You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ০২ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত আরও কয়েকটি নিয়মিত কথিকা শব্দসৈনিক’, ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ । আগষ্ট-ডিসেম্বর,১৯৭১।

দর্পণ
২৬ আগষ্ট, ১৯৭১

ক্যাম্পে বসে বসে সে তার পুরানো দিনগুলোর কথা ভাবছিল। সেই নদী, শীতের সকাল, গ্রামকে বিলুপ্ত পরান মাঝির চোখ-এক এক করে সব কথাই মনে পড়ছে। প্রথম যেদিন বন্দুক থেকে গুলি ছুড়েছিল সেদিনের কথাও ।

সোনাগাছির চর পাখী শিকারের জন্য বিখ্যাত। শীতকালে নদী ক্রমশঃ শুকিয়ে এলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চর পড়ে। এই চর থেকে প্রায় মাইল তিনেক দূরে তোরণের বাড়ি। বাড়ি বলতে অবশ্য ছোট দুটি কুড়েঘর, একট আমগাছ, গোটা কয়েক সুপারি গাছ চালের উপর সারা বছর কুমড়ো গাছের লতা ছেয়ে থাকে। শীতের গেছে। ঘাটে বাঁধা নৌকায় নদী পার হয়ে, চরের শিশির ভিজে ওঠা বালুর উপর দিয়ে আরও মাইল খানেক হাঁটার পর এলোমেলো চরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা খালের পাড়ে এসে দাঁড়াত। খালের পাশেই বালুর উপর দুটো ছই পাতা। তার একটাতে খড়ের উপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে বৃদ্ধ পরান মাঝি তখনও ঘুমাচ্ছে। তোরণ তাকে ডেকে তুলতো। খালে বেড় দিয়ে মাছ ধরার যন্ত্র সারারাত পেতে রাখা হত; তোরণ আর পরান দু’জনে মিলে গামছা পরে সব মাছ খাঁচিতে ঝেড়ে তুলতো। তারপর তোরণ নিজ হাতে ছোট ছোট কাঠের টুকরো দিয়ে মালসা জ্বালিয়ে তাতে দুজনেই হাত-পা সেঁকে নিত। পরান নিজ হাত হুকো ধরিয়ে হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে আয়েশ করে খোঁচা খোঁচা মুখে ধোঁয়া ছাড়ত। এরপর একটা বাঁশের টুকরোর দু’পাশে দুটো খাঁচি বেঁধে নিয়ে নদীর ঘাট পার হয়ে কুয়াশা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে যেত গঞ্জের দিকে।

মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের বাইরে রাতের অন্ধকারে বসে থাকা তোরণের এক এক করে অনেক কথাই মনে পড়ল। তখন ওর বয়স প্রায় ২৩ বছর। বছর নীয়েক পূর্বে ওর বাবা মারা গেছে। সংসারে একমাত্র বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই। পনের বছর বয়স থেকে সে পরান মাঝির সাথে কাজ করে। বৃদ্ধ পরান তাকে ছেলের চেয়েও বেশী স্নেহ করত।

সে শীতের সেই সকালগুলোর কথা ভাবছিল। পরান গঞ্জের দিকে বেরিয়ে গেলে, তোরণ মালসার পাশে বসে নতুন করে হুকো ধরিয়ে পরানের মত ভঙ্গিতে টানতো। ক্রমে ক্রমে কোন দিন কুয়াশা আরও পাতলা হয়ে আসত, কোন কোন দিন আরও ঘন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চরের বালু পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দিত। সূর্য উঠবে উঠবে পায়ের ছাপ পড়তে শুরু করত। এবং তাদের সবাইকে যেতে হ’ত পরান মাঝির মাছ ধরার জায়গার উপর দিয়ে। তারপরই বিস্তীণ চর-যেদিকে খুশী চলে যাওয়া যায়। এইসব শিকারীদের একজনের কাছ থেকে সে প্রথম বন্দুক চালান শেখে।

<005.006.179>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সেদিনও তোরণ যথারীতি বসে বসে হুকো টানছিল। বন্দুক হাতে জনাতিনেক লোক তার কাছে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, চরের কোন অঞ্চলটায় ভাল পাখী পাওয়া যায় এবং এর জন্য তোরণকে তারা সঙ্গে নিতে চায়। উপযুক্ত পারিশ্রমিকেরও কথাও তারা উল্লেখ করল। তোরণ বন্দুক কোনদিন নিয়ে পর্যন্ত দেখেনি। চট করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বলল, “যাবার পারুম এক শর্তোত, হামাক বন্দুক মারা শিখাবার নাগিবে।” যে ভদ্রলোক কালো একটা ওভারকোট গায়ে দিয়েছিলেন তিনি হেসে উঠলেন। মাছ মেরে শখ মেটে না, পাখী মারার ভীষণ শখ তাই না?

তোরণ কোন উত্তর দেয়নি, ভদ্রলোকরা রাজী হয়ে গেল। সেদিনই সে প্রথম বন্দুক ছুড়লো। লাল একটা কার্তুজ ভরে যখন তার হাতে বন্দুকটা দিল তখন সে নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের আনন্দে কেঁপে উঠেছিল, কিছুটা ভয়ও করেছিল। নির্দেশমত বাঁটটা বুকের কাছে শক্ত করে ধরে ট্রিগারটা ডানহাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে দিয়েছিল। এখনও সেই দিনের কথা ভাবলে তোরণের নাকে বারুদের গন্ধ এসে লাগে।

সেইদিন থেকেই প্রায় প্রত্যেকদিন বন্দুক ছোড়ায় শর্তে চরের যেসব অঞ্চলে প্রচুর পাখি সেইসব এলাকায় শিকারীদের নিয়ে যেত। তারপর দুপুরবেলা মাছ ধরার ডেরায় ফিরে আসত। ভোরে গঞ্জে যাওয়া বৃদ্ধ পরান দুপুর গড়িয়ে গেলে ফিরে আসত। আসার সময় বাড়ি থেকে খেয়ে আসত। পরান ফিরে এলেই তোরণ বাড়িতে ফিরে যেত। আবার সন্ধ্যেবেলায় দিকে কিছুক্ষণের জন্য আসত-তারপর আবার সেই ভোরের দিকে।

মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের বাইরে বসে এক এক করে সব কথা মনে পড়ল। কবে তার বাবা মরে গিয়েছিল। কবে একবার নদীর পাঁকে পড়ে ডুবতে ডুবতে আশ্চর্যভাবে বেঁচে এসেছিল, একবার মাছের ডেরা ফেলে সারা রাত যাত্রা শোনার জন্য বুড়ো পরান মাঝি তাকে ভীষণ মেরেছিল । সব কথা এক এক করে মনে পড়ছে। কিন্তু একদিনের কথা তোরণ কিছুতেই ভুলতে পারে না। একদিন দেখল অসংখ্য নৌকায় চড়ে দলে দলে সব লোক যাচ্ছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল কুড়িগ্রামে নাকি বিরাট মিটিং-শেখ মুজিব বক্তৃতা করবেন। অতি পরিচিত নামটা শুনে তোরণ যেন সম্মোহিত হয়ে গেল। বলে কয়ে কুড়িগ্রামমুখী একটা নৌকায় উঠে বসল।

এখনও মনে পড়ছে কি সে মিটিং লক্ষ লক্ষ লোক যেন ফেটে পড়তে চাইছে। অসংখ্য স্পীকার লাগান হয়েছে। ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। শেখ মুজিব বক্তৃতা দিলেন, বাংলার কথা বললেন, বাংলার মানুষের কথা বললেন। তোরণ নিম্পলক দৃষ্টিতে সমস্ত বক্তৃতা শুনলো।

মিটিং ভাঙ্গলে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ফিরতি কোন এক নৌকায় ফিরে এসেছিল। ভোররাতের দিকে তাকে ঘাটে নামিয়ে দিল। তোরণ ভয়ে ভয়ে মছের ডেরায় ফিরে এসে দেখলো ছই-এর নীচে পরান চাচা নেই। সে অবাক হয়ে গেল। এরকম একটা ব্যতিক্রম পরান মাঝির জীবনে নেই বললে চলে। ভোরের দিকে মাঝি ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলো পরান মাঝিও মিটিং -এ গিয়েছিল। মাছের ডেরা ফেলে মিটিং-এ যাওয়া পরান মাঝির জীবনে এই প্রথম।

তোরণের জীবন থেকে একটা একটা দিন প্রতিদিনের মত খসে যেতে লাগল। এক সময় সারা দেশ জুড়ে ভোট হল, শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন । তারপর বাংলার বুকে খুব দ্রুত কতকগুলো দৃশ্যান্তর ঘটে গেল। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করার চক্রান্ত ফাঁদলেন। আবার নতুন করে শুরু হল শ্লোগান, মিটিং, পোষ্টার, ব্যানার। ঢাকায় শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর বৈঠক বসল।

গঞ্জ থেকে ফিরে আসা লেকাজনের কাছ থেকে সব খবরই সে পেত। কিন্তু পরান মাঝি বিশ্বাস করত না। তোরণও বিশ্বাস করত না। ভোট দিনু যাক’ ক্ষমতাও যাবার নয় এটা হবার পারে না।”

পরান মাঝি তখন নিশ্চিন্তে ডেরা নিয়ে ব্যস্ত।

<005.006.180>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

একদিন দেখল গঞ্জ থেকে ফিরে আসা লোকগুলো খুব উত্তেজিত। প্রায় প্রত্যেকের হাতে একটা করে পত্রিকা। গ্রামের ছাত্ররা দল বেঁধে যেন দিন-রাত কিসব সলাপরামর্শ করে। থানায় পুলিশদের মধ্যেও এ কি উত্তেজনা।

তারপর একদিন দুপুর গাড়িয়ে বিকেল হ’ল-বিকেল গড়িয়া সন্ধ্যা। ভোরে গঞ্জের দিকে বেরিয়ে যাওয়া পরান মাঝি ফিরে এলো না। অন্যান্য দিন গঞ্জ থেকে সারি সারি নৌকা ফিরতো। সেসবও দেখা গেল না। রাত্রিবেলার দিকে সে মাঝির বাড়িতে গিয়ে দেখা করল। না, তখনও মাঝি ফেরেনি। তারপর রাত আরও বাড়লে গঞ্জ থেকে পালিয়ে আসা একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম বন্দরের উপর পশ্চিমা সৈন্যবাহিনী প্রচণ্ড গুলি চালিয়েছে। তোরণ মুহুর্তেই ভেঙ্গে পড়ল। কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে পরান মাঝি নিশ্চয়ই ফিরে আসত।

পরের দিন তোরণ গঞ্জের দিকে রওয়ানা দিল। স্কুলবাড়ির থেকে একটু দুরে পাটের গুদামের পাশ দিয়ে গঞ্জের ভেতর ঢুকতে যাবে এমন সময় সমস্ত গা ছমছম করে উঠল। একটা লোকজন নেই। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। আর একটু অগ্রসর হতেই দেখতে পেল বাজারে পোড়া ধ্বংসাবশেষ। তোরণের আর ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে সোজা গ্রামে চলে এসেছিল।

তোরণের এখন অন্য জীবন শুরু হয়েছে। বসে বসে পরান মাঝির চোখ দুটোর কথা মনে করল। সেই চোখ দুটো থেকে তোরণের জন্য সবসময় স্নেহ ঝরে পড়ত। না, পরান মাঝি আর গঞ্জ থেকে ফিরে আসেনি। সব বুঝতে পেরে তোরণ মাছের ডেরার পাশে গ্রামে চলে এসেছিল।

তারপর পশ্চিমা সৈন্যরা ক্রমে ক্রমে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন তোরণ মাছের ডেরায় কাজ করছিল, এমন সময় তাদের গ্রামের দিক থেকে গুলির শব্দ শুনতে পেল। তোরণের ছেড়া জাল মেরামত করা বন্ধ হয়ে গেল। সে খুব ভয় পেয়েছে। ঘণ্টা খানেক পর গুলির শব্দ থেমে গেল। বাড়িতে ফেরার সময় বার বার কেন যেন পরান চাচার কথা মনে পড়ল। গঞ্জে গুলি হয়েছিল। পরান চাচা আর ফিরে আসেনি। মা, পরান চাচার বউ এখনও কি বেঁচে আছে? ঘাটে নৌকো পেল না। পশ্চিমা দস্যুরা নৌকো ডুবিয়ে দিয়েছে। সাঁতারে তোরণ নদী পার হ’ল।

তোরণ এখন মুক্তিযোদ্ধা। গতকাল একটা অপারেশনে গিয়েছিল। আবার আগামীকাল রাতের অন্ধাকারে পশ্চিমা দস্যুদের খোঁজে গ্রেনেড, এল-এম-জি নিয়ে কয়েকজন মিলে যেতে হবে। আজ রাতটা শুধু একটুখানি বিশ্রাম। ক্যাম্পের বাইরে একটা অন্ধকারে গাছের নীচে বসে বসে তোরণ এইসব ভাবছিল। সাঁতরে তোরণ নদী পার হয়ে কাছাকাছি আসতেই সে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়েছিল। গ্রামের ঘরগুলো পুড়ে ছাই হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। ঠিক শ্মশানের পরিত্যক্ত চিতার মত। গ্রামের ভেতর ঢুকে দেখতে পেল গুলি চালনার সময় যারা পালিয়ে বেঁচেছিল তারা ফিরে এসে ছাইয়ের ভেতর থেকে তাদের আপনজনের মৃত লাশ খুঁজছে। তোরণ পাগলের মত দৌড়ে তার বাড়ির দিকে ছুটে গেল। ভিটের উপর তার মায়ের চিহ্ন খুঁজে পেল না। তারপর বাড়ির আশেপাশের ফিরে আসা দু’চারজন লোককে জিজ্ঞেস করল। তারা কেউ কিছু বলতে পারল না। তোরণ পাগলের মত বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল। এমনও তো হতে পারে গুলি খেয়ে বাঁশঝাড়ে ঢুকে সেখানেই মারা গেছে। তন্নতন্ন করে সেখানে খুঁজতে লাগল। সেখানেও পেল না। তারপর বাড়ির থেকে আরও দূরে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।

ক্যাম্পের বাইরে বসে থাকা তোরণের চোখ দিয়ে দু’ফোটা উত্তপ্ত অশ্রু বেরিয়ে পড়ল। তাদের গ্রাম থেকে আধা মাইল খানেক দূরে একটা আমবাগানে আছে। তারি ভেতর তার মায়ের লাশের পাশে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছিল তোরণ।

<005.006.181>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

এখনও মায়ের কথা মনে পড়লে তার কণ্ঠেস্বর যেন কানে এসে বাজে। শীতের খুব ভোরে মাছ ধরার ডেরার দিকে যাবার সময় মা তাকে বলতো, “জার নাগিবে রে তোরণ, জার নাগিবে। মোর একখানা শাড়ি জড়ায়া নে ক্যানে?”

এই মা আর কোনদিন ফিরে আসবে না।

তোরণ শুধু ভাবছে। সে প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েছিল, তারি বন্ধু কাজল যে ইউনিভাসিটিতে পড়ত তার সথে একদিন দেখা হয়ে গেল। সে-ই তাকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসে।

শেষবারের মত তার মায়ের কাঁচা কবরের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার পোড়া ভিটেটাকে পেছনে ফেলে রেখে কখনও নৌকায়, কখনও হেটে কাজলের সাথে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে চল এসেছিল।

প্রায় মাস দুয়েক হয়ে গেল। রাতের পর রাত জেগেছে। আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়েছে কিন্তু তোরণের মধ্যে আজ পর্যন্ত বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নামেনি। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দিনের পর দিন লড়াই করে চলেছে। সে জানে মাকে আর কোনদিন সে ফিরে পাবে না। পরান মাঝি আর কোনদিন ফিরে আসবে না। প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে সে লড়ছে। তোরণ আবার সেই ফেলে আসা শীতের সকাল, গ্রামকে বিলুপ্ত করে দেয়া কুয়াশা, পানিতে ভেসে বেড়ান পানকৌড়ি, সোনাগাছির চরের উপর প্রসন্ন বুনো হাঁস এইসব হারিয়ে যাওয়া টুকরো টুকরো সুখ আবার আগের মত ফিরে পেতে চায়।

(আশরাফুল আলম রচিত)

রাজনৈতিক মঞ্চ
২ নভেম্বর, ১৯৭১

পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও গোপন দুরভিসন্ধি সে কি ছিলো গত চব্বিশ বছরে বাংলাদেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির মূল রহস্যের উপসংহার ঘটালো গত ২৫ মার্চ থেকে জন্ম নিলো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের লাখো মানুষের গলিত লাশের তলায় কবর হয়ে গেল পাকিস্তানের। বাংলাদেশের কিছু অশের উপর আজও যেহেতু দখলদার হানাদার বাহিনী তাদের মরা পাকিস্তানের লাশকে জিন্দা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় লিপ্ত সেই কারণে বাংলাদেশ মৃত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্পর্কে দু’চার কথা বলার অবকাশ আজও আছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, রাজনৈতিক কর্মী, যুদ্ধরত তরূণ এবং কৃষক-মজুর সকল শ্রেণীর মানুষকেই জানতে হবে পাকিস্তান নামক সেই মৃত রাষ্ট্রের প্রকৃত শ্রেণী-চরিত্র কি ছিলো, এবং কোন অনিবার্য কারণে তার মৃত্যু ঘটলো। এবং বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাসমূহ থেকে আমরা শত্রু বাহিনী তথা শত্রু র নাম-নিশানা ও অস্তিত্বকে কেনই বা দ্রুত নিশ্চিহ্ন করতে চাইছি। এসব বিষয়ে আমাদের প্রত্যেকের ধারণা আজ স্পষ্ট হতে হবে।

একথা সবাই জানেন যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যে যে মূল রাজনৈতিক শক্তি কাজ করেছিলো তার নাম হলো মুসলিম লিগ। এই মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিলো দুটি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্যে। একটি হলো বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমান জমিদার শ্রেণী এবং অপরটি হলো তদানীন্তন ভারতের গজিয়ে ওঠা

<005.006.182>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মুসলমান বণিক শ্রেণী, যারা সে সময় ভারতবর্ষের অন্যান্য বণিক শ্রেণীর কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছিলো। বাংলাদেশের মানুষকে বোঝানো হয়েছিলোঃ যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় মূলতঃ কৃষিজীবী, সেই কারণে তাদের মুক্তি নিহত আছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অমুসলমান জমিদার, জোতদার ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অমুসলমানদের উৎখাতের মধ্যে। মুসলিম লীগ বাংলাদেশে এই সাম্প্রদায়িক প্রচার জোরদার করে কাজ হাসিল করে নিল। আসল উদ্দেশ্য ছিলো দেশের অর্থাৎ গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের বাসস্থান বাংলাদেশকে বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তান এবং ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত উদ্বাস্তু বণিক শ্রেণীর একটি স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরলপ্রাণ বাংলাদেশের মানুষ প্রথম দিকে তাদের এই গোপন দুরভিসন্ধি ধরতে পারেনি। তারা আশা করেছিলো দেশ ভাগ হলে সামন্ত ও আমলাদের হাত থেকে তারা মুক্তি পাবে। সোনার বাংলা তার হৃত শ্রী আবার ফিরে পাবে। এই আশাতেই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় মুসলিম লীগকে প্রথম দিকে সমর্থন করেছিলো। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের অবাঙালী কায়েমী স্বার্থবাদী ও পুঁজিপতিদের আসল রুপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকাশ পেলেও শুরু থেকে বাংলাদেশের আপামর সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে তার প্রক্রিয়া হতে থাকে। বাংলাদেশের সচেতন ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যেই তা সীমিত ছিলো। এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনও ওই পর্যায়ের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছিলো। পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীরা কিন্তু শুরুতেই আর একটা খেলা খেলেছিলো। সেটা হলো ভারত-বিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং আসল উদ্দেশ্যে সিদ্ধির জন্যে এই সাম্প্রদায়িক প্রচারকে স্থায়ী করতে তারা ১৯৮৪ সালে কাশীর আক্রমণ করে। জন্মলগ্নে কাশীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের পক্ষে একটা সুবিধে হয়ে গেল। তারা কাশ্মীরকে পাকিস্তানের প্রথম এবং প্রধান জাতীয় সমস্যারূপে চিহ্নিত করলো। এবং কাশ্মীর সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা দেশের চিন্তা-ভাবনা, রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজনীতি প্রভৃতি সবকিছুই যাচাই করতে লাগলো। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ নেতারা কাশ্মীরের দোহাই দিয়ে এগুতে লাগলো তাদের আসল উদ্দেশ্যের পথে। এর মধ্যে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার ভাগবোটোয়ারা নিয়ে আত্মকলহ যে বাধেনি তা নয় । বরং বলা যায় তাদের নিজেদের মধ্যকার কলহ-বিবাদ চরমে পৌছেছিলো, আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে দেশে ঘটলো সামরিক অভ্যুত্থান। গজিয়ে ওঠা পুঁজিপতি ও আমলারাও তথাকথিত নেতাদের ঝগড়া-বিবাদ ও কামড়াকামড়িতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সমারিক শাসনকে সমর্থন করে চললো। তারা সাপমরিক শাসনের সাহায্যে নিয়ে রাতারাতি ফুলে উঠতে লাগলো। ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশকে পশ্চিমক পাকিস্তানের একটি লাভজনক উপনিবেশে পরিণত করার সব রকম আয়োজন তারা গ্রহণ করলো। আইয়ুবের ছত্ৰচ্ছায়ায় অর্থাৎ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ছত্ৰচ্ছায়ায় তাদের গতি হলো অপ্রতিরোধ্য। অন্যদিকে এই দীর্ঘকালীন সামরিক শাসনে দেশের গণআন্দোলনের সর্বনাশ করা হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে যে গণআন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিলো আইয়ুব তাকে গুঁড়ো করে দিলো।

পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্ৰীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে বঞ্চিত করতে চেষ্টা করা হয়। গোটা দেশের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা সাম্প্রদায়িককতা ও ভারতবিদ্বেষের প্লাবন বইতে দিয়ে তারা এপথে এগিয়েছে। সচেতন বাঙালীরা যে এ সম্পর্কে কিছু জানতে পারেননি তা নয়, কিন্তু জানতে পারলেও পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্লাবনের মুখে তাদের করার কিছু ছিলো না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে যে কিভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিলো তার প্রথম একটা চিত্র পাওয়া গেল আইয়ুবের শাসনামলে ১৯৬৩ সালে। এই সময় সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে বাঙালীদের সংখ্যা ছিলো শতকরা ৫ ভাগ, বিমান বাহিনীতে ছিলো শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ এবং নৌবাহিনীতে ছিলো শতকরা ৩ ভাগ।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে পুরোপুরি ফাঁকি দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্বেও এর কৃষি উন্নয়নের জন্যে কোন রকম ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান-অনুর্বর অনাবাদী পশ্চিম পাকিস্তানকে কৃষি ও খাদ্যশস্যে স্বনির্ভর করে তোলার জন্যে

<005.006.183>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সর্বপ্রকার চেষ্টা করা হয়েছে। এদিকে বাংলার যে সোনালী আশে পশ্চিম পাকিস্তানটা গড়ে উঠলো তাকেও শেষ করার চেষ্টা করা হয়। পাটচাষ ও পাটচাষীদের কৃত্রিম অসুবিধে সৃষ্টি করা হয়। ১৯৪৯ সালে টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে বিরোধ বাধিয়ে বসায় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের পাটের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেল এবং তাতে পাটচাষীরা ডুবে গেল।

শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পুরোপুরি বঞ্চিত করা হলো। সুতীবস্ত্র, পশমীবস্ত্র, ইস্পাত, কাগজ, রাসায়নিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতি ও মেশিনারী শিল্প-কারখানাগুলোর মধ্যে সবগুলোই করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ববাংলায় বা বাংলাদেশে যা করা হলো তা অত্যন্ত নগণ্য, এবং তা করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানী বণিক পুঁজিপতি তথা কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থেই। সরকারি খাতে বাংলাদেশে শিল্প বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় রয়ে গেল। বেসরকারি বিনিয়োগ আরও শোচনীয়। সারা পশ্চিম পাকিস্তানকে সরকারি ও সরকরি সাহায্যপুষ্ট বেসরকারি শিল্প কারখানায় ভরে তোলা হলো। বাংলাদেশ হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপণ্যের বাজার। শুরু হলো বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ শোষণ। বাংলাদেশ পৃথিবীর বাজারে পাট বিক্রি করে ও চা বিক্রি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা পেতো তার শতকরা আশি ভাগেরও বেশি খরচ করা হতে লাগলো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়ন ও শিল্প সম্প্রসারণের কাজে। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের স্বার্থে বিদেশ থেকে সাধারণের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আমদানি বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিরা নিজেদের কারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী অত্যাধিক চড়া দরে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করলো তাদের দ্বিমুখী শোষণ। রফতানি ও বৈদেশিক সাহায্যের সবখানি ফল ভোগ করতে লাগলো পশ্চিম পাকিস্তান। অতএব, দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে বাদ দেয়া হয়েছে। তা যদি না দেয়া হতো তাহলে আর যাই হোক বাংলাদেশকেও ওদের কলোনীতে পরিণত করতে পারতো না। অবশ্য এ সবই হচ্ছে আজ গৌণ বিষয়। আজকের দিনের বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানীদের দীর্ঘদিনের শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে নিজেদের নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে স্বাধীন সার্বভৌগ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করেছে। দেশ থেকে হানাদার পাকিস্তানী সামরিক দস্যদের সম্পূর্ণ নির্মুল করার মহান লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা দ্রুতগতিতে।

(সাদেকীন রচিত)

জনতার সংগ্রাম
১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমি যতদিন শত্রু কবলিত থাকবে ততদিন আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চূড়ান্ত জয়ের পূর্বে এই যুদ্ধ আর থামবে না। এবং এই যুদ্ধে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। এই কথাগুলো আজ আর উচ্ছাস বা ভাবাবেগে চালিত নয়, এই কথার সত্যতা আজ প্রতিটি বাঙালীর ধমনীতে প্রবাহিত। বিশ্ববাসীও বিস্ময়ে লক্ষ্য করছে বাঙালীর এই অভূতপূর্ব সংগ্রামের সাফল্যের দিকে।

নানা প্রতিকুল অবস্থায় নিজের জমিতে চাষ করতে করতে কৃষক লাঙলের ফলা হাতে আজ শত্রুনিধনে তৎপর। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে পার্শ্ববর্তী চাষী ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে বলে ওঠে, পশ্চিম পাকিস্তানী শত্রু সৈন্যরা যতদিন আমাদের সবুজ মাটিতে আছে ততদিন আর শান্তি নেই। তার রক্ত জল করে উৎপাদিত

<005.006.184>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পাট-চা-ধান-ধানের মুনাফা লুটবে পশ্চিম পাকিস্তানী ধনী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা আর কিছুতেই সহ্য করা যাবে না। কারখানার শ্রমিক আজ বুঝতে পেরেছে তারা পশ্চিম পাকিস্তানী মুনাফখোর শিল্পপতিদের শিকার মাত্র, কাজেই সর্বপ্রথমে তাদের সরাতে হবে এবং ঐ ধনিক গোষ্ঠীর অনুচর হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদল। ছাত্ররা আজ দিশেহারা, স্কুল-কলেজে আজ শিক্ষক নেই, ক্লাসগুলো বলতে গেলে প্রায় শূন্য, তারা আজ মিলিটারী জান্তার শিকার মাত্র। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সৈন্যরা বুঝতে পেরেছে তাদের উন্নতির পথ অবরুদ্ধ। কেননা তাদের উপরে বসে আছে পাঞ্জাবী সামরিক অফিসাররা দিনে দিনে সর্বস্তরে এই পুঞ্জীভূত অসন্তোষ থেকে জন্ম নিয়েছে তাদের প্রতিরোধ আকাংক্ষা। মার খেয়ে বাঙালী অস্ত্র তুলে নিয়েছে, তারা হাতিয়ার তুলে নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে।

তাই স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আজ সর্বস্তরের মানুষ সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, মুক্তিবাহিনীতে আজ কৃষক-মজুর-ছাত্র-পুলিশ-সৈন্য সকলেই যোগ দিয়েছে এবং দিচ্ছে। সামরিক অফিসার থেকে গ্রামের একেবারে সাধারণ একজন কৃষক যুবক প্রত্যেকেই মুক্তিবাহিনীর আজ সক্রিয় সদস্য, অর্থাৎ বীর যোদ্ধা। একজন কারখানার মজুরের পাশে বসে একজন ছাত্র বলছে সে কয়জন শত্রু কে নিহত করেছে। একজন শিক্ষক, যে কোনদিন রাইফেল ধারার কথা চিন্তাও করেনি সে আজ একজন পরিপূর্ণ যোদ্ধা। এই সম্মিলিত শক্তি নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছে, এবং তারা যুদ্ধ করছে মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞায়।

অনেক ত্যাগ এবং অনেক রক্ত দিয়ে বাঙালী আজ আরো রক্ত দিতে ও নিতে শিখেছে। এবার প্রতিটি রক্তবিন্দু ঝরবে শত্রু র রক্তের বদলা নিতে। অনেক রক্ত দেবার পর বাংলাদেশের সবুজ মাটি আজ নির্মম হয়ে উঠেছে। এই রক্তপাত ব্যর্থ হবার নয়। বীরের রক্ত কখনো ব্যর্থ হয় না এই সত্য মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা বুঝতে ফেলেছে।

আমাদের স্বাধীনতার রক্ষার সংগ্রামে প্রথম দিকের অস্ত্রর সংগ্রহের অভিযান এখন শেষ হয়ে গেছে। প্রথম দিকে আমাদের ভয় ছিল আমরা অস্ত্র পাব কোথায়। এখন আমাদের হাতে প্রচুর অস্ত্র এসেছে। আরো আসছে। ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের মত ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র। এমনকি তাতে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পর্যন্ত উঠেছে। আমাদের টাকায় কেনা অস্ত্র আজ আমাদের হাতে এসেছে শত্রুর হাত হয়ে। বাঙালীদের টাকায় শত্রুরা যে অস্ত্র কিনেছিল দেশরক্ষা করতে, সেই অস্ত্র দিয়ে তারা আমাদের মারছে। আমরা রুখে দাঁড়িয়ে সেই অস্ত্র কেড়ে নিয়েছি এবং নিচ্ছি। প্রতিটি গেরিলা আক্রমণে আমাদের পীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে রাইফেল, মর্টার, মেশিনগান, কামান। সেই অস্ত্র বাঙালীদের ঘরে ঘরে উঠছে। মুক্ত এলাকায় আজ প্রত্যেকেই রাইফেল চালাতে জানে, অস্ত্র আজ তাদের খেলা। বাঙালী আজ বুঝতে শিখেছে যে এই অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, এই অস্ত্র আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। এবং অস্ত্র দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবেনিয়মতান্ত্রিক পথে কিছু আদায় করা যাবে না, শত্রুর সঙ্গে কোন আপোস নেই। যুদ্ধ করেই মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, কিউবার মুক্তিসংগ্রাম থেকে আমরা শিখেছি স্বাধীনতাস্পহাই হচ্ছে বড় কথা। এই স্বাধীনতার আকাংক্ষাই সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র। বুকের মধ্যে একবার এই আগুন জ্বলে উঠলে তা আর কোনদিন নেভে না। আমাদের বুকের মধ্যে যে স্বাধীনতার আগুন প্রতিনিয়ত খেলা করছে তাকে পৃথিবীর কোন শক্তি নির্বাপিত করতে পারে না, সেই আগুন দিনে দিনে শুধু বেড়েই থাকে। একবার সেই আগুন জ্বলে উঠলে কোনদিন আর নেভে না। বাংলার বুকে আজ সেই আগুনের অনির্বাণ শিখা। শত্রুকে চিরতরে শেষ করে তাতেই তার শান্তি। এমনকি স্বাধীনতার এই স্পৃহা বা আগুন থেকে কোন মানুষ নিজেকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। ইচ্ছা করলেও এই আকাংক্ষা থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না। এমনকি এক সময় এই স্বাধীনতাপূহ এমনভাবে মানুষকে সংক্রামিত করে যে ভীতু এবং দুর্বল লোক পর্যন্ত সাহসী যোদ্ধায় পরিণত হয়ে ওঠে । তখন সে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেয় শত্রুর ওপর দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কোন বাধা তখন তার কাছে আর বাধা থাকে না। আমাদের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসামানী বলেছেন, “আমাদিগকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে

<005.006.185>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রাতদিন প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে হবে। সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে যেতে হবে যাতে শত্রু এক মুহুর্তের জন্যেও অবকাশ না পায়।” তিনি আরো বলেছেন, “আপনাদিগকে দলমতনির্বিশেষে সকল পার্থক্য ভুলে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে, পরিকল্পনা প্রস্তুতি নিতে হবে, শত্রুর উপর আঘাত হানতে হবে, এবং শত্রুকে ধ্বংস করতে হবে। শেষ শত্রুটি ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না।” -এই যুদ্ধ তাই প্রত্যেক বাঙালীর যুদ্ধ, এই মুক্তিযুদ্ধে তাই অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ, সর্বস্তরের মানুষ নিয়ে সংগঠিত হয়েছে মুক্তিবাহিনী। তারা রাতদিন চেষ্টা করছে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৃঢ় মনোবল আমাদের সহায়। আমাদের অস্ত্র যোগাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পাওয়া শত্রুর হাতের অস্ত্র। এবং মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র দিয়েই। এমনিভাবে মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিহত অগ্রগতি চলছে দুর্বার ও দুর্দম গতিতে; তারা আর থামবে না, কোনদিন থামবে না। দেশকে শত্রুমুক্ত করার পূর্বে, চূড়ার বিজয়ের পূর্বে এই যুদ্ধ থামবে না। কারণ প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা জানেন –
আমি সেই দিন হত শান্ত-
যবে উৎপীড়িতের ক্ৰন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না;
অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।

(বিপ্রদাস বড়ুয়া রচিত)

অভিযোগ*

……১৯৭১

বাঙালীর মনোবল ভাঙতে ত্রাস সৃষ্টির জন্যে ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম ক’দিন হাজার হাজার বাঙালীর লাশ ওরা পথে-ঘাটে ছড়িয়ে রাখলো। সংসার-নিম্পূহ ডক্টর গোবিন্দ দেব, আমার বন্ধু অধ্যাপক জ্যোতির্ময়, ডক্টর মনিরুজ্জামান, সপ্ততিবষী আইনজীবী ধীরেন্দ্র দত্ত, নব্বই বৎসরের ভিষগাচার্য যোগেশ ঘোষ, মিউনিসিপ্যালিটির মেথর, ষ্টেশনের কুলি, নৌকার মাঝি, ক্ষেতের চাষী, নদীর জেলে, গায়ের তাঁতী, ঘাটের ধোপা, পথের নাপিত, হাটের পশারী, গঞ্জের মহাজন, মসজিদের ইমাম, গীর্জার পাদ্রী, মন্দিরের পুরোহিতসাধারণ থেকে অসাধারণ সকল শ্রেণী-ধর্মের নিরীহ বাঙালীর শবদেহ অসনাক্তভাবে কুকুর-শকুনের ভক্ষ্য হল সকলের চোখের সমানে। মনুষত্বের এতবড় অবমাননা ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও সম্ভব হতো বলে আমি বিশ্বাস করি না। আর সেই জন্যেই বোধ করি এই অমানুষিক বর্বরতা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তবু বলব, দুস্কৃতি দমনের নামে যারা বাঙালীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করল, জাহাজ ভর্তি নতুন নতুন গাড়ী, টেলিভিশন, রেডিও, রিফ্রিজারেটর, এয়ারকুলার ব্যক্তিগত মালিকানায় পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করল, কোটি কোটি টাকার অর্থ, অলংকার প্রকাশ্য মানি অর্ডার, পার্সেল অথবা পি-আই-এ কার্গো মারফত নিজের নিজের এলাকায় পাঠিয়ে দিলো, হাজার হাজার অবাঙ্গালীর হাতে মারণাস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাঙালীর শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের পরিমণ্ডল থেকে চিরনির্বাসনের সড়ক তাঁরা নিজেরাই প্রশস্ত করে নিলেন।

* কবি সিকান্দার আবু জাফর ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই একটি অভিযোগ-ইশতেহার প্রকাশ করেন। এটি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়। এখানে তার অংশবিশেষ সংকলিত।

<005.006.186>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পাকিস্তানী হানাদারদের তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সংহতির পরিকল্পনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তারা শহীদ মিনারগুলো ধ্বংস করে নিজেদের পদলেহী কিছুসংখ্যক গরুচোর দিয়ে সেখানে নামাজ পড়াচ্ছে। অর্থাৎ ওইসব জায়গার এক-একটা মসজিদের দাবী খাড়া করানো হচ্ছে। মজার ব্যাপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছটিকেও তারা নির্মুল করে উপড়ে ফেলেছে। যেন ওই বটগাছের ডালগুলোতেই বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা ট্রাপীজ খেলতো। বাংলাদেশে হিন্দুর অস্তিত্ব পাকিস্তানী সংহতির পরিপন্থী। কাজেই তাবৎ হিন্দুকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা পালিয়ে বেঁচেছে তারা এখানে ওখানে লুকিয়ে থাকছে কিন্তু একজনেরও সম্পত্তি নিজেদের দখলে নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঙালী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের পেশাদার বাঙালী গুপ্তারা সেগুলো দখল করে বসে আছে। তাই যখন ইয়াহিয়া খান বাঙালী হিন্দুদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তথা অতি দুঃখেও হাসি পাচ্ছে এই ভেবে যে, হিন্দুরা তো আসবে কিন্তু উঠবে কোথায়? নিজের নিজের বাড়ি বলতে যা বেঝাতো সে তো পুড়ে-জুলে খাক। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা-ও কি আর খালি আছে?… হিন্দুর মন্দির ভেঙ্গে মাটির বরাবর করা হচ্ছে তা-ও দেখছি চোখের সামনে। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন এলাকার লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমানদের সম্পত্তি এখন অবাঙালীদের দখলে। ঢাকার মীরপুরমোহাম্মদপুর থেকে বাঙালী খেদানো এবং নির্বিচারে বাঙালী নিধন শুরু হয়েছে ২৩ শে মার্চ থেকে। ওই দুটি অঞ্চলের তাবৎ বাঙালীর সম্পত্তি লুষ্ঠিত এবং অবাঙালীদের অধিকৃত। ভারতে শরণার্থী বাঙালী মুসলমানেরা ফিরে এলে যথাসময়ে ওইসব অবাঙালীদের অস্ত্রের শিকার হবে। আঠারো থেকে তিরিশ বছর বয়সের হাজার হাজার বাঙালী ছাত্র যুবককে পাকিস্তানী ঘাতকরা ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং তাদের অধিকাংশকেই মেরে ফেলেছে। এখনও ধরে নিয়ে যাচ্ছে, হয়তো মেরেও ফেলেছে। উদ্দেশ্য, সক্ষম বাঙালী যুবকদের খতম করে বাঙালীদের বাহুবল ভেঙ্গে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথের দেয়া ভারতীয় সংহতির চোহারা- “শক হুনদল পাঠান মোগল এবং দেহের হলো লীন”- আমরা দেখলাম, পাকিস্তানী সংহতি কসরতে হানাদার সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবী পাঠান বিহারী বালুচ অফিসার জওয়ান পাইকার হারে অপহৃতা বাঙালী নারীদেহে লীন হচ্ছে। দূরপ্রসারী অভিসন্ধি হয়তো একটি মিশ্র জেনারেশন সৃষ্টি করা। সেটা রোধ করতে গেলে আমার আশঙ্কা, যে পরিমাণ গর্ভপাতের প্রয়োজ হবে তাতে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় মেটারনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদেশ থেকে শত শত বিশেষজ্ঞ ধাত্রী আমদানি অপরিহার্য। আজ এদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ আমদানি হচ্ছে। বাঙালী অফিসার অবাঞ্ছিত তাদের মেরে ফেলা এবং আধা-বাঞ্ছিতদের বিষদাঁত ভাঙ্গার জন্যে জেলে পোরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেই একই ব্যবস্থা হবে শিক্ষক, সংস্কৃতিবিদ এবং সাহিত্যকদের ক্ষেত্রেও। ফলে গড়ে উঠছে অবাঙালী তাঁবেদার গোষ্ঠী এবং সুবিধাভোগী বাঙালী মীরজাফর শ্রেণী। বাংলা ভাষার মর্যাদা এবং গুরুত্ব হাস করা হচ্ছে শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁবেদার গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি বাড়িয়ে। এই সংহতি অভিযানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কোন ফললাভের সুযোগ আমাদের নেই। কারণ এসবই পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত বাঙালী আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে মুক্তি সংগ্রামের দুর্জয় অঙ্গীকারে। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক বাংলার বাছাই করা বীর সন্তানেরা তাদের সঙ্গে নিজেদের বন্ধু-আত্মজনের রক্তস্নাত তৎখালীন ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার বাহিনী আর মুক্তি- মাতাল বাঙালী তরুণ কিশোর ছাত্র এবং ছাত্রীরাও। রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছিলেন “বাঙলার মাটি বাঙলার জল বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল পুণ্য হউক।”- আজ এতদিনে শ্রেণী বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে নিরীহ বাঙালী নরনারীর রক্তধৌত বাংলার মাটি মহাপুন্যাস্নাত হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার ঘাতকেরা ইতিহাসের একটি সহজ সত্য আবিষ্কার করতে পারেনি যে, সার্বিক মৃত্যু ছিটিয়ে একটি জাতিকে আর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে চিরকালের জন্যে বঞ্চিত রাখা যায় না।

জাতীয়তাবাদ কোন একটা নির্ভরযোগ্য নীতি নয়। আমার মানসিক প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকতাবাদ গ্রহণ করারই সপক্ষে। কিন্তু পাকিস্তানের কালে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমার বিভিন্ন কবিতায় বাঙালী

<005.006.187>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

জাতীয়তাবাদকেই আমি বলিষ্ঠ আকৃতি দেবার চেষ্টা করেছি। এর কারণ, প্রথম থেকেই বাঙালীর সমস্যা স্বাক্ষরিত, বাঙালী জাতীয়তাবাদ বর্জনের তাগিত। এই তাগিদ এসেছে প্রধানতঃ দ্বিজাতিতত্বের প্রবক্তা এবং তাদের অনুগামী গোষ্ঠীর কাছ থেকে, পাকিস্তান যাদের মুষ্টিমেয় কয়েকজনের স্বার্থে এক উজ্জ্বল সূর্যসম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে। এদের প্রায় অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পতি এবং পাকিস্তানী জঙ্গীযন্ত্রের পরিচালক। দেশ-বিভাগের প্রথম দিন থেকেই এরা বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করার চক্রান্তে বাঙালী জাতীয়তাবাদ সমূলে উৎখাত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে এবং সেই একই দিন থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা উপলব্ধি করে বাঙালী যতই লুষ্ঠিত, নিগৃহীত এবং অপমানিত হয়েছে ততই হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জাতীয়তাবোধ তার কাছে উজ্বল হতে উজ্জ্বলতর দীপ্তিলাভ করেছে। বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্রের একমাত্র উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য-নরহত্যা, লুণ্ঠন এবং নারীধর্ষণের অভিজ্ঞতা আর স্বাধীনতা লাভের আগে দীর্ঘ দুই শতাব্দী শৃঙ্খলিত শিকারী কুকুরের মত ঔপনিবেশিক প্রভুর পদলেহনের কৃতিত্ব। বাঙালীর আত্মমর্যাদা এই চক্রের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে কোনদিনই তাকে আত্মহননের উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানী ঘাতকেরা আজ বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার পরিকল্পনা সূচীত হয়েছে স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিনটি থেকে।

আর সার্বিক অবলুপ্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালীর পক্ষে আত্মসংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। শিক্ষক হিসেবে যাদের প্রতিষ্ঠা এবং প্রশ্নাতীত মর্যাদা, তারা আজ শুধুমাত্র পেশাদার চাকুরে। ডাক্তার কিম্বা ইঞ্জিনিয়ার, বিচারপতি কিম্বা আইনজ্ঞ হিসেবে নিজের নিজের কৃতিত্বে যারা গোটা দেশের জন্যে অপরিহার্য তারা আজ অনিশ্চয়তা এবং বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় আত্মবিস্তৃত, চাষী-মজুর বাস্তুহারা, দিশাহারা। সরকারী কর্মচারী আজ নিরক্ষর সিপাই প্রভুর ভ্ৰকুটিলাঞ্ছিত মর্যাদাহীন হুকুমের নফর। ব্যবসায়ী-শিল্পপতি আজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় নিস্পিষ্ট নিরূপায় সরীসৃপ। ছাত্রছাত্রীরা আজ উদ্দেশ্যহীন আকাংক্ষাহীন। এমন সামগ্রিক মৃত্যুর আবর্তে কোন জাতি নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে না। তাই বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন আজ অগণিত আত্মপরিজনের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাশের সামনে দাঁড়িয়ে এক বেদনায় একাত্ম হয়েছে, এক প্রতিজ্ঞায় বাহুবদ্ধ হয়েছে- মৃত্যুর বিনিময়-মূল্যেই তারা মৃত্যুকে রোধ করবে। বাংলার মাটিরে পূণ্য-পীযুষধারায় সঞ্জীবিত প্রাণ একটি বাঙালী বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের এই মুক্তি-সংগ্রাম শেষ হবে না।

(সিকান্দার আবু জাফর রচিত)

চরমপত্র
….. ১৯৭১

মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে। চাইরোমুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচকা মাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলো তেজগাঁ-কুর্মিটোলায় আইস্যা- আ-আ-আ- দম ফেলাইতেছে। আর সমানে হিসাবপত্র তৈরি হইতাছে। তোমরা কেডা? ও-অ-অ-ভৈরব থাইক্যা আইছো বুঝি? কতজন ফেরত আইছো? অ্যাঃ ৭২ জন। কেতাবের মধ্যে তো দেখতাছি- লেখা রইচে ভৈরবে দেড় হাজার পোস্টিং আছিলো। ব্যাস ব্যাস আর কইতে হইবো না- বুইজ্যা ফালাইছি। বাকীগুলোর বুঝি হেই কারবার হইয়া গেছে। এইডা কি? তোমরা মাত্র ১১ জন কীর লাইগা? তোমার কতজন আছিলা? খাড়াও খাড়াও- এই যে পাইছি কালিয়াকইর-১২৫ জন। তা হইলে ১১৪ জনের ইন্নালিল্লাহে ডট ডট ডট রাজেউন হইয়া গেছে। হউক, কোন ক্ষতি নেই। কামানের খোরাকের লাইগ্যাই এইগুলর বাঙ্গালমুলুকে আনা হইছিলো। আরে এইগুলি কারা? যশুরা

<005.006.188>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কই মাছের মতো চোহারা হইছে কীর লাইগ্যা। ও-অ-অ তোমরা বুঝি যশোর থাইক্যা ১৫৬ মাইল দৌড়াইয়া ভাগোয়াট হওনের গতিকে এই রকম লেড়লেড়া হইয়া গেছো। অ্যাঁ: তুমি একা খাড়াইয়া আছে কীর লাইগ্যা? কী কইলা-তুমি বুঝি মীরকাদিমের মাল নাঃ- ও-অ-অ-অ বাকী হগগলগুলোরে বুঝি বিচ্ছুরা মেরামত আছে? গাং- এর পারে পাইয়া আর মাসে পানির মাইদে চুবানী মারছে। কেইসডা কী? আমাগো বকশীবাজারের ছক্ক মিয়া কান্দে কীর লাইগ্যা? ছকু-উ, ও ছক্ক! কান্দিস না ছকু, কান্দিস না। কইছিলাম না, ‘বাঙ্গাল মুলুকের কেদো আর প্যাকের মাইন্দে মছুয়াগো মউত তেরা পুকারতা হ্যা।’ নাঃ তখনই কী চোট-পাট-হ্যান করে গা, ত্যান করেগা; আর তখন অখন তো মওলবী সাবরা কপিকলে মাইদে পড়ছে। সামনে বিচ্ছ, পিছনে বিচ্ছ, ডাইনে বিচ্ছ, বাঁয়ে বিচ্ছ। অখন খালি মছুয়ারা চিল্লাইতাছে। ইডা হ্যামি কী করছুনুরে, হামি ক্যা নানীর বাড়িতে আচ্ছিনুরে। হামি ইডা কী করণুরে।’ আতকা আমাগো ছক্ক মিয়া কইলো, ‘ভাইসাব, আমার বুকটা ফাইট্যা খালি কান্দন আইতেছে। ডাইনা মুড়া চাইয়া দেহেন ওইগুলা কী খাড়াইয়া রইছে। কী লজ্জা, কী লজ্জা মাথাডা এ্যাঙ্গেল কইরা তেরহী নজর মারতে দেহী কী! শও কয়েক মছুয়া অক্করে চাউয়ার চাপ মানে কিনা দিগম্বর সাধু হইয়া খাড়ইয়া রইছে। ব্রিগেডিয়ার বশীর তাগো জিগাইলো “তুম লোগকো কাপড়া কেধায় গিয়া? জবাব আইলো যশোরে সার্ট, মাগুরায় গেঞ্জী, গোয়ালন্দে ফুলপ্যান্ট আর আচিায় আণ্ডারউইয়ার থুইয়া বাকী রাস্তা খালি চিল্লাইতে চিল্লাইতে আইছি-হায় ইয়াহিয়া ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া- হামলোগ তো আভি নাঙ্গা মছুয়া বন গিয়া?’ আতকা ঠাস ঠাস কইরা আওয়াজ হইলো- ডরাইয়েন না ডরাইয়েন না। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী চুলে ভর্তি সিনা চাবড়াইতে শুরু করেছে- ‘পদ্মা নদীর কূলে আমরা নানা মরেছে, পদ্মা নদীর কূলে মওলবী রাও ফরমান আলী, ঠেটা মালেক্যা ভাগোয়াট হওনের গতিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের কাছে খবর পাড়াইলো, হে প্ৰভু তোমার দিলে যদি আমাগো লাইগ্যা কোনরকম মহব্বৎ থাইক্যা থাকে, তা হইলে তুরনদ আমাগো কইয়া দাও কীভাবে বিচ্ছ আর হিন্দুস্থানী ফোর্সের পা ধরলে আমার লেড়লেড়া আর ধ্বজভংগ মার্কা বাকী সোলজারগো জানটা বাঁচানো সম্ভব হইব।’ এই খবর না পাইয়া জেনারেল পিয়াজী আর সেনাপতি ইয়াহিয়া কী রাগ? ছদর ইয়াহিয়া লগে লগে উ থান্টের কাছে টেলিগ্রাম করলো, ভাই উ থান্ট, ফরমাইন্যার মাথা খারাপ হওনের গতিকেই এইরকম কারবার করছে। হের চিডিডারে চাপিশ কইরা ফালাও। এদিকে আমি আর শাহনেয়াজ ভূট্টোর ডাউটফুল পোলা পোংটা সরদার জুলফিকার আলী ভুট্টোরে মিছা কথার ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করণের লাইগ্যা জাতিসংঘে পাড়াইতেছি। একটুক নজরে রাইকখো।” বেডার আবার সাদা চামড়ার কসবীগো লগে এথি-ওথি কারবার করণের খুবই খায়েশ রইছে। সাবে কইছে ভুট্টো ব্রাকেটে শপথ লওনের টাইম হয় নাইক্যা। ব্রাকেট শেষ জাতিসংঘে যাইয়া পয়লা রিপোর্টারগো লগে টুউ-উ মারত মানে কিনা লুকোচুরি খেলা খেলতাছিলো। তারপর জাতিসংঘে আতকা কান ধইর্যা উঠ বস উঠ বস কইরা ভুট্টো সাবে চিল্লাইতে শুরু করলো, আর লাইফে এইরকম কাম করুম না। বাঙ্গাল মুলুকে আমরা গেনজাম কইর্যা খুবই ভুল করছি। আমরা মাফ চাইতাছি, তোওবা করতাছি, কান ডলা খাইতাছি।- আমাগো এইবারের মতো ক্ষমা কইর্যা দেন। কিন্তু ভুট্টো সাহবে বহুত লেইট কইর্যা ফালাইছেন। এইসব ভোগাচ কথাবার্তায় আর কাম চলবো না। ঠাস ঠাস কী হইলো? কি হইলো? সোভিয়েত রাশিয়া জাতিসংঘে ভেটো মাইরা হগগল মিচকী শয়তানরে চীৎ কইর্যা ফালাইছে। কইছে ফাইজলামীর আর জায়গা পাওনা? এদিকে সপ্তম নৌবহরের সিঙ্গাপুরে আনছে। লগে লগে সোভিয়েট রাশিয়া একটুক হিসাব কইর্যা কামকরণের লাইগ্যা হোয়াইট হাউসরে এ্যাডভাইসিং করছে। প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগদি ক্রেমলিন থাইক্যা কইছে পাক-ভারত উপমহাদেশে বাইরের কেউ নাক না গলাইলেই ভালো হয়। ব্যাস, আমেরিকার সপ্তম নৌবহর সিঙ্গাপুর আইস্যা নিল-ডাউন হইয়া রইলো। এ্যাঃ এ্যাঃ এই দিককার কারবার হুনছেন নি? হারাধানের একটা ছেলে কাঁদে ভেউ ভেউ, হেইটা গেলো গাথার মাইন্দে

<005.006.189>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রইলো না আর কেউ। জেনারেল পিয়াজী সরাবন তহুরা দিয়া গোসল কইর্যা ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মাইন্দে হান্দাইয়া এখনও চ্যাঁ চ্যা করতাছে, আমার ফোর্স ছেরাবেরা হইলে কি হইবো? পাইট করুম, পাইট করুম। আমাগো মেরহামত মিয়া আতকা চিল্লাইয়া উঠলো এইডা কী? এইডা কী? জেনারেল পিয়াজীর ফুলপ্যান্টোর দুই রকম রং দেখতাছি কীর লাইগ্যা? সামনের দিকে খাকী রং, পিছনের মুড়া বাসন্তী রং, কেইসডা কী? অনেক থিংক করলে বোঝন যায় এর মাজমাডা। হেইর লাইগ্যা কইছিলাম…
(এম আর আখতার রচিত)

<005.007.190>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত বাংলা কথিতমালা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর দলিলপত্র মে-ডিসেম্বর, ১৯৭১

সাময়িকী

২৮ মে, ১৯৭১

স্বাধীন বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের নিধনযজ্ঞে নেমে পাকিস্তানের সামরিকশাহী অকল্পনীয় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। লণ্ডনের যুদ্ধ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেড় হাজার মাইল দূর থেকে এসে বাংলাদেশে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর দৈনিক এককোটিরও বেশি টাকা খরচ হচ্ছে- এ হিসেবে যুদ্ধের প্রথম পঞ্চান্ন দিনে পাকিস্তানের আড়াইশ’ কোটি টাকা খরচ ও ঘাটতি হয়েছে। মার্চ মাসের শুরু থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কোন মাল রপ্তানি না হওয়ায় পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ নেমে কমেছে ১৫ কোটি ডলারে। বাণিজ্য খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা।

ফ্রান্স-এর পত্রিকা ‘লা ফিগারোর মতে যুদ্ধের প্রথম মাসে অর্থাৎ প্রথম ত্রিশ দিনে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানী-বাণিজ্যের ক্ষেত্রের পশ্চিম পাকিস্তান একশ’ কোটি টাকা হারিয়েছে।

এ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা জমা ছিল ১২৭ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৯০ কোটি টাকা। যুদ্ধের দরুন এপ্রিলের শেষে সেই অংক কমে ৮২ মিলিয়ন ডলারে, অর্থাৎ প্রায় ষাট কোটি টাকায়। এবং বর্তমানে সেটা এসে ঠেকেছে ২০ কোটি টাকার কাছে।

পাশ্চাত্যের অর্থ-বিশেষজ্ঞদের মতে, কোন দেশের সংরক্ষিত তহবিলে বিশ কোটি ডলার অর্থাৎ এক শ’ কোটি টাকা জমা থাকা উচিত। এর কম হলে সে দেশকে অর্থনৈতিক দেউলিয়া দেশ বলা হয়। পাকিস্তানের সংরক্ষিত তহবিলে এখন জমা আছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। এদিক থেকে পাকিস্তান এখন সত্যসত্যই দেউলিয়া দেশ।

ফলে পাকিস্তানী টাকার মূল্যমান কমানো অনিবার্য হইয়ে পড়েছে । পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্যমান কমাতে সম্মতও হয়েছে। কারণ এখন আর উপায় নেই।

ফ্রান্সের “লা ফিগারো পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে যে, মার্কিন সরকার পাকিস্তানের সামরিকশাহীকে এ বছর ষাট কোটি টাকার সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এখন আর তা দেয়া হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শে মার্চ অর্থাৎ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনানায়করা যুদ্ধ শুরু করার দিন থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া স্থগিত রেখেছে। বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুত সাড়ে একত্রিশ কোটি টাকার সাহায্য বন্ধ রয়েছে।

এদিকে বিশ্বব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট উপদেষ্টা মি.এম,এম আহমদকে বাংলাদেশে যুদ্ধ বন্ধ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনো ঋণ দেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে।

জার্মান পত্রিকা ‘আলগেমাইনে জাইটুং-এ এই মর্মে সংবাদ ছাপা হয়েছে যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের রফতানী এখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ এবং যুদ্ধ খাতে প্রচুর ব্যয়ের জন্য পাকিস্তান এখন আর্থিক দেউলিয়া দেশে পরিণত হয়েছে।

<005.007.191>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ইয়াহিয়া খানের অর্থ-উপদেষ্টা মি. এম,এম আহমদ ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেছেন, পাকিস্তানের মাত্র তিন-চার মাসের খাদ্যশস্য মজুদ আছে। সেখানে তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে গিয়ে পাক-সেনারা বাংলাদেশের শতকরা ৫০ ভাগ রেলপথ ধ্বংস করে দিয়েছে এবং বর্তমান শতকরা ৮০ ভাগ রেলপথই অকেজো। ফলে বাংলাদেশে সরবরাহ ব্যবস্থা বিলকুল বন্ধ- মানে প্রায় তিনমাস ধরে বন্ধ। তাছাড়া প্রায় তিনমাস ধরে চট্টগ্রাম ও চালন বন্দর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। বাংলাদেশের কল-কারখানা বন্ধ-ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় নেমে এসেছে রীতিমতো আকাল।

অপরপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত কোনো জিনিসপত্র গত তিনমাস ধরে বাংলাদেশে আমদানী কলা সম্ভব হয়নি। অথচ এই বাংলাদেশেই গত ২৩ বৎসর ধরে পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের কাজ-কারবারের বাজার ছিল। যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার এই অচলাবস্থার দরুন বাংলাদেশে থেকে যেমন চা, পাট, পান, সুপারি পশ্চিম পাকিস্তানের নেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কোন মালামাল এখান আমদানী করা সম্ভবপর হয়নি। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদনকারীরা অতুলনীয় ব্যবসায়ীক সংকটে পড়েছেন। এদিকে বাংলাদেশে পাক-সেনারা জানমালের যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে এবং এখনো করছে তার দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে বিরল।

এ অবস্থায় পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করেছেন। ১৪ বৎসর ধরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন কায়েম থাকায় এবং এবার জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে বরং বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী-নির্যাতন ও লুটতরাজসহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মতো লাভজনক বাজার হারাতে বসায় পঃ পাকিস্তানের সর্বত্র খান-সরকারের অপরিণামদর্শিতার বিরুদ্ধে দারুণ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশে থেকে ইয়াহিয়াশাহী অবিলম্বে সেনাবাহিনী গুটিয়ে না নিলে আর্থিক ও জানমালের ক্ষতি যে কি পর্যায়ে পৌছে তা বলা দুষ্কর- তাই জঙ্গীশাহীর অর্থর-বিশেষজ্ঞরা আজ আতঙ্কিত হয়ে কি ভাবছেন না যে, ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি?

(আবুল কাসেম সন্দ্বীপ রচিত)

<005.007.192>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বিদেশী মুসলিম রাষ্ট্রের পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয় অভিমত

৬ জুন, ১৯৭১

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন মুসলিম দেশের পত্রপত্রিকা সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার তেইশ বৎসর পরে এবারই প্রথমবারের মত সারাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে দুনিয়ার বিভিন্ন মুসলিম রাষ্টের পত্রপত্রিকায় যে সম্পাদকীয় নিবন্ধ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি মুসলিম দেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। এটা আমাদের জন্য অত্যান্ত আশা ও আনন্দের বিষয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে আমরা বিশ্ববাসীর আন্তরিক সহানুভূতি ও সমর্থন পেয়ে আসছি।

* সিরিয়ার আল-তাউরা’ পত্রিাকায় ২৭ শে মার্চ তারিখের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছেঃ

পূর্ব বাংলায় সামরিক অভিযান শুরু হওয়ায় এ কথা প্রমাণিত হচ্ছে যে পাকিস্তানের মিলিটারী শাসকগোষ্ঠী দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক অবস্থা ফিরে আসুক, এটা চাননি। তারা এটাও চানটি যে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে হোক।

* তুরস্কের দৈনিক ‘জমহুরিয়াত’-এ ২৮ শে মার্চ তারিখের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছেঃ

পশ্চিম পাকিস্তান তাদের কামান-বন্দুক দিয়ে পূর্ব বাংলাকে দমন করতে শুরু করেছে কিন্তু একটু আগে বা পরে পূর্ব বাংলা তার অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হবে।

* মালয়েশিয়ার দৈনিক ‘উতশান মালয়েশিয়া’ পত্রিকার ৩০ শে মার্চ তারিখে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছেঃ

পাকিস্তানের মিলিটারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বয়ং বুঝেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ পূর্ব বাংলার জনগণের অবস্থা ও ভাগ্যের প্রতি ক্রমাগত অবহেলা ও উদাসীন মনোভাব পোষণ করায় বাংলাদেশে গণ-অসন্তোষ বিরাজ করছে। বর্তমানে ইয়াহিয়া খান পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছেন যে, পূর্ব বাংলা কোন স্বাধীন দেশের অংশ নয়- বরং পূর্ব বাংলাকে বলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী।

* সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের আরবী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘রোসে আল-ইউসুফ-এর এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছেঃ

অনেক পর্যবেক্ষক এই ভেবে অবাক হয়েছেন যে, পূর্ব বাংলা এতদিন পরে কেন স্বাধীনতা চাইল! পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি লোক বাস করে পূর্ব বাংলায়। অথচ পাকিস্তানের মোট সাধারণ বাজেটের ৪ ভাগের ১ ভাগের চাইতে কম অর্থ ব্যয় হয় পূর্ব বাংলায়। পাকিস্তানের উন্নয়ন সংক্রান্ত বাজেটের তিন ভাগের একভাগের চেয়েও কম টাকা ব্যয় হয় পূর্ব বাংলায়। আর বৈদেশিক সাহায্য ও রপ্তানিজাত আয়ের মাত্র ৪ ভাগের ১ ভাগ পায় পূর্ব বাংলা। সরকারি চাকুরির মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ এবং সামরিক বিভাগীয় চাকুরির শতকরা মাত্রা ১০ ভাগ পেয়েছে পূর্ব বাংলার মানুষ। ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার সময় দেখা গেছে যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি বেশী নজর দিয়েছে।

<005.007.193>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

*সুদানের দৈনিক আল-সাহাফা’ পত্রিকার ৫ই এপ্রিল তারিখের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছেঃ

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র দ্বারা বঞ্চিত ও শোধিক হয়ে আসছিল বলে অভিযোগ করে আসছে। পূর্ব বাংলার এই অভিযোগের কারণ হলো এইঃ

১। পাকিস্তানী সামরিক অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের শতকরা ৯০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেয়া নেওয়া হয়েছে।
২। বেসামরিক সরকারী অফিসার পদে ৮০% পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে নিয়োগ করা হয়েছে।
৩। পাকিস্তানের বার্ষিক আয়ের শতকরা ৭০ ভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
৪। রপ্তানিজাত আয়ের ৮০% ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে আর মাত্রা ২০% ব্যয় হয় পূর্ব বাংলায়।

এ সকল কারণেই পূর্ব বাংলার মানুষ নিজেদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র দ্বারা শোষিত ও নির্যাতিত মনে করেছে। বর্তমানে পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে পূর্ব বাংলার ১৭% আর পশ্চিম পাকিস্তানে ৪২%। পূর্ব বাংলার অধিকার সচেতন মানুষের কাছে এখন এ বিষয়টি একেবারে খোলাসা হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের উৎপাদিত পাট, চা ও চাউল বিদেশে রপ্তানী করে যে আয় পাকিস্তানের হয়, তা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতির জন্যই ব্যয় করা হয়। এ কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিরা পূর্ববাংলার মানুষের কাছে তাদের সম্পদের শোষক ও বঞ্চনাকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। এ প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখযোগ্য যে পূর্ব বাংলার মানুষের টাকা দিয়ে রাওয়ালপিণ্ডিতে যে রাজধানী গড়া হলো হলো তাতেও খরচ করা হয়েছে ৫শ কোটি টাকা।

এ সকল ন্যায্য কারণেই পূর্ববাংলা স্বায়ত্তশাসন চেয়েছে।

* আফগানিস্তানের দৈনিক আফগান মিল্লাত’-এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছেঃ

পশ্চিম পাকিস্তানী একচেটিয়া পুঁজিবাদী এবং ফৌজী নেতারা এ অবস্থা দেখতে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না যে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা বাঙালীর হাতে যাক। এ কারণেই তারা জাতীয় পরিষদের বৈঠক বানচাল করতে সচেষ্ট ছিল। এবং পরিষদের অধিবেশন বসবার আগে একটা কিছু গোঁজামিল দিয়ে বাঙালী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমঝোতা করতে ফন্দি এটেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র ন্যাপপ্রধান ওয়ালী খানই এসব বেআইনী ও অবৈধ কার্যকলাপের প্রতিবাদ করেছেন। তার দাবি ছিল, যেকোনো সমস্যার সমাধানের পন্থা পরিষদের বৈঠকে বসেই স্থির করতে হবে। পশ্চিমা শাসকচক্র দেখলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান শুধু পূর্ব বাংলাকে শোষণমুক্ত করতে চান না, একই সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অনুন্নত ও বঞ্চিত প্রদেশগুলোকেও পুঁজিপতি ও সামরিক জান্তার শোষণ থেকে মুক্ত করতে চান। কাজেই ক্ষমতা হাতছাড়া হবার আশঙ্কায় ইয়াহিয়া খান, ভুটো পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি নস্যাৎ করার জন্য আটলেন ভয়াবহ ষড়যন্ত্র-পূর্ব বাংলার এরা পাঠালেন সেনাবাহিনী।

* কুয়েতের দৈনিক আখবার আল-কুয়েত’-এর ৬ এপ্রিল তারিখের এক সম্পাকদীয় নিবন্ধে লেখা হয়েছেঃ

শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর কাছে এই ওয়াদা করেছিলেন যে, নির্বাচনের জয়লাভ করলে তার দল পূর্ব বাংলা জন্য স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা করবেন। নির্বাচনের তার দল বিপুল ভোটে জয়লাভ করলো। শেখ সাহেবের দাবি ছিল ন্যায্য, আইন-সঙ্গত এবং গঠনমূলক। তিনি চাইলেন গণতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক উপায়ে লক্ষ্যে পৌছতে এবং দেশের সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলায় সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে

<005.007.194>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সশস্ত্র ধ্বংসাভিযান চালিয়ে সব নস্যাৎ করে দিলেন। ভাইয়ে ভাইয়ে এই হত্যাকাণ্ড সৃষ্টির অপরাধে ইয়াহিয়া খানকে ভবিষ্যৎ বংশধররা কোনদিন ক্ষমা করবে না।

(আবুল কাসেম সন্দ্বীপ অনুদিত)

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের কবিতা

১১ জুন, ১৯৭১

পচিশে মার্চের রাত্রির সুপ্তি থেকে সমগ্র বাংলাদেশ জেগে উঠেছে। মধ্যরাতের দুঃস্বপ্নে অকস্মাৎ কেদে উঠেছিল ঢাকা নগরী। সে কান্না মায়ের জঠর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নবতর জন্মলাভের কান্না। বিশ্বাসঘাতকতার খোলস ছেড়ে নতুন সূর্যোদয়ের মতই স্বাধীন বাংলা পূর্বদিগন্তে উদ্ভাসিত হয়েছে। তার মুক্ত আলোকচ্ছটা সূর্যকরের মতই সত্য আর স্বচ্ছ।

সুজলা সুফলা বাংলা আজ বিশ্বের বিস্ময়ে পরিণত কৃষাণের লাঙ্গল রূপান্তরিত হয়েছে সংগ্রামী হাতিয়ারে, শ্রমিক তার হাতুড়ি ছুড়ে দিয়েছে গ্রেনেডের মত, দেশের অগণিত জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার পোষ্টার লিখছে। এ কোন বাংলাদেশ। এই অচিন্তনীয় বাংলার রূপ কি পৃথিবীর মানুষ কখনও দেখেছিল? হয়ত দেখেনি, কিন্তু বাংলার কবিতার চিরকালীন আবহমান বাংলাকে অনুভব করেছেন এই বিস্ময়ময় রূপের মধ্যে। তাই বাংলার রণক্ষেত্রে আজ তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং তাদের দেশের একান্ত প্রিয় কবিদের কাব্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একদিকে হিংস্র বন্য পশুদের নির্মম অত্যাচারের যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর, অন্যদিকে স্বদেশের প্রতি গভীর আবেগময় ভালবাসা। এই ভালাবাসার প্রতিভাস ফুটে উঠেছে এ দেশের কবির সৃষ্টিতে। মসি এখানে অসির সহযোগী। বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণ জীবনানন্দের অনুভবে একান্ত হয়ে উচ্চারণ করেনঃ “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর।“

ভাষাই সম্ভবত বাঙালির চেতনার উৎসমুখ। নদীর স্রোতের মত অগণিত কাব্যের প্রবাহে হৃদয় ভাসিয়ে এদেশের মানুষ আত্মশুদ্ধ হন। পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব ভাষা ও ভাবের আত্মীয়তার মধ্যে নিজেদের অস্তিত্বের মুক্তি আবিষ্কার। এ জন্যেই একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষার আন্দোলন নয়; একুশে ফেব্রুয়ারি আজকের স্বাধীনতা-বাসনার প্রথম প্রজ্জ্বলন।

দেশের প্রতি কবিদের আত্মনিবেদনে দেশের মানুষ সমান অংশীদার। তাই এদেশের মানুষের কাছে একজন সৈনিক এক একজন কবি পাশাপাশি পথ চলেন। “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালেবাসি- এ কেবল জাতির সঙ্গীত নয়, জাতির হৃদয়-সঙ্গীত। অন্তরের প্রতি প্রান্তে স্বদেশের মাটির প্রতি কবির যে সংবেদন, মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রতিটি বুলেটে সেই চিরন্তন সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর তাই অকুতোভয় বাঙালী সৈনিকের কাছে মৃত্যুকেও মৃত মনে হয়, তুচ্ছ মনে হয়।

বাংলার জাতীয় জাগরণে জসীম উদ্দীন কেবল কবি নন, তিনি সংগ্রামের সৈনিক ও বটে। মানুষের প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি তাকে নিয়ে এসেছে সংগ্রামী জনতার পুরোভাগে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করে তাই তিনি বলেনঃ

<005.007.195>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

‘সেনাবাহিনীর অশ্বের চড়িয়া
দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,
কামান গোলার বুলেটের জোরে
হানে বিষাক্তা শ্বাস।
তোমার হুকুকে তুচ্ছ করিয়া
শাসন ত্রাসন ভয়
আমরা বাঙালী মৃত্যুর পথে
চলেছি আনিতে জয়।’

আমাদের স্বাধীনতার মূল উদ্দীপনা আহৃত হয়েছে দেশের প্রতি উৎসারিত মমত্ববোধ থেকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্রেও এই স্বদেশপ্রীতিই হচ্ছে আসল হাতিয়ার। দেশকে ভালোবাসার অপরিমেয় আগ্রহ এক নতুন রণশক্তির সৃষ্টি করেছে যে মানবিক মূল্যবোধহীন বর্বর পশুশক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যুত্তর দিতে সক্ষম। এখানেই বাংলাদেশের কবিরা হয়ে উঠেছে মুক্তিসেনার পরম সহায়ক। যুদ্ধ এক ধরনের হিংস্রতা সন্দেহ নেই, কিন্তু জীবন দেয়া-নেয়ার গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টিতে মুক্তিবাহিনীর প্রত্যেকটি সৈনিকের মুখে যে নির্ভীক সাহসিকতার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশমান তার প্রেরণা বাংলা মায়ের মুখ। দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসই যেখানে অস্ত্র, সেখানে পশুশক্তির পরাজয় অনিবার্য। হাসান হাফিজুর রহমান এমনিতর অস্ত্রই আবিষ্কার করেছেন। যা জনগণের চোখের দৃষ্টি আর বুকের ভাষা থেকে উৎসারিত।

‘অনাদি অটল দুর্গজয়ী অস্ত্র পাবে কোথায়?
মোহাচ্ছন্ন চোখে তোমার পড়ে না কিছুই।
দ্যাখো না লক্ষ্য কোটি তীব্র চোখ ভিন্ন আলো ফেলে,
কণ্ঠ তাদের আকাশ বাতাস চেরে?
অস্ত্র আমার তাদের চোখ
অস্ত্র আমার কোটি কণ্ঠের ভাষা’।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি আজ অতি স্পষ্ট। ইতিহাসের অনিবার্য গতিতেই আসন্ন হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা। মানুষ মারার জন্যে বুলেটের সাথে অমানবিক জিঘাংসার প্রবৃত্তি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু পশু হত্যার জন্যেই চাই মানবিক দৃঢ়বদ্ধ চেতনা। এ বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র জাতি এখন রক্তক্ষয়ী আপোষহীন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাজার মাইল দূর থেকে নিয়ে আসা ভাড়াটে হানাদল বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে উঠেছে। কোন নৈতিক মনোবলশূন্য সামরিক শক্তি যত বিশালই হোক না কেন, আত্মিক বলে বলীয়ান নিরস্ত্র মানুষের শক্তিও তার চেয়ে কম নয়। এহেন মনোবলের বোধ পাকিস্তানের শূন্যগর্ভ বুলিতে কোনকালেই জাগ্রত করা সম্ভব নয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের কবিরা বাঙালীর আত্মিক প্রেরণার সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে। রক্তের ফিনকিতে লাল হয়ে যদিও বাংলাদেশ ধুয়ে যাচ্ছে, তবু মহান মুক্তিসেনারা আজ মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। তাদের মনের নির্ভীক প্রতিরূপটিকে ব্যক্ত করে এদেশের কবি বলেনঃ

মৃত্যুকেও মৃত মনে হয় আজকাল, কারণ মৃত্যুতে
মোমবাতির শিখাটি নড়ে না,

<005.007.196>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শোকধ্বনির মধ্যে গভীর আনন্দে খোল করতাল বাজে
অন্ধকারে আলো ওঠে জ্বলে
স্বপ্লের রং গুড়ো হলে কারা তবু আঁকতে চায় ছবি
বারুদের পোড়া গন্ধ শুঁকে
স্বদেশের ঘ্রাণ পায়, প্রাণে নেয় আশ্বাসের বায়ু
দুঃখ ক্লান্তি ভীতি নেই, যেহেতু তাদের
প্রত্যেক দুঃখের সঙ্গে আনন্দ ঘুমায় অবিরত,
যেহেতু এখন
মায়ের জঠরে কাঁদে বাংলাদেশ নবতর জন্মের পুলকে।’

ইতিহাসের অমোঘ ধারাকে লংঘন করার সাধ্য পাশব শক্তির প্রতিভূ ইয়াহিয়া খানের নেই। বাংলাদেশ এখন সেই মহাজাগতিক সত্যের ধারায় স্নাত হয়ে মুক্ত সত্তার প্রতীক্ষায় দিন গুণছে। এ পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়’- জীবনানন্দের এই চিরন্তন বাণী মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে স্বাধীনতা পরম সত্যের মাঝখানে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করবে। সেই অলখ অরুণোদয়ের প্রতীক্ষায় আমরা নিদ্রাহীন, ক্লান্তিহীন। জীবনকে ভালবাসি বলেই আমরা বরণ করি মৃত্যুকে।

(কামাল মাহবুব’ ছন্দনামে মাহবুব তালুকদার রচিত)

রণ দামামা

৬ জুলাই, ১৯৭১

“এসো শ্যামল সুন্দর,
আনো তব তৃষ্ণাহারা তাপহারা সঙ্গসুধা
বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে”

গ্রীষ্মের খরদাহ তাপক্লিষ্ট রুদ্র রূপের পর বর্ষা তুমি এসেছে। তোমার রুমঝুমঝুমু নৃত্য আমার হৃদয়ে ফেনিল তরঙ্গোচ্ছাস তোলে না। রুদ্র দাহনের পর তোমার শ্যাম-সুন্দর সরল আগমন। আজ জনমত সঞ্জীবিত তোমার রসসিঞ্চনে। হারান সম্পদ বিয়োগব্যথার ত্রিধরা প্রকৃতি আজ শীতল হল।

গুরু গুরু মেঘ গুমরি গরজে গগনে গগনে। সেই সাথে গরজে আমার উত্তাল তরঙ্গ বিষুব্ধ মন। আজ হৃদয় দুর্জয়, অশান্ত, টালমাটাল। ঘন বর্ষার বাংলার ঘুমন্ত রানীল তন্দ্ৰালু স্বপ্নাচ্ছন্ন বেশ ঝমঝম করে একটানা করছে। ঝরে পড়া জলের সমুদুরে আরও নতুন ধারা পড়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। আমার হৃদয় সমুদ্রেও তেমনি বিক্ষুব্ধ কল্লোলধারা অশান্ত উৰ্মিমালা উখিত-পতিত হচ্ছে ভীমবেগে। আজ জনতা সাগরে জেগেছে উর্মি টালমাটাল’। স্বাধীন বাংলায় বর্ষা এসেছে নতুন জাগরণের বাণী নিয়ে, উত্থানের মন্ত্র নিয়ে- ঘুমপাড়ানী গান যেন নয় শিকল-ছেড়া বাঁধনহারার গান গেয়ে। তরুণ অরুণের বহ্নিশিখার মতো প্রতিজ্ঞার ভাস্বরতা নিয়ে।

<005.007.197>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হৃদয়-বারিধি তীরে সে আহবানের অনুরণন। নতুন নতুন শপথের দীপ্ত প্রতিভাস, নবীন প্রত্যয়ের সুরে ঝংকৃত অসংখ্য প্রতিজ্ঞার মালা হৃদয়কে আরও কঠিন, আরও ভৈরব-রুদ্র করে তুলছে। বরষার মন্দ্রার মঞ্জরী উত্তরীয় আর হৃদয়পদ্মের কোমল পাপড়িকে আন্দোলিত করে না, বরং নব উচ্ছাসে হৃদয়ের ঘুমন্ত বিদ্রোহী সত্তাকে জাগিতে তোলে। আজ প্রাণের রুদ্রবীণায় একটি সুরের লয় মিলে-মুক্তির সুর, স্বাধীনতার সুর। রিমঝিম সুরের ঐকতান হৃদয়ের নিকুঞ্জবনকে স্বর্ণমদিরায় অসল-উতল ঘুম আর্দ্র করে তোলে না, বরং বিসুভিয়সের সুপ্ত লাল লাভা উদগীরণ করে। বর্ষার কলকল্লোল বারিধারা, ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনীর উদম কলহাস্য, তাল-তমালের শিহরণ এখন আর হৃদয়ের পেলবতন্ত্রীতে সুন্দরে ঝঙ্কার তোলে না বরং দুরন্ত দুর্দম কালবোশেখীর প্রলয়বিষাণ বাজায় হৃদয়মধ্যে। কদম্ব-কেতকী-কামিনী আর কুমুদ-কহলার অনুপম অনাবিল সৌন্দর্যের মধ্যে দেখি ভয়ঙ্কর সুন্দরের প্রতিভাস। স্ফীতকায়া নির্বারিণীর সলিল-উল্লম্ফনে রক্তের ফিনকি চমক দিয়ে যায়। বজ্রামানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ়ের মালায় একটি রক্তকবরী গেথে দেই। যেন এক শপথের গুচ্ছ শহীদী রক্তের সিক্ত হয়ে নতুন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করছে। বিজলী চমকের ঝিলিকে সে প্রত্যয় আরও প্রোজ্জ্বল, আরও দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে। মেঘমল্লার রাগে নতুন করে বাজুক রণদামাম- ‘জয় নিপীড়িত প্রাণ, জয় নব উত্থান’।

(দিলীপ কুমার ধর রচিত)

কথিকা

১৩ আগষ্ট, ১৯৭১

২৪ বছর পরে আজ ১৪ই আগস্টে মনে পড়ছে আজ থেকে ২৪ বৎসর আগেকার দিনটি কথা। সেদিন কি উজ্জ্বল ছিল বাংলাদেশ, আর প্রাণদপ্ত ছিল বাংলার মানুষ। সারাদেশে কাগজের রঙিন পতাকা আর মালার ছড়াছড়ি। আলোয় আলোয় সারাদেশ ঝলমল। আমরা স্বাধীন হয়েছি, এবার আমাদের দুঃখ ঘুচবে। বিদেশী শাসন, জমিদারের অত্যাচার, মহাজনের শোষণ আর সামাজিক অসাম্যের হাত থেকে রেহাই পাবে বাংলার মানুষ। সারাদেশের মানুষ অন্তরের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে বরণ করে নিল ১৪ই আগষ্টের ভোরের লগ্নটি।

তারপর প্রতিবছর ১৪ ই আগষ্ট ঘুরে ঘুরে এসেছে। বাংলার মানুষ তাদের ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশ্যা নিয়ে প্রতিবছর ১৪ই আগষ্টের ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। ভেবেছে, যে দিনগুলো চলে গেলো সে এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। এবার নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুত নতুন জীবনের বাণী বহন করে আসছে ১৪ই আগষ্ট। কিন্তু প্রতিবারই ভুল ভেঙ্গে গেছে বাংলার মানুষের। তার অতি কাজেক্ষয় জীবনের প্রতিশ্রুতি বহন করেন এলো না কেন ১৪ই আগষ্ট। বিদেশী শাসনের পরিবর্তে তার ঘাড়ে চেপে বসলো পশ্চিম পাকিস্তানী শাসন। ১৪ই আগষ্ট বাঙালীর জন্যে মুক্তি নিয়ে এলো না কোনবার। শুধু তীব্রতর হলো শোষণ জমিদারের অত্যাচার আর মহাজনের শোষণের চাইতে পশ্চিম পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র এবং পুঁজিপতিদের বর্বরতম অত্যাচার ও তীব্রতর শোষণে তারা জর্জরিত হয়ে উঠলো। সামাজিক অস্বীকৃতি আর অনাচারে তাদের জীবন হয়ে উঠলো দুঃসহ।

এই শৃঙ্খলিত শাসন আর সামাজিক অবিচারের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছে বাংলাদেশের নিপীড়িত জনসাধারণ। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকবার প্রতিটি উপকরণের জন্যে তাদের লড়তে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র বাংলাদেশের প্রতিটি দাবিকে অস্বীকার করেছে, আর প্রতিটি দাবি আদায়ের জন্যে বাংলার মানুষকে লড়তে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের পর বাংলাদেশের ইতিহাস পশ্চিম পাকিস্তানী
<005.007.198>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শোষকশ্রেণীর শোষকের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস। এই ইতিহাস গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মানুষের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস।

১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে বাংলার বীর সন্তানেরা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে, ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে বাংলার মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে তাজা তাজা প্রাণগুলো উৎসর্গ করেছে। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন কোটি বাঙালীর প্রাণের দাবি দফ-দফাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে ভাই মনু মিয়া এবং আরো অনেকে। ১৯৬৯ সালে বাংলার স্বাধিকারের দাবিতে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার দাবিতে, বাঙালীর প্রাণাপেক্ষা প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে বুকের তাজা রক্তে বাংলার শ্যামল মাটি লালে লাল করে দিয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকশ্রেণী, আমলাতন্ত্র, সামরিকচক্র এই তিনশক্তির বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে বার বার হামলা করেছে। প্রতিবারই বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতিরোধের সম্মুখে পিছু হটে গিয়েছে। এবং চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। তারপর তারা তাদের চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনা করলো ২৫ মার্চের মুক্তিকামী জনতার কণ্ঠকে। কিন্তু বাংলার মুক্তিকামী জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের সম্মুখে আবার পিছু হটে চলেছে পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর শোষকশ্রেণী এবং তাদের স্বার্থবাহী সামরিক চক্র। তাদের এই অভিজ্ঞান হয়েছে যে, পরাজয় তাদের সুনিশ্চিত-মৃত্যুর ঘন্টা বেজেছে।

বাংলায় আজ রক্তের স্রোত বইছে। ঘরে-ঘরে, মাঠে মাঠে, রাজপথে জমাট-বাঁধা রক্ত। ধর্ষিতা মাবোনদের মরণ আর্তনাদ অভিশপ্ত ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগষ্ট আর তার নায়কদের প্রতিমুহুর্তে ঘৃণার সাথে ধিক্কারে ধিকৃত করছে। ’৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট বাংলার জন্য এনেছে প্রতিশ্রুতির আড়ালে বঞ্চনা, শোষণ আর রক্তস্নান; কান্না আর দীর্ঘশ্বাস।

তাই আজ ১৪ই আগষ্টে স্বাধীন বাংলার পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে শিকল-ছেড়া বাংলার মানুষ অতীতের অপমান আর গ্লানিভরা দিনগুলোকে স্মরণ করছে প্রচণ্ড ঘৃণার সাথে। আর সেজন্যেই সেদিন ছোট ছেলেটি বললো- মা, কি পুণ্যই যে ছিল তোমার, যার জন্যে ১৯৪৭-এর আগষ্টের কলঙ্কিত দিনটির মুখ দেখেতে পাইনি, আর তোমাদের মত আমার দুহাত দিয়ে এমন দিনটির জন্যে মালা গাঁথতে হয়নি।

(জেবুন্নাহার আইভি রচিত)

বাংলাদেশ গেরিলা

২৯ আগষ্ট, ১৯৭১

‘গেরিলা’ শব্দটি এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে উচ্চারিত। এ শব্দটা শুনলেই মানসপটে ভেসে উঠে একটা ছবি-রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি চলেছে এক যুবক, কখন ঝড়ের রাতে তার সর্বাঙ্গে ঝরে পড়ছে বাংলা মায়ের আনন্দাশ্র বৃষ্টিধারায়, কখন স্রষ্টার বরাভয়ের মত ঝরে পড়ছে তালনবমীর আধো আধো জোছনা। পরনে কেন নির্দিষ্ট যুদ্ধসাজ নেই। কখন লুঙ্গী, কখন পাজামা, উর্ধ্বাংগে কখন শার্ট কখন ফতুয়া। সে চলেছে শত্রুপক্ষের

<005.007.199>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কোন গুপ্ত অবস্থানের খবর পেয়ে। অস্ত্র তার দেহের ভাঁজে ভাঁজে লুকানো কিছুক্ষণ পরেই গর্জন করে উঠবে প্রচণ্ডভাবে…।

এখন প্রশ্ন-গেরিলা কে? তাকে দেখতে কেমন? কী এমন তার মাঝে আছে যা তাকে সাধারণের থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে?

প্রথম প্রশ্নের একমাত্র উত্তর : বর্তমানে বাংলাদেশে গেরিলা সবাই। গেরিলা যে কেউ হতে পারে, সে ছাত্র হোক অথবা শিক্ষিত হোক। কৃষক শ্রমিক মজুর মালিক যে কেউই গেরিলা হতে পারে। জীবিকার জন্যে যে -যে পেশায় নিয়োজিত আছে- যেমন মুদি দোকানী, হোটেল বা রেস্টুরেন্টের মালিক, কর্মচারী, রিকশাঅলা, বুদ্ধিজীবী- সবাই গেরিলা। গেরিলা শব্দের অর্থ আরো ব্যাপক হতে পারে। যেমন শত্রুনিধনে যারা সক্রিয়ভাবে জড়িত তাদেরই শুধু নয়, বরঞ্চ যারা সক্রিয় গেরিলাদের প্রকারান্তরে সাহায্য করছে গেরিলা বলতে তাদেরকেও বোঝায়। বাংলাদেশের মা-বোনেরা যারা মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের খাবার দিয়ে বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে সাহায্য করে অশীতিপর বৃদ্ধা, বেঁকে যাওয়া কোমড়ের ভাঁজে মুড়ির ধামা আর লোলচর্ম হাতে জলের বালতি নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর জন্যে অক্লান্ত স্মিত মুখে। সেই অর্থে এমন বাংলাদেশের আবলবৃদ্ধবনিতা, কুলি-মজুর, কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী সবাই গেরিলা’।

(শামীম চৌধুরী রচিত)

আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মহিলা

১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

২৩ বছর ধরে নিরপরাধ নিঃসহায় বাঙালীর উপর যে অত্যাচার অবিচার আর নির্যাতন চলে আসছিল সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বাঙালীর দানাবাঁধা ক্ষোভ এবার ফেটে পড়েছে ’৭১-এর ২৫শে মার্চে স্বাধীনতা সংগ্রামের বাঙালীর উপর অস্ত্র ব্যবহার করছে। রক্তপিপাসু নরপিশাচরা বার বার রক্ত পান করছে। কিন্তু এবার বাঙালীর সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, তাই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ স্বাধীনতাকামী বাঙালী তার স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে এবার হাতে অস্ত্র নিতে শিখেছে- হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে।

আর তাই বাংলার তরুণ যুবকরা দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর তরুণ যোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে সাহস আর কৃতিত্বের সহিত প্রচুর শক্রসেনা খতম করে অস্ত্রের ভাষায় অস্ত্রের জবাব দিচ্ছে।

আজকের আমাদের মুক্তিসংগ্রাম বাংলার সাড়ে সাত কোটি নরনারীর মুক্তিসংগ্রাম। বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি আন্দোলনের এ ধারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে অকাতরে এ সংগ্রামের সাফল্যের জন্য প্রাণ দিচ্ছে। বাংলার সামগ্রিক জনতার অর্ধাংশ যে নারী তারাও আজ পিছিয়ে নেই। তারও স্বাধীনতা-চেতনার পরিস্ফুটন আজ আমরা আমাদের মুক্তসংগ্রামে দেখতে পাই। তাই দেখতে পাই ইতিহাসের পাতায় বীরাঙ্গনা খাওলা, চাঁদ সুলতানা থেকে শুরু করে জামিলা বোখারদ, প্রীতিলতা

<005.007.200>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ওয়াদেদার আর লায়লা খালেদের পাশে বাংলার বীরঙ্গনা রওশনারা নিজের নাম যোজনা করে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। এ প্রসঙ্গে কবির সেই বৈপ্লবিক চেতনার কথা স্মরণ করতে হয়। কবির ভাষায়-
এ বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
কিংবা-

জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।

আজকের আমাদের এ সংগ্রামও বাংলার মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে মহীয়ান হয়ে উঠেছে। আজকে দেখি বঙ্গমাতার হীরের টুকরো ছেলে যখন অশ্বধামের বলির মত বর্বর পশুর হাতে স্বাধীনতা শিকারে পরিণত হয়েছে তখনও শোকাকিনী মাতা সগর্বে আর এক সন্তানকে তার প্রতিশোধ নিতে মুক্তিসংগ্রামে পাঠাচ্ছে। আজকে বাংলার ভগ্নীকুল তার নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়েও ভাইকে দেশের স্বাধীনতা মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে। আজকে বাংলার কুলবধূ স্বামী হারিয়েও রণাঙ্গনের পাশে পাশে বীর সৈন্যদের সেবশুশ্রা করছে।

নরপিশাচরা আবাল বৃদ্ধাবনিতা নির্বিশেষে হত্যা করে, পাইকারি হারে লুটতরাজ করে, মহিলাদের ইজ্জত নষ্ট করে-কামান, মেশিনগান, ট্যাঙ্ক চালিয়ে, নাপাম বোমা ব্যবহার করেও আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে নস্যাৎ করতে পারে নাই। কেননা আমাদের ভাইরা যখন রণাঙ্গনে থেকে শক্ৰ খতম করছে, বিভিন্ন জায়গায় রাস্ত, সড়ক, সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে তখন বাংলার মহিলারা তাদের অনুপ্রেরণায় শরীরে ডিনামাইট বেঁধে ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছে।

তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় মহিলারা তাদের স্বেচ্ছাসেবিদেকা কেন্দ্রে স্থাপন করে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন ট্রেনিং গ্রহণ করছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে মহিল সমাবেশ সৈন্যদের খাবার ও পোশাক তৈয়ার করা হচ্ছে। চিকিৎসালয়ে মায়েরা বোনেরা নার্স হিসাবে তৎপর রয়েছে।

‘কোনকালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।’

তাই বাংলার বিজয়লক্ষ্মী নারীরও আজ বঙ্গবন্ধুর ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেব মন্ত্রে আজ দীক্ষা নিয়েছে। জয় বাংলা।

(মেহের খন্দকার রচিত)

দেশবাসী সমীপে নিবেদন

১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশবাসী ভাই-বোনেরা,

কী বুকফাটা আহাজারী আর কান্নার দরিয়া সাঁতরে সাঁতরে আমাদের দিন কাটছে, তা ইসলামাবাদের দুৰ্বত্তেরা না জানলেও, পৃথিবীর মানুষ জানে। অনেকেই আজ একে অপরের কাছ থেকে ছিটকে পড়েছে। লক্ষ মানুষ ছিটকে পড়েছে দিগ্বিদিক-স্বদেশহারা, গৃহহীন, আত্মীয়স্বজনহারা। একদিন যার কাছে ছিল, আজ নেই।

<005.007.201>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শুধু মানুষ নয়, আমাদের অতি মেহনতে-গড়া শহর- সবুজের ভাঁড়ার ঘর আমাদের গ্রাম-যেখানে ছোটখাট সুখ-দুঃখ নিয়ে হাসিকান্নায় দিন কাটত- পরম শান্তির নিবাস আমাদের বহু গ্রামও ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে আওয়াজ মানুষের গোঙানি- রমণীর আর্তনাদ। বেঁচে যাওয়াটা এদেশে দৈবী ব্যাপার। ছোট ছেলেমেয়ে, এমন দৈবীভাবেই যারা বেঁচে গেছে, আজ তাদের মুখে স্বাভাবিক হাসি নেই। কান্না ভুলে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল চেয়ে আছে সেই রাস্তার দিকে যে-পথে ঘরবাড়ি তছনছ করার পর বুটপরা খাকী লেবাস জানোয়ারেরা কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছে। এরা কেউ বাংলার বাসিন্দা নয়। বাংলাদেশের দুঃখ-আনন্দের শরীক তারা কী করে হবে? লুটতরাজের মালে পকেট বোঝাই এইসব জানোয়ারদের কাছে কিন্তু আমাদের পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
কিসের পরীক্ষা? তা আপনাদের জানা। অনেককে ব্যক্তিগতভাবে এই মসিবৎ পার হতে হয়েছে। পরীক্ষাআমরা বাঙালীরা মুসলমান কি না। তাই চার-কলেমা পড়তে হয়েছে উদ্যত সঙ্গীন বা রাইফেলের মুখে। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! যে বাঙালীর তাগদ ও তাগিদের জোরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে বাঙালী নিজ প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মুসলমানদের প্রতি প্রীতি-পরবশ পাকিস্তান চেয়েছিল, যে বাঙালী শাসনতন্ত্র পরিষদে লিয়াকত আলি প্রমুখ অবাঙালীদের বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল, নেহয়েৎ বাঙালীসুলভ উদারতায় এবং নিজে সংখ্যালঘিষ্ঠ বা মাইনরিটি হয়েছিল শাসনতন্ত্র পরিষদে- সেই বাঙালীকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে ও হচ্ছেঃ সে মুসলমান কি না। অদৃষ্টের পরিহাস বটে!
পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বা হয়েছে কার কাছে? যে পাঞ্জাবী সৈন্য লুটতরাজ করে, নিরীহ নিরস্ত্রকে হত্যা-খুন করে, জুলুমের চাকা নির্দয় চালিয়ে যায়, বোনকে ভাইয়ের সামনে বলাৎকার করে- এমন জন্তুর কাছে। পশু ইসলামের ফর্মাবরদার। আর আমি আমার ভালমানুষিয়ানা এবং উদারতা নিয়ে মুসলমান নই। অদৃষ্টের পরিহাস বটে।
ভাইবোনেরা আমার, আমাদের ভালুমানুষিয়ানার দাম দিচ্ছি। বড় চড়া দাম। রক্ত অশ্র অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা প্রাণের বিনিময়ে- বড় চড়া দাম। অথচ বাংলাদেশের পাটচাষী তার ফসলের দাম পায় না। রোদেবৃষ্টিতে অমানুষিক পরিশ্রমের পর তাদের আবাস জীর্ণ কুঁড়েঘর। ভরপেটে দু’বেলা অন্ন তাদের কাছে স্বপ্ন। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা তারা ভাবে না, যেহেতু কুলকিনারা অসম্ভব। সেই পাটে আদমজী ইস্পাহানীরা শুধু ধুনকুবের হয় না, ঐ ফসলজাত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা অস্ত্রে সজ্জিত হয় পাঞ্জাবী সেনাবাহিনী। সেই অস্ত্র আজ আমাদের বুকে বিধছে। ভালমানুষিয়ানার দাম এইভাবে দিতে হয় কি না? কেউ কোথায় দিয়েছে?
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভালমানুষিয়ানা ও সরলতার সুযোগ নিয়েছিল। আজও তার কামাই নেই। পূর্বে আমাদের তারা বাঙালী হতে দেয়নি। মুসলমান বানানোর চেষ্টা নিয়েছে। এর উপর ফিরিস্তি আজ দেয়া সম্ভব নয়। আপনারা জানেন। মিসর, ইরান, তুরানে মুসলমান থাকতে পারে- মিশরী ইরানী তুরানী হয়েও। কিন্তু আপনি আমি বাঙালী হলে আর মুসলমন থাকতে পারি না। শোষণের চাকা সদা সচল রাখতে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তাঁবেদার কিছু দেশী দালাল সব সময় এই দাগাবাজির আশ্রয় নিয়েছে। এমন কি আমাদের প্রতি কটাক্ষ করতে জিন্না সাহেবের পর্যন্ত এতটুকু বাধেনি।
ওদরে জারিজুরি ধরা পড়ে গেছে। তাই তো হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু মাদারীর পুরাতন খেল চালু করতে ওদের কসুর নেই।
পঁচিশে মার্চের রাত থেকে নেকড়ের মত যখন বাংলদেশের নিরীহ-নিরস্ত্রের উপর পোষা জন্তুরা ঝাঁপিয়ে পড়লো তখন তারা জাতিধর্ম নির্বিশেষে বাঞালী হত্যা করতে লাগলো। মনে রাখবেন, এই হত্যা খুচরো

<005.007.202>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নয়। পাইকারী। কতলে আম! ধর্ম ছাড়া আরও হাজার রকম মানবিকতার মিল বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা মধ্যে বর্ণের দিক থেকে এক দেখতে একই রকম। পচিশে মার্চ থেকে নামটা উচ্চারণ করতে ঘৃণা হয়, টিক্কা খান ও অনুচরেরা বাঙালী ধ্বংস করতে নামল। এক মাস পরে যখন নিজেদের কৃতকর্মের চেহারা ওরা দেখতে পেল, তখন আবার সেই পুরাতন ফন্দি-সাম্প্রদায়িকতায় ফিরে গেল। প্রথম কিস্তি, হিন্দু মুসলমানকে নির্যাতন করছে, তাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। কিন্তু শয়তানের জন্মগত খাসলৎ অভ্যাস কি সহজে যায়? জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ফন্দি পুনরায় চালু হলো। এবার বেছে বেছে হিন্দু হত্যা, হিন্দুর গৃহদাহ ওরা শুরু করল। তাই বলে কেউ মনে করবেন না, মুসলমানদের তখন টিক্কা খান ভগ্নিপতির আদরে আপ্যায়িত করছিল। হিন্দুর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে, মুসলমানের ক্ষেত্রে অপ্রকাশ্যে। তফাৎ এতটুকু। বাঙালী ধ্বংসের পরিকল্পনা থেকে পাঞ্চাবী মুসলমান (হায় মুসলমানদের নামধারী!) সেনারা এতটুকু নড়েনি। কৌশল বদলেছিল, নীতি যথারীতি অব্যাহত । এইভাবে মুসলমানদের কাছে গোঁসাই ঠাকুর সাজার ফন্দি। নিজেদের অপরাধের বোঝা হাল্কা করার অপচেষ্টা ওরা নিয়েছিল। এইভাবে আমার মৃত সাম্প্রদায়িকতাকে খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা চলে।

কিছুটা সফল হলো বৈকি পাঞ্জাবাগত এই হানাদারের দল নেজামে ইমাম ইসলাম, জামাতে ইসলামীর ধর্মান্ধ পশুর দল যারা এতদিন গণঅভ্যুত্থানের সামনে কেচোর মত মাটিতে মিশেছিল, তারা তাদের মিলিটারী আব্বাজানের ডাকে এবং উৎসাহে কেউটের মত তৎপর হয়ে উঠল। নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলামীর গুণ্ডারা বাঙালী নয়। পাঞ্জাবী মিলিটারীরা সত্যি ওদের বাবা ও বাপজান। নচেত বাংলাদেশের মাটিতে জন্মে, বাংলার মা-বোনের বেইজ্জতি দেখেও ওরা কীভাবে মিলিটারীর সঙ্গে হাত মিলায়? যারা দেশকে বিদেশীর হাতে বিকিয়ে দিতে পারে, তারা মা-বোনকেও বিদেশীর হাতে বিকিয়ে দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, কবি, লেখক-আশা করি এই কথাটা স্মরণ রাখবেন।

কিন্তু সকলেই তো নেজামে ইসলাম ও জামাতে ইসলামীর অনুচর নয়। সাড়ে সাত কোটির মানবজননী বাংলাদেশের কি সাচ্চা সন্তান নেই, জন্মভূমির অপমান যাদের বুকে যন্ত্রণার ঝড় তোলে; দেশের চাষীমজুর ও অন্যান্য সকলের দুঃখ-কষ্ট যাদের বিচলিত করে। তারা এগিয়ে এসেছে বৈকি। শুধু এগিয়ে আসেনি অন্যায়ের নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল, পুলিশ ভায়েদের গৃহসুখ , স্নেহমমতা ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। জন্মভূমি প্রেমের বেদীতে সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। আর আছে আমাদের দেশের তরুণেরা-যাদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজের ছেলে। নিজেদের সকল সাধ-আরাম-আয়েস হারাম ভেবে যারা সৈনিকজীবনের কঠিন ব্রত গ্রহণ করেছে। হিন্দু-মুসলমান এখানে এক-কাতার। যে বিভেদ মারফৎ বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বাৰ্থ বছরের পর বছর শোষণ করেছে, তা মুছে দিয়ে এক-কাতারে দাঁড়িয়েছে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্ৰীষ্টান। নতুন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। নতুন আদর্শের প্রদীপ জ্বালিয়েছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। সেই প্রদীপের শিখা-রোশনাই অনির্বাণ রাখার দায়িত্ব আমাদের, আমার যারা ঠিক লড়াইয়ের ময়দানে নেই, তারাও জন্মভূমির মুক্তিসংগ্রামে শরীক মনে রাখবেন, এই লড়াই সর্বাত্মক লড়াইয়ের পর্যায়ে পড়ে। আজ আমরা প্রত্যেকেরই সৈনক- হাতে হাতিয়ার থাক বা না থাক। পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি সামগ্রী যে কেনেনা সেও লড়াইয়ের ময়দানে আছে বৈকি। শত্রুক সেও ঘায়েল করছে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে। যে পাটচাষী পাট চাষ করে না, ধান চাষ করে সেও লড়াইয়ে শরীক কোন সভ্য দেশে নজীর নেই, দুশমনেরা আমাদের প্রতিটি বাজারে চাল-ডাল ধ্বংস করে দিয়েছে, যেন আমাদের অন্ন না জোটে এবং দুর্ভিক্ষ আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়- যার ফলে গোলামি আমরা শেষ পর্যন্ত মেনে নেব। এই চালেঞ্জ-তালু-ঠুকা-স্পর্ধার মোকাবিলা করছে সেই চাষী যে প্রচুর পরিমাণ ফসল ফলানোর চেষ্টায় কোমল বেঁধেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা যাতে শত্রু না পায় তার জন্যে সতর্ক-সে পাট করছে না। এই কৃষক কোন সৈনিকের চেয়ে কম নয় যদিও স্রেফ কাস্তেধারী, অস্ত্রধারী নয়। এমনিভাবে জন্মভূমির স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমরা সকলেই শরীক হতে পারি।

<005.007.203>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আমরা লড়ব বৈকি। যতদিন একটি হানাদার সেনা (আশ্চর্য, এগুলো আবার ধর্মে মুসলমান) আমাদের জন্মভূমির মাটির উপর থাকবে ততদিন আমাদের সংগ্রামের বিরতি নেই। বৃটিশের শিকল ছিড়ে আমরা গোলামির নতুন জিঞ্জির পরেছিলাম- এতদিন পশ্চিমের শাসকগোষ্ঠী যাকে ইসলামী জেওর বা অলঙ্কার বলে জাহির করেছে। সেই জিঞ্জির ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে। আমার আর ধোঁকাবাজির শিকার হবো না।
আমরা স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ব- যেখানে শোষণ চিরতরে নির্বাসিত- যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের মেহনতের দাম পায় যথাযথ মর্যাদায়- যেখানে জাগতিক অসহায়ত কারো মনুষ্যত্বের বিকাশ-পথে বাধা নয়। আমরা গড়বো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পমুক্ত শ্ৰেয়বোধ প্রিয়বোধে দীপ্ত খাড়া শিরদাড়া নাগরিকের কলকণ্ঠস্কৃত নতুন বাংলাদেশ। জয় বাংলা ।

(শওকত ওসমান রচিত)

যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ও বাংলার নারী

২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
গত ২৫শে মার্চ রাত ১২টা থেকে বাংলাদেশে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছে, সে আন্দোলন আমাদের মুক্তির আন্দোলন, সে আন্দোলন আমাদের বাঁচার আন্দোলন, স্ব-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বর্বর জঙ্গশাহী সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে আমাদের বুকের রক্ত শোষণ করে আমাদের সোনার বাংলাকে নিঃস্ব করে তার বুকে মেরেছে ছুরি। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশকে তারা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। আমাদের শস্য-শ্যামলা মাকে তারা পরিয়েছে শ্বেত বসন, মাঠের ফসলে জঙ্গীশাহী বিমান থেকে ফেলেছে বিষ। আমাদের ঐতিহ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বৃদ্ধ অধ্যাপকদেরও তারা রেহাই দেয়নি। বিখ্যাত দার্শনিক ডঃ গোবিন্দ চন্দ্রদেবকে বিছানা থেকে পথে টেনে এনে জঙ্গীশাহী তাঁর বুকের উপর করল বেয়নেট চার্জ। এমনি করে মারা হয়েছে মনিরুজ্জামানকে ও আরো অনেককে। জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের ছাত্ররা রাত ১১টার দিকে নিদ্রামগ্ন ছিল। সেই অসস্থায় তাদের উপর চালান হয়েছে মেশিনগান। ঘুম থেকে তারা উঠতে পারেনি। যখন তাঁরা পড়াশুনা করে ঘুমিয়েছিল তখন তাদের মনে ছিল কত আশা, কত স্বপ্ন। কিন্তু না, তারা সেই যে ঘুমিয়েছিল- সে ঘুম তাদের আর ভাঙ্গেনি। তারা আর ঘুম থেকে ওঠেনি, আর উঠবেও না কোনদিন। রোকেয়া হলে রাত ১২টায় জ্বালিয়ে দিল আগুন। ঘুমন্ত হল আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ল। আরো কত হাজার হাজার মানুষকে এই হিংস্র জানোয়ারদের বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। ভাবতে পারেন? কলপনা করতে পারেন? কি নির্মম্ভাবে জঙ্গীশাহী আমাদের রক্ত দিয়ে আমাদের জন্মভুমিকে রক্তস্নান করিয়েছেন ?

হিংস্র পশুর মত টিক্কা খান ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের উপর ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়ে। দম্ভভরে বলেছিল জঙ্গীসর্দার ইয়াহিয়াকে “আমার হাতে ক্ষমতা দাও, আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিক করে দেব।” হ্যাঁ, নেমেছিল সে তার সবটুকু ক্ষমতা নিয়ে, কিন্তু পেরেছিল কি? পারেনি, পারবেও না। ২৪ ঘণ্টা অতীত হয়ে কতদিন পার হয়ে গেল তবুও পারেনি। শেষ পর্যন্ত হালে পানি না পেয়ে হাল ছেড়ে পালিয়ে গেল। এবার আর এক মিরজাফর

<005.007.204>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ক্ষমতা হাতে নিয়ে বসেছে গদিতে। দেখা যাক কদিন এর আয়ু? এই কদিনেই ডাঃ মালিকের অবস্থা হয়েছে ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি।

যাক সে কথা। জঙ্গী সরকার যেভাবে আমাদের অগণিত মা-বোনদের নিঃস্ব করে গৃহছাড়া করেছে আমাদের ভাইকে হত্যা করেছে, আমাদের বোনকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে-সেই হানাদারদের আমাদের দেশ থেকে নির্মুল করতেই হবে। আজ আমাদের দেশে যে সংগ্রাম চলছে সে হল মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই সংগ্রামে আমাদের অর্থাৎ নারীদেরও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যেমনভাবে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছে আমাদের ভাইয়েরা। ভাইয়েদের সাথে আমাদের হাতে হাত মেলাতে হবে। এখন দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের আজ ঘরে বসে থাকলেও চলবে না। তোমারা এস- এগিয়ে এস- আজ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমাদের ভাইয়ের মত আমরাও মেশিনগান-মর্টার হাতে নিয়ে শত্রুনিধনযজ্ঞে অংশগ্রহণ করি। আমাদের এগিয়ে আসতেই হবে। বোনেরা আমার এগিয়ে এস। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আমরা কেন ঘরে থকব? মহাবিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তোমরা কেন ঘরে থাকবে? পথে নামো। আজ আমাদের ঘরে থাকার দিন নয়, আমাদের সামনে আজ বহু কাজ। ঝাঁসির রানীর বাহিনীর মত আমাদেরকেও সেনাবহিনী গঠনে অগ্রণী হতে হবে। আমাদেরকে নার্সিং-এ অংশগ্রহণ করতে হবে আহত ভাইদের সুস্থ করে তাঁদেরকে আবার দেশমাতৃকার বন্ধনমোচনে পাঠাতে হবে। যেদিন দেশমাতৃকাকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করতে পারব- সেদিন আবার আমরা আমাদের ঘর আলোকিত করব-আবার স্বপ্নের জাল বুনব। শুধু বোনদেরই এগিয়ে আসলে চলবে না। মায়েদেরও এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে। মায়েরা তাঁদের সন্তানকে উৎসাহিত করবেন এই মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে। এই সংগ্রাম আমাদের সকলের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমন্ত্রে আমাদের সকলকে দীক্ষিত হতে হবে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় আমাদের হবেই। আমাদের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না। (মিস ডলিনাথ রচিত)

সাংবাদিক স্বাধীনতা ও হানাদার অধিকৃত বাংলাদেশ
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

……সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পকিস্তানের বিগত চব্বিশ বছরের ইতিহাস মানবসভ্যতার ক্ষেত্রে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। এই দীর্ঘ চব্বিশ বৎসর যাবৎ পশ্চিম শাসক ও শোষক গোষ্ঠী তাদের শ্রেণী:স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বার বার শুধু জনগণের কণ্ঠই রোধ করেনি অধিকন্তু জনগণের অন্তরে আশা ও ভাষার মূর্ত প্রতীক নির্ভীক মুখপত্রগুলোর উপরও চালিয়েছে বিবেকহীন ধারলো কাঁচি।
১৯৯৪ সন থেকেই পশ্চিমা শাসক ও শোষক গোষ্ঠী অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই পথটি বেছে নেয়। শুধু তাই নয়, নিজস্ব স্বার্থে তারা জনগণের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির উপরও জঘন্য হামলা চালিয়েছে। বাংলাদেশ তার অনন্য শিকার। আর সেই শাসকচক্র বাংলাদেশে তাদের অন্যান্য রাজনৈতিক দালাল গোষ্ঠীর মতোই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও কিছু তোষামদকারী ও চাটুকারের দল খুঁজে পেয়েছিল। নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ

<005.007.205>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

করার জন্য তারা সব সময়ই জনগণের স্বার্থকে নিদারুণভাবে বলি দিয়ে গেছে। অপরদিকে স্বীয় স্বার্থের প্রতি নজর দিয়ে যারা শোষিত জনগণের অন্তরের কথাকে তুলে ধরতে চেয়েছিলো, তাদের ভাগ্যে জুটেছে সীমাহীন অত্যাচার, লাঞ্ছনা ও চরম দারিদ্র।
বিগত চব্বিশ বছরে বাংলার জনগণের প্রিয় মুখপাত্র দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও জনতার আরো কয়েকটি পত্রিকা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সে সমস্ত দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকের সেদিনকার সে দুরবস্থা কোনদিনই ভোলার নয়। তবু তারা হার মানেনি কোনদিন ষড়যন্ত্রকারীদের কাছেসকল প্রকার দুঃখ-দারিদ্র, জেল-জুলুম, অন্যায় ও নির্যাতনের কাছে। সত্য ও ন্যায়ের পথে তাঁরা ছিল একাত্ম এবং সোচ্চার। অগ্নিক্ষরা ছিল তাঁদের লেখনী।
সরকারী বিধিনিষেধ, জেল-জুলুম এবং সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়াও পশ্চিমা শাসক ও শোষক পদলেহী বিছুসংখ্যক এদেশীয় পত্রিকার মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক তাঁদের প্রভুদের চেয়েও কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ক্ষেত্রে অনেক বেশী বর্বরতার পরিচয় দিয়েছেন।…….. তাছাড়া স্থাবর ও অস্থাবরসহ প্রায় কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে। মালিকপক্ষ ছাড়াও বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কয়েকজন লোক অপ্রয়োজনীয় আগাছার মতো সম্পাদকের আসন গেড়ে বসে আছেন- যারা সবসময়ই জাতীয় স্বার্থ, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে সর্বপ্রকার শোষণ, শাসন ও নির্যাতন চলাকালেও একতা, সংহতি ও ইসলামের জিগীর তুলে বাঙালী জাতির ন্যায্য অধিকারকে নির্দয়ভাবে চাপা দিয়ে গেছেন।…….
এছাড়া বাংলাদেশের বাইরে- পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সব সম্পাদক এবং সাংবাদিকই ‘পাকিস্তান টাইমস’ এর দীর্ঘস্থায়ী সম্পাদক জেড, এ, সুলেরীর চেয়ে গুরুত্বের দিক থেকে কোন অংশেই কম নয়। অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বাঙালী জাতিকে দাবিয়ে রাখার ব্যাপারে তিনি তার লেখনীতে সর্বপ্রকার ছলা, কলা ও ভণ্ডামির আশ্রয় নিতে কোনদিন কার্পণ্য করেননি।

সারা বাংলাদেশ আজ একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দিকে দিকে জ্বলে উঠেছে মুক্তির লাখো কোটি মশাল। তার আগুন স্ফলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার দিকে দিকে। স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অগণিত বাঙালী শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীর দল। তারা প্রত্যেকেই আজ এক-একটি মুক্তিসেনায় পরিণত হয়েছে। জীবনকে বাজি রেখে তারা লড়ে যাচ্ছে মুক্তির জন্য। দুর্জয় সাহসে অপ্রতিরোধ্য গতিতে শত্রুর উপর আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছে। সে আক্রমণে পশ্চিমা জঙ্গীশাহীর তখতে তাউস কেঁপে উঠেছে।
এ মুহুর্তে কি করছেন শত্রুকবলিত আমাদের বাংলাদেশের সাংবাদিকরা? কি আজ তাদের নৈতিক এবং ঐতিহাসিক দায়িত্বে? বিবেকসম্পন্ন মননশীল সেসব সাংবাদিককে কোনকিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ, বাংলাদেশের বিগত চব্বিশ বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাসে তাদেরও ছিল একটি সংগ্রামী ভূমিকা। কিন্তু আজ যখন তারা সম্পূর্ণ পরাধীন-বিবেক যেখানে বিধিনিষেধের বাহুল্যে ক্ষতবিক্ষত- চোখের সামনেই যেখানে ২৫শে মার্চের পর একমাত্র বাঙালী সংবাদ সরবরাহ সংস্থা বলেই Eastern News Agency- কে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ENA ছাড়াও দি পিপল, সংবাদ, স্বরাজ, বাংলার মুখ, একতা, স্বাধিকার, বাংলার বাণী, গণশক্তি, গণবাণী, হলিডে, এক্সপ্রেস ও আরও অনেকগুলো দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা বাঙালী জাতীয়তাবাদ, আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও তাদের সংবাদকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এহেন অন্যায়কে তারা কিভাবে সহ্য করে যাচ্ছেন? শুধু তাই নয়- হানাদার এহিয়া সরকারের সর্বৈব মিথ্যা সংবাদ কিভাবে তারা দিনের পর দিন প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন? আমরা জানি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা। তবুও বলবো, আজ যারা বাংলাদেশের নির্যাতিত ও শোষিত জনগণ এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তারা তাদের

<005.007.206>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

চেয়েও কি মানসিক দুরবস্থায় আছেন। হার না মানা সেসব বিবেকসম্পন্ন সাংবাদিকরা তো মরে যান নি! মুক্তিপ্রত্যাশী সেসব সাংবাদিকরা দুর্বার আকাংক্ষা নিয়ে এখনো জনগণের সংগ্রামী চেতনা ও মনোবল যোগানোর জন্য লেখনীতে অগ্নি ঝরিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালী জাতি তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা কোন দিনই ভুলে যাবে না। মুক্তিসংগ্রামে তাদের অমূল্য অবদান অমর ও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাঙালী জাতির সংগ্রামী চেতনার এবং ইতিহাসে ।
পশ্চিমা হানাদার বাহিনী- যারা পৃথিবীর বুক থেকে বাঙালী জাতিকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন- যাদের আক্রমণে ১৪ লক্ষ নিরস্ত্র লোক নিহত- যাদের অত্যাচকারে ৯০ লক্ষ নিরপরাধ, নিঃসহায় মানুষ নিজেদের আবাসভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে- তাদের ক্ষমা নেই। বাঙালী জাতি তার সমুচিত প্রতিশোধ নিতে আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুধু তাই নয়- বাংলাদেশের যেসব পত্রিকা মালিকপক্ষ ও সাংবাদিক গোষ্ঠী আজো সেই নরঘাতক ঔপনিবেশিক সরকারের নারকীয় কার্যক্রমকে সহায়তা করছেন এবং মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন তাদেরও ক্ষমা নেই। সেদিন খুব বেশী দূরে নয়। এর যথাযোগ্য প্রতিদান তারা পাবেনই। পশ্চিম পাকিস্তানে কোনদিনই তাদের ঠাই হবে না। আত্মশুদ্ধি এবং দোষ স্থলনের পথ এখনো খোলা আছে। আমরা তাদের সংগ্রামী আহবান জানাই তারা যেন হানাদার এহিয়া সরকারের তাঁবেদারী ও দালালী ত্যাগ করে, এখনো জনগণের মুক্তিসংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করতে এগিয়ে আসেন।
বাঙালী জাতি হানাদার জঙ্গীশাহীর কোন প্রকার চাতুরিতেই আর বিভ্রান্ত হবে না। তারা জানে বাংলাদেশে অসামরিক পুতুল সরকার নিয়োগ, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও আলোচনার জন্য ভারত সবকারকে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে তাদের আন্তরিকতা ও সততা কতটুকু আছে। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করাই হচ্ছে বাঙালী জাতির শেষ কথা! বাঙালী জাতি তাদের জীবনে আর কখনো ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না, বরং পশুশক্তির সমূলে উচ্ছেদ করাই হচ্ছে তাদের বজ্ৰকঠোর শপথ। সে সংগ্রামে বাংলাদেশের বুদ্ধিদীপ্ত বিবেকসম্পন্ন সাংবাদিক শ্রেণীই বা কেন পিছিয়ে থাকবেন। বাঙালী জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে তাদেরও একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। আজ যখন সে দিন অত্যাসন্ন তখন দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য বিনা দ্বিধায় তাদের এগিয়ে আসা উচিত। পূর্ব দিগন্তে উদীয়মান মুক্তিসূর্যের দীপ্ত আভাস ফুঠে উঠেছে। তাকে জীবন্তভাবে প্রকাশের মাধ্যমে জনগণ ও বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরার অনেকটা দায়িত্বই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের উপর ন্যস্ত।

(গাজীউল হাসান রচিত)

আমরা তাদের ভাতে মরবো

১অক্টোবর, ১৯৭১
রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে দিয়ে জিন্না এভিনু হয়ে ফকিরাপুল আমার গন্তব্যস্থল। রেলওয়ে হাসপাতাল পেরিয়ে শ’দুয়েক ফুট যাওয়ার পরই রাস্তার ডান দিকের টেলিফোন ভবনের স্থানে মেশিনগানের ট্রিগারে হাত দিয়ে শুয়ে থাকা কয়েকজন সৈনিক দৃষ্টিগোচর হবে। জানোয়ারের রুক্ষ হিংস্রতা নিয়ে তারা অদৃশ্য শত্রুর দিকে নিশানা করে রয়েছে। এ ছাড়াও টেলিফোন ভবনের চারদিকে প্রকাশ্য ও গোপন জায়গা থেকে প্রহরারত রয়েছে আরও শ’খানেক সৈনিক। দেহের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তারা সশস্ত্র। কিন্তু টেলিফোন ভবনের মূল ফটকে অস্ত্রের সমাবেশ বেশী চোখে পড়বে না। সেখানে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল হাতে কয়েকজন অবাঙালী মোহাজের

<005.007.207>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রাজাকারকে দেখা যাবে। তাদের চোটপাট দেখার মতো। টেলিফোন ভবনে ঢুকতে প্রত্যেককেই তল্লাশী করা হয়। শার্টের কলার থেকে শুরু করে দেহের বিভিন্ন অংশে নিষ্ঠার সাথে বোমা, অটোমেটিক সমরাস্ত্র, এসিডের বোতল রয়েছে কিনা পরখ করে দেখা হয়। এ টেলিফোন হাউজ তাদের রক্ষা করতেই হবে। কারণ এ ভবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বিকল হলে পশ্চিমের সাথে পূর্বের তার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অবশ্য এ ব্যবস্থা বিকল হলে একমাত্র ভরসা থাকবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ওয়্যারলেস সিস্টেম। আমি বাসা থেকে যে রিকশায় উঠেছিলাম তার চালকের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ দাড়ির অর্ধেকেরও বেশীতে সাদা ছাপ লেগেছে। রিকশায় উঠে বসার পরেই হঠাৎ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস কজরলেন, “বলতে পারেন সাহেব, এটা কার দেশ?” আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম। রিকশাওয়ালার বললেন, “এটা হারামজাদা বদমাশ পাঞ্জাবীদের দেশ, না মানুষের দেশ?” আমি চারদিকে তাকিয়ে আস্তে কথা বলতে অনুরোধ জানালাম। বুড়োর দু’চোখে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে। বুড়োর কাহিনী হলোঃ পাঁচদিন রিকশা চালিয়ে সঞ্চয় করেছিলেন তের টাকা। একটি ছোট্ট কাপড়ের থলেতে তার জীবনের নিঃশ্বাসের মতো মূল্যবান সঞ্চয়গুলো গোপন করে রেখেছিলেন। মালীবাগের কাছে মোড়ে এক পাঞ্জাবী বর্বর সৈন্যের লোভের লুটেরা হাত তার সে সঞ্চয় কেড়ে নিয়ে গেছে। মনেও দয়া হতো। কিন্তু তার মনে দয়া নেই। আবার রাইফেল উঠানোর পর থলে থেকে আমার সঞ্চয় তাকে দিয়ে দেই। বলতে পারেন সাহেব, আর কতদিন এ ভাবে চলবে? আল্লার গজব পড়বে না। তাদের ওপর! আল্লা আর কত সহ্য করবে? হে খোদা, তাদের ওপর তোমার গজব নাজেল করো।” বুড়ো এরপর থেমে গিয়ে একমনে রিকশা চালাতে শুরু করলেন। এ তো শুধু বুড়োর অভিযোগ নয়। রাস্তা থেকে পথচারীদের হাতের ঘড়ি খুলে নেওয়া, পকেট হাতড়িয়ে টাকা-সিগারেট বের করে নেয়া তো সাধারণ ব্যাপার। একটি দেশের আসতে দেখলেই হাতের ঘড়ি, চোখের গগলস খুলে পকেটে লুকিয়ে রাখা তো সাধারণ ঘটনা। দু-এক টাকার বেশী পকেটে নিয়ে কেউ রাস্তায় বেরোয় না।
টেলিফোন ভবনের সামনে আসার পর দেখলাম একটি কিশোরের দেহ জনৈক রাজকার তল্লাশী করছে। কিছু না পেয়ে পকেট থেকে কলম নিয়ে ক্যাপ খুলে নাকের সামনে তুলে তা পরীক্ষা করে দেখলো। উর্দুভাষী লোকজন এ অপমানজনক তল্লাশী ব্যবস্থা থেকে নেহাই পাচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তো তারাই। তারাই মালিক-মোখতার।
এ টেলিফোন ভবনের অভ্যন্তরে ২৫শে মার্চ রাত বারটায় এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। রাত বারটা বাজার কয়েক মিনিট আগে হিংস্র হায়েনার ক্ষিপ্রতা নিয়ে একদল রক্তলোলুপ এ্যালসেসিয়ান টেলিফোন ভবনের কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়ে। কন্টোল রুমে কয়েকজন বাঙালীর ডিউটি ছিল। বাইরের হত্যাকাণ্ডের খবর সম্পর্কে তারা কিছুই জানতো না। অন্যান্য দিনের মতোই সেদিন রাতেও তারা ডিউটি করছিলো। আওয়ামী লীগের নির্দেশ মোতাবেক যা করার সে কাজই করছিলো। হাতে সমরাস্ত্র নিয়ে রক্তখেকো কুকুরগুলো সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে তাদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই মনে করে কয়েকজন কর্মী কন্ট্রোল রুমের যন্ত্রপাতি চোখের পলকে যতদুর সম্ভব বিনষ্ট করে দেয়।
এর ফলেই ঢাকা শহরের সব বেসামরিক টেলিফোন ২২ দিনের মতো অকেজো ছিল।
হঠাৎ কি মনে করে গুলিস্তান এলাকায় রিকশা ছেড়ে দেই। দিনের বেলাও চারদিকে থমথমে ভাব। এখানে কয়েকটি পশ্চিম পাকিস্তানী রেডিমেড শার্ট বিক্রির দোকান রয়েছে। দু-একটা দোকান ঘুরে দেখলাম। মালিক মুখে হাত দিয়ে বসে রয়েছে। বিক্রি নেই। একজন দোকানদারের সাথে পরিচয় ছিল। তাই কণ্ঠে সহানুভূতির

<005.007.208>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রেশ নিয়ে বেচাকেনার খবর জিজ্ঞেস করলাম। উর্দু ভাষা ব্যবহার করলাম। কারন উর্দুভাষী দোকানদারদের সাথে বাঙালীর বাংলা ভাষায় কথা বলাও প্রায় দেশদ্রোহিতার শামিল। কোন অবস্থাতেই অধিকৃত এলাকায় বাঙালীতু প্রকাশ পায় এমন কিছু করা হারাম। প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে।

‘বেচাকেনা কেমন চলছে’ প্রশ্নের উত্তরে দোকানদার যা বললো তার সারমর্ম হচ্ছে-কোন বাঙালী পাকিস্তানী কাপড় কেনে না, আর অবাঙালীরাও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অর্থ ব্যয় করতে চাচ্ছে না।
এরপর গেলাম বায়তুল মোকাররম ও ষ্টেডিয়ামের একটি শাড়ির দোকানে। দোকানদার বললো, তাঁতের শাড়ি কিছু বিক্রি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাড়ি সারা দিনে একটিও বিক্রি হয় কিনা সন্দেহ।
দখলীকৃত এলাকার আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত কোটি কোটি বাঙালী ইয়াহিয়াশাহীর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের এমনি প্রাচীর সৃষ্টি করে চলেছেন। এমনিভাবে কোটি বাঙালী জনতা বাঙালী জাতীয়তাবাদের উদগাতা শেখ মুজিবের সেই ঐতিহাসিক আহবান ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো’ বাণীকে বাস্তবায়িত করছেন।

(ইলিয়াস আহমদ ছদ্মনামে সলিমুল্লাহ রচিত)

যুদ্ধই একমাত্র পথ

১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ যুদ্ধ করছে। প্রতিদিন তারা শত্রুর সঙ্গে লড়ছে পাঞ্জা। তাদের কাছে একথা স্পষ্ট যে, যুদ্ধ ছাড়া স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। একই সঙ্গে বাঙালীরা ইতিহাসের এ-সত্যও উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, কোন স্বাধীনতাই অল্প কয়েকদিনের যুদ্ধে অর্জন করা যায় না। কোন দেশে কোন কালে তা সম্ভব হয়নি। সুতরাং আমাদের আবেগ যতই তীব্র হোক না কেন, সত্যকে, অভিজ্ঞতাকে, বাস্তবকে, যুক্তিকে, অস্বীকার করা উচিত নয়, সম্ভবও নয়। যুদ্ধের প্রথমদিকে, আমরা প্রচণ্ড আবেগে বার বার মনে করেছি দু-একদিনের মধ্যেই আমরা সৈন্যবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে পারবো, কিন্তু এখন আমরা অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, যুদ্ধের বাস্তব কলাকৌশল শিখেছি, এখন আমরা যুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পেরেছি-তাই আমরা জানি যুদ্ধ শুধু আবেগের ব্যাপার নয়, যুদ্ধ যুক্তির ব্যাপার, পরিশ্রমের ব্যাপার, বুদ্ধির ব্যাপার, জীবন উৎসর্গ করার ব্যাপার। শুধু আবেগ থাকলেই যুদ্ধ জয় করা যায় না। কারণ তাহলে এতদিনের বাংলাদেশে হানাদারদের অস্তিত্ব থকতো না। যুদ্ধ শুধু অস্ত্রেরও ব্যাপার নয়, কারণ তাহলে এতদিনের মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়তো না। যুদ্ধজয়ের জন্য পারিপার্শ্বিকতার সাহায্য লাগে। যে মাটির উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হয় সেই মাটির সমর্থন, যে মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হয় সেই মানুষের সমর্থন- এ দুটোই হানাদারদের বিরুদ্ধে, আর এ দুটোই আমাদের পক্ষে। কিছু পিছনে তাকালে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাবো যে, আমাদের পাওনা আদায় হবে। দেশের লোক বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্যই শেখ মুজিবুর রহমানকে ভোট দিয়েছিল। শেখ মুজিব আশা করেছিলেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনাসাধারণের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত দেশবাসী সেই আশাই করেছিল। দেশের মানুষ বুঝতে পারেনি যে, ধীরে ধীরে তারা এক চরম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার

<005.007.209>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হতে যাচ্ছে। সে কথা বুঝতে পারলে আমরাই সর্বপ্রথম তাদের ওপর আঘাত হানতে পারতাম। সমস্ত পরিস্থিতিই আমাদের অনুকূলে ছিল। বেসামরিক শাসনব্যবস্থা, বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী ও বাঙালী সৈন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে শেখ মুজিব সেনানিবাসে আবদ্ধ পাকিস্তানী, সৈন্যবাহিনীকে সহজেই ধ্বংস করে দিতে পারতেন। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও যুদ্ধ, যশোরের পরিস্থিতি ও যুদ্ধ ও রংপুর-রাজশাহীর পরিস্থিতি ও যুদ্ধ এবং সিলেটের পরিস্থিতিও যুদ্ধ যাঁরা দেখেছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা সহজেই বুঝতে পেরেছেন যে, বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারকারীদের ধ্বংস করার জন্য কেবল প্রয়োজন ছিল পূর্বপ্রস্তুতির। উপযুক্ত প্রস্তুতির নাম অর্ধেক যুদ্ধজয়। চট্টগ্রামের সেনানিবাস থেকে ২৫শে মার্চের আগেই শত শত বাঙালী সৈন্যকে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দেয়া হয়, বহু বাঙালী সৈন্যের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। অথচ সে পথ বন্ধ করতে পারলে, চট্টগ্রামে ও চালনা বন্দরে দূরপাল্লার কামনা বসাতে পারলে ও বিমানবন্দর দখল বা অকেজো করে দিতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা সম্পূর্ণ শক্তিহীন হয়ে পড়তো। কিন্তু আমরা কেন তা করিনি? কেন আমরা হানাদারদের তৈরি হওয়ার সুযোগ দিলাম? কেন আমরা অসহায়ের মতো তাদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হোলাম? এর তত্ত্বগত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা না করেও বলা যায় যে, জনসাধারণ নেতৃবৃন্দের মতো আশা করেছিলো আলোচনাই একমাত্র পথ।

আমাদের ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা বুঝতে পেরেছি, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক শাসকবৃন্দ এবং সামন্তপ্রভূ ও বড় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে শোষণ করা বন্ধ করতে পারে না। ছয়-দফা বাস্তাবায়িত হলে শোষণের পথ বন্ধ হয়ে যেতো। শেখ মুজিব বার বার চেয়েছিলেন যে-কোন প্রকারে হোক বাংলাদেশকে আর শোষণ করতে দেবো না, বাংলাদেশকে শোষণ করার পথ বন্ধ করতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গণতন্ত্রের ভক্ত শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক পথই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব যেমন বলেছিলেন কিসের গোলটেবিল, কার সঙ্গে গোলটেবিল, আজ দেশের সাধারণ মানুষও বলছে ‘কার সঙ্গে গণতন্ত্র? পশ্চিম পাকিস্তানী কুচক্রীদের সঙ্গে কি গণতন্ত্রের পথে মিত্রতা করা যায়? তাদের একমাত্র উত্তর হচ্ছে যুদ্ধ। যারা হাতে রাইফেল তুলে নিয়েছেন সেই স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধারা আজ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন যে, শত্রুর সঙ্গে কোনরকম আপোষ করা চলে না। বিশ্বাস করার অর্থ অনিবার্য মৃত্যু। শক্রর শেষ রাখতে নেই। শত্রুর বিনাশ সম্পূর্ণ না হওয়ার পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা তাই নিশ্চিন্ত হতে পারে না। একাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ করে আমি জানতে পেরেছি যে, তারা সবাই দুটি সত্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। একঃ শত্রুকে ছোট করে দেখতে নেই। নিউইয়ক টাইমস’ পত্রিকাই বলেছেন, প্রথম ৪৮ ঘন্টার মধ্যে হানাদররা ৩ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করেছে। এর দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের ধ্বংস করার ক্ষমতা বোঝা যায়। আধুনিক অস্ত্র যেমন এদের রয়েছে তেমনি মনের দিক থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে বাঙালী-বিরোধী। তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, বাঙালীরা ছোট জাত, তারা শাসিত হতেই জন্মেছে, তাদের বিশ্বাস করা যায় না। সাধারণ সৈনিকদের এই মজ্জাগত ধারণার জন্যই তারা দুঃসাহসী হয়ে ইয়া আলী” ধ্বনি দিতে দিতে যুদ্ধের মধ্যে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় ও এগিয়ে আসতে চেষ্টা করে এবং আমাদের সাহসী বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধাদের ভেঙ্গে পড়েছে, তবু জয় নিশ্চিত জেনেও শত্রুকে খাটো করে দেখা চলে না। দুইঃ শক্রকোনদিনই অপরাজেয় নয়। কারণ শত্রু রয়েছে অন্যায়ের পক্ষে, অসত্যের পক্ষে, সাধারণ মানুষের বিপক্ষে। আমরা রয়েছি সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, জনসাধারণের স্বার্থের পক্ষে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ কোনদিনই পাক-সেনাদের অন্যায়ের পক্ষে সমর্থন জানাবে না। কিছু দালাল যা গজিয়েছে তা নতুন কিছু নয়। কারণ ফ্রান্সের মতো দেশেও হিটলার মার্শাল পেতার মতো বন্ধু খুঁজে পেয়েছিল। সুতরাং দালাল নতুন কোন ব্যাপার নয়। তাছাড়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দালালরা আসলে সুবিধাবাদী। হাওয়া ঘুরেছে বুঝতে পারলেই তারা তাদের ভোল পাল্টে ফেলবে। সুতরাং বিদেশে দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থনশূন্য পাক-সেনারা চরমভাবে পরাজিত হবেই। আঘাতের পর আঘাত হানলে পাহাড়ও ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ইতিহাসের শিক্ষাই তাই। সুতরাং আঘাতের পর আঘাত হানতে হবে।

<005.007.210>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আজ যারা যুদ্ধ করছে তারা কি কোনদিন যুদ্ধ করেছিল? তাদের কি যুদ্ধের কোন অভিজ্ঞতা ছিল? তাদের হাতে কি আগের থেকেই অস্ত্র ছিল? এর উত্তর হচেছ- না। কিন্তু তবু কেমন করে যুদ্ধ চলছে, কেমন করে অস্ত্র এলো? এর উত্তর হচ্ছে- যুদ্ধ করতে চাইলে,স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে চাইলে অস্ত্র এসে যায়, যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও হয়, যুদ্ধ জয়ও হয়। আলজিরিয়া তর প্রমাণ, ভিযেতনাম তার প্রমাণ। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ইচ্ছাটাই বড় কথা।

আমাদের যোদ্ধারা, যুবকেরা বার বার বলেছেন যুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত করবো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের ঘটনাবলী বিচার করছেন, সে ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন আকর্ষণ নেই। তাঁরা বলছেন, আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো, যাচ্ছি। আমাদের নেতারাও সেই কথা বলেছেন। কারণ, তাছাড়া বাংলাদেশের শোষণ বন্ধ হওয়ার আর কোন পথ খোলা নেই। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ শোষিত হয়েছে। তাদেরকে শোষণমুক্ত করতে হলে যুদ্ধই একমাত্র পথ। শেখ মুজিব শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার একমাত্র নাম যুদ্ধ। আমাদের যুবকরা প্রাণ দিয়ে শোষণের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিতে আজ বদ্ধপরিকর। দেশের মানুষ চায় বাংলাদেশের টাকা বাংলাদেশে থাকবে, আমরা সবাই সেই টাকা সমানভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবো। কেউ যেন বলতে না পারে, আমি আমরা ভাগ পাইনি, আমি ব্যথিত, আমি শোষিত। সুতরাং সেই মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে, আমাদের যুদ্ধ করে যেতে হবে। এ ব্যাপারে যারা সাহায্য করবে তারাই আমাদের বন্ধু।

(‘জাফর সাদেক’ ছদ্মনামে মোহাম্মদ আবু জাফর রচিত)

কয়েকটি ছবি- একটি ইতিহাস

৩ নভেম্বর, ১৯৭১

– কি ভাই, কি দেখছেন? ও, ছবিগুলো? আচ্ছা দেখুন। একের পর এক ছবিগুলো দেখে যাচ্ছিলাম আমি।

প্রথম ছবিটি একটা তুলসী গাছের। অবশ্য এতে দেখার কিছু নেই। শুধু উপলব্ধি ছবিটি তোলা হয়েছিলো ১৩ই এপ্রিল। ময়মনসিংহ শহরের কোন এক হিন্দুপারা থেকে। ক্ষতবিক্ষত একটি দোতলা দালানের পাশে দেখা যাচ্ছে গাছটি, বোবার মতো দাঁড়িয়ে। বাড়িতে কোন লোকজন নেই। হয়তো তাদের সবাই প্রাণ হারিয়েছে পাকস্তানী সৈন্যদের মেশিনগানের গুলিতে। অথবা সবাই প্রাণভয়ে পালিয়েছে ওপার বাংলায় শরণার্থী হয়ে। ছবিটি দেখে মনে হচ্ছিলো, কেউ আর মাথা নীচু করে, নতজানু হয়ে পূজা দেবে না সকাল -সাঁঝে-তুলসী তলায় বসে প্রার্থনা জানাবে না হরি-মাধবের কাছে আর কোনদিন।

দ্বিতীয় ছবিটি কোন এক নবদম্পতির-মুখোমুখি অবস্থায়। তবে জীবিত নয়, মৃত। হাতে মেহেদীর কাঁচা রং। তরুণের মুখটা থ্যাবড়া হয়ে গেছে-চেনার জো নেই। তরুণীর বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গেছে-টকটকে লাল রক্তিম কলজেটা দেখা যায় শুধু! এদের বিয়ে হয়েছিলো ২৪শে মার্চ। আর ছবিটি তোলা হয়েছিলো ২৬শে মার্চ-ঢাকা মিটফোর্ড থেকে। ২৫শে মার্চ গভীর রাতের নির্জন নিস্তব্ধতায় এ নবদম্পতির মাঝে ছিলো এক মধুময় পরিবেশ। কিন্তু অকস্মাৎ গর্জে উঠলো পশ্চিমা বর্বর সেনাদের কামান। মুহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল ওরা। চিরদিনের মতো নিঃশেষ হলো ওদের পরস্পরের সকল চাওয়া-পাওয়া।

<005.007.211>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

তৃতীয় ছবিতে বুড়ীগঙ্গার সীমাহীন জলরাশি। একটি বৃদ্ধ সাঁতরে যাচ্ছেন প্রাণপণে। কিন্তু জানা নেই কোথায় যাবে, কখন যাবে বা আদৌ কোথাও গিয়ে উঠতে পারবে কিনা। ছবিটি ২৯শে মার্চ সকালে তোলা। হয়তো এ বৃদ্ধ ছিল রাজধানীর কোন এক ঝাড়ুদার, সরকারী অফিসের পিয়ন, নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী- নতুবা কোনমতে রক্ষা পেয়ে অতি সন্তপণে পালাচ্ছেন। শহর ছেড়ে, তার সর্বস্ব ত্যাগ করে। হয়তো চলে যাচ্ছেন কোন এক দূরপল্লীতে, অথবা অতি কষ্টে দেশ ছেড়ে বিদেশে। যেখানে আর দেখা যাবে না পশ্চিম জল্লাদ বাহিনীর চেহারা- শোনা যাবে না সন্তানহারা জননীর অথবা বেয়নেট উচিয়ে আসবে না কেউ হৃদপিণ্ডটি বিধে ফেলতে।

এটি চতুর্থ ছবি। তোলা হয়েছিলো ২৭শে এপ্রিল ভৈরবের পুলের উপর থেকে। ছবিতে অসংখ্য মরা লাশভেসে যাচ্ছে নদীর স্রোতে। কে জানে কতদিন এরা নদীতে ভেসে চলেছে এমনি করে। ফুলে ওঠা বীভৎস দেহ ওদের। কতকগুলো কাক-শকুন বসে আছে এদের উপর।

এর পরের ছবিটি তোলা হয়েছিল কুমিল্লা শহরে। ৪ঠা মে সকালে। ছবিটির একপাশে দেখা যাচ্ছে একদল লোক লুট করছে দোকানের মাল। অপর পাশে খাকী পোশাক পরা একজন লোক ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছেঃ ঠিক এর পরে ছবিতেও এরাই। ব্যতিক্রম শুধু এ্যাকশনে। কারণ এটিতে লুটেরার দল হ্যাণ্ডস-আপ হয়ে একলাইনে দাঁড়িয়ে। আর সেই ক্যামেরাম্যান ষ্টেনগানের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে তখনও অপেক্ষমাণ । হয়তোবা কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রিগারে চাপ পড়বে। কড় কড় করে উঠবে ষ্টেনগান। অসহনীয় যন্ত্রণায় গড়াগড়ি দিতে থাকবে লুটেরার দল। এরপরের দৃশ্যে হয়তোবা এরা পড়ে থাকবে অবাঞ্ছিত আৰ্বজনার মতো কপালে হাত রেখে। ওদের প্রাণবায়ু তখন অনন্ত অসীমের সন্ধানে উর্ধ্বগামী।

এবারের ছবিতে ছনের ছাউনি দেয়া একটা ঘর। দুটো কুকুর মুখোমুখি বসে। মনের সুখে লেজ নাড়ছে ওরা। আর একটি ছাগল ওদিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইস। এ ঘরটা তৈরি না হলে বেচারা ছাগল আর এ কুকুর দুটো ভর দুপুরের এ কাঠফাটা রোদে কি মুসকিলেই না পড়তো। ছবিটি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি পাক জঙ্গীশাহীর কোন এক অভ্যর্থনা শিবিরের সম্মুখভাগ থেকে নেয়া। কিছুদিন আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এ অভ্যর্থনা শিবির। শক্র কবলিত ঢাকা বেতার অহরহ মিনতির ফাঁদ পেতে চাইছিলো শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু এতোই দুর্ভাগ্য যে, কেউ গেলো না পাক-জঙ্গীশাহীর অভ্যর্থনা কুড়াতে, এতো সাধের শিবিরে এক রাত ঘুমাতে, বিষ মেশানো তাদের দুধ-কলা খেতে।

এ ছবিটি একদল তরুণ রাইফেল হাতে ট্রেনিং নিচ্ছে। চেহারায় তাদের দারুণ জিজ্ঞাসার ভাব। চোখে সংগ্রামের সীমাহীন দীপ্তি হয়তো এরাই হবে বাঙালী মুক্তিবাহিনী। উপযুক্ত শিক্ষা নিয়ে আক্রমণ চালাবে গেরিলা কায়দায়, নতুবা অবতীর্ণ হবে সম্মুখসমরে। আজ হোক বা কাল হোক বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করবেই এরা। মায়ের বুকে ফিরে আসবে সান্তুনা-প্রিয়ার মুখে হাসি। ছবিটি তোলা হয়েছিল বাংলাদেশের কোন এক মুক্ত এলাকা থেকে।

এর পরের ছবিতে পাক-তস্করদের ২০টি শবদেহ পড়ে আছে বুলেটবিদ্ধ হয়ে। বঙ্গশার্দুল মুক্তিসেনাদেরই এ কাজ হয়তোবা এদের কোন এক গেরিলা ইউনিট লুকিয়ে ছিলো ঝোপের আড়ালে , টহলদার পাকসেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছিলো ওরা। শত্রুকে সম্পূর্ণ খতম করে ওদের অস্ত্র-গোলাবারুদ দখল করে নিয়ে নিমিষেই উধাও হয়ে গিয়েছিলো ওরা। আর পাক-সেনারা পড়ে রইলো বাংলার কুকুরশেয়ালের খাবার হিবেবে। ছবিটি তোলা হয়েছিল পূর্ব রণাঙ্গনের কসবা এলাকা থেকে।

<005.007.212>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ছবিগুলো দেখা হলে চলে এলাম আমি। পথে এক পা দু’পা করে হাটছিলাম, আর ভাবছিলাম শুধু ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, সে অনেক কথা! হয়তো বন্ধুটি ক্যাপশন লিখবে ছবিগুলোর। এরপর তার এ্যালবামে সাজিয়ে রাখবে একে একে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে। এরপর চলে যাবে এক বছর, দু’বছর- দশ বছর, বিশ্ব বছর বা আরও কয়েক বছর। কিন্তু ছবিগুলো? এগুলো ঠিকই থেকে যাবে এ্যালবামে। এরপর হঠাৎ একদিন এ্যালবামটা পড়বে বন্ধুটির কোন এক ভবিষ্যৎ বংশধরের হাতে। সে ছবিগুলো দেখে যাবে, তা থেকে শিক্ষা নেনে- তরে ঠিক ছবি হিসেবে নয়, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হিসেবে।
(জাহাঙ্গীর আলম রচিত)

মুক্তি সংগ্রামে মায়ের প্রেরণা
৪ নভেম্বর, ১৯৭১

মুক্তাঞ্চলেই মায়েদের সভা ডাকা হয়েছিল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলছিল সভার কাজ। একে একে সবাই বিদায় নিয়ে গেলেন। সারাদিনের খাটুনিতে মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। টেবিলের উপর মাথাটা রেখে চোখ বুজেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ পায়ের শব্দে তাকিয়ে দেখি আনুর মা ভাবী এসে দাঁড়িয়েছেন আমার টেবিলের কাছে।

আমাকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসতে দেখে বললেন, “মাথাটা ধইরছে বুঝি, টিইপ্যা দিমু|” হেসে বল্লাম, “না, তেমন কিছু না, ও এমনি সেরে যাবে।” “না না সরম কইর না, খাডনী পইড়ছে ধরব না ক্যান।” আনুর মা ভাবী সত্যি সত্যি হাত লাগাতে আসছে দেখে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বললাম, “তেমন কিছু মাথা ধরেনি। সভা শেষ হবার পর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। যাক ওসব। আচ্ছা ভাবী সভা তো হলো। সবাইকে বললাম এবং সবাই স্বীকার করলেন প্রত্যেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের জন্য কাপড়, জামা , কাঁথা সেলাই করে দেবেনে। সত্যি, হবে তো?” “অইব না মানে? আইজ থাইক্যা হগলে ল্যাইগা যাইব৷ মুক্তিবাহিনীর ছাওয়ালগুলা আমাগো ছাওয়াল না? ছাওয়ালগো বাঁচান আমাগো ফরজ না?” একটা গর্বিত দীপ্তিতে আনুর মা ভাবীর মুখখানি ঝলমল করে উঠল। মাতৃত্ব ঝরে পড়লো তার কণ্ঠ থেকে। বিস্মিত হলাম এই অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলার তেজস্বিতায়, মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদে। একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাবী, আনুর কোন সংবাদ পেয়েছ?” আনোয়ার ওরফে আনু ভাবীর একমাত্র ছেলে। আর একটি ছেলে ছিলো, নাম হাবিব। কারখানায় কাজ করতো। এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে দু’বছর আগে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়েছে, যার যার স্বামীর বাড়িতে থাকে। আনুই ছিল ভাবীর কাছে। বোশেখের শেষের দিকে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো একটা লক্ষ্মী মেয়ের সাথে। সে বিয়ে আর হতে পারেনি। এরই মধ্যে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী বাংলাদেশের উপর চালিয়েছে নারকীয় আক্রমণ। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে সারাটা দেশ। যে মেয়েটির সথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে খুনী পাকসেনা। মেয়েটির কোন হদিস নেই। আনু তার মাকে নিয়ে চলে এসেছে মুক্তাঞ্চলে, তার মামার বাড়িতে। এখানে এসে আনু শুধু ছটফট করতো আর বলতো, “মা , আমাকেও কিছু করতে হবে।”

ভাবী প্রথমে ছয় পেতেন, আনুকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন- “আমাকে দেখাই তোর এখন ফরজ কাম।” আনুও বেশীকিছু কথা বাড়াতো না।

<005.007.213>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

একদিন আনু ফিরলো বিকেলে। মুখখানা থমথম করছে। মাকে ডেকে বললো, “শুনছ মা, রিজিয়াকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে।” রিজিয়া মেয়েটির সাথেই তা বিয়ে ঠিক হয়েছিল।

আনুর মা ভাবী আফসোস করেছিল সংবাদটি শুনে কিন্তু তার জন্যে আরও কিছু অপেক্ষা করছিল। আনুই বললো, “মা, আমি মুক্তিবাহিনীতে যাবো। রিজিয়াকে উদ্ধার করবো।”

আনু মুক্তিবাহিনীতে যাবে শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন আনুর মা ভাবী। বোকার মত জিজ্ঞেস করলেন, “রিজিয়াকে উদ্ধার কইরা কি কইরবি?”
“বিয়ে করবো, তার দোষ কি মা? আমারই সাথে তার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল। আমারই তাকে রক্ষা করা উচিত ছিল। আমি পারিনি। আমারই দোষ ও যদি বেঁচে থাকে আর ওকে যদি উদ্ধার করতে পারি তবে আমি ওকেই ঘরের বউ করে আনব।” আনু লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলে কথাটি। আনুর মা ভাবী আনুর কথার জবাব দিতে পারেন নি। ঠিকই তো। রিজিয়ার দোষ কি? আজ যদি তার দুই মেয়ের এই অবস্থা হতো? ছেলের কথায় রাগ হয় না। তার – গর্বই হয়। এর কয়েকদিন পরে আনু মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এখন সে আছে পূর্ব রণাঙ্গনে। তারই কুশল জিজ্ঞাসা করলাম ভাবীকে।

“তার লাইগ্যাই ফিরা আইলাম। এইহানে আইবার আগে একখানা চিডি আইছে। তোমর কাছে পইড়া শুনুম বইলা লইয়া আইছি। তোমাগো কথা শুইনতে শুইনতে ভুইলা গেছলাম। মনে হইতে ফিরা আইছি।”
আনুর মা ভাবী তার জামার বুকের ভিতর থেকে একখানা খাম বের করলেন। আটদিন আগেকার লেখা চিঠি। আনু লিখিছেঃ

মা,
কয়েকদিন তোমাকে কোন খবর দিতে পারিনি। কারণ আমাদের দুটো লড়াই লড়তে হচ্ছে। মা, তোমার দুটো ঘাঁটি দখল করেছি। দুটো লড়াইয়ে আমরা ৮১ জন পাকসেনাকে মেরেছি। তোমর দোয়ায় আমাদের কারো গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। জান মা, লড়াইতে যাওয়ার আগে আমি কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে তোমার মুখটা স্মরণ করতাম,আর আমার দেহে শক্তির বান ডাকতো। কেন এমন হয় মা? আমার মনে হয় মায়েরাই সকল শক্তির উৎস। তাইতো আমরা দেশকে মা বলি ডাকি, বলি দেশমাতা। আর একটি খবর বলি মা, একটা ঘাঁটি থেকে আমরা ১৩ জন মেয়েকে উদ্ধার করেছি। বর্বর দস্যুরা ওদের উলঙ্গ করে আটকে রেখে ওদের ওপর বর্বর পাশবিক অত্যাচার করতো। সবগুলো মেয়েই রেজিয়ার বয়সী। উদ্ধার করার পর কি কান্না ওদের। দুইজন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আমিই ওদের বাঁচিয়েছি। জানো মা, ও দুজনের কাছে রিজিয়ার গল্প বলেছি, বলেছি- রিজিয়াকে উদ্ধার করতে পারলে আমি ওকে বিয়ে করবো,সম্মান দেবো। ওরা তাতে কিছুটা সান্তনা পেয়েছে। আমাকে ওরা ভাই ডাকে। ওরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমাদের হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাশ্রূষা করে।
মা, আমার দেশকে যাঁরা ধ্বংস করেছে তাদেরে ধ্বংস করবো। আমরা পশুদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেবো। তুমি দোয়া করো মা। আমরা জিতবো, তারপর একদিন তোমার কোলে মাথা রেখে খুউব করে ঘুমাবো।

ইতি –
তোমার আনু।

<005.007.214>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পড়া শেষ হলো। আনুর মা ভাবীর চোখে থেকে টস টস করে জলে পড়ছে।

“কেদো না ভাবী, আনু নিশ্চিয়ই ফিরবে। মন খারাপ করো না।” আনুর মা ভাবীকে সান্তনা দিতে গেলাম।

“মন খারাপ না। খুশী লাইগতাছে। আনু আমাগো দেশের লাইগ্যা লড়তাছে। এর থাইক্যা খুশীর আর কী অইতে পারে। কারবালায় কাশেমের মা যুদ্ধে যাওনের আগে পাগড়ী বাইন্ধা দিছিলো। আমিও তারে নিজের হাতে কাপড় পরাইয়া দিছি। আনু আমার কাশেম।” চোখের জল মুছে ফেলে আনুর মা ভাবী হাসলেন। তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে একটা স্বগীয় দীপ্তি।………….

(জেবুন্নাহার আইভি রচিত)

মুক্তিসংগ্রাম ও বঙ্গ বীরাঙ্গনা

৫ নভেম্বর, ১৯৭১

নারী জাতির ললাটে গৌরবের টিকা দিয়ে কবি নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন –
যুগে যুগে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।

আজকের যখন বাংলাদেশের এক অন্ধকারময় দুদিনে পশ্চিমা পশুদের বিতাড়নের জন্য দিকে দিকে আমাদের সংগ্রামী যুবকগণ জীবনকে তুচ্ছ করে সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন, তখন বাংলাদেশের মা-বোনেরাও এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পশ্চিম পাকের বর্বর পশুগুলো বাংলাদেশের মা-বোনদের ওপর যে পাশাবিক অত্যাচার করেছে মানবতার ইতিহাসে তার তুলনা নেই। বাংলাদেশের মা-বোনেরা এই অবমাননার কথা কোনদিন ভুলতে পারেন না। তাঁরা দেখেছেন তাঁদের সামনেই সন্তানদের কিরূপ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে- তাঁরা দেখেছেন তাঁদের স্বামীর করুণ মৃত্যু,স্বজনদের রক্তাক্ত নিধন। আর দেখেছেন অসংখ্য মা এবং কন্যার ওপর বর্বরতম পাশবিক অত্যাচার। আজো বোধ করি কয়েক হাজার মা-বোন পশুসৈন্যদের শিবিরে শিবিরে ছাউনিতে ছাউনিতে গ্রানিকর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। আমরা এই করুণ বেদনার কথা ভুলি নাই, ভুলতে পারি নাই। তাই বাংলাদেশের মা-বোনেরাও আজ সংগ্রামের পথকেই বেছে নিয়েছেন।

নারীর স্থান যে শুধু ঘরে নয়, বাইরের জগতেও যে তার সমাজকল্যাণমূলক এবং দেশসেবার প্রচুর কাজ আছে, বাংলাদেশের জাগ্রত নারী সমাজ তা প্রমাণ করেছেন। আজকের মুক্তিসংগ্রামেও বাংলাদেশের ললনাগণ সেই কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে এগিয়ে এসেছেন। আমরা জানি, আমাদের কোন কোন রণাঙ্গনে অনেক উৎসাহী ছাত্রী আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে পাক-সেনাদের খতমের কাজে তাঁদের সংগ্রামী ভাইদের সাহায্য করছেন। কিন্তু নারীর পক্ষে শুধু অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করাই আধুনিক যুদ্ধের বড় কথা নয়-নারীর পক্ষে আহত সৈনিকদের সেবার মাধ্যমে বাঁচিয়ে তুলতে সাহায্য করাও একটি বড় এবং মহান কাজ। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমাদের বহু সক্ষম ছাত্রী ও মহিলা আজ এই সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। ইতিমধ্যেই তাঁদের সেবায় আমাদের বহু সংগ্রামী বাঙালী উপকৃত হয়েছেন।

<005.007.215>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় মেয়েদের জীবন যে কত সমস্যার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে সেকথা ভেবে আমরা বেদনায় অস্থির হই। সেখানে খাদ্যভাব, অর্থাভাব এবং চিকিৎসার নিদারুণ অভাব ছাড়াও রয়েছে নিরাপত্তার অভাব। দখলীকৃত এলাকায় যে-কোন মুহুর্তে যে কোন স্থানে পশ্চিম পাকের পশুসেনারা অথবা রাজাকার বাহিনীর গুণ্ডারা যে-কোন মেয়েকে তাদের পাশবিক আনন্দের শিকারে পরিণত করতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, দখলীকৃত এলাকায় এই সংকটের মুখে বাস করেও আমাদের নারী সমাজ সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর সাহায্যের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। দখলীকৃত অঞ্চলের যে গ্রামে মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীরা আশ্রয় গ্রহণ করেন সেই গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে তাঁদের জন্য রুটি প্রস্তুত করতে বসেন, ভাত রান্না করেন এবং পরম উৎসাহ সহকারে খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আর সবচেয়ে আনন্দের কথা এই যে, গ্রামের মেয়েরা মুক্তবাহিনীর সেননীদের জন্য খাবার তৈরি করে যে কি এক গভীর তৃপ্তি অনুভব করে তার সীমা নেই। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি গ্রাম ও শহরের সর্বত্র দখলীকৃত বাংলাদেশের মেয়েরা কি অসীম প্রতীক্ষায় দিন গুণছে- কখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে বিজয়ের দিন আসবে আর বাংলাদেশ এই পশুদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করবে। এই আন্তরিক শুভেচ্ছার মূল্য যুদ্ধের দিনে কম নয়। আমরা মনে করি, মহিলারা মুক্তিবাহিনীর সেনানীদের খাবার প্রস্তুত করে, তাদের উৎসাহ প্রদান করে যেভাবে সাহয্য করছে তারও অপর নাম সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মহিলা সমাজও তাই কৃতিত্বের দাবীদার।

কিন্ত বাংলাদেশের মহিলারা কৃতিত্ব চান না- পার্থিব কোন কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশের মহিলারা কাজ করেন না। সন্তানের মুখে, ভাইয়ের মুখে, স্বামীর মুখে, পিতার মুখে তাঁরা যদি দেখতে পান অমলিন হাসি, তবে সব কষ্ট, সব ত্যাগকে তাঁরা সার্থক মনে করেন। দেশজুড়ে এই হাসিমুখ যদি তাঁরা দেখতে পান তবে তাই হবে তাঁদের সবচেয়ে বড় পাওয়া, সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।

আরো একটি উপায়ে বাংলাদেশের মহিলারা এই সংগ্রামে সাহায্য করতে চলেছেন। মায়েরা সন্তানকে বোনেরা ভাইকে এবং স্ত্রীরা স্বামীকে বার বার তাগিদ দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য প্রেরণ করছেন। রাজশাহী জেলার উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামে এমনি একজন মহীয়সী মায়ের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তার একটি মাত্র ছেলে। ছেলেটির বয়স বাইশ বছর। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। ছেলেটির পিতা যদিও দেশপ্রেমিক-তবুও একমাত্র ছেলের প্রতি অসীম দুর্বলতা। বস্তুত তিনি ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু মা বলেছেন, না-আজ যখন মা-বোনের ইজ্জত ভুলুষ্ঠিত করেছে পাক-সেনারা তখন আমার ছেলেকেই সেই ইজ্জত রক্ষার্থে প্রথম যুদ্ধে যেতে হবে।

ছেলেটিকে হাসিমুখে তিনি যুদ্ধে পাঠিয়ে এখন পবিত্র প্রতীক্ষায় দিন গুণছেন। তাঁর ছেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে আবার তাঁর কোলে ফিরে যাবে। তাঁর মনে দুঃখ নেই, কোন সংশয় নেই। সেই মহীয়সী মায়ের কথা মনে পড়ে শ্রদ্ধার আমার মাথা নত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ এমনি মায়ের পবিত্র মুখ আমরা দেখতে পাব। সেই মুখগুলো শুধু পবিত্র নয়- যেন বঙ্গজননীর মুখচ্ছবির মতই সে মুখগুলো সোনালী অরুণাভায় সমুজ্জ্বল। আর তাঁদের সেই সংগ্রামের মূল্যও আমাদের মুক্তিসংগ্রামে অপরিসীম মূল্যে স্বাক্ষরিত।

(নূরজাহান মযহার রচিত)

<005.007.216>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলার মুখ
২২ নভেম্বর, ১৯৭১

হেমন্তের সন্ধ্যা দ্রুত নেমে এলো। আমরা এখানে এসে পৌঁছুনোর অপেক্ষাতেই যেন সে বসেছিলো। এসে পৌঁছুনোর সঙ্গে সঙ্গে তুরা পড়ে গেল। আমার চার পাশে, সমুখের ওই বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর আর এই দূরের গ্রামগুলোর কোলে ঘেষে ঘেঁষে নীল ধোঁয়ার মতো কুয়াশারা জমে উঠেছে। চাপা কান্নায় ভেজা দৃষ্টির মতো হালকা কুয়াশার জমে উঠেছে ঢাকার উপকণ্ঠের এই বনানীর প্রান্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে।

একটু আগেই আমরা এই ছোট্ট উপবনটিতে এসে পৌঁছেছি। আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু জিনিসপত্র মেশিনগান। এ সবই আমরা পেয়েছিলাম শালদা নদীর তীরে পাকিস্তানী-সৈন্যদের বেলুচ রেজিমেন্টের ১০৩ ব্রিগ্রেডের একটা কোম্পানীর সঙ্গে প্রচণ্ড এক লড়াইয়ের পর। এই লড়াইয়ে শত্রুপক্ষের ১৪৩ জন নিহত হয়েছিল। আর আমাদের পক্ষে একজন বীর মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তিনজন আহত হছেন। শালদা নদীর তীরের এই লড়াইকে আমরা আমাদের কোন বড়রকম বিজয় বলে মনে করি না। কারণ এ লড়াইয়ে আমাদের একজন মুক্তিসেনারও আহত হওয়ার কথা ছিল না। এই লড়াইয়ে আমাদের গেরিলা বাহিনীর যে ইউনিটটি অংশগ্রহণ করেছিলো তারা প্রত্যেকেই ছিলেন সুশিক্ষিত, অধিকাংশই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র। আমাদের আক্রমণ অভিযানের পরিকল্পনাটিও ছিলো নিখুঁত। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুবাহিনীর প্রতিটি সৈন্য নিহত হবার কথা ছিলো। কিন্তু ওদের কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ গরম আলোচনা হয়েছে, আমাদের সামান্যতম ভুলত্রটি ও শিথিলতার কঠোর সমালোচানাও করা হয়েছে।

কিন্তু যে কথা বলছিলাম, আমরা পাঁচজন মুক্তিসেনা সঙ্গে করে যেসব অস্ত্রশস্ত্র এনেছি ওজনে বেশ ভারী ছিলো। আমাদের এক-একজনের ওজন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছিলো। এগুলো পিঠে-কাঁধে ঝুলিয়ে একটানা বেশ কয়েক ঘণ্টা আমাদের হাঁটতে হয়েছে। হাঁটতে হয়েছে নদীতীরের বালুকারাশির ওপর দিয়ে, মাঠের ওপর দিয়ে, মাঠ পেরিয়ে জলাভূমি ভেঙে ভেঙে। আবার কখনো হেঁটেছি ছবির মতন শান্তস্নিগ্ধ ছোট ছোট সব গ্রাম আর ক্ষেতের মাঝ দিয়ে দিয়ে।

স্বাভাবিকভাবেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। পিঠে আর কাঁধের বোঝা নামিয়ে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হাতিয়ারটা নিয়ে অপেক্ষাকৃত হালকা একটা ঝোপের পাশে এসে বসলাম। সঙ্গীরাও আমার পথ অনুসরণ করলো।

এই উপবনটিতে এসে পৌছুনোর পরমুহুর্ত থেকেই একটা পাখির ডাকের জন্যে আমি উৎকর্ণ হয়ে ছিলাম। বাংলাদেশের এমনি সব বন-উপবন মুখর করা একটি অত্যন্ত পরিচিত পাখির ডাক।

সৌভাগ্যক্রমে আমাকে বেশীক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে থাকতে হলো না। কয়েক মিনিট পরেই শুনতে পেলাম আমাদের সেই আকাংক্ষিত পাখির ডাক। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাঁচজন সঙ্গীত একজনের কণ্ঠে সে ডাক প্রতিধ্বনিত হলো। একটু পরেই দেখতে পেলাম তিনজন শীর্ণকায় লোক। গ্রামের সাধারণ ক্ষেতমজুর ছাড়া তাদের আর কিছু মনে করা সম্ভব নয়। এদের আগে কখনও দেখিনি। এরা তিনজনই ভয়ংকরভাবে রোগা। এদের বুকের পাঁজরের হাড়গুলো মাঠের বা গ্রামের খাল-নালার ওপরকার বাঁশের সাঁকোর মতো উচু উচু। এরা তিনজনেই আমাদের গেরিলা বাহিনীর অত্যন্ত দক্ষ সৈনিক। আগে ইপিআর প্যারামিলিটারী গ্রুপে কাজ করতেন। তাদের সঙ্গে আমরা অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে নিলাম। আজ রাতেই এই এলাকা আমরা ছেড়ে যাবো। যাবো-ঢাকা শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে, শত্রুবাহিনীর চেকপোষ্টগুলোর কাছাকাছি। ওই তিনজনের

<005.007.217>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সঙ্গে কথাবার্তার পর বুঝলাম এ স্থান ত্যাগ করতে আরও ঘন্টা তিনেক লাগবে। গভীর অন্ধকারের মধ্যে আমাদের এগোতে হবে এবং তাও ওদের সিগন্যাল পেলে তবেই। সুতরাং হাতে আমাদের অঢেল সময়। ওরা আমাদের জন্যে কিছু খাবর এনেছিলেন- ঢেকিভাঙ্গা চালের আটার রুটি আর হাঁসের মাংস। পাশের গ্রামের এক গৃহস্থ পরিবার আমাদের জন্যে এই খাবার পাঠিয়েছে।

হাঁসের মাংসের হালকা একটা গন্ধ পেলাম।- বুকটা কেমন যেন ছ্যাৎ করে উঠলো- বুকের অনেক গভীরে একটা বেদনা, ভারী একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম।

সন্ধ্যার অন্ধকার আর বিক্ষিপ্ত কুয়াশার সিড়ি ভেঙে আমার সমুখে যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিলো আমার মা, আমার নিঃসন্তান বিধবা বড়ো আপার মুখ। বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটা ক্রমশঃ যেন আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিলো। হেমন্ত সন্ধ্যায় মাঠের তৃণের মতোই আমার দুচোখ আর্দ্র হয়ে উঠেছিলো।

তাড়াতাড়ি করে কোন রকমে খাওয়া সেরে আমি আবার সেই ঝোপটার পাশে এসে বসলাম। একটা পোড়া সিগ্রেট ধরিয়ে সমুখে তাকিয়ে ছিলাম। সমুখের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়- দেখা যায় আমার প্রিয় নগরী আমার ঢাকার প্রান্তদেশ পর্যন্ত। চারপাশে বহুদূর বিস্তৃত ঝোপঝাড় থাকলেও এখান থেকে সমুখের অনেক দূর দূর এলাকা দেখতে পাচ্ছিলাম। কারণ, আমি যে জায়গাটিতে বসে ছিলাম সেটি ছিলো বেশ উচুবলা যায়, এই বনান্তরে একটা উচু ঢেউয়ের চূড়ায় বসেছিলাম।

সমুখের দিকে তাকিয়েছিলাম কিছুটা উদ্দেশ্যহীন এক দৃষ্টি নিয়ে। একটু পরেই জুলে উঠলো ঢাকার উপশহর সাভারের আলোকমালা। দেখতে পেলাম ঢাকা বেতারের হাইপাওয়ার ট্রান্সমিটারের টাওয়ার লাইট, লাল একটা জ্বলন্ত বুলেটের মতো ঝুলছে।

সহকর্মীদের সঙ্গে দু’একটা কথার মাঝ দিয়ে আমার সময় কাটছিলো। কাজের কথাই বলছিলাম। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ যা ঘটনা নিয়েও আমরা কথা বলছিলাম।

আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আমরা রওয়ানা হবো। কিন্তু মাঝখানের সময়টা বড়ো অসহ্য মনে হচ্ছিল। আর এই অসহ্য ভাবটা কাটিয়ে ওঠার জন্যেই বেশ কিছুটা নির্ভাবনা ও নির্লিপ্ততার ভাব নিয়ে বিশ্রামের চেষ্টা করলাম। সমুখে ফেলে দেয়া জ্বলন্ত সিগ্রেটের থেকে শেষ ধোঁয়ার শীর্ণ রেখাটি তখন বিসর্পিল গতিতে একে বেঁকে ছোট্ট একটা শটিঝোপের দিকে মিলিয়ে যচ্ছিল।

শঁটিবনে হারিয়ে যাওয়া ওই বিশীর্ণ নীল ধোঁয়ার মতোই মনটা আমার হারিয়ে গেল পিছনে ফেলে আসা নাম-না-জানা অনেক গ্রাম-জনপদ, নদী, নদীর তীরভূমি-মাঠ, মাঠের মাঝখানের বিজন বটগাছটি-আপনমনে ঘাস ছিড়ে খাওয়া কতগুলো গরু। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠের একান্তে বাঁধা একটা গরু-লম্বা মুখ তুলে উদাস চোখে তাকিয়ে আছে দূরের গ্রামটির দিকে। দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠের মাঝখানে চিলতে একটুখানি জায়গায় জমে থাকা পানির ধারে ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো অসংখ্য বক-কয়েকটা অল্প উচু দিয়ে ইতস্তঃত উড়েছে।

হটাৎ করে আমার চিন্তার নীল বিশীর্ণ রেখাটি যেন শঁঅটি বনে ছড়িয়ে আরো অনেক- অনেক দূরে হারিয়ে গেল। উপশহর সাভারের ওই ঝিলমিল আলোকমালার চেয়ে অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমার গ্রাম-গ্রামের মাঠের সেই বিজন বটতলাটি, যেখানে কেটেছে আমার শৈশবের দিনগুলোর অনেক অলস দুপুর, চারপাশের গ্রামের বৃত্তরেখার অনেক ওপরে ছড়ানো আমার সেই শিশু আমির কল্পনাগুলো যেখানে রামধনু হয়ে থাকতো।

<005.007.218>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অত্যন্ত গরীব এক কৃষক পরিবারের ছেলে ছিলাম আমি। তবু আমার মা-বাবার সাধ ছিলে, আশাআকাংক্ষা ছিলো-আমি বড়ো হবো, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবো-সীমাহীন দারিদ্রের কশাঘাত থেকে পরিবারটিকে বাঁচিয়ে তুলবো। আমার মা-বাবার গোটা জীবন-তাদের আজীবন বাঁচার লড়াই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো লেখাপড়া শিখতে। গাঁয়ের নওশের মাস্টারের পাঠশালে যেতাম। পাঠশালা বসতো সকালে, কারণ নওশের মাস্টারকেও আমার বাবার মতো মাঠে কাজ করতে হতো শুধু পেট চালানোর জন্যেই। দুপুরে আমার মাঠে কাটতো। আমাদের একটি গাই গরু ছিল। পাঠশালার পড়া সেরে আমি তাকে মাঠে চরাতে নিয়ে যেতাম। দুপুরে মাঠের মাঝখানের বটগাছের তলায় বসে যেন এক দারণ একাকীত্ব আমার ঘিরে ধরতো। একটা বাঁশির অভাব আমি বোধ করতাম।

একদিন অনেক রাতে মায়ের কোলে ঘুমানোর সময় মাকে কথাটা বলেছিলাম। মা রাজী হয়েছিলেন, আমাদের গা থেকে দু’মাইল দূরে বৈশাখী মেলা বসলে আমাকে একটা তালপাতায় রাঙা বাঁশি কিনে দেয়া হবে।

এরপর থেকে প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে আমার কল্পনার ভাসতে লাগলো তালপাতার একটা বাঁশি। মুহূর্ত দিন গুণতে গুণতে সত্যি সত্যিই সেই দিনটি ফিরে এলো । মা আমাকে দু’আনা পয়সা দিলো। সাতরাজার ধন মানিকের মতো ওই দু’আনা পয়সা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে চঞ্চল এক হরিণশিশুর মতো আমি ছুটে যাচ্ছিলাম। পুকুরের পাড়ে বসেছিলেন ফকির দাদু। আশি বছরের এক সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ। গাঁয়ের সব ছোটরা তাঁকে দাদু বলতো। আমাকে ওভাবে ছুটে যেতে দেখে তিনি আমায় ডাক দিলেনঃ কোথায় যাচ্ছো দাদুভাই। হাঁপাতে হাঁপাতে আমি বললামঃ আমি-আমি মেলায় যাচ্ছি- বাঁশি কিনতে। মা আমাকে দু’আনা পয়সা দিয়েছে। বৃদ্ধ আমার শেষের কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন কিনা জানি না, মেলা থেকে ফেরার সময় বৃদ্ধকে ওই একই জায়গায় আমি দেখেছিলাম। তিনি অবশি সকাল-সন্ধ্যে ওই জায়গাতেই বসতেন। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন বিকেলের হলুদ রোদ গাছের চূড়োয় চূড়োয়। বৃদ্ধ আমায় জিজ্ঞেস করলেনঃ কই দাদুভাই তোমার বাঁশি কই? আমি সহজভাবে বললামঃ কিনিনি তো বৃদ্ধ বললেনঃ তবে তুমি যে বললে বাঁশি কিনবে? বললামঃ সারাদিন মেলায় ঘুরে ঘুরে আমার খুব ক্ষুদে পেয়েছিলো, মুড়ি কিনে খেয়ে ফেলেছি। বৃদ্ধ অপলক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে কয়েক মুহুর্ত ধরে তাকিয়ে ছিলেন, তারপর হঠাৎ উচ্ছাসের সঙ্গে বলে উঠেছিলেনঃ বেশ, বেশ, করেছো দাদুভাই! মুড়ি খেতে আমারও বেশ ভালো লাগে- এখন সব নতুন চালের মুড়ি তো, বেশি মিষ্টি লাগে- তাই না দাদুভাই।

মিষ্টি আমার মোটেই লাগেনি। প্রচণ্ড ক্ষিদের সময় মুড়িগুলো গিয়েছিলাম মাত্র। মেলায় ঘুরে ঘুরে রকমারি মিষ্টি আর নানা ধরনের নানা স্বাদের খাবার দেখার পর ওই শুকনো মুড়িগুলো মিষ্টি লাগার কথাও নয়। তাছাড়া বৃদ্ধ যতোই উচ্ছাস আর হাসির সঙ্গে কথাগুলো বলুন কেন, আমার কাছে তা বিষন্ন মনে হয়েছিল।

সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে মাও আমার বাঁশি কেনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। আমি একই উত্তর দিয়েছিলাম। মা দারুণ স্নেহের আবেগে বুকে টেনে ধরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু কয়েক মুহুর্ত পরেই মুখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। মায়ের দু’চোখে জল। পারলাম না- উঠোন থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম আমাদের ভিটের এক প্রান্তে একটা ডালভাঙ্গা সজনে গাছের তলায়। সেখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকের অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ জুলে ওঠা জোনাকীদের আলো আর আমার বিধবা আপার ধরানোর চুলোর অগ্নিশিখা দেখতে দেখতে আমিও কাঁদছিলাম।

সেদিন আমাদের দাদুভাইয়ের কণ্ঠের সেই বেদনাভারাক্রান্তের বিষণ্ণতা, আমার মায়ের এই আবেগাকুলতা, চোখের জল, আমার কান্না- এসবের কোন অর্থ আমি খুঁজে পাইনি।

<005.007.219>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অর্থ খুঁজে পেয়েছি আরও অনেক পরে- দীর্ঘ একুশ বছরের পর, ঢাকায়-গত ২৫শে মার্চের বীভৎস রাতে। একটি সংবাদপত্র অফিসের ছাদে বসে। আমাদের গায়ের ভিটের সেই ডালভাঙা সজনে গাছের চারপাশের অন্ধকার আর হঠাৎ হঠাৎ জুলে ওঠা জোনাকীর আলোর মধ্যে নয়, চারদিকে পাকিস্তানী বর্বরদের স্বয়ংক্রিয় রাইফফেল, মেশিনগান, মর্টার ও ট্যাঙ্কের গোলাগুলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার বিধবা আপার ধরানো চুলোর চকবাজার, পিলখানা আর ফার্মগেটে হাজার হাজার ঘরে পাকিস্তানী বর্বরদের লাগানো ভয়াবহ আগুন দেখতে দেখতে।

সেদিন রাতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম আমার সেই গ্রাম, গ্রামের মাঠ আর বৈশাখী মেলায় ঘুরে বেড়ানো আমার সেই শিশু আমিকে। দেখতে পাচ্ছিলাম প্যান্ট পরা নগ্ন গায়ের সেই চঞ্চল শিশু- তার মাথাটা ওরা গুলির আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে-কালো পীচের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তধারা -মাথার খুলির টুকরোগুলো- সেইদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের গাঁয়ের সেই দাদুভায়ের কান্নাভারাক্রান্ত কণ্ঠের পেরেছিলাম আমার সেই শিশু আমির ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার অর্থ। অতীতের এইসব টুকরো টুকরো স্মৃতির কথা ভাবতে অজান্তেই কখন যে হাতের এল-এম-জিটাকে ইস্পাতের সাঁড়াশির মতো দু’হাতে চেপে ধরেছিলাম তা আমার মনে নেই।

(সাদেকীন রচিত)

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন
……..ডিসেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তরকারী ঘটনা। এর পটভূমিতে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত ও জীবনদানের করুণতম গাথা। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী স্বাধীন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়নি। বিশ্বের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত নৃশংসতম ও বর্বর পাক-সৈন্যদের বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের এ স্বাধীনতার সূর্যোদয় সম্ভবপর হয়েছে। অন্যান্য স্বাধীনতা আন্দোলনের মতই আমাদের মুক্তিযুদ্ধও প্রথমদিকে কতগুলি অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল। যেমন- পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, প্রয়োজনীয় সামরিক প্রশিক্ষণের অভাব প্রভৃতি। এই সমস্ত কারণে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম স্তরে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চলেছিল। এই গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালানোর উদ্দেশ্য হলো শত্রুকে বিভিন্ন দিক দিয়ে নাজেহাল করা। মূলত কতগুলি ফ্রন্টে বিভক্ত করে শত্রুকে কোণঠাসা করে আনা গেরিলা যুদ্ধের মূলনীতি। এই ফ্রন্টগুলি হলো অর্থনৈতিক, সামরিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি। তাই নিতান্ত অনিচ্ছা ও ক্ষতি সত্ত্বেও শত্রুকে কোণঠাসা করার জন্য বাংলাদেশ গেরিলাদের বিভিন্ন পুল, রেলওয়ে, ব্রিজ, কালভাট, প্রধান প্রধান সড়ক প্রভৃতির ধ্বংসসাধন করতে হয়। শত্রুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আঘাত হানার জন্যে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের অনেক শিল্পকারখানাও নষ্ট করতে হয়।

পরে শত্রুমুক্ত করার তথা স্বাধীনতা অর্জনের চরম মুহুর্তে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে নিশ্চিত পরাজয় বর্বর হার্মদ পাক-সৈন্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বহু বছর পিছিয়ে

<005.007.220>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দেবার মানসে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের উপর ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয় এবং সার্বিক অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। তাই বিজয়ের পরে আজ আমাদের প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব হবে বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সব মন-প্রাণ নিয়োগ করা।

মুক্তিসংগ্রামের থেকে মুক্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন আরো কঠিন ও কঠোর । এ বিরাট দায়িত্ব স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এবং সরকারও এ ব্যাপারে পূর্ণ প্রতিশ্রুত ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানী হার্মাদ নরপিশাচরা স্বেচ্ছায় হাতের অস্ত্র ছাড়েনি। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তারা পরাজয়ের শেষ মুহুর্তে শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জের কল-কারখানাগুলি নষ্ট করে দিয়ে গেছে। এছাড়া দেশের এই অস্বাভাবিক অবস্থায কৃষকরা ঠিকমত চাষাবাদ করতে পারেনি। শিল্প ও কৃষি দেশের প্রধান দুইটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের উপর মারাত্মক আঘাত পড়ায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। গত নয় মাস যাবৎ বাংলাদেশের অধিবাসীদের ওপর যে দুর্যোগ ও কালরাত্রি নেমে আসে তাতে ১২ লক্ষাধিক লোক নিহত হয়, ১ কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নেয় এবং লক্ষ লক্ষ লোক দেশের অভ্যন্তরেই গৃহহারা হয়। এই ছিন্নমূল অধিবাসীদের মানসিক অবস্থা কৃষিকার্যে মনোনিবেশ করার অনুকূলে ছিল না। অন্যান্য সকল লোকমাত্রেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। সুতরাং কল-কারখানা, কৃষিকার্য, স্কুল, কলেজ, কোর্টকাচারী প্রভৃতি সবকিছু বন্ধ অবস্থায় ছিল।

বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল স্বর্ণতন্তু পাট। এই পাটচাষের প্রতি কৃষকদের আবার দ্বিগুণ উৎসাহে মনোনিবেশ করতে হবে। বিশ্বে এর অসম্ভব চাহিদা অনস্বীকার্য। এছাড়া চাও বাংলাদেশের রপ্তানীযোগ্য ফসলের মধ্যে অন্যতম। এ দুটি ব্যবসায় বৃটেনের বাংলাদেশের সহযোগিতার অত্যন্ত প্রয়োজন। এবং এমন ধারণা নিত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এই দুটি শিল্পে ব্যাঘাত না সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বৃটেন বাংলাদেশ সমস্যায় পাক-জাঙ্গীশাহীকে শেষের দিকে সমর্থন করেনি।

এছাড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত শিল্পের পুনর্গঠনে বহু অর্থের প্রয়োজন। এটা কিছু সময়সাপেক্ষও বটে। বাংলাদেশে সম্পদের অভাব নেই। আর বাংলাদেশ সরকারের বিরাট ও নিরঙ্কুশ জনসমর্থন আছে। তাই মনে হয় বাংলাদেশে এই সমস্ত সমস্যা অচিরেই দূর হয়ে যাবে। দেশের সাংগঠনিক কার্যে মানুষ চরম নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ত্যাগ ও সহনশীলতা দ্বারা দেশকে গড়ে তুলবেন।

দেশের সাংগঠনিক কার্যে প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ দেশের যাতায়াত ব্যবস্থাকে পুনরায় চালু করতে হবে। শুধু দেশের অভ্যন্তরেই এ ব্যবস্থা সীমিত রাখলে চলবে না। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন ও সাহায্য তর্কাতীত। তাই রণবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে সবচেয়ে আগে। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জল, নৌ ও বিমানপথের যোগাযোগ স্থাপন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অবশ্য ইতিমধ্যেই বনগাঁ, বেনাপোল, শিয়ালদহ ও যশোরের মধ্যে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা হয়েছে, তথাপি তা আরো প্রসারিত করার আমু ব্যবস্থা দুই সরকারকেই করতে হবে- যদিও তা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। স্থলপথ ও জলপথের এই অসুবিধাগুলি আকাশপশে বিমান চলাচলের ব্যবস্থা করে অনেকাংশে দূর করা যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির সঙ্গে সত্বর বিমান যোগাযোগ একান্ত প্রয়োজনীয়। অবশ্য এটা ঠিক, যুদ্ধে অনেক বিমানক্ষেত্রে রানওয়েগুলির ক্ষতি হয়েছে, তথাপি সেগুলির সংস্কার খুব বেশী সময়সাপেক্ষ নয়।

বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গড়ে তোলার জন্যে বদ্ধপরিকর, দেশের ভবিষ্যৎ রূপরেখায় যা উপস্থাপিত হয়েছে তাতে কায়েমী স্বার্থের কোন স্থান থাকবে না, পুঁজিবাদ বা আমলাতান্ত্রিকতা কোন অসুবিধা করতে পারবে না, নতুন করে কোন সুবিধাবাদী চক্রকে গড়ে উঠতে দেয়া হবে না। সরকার এটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন যে, সংগঠন ও পুনর্গঠনের জন্যে রয়েছে যেটা সেটা

<005.007.221>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হলো দেশের সর্বত্র অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রসারিত করে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করা। ইতিমধ্যেই সরকার দেশের অগ্রগতির প্রতিবন্ধক সম্প্রদায়িক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন, বাংলাদেশে আর কোন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থাকবে না। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাম্পে দেশ আর কলুষিত হতে পারবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা যুবকদেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তাদের ভূমিকা সর্বগ্রগণ্য।

পশ্চিম পাকিস্তানী রক্তলোভী হার্মাদরা বাংলাদেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, অধ্যাপক, রাজনৈতিক কর্মী, সাহিত্যিক প্রভৃতি বাঙালী বুদ্ধিজীবীরাই দেশের পুনর্গঠনে অধিকতর সহায়ক হবে জানতে পেরেই ইয়াহিয়ার লুটেরারা বেছে বেছে এদের হত্যা করে। কাজেই নানা দিক দিযে সরকারের অসুবিধা হবে। অবশ্য যতই বাধা থাকুক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আবার দেশ গঠনেও আত্মনিয়োগ করতে পারবে। সাংগ্রামের মধ্য দিয়ে শোণিতমূল্যে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি- এই স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্যে এবং দেশের আর্থিক পুনর্গঠনের জন্যেও আমরা তেমনি প্রাণ পণ করব। এ ব্যাপারেও আমরা বিশ্বে নতুন বিস্ময় সৃষ্টি করতে সক্ষম হব।

(নাসিম চৌধুরী রচিত)

বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায়

……..ডিসেম্বর, ১৯৭১

যুদ্ধ একদিন শেষ হয়। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে গড়ে তুলতে হয় নতুন জীবন,সভ্যতা। মানুষ যুদ্ধ চায় না। চায় শান্তি। তবু যুদ্ধ চলে আসছে মানব অস্তিত্বের আদিকাল থেকে। আমরা যুদ্ধ চাইনি। তবু যুদ্ধ চেপে বসেছিল আমাদের উপর ন্য মাস ২২ দিন পরে বাংলাদেশের পাক দখলদার বাহিনী সর্বত্র আত্মসমর্পণ করেছে। এখন আমাদের ভাববার পালা যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন নিয়ে। এখন আমাদের লক্ষ্য হবে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে দেশ গড়বার কাজে আত্মনিয়োগ করা। সাধারণ মানুষের জীবন থেকে দুঃখ-দারিদ্রকে দূর করে, সমগ্র দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম জনবহুল দেশ। এখানে গড়পড়তায় প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার হার ৯০০ জনের উপরে। জমির উপর জনসংখ্যার চাপ এখানে খুব বেশী। আমাদের প্রধান এবং প্রাথমিক সমস্যা এই বিরাট জনসংখ্যার মুখে অন্ন যোগান।

বাংলাদেশের মোট আয়তন ৩৫.৩ মিলিয়ন একর। এর মধ্যে আবাদী জমির পরিমাণ হল ২২.৫ মিলিয়ন একর। এর মধ্যে বৎসরে একাধিকবার আবাদ করা হয় এমন জমির পরিমাণ হল ৩ মিলিয়ন একর। তাই বলতে হয় মোট ফসল উৎপাদন জমির পরিমাণ হল ৩৮.৮ মিলিয়ন একর।
একটা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় দু’ভাবেঃ
(১) নতুন জমিকে কর্ষণ উপযোগী করে; এবং
(২) আবাদী জমিতে ফসলের উৎপাদন মাত্রা বাড়িয়ে।

<005.007.222>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলাদেশে বর্তমানে চাষ করা হয় না কিন্তু চেষ্টা করলে কর্ষণ উপযোগী করা যায় এমন জমির পরিমাণ প্রায় ১ মিলিয়ন একর। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, যেমন কলের লাঙ্গল ব্যবহার করে এই ভূমিকে কর্ষণ উপযোগী করা সম্ভব। বিগত কয়েক বছরে অনেক উন্নয়নগামী দেশে খাদ্য উৎপাদনের মাত্রা দ্রুত বেড়েছে। অনুসন্ধান করলে দেখা যায় তা সম্ভব হয়েছে প্রধানত নতুন জমি আবাদ করে। কিন্তু বাংলাদেশে আবাদযোগ্য অনাবাদী জমির পরিমাণ খুব বেশী নয়। তাই ফসল বাড়াবার প্রধান উপায় হিসাবে এখানে গ্রহণ করতে হবে বর্তমানে যে আবাদী জমি আছে তাতেই অধিক ফসল ফলানোর উপায় উদ্ভাবন করে- উন্নত কৃষিপ্রণালীর প্রয়োগ ঘটিয়ে।

বাংলাদেশে ফসলের ফলনের মাত্রা খুবই কম। যেখানে বাংলাদেশের ধানের গড়পরতা ফলনের পরিমাণ একরপ্রতি ৯০০-১০০০ পাউণ্ডের মত সেখানে জাপানে একরপ্রতি ধানের ফলন হচ্ছে ২০০০ পাউণ্ডের উপর। আমাদের দেশে ধানের ফলন-মাত্রা কমের একটি বড় কারণ জমিতে যথাযথভাবে সার দেওয়ার ব্যবস্থা নাই। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের জমিতে কেবলমাত্র নাইট্রোজেন ঘটিত সার প্রদান করে ফসলের হার অনেক বাড়িয়ে দেওয়া যায়। যেমনঃ একর প্রতি ৪০ আউন্স নাইট্রোজেন ঘটিত সার দিয়ে দেখা গিয়েছে যে, এর ফলে আউশ ধানের ফলন ৩৭ ভাগ, আমন ধানের ফলন শতকরা ৪০ ভাগ ও বোরো ধানের ফলন শতকরা ৪৬ ভাগ বাড়িয়ে দেওয়া যায়।

আমাদের দেশে মাটির নীচে যে প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার সাথে বাতাসের নাইট্রোজেন গ্যাস যুক্ত করে নাইট্রোজেন ঘটিত সার যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তার পরিমাণ হল ৯.৩৪ মিলিয়ন কিউবিক ফুট। এই গ্যাস আমরা বহুদিন ধরে ব্যবহার করতে পারবো। সার উৎপাদনের কাজে জ্বালানী হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে হবে।

বাংলাদেশের আবাদী জমির কম করে শতকরা ৬০ ভাগ শীতকালে পতিত থাকে। এর প্রধান কারণ শীতকালে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। ডিসেম্বর ও জানুয়ার মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গড়পরতায় দেড় ইঞ্চির বেশী নয়। শীতকালে জলসেচের ব্যবস্থা করে তাই বহু জমিতে ফসল ফলান সম্ভব। এইভাবে রবিশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা বহুলভাবে সমাধা করা চলে। পাকিস্তানী আমলের সরকারী হিসাব থেকে দেখা যায় যে, ১৯৬৬-৬৭ সালে বাংলাদেশে ১.৫ মিলিয়ন একর জমিতে জলসেচ ব্যবস্থা ছিল। অর্থাৎ মোট আবাদী জমির মাত্র শতকরা ৫ ভাগ জমিতে জলসেচ ব্যবস্থা ছিল। উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহন করে দ্রুত আরো অনেক জমিতে সেচ-ব্যবস্থা সম্ভব।

বাংলাদেশের এক বিরাট সমস্যা বন্যা। বন্যার পানি প্রতিবছর যথেষ্ট পলিমাটি বহন করে বাংলার মাটিকে উর্বর করে। কিন্তু বড় বন্যা হলে তাতে বাংলাদেশের ফসলের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে যখন মাঝারি রকমের বন্যা হয়, তখন প্রায় ৯ মিলিয়ন একর জমি জলমগ্ন হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনুসন্ধান এ পর্যন্ত চালান হয়েছে। তা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ভারতের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক কারণে, ভারতের সাথে এতদিন বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারে কোন সহযোগিতা সবস্তব হয়নি। কিন্তু এই সহযোগিতার প্রতিবন্ধক এখন দূর হয়েছে।

একটা দেশের আর্থিক শ্ৰীবৃদ্ধির জন্য বর্তমান যুগের রাষ্ট্রক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার কথা এখন মোটামুটি সব অর্থনীতিবিদই স্বীকার করেন। কিন্তু সব পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করে যেমন পরিকল্পনা তৈরির নির্ভুলতার উপর, তেমনি সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে কাযর্কর করার ভার যাদের হাতে ন্যস্ত থাকে তাদের নিষ্ঠা ও সত্যতার উপর। কেবল আমলাতন্ত্রের সাহায্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্ভব নয়। এর জন্যে প্রয়োজন হয় উপযুক্ত গণসংগঠনের। আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, যে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে দেশকে শত্রুকবল

<005.007.223>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

থেকে মুক্ত করল, তাদের দেশপ্রেম ও কর্মশক্তিকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে লাগাতে হবে। এদের সাহায্যে গ্রামবাংলার কৃষি অর্থনীতিতে দ্রুত বিরাট পরিবর্তন আনা সম্ভব।

(ডা, এবনে গোলাম সামাদ রচিত)

অগ্রগামী মুক্তিবাহিনী

১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

পাকিস্তানী বর্বর সেনারা মুখের উপর এক বিরাশী-সিক্কার চড় খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ার উপক্রম। গত মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত সমানে জ্বালাতন করে, বাংলার বুকে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে, সমৃদ্ধ জনপদ শশানে পরিণত করে, বাংলার শক্তিকে নিঃশেষ করেছে ভেবে, বাংলার পথে পথে শকুনী-গৃধিনী এবং শিবাদলের অট্টহাসিতে ভরে তুলেছিল বাংলার আকাশ। কিন্তু ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি তাদের বোধের অন্তরালে কখন যে জেগে উঠেছে, অনুধাবন করতে পারেনি অদূরদশী বর্বর হয়েনার দল। আচমকা কোন দিক থেকে গালের উপর পড়ল বিরাশী সিক্কার চড়।

আর অমনি বন্ধুর দল হায় হায় করে উঠলো। নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বিতাড়িত হয়ে সাধারণ পরিষদে হাজির গণতন্ত্রের জিগির তুলে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলে, পাকিস্তানের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তানী বন্ধুরা আরামকে হারাম করে বিশ্বের দরবারে হাজির হলো। বন্ধ কর, যুদ্ধ বন্ধ কর।

কারণ কী? কারণ আছে তো বটেই। মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে পরিণতির দিকে। একের পর এক পতন হচ্ছে নিরাপদ দুর্গগুলোর সাহায্যদ্রব্য আনয়নের এবং পাঠানোর পথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। দুটি প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম এবং চালনা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। বিমান বাহিনী যে সাহায্য করবে সে উপায়ও নেই। কুল্লে দু’খানা বিমান এখন পাকিস্তানের বেঁচেবর্তে আছে, তাও আবার লুকানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। কেননা সারা বাংলাদেশে জানোয়ারগুলোর আর লুকানোর কোন ঠাই নেই। মুক্তিবাহিনী খুঁজে খুঁজে ওদের আঘাত করছে, শেষ করছে। সারাবাংলা এখন হয়ে উঠেছে শয়তানের মৃত্যুফাঁদ।

বাংলাদেশের অর্থে কেনা সমরসম্ভার নিঃশেষিত প্রায়। এতদিন যে ধর্মের আফিমের নেশায় বুদ হয়েছিল সারা পাকিস্তানের সুবিধাবাদী জল্লাদ আর দালালের দল, আজ তাদেরও নেশা ভাঙতে শুরু করেছে। জাতীয় সংগ্রামের আগুনের আচে আফিমের নেশাও চড়াৎ করে ভেঙে যাচ্ছে। পাঞ্জাবী মহাপ্রভূদের মনোরঞ্জনার্থে আর অস্ত্র ধরতে রাজী নয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অনেকেই। আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জবানবন্দীতে একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে।

এবার দিন গুণবার পালা সামরিক জান্তার এবং তাদের চেলাচামুণ্ডা মওদুদী, ভুট্টো, কাইয়ুম খান, নুরুল আমিন, মাহমুদ আলী প্রমুখের। নিয়াজী বাংলার মাটিতে বসে ইয়ানফসী, ইয়ানফসী শুরু করেছে। ঢাকা বেতার তবু আজো প্ৰলাপ বকছে। ওদেরই কথার প্রতিধ্বনি তুলে নিজেদের বোঝাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অনুভব ভুলের বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে।

মুক্তিবাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে এবং মেশিনগানের গুলিতে সচকিত দালালের দল কোন বিবর খুঁজছে? বোমার আঘাতে প্রকম্পিত ঢাকা নগরীতে আজ কি আর বর্বরদের জীবনের উচ্ছলতার কোন অবশিষ্ট আছে? না,

<005.007.224>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নেই। যশোর দুর্গ পতনের পর, ময়নামতি দুর্গ অবরুদ্ধ হওয়ার পর, সিলেট জেলা, রংপুর এবং যশোর খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত হওয়ার পর আর কি ভাবছে বাংলার স্বার্থবিরোধী, বাঙলার চরম শত্রু পাকবাহিনী এবং তার অনুচরেরা?

আজ মুক্তিবাহিনীর পথ রোধ করবে কে? কোথায় সে শক্তি? নিঃশেষিত শক্তি পাকিস্তানের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে । যারা নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ছে তাদের নিজেদের স্থান করে নিতে হবে সেই কবরে।

দুঃসাহসী মুক্তিবাহিনীর দৃঢ়পণ, বজ্ৰমুঠিতে ধরে রাখা হাতিয়ার আজ বদ্ধপরিকর সব অনাচারী, অত্যাচারী, জুলুমবাজদের মূলোচ্ছেদ করার জন্য। লাখো শহীদের রক্তলাল-বাঙলায় উদিত আজ স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। উত্তাল বিজয়-উল্লাসে মুখরিত বাংলা আকাশ-বাতাস।

আজ শোন বর্বরের দল, হয় মৃত্যুবরণ করো নয় পরাজয়ের কালি ললাটে লেপন করে আত্মসমর্পণ করো। বাংলার মাটিতে ঠাই নেই তোমাদের।

দুর্জয়, দুর্বার বাঙলার মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলো। সংহার করো, নিঃশেষ করো অনাচারী বর্বরদের। বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তোমাদের বিজয়-আহবান জানাতে প্রস্তুত।

সুদূর দিনাজপুরের বাংলাবান্ধা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দৃঢ় দুর্দমনীয় হোক তোমাদের পদক্ষেপ। মনোবলহীন, ক্লাব, কুৎসিৎ হানাদার আজ মৃত্যুর দিন খুঁজছে বন্দীপ্রায় বিবরে।

তোমাদের জয়যাত্রায় শরীক সাতে সাত কোটি বাংলার মানুষ। গণহত্যাকারীদের নিঃশেষ করো বাংলার মাটি থেকে

(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

এখন অনেক কাজ

২২ ডিসেম্বর, ১০৭১

বাংলাদেশ এখন মুক্ত, কিন্তু আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই সবে শুরু। মুক্ত বাংলার আকাশে নতুন সূর্যের প্রভাতী আবিরে সদ্য স্নান করে উঠেছি আমরা একটা জাতি। তাই নতুন জাতির জন্ম হোল-এখনই না বলে-একটি বাস্তব সত্য মিথ্যার কারামুক্ত হোল একথাই ঠিক। সত্য বনাম মিথ্যার চূড়ান্ত এই মুখোমুখি সংঘর্ষে পতন হয়েছে মিথ্যার, কিন্তু এ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে সত্যও হয়েছে মারাত্মক ক্ষতবিক্ষত। সে জন্যেই এখন বিজয়ের উল্লাসে বুদ হয়ে আমাদের খুখীর তুফানে ভেসে যাওয়া চলবে না। এখন অনেক কাজ।

কারামুক্ত হলেই মুক্তি নয়, মুক্তির জন্য দরকার বেশুমার ত্যাগের-অনাবিল একতার। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে আমরা শোষিত, ধর্মের নামে ভণ্ডের অত্যাচারে জর্জরিত। আমাদের আকাশে এখন নতুন সূর্য- কিন্তু মাটিতে ২৪ বছরের ভাগাড়ের ধ্বংসাবশেষ। শকুনেরা চব্বিশ বছর ধরে- আমাদের মরা আত্মাকে নখ দিয়ে ছিঁড়েছে, গায়ের

<005.007.225>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

জোরে এই ভাগাড়েই কামড়াকামড়ি করেছে একে অন্যে। এই চব্বিশ বছরের নৃশংস ভাগাড়কে, শকুনের উচ্ছিষ্ট এই হাড়গোড়ের পাহাড়কে অপসারণ করে যদি সজীব করতে পারি তাহলে হবে আমাদের সত্যিকারের মুক্তি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক।” নজরুল বলেছেন, “সজীব করিব মহাশ্মশান”। এই শপথই আমাদের সত্যিকারের মুক্তির শপথ।

আমাদের অনেক ক্ষত-জাতায় দেহ আজ ক্ষত ত। এই মুক্তির প্রভাতে আমরা হয়তো মনের ক্ষতই উপলব্ধি করছি গভীরভাবে ।

আমাদের এখনই ফিরে যেতে হবে ১৯৫২-র সেই ভাষা আন্দোলনে, আমাদের এখনই ফিরে যেতে হবে ১৯৪৮-এর মোহাম্মদ আলী জিন্না সেই সমাবর্তন বক্তৃতায়, সে বক্তৃতায় জিন্না বলেছিলেন,- “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে।”

আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ বরকত, সালামের মায়ের কথা- আজকের খসরু ড্রাইভারের মায়ের মতই। এ স্বাধীনতাকে তাদেরও ভাগ আছে সমান সমান। স্বাধীনতার প্রত্যেকটি শহীদকে আমাদের জানতে হবে। এ যুগের দধীচির মতই। এবং সেখান থেকে শুরু করতে হবে এই নতুন জাতির পুনর্গঠন।

শত্রুরা আমাদের অর্থনীতিকে যেনম তছনছ করেছে তেমন তছনছ করেছে সংস্কৃতি ও জাতীয় সম্রমকে। একটা জাতির বিকাশে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা যেমন বাধ্যস্বরূপ, তেমনই সমান প্রতিবন্ধক হল সাংস্কৃতিক সংকট। আমাদের সামনে এখন দুটোরই সংকট অতিমাত্রায়। জাতির অর্থভাণ্ডার আজু মুক্তির উষালগ্নে যেমনই শূন্য, সংস্কৃতিও একইভাবে শূন্য। শত্রুরা জাতীয় তহবিলের অর্থের মতোই শেষবেলায় রাইফেল দিয়ে লুটিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী তথা শিল্পী গোষ্ঠীকে।

সব খুইয়ে মুক্তি পেয়েছি বলে আমাদের হতাশায় ভেঙ্গে পড়া ভুল- শূন্যতা আমাদেরই পূর্ণ করতে হবে। মোড়লী করেছে এতকাল। আমাদের মাটিতে ফসল ফলে- আমাদের ভেতর থেকেই এসছিলেন জাতীয় সংস্কৃতিক বা বুদ্ধিজীবীরা। সুরের ইন্দ্রজাল বা মধুকণ্ঠ আমাদেরই ঘরের ফসল। তাই শূন্য দেখে ভেঙ্গে যাওয়া মানেই পূর্ণতার পথে কাটা দেওয়া। শত্রু র শিবিরে নির্যাতিতা বোনদের দেখে আমাদের শিউরে ওঠার প্রয়োজন নেই। তাদের সামনে আমরা মুখ তুলেই দাঁড়াবো। আমাদের ছেলেরাই দেবে তাদের এই চরম ত্যাগের বখশীস। তাদের ত্যাগের মর্যাদা দিতে যদি আমরা না পারি তাহলে অসংখ্য-শহীদকেও আমরা অপমানিত করবো- কারণ শহীদের আত্মার সঙ্গে এই নির্যাতিত আত্মার যোগ খুবই নিবিড়।

আমরা জীবন দিয়েই নতুন জীবন লাভ করেছি। ত্যাগের মধ্যে দিয়ে এসেছে আমাদের এই মুক্তির প্রভাত, তাই সেই ত্যাগ দিয়েই এই মুক্তিকে আমাদের বরণ করতে হবে- ভোগ দিয়ে শুরু করে নয়। আমরাই প্রমাণ করেছি- ভোগের জগৎ মিথ্যা এবং মিথ্যা বলেই আজ চব্বিশ বছর পরে ভোগের চিরনিবৃত্তি হোল।

আজ নতুন দিনের এই প্রভাতবেলায় আমাদের আরো ত্যাগের জন্য শপথ নিতে হবে। কারণ, কোন মতেই আবার যেন আমাদের এই মুক্ত আকাশ কালো মেঘে না ঢেকে যায়, কোনোমতেই যেন আজকের এই মুক্ত বাতাস আবার বিষিয়ে না যায়।

<005.007.226>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অর্থ নাই- তাতে কী? আমাদের মাটিতে সোনা ফলে। যে সোনার বাংলাকে কবি ভালবেসে গেছেন, কবি যে বাংলার মুখ দেখে আশান্বিত হয়েছেন- সে বাংলাকে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙলী আবার ভরিয়ে তুলতে পারবো।

শকুনেরা চলে গেছে, ফেলে গছে অজস্র হাড়গোড়। তাই আমরা এখনও মুক্ত নই, শকুনমুক্ত মাত্র। এই জন্যেই আনন্দ মিছিলে আমাদের উল্লাস করার মত সময় নেই- এখন ত্যাগের মুহুর্ত। ঝটিকাবিধ্বস্ত জাতির ভাঙ্গা কাঠামোকে পূর্ণ উদ্যম গড়ে তোলার কাজে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে আমাদেরই। মনে রাখতে হবে, ব্যথা আমাদের এবং তা আমাদেরই দেহে। তাই এখন শুধু উল্লাস নয়, এখন অনেক কাজ।

(হাফেজ আলি রচিত)

<005.008.227>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত আরও বাংলা কথিকা “শব্দসৈনিক”
ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১

রাজনৈতিক বঞ্চনার নেপথ্যে

১৪ আগস্ট, ১৯৭১

আজ উনিশশো একাত্তর সালের চৌদই আগষ্ট। মাত্র এক বছর আগেও এই দিনে আমি ছিলাম ঢাকায়। আমার প্রিয় পরিজন, পরিচিত পরিবেশের মধ্যে। আমার চোখে কত স্বপ্ন, দেশ স্বাধীন, স্বাধীন দেশে এই প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচনে দেশে আসবে বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা। সর্বোপরি দেশের মানুষ পাবে তাদের হারানো অধিকার।

এই অধিকার আমরা পাইনি। তার বদলে পেয়েছি বুলেট। পচিশে মার্চ মধ্যরাতে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেছে, চারদিকে কামান আর ট্যাঙ্কের গর্জন। অসহায় মানুষের ভীত আর্তনাদ। রক্তে ঢাকা শহর ভেসে গেছে। সারা বাংলাদেশ ভেসে গেছে। আর সেই রক্তের স্রোতে ভাসমান স্তুপীকৃত লাশ। শিশু-নারী-বৃদ্ধ-যুবকের মৃতদেহ এই লক্ষ মানুষের মৃতদেহের স্তুপের নীচে ইয়াহিয়া চাপা দিতে চেয়েছে বাঙালীর আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আমার পিতার সাধের গোলার ধান পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। আমার মাকে দিয়েছে এক-বুক হাহাকার উপহার। গত ২রা জুন তারিখে আমার কৈশোর আর যৌবনের হাজারো স্বপ্নমাখা ঢাকা শহর ছেড়ে যেদিন মুক্তাঞ্চলের দিকে পা বাড়াই, সসিদন জ্যৈষ্ঠের বাংলার তপ্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলেছি, মাগো, আবার যেন তোর কোলে ফিরে আসতে পারি। ফিরে আসতে পারি স্বাধীন বাংলার পতাকাশোভিত তোর ছায়া-সুনিবিড় নীড়ে। খুনী ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাবাহিনী আমার চোখ থেকে স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে, আমার রক্তে। কিন্তু সে আমার মৃত্যুঞ্জয় কালজয়ী আবহমানের স্বাধিকার-চেতনা হরণ করতে পারেনি। তাই আজ মুক্ত বাংলার বুকে লক্ষ মুক্তিফৌজ প্রস্তুত। আমার একমাত্র সান্তনা, আমি আমার দেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিফৌজের পাশে রয়েছে। যদি মরতে হয় স্বাধীনতার জন্য মরবো, যদি বাঁচতে হয় স্বাধীন জাতির গৌরব ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচবো।

চৌদ্দই আগষ্টের কথা বলছিলাম। এই দিনটি পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু গত ২৫শে মার্চ বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া মধ্যরাতের বর্বরতায় যে পাকিস্তানকে হত্যা করেছে, তার আবার স্বাধীনতা-দিবস কি? বাঙালীর স্বাধীনতা স্বাধীন বাংলার স্বাধীনতা। এই স্বাধীন বাংলার স্বাধীনতা দিবস আমরা পালন করবো ঢাকায়, রাজপথ থেকে ইয়াহিয়ার দস্যুচক্রের রক্তচিহ্ন মুছে, শিশুঘাতী নারীঘাতী বর্বরতার শেষচিহ্ন লুপ্ত করে স্বাধিকার-চেতনার নতুন উৎসবে মুখর হবে ঢাকা, উদ্ভাসিত হবে সারা বাংলাদেশ। বিশ্বাস করুন, এই প্রত্যয় নিয়ে আমি বেঁচে আছি। আমার বিশ্বাস বাঙালীমাত্রেই এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছেন।

চৌদ্দই আগষ্ট আমারও স্বাধীনতা দিবস হতে পারতো। কিন্তু তাকে হতে দেয়া হয়নি। যা হতে পারতো আমার প্রাণের, ধানের, গানের, সৌরভ, তাকে করা হয়েছে আমাকে দমানোর-নির্মমভাবে দমনের হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার আজ ভেঙে গেছে। তাই চৌদ্দই আগষ্ট আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জীবনে মৃত আর এই একটি

<005.008.228>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দিবসের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে নব-জন্মগ্রহণ করেছে গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলা। বঙ্গবন্ধু যার নেতা। আমি, আপনি সকল বাঙালী যে স্বাধীনতার অগ্নিরথের আরোহী।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকার, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় সমঅংশীদারিতু দেয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না করাচী ও ইসলামাবাদের শাসক চক্রের। তারা চেয়েছে বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক কলোনী প্রতিষ্ঠা করতে। আর এই কলোনী শাসনের জন্য চেয়েছে বাঙালীর উপর একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভুত্ব। সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের ততোধিক সংখ্যালঘু একটি আমলাতান্ত্রিক সামরিকচক্র গত তেইশ বছর বাংলাদেশকে শাসন করেছে, তাদের অনুগৃহীত তেইশটি পরিবার বাংলাদেশেকে যথেচ্ছ শোষণ করেছে, তাদের পণ্যের একচেটিয়া বাজার করে রেখেছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কোন কোন খ্যাতনামা রাজনৈতিক ভাষ্যকার সম্পূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার অশ্বেতাঙ্গদের উপর মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গের শাসনের অনুরূপ। পিণ্ডির শাসকচক্র ও প্রিটোরিয়ার শাসকচক্রের ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক ও মানবতাদ্রোহী ভূমিকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বাঙালীর ভাষা, বাংলাদেশের সংস্কৃতি-এক কথায় যা কিছু বাঙালীর জাতীয় চেতনার মহত্তম প্রকাশ, ১৯৪৮ সাল থেকে তাকে বার বার ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে, এই একটিমাত্র লক্ষ্য থেকে। এবং সেই লক্ষ্য হল বাঙালীর রাজনৈতিক অধিকার হরণ। বাংলাদেশে পিণ্ডির একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা।

এই প্রভূত্বের বিরুদ্ধে, এই নির্মম শোষণ আর শাসনের বিরুদ্ধে যিনিই কথা বলেছেন, বাংলাদেশের বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, করাচী এবং পিণ্ডির শাসকচক্রের চোখে তিনিই হয়েছেন দেশদ্রোহী। বৃটিশ আমলের আমলা গোলাম মোহাম্মদ শেরে বাংলা ফজলুল হকের মত বরেণ্য নেতাকে বলেছেন দেশদ্রোহী, তার বিচার করতে চেয়েছেন। মীরজাফরের বংশধর ইস্কান্দার মীর্জা হুমকি দিয়েছেন, তিনি গুলি করে মারবেন বয়োবৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে। ইংরাজ আজলের পা-চাটা সিপাই আইয়ুবের চক্রান্তে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশের বাইরে সুদূর বৈরুতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছে। আজ আইয়ুবের বিশ্বাসঘাতক দক্ষিণ হস্ত ইয়াহিয়ার চক্রান্তে প্রাণপ্রিয় মুজিব ভাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত। চলছে তার প্রাণ হননের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।

বাংলাদেশের এমন একজন বরেণ্য নেতা নেই, যিনি পিণ্ডির প্রাসাদ-চক্রীদের কাছ থেকে দেশদ্রোহী আখ্যা পাননি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বাধিকারের দাবি যিনিই করেছেন, তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহীতার দায়ে। পিণ্ডির এই নির্মম পীড়ন-চিহ্ন আজ যারা বাংলাদেশের শরীরে। ১৯৪৭ সালের পর এমন একটি বছর নেই, যে বছর বাংলাদেশে রক্ত ঝরেনি, মায়ের বুক খালি হয়নি, সন্তানহারা বাপের বুকফাটা আর্তনাদ বাংলাদেশে আকাশ বিদীর্ণ হয়নি। বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখ কি একটি? ১৭ই মার্চ, ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ৭ই জুন, ২০ শে জানুয়ারি, ২৫ শে মার্চ কত রক্তাক্ত তাখির আর এই তারিখের বীভৎস বর্বরতার কথা বলবো? সবশেষের তারিখ এই ২৫ শে মার্চ তারিখ। ছাত্র-যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ব্যবসায়ী মজুর, ঘুমন্ত বস্তিবাসী নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে অকাতরে হত্যা করা হল একটিমাত্র উদ্দেশ্যে, এবং তা হল বাঙালীর স্বাধিকার হরণ।

তাই বাংলাদেশ আজ বিদ্রোহী। স্বাধীনতার রক্তপতাকার নিচে জমায়েত হয়েছি আমরা কোটি কোটি বাঙালী। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর প্রিয় মুজিব ভাই। এই একটি নাম আজ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী প্রেরণা। বাঙালীর স্বাধিকার চেতনার সঙ্গে এই একটি সংগ্রামী মানুষকেও হত্যার জঘন্য ষড়যন্ত্র চলছে পিণ্ডির খুনী চক্রীদের মধ্যে।

আমি সূর্যসম্ভাবনার বিশ্বাসী। বুড়িগঙ্গার পলিমাটিতে তৈরি নতুন জীবন সম্ভাবনাতেও আমি আস্থাবান। এত রক্ত আমরা দিয়েছি, এই রক্তপিচ্ছিল পরে স্বাধীনতার সূর্যোদয় অবশ্যম্ভাবী।

<005.008.229>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আমরা আবার ফিরবো ঢাকায়। আমাদের নতুন স্বাধীনতা-দিবসে উৎসব হবে। প্রিয় পরিজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই উৎসব দিবসটি পালনের জন্য আমি অপেক্ষা করছি। আমি জানি, আমার স্বপ্ন, আমার প্রতীক্ষা সফল হবেই।
(আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত)

প্রতিধ্বনি

১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সেখানে অন্যায় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, যেখানে মানুষ মানুষের রক্ত চোষে, যে দেশে রক্তের স্রোত বয়, পংকিলতা আর কুটিলতার শত আচ্ছাদন ভেদ করে সেখানেই ফুটে ওঠে নতুন সূর্য রক্তনদীর ঢেউ চুরমার করে দেয় শোষণ-নির্যাতনের যাতাকল। এটাই চিরন্তন সত্য। আর এই মহাসত্যের ভিত্তিইে এই নরম রোদের দেশবাংলায় আজ আমরা হয়েছি সৈনিক। পক্ষান্তরে পাক জঙ্গিশাহী বাংলাদেশে শোষণ, নির্যাতন ও নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েও যখন আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারনি বরং বাংলাদেশের অর্থের ওপর নির্ভরশীল গোটা পশ্চিম পাকিস্তানই টুকরো টুকরো হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে, তখন গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বজনমতকে ধোঁকা দেবার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে ইয়াহিয়া চক্র।

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় খুনী টিক্কার পরিবর্তে ডাক্তার মালিককে গবর্নর নিয়োগ এমনি একটি চক্রান্ত। এর পেছনে জঙ্গিশাহীর চারটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত বাঙালী গবর্নর নিয়োগ করে বাঙালীদের বিভ্রান্ত করে যুদ্ধকে দুর্বল করে দেয়। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন চালু হচ্ছে বলে বিশ্ব-বিবেককে ধোঁকা দেয়া।

ডাক্তার মালিককে গবর্নর নিয়োগের তৃতীয় কারণটি হচ্ছেঃ ইয়াহিয়া খান একটা ব্যাপারে অত্যন্ত সুনিশ্চিত যে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার গবর্নর আজ হোক, কাল হোক মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের হাতে নিহত হবেই। সুতরাং জঙ্গিশাহীর কথা হচ্ছে, মরবেই যখন পশ্চিম পাকিস্তানী কেন, একজন বাঙালীই মরুক। চূড়ান্ত এবং প্রধান কারণটি হচ্ছে বেসামরিক প্রশাসনের মুখোশ ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থাকে চাঙ্গা করবার জন্য বৈদেশিক সাহায্যে বাগানো। কারণ বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জঙ্গিশাহীকে সাহায্যদান বন্ধ করে দিয়েছে।

ডাক্তার মালিককে গবর্নর নিয়োগের দুরভিসন্ধি ধরা পড়ে গেছে বিশ্ববিবেকের কাছে। তাই বিশ্বের নামকরা পত্রপত্রিকা ও বেতারে এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া চক্রের কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্রডকাস্টিং কমিশনের রিপোর্টার মি.শ্যোন ও কনার ঢাকা সফর শেষে বলেছেন। “টিক্কা খানকে সরিয়ে ডা. মালিককে দখলীকৃত এলাকার গবর্নর নিয়োগের আসল উদ্দেশ্য বিদেশী সাহায্য বাগানো এবং বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করা।”

এ প্রসঙ্গে গাডিয়ান পত্রিকার মি. মার্টিন এডিনি বি-বি-সি থেকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় অসামরিক গবর্নর নিয়োগ করা হলেও সামরিক তৎপরতার কোন পরিবর্তন ঘটবে না ।” অর্থাৎ “বাংলার নিরীহ জনগণের ওপর পাক বর্বরতা ঠিকই চলবে এবং বেসামরিক গবর্নর ডা. মালিক সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল মাত্র ।”

<005.008.230>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
জন্মভূমি থেকে হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করে দেশকে মনের করে গড়ে তুলতে আজ আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের দুর্বার প্রথিরোধের সম্মুখে টিকতে না পেরে দখলীকৃত এলাকায় জাতিসংঘের রিলিফ কর্মী নিয়োগের আরেকটি চক্রান্ত এটেছে জঙ্গীশাহী। কিন্তু আমরা জানি এই রিলিফ কর্মী নিয়োগের আসল উদ্দেশ্য কি। জঙ্গীশাহী চাচ্ছেঃ রিলিফ কর্মীর কথা বলে বাংলার বুভুক্ষ জনতাকে যেমন যুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা যাবে, তেমনি বিশ্বজনমতকে বাঙালীর দরদি সেজে ধোঁকা দেয়া যাবে।

আমরা এও জানি, জাতিসংঘের এই তথাকথিত রিলিফ কর্মীদের বাংলাদেশে নিয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে জঙ্গশাহীর বর্বরতা-ও পৈশাচিকতায় সহায়তা করা। অর্থাৎ এদের ভূমিকা হবে দস্যুবাহিনীর দালালদের প্রতি আমাদের যে ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে এদের প্রতিও তাই করা হবে।

এই প্রসঙ্গে বি-বি-সি থেকে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর একজন মুখপাত্র জাতিসংঘকে এই বলে হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, তাদের রিলিফ কর্মীদের জঙ্গীশাহীর দালাল বলেই গণ্য করা হবে এবং তারা দালালদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থারই আওতায় পড়বে। বি-বি-সি থেকে আরও বলা হয়, এ ব্যাপারে জাতিসংঘ থেকে কোন মন্তব্য করা হয়নি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর মুখপাত্রের এই হুশিয়ারি জাতিসংঘকে বেশ খানিকটা ভাবিয়ে তুলেছে।”

ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে বলা হয়, “ডেমোক্রাট দলের নেতা এডওয়ার্ড কেনেডির মতো রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর পার্সীও পাকিস্তান সরকারকে আমেরিকান সাহায্য দান বন্ধের দাবী জানান।”

বি-বি-সি রিপোর্টার মিঃ মাটিন বেল সম্প্রতি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের জন্য ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শরণার্থীদের অসীম দুঃখ-দুর্দশাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন- শুনেছেন পাক জঙ্গীশাহীর চরম বর্বরতা ও পৈশাচিকাতর অনেক করুণ কাহিনী। কিন্তু তিনি লাখ লাখ লাঞ্ছিত মানুষের শুধু একটা প্রমাণই দেখেছেন। শুনেছেন একই কথা। চাপ চাপ যন্ত্রণায় সে কথা চাপা পড়ে যায়নি বরং আরো বলিষ্ঠ হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। আর সে কথাটি হচ্ছে বাঙালীর অন্তর মথিত হৃদয়-সঙ্গীত “জয় বাংলা।’

(শহীদুল ইসলাম রচিত)

অমর ১৭ই সেপ্টেম্বর স্মরনে

১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদে বাংলাদেশের দীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন বাংলাদেশের ছাত্ররা বুকের রক্ত দিয়ে সরকারী শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করেছিল। সেই থেকে এই দিন বাংলাদেশের সর্বত্র শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, স্বতন্ত্র পরিস্থিতিতে, দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের মাঝে ১৯৬২ সালের শিক্ষা-আন্দোলনের শহীদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।

পাকিস্তান সরকারের শিক্ষানীতি চিরকালই ছিল জনসাধারণের স্বার্থের থেকে বিযুক্ত। নানারকম প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সার্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দেশে প্রবর্তিত হয়নি, বয়স্কদের শিক্ষার ব্যাপারেও

<005.008.231>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। শিক্ষালাভের সুযোগের ক্ষেত্রেও দেশের দুই অংশে ইচ্ছাকৃতভাবে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার। পশ্চিম পাকিস্তানে এর সংখ্যা ছিল অনেক কম। গত বছরে বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা দাঁড়িয়ে ২৪ হাজার আর পশ্চিম পাকিস্তানে সে সংখ্যা স্ফীত হয়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজারের চেয়ে বেশি।

শুধু স্কুল-কলেজের সংখ্যা নিয়েই কথা নয়। সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্কুলকলেজের যে পাঠ্য তালিকা তৈরী করা হয়, তা প্রকৃত শিক্ষার অগ্রগতির সহায়ক ছিল না; বরঞ্চ ভাষার চাপ, সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তুর অবতারণা এবং অগণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রবর্তনে এই পাঠ্য তালিকা ছিল গঠনশীল চিত্তের পক্ষে ক্ষতিকর। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে চিন্তার ও বক্তব্যের স্বাধীনতা হরণ ছিল সরকারী শিক্ষানীতির অঙ্গ। শিক্ষার প্রশাসনের ক্ষেত্রেও সরকার যে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, তাও স্বাধীন ও ফলপ্ৰসূ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ রুদ্ধ করেছিল। মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাদানের বিষয়েও সরকারী উদাসীনতা ছিল এই নীতির অংশস্বরূপ।

আইয়ুব সরকারের আমলে যে নতুন শিক্ষানীতির অবতারণা হয়, তাতেই এই অগণতান্ত্রিক শিক্ষা পদ্ধতির সম্পূর্ণ চেহারাটা ধরা পড়ে। বাংলাদেশের শিক্ষক ও ছাত্ররা স্বভাবতঃই এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এই প্রতিবাদকে আন্দোলনের রূপ দেওয়ার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছাত্রসমাজের প্রাপ্য। ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সেই আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী দিবস হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।

সরকারী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের সূচনা হলেও, তা শুধু শিক্ষানীতির প্রতিবাদস্বরূপ ছিল না। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান যে একনায়কত্ববাদী শাসনের প্রবর্তন করেন, ১৭ই সেপ্টেম্বরের বিক্ষোভ সেই অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। যখন সারাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পীড়িত হচ্ছিল, তখন ছাত্ররাই বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছিল এবং প্রাণের বিনিময়ে সে আন্দোলনে তারা সাফল্য অর্জন করেছিল। একনায়ক আইয়ুবের সেই ছিল প্রথম পশ্চাদপসরণ। আর এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে ১৯৬৯ সালে- যখন আইয়ুবকে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়।

এরপর ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া-সরকারের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে দেখা গেল শিক্ষাসংক্রান্ত আন্দোলনের আরো স্বীকৃতি ঘটেছে। প্রস্তাবিত নীতিতে শিক্ষা-প্রশাসনের গণতন্ত্রীকরণের ধারণা কিছুটা গৃহীত হয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা পদ্ধতির জন্য যে দাবী শিক্ষক ও ছাত্ররা করেছিলেন, তা স্বীকার করা হয়নি। মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষাদানের প্রস্তাবও সেখানে ছিল না। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা, এই শিক্ষা সংস্কারের প্রস্তাবও শেষ পর্যন্ত ধামাচাপা দেয়া হয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যকেই মেনে নেয়া হয় নীতি হিসাবে। আশা করা গিয়েছিল যে, দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা সম্ভবপর হবে।

কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। তার আগেই সামরিক শাসনের বর্বরতম আঘাত নেমে এসেছে দেশের মানুষের উপর।

আজ বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। দেশকে শত্রু মুক্ত করার পরে সার্বিক পুনর্গঠনের সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার নব রূপায়ণ ঘটবে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের শতকরা আশি ভাগ লোক নিরক্ষরতার অভিশাপগ্রস্ত, সেই শিক্ষাব্যবস্থা দেশের কলঙ্কস্বরূপ। শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে সকলকে। শিক্ষার ভিত্তি প্রসারিত করে গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে আমাদের। শিক্ষার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে কাজের সুযোগ। সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার এই অভিপ্রেত পুনর্গঠন সম্ভবপর হবে না।

<005.008.232>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আজ আমরা সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে ব্যাপৃত। ইতিহাসে অতুলনীয় ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন উষার স্বর্ণদ্বার যেদিন উদঘাটিত হবে, সেদিনই ১৭ই সেপ্টম্বরের আন্দোলন সার্থকতায় উপনীত হবে।

(ডক্টর আনিসুজ্জামান রচিত)

ইয়াহিয়া জবাব দাও
প্রথম সওয়াল
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

আগা মোহাম্মদ এহিয়া খান, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।

আমার সওয়াল খুব ছোট। ইচ্ছে করলে এক কথায় জবাব দিতে পারেন। আপনাকে জিজ্ঞেস করি, ১৯৭০ সনে আপনি ইলেকশন কেন দিয়েছিলেন? একদম সোজা জবাব দেবেন। সাফ, সাফ। তালিবালি করবেন না। কারণ, আপনার খাসলৎ আমাদের জানা আছে। খালি আপনার নয়, পাঞ্জাবে যত ইসলামের চ্যাম্পিয়ান আছে, সকলের খাসলৎ আমাদের জানা। সাংবাদিক হিসেবে আপনার সঙ্গে সফর করবার বদনসীব বা খোশ-নসীব আমার হয়েছে। বেলা এগারোটা না বাজতে আপনার ছাতি শুকিয়ে যায়, আপনার বড় পেয়াস লাগে। আপনার তেষ্টা আবার সাধারণ পানিতে যায় না। পেগের পর পেগ হুইস্কি জরুরৎ হয়।তাই বলছি সাফ-সাফ জবাব দেবেন। বাংলাদেশের মানুষের চোখে অনেক ধুলো দিয়েছেন, আর তা চেষ্টা করবেন না।

আসুন, আসুন, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, এবার ঢুক করে জবাবটা বলে ফেলুন, আপনি নির্বাচন বা ইলেকশান কেন দিয়েছিলেন?

এখন মনে হচ্ছে আপনি নির্বাচনের মানে জানতেন না। ইলেকশান মানে জনগণের রায়। তখন বাংলার মানুষ কী চেয়েছিল? দেশের সাচ্চা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরে আসুক। ইলেকশানের ফল বেরুনোর পরই আপনি বললেন, শেখ মুজিব পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং আপনার যে জনগণের রায়কে সম্মান দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, তা বোঝা যায়। আর কথাটা আপনি মুখ দিয়ে বলেননি আর কোন জায়গা দিয়ে বাতাসে বের করেছিলেন? তার প্রমাণ তখন ছিল না। আপনি মুখই ব্যবহার করেছিলেন।

তবে ওয়াদার খেলাফ করলেন কেন আগা মোহাম্মদ এহিয়া খান? তার ফলাফল কি আপনি জানেন না? জেগে ঘুমাচ্ছেন? আপনার নাম নারীঘাতী, শিশুঘাতী- অন্ধকারে আগুন-লাগানো চণ্ডাল নামে দুনিয়ায় পরিচিত যারা বেঁচে আছে, তারা নিজের বাপ-দাদার বাস্তভিটা থেকে খারিজ। আর কোথাও মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে হয়রান। তাদের বুকফাটা আহাজারী, দুর্দশা-সব আপনার ওয়াদা খেলাফের ফল।

অথচ নির্বাচন বা ইলেকশানের পর কী আপনি বগল বাজাননি? নিজের ঈমানদারী দুনিয়ার কাছে জানাতে বুক টান টান করে ফুলিয়ে দাঁড়াননি? আপনার বোধ হয় খেয়াল নেই? একটু শলা দিয়ে উস্কে দিচ্ছি। আপনার প্রচার বিভাগের পুস্তিকা মানে ছোট কেতাব -Election in the world’s third largest democracy- “দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাজ্যে নির্বাচন” এর পাতায় পাতায় কী নিজের সাফাই গাননি? বইটা এবার

<005.008.233>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

খুলে দেখুন। বাংলা তর্জমা করে বলছি, কান খুলে শুনুন দেখিঃ সেনাবাহিনী সাধারণত বেসামরিক শাসনভার গ্রহণ করে সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়। এই নির্বাচন ঠিক নাটকীয়ভাবে তার বিপরীত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগণের কাছে তার কথা, প্রতিশ্রুতি, ঈমান ঠিক রেখেছেন, স্বাধীন এবং ন্যায্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছেই তিনি ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন।”

শুনলেন ত? আপনার প্রচার বিভাগের কেতাব এ কথা বলছে। আরো জানিয়েছে, ঐ বইয়ের দ্বিতীয় পাতা C-TGF, “The Election results underlined the political maturity, sound commonsense and practicality of the average voter……Parties preching regionalism, tribalism, racialism and religious Bigorty have been short shrift. অর্থাৎ “এই নির্বাচন থেকে বোঝা যায়, জনসাধারণ রাজনৈতিক দিক থেকে কত পাকা। তাদের সাধারণ জ্ঞান কত খাঁটি। যেসব পার্টি আঞ্চলিক, বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মীয় গোঁড়ামির কথা বলেছে, সাধারণ মানুষ তাদের তওবা করার সময় পর্যন্ত দেয়নি।

এরপরও কী আপনি বলতে পারেন শেখ মুজিব দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল? যা ঘটছে সব হিন্দুদের কারসাজি? সব গণ্ডগোল ভারতের ফন্দী- এসব ধুয়া আপনি তুলতে পারেন? না তোলার কোন সুযোগ আছে, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান?

আজ সর্বদা আমানুল্লাহ খান যে বাংলাদেশে আপনার জনসংযোগ-অফিসার, তিনিই তা ঐ পুস্তিকা লখেছিলেন তার দপ্তর থেকে প্রকাশিত।

সর্দার আমানুল্লাহ পাঠানের বাচ্চা। তাকেও আপনি ঝুটটা বানিয়ে ছেড়েছেন। এ-ই ঘটে দুনিয়ায়। মিথ্যেবাদীর সঙ্গে যে বসবাস করে, সেও সিথু্যকে পরিণত হয়। সঙ্গ দোষ।

ইয়াহিয়া, জাবব দাও, তুমি কেন ওয়াদা খেলাপ করলে?

(শওকত ওসমান রচিত)

ঝিলামের চার ভাই
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে অবস্থানকালীন কয়েকটি ঘটনার স্মৃতি আমার মনে আজও অনেক অনেক ঘটনার সাথে জেগে রয়েছে। অজস্র ঘটনার সমষ্টি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আমার অবসর সময়ে জাতীয় অনেক অনেক চিন্তার মেঘ এসে আবৃত করে ফেলে। আমি যেন সম্বিতহারা হয়ে পড়ি। হৃদয়ের কোন সূর্য তারে এক অদৃশ্য হস্তের টোকায় যে শব্দ ধ্বনি উত্থিত হয় তা যেন বেদনার মতো শীতল। আগ্রাসী নিস্তব্ধতা যেন আমার সমস্ত সত্তাকে ছেকে ধরে। আমার উন্মনা উদাসী মন আমার শ্যামল বাংলার পথ-ঘাট, গঞ্জ-গ্রাম, বন্দর-নগরের পরিধি পেরিয়ে চলে যায় (এক সময়ে আমাদেরই দেশে অংশ হিসেবে বিবেচিত) পশ্চিম পাকিস্তানের ঝিলাম, নওশেরা, লায়ালপুরে। সেখানকার খেটেখাওয়া মজুর চাষীদের পূর্ণ কুটিরে। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে ক্লান্ত-অভুক্ত কোন পরিবারের মরুভূমি আবাসে।

সেদিন দাঁড়িয়েছিলাম বায়তুল মোকারমের একটি ষ্টীল ফার্নিচারের দোকানের সামনে। আমার কাছে একটি গোপন বার্তা। এ বার্তাটি নিয়ে একজন মুক্তিসেনা চলে যাবে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্পে। এ বার্তার

<005.008.234>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

আলোকে রাতের কমান্ডো আক্রমণের ধারা রচিত হবে। বার্তা যার হাতে দেওয়ার নির্দেশ তাকে আমি চিনি না। আমার হাত থেকে যিনি বার্তা নেবেন তিনিও আমাকে চেনেন না। কিন্তু উভয়ে উভয়কে প্রথম দৃষ্টিতে চিনে নেয়ার একটি বিশেষ সংকেত ছিল।আমাদের শার্টের বিশেষ একটি দৃশ্যমান স্থানে একটি বিশেষ চিহ্ন ছিল। আমরা দু’জন দু’জনকে চিনলাম এবং কৌশলে বার্তাটি হস্তান্তর করলাম। এরপর আমার কাজ শেষ। তেজগাঁর কোন এক স্থানে চলে যাবো পরবর্তী নির্দেশ গ্রহণের জন্য। অনেক চেষ্টা করে একটা বেবী ট্যাক্সি পাকড়াও করলাম। গ্যারিসন শহর ঢাকা নগরীতে বেবী ট্যাক্সি পাওয়া দুস্কর। চালকের অভাবে অধিকাংশ যানই মালিকদের গৃহে পড়ে রয়েছে। ২৫শে মার্চের মধ্যরাত থেকে পাইকারী হত্যাকাণ্ড চালানোর পর বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে অসংখ্য বেবী ট্যাক্সি চালকও মার্কিন ও চীনের বুলেটের শিকার হয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন জীবনধারণের তাড়নায় তাদের কেউ কেউ রাস্তায় বেবী ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়েছেন। কিন্তু রাস্তায়ও ভয়। কারণ ট্যাক্সিতে আরোহণ করে কিন্তু ভাড়া দেয় না। ভাড়া চাওয়ার দুঃসাহস দেখলে চালক সাথে সাথে ভারতীয় চর বা মুক্তিবাহিনীর এজেন্টে পরিণত হয়ে যান এবং এদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার অবাধ অধিকার জল্লাদ বাহিনীর রয়েছে। এমনকি রাজাকারাও এ জাতীয় হত্যা চালাতে পারে। হত্যার জন্য কোন জবাবদিহি হয় না, বুলেটের হিসাব দিতে হয় না। এ জাতীয় হত্যার জন্যে উপরি বাহবা পাওয়া যায়।

বেবী ট্যাক্সিতে আমি উঠে বসেছি। এমন সময় একজন দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ সৈনিক আমাদের থামাতে ইশারা করলো। সৈনিকটি কাঁধে একটি অটোমেটিক চীনা রাইফেল। রাইফেলের নলটি আমাদের দিকে উদ্যত নয় বলে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। তবু যেন আমার মনে হলো বেবী ট্যাক্সির দিকে প্রতিটি বুটের পদক্ষেপ যেন আমার মৃত্যুর সময়সীমাকে ঘটিয়ে আনছে। একটি চীনা সীসার গুলি আমাকে প্রাণহীন করে দেবে। যেমন ১০ লক্ষ বাঙালীকে তারা প্রাণহীন করে দিয়ে ৭ কোটি ৪০ লাখ বাঙালীকে রক্তের বদলা নেওয়ার জন্য অবিস্মরণীয় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করেছে।

কিন্তু না-সৈনিকটি আমাকে গুলি করল না। বাঙালীর জাত তুলে গালাগালিও করলো না। আমাকে লাথি মেরে বেবী ট্যাক্সি থেকে ফেলেও দিলো না। শুধু উর্দুতে জিজ্ঞেস করলো আমি কোথায় যাবো। আমি বললাম তেজগাঁ ফারমগেট। সে বেবী ট্যাক্সিতে উঠে বললো, আমিও ওদিকে যাবো। প্রতিবাদ করার সাহস আমার ছিল না। আমি সরে জায়গা করে দিলাম। সৈনিকটি কাঁধ থেকে রাইফেলটি হাতে নিয়ে তার দু’পায়ের ফাঁকে তা দাঁড় করিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। জিপিও ছাড়িয়ে, প্রেসক্লাব সামনে ফেলে হাইকোর্টের কাছে আসার পর নির্বাক সৈনিকটি সবাক হলো। সে আমার নাম জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম। জিজ্ঞেস করলো আমি মুসলমান কি না। বললাম নামেই তো বুঝতে পারছো। সৈনিকটি আবার চুপ করে গেলো।

আবার সে মুখ খুললো। অনেকটা জনান্তিকেই যেন বললো- তোমরা বেশ আছো! তোমরা বেশ আছো!

আমি এবার কথা জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম। আমি বললাম, আপনারাও তো বেশ আছেন। বাঙালী কেমন আছে একথা তাকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আমার কাছে যে হায়েনাটি বসে আছে কত বাঙালীর রক্ত তার দেহে লেগে রয়েছে। হয়তো আমার কোন বোন এ পশুটির লালসার শিকার হতে অস্বীকার করায় বেয়নেটের খোঁচায় জীবনকে আলিঙ্গন করেছে। আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না! তাই আবার বললাম- আপনারা তো বেশ আছেন। ভালো খাওয়া, ভালো পোশাক আর জীবনের নিরাপত্তা। প্রশ্নে একটু যেন জ্বলে উঠলো।

<005.008.235>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বললো সে তার কথা। সুখে থাকার কথা। ঝিলামের সুদেহী দীর্ঘকায় যুবকটি বললো তার কথা। সে বললো- সকালে নাস্তা দেওয়া হয় এক চামচ সেমাই আর এক চামচ ভিটামিন। ব্যস। এ খাবার খেয়ে হয়তো বেঁচে থাকা যায়; কিন্তু যুদ্ধ করা যায় না। খাওয়ার মান অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই ক্ষিধে পেলেই সৈন্যরা দোকানে ঢুকে খেয়ে নেয়। পয়সা চাওয়ার সাহস করে না দোকানদাররা।

একটি বিমর্ষ কণ্ঠ থেকে শব্দ ঝরে পড়ছিলো। আমি খেতেও পারিনে। খেতে গেলেই ভাইদের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার আম্মার মুখ ভেসে ওঠে।

ভাবলাম ভাইদের হয়তো খুব ভালোবাসে। তাই বিদেশ, বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে এসে ভাইদের কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছে। বললাম- তারা বুঝি ঝিলামে রয়ে গেছে? সৈনিকটি বললো- না। তারা মাশরেকী পাকিস্তানের মাটির নিচে শুয়ে আছে।

এই সৈনিকটির চার ভাই বাংলাদেশের যুদ্ধে রত ছিল। তিন ভাই ফেনী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছে। আমার পাশে বসা এই জানোয়ারটি আরও অনেক জানোয়ারের মতো আমার বাংলাদেশের অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু-হত্যার জন্য দায়ী। তার খাকী রং আমাদের অনেক অনেক রক্তে রঞ্জিত। তবু পশুটির সাথে আমি বসে রয়েছি বলে আমার চাঞ্চল্য চাপা রাখতে হলো। সে কাদো কাঁদো হয়ে বললো যে, সে তার মাকে কি জবাব দেবে। যে মায়ের চার সন্তান ছিল, এখন তার মধ্যে তিনজনই চিরদিনের জন্য অনুপস্থিত হয়ে গেছে। তেজগাঁ আসার পর সে নেমে পড়ে। আমি এবং বেবী ট্যাক্সি ড্রাইভার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

(ইলিয়াস আহমদ ছদ্মনামে সলিমুল্লাহ রচিত)

রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম

৬ অক্টোবর, ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বছরের অর্ধভাগ পেরিয়ে গেলো। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছমাস পূর্ণ হয়েছে। একটি জাতির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে ছ’মাস সময় তেমন কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের কাছে এই ছ’মাস সময়ের ব্যাখ্যা অনেক বেশী, অনেক ভিন্নভাবে মূল্যবান। কেননা যে সামরিক এক নায়কতন্ত্রের হিসাব কষা ধারণা ছিলো মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, সেখানে ছ’মাস প্রতিনিয়ত সংগ্রামমুখর একটি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অস্তিত্ব আমাকে নিঃসন্দেহে সগর্বিত জবাব দেবার অধিকার দেয়, আমি গর্ববোধ করি।

আমরা গর্ববোধ করি, আমরা যুদ্ধ করেছি। আমরা গর্ববোধ করি আমাদের বাঁচার সংগ্রামে। কারণ আমরা যুদ্ধ করে বেঁচে আছি, আমরা যুদ্ধ করে মরছি। আমাদের অস্তিত্ব আজ তাই পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত প্ৰভু, ভূস্বামী পুঁজিপতি কিংবা বর্বর সামরিকতন্ত্রের অনুগ্রহ নয়, আমাদের অস্তিত্ব আমাদের অর্জিত অধিকার। এ কারণে আমি গর্ববোধ করি। আমরা সবাই যুদ্ধ করে বেঁচে আছি কিম্বা বেঁচে থাকার জন্যে যুদ্ধ করছি, আমাদের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য যুদ্ধ করছি- এ আমার অহংকার ও এ আমার সম্মান। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের অস্তিত্বকে আমরা নিরাপদ না করে পারি না, আমরা সে জন্য যুদ্ধ করছি। আমরা যুদ্ধ করছি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ। মনে পড়ে ছ’মাস আগের কথা। ২৮শে মার্চ ঢাকা থেকে বেরিয়ে চলেছি

<005.008.236>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

গ্রামের দিকে। ঢাকা থেকে দীর্ঘ পথ। যানবাহন নেই। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকায়, এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে চলেছি। আমার একজন সহযাত্রী বন্ধু নিজের হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে পুরে অতি সন্তৰ্পণে একটি রেডিও সেট নিয়ে এসেছিলেন। ফরিদপুরের দিকে পদায় আমরা নৌকা নিয়ে চলেছি। রেডিও সেটটি হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ শুনলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বলছি। সহসা বুকের মধ্যে লাল রক্ত যেনো ফিনকি দিয়ে উঠলো। স্থানকাল ভুলে আমরা ক’জন সহযাত্রী আনন্দে একসংগে চিৎকার করে উঠলাম, চিৎকার করে উঠলাম আমরা বেঁচে আছি, আমরা বাঁচবো।

হয়তো পদ্মার বক্ষ থেকে আমাদের সেদিনের সেই উল্লাসধ্বনি ক্ষণিকেই বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু রক্তের মধ্যে সেদিন যে প্রবল উত্তাপ অনুভব করেছিলাম তা আজো ভোলা যায়নি। জানি না, যুদ্ধের জন্যে কখনো এমন হয় কিনা। এতো দিন নিজের মানসিকতা সম্পর্কে যতোটুকু সচেতন হয়েছি, তাতেও জানি যে নিরাপদ নিৰ্ব্বঞ্জাট জীবনের সপক্ষেই আমার মানসিক প্রস্তুতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদিন যুদ্ধের সংবাদে, আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের ঘোষণায় পবিত্র আনন্দে ফেটে পড়েছিলাম। দীর্ঘ শীতরাত্রির নিরুত্তাপ নিঃশব্দ অন্ধকারের পর এই যেনো প্রথম আমাদের রক্তের মধ্যে দারুণ উত্তাপ বোধ করেছিলাম। যুদ্ধ কোনো মানুষকে এমন জীবিত করে তোলে এর আগে কখনো এমন ভাবতে পারিনি। পচিশে মার্চের সেই ভয়ংকর দুঃসহ অন্ধকার ২৬, ২৭ ও আটাশের দিবালোকেও ছিলো এরো বেশি স্পষ্ট, সমাচ্ছন্ন। আর বহু হাতড়িয়েও সে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিলো, নিজের সবকিছু নিয়ে সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা ও এলামেলো ভাষারাজী নিয়ে ক্রমাগত যেনো কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি; কোথায় তা জানিনে, তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে, ভয়ানক অস্বাভাবিক অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি।

দীর্ঘ পাঁচদিন পর এই আমাদের প্রথম ভোর হলো। জানিনে ইতিহাসে কারো জীবনে কখনো দীর্ঘ পাঁচ শেষ হয়েছিলো পুরো পাঁচদিন পরে। পুরো পাঁচদিন পর এই প্রথম বুঝলাম, ভোর হচ্ছে, আলো আসছে। অথচ আমরা তখন কোনো বন্দী শিবিরে ছিলাম না, ছিলাম না দেয়াল ঘেরা কারান্তরালে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যখন প্রথম শুনলাম আমরা যুদ্ধ করছি, বিশ্বাস করুন, আমার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে তখনই কেবল অনুভব করলাম যে, দীর্ঘ পাঁচদিন পর ভোর হলো। তখন কেবল বোধ করলাম যে আমি বেঁচে আছি। নিজের পায়ে হাত দিলাম, রক্তের উত্তাপ নিলাম। দেখলাম আমি মরিনি।

আমি তাই জানি না আর কোনো মানুষের যুদ্ধের সংবাদ এমন শিহরণ এনেছে কি না। কিন্তু আমি জানি, আমরা সেদিন অস্ত্র হাতে পথে না নামলে আমরা মরে যেতাম, এই মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুলে মাথা উচু করে না দাঁড়াতে পারলে আমরা মরে যেতাম। অথবা বেঁচে থাকতামথ- কিন্তু সে দুই-ই মৃত্যু। কারণ আমরা জানি, এ আমাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, আমাদের অস্তিত্বের যুদ্ধ। আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন হানাদার দস্যুদের অধিকৃত অঞ্চলে ঢুকে তাদের ওপর মরণ আঘাত হেনে। তারা যুদ্ধ করেন, এক- একটি অঞ্চল মুক্ত করেন হানাদার দস্যুদের পাপপঙ্কিল অধিকার থেকে। সেখানে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের ভালোবাসার বিজয় পতাকা। সেখানে খুলে দিয়ে আসেন আমাদের উত্তর পুরুষের আগামী সুখীস্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ জীবনের সোনালি স্বপ্ন, ওরা তাই যুদ্ধ করে; যুদ্ধ করে বাঁচে, যুদ্ধ করে মরে- মরেও বেঁচে থাকে। আমরা বেঁচেও মেরে ছিলাম, তাই আমরা যুদ্ধ করছি- আমরা মরেও বেঁচে থাকবো। তাই আমরা রক্ত দিচ্ছি, আমরা রক্ত দিয়ে রেখে গেলাম আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের দুর্জয় স্বপ্নের ফুল। ফ্রন্টে আমাদের মুক্তিসেনারা অবিরাম যুদ্ধ করছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য; ঘরে আমাদের জায়া-জননী, ভগ্নীরা যুদ্ধ করছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য, শরণার্থী শিবিরে শিবিরে লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনের সংগে যুদ্ধ করছে বেঁচে

<005.008.237>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

থাকার জন্য, আমাদের অস্তিত্বের জন্যে। হানাদার আক্রমণকারীর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী, তার যুদ্ধ সাময়িক, কিন্তু আমরা যারা বাঁচার জন্য যুদ্ধ করছি- এ যুদ্ধের শেষ নেই।

(মহাদেব সাহা রচিত)

রেনেসাঁর সূচনাঃ বাংলাদেশ

৪ নভেম্বর, ১৯৭১

রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ কথাটা আজ নানা সূত্রে- বিশেষ করে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ প্রগতি উপলক্ষে বারংবার উচ্চারিত। রেনেসাঁর দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের সামনে রয়েছে বহু আলোচিত ইওরোপীয় রেনেসাঁ এবং উনিশ শতকে বাংলার রেনেসাঁধর্মী নবজাগরণ। বর্তমানে বাংলায় যে মুক্তি আন্দোলন বাঙালী চাই। এই জাগরণ বা অভ্যুত্থানকেই রেনেসাঁ না বলে রেনেসাঁর লক্ষণ বলতে চাই এই কারণে যে, রেনেসাঁ মুখ্যতঃ গঠনধর্মী, আর এখন আমরা একটি অচলায়তন ভাঙ্গার কার্যে ব্ৰতী- ভাঙ্গার পরে গড়বার পালাস্বভাবতঃই সে দায়িত্বও হবে দুরূহ এবং তাতে প্রয়োজন হবে মুক্তিযুদ্ধের মতোই চরিত্র ও সংকল্পের প্রতি একনিষ্ঠতা। বর্তমান সংগ্রামে যে দুর্জয় শক্তি ও মানসিক বলের পরিচয় বাঙালী দেখিয়েছে- তা মুক্ত নবজীবনকে অঙ্গীকার করার প্রবল বাসনা থেকেই জাগ্রত।

বাঙালীচিত্তের এই নবজীবন প্রয়োগের পশ্চাতে যেসব অনুপ্রেরণা কার্যকরী সেসবের লক্ষণ বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারব রেনেসাঁর সূচনা কত স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী।

স্বাধীনতা নিজেই একটি জাতির জীবনে অনুপ্রেরণাস্বরূপ হতে পারে এবং তার নবজাগরণ সূচিত করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সে আশাকে সফল হতে দেয়নি। বৃহত্তম জনসমষ্টির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে পঙ্গু করার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে তার জাগরণ সম্ভাবনাকে-সুপরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় মেতে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী পাঞ্জাবী চক্রান্ত। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এর ফল হয়েছে বিপরীত। জলস্রোত যেমন আপন গতিপ্রবাহেই সব বাধাকে অতিক্রম করে সম্মুখগামী- তেমনি বাঙালীর নবজীবন তৃষ্ণাও কোন ষড়যন্ত্র বা বাধাকে গ্রাহ্য করেনি বরং বিরুদ্ধতা তার শক্তিকে সংহত করেছে। রেনেসাঁর বিশেষত্বগুলিকে সংক্ষেপে এভাবে প্রকাশ করা যায়। যেমনঃ

১। জাতির অতীত ঐতিহ্য থেকে রস আহরণ এবং তার পুনর্মুল্যায়ন।

২। সংস্কারমুক্ত উদার জীবনবোধ।

৩। অপরিময়ে জীবনতৃষ্ণা।

মাটির রস যেমন বৃক্ষদেহে সঞ্চারিত হয়ে তাকে সজীব রাখে, তেমনি ঐতিহ্যও একটি জাতির জীবনের সঞ্জীবনী সুধা। পাকিস্তানী শাসকচক্র প্রথমেই আঘাত হানে বাঙালীর যুগ যুগ সঞ্চিত ঐতিহ্য সম্পদের ওপর। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সৃষ্টি হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও লোকশ্রুতিকে হিন্দুয়ানীর গোড়া অজুহাতে বাতিল করে দেওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা হয়, নজরুলের

<005.008.238>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সাহিত্যে হিন্দু পৌরাণিক দেবদেবীর উল্লেখের জন্যে তাকে পৌত্তলিক বলে উপেক্ষা করা হয়- সর্বোপরি দেশের শতকরা ৬৫ জনের ভাষা বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা বলে ফতোয়া জারি করে বাঙালীর প্রাণরস শুষ্ক করে দেবার ষড়যন্ত্রের মেতে ওঠে এই কীর্তিমানেরা। কিন্তু মনন-সমৃদ্ধ বাঙালী সেদিন ধরে ফেলে এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের স্বরূপ। সে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করল, বাংলার আবহমান কালের ঐতিহ্য-ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি সমস্তই তার রক্তধারায় প্রবাহিত। বাংলা ভাষা তার বুকের রুধিরের চেয়েও প্রিয়। প্রমাণ দিতে হলো বুকের রক্ত দিয়েই। ভাষার জন্যে প্রাণদান। লিখিত হলো নব ইতিহাস। বাঙালী মুসলমান তার ধর্মের প্রতি অনুগত থেকেও খর্জুর কুঞ্জের পরিবর্তে আম্ৰবীথির শোভা নিরীক্ষণ করলেন। শুরু হলো বাঙালীর আত্মঅন্বেষা এবং তার পুনর্জাগরণ। ইওরোপের এবং উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসেও দেখি ঐতিহ্যের পুনরালোচনা এবং তার থেকে শক্তি সঞ্চয়। সুতরাং ঐতিহ্যের নব-স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালী জীবনেও রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়েছে এ ঘোষণা করা চলে নিদ্বিধায়।

২। সংস্কারমুক্ত উদার জীবনবোধ রেনেসাঁর একটি বিশেষ লক্ষণ। সংস্কারের আবাসস্থল হলো আচল মন। যে মন নিত্য বহমান, সে মনে কখনো সংস্কারের জড়বুদ্ধি আশ্রয় পায় না, সেই আচল মনের নিত্যসংগ্রাম বিশ্ব মানবসমুদ্রের চিন্তা-তরঙ্গে। মধ্যযুগের অন্ধকার অতিক্রম করে ইউরোপ রেনেসাঁ যুগের আলোকোজ্জ্বল পথে পা বাড়ালো মুক্তিবুদ্ধির প্রদীপ হাতে নিয়ে। উনিশ শতকে বাংলার চিত্ত বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল ইউরোপের এই সচল মনের স্পর্শেই। মানস-মুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পদক্ষেপের বেলায়ও একথা অনেকখানি সত্য। এই আলোকাভিসারের প্রথম যাত্রী ঢাকার শিখা গোষ্ঠী। সংস্কারমুক্তির ক্ষেত্রে তাঁদের সেদিনের ক্ষুদ্র অথচ উজ্জ্বল অর্থপূর্ণ প্রয়াসের ফল ভেতরে ভেতরে আজও অবশ্যিই ক্রিয়াশীল। মহৎ আজ বা আন্দোলন- তা যতো সামান্যই হোক- এইভাবেই যুগতিক্রমী হয়। সেদিন তাঁদের আন্দোলন নির্বিরোধে হয়নি। বর্তমান জাগরণের সূত্রপাতে বাধা এসেছে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল পাঞ্জাবীচক্রের তরফ থেকে। তাদের আশংকা, আলোকপ্রাপ্ত বাঙালী হবে শোষণের প্রতিবন্ধক। তাই ওদের ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেয়াল গাঁথার আরা আমাদের নিয়ত প্রয়াস দেয়াল ভাঙ্গার। শিক্ষার সংকোচন, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের লাঞ্ছনা, বাংলার ঐতিহ্যকে বিদেশীয় বলে ঘোষণা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে কৃত্রিম বিরোধ সৃষ্টির দ্বারা এক-জাতীয়তার ধারণাকে বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস-এর প্রত্যেকটি বাঙালীকে অন্ধকারে রাখার ষড়যন্ত্রের অংশ।

তবে এ ষড়যন্ত্রের পূর্ণ স্বরূপ বাঙালীর নিকট পরিষ্কার। সর্বপ্রকার অচলায়তানকে দূর করে জাতির যাত্রা এক মহাজীবনের পথে, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এক বাঙালী জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির পথে। এক্ষেত্রে একটা কথা অবশ্যি স্বীকারযোগ্য যে, বিংশ শতাব্দীর এই রাজনীতি-প্রাধান্যের যুগে যেহেতু সব রকম আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রাজনীতির অবস্থান, সুতরাং বাংলাদেশের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি এখানেও নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং এই মুহুর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য যুদ্ধজয়ের দ্বারা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু সমগ্র জাতির পরম লক্ষ্য এক বিপুল জীবনের আহবান সেই আহবানের পথে সার্থক পদক্ষেপেই পথে বাঙালী জীবনের সার্বিক জাগরণ বা রেনেসাঁ।

(সুকুমার হোড় রচিত)

<005.008.239>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

রণাঙ্গণে বাংলার নারী
৮ নভেম্বর, ১৯৭১

পবিত্র রমজানের কঠোর উপবাস পালন করছেন এখন দেশ রণাঙ্গন বাংলার প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নারী-পুরুষেরা। অশেষ পুণ্যের মাস এই রমজান। সাধারণভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার বিরত থাকাই রমজানের বাহ্যিক উপবাস অনুষ্ঠান। এ ছাড়া কায়মনোবাক্যে সংযম পালন করা রমজান মাসের অবশ্য করণীয় ইবাদত।

এবারের রমজান এসেছে আমাদের জাতীয় জীবনের এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী যুগসন্ধিক্ষণে। এখন আমাদের সন্তানরা দেশকে শত্রুমুক্তি করার সার্বক্ষণিক যুদ্ধে নিয়োজিত, আমাদের সর্বস্তরের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ তথা নিজ নিজ কর্তব্য পালন করেছেন। পবিত্র রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনার সঙ্গে সঙ্গে এ যুদ্ধ হয়েছে আমাদের মা-বোনের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কৃচ্ছসাধনা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাধানমন্ত্রী পবিত্র রমজান উপলক্ষে তাঁর বেতার বাণীতে বলছেন, গত বছরের রমজান মাসে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ এক প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করেছে, প্রকৃতির নির্মম তাণ্ডবে সেবারে এখানে সংঘটিত হয়েছে এক ব্যাপক, ধ্বংসযজ্ঞ, বিপুলসংখ্যক মানুষের আকস্মিক মৃত্যু। আর এবারের রমজানে আমরা সাত মাস আগে সূচিত এক আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে বিরতিহীন পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করছি, যে আক্রমণ আমাদের ওপরে এসেছে এক পশু প্রকৃতির সামরিক জান্তার কাছ থেকে একান্তই অতর্কিতে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জীবনের তাগিদে আমরা সেবারের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছিলাম, স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনেছিলাম বানের জলে ভেসে যাওয়া ক্ষেতেখামারে, আত্মীয়স্বজনহারা ঘর-সংসারে। আর এবারের জাতীয় জীবনের তথা বাংলাদেশ ও বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে আমরা আমাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। একটি স্বাধীন দেশ ও স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্ম-প্রতিষ্ঠার জীবনযুদ্ধই দেশ রণাঙ্গন বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী-পুরুষের জন্যে এবারের রমজান সমাসের পুণ্যময় শপথরূপে অভিষিক্ত হয়েছে।

বরকতের মাস রমজান এ মাসে আমাদের মুসলিম পরিবারে সাধারণ বাড়তি খাদ্যসামগ্রীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। ইফতারী, সেহরী ইত্যাদির সরঞ্জাম হয়ে থাকে ব্যয়বহুল। সারাদিন উপবাস পালনের ওপর প্রচুর খাদ্য, ঘ্ৰাণযুক্ত ও সুস্বাদু খাবার স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যেই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এবারে অন্য রকম। বাংলার গৃহিনীরা এবারে সর্বময় সংযম ও কঠিন কঠোর কৃচ্ছসাধনের পক্ষপাতী। অল্পে তুষ্টির সুশিক্ষাই তারা আজ গ্রহণ করেছেনথ- গ্রহণ করেছেন জাতীয় স্বার্থের কারণেই।

আজকাল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহেস সালামের সেই সুমহান হাদিসের শিক্ষাই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য- বলা হয়েছে, এক বেলার খাবার, উপস্থিত পরিধানের জন্য এক প্রস্থ কাপড় এবং এক রাতের মতো মাথা গুজবার আশ্রয় বা ঘুমোবার বিছানা যার আছে, সে কাঙাল নয়। তার জীবনে থাকা উচিত পূর্ণ পরিতৃপ্তি। আমরা পরিতৃপ্ত। রমজানের সত্যিকার সংযম সাধনার শুভ মুহুর্তে আমাদের বর্তমান যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। আমাদের পরিতৃপ্তি শুধু একটা নির্দিষ্ট সময়ে পানাহার বিরত থাকাতেই নয়, বরং এই বরকতের মাসে ব্যয়বাহুল্য অর্জন করে। আমাদের পরিতৃপ্তি উপবাসের চেয়ে কঠোর ত্যাগ বুকের সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে। আমাদের পরিতৃপ্তি দেশকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করার কাজে আমাদের রক্তবীজ সোনামণিদের উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়ে।

<005.008.240>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ত্রিশ দিনের আনুষ্ঠানিক উপবাস পালনের শেষে যে ঈদ- সে ঈদকে আমরা কিসের মূল্যে আনন্দমুখর করে তুলবো, সে ভাবনা থেকেও আজ বাংলার মা-বোনরা নির্লিপ্ত নন। আমরা জানি, আমরা বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার পশুশক্তি যেদিন আমাদের দেশ থেকে সম্পূর্ণ নির্মুল হবে, সেদিনই জমে উঠবে আমাদের ঈদের উৎসব। এ জন্য যতো ত্রিশ দিনই আমাদের কেটে যাক, আমরা করে যাবো সংযম-সাধনা। একটি স্বাধীন জাতির ভবিষ্যৎ হিসাবে যেদিন আমাদের বংশধররা আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করবে, সেদিনই তো শুভ সমাপ্তি হবে আমাদের উপবাস পালনের।

এবারে আমরা দেখেছি, পুজোপার্বনে আমাদের দেশ ঢাকা-ঢোল, সানাই-কাঁসা, শঙ্খঘণ্টায় মুখরিত হয়নি। কেবল কানে শুনেছি মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ। পূজামণ্ডপে রক্তচন্দনের লেপ দেখিনি, দেখেছি রক্ত। দুৰ্বত্ত হানাদার সৈন্যদের রক্ত। আমাদের দুঃসাহসী গেরিলা সন্তানদের হাতের অস্ত্র অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করে চলছে এক একটি হানাদারের বক্ষদেশ। পুজোর আনন্দ আমরা উপভোগ করেছি মহিষাসুর বধের মাধ্যমে। বাংলা মাকে প্রত্যক্ষ করেছি জাগ্রত রণচন্ডীরূপে।

আমাদের সন্তানরা দেশের সর্বত্র বিস্তৃত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। আমাদের মা-বোনরা কেউবা তাঁদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার ভূক্ষা পালন করেছেন, কেউবা গৃহবাসে যুদ্ধকালীন কর্তব্য পালন করছেন। এ কর্তব্য বড় কঠোর, ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের মতোই বাংলার মাবোনরা আজ মেনে নিয়েছে জাতির এই মুক্তিযোদ্ধাকে। এ যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় তাই হয়ে উঠেছে সুনিশ্চিত।

(বেগম উম্মে কুলসুম মুসতার শফি রচিত)

দেয়ালের লিখন
১৭ নভেম্বর, ১৯৭১

সব ভালো, যার শেষ ভালো। আর সব খবরের সেরা খবর শেষ খবর। সেই শেষ সংবাদটা কোন কোন ক্ষেত্রে আসলে দেয়ালের লিখন। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা, বিবেচক ব্যক্তিরা, বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিরা আগেভাগেই দেয়ালের লিখন পড়তে পারেন, পড়ে সাবধান হতে পারেন।

দেয়ালের এই লিখনকে কেউ কেউ হয়তো বলবেন ভবিতব্য, আমি কিন্তু বলি- ইতিহাসের মার।

মরণকালে যাদের বুদ্ধি নষ্ট হয়, সংকীর্ণ আত্মস্বার্থে যারা কাণ্ডাকাণ্ড, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। দেয়ালের লিখন তারা পড়তে পারে না।

ইতিহাসের চরম মারের হাত থেকে তাদের কেউ বাঁচতে পারবে না।

ইতিহাসের মার দুনিয়ার বার। সেই মারের রকমটা কেমন, শুনবেন? ইতিহাসের সেই মারের চোটে দখলীকৃত বাংলাদেশে একটা নতুন ছুতোর-শিল্প গড়ে উঠেছে। ঢালাও কারবার চলছে সেই ছুতোর-শিল্পের। তার নাম হচ্ছে কফিন-শিল্প। ঢাকা, যশোর, ময়নামতি, ক্যান্টনমেন্টে দিনরাত তৈরী হচ্ছে শুধু কফিনের বাক্স। কফিনের বাক্সের যোগাড় দিতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ছুতোর-মিস্ত্রিরা। পাক হানাদারদের কর্নেল জাঁদরেলরাই

<005.008.241>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বেনামীতে কফিন সাপ্লাইয়ের ঠিকাদারী নিয়ে বেশ টু-পাইস কামাতে শুরু করেছে। আর কামাইয়ের এই নতুন রাস্তাটা যাতে চালু থাকে, নতুন নতুন লাশ সরবরাহের রাস্তাটাও তারা তৈরী করে রেখেছে। মৃত্যুর এই ঠিকাদাররা সহজে তো আ এমন লাভের কারবার ছাড়তে পারে না? পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেসব তরতাজা জল্লাদ আমদানী করা হয়েছে মুক্তিবাহিনীর কবল থেকে, তাদের তো আর বিদেশে জ্যান্ত ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাদের লাশগুলো কফিনের বাক্সে পুরে তাদের স্বদেশে পাঠানো হবে।

বলিহারী আশা।

বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধকে যখন এই জল্লাদরা নির্বিচারে হত্যা করেছে, পুড়িয়ে মেরেছে, নৃশংস হত্যার নব নব কৌশল উদ্ভাবন করে চরম নির্যাতনের ভেতর দিয়ে হত্যা করেছে, তখন তারা এদেশের সেই শহীদদের দাফনের কথা ভাবেনি, মৃত্যুর পরে তাদের কবরে ঠাঁই মেলেনি। পথে-ঘাটে-ভাগাড়ে এদেশের বাপ, মা-ভাই, বোনের মৃতদেহ পড়ে থেকে পচেছে, শেয়াল-শকুনের খোরাক হয়েছে- কবরের কোলে তাই ঠাই দেয়া হয়নি, ইয়াহিয়ার জল্লাদরা সে সুযোগটুকুও দেয়নি। নিরপরাধ সদ্য বিবাহিত হারুনকে হত্যা করে ঠাটারী বাজারের পথের ওপারে ফেলে গিয়েছিল জল্লাদরা। হুকুম দিয়ে গিয়েছিল চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কেউ সেই লাম ছুতে পর্যন্ত পারবে না। তেমনি পড়ে থেকেছে যুবক হারুনের মৃতদেহ, ঠাটারী বাজারের পথের ওপরে। জল্লাদদের জীপ বার বার সেই মৃতদেহের ওপর দিয়ে গিয়েছে, এসেছে। আর দানবীয় তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে এসেছে ভাগাড়ে।

এ ইতিহাস শুধু এক হারুনের ইতিহাস নয়। ইয়াহিয়ার জল্লাদদের হাতে নিহত বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ বাবা-মা, ভাই-বোনকে তারা শেয়াল-শুকুনের খোরাকে পরিণত করেছে।

আজ তারা আশা করে করে তাদের জল্লাদের দেহ কফিনের বাক্সে পুরে স্বদেশ পাঠাবে দাফনের জন্যে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী জল্লাদদের কাউকেই স্বদেশের মাটিতে যেতে দেবে না- জ্যান্ত অথবা মৃত কোন অবস্থাতেই না। এই বাংলাদেশের মাটিতেই নির্বান্ধব জল্লাদের অন্তিমশয্যা রচিত হবে। কফিনের বাক্স যেমনকার তেমনি পড়ে থাকবে। অনেক বিলম্বে হলেও এই অনিবার্য পরিণতির কথা জল্লাদদের প্রভুরা বোধ হয় কিছু কিছু অনুমান করতে পারছে। তাই তাদের এবং তাদের ভাড়াটিয়াদের কণ্ঠে ইদানিং যেন দরদের বান ডাকছে। তাই তারা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর তরুণদের উদ্দেশে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদুনী গাইছে। আহা, কুলোকের কুপরামর্শে বাংলাদেশের এইসব সরল-নিরীহ ছেলেরা না-হক প্রাণ দিচ্ছে। ওহো, কি দুঃখের কথা!

একেই বলে গরুর শোকে শুকনের কান্না। বাংলাদেশের তরুণদের জন্যে জল্লাদ ইয়াহিয়া গোষ্ঠী আর তার দালালদের কি দরদ।

বলি বেহায়া খান, বাং র এই তরুণদের, তাদের মা-বাপ, ভাই-বোনকে কিভাবে তোমরা হত্যা করেছো। সে কথা আমরা ভুলে যাব ভেবেছ? ভুলে যাব ভেবেছ মা-বোনের সন্ত্রমহানির কথা? তোমরা ঘাতকরা হঠাৎ এক-একটা জায়গা ঘেরাও করে শিশু-কিশোর-যুবকদের ট্রাকে উঠিয়ে পাগলায় নিয়ে গিয়ে বেয়নেট দিয়েছো। শিশু-কিশোর-যুবকদের চোখ বেঁধে ট্রাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের দেহ থেকে নিঃশেষ রক্ত শুষে নিয়ে হত্যা করেছ তোমরা। তারপর ফেলে এসেছ ভাগাড়ে। শকুনে শকুনে সেখানকার আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল। আজ তোমাদের কণ্ঠে দরদের বান ডাকছে। তোমরা বেহায়া, তোমরা পশুরও অধম, দানবের চেয়েও নৃশংস।

<005.008.242>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ততোধিক ঘৃণ্য তাদের দাদালেরা, যারা আজ ইনিয়ে বিনিয়ে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের জন্যে মায়াকান্না কাঁদছে।

ঢাকার রেডিও ষ্টেশন পাগলার সেই বধ্যভূমি দূরে নয়, যেখানে হাজার হাজার নিরপরাধ শিশু, কিশোর ও যুবককে বেয়নেটের খোঁচায় আর রক্ত নিংড়ে নিয়ে ইয়াহিয়ার ঘাতকরা হত্যা করেছে। বধ্যভূমির আকাশে শুধু শকুন আর শকুন। সে বীভৎস নারকীয় হাহিনী জানে ঢাকার প্রতিটি মানুষ, শকুন-ছাওয়া আকাশ সকলে দেখেছে আর শিউরে উঠেছে। কিন্তু শিউরে ওঠেনি ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দালালরা। তাই দিনের পর দিন মুক্তিশপথে দৃপ্ত বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের জন্যে মায়াকান্না কাঁদতে কণ্ঠটাও একটু কাঁপে না।

কোন্দিন কি তোমরা পাগলার কাছে বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে পাবে হাজার হাজার শিশু-কিশোর তরুণ কণ্ঠের চাপা গোঙানি। আরও কান পেতে থাকলে শুনতে পাবে শান্ত বুড়িগঙ্গার প্রাণের অশান্ত চাপা গর্জন। শুনতে পাবে বুড়িগঙ্গার আকাশ, পাগলার বাতাস সারা বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের ডাক দিয়ে বলেছে –

তোমরা এর প্রতিশোধ নিয়ো,
তোমরা এর প্রতিশোধ নিয়ো।

সেই চাপা অথচ বজ্রনিৰ্ঘোষ, সেই অবরুদ্ধ লাঞ্ছিত পরাধীন প্রাণের ক্রুদ্ধ হাহাকার যদি তোমরা শুনতে পেতে তাহলে বুঝতে-বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণপ্রাণ শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেও কেন জানোয়ার হত্যার শপথ গ্রহণ করেছে। শুনলে বুঝতে পারবে তোমাদের জন্যে শেষ সংবাদে কোন বার্তা অপেক্ষা করছে।

(আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী রচিত)

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বাংলার মাটিকে বাংলার আকাশ-বাতাস-মাঠ-প্রান্তরকে এবং বাংলার মানুষকে এমন নিবিড় করে বোধ করি আর কোন বাঙালী ভালোবাসতে পারেনি। বাংলাদেশকে ভালোবেসে, বাংলার নির্যাতিত শোষিত লাঞ্ছিত মানুষকে ভালোবেসে শেখ মুজিবের ন্যায় দুঃখ ও নির্যাতন আর কোন মানুষ সহ্য করেননি। বাংলার মাটির প্রবাহ শেখ মুজিবের রক্তে সৃষ্টি করেছে তরঙ্গ, বাংলার নিঃশ্বাস যেন শেখ মুজিবের নিজের শরীরের নিঃশ্বাসে পরিণত হয়েছে- বাংলার সমগ্র অস্তিত্বের সাথে তিনি যেন একাত্ম হয়ে পড়েছেন। তাই বাংলার শরীরে যখন যে ব্যথা বেজেছে সে ব্যথা যেন শেখ মুজিবের শরীরেও ঝংকার তুলেছে। বাংলার মাটিতে যুগে যুগে মানুষ বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ন্যায় বাংলার প্রাণের সাথে একাত্মতা এমন গভীরভাবে কেউ অনুভব করেননিআর পরবর্তীকালে শুধু বাক্যে নয়, শুধু অনুভূতি দিয়েও নয়, দেহের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে, জীবনের সকল আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে, সকল শক্তি ও সাধনা দিয়ে যিনি বাংলার সাথে একাত্মতা প্রমাণ করেছেন তিনিই বাংলাদেশের নয়নমণি শেখ মুজিব। বাংলার অস্তিত্ব থেকে তাঁর ব্যক্তিত্বকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।

<005.008.243>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
কিন্তু দুর্ভাগ্য, “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব” অথবা “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর” এই কবিতা শুনে যিনি বাংলার প্রেমে তন্ময় হতেন, তিনি আজ আর প্রিয় জন্মভূমি বাংলার থেকে দূরে-বহু দূরে শত্রুর কবলে, দানব পশুর পাহারায় আবদ্ধবঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ রক্তস্নাত আর জননী বঙ্গভূমির সবচেয়ে আদরের দুলাল শেখ মুজিব আজ হৃদয়হীন পাষণ্ডের দেশ পাকিস্তানে বন্দীজীবনের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। আজো বাংলার মাটিতে “কাঁঠালপাতা করিতেছে ভোরের বাতাসে” এবং “সেখানে খয়ের ডানা শালিকের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে”- কিন্তু এই দৃশ্য দেখে যে মানুষটি সবচেয়ে অভিভূত হতেন, যে সিংহপুরুষ সমগ্র বাংলাদেশকে হৃদয়ের কাছে আঁকড়ে ধরতে হাত বাড়াতেন সেই শেখ মুজিব বাংলা থেকে বহু দূরে শত্রুর কারাগারে শত অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে দিন অতিবাহিত করে চলেছেন। বাংলাদেশের কাছে এর চেয়ে দুঃখের, এর চেয়ে মর্মান্তিক বুঝি আর কিছুই হতে পারে না। বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে কি এক নিঃসীম শূন্যতা অনুভব করি, মনে হয় –

যতদূর যাই,
নাই নাই সে পথিক নাই,
মনে হয়ঃ প্রভাতের অরুণ আভাসে
ক্লান্ত সন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিঃশ্বাসে
পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলীর লাবণ্য বিলাসে
ভাষার অতীত তীরে
কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে
যতদূর চাই
নাই নাই পথিক নাই।

কিন্তু না। কে বলে শেখ মুজিব আমাদের মধ্যে নাই। তুমি যদি বাঙালী হও, তুমিও যদি বাংলাদেশের মাটি ও আলো-বাতাসকে শেখ মুজিবের মতই ভালবেসে থাকো, তুমি একবার চোখ নিচু করে তোমার হৃদয়ের দিকে চেয়ে দেখ- দেখবে শেখ মুজিব তোমার হৃদয়ে বাংলার প্রেমের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন আর তোমার হৃদয়কে বার বার নাড়া দিয়ে আহবান করছেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তুমি যদি মুক্তিযোদ্ধা হও, সংগ্রামী বাঙালী হয়ে পাকিস্তানের হানাদার কুকুরগুলোকে বিতাড়নের শপথ গ্রহণ করে থাকো- তুমি তোমার হৃদয়ে শেখ মুজিবকে খুঁজে পাবে, তোমার বাহুতে অজেয় শক্তি হয়ে, তোমার বক্ষে দুর্বার সাহসের প্রবাহ হয়ে শেখ মুজিব সর্বদা জাগ্রত রয়েছেন। শেখ মুজিব বাংলার আমাদের সবার একান্ত নিকটে। পিণ্ডির কয়েদখানা শেখ মুজিবের দেহকে আবদ্ধ করে একটি বর্বর আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, বাংলাদেশের আজাদীর জনক শেখ মুজিবকে বিশ্বের কোন শক্তির সাধ্য নেই আবদ্ধ করে, কোন শক্তির সাধ্য নেই তাঁকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে। তবু দুঃখ হয়, দুঃখে প্ৰাণমন সংকুচিত হয়ে আসে এই ভেবে যে, পাকিস্তানের বর্বরদের মধ্যে কি নিদারুণ বেদনার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবের। বাংলাকে ভালবেসে জীবনে যিনি সর্বদা যে কোন নির্যাতনকে এমন কি মৃত্যুকে পর্যন্ত মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত, বাংলার সেই সবচেয়ে দরদি সন্তান আজ একটি বাঙালীর মুখ দেখতে পারছেন না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি দেখছেন সেই হীনতম জানোয়ারগুলোর মুখ, যাদের স্মরণ করলেও আজ প্রত্যেকটি

<005.008.244>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
বাঙালীর হৃদয় প্রতিহিংসায়, ঘৃণায় ও ধিক্কারে সংকুচিত হয়ে ওঠে। কবিগুরুর ভাষায়- আল্লাহকে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করেঃ

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো;

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, বেসেছ তাদের ভালো?

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করেঃ শেখ মুজিব কি অন্যায় করেছেন, যার জন্য আজ এই নিদারুণ শাস্তি তাঁর ভাগ্যে নেমে এলো? বাংলাদেশকে ভালোবাসা, বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ মোচনের জন্য শপথ গ্রহণ করাই কি শেখ মুজিবের একটি অন্যায় কর্ম? আর তারই জন্য কি এই মহান নেতার ভাগ্যে এমন বিপর্যয়?

(ডক্টর মাযহারুল ইসলাম রচিত)

দেশ গঠনে নারীর ভূমিকা
১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১

আজ দেশের প্রায় সকল এলাকাই শত্রুমুক্ত। এই স্বর্গাদপি গরীয়সী জন্মভূমি, যাকে ভালোবাসার অপরাধে বুলেট, বেয়নেট, মর্টার, মেশিনগানে, লক্ষ লক্ষ প্রাণের অবসান ঘটেছিল। হারিয়েছিল কতজন স্বামী, সন্তান পিতা-ভ্রাতা। আত্মীয়পরিজন ভরা সুখের সংসার সর্বস্বহারা। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কতজন বাহির হয়েছিল পথে- সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে।

আজ শত্রুমুক্ত অঞ্চলে ফিরে আসছে সবাই- কিন্তু বসতি গড়ে তুলবে এ কোন মাতৃভূমির কোলে চির সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা যার প্রতিরূপ এক পশুশক্তির দাহনে জনশূন্য, শস্যশূন্য, গৃহশূন্য দগ্ধ হাহাকারের এক চরম অভিশাপে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। বর্বর ইয়াহিয়ার অনুচরবর্গের অঞ্চল ত্যাগের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের অবশিষ্টরূপে রয়েছে দগ্ধ গৃহ, লুষ্ঠিত দ্রব্যের ভগ্নাংশ, স্বজনসম্পত্তি হারা, শোকার্ত, বুভুক্ষু ও পঙ্গু কুকুর আর শকুনের লড়াই। শূন্য ভিটায়, ভগ্নগৃহে কারো বুকে জ্বলছে পিতা-মাতা, ভ্রাতা আর বন্ধু বিয়োগের বেদনা- স্বামী-সন্তান আর সুখের সংসার হারিয়ে কেউ বা কাঁদছে ভূলুষ্ঠিত হয়ে, কারো বা বেদনা ভাষাহীন। বিয়োগের বেদনা, সন্তান আর সম্পদ হারানোর শোক অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিকও নয়- আর এ শোকে সান্তুনার ভাষাও নেই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নিস্ফল শোকও পরিহার করতে হবে। অত্যাচারীর কবলমুক্ত পুনজীবিত আমরা। আমাদের এই নবজন্ম ও জীবন পরিচালনার সন্ধিক্ষণে পশ্চাতের শোক, দুঃখ, অনুশোচনাকে দূরে সরিয়ে একতা, শান্তি ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ সংগঠনে সক্রিয় হয়ে নতুন উদ্যমে বাঁচতে ও বাঁচাতে হবে। এই ভগ্নহাটের দগ্ধভূমিতে এই শোকার্ত, নির্যাতিত পদুদের মাঝেই আমাদের কর্মক্ষেত্র বিছাতে হবে। আত্মনিয়োগ করতে হবে বিপন্ন, বিপর্যস্ত, নিরন্ন এই জনসমাজের কল্যাণমূলক সংগঠনের দায়িত্বে।

দীর্ঘ সংস্কারের অভাবে মুক্তাঞ্চলের স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা নানাভাবে বিপর্যস্ত। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অব্যবস্থা ও ময়লা নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে মশামাছির বৃদ্ধি ইত্যাদিতে নানা রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে।

<005.008.245>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

তদুপরি রক্তলোলুপ খান সৈন্যদের পলায়নের প্রাক্কালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে নিহত পরিত্যাক্ত গলিত মৃতদেহ বসবাসের উপযোগী পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে। পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের উদ্যোগে এ সমস্ত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যরক্ষা সমস্যা সত্বর নিরসনে অগ্রণী হওয়া উচিত। পল্লী অঞ্চলের ভগ্ন, অর্ধভগ্ন নলকূপ মেরামত, প্রয়োজনবোধে নতুন নলকূপ চালু করার ব্যাপারে কর্তপক্ষকে অবহিত করা, নর্দমা ইত্যাদি সংস্কারে নিজেদের মনোযোগী হওয়া- যেখানে সেখানে আবর্জনা আর ময়লা ফেলার ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করা, জল ফুটিয়ে পান করা- স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনীয় এই সমস্ত দায়িত্বগুলিতে মেয়েরা নিজেদের দৃষ্টান্তে অপরকেও সতর্ক করতে পারেন। নালা-নর্দমায় জীবাণুনাশক ঔষধ প্রয়োগ, ঘরে ঘরে টিকা-ইনজেকশনের ব্যবস্থা তুরান্বিত করা ইত্যাদিতে বর্তমান পরিস্থিতির অনুকূলে মেয়েরা যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারেন।

বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত প্রায় পল্লী ও শহরগুলির যেখানে আহত-পীড়িতদের চিকিৎসা ও শুশ্রষাব্যবস্থা তুরান্বিত করা সহজসাধ্য নয়, সেখানে সকলে একতাবদ্ধ হয়ে গাঁয়ে, গঞ্জে, শহরে, ঘরোয়া চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলে ও সাধ্যানুযায়ী সহায়তা দানে মেয়েরা এগিয়ে আসতে পারেন- আর্তের সেবা, সাহায্য পথ্য ও পানীয়ের সমস্যা সকলের সম্মিলিত যত্নে সমাধান হয়ে যাবে।

তা ছাড়া, বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিয়মিত বিদ্যালয় চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাঠাভ্যাস দীর্ঘ অনভ্যস্ত ছেলেমেয়েদের একত্রিত করে সমান সহোযোগিতায় কাজ চালিয়ে গেলে শিক্ষাদান কার্য অনেকটা এগিয়ে যাবে।

উপস্থিত আমরা সকলেই লুষ্ঠিত, সর্বস্বান্ত- তবুও তার মধ্যে কিছুটা সামর্থ্য আর সঙ্গতি যাদের আছে, তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু অর্থ সাহায্য নিয়ে, আর সঙ্গতি যাদের আছে, তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু অর্থ পারি। শীতবস্ত্রের প্রয়োজনে সুতো-কটা সংগ্রহ করে বসে গেলে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে অপরের প্রয়োজনেরও সাহায্য করতে পারি। রোগীদের প্রয়োজনীয় ব্যাণ্ডেজ, বন্ধনী, নবজাত শিশু আর প্রসূতির উপযুক্ত বস্ত্রাদি, সাময়িক সাহায্য, কিছু ঔষধপত্রের ব্যবস্থা, শিশুদের পাঠ্যবইও আমরা এ থেকে করে নিতে পারি।

হানাদার বাহিনীর জঘন্যতম অত্যাচারের শিকার পরিনণত, নির্যাতিত –নিপীড়িত- যারা স্মগ্র মাতৃজাতির অবমাননার কালিমা নিজের গায়ে মেখে জীন্মৃতঃ জনচক্ষুর অন্তরালে পড়ে আছে, আসুন আমরা এগিয়ে যাই ব্যথায় বিমূঢ় লাঞ্চনা, বেদনা আর অপমানের বিষপানে জর্জরিত নিরূপায় সেই মা, বোন, বধূ আর কন্যাদের মাঝে। তাদের দুঃসহ দুঃখ ও লজ্জার গুরুভার যদি সমগ্র অন্তর দিয়ে লাঘব করতে না পারি, তবে বৃথাই আমরা মাতৃ অংকে জন্ম নিয়েছি। সমবেদনার প্রলেপে, দরদের অশ্রুতে আমরা মুছে নেব তাদের হৃদয়ের গভীর ক্ষত। ডেকে নেব আমাদের সর্ব কাজে, সর্বস্তরে। বেঁধে দেব তাদের ভাঙ্গা ঘর, ফিরিয়ে দেব তাদের সুখ-শান্তি, সম্মান।

তবে একতা, শৃঙ্খলা, শান্তি আর সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে যেন আমরা পরষ্পরের সাহায্যে এগিয়ে যাই। হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিযোগিতা আর সাম্প্রদায়িকভাবে বিষাক্ত নিঃশ্বাস যেন আমাদের এই কল্যাণব্ৰতকে কলুষিত না করতে পারে। সকল স্বার্থ, নিন্দা, ভয়, ভেদ, বিবাদের সমস্যাজয়ী বাংলার নারী যতই দুরূহ হোক না কেন, সুসমাধান যে হবেই এ কথা সম্পূর্ণ নিশ্চিত।

(বাসনা গুণ রচিত)

<005.008.246>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

স্বদেশ স্বকাল
২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশে পাকিস্তানের মৃত্যু হলো আনুষ্ঠানিকভাবে এবং সেই সাথে শেষ হলো শাসনের এবং শোষণের একটি কলংকজনক অধ্যায়। হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা এক তুলনাহীন বেঈমানকে, যে ভাইয়ের মুখোশ পরে সিন্দাবাদের গল্পের সেই অসহ্য দৈত্যটার মত বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছিল গত চব্বিশ বছর ধরে, অবশেষে আমরা উৎখাত করলাম বাংলাদেশের মাটি থেকে। স্বেচ্ছায় ঘাড় থেকে নামেনি লোভী দৈত্যটা বারবার প্রচণ্ডভাবে মার খেয়ে একটি পরাজিত আহত কুকুরের মত সে আত্মসমর্পণ করেছে প্রাণ বাঁচাবার নিতান্ত জৈবিক তাড়নায়।

বাংলাদেশে পাকিস্তানের কবর রচিত হবার সাথে সাথে মৃত্যু হলো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার, যে বিষ একদিন বাংলাদেশের মানুষের উপর উগড়ে দেবার চেষ্টা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানী প্রাসাদষড়যন্ত্রীরা। বিগত চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তানী প্রভুরা এই উৎকট বিষবৃক্ষটিকে বাংলাদেশের মাটিতে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। কারণ, নিরবচ্ছিন্ন শাসন এবং শোষণ চালিয়ে যাবার জন্যে প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, একজন বাঙালীকে অন্য একজন বাঙালীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। এর জন্যে আমদানী করার চেষ্টা চলেছিল সাম্প্রদায়িকতার, যা মানুষকে ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করতে এবং অর্থহীন হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে।

এই সচেতন উগ্র সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুরা- এ কথা সত্যি, কিন্তু এই বিষবৃক্ষটির লালনে এবং পুষ্টিসাধনে নিরন্তর সহায়তা যুগিয়েছে একদল বাংলাদেশের ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীযারা সামান্য কিছু লাভের আশায় নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমা প্ৰভুদের প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে পদলেহী কুকুরের মত। সাম্প্রদায়িকভাবে বাংলাদেশের মাটিতে জিইয়ে রাখবার জন্যে এরা সব রকম ঘৃণ্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে- এমনকি বাঙালী সংস্কৃতিকে সমূলে বিনাশ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও এদের বিবেকে বাধেনি। এরাই প্রচেষ্টা চালিয়েছে, উর্দু হরফে বাংলার প্রচলনের, এরাই ফরমান দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ বর্জনের, এরাই মুখর হয়েছে বাঙালী আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিরুদ্ধে। সর্বস্তরে এই উৎকট ব্যাধিটিকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে সমগ্র দেশব্যাপী গড়ে তুলেছে বিএনআর, পাকিস্তান কাউন্সিল ইত্যাদি মগজ ধোলাইয়ের প্রতিষ্ঠান। এরাই বিকৃত করে রচনা করেছে ইতিহাস, এমনকি সুকুমারমতি শিশুদের মনটিকে পর্যন্ত বিষিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে- সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে। এদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাঙালীর বাঙালিত্ব, তার আচার অনুষ্ঠান, তার ভাষা, তার আজন্মের অন্তরঙ্গ সংস্কৃতি। পশ্চিমা প্ৰভুদের সুরে সুর মিলিয়ে এরাও গান ধরেছিলঃ বাঙালীয়ানা আসলে হিন্দুয়ানীরই নামান্তর মাত্র। বাংলা ভাষাটাই নাকি হিন্দুদের ভাষা- মায়ের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাঙালী মুসলমানের তাতে কোন অধিকার নাই। অতএব একজন সাচ্চা পাকিস্তানী হতে হলে এইসব বাঙালীয়ানা সযত্নে পরিহার করতে হবে এবং তার বদলে গ্রহণ করতে হবে পশ্চিমা প্ৰভুদের প্রেরিত সেই ঘৃণ্য, ব্যাধিটিকে, যার নাম সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা। বাংলাদেশে বাঙালী সংস্কৃতি চলবে না, তার বদলে বরণ করতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ধোলাই হয়ে আসা পাকিস্তানী তমদ্দুন নামক আজব বস্তুটিকে। এসব কুকীর্তির বিনিময়ে কুচক্রী প্ৰভুদের কাছ থেকে কিছুই যে ইনাম মেলেনি তা নয়। এই পাপের পথে পদচারণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কুখ্যাত শিক্ষকটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ লাভ করেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ঘৃণ্য মীরজাফরটি পেয়েছে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের রাষ্ট্ৰীয় পুরস্কার এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ। এবং একইভাবে লাভবান হয়েছে তাদের সমগোত্রীয় ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু এই সমস্ত ঘৃণ্য দেশদ্রোহীদের চক্রান্ত কোদিনই বিভ্রান্ত

<005.008.247>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

করতে পারেনি বাংলাদেশের মানুষের মুক্তবুদ্ধিকে- ফেলে আসা কয়টি উজ্জ্বল গণআন্দোলন এবং আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায় এই মন্তব্যের সপক্ষে রায় দেবে। নগ্ন অর্থনৈতিক শোষণ যখন বাংলাদেশের মানুষকে নিক্ষেপ করেছে এক অকল্পনীয় দুঃসময়ের বিবরে, তাদের কাছে দিনের আলোর মত স্বচ্ছ হয়ে গেছে চক্রান্তের আসল রূপটি।

মুক্ত বাংলাদেশে তাই আজ সাম্প্রদায়িকতার কোন ঠাই নেই। আপন ধর্মবিশ্বাসে অবিচল থেকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দিতে রাজি নই। আমার সোনার বাংলাদেশে তাই আর সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কোন কথা নেই- প্রতিটি মানুষের আপন আপন ধর্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা এবং স্বাধিকার নিয়ে বাঁচবার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মুক্তবুদ্ধিকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে, এ কথা আলোচনা করতে গিয়ে এই মুহুর্তে অনেক দিন আগে পড়া সুসাহিত্যিক শ্রী মনোজ বসুর একটি আশ্চর্য সুন্দর গল্পের কথা আমার মনে পড়ছে। দেশ বিভাগকালীন অর্থহীন সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার পটভূমিতে লেখা গল্পটি। এক গ্রামে পাশাপাশি বাস করত দুটি পরিবার- একটি হিন্দু, অন্যটি মুসলমান। এই দুই পরিবারের সম্পর্ক ছিল নিবিড় সম্প্রীতির এবং অন্তরঙ্গতার। তারপর- এক সময় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটি ছোট্ট ঢেউ সেই সুদূর গ্রামটিতেও গিয়ে লাগল এবং ফাটল ধরল সম্পর্কের। একে অন্যকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করল, সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। বন্ধ হয়ে গেল মেলামেশা পর্যন্ত। দু’বাড়ির দুটি ছোট ছেলেমেয়ে কিন্তু এতসব জানতো না। তাই বাপ-মা’র নিষেধ সত্ত্বেও তাদের লুকিয়ে মেলামেশা বন্ধ হয়নি।

একদিন হিন্দু বাড়ির সেই ছোট্ট ছেলেটি মুসলমান বাড়ির মেয়েটিকে বলল, “জনিস মুসলমানরা হিন্দুদের দেখলেই কেটে ফেলছে।’

তুই কিছু জানিস না, মেয়েটি বলল। আসলে হিন্দুরাই মেরে ফেলছে মুসলমানদের। একটু নীরবতা। তারপর মেয়েটি বলল, আচ্ছা তুই হিন্দু দেখেছিস?

ছেলেটি বলল, নাতো! তা তুই মুসলমান দেখেসনি? মেয়েটি উত্তর করল, না রে! দরকার নেই বাবা ওসব হিন্দু-মুসলমান দেখে।

ছোট্ট ছেলেমেয়ে দুটি খুবই আশ্বস্ত বোধ করল এই ভেবে যে, ওদের কাছাকাছি কোন হিন্দু’ বা “মুসলমান নেই।

গল্পটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কি হাস্যকর এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, যার নিরর্থকতা ছোট্ট দুটি ছেলেমেয়েও তাদের সহজাত বুদ্ধিতে বুঝতে পেরেছে।

উগ্র ধর্মান্ধতা অনেক দেখেছি আমরা, বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছি তার বিষাক্ত নখরে। তাই বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে এই কুৎসিৎ বিষবৃক্ষটিকে ঠাই দিতে আর প্রস্তুত নই আমরা।

(অসিত রায় চৌধুরী রচিত)

<005.008.248>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলার সংগ্রামী জনতা প্রস্তুত
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

মোহাম্মদপুর কলোনীর একমুঠো মাটি একটা কাগজে মোড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে টেবিলের ওপর। কালচে মাটি। রক্ত আর মাটি মিশে জমাট বেঁধে গেছে। কার রক্ত? হয়তো মুনীর চৌধুরী কিংবা ডাঃ ফজলে রাব্বির। ডাঃ আলীম চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, গোলাম মোস্তফা, সিরাজউদ্দিন হোসেন খানকার রক্ত মিশে আছে এ মাটিতে? জানিনে। হয়তো সকলের রক্তই মিশে একাকার হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বরতার জঘন্যতম নিদর্শন। বুদ্ধিজীবীদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিশ্বমানব ঘৃণায় শিউরে উঠেছে; বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গেছে তাদের কণ্ঠ। মোঙ্গল হালাকু খাঁ বাগদাদ আক্রমণ করেছিলো। বাগদাদের রাজপথে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েও তার তৃপ্তি হয়নি। আব্বাসীয় খলিফাদের যুগ যুগ ধরে সযত্নে সঞ্চিত গ্রন্থাগারে আগুন দিয়ে বহ্নি-উৎসব করেছিলো। রাশি রাশি পোড়া গ্রন্থের ছাই ইউফ্রেটিস নদীর জল কালো করে দিয়েছিলো। ৮০০ বছর পর ঢাকার বুকে বিংশ শতাব্দীর হালাকুরা যে ঘটনা সংঘটন করলো তাতে অতীতের হালাকুও লজ্জা পেতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শরিক। কারাবরণ করতে হয়েছিলো তাঁকে। ফজলে রাব্বি বিখ্যাত হৃদরোগ চিকিৎসক, ডাঃ আলীম চৌধুরী চক্ষুরোগ বিশারদ, সন্তোষ ভট্টাচার্য ইতিহাসের অধ্যাপক, সাংবাদিক মোস্তফা, নজরুল, কেউই রেহাই পেলো না। বাংলাদেশের মাটিকে, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসার এবং পণ্ডিত বুদ্ধিজীবী হবার চরম খেসারত দিতে হলো তাঁদের। থোকা থোকা রক্তে বাংলা মায়ের পায়ে আলপনা একে গেলেন তাঁরা।

বাংলাদেশের বিগত চব্বিশ বছরের ইতিহাস এক রক্তাক্ত ইতিহাস। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য বাংলাদেশের জনতার রক্তদানের ইতিহাস। ১৯৫০ সালে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের খাপরায় সামান্য মানবিক দাবী আদায়ের জন্য আনোয়ার, হানিফ, কম্পরাম এদের সাতজনকে প্রাণ দিতে হলো। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবী করার অপরাধে স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শাসকচক্রের সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হলো বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারদের। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল আন্দোলনে বাস কর্মচারী ওয়াজিউল্লা প্রাণ দিলেন। ১৯৬৬ সালে ছয়-দফা দাবী, বাংলার স্বাধিকার দাবিতে আবার কৃষকশ্রমিকের বুকের খুনে লাল হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, টঙ্গীর মাটি। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ১১-দফার দাবীতে আসাদ, ডাঃ শামসুজ্জোহামতিউর, রোস্তম এমনি শত শত লোক বুকের রক্তে দেশমাতৃকার তর্পণ করলেন। ১৯৭১ সালে স্বৈরাচারের অবসানের জন্য আবার শুরু হলো প্রাণ বলিদান পর্ব। ফারুক, ইকবাল, পাবনার এ্যাডভোকেট আমীরুদ্দীন, যশোহরের মসীউর রহমান, রাজশাহীর বীরেন সরকার, ঢাকার ডক্টর মনিরুজ্জামান, ডঃ গোবিন্দ দেব, ডাঃ ফজলে রাব্বি, ডাঃ আলীম চৌধুরী এমনি লক্ষ লক্ষ লোকের বুকের রক্তে বাংলার মাটি আজও ভেজা। একটা অপূর্ব গৌরবোজ্জ্বল রক্তদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা বাংলাদেশের পবিত্র মাটিকে শত্রুর কলুষ স্পর্শ থেকে মুক্ত করেছে।

বিগত চব্বিশ বছরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়েছে। সেই মহান অপূর্ব সংগ্রামের পরিণতি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনতার চূড়ান্ত বিজয়, আজকের গণজপ্রতান্ত্রী বাংলাদেশ। বাংলার মাটি শত্রুমুক্ত হবার সংগে সংগেই বাংলাদেশের জনতার সংগ্রামের অবসান হয়েছে- এই চিন্তা ভ্রান্তিমূলক। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনতা আজ এক কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এই সংগ্রাম হলো দেশ পুনর্গঠনের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর হানাদাররা বিগত নয় মাসে সুপরিকল্পিত উপায়ে একদিকে যেমন বাংলাদেশের মনীষা এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের সর্বত্র এক প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা চালিয়ে সোনার বাংলাদেশকে আপাত-শ্মশানে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, হাসপাতাল, কলকারখানা এবং হাজার

<005.008.249>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হাজার বাড়ি তারা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আত্মসমর্পণ করবার প্রাক্কালে বাংলাদেশের ব্যাঙ্কগুলো লুট করে সমস্ত টাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সমগ্র পাকিস্তানের Gold Reserve রাখা হতো করাচী ষ্টেট ব্যাঙ্কে। বাংলাদেশের ব্যাঙ্কে কোন স্বর্ণ রক্ষিত হতো না। এর অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ সদ্যজাত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে বৈদেশিক বাণিজ্য এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন। যে কোন দেশের অস্তিত্ব এবং সমৃদ্ধির জন্যে স্বর্ণের একান্ত প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধান শুধু বাংলাদেশ সরকারের একার হাতে নিবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের যে সাড়ে সাত কোটি জনতা তাদের অতুলনীয় দেশপ্রেম এবং নিষ্ঠার দ্বারা বাংলার মুক্তি অর্জন করলো, সেই সাড়ে সাত কোটি জনতাকেই আজ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ কঠিন সমস্যার সমাধানে অগ্রসর করবে। আর এ কথাও জানা যে, বাংলার সংগ্রামী জনতা এককণ্ঠে সেই দাবীর প্রতি জানাবে তাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা। প্রস্তুত সংগ্রামী বাংলার সংগ্রামী জনতা। জয় বাংলা।

(গাজীউল হক রচিত)

বাংলাদেশের পুনর্গঠন-৩
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

ধর্মের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে জাগতিক তথা রাজনৈতিক কাজে লাগানো হয়েছিল বলেই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান টেকিনি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির পটভূমি ছিল ধর্ম। সাম্প্রদায়িকতা; কিন্তু বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ লক্ষ প্রাণের রক্তে অর্জিত হলো- তার সংগ্রামী পটভূমিতে যে সত্যটি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল তা হলো দেশপ্রেম। দেশের মাটির প্রতি দেশবাসীর ভালোবাসা- দেশের সংগ্রামী শাসনক্ষমতার সংগে দেশবাসীর প্রাণের মিলন। আজ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি নবজাত রাষ্ট্রের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সামনে নতুন স্বপ্নের হাতছানি- কলপনার অজস্র বিস্তার।

এদেশ কেমন হবে- এ প্রশ্নের উত্তরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুন্দর জবাব দিয়েছিলেন। আপনারা কিভাবে এ দেশকে গড়ে তুলতে চান- এর উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশ কেমন হবে। সত্যিই অনেক ধ্বংসস্তুপের মধ্যে মাথা তুলে যে নতুন রাষ্ট্র আজ এলোমেলো, এবড়োথেবড়ো, বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত হয়ে আছে তাকে আমাদের মনের মতো করে সাজাতে হবে- রূপায়িত করতে হবে আমাদের প্রতিটি স্বপ্নকে।

এই স্বপ্নকে রূপায়িত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সহযোগী চেতনার। হানাদার বাহিনীর চলাচলের পথ দুর্গম করে তোলার জন্য একদিন যে পুল, কালভার্ট আমরা ভেঙে দিয়েছিলাম- আজ সেই পথেই আমাদের নিত্যদিনের যাত্রা। এই বাড়ির পাশের পুলটির পুনঃনির্মার্ণের জন্য আপনি কি সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবেন? নিশ্চয়ই নয়। আপনার কাজ হবে প্রাথমিকভাবে পার্শ্ববর্তী মানুষের মধ্যে এমন এক চেতনার জন্ম দেয়া- এমন এক নতুন কর্মপ্রেরণাকে সঞ্চারিত করা, যাতে শারীরিক সাধ্যের অন্তর্গত পরিশ্রমে দেশের যে কোনো পুনর্গঠন কাজে নিদ্বিধায় অংশ নিতে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। এ ভাঙা পুলটি আপনারাই পুনঃনির্মাণ করতে পারেন। অর্থের সংগে কর্মের নিষ্ঠা যুক্ত না হলে অপচয়কে রোধ করা যায় না।

<005.008.250>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সর্বপ্রথম এই ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যতশীঘ্র সম্ভব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মেঘনা নদীর ওপর ভৈরব রেলব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মতো বড়ো বড়ো সেতুগুলোর ব্যবস্থাধীনেই তুরান্বিত হবে- কিন্তু বাড়ি পাশের, গ্রাম-গঞ্জের ছোটখাট পুলগুলো গ্রামীণ স্থানীয় চেষ্টায় মেরামত করা অসম্ভব কিছু নয়। এ ব্যাপারে অগ্রণী হতে হবে সাধারণ মানুষকেই।

আপনার বাড়ির পাশের যে স্কুলটি কিম্বা আপনার বাড়ির পাশের মসজিদটি, যা কিছুদিন আগে হানাদার বাহিনীর কামানের গোলা বা বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আপনাদের দায়িত্ব নিজেদের প্রচেষ্টায় তার প্রয়োজনীয় পুনঃনির্মাণ। সরকারকে ছোটখাটো পুনর্গঠনের দায়িত্বের দিকে টেনে না এনে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সরকারী প্রচেষ্টাকে কাজে লাগাতে দেয়া। আজকে অর্থনৈতিকও সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধান প্রভৃতি যে মহান দায়িত্ব সরকারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সমবেতভাবেই সেই দায়িত্ব পালনে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

দীর্ঘদিন শত্রুকবলিত বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদন অসম্ভব রকম হাস পাওয়ায় এবং বহিঃবিশ্বের সংগে যোগাযোগহীন হয়ে পড়ায় গ্রামে গ্রামে তেল, কেরোসিন, লবণ, সাবান, কাপড়, ঔষধপত্র প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। যোগাযোগের অব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কালোবাজারী-মুনাফাখোর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়াবে। স্থানীয়ভাবেই গ্রামে গ্রামে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, অসামরিক প্রশাসন গ্রামে গ্রামে চালু হবার সময় এসে গেছে। সুযোগসন্ধানী যারা সময়ের সুযোগ নিতে চাইবে- দেশদ্রোহিতার অপরাধে শাস্তিই তাদের প্রাপ্য হবে।

আগামী শুভ নববর্ষের পদার্পণের সংগে সংগেই পূর্ণ উদ্যমে শুরু হবে বাংলাদেশ সরকারের তথা বাংলাদেশবাসীর পবিত্র দায়িত্ব- শরণার্থীদের পুনর্বাসন। এই পবিত্র মানবিক দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সাহায্য, সহানুভূতি ও সশ্রম আত্মত্যাগ অপরিহার্য। এ দায়িত্ব সরকারের নয়- এই পুনর্বাসনের নৈতিক ও মানসিক দায়িত্ব আপনার আমার সকলের। হানাদার বাহিনীর প্ররোচনায় যে সমস্ত দালাল অনেক ভাবে অপরের সম্পত্তি, বাড়িঘর ও অস্থাবর মালামাল নিজেদের দখলে রেখেছিল- সরকারী হস্তক্ষেপের পূর্বেই সবকিছু ফিরিয়ে দিয়ে তাদের কর্তব্য হবে পুনর্বাসনের কাজকে তুরান্বিত করা। অবৈধভাবে অপরের সম্পদ ভোগ-দখলের যে কোন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আপনার বাড়ির পাশেই তার নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে নিঃস্ব হয়ে দীর্ঘ দশ মাসের অনিশ্চিত জীপনযাপনের পর আজ শরণার্থীদের দিকে বন্ধুত্বের কোমল হাতকেই প্রসারিত করা। ভাই, বন্ধু ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ পরস্পরের সহযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। জনসাধারণের মধ্যে এই শুভবুদ্ধির প্রসার ঘটাতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ঘৃণা নয়, প্রতিবেশী বলে বুকে টেনে নিতে হবে পরস্পরকে।

এ ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টার সফলতা জনসাধারণের সহযোগিতা নির্ভর। যাদের বাড়িঘর ভেঙে গেছে, তাদের জন্য ঘর তুলতে হবে- প্রয়োজনবোধে অর্থ, প্রয়োজনীয় আসবাব দিয়ে সাহায্য করতে হবে আমাদের যে অশুভ শক্তি একদিন তার অসহনীয় বর্বরতা দিয়ে এক কোটি মানুষকে দেশছাড়া করেছিলঅনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা সেই শক্তিকে পরাজিত করেছি। সেই ত্যাগের মহান আদর্শ, সেই সহযোগিতার ঐতিহ্যই বাংলাদেশের প্রতিটি পুনর্গঠনে আমাদের সরকারের হাতকে শক্তিশালী করুক, ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেই আমাদের সরকারের হাতকে শক্তিশালী করুক। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেই আমাদের আকাংক্ষিত সোনার বাংলাদেশ নতুন আলোয় স্নাত হবে।

(নির্মলেন্দু গুণ রচিত)

<005.008.251>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
…..১৯৭১

পাকিস্তানের গত তেইশ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল পাকিস্তান কখনো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হয়নি।

প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি চক্রান্তের রাজনীতিতে আস্থাবান ছিলেন এবং তাঁর আমল থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের তল্পিবাহকদের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও চক্রান্তের জাল বিস্তার পেতে তাকে। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, গোলাম মোহাম্মদ, ইসকান্দার মির্জা, এরা সবাই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুগত ভূত্য ছিলেন এবং চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির গুপ্ত পথ বেয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি নিয়োগপত্র নিয়ে ক্ষমতায় আসেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে পুর্বপরিকল্পিত পন্থায় বিভিন্ন সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে পাকিস্তানকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়েপরিণত করেন তিনি।

পাঞ্জাবের মালিক ফিরোজ খান নূন করাচীর আই, আই, চুন্দ্রিগড় ও সেই একই চক্রান্তের সিড়ি বেয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। আইয়ুব খান ছিলেন বৃটিশ সামরিক বাহিনীর একজন পেশাদার সৈন্য। তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে- একটি সামরিক ‘জুন্টার সহায়তায়। আইয়ুব খানের অনুচর কালাতের খান, মোনায়েম খান, সবুর এরাও কেউ প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গদীনসীন হননি।

পাকিস্তানের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও ক্ষমতায় এসেছেন সামরিক বাহিনীর দৌলতে, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অন্ধকার পথ বেয়ে আর তাই লিয়াকত আলী খান থেকে ইয়াহিয়া খান- পাকিস্তানের গত তেইশ বছরের ইতিহাস হচ্ছে গুটিকয়েক ক্ষমতালি সু, কায়েমী স্বার্থবাদী, আমলা মুৎসুদি, সামন্তপ্ৰভু, ধনপতি, সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী, সামরিক ও রাজনৈতিক স্বার্থশিকারীদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস।

যেহেতু চক্রান্ত, দলাদলি ও ষড়যন্ত্রের পঙ্কিলতার মধ্যে এই শাসকগোষ্ঠীর জন্ম, লালন-পালন ও মৃত্যু সেহেতু ওই তিনটি প্রক্রিয়ার প্রতিই তারা আস্থাবান ছিলেন। জনগণের কথা তাঁরা ভাবতেন না, কিম্বা ভাববার অবসর পেতেন না। জনগণের কোনো তোয়াক্কা তাঁরা করতেন না। জনগণের আশা-আকাংক্ষা, তাঁদের চাওয়াপাওয়া আর দাবী-দাওয়ার প্রতি সব সময় এক নিদারুণ নিস্পৃহতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন এই শাসকচক্র।

তাই এই গণবিমুখ শাসকচক্রের হাতে পড়ে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এক দুঃসহ সময় অতিবাহিত করেছে গত তেইশ বছর ধরে। ধনীরা আরো ধনী হয়েছে। গরীবের দল আরো গরীব হয়ে গেছে। যেহেতু এই শাসকচক্র পাঞ্জাবী ভূস্বামী, পাঞ্জাবী ধনপতি, পাঞ্জাবী আমলা-মুৎসুদি ও পাঞ্জাবী সামরিক জুন্টার দ্বারাই বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো, সেহেতু পাকিস্তানের বাকি চারটি প্রদেশ, পূর্ববাংলা, বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশের সাধারণ মানুষ এই শাসকচক্রের হাতে আরো বেশি লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও শোষিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি শোষিত হয়েছে পূর্ববাংলা ও পূর্ববাংলার মানুষ। পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ অধ্যুষিত পূর্ববাংলা এই শাসক চক্রের হাতে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয়েছে। যদিও পাকিস্তানের আয়-করা বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ আসত পূর্ববাংলা থেকে, তবু পূর্ববাংলাকে তার আয়ের সিকি ভাগও ভোগ করতে দেওয়া হতো না। সব তারা ব্যয় করত পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে কলকারখানা তৈরীর কাজে। যদিও কেন্দ্রীয় পাক সরকারের আয়ের শতকরা সত্তর ভাগ আসত পূর্ববাংলা থেকে, তবুও শিক্ষা খাতে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে

<005.008.252>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ব্যয় করা হতো মাথাপিছু চার টাকা ছয় আনা তিন পাই, আর পূর্ববাংলার জন্য মাথাপিছু মাত্র এক পাই শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য মাথাপিছু একাত্তর টাকা চার আনা পনেরো পাই, আর পূর্ব্বাংলার জন্যে মাথাপিছু মাত্র পাঁচ টাকা বারো আনা পাঁচ পাই। সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য মাথাপিছু টাকা দুই আনা সাত পাই, আর পূর্ববাংলার জন্য মাথাপিছু মাত্র নয় আনা ছয় পাই।

বৈষম্যের এখানেই শেষ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে বছরে মাত্র সত্তর লক্ষ টাকা সাহায্য দেয়া হয়েছে সেই একই বছরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়কে সাহায্য দেয়া হয়েছে চার কোটি দশ লক্ষ টাকা। যে বছরে রেডিওর জন্যে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র এক লক্ষ নিরানব্বই হাজার টাকা। সেই একই বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের রেডিও ষ্টেশনগুলোর জন্য ব্যয় করা হয়েছে নয় লক্ষ বারো হাজার টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বস্তরে নিযুক্ত পূর্ববাংলার অধিবাসীদের হার হচ্ছে শতকরা মাত্র চারজন। আর পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের হার শতকরা ছিয়ানব্বই জন।

বৈদেশিক বিভাগে রাষ্ট্রদূত পদসহ সমস্ত শ্রেণীর বঙ্গবাসী কর্মচারীর সংখ্যা শতকরা মাত্র পাঁচজন, আর পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের হার হচ্ছে শতকরা পচানব্বইজন।

আর দেশরক্ষা বিভাগ? শতকরা ৯১.৯ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী, আর শতকরা ৮.১ ভাগ পূর্ব বাঙালী। কী নিদারুণ বৈষম্য! কী ভয়াবহ শোষণ পূর্ববাংলার সদাজাগ্রত মানুষ তাই সংঘবদ্ধভাবে এই শোষণের অবসান দাবি করল। স্বায়ত্তশাসনের আওয়াজ তুলল তারা। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের কথাই বলা হয়েছে, তার বেশি কিছু নয়।

পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কোনো বিরোধ ছিল না, এখনও নেই। পাকিস্তানের যে কোনো অঞ্চলের মানুষের ওপরে যে কোনো রকমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণ সবসময় সোচ্চার হয়েছে। পূর্ববাংলার জনগণ শুধুমাত্র নিজেদের স্বাধিকার চেয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, তারা পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষের স্বাধিকারের দাবি তুলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্বল প্রদেশগুলোর ওপরে যখন শাসকচক্র জোর করে এক ইউনিটের জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছে, তখন পূর্ববাংলার জনগণ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোর জনগণের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তারাও এক ইউনিটের বিলোপ সাধনের দাবি তুলেছে।

বেলুচিস্তানের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর যখন জঙ্গী আইয়ুবশাহী তার সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়েছে, যখন অসংখ্য নরনারীকে লক্ষ্য করে মেশিনগানের গুলি চালিয়েছে, তখন পূর্ববাংলার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়েছেএই গণহত্যার নায়ক আইয়ুব খানের বিচার দাবি করেছে।

পাকিস্তানের শাসকচক্র সবসময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে এবং সেই বিরোধের ঘোলা জলে নির্বিঘ্নে সাঁতার কেটে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু ১৯৬৯ সালে তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। সারা পাকিস্তানের একসঙ্গে আইয়ুব খানের ডিক্টেটর শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দিল। পূর্ববাংলা, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান আর পাঞ্জাব এক সঙ্গে গর্জে উঠল।

খাইবার থেকে টেকনাফ প্রতিটি অঞ্চলের জনগণ, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, প্রতিটি স্তরের মানুষ গণতন্ত্রের পতাকা হাতে নিয়ে আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব আন্দোলনের জন্ম দিল।

<005.008.253>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম সারা পাকিস্তানের মানুষ দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হলো গণবিমুখ শাসকচক্রেকে উৎখাতের লড়াইয়ে। ১৯৬৯- এর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পাকিস্তানের শাসকচক্রের ভিত নড়িয়ে দেয় এবং তারা বুঝতে পারে যে জনতার এই একতায় ফাটল না ধরাতে পারলে তাদের একচেটিয়া শোষণ আর গণবিমুখ শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভবপর হবে না। জনতার মধ্যে ভাঙন ও বিরোধ সৃষ্টির সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক কলহের জন্ম দেয়া-হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, বাঙালী-অবাঙালী বিরোধ, পাঞ্জাবী-পাঠান বিরোধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে যখনই গদিচ্যুত হবার সম্ভবনা প্রকট হয়ে উঠছে, তখনই যে কোন একটি সাম্প্রদায়িক পদ্ধতি অবলম্বন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির পথে চালিয়ে, আত্মকলহে লাগিয়ে দিয়ে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করেছে তারা ।

১৯৬৯- এর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করেও যখন শাসকচক্র ব্যর্থ হলো, তখন একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আইয়ুব খান সরে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান চক্রান্তের পরিকল্পিত পথে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলেন। মুখে বলতে লাগলেন প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আসলে তাঁর পরিকাল্পনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ছোট-বড় সকল রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনি পৃথক-পৃথকভাবে মিলিত হতে লাগলেন- কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে উদ্দেশ্য ছিলো পরস্পরের বিরুদ্ধে পরস্পরকে লাগিয়ে দেয়া। সকল দলের সঙ্গে সমানে তাল রেখে চলেছিলেন তিনি। নিজেকে সাধু-সজ্জন হিসেবে উপস্থিত করেছিলেন সবার কাছে। নির্বাচনের দিন তারিখ ঘনিয়ে আসতে লাগল। এমন সময় ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হলো পূর্ব বাংলার মানুষ। সর্বনাশা ঝড় আর সামুদ্রিক জলচ্ছাসে দশ লাক্ষ মানুষ মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে প্রাণ হারালো। পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ সহায়- সম্বলহীন হয়ে পড়ল। পৃথিবীতে এত বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর হয়নি। এই দুর্যোগের সময়ে হাজার হাজার বিদেশী সৈন্য , বিদেশী সাংবাদিক বিদেশী সাহায্যকারীতে ভরে গেল পূর্ব বাংলার ঝড় উপদ্রুত অঞ্চল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকচক্রের একটি লোকও এলেন না এই অসহায় মানুষগুলোকে একটু সান্তনা জানাবার জন্যে। বাতাসে অনেক কথা শোনা যেতে লগল। নানা প্রশ্ন উঠল নানা মহল থেকে। ত্রাণ কাজের নাম করে বিদেশী সৈন্য কেন নামবে আমাদের মাটিতে? আমাদে সৈন্যরা বসে বসে করছে কি? এত বড় দুর্যোগ ঘটে গেল কিন্তু দেশের প্রেসিডেন্ট আর তার হেলিকপ্টারগুলো গেলো কোথায়? নানা গুজব ছড়াতে লাগল দ্রুত। জনৈক বিদেশী সাংবাদিক জানালেন, তোমাদের জন্য দুঃখ হয়। দশ লাক্ষ লোক তোমরা ঝড়ে হারিয়েছো। কিন্ত আরো দুঃখ আছে তোমাদের কপালে। আরো অনেক প্রাণ তোমাদের দিতে হবে শীঘ্রই। বিদেশী সাংবাদিকের এই উক্তি তখন থেকেই নানা আলোচনা, সমালোচনা, সন্দেহ এবং জল্পনা কল্পনার জন্ম দিয়েছিল পূর্ববাংলায়। অনেকের মনেই সন্দেহ জেগেছিল, আমরা কি কোনো বিশ্বরাজনীতির দাবা খেলার ছকের মধ্যে পড়ে আছি?

নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলো। যথা সময়ে শান্তি পূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে সারা পাকিস্তান ব্যপী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেলো পাকিস্তানের নাগরিকরা। নির্বাচনের ফলাফল বেরবার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেলো পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে তিনটি প্রদেশে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও একচেটিয়া শোষণের অবসানকারী দুটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। দল দুটি হলো- আওয়ামী লীগ আর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি।

আর প্রদেশ তিনটি হলো- পূর্ববাংলা, বেলুচিস্তান আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। বাকি দুটি প্রদেশ সিন্ধু ও পাঞ্জাবে জয়ী হলো জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি। পিপলস পার্টির নির্বাচনী ইস্তাহারেও একচেটিয়া শোষনের অবসান ও সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।

<005.008.254>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হতে দেখা গেল, যে সমস্ত দল ও গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে অস্বীকার করে এসেছে এবং সাধারণ মানুষকে শোষণের দেয়ালে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছে- সেই সমস্ত দক্ষিণপন্থী দলগুলোকে পাকিস্তানের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরিভাবে বর্জন করেছে।

পূর্ব বাংলায় নির্বাচনের ফলাফল গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন দখল করলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ। জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন তাঁরা। আওয়ামী লীগের এই বিজয়ের পেছনে যে সকল সম্প্রদায়ের লোকের সমর্থন ছিল তার প্রমাণ হলো, ঢাকার মীরপুর-মোহাম্মদপুর, খুলনার খালিশপুর, রংপুরের সৈয়দপুর ও ঈশ্বরদী প্রভৃতি অবাঙালী অধুষিত অঞ্চলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিপুল ভোটাধিক্যে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম নামক সামরদায়ীক দলের প্রার্থীদের পরাজিত করেছে।

নির্বাচনের এই ফলাফল পাকিস্তানের শাসক ও শোষকচক্রের নাভিশ্বাস তুলে দেয়। তাঁরা ভেবেছিলেন নির্বাচনে কোন একটি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তাদের মধ্যে তখন ক্ষমতা নিয়ে কলহ দেখা দেবে, এবং সেই কলহের সুযোগ নিয়ে পুরোনো পাপীরা আবার নতুন করে ক্ষমতা দখল করে বসবে।

কিন্তু ফলাফল যখন উল্টো হয়ে গেল তখন আবার চক্রান্তে লিপ্ত হলো ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারকবাহক পাকিস্তানের শসকচক্র। আবার সেই পুরনো বিভেদের রাজনীতির দাবা খেলা শুরু করল তারা। এবং এই দাবা দেখার সুযোগ্য সহযোগী হিসেবে ভুট্টো আর কাইউম খান দুজনেই ছিলেন এই ষড়যন্ত্রকারীদের গোত্রভুক্ত।

খান আবদুল কাইউম খান হলেন সেই হিংস্র বর্বর রাজনীতিবিদ যিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে গণহত্যা আর জেল-জুলুমের মাধ্যমে সংখ্যালঘু দলে পরিণত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন।

আর জুলফিকার আলী ভুট্টো হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আইয়ুব খানের পোষ্যপুত্র হিসেবে তাঁর মন্ত্রিসভায় থাকাকালীন ছয়-দফার প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়েছিলেন। পরে আইয়ুব খানের সভাসদের দল থেকে বিতাড়িত হয়ে সহসা সমাজতন্ত্রের বুলি কপচাতে থাকেন। আজলে তিনি একজন চরম প্রতিক্রিয়াশীল, ক্ষমতালোভী, বৃহৎ ভূস্বামী।

ভুট্টো আর কাইউম খানকে দলে টেনে নিজেদের শক্তিশালী করলেন শাসকচক্র। তাঁরা দেখলেন পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধিকারের প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। তাদেরকে যদি চিরতরে দাবিয়ে দেয়া যায় তাহলে বেলুচিস্তান, সিন্ধু আর সীমান্ত প্রদেশের জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনকেও বানচাল করে দেয়া যাবে- এক ঢিলে চার পাখি মারতে সক্ষম হবেন তাঁরা।

তাই নির্বাচনের ফলাফল বের হবার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকচক্র নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে, ভুট্টো ও কাইউম খানের মাধ্যমে, পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও তিক্ততা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মাটিতে বাঙালী ও অবাঙালীদের মধ্যে একটা সামাজিক দাঙ্গাহাঙ্গামা বাঁধানোর চেষ্টাও করলেন তাঁরা তাঁদের অনুচর মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম আর নেজামে ইসলামের দালালদের মাধ্যমে। কিন্তু, পূর্ব বাংলার সদাসচেতন মানুষ এই প্ররোচনায় সাড়া না দেওয়ায় শাসকচক্র আবার বিপদে পড়ে গেলেন।

তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর মুখোশের কিছুটা খুলতে বাধ্য হলেন। শাসকচক্রের কলের পুতুল ভুট্টো হঠাৎ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন। তিনি জানালেন, জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত বৈঠক পিছিয়ে দিতে হবে, নইলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবেন তিনি। তিনি জানালেন, জাতীয়

<005.008.255>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পরিষদের সভা বসার আগে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলকে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র ও ক্ষমতার বিলিবন্টন সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে একটা সমঝোতায় উপনীত হতে হবে। তা না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকা হবে না।

এই ধরনের একটি অযৌক্তিক দাবি ও অন্যায় আবদার গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল হলেও এটাই ছিল খান যে এই সিদ্ধান্তের অন্যতম ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন ভুট্টোর হুমকির সঙ্গে সঙ্গে তিনি জাতীয় পরিষদের ৩রা মার্চে আহুত সভা কোনো কারণ না দেখিয়েই অনির্দিষ্টকালের জন্যে মুতলবী ঘোষণা করে দিলেন- যদিও জাতীয় পরিণষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য তখন পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবার জন্য ঢাকা এসে জমায়েত হয়েছিলেন। এর মধ্যে কাইউম খান ও ভুট্টোর দল ছাড়া অন্য সব দলের সদস্যরা ছিলেন।

ইয়াহিয়া খানের এই হঠকারী ঘোষণা স্বাধিকারকামী পূর্ব বাংলার জনগণের মনে অসন্তোষের আগুন জুলিয়ে দিল। শাসকচক্রের চক্রান্তের কথা বুঝতে তাদের বাকি রইল না।

আওয়ামী লাগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে শান্তিপূর্ণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাবার আহবান জানালেন। জনগণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করল। ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী এই অহিংস জনতার ওপর বিনা প্ররোচনায় গুলিবর্ষণ করল। সহসা ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করে একরাতে তাঁর বর্বর সৈন্যেরা প্রায় দু-হাজার দেশপ্রেমিককে খুন করলো। কিন্তু এই প্ররোচনার মুখেও শেখ মুজিবর রহমান জনগণকে শান্ত থাকার আহবান জানালেন। জনগণ শান্ত রইল। তখন শাসকচক্রের ভাড়াটে দালালরা পূর্ব বাংলায় বাঙালী ও অবাঙালীদের মধ্যে একটা দাঙ্গা বাধাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। এ সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন- পূর্ব বাংলার বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ শাসকচক্র দাঙ্গা বাধাতে টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার সামরিক প্রশাসনের প্রধান ও গভর্নর হিসাবে নিয়োগ করে ঢাকায় পাঠান হলো।

জেনারেল টিক্কা খান হচ্ছেন সেই জেনারেল- যিনি বেলুচিস্তানের নিরীহ জনগণ যখন ঈদের নামাজে অংশ নেওয়ার জন্য কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তাঁদের ওপরে বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে ও মেশিনগান চালিয়ে কয়েকশ বালুচকে হত্যা করেন। সেই টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলায় পাঠানো তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

টিক্কা খান এলেন এবং তার কিছুদিন পরে ইয়াহিয়া খানও দলবল নিয়ে এলেন ঢাকায়। ১৬ই মার্চ তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। মুখে আলোচনার বাণী। এবং আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত আর অন্যদিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে এক বিরাট সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন ইয়াহিয়া খান আর সামরিক ‘জুন্টা’র প্রধানরা।

জল এবং বিমান পথ হাজার হাজার সৈন্য আমদানি করলেন তাঁরা পূর্ব বাংলার মাটিতে। সামরিক নিবাসগুলোকে আরও সুদৃঢ় করলেন। ঢাকা সৈন্যশিবির ও বিমানপোতের চারপাশে অসংখ্য বিমানধ্বংসী কামান বসান হলো। মেশিনগান বসান হলো বিমানপোতের আশেপাশের বাড়ির ছাদে। একদিকে আলোচনার প্রহসন চলল আর অন্যদিকে চলল দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি।

২৫ শে মার্চ, ১৯৭১

এল সেইদিন, যে-দিনটির জন্যে পাকিস্তানের শাসকচক্র ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ থেকে অপেক্ষা করছিল রাতের অন্ধকারকে আশ্রয় করে মিথ্যাবাদী তস্কর ইয়াহিয়া খান চুপিচুপি ঢাকা থেকে পালিয়ে গেলেন এবং যাবার আগে তার বর্বর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে গেলেন বাংলার নিরীহ নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষ নিধনযজ্ঞে।

<005.008.256>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় গণহত্যা শুরু হলো। ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, মর্টার, বোমারু বিমান ব্যবহৃত হলো নিরস্ত্র মানুষকে মারার জন্যে।

লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করল তারা।

কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, নারী, পুরুষ, দুগ্ধপোষ্য শিশু, ছাত্র, কেরানী, বুদ্ধিজীবী-কেউ বাদ গেল না তাদের এই নৃশংস বর্বরতার হাত থেকে। ইয়াহিয়া খানের হিংস্র বন্য সেনারা অসউইজ আর বুখেনওয়ালডের হত্যাকাণ্ডকেও স্নান করে দিল।

মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে অসহায় বাংলার মেহনতি মানুষ আর দুর্জয় মনোবল আর তার সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণপণ প্রতিরোধ যুদ্ধে। বাংলার ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, আনসার আর পুলিশ বাহিনী তাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্যে অস্ত্র তুলে নিল হাতে। আর অন্যদিকে, ইয়াহিয়া খানের বর্বর সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জুলিয়ে দিয়ে পুরো দেশটাকে শ্মশানে পরিণত করতে লাগল।

হিংসার এই উন্মত্তার মধ্যে বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব সরকার গঠন ছাড়া আর অন্য কোনো পথ রইল না। বাংলাদেশের জন-প্রতিনিধিরা তাই মুজিবনগরে সমবেত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন।

পাকিস্তান এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে মৃত।

পাকিস্তানের এই অপমৃত্যুর জন্যে বাংলাদেশের মানুষ দায়ী হয়। দায়ী পাকিস্তানের শাসকচক্র, যারা পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষের স্বাধিকারের প্রশ্নকে লক্ষ লক্ষ লাশের নীচে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। পাকিস্তানের এই মৃত্যুর জন্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলও দায়ী নয়। দায়ী লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, ইস্কান্দার মীর্জা, খাজা শাহাবুদ্দিন, খান আলী ভুট্টো প্রভৃতি গুটিকয়েক ক্ষমতালি সু কায়েমী স্বার্থবাদী আমলা-মুৎসুদ্দি, সামন্তপ্রভু, ধনপতি, ব্যক্তিগত জমিদারী হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে।

বাংলাদেশ এখন প্রতিটি বাঙালীর প্রাণ।

বাংলাদেশে তারা পাকিস্তানের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না।

সেখানে তারা গড়ে তুলবে এক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। সেখানে মানুষ প্রাণ ভরে হাসতে পারবে, সুখেশান্তিতে থাকতে পারবে।

বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে।

লড়ছে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক পেশাদার বাহিনীর সঙ্গে। লড়ছে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে জীবনকে অর্জন করার জন্য।

বাংলার মানুষের এইমুক্তির লড়াই পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত অঞ্চলের মেহনতি মানুষকেও শোষণমুক্ত হবার প্রেরণা যোগাবে।

(জহির রায়হান রচিত)

<005.009.257>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত রণাঙ্গন সম্পর্কিত কয়েকটি কথিকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- এর দলিলপত্র সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১

দখলীকৃত এলাকা ঘুরে এলাম

২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

এক

মুজিবনগরে এসেছিলাম প্রায় দু’মাস আগে। তাই এ দু’মাস শুধু পরের মুখেই শুনেছি দেশের দখলীকৃত এলাকার কথা শুনেছি পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনীর গণহত্যা, নির্মম অত্যাচার, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের লোমহর্ষক কাহিনী। তাই, মনে মনে ভাবছিলাম একবার বাড়ি যাব। স্বচক্ষে দেখে আসব দেশের ও দশের অবস্থা। পারলে ওদেরকে একটু প্ৰবোধও দিয়ে আসব। আর বলে আসব তোমাদের মুক্তির দিন আগত প্রায়।’

কিন্তু যাবো বললেই ত যাওয়া হয় না। প্রথমত, আমি যে দায়িত্বে ন্যস্ত তা কার হাতে দিয়ে যাই। তার ব্যবস্থাও যখন করলাম তখন দেখা দিল নতুন ফ্যাসাদ। বন্ধু-বান্ধব ও হিতাকাংক্ষীদের দু’একজন ছাড়া সবাই নিষেধ করে বললেন, ‘গেলে আর ফিরে আসতে পারবেন না। ওরা পেলে আপনাকে গুলি করে মারবে।’

তবু সব উপেক্ষা করে একদিন রওয়ানা দিলাম, অতি ভোরে। হাঁটতে হাঁটতে সকাল ১১টা নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। বন-জঙ্গল ও গাছপালার ঘেরা একটা ছোট্ট গ্রাম। তারই মধ্যে একটা পোড়ো বাড়িতে এই ক্যাম্প। বাড়িটার চারদিকে এক মাইলের মধ্যে নেই আর কোন বাড়িঘর। তবে এলাকাটা এমন জনমানবহীন সব সময় ছিল না। সোনার বাংলাকে দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণে যারা শাশানে পরিণত করেছে, তাদেরই লেলিয়ে দেওয়া খুনী সৈন্যরা গত এপ্রিল মাসে সমগ্র এলাকাটিকে উজাড় করে দিয়েছে। বহু লোককে ওরা গুলি করে মেরেছে, প্রায় সমস্ত বাড়িঘর ওরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই এসবের পরও যারা বেঁচে ছিল তারা সীমান্ত আতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

ক্যাম্পের কাছে যেতেই কে একজন হল্ট’ বলে চেচিয়ে উঠল। ডানে তাকিয়ে দেখি রাইফেল হাতে একজন তরণ। সম্ভবত কয়েক মাস আগে সে কোন কলেজে পড়ত। কাছে এসেই জিজ্ঞেস করল, আমি কে এবং কি জন্য ওখানে গিয়েছি। বললাম, আপনাদের কম্যাণ্ডার সাহেবের সাথে দেখা করব, ব্যক্তিগত প্রয়োজন আছে।

সৈনিক আমাকে দাঁড়িয়ে রেখে আরেকজনকে ডেকে আনতে গেল, কয়েক কদম আগে। মধ্য-বয়সের দ্বিতীয় লোকটি কাছে এসে অতি বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন আমার পরিচয় এবং কম্যাণ্ডার সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাতের কি প্রয়োজন। তার প্রশ্নের যথাযথ জবাব দানের পর তিনি আমাকে একটা গাছের গোড়ায় বাঁশের চটায় তৈরী একটা বেঞ্চিতে বসতে বলে ভেতরে গেলেন। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এসে আমাকে কম্যাণ্ডার সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন।

র্যা ঙ্ক তার ক্যাপ্টেন বটে, কিন্তু তিনি হলেন ঐ ক্যাম্পের সর্বাধিনায়ক। আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে যুদ্ধ করছেন তারই নির্দেশে। সারাদিন সারারাত বসে বসে তিনি খবরাখবর নেন শত্রুর

<005.009.258>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

গতিবিধির। তারপর স্ট্রাটেজী ঠিক করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠান এ্যাকশনে, মাঝে মাঝে তিনি নিজেও এ্যাকশনে যান, তবে তা নির্ভর করে এ্যাকশনের গুরুত্বের উপর।

দোহারা চেহারার লোক এই ক্যাপ্টেন বা কম্যাণ্ডার। তাকে আগে কোথায় দেখেছি বলে আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল। কিন্তু স্মরণ করতে পারলাম না। তবে তিনি আমাকে দেখেই বলে ফেললেন। বললেন, রহমতের খবর কি? বললাম, ২৩শে মার্চ পর্যন্ত তার খবর জানতাম। বিজলীদের দেশে পাঠিয়ে দিয়ে সে সময় রহমত ঢাকায় ছিল। তারপর আর কিছু জানি না। সাথে সাথে মনে পড়ল এ ক্যাপ্টেনকে ঢাকা মেডিক্যাল পুরোভাগে। তাছাড়া, তাকে দেখেছি সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের টেবিলে। কলেজ ছাত্র সংসদের খবর নিয়ে তিনি যেতেন রিপোর্টারদের কাছে।

বললাম, আপনি ত ডাক্তার হয়েছেন, শুনেছি আর্মি মেডিক্যাল কোরে গিয়েছেন। আর এখন দেখছি কম্যাণ্ডারগিরি করছেন। হেসে বললেন, ‘এখন দরকার এ্যাকশনের, যুদ্ধের। তাই জল্লাদের আর্মি মেডিক্যাল কোর থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছি।”…….

মার্চ-এপ্রিলের মত আজ আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আনাড়ী যোদ্ধা নয়। তারা আজ পুরাপুরি ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তারা আজ মেশিনগান চালাতে পারে, মর্টার চালাতে পারে এবং গ্রেনেড ও ডিনামাইট ব্যবহার করতে পারে। প্রয়েজনীয় অস্ত্র হাতে থাকলে এদের দশজন অন্তত একশো-দুশো শত্রুসেনাকে ঘায়েল করতে পারে।

ক্যাপ্টেন ও তাদের কয়েকজনের সাথে আলাপ করে দেখলাম ওরা নির্ভয়, মৃত্যুকে ওরা আজ পরোয়া করে না। মৃত্যুর সাথে ওরা আজ পাঞ্জা লড়তে প্রস্তুত। কথাটা ক্যাপ্টেন নিজেও আমাকে এক পর্যায়ে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওদের নিয়ে আমাকে অসুবিধায়ও পড়তে হয় অনেক বাঘ যেমন নরমাংসের গন্ধ পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তেমনি ওরাও কোনস্থানে শত্রুপক্ষের উপস্থিতির খবর পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শত্রুর কাছে কি অস্ত্র আছে আর ওদের কাছে কি আছে তার বাছবিচার ওরা করতে চায় না।’

ক্যাম্প থেকে ফিরে আসছি, এমন অতি পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মতিন ভাই, আমাদের মুজিব ভাই কি বেঁচে আছেন? ওনাকে কি ফিরে পাব?”

এ প্রশ্নে নতুনত্বের কিছু ছিল না। এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিদিন অসংখ্যবার। তবু তাকে বললাম, তিনি ত বলে গেছেন, তিনি হকুম দিতে না পারলেও যেন আমরা নিজ নিজ কৰ্তব্য করে যাই। সুতরাং বর্তমান সময় ওসব বিচার না করে তিনি যা চেয়েছিলেন তা সমাধা করায় আত্মনিয়োগ করাই কি শ্রেয় নয়?

তিনি বললেন, “তা ত ঠিক। আমরা তাই করছি এবং করে যাব। প্রয়োজনবোধে প্রাণ দেব। কিন্তু মুজিব ভাইকে ছাড়া যে বাংলাদেশের অস্তিত্বই চিন্তা করতে পারি না! জানেন, আমার বাবা ও দুই ভাইকে ঘাতকরা হত্যা করেছে। তবু বেঁচে আছি। কিন্তু মুজিব ভাইকে হারালে যে বাঁচতে পারব না।’

দুই

* * * * * সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

ক্যাম্পে কিছু সময় কাটানোর পর ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে ফিরে আসলাম। তিনি আমাকে একজন সুবেদার মেজরের হাওলা করে দিয়ে বললেনঃ ‘ওনার সাথে কথা বলুন, আমরা শিকারে যাচ্ছি।’

<005.009.259>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সুবেদার মেজর ৩৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের একজন লোক। কয়েক বছর আগে বাঙালীর গৌরব বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢুকেছিলেন একজন সৈনিক হিসাবে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ছিলেন যশোর ক্যান্টমেন্টে। তারপর থেকে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, বনে-জঙ্গলে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছেন দখলকার সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি জানেন না, তাঁর পরিবারের কে আজ বেঁচে আছে আর কে বেঁচে নেই। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন “পরাধীন জাতি হিসাবে বাঙালীদের বেঁচে থেকেই বা লাভ কি? পশ্চিমারা যেভাবে জাতি হিসাবে আমাদের অপমান করেছে, সর্বনাশ করেছে- তার প্রতিশোধ নিতেই হবে। আর সব কথার সেরা কথা বাংলাদেশকে শত্রুকবলমুক্ত করতেই হবে। তারপর বাপ-ভাই-এর অভাব হবে না বাংলাদেশে।”

অবাক হয়ে ভাবলেন এই আধশিক্ষিত লোকটির কথা। কি অসীম দৃঢ়তা! কি গভীর আত্মপ্রত্যয় বিরাজ করছে তার মাঝে! বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বাঙালীর অপমানের প্রতিশোধই আজ তার কাছে বড়। নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-পুত্রদের বেঁচে থাকা না থাকার প্রশ্নটি আজ তার কাছে গৌণ।

এতদিন পরে বুঝতে পারলাম কি করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে মাত্র দুই কোম্পানী বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের অন্ততঃ ৫/৭ গুণ শত্রুসৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েও যুদ্ধ করতে করতে পথ করে নিতে পেয়েছিলেন। সেদিন তাদের পাঞ্জাবী-অধিকর্তা লেঃ কর্নেল বেঈমানী করেছিল। ষড়যন্ত্র করে সন্ধ্যার সময় অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবু এরা বাঙালীর জাতশত্রুদের হুকুম মোতাবেক আত্মসমর্পণ করেনি। অন্যান্য বাঙালী অফিসারদের নেতৃত্বে তারা যুদ্ধ করেছে। একজনের প্রাণের বদলে ১০ জনের প্রাণ নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে।

সুবেদার মেজরের কাছে শুনলাম ক্যাপ্টেনের পশু-শিকারে যাওয়ার কাহিনী। তিনি বললেন, ‘একটু আগেই খবর এসেছে ৪০-৫০ জন খানসেনা এসে আস্তানা গেড়েছে। গত রাতেও তারা নাকি ওখানে ছিল। আজ রাতে ওদেরকে দলবলে খতম করতে হবে। স্থানটাও এখান থেকে বেশ দূরে। তাই ক্যাপ্টেন জন পনেরো মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এখনই রওয়ানা হতে যাচ্ছেন।”

বললাম, ৪০-৫০ জন সুদক্ষ শত্রুসৈন্যের মোকাবেলায় আমাদের ত আরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা যাওয়া দরকার।’

তিনি হেসে দিয়ে বললেন, ‘না, না, তা মোটেই নয়। আমাদের ১৫ জনই ওদের ৫০ জনের মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট। ইনশাআল্লাহ, ঐ ১৫ জনের হাতেই ওদের অন্ততঃ ৩০ জন খতম হবে এবং অন্যরা কুকুরের মত পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করবে।’

কথা প্রসঙ্গে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম উভয় পক্ষের হতাহতের তুলনামূলক হার। তিনি একটা রেকর্ড বের করে বললেনঃ হতাহতের হার হচ্ছে ১:৫০- অর্থাৎ গড়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার বদলে ৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে।

আমি বললাম, এমনটা কি করে সম্ভব? যুদ্ধে দু’পক্ষের হতাহতের এমনতর অনুপাতের কথা ত কোনদিন শুনিনি।’ জবাবে তিনি বললেনঃ “আমরাও আগে শুনিনি।

জবাবে তিনি বললেনঃ “আমরাও আগে শুনিনি।কিন্তু এখন নিজের চোখে দেখছি। আসলে ব্যাপারটা কি জানেন? আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ওদের খতম করা। আর ওদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাণে বাঁচা। তাই, প্রাণের বাঁচার তাগিদে ওরা এখন আর আমাদের সাথে যুদ্ধই করতে পারছে না, আর কোনদিন পারবেও না………

<005.009.260>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সুবেদার মেজরের সাথে কথা বলার সময় সেখানে এসে হাজির হলেন একজন তরুণ পূর্বতন সি-এস-পি অফিসার। কয়েক মাস আগেও তিনি ছিলেন কোন এক মহকুমার প্রশাসক।

পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা হাফশার্ট, পায়ে একজোড়া সাধারণ স্যাণ্ডেল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এ অবস্থা কেন? জবাবে জানালেন, ‘এর চেয়ে বেশী যোগাড় করাও সম্ভব নয়। তদুপরি, আমার সহমুক্তিযোদ্ধারা যেখানে এক-কাপড়, এক-জামায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানে কারো পক্ষে কি বিলাসিতা শোভা পায়?”

ভদ্রলোক চলে গেলে সুবেদার মেজরের কাছে সব শুনতে পেলাম। সাবেক মহকুমা প্রশাসক আজ একজন মুক্তিসেনা হিসাবে কাজ করছেন। আর দশজন যেখানে থাকেন, যা খান- তিনিও সেভাবে থাকেন, খান।

এসব শুনে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পরলাম। সুবেদার মেজর কিছুক্ষণ পর বললেনঃ এত কি ভাবছেন? সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, ভাবছিলাম ওই ভদ্রলোকের কথা।

একটি মহকুমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন তিনি মাত্র সেদিনও। আমরা যারা যুদ্ধ করি, সাংবাদিকতা করি অথবা যারা রাজনীতি করেন তারা ত বিপদ-আপদের ঝুঁকি নিয়েই ওসব পেশা গ্রহণ করেছিলাম। শেখ সাহেবের যে বিচার প্রহসন হতে পারে তা তিনি নিজেও জানতেন। কিন্তু এরা? এরা ত ছিলেন পাকিস্তান সরকারের সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত কর্মচারী। রাজনীতি ছিল এদের জন্য নিষিদ্ধ। এরা ইচ্ছে করলে মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকতে পারতেন। কিন্তু এরা নিজেদের আলাদাভাবে ভাবতে পারেননি। ভেবেছেন জাতির একজন হিসাবে। তাই জাতীয় দায়িত্ব হিসাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মুক্তিসংগ্রামে। সত্য বলতে কি, এই দায়িত্ববোধের আদর্শই বর্তমান মুক্তিসংগ্রামের সবচেয়ে মূল্যবান পাথেয়।

তিন

২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প থেকে বের হয়ে পড়লাম গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। বেলা তখন সাড়ে ১২টা। পথ রয়েছে ২২ মাইল। অথচ সোজাপথে গেলে এ দূরত্ব অর্ধেকে হ্রাস করা সম্ভব ছিল।

যাত্রার সময় সুবেদার মেজর আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন সামনের কতিপয় এলাকা সম্পর্কে। কেননা ঐ এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও শত্রুপক্ষ তখন সক্রিয় ছিল। তবে তিনি আমার সাথে একজন গাইডও দিয়েছিলেন যাতে আমার কোন অসুবিধা না হয়।

মাঠ-ঘাট পেরিয়ে মাইল তিনেক যাওয়ার পর আমরা একটা জঙ্গলে গিয়ে হাজির হলাম। চারদিকে তাকিয়ে আমি জঙ্গল আর জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। মাত্র মিনিট তিনেক সময়ের ব্যবধান। তারপরই ১৮-১৯ বছরের এক যুবককে সাথে নিয়ে আসলেন। আমাকে নিয়ে রওনা হলো সেই তরুণ সঙ্গী।

আমরা দুজন চলছি। তরুণ চললো আগে আগে, আমি তার পেছনে পেছনে। তরুণকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র। এখন মুক্তিবাহিনীতে কাজ করছে। যশোর জেলায় তার বাড়ি। বহু আগেই বাবা মারা গেছেন। বাড়িতে ছিলো বিধবা মা আর ভাইবোন। গত এপ্রিল মাসে পাকিস্তানী সৈন্যরা তার কলেজে পড়া বোনকে ধরে নিয়ে যায়। ছোটভাই তাতে বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যা করে। অবশ্য পরে ছোট বোনটিকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, বাড়ি থেকে দূরে। এই খবর পেয়ে সে যখন বাড়ি গিয়েছিলো তার

<005.009.261>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

শোকাহতা মা নাকি তাকে বলেছিলেনঃ বাবা তুই যদি আমার সন্তান হোস, তাহলে এই ঘৃণ্য অপরাধের যোগ্য প্রতিশোধ তুই নিবি৷ যা, এক্ষুনি বের হয়ে পড়- মা-বোনদের অপমানের প্রতিশোধ তোকে নিতেই হবে।

মায়ের দোয়া মাথায় নিয়ে সেই সে তরুণ ছাত্রটি বেরিয়ে এসেছে, আর ঘরে ফেরেনি। এরপর মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। ছোট ভাইবোনের হত্যার প্রতিশোধ সে নিয়েছে। নিজের হাতে হত্যা করেছে পাঁচজন খান সেনাকে। তবু তার শান্তি নেই, বিশ্রাম নেই। যেদিন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ মুক্ত হবে, বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে-গ্রামে উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা, সেদিনই হবে তার সত্যিকারের প্রতিশোধ নেওয়া।

মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই বীর সৈনিকের নিষ্ঠা ও অবিচলতার প্রমাণ তার কথা থেকেই। অমিততেজ বাঙালী তরুণ আমাকে বললঃ দেখুন, যারা আমার বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছিলো, আমিও পেয়েছিলাম তাদের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করার সুযোগ; কিন্তু তা আমি করিনি। তা আমি করতে পারি না। সহকর্মীদেরও এমন অপকর্ম থেকে নিবৃত করেছিলাম- কেননা আমরা যে পাশবিকতার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করছি। ওরা পশু, ওরাই পারে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করতে- আমরা তা করতে পারি না।

আমরা একটা বিস্তৃত মাঠের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঠের এখানে সেখানে লোকজন কাজ করছে। কেউ ধান কাটছে, কেউ ঘাস তুলছে ক্ষেত থেকে। একটা পাটক্ষেতের আড়ালে কজন ক্ষেতচাষী ধানখেত থেকে ঘাস তুলছে। তাদের দিকে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে তরুণ আমাকে বললো, ওরা আমাদেরই লোক। আরো বললোবাংলাদেশের মুক্তিসেনারা এমনি করে ছড়িয়ে আছে গ্রাম-গ্রামান্তরে বাংলার মাঠে-ঘাটে সর্বত্র। ঐ যে সামনে নদীটা দেখছেন তার ওপারেই রয়েছে একটা বাজার। বাজারে আগে পাকিস্তানী সৈন্যের ঘাটি ছিলো। তাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশীরভাগ খানসেনা মারা পড়েছে। আর যারা বেঁচে ছিলো তারা সবাই প্রাণ নিয়ে কোনমতে পালিয়েছে। তারপর বহুদিন এদিক আর ওরা আসেনি। কিন্তু গতকাল নাকি একটা দল এসেছিলো। শুনেছি আজো আবার আসতে পারে। তাই আমাদের মুক্তিসেনারা পশুদের যোগ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।

খানিকটা সামনেই ছিলো নদী পারাপারের খেয়া। খেয়াঘাটে গিয়ে পাটনীর সাথে কীছু কথা বলে তরুণ বিদায় নিলো। অতপর তীরে গিয়ে আমি নেমে পড়লাম। পাটনীও আমার পেছনে পেছনে নেমে পড়লো। সে আমাকে নির্দিষ্ট একটা রাস্তা এড়িয়ে যেতে বললো। আমি যখন সেই বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম, আনন্দে তখন আমার বুকটা ভরে উঠলো। সেখানে সবগুলো দোকানেই উড়ছিলো স্বাধীন বাংলার পতাকা নিজের মনেই খানিক দাঁড়িয়ে গেলাম। সেখানে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এলো। বললাম : সালাম, আমার স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা, তোমাকে সালাম।

আরো মাইল তিনেক এগিয়ে গেলাম। চোখের সামনে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের পাশবিকতার চিহ্ন। চারদিক ধ্বংসের ছাপ লেগে আছে। সবকিছু লণ্ডভণ্ড, আগুনে জুলিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম লণ্ডভণ্ড করেছে কতো সুখের সংসার। খুব পিপাসা পেয়েছিলো। বারান্দায় এক বৃদ্ধকে দেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম, বুড়িমা পানি খাবো। বৃদ্ধার বয়স ৭০/৭৫ হবে। একটা ছেলেকে পানি আনতে বলে তার দুঃখের কথা শুরু করলেন। বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। বলাম মুজিবনগর থেকে। বাড়ি যাবো।

বাড়ি যাবো এ কথাটা শুনেই বৃদ্ধ আত্ক উঠলেন, বললেন- বাড়ি যেয়োনা, পাঞ্জাবীরা মেরে ফেলবে, ওরা মানুষ নয়, ওরা পশু। দেখছো না, আমার ঘর খালি। আমার সোনার ছেলেদের ওরা হত্যা করেছে। আমার আর কেউ নেই বাবা। তবু আমি কেনো যে বেঁচে রইলাম। বলতে বলতে বৃদ্ধা আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

<005.009.262>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বললাম-বুড়িমা কাঁদবেন না। আপনার ছেলে গেছে, আমরা রয়েছি তো আপনার সন্তান- আপনার আরো কতো সোনার ছেলে দেশের জন্যে যুদ্ধ করছে, তাদের দোয়া করুন

।পানি খেয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, বৃদ্ধা বললেন- আচ্ছা বাবা বল তো, ঐ যে আমরা ভোট দিয়েছিলাম, সেই মুজিবর ভালো আছে তো? সে বেঁচে থাকলে এর শোধ নেবেই।

দেখলাম গ্রামের সাধারণ বৃদ্ধাও বঙ্গবন্ধুর খবর রাখে- তার হৃদয়ে রয়েছে তার জন্যে অফুরন্ত দরদ। আরো অবাক হলাম এ ভেবে, যে দেশে এমন বৃদ্ধা রয়েছে সে দেশের ছেলেরা বীর সৈনিক না হয়েই পারে না।

এরপর যেখানে গেলাম সেটি যশোরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মশিউর রহমানের নির্বচনী এলাকা। চারদিকে থমথমে ভাব। কোথাও কোনো মানুষ দেখা গোল না। এই জনশূন্য পথে চলতে চলতে হঠাৎ রাস্তার উপর একটি লোকের সাথে দেখা। ২৭/২৮ বছরের লোকটির মুখে দাড়ি। পরনে পাঞ্জাবি। দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে লোকটি সম্ভবত জামাতপন্থী কেউ হবেন। দু’জন পাশাপাশি চলছি, কারো মুখে কোনো কথা নেই। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে নিতান্ত কৌতুহল ও উদ্বেগ বশেই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই, মশিউর রহমান সাহেবের খবর কি?” প্রশ্ন করেই নিজের মনেই শংকিত হলাম কি জানি কি হয়। কিন্তু প্রশ্ন শুনে লোকটি আমার দিকে এমন বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন যে তাকে দেখে মনে হবে তিনি যেন কোন ভাবনার সাগরে ডুবে আছেন। সারা চোখ-মুখে তার উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। হয়তো এক্ষুনি দু’চোখ বেয়ে নামবে অশ্রুর বন্যা।

ভরসা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এমন বিচলিত হলেন কেনো? তাকিয়ে দেখি পাঞ্জাবি পরা সেই অপরিচিত লোকটির চোখ বেয়ে তখন অশ্রু পড়াতে শুরু করেছে। তারই মধ্যে আমাকে বললেনঃ দেখুন, শেখ সাহেব কিংবা মশিউর রহমানের কথা তো কেউ এমন প্রকাশ্যে বলাবলি করতে সাহস করে না। তাই আপনার কথা শুনে আমার অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আপনি বোধ হয় এ এলাকায় নতুন এসেছেন?

পরে আলাপে জানতে পারলাম লোকটি স্থানীয় একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্যে প্রাণপণ খেটেছেন। মাইল খানেক একসাথে গিয়ে তিনি ভিন্ন রাস্তায় চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আমাকে সাবধান করে দিয়ে গেলেন যেন প্রকাশ্যে এমন কথা আর কাউকে আমি জিজ্ঞেস না করি।

মশিউর রহমানের পৈত্রিক গ্রাম সিংহঝুলি। সেখানে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো একটা উপশহর। তার উপর দিয়ে চলে গেছে যশোর-চৌগাছা সি এণ্ড বি রোড। রোড থেকে মাত্র এক মাইল দূরে আছি। সি এণ্ড বি রোড পার হবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছি-হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে এলো একটি লোক। বললো, বসে পড়ুন সাহেব, বসে পড়ুন। ঐ যে মিলিটারীর গাড়ি আসছে যশোরের দিক থেকে। লোকটি একরকম জোর করে আমাকে রাস্তার একপাশে বসিয়ে দেয়।

দেখতে দেখতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই তিনখানা গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাজারের উপর। গাড়ির গতি থামলো মাত্র মিনিট খানেকের জন্যে। চারদিকে একবার নজর করে ভোঁ করে চৌগাছার দিকে ছুটে চললো তারা।

লোকটির কাছেই শুনলাম, ঐ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর হাতে বারবার প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজকাল এদিকে বড়ো একটা এগুতে সাহস করে না। যদিওবা আসে একদণ্ড অপেক্ষা করার ভরসা পায় না।

মিলিটারীর গাড়িগুলো চলে যাওয়ার সংগে সংগে আমি তাড়াতাড়ি সি এণ্ড বি সড়ক পাড়ি দিলাম। যাবার সময় দু’পাশে তাকিয়ে দেখলাম ধ্বংসস্তুপের সীমাহীন চিহ্নরাশি। সারা বাজারের প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িই হার্মাদ

<005.009.263>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দস্যুরা ধ্বংস করে দিয়েছে। আর জনাব মশিউর রহমান সাহেবের বাড়ি তো ছিলো এই দস্যদের প্রধান লক্ষ্যস্থল। সুতরাং সে বাড়ির যে কিছুই অক্ষত থাকবে না তা বলাই বাহুল্য।

রাত তখন সাড়ে আটটার মতো হবে। কোথায় রাত কাটাবো ঠিক করে উঠতে পারছি না। একজনকে রাত কাটানোর অনুরোধ জানালে দেখিয়ে দিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যের বাড়ি। তবে একথাও শুনলাম ঐ সদস্য আগে জামাতে ইসলামীর লোক ছিলেন। সোজা গেলাম তার বাড়িতে। ডেকে বললাম, আমি আপনার এখানে রাত কাটাতে চাই, আমাকে থাকতে দিতে হবে। আর যদি আমাকে মিলিটারীর বা রাজাকারের হাতে তুলে দিতে চান, তাও করতে পারেন। তবে তার আগে খেতে দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন বড়ো বেশি ক্ষুধার্তা

ভদ্রলোক ছোট ভাইকে ডেকে আমার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি আগে জামাতপন্থী ছিলাম। কিন্তু গতকাল থেকে আমি বাঙালী এবং এখন এটাই আমার একমাত্র পরিচয়। জানেন, গতকাল মিলিটারী আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি এসে তাকে ২০টি যুবক ও কয়েকটা মেয়ে সংগ্রহ করে দিতে বলে। তিনি দুইদিনের সময় চেয়েছিলেন মাত্র। তারপর সৈন্যরা তার বাড়িতে ঢুকে চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রবধু ও যুবতী মেয়েকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে বুঝতেই পারছেন। বলতে বলতে মুহুর্তে ভদ্রলোকের মুখ-চোখের লক্ষণ পরিবর্তিত হয়ে গেলো। দেখলাম, তার সারা মুখে ঘৃণা ও গ্লানির চিহ্ন পরিস্ফুট। বাঙালী কি আর ভাইয়ের অপমান সইতে পারে?

চার

৩ অক্টোবর, ১৯৭১

মেম্বার সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেল। তথাকথিত ইসলাম-দরদীদের বর্বর মানবতাবিরোধী কাজই যে জামাতপন্থী এ মানুষটিকে সত্যিকারের বাঙালীতে পরিণত করেছে তার কথাবার্তায় তা পরিস্ফুট হয়ে উঠল। স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে অভিজ্ঞ মানুষটির কথাবার্তা থেকে আরো বুঝতে পারলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিটি গুলি, প্রতিটি অত্যাচার বাঙালীর ঐক্যকে দিন দিন সুদৃঢ় করে তুলেছে।

গালগল্প শেষ করে যখন শুয়ে পড়লাম তখন রাত প্রায় ১টা। চোখে তন্দ্রার ভাব আসলেও পুরোপুরি ঘুম বলতে যা বুঝায় তা তখনও আসেনি। এমনি সময়ে গগনবিদারী একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চমকে উঠলাম। এটা যে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের কাজ তা বুঝতে বাকী থাকল না। তবে কোথায় তারা এ বিস্ফোরণ দ্বারা কি নষ্ট করেছে তা তখনও জানতে পারলাম না। এরই কয়েক মিনিট পরে রেললাইনের দিকে আরেকটি প্রচণ্ড শব্দ হল। পরের দিন ভোরে জানতে পারলাম গেরিলারা সিংহঝুলির কাছে জোড়াপুলটি উড়িয়ে দিয়েছে। যশোর থেকে চৌগাছায় সৈন্য আনা-নেওয়ার জন্য এ পুলটির গুরুত্ব ছিল অনেক। আর দ্বিতীয় বিস্ফোরণ সম্পর্কে জানা গেল যে তা দিয়ে গেরিলারা একটি মালগাড়িসহ রেললাইন উড়িয়ে দিয়েছে। মালগাড়ির পাহারাদার কয়েকজন রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে।

সকাল তখন প্রায় ৮টা। আমি মেম্বার সাহেবের বাড়ি ছেড়ে নিজের পথে বের হয়ে পড়বো ঠিক এ সময়ে ঐখান থেকে মাইল চারেক দূরে শুরু হল মর্টার ও মেশিনগানের গোলা বর্ষণ। গোলা বর্ষণ চলছে তো চলছেই। থামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তাই ব্যাপারটা না জানা পর্যন্ত মেম্বার সাহেব আমাকে ঘরের বাইরে পা দিতে নিষেধ করলেন। ইত্যবসরে একটা সাহসী তরুণকে পাঠান হল ব্যাপারটা জেনে আসতে। ঘন্টা দু’এক পরে তরুণ এসে যা জানাল তা হচ্ছেঃ প্রত্যুষের দিকে কে বা কারা যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তার এক জায়গায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে গেছে। স্থানীয় রাজাকাররা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে খবর দিলে তারা পতাকা থেকে মাইল তিনেক দূরে এসে অবস্থান নেয় এবং সেখান থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করে। পতাকা যেখানে উড়ান

<005.009.264>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হয়েছে তার আশেপাশে কোথাও হয়তো মুক্তিবাহিনী লুকিয়ে আছে- এ ভয়েই পাঞ্জাবী সৈন্যরা ঘটনাস্থলের তিন মাইল দূর থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে।

যাহোক, সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তারা অবিরাম গোলাবর্ষণ করে কম্পিত শত্রুর উদ্দেশে। তারপর রাস্তার দু’পাশে ও সামনে গোলাগুলি ছড়তে ছুড়তে তারা এগিয়ে এল ঘটনাস্থলে। এতে প্রায় আরও ১ ঘণ্টা সময়। পতাকাটা তখনও সগৌরবে দাঁড়িয়ে থেকে পতপত করে করে মুক্তির গান গাইছিল। কিন্তু মানবতার দুশসন পাঞ্জাবী সৈন্যরা তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুজি করেও কোন মুক্তিসেনাকে জীবন্ত বা মৃত খুঁজে পেলনা। কিন্তু তবুও ক্যান্টানমেন্ট গিয়ে যে নিজেদের বীরত্বের কাহিনী ঢাকায় নিয়াজীর কাছে পাঠাতে হবে- তাই তারা কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে।

সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৪ঘন্টা সময়ে শুধু মাত্র কল্পিত শত্রুর উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে কত হাজার রাউণ্ড গোলা-গুলি অপচয় করেছে এবং তার মূল্যই বা কত হাজার বা কত লাখ টাকা তা কেবল সামরিক বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারেন। কিন্তু আমার মনে যে প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে তা হল নিজেদের টাকায় কিনতে হলে অথবা অন্যের কাছ থেকে না পেলে কি পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এমনভাবে গোলাগুলির অপচয় করতে পারত?

জবাবও আমি নিজের কাছ থেকে পেয়েছি। নিশ্চয়ই তারা এমনটা পারত না।

আমি আরো ভেবে দেখেছি, পশ্চিম পাকিস্তান বিভিন্ন সামরিক জান্তা এ পর্যন্ত বিদেশ তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ করেছে। বাংলাদেশ থেকে তাদেরকে দুদিন আগে বা পরে তল্পীতলপা গুটিয়ে যেতে হবে। সেদিন হয়ত বর্তমান জান্তা ক্ষমতায় থাকবে না- যেমন নাই আইয়ুব ভুট্টোর চক্র। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে যে এ টাকা সুদে আসলেই শোধ করতে হবে। বাংলাদেশের সোনালী সূত্র-পাট বেচা টাকা ছাড়া যে এ কাজ কত দুঃ সাধ্য হবে তা আমরা যেমন জানি, তারাও তেমনি জানে। তার প্রমাণ ইতি মধ্যেই মিলেছে। যুদ্ধের তিন মাস অতিক্রান্ত হতে না হতেই সামরিক জান্তাকে সমস্ত লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ঋণের কিস্তি পারিশোধের ব্যাপারে নিজেদের অপারগতার কথা ঘোষণা করতে হয়েছে। নতুন ঋণের জন্য নাকে খৎ দিতে হয়েছে বিভিন্ন দেশে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ধর্ণা দিতে হয়েছে রাজধানীতে রাজধানীতে। সুতরাং যুদ্ধ বেশী দিন স্থায়ী হলে তাদের পক্ষ নিজেদের সগৌরবে দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।…

(মতিন আহমেদ চৌধুরী রচিত)

মুক্তিযুদ্ধ কোন পথে

৪ অক্টোবর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ছমাস পূর্তি হয়েছে গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর তারিখে। এই ছমাসে মুক্তিযুদ্ধ কতটা এগিয়েছে তার খতিয়ান নিতে গেলে দেখা যাবে আমাদের হতাশ হবার কিছু নেই। বরং বাংলাদেশের বর্ষণমুক্ত শারদ আকাশের মতই বাংলার মুক্তিযুদ্ধও এক সফল ও প্রসন্ন প্রভাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পথ আমাদের দুর্গম। যাত্রাপথও বিপদসঙ্কুল। তবুও এই যাত্রাশেষে স্বাধীনতা ও মুক্তির সোনালী উষা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, এই দৃঢ়বিশ্বাসে আজ আমাদের বুক ভরে উঠছে। গত ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ

<005.009.265>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

মুজিবুর বলেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, তখন আরো দেব-কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।” বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়নি। সেই সে মার্চ মাস থেকে রক্তদান শুরু, বাংলার মানুষ এখনো জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য রক্ত দিয়ে চলেছে। কিন্তু এই রক্ত ও প্রাণদান এখন আর একতরফা নয়। বাঙালীর হাতে এখন অস্ত্র। বাংলাদেশের যুবশক্তি এখন মুক্তিবাহিনীতে রূপান্তরিত। তাদের হাতে রোজ খতম হচ্ছে শত শত হানাদার সেনা। তাই গভীর প্রত্যয়ে বুক বেঁধে আজ আমরাও বলতে পারি- “রক্ত দিয়েছি, আরো দেব। ইনশাআল্লাহ গোটা বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদারদের কবলমুক্ত হয়ে ছাড়বো।”

গত ছ’মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তিনটি ফ্রন্টে বিস্তৃত হয়েছে। যুদ্ধ এখন আর একটি ফ্রন্টে সীমাবদ্ধ নয়। এই তিনটি ফ্রন্ট হচ্ছে- এক, রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধ এবং দখলকৃত এলাকায় ক্রমবর্ধমান গেরিলা তৎপরতা। দুই অর্থনৈতিক ফ্রন্টে প্রত্যক্ষ অসহযোগিতা। তিন বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টি এবং ইসলামাবাদের জঙ্গী ফ্যাসিষ্ট চক্রের উপর ক্রমাগত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি।

হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের সাফল্যের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় সেপ্টেম্বর মাসের শেষ তিনদিনের যুদ্ধের কথা। এই তিনদিনের যুদ্ধে ১১৯ জন খানসেনা নিহত হয়েছে। ঢাকা শহরের অদূরে ইছামতী নদীতে হয়েছে আরো চমকপ্রদ যুদ্ধ। কয়েকটি লঞ্চযোগে সশস্ত্র হানাদার সৈন্যকে যখন নদী অতিক্রমের চেষ্টা করছিল, তখন নদীর উভয় তীর থেকে মুক্তিবাহিনী মেশিনগানের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় দলে দলে গ্রামবাসী। ফলে বহু হানাদার সৈন্য নিহত হয়। পাঁচজন আহত সৈন্যকে গ্রামবাসী পিটিয়ে মেরে ফেলে। অবশিষ্ট লঞ্চগুলো দ্রুত পলায়ন করে। পদ্মা ও ইছমতী নদীতে এ পর্যন্ত হানাদার সৈন্য বোঝাই একুশটি লঞ্চ ও অন্যান্য যান হয় ধ্বংস, নয় ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও হানাদার সৈন্যদের জন্য খুব ভীতিপ্রদ। শহরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার বাঁশ ও লোহার ডাণ্ডা দিয়ে রোড ব্লক করে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। রাতে গেরিলাদের চলাচলে বাধা দেয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু রাতে গেরিলারা যখন সত্য সত্যই অপারেশনে বের হন, তখন তাদের ভয়ে বীরপুঙ্গব খানসেনারা আর ঢাকার রাস্তায় থাকেন না। তারা ব্যারাকে গিয়ে আশ্রয় নেন। অবাঙালী রাজাকারদের বাধ্য করা হয় এই রোডব্লক পাহারা দিতে।

এটা গেল সম্মুখযুদ্ধ ও গেরিলা তৎপরতার কথা। এবার অর্থনৈতিক ফ্রন্টের যুদ্ধের খবর শুনুন। বাংলাদেশে কোন বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য কিনছে না। ফলে হাহাকার উঠেছে বাইশ পরিবার ও অবাঙালী ব্যবসায়ী মহলে। বাংলার চাষী পাট বুনছে না, ধান বুনছে- ফলে কারখানায় বাঙালী মজুর উৎপাদন চালাচ্ছে না। ফলে কি দাঁড়িয়েছে, তারই একটা হিসাব দিয়েছেন ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকার রিসার্চ ব্যুরো। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে। শিল্পোৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রা ও বিদেশী মুদ্রা আয়ের পথ ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হওয়ায় পাকিস্তান এক দারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাট রপ্তানি শতকরা ৮০ ভাগ কমে গেছে। পাকিস্তানের সমগ্র বিদেশী মুদ্রার শতকরা পয়তাল্লিশ ভাগই আসে বাংলাদেশের পাট রপ্তানি করে। এছাড়া আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যে ২৫০ কোটি টাকারও বেশী ক্ষতি হয়েছে। একদিকে এইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি অন্যদিকে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিষ্টচক্রের মাসে খরচ হচ্ছে পয়তাল্লিশ কোটি টাকা। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে যেখানে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে ছিল ২২ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারে। গত দু’মাসে এই তহবিল আরো শূন্য হয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানির আণ্ডারইনভয়েসিং ও আমদানীর ওভার-ইনভয়েসিং এর দরুণ বিদেশে পাকিস্তানের মূলধন দেদার চলে যাচ্ছে। বৃটেন ও ফ্রান্স পাকিস্তানে রপ্তানি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। ওদিকে আবার খবর প্রচারিত হচ্ছে, বিশ্বব্যাঙ্ক কনসরটিয়াম ইয়াহিয়া চক্রকে আবারো জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত, তাদের কোন সাহায্য দেয়া সম্ভব নয়।

<005.009.266>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বিশ্বে জনমত সৃষ্টি ও রাজনৈতিক চাপের ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া-চক্রের অবস্থা আরো খারাপ। ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়নের যুক্ত ইস্তাহারে এই প্রথমবারের মত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বাতিল করা হয়েছে এবং পূর্ব বাংলার মানুষের অনপহরণীয় অধিকার রক্ষার দৃঢ়সংকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের বিশ্ব শান্তি কমিটি, ট্রেড ইউনিয়ন, আফ্রো-এশীয় কমিটি, সাংবাদিক সমিতি একবাক্যে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট জঙ্গীচক্রের বর্বরতার নিন্দা করেছেন এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবিলম্বে মুক্তি দাবী করেছেন ‘প্রাভদা ও ইজভেস্তিয়া পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নারকীয় বর্বরতার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে। আরব রাজ্য কাতারের প্রধান শাসক বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রধানত্রীর কাছে এক তারবার্তায় তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরূপে উল্লেখ করে কার্যতঃ বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকার করে নিয়েছে। সিংহলের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ গুণবর্ধন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তিদাবীতে সিংহলের পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে সই সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ককালে ভারত বাংলাদেশ সমস্যার যে রাজনৈতিক সমাধান দাবী করেছে, তার প্রতি সোভিয়েট ইউনিয়ন, ফ্রান্স, সুইডেন, ইকুয়েডর ও নরওয়ে জোরালো সমর্থন জানিয়েছে। উগাণ্ডা, জাম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস এবং চিলিও বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত সমাধান দাবী করেছে।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন অধিনায়ক এয়ার মার্শাল আসগর খান আবার মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, ঢাকায় নতুন মীরজাফর ডাঃ মালিক ওরফে মল্লিকের নেতৃত্বে যে অসামরিক সরকার বসানো হয়েছে, জনপ্রতিনিধিত্বের কোন যোগ্যতা তাদের নেই। কয়েকজন অখ্যাত ও অপরিচিত লোক নিয়ে এই তাঁবেদার সরকার গঠনর করা হয়েছে। করাচী, পেশোয়ার, তুরঘামের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়েছে জঙ্গশাহী নিপাত যাক। লাহোরের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে। ফলে ইয়াহিয়া-চক্র বেসামাল হয়ে পড়েছেন। চারদিকের অবস্থা দেখে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, এদের ভরাডুবির আর দেরী নেই। তাই সাহসে বুক বেঁধে আজ আমরা বলতে পারি –

পূর্ব দিগন্তে রক্ত সূর্য শিশু রোদের জন্ম দিচ্ছে

মেঘনা, পাদ্মা, তিস্তা, কীর্তনখোলা তার প্রতিভাস

আমরা মুক্তি সৈনিক, আমাদের জয় অনিবার্য,

আমাদের হাতের মুঠোয় স্বাধীনতা ও মুক্তির পতাকা।

(আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত)

মুক্তিফৌজের ক্যাম্পে

……….অক্টোবর, ১৯৭১

সেদিন একটা মুক্তিফৌজ-এর ক্যাম্পে গিয়েছিলাম রিপোর্ট সংগ্রহের জন্যে। কিন্তু মনের মধ্যে আরো একটা ইচ্ছা সুপ্ত ছিল। সেটা হলো বাংলাদেশের সেই সমস্ত কিশোরদের দেখা, তাদের কথা শোনা, যাঁরা মাবাবা আত্মীয়-পরিজন সবার মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে, দেশের স্বাধীনতা রক্ষার দুর্বার শপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর ওপর। সত্যি বলতে কি এটা আমাকে নেশার মত পেয়ে বসেছিল। তাই যখন রিপোর্ট সংগ্রহের ছুতো করে সেই সুযোগটা অকস্মাৎ এসে গেল তখন আর এক মুহুর্ত দেরী না করে ক্যাম্পে যাবার আয়োজন আরম্ভ করলাম।

<005.009.267>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ক্যাম্পে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা সাড়ে তিনটা চারদিকে সারি সারি টেন্ট খাটানো। প্রায় আধমাইল দূরে কোলাহলমুখর বসতি। আমরা এতদূর থেকেও আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিটি ঘরের চালে ও গাছের ডালে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছিল। ক্যাম্পে দেখলাম এক জায়গায় কতগুলি ছেলে তাদের অস্ত্র পরিষ্কার করছে। কেউ কেউ তাদের জুতোর কাদা ধুয়ে ফিতে পরাচ্ছে, আবার এক জায়গায় কয়েকজন মিলে জয়বাংলা পত্রিকা পড়ছে। সবার চোখে মুখে যেন একটি ভাষাই সোচ্চার, সবার মনেপ্রাণে একই দৃঢ়তা ও প্রত্যয়। দেখে মনে হলো এরা সবাই যেন এখনই জীবনাৰ্ণবের অমৃত উৎসে অবগাহন করে উঠেছে। হঠাৎ দেখলাম পাশের একটা টেণ্ট থেকে একটা কিশোর চপল হরিণের মত চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে এলো। ওর দিকে তাকিয়ে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। ওর গভীর অতল চোখগুলো দেখে মনে হলো যে-কোন মুহুর্তে সেগুলো জ্বলে উঠতে পারে নির্মম দহনে। ছেলেটাকে দেখে আমার এত ভাল লাগল যে আমি আলাপ করার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “তোমার নামটা কি?” প্রথমে কোন উত্তর করল না। তার চোখে স্পর্শ দিয়ে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে রইল। মনে হলো ও যেন আমার কপালের ত্ৰিবলী আর মুখের বিভিন্ন রেখার মাঝে কী এক পাঠ্য খুঁজে পেয়েছে। আর তাই পড়ে নিচ্ছে নিঃশব্দে। কিছুক্ষণ পর একটু আত্মস্থ হয়ে বলল- ‘নাম? আবার একটু থেমে বলল “আমার নাম জানেন না? আমরা তো আমাদের সবার নাম জানি। আমাদের সবার নামই তো এক- বাঙালী” চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। সম্বিৎ ফিরে পেলাম ওর কথায়। ও বলল, “আপনি তো রিপোর্টার।” আমি বললাম, “হ্যাঁ। শুনলাম মুক্তিবাহিনীর মাত্র তেরজন গেরিলা আড়াইশ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য মেরেছিল। এবং আমিও তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। যদি আপনার ইচ্ছা হয়,আমার থেকেও সব ব্যাপার জানতে পারেন।” আশ্চর্য হয়ে গেলাম, এত বড় সাহসিকতার যে সেও একজন ভাগীদার তাতে তাঁর কোন বিকার নেই। এগুলি যেন এখন তাদের কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার। আমি আরো ঘন হয়ে ঘাসের উপর বসলাম। সে বলতে রইলঃ গত পরশু দিন আমাদের মেজর এসে খবর দিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর কয়েক ব্যাটেলিয়ন নিয়ে আড়াইশ জনের মত সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের অদূরে অধিকৃত এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে। একথা শোনার পর আমরা সবাই তাদের খতম করতে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম। পেয়েছিল হানাদার বাহিনীর সাথে এল-এম-জি, এইচ-এম-জি প্রভৃতি ছাড়াও তিন ইঞ্চি মর্টার আছে। আমরা সেইভাবে প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা দিলাম শত্রুর ঘাটির দিকে। যখন সেই জায়গাটায় পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। জায়গাটা একটু উচুনিচু ও টিলাবহুল। কিছুটা দূরে কী এক বড় নদীর এক ক্ষীণ শাখা প্রবাহিত। বহু দূরে দেখা যাচ্ছিল শত্রুর ক্যাম্পের নিম্প্রভ ও কম্পিত শিখা জানেন, সেদিকে চোখ পড়তে আমাদের রক্ত এত চঞ্চল হয়ে উঠল, শত্রুহননের জিঘাংসা এত প্রবল হয়ে উঠল তা আপনি বুঝতে পারবেন না। এ তো ভাষায় বোঝান সম্ভব নয়, জন্তু হত্যা করায় এত আনন্দও আছে। কিন্তু আমাদের সে অধৈর্য কমাণ্ডারের আদেশে প্রশমিত করতে হলো। ঠিক হলো রাত সাড়ে এগারটার দিকে আমরা আক্রমণ চালাব। কমাণ্ডার আমাদের দলের দু’জনকে নিয়ে শক্রক্যাম্পের জায়গাটা পরিদর্শন করতে গেলেন।

প্রায় আধঘণ্টা পরে তারা ফিরে এসে আমাদের জানালেন পরিস্থিতি আমাদেরই অনুকূল এবং আমাদের আক্রমণ চালাতে হবে, A.B.C এই তিন পদ্ধতিতে। তখন রাত সাড়ে আটটা। আরো তিনঘণ্টা, ১৮০ মিনিট, কত সহস্র সেকেণ্ড উফ ভাবতেও অসহ্য লাগল। এত সময় কীভাবে কাটাব, ঐ নোংরা পাপী পশুগুলি আরো দুঘণ্টা বাংলাদেশের নির্মল পবিত্র বাতাসে নিঃশ্বাস টানবে। ভাবতেও গা রী-রী করে জ্বলে উঠল। কিন্তু কমাণ্ডারে আদেশ। একচুলও এদিক-ওদিক করার জো নেই। বসে রইলাম দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে। সদ্য পানিতে ফেলা এ্যাসপিরিন ট্যাবলেটের মত চাঁদটা ঝুরো ঝুরো লঘু মেঘের ভেতর ঢুকে গলে যাচ্ছে, আধো আধো হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম। নাকে ভেসে আসছিল অদূরের ঝোপ থেকে কোন বনফুলের গন্ধ। হঠাৎ গ্যাছে।

<005.009.268>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। জন্তু বধ করার সময় হয়ে গেছে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমরা যাত্রা আরম্ভ করলামকখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে নিঃশব্দে, কখনো খর পায়ে। শত্রুক্যাম্পের থেকে একটু দূরে আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে এসে আমরা A.B.C পদ্ধতিতে ভাগ হয়ে দাঁড়ালাম। A ও B দুই দল LM-G, H-M-G, S-M-G সাধারণ রাইফেল নিয়ে দাঁড়াল দুই টিলার আড়ালে। এখান থেকে শক্রক্যাম্প মাত্র চারশ গজের মত দূরত্ব। আর C দলের দুইজন রকেট লাঞ্চার নিয়ে আমাদের উল্টো দিকে শত্রুক্যাম্পকে আমাদের উভয়ের মধ্যে রেখে প্রস্তুত হয়ে রইল। ঠিক সাড়ে এগারটা বাজতে সে দল বাদে আমাদের সবার অস্ত্র গর্জন করে উঠল। হঠাৎ-আক্রমণে শত্রুসৈন্যগুলি কিছু বুঝতে না পেরে ক্যাম্পের ভিতরেই চুপ করে বসে রইল। বাইরে যে কয়জন ক্যাম্প গার্ড দেয়ার জন্য ছিল, তারা, সে আবছা আলোতেও দেখলাম মৃত্যুযন্ত্রণায় দাপড়াচ্ছে। ক্যাম্পের ভিতরের সৈন্যগুলোর কোন সাড়া-শব্দ না পাওয়াতে আমরা বুঝতে পারলাম তারা কিছু একটা ফন্দী বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে। চারিদিকে নীরব। আমাদের অস্ত্রগুলিও তখন নীরব। কারণ আমাদের উপরে কড়া নির্দেশ অযথা গুলি নষ্ট করা যাবে না। হঠাৎ ওদিকে যারা বসে ছিল তাদের রকেট লাঞ্চার গর্জন করে উঠল ও একসঙ্গে বহু মর্মান্তিক আৰ্তরব সেই ভয়াল নীরবতাকে খান খান করে তুলল, আর সঙ্গে সঙ্গে তারা কিছুক্ষণ নীরব থেকে এই ফন্দি বের করেছিল যে যেহেতু আমরা সামনে দিয়ে আক্রমণ করছি, তাই তারা নিঃশব্দে ক্যাম্পের পিছন দিক দিয়ে আমাদের অস্ত্রের রেঞ্জের বাইরে চলে যাবে ও সেখান থেকে দূরপাল্লার রকেট ও মর্টারের সাহায্যে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে তারা যেদিকে পিছন ফিরে সরে আমাদের আক্রমণের চেষ্টা করছে সেখানেই আমাদের দলের দুজন রকেট লাঞ্চার নিয়ে বসে আছে। তাই যখন তারা আমাদের সেই দুজনের রকেট লাঞ্চারের রেঞ্জে এসে পড়ল অমনি আমাদের পক্ষের রকেট লাঞ্চার গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগারজন ছত্রভঙ্গ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় শত্রুসৈন্যের উপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের কোণঠাসা করে আনলাম। অল্পক্ষণ পরেই আমাদের কমাণ্ডারের আদেশে শত্রুসৈন্যরা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করল। গুণে দেখলাম চল্লিশজন। মৃতদের সংখ্যা ২১০ জন হয় নাকি আর গুনিনি বলে একটু হেসে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু লক্ষ করে দেখলাম সেই হাসিতে কী এক বিষন্নতার ছাপ, যেন একটু ভিজে ভিজে। পরে একটু থেমে আবার বলল, “না গুণে ভালই করেছিলাম। কারণ মৃতের সংখ্যা একটু বেশীই ছিল। আমার দুজন বন্ধুও কাল শহীদ হয়েছে। তার ছলছলে চোখ দুটো দেখে আমার চোখ ভিজে আসলো। দেখলাম চারদিকে গোধূলি থমথমে হয়ে উঠেছে। তাকে আর সান্তনা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। কাল প্রথম সূর্যোদয়ে সে আবার হয়ত ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন রণাঙ্গনে। জিঘাংসার মদমত্ততায়ই হয়ত তার কেটে যাবে প্রতিটি সূর্যোদয়, প্রতিটি সূর্যস্ত। এই সময়টুকু যদি দিনান্তের বিধুবতায় সে আত্মবিশ্লেষণে বসে প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় তার চোখ ভরে আসে তবে মন্দ কী !

(লেখকের নাম জানা যায়নি)

দুর্জয় বাংলা

১২ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলা চিরদুর্জয়-চির দুঃসাহসী তার দূরন্ত সন্তান। বাংলাদেশের গা বেয়ে ঝরছে রক্ত আর রক্ত, বাংলা মা-বোনের বুকে দুঃসহ কান্না আর কান্না। রক্তের বদলে রক্ত নিয়ে, মার অশ্রুজল মুছিয়ে দিয়ে লাঞ্ছনা ঘুচিয়ে দিতে বাংলার দূরন্ত দুলাল আজ বদ্ধমুষ্টি। কন্টকপথে বিরামহীন যাত্রায় শ্রান্তিহীন ক্লান্তিহীন তার ব্ৰত। শপথের গান উদাত্ত কন্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত-

<005.009.269>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাংলা মার দুনিবার আমরা তরুণদল
শ্রান্তিহীন ক্লান্তিহীন সংকটে অটল
সূর্যসেন তিতুমীরের বীর্যগরিমা
রবীঠাকুর নজরুলের ছন্দভঙ্গী

* * * *

সংগীতের মূর্ছনা শেষ হয় না ভাবাবেগের আবেশ গড়িয়ে। কারণ কঠিন বাস্তব রক্তাক্ত সংগ্রামের পথের রক্ত পথিক বাংলাদেশের লৌহদৃঢ় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় সাহস আর রণকৌশলের সাহায্যে পাক-হানাদার, তার পদলেহী কুকুর রাজাকারের দল ভীতসন্ত্রস্ত। বাংলাদেশের সুদূর উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্তে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের রক্তস্বাক্ষর খোদিত।

কিছুদিন আগেই রাজশাহীর আরানী ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিফৌজ কেবল বীরত্বের পরিচয় দেয়নিদিয়েছে অসম সাহসিকতা ও রণকৌশলের পরিচয়। টহলদার পুলিশ ও রাজাকাররা অগ্রসরমান বীর সেনাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেলেও অধিকতর ক্ষিপ্রতার সাথে পুলিশদের কাবু করে ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে গেরিলা যোদ্ধারা সক্ষম হন। তারা কয়েকজন পুলিশকে গ্রেফতারও করেছেন, সেই সাথে কিছু মূল্যবান যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্রও হয়েছে হস্তগত। এ নহে কাহিনী এ নহে স্বপন’। সচিত্র বিবরণই তার প্রমাণ।

পাহাড়পুর-পবিত্র বৌদ্ধ বিহার ভূমি- যেখান থেকে একদিন বৌদ্ধধর্মের অহিংসার মন্ত্রধ্বনি উত্থিত হোত। হাজার হাজার তীর্থযাত্রী, পর্যটনেচ্ছ পথিক, ইতিহাসের তথ্যাভিলাষী শিক্ষক-ছাত্র যেখানে পদচারণা করেছে সবিস্ময়ে, সংগ্রহ করেছে নানান তথ্য- সেই হাজার হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধস্তুপ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে হিংসার অনল জ্বালিয়েছে পাক হানাদাররা অহিংসার পাদপীটে। ধর্মদ্বেষী সেই পাক পশুদের দশজন খতম হয়েছে মুক্তিবাহিনীর হাতে।

দিনাজপুরের গোসাইনগঞ্জে, রংপুরের কারনাইতে হানাদার রাজাকাররা গেরিলাদের অব্যর্থ নিশানার লক্ষ্যবস্তু হয়ে করেছে মৃত্যুবরণ। পেয়েছে পাপের চরম শাস্তি। সিলেট, ময়মনসিংহের রণাঙ্গন থেকেও আসছে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর। কুমিল্লার শান্তধরে গোমতীর তীর মুক্তিসংগ্রামের রণঝনঝনায় ঝংকৃত। ময়নামতীর গুহাবাসী দানবের দল শালদা নদী অধিকার করতে এসে পেয়ে গেছে ইহলোক ত্যাগ করার ছাড়পত্র। পৃথিবীর আলো-বাতাস ভোগের অধিকার তারা চিরদিনের জন্য হারালো। কায়েমপুরের ক’জন পাকসেনার ভাগ্যে ঘটেছে একই পরিণতি।

খবর ! খবর ! নিঃশব্দে শব্দেরা কাগজের পাতায় আর নিরূপদ্রব নির্জীব খবর নয়-তাজা জীবন্ত জ্বলন্ত শব্দের স্ফুলিঙ্গ আজকের খবর। কামানের গোলা, মেশিন-গানের গুলি, মটারের ভয়ংকর শব্দ আর তারই মোকাবেলায় মুক্তিবাহিনীর তরুণ গেরিলার হাতের গ্রেনেডের সশব্দ বিস্ফোরণ, এলএমজি’র ঘন ঘন তরুণ দলের উল্লাসধ্বনি কাঁপাচ্ছে বাংলার দিগদিগন্ত। এই প্রচণ্ড সশব্দ সংবাদ শত্রুবুকে সৃষ্টি করেছে হৃদকম্পন। তাই পাক-সরকার আর সেনাবাহিনীতে লোক পাচ্ছে না নতুন করে। মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে বিস্ফোরিত বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আর পদার্পণ করতে নারাজ। তারা জানে বাংলার নদী, অরণ্য, পাহাড়, গ্রামে গঞ্জে বন্দরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যুছোবল। হাতে অটোমেটিক রাইফেলই থাক আর মেশিনগান থাক- একা কিংবা দশজনই হোক- প্রতিহিংসায় গজমান ভয়ংকর সৰ্পের বিষমুখে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষাৎ যম বাংলার গেরিলা। তথাকথিত ‘কাফের মারা’র জেহাদী জোশ আজ মারের চোটে অন্তৰ্হিত। তাই আত্মসমালোচনার আত্মস্বরে

<005.009.270>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

পশ্চিম পাকিস্তানীরা ক্ষতবিক্ষত- ২৫শে মার্চের হামলার কী প্রয়োজন ছিল? বেলুচ-পাঠান-সিন্ধীরা গালে হাত দিয়ে ভাবছে বাংলার মানুষের কী দোষ? তারা চেয়েছিল স্বাধিকার। তারা চেয়েছিল দেশের বেশিরভাগ লোকের মঙ্গল। সে মঙ্গলের আলো ছড়াতো সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতিত সিন্ধী-পাঠান-বেলুচদের ঘরে ঘরে। একদিন বেলুচরা মাথা নোয়ায়নি বলে তাদের জীবনেও নেমেছিল টিক্কা খানের পাশর অত্যাচার। ৪৮ সালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ঈদের জামাতে পাক-বাহিনী ফেলেছে বোমা। মুক্তিবাহিনীর সাফল্যই ঘরে-বাইরে পাকহানাদারদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছে। দুর্জয় বাংলার দুর্জয় প্রাণের জয় অবশ্যম্ভাবী।

(বদরুল হাসান রচিত)

মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই মুহুর্তে একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে। প্রতি প্রহরে মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা নতুন নতুন এলাকায় তাদের বিজয় ধ্বনিত করে তুলছে। তাদের বিজয়দৃপ্ত পদচারণা মানুষের মুক্তি এবং মানবিকতার শাশ্বত বাণীকে চিরন্তন এবং মহিমান্বিত করে তুলছে। শত্রুরা হটছে, পিছু হটছে, মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চলেছে, সামনে চলেছে। মানবিকতার শক্রপাক-হানাদাররা মৃত্যুমুখী যাত্রাপথের শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে, বাঙালীরা মহিমাময় মুক্তিতোরণের দ্বারে এসে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা পায়ে পায়ে চলেছে, সামনে চলেছে, চলেছে মুক্তির মহাসঙ্গীত উৎসে। পাক হানাদাররা পায়ে পায়ে মরছে, আরো মরছে, মরছে ঘৃণা এবং গ্লানির অন্ধকারে। ওদের মৃত্যু সহজ, সম্ভব- তাই সত্য। আমাদের অমরত্ব ন্যায়ত্ব, সত্যত্ব তাই অবধারিত। ওরা লাঞ্ছিত সমগ্র মানুষের বিবেকের বিচারে। আমরা নন্দিত সমগ্র সভ্যতার সান্নিধ্যে। সভ্যতার বিনাশে ওদের পাশবিক তৃপ্তি। সেই সভ্যতার স্থায়িত্ব আমাদের একমাত্র মুক্তি।

সভ্যতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস যে যুদ্ধ বাংলাদেশের সীমানায় বন্দী ছিল, হানাদার হায়েনারা সে যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিয়েছে আরো বৃহত্তর পৃথিবীতে। পাকিস্তানীরা সমগ্র মানুষের রক্তে স্নাত হতে চাইছে। চাইছে পৃথিবী জুড়ে তাদের বর্বর মৃত্যু, হত্যাযজ্ঞ নির্বিচারে শুরু করতে।

এদের থামতে হবে। এদের থামাতে হবে। এদের অস্তিতুকে ধ্বংস করতে হবে। এদের বিনাশ করতে হবে। মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে হবে।

আজ মানুষকে বাঁচাবার লড়াই। বিস্তারিত মুক্তাঞ্চলে অন্ততঃ তারই বিরামহীন প্রচেষ্টা চলেছে। ওরা তোলার শ্রমে জড় হচ্ছেন। ইতিমধ্যে বাংলার বহু অঞ্চল মুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলোর অনেক স্থানই এখন জ্বলছে। পশ্চিমারা পিছু হটার প্রাক্কালে অনুসরণ করছে পোড়ামাটি নীতি। জ্বালিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, বসতির পর বসতি।

খুলনার দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে দেখে এলাম। কয়েকদিন আগে এই অঞ্চলে পাক-হানাদারদের সাথে প্রচণ্ডভাবে লাড়াইয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী খুলনার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রায় ৬০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করেছেন। এই এলাকা সম্পর্কে কথা হচ্ছিল শাজাহান মাস্টারের সাথে। তিনি দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর হাই-স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। আজ তিনি কলম ছেড়ে ষ্টেনগান হাতে নিয়েছেন। শিক্ষকের চেয়ার ছেড়ে সৈনিকের বাঙ্কারে বসেছেন।

<005.009.271>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

দশমাস আগেও যিনি ছাত্রদের নিয়ে ক্লাসে বসতেন, আজ তাদেরকে নিয়েই তিনি বৈরীদের মুখোমুখী লড়াই করতে বসেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেনঃ কি লাভ, কি হবে স্কুলে, যদি ভবিষ্যতের ছাত্রদের না বাঁচানো যায়।

একটা আশ্চর্য দেশপ্রেম এবং সাহস ভদ্রলোককে আজ এতখানি দুর্বার করে তুলেছে যে অন্ততঃ একটা রাত দেখলেন না ঘুমিয়ে- মুক্তিবাহিনীর সরবরাহ কর্মে কাটিয়ে দিলেন। আমার মনে হোল শিক্ষকরা মহান, কিন্তু ক্যাপ্টেন শাজাহানের মত নিরলস শিক্ষকরা? নিশ্চয় ভবিষ্যৎ জবাব দেবে।

শাজাহান মাস্টার সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন শরীফপুর গ্রামে। গ্রামটি খুবই ভালো। অবাক বিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করলাম গ্রামে একটা বাড়িও নেই। আমার চোখকেই যেন ক্ষণমুহুর্তের জন্য বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কোনো কোনো পোড়া ঘর থেকে তখনও মৃদু মৃদু ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। গ্রামের অস্তিত্বটাই যেন হরণ করেছে কোন এক পাষাণ দানব। ক্যাপ্টেন শাজাহান সাহেব বললেনঃ হ্যাঁ-এই গ্রামের এগার হাজার লোকের বাসযোগ্য গৃহাদি ছিল। কিন্তু এখন আপনি দেখছেন- তার একটাও নেই। আমি মাষ্টার সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি বললেনঃ দীর্ঘ বাইশ ঘণ্টা তীব্র সংঘর্ষের পর পাক-হানাদাররা পিছু হটবার সময় সব বাড়িতে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমরা মাত্র চার ঘণ্টা আগে এই গ্রাম দখল করেছি। এক বৃদ্ধাকে দেখিয়ে তিনি বললেনঃ এর নাম রতন। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এলেন। চোখে তাঁর অশ্রুধারা। ঠোঁট দুটো একটু নড়লো। কোন শব্দ উচ্চারিত হোল না। আবার ফিরে গেলেন। মাষ্টার সাহেব জানালেন, বৃদ্ধার পেশা ছিল দুধ বিক্রী করা। চারটে গাই গরুই ছিল তার সম্বল। এবারে আসুন আমার সাথে। শাজাহান সাহেব আমাকে যে গোয়ালঘরের কাছে নিয়ে এলেন সেখানে সে কি বীভৎসতা, কি দুর্গন্ধ- চারটে গরুর বিকৃত পোড়া দেহ পড়ে আছে। চার ধারের মাটিতে পোড়া চর্বির তেল গড়িয়ে গড়িয়ে ভিজিয়ে তুলছে। নাকে কাপড় চেপে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। আমি বললাম, ক্যাপ্টেন সাহেব আমার বড় খারাপ লাগছে। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলুন।

ভাঙ্গা ধরা গলায় ক্যাপ্টেন শাজাহান কথা বললেন। আমি চমকে উঠলাম। তিনি বললেনঃ ও, আপনি আমার এক ছাত্রের বৃদ্ধা আচল মাকে ওরা ঘরে পুড়িয়ে মেরেছে তা দেখবেন না? তারপর বললেনঃ আর কটাই বা দেখবেন? ওরা যেখানে যেখানে যাচ্ছে সর্বত্র গ্রাম, ধানের গাদা, গরুর গোয়াল, পাটের ঘর, সাঁকো, পুল সবই তো জুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু একটা শরীফপুর গ্রামই না-এমন বহু শরীফপুর ওরা প্রতিদিন তৈরী করছে। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, আমরা আবার গড়ে তুলবো পোড়া ঘর ভাঙা ভিটেগুলোকে। কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার চোখ চলে গেল বড় একটা ভিটের ওপর, যেখানে ঘরের চারকোণের চারটে পোড়া ফাটা কাঠই অবশিষ্ট আছে- আর সব ফাঁকা। আমার মনে হোল এই ফাঁকা ঘরকে এরা একদিন ভরাট করবে, এই পোড়া নির্জনতার বুক চিরে এরা তুলে আনবে জীবনের স্পন্দন, নির্মাণ করবে পুনরায় সেই শান্তির নীড়-ছোট ছেলে-মেয়েদের কলকাকলিতে আবার ভরে উঠবে ঘরের আনাচ-কানাচ, সোনার বাংলায় আবার জেগে উঠবে সোনার গ্রাম। সেই সাধনায় এরা রত-রত শিক্ষক, রত ছাত্র, রত গ্রামের কৃষক-শ্রমিক।

সন্ধ্যা হলে এলো। ভাবছিলাম এবার আমাকে ফিরতে হবে। এমন সময় সাইকেলে একজন লোক এলো। হাতে তার একটা ভাঙ্গা সাইকেল। ক্যাপ্টেন সাহেবকে জানালেনঃ আমাকে মাফ করবেন, এক্ষুণি আমাকে অগ্রবর্তী ঘাঁটির দিকে যেতে হচ্ছে যে ছেলেটি এসেছিলো তাকে দেখিয়ে বললেনঃ ওর নাম মৃণাল কান্তি মুখার্জি ও আমার অত্যন্ত স্নেহের ছাত্র ছিল। এখন ও একজন মুক্তি সৈনিক ও খুব সাহসী যোদ্ধা। একবার দেবহাটা থানায় ও এগার জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১০০ জন পাকবাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল। ১৮ জনকে হত্যা করেছিল। লেঃ মৃণাল বাবু আমাকে হাত বাড়ালেন। তার সাথে পরিচয় হোল। তার ডান আর বাম হাতে ব্যান্ডজ বাঁধা। বললাম, এ কেন? তুচ্ছভাবেই জবাব দিলো যোদ্ধা মৃণালঃ কয়েকদিন আগে দুই হাতে হারামীদের ব্রাশ

<005.009.272>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

লেগেছিল। ও কিছু না, শত্রুদের খতম না করা অবধি আমরা ক্ষান্ত হবো না। তার দৃঢ় জীবন্ত শব্দগুলো আমার বিস্ময় এনে দিল

তারপর ওঁরা আমার কাছ থেকে বিদান নিয়ে চলে গেলেন সাইকেলে চেপে হাত নেড়ে ক্যাপ্টেন শাজাহান সাহেব বললেনঃ দানবের সাথে সংগ্রামের তরে- আমি হাত নেড়ে বললামঃ জয় বাংলা।
(মুসা সাদেক রচিত)

ঘুরে এলাম মুক্তাঞ্চল

৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১

অনেক ঝড়ঝাপ্টার পরেও- দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে বিধ্বস্ত হওয়া সত্বেও সহজ স্বাভাবিক সবুজ শ্যামলিমা সর্বত্র অক্ষুন্ন। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। গ্রামবাংলার সেই চিরন্তন দৃশ্যই দেখছিলাম দু’চোখ ভরে, আর পায়ে পায়ে এগিয়ে চলছিলাম সামনের দিকে। পথে ছোট একটি খাল পড়ল। এটি পার হয়ে যেতে হবে। দেখলাম খালের পুলটি ভেঙ্গে পড়ে আছে আর তার পাশ দিয়েই নতুন একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। হানাদার বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করার আগে গ্রামবাসীরা পুলটি ভেঙ্গে দিয়েছিল। এখন আবার তারাই নতুন করে সাঁকো তৈরী করেছে।

খালের ওপারে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। সামনে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। না, কোন ঝড়ের তাণ্ডবে ওটি বিধ্বস্ত হয়নি। ইতিহাসের কলঙ্ক ইয়াহিয়ার উন্মত্ত জানোয়ারগুলো বাড়িটিকে জুলিয়ে দিয়েছে। এগিয়ে গেলাম বাড়িটির ভিতরে। কোন মানুষ নেই, আছে শুধু চাপ চাপ রক্ত। বাঁধানো উঠোনের এক প্রান্তে একটি কুকুরের মৃতদেহ পড়ে আছে। ওটির পায়ে গুলির চিহ্ন দেখতে পেলাম, পশুগুলোর হিংস্রতার কাছে কুকুরটিও রেহাই পায়নি।

হ্যাঁ, বলছিলাম খুলনা জেলার একটি মুক্তাঞ্চলের কথা। ওই ফ্রন্টের মুক্তিবাহিনীর একটি ছোট দলের অধিনায়ক আমার বন্ধু আনোয়ার। গত পরশুদিন গিয়েছিলাম ওর ক্যাম্পে। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন অধিবাসী। তাদের মধ্যে একজন বললেন, যে বাড়িটি দেখলেন ওটি স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়ি। পশুগুলো তাকে এবং তার দুই পুত্রকে হত্যা করেছে এবং তার একমাত্র মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক যা শুনলাম তা হল, মাস্টার সাহেবের এক বছরের শিশুপুত্রটির পা ধরে একটি জানোয়ার সিমেন্ট বাঁধানো উঠানে সজোরে নিক্ষেপ করে শিশুটির মাথাটিকে চৌচির করে ফেলেছে। তখন আর একটি জানোয়ার পাকিস্তানী পতাকা একখণ্ড বাঁশের মাথায় লাগিয়ে শিশুটির মাথার ভিতরে পুতে দিয়ে পৈশাচিক আনন্দে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল।

এ ধরনের শত শত জল্লাদী তাণ্ডবের কথা শুনতে শুনতে উপস্থিত হলাম স্থানীয় বাজারে। সেখানে দেখলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। বাজারে বেশ লোক সমাগম হয়েছে। কেনাকাটার মাঝে আলাপ হচ্ছে কোন কোন এলাকা মুক্ত হলো, কটা জানোয়ার খতম হল ইত্যাদি হরেক রকমের কথা। প্রতিটি মানুষের দৃঢ় মনোবল দেখে সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বীর প্রসবিনী বাংলার আজ এক অভূতপূর্ব সাজ।

<005.009.273>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বাজার থেকে অল্প দূরেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প । সেখানে গিয়ে শুনলাম আনোয়ার ক্যাম্পে নেই, রণাঙ্গনে। তার দলের একজন যোদ্ধা আহত হয়ে ক্যাম্পে শুয়ে আছেন। তার কাছে গিয়ে বসলাম, চারিদিক থেকে অনবরত গোলাগুলির শব্দ হচ্ছিল। এক-একটি প্রচণ্ড শব্দের সাথে আহত তরুণটি চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন। আমাকে দুঃখ করে বললেন, সামান্য আঘাতের জন্য তাকে শুয়ে থাকতে হচ্ছে। এতক্ষণ রণাঙ্গনে থাকলে নিশ্চয়ই সে কয়েকটি হায়েনার জীবন নিতে পারতো। ডাক্তার তাকে বিশ্রাম নিতে বলেছে। কিন্তু সে বিশ্রাম চায় না। তার ইচ্ছা কালই সে যুদ্ধে যাবে। কিন্তু আমি দেখেছি তার আঘাত বেশ গুরুতর। কম করে আর ৩/৪ দিন তাকে বিশ্রাম নিতে হবে। সত্যি, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য অনুসারী আজ এক-একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়েছে। এই আগুনের দুর্জয় শক্তির স্পর্শে শত্রুর সকল প্রতিরোধ খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। মৃত্যু তাদের কাছে আজ খেলা মাত্র। আহত যোদ্ধাটির উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।

ক্যাম্প থেকে আর একজন তরুণের সাথে এগিয়ে গেলাম রণাঙ্গনের দিকে। কানে আসছিল শুধু শব্দ আর শব্দ। যাবার পথে গ্রামবাসীদের দেখলাম কেউ চাষ করেছেন, কেউবা মাছ ধরছেন, আবার কিছু লোককে দেখলাম তাদের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করতে। ওদের চোখ-মুখে ভয়ের কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। মুক্তিবাহিনীর উপর অগাধ বিশ্বাস রেখে বিনা দ্বিধায় তারা দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছেন। মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদ ইয়াহিয়া ডালকুত্তা বাহিনীর আক্রমণে যারা আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে, নিজ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা একে একে ফিরে আসছেন। কবরের মাঝে আবার গড়ে উঠেছে জনবসতি।

যেতে যেতে গ্রামের শেষপ্রান্তে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে পরিখা খনন করে তার ভিতর মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান তৈরী হয়ে আছেন যে-কোন বিপদের মোকাবিলা করার জন্য। ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিজয়ের গর্বে তারা প্রত্যেকে গর্বিত। স্বাধীনতার পবিত্র আলোকে ওদের মুখ-চোখ উদ্ভাসিত। তারা জানালেন হানাদার বিতাড়িত হওয়ার পর মুক্ত এলাকা রক্ষার ভার তাদের উপর পড়েছে। এবং তারা দৃঢ়তার সাথে সে দায়িত্ব পালন করছেন। আর ওদের সহযোদ্ধারা প্রচণ্ডতম আক্রমণে কচুকাটা করে চলছেন পররাজ্যলোভী ডালকুত্তাদের। তাদের এই আক্রমণে মনোবলহীন ভাড়াটিয়া হায়েনার দল পরাজয়ের বিভীষিকায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পিছু হটছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাবাহী এই দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা বাংলার দশদিগন্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিজয়ের বার্তা। চূড়ান্ত আঘাত হেনে শেষ হানাদারটিকে খতম করার দুর্জয় সংকল্পে অটল বঙ্গশার্দুল এই বীরবাহিনী সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে জানিয়ে দিচ্ছে- তাদের সম্পূর্ণ মুক্তির দিন সমাগত।

আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলাম তার দুই মাইলের ভিতরেই তখন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। কাজেই আর সামনে যাওয়া যাবে না। এবার ফিরতে হবে। ফিরে এলাম ক্যাম্পে। একটু আগেই আনোয়ার ফিরে এসেছে। শুয়ে আছে ওর ক্যাম্পখাটে। কিন্তু ওরে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। শুনলাম যুদ্ধ করার সময় ওর পায়ে হঠাৎ গুলি লাগে। কিন্তু ও কাউকে না বলে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যখন হানাদারেরা পিছু হটে গিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যাবার পালা তখন আনোয়ার ওর দুজন সহযোদ্ধাকে বলেছিল ওকে সামনে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু তারা ওকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। তাদেরকে দেখলাম তখনও তারা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি, কাঁধে ষ্টেনগান আর চোখে উজ্জ্বল দীপ্তি। ওরা চলে গেল ওদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে। আনোয়ারের কাছে যুদ্ধের খবর শুনলাম। ওই দিনই আরও তিনটি থানা শত্রুমুক্ত হয়েছে, আর ও নিজেই ৪টি হানাদারকে খতম করেছে। পশ্চিমারা এখন আক্রমণের চেয়ে আত্মরক্ষায় বেশী তৎপর। কাজেই পালানোর সময় অধিকাংশই মারা পড়ে। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। “বজ্রকণ্ঠ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বাণী শোনা যেতেই আনোয়ার কঠিন হয়ে উঠল। ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম ওর চোখেমুখে এক কঠিন শপথের ছায়া। বজ্রকণ্ঠ শেষ হয়ে যেতেই আমাকে বলল, বঙ্গবন্ধু আজ শত্রুর হাতে বন্দী। কিন্তু সবসময় মনে

<005.009.274>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

হয় তিনি আমাদের সাথেই আছেন, নির্দেশ দিয়ে চলছেন সামনে এগিয়ে যাবার, জননী বাংলার শৃঙ্খল মোচন করার। তিনি যতই দূরে থাকুন আর যেখানেই থাকুন না কেন, আশীৰ্বাদই আমাদের প্রেরণা দিচ্ছে মৃত্যুভয়কে হরণ করে সামনে এগিয়ে যাবার। এমনি অনেক কথা বলতে বলতে আনোয়ার উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ গুম গুম করে প্রচণ্ড দুটো শব্দ হল একেবারে কাছেই। আমাকে বিস্মিত করে ওর খাটের পাশে রাখা রাইফেলটা নিয়ে ও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই পায়ের যন্ত্রণায় কুকিয়ে উঠল। ততক্ষণে আমি ওকে ধরে ফেলেছি। আমি ধরতেই ও সম্বিত ফিরে পেল। আমাকে বলল, মনে ছিল না আমি আহত। ওই শব্দ শুনলে কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। আবার ওকে শুইয়ে দিলাম।
(তপন ভট্টাচার্য রচিত)

রণাঙ্গন ঘুরে এলাম
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বাংলার স্বাধীনতা এখন অবধারিত সাফল্যের পথে যাত্রা করেছে। প্রতিটি রণাঙ্গনে এখন পশ্চিমী হানাদার বাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনীর কাছে হন্দম মার খাচ্ছে এবং পিছু হটছে। অচিরেই তারা লক্ষ্য করবে কিছু হটার পরিণামে তারা বঙ্গোপসাগরের কলে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে ফিরে আসার এবং ফিরে যাওয়ার দুটো রাস্তাই বন্ধ। শেষের সেদিন কি ভয়ংকর আর মাত্র কয়েক দিনেই তারা হাড়ে-মাংসে টের পাবে। বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা এখন এগিয়ে, শুধু এগিয়ে চলেছে। শত্রু এখন ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। খুলনা, বরিশাল, যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম মুক্তিবাহিনীর কবজার মধ্যে প্রায় এসে গেছে। এসব অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা এ মুহুর্তে মুক্তিবাহিনীর দখলে এবং এসব এলাকার কয়েক কোটি মানুষ এখন স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে শান্তিতে জীবনযাপন শুরু করেছে। প্রতিটি রণাঙ্গন এখন মুক্তিবাহিনীর উল্লাস-ধ্বনিতে মুখরিত- ‘জয় বাংলা’ নিনাদে প্রকম্পিত। খুলনা, বরিশাল এবং পটুয়াখালির যুদ্ধরত মুক্তিফৌজ ভাইদের সাথে আলাপ করে এবং এইসব রণাঙ্গন সফল করে আমার যেন বরাবর মনে হয়েছে- এ কি সেই বিধ্বস্ত বাংলা, না জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীর ঢাকা? এই বছরের প্রথম দিকে সমগ্র ঢাকার আকাশ-বাতাস নগর বন্দর যে নামে যে ধ্বনিতে কেপে কেপে উঠতো- বরিশাল খুলনার রণাঙ্গনগুলোর জয়ধ্বনি তার সাথে কত আশ্চর্যভাবে একাত্মং যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার রণাঙ্গনের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে যে ‘জয় বাংলা শেখ মুজিব জিন্দাবাদ ধ্বনি তা যেন বরিশাল-পটুয়াখালি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থেকেও শোনা যায়। বাংলার সব রণাঙ্গনের রঙ আজ এক, সব রণাঙ্গনের ধ্বনি আজ এক, সব রণাঙ্গনের চিত্র আজ এক মুক্তিবাহিনী সর্বত্র জিতছে, শুধু জিতছে। রণাঙ্গন এবং সেই সাথে বাংলার প্রত্যন্ত পল্লী এলাকা শেখ মুজিব ও জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত, নিনাদিত। সব রণাঙ্গনেই একই রবঃ যাত্রা করো- যাত্রা করো- এগিয়ে চলো- এগিয়ে চলো। বাগেরহাট রণাঙ্গনে এসে মনে হলো সেই

<005.009.275>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

সামনে মনে হলোঃ বীর আলেকজাণ্ডারের গ্রীকবাহিনী যে বিজয়যাত্রার দৃপ্ত পদধ্বনিতে সাফল্যকে অতিক্রম করেছিল এখন সেই বাহিনীরই আরেক রূপ। এদের যাত্রা যেন শুধু সফলতার ইঙ্গিতকেই চেনে। শুধু বিজয়ের যাত্রাকেই স্বীকার করে। একেকটা বাহিনী একেকটি এলাকা থেকে এসে একটু থেমে আবার যাত্রা করছে। শত্রুর সাথে ওরা কেউ হয়তো বারো ঘণ্টা বুঝেছে, কেউ তিরিশ ঘণ্টা। তারপর সে জিতেছে- শত্রুকেহারিয়েছে, বিবেকের সম্মান আদায় করেছে। সবাই এসে মিলিত হয়েছে। এতক্ষণ ওরা লড়েছে। কিন্তু কেউ বিশ্রাম চায় না। তাই আবার ওদের যাত্রা শুরু। অকস্মাৎ একটি রবে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। ওরা যাত্র করছে কোথায়? ওদের ধ্বনিতে ওরা জানায়ঃ চলো চলো, ঢাকা চলো। কুর্মিটোলা ভাঙো, ভাঙো শত্রুদের, হানো হানো। এখানে দীর্ঘ সতের ঘণ্টা পশ্চিমী হানাদাররা লড়ছে। অতঃপর তারা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। গ্রামের লোকেরা মুক্তিবাহিনীর সাথে সক্রিয় সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন। এখন ওদের তারা খাওয়ার পালা। এখন ওদের পরাজয়ের পালা। রণবিধ্বস্ত বাগেরহাটের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে আলাপ হল নবম সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর জলিলের সাথে। তিনি দেখলাম দারুণ ব্যস্ত। মাথায় একটা সবুজ ক্যাপ, পায়ে বুট, এক হাতে একটা দূরবীন এবং অন্য হাতে একটি ষ্টিক। আমাকে দেখে ষ্টিক উঠিয়ে বললেনঃ জয় বাংলা। আমি তাঁর কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলামঃ শত্রুদের ক্ষয়ক্ষতি কি পরিমাণ? ছোট্ট জবাবে বললেনঃ বহু। তারপর বামহাত দিয়ে ষ্টিক তুলে হাত বিশেক দূরে নির্দেশ করলেনঃ দেখুন। একটা মিলিটারী জিপ বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তার মধ্যে তিনটে রক্তাক্ত নিম্প্রাণ হানাদার, একজনের মাথাটা আছে কি নেই বোঝা মুস্কিল- দেখা শেষ না হতেই কমাণ্ডার জলিল সাহেব ষ্টিকটা আরেকটু ডাইনে সরিয়ে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললেনঃ ঐ বাঙ্কারে ওদের কমপক্ষে বিশটা লাশ পড়ে আছে। একটু সামনে ডাইনে সরে গিয়ে দেখলামঃ হানাদারদের সেই দুর্ভেদ্য বাঙ্কারের মধ্যে থেকে তখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে- আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকদের শেল এসে বাঙ্কারটা দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে দেয়। নবম সেক্টরের কমাণ্ডার জলিল সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এবার আপনি বলুন ক্ষয়ক্ষতি। কমাণ্ডার সাহেব এরপর কয়েকটি গ্রুপকে কারো ফিরে যেতে দেইনি। আমাদের আরো দ্রুত সম্মুখপানে যেতে হবে। ওদের কারো ফিরতে দেয়া হবে না। সুতরাং বাংলার এই মুক্তিবাহিনীর এই অপ্রতিরোধ্য গতিকে না থামিয়ে সামনে চলার গতিকে আরো দ্রুতময় করে তুলবো আমরা। হেসে আমাকে বললেনঃ চলি, জয় বাংলা।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে ট্রপ এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, পশ্চাতে উড়ছে ধূলি, তার পাশ দিয়ে কমাণ্ডারের গাড়ি এগিয়ে গেল। মুক্তিবাহিনীর পশ্চাতে বিকেলের শেষ সূর্যের বিদায়ী রঙ কাত হয়ে পড়েছে- তারা চলে গেল- দূরে, অনেক দূরে- একসময় চোখের নিশানার ওপারে- এখানে তখনও শত্রুদের বাঙ্কার থেকে কালো ধোঁয়ার রেশ উঠছে, চারদিকে শত্রুদের মৃতদেহ পড়ে, পড়ে বিধ্বস্ত সামরিক যান, তার ওপর চার-চারটি হানাদারের নিম্প্রাণ দেহ আরো ওপাশে হানাদার বাহিনীর একটি তাঁবুর ভস্মাংশ, তারও ওপাশে পশ্চিমা দস্যুর একটা ভগ্নকামান, দুটো বিক্ষত ট্রাক, ট্রাকের ওপর দিয়ে তখনও রাবারপোড়া ধোঁয়া উঠছে। এখানে হানাদাররা ছিল। এখন হটছে তারা। চোখ তার ওপারে এক বৃদ্ধার এবং গ্রামের আরো কতকগুলো পুরুষরমণীর দিকে ফিরে গেল। তারা এতসময় আমাদের মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কর্মে সহযোগিতা করছিলো। এবার তারা সবাই সমস্বরে ‘জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে গ্রামের দিকে ফিরছে। আমি এগিয়ে গেলাম। সবাই গ্রামের দিকে ফিরছে, কিন্তু এক বৃদ্ধা, সাদা একমাথা চুল, নিশ্চপ দাঁড়িয়ে ততক্ষণে। বৃদ্ধার দৃষ্টি তখনও সেই পথপ্রান্তে- যেদিক দিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভায়েরা এগিয়ে গেছে। বৃদ্ধার মুখের ওপর চোখ পড়তেই দেখলাম, তাঁর চোখে অশ্রুধারা। জিজ্ঞেস করলামঃ কি মা, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বৃদ্ধাটি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেনঃ “আমার মণি গেছে যুদ্ধে। খানদের খতম করে ও শহরে ফিরবে।’ তারপর তাঁর কণ্ঠস্বর আর আমি শুনতে পেলাম

<005.009.276>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

না- অথচ লক্ষ্য করলাম যে, তাঁর ঠোঁট দুটো তখনও নড়ছে। আমার যেন মনে হলো বৃদ্ধা মণির মায়ের ঠোঁট দিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদে হাজার মণিদের মাথায় বর্ষিত হোচ্ছে, মণির মায়ের ঠোঁট দিয়ে ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত নির্মিত হোচ্ছে।

(মুসা সাদেক রচিত)

মুক্তাঞ্চলে

১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ বাংলাদেশ আজ স্বীকৃত সত্য। বাংলাদেশ আজ প্রতিটি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের আর্তি, বাংলাদেশ আজ সকলের হৃদপিণ্ডের শব্দ হয়ে বাজবে। আমাদের প্রাত্যহিক কাজে, চিন্তায়, স্বপ্নে, জাগরণে সুষুপ্তিতে বাংলাদেশ অবিশ্রাম ধ্বনিত হচ্ছে। আমাদের ভালোবাসায়, বাঙালীর প্রতি মুহুর্তের উদ্বেগ, চিন্তা-অনুরাগে, পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের সহানুভূতিতে বাংলাদেশ জেগে উঠেছে।
কিন্তু শক্র এখনো বাংলাদেশে আছে। শত শত শত্রু আত্মসমর্পণ করছে, অনেকে আবার আত্মসমপর্ণ না করে পালাতে গিয়ে মরছে- মৃত্যু তাদের জন্য নির্ধারিত। এতোদিনের অত্যাচার আজ সমাহিত হওয়ার কালে, অস্ত্র তাদের দিকে উদ্যত হয়েছে, ইতিহাসের এই অমোঘ নিয়ম। তাই শত্রুসৈন্যের পরাজয় এতো দ্রুত, এতো করুণ। কিন্তু পলায়নের পর কি চিহ্ন আমরা পাচ্ছি অতীতের বাংলাদেশের? ছোট-বড় শতেকের মতো শহরে, ৬০ হাজার গ্রামে তারা কি স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে? মিত্ৰশক্তির সহায়তায় মুক্তিবাহিনী একের পর এক গ্রাম ও শহর দখল করে এগিয়ে চলেছে এবং যেখানেই তারা যাচ্ছেন দেখতে পাচ্ছেন শুধু ধ্বংস, ধ্বংস আর ধ্বংস। যেন মানবসভ্যতার শক্রচেঙ্গিশ খাঁর দলিত জনপদ ও গ্রাম, যেন নাৎসী বাহিনীর অত্যাচারে বিক্ষত কোন গ্রাম বা শহরের ওপর দিয়ে পথ চলা- যেন এক অচেনা জগতের পথে, কোন ঝঞ্চাহত গ্রামের ওপর দিয়ে। বাংলার চিরপরিচিত গ্রাম, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, যেদিকে চোখ ফেরাই শুধু ধূ ধূ করে হাওয়া। পরিচিত যশোরের সঙ্গে জনগণের মনে যে কি উল্লাস! তারা আবার সেই হারানো শক্তি ফিরে পাচ্ছে। দুহাত বাড়িয়ে তারা জানাচ্ছে সাদর সম্ভাষণ। বুকের থেকে একটি বিরাট পাথরের বোঝা নেমে গিয়ে তারা পেয়েছে মুক্তির স্বাদ। যেখানে সেখানে পথে পথে ধ্বংসের ছবি লাফিয়ে উঠছে। শত্রুর অত্যাচারের কাহিনী। লজ্জা ক্ষোভ প্রকাশ বুক, স্বজন পরিজন হারানোর ব্যথা, সম্পদ হারানোর দুঃখ, গৃহহীন মানুষের অসহায় কান্না- কিন্তু মুক্তির নিঃশ্বাস টেনে, দুচোখ মেলে বলছে আর গান গাইছে- সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত মানুষের জয়।
কোথাও পথের ওপর দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ছে পাগল একটি মানুষ। খবর নিয়ে জানা গেলো কিছুদিন আগেও সে ছিলো একজন বেসরকারী অফিসের অধস্তন চাকুরে। শত্রুসৈন্যরা তার পিতা-মাতা সকলকে হত্যা করেছে এবং সে হয়ে গেছে পাগল। মুক্তিবাহিনী থেকে খবর জানতে চাইলো তার, কিন্তু হায়, তার আর পূর্বের সেই সুখের বা দুঃখের স্মৃতি স্মরণে নেই। মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের চোখে দুফোঁটা অশ্রু বেয়ে পড়লো, মিত্র বাহিনীর জওয়ানরা সহানুভূতি জানালো। তারা এগিয়ে চললো। তাদের হাতে অনেক কাজ। আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে। পেছনে যারা প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে আসছে তাদের

<005.009.277>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

কর্তব্য সকলের দেখাশোনা করা। তারা দেখবে জনগণের সমস্যা, দুঃখ আর বেদনা। দুঃখের প্রতিকার করবে অসামরিক প্রশাসনের কর্মচারীবৃন্দ এবং সেই কাজটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি জমি শত্ৰমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত অসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনা, জনগণের মনে পূর্বের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং সুখের সন্ধান দেবার দায়িত্ব তাদেরই, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে সাধারণ মানুষ। সরকার আর জনগণের সহায়তায় বাংলাদেশ সত্যিকার সুখী-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে।
আরো কিছুদূর যেতে যেতে একটি ছোটখাটো যুদ্ধ হলো শত্রুদের সঙ্গে, শত্রুসৈন্য মরলো, আত্মসমর্পণ করলো বহু কিছুদূরে গিয়ে চোখে পড়লো একজন আহত মানুষ। তার হাতে একটি ষ্টেনগান তখনো, দৃঢ়মুষ্টিবদ্ধ এবং সে তখনো জীবিত। একজন মুক্তিযোদ্ধা তার মুখে জল দিয়ে ডাকলো, জিজ্ঞেস করলো ঠিকানা, নাম। তবু নিরুত্তর সেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরা তরুণটি। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ তাকে রাজাকার বলে সন্দেহ করলো, অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করলো। কেউ কেউ বললঃ কেড়ে নাও অস্ত্র, বিশ্বাসঘাতকের উপযুক্ত সাজা হয়েছে, পথের ধারে তাকে ফেলে রাখা, ধুকে ধুকে মরুক। কিন্তু অনেকেই জানতে চাইলো প্রকৃত ঘটনাটি। সহসা ক্যাপ্টেন এলো, আহতের মাথাটি কোলে তুলে নিয়ে গ্লাস থেকে আরেকটু জল মমতা-মাখা হাতে তুলে দিলো, জিজ্ঞেস করলো ঠিকানা। আহত জবাব দিলো, আস্তে আস্তে যেন মাধ্যাহ্ন সূর্য ধীরে ধীরে গ্রাস করছে কালবোশেখীর কালো মেঘ। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় সে বললো তার মনের কথাঃ

ঠিকানা আমার চেয়েছো বন্ধু-
ঠিকানার সন্ধান,
আজও পাওনি? দুঃখ যে দিলে করবো না অভিমান?
* * *
বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না
তোমাদের দেওয়া ক্ষতে
আমার ঠিকানা খোঁজ করো শুধু
সূর্যোদয়ের পথে।
* * *
আমার হদিস জীবনের পথে
মন্বন্তরে থেকে
ঘুরে গিয়েছে যে কিছুদূর গিয়ে
মুক্তির পথে বেঁকে।
* * *
বন্ধু, আজকে বিদায়!
দেখেছো উঠলো যে হাওয়া ঝড়ো,
ঠিকানা রইলো,
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা করো ।
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা করো ।।

<005.009.278>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

বলতে বলতে আহত অনামা সৈনিক মুৰ্ছিত হয়ে পড়লো। সকলের মনে প্রশ্ন জাগলো- কে এই অজানা বীর। হয়তো সে একা একা শত্রুকে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করেছিলো, হয়তো মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিলো সে। কিংবা সে একজন গেরিলা বাহিনীর সদস্য।
তাকে তাড়াতাড়ি সামরিক ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে দিয়ে আবার পথ চলা শুরু। কখনো মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেনের বার বার মনে পড়তে লাগলো এবং বিড় বিড় আবৃত্তি করতে লাগলোঃ

আমার হদিস জীবনের পথে
মম্বন্তর থেকে
ঘুরে গিয়েছে যে কিছুদূর গিয়ে
মুক্তির পথে বেঁকে।

* * *

(বিপ্লব বড়ুয়া রচিত)

<005.010.279>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
প্রচারিত উর্দু অনুষ্ঠান থেকে শব্দসৈনিক” ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ আগষ্ট, ১৯৭১

একটি উর্দু কথিকা

১৪ আগস্ট, ১৯৭১
আজ ১৪ই আগষ্ট- মৃত পাকিস্তানের জন্মদিন। এই মৃত শব্দটি শুনে চমকে উঠবার কোন কারণ নেই। গত ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে ইয়াহিয়া, টিক্কা এবং নিয়াজী সমবেতভাবে পাকিস্তানকে হত্যা করেছে। ২৫ বছরের ভরা যৌবনে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটল। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই দেশকে কেন্দ্র করে এই দেশের বিশেষ এক অঞ্চলে কি ধরনের শোষণ-অত্যাচার-চক্রান্ত চালানো হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা সম্ভব নয়। তবু সংক্ষেপে বলছি।

গত ২৪ বছরের ইতিহাস অত্যাচার এবং বর্বরতার ইতিহাস। ফ্যাসিজমের একটা জীবন্ত চিত্র। এই চব্বিশ বছরে এদেশের শাসক এবং শোষক গোষ্ঠী গণতন্ত্রের সমস্ত শত এবং দাবীকে পায়ের তলায় নিস্পিষ্ট করেছে। মনুষ্যত্ববোধ এবং মানবিকতাকে বিকৃত করবার চেষ্টা করেছে। বাঙ্গালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ- শোষক এই ভয়ে ভীত হয়ে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলে এর সমস্ত সুফল বাঙ্গালীদের জীবনে বিরাট কল্যাণ ডেকে আনবে। তাই গণতন্ত্র যাতে প্রতিষ্ঠিত না হয় তার চক্রান্ত চালিয়ে যেতে লাগল। এবং ধর্ম ও সংহতির নামে গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করা হল। শোষকগোষ্ঠীর ধারণা ছিল বাঙ্গালীরা ধর্মভীরু। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে নেবে। ইসলামের নামে অর্থনৈতিক শোষণ এমনকি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর হস্তক্ষেপ শুরু করল। এই শোষণ থেকে বেলুচিস্তান এমনকি সিন্ধুকেও মুক্তি দেয়া হল না। সিন্ধুর জনগণের কবি শেখ আয়াজকে তারা কারারুদ্ধ করল।

সীমান্ত প্রদেশের জনগণের কবি ফারেগ বোখারীকে জেলে পুরে নির্যাতন চালাল। উপমহাদেশের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা খান আবদুল গফফার খানকে মানবতামুখী কার্যকলাপের দোষে তার মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করলো। এমনকি নির্যাতিত বেলুচিদের মৌখিক দাবীগুলোকে নস্যাৎ করে দেবার জন্য ঈদের জামাতে অমানুষিকভাবে বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল। |

সাম্প্রতিক একটা ভয়ঙ্কর চক্রান্তের কথা উল্লেখ করছি। প্রতিরক্ষা খাতে মোট ব্যয়ের ৬০% ভাগ দিত বাংলাদেশ এবং মাত্র ৪০% ভাগ দিত পশ্চিম পাকিস্তান। বর্তমান শাসকচক্র সুস্পষ্ট ভাবে জানত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আর তাই বাংলাদেশে যুদ্ধের আগুন আরো প্রচণ্ডভাবে জ্বালিয়ে পাকিস্তানের সৈন্যদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে যাতে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকা এইসব সৈন্যের ব্যায়ার তাদের বহন করতে না হয়। একবার ভেবে দেখুন, যে দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ তাদের পরিচিত, যে দেশের জলবায়ুতে তাদের দৈনন্দিন জীবন অভ্যস্ত নয় সে দেশে ১৫শ মাইল দূর থেকে এসে এই নদীমাতৃক সমতল ভূমিতে তারা কি পেতে পারে- একমাত্র অসহায় মৃত্যু ছাড়া?

নাট্যকার খুনি ইয়াহিয়া এই রক্তাক্ত নাটকের পরিকল্পনা অনেক পূর্বেই করেছিল। এই নাটকের সবচেয়ে গত ও ভয়ঙ্কর চরিত্র টিক্কা খাঁকে সে একবার প্রশ্ন করেছিল, “বলো, তুমি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আয়ত্বে আনতে পারবে কি না?”

<005.010.280>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

টিক্কা বিনা দ্বিধায় চট করে উত্তর দিয়েছিল, হুজুর ৭২ ঘণ্টা নয়, বলুন ২৪ ঘণ্টার ভেতরে আমি বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। শুধু দশ-বিশ লাখ বাঙ্গালীর রক্তের প্রয়োজন।
এই উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে নাট্যকার ঘাতক ইয়াহিয়া আহাম্মকের স্বর্গ ইসলামাবাদ চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকে সেই রক্তাক্ত নাটকের মঞ্চ বাংলাদেশ।
২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাতে নরঘাতক টিক্কা তার সশস্ত্র বর্বর বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র, নিরীহ বাংলাদেশের মানুষের উপর। কামানের কুটিল গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ‘জয়বাংলা ধ্বনি আরও প্রচণ্ড রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাংলার আকাশে-বাতাসে। টিক্কা খান এতে হতভম্ব হয়ে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, এদেরকে নির্বাচারে হত্যা করার আদেশ দিল। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর পশুরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সমগ্র বাংলা জুড়ে চালাল হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। গ্রামের পর গ্রাম তারা পুড়িয়ে দিল। বাংলার মাটিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। একদিকে এইসব অত্যাচার অন্যদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শক্তি ও মনোবল দিন দিন বেড়েই চলল। বাংলার জনতা এক হয়ে একটা ইস্পাতের দেয়াল হয়ে গেল। রক্তলোলুপ হায়েনারা জানত না এরা বাংলার সন্তান, এরা সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর বাঘের সাথে খেলে, প্রচণ্ড ঝড়ের সাথে পাঞ্জা লড়ে এবং মৃত্যুর চোখের উপর চোখ রেখে হাসে।
গত ২৫শে মার্চের পরে টিক্কা খাঁর ২৪ ঘণ্টা- ঘণ্টা থেকে দিনে, দিন থেকে মাসে অতিক্রম করল। এখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫ মাস। অর্থাৎ শত্রুকবলিত বেতার থেকে প্রত্যহ তারা প্রচারণা চালাচ্ছে অবস্থা স্বাভাবিক তালা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ, কারখানার চাকা নিস্তব্ধ, মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে বর্বর সৈন্যরা পালাবার পথ খুঁজছে, সত্তরজন সামরিক পদস্থ অফিসার প্রাণভয়ে আকাশ পথে পাড়ি জমিয়েছে। এইসব অফিসাররা তো আকাশপথে পাড়ি জমাবেই, বিপদ আসবে শুধু সাধারণ সৈন্যদের উপর। কেনই বা আসবে না? তাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াই তো শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। সামরিক পদস্থ কোন অফিসার যুদ্ধে মারা গেলে তাদের মৃতদেহ কাঠের তৈরী কফিনে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সাধারণ সৈন্য মারা গেলে তাদেরকে বাংলাদেশের মাটিতে মাটিচাপা দিয়ে দায়সারা কাজ সারে। এটাই তো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ।
মিথ্যের সম্রাট ইয়াহিয়া খান ইরানে গিয়ে বলেছে, হিন্দুদের ভোটে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। চমৎকার! মিথ্যার সম্রাট চমৎকার। তোমার ওষ্ঠদ্বয়ই শুধু চওড়া নয়, মিথ্যে বলায় তোমার জিভের দৌরাত্ম্যও অসীম। নিজের ঘৃণিত কার্যকলাপকে ঢেকে ফেলার জন্য আর কত মিথ্যে তুমি বলবে? শোন এহিয়া খাঁ, কান খুলে শোন, বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এটা ধ্রুবতারার মত জীবন্ত সত্য। তোমাদের তথাকথিত পাকিস্তান মৃত। তার গলিত শবদেহকে সতুর কবরস্থ কর, নইলে পচন ধরা দেহের দুর্গন্ধ বাতাস বিষাক্ত করে তুলবে। মারাত্মক বীজাণু ছড়াবে বাতাসে বাতাসে। ইরানের সেই নোংরা বিবৃতিতে তুমি আরও বলেছ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুমি শাস্তি দেবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের হৃদয় যার স্পন্দনে স্পন্দিত তাকে তুমি শাস্তি দেবে কি করে? শেখ মুজিব শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়, তার ব্যক্তিত্ব সমস্ত বাঙ্গালীর জন্য একটা আলোকস্তম্ভ, যে আলো পথনির্দেশ করবে একটা শোষণহীন জাতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। জেনে রেখো, আমরা যারা বাঙ্গালী তারা তোমাদের মতো শোষকদের এ দেশের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করব। বাংলাদেশে-নব ইতিহাস সূচীত হবে, বাংলার আকাশ-বাতাসকে রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গীত মুখরিত করে তুলবে। বিশ্বের সে নাম তোর। নরঘাতক হায়েনা ইয়াহিয়া, সে নাম তোর।

(উর্দুতে মূল রচনা : জাহিদ সিদ্দিকী। অনুবাদ : আশরাফুল আলম)

<005.011.281>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১১। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
প্রচারিত ধর্মীয় আলোচনা
অনুষ্ঠানের কয়েকটি কথিকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের
দলিলপত্র …….১৯৭১

ইসলামের দৃষ্টিতে
…জুলাই, ১৯৭১

মানুষ যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন অথবা যে স্বভাবেরই হোক না কেন, আল্লাহতায়া কতগুলো বিষয় থেকে তাকে কখনো বঞ্চিত করেন না। একজন মানুষ অবিশ্বাসী হতে পারে, নাস্তিক বা কাফের হতে পারে, অথবা আল্লাহর বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে পারে, কিন্তু তবুও মানুষ হিসাবে তার কতগুলো অধিকার ইসলামে স্বীকৃত। সেসব অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করবার ক্ষমতা কারোরই নেই। এ অধিকারগুলো হচ্ছে- আলোর অধিকার, বাতাসের অধিকার, পানির অধিকার এবং মৃত্তিকার অধিকার। অর্থাৎ মানুষকে আলো থেকে বঞ্চিত করবার, বাতাস থেকে বঞ্চিত করবার, পানি থেকে বঞ্চিত করবার এবং মৃত্তিকা থেকে বঞ্চিত করবার অধিকার কারো নেই।

আল্লাহতায়ালা চরমতম পাপীকেও এ সমস্ত অধিকার থেকে মাহরুম করেননি। সুতরাং যেখানে আল্লাহতায়ালা শাশ্বতরূপে কতগুলো অধিকারের সংগে মানুষকে যুক্ত রেখেছেন সেখানে পৃথিবীর কোন প্রচল শক্তিরই অধিকার নেই সেই কল্যাণ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার। যখন মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে আল্লাহর নাফরমান হয়ে এসমস্ত অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করতে চায়, তখন সে মানুষ ইসলামের দৃষ্টিতে যথার্থ পাপী বলে চিহ্নিত হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে যে নৃশংস অন্যায় লীলা চলছে সেগুলো পরিপূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী এবং আল্লাহতায়ালার শাশ্বত ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের ঘরসংসার, কৃষিজীবন এবং সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে জীবনযাপন করছিল- সে সমস্ত মানুষকে তাদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পথে যারা বের করেছিল তারা সম্পূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী। যে মানুষ ক্ষুদ্র এক মাটির ওপর ঘর বানিয়ে সংসার যাপন করেছে, যে মানুষ উৎসবে-আনন্দে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক নির্লিপ্তি হচ্ছে সেসব মানুষকে তাদের সকল প্রকার সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন করা শুধু যে মানবিক বিচারে অন্যায় তাই নয়, এটি জঘন্যতম পাপাচার এবং ইসলামের মর্মমূলে প্রচণ্ড আঘাত। কোরান শরীফের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহতায়ালা ফলবান বৃক্ষের সাক্ষ্য দিচ্ছেন, নদী এবং সমুদ্রের সাক্ষ্য দিচ্ছেন, বাতাস এবং মৃত্তিকার সাক্ষ্য দিচ্ছেন। এগুলো দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহতায়ালা মানুষকে এই চারটি সম্পদের মধ্যে প্রকাশিত দেখতে চান।

অর্থাৎ কোন মানুষ খাদ্যের অভাবে কষ্ট পাবে না, পানির অভাবে পিপাসার্ত থাকবে না, বাতাসের অভাবে নিঃশ্বাস রুদ্ধ হবে না এবং মৃত্তিকার অভাবে গৃহহারা হবে না। সুতরাং, যে সমস্ত লোক বাংলাদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে, বঞ্চনা এবং হত্যাকাণ্ডে সময়কে কলুষিত করছে, তারা ইসলামের নাম মুখে উচ্চারণ করলেও পৃথিবীতে তারাই একমাত্র ইসলামবিরোধী। সুতরাং আল্লাহর লানৎ তাদের ওপর একদিন না একদিন পড়বেই।

<005.011.282>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

যারা নিষ্পাপ, নিরপরাধ- যারা শুধু বাঁচার অধিকারের কথা ঘোষণা করতে চাচ্ছে তাঁদের জয় একদিন হবেই। বাংলাদেশের মুসলমান অত্যন্ত নিগৃঢ়ভাবে ধর্মবিশ্বাসী এবং আল্লাহর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। এ সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে যারা অন্যায়ভাবে মারণ অস্ত্র ধারণ করেছে, আমি ইসলামের নামে তাদের বিরুদ্ধে অভিশাপ ঘোষণা করছি।
আমাদের জয় হবেই, আমাদের জয় অপরিহার্য ।।
(সৈয়দ আলী আহসান রচিত)

ইসলামের দৃষ্টিতে জেহাদ
৮ অক্টোবর, ১৯৭১
।। দ্বিতীয় অংশ ।।

আল্লাহ রাবুল আলামীন কোরান শরীফের সুরা তওবাতে মুনাফেকদের সম্পর্কে হুজুর (ছঃ)কে নির্দেশ করে বলেছেনঃ
يا ايها النبي جاهد الكفار والمنافقين واغلظ عليهم وماوهم بجهنم. وبئس المصير. يحلفون بالله ما قالوا. ولقد قالوا كلمة الكفر وكفروا بعد اسلامهم وهمو بما لم ينالوا.

অর্থাৎ, হে নবী, অবিশ্বাসী ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করুন এবং তাদেরকে দমন করুন। এদের বাসস্থান হয়েছে দোযখ। এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ঠিকানা। ঐ সমস্ত মুনাফেকগণ কথায় কথায়ই আল্লাহর নামে কছম খায়, পক্ষান্তরে তারা গৰ্হিত কথাবার্তা বলে ও মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কুফুরী কাজ করে এবং লোকসম্মুখে ঐ সমস্ত ইচ্ছা প্রকাশ করে যেগুলির সাথে তাদের অন্তরের কোন মিল নেই। অর্থাৎ, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে নিজেদের কুমতলব হাসেল করার জন্য ঐ সমস্ত অলীক ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলে বেড়ায়, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে ওরা হচ্ছে মুসলমান নামধারী বেঈমান। এজন্য ঐ সমস্ত বেঈমানদের কথায় কর্ণপাত করে ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ওদের ভাওতাবাজির উপযুক্ত জওয়াব দেওয়ার জন্য আল্লাহতালা মুসলমানদের উপর নির্দেশ জারি করেছেন।
আল্লাহতালা সুরা নেছা-তে আরো বলেছেনঃ

الذين امنو يقاتلون في سبيل الله . والذين كفروا يقاتلون في سبيل الطاغوت فقاتلوا اولیاء الشیطان.

অর্থাৎ, যাঁরা বিশ্বাসী ও সৎ তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আর যাঁরা অবিশ্বাসী এবং অসৎ তারা মিথ্যা নির্দেশক বা শয়তানের পথে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য যুদ্ধ করে। তাই হে বিশ্বাসী ও সৎ

<005.011.283>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

লোকগণ, তোমরা শয়তানের বন্ধু- অর্থাৎ অশান্তি সৃষ্টিকারী, বেঈমান, মুনাফেক ও বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করতে গিয়ে যাঁরা মারা যাবেন, তাঁরা শহীদ ও অমর হয়ে থাকবেন এবং পরকালে অসীম সুখের অধিকারী হবেন। যেমন কোরান শরীফে আছেঃ ولا تقولوا لمن يقتل في سبيل الله اموات بل احياء ولكن لا تشعرون
অর্থাৎ, আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে যাঁরা মৃত্যুমুখে পতিত হবেন; হে মানুষ, তোমরা তাঁদেরকে মৃতব্যক্তি বলে অভিহিত করো না, বরং প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত। কারণ তারা হলেন শহীদ এবং শহীদকে কখনো মৃত বলে অভিহিত করা ঠিক নয়।
আল্লাহ রাব্দুল আলামীন আরও বলেছেন, আমার নির্দেশিত জেহাদে দৃঢ় মনোবল নিয়ে অংশগ্রহণ জেহাদের সম্মুখীন হতে বাধ্য করব এবং কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখব, আমার নির্দেশের আজ্ঞাবহ হয়ে আমার এ সমস্ত অগ্নিপরীক্ষায় তোমরা কতটুকু উত্তীর্ণ হতে পারো। তোমাদের মধ্যে যাঁরা এ সমস্ত কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় ধৈর্য ও বীরত্বের সাথে উত্তীর্ণ হতে পারবে, একমাত্র তাঁদের জন্যই রয়েছে অসীম সুখময় বেহেস্তের শুভ সংবাদ। যেমন নাকি আল্লাহতালা কোরানে উল্লেখ করেছেনঃ
ولنبلونكم بشى من الخوف والجوع ونقص من الاموال

والانفس والثمرات. وبشر
অর্থাৎ, আমি কতগুলি জিনিস দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করব। সেগুলো হল এইঃ
(১) আমি তোমাদেরকে এমন এক পরিবেশে ফেলে দিয়ে ভীতি প্রদর্শন করব, যেখানে চতুর্দিক থেকে ভয় ও আতঙ্ক তোমাদেরকে গ্রাস করতে চাইবে।
(২) তোমাদেরআেনাহারে ফেলে ক্ষিধের জালায় কষ্ট দেব কিন্তু আবার কোন জিনিস থেকে বঞ্চিত রাখব, অর্থাৎ তখন কোন খাবার দ্রব্য তোমরা খুঁজে পাবে না।
(৩) তোমাদের ধনসম্পত্তি বিনষ্ট করে দেব; অর্থাৎ অত্যাচারীরা তোমাদের ধনদৌলত লুট করে নেবে ও বিনষ্ট করে দেবে, অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
(৪) আমি তোমাদের স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন এবং অত্যন্ত আপনজনকে তোমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেব, অর্থাৎ মেরে ফেলব।
(৫) তোমাদের ফলে সুসজ্জিত বৃক্ষ এবং শস্য-সামগ্রীতে ভরা ক্ষেতের ফসল প্রাকৃতিক দুর্যোগ-যথা ঝড়তুফান, বন্যা ইত্যাদির মাধ্যমে বিনষ্ট করে দেব।
আমি তোমাদেরকে ঐ সমস্ত বিপদে ফেরে পরীক্ষা করে দেখব- যাতে তোমরা ভয় ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে, ক্ষিধের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে, ধন-সম্পত্তির প্রাচুর্য হতে বঞ্চিত হয়ে, স্ত্রী-পুত্র ও আত্মীয়-স্বজনহারা হয়ে, ফলে সুসজ্জিত বৃক্ষ ও সুফলা জমির ফসল থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার উপর থেকে ভরসা ছেড়ে দিয়ে একেবারেই হা-হুতাশে পড়ো এবং ন্যায় পথ থেকে সরে দাঁড়াও ঐ সমস্ত বিপদে ধৈর্য ধারণ করে আমার নাম স্মরণ করে দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য নিয়ে এবং সৎপথে থেকে ঐ সমস্ত চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে জেহাদ করে যাও, অর্থাৎ ন্যায়নীতির

<005.011.284>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

ভিতর দিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করো। মনে রাখবা, সৎপথ ও ন্যায়নীতির ভিতর থেকে ধৈর্য সহকারে ঐ সমস্ত বিপদের মোকাবিলা করা এবং এ সমস্ত দুর্যোগ যদি কোন অত্যাচারী লোকের দ্বারা সংগঠিত হয়ে থাকে, তবে তাদের ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে রুখে দাঁড়ানোর নামও আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ৷

অতঃপর আল্লাহতালা বলেছেনঃ যে সমস্ত লোক ঐ সমস্ত বিপদে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর এই সমাধানের উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এবং কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত না হয়ে সৎ ও ন্যায়নীতির ভিতর থেকে জেহাদের মাধ্যমে ঐ সমস্ত বিপদের মোকাবিলা করে, আর ঐ কথা বলে- আমরা আল্লাহরই সিদ্ধান্তের উপর রাজী রয়েছি এবং তাঁরই কাছে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে, তাদেরকে আমার বেহেস্তের শুভ সংবাদ জানিয়ে দাও।
কোরান শরীফের এই আয়াতের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিগত ২৫শে মার্চ থেকে নরঘাতক জল্লাদ ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও পাশবিকতা চালিয়েছে এবং এর মাধ্যমে এদেশের জনগণের উপর যে ভয়াবহ ও দুর্বিষহ বিপদ নেমে এসেছে, এগুলোও মানুষের উপর আল্লাহতালার বিরাট পরীক্ষা। এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় অবশ্যই আমাদেরকে উত্তীর্ণ হতে হবে। এবং সেজন্য প্রয়োজন হচ্ছে অসীম সহনশীলতা ও ধৈর্যের সাথে জেহাদ করে যাওয়া। এই বিপদের দিনে অবশ্যই আমাদেরকে ন্যায়-নীতি মেনে চলতে হবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিপদ কাটিয়ে ওঠার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অক্টোবর, ১৯৭১
। তৃতীয় ও শেষ অংশ।
পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকগোষ্ঠী বিগত ২৪ বৎসর যাবৎ শুধু বাংলাদেশের জনগণকে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকেই বঞ্চিত করে নাই, উপরন্তু এদেশের জনগণের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাদের ন্যায্য অধিকার চিরতরে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে বিগত ২৫শে মার্চ থেকে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। তারা হিংস্র পশুর ন্যায় বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, ঘর-বাড়ি, ধন-দৌলত, দোকান-পাট লুট করছে ও জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে, প্রায় এক কোটি লোককে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে ও তিন কোটি লোককে নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়া করেছে এবং বলপূর্বক এদেশের মানুষকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে ও তাদের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ওরা আমাদের সাথে যে ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, তা হচ্ছে ন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ। কোরানের দৃষ্টিতে ওরা শয়তানের বন্ধু এবং দোযখী। অতএব আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য।

আল্লাহতালা আরও বলেছেনঃ ومن يقتل مؤمنا متعمدا فجزائه جهنم ه
অর্থাৎ, সুপরিকল্পিতভাবে যদি কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে হত্যা করে তবে এর একমাত্র বদলা হচ্ছে দোযখ। এমনকি কোন অমুসলমানকেও যদি অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় তবে তার জন্যেও একই শাস্তির কথা হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে। দোযখীদের সাহায্য করাও দোযখের কাজের মধ্যে গণ্য। আল্লাহতালা বলেছেন, আমার বান্দা যত বড় গোনাহ বা অন্যায়ই করুক না কেন, সে তার অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত হয়ে যদি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে তা আমি মার্জনা করে দেব। কিন্তু কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, অন্যায়ভাবে অন্যের অধিকার নষ্ট করে, অন্যের অধিকারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, অপরের মনে কষ্ট দেয় ও নারীর অমর্যাদা করে সে আমার যত এবাদত বন্দেগীই করুক না কেন আর যত ক্ষমাই চাক না কেন, তাকে ক্ষমা করার কোন অধিকার আমার নেই। তাকে একমাত্র ক্ষমা সে-ই করতে পারে, যার সঙ্গে সে এহেন আচরণ করলো। রাসূলুল্লাহ

<005.011.285>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

(ছঃ) বলেছেন, এ ধরনের আচরণ করে যে ইহলীলা ত্যাগ করবে, সে সবচেয়ে নিম্নস্তরের হতভাগ্য ব্যক্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের লোক হীনতর ইতর প্রাণী শূকর ও কুকুরের চেয়েও বেশী নিকৃষ্টতর। যেমন আল্লাহতালা তাকে কোরানে বলেছেনঃ اولائك كالانعام بل هم اضل সুতরাং, চিন্তা করুন ওরা ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে বাংলাদেশে যেভাবে অন্যের অধিকার নষ্টের কাজে লিপ্ত রয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে তারা কত বড় অপরাধী! নারীদের উপর বলাৎকার করা ইসলামের কঠোর ভাষায় নিষেধ আছে। হুজুর (ছঃ) বলেছেন
الزني لايزني حين يزني وهو مؤمن

অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি মুসলমান থাকা অবস্থায় কোন নারীর সাথে জেনা বা অবৈধভাবে পাশবিক লালসা চরিতার্থে মিলিত হতে পারে না। সুতরাং পাক হানাদার পশুরা যেভাবে বাংলাদেশে নারীধর্ষণ চালাচ্ছে, তাদেরকে আমরা ইসলামের নামে সংহতির ধ্বজাধারী মুসলমান বলে মেনে নিতে পারি না। তারা হল মুসলমান নামধারী বেঈমান ও মুনাফেক। অতএব, এদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করে ও সার্বিক অসহযোগিতা প্রদান করে ওদের বেঈমানীর সমুচিত জবাব দেওয়া আমাদের প্রত্যেকের ইসলামিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা যদি আমাদের এই দায়িত্বের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করি, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে আমরাও ওদের সমঅপরাধী বলে গণ্য হব। কারণ, ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করতে প্রতিটি বিশ্বমানবকে নিদেশ দিয়েছেন ।
ইসলামের দৃষ্টিতে জেহাদের অর্থ শুধু অস্ত্ৰধারণ করে জেহাদই নয়- অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক সাহায্য প্রদান, অন্যায়কারী ও তাদের সহযোগীদের সাথে সার্বিকভাবে অসহযোগিতা করা, এর বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণকারীদের নানাভাবে সাহায্য প্রদান করা, এর বিরুদ্ধে মানুষকে বুঝিয়ে গণসমর্থন গড়ে তোলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয়ের উপর দৃঢ়বিশ্বাস ও আশা পোষণ করা এবং পুরোপুরি ধৈর্য সহকারে সৎ ও ন্যায়নীতির মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে বিপদ কাটিয়ে উজ্জ্বল ও স্বর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখাও ইসলামের দৃষ্টিতে জেহাদের অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, হে বাঙালী ভাইবোনেরা, আসুন আমরা অন্যায়কারী পশ্চিমা হানাদার পশু ও এদের পদলেহী দালাল কুকুরদের বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে জেহাদ চালিয়ে আমরা আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হই। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
نصر من الله وفتح قريب.
(আবু রাহাত মোঃ হাবিবুর রহমান রচিত)

বাইবেল পাঠ ও আলোচনা

…..নভেম্বর, ১৯৭১

আজ আমরা আলোচনা করব যীশুখ্রষ্টের মৃত্যু সম্পর্কে। প্রথমেই পবিত্র বাইবেল শাস্ত্র থেকে কটি অংশ পাঠ করে নেই।

* * * * “প্রভাত হইলে প্রধান যাজকেরা ও লোকদের প্রাচীনবর্গ সকলে যীশুকে বধ করিবার নিমিত্ত তাঁহার বিপক্ষে মন্ত্রণা করিল; আর তাঁহাকে বধিয়া লইয়া গিয়া দেশাধ্যক্ষ পীলাতের নিকটে সমর্পণ করিল।”

<005.011.286>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

“তখন পীলাত যীশুকে লইয়া কোড়া প্রহার করাইলেন । আর সেনারা কাঁটার মুকুট গাঁথিয়া তাঁহার মস্তকে দিল এবং তাঁহাকে বেগুনিয়া কাপড় পরাইল, ……তখন পীলাত আবার বাহিরে গেলেন ও লোকদিগকে কহিলেন, দেখ, আমি ইহাকে তোমাদের কাছে বাহিরে আনিলাম, যেন তোমরা জানিতে পার যে, আমি ইহার কোনই দোষ পাইতেছি না। …তখন যীশুকে দেখিয়াই প্রধান যাজকেরা ও পদাতিকেরা চেচাইয়া বলিল, উহাকে ক্রুশে দেও, উহাকে ক্ৰশে দেও। …পীলাত তাহাদিগকে কহিলেন, তোমাদের রাজাকে কি ক্ৰশে দিব? প্রধান যাজকেরা উত্তর করিল, কৈসর ছাড়া আমাদের অন্য রাজা নাই। তখন তিনি যীশুকে তাহাদের হস্তে সমর্পণ করিলেন, যেন তাঁহাকে ক্রুশে দেওয়া হয়।”
একথা বললে ভুল হবে না যে, জগতে যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাব ছিল ঈশ্বর-নিরূপিত। যীশু জগতে এসেছিলেন মানুষকে তার পাপের অন্ধকার থেকে পুণ্যের আলোক-সরণীতে পৌঁছে দিতে। তিনি এসেছিলেন মানুষকে পাপ থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য- মুক্তির পথ দেখাবার জন্য। তিনি বলেছিলেন, মানুষকে আমিই পথ, সত্য ও জীবন- আমাতেই তোমরা পরিত্রাণ পাবে। বলেছিলেনঃ সৎ হও, পবিত্র জীবনযাপন কর; কারণ তোমাদের স্বৰ্গস্থ পিতা ঈশ্বর পবিত্র। আহবান জানিয়েছিলেন, “হে পরিশ্রান্ত ভারাক্রান্ত লোকসকল, আমার নিকটে এসো, আমি তোমাদের শান্তি দেব।’ তাঁর সমস্ত বক্তব্য ছিল মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে। জীবনভর তিনি অশুভ শক্তির সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। তাই সামাজিক প্রভুত্বের ক্ষমতালোভী যাজক-পুরোহিত ও গোঁড়াদের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা প্রতিবাদ করেছেন। কারণ, এই সমস্ত ভণ্ড ধর্মগুরুরাই তখন মানুষকে এক মহাভ্রান্তির পথে ঠেলে দিয়েছিল নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থে। এরাই নিজেদের কুটিল চক্রান্তে শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা করে, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে নিজেদেরকে মধ্যস্থ ব্যক্তিরূপে বসাতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে মানুষ তখনকার দিনে সরাসরি ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণ করতে পারতো না। আসতো ঐসব যাজকদের কাছে।
কিন্তু খ্ৰীষ্ট এসে মানুষকে দেখালেন প্রকৃত সত্যকে। কারণ, পাপী মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অসীম সমমৰ্মিতা। মানুষকে ভালোবেসে তাই তিনি স্বর্গ ছেড়ে মাটিতে এসেছিলেন মানুষের অতি কাছে। এর ফলে পুরোহিত সম্প্রদায় ভিন্ন সকলের কাছে তিনি শুধু আপন হয়েই ওঠেননি- সকলের হৃদয়ে তাঁর জন্য পাতা হয়েছিল শ্রদ্ধার আসন। সকলেই তাঁর ধর্ম উপদেশ শুনতে ভালোবাসত। সকলেই তাঁকে প্রকৃত ধর্মগুরু হিসাবে গ্রহণ করেছিল।
কিন্তু পুরোহিত-তন্ত্র সেদিন এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা তখন সর্বদাই যীশুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। তাঁর দোষ ধরতে চেষ্টা করেছে, তাঁকে জনসমাজে-অপদস্থ করতে সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়ে গেল। তখন হিংসায় উন্মত্ত হয়ে তারা যীশুর প্রাণনাশের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো। আজও যেমন সুবিধাবাদী, বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই, সেদিনও অভাব হয়নি। যীশুর বারোজন শিষ্যের একজন এসে যোদ দিল এই ষড়যন্ত্রে- শুধুমাত্র অর্থের প্রলোভনে।
এই বিশ্বাসঘাতক শিষ্যের সাহায্যে চক্রান্তকারীরা লোকচক্ষুর আড়ালে রাতের অন্ধকারে গেৎশিমানী বাগান থেকে যীশুকে বন্দী করল। ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষ পিতা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবার জন্য বিচারকের কাছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল- এ ব্যক্তি ঈশ্বর-নিন্দুক, কারণ এ নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবী করে। আরও অভিযোগ করা হল, এ ব্যক্তি রাজদ্রোহী, কারণ এ নিজেকে যিহুদীদের ইব্রীয়দের রাজা বলে ঘোষণা করেছে। বলা বাহুল্য, সে সময় সমগ্র প্যালেস্টাইন দেশ রোম-সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। যাহোক, যীশুর বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছিল তার জন্য পুরোহিত-তন্ত্র হাজির করেছিল বহু মিথ্যা সাক্ষীকে। রোম সম্রাটের প্রতিনিধি ছিলেন দেশাধ্যক্ষ পীলাত। তার সামনে চলল এক বিচারের প্রহসন। তিনিও বুঝলেন যাজকরা হিংসার বশে যীশুর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে। বুঝলেন, ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে এনেছে রাজদ্রোহিতার

<005.011.287>
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড

অভিযোগ- যাকে অবজ্ঞা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যুগে পুরোহিততন্ত্রের প্রভাব ও ক্ষমতা ছিল বিস্তৃত। তারা পীলাতকে ভয় দেখাল যে, যদি পীলাত যীশুর বিচার না করে তবে তিনি রোম সম্রাটের প্রকৃত বন্ধু নন।
পরিশেষে পীলাত নিজের ভালো দেখলেন। চাইলেন তার বিরুদ্ধে যেন সম্রাটের কাছে কোন নালিশ না যায়। তাই তার বিচার প্রহসনে দাঁড়িয়ে গেল। সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই বিচার বিচার খেলাটা শেষ হয়ে গেল। প্রকাশ করা হল রায়- ঐ ব্যক্তিকে চরম দণ্ড দেওয়া হল। না, ফাঁসী নয়- আরও নির্মম, নৃশংস ও লাঞ্ছনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ-ক্রুশীয় মৃত্যু। হাতে, পায়ে পেরেক গেথে ক্রুশকাঠে ঝুলিয়ে যীশুকে হত্যা করা হল- যিনি ছিলেন নিরপরাধ, নিষ্কলঙ্ক, নিষ্পাপ ব্যক্তি। যিনি এসেছিলেন মানুষের ধর্মীয় পরিমণ্ডলের শুচিতা, শুভ্রতা ফিরিয়ে আনতে। যিনি এসেছিলেন মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধার করে অনন্ত, অমৃত জীবনের সন্ধান দিতে।
এখন প্রশ্ন হল, তাঁর মৃত্যুতেই কি সব শেষ হয়ে গেল? তিনি কি হেরে গেলেন পাপী প্রতিক্রিয়াশীল পুরোহিত-তন্ত্রের কাছে? তাঁর মৃত্যু কি তাঁর সাথে মানুষের চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিল? না। এর উত্তরে অসংকোচে বলা যাবে, তা নয়। অন্ধকারের পরে আসে আলো- এটা বিতর্কিত নয় কিন্তু প্রাকৃতিক সত্য। যীশু প্রমাণ করলেন মৃত্যুর পরে তেমনি আসে পুনরুত্থান। মৃত্যুর তিন দিন পর কবর থেকে অমোঘ মৃত্যুকে পরাজিত করে তিনি পুনরুখিত হলেন। তাঁর পুনরুত্থান তার প্রতি বিশ্বাসী মানুষকে পাপ থেকে পরিত্রাণ দিল। মানুষকে বললেন, আমাকে বিশ্বাস কর। বললেনঃ ভয় নেই আমি আছি, আমি তোমাদের শক্তি দেব। সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর, সমস্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর- পরাজিত হবে না। আমার মতো বিজয়ী হবে। পাপের সাথে যুদ্ধ কর-অবশ্যই তোমরা পাপকে জয় করতে পারবে। কারণ, আমি তোমাদের পরিত্রাণ কর্তাতোমাদের শক্তিদাতা। মৃত্যুকেও তোমরা জয় করবে, আমার মতো মৃত্যুঞ্জয়ী হবে- ঈশ্বরের রাজ্যে, অনন্ত জীবনের দেশে তোমরা পৌছাতে পারবে। তখন অনায়াসেই বলতে পারবে- মৃত্যু, তুমি নাই।
কবির ভাষায়ঃ
“মেঘ ঢেকে কেঊ করিস নে ভয়,
আড়ালে তার সূর্য হাসে।”

(ডেভিড দাস রচিত)