাষ্ট্রদূতের পত্নী জনাবা আলী সাংবাদিকদের এক বিবৃতিতে জানান, পাকিস্তান সেনারা যখন প্রথম নিরস্ত্র বাঙালী জনগণের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তখন তিনি ঢাকায় ছিলেন। তাঁর ঢাকাস্থ বাসস্থানের সামনে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পাকিস্তান বাহিনী ২২ জন ছাত্রকে হত্যা করে। তিনি জানান, এই দৃশ্য এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এই ঘটনার পর তাঁর কন্যা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচারে অধ্যাপক, শিক্ষক ও ছাত্র হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জনাবা আলী কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, অবস্থা এতটাই অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি তাঁর স্বামীকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে মিনতি করেন।
জনাবা আলী গত কয়েক বছরের পূর্ব বঙ্গের করুণ দুর্দশার বর্ণনা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। পূর্ব বঙ্গের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে জনাবা আলী বলেন; ভাত – যা কিনা বাংলাদেশীদের প্রধান খাদ্য তা ইসলামাবাদের তুলনায় অধিক দামে এখানের জনগণের কাছে বিক্রয় করা হত। বিশেষ করে, বৃদ্ধ ও শিশুরা ঔষধ, কাপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যাদির স্বল্পতায় ভুগেছে।
জনাবা আলী তাঁর স্বামীর কর্মকাণ্ডের সমর্থন করে বলেন, ইয়াহিয়া খান ভেবেছিল যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্বাধীনতা সংগ্রামকে গুড়িয়ে দিতে পারবে কিন্তু এটা সম্ভব না কারণ সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ তার বিরুদ্ধে ছিল।
কূটনৈতিক কর্মকর্তাবৃন্দ
জনাব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ( প্রথম সচিব )
জনাব আনোয়ারুল করিম চৌধুরী ( তৃতীয় সচিব )
জনাব কাজী নজ্রুল ইসলাম (তৃতীয় সচিব )
জনাব এম. মাকসুদ আলী ( সহকারী গণ সংযোগ দূত )
কার্যনির্বাহী কর্মচারীবৃন্দ
জনাব সাইদুর রহমান , জনাব এম. এ. হাকিম , জনাব আমির আলী চৌধুরী , জনাব আনোয়ার হুসেইন চৌধুরী , জনাব মোহাম্মদ সায়েদুজ্জামান মিয়া , জনাব জয়নাল আবেদিন চৌধুরী , জনাব মুস্তাফিজুর রহমান , জনাব আলিমুজ্জামান , জনাব এ. জেড. এম. এ. কাদির , জনাব মতিউর রহমান , জনাব কাজী সেকান্দার আলী , জনাব মোহাম্মদ গোলামুর রহমান , জনাব শামসুল আলম , জনাব মোহাম্মদ সিদ্দিকুল্লাহ , জনাব এ. কে. এম. আবু সুফিয়ান , জনাব আব্দুর রব , জনাব মোহাম্মদ ফকরুল ইসলাম , জনাব মোহাম্মদ আমিনুল্লাহ , জনাব মোহাম্মদ আব্দুল বাশার , জনাব এ. বি.এম. খুরশিদ আলম , জনাব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া , জনাব আব্দুর রহমান ভুঁইয়া , জনাব মোহাম্মদ আব্দুর রহিম , জনাব মোহাম্মদ নুরুল আমিন , জনাব নূর আহমেদ , জনাব মোহাম্মদ আলাউদ্দিন , জনাব সমিরুদ্দিন , জনাব এম. সোলায়মান , জনাব এস. শামসুদ্দিন হুসেইন , জনাব জহুর হুসেইন , জনাব মীর মোজাম্মেল হক , জনাব মোহাম্মদ জাকারিয়া , জনাব মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান , জনাব আব্দুর নূর , জনাব এ. কে. এম. আব্দুর রব , জনাব এ. এন. এম. কামরুর রশিদ , জনাব আনোয়ারউজ্জামান , জনাব আব্বাস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী , জনাব ওয়াহিদুর রহমান , জনাব মোহাম্মদ শহিদুর রহমান , জনাব শরিফুল আলম , জনাব আব্দুল কাদের , জনাব আব্দুল মতিন প্রধানিয়া , জনাব আব্দুল আমিন , জনাব মোহাম্মদ হুসেইন , জনাব মতিউর রহমান , জনাব আব্দুল গফুর মৃধা , জনাব আমান হুসেইন , জনাব হাতেম আলী , জনাব বযলুর রহমান , জনাব মোহাম্মদ হেদায়েতুল্লাহ , জনাব নুরুল হক , জনাব শামসুল আনোয়ার , জনাব মমতাজ মিয়া , জনাব শামসু মিয়া , জনাব মোহাম্মদ ইলিয়াস , জনাব আব্দুল হাশেম ।
.
.
অনুবাদঃ তুষার শুভ্র
<৬, ২৮৩, ৪৮৬>
শিরোনামঃ জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের দ্বৈত আচরণ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ভলিউম ১ নং ৫
তারিখঃ ২৮ জুলাই, ১৯৭১
.
জাতিসংঘ সচিবালয় বাংলাদেশের অভ্যান্তরে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাবকে সক্রিয়ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তাদের এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশের ৭ মিলিয়ন উদবাস্তু যারা এখন ভারতে অবস্থানরত তাদেরকে অঙ্গীকার দেওয়া যে তাদের মাতৃভূমি এখন তাদের জন্য নিরাপদ।
পাকিস্তানী মিলিটারি কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিচ্ছে যেন রেফিউজিরা তাদের দেশে ফিরতে না পারে এবং পাকিস্তানী আর্মি বাংলাদেশের জনগণের উপর এমন বর্বরতা এখনও চালাচ্ছে যে ৫০,০০০ রেফিউজি গতসপ্তাহে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছে। এটি মনে হচ্ছে যে, জাতিসংঘের সুযোগ্য ভদ্র মহাদয়গণ বাংলাদেশের লাখ লাখ গৃহহীন মানুষেরই শুধু নয় ; নিজেদেরকেও প্রতারিত করার জন্য বদ্ধপরিকর। যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং কৃপাহীন তাই জাতিসংঘের নিযুক্ত পর্যবেক্ষকদের পাকিস্তানী আর্মির আশেপাশে থাকা অনিরাপদ।
আমাদের মনে আছে, মার্চ মাসে যখন পাকিস্তান আর্মি বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, জাতিসংঘ তখন বাংলাদেশ থেকে সকল কর্মীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল যাতে পাকিস্তানী আর্মি জাতিসংঘের তথাকথিত পর্যবেক্ষকদের অনুপস্থিতিতে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে।
জাতিসংঘের যদি সত্যিই গৃহহীন মানুষের জন্য উদ্দেগ থাকে তবে তারা কেন এই গৃহহীন মানুষদেরকে আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে? এটি কখনওই তারা অস্বীকার করতে পারবে না যে তথাকথিত নিরপেক্ষ জাতিসংঘের কর্তাব্যাক্তিরা পাকিস্তানী আর্মির বাঁশির সুরে নাচছে।
তাছাড়াও ইউ এন হাই কমিশনারের বিচার ব্যাবস্থায় শুধুমাত্র ফুটে উঠেছে রেফিউজিদের মানবিক ত্রাণ পাঠাবার কথা। এটি অদ্ভুত যে এই প্রতিষ্ঠানটি রেফিউজিদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো-তেই বদ্ধ পরিকর। এটি পরিষ্কার যে রেফিউজিদের বাংলাদেশে নিরাপদে ফেরত পাঠনোতে রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত। আমরা বুঝতে পারছিনা কিভাবে জাতিসংঘের শরনার্থিদের এই কমিশনার একক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যেখানে এখনও জাতিসংঘের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘দি “সিকিউরিটি কাউন্সিল” (নিরাপত্তা পরিষদ) বাংলাদেশের অবস্থার জন্য কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে নি।
পাকিস্তান আর্মির প্রকাশ্যে গনহত্যায় নীরব ভূমিকা প্রদর্শনের মাধ্যমে জাতিসংঘ ইতিমধ্যে মর্যাদাহানিকর বদনাম কুড়িয়েছে যেটি জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আমরা আশাকরি, ইউ এন তার উত্তরাধিকে অনুসরণ করবেন না যিনি নিজের কারিয়ারের শেষ দিনটিকে স্মরণীয় করার জন্য কঙ্গোতে হস্তক্ষেপের একটি ভুল ও অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বর্তমানে সেক্রেটারি জেনারেল ও যদি বাংলাদেশে সেই নোংরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটান তাহলে এটি খুব মর্মান্তিক হবে।
.
.
অনুবাদঃ দ্বীপ অধিকারী
<৬,২৮৪,৪৮৭>
শিরোনাম: বাংলাদেশের ডাক টিকিট
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১: নং.৫
তারিখঃ ২৮ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশের ডাক টিকিট
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাকটিকেটের প্রথম ইস্যুর আন্তর্জাতিক বিতরণ অনুমোদিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ডাকটিকেটের মূল্য সমূহ:
১০ পয়সা. নীল, অত্যুজ্জ্বল লাল, বেগুনী, বাংলাদেশের মানচিত্র।
২০ পয়সা. হলুদ, অত্যুজ্জ্বল লাল, গাঢ় সবুজ, নীল, ১৯৭১ এর ২৫-২৬ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত গনহত্যার ছবি চিত্রিত।
৫০ পয়সা. orance(বাংলা পেলাম না), হালকা বাদামী, গাঢ় বাদামী, ধূসর, জাতির জনসংখ্যার ৭৫ মিলিয়ন বোঝাতে চক্রাকারে ৭৫ সাজানো।
১ রূপি. হলুদ, অত্যুজ্জ্বল লাল, সবুজ, স্বাধীনতার পতাকা, মানচিত্রে সংঘবদ্ধ বাংলাদেশ।
২ রূপি. নীল, গাঢ় নীল, ম্যাজেন্টা, ১৯৭০ এর নির্বাচন, একটি ব্যালট পেপার যাতে লেখা ‘ফলাফল-১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন বাংলাদেশের পক্ষে’।
৩ রূপি. সবুজ, গাঢ় সবুজ, নীল, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলার চিত্র।
৫ রূপি. সোনালী, কমলা, গাঢ় বাদামী, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
১০ রূপি. সোনালী, ম্যাজেন্টা, গাঢ় নীল, ‘বাংলাদেশকে কে সমর্থন করুন’ লেখা ডাকটিকেট।
.
.
অনুবাদঃ ফজলে রাব্বী সৌরভ
<৬,২৮৫,৪৮৮>
শিরনামঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৫
তারিখঃ ২৮ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গ্যাস্টাপো কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ
পশ্চিম পাকিস্তান দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে নতুন রাজত্ব অথবা গ্যাস্টাপো আইন শুরু করেছে।ফ্যাসিবাদী কৌশলগুলোর একটি হচ্ছে সকল বাঙালি বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্য একটি প্রশ্নমালা জারি করা যা মূলত একটি সরাসরি হুমকি। কিছু প্রশ্ন নিম্নে উল্লেখ করা হলো এবং সন্দেহ নেই যে,সেনাবাহিনী শুধু সে উত্তরগুলো চায় যা পাকিস্তানের প্রোপাগান্ডা মূলক প্রচার কার্যক্রমকে তুলে ধরে।
.
১.আওয়ামীলীগের ছয় দফার মধ্যে কোন কোন দফাগুলো আপনি সমর্থন করেন? আপনার উত্তরের জন্য যুক্তি দিন।
২.কি অবস্থা হতো যদি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসতো?
৩.পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক নেতাকে আপনি সবচেয়ে বেশী সম্মান করেন এবং কেন আপনি তার দলের কর্মসূচি সমর্থন করেন?
৪.আওয়ামীলীগের দ্বারা পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে কি আপনি যোগ দিয়েছিলেন? আপনি এটি স্বেচ্ছায় নাকি ভয়ের কারণে করেছিলেন?
৫.আওয়ামীলীগ নেতা ও অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ব্যর্থ হয়েছিলো কেনো?
৬.পাকিস্তানের জন্য আপনি কোন সরকার ব্যবস্থা (সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতি) উপযুক্ত মনে করেন এবং কেন?
৭.আপনার উর্ধ্বতন এবং জুনিয়র কর্মকর্তা যারা আওয়ামীলীগ সমর্থন করেন তাদের নাম দিন।
৮. আপনি আওয়ামীলীগের তহবিলে স্বাক্ষর করেছিলেন? যদি করে থাকেন তবে সেটি নগদে কিনা এবং সেটি আপনি স্বেচ্ছায় অথবা জোরপূর্বক দিয়েছিলেন কিনা এবং সেটি কোন ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিলো?
.
.
অনুবাদকঃ জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা
<৬, ২৮৬, ৪৮৯-৪৯১>
শিরোনামঃ বিশ্বজনমত
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৫
তারিখঃ ২৮ জুলাই, ১৯৭১
.
ওয়ার্ল্ড প্রেস
বিশ্বের সর্বত্র প্রেস রিপোর্টগুলোতে ইয়াহিয়ার শাসনামলের বিরুদ্ধে নিন্দা চলতে থাকে এবং সেখানে মুক্তি বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আলোকপাত করা হয়।
ইউ এ.আর.
রোজ আল ইউসেফ
১৪ জুলাই, ১৯৭১.
নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আল-আহরাম সম্পাদক হেইকেল এটিকে সমকালীন ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে ইউ এ আর এর কাছে জোরালো ভাবে প্রকাশ করেন। আরেকটি কায়রো জার্নাল “রোজ আল ইউসেফ” এই বলে সতর্ক করেছে যে পূর্ব বাংলার গৃহযুদ্ধের করুণ পরিণতি ও ভারতে ষাট লক্ষের বেশি উদ্বাস্তুর অনুপ্রবেশ উপমহাদেশকে বৈশ্বিক দ্বন্দের নতুন কেন্দ্রে পরিণত করতে পারে।
এটি বলেছিলো ধর্মই ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবী আর পূর্ব বাংলার বাঙ্গালিদের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র।
ইউ কে
ডেইলি টেলিগ্রাফ
জুলাই ১৯, ১৯৭১।
গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, এর বড় কারণ মূলত বাংলাদেশের শহুরে গেরিলা গ্রুপের কাঠামোগত উন্নয়ন ও উন্নত প্রশিক্ষণ।
লণ্ডন
সানডে টাইমস
১১ জুলাই, ১৯৭১.
মারি সেইলির একটি প্রবন্ধ একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তথাকথিত রাজাকারদের কার্যকলাপ এবং সংগঠনের উপর আলোকপাত করেছে যাদের উপর পাকিস্তানি সেনারা আজ নির্ভর করছে।
এসব লোক (রাজাকার) আসলে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি যারা বিগত নির্বাচনে নাস্তানাবুদ হয়েছিলো আর যাদের রয়েছে অপরাধমূলক অতীত ও যারা ধর্মান্ধ মুসলিম………
আমি একটি সেতু অতিক্রম করেছিলাম যা মুক্তিফৌজ উড়িয়ে দিয়েছে, “মুক্তি বাহিনী” । স্থানীয়রা, আমার মনে হয়েছে কিছুটা উল্লসিত হয়ে, জানালো যে ২৫ রাজাকার যারা সেতু পাহারা দিচ্ছিলো তারা গুলির শব্দ শুনেই পালিয়েছে। জনাব সেইলি রাজাকারদের প্রশাসনকে মূলত ঠগ, বেতনভুক্ত সন্ধানদাতা আর ধর্মান্ধদের সঙ্ঘ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যাদের কোনই জবাবদিহিতা ছিলো না অথবা আপাতদৃষ্টিতে যেটুকু আইন অবশিষ্ট ছিলো বাংলাদেশে।
দি টাইমস, লন্ডন
১২ জুলাই, ১৯৭১।
সামরিক শক্তি প্রয়োগের সুপারিশ করতে একটি গ্রহণযোগ্য প্রচারণার প্রচেষ্টা পাকিস্তানি সরকার থেকে নেয়া হয়েছে যেটাতে বলা হয়েছে এই শক্তি প্রয়োগ শুধু বিহারিদের গণহত্যার প্রতিরোধ করার প্রয়োজনে ই করা হয়নি সেইসাথে যে অবাঙালি হত্যাকাণ্ড সেনা মোতায়েনের আগে থেকেই বড়সড় মাত্রায় ঘটে আসছে সেটা প্রতিরোধেও করা হয়েছে।
এটি খুবই ঠুনকো ব্যাখ্যা। এই খবর বিশ্বাসযোগ্য ছিলনা, যেহেতু যদি ঐ মাত্রার হত্যাকাণ্ড হয়েও থাকতো, তাহলে তা ঐসময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের চোখে ও কানে অবশ্যই আসতো ২৫ মার্চ তাদের বহিষ্কারের আগ পর্যন্ত।
.
ইউ কে:
দি নিউ স্টেটসম্যান
১৬ জুলাই, ১৯৭১।
জনাব রেজিনাল্ড প্রেন্টিস, এম পি ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য যা সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারত ভ্রমণ করে, লিখেছেন, “আগরতলায় স্থানীয় হাসপাতালে রোগীদের মধ্যে ১৫০ বুলেট বা বেয়নেটের ক্ষতয় আহতরা রয়েছে, এদের সবাই সম্প্রতি আহত-এর মধ্যে ৮০ জনই ছিলো শিশু।
ইউ এ আরঃ
আল আহরাম
৯ জুলাই, ১৯৭১
একটি নতুন আরব স্ট্র্যাটেজির দিকে
এডিটর হেইকেল দ্বারা লিখিত.
আমরা কিভাবে এই চুপ থাকাকে কীভাবে সমর্থন করতে পারি যখন সমসাময়িক ইতিহাসে পূর্ব পাকিস্তানের এক মিলিয়নের এক-চতুর্থাংশ মানুষকে সবচেয়ে দুঃখজনক ভাবে হত্যা করা হয়। এটা কীভাবে বলা যেতে পারে যে আমাদের নীরবতা ছিল পাকিস্তানের সৌজন্যে যখন এশিয়ার সব ইউ এ আর এর মান এবং প্রভাব ছিল মূলনীতির বিষয়?
আমরা যদি বলি এশীয় নীতি নিয়ে আমাদের কোন উদ্বেগ ছিল না, তাহলে এশিয়ারও বলার অধিকার আছে আরব নীতিও মোটেই তাদের ব্যাপারে উদ্বেগী ছিল না।
আমেরিকা:
নিউ ইয়র্ক টাইমস
১২ জুলাই, ১৯৭১
কলামিস্ট অ্যান্থনি লুইসের আর্টিকেল থেকে
হিটলারের পর শুধু জার্মান নয় অনেকেই বলেছিল তাদের কোন ভাবেই হত্যার বীভৎসতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। তারা শুধু জানত খুব খারাপ কিছু ঘটছে আর ছয় লক্ষ ইহুদি তখন ছিল গ্যাস চেম্বারে। ঠিক এখনি এমনি একটা মানবিক বিপর্যয় রাজনৈতিক কারনে ঘটছে। এইবার কি ঘটছে যাদেরকে জানানো হচ্ছে তারা এ ব্যাপারে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে এরকম অজুহাত থাকতে পারে না এবং এখনও কিছু দায়িত্তে থাকা লোক ব্যাপারটিকে দেখেও দেখছে না।
দুর্যোগটা ঘটছিল পূর্ব পাকিস্তানে। যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা গত বসন্তে পূর্ব রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল, ছয় কোটি মানুষ ভারতে পালিয়েছিল তখন। দশ, সম্ভবত হাজার হাজার শত শত মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। আর দুর্বল পাকিস্তান অপপ্রচার ছড়াচ্ছিল তারা শুধুমাত্র ‘দুষ্কৃতকারীদের’ সঙ্গে ডিল করছে কিন্তু তাতেও তাদের সৈন্যরা যে রাজনীতির নামে নির্বিচারে হত্যা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি করছিল সে গোপন থাকেনি।
হংকং:
হংকং স্ট্যান্ডার্ড
৪ জুলাই, ১৯৭১
ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী বীভৎস মানব হত্যার বর্বরোচিত রক্তাত্ত উল্লাসে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। এবং স্পষ্টতই জেনারেল টিক্কা খানের প্রতিশোধপরায়ণ সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে পাইকারী ও নৃশংস গণহত্যার পর ক্লান্ত হয়েছে এবং এটা মনে হয় বিনা উস্কানিতে বিক্ষিপ্ত হত্যাকাণ্ডের রেকর্ড খর্ব করেছে।
.
.
পূজা পলি
<৬, ২৮৭, ৪৯২-৪৯৩>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কিছু চিন্তা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ভলিউম ১ নং. ৯
তারিখঃ ২৫ জুলাই, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ নিয়ে কিছু ভাবনা
লিখেছেন- এ.এল. বাসাম
.
কলকাতা ভ্রমণের শুরুতে কিছু দুর্দশাগ্রস্ত,অসুখী মানুষদের দেখেছি।এরা পূর্ববাংলার অত্যাচারিত মানুষ।পশ্চিম পাকিস্তানের পশুতুল্য সেনাবাহিনী দ্বারা সংগঠিত নিষ্ঠুর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসা মানুষ এরা। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ,মানুষকে ঘৃণা করতে উৎসাহিত করা আমার কাজ নয়।অন্যথায় আমি ইতিহাসবিদও।সেক্ষেত্রে অতীতকে এড়িয়ে আমি তুলনা করতে পারিনা। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ আর তিক্ততার ক্ষমতা কতটা প্রবল তার উদাহরণ স্বয়ং আমার নিজের জন্মভূমির ইতিহাস।
সেই সুপ্রাচীনকাল আর মধ্যযুগীয় সময়কালে কারও প্রকাশিত জাতিসত্তা দুর্বল হলে,সে জাতির উপর বিজয়ী হওয়া কিংবা নিজ জাতিকে অন্যকোন জাতির নিকট হস্তান্তর করা সম্ভবপর ছিল।বিখ্যাত নরম্যান অ্যাঞ্জেলো-সাক্সন সর্বপ্রথম একই ভাষাভাষি দুটি ভিন্নজাতিকে একটি জাতিতে পরিণত করেছিলেন।তার সামসময়িক এই ভিন্ন চিন্তাধারাকে সাধুবাদ।নরম্যান আয়ারল্যান্ডও জয় করেছিলেন।কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের উপর সেটা কার্যকর হয়নি।সেই ঘটনার চুড়ান্ত পরিণতি আসে সপ্তদশ শতাব্দীতে,যখন অলিভার ক্রোময়েল আয়ারল্যান্ডে শান্তি স্থাপন করেছিলেন।যারা কিনা গৃহযুদ্ধের সময় কিংসস্ পার্টির সমর্থক ছিল।আইরিশরা কখনো সেইসব সাংবিধানিক নরপশুগুলোকে ভুলতে পারবে না যারা সেইসময়টাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর লুন্ঠন চালিয়েছিল।ঊনিশশতকে তারা পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে।ব্রিটিশদের প্রতি আইরিশদের তীব্র অসন্তোষ-বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও তারা শেষপর্যন্ত শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র(republic of Eire) প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলন।
প্রায় তিনশ্ বছরের ক্রোমেলের নৃশংসতার ইতিহাস তারা ভুলে নি। ‘The Curse of Cromell on You’ একজন আইরিশের তিক্তস্বাদ অভিশাপের স্মরণ করিয়ে দেয়।
.
ব্রিটিশররা তাদের গোয়ার্তুমি আর পীড়াদায়ক শাসনতন্ত্রের কারণে আমেরিকান কলোনিগুলোতে পতন হতে শুরু করে।পরবর্তীতে অষ্ট্রেলিয়া এবং কানাডার (যেটা এখন আমার দেশ) রক্তপাতবিহীন স্বাধীনতা অর্জনে তারা আরও যথোপযুক্ত শিক্ষা পায়।কিন্তু ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে সেটা ভিন্ন।শিক্ষিত ভারতীয়রা কানাডা আর অষ্ট্রেলিয়ার বিষয়বস্তু দেখেন এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিল।কিন্তু বেশিরভাগ ভারতীয় লোকজন পরিমাণে বেশি কিংবা কম নিরব ছিল এবং ব্রিটিশদের নীতিমালা ত্রহণ করেছিল।নিজেদের সরকার দ্বারা পরিচালিত কিছু সল্প পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেছিল।সেসব পদক্ষেপগুলোই ভারতকে অষ্ট্রেলিয়া-কানাডার মত স্বাধীনতার পথে ধাবিত করে তবে তার জন্য দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়।
হঠাৎ একদিন,ঊনিশো ঊনিশ সালে,পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।একটি নামবিহীন রাজনৈতিক জমায়েত তৈরী হয়।জালিয়ানওয়ালাবাগ,অমৃতসরে আগুন জ্বলে উঠল।বহু নারী-পুরুষ নিহত হল।সারা ভারতবর্ষে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।ঠিক ঐ মুহূর্তে ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিমূর্তি প্রতীয়মান হয়।এরপরেই আসে ভারতের তুলনামূলক যৌথ স্বাধীনতা ঠিক ঐ মুহূর্তে ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিমূর্তি সৃষ্টি হয়।ভারতীয়দের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে তুলনামূলক কম রক্তপাতের বিনিময়ে এবং সেখানের জনগণ মানসিকভাবে ব্রিটিশদের কঠোর নিয়মকানুন মেনে নিতে পারছিলনা।
সেক্ষেত্রে, পূর্ববাংলা নিষ্ঠুরতা একমাসের মধ্যেই যে চরমতার রূপ নিয়েছে সেটা জালিয়ানওয়ালাবাগকের চেয়েও নৃশংস এবং যা পরিকল্পনা আর সাবধানতার সাথে ঘটছিল যেখানে জালিয়ানওয়ালাবাগের আতংক ছিল স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে।নৃশংসতার মাত্রা অনুমোদিত হারে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে বিগত তিনমাসে পূর্ববাংলায় দশলক্ষেরও বেশি প্রাণহানি ঘটে।চেঙ্গিস খানের সময়ের চেয়েও এই নৃশংসতা অদ্বিতীয়,তুলনাহীন এমনকি এটা আয়ারল্যান্ডের ক্রোময়েলের নৃশংসতারর সাথেও অসংগতিপূর্ণ। ভারতীয় সীমান্তে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের উপস্থিতি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আচরণ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
.
হিথ্রো, অবশেষে আমি নিশ্চুপ ছিলাম। ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে অনেক বিষয়ে বিবাদ রয়েছে। আমি সমসাময়িক ইতিহাসে একজন বিশেষজ্ঞ এবং এ ঘটনাকে আমার সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার প্রচারের অংশ হিসেবে দেখছি না আমি এবং আমি এটাকে সাধারণ ঘটনা হিসেবেও নিচ্ছি না। কিন্তু একজন ইতিহাসবিদ হয়ে আমি তা প্রকাশ করতে বাধ্য।এই প্রসঙ্গে ইতিহাস যা দেখায় সেটা হল পূর্ববাংলার জনগণ স্বেচ্ছায় কখনো পাকিস্তানেরর সাথে থাকবেনা।যদি পাকিস্তান পূর্ববাংলাকে সংযুক্তিতে রাখতে চায় সেটা হবে বল প্রয়োগ করে,সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাধ্যমে দখল করে, এবং আধিপত্য বিস্তারে শিকার হওয়া জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে।এ অবস্থা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়না।একটা প্রশ্নই সৃষ্টি হয়-কতদিন? পাকিস্তানিরা যদি এভাবে তাদের সংকল্পে স্থির থাকে এবংঅবিরামভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে তবে সেটা দুই দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিবে এবং অবিরামভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে তবে সেটা দুই দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিবে এবং জনজীবনের অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশার কারণ হবে।অন্তিমে বাঙলাদেশ স্বাধীন হবে।পাকিস্তানীদের কৃত নিষ্ঠুরতা তারা কখনো ভুলবেনা।আবার বাঙালিরা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো তাদের শাসনব্যবস্থা মেনে নিবেনা।
.
পাকিস্তানী বিজ্ঞজনেরা অব্যশই সেটা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন। জাতিসংঘ দুটি সরকারকেই আলাদাভাবে জনজীবন রক্ষার্থে- পাকিস্তান সরকারকে তার সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তার না করে সেটা প্রত্যাহার এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের অনুমতি প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।যদি পাকিস্তানের শরণার্থীরা সমগ্র বিশ্বের নিকট নিষ্ঠুররতার প্রতীক হয়ে উঠে, তবে ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস সাম্রাজ্যবাদের ঘএনা হিসেবে গণ্য হবে। বিগত ইতিহাসে দেখিয়েছে,এমন সাম্রাজ্যবাদ অনিশ্চিতভাবে ঠিকে থাকেনি।
.
.
অনুবাদঃ ইফতেখার হাসান
<৬, ২৮৮, ৪৯৪-৪৯৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
‘নতুন ভিয়েতনাম’ এর পূর্বাভাষ |
বাংলাদেশ ভলিউম ১, ক্রমিক ৯ |
২৫ আগস্ট, ১৯৭১ |
পাকিস্তানের জন্য মার্কিন সমরাস্ত্র
বাংলাদেশের মানুষের উপর ইয়াহিয়া সরকারের অমানবিক নিপিড়ণের বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে চলমান নিন্দা আর সমালোচনা সত্বেও, রক্তপিপাসু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সরমাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার নীতি পরিত্যাগ করেনি নিক্সন প্রশাসন। মূলতঃ মার্কিন সমরাস্ত্রে সজ্জিত হবার কারণেই ইয়াহিয়া এরকম একটি ন্যাক্কারজনক সামরিক অভিযান শুরু করার সাহস পেয়েছিল, তা স্বত্বেও নিক্সন তার সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। অথচ নিক্সনের পক্ষেই সম্ভব ছিল ইয়াহিয়াকে যৌক্তিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনা। নৃশংস সামরিক নিপিড়ণের নিন্দা জানানোর বদলে তিনি ইতোমধ্যে সুসজ্জিত ও বেপরোয়া এই সামরিক শক্তিকে আরো অস্ত্র-শস্ত্র আর রসদ জুগিয়ে যাচ্ছেন।
ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপারটমেন্টের এক মুখপাত্রের বয়ান অনুযায়ী মার্চ ১৯৭২ এর মধ্যে তারা প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সমরাস্ত্র সরবরাহ করবে – গনতন্ত্রের ধব্জাধারীরা কেবল অস্ত্র-শস্ত্র জুগিয়েই ক্ষান্ত হয়নি! সমস্ত লক্ষণ এটাই বলে যে ইয়াহিয়া সরকারের পেছনে মার্কিন সমর্থন ক্রমশঃ বাড়বে।
মার্কিন সরকারের দাবী অনুসারে ১৭টি ১০০০-টন ধারণক্ষমতার জাহাজ প্রস্তুত করা হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করার জন্য। আদতে এগুলো সামরিক কাজে ব্যবহার করা হবে, এটি সবার জানা আছে যে ইয়াহিয়ার খুনি বাহিনীর জন্য জরুরী ভিত্তিতে নৌযান প্রয়োজন যাতে তারা নদীমাতৃক বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রবেশ করতে পারে।
মার্কিন-বান্ধব যেসব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছে ভিয়েতনামের ‘গ্রীন বেরেট’ এর আদলে তারা এ মুহূর্তে বাংলাদেশেই অবস্থান করছে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এই ‘অদম্য’ সৈনিকেরা বিশেষকরে গণহত্যা, স্যাবোটাজ, গুপ্তহত্যা আর নির্যাতন করায় পারদর্শী। বিশ্বস্ত সুত্রে এও জানা গেছে যে এক ডজনেরও বেশি আমেরিকান ‘বিশেষজ্ঞ’ কোয়েটা, বালুচিস্তান আর ঢাকায় পাকিস্তানিদের বিচ্ছিন্নতাবিরোধী অভিযানের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও মার্কিন বিশেষজ্ঞরা একই রকম ভূমিকা পালন করেছিল। ভিয়েতনামের মত বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে যুক্তরাস্ট্র সরকার বেশ উন্মুখ বলেই মনে হচ্ছে।
মার্কিন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভিয়েতনামের জন্য বরাদ্দ করা মার্কিন সমরাস্ত্র ঢাকা ও করাচিতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ‘গনতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ করা এইসব অস্ত্র এখন এখানে এসে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া যে বোয়িং উড়োজাহাজটি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বহরে যুক্ত হয়েছিল সেটি এখন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা পাঠানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছে।
এর বাইরে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের জন্য আরও এক মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা ব্যবহৃত হবে ছয় মাসের জন্য ১৮টি জলযান কিনতে যা দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় ও লোকেদের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছান যায়।
বর্তমানে প্রায় ২০০ মার্কিন ত্রাণ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদেরকে মার্কিন সরকার নির্দেশনা দিয়েছে বেসামরিক জনসাধারণকে বিচ্ছিন্নতা বিরোধী প্রশিক্ষণ দিতে। এই বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
আর সর্বোপরি, ভিয়েতনামে ব্যবহৃত কিছু মার্কিন ‘কোবরা’ হেলিকপ্টার পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে যাতে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আমূলে দমন করতে পারে।
এই সব বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অশুভ পরিকল্পনারই প্রমাণ দেয়। তবে ইয়াহিয়া বাহিনীর সমর্থনে মার্কিন এই নীতি বেশি দীর্ঘায়ু হবেনা। ৭৫ মিলিয়ন মুক্তিকামী মানুষ এই যুদ্ধবাজ নিপীড়কদের কাছ থেকে ঠিকই বিজয় ছিনিয়ে আনবে। কোরিয়া, ভিয়েতনাম আর লাওসে ন্যক্কারজনক পরাজয় থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোন শিক্ষা গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছেনা। ঠিক যে মুহূর্তে নিক্সন ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলছেন, তিনি বাংলাদেশে নিজের হাতকে আরও বেশি রক্তাক্ত করতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। মার্কিন সেনাদের যত বড় দলই আসুক না কেন, তারা ইয়াহিয়াকে বাঁচাতে পারবেনা। তারা কেবল ইতিহাসের পাতায় হত্যাকারী কসাই ইয়াহিয়ার সহযোগী হিসাবে নিক্সনের নামটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তবে এই গনহত্যার নীতি থেকে নিক্সনের সরে আসার এখনও সময় আছে। সিনেটর কেনেডি, সিনেটর বোয়েলস গলব্রেথ বা কংগ্রেসম্যান গ্যালাহার এর মত অপেক্ষাকৃত সুবুদ্ধিসম্পন্ন নেতাদের পরামর্শ গ্রহণ করাটাই তার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
.
.
অনুবাদঃ এ. এস. এম. হাসান লতিফ এবং সুমিতা দাশ
<৬,২৮৯,৪৯৬-৪৯৯>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় সত্যের সন্ধানে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিয়মঃ১. নং ৩
তারিখঃ ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
সত্যের সন্ধানে
আধুনিক বিশ্বের সরকারদের বিবেক এখনও অনুভূতিহীন । নিম্ন গাঙ্গেয়ভূমির ৭,৫০,০০,০০০ মানুষের দুরাবস্থা, বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশা বিশ্বের নানা দেশের সরকারদের তন্দ্রা এখনও ভাঙ্গাতে পারেনি।
সভ্যতার শিখরে উত্তরণের দাবীদার আধুনিক বিশ্ব প্রশান্ত চিত্তে বাংলাদেশের ঘটনাবলী অবলোকন করছে। ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানী মার্সনারীদের অতুলণীয় বর্বরতায়, এমন কি অন্ধকার যুগের বর্বরতাও যার সাথে সামান্যই তুলণীয়, তাদের বিব্রত বা বিচলিত করতে পারেনি।
বাংলাদেশের অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক জনগণের এক হিসেবে ৭৮ ঘন্টা ইয়াহিয়া খান দমন চালিয়ে ক্রীতদাস বানানোর চেষ্টা চালানোর পর ৩৮৪০ ঘন্টা বিস্মৃত হয়ে গেছে। কিন্তু, হিসেব তার সাথে প্রতারণা করেছে। তার প্রিয় স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। জাতি প্রতিপক্ষকে প্রতিহত ও পাল্টা আঘাত করতে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হলে নির্বোধ ইয়াহিয়া এ জাতির সংকল্প পরিমাপে ব্যর্থ হয়, ইয়াহিয়া ও তার দোসররা একটি জাতিকে দাসে পরিণত করতে বিভীষিকার আশ্রয় নিলে বাংলাদেশের জনগণ অস্তিত্তের লড়াই এ হয় কেননা দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে মুক্ত হতে ও নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে আসার জন্য অস্ত্র তুলে নিয়েছে। বাঙ্গালীদের কাছে, এ যুদ্ধ মানুষ হিসেবে সম্মানের সাথে বাঁচার যুদ্ধ, এটি বন্ধন ছিন্নের ও স্বাধীনতার যুদ্ধ।
যুদ্ধটি এখনও অসম যুদ্ধ। সুদীর্ঘ ২৪ বছরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশের রাজস্ব দিয়ে একটি মানসম্পন্ন সেণাবাহিণী গঠন করেছে যা সর্বাধুনিক ও শক্তিশালী মারণাস্ত্রে সজ্জিত। তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন ও ইরান হতে সংগৃহীত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হচ্ছে। এভাবে একটি সংগঠিত নিয়মিত এ আধুনিক বাহিণী কে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবি সমাজের বিরুদ্ধে। ২৫ মার্চের সেই বিভীষিকাময় রাতে তাদের উপর নির্দেশ ছিল, “বাঙ্গালীদের মারো, সহায় সম্পদ লুট করো, তাদের বাড়ীঘর জ্বালীয়ে দাও, নারীদের ধর্ষণ করো। ধারণা করা হয় উক্ত আদেশটি এখনও চলমান রেয়েছে। সবথেকে অনুগত এ খুনির দল সর্বোচ্চ ধংসাত্মক শক্তি নিয়োগ করে তাদের প্রভুর হুকুম তামিল করেছে। এই নৃসংসতা ও বর্বরতা হতে ধর্ম, বর্ণ ও বয়স ভেদে নারী-পুরুষ সকলকে সমানভাবে জ্বালিয়েছে।
দুই মিলিয়ন ইতোমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে, আট মিলিয়ন প্রতিবেশী দেশসমূহে পালিয়ে গেছে, ত্রিশ মিলিয়নকে, যদি এর বেশী না হয়, বাস্তুহারা করা হয়েছে যারা দেশের অভ্যন্তরে এখান থেকে সেখানে জীবন বাচানোর চেষ্টায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, হাজার হাজার নারীর উপর পাশবিকতা চালানো হয়েছে, হাজার হাজার গ্রাম জ্বালীয়ে দেওয়া হয়েছে, কয়েক বিলিয়ন রুপীর সমমূল্যের সহায় সম্পদ লুট করা হয়েছে। এর উপর বণ্যায় আক্রান্ত বাংলাদেশ আজ দূর্ভিক্ষ ও মহামারির মুখোমুখি হয়েছে।
যারা পালিয়ে এসে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তারা আজ মানবজাতির এক চরম দুর্দশার কাহিনী বর্ণণা করছেন। অনেকে মারা গেছেন কলেরায়, অনেকে দীর্ঘ পদযাত্রায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে। এক মিলিয়ন শিশু অপুষ্টির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।
এই গল্পের বাইরেও রয়েছে অনুপ্রেরণার গল্প। বাংলাদেশের তরুণরা তাদের দৃঢ় বিশ্বাস অকুন্ঠ মনোবল, নিরেট আনুগত্য ও অবিনাশী সংকল্পচিত্তে দখলদার বাহিণীর উপর একের এক এক বিধ্বংসী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের গেড়িলা ও কমান্ডো হামলায় এরই মধ্যে বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে। হাজার হাজার তরুণ মুক্তিবাহিনীতে তাদের নাম লেখাচ্ছে। তরুণদের শিবিরগুলো আজ সকল সেক্টরের ১৫–৫০ বছর বয়সের অটল ও বদ্ধপরিকর প্রশিক্ষণার্থীদের দ্বারা মুখরিত, এই স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ যুদ্ধের সরবরাহ, ক্ষিপ্রতা ও নির্ভুলতার সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণে তাঁরা যেমন বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। “মুক্তি বাহিনী” শব্দগুলো এখন শত্রুদের জন্য এক বিভীষিকার নাম। শত্রু বাহিনীকেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ব্যাপক সংখ্যক অফিসারসহ প্রায় ৪০,০০০ জনের নিহত হবার কারণে। সড়ক ও রেলপথ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, নদীপথ সবচেয়ে অনিরাপদ, পাকিস্তানী ও বিদেশী জাহাজ বিস্ফোরণে ডুবে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম, চালনা ও মংলা বন্দর কার্যক অচল হয়ে পরেছে। সেখানে রপ্তানীর জন্য পাট, চামড়াদি বা চাও অপেক্ষা করছে না, শহরগুলোর দপ্তরসমূহে উপস্থিতি ক্ষমারও অযোগ্য, দপ্তরগুলো শুধু নামকাওয়াস্তেই কার্যকর। “স্বাভাবিক জীবনযাত্রা” অব্যাহত আছে বলে সামরিক সরকার জোড়েশোড়ে চেচালেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত ভূতুড়ে স্থানে পরিণত হয়েছে। এই নিস্তব্ধতা কেবল মুক্তি বাহিনীই ভাংছে। মুক্তি বাহিনীর সাথে রয়েছে জন সাধারণের আশা ও আকাংখা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (বাংলাদেশ বেতার) মুক্তি বাহিনীকে উৎসাহ প্রদান করে যা জন সাধারণকেও সাহস জোগাচ্ছে। তাঁরা তীব্র সাহসিকতা ও মনোবলের সাথে সকল নৃশংসতা, হিংস্রতা ও অনাকাংখিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও তা সহ্য করে যাচ্ছে কেননা তাঁরা জানেন যে তাঁরা সত্যের জন্য লড়ছেন। তাঁরা স্বাধীনতা, সমঅধিকার ও ভ্রাতৃত্বের জন্য লড়ছেন।
অনেক কথাই বলা হয়েছে, ভল্যুমের পর ভল্যুম লেখা হয়েছে, উদ্যেগ ও সমবেদণাও প্রকাশ করা হয়েছে, বিশ্ববাসীর চোখের অনেক জলও গড়িয়ে পরেছে কিন্তু শাসকগোষ্ঠী এব্যাপারে এখনও শীতলতা প্রকাশ করছেন। তাইতো “শাসক ও শাসিত” এর এই সমস্যায় বিশ্ববাসী আজ হতবুদ্ধিতার শিখড়ে উপনীত হয়েছে।
দাতা, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যক, শিল্পী, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ জনগন আজ এমন এক মতৈক্যে পৌছেছেন যে তাঁরা মনে করছেন যে একটি জাতি বর্বর দস্যুদের হিংস্রতায় রক্তে ভেসে যাচ্ছে, তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারকে মানবতা রক্ষার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গণস্বাস্থ্য বিভাগের ড: এন. হার্শম, ড: আর. আর. ক্যাশ ড: ডব্লিউ. ই. উডওয়ার্ড লিখেছেনঃ
“……কখনও কি যুক্তরাস্ট্রের সরকার বুঝতে পারবে যে বাস্তবিকভাবে অনৈতিক রাজনীতি ধ্বংস, হতাশা ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়?”
জেমস নিকোলাস, উইল্যান্ড, ওন্ট বলেছেনঃ
“ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সাহায্যে কৃপণতা দেখিয়ে সভ্য দেশগুলোর সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য প্রেরণে কেন উদারতা দেখাচ্ছে? কেনই বা পশ্চিমের কিছু ব্যক্তি প্রাণী অধিকার সংরক্ষণের জন্য নাটক করলেও তাদেরই মত পূর্বের ৬ মিলিয়ন মানুষ যন্ত্রণার দূর্বিপাকে পৌছালেও নিশ্চুপ থাকে?”
.
সেইন্ট জন এনএফডি থেকে লিখেছেন ডঃ ওয়ালী খানঃ
“কোথায় ওয়াশিংটন নেতাদের মানবতা যারা সচেতন এবং দয়াশীল গনতন্ত্রের সমর্থক আমেরিকার ঐতিহ্যগত ভাবমূর্তি ধরে রাখেন? ইউএস কি নৈতিকতার চেয়ে স্তিতিশীলতার স্বার্থে বাংলাদেশের গনহত্যা না দেখার ভান করছে?“
রাটজার ল স্কুল এর অধ্যাপক ডঃ আলবার্ট ব্লাউস্টেন পীড়িত মনে বলেছেনঃ
“এটা অকল্পনীয় যে অনেক মানুষ গুরুতরভাবে ভুগছে। আমাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো বিশৃঙ্খলা আছে। আমরা ভুলে গেছি যে আমরা একটি মানবতাবাদী জাতি।“
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সম্পাদক ও সংসদ সদস্যদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন টরন্টোতে অনুষ্টিত হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে “উদ্বেগের টরন্টো ঘোষণা” এর যে পার্লামেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক মাসের ঘটনা দেখে আতঙ্কিত হয়।যা মানব ইতিহাসে বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে গেছে।
“…বর্তমান পরিস্থিতি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শান্তির জন্য হুমকিস্বরুপ।তীব্রতাবৃদ্ধির পরিচিত নমুনাতে মহাশক্তিধরদের জড়িত থাকার বিপদ ও পুরো বিশ্বের জন্যে হুমকিস্বরুপ।সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট এর বার বার সতর্কীকরণ সত্ত্বেও পৃথিবী বড়ভাবে অপরিবর্তিত রয়েছে।উদ্বাস্তু কার্য এর বাড়তি খরচ স্পষ্টভাবে ভারতে জন্য বহন করা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিশ্ব সম্প্রদায় দ্বারা কোন কার্যকরী রাজনৈতিক চাপ আনা হচ্ছে না এই বিয়োগান্ত পটভূমি শেষ করার জন্যে।“
এমনকি ইসলামাবাদে আমেরিকান দুতাবাস-ইউএস এইড এর ক্যাথরিন জি কেলি বলেছেনঃ
“গনতন্ত্র সমর্থন করার বিপরীতে মিলিটারি সমর্থনকারী শাসন যা তার নাগরিকের মধ্যে ১০ লক্ষ হত্যা করেছে এবং ৬০ লক্ষ মানুষকে তাদের ঘর ও দেশ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, প্রশ্ন যদি ইউএস কে পীড়িত করে, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী আবার নৈতিক নেতৃত্ব চর্চা বা গনতন্ত্র প্রচার করার অধিকার বাজেয়াপ্ত করেছে।“
মানবতা স্থগিতের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেয়ে মানবতাবাদীরা পীড়িত।‘মানব অধিকার ও মর্যাদা’ র মহান দলিল স্রষ্টাদের সমর্থক নিজ হাতে মানবিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের কবর খুঁড়তে দেখে তারা হতবুদ্ধি হয়।
আজ পৃথিবী বিশাল প্রশ্নের দাবি রাখে, সত্য কোথায়।
সত্য বাংলাদেশের মানুষের মনের মধ্যে,সত্য মুক্তিবাহিনীর কাজের মধ্যে। ইহা বাঙ্গালীদের সঙ্গে একটি বিশ্বাস।
বাংলাদেশের মানুষ, যারা একবার পূর্ব পাকিস্তানের নাম দ্বারা গিয়েছিল,সব মানবিক মর্যাদার সাথে বাঁচতে চেয়েছিল। অর্থনৈতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক নাশ ও রাজনৈতিক আধিপত্য মুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিল। ইহাই তাদের ইচ্ছা। যখন জনগণ চায় কে তাদের পথে দাড়াতে পারে? কে দেশ গঠন করে? ইহা জনগণ, সরকার কি? এটা হল, উক্ত করা, “জনগনের, জনগনের দ্বারা,জনগনের জন্য”। সুতরাং, সত্য হল,যখন বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম ও তাদের নিজস্ব ব্যাপারের কর্তা হতে চায়, কোন কর্তৃত্ব, আইনগত বা নৈতিক, ইয়াহিয়া খান কে একটি জাতি হত্যা করতে হবে?
ভূগোল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, প্রবণতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা, জীবনাচরণ বাঙ্গালীদের পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে পুরোপুরি আলাদা জাতি করে তুলেছে। এটা সত্য। কেউ অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করতে পারবে না। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাস ও এটা অস্বীকার করতে পারবে না। সুতরাং দুই টি পৃথক নীতি অনুশীলন ছিল। যে দেশগুলো পাকিস্তানকে সহায়তা সরবরাহ করছে তারা এগুলো বাইরে বহন করছে। দেশ যদি এক হতো সেখানে কোন শুল্ক বাধা ও আনুষ্ঠানিকতা হতো না, দ্রব্যমূল্য আশ্চর্যজনকভাবে অসমান হতো না। যদি দেশ এক হতো, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠরা ক্ষমতা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো না, এখানে এরকম ঘৃণা ও রক্ত থাকতো না বাঙ্গালীদের জন্য ।দেশ যদি একই হতো, বিশৃঙ্খল বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড হতে পারতো না, অখণ্ডতার প্রচারক বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে অখণ্ডতা ঘৃণা ও রক্তের মধ্য দিয়ে অর্জন করা যায় না।
ইসলাম? ইহা, সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততো ভালো। পাকিস্তানী বাজপাখি যারা আক্ষরিক অর্থে হুইস্কি ও শ্যাম্পেইনের পিপায় ভাসে, যারা অসৎ কামনা করে, অসম্মান, নারীদের ধর্ষণ করে, যারা লোভের জন্যে মানুষ হত্যা করে, অন্য বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের অত্যাচার করে, ধন-সম্পত্তি লুট করে, ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়, তারা পবিত্র শব্দ “ইসলাম” যার অর্থ “শান্তি ও স্রষ্টার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য”, উচ্চারণ করার অধিকার হারিয়েছে।এই মানুষগুলো ইসলামের উপর কলংক আরোপ করেছে।তারা ধর্মের মৌলিক সৌন্দর্য নষ্ট করার চেষ্টা করছে। মুসলিম নামের নিচে(টিক্কা খান আরবি না ও কোন অর্থ বহন করে না) তারা ‘মুনাফিক’(ভণ্ড) এবং তারা ইসলামের জন্য দুর্নাম ও অসম্মান বয়ে আনতে এসেছে। এইসব ভণ্ডদের ব্যাক্তিগত ও সর্বজনবিদিত জীবন ইসলামিক আইনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
সুতরাং সত্য এই, বাংলাদেশের মানুষ হানাদার বাহিনী তাড়িয়ে বাংলাদেশের মাটি পরিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর। সত্য হল বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র, ৭৫ মিলিয়ন মানুষের পৃথিবীর অষ্টম বড় রাষ্ট্র, থাকতে এসেছে।
সত্য যা সময়(আন্তর্জাতিক) এই বিষয়ে আগস্ট ২৩, ১৯৭১ এ দেখা যায়,
“একত্রিত পাকিস্তানের সব আশা সামরিক যুদ্ধের দ্বারা শেষ হচ্ছে। যুদ্ধের চেয়ে আলোচনার ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিমের শান্তিপূর্ণ বিভাজনের জন্য মুজিবকে জীবিত রাখাই শেষ অবলম্বন।“
.
.
অনুবাদঃ সাইমা তাবাসসুম
<৬, ২৯০, ৫০০-৫০২>
শিরোনাম: পাগলা কুকুর হতে সাবধান
সংবাদপত্র : বাংলাদেশ ভলিউম ১: নং ১১
তারিখ: ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
পাগলা কুকুর হতে সাবধানঃ মেরে ফেল
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আর কিছু নয়,অন্তত তাদের জন্য বৃথা যেতে পারেনা, যারা অকৃতিম ভালবাসা আর প্রচেষ্টা দিয়ে দেশটার জন্য লড়ছিল। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও সেদিকে ইংগিত করছিল, ইংগিত করছিল আমরা জয়ের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি।
পাকিস্তানি মিলিটারিরা নিজেদের ফাঁদে নিজেরা আটকে পরছিল। তারা চেষ্টা করেছিল, হয়ত কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য প্রতারণা করতেও সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হতে পারেনি। তাদের হিসেব মতো চলছিল না কোনো কিছুই। তীক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পুর্ন ইয়াহিয়া খানও তার ভারসাম্য হারাচ্ছিল। শুধু তার আচরণই নৃশংস ছিল না, বরং তার কথাও ভীষণ রুঢ় হচ্ছিলো। শেষপর্যন্ত সে তার ভেতরের পশুকে আটকে রাখতে পারেনি। তার পশুত্ব মানুষের সামনে বেরিয়েই এসেছিল।
এইটা স্মরণযোগ্য যে ইয়াহিয়া খান তার ২৮ জুনের বেতার ভাষণে নিশ্চিত করে ছিলেন, অবশ্যই তিনি ক্ষমতা ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত জন প্রতিনিধির কাছে ছেড়ে দিবেন। এইটা সাংবাদিকদের মাধ্যমে বার বার প্রচারিত হচ্ছিল, সাম্প্রতিককালে যখন মৃদুহাস্যে সে বলছিল “আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব প্রথম সেই মানুষটির কাছে যাকে আমি ২৭ অক্টোবরের সকালে পাবো।” বাংলাদেশের জনগণের ইয়াহিয়ার কথা সম্পর্কে কোন সন্দেহ ছিল না। সুতরাং সেই রসিকতার কথা ছিল, ২৭ অক্টোবরের পূর্ব রাত্রে ইয়াহিয়া সামরিক হেডকোয়ার্টারে যাবে এবং ক্ষমতা তাকেই দিবে যাকে প্রথমে দেখবে, অর্থাৎ যেখানে একজন জেনারেল আর তার স্ত্রী থাকে । কিন্তু তার বেড টি এবং মদের বোতল পরিষ্কার করার জন্য কে থাকবে?
প্রতিশ্রুতির দুই-তৃতীয়াংশ সময় ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে কিভাবে নির্বাচন হবে? আর কারাই বা প্রতিদ্বন্দ্বী? সামারিক সৈন্য কিংবা তাদের সাহায্যকারী জোট এখন বুঝতে পারছিল মুক্তিবাহিনীরা যা বলছে তা পাকাপোক্ত আর জোর দিয়েই বলছে। তারা তাদের জাতির ভাগ্য নিয়ে মোটেও হইচই করছিল না।
অল্প কিছু দেশদ্রোহী নিজের দেশে থাকার বদলে লাহোর-করাচী-পিন্ডিতে থাকার পক্ষপাতী হয়ে উঠে। তথাকথিত নেতারা তাদের সমর্থকদের দিয়ে নিজেদের থাকার এলাকাকে সুরক্ষিত দূর্গের মত তৈরি করল। তারা চাইছিল তাদের সমর্থক এবং প্রশংসকরা রক্তের বিনিময়ে তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা তৈরি করুক। তাদের সমর্থকরা উদ্বিগ্ন ছিল। তারা আরো উদ্বেগ হয়ে দেখছিল পাকিস্তানি আর্মি তাদেরকে মুক্তিবাহিনীর কঠোর আন্দোলন, পিটুনির দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল। আর এই যুবসমাজ যারা পাকিস্তানিদের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল এবং নিজেদের রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল প্রকৃতপক্ষে এই বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক তাদেরকেই সব থেকে বেশি দাম দিতে হয়েছে। যুদ্ধটা যেহেতু সবার সামনে হচ্ছিল, সেহেতু আমরাও খবর শুনেছি রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে।
পাকিস্তান রেডিও আবার ই. বি. আর, ই. পি. আর আর পুলিশদের “সাধারণ রাজক্ষমা” নিয়ে চিল্লাচ্ছিলো। যদি স্মৃতি ধূসর না হয়ে যায়, স্পষ্টত মনে থাকার কথা যে, মাস কয়েক আগে প্রথম রাজক্ষমার ঘোষণার পর, পাকিস্তান রেডিও এক হাজার সৈন্যবাহিনী এবং পুলিশ কর্মকর্তার নাম উপস্থাপন করেছিল। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রদত্ত বিবরণ অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত তাদের দশ লক্ষ্যের ও বেশি আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। যদি এটা বিশ্বাসই করতে হয় যে পিন্ডির মানুষখেকো এখন নিরামিষাশী হয়ে গেছে, তাহলে এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে কেন মানুষ এখনো শত্রুর ভয়ে মরিয়া হয়ে তাদের দেশত্যাগ করছে। বাংলাদেশিদের মাঝে কেনো এত ভয় আর অনিরাপত্তা বোধ? আসলে, উত্তরটা পানির মতোই সহজ এবং সরল। এর জন্য খুব একটা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পরে না। মানুষ তাদের বিশ্বাস করতে পারছিল না, আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল তাদের উপর থেকে।
এদিকে ডাঃ মালিক ছিলেন কাঠের পুতুল, কেবল প্রদর্শনের জন্য। কারণ, ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান ওরফে জেনারেল নিয়াজি ছিলেন সামরিক আইন শাসন এবং পূর্ব আধিপত্যের সেনাপতি। মেজর জেনারেল রহিম খান ছিলেন সামরিক আইনের সহকারী পরিচালক। ক্ষমতা ছিল সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এবং গভর্নরের, একজন রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, এবং সামরিক আইন অধিদপ্তরের নেতা যে কিনা কেবল তার শাসকের খেয়ালখুশির দেখাশুনো করছিল মাত্র।
পাকিস্তানি ডেমোক্রেসি পার্টির নেতা মিঃ নুরুল আমিন, তাদের “বাধ্যগত কর্মী” নয় বলে জানানো হয়। তাই তাকে তার নিজের মতো করে কাজ করতে দেয়া হয়নি। এজন্য পিডিপি আর পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল পার্টির মিঃ আমিন এই ক্ষেত্রে যখনি “না” বলবেন তখনি তার পদ বহিঃস্কার হয়ে যাবে বলে জানানো হয়। জামায়াত-ই-ইসলাম এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের তিনটি চক্র( কাইয়ুম, কাউন্সিল, কনভেনশন) এর সদরদপ্তর ছিল লাহর আর পিন্ডিতে। এদের কিছু কর্মী বাংলাদেশে কাজ করছিল। তাদের ভূমিকা ছিল ভাড়াটে সৈনিকদের মতো। দেশ থেকে কোনো সমর্থন তারা পায়নি। মানুষের উপর তাদের নৃশংসতাই তাদের নগ্ন উদাহারণ যে তারা মানুষের নয়, মানুষের জন্যে নয়।
রাজনৈতিক অবস্থার এই প্রেক্ষাপটে মুক্তিবাহিনী ধীরেধীরে একরকম তীব্র আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো এবং তাদের জন্য মরণ ফাঁদের আয়োজন করছিল। শত্রুপক্ষ ও অশান্ত হচ্ছে, আতংকিত হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য থেমে আছে। বন্দরগুলো বিনিয়োগের বাইরে চলে গেছে। এমনকি নদীপথও চলাচলের জন্য অনিরাপদ।
পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। ওমার টিক্কা আকবর জোটের ইয়াহিয়া হামিদ পিরজাদা জোটের কাছে পরাজয়ে টিক্কার গ্রুপের প্রিয় উত্তরাধিকার জুলফিকার আলি ভুট্টোকে অরাজকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পাকিস্তান পিপল পার্টির কার্যক্রম সামন্ত এবং শিল্পপতিদের পছন্দ নয়। তারা তাদের সাময়িক সমর্থন ভুট্টোকে দিয়েছিল যাতে বাঙালীদের দমন করা হয়। কিন্তু যখন তা ব্যর্থ হয় তারা তাদের সমর্থন তুলে নেয় এবং তাদের পুরাতন বন্ধু জামাত, মুসলিম লীগ আর জামায়াত-এ-উলমাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। ভুট্টো ছিল তার নিজের লক্ষ্যে স্থির, ক্ষমতালোভী সামন্ত প্রভু, এমনকি সে মৌদুদ, কাইয়ুম এবং দাউলাতানা দের চোখে চোখ তুলে চাইতো না। তাই ভুট্টো যখন ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাঝে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বলল তখন অন্যরা সামরিক শাসনের অবসানে বাঁধা দিল। তাদের কাছে ব্যক্তিগত আক্রমণ বৈষয়িক আক্রমণ নয়।
ন্যাশনাল আওয়ামীলীগের নেতা মিঃ ওয়ালি খানকে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি ইয়াহিয়ার কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। অন্যদিকে, তেহরিক-ই-ইশতেকলাল এর শীর্ষস্থানীয় নেতা এয়ার আমি মার্শাল আসগর খান গণতন্ত্র পূণরুদ্ধার এবং বেপরোয়া হত্যাকান্ডের ইতি টানা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পরেন। বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাতে প্রচুর নেতা গ্রেপ্তার ও হয়। ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। উৎপাদন এবং বিক্রি কোনোটাই এখানে ছিল না সুতরাং শিল্পপতিরা রুষ্ট হয়ে উঠছিল। বন্দুকের নল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তি কিংবা সাহসের সঞ্চার হয়নি, বরং দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রকদের ২২টি পরিবার থেকে হয়েছিল। ছাত্ররা যারা আইয়ুবের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে যুদ্ধে নেমেছিল, তারা ইয়াহিয়ার চিরস্থায়ী আর্মি শাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা এবং তার ভন্ড মুখোস টেনে ছিড়ে জনতার সামনে এনে রেখেছিল।
এরকম দূর্যোগময় অবস্থায়, ইয়াহিয়ার পাগল প্রায় অবস্থা। সবার উপর সে দিন রাত তর্জনগর্জন চালাতে লাগলো। এমনকি সে তার কথার মাঝে সংযম পর্যন্ত হারিয়ে ফেললো। প্রচন্ড হতাশা আর অবজ্ঞায় মরিয়া হয়ে সে মুক্তিবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে দিল : ” পাগলা কুকুরগুলোকে একটা একটা করে ধরো আর মেরে পুঁতে ফেলো।”
.
.
অনুবাদঃ জয়ন্ত সেন আবীর
<৬, ২৯১, ৫০৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুজিবনগর সমাচার | বাংলাদেশ ভলিউমঃ ১, নম্বরঃ ১১ |
৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
মুজিবনগর থেকে
“আত্মসমর্পণ”
.
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলগুলোর গভর্নর হিসেবে ড. মালিকের দায়িত্ব প্রাপ্তিকে আত্মসমর্পণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
.
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলগুলোর গভর্নর হিসেবে একসময়কার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ড. এ. এম. মালিকের নিয়োগদান ইসলামাবাদের তথাকথিত সামরিক জান্তার আত্মসমর্পণের স্বরূপ মাত্র। নির্দয়ভাবে হত্যা, লুট, জ্বালাও-পোড়াও এবং ধর্ষণে টিক্কা খানের বীভৎস গৌরব বাংলার মাটিতে ন্যাক্কারজনকভাবে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। মৃতরা বাতিলের খাতায় চলে গেছে। তার পৌরুষদীপ্ত মহিমা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে, আত্মসম্মান খুইয়ে অপদস্থ হয়ে তাকে চলে যেতে হচ্ছে। এতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতিও এক পরিষ্কার বার্তা উল্লেখিত আছে।
.
পাকিস্তানি জান্তা একে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার এক উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখ করছে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ইসলামাবাদের ঘাতকেরা শুধুমাত্র উপনিবেশেই “বেসামরিক শাসন” প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে, পশ্চিম পাকিস্তানে নয়। এটা আরেকটি পরিষ্কার ইঙ্গিত যে ঔপনিবেশিক শাসন মূল ভূখণ্ড শাসন থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে পরিচালিত হয়। বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর আগে আলোচ্য বিষয় ছিল। জনগণ প্রায় অবিসংবাদিতভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করেছিল। সেসময়ে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার অর্থ ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেশের শাসনভার অর্পণ, অনির্বাচিত কারো হাতে নয়।
.
জনাব মালিকের নিয়োগপ্রাপ্তি কেবল মাত্র বিশ্বের চোখে ধুলো দেয়া ও ধাঁধা সৃষ্টি করার এক অপপ্রয়াস মাত্র। বাংলাদেশের জনগণ এরূপ বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পেছনে কী পরিকল্পনা রয়েছে তা জানে। আইয়ুব খানের ১৯৫৮ সালের ক্যু এবং ১৯৬৯ এ ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলের পর এরকম দুটি “পুনঃপ্রতিষ্ঠা”র এরা প্রত্যক্ষদর্শী। যখন কোনো সামরিক শাসকের ঔপনিবেশিক শাসন সামরিক শাসকদের পক্ষে কটুগন্ধময় এবং বিব্রতকর হয়ে ওঠে তখনই তারা এক বিশ্বাসঘাতক বাঙ্গালী বেসামরিক ব্যক্তিকে বাংলার “সুবেদার” হিসেবে নিয়োগ দেয়। এবারো সামরিক শাসকেরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের চেনা পথ ধরে চলছে। এই অতিপরিচিত চাল এবার আর বিদেশী শক্তিদের থেকে সাহায্য ও সহায়তা আনয়নে সমর্থ হবে না।
.
ড এ এম মালিক একজন বৃদ্ধ ব্যাক্তি। তার রয়েছে এক সন্দেহজনক অতীত, নেই কোনো ভবিষ্যত। তিনি লিখিত দিয়েছেন যে বাংলার মাটিতে তার প্রভুদের দ্বারা সংঘটিত সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া অপরাধগুলো সম্বন্ধে তিনি একদমই ওয়াকিবহাল নন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি দেয়ালের লিখন পড়তে অক্ষমতা প্রকাশ করছেন। আমাদের থেকে কেবল করুণাই তিনি আশা করতে পারেন, আর কিছু নয়।
.
.
অনুবাদঃ নিয়াজ মেহেদী
<৬, ২৯২, ৫০৪>
শিরোনামঃ অঙ্গীকার প্রতিপালিত হয়েছে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম. ১ : নং. ১১
তারিখঃ ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
এ ওয়াদা পূর্ণ হবারই
পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বন্ধ হবার পর কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাকি পড়া সকল পেনশন বাংলাদেশ সরকার শোধ করে দিয়েছে।
৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় কবির নিজ বাসস্থানে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু জাকজমকপুর্ন অনুষ্ঠানে ভারতে বাংলাদেশের মাননীয় হাই কমিশনার মিস্টার এম. হোসেন আলী, ২১০০.০০ রূপীর একটি চেক কবির বাকি পড়া পেনশনের অংশ হিসেবে তার নিকট হস্তান্তর করেন। যখন বাংলাদেশের হাইকমিশনার মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছিলেন, তখন পাকিস্তান সরকার পুনরায় পেনশন অফারটি চালু করেন, শুধুই কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জন্য।
মিস্টার আলী তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন যে, সে সেখানে বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন জনতা ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মাসিক ভাতা দেওয়ার জন্য উপস্থিত আছেন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের সম্পদ খুব সীমিত। কিন্তু আমরা মুক্ত চিন্তা এবং মানবিক মূল্যবোধের দরজা খোলা রাখার চেতনা লালন করি।
চমৎকার বাংলায় মিস্টার আলী বলেন, বাঙালি জাতির জাতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করার সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে যখনি জাতীয় জীবন শৃঙ্খলের অধীনে ন্যাস্ত হয়েছে, বাঙালিরা তখনি নানাভাবে এই শেকল ভাঙার চেষ্টা করেছে। তিনি আরো বলেন, কবি, ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম ব্যাক্তি ছিলেন যিনি তার মুষ্টিবদ্ধ হাত তোলেন স্লোগান দিয়ে যা কবি চাইতেন, যার তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারা আজ বন্দুক হাতে তাদের মাতৃভূমির জন্য মুক্তিযুদ্ধে রত। তিনি সবশেষে বলেন, বন্দুকের গুলিতে মানবতার শত্রুদের খুব দ্রুতই খতম করা হবে।
.
.
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,২৯৩,৫০৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুজিবনগর সমাচার |
বাংলাদেশ খণ্ড ১: নং ১৮ |
২৭ অক্টোবর, ১৯৭১ |
মুজিবনগর থেকে
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ফেডারেল প্রজাতন্ত্রী জার্মানির চ্যান্সেলর জনাব উইলি ব্র্যান্ডট্ এর কাছে নিম্নলিখিত টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন।
“আপনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জেনে খুবই আনন্দিত হলাম। আমার এবং বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আশা করছি আপনি সারা বিশ্বব্যাপী শোষিত-নিপীড়িত মানবতার পক্ষে থেকে শান্তির বাণী প্রচারে কাজ করে যাবেন।”
কোন “অনুপ্রবেশকারী” নেই
ইরানে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতে এবং ১৮ অক্টোবর, ১৯৭১ তারিখে করাচিতে এক ফরাসি সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খানের “ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধ করছে” এরূপ বক্তব্যের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী, এম এন এ বলেন,
“আসল ইস্যুকে বিভ্রান্ত করার জন্য জেনেশুনে এভাবে সত্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে – আসল ইস্যুটি সাত কোটি বাংলাদেশী জনগণ এবং ইসলামাবাদের অবৈধ সামরিক শাসনের মধ্যে, যেখানে সার্বভৌম মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে গণহত্যা, ধর্ষণ, দমন-পীড়ন এবং উৎখাত করা হচ্ছে, এর সাথে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কোন সম্পর্ক নেই। এটা আশা করা অনুচিত যে, “অনুপ্রবেশকারীরা” ইয়াহিয়ার ২৫০০০ এরও বেশি অস্ত্রসজ্জিত হানাদারদের শেষ করবে, সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক সমর্থন পাবে যারা জাতিগত এবং রাজনৈতিকভাবে একক জাতি গঠন করেছে এবং স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সব কিছুর বিরুদ্ধে সাহসের সাথে লড়াই করছে। সত্যি বলতে, মুক্তিবাহিনীতে সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী সদস্যদের পাশাপাশি সর্বস্তরের বেসামরিক সদস্যও রয়েছে, রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কৃষক-শ্রমিক, যারা দৃঢ় মনোবল, সাহস এবং লক্ষ্যের প্রতি অটুট বিশ্বাস নিয়ে লড়াই করছে; তাদের যুদ্ধ সত্য ও ন্যায়ের, ঘৃণ্যতম ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির যুদ্ধ। এ জন্যই অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত হয়ে অনেক এগিয়ে থেকেও শত্রুরা বেপরোয়াভাবে এ লড়াই লড়ে যাচ্ছে যাতে তারা নিশ্চিত হেরে যাবে। মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে এবং আশু লজ্জাস্কর পরাজয় থেকে তাঁর দলকে বাঁচাতে শেষ চেষ্টা করছেন।”
.
.
অনুবাদঃ এ. এস. এম. হাসান লতিফ
< ৬,২৯৪,৫০৬-৫০৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা |
বাংলাদেশ ভলিউম: ১ নং. ৮ |
২১ অক্টোবর, ১৯৭১ |
মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা
.
বাংলাদেশ মুক্তিবাহীনির সামরিক ক্যাম্পগুলোর নিকটে বেশ কিছু সংখ্যক বেজ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। “বাংলাদেশ” নামক এমন একটি ফিল্ড হাসপাতাল কুমিল্লা সেক্টরে পুর্ণাঙ্গমাত্রায় সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এতে কর্মরত সকলেই বাংলাদেশী যাদের ৬ জন চিকিৎসক, ৪ জন মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র ও ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবী সেবীকা এবং এটির পৃষ্ঠপোশকতা করছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন, যুক্তরাজ্য।
.
ডাঃ আব্দুল মতিন চৌধুরী একজন তরুণ চিকিৎসক যিনি ইংল্যান্ডে রোগী দেখা বাদ দিয়ে এখন এই হাসপাতাল চালু রাখার জন্য সাহায্য করতে সার্বক্ষনিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
.
বেজ হাসপাতালটি রণাঙ্গনের ১২টি সাব সেক্টর চিকিৎসাকেন্দ্রের সাথে যুক্ত যেগুলো মুক্তিবাহীনির বিভিন্ন অগ্রগামী অবস্থানের কাছাকাছি; প্রতিটি অগ্রগামী অবস্থানে প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষত ২জন স্ট্রেচার বাহক রয়েছেন যাদের কাজ আহত ব্যক্তিদের দ্রুততার সাথে সাব-সেক্টর সদর দপ্তরে সরিয়ে ফেলা। এক্ষেত্রে যাদের আঘাত ছোটখাট যেমন অসংবেদনশীল স্থানে স্প্লীন্টারের আঘাত, বুলেটে চিড়ে যাওয়া ক্ষত, তাদেরকে চিকিৎসক বা চিকিৎসা-সহকারী কর্তৃক চিকিৎসা প্রদানের জন্য তাবুতে তৈরী চিকিৎসাকেন্দ্রে রেখে দেয়া হয়। যাদের আরও গুরুতর আঘাত রয়েছে তাঁদের বেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
.
শন ও বাঁশের কাঠামোয় তৈরী বেজ হাসপাতাল ‘বাংলাদেশ’ এর অভ্যন্তরে ১০০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেবার মত ধারণক্ষমতা রয়েছে। এর ৮০% ভাগ যুদ্ধাহতদের জন্য ও বাকিটুকু সাধারণ জনগণের জন্য যারা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। বাস্তবতা হচ্ছে ১০,০০০ যোদ্ধাকে চিকিৎসা প্রদানকারী বেজ হাসপাতাল ‘বাংলাদেশ’ এটাই নির্দেশ করছে যে প্রকৃতভাবে মুক্তিবাহীনির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত স্বল্প।
.
হাসপাতালের বেশীরভাগ যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুপক্ষ নিয়ন্ত্রিত চিকিৎসাকেন্দ্র হতে দখল করা হয়েছে। এভাবে হাসপাতাল বিপূল পরিমাণ সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ও একটি বৈদ্যুতিক জেনারেটর পেয়েছে। তবে হাসপাতালটিকে ঔষধ ও অন্যান্য জরুরী সরবরাহের জন্য সর্বক্ষনিক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে চিকিৎসকরা উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ করছেন। আর এভাবেই পুরোনো মশারী কেটে গজ হিসেবে ও বিছানার চাদর ব্যান্ডেজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
.
বেজ হাসপাতাল ‘বাংলাদেশ’ ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতি, প্রথানমন্ত্রী ও সর্বাধিনায়ক কর্তৃক পরিদর্শিত হয়েছে যাঁদের সকলেই উষ্ণভাবে হাসপাতালের সংগঠকদের প্রশংসা করেছেন ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় সবধরণের সহযোগীতার প্রতিশ্রুতী প্রদান করেছেন। বাংলাদেশ সরকার চিকিৎসাজনিত সরঞ্জামাদীর অবিরত সরবরাহ চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এবং আশা করা যাচ্ছে যে বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দানে এগিয়ে আসবে।
.
৪টি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনসমূহ হচ্ছেঃ এক্স-রে সুবিধাদি, একটি ভালো বৈদ্যুদিক জেনারেটর, এম্ব্যুলেন্স হিসেবে ব্যবহারযোগ্য মোটরযান, নিরবিচ্ছিন্ন ঔষধ সরবরাহ এবং ঔষধপত্র মজুদের ব্যাবস্থা করা।
.
একই রকমের যে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান ও স্ট্রীমলাইন বজায় রাখার জন্য অসামান্য অবদান রেখে চলছে তাদের মধ্যে বেজ হাসপাতাল “বাংলাদেশ” একটি। সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে কেননা তাঁরা জানেন আহত হলে তাঁদের চিকিৎসার ত্রুটি হবে না।
.
.
অনুবাদঃ আহসানউল্লাহ
<৬,২৯৫,৫০৮>
শিরোনামঃ পাকিস্তানের দিল্লী মিশন ইয়াহিয়ার কসাইখানা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ২০
তারিখঃ ১০ নভেম্বর ১৯৭১
.
পাকিস্তানিরা পরদেশে নয়াদিল্লীতে তাদের হাই কমিশনে বাংলাদেশি
কর্মকর্তাদের উপর বর্বরতা ও পশুত্বের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল ২ নভেম্বর,১৯৭১ তারিখে।
বাঙালি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা স্বাধীনতার দাবি জানালে এবং বাংলাদেশের প্রতি অনুগত্য শিকার করায় তাদের নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়।ভারতে তাদের ইন্টেলিজেন্ট নেটওয়ার্ক এর চিফ মি.আব্দুল গণির ব্যক্তিগত সহকারী বাংলাদেশি জনাব হুসাইন আলী খানকে জোরপূর্বক হাই কমিশনে আটকে রাখা হয় এবং মারধর করা হয়।হুসাইন আলী খান আর বেচে আছেন কিনা সেটা এখনো অজানা।বাঙালি কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের আশ্বাস ও নিশ্চয়তা দেওয়া সত্ত্বেও তাদের উপর নির্মমভাবে কুৎসিত অসদাচরণ করা হয়।হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ আন্দোলনের জন্য পূর্বঘোষিত কারাবাসীর মত যারা হাইকমিশনে ছিলেন সেই বাঙালি কর্মকর্তাদের সকল নিষেধাজ্ঞ তুলে দেন।তাদের বলা হয় যে যদি তারা চায় তবে তারা হাই কমিশন ছেড়ে চলে যেতে পারে।তবে তারা হুসাইন আলীকে তাদের আটকে রাখে কেননা তিনি ভারতে তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক এর চীফের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন।ভারতে পাকিস্তানের
হাই কমিশন যাকে বলা হত ইয়াহিয়া খানের ঘর সেখান থেকে অপেক্ষারত এবং রক্তাক্ত মানুষের অবস্থাই সংবাদ মাধ্যম এবং হাইকমিশনের বাইরের সকলের কাছে ভেতরের পরিস্থিতিকে বর্ণনা করে!এরপর পশ্চিম পাকিস্তান সমগ্র বাংলাদেশের উপর নৃশহংস এবং ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ পোষণ করে।বাংলাদেশ সরকার এবং নেতাগণ খুব শক্তভাবে বাঙালি কর্মকর্তাদের প্রতি এই অত্যাচারের নিন্দা জানায় এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে জনাব হুসাইন আলি খানের মুক্তি চায়!
.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ২৯৬, ৫০৯-৫১০>
শিরোনামঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ২০
তারিখঃ ১০ই নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংবাদ
বাংলাদেশের জনমানবশূন্য শহর
পূর্ব বঙ্গের প্রতিটি শহর থেকেই প্রাক-মিছিলের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। এখনও গ্রাম অঞ্চলে আগুন জ্বলছে, দাঙ্গা, লুটতরাজ ছড়িয়ে পড়েছে এবং বাঙালী ও পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের মধ্যকার পারস্পরিক ঘৃণা ও বিভেদ কোন অংশেই হ্রাস পায় নি। সামরিক শাষিত সরকার এখনও প্রতি মুহূর্তে বাঙালীদের উপর সতর্ক নজর রাখছে এবং তাদের তথাকথিত ” অপরাধের ” কঠোর শাস্তি প্রদান করছে।
সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানী সেনা বহর
মুক্তি বাহিনীর কাছে পর্যায়ক্রমে হয়রানীর শিকার হওয়া ছাড়াও , পাকিস্তানী সেনা বহর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও সরবরাহ সংক্রান্ত ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
সমগ্র বাংলাদেশেই পাক সেনারা খাদ্য বিষক্রিয়া ও পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটা মূলত আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে দূষিত পানি থেকে সংক্রামিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পাক সেনাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে গম স্বল্পতার কথা এক বিবৃতিতে প্রকাশ করা হয়। এটা পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে এক বিশাল প্রতিবন্ধকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেহেতু, গম তাদের প্রধাণ খাবার।
তবে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পরিবার পরিজনের চিঠি বাংলাদেশে পৌঁছাতে না পারাটা পাকিস্তানী সেনাদের জীবনে সবচেয়ে বড় হতাশার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
এই চিঠিগুলা সামরিক কর্মকর্তারা সুস্পষ্ট কারণেই বিতরণ করছে না। কারণ, চিঠিতে পরিবারের সদস্যদের উৎকণ্ঠা সৈনিকদের মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। আরও আশংকা করা হচ্ছে, এসব চিঠিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দূরবস্থার কথা উল্লেখ থাকতে পারে।
বিপুল সংখ্যক সেনার জীবনাবসান
লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার সংবাদদাতার বার্তা অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনা মৃত্যুর হার বেড়ে দিন প্রতি ১৮৯ হয়েছে। তিনি আরও জানান, ঢাকা সেনানিবাসে সেনা কর্মকর্তাদের লাশ বহনের কফিন তৈরির জন্য পূর্ণ মেয়াদে কাঠ মিস্ত্রি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। লাশ ভর্তি কফিনগুলো কবর দেবার জন্য জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়।
পাকিস্তানের বোয়িং বিমানের উড্ডয়ন পরিকল্পনার পরিবর্তন
ঢাকার ভেতরে মুক্তিবাহিনীর জোরালো আক্রমণ পাকিস্তানী সেনাদের বিমানবন্দরের রাস্তার পাশে পিল বক্স ( কংক্রিট বাঙ্কার ) তৈরী করতে বাধ্য করেছে। এমনকি পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান বহরও মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমের প্রভাব অনুভব করতে পেরেছে। তাদের বোয়িং বিমান, যেগুলো পূর্বে বিমানের প্রজ্বলিত অবতরণ আলো জ্বেলে আন্তর্জাতিক বিমান পথে প্রতিদিন ঢাকায় অবতরণ করতো, বর্তমানে উড্ডয়ন পথ পরিকল্পনার পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের বিমানবহর বর্তমানে যতটা সম্ভব সমুদ্রের উপর দিয়ে দিক নির্দেশক আলো ছাড়াই উড্ডয়ন করছে।
নির্বাচনে কারচুপির প্রস্তুতি
অসন্ন জাতীয় সংসদের ৭৮টি আসনের বিদায়ী নির্বাচনে সামরিক শোষকের সমর্থকদের পূর্ব বঙ্গ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া নিশ্চিত করতে, পূর্ব অনুমিতভাবেই ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন নির্বাচনে কারচুপির প্রস্তুতি নিয়েছে।
পূর্ব বঙ্গের তাবেদার রাজ্যপাল ডক্টর এ. এম. মালিক নিউ ইয়র্ক টাইমস এর ম্যালকন ডাব্লিউ ব্রাউনের কাছে এক স্বীকৃতিতে জানান, “বিদায়ী নির্বাচনে প্রচুর অসঙ্গতি রয়েছে”।
.
.
অনুবাদঃ তানুজা বড়ুয়া
<৬, ২৯৭, ৫১১-৫১৩>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ সরকারের কৃতিত্ব
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ২১
তারিখঃ ১৭ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য
আজকের বাংলাদেশ সরকার একটি অসামান্য আন্দোলন এবং লাখো পীড়িত মানুষের রক্তে রাঙ্গানো প্রেক্ষাপট থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর উদয় ঘটেছে প্রথাগত উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে, যা একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যাশিত। পাকিস্তানের গত নির্বাচনের বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ, যারা পূর্ব বাংলায় ৮৮,৬ শতাংশ আসন পায় এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ২১ টি আসন লাভ করে, ছিল সংবিধানসম্মত একটি রাজনৈতিক দল যারা আইনি প্রক্রিয়ায় সামাজিক সংস্কারে বিশ্বাসী ছিল। এ ধরনের পটভূমির একটি দল এবং তার নেতৃত্বের জন্য একটি সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করাটা ছিল একটি অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত অগ্রগতি।
এক অনন্য নেতৃত্ব
কিন্তু আজ সেই একই দল, ইতিহাসের এক অনন্য প্রেক্ষাপটে, একটিঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধেসশস্ত্র সংগ্রামে দৃঢ়তার সাথে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করার ১৫ দিনেরও কম সময়ে , দেশের নির্বাচিত নেতারা একত্র হন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে একটি সরকার গঠন করেন। প্রথাগত ধ্যানধারণা থেকে এই সরকার গঠন করা হয়নি, বরং এই সরকারের প্রধান কাজ ছিল দখলদার বাহিনীকে এই ভূখন্ড থেকে বিতাড়িত করার জন্য মুক্তিফৌজকে নেতৃত্ব দেওয়া।একইসাথেসরকারের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল এবং দখলদার অধিকৃত অঞ্চলেরমানুষকে সর্বোচ্চআইনী অধিকার প্রদান করা। এই সরকারকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার তদারকি করতে হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়ানো লক্ষ লক্ষ মানুষের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। তাকে এই বিশাল যুদ্ধের অর্থায়ন করতে হচ্ছে এবং একই সাথে বিশ্ব জুড়ে সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখা এবং প্রচারণা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হচ্ছে।
মুক্তিবাহিনী : বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত গেরিলা বাহিনী
বাংলাদেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী , স্বেচ্ছাসেবক , ছাত্রদের নিয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনী আজ একটি সুসংগঠিত এবং সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এটি যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং কলবরেও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি বিরাট কৃতিত্ব যে তারা সফলভাবে সমগ্র মুক্তিবাহিনীকে একটি একক সুশৃঙ্খল নেতৃত্বের অধীনে সামিল করতে পেরেছে এবং এখন যুদ্ধ চলছে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে থেকে।
বিশ্বের আর কোন অংশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শত্রুকে দুর্বল করা এবং একক প্রচেষ্টায় যুদ্ধপ্রক্রিয়া সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এত দ্রুত সাফল্যের মুখ দেখেনি। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য কোন স্বাধীনতা সংগ্রামেইএত অসাধারণ সুশিক্ষিত গেরিলা বাহিনী অংশগ্রহণ করেনি। মুক্তিবাহিনী এখন সব ক্ষেত্রে সুসজ্জিত । মুক্তিবাহিনী সম্প্রতি তরুণ অফিসারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং সম্পন্ন করেছে এবং ট্রেনিং এর আওতাধীন আছে আরো অনেকে। মুক্তি বাহিনীর নৌ – কমান্ডোগণ ইতোমধ্যে পাকিস্তানি নৌ চলাচলকে অকার্যকর করতে সফল হয়েছেন। ঢাকা সহ অন্যান্য বড় এলাকায় গেরিলা বাহিনী তাদের কার্যকর এবং স্থায়ী অবস্থান সুনিশ্চিত করেছেন।
কূটনীতি এবং যুদ্ধ প্রচারণা
কূটনৈতিকফ্রন্টে, বাংলাদেশসরকারের ঈর্ষনীয় সাফল্য ছিলো। বিশ্বে সম্ভবত এটিই একমাত্র আন্দোলন যেখানে এত ব্যাপক সংখ্যক কূটনীতিবিদ একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী আরেকটি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন।রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে জুনিয়র ৩০ জন কূটনৈতিক নতুন সরকারে যোগদান করেছেন এবং আরো ৯৬ জন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাওতাদের আনুগত্য বদল করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য এবং দেশের ভেতর এবং বাইরের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ, বিশ্বস্ততা এবং আনুগত্যের জন্যই এটি সম্ভবহয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রচারযন্ত্রও বিশ্বজনমতকে তার পক্ষে প্রভাবিত করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এখন পর্যন্ত এটি ২৫০ জোন বিদেশি সাংবাদিক, বেতার , টেলিভিশন এর কর্মী এবং আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছে। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা, সাংবাদিকদের এবং ১০০ এর ও বেশি বিদেশি অতিথি এবং প্রতিনিধিদের দেখাশোনায়কোলকাতা সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। বহির্বিশ্বে বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিষয়ক তথ্য সরবরাহের জন্য ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেবহির্বিশ্ববিষয়কপ্রচারণাবিভাগ। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি উপস্থাপনের জন্য ভারতের সকল এলাকাসহ মধ্য প্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়াতেও প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছে। জনসাধারণের মনোবল তুঙ্গে রাখতে সংবাদ মাধ্যম ও তথ্য বিভাগএবং তাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ বাংলাদেশ বেতার অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। পরিশেষে, ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে জাতিসংঘের লবিং এ পাঠানো হয়েছে এবং তারা নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য সুদৃঢ় আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সফল হয়েছে।
প্রশাসন
বাংলাদেশ সরকারের কঠোর প্রচেষ্টা বেসামরিক প্রশাসনের কার্যকর সংহতির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে যা মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক প্রচেষ্টাকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রয়োজনীয় সব বিভাগসহ তরুণ এবং দক্ষ কর্মকর্তা, কুশলী এবং বিভিন্ন পেশা থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে একটি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। উক্ত প্রশাসন মুক্ত অঞ্চল সমূহের ব্যবসা – বাণিজ্য , আদালত, শিল্প –কারখানা, ডাক এবং টেলিযোগাযোগ ব্যাবস্থা, থানা , বিদ্যালয় , বহিঃ শুল্ক , অন্তঃ শুল্ক ব্যবস্থা এবং কর সংগ্রহসহ অন্যান্য কাজে নিয়োজিত আছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
চলমান যুদ্ধ প্রক্রিয়া এবং মুক্তাঞ্চলের প্রশাসনিক কাজকর্ম তদারকি ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার একই সাথে ভবিষ্যতের বিষয়েও যথেষ্ট সচেতন। ইতোমধ্যে দেশের প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিতএকটি পরিকল্পনা কমিশন নতুন সমাজের জন্য আর্থ- সামাজিক অবকাঠামো প্রস্তুত করছেন। সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যে যুদ্ধ-পরবর্তী দায়িত্ব অনেক ব্যাপক ও কঠিন হবে এবং অবিলম্বে ব্যাপকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে। বাংলাদেশকে তার জনগণের প্রয়োজন এবং চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হতে হবে, যারা এরই মধ্যে এই বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।
জনযুদ্ধ
এই সংগ্রামকে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত করতে বাংলাদেশ সরকার দেশের অন্যান্য বাহিনীকেও নিয়োজিত করেছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই গণযুদ্ধকে শক্তিশালী করতে ৫- সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে যে যুদ্ধ এখন সরাসরি বিজয়ের নিশ্চিত রূপ নিয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান
আমাদের নেতা এবং এই স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রেরণার উৎস, যিনি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে “বাংলাদেশ” শব্দটি উচ্চারণ করেছেন, তিনি এখনো দখলদার বাহিনীর হাতে বন্দি। তা সত্ত্বেও , এটি লক্ষণীয় বিষয়যে, শেখ মুজিবুর রহমান এখনো বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছেন। তিনি সাহস, ত্যাগ এবং মানুষের প্রতি আত্মদানের একজীবন্তপ্রতিমূর্তিহিসাবেবিরাজকরছেন। বাংলাদেশের জনগণ আত্মবিশ্বাসী যে তারা শীঘ্রই তাদের নেতাকে ফিরে পাবে।
একটি স্বাধীন বাংলাদেশ এখন এক রাজনৈতিক বাস্তবতা। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জিত ত্বরিত সাফল্য ইতিহাসের আর কোন স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথেই সমতুল্য নয়। সুনিশ্চিত বিজয় জেনে সে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য , শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার এসব কর্মসূচী সফলভাবে বাস্তবায়নের বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ যেমনভাবে সে জনগণকে মুক্ত করার আন্দোলনেও শরীক হয়েছিল।
.
.
অনুবাদঃ তাসমিয়াহ তাহসিন
<৬, ২৯৮, ৫১৪-৫১৫>
শিরোনামঃ ভারত বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিয়েছে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ২৪
তারিখঃ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দান
সত্যের জয় হয়েছে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সোমবার , ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১, নয়াদিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দ্বারা ভারত মানব সভ্যতার বৃদ্ধি, শান্তি ও উন্নতির প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনরুদ্ধার করেছে। আশা করা যায়, যেসব রাষ্ট্র গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃত করতে এগিয়ে আসবে এবং মানবাধিকার ও মর্যাদার যে উদ্দেশ্য সেটি তুলে ধরবে।
স্বীকৃতিপ্রাপ্তির এই খবরে বাংলাদেশের মানুষ আনন্দে ভাসছে এবং এক অভূতপূর্ব আনন্দধ্বনির সমারোহ হয়েছে। আকাশে-বাতাসে শুধু “জয় বাংলা” ও “শেখ মুজিব জিন্দাবাদ” স্লোগান। সবুজ-লাল-হলুদে রাঙ্গা বাংলাদেশের পতাকা গর্বের সাথে বাড়িতে বাড়িতে পতপত করে উড়ছে।
বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা এক বিশ্লেষন সভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ভারতীয় সরকারকে অভিনিন্দন জানান।
খন্দকার মোস্তাক আহমেদ , গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সোমবার এক বক্তব্যে বলেনঃ
“অভিভুত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হৃদয়ে, আমরা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ, আবারো ভারতীয় সরকার ও জনগণকে ইতিহাসের এই যুগান্তকারী মূহুর্তে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে মানব সভ্যতা, শান্তি, অগ্রগতি বৃদ্ধির প্রতি তাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির আদর্শ পুনরোদ্ধার করেছেন।
এই ঐতিহাসিক দিনে , আসুন আমরা সবাই অনুগতভাবে নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা আনতে অঙ্গীকার করি যেমনটি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবাসীদের অঙ্গীকার করেছেন। আমরা আশা করি যে বাংলাদেশ-ভারতের এই মিত্রতার বন্ধন আরো বৃহত্তরভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অনন্ত ও শ্বাশত মহিমা লাভ করবে। এই মহান ভারতীয় জাতি এবং উদীয়মান বাঙালি জাতি তাদের সমর্থ অনুযায়ী পঞ্চশীলের নীতি অনুসারে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পরস্পরের পূরক কিংবা সম্পূরক হতে পারবে।
মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধারা ও কর্মকর্তারা, এবং ভারতীয় বাহিনী যারা সোনালী হরফে না বরং রক্তঝরা শব্দে ইতিহাসের নতুন পাতা লিখেছে, তারা আমাদের ধন্যবাদ ও অভিনন্দন পাওনা। সকল গৌরব তাদেরই প্রাপ্য।
আমাদের মহান নেতা, বাংলাদেশের স্বপ্নদর্শী , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইসলামাবাদের বর্বর জনতা থেকে মুক্ত করতে হবে । যদি রক্তই স্বাধীনতা আনতে পারে, তাহলে রক্ত তাকে তার স্বপ্নের বাংলাদেশেও ফিরিয়ে আনতে পারবে।
বিশ্বের সকল স্বাধীনতা-প্রেমী, শান্তিপ্রিয় সরকারদের আমরা আকুল আবেদন জানাই যেন তারা অনতিবিলম্বে গণপ্রিজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয় এবং গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিকতার নিশানা সুউচ্চে তুলতে সাহায্য করবে। — জয় বাংলা।
.
.
অনুবাদঃ সুমিতা দাশ
<৬, ২৯৯, ৫১৬>
শিরোনামঃ জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ২৪
তারিখঃ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বাংলাদেশের দিকে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের মত কে বাংলাদেশ সরকার দ্বারা নিন্দা ও ঘৃণার সাথে অপমান করা হয়েছে।একই মতকে সরকার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হয় যত দ্রুত সম্ভব ২২শে জুলাই,১৯৭১।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ একে পরিকল্পিত চক্রান্ত ও পিছনের দরজা থেকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন রক্ষা করার পূর্ণ চেষ্টা রুপে আখ্যায়িত করেছেন।
জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বলেছেন যে প্রস্তাবের ধর্মপিতারা যে কারো ভাগ্যের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী থাকবেন যারা “আমাদের বিজয়ের শীর্ষ কাল” এ বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক হিসেবে আসার চেষ্টা করবে।
জনাব আহমেদ বলেন যে ইয়াহিয়া’র সেনা আক্রমণ দ্বারা বাংলাদেশে নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডের সময় যারা নীরব দর্শক ছিল, তারা এখন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর নামে সেনা জান্তা বাঁচাতে বাইরে এসেছে।তিনি আরও বলেন যে আমরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে কোনো অজুহাতে কোনো হস্তক্ষেপ সহ্য করব না।
খন্দকার মুশতাক আহমেদ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগ কে সর্বশেষ উদ্যোগে নিন্দা জ্ঞাপন করেন।তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে কোনো প্রকারের জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বার্তাবাহক এবং সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক স্বার্থের অভিভাবক হিসেবে গণ্য করা হবে।
২রা ডিসেম্বর মুজিবনগরে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মানুষের সংগ্রামের উপর দৃঢ় বিশ্বাস ব্যাক্ত করেন এবং বলেন, যদি পৃথিবীর কোথাও কখনো মানুষের সংগ্রাম জয়ী হয়ে থাকে, এটা আবার ও বাংলাদেশে জিতবে।বাংলাদেশের মানুষের সুবিশাল জনসাধারনের অন্তর্নিহিত শক্তি অধীনে করার প্রয়াসের বদলে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌম মেনে নেয়ার জন্যে পাকিস্তানের বন্ধুদের প্রতি আহ্বান জানান।
শুধুমাত্র ৭৫ মিলিয়ন বাংলাদেশের মানুষকে বশীভূত করার তথাকতিত আবদ্ধ নিষ্ফল “শান্তি তৈরির প্রচেষ্টা”র জন্য ঘৃণা প্রকাশ করছি না বরং আমরা যে কোন অনাকাংখিত অতিথিদের সতর্ক করে দিতে চাই। ইয়াহিয়া খানের পক্ষে ও জন্যে যেই আসুক না কেন, সে বাংলাদেশে একই উত্তর পাবে যেমন ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আমাদের বীর সদস্যদের দ্বারা পাচ্ছে…..
.
.
অনুবাদঃ সাইমা তাবাসসুম
<৬, ৩০০, ৫১৭-৫১৮>
শিরোনামঃ জোট নিরপেক্ষ ও শান্তিপুর্ন সহ অবস্থান
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১: নং ২৪
তারিখঃ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
জোট নিরপেক্ষতা এবং শান্তিপুর্ণ সহাবস্থান
প্রেসিডেন্টের মৌলিক পররাষ্ট্রনিতি ঘোষণা
.
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বিশ্বের প্রতিটি দেশের কাছে আবেদন করেছিল যেন তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক চিহ্নিত করে, যেখানে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার আদর্শ সংরক্ষণ করা হয়।
গতকাল রেডিও বাংলাদেশে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘোষণায় তিনি বলেন, [স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমি বিশ্বের সকল দেশকে আহবান করবো যেন তারা আমাদের, এবং ৭৫ কোটি মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে অবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করে।]
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আরও বলেছেন, “আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখানেই শেষ হওয়া উচিৎ নয়। বরং অর্থনৈতিক কাঠামো, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের পুনর্গঠিত করার এবং বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এখান থেকেই শুরু হওয়া উচিৎ।”
স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আমরা সকল শহীদদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি যারা তাদের নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য লড়াই করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এই বিশেষ মুহূর্তে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করছি যার উপস্থিতি ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়।”
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তার সরকারের নীতির সম্পর্কে বলেন, “জোট নিরপেক্ষ্যতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মতবাদ হবে।“
সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সমর্থন করবে। তিনি আরও যোগ করেন, বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ ইস্যুতে বিশ্বকে জাগানোর জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার সঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য মিসেস গান্ধীকে ধন্যবাদ জানান।
মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে জনাব ইসলাম বলেন, “ দিন বেশিদূরে নয় যখন বাংলাদেশের পতাকা ঢাকায় উত্তোলন করা হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ হবে।“
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘোষণা করেন যে, ভারত সরকারের আশ্রয়ে থাকা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সমগ্র দায়িত্ব তার সরকার বহন করবে। তিনি শরণার্থীদের দ্রুত নিজেদের বাড়িতে নিরাপদে ফেরার ব্যাপারে আশ্বস্থ করেন। তিনি বলেন, এটা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য প্রতিটি শরণার্থীকে পুনর্বাসিত করা, যারা আর্মি অ্যাটাকের সময় জোর পূর্বক নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল।
.
.
অনুবাদঃ রাশেদ সাইফুল
<৬, ৩০১, ৫১৯>
শিরোনামঃ ভয়ঙ্কর বুদ্ধিজীবী নিধন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১: নং ২৭
তারিখঃ ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভয়াবহ বুদ্ধিজীবী হত্যা
ইন্দো-বাংলা যৌথ বাহিনীর কাছে আসন্ন পরাজয়ের আগে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রধানসহ আরো কিছু অফিসার মিলে বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে। ৬ ডিসেম্বর তারিখে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সর্বভৌম এবং পৃথক আইনী সত্ত্বা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর ঢাকা ক্যান্টমেন্টের জেনারেলের অফিসে হত্যা করার জন্য কম করে ৭ হাজার বুদ্ধিজীবীর তালিকা করা হয়েছিল।
.
৭ থেকে ১৩ ডিসেম্বর, পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনী দ্বারা এই ষড়যন্ত্রটি নিখুঁত ভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে এই ছয় রাতে পুরো প্রদেশে শত শত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। ঢাকায় হত্যাকান্ডের সংবাদ বাংলাদেশের বিশিষ্ট পণ্ডিত ও বুদ্দিজীবিদের হত্যাকান্ডের সত্যতা নিশ্চিত করে।মোহাম্মদপুর এবং অন্যান্য স্থানের আশেপাশে মৃতদেহ গুলো এখন খোলা মাঠে পড়ে আছে এবং পঁচতেছে। এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে তারা যে পরিমাণ হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল সে পরিমাণে হত্যা করতে পারে নাই তবে তারা তাদের সাধ্যমত সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে।মুখোশ দিয়ে মুখ ঢাকা একদল সশস্ত্র লোক দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, সরকারী কর্মকর্তা সহ সব বিশিষ্ট নাগরিকদের হয় তাদের কর্মস্থল থেকে অথবা বাসা থেকে পিকাপে তোলা হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল এবং খোলা মাঠে ও ঢাকার রাস্তায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া যাদের নাম জানা গিয়েছে তারা হলেন অধ্যাকাপক মুনীর চৌধুরী, ডাঃ রাব্বি, ডাঃ আবুল খায়ের, শহিদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসাইন, ডাঃ আলীম চৌধুরী, ডাঃ গিয়াসুদ্দিন আহমেদ।
.
এটা গণহত্যার চাইতে বেশি ছিল। এটা বুদ্ধিজীবী হত্যার চাইতে বেশি ছিল, এটা এমন একটি গণহত্যা ছিল যার উদ্দেশ্য ছিল নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশের সেরা নাগরিকদের হত্যা করা। ইতিহাস এর আগে কখনও একটি জাতির এমন ভয়াবহতা, আপত্তিকর ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেনি।
.
.
অনুবাদঃ মোহাঃ তূর্য রহমান
<৬, ৩০২, ৫২০>
শিরোনামঃ দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ২৬
তারিখঃ ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পন
ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে। ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর কাছে দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আট মাসব্যাপী বাংলাদেশের মানুষের ওপর চলা অত্যাচার ও শোষণের পালা শেষ হল এবং শুরু হল শান্তি ও উন্নয়নের দিন। দেশের স্বাধীনটার জন্য জীবন দেয়া লক্ষ লক্ষ শহীদের নাম ইতিহাসের সোনালি পাতাই রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হল।
ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ৭ মার্চ যে স্থানে বিশাল জনসমাবেশে জাতির জনক দেশকে স্বাধীন করার শপথ নিয়েছিলেন, সেই ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে দখলদার বাহিনীর প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল এ কে খান নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন, যা গৃহীত হয় মিত্র বাহিনীর লেফটেনেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা কর্তৃক।
ঝড়ের মুখে আগুনের মত আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্রই জনগণ বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে আনন্দ প্রকাশ করে। আত্মসমর্পণের স্থান রেসকোর্সে ছড়িয়ে পড়ে বুনো উল্লাস। ‘জয় বাংলা’, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’, ‘মুজিব, ইন্দিরা জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনিতে তীব্রভাবে মুখরিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দান।
স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু আমাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র- ঘোষিত এই তিন মুলনীতির উপর ভিত্তি করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণের সংগ্রাম ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
শোষণ-নিপীড়ন অবসানের জন্য বাংলাদেশের নেতারা এক নতুন সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রত্যয় ব্যাক্ত করেছেন। সেই সাথে তাঁরা জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাভাজন হওয়ার এবং আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার অনুরোধ করেছেন। তাঁরা বলেন, সামরিক শাসকের সহচরদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জন্য অতিশীঘ্র একটি বিচারসভা প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেইসাথে শীঘ্রই জনগণের জন্য নিজেদের সংবিধান প্রণীত হবে।
ঢাকার বেসামরিক প্রশাসন ইতিমধ্যে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। অন্যান্য স্থানের মত ঢাকাতেও জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবনচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট খেত্রের কর্মকর্তা এবং জনগণ দিনভর কাজ করে যাচ্ছে।
.
.
অনুবাদঃ তানুজা বড়ুয়া
<৬, ৩০৩, ৫২১-৫২২>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
[ দি নেশনঃ পাক্ষিক। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের মুখপাত্র। সম্পাদক আবদুস সোবহান। দি ন্যাশন পাবলিকেশন্স মুজিবনগর, বাংলাদেশের পক্ষে আবদুস সোবহান কর্তৃক মূদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৯, ক্রুকড লেন, কলিকাতা-১ ]
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এখন সঙ্কটে। তাদের শুদ্ধবাদীবিকার এবং দূরদৃষ্টির অভাবে, মুক্ত চিন্তা, সঠিক এবং সচেতন মানবতাবোধ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্নতার ফলে তারা হত্যা ও ধ্বংসের পথকেই আঁকড়ে ধরেছে।তাদের এই গণহত্যা এবং তাদের পথে যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাকেই নির্মূল করার নীতি সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের মূল ধারণাটিকেই সরাসরি নাকচ করে দেয়।মানুষের এই অধিকার সর্বসম্মতভাবেই প্রকৃতি প্রদত্ত , এবং একই সাথে জাতিসংঘের বিশ্ব পরিষদ কর্তৃক সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত । এছাড়াও, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার স্রষ্টা প্রদত্ত অধিকার যাকে কোনক্রমেই খর্ব করা যায় না।
কিন্তু বাংলাদেশে পাকিস্তানি জান্তা যে নির্দয় এবং নির্বিচার অপরাধকর্ম সংঘটন করছে তা কেবল বাঙালি জাতির বিরুদ্ধেই নয় , সামগ্রিকভাবে মানবতার বিরুদ্ধেও বিরাট অপরাধ। এটি ধর্মীয় নির্দেশনারও অমার্জনীয় লঙ্ঘন। মানবতার বিরুদ্ধে এই নির্বোধ আগ্রাসন এবং মানবতার অস্তিত্ব রক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পীড়াদায়ক প্রসঙ্গ যা বিশ্ব-বিবেক কে নাড়া দিতে বাধ্য, যে বিশ্ব মানবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং মানবসভ্যতার ধংস ও বিলোপের যে কোন ধারণা কে ঘৃণা করে।
শত্রু একটি ধারালো ছুরির ওপর দিয়ে হাঁটছে, এবং সে অনুধাবন করতে পারছে না যে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা কোন ছেলেখেলা নয়। এবং অন্যদিকে আমরা একটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছি যারা মুমূর্ষু বাঙালিদের করুণ দুরবস্থায় নির্লজ্জ পরিহাসের হাসি হেসে যাচ্ছে ।
এই সর্বনাশা পরিবর্তন নতুন ভোরের দিগন্তকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করেছে।নতুন দিনের রক্তিম আভাকে নৈরাশ্যের অপশক্তি গ্রাস করতে চাইছে । রক্তাক্ত একটি জাতি অনন্যোপায় হয়ে বিশ্বের অন্যান্য জাতির কাছে স্বীকৃতি চাইছে।মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার একটি স্বতঃসিদ্ধ এবং তা স্বীকৃতি অর্জনের দাবিকে যোগ্য প্রমাণ করে।প্রত্যক্ষ উপস্থিতি যদি একটি অঞ্চলের স্বীকৃতির পূর্বশর্ত হয়, তবে বাংলাদেশ সরকার সেই পূরণ করেছে। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, যারা বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন তাঁরা এর সাক্ষী। বাংলাদেশ সরকারের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে এবং দেশের জনগণ এবং ভূখণ্ডের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্লজ্জ মিথ্যাচার এরই মধ্যে মিথ্যাবাদী পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা সহকারে প্রত্যাঘাত হিসেবে ফিরে এসেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হলো পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম এই জাতিগোষ্ঠীর স্বশাসনের ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষা, যা অন্য কোথাও থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে না।একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকদের থেকে বিচ্ছিন্নতাই এই জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদনবিহীন শাসন এবং ক্রমাগত শোষণের ফলে এই ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিদায় জানানো এখন অনিবার্য, যাদের উপস্থিতি ইতিহাসের এক দুর্ঘটনা মাত্র। তাই আমরা বিদ্রোহ করেছি।সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অক্টপাসকে বাঙালি এমন প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছে, যে সেই হিংস্র প্রানী তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী , জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান যেমন স্পষ্টভাবে বলেছেন, “সে অনুযায়ী স্বীকৃতির বিষয়টি এখন আমাদের প্রকৃত বন্ধুদের জন্য একটি এসিড টেস্ট”। আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান মানেই অনিবার্যকে স্বীকার করে নেওয়া। বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি বাস্তবতা, টিকে থাকার জন্যই আত্মপ্রকাশ করেছে । যারা একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে বিশ্বাস করেন , যে জাতির একটি নিজস্ব ভূখণ্ড, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে, তাদের বাঙ্গালি জাতির প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের এই বাস্তব সত্য কে স্বীকার করে নেওয়ায় ব্যতীত আর কোন বিকল্প নেই। ঔপনিবেশিক শাসনের বিলুপ্তিতে বিশ্বাসী এবং একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংহতি পোষণকারী কোন জাতির পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের এই আহবান উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আমরা আশাবাদী যে,এই সরকার কে স্বীকৃতি প্রদানে আমাদের মিত্রদের অনুপ্রাণিত করতে মানবতার জন্য ভালোবাসা এবং মানবিক মর্যাদার প্রতি সম্মান সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে, যে সরকার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির পক্ষে মুজিবনগর থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
.
.
অনুবাদকঃ জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা
<৬, ৩০৪, ৫২৩-৫২৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
এ যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? | দ্যা ন্যাশন, ভলিউমঃ ১, নম্বর ১ | ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
এ যুদ্ধ আর কতদিন চলবে?
দ্যা ন্যাশনের বিশেষ প্রতিবেদন
পৃথিবীর প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে এখন একটিই প্রশ্ন, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এ কাণ্ডজ্ঞানহীন যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? এ উদ্বেগের কারণ ইয়াহিয়ার এই দক্ষ ও সুপ্রশিক্ষিত দলটি ইতিমধ্যে দেশটির শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা যথেষ্ট পরিমানে বিপন্ন করেছে।
যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী নির্মম গনহত্যা বিষয়ে একটি স্ন্যাপ বিশ্লেষণ বলছে যে, নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে নৃশংস গণহত্যা শুরু করেছিল সেটি প্রতিহত করতে বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট সাহসের প্রমাণ দিয়েছে। বিশ্লেষণটি আরও বলছে, শেষ চার মাসে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধারা এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে যেন তারা এ দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করেই ছাড়বেই।
তবে অন্যভাবে বলতে গেলে এই যুদ্ধটা যেন অনেকটা আশীর্বাদও বটে, যেটা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেককে এক সাহসী যোদ্ধায় পরিণত করেছিলো। বাংলার মাটির প্রতিটি মানুষ হয় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে না হয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। তরুন এবং ছাত্ররা গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এবং প্রশিক্ষিত এই তরুনেরা যারা যুদ্ধে নেমেছে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘায়েল করে ছেড়েছে।
ঢাকা শহর যেটি ইয়াহিয়ার দলবলের নিয়ন্ত্রণে ছিল একসময়, সেটি এখন হয়েছে গেরিলাদের শহর এবং এই গেরিলারা সামরিক জান্তাদের কাছ থেকে রাতের ঢাকার দখল কেড়ে নিজেদের অধীনে নিয়েছে।
সম্মুখ যুদ্ধের ছবিগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। ইতিমধ্যে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা এবং সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের একটা বড় অংশ মুক্তি বাহিনীরা দখলে নিয়েছে। বাংলাদেশের শহরগুলোতে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করা শুরু হয়ে গিয়েছে এবং শহুরে জনগোষ্ঠীর মনোভব এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের হুমকি যাই থাকুক পশ্চিম পাকিস্তানকে তারা দমন করে ছাড়বেই।
যে পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালানো ছাড়া কিছুই বুঝত না। তারাই এখন অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছে। দেশের মানুষ ক্রমশ এদের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন এবং স্বাধীনতা পাগল হয়ে উঠছে। দুই দেশের বিভক্তি টেনে এই যে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা, এটা সত্যিই ছিল একটা বুমেরাং এর মত। স্বাধীনতা পাগল এই মানুষগুলো এত বিপুল সংখ্যক রাজাকার নিধন করেছে যে প্রকাশ্যে রাজকার তখন খুব কম দেখা যেতো। রাজাকার নিধনের এই বিরুপ পরিস্থিতির কারনে যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পাকবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অবাঙালী সৈন্যদেরকে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ।
.
কিন্তু প্রচলিত প্রবাদই বলে দেয় যে পাপী কখনও শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে না এবং যেই পাপী পাকিস্তানিদের ইচ্ছে পুরনে পাশে দাঁড়িয়েছে। অবাঙালি যাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছিল পাকিস্তান বাহিনী তাদেরকে রাজাকার হিসেবে দলে অভিষিক্ত করে। এবং সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরে পাঠায় যাতে সাধারণ লোকেরা ভয় পেয়ে সামরিক জান্তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। কিন্তু ব্যাপারটা উল্টো এমন হিতে বিপরীত হলো, যা পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাসীনদেরকে ভীষণ মর্মাহত করল। অভিষিক্ত রাজাকারদের সাথে সহযোগিতার পরিবর্তে বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বরং রাজাকার নিধন করতে লাগলো। এমনকি গেরিলা প্রশিক্ষণ ছাড়াই সাধারণ জনগণ নিজেদেরকে সফল গেরিলা হিসেবে প্রমাণ করেছিল এবং প্রকাশ্য দিবালোকে তারা রাজাকার নিধন চালিয়ে যেতে লাগলো।
ইয়হিয়ার দখলদারবাহিনীর জন্য সম্মুখ যুদ্ধ একেবারেই কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না এবং এমনকি সে তাদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলোতে থেকেও। মুক্তিবাহিনীর ২৫ মার্চ রাতের হার্ড কোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ছাড়াও অনেক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তরুনকে বিভিন্ন মুক্তি ক্যাম্পে প্রশিক্ষন দিয়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ব্যাচের পর ব্যাচ প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল এবং প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছিলো। এবং সেইসব তরুন প্রশিক্ষিত যুবাদের মুখেই যেন তাদের সংকল্পের ছবি ভয়ানক ভাবে আঁকা ছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিটি অপারেশনে তারা মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার এক প্রেরনা নিয়েছিল। আর এভাবেই তারা একটার পর একটা ব্যাটালিয়ান দল গড়ে তুলছিল। দুই ব্যাটালিয়ান এবং এক কোম্পানি সৈন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর এক আর্টিলারি ব্যাটালিয়ান এর সাথে যারা বের হয়েছিল যাদের ৪০০ জন পরবর্তীতে হতাহত হয়েছিলো।
পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ। ইতিমধ্যে মুক্তি বাহিনীর সাথে চার মাসের যুদ্ধে তাদের ৪২,০০০ লোক হতাহত হয়েছে। একজন নিয়মিত এবং আধুনিক সৈন্যকে শক্তি সুবিধাহীন এমন পরাজিতের ভাগ্য বরণ করতে হবে, তা ছিল চিন্তারও বাইরে। এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি দুর্লভ অর্জন এবং এই যুদ্ধের স্মরণীয় স্মৃতি। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দুর্দশার শিকার হয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল এবং তারা প্রচণ্ড একটি টলায়মান অবস্থার মধ্যে ছিল। ইয়াহিয়ার লোকদের জন্য এ যুদ্ধ ছিল নিশ্চিত পরাজয় এবং প্রচণ্ড অপমানজনক।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঞ্জাবীরা পাঠান ও বেলুচিদের বিশ্বাস করত না এবং আবার ওরাও পাঞ্জাবীদের করত না। এক প্লাটুন বেলুচি সৈন্য তাদের সাথে পাঞ্জাবী কমান্ডারদের মতবিরোধ থাকায় ভারত অতিক্রম করে আত্মসমর্পণ করেছিলো। এই পাঞ্জাবী কমান্ডাররা চেয়েছিল বেলুচি অফিসাররা যেন সাধারণ বাঙালীদের হত্যা করে কিন্তু তারা তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এবং এটা হয়েছিল এক পাঞ্জাবী জওয়ান এক বেলুচি সৈন্যকে হত্যা করার জন্য।
বেলুচিদেরকে তখন খুবই সন্দেহের চোখে দেখা হতো। এমনকি বেলুচি গান্ধী, খান আব্দুস সামাদ আছাকজাইকে জেলে ঢোকানো হয়। মিলিটারি বাহিনী থেকে মোবাইল সামরিক কোর্ট গঠন করা হয় যাতে লোকেরা তাদের ভিন্নমতগুলো জানাতে পারে। যারা এই সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করেনি তাদেরকে নিদারুণ নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। উচ্চ পর্যায়ের সিন্ধি নেতা জি এম সৈয়দ সাহবকে জেলে পোরা হয় শুধু বাংলাদেশ যুদ্ধের নিন্দা করার জন্য। এবং ঠিক এই কারনে প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় জনপ্রিয় সীমান্ত প্রদেশ নেতা খান ওয়ালি খান দেশ ত্যাগ করেন।
অনুবাদকঃ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ( অতিথি অনুবাদক)
যেটা দাঁড়ালো, পাকিস্তানী আর্মি পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তাদের জওয়ান এবং অফিসাররা টাকা এবং মূল্যবান দ্রব্যাদি লুটপাট এবং দখলে লিপ্ত। তার উপর, যুদ্ধ করার চেয়ে, তাদের বেশী মনোযোগ বিভিন্ন সেনানিবাস এবং ক্যাম্পে বন্দী মেয়েদের অত্যাচার করা। ভগ্ন মনোবল এবং হীন চরিত্রের একটি সেনাবাহিনী যুদ্ধ করতে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যাদের একমাত্র লক্ষ্য স্বীয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করা। বাংলাদেশ সরকার তাঁদের বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী সংগঠিত করার পর পর ই পুরোদমে আক্রমণ শুরু হবে। এখন এটাই দেখার বিষয়, ভগ্ন মনোবল এবং হীন চরিত্রের পাকিস্তানী বাহিনী এ মাটিতে টিকে থাকতে পারে কি না। যখন বাংলাদেশের মাটি, বাতাস এবং পানি এই লুটেরা বাহিনীকে সহ্য করবেনা, যখন মুক্তি বাহিনী ভারি অস্ত্র এবং এয়ার কাভার পাবে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানী দস্যুদের বাংলাদেশ থেকে ছুঁড়ে ফেলে না দেওয়ার কোন কারণ খুজে পাই না। আজকে, প্রত্যেক বাংলাদেশী একেকজন বিশ্বস্ত সৈনিক, নিজ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে বদ্ধপরিকর। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতার জন্য যে অপরাজেয় আকাঙ্ক্ষা, তাঁদের এই সঠিক এবং মহান আন্দোলন অবশ্যই যুদ্ধের ফলাফল তাঁদের দিকে নিয়ে যাবে। শহিদের রক্তমাখা স্বাধীনতার পতাকা থাকবে চির উন্নত। বাঙ্গালী স্বাধীন হবেই।
.
.
অনুবাদঃ সৈকত জয়ধর
<৬, ৩০৫, ৫২৬-৫২৭>
শিরোনামঃ স্পষ্ট ভাষণ
সংবাদপত্রঃ দি নেশন
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
সোজাসুজি কথা
বাংলাদেশ আজ রক্তাক্ত। দেশের মানুষ আজ নির্যাতন ও মর্মবেদনায় উচ্চস্বরে ক্রন্দনরত। যে রক্তগঙ্গা বিশ্ব দেখেছে বাংলার মাটিতে, তা বর্বরতা ও পাশবিকতার বিচারে নজিরবিহীন। ক্ষমাহীন ভাবে যে মুনূষ্যরক্ত ঝরিয়েছে পাকবাহিনী, সেই রক্তে আজ এই হতভাগ্য অঞ্চলের শহর ওও নগরের মাটি সিক্ত। তাদের কাছে এই যুদ্ধ ক্ষয়ের। বাঙালীদের কাছে এ হল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এটা এমন এক যুদ্ধ, যা আমরা কখনও চাই নি। এটা এমন এক যুদ্ধ, যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষমতালোভী সামরিক জান্তার দ্বারা। তারা চায় আমাদের কন্ঠ চেপে ধরতে, চায় পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে মেরে ফেলতে। স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার, স্বাধীনতা আমাদের জীবনরেখা, যে স্বাধীনতা ছাড়া আমরা বয়ে বেড়াই আমাদের অসুস্থ অস্তিত্ব। স্বাধীনতাহীন অস্বিত্ব আত্মাহীন দেহের মত, প্রাণহীন হাত-পায়ের মত। যা কার্যত মৃত্যুর সমান।
পৃথিবীতে বসবাসরত অষ্টম বৃহত্তম জাতি হিসেবে বাঙ্গালীরা কখনই স্বকীয়তা হারাতে চাইবে না। কোন দেশই আত্মহননের পথে রাজী হবে না। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও পূর্ব পাকিস্তানী শাসিতের মধ্যে একটি স্বার্থের সংঘাত আছে। পাশবিক শক্তির দ্বারা স্ফীত সেনাবাহিনীর মারমুখী মনোভাব বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে বাধ্য করেছে অহিংসার শক্তিতে জেগে উঠতে। বাঙালীদের সদিচ্ছার প্রাচুর্যের প্রতিদান কখনোই তারা পায় নি। আমাদের বিনয়কে সবসময় ধরা হয়েছে আমাদের দুর্বলতা হিসেবে। শান্তির শক্তি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে নৃশংসতার নির্মম প্রদর্শনীর দ্বারা। নৃশংসতার ভয়াবহতা দখল করে নিয়েছে শান্তিপ্রিয় বাংলার মাটি। সামরিক জান্তার অসহনীয় ও আক্রমণাত্মক মনোভাব শান্তিপ্রিয় বাংলাকে পরিণত করেছে এক যুদ্ধক্ষেত্রে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আধুনিক সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে নিরস্ত্র জনগণের উপর। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। মানুষের বসতবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। অগণিত মানুষ প্রাণের ভয়ে বাড়িছাড়া হয়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। মানবহত্যার পাশবিকতা হিটলারের “গেস্তাপো-প্রক্রিয়া” এবং “স্কেয়ার-ক্রো” পদ্ধতিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাংলার জল, স্থল ও আকাশ অমানবিক নৃশংসতার এবং অমানুষিক যন্ত্রণার নিপীড়নের আর্তনাদে প্রকম্পিত হচ্ছে। রক্তপিপাসু জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষায় পাশবিকতাই মানুষের একমাত্র সম্পদ। যৌক্তিকতা পাশবিকতার কাছে পরাজিত হয়েছে। তা না হলে কিভাবে নারী, পুরুষ ও শিশুকে এমন নির্দয়ভাবে হত্যা করা সম্ভব এমন জমির উপরে দাঁড়িয়ে, যাকে কিনা তারা আজ পর্যন্ত দাবী করে তাদের দেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।
শত্রুপক্ষ ভুল করেছিল এই ভেবে যেয়াধুনিক সেনাবাহিণির দ্বারা তারা নিমিষেই “বাঁশের লাঠি-সজ্জিত বাহিনী”কে ধ্বংস করে দেবে। আমরা বাঙালীরা কখনোই যুদ্ধ চাই নি। আমরা কখনও প্রস্তুতও ছিলাম না যুদ্ধের জন্য। কিন্তু যখন সেই যুদ্ধই আরোপিত হল আমাদের উপর, তখন তা হয়ে দাড়ালো আমাদের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন। স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আমাদের অস্তিত্ব, অথবা অমর্যাদাকর পরাধীনতার দাসত্ব মেনে নেয়া- এই দু’য়ের মধ্যে প্রশ্ন হয়ে দাড়ালো এ যুদ্ধ। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জাতি কি মেনে নেবে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও বশ্যতা? না, কখনোই না। প্রথমটিকেই তাই বেছে নিতে হল আমাদের। আজ আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার অগ্নিশিখায় আজ আমাদের হৃদয় জ্বলছে। বর্বরতার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে গত দুই মাসে আমাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ স্বীকার করে নিতে হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি। ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। স্বাধীনতার পতাকাকে আমাদের সমুন্নত রাখতে হবে। স্বাধীনতার চেতনা আমাদের মধ্যে সদাজাগ্রত থাকবে। শহীদের রক্তে সিক্ত স্বাধীন এ সমতল কখনও হারিয়ে যাবে না।
আমরা সাহসিকতা, সংকল্প ও সংযমের সাথে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সম্মুখশক্তি মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের কাল্পনিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের পর্যাপ্ত জনশক্তি আছে। আমাদের এখন যা দরকার, তা হল সমরাস্ত্র। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত নারকীয় শত্রুবাহিনীকে দমন করা আজ অবশ্য করণীয়। শুধুমাত্র তখনই পাকিস্তানি লুটেরারা বুঝতে পারবে তারা কাদের সাথে যুদ্ধে নেমেছে। শুধুমাত্র তখনই শত্রুপক্ষ বাধ্য হবে যুদ্ধে অব্যাহতি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পাহাড়ি ভুমি ও সীমাহীন মরুভূমিতে পালিয়ে যেতে। নদীবিধৌত বাংলাদেশই হবে ইয়াহিয়া খানের জন্য ওয়াটারলু।
বাংলাদেশের লাখ লাখ ক্ষুধার্তের জন্য আমরা খাদ্য চাই। শস্যভাণ্ডার আর গুদামঘরগুলো ইতিমধ্যেই ইয়াহিয়া বাহিনী পুড়িয়ে ফেলেছে অথবা লুট করে নিয়ে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর অধীনস্থ অঞ্চলগুলোতে ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। উপরন্তু আশি লক্ষ বাঙালী ভারতের পাঁচটি প্রদেশ জুড়ে সীমাহীন অভাবের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তাদের এখন জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য ও অষুধ দরকার। এই মানুষগুলোর জীবন বাঁচাতে হবে। যুদ্ধাক্রান্ত এই হতভাগ্যদের প্রতি পুরো দুনিয়ার দায়িত্ব রয়েছে। বিশ্বমানবতার কাছে আমরা এসকল আর্তমানবতার ত্রানের জন্য আকুল আবেদন জানাই।
এছাড়াও আমরা বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি চাই, যে সরকার দেশ শাসনের অধিকার বহন করে। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত কার্যত শেখ মুজিবই সরকারকে নিয়ন্ত্রন করেছেন। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হল। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের দখলদার বাহিনীর দ্বারা কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রন করলেও বাংলাদেশের কোন শহর বা নগরের উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। এমনকি প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা।
যদি অঞ্চলের উপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রনের দ্বারা স্বীকৃতি নির্ধারিত হয়, তবে পশ্চিম পাকিস্তান অনেক আগেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার হারিয়েছে। একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে শেখ মুজিব সরকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁর জনগণ শুধুমাত্র তাঁর প্রতিই
.
আনুগত্য স্বীকার করে। এ ধ্রুবসত্যকে হানাদার বাহিনীর মেনে নেয়া উচিত। এটা এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার। গত নির্বাচন এই উজ্জ্বল সত্যকেই আরো শক্ত ভিত্তি প্রদান করে। স্বাধীনতাপ্রিয় বিশ্বজনতা এতদিনে বাংলাদেশে বিরাজমান বাস্তবতাকে বুঝতে পেরেছে। বহমান বায়ুর গতিপথ সবাই বুঝতে পারছে। হানাদার বাহিনীর নির্মমতাকে উপেক্ষা করে টিকে থাকা নতুন এ জাতিটি তাদের যোগ্যতার বলেই স্বীকৃত হবার দাবি রাখে। এটি একটি ন্যায়সঙ্গত দাবি। এর শিকড় বাংলার মাটির গভীরে বিরাজমান। তাই বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ অনিবার্যকেই মেনে নেয়া।
.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ৩০৬, ৫২৮>
শিরোনামঃ – আপাতঃ দৃষ্টিতে
সংবাদপত্রঃ – দি নেশন ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
সূচনা লগ্ন
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এখন বিশ্ব প্রতিক্রিয়া যতটাই জোরালো হয়ে উঠছে, বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও ততটাই কার্যকর ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠছে। এতদিন ধরে যেসব জাতি বাংলাদেশ বিষয়ে নিশ্চুপ কিংবা গোপনে সমর্থন দিয়েছে তারাও বাস্তবতাকে গ্রহণযোগ্য করার সংগঠিত পদক্ষেপ নিয়েছে।
দিল্লীতে সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে, বিশ্বের সচেতন জাতি সমূহ বাংলাদেশের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ও সহানুভূতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। ২৫ টি দেশের প্রতিনিধিরা সমান আবেগ ও উদ্দীপনায় এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে তারা বাংলাদেশের মাটিতে ঘটা গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিন্দা জানিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেন।
কাবুল থেকে পিন্ডি পর্যন্ত শান্তি শোভাযাত্রায় মানবতা ও আন্তরিকতার ইঙ্গিত প্রকাশ পায়। এই ঘটনা একটি ইতিহাস সৃষ্টি করে যা অনুকরণ যোগ্য। ভবিষ্যতে মানব সভ্যতা বজায় রাখতে এই সরব অনুভুতির প্রকাশ অবশ্যই সাহায্য করবে। শুধুমাত্র মানবিক মূল্যবোধের উপর দৃঢ় বিশ্বাস থাকলেই এমন অসাধারণ উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। এর মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে মানবতার করুন অবস্থায় সচেতন বিশ্ব বিবেক কখনই নিশ্চুপ থাকতে পারে না।
প্রস্তাবিত শান্তি শোভাযাত্রার কারণে, ইয়াহিয়ার অকার্যকর দাম্ভিকতা ও নির্বোধ আচরণ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতার হস্তক্ষেপ জনগণের রায়কে কখনই মুছে ফেলতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ব জনগণের পক্ষে আছে, সব শক্তি ও চাতুর্যপূর্ণ কৌশল তাসের ঘরের মতই ধ্বসে পরবে।
ইতিমধ্যে ইয়াহিয়াকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, সমগ্র বাঙালী জাতীর বিরুদ্ধে করা এই জঘন্য অপরাধের পর আপোষের কোন সুযোগ নাই। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধান।
একতা বজায় রাখার জন্য গণহত্যা প্রকৃত হাতিয়ার হতে পারে না, যদি না তা সর্বসম্মতভাবে আসে। গণহত্যা অবলম্বন কোন সহনীয় উপায় নয়। প্রস্তাবিত শান্তি শোভাযাত্রা অবশ্যই তাকে এই শিক্ষা দিবে। তার কাছে যাই থেকে থাকুক না কেন, শান্তি অভিযানের বিরুদ্ধে সেই একই পন্থা অবলম্বন তার সাহসে কুলাবে না। আর এর মর্মার্থই তার হার নিশ্চিত করছে, অথবা বলা যায়, বাংলাদেশের বিজয়ের সংকেত বহন করছে।
.
.
অনুবাদঃ সাইমা তাবাসসুম
<৬, ৩০৭, ৫২৯-৫৩০>
শিরনামঃ স্বাধীনতার জন্য নারীরা
সংবাদপত্রঃ দা ন্যাশন ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
নারীরা পর্দা ছেড়ে বন্দুক তুলে নিয়েছে
মিনা রহমান
.
বাংলাদেশের লাজুক এবং মৃদুভাষী নারীরাও তাদের মাতৃভূমির ডাকে প্রখরভাবে সাড়া দিয়েছে। জাতির এই সংকটময় অবস্থায় তারা হাল ধরেছেন তারা।অনাদিকাল থেকেই, পুরুষদের সাহায্য করার জন্য নারীরা এগিয়ে এসেছেন এবং এই বর্তমান সময়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নারীরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
বাঙালি নারীদের যারাই জানতে এসেছেন তারাই চমকে উঠেছেন তাদের এই আকস্মিক পরিবর্তন ও জাগরণ দেখে। তারা তাদের পর্দা আর ঘরের কাজকর্মকে পাশে রেখে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে। নারীরা তাদের ছেলে, ভাই, স্বামীদের খুশি মনে দেশের স্বার্থের জন্য উৎসর্গ করেছে এবং তারা সেটা গর্বের সহিত করেছে।
ক্র্যাকডাউনের পরে, তাদের স্বপ্নগুলো চুরমার হয়ে গিয়েছিল তবুও তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তাদের দায়িত্ব পালন করছে। যুবকদের সাথে বৃহৎ সংখ্যায় অল্পবয়সী মেয়েরাও নাম লিখেছিল এবং এখনও প্রতিদিন তারা গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দিচ্ছিল। এমনকি মেয়েরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে। তাদের জন্য আর কোন কিছুই কঠিন আর অসম্ভব ছিল না।
আজ বাংলাদেশের সাহসী মা জাতি পাকিস্তান আর্মির উপর প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা তাদের ছেলের-ভাইয়ের নির্মম মৃত্যুর এবং তাদের মেয়ে ও কন্যাদের উপর নৃশংসতার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তাদের মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি মুক্ত হওয়ায় আগ পর্যন্ত তারা যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
বাংলাদেশের নারীরা, বৃদ্ধ কিংবা যুবতী, কেউই শুধু মাত্র শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল না, বরং তারা যুদ্ধ করছিল রোগ ও জরা , ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মতো আরও বিভিন্ন অভাবের সাথে। যারা বাংলাদেশের দখল সীমানায় ছিলেন তারাও তাদের শ্রেষ্ঠত দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। দিনের প্রতি মিনিট তারা মৃত্যু আর অপহরণের ভয় নিয়ে বেঁচে ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতি প্রধানত ঢাকা চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যমান ছিল।
.
লক্ষ লক্ষ মহিলা ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিল, কেউ তার পরিবাবের সাথে যেতে পেরেছে আর কেউ কেউ ভয়ে একাই চলে গেছে। একবার তারা সকলে হতবাক অসাড় অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসছিল, পরক্ষনেই তারা নিজেরাই তাদের প্রতিরূপের মত বিভিন্ন কাজের মধ্যে নিমজ্জিত করছিল। নারীদের মেডিকেল কোর , নার্সিং ও ফার্স্ট এইড ট্রেনিং সেন্টার যুব শিবিররা বিনামূল্যে সর্বত্র ব্যবস্থা করেছিল। বিশেষজ্ঞ নির্দেশিকা অনুযায়ী , অনুগত মেয়ে ও নারীরা চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করছিল।
.
নার্সিং ও ফার্স্ট এইড ট্রেনিং শেষ করার পর, তারা যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গেছে অসুস্থ আর আহতদের সাহায্য করার জন্য। স্বীকার করতেই হবে, সবচাইতে কঠিন কাজ মহিলা ডাক্তার আর নার্সদের করতে হয়েছে। শরণার্থীদের অধিকাংশই যখন ভারতের মাটিতে পৌছায়, তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল যে চিকিৎসার জন্য সাড়া দেয়ার অবস্থাও তাদের ছিল না। ক্ষুধা আর অসুস্থতা তাদের দুর্বল করে ফেলেছিল, সবথেকে দুর্ভাগ্যের ব্যপার ছিল কখনো কখনো চিকিৎসা ত্রাণ তাদের নিকট পৌঁছানোর আগেই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেছিল। আর বেঁচে যাওয়া অনেকেই বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিল। ডাক্তার এবং নার্সদের অসুস্থ আর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষদের বাঁচিয়ে তোলার কঠিন কাজটি করতে হচ্ছিল।
.
বাংলাদেশ তাদের নারীদের এবং তাদের কাজের জন্য গর্বিত বোধ করবে। তারা পুরুষদের মতোই সাহসী এবং বদ্ধপরিকর এবং তারা বদ্ধপরিকর ছিল দখলদার সৈনিকদের পতন করবেই আর স্বাধিনতা ছিনিয়ে আনবে। রওশন আরা এবং বাংলাদেশের আর অনেক রওশন আরাদের নাম জোয়ান অব আর্ক, চাঁদ সুলতানা এবং অনেকের পাশে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
.
.
অনুবাদঃ তামীম
<৬, ৩০৮, ৫৩১>
শিরোনামঃ মুজিবের বিচারঃ বাংলাদেশের আইনজীবীদের নিন্দা
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ২৪ সেটেম্বর, ১৯৭১
.
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের আইনজীবীরা একটি সংগঠন তৈরি করেন মুজিবনগরে। প্রবীণ বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ কফিলউদ্দিন চৌধুরী সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক নির্বাচিত হন। আইন ও সংসদব বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট পদে।
এই সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা হলেনঃ কাজি আবদুল খালেক (সেক্রেটারি), শাহ মোয়াজ্জেম হোসাইন, এমপিএ, আবু বকর সিদ্দিকি এবং শাহ জামাল বিশ্বাস ( ভাইস প্রেসিডেন্ট), চিত্তরঞ্জন গুহ এবং কাজি আব্দুস সালাম ( জয়েন্ট সেক্রেটারি), আবদুল হক (কোষাধ্যক্ষ) এবং সমরেশ চন্দ্র ঘোষ ( অফিস সেক্রেটারি)
সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হলোঃ
১। এই সভা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনৈতিক সাজার জন্য পাক মিলিটারি জান্তা কে অভিযুক্ত করে এবং সমগ্র বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ও আইনজীবীদের অনুরোধ করে তাঁদের দেশের সরকার যেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
২। এই সভা জাতিসংঘের সদস্য দেশ গুলোকে আহবান জানায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার।
৩। এই সভা শান্তিকামী বিশ্ববাসীকে অনুরোধ করে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা ও ভুট্টোকে অমানবিক গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দমন ও ধর্ষণ এর দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাড়া করাতে।
৪। এই সভা সমগ্র বিশ্বের সকল নির্যাতিত ও নিপীড়িত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পূর্ণ সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়।
৫। এই সভা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে সরাসরি পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার জন্য, যারা সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনে এবং গণহত্যায় নিয়জিত। এই সভা যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবীদের আহবান জানায় তাঁদের সরকারের অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সহায়তায় তৎক্ষণাৎ বন্ধ করতে।
৬। জনপ্রিয় বাঙ্গালি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর করুন মৃত্যুতে এই সভা তিন মিনিট নীরবতা পালন করে।
.
.
অনুবাদঃ দ্বীপ অধিকারী এবং সাইমা তাবাসসুম
<৬,৩০৯,৫৩২-৫৩৩>
শিরোনামঃ পাকিস্তানের উপর কূটনৈতিক আক্রমণের পুরোধাগণ
সংবাদপত্রঃ দা নেশন ভলিউম-১: সংখ্যা-১
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
নয়াদিল্লী কূটনীতিক
মি. কে. এম. শাহাবুদ্দিন
দ্বিতীয় সচিব
মি. আমজাদুল হক
সহকারি সংবাদ সহদূত
অকূটনীতিক কর্মচারী
মি. আব্দুল মাজিদ
মি. শামসুদ্দিন
মি. নুরুল হুদা
কোলকাতার কূটনীতিক
মি. এম. হোসাইন আলী
ডেপুটি হাইকমিশনার(প্র-মহাধ্যক্ষ প্রতিনিধি)
মি. আর. আই. চৌধুরী
প্রধাণ সচিব
মি. আনোয়ারুল কবির চৌধুরী
তৃতীয় সচিব( রাজনৈতিক)
মি. কাজী নজরুল ইসলাম
তৃতীয় সচিব(প্রশাসন)
মি. এম. মাকসুদ আলী
সহকারী সংবাদ সহদূত
অকূটনীতিক কর্মকর্তা এবং স্টাফ
মি. সাইদুর রহমান
মি. এম. এ. হাকিম
মি. আমীর আলী চৌধুরী
মি. আনোয়ার হোসেন
মি. মো. সাইদুজ্জামান মিয়া
মি. জয়নাল আবেদীন চৌধুরী
মি. মুস্তাফিজুর রহমান
মি. আলীমুজ্জামান
মি. এ. জেড. এম. এ. কাদির
মি. মতিউর রহমান
মি. কাজী সিকান্দার আলী
মি. মো. গোলামুর রহমান
মি. শামসুল আলী
মি. মো. সিদ্দিকুল্লাহ
মি. এ. তে. এম. আবু শাফিন
মি. আব্দুর রব
মি. মো. ফকরুল ইসলাম
মি. মো. আমিমুল্লাহ
মি. মো. আব্দুল বাশার
মি. এ. বি. এম. খুরশেদ আলম
মি. আবদুল মান্নান ভুঁইয়া
মি. আবদুর রহমান ভুঁইয়া
মি. আব্দুর রহিম
মি. মো. নুরুল আমিন
মি. মো. নুর আহমেদ
মি. মো. আলাউদ্দিন
মি. সমিরুদ্দিন
মি. মো. সোলাইমান
মি. শামসুদ্দিন হোসেন
মি. জহুর হোসেন
মি. মীর মোজাম্মেল হক
মি. মো. জাকারিয়া
মি. মো. ওয়াহিদুর রহমান
মি. আবদুন-নুর
মি. এ. কে. এম. আব্দুর রব
মি. এ. কে. এম. কামরুর রশিদ
মি. আনোয়ারুজ্জামান
মি. আব্বাস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী
মি. ওয়াহিদুর রহমান
মি. শরিফুল আলম
.
অন্তর্বর্তী চতুর্থ শ্রেণী
মিঃ আব্দুল কাদের
মিঃ আব্দুল মতিন প্রধান
মিঃ আব্দুল আমিন
মিঃ মোহাম্মদ হোসেন
মিঃ মতিউর রহমান
মিঃ আব্দুল গাফফার মিরধা
মিঃ আমান হোসেন
মিঃ হাতিম আলি
মিঃ বজরুল রহমান
মিঃ মোহাম্মদ হেদায়েতউল্লাহ্
মিঃ নুরুল হক
মিঃ সামসুল আনোয়ার
অন্তর্বর্তী চতুর্থ শ্রেণী
স্থানীয় নিয়োগ
মিঃ মোহাম্মদ ইশাক
মিঃ মমতাজ মিয়াহ
মিঃ মোজাম্মেল হক
মিঃ আব্দুস সোবহান
মিঃ শানু মিয়াঁ
মিঃ মোহাম্মদ ইলিয়াস
মিঃ আব্দুল হাশেম
নিউইয়র্ক কূটনীতিক
মিঃ এ. এইচ. মোহাম্মদ আলি
ভাইস কনসাল
মিঃ এস.এ. করিম
ডেপুটি পার্মানেন্ট রিপ্রেজেন্টটেটিভ
ওয়াশিংটন কূটনীতিক
মিঃ এনায়েত করিম
মিনিস্টার
মিঃ এস এ এম এস কিবরিয়া
পলিটিক্যাল কাউন্সিলার
মিঃ এ এম এ মুহিত
ইকোনমিক কাউন্সিলার
মিঃ এ আর মাতিনউদ্দিন
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কাউন্সিলার
মিঃ সায়েদ মুজ্জাম আলি
থার্ড সেক্রেটারি
মিঃ এ আর চৌধুরী
ফিন্যন্স এনং একাউন্ট অফিসার
শেখ রুস্তাম আলি
সহকারি তথ্য অফিসার
নন- ডিপ্লোম্যাটিক স্টাফ
মিঃ হাবিবুর রহমান
মিঃ সুলায়মান
মিঃ এম হক
মিঃ নুরুল ইসলাম
মিঃ মুস্তাক আহমেদ
লন্ডন কূটনীতিক
মিঃ মহিউদ্দিন আহমেদ
সেকেন্ড সেক্রেটারি
মিঃ মোহাম্মদ আকবর লুতফুল মতিন
ডিরেক্টার অফ অডিট এন্ড একাউন্টস
মিঃ আব্দুর রৌফ, ডেপুটি ডিরেক্টার
ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশনস
মিঃ ফজলুল হক চৌধুরি
শ্রমিক সহদূত
প্যরিস নন ডিপ্লোম্যাটিক স্টাফ
মিঃ মোশারফ হোসেন
মিঃ শওকত আলি
বারনে নন- ডিপ্লোম্যাটিক স্টাফ
মিঃ গোলাম মোস্তফা
হং কং কূটনীতিক
মিঃ মহিউদ্দিন আহমেদ
ভারপ্রাপ্ত ট্রেড কমিশনার
বাগদাদ কূটনীতিক
এইচ ই মিঃ এ এফ এম আবুল ফাতেহ
রাষ্ট্রদূত
মানিলা কূটনীতিক
কে কে পান্নি
রাষ্ট্রদূত
.
.
অনুবাদঃ জয়ন্ত সেন আবীর
<৬, ৩১০, ৫৩৪-৫৩৫>
শিরোনামঃ বিশ্ব জনমত
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বিশ্ব সংবাদ
.
বাংলাদেশ সমস্যা সম্বন্ধে জাতিসংঘের পলায়নপর মনোভাবের ছাপ দেখা যায় সাধারণ অধিবেশনের নবনির্বাচিত সভাপতি, ইন্দোনেশিয়ার ড. আদম মালিকের কৌতূহল উদ্রেককারী বিবৃতিতে। তিনি জনসম্মুখে মনোভাব প্রকাশ করেন যে এ ব্যাপারটিতে তিনি কোনো বিতর্কের পক্ষপাতী নন। এটা অবশ্যই তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, কিন্তু সভাপতির এরূপ সময়ের আগেই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ অধিবেশনের বিচারকে প্রভাবান্বিত করবে এমন সংশয় রয়ে যায়। এই বিশ্ব সংস্থাটির উদ্দেশ্য হল স্বাধীন আলোচনা এবং মতামত ও ধারণার মুক্ত আদান-প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সাহায্য করা। এটা কিছুটা অবাক হবার মতই ব্যাপার যে সাধারণ অধিবেশন (সবকটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত এবং তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি সভা) এর সভাপতি মৌলিক মানবিক অধিকারের জন্য সংগ্রামরত সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ক্ষেত্রে এই একই পদ্ধতি অনুসরণের বিপক্ষে। তার এই মনোভাবের স্বপক্ষে তিনি যুক্তি দিয়েছেন এই বলে যে “এই আলোচনা কখনো সমাপ্ত হবে না এবং এ সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভবপর নয়”। তিনি “পর্দার অন্তরালে” কাজ করতে আগ্রহী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি লীগ অব নেশনস এর চুক্তিপত্র দ্বারা নিষিদ্ধ গোপন কূটনীতির যুগ ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন। যদি সময়ক্ষেপণ আলোচনার বিপক্ষে অবস্থান নেবার যুক্তিসিদ্ধ কারণ হতে পারে তবে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই নাকচ করে দিতে হবে। সাধারণ অধিবেশন কি গণতন্ত্রের সমাধিফলক লিখতে চলেছে?
.
এরূপ অনুমান করা কি খুব কঠোর হয়ে যায় যে ড. মালিকের বাংলাদেশ সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনার বিপক্ষে অবস্থানের পেছনে ইয়াহিয়ার শাসনকে প্রকাশ্যে আসা থেকে রক্ষা করতে তার ইচ্ছাই তাকে চালিত করেছে? এই শাসনের অপকর্ম সমূহ সম্পর্কে এখন বিশ্ব বেশ ভালভাবেই ওয়াকিবহাল। তবু বিশ্বমঞ্চে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবার কলঙ্ক থেকে বাঁচতে ইসলামাবাদ স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সুরক্ষা দেয়া ড. মালিকের কর্তব্য নয়। যদি অন্যান্য রাষ্ট্র পাকিস্তানকে মানবসৃষ্ট আইন ভঙ্গ করে চালানো পাশবিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তবে পবিত্র পাকিস্তান নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ পাবে। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে এই বিতর্কে অংশ নেবার। গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্তদের সামনে কেবলমাত্র একটি সম্মানজনক পথই খোলা থাকে, আর তা হল কার্যকরীভাবে সেই অভিযোগের খণ্ডন। যদি ইয়াহিয়া ও তার সাগরেদরা সেপথ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে তবে তাদের এর ফলও ভোগ করতে হবে। সাধারণ অধিবেশনের কাজ হল বিশ্বমানবের মনোভাব প্রকাশে সহায়তা করা, তাকে রুদ্ধ করা নয়। ড মালিক গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বচ্ছতার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর নজির স্থাপন করছেন।
.
ড. মালিকের তত্ত্বের যা কিছু অভিনবত্ব তা এইক্ষেত্রে পাকিস্তানের আইনগত অবস্থান সম্বন্ধে তার ধারণা থেকে উদ্ভূত, এবং এই ধারণা বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়া অব্দি পাকিস্তানের উৎসাহী বন্ধুদের দিয়ে আসা বক্তব্যের প্রতিধ্বনি মাত্র। ‘আপনি পারেন না’ তিনি বলেন ‘পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে কারণ এটা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা’। ইহুদী নিধন হিটলারের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সমস্যাই ছিল! ড. মালিকের দাওয়াই হল ভারত এবং পাকিস্তানকে ‘চাপ প্রয়োগ’ যেন তারা একত্রিতভাবে ‘এই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে’। এই ‘চাপ প্রয়োগ’ কিভাবে হবে, কে বা কারা করবে? পাকিস্তান কেন তাদের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ এ ‘চাপ প্রয়োগ’ বরদাস্ত করবে? আবার কেন ভারত এবং পাকিস্তানকে একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে? এই ‘রাজনৈতিক সমস্যা’ যা এখন পুরো বিশ্বের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা তৈরীতে কি ভারতের হাত ছিল? ড. মালিক বহুবছর ধরে পশ্চিমা শক্তিগুলোর গ্রহণ করা পথেই চলতে চেয়েছেন, আর তা হল এই উপমহাদেশের সকল ব্যাপারেই ভারত ও পাকিস্তানকে একত্রিতভাবে পদক্ষেপ নিতে চাপ প্রয়োগ করা। এই কৌশল কাশ্মীরের ক্ষেত্রে খুবই সামান্য সুফল এনেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, যেখানকার জনগণ স্বাধীনতা লাভে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেখানে এটা বিন্দুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না। সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি এক ঐতিহাসিক ঘটনা; এটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বা সাধারণ অধিবেশনের সভাপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
.
.
অনুবাদঃ নিয়াজ মেহেদী
<৬, ৩১১, ৫৩৬-৫৩৭>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়, রাজনৈতিক সমাধান কোথায়
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ৮ অক্টোবর, ১৯৭১
.
অনিশ্চিত রাজনৈতিক সমাধান
বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক সমাধান একটি প্রায়শই প্রস্তাবিত এবং আবেদন করা কৌশল। উভয় পূর্ব এবং পশ্চিমে এই উদাহরণগুলো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী এবং খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের পর্যন্ত পরিবেষ্টন করেছে। এটা ঠিক যে এই পরামর্শ গুলো লাখ লাখ মানুষের বেদনাময় কান্না, যারা এখন পশ্চিম পাকিস্তানের রক্তপিপাসুদের শিকার এদের প্রতি তাদের উদ্বেগ ও মর্মপীড়ার প্রতীক।এই ধ্বংসলীলা এখনো চলছে এবং নিকৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা বেড়েই চলেছে। যত দিন যাচ্ছে নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনদের মৃত্যু দ্বিগুণ হচ্ছে। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ দেশত্যাগ অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই অন্ধকার ইতিহাসের গায়ে একটি কালো পালক।
বাংলাদেশের ব্যপার নিয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত দলগুলো হচ্ছে সম্পূর্ণ বাঙালি জাতি, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, যারা বাঙালি জাতির অধিকার জবরদখল করেছে। উভয়পক্ষই রক্তাক্ত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তী পক্ষ অর্থাৎ পকিস্তানি সামরিক জান্তা যে মাটি তাদের নয় তা জোর-জবরদস্তি দখলের লড়াইয়ে জড়িত এবং প্রথম পক্ষ অর্থাৎ বাঙালি জাতি শক্তভাবে লড়াই করছে হানাদারদের তাড়িয়ে স্বদেশ নিজেদের আয়ত্বে আনার। লড়াই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে এবং বাঙালি জাতির ভাগ্য সুস্পষ্ট ভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে।
তৃতীয় পক্ষ যারা সরাসরি যুক্ত তারা হচ্ছে ভারত। ভারত ইচ্ছাকৃত ভাবে এর সাথে জড়ায় নি। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়েই তারা এই ইস্যুতে জড়িয়েছে, মানবিক মূল্যবোধ এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই। বিশ্বের ইতিহাসে অদ্বিতীয় এই ব্যাপক গণহত্যার পর প্রায় ১ কোটি বাঙালি নিরাপত্তার জন্য ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ভারতের জনতা এবং সরকারের এই ত্যাগ স্বীকার আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে দেখি। “আমরা ৯০ লক্ষ শরনার্থী কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবনা” ইন্দিরা গান্ধীর এই সাহসী বিবৃতিতে আমরা অভিভুত।
অনির্দিষ্ট কালের জন্য প্রায় ১ কোটি মুখের অন্য জোগারের বোঝা বইবার তারিফ আমরা করি। ভারতের অর্থনীতির জন্য এটি একটি বোঝা। আমরা চাইব আমাদের উপকারী বন্ধুরা যেন সত্যিটি বুঝেন। বাঙালিরা স্বাধীনতা ব্যাতিত অন্যকিছু মেনে নিবেনা। প্রায় ১০ লক্ষ বাঙালিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করার পর, হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করার পর, এক কোটি বাঙালিকে গগৃহহীন নিঃস্ব করার পর রাজনৈতিক সমাধান আমরা কিভাবে মেনে নেই? এই অসন্তোষজনক বিষয়ের সকল খুঁটিনাটি দেখার পর বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, “স্বাধীনতা ব্যাতিত অন্য কোন সমাধান গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্বাধীনতাই কেবল পারে শরনার্থিদের স্বাধীন এবং নিরাপত্তার সাথে দেশে ফেরানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে।
রাজনৈতিক সমাধানের সর্বশেষ ওকালতকারী হচ্ছে আমেরিকা। যারা এযাবৎ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান করে এসেছে, এমনকি তাদের উৎস– এবং বিশ্বব্যাংক স্টাডি টিম দ্বারা ওয়াশিংটনে গণহত্যার নিশ্চিত খবর যাওয়ার পরেও। যখন মুক্তি বাহিনী তাদের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে এবং মৃত্যুকে তুচ্ছ করে লুটেরাদের একের পর এক রণক্ষেত্রে পরাজিত করছে আমেরিকা কর্কশ স্বরে কাঁদছে। রজার্সের থ্রী পয়েন্ট পরিকল্পনা হলঃ উপমহাদেশে সংযমের চর্চা অবশ্যই করতে হবে। এবং একটি কার্যকরী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক, দুর্ভিক্ষ এড়াতে এবং শরনার্থিদের ফেরার জন্য অনুকুল পরিস্থিতি তৈরিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কর্মসূচীকে অবশ্যই সম্প্রসারিত করতে হবে।
এবং এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এবং এর জনগনের অবস্থান একদম অকপট। একটি কার্যকরী রাজনৈতিক সমাধান তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির পূর্বশর্ত সমূহ মেনে চলবে। পূর্বশর্ত সমুহ হচ্ছেঃ শেখ মুজিবর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্পুর্ন স্বীকৃতি, পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সম্পূর্নরূপে প্রত্যাহার এবং মিলিটারি ক্র্যাকডাউনের সময় থেকে মানুষ এবং সম্পদ রক্ষার ক্ষতিপূরণ। যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের থ্রী পয়েন্ট ফরমুলায় যা বলেছে আসলেই তা তাদের উদ্দেশ্য হয় তাদের উচিৎ হবে তার রক্ষিতা ইয়াহিয়া খান কে যাতে সে সম্পুর্ন রূপে পুর্বশর্তগুলো মেনে নেয়।
এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে যেকোন গ্রহণযোগ্য এবং অর্থপূর্ণ সমাধানের জন্য রজার্সের প্রস্তাব প্রসঙ্গে, সম্পুর্ন স্বাধীনতাই শেষ কথা। বাঙালিরা যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত, স্বাধীনতা ব্যাতিত অন্য কিছু তাদের তৃষ্ণা মেটাতে পারেবনা। স্বাধীনতা মুল্য রক্ত, এবং আমরা এর মুল্য পরিশোধ করেছি। শেষ লক্ষ্যে পৌছুতে পৃথিবীর ৮ম সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র আরো রক্তদানের জন্য প্রস্তুত আছে। কোন শক্তিই তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ৭.৫ কোটি জনতার আওয়াজ চাপা দিতে পারবেনা, যারা একদম শেষ সৈনিকটি, শেষ গুলিটি পর্যন্ত লড়াই করে যেতে এবং তাদের মাটিকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রস্তুত। বিশ্ব মোড়লদের কুমন্ত্রনা এবং ষড়যন্ত্র তাদেরকে তাদের ঠিক করা পথ থেকে সরাতে পারবেনা এবং সেই পথটি হল সম্পুর্ন স্বাধীনতা।
.
.
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,৩১২,৫৩৮-৫৪০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
যুদ্ধেই বাংলাদেশের মুক্তি |
দ্য নেশন খণ্ড ১: সংখ্যা ২ |
৮ অক্টোবর, ১৯৭১ |
কেবল যুদ্ধই পারে বাংলাদেশকে বাঁচাতে
(বিশেষ জাতীয় প্রতিবেদন)
কখন, কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সমাপ্তি হবে? প্রায়ই জিজ্ঞাসিত এই প্রশ্নের উত্তর এক শব্দে দেয়া সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার এ ইস্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকা বিষয়গুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের একজন আগ্রহী পাঠক খুব শক্ত একটি উপসংহারে পৌঁছবেন। আমাদের মুক্তিবাহিনীই কেবলমাত্র বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পারে, এবং সেটি কবে হবে তা পুরোপুরিই নির্ভর করে শত্রুকে একই সঙ্গে স্থলে-জলে-আকাশে সমানে-সমানে আঘাত করতে মুক্তিবাহিনী কতটা প্রস্তুত তার ওপর।
সমাধানটা ওখানেই, অন্যত্র নয়। এ ধরনের যুদ্ধে নিয়ামক মুক্তিবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সামরিক ও মানসিক শক্তি, যা আমাদের ভাগ্য, সামর্থ্য এবং চারিত্রিক দৃঢ়তাকে নির্ধারণ করতে পারে।অন্য কোন পথে অগ্রসর হওয়াটা হবে আসল উদ্দেশ্যের সাথে প্রতারণার সামিল, এটা আত্মপ্রতারণা বা বুনোহাঁস খোঁজার মতই ব্যাপার হবে।
উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ ইস্যুটি ক্যান্সারের মতো হয়ে পড়েছে, এটি সত্য। অন্য কোন দেশ তাদের হয়ে লড়াই করে জয় এনে দেবে, এ বিভ্রমজাল থেকে বাঙালি জাতিকে বের হয়ে আসতে হবে। “ভিক্ষা চেয়ে মুক্তি অর্জন হয় না। শক্তি প্রয়োগ করেই একে অর্জন করতে হয়, রক্তের মুল্য দিয়েই।”–এইবেদবাক্যবাঙ্গালিকেতাইসর্বাংশেঅনুসরণকরতেহবে।এরবিকল্পপ্রস্তাবনাহচ্ছে“পিঠটানদেয়া”, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সম্মুখযুদ্ধে এ মাটির সন্তানদের বীরত্বকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করার জঘন্য প্রচেষ্টা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ছয়টা রুদ্ধশ্বাস মাস অন্তত একটি জিনিস প্রমাণ করেছে, সামরিক জান্তাকে তোষামোদ করে এবং তাদের মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়ে কোন লাভ হবে না। তারা এই সংহারী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তারা এখনো গণহত্যা চালানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
জাতিসংঘে জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক, চিন্তা-জাগানিয়া সিদ্ধান্ত অথবা কোন লোকদেখানো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভোটাভুটি করাটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরর্থক হবে। এরই মধ্যে কাঁচের মত স্বচ্ছ হয়ে গেছে যে, প্রচণ্ড শক্তিতে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোন কিছুই দখল করে রাখা ভূখণ্ড থেকে শত্রুদের এক ইঞ্চিও সরাতে পারবে না।
অন্য দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটি মাত্র শক্তির ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পেরেছে, মুক্তিবাহিনী, যাদের অদম্য উদ্দীপনা এবং জেদি অধ্যবসায়ের কারণে শত্রুসেনারা হতাহত হচ্ছে, এক ফ্রন্ট থেকে আরে ফ্রন্টে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের সাহসী যোদ্ধাদের স্থলযুদ্ধে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। বিমানবাহিনীর বদৌলতেই দখলদার বাহিনী এখনকার মতো কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে। প্রশিক্ষিত জনশক্তির দিক দিয়ে সংখ্যাগত সীমাবদ্ধতা মুক্তিবাহিনী কাটিয়ে উঠেছে। এখন তারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার মত সমান শক্তিশালী। তাদের নৈতিক শক্তিও একই রকম দুর্দান্ত। এ ভূখণ্ডের দাবিদাররা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সুনিশ্চিতভাবে সুবিধানজনক অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রসঙ্গে, আশু করণীয় হচ্ছে: বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবংজটিল অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের যোগান, এর মধ্যে প্রথমটির সাথে পরেরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের স্বীকৃতিলাভ না হলে কারা অস্ত্র সরবরাহ করবে? এমনকি নব্বই লক্ষ মানুষের অন্নসংস্থান করতে বাধ্য হওয়া ভারতও বাংলাদেশের স্বীকৃতিলাভের আগে এদেশে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না।
সারা বিশ্ব জানে, ২৬ মার্চে বিদ্রোহ শুরু করার সময় ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং সহায়তাকারী বাহিনীগুলোর হাতে যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল, প্রধানত তা দিয়েই মুক্তি বাহিনী লড়াই করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি আমাদের যোদ্ধারা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া বিশাল অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও লড়াই করছে।
আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব এবং যুদ্ধবিমান না থাকার কারণে মুক্তিবাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধকৌশলেই আটকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, গেরিলা যুদ্ধ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের উপায় নয়। সার্বিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সার্বিক যুদ্ধ প্রয়োজন। সার্বিক স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি যোদ্ধা এবং সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে অন্য কোন কিছুই মেনে নেয়ার মতো নয়।
তাছাড়া, গেরিলা যুদ্ধ হবার মানে দীর্ঘস্থায়ী একটি যুদ্ধ, যেখানে আমাদের ভাগ্য অনিশ্চয়তায় ঘেরা। বাঙালি জাতি কি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে সন্তুষ্ট হবে? না, কখনোই না, কারণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা কামনা করা বাঙালি জাতির মুক্তির তাড়নার সাথে এ সন্তুষ্টি বেমানান। এ জন্য, প্রচলিত যুদ্ধের মতোই, শত্রুর ওপর পূর্ণ আক্রমণ বাধ্যতামূলক বলেই বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তিদের জোরালো অনুভূতি।
যাঁরা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের সমাপ্তির ওপর বিশ্বাস রাখেন, যাঁরা এক দল মানুষের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে বিশ্বাসী, তাঁদেরকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। মুক্তিবাহিনীতে জনশক্তির অভাব নেই। অভাব হচ্ছে জটিল অস্ত্রশস্ত্রের, এর পরেই রয়েছে যুদ্ধবিমানের অভাব। আধুনিক সমরাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান সজ্জিত মুক্তিবাহিনী আরো তাড়াতাড়ি শত্রুবাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে পারবে। তখন হয় শত্রু পলায়ন করবে, নয়তো আত্মসমর্পণ করবে, নয়তো ধ্বংস হবে।
তারা যদি সমুদ্রপথে পালানোর চেষ্টা করে, তাদের ব্যবস্থা করার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনী অবশ্যই পাহারায় থাকবে।
এটা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জাতির বাঁচামরার প্রশ্ন। বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রেমী জাতিসমূহ কি একটি স্বাধীনতাকামী জাতির সংকটের মুহূর্তে নীরব দর্শক হয়ে থাকবে? মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে তাদের দায়িত্ব, জাতিগতভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সমুন্নত রাখার। তারা যাতে ভুলে না যায়, বর্তমানে জাতিসংঘের বেশিরভাগ সদস্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপজাত, যে যুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল।
মানবতার অপেক্ষাকৃত প্রকৃতিস্থ অংশের ওপর, বিশেষ করে যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন দেশগুলোর ওপর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াটা যৌক্তিকভাবে অবশ্যপালনীয়, যাতে করে আরেকটি ঔপনিবেশিক রাজত্বের পতন ঘটে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
.
.
অনুবাদঃ আহসানউল্লাহ
<৬,৩১৩,৫৪১-৫৪২>
শিরোনামঃ স্পষ্ট ভাষণ
সংবাদপত্রঃ দ্যা নেশন ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ৮ অক্টোবর, ১৯৭১
.
স্পষ্ট ভাষণ
.
দক্ষিণ ভিয়েতনাম নামের মাই লাই নামের ছোট্ট একটি গ্রামে যে মানবিকতার দুঃখজনক ঘটোনা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশের অসংখ্য গ্রামে করেছিল বর্বর পাক সৈন্যরা । শুধুমাত্র গভীরভাবে দেখা বা পর্যবেক্ষণই নয় বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক গবেষণায়ও এর প্রমাণ মিলে । এটা বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক গবেষকদেরও পর্যবেক্ষণ । বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানকে একটি বৃহৎ ঋণ দিয়েছিল উন্নয়ন প্রকল্পের স্বার্থে । তারা একটি পর্যবেক্ষণ দল পাঠিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে দশজনেই রিপোর্ট করেছিলেন যে জরুরি ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে
যেন ত্রাণ তুলে নেওয়া হয় । সেই দলিল খুব সহজেই প্রমাণ করে পাকিস্তানিদের সেই অর্থনৈতিক দুর্নীতির যার খুব পরিষ্কার মিল রয়েছে মাই লাই এর । সেই দলিল এতটাই প্রমাণ বহুল এবং সঠিক ছিল যে তাতে মন্তব্য বা সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকে নাহ । সেই দলিলের মূল ভাবার্থ আমাদের এটাই বলে যে , সেই তথ্য গুলো কখনোই জিজ্ঞাসাবাদ,বাস্তব ভ্রমণ বা সঠিকভাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে করা যায় নি ।অনেক ধরনের তথ্য,প্রমাণ এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তা করা হয়েছিল । ব্যাংকের স্বার্থে তাদের জন্য এটা খুবই কঠিন কাজ ছিল এবং এটা বলা যায় যে সঠিক ব্যবস্থার অভাবে অনেক সমস্যার পর আমরা তার একটা সঠিক রূপ এবং পরিস্থিতি দলিলের মাধ্যমে তুলে ধরতে পেরেছি । এমন কিছু তথ্য (যা সৈনিকরা খুব সমস্যা করে আমাদের মধ্যে পোঁছাতে চায় নি অথবা কোনো অফিসিয়াল স্ট্যাট্মেন্ট দেয় নি ) যেগুলোর সমাধান হিসেবে আমাদের পূর্ব বাংলার আসল বর্ণনা দেখতে হয়েছে কাছ থেকে উপলব্ধি করতে হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র হতে শুনতে হয়েছে এবং নিজেদের পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে যা আমরা লিখে রেখেছি বা মনে করে নিয়েছি । সেই অবস্থার হিসেবে বিশ্বব্যাংক বলে এটা অবশ্যই স্বাভাবিকতার বাইরে ছিল এবং স্বাভাবিকভাবে পূর্ব বাংলার দিকে এগুনোর জন্য কোনো অফিসিয়াল স্বাক্ষর বা ব্যাপার ছিল নাহ । দু দেশের এই চিত্রকে বদলানোর জন্য সত্যি দুটো বিষয়ের উপর জয়ী হয়া বা সেগুলো বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল ,
১। জনসংখ্যাবহুল এলাকা হয়া সত্ত্বেও সাধারণ ভীতি এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব ।
২।সম্পূর্ণ আলাদা যোগাযোগব্যস্থা এবং মূল ব্যাপারটি হচ্ছে জনগণের যাতায়াত এবং ধর্ম বর্ণ ও জিনিসপত্রেও দুটো অঞ্চলে আদান প্রদানের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি ।
.
বর্তমানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে , এটা বলা সম্ভপর না যে খুব সহজেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সম্বলিত পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি স্বাভাবিক দেশের অগ্রসর হবে । যাই হোক এই ব্যবস্থা চালু করতে হলে আরো অরো অনেকগুলো নিয়মের সন্নিবেশ করতে হবে যেকোনো বিষয়েই বা হোক সেটা ।
প্রথমত এটা খুবই দুঃখজনক যে এ অগ্রসর ও স্বাভাবিক নাগরিক জীবন ততদিন হবে না যতদিন পূর্ব বাংলায় সৈন্য শাসন চলবে এবং তাদের অনৈতিক কাজ অবিরত থাকবে ।
দ্বিতীয়ত খাদ্য সমস্যার অবশ্যই সমাধানের প্রয়োজন ।বরতমানের সাপেক্ষে এই সমাধান বলতে বোঝায় আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের পর্যাপ্ত খাদ্যের মজুদ এবং উপযুক্ত বণ্টন ব্যবস্থা ।
তৃতীয়ত যে সকল সাংঠনিক এবং শারীরিক কর্মকাণ্ড এখনো অসম্পূর্ণ রয়েছে তা পুরনো কায়দা ও ধরন ভেঙ্গে নতুন ধারায় নতুন আঙ্গিকে করতে হবে যেন হারানো অর্থনৈতিক ভারসাম্য আবার পুনরায় ফিরিয়ে আনা যায় ।
.
.
অনুবাদঃ শিহাব শারার মুকিত
<৬, ৩১৪, ৫৪৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
আপাতঃ দৃষ্টিতে |
দ্যা নেশন ১ম খণ্ডঃ নম্বর ২ |
৮ অক্টোবর ১৯৭১ |
আপাতঃ দৃষ্টিতে
ভুট্টো এখন রাগে ফুঁসছে আর বিশ্রীভাবে কান্না করছে। ক্ষমতায় যাওয়ার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা এখনও শুধুই ধারণামাত্র, বাস্তব নয়। ইয়াহিয়ার বাহিনীর হাতে শুরু হওয়া ধ্বংসযজ্ঞের অভিযানের পথে রক্তমাখা গালিচা বিছিয়ে দেওয়া ভুট্টো আসলে ফাপড় ছাড়া কিছুইনা। সে এখন তার নিজের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। ইয়াহিয়া তাকে ব্যবহার করেছে এবং পরে তাকে লাথি দিয়ে বাতিল করে দিয়েছে।
সেনাপ্রধানের পাকিস্তানের “নিখাত সৌন্দর্য” কে পুনরুদ্ধার করা এবং নতুন সংবিধানের সাথে তথাকথিত সমন্বয় করার ধারণা এখন ফুর্তিবাজ রাজনীতিবিদ ভুট্টোর হাতে, যা তাদের কাছে একটা ভয়ানক ধাক্কা ও হতাশার কারণ। একজন বহিষ্কার হওয়া রাজনীতিবিদ, যিনি বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গনহত্যায় সব রকমের সাহায্য প্রদান করেছিলেন, তিনি এখন আবিষ্কার করলেন ইয়াহিয়ার গণতন্ত্র পুনস্থাপন ভাবনা ছিল “সাধারণ জনগণের আশার বিপরীত।”
বিশ্বাসঘাতককে কখনই বিশ্বাস করা যায় না। একবার যে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে বিশ্বাস ভেঙেছে সে কোনভাবেই ইয়াহিয়ার প্রতি বিশ্বস্ত হতে পারে না। তাই তার বিপথগামিতা গণতন্ত্রের পবিত্র নীতিসমূহ বা নিজস্ব ইচ্ছাধীন সমাজতন্ত্র কোনকিছুর প্রতিই ভালবাসা প্রকাশ করেনা। বরং এটি তার কলঙ্কিত চেহারার সাথে আরও কিছু সন্দেহের সমষ্টি ঘটায়।
হ্যাঁ, বাংলাদেশের জনগণ জানে যে “পূর্ববাংলায় এখন আগুন জ্বলছে, পুরো দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।” কিন্তু তারা এই কথাটি মায়াকান্না কেঁদে যাওয়া একজন বিশ্বাসঘাতকের মুখ থেকে শুনতে চায় না। এবং এছাড়াও “আড়াই বছর ধরে চলে আসা সামরিক শাসন এখন নিজেদেরকে অন্তর্বর্তী সরকার বলে পরিচয় দিচ্ছে” এটাও কোন খবর না। এটা ভুট্টো সাহেবের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করে না, সারা দুনিয়া জানে।
তিনি রাজি হোক বা না হোক, ভুট্টো তার নিজের জন্য নতুন ক্ষেত্র তৈরির প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ইয়াহিয়ার দেয়া পূর্ববাংলায় নির্বাচনের আশ্বাসই তাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার সহানুভূতি শুধুই লোক দেখানো, আর কিছু নয়। তিনি যদি ভেবে থাকেন বাংলার মানুষের স্মৃতি এতই কম, তাহলে দুঃখের সাথে বলতে হয় তিনি ভুল করছেন। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ আর ভুট্টোর মিষ্টি কথায় চিড়া ভিজাবে না।
.
.
অনুবাদঃ পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬, ৩১৫, ৫৪৪-৫৪৫>
শিরোনামঃ মুজিবনগর সংবাদ
সংবাদপত্রঃ দি নেশনঃ ভল্যুম ১ নং ২
তারিখঃ ৮ই অক্টোবর, ১৯৭১
.
দাবি আদায়ের ডাক
প্রতিবেদক- দেশ পত্রিকা।
.
বাংলাদেশের ভিন্নমতের নির্দিষ্ট কিছু অংশের ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তির জন্য ত্যাগ স্বীকার করা নিয়ে মনের ভেতরকার একঘেয়ে বিহ্বল সুর অনেকটাই প্রশমিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম দল সম্বন্ধ, বর্ণ বা ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সকল বাঙালীর জন্য সংগ্রাম। শত্রুরা কাউকেই ছাড়েনি, যখন ওরা আক্রমন করেছিল, যখন ওরা গণহত্যা আরম্ভ করেছিল বাংলাদেশের মাটিতে।
গোটা বাঙালী জাতির আত্নমর্যাদার জন্য এই রক্ত-স্নান এক্যবদ্ধ হবার দৃঢ়শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। গোটা জাতিই একসাথে পশ্চিম পাকিস্তানি লুটেরাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, এবং একইসাথে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছে। অনেক মতভেদ আছে এবং এ লড়াই চ্যালেঞ্জিং। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়াই করতে অটল।
তারা একসাথে একটা বিপদসংকুল যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু আওয়ামী লিগের অন্তর্ভুক্ত দল গুলোর বাইরে কৃতিত্বের ভাগের অনুপস্থিতি আওয়ামিলীগের, যারা বাংলাদেশ প্রশাসনের বর্তমান শাসক দল, তাদের বাইরের জনদের নিরুতসাহিত করছে। এটা একটা আনন্দের খবর যে, ৫টা দলের ৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে একটা পরামর্শক কমিটি তৈরি করা হয়েছে। কমিটিতে আওয়ামি লীগ ছাড়াও আরও যে চারটি দল প্রতিনিধিত্ব করছে তারা হলঃ ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি ( ন্যাপ- ভাসানী গ্রুপ ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( ন্যাপ- মুজাফফর গ্রুপ ), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি।
গোটা বাঙালি জাতি একটা সর্বাত্মক স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। এটা গোটা জাতির লড়াই। অন্য চারদলের অবদান স্বীকার একটা শুভ প্রভাব রাখবে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই দলগুলো এখন একটা অংশগ্রহণমূলক বোধ অনুভব করবে, যা কোন সন্দেহ ছাড়াই এই মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যেতে তাদের মাঝে একটা উদ্দীপনামূলক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
শত্রুরা তখনই সফল হবে যখন তারা এই সংগ্রামরত মানুষগুলোর মাঝে কোনো বিভেদ ঘটাতে পারবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সময়ের চাহিদার স্বার্থেই নিজেদের মাঝে সোৎসাহে একতা বজায় রাখতে হবে। এটাই সেই সময়, যা আমাদের চালচলনে-কার্যকলাপে সামরিক শৃঙ্খলা চায়। আমাদের বাচনভঙ্গির প্রতিটি খুঁটিনাটি বিবেচনায় নিয়ে এখনই একটা সুরক্ষিত ভাষায় কথা বলা শুরু করতে হবে।
বাঙালি জাতি তাদের ঈর্ষা জাগানিয়া কর্মক্ষমতার মাধ্যমে একটার পর একটা উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে। নির্বাচনের ইতিহাসে একটা রেকর্ড স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিপ্লবীদের ফিরিয়ে এনেছে। তারা ২৫শে মার্চের কঠোর পদক্ষেপের চূড়ান্ত পরিণতিতে আসা স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার পর উদ্ভুত পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী সাড়া দিয়েছে। হ্যাঁ তারা সাড়া দিয়েছে। প্রতিটি সাধারণ বাঙালি এখন যোদ্ধাতে পরিণত হয়েছে, তারা দখলদার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত মাতৃভূমির সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষার শপথে দীপ্ত। তারা এখন পশ্চিম পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুরতা থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার মাধ্যমে আরেকটা উদাহরণ স্থাপনে সংকল্পবদ্ধ।
রাত সত্বর পোহাবে।
******
শব-ই-বরাত, পবিত্র ইসলাম ধর্মীয় উৎসব, মুজিবনগরে যথেষ্ঠ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ মতে, এই রাতেই মহান আল্লাহ প্রত্যেক মুসলিমের আসছে বছরগুলোয় তৃপ্তি বা আক্ষেপ, ভাল বা মন্দ দিনগুলো হিসেব করবেন। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রবল আগ্রহের সাথে সৌভাগ্যের জন্য সারারাত প্রার্থনা করে। বাংলাদেশও সরকারের সকল অফিস ৫ই অক্টোবর একদিনের ছুটি পালন করেছে।
মুজিব নগরে, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের মন্ত্রীসভা সদস্যেরা বিশেষ প্রার্থনায় শামিল হয়েছেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী শহীদদের আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বর্বর এবং নিষ্ঠুর আক্রমণে নিহত লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ পুরুষ, নারী এবং শিশুদের আত্মার জন্যেও প্রার্থনায় মুক্তি ও শান্তি কামনা করা হয়।
.
.
অনুবাদঃ আবির অনন্য
<৬,৩১৬,৫৪৬>
শিরনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
স্বেচ্ছাসেবী দলের প্রশংসনীয় কাজ |
দা নেশন ভলিউমঃ ১ নংঃ ২ |
৮ অক্টোবর ১৯৭১ |
সেচ্ছাসেবক সৈন্যদল তাদের দায়িত্ব পালন করছে
বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চল গুলোতে বাংলাদেশে সেচ্ছাসেবক সৈন্যদল এক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, সেখানে ও সেনা ছাউনিতে ভ্রমণ ছিল এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা । সৈন্যদল সেখানে শিশু বিদ্যালয়, সূচিকর্ম বিদ্যালয় নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে শিশুদের মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করতে যাতে সে নারী পুরুষ কে শ্রমের ভিত্তিতে শ্রদ্ধা করেতে শেখে ।
একটি সেনা ছাউনিতে ভ্রমণের সময় সেচ্ছাসেবক সৈন্যদলের সভাপতী জনাব রহমত আলী বিবৃতি দিচ্ছিলেন সেচ্ছাসেবক সৈন্যদল সীমিত সম্পদ ও ক্ষমতা মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান চালাবে । সে আশাবাদী যে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার পর এই সৈন্যদল বড় চাকরী নিতে সক্ষম হবে , যেমন ধরা যায় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, যে নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য ভারত যাবে । সামান্য আপ্যায়নে সময় রহমত আলী ঘোষণা দিল “আমাদের প্রকৃত ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা এবং সেই দিন খুব বেশি দূরে নয় যখন আমরা আমাদের নিজ অধীকারে ফিরে আসবো” ।
এই উপলক্ষকে লক্ষনীয় করে ছোটছোট বালক বালিকারা প্যারেড করে জাতীয় সঙ্গীত গায় । বাচ্চারা সভাপতীকে স্বাগত জানিয়ে চিৎকার করে বলে “জয় বাংলা” ।
.
.
অনুবাদঃ সুমিতা দাশ
<৬, ৩১৭, ৫৪৭-৫৪৮>
শিরোনামঃ ভারতীয় দৃষ্টিতে
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ৮ অক্টোবর, ১৯৭১
.
ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গী
একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ দ্বারা
.
পূর্ববঙ্গ স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের নতুন নাম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের জন্য যুদ্ধরত সর্বগ্রাসীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ এবং সাহসী যুদ্ধের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের মানুষকে আমরা ভ্রাতৃপ্রতিম শুভেচ্ছা জানাই। নিরস্র বাংলাদেশের মানুষের উপর সংঘটিত অমানবিক নৃশংসতার নিন্দা জানানোর জন্য কোন ভাষাই যথেষ্ট নয়, যারা দুই দশক ধরে গণতান্ত্রিক অধিকার, আইনের শাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টার জন্য সংগ্রাম করছে। মৌলিক মানবাধিকারের উপর পৈশাচিক হামলা সভ্য জগতের ইতিহাসে অজানা। পশ্চিম পাকিস্তানের ছদ্ম-সাম্রাজ্যবাদীদের নিপীড়ন ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য নির্ভীক সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাস তৈরি করেছে।
পাকিস্তানে সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের পর, আশা করা হয়েছিল যে সামরিক শাসন গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।কিন্তু একদিকে স্ব-আরোপিত সামরিক স্বৈরশাসকরা ও কায়েমী স্বার্থ এবং অন্যান্য মানুষের স্বীকৃত প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ ত্বরান্বিত হয়েছে কায়েমী স্বার্থ দ্বারা সমর্থিত সামরিক নেতাদের ক্ষমতার লোভ এর দ্বারা। ২৬শে মার্চ এ আধুনিক যুগের শ্রেষ্ট দেশপ্রেমিক শেখ মুজিবুর রহমান দ্বারা চালিত অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনে সামরিক স্বৈরশাসকদের গৃহীত চরম কঠোর দমনমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে শুনে আমরা মর্মাহত হই।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ হতে মুক্তি প্রত্যেক মানুষ ও জাতির জন্মগত অধিকার।অসভ্য উপায়ে মৌলিক অধিকারের অস্বীকৃতি একুশ শতকে এসে সহ্য করা যায় না।সমতা, বিচার এবং সর্বোপরি মানবতার জন্য, এখনই সময় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং জাতিসংঘের অনুষ্টানে আওয়াজ তোলার এবং দৃঢ়ভাবে এক স্বরে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের অবিলম্বে গনহত্যা বন্ধ করতে বলার।যদি বিশ্বের চাপের মধ্যে সামরিক স্বৈরশাসকদের জ্ঞান না আসে এবং গৃহ যুদ্ধ চলার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ করা উচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে, ফ্যাসিবাদিত্ব উজ্জ্বলতর হওয়া ও পুনরুজ্জীবন লাভ বিশ্বের শান্তি, উন্নতি ও প্রশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ।
আমরা ভারতে বিশেষ করে সরকারী প্রশাসনের জন্য দায়ী, আমি সম্পূর্ণরূপে একমত যে আমাদের পূর্বদিকের সীমান্তের ঘটনার জন্য অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।বেশী নির্ভর করবে না, যা শুধু আমরা করব , বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যবহারের উপর ও নির্ভর করে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় একতার হিতের কথা এবং আমাদের সীমান্তবর্তী রাজ্য যেমন পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের নিরাপত্তার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। যা ঘটছে তা নিয়ে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না। তাছাড়া, এসব রাজ্যের মানুষের রয়েছে বাংলাদেশের সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক যোগাযোগের দীর্ঘ ইতিহাস। এইসব সীমান্তবর্তী রাজ্যের মানুষের স্বাভাবিক আবেগ আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা পূর্ণ গুরুত্বের সাথে নেওয়া হবে।
আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করেছি (১) একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশকে অবিলম্বে কূটনৈতিক স্বীকার প্রদান করা; (২) নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করা এবং বাংলাদেশে গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করা; (৩) কূটনৈতিকভাবে সব দেশ বিশেষ করে আফ্রো-এশিয়ান জাতি একই সাথে জাতিসংঘ সংগঠন এবং পরাশক্তির সাথে বিশ্ব বিবেককে গনহত্যার বিরুদ্ধে জাগিয়ে দিতে হবে; (৪) খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য সংগঠিত করা এবং এ উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা; (৫) সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষমতার মাধ্যমে রপ্তানির উপর এবং পাকিস্তানে বিমানপথে অস্র বহন একই সাথে সশস্র ব্যাক্তিদের ট্রানজিট সুবিধার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা; (৬) যারা বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন তাদের ধর্ম উল্লেখ না করে আশ্রয়স্থান দেওয়া; (৭) সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যথাযথ কার্যসম্পাদন করার জন্য বাংলাদেশকে সক্ষম করতে যথা সম্ভব সব রকমের সাহায্য করা।
.
.
অনুবাদঃ রাশেদ সাইফুল
<৬, ৩১৮, ৫৪৯-৫৫০>
শিরোনামঃ স্বাধীনতার যুদ্ধ মধ্য পথে
সংবাদপত্রঃ দ্য ন্যাশন ভলি. ১: নং- ৩
তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১
.
স্বাধীনতা যুদ্ধের অর্ধেক পথ অতিক্রান্ত
নতুন ভোর আনতে সর্বাত্বক চেষ্টা
দ্য ন্যাশন এর বিশেষ প্রতিবেদন
.
সম্ভবত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ছদ্মরূপ উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে। অন্ধকার এবং নিরাশার দিনগুলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নতুন ভোর দরজায় কড়া নাড়ছে। হ্যাঁ বাঙ্গালী, জেগে উঠো, আরো সাহস সঞ্চার করো, অস্ত্র হাতে নাও আর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ো, শত্রু এবং তাদের দোষরদের আঘাত করো, তাদেরকে হত্যা কর, অঙ্গচ্ছেদ কর এবং কবরে মিশিয়ে দাও।
সাড়ে ৭ কোটি বাংলাদেশী অনেক বড় একটি দল, অসাধারণ শক্তি। এই জন্যই এমন শক্তির বিরুদ্ধে শত্রুদের শক্তি নিঃশেষ হয়েছে। এত বড় জাতির বিরুদ্ধে শত্রুরা সমপ্রতিপক্ষ না। শহর, বন্দর, নদী, সমুদ্র, খোলা মাঠ বা লুকানো জায়গা যেখানে শত্রুরা রয়েছে তাদেরকে শেষ করে দাও। তাদেরকে আঘাত কর, হয়রানি কর, তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দাও এবং শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়বে অথবা মারা যাবে।
এটা স্বাধীনতার ডাক, এটা মাতৃভূমির ডাক। রক্তই হল মুক্তির মূল্য, স্বাধীনতা হল মুক্তির মূল্য, স্বাধীনতা হল ত্যাগের মূল্য। যুদ্ধ জয়ের জন্য, ডাকাতের হাত শেষ করার জন্য এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রত্যেকটি বাঙ্গালীকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে, সর্বচ্চ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ইসরায়েলের ছোট্ট জাতির দিকে তাকান। তারা এমন একটি শক্তি যাদেরকে স্বীকার করতেই হবে। হতে পারে ক্ষুদ্র কিন্তু তাদের আত্মত্যাগ ছিল মহান। স্বাধীনতার স্বাধ নেয়ার জন্য আমরা কেন মৃত্যু শপথ নিতে পারি না? হ্যাঁ, আমরা পারি। আমরা তৈরি। অতীত নিয়ে আহাজারি করার মত সময় আমাদের হাতে নেই। চলুন আত্মবিশ্বাসের সাথে সামনে তাকাই। জয় আমাদেরই।
বাঙ্গালীদের ইতিহাস আছে, গৌরবময় অতীত আছে। আমরা ক্ষুদিরাম, তীতুমির, সূর্যসেন এবং সুভাষ বোসের উত্তরসূরি। তারা নির্ভয়ে ব্রিটিশ অত্যাচারীদের মুখোমুখি হয়েছিল। আমাদের অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকেও মুখোমুখি হতে হবে একই সাহত এবং আত্মত্যাগের মনোভাব, আত্মবিশ্বাস এবং সংকল্প নিয়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এরই মাঝে অর্ধেক পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। এবং আরো একটি আঘাত, চারিদিক থেকে ৭৫ মিলিয়ন মানুষ দ্বারা মিলিটারি অস্ত্র, তরবারি, বল্লম, তীর এবং অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে আরেকটি বড় মাপের আক্রমণ। চলুন, আমাদের বিক্ষিপ্ত আক্রমণ দিয়ে শত্রুদের অন্ধ করে দিই, কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিই যাতে শত্রুদের শেষ জন পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মনে রাখবেন, তারাই হল আক্রমণকারী, অনুপ্রবেশকারী। আপনার সাহসী আক্রমণকে মোকাবিলা করার জন্য, আপনার দেশ দখল করার জন্য তাদের কোন নৈতিক শক্তি নেই।
শত্রুরা বিভ্রান্ত, তাদের মাঝে পদমর্যাদা এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে দন্ধ রয়েছে। তাদের শক্তি এরই মাঝে মুক্তি বাহিনী দ্বারা নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে। আপনারা শুধু আমাদের সাহসী যোদ্ধাদের দিকে যারা এরই মাঝে ২৫০০০ হানাদারকে শেষ করে দিয়েছে, সেই মুক্তি বাহিনীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। তারপর পুরুষ্কার নিশ্চিত হবে, স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।
মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বৃহস্পতি বার মুজিব নগরে এক বিবৃতির মাধ্যমে একই রকম অনুভূতি এবং সংকল্প প্রকাশ করেছেন। শত্রুরা নিদারুণভাবে মুক্তিবাহিনীর হাতে যুদ্ধ হারাচ্ছে যারা কিনা বিজয়ের দিকে খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
শত্রু জন্য কলঙ্কজনক পরাজয়ের এড়ানো সম্ভব নয় বরং অনিবার্য পরাজয় এড়ানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী যুদ্ধবাজরা ধুম্রজাল সৃষ্টি করছে। এই উদ্দেশ্য তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু বানানোর চেষ্টা করতেছে। পাকিস্তানের দাবীকৃত ভারত কর্তৃক পাঠানো অনুপ্রবেশকারী গল্পটি কেবল মাত্র সত্যের অপলাপ। আমাদের অনুপ্রবেশকারী দরকার নেই। মুক্তিবাহিনীই হানাদার সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা এবং পরাজিত করার জন্য পর্যাপ্ত পর্যায়ের শক্তিশালী।
.
.
অনুবাদঃ পূজা পলি
<৬, ৩১৯, ৫৫১>
শিরোনামঃ আপাতঃ দৃষ্টিতে
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১
.
ইয়াহিয়া খানের একত্রে ত্রৈধ পৈশাচিক আক্রমণ আর অমীমাংসিত নাটকীয় ঘটনাগুলো ক্রমশ এসোপ্’স ফেবলস্-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। রূপকথার গল্পের নিবিষ্টতায় ইতিহাসের কাল্পনিক নায়কেরা নিশ্চয়ই তাদের কম বয়েসী মনটাকে প্রভাবিত করছিল।তাই হয়ত তারা নিজেদের অপরিণত বয়েস ভুলে গিয়েছিল। টারজানের সেই বাষ্পীভূত করার মত প্রকান্ড শক্তি তাদের মনকে প্রভাবিত করেছিল,সেই সাহসিকতার সাথে তারা বেড়ে উঠল আর ভাবল তারাও সেইসব নায়কদের মত। কিন্তু ইয়াহিয়া তার এসোপ্’স-এর জাল এবং অকল্পনীয় হীন আচরণ সীমালঙ্ঘন করলেন।
ইয়াহিয়া খান “তিনের ভেতর এক” একত্রিত করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এক প্রহনসনমূলক বিচারকার্য শুরু করলেন।তিনি সব সরকারি উকিল,বিচারক এমনকি শাস্তি স্থগিতাদেশের উপরও হস্তক্ষেপ করলেন।
তার জীবদ্দশায় তিনি জাগতিক পৃথিবীতে নোংরাভাবে সুপারম্যানের চরিত্রে প্রকাশিত চেয়েছেন তার অতিপ্রাকৃত কাজের মাধ্যমে,বাংলাদেশের শিশুদেরকে রূপকথার হিরোদের স্মরণে আনার জন্য তার প্রতিহিংসাপরায়ণ কাজই যথেষ্ট।
নিঃসন্দেহে,তিনি একজন কৌতূহলী চরিত্র ছিলেন।তিনি কেবলমাত্র একজন অদ্ভূত অদ্বিতীয় খলনায়কই নন,তিনি এখন পর্যন্ত বইয়ে প্রকাশিত অন্যসব দৈত্য-দানবের চেয়েও হিংস্র।তিনি নিষ্ঠুর,অমার্জিত এবং রূঢ়।আর সেই সাথে নরম্যানদের চেয়েও বেপরোয়া।ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বর্বরতা সাধন করেও তখনও তারা উচ্চ পদমর্যাদায় ছিলেন।
২৬ মার্চ,তিনি আদালতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলেন এবং কোর্ট মার্শালের হুমকি দেন।সামরিক সৈন্য নিবাস থেকে তিনি সেই কোর্ট-মার্শালের বিচারক হিসেবে নিজেই নিজেকে নিয়োগ দিলেন।আরও যথাযথ এবং স্পষ্টতায় বলা যায়,ইয়াহিয়া তার আদেশ এবং ইচ্ছায় সামরিক বিচারক নিয়োগ হয়েছেন আর সেটাই সত্যি হল।লাহোরের উর্দু দৈনিক’ইমরোজ’-এর বক্তব্য অনুসারে, সামরিক আদালত মুজিবকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার জন্য সুপারিশকৃত, কেবল এই নয়য়,এই প্রহসনের বিচারকার্য শেষ হবে তখনি যখন তিনি ‘ আল- আহরাম’ উচ্চারণ করবেন।কিন্তু তারা ভাবেনি কোর্ট মার্শালের পরও মুজিব বেঁচে থাকবেন।
.
কিন্তু হাওয়া ভিন্নদিকে বইল,ইয়াহিয়ার খুনের নীল নকশার বিপরীতে বিশ্বনেত্রীবৃন্দ জোরাল প্রতিবাদ জানাল।এবার ইয়াহিয়াও ভিন্নসুরে কথা বলতে লাগলেন।মুজিবের মৃত্যুদন্ডাদেশ স্থগিত করলেন।বিশ্বাসযোগ্য সূত্র জানাল,চিঠি ইতিমধ্যেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং তাতে মুজিবের জীবনের নিরাপত্তার কথা নিশ্চিত করা হয়েছে।
.
এরপরই যুদ্ধের গুনটানা শুরু হয়ে যায়,সেই মুকুটহীন রাজার বিরুদ্ধে তার অমানবিক হত্যার পরিকল্পনায় সমগ্র বিশ্বের বৈপরীত্য ছিল।এই অমানবিকতা শুধুই ছিল বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে। অবশ্যই মুজিবের জীবন সুরক্ষিত হলো।পৃথিবীরআর কোন শক্তি এ সত্যকে বদলাতে পারবে না।
.
.
অনুবাদঃ মোহাঃ তূর্য রহমান
<৬, ৩২০, ৫৫২-৫৫৪>
শিরোনামঃ কলিকাতা মিশনের দৃষ্টিতে অপূর্ব
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১
.
কলকাতা মিশনের অবিস্মরণীয় বিদ্রোহ
জাতীয় পররাষ্ট্র ডেস্ক থেকে
.
এটা ছিল কর্তব্যের ডাক, মাতৃভূমির আহ্বান। সমগ্র বাঙালি সমাজের উপর ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার উত্তাপ শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশপ্রেমিক প্রবাসীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার চেতনা ও মাতৃভূমির প্রতি সহজাত ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রবাসী বাঙালিরা, বিশেষত কূটনৈতিক মিশনের বাঙালিরা, প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তাঁদের একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কূটনৈতিক মিশন ত্যাগ করা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোন সাধারণ ঘটনা বা খামখেয়ালিপনা নয়, বরং সাহসী,সুচিন্তিত ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ যা মিশনে কর্মরত ব্যাক্তিদের দেশপ্রেম ও গভীর ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ।
পক্ষত্যাগ করা মিশনগুলোর মাঝে, জনাব হোসেন আলীর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা কলকাতার প্রাক্তন পাকিস্তানী দূতাবাসের কথা বিভিন্ন কারণে উল্লেখ্য।
প্রথমত,শুধু এই মিশনেই অবাঙালি ব্যাতীত সকল কর্মচারী পাকিস্তানি সরকারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছে।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি কর্তৃত্ব নাকচের পরেও এই মিশন তাঁদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সমর্থকদের কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে মিশনের ৩১ জন অবাঙালি কর্মচারি বেরিয়ে এসেছেন।
তৃতীয়ত, পক্ষত্যাগের পর কলকাতা মিশন বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠছে। সেই সাথে, একমাত্র পূর্ণ কর্মক্ষম কূটনৈতিক সেল হিসেবে এটি ব্যাবহারের মাধ্যমে এখান থেকে বিদেশের মিশনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
চতুর্থত, যুদ্ধকালীন রাজধানী মুজিবনগরের কাছাকাছি অবস্থানের জন্য এটি অনন্যসাধারণ। কাছাকাছি অবস্থানের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এখান থেকে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মতামত ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দ্বারা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
পঞ্চম কারণ, যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন-ই ছিল একমাত্র স্থান, যেখানে বাংলাদেশের শরনার্থীরা যথাযথ দিকনির্দেশনা বা অন্তত দুটি সান্ত্বনার কথা শুনতে পেত।
সুতরাং, স্পষ্টতই লক্ষ্যণীয়, এই দূতাবাস স্বাধীনতা সংগ্রামে কেবল নৈতিকভাবেই নয়, রাজনৈতিক ভাবেও সাহায্য করে যাচ্ছে। সেই সাথে শরণার্থীদের প্রতি তাঁদের মানবিক সাহায্যের দিকটিও ভোলার নয়।
যুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায় শেষ হয়ে এলেও জনাব হোসেন আলীর নেতৃত্বে দূতাবাসের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সব কার্যক্রমের প্রমাণ থাকছে। এসকল প্রশংসণীয় কার্যক্রম পুরস্কৃত হবেই।
উৎসাহজনক ব্যাপার হল,অসাধারণ কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার উক্ত দূতাবাসের মর্যাধা বৃদ্ধি করেছে এবং জনাব হোসেন আলীকে বাংলাদেশ সরকারের ভারতীয় হাই কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করেছে। এ সম্মান তিনি অর্জন করে নিয়েছেন, এ পুরস্কার তাঁর প্রাপ্য।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, হাই কমিশনার সমগ্র দূতাবাসের কর্মচারীদের বড় এক পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেন, এবং স্বভাবতই এই পরিবারের অভিভাবক তিনি।
এবং একথা স্পষ্টই বোঝা যায়, তিনি তাঁদের জন্য যথাযথ পুরস্কারের ব্যাবস্থাও করবেন।
এই ‘বড় পরিবারে’র প্রতি মনোযোগের পাশাপাশি, অন্যান্য বাঙালির মতই জনাব হোসেন আলী তাঁর গভীর মমত্বের সাথে তাঁর মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এই লক্ষ্য হল মুক্তি- পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদারী বাহিনীর থেকে মুক্তি।বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি গভীর বিশ্বাস রেখে জনাব হোসেন আলী, সম্প্রতি কলকাতার এক সমাবেশে গভীর প্রত্যয়ের সাথে বলেন,
“এখন পর্যন্ত মুক্তিসংগ্রামে, সভ্যজগতের জানা আছে, বাংলাদেশে এখন কি চলছে। একটা বিশাল জনগোষ্ঠী কিভাবে সামরিক জান্তার দুঃসহ বর্বরতার স্বীকার হয়, সেকথা আমি পুনর্ব্যাক্ত করবো না। এ গল্প সবার পরিচিত। নিরস্ত্র অসহায় জনগণের উপর চালানো গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ব সচেতন।
তবে, বাংলাদেশের খোদা-ভীরু সাধারণ জনগণের উপর উপর গণহত্যা চালিয়ে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা একটি ঘটনার শৃঙ্খল চালু করে দিয়ে গেল, যেই শৃঙ্খল সময়ের ব্যাবধানে শুধু বাংলাদেশকেই স্বাধীন করবে না, বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তানের ভাঙনও নিশ্চিত করবে।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী এ ব্যাপারে অবগত যে, বিশাল সামরিক শক্তি আর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে বাংলাদেশের বিশাল জনগণকে বন্দী করে রাখার তাঁদের এই চেষ্টা সফল হবার নয়।
সভ্য সমাজের কাছে এটি স্পষ্টতই দৃশ্যমান যে, বাংলাদেশের সম্পদ শোষণ করে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাঁরা করেছে, অবিবেচনাপ্রসূত এ যুদ্ধের মুখে তা টিকে থাকতে পারছে না। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলো ইতিমধ্যে রাজনৈতিকভাবে এই সামরিক আগ্রাসন ও নাগরিক স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলার জন্য যে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক সাহায্য তারা পেয়েছে, তাও শেষের পথে।
বাংলাদেশে সামরিক আগ্রাসন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির ব্যাপারেও তারা সচেতন হবে, যে অর্থনীতির ভিত্তি সামরিক শিল্প, যা আপাতদৃষ্টিতে ভারতের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তবে মুলত এর লক্ষ্য জনগণের স্বার্থ শোষণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ‘সামরিক জাতে’র জন্য চাকরির ব্যাবস্থা করা।
মৃত্যু ভয়কে পরোয়া না করে আমাদের মুক্তি বাহিনী শত্রুর মোকাবিলা করে চলেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে।শত্রুর নিধনের পাশাপাশি অস্ত্র ও সৈন্য পরিবহনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেই ব্রিজ, রেল আর রাস্তা বায়বহার করত মুক্তিবাহিনীরা তা ধ্বংস করছে, সেই সাথে তাঁদের নৌযানও ডুবিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে আমাদের গেরিলারা দেশের অভ্যন্তরের পাকিস্তানিদের সাহায্যকারীদেরও নির্মূল করে চলছে।
ক্রমাগত সৈন্য ও সরঞ্জামাদি হারিয়ে এবং কিছু স্থানে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে। ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনী দেশের বিশাল অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং তথাকথিত ‘সামরিক জাত’ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটছে।
রাজনইতিকভাবে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ আমরা। যদিও নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠটা পেয়েছে, দেশের বৃহত্তর স্বাধীনতাকামী সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগীতার মাধ্যমে এবং সকল স্তরের ও মতের সমঅংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ালোকিত সমাপ্তি আনা এখন সময়ের দাবী।
.
.
অনুবাদঃ ইফতেখার আহমেদ
<৬,১২৩,৫৫৫-৫৫৭>
শিরোনামঃ বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১
.
দুর্ভিক্ষ কবলিত বাংলাদেশ
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক কঠোর বাবস্থাপনায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন আরও গভীরভাবে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। একটি আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, আগামী মাসগুলোতে ১০ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করবে যদি না অতিসত্বর তৎপরতার সাথে এবং বিস্তারিতভাবে আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত ত্রাণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়।
এই বছর পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সন্ত্রাসী রাজত্বে বাংলাদেশের চাষাবাদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইতিমধ্যেই এইখানে একটি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, চলতি মৌসুমে ধান চাষাবাদ অতিশয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। ফলে নভেম্বর মাসের ফসলের ঘাটতি প্রায় ৭ কোটি মানুষের মুখের খাবার যোগাতে ব্যর্থ হবে।
প্রকৃত সত্য এই যে, রক্ত পিপাসু পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী খাদ্যগুদাম ধ্বংস করতে চায়। সেটি হয় সকারি গুদাম অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন অথবা কোন বসতবাড়ির সঞ্চিত খাদ্যদ্রব্য।
এই দুঃখজনক বাস্তবতা আবির্ভাবের অনেক আগেই আন্তর্জাতিক খাদ্য বিশেষজ্ঞগণ এমন একটি সর্বনাশা পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। এই ভাবে দিনের পর দিন যেতে থাকলে পূর্ববঙ্গে একটি মর্মঘাতী দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে যদি না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনি হস্তক্ষেপ না করে। এটাই ছিল দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞদের কঠোর হশিইয়ারি , যারা সেইসময় কানাডার অক্সফাম এর উদ্যোগে টরেন্টোতে সাক্ষাত করেছিলেন।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ গড়ে ১০.৮ লক্ষ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করে যা প্রয়োজনীয় ১২ লক্ষ টন থেকে ১০ শতাংশ কম। বারংবার বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের এই ঘাটতি পূরণে বাধা সৃষ্টি করে । বাৎসরিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ অথবা সেচ নেটওয়ার্ক স্থাপনে খুবই সামান্য উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল ।
বেশিরভাগ বাংলদেশের মানুষ অনিশ্চিত বিপদজনক সীমারেখায় বসবাস করছে। তাদের আশেপাশের সামান্যতম চ্যুতি ঘটলেই অনেকেই অস্তিত্ব শঙ্কটের মুখে পড়বে।
যখন গত নভেম্বেরের ঘূর্ণিঝড় হানা দেয়, ৫ লক্ষ মানুষ ভেসে যায় । কিন্তু যে ৫০ লক্ষ মানুষ বেঁচে ছিল, তারা নিশ্চিত ছিলনা না যে এই অগ্নিপরীক্ষায় তারা বেঁচে থাকতে পারবে কিনা। পরিবহণ ব্যবস্থা এতটাই সেকেলে যে আন্তর্জাতিক খাদ্য সাহায্য সহযোগিতা দ্রুততার সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ছুটে যেতে পারে না। মনুষ্যসৃষ্ট ইয়াহিয়ার দুর্যোগ আবার আরেক বিষয়। এটা শুধু যোগাযোগ এবং পরিবহনে সীমাবদ্ধ না। এটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয় ।
এপ্রিল মাসে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের পাশবিক কার্যকলাপ ছিলঃ জীবনযাত্রা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে ফেলাঃ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে নিরাপত্তাহীনতা, সন্ত্রাস এবং ভয় কাজ করছিল।
সেনাবাহিনীর বিধ্বংসতা থেকে রক্ষা প্রাপ্ত কৃষিক্ষেত্র গুলো অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল।কৃষি ব্যবস্থাপনা ৯০ লক্ষ উদ্বাস্তু ও তাদের গৃহপালিত পশুদের নিয়ে প্রস্থানের ফলে ধসে পড়েছিল । সেই সাথে ৩ কোটি ছিন্নমুল জনগণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বাংলাদেশ কৃষিক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগী হিসেবে যেখানে পৃথিবীর গর্ব ( একই আয়তনের ক্ষেত্রে) , সেখানে কৃষিজ যন্ত্রপাতির বিনষ্ট হওয়ায় নিজেদের খুঁজে পায় পতনের শেষ প্রান্তে।
নভেম্বর ফসল উৎপাদন ও জুন হল ফসল রোপণের মাস। কিন্তু এই সময় চাষাবাদ অনিয়মত হয়ে পড়েছিল । এমনকি পাকিস্তান সরকারের প্রতিবেদনেও দেখা যায় যে উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে দশ শতাংশ কমে গেছে।
এই মাসে ৪ হাজার বর্গ মাইল বন্যা কবলিত হয়েছিল। এই এলাকায় যেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক না কেন,সেটির অর্ধেক সম্পূর্ণরূপে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
মার্চের শেষের দিকে পিএল ৪৮০ খাদ্যশস্য যা স্বাভাবিক খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, সেগুলো চট্টগ্রামে সেনা-নৌ কার্যক্রম এড়াতে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেও চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতা বেশ সীমিত। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর করাচী থেকে ক্রমাগত সেনা সরবরাহ শীর্ষ অগ্রাধিকার থাকায় বন্দরে খাদ্য হ্যান্ডলিং ক্ষমতা আরও হ্রাস পেয়েছে।
সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ অকেজো। উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্যাদি বহনের একমাত্র মাধ্যম নদী পথ । সকল জলযান, এমনকি অভাবগ্রস্তদের নিকট খাদ্য প্রেরণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রদত্ত জলযানগুলোও ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সেনাদল বাহক এবং গানবোটে রুপান্তরিত করা হয়েছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাথায় শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্য খুব সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত রয়েছেঃ
যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।সেনাবাহিনী ওই একটি ভাষাই বোঝে । যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ত্রানসামগ্রী বহনের জন্য জলযান তুলে দেয়া হয়েছিল, তখন একজন সেনা কর্মকর্তা মন্তব্য করেন:”এখন আমরা সেইসব এলাকায় যেতে পারবো যেখানে অতীতে পারিনি।” তিনি জানতেন কিভাবে এইগুলো ব্যবহার হবে ।
ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ডঃ লিংকন সি.চেন এবং শিশু হাসপাতাল মেডিকেল সেন্টারের ডাঃ জন ই.রোহডে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে একটি প্রবন্ধ ‘ল্যানসেট’এ পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে,এখন ও নভেম্বরের মাঝে আনুমানিক ২ কোটি ৫০ লক্ষ জনগণ এক নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষে পতিত হবে।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষ অনাহার মৃত্যুবরণ করে। এই আসন্ন দুর্ভিক্ষ তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের মাত্রার চেয়ে অনেক দূর ছাড়িয়ে যাবে।একটি রক্ষণশীল ৩০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতিতে (মোট চাহিদার এক চতুর্থাংশ) অনাহারে মৃত্যু সংখ্যা হতভম্ব করে ১ কোটি কিংবা তারও বেশি হতে পারে।
যদিও একটি বিশাল মানবিক বিপর্যয় দৃশ্যমান, ইয়াহিয়া জাতিসংঘের সাথে খেলা খেলে যাচ্ছে । তিনি তার দখলদার সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান ছাড়া কোন ত্রাণ কার্যক্রম অনুমতি দেননি।আর পূর্বের ত্রাণ কার্যক্রমের ধরন দেখে বাঙালিরা জানে যে,তারা সেনাবাহিনীর সাহায্য ছাড়াই নিরাপদ থাকবে। যদি বিশ্ববাসী এই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের জন্য কোনভাবে নিজেদের দায়ী মনে করে ,তাহলে তাদের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হল বাঙালি জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যম।
প্রাক্তন ব্রিটিশ শ্রম মন্ত্রী পিটার শরে অনুরুপ প্রস্তাব দেন।“ সর্বপ্রথম জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি মধ্যকার আস্তাভাজন সম্পর্ক দ্রুত স্থাপন করা জরুরি।”বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং সঙ্গত কারনেই প্রশাসনিক খাদ্যত্রান কর্মসূচী বাতিল করতে হবে।”
বিশ্ব বিবেক বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে এটা ভয়ঙ্কররুপে অস্বস্তিদায়ক হবে যে আগামী মাসগুলোতে দশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করবে। খুব অল্প সময় বাকী আছে। বিবেকবান নারী এবং পুরুষদের এখনই সক্রিয় হতে হবে।
.
.
অনুবাদঃ তামীম
<৬, ৩২২, ৫৫৮-৫৫৯>
শিরোনামঃ একটি দেশত্যাগী শিশুর লেখা
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১
.
একটি উদ্বাস্তু শিশুর লেখনী থেকে,
নাসরিন
দোসরা মে শেষ হয়েছিলো সুন্দর একটি বসন্তের সন্ধ্যা দিয়ে, যেই দিনটির কথা জীবন থাকা পর্যন্ত ভুলতে পারবোনা। আমরা তখনো পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজেলা শহর রামগড়ে। আমি এখনো যখনি সেই দিনের কথা ভাবি, মনের চোখে দেখতে পাই ছোট্ট শহরটির মানুষরা সহজ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।
মে মাসের দ্বিতীয় দিনে কর্নেল জিয়াউর রহমান আমার বাবাকে বলেছিলেন তিনি যেন পরিবার নিয়ে সীমান্তের ঐ পাড়ে চলে জান। বিএসএফ আমাদেরকে নদী পার হতে সাহায্য করেছিলো। বেলা চারটার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রামগড়ে এসেছিলো এবং তারপরেই আমি দেখি আমার কলেজের কিছু বন্ধু আর শৈশব থেকে চেনা কিছু বন্ধু হাসিমুখে সামনের দিকে হেঁটে জায়গামতো অবস্থান করলো। ইবিআর, ইপিআর এবং পুলিশরাও একই কাজ করেছিলো।
কিন্তু আমার শঙ্কিত মনের ভিতর শুধুই ভয় আর দুশ্চিন্তা কাজ করছিলো আমার বন্ধুদের জন্য। তাদের কেউ কেউ মাতৃভূমির জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলো।
ধীরে ধীরে আকাশে তারা ফুটে জানান দিচ্ছিলো দিন আসছে শীঘ্রই। হঠাৎ আমি একটি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম, বুঝে উঠতে পারিনি ঠিক কোন দিন থেকে শব্দটি এসেছিলো। আমার বাবার পিওন কে দেখলাম আমার দিকে দৌড়ে আসছিলো, যিনি আমার উপর ভীষণ বিরক্ত পুলিশ স্টেশনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। আমার হাত ধরে তিনি টেনে আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসার পরই বুঝতে পারলাম কি হয়ে গেছে!
সন্ধ্যার টকটকে লাল আকাশের নিচে আমি আমার বন্ধুদের দেখছিলাম দৌড়ে তাদের যুদ্ধের অবস্থানে যাচ্ছে। ভীষণ ভয় পেয়ে আমি দৌড়াতে শুরু করি, জীবনে প্রথম বারের মতো মর্টার শেল বৃষ্টির মতো পড়তে দেখেছিলাম আকাশ থেকে, সব জায়গায়। এই ভয়াবহ দুর্যোগের মুহূর্তেও ভীষণ কৌতূহলে আমাদের কিছু প্রতিবেশী আর আমরা তিন বোন একটি টিলায় উঠেছিলাম, দেখেছিলাম আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে।
কিন্তু তবুও আমরা আশা হারাইনি, কারণ আমরা জানতাম একদিন আমরা আমদের দেশকে মুক্ত করবোই, এই দেশের পবিত্র মাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা একজন হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যকেও থাকতে দেবেনা।
আশাবাদী এই চিন্তার মাঝেই দেখলাম আমাদের ছোট হসপিটালের ডাক্তার আমার বোন নাসিমের দিকে দৌড়ে আসতে, সাহায্যের জন্য। আমরা তিন বোন তাকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। মর্টার আর মেশিনগানের শব্দ এতো কাছে চলে এসেছিলোযে আমরা ভেবেছিলাম সেগুলো আমাদের আহত ভাইদের উপর এসে পড়বে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ চলেছিল আরও ২দিন। কিন্তু আমাদের সাহসী যুবকরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো কারণ পাকিস্তানি বাহিনীর ছিলো তিন গুন শক্তিশালী, সাথে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।
কিছুদিন পর, ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে বয়ে চলা ছোট্ট ঝিরির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখতে পেলাম বন্য বর্বর হানাদার বাহিনী আমাদের দেশের কাঁঠাল খাচ্ছে। তাদেরকে শেষবারের মতো এই ফল খেতে দাও, কারণ তারা আর জীবনে কোনদিন এই সুযোগ পাবেনা।
আমাদের প্রিয় বাবা আর ভাইরা অবশ্যই এই বর্বর ইয়াহিয়ার ছেলেদের ফেরত পাঠাবে এবং আর কোনদিন যেন ফিরে আসতে না পারে এমনভাবেই ফেরত পাঠাবে। এবং আমি নিজেও এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি সুযোগ পাই কমপক্ষে একজন পাকিস্তানি হানাদারকে হত্যা করবো, আমাদের দেশের শান্তিকামী প্রিয় নারী পুরুষ আর শিশু হত্যার প্রতিশোধ নিতে।
আমার মা এবং বোনরা নির্যাতিত হয়েছিল তাদের কাছে। আমি, বাংলাদেশের একটি মেয়ে হিসেবে, কখনো পাকিস্তানি বাহিনীর উপর প্রতিআঘাতের সুযোগ ছেড়ে দেবনা।
.
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রবাসী বাঙালীদের দ্বারা প্রকাশিত পত্র–পত্রিকা (বৃটেন)
[ইংরেজি পত্রিকা]
অনুবাদঃ জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা
<৬, ১, ৫৬২>
ব্রিটেন
ইংরেজী সংবাদপত্র
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ঐক্যবদ্ধ হও নয়তো নিন্দা কুড়াও | বাংলাদেশ নিউজ লেটার, লন্ডন নম্বরঃ ৪ | ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১ |
ইউনাইট অর বি ড্যামড (ঐক্যবদ্ধ হন অথবা ধ্বংস হয়ে যান)
‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ এর সামরিক একনায়কতন্ত্র বাঙালীদের উপর একটি জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম চাপিয়ে দিয়েছে। একটি অপ্রস্তুত এবং নিরস্ত্র জাতি এখন তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করছে। এবং এই যুদ্ধটি চলছে এমন দুইটি পক্ষের মধ্যে যাদের এক পক্ষের রয়েছে আধুনিক সেনাবাহিনী, যারা অতি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ন্যাপাম বোমা থেকে স্যাব্রি জেট সবই এদের আছে। আরেক পক্ষের বুকে একটা দৃঢ় প্রত্যয় ছাড়া আর কিছুই নেই। এবং তাদের প্রত্যয়টি হলো নিজের মাতৃভূমিতে তারা কিছুতেই অন্যের দাস হয়ে থাকবে না।
জয় আমাদেরই হবার কথা। কারণ আমাদের মাটির বীর সন্তানেরা বিদেশী হানাদারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়ছে। আমরা তাদেরকে আমাদের লোকবল দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলবো। আমাদের সুড়ঙ্গ ও জলাধারের মধ্যে তাদেরকে ফাঁদে ফেলব। তারপর আমরা এক এক করে ওদেরকে পানিতে চোবাবো। আমরা ওদেরকে ধ্বংস করে দেবো এবং স্বাধীনতার জন্য আমাদের যে সহযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের হত্যার উপযুক্ত বিচার করব। এই নৃশংস খুনিদের বিচার হবে না, এ কিছুতেই হতে পারে না।
কিন্তু এই বিজয়ের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো আমাদেরকে আরও সংগঠিত হতে হবে। কোন লক্ষ্যের জন্য যে ঐক্য তা আমরা ইতোমধ্যে অর্জন করেছি। এখন বাস্তবায়নের জন্য যে ঐক্য তার জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। প্রবাসী বাঙালীদের জন্য এটাই সময়, নিজেদের মধ্যে সব দল উপদল ভিত্তিক সকল সংকীর্ণতা এবং ঝগড়াঝাটি ভুলে, নিজের সকল প্রচেষ্টা ও সামর্থ্যকে একত্রিত করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানো।
তাই অনুগ্রহ করে ! অনুগ্রহ করে ! অনুগ্রহ করে !
একত্রিত হন এবং কাজে নেমে পড়ুন।
এবং খুব তাড়াতাড়ি নেমে পড়ুন।
.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ২, ৫৬৩-৫৬৮>
শিরোনামঃ যুক্তরাজ্য ডায়েরী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং ৪
তারিখঃ ২৬ শে এপ্রিল, ১৯৭১
.
যুক্তরাজ্যের দিনলিপি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যকর পরিষদ
২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১ শনিবার; যুক্তরাজ্যের কভেন্ট্রিতে স্থানীয় ও আঞ্চলিক কার্যকর পরিষদের প্রতিনিধিদের জাতীয় সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যকর পরিষদ গঠন করা হয়। ১২৫ জনেরও বেশী সর্বজনস্বীকৃত প্রতিনিধি এবং ২৫ জনেরও বেশী পর্যবেক্ষক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বেগম বিলকিস বানুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ উপাচার্য বিচারপতি আবু সাইয়ীদ চৌধুরী।
কেন্দ্রীয় কার্যকর পরিষদের সৃষ্টি যুক্তরাজ্যের বাংলাভাষী অভিবাসীদের রাজনৈতিকভাবে একত্রীকরণের এক নবযাত্রার সূচনা করেছে। সংগঠকরা উল্লেখ করেন, এই কাজটি অনেক শ্রমসাধ্য হবে। কিন্তু তারা আশাবাদী ভবিষ্যতে অবশ্যই এই কাজের সুফল পাওয়া যাবে। জনাব আবু সাইয়ীদ চৌধুরী তার সমাপনী বক্তব্যে এই সম্মেলনকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের আন্দোলনের জন্য ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেন।
সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যকর পরিষদের সকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৫ সদস্যের কার্যকর সমিতি নির্বাচিত করা হয়। জনাব আবু সাইয়ীদ চৌধুরীকে নবগঠিত সমিতির উপদেষ্টা পদের জন্য আহবান জানানো হয়।
অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউজ
পিস নিউজ এর কার্যালয়ে ২টি সভার পর বাংলাদেশ এবং এর সাহায্যার্থে সকল কার্যক্রমের জন্য ক্লিয়ারিং হাউজ গঠন করা হয়। এই সভায় বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা ; যেমন – বাংলাদেশ ছাত্র কার্যক্রম সমিতি, ইন্টারন্যাশনাল কন্সাইন্স ফর অ্যাকশন, পিস প্লেডজ ইউনিয়ন, ফ্রেন্ডজ পিস কাউন্সিল, থার্ড ওয়ার্ল্ড রিভিউ, ইয়ং লিবারেলস, পিস নিউজ, ক্যাম্পেইন ফর সেলফ রুল ফর বাংলাদেশ উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন লেবার পার্টির সংসদ সদস্য জনাব মাইকেল বার্নস এবং জাকারিয়া চৌধুরী।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্বের এই সংকটলগ্নে বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তায় লন্ডনে ক্লিয়ারিং হাউজ গঠন করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ জনগণের কাছে পৌছানো নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। একটি কার্যালয়, ফোন এবং স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়েই এই ক্লিয়ারিং হাউজ গঠিত। ক্লিয়ারিং হাউজের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারী, সংবাদ সংস্থা, শান্তি ও ধর্মীয় সংগঠনের সদস্যরা কিভাবে তাদের জনবল অগ্রসর করাবে এবং ত্রাণ বিতরণ করবে এই বিষয়ে তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহ করা হবে। ঠিকানা – অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউজ। ৩৪ স্ট্রাটফোরড ভিলাস। লন্ডন এন ডাব্লিও ১। টেলিফোন – ০১-৪৮৫২৮৮৯। শুধুমাত্র সকাল ১০ টা থেকে বেলা ১ টা পর্যন্ত। সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত কার্যালয় খোলা থাকবে।
ত্রাণ তহবিল
জেনেভার রেড ক্রস সোসাইটির সংঘ ফেডারেশন অফ ন্যাশনাল রেড ক্রস দল তাদের দীর্ঘমেয়াদী শরৎকালীন ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত নাগরিক পুনর্বাসন প্রকল্প অনিদৃস্টকালের জন্য স্থগিত রেখেছে। সংঘের কাছে প্রায় ২ মিলিয়ন বৃটিশ পাউন্ড অব্যবহৃত পড়ে আছে। বৃটেনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা, যার অন্তর্ভুক্ত বৃটিশ রেড ক্রস, অক্সফাম, সেভ দ্যা চিল্ড্রেন, ওয়ার অন ওয়ান্ট এবং ক্রিশ্চিয়ান এইড নিদৃষ্ট প্রকল্পে প্রায় ৮ লক্ষ বৃটিশ পাউন্ড খরচ করেছে এবং এসব সংস্থার কাছে আরও প্রায় ৭ লক্ষ পাউন্ড রয়েছে যা যুদ্ধ, তথ্য ও যোগাযোগ ঘাটতির কারণে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
১৫ই এপ্রিল গার্ডিয়ান পত্রিকার মাইকেল লেক এক উদ্ধৃতিতে জানান, – খুব সহজেই এই অবস্থার সংকলন করা সম্ভব। নির্মম সত্য হচ্ছে, পূর্ব বঙ্গের অর্থনীতি যা সর্বদাই সমস্যাগ্রস্ত ছিল, এখন পুরনাঙ্গরূপে ভেঙ্গে পড়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিতরণ অবকাঠামো স্থানীয় পরিষদ থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্রই ধ্বংসের শেষ পর্যায়। চট্টগ্রামের মুল বন্দর অথর্ব হয়ে আছে এবং ২৬ টি ত্রাণ বাহী জাহাজ বন্দরের বাহিরে অবস্থান করছে। প্রাক বর্ষাকালীন বৃষ্টি সম্ভাব্য সকল অগ্রসরতায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। আগামী মাসের সম্ভাব্য বর্ষা আবশ্যিকভাবেই বন্দরের পড়ে থাকা সকল ত্রাণ সামগ্রীর নষ্ট হওয়া নিশ্চিত করছে। উপরন্ত অর্ধ বাৎসরিক ঘূর্ণিঝড় অধিক সংখ্যক মৃত্যু ও ক্ষতির পূর্বাভাস দিচ্ছে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ব বাংলার প্রতিরোধ গুড়িয়ে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু, বস্তুত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে একত্রীভূত হওয়া সমগ্র জনসংখ্যার সামনে তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে।
“আমরা এত নিশ্চুপ কেন?”
“আমরা এত নিশ্চুপ কেন?” – এভাবেই জনাব উডরো ওয়াট ২৬শে এপ্রিলের ডেইলি মিররের প্রথম পাতার এক অনুচ্ছেদে তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ” আমি পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া গণহত্যার প্রতিবাদে একটি শব্দও না বলা ও না লেখার জন্য গভীরভাবে লজ্জিত।
এবং কেন আমরা এত নীরব?
কোথায় সেসব বিপ্লবী যারা বায়াফ্রাতে বৃটিশ ও নাইজেরিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল?
কোথায় সেসব মানব দরদী যারা পারমাণবিক অস্ত্র সমর্পণের দাবীতে অল্ডারমাস্টন থেকে পদযাত্রা করেছিল?
পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা এসব ঘটনার থেকেও ভয়াবহ।
বায়াফ্রার অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, কিন্তু বায়াফ্রার কর্নেল অযুকয়া কোনরকম প্ররোচনা ছাড়াই অপ্রয়োজনীয় এই গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই এলাকা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার মাইলের ব্যবধানে বিভক্ত।
অরক্ষিত, শান্তিপ্রিয়, দারিদ্র্য দুর্গত বাঙালী হত্যা শুরু হয়। শত শত ছাত্র, রাজনৈতিক নেতাকে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হাজার হাজার সাধারণ, নির্দোষ বাঙালীকে বোমা ও গুলি মেরে হত্যা করা হয়। সাধারণ নির্বাচনের জয়ী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং এর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়।
সকল সংবাদ সংস্থা, টেলিভিশন সংবাদদাতা অথবা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের নিষিদ্ধ করা হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া সমগ্র বিশ্বকে হিটলার ও স্টালিন পরবর্তী বর্বরতার ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞত রাখতে দৃঢ়বদ্ধ।
আমরা এই বিষয়ে কি করছি? আমরা এখনও জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিচ্ছি।
এবং মঙ্গলবার সাধারণ সাংসদদের সভায় জনাব হিথ বলেন, যদি জনাব উইলসন আমাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির সাথে ঘটা কথোপকথনের বিস্তারিত জানাতে জোর না করতেন তবে তিনি খুশী হতেন।
একটি সমগ্র জাতিকে গুড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টা কোন বন্ধু সভায় আলোচনার অভ্যন্তরীণ বিষয় বস্তু নয়। যদি আমাদের কিছু নৌবহর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে বিক্রয়ের বিষয় কমনওয়েলথকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে, তবে কেন এই বিষয়ে নিশ্চুপ থাকবে?
কেন আমরা এই বিষয়টা জাতিসংঘে তুলে ধরছিনা? জনসম্মতি ছাড়া উগান্ডার ক্ষমতা হরণের পর আমরা খুব দ্রুতই জেনারেল আমিনকে চিহ্নিত করেছিলাম।
আমরা কি সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ভোটকে স্বীকৃতি দেই না? নাকি বাংলার মানুষ অত্যন্ত গরীব, অনেক দুরের দেশ অথবা আমাদের স্বার্থে তারা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ না?
আমাদের সরকার কি সামান্য নৈতিক নিন্দা প্রকাশেও সাহস পায় না? নাকি ভিন্ন ধারার যৌন চলচ্চিত্রের হস্তমৈথুনরত শিক্ষকদের মতই এর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ?
আমাদের কি হয়েছে? আমরা কি আমাদের নতুন পাওয়া টেবিল টেনিস বন্ধু চীনাদের অখুশি করতে এতটাই ভীত? যারা সম্প্রতি জেনারেল ইয়াহিয়াকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে।
গত শতাব্দীতে তুর্করা যখন আর্মেনিয়ার খ্রিষ্টানদের হত্যা করে তখন, গ্ল্যাডস্টোন (প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ) তাদের বিরুদ্ধে সরব ভুমিকা পালন করেন। আজকে আফসোস, আমরা খুবই ক্ষুদ্র মানুষ দ্বারা শাসিত।
এখনও জেনারেল ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা এমন যে, সামান্য চাপ তাকে এইসব ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে সমীচীন হতে বাধ্য করবে।
আন্তর্জাতিক গণহত্যা
১৬ই এপ্রিলের পিস নিউজে রজার মুডি লেখেন,- ” সম্প্রতি পূর্ব বঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান যা ঘটিয়েছে এবং যা অর্জনের জন্য ঘটিয়েছে তার জন্য আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ থাকতে পারে না। যদিও বা ইয়াহিয়া খান সংঘাতহীন ভাবে পূর্ব বঙ্গের জনগণকে ভারসাম্যহীন অঙ্গরাজ্যে ( যা কখনই পুরনাঙ্গ যুক্তরাষ্ট্র ছিল না ) পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, এটা সর্বসম্মতভাবেই বিশ্বাসযোগ্য যে, করাচীর সামরিক সরকার পশ্চিমের খাদ্য যোগাতে পূর্বের জনগণের রক্ত ঝরানো অব্যাহত রাখবে। এবং এমন এক কৃত্তিম অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করবে যা শীঘ্রই পূর্ব বঙ্গের লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার নিজের মনে ধারণা করতে চেয়েছি , পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী এখন যা করছে তা ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ সময়কালীন হিটলারের নীল নকশার চেয়ে কম, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটা গণহত্যা। সাত্রের পরিভাষায় এটা আন্তর্জাতিক গণহত্যা এবং জাতিসংঘের গণহত্যা বিষয়ক সম্মেলনের ( যুক্তরাজ্য ১৯৬৯ ে যা স্বাক্ষর করে ) রীতি সুবিস্তৃতভাবে এই উক্তির সমর্থন করে। এই সময়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও লিখিতভাবে পাকিস্তানকে দেউলিয়া অবস্থার সম্মুখীন করবে। এখন এটা খুবই পরিষ্কার যে, পাকিস্তান সরকার বাঙ্গালীর আত্মসমর্পণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। এখন উদ্দেশ্য একটাই হতে হবে, পূর্ব বঙ্গের যেখানেই সম্ভব হবে, পশ্চিম পাকিস্তান কতৃপক্ষের সকল কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা, যাতে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়া কোন উপায় না থাকে।”
ছাত্র কার্যক্রম সমিতি
গত রবিবারের প্রদর্শনীর পর ছাত্র কার্যক্রম সমিতি যুক্তরাজ্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহানুভূতি ও সমর্থন সংগ্রহের জন্য সংসদীয় পর্যায় তাদের তদবির বাড়িয়ে দিয়েছে।
ছাত্ররা পাকিস্তান ক্রিকেট দলের পরিকল্পিত সফরের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ও প্রদর্শনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে। তারা ইতিমধ্যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে প্রত্যাখ্যান করার এবং প্রতিরোধের জন্য ইয়ং লিবারেল দল এবং সাধারণ সংসদ সদস্যদের ৩০ জন সদস্যের পূর্ণ সমর্থন যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছে। ছাত্ররা চায়, খেলোয়াড়ি মনোভাবসম্পন্ন বৃটিশ জনগণ অনুভব করুক, যখন পশ্চিম পাকিস্তান সেনারা হিটলারি কায়দায় পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা চালাচ্ছে, তখন তাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ক্রিকেতের মত আনন্দময় ও ন্যায়সঙ্গত খেলা যুক্তরাজ্যে খেলতে আসছে। যা কিনা বৃটিশ জনগণের ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষ অনুভূতির জন্য অবমাননাকর। সাড়ে ৭ কোটি জনতা পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের স্বাধীন দেশের জন্য লড়াই করছে। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিকাংশই পাঞ্জাবী খেলোয়াড় এবং পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড সামরিক জান্তার অধীনে পরিচালিত সংস্থা। বৃটিশ খেলোয়াড়দের বুঝতে হবে, পশ্চিম পাকিস্তান কখনোই পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।
ওয়েলস এ বাংলাদেশ কার্যক্রম সমিতি
কার্ডিফ থেকে জনাব নুরুল হোসেন লিখেছেনঃ –
আমরা ওয়েলসের অভিবাসীরা গত ২৭শে মার্চ ” বাংলাদেশ কার্যক্রম সমিতি ” গঠন করেছি। এর প্রধাণ কার্যালয় কার্ডিফে ( ৮ নর্থ কোট স্ট্রীট, রোথ, কার্ডিফ, ওয়েলস। ফোন- কার্ডিফ ৪৪৭০২ )। ওয়েলসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে বাঙালী জনগণ এই সভায় যোগ দেন এবং এই কার্যক্রম সমিতিকে সমর্থন জানান।
আমরা ২৮শে মার্চ লন্ডনে বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটির সাথে সম্মিলিতভাবে রাশিয়া, সিলন, আমেরিকা ও ভারতের দূতাবাসের সামনে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করি।
আমরা কার্ডিফের এনজেল হোটেলের বাইরে জনাব হিথ এর সামনে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করি। জনাব হিথ ৩রা এপ্রিল কার্ডিফ সফরে আসেন এবং আমাদের প্রদর্শনীর প্রচারপত্র বিতরণ করেন এবং পূর্ব বঙ্গের গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা প্রকাহ করেন।
আমরা ১১ই এপ্রিল কার্ডিফে এক সাধারণ সভার আয়োজন করি যাতে ৫০০ জন বাংলাদেশী কার্ডিফ, নিউপোর্ট, সোয়ানসী, ব্রিগেন্ড, পেন্টার, নিথ সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন এবং ২৬ সদস্যের এক সমিতি গঠন করা হয়।
বাংলাদেশী জনগণের জন্য ত্রানের অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি অর্থ সংস্থান সমিতিও গঠন করা হয়।
১৮ই এপ্রিল বাংলাদেশের সমসাময়িক অবস্থা আলোচনা এ কাঠামোগত পরিকল্পনার জন্য সমিতির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, জনগণ অন্তত এক সপ্তাহের বেতন কিংবা নিদেনপক্ষে ২৫ পাউন্ড প্রাথমিক অনুদান হিসেবে দিচ্ছে এবং যতদিন পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে ততদিন সপ্তাহে ১ পাউন্ড করে অনুদান দিতে থাকবে।
আমরা সমগ্র ওয়েলসের জনগণের মাঝে আমাদের প্রচারপত্র বিতরণ করেছি এবং বাংলা ভাষায় সাপ্তাহিক এক পাতার সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
“নিষ্ঠুরভাবে দমন নীতি”র উপর ফ্রাঙ্ক যুড এর বক্তব্য
পশ্চিম পোর্টসমাউথের লেবার পার্টির সংসদ সদস্য জনাব ফ্রাঙ্ক যুড এক বক্তব্যে জানান, ” বৃটেনের উচিৎ পাকিস্তানে সকল সাহায্য কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া। প্রথমে পূর্ব বঙ্গের পুনর্বাসন এবং দ্বিতীয়ত ‘নিষ্ঠুরভাবে দমন’ নীতির সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহযোগিতায় বৃটেনের অস্বীকৃতি প্রদর্শন “।
অবশ্যম্ভাবী বাংলাদেশ
হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন অধ্যাপক – এডওয়ার্ড এস. মেসন, রবার্ট ডরফম্যান এবং স্টিফেন এ. মারগ্লিন স্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় ১লা এপ্রিলের এক বক্তব্যে জানান – ” পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা অনিবার্য। সংযুক্ত পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন , পূর্ব বঙ্গের সাধারণ মানুষের গণহত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তর হয়েছে এবং আজ না হোক কাল স্বাধীন পূর্ব বঙ্গের উৎপত্তি ঘটবেই। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র “।
লর্ড ব্রডওয়ের তিরস্কার
১৮ই এপ্রিল এক বক্তব্যে লর্ড ফেন্নার ব্রডওয়ে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সরকারের কর্মকাণ্ডকে হিটলার পরবর্তী বিশ্বের সবচেয়ে নির্মম ও বর্বরতর ঘটনা আখ্যা দিয়ে তিরস্কার জানান।
ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সভায় স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সংকল্প গ্রহণ করা হয়।
পিন্ডির নির্যাতনের প্রতিবাদে যুগোস্লাভিয়া
যুগোস্লাভিয়ার নির্ভরযোগ্য সংবাদপত্র কমিউনিস্ট যা ক্ষমতাসীন দল লীগ অফ কমিউনিস্ট এর মুল গণমাধ্যম এবং সরকার দলীয় মতামতে প্রকাশিত; ৭ই এপ্রিলের এক সম্পাদকীয়তে প্রকাশ করে, – ” পূর্ব বঙ্গের পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে এবং আমরা পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে হাজার হাজার নিরীহ লোকের হত্যার জন্য দায়ী করি। পাকিস্তানের মর্মান্তিক অবস্থা দুর্ভাগ্যবশত এই বছরের ষষ্ঠ ঘটনা যেখানে সেনাবাহিনী রাজনীতির মুক্ত অঙ্গনে হস্তক্ষেপ করেছে “।
সোশ্যালিস্ট লেবার লীগ
সোশ্যালিস্ট লেবার লীগের প্রধাণ প্রচার মাধ্যম, ওয়ার্কার্স প্রেস পত্রিকার সম্পাদক মাইক বান্ডা গত ১৮ই এপ্রিল লন্ডনের ইস্ট এন্ডের টইয়েনবি হলের জনারণ্যের উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখেন। তিনি তার আবেগপূর্ণ বক্তব্যে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী মানুষের স্বাধীনতার জন্য তার সংস্থা ও পত্রিকার পূর্ণ সমর্থনের কথা উল্লেখ করেন।
বৃটিশ লেবার আন্দোলনের সর্বস্তরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য সমর্থন জানিয়ে জনাব বান্ডা বলেন, বাঙালীদের আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদের উপর বিশাল আঘাত। তিনি জাতিসংঘ ও তথাকথিত শক্তিশালী রাষ্ট্রের উপর বিশ্বাস না রাখার ব্যাপারে সতর্ক করেন। তিনি বৃটিশ কর্মজীবী শ্রেণীর সকলের কাছে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থিত সকল বাঙালীকে সমর্থনের আবেদন জানান।
পূর্ব বঙ্গে ত্রাণ সরবরাহে স্বেচ্ছাসেবী
পিস নিউজ ( ৫ ক্যালেডোনিয়ান রোড, লন্ডন এন-১ ) পত্রিকার সম্পাদক রজার মুডি ঘোষণা দেন – ” বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লন্ডনের একটি ছোট দলের পূর্ব বঙ্গে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যাবার সকল সম্ভাবনা ভেবে দেখা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকদের যেকোনো পরিণতি হতে পারে জানা সত্ত্বেও এই কাজে ইচ্ছুক লোকদের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক দল গঠনের আশা প্রকাশ করছি। সম্ভাব্য সকল শারীরিক ভাবে সক্ষম এবং ব্যক্তিগত সমস্যামুক্ত স্বেচ্ছাসেবীদের যত দ্রুত সম্ভব পিস নিউজের কার্যালয়ে রজার মুডির বরাবর লিখিত আবেদন জমা দেবার আহবান জানানো হচ্ছে। দয়া করে ফোনে আবেদন জানাবেন না। অন্যান্য প্রশ্ন এবং সাহায্য প্রদান কিংবা উপদেশ চিঠির মাধ্যমে জানাতে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে “।
.
.
অনুবাদঃ তানুজা বড়ুয়া
<৬, ৩, ৫৬৯-৫৭০>
শিরোনামঃ আমেরিকার চিঠি
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং ৪
তারিখঃ ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১
.
আমেরিকার চিঠি
নিউ ইয়র্ক (এয়ার মেইলে )
ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়োগ করে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, এ খবরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং লাতিন আমেরিকার জনসাধারণ গভীরভাবে শঙ্কিত।
জনমত পূর্ব বাংলার জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার রক্ষার দাবীতে সম্পূর্ণ একাত্ম , যে দাবী উত্থাপন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকার ব্যানারে সংগঠিত, আমেরিকায় বসবাসরত বাঙ্গালী ছাত্ররা , ২ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘটনার রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে এবং বাংলাদেশের দাবীকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । তারা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তৃতা, শিক্ষণ, সমাবেশ এবং লবিং এর জন্য জোরেশোরে প্রচারণা চালানোর জন্য সংগঠিত হচ্ছে। বেঙ্গল একশন কমিটি অব ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকার ২ মার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেটির প্রধান কার্যালয় নিউ ইয়র্কে অবস্থিত। এই একশন কমিটি গঠনের ফলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয় :
(ক) হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সারা দেশজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিপীড়িত বাঙ্গালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের বক্তৃতা এবং শিক্ষণে এটি একটি নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে।
(খ) ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস কালচারাল অরগানাইজেশন বেংগল একশন কমিটির স্বাধীনতা আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।
(গ) “আমেরিকানস কনসারনড ফর বাংলাদেশ” নামে অন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যার কার্যালয় নিউ ইয়র্কের 145 East 14th Street-এ। ইতোমধ্যে এই সংগঠন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মিশনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে।
একশনর কমিটির প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির সাক্ষাৎকার প্রার্থনার উদ্যোগ গ্রহণ করা। তারা সভাপতিকে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের উপর তার ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানোর জন্য একান্ত অনুরোধ জানান , যাতে তারা নিপীড়িত মানবতার স্বার্থে পূর্ব বাংলায় হস্তক্ষেপ করে এবং তাঁকে পূর্ব বাংলার দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সহায়তার অনুরোধ জানান।
একশন কমিটির উদ্যোগে প্রথম বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ৯ মার্চ , জাতিসংঘ ভবনের সামনে। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা কিছু আমেরিকান ছাত্রসহ নিউ ইয়র্কের বেশ কিছু প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে এবং অবশেষে পাকিস্তানের কন্স্যুলেট জেনারেল এর কার্যালয়ের সামনে এসে তা শেষ হয়। তারা কয়েক ঘন্টার জন্য কার্যালয় দখল করে এবং সাংগঠনিক বিষয়ে বেশী কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।
এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশের জনসাধারণের উপর গনহত্যা বন্ধ করতে , কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ জানায়।
এ্যাকশন কমিটি অপর একটি টেলিগ্রামে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারার আওতায় নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহবান করার জন্য অনুরোধ জানায় এবং পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ওপর পরিচালিত নির্দয় এবং বাছাইকৃত গণহত্যা বন্ধে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর অনুরোধ জানায়। এ্যাকশন কমিটি ফ্রান্স সহ নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যকে আহ্বান জানান এবং বাংলার ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। ফ্রান্স , আর্জেন্টিনা এবং ভারতের প্রতিনিধিগণ এ্যাকশন কমিটির সদস্যদের একাধিকবার সাক্ষাৎ মঞ্জুর করেন।
এছাড়াও আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় চিঠি-পত্র পাঠানো এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উপস্থিতির পাশাপাশি, একশন কমিটি বহু সংখ্যক বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করে। ২৬ মার্চ বিক্ষোভকারীরা জাতিসংঘ ভবনের সামনে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। এছাড়া পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়ার সৈন্য বহনকারী পশ্চিম পাকিস্তানি নৌ ও বিমানবহরে সুবিধাদি প্রদান বন্ধ করার দাবী জানিয়ে তারা শ্রীলঙ্কান মিশনের সামনে বিক্ষোভ করে।
এই বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পূর্ববঙ্গের নৃশংস গণহত্যার কথা টেলিভিশন এবং বেতারে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সম্প্রচারিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র , কানাডা এবং লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের বড় বড় শহরে অবস্থানরত বাঙালী ছাত্ররা স্থানীয় ছাত্রদের সঙ্গে মিলে একশন কমিটির শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে।
একশন কমিটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ত্রাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহের জন্য ১৬ সদস্য বিশিষ্ট ফাইন্যান্স কমিটি গঠন করে।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬, ৪, ৫৭১-৫৭৪>
শিরোনামঃ যুক্তরাজ্য ডায়েরী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার লন্ডনঃ নং ৭
তারিখঃ ২১ জুন, ১৯৭১
.
ইউনাইটেড কিংডম ডায়েরী
আন্থনি মাসকারেনাস
“ পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক পুর্ব বাংলার মানুষের উপর গণহত্যা” বিষয়ক “The bombshell of the week” প্রকাশনায় আন্টনি মাসকারেনাস , মর্নিং নিউজের(করাচি) উপ–সপাদক, টাইমস ও সানডে টাইমস এর পক্ষ থেকে পাকিস্তানে নিযুক্ত।
২রা মে “সানডে টাইমস” প্রকাশ করে টনির একটি লেখা যেখানে বাঙালীদের দ্বারা অবাঙালী ও বিহারীদের উপর ভহাবহ হত্যাকান্ডের কথা বলা আছে যা আমরা অতিরঞ্জিত, একপেশে ও বিরুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ইহার উপর ভিত্তি করে বলা যায় বিষয়গুলো আর্মি ও “ইসলামিস্ট”দের দ্বারা সরবরাহকৃত । আমরা তখন বলেছিলাম যে বাস্তবিকপক্ষে ইহা ‘ইন্টার সার্ভিস রিলেশনের’ হস্তক্ষেপে করা এবং টনি’সহ আরো পাকিস্তানি সাংবাদিক যারা ব্রিটিশ ও আমেরিকান পত্রিকায় লিখেন তাদেরকে জোরপূর্বক তাই লিখতে দেওয়া হয়েছে যা আর্মি তাদেরকে লিখাতে চেয়েছিলো। বর্তমানে ১৩ জুন টনি নিজে “সানডে টাইমস”এর একটি নিবন্ধে প্রকাশ করেন তার বন্দুকসম্মুখে লিখা রিপোর্টের কথা। আমরা টনিকে সাধুবাদ জানাই এবং আনন্দিত যে সে রক্তপিপাসুদের দেশ থেকে দূরে আছে ও গণতন্ত্রের এমন দেশে নিরাপদে আছে যেহানে কারো কলম অথবা জবান বুলেট এবং বেয়নেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না । তার নিবন্ধ “genocide by the Pakistani army ” (পাকিস্তানি আর্মিদের দ্বারা গণহত্যা) সমগ্র প্ররথিবীকে চিরকাল তাড়িয়ে বেড়াবে। যদি নির্বাচনের পর পরই ক্ষমতা আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করা হত তাহলে কোন সন্দেহই ছিলো না যে শেখ মুজিবুর রহমান এই সাম্প্রদায়িক এবং বিভাগীয় হত্যাকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন যেভাবে তিনি তার তিন সপ্তাহের “অভন্তরীণ আনুগত্য” ও সাম্প্রতিক সাপ্রদায়িক দাঙা হাঙ্গামার সময় শাশন কার্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
রেহমান সোবহান
আমাদের সর্বশেষ ইস্যু প্রকাশিত হওয়ার পর রেহমান সোবহান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসেন। রেহমান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছিলেন দাতা দেশগুলোর প্রতিবনিধিদের সাথে দেখা করতে এবং ইহাহিয়ার প্রুধান অর্থ সচিব এম.এম.আহমেদের ভোজবাজির বিরোধীতা করতে যে কিনা প্রত্যাশিত আমেরিকার সকল দরজায় ভিক্ষার থালা নিয়ে ঘুরছিলেন।
লন্ডনে রেহমান যোগাযোগ করেন নিউ স্টেটম্যান এ থাকা তার বন্ধুদের এবং পত্রিকাটি “corpse in the sun” নামে একটি শক্তিশালী সম্পাদকীয় নিয়ে প্রতিভূত হয়। পরবর্তী দিন থেকে “গার্ডিয়ান” ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকে তার নিবন্ধ “prelude to an order and genocide”(শাসন ও গনহত্যার উপক্রমনিকা) এবং “helping yahya to himself”(ইয়াহিয়ার নিজ সাহায্য )
বাংলাদেশ নিউজলেটার এক্টিভিটিস্ট ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষদের নিয়ে রেহমান দুই ঘন্টা স্থায়ী একটি প্রীতিসম্মেলনের ব্যবস্থা করেন “Ganges Restaurant” যা যথেষ্ট নজর আকর্ষনে সচেষ্ট হয়েছিলো।
প্রধান সম্পাদক , কলামিস্ট, লেখক, সংসদ সদস্য এবং বাণিজ্যিক নেতাদের সাথে রেহমান অনেকগুলো মিটিং করেন। “স্টুডেন্ট একশন কমিটি”র একটি জনসভায় উনি যোগদান করেন যেথায় উনি দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেন।
ত্রাণের লক্ষ্যে নারী মিছিল
৫-ই মার্চ এক শত পঞ্চাশ বাংলাদেশী নারী ও শিশু প্রধান মন্ত্রী ও
ত্রাণ সংস্থার জন্য প্রতিবাদের চিঠি হাতে ওয়েস্টমিন্সটারে মিছিল করে।
এই প্রতিবাদ গ্রেট ব্রিটেন এর বাংলাদেশ উওমেন্স এ্যাসোসিয়েশন দ্বারা সংগঠিত হয়। মিঃ হিথ, যিনি উপস্থিত ছিলেন না, এই চিঠিতে পাকিস্তান এ ত্রাণ কাজ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য তাকে আহবান জানান হয়।
প্ল্যাকার্ডে গণহত্যা শেষ করার জন্য, পাকিস্তানের জন্য সাহায্য, এবং পাকিস্তান সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য বলা হয়।
মিসেস জাহানারা রহমান, সংগঠক, বলেন, নারীরা ভারতের বাঙালি উদ্বাস্তুদের মধ্যে কলেরা মহামারি নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু তারা আশঙ্কা করছিল যে, কলেরা ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ পাঠানোর জন্যে খাদ্য ছাড়া শরণার্থীদের ভুলে যাওয়া হবে।
সমিতিটি ব্রিটেনে ৪০০ ইউরো, এবং একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিশুদের পোশাক সংগ্রহ করে। কিন্তু যখন এটি প্রেরণ করা হয়, এটা তাদের মানুষের কাছে পৌঁছাবে- এই আশ্বাস এর জন্য তারা অপেক্ষা করতে থাকে।
পাকিস্তানে এইড থামাতে প্রচারণা
ব্রিটেনে বাংলাদেশের সমর্থকদের একটি বড় বিক্ষোভ মিছিল ১৩ জুন পাকিস্তান এইড থামাতে একটি প্রচারণা Hyde Park থেকে শুরু করে বৈদেশিক উন্নয়ন, কানাডিয়ান হাইকমিশন ও মন্ত্রণালয়, ফরাসি, বেলজিয়ান, জার্মান, অস্ট্রিয়ান, আমেরিকান, জাপানি, ডাচ ও ইতালিয়ান দূতাবাস, যার সরকারগুলো পাকিস্তানে সাহায্য পাঠান তাদের কাছে পৌঁছান। মিছিলটি পার্ক লেন, পিকাডিল্লি, ডাউনিং স্ট্রিট এবং ট্রাফাল্গার স্কয়ারে মনোযোগ আকর্ষণ করে। মিছিলের একজন মানুষ পবিত্র কুরআন থেকে আবৃত্তি করে নেতৃত্বে ছিল। অন্য যুবক কবিতাও আবৃত্তি করেন। বিক্ষোভ কিছু দিনের জন্য চলতে থাকবে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতা “গণহত্যা দোষী“
ছয় প্রিভি কাউন্সিলর লেবার পার্টির চেয়ারম্যান সহ তিন শতাধিক শ্রমিক এমপি, জনাব ইয়ান মিকারডো এবং লেবার এর জাতীয় নির্বাহী, অন্য তিন সদস্য প্র্যাঙ্ক এলাউন, জনাব টম ড্রিবারগ, জনাব টম ব্র্যাডলে, জনাব জন স্টোন হাউস, প্রাক্তন পোস্ট ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী দ্বারা স্পন্সরক্রিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন- “জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন ভাঙার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতাদের আসামি করে বিচারের জন্য দায়ি করা হচ্ছে।”
সভায় প্রস্তাবিত বিষয় এর মতেঃ “সংসদ বিশ্বাস করে বিপুল পরিমাণ সাধারণ মানুষের হত্যা এং পুর্ব বাংলায় পাকিস্তানি আর্মিদের এই নিষ্ঠুরতা জাতিসংঘ গনহত্যা কনভেনশনের বিরুদ্ধ যা কিনা পাকিস্তানি সরকার দ্বারা সাক্ষরিত যার মাধ্যমে নিশ্চিত করে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ শাসনের জন্য সব অধিকার রাখে না এবং ইহার নীতি অমান্য করেই জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা যা তারা ১৯৭০ এর নির্বাচনের মাদ্গ্যমে প্রকাশ করেছিলো অমান্য করছে; এর ফলে বিশ্বাস রাখা যায় যে অতিশীঘ্রই আন্তর্জাতিক শান্তি হুমকি ও গনহত্যা কনভেনশনের প্রতি লঙন ; উভয় অবস্থার উপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পর্ষদের অধিবেশন হবে; এবং পরবর্তীতে বিশ্বাস রাখা যায় যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের সাময়িক সরকার পুর্ব বাংলার গণমানুষের স্বীয়সিন্ধ্বান্তের পরিচায়ক হবে।”
দ্বিতীয় আরেকটি প্রস্তাবনা সাক্ষরিত হয় সকল দলের প্রায় ২৫০ সদস্যের দ্বারা যেখানে পাকিস্তান সরকারের নিন্দা করা হয় এবং আশা করা হয় “যতদিন পুর্ব পাকিস্তানে যথাযথ রাজনৈতিক অবকাঠামো তৈরি না হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক সাহায্য ব্বন্ধ থাকবে… রাজ অনুগত সরকার আসন্ন সভায় পাকিস্তানি সাহায্য তহবিলের বিষয় এমনভাবে প্রস্তাব করুক যেন সাহায্য শরনার্থী চাহিদা পুরণে সহায়ক হয়।”
সংসদ এই মাসের ০৯ ও ১০ তারিখ “বাংলাদেশ”এর উপর দুইবার অধিবেশন করে (বিতর্ক) করে।
.
পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের দুর্যোগ তহবিল
দুই সপ্তাহ আগে করা জাতীয় আবেদনের পর প্রায় পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের সাহয্য তহবিল গঠন করা হয় “Disaster Emergency Committee” দ্বারা পাকিস্তানি শরনার্থীদের সাহায্য করার জন্য।
পুর্ব বাংলার শরনার্থীদের মল্ডিং
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মিঃ মল্ডিং ১৫ জুন বলেন যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাঙালী শরনার্থিদের উপর তদন্ত করবে যারা যেখানে তাদের নিকট আত্মীয়দের সাথে থাকতে চায় কিন্তু পুর্ব বাংলার যুদ্ধাবস্থার কারণে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রের ব্যবপ্সথা করতে পারছে না ।
বাংলাদেশ তহবিলে দান
পুর্ব ANGLIA ‘য় “The Bengali Association” (সভাপতি এম.এন.রাহমান সম্পাদক মোঃ আকসার ) প্রায় এক হাজার পাঁচশ পাউন্ড দান করেন বাংলাদেশের পক্ষে “ঈস্ট ১১ গোরিং স্ট্রিট,লন্ডন ই সি ৩” থেকে। তারা ১৩ তারিখ থেকে সাপ্তাহিক অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করে। আমরা তাদেরকে সাধুবাদ জানাই এবং আশা করি অন্যরাও তাদেরকে অনুসরণ করবে।
শান্তি সংবাদ
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণহত্যার পর থেকেই “মুভমেন্ট ফর বাংলাদেশ” পক্ষএ শান্তি সংবাদ প্রকাশ শুরু হয়। ইহা রজার মোডি এবং আরো অনেকের কিছু শক্তিশালী নিবন্দ প্রকাশ করে। আমাদের পাঠকরা ইহা অত্যন্ত ভালো নিয়মিত লেখা হিসেবে গ্রহণ করে। ইহা ৫ পাউন্ড মুল্যের ছিলো এবং 5 Caledonian Road, London N L(OL-837
9794/5) থেকে পাওয়া যেত।
উত্তর ও উত্তর–পশ্চিম লন্ডন সভা
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম লন্ডনে Rt. Hon. A. J. Stallard MP সভাপতিত্বে তদানিন্তন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একটি সভার ব্যবস্থা করে। অন্যতম প্রধান বক্তারা ছিলেন লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি জনাব বিচারপতি এ.এস.চৌধুরী, তৎকালীন জাতীয় অধিবেশনে জয় পাওয়া আওয়ামীলীগ সদস্য আব্দুল মান্নান এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সভাপতি জনাব শাহ-জাহান(যিনি গত সপ্তাহে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশন কনফারেন্সে উপস্থিত থেকে ফিরেছেন )। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনাব স্ট্যালার্ড তার সম্পুর্ণ সহোযোগিতা ও সমর্থন প্রকাশ করেন এবং সভায় উপস্থিত যেকোন পাকিস্তানি প্রতিনিধির প্রটি বলেন তারা যেন তাদের প্রভুদের বলে উনাকে শিরোনামের মাধ্যমে ভিত্তিহীন কিছু না পাঠায়। তিনি বলেন তিনি নিয়মিত বাংলাদেশ নিউজলেটার পড়েন এবং বাংলাদশের ভিতরের চলমান অবস্থার উপর প্রকাশিত সংবাদকে সাধুবাদ জানান।
জনাম জাস্টিস চৌধুরী আওলোকপাত করেন সাধীনতা ঘোষণা এবং সবার প্রটি আহবান করেন যেন সবাই এক থাকে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য সচেষ্ট কাজ করে এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বের এগিয়ে আসে।
লন্ডনের শরম ও বাণিজ্য সংস্থাদের প্রতি জনাব শাহ জাহান বাংলাদেশের শ্রমিক যারা গণতন্ত্র ও নিজ অধিকার আদায়ে কড়াই করছে তাদের প্রতি একাত্মতার প্রকাশে আহবান করেন।
জনাব মান্নান একজন বাকপটু এবং উনি বাংলায় বকৃতা দেওার সময় কেউই তার কথা বুঝুক আর নাইবা বুঝুক কিন্তু সবাইকে অশ্রুসজল করেন যখন উনি গণহত্যার দৃশ্যমান অবস্থা সবার সামনে উপস্থাপন করেন।
হাইড পার্ক র্যালী
১৯ জুন হাইড পার্ক, লন্ডনে বাঙ্গালীদের প্রতিবাদ সভায় জনাব পিটার শোর (এমপি) এবং অর্থনৈথিক সংযোগের প্রাক্তন কর্মসচিব বলেন “ব্রিটিশরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের অগ্রনী ভূমিকা রাখা উচিত।আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাদের এইটা নিশ্চিত করতে হবে যে পাকিস্তানি অর্থনীতি আর কোন সাহায্য পাবে না যতক্ষণ পাকিস্তান সরকার তাদের গুলিবর্ষণ বন্ধ করে এবং সাধারণ ও গণতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাস্ন নিশ্চিত না করছে । ”
লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশেরর প্রতিনিধি জনাব জাস্টিস চৌধুরী প্রায় সম্পুর্ণ ব্রিটেনে ভ্রমণ করেন এবং ব্র্যাডফোর্ট, ম্যানচেস্টার, লীডস, বার্মিংটন, কার্ডিফ ও স্কটল্যান্ডে বিভিন্ন জায়গায় বিপুল জনসমাবেশের ব্যবস্থা করেন ।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬,৫,৫৭৫-৫৭৭> অনুবাদ
শিরোনামঃ বাংলাদেশের রিপর্ট
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং ৭
তারিখঃ ২১ জুন, ১৯৭১
গ্যারিলা কর্মকান্ড বাড়ছে
স্বাধীনতা সংগ্রাম স্থিমিত হয়নি
অতি সম্প্রতি সিলেটে বেশ কিছু বেদখলকৃত জায়গায় হামলাকারি কমান্ড বাহিনীর সাথে ব্যাক্তিগতভাবে আমি ছিলাম। গত দেড় মাস ব্যাপি অভিযানে পাঁচশোর বেশি পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে এবং গোলা বারুদ বাজেয়াপ্ত করে কমান্ডো ঘাটিতে আনা হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি জীপ এবং একটি মিলিটারি ট্রাক রয়েছে। নির্মূল করা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের ইউনিফর্মগুলো শত্রুপক্ষ এবং তাদের অনুচরদের বিভ্রান্ত করতে ব্যাবহার করা হচ্ছে এবং ছাত্র গ্যারিলাদের অনেকে ছদ্মবেশে শত্রু শিবিরে অনুপ্রবেশ করতে স্বক্ষম হয়েছে। তারা রেডিও বা বার্তা বাহক হিসেবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদের ব্যাবহার করে ঘাঁটির সাথে যোগাযোগ রাখছে। একটি যুদ্ধনৌকা ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস এবং স্থানীয় রাজাকার-তথ্য পাচারকারি-গুপ্তচরদের নির্মূল করার মাধ্যমে উত্তর সিলেটের অধিকাংশ এলাকা স্বাধীন করা হয়েছে।
আমরা ৩০টি ক্যাম্প স্থাপন করে ফেলেছি যেখানে ৩০০০০ স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা, অফিসার, বেংগল রেজিমেন্টের সদস্যগন, মিলিশিয়া এবং কিছু সংখ্যক পুলিশ আমাদের সাথে আছে, তারা শত্রুপক্ষকে ছোট ছোট লড়াইয়ে ব্যাস্ত রাখে আর গ্যারিলারা এই ফাঁকে ক্যাম্পে ঢুকে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের রেশন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নষ্ঠ করে দেয়। ১০৩৪ মাইল ব্যাপি এলাকা জুড়ে আমরা শত্রুদের নাস্তানাবুদ করে যাচ্ছি।পশ্চিম বাংলা, আসাম এবং ত্রিপুরার নিকটবর্তী সকল পাকিস্তানি ফাঁড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং আমাদের সামর্থের সবটুকু দিয়ে আসছে বর্ষায় এই ফাঁড়িগুলোর পূননির্মাণ আমরা ঠেকাব।
কৃষ্ণনগর প্রতিনিধির প্রতিবেদন
আমি গ্যারিলাদের একজন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এবং আমি নিজের চোখে আমার বন্ধুদের পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের হাতে খুন হতে দেখেছি।আমি কলকাতা পালিয়ে যাই এবং সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিই। আমি আমার প্রায় সব প্রিয়জনদের হারিয়েছি। আমার এখন প্রতিশোধ নিতে হবে। মৃত্যু আমাকে আর ভীত করে না। আমি মৃত্যুকে তার চরম বিভৎস রূপে দেখেছি। আমরা এখন বেশ তৎপর এখানে। আমাদের মুক্তি ফৌজ পাকিস্তানিদের ভালই শিক্ষা দিচ্ছে। উদ্বাস্তু শিবিরে অনেক সক্ষম পুরুষ আমাদের ফৌজে যোগ দিয়েছে। আমরা মনে করি সক্ষম পুরুষ যারা বন্দুক বা বর্ষা চালাতে পারে তাদের মুক্তি ফৌজে যোগদান করা উচিত এবং বৃদ্ধ, মহিলা, শিশু এবং অসুস্থরা উদ্বাস্তু শিবিরে থাকবে। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের মুক্তি ফৌজে অংশগ্রহণ করতে দেখে আমাদের গর্ব হয়। তাদের এই অন্তর্ভুক্তি আমাদের বাহিনীকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। যদি বিহারীদের বেশিরভাগ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং বাংলার শত্রুদের সাথে যোগ দিয়েছে তারপরও আপনি অবাক হবেন আওয়ামি লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির প্রচুর বিশ্বস্ত বিহারী সদস্য আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। বাহিনী ত্যাগ করা দু’জন পাঠান সৈন্য আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তারা আব্দুল গাফ্ফার খান এর অনুসারি। আমাদের অনেকে আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন জাতিস্বত্তার সৈন্যদের এই আগমনকে স্বাদরে আমন্ত্রণ জানাবে।
মুজিবনগরকে বাংলাদেশ অস্থায়ি সরকারের সক্রিয় প্রধান কার্যালয় হয়ত বলা যাবে না তবে এটাই এখান আমাদের দখলে এবং এখানে আমরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হই।
গ্যারিলা যুদ্ধে পারদর্শি এমন কিছু প্রশিক্ষক আমাদের প্রয়োজন। ভারত এবং পাকিস্তানের আল-ফাতাহ থেকে একজন আমাদের কাছে আসতে স্বক্ষম হয়েছে এবং গ্যারিলা যুদ্ধে পারদর্শি এমন কিছু প্রশিক্ষক তারা আমাদের দিতে আগ্রহি যারা আমাদের ছেলেদের গ্যারিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দিবে।তিনি বললেন পাকিস্তানি সরকার রাজা হুসেনকে সমর্থন জানিয়েছে এবং তাকে অস্ত্র পাঠিয়েছে অনুদান হিসেবে প্যালেস্টানিয়দের মারার জন্য, তাই প্যালস্টানিয়রা খুশি মনে মুক্তি যোদ্ধাদের সাহায্য করবে। তিনি তাদের নেতা ইয়াসির আরাফাত এর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন
আজকের ঢাকা
জনাব শাইখ রহমান, ঢাকার একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, তিনি জুনের ৭ তারিখ ঢাকা ত্যাগ করেন, গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক মার্টিন এডিনিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জনাব রহমান ঢাকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেন এভাবে,” সাধারন মানুষদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকাতে এবং তাদের আর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা ত্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আছে এমন লোকের তালিকার দৈর্ঘ্য ৬৩ পৃষ্ঠা এবং যেসকল বুদ্ধিজীবি হত্যা ও গুম হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন অসামরিক নিরাপত্তা বাহিনী আলাদা তালিকা করে তদেরকে তদন্তের আওতাধীন করছে।
জনাব রহমান ব্যাবসায়ীদের নামের একটা তালিকা দিয়েছেন যাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ এর জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তাদের আর কোন খবর পাওয়া যায়নি, খুব সম্প্রতি গুম হওয়াদের তালিকায় আছেন ফিলিপস কোম্পানির লোকাল এরিয়া ম্যানেজার, উইং কামান্ডার বাকি, যাকে গত সপ্তাহের বুধবার ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি দাবি করেন, ঢাকাতে যেসব পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যাবসায়ী সবকিছু স্বাভাবিক শুনে আগমন করেন তারা পরিস্থিতি দেখে আঁৎকে উঠেন। ঢাকার বাইরে সড়ক পথে যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব। মুক্তি বাহিনী একটি ষ্টীমারে গুপ্ত হামলা করায় খুলনায় সকল প্রকার নৌ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা ছাড়া অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতে টেলিফোনে যোগাযোগ করাও বেশ দুরূহ। বন্দর নগর চট্টগ্রামে যাওয়ার একমাত্র উপায় আকাশ পথ তাও একটা ওয়ান ওয়ে টিকেট পেতে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হয়। দূরে থেকে হলেও মুক্তি বাহিনী তাদের উপস্থিতি জানান দেয়, যদিও তাদের অধিকাংশই বর্ডারের ওপারে চলে গেছে। সকাল ও সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রবল সম্প্রচার শোনা যায়, গত ১৭ মে স্ট্যাট ব্যাংক, দু’টি সিনেমা ঘর, একটি আধুনিক শপিং এরিয়া সহ ঢাকার বেশ ক’টি ভবনে ৮টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। পাটের শহর নরসিংদি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬,৬,৫৭৭> অনুবাদ
শিরোনামঃ আফ্রো-এশীয় জনমত
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার লন্ডনঃ নং ৭
তারিখঃ ২১ জুন, ১৯৭১
আফ্রো-এশিয় পত্রিকার সংবাদ
জাপান
২৪শে মে পশ্চিম পাকিস্তান সফরের পর জাপানের অন্যতম প্রধান অর্থনীতি বিষয়ক দৈনিক পত্রিকা নিপ্পন কাইজাই শিমবান এর একজন প্রতিনিধি মন্তব্য করেন,
” পাকিস্তানের বর্তমান সামরিক শাসন যেটা পূর্ব বাংলার স্বাধিনতা আন্দোলনকে জোরপূর্বক দমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে তা পূর্ব বাংলায় স্থায়ি ভাবে শাসন করার প্রচেষ্ঠা চালাচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বকে ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।”
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিদর্শনের সুবাদে পত্রিকাটির প্রতিনিধি সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তার মনভাব ব্যাক্ত করেছেন নিম্নোক্ত ভাবে:
১) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা হিশেবে সর্বজন স্বীকৃত নয়
২) প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত পরিমানে অস্ত্র সজ্জিত।
৩) সাধারন জনগন রাজনীতি বিষয়ে নীরব এবং তারা বিদেশি কারো সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা বলে না।
৪) পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকের সংবাদপত্রগুলো কড়া সেন্সরশীপের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় এবং গড়পড়তা খবর ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করে না।
৫) ভোগ্য পন্যের ঘাটতি, মজুদ করার প্রবনতা এবং জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি।
উগান্ডা
উগান্ডায় প্রকাশিত সংবাদপত্র দি পিপল (৫মে) এর একটি প্রবন্ধে লিখক নাথান এপেনু প্রশ্ন করেছেন,” পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা বাংলাদেশে সংগঠিত নির্বিচার গণহত্যা নিয়ে বড় বড় রাষ্ট্রগুলো কেনো চুপ এবং নিরাসক্ত?”
যদিও ইউ এস সিনেটর ফুলব্রাইট এবং ব্রিটিশ এম পি শঅ এর মত কিছু প্রতিবাদি কন্ঠের খবর পাওয়া যায় তথাপি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশে ঘটা গণহত্যা, নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম বিবাদ নিয়ে সামগ্রিক ভাবে পরিপূর্ণ কোন অবস্থান এবং প্রচারনা এখনো দেখা যায়নি।
পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ নিয়ে বড় শক্তিগুলোর এই সম্মিলিত নিরাসক্তির মূলে রয়েছে হয় পাকিস্তান এবং স্বাধিনতাকামি বাংলাদেশের মানুষ এবং দেশগুলোর নিজ নিজ স্বার্থের মধ্যে অপাত অমিল অথবা বড় বড় শক্তিগুলো এই ইস্যুতে সম্পুর্ণভাবে পরস্পর বিরোধী। তাই একটা ভয় কাজ করে যদি কেউ একজন এই যুদ্ধে কোন একপক্ষকে সমর্থন দেয় তাহলে অন্যরা অপর পক্ষকে সমর্থন করবে এবং এটা বৈশ্বিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার নিতে পারে। অবশ্যই সারা বিশ্বে যাতে এই বিরোধ ছড়ায় না পরে সেই চেষ্টাটা মহৎ, কিন্তু আমরা যা চাই তা হল বড় বড় শক্তিগুলো এই গৃহযুদ্ধে কোন পক্ষকে সমর্থন করার বদলে সম্মিলিতভাবে শক্তিশালি পক্ষকে (পশ্চিম পাকিস্তান) চাপ প্রয়োগ করে একটা সমাধানের চেষ্টা করুক।
.
.
অনুবাদঃ লেনিন, তানভীর এবং তানুজা
<৬, ৭, ৫৭৮-৫৮০>
শিরোনামঃ যুক্তরাজ্য ডায়েরী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং ৮
তারিখঃ ৭ জুলাই, ১৯৭১
.
যুক্তরাজ্যের দিনপঞ্জী
বৃটিশ মিডিয়ার চোখে
দ্য টাইমস সতর্ক করেছে: “ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মতের পরিপন্থী না হয়। উদ্যোগী যারা নিজেদেরকে গাদ্দার বা রাজাকার হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন তারা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বেন, পূর্ব পাকিস্তানে (পূর্ব বাংলায়) প্রেসিডেন্ট যে ঘোষণা দিয়েছেন তাকে অধিকাংশ লোক নিজ জনগোষ্ঠীর প্রতি গাদ্দারি হিসেবেই দেখছেন… পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এমন ঘোষণায় সাড়া দেবে তা কারও কষ্ট কল্পনায়ও সম্ভব নয়। গতকাল এমন কিছুই বলা হয়নি যা সৃষ্ট অসন্তোষকে প্রশমিত করতে পারে। বাঙালি জনগোষ্ঠী কোনো বিবৃতিতে তুষ্ট হবে না, তবে ঘোষণাটিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক কারও দ্বারা যুদ্ধের ঘোষণার মতই মনে হবে। “
দ্য গার্ডিয়ান, তাদের স্বভাবসুলভ উদারমনাভাবে স্পষ্টতই জানিয়েছে, “বিশ্ব ইয়াহিয়া খানের দু:স্বপ্ন দূরীভূত হবার কোনো লক্ষ্মণই দেখছে না। এই সৈনিকের জন্য সন্তুষ্টির ব্যাপার এটিই যে, আমাদের উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং যে সমস্যাগুলো আমরা মোকাবেলা করছি এবং সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি, পুরো বিশ্বের দেশগুলো ব্যাপকভাবেই তাতে উদ্বেগ এবং সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
যদি ইয়াহিয়া বিশ্বাস করে যে, সে তাবৎ পশ্চিমা বিশ্বের বিবমিষাপ্রদ প্রতিক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে চলবে যদি সে সত্যিই কিছু বিশ্বাস করে থাকে: বাংলার মাটি থেকে তার জেনারেলরা তাকে যে রিপোর্টগুলো জানাচ্ছে। তার পক্ষের লোকেরা তার কাছে এখন যা বলছে তার উপর তার বিশ্বাস সত্যিই করুণ। এ মুহূর্তে তার সত্যিকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। গতকাল গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ফেরৎ যাবার যে অভিপ্রায় সে ব্যক্ত করেছে তা সত্যিই লজ্জাকর। বিশ্বের সাহায্যকারি দেশগুলো যদি তাদের বিস্ময়ভরা অবজ্ঞা নিয়ে পাশে আসেও তা ঢাকাকে আবার বশে আনার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ প্যানেল হিসেবে নয়। গতকাল বিশ্বব্যাংক তাদের সংকল্পে জানিয়েছে তারা চাতুরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতিতে মত পাল্টাবে না। সংকল্প যতই দৃঢ় হবে, রাওয়ালপিন্ডির ক্ষমতাও তত দুর্বল হবে।
গার্ডিয়ান কিছু প্রশ্নও রেখেছে: ইয়াহিয়ার মাস্টারপ্লানের নর্দমার কোথাও এই মূল প্রশ্নটির উত্তর নেই। পাকিস্তানের কি আর কোনো অস্তিত্ব আছে? ঐক্যের কি আর কোনো প্রয়োজন আছে? পাঞ্জাবি সেনারা আসলে কতটুকু কী অর্জন করতে পেরেছে?
.
বিচারপতি চৌধুরীর মন্তব্য
২৯ জুন ইয়াহিয়ার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্যের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি এ এস চৌধুরী বলেন – “ বাংলাদেশের ৭.৫ কোটি মানুষ ইতোমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। তারা এখন বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করতে সচেষ্ট। স্বাধীনতা ব্যতিরেকে অন্য কোন রাজনৈতিক সমাধান এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান কেবল জনগণেরনির্বাচিতপ্রতিনিধিগণের দ্বারাই প্রণীত হবে।আজ ইয়াহিয়া তার মনোনীত বিশেষ কমিটির মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের যে ঘোষণা দিয়েছেন সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কিছুই করার নেই। এই বক্তব্যথেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে সামরিক জান্তা জনগণের নিকট সত্যিকার অর্থে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইচ্ছুক নয়, এবং কখনো ছিলও না। যে কোন মূল্যে স্বাধীনতার জন্যলড়াই চলবেই এবং জনগন দ্বারা প্রত্যাখ্যাত সামরিক শাসকদেরকোন বক্তব্যই আমাদের বিবেচ্য নয়। আমার আন্তরিক প্রত্যাশা এই যে, বিশ্বের সকল সরকার এবং তার জনগণ জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার সামরিক বাহিনীর এই কূটকৌশল অনুধাবন করতে সমর্থ হবেন, এবং বাংলাদেশেরনিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবেন”।
সম্প্রতি বিচারপতি চৌধুরী , ডাচ লেবার পার্টির আমন্ত্রণে নেদারল্যান্ডস সফর করেন। তিনি নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং সংসদ সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নেদারল্যান্ড সংসদের পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন এবং পূর্ব বাংলার সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেন। বিচারপতি চৌধুরী এবং তাঁর সফরসঙ্গী , জাতীয় পরিষদের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি জনাব মান্নান নেদারল্যান্ডের পররাষ্ট্র দপ্তরেও একটি সৌজন্য সাক্ষাত করেন।
কার্যক্রম সমিতির সভা
কার্ডিফে এক সভায় বিচারক জনাব এ. এস. চৌধুরী এবং জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব এ. মান্নান বক্তব্য রাখেন। সভায় উপস্থিতবৃন্দরা বাংলাদেশের ত্রাণ তহবিলের জন্য নগদ অর্থ সংগ্রহ করেন। পাক্ষিকভাবে আয়োজিত একই ধরণের সভা দেশের সর্বত্র অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে এসময়ে কার্যক্রম বেশ সক্রিয় ছিল।
পাকিস্তানে দুই জাহাজ ভর্তি অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে মিছিল ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতিতে একজন কর্মকর্তা একটি চিঠি গ্রহণ করেন এবং তা শীঘ্রই ওয়াশিংটনে হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দেন। লন্ডন সমিতি, স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, অ্যাকশন বাংলাদেশ, উইমেনস এ্যাসোসিয়েশন এবং অন্যান্য সহানুভব দলের সমন্বয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী কতৃক বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় ঘটানো গণহত্যার উপর এক চলচ্চিত্র গত ৩০শে জুন কনওয়ে হলঘরে প্রদর্শন করা হয়। স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে অসংখ্য দর্শক এবং বৃটিশ সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন।
২৯শে জুন, এইচ.বি.সি. তে বাংলাদেশ নিউজলেটার পত্রিকার সম্পাদক, মাশরিক পত্রিকার সম্পাদক জনাব মাহমুদ হাশমি এবং ভুট্টোর পিপলস পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি জনাব গাজীর সাথে ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক বিবৃতি ও নীতির উপর এক আলোচনায় যোগ দেন। পাকিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় এই আলোচনা সম্প্রচার করা হয়।
গণহত্যা বন্ধ এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবী
রবিবার ১লা আগস্ট ট্রাফেলগার স্কয়ারে জাতীয় সম্মেলন। সময়- বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা।
এই সম্মেলনের প্রাথমিক পৃষ্ঠপোষক অ্যাকশন বাংলাদেশ ( ৩৪ স্ট্র্যাট ফোড ভিলাস, লন্ডন। এন ডাব্লিয় ১। ফোন- ৪৮৫ ২৮৮৯) এর একজন মুখপাত্র এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন – “সংবাদপত্র পড়তে সক্ষম ও টেলিভিশন দেখতে পারে এমন সকলের কাছেই এখন এ বিষয় পরিস্কার যে পূর্ব বঙ্গের জনগণ গণহত্যার শিকার। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের পরিকল্পিত সন্ত্রাস অভিযানের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের জনসংখ্যা সীমিত করতে উদ্ভূত, যাতে তা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের বেগ পেতে না হয়। আমরা মনে করি, বৃটিশ জনগণের জন্য এখনি সময় যাতে তারা এই ব্যাপারে তাদের অসম্মতি প্রকাশ করতে পারে। এবং আমরা আশা করি, এই সম্মেলনে পূর্ব বঙ্গের গণহত্যা বন্ধে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বার্তা পরিষ্কার ও জোরালো ভাবে প্রচারিত হবে। বৃটেনের মত দেশের স্বীকৃতি পাকিস্তানের শাসকদের বাস্তবতার মুখোমুখি করার একমাত্র পন্থা। এবং বাস্তবতা হচ্ছে, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে। ২৫শে মার্চের রাতের সেই বর্বরতর আক্রমণের সময় থেকে তারা পূর্ব বঙ্গের মানুষের কাছ থেকে সম্মানও হারিয়েছে। বাকি বিশ্বের উচিৎ এই নির্মম বাস্তবতাকে ক্রমবর্ধমান লাশের পাহাড়ের নিচে দাবিয়ে রাখার পাকিস্তানী প্রচেষ্টা প্রতিহত করা “।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬, ৮,৫৮১> অনুবাদ
শিরোনামঃ বাম ফ্রন্টের সমর্থন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার লন্ডনঃ নং ৮
তারিখঃ ৭ জুলাই, ১৯৭১
খনি শ্রমিকদের সমর্থন ৬ই জুলাই আবের্দিনে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে একটি জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, খনিশ্রমিক সমিতির কার্যনির্বাহক পূর্ব পাকিস্তানের এ অবস্থার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং মিমাংসায় আসার জন্য একটি আলোচনা বৈঠকের ডাক দিয়েছিলেন।
পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তান উভয়ের জনসাধারনের পূর্ণাংগ অভিমত এটাতে থাকা উচিত ছিল যা তাদের সাধারন নির্বাচনের সংকল্প ছিল, সংকল্পটি উত্থাপনকারী সংঘের সাধারন সচিব মি. লরেন্স ডেলিও বলেছিলেন, ‘আমরা শেখ মুজিবুর রহমান সহ বাকি রাজনৈতিক কয়েদিদের ভাগ্য সম্পর্কে চিন্তা রাখি।’
এটা ব্রিটিশ সরকারকে প্ররোচিত করেছিল সকল লড়াই এবং সামরিক মধ্যবর্ত্তিতার একটি দ্রুত সমাপ্তির জন্য পাকিস্তান সরকারকে প্রভাবিত করতে।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬, ৯,৫৮২> অনুবাদ
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
আরব সাংবাদিকের চোখে ‘জিন্নাহর স্বর্গ’ |
বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং-৮ |
৭ই জুলাই, ১৯৭১ |
‘আরব লেখক জিন্নাহ’র স্বর্গ উন্মোচন করল’
আরবের বৈরুতের প্রসিদ্ধ সংবাদপত্র ‘আল শাব’(৯ই জুন) এ আরবের অন্যতম সম্মানিত লেখক মুহাম্মদ নাকশ নিম্নলিখিত কলামটি প্রকাশ করেছিলেন।
‘যদি মৃত মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ আজ ফিরে আসতো আর দেখত পাকিস্তানে এখন কি হচ্ছে এবং কি উপায়ে; তার অসমান্য স্বপ্নটি পূরণ হচ্ছে, তবে কি তিনি গর্বিত নাকি খুশি হতেন অথবা অনুতাপ করতেন?
জিন্নাহর স্বর্গকে নরকে পরিণত হতে দেখে পূর্ব বাংলার ৫০ লক্ষ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে চলে আসে। তারা শত্রু দেশ কে নিজেদের হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল এমনকি নিজেদের ঘরে থাকার থেকে অভিবাসন , তাঁবুতে কিংবা খোলা আকাশের নিচে থাকাটা বেশি সমর্থন করেছিল। তারা তাদের সহ-নাগরিকের মাধ্যমে কলেরা রোগে মৃত্যু কিংবা দূর্ভিক্ষ্যকেও গ্রহন করেছিল আর সেই তথাকথিত শত্রুরাই তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল।
এটাই প্রমান করে যে, ধর্ম কোনো রাস্ট্র গঠনের ভিত্তি হতে পারে না। ভূমি,জনগন , সরকার এবং সার্বভৌমত্ব এগুলোই রাস্ট্র গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত । যেখানে পাকিস্তানি বাঙালিরা ভারতীয় বাঙালি থেকে আশ্রয় আর সাহায্য পেয়েছিল , সেখানে তাদের সহঅধিবাসী পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে তারা আগুন আর কামানের গোলা ছাড়া আর কিছুই পায়নি।
পূর্ব পাকিস্তানিদের দোষ কি ছিল? পাকিস্তানের রাস্ট্রপতি তাদের নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বলেছিল এবং তারা নির্বাচনেও গিয়েছিল। রাস্ট্রপতির নিজস্ব তত্ত্বায়বধানে সৎ এবং গণতান্ত্রিক এই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের দল জয় লাভ করেছিল। সেখানে দুটো গণতান্ত্রিক বিকল্প ছিলঃ যেখানে পাকিস্তানকে যুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে যার পূর্বের অংশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে করা হবে এবং পশ্চিমের দায়িত্ব সে অংশে জয়ী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দেওয়া হবে; অথবা পার্লামেন্টে অধিক ভোটে বিজয়ী শেখ মুজিব কে সরকার গঠন করে পাকিস্তানকে আগের নিয়মেই রাখা হবে।
দুটো বিকল্পর একটাও অনুসরন করা হয়নি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে যাদের হাতের মুঠোয় ক্ষমতা ছিল তারা জোরপূর্বক সামরিক শক্তি অবলম্বন করে যার ফলে সেখানে বিপর্যয় নেমে আসে। তাদের অজুহাত এই ছিল যে সামরিক বাহিনী বিচ্ছিন্নবাদীদের দমন করবে। পূর্ব পাকিস্তানিরা এ দমনেও মাথা নত করেনি যখনও তাদের কাছে প্রমানিত হয়েছিল যে, দেশের সরকার তার জনগনের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল না বরং সরকার নির্ভর করে হাজার মাইল দূরে বাস করা দাম্ভিক অংশের ইচ্ছার উপর। এমন একটি দেশের নাগরিকত্ব কে চাইবে?
কারন যাই হোক না কেন,এটা প্রমানিত ছিল যে, প্রতিষ্ঠাতারা এবং সমর্থনকারীরা পাকিস্তানকে যে তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল তা আর উপযোগী ছিল না। এটি একটি কৃত্রিম নির্মান ছিল এবং সকল কৃত্রিমতার নিয়তি বিনাশই হয়।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬,১০,৫৮৩> অনুবাদ
শিরোনামঃ পশ্চিম পাকিস্তানের দৃশ্যপট
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং ৮
তারিখঃ ৭ জুলাই, ১৯৭১
.
তাদের কাজের ফলাফল ছিল ঔপনিবেশিক যুদ্ধ যা পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়। একমাত্র পতনের মাধ্যমেই সামরিক একনায়কতন্ত্র নিবারন সম্ভব। উঠতি অস্থিতিশীলতার ইংগীত ‘WEST PAKISTAN SCENE’ এর প্রতিবেদনে ছিল।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি থেকে (করাচি)
পশ্চিম পাকিস্তান এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি বিষ্ময় এর শিকার হয়। প্রথমটি বিশ্ব ব্যাংক এর নেতৃত্বে প্রধান সাহায্যপ্রদানকারী দেশেগুলোর সিদ্ধান্ত ছিল যাতে পাকিস্তানের জন্য সকল অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত হয়ে যায়। শাসক গোষ্ঠীর গুপ্তসভা কোন দৃশ্যমান নৈরাশ্য দেখায়নি। নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমকে অনুপ্রানিত করা হয়েছিল সহ্য করা ২৩ বছর পাকিস্তানের শাষনের অভিযোগ করার জন্য। কিন্তু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, ব্যাবসায়িক এবং সাধারন লোকেরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কারন তারা জানত তাদের সাথে সামনে কি হতে যাচ্ছে। প্রথম বারের জন্য পাকিস্তানের অর্থনীতি পংগু হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিস্ময় ছিল ‘বাজেট’ এবং এটি প্রশংসিত হয়েছিল; গণমন্ত্রনালয় এর দায়িত্বে ছিল। ধনীদের উপর মোটা কর আরপ করা হয়েছিল যদিও তারা যা দিত অন্যভাবে তা তাদের কাছে ফেরত আসত। ২২ টি কর্পোরেশন মনে করতো আসল বোঝাটা ভোক্তা এবং শ্রমিকশ্রেণীর বহন করা উচিত, তাদের তাদের রক্ত ও ঘামের প্রতিটি বিন্দু তাদের থেকে নিংড়ে নিয়ে পুঁজিবাদি শাসকদের কফিতে মিশিয়ে খাওয়ানোটাই আমাদের নিয়তি ছিল। চিনি,চাল,ডাল,আটা ময়দা,সবজি, তেল,পেট্রল,ম্যাচ,শিক্ষা সব শেষ হয়েগিয়েছিল। এখন ভুট্টোকে দেখানোর সময় হয়েছিল ‘কিভাবে হাজার বছর ধরে ঘাস খেতে হয়’ যা তিনি কিছুদিন আগেই ভবিষ্যতবাণী করেছিল। তিনি এই পরিবর্তনে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আর তার মুখ থেকে কোনো শব্দই আর বের হয়নি। এমনকি বিষ্ময়ের ব্যাপার এই যে, মুসলিম লীগ , জামায়াতে ইসলামএর মূর্খ রাজনৈতিকেরা যারা ইয়াহিয়া খান কে দেবতা মানত তারাও বোবা বনে গিয়েছিল।
তৃতীয় বিষ্ময় ছিল ইয়াহিয়া খানের ‘রাস্ট্র নীতি’। সার্জেন্ট-মেজর রাও ইয়াহিয়া খানের পুতুল হয়ে কথা বলা শুরু করেছিল , শুধুমাত্র মুল্লাহ এবং নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম ব্যাতীত আর কেউ একটিও শব্দ পক্ষে বা বিপক্ষে বলেনি। রাজনৈতিকেরা এবার শেখ মুজিবের কথার গুরুত্ব বুঝতে পারল যে, ‘আজ সামরিক সেনারা আমাকে দমনে নেমেছে কাল তোমাদের জন্য নামবে।’ গণতন্ত্র সেনাদের বুটের নিচে পদদলিত হয়ে চূর্ণ হয়ে যবে। ‘রেভোলিউশনারী কাউন্সিল’ মার্শাল ল’ এর আওতায় ইসলামিক রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার শুরু করল যা এখন পর্যন্ত ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে স্থায়ী হয়ে আছে। ভুট্টো বুঝতে পেরেছিল পরিস্থিতি এ অবস্থায় আর কিছুদিন থাকলে সে এবং তার দলের অবস্থা চরমে পৌছাঁবে। সে ছলচাতুরীর সহায় নেওয়ার চিন্তা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল সে আয়ুব ও তার দলের ১০ বছর ধরে যেভাবে খিদমত করেছে সেভাবে অন্য কারো সরণাপন্ন হবে। সে সহ অন্য কোনো রাজনীতিবিদদের কেউই মুখ খুলল না। ২২ গোত্রের অধিপকতিরাও দেখ্ল তাদের ডানা কেটে দেওয়া হচ্ছে। তাদের পুরোপুরি দমিয়ে রাখার ব্যাবস্থা করা হচ্ছে আর শীঘ্রই এমন পরিস্থিতি আসবে যে এই অসহায়দের জন্য বিলাপ করার মতউ কেউ থাকবে না।
.
.
অনুবাদঃ চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬, ১১,৫৮৪-৫৮৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ অনিবার্য সফলতা ত্বরান্বিত করুন। |
বাংলাদেশ লিউজ লেটার* লন্ডনঃ নং ১২ |
নভেম্বর ১৯৭১ |
[* এই সংবাদপত্রটিতে সম্পাদক ও প্রকাশকের নাম ও ঠিকানার উল্লেখ নেই। যোগাযোগের জন্য একটি ঠিকান নির্দেশ রয়েছে, সেটি হলঃ Editorial Board, Bangladesh News letter. P.O. Box 4 RG, London WL.. ]
মিসেস গান্ধী দৃঢ়ভাবে বলেছেন পূর্ব বাংলা
অবশ্যই স্বাধীনতা লাভ করা উচিত
আর আমরা বলছিঃ
চলুন আমরা সবাই একত্র হই এই অনিবার্য
সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করতে
মিসেস গান্ধী বর্তমানে তার বিশ্ব ভ্রমণের শেষ পর্যায় শেষ করেছেন। এই ভ্রমণ ছিল বিশ্ব বিবেককে এসব ব্যাপারে আলোকিত করা যা ছিল- পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্রের হত্যা, একটি নতুন জাতির যৌক্তিক আকাঙ্ক্ষাকে রক্তে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য একটি সামরিক একনায়কতন্ত্রের বর্বর এবং ভয়ানক কর্মকান্ড যা ভারতের টানাপড়েনে ধরে রাখা ভূমিতে ৯০ লক্ষ বেপরোয়া,উদ্বিগ্ন এবং উন্মত্ত শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। মিসেস গান্ধীর ভারতে প্রত্যাবর্তনের সাথে বাংলাদেশ সংকটটি অনমনীয় ভাবে শেষ পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে এবং এর চূড়ান্ত সীমার দিকেই এগোচ্ছে। ভারত এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কতদিন তারা এভাবে “আগ্নেয়গিরি’র উপর বসে” থাকতে পারবেন।
সকল অবস্থান থেকেই এখন মনে হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এর জান্তা অবস্থান এখন অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সকল ধরনের অস্ত্রবোঝাই জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। চীনের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব ভুট্টোর প্রতিনিধি দলকে শুধুমাত্র শুভকামনা জানিয়েই শেষ করেছেন। সেই সাথে পাকিস্তানি জেনারেলরাও তাদের আনাড়ী বর্বরতার পথের শেষে চলে এসেছেন। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার সামনে বিকল্প পথ এখন সীমিত। তিনি এবং তার শিকারী জেনারেলরা এখন যুদ্ধ করে হারতে পারে; অথবা সুবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে কথা বলে অব্যাহতি দিতে পারে; অথবা সর্বশেষ বেপরোয়া অবলম্বন হিসেবে উন্মত্ততার শেষ সীমায় গিয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিজেদের বিপদ আরো বাড়াতে পারে।
ভারত এবং সারা বিশ্বের এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। তাদের এখন মিথ্যা বা মোহজনক সমাধানের পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করা উচিত। তাদের এখন দ্রুত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা উচিত,যেহেতু মিসেস গান্ধী প্যারিস থেকে তাঁর টেলিভিশন সম্প্রচারের সময় দূর্বল গলায় বলার চেষ্টা করেছেন বলে জানা গেছে….”পূর্ব বাংলা সংকটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা। এটি অনিবার্য। আজ অথবা কাল এটি আসবেই..”
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বড় শক্তিদের কাছে যেমন অনুপ্রেরণামূলক সমর্থন আশা করেছিলেন তেমনটি হয়ত পান নি, কিন্তু তিনি তাদের কাছে সহানুভূতিমূলক বোঝাপড়া পেয়েছিলেন। এখন তাঁর দায়িত্ব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য কাজ করা। যাই ঘটুক, তিনি তাঁর সাথে পুরো বাংলার মানুষের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা পাবেন, যতদিন মানুষের সাহস এবং যেকোন উপায় থাকবে, বর্তমান সময়ের একমাত্র সঠিক সমাধানটির সফলতা আনতে, একমাত্র “অনিবার্য সমাধান”, যার নাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলার দেশপ্রেমিকেরা এটি অবশ্যই বুঝতে চেষ্টা করবে, এর
.
সাথে জড়িত সকল আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ না করে হলেও। এবং শুধুমাত্র এই একটি উপায়েই বাংলাদেশ সরকার আমাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে পারবে যারা ভারতের মাটিতে সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব হয়ে পড়ে আছে। সেই সমাপ্তির প্রতি চলুন আমরা সবাই, বাংলাদেশের মুক্তি সেনারা, বাংলাদেশ সরকার, দেশের বাইরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা, এবং সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সকল বন্ধু এবং মিত্র রাষ্ট্র,সবাই মিলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করি।
সম্পাদনা পরিষদ হতে
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬,১২,৫৮৬>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান |
বাংলাদেশ টুডে* সংস্করণ ১ : নং ৮ |
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
[*বাংলাদেশ টুডে : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, মুজিবনগর সরকারের লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত একটি পাক্ষিক।]
মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান
(বিশেষ প্রতিনিধি হতে)
অপমানিত এবং ক্লান্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী তাদের নিহত সহযোদ্ধাদের জন্য শোক পালন করার পাশাপাশি নিজেদের ও একইরকম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা,মুক্তিবাহিনী, মুক্তিফৌজের হাতে,যাদের সংখ্যা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে কৌশল ও দক্ষতা ও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুদ্ধচলাকালীন গত পঁচিশ সপ্তাহে ভয়ানক রক্তপিপাসু জান্তা ইয়াহিয়া খানের আদেশ পালনের মূল্য ২৫,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য তাদের জীবন দিয়ে দিয়েছে।শুধুমাত্র গত সপ্তাহেই ৭০ জন পাকিস্তানী সৈনিকের মৃতদেহ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় আনা হয়।এতে কোন সন্দেহ নেই যে পশ্চিম পাকিস্তানী নওজোয়ানরা মানুষ এবং অর্থ উভয়ক্ষেত্রেই তাদের পেশার মূল্যের প্রতি আশংকাজনক ভাবে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে।
বর্বর আক্রমণকারীদেরকে গেরিলা আক্রমণ এবং হত্যা করার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর প্রধান পরিকল্পনা ছিল যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিকল করে দেওয়া। “দি টাইমস” এর সূত্র অনু্যায়ী, ৯০% ক্ষুদ্র সেতু এবং ব্রিজ রাস্তায়। এবং, পশ্চিম পাকিস্তানী প্রচারকরা এই কৌশল এবং দক্ষতা সবসময়ের মত ভারতীয়দেরই হতে পারে বলে গণ্য করার কারণে দূর্বল হয়ে পড়েছে।
এটি একটি বহুল পরিমাণে প্রমাণিত সত্য যে, বাংলাদেশী গেরিলাদের যুদ্ধক্ষমতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।ঢাকায় সামরিক বাহিনীর অনেক বাধানিষেধ থাকা সত্ত্বে ও এমতে,ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের সকল রেল সম্বন্ধীয় নিয়ম কানুন অমান্য করে গত শুক্রবার একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে গেরিলা কর্তৃক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
বর্তমানে সিলেট,রংপুর এবং কুমিল্লার কাছাকাছি সীমান্ত এলাকায় ঢাকার দিকে অগ্রসর গেরিলাদের নিয়মিত তৎপরতা রয়েছে। বিস্তৃত সীমান্ত এলাকা পুরোপুরিভাবে মুক্ত এবং বেশীরভাগ গ্রামীণ এলাকাই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” এর মিস ক্লেয়ার হলিংসয়ারথ ঢাকার ৪০ মাইলের আশে পাশে একটি গণ্যমান্য এলাকায় বাংলাদেশী পতাকা উড়তে দেখেছেন বলে দাবী করেন।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অনিবার্য। এই অনিবার্যতার কারণ শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীর সামরিক দক্ষতাই নয়,বরং সহযোগিতা যা আমাদের নির্ভীক মুক্তিসেনারা দেশের জনগণের কাছ থেকে পাচ্ছে যাকে মিস হলিংসওয়ারথ “মানুষের কাছে বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করেন।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬,১৩,৫৮৭-৫৮৮> অনুবাদ
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ ইয়াহিয়ার বেসামরিকি করণ |
বাংলাদেশ টুডে সংস্করণ ১ : নং ২ |
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
ইয়াহিয়ার বেসামরিকি করণ
জেনারেল ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানের পদে ডঃ মালিককে পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন।জেনারেল টিক্কা খান বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর “প্রধান কমান্ডার” হিসেবে পদন্নোতি পেয়েছেন।ডঃ মালিকের প্রধান দায়িত্ব এমন বাঙ্গালী রাজনীতিবিদদের নিয়ে সামরিক মন্ত্রিসভা গঠন করা যারা ইয়াহিয়ার সাথে মতৈক্য পোষণ করবেন। পশ্চিম পাকিস্তানী সমর্থন লাভের জন্য প্রচারকার্যের মাধ্যমে এটি ত্বরান্বিত করা হয়েছে যা রাজনৈতিক স্থিরতা পুনরায় ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে দেশকে সংস্কার হতে মুক্ত করবে। একজন বেসামরিক শাসকের নেতৃত্বে কোনরকম নির্বাচন ছাড়াই গঠিত মন্ত্রিসভা যাই হোক অপরিবেশনযোগ্য হতে পারে যা বেসামরিক নিয়ম কানুনের ভাসা ভাসা চেহারাটি দেখায়। অট্টালিকার সম্মুখভাগ খুব সুন্দরভাবেই রহস্যপূর্ণ কারিগর দ্বারা চাকচিক্যময় করে তোলা হয়েছে!দর্শকদেরকে বেশ চাকচিক্যময় ভাবেই বোকা বানানো হচ্ছে!
যদি ও ডঃ মালিকের শাসনে ইয়াহিয়ার সহযোগী মন্ত্রীসভা শীঘ্রই তৈরী হবে,তবু ও পৃথিবীই এর বিচার করবে যে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে কীনা।প্রায় এক লক্ষ সামরিক সেনা বাংলাদেশের শহর এবং বন্দর এলাকায় রয়েছে। গত কয়েক মাসে বেসামরিক,পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগ এর পদসমূহ পাঞ্জাবী কর্মকর্তাদের দ্বারা পূর্ণ হয়েছে।বাংলাদেশীদেরকে সুচতুরভাবে উচ্চ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতিই পশ্চিম পাকিস্তান হতে বিশাল পুলিশ বাহিনী আনা হয়েছে। এই পুলিশবাহিনীকে কাজে লাগানোর জন্য পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী অবাঙ্গালী বিশাল রাজাকার বাহিনীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যারা সামরিক বাহিনীর বর্শার ফলা হিসেবে কাজ করবে। সংবাদপত্র,আন্দোলন এবং সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষিদ্ধতা আগের মতই বজায় থাকবে। রাজনৈতিক নেতাদেরকে অপহরণ করা যারা একসময় দেশপ্রেমিক বলে গণ্য হতেন,নিষ্পাপ নারী পুরুষ দেরকে হত্যা করা সৈন্যদের আনন্দের খেলা হিসেবে চলতেই থাকবে।দেশ আসলে কে শাসন করবে? কে পারবে এই অন্ধকার সামরিক শাসনের আসল শক্তিটাকে কাজে লাগাতে?যখন জেনারেলরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তাদের ভয়ানক উপস্থিতি সাধারণ মানুষের জীবনকে লন্ডভন্ড করে দেয়,তখন কেউ কী ভাবতে পারে যে ডঃ মালিক এবং তার মন্ত্রীসভা কেবলমাত্র জেনারেলদের হাতের কয়েদী? তারা ও অন্যদের মতই জেনারেলদের হাতের পুতুল হবেন।
এমনকি ইয়াহিয়ার একান্ত অনুগত ভুট্টো ও ‘সে(ডঃ মালিক) নিজেকে ছাড়া আর কী উপস্থাপন করে?’ বলার মাধ্যমে ডঃ মালিককে নিয়োগ দেওয়ার কড়া সমালোচনা করেন।যদি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ও একই ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ভুট্টোর পশ্চিম পাকিস্তান শাসন করার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।সন্দেহাতীত ভাবেই ভুট্টোর মত একজন ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ মালিকের নিয়োগের মাঝে বেসামরিক নিয়মের মৃত্যু দেখেছিলেন।
পৃথিবীকে বোকা বানানোর চেষ্টায় থাকা ইয়াহিয়া খান শুধুমাত্র নিজেকে এবং গত সাধারণ নির্বাচনে (ডিসেম্বর ১৯৭০) বাংলাদেশীদের দ্বারা নাকচ হওয়া তার কিছু সহযোগীদেরকে ছাড়া আর কাউকেই বোকা বানাতে পারেননি।কোন বাঙ্গালীই ভাবতে উদ্যত হবে না যে এই পরিকল্পনাটি সামরিক শাসন তুলে নেওয়ার দিকে একটি ভেজালবিহীন পদক্ষেপ।এতে কোন সন্দেহ নেই যে ইয়াহিয়া খানের বাহিনীর শেষ সৈন্যটির মৃত্যু নিশ্চিত না করা পর্যন্ত গেরিলা বাহিনী লড়াই চালিয়ে যাবে।গেরিলারা নিজেদেরকে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছে।ইয়াহিয়া খানের সহযোগীদেরকে গেরিলারা সবচেয়ে উপযুক্ত শাস্তিটাই দিবে।বাঙ্গালিরা এবং গেরিলা বাহিনী তাদের সহযোগীদের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের হাস্যকর তালিকার পুরোটাই জানে যা ক্রমেই অন্যায় এবং অজনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠছে।ইয়াহিয়ার হাতের পুতুলরা দপ্তরে আসবে, যাবে কিন্তু তাদের ভাগ্যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত লক্ষ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া নেই।
যাই হোক,বেসামরিক শাসন কায়েমে ইয়াহিয়ার ব্যর্থতা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা।তিনি এখন চরম অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হচ্ছেন। বিদেশী সাহয্যের জন্য ইয়াহিয়ার আবেদন এর মধ্যে দুইবার নাকচ করা হয়েছে।তৃতীয় সাক্ষাতের সময় ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে এবং এইবার ইয়াহিয়ার দ্বারা তার ভিক্ষার থালা পুরোপুরিভাবে খালি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।সাহয্যের পুনরায় আবেদন করতে হলে বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ লাগবে যা পর্দার পেছনে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা বর্ণনা করবে। এই প্রমাণের জন্য ইয়াহিয়া খানকে সাহায্যকারী দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর চাপ দিচ্ছে।ইয়াহিয়া যা করে আসছিলেন তা কেবলমাত্র সাহায্যকারী দেশগুলোকে খুশি করার জন্য একধরনের ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়।
যদি এখন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোন দেশ পাকিস্তানকে সাহায্য করে,তাহলে বাঙ্গালীরা একে একধরনের পরিত্যাগই ভাববে।এতে কারো কোন সন্দেহ নেই যে এই সাহায্য বাংলাদেশে অবস্থানকারী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর ভরণ পোষণের জন্য ব্যবহৃত হবে।গত বিশ বছরের ও বেশী সময় ধরে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে তার একটি অস্ত্রাগার এবং পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীকে সাম্যবাদ বিরোধী হিসেবে গড়ে তুলেছে।যখন আমেরিকান প্রশাসন নির্বিচারে বাঙ্গালী হত্যা থেকে তাদের সাম্যবাদ বিরোধীদের বিরত রাখতে পারেনি,তখন আমেরিকা ইয়াহিয়া খানের ঘৃণ্য কাজকর্মের সঙ্গী হয়।পৃথিবী আশা করেছিল আমেরিকা এই যুদ্ধ বন্ধের মাধ্যমে তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করবে।তারা এইক্ষেত্রে পুরোপুরি ভাবে অসফল।ইয়াহিয়ার জান্তাকে পুনরায় সাহয্য করার মাধ্যমে তারা তাদের দায়িত্বকে চরম ভাবে পরিত্যাগ করার পাশাপাশি তারা পৃথিবীর এই অংশটার গণতন্ত্রের দাফনের কাজটির অর্থায়ন ও করে দিয়েছে।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬,১৪,৫৮৯-৫৯০> অনুবাদ
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুজিবের বিচার চলছে |
বাংলাদেশ টুডে সংস্করণ ১ : নং ২ |
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
মুজিবের বিচার চলছে
প্রায় পাঁচ মাস পীড়াদায়ক নিস্তব্ধতার পর পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধে” শেখ মুজিবের বিচার করার জন্য একটি আদালতের সৃষ্টি করেছেন।
যদি ইয়াহিয়া অকপট হয়ে থাকেন,তাহলে শেখ মুজিবকে কেন তিনি তার পছন্দ অনুসারে আইনের সাহায্য নিতে দিচ্ছেন না? পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে কেন তার আইনজীবী পাঠানো যাচ্ছে না? এটি কী ন্যায়বিচারের উপর একধরনের শোষণ নয়? এমনকি একজন অপরাধীর ও আদালতে নিজেকে রক্ষা করার সাধারণ অধিকার থাকে।তাহলে শেখ মুজিব কেন এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন? এটি কী ন্যায়বিচারের নামে একটি কলংক নয়?
মূল প্রশ্ন হলো,কখন তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন? পুরো পৃথিবী সঠিকভাবেই জানে যে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এর নির্বাচনে তিনি সাধারণ পরিষদে তার ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩০৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন) অর্জন করেন।সামরিক জান্তা কি এই দাবী নির্বাচনের পূর্বে এমনকি পরে অন্যায় বলে ঘোষণা করেছিল?অপরদিকে জেনারেল ইয়াহিয়া মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি ভবিষ্যৎ সংবিধানে ছয় দফা থাকার কোন কারণ তিনি দেখেন নি। যেটি এখনো বেশী গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল, তিনি ১৯৭১ সালের ১৪ই জানুয়ারী বলেছিলেন “শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী”। সেই দিনের পর কী এমন হলো যে শেখ মুজিব রাতারাতি “রাষ্ট্রের শ্ত্রু” হয়ে গেলেন?দু মুখো সাপ কে ছিলেন?ইয়াহিয়া হুট করে ন্যাশনাল এসেম্বলির যে মিটিং ১৯৭১ সালের মার্চের তিন তারিখ হওয়ার কথা ছিল,তা পিছিয়ে দেন।তাকে এসেম্বলি পেছানোর অধিকার কে দিয়েছিল? বিচারালয় কী তাকে এতই ক্ষমতা দিয়েছে যে তিনি এরকম একটি তারিখ পেছাতে পারবেন?যে রায় এতটা এতটা জনপ্রিয়?
যাইহোক, ১৯৭১ সালের ১লা মার্চের যে অধিবেশন ইয়াহিয়া পিছিয়ে দিয়েছিলেন তার জন্য দুশ্চিন্তাটা রীতিমত সংকটে পরিণত হয়েছে।পরিস্থিতি আরো নোংরা করার জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সহ-নৌ সেনাধ্যক্ষ এস এম আহসানকে বরখাস্ত করেন এবং তার স্থলে পাঞ্জাবের কসাই এবং বালুচিস্তানের জল্লাদ খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে নিযুক্ত করেন।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য স্থানান্তর অধিক হারে বেড়ে যেতে লাগল।৩০,০০০ সৈন্যের পরিবর্তে সৈন্য সংখ্যা হয়ে যায় ৮০,০০০।অত্যন্ত ভালো প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এই সেনাবাহিনীর অবসথানের ভয়াবহতা চারদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল।সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত পরিকল্পনা বিষয়ক গুজবে ভারী হয়ে উঠেছিল বাংলার বাতাস।সবদিক থেকেই বুঝা যাচ্ছিল যে একটি নিষ্ঠুর মিলিটারী হামলা এগিয়ে আসছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা নিয়ে মানুষের অবিশ্বাসের বিস্ফোরণ ঘটল ২রা মার্চ।ইয়াহিয়ার সৈন্যদলের নিষ্ঠুর হামলার কারণে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মৃতের সংখ্যা কয়েক শ বৃদ্ধি পেল।সেনাবাহিনীর গোলাগুলির মধ্যে শেখ মুজিবকে
গ্রেফতার করা এবং এর কারণে মানুষের ক্ষোভই এখন মূল আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বাঙ্গালীরা সংবিধানিক এসেম্বলি বসার দাবীতে একটি সংঘর্ষবিহীন এবং অসহযোগ আন্দোলন করে।সম্পূর্ণ সরকার,শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পূর্ব বাংলার ব্যবসায়িক ব্যবস্থা তার নির্দেশে চলতো।১৯৭১ সালের মার্চের ৭ তারিখ তিনি জনগণের প্রতি কিছু দিকনির্দেশনা দেন।এটি ইয়াহিয়াকে তার সাথে কথা বলতে আসতে বাধ্য করে।যা মনে রাখা সবচেয়ে জরুরী তা হলো ইয়াহিয়া একবার ও এই সংঘর্ষ বিহীন আন্দোলনকে অপরাধ বলে ঘোষণা দেন নি।
বিশ্ব জানে কীভাবে শেখ মুজিবুর ২৫ তারিখ পর্যন্ত জনগণের সহায়তায় পূর্ব বাংলায় একটি সরকার গঠন করেন।বিশাল হামলার প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি ১২ই মার্চ ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে সাংবিধানিক আলাপ শুরু করেন।যখন শেখ মুজিব আলাপচারিতা এবং সবকিছু চূড়ান্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন,তখন টিক্কা খানকে ঢাকার পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে এবং ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বাঙ্গালীদেরকে ঠান্ডা করার দায়িত্ব দিয়ে আলাপ শেষ না করে হুট করে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন।একটি সম্পূর্ণ মিলিটারী হামলা সংঘটিত হলো।যদি ও সকল বিদেশী সাংবাদিকদেরকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া এবং এবং সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তবু ও পৃথিবী আস্তে আস্তে পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংসতার কথা জানতে পারল।প্রায় দশ লক্ষা মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল এবং প্রায় সত্তুর লক্ষা মানুষকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে শরণার্থী বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
শেখ মুজিবের “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা” কোথায় ছিল?যুদ্ধটা আসলে কে ঘোষণা করেছিল? যদি কেউ তা করে থাকে তাহলে তারা হল ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী যারা অসহায় এবং নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।সেই বাঙ্গালীদের একমাত্র দোষ ছিল তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সঠিক জিনিসটাকে ভোট দিয়েছিল।ইয়াহিয়া এবং তার সেনাবাহিনীকেই কাঠগড়ায় দাড় করানো উচিত।
শেখ মুজিবের বিচার যদি ও এখন গোপনে করা হচ্ছে,সভ্য সমাজ কর্তৃক ইয়াহিয়া খান এবং তার জান্তার বিচার শীঘ্রই করা হবে।সভ্য সমাজ কখনোই মানবতা বিরোধী অপ্রাধের জন্য এই জান্তাকে ক্ষমা করবে নাহ।
যদি শেখ মুজিবকে শারীরিক বা যেকোন ভাবে অত্যাচার করা হয় তবে এটির প্রতিশোধ অবশ্যই নেওয়া হবে।বাঙ্গালী এর প্রতিশোধ ইয়াহিয়ার পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে নেবে।ইয়াহিয়ার জান্তা একে ঠিকভাবে নিক।
.
.
অনুবাদঃ চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি এবং তাসমিয়াহ তাহসিন
<৬, ১৫,৫৯১-৫৯২>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ এখন আর অভ্যান্তরীণ ব্যাপার নয়
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ টুডে ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
“বাংলাদেশ এখন আর অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়”
জন স্টোনহাউজ, এমপি
.
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ই হবে বাংলাদেশের সকল আইনী কার্যক্রম পরিচালনার বৈধ কর্তৃপক্ষ”, তিনশ জনেরও বেশি কমন হাউসের সদস্যবৃন্দ মহামান্য রানীর সরকারের কাছে এই আহবান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ ও স্বাক্ষর করেন।এর আগেও সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর আস্থাভাজন নেতা শেখ মুজিবর রহমান এর মুক্তির দাবিতে এমন একটি প্রস্তাবে দুইশত পঞ্চাশজন এর মত এম.পি সাক্ষর করেন।১৯৭১ এর ৫ই আগস্ট পূর্ববর্তী বিষয়টি নিয়ে হাউজ অফ কমন এ বিতর্ক হয়। এই প্রসঙ্গে মাননীয় জন স্টোরহাউজ এম.পি এর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক সারমর্ম নিচে দেওয়া হল-
এই সময়ে যা কিছু বাংলাদেশ ঘটছে তা এখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এটি বিশ্ব-সমাজ স্বীকৃত। হিটলার কর্তৃক ইহুদিদের বিনাশের মত বাংলাদেশের এই গণহত্যাও অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। এটি একটি বৈশ্বিক উদ্বেগ। উদ্বাস্তুদের বৃহৎ সংখ্যায় ঘর পালিয়ে ভারতে যেতে হচ্ছে এমন ভাবে যে, পাকিস্তান ভারতেই আক্রমন করবে। ইয়াহিয়া খানের সরকারের নীতি উদ্বাস্তুদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছিলো। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশে এই শরতে এক গণদুর্ভিক্ষ হতে চলছে। ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। এসবকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসাবে যারা মনে করছে, তারা আসলে পরিস্থিতিকে ছোট করে দেখছে। উল্লেখ্য ঘটনার কারণ গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মতামত প্রকাশের ফলে পাকিস্তানের সামরিক নিপীড়ন।
ঘটনা হলো, ২৫ মার্চের পূর্বে সংখ্যালঘুদের উপর নৃশংসতার নজির পাওয়া গিয়েছে যা সৈন্যদের আক্রমণের কারণ ছিলো।এরূপ অস্থিতিশীলতার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় যদিও এরূপ দাঙ্গা হামলায় রাজনৈতিক নেতাদের নিশ্চল দেখা যায়।আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবর রহমান এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে শান্ত করার প্রয়াস করেছিলেন।
বিশ্বের ইতিহাসে পাকিস্তানের এই পাশবিক নিপীড়ণ বিরল। সর্বদিক হতেই এটি অনুমোদিত। এই গণহত্যাগুলোতে যে কি কি হচ্ছে তা “দি সান দে টাইমস” এর ব্যাপক তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ হয়। “নিউজ উইক” এর ১লা আগস্টের সংখ্যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভয়ানক নৃশংসতার বর্ণনা পাওয়া যায়। যখন সরকারই সেনাবাহিনী দ্বারা এহেন বর্বর কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, তখন হস্তক্ষেপ করাটা এবং এর ইতি টানাটা বিশ্ব সমাজের দায়িত্ব হয়ে পড়ে, যেমনটি দরকার ছিল ১৯৩০ সালে হিটলারের ইহুদিদের উপর অত্যাচারের সময়।
জাতিসংঘের গণহত্যার ব্যাপারে সম্মেলন চালু করা প্রয়োজন, এবং দরকার হলে এরূপ দুর্যোগ প্রতিরোধে বড় বড় শক্তির সম্মতিতে জাতিসংঘের বাহিনী ব্যবহার করতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রস্তাব আড়াইশোর বেশি এম.পি দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই মানুষটির অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এত আগ্রহী কেন? কারন আমরা বুঝতে পেরেছি, যদি কোন রাজনৈতিক সমঝোতা করতেই হয়, তা শুধুমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথেই হওয়া সম্ভব। তিনি এই পরস্থিতির চাবিকাঠি। ইয়াহিয়া খানকে এই সত্য অনুধাবন করতেই হবে। তখনি কেবল কোন ধরনের চুক্তিতে পৌছানো যাবে, এবং আমার কোন সন্দেহ নাই যে কি চুক্তি হতে পারে, এটি হবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান।
যদি এই বৈশ্বিক সমস্যার ইতি টানতে হয় এবং বাংলাদেশের ও শরণার্থী শিবিরে প্রাণগুলো বাঁচাতে হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি আবশ্যক। ইয়াহিয়া খান যে বিকট পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে গেছে, এর থেকে বের হওয়ার উপায় বের করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দিতে ও এই দুর্যোগ বন্ধ করতে মধ্যস্থতা করতে ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি করা বিশ্বসমাজের জন্য জরূরী, বিশেষত যে কোন সরকারের জন্যই তা প্রয়োজন।
.
.
অনুবাদঃ চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি এবং তাসমিয়াহ তাহসীন
<৬, ১৬,৫৯৩-৫৯৪>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ মানবাধিকার নিশ্চিত করবে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ টুডে ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ মানবাধিকার নিশ্চিত করবে;
সকলের জন্য সমান সুবিধা।
-বিচারপতি চৌধুরী
.
“বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক সাম্য ও ভাতৃত্বের ভিত্তিতে মৌলিক মানবাধিকার ভোগ করবে”, লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা দেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রতিনিধি এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি আরো বলেছেন যে, বাংলাদেশে ধনী ও দরিদ্র সবাইকে এক বলে গন্য করা হবে এবং সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে।
যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্রায় ৩০০ নাগরিকের এক সমারোহে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা একটা বড় পদক্ষেপ, যা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বৈশ্বিক আন্দোলনের কেন্দ্র, এবং গ্রেট ব্রিটেনে বাংলাদেশের নাগরিকদের সদিচ্ছারই ফল।তিনি আশাবাদী যে, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন বিশ্বের বহু রাষ্ট্র বাস্তবতা মেনে নিয়ে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকার করে নেবে।
তিনি আরো বলেন, পূর্ব পাকিস্তান দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা রাজনৈতিকভাবে অধীনস্থ এবং অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হয়ে আসছে। সাংবিধানিক উপায়ে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী সত্য ও ন্যায়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ বজায় রাখে এবং তারা এখনো গণহত্যাও চালিয়ে যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বাস্তবতা হল আজ পাকিস্তান একটি মৃত ধারণা।
মুক্তিবাহিনীর প্রতি সম্মাননা
মুক্তিবাহিনীকে সম্মান জানিয়ে, বিচারপতি চৌধুরী বলেন, “আমাদের পবিত্র মাটি থেকে হানাদার সেনাবাহিনীদের দূর করতে তারা এখন এক ভয়ানক যুদ্ধে নিযুক্ত, যে মাটিতে আমরা শান্তিতে ও সৌহার্দ্যে বসবাস করতে আমাদের সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলবো”।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিপ্লবী প্রেরণাকে যারা পথ প্রদর্শন করেছেন ও দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের এবং যে সকল তরুণ তরুণী বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে তাদের, তিনি প্রদীপ্ত সম্মাননা জানান।
মুজিবকে মুক্তি দাও
মানব ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধের জন্য ইয়াহিয়া খানকে দোষারোপ করে, বিচারপতি বলেন, সেনাবাহিনী জান্তা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবৈধভাবে আটক করেছে, এবং এখন তাকে তথাকথিত ‘সিক্রেট ট্রায়াল’ এ রাখা হয়েছে। তিনি ঘোষণা করেন যে ইয়াহিয়া খানের কোনো অধিকার নেই একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে আটকে রাখে।শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি কিনা একজন নিবেদিত প্রাণ এবং নির্ভীক নেতাদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিশ্বে পরিচিত, গত পাঁচ মাসে তার সাথে কারো সাক্ষাৎ হয়নি, এমনকি তার আইনজীবীদের সাথেও নয়। তিনি সতর্ক করেন যে, তার কোনো ক্ষতি হলে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তা কখনোই ক্ষমা করবেনা এবং সমগ্র বিশ্বের শান্তি হুমকির সম্মুখীন হবে।
.
যুক্তরাজ্যের বাঙ্গালিরা প্রশংসিত
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশে সামরিক শাসন শুরু থেকে যুক্তরাজ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন এর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, গ্রেট ব্রিটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশকে স্বাধীনতা লাভে সহায়তায় তাদের নিরলস প্রচেষ্টা ও অসাধারণ উৎসর্গের জন্য তিনি প্রশংসা করেন। তিনি সরকার এবং মুক্তিবাহিনীর পাশে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের এই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন ।
মিশন ও পরিচালনা কমিটির কার্যক্রম বর্ণনা করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, মিশনটি যেমুন তাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে যুক্তরাজ্যে থাকবে এবং তাদের সাধারণ কূটনৈতিক কার্যাবলী সম্পাদন করবে, পরিচালনা কমিটিও যথারীতি যুক্তরাজ্যে প্রধান প্রধান কার্যনির্বাহী কমিটির মধ্যে সমন্বয় সাধনে তাদের যে কর্তব্য তা পালন করতে থাকবে এবং এটি বাংলাদেশকে আক্রমনকারী সেনাবাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করা সংক্রান্ত সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য দায় বদ্ধ থাকবে। এটি নিশ্চিত করেন যে পরিচালনা কমিটিতে তার সেবা আগের মতোই বজায় থাকবে, এবং তিনি মুক্তিসংগ্রামে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করে যাবেন।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬,১৭,৫৯৫> অনুবাদ
শিরোনামঃ বাংলাদশে লবী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ টুডে ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের জন্য প্রচারণা
বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব সমর্থন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটি ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত নানা সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি পাঠানোর ব্যবস্থা করছে।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের ৫৯ তম সম্মেলনে স্টুডেন্ট একশন কমিটির মোঃ হোসেন, নজরুল ইসলাম এবং ডঃ এইচ.এম.প্রামানিক-এর একটি দল অংশ গ্রহন করে। সম্মেলনে উপস্থিত ৭৭ টি দেশের ৭০০ জন প্রতিনিধিদের মাঝে তারা সফলভাবে প্রচারণা চালাতে সক্ষম হন।
অন্যদিকে ব্ল্যাকপুল-এ অনুষ্ঠিত টি.ইউ.সি এর বার্ষিক সম্মেলনে অংশগ্রহন করেন জাকারিয়া চৌধুরী,সুলতান শরীফ ও সুরাইয়া খানম। এই সমে¥লনের ফলাফল ও অভাবনীয়।
এই দলটিই এখন ব্রিটিশ লিবারেল পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে অংশগ্রহনের জন্য এখন স্কারবোর্গে অবস্থান করছে।
.
.
চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি এবং ইফতেখার হাসান
<৬,৫৯৬-৫৯৭> অনুবাদ
শিরোনামঃ বৃটিশ লেবার পার্টি ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিন্দা করেছে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ টুডে ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
বিশ্ব শান্তির পথে হুমকি
ইয়াহিয়ার বর্বরতার প্রতি
ব্রিটিশ লিবারেল পার্টির নিন্দা।
গত বৃহস্পতিবার ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ লিবারেল পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে সংগঠনটি বাংলাদেশে ঘটতে থাকা নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতি তাদের গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগন এবং গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের উপর অনৈতিকভাবে মিলিটারি ব্যবহারের কারনে তারা পাকিস্তান সরকারের প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে। বাংলাদেশের মানুষের এ ভয়াবহ অবস্থার জন্য তারা পাকিস্তান সরকারকে সম্পূর্ণভাবে দোষারোপ করে।
সম্মেলনে উপস্থিত তিন হাজারের ও অধিক প্রতিনিধিদের সকলের সম্মতি অনুযায়ী সংগঠনটি জাতীয় নির্বাহী কমিটির একটি অনুবন্ধ প্রকাশ করে যাতে কাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক শরনার্থীআশ্রয়ের সমস্যার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার প্রতি গভীর উদ্ধেগের কথা জানানো হয়েছে। এছাড়াও অনুবন্ধটিতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশে দূর্ভিক্ষ প্রতিরোধে একটি জরুরী মানবিক কার্যক্রম চালানোর জন্য এবং দাবী জানানো হয়েছে পাকিস্তানকে কোন প্রকার সাহায্য সহযোগীতা না করার জন্য যতদিন না পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মিলিটারী প্রত্যাহার করা হচ্ছে ও সকল বন্দি নেতাদের,বিশেষ করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া না হচ্ছে।
অনুবন্ধের কপি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সম্মেলনে অনুমোদিত অনুবন্ধটি ছিল-
এই অধিবেশন বাংলাদেশে সংগঠিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতি গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করছে। পাকিস্তান সরকারকে অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের এ ভয়াবহ পরিনতির দায়দায়িত্ব নিতে হবে এবং পাকিস্বতান সরকারের প্রতি তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ও জননেতাদের উপর অনৈতিকভাবে মিলিটারী আক্রমনের কারনে।
মুজিবকে মুক্তি দাও
এই অধিবেশন বিশ্বাস করে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় তখনই পৌছানো যাবে যখন-
১. পূর্ব পাকিস্তান থেকে মিলিটারী আক্রমন প্রত্যাহার করা হবে।
২. পূর্ব পাকিস্তানের আটককৃত নেতৃবৃন্দ, বিশেষত শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হবে।
যেকোন রাজনৈতিক সমাধান অবশ্যই পূর্বপাকিস্তানের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে করতে হবে।
“গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানকে সহায়তা দিলে তা হবে একটি প্রশ্নবিধ্য সামরিক শক্তিকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার নামান্তর। এই কনফারেন্স তাই পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত জরূরি মানবিক সাহায্য ছাড়া আর কোন রকমের অনুদান বা সহায়তা দেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য সব দেশ, বিশেষ করে ‘পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের’ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।”
বিশ্ব শান্তির প্রতি হুমকি
“এই ধরণের পরিস্থিতে বৃহৎ শক্তিগুলোর জড়িয়ে পড়ার যে স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা, তা আলোকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিরাজমান অবস্থা বিশ্ব শান্তির প্রতি হুমকি স্বরূপ বলে এই কনফারেন্স মনে করে। সুতরাং, পূর্ব বাংলার মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতা বাঞ্ছনীয়; এবং এই ইস্যুটি জাতিসংঘে উত্থাপন করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।”
শরণার্থী এবং দুর্ভিক্ষ
“শরণার্থী সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করা স্বত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অপ্রতুল সাড়ায় এই কনফারেন্স উদ্বেগ প্রকাশ করছে। ভারত সরকারকে এই সমস্যার সিংহভাগের ভারসাম্যহীন দায় নিতে হয়েছে। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ অদূর ভবিষ্যতে পূর্ববাংলায় দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাষ দেয়। বাইরে থেকে খাদ্যসহায়তা সরবরাহ করে নিরপেক্ষভাবে সরাসরি গ্রামীণ এলাকাগুলোতে তা বিতরণ করতে হবে, এবং সেটি হতে হবে প্রধানতঃ জাতিসংঘের কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত এরকম পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতা ও সরঞ্জাম সম্পন্ন একটি কর্তৃপক্ষের তদারকিতে। আমরা পাকিস্তান সরকারকে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের এই ব্যবস্থাকে মেনে নিতে আহ্বান জানাচ্ছি। এই প্রসঙ্গে জাতিসংঘের তরফে গৃহীত উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য আমরা ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করছি, এবং এমতাবস্থায় উদ্ভূত জরুরী সংকট মোকাবেলার জন্য ভারতীয় সরকারকে প্রদত্ত সহায়তা অব্যাহতভাবে জোরদার করতেও আহ্বান জানাচ্ছি।”
উল্লেখ্য যে এই কনফারেন্সের ৩,০০০ এরও বেশি প্রতিনিধির সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সেন্ট্রাল স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে ১৪ সদস্যের একটি দলকে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া বারমিংহ্যাম একশন কমিটি ও বাংলাদেশ উওমেন’স এ্যাসোসিয়েশনের কিছু প্রতিনিধিও কনফারেন্সে যোগ দেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সপক্ষে লেবার পার্টির প্রতিনিধিদের সমর্থন আদায় করা।
স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভুঁইয়া এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন।
.
.
অনুবাদঃ সাইমা তাবাসসুম উপমা
<৬, ১৯, ৫৯৮-৫৯৯>
শিরোনামঃ ব্যাপক হারে মৃত্যু
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ টুডে ভলিউম ১: নং ৪
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
.
ব্যাপক হারে মৃত্যু
মিসেস জুরিথ হার্ট,গত লেবার সরকারের শাসনামলে বৈদেশিক সাহায্য খাতের সাংসদ এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ৭ই অক্টোবর ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত বার্ষিক লেবার সম্মেলনে একটি মত বিনিময় সভায়, ব্রিটিশ সরকারকে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যক্ত করেন এবং বাংলাদেশের পরিপেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহবান জানান যেন পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। সরকার যে ইতিমধ্যেই চাপ প্রয়োগ করছে তাতে তার কোন সন্দেহ নেই, তবে তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি বিশ্ববাসির সরাসরি মতামত দেয়ার উপযুক্ত সময় চলে এসেছে। আর এটা অবশ্যই এখন জরুরি”।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির পক্ষে মিসেস হার্ট বলেন যে, তাঁদের কিছুই করার ছিল না কারণ এতো দুর্ভোগের বিশালত্ব ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। “মৃত্যু হচ্ছে, মেগাটন স্কেলে হচ্ছে, যেমনটা পরমাণু যুদ্ধের বেলায় আমরা আলোচনা করতাম, সেরকম”। তাদের এটা বুঝতে হবে, এটি একটি মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা আর তাই মনুষ্যসৃষ্ট সমাধানও তৈরি করা সম্ভব। এই ট্রাজেডির সমস্ত দায়িত্ব সরাসরি পাকিস্তান সরকারের উপর ন্যস্ত। তিনি পূর্ববাংলার আসন্ন দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সতর্ক করেন যেহেতু ফসল রোপণ করা হয়নি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গ্রামীন অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছে। সেখানে আশু সাহায্যের প্রয়োজন এবং এজন্য ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।
“মন্দের বিজয়ের জন্য সৎ লোকের কিছু না করলেই হয়” – ব্রুকের এ কথা উদ্ধৃত করে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, সেখানে এখনই কিছু করা উচিত যেহেতু এখনও হয়ত সময় রয়েছে।
মিস্টার ব্রুস ডগলাস ম্যান,উত্তর কেনসিংটন এর সাংসদ, তিনি বলেন এ দুর্যোগ থেকে তৈরি হতে পারে এক অভূতপূর্ব ট্র্যাজেডির। “পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষকে” তিনি “সর্বকালের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের” দায়ে অভিযুক্ত করে। তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সম্মেলনে সবাইকে আহবান জানান। এটা মানতেই হবে পাকিস্তান নামক দেশটি ধীরে ধীরে মৃত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছিল। এবং লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচানোর জন্যই বাঙালি গেরিলাবাহিনীকে এই যুদ্ধ জয় করতেই হবে।
আর.টি.হন জন স্টোরহাউজ, ওয়েডনেসবিউরি এর সাংসদ বলেন, আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ১কোটির বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের কারণে মারা যেতে পারে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও কর্তৃপক্ষের আচরণকে বর্ণনা করতে গিয়ে “মারকুইস ডি সেইডের লেখনীর বৃহৎ মঞ্চায়নের” সাথে তুলনা করেন। প্রায় ২০০ দিন পার হবার পরেও এই ভয়াবহতা চলছে। এটি একটি বিশাল হতাশাজনক ব্যপার যে, জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায় এইসব দেখেও চুপ রয়েছে এবং এই অসভ্যতার কঠোর নিন্দাজ্ঞাপন করছে না।
জনাব টম টর্নি, ব্র্যাডফোর্ড দক্ষিণের সাংসদ , তাঁর শহরে পাকিস্তান সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, তাদের প্রথমেই বঙ্গপ্রদেশের গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং তারপর তাদের সাথে গোলটেবিল বৈঠকে বসে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন হওয়া উচিত কি না তা নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু প্রথম কাজ হচ্ছে গণহত্যা বন্ধ করা।
ইতিপূর্বে লেবার পার্টির ব্রিটিশ ওভারসিজ সোশ্যালিস্ট ফেলোশিপের আমন্ত্রণে ব্রাইটন লেবার ক্লাবে অনুষ্ঠিত সভায়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী লেবার কনফারেন্সের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
জনাকীর্ণ সভায় বিচারপতি চৌধুরী বিশ্বের সকল স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের কাছে আবেদন জানান, যেন তারা প্রত্যেকে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়, যারা তাদের দেশের জন্য ভয়ংকর এক লড়াই লড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য, শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপদ মুক্তির এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দেয়ার জন্য ঐকান্তিক আবেদন জানান।
.
.
অনুবাদঃ ইফতেখার আহমেদ এবং চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬, ২০, ৬০০-৬০১>
শিরোনামঃ মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ টুডে ভলিউম ১ নং ৫
তারিখঃ ১ নভেম্বর, ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণে অবরুদ্ধ ঢাকা
.
সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ঢাকা শহর প্রায় বিচ্ছিন্ন। এটি এখন তীব্র গেরিলা আক্রমনে অবরুদ্ধ শহর। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গেরিলা বাহিনীর সমন্বিত ও ব্যাপক আক্রমনের ফলে শহরতলীর ৩০ মাইল পর্যন্ত সকল সড়ক ও রেল যোগাযোগ সমগ্র বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন।
পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদীর নিকটবর্তী ডেমরা শিল্প কমপ্লেক্স ; উত্তরে ঝিনারদি , নাহারবাজার, মাতখোলা, চারমান্দালিয়া এবং কতিয়াদি ; দক্ষিনে নবাবগঞ্জ দাওর এবং পশ্চিমে কালিয়াপুর,মধুপুরগড় এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমনে রয়েছে। শহরকে সবকিছু থেকে অবরুদ্ধ করে রাখতে মুক্তিবাহিনী সকল কালভার্ট ও রেলসেতু ধ্বংস করে এবং হাঁটার রাস্তা ও রেলপথে মাইন স্থাপন করে।
তারা ক্ষুদ্র অস্ত্র ও গ্রেনেড দিয়ে প্রধান সড়কে সাতটি অতর্কিত আক্রমন করে ১০০ রাজাকার ও ৬০ সেনা মেরে ফেলে। এতে সামরিক কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা হয় যেন তারা পার্শ্ববর্তী স্থানগুলোতে সরবরাহে হেলিকপ্টার ব্যাবহার করে। ঢাকা শহরে মতিঝিল, ধানমন্ডি,বেইলি রোড ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গুরুতর আক্রমন হয়েছে। এমনকি সামরিক আইন প্রশাসনের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্তেও ঢাকা শহরের পোস্তগোলায় অবস্থিত পাওয়ার সাপ্লাই স্টেশন উড়িয়ে দেয়া হয়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাজ্যব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবং রেডিও স্টেশনের চারপাশে সেনাবাহিনী আট মিটার উঁচু দেয়াল তৈরি করে।
১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর, ঢাকা থেকে গার্ডিয়ান পত্রিকায় জনাব মার্টিন উলাকোট লেখেনঃ
“নতুন গেরিলা দল গত তিন সপ্তাহে ঢাকায় ঢুকে পড়ে একটি সবল আক্রমন শুরু করে পরিস্থিতি অশান্ত করে ফেলে। যার শুরু হয়েছিলো সেপ্টেম্বরে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বোমা মারার পর থেকে।
নতুন দলগুলো ঢাকা বিমানবন্দর গুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। ঢাকা স্যাটেলাইট বন্দরে অসংখ্য গ্যাস পাইপ এবং চালানের জন্য অপেক্ষারত বিপুল পরিমাণ পাট পুড়িয়ে দেয়।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার প্রচারাভিযান অংশ হিসেবে তারা ছাত্রছাত্রীদের সতর্কীকরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল স্কুলে বোমাবর্ষণ করে।এক মেয়ে সতর্কবার্তা না পাওয়ায় গুরুত্র আহত হয়েছিল ।
এছাড়াও চার দিন আগে জনাব এর,আবদুল মোনেম খানের হত্যাকাণ্ডের জন্য গেরিলা বাহিনীকে দায়ী বলে মনে করা হয় ,যিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন।কিছু অ-বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় দলের আশা ছিল তিনি রাজনীতিতে ফিরে আসবেন। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যক্তিগত প্রতিশোধমূলক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।
.
ঢাকার শহরতলীতে অবস্থিত জাতিসংঘের সদরদপ্তরে দুই রাত পূর্বে একটি গ্রেনেড ছোড়া হয়, কিন্তু বিস্ফোরিত হয় নি। ঘটনাটি জাতিসংঘের জন্য আশংকাজনক।
বিমানবন্দরে আক্রমণের প্রচেষ্টাছিল সামরিক কর্তৃপক্ষের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনা। তিন ইঞ্চি বোমা, আসলে কলেরা পরীক্ষাগারের উপর পড়েছিলো। এই সম্পর্কে অনেক অজ্ঞানতায় ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না উপলব্ধি করা হয় যে পরীক্ষাগারটি বিমানঘাঁটি সঙ্গে সরাসরি সঙ্গতিপূর্ণ, এবং ওই কার্তুজ অগ্রসরমান পর্যবেক্ষক কর্তৃক লক্ষ্যস্থির না করেই ছোঁড়া হয়েছিল যা মাঠের মাত্র ৬০০ গজ আগে পতিত হয়েছিল।
এই ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনার ফলস্বরূপ ঢাকার পুলিশ এবং আর্মি চিন্তীত ছিল এবং পূর্ন সতর্ক ছিল। বসবাসকারীরা বলেন কয়েক সপ্তাহ পূর্বের তুলনায় শহরের সৈন্য সংখ্যা, চেকপয়েন্ট এবং গুরুত্র্বপূর্ন ভবনে পাহারা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর কিছুদিন আগে থেকে ঢাকার ঠিক বাইরের এলাকা ময়মনসিংহে সড়ক ও রেল যোগাযোগে আক্রমন করা হয়েছিলো। ৪ দিন পূর্বে গেরিলারা ঢাকার উত্তরে টঙ্গী ও নরসিংধির মধ্যবর্তী একটি রেলওয়ে সেতু উড়িয়ে ফেলে। ইঞ্জিন এবং কিছু বগি নদীতে পড়ে যায়। একটি প্রতিবেদন অবলম্বনে, পাকিস্তানের পত্রিকা সেতুতে আক্রমনের কথা নিশ্চিত করেছে কিন্তু হতাহতের সংখ্যা খুব কম বলে উল্লেখ করেছে।
এখানকার সূত্র জানায় যে মূলত ছাত্রদের নিয়ে নতুন গ্রুপগুলো তৈরি হয় । তারা যেখানে বাস করতো এবং যেখানে তাদের পরিবার এখনো বাস করে, তাদেরকে সেই সকল আলাকায় নিয়োগ করা হয়। কেউ কেউ, প্রকৃতপক্ষে, ২ সপ্তাহের প্রশিক্ষণের সময়টুকু ছাড়া মার্চের পর কখনো ‘শহর ত্যাগ করে নি।
তাদের সমর্থনের জন্য, সামরিক কর্মে যে সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহন করে নি, তারা নিজ পক্ষের সমর্থকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। এভাবে রাজনৈতিক দল গুলোর সুসংঘটিত উত্থান হয়েছিল। কিন্তু তারা কলকাতায় মুদ্রিত একটি গোপন খবরের কাগজ বের করা এবং বাংলাদেশে বিতরণ করা শুরু করতে সক্ষম হয়েছে।
সীমান্ত শহরে গোলা বর্ষণে মেডিকেলের ছাত্র ও বেসামরিক জনগণের হতাহতের মত দুর্ঘটনা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে রিপোর্ট মুক্তিবাহিনীর প্রতি জনসাধারণের সহানুভূতি বাড়িয়ে তোলে।
প্রকৃতপক্ষে, সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের মনোভাব এখন এমনই যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই এসব গোলাবর্ষণ করছে এ জাতীয় গুজব রটে যাচ্ছে। গুজবটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন; তবুও এ জাতীয় সংবাদই ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
প্রদেশের অন্যত্র, মুক্তিবাহিনীর অধ্যুষিত এলাকাগুলো থেকে তাদের বিতাড়িত করতে পাকিস্তান আর্মি তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি বলেই মনে হয়।
.
.
অনুবাদঃ চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটি
<৬, ২১, ৬০২>
শিরোনামঃ ‘বাস্তব মেনে নিন’
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ টুডে ভলিউম ১ নং ৫
তারিখঃ ১ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাস্তবতা মেনে নিন
বিচারপতি চৌধুরীর জাতিসংঘ সদস্যদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান
বৈদেশিক সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি এবং ১৪ সদস্যের বাংলাদেশের জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল এর নেতা জনাব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর জাতিসংঘের প্রতি উদাত্ত আহ্বান, “কাগজে কলমে সম্ভাবনার কথা ভাবা থেকে সরে বাস্তবে নেমে আসুন, বাস্তবতাই বাংলাদেশ।’’
জনাব চৌধুরী নিউ ইয়র্কে পিটিআই কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরই যুদ্ধ করছি। এবং আমাদের কোন সন্দেহ নেই যে জয় আমদের ই হবে। “
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলা ঘটনাগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন , “আমাদের এখন একটাই কাজ বাকি, তা হচ্ছে ইয়াইয়া খানের পশ্চিম পাকিস্তানের শেষ সৈনিককেও বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।’’ তিনি মুক্তিবাহিনী ও অগণিত তরুণ সম্প্রদায়কে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন যারা এই কাজে জড়িত ছিলেন।
যখন পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিদল থেকে জাতিসংঘে যাওয়া কতিপয় বাংলাদেশী ব্যক্তিবর্গের পরিচয় নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় তখন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা অসহমত পোষণ করেন এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “তাদের কে এখানে তাদের ভয়ংকর নেতার (ইয়াহিয়া) বার্তাবাহক হিসেবে পাঠানো হয়েছে এবং জাতিসংঘের দরবারে তাদেরকে প্রতারক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জনাব চৌধুরী আরো যুক্ত করেন, “এই স্বদেশদ্রোহী সদস্যদের পরিবারকে ঢাকায় জিম্মি করে রাখা হয়েছে। ইয়াহিয়া খান যেভাবে চান সেভাবে যদি তাঁরা কথা না বলেন তাহলে তাদের পরিবারের উপর প্রতিশোধ নেয়া হবে। সুতরাং, আমি বলতে চাইছি, এই ভদ্রলোকেরা নিজেদেরই প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না কারণ তাঁরা বন্দুকের নিশানার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।’’
উপনির্বাচন আটকে রাখা এবং বাংলাদেশে তথাকথিত বেসামরিক সরকার নিয়োগের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে জনাব চৌধুরী চতুরতার সাথে বলেন, “ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে । প্রতারকরা স্বাধীনতার দেরী করাতে পারবে না। শেষ মহাযুদ্ধে তারা দ্রুত তাদের পরিণতি বরণ করে নিয়েছিল, এবং বাংলাদেশেও একইভাবে করবে।’’
.
.
কম্পাইলারঃ সৌ রভ
<৬, ২২, ৬০৩-৬০৪>
শিরোনামঃ সভা-সমিতি-সম্মেলন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ* সংবাদ পরিক্রমা ১২শ সংখ্যা
তারিখঃ ৩ আগস্ট, ১৯৭১
.
[*বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিক্রমাঃ বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটির জনসংযোগ বিভাগ কর্তৃক ১১নং গোরিংস্ট্রিট, লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি অর্ধ সাপ্তাহিক]
সাম্প্রতিককালে বৃহত্তম জনসভা
‘অ্যাকশান বাংলাদেশের’ উদ্যোগে গত ১লা আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশের সমর্থনে সাম্প্রতিককালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৪০ হাজার প্রবাসী বাঙালী ও কয়েক হাজার ব্রিটিশ নাগরিক উক্ত সভায় যোগদান করেন।
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা এবং মুহুমুরহু করতালি ও জয়ধ্বনির মধ্যে প্রায় চার ঘণ্টাকাল সভার কাজ চলে। সভাশেষে বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে চরম শৃঙ্খলার সাথে এই বিপুল জনতা মিছিল সহকারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ হীথের বাসভবন, পার্লামেন্ট হাউস ও বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন। বিভিন্ন শ্লোগানের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ, বাংলাদেশ সরকারের আশু স্বীকৃতি, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং বর্বর ইয়াহিয়া সরকারের সকল প্রকার আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করার দাবী জানানো হয়। উক্ত মর্মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি স্মারক লিপিও পেশ করা হয়।
সভায় বিচারপতি চৌধুরী প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদেরও সুবিধার জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের কথা ঘোষণা করেন। পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ প্রেনিটস, মিঃ স্টোনহাউস ও মিঃ এডওয়ার্ডস, রেভাঃ রাইড, রেভাঃ ক্রনহউইথ, লেডী গিফোড এবং পল কনেট বক্তৃতা করেন।
.
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন
যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ভারতে অবস্থানরত বাঙালী শরণার্থীদের জন্য এ পর্যন্ত বেশ কিছু কাপড় ও মুক্তিবাহিনীর জন্য কিছু ঔষধপত্র পাঠিয়েছেন। তাঁরা মুক্তিবাহিনীর সাহায্যের জন্য সারজিকাল টীম ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল অবিলম্বে বাংলাদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। এই পরিকল্পনায় উৎসাহী ব্যক্তিদের নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছেঃ
Bangladesh medical association
9A wotton road
Crickwood, London N.W.2
.
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কর্মী সম্মেলন
আগামী ২১শে আগস্ট শনিবার লন্ডনে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ ( ঠিকানাঃ Bangladesh peoples cultual society, 59 Seymour house, tavistock place, London W.C 1 Tel: 018374542) এর উদ্যোগে ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালী সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক মহতী সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনের বাঙালী শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, শ্রমিক ও ছাত্রকর্মী এবং আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদেও প্রতিনিধিবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করবেন।
সম্মেলন উদ্ধোধন করবেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এতে যোগদানের জন্য বাংলাদেশের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডক্টর এ, আর, মল্লিক এবং খ্যাতনামা সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও বাংলাদেশ মুক্তিসংঘের সম্পাদক জহির রায়হানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
সম্মেলন শেষে দেশাত্নবোধক সংগ্রামী গান পরিবেশন করা হবে।
.
.
কম্পাইলারঃ শফিকুল ইসলাম
<৬, ২৩, ৬০৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
পরিচিতি সভা বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন |
বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ১৭শ ও ১৯শ সংখ্যা |
২০ ও ২৭ আগষ্ট, ১৯৭১ |
২০ আগষ্ট
ব্রাডফোর্ডে পরিচিতি সভা
গত রবিবার ব্রাডফোর্ডের তকদীর রেষ্টুরেন্টে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী বাঙালী কর্মচারীদের এক পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের এ্যাকশন কমিটির ইয়র্কশায়ার বিভাগ এই সভার আয়োজন করেন। এতে ইয়র্কশায়ারের বিভিন্ন এ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিবৃন্ধ এবং শটীয়ারিং কমিটির কনভেনর জনাব আজিজুল হক ভূঞা ও সদস্য জনাব শেখ আবদুল মান্নান উপস্থিত ছিলেন।
যাদেরকে এই সভায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তারা হলেন জনাব ফজলুল হক চৌধুরী, জনাব লুৎফুল মতিন, জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরী ও জনাব নুরুল হুদা।
.
২৭ আগষ্ট
লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন
আজ বেলা ৩টায় অনাড়ম্বর পরিবেশে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি ও গ্রেট বৃটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার জনাব বিচারপতি আবু সাঈদ নটিংহিলগেটের নিকট ২৪ নং পেম্বরিজ গার্ডেনে আনুষ্ঠানিকভাবে মিশন উদ্বোধন ঘোষনা করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারী ও অন্যান্য প্রতিনিধিবর্গসহ প্রায় দুইশত অতিথি উপস্থিত ছিলেন। এই উপলক্ষে সকাল ১১ টায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, রেডিও টেলিভিশনের সাংবাদিকদের জন্য আরেকটি বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় শতাধিক এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
মিশনের ঠিকানাঃ 24 PEMBRIDGE GARDENS, LONDON W-2
.
.
কম্পাইলারঃ শফিকুল ইসলাম
<৬, ২৪, ৬০৬-৬০৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন |
বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ১২শ (?) সংখ্যা |
৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের প্রতি বৃটিশ শ্রমিক দলের পূর্ণ সমর্থন
ব্রাইটনে বার্ষিক সভায় এহিয়া সরকারের তীব্র নিন্দা
বর্তমানে ব্রাইটেনে অনুষ্ঠান্রত বৃটিশ শ্রমিকদলের বার্ষিক সভায় উপস্থিত প্রায় তিন হাযার ডেলিগেট গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও জনগণের উপর বর্বরোচিত সামরিক অত্যাচার ও বেপরোয়া গণহত্যার জন্য পাকিস্থানী সামরিক জান্তার তীব্র নিন্দা করে পাকিস্তান সরকারকে এই মর্মান্তিক নির্যাতনের জন্য সম্পূর্ণরুপে দায়ী করেন।
প্রায় এক ঘন্টা আলোচনা ও বক্তৃতার পর উক্ত সভা সর্বসম্মতিক্রমে অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি, সকল প্রকার সামরিক নির্যাতনের অবসান, জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য শর্তাবলী নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদলের সংগে আলাপ-আলোচনা চালাবার জন্য এহিয়া সরকারের নিকট দাবী জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহন করা হয়।
উক্ত সভা বর্তমান পরিস্থিতির অবসান না হওয়া পর্যন্ত ‘ঘৃণিত সামরিক জান্তাকে কোন প্রকার সাহায্য না দেওয়ার জন্য বিশ্বের সকল বিশেষ করে “পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিলের” সদস্য দেশসমূহের কাছে আবেদন জানান।
বাংলাদেশের বর্তমান দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলী যে কোন সময় বিশ্ব শান্তি ব্যহত করতে পারে মনে করে শ্রমিক দলীয় সভা জাতিসংঘকে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানান যাতে জাতিসংঘ এমন কোন পন্থা অবলম্বন করেন যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়। জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশন বৃটিশ সরকারকে সক্রিয় হওয়ার জন্য জোর দাবী জানানো হয়।
দারুন দুর্ভিক্ষের আশংকা প্রকাশ করে উক্ত সভা অনতিবিলম্বে ভারতে শরণার্থীদের মধ্যে ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধারে সরাসরি সাহায্য কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানান।
প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে বৃটিশ শ্রমিক দলীয় সভায় বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারকার্য জোরদার করা ও ডেলিগেটদের পূর্ণ সমর্থন আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ষ্টিয়ারিং কমিটি ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল ব্রাইটনে প্রেরণ করেন। বার্মিংহাম এ্যাকশন কমিটি এবং বাংলাদেশ মহিলা সমিতি থেকেও কয়েকজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন এবং সম্মিলিত এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন ষ্টিয়ারিং কমিটির আহবায়ক জনাব আজিজুল হক ভূঞা। তাঁদের কয়েক দিনব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সম্মিলিত ডেলিগেটগণ বাংলাদেশ এহিয়ার নির্যাতনে অত্যন্ত বিমোহিত হন এবং সর্বসম্মতিক্রমে উক্ত প্রস্তাবসমূহ পাশ করেন।
ইতিপূর্বে শ্রমিকদলের একটি বিশেষ শাখা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রনক্রমে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব বিচারপতি চৌধুরী ব্রাইটনে লেবার ক্লাবে সম্মিলিত ডেলিগেটদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এহিয়ার বর্বরতার উপর ভাষন দেন। তিনি বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশসমূহকে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং শেখ মুজিবর রহমানের আশু মুক্তির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আবেদন জানান।
বাংলাদেশের পক্ষে জোর দাবী জানিয়ে যাঁরা বক্তৃতা করেন তাঁদের মধ্যে মিঃ পিটার, রাইট অনারেবল জন স্টোন হাউস, মিঃ ব্রুস ডগঅলাস ম্যান, মিঃ ফ্রেড ইভান্স, লর্ড ব্রকওয়ে, অক্সফামের মিঃ বার্নাড হাম্ফরী, মিঃ পিটার কে, এইচ এবং মিঃ জাকারিয়া চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের প্রতি রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর পূর্ণ সমর্থন
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা বাংলার জনপ্রিয় নেতা ও পাকিস্তানের এককালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র পুত্র জনাব রাশেদ সোহরাওয়ার্দী গতকাল এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষনা করেন যে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্ণ সফলতা কামনা করেন।
বাংলাদেশে গণহত্যার কথা শুনে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছেন। যেহেতু রাজনীতির সংগে জড়িত ছিলেন না সেজন্য এ পর্যন্ত কোন বিবৃতি দেননি। সম্প্রতি তাঁর ভগ্নি বেগম আখতার সোলায়মানের দেওয়া কয়েকটি বিবৃতিতে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার রাজনৈতিক বলিষ্ঠ ভূমিকা ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে মনে করে তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা গত ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের জনসাধারণকে শোষন করে আসছে এবং বর্তমানে বেপরোয়া গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে। এই শোষনের বিরুদ্ধে তাঁর পিতা আমরণ সংগ্রাম করেছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন যে, মুক্তিবাহিনী শিঘ্রই হানাদার শত্রুসৈন্যকে বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে বিতারিত করে বাংলাদেশে পূর্ণ স্বাধীনতা কায়েম করবে।
জনাব সোহরাওয়ার্দী সকল বাঙালীকে দলমত ও রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে একতার সংগে স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করার জন্য আবেদন জানান।
জনাব সোহরাওয়ার্দী বাংলাদেশ সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে যে তাঁরা সকলেই তাঁর পিতার সহকর্মী ও স্নেহভাজন ছিলেন।
জনাব সোহরাওয়ার্দী গতকাল বাংলাদেশ ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিস পরিদর্শন করেন এবং বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরী, ষ্টিয়ারিং কমিটির আহবায়ক আজিজুল হক ভূঞা, সদস্য জনাব শেখ আবদুল মান্নান ও অন্যান্য কর্মীবৃন্দের সংগে প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করেন।
.
কম্পাইলারঃ শফিকুল ইসলাম
<৬, ২৫, ৬০৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বিভিন্ন বিশ্বসম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব |
বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ২৫তম সংখ্যা |
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
বিভিন্ন বিশ্বসম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব
সাম্প্রতিককালে ইউরোপ ও গ্রেট বৃটেনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারকার্য ও জনমত সৃষ্টি করার জন্য লন্ডনস্থ বাংলাদেশ ষ্টিয়ারিং কমিটি বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্নভাবে কয়েকটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন।
- প্যারিসে ৫৯তম আন্তঃপার্লামেন্টারী ইউনিয়ন সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনাব মোহাম্মদ হোসেন, জনাব নজরুল ইসলাম ডঃ প্রামানিক বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের ৭৭টি দেশের ৭০০শত প্রতিনিধিদের মধ্যে সপ্তাহব্যাপী প্রচারকার্য চালিয়ে সম্প্রতি লন্ডনে ফিরে এসেছেন। তাঁদের সার্থক প্রচারের ফলে সম্মেলনে বাংলাদেশ ও বাস্তুহারাদের সমর্থনে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয়।
- ব্লাকপুলে অনুষ্ঠিত বৃটিশ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারকার্য চালান জনাব জাকারিয়া চৌধুরী, জনাব সুলতান শরিফ ও মিস্ সুরাইয়া খানম।
অধিবেশনে অংশগ্রহনকারী কয়েকজন বিশিষ্ট শ্রমিক প্রতিনিধি বাংলাদেশে গনহত্যা ও শ্রমিক নিধনের করুন ইতিহাস বর্ণনা করেন এবং পৃথিবীর সকল ডক শ্রমিকদের অস্ত্রশস্ত্র বহনকারী পশ্চিম পাকিস্তানী জাহাজ সমূহে কোন কাজ না করার অনুরোধ জানান।
- স্কারবরোতে অনুষ্ঠান্রত বৃটিশ লিবারেল পার্টির বার্ষিক সম্মেলনেও আমাদের প্রচারকাজ সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে। জনাব জাকারিয়া চৌধুরী, জনাব সুলতান শরিফ ও মিস্ সুরাইয়া খানম বর্তমানে এই গুরুদায়িত্ব পালনে ব্যস্ত রয়েছেন।
- ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক জনাব মোহাম্মদ হোসেন সম্প্রতি বুকারেষ্টে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কিত ২১তম সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারকার্য চালান। ফলে উক্ত সম্মেলন বিশ্বের সমস্ত দেশকে এহিয়ার সামরিক জান্তার জন্য কোন অস্ত্রশস্ত্র না দেওয়ার সুপারিশ জানান।
.
কম্পাইলারঃ শফিকুল ইসলাম
<৬, ২৬, ৬০৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বিচারপতি চৌধুরীর তৎপরতা |
বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ২৬তম সংখ্যা |
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড সফরশেষে
বিচারপতি চৌধুরীর লন্ডন প্রত্যাবর্তন
বাংলাদেশের আহু স্বীকৃত ও শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে দুই সপ্তাহব্যাপী স্বানডেনেভিয়ান দেশসমূহে সফর শেষ করে বিচারপতি চৌধুরী সম্প্রতি লন্ডন প্রত্যাবর্তন করেছেন।
এই সাক্ষাতকারে বিচারপতি চৌধুরী জানান যে, তাঁর এই সফর অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়েছে। সর্বত্রই তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে অত্যন্ত সহানুভুতিশীল মনোভাবের পরিচয় পান এবং স্থানীয় জনগণের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটিগুলো খুবই সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সুইডেন সফরকালে জনাব চৌধুরী পার্লামেন্ট সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মন্ডলী, লিবারেল পার্টির হুইপ, ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্রোটিক পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল, সুইডেন সরকারের বৈদেশিক দফতরের আইন বিভাগের প্রধান এবং বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক ও প্রন্থকার মিঃ জনাব মডালের সংগে সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেন। তিনি রেডিও, টেলিভিশনে ও বিখ্যাত সাংবাদিক ক্রেডেরিকসনের সংগেও ভিন্ন ভিন্নভাবে সাক্ষাতকারে মিলিত হন। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সেক্রেটারীর সংগেও বাংলাদেশ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়।
ফিনল্যান্ডে জনাব চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সদস্য, বৈদেশিক দফতরের সেক্রেটারী, পার্লামেন্টের সদস্যবৃন্দ ও আন্তর্জাতিক শান্তি কাউন্সিলের সেক্রেটারীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এ ছাড়াও তিনি স্থানীয় টেলিভিশনে সাক্ষাতদান ও সোশ্যাল ডেমোক্রোটিক পার্টির অফিস পরিদর্শন করেন।
ডেনমার্ক সফরকালেও জনাব চৌধুরী অনুরুপভাবে পার্লামেন্টের সদস্য, বৈদেষিক বিভাগের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় জনসাধারণ দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির সংগে দেখা করেন ও বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। সেখানকার সকল মহল থেকে তাঁকে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়।
প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠিও হস্তান্তর করেন।
.
.
কম্পাইলারঃ শফিকুল ইসলাম
<৬, ২৭, ৬১০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
জনসভা ও নৃত্যনাট্য |
বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ২৬তম সংখ্যা |
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
ইপসুইজে জনসভা
গত শনিবার ইপসুইজে ইংরেজী নাগরিক ও প্রবাসী বাঙালীদের মিলিত উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রায় তিনশত বাঙালী ও দুই শতেরও অধিক ইংরেজ নাগরিক উপস্থিত ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা করেন। ষ্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে জনাব ডঃ কবির ও আবদুল হক প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী বক্তৃতা করেন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ ব্যাখ্যা করেন। সভা শেষে সমবেত জনতা মিছিল সহকারে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিন করেন।
মিচেন জনসভা
বৃটিশ কমিউনিষ্ট পার্টির উদ্যোগে গত বৃহস্পতিবারে মিচানে এক জনসভা হয়। উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রক্রমে বাংলাদেশ ষ্টিয়ারিং কমিটির সদস্য জনাব শেখ আবদুল মান্নান উক্ত সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভুমিকায় উপর আলোকপাত করেন।
গণ-সংস্কৃতি সংসদের নৃত্যনাট্য
বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে গত শনিবার ও রবিবার স্থানীয় কনওয়ে হলে মুক্তি সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে রচিত “অস্ত্র হাতে তুলে নাও” নৃত্যনাট্যটি পরিবেশিত হয়। উভয় দিন হল ভর্তি জনসমাগম হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী প্রধান অতিথির আসন গ্রহন করেন এবং বৃটিশ এম, পি, মিঃ পিটার শোর ও সঙ্ঘলের বিরোধী দলের মিঃ নভরতম বক্তৃতা করেন।
.
কম্পাইলারঃ শফিকুল ইসলাম
<৬, ২৮, ৬১১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ডেলিগেশন গণমিছিল |
বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ৩৬ তম ও ৩৭তম সংখ্যা |
২৬ ও ২৯ অক্টোবর, ১৯৭১ |
২৬ অক্টোবর
কনজারভেটিভ কনফারেন্স ডেলিগেশন
ষ্টিয়ারিং কমিটির এক প্রতিনিধিদল অম্প্রতি অনুষ্ঠিত কনজারভেটিভ পার্টির কনফারেন্স বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারকার্য চালান। এহিয়ার বর্তমান জংগী মনোভাবাপন্নতার জন্য কয়েকজন ইয়ং কনজারভেটিভ বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করবেন বলে মতামত দিয়েছেন। তাঁরা সম্মিলিতভাবে আলেক ডগলাস হোমকে অনুরোধ করবেন বলে জানান। ষ্টিয়ারিং কমিটির তরফ থেকে মিস সুমাইয়া খানম, জাকারিয়া চৌধুরী, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মানিক, আবদুল হাই, বার্মিংহামের জহুর আলী, ইসমাইল আজাদ, মিঃ পাশা প্রভৃতি যোগ দেন।
২৯ অক্টোবর
বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবীতে বিরাট গণ-মিছিল
বাংলাদেশ ষ্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবীতে আগামী শনিবার ৩০শে অক্টোবর ১৯৭১ বেলা দেড় ঘটিকায় এক বিরাট জনসভা ও গণ্মিছিলের আয়োজন করেছেন। সভায় বিচারপতি চৌধুরী ছাড়াও বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের কয়েকজন ও বাংলাদেশ থেকে আগত আওয়ামী লীগের ৪ জন এম-এন-এ ও ও এম-পি-এ এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটির প্রতিনিধিগণ বক্তৃতা করবেন।
সভাশেষে মিছিল হাউডপার্ক স্পীকার্স কর্ণার হতে আরম্ভ করে ব্রুক ষ্ট্রীট ক্লারিজেস হোটেল হয়ে হ্যানোভার স্কোয়ারে শেষ হবে।
লন্ডনে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর আগমন উপলক্ষে এই জনসভা ও মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবীতে এক স্মারকলিপি মিসেস গান্ধীকে দেওয়া হবে।
.
.
কম্পাইলারঃ দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬, ২৯, ৬১২>
শিরোনামঃ বাংলাদেশের সরকার তৈরীঃ স্বীকৃতির দাবীতে জনসভা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা ৩৯তম ও ৫০ তম সংখ্যা
তারিখঃ ৫ নভেম্বর ও ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ সরকার পুরো প্রশাসনভার নেবার জন্য তৈরী
মুক্ত বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থার বিস্তারিত কাঠামো বাংলাদেশ সরকার এখন দ্রুত চূড়ান্ত করে ফেলছেন । প্রকাশ শিঘ্রই পাকিস্তানী শত্রুসেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করে গোটা বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে ।
বাংলাদেশ সরকার আগে থেকেই পূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তৈরী হয়ে থাকছেন । শত্রুসৈন্য সম্পূর্ণ বিতাড়িত হওয়ার পর যাতে বাংলাদেশের ভেতরে কোন অরাজক অবস্থা সৃষ্টি না হয় সেইজন্যই গোটা ছকটা তৈরী করে রাখা হচ্ছে এবং আগাম কতকগুলি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ।
পাকিস্তানী শত্রুসৈন্যদের সাহায্যকারী লোকদের শাস্তিদানের ব্যাপারেও ইতিমধ্যে কয়েকটা নিয়ম-কানুন করে দেওয়া হয়েছে । বলা হয়েছে, শত্রুসৈন্যদের সংগে বা পাকিস্তান সরকারের সংগে সহযোগিতা করার অভিযোগে কাউকে মুক্তিফৌজ বা কেউ কোন শাস্তি না দিয়ে তাদের ধরে আঞ্চলিক কমিটির কাছে নিয়ে যেতে হবে । প্রত্যেক এলাকায় এদের শাস্তি দেয়ার জন্য বা অনুরুপ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাংলাদেশ সরকারের একটি বিশেষ কমিটি থাকবে ।
বাংলাদেশের জন্য একটি পূর্ণাংগ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরী করার জন্যও ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিকল্পনা বিশারদের সংগে কথা বলেছেন । উক্ত বিশারদ বাংলাদেশের কয়েকজন অভিজ্ঞ প্রতিনিধির সংগে আলোচনা করে একটি পূর্ণাংগ পরিকল্পনা তৈরী করেছেন ।
স্বীকৃতির দাবীতে হাইডপার্কে বিরাট জনসভা
গত রবিবার হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্নারে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবীতে এক বিরাট জনসভা হয় । গ্রেট বৃটেনের বিভিন্ন অঞ্চল হতে বহু কষ্ট স্বীকার করে পনের সহস্রাধিক বাঙালী হাইডপার্কে সমবেত হয়ে বজ্রকণ্ঠে দাবী জানান, বাংলাদেশকে অভিলম্বে স্বীকৃতি দাও ও ‘শেখ মুজিবুরের মুক্তি চাই’ ।
ষ্টিয়ারিং কমিটির জনসভায় বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল কিন্তু তিনি জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন বাংলাদেশের স্বপক্ষে ও বিভিন্ন দেশের নিকট স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টার জন্য উপস্থিত হতে পারেননি ।
কেন্দ্রীয় ষ্টীয়ারিং কমিটি তাই দেশের বৃহত্তম স্বার্থে একই স্থানে অনুষ্ঠিত একি উদ্দেশ্যে আহূত আওয়ামীলীগের জনসভাকে সমর্থন জানিয়ে উক্ত জনসভায় সকলকে শান্তিপূর্ণভাবে যোগ দিতে অনুরোধ করেন ।
একই স্থানে দুইটি জনসভা বিদেশীদের নিকট ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হতে পারে বা বাংলাদেশের এই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে কোনরূপ বিভেদ সৃষ্টি না করে ষ্টিয়ারিং কমিটির আহূত জনসভা বাতিল করে সকলে এক বাক্যে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দাবী জানান ।
সভাশেষে পনের সহস্রাধিক জনতার মিছিল বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট ১০ নং ডাউনিং ষ্ট্রিটে যেয়ে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতির আবেদন জানান ।
.
.
কম্পাইলারঃ দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬, ৩০, ৬১৩>
শিরোনামঃ কোন আপোষ নয়
সংবাদপত্রঃ জনমত* ৩য় বর্ষঃ ৪০ তম সংখ্যা
তারিখঃ ২১ নভেম্বর, ১৯৭১
.
[ * জনমতঃ সাপ্তাহিক। প্রধান সম্পাদকঃ এ, টি, এম ওয়ালী আশরাফ। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ আনিস আহমদ, জনমত পাবলিশার্স লিমিটেড, ২ টেম্পারলে রোড, লন্ডন থেকে প্রকাশিত। ]
কোন আপোষ নয়
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এসেছে । আরও আসছে এবং আসবে । সেদিনের বিক্ষিপ্ত মুক্তিসেনারা আজ এক সুসংগঠিত আদর্শবান মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়েছে । তাঁদের লক্ষ্যঃ এক । মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করা । দখলকারী বাহিনীকে পরাভূত করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করা হলো তাদের আদর্শ । সেই আদর্শে ব্রতী হয়ে লক্ষ লক্ষ কিশোর-যুবক অস্ত্র হাতে নিয়েছেন, শত্রুর সংগে লড়াই করছেন । দেশের ভিতর থেকে সাধারণ মানুষ তাদের সমর্থন করছেন । দেশের ভিতরের মানুষের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা মুক্তিসেনাদের কাজে সুবিধা করে দিয়েছে অনেক । সেই সুবিধে আছে বলেই মুক্তিসেনারা খুব সহজেই শত্রুদের কাবু করতে পারছেন । সারা বাংলায় শত্রুরা আজ নাস্তানাবুদ, ঘায়েল হয়ে গেছে আক্রমণকারী বাহিনী । সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন বাংলার লক্ষ লক্ষ মুক্তিসেনারা তাঁদের সামরিক লক্ষ্যস্থল ঢাকার দিকে দূর্বার গতিতে অগ্রসর হবে- সে জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলেছে সেই ‘চলো চলো-ঢাকা চলো’ অভিযান পরিচালনার জন্য । আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ।
ঠিক এই যখন পরিস্থিতি তখন বিশ্বের নানা স্থান থেকে কুটনৈতিক চাপ পড়েছে সংশ্লিষ্টদের ওপর-আপোষের জন্য । বিশ্বের বিভিন্ন সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন পথে চাপ দিচ্ছেন । পত্রান্তরে প্রকাশ, শুধু পাকিস্তানের ইয়াহিয়াকেই নয়, আপোষের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের উপর পরোক্ষ চাপ দেওয়ার জন্য ভারত সরকারকেও চাপ দিচ্ছেন ।
কিন্তু কিসের আপোষ ? কার সংগে আপোষ ? কেন সে আপোষ ?
আমরা, সাড়ে সাত কোটি মানুষ-বাংলাদেশের অধিবাসী । আমরা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত ছিলাম । ২৩ বছরেও তা পাইনি । আর পেতে চাই না । আমরা এখন চাচ্ছি পুনর্দখল । স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হচ্ছে আমাদের মাতৃভূমি । আক্রমণকারী পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী হটকারিতা ও অস্ত্রের বলে দখল আদায় করবো । এই পথে কোন আপোষ নেই । রাশিয়া, আমেরিকা, বৃটেন, গণচীন, পশ্চিম জার্মানী ও যে কোন দেশই হোক না কেন-তারা যদি ইয়াহিয়াকে আপোষের পরামর্শ দিয়ে থাকে-দিক । আমরা তাতে সংশ্লিষ্ট নই । আমরা মাতৃভূমির মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত-মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব । আমাদের সংগ্রামের ক্ষতি করে এমন কোন প্রস্তাব যাঁরা করবেন-তাঁদেরকে আমাদের শত্রুর সহযোগী বলে আমরা ধরব ।
ভুট্টোকে পিকিং কি বলেছে জানি না, সুলতান মোহাম্মদকে উথান্ট কি বলেছে জানতে চাই না, মিসেস গান্ধীকে পশ্চিমা নেতারা কি বলেছেন-শুনতে রাজী নই । আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবো-আমরা, এ কথাটা সকলের অবগতির জন্য আমরা আবার পরিষ্কার ভাষায় প্রকাশ করছি । কত বছর যুদ্ধ চলবে-সে হিসাব এখন করব না । শত্রুদের বিতাড়িত করার পর সে হিসেব হবে-কতদিন লাগলো । বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে খেয়াল রাখবেন বলে ‘জনমত’ আশা করে ।
.
.
কম্পাইলারঃ দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬, ৩১, ৬১৪-৬১৫>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের সপক্ষে বিভিন্ন তৎপরতা
সংবাদপত্রঃ জনমত ৩য় বর্ষঃ ৪০ তম সংখ্যা
তারিখঃ ২১ নভেম্বর, ১৯৭১
.
ছাত্র সংগ্রামে পরিষদের ডাক
লন্ডন, ১৪ই নভেম্বর
গ্রেট বৃটেনস্থ বাংলাদেশ চাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জন্য গরম কাপড়-চোপড় চেয়ে প্রবাসী বাঙালীদের কাছে এক আবেদন জানিয়েছেন । ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেন যে, দেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার জন্য প্রবাসী বাঙালীদের কাছে এবার বিশেষ সুযোগ এসেছে । তাঁরা আশা প্রকাশ করেন যে, মুক্তি সেনাদের ব্যবহারের জন্য প্রবাসী বাঙালী ভাইবোনেরা নিজেদের সাধ্যমত গরম কাপড়-চোপড় দান করবেন । সংগ্রাম পরিষদের কাছে সাহায্য পাঠানো যাবে বলে তাঁরা বলছেন ।
কর্নেল ওসমানীর চিঠি
বামিংহাম, ১০ই নভেম্বর
আজ এখানে জানা গেছে যে, সেনাপতি কর্নেল ওসমানী মিডল্যান্ডের মহিলা সমিতির এক চিঠির জবাবে ঔষধ, তাঁবু ও কাপড়-চোপড় চেয়ে মহিলা সমিতির সভানেত্রী মিসেস বদরুন পাশার কাছে সম্প্রতি এক চিঠি লিখেছেন ।
জানা গেছে যে, মহিলা সমিতি মুক্তি সেনাদের ব্যবহার্যে পাঠানোর জন্য কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করছেন ।
বাংলাদেশের সমর্থনে প্রস্তাব গ্রহণ
পোর্টসমাউথের দক্ষিণ নির্বাচনী এলাকার শ্রমিক দল গত ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের সমর্থনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন এবং প্রস্তাবের একটি স্থানীয় বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদেও পাঠানো হয়েছে ।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, এই ওয়ার্ড সভা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে পূর্ণভাবে সমর্থন করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক গোষ্ঠী কর্তৃক মানবাধিকার অস্বীকার করায় তার নিন্দা করেও নির্বাচনী এলাকার দলকে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের সমর্থন করার আহবান জানায় ।
বাস্তুহারাদের সাহায্যার্থে বিচিত্রানুষ্ঠান
লন্ডন ১৪ই নভেম্বর
আজ স্থানীয় স্যাডলার্স ওয়েলস থিয়েটারে বাংলাদেশের বাস্তুহারাদের সাহায্যের উদ্দেশ্য কনসার্ট ইন সিমপেথি’র উদ্যোগে এক বিচিত্রানুষ্ঠান হয় । পূর্ণ হলে উদ্ধোধনী দিবসে দুটি শো হয় । বাংলাদেশ ও ভারত থেকে আগত প্রখ্যাত শিল্পীবৃন্দ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেন ।
বীরেন্দ্র শংকর অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ।
বাংলাদেশের পক্ষে-৫০০, বিপক্ষে-৩, নিরপেক্ষ-২
ম্যানচেষ্টার থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছে যে, গত শুক্রবারে ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের এক বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই মর্মে মত প্রকাশ করেছেন যে, পূর্ণ স্বাধীনতাই হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান ।
বাংলাদেশ তহবিলে ১৯ পাউন্ড দান করার এক প্রস্তাব সভায় ৫০০ ভোটে গৃহীত হয়েছে । প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৩টা এবং ২ জন ভোটদানে বিরত থাকেন । অন্য একটি প্রস্তাবে তথাকথিত বৃটিশ নিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এলেককে বলার জন্য ন্যাশনেল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টস-এর প্রেসিডেন্টের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে ।
সভায় সভাপতিত্ব করেন এন, ইউ, এস-এর আঞ্চলিক সভাপতি মিঃ জেঃ হ্যারিস ও বাংলাদেশের পক্ষে বক্তৃতা করেন জনাব কবীর আহমদ ।
.
.
কম্পাইলারঃ দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬, ৩২, ৬১৬>
শিরোনামঃ মুক্তিসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী
সংবাদপত্রঃ জনমত ৩য় বর্ষঃ ৪০ তম সংখ্যা
তারিখঃ ২১ নভেম্বর, ১৯৭১
মুক্তিসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী
মিডল্যান্ডের বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী মিসেস বদরুন পাশা বলেন, “আমি গত ১৯৭০-এর জানুয়ারী মাসে বার্মিংহাম আসি । এর আগে লেষ্টারে ছিলাম এবং সেখানে আমি পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতির আহবায়ক ছিলাম । বার্মিংহামে এসেও পাকিস্তান মহিলা সমিতির সংগে জড়িত ছিলাম । কিন্তু গত মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খাঁ-র বর্বর সেনারা বাংলাদেশে আক্রমণ পরিচালনার পরে আমরা বুঝতে পারলাম যে, পশ্চিমাদের সংগে আমাদের আর চলা সম্ভব নয়” ।
মিসেস বদরুন পাশা বলেন, “এর পরই আমরা মিডল্যান্ডে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গঠন করি এবং ২৮শে মার্চ মিডল্যান্ড প্রবাসী বাঙালীদের স্মলহিথ পার্কের জনসভায় মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বক্তৃতা করি । তখন থেকেই মিডল্যান্ডের বাঙালীরা একত্রে কাজ করতে শুরু করলেন ।”
মিডল্যান্ডের বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কার্যবিবরণী দিতে গিয়ে মিসেস পাশা বলেন, “সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবীতে ২৬শে এপ্রিল ছ’জন সদস্য বৃটিশ পার্লামেন্টের লবি করেন এবং প্রধানমন্ত্রী মিঃ হীথের কাছে এক আবেদন পাঠানো হয় । ২০শে জুন বলসল হীথ মাউন্ট প্লেজেন্ট স্কুলে এক মিলাদ মাহফিলেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল । ২৭শে জুন আমরা বিংলী হলের সভায় একটা মীনাবাজার করেছি । ৪ঠা জুলাই স্থানীয় কার্লটন সিনেমা হলে মণিহার নামের একটা চ্যারিটি সিনেমা করেছি । ১৭ ও ১৮ই জুলাই বার্মিংহামের সিটি সেন্টারে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল । ২রা অক্টোবর বলসল হীথ মাউন্ট প্লেজেন্ট স্কুলে আমাদের সমিতির উদ্যোগে একটা বিরাট প্রদর্শনী হয় । এ ছাড়া বিলাতের প্রত্যেক স্থানে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সফরের বিরুদ্ধে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলগুলোতে আমরা যোগ দিয়েছি ।”
মিসেস পাশা আরও বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর ব্যবহারের জন্য তাঁদের সমিতির কাছে বিলাতের বিভিন্ন স্থান থেকে কাপড়-চোপড় আসছে । এইগুলি এবার ইন্ডিয়ার বিমানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিন্তু এবার ইন্ডিয়া প্রথমে সম্মতি জানিয়ে এখন আবার পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় একটু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে । তিনি আরও বলেন যে, বর্তমানে এই সব কাপড়-চোপড় কেন্দ্রীয় ষ্টিয়ারিং কমিটির মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে ।
মিসেস পাশা প্রবাসী সকল ভাইবোনদের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন যে, ইয়াহিয়া খাঁ-র বর্বর সেনাবাহিনী আমাদের মা-ভাই-বোনদের উপর যে অত্যাচার করেছে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সকলকে তৈরী থাকতে হবে । তিনি বলেন, রক্তের বদলে রক্ত নেওয়াই হচ্ছে ইয়াহিয়া বাহিনীর অত্যাচারের উপযুক্ত জবাব ।
মিসেস পাশা জানান যে, এদেশের এবং দুনিয়ার অন্যান্য সব বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদগুলোর সংগে মিডল্যান্ডের বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে । তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এই যোগাযোগ বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত চলবে । মিসেস পাশা বলেন, স্বাধীন বাংলার মানুষের পূর্ণ মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বাঙালীদের এই সংগ্রাম দেশ-বিদেশে চলতে থাকবে, এতে কোন বিরতি হবে না ।
.
.
[বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার শাখাসমূহ]
আমেরিকা
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার বিভিন্ন শাখা কর্তৃক
প্রকাশিত সংবাদপত্র
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার শাখা সমূহ
সাইমা তাবাসসুম
<৬, ৬১৭-৬১৮>
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খণ্ড
[*এই তালিকাটি জনাব, কে, এম, আলমগির সম্পাদিত “BANGLADESH” পত্রের তৃতীয় সংখ্যা ( নিউইয়র্কঃ ১৬ জুন, ১৯৭১) হতে নেয়া হয়েছে।]
১. নিউইয়র্ক
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা,ইনক
২৬৬৭ ব্রডওয়ে,
নিউইয়র্ক, N.Y ১০০২৫
প্রেসিডেন্টঃ কে এস আহমেদ
সেক্রেটারিঃ ফাইযুর রহমান
ট্রেসারারঃ আব্দুল হক
২. ক্যালিফোর্নিয়া
আমেরিকান লীগ অফ বাংলাদেশ
৪১৬ সিনক্লেয়ার এভিনিউ
গ্লেন্ডালে খালিফ, ৯১২০৬
প্রেসিডেন্টঃ এস.এম.এস.দোহা
শিকাগো ১১১.৬০৬১৫
৩. কলোরাডো
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা
৩৭২৮ ৭ পূর্ব এভিনিউ
ডেনভার, কোলো. ৮০২০৬
সেক্রেটারিঃ এম. শের আলি
এ.কে.এম. আমিনুল ইসলাম
৪. ম্যাসাচুসেটস বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ২৪ পিবডি টেরেস, এপ্রিল ৫১০ বোস্টন, প্রেসিডেন্টঃ খুরশেদ আলম সেক্রেটারিঃ এম. আলমগির ৫. ইলিনয়স বাংলাদেশ অফ আমেরিকা (আরবানা অধ্যায়) ১১০৭ পশ্চিম গ্রিন স্ট্রীট আরবানা, ১১১,৬১৮০১ প্রেসিডেন্টঃ এম. রহমান সেক্রেটারিঃ এ.এস. শাহাব-উদ-দিন ৬. বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা (শিকাগো অধ্যায়) (সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা লীগের পরিবর্তন) ৫২৪৫ দক্ষিণ কেনউড এভিনিউ প্রেসিডেন্টঃ এফ. আর. খান ৭. ওহিও বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ৫১১৫ প্রেসকাট এভিনিউ ডি প্রেসিডেন্টঃ জিরাল্ড আর. হান্ড্রিকস সেক্রেটারিঃ এ. এইচ. জাফরুল্লাহ প্রেসিডেন্টঃ এ এল চৌধুরি ৮. উত্তর ক্যারোলিনা বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ২১৮ ব্রর্ড স্ট্রীট (পূর্ব) এলিজাবেথ সিটি, N.C. ২৭৭০৯ ৯. মিশিগান পাকিস্তান এসোসিয়েশন অফ আমেরিকা ইনক, ৩১৩০ কাস এভিনিউ ডেটরয়েট, মিচ. ৪৮২০১ প্রেসিডেন্টঃ আব্দুস শাহীদ সেক্রেটারিঃ মুস্তাফিজুর রহমান ১০. পেনসিলভানিয়া বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ৫৯০৩ পঞ্চম এভিনিউ পিটসবার্গ, পেন. প্রেসিডেন্টঃ কিউ.এম.আহমেদ ১১. টেক্সাস বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা পি.ও.বক্স ৩৩২৫ কলেজ স্টেশন, টেক্সাস ৭৭৮৪০ প্রেসিডেন্টঃ হাফিজুর রহমান ১২. ওশিংটন, ডিসি বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা পি.ও. বক্স ৪৪৬৫ ব্রুক ল্যান্ড স্টেশন, ওয়াশিংটন ডিসি ২০০১৭ প্রেসিডেন্টঃ এনায়েতুর রাহিম সেক্রেটারিঃ মহসিন আর. সিদ্দিক ১৩. টেনেসি বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ইনক. ৮০৮ হিলউড বিএলিভিডি ন্যাশভিলে, টেনেসি.৩৭২০৯ প্রেসিডেন্টঃ জিল্লুর রহমান আতাহার সেক্রেটারিঃ পাওয়া যায়নি ১৪. ক্যানটুকি বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ২০৮১ উইলিয়ামস বার্গ রোড লেক্সিংটন, ক্যান্টুকি ৪০৫০৪ প্রেসিডেন্টঃ জর্জ এইচ ব্রাডবয়েস জেআর. সেক্রেটারিঃ মুখতার এম. আলি ট্রেসারারঃ সামসুল এইচ মোল্লা ..
কম্পাইলারঃ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
<৬, ৩৩, ৬১৯-৬২২>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়, সংগঠন ও সংগ্রামের ইতিহাস ও কর্মসূচী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশপত্র*, টেক্সাসঃ ১ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৪ মে, ১৯৭১
.
[*বাংলাদেশপত্রঃ বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা, কলেজষ্টেশন শাখা কর্তৃক মুদ্রিত, প্রকাশিত ও প্রচারিত।]
স্বাধীনতার ডাকে
বাংলাদেশে আজ রক্তগঙ্গা বইছে। বাঙ্গালীদের রক্তে হোলী খেলে পান্জাব দস্যু দল পৈশাচিক আনন্দে মত্ত। আমোদের ভাই –বোনেরা যখন অত্যাচারীর খড়্গ রুখে দাঁড়াতে গিয়ে নির্বিচারে জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করছেনা, তখন মার্কিন দেশের বিলাসময় পরিবেশের মধ্যে থেকে দেশের জন্য আমরা কি করছি? স্বাধীনতা আমরা পাবই, এ ব্যাপারে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। তবে, আন্দোলনে আমরা আমাদের দেশবাসীকে কতটুকুই বা সাহায্য করছি? ছিন্নবস্ত্রে, অনাহারে ও অন্নাভাবে থেকেও বাংলাদেশের বীর জনতা সৈরাচারী সাম্রাজ্যবাদের বেয়নেট শাসনকেও ভুলুন্ঠিত করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সংকটময় মূহুর্তে দেশবাসী আমাদের কাছে অনেক কিছু আশা করে। আজ আমাদের সামান্য আত্মত্যাগের ভয়ে ভীত হলে চলবেনা। কৈ আমরা এতটুকু আরাম আয়েশ বিশর্জন দিতে পেরেছি? হাজারো মানুষের রক্তের ঋনে গড়া এই সংগ্রামের ডাকে আমরা এককভাবে সাড়া দিতে না পারলে উত্তরসুরিা আমাদের ক্ষমা করবে না।
তাই আজ আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। আসুন বাংলা মায়ের ডাকে সবাই একসাথে কাজ করে যাই। দলাদলি ও বিভেদ ভুলে গিয়ে মাত্র একটি লক্ষে পৌছাবার জন্য আমাদেরকে আত্মোৎসর্গ করতে হবে।
করণীয় আমাদের অনেক। প্রচারকার্যে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। গণতন্ত্র ও স্বাধীকার আদায়ে বাংলাদেশের বীর জনতার মহান আদর্শ ও আত্মত্যাগের সংগ্রাম বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে। প্রচারকার্য এবং বাংলাদেশের দুর্গত মানবতার জন্য আর্থিক সাহায্যের একান্ত প্রয়োজন। এই মূহুর্তে আমাদের যথাসাধ্য সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আমা উচিত।
এই চরম সংকটকালে নির্বিকার হয়ে থাকলে চলবেনা। বিনা ত্যাগে স্বাধীনতার আকাঙ্খা করলে ভুল হবে। সংগ্রামহীন স্বাধীনতার নজির ইতিহাসে নেই। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গড়া এই মুক্তির সংগ্রামকে আমরা ব্যর্থ হতে দেব না। বাংলার জয় হবেই।
জয় বাংলা/
কলেজষ্টেশানঃ আমাদের করণীয়
গত নির্বাচনে অর্জিত গণতন্ত্রের অধিকার আদায়ের জন্য মার্চ মাসের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশব্যাপী এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনকে বানচাল করে দেবার জন্য পান্জাবী সৈন্যরা নির্বিচারে গণহত্যা আরম্ভ করে। এই ঘটনার প্রথম থেকেই আমরা কলেজষ্টেশানের বাঙ্গালী ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের জন্য কাজ শুরু করি। প্রথমতঃ একটি সামরিক পরিষদ গঠন করা হয়। তারপর আজ (১৪ই মে) মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের তিনজন সদস্য সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ সংগ্রামী ছাত্র সংস্থার সভাপতি, সাধারন সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। এছাড়াও অনেকে বিভিন্ন দ্বায়িত্ত নিয়ে স্বেচ্ছায় কাজে এগিয়ে আসেন।
.
পঁচিশে মার্চের আগে পর্যন্ত অনেক বার মার্কিন সিনেটর, প্রেসিডেন্ট নিক্সন, উথান্ট এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের সরকার ও আরো অনেক প্রভাবশালী ব্যাক্তির কাচে পত্র ও তারবার্তা পাঠানো হয়- বাংলাদেশে রক্তপাত বন্ধ করা ও জনগণের নির্বাচিত নেতাদের হাতে শাষনভার হস্তান্তর করার দাবি জানিয়েছে।
পঁচিশে মার্চের অপরিনামদর্শী ঘটনা আমাদেরকে সাময়িকভাবে স্তম্ভিত ও বিহ্বল করে। কিন্তু বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনার পর পরই পুরোদমে আমাদের প্রচারকার্য শুরু হয়। মাত্র এক ঘন্টার নোটিশে আমরা সকল সদস্য একটা জরুরী সভায় মিলিত হয়ে আমাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারন করি। দুর্গত মানবতার সেবায় ব্যায় করবার জন্য মাথাপিছু কমপক্ষে একশত ডলার চাঁদা দেওয়ার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে এই সভায় নেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রচারকার্যের ব্যয় বহনের জন্য মাসিক চাঁদার পরিমান নির্ধারণ করা হয়। প্রথম কিস্তিতে তিন হাজার ডলার তুলে নিউইয়র্কে কেন্দ্রিয় সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই যে অনেকে ব্যান্কে ধারের খাতার অঙ্ক বাড়িয়ে চাঁদা দিয়েছেন, অনেকে নির্ধারিত নিম্নমানের অনেক বেশি দিয়েছেন, এবং সকলেই যে কোন মূহুর্তে বাংলাদেশের জন্য সাধ্যমত সাহায্য করার অঙ্গিকার করেছেন।
ছাত্র হিসেবে চাকার অভাব থাকলেও আমাদের কর্মপ্রেরণার অভাব নেই। কলেজশ্টেশন থেকে এ পর্যন্ত বহুমুখী প্রচারকার্য চালিয়েছি তার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি উল্লেখযোগ্যঃ
পঁচিশে মার্চের পর একশো সিনেটর, জাতিসংঘ প্রধান ও বৃহৎ শক্তির রাষ্ট্রপ্রধানগনের নিকট কয়েকদপা আবেদসপত্র ও তারবার্তা পাঠানো হয়। এখনও বিশেষ প্রয়োজনে তাদের নিকট পত্র তারবার্তা পাঠানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে ও দুর্গত মানবতার সাহায্যের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন শহরে মার্কিন নাগরিকদের স্বাক্ষরসহ ১১ জন প্রভাবশালী সিনেটরের কাছে ১৫০০ আবেদন পত্র পাঠানো হয়েছে।
টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে বাংলাদেশের সংগ্রামের সঠিক চিত্র তুলে ধরা হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রত্যাগত অনেক শিক্ষক আমাদের বিশেষ সাহায্য করেন। বিশ্বাবদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের সাথে দলবেধে দেখা করে এখানকার বাংলাদেশের দুর্গত ছাত্রদের জন্য আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন লক ও প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলের নেতা উলিসনের সাথে যথাক্রমে ডালাস ও অস্টিনে দেখো করে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করি এবং বাংলাদেশকে সাহায্য করার আবেদন জানাই।
স্থানীয় বেতার,টিভি ও দৈনিক বাংলাদেশের উপর স্ক্ষাতকারে অংশগ্রহন করেছি। এছাড়াও হিউস্টনে বাংলাদেশ ছাত্রসংস্থার আয়োজনে ওখানকার টিভি ও বেতারে একই রকম আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছি।
হার্ভাডের তিনজন বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদের লেখা “Conflict in East Pakistan: Background and Prospect” নামক নিরপেক্ষ রিপোর্টখানির পাঁচশ কপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে এবং বিশ্বব্যাপি প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এখানে ছাত্র সিনেটে বাংলাদেশের গণআন্দোলন দমনে পাকিস্তান সরকারের মার্কিন অস্ত্র শস্ত্র ব্যবহারের নিন্দা জানানো হয়েছে।
********
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকাঃ
সংগঠন ও সংগ্রামের ইতিহাস
আমাদের কেন্দ্রীয় সংস্থা গড়ে উঠার পেছনে রয়েছে বহুদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টা। ১৯৪৭ সালে প্রবাসী সিলেটী ব্যাবসায়ীরা নিউইয়রর্কে পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা নামে বাঙ্গালীদের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। পরে এর নামকরন হয় ইষ্ট পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা। সদস্য সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এই সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করা হয়। গত প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পর এ সংস্থার সদস্যবর্গ পাক সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, বাংলাদেশে রিলিফের জন্য চাঁদা সংগ্রহ ও বাংলা ছবি দেখানো, জাতিসংগের সামনে বাংলাদেশকে আলাদা করার দাবী, একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন, এছাড়া আরো বহুমুখী প্রচারকার্যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহন করেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সংস্থার নাম বদলিয়ে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সাথে এর সরাসরি যোগাযোগও স্থাপন হয়েছে।
শীঘ্রই কেন্দ্রীয় সংস্থার কর্মকর্তা নির্বাচিত হবে। এ ব্যাপারে সকল সংস্থা ও মেম্বারদেরকে পূর্বভাগে কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রের সাধারন সম্পাদক ফয়জুর রহমান বাংলাদেম লীগকে আরো জোরদার করে গড়ে তোলার জন্য মার্কিন ও কানাডাবাসী সকল বাঙ্গালীদের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।
কেন্দ্রীয় সংস্থার ঠিকানাঃ
ইষ্ট পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা, ইনক
২৬৬৭ ব্রডওয়ে, নিউইয়র্ক, ১০০২৫
ফোনঃ (২১২) ৮৬৬-৭৪৭৪
যোগাযোগের আবেদন
নিউইয়র্ক মূল কেন্দ্রকে সবরকমের সাহায্য ও সরাসরি যোগাযোগের জন্য সমস্ত আমেরিকা ও কানাডাকে কতগুলি উপকেন্দ্রে ভাগ করা হয়েছে। আমেরিকার দক্ষিন অঞ্চলের ৯ টি স্টেসের ভার আমরা কলেজষ্টেশন টেক্সাস এ গ্রহন করেছি। আমাদের আঞ্চলিক কেন্দের নাম – উপকেন্দ্রঃ দক্ষিনাঞ্চল। যে সমস্ত ষ্টেটে আমরা সদস্য শাখাগুলির সাথে একসংগে কাজ করতে চাই সেগুলো হলোঃ টেক্সাস, নিউমেক্সিকো, লুজিয়ানা, ওকলাহোম, আলাকমা, আরকানসা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা ও জর্জিয়া। এ সমস্ত ষ্টেটে বাঙ্গালী ছাত্র ও চাকুরিজীবি যারা আছেন তারা সবাই শীঘ্রই আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনার এলাকায় আপনি একা হলেও দুর্দিনে আপনার সাহায্য আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
আপনাদের নিজ নিজ এরাকায় বাংলাদেম লীগ অফ আমেরিকা শাখা গঠন করুন এবং শীঘ্রই আমাদের উপকেনেদ্র আপনাদের সংগ্রাম পরিষদ ও সদস্যদের ঠিকানা ও আপনাদের কার্যকলাপের বিবরন পাঠান। আপনাদের খবর “বাংলাদেশপত্র” এ ছাপা হবে।
আমরা যদি কোনভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি, তবে জানাতে দ্বিধা করবেননা। আমরা আরো ফলপ্রসুভাবে কাজ করতে চাই। প্রচারকার্যে এবং নিউইয়র্কের সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগে আমরা আপনাদেরকে সাহায্য করবো। তবে চছাঁদা পাঠানো ও যে কোন জররী কাজের জন্য আপনারা মূল কেন্দ্রের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।
একটি প্রস্তাবঃ
আমাদের এই আঞ্চলিক কেন্দ্রে আরো সুষ্ঠুভাবে কার্য সমাধার জন্য সকল সদস্য শাখাকে নিয়ে শীঘ্রই একটা আনুষ্ঠানিক আঞ্চলিক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব এসেছে। এর মাধ্যমে আমাদের বর্তমান কর্মপ্রচেষ্টা আরো জোরদার করা যায়। প্রচারকার্য, অর্থ-সংগ্রহ, নিজেদের মধ্যে সমজোতা ও সহযোগিতার একটি নিয়মতান্ত্রিক ভিত্তি গঠন করাই আনুষ্ঠানিক সংগঠনের মূল লক্ষ্য হবে। পনেরই মে এক সাধারন সভায় আমরা এই প্রস্তাব বিবেচনা করবো। এ ব্যাপারে আপনাতের মতামত জানাবেন।
ভবিষ্যত কর্মসূচি
শীঘ্রই আমরা কলেজষ্টেশান ও নিকটবর্তী শহরগুলোতে স্থানীয় মহলের কর্মকর্তাদের সাহায্যে চাঁদা সংগ্রহ অভিযান শুরু করব।
বাংলাদেশের উপর টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটিতে আলোচনা সভা ও সেমিনারের আয়োজন হচ্ছে।
পত্র পত্রিকা ও বিদেশী খবরের কাগজে বাংলাদেশের উপর রচনা ও সংবাদ ছাপাবার আরো জোরদার চেষ্টা চালানো হবে।
এখানে অনেকেরই স্কলারশীপ বা দেশ থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের জন্য চাকুরী বা অন্য কোন অর্থ সাহায্য জোগাড় করার চেষ্টা করা হবে।
এ ছাড়াও আমাদের নিয়মিত প্রচারকার্য আরো সুষ্ঠুভাবে চালানো হবে।
শীঘ্রই “বাংলাদেশপত্র”-এ বাংলাদেশের সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের উপর একটি সাহিত্য সংখ্যা বেরুবে। প্রবন্ধ ও যে কোন রকম সাহিত্যমূলক রচনা সম্পাদকের ঠিকানায় পাঠাবার জন্য আমাদের পাঠক ও শুভাকাঙ্খীদের অনুরোধ করা হচ্ছে।
সম্পাদক, ”বাংলাদেশপত্র”
বক্স- ২৩৭০
কলেজষ্টেশান, টেক্সাস ৭৭৮৪০..
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,৩৪,৬২৩-৬২৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ আন্দোলনঃ সম্পাদকীয় ও খবর | বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং ১ | ১৭ মে, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
এ সপ্তাহে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ৭ম সপ্তাহ শুরু হলো। পূর্বের ৬ সপ্তাহে, বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো অমানুষিক বর্বরতার প্রতিক্রিয়ায় প্রবাসী বাঙ্গালিরা তাদের আতংক বেশ ভালোভাবেই ব্যক্ত করেছে, একই সঙ্গে তাদের প্রয়োজন এবং সমর্থনে জনমত সংহত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী স্ব স্ব রাজ্যের সিনেটর এবং কংগ্রেস সদস্যদেরকে চিঠি লিখেছেন, তাঁদের সাথে দেখা করেছেন –তাঁদেরকেরাজি করাতে, তাঁদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে রাজি করাতে, যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিকযন্ত্রকে সব রকম সহায়তা দেয়া বন্ধ করা হয়। এতো সব তদবিরের ফলাফল সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক কমিটির সাম্প্রতিক ঘোষণাবলী এবং সিনেটে পাশের অপেক্ষায় থাকা সমাধানসমূহের মধ্যে দৃশ্যমান। সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশন মিডিয়া, উভয় মাধ্যমেই বেশ কিছু ভালো কাজ করা হয়েছে। আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় এবং লড়াইয়ের দৃপ্ত সংকল্প সম্পর্কে ওয়াশিংটন এবং নিউ ইয়র্কের সকল বৈদেশিক দূতাবাসকে অবহিত করা হয়েছে।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের এ কেবল শুরু। কারণ, এমনকি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের পরেও, একেবারে শেষ ভিনদেশি সৈন্যটিকেবাংলার মাটি থেকে উৎখাত করার পরেও, আমাদের মুখোমুখি হতে হবে একটি জাতিকে শুন্য থেকে গড়ে তোলার বিশাল কাজের সামনে। শত্রুর পোড়ামাটিনীতি বাংলাদেশ থেকে শত্রুর পলায়নের আগে বাংলাদেশের সকল অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেবে। বলা নিষ্প্রয়োজন, এই পুনর্গঠনের কাজে স্থানীয়-প্রবাসী সকল বাঙ্গালির প্রচুর ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রয়োজন হবে। এ প্রয়াস হতে হবে সামগ্রিক ওসমন্বিত । বর্তমানে আমাদের সামনে দু’টোকাজরয়েছে, মুক্তিসংগ্রামেসহায়তাকরা এবং পাশাপাশি পাকিস্তানি আর্মির কারণে উদ্বাস্ত হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে ত্রাণসাহায্য পাঠানো। আমরা জানি, প্রতিরোধী বাঙালি গোষ্ঠীসমূহ দু’টো কাজেই মনোনিবেশ করেছে, কিন্তু কার্যক্রমের কোন সমন্বয় না থাকায় এক গ্রুপের পক্ষে জানা সম্ভব হচ্ছেনা অন্যরা কী করছে।এরফলে অনেক ক্ষেত্রেই কাজের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এ কার্যক্রমে সমন্বয় আনার লক্ষ্যে, আমরা এই সংবাদবাহী পত্রটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য বিভিন্ন গ্রুপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সকল বাঙালি ও বন্ধুদের সুবিধার্থে এ তথ্য প্রচার করা। আমরা বিভিন্ন গ্রুপের তোলা টাকার একটা কেন্দ্রীয় তহবিল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে করে এ টাকাগুলো সর্বাধিক সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করা যায়।
ভিন্ন ভিন্ন ভাগ থেকে আনা সংবাদের পাশাপাশি আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের সুবিধার্থে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার কেন্দ্র থেকে পাওয়া সংবাদও সরবরাহ করবো। আমরা আরো আশা করি সরাসরি বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাওয়া সংবাদ আমাদের পাঠকদের পরিবেশন করার।
আরো বড় পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে, আমরা নিউজলেটার পেতে ইচ্ছুক সকল বাঙালি এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের তালিকা চাই। সেজন্য, আমরা আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করছি আমাদের নাম-ঠিকানা পাঠানোর জন্য, যেগুলো আমাদের তালিকায় নাও থাকতে পারে। অনুগ্রহ করে নিচের ঠিকানায় এখনই চিঠি লিখে আমাদের সহায়তা করুন:
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, শিকাগো চ্যাপ্টার
৫২৪৫ সাউথ কনউড অ্যাভিনিউ
শিকাগো, ইলিনয়, ৬০৬১৫
প্রতিরোধের সংবাদ
পাকিস্তানি সরকার তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে বাঙ্গালিদের এদেশের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে একগাদা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে এবং পুরো স্বাধীনতা আন্দোলনই “কিছু সংখ্যক ভারত পন্থী দুর্বৃত্তের” তৈরিকরা।
এ সবই অর্থহীন কথাবার্তা। আপনারা যদি এ ধরণের লেখা আপনার কাছে আসা থামাতে না পারেন, তাহলে বরং এ মিথ্যাচারগুলো ময়লা কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিন।
মূল যে কারণে এদেশের সংবাদপত্রে ইদানিং কোন প্রতিরোধের খবর দেয়া হয় না, সেটি হলো, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কলকাতা থেকে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে মোটরযান চলাচলোপযোগী একমাত্র রাস্তাটি সাফল্যের সাথেউপড়ে ফেলেছে। যুদ্ধের প্রথম দু’সপ্তাহে এ অঞ্চল থেকেই কলকাতা ভিত্তিক বিদেশী সংবাদকর্মীরা খবর সংগ্রহ করতেন। অবশ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৩০০ মাইল লম্বা সীমান্তের অনেকাংশই এখনো খোলা। ভারতীয় সংবাদকর্মীরা এবং আমাদের নিজেদের লোকজন নিয়মিত সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডের খবর নিয়ে আসছেন।
একজন বাংলাদেশী প্রতিনিধি যিনি মাত্রই এদেশে পৌঁছেছেন, তিনি লিখেছেন, “সিলেট, যেখানে চা-বাগানের বন প্রাকৃতিক ভাবেই আড়াল তৈরি করে, তা এখনো বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়ন্ত্রণে। এ বাহিনীটি এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দখল করে রেখেছে। সারা বাংলাদেশেই সশস্ত্র বাঙ্গালিরা পালিয়ে গ্রামীণ অঞ্চলে চলে গেছে এবং সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলোকে গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে আক্রমণ করছে। এটা সামনে আরো ঘন ঘন এবং আরো বেশি তীব্রতায় হবে বলেই আশা করা হচ্ছে, কারণ এ ধরণের যুদ্ধে প্রতিরোধী বাহিনী আরো অনেক দক্ষতা অর্জন করে, আরো যুদ্ধাস্ত্র ও সরবরাহ পায় — যার মধ্যে বেশ বড় অংশ এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে, এবং বর্ষা মৌসুমে সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র বণ্টন ও পরিবহণ সমস্যা আরো অনিরাপত্তার মুখোমুখি হবে। সেখানে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ সেনাবাহিনীর নির্বিচার আক্রমণ জনতার রাজনৈতিক উদ্দীপনাকে নিশ্চিত করেছে। তাদের অস্ত্রের সীমানার মধ্যে থাকা গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে এবং সে এলাকাগুলোকে “ফ্রিফায়ারজোন”ঘোষণাকরেতারানিজেদের [সেনাবাহিনী] ঘৃণারপাত্রেএবং৭৫মিলিয়নবাঙ্গালির, যারা বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিরোধে অংশগ্রহণ অথবা সাহায্য প্রদানে বদ্ধপরিকর, তাদের নিরাপত্তার প্রতি প্রত্যক্ষ হুমকি হিসেবে পরিণত করেছে।
প্রায় এক মাস আগে দেশ ছেড়ে যাওয়া আরেক বাঙালি আগরতলা থেকে লিখেছেন, “প্রতিদিন শতশত তরুণ গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তারা কত দ্রুত শিখে ফেলছে, তা অবিশ্বাস্য। আমি এসেছি, তাই আমি খুশি। নয়তো বাঙ্গালির একাগ্রতা, দেশপ্রেম এবং দেশের স্বাধীনতা-সম্মানের জন্য তাদের মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার ইচ্ছা সম্পর্কে কখনোই জানতাম না আমি।”
চ্যাপ্টার নিউজ
নিউজ লেটারের এ অংশে আমরা ভিন্ন ভিন্ন চ্যাপ্টার এবং বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার জাতীয় কার্যালয় থেকে পাওয়া সংবাদ ছাপাবো। আশা করি যে, চ্যাপ্টার প্রতিনিধিরা আমাদেরকে তাঁদের কার্যক্রমের ব্যাপারে সরাসরি লিখবেন, যাতে আমরা অন্যদের কাছে সেগুলো পাঠিয়ে দিতে পারি। এখন পর্যন্ত আমরা জানি যে নিউ ইয়র্কে জাতীয় কার্যালয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশ লীগের বিভিন্ন চ্যাপ্টার চালু করা হয়েছে বোস্টন, ওয়াশিংটন, বাল্টিমোর, ব্লুমিংটন (ইন্ডিয়ানা), হিউস্টন, কলেজ স্টেশন (টেক্সাস), বার্কলে এবং লস অ্যাঞ্জেলসে। আরো চ্যাপ্টার থেকে থাকতে পারে যাদের সম্পর্কে আমরা অবগত নই। তাই অনুগ্রহ করে আমাদের জানান এবং আপনাদের অফিসের কর্মকর্তাদের তালিকা পাঠান। আমাদের একত্রিত হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নিউইয়র্কস্থ জাতীয় কার্যালয় আমাদের জানিয়েছে যে বাংলাদেশ লীগের একটি জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করা হচ্ছে। নিউ ইয়র্ক মেট্রোপলিটন এলাকায় জুনের কোন এক সময় এটি অনুষ্ঠিত হবে। আপনাদের দিনক্ষণ সম্পর্কে জানানো হবে।
নিউ ইয়র্ক গ্রুপ জুন ১২, ১৯৭১ এ জাতিসংঘের সামনে বড় আকারের একটি র্যালির আয়োজন করছে। আপনারা যদি আসতে পারেন তাহলে দয়া করে জানান এ ঠিকানায়: জনাব কে এস আহমেদ, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, ২৬৬৭ ব্রডওয়ে, এন ওয়াই সি, নিউ ইয়র্ক ১০২৫, ফোন (২১২) ৮৬৬-৭৪৭৪।
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পর্ক
আমাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আগত সবারই পশ্চিম পাকিস্তানে বন্ধু ছিল, ২৫ মার্চ মিলিটারি ক্র্যাকডাউনের আগ পর্যন্ত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের তাদের সাথে সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। সকল পশ্চিম পাকিস্তানিই যে আমাদের শত্রু –এটা অবশ্যই সত্য নয়। তাদের অনেকেই আমাদের দাবিতে সমর্থন জানিয়েছেন (পাকিস্তান ফোরামের এপ্রিল-মে, ’৭১ ইস্যু দ্রষ্টব্য, সম্পাদক জনাব ফিরোজ আহমেদ, ১৯০০ সাউথ চার্লসস্ট্রিট, গ্রিনভিল, এনসি ২৭৮৩৪)
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। আমাদের যত বেশি সম্ভব মিত্রদের প্রয়োজন। কেবলমাত্র বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রেও জয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করতে পারবো । আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানি বন্ধুরা সে যুদ্ধে জয়লাভে আমাদের সহায়তা করতে পারবেন।
আমাদের মনে হয় যে কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের দাবিতে এখনো সমর্থন জানাচ্ছেন না, সেটি হলো, তাঁরা হয় অজ্ঞাত অথবা পাকিস্তান দূতাবাসের ছড়ানো মিথ্যে প্রোপাগান্ডায় তাঁরা ভুল পথে চালিত হচ্ছেন। বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী ঘটনাসমূহ সম্পর্কে তাদের জানানো আমাদের দায়িত্ব। আমরা নিশ্চিত, তারা একবার যদি আমাদের পক্ষ থেকে ঘটনাগুলোর রূপ সম্পর্কে অবগত হয়, তারা তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে। আমরা প্রস্তাব করছি, আপনি তাদেরকে তাজউদ্দীন আহমেদের দেয়া বক্তব্যের আপনার কাছে থাকা অনুলিপিটি ধারে পড়তে দিন, বক্তব্যটিতে বর্তমান সংকটের ওপর চমৎকার পটভূমি বর্ণনা করা রয়েছে। আপনার কাছে কোন অনুলিপি না থাকলে আমাদের জানান। আমরা ডঃ রেহমান সোবহানের অন্য একটি দলিল নামমাত্র মূল্যে সরবরাহ করবো, যার শিরোনাম “বাংলাদেশ: সিচুয়েশন অ্যান্ড অপশনস”।
চাকুরি এবং বৃত্তি
বাংলাদেশ থেকে আগত যেসব বাঙ্গালিরা এই মুহূর্তে দেশে ফিরতে ইচ্ছুক নন তাদের জন্য চাকুরি এবং বৃত্তির ব্যবস্থা করার সম্ভাবনা নিয়ে আমরা বর্তমানে কাজ করছি। যদি আপনার বৃত্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে থাকে, অথবা পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক আপনার বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে থাকে, অথবা যদি আপনার কোন কাজের প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে শিকাগো চ্যাপ্টারের সচিবের কাছে অনুগ্রহ করে লিখুন। সব ধরণের অনুসন্ধানের সাথে নিম্নোক্ত তথ্যগুলো থাকা উচিৎ: ভিসার ধরণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের অভিজ্ঞতা, যে ধরনের কাজ অথবা বৃত্তি পেতে ইচ্ছুক। তাছাড়া আপনার কোন ধরণের ভিসা সম্পর্কিত সমস্যা থেকে থাকলেও আমাদের জানান। আমাদের পক্ষে কিছু পরামর্শ দেয়া সম্ভব হতে পারে।
মেইলিং লিস্ট
আমাদের শক্তি সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি করার জন্য এ দেশে অবস্থানরত সকল বাঙ্গালির তালিকা আমাদের কাছে থাকতে হবে। তাই দয়া করে আমাদের শিকাগোর ঠিকানায় যেসব বাঙ্গালিকে আপনি চেনেন, তাদের নাম ঠিকানা পাঠিয়ে দিন।
আমরা বাংলাদেশের সকল বন্ধু এবং সমর্থকের তালিকাও পেতে ইচ্ছুক। যদি আপনার মনে হয় যে আমাদের মেইলিং লিস্টে কারো থাকা উচিৎ, আমাদের জানান।
তহবিল
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের জন্য জরুরী ভিত্তিতে তহবিল প্রয়োজন, বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রা। এ প্রয়োজন মেটাতে লীগ দু’টোতহবিলগঠনকরেছে, বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিল এবং সাধারণ তহবিল। প্রথম তহবিলে প্রদত্ত চাঁদা শুধুমাত্র ত্রাণ কার্যেই ব্যবহৃত হবে, দ্বিতীয় তহবিলে প্রদত্ত অনুদান ব্যবহৃত হবে লীগের কার্যক্রমের খরচ যোগানো, তদবির কার্য ইত্যাদির জন্য।
ত্রাণ
জরুরী ত্রাণের জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। আজ পর্যন্ত বিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গিয়েছে এবং প্রতিদিনই প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ ভারতে প্রবেশ করছে। পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য ভারতের সরকার এবং অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব নয়। ভারতে শরণার্থীরা আপনাদেরই আত্মীয়, আপনাদেরই দেশের মানুষ। তাদের আপনার সাহায্যের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ, এবং পরিস্থিতি ভালো হবার আগে সেটির আরো অবনতি হবে এরকমটা ধরে নেয়ার সব রকম কারণই রয়েছে। দশ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু। আগামী কয়েক মাসে দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসন এটা পরিস্কার করে দিয়েছে যে বাঙ্গালিদের দুর্দশা লাঘবে তারা এখন অথবা পরবর্তীতেও কিছুই করতে ইছুক নয়। উলটো, সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে দেয়ার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে, তারা বাংলাদেশের জনগণকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করার জন্যে তাদেরকে অনাহারে রাখতেও প্রস্তুত। আমেরিকাতে আমরা যারা আছি, তারা এখন এবং পরবর্তী মাসগুলোতে যতটা সম্ভব ত্রাণ পাঠাতে প্রস্তুত থাকবো। আপনিও পারেন সাহায্য করতে। নিম্নোক্ত ঠিকানায় অনুদান পাঠান, আপনার বন্ধুদেরকেও অনুদান পাঠাতে বলুন:
বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিল
৫২৪৫ সাউথ কেনউড এভিনিউ
শিকাগো, ইলিনয় ৬০৬১৫
কার্যক্রমজনিত খরচ
লীগ বাংলাদেশের বর্তমান সংকটপূর্ণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েক ধরণের কার্যক্রম চালু করেছে। সমস্যা হচ্ছে, এ কার্যক্রমগুলোর সবগুলোতেই অর্থের প্রয়োজন। নিয়মিতভাবে এই খরচ যোগাতে অর্থ উত্তোলনের জন্য আমরা অনুরোধ করছি সেসব চাকুরিরত বাঙ্গালিদের , তাঁদের আয়ের যতটুকু শতাংশ সম্ভব ততটুকুই লীগের তহবিলে দেয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার এবং মাসিক হারে লীগে এই অর্থ পরিশোধ করার। নিম্নের ফর্মটি পুরণ করে অনুগ্রহপূর্বক শিকাগো চ্যাপ্টারে পাঠিয়ে দিন:
আমি, ________, প্রতি মাসে বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকাতে অনুদান হিসেবে $ ___________ দেয়ার অঙ্গীকার করছি। আমার অনুদান লীগের সাধারণ তহবিলে জমা হবে, তাই এই অনুদানের কর মওকুফ হবে না, এ মর্মে আমি অবগত আছি।
স্বাক্ষর ______________
তারিখ ______________
ঠিকানা _____________
টেলিফোন ___________
( এটা বলা নিষ্প্রয়োজন, অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত প্রদত্ত সকল তথ্য শিকাগো চ্যাপ্টারের কোষাগার-রক্ষক নিজেই রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। আপনার চেক পাঠিয়ে দিন বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, ৫২৪৫ সাউথ কেনউড এভিনিউ, শিকাগো, ইলিনয়, ৬০৬১৫ এই ঠিকানায়। আপনার প্রদত্ত যে কোন পরিমাণ চাঁদার বিনিময়ে আপনি রসিদ পাবেন। বাংলাদেশ সরকার তার দূতের মাধ্যমে আমাদের জানাচ্ছে যে আপনাদের প্রদত্ত চাঁদা পরবর্তীতে যাতে আপনারা ফেরত পান সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তাই আপনাদের রসিদগুলো সংগ্রহে রাখুন।
.
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,৩৫,৬২৮-৬৩০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় ও ঘোষণা | বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগোঃ নং ২* | ২৫ মে, ১৯৭১ |
[*এই সংখ্যা হতে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার শিকাগো শাখার নাম ‘বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’ উল্লেখ করা হয়েছে]
বাংলাদেশের মাটিতে এখনো মৃত্যু হানা দিয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালিদের দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রতিদিন নিহত হচ্ছে শত-হাজার জনতা। বাড়িঘর-সহায়সম্পদ যখন তখন ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, এরই মধ্যে তিন মিলিয়নেরও বেশি (নিউ ইয়র্ক টাইমস, মে ২২ দ্রষ্টব্য) বাংলাদেশী পার্শ্ববর্তী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে; প্রতিদিনই ৫০০০০ এরও বেশি মানুষ ঢুকছে। এখনো বিশ্ব-সরকারের বিবেক এতটুকু টলেনি বলেই মনে হয়। তারা এখনো তাদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে চিন্তিত। পাকিস্তানের ক্রমপতনশীল অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে সাম্প্রতিক চুক্তিটি, বিশেষ কিছু শর্তাধীনে এরকমই একটা ঘটনা (নিউ ইয়র্ক টাইমস, মে ২০ দ্রষ্টব্য)। এ চুক্তিটি বাঙ্গালিদের জন্য বৃহত্তর ন্যায়বিচারের আহ্বান জানায়, কিন্তু পাকিস্তানিদের বর্তমান প্রচারণার ভেতরে বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বাঙ্গালিদের লাশের নিচে চাপা পড়ে আছে মৃত পাকিস্তান। সংশ্লিষ্ট সকলেই যত তাড়াতাড়ি এটা মেনে নেন, ততই ভালো। মার্চ ২৫, ১৯৭১ এর আগে যেমন পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল, সেখানে যে কোন ভাবে ফিরে যাবার স্বপ্নই এখন অসাড়। ওই তারিখ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত এক মিলিয়ন বাঙ্গালির রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাকি ৭৪ মিলিয়ন বাঙালির দায় তাদের নিহত ভাইদের প্রতি, নিজেদের রক্তের শেষ বিন্দু ত্যাগ করে হলেও বাংলাদেশের পবিত্রতা, সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা। এবং তারা সেই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত। বাঙ্গালিদের দৃঢ়প্রত্যয় সম্পর্কে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
এটা সত্য, জাতির মুক্তিসংগ্রামের প্রথম ধাপগুলোতে বাঙালি প্রতিরোধ বাহিনী বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নগরের পর নগর হারিয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে প্রতিরোধী শক্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বের দৌড় এর অস্ত্রশস্ত্রের পাল্লা পর্যন্তই। এর বাইরে বাংলাদেশের সমগ্র গ্রামাঞ্চল বিস্তীর্ণ, নিশানাবিহীন এবং মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই বাহিনীর সদস্যরা আবার একজোট হয়েছে এবং গত দেড় মাস ধরে চোরাগোপ্তা হামলার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তারা এখন পাকিস্তানি বাহিনীকে সর্বদাই পর্যুদস্ত করছে। আর্থিক এবং সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা, দু’দিক দিয়েই শত্রুপক্ষের কার্যক্রম ব্যয়বহুল হচ্ছে।
বিশ্বের বৃহৎ শক্তিসমূহ এবং দাতা দেশগুলো অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তান শাসনব্যবস্থায় সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক কার্যক্রম চালু রাখতে পারে। বর্তমানে যে গণহত্যা নির্মম দক্ষতায় চালানো হচ্ছে, এ সাহায্যপ্রদান সেটিকেই কেবল প্রলম্বিত করতে পারে। এ বর্বর বাহিনীর পোড়ামাটি নীতি অর্থনীতিকে আরো পঙ্গু করে ফেলতে পারে, সমগ্র বাংলাদেশকে বিরানভূমিতে পরিণত করতে পারে। অবশ্য, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙ্গালিদের আর শাসন করতে পারবে না, তারা তাদের বিচ্ছিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে যতই শক্তিশালী করুক না কেন। সেনাবাহিনীর অবস্থা হবে বিক্ষুব্ধ সাগরের মধ্যে দ্বীপাশ্রিতের মতো, সাহায্য নেয়ার মতো কোন মিত্রশক্তি যাদের নেই। এরই মধ্যে বাঙালি সরকারী চাকুরিজীবীদের ৮০% এরও বেশি মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি লড়াইয়ে শরিক হয়েছে – যার ফলে প্রশাসনকে বিকল হয়ে গেছে। বাঙালি পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী দলে দলে লড়াইয়ে যোগদান করেছে।
জনগণের জীবন এবং ভোগান্তির ব্যাপারে দায়িত্ব নেয় এমন যে কোন সরকার যদি এরূপ বাস্তবতার ব্যাপারে সচেতন হয়, তাহলে তাদের পদক্ষেপ নেয়ার কেবল একটি রাস্তাই খোলা থাকে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাধ্য করা উচিত বাংলাদেশের মাটি থেকে সরে যাবার জন্য। বিশ্ব যদি সত্যিই বিশালসংখ্যক নিরাপরাধ মানুষের জীবন বাঁচাতে চায়, যদি গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার কোন মানে থেকে থাকে বিশ্বের কাছে, তাহলে বাংলাদেশকে সাহায্য করতেই হবে এবং এখনই।
বাংলাদেশ তাই সমগ্র বিশ্বের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। চীনা বন্দুক, আমেরিকান গোলাবারুদ, ব্রিটিশ এবং সোভিয়েত সাজসরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে এ গণহত্যায়। আজ বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থের প্রতি আগ্রহ তাদেরকে মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের পক্ষ নেয়ার পথে বাধা তৈরি করছে। যদি এই শক্তিগুলো শুধুমাত্র এটুকু ইঙ্গিত দেয় যে তাদের নিজেদের যন্ত্রপাতি গণহত্যার কাজে ব্যবহার করা যাবে না, আর কোন সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানের কাছে আসা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মাটি থেকে অপসারণ না করে – যে বাংলাদেশে জনগণ আগের সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো, যেখানে বাঙ্গালিদের রক্তের বন্যায় বিরোধ নিষ্পত্তির সকল আশা ডুবে গেছে –তাহলে সামরিক শোষণযন্ত্র ধীরে ধীরে নিশ্চল হয়ে পড়বে।
ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্ববাসীর সরকার প্রধানদের উদ্দেশ্যে আবেদন জানাতে হবে, তাঁদের অনুরোধ করতে হবে যাতে তাঁরা তাঁদের সরকারকে জানান যে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানও সাময়িক। এ অঞ্চলে তাঁরা যে ভবিষ্যৎ খুঁজছেন, সে ভবিষ্যৎ নিহিত এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যেই, তাদের শোষকদের মধ্যে নয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক জনগণ, সমাজতন্ত্রী এবং মানবিকতাপূর্ণ সকল মানুষের উদ্দেশ্যে আমাদের আবেদন, তাঁরা যাতে তাদের যতটুকু ক্ষুদ্র প্রভাবই থাকুক সেটুকু ব্যবহার করেন যাতে করে এ গণহত্যা আর চলতে না পারে। আমাদের দ্বন্দ্ব কখনোই তাদের সাথে ছিলো না, তাদের অবশ্যই একত্রিত মানবতার উদ্দেশ্যে একীভূত হতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে তাদের শাসকদের মধ্যে যাতে বিচারবুদ্ধির সুস্থতা ফিরে আসে। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য এই যে, বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের অস্থি-রক্ত-মাংস থেকে কখনোই পশ্চিম পাকিস্তানে ন্যায়বিচারসম্পন্ন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে আমরা উঠে দাঁড়াবো, নতুন সমাজ গঠন করবো, কিন্তু তাদের পরোক্ষ সম্মতিসূচক মনোভাবের কারণে তারা চিরকাল সে বুটের আঘাতে পিষ্ট হবে যেটি আমাদের পিষে ফেলতে চেয়েছিলো।
আমাদের নিজেদের জন্য আমরা অনুরোধ করি, আমরা যেন ১৯৪৭ এর অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি না ঘটাই, যেখানে পাকিস্তানের লক্ষ্যে সংগ্রামের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সকল উৎসাহ মুছে গিয়েছিল বিশেষাধিকার এবং লোভের সমাজ গঠনের ফলে। আমাদের দ্বিতীয় জন্মের দুর্লভ সুযোগ হয়েছে। চলুন আমরা গড়ে তুলি সব কিছু, জনগণের সাথে, জনগণের জন্য।
ঘোষণা
১) বাংলাদেশে সংকট শুরু হবার পর থেকে এদেশে বসবাসরত বাঙ্গালিরা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের কাজকর্মের সমন্বয় সাধনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রয়োজন অনুভব করেছে। এর ফলে, শিকাগোর একটি ল ফার্মের কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নেয়া হয়েছে, এবং সে পরামর্শ অনুসারে একটি নতুন সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ ইলিনয়ে গঠিত হয়েছে একটি অলাভজনক, করমুক্তসংগঠন হিসেবে; যদিও এ সংগঠনে কোন চাঁদার ওপর কর মওকুফ হবে না।
মে ২৩, রবিবার শিকাগোতে এক সভায় বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের একটি বোর্ড অব ডিরেক্টরস গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে সভায় উপস্থিত গ্রুপগুলোর প্রতিটি থেকে একজন করে সদস্য রয়েছেন। বোর্ড অব ডিরেক্টরস হবে লীগের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী অংশ, এবং তাঁরা অনুদান সংগ্রহ এবং .তদবির ইত্যাদি কার্যক্রম সমন্বয় করবে। এখন পর্যন্ত বোর্ড অব ডিরেক্টরস এ মিশিগান, ইলিনয়, ওহিও, ইন্ডিয়ানা এবং টেক্সাসের যে গ্রুপগুলো মে ২৩ এর সভায় প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল, তাদের থেকে একজন করে সদস্য রয়েছেন। যে সময়ের মধ্যে আপনার হাতে এই নিউজলেটারটি পৌঁছেছে, সে সময়ের মধ্যে সেটি বোর্ডেও প্রকাশ করা হবে।
২) বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার আপীল নামের আরেকটি নতুন সংগঠনও ইলিনয়ে গঠিত হয়েছে, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলাদেশের যুদ্ধাক্রান্ত এবং উদ্বাস্তু জনগণের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করা। আপিল এ দেয়া চাঁদার কর মওকুফ করা হবে, এর মানে লোকজন তাদের বার্ষিক আয়কর থেকে ‘আপীল’ এ তাদের প্রদত্ত চাঁদার পরিমাণ বাদ দিয়ে দিতে পারবেন। বিডিএল এর মত, বিইডব্লু এ ও এ দেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রুপের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড অব ডিরেক্টরের মাধ্যমে ব্যবস্থাপিত হবে। বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. এফ আর খান, শিকাগোর প্রখ্যাত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার।
বিইডব্লু এ শীঘ্রই দেশব্যাপী অনুদান সংগ্রহের জন্য আবেদন করবে। আরো তথ্য এবং রিসিপ্ট বুক স্থানীয় গ্রুপগুলোর সচিবদের কাছে মেইল করে দেয়া হবে।
৩) এদেশের বাঙ্গালিরা যুক্তরাষ্ট্রের অনেকাংশ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আপনাদের অনেকেই যারা এই নিউজলেটারটি পাবেন, তারা হয়ত এরই মধ্যে কোন গ্রুপ তৈরি করে ফেলেছেন, যার ব্যাপারে আমরা এখনো জানি না। জুন ৬ তারিখে শিকাগোতে বিডিএল এর বোর্ডের পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হবে। যদি আপনি এ সভায় প্রতিনিধিত্ব করতে চান তাহলে এই ঠিকানায় আপনার প্রতিনিধির নাম পাঠিয়ে দিন, সেক্রেটারি, বিডিএল, ৫২৪৫, সাউথ কেনউড এভিনিউ, ইলিনয়, ৬০৬১৫।
৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিচারক আবু সাঈদ চৌধুরী সোমবার, মে ২৪ এ নিউ ইয়র্কে আসছেন। তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করবেন।
.
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,৩৬,৬৩১-৬৩৩>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় ও খবর | বাংলাদেশ* (ওয়েস্ট কোস্ট) নিউজ বুলেটিন ক্যালিফোর্নিয়াঃ নং ১ | ১ জুন, ১৯৭১ |
[ বাংলাদেশ (ওয়েস্ট কোস্ট নিউজ বুলেটিন) বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া শাখা- আমেরিকান লীগ অব বাংলাদেশ কর্তৃক মূদ্রিত ও প্রাচারিত।]
প্রিয় দেশপ্রেমী বন্ধুগণ,
শুভেচ্ছা নিন!
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার ৮ সপ্তাহের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট কোস্টে বসবাসরত বাঙ্গালিদের জন্য দেশপ্রেমের স্বতস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশের সমন্বয়করণের জন্য উপায় বের করাটা দরকারী হয়ে পড়েছে। কার্যকর সমন্বয় এবং যোগাযোগের কিছু নির্দিষ্ট ধরণে পৌঁছানোর জন্য, লস এঞ্জেলস, বার্কলে, স্ট্যানফোর্ড এবং সান ফ্রান্সিসকোতে বসবাসরত বাঙ্গালিদের মধ্যে একটি সভা হয়ে গেলো সান ফ্রান্সিসকোতে, মে ১৯৭১ তে।
যেহেতু আমাদের অনেক দেশপ্রেমী ভাই বোনেরা বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, আমাদের অবশ্যই এ সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষদের উদ্যম এবং প্রয়াসকে ব্যবহার করার জন্য কার্যকর সমন্বয়কারী ব্যবস্থা গঠন করতে হবে। এর ফলে দূরপাল্লার ফোন কল, মানব শক্তির অযাচিত অপচয় ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ হবে। এরকম কার্যকর সংঘবদ্ধ সংগঠন তৈরির পথে প্রথম ধাপ হিসেবে এ নিউজ বুলেটিন চালু করা হলো।
মে ২২ এর সভা, বার্কলে, লস এঞ্জেলস, স্টানফোর্ড এবং সান ফ্রান্সিসকোর প্রতিনিধিরা সবাই মিলে নিম্নোক্ত সিদ্ধ্বান্তে উপনীত হয়েছেন।
১) প্রধান সমন্বয়ক অংশটি লস এঞ্জেলস কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হবে, এবং বার্কলে, সান ফ্রান্সিসকো, স্ট্যানফোর্ড, স্যান ডিয়েগো, সান্টাবারবারা, ডেনভার (কলোরাডো) এবং ট্যুসন (অ্যারিজোনা) তে অবস্থিত ওয়েস্ট কোস্টের অন্যান্য ইউনিটগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে। হাওয়াই, ডালাস এবং পিটসবার্গ (কানসাস) এ আরো ইউনিটের সাথে যোগাযোগ চালু করার ব্যাপারেও এর ইচ্ছে রয়েছে।
২) প্রধান সমন্বয়ক অংশটি নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং মিশিগানে অবস্থিত অংশগুলোর সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করবে। এমনকি, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া নিয়মনীতিগুলোও ওয়েস্ট কোস্টের অন্যান্য ইউনিটের কাছে পাঠিয়ে দেবে এ অংশটি।
৩)সকল ইউনিট নিজেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আদানপ্রদান করবে, এবং সকল স্থানীয় সদস্যদের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে দেবে।
৪) প্রচার এবং কার্যক্রম সমন্বয়ের অন্যান্য খরচ বহন করার জন্য সকল ওয়েস্ট কোস্ট ইউনিট থেকে লস এঞ্জেলস ইউনিটে পাঠানো সংগ্রহের ওপর ৫% রেমিট্যান্স আরোপ করা হবে।
৫) সাধারণত সকল ইউনিটই প্রচারণা অব্যাহত রাখবে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা এবং নির্মমতাকে তুলে ধরা হবে, পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বৈধ দাবিকে তুলে ধরা হবে আমেরিকান জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে আমেরিকান প্রতিনিধিদের মধ্যে।
৬) সকল অনুদান সংগ্রহের বিবরণী লস এঞ্জেলস ইউনিটে উপস্থাপন করা হবে।
৭) সকল [বাংলাদেশী] অধিবাসী এবং সমর্থকদের একটি মাস্টার লিস্ট তৈরি করা হবে এবং প্রতিটি ইউনিটের সমন্বয়করা এরকম সকল ব্যক্তির নাম-ঠিকানা লস এঞ্জেলসের ইউনিটের সমন্বয়কারীদের কাছে পাঠাবেন।
৮) বার্কলেতে বসবাসরত পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড: জ্যোতি দাসগুপ্ত রাজনৈতিক তথ্যের ব্যাপারে এবং রাজনৈতিক পত্র লিখতে আগ্রহী যে কাউকে পরামর্শ দেবেন।
কয়েকটি ওয়েস্ট কোস্ট ইউনিটের সমন্বয়কের নাম ঠিকানা নিচে দেয়া হলো। অন্যান্য ইউনিটগুলোকে তাদের সমন্বয়কদের নাম ঠিকানা লস এঞ্জেলসে পাঠানোর অনুরোধ করা হচ্ছে।
লস এঞ্জেলস:
১) জনাব আবুল এইচ সাদ-উদ্দিন ৫০৫, গেইল এভিনিউ, ৪০১ |
২) জনাব চন্দন দাস ১৬২১, গ্লেন্ডন এভিনিউ, ৭ লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া ৯০০২৪ টেলিফোন: (২১৩) ৪৭৫-২৯৪৬ |
বার্কলে:
১) জনাব জামাল মুনশী ১২১৫, কেইনস বার্কলে, ক্যালিফোর্নিয়া টেলিফোন: (৪১৫)৫২৬-৭৪১৭ |
২) ড: জ্যোতি দাসগুপ্ত টেলিফোন: (৪১৫)৫২৪-৮৫৩৩ |
সান ফ্রান্সিসকো:
১) মিস আমিনা পন্নী ৭৭০, লেক মার্সিড বুলেভার্ড রুম ১৩৩০, ভারদুচ্চি হল সান ফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়া টেলিফোন: ৯১৪৩২(৪১৫)৪৯৬-৩১৭৯ |
২) জনাব এ বি এম ফারুক টেলিফোন: (৪১৫)৭৭৫-৪৯৬৬ |
স্ট্যানফোর্ড:
১) ড: রফিকুর রহমান |
স্যান ডিয়েগো: ১) জনাব রণধীর মিত্র |
সান্টা বারবারা: ১) মিস প্রমিতা ঘোষ |
ডেনভার (কলোরাডো): ১) ড: এম শের আলী |
ট্যুসন (অ্যারিজোনা):
১) ড: এম শফিকুল্লাহ |
গুরুত্বপূর্ণ খবর
বার্কলে | ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী শরণার্থীদের ত্রাণের জন্য তহবিল উত্তোলনের জন্য প্রখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আলী আকবর খান, জ্যাজ শিল্পী মি. জন হ্যান্ডি এবং তবলাবাদক জনাব জাকির হোসেইন এর পরিবেশনায় একটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭১ এর মে ২৮ তারিখে। অনুদান হিসেবে কনসার্টস্থল থেকে প্রায় তিন হাজার ডলার সংগ্রহ করা হয়েছে। |
সান ফ্রান্সিসকো | জুন ২, ১৯৭১ তারিখে একটি বিক্ষোভ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। |
লস এঞ্জেলস | সংগঠনে প্রতি মাসে ১০ ডলার করে চাঁদা দেয়ার ব্যাপারে সব সদস্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন এবং আমরা আশা করি অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরাও তা করবেন। অনুদান আসছে এবং আরো আসবে বলে আশা করা যায়। জুন ১১, ১৯৭১ তারিখে একটি বিক্ষোভ মিছিল করার ব্যাপারে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। |
ট্যুসন (অ্যারিজোনা) | অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে প্রচারনা চালানো হচ্ছে এবং চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। |
ডেনভার (কলোরাডো) | স্থানীয় চ্যাপ্টার গঠন করা হয়েছে এবং তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই নিউজলেটারেরে সাথে সংযুক্তি হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার একটি বিবরণী উপস্থাপন করা হলো। এতে আরো রয়েছে বাংলাদেশে একটি পুতুল সরকার গঠনের জন্য পাকিস্তানি সেনা শাসন যেসব ব্যক্তিদের সাথে দেনদরবার করছে তাদের ব্যাপারে মূল্যায়ন। |
..
অনুবাদঃ মিশকাত
<৬, ৩৭, ৬৩৪-৬৩৫>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং ৩
তারিখঃ ১০ই জুন, ১৯৭১
.
নিক্সনের প্রতি বিজ্ঞজনের আহবান
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্টি,ভাষা, জীবনধারা, অর্থনীতি ও ইতিহাস বিষয়ে আমেরিকান ও কানাডিয়ান বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ ও ৩০শে মে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন । সম্মেলনের দুইটি অধিবেশনকে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য উৎসর্গ করা হয় । প্রেসিডেন্ট নিক্সন, মন্ত্রীবর্গ , হাউজ এবং সিনেট সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক বিবৃতিতে বিজ্ঞজনেরা পাকিস্তান সরকারকে আমেরিকান সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য না পাঠাতে সুপারিশ করেন । বিবৃতিটি নিচে উল্লেখ করা হলঃ
পাকিস্তান সরকার যে বিশাল বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর ও তাদের সমাজব্যবস্থার উপর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে বাংলা বিশেষজ্ঞ হিসেবে এ ব্যাপারে গভীর উদ্ধেগ প্রকাশ করছি । ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ থেকে পূর্ববাংলায় ঘটতে থাকা ঘটনার প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে বুঝা যায়, পাকিস্তান সরকারের এই নীতি শুধুমাত্রই বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা। আমরা এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে সতর্ক আছি এবং মোটেও একে হালকাভাবে নিচ্ছি না, বাংলার বাইরে থাকা বাংলার সমাজ সংস্কৃতির ছাত্রহিসেবে আমি অনুভব করি যাদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আমরা পড়ছি এবং পূর্ববঙ্গে আমাদের সতীর্থদের প্রতি আমাদের বিশেষ দায়িত্ব আছে। যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী এমনসব মানুষকে হত্যা করছে যাদের কাছে আমরা ঋণী তখন যে দেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ব্যাপকভাবে অস্ত্রে সজ্জিত করেছে তার নাগরিক হিসেবে আমরা চুপ থাকতে পারি না । অতএব আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে পূর্ববঙ্গে হত্যাযজ্ঞ থামাতে যা উদ্যোগ প্রয়োজন তা গ্রহণ করতে আহবান করছি । আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ববঙ্গ এ সামরিক শক্তি প্রয়োগ নিষিদ্ধ/স্তগিত না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ পাকিস্তানের প্রতি সবধরনের সহযোগিতা প্রদান থেকে বিরত থাকা।
অধিকন্তু,আমরা অনুরোধ করব আপনাদের যথাসম্ভব সকল সাহায্য সহযোগিতা সুবিশাল ও ক্রমবর্ধমান বাঙালিদের জন্য বরাদ্দ করুন যারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দ্বারা জোরপূর্বক তাদের বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে।
এধরণের একটি বক্তব্য বিভিন্ন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে স্বীকৃত হয়েছে,যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন।তারা এই বক্তব্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোর দাবী জানিয়েছেন।
.
সাংগঠনিক খবর
আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দলের কাজ পরিচালনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের একটি সভা ৬ইই জুন শিকাগোতে অনুষ্ঠিত হয়। ইলিনইস, ইন্ডিয়ানা, মিশিগান,ওহিও ও ওয়াশিংটন এর প্রতিনিধিগণ সভায় উপস্থিত ছিলেন। দক্ষিণ-পশ্চিমের নয়টি অঙ্গরাজ্যে সক্রিয় বাংলাদেশী দলগুলো ইতিমধ্যেই একটি জোনাল ইউনিট গঠন করেছে, এবং সভায় অংশ নিতে তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। বিডিএল এর আইনি পরামর্শক সংগঠনের আইনী কাঠামো ব্যাখ্যা করেন এবং সদস্যদের জ্ঞাতার্থে বিভিন্ন বিধি নিয়েও আলোচনা করেন। বিডিএলের কোষাধ্যক্ষ অনুদান সংগ্রহের কার্যকরী পদ্ধতি ও তা কেন্দ্রীয় তহবিলে সঞ্চালনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। অন্যান্য সাংগঠনিক ব্যাপার নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয় বিশেষ করে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও ধারাবাহিকতা অর্জনের জন্য কাজ করতে প্রতিটি ইউনিট ঐক্যমতে পৌঁছেছে।
প্রতিটি দল থেকে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি বোর্ড ওব ডিরেক্টরস গঠন করা হয়েছে যাদের দিক নির্দেশনায় সহযোগিতা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। যেসব দল থেকে প্রতিনিধি নেয়া হয়নি তাদের অন্তর্ভুক্ত করে এর পরিধি আরো বর্ধিতকরা হবে।
নিউইয়র্কে পাকিস্তান দূতাবাসের সাবেক সহকারী রাষ্ট্রদূত জনাব মাহমুদ আলি যিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছেন , তিনিও সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। সভায় নিউইয়র্কে বাংলাদেশ বাংলাদেশ মিশনের বাজেট অনুমোদিত হয় এবং এই অর্থ বিডিএল তহবিল থেকে বরাদ্দ করা হয়।
সভায় জরুরী ভিত্তিতে ওয়াশিংটনডিসিতে একটি মিশন স্থাপনের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়।
সভায় বিডিএলের সকল সদস্যের জন্য একটি নীতিমালা অনুমোদন পায়, যাতে প্রত্যেক সদস্য তার মূল বেতনের শতকরা দশভাগ বিডিএলে জমা করবেন যতদিন না বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারের জরুরী ভিত্তিতে এই মুহুর্তে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন। সকল সদস্য ও সমব্যাথীগন সর্বোচ্চ সম্ভাব্য অংকের অনুদান দেয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ রিসার্চ সেন্টার নামে বিডিএলের সহায়ক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । এই গবেষণা কেন্দ্রের কাজ হবে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যের উন্নতি ও পাকিস্তান সরকার ও এর দূতাবাসগুলোর মিথ্যা ও বিদ্ধেষপূর্ণ প্রপাগান্ডার জবাবে প্রতিবেদন ,সাময়িকী , পুস্তিকা ও পত্রিকা প্রকাশ করা । বাংলাদেশ রিসার্চ সেন্টার প্রকাশনা ও বিতরণের জন্য তথ্য আহবান করছে । আপনার পরামর্শ আমাদেরকে পাঠান ।
বিডিএল এর সভাপতি পশ্চিম উপকূল পরিদর্শন করবেন এবং অন্যদলগুলোর সাথে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে সেখানকার বাংলাদেশী দলের সাথে মতবিনিময় করবেন ।
বাংলাদেশ ইমারজেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল নামে একটি দেশব্যাপী অনুদানসংগ্রহ অভিযানের প্রস্তুতি চলছে । এই অভিযানের সহায়তার জন্য একটি পুস্তিকাও বানানোর কাজ চলছে ।..অনুবাদঃ ওমার ফাইলাসূফ <৬, ৩৮, ৬৩৬-৬৩৭> শিরোনামঃ সম্পাদকীয় সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ* নিউ য়র্কঃ নং ৩ তারিখঃ ১৬ জুন, ১৯৭১ .[ * বাংলাদেশ’ বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা শাখা কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রচারিত। সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি কে. এম. আলমগীর। ] .সম্পাদকীয়২৬ মার্চ রাতে ভুমিষ্ট হওয়া আমাদের দেশটি অসম্ভব বেদনাদায়ক এবং কষ্টকর একটি সময় পার করছে। বাস্তবতার সকল বিবেচনায়, একক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অস্ত্বিত্বের কবর রচনা হয়ে গেছে। অনেক ত্যাগ ও তিতীক্ষার বিনিময়ে অভ্যুদয় হওয়া বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ক্রমশ তার ভূমিতে একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে। এর মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট শাসক ইয়াহিয়া খানের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ ও প্রত্যাশিত যুদ্ধের অবতারনা হলো। ইয়াহিয়া খানের এজেন্ট টিক্কা খান এখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে পাকিস্তান পন্থী একটা তাবেদার গোষ্ঠি তৈরি করার জন্য, তার জন্য হয়তো বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে অনেককে দিয়ে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হবে। জান্তা আরোপিত ব্লাক আউটের কারনে আমাদের পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ খবর জানার কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই। বিদেশ থেকে আগত বা প্রেরিত বার্তা গুলোকে যথাস্থানে পৌছানোর অনুমতি লাভ করতে এখন কঠোর সামরিক নজরদারি পার করতে হচ্ছে। ছয় দফা দাবীর পক্ষে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পাকিস্তানের জনগনের কাছ থেকে নিরংকুশ মান্ডেট লাভ করেছিলো। পরবর্তীতে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে এবং এর নেতাকে গাদ্দার ঘোষনা করে ফ্যাসিস্ট সামরিক জান্তা শহরে ও গ্রামে হামলা চালাতে শুরু করে, তারা বাড়ীঘর-ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, বোমা নিক্ষেপ করে, ট্যাংক চালিয়ে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দেয়। এরই মধ্যে তারা দশ লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করে ফেলেছে এবং আরও প্রায় ৪০ লক্ষাধিক মানুষ প্রানভয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সামরিক জান্তার মতে, গোটা বাংলাদেশের সকল মানুষ “ষড়যন্ত্রকারী এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী”। এই অচিন্তণীয় বর্বরতা অবলোকন করে স্তম্ভিত বিশ্ব বিবেক যেন নিন্দা জানানোর ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের হাতে এখন অনেক কাজ। আমাদেরকে বুঝতে হবে যে আমাদের পক্ষে এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হয়ে থাকার অবকাশ নেই। বরং বিজয় না আসা পর্যন্ত এই যুদ্ধটা আমাদেরকে চালিয়ে যেতে হবে। সভা সেমিনার আয়োজন, তহবিল গঠন, প্রতিবাদ, র্যালি ইত্যাদি প্রচারনামূলক কর্মসূচীর মাধ্যমে আমেরিকার জনগনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে হবে হবে যেন আমেরিকার সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানকে সামরিক ও অর্থ সহায়তা দেয়া বন্ধ করে। আমেরিকার জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে তাদের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে টেলিগ্রাম, চিঠি ও মেমোরেন্ডা পাঠাতে যেনো তারা বাংলাদেশ ও তার জনগনের প্রতি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়। একইসাথে পাকিস্তানি দূতাবাস ও ইসলামাবাদ যেনো মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সেদিকেও দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, এবং এর পালটা জবাব দিতে হবে সত্য প্রচারের মাধ্যমে, যত দিন যাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা আগের থেকে অনেক বেশি সুসৃংখল হচ্ছে এবং দৈনিক সহস্রাধিক মানুষ ক্যাম্পগুলোতে ভীড় করছে যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর.প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানি আশা প্রকাশ করেছেন, “আগামী ১৪ থেকে ১৮ মাসের ভেতর দেশ থেকে শত্রুবাহিনী সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা সম্ভব হবে।” বিজয় সুনিশ্চিতভাবে আমাদের।. একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি জনাব দেওয়ান মাহবুব নামে বাঙ্গালীদের মাঝে সুপরিচিত ছিলেন, তিনি চলতি মাসে বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক সভা চলাকালে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহ …)। উনার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা জানাই। এই মৃত্যুর ফলে জাতি একজন বীর যোদ্ধা এবং প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাকে হারালো, যার অভাব পূরণের জন্য নিঃসন্দেহে আমাদেরকে দীর্ঘ দিন প্রতীক্ষায় থাকতে হবে।..
অনুবাদঃ জয়ন্ত সেন আবীর
<৬,৩৯,৬৩৮-৬৪০>
এক নজরে আন্দোলন তৎপরতা
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
কর্মকাণ্ডের খণ্ডচিত্র | বাংলাদেশ নিউইয়র্কঃ নম্বর ৩ |
১৬ জুন, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা (নিউইয়র্ক)
কর্মকাণ্ডের খণ্ডচিত্র
.
ইস্ট পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা, বর্তমানে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭০ এটি ইস্ট পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকাতে পরিবর্তিত হয়। জন্মলগ্ন থেকে সংগঠনটি দেশের এবং দেশের বাইরের বাঙালিদের জন্য কাজ করে গেছে। এখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রধান ঘটনাগুলোর সাপেক্ষে এই লীগের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সংক্ষেপে বিবরণ দেয়া হয়েছে।
.
ঘুর্ণিঝড়ঃ
পূর্ব পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মানুষের জন্য তহবিল জোগাড় করতে এই লীগ “সুতরাং” নামে একটি চলচিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা আক্রান্ত মানুষের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক শহরে প্রতিবাদের আয়োজন করে তারা। পূর্ব পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মানুষের জন্য আসা খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ ঘুরিয়ে করাচী নিয়ে যাবার প্রতিবাদে আমেরিকার সরকার, ইসলামাবাদের আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং ঢাকার আমেরিকান কনসাল বরাবর চিঠি ও টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। এছাড়াও এই লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে এবং পূর্বের স্বায়ত্বশাসনের অধিকারের স্বপক্ষে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে।
.
সাধারণ নির্বাচনঃ
প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের পরপর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বরাবর পাঠানো ৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখের একটি টেলিগ্রামে লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ের জন্য বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করে এবং ছয় দফা দাবীর স্বপক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। তারা ইয়াহিয়া খান বরাবরেও একটি টেলিগ্রাম পাঠায় যাতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার প্রদানের দাবী জানানো হয়।
.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাঃ
পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাক সেনাবাহিনী নির্দয় আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চ ১৯৭১ শেখ মুজিবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জাতির প্রয়োজনে এই লীগ সম্ভাব্য সব উপায়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জন এবং ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখে তারা। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এবং ব্রিটেন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের কাছে চিঠি ও টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। এই সংঘাতের প্রতিরূপ তুলে ধরে এসব চিঠি ও টেলিগ্রামে আশা করা হয় যে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন এবং নিজেদের ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে গণহত্যা বন্ধে সাহায্য করবেন।
আমেরিকার সরকার এবং কংগ্রেস সদস্যদের কাছে চিঠি ও স্মারকলিপি পাঠিয়ে গণহত্যা বন্ধে সাহায্য চাওয়া হয় এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি কোনোরূপ সাহায্য না পাঠাবার সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়। জাতিসংঘের প্রায় সকল দেশের দূতদের সাথে লীগের প্রতিনিধিরা দেখা করেন এবং পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের যথেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ জানাতে অনুরোধ করেন। এছাড়াও তাঁরা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে সমর্থন জোগাড়েরও চেষ্টা চালান।
জাতিসংঘ চার্টারের চ্যাপ্টার ৯৯ অনুযায়ী এই সংকটের মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব ইউ. থান্টের কাছেও টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। তাঁকে বাংলাদেশে জাতিসংঘের একজন পর্যবেক্ষক পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশে জাতিসংঘের পরিচালনায় একটি ত্রাণ শিবির পরিচালনার জন্যেও অনুরোধ করা হয়। জনাব ইউ. থান্টের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়।
সাংগঠনিক কার্যক্রমঃ
৩০ মার্চের এক সভায় জনাব নুরুল আমিন চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ এর এক সভায় আগের প্রস্তুত অ্যাকশন কমিটিকে আরো বিস্তৃত করা হয়। এপ্রিলের ২৫ তারিখে লীগের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে জনাব শাহাদাত হোসেনকে চেয়ারম্যান করে ইলেকশন এক্সামিনেশন কমিটি গঠন করা হয়।
.
শাখার খবরঃ
বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসিস্থ বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার শাখা বাংলাদেশের সাহায্যকল্পে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই শাখা থেকে প্রতিদিন একদম রুটিনমাফিক একদল প্রতিনিধি প্রাসঙ্গিক তথ্য ও রচনাসহ আমেরিকান সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং চালিয়ে যাচ্ছে। এই চেষ্টা খুবই কার্যকর এবং ফলদায়ক। বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোশিয়েশনের স্থানীয় শাখা এবং আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সাথে মিলে এখানকার লীগ ভারতের ‘সর্বোদয়’ নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের জন্য এক সেমিনারের আয়োজন করে। এছাড়া লীগের পক্ষ থেকে তহবিল সংগ্রহের এক বিশাল উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। লীগের এক সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে লীগের প্রতি সদস্য তার প্রতিমাসের বেতনের অন্তত ৫% লীগের অ্যাকাউন্টে দান করে দেবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হারও খবুই আশাপ্রদ।
ম্যাসন সিটি, আইওয়ার ড. বদরুদ্দোজা স্থানীয় চ্যানেলে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান আয়োজন করেন যাতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট ব্যাখা করেন। আমেরিকান সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের কাছে তিনি তাঁর স্থানীয় আমেরিকান বন্ধুদের মাধ্যমে ৪০এরও বেশি টেলিগ্রামও পাঠান।
১৯৭১ এর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে কলম্বিয়া ভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল হাউসে বাংলাদেশের উপর একটি প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়। শ্রীমান ও শ্রীমতি বমন বসু, ড. রশিদুজ্জামান এবং অন্যেরা এতে অংশ নেন। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশের যুদ্ধাক্রান্ত মানুষের সাহায্যকল্পে ইন্টারন্যাশনাল হাউসের সদস্যদের অংশগ্রহণে একটি তহবিল গড়ে তোলা হবে।
ড. জিল্লুর রহমান আতহার, ড. হাবিবুর রহমান, ড. ইউনূস, ড. ইসমাইল এবং ন্যাশভিল, টেনিসির অন্যান্য অনেকে স্থানীয় চ্যানেলে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক চলমান রক্তগঙ্গার বিশদ বিবরণ দেয়া হয়।
.
নিউইয়র্কে শোভাযাত্রা
নিউইয়র্ক, জুন ১২, ১৯৭১। বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা, বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোশিয়েশন এবং ভারতীয় সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগে জুন ১২, ১৯৭১ নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পক্ষে এক গণশোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। দেশটির নানা অঞ্চল থেকে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রায় ১,০০০ মানুষ এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। এতে শ্রীমান জয়প্রকাশ নারায়ণ, ড. ইকবাল আহমেদ, মিস্টার উইলিয়াম রায়ান, ড. প্লাসট্রিক, মিসেস অ্যান টেইলর, ড. আলমগীর এবং মিস্টার এ. পুলি বক্তৃতা করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন অশীতিপর মুক্তিযোদ্ধা শ্রীমাণ পি. সি. মুখার্জী।
ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন যে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতা চায়নি, বরং পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তাদের সেই পথে জোর করে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন যে এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, কারণ তা ওই অঞ্চলে বাস করা প্রতিটি বাঙালির জীবন-মরণের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। তিনি বিশ্বনেতাদের কাছে, বিশেষ করে মুক্ত বিশ্বের নেতাদের কাছে নিজেদের সক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘাতময় অঞ্চলটিতে সাধারণ মানুষের চাওয়া মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে খুব দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনতে আবেদন জানান। তিনি এক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনবার পদক্ষেপ নেয়া তাদের কর্তব্য। তিনি আরো বলেন বৃহৎ শক্তিগুলো যদি লাখো বাঙালির চাওয়া-আকাঙ্খা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তবে তারা বাঙালির দুর্দশার জন্য তাদের কাছে দায়বদ্ধ রয়ে যাবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের এক বিদ্বান ব্যক্তি, ড. ইকবাল আহমাদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের নৃশংসতার প্রতিবাদ করেন। তিনি এই সামরিক জান্তাকে এক চরম ফ্যাসিস্ট সরকার হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের দাবীর পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থনও জানান।
আমেরিয়াকন কংগ্রেসম্যান উইলিয়াম রায়ান তার বক্তৃতায় যতদিন না পর্যন্ত বাঙালিদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে সবরকম সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. প্লাসট্রিকও পূর্ব বাংলায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান। তিনি সতর্ক করে দেন যে বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের দাবী পূরণ হবার আগেই যদি পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য প্রদান করা আবারো শুরু হয়ে যায় তবে তা আমেরিকাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মৌলিক অধিকার দাবিয়ে রাখার স্বপক্ষের একজন হিসেবে তুলে ধরবে।
ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক মিসেস অ্যান টেইলর, যিনি ইতোপূর্বে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পক্ষে অনশন করেছিলেন, পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংশতা সম্পর্কে অবগত করেন তাঁর নিজের চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা থেকে। সবশেষে তিনি আমেরিকার সুস্থ চিন্তার অধিকারী নাগরিকদের প্রতি বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার পাবার লড়াইয়ে সমর্থন দিতে আবেদন জানান। এর আগে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার ড. আলমগীর আমেরিকার নাগরিকদের কাছে আকুল আবেদন জানান যেন তারা নিজ সরকারর উপর চাপ প্রয়োগ করেন; যাতে করে যতদিন না পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হচ্ছে এবং শেষ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাটিও বাংলাদেশের ভূভাগ থেকে চলে যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে কোনরূপ সাহায্য প্রদান করা না হয়।..অনুবাদঃ মুশফিকুর রহমান অমিও <৬, ৪০,৬৪১> শিরোনামঃ সম্পাদকিয়ঃ বাংলাদেশকে সাহায্য করুণ।সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগো নং ৪তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১.বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙ্গালী কে স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের জন্য জীবন দিতে হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে খুন হয়েছে। ৬ মিলিয়ন লোক নিরাপত্তা এবং আশ্রয়ের জন্য তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে সীমান্তের অন্য পাশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। হানাদার বাহিনীর পাশবিকতা,ধর্ষণ,অত্যাচার,অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার অভিজ্ঞতার বর্ণনা সাথে নিয়ে লাখ লাখ মানুষ প্রতিনিয়ত ইন্ডিয়ার পথে যাচ্ছে। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ ক্লান্তি এবং অবসাদের কারণে মারা যাচ্ছে। কলেরা ও অন্যান্য রোগ এবং ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে অতিরিক্ত ভীড়ের কারণেও প্রতিনিয়ত অনেক লোক মারা যাচ্ছে। মানব ইতিহাসে এত বেশি লোকের এক সাথে দেশ ত্যাগের ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতীয় সরকার এবং মানুষেরা এই অসহায় শরণার্থীদের সাহায্য ও যত্ন করছেন। চরম বিপদের সময় আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্যে আমরা তাদের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। .আমরা যেন সবসময় স্বাধীনভাবে এবং গর্বের সাথে বাঁচতে পারি সেই জন্য বাংলাদেশের বাঙালিরা তাদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন। তাদের সাহস এবং দৃঢ়তার কাহিনী প্রতিদিন সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে।.কিন্তু মাতৃভূমির চরম প্রয়োজনের মুহূর্তে আমরা তার জন্যে কি করছি? আমরা যারা মৃত্যু দৃশ্য, রোগ এবং ধ্বংস থেকে অনেক দূরে আধুনিক জীবনের আরাম এবং বিলাসিতার মধ্যে বাস করছি তাদের নিজেদেরকে এই প্রশ্নটি করা উচিৎ। আমরা কি দেশের জন্যে আমাদের সর্বোচ্চটা দিতে পেরেছি? আমাদেরকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে আমাদের সর্বচ্চ চেষ্টা করতে হবে এদেশ অফিশিয়াল ভাবে পাকিস্তানকে যেন কোন সাহায্য করতে না পারে এবং এদেশে পাকিস্তানকে সাহায্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত তৈরী করতে হবে।.দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার খুবই প্রয়োজন। একটি ডলার আমাদেরকে অনেক সাহায্য করতে পারে। প্রত্যেকবার বেতন থেকে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কিছু অংশ রেখে বাকি অংশ বাংলাদেশের সাহায্যে ব্যয় করার জন্য আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিৎ। আমরা কি তা করতে পারিনা?..
অনুবাদঃ তাসমিয়াহ তাহসিন
<৬, ৪১, ৬৪২-৬৪৩>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগোঃ নং ৪
তারিখঃ ২১ জুলাই, ১৯৭১
.
পশ্চিম উপকূলে
বাংলাদেশ গোষ্ঠী সমন্বয়ক পর্ষদ
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সব বাঙালিদের সহজাত দেশাত্মবোধক প্রতিক্রিয়া সমন্বয়ের ও সঞ্চালনের জন্য উপায় খোঁজা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে । কার্যকরী সমন্বয় ও যোগাযোগের জন্য কিছু নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে একটি সভা সান ফ্রান্সিসকোতে ২২ মে,১৯৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়, যেটিতে লস এঞ্জেলস, বার্কলে, স্টেনফোর্ড এবং সান ফ্রান্সিঙ্কো থেকে বাঙ্গালিরা অংশগ্রহণ করেন। এই সভায় নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
১.প্রধান সমন্বয়ক অংশ নিউ ইয়র্কে সংস্থিত হবে এবং বার্কলে, সান ফ্রান্সিস্কো, স্টেনফোর্ড, সান ডিয়াগো, সান্টা বারবারা, ডেনভার (কলরাডো)এবং টাস্কন (আরিজোয়ানা)ইত্যাদি অন্যান্য পশ্চিম উপকূলের ইউনিট গুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে। এটি হাওয়াই, ডালাস ও পিটসবার্গে (কানাস) আরো কিছু ইউনিটের সাথে সমন্বয় স্থাপনে উন্মুখ হয়ে আছে।
২. প্রধান সমন্বয়ক অংশ দ্বারা নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো ও মিশিগানের সাথে সক্রিয় যোগাযোগ রক্ষা করা হবে, এবং এটি বাংলাদেশ সরকার থেকে প্রাপ্ত নির্দেশাবলী পশ্চিম উপকূলীয় অন্য সকল ইউনিট গুলোতে বহনও করবে।
৩. সবগুলো ইউনিট নিজেদের মধ্যে আগ্রহের বিষয়ে তথ্য বিনিময় করবে এবং স্থানীয় সদস্যদের কাছে সেগুলোর খবর স্থানীয়দের কাছে সরবরাহ করবে।
৪. প্রচারকার্যের উপরি খরচ ও অন্যান্য সমন্বয়ের খরচ বহনের জন্য সকল পশ্চিম উপকূলীয় ইউনিট দ্বারা মোট সংগ্রহের উপর ৫% রেমিটেন্স লস এঞ্জেলস পর্ষদকে দেওয়া হবে।
৫. সাধারনভাবে আমেরিকার জনগণের কাছে, বিষেশত আমেরিকান প্রতিনিধিদের কাছে আমাদের দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃসংশতা ও বর্বরতা প্রকাশ করতে, এবং স্বাধীনতা সম্পন্ন করতে বাংলাদেশের বৈধ দাবী প্রচারে সাধারণত প্রতিটি ইউনিট প্রচার প্রচারনা চালু রাখবে।
৬. তহবিলের সকল সংগ্রহের বিবরণী লস এঞ্জেলস কে জমা দেওয়া হবে।
৭. সকল নাগরিক ও সমব্যথীদের একটি সার্বিক লিষ্ট বানানো হবে এবং প্রতিটি ইউনিটের সমন্বয়কেরা সেসব নাম ও ঠিকানা লস এঞ্জেলসের সমন্বয়ককে পাঠাবে।
গনসভা
ফোর্থ এন্ড আর্চ স্ট্রীট, ফিলাদেলফিয়াতে অবস্থিত ফ্রেন্ডস মিটিং হাউজে ২৪ ই জুন , বৃহস্পতিবার, ৮ ঘটিকায় এক গনসভা অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে “ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা যেটি ১)আমেরিকান নাগরিকদের পূর্ব বাংলার কার্যক্রম সম্বন্ধে অবগত করবে, ২) ত্রাণকার্যে সহায়তা করবে এবং ৩) পূর্ববাংলায় তাদের ত্রাসের রাজত্ব বন্ধ করার আগ পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার সকল সহায়তার উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপের আবেদন করবে। বৈঠকটি অধ্যাপক চার্লস কান (পেন বিশ্ববিদ্যালয়), রেভ. রিচার্ড এল. কিয়াচ (সেন্ট্রাল ব্যাপিস্ট চার্চ , ওয়েন) এবং অন্যান্যদের দ্বারা সংগঠিত হবে। সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
সংবাদ সংক্ষেপ
উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডায় ৭ই জুলাই,১৯৭১, ৭ ঘটিকায় বাংলাদেশের একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই সভার বিষয় হচ্ছে “দি কেস ফর বাংলাদেশ”। বক্তা হিসেবে থাকবেন অধ্যাপক রন ইন্ডেন, ইতিহাস বিভাগ, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক রালফ নিকোলাস, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক পিটার বারতোক্কি, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান, আজিজুল হক খন্দকার, বিডিএল পরিচালক, ডেট্রয়েট। সভার স্থান হল ‘দি রুম’, এসাম্পটন কলেজ, ৪০০ হারন লাইন, উইন্ডসর, কানাডা। সবাইকে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা পরিষদের পরবর্তী সভা মেডিসন, উইস্কন্সিনে ৩রা জুলাই, ১৯৭১ (শনিবার, ১.৩০ ঘটিকায়) অনুষ্ঠিত হবে।বিডিএল এর সকল সদস্য এবং সমব্যথীরা এই সভায় যীগদানের জন্য স্বাগত। যদি আপনি যোগদানে ইচ্ছুক হন, তবে দয়া করে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করুন- বিডিএল, ৪০৮ ভার্জিনিয়া টেরেস, মেডিসন, উইস্কন্সিন (ফোন-৬০৮-২৩৩-০২৫৩)
ওয়াশিংটনে জনাব আব্দুর রাজ্জাক দ্বারা বাংলাদেশের তথ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এই দপ্তরে ওয়াশিংটন ডিসি এর সকল তদবির কার্যক্রম সমন্বিত হবে। তদবিরের জন্য যে কোন নির্দেশনার প্রয়োজনে জনাব খানের সাথে ৭০৩-৯৩১-২৯ এ
( অফিস ৯৭ হবে) যোগাযোগ করুন।..
অনুবাদঃ জয়ন্ত সেন আবীর
<৬, ৪২, ৬৪৪-৬৪৬>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ (পশ্চিম তীর নিউজ বুলেটিন) ক্যালিফোর্নিয়াঃ নম্বর ২
তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
আমেরিকার হাতে বাঙালিদের রক্তঃ
অবশেষে আমেরিকার হাত বাঙালিদের রক্তে রঞ্জিত হল। দুঃখের ব্যাপার এই যে আমেরিকার মত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্বাধীনতার ধারণাকে চূর্ণ করে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের সাথে হাত মিলিয়েছে, যাদের কার্যকলাপ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে যে কারণ দেখিয়ে আমেরিকা যুদ্ধ লড়ছে তার বিপরীত।
বিশ্বব্যাপী ধিক্কার এবং আমেরিকান সিনেটর, কংগ্রেসম্যান ও নাগরিকদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও দুই জাহাজ ভর্তি অস্ত্র-গোলাবারুদ পাকিস্তানে পাঠানো আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ)তে যে মানবিক দুর্দশার জন্ম দিয়েছে তার প্রতি এক স্থূল অবজ্ঞা প্রকাশ করছে। ইয়াহিয়ার নেকড়ের পালের পাশবিক আচরণে আমেরিকান করদাতাদের টাকায় অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে আমেরিকান সরকার তার নাগরিকদের বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার এক অনিচ্ছুক অংশীদারে রূপান্তরিত করে নিয়েছে।
এর মাধ্যমে নিক্সন সরকার শুধুমাত্র নিরস্ত্র বাঙালিদের মানবাধিকার ক্ষুণ্নই করছে না, সাথে সাথে আমেরিকান নাগরিকদের সাথে এক বিদ্রুপাত্মক ছলের আশ্রয়ও নিচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা এবং ইয়াহিয়াকে সরাসরি আমেরিকান সাহায্যের পরেও তাদের মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, এবং তার জন্য তারা আমেরিকান জনগণ, লীগের সদস্য ও তাদের সহযোগী বন্ধুদের নিকট হতে অভিনন্দন পাবার যোগ্য।
আমরা লীগ এবং আমেরিকান জনগণের পক্ষ থেকে জনাব নিক্সন এবং তার সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন মানবতার শত্রুদের সবরকম সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে এবং ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তা বাংলাদেশে থেকে চলে না আসা পর্যন্ত তাদের প্রতি সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা মুলতবি রাখে।
.
ধর্ষণের পেছনের কাহিনী
বাংলাদেশে মানুষ উৎপাদনের কেন্দ্রঃ
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে সামরিক আক্রমণের সাথে যুক্ত একজন কর্নেলের ছেলে, এক পাঞ্জাবি ছাত্র, এমন কিছু জঘন্য মনোভাব প্রকাশকারী মন্তব্য করে যা হালকা ভাবে নেয়া উচিৎ নয়। সে মাত্র ১০ দিন আগে করাচী থেকে লস অ্যাঞ্জেলসে এসে পৌঁছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের মাঝে বর্তমানে বিরাজমান এক সাধারণ মনোভাবের উল্লেখ করে – বাঙালিদের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
তার গর্বিত বিবৃতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্বে তাদের কলোনিকে রক্ষা করতে এখন আন্তঃজাতি মিলন ঘটাতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। অফিসার এবং সেনা সকলকেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেকোনো উপায়ে বাঙালি নারীদের সাথে জোরপূর্বক যৌনমিলন ঘটাতে, যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তানী বাবার ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তানদের দ্বারা বাংলাদেশে অবাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এমন অশুভ, জঘণ্য ও ঘৃণিত কার্যকলাপ বাঙালি জনগণের ওপর এক চরম আঘাত, কেননা এসব সন্তান যখন বেড়ে উঠবে এবং শারীরিক দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে মিল খুঁজে পাবে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের আনুগত্য পশ্চিমের প্রতি ঝুঁকে পড়বে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করে তাদের এই পরিকল্পনা পরবর্তী প্রজন্ম থেকেই প্রভাব ফেলা শুরু করবে এবং বাংলাদেশ চিরকালের জন্য কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
সরাসরি বলতে গেলে বাঙালি নারীরা- আমাদের মা, মেয়ে, বোন, স্ত্রী, ভাতিজি, ভাগ্নী পাকিস্তানী সেনাদের হাতে চরম অপমান ও অবমাননার স্বীকার হচ্ছে। তাদের কথা একদা তারা কেবল ১৭ জন ঘোড়সওয়ার দিয়েই বাংলা দখল করে নিয়েছিল। এই বিংশ শতকে এসে তাদের ৭০,০০০ সেনা এই কাজটা আবার করে দেখাবে। পাঞ্জাবি ছাত্রটির কথা শুধুমাত্র ফাঁকা বুলিই নয়, হয়ত এর মাঝে কিছু সত্যতাও লুকিয়ে আছে।
.
নিজের বোকামীর কারাদণ্ড
ম্যাককার্থিজমের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিতে আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি ছিল “যারা আমাদের পক্ষে নেই, তারা আমাদের বিপক্ষে।“ ‘দূরদর্শী’ রাষ্ট্রসচিব জনাব জন ফস্টার ডুলস-এর মস্তিষ্ক প্রসূত এই নীতি আইজেনহাওয়ারের দিনগুলোতে আমেরিকাকে ৪৭ টি কৃত্রিম ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পথে পরিচালিত করে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্র নীতির মূল বিষয়গুলোর একটি ছিল “ চীনের নিয়ন্ত্রণ”, যার মাধ্যমে চীনের সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে এক কৌশলগত আবরণের ভেতর নিয়ে আসা হয়। ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই এক দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় সামরিক সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ভারত এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও পাকিস্তানের ভারতভীতি তাদের এই প্রস্তাব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। ভারত স্বাভাবিকভাবেই উপলব্ধি করে উপমহাদেশে এরূপে অস্ত্রের আমদানি এ অঞ্চলে সামরিক ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করবে এবং এই চালান ঠেকানোর জন্য তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে । ভারতের বিরোধিতার মুখে আমেরিকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ছিল এইসকল অস্ত্র এই শর্তেই দেয়া হচ্ছে যে পাকিস্তান তাদের কেবল চীনের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারবে। এই বিবৃতি যে মিথ্যা তা সকলের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তান যখন ১৯৬৫ সালে এইসকল অস্ত্র ব্যবহার করেই ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালিয়ে বসে। ‘কূটনৈতিক বিরোধিতা’ ব্যর্থ হলে আমেরিকা নতুন করে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রাণঘাতী নয় এমন তৈরী জিনিস, যেমন যন্ত্রাংশ, জিপ, ট্রাক প্রভৃতি এই আংশিক নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে ছিল। বিনাশর্তে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগের লক্ষ্যে পাকিস্তান চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের কাছ থেকে বেশ বড় পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। এভাবে এক বৃহৎ শক্তিকে আরেকটির বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান সফলতা লাভ করে এবং গত অক্টোবরে আমেরিকা আবারো পাকিস্তানে নতুন অস্ত্রের চালান শুরু করে। তারা কারণ দেখায় যে তা না হলে পাকিস্তান তার সামরিক সরঞ্জামের জন্য সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এই নিষ্ঠুর কপটতা এখন জন্ম দিয়েছে মধ্যযুগের নৃশংসতার সাথে তুলনীয় এক গণহত্যার। নিক্সন সরকারের কর্মকর্তাদের হাত এখন বাঙালিদের রক্তে রঞ্জিত, যাদের একমাত্র অপরাধ ছিল নিজ দেশের সরকারে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব দাবী করা। পাকি যুদ্ধযন্ত্রের নৃশংসতার সাথে বাঙালিদের অবমাননায় যুক্ত হয়েছে ভারতে পালিয়ে যাওয়া অসংখ্য শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশার প্রতি আমেরিকান সরকারের নির্লজ্জ অনীহা। কিউবা থেকে নির্বাসিতদের আমেরিকায় এনে ‘স্বাধীনতা’ দান করার পেছনে আজ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। কিন্তু অপর দিকে ৬ মিলিয়ন(৬০ লাখ) শরণার্থীর শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করবার জন্য অর্থ ও অন্যান্য সরবরাহের বড়ই অভাব। আমেরিকা এখনো নিজেকে মানবিক মূল্যবোধ ও গণতান্রিক অধিকারের বৈশ্বিক রক্ষাকর্তা হিসেবে বিবেচনা করে গর্ব বোধ করে। এই হিপোক্রেসি শেষ হবে কবে?
এ. কে. এম.
লস অ্যাঞ্জেলেস
.
.
অনুবাদঃ নিয়াজ মেহেদী এবং ওমার ফাইলাসূফ
<৬, ৪৩, ৬৪৭-৬৫২>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগোঃ নং ৫
তারিখঃ ১৫ জুলাই, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পিস অর্গানাইজেশনগুলোর সমর্থন
উইসকনসিন প্রদেশের মিলওয়াকি শহরে গত ২৫-২৭ জুন অনুষ্ঠিত পিপলস কোয়ালিশন ফর পিস জাস্টিস (পিসিপিজে) এর বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রেজুলেশন পাশ করা হয়েছে। পিপলস কোয়ালিশন এই দেশের প্রায় শতাধিক পিস অর্গানাইজেশনের মূল সংগঠন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৮০০ জন ডেলিগেট উক্ত সম্মেলনে অংশগ্রহন করেন।
সভায় সূচনা বক্তব্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ড. ইকবাল আহমেদ উপস্থিত ডেলিগেটদের সামনে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির উপর একটি মূল্যায়ন পাঠ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে সহায়তার যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র অনুসরন করছে তার বিরুদ্ধে এবং দক্ষিন এশিয়ায় আরেকটি ভিয়েতনাম পরিস্থিতির সৃষ্টি যেনো না হয় সে ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিতে ড. আহমেদ উপস্থিত ডেলিগেট বৃন্দের প্রতি আহবান জানান।
বাংলাদেশ পরিস্থিতির উপর দিনব্যপী ব্রিফিং এর পর বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ আলোচ্য বিষয়ে উপস্থিত সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম দ্বারা উক্ত ব্রিফিং এ পিসিপিজে এবং তার অংগ সংগঠনগুলো পৃথকভাবে এবং একসাথে কনফারেন্সে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।
পিসিপিজের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটন ডিসি অফিসের সদস্যবৃন্দের প্রতি নিম্নোক্ত সাজেশন পাঠানো হয়ঃ
তিন সপ্তাহের ভেতর (কমপক্ষে) যুক্তরাষ্ট্রকে সাম্প্রতিক সময়ের নিকৃষ্টতম মানবীয় বিপর্যয় ঘটানো থেকে বিরত রাখতে আমরা কি পদক্ষেপ নিতে পারি?
পিসিপিজে এর জাতীয় পরিকল্পনাকে সমর্থন করা
পিপলস কোয়ালিশন তিনটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করেছেঃ
নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং সানফ্রান্সিসকো। আপনি যদি এই তিন এলাকার বাসিন্দা হয়ে থাকেন, তাহলে পিসিপিজে আয়োজিত প্রতিবাদ সভার বিষয়ে খোজ করুন এবং রিক্রুটমেন্ট, মিডিয়া এডুকেশন সহ অন্যান্য কর্মসূচীতে অংশ নিন। (এবং একই সাথে মে দিবসের বিশেষ ট্রাইব অ্যাকশনের ব্যাপারে খবর নিন।)
আভ্যন্তরীণ অন্যান্য কর্মসূচীগুলোতে অংশ নিন
পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে আপনার চারপাশের গ্রুপগুলোর অবস্থান সম্পর্কে যত দ্রুত সম্ভব (খুব বেশী হলে এক মাসের ভেতর) খোঁজ নিন। তাদেরকে যথাসম্ভব সাহায্য-সহায়তা করুন।
স্থানীয় প্রতিবাদ সভা আয়োজন
এয়ার ফোর্স, সামরিক বাহিনী অথবা ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের সাপ্লাই এজেন্সি অথবা কনট্রাক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে সামনে কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পেন্টাগনের পাকিস্তানে অস্ত্র শিপমেন্ট চালিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ আয়োজন। (নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ২২ এবং ২৫শে জুন তারিখের সংখ্যা দৃষ্টব্য।)
লবিং
পাকিস্তানকে সকল প্রকার সাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে কংগ্রেসম্যানদের প্রতি লিখিত আহবান জানাতে চার্চগুলোকে উদ্বুদ্ধ করা। একই সাথে গেলাহার অ্যামেন্ড, এইচ.আর. ৮৯৬১ দ্য সাক্সবে-চার্চ অ্যামেন্ডমেন্ট থেকে ফরেন অ্যাসিসটেন্স অ্যাক্ট (সিনেটে) এর প্রতি সমর্থন আদায়।
এছাড়া স্টেট ডিপার্টমেন্টে (পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কিত রিপোর্ট সমূহ গোপন রাখার প্রতিবাদ জানানোর জন্য)– নিক্সন এবং সিনেটের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিশন ইত্যাদি অফিসে তার প্রেরণ। এছাড়া বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্য নিম্নোক্ত স্থানীয় পিস গ্রুপগুলোর সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখুনঃ
জাতীয়ঃ পিসিপিজে অফিস – (২০২) ৭৩৭-৬৮০০;
বাংলাদেশ লীগ(ওয়াশিংটন) (৭০৩) ৯৩১-২৯৯৭;
নিউ ইয়র্ক (বাংলাদেশ) (২১২) ৬৮৫-৪৫৩০;
শিকাগো (বি.ডি.) (৩১২) ২৮৮-০২৭২৮;
সান ফ্রান্সিসকো (বি.ডি.) (৪১৫)৩২৫-৫৭৯৬;
ফিলাডেলফিয়া (২১৫) ৭৪৭-৪৭৪৭;
পাকিস্তানকে অস্ত্রসহায়তা দেয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচী ঘোষনা
যুক্তরাষ্ট্র কতৃক পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা দেয়ার প্রতিবাদে তিনটি জেলা শহরে বিক্ষোভ কর্মসূচী ঘোষনা করেছে পিস অর্গানাইজেশন গুলোর জোট। ২৫ ডাব্লিউ জ্যাকসনের ক্রাইস্ট-দ্য-কিং চার্চে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে পিসিপিজে কো-অর্ডিনেটর সিডনি লেনস সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পাকিস্তানে কুখ্যাত একনায়কতন্ত্রকে জিইয়ে রাখার কাজে খরচ করা হচ্ছে। লেনস বলেন পিপলস কোয়ালিশন নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং সান ফ্রান্সিসকোর প্রাদেশিক ভবনগুলোর সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচী আয়োজনের চিন্তা ভাবনা করছে। জোটভূক্ত আরেকটি সংগঠন ‘মেয়ডে ট্রাইব’ এর স্পোকসম্যান ডেভিড বুরাক বলেন তার সংগঠন ‘নিউ ইয়র্কের জাহাজে অস্ত্র বোঝাই কমিয়ে যেনো অর্ধেকে আনা হয়’ সেই দাবীতে একটি জোরালো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী দেয়ার পরিকল্পনা করছে। অবশ্য সেই কর্মসূচীর ভেতর কি থাকছে বা কবে ঘোষনা করা হবে সে বিষয়ে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি। (সান-টাইমস। জুলাই ১, ১৯৭১ শিকাগো)
উইসকনসিন এর পিস গ্রুপগুলোর প্রতিবাদ আয়োজনের খবর
ম্যাডিসনে গত ৩ জুলাই পাকিস্তান স্টুডেন্টস কনভেনশন চলাকালে তার সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করেছে উইসনসিনের পিস গ্রুপ-গুলোর জোট। উইসকনসিন এলায়েন্স ইন অ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকান সার্ভিসমেনস ইউনিয়ন (এএসইউ) নামক দুটি সংগঠন যৌথভাবে এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। ভেতরে কনফারেন্সে আলোচনা চলাকালে বাইরে প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে অংশ নেয় উক্ত সংগঠনগুলোর সদস্যরা। এর আগে উক্ত কর্মসূচীর বিষয়ে একটি প্রেস ব্রিফিং এর আয়োজন করা হয়, সেখানে আয়োজক সংগঠনগুলো জানায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের আগমন উপলক্ষ্যে বিমানবন্দরের সামনে আরেকটি বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন তারা। কিন্তু শেষ মুহুর্তে পাক রাষ্ট্রদূত সফর বাতিল করায় সেই বিক্ষোভ আর আয়োজিত হয়নি। অবস্থান কর্মসূচী শেষে পিস সংগঠনের জোট এবং এএসইউ এর সৌজন্যে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়, যেখানে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা এবং বিভিন্ন তথ্য বিলি করা হয়। সভায় আলোচনা করেন ড.ইকবাল আহমেদ এবং জনাব মোজাম্মেল হক। বক্তারা বাংলাদেশ এবং বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে উপস্থিত জনতার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এছাড়া বাংলাদেশ বিষয়ে টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান সেখানে প্রদর্শন করা হয়।
বিডিএল বোর্ড মিটিং
গত ৩রা জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসদের সভা। উক্ত সভায় বিডিএল এর কার্যক্রম ও কর্মসূচী সমূহ পুনরায় ঘোষনা করা হয়।
.
বিডিএল, ইউএসএ এবং কানাডাতে থাকা বাংলাদেশি সকল গ্রুপকে তাদের স্থানীয় শান্তি সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে এবং তাদের সাথে তাদের কর্মকান্ড সমন্বয় করতে অনুরোধ করেছে। নিকটবর্তী শান্তি সংস্থার ঠিকানা ও ফোন নং মিঃ ব্র্যাড লিটল, ১০২৯ ভারমন্ট অ্যাভিনিউ, নিউইয়র্ক ওয়াশিংটন ডি.সি.(ফোনঃ (২০২) ৭২৭-৮৬০০) এর নিকট হতে পাওয়া যাবে।
.
পূর্ব বাংলার বন্ধুগন
২৪ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, চতুর্থ আর্চ ষ্ট্রীটে ফ্রেন্ডস মিটিং হলে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে চিন্তিত একদল নাগরিক গঠন করেন “ফ্রেন্ডস অফ ইষ্ট বেঙ্গল(পুর্ব বাংলার বন্ধুগন)” নাম একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। যারা এখানে যোগ দিতে চায় তাদের প্রতি দরজা খোলা ছিল। নিমোক্ত উদ্দেশ্য ঠিক করা হয়েছিলঃ
১. ২৫শে মার্চ,১৯৭১ থেকে পুর্ব বাংলার মানুষের উপর সামরিক বাহিনী দ্বারা যে অত্যাচার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করা।
২. পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সংকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
৩. লক্ষ্য সফল করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করা।
যারা “ফ্রেন্ডস অফ ইষ্ট বেঙ্গল (পুর্ব বাংলার বন্ধুগন)” এ যোগ দিতে চান বা আমাদের সম্পর্কে আরো জানতে চান তারা যোগাযোগ করতে পারেনঃ
“ফ্রেন্ডস অফ ইষ্ট বেঙ্গল (পুর্ব বাংলার বন্ধুগন)”
কেয়ার/অফ চার্লস খান
৩০৫, লোগান হল,
পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
৫৯৪-৮৫৬৩
জিআর২-৩৯৬৯
“কলম্বিয়া স্টুডেন্টস ফর বাংলাদেশ (বাংলাদেশের জন্য কলম্বিয়ার ছাত্র-ছাত্রী)”
.
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রছাত্রী পূর্ব বাংলার ভয়ানক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় ৪০০ ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপকের স্বাক্ষরযুক্ত একটি পিটিশন জাতিসংঘের নিকট উপস্থাপন করেন। এই পিটিশনে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল যাতে বাংলাদেশে রক্তগঙ্গা বন্ধ হয়। বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে দুজন নোবেল বিজয়ী ও ছিলেন।
.
কানাডাতে জনসভা
১৬ জুন তারিখে ব্রিটিশ-কল্মবিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের, ইন্টারন্যাশনাল হাউজে একটি জনসভায় গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের (গান্ধী শান্তি সংস্থা) জয় প্রকাশ নারায়ণের বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে কথা বলেন এবং তাঁর বক্তব্যে নিমোক্ত লক্ষ্যগুলো গৃহীত হয়।
“আমরা পাকিস্তানের রাস্ত্রপতির নিকট আহবান জানাই যাতে সে যাদের নামে সে দেশ শাসন করে তাদের উপর জুলুম করা বন্ধ করেন এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত যারা জীবিত আছেন তাদের সাথে আলোচনার দরজা খুলে দেন যাতে পুর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক এবং দায়িত্বশীল সরকার পুনরধিষ্ঠিত করা যায়।
.
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ব্যারি এম. মরিস কর্তৃক ১৬ জুন, ১৯৭১ তারিখে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডি সেন্টারের অধ্যাপক র্যালফ ডব্লিউ নিকোলাসের নিকট পাঠানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশান অফ কুইবেক (কুইবেকে বাংলাদেশের সমিতি)
নাইয়ুম চৌধুরী, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশান অফ কুইবেক এর সাধারণ সম্পাদক বলেনঃ
“পদ্মা” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র এবং গোলাবারুদ বহন করে মন্ট্রিয়ল বন্দরে পৌঁছেছে। এর উদ্দেশ্য কানাডার তৈরি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর স্যাবর জেটের যন্ত্রাংশ বোঝাই করা। মন্ট্রিয়ল সাংবাদিকদের সময়মত নেয়া এই পদক্ষেপের কারনে কানাডার অস্ত্র রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা স্থাপন করা হয়।
আমরা উত্তর আমেরিকা ও পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের উপর সতর্ক নজর রাখছি, এবং স্থানীয় পত্রিকা ও সহানুভূতিশীল কানাডিয়ানদের সাথে কাজ করে এই ষড়যন্ত্রের পর্দা কানাডার নাগরিকদের জন্য উন্মোচনের চেষ্টা করছি।
“পদ্মার” আগমনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের সম্মেলন সহ বেশকিছু শ্রমজীবীদের সংগঠন দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল এবং তারা এতে যোগও দিয়েছিল।
মিশিগান থেকে রিপোর্ট (মিশিগান থেকে প্রতিবেদন)
মিশিগান থেকে মিঃ মোজাম্মেল হক বলেনঃ
২৯ জুন আমি “শান্তির জন্য আরেকটি মা” সম্মেলনে যোগদান করার জন্য গ্র্যান্ড র্যাপিডে গিয়েছিলাম তথ্য সংক্রান্ত উপকরন দিয়ে আসতে এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতির ব্যাপারে কথা বলতে।
আমরা একটি তহবিল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেছি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এম.এস.ইউ এর ৪০০০ শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাস(নৃতত্ববিদ্যার অধ্যাপক), অধ্যাপক বিল রস(সভাপতি, দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ান স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট) এবং অধ্যাপক রিচার্ড নিয়েকফ এই তহবিলে দান করেছেন।
এম.এস.ইউতে “ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ”র সাথে একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তহবিল সংগ্রহের জন্য বাকেট ডিনার চালু করেছে। প্রথম সপ্তাহেই ডিনারের প্রায় ৩০০ টিকেট বিক্রয় হয়েছে। এই ডিনারে বাংলাদেশ নিয়ে একটি আলোচনা থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ডক্টর. জুমজা আলভী শ্রোতাবৃন্দের সাথে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলবেন।
(দয়া করে আমাদের আপনার গ্রুপের কার্যক্রম সম্পর্কে জানাবেন। আপনাদের অনুষ্ঠানগুলো হয়তো আমাদের নতুন পরিকল্পনার আইডিয়া দিতে পারে অন্য একটি গ্রুপঃ বাংলাদেশ নিউজলেটারের জন্য)
ডেলাওয়ার ভ্যালীতে বাংলাদেশের অ্যাসোসিয়েশান
ফিলাডেলফিয়া এবং এর আসে পাশে বসবাসরত বাঙালীরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কার্যক্রমকে সমন্বয় করতে একটি সংগঠন তৈরি করেছে। এই সংগঠনের কাজ হবে পশ্চিমা সংবাদপত্র থেকে আগ্রহী লোকজনদের জন্য তথ্য সরবরাহ এবং তথ্য পাইয়ে দেয়া। আরো জানার জন্য যোগাযোগ করুন, ৪৯, মার্লবোরো লেন, উইলিংবরো, এন.জে. ০৮০৪৬
.
বাংলাদেশ লীগ সম্মেলন
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার বার্ষিক সম্মেলন নিউইয়র্কে ২৬ শে জুন ১৯৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্ক গ্রুপ ছাড়াও বাংলাদেশ লীগের যে অধ্যায় গুলো সম্মেলনে বর্ননা করা হয় সেগুলো হল, ওয়াশিংটন ডিসি, কেন্টাকি, ট্যেনেসি, এবং নর্থ ক্যারোলিনা। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা লীগ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেলাওয়ার ভ্যালি এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশান অফ ওহাইও থেকে পর্যবেক্ষক ও উপস্থিত ছিল। সারাদিনব্যাপী সম্মেলনে অধ্যায়সমূহ এবং অন্যান্য বাংলাদেশের সংগঠন সমূহ থেকে রিপোর্ট ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা বিভিন্ন গ্রুপের কাজ এবং লীগের নির্বাহী কমিটির নির্বাচন সমন্বয়ের জন্য একটি সমন্বয়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা লীগ পশ্চিমা উপকুলের গ্রুপের সাথে সংযুক্তি
ডক্টর এফ.আর. খান, বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের সভাপতি ২৫ শে জুন ১৯৭১ তারিখে স্যানফ্র্যান্সিস্কোতে অনুষ্ঠিত বে এরিয়া বাংলাদেশ এবং সমব্যাথীগন দের একটি মিটিং এ যোগদান করেন। লস অ্যাঞ্জেলেস গ্রুপের প্রতিনিধিরাও এই মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন। ডক্টর খান বিডিএল এবং বাংলাদেশ জরুরী কল্যাণ আপীল(Bangladesh Emergency Welfare Appeal) এর সাংগঠনিক কাঠামো ব্যাখ্যা করেন এবং এসব সংগঠনের কার্যক্রম এবং ক্রিয়াকলাপ এর উপর একটি প্রতিবেদন দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে থাকা সকল বাংলাদেশী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের উপর জোর দেন।
বিডিএল এর সভাপতির সাথে দ্বিতীয় একটি সমন্বয়কারী মিটিং ১৮ জুলাই ১৯৭১ অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ মিশন থেকে, নিউইয়র্ক
নিউইয়র্কের বাংলাদেশ মিশন থেকে মিস্টার এ.এইচ. মাহমুদ আলী আমাদের নিম্নোক্ত তথ্য দিয়েছেনঃ
১. বৈষম্য ও সংখ্যালঘুদের রক্ষায় নিয়োজিত সাব-কমিশন যেটি জাতিসংঘের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ২ অগাস্ট ১৯৭১ থেকে নিউইয়র্কে মিটিঙে বসবে। এই সাব-কমিশন বিশেষজ্ঞ লোকদের দ্বারা গঠিত তাই পুর্ব পাকিস্তানের মানবাধিকার দিকের পরিস্থিতি বিবেচনা ও তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের একটি সঠিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। যদি কারো কাছে কোন তথ্য থাকে তাহলে বাংলাদেশ মিশনে একটি প্রতিলিপি সহ জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট নিম্নোক্ত ঠিকানায় চিঠি পাঠাতে পারেনঃ ১০ ইষ্ট ৩৯ স্ট্রীট, কক্ষ ১০০২এ, নিউইয়র্ক, ১০০১৬।
যারা ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ এরপর পুর্ব-বাংলা ছেড়ে গেছেন তারা বেসরকারী সংগঠনসমূহের সামনে যেমন “দ্যা ইন্টারন্যাশনাল লীগ ফর দ্যা রাইটস অফ ম্যান” যেটি জাতিসংঘের পরামর্শমূলক সহযোগী হিসেবে আছে, সাক্ষ্য দিতে পারেন। যাতে তাদের সাক্ষ্য সাব-কমিশনে উপস্থাপন করা যায়।
ইন্ডিয়া অথবা পুর্ব বাংলার উদ্বাস্তু দের থেকে পাওয়া চিঠি গুলো উপকারী হতে পারে।
যারা সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক, দয়া করে বাংলাদেশ মিশনকে লিখুন।
২. যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশী বৃত্তি বিসয়ক রাষ্ট্রপতির কমিটি সামনে সেপ্টেম্বরে মিটিং করবে। এই কমিটি বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিলের অনুমোদন নিয়ে সিধান্ত দিয়ে থাকে।
যারা ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এর পর পুর্ব বাংলা ছেড়ে গেছেন তারা এই কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে পারেন। যারা দিতে ইচ্ছুক তারা বাংলাদেশ মিশনকে চিঠি দিতে পারেন।
প্রস্তাবিত পদক্ষেপসমূহ
১. সিনেটর এবং যতগুলো রাজ্যের প্রতিনিধি সম্ভব সবাইকে যত পারা যায় ফোন, চিঠি এবং টেলিগ্রাম করতে হবে। তাদের বলতে হবে তারা যেন আইন-সভায়(গ্যলাগার সংশোধনী) চার্চ-স্যাক্সবে অ্যমেন্ডমেন্ট এস-১৬৫৭ এবং অনুরূপ আইন কো-স্পন্সর করেন। প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে তাদের প্ররোচিত করতে হবে এবং রাষ্ট্র বিভাগ এবং পেন্টাগনকে প্রশ্ন করতে হবে।
২. আপনার স্থানীয় নাগরিক গোষ্ঠীর সাথে কথা বলুন এবং তাদের জানান বাংলাদেশে দুর্যোগের ভয়াবহতা এবং আমরা বর্তমানে কিভাবে জড়িত আছি।
৩. তথ্যের জন্য সকল খবরের কাগজের প্রতি প্রতিদিন লক্ষ্য রাখুন। আপনার এলাকায় কাউকে রাখুন এবং একটি নির্দেশ উপদেশ সম্বাদাদি ফাইল রাখুন।
৪. আপনার স্থানীয় বাংলাদেশ গ্রুপ কে সমর্থন/সাহাজ্য করুন। ওয়াশিংটনের উপর চাপ প্রয়োগের মুল্য সম্পর্কে তাদের বোঝান।
৫. কংগ্রেসম্যানদের বোঝানোর মত বড় কাজে সরাসরি সাহায্য করার জন্য আপনার সবচেয়ে উপযুক্ত এবং ওয়াকিবহাল লোককে পাঠান।
.
.
শিহাব শারার মুকিত এবং অভিজিৎ সরকার
<৬, ৪৪,৬৫৩-৬৫৬> অনুবাদ
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয় এবং বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর |
শিখা নিউইয়র্কঃ নং ৫ |
১ আগস্ট, ১৯৭১ |
[ শিখাঃ বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, নিউ ইয়র্ক শাখা কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রচারিত।]
সম্পাদকীয়ঃ একতায় শক্তি…
পাকবাহিনী কর্তৃক প্রথম স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের রক্তাক্ত সমাপ্তির অনেক দিন পেরিয়ে গেছে এবং ২৫ মার্চ বাঙালীর স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়েছে যা সাধারণ বাঙ্গালি বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের উপরে বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড ও প্রায় ৭০ লক্ষ ভীতসন্ত্রস্ত জনগণের জন্ম দিয়েছিল। বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা পাকিস্তান সরকারের এই মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু তথাকথিত বিশ্বশক্তিগুলোর অল্প কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া আর কেউই হিটলার পরবর্তি সময়ের সবথেকে নিষ্ঠুর এই গনহত্যা নিয়ে কোন কথা বলেনি। তাদের জনগণের আর্তচিৎকার ক্ষমতার রাজনীতির দূর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করতে ব্যার্থ। ব্যাতিক্রম হল ভারত, আমেরিকা ও চীন। ভারত ৭০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় ও সেবা দেয়ার মত কঠিন কাজ ছাড়াও বাংলাদেশের জনগণকে প্রকাশ্যে সহায়তা দিচ্ছে। এদিকে আমেরিকা সরকারের ভিতর ও বাহির দুইদিক থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার আগে পাকিস্তানকে কোন ধরণের সাহায্য না দেওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও রক্তপিপাসু পাকিস্তানি জান্তাদের সমরাস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। চীন, যারা ছিল “হানাদার বাহিনী ও তাদের পা-চাটা কুকুর” তত্ত্বের সবথেকে কড়া সমালোচক, তারাই এখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষ নিয়ে নিজেদেরকেই হানাদার বাহিনীর পা-চাটা কুকুরে পরিনত করেছে। যখন এসব হচ্ছে তখন বাংলার বুক থেকে রক্ত অঝোরে ঝরছে।
এখানে আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, আমাদের, বাংলাদেশের জনগণের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার জন্য আমাদের যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে, এমনকি ঐসব বিশ্বশক্তির সাহায্য না পেলেও। এর মানে হচ্ছে মুক্তি বাহিনী, কৃষিজীবী ও দখলকৃত বাংলাদেশের কর্মচারিরাই আমাদের ত্রানকর্তা।
ইতিহাস রচনার এই চরম মুহুর্তে আমাদের দরকার বৈশ্বিক ঐক্য এবং সকল রাজনৈতিক ও সেনা দলের ভিতরে। যেহেতু গেরিলা যুদ্ধের সফলতার জন্য আপামর জনসাধারণের প্রত্যক্ষ সাহায্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন বিষয় তাই একই সাথে আমাদের উচিত হবে এই সম্পর্কে বাংলার জনসাধারণের মাঝে এ সম্পর্কে ধারণা ও নির্দেশনা দেওয়া। যখনই বাংলার সকল জনগণ হাতে অস্ত্র তুলে নেবে তখনই সামরিক জান্তার দূর্গ ভেঙ্গে পরবে। নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ দেশের সবথেকে বড় অপ্রতিরোধ্য জনগণকে নির্দেশনা দিয়ে থাকে, কিন্তু তারপরেও অন্যান্য দলসমূহ যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে নিজেদের এলাকায় তারা বেশ প্রভাবশালী। একথা বলা অত্যন্ত জরুরী যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক নীতিবোধের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সকল রাজনৈতিক দল হাতে হাত রেখে মুক্তিবাহিনী গঠন করেছে ৭০ হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্যের সাথে যুদ্ধের মানসে। আমরা যত অপেক্ষা করব আমাদের উপরে পশ্চিম পাকিস্তানি রক্তচোষাদের ছোবল আরও শক্ত হবে এবং তাদেরকে ছুড়ে ফেলাও তত কঠিন হবে।
আমেরিকা ও তার আশেপাশের কার্যক্রমসমূহ
আলি-চৌধুরী কানাডায়
হামিদুল হক চৌধুরী এবং মাহমুদ আলি সংবাদ সম্মেলনে বলেন গৃহযুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, উদ্বাস্তু, কলেরার প্রকোপ ইত্যাদি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো বিরাট অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর দ্বারা ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। একই সময় জাতীয় প্রেস ভবনের সামনে ১৫ জন নারী পুরুষ ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ ‘বিশ্বাসঘাতক নিপাত যাক’ ‘আলি-চৌধুরী দেশে ফিরে যাক’ প্ল্যাকার্ড হাতে জড়ো হয়।
প্রায় জনশূন্য সংবাদ সম্মেলনে জনাব চৌধুরীই বেশিরভাগ কথা বলেছেন। তিনি সাধারণ ভাবে উল্লেখিত ভারতে পালিয়ে যাওয়া উদবাস্তুর সংখ্যা ৬৫ লক্ষের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে এই দাবি তিনি সরাসরি অস্বীকার করেন।
বেশিরভাগ সময়েই জনাব চৌধুরী সরাসরি প্রশ্নগুলোকে নানা ধরণের যুক্তি দেখিয়ে আসল জায়গা থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছেন। তিনি কয়েকবার হতাশ ও বিরক্ত সাংবাদিকদের আপত্তির মুখে পরেন এবং তারা সোজাসুজি উত্তর প্রত্যাশা করেন।
গত ৭ ও ৮ মার্চ ঢাকায় ছিলেন এমন একজন সাংবাদিককে জনাব চৌধুরী বলেন ‘এটা তোমাদের প্রকাশনা। পত্রিকা তোমাদের পড়তেই হবে’।
বলিষ্ঠ চেহারার জনাব আলি বেশিরভাগ সময় শান্ত হয়েই বসে ছিলেন। এক পর্যায়ে টেবিলের দিকে ঝুকে আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে উচ্চস্বরে বলেন “যদি দেশের সংহতি হুমকির সম্মুখীন হয় তখন এটা সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব (সংহতি সমুন্নত রাখা ) এবং যখন প্রয়োজন হবে সেনা ও পুলিশ ব্যবহার করা হবে রিপোর্ট করেছেন গ্লোব এন্ড মেইলের প্রতিনিধি ক্লেয়ার ব্যালফোর, টরোন্টো, ২২ জুলাই ১৯৭১)।
টরোন্টো থেকে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডার সভাপতি জনাব সরোয়ার আলম খান জানিয়েছেনঃ
তথাকথিত ‘পাকিস্তান সংহতি কমিটি’ টরোন্টোতে ১৮ জুলাই ১৯৭১ তারিখে বিশ্বাসঘাতক মাহমুদ আলির সভাপতিত্বে অন্টারিও কলেজ মিলনায়তনে এক সভার আয়োজন করে।
ইয়াহিয়া খানের এই প্রচারণা কৌশলের প্রতিবাদে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা (টরোন্টো) মিলনায়তনের সামনে একটি শান্তিপূর্ন প্রদর্শনির আয়োজন করে। যেহেতু শুধু ‘পাকিস্তানিরা’ আমন্ত্রিত ছিল তাই আমরা এই সভা সম্পুর্নরূপে বয়কট করি।
অবাধ্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের আইনগত শান্তিপুর্ন প্রদর্শনিতে আমাদের পক্ষ থেকে কোন ধরণের উস্কানি ছাড়াই হামলা করে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন শুরু করে। তারা যখন আমাদের উপরে একেবারে চড়ে বসেছিল আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। খবর পাওয়া গেছে যে সভাটি সম্পূর্ন ব্যর্থ হয়েছিল।
জাতিসংঘের সামনে বিক্ষোভ
জুলাই ২৪ তারিখে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে প্রায় পঞ্চাশজন বাঙালি এবং আমেরিকান সমর্থক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের কাছে “মুজিবকে এখনই মুক্তি দিন”, “মুজিবের নয়, ইয়াহিয়ার বিচার হোক” ইত্যাদি স্লোগান সম্বলিত নকশা ছিল। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, নিউ ইয়র্ক আয়োজিত এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় বেশ কিছু অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার হবে এ মর্মে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতিবাদে। এ সব অভিযোগ প্রমাণিত হলে শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।
পরে বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে, যাতে শেখ মুজিবকে বিচারের নামে হত্যাচেষ্টায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে বাধা দিতে, গণহত্যা বন্ধ করতে এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে গণহত্যাকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে তাঁকে অনুরোধ করা হয়।
বিশ্বশক্তির কাছে ইসকোর আবেদন
আন্তর্জাতিক ছাত্র সাংস্কৃতিক সংস্থা(ইসকো), নিউ ইয়র্ক, যাদের সদস্যরা জার্মানি, পোল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত, ইরান, সুদান এবং অন্য আরো দেশ থেকে এসেছেন, তারা বিশেষ একটি সভায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সকল সদস্যের আশু প্রত্যাহার দাবি করেছে এবং অন্যান্য সমমনা সংস্থার প্রতি গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের জনগণের দৃঢ়সংকল্পের সমর্থন জানানোর আহ্বান জানিয়েছে।
সংস্থার চেয়ারম্যান, জনাব সুধাংশু বি. কর্মকার বলেন, সংস্থাটি জাতিসংঘের প্রতিনিধি, প্রিমিয়ার চৌ এন-লাই, প্রেসিডেন্ট নিক্সন সহ বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কাছে অনুরোধ জানিয়ে পত্র পাঠিয়েছে, যাতে তাঁরা এখনই গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশ থেকে সকল খুনি সৈন্যদের প্রত্যাহার করতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ওপর তাঁদের প্রভাব ব্যবহার করেন।
তাদের পাঠানো অনুরোধের জবাবে জাতীয় ইসরায়েলি ছাত্র কাউন্সিল বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে বলে জানা গেছে।
বিটলস এগিয়ে এলো বাংলাদেশের সাহায্যে
বিটলস ব্যান্ডের চার সদস্যের মধ্যে জর্জ হ্যারিসন এবং রিঙ্গো স্টার বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের সাহায্যার্থে আগস্ট ১, ১৯৭১ তারিখে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বিশেষ কনসার্টে অংশগ্রহণে সম্মতি জানিয়েছেন। এ কনসার্ট থেকে অর্জিত লভ্যাংশ বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের সাহায্যার্থে জাতিসংঘের তহবিলে দান করা হবে।
১৯৬৬ সালের পর এটিই হবে হ্যারিসনের প্রথম কনসার্ট। তহবিল উত্তোলনে তাঁর সাথে রবি শংকর এবং গায়ক লিয়ন রাসেল যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।
জাহাজে অস্ত্র বোঝাইয়ে বাধা দান
সেভ ইস্ট বেঙ্গল কমিটি, ফ্রেন্ডস ফর বাংলাদেশ, খ্রিস্টান বন্ধুসভা (কুয়েকার্স) এবং বিভিন্ন শান্তিকামী গোষ্ঠী সমবেতভাবে জুলাই ২৩ তারিখে নিউ ইয়র্কের ইস্ট রিভারের ৩৬ নম্বর জেটিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের জন্য জাহাজে করে অঅস্ত্র পাঠানোতে বাধা দিয়েছে।
জেটিতে নোঙ্গর ফেলা পাকিস্তানি যাত্রীবাহী জাহাজ ‘সাটলেজ’ সামরিক যন্ত্রপাতি বহন করছে বলে শোনা যাচ্ছে।
গত জুলাই ১৫ তারিখেও বাল্টিমোর নগর বন্দরে পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজ পদ্মায় অস্ত্র বোঝাই করার বিরুদ্ধে অনুরূপ বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছিল। বেশ কয়েকজন বন্ধুসভা সদস্যকে সেদিন গ্রেফতার করা হয়েছিল।
মালবাহী জাহাজ পদ্মা মালবোঝাই শেষ করে জুলাই ১৮ তারিখে বাল্টিমোর থেকে ছেড়ে যায়। দুজন খালাসির জানিয়েছে, তারা জাহাজে কামান দেখেছে।
গ্যালাহার বিলে সমর্থন
নিউ ইয়র্কে ও আশপাশে বসবাসরত পূর্ব বাংলার বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পাকিস্তানে পাঠানো সকল সাহায্য বন্ধ করতে প্রভাব খাটানোর এবং জনাব গ্যালাহারকে চেয়ারম্যান করে গঠিত এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স স্ট্যান্ডিং কমিটি কর্তৃক উত্থিত বিল সমর্থনের জরুরী অনুরোধ জানিয়ে কংগ্রেস সদস্যদের কাছে চিঠি এবং টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। চিঠিতে তারা আরো অনুরোধ করেছে যাতে তাঁদের কক্ষে উত্থিত হবার পর স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী নং এস-১৬৫৭ কেও তাঁরা সমর্থন দেন।
বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র
ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তথ্যকেন্দ্র যেটি বাংলাদেশের সকল গোষ্ঠী এবং সমর্থকদের সব সময় নিরপেক্ষ তথ্য প্রদানে সচেষ্ট থাকবে। আপাতত তথ্যকেন্দ্রে নিম্নোক্ত স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন, এম সিদ্দিক, এম ইউনুস, এফ ফয়সাল, ডব্লিউ গ্রিনাফ, ডক্টর নালিন (খণ্ডকালীন), এ টেইলর (পূর্ণকালীন)।
তথ্যকেন্দ্র তাদের প্রথম নিউজলেটার প্রকাশ করেছে। আরো তথ্যের জন্য লিখুন:
বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র
৪১৮ সেওয়ার্ড স্কয়ার, অ্যাপার্টমেন্ট ৪
ওয়াশিংটন ডিসি, ২০০০৩
অথবা কল করুন (২০২)৫৪৭-৩১৯৪ এই নম্বরে।
ঘোষণা!! ঘোষণা!!
নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, ইনকর্পোরেটেড এর মহাসচিব আগামী আগস্ট ৮, ১৯৭১, রবিবার বেলা ১১টায় নিউ ইয়র্কের ১৪৫, ব্লিকার স্ট্রিটে অবস্থিত গুলিস্তান রেস্টুরেন্টে সাধারণ সভা ঘোষণা করেছেন। লীগের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সাধারণ মতামত প্রদানের পাশাপাশি সভায় নির্বাচনী দিনটিতে সংবিধান সংশোধনীর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ উপলক্ষে বক্তব্য রাখবেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্ট্যানলি প্লাস্ট্রিক। সকল সদস্য এবং আগ্রহী ব্যক্তিবর্গকে এ সভায় অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
.
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,৪৫,৬৫৭-৬৫৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
পাকিস্তান প্রশ্নে কংগ্রেসের অবস্থান |
বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগো: নং ৬ |
৫ আগস্ট, ১৯৭১ |
পাকিস্তান প্রশ্নে কংগ্রেসের অবস্থান
জুলাই ১৫ তারিখে, লোকসভার বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত কমিটি, যতক্ষণ না পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ফেরত না আসছে এবং দেশে “গ্রহণযোগ্য মাত্রায় স্থিতিশীল অবস্থা” তৈরি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা না দিতে গ্যালাহার সংশোধনীর (এইচআর ৯১৬০) পক্ষে ১৭, বিপক্ষে ৬ ভোট প্রদান করেছে। আমরা আশাবাদী, কমিটির সুপারিশ অনুসারে সমগ্র লোকসভা সিদ্ধান্ত নেবে। ১৯৭২ অর্থবছরের জন্য প্রশাসনের সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য হিসেবে ১৩১.৮ মিলিয়ন ডলারের অনুরোধ কংগ্রেসের অনুমোদন দেয়া মানে [পূর্ব পাকিস্তানে] সামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদার করা এবং সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের শিকার বাঙালিদের সাহায্য করতে অস্বীকার করা।
সিনেটে পাকিস্তানকে আমেরিকার অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা দেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান লোকসভার চেয়ে আরো কঠোর। বর্তমানে ১৯৬১ সালে প্রণীত বৈদেশিক সহায়তা আইনে স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী (এস ১৬৫৭) এর পক্ষে সিনেটে ৩২ জন কোস্পন্সর রয়েছেন। তাঁরা হচ্ছেন, কলোরাডো থেকে অ্যালট, মেরিল্যান্ড থেকে বিয়েল, ইন্ডিয়ানার বেহ, ওকলাহোমার বেলমন, ইউটাহ এর বেনেট, ডেলাওয়ারের বেগস, ম্যাসাচুসেটসের ব্রুক, নিউ জার্সির কেইস, আইডাহোর চার্চ, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্র্যানস্টন, মেইনের ইগলটন, ফ্লোরিডার গার্নি, মিশিগানের হার্ট, ইন্ডিয়ানার হার্টকে, অরেগনের হ্যাটফিল্ড, আইওয়ার হিউজ, মিনেসোটার হামফ্রে, দক্ষিণ ডাকোটার ম্যাককভার্ন, মিনেসোটার মন্ডেল, ইউটাহ এর মস, মেইনের মাস্কি, রোড আইল্যান্ডের প্যাস্টোর, রোড আইল্যান্ডের বেল, উইসকনসিনের প্রক্সমায়ার, পশ্চিম ভার্জিনিয়ার প্যান্ডলফ, কানেকটিকাটের রিবিকফ, ডেলাওয়ারের রথ, ওহিওর স্যাক্সবি, পেনসিলভ্যানিয়ার স্কট, আলাস্কার স্টোভেনস, ইলিনয়ের স্টিভেনসন, ক্যালিফোর্নিয়ার টানি। অনুগ্রহপূর্বক এখনই তৎপর হউন। এ পদক্ষেপগুলো কংগ্রেসে বর্তমানে বিবেচনাধীন রয়েছে।
কীভাবে সাহায্য করবেন:
লোকসভায়(যদি এ সপ্তাহে লোকসভা কোন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়)
বৈদেশিক সহায়তা আইনে গ্যালাহার সংশোধনী (এইচআর ৯১৬০) লোকসভায় তোলা হলে সেটি যাতে পরবর্তীতে সিনেটে পাঠানো সম্ভব হয় এ ব্যাপারে, এ সংশোধনীর ব্যাপারে আপনার অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধির সমর্থন কামনা করে আপনার লেখা চিঠি বা পোস্টকার্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিধিদের কাছে ডাকযোগে প্রেরিত সব কিছুই টালি করা হয়, যা প্রতিসপ্তাহে কংগ্রস প্রতিনিধিদের হাতে হাতে দেয়া হয়। পাশাপাশি, চিন্তাশীল কোন চিঠি সচরাচর চিন্তাশীল প্রত্যুত্তরের প্রেরণা যোগায়। সেজন্য আমরা চিঠির একটি নমুনা পেশ করছি যেটি আপনারা চাইলে পাঠাতে পারেন।
পোস্টকার্ডের প্রস্তাবিত ধরণ:
১৯৬১ সালে প্রণীত বৈদেশিক সহায়তা আইনে গ্যালাহার সংশোধনীতে (এইচআর ৯১৬০) সমর্থন দিন। পাকিস্তান সামরিক শাসকগোষ্ঠীকে আর্থ–সামরিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করুন। পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণকার্যে সমর্থন দিন।
সিনেটে
আপনাদের সিনেটরদেরকে স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনীতে (এস ১৬৫৭) সমর্থন জানাতে অনুরোধ করে চিঠি দেয়াটাও একই সাথে দরকারি। বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির কয়েকজন সদস্যকে আরও চাপ দেয়া প্রয়োজন, যদিও তাঁরা আপনাদের অঙ্গরাজ্যের নাও হতে পারেন:
স্পার্কম্যান, আলাবামা | এইকেন, ভার্মন্ট |
ম্যানসফিল্ড, মনটানা | স্কট, পেনসিলভ্যানিয়া |
সাইমিংটন, মিসৌরি | পিয়ারসন, ক্যানসাস |
ম্যাকগি, ওয়াইওমিং | স্পং, ভার্জিনিয়া |
পোস্টকার্ডের প্রস্তাবিত ধরণ:
১৯৬১ সালে প্রণীত বৈদেশিক সহায়তা আইনে স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনীতে (এস ১৬৫৭) সমর্থন দিন। পাকিস্তান সামরিক শাসকগোষ্ঠীকে আর্থ-সামরিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করুন। পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণকার্যে সমর্থন দিন।
.
.
অনুবাদঃ মিশকাত
<৬, ৪৬, ৬৫৯-৬৬১>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নম্বর ৬১
তারিখঃ ৫ আগস্ট, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
আমাদের নিউজলেটারের এই সংখ্যা প্রকাশে বিলম্বের জন্য আমরা দুঃখিত। আমাদের দুজন সম্পাদকই শহরের বাইরে আছেন এবং আমাদের প্রধান সম্পাদক এখনো ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটাল হলে তদবিরের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি আমাদের পাঠকেরা আমাদের অপারগতাকে আমলে নিবেন।
এই নিউজলেটারটি আপনাদের হাতে পৌঁছানোর আগেই যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে গালাঘর সংশোধনী আলোচনা এবং তা পাশ হবার সমূহ সুযোগ আছে। মঙ্গলবার, ৩রা আগস্ট ১৯৭১ অধিবেশনের দৈনিক আলোচ্য তালিকায় অন্তত এটা থাকছেই। অধিকাংশ কংগ্রেসম্যানের সহায়তা পেয়ে আমাদের তদবিরকারীরা আরো বেশি উৎসাহ পাচ্ছেন। সংশোধনীটি হাউজে পাশ হবার ব্যাপারে আমরা বেশ আশাবাদী।
সেপ্টেম্বরের যেকোনো সময় যখন গরমের ছুটির পর পুনরায় অধিবেশন বসবে তখন স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনীও সিনেট আলোচ্যসূচিতে উঠে আসবে। সিনেটে দুদলেরই একটি শক্তিশালী অংশ এই সংশোধনীটির পক্ষে আছে। (বৈদেশিক সহায়তা নীতিমালা ১৯৬১ এর দুই সংশোধনী গালাঘর ও স্যাক্সবি-চার্চ , পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনা শাসকদের আমেরিকার আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেয়া বন্ধ রাখবে)। ইতিমধ্যেই ৩২ জন সিনেটর এই সংশোধনীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। কিন্তু আমাদের আমাদের আরো বেশি সমর্থন দরকার। অতএব দয়া করে আগস্ট মাস জুড়ে সিনেটরদের কাছে এই ব্যাপারে আরো চিঠি পাঠাতে থাকুন। যদি কোনো কারণে গরমের ছুটির আগে গালাঘর সংশোধনী পাশ নাও হয় তবুও কংগ্রেসম্যানদের কাছে চিঠি ও তারবার্তা চালিয়ে যেতে হবে।
আমরা একটি ন্যায্য দাবীর স্বপক্ষে লড়ছি। এতটা অন্যায় কারো সাথে হয়নি যতটা পাকিস্তান আমাদের সাথে করেছে। তাই তুলনামূলক ভাবে আমাদের দাবীর পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা সহজ হবে। শুধু বেশি বেশি মানুষকে আমাদের এই ব্যাপারে জানাতে হবে এবং আমরা সমর্থন পেতে থাকবো। চলুন এই আগস্টে আমরা একটু আটঘাঁট বেঁধে নামি। আমরা যদি আমেরিকান সরকারকে ভঙ্গুর পাকিস্তান সরকারকে সহায়তা করা থেকে বিরত রাখতে পারি তবে আমাদের অর্ধেক যুদ্ধজয় হয়ে যাবে। বাকিটা মুক্তিবাহিনী সেরে ফেলবে, জয় বাংলা!
দৃষ্টি আকর্ষণ
১। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রেকর্ড হতে যাচ্ছেঃ বিডিএল একটি রেকর্ডিং কোম্পানির সাথে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা”র রেকর্ড সম্বলিত ৪৫ আর পি এম ডিস্ক বানানোর ব্যবস্থা করেছে। ইতিমধ্যেই রেকর্ডিং এর পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের দুজন সুপরিচিত সঙ্গীতশিল্পী রেকর্ডিং এর জন্য জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছেন। রেকর্ডটি বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ অফিস থেকে সংগ্রহ করা যাবে। দয়া করে আমাদের অফিসে অর্ডার করুন।
২) “বাংলাদেশ কেন?” নামের একটি বই (৪৬ পৃষ্ঠা) এর হাজারখানেক কপি আমরা পুনর্মুদ্রণ করি যা মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জনসংযোগ বিভাগ দ্বারা প্রকাশিত হয়। আমরা তহবিল বাড়াতে এবং প্রচারের জন্য এই বই বিক্রি করতে চাই। আমরা আমাদের পাঠকদের সাহায্য চাই। আপনারা নিজের জন্য কত কপি চান এবং কতগুলো আপনারা বিক্রি করতে পারবেন অনুগ্রহ করে আমাদের জানান। আমরা বইটি প্রতি কপি ৫০ সেন্টে বিক্রি করতে আগ্রহী।
৩) আগস্টের কোন একসময় ভারতের শরণার্থী শিবিরে সিনেটর কেনেডি সফরে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। অনুগ্রহ করে সিনেটর কেনেডির কার্যকলাপের উপর প্রশংসাসূচক লিখা লিখুন এবং আপনার বন্ধুদেরও লিখতে বলুন।
৪) বাংলাদেশ ইমারজেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল ( বি ই ডাব্লু এ )এর জন্য প্রচারপত্রে বিন্যাস প্রেসে গিয়েছে। এটা তৈরী হওয়া মাত্র আমরা ভিন্ন ভিন্ন দলের কাছে পাঠাবো। প্রচারপত্র ব্যক্তিগতভাবে বিতরণ অথবা সম্ভাব্য দাতাদের পাঠানো হতে পারে।
আমরা আমাদের প্রত্যেক পাঠককে প্রচারপত্রের একটি কপি পাঠাবো পরবর্তী নিউজলেটারের সাথে। ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র প্রথম নিউজলেটার প্রচার করে যাতে সুপারিশমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। যদি আপনি আপনার কপি না পেয়ে থাকেন অনুগ্রহ করে বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র, ৪১৮ সেওয়ার্ড স্কয়ার, আপার্টমেন্ট ৪, ওয়াশিংটন, ডি. সি. ২০০০৩ (ফোন: ২০২-৫৪৭-৩১৯৪) বরাবর আপনার ঠিকানা পাঠিয়ে দিন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
নিচে একটি চিঠির খসড়া রয়েছে যা কংগ্রেস সদস্য এবং সিনেটরদের কাছে পাঠানো যেতে পারে।
যদি আপনার সিনেটর আর কংগ্রেস সদস্য এরই মধ্যে গালাঘর সংশোধনী বা স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী-এর জন্য সমর্থন ইঙ্গিত করে থাকেন তবে এটা তাদের জন্য সহায়ক হত যদি আপনি তাদেরকে তাদের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংক্ষেপে লিখতেন।
সিনেটর বা কংগ্রেস সদস্য যারা জাতীয় ভোটারগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত (যেমন পাউল ম্যাক্লোস্কি বা হ্যারল্ড হ্যাগস) নিঃসন্দেহে ঐসব ব্যাক্তির মতামত আমলে নিবেন যারা অন্যরাজ্য থেকে তাদের লিখছে, বিশেষ করে একটি ইস্যুর উপর যা নিজ শহরের ভোটারদের খুব একটা প্রভাবিত করেনা।
প্রিয় সিনেটরঃ
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আপনার উৎসাহের কথা জানতে পেরে আমরা পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য প্রশ্নে আমাদের উদ্বেগের কথা জ্ঞাপন করতে চাই। বিগত কয়েক মাসে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থায় ক্রমান্বয়ে অবনতি হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে বিশ্ব ব্যাংক মিশনের আগের মাসের একটি রিপোর্ট কোনো সন্দেহ ছাড়াই নিশ্চিত করে ব্যাপক ভয়, মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যকলাপও থমকে গেছে । বাঙালিরা মৃত্যুভয়ে ভীত থাকে প্রতিদিন; পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক জীবন প্রায় সম্পূর্নভাবে ভেঙে পড়েছে; আর খাদ্য পরিস্থিতি বেপরোয়া হয়ে উঠবার হুমকি দিচ্ছে।
যতদিন পর্যন্ত আমেরিকান সরকার পাকিস্তান সরকারকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাবে তার প্রভাবে বেসামরিক জনগণের উপর দমন পীড়নমূলক আচরণ ও বিরামহীন বর্বরতা চলতেই থাকবে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য অনুসারে আমেরিকান বিমান, সাঁজোয়া যান ও সাঁজোয়া সেনা বহনকারী যান পূর্বপাকিস্তানে ব্যবহৃত হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সংস্থার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২৫ মার্চের জটিলতার পর থেকেই আমেরিকা থেকে পাকিস্তানে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র চারটি পাকিস্তানী জাহাজে করে পাঠানো হয়েছে। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরূপ সাহায্য পাঠানোর নিষিদ্ধ করেছে। সহায়তা সংঘের ১১ জন সদস্যের মধ্যে দশজনই এই সুপারিশ মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র সহায়তার ব্যবস্থা চালু রেখেছে। প্রমাণাদি, প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য, পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধিদের নিরীক্ষণ এবং বিশ্বব্যাংক দলের রিপোর্টের পরও যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে সহায়তা চালু রাখাটা অমার্জনীয়।
সুতরাং, আমরা আপনাকে সিনেটর স্যাক্সবি-চার্চ (গ্যালাঘর কংগ্রেসের সদস্য) কর্তৃক প্রস্তাবিত বিবেচনাধীন আইনের খসড়ার পরিবর্তনে সম্মতি প্রদানের জন্য অনুরোধ করছি। এই সংশোধনীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যাতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয় যতদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা স্বীকৃত একটি উপযুক্ত ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত না হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে কংগ্রেসের একটি দৃঢ় সংকল্পিত কার্যক্রমই যুক্তরাষ্ট্রকে এই নাজুক পরিস্থিতিতে অন্তর্ভুক্তি থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবে। দেশের মানুষকে বিরামহীনভাবে একটি নিষ্ঠুর শাসনব্যবস্থায় জিম্মি রেখে দমন করে যুক্তরাষ্ট্রের দুরভিসন্ধি অথবা পাকিস্তানের অভিসন্ধি, কোনভাবেই চলমান থাকতে পারেনা। এটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বিনীত করে তুলছে। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে দেখতে পাওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের আশায় আঘাত করেছে এবং এসব কারণে প্রায় ৭০ লক্ষ শরণার্থীর এক বৃহৎ জনস্রোত পার্শ্ববর্তী দেশে প্রবাহিত হয়েছে। এই ঘটনাটি সমগ্র উপমহাদেশের সার্বিক শান্তি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিনীত
.
.
অনুবাদঃ আহসানউল্লাহ
<৬,৪৭,৬৬২>
শিরোনামঃ ইকনমিক কাউন্সিলর এর পদত্যাগ বি,ডি,এল, সভাপতির সফর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগোঃ নং ৬
তারিখঃ ৫ আগস্ট, ১৯৭১
.
পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর পদত্যাগ করেছেন।
ওয়াশিংটনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের একজন সিনিয়র অফিসার জনাব এএমএ মুহিত আনুষ্ঠানিকভাবে তার পদ থেকে সরে দাড়িয়েছেন এবং পাকিস্তান সরকারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। ২১ জুলাই পদত্যাগের কারণ হিসেবে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট কে দেওয়া এক চিঠিতে জনাব মুহিত ইয়াহিয়ার শাসন ব্যবস্থার সমগ্র অভিযোগ তুলে ধরেন। চিঠিতে জনাব মুহিত ইয়াহিয়া সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, তিনি ইয়াহিয়ার উপনিবেশিক শাসন, হিংস্রতা, মানবাধিকারহীনতাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন।
এটা স্মরণীয় যে জনাব মুহিতকে পাকিস্তান সরকারের প্রশংসনীয় কাজের জন্য “তমঘা” পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্রে তিনি পাকিস্তান জাতীয় সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব ছিলেন।
জনাব মুহিতের এই সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই।
.
দল প্রেসিডেন্ট সানফ্রানসিসকো এবং হাটসন সফর করেছেন।
ওয়েস্ট কোস্টের বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা করার জন্য ১৮ই জুলাই বি ডি এল এর সভাপতি সানফ্রানসিসকো গিয়েছিলেন।সেই সমারোহে সমদ্র অঞ্চলের এবং লস এঞ্জেলসের প্রতিনিধিদের সাথে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।সেই সভায় সমুদ্র অঞ্চলের একজন সদস্যের নাম করা হয় বিডি এলের পরিচালনা পরিষদের কাছে।আগামী সাধারণ সভায় লস এঞ্জেলস দলও পরিচালনা পরিষদে একজন সদস্যকে নির্বাচন করবে।বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা পরিষদের
দক্ষিণ পশ্চিম কোঠার প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করার জন্য বি ডি এল সভাপতি ২১ শে জুলাই টেক্সাসের হোস্টন পরিদর্শন করেন।সকল বিষয়াদির উপর বিবেচনা করে দলটি বিক্ষিপ্ত পরিশ্রমকে একত্রিত করার জন্য উত্তর আমেরিকার ৩ টি সংবাদ পরিক্রমাকে এক করা এবং সেগুলার একটি মাত্র কেন্দ্রীয় সংবাদ পরিক্রমা রাখার পরামর্শ দেন।
(আমরা ধারণাটিকে স্বাগত জানাই।আমরা অন্য দুটো দল যারা এই ব্যাপারে চিন্তিত তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করব।
সম্পাদক:বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা)
.
.
পার্থ সুমিত ভট্টাচার্য্য
<৬, ৪৮,৬৬৩-৬৬৫>
শিরোনামঃ বিভিন্ন বাংলাদেশ দলের খবর।
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং, ৬।
তারিখঃ ৫ আগস্ট, ১৯৭১।
.
বিভিন্ন বাংলাদেশ দলের খবর
মধ্য-পশ্চিম বাংলাদেশ সমিতি।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশিদের জন্য এক সপ্তাহের ভেতরে মধ্য-পশ্চিম বাংলাদেশ সমিতি একটি বৃহদায়তন তহবিলের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। আমাদের ব্লুমিংটন ( ইন্ডিয়ানা ) গোষ্ঠী আমাদের জানিয়েছে যে উদ্যোগটি নির্দিষ্টভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে নেয়া। এরই মধ্যে ব্লুমিংটনের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, বেশ কয়েকজন ডিন এবং বিভিন্ন বিভাগের প্রায় পাঁচজন চেয়ারম্যান তহবিল সংগ্রহের জন্য আবেদন প্রচার করেছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাদেশিক সিনেটররাও এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন।
.
বাংলাদেশে এসোসিয়েশন অব কানাডা।
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা টরোন্টো শাখার সভাপতি আমাদের নিম্নোলিখিত তথ্যগুলো পাঠিয়েছেনঃ
.
তথাকথিত ‘পাকিস্তান সহংতি কমিটি’ টরোন্টোয় ওন্টারিও কলেজ অব এডুকেশন মিলনায়তনে পিডিপি’র দেশদ্রোহী মাহমুদ আলির সভাপতিত্বে ১৮ জুলাই, ১৯৭১-এ একটি বৈঠক আহ্বান করেছে।
ইয়াহিয়া খানের রটনা কৌশল ঠেকানোর জন্য, বিএসি-কানাডা ( টিরোন্টো) মিলনায়তনের সামনে একটি শান্তিপূর্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেছে। যেহেতু শুধুমাত্র পাকিস্তানিরাই আমন্ত্রিত সেই বৈঠকে, সেহেতু আমরা সম্মিলিত ভাবে বৈঠক বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
.
বেপরোয়া পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই আইনসঙ্গত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাঁধা দিয়েছে এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে সরিয়ে দিয়েছে কোনো উস্কানি ছাড়াই। চাপের মুখে আমরা প্রতিশোধ পরায়ণ হতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং তারাও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। যদিও, সেই মুহুর্তে পুলিশ চলে আসে এবং তাদের মিলনায়তনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
.
আমরা একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি করতে চেয়েছিলাম এবং পুলিশকেও কর্মসূচির পুর্বেই তা জানিয়েছিলাম। পক্ষান্তরে ‘সংহতি কমিটি’ তাঁর দুর্বৃত্তমূলক কৌশলে সন্ত্রাস দিয়ে আমাদের দমাতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই প্রয়াস সফল হয় নি, এবং প্রতিবাদ নির্ধারিত সূচি অনুসারে চলেছিল।
.
বৈঠকটা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এটা শুধু একটা হাস্যরসের প্রমাণ দেয় আর কিছুই না।
.
বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সাস্কাচুয়ান
বিএসি- সাস্কাতুন শাখার সভাপতি অন্যান্য প্রসঙ্গের সাথে বলেছেনঃ
“এখানে সাস্কাতুনে আমরা সাধ্যানুযায়ী সব করছি। কানাডার সরকারি নেতাদের কাছে টেলিগ্রাম, চিঠি পাঠানোর কাজটাই মূলত আমরা করছি। যদ্দুর জানি, এর ফলাফলে কানাডা সরকার বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। খুব সাম্প্রতিক একটা খবর হল, পদ্মার জন্য নির্ধারিত সব অস্ত্র সরবরাহ অনুমতির বাতিল”।
.
স্যান ফ্রান্সিসকো
স্যান ফ্রান্সিসকো গোষ্ঠী ২৪শে জুলাই স্ট্যানফোর্ড ফ্রস্ট মুক্তাঙ্গনে স্ট্যানফোর্ড ইন্ডিয়া সংঘের সহযোগিতায় জোয়ান বায়েজের একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত সফল হয়েছে। ১২০০০ এরও বেশি মানুষ জমায়েত হয়েছিল সেই সঙ্গীতানুষ্ঠানে, সেই সাথে অসংখ্য মানুষ বাইরে অপেক্ষারত ছিল। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝিতে মিস বায়েজ ঘোষণা করেন যে অনুষ্ঠানের আয়ের সিংহভাগ পূর্ব বাংলার শরনার্থীদের জন্য দেয়া হবে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ গোষ্ঠী একটি আবেদনের স্বপক্ষে প্রায় ২৫০০ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে যা পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়ার সমস্ত সিনেটরদের এবং কংগ্রেসম্যানদের পাঠানো হয়েছে। গোষ্ঠীটি কংগ্রেসম্যানদের উদ্দেশ্যে গ্যালাগার সংশোধনের পক্ষে একটি বড় আকারের পত্র-লিখন প্রচারণা শুরু করেছে। এছাড়াও তারা সাহায্য এবং সমর্থন পাওয়ার জন্য স্যান ফ্রান্সিসকোর অনেক গীর্জা প্রধানদের সাথে বৈঠক করেছে।
.
লস এঞ্জেলেস
লংশোরম্যান’স সমিতির সাথে লস এঞ্জেলেস গোষ্ঠী যোগাযোগ করেছে বলে আমাদের জানায় এবং তারা তাদের কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা পেয়েছে যে তারা কোনো সামরিক পণ্য পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে জাহাজ বোঝাই করবে না।
.
শ্যাম্পেইন-আরবানা
গোষ্ঠীটি বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সিনেমা নিয়ে একটি নিয়মিত সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করেছে। তারা এই ২৩ জুলাইতেই সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ প্রদর্শন করে ফেলেছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনীটি জলখাবারের সাথে চালানো হয়েছে যেখানে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাঙালি খাবারগুলো বিক্রি করা হয়েছে। প্রায় ২৫০ ডলার সংগ্রহিত হয়েছিল। পরবর্তী ছবি হবে ‘ডে শ্যাল ডাউন’ যা পূর্ব বাংলায় প্রযোজিত মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া প্রথম বাংলা ছবি।
.
ম্যাডিসন
বাংলাদেশের লিবারেশন কমিটি উইস্কন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাডিসন ক্যাম্পাসে ছাত্র সঙ্ঘে একটি স্থায়ী টেবিল স্থাপন করেছে ম্যাডিসনে বাংলা সাহিত বিতরণের জন্য। এই মার্কিনিদের নিয়ে গঠিত টেবিলটি শেষ এক মাসে বাংলাদেশ লিবারেশন কমটির দেয়া সাহিত্য বিতরণ করেছে এবং বাটনগুলো বিক্রি করেছে। তারা ম্যাডিসনের বহুলপ্রচারিত সংবাদপত্র ক্যাপিটাল টাইমসে একটি প্রবন্ধ ছাপিয়েছে যাকে ঐ সংবাদপত্রে বিশেষ স্থান দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা ১৫০০ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে এই মর্মে যে পাকিস্তানে সকল সামরিক এবং আর্থনীতিক সাহায্য বন্ধ করে রাখা হবে যতক্ষণ না তারা সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ থেকে না সরাচ্ছে। এই আবেদন উইসকনসিনের সকল কংগ্রেসম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে।
.
ফিলাডেলফিয়া
পূর্ব বাংলার বন্ধুরা যেকোনো পাকিস্তানি নৌযানের ব্যাপারে সহিংস থাকছে। যখনি কোনো পাকিস্তানি নৌযান সমরাস্ত্র বা গোলাবারুদ বোঝাইয়ের উদ্দেশ্যে বাল্টিমোর পোতাশ্রয়ে দেখা যাচ্ছে তখনি এই গোষ্ঠীটি ভাংচুর এবং প্রতিহত করছে। তারা এরই মাঝে লংশোরম্যান’স এর কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা পেয়েও গেছে যে তাদের কোনো কর্মী এই সমরাস্ত্র বা গোলাবারুদ বোঝাইয়ে জড়িত হবে না। এই গোষ্ঠীটি তাদের কাজের উদ্দেশ্য এবং কারণ জানানোর জন্য আশেপাশের এলাকায় ইতিমধ্যে হাজারেরও বেশি লিফলেট বিলি করেছে।
******
একজন পাঠকের চিঠি।
নিচের চিঠিটি আমাদের একজন পাঠকের কাছ থেকে পাওয়া। যদিও আমাদের মতো পত্রিকা গুলোর কারও নিজস্ব লেখা ছাপানোর সুযোগ খুব কম থাকে, তবুও আমরা ভেবে দেখেছি এটা ছাপানো গুরুত্বপূর্ণঃ
জনাব,
আমি নিশ্চিত যে আমরা অনেকেই এরই মাঝে পাকিস্তান ফোরামের জুন-জুলাইয়ের ঘটনাক্রম সম্পর্কে পড়েছি। এই পুর্বাপর ঘটনাগুলো, বিশেষত এপ্রিল-মে ঘটনাক্রমগুলো, থেকে একজন দেখতে পারে যে পাকিস্তান ফোরাম এবং এর ব্যবস্থাপনা মুলত বাঙালি এবং বাংলাদেশিদের সাহায্য করছে তাদের স্বাধীনতার জন্য। তাই, আমি মনে করি সব বাংলাদেশী বাঙ্গালিদের শুধুমাত্র এটা পড়া নয়, এর সাথে সাথে পাকিস্তান ফোরামের ব্যবস্থাপনাকে সাহায্য করা উচিৎ যাতে অবাঙ্গালি পাকিস্তানিরা এটা পড়তে পারে।
সুতরাং, আমি অনুরোধ করছি সমস্ত স্থানীয় গোষ্ঠীদের এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হোক যে তারা তাদের সমস্ত সদস্যদের আবেদন করুক এবং ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ এর সকল পাঠকদেরও আবেদন করুক যেন তারা এক বছরের চাঁদা হিসেবে পাকিস্তান ফোরামকে ১০.০০ মার্কিন ডলার করে পাঠায়। যদিও চাঁদা হার ৭.০০ মার্কিন ডলার তথাপি এই অতিরিক্ত $ ৩ ফোরামকে অবাঙ্গালি পাকিস্তানিদের, যারা বাংলাদেশে বিশ্বাসী নয়, এক কপি পত্রিকা পাঠাতে সাহায্য করবে। ফোরামটির এই বাংলাদেশকে সমর্থনের কারণে প্রচুর অনুরাগী রয়েছে।
পাকিস্তান ফোরামের ঠিকানাঃ মিঃ ফয়েজ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক, অয়াকিস্তান ফোরাম, ১৯০০ দক্ষিণ চার্লস স্ট্রিট, ২২-ডি, গ্রীনভিলা, এন,সি, ২৭৮৩৪।
.
.
অনুবাদঃ এ. এস. এম. হাসান লতিফ
<৬,৪৯,৬৬৬-৬৬৭>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকের মন্তব্য ও পরামর্শ |
বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগো: নং. ৭ |
২০ আগস্ট, ১৯৭১ |
সম্পাদকের মন্তব্য
আমাদের বিগত নিউজলেটারটি প্রকাশিত হবার পর বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সংঘটিত হয়েছে।
.
১। পাকিস্তানে সকল প্রকার সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগীতা স্থগিত করার জন্য মন্ত্রীসভা গালাঘর সংশোধন অনুমোদন করেছে। এটি প্রধানত সম্ভব হয়েছে এদেশে সমগ্র বাংলাদেশী গ্রুপের প্রচেষ্টায় ও আমাদের অনেক আমেরিকান বন্ধুদের কারণে। বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র ক্যাপিটল হিলে তদবিরে যাবতীয় কাজ সমন্বয় করেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট সকল সহায়তাকারীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি তাদের নিরলস প্রচেষ্টার জন্য যা ব্যতীত মন্ত্রীসভায় এরকম ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যেত না।
.
আমাদের পরবর্তী বাধা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট। ইতোমধ্যেই সেখানে ৩২ জন সিনেটর রয়েছেন যারা সিনেটে স্যাক্সবো-চার্চ সংশোধণে পৃষ্ঠপোশকতা করেছেন। সেখানে অল্প কয়েকজন সিনেটর রয়েছেন যারা পৃষ্ঠপোশকতা করেননি এবং পাকিস্তানে সকল সহায়তা প্রদান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। সেপ্টম্বরের শেষে অথবা অক্টোবরের শুরুতে কোন এক সময়ে সিনেটে সংশোধনের জন্য বিবেচণা করা হলে খুব বড় ধরণের কোন সমস্যা আমরা দেখছি না। যাহোক, সিনেট এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম স্থগিত করতে পারি না। এজন্য সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সিনেটে তদবীর করতে বিপূল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর প্রয়োজন পড়বে। আমরা আপনাদের সাবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি, এখন থেকেই ঐ সময় ওয়াশিংটন ডি.সি.তে অবস্থানের লক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য। অক্টোবরে সাধারণ পরিষদের সভার সময় জাতি সংঘে তদবীরের প্রয়োজন হতে পারে।
.
২। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে যা হলো ওয়াশিংটন ডি.সি. -এর পাকিস্তান দূতাবাস ও জাতি সংঘের পাকিস্তান মিশনে কর্মরত সকল বাঙ্গালী কূটনৈতিক ও কর্মকর্তারা গত ০৪ আগস্ট, ১৯৭১ তারিখে পক্ষত্যাগ করেছেন। আমরা তাঁদের সকলকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি যাঁরা পক্ষ ত্যাগ করেছেন ও গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। আমরা আশা করি এর ফলে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত আন্দোলনের সূচনা হবে যার ফলে পাকিস্তান সরকারে এখনও কর্মরত সকল বাঙ্গালী কর্মকর্তা পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করবে।
.
৩। একই সময়ে জনাব মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকির রাষ্ট্রদূত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে আগমনও পক্ষত্যাগের গুরুত্বকে বৃদ্ধি করেছে। জনাব এম. আর. সিদ্দিকি, যিনি চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় এসেম্বলীর একজন সদস্য, বিগত ০৬ আগস্ট, ১৯৭১ এ ওয়াশিংটন ডি.সি. তে এসে পৌছেছেন। তিনি বর্তমানে এদেশে অবস্থানরত বাঙ্গালীদের সাথে পরিচিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যেই নিউ ইয়র্কে একটি সংবাদ সম্মেলণ করেছেন ও বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। আগামী এক/দুই সপ্তাহের মধ্যই তাঁর মাধ্যমে ওয়াশিংটন ডি.সি.তে একটি বাংলাদেশ মিশন উন্মুক্ত হবে। আমরা জনাব সিদ্দিকি’কে স্বাগত জানাচ্ছি এবং আমাদের হৃদয় নিংড়ানো সহযোগীতার হাত প্রসারণসহ শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
—————————————————————-
বাংলাদেশ গ্রুপের কার্যক্রম গ্রহণের জন্য পরামর্শ
.
ক) বাংলাদেশ মিশন, কোলকাতা হতে প্রাপ্ত টেলিগ্রামের পরামর্শক্রমে আমারদের উচিৎ হবে শেখ মুজিবের বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ও তাঁর অবিলম্বে মুক্তির দাবীতে যুক্তরাষ্টসহ কানাডার বিভিন্ন স্থানে র্যালির আয়োজন করা। এবং আপনাদের বন্ধুদের এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, জনাব উ. থান্ট, এ্যামেনেস্টী ইন্টারন্যাশনাল (ঠিকানা: তুরানগাইন লেইন, ফারিংডন স্ট্রীট, লন্ডন ইসি৬, ইংল্যান্ড) বরাবর লিখতে বলুন। টেলিগ্রামের জন্য প্রস্তাবিত ফরমেটঃ
“Pakistan military court holding secret
trial for Bengali leader Sheikh Mujibur Rahman on fictitious charges. We urge you to use your good offices to prevent President Yahya from doing so”.
.
[পাকিস্তানী সামরিক আদালাত কাল্পনিক অভিযোগে গোপনে বাঙ্গালী নেতা শেখ মুজিবের বিচার করছে। আমরা আপনার মহান দপ্তরের মাধ্যমে প্রেসিন্ডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ কাজ হতে নিবৃত করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।]
.
খ) দখলকৃত বাংলাদেশে জাতি সংঘ পর্যবেক্ষণ দলের পর্যবেক্ষণের শর্ত পাকিস্তান কর্তৃক মেনে নেয়ার নেপথ্যের হীন পরিকল্পণা তুলে ধরুণ। এই নিউজলেটারে অপর কোনও পাতায় প্রকাশিত জনাব সিদ্দিকি’র বক্তব্য হতে যুক্তি তুলে ধরুণ।
.
গ) অন্যান্য যে কোন স্থানের চেয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের কথা শুনতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সদস্যগণ বেশী বাধ্য। আপনাদের এলাকার স্থানীয় পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয়তে কিংবা মন্তব্যে এর অনুকূলে কিছু প্রকাশিত হলে অনুগ্রহ করে সেগুলোর কপি আপনাদের সিনেটরদের নিকট প্রেরণ করুন।
.
ঘ) সম্প্রতি স্যাক্সবো-চার্চ সংশোধণীর অনুরূপ একটি রেজ্যুলুশন কার্যকরের নিমিত্তে ম্যাসাচুসেটস্ অঙ্গরাজ্যে অনুমোদিত হয়েছে। অনুরূপ রেজ্যুলুসন অনুমোদনের জন্য আপনাদের নিজ নিজ অঙ্গরাজ্যের আইন প্রণেতাদের ও সহ-পৃষ্ঠপোশকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করুন। এ ধরণের সকল রেজ্যুলুশন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিকট প্রেরণ করা হবে এবং তা হয়ত তাঁর ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলবে.
.
.
অনুবাদঃ শিহাব শারার মুকিত
<৬, ৫০, ৬৬৮-৬৬৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ দূতের ভাষণ, বি ডি এল সভাপতির সফর |
বাংলাদেশ নিউজলেটার, শিকাগোঃ ০৭ |
২০ আগস্ট, ১৯৭১ |
ডেট্রয়েটের সভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের ভাষণ প্রদান
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই জনাব এম আর সিদ্দিকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রবাসী বাঙ্গালিদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। তিনি ইতোমধ্যেই ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক, কানেক্টিকাট, বোস্টন ও ডেট্রয়েটের বাঙ্গালি সম্প্রদায়ের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
১৫ আগস্ট ডেট্রয়েটের সভার আয়োজন করেছিল মিশিগানের বাংলাদেশ সমর্থক গোষ্ঠী (বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মৈত্রী)। বিডিএল এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং মধ্যাঞ্চল থেকে কিছুসংখ্যক সদস্য এই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
তাঁর ভাষণের শুরুতেই তিনি আমেরিকায় বসবাসরত সকল বাঙ্গালিদের অভিনন্দন জানান মার্কিন জনগণের সাহায্য ও সহমর্মিতা অর্জনের জন্য কাজের জন্য। তিনি আরও বলেন “আপনারা যা অর্জন করেছেন তা আমাদের অনেক সামনে এগিয়ে নিয়েছে।”
বিডিএল সভাপতির ওয়াশিংটন, ফিলাডেলফিয়া ও নিউইয়র্ক সফর
বিডিএল সভাপতি ১০ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে এম আর সিদ্দিকি এবং অন্যান্য বাঙ্গালি কূটনীতিক যারা পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করে এসেছেন তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্গালি সম্প্রদায় এবং নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ মিশনের সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়ে আলোচনা করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র পরিদর্শন করেন বিডিএল এবং তথ্য কেন্দ্রের মাঝে চলমান সমঝোতা সম্পর্কে আলোচনা লরার উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যায় বিডিএল সভাপতি ফিলাডেলফিয়া সফর করেন এবং পূর্ব বাংলার বন্ধু সদস্য ও বৃহত্তর ডেলাওয়ার উপত্যকার বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই দুটি সংগঠন ও বিডিএল এর মধ্যে সরাসরি পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়। এই তিন সংগঠনের মধ্যে সকল ধরণের যোগাযোগ রক্ষার বিষয়ে ঐক্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। একজনকে বিডিএল এর পরিচালনা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
১১ আগস্ট বিডিএল সভাপতি নিউইয়র্ক সফর করেন এবং আমেরিকার বাংলাদেশ লীগের একটি সভায় অংশগ্রহণ করেন যেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন এবং ভাষণ প্রদান করেন।
২৬শে জুলাই সেইন্ট জন স্টোরহাউজের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমবারের মত বাংলাদেশের কোন নীতিনির্ধারককে লন্ডনের হাউজ অফ কমন্সে সম্মান প্রদর্শন করা হয় যখন বৃটিশ সরকারের ডাক যোগাযোগ মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্রে ২৩,০০০ ডলারের অধিক মূল্যমানের ডাকটিকিট উদ্বোধনের দিনেই ইংল্যান্ড জুড়ে বিক্রি হয়ে যায়।
ডাকটিকিটগুলোর ডিজাইন করেন বাঙ্গালি শিল্পী বিমান মল্লিক যিনি ১৯৬৯ সালে ব্রিটেনের গান্ধী টিকিটের ডিজাইন করেছিলেন। সেগুলো ফরম্যাট সিকিউরিটি প্রিন্টার্স লিমিটেড কর্তৃক ইংল্যান্ডে ছাপা হয়েছিল।
বাংলাদেশের ডাকমাসুল টিকিটগুলো নিজস্ব ও বাইরের চিঠি আদান প্রদানে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে মুক্ত অঞ্চল গুলোতে ডাকঘর চালু আছে। বাংলাদেশের টিকিটযুক্ত চিঠি ভারত সরকার গ্রহণ করে এবং পরবর্তিতে চালান করে দেয়। (১৮৮১ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত ঠিক একইভাবে নেপালের টিকিটযুক্ত বার্তা ভারত সরকার গ্রহণ করে চালান করে দিত।)
.
.
অনুবাদঃ জয়ন্ত সেন আবীর
<৬, ৫১, ৬৭০-৬৭৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বিভিন্ন বাংলাদেশ গ্রুপ বিষয়ক সংবাদ | বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগো নং: ৭ |
২০ আগস্ট, ১৯৭১ |
.
বিভিন্ন বাংলাদেশ গ্রুপ বিষয়ক সংবাদ
মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন
.
চলার পথেঃ
ড. ইসলাম এখন বাংলাদেশে। আসবার পথে তিনি বিচারপতি চৌধুরী, স্টিয়ারিং কমিটি এবং লন্ডনের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ও দলসমূহের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আশা করা যায় তিনি সেপ্টেম্বরের মাঝ অবধি বাংলাদেশে থাকবেন। ড. ব্যানার্জি বিদেশী সাহায্য আইনের গালাঘার সংশোধনীর পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ক্যাপিটাল হিলে প্রচারণা চালান। তিনি কজন গুরুত্বপূর্ণ সিনেটর এবং কংগ্রেস সদস্যের সাথে দেখা করেন।
ড. ভট্টাচার্য এবং ড. ও মিসেস ফারুক সংশোধনীটির উপর ভোটাভুটি আরম্ভ হবার পূর্বে এরূপ আরেকটি প্রচারাভিযান চালান এবং ৪৫ জন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যের সাথে কথা বলেন।
এঁরা ‘শেখ মুজিবের জীবন রক্ষাকল্পে’ সিনেটে একটি প্রচারকার্যও শুরু করেন।
ড. ভট্টাচার্য ফিলাডেলফিয়া এবং কলাম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল’ এর সভাতেও অংশগ্রহণ করেন।
ড. ব্যানার্জি মন্ট্রিলে এক সফর শেষ করে ফিরে এসেছেন। সেখানে তিনি আমেরিকান কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ওখানকার বাংলাদেশ গ্রুপের সাথে আলোচনা করেন। তিনি শীঘ্রই লন্ডন এবং প্যারিসের পথে রওনা হবেন।
মেইল ব্যাগঃ
দেশব্যাপী একটি টেলিফোন প্রচারাভিযান চলে। এতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলকে নিজ নিজ কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি চিঠি লিখতে উদ্বুদ্ধ করা হয় যার লক্ষ্য ছিল গালাঘার সংশোধনীর পক্ষে সেসকল কংগ্রেস সদস্যের সমর্থন আদায়। অহাইও এর ২৪ জন কংগ্রেস সদস্যের কাছে ২০০ এরও বেশি টেলিগ্রাম আসে। শেখ মুজিবের জীবন রক্ষায় দেশব্যাপী একটি টেলিগ্রাম প্রচারাভিযানেরও আয়োজন করা হয়।
অনুগ্রহ করে রাষ্ট্রপতি নিক্সন বরাবর যত বেশি সম্ভব টেলিগ্রাম পাঠান।
বিভিন্ন ব্যাক্তি ও দলের পক্ষ থেকে সিনেটর, কংগ্রেস সদস্য এবং জাতিসংঘের প্রতি অসংখ্য চিঠি ও আবেদন পাঠানো হয়েছে।
তহবিলঃ
ব্যক্তি পর্যায়ে সদস্যরা বিভিন্ন কর্মসূচির জন্য খোলা মনে অবদান রেখেছেন। ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানায় একটি বৃহদাকার তহবিল সংগ্রহ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ সংগ্রহের জন্য শরতের শুরুতে একটি কনসার্টের পরিকল্পনা গৃহিত হয়েছে। আপনি যদি নিজ শহরে এরূপ কোনো কনসার্টের আয়োজনে আগ্রহী থাকেন তবে অনুগ্রহপূর্বক আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। অক্সফামের পক্ষ থেকেও তহবিল সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে। আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।
পূর্ব ল্যানসিংঃ
বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ, মিশিগানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তারা সিম্পোজিয়াম, পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের লক্ষ্যে আমেরিকান সিটিজেনদের স্বাক্ষর সংগ্রহ এবং তাদের মাধ্যমে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের কাছে চিঠি ও টেলিগ্রাম পাঠানোর মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এছাড়াও ছিল বাংলাদেশের উপর একটি ৪০ মিনিটের টেলিভিশন প্রোগ্রাম, দাতব্য ডিনার, ক্যাম্পাসে অনুদান কেন্দ্র এবং স্বাক্ষর সংগ্রহ। শপিং সেন্টারেও অনুদান কেন্দ্র খোলা হয়।
ডক্টর নিকোলাস, মিসেস মার্থা নিকোলাস এবং ডক্টর আলাভির লেখা প্রবন্ধ সংবাদপত্রে ছাপা হয়। রেডিও প্রোগ্রাম এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে অনুদান প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। আমেরিকান সাহায্যের প্রতিবাদে ফ্যাকাল্টির চিঠি (২,০০০), বাংলাদেশ, কংগ্রেসে কাগজপত্র বিলি, রাজ্য রাজধানীর সিঁড়িতে প্রতিবাদ সভা হয়। চার্চ, সার্ভিস ক্লাব (যেমন রোটারী প্রভৃতি), শান্তি পরিষদ, ছাত্রদের আবাসস্থল প্রভৃতি জায়গায় বাংলাদেশ বোতাম এবং স্টিকারের বাম্পার বিক্রি হয়।
ডেট্রয়েটঃ
আজিজুল এইচ. খন্দকারের প্রতিবেদন অনুযায়ীঃ
৩০ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ডেট্রয়েট নদী তীরের আদিবাসী উৎসব স্থলে আয়োজিত ভারতীয় মেলায় একটি বাংলাদেশী বুথ দাঁড়া করানো হয়। কমিটি অফ দ্যা কনসার্নড(অ্যান আকবর), বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ (মিশিগান) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোশিয়েশন অফ আমেরিকা (ডেট্রয়েট) থেকে আসা ৫০ জন ভলান্টিয়ার মানুষের কাছে বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির বর্ণনা দেয়, অনুদান গ্রহণ এবং গালাঘার সংশোধনীর স্বপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে। ১৩,০০০ এর উপর স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়। ভারতীয় মেলাটি থেকে প্রাপ্ত সমস্ত আয় শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে পাঠানো হয়। মেলার বাংলাদেশী বুথটিতে মাঝেমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানী দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করে শান্তিভঙ্গের চেষ্টা চালায়, তবে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
৭ জুলাই ইউনিভার্সিটি অফ উইন্ডসর, অন্টারিওতে বাংলাদেশের পক্ষে এক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। এর আগ্রহী শ্রোতা সংখ্যা আয়োজকদের আশাকেও ছাড়িয়ে যায়। সংবাদপত্রের কর্মীরাও এতে উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল সিকেএলডব্লিউ-টিভি সিম্পোজিয়ামের রাত্রে কর্মসূচিটির উপর একটি পর্যালোচনা প্রদর্শন করে। পরের দিন উইন্ডসর স্টার উইকএন্ড ম্যাগাজিন তার বিশেষ প্রতিনিধি আরনেস্ট হিলকে পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের সম্পর্কে সরাসরি খবর সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। তিনি ৩১ জুলাই এর উইকএন্ড ম্যাগাজিনে ৯ পৃষ্ঠার এক প্রবন্ধের মাধ্যমে তার প্রতিবেদন তার তুলে ধরেন।
অহাইওঃ ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল
অহাইও থেকে বি. চন্দ্রশেখরের প্রতিবেদনঃ
আমরা একথা জানাতে গর্ব বোধ করছি যে কলম্বাসে ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে।
২৯ জুলাই জনা পনের আগ্রহী ব্যক্তি, প্রধানত অহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র এবং শিক্ষক, একত্রিত হয় বাংলাদেশে চলমান শোকাবহ ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে তা স্থির করতে। এই প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আরেকটি বৃহদাকার সভার আয়োজন করি। ৫ আগস্ট হওয়া এই সভাতে সমাজের আরো অনেক স্তর থেকে প্রায় ৬০ জন মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং এই সভাটিই আমাদের সংগঠনটির জন্ম দেয়। অক্সফোর্ড, অহাইও এর ডক্টর জে. কে. ভট্টাচার্য কে আমরা আমাদের সভার প্রধান বক্তা হিসেবে পেয়ে নিজের ভাগ্যবান মনে করি। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে খুবই সক্রিয়ভাবে তাঁর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন এবং অনুরূপ আরো অনেক সংগঠনের সাথেও যুক্ত আছেন। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই কোনো না কোনো কমিটিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে। সেদিক থেকে দেখলে সভাটি বেশ ভালোভাবেই সফল হয়েছে।
আমরা ইতোমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান বন্ধের জন্য প্রসিডেন্ট এবং কংগ্রেস সদস্যদের আহবান জানিয়ে একটি স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করেছি। স্থানীয় একেশ্বরবাদী এবং ক্যাথলিক চার্চদের প্রতি আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় কংগ্রেস সদস্যদের কাছে গালাঘার সংশোধনীর পক্ষে সমর্থন প্রদানের আহবান সম্বলিত শতাধিক টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছে। কলম্বাসের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রদর্শন ও তথ্য কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গৃহিত হয়েছে। শরণার্থীদের সাহায্যকার্যে ব্যবহারকল্পে রেডিও সংগ্রহের জন্য শুরুতে স্থানীয় চার্চ গ্রুপগুলো হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। একই উদ্দেশ্যে রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্য পাবলিক সার্ভিস স্পট তৈরীও পরিকল্পনাধীন আছে।
এই মুহূর্তে ৩টি প্রধান কমিটি ক্রিয়াশীল আছে। ১- ত্রাণকার্য, ২- প্রচার এবং তথ্য, ৩- অনুদানমূলক অনুষ্ঠান, বৃহদাকার সভা ইত্যাদি।
এদের ঠিকানা হলঃ
ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল
পি.ও. বক্স-৩০৩৫
কলাম্বাস, অহাইও ৪৩২১০
অ্যারিজোনাঃ ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গলঃ
অ্যারিজোনা থেকে জন মারকৌলিস লিখেছেনঃ
আয়রিজোনার টেম্পে তে আমরা ‘ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল’ এর একটি শাখাদল গঠন করেছি। এখনো পর্যন্ত আমরা একটি প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করেছি। এছাড়াও আমরা ফিনিক্সের ফেডারেল ভবনের সামনে রাত্রিযাপন করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল এলাকার মানুষজনদের এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা কারণ স্থানীয় পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। আমরা খুব একটা ভাল টিভি কভারেজ পেতে ব্যর্থ হই। সংগঠন হিসেবে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকান সাহায্য বন্ধের দাবী জানাই এবং এশিয়াতে অবস্থানরত আমেরিকান সেনাদের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার অভাবী মানুষদের কাছে খাদ্য এবং ওষুধ-পত্র পাঠানোর আহবান করি। এখনো পর্যন্ত আমরা ১০০ আমেরিকান ডলার সংগ্রহ করেছি যা ইউনিসেফের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
টেম্পে এবং ফিনিক্সের শান্তি কেন্দ্রসমূহ, শান্তি ও ন্যায়ের ক্যাথলিক কেন্দ্র, ডব্লিউআইএলপিএফ এবং ইউনিসেফ মিলে আমাদের এই দলটি গঠিত। সেপ্টেম্বরে আমরা পূর্ব বাংলার অবস্থার উপর একটি প্যানেল আলোচনার আয়োজন করতে যচ্ছি। দলের ঠিকানাঃ
ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল
১৪১৪, এস. ম্যাকঅ্যালিস্টার
টেম্পে, অ্যারিজোনা
মিলওয়াউকি, আগস্ট ১২, ১৯৭১
মিলওয়াউকি শান্তি কার্যক্রম কমিটি থেকে রন ডিনিকোলা লিখেছেনঃ মঙ্গলবার রাতের সভাটিকে তুলনামূলকভাবে সফল বলা চলে। এতে ২০ জনের উপস্থিতি ছিল যার মাঝে ছিল ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ক্লাবের কয়েকজন মারকুয়েট ভারতীয় ছাত্র।
আমরা এই ২০ জনের দলটিকে দুভাগে বিভক্ত করি। একটি কাজ করবে ত্রাণসাহায্যের ক্ষেত্রে, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত বড় দলটি রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং সচেতনতার ভার। আগামী মঙ্গলবার রাত ৮টায় আমাদের দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হবে যার মূল বিষয় হবে একটি অভ্যন্তরীণ কর্মশালা। এই সভাটি হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মাধ্যমে আমরা আমাদের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্বোচ্চরূপে সচেতন করে নিতে পারব। আমি আশা করছি আপনি বা বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ(বিডিএল) এর একজন প্রতিনিধি এতে উপস্থিত থাকতে পারবেন।
বুধবারে আমরা একটি প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করে জানিয়ে দিই যে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ক ত্রাণসাহায্য ও সচেতনতা গড়ে তোলার পদক্ষেপসমূহ মিলওয়াউকি এর শান্তি কার্যক্রম কমিটিতে কেন্দ্রীভূত করা হবে। আমরা স্থানীয় জনগণের সহায়তাও কামনা করি। শুধুমাত্র একটি টিভি স্টেশন, চ্যানেল ৬ এ আমাদের এই প্রেস কনফারেন্স ভাল কভারেজ পায়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কানাডা
টরেন্টো
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে ৫ আগস্ট ১৯৭১ এর সন্ধ্যা ৭:৩০ থেকে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ‘সঙ্কটপূর্ণ বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বক্তাদের মধ্যে ছিলেনঃ
১) মি. অ্যান্ড্রু ব্রিউইন, কানাডিয়ান সংসদ সদস্য
২) মি. ফ্রেডেরিক নোসাল, সহযোগী সম্পাদক, টরেন্টো টেলিগ্রাম
৩) মি. পল ইগনাটিফ, পরিচালক, ইউনিসেফ টরেন্টো
৪) মি. লেসলি স্মিথ, খাদ্য ও ওষুধ পরিচালকের দপ্তর, জাতীয় স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা বিভাগ
মি ব্রিউইন ছিলেন ৩ সদস্য বিশিষ্ট কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদলের একজন যারা ভারত ও পাকিস্তানের সরকারের আমন্ত্রণে সাম্প্রতিকসময়ে ভারত ও বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে এসেছেন। তিনি তার পূর্বতন অভিমতই পূনর্ব্যক্ত করেন এই বলে যে পূর্ব বাংলায় যেকোনো রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে অবশ্যই গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রাপ্ত জনমতের প্রতিফলন থাকতে হবে।
মি ইগনাটিফ ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের বিষয়টিকে ‘সঙ্কটের মধ্যে সঙ্কট’ হিসেবে অভিহিত করে বৃহদাকার ত্রাণকার্য পরিচালনার উপরে জোর দেন।
মি স্মিথ শরণার্হীদের দুরবস্থার প্রত্যক্ষ ববরণ দেন। তার তৈরী একটি ডকুমেন্টারিও এসময় দেখানো হয়।
ক্যালিফোর্নিয়াঃ জোয়ান বিয়াজের সাহায্য সংগ্রহাক কনসার্ট
বিখ্যাত লোকসঙ্গীত গায়িকা জোয়ান বিয়াজ ২৪ জুলাই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের ৭০ লাখ শরণার্থীদের সাহায্যকল্পে এক কনসার্টের আয়োজন করেন। সান ফ্রান্সিস্কোর উপকূলীয় এলাকা থেকে ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ এই কনসার্টে যোগ দেয়। এই কনসার্টটি মিসেস রানু বসু এবং স্ট্যানফোর্ড ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের দ্বারা আয়োজিত হয়েছিল। আমেরিকান লীগ অফ বাংলাদেশের সদস্যগণ, পিপলস ইউনিয়ন এবং অহিংসার উপর গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি এই কনসার্টের প্রচারণা ও আয়োজনে ব্যাপক সাহায্য করে।
কনসার্টে আমেরিকান লীগ অফ বাংলাদেশ এবং স্ট্যানফোর্ড ভারতীয় ছাত্র সমিতির সদস্যগণ ৮ হাজারেরও বেশি লিফলেট বিলি করে যা বাংলাদেশে চলমান গণহত্যায় আমেরিকান সহযোগিতার কথা ফাঁস করে দেয়। এই লিফলেটে নৃশংস পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে সাম্প্রতিককালে পাঠানো আমেরিকান অস্ত্রবাহী জাহাজের কথা এবং এরূপ আরো চালান পাঠাবার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়। মিসেস জোয়ান বিয়াজ হ্যারিস কর্তৃপক্ষের এহেন অনৈতিক ও লজ্জাজনক নীতির প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করেন এবং আমেরিকান সরকার যেন ইসলামাবাদের শোষক সরকারকে কোনরূপ সহায়তা না করে তার পক্ষে একটি স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে যোগ দিতে সমবেত ১২ হাজার দর্শককে অনুরোধ জানান। বেশ কয়েক হাজার মানুষ এতে অংশ নিয়ে স্বাক্ষর প্রদান করে।
নিউ ইয়র্ক ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল
ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল (নিউ ইয়র্ক) আগস্টের ১৪ তারিখে নিউ ইয়র্ক শহরে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার সাথে সম্মিলিতভাবে এক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। জাতিসংঘ প্লাজায় মধ্য দুপুর থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত চলা এই শোভাযাত্রায় প্রায় ৫০০ লোক অংশগ্রহণ করে। এতে বাংলাদেশ লীগের ড. আলমগীর, পশ্চিম পাকিস্তানের দুজন উল্লেখযোগ্য দুজন বিদ্বান ব্যক্তি ড. ইকবাল আহমেদ ও ইজাজ আহমেদ এবং কুয়াকার প্রজেক্টের মি. এস. জে. আভেরি বক্তৃতা রাখেন।
বক্তৃতাগুলোর পর বাংলাদেশ সঙ্কটের উপর বেশ কিছু ছোট ছোট কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
র্যালিতে বিভিন্ন প্রচারকার্যে ব্যবহার্য পুস্তিকার পাশাপাশি ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল থেকে প্রকাশিত ৮০ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ থেকে পাক-বাংলাদেশ সংঘাতময় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক সারসংক্ষেপ এতে তুলে ধরা হয়। ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গল(নিউ ইয়র্ক) এর ঠিকানাঃ ১৩ ই., ১৭…… ৭ম তলা, নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্ক ফোন(২১২) ৭৪১-০৭৫০।
ঘোষণা
১) আমরা এই নিউজলেটারের সাথে নমুনা কপি হিসেবে বাংলাদেশ জরুরি সমাজসেবা আবেদনের ইশতেহার সংযুক্ত করছি। সম্ভাব্য দাতাদের মধ্যে বিলির জন্য আপনার কতগুলো দরকার অনুগ্রহ করে জানাবেন।
২) যারা আমাদের কাছে “বাংলাদেশ কেন” নামক পুস্তিকাটি চেয়ে আবেদন করেছেন, তাদের কাছ থেকে আমরা আরেকটি সপ্তাহ সময় চেয়ে নিচ্ছি তা ডাকের মাধ্যমে আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য।
৩) অনুগ্রহ করে আপনাদের দলগত কার্যকলাপের প্রতিবেদন আমাদের কাছে পাঠান। আমরা তা নিউজলেটারে ছাপাবার ব্যবস্থা করব। স্থানীয় সংবাদপত্র থেকে পেপার ক্লিপিংও পাঠাতে থাকবেন।
৪) আমরা প্রচুর পরিমাণে “বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা বন্ধ কর” শীর্ষক বাম্পার স্টিকার পুনর্মুদ্রণ করিয়েছি। আমরা খরচার বিনিময়ে সেগুলো বাংলাদেশ গ্রুপগুলোর কাছে হস্তান্তর করব।
বাংলাদেশ পোস্টাল স্ট্যাম্প
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে আটটি পোস্টাল স্ট্যাম্পের একটি সেট বের করা হয়েছে। এই পুরো সেটটি ২.৬৪ ডলারে আন্তসরকার ডাক টিকেট সংক্রান্ত কর্পোরেশন, পি.ও. বক্স ২৫৯, সিডারহার্স্ট, নিউ ইয়র্ক ১১৫১৬ এ পাওয়া যাবে। তহবিল সংগ্রহের কাজে এসব ডাকটিকেট ব্যবহার করতে বাংলাদেশ গ্রুপগুলোকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
.
.
অনুবাদঃ সাইমা তাবাসসুম
<৬, ৫২, ৬৭৫>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : ষষ্ঠ খন্ড
শিরোনামঃ ওয়ার্ড এয়ার ওয়েজের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগো: নং,৮
তারিখঃ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
” ওয়ার্ড এয়ার ওয়েজের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ”
শিকাগো ফ্রেন্ডস অফ ইস্ট বেঙ্গলের সদস্যরা ২৪ আগষ্ট থেকে ওয়ার্ড এয়ার ওয়েজের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ আয়োজন করে। বিক্ষোভকারীরা শিকাগো শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আদালত ভবনের সামনে প্রতিদিন মিলিত হয়ে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা নেয়ার জন্য পাকিস্তানকে দুইটি বোয়িং ৭০৭এস লীজ দেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পতাকা বহনকারী সংস্থা পিআইএ এর অধীনে সাতটি বোয়িং ৭০৭ আছে। ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ থেকে লিজ নেওয়া বিমা দুটো বহরে সংযুক্ত হয়েছে । ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্ড ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ কে পিআইএ প্রতি মাসে এই দুটি লিজ নেওয়া বিমানের জন্যে ১৭০,০০০ ডলার করে দেয়।
প্রদর্শকরা বাংলাদেশে ঘটতে থাকা হত্যাকাণ্ডে বিমান সংস্থাগুলোর সহযোগিতার প্রতি সাধারণ জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য “ট্যাঙ্ক ও সৈন্য বহনকারী” প্রচুর কাগজের বিমান তৈরি করে নিক্ষেপ করেন। রাস্তার পাশে বিক্ষোভকারীদের বক্তৃতায় প্রতিদিন অনেক সহানুভূতিশীল শ্রোতাদের আগমন হয়।
বাংলাদেশের নদীতে ভেসে যাওয়া মৃত দেহের স্তুপের পুনর্মঞ্চায়ন করতে বিক্ষোভকারীরা মানব দেহের আকৃতি দিয়ে বেলুন তৈরি করে সেগুলো লাল রঙে রঞ্জিত করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়।
প্রদর্শনের দুই আয়োজক ডিক মুররি এবং উইলিয়াম হোগানকে পানি দূষণের মামলায় সোমবার (আগষ্ট ৩০) গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রর্দশনীর ইতি ঘটে ৩১ তারিখ। এদিকে সিকাগোর পত্র পত্রিকা এবং টেলিভিশন এই প্রদর্শনীর উপর বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল।
.
ডিফেন্স লীগের বৈঠক
১১ সেপ্টেম্বর শনিবার শিকাগোতে বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের একটি অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে তাদের কর্মকাণ্ড এবং ব্যাপক কর্মসুচি গ্রহণের পর্যালোচনা করা হবে। সবাইকে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিস্তারিত জানতে (৩১২) ২৮৮-০৭২৮ নাম্বারে যোগাযোগ করুন।
.
অনুবাদঃ তাসমিয়াহ তাহসিন
<৬, ৫৩, ৬৭৬>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ দল সমূহের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগোঃ নং ৯
তারিখঃ ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের গ্রুপগুলোর খবর
কলোরাডো
ডাঃ এম. শের আলী, আমেরিকায় বাংলাদেশ লীগের সভাপতি, কলোরাডো, প্রতিবেদন করেনঃ
মধ্যপাশ্চাত্যের বৃহত্তম বিপণী বিতান সিন্ডারেলা সিটির ব্লু রুম মলে ১৪ আগস্ট একটি বুথ স্থাপিত হয়।
২১ আগস্ট চাঁদা তোলার জন্য একটি ভিন্নধর্মী অনুষ্ঠান মঞ্চায়িত হয় ।
৩১ আগস্টে রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকী এবং এম, এ, মুহিত এক বিপুল অংশগ্রহণকারী নিয়ে ডেনভারে এক সংবাদ সম্মেলনের ডাক দেন। রেডিও , স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো এই সম্মেলনের ব্যাপক প্রচারণা চালায়। রাষ্ট্রদূত প্রাদেশিক রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের অবস্থার সম্বন্ধে অবহিত করেন।
ইন্ডিয়ানা-ওয়াহিও
ডাঃ আমিনুল ইসলাম যিনি মাত্রই বাংলাদেশ সরকারের সাথে তার ছয় সপ্তাহের দায়িত্বসফর থেকে ফিরেছেন , তার থেকে সরেজমিনে প্রতিবেদন শুনতে, ১৮ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন বাংলাদেশ গ্রুপের প্রতিনিধিরা ও পূর্ব্বঙ্গের মিত্ররা মধ্যপাশ্চাত্যে বাংলাদেশ সংগঠনের সভায় অংশগ্রহণ করেন । ডাঃ ইসলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিবাহিনীর সাথে অত্যন্ত কাছে থেকে কাজ করেছেন। ব্যাক্তি অথবা দল কেঊ যদি সাম্প্রিতিক অবস্থা সম্বন্ধে আরো জানতে চায়, তবে ডাঃ ইসলাম (১২৭১), মাউন্ট ভার্নন এভেনিউ, ডায়টন, ওয়াহিও (৪৫৪০৫) এ যোগাযোগ করতে পারে ।
আর্বানা, আইএল
ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের শিশুদের সাহায্যার্থে এক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হয়েছে। সাতটি ভিন্ন দেশ থেকে সাতটি কাহিনীচিত্র সেপ্টেম্বর ২০-২৬ এ প্রদর্শিত হবে।
টেনেসি
আমেরিকার বাংলাদেশ লীগের সভাপতি ও অনেক সদস্যরা শিকাগোতে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা লীগের সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং তারা নিজেদের সাথে প্রতিরক্ষা লীগের কার্যক্রম সমন্বিত করার আকাঙ্খা প্রকাশ করেন। প্রতিরক্ষা লীগের পরিচালকবৃন্দ হিসেবে যোগদান করতে টেনেসি থেকে একজন সদস্য খুব শীঘ্রই মনোনীত হবেন।
টরেন্টো
২৬ আগস্ট সত্যজিত রায়ের “দুই কন্যা” এর এক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। চলচ্চিত্রটির মোট চারটি প্রদর্শনী ছিল। প্রদর্শনীর সকল আয় কানাডার অক্সফামকে দান করা হয়।
আরেকটি দাতব্য অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। ইটন অডিটোরিয়ামে নাচে-গানে পরিপুর্ন এক সন্ধ্যা, সুমন কল্যাণপুর ও তার দলের অধিবেশন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আয় সব অক্সফামে দান করা হবে।
.
.
অনুবাদঃ শিহাব শারার মুকিত
<৬, ৫৪, ৬৭৭-৬৭৮>
শিরোনামঃ সম্পাদকের মন্তব্য
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ ০৯
তারিখঃ ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দৃষ্টি আকর্ষন
১। আমরা আশা করছি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলবার সাথে সাথেই বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে বাংলাদেশ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বক্তার অনুরোধ আসবে। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মৈত্রীর পক্ষে ড. জে ভট্টাচার্য সারাদেশের বিভিন্ন অংশের বক্তাদের তালিকা সমন্বয় করবেন। যারা এই বক্তাদের দলে নাম লিখাতে ইচ্ছুক এবং যাদের বক্তা দরকার তারা নিম্নোক্ত ঠিকানায় যোগাযোগ করুনঃ
ড. জ্ঞানেন্দ্র কে ভট্টাচার্য
জীবার্ণুবিজ্ঞান বিভাগ
মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড, ওহাইও ৪৫০৫৬
(৫১৩) ৫২৯-৪৭২৭
আপনার অঞ্চলে উন্নত সাংগঠনিক সেবা প্রদানের জন্য ড. জে ভট্টাচার্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও অন্যান্য সাহায্য করবেন।
২। বাংলাদেশ নিউজলেটার এর ৭ম সংখ্যার সাথে আমরা একটি পুস্তিকা দিয়েছিলাম যেখানে বাংলাদেশ জরুরী কল্যাণ আবেদনের অর্থ সংগ্রহের ইশতেহার ছিল। সকল আগ্রহী ব্যক্তি বা দলকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম অর্থ সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত ইশতেহার নির্দ্বিধায় চাওয়ার জন্য। আমরা এই ইশতেহার খুশি মনেই পৌছে দেব।
৩। ডিফেন্স লীগ তথ্য উপকরণের একটা বড় চালান প্রস্তুত করেছে। আপনি যদি সেগুলোর কিছু ব্যবহার করতে চান, আমাদের অবগত করুন।
৪। ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ মিশন একটি সাপ্তাহিক সংবাদ সংকলন বের করছে। আপনি যদি সেটা না পেয়ে থাকেন তাহলে লিখুন
বাংলাদেশ মিশন
১২২৩ কনফারেন্স এভিনিউ
৫ম তলা, ওয়াশিংটন ডিসি২০০৩৬।
৫। ন্যাশভিলের পূর্ব বাংলা মৈত্রী বলছে তারা স্কুল লেভেলে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য অস্থায়ী তথ্য কেন্দ্র খুলতে আগ্রহী। তারা আপনাকে কিভাবে তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করা যায় এ সম্পর্কিত পুঁথি ও উপদেশ দিয়ে সাহায্য করতে পারে (আপনাকে শুধু পাঠানোর খরচটা বহন করতে হবে।) যোগাযোগঃ
পূর্ব বাংলা মৈত্রী
বক্স ৪২, স্টাঃ বি
ভ্যন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়
ন্যাশভিল, টিএন ৩৭২০৩
ঘোষণা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই সংগ্রামে চিকিৎসা পেশার সাথে সম্পৃক্তদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। মুক্তি বাহিনী ও উদ্বাস্তুদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যের ডাক্তাররা ইতিমধ্যেই নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। উত্তর আমেরিকাতেও বিডিএল এর উদ্যোগে একই রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পরবর্তি যোগাযোগের জন্য সকল ডাক্তারদেরকে অতিসত্ত্বর ডঃ জিল্লুর রহমান আতহার এর সাথে নিম্নোক্ত ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলা হলঃ
ডঃ জিল্লুর রহমান আতহার
৮০৮ হলিউড বুলেভার্দ
ন্যাশভিল, টিএন ৩৭০২৯
ফোনঃ (৬১৫) ৩৫৬-৩৯১২
.
…লিখুন আমাদের কে আপনাদের চিন্তাধারা, মন্তব্য কিংবা উপদেশ সম্পর্কে। আপনার কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের জানান। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগ্রহী ব্যক্তিদের ঠিকানা আমাদের দিন। আমরা তাদের কাছে সনফবাদ সংকলন ও অন্যান্য পুঁথি পাঠিয়ে দিব।
সম্পাদক
.
.
অনুবাদঃ সুমিতা দাশ
<৬, ৫৫, ৬৭৯>
শিরোনামঃ সম্পাঃ ইয়াহিয়ার মোমের প্রাসাদ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং ১০
তারিখঃ ১০ অক্টোবর, ১৯৭১
.
সম্পাঃ ইয়াহিয়ার মোমের প্রাসাদ
যদি মোমের পুতুল দেশ চালাতে পারতো, উপনিবেশিকতা একটি সম্প্রসারণশীল ব্যবসা হত। দক্ষ উপনিবেশিক শক্তিগুলো জেনারেল ইয়াহিয়ার মতই যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতা রাখে আঞ্চলিক তথাকথিত “নেতৃত্ব” তৈরিতে। ইতিহাস অনেক উদাহরনে পরিপূর্ণ কিভাবে এই গৃহনির্মিত “নেতারা” তাদের বিপুল বিস্তৃত রাজকীয় সম্ভার নিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় বাংলাদেশে বিদ্যমান অবস্থা থেকে আরও শিথিল পরিস্থিতিতে। কিন্তু, হয়তো উপনিবেশিক মানসিকতা এমন ভাবে কাজ করে যাকে ইতিহাস সুস্থ করতে পারে না।
ইয়াহিয়ার পর্দার আড়ালের কারখানা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে আমাদের সময়ের অন্যতম বৃহৎ মোমের জাদুঘর তৈরিতে। একজন “গভর্নর”, হাতের পুতুল “কেবিনেট সদস্য” এমনকি সম্পূর্ণ সংসদ সদস্য! উপহাস হচ্ছে এই খেলার নাম। খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি উপহাস। জেনারেলের থামার কোনো ইচ্ছা নাই যতক্ষণ পর্যন্ত সে পূর্ব-রচিত “গনতন্ত্র” এই নাটিকার কেন্দ্রবস্তু হিসেবে না বসাচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে সব দেশ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার এই চেষ্টা দেখছে এবং হয়তো সামান্য আমোদিত তার এই হতাশায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের জন্য সামান্যই রয়েছে আমোদিত হওয়ার মত। “পরিবর্তনের” এই মহা নাটক যখন মঞ্ছে উন্মোচিত হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর বিনোদনের জন্য, হাড় কঙ্কালের স্তুপ আগের থেকেও দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে পর্দার আড়ালে। দখলকৃত বাংলাদেশে জীবন হয়ে উঠেছে আরো এবং আরো অনিরাপদ।অন্যত্র
এই পাতায়, ধারাবাহিকতা এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বর্বরতার তীব্রতা নিয়ে আমরা রিপোর্ট বর্ণনা আছে।যখন সামরিক প্রধানরা মার্কিন সিনেটরদের শান্ত এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনকে আশাবাদী রাখার জন্যে মিষ্টি-কথা বলছেন।
যেহেতু ইতিহাস ঔপনিবেশিক মনের অদ্ভূত কাজগুলোকে দূর করতে পারে না, তাদের সাথে আচরণের নিজস্ব উপায় ইহা উন্নত করেছে।ইহা ইহাদের চাকার নিচে তাদের পিষ্ট করছে।বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের এই চাকাগুলো দ্রুত ঘুরিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
* * *
গুরুত্তপূর্ণ ঘোষণা
স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী হতে বিদেশী সহায়তা বিল আশা করা হচ্ছে যে খুব শীঘ্রই বৈদেশিক সম্পর্কের উপর কমিটি বের হবে।ইহা “ফ্লোর আকশন” এর জন্যে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে তৈরী হবে।
আপনি যত পারেন চিঠি ও টেলিগ্রাম আপনার সিনেটরকে দিতে পারেন।আপনার বন্ধুদের জানান অবিলম্বে তাদের সিনেটরকে লিখতে।আরো ভালো হয়, যদি আপনি পারেন, ব্যাক্তিগতভাবে ওয়াশিংটন ডি. সি. সিনেটের লবিতে আসেন।আমরা আমাদের প্রতিটি পাঠককে অনুরোধ করছি তদবির সংঘটিত করার যোগাযোগ বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার,৪১ সেওয়ার্ড স্কোয়ার এসই, এপিটি ৪, ওয়াশিংটন ডি. সি. ২০০০৩ (ফোন (২০২)৫৪৭ ৩১৯৪)
.
অনুবাদকঃ জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা
<৬, ৫৬, ৬৮০-৬৮১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
দখলীকৃত বাংলাদেশে মৃত্যু ও সন্ত্রাসের তান্ডব |
বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগো: নং ১০
|
১০ অক্টোবর, ১৯৭১
|
মৃত্যু এবং সন্ত্রাসের রাজত্বে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশ
সেপ্টেম্বর ২৫, শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা লীগের বৈঠকটিতে বাংলাদেশের একজন উচ্চপদস্থ নাগরিক অংশগ্রহন করেন যিনি মাত্র দেশ থেকে পালিয়ে এসেছেন। তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটি রিপোর্ট দাখিল করেন। এবং রিপোর্টে সেনাবাহিনী কর্তৃক তার পরিবারের প্রতি প্রতিহিংসামূলক যে কোন হামলার আশংকায় তার নাম উহ্য রাখেন।
তিনি তার রিপোর্টে বলেন ঢাকা হল মৃত্যু এবং সন্ত্রাসের শহর এবং বাংলাদেশের বাকি অঞ্চলগুলোতেও ঠিক ঢাকার মতই পরিস্থিতি। সূর্যাস্তের পর ঘর থেকে বের হওয়া যে কোন ব্যাক্তির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এমনকি সেটি খুব জরুরী প্রয়োজনেও। কেউ যদি ঘর থেকে বের হয়, তবে সে যে আর ঘরে কোনোদিন ফিরবে না এরকম একটি অনিশ্চয়তা রয়েছে। এমনকি এই ঝুঁকি তাদের জন্যও এই যুদ্ধে যাদের কোন প্রত্যক্ষ ইন্ধন নেই। তাদের জীবনটিও এখন ঠিক নিশ্চিত বলা যায় না। এদের অনেকেই কোন কারণ ছাড়াই নিরুদ্দেশ হয়েছে এবং তাদেরকে কেউ কোনোদিন আর খুঁজেই পায়নি।
অফিস এবং ঢাকার বিদ্যালয়গুলো খোলা থাকলেও সেখানে কোন কাজকর্ম চলছে এটি বলা ভুল হবে। উচ্চ নিম্ন কোন বাঙালী অফিসারকেই আর বিশ্বাস করা হচ্ছে না। তাদেরকে নামিয়ে ক্লার্কের মত নিচু পদে অধিষ্ঠিত করা হচ্ছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পদগুলো আর্মিরা দখল করে নিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপস্থিতি ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম খুলেছে, ছয় হাজার ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৩২ জন ছাত্র উপস্থিত ছিল। উপস্থিতি এখন কিছুটা বেড়ে বর্তমান স্তরে পৌঁছেছে তবে সেটা সম্ভব হয়েছে অভিভাবকদের লাগাতার প্রতিবাদ এবং প্রচারণার পর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপস্থিতি শতকরা ৩ এর নিচে এবং এদের অধিকাংশই অবাঙালি। ৯৪,০০০ ছাত্র যাদের মাধ্যমিক পরিক্ষায় বসবার কথা ছিল, তাদের মধ্যে মাত্র ৩৫০০ জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে এবং এদেরও একটা বড় অংশ ছিল অবাঙালি।
বাঙালী যুবকদেরকে প্রধান সন্দেহভাজন ধরা হচ্ছে এবং যুবকদের হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতন যেন খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর শহরগুলো যেন দিনে দিনে এক একটা মধ্য যুগের কারাগার হয়ে উঠছে।
হত্যা নৃশংসতার গল্পগুলো যেন সংখ্যা বিবেচনায় দিনে দিনে হয়ে উঠছে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন বাঙালি উইং-কমান্ডার অফিসারকে ডিটেনশন সেলে ছাদের সাথে পা ঝুলিয়ে বেঁধে রাখা হয় এবং ৬৬ দিনের বিরামহীন অসহনীয় অত্যাচারের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৩০০ মহিলা কয়েদি যাদেরকে ঢাকা মিলিটারি ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল, তাদেরকে কোন কাপড় পরতে দেওয়া হয়নি কারন তারা তাদের পরনের শাড়িগুলোতেত ঝুলে আত্মহত্যা করছিল।
মুসলিম লীগ ও জামাত-ই-ইসলামীর মতো দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো এ সময় রাজাকার নিয়োগে ভীষণ সক্রিয় ছিল। রাজাকাররা ছিল পাকিস্তান বাহিনীর নজরদার কমিটির সদস্য গ্রুপ। রাতের বেলা এই রাজাকারদেরকে নিয়মিত পাঠানো হত গ্রামগুলো লুট এবং পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে তদানীন্তন সরকার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই লুটতরাজের বিরুদ্ধে নিন্দা জানায় এবং এর দায় মুক্তিবাহিনীর ঘাড়ে চাপায়।
শহরগুলোতে গরীব রিক্সাআলাদের রাজাকারে যোগদানের জন্য জোর জবরদস্তি করা হতো এবং ভয় দেখানো হতো যে তারা রাজাকার বাহিনীতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যোগদান না করলে তাদের রিক্সা চালানোর অনুমতিপত্র বাতিল করা হবে।
সেসময় প্রতিহিংসাস্বরূপ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়দের কাউকে কাউকে নিয়মিতভাবে তুলে আনা হতো। গেরিলা বন্দীদেরকে মাঝে মাঝে খবর সংগ্রহের জন্য ছেড়ে দেওয়া হতো, আবার ক্যাম্পে পাঠানো হতো এবং তাদের পরিবারকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিম্মি হিসেবে ব্যাবহার করত।
.
.
অনুবাদঃ আবির অনন্য
<৬, ৫৭,৬৮২>
শিরোনামঃ সংবাদকণিকা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ বার্তা শিকাগোঃ নং ১০
তারিখঃ ১০ অক্টোবর, ১৯৭১
সংক্ষিপ্ত খবর
সাচকাচুয়ান, কানাডা
সাচকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। সাচকাচুয়ানের বাংলাদেশ সংঘ একত্রিত হয় ও এই দিবস উদযাপনে দীর্ঘ কর্মসূচীর আয়োজন করে । বাংলাদেশ দিবসের সমর্থনে বিশ্ববিদ্যলয় মণ্ডলী সমস্ত কর্মসূচী প্রদর্শন ও কর্মসূচী অংশগ্রহন করে ।
কার্বনডেল, ইলিনয়
কার্বনডেল শান্তি সংস্থার বাৎসরিকসম্মেলন অক্টোবর মাসের ২২-২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। আনুমানিক প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ছিল সম্মেলনের অন্যতম বিষয়বস্তু। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মৈত্রীসংঘের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগদান করে এবং শেখে পরিচালনের যথোপযুক্ত পদ্ধতি ।
এথেন্স, জর্জিয়া
এখানে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মৈত্রীসংঘ গঠিত হয়। মৈত্রীসংঘেরপ্রতিনিধিরা প্রচারণা চালায় ও আমেরিকার নাগরিকদের বাংলাদেশ বিষয়ে লিখতে বলে। ইতোমধ্য তারা ১০০০০ প্রচারপত্র বিলি করে তারা।
মিনিয়াপলিস, মিনিসোটা
মিনিসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সংকটাবস্থা কমিটি গঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ সদস্যদের অর্থায়নে । সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে বাংলাদেশেরযুদ্ধকালীন অবস্থা মানুষকে জানাতে নবনির্মিত কমিটি একটি জনসভার আয়োজন করে । অক্টোবরের ২ তারিখে কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশের জন্য ত্রান তহবিল গোছাতে অব্যবহৃত পণ্য বিক্রি করে ।
ম্যাডিসন, উইস্কসিন
উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন নবীন পৃথিবীর উন্নয়নে নানা কাজের জন্য তহবিল জোগাড় করতে একত্রিত হয়ে অগ্রসর হচ্ছিল সমস্ত আমেরিকায় । একজন তহবিল সংগ্রাহক খুব সামান্য অর্থ নিচ্ছিল কোন দাতার কাছথেকে এক মাইল হাটার জন্য । সেই বছর ম্যাডিসন অধ্যায়ের (YWD) হেটেহেটেঅর্থ সংরগ্রহ করছিল ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত । বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মৈত্রী সংঘের প্রতিনিধিরা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ম্যাডিসনের স্কুল ও বিভিন্ন যায়গা গুলোতে কথা বললো, বাংলাদেশের যুদ্ধকালিন অবস্থা পরিচিতিকরাতে এবং আহবান করলো তারা যেন সাহায্যে অংশ গ্রহণ করে।
লাখলাখ মানুষ খুধায় মারাযাবে তাদেকে তুমি সাহায্য করো । বাংলাদেশের জরুরি কল্যাণ আবেদনে তোমরা অংশগ্রহণ করো ।
30, W. Monroe Street (5th floor)
Chicago, II 60603
.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ৫৮, ৬৮৩>
শিরনামঃ বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধ্যাপকগণ গ্রেফতার ও চাকুরিচ্যুত
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার, শিকাগো, নম্বর ১১
তারিখঃ- ২৫ শে অক্টোবর, ১৯৭১
.
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রেফতার, বরখাস্ত
দুষ্কৃতকারী ইয়াহিয়ার “সাধারণ ক্ষমা” ছলনার আসল রুপ অভ্রান্তকরভাবে এর সকল আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট নিয়েই উদ্ভূত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ সদস্যদের উপর তথাকথিত ছাঁটাই প্রক্রিয়া চালানো হয়। প্রাথমিক ছাঁটাইয়ের পর নিম্নে উল্লেখিত অনুষদ সদস্যদের গ্রেফতার করা হয় —
১. অধ্যাপক আহসানুল হক
ইংরেজি অনুষদ
সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
২. অধ্যাপক ক.ম. সাদউদ্দিন
সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ
সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংঘ
৩. অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম
বাংলা অনুষদ
৪. অধ্যাপক শহীদুল্লাহ
গণিত অনুষদ
৫. অধ্যাপক আবুল খায়ের
ইতিহাস অনুষদ
নিম্নে উল্লেখিত অনুষদ সদস্যদের বরখাস্ত করা হয় —
১. অধ্যাপক এ.বি.এম. হাবিবুল্লাহ
ইসলামিক ইতিহাস অনুষদ প্রধান
২. অধ্যাপক এনামুল হক
সম্মান ও উপাধিসহ অবসরপ্রাপ্ত
৩. অধ্যাপক এম. মনিরুজ্জামান
বাংলা অনুষদ
নিম্নে উল্লেখিত অনুষদ সদস্যদের সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় —
১. অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী
বাংলা অনুষদ প্রধান
২. অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম
বাংলা অনুষদ
৩. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইংরেজি অনুষদ
.
.
অনুবাদঃ সাইমা তাবাসসুম
<৬, ৫৯, ৬৮৪-৬৮৫>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগো : নং ১১
তারিখঃ ২৫ অক্টোবর,১৯৭১
.
পাইপ নগরীতে দশদিন
ওয়াশিংটন এর লাফায়েত পার্ক একটি সুযোগ পেয়েছে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দৈন্যতার নমুনা দেখার।উঠেছে ওয়াশিংটনের নাগরিকদের কে ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পের চিত্র আরও কাছ থেকে তুলে ধরতে একটি ক্ষুদ্র শরণার্থী শহর গজিয়ে উঠেছে এ পার্কে। ফিলাডেলফিয়া ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল এটি আয়োজন করেছে। এবং অনেক বাংলাদেশি সংঘ এতে সমর্থন করেছে। বেশ কয়েকটি ড্রেনপাইপ আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা হয়েছে অক্টোবর এর ১৪ থেকে দশ দিন ব্যাপী সময়ের জন্য। শরণার্থী সমস্যার এ নাটকীয় রূপায়ণ ওয়াশিংটনের জনগণ ও সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী এসেছে নিউইয়র্ক, ফিলাডেল্ফিয়া, বাল্টিমর ও বোস্টন থেকে ওয়াশিংটনে এই দশদিনের প্রকল্পে যোগদান করার জন্য।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শনিবার (১৬ই অক্টোবর) পাকিস্তান দূতাবাস অভিমুখী মিছিল, রবিবার ধর্মীয় স্মরণ অনুষ্ঠান ও সোমবার সিনেটে গণ সংযোগ।
এই দশদিন ব্যাপি “শরণার্থী শিবির” “ক্যাম্প পরিচালক” ডিক ট্যালার পরিচালিত করেন, যিনি পাকিস্তানি নৌবাহিনীর অস্ত্র বহনকারী পদ্মা জাহাজটিকে নৌপথে অবরোধ কর্মসূচী আয়োজন করেছিলেন। ডেভিস হারসা এবং বিল মইয়ার ডিক ট্যালারকে সহায়তা করেন।
.
বৃহত্তর কূটনৈতিক গোষ্ঠীর বাংলাদেশকে যথাযোগ্য সম্মান দেয়ার ঘোষণা
অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে সারা বিশ্বের মোট ১৪৪ জন কূটনৈতিক ইয়াহিয়া সরকারের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সম্প্রতি যোগদান করা কূটনৈতিকদের মাঝে ছিলেন আর্জেন্টিনার পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মিষ্টার আব্দুল মমিন, যুক্তরাজ্যের পাকিস্তানি হাইকমিশনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা মিষ্টার এম.এম. রেজাউল করিম, নিউ দিল্লির পাকিস্তানি হাই কমিশনের মন্ত্রী পরিষদের উপদেষ্টা মিষ্টার হুমায়ুন রাশেদ চৌধুরী, বেরুত এর মিষ্টার লতিফ, মাদ্রিদ এর মিষ্টার আব্দুল করিম মন্ডল, বেলজিয়াম এর মিষ্টার নায়েবুল এবং নেপালের পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মিষ্টার মুস্তাফিজুর রহমান।
.
সংক্ষিপ্ত খবর
মিশিগান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে এন আরবর সিটি হলের সামনে এক বিশাল র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে একশোরও বেশি মানুষ প্ল্যাকার্ড বহন করেছিল, তাদের দাবি ছিল আমেরিকান সৈন্য বাহিনী এবং তাদের অর্থনৈতিক সাহায্য সম্পূর্ণ নিষেধ করা হোক।
সেদিনের র্যালি শেষে “ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান” এ বাংলাদেশের উপর একটি সেমিনার অনুষ্ঠান হয়। প্রফেসর রোড মারফি, চাইনিজ স্ট্যাডি সেন্টারের ডিরেক্টর, মেয়র হ্যারিস, প্রফেসর আর.সি. পর্টার, ইকোনমিক্স এর প্রফেসর, প্রফেসর রড হুবের, মিষ্টার মোজাম্মেল হক, মিষ্টার রাশেদুর রেজা ফারুকি সেদিনের সেই সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
মিশিগানের গভর্নর মিলিকান সমগ্র অঙ্গরাজ্যে “বাংলাদেশ দিবস” নামে একটি দিবস পালনের ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বর্ণনার জন্য ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান সিনেটর কেনেডি কে আমন্ত্রণ জানান।
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর হাওয়ার্ড সুমেনের তত্ত্বাবধানে একটি “ফ্যাকাল্টি কমিটি” গঠন করা হয় যেখানে বাংলাদেশের সে সমস্ত শিক্ষকদের সহায়তা করা হয় যারা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
.
বাংলাদেশের পক্ষে ম্যাডিসনে শোভাযাত্রা
বাংলাদেশের ডিফেন্স লিগের সেক্রেটারি অক্টোবর ৭ এবং ৮ ম্যাডিসনব্যাপী সফর করেন এবং স্থানীয় স্কুল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন,তারা যেন উন্নতির এই প্রকল্পে নিজেদের সামিল করে, যা ম্যাডিসনে রবিবার, অক্টোবর ১৭,১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সে বছর গ্রুপটি বাংলাদেশকে একটি বৈদেশিক প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে এবং সংগৃহিত ফান্ডের একাংশ বাংলাদেশের জরুরী অবস্থায় অনুদানের জন্য আবেদন করে। বিগত বছর তারা ৮৫০০০ ডলার সংগ্রহ করে। এ বছর সেটা বৃদ্ধি পেয়ে আনুমানিক ১লক্ষ ডলারের উপরে পৌঁছাবে আশা করা যায়।
এই পথ চলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ হচ্ছে মতভেদ প্রকল্পে স্থানীয় জনসাধারণকে শিক্ষা দেয়া এবং এই মতভেদ দূর করার জন্যই এটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এর সূত্র ধরে এলাকার প্রতিটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবং সপ্তাহব্যাপী রেডিও-টেলিভিশন শো স্পন্সর করা হয়েছে।
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ৬০, ৬৮৬-৬৮৮>
শিরোনামঃ সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বাংলাদেশ তৎপরতা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার। শিকাগো; নম্বর – ১২
তারিখঃ – ১০ ই নভেম্বর, ১৯৭১
.
সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বাংলাদেশ বিষয়ক কর্মকাণ্ড
অ্যান আরবর, মিশিগান
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অনুষদ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত “ফ্রেন্ডজ অফ বাংলাদেশ” নামক সংগঠন ৬ই নভেম্বর, ১৯৭১ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রাবাসে একদিনের অনশন কর্মসূচীর আয়োজন করেছে। অধ্যাপক রডরিক হুবার এবং জনাবা ডেব্রাহ বার্নহার্ড বাংলাদেশের ত্রাণ তহবিল সংগ্রহের জন্য এই কর্মসূচীর আয়োজন করেন।
২৮শে অক্টোবর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের অনুষ্ঠানে, “ফ্রেন্ডজ অফ বাংলাদেশ” সংগঠনের সমন্বয়ে বাংলাদেশের উপর পাক সেনাদের পাশবিক নির্যাতন ও বর্বরতার চিত্র একটি নাটকের মাধ্যমে মঞ্চায়স্থ করা হয়। অধ্যাপক পিটার হুক এবং শ্রীমতী স্নেহলতা দীক্ষিত এর পরিকল্পনায় এই নাটকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ এবং এর পেছনে আমেরিকার ভূমিকা তুলে ধরা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর এ. আর. মল্লিক এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডক্টর আসহাবুল হক ( উভয়ই জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য ) , গত ২৬শে অক্টোবর, ১৯৭১ এ পূর্ব ল্যানসিঙ্ক এর একটি জনসভায় বক্তব্য দেন এবং স্থানীয় টিভি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন।
একই দিনে তারা অ্যান আরবরে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং অনুষদ সদস্যদের এক সভায় বক্তব্য দেন।
গ্র্যান্ড র্যাপিডস, মিশিগান
আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্বাধীনতা পরিষদ এবং YWCA এর শান্তি গোষ্ঠীর কার্যনির্বাহী দলের যৌথ পরিচালনায় YWCA কেন্দ্রে গত ১১ই অক্টোবর, ১৯৭১ এ বাংলাদেশের সমসাময়িক অবস্থার অবগতির জন্য এক সম্মেলন আয়োজিত হয়। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশের সমিতির সভাপতি জনাব মোজাম্মেল হককে এই শিক্ষা সম্মেলনে বক্তব্য দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিক্ষা সম্মেলনের শেষে মিসেস জ্যানেট ম্যায়ের এর সভাপতিত্বে স্থানীয় জনগণকে বাংলাদেশের সমসাময়িক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত এবং ত্রাণ তহবিল সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি বাংলাদেশ সংঘ গঠন করা হয়। জনাব হক, গ্র্যান্ড ভ্যালী স্টেট কলেজের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশেও বক্তব্য রাখেন।
মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের বাংলাদেশ সমিতি
মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের বাংলাদেশ সমিতির এন বিবৃতিতে জানা যায়, সংগঠনের প্রতিনিধিরা ক্যাপিটাল হিল, ওয়াশিংটন ডি.সি. র উপর সর্বদা সতর্ক নজর রাখছে। তাদের সাথে কলম্বাস, ওহাইও অঙ্গরাজ্যের সংগঠন ” ফ্রেন্ডজ অফ ইস্ট বেঙ্গল ” এর প্রতিনিধিরাও ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশের প্রচারণার সাথে সম্পৃক্ত সংগঠনগুলো বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংঘের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করছে। এর মধ্যে পারডিউ, ওহাইও অঙ্গরাজ্য, মায়ামি-পশ্চিমাঞ্চল, একরন, কেস-পশ্চিমাঞ্চল এবং ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য উল্লেখযোগ্য। প্রচারণার মাধ্যমে শিক্ষা সমাবেশ, সাহিত্য বিতরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্র সমূহে চিত্র প্রদর্শনী এবং তহবিল সংগ্রহ করা হয়।
সংগঠনটি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য শীতবস্ত্রের এক বিশাল চালান পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা পরিষদ
গত ২৩শে অক্টোবর, ১৯৭১ এ জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী ডক্টর এ. আর. মল্লিক এবং ডক্টর আসহাবুল হক বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা পরিষদের পরিচালনা পর্ষদের এক সভায় উপস্থিত থেকে বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন।
একটি জীবন বাঁচাতে একদিনের উপবাস
৩রা নভেম্বর, বুধবার; যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা একদিন উপবাস করবে। তাদের মধ্যাহ্নভোজ, নাস্তা এবং এই সম্পর্কিত অর্থ যা তারা খাবারের জন্য খরচ করতো, তার পরিবর্তে সেদিনের টাকা পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরের লক্ষাধিক ক্ষুধার্ত শরণার্থীদের খাবারের জন্য দান করা হবে। “৩রা নভেম্বর, একটি জীবন বাঁচাতে একদিনের উপবাস” নামক এই প্রকল্পের সাথে বিভিন্ন সংগঠন সম্পৃক্ত রয়েছে। সংগৃহীত সকল তহবিলের অর্থ অক্সফাম-আমেরিকার মাধ্যমে বিতরণ করা হবে।
তিন হাজার কলেজ এবং ৩০,০০০ উচ্চ বিদ্যালয় এই প্রকল্পে অংশ নিতে পারে। রোড আইল্যান্ড এবং আরাকান্সাস রাজ্যের রাজ্যপাল ৩রা নভেম্বেরকে তাদের রাজ্যে “পূর্ব পাকিস্তান শরণার্থী” দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন।
মৃত্যুর দূতের সাথে মিস ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ এর বিবাহ
শিকাগোর ” ফ্রেন্ডজ অফ ইস্ট বেঙ্গল ” সংঘ, ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ এর বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণা জারি রেখেছে। ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অস্ত্র ও সেনা বহর বাংলাদেশে বহনের সুবিধার্তে ২টি বোয়িং ৭০৭ বিমান ইজারা দেয়। ২১ শে অক্টোবর “ফ্রেন্ডজ” সংঘ ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ এর সাথে মৃত্যু দূতের এক “প্রতীকী বিয়ে” র আয়োজন করে। বিবাহ অনুষ্ঠানটি ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজএর কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। বিপুল সংখ্যক শিকাগোবাসী এই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।
বাংলাদেশের জন্য জোয়ান বায়েজের গান
অ্যান আরবর, ২৪শে অক্টোবর:- ক্রাইস্লার এরেনায় ২০ হাজার শ্রোতার উপস্থিতিতে জোয়ান বায়েজ ২ ঘণ্টা ব্যাপী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। জোয়ানের সঙ্গীতে মূলত নিক্সন প্রশাসন এবং সংস্থাপন রাজনীতির উপর ক্ষোভ ফুটে উঠে। বাংলাদেশের সত্যিকার রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই গত রাতের বেশ কিছু বিশেষ গানের সৃষ্টি।
“যখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে
ঝোরে পড়ে লক্ষ বাংলাদেশীর প্রাণ “
জোয়ান উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে আবেদন করেন বাংলাদেশকে সমর্থন করতে এবং যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী শরণার্থীদের সাহায্য করতে।
বাংলাদেশের কল্যাণে রবিশংকরের অবদান
আইওয়া শহরের “আইওয়া বেঙ্গল ত্রাণ সংগঠন” এর আয়োজনে গত ২১শে অক্টোবর ,১৯৭১ এ স্বনামধন্য সেতারবাদক ওস্তাদ রবি শংকর বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে এক অনুষ্ঠান করেন। অনুষ্ঠানের পূর্বে এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের উপর নেমে আসা বিপর্যয়ের মাত্রা এবং এর ফলশ্রুতি সম্পর্কে বিশাল প্রচারণা চালানো হয়।
অনুগ্রহ করে লক্ষ করুন
১. মুক্তি বাহিনীর প্রচুর পরিমাণে শীত বস্ত্র, ঔষধ, তাবু এবং কম্বল প্রয়োজন। আপনি আশ্চর্যিত হবেন, এসব সামগ্রী নিজ প্রচেষ্টায় নিজস্ব সম্প্রদায় থেকে কি বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করা সম্ভব। সংগঠনের মাধ্যমে আরও বেশী সংগ্রহ করা সম্ভব। আজকেই উদ্যোগ নিন। মুক্তিবাহিনীর কাছে বিনা মূল্যে এসব সামগ্রী বিমানে পরিবহনের জন্য যোগাযোগ করুন —
ডক্টর মোহাম্মাদ ইউনুস
৫০০ প্যারাগন মিলস রোড। এপার্টমেন্ট- বি-৭
ন্যাশভিল, টেনেসি – ৩৭২১১
ফোনঃ- (৬১৫) ৮৩৩-৩০৬৪
২. চিকিৎসকগণ সহজেই ঔষধ প্রস্তুতকারক কারখানা থেকে লিখিত ভাবে এবং সহকর্মীদের নমুনা ঔষধ দান করার আহবান জানিয়ে বিভিন্ন ঔষধ সংগ্রহ করতে পারেন। ন্যাশভিলের চিকিৎসকগণ ইতোমধ্যে ৯০ বাক্স ঔষধ মুক্তি বাহিনীর হাসপাতালে পাঠিয়েছে। আপনিও এই কাজে সাহায্য করতে পারেন। বিনামূল্যে বিমানে পরিবহনের জন্য উপরে উল্লেখিত ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।
৩. আমরা আমাদের পাঠকের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে তারা মাসিক সদস্যপদের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিউজ লেটার পত্রিকা প্রকাশনায় অবদান রাখার আশা ব্যক্ত করেছেন। আমরা এই মুহূর্তে আলাদা করে পত্রিকার জন্য কোন অবদান গ্রহণ করছিনা। তবে আমরা দৃঢ়ভাবে পাঠকদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর কার্যক্রমের সাহায্য ও সমর্থনে অবদান রাখতে। আপনি কি মাসিক / সময়মত আপনার অবদানের অংশ দিতে পারবেন না?
.
অনুবাদঃ রাশেদ সাইফুল
<৬, ৬১, ৬৮৯-৬৯০>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং ৩১
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
.
জাতিসংঘে বাংলাদেশ রিফিউজি ক্যাম্প
নিউ ইয়র্কঃ ভারতে বাঙ্গালী শরণার্থী ক্যাম্পের চিত্র তুলে ধরার জন্য গত ১ নভেম্বর তারিখে জাতিসংঘ ভবনের সামনের হ্যামারসজোল্ড প্লাজায় সুয়ারেজ পাইপ দিয়ে একটি শরণার্থী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে ইন্ডিয়াতে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ মিলিয়ন বাঙ্গালীর অবস্থা তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ একশন কোয়ালিশন কর্তৃক স্থাপিত ক্যাম্পটি ১ সপ্তাহ ধরে অবস্থান করেছিল।
ভাত, ডাল এবং ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পের রেশনের উপর নির্ভর করে স্বেচ্ছাসেবীরা পুরো সপ্তাহ ক্যাম্পে অবস্থা করেছিল। ইউএন রিফিউজি ক্যাম্পের সংগঠকদের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, ক্যাম্পের অবস্থান করা স্বেচ্ছাসেবীরা কলেরা, টাইপয়েড দ্বারা মৃত্যু ঝুঁকিতে ছিল, এমন কি তাদের হতভাগ্য স্বজাতির মত বর্বর সেনা আক্রমনের শিকার ছিল না কিন্তু তারা জাতিসংঘের ভালো খাদ্য গ্রহণ করা এবং ভালো পোষাক পড়া কূটনৈতিকদের কাছে বাংলাদেশের করুণ বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ একশন কোয়ালিশন এর চেয়ারম্যান ইগাল রুডেঙ্কো বলেছেন, “ক্যাম্পটি গত সাত মাসে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অগ্রহনযোগ্য অসাড়তা এবং অনৈতিক মৌনতার বিরুদ্ধে একটু প্রতিবাদ যখন একটি পুরো জাতি মানব সভ্যতার সবচেয়ে বর্বর গণহত্যার শিকার হচ্ছিল”। তিনি আরো বলেন “ক্যাম্পটি ছিল মার্কিন সরকারের পাকিস্তানী সেনা শাষনের প্রতি অস্ত্র এবং আর্থিক সহায়তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দের প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে যেখান গণতন্ত্র পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সেখানে মার্কিন সরকার অনরত আন্তর্জাতিক ত্রাণ কার্যক্রম কে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তাতে শুধুমাত্র নিপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে”।
রুডেঙ্কো বলেন, জাতি সংঘের সব সহায়তা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা শাষকদের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে জাতি সংঘের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে আগের ত্রাণ সহায়তাগুলো সামরিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
কোয়ালিশনে আর্থিক সহায়তাদানকারী প্রুপগুলোর মাঝে রয়েছে- বাংলাদেশের জন্য আমেরিকান, আমেরিকার বাংলাদেশলীগ, পূর্ববঙ্গ রক্ষা কমিটি, যুদ্ধ প্রতিরোধক লীগ, কোয়াকার সামাজিক কার্যক্রম কর্মসূচী, ক্যাথলিক শান্তি সংঘ এবং আর এক ডজন এর বেশি নাগরিক সংগঠন।
কবি এলেন গিন্সবার্গ এবং ডব্লিও. এস. মরউইন সপ্তাহব্যাপী কবিতা আবৃতি কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কর্মসূচিতে আরো অন্তর্ভুক্ত ছিল ত্রাণ সংগ্রহ, স্মৃতিচারণ, সিক্সথ এভিনিউতে শান্তি মিছিল, পাকিস্তান কনস্যুলেট অভিমুখে প্রতিবাদ মিছিল।
.
ইস্ট ল্যান্সিং এ বাংলাদেশ কার্যক্রম
শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে Lansing Area Committee for emergency Refugee Fund নামক একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ১ লাখ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। সংগ্রহ কার্যক্রম সাফল্যের সাথে অগ্রসর হচ্ছে।
MSU রেজিস্ট্রেশনের সময় ৩ দিনের জন্য একটি বুথ বাংলাদেশ এসোসিয়েশন দ্বারা স্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশের উপর সাহিত্যকর্ম বিতরণ করা হয়েছে এবং “জয় বাংলা” বোতাম বিক্রি করা হয়েছে। এসোসিয়েশনের মাধ্যমে বিভিন্ন চার্চ এবং স্কুলে বাংলাদেশের উপর একটি শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইন চালু করা হয়েছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য ডক্টর এ. আর. মল্লিক এবং ডক্টর আসাবুল হক এর সভাপতিত্বে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির ইউনিয়ন বিল্ডিং এ একটি পাবলিক মিটিং এর আয়োজন করা হয়েছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মিশিগান ভ্রমণ রেডিও সিরিজ, টিভি ইন্টারভিউ, প্যানেল ডিসকাশন এবং প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টিগোচর করা হয়েছে।
.
বাংলাদেশের জন্য ফরাসী কমিটি
সম্প্রতি ফান্সে বাংলাদেশের সাথে সংহতি প্রকাসের জন্য ফরাসী কমিটি (French Committee of Solidarity with Bangladesh) গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের নাগরিকদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। কমিটি ফরাসী সরকারে সকল ধরনের অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম, হেলিকপ্টার, সাবমেরিন সহ ধরনের অতিরিক্ত পার্টস সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ আক্রমের আগে পাকিস্তানী সরকারের সাথে সে সকল চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল তার ডেলিভারির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য অনুরোধ জানিয়ে বিবৃত প্রকাশ করেছে। কমিটি বিশেষভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একটি বিবৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যেখানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার দেশকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার জন্য ফরাসী সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।
.
অনুবাদঃ মোহাঃ তুর্য রহমান এবং তানুজা বড়ুয়া
<৬, ৬২, ৬৯১-৬৯৪>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং ১৪
তারিখঃ ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ কনফারেন্স
১০ থেকে ১৮ নভেম্বর ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে ‘পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় আমেরিকার প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে পরামর্শ’ শীর্ষক একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন আয়োজন করে চার্চ দলের প্রতিনিধিরা (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ চার্চেস, দ্যা ফ্রেন্ডস এবং ইউনিটারিয়ান ইউনিভারসালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন সহ) সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ১০০ জন আলোচিত জননেতা এতে অংশ নেন।
প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতা রাখেন সিনেটর কেনেডি। সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সমালোচনা করেন এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরের ভয়াবহতা বর্ণনা করেন যেখানে দৈনিক প্রায় ৪৩০০০ শিশু মৃত্যুবরণ করছে (কেনেডির ভাষ্যমতে)।
অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডিমক, যিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয় ভাষা ও আঞ্চলিক কেন্দ্রের পরিচালক। (অধ্যাপক ডিমক-এর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণের অনুলিপি বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার , রাস্তা-৪২৩৫ এসআর, ওয়াশিংটন ডি.সি.–তে পাওয়া যাচ্ছে)।
পররাষ্ট্র দফতরের পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বিভাগের পরিচালক ব্রুস লেইঙ্গেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যাপারে গভীর আলোকপাত করেন কিন্তু প্রশাসনের নীতির প্রতি কোন বিশ্বাসযোগ্য সমর্থন আনতে ব্যর্থ হন।
তিনি দৃঢ়ভাবে ব্যাক্ত করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে যে মুজিব বেঁচে আছেন।
সম্মেলনে পাকিস্তান এম্বাসির প্রধান সচিব জনাব মুজাহিদ হোসেন এর বক্তৃতা দেয়ার কথা থাকলেও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মিশনের জনাব এস. এ. এম. এস. কিবরিয়া-র নাম দেখামাত্র তিনি অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। (পরবর্তীতে পাকিস্তান দূতাবাস এ সম্মেলনের ব্যাপারে নিন্দা জ্ঞাপন করে)
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন জনাব এনায়েত করিম এবং তারপর বক্তব্য রাখেন ভারতীয় দূতাবাসের রাজনীতি বিষয়ক মন্ত্রী জনাব মহারাজাকৃষ্ণ রাসগোত্রা।
সর্বশেষ বক্তব্য রাখেন প্রতিনিধি পিটার ফ্রেলিঙ্গুয়েশেন, যিনি সম্প্রতি ভারতের শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসেছেন।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ডঃ হোমার জ্যাক, ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অফ রিলিজিয়ন ফর পিস’- এর সাধারণ সম্পাদক, আরও ছিলেন ‘কাউন্সিল ফর ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল একশন, ইউনাইটেড চার্চ অফ ক্রাইস্ট’ এর পরিচাল্ক হ্যারি এপেল হোয়াইট, ‘ ইউনিটারিয়ান ইউনিভারসালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন, ওয়াশিংটন অফিস’ এর পরিচালক রবার্ট জোন্স, ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ চার্চেস’ এর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী বিভাগের ডঃ এলান প্যারেন্ট, এবং ‘ফ্রেন্ডস কমিটি অন ন্যাশনাল লেজিসলেশন’ এর এডওয়ার্ড স্নিডার।
বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন এর চিঠি
বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার পর বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন, যুক্তরাজ-এর সাধারণ সম্পাদক ৪ নভেম্বর,১৯৭১ তারিখে সকল ডাক্তারদের প্রতি নিম্নের চিঠিটী প্রকাশ করেনঃ
সুপ্রিয় সহকর্মীগণ,
অবস্থা অতীব শোচনীয়। ঔষধ এবং গরম কাপড়ের ব্যাপক সংকট চলছে। সেপ্টেম্বরে সেনাপ্রধান হাসপাতাল পরিদর্শন করেন, অক্টোবরে বাংলাদেশের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন। সেনাপ্রধান আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেনাপ্রধান আমাদের আরও তিনটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছেন, এমনকি এর অন্যথা না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। যত তাড়াতাড়ি এই কাজ সম্পন্ন হবে, দেশের যুদ্ধে আমরা ততই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবো।
বিগত দুই মাসে আমাদের যা যা দেয়া হয়েছে-
-মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা
-চিকিৎসা সরঞ্জাম (৫০০০ পাউন্ড ঔষধ ইত্যাদি)
– বস্ত্র (২০০০ পাউন্ড)
নিম্নবর্ণিত কাজসমূহে অতিসত্বর আপনাদের সাহায্য প্রয়োজন-
১- প্রথম বাংলাদেশ হাসপাতালটি স্থাপনের জন্য ডাঃ মবিন অসাধারণ কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বিগত ছয় মাস যাবত ওখানে কাজ করে যাচ্ছেন। খুব শীঘ্রই তাঁকে বদলি করা প্রয়োজন। তিন মাসের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের গুরুভার নিতে আগ্রহী থাকলে আপনারা যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
২- অনুগ্রহপূর্বক আপনার বেতনের ১০ শতাংশ আমাদের দেয়ার চেষ্টা করুন, উক্ত অর্থ ব্যাঙ্কার অর্ডারের মাধ্যমে সহজেই সংগ্রহ করা যাবে।
৩- ঔষধের ব্যাপারে, স্থানীয় চিকিতসকদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের বিনামুল্যে পাওয়া নমুনাগুলো অনুদানের জন্য অনুরোধ করুন। এস্পিরিন, কাশি প্রতিরোধী এন্টিবায়োটিক, টিটেনাস টিকা, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ঔষধ- সবগুলোই প্রয়োজন।
৪- গরম কাপড় দানের জন্য সকল্কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। মুক্তিবাহিনীদের ঠান্ডায় মারা পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে তাঁদের মৌলিক চাহিদাটুকু অন্তত পূরণ করা প্রয়োজন। এসব সামগ্রী যুক্তরাজ্য থেকে সহজেই পাঠান যাবে। উলে বোনা স্কয়ার একসাথে জুড়ে দিলে বেশ ভালো কম্বল বানানো যায়। অনুগ্রহ করে এসব দিয়ে আমাদের সাহায্য করুন।
৫-যুক্তরাজ্যের সকল বাংলাদেশী ডাক্তারদের নাম আমাদের ডাকপ্রেরণ তালিকায় লিপিবদ্ধ নেই। এব্যাপারে আপনাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন এর তালিকায় যেসকল ডাক্তারদের নাম এখনো লিপিবদ্ধ করা নেই, ব্যাক্তিগত উদ্যোগে সেইসব নাম খুজে বের করে আমাদের জানানোর জন্য অনুরোধ করছি। কোন ঠিকানা পরিবর্তন হলে তৎক্ষণাৎ আমাদের জানানোর ব্যাপারেও উৎসাহিত করা হচ্ছে।
গতকাল বাংলাদেশ থেকে মুক্তি ফৌজের খবর জানিয়ে লেখা একটি চিঠি আমি পাই। আমাদের মুক্তিবাহিনী ছাতক দখল করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সুনামগঞ্জের দিকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। চিঠিতে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের প্রতিবেদনের একটি গোপন তথ্য ছিল, যাতে জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহতের ব্যাপারে বর্ণিত আছে।
.
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকা, হতাহত ব্যক্তির সংখ্যা ২৬-০৭-১৯৭১ পর্যন্ত
হাসপাতালে আনার পর মৃতের/নিহতের মোট সংখ্যা— ৭,৪৯৩
মারাত্মক আহত মোট সৈন্যের সংখ্যা — ৫,৬৪৩
মোট আহত সৈন্যের সংখ্যা— ৪,৮৩০
সাপের কামড়ে মৃত মোট সৈন্যের সংখ্যা — ১৪৭
পরবর্তীকালে অন্যত্র স্থানান্তরিত মানসিক ভারসাম্যহীন সৈন্যের সংখ্যা — ২৪৬
———-
মোট — ১৮,৩৫৯
.
আমাদের প্রকল্পে ব্রিটিশ সর্বসাধারণের আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি, এবং আশা করছি “ভিয়েতনাম এর জন্য চিকিৎসা সহায়তা” এর অনুরূপ একটি চিকিৎসা সেবা কমিটি প্রতিষ্ঠা করতে পারবো । প্রতি ৪-৬ সপ্তাহ নাগাদ আমরা আপনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবো।
যেসব বাঙ্গালী স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করছেন না তাদের নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখা অত্যন্ত জরুরী। চিকিৎসক এবং ওষুধ ছাড়া আমাদের যোদ্ধাদের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি এবং আমাদের তা করতেই হবে।
বিনীত
এ টি এম জাফরুল্লাহ চৌধুরী
মহাসচিব
.
মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ কর্তৃক বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সভাপতিকে প্রেরিত চিঠি
প্রতি
ডাঃ এ. এইচ. এস. রহমান
সভাপতি
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন,
প্রিয় ডাঃ রহমান, অক্টোবর ১৩, ১৯৭১
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাময়িক যুক্তরাজ্য প্রত্যাগমনের সুযোগে আমি আপনাকে লিখছি, এবং যুদ্ধ ময়দানে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ঔষধপত্রের জন্য হাসপাতাল স্থাপনে ডাঃ জাফরুল্লাহ এবং ডাঃ মবিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য আমি আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। এ পর্যন্ত তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে একটি হাসপাতাল স্থাপন করেছেন, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাঁশের কুড়েঘরে স্থাপিত হলেও, এটির একটি ভালো হাসপাতাল হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ কথা বলাই বাহুল্য যে, চিকিৎসা সুবিধা এবং সরঞ্জামাদি প্রেরণে আপনাদের আগ্রহ এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশাবাদী , যা ডাঃ জাফরুল্লাহর নিবিড় তত্ত্বাবধানে যথাযথভাবে ব্যবহৃত হবে বলে আমি নিঃসন্দেহ।
বিনীত
এম. এ. জি. ওসমানী .
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিন
মুক্তি বাহিনিকে সহায়তা করুন
আপনি যদি একজন চিকিৎসক হয়ে থাকেন, তবে আপনার অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজন। আপনি তিন মাস মুক্তিবাহিনীর হাসপাতালে সেবা প্রদান করতে পারেন। ডাঃ জিল্লুর রহমান আতহার এম. ডি. (808 Hillwood Blvd., Nashville, TN 37209, Phone (615) 356-3912) উত্তর আমেরিকার চিকিৎসা কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করছেন এবং যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। মুক্তিবাহিনীর হাসপাতালের জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে অংশগ্রহণ করবেন এমন চিকিৎসকদের তালিকা তৈরিতে সহায়তা করতে তার সাথে যোগাযোগ করুন। যুক্তরাজ্যের মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সাথে আপনি চাইলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন (9A Wotton Road, London, NW2, U.K.)।
অনুগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর জন্য ওষুধ, গরম কাপড় এবং অর্থ সাহায্য প্রেরণ করুন। মুক্তিবাহিনীর জন্য বিনামূল্যে বিমানযোগে ওষুধ প্রেরণ সংক্রান্ত তথ্যাদি এবং আর্থিক সাহায্য পাঠানোর মাধ্যম সম্পর্কে জানতে ডাঃ মুহাম্মদ ইউনুসের সাথে যোগাযোগ করুন (500 Paragon Mills B-7, Nashville, TN37211, Phone (615) 833-3064)।
.
অনুবাদঃ গাজী আসীফ সালাহ্উদ্দীন (লেনিন)
<৬, ৬৩, ৬৯৫-৬৯৭>
শিরোনামঃ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ তৎপরতা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং ১৪
তারিখঃ ১০ নভেম্বর, ১৯৭১
.
আমেরিকা জুড়ে বাংলাদেশ বিষয়ক কর্মকাণ্ড
সান ফ্রান্সিসকো উপকূলীয় এলাকাঃ
নভেম্বরের ২ তারিখে ড. এআর মল্লিক এবং ড. এ হক, জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রায় ২৫০ জন ছাত্র ও শিক্ষকদের সমাবেসে বক্তব্য রাখেন। আমেরিকান লিগ ফর বাংলাদেশ জনসাধারণের মাঝে এবং ক্যাম্পাসে মিছিলের জন্য ব্যাপক প্রচারণার আয়োজন করে। আয়োজনটি সম্পর্কে স্ট্যানফোর্ড ডেইলি এবং স্থানীয় পালো আল্টো টাইমস আয়োজনটি সম্পর্কে যথাযথ প্রচার করে। মিছিলের ঠিক আগমুহূর্তে আগতরা স্থানীয় সংবাদকর্মীদেরকে উদ্দেশ্য করে তাদের বক্তব্য জানান। যেখানে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ও ধরন ব্যাখ্যা করেন।
তারা বারংবার উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা একটি শত্রু রাষ্ট্র থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে, যে শত্রুরা জুলুমবাজ এবং যাদের অত্যাচারের কায়দা মধ্যযুগীয়। মিছিলটি বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা জোয়ান বায়েজ এর একটি গানের মাধ্যমে সূচনা হয় তারপর মি: নিক্সনের তথাকথিত শান্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল ও দরিদ্র দেশ আক্রান্ত হয়েছে তা তুলে ধরা হয়।
ড. মল্লিক তার উদ্বোধনী ভাষণে বাংলাদেশে বিদ্যমান গণহত্যামূলক যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন। তিনি সেই র্যালিতে জানান বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি একটি সত্য ও ন্যায়ের স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তাদের এই সংগ্রাম মৃত্যুর বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার।
তিনি পাকিস্তানি চলমান শাসনের বর্বর এবং মধ্যযুগীয় চরিত্রের কথা তুলে ধরেন। শত্রু যেখানে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পায়তারা করে চলেছে।
ড. মল্লিক এর পর ড. হক এই সমাবেসে বক্তব্য রাখেন। তিনি নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন এবং সমাবেশে বলেন, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জনতার মুক্তির সংগ্রাম ক্রমাণ্বয়েই এগিয়ে চলেছে এবং জয় আসবেই। বাংলাদেশের জনগণের বাহিনী অপ্রতিরোধ্য। মিছিল শেষে স্ট্যানফোর্ড উইমেন ফর পিস এর মুখপাত্র মিসেস হুবার্ট মার্শাল, বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার প্রতি নিক্সন প্রশাসনের সমর্থনের তীব্র সমালোচনা করেন।
স্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাস ছাড়াও বক্তারা ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ বার্কলে এবং সান্টা ক্রুজেও বক্তব্য রাখেন।তারা নাগরিকদের প্রতি আহবান জানান জুলুমবাজ ও অত্যাচারি পাকিস্তান সরকারের প্রতি যেকোনোরকমের সাহায্য সহযোগিতা বন্ধে সোচ্চার হতে।
.
সান্তা ক্রুজ, ক্যালিফোর্নিয়া:
১০ই নভেম্বর সান্তা ক্রুজের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে ছাত্র ও শিক্ষকদের একটি মিটিংয়ে ‘ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ’ নামে একটি ক্যাম্পাস গ্রুপ সৃষ্টির প্রস্তাব রাখা হয়, যেখানে ক্রিস মেইয়ার এবং ইভলিন লিগ থাকবেন সমন্বয়ক এবং প্রফেসর দিলিপ বসু থাকবেন উপদেষ্টা। এই গ্রুপটির কাজ হবে ক্যাম্পাস এবং স্থানীয় কমিউনিটিগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাপারটি সম্পর্কে জানানো, যার জন্য তারা লিফলেট, লেকচার, টিচ-ইন এবং চলচিত্র প্রদর্শন ইত্যাদি উপায়ের কথা ভাবেন। শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে তাদের নিজ নিজ পিতামাতা/অভিভাবকদের প্রাসঙ্গিক লেখালেখি মেইল করতে অনুরোধ করা হয়, যাতে তারা সেগুলোর ভিত্তিতে ত্রাণ সাহায্য চাইতে পারে এবং তাদের ক্রংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের চিঠি দিতে পারে। নভেম্বরের ১০ তারিকে প্রায় আড়াইশো জন শিক্ষার্থী অনশনের জন্য স্বাক্ষর দেয়, বাংলাদেশের পীড়িত জনগণের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনই এই অনশনের উদ্দেশ্য। নিজেদের মিল টিকেটের টাকা তারা শরণার্থীদের ত্রাণে দান করতে পারে।
.
পূর্ব ল্যানসিং, মিশিগান
ডিসেম্বরের ১ তারিখে অনশনের আয়োজন চলছে ১৬টি ডরমিটরিতে, ২০টি মেয়েদের সংঘে, ৩০টি ফ্র্যাটার্নিটি এবং ১৩টি কোঅপ হাউজিংয়ে। অনশনের আয়োজন থেকে উত্তোলিত সমুদয় অর্থ ইত্যাদি শরণার্থীদের দানে পাঠানো হবে। বাংলাদেশি বক্তারা বিভিন্ন ডরমিটরি এবং উচ্চ-বিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশ বিষয়ে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের আবেদনের কথা অল্পসময়ের জন্য হলেও স্থানীয় টিভিতে প্রচার পেয়েছে। নভেম্বরের ১৪ তারিখে, বাংলাদেশে সংঘটমান ইতিহাসের চরমতম মানবিক বিপর্যয় এবং তার ফলে সৃষ্ট শরণার্থীদের দুর্দশার কথা নিয়ে ১৫ মিনিট ব্যাপী আলোচনা করেন ল্যানসিং এরিয়া কমিটি ফর ইমার্জেন্সি রিফিউজি ফান্ডের রেভ ওয়ারেন ডে এবং মি. এস পোদ্দার। নভেম্বরের ২১ তারিখে পুরো ল্যানসিং এলাকার সকল প্রেসবাইটারিয়ান চার্চগুলো শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহ করে।
.
ডিউইট, মিশিগান
নভেম্বরের ১৮ তারিখে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে ডিউইট-ল্যানসিং এর লায়নস ক্লাব তাদের সভায় বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানায়। তিনি সেই সভায় বাংলাদেশের বিদ্যমাণ পরিস্থিতি সবাইকে অবহিত করেন এবং তহবিল ও শীতবস্ত্র দানের অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধ এবং লিফলেটও বিলি করা হয়।
.
অ্যান আরবর, মিশিগান
নভেম্বরের ২২ তারিখে মিশিগান ইউনিভার্সিটির সাউথ কোয়াড্রাঙ্গেল এর প্রায় ১০০০ শিক্ষার্থী বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনশন পালন করে। সন্ধ্যায় অনশনরত শিক্ষার্থীদের জন্য গণসভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন মি. রব হিউবার এবং মি. হ্যাংক হেইটোউইট। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরে মিস বেথ লিন্ডবার্গ, মি. অশোক তালওয়ার এবং মিস্টার ও মিসেস রাজা দম্পতির গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন মিস শেরন লোয়ার এবং মিস ইন্দু মালিনি। অনুষ্ঠানটির পরিচালনা ও সমন্বয়ে ছিলেন মি. পিটার হক এবং মিস স্নেহলতা দীক্ষিত। অনশনটির আয়োজনে ছিলেন মি. বার্ট টাউব। ইউনিভার্সিটি সেন্টারে সাপ্তাহিকভাবে একটি বাংলাদেশ ইনফরমেশন ডেস্ক পরিচালিত হয় একটি সাব-কমিটির চেয়ারম্যান মিস টেরি ক্লাইন এর তত্ত্বাবধানে, তাদের কাজ ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি করা।
.
আরবানা, ইলিনয়েস
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়েসের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় কসমোপলিটান ক্লাবের অর্থায়নে একটি প্যানেল ডিসকাশনে অংশগ্রহণ করে। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মি. মোহাম্মদ এইচ মণ্ডল এবং ইস্টার্ন ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটি অ্যাট ক্লেসটন তিন এর ড. এম রহমান বাংলাদেশের বিদ্যমান শোকাবহ পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও আলোচনা করেন। অ্যাসোসিয়েশনটি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি চলচিত্র প্রদর্শন করবে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহের জন্যও একটি উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
.
গিনসবার্গ এবং ভজনেসেনস্কি এর কবিতা আবৃত্তি
নিউ ইয়র্ক:
প্রথমবারের মতো অ্যালেন গিনসবার্গ এবং খ্যাতনামা রাশিয়ান কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি একসাথে কবিতা আবৃত্তি করবেন। আবৃত্তি অনুষ্ঠানটি হবে, সিক্সটিন্থ স্ট্রিট ২০৮ই এর সেইন্ট জর্জ চার্চে, ২০শে নভেম্বর, সন্ধ্যা ৭টায়। বাংলাদেশে বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ্যের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আমেরিকানরা তার নিরসণে কী ভূমিকা রাখতে পারে, তাই অনুষ্ঠানটির প্রতিপাদ্য।
গিনসবার্গ, যিনি সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে এসেছেন, যেভাবে বলেন:
[কোটি ভাইয়েরা আছে বিপদে
কোটি বোনের নেই কোনো যাবার জায়গা,
কোটি শিশু ভিজছে বর্ষায়,
কোটি মা কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়
যশোর রোডে বইছে সেপ্টেম্বরের বন্যার জল।]
তাঁদের সাথে যোগ দেবেন কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স, গ্রেগরি করসো, পিটার অরলোভস্কি, অ্যান ওয়াল্ডম্যান, মাইকেল ব্রাউনস্টেইন, ডিক গ্যালাপ এবং রন প্যাজেট।
আবৃত্তি অনুষ্ঠানটির ব্যয় নির্বাহ করবে আমেরিকানস ফর বাংলাদেশ নামে বাংলাদেশের বিদ্যমাণ দুর্দশা সাধারণের মাঝে তুলে ধরে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সাহায্য সংগ্রহে নিবেদিত একটি সচেতন নাগরিক সংঘ।
কবিতা আবৃত্তি ইংল্যান্ডে
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের জন্য, ৭১-এর ১৪ই নভেম্বর, অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন স্যাডলার্স ওয়েলস থিয়েটার কনসার্টে একটি বাংলা কবিতা পাঠ করবেন সেই সাথে পড়ে শোনাবেন শেক্সপিয়ার এবং ইয়েটস থেকেও। বিখ্যাত সেতার বাদক রবি শঙ্কর এর ভাগনে বীরেন্দর শঙ্কর এবং প্রখ্যাত বাঙালি লোকসঙ্গীতশিল্পীরাও থাকবেন সেখানে।
.
.
অনুবাদঃ তামীম
<৬, ৬৪,৬৯৮>
শিরোনামঃ পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের ডাক
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, টরেন্টোঃ নং ২
তারিখঃ ৩১ জুলাই, ১৯৭১
.
পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের ডাক
“আমাদের সাথে ইন্ডিয়ার যুদ্ধ খুবই সন্নিকটে”, গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার চরম সাবধানবানীর পর পরই প্রথম বারের মতো পাকিস্তান সেনাবাহিনী নতুন সৈন্য যোগদান কর্মসূচী শুরু করে, লিখেছেন অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস। এবং এই পূর্ব প্রদেশের যুদ্ধ ইতিমধ্যে পশ্চিমের অর্থনীতিতে থাবা দেয়া শুরু করে দিয়েছে। করাচী সংবাদপত্রের সূত্রে জানা যায় শুধু মাত্র করাচীতেই ২,৩০০ টেক্সটাইল শ্রমিক ও ১,০০০ সরকারি কর্মীকে চাকরীচ্যুত করা হয়। ৭৫টি টেক্সটাইল কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লায়ালপুরে শ্রমিকরা পথে নামে এই গণ চাকরিচ্যুতির বিরুদ্ধে।
.
সম্পূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের এই বাজার ধ্বসে। পূর্বের সহজ কাঁচামালের সরবরাহ হারিয়ে ফেলায় নগদে কিনতে বাধ্য হয় বিভিন্ন রাসায়নিক কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি। কিছু জাপানি কোম্পানি সরাসরি ঋণ দিতে অস্বীকার করে বৃটিশ ব্যাংকের নিশ্চয়তা ছাড়া। অন্যদিকে বৃটিশ রপ্তানি বোর্ড পাকিস্তানের সাথে নতুন চুক্তি করতে নারাজ হওয়ায় বৃটিশ রপ্তানিকারকরা পিছিয়ে যায়।
.
নিউজউইক এর লরেন জেনকিন্স এর রিপোর্টে জানা যায়- একজন করাচী সম্পাদক বলেন “পাকিস্তানের মৃত্যু হয় মার্চেই। শুধুমাত্র একভাবেই এই দুই প্রদেশকে একসাথে ধরে রাখা যাবে, বেয়নেট আর মশাল দিয়ে। কিন্তু এটা একতা নয়, দাসত্ব। আর কখনোই একটি জাতি আমরা পাবোনা, পাবো দুটি শত্রু।”
.
শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েই চলে আর তার সাথে পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) চিফ জেড এ ভুট্ট খুব দ্রুত সমর্থন হারাতে শুরু করে। সম্প্রতি তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন, কিন্তু ইয়াহিয়া খান কোনভাবেই শাসন ব্যবস্থা অসামরিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি ছিলেননা।
.
[বাংলাদেশঃ বাংলাদেশ সমিতি কানাডা শাখা কর্তৃক প্রকাশিত।]
.
.
অনুবাদঃ তাসমিয়াহ তাহসিন
<৬, ৬৫, ৬৯৯-৭০০>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, টরেন্টো, নং ৩
তারিখঃ ২৫ আগস্ট, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ সংগ্রামের সময় থেকে, দীর্ঘদিনের ফুঁসতে থাকা সুপ্তাবস্থা গত মার্চে তীব্র কর্মকান্ড রূপে বিস্ফোরিত হয়, আকস্মিক এই পরিবর্তনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে আমাদের মন দ্বন্দযুক্ত এবং আমাদের আত্মা বাঙ্গালিদের দুঃখ-কষ্ট ও প্রাণবন্ততায় ছোঁয়া।
যে গনহত্যা ৭০ লক্ষ্য বাঙ্গালিদের দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে তা পুরো বিশ্বকে স্তব্ধিত করেছে। এই অধিকারচ্যুত মানুষগুলো তাদের এক সময়ের স্বদেশীদের মরণাস্ত্রের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে অন্যের দেশে রোগ ও অপুষ্টির মুখোমুখি হতে রাজি। যে ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে তারা অতিক্রম করেছে, তারা এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে। এই অবস্থায় পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। এবং “রাজনৈতিক সমঝোতা”-র সম্ভাবনা একদম নেই। তাদের শুধু একটি আশা-যা তাদের একটি উন্নত ভবিষ্যত দিতে পারে- সে আশা জয়ের আশা। জয় মুক্তিবাহিনীর, জয় বাঙালি মানুষের।
বাংলাদেশের মধ্যে ইয়াহিয়া খানের বাহিনী তাদের ত্রাসের সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্বের ইতিহসের সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়ে, কেউ কথা বলতে সাহস করে না। কিন্তু মানুষের মনে শুধু একটিই ভাবনা- যখনই সুযোগ আসে, অত্যাচারীদের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া এবং স্বাধীনতা অর্জন করা। পাকিস্তানের সরকার সেটি জানে। সেজন্যই তারা বাঙ্গালিদের নিরুৎসাহিত করতে তীব্র প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা জনপ্রিয় বাহিনীগুলোকে পাকিস্তান বিরোধী অশুভ ভারতীয় চক্রান্তের অংশ হিসেবে অভিযুক্ত করে “দুষ্কৃতিকারী” বলে চিহ্নিত করে। হিন্দু হওয়াকে অপরাধ বানিয়ে তারা ধর্মকে বিভেদকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস করে। তারা সহযোগীদের নিয়ে “শান্তি কমিটি” প্রতিষ্ঠা করে। সবার একটাই লক্ষ্য- মানুষের পরাধীনতা।
কি আছে যা এই মানুষদের আশা দিতে পারে , যারা জুলুমের মধ্যে বাস করছে, যাদের জীবন ও সহায়-সম্বল কখনোই সুরক্ষিত নয় এবং যারা তাদের বর্তমান দূর্দশার সাথে সাথে আসন্ন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ? তাদের জন্য “ইসলামিক” পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্রের “একতা ও অখন্ডতা” মানেই শোষিত উপনিবেশবাসী হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করা। তাদের আশাও শুধু জয়ের জন্য। মুক্তিবাহিনীর জয়ের! বাঙালি মানুষের জয়!
যারা প্রবাসে বসবাস করছেন, বাঙালি হিসেবে আপনাদের সুযোগ আছে এই অতিপ্রয়োজনীয় জয়ে অবদান রাখার। আপনারা এই অত্যাচারীদের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবেন, এবং বিশ্বের প্রভাবশালী মানুষদের কাছে ও সচেতন নাগরিকদের কাছে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য জানাতে পারবে্ন। আপনারা তাদের সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে চেষ্টা করতে পারবেন। আপনাদের চুপ থাকার কোন বৈধ ছুতো নেই। আপনাদের মৌনতা দেশে আপনাদের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেনা। কেউ সেখানে নিরাপদ নয়। তাই গর্জে উঠো বাংলাদেশ।
বাঙ্গালিদের জয়ে অবদান রাখার আরেকটি উপায় হচ্ছে আপনাদের অর্থনৈতিক সমর্থন। হতে পারে আপনি খুব অল্পই দিতে পারবেন, কিন্তু এই ক্ষুদ্র পরিমাণও এই প্রচেষ্টায় জোরালো সমর্থন দিতে অন্যদের অবদানের সাথে যুক্ত হবে। প্রতি মাসে কিছু কিছু দান করুন। আপনাদের অর্থনৈতিক সমর্থন অব্যাহত থাকাটা প্রয়োজন। মানুষেরা যেখানে প্রাণ ত্যাগ করছে, সেখানে আপনাদের একটি ত্যাগই যথেষ্ঠ- শুধুমাত্র আর্থিক অবদান। উদার হতে দ্বিধা করবেন না।
বাংলাদেশ মানে অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। এর মানে সত্যিকারভাবে মানুষের বিশ্ব-নীতির গনতন্ত্র। এর মানে একটি পার্থিব প্রদেশ যেখানে সকলের জন্য সমতা থাকবে। এইসবকে বাস্তবরূপ দিতে অনেক বাঁধা পেরোতে হবে । আপনার সমর্পিত সহায়তা এই স্বপ্নকে সত্যি করতে সাহায্য করতে পারে। দেশবাসীর দুঃখ-কষ্টকে বৃথা যেতে দিবেন না। নিজেকে সংগ্রামে সমর্পন করুন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়কে নিজের বিজয় করে নিন।
.
অনুবাদঃ এ. এস. এম. হাসান লতিফ
<৬,৬৬,৭০১-৭০২>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
শেখ মুজিবের বিচার ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়া |
বাংলাদেশ টরোন্টোঃ নং.৩ |
২৫ আগষ্ট, ১৯৭১ |
শেখ মুজিবের বিচারের ঘোষণা
রাওয়ালপিন্ডি,
আগষ্ট ৯,- “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পায়তারা” ও অন্যান্য অভিযোগে বিশেষ সামরিক আদালতে “পূর্বপাকিস্তান” নেতা শেখ মুজিবে রবিচার করা হবে, গতকাল এক সরকারী ঘোষণায় এ কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিচারিক কার্যাক্রম আগামী কাল থেকে শুরু হবে এবং তা হবে রুদ্ধদ্বার বিচার। মুখপাত্র আরও জানিয়েছেন যে, আইন অনুসারে অপরাধীকে তার স্বপক্ষে লড়ার প্রস্তুতিগ্রহণের জন্য জন্য তাঁর পছন্দানুযায়ী পরামর্শ নিয়োগসহ যথোপযুক্ত সকল সুযোগ সুবিধাদিদেয়া হবে, তবে পরামর্শককে অবশ্যই পাকিস্তানের নাগরিক হতে হবে।
.
বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়াঃ
জাতিসংঘ, নিউইয়র্ক, আগষ্ট ১০, মহাসচিব থান্ট এই মর্মে হুশিয়ারী জানিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তান নেতা, শেখ মুজিব, এর পরিণতি “পাকিস্তানের সীমানার বাইরে অনিবার্য প্রতিক্রিয়া” বয়ে আনবে।জনাব থান্ট জানিয়েছেন যে তিনি প্রতিদিন অনেক সরকার কাছ থেকেশেখ মুজিবের ব্যাপারে উদ্দেগ জানতে পারেন, যিনি আওয়ামী লীগ দলের প্রধান। শেখ মুজিব সম্পর্কিত জনাব থান্টের বিবৃতি বলছে যে, মহাসচিবের “মনে হচ্ছে যে এটি একটি মারাত্মক সংবেদনশীল ও কোমলবিষয় যা সদস্য রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত, এক্ষেত্রে যা পাকিস্তান।” “এই বিষয়টি মানবিক এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন পক্ষের জন্য অত্যন্ত আগ্রহ ও উদ্বেগের বিষয়।”জনাব থান্ট বলেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন রকম সমঝোতায় পৌছা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত অত্র অঞ্চলে শান্তি ও স্বাভাবিক জীবন যাত্র পুনরুদ্ধার সুদুর পরাহত।
.
ওয়াশিংটনঃ
আগস্ট ১০, ১১ জন সেনেটর আহব্বান জানিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার শেখ মুজিবের প্রতি সমবেদনা দেখানোর ব্যাপারে তাদের ‘গভীর আশার’ কথাপাকিস্তানকে বোঝাতে সক্ষম হবে। সেনেটর ফ্রেড আর হ্যারিস যিনি অক্লামের ডেমোক্রেট বলেছেন যে শেখমুজিবের মৃত্যু হলে তাঁর প্রতি অনুগত মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানি অস্থিরতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে এবং এটা হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে যখন যেকোন সময়ে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
.
ওয়াশিংটন
আগষ্ট ১১, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলয়াম রজার্স পাকিস্তানকে এইমর্মে হুশিয়ার করেছেন যে যদি পূর্ব পাকিস্তান নেতা শেখ মুজিবের বিচারে কোন [সংক্ষিপ্ত বিচারিক ব্যবস্থা] গৃহীত হয় তবে এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।জনাব রজার্স ইংগিত দেন যে, যদি গোপন সামরিক আদালতে বিচারাধীন শেখ মুজিব’কে [পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পায়তারার দোষে মৃত্যুদন্ড কিংবা দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড দেয়া হয় তবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারাতে পারে।]
.
প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো এর পক্ষে পাকিস্তানে কানাডার হাইকমিশনার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে [উদারতার ও মানবিকতার মূল্যায়ন] অনুসরণের জন্য অনুরোধ করেছেন। যদিও বিচারিক প্রক্রিয়াটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়, তবুও কানাডার সরকার অনুধাবণ করছে যে এর ফলাফল আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বয়ে আনবে বলে একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন।
.
.
অনুবাদঃ এ. এস. এম. হাসান লতিফ
<৬,৬৭,৭০৩-৭০৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের আন্দোলনের খবর |
বাংলাদেশ টরোন্টোঃ নং.৩ |
২৫ আগষ্ট, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের টরোন্টো পরিদর্শন
জনাব এম. আর. সিদ্দিকি, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় নিয়োগকৃত বাংলাদেশের নয়া রাষ্ট্রদূত দক্ষিণ এশিয়ার উপর আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদিতে টরোন্টোতে অবস্থান করেছিলেন। ২২শে আগষ্ট তিনি [বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ কানাডা (টরোন্টো)] এর সদস্য বর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেন ও মতবিনিময় করেন।
.
বাংলাদেশ বিষয়ে সেমিনার
বিগত আগষ্ট ০৫, ১৯৭১ তারিখে [বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ কানাডা (টরোন্টো)] কর্তৃক [বাংলাদেশেসংকট] শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বক্তা ছিলেন জনাব এন্ড্রু বারউইন এমপি, যিনি ইতোপূর্বে কানাডিয়ান সংসদিয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে গতমাসে ভারত, পিপিকে ও বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। প্যানেলের অন্যান্য সদস্যগণ যারা সম্প্রতি ভারত থেকে ফিরেছেন তাঁরা হলেন টরোন্টো টেলিগ্রামের জনাব ফ্রেডেরিক নোসাল, অক্সফামের জনাব লেসলী স্মিথ এবং ইউনিসেফের জনাব পল ইগনিটিফ। সভাপতিত্ব করেছেন জনাব স্ট্যানলী বার্ক।
.
সকল বক্তা ভারতে অবস্থানরত ৭ মিলিয়ন শরণার্থীর ভয়াবহ জীবনযাত্রার বর্ণণা তুলে ধরেন। যখন জনাব স্মিথ ও জনাব ইগনিটিফ নিজেদের বক্তব্য শুধুমাত্র শরণার্থী সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছিলেন, তখন জনাব বারউইন ও জনাব নোসেল রাজনৈতিক ও অন্যান্য দিক থেকে সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। জনাব বারউইন তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, তাঁর মতে বাংলাদেশ সংকটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জনাব স্মিথ তাঁর বক্তব্যে শরণার্থী শিবিরের ছবি ফুটিয়ে তোলেন।
.
তথাকথিত [পাকিস্তান শান্তি কমিটি]-এর দুইজন বাঙ্গালীসহ একদল পশ্চিম পাকিস্তানী তাদের অবাধ্যতার নমুনা স্বরূপ বিক্ষোভ মঞ্চস্থ করে এবং চরম লজ্জাজনক ও শিশুসুলভ আচরণের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের কার্যাদি পন্ড করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অনুষ্ঠানের দর্শকমন্ডলী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে তারা দ্রুত সভাস্থল ত্যাগ করে। তারা সভাস্থল ত্যাগ করার পর একজন কানাডিয় নাগরিককে বলতে শোনা যায়, “এখন আমি জানি আসল সমস্যাটি কোথায়।” অন্যজন বলেন, “ এই যদি হয় স্বদেশীদের প্রতি তাদের (বিক্ষোভ প্রদর্শণকারী) আচরণ, তবে আমি বুঝতে পারছি না তাদের মধ্যে কি করে অর্থপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব।
সেমিনারটি সফল হয় ও এতে ৫০০ এরও বেশী অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন।
.
দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি
শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স
কানাডার অক্সফাম কর্তৃক টরোন্টোতে ২০ ও ২১ আগষ্ট একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজিত হয়েছে। কনফারেন্সটিতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণের আশা ব্যক্ত করলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে অসমর্থ হয়েছেন।
প্রতিনিধিগণ, যাদের সকলেই ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন, উদ্দেশ্যের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করেন এবং পরিশেষে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি ঘোষণা প্রকাশ করেন। উক্ত ঘোষণায় সকল সরকারের প্রতি এই মর্মে অনুরোধ করা হয়ঃ
১। পাকিস্তানে সমগ্র সামরিক পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করা।
২। পাকিস্তানের অনুকূলে সকল অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা।
৩। জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য সকল উৎস কে জোরদার করে [পূর্বপাকিস্তান]-এর দূর্ভিক্ষ মোকাবেলায় ব্যাপক ভাবেজরুরী ত্রাণ সরবরাহ কার্যক্রম গ্রহণ করা।
৪। ভারতের শরণার্থী সমস্যাজনিত কারণে অর্থনৈতিক চাপ সহণীয় রাখতে সহযোগীতার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা।
৫। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচাতে হস্তক্ষেপ করা।
বাংলাদেশের স্বীকৃতি না থাকায় ঘোষণাটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়নি।
.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ৬৮, ৭০৫>
শিরোনামঃ- স্থানীয় সংবাদ
সংবাদপত্রঃ- বাংলাদেশ টরন্টো নম্বর ৬
তারিখঃ- ১৫ ই অক্টোবর, ১৯৭১
স্থানীয় সংবাদ
টরন্টোতে অধ্যাপক মুজাফফর
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি এবং উপদেষ্টা কমিটির সদস্য জনাব অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ , জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে নিউ ইয়র্ক এসেছিলেন এবং বাংলাদেশে ফেরত যাবার প্রাক্কালে টরন্টোতে আসেন। ৭ ই অক্টোবর তিনি সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
তিনি তার বক্তব্যে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের অগ্রগতি এবং সেই সাথে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক অগ্রগতির উপর প্রতিবেদন পেশ করেন। তিনি ওই মুহূর্তের যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাস্তবচিত্রও তুলে ধরেন। জাতীর এই সংকটলগ্নে সকলের ঐক্যবদ্ধতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরও বলেন, যদিও বাংলাদেশের জনগণ তাদের উপর আরোপিত এই যুদ্ধের দ্রুত অবসান চায়, তারপরও যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় তবে মাতৃভূমির মুক্তির প্রয়োজনে জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই করে যেতে সবাই প্রস্তুত আছে।
দক্ষিণ এশিয়া সংকট কমিটি
সম্প্রতি টরন্টোতে সিবিএস এর সাবেক সম্প্রচারক স্ট্যানলি বার্ককে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করে দক্ষিণ এশিয়া সংকট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির লক্ষ্য হচ্ছে কানাডার জনগণকে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে অবহিত করা। জনাব বার্ক জাতীয় পর্যায়ে এই কমিটির কার্যক্রম প্রসারিত করার আশা ব্যক্ত করেন। বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংগঠন সক্রিয়ভাবে জনগণের অবগতির জন্য কাজ করছে। এক বক্তব্যে জনাব বার্ক বলেন, ” যখন লক্ষ মানুষ মৃত্যুর দোর গোঁড়ায় , তখন সকলকে এগিয়ে আসতে হবেই “।
ঘোষণা
২০শে অক্টোবর সন্ধ্যা ৭ টায় হ্যামিলটনের ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য জনাব এস. এ. সুলতান এবং জনাব মফিজ চৌধুরী।
সমিতির পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হবে ৩১শে অক্টোবর বেলা ১২ টায়। স্থান – ১১৭ কার্লটন ষ্ট্রীট , টরন্টো। সকল সদস্যকে সভায় উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ৬৯, ৭০৬>
শিরোনামঃ- স্থানীয় সংবাদ
সংবাদপত্রঃ- বাংলাদেশ টরন্টো নম্বর ৭
তারিখঃ- ৩১ শে অক্টোবর, ১৯৭১
.
স্থানীয় সংবাদ
বাংলাদেশ বিষয়ক সম্মেলন
ক্যারিবীয় ছাত্র সংগঠন এবং বাংলাদেশ সমিতির যৌথ আয়োজনে ৬ই অক্টোবর হ্যামিল্টনের ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ বিষয়ক এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য জনাব এস, এ, সুলতান এবং জনাব এস, আহমেদ এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন এবং সভায় উপস্থিতবৃন্দের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্র এবং শিক্ষক এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে সভাটি সফল প্রমাণিত করেন।
একই দিনে ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান পরিষদে উভয় বক্তাই বক্তব্য রাখেন এবং বিকেলে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশ সমিতির সদস্যদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করেন। উভয় বক্তাই জাতীয় সঙ্কটের এই মুহূর্তে সকলের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
৬ ই নভেম্বরের শোভাযাত্রায় যোগদান করুন
আলাস্কার আমশিটকায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের প্রতিবাদে আগামী ৬ ই নভেম্বর , শনিবার বেলা ২ টায় ভিয়েতনাম সংহতি কমিটি এক যুদ্ধ বিরোধী শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশ সমিতি এই শোভাযাত্রায় যোগদান করবে।
বাংলাদেশ সমিতি তাদের নিজস্ব ব্যানার, প্ল্যাকার্ড এবং স্লোগান নিয়ে যোগদান করবে। প্রাথমিকভাবে নিজস্ব কারণ সঞ্চারণ এবং সেই সাথে পৃথিবীর সকল নিপীড়িত মানুষের প্রতি সংহতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সমিতি এই শোভাযাত্রায় যোগদান করবে। আমরা কানাডার জনগণকে জানাতে চাই , আমরা যুদ্ধ চাই না, আমাদের উপর জোরপূর্বক এই যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কুইনস পার্কে বেলা ২ টায় এই শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় এসে আমাদের সাথে যোগদান করুন।
বাংলাদেশের ডাকটিকেট
বাংলাদেশের একটি পূর্ণাঙ্গ ডাকটিকেট সমগ্র আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। ডাকটিকেট সমগ্র কিনতে ইচ্ছুক হলে যোগাযোগ করুন — জনাব খান ( ৩৬৩-২৮৩৪)। অর্জিত অর্থ স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যায় করা হবে।
.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ৭০, ৭০৭-৭০৮>
শিরোনামঃ- সম্পাদকীয়ঃ বাংলাদেশে জনযুদ্ধ
সংবাদপত্রঃ- স্ফুলিঙ্গ ; কুবেক নম্বর ২
তারিখঃ- ১ লা অগাস্ট, ১৯৭১
বাংলাদেশে জনগণের যুদ্ধ
বাংলাদেশের জনগণ এখন যুদ্ধের সম্মুখীন। ভুট্টো – ইয়াহিয়া চক্রের ফ্যাসিস্ট বাহিনী সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীকে পরাধীন করে রাখার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সন্ত্রাস এবং বর্বরতর আক্রমণের প্রয়াশ চালিয়েছে। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সর্বাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরিবর্তে, স্বাধীনতা সংগ্রামে অটল বাঙালী সফলতার সাথে একতাবদ্ধ হয়েছে। পূর্ব বাংলার জনগণ এখন শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ থেকেই নয় বরং পশ্চিমা বহির্বিশ্বের ঔপনিবেশিক সম্রাজ্যবাদ থেকেও বেরিয়ে আসার জন্য সোচ্চার।
বর্তমান বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্বের জনগণের উপর পর্যায়ক্রমে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ও পরাধীনতার শিকল পরাতেই মার্কিন সাম্রাজ্যের মূল স্বার্থ নিয়োজিত। যখনই মানুষ এই শোষণের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে, তখন মার্কিন সাম্রাজ্য এই বিরুদ্ধাচরণ দমনের জন্য তাদের সেনা বাহিনী ব্যবহার করে ( ভিয়েতনাম যুদ্ধ ) , অথবা তাদের নিয়োজিত তথাকথিত “উন্মুক্ত বিশ্ব” র শোষক শ্রেণীর সাহায্য নেয়। পাকিস্তানও এই ব্যবস্থার ব্যতিক্রম নয়। সেকারনেই, এটা মোটেও বিস্ময়জনক ঘটনা নয় যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন করে এবং পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সাহায্যার্থে পুলিশ বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। [ সূত্রঃ- নিউজ উইক, অগাস্ট ২, ১৯৭১। ” এবং এই বিষয়ে তিনি ( সিনেটর কেনেডি ) আন্তরিকভাবে মত পোষণ করেন যে, ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবী সেনাদের বাঙালী বিদ্রোহ দমনের সাহায্যার্থে , পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকার পুলিশ বাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল ” ]। এখন তারা কম্পমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য জাতিসংঘকে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
সংকল্পবদ্ধ বাঙালীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রক্ষার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলে, ভবিষ্যতে ষড়যন্ত্রের ভিন্ন উপায়ও মার্কিন সাম্রাজ্যের আছে।
যারা প্রকৃত অর্থেই আমাদের দেশের স্বাধীনতা চান তাদের অবশ্যই মার্কিন সাম্রাজ্যের এসব অসৎ পরিকল্পনার প্রতি নজর রাখতে হবে। বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থে কাজ করবে। এতে বিশ্বাস করার মত কোন কারণ নাই যে, তাদের কৌশলগত নীতির পরিবর্তন বাঙালী জনগণের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই বিশ্বের জনগণের শ্ত্রূ, এবং এই সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসের উপরই সবার মুক্তি নির্ভর করে। বাংলার জনগণ এখন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া , মধ্যপ্রাচ্য , আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার জনগণের সাথে সম্মিলিত ভাবে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রসর হচ্ছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক পদ্ধতি এখন বাংলার জনগণের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহাসিক ইন্দো-চীন সংগ্রাম এবং বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া যায় যে, ” শ্রেণী সংগ্রাম ” এবং ” গণ যুদ্ধ ” র উপর ভিত্তি করা দীর্ঘায়িত গেরিলা পদ্ধতিই একমাত্র পন্থা যার মাধ্যমে অধিক শক্তিধর শত্রূকে পরাজিত করা সম্ভব। এই পরীক্ষিত পদ্ধতি অনেক যুদ্ধেই দৈত্যসম আমেরিকান শক্তিকে পরাজয়ে বাধ্য করেছে।
অতীতের অনেক ভুল এবং দুর্বলতা এখন সুস্পষ্ট। পরিস্থিতি বোঝার সীমাবদ্ধতার ফলশ্রুতি সীমিত জয়ের জন্য সীমিত সংগ্রাম। কিন্তু ভয়ঙ্কর শত্রূর সামনে এই জয় অকার্যকর এবং কাম্যও নয়, যেহেতু এতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদে শোষিত অধিকাংশ জনগণের সামগ্রিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। যখন শত্রূপক্ষ আপাদমস্তক অস্ত্র সজ্জিত এবং স্বেচ্ছায় নিজ অবস্থান থেকে নড়বে না তখন অহিংসা , অসহযোগ এবং গনতান্ত্রিক পদ্ধতির ধারণা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। অস্ত্র এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির অভাব জনগণকে রক্ত পিপাসু শত্রূর সামনে সহজ ও অসহায় শিকারে পরিণত করেছে।
বাংলার জনগণ অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কার্যকরী যোদ্ধায় পরিণত হচ্ছে। বাঙালী আজ বিশ্বাস করে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং স্থানীয় কিছু লোকের সাহায্যপ্রাপ্ত এই সশস্ত্র শত্রূকে শুধুমাত্র বাঙালী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতৃত্বে এবং প্রতিনিধিত্বে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে দীর্ঘায়িত গণ যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করা সম্ভব ; অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক এবং বৃহত্তর গরীব জনগোষ্ঠী।
.
তানুজা বড়ুয়া
<৬, ৭১,৭০৯-৭১০>
শিরোনামঃ ‘পদ্মা’র ঘটনা
সংবাদপত্রঃ স্ফুলিঙ্গ কিউবেকঃ নং ২
তারিখঃ ১ আগস্ট, ১৯৭১
.
পদ্মার গল্প
সরোয়ার আলম
.
পদ্মা, বাংলার বুকে প্রবহমান খরস্রোতা এক নদী, নিপীড়ন এবং বিপ্লবের ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য বহন করছে, যা বাঙ্গালি কৃষকের জন্য আদৌ নতুন কিছু নয়। এ নামেরই একটি পাকিস্তানি জাহাজ সম্প্রতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে যোগসাজশে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমনের প্রচেষ্টা চালায়।
.
“গত রাতে পাকিস্তানের পতাকাবাহী একটি জাহাজ মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম সমেত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে করাচীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে, যা নিক্সন প্রশাসনের এ সংক্রান্ত নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন” (Ted Szulc, Montreal Star, June 22, 1971.)। ৩০ জুন জাহাজটি মন্ট্রিলে পৌঁছায়। সেদিনেই, দৈনিক মন্ট্রিল স্টার এর প্রথম পাতায় প্রকাশ করে “অস্ত্রবাহী জাহাজকে বিক্ষভ প্রদর্শন”। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কূইবেক ত্বরিত একটি প্রতিবাদ এবং মিছিল আয়োজন করে। তারা স্থানীয় সংবাদ সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে এবং পাকিস্তানে কানাডিয়ান সম্ভাব্য অস্ত্র চালান বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। যদিও কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিশেল শার্প গণমাধ্যমে ঘোষণা দেন, “পদ্মার সাথে কানাডার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই”, কিন্তু এই ঘোষণা তাদেরকে মোটেও আশ্বস্ত করতে পারেনি। এদিকে, হাউজ অফ কমনস এ বিরোধিদলীয় নেতা রবার্ট এল. স্টেইনফিল্ডকে সংসদে বিষয়টি উত্থাপনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
.
সিএনটিইউ নেতা মিশেল চারট্রেন্ড, পলাতক আমেরিকান, দ্যা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, ভিয়েতনামি দেশপ্রেমিক সংঘ, ভিয়েতনামের স্থগিত কমিটি, নারী মুক্তি সংগঠন এবং অনেক স্থানীয় কানাডিয়ান প্রতিবাদ র্যালিতে/সমাবেশে অংশগ্রহন করেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানে অস্ত্র চালান নীতি এবং সামগ্রিক ভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নীতির কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করেন।
.
সেই দিনে সন্ধ্যার মধ্যেই, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম আবিস্কার করে “ কানাডায় তৈরি স্যাবার জেট বিমানের যন্ত্রাংশ পদ্মা জাহাজের মাধ্যমে পাকিস্তান যাচ্ছে”। হেলথ ম্যাককুয়ারী, এমপি, পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। অবশেষে এই অস্ত্র চালানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
.
আমাদের প্রতিবাদ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ নীতির বিরুদ্ধে, বিশ্বের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি বা প্রগতিশীল আমেরিকানদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী তীব্র মনোভাবের প্রতি যাদের কোন সহানুভূতি নেই। অন্যান্য দল, বিশেষত ভিয়েতনামিজ এবং প্যালেস্টানিয়ানদের অংশগ্রহণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভিয়েতনাম , প্যালেস্টাইন এবং বাংলাতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে একই সংগ্রাম চলমান। আমাদের প্রতি তারা যে সংহতি প্রদর্শন করেছে, তা নিশ্চিতভাবেই তাদের স্ব স্ব দেশের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি সংহতি প্রদর্শন নির্দেশ করে। কানাডার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম অস্ত্র চালানের বিরোধিতা করে কারণ তারা জানতো পাকিস্তানের সাথে সামরিক সম্পৃক্ততা সামরিক-শিল্পকে আরও পুষ্ট করবে এবং এর ফলস্বরূপ জনসাধারণকে অধিক করের বোঝা বহন করতে হবে। আমেরিকানরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যয়ভার সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলো; আমেরিকান সমর-শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তাদের প্রচুর কর প্রদান করতে হয়েছে। তারা কি বাংলায় আরেকটি ভিয়েতনাম দেখতে চাইবে? এর উত্তর না। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ খরচের আরও অনেক জায়গা রয়েছে।
* * *
এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সম্পাদক আপনাদের চিঠি এবং মন্তব্যকে স্বাগত জানাবেন।
দ্যা বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কুইবেক এর জরুরি ভিত্তিতে অর্থের প্রয়োজন । দয়া করে নিম্নোক্ত ঠিকানায় আপনার অনুদান পাঠানঃ
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব কুইবেক
৩৫২০ লোনি এভিনিউ, মন্ট্রাল ১৩০, পি. কিউ.
.
অনুবাদঃ তানভীর হেদায়েত
<৬, ৭২, ৭১১>
শিরোনামঃ- বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ- স্ফুলিঙ্গ । কুবেক নম্বর ৩
তারিখঃ- ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ভ্যানকুভারের বাংলাদেশ সংগঠনের সদস্য এবং সহানুভূতিশীলদের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমেরিকার প্রতি প্রতিবাদ
বি.সি. ( ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ) র বাংলাদেশ সংগঠনের সদস্য এবং সহানুভূতিশীলদের উদ্যোগে গত ৩০শে জুলাই আমেরিকান দূতাবাসের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশের পরে তারা বাংলাদেশের যুদ্ধে আমেরিকার কুকর্মের সহকারিতাপূর্ণ আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে স্মারকলিপি পেশ করেন। ইতিমধ্যে এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ বাঙালী শহীদ হয়েছেন এবং এক কোটিরও বেশী সংখ্যক বাঙালী ভারতের কলেরা উপদ্রুত শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবস্থান করছে।
৩ জন বাঙালী নাবিকের কানাডাতে রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন
৩ জন বাঙালী নাবিক গত ১৭ই অগাস্ট পাকিস্তানী জাহাজ “সুতলেজ” পরিত্যাগ করেন। মন্ট্রিলের এক সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, তারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করেন নি, তারা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর জন্য আমারিকা থেকে আসা অস্ত্র সজ্জিত জাহাজে সহযোগিতা করতেও অসঙ্গতি জানান। বর্তমানে তারা কুবেক এর বাংলাদেশ সংগঠনে অবস্থান করছেন।
গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তি বিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের তথ্য আহরণ, সংগ্রহ এবং প্রচার সংস্থার ডক্টর উভান গারসে আমাদেরকে এক লিখিত বক্তব্যে জানান, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের গণহত্যার যেকোনো তথ্য ও দলিল তাদের সংস্থায় পাঠালে তারা বাধিত থাকবেন।
তার সংস্থা গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তি বিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন প্রকাশনী, সাময়িকী, প্রতিবেদন মানচিত্র, নিবন্ধ, ছায়াছবি এবং আলোকচিত্র সংগ্রহ করে।
ঠিকানাঃ- স্টাডিসেন্ট্রাম, পার্কলান ২
বি-২৭০০ সিন্ট নিকি, আস ওআস। বেলজিয়াম।
মুক্তিবাহিনীর আবেদন
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে বাংলাদেশ মেডিকেল সংস্থা, লন্ডনের কাছে এক টেলিগ্রাম বার্তায় ৪ জন অস্ত্রপ্রচার বিশেষজ্ঞ এবং আবেদনিক প্রয়োগকারী ( এনেস্থেটিক ) র জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন-
বাংলাদেশ মেডিকেল সংস্থা
৯ এ ওটন রোড, ক্রিকেলউড
লন্ডন, ডাব্লিউ ২
.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, মুজিবনগর সরকারের ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্র
.
তুষার শুভ্র
<৬.৭৩.৭১২-৭১৩>
.
শিরোনামঃ world concern over Mujibur Rahman’s Trial
সংবাদ পত্রঃ Bangladesh
তারিখঃ ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
[ Bangladesh: সাপ্তাহিক বুলেটিন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ মিশন, ওয়াশিংটন হতে এম আর সিদ্দিকী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।]
.
শেখ মুজিবের বিচারে বিশ্বের উদ্বেগ
সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য আইনজীবি,রাষ্ট্রনায়ক এবং খবরের কাগজ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক কর্তৃক শেখ মুজিবের গোপন বিচারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁদের মতামত এই যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভোটে নির্বাচিত কোন নেতার গোপনে সামরিক আইনে বিচার শুধু অন্যায়ই নয় অমানবিকও বটে।
ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল
ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল এর সেক্রেটেরিয়েট হেলসিঙ্কিতে একটি বিবৃতিতে বলেছিলেন যে বিচার মন্চায়ন এবং গনহত্যা ও লুটতরাজ এর ইয়াহিয়ার একনায়কতন্ত্র পৃথিবীর কাছে এটাই প্রকাশ করে দিয়েছে যে এটি সম্পূর্ণ রূপে নৈতিকতা বর্জিত এবং তা জনগনের অধিকার ক্ষুন্ন করে। “শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ভারতে বৃটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিলেন যখন ইয়াহিয়া ও তার দোসররা তাদের ব্রিটিশ মনিবের প্রতি চরম আনুগত্য প্রকাশ করছিল,একমাত্র ভুলটি হচ্ছে প্রথম বারের মত অনুষ্টিত সাধারন নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ তার দলকে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে বিজয়ী করেছিল।
আর্ন্তজাতিক জুরিস্টস কমিশন
আর্ন্তজাতিক জুরিস্টস কমিশন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গোপনে সামরিক আইনে বিচারে পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আইসিজে এর সেক্রেটারি জেনারেল কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক বার্তায় বলেন, “আর্ন্তজাতিক জুরিস্টস কমিশন শেখ মুজিবুর রহমানের গোপনে সামরিক আইনে বিচারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ন্যায় বিচারে গোপনীয়তার কিছু থাকতে পারে না।”
ইউ থান্ট
জাতিসংঘের মহাসচিব ইউ থান্ট এক সংবাদ বিবৃতিতে বলেছিলেন জাতিসংঘে কর্মরত অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সাথে তিনিও একই অনুভূতি পোষণ করেন যে শেখ মুজিবের ভাগ্য সংক্রান্ত যেকোন উন্নতি বা অবনতি পাকিস্তান সীমান্তের বাইরেও প্রভাব ফেলবে।
ইউএস সিনেটর
গারজন ইউএস সিনেটর আমেরিকার সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন যেন সরকার পাকিস্তানকে জানায় যে তারা আশা রাখে যে শেখ মুজিবের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হবে।
নিউ ইয়র্ক পোস্ট
যেহেতু ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা কুড়িয়েছে, তা ব্যবহার করে তাদের উচিত ইয়াহিয়া কে শেখ মুজিবের প্রতি প্রতিহিংসা মূলক বিচার থেকে বিরত রাখা। যদি গোপন বিচারে রহমান দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে যদি মেরেও ফেলা হয় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ও ভারত দুটি দেশেই শহীদ বলে বিবেচিত হবেন এবং এই বিচার প্রক্রিয়ার সত্যিকার বলি হবে এশিয়ার শান্তি।
ক্রিস্তিয়ান সায়েন্স মনিটর
পূর্ব বাংলার সায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর (মুজিবুর রহমান) ভূমিকা কি আদৌ রাষ্ট্রদোহীতামূলক কিনা তা বেশিরভাগ মানুষের মনেই সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। গোপন বিচারে তাঁকে দন্ডিত করা অবশ্যই বেদনাদায়ক অনুভূতির জন্ম দেবে।
টরেন্টো টেলিগ্রাম
শেখ মুজিবের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করা এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারকে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় হত্যাকান্ড থেকে বিরত রাখাই শুধু নয়, সমগ্র উপমহাদেশকে নতুন করে বিক্ষোভের মুখে ঠেলে দেওয়া থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপরই বর্তায়।
আর্সেইটার জয়তুং ( অস্ট্রিয়া )
মুজিবের মৃত্যুদন্ডের মানে হবে ঐতিহাসিক ভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি মৃত্যুদন্ড।
.
অনুবাদঃ তুষার শুভ্র
<৬,৭৪,৭১৪-৭১৫>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ আন্দোলনের খবর
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তানকে দেওয়া সব ধরনের সাহায্য বন্ধের জোর দাবি জানালেন ইউ.এস সিনেটররা
.
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তের রেফিউজি ক্যাম্পে সপ্তাহব্যাপী পরিদর্শন শেষে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পাকিস্তানের প্রতি ইউ.এস পলিসির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ” পশ্চিম পাকিস্তানে সরবরাহ করার জন্য আর কোনো ইউ.এস অস্ত্রের চালান থাকলে তা এখনই আমাদের বন্ধ করতে হবে। মনুষ্যত্বের মৌলিক নীতিকে যে সরকার নিয়মিত লঙ্ঘন করছে সে সরকারকে দেওয়া সব ধরনের অর্থনৈতিক সাহায্য আমাদের বন্ধ করতে হবে।”
.
২৬ শে আগস্ট,ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে সিনেটর কেনেডি এক আবেগপূর্ণ ভূমিকায় বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেল এবং বিশ্ববাসীকে আমাদের অবশ্যই স্পষ্ট করে দিতে হবে যে, যে পর্বতসম গনহত্যা পূর্ব পাকিস্তানকে বিদ্ধস্ত করেছে তার প্রতি ইউনাইটেড স্টেটস্ এর গভীর সহানুভূতি ও মনোভাবের স্থায়ী পরিবর্তন আছে।”
.
সিনেটর কেনেডি,জুডিশিয়ারী সাবকমিটি অন রেফিউজিস এর চেয়ারম্যান বলেন যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট আমেরিকানদের জন্য বিশেষভাবে বেদনাদায়ক হবে কারন ” আমাদের মিলিটারি হার্ডওয়্যার,আমাদের অস্ত্র,আমাদের ট্যাংক,আমাদের বিমানগুলো যেগুলো বেশ কয়েক যুগ ধরে তাদেরকে দেওয়া হয়েছে সেগুলোই এই দুর্দশা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।”
.
তিনি আমেরিকানদের প্রতি জোড় দাবি জানান যে এমন কোন শাসকদের সাহায্য না করতে যারা নীতি বর্জিত এবং যাদের কারনে তার নিজ দেশের মানুষদের সারা পৃথিবী জুড়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
.
ম্যাসাচুসেটস সিনেটর এটিকে “বতর্মান সময়ের মানুষের দুর্দশার সবচেয়ে বেদনাদায়ক নিদর্শন” আখ্যায়িত করে তিনি আমেরিকানদের বুঝতে বলেছিলেন যে কোন ব্যাপারটি বাংলাদেশে এমন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মূলে জড়িত।
.
সিনেটর কেনেডি ভিয়েতনামে আমেরিকানদের কার্যকলাপ এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে ইউ.এস. এর ভূমিকার তুলনা তুলে ধরে তিনি বলেন ভিয়েতনামে গনতন্ত্রকে সাহায্য করতে গিয়ে ১০০বিলিয়ন ইউ.এস ডলার ও ৪৫,০০০ জীবন বিলিয়ে দেওয়ার পর এখন আমেরিকাকে তার নেতৃবৃন্দ কর্তৃক অনুরোধ করা হয়েছে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সংঘটিত হওয়া একটি নির্বাচনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য।
.
সিনেটর চার্লস পার্সি
সিনেটর চার্লস পার্সি ২৮শে আগস্ট নয়া দিল্লিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে তিনি পাকিস্তানকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধের পক্ষপাতী।
রিপাবলিকান এই সিনেটরটি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এই গনহত্যাকে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন।
.
টরেন্টো কনফারেন্সের বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ
.
বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সামরিকভাবে বা অর্থনৈতিক ভাবে সহায়তা না করার জন্য সকলদেশের সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে টরেন্টোতে স্বনামধন্য পন্ডিত ব্যক্তি,সম্পাদকমণ্ডলী এবং সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়।
.
কনফারেন্সটিতে এই বলে সতর্ক করা হয় যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তির জন্য এক বিরাট হুমকি। “টরেন্টো ডিক্লারেশন অব কনসার্ন” নামে এই প্রস্তাবনায় বলা হয় যে ” গত কয়েকমাস জুড়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া যে ঘটনাগুলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভয়ংকর দূর্যোগের জন্ম দিয়েছে এতে কনফারেন্সে অংশগ্রহনকারী সবাই খুব ভীত।”
.
এতে আরো বলা হয় ” বর্তমান পরিস্থিতি দক্ষিন এশিয়া উপমহাদেশেই শুধু নয় সমগ্র পৃথিবীর শান্তির জন্য এক বিশাল হুমকি যেহেতু এখানে বিভিন্ন পরাশক্তির অংশগ্রহনের আশংকা রয়েছে যা এই ধরনের নৃশংস ঘটনার গতি বহুগুণ বৃদ্ধি করবে।
.
১৯ থেকে ২১ শে আগস্ট অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘের টেকনিকাল অ্যাসিস্টেন্সের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল হিউ কিনলিসাইড, প্রাক্তন বৃটিশ শ্রমমন্ত্রী জুডিথ হার্ট, বৃটিশ এম.পি বার্নার্ড ব্রেইনি এবং চীনে নিযুক্ত প্রাক্তন কানাডিয়ান অ্যাম্বাসেডর চেস্টার রানিং।
.
অনুবাদঃ তুষার শুভ্র
<৬, ৭৫, ৭১৬>
শিরোনামঃ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাজ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
পশ্চিম পাকিস্তান আর্মি-গেস্টাপো আর এস.এস. এর অন্য নাম
সুপরিচিত শিক্ষাবিদ এবং প্যারিসের দ্যা স্টাডিস অব দ্যা একোল ডে প্র্যাটিক হউটস্ এটিউডস্ এর ডিরেক্টর প্রফেসার লুই ডুমন্ট ৬ আগস্ট বিখ্যাত সাপ্তাহিক “লা মন্ডে” তে “বাংলাদেশ চিরজীবি হোক” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন।
ইন্টার আলিয়া অনুচ্ছেদে ২৬শে মার্চ সকালে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর একটি ফিল্ড ইউনিটের সাথে কুর্মিটোলায় হেডকোয়ার্টারের টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস করা হয়। কথোপকথনটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রবন্ধটিতে নিম্নোক্তাকারে প্রকাশ করা হয়,
পাকিস্তান আর্মি হেডকোয়ার্টাস: আনুমানিক কয়জন মেরেছ?
প্রবন্ধটিতে আরো বলা হয় “
ফিল্ড ইউনিট: অন্তত ৩০০জন।
হেডকোয়ার্টাস : ভালো করেছ……খুব ভালো।
প্রবন্ধে আরো বলা হয় ” ঐ যোগাযোগে তাদের আদেশের নিশ্চয়তা দিয়ে এটা বলা হয় যে, লাশ পুঁতে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীদের দিয়ে গর্ত খনন করা হয়েছে এবং কাজ শেষ হওয়ার পর তাদেরকে ওখানেই খুন করা হয়েছে। এগুলোই প্রমান করে দেয় যে একটি নিয়মিত সৈন্যদলকে কিভাবে গেস্টাপো ও এস.এস এর সমকক্ষ বলা যায় এবং পরবর্তীতে ঘটানো নৃশংস হত্যাকান্ড তারই স্বাক্ষর বহন করে।
.
.
অনুবাদঃ তুষার শুভ্র
<৬, ৭৬, ৭১৭-৭১৮>
শিরোনামঃ পাকিস্তানী ধবংসলীলা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তান হত্যাকান্ড
আমেরিকায় কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানের অধ্যাপক ড. ইকবাল আহমেদের “পাকিস্তানি কূটনীতিকের প্রতি চিঠি” এর কিছু অংশের উদ্ধৃতি নিচে হুবহু তুলে দেওয়া হল। চিঠিটি নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস এর ভলিউম ১৭ নাম্বার ৩ এ ২ সেপ্টম্বর ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
……ঘৃনার যোগ্য জনাব ভুট্টো যিনি গিরগিটির মত নিজের রাজনীতির রং পাল্টান, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবিধিদের দ্বারা প্রসূত এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রের দম্ভ দেখিয়ে দেশটাকে গ্রিস ও স্পেনের মুসলিম ভার্সনে পরিনত করছে। যদিও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিবেচনা করে আমি দেশটিতে সামরিক আগ্রাসনের কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কিংবা নৈতিক কারন খুঁজে বের করতে পারি নি। বাঙ্গালীরা যে অর্থনৈতির বৈষম্য ও শোষণ, বঞ্চনার শিকার তা পশ্চিম পাকিস্তানের তুখোর রাজনীতিক ও অস্বীকার করতে পারবে না। রাজনৈতিকভাবে, দেশটিতে পশ্চিম পাকিস্তানের ১২ বছরের প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন বাঙ্গালিদের ক্ষমতার ক্ষুদ্র ব্যবহারের চর্চা থেকেও বঞ্চিত করেছে।
প্রাদেশিক সায়ত্তশাসনের জন্য আওয়ামীলীগের দাবির প্রতি সবার ঐকমত্য পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলারই ফলাফল। অবিশ্বাস্য রকম অবহেলার চূড়ান্ত নমুনা প্রদর্শিত হয় নভেম্বরে সাইক্লোন দূর্গত মানুষদের প্রতি। সংসদীয় কোন সমযোতায় আসতে না পেরে,সেনাবাহিনী,পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করে। তাদের এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল বিবর্ণ করে দেওয়া।
পাকিস্তানি আর্মিদের মনে হয়তোবা এই আশা ছিল যে তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আত্মসমর্পনের বাধ্য করতে পারবে। এটি এখন পরিষ্কার যে, সেনাবাহিনী সত্যিকারার্থে জেনারেল ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের আলোচনাটি দেশটি আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। আসাদ এবং লেইন-ও-নাহার এর মত পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া, পশ্চিম পাকিস্তানের সম্প্রতি ৮০০ ব্যক্তিকে বিচারবহির্ভূত ভাবে কারাবন্দী করে রাখা যাদের মধ্যে আছেন আফজাল বাঙ্গাস, মুক্তার রানা ও জি.এম. সৈয়দের মত নেতা, আবদুল্লাহ মালিক, শেখ আয়াজের মত বুদ্ধিজীবি, জি.এম শাহ্ এর মত শিক্ষাবিদ এবং লায়েলপুর ও শিয়ালকোটে সরকারের প্রতি ভিন্নমত পোষণকারীদের উপর নির্দয়ভাবে লাঠিচার্জ করা পূর্ব পাকিস্তানের সর্বগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় বহন করে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনের যদি খুব শীঘ্রই ইতি ঘটানো না হয় তাহলে দূর্ভিক্ষ,মহামারী এবং ধারাবাহিক গনহত্যা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের জীবনহানির কারন হবে। তাদের সামরিক আগ্রাসনে ইতিমধ্যে ২,৫০,০০০ নিরস্ত্র জনগনের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
দ্রুত রিলিফের ব্যাবস্থা করেও আসন্ন বিপর্যয় এড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। শুধুমাত্র নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত আইনকে পুনরায় প্রয়োগই খাদ্যশস্য ও ওষুধকে সামরিক অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার প্রতিরোধ করতে পারে এবং শুধুমাত্র এটিই পারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক ত্রাণের সঠিক বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে।
সর্বশেষ আমি এটা বলতে পারি যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা স্বায়ত্বশাসন ও ভিন্নমত পোষণ করার অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত বেসামরিক সরকার ব্যাবস্থার পুনঃবহাল কখনই সম্ভব হবে না।
আমি বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানীদের এখন একমাত্র করনীয় কাজটি হচ্ছে মার্শাল ল এখনি এবং বিনাশর্তে বাতিল করে দেওয়া, একটি ন্যাশনাল এসেম্বলিতে গৃহীত সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতে বিনাশর্তে রাজী হওয়া। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে একটি রাজ্য এই বিরোধী হলেও শর্তটি মেনে নিতে হবে।
সেনাবাহিনীর হাস্যকর দাবীটি আমাদের বাদদিতে হবে যে তারা দেশটিতে হস্তক্ষেপ করেছে দেশের অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য। এমন একটি দলের বিরুদ্ধে তারা এ দাবী করেছে যারা পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত একমাত্র নির্বাচনে বিপুল আসনে জয়ী হয়েছে এবং জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য। সত্যিকারার্থে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শুধুমাত্র তাদের নিজেদের রাজ্যের সায়ত্বশাসনের দাবী জানিয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জাতীয় পরিষদ আহবান করতে অস্বিকৃতি জানানোয় এবং ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে পূর্ব পাকিস্তানিরা এখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের ঘোষণা দিয়েছে।
.
যেটি সবচেয়ে বিপজ্জনক তা হচ্ছে তার পশ্চিমা বন্ধু রাষ্ট্রগুলো, কংগ্রেসের গুরুত্বপুর্ণ ব্যাক্তি এবং বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও আমেরিকান সরকার অস্ত্র দেওয়া ও অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শেখমুজিব ও তার দলের আনুগত্যের প্রতি এটি হুমকিস্বরূপ।
আমেরিকানরা এশিয়ার অন্য একটি অংশে মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে সংগঠিত আরও একটি অপরাধের নীরব সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে।
.
.
অনুবাদঃ তুষার শুভ্র
<৬, ৭৭, ৭১৯>
শিরোনামঃ সিদ্দিকী বাংলাদেশ মিশনের নেতৃত্ব করছেন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করেছেন। মি. সিদ্দিকী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রী নিয়ে ছিলেন। তাঁর আসার পর থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে জনমত গঠন ও সহযোগিতার জন্য রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও তিনি আমেরিকার সরকার ও জাতিসংঘের সদস্যদের সাথে বৈঠক করেন। একজন সক্রিয় কূটনৈতিক হিসেবে তিনি সম্প্রতি আমেরিকার ১২টির অধিক শহর ও কানাডা সফর করেন। বাংলাদেশ মিশনের প্রধান, তাঁর এই সফরের বিভিন্ন অংশে ছাত্র সম্মেলন ও সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নেন। যেসব শহরের খবরের কাগজের অফিস তিনি পরিদর্শন করেন, সেসব পত্রিকা তাঁর ছবিসহ বক্তৃতা প্রথম পৃষ্ঠার খবর হিসেবে প্রচার করে। জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান কালে তিনি বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তান আর্মির সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বিভিন্ন শহরে পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে অত্যাচার ও হত্যাকান্ডে আমেরিকান অস্ত্র ও অর্থের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তাই এই হত্যাকান্ড বন্ধকরা আমেরিকার বিশেষ কর্তব্য। ইয়াহিয়ার সরকারকে আমেরিকানরা যেন তাদের অস্ত্র ও অর্থের সাহায্য বন্ধ করে দেয় এজন্য জোর দাবী জানান।
ডেভিসে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্মেলনে তিনি ছাত্রদের বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণই শুধু সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা কি চায় এবং ইতিমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়ে দিয়েছে’।
.
.
অনুবাদঃ তুষার শুভ্র
<৬, ৭৮, ৭২০-৭২১>
শিরোনামঃ বাংলাদেশে জাতিসংঘ ত্রাণ সাহায্য
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য
এর আসল অর্থ কি
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে
বাংলাদেশে জাতিসংঘ মিশনের প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে ৩৮ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল পাঠানো হয়েছে। বাইরে থেকে দেখে জাতিসংঘের এই ভূমিকাটি বর্তমানে পৃথিবীর ঐতিহ্যের যোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু এর মনুষ্যত্বের মুখোশসের পেছনে ওতপেতে আছে বিপদ।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল যোগাযোগ ব্যাবস্থার পূনর্বাসন এবং সড়ক ও নদীপথ পুনরায় চলাচলের উপযোগী করা। সেটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে অবদান রাখবে। আমাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, যদি এই শর্ত পূরণ না হয় তাহলে দাতা দেশ গুলোর সহানুভূতির সাথে দেওয়া সাহায্য সেই ব্যাক্তিদের কাছে পৌঁছাবে না যাদের এটির প্রয়োজন এবং মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে। এটি ধরে নেওয়া যায় যে, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্বাবধান না থাকলে দাতা দেশগুল বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাতে উৎসাহিত হবে না।
বাংলাদেশে দুর্গত মানুষের জন্য দাতা দেশগুলোর এই উদ্বেগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষই বাংলাদেশে মানুষের হাতে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার একমাত্র বাহন- দাতা দেশগুলোর এই বিশ্বাসটার সাথে একমত হতে আমরা ব্যার্থ। গত বছরের ঘুর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট যে মিলিটারিদের ত্রাণ সরবারহের কার্যকলাপের উপর বিশ্বাস রাখা ভিত্তিহীন। এটি একটি সাধারণ জ্ঞান যে, মিলিটারিরা এই ত্রাণ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে অপব্যাবহার করেছে এবং ব্যাক্তি ও বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থার দেওয়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের কোন উপযুক্ত হিসাব পাকিস্তান এমব্যাসি দিতে ব্যার্থ হয়েছিল।
পাকিস্তানিরা ত্রাণ কার্যের উদ্দেশ্যে সরবরাহকৃত হেলিকাপ্টার ও বোটগুলো যে ২৫শে মার্চ ও তাঁর পরে ব্যাবহার করেছে তারও প্রমাণ আছে।
ইউনিসেফের যানবাহন
মিলিটারিরা জাতিসংঘের যে সব সম্পত্তি গুলো জোরদখল করে রেখেছে সেগুলো অব্যাহতি দেয়নি। ইউনিসেফের জীপগুলো মিলিটারিরা তাদের সামরিক প্রয়োজনে উনমুক্তভাবে বাংলাদেশে ব্যাবহার করেছে। ৩১শে আগস্ট লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা অনুসারে, মুষ্টিমেয় কিছু জীপ তার মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় প্রমাণ আছে যে এফ.এ. ও এর গাড়ি ও বোটগুলো বাংলাদেশীদের গ্রাপ্তার ও অত্যাচারের জন্য ব্যাবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল, এই সম্পত্তি দখলের কথা অস্বীকার করার সাহস দেখাতে পারেননি। এমনকি এ ধরণের ঘটনা যে আর ঘটবে না সে আশ্বাস ও দিতে পারেননি।
যদি এই হয় বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য দেওয়ার নমুনা তাহলে সাহায্যের জন্য দেয়া সুক্ষ যন্ত্রপাতিগুলো যে বাংলাদেশীদের অত্যাচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাবহার করবে না তাঁর নিশ্চয়তা কি?
সেক্রেটারি জেনারেল
যতদিন পাকিস্তান সরকার আছে ততদিন সেক্রেটারি জেনারেল ‘হিয়ার নো ইভিল, স্পিক নো ইভিল, সি নো ইভিল’ নীতি অনুসরণ করছেন। তিনি নিউ ইয়র্কে টাইমসে প্রকাশিত মিস এলিস থর্নায়ের প্রকাশিত একটি চিঠির বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে মিস থর্নার জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে বাংলাদেশে জাতিসংঘের সাহায্য সামরিকভাবে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে শক্তিশালী করবে এবং বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশের জনগণ নিজেই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্তা এবং তারা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে বদ্ধ পরিকর।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ জোড় দিয়ে বলেছেন, বিশ্ববাসীকে এটি খেয়াল রাখতে হবে যে, ‘বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের সরকারকে বিপথে নেওয়ার চেষ্টা করা বিপদজনক হবে’।
এটি এখন আমাদের দৃঢ় আশা যে সেক্রেটারি জেনারেল এই ডাক শুনবেন এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি আর্মিদের দখলদারিত্বের দীর্ঘ সূত্রিতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া থেকে কারও প্রভাবে বিচ্যুত হবে না।
বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সদস্যকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত যে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
.
.
অনুবাদঃ মেহেদী হাসান চৌধুরী
<৬,৭৯ ,৭২২>
.
শিরোনামঃ বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশভলিউম ১ : নং. ৪
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ
ইউ থান্ট-পডগোর্নি-গিরি-জহির শাহ
রাজনৈতিক সমাধান চান
.
বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব, ইউ থান্ট, সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পডগোর্নি, ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি এবং আফগান রাজা মোহাম্মদ জহির শাহ, এশিয়ার শান্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশে দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতা আহবান করেছেন।
.
ইউ থান্ট
গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব, ইউ থান্ট, পুনর্ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দেওয়া তার ২০ জুলাই এর স্বারকলিপির প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো পদক্ষেপ গ্রহন না করায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি আরও মনে করেন, স্থিতিশীল অবস্থা পুনরুদ্ধার না হলে, ভারত থেকে অধিকাংশ শরণার্থীদের ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
.
পডগোর্নি
সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পডগোর্নি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি রক্ষার্থে বাংলাদেশে “দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতা”আহবান করেন। ১৪ ই সেপ্টেম্বর আফগান রাজা মোহাম্মদ জহির শাহের আগমনে ক্রেমলিনে আয়োজিত এক ভোজসভায় তিনি এই বক্তব্য রাখেন। সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি বলেন, “সম্প্রতি এশীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে অবনতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি মনে করেন, শরণার্থীদের সমস্যাগুলো বাংলাদেশের চলমান ঘটনাবলীর সাথেই উদিত হচ্ছে।
.
জহির শাহ
সোভিয়েত রাষ্ট্রপতির ভোজসভার বক্তব্যের জবাবে আফগান রাজা বলেন, “আমাদের মতে বিরোধ সমাধানে যে কোন সামরিক চাপ সৃষ্টি ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। মানুষ ও জাতির অবিচ্ছেদ্য অধিকার নিশ্চিত করেই সকল বিরোধ রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে…।”
.
ভি.ভি. গিরি
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি গত সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে এক বক্তব্যে বলেন যে, আট লক্ষের অধিক উদ্বাস্তুর অন্তঃপ্রবাহ ভারতের জন্য বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করছে। তিনি তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বিশ্বাস থেকে, যতদিন না উদ্বাস্তুরা নিজের দেশে নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে ফিরে যেতে পারছে ততদিন ভারত তাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, অভীষ্ট অর্জনে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরী করা সেসময়ে জরুরী ছিল।
.
.
অনুবাদঃ মেহেদী হাসান চৌধুরী
<৬,৮০,৭২৩>
শিরোনামঃ বাংলাদেশের মিশন সমূহ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশভলিউম ১ : নং. ৪
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ মিশন
বিভিন্ন দেশে সাতটি বাংলাদেশ মিশন গঠিত হয়েছে। মিশনগুলো ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, নয়াদিল্লী, কলকাতা, স্টকহোম এবং হংকং এ অবস্থিত। যখন আরো বাংলাদেশ মিশন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীগুলোতে স্থাপিত হচ্ছে, অষ্টম মিশনটি ম্যানিলায় এই সপ্তাহে শুরু হতে যাচ্ছে। .
বাংলাদেশ সমিতি
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন শহরে বত্রিশটি বাংলাদেশের সমিতি গঠিত হয়েছে। উপরন্তু ,যুক্তরাষ্ট্রে এক ডজনেরও বেশী “ফ্রেন্ড্স ওফ বাংলাদেশ” (একটি বহুজাতিক সংগঠন) সক্রিয় রয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোতেও এমন অনেক সংগঠন গঠিত হচ্ছে।
.
তথ্য কেন্দ্র
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের নাগরিকদের সহযোগিতায় আমেরিকানদের দ্বারা বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় তথ্য কেন্দ্র পরিচালিত হয়।
.
অনুবাদঃ মেহেদী হাসান চৌধুরী
<৬, ৮১,৭২৪-৭২৫>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বাড়ছে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলি-১: নং.৪
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর,১৯৭১
.
বাংলাদেশ বাহিনীর ধৈর্যশীলতা
ও দক্ষতা অর্জন
বাংলাদেশ চার মাসেরও কম সময়ে দুইটি সৈন্যবাহিনীর শাখা- নিয়মিত সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী- সংগঠিত করেছে। উভয় শাখাই পশ্চিম পাকিস্তানের পেশাদার সেনাবাহিনী, যারা ২০০ বছরেরও অধিক সময়ের সামরিক ঐতিহ্যের বাহক এবং অত্যাধুনিক আমেরিকান ও কমিউনিস্ট অস্ত্রে সজ্জিত, তাদের বিরুদ্ধে অপারেশনে বেশ ভালো ধৈর্যশীলতা ও দক্ষতা অর্জন করেছে, যদিওবাংলাদেশ বাহিনীনতুন এবং আকারে ছোট।
মার্টিন ওলাকট, একজন ব্রিটিশ সংবাদদাতা, সাম্প্রতিককালে মনোবলহীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে নৌকায় অভিযানে বাংলাদেশের ১৬ জন সৈন্য ও ২ জন অফিসার এর সঙ্গী হন। (১৮ সেপ্টেম্বরের ওয়াশিংটন পোস্ট এ উদ্ধৃত)-
১৬ জোড়া শূন্য চরণ, তিনটি পুরানো হালকা মেশিনগান, তিনটি ভগ্ন ব্রিটিশ দুই ইঞ্চি মর্টার এবং এক ডজন মর্টার বোমা, যেগুলো এখনো তাদের সীল করা খোলসে আছে, সেগুলোসহ একটি ঝোলা- ওয়ারেন্ট অফিসারের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হয় ।
ক্যাপ্টেন, চশমা পরিহিত একজন লম্বা তরুণ যিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সার্ভিস কোরের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, ডোরা কাটা শার্ট আর লম্বা স্কার্ট সদৃশ পোশাক, যা লুঙ্গি নামে বাঙ্গালিদের কাছে পরিচিত, পরিধান করে তাঁর তাঁবু থেকে বের হোন। ওয়ারেন্ট অফিসার তাঁকে স্যালুট ঠুকেন।ক্যাপ্টেন লোকগুলোকে বাংলায় সম্বোধন করেন। ইংরেজি শব্দ “ডিসিপ্লিন”, “ডিসিপ্লিন্ড ফোর্স”, “নো স্মোকিং”বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হয়।
তিনি ইংরেজিতেই শেষ করেন, বলেন, “আমি লক্ষ্যে দ্রুত গুলি করা এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়া দেখতে চাই”। ওয়ারেন্ট অফিসার আবার স্যালুট দেন, এবং এই ১৮ জন, পিছনে অনুসরণকারী ২ জন প্রতিনিধিসহ সেনা-শিবির থেকে কলকাতার ৫৫ মাইল উত্তর-পূর্বের এক সীমান্ত এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ক্যাপ্টেন আগেই বলেছিলেন, তার দলের মুখোমুখি আছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুইটি ব্যাটেলিয়ন, উভয়ই সীমান্ত বাহিনী রেজিমেন্ট থেকে আসা। রাতের দলটি ছিল যাকে বলে “বিরক্তকারী দল” এবং কপোতাক্ষ নদীর বাঁকে পূর্ববঙ্গের চার মাইল ভিতরে “মাসলিয়া” নামক স্থানে পাকিস্তানের সেনা দলের ঘুম ও মনের শান্তি নষ্ট করাই এদের মূল লক্ষ্য ছিল।
সেনাশিবির থেকে প্রায় এক মাইল দূরে, দলটি তিনটি বড় দেশী নৌকায় আরোহণ করে। কেউ আমার হাতে একটি মর্টার নামিয়ে রাখে, সেখানে শুধু রক্ষা খিলের (সেফটি ক্যাচের) টকটক শব্দ, এবং ক্যাপ্টেনের কড়াকড়ি স্বত্বেও অনেকেই সিগারেট জ্বালায়।
নৌকাটি পানিতে এগোনো শুরু করে-ঠিক এখনকার নদীগুলোর মত না, বরং বৃহৎ ও বাঁকানো হ্রদের মতন, কারণ এটিকে বন্যায় গ্রাস করেছে।তারার আলোয় দূরের গাছগুলো ও পরিষ্কার দেখা যায়।
.
আমি আতঙ্কিত হয়েই লক্ষ্য করি, অনেকেই স্বাভাবিক আলাপচারিতার স্বরেই কথা বলছিল, কিন্তু তাদের কথোপকথনম্লান হয়ে যায় যখন আমরা আরও গহীনে প্রবেশ করি। নৌকা তীরে ভিড়তেই সবাই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং জমির দিকে সাঁতরে অগ্রসর হই,একদল লোক ছোট মেশিনগান হাতে, আরেক দল মর্টার সহ, বামদিকের আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে, এবং আমরা বাকিরা দুইটি হাল্কা মেশিনগান আর দুইটি মর্টার নিয়েএক সারিতে বনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
সেখানে অসংখ্য ব্যাখ্যাতীত পথমধ্য বিরতি ছিল, এবং তরুণ গেরিলা যারা আমাদের দেখাশোনার জন্য বরাদ্দ ছিল, তারা খানিকটা অর্থহীনভাবেই বলতে থাকলোযে , “আমরা এখন বাংলাদেশে”।
প্রায়২০ মিনিট পর আমরা বড় একটি গ্রামে আসি,নীরবে তা পার হয়ে নদীতীরে পৌঁছাই।বন্দুক ও মর্টারগুলো তাক করা হয়, বোমাগুলো তাদের খোলস থেকে বের করা হয়। গোলাগুলির দলের কাছাকাছি অবস্থিত কুঁড়েঘরগুলোতে প্রায় ২০০ জন গ্রামবাসী ঘুম থেকে জেগে উঠে দ্রুত বের হয়, ছুটতে থাকে গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে,সম্ভবত গ্রামের অপর প্রান্তের ঘরগুলোর দিকে।
আগের সকল ফিসফিসানি ও অদলবদলের পর অবিশ্বাস্য রকমপ্রবল আওয়াজ করে,এরপর শুরু হয় গুলিবর্ষণ, মেশিনগান এর আকস্মিক বিস্ফোরণ , মর্টারের ধপধপ – ঠুসঠাস শব্দ, অন্যদের ৩০৩ রাইফেলের একক গুলি। আমাদের বামে একদল যোগ দেয়। এটি সম্ভবত ৮ মিনিট টিকে থাকে।“শত্রু এলাকা” থেকে কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না , সার্জেন্ট রহস্যময়ভাবে ঘোষণা দেন “আমরা এখন গোলাগুলি আরম্ভ করবো, তারা ২০ মিনিট পর গোলাবর্ষণ করবে”।
আমরা সামান্য গতিতে নৌকায় ফিরে যাই। ওয়ারেন্ট অফিসারদলটি গুনেন , এবং আমরা পুনরায় পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ২০ মিনিট পর, যেই আমি ঘড়ি দেখি –নৌকা থেকে ৪০০ গজ দূরে বোমা বর্ষণের বিকট আওয়াজ আসে।
১০ মিনিট পর আমরা নৌকা থেকে বের হই এবং আধঘণ্টার মধ্যে শিবিরে ফিরি, কলের পানি মাথায় দিয়ে আমরা তাজা হই। ক্যাপ্টেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুমাতে যান যে তার “বিরক্তকারী দল”এর কোন ক্ষতি হবে না। টহল দল, সর্বেসর্বা ভাবে একটি উপযুক্ত প্রয়াস। তারা জানে কিভাবে অস্ত্র কাজে লাগাতে হবে, তারা দ্রুত তাদের অবস্থান নিয়ে নেয়…
সত্যিকার অর্থে মুক্তিবাহিনীরপ্রধান কাজ “বিরক্তকারী দল” হিসেবে ছিল না।ক্যাপ্টেনের নিয়মিত বাহিনী দাবি করে যে তাদের ৪ মাসের সময়ে তারা ১২৫ জন পাকি সেনাদের হত্যা করেছেন, এর মধ্যে দুইজন অফিসারও ছিলেন। তিনি আরওবলেন, এই চার মাসে ,পাকিস্তানিরা কোনও পাল্টা ওঁত পাতেনি, পাল্টা খনন করেনি এবং “শুধুমাত্র একবার” বিবাদের সময় মুক্তিবাহিনীর উপর বাটপারি করতে চেয়েছিল।
.
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,৮২,৭২৬-৭২৭>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৫
তারিখঃ ১ অক্টোবর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়ঃ মার্কিনীদেরকে প্রতারণা
.
মঞ্চ প্রস্তুত করাই ছিলো, ছোঁড়া হলো পাশার ছক্কাও। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকায় মুজিবুর রহমানের সাথে সংলাপ হঠাৎ স্থগিত করলেন। সূর্যাস্তের সময় ঢাকা থেকে গোপন ফ্লাইটে পশ্চিম পাকিস্তানে তার আশ্রয়স্থলে ফিরে যাবার আগে, ইয়াহিয়া জেনারেল টিক্কা খানকে নির্দেশ দিলেন বাঙ্গালিদেরকে নিজেদের পছন্দে নেতা নির্বাচন করার অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার জন্য। বাঙ্গালিরা এমন নেতাদের নির্বাচন করেছিল, বাঙ্গালিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের অবসান ঘটাতে যাঁরা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এতো অল্প সময়ে, আমেরিকান মেশিন গান, ট্যাঙ্ক, বাজুকা, কামানে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা পৃথিবীর অন্য যে কোন জায়গার তুলনায় অনেক বেশি নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। হত্যাযজ্ঞ চলছে এখনও।
.
জেনারেল ইয়াহিয়ার হিসেবে ভুল ছিলো। তিনি ভেবেছিলেন, দমন-পীড়নের ক্ষমতাই সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এখন বাঙালি প্রতিরোধ তাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং বাংলাদেশ লুট করে পাওয়া সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে যারা আর্থিক এবং সামরিক সহায়তাপ্রদান করেছিল তাদের জন্য, বহির্বিশ্বে নিজেদের ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে বিশেষ যত্নসহকারে আমেরিকানদের বোঝাতে হচ্ছে যে, আমেরিকার সাহায্য মানবকল্যাণে ব্যবহার করা হবে।
.
জেনারেল ইয়াহিয়া তার দমন-পীড়নের নিয়ম চালু রাখতে গিয়ে আমেরিকানদের চোখে ধূলা দেয়ার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। একজন বেসামরিক গভর্নর, কয়েকজন মন্ত্রী নিয়োগ করেছেন তিনি, যারা কখনো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন নি। এঁদের সকল ক্ষমতার অধিকারী সামরিক শাসকের “নিরাপত্তায় থেকে” দায়িত্ব পালন করার কথা, যাঁরা টিক্কা খানের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে বাংলাদেশে বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া এমনকি এও দাবি করছেন যে শরণার্থীরা ফিরে আসছে। যদিও দাবি করা হয়েছে ১,০৫,০০০ শরণার্থী ফিরে এসেছে, কিছু নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক বলে আসছেন যে, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর পালিয়ে যাওয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে, এবং এ সংখ্যা নব্বই লক্ষে পৌঁছেছে।
.
ইয়াহিয়া, স্বৈরশাসকের ঐতিহ্য বজায় রেখে, দেশের জন্য সংবিধানও প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন আয়োজন করতে চান, যদিও তাঁর অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সকল নির্বাচকমণ্ডলীর ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ভবিষ্যতে কোন নির্বাচনের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তুলেছে। তিনি জাতীয় সংসদকে সংবিধান নিয়ে মতামত দেয়ার অধিকার দিয়েছেন, কিন্তু যে কোন সংশোধনীকে ভেটো দেয়ার সর্বোচ্চ এখতিয়ার তাঁর থাকবে।
.
ইয়াহিয়ার নীতি খুব বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ, সেগুলোর ওপর একেবারেই আস্থা রাখা যায় না। পাকিস্তানে সব রকম অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য স্থগিত করার ব্যাপারে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এরই মধ্যে বিল অনুমোদন করেছে। একইরকম একটি আইন, স্যাক্সবি এবং চার্চ সংশোধনী, ৩৫ জন সিনেটরের যৌথ প্রযোজনায় সিনেটে উত্থাপন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই যে আমেরিকানরা এবং তাদের প্রতিনিধিরা গণতন্ত্র ও সংবিধানকে জবাই করতে বদ্ধপরিকর কোন স্বৈরশাসকের সামরিক অভিযানে অর্থসাহায্য দেবে না।
.
অনুবাদঃ নিয়াজ মেহেদী
<৬, ৮৩, ৭২৮-৭২৯>
শিরোনামঃ ইয়াহিয়ার গোপনীয়তার অন্তরালে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং. ৫
তারিখঃ ১ অক্টোবর, ১৯৭১
.
ইয়াহিয়ার গোপনীয়তার অন্তরালে
.
২১ শে জুন ১৯৭১ তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তথ্য ও জাতীয় বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব রোয়েদাদ খানের স্বাক্ষরিত গোপন আদেশ নং U. O. No. 2303/71-Secy(s) তে বিদেশী সংবাদদাতা, ইউ.এস সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান এবং ব্রিটিশ সংসদ সদস্যদের ম্যানেজ করার জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক কর্মচারীদের প্রতি কিছু দিক নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল।
.
“বিদেশী সংবাদদাতাদের ভ্রমনে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পরের অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য নিম্নোক্ত দিকনির্দেশনা গুলো সুপারিশ করা হয়েছিলঃ আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কে ঢাকায় পা রাখছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে কে কোথায় যাচ্ছে। এই জন্য পি.আই.এ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) কে অনুরোধ করা হয়েছে চাতুর্যের সাথে তথ্য সংগ্রহ করতে এবং তা পি.আই.ও (প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার)/ডি.জি.পি.আর (ডিরেক্টর জেনারেল অফ পাবলিক রিলেশন্স) এবং JS, ঢাকাকে জ্ঞাত করার জন্য।”
.
“ঢাকা এবং করাচিতে তাদের দ্বারা পূরণকৃত সকল কাগজপত্র তৎক্ষণাৎ পি.আই.ও (প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার)/ডি.জি.পি.আর (ডিরেক্টর জেনারেল অফ পাবলিক রিলেশন্স) এর নিকট পাঠাতে হবে”
.
“ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ঢাকায় পি.আই.ডি (প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট) একটি ইনফরমেশন ডেস্ক স্থাপন করবে যাতে বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে লিয়াজো বজায় রাখা যায় এবং তাদের নিকট আমাদের তথ্য সরবরাহ করা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রনালয়ের সচিব প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিবে যাতে মহকুমা পর্যায় পর্যন্ত বিদেশী সাংবাদিকের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখার ব্যাবস্থা থাকে। এবং মহকুমা পর্যায়ে প্রাদেশিক তথ্য অফিসার শুধু তথ্য সরবরাহের জন্যই প্রস্তুত থাকবেনা, সেই সাথে ভ্রমনকৃত বিদেশী সাংবাদিকদের ও ব্রিফ করতে হবে। এর মানে এই যে, তাঁর প্রান্তে তাঁকে সবকিছু অবহিত করে রাখতে হবে এবং তাঁকে বলার মত পয়েন্টস এবং অন্যান্য দলিল সরবরাহ করতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সরকারের নীতি প্রকাশ পায়।”
.
“চিফ সেক্রেটেরী একই সাথে ডিভিশনাল কমিশনার, ডিস্ট্রিক্ট ও সাব-ডিভিশনাল অফিসারদের কিভাবে বিদেশী সাংবাদিকদের মোকাবেলা করতে হবে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেবে, যারা সাধারনত স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করতে পারে তাদের অনুসন্ধানের জন্য। এটাও আসা করা যাচ্ছে যে, বিদেশী সাংবাদিকদের ক্যান্টনমেন্ট ও সামরিক অফিসারদের থেকে দূরে রাখা হবে।”
.
“VIP দের ভ্রমন প্রসঙ্গে (যেমনঃ ব্রিটিশ এম.পি এবং কংগ্রেসম্যান) ঃ
.
“VIP দের সাধারণত যেসকল সুবিধা দেয়া হয় এবং বিবেচনা করা হয় তা দেয়া সাপেক্ষে অতিরিক্ত কোন বিনোদনের ব্যাবস্থা করা যাবেনা, যেটি বর্তমানের পূর্ব-পাকিস্তানের অবস্থার সাথে বেমানান। এবং অতিরিক্ত সামরিক ব্যাক্তিদের প্রদর্শন করানো যাবেনা। নিরাপত্তা ব্যাবস্থা হবে বিচক্ষন…
.
“তাদের বন্ধুত্বপূর্ন বিদেশীদের সাথে দেখা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা যেতে পারে। বিশেষত তাদের সাথে যারা চট্টগ্রাম ও সিলেটে আছে। এবং ব্যাক্তিগত ভাবে বিদ্রোহীদের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছে।”
.
“তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং নারায়ণগঞ্জের স্বাভাবিক জীবন-যাপন নিজে থেকে দেখতে চাইবে।”
.
“সর্বোপরি, তারা দেখতে চাইবে যে উদ্বাস্তু ব্যাক্তিদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে এবং তাদের গ্রহণ ও পুনর্বাসনের ব্যাবস্থার ব্যাপারে যথাযথ ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা। এই ব্যাপারে তারা দুই-তিনটি শরনার্থী শিবির ভ্রমন করতে পারে। তাদের জনাকীর্ন গুলোই দেখানো হবে, কিন্তু জনতাকে পুনর্বাসনের মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার বদলে তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের পুনর্বাসনে দেরি হবে”
.
“অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলো যেমন খুলনা, থেকে তাদের দূরে রাখার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু তাদের দূরে রাখার জন্য কোন ইচ্ছাকৃত সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেয়া যাবেনা।”
.
“আশা করা যাচ্ছে যে বুদ্ধিজীবী হত্যার কথিত প্রচেষ্টার ব্যাপারে তারা জেনেছে, এবং তারা এই ব্যাপারে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবে এবং জগন্নাথ হল ঘুরে দেখা এবং কিছু বুদ্ধিজীবীর সাথে দেখা করার ব্যাপারে জোর করবে। এই ব্যপারে আমাদের কোন আপত্তি থাকবেনা কিন্তু শুধু নির্ভরশীল ব্যাক্তিদের তাদের সাথে দেখা করিয়ে দেয়া হবে।….
.
অ্যাব্রিভিয়েশনের অর্থঃ
ডি.জি.পি.আর-ডিরেক্টর জেনারেল অফ পাবলিক রিলেশন্স
জে.এস- জয়েন্ট সেক্রেটারি
পি.আই.এ- পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স
পি.আই.ডি- প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট
পি.আই.ও-প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার।
.
অনুবাদকঃ শিহাব শারার মুকিত
<৬, ৮৪, ৭৩০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
পাকিস্তান পরিস্থিতি |
বাংলাদেশ ভলিউমঃ ১, নং- ৫ |
১ অক্টোবর ১৯৭১ |
পাকিস্তান দেউলিয়া
বাংলাদেশে চলমান সংকটের প্রথম তিন মাসের (এপ্রিল-জুন) অর্থনৈতিক প্রভাব স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের ১৯৭০-৭১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের জন্য বিশাল খরচের ইঙ্গিত পাওা যায়। স্টেট ব্যাংকের গভর্নর তার মন্তব্যে বলেন “আমরা একটা অকার্যকর, মূলধন প্রবণ, আমদানি নির্ভর, অভ্যন্তরীণ চাহিদাসমূহ পূরণের ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় খাত প্রাধান্য দেওয়ার মাঝে আটকে আছি।” বার্ষিক প্রতিবেদনের লক্ষ্যণীয় দিকগুলো নিম্নরূপঃ
বার্ষিক জাতীয় উৎপাদন
১৯৬৯ সালের ৬৬% থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯৭০-৭১ সালে ১.৪% হয়েছে। কৃষি উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালের ৮.২% বৃদ্ধির বিপরীতে ৩.২% হ্রাস পেয়েছে।
প্রধান ফসলাদির উৎপাদন হ্রাস
গম ৯.৩%, ধান ৯.১%, পাট ১২.৭% হ্রাস পেয়েছে
শিল্পজাত উৎপাদন
আগের বছরের ১১.২% এর তুলনায় ২.৪% বেড়েছে। সরকারী অর্থ লেনদেনে ঘাটতি গত বছরের ১৩০ মিলিয়ন (১৩ কোটি) মার্কিন ডলারের বিপরীতে হয়েছে ২২৯ মিলিয়ন (২২ কোটি ৯০ লাখ) মার্কিন ডলার।
পারিশ্রমিক ভারসাম্যতা
গত বছরের ৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিপরীতে সর্বপরি ১১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি। এই সময়ের ভিতরে জুলাই-সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা সবথেকে খারাপ ছিল।
আপনি কি এরপরেও ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনকে আর্থিক সাহায্য করবেন?
পশ্চিম পাকিস্তানি কূটনীতিকদের গণ-বদলি
রাস্ট্রদুত, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স অফিসার এবং তাদের নেপথ্য সাহায্যকারী সহ সকল পশ্চিম পাকিস্তানি কূটনীতিকদের ওয়াশিংটন থেকে রাওয়ালপিন্ডি বদলি করা হয়েছে।
এই গন-বদলির কারণ হল ১৮ বাংলাদেশি কূটনীতিক ও কর্মকর্তার বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের বিষয়ে আগেই ইসলামাবাদে রিপোর্ট করতে না পারা।
পশ্চিম পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত যার ৩১ অক্টোবর অবসর গ্রহন করার কথা তাকে ডেকে পাঠান হয়েছে। ওয়াশিংটনে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল যিনি আগে পিকিংএ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
.
.
অনুবাদঃ শিহাব শারার মুকিত
<৬, ৮৫, ৭৩১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
পাকিস্তান পরিস্থিতি |
বাংলাদেশ ভলিউম-১, নং-৬ |
৮ অক্টোবর, ১৯৭১ |
বিশ্বব্যাংকের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অযাচিত উপদেশ
পশ্চিম পাকিস্তান ১১৪ জাতীয় বিশ্বব্যাংককে একতরফা ঋণ প্রদানকে বৈধতা না দেয়ায় অভিযুক্ত করেছে। মনে করিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান এর আগে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সকল ঋণ ছয় মাসের জন্য একতরফাভাবে স্থগিত রেখেছিল। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের বার্ষিক ব্যাংক তহবিল সম্মেলনে উপস্থিত পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের প্রধান এস ইউ দুররানি ২৯ সেপ্টেম্বর বলেন, “একটা অবস্থায় পৌছেছি যেখানে বেশ কিছু বড় উন্নয়নশীল দেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে না। …… এটা অবশ্যই একটি অসমর্থনীয় অবস্থা এবং নির্দিষ্ট শর্তাধীন ঋণের ঘাত-শোষণ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ব্যাংক কতটুকু নমনীয়তা দেখাতে পারে সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছেই। ”
গত জুনে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কিত ব্যাংক প্রতিবেদনের দিকে জনাব দুররানি কর্কশভাবেই তীর্যক ইঙ্গিত করেন। এর মানে হতে পারে যে ইহার কঠোর অর্থনৈতিক ভিত্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দন্দ্ব রয়েছে। তিনি আঁচ করেন যে সম্ভবত প্রয়োজনটা এমন একজন কর্মচারীর বৃহত্তর ও সংবেদনশীল রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ফলাফলের জন্য যিনি শুধু তার নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রেই দক্ষ, কিন্তু তার বস্তুনিষ্ঠতার জন্য প্রযোজকদের মধ্যেই দরকার একজন যিনি হবেন শক্তখুটির মত এবং প্রতিষ্ঠানের নিজের মধ্যেই ব্যাবস্থা থাকতে হবে। গত জুনের মিশন রিপোর্টে বাংলাদেশে চলমান সন্ত্রাস ও ধ্বংসের বিষয়ে মন্তব্য করে যা উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত অসম্ভব করে ফেলেছে।
ব্যাংকের বার্ষিক ব্যাংক তহবিল সম্মেলন শেষ হবার পরেই পশ্চিম পাকিস্তান ১৯৭১-৭২ অর্থ বছরের জন্য ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। অবাক করা বিষয় হল এই সময়ে প্রতিনিধিদলের প্রধান ছিলেন বিদায়ী রাষ্ট্রদূত হিলালি।
পশ্চিম পাকিস্তানের এবছর ৩১০ মিলিয়ন ডলার ঋণের দায় রয়েছে এর মধ্যে গতবছরের বিলম্বিত আদায় ৮৮ মিলিয়ন ডলারও অন্তর্ভুক্ত। পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশগুলো পাবে ৪০ মিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংক পাবে ৫১ মিলিয়ন ডলার।
.
.
অনুবাদঃ সৈকত জয়ধর
<৬, ৮৬,৭৩২-৭৩৩>
শিরোনামঃ রাজনৈতিক সমাধানের বিশ্বজনীন আহবান
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৭
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
.
জাতিসংঘের চার শীর্ষ ক্ষমতাধর ও অন্য অনেক সদস্য বাংলাদেশের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারন সভায় উপস্থিত বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মির নৃশংসতার ফলে সৃষ্ট বাঙালী স্মরণার্থী সমস্যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
.
২১ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ১৩০ সদস্য বিশিষ্ট সাধারন সভা চলবে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত। যেসকল প্রতিনিধি ইতিমধ্যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারা পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন যেন নব্বই লক্ষ বাংলাদেশী শরণার্থীর জন্য তাদের বাড়ি ফেরার উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। (নিম্নে গুরুত্বপুর্ন কোটেশন ক্যাপিটালাইজ করা হইলো)
.
ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা
আমেরিকার স্বরাষ্ট্রসচিব, উইলিয়াম পি. রজারস বাংলাদেশে চলমান সমস্যার “একটি কার্যকর রাজনৈতিক নিষ্পত্তির প্রচেষ্টা” -এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, “দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ও শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে।”
.
ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত স্যোশালিষ্ট রিপাবলিক (সোভিয়েত ইউনিয়ন)
সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকো জাতিসংঘ সদস্যদের বলেছেন যে “অত্র এলাকার (বাংলাদেশের) বর্তমান অবস্থা তীব্র এবং নিছকই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়”। তিনি বলেছেন, “আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশ প্রশ্নে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমেই এই অঞ্চলের বৈরিতার অবসান ঘটানো সম্ভব।”
.
ইউনাইটেড কিংডম
বৃটিশ পররাষ্ট্রসচিব স্যার অ্যালেক ডগলাস হুম বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও অন্যান্য রাষ্ট্রসমুহের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বিশ্বসম্প্রদায়কে সাবধান করে বলেন, “রাজনিতিকরা কখনই বলতে পারেন না যে আমরা এখানে মিলিত হয়ে খাদ্যের বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে তর্ক করেছি যখন লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ অনাহারে দিন কাটিয়েছে।”
.
ফ্রান্স
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সুমান বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত সমাধানের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, পাকিস্তান যে অন্যায় করেছে, তা শুরুতেই শুধরানো না হলে বাংলাদেশীদের দেশত্যাগ বন্ধ হবে না।
.
ভারত
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং জাতিসংঘের প্রতি ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের উপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শক্তির প্রয়োগ সফল হবে না, তাই সামরিক শাসক ও ইতিমধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি আবশ্যক।
.
কানাডা
কানাডার প্রতিনিধিদলের প্রধান প্রশ্ন করেছেন, “কোন পর্যায়ে পৌছালে একটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতগুলো জাতিকে এত বেশি প্রভাবিত করে যে তাকে আর ঘরোয়া ব্যাপার বলা যায় না?”
.
জাপান
জাপান বিশ্বের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক নিস্পত্তি ত্বরান্বিত করার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
.
অন্যান্য
এছাড়াও পোল্যান্ড, হল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, সুইডেন, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, জাম্বিয়া, ইতালি, নিউজিল্যান্ড এবং লুক্সেমবার্গ বাংলাদেশ সমস্যার একটি যথোপযুক্ত রাজনৈতিক নিস্পত্তিতে পৌছার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
.
অনুবাদঃ নিয়াজ মেহেদী
<৬, ৮৭, ৭৩৪>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ রাজনৈতিক সমাধান
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম. ১ : নং. ৭
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
রাজনৈতিক সমাধান
১২ অক্টোবরের বেতারবার্তায় ইয়াহিয়া খান তাঁর অভিপ্রায় সম্পর্কে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর দ্বারা জাতীয় পরিষদের জোরপূর্বক শুন্য করা আসন সমূহ ভরাট করার জন্য ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর পরই একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাবনা করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে যে সংবিধান লেখা হচ্ছে তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব করার ক্ষমতা সে জাতীয় পরিষদকে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি সংশোধনী অবশ্যই তাঁর নিকট পাঠাতে হবে তাঁর বিবেচনা এবং অনুমোদনের জন্য।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের একমাত্র প্রতিনিধি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে কারাগারে আটকে রেখে প্রস্তাবিত উপ-নির্বাচনে কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন করবে সেটি বোঝা যাচ্ছেনা। এছাড়াও,জনগনের দ্বারা মুক্তভাবে নির্বাচিত এতজন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য কে গদিচ্যুত করার অধিকার ইয়াহিয়াকে কে দিয়েছে? আবার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অবশিষ্ট সদস্যগন যে তাঁর হাতের পুতুল হবে ইয়াহিয়ার এই অনুমানের ভিত্তি কি? এরকম কেন্দ্রীয় সরকারের বৈধতা কি যেখানে বাংলাদেশের জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের প্রতিফলন হয়নি?
মূল ব্যাপার হচ্ছে যে লক্ষে অটুট থাকা এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাংলাদেশের জনগন থেকে আওয়ামী লীগ পরিষ্কার এবং অভিভূত জনসমর্থন পেয়েছে। এই জনসমর্থন ইয়াহিয়ার সরকার থেকে সম্পুর্ন ভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছিল এবং তারা স্বায়ত্তশাসনের এই আন্দোলন নৃশংস এবং বর্বর শক্তি প্রয়োগ করে দমনের চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশের মানুষ বীরত্বের সাথে এর প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়। এই পরিস্থিতিতে ইহা আশা করা নিরর্থক যে সামরিক বাহিনীর অনুগত পুতুল সরকারের নিকট মিথ্যা ক্ষমতা হস্তান্তর দ্বারা সামরিক শাসন ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য হাসিল হবে। এমনকি ২৫ মার্চের ভয়াবহ ঘটনাবলির জন্য আন্তর্জাতিক অভিমতকে ধোকা দেয়ার চেষ্টাও যে সফলকাম হবেনা তা এখন বোঝাই যায়।
ইয়াহিয়া খানের অবশ্যই বোঝা উচিৎ যে তিনটি শর্তাবলি পূরণ করা ছাড়া দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন অর্থপূর্ন রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারেনা। শর্তাবলিঃ ক) বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়া। খ) শেখ মুজিবর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি। গ) বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার করা।
এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে ইয়াহিয়া খান তাঁর পূর্বসূরির নিকট হতে কোন শিক্ষা গ্রহন করেননি, যিনি একটি পুতুল সরকারের জন্য জনগনের উপর একক ব্যাক্তির রচিত সংবিধান চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আইয়ুব খানের প্রচেষ্টা বিফল হয়েছিল এবং জনগনের আন্দোলনে তিনি ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। ইয়াহিয়ার জন্যও একই ভাগ্য অপেক্ষা করছে যদি সে তাঁর মূর্খতায় অবিচল থাকে।
একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে একটি সংবিধান জনগন দ্বারা জনগণের জন্য প্রণীত হয়।
.
.
অনুবাদঃ অভিজিৎ সরকার
<৬,৮৮,৭৩৫-৭৩৬>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত | বাংলাদেশ, ভলিউম ১, নম্বর ৭ |
১৫ অক্টোবর, ১৯৭১ |
আমাদের পাঠকদের মন্তব্যঃ বাংলাদেশের জয় সুনিশ্চিত হবার ১০টি কারণ
সামরিক
১) বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী এখানকার ভূখণ্ডের সাথে অপরিচিত, জলবায়ুর সাথে অনভ্যস্ত এবং স্থানীয় ভাষা ও রীতিনীতির ব্যাপারে অজ্ঞ। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহারে বাঙ্গালি-নিধনের ফলে, মূলত বিহারী-অধ্যুষিত ক্ষুদ্র অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই শুধুমাত্র তারা স্থানীয় সমর্থন পেতে পারে।
২) পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তাকে বিপদগ্রস্ত না করে, বাংলাদেশে এক লক্ষের চেয়ে বেশি পাকিস্তানি সৈন্যের অবস্থান করা সম্ভব নয়, যদি না পাকিস্তান তার সেনাবাহিনীতে নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কিন্তু পাঞ্জাবী-নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী (৮৫% এরও বেশি) অপাঞ্জাবীদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে ইচ্ছুক নয়, কারণ তাদের আশঙ্কা এতে করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে (সিন্ধি, বেলুচি, পাঠান) সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হতে পারে। সেনাবাহিনী পাঞ্জাবের তথাকথিত “সামরিক” জেলাগুলোতে বলতে গেলে “বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগদান নীতি” চালু করতে বাধ্য হয়েছে।
৩) সেনাবাহিনীর মাথাব্যথা মূলত মুক্তিবাহিনী, যারা দ্রুতই সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করছে এবং ক্রমশঃ জটিল অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে। বছরের শেষে, মুক্তিবাহিনী সক্ষমতা অর্জন করবে দখলদার বাহিনীর চেয়েও বেশি সংখ্যক যোদ্ধা মাঠে নামানোর। এটা জানা কথা যে, গেরিলা যোদ্ধাদের ঠেকানোর জন্য সাধারণত সৈন্যসংখ্যা অন্তত পাঁচগুণ বেশি হতে হয়।
অর্থনৈতিক
৪) পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ঘাটতি রয়েছে। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানকে নিজস্ব উচ্চমূল্যের পণ্যের বাজার হিসেবেও ব্যবহার করা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে আর সম্ভব নয়।
৫) পাকিস্তানকে দেয়া বৈদেশিক অর্থসহায়তা, যার সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো, পাশ্চাত্য দাতা দেশগুলো সেটি কার্যতঃ বন্ধ করে দিয়েছে (যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত), যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে, যা পাকিস্তানের বার্ষিক আমদানির অর্ধেক। বাংলাদেশে গণহত্যার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো সকল সাহায্য বন্ধ করার পক্ষে, যতক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হচ্ছে। চীন থেকে পাওয়া সহায়তার পরিমাণ কম এবং সেটা অর্থমূল্যের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় না।
৬) সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ১৯৬৫ সালে বার্ষিক ৪০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন বার্ষিক ৮০০ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। যুদ্ধাস্ত্রের বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়, এর ফলে সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ ব্যয় হয়ে যায়। সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের যেটুকু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনহয়েথাকে, তাও হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এর ফলে, সকল অস্ত্রশস্ত্র পরিবহন করতে হয় ভারতীয় সমুদ্রসীমা ঘুরে এসে, যার ফলে খরচ হয় অত্যধিক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিবহন করাটাও আরেকটা বড় সমস্যা, কারণ চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মধ্যে রেলপথ এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক
৭) অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান না করে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে সামরিক প্রয়োজনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সামরিক ক্র্যাকডাউন খুব অল্প সময়ের মধ্যে সুচারুভাবে সমাপ্ত হবে, এ বিশ্বাসে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শুরুতে একে সমর্থন দিয়েছিল। তারা এখন অসন্তুষ্ট। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আস্থার অভাবে বড় বড় ব্যবসায়ীরা এবং শিল্পমালিকরা কালোবাজারির মাধ্যমে তাদের ফান্ড বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মধ্যবিত্তরা এ দুর্গতি অনুভব করছে আরো বেশি, কারণ মার্চ মাস থেকে করের উচ্চহার এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। শ্রমিকদের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে অসন্তোষ।
৮) উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এমনকি যিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একত্রে চক্রান্ত করে বর্তমান সংকট সৃষ্টি করেছেন, সেই ভুট্টো নিজেও জনসম্মুখে “পশ্চিম পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের” সম্ভাবনার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। একইরকম বক্তব্য এর আগে দিয়েছিলেন ওয়ালি খান, যাঁর দল পশ্চিম পাকিস্তানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়েছিল।
৯) পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির অভাব ক্রমশ বাড়ছে। টিক্কা খান — সেনাবাহিনীতে যাঁর উত্থান শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে, যখন তিনি নির্মমভাবে বোমাবাজি করে বেলুচি আদিবাসীদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেছিলেন – তাঁর অপসারণকে এটা অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে।
নৈতিক
১০) স্বাধীনতা আদায়ের সকল সংগ্রামেই আন্তর্জাতিক নৈতিক অনুভূতি সবসময় বড় ভুমিকা রেখে আসছে। বিদেশী দখলদার বাহিনীর দমন-পীড়নের পদ্ধতির বিরুদ্ধে জনমতের বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত প্রধান প্রধান অঞ্চলে “[দখলদারদের] ইচ্ছের অভাবের” জন্ম দেয়, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির অবক্ষয় ঘটায়। পুরো পৃথিবীর সাথে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক অবধারিতভাবে আরো খারাপ হবে, শুধুমাত্র সেসব সরকারগুলো বাদে যারা পাকিস্তানের অনুরূপ নীতি মেনে চলে (যেমন, মুসলিমপ্রধান উত্তর আফ্রিকার নাইজেরিয়া), অথবা যেসব দেশগুলো ব্যতীত যারা জনসমর্থিত শক্তি দমনে পাকিস্তানি ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহার করে বা করতে পারে (যেমন, পারস্য সাগরের উপকূলবর্তী আরব দেশসমূহ)।
একজন কূটনীতিবিদ
ওয়াশিংটন ডি.সি.
.
অনুবাদঃ রাশেদ সাইফুল
<৬, ৮৯, ৭৩৭>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় মুক্তিবাহিনী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম-১: নং- ৮
তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
মুক্তিবাহিনী
গত এপ্রিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে এই অঞ্চলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ছিল মুক্তিবাহিনীর আবির্ভাব।
মুক্তিবাহিনী সফলতার সাথে স্বাধীনতার জন্য বাঙ্গালীর সংগ্রামকে পুনর্জীবিত করেছে। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং সমাজের সর্ব স্তরে তাদের সমর্থক রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ স্বার্থে তারা বিধ্বংসী নয় বরং উন্নয়নশীল এবং বিশ্বব্যাপী গুরুত্বহীন হিসেবে পরিগণিত হলেও তারা প্রমাণ করছে যে তারা খুব ভয়াবহ অন্তর্ঘাত বজায় রাখতে সক্ষম।
মুক্তি বাহিনী আকারে, কৌশলে এবং দক্ষতায় উন্নতি করছে। তাদের দর্শনীয় কাজের মাঝে রয়েছে ঢাকায় অবস্থিত ইন্টারকন্টিনেল্টাল হোটেলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন যা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা সদরদপ্তর এর দৃষ্টিসীমার মাঝে অবস্থিত। বাঙ্গালী নৌ কমান্ডোরা বাংলাদেশ বন্দরে ডজন খানেক পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিদেশি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। যেহেতু ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী বিদেশি স্বার্থের পর্যাপ্ত নিরাপত্ত দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ব্রিটিশ শিপিং লাইন এরই মধ্যে বাংলাদেশে সব ধরনের নৌ চলাচল স্থগিত করেছে।
এছাড়াও যখন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যখন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু করেছে তখন থেকে ১৫৭ টি প্রধান সড়ক এবং রেল ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা বাংলাদেশের প্রধান রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সড়ক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে রয়েছে কারণ ব্রিজগুলো মেরামতের আওতার বাইরে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
বীর বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রদীপ্ত শ্রদ্ধা নিবেদন করে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (অক্টোবর ১৭) লিখেছে, যদি ভিয়েতকংরা ছয় মাস পরে এরকম করতে পারত তাহলে তারা এটাকে একটি ভালো সূচনা হিসেবে মূল্যায়ন করত।
সাধারন ভাবে বলতে গেলে, মুক্তিবাহিনী ব্যাপক ভাবে সেনা শাসনের আইন, আদেশ এবং সরকারি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ক্ষতিসাধন করেছে। এটি ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর মাঝে বিষন্নতা এবং হতাশা বাড়াতে সাহায্য করেছে। অতি সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে হাতাহাতি লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা বাহিনী এরই মাঝে অবাধ্যতারা চিহ্ন দেখাতে শুরু করেছে।
মনোবলহীন পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী। আমেরিকার গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং আলজেরিয়ার মুক্তির সংগ্রামের মতই এই বিজয় নিশ্চিত।
.
অনুবাদঃ ওমার ফাইলাসূফ
<৬, ৯০, ৭৩৮>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ ইয়াহিয়ার কৌশল
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ৯
তারিখঃ ২৯ অক্টোবর, ১৯৭১
.
ইয়াহিয়ার কৌশল
রাজনীতির মাঠের সবচেয়ে সরল কথাটাও মোড়ানো থাকে বিভ্রান্তির পুরু চাদরে। এ প্রসংগে বলা যায়, ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সম্প্রতি যে সর্বাত্বক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন, পরিস্থিতির বিচারে তা যতই সোজা সাপটা শোনাক, এর অন্তর্নিহিত অর্থ যথেষ্টই বিভ্রান্তিকর।
.
এখন যেহেতু যত দিন যাচ্ছে পূর্বে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে, পশ্চিমের জেনারেলদের শাসন কায়েম রাখার জন্য তুরুপের শেষ তাস হিসাবে ইয়াহিয়া খান সামনে এনেছেন “ভারত ভাঙ্গা”র স্লোগান।
.
ইয়াহিয়ার সর্বাত্বক যুদ্ধের ঘোষনাকে বিভ্রান্তিকর বলার কারণ হলো, বিগত যুদ্ধগুলিতে ভারতের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের ব্যার্থতার বিষয়ে তিনি ভালোভাবেই অবগত আছেন। কিন্তু প্রপাগান্ডা যে বিষয়টাকে আড়াল করে ফেলছে তা হলো এই ফাঁকা হুমকীর পেছনে ইয়াহিয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আদায় করে পুর্ব ও পশ্চিমে খানের শাসনের ভীত অটুট রাখা।
.
ইয়াহিয়া মূলত বিশ্বকে একটা ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছেন যে ভারত যদি অনুপ্রবেশকারী ও এজেন্টদের বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেয়, তিনি খুব সহজেই “আভ্যন্তরীণ বিষয়” ফয়সালা করে ঢাকায় একটি তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবেন। তবে “কতিপয় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী আর এজেন্ট” মিলে কিভাবে গোটা বাংলাদেশে কিভাবে এতো জটিল সমস্যা বাধিয়ে দিতে পারলো, তা এক আশ্চর্যের ব্যাপার বটে।অপরদিকে বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে বাঙ্গালী মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে চলে আসছে এই সত্য কবুল করতে ইয়াহিয়া দৃশ্যতই লজ্জা বোধ করছেন। তবে, বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামের বৈশ্বিক স্বীকৃতি বিলম্বে আসার কারণ ইয়াহিয়ার বিদেশী সামরিক মিত্রদেশগুলো, যারা এখনি তাকে খরচের খাতায় ফেলে দিতে দ্বিধান্বিত্ত।
.
ইয়াহিয়া এখন দিন গুনছেন কবে তিনি দেশে একটা শাসনতন্ত্র তৈরি করে এসেম্বলির শূন্য আসনগুলো ভরাট করার কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন, সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় একটা বেসামরিক সরকার গঠন করার জন্য তিনি ইতোপুর্বে গোটা এসেম্বলির প্রায় অর্ধেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করেছেন। সম্ভবত উনার ধারনা হয়েছিলো তিনি সহজেই এই ভুয়া গনতন্ত্র দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সহানুভূতি আদায় করে নিতে পারবেন।
.
কিন্তু মুক্তিবাহিনী তার সমস্ত হিসাব নিকাশের ছক পালটে দিয়েছে। এখন তারা ক্রমান্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের উপর আক্রমনের জোর বাড়িয়ে দিচ্ছে। যুদ্ধের মাঠে নাস্তানাবুদ ইয়াহিয়া এখন সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী প্রপাগান্ডা চালানোর কাজে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার এই প্রপাগান্ডার প্রভাব যে বাংলাদেশে বা বাইরের বিশ্বে পড়বে না এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায় সামরিক শাসন যে এর দ্বারা ন্যায্যতা পাবে না, তা বলাই বাহুল্য।
.
.
অনুবাদঃ সৈকত জয়ধর
<৬, ৯১, ৭৩৯>
শিরোনামঃ জাতিসংঘ মিশন উঠে যেতে পারে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ১২
তারিখঃ ১৯ নভেম্বর, ১৯৭১
.
“জাতিসংঘের মিশন প্রত্যাহার হতে পারে”
ঢাকা, ১০ নভেম্বরঃ বাংলাদেশে জাতিসংঘের জরুরি মিশনের প্রধান শীঘ্রই একটি প্রতিবেদন সহ নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবে যেখানে বলা হয়েছে যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান হার সেখানে মিশনের কার্যক্রম পরিচালনা অসম্ভব করে তোলার হুমকি দিচ্ছে- বালটিমোর সান, নভেম্বর ১১ এর রিপোর্ট।
বাংলাদেশে মিশনের প্রধান ও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক-হেনরি স্বাধীন এলাকার পৌছাতে বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেক বিদেশী সংবাদদাতা তাদের প্রতিবেদনে বলেছেন, কমপক্ষে বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ অঞ্চল এখন বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রনে আছে। ঢাকা থেকে বালটিমোর সানের প্রতিবেদক জন উডরাফ জানিয়েছেন, আশা করা হচ্ছে মার্ক হেনরি মহাসচিব ইউ থান্ডের কাছে সরাসরি প্রতিবেদন পেশ করবেন যে, মুক্ত অঞ্চলগুলোতে নতুনভাবে প্রস্তুতি গ্রহন ছাড়া পৌছানো অসম্ভব, বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিও যে প্রস্তুতির অংশ।
দ্য সান এর প্রতিবেদক উডরফ আরও চিহ্নিত করেছেন যে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলরা এখনও জাতিসংঘ মিশনকে জনগণের কাছে সরাসরি খাবার পৌছে দেয়ার অনুমতি দানে রাজি হয় নি।
.
.
অনুবাদঃ সৈকত জয়ধর
<৬, ৯২, ৭৪০>
শিরোনামঃ মানব সৃষ্ট ধ্বংসলীলা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ১৪
তারিখঃ ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
“মানবসৃষ্ট দুর্যোগ”
বাংলাদেশে “মানবসৃষ্ট দুর্যোগ” নিয়ে করা প্রথম সন্তোষজনক চলচ্চিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছিল ২৬ নভেম্বর এন, বি, সি নেটওয়ার্কের মাসিক অনুষ্ঠান “ক্রনোলগ”-এ।
তথ্যচিত্রটি রচনা, প্রযোজনা, পরিচালনা ও বর্ণনা করেছেন বব রজারস, যিনি কিনা বাংলাদেশে এবং ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে প্রায় দুই মাস কাটিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের এক্সক্লুসিভ সচিত্র প্রতিবেদন সংগ্রহের জন্য রজারস বেশ কয়েকবার অধিকৃত বাংলাদেশে গোপনে প্রবেশ করেছেন। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণকারী বড় একদল বাঙালী গেরিলাবাহিনীর সঙ্গে এন, বি, সি এর প্রতিবেদক দল চারদিন অতিবাহিত করে।
অধিকৃত বাংলাদেশে ভিন্ন এক যাত্রায় এন, বি, সি এর কর্মীবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক সম্প্রতি ধ্বংস হওয়া এক বাঙালী গ্রামের চলচিত্র ধারন করতে সক্ষম হন।
চলচিত্রের বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার অব্যাহত নৃশংসতা এবং বাঙালী নারীর উপর হামলার চিত্র ফুটে ওঠে। কখনও আবার ফুটে ওঠে ভারতে বাঙালী শরণার্থী শিবিরের জীবনযাত্রা।
রজারস, যিনি কিনা গত দশ বছরে সংগঠিত হওয়া অনেক সহিংস ঘটনার উপর অত্যন্ত প্রশংসিত চলচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে তার ধারাভাষ্যে বলেছেন, “আমি যেসকল ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বিভীষিকাময়। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল তাবৎ দুনিয়া চুপচাপ বসে আছে এবং এমন একটি ঘটনা গটে যেতে দিচ্ছে।”
তথ্যচিত্রটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ২৭ নভেম্বরের ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, “দক্ষতার সঙ্গে নির্মিত, এমন আপোষহীন বিবরণ, যার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচন্ড শারীরিক ও নৈতিক শক্তির।”
বাস্তবিক অর্থেই তথ্যচিত্রটি ছিল অসাধারণ। এটি আমেরিকান কমিউনিকেশন মিডিয়ার দক্ষতা, বিশেষ করে এন,বি,সি টিমের সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া শোকাবহ ঘটনাসমূহ লাঘব করতে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মিত অনুষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা করায় আমরা বব রজারস, তার দলের সদস্যবৃন্দ ও এন,বি,সি নেটওয়ার্ককে অভিনন্দন জানাই।
.
.
অনুবাদঃ নিয়াজ মেহেদী
<৬, ৯৩, ৭৪১>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ আন্দোলন কর্মসূচী | বাংলাদেশ ভলিউম. ১ : নং. ১৪ | ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ নিয়ে অনুষ্ঠান সমূহ
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম.আর. সিদ্দিকী রবিবার ৫ ডিসেম্বর রাত ১১:৩০ মিনিটে চ্যানেল ২৯ এ একঘন্টা ব্যাপী একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন, এছাড়া ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরাও অংশ নিবেন।
ওয়াশিংটনের অনেকেই ২৪শে নভেম্বর চ্যানেল ২৬ এ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রথমবারের মত দেখেন, যখন তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের প্রোপাগান্ডার সমুচিত জবাব দিচ্ছিলেন যেটি আগের রাতে একই অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল। বাংলাদেশ মিশনের ডেপুটি চীফ এনায়েত করিমকে অনুরোধ করলে সেও অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে পাকিস্তানি শাসক বা আমেরিকান সরকারের যেকোন চুক্তির কথা অস্বীকার করেন।
শেষ আগস্ট মাস থেকে যখন দেশের রাজধানীতে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করা হয়েছিল রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকি তখন থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ভ্রমন করছেন। সে বোস্টন, ডেট্রয়েট, লস এঞ্জেলেস, স্যান ফ্রান্সিস্কো, ডেভিস, ডেনভার, আলবেনি এবং বেথেলেমে টিভি এবং পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন। এছাড়াও রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকি ইউ.এস এবং কানাডার বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সাথেও কথা বলেছেন।
ইউ.এস এ খৃষ্টানদের চার্চের ন্যাশনাল কাউন্সিল ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে একটি আলোচনা সভা আয়োজন করে। বাংলাদেশ মিশনের ডেপুটি চীফদের উদ্দেশ্য করে, এনায়েত করিম বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সহাবস্থান করা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা আলোচনাসভায় পৌঁছলেও বাংলাদেশ মিশনের সদস্যদের দেখার পর অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। আলোচনা সভার আয়োজকদের সারাংশ প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানী কূটনীতিকদের “ইহা পূর্বের ধারনার বিপরীত ছিল যে এই অধিবেশনের আয়োজন সন্তোষজনক”
বাংলাদেশের উপদেষ্টা এস.এ. এম.এস. কিবরিয়া, এ.এম.এ মুহিথ এবং এস.এ.আর মতিনুদ্দিন বিভিন্ন আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা রাখেন। এছাড়াও বাংলাদেশের সংগ্রামের জন্য সমর্থন চাইতে তারা টিভি এবং রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।
.
.
অনুবাদঃ নিয়াজ মেহেদী
<৬, ৯৪, ৭৪২>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাঃ বাংলাদেশের স্বীকৃতি | বাংলাদেশ ভলিউম. ১ : নং. ১৫ | ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের স্বীকৃতি
এটা সর্বজনবিদিত যে ২৫ শে মার্চের রাতে যখন পাকিস্তানের হবু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি অজানা স্থানে উড়িয়ে নিয়ে বন্দী করা হয়েছিল এবং ইয়াহিয়ার সেনাপতি টিক্কা খান নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নামেন, পাকিস্তানের তখনি মৃত্যু হয়। সে রাতে এক আতংকের রাজত্ব লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতাদের ঢাকার রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত পেশাদার সৈনিকরা নারীদের ধর্ষণ করে এবং শিশুদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একজন মানুষের নিয়মতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ সমগ্র বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল। ইয়াহিয়ার গণহত্যার রেকর্ড হিটলারকেও ম্রিয়মাণ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ একটি নিয়মতান্ত্রিক বদ্ধ গণহত্যার মল্লভূমিতে পরিনত হয়েছে। সংক্ষেপে এটাই বাংলাদেশের সৃষ্টির পিছনের পটভূমি।
বাংলাদেশকে বিধিসম্মত ভাবে স্বীকৃতি দেয় ভারত এবং আরেক প্রতিবেশী ভূটান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লীতে সংসদে বলেন “বাংলাদেশের মানুষ তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করছে এবং ভারতের জনগন লড়ছে অত্যাচারী কে প্রতিহত করতে এবং এখন তারা নিজেদের একই লড়াইয়ের স্বপক্ষে পেয়েছে। মিসেস গান্ধী বলেন ভারত দ্বারা বাংলাদেশের স্বীকৃতি কোন আবেগের বশবর্তী হয়ে দেয়া হয়নি বরঞ্চ বাংলাদেশে বিদ্যমান বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তব পর্যালোচনা করেই দেয়া হয়েছে। আসলে স্বীকৃতি একটু বিলম্বিত করা হয়েছিল যতক্ষন পর্যন্ত না মুক্তিবাহিনী এযাবৎ পশ্চিম পাকিস্তানের দখলে থাকা প্রায় সকল ভূখণ্ড স্বাধীন করে এবং কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশ সরকার সুপ্রতিবেশী সুলভ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপনের জন্য “সাহসী এবং দৃঢ়সংকল্প” পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ভারতকে অভিনন্দন জানান।
১৭৭৮ সালে ফ্রান্স যখন ইউনাইটেড স্টেটসকে স্বীকৃতি দেয় তখন অনেকটা একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এটার এখন কোনই মূল্য নেই যে বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে উইনাইটেড স্টেটস একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। আমেরিকান কলোনিগুলো একই ধরনের শোষণের শিকার হয়েছিল এবং কলোনিগুলোর কোন প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়াই তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়ে হয়েছিল করের বোঝা। পুরনো এই দেশটি এবং নতুন দেশের মধ্যেও নতুন এই দুই দেশের আকর্ষণীয় মিল গুলোর কারনে আমরা আশাবাদী হই যে ইউনাইটেড স্টেট্স গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় সঙ্গী হিসেবে স্বীকৃতি দিবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক চালূ করার মাধ্যমে বর্তমানে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ইতোমধ্যে বিরাজ করছে তা আরও দৃঢ় হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আহবান জানিয়েছেন। এটা আমাদের আশা যে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশকে পূর্ন কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের আহবানে পর্যাপ্তরূপে সাড়া দিবেন।
.
.
অনুবাদঃ সৈকত জয়ধর
<৬, ৯৫, ৭৪৩>
শিরোনামঃ সম্পাঃ বাংলাদেশ
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ লিবারেশন সাপ্লিমেন্ট
তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ
আজ স্থানীয় সময় সকাল ৬:০১ মিনিটে বাংলাদেশ সম্পুর্ণরুপে শত্রুমুক্ত হয়। জয় বাংলা: বাংলার জয়। এই দিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি গ্লানিকর পর্যায়ের পরিসমাপ্তিকে ইঙ্গিত করে।
এই গুরুমুহুর্তে আমাদের চিন্তাজুড়ে রয়েছেন আমাদের জাতির পিতা, শেখ মুজিবর রহমান। আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ও বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ এই বীর নেতাকে স্যালুট জানায় এবং তার দ্রুত মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে।
এটা একটি নতুন ও মহান জাতির শুরু। আমরা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীকে শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানাই। গভীরতম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি বিদেশে আমাদের বন্ধুদের প্রতি।
বাংলাদেশের এই জন্ম শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রমুখী আমাদের উদ্দেশ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এক অসাধারণ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই খুশির দিনে এই শুভক্ষনে আমরা আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথেই আছি, যারা জাতির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন সেই সব অবাঙালী নাগরিক, যারা কিনা বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে পৈশাচিক অপরাধ সংগঠিত করেছে, তাদের উপর প্রতিশোধ না নিতে। বিজয়ের এই ক্ষনে আমাদের মহানুভব হতে হবে এবং ক্ষমাশীল হতে হবে আমাদের শত্রুদের প্রতি। আমাদের কর্মকাণ্ড ও আচরনেই বিশ্বের সামনে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য সম্পূর্ণ যোগ্য।
দেশের সকল নারী ও পুরুষের প্রতি আমাদের আবেদন একটি নতুন জাতি প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার, যার জন্য তারা ইতিমধ্যেই অপরিসীম কষ্ট ও ত্যাগ স্বিকার করেছেন।
সত্যিকার অর্থেই এটি একটি অম্লমধুর বিজয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন দিয়েছে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, অগণিত মানুষ স্বিকার করে নিয়েছে সীমাহীন ভোগান্তি। অগণিত বাসস্থান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো আজ ধ্বংসের দাড়প্রান্তে। এই সবকিছুই এখন প্রধান চিন্তাধারা, কিন্তু তন্মধ্যেও স্বাধীনতার স্পন্দনশীল বাস্তবতা যেন অনন্ত জাগ্রত অনুভূতি।
.
.
অনুবাদঃ সৈকত জয়ধর
<৬, ৯৬, ৭৪৪>
শিরোনামঃ কংগ্রেস সদস্যগণ কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রস্তাব
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ১৬
তারিখঃ ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের অনুবন্ধ (রেজোলিউশন) পেশ
.
মার্কিন কংগ্রেস সদস্য পল এন. ম্যাকক্লস্কি এবং হেনরি হেলস্টস্কি ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দু’টি ভিন্ন ভিন্ন অনুবন্ধে মার্কিন উপনিবেশ-বিরোধী ঐতিহ্য মোতাবেক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণ কুটনৈতিক স্বীকৃতি দানের জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি জোড় দাবি জানিয়েছেন।
ম্যাকক্লস্কি
রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, কংগ্রেস সদস্য ম্যাকক্লস্কি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, “বাঙালীদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের পুনর্মিলনী কোনদিন সম্ভব নয়।”
হেলস্টস্কি
কংগ্রেস সদস্য হেলস্টস্কি, যিনি ৯ ডিসেম্বর হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে অনুবন্ধটি উপস্থাপনা করেছিলেন, তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন পলিসির সমালোচনা করে বলেন, “আওয়ামীলীগ ও পূর্ব বাংলার বেসামরিক জনগণের উপর জঘন্য নিপীড়নের দ্বারা পাকিস্তানী সরকার ওই অঞ্চলের জনগণের আনুগত্যের উপর তাদের সকল দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ৮ ডিসেম্বর এক বেতারবার্তায় বিশ্বের অন্যান্য জাতির প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে ভারত এবং ভুটানকে অনুসরণ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
.
.
অনুবাদঃ মুশফিকুর রহমান অমিও
<৬, ৯৭, ৭৪৫>
শিরোনামঃ পর্যালচনা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলিউম ১ নং ১৬
তারিখঃ ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
পৃথিবীতে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সবচাইতে পুরাতন প্রতিরক্ষা বাহিনী হল আমেরিকারর এবং সবচাইতে নতুন বাংলাদেশের।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যার সফল সমাপ্তি হয়ে ছিল, তা পৃথিবীজুড়ে হওয়া উপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তির আন্দোলনের অংশ ছিল।এই আন্দোলন ১৭৭৫ সালে উত্তর আমেরিকা তে শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে প্রায় দুই দশক আগে আমেরিকান দেশপ্রেমিক দের স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো পার্থক্য ছিল না। আমেরিকান উপনিবেশ গুলোর মতই পূব পাকিস্তানও বহুদুরের পরাশাসকদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য শোষিত হচ্ছিল।আমেরিকানদের মত তাদেরও অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের কর দিতে হত, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উন্নতির প্রতি উদাসীন ছিল। তাই আমেরিকান দের মত বাঙালিরাও তাদের নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার প্রয়োগের জন্য নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চাইল।বাঙালিরাও আমেরিকান দের মত জয়ী হল। তারা স্বাধীনতা,সমতা,মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের সহজাত অধিকার লাভ করল। আমেরিকানদের মত বাঙালিরাও “জনগণের সরকার,জনগণের দ্বারা সরকার,জনগণের জন্য সরকার” প্রতিষ্ঠা করে।
.
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ
আমেরিকানরা আটলান্টিক মহাসাগরের অপরপাশে ৩০০০ মাইল দূরে অবস্থিত ব্রিটিশদের শাসন দ্বারা শোষিত হচ্ছিল। তারা কোনোরূপ বিবরণ ছাড়াই আমেরিকান দের উপর করারোপ করতে শুরু করল। আমেরিকান উপনিবেশিকরা পশ্চিমের প্রভাব নষ্টের আদেশ, পরাসেনাবাহিনীর ভরণপোষণ,তাদের পশ্চিম ভারতীয় সংস্কৃতির উপর বিধি নিষেধ এবং হস্তক্ষেপ করা, বৈদেশিক বাণিজ্যে ক্ষতি ইত্যাদি কারণে ব্রিটিশ দের প্রতি অভিযোগ প্রকাশ করে।
প্রথমে ব্রিটিশদের কাছে আমেরিকানরা তাদের অধিকার দাবী করে। ব্রিটিশরা উপনিবেশিকদের উপর সশস্ত্র হামলা করে তাদের প্রভুত্ব জাহির করে।ক্রমেই আমেরিকান দেশপ্রেমিক রা বুঝতে পারে যে তাদেরকে তাদের অধিকার আদায় করতে হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।
অবশেষে ১৭৭৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ব্রিটিশ রাজ্য ১৭৭৫ সালের ২৩ আগস্ট একে রাজবিদ্রোহ বলে ঘোষণা দেয়।ব্রিটিশ সৈন্যরা গণহত্যা শুরু করে যার জন্য আমেরিকার স্বাধীনতারর জন্য দ্বিতীয় মহাদেশীয় মহাসভা গঠিত হয়।
অবশেষে, আমেরিকান উপনিবেশিকরা বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে বৃটিশ পরাজিত করে। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা পৃথিবীর স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ঘোষণাটি, সব মানুষই সমান এবং সবারই স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে।
.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
২৪ বছর ধরে বাঙালিরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ সহ্য করছিল এইভেবে যে হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের ভুল বুঝতে পারবে। আওয়ামীলীগ এর ছয় দফা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে বাঙালিদের সম্মানের সাথে বাঁচতে সক্ষম করা। কিন্তু ভারতীয় মহাসাগরের অপরপাশে ৩০০০ মাইল দূরে পাকিস্তানি শাসকেরা ছয় দফা আন্দোলনের মধ্যে পুরব পাকিস্তান হাতছাড়া হওয়ার আশংকা দেখতে পায়।
২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যারর নির্দেশ দেয় এবং পূরব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয়।সেই মুহুরতে তারা এটা বুঝতে পারে পূরব পাকিস্তানের সাথে একত্রিত থাকা সম্ভব নয়।
বাঙালি মুক্তিবাহিনীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধ করল। গত মাসে ১৫০,০০০ মুক্তিযোদ্ধা সহযোগে একটি সফল আক্রমণ পরিচালিত হয়। সারা বিশ্বের স্বাধীনতা প্রেমী মানুষেরা মুক্তিবাহিনীকে নৈতিক ও বস্তুগত সাহায্য করেছে।
.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা
বাংলাদেশের মুজিবনগরে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্মের ঘোষণা দেয়। ততকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেই ঘোষণাতে বলেন “ বাংলাদেশকে তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য, পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ছাড়া আর কোন সুযোগ দেওয়া হয়নি। ”
.
অনুবাদঃ শিহাব শারার মুকিত
<৬, ৯৮, ৭৪৭-৭৪৮>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ উপনিবেশিক শোষণ |
বাংলাদেশ ১ম খণ্ড, নং ১৬ |
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
এক নজরে বাংলাদেশ উপনিবেশিক শোষণ
নীতি নির্ধারক
বাংলাদেশ | পশ্চিম পাকিস্তান | |
প্রধান নির্বাহী (প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি) |
৫ বছর | ১৯ বছর |
সেনাবাহিনী প্রধান | নাই | ২৪ বছর |
নৌবাহিনী প্রধান | নাই | ২৪ বছর |
বিমানবাহিনী প্রধান | নাই | ২৪ বছর |
অর্থমন্ত্রী | নাই | ২৪ বছর |
পরিকল্পনা মন্ত্রী | নাই | ২৪ বছর |
শক্তিকেন্দ্র
বাংলাদেশ | পশ্চিম পাকিস্তান | |
দেশের রাজধানী | নাই | x |
দেশের সংসদ | নাই | x |
সুপ্রিম কোর্ট | নাই | x |
সেনাবাহিনী সদরদপ্তর | নাই | x |
নৌবাহিনী সদরদপ্তর | নাই | x |
বিমানবাহিনী সদরদপ্তর | নাই | x |
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সদরদপ্তর | নাই | x |
বৈদেশিক বানিজ্য
বাংলাদেশ | পশ্চিম পাকিস্তান | |
রাষ্ট্রদূত সহ ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা | ৫৮ | ১৭৯ |
২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা | ৪৮ | ১৯৬ |
৩য় শ্রেণীর কর্মকর্তা | ১৭ | ৫৮ |
৪র্থ শ্রেণীর চাকরিজীবী | ৮ | ৮৯ |
সর্বমোট ব্যয় (মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
বাংলাদেশ | সাল | পশ্চিম পাকিস্তান |
৫৬৯.১০ (২০%) | ১৯৫০-৫৫ | ২৩৭০.৯০ (৮০%) |
১১০৪.০০ (২৬%) | ১৯৫৫-৬০ | ৩৪৭৫.৫০ (৭৪%) |
২৯৪৮.৪০ (৩২%) | ১৯৬০-৬৫ | ৭০৪৫.৫০ (৬৮%) |
৪৮৩৮.৪০ (৩৬%) | ১৯৬৫-৭০ | ৮৬০১.৬০ (৬৪%) |
কেন্দ্রীয় সেবা
বাংলাদেশ | পশ্চিম পাকিস্তান | |
নিরাপত্তা | ৮.১% | ৯১.৯% |
স্বরাষ্ট্র | ২২.৫% | ৭৭.৫% |
শিক্ষা | ২৭.৩% | ৭২.৭% |
তথ্য | ২০.১% | ৭৯.৯% |
স্বাস্থ্য | ১৯.০% | ৮১.০% |
কৃষি | ২১.০% | ৭৯.০% |
আইন | ৩৫.০% | ৬৫.০% |
.
[1] দেশবাংলাঃ সাপ্তাহিক। বাংলাদেশের জনযুদ্ধের মুখপত্র। সম্পাদকঃ ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। দীপক সেন কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও ‘অগ্নিশিখা’ প্রকাশনীর পক্ষে বিজয় নগর, ঢাকা থেকে প্রকাশিত।