শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০১। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে অধ্যাপক মোজাফফার আহমেদের বিবৃতি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ২০শে এপ্রিল ১৯৭১
২০শে এপ্রিল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশ জাতীয় আওয়ামী পার্টির সভাপতি, অধ্যাপক মুজাফফার আহমেদ কতৃর্ক জারিকৃত সংবাদ বিবৃতি-
আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী অধ্যাপক মুজাফফার আহমেদ সার্বভৌম সরকার প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে নামেমাত্র ঘোষণা করতেছি। আমরা আরো বাংলার মুক্তি সেনাদের (মুক্তি ফৌজ) দৃঢ় প্রচেষ্টা এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীদের আমাদের মাতৃভূমির পবিত্র মাটি থেকে বিতাড়িত করার দুঃসাহসী সংগ্রামকে অভিবাদন জানায়। আমরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি যে, শুধুমাত্র শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আইনগতভাবে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। আর সকল গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল জাতির প্রতি সদ্য জন্মানো রাষ্ট্র ও এর সরকারকে স্বীকৃতি এবং সকল প্রকার সাহায্য ও নৈতিক সমর্থন প্রদানের আহ্বান জানায়। এ প্রসংগে, আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় এবং গণতান্ত্রিক মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতি প্রাপ্তিস্বীকার করা আমাদের কর্তব্য বলে বিশ্বাস করি, বিশেষত ভারত ও সোভিয়েত ইউনিউনের সরকার ও জনগণ কতৃর্ক প্রদত্ত সমর্থন ও সহযোগিতা।
মানবতার নামে, সভ্যতার মতবাদ ও বিবেক দিয়ে আমরা তীব্রভাবে বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল জাতির প্রতি এবং জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানায়, বাংলাদেশের হাজার হাজার নিরস্ত্র পুরুষ, নারী ও শিশুর উপর সংঘটিত গণহত্যা রোধে অবিলম্বে পদক্ষেপ কার্যকরী করার।
এখনকার প্রধানতম কাজ হল স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা এবং একে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক দলের যুক্তফ্রন্ট ও সেনাদের একটি বোর্ড গঠন করা। আওয়ামী লীগের নেতা এবং বাংলাদেশ সরকারকে আমরা এ নিয়ে তাগদা দিচ্ছি।
আমরা বাংলাদেশের সকল ছেলে ও মেয়েদের উদাত্ত আহ্বান জানায়, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত নব প্রাণশক্তি এবং সংকল্প নিয়ে তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার। এই সংগ্রামে নিহত দশ হাজার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মান জানিয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দিবনা এবং সংগ্রামে জনতার জয় হবেই। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং বর্বরোচিত গণহত্যার বিচার বাংলাদেশের ৭৫ লক্ষ মানুষ নির্ধারণ করবে। বিজয় আমাদের হবেই।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীন জনগণ চিরজীবী হোউক।
<৪,২০২,৪২৩-৪২৮>
অনুবাদকঃ অনুরাধা চৌধুরী, সাবরিনা, খন্দকার কাফি আহমেদ
শিরোনাম সুত্র তারিখ
২০২। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে মাওলানা ভাসানির আবেদন প্রেস বিঞ্জপ্তি ২১ আগস্ট, ১৯৭১
বিশ্ব নেতাদের কাছে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির সনির্বদ্ধ আবেদন
তারিখ – এপ্রিল ২১,১৯৭১।
(i)
সেক্রেটারি জেনারেল ইউ-থাস্ট, জাতিসংঘ,
নিউ ইয়র্ক,ইউ এস এ।
সাত কোটি পাঁচ লাখ বাংলাদেশীর পক্ষ থেকে আমি আপনাকে মধ্যস্থতাকারী হয়ে আমি আপীল করছি যে আপনি আপনার দক্ষ অফিসারদের ব্যবহার করুন এবং এক নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অধিনস্থ সৈন্যদের কর্তৃক বাংলাদেশের ধর্ম,বর্ণ,মতবাদ নির্বিশেষে নারী,শিশু ও মায়ের কোলের সদ্যজাত শিশুসহ নিষ্পাপ,নিরস্ত্র ও অসহায় বাংলাদেশীর উপর সম্পাদিত নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা ও জন্মগত অধিকার দমনে পশিম পাকিস্তানের হস্তক্ষপের বিরুদ্ধাচার করার অনুরোধ জানাচ্ছি। মানবতার নামে বর্বর এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে যত দ্রুত সম্ভব যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নিবেদন জানাচ্ছি। সেই সাথে বাংলাদেশে এক নায়ক ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি আইনের শিকার মানুষের জন্য সম্ভাব্য সকল ত্রাণ সহায়তা দানে সনির্বদ্ধ আবেদন জানাচ্ছি। জন্য।আমি আপনার পাঠানো পর্যবেক্ষকদের স্বাগতম জানাতাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দেখার জন্য এবং লুণ্ঠন,অগ্নিসংযোগ,গণহত্যা ও নারীদের প্রতি উৎপীড়ন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা,যাতে করে বিশ্ববাসীর কাছে জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশের শোচনীয় কাহিনীর প্রকৃত ছবি প্রকাশ পায়।
(ii)
প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং,চাও এন লেই পোকিং,চায়না
সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ হল নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই। আমি আপনার নিকট একনায়ক ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা দ্বারা সম্পাদিত নৃশংসতা থেকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত মানুষকে বাঁচানোর অনুরোধ করছি। আপনার সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে ইয়াহিয়া সামরিক সরকার নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে বাংলাদেশের নিষ্পাপ,নিরস্ত্র, অসহায় কৃষক,শ্রমিক,ছাত্র,বুদ্ধিজীবি,নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। যদি আপনার সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ কায়েমে তাদের মিলিটারিজান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের উৎপীড়িত জনসাধারণের উপর বর্বর নৃশংসতার প্রতিবাদ না করেন,তবে বিশ্ব ভাবতে পারে আপনি নিপীড়িত মানুষের বন্ধু নন।
নিপীড়নের যে উদাহরণ পাকিস্তানী বাহিনী অসহায় বাঙ্গালীদের উপর প্রদান করছে তা চ্যাং-খাই শেখের আমলে , রাশিয়াই সিজারের শাসনামলে অথবা ভারতীয় মহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলেও দেখা যেত না । বিভিন্ন ভারতীয় এজেন্সি পাশবিকতা ও নির্যাতনের যে চিত্র পেশ করছিল তা আসলে বাঙ্গালীদের উপর চলে আসা নির্যাতন ও পাশবিকতার তুলনায় কিছুই না । সমগ্র বিশ্ব প্রকৃত চিত্রের ভয়াবহতা তখনই জানতে পারবে যখন সাংবাদিক , বুদ্ধিজীবী এবং ইয়াহিয়া সরকারের মিত্রপক্ষসহ বিশ্বের যে কোনো দেশের রাজনীতিবিদরা অনুসন্ধান চালাবে ।
আপনারা জানেন যে কম্বোডিয়ার সিহানোক সরকারের তুলনায় এখা্নে স্বাধীন বাংলাদেশের পিছনে বিস্তর মানুষের সমর্থন আছে । সুতরাং আমি আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি আপনারা আমাদের সমর্থনের মাত্রা বাডিয়ে দিন, স্বীকৃতি দিন এবং আপনাদের পক্ষে যতটা সম্ভব স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের জন্য সম্পূর্ণ সাহায্য করুন ।
ইন্দো-পাক উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য এবং পাকিস্তানীদের অধিকার রক্ষার্থে আমাকে ৩১ বছর জেলবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে । এখন আমি ৮৯ বছরের বৃদ্ধ । এ পর্যায়ে আমার বাড়িঘর ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী পুড়িয়ে ফেলেছে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা আমার বহু মুল্যবান বই ও এর সাথে পুড়ে গেছে । আমি এও জানিনা আমার পরিবারের মানুষের ভাগ্যে কি হয়েছে আমার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর ।
(iii)
সেক্রেটারী জেনারেল ব্রেযনেভ , প্রেসিডেন্ট পজর্নি , চেয়ারম্যান কোসিগিন , ক্রেম্লিন , মস্কো , ইউএসএসআর
বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়নের মানুষের পক্ষ থেকে আমি কি পূর্ব পাকিস্থানের অবস্থা সম্পর্কে সুপ্রীম সোভিয়েতের প্রেসিডিয়ামে প্রেসিডেন্ট পজর্নি কর্তৃক বর্ণিত প্রদত্ত উক্তিতে আপনার মনোযোগ আকর্ষন করতে পারি?
বাংলাদেশের অসহায় , নিরস্ত্র অসংখ্য মানুষের উপর শাসক ইয়াহিয়া খানের হানাদার মিলিটারী বাহিনীর হিংস্র ধ্বংসযজ্ঞ থামানোর জন্য যে আরো পদক্ষেপ দরকার এই বিষয়টিতে আপনার দৃষ্টি আলোকপাত করতে চাই । পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা এই ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে আমারিকা ও চায়না প্রদত্ত অতি আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করছে । মহিলা , বাচ্চা এমনকি মায়ের কোলে থাকা নবজাতক শিশুসহ জাতি , ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ এদের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে । তাদের এই হিংস্রতা ইতিহাসের যে কোনো ঘটনাকে হার মানাবে । এই রক্তাক্ত ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতে পাকিস্তানী সরকারকে যে কোনো সাহায্য প্রদানে বিরত থাকতে আমি আপনাকে আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি । লেলিনের বিজ্ঞ ও দৃঢ়বিবেচক নেতৃত্বাধীনে আপনি ও আপনার দেশের জনগন এর আগেও আর্ত মানুষের সাহায্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার সাথে পাশে দাড়িয়েছেন এবং স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে নৈতিক , রাজনৈতিক এবং সকল প্রকার সাহায্য সহযোগীতা করেছেন । গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে সম্মতি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকেও একইভাবে সাহায্য করতে আমি আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এশিয়া এবং ইউরোপের অংশবিশেষ । লেনিনীয় শান্তির প্রথা উন্নয়নের পথে উত্তম দিকনিদর্শন বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের জন্য । বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নির্যাতন ও সাম্রাজ্যবাদের এক নিক্কৃষ্ট নিদর্শন । লুটতরাজ , ডাকাতি , ছিনতাই , গনহত্যা , নারীনির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা । হিংস্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিপক্ষে সোচ্চার হতে আমি আপনাদের জনগনের সাহায্য প্রার্থনা করছি । আমি আশা ব্যক্ত করছি আপনাদের সরকার এই গুরুতর বিষয়টিতে অতি দ্রুত দৃষ্টি আলোকপাত করবেন এবং বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের ভাগ্য নির্ধারণের স্বাধীনতা অর্জন করবে ।
ইন্দো-পাক উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য এবং পাকিস্তানীদের অধিকার রক্ষার্থে আমাকে ৩১ বছর জেলবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে । এখন আমি ৮৯ বছরের বৃদ্ধ । এ পর্যায়ে আমার বাড়িঘর ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী পুড়িয়ে ফেলেছে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা আমার বহু মুল্যবান বই ও এর সাথে পুড়ে গেছে । আমি এও জানিনা আমার পরিবারের মানুষের ভাগ্যে কি হয়েছে আমার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর ।
( IV )
প্রেসিডেন্ট নিক্সন , ওয়াশিংটন ডিসি , ইউএসএ ।
ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে আমারিকা ও চায়না প্রদত্ত অতি আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানী মিলিটারী বাহিনী মহিলা , বাচ্চা এমনকি মায়ের কোলে থাকা নবজাতক শিশুসহ জাতি , ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে নিষ্পাপ , নিরস্ত্র , অসহায় মানুষের প্রাণ নাশ করছে ।
আমি আপনার কাছে পাকিস্তানীদের যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি এবং পূর্বে সরবরাহকৃত অস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে অনুসন্ধান করার আবেদন করছি যেন ইয়াহিয়া সরকার সেগুলো নিরস্ত্র বাঙালীদের নিধনে আর ব্যবহার না করতে পারে ।
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে আপনার সর্বোচ্চ সাহায্য কামনা করছি ।
আমি আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকব যদি বিভিন্ন বিদেশী সংবাদপত্রের প্রতিবেদকদের বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয় যেন তারা পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের উপর লুটতরাজ , ছিনতাই , ডাকাতি , গণহত্যা , নারীনির্যাতনসহ যে অবিচার করে আসছে তার পরিমাণ ও স্বরুপ যেন বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে পারে ।
(V)
প্রেসিডেন্ট পম্পিদৌ , প্যারিস , ফ্রান্স
৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর পক্ষ থেকে আমি কি আপনার প্রতিবাদের উচ্চস্বর আহবান করতে পারি যখন স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী মিলিটারী বাহিনী আপনাদের এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের দেওয়া অস্ত্রের সাহায্যে যে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে ?বাংলাদেশের জনগনের যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এই নির্মমতার বিপক্ষে আপনার প্রতিবাদের জন্য আবেদন জানাচ্ছি । যুগান্তকারী আন্দোলনে ফ্রান্সের অবদান তাদের ঐতিহ্য এবং এই মর্মে আমিও আশাবাদ ব্যক্ত করি যে আপনার নেতৃত্বাধীনে ফ্রান্স বাংলাদেশের পাশে থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের ভাগ্য নির্ধারনে এবং তাদের অধিকার বাস্তবায়নে । ভিয়েতনাম এবং আলজেরিয়ায় চলে আসা ঘটনার সত্যতা নিরুপনে পূর্বেই ফ্রান্স মাহাত্মের নিদর্শন রেখেছে এবং আমরা আশা রাখি আপনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন । গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে আমাদের প্রতি আপনার সর্বোচ্চ সাহায্য কামনা করছি । আপনাদের সংবাদ প্রতিবেদকদের বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয় নিজেরাই তারা দেখতে পারবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের উপর লুটতরাজ , ছিনতাই , ডাকাতি , গণহত্যা , নারীনির্যাতনসহ যে অবিচার করে আসছে তার পরিমাণ ও স্বরুপ ।
(VI)
প্রাইম মিনিস্টার এডওয়ার্ড হিথ , লন্ডন , ইউকে
৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর পক্ষ থেকে আমি আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি তাদের জন্মগত অধিকার নিজেদের ভাগ্য নির্ধারনের স্বাধীনতার স্বপক্ষে আওয়াজ তোলার জন্য । শাসক ইয়াহিয়া খানের ধ্বংসযজ্ঞ যা শত শত বাঙালীর জীবন নাশ করছে তার বিপক্ষে দয়া করে সোচ্চার হয়ে উঠুন । আমি আপনার কাছে আরো অনুরোধ করছি তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ না করতে যেন আর কোন অসহায় , নিরস্ত্র বাঙালীকে প্রাণ না হারাতে হয় । আমি আশা ব্যক্ত করছি লন্ডন সরকার ঘটনার বাস্তবতা অনুধাবন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে যথাযথ সহযোগীতা করবে । ব্রিটিশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান হৃদয়বিদারক হলেও তা পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের উপর যে পরিমাণ লুটতরাজ , ছিনতাই , ডাকাতি , গণহত্যা , নারীনির্যাতনসহ অবিচার করে আসছে তার প্রকৃত পরিমাণ ও স্বরুপের তুলনায় কিছুই না ।
(VII)
প্রেসিডেন্ট টিটো , বেলগ্রেড , যুগোস্লোভিয়া
৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর পক্ষ থেকে আমি আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি
শাসক ইয়াহিয়া খানের ধ্বংসযজ্ঞ যা শত শত নিরস্ত্র , অসহায় বাঙালীর জীবন নাশ করছে তার বিপক্ষে দয়া করে সোচ্চার হয়ে আওয়াজ তোলার জন্য । বাংলাদেশের মানুষ যে অধিকার বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান করছি । যখনই কোথায় মানবাধিকার বঞ্চনার শিকার হয়েছে আপনি সেখানে সোচ্চার হয়েছেন । প্রেসিডেন্ট সাহেব আমি আপনাকে অনুরোধ করছি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ধ্বংশযজ্ঞের পক্ষে এবং নির্মম শক্তির প্রয়োগে যেভাবে মানব স্বাধীনতা অস্বীকার করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধেও একইভাবে আওয়াজ তুলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে আমাদের পাশে এসে দাড়াতে । আপনাদের সংবাদ প্রতিবেদকদের বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয় নিজেরাই তারা দেখতে পারবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের উপর লুটতরাজ , ছিনতাই , ডাকাতি , গণহত্যা , নারীনির্যাতনসহ যে অবিচার করে আসছে তার পরিমাণ ও স্বরুপ ।
(VI I I)
প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত,কায়রো, ইউ. এ. আর.
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,একজন মুসলিম বিশ্বের মহান ক্ষমতাধর নেতা হিসেবে আপনার কাছে আমি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অসহায় মানুষের পক্ষে সমর্থন জানানোর জন্য বিনীত আবেদন জানাচ্ছি যাদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা খুনে স্বৈরশাসক জেনারেন ইয়াহিয়ার সৈন্য কর্তৃক নৃশংস ভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। এটি ইসলামের নামে একটি প্রহসন যা বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা সৃষ্ট। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে শত শত হাজার হাজার নিরীহ,নিরস্ত্র,অরক্ষিত মানুষদের হত্যা করছে। অস্ত্রের জোড়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, গুন্ডামি,শ্লিলতাহানি এবং হত্যাযঙ্গ না দেখে বিশ্বাস করা দায়। আপনার কাছে আমার অনুরোধ আপনি কি এই নৃশংসতা ও দমনীয় মানবাধিকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন এবং অবিলম্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান এবং সহায়তার হাত প্রসারিত করবেন যাতে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী মিলিটারি হস্তক্ষেপ ছাড়া আমরা যেন নিজেদের অধিকার এবং ভবিষ্যত নির্ধারন করতে পারি?
IX
জনাব আবদেল খালেক হাসাওনা
সেক্রেটারি জেনারেল,আরব লিগ,কায়রো, ইউ. এ. আর.
আমি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আপনার কাছে আরব লীগকে খুনি স্বৈরাচারী শাসক ইয়াহিয়া খানের বাংলাদেশে অসহায়,নিরস্ত্র এবং অরক্ষিত মানুষের ওপর নৃশংসতা চালাচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। নারীদের পালাক্রমে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে এমনকি নবজাতক শিশু কোলে থাকা মায়েদেরকেও রেহায় দেয়া হচ্ছে না। এসব অবর্ণনীয় কর্মকান্ডগুলি একটি মুসলিম দেশের সৈন্যরা সিংহভাগ মুসলিমদের ওপর চালাচ্ছে। আরব লিগ সর্বদাই নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। বাংলাদেশে এই ভয়ানক ঘটনায় আরব লীগের নীরবতা জনমনে হতাশা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হিংস্র সৈন্যদের লেলিয়ে দেয়ার পর থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলী আমি আপনাদেরকে আরব লীগের সামনে পেশ করার অনুরোধ করব, যাতে করে লীগের সদস্যদের উদ্যোগ/বক্তব্য বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান রক্তপাত ও মানুষের অধিকার দমনকে থামাতে সক্ষম হয়। আমি আপনার প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের নিরীহ, নিরস্ত্র এবং অসহায় মানুষ যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর দ্বারা সংগঠিত লুটপাট,অগ্নিসংযোগ,হত্যা এবং নারীদের ওপর চালানো শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ প্রত্যক্ষ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
(X)
মিঃ ডিয়াল্ল টেল আই
সেক্রেটারি জেনারেল ও এ ইউ আদ্দিস আবাবা
আমি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ হতে ও এ ইউ ‘র কাছে ইয়াহিয়া খানের খুনে সেনাবাহিনী দ্বারা বাংলাদেশের অসহায়,নিরস্ত্র ও অরক্ষিত মানুষের ওপর বর্বরতা ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে দাড়াতে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী দ্বারা পুরুষ,নারী ও শিশু হত্যা এবং নারীদের শ্লীলতাহানি একটি সাম্প্রতিক ঘটনা। একটি ক্ষুদ্র সামরিক গোষ্ঠী বাংলাদেশের জনগণেরর মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকার দমন করার জন্য জোড় শক্তি প্রয়োগের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ও এ ইউ যা উপনেবিশবাদ দমনের জন্য লড়াই করছে,বাংলাদেশে দানা বাঁধতে শুরু করা ঔপনেবিশবাদের নগ্ন কথনের বিরুদ্ধে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
মাননীয় মহাসচিব,মানবতার নামে আমি আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি নিরীহ জনগণের ওপর এই নৃশংস গণহত্যা বন্ধ করুন এবং বাংলাদেশে সৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের শিকার সকলের জন্য সম্ভাব্য সহায়তা প্রদানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
<৪,২০৩,৪২৯-৪৪১>
অনুবাদকঃ মুহসীন, নাজিয়া বিনতে রউফ, ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি, সুজন, ইমরান, হাসান লতিফ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৩। সমমনা দলসমূহের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বান পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ৩ মে, ১৯৭১
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে
সমমনা দলসমূহের উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির আহ্বান, ৩ মে, ১৯৭১
প্রিয় সহকর্মীগন,
২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) যে অমানুষিক গণহত্যা চালাচ্ছে বিশ্ববাসী এ সম্পর্কে অবগত। বিগত পাঁচ সপ্তাহে পাকিস্তানী আর্মি প্রসিদ্ধ নেতৃত্বস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবীসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে; ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে লুটতরাজ ও লুটপাট চালিয়েছে, শত শত গ্রাম-হাট-বাজার পুড়িয়ে দিয়েছে; পুরো বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। মানুষের জীবন ও সহায়-সম্পত্তির এই অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চলছে এবং প্রায় দশ লক্ষ সহায়সম্বলহীন নিঃস্ব বাংলাদেশী মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আকাশ-মাটি-পানি এই তিন সামরিক শক্তি নিয়েই পাকিস্তানী জান্তারা প্রকৃতপক্ষে নীরিহ-নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের সমূলে ধ্বংস করার যুদ্ধে নেমেছে। বাংলাদেশ চলমান ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ইতোমধ্যে আধুনিক ইতিহাসে কালো দাগ একে দিয়েছে।
কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী জনগণের এই পরিষ্কার রায় মেনে নিতে রাজি ছিলো না অথবা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে রাজি ছিলো না। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র করেছিলো এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য সমর্থন ছিলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যবাদীদের, যারা মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিন অথবা তার কয়েকদিন পরেই এক মিথ্যা ও বানোয়াট অজুহাত আমলে নিয়ে ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি ভেঙে দিয়েছিলো। তাদের অজুহাত ছিলো যে, ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি, বিশেষ করে সাবেক নেতা এ. কে. ফজলুল হক, ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো এবং পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তানকে বিনাশ করার চেষ্টা করছে। শাসক শ্রেণীরা পূর্ব পাকিস্তানে এক ভীতির রাজত্বও সঞ্চার করেছিলো এবং হাজার হাজার লোককে কারাগারে পাঠানো হয়েছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি যারা জোট বেঁধেছিল এই সময়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলো। উল্লেখযোগ্যভাবে, ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি ভেঙে দেওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ বা তার কিছুদিন পরেই পাকিস্তান সাম্রাজ্যবাদের অধীনে সামরিক চুক্তিতে যোগদান করেছিলো।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে শাসক গোষ্ঠীর এ ধরনের লজ্জাজনক আক্রমণের পরেও, স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন বিভিন্ন আকারে চলতে থাকে। সিন্ধি, পাঠান এবং বেলুচীরাও তাদের জাতীয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে লড়ে যাচ্ছিলো।
অন্যদিকে শাসক শ্রেণীরা স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের এই ক্রমবর্ধমান আন্দোলনকে নিরোধ করতে দুইটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলো। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের ইচ্ছামত দুইটি আইন পাস করে। এগুলোর মধ্যে একটি আইনে বলা হয় যে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সকল বিষয়েই “সমতা” থাকতে হবে, যার অর্থ ছিলো এই যে পূর্ব পাকিস্তান যার ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা (শতকরা ৫৬ ভাগ), তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ শতাংশ জনগণকে সমান করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় আইনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশগুলো, যেমন সিন্ধ, পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচীস্তান, রহিত করা হয় সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি একক পূর্ণাঙ্গ অথবা একক প্রদেশ হিসেবে গঠন করা হয়। জাতীয় দমননীতিকে তীব্র করতে এই দুটি আইন ছিলো প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর নতুন পদক্ষেপ।
কিন্তু পূর্বে যেমনটা বলা হয়েছিলো, স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের এই জনপ্রিয় আন্দোলনকে ঠেকানো যায়নি। এটা একই সাথে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে চলছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানে একক প্রদেশ নীতি আরোপের পর ছোট জাতিগুলোর- সিন্ধি, পাঠান এবং বেলুচীস্তানিদের উপর দমন প্রকট আকার ধারণ করেছিলো। তারা অভিযোগ করেছিলো যে পাঞ্জাবী কায়েমি স্বার্থোদ্ধারে অদৃশ্য দাস বানানো হয়েছে তাদেরকে, যারা একক প্রদেশের চটুলতায় ঐ সকল প্রদেশগুলোতে প্রশাসনের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেছিলো এবং তাদের অর্থনীতিতেও একটি প্রভাবশালী অবস্থান দখল করে নিয়েছিলো। সুতরাং সেই সময় থেকে সিন্ধি, পাঠান এবং বেলুচীস্তানীদের স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের প্রধান স্লোগান হয়েছিলো একক প্রদেশ বাতিলকরণের দাবি ।
সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপ
একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা জরুরী, ১৯৬৬ সালে তৎকালীন সংবিধান সভার মাধ্যমে সমতার ভিত্তিতে একটি সংবিধান গঠন করা হয়েছিলো দেশের জন্য, যারা ১৯৫৫ সালে পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলো। প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী দ্বারা গঠিত ঐ সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো এবং বিভিন্ন জাতির স্বায়ত্তশাসনের জন্য জায়গা ছিলো না। রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন বিশেষ ক্ষমতায় ভূষিত করা হয়েছিলো। এটার একমাত্র ক্ষতিপূরণমূলক বৈশিষ্ট্য ছিলো যে, এটা সংসদীয় শাসনের যোগান দিয়েছিলো এবং উর্দুর সাথে বাঙলা ভাষাকেও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলো, একমাত্র এই কারণে যে এগুলোই ছিলো সবচেয়ে সনির্বন্ধ এবং জনপ্রিয় দাবি।
ঐ সংবিধানের গঠনের পর আরেকটি জনপ্রিয় দাবি উঠেছিলো যে নতুন সংবিধানের ভিত্তিতে দ্রুত একটি সাধারণ নির্বাচন হোক। এই দাবিটি খুবই জোরালো হয়ে উঠেছিলো। শাসক শ্রেণীর মধ্যে পক্ষ প্রতিপক্ষও ছিলো।
এই অবস্থায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীবর্গ ঘোষণা করেন যে ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের সাথে সাধারণ নির্বাচনের এই ঘোষণা প্রভাবশালী এক শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন কুখ্যাত ইস্কান্দার মির্জা, একজন প্রাক্তন সেনাবাহিনী নেতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী সঙ্ঘেও ভীতির সঞ্চার করেছিলো। তারপর এটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যবাদীদের পরোক্ষ সম্মতি এবং সুস্পষ্ট সমর্থন যে নির্বাচিন এগিয়ে নিতে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করতে শাসক গোষ্ঠী ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে শক্তহাতে সামরিক আইন দমন করেছিলো। তখন আইয়ুব খান যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদীদের স্পষ্ট সমর্থনে ক্ষমতায় আসে।গণতন্ত্রকে দমন করতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদীদের এটা ছিলো দ্বিতীয় নগ্ন হস্তক্ষেপ। প্রথমটি ছিলো ১৯৫৪ সালে যখন ইউনাইটেড ফ্রন্ট মিনিস্ট্রি জনগণের ভোটে ক্ষমতা পেয়েছিলো, তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদীরা সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর পশ্চাতে ছিলো, তাদের আহবানে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে দমন করতে।
পুনরুজ্জীবিত জনপ্রিয় সংগ্রাম
এটা ছিলো আইয়ুব খানের স্বৈর শাসনামল দশক যখন গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে দমন, গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে পদদলন এবং বাঙালিদের জাতীয় অধিকার এবং অন্য জাতিগুলোর অধিকার ভয়াবহ অনুপাত ধারণ করে। শাসক শ্রেণীর গঠিত ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করা হয়েছিলো। সাম্যবাদীরা কঠোরভাবে নির্যাতিত হয় এবং কোন গণতন্ত্রবাদী স্বায়ত্তশাসন কিংবা গণতন্ত্রের জন্য আওয়াজ তুললে তাকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছিলো, গণতন্ত্রের সকল সাক্ষ্য প্রমাণ মুছে দেওয়া হচ্ছিলো এবং শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ যারা তাদের কোন অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে খুঁজে পাওয়া গেলে সিংহবৎ নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করা হতো। হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ক্ষেপিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো এবং জনগণকে তছনছ করতে সংগঠিত হয়েছিলো।
কিন্তু আইয়ুব শাসনামলের নিপীড়ন ও দমননীতি অবিসন্বাদিত যায়নি। ১৯৬১ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং পাঠানভূমি ও বেলুচিস্তানের জনগণ তাদের স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে অনেক গৌরবময় যুদ্ধ করেছিলো। ১৯৬১ সালে পাঠানদের বীরোচিত সংগ্রাম, ১৯৬১-৬২ সালে বেলুচিস্তানের আমৃত্যু সংগ্রাম, এবং ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণদের গৌরবময় সংগ্রামের কথা এই সূত্রে উল্লেখ করা যায়।
১৯৬৫ সালে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়, প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী সাময়িকভাবে উৎকট ভারত-বিদ্বেষী অপপ্রচারের মাধ্যমে দ্বিধান্বিত করতে পেরেছিলো। কিন্তু যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির এক সক্রিয় আন্দোলন সংঘটিত হয় (জুন ১৯৬৬)। আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি ছিলো মূলত সংসদীয় গণতন্ত্র এবং পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের এক কর্মসূচি। স্বায়ত্তশাসনের সাপেক্ষে ছয় দফা কর্মসূচি দাবি করেছিলো যে প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক বিষয়াবলী (বৈদেশিক বাণিজ্য ছাড়া) কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত হবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যসহ অন্য সকল বিষয় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে। মুদ্রা বিনিময় প্রসঙ্গে, ছয় দফা কর্মসূচি দুইটি বিকল্প রেখেছিলো। বলা হয়েছিলো, হয়তো পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি আলাদা কিন্তু সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একটি মুদ্রা থাকবে এই শর্তে যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পক্ষীয়দের মূলধন যুদ্ধ বন্ধে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
সুতরাং আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিস্তর স্বাশাসনিক ক্ষমতার দাবি করেছিলো এবং কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপ ছিলো না, যেমনটা কিছু স্বার্থসম্পন্ন লোকেরা ইঙ্গিত দিয়েছিলো।
আওয়ামী লীগের এই ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলো এবং এর ভিত্তিতে (১৯৬৬) আওয়ামী লীগের শুরু করা আন্দোলন ছিলো শক্তিশালী একটি, যেটি কমিউনিস্ট এবং মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে থাকা তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বামপন্থী শাখারও সমর্থন পেয়েছিলো। আইয়ুব সরকার ঐ আন্দোলন হিংস্রতার সাথে দমন করেছিলো।
কিন্তু ১৯৬৮-৬৯ সালে আবারো আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে এক বিশাল জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থান হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনে এক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলো, বিশেষত সকল রাজনৈতিক এবং বিরোধী শক্তিগুলোকে গঠন করে একটি সম্মিলিত জোট তৈরি করতে। পূর্ব পাকিস্তানে, এই জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থান ছাত্র কর্ম পরিষদ (সকল প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত) দ্বারা পরিচালিত এগারো দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে তরান্বিত হচ্ছিলো এবং আওয়ামী লীগ ও ওয়ালী এবং মুজাফফরের নেতৃত্বে থাকা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে সমর্থিত হচ্ছিলো। এগারো দফা দাবিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবির পাশাপাশি ছিলো নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বৈদেশিক নীতি, সামরিক চুক্তি বাতিলকরণ, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স এবং বড় শিল্পগুলোর জাতীয়করণ, শ্রমিকদের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরি, কর ও শুল্ক হ্রাসকরণ, শিক্ষাবিষয়ক পুনর্গঠন, পূর্ণ নাগরিক স্বাধীনতা ইত্যাদি (আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচি)।
পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকারীসহ সকল বিরোধী শক্তিগুলো সংসদীয় গণতন্ত্র ও পূর্ণ বয়স্ক ভোটাধিকারের দাবিতে সম্মিলিত হয়েছিলো। পাঠানভূমি, বেলুচিস্তান এবং সিন্ধের জনগণ সংসদীয় গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসনের আশায় এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো, বিশেষত একক প্রদেশ ভাঙনের জন্য।
এটা ছিলো পাকিস্তান জুড়ে ঐ জনপ্রিয় গণুভ্যুত্থান, যার প্রধান দাবি ছিলো গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন, যা আইয়ুব খানের স্বৈর শাসনের পতন ঘটিয়েছিলো।
ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা বাতিল
কিন্তু আইয়ুব খান, তিনি পদত্যাগ করার আগে, প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং ১৯৬৯ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন আসে।
কিন্তু যদিও সামরিক শাসন ক্ষমতায় এসেছিলো এবং ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে একটি সামরিক আইন ছিলো, এটা ছিলো বিশাল জনসমর্থিত গণঅভ্যুত্থানের চাপ যা ইয়াহিয়া খানকে পরবর্তী জনসমর্থিত সার্বজনীন প্রত্যক্ষ নির্বাচনের এবং পূর্ণ বয়স্ক ভোটাধিকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছিলো। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় সভায় ১৯৫৫ সালে প্রবর্তিত “সাম্য” ও বিবৃতি বাতিলকরণ, নির্বাচিত জাতীয় সভার মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান গঠন, পশ্চিম পাকিস্তানে একক প্রদেশ বাতিলকরণ এবং সাবেক প্রদেশগুলোর পুনরুদ্ধার, সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ইত্যাদি বিষয়গুলোও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান।
কিন্তু ইয়াহিয়া খান একটি আইনী কাঠামো আদেশ (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) ঘোষণা করেন যেখানে শর্ত আরোপ করা হয় যে নির্বাচিত জাতীয় সভার মাধ্যমে গঠিত নতুন সংবিধান রাষ্ট্রপতির (ইয়াহিয়া খান) দ্বারা প্রমাণীকৃত হতে হবে, এবং অবশ্যই একটি ইসলামি সংবিধান হতে হবে।
এই LFO প্রমাণ করেছিল যে, যদিও ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদির চাপে নির্বাচন মেনে নিতে বাধ্য হয়, কিন্তু পূর্ণ সংসদীয় গণতন্ত্র ও পূর্ণ জাতীগত স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করার মতো মেজাজে তারা ছিল না। বরং এই আদেশের মাধ্যমে ওরা নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্ব খর্ব করেছিল, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় ভিত্তি নিশ্চিত করেছিল এবং গণতন্ত্র ও বিভিন্ন জাতীসত্তার স্বায়ত্তশাসনের অধিকার সঙ্কুচিত করতে চেয়েছিল।
আমাদের পার্টিও সামরিক জান্তার এই ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে গেছে, LFO এর সমালোচনা করেছে এবং এর সংশোধন ও নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্ব দাবি করেছে। ওয়ালি ও মুজাফফরের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও তাই করেছে, কিন্তু LFO সংশোধিত হয়নি।
সাধারণ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের বিজয়
তবে পাকিস্তানে বিগত ২৩ বছরের মধ্যে এই ধরণের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৬৭টি ও প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ টির মধ্যে ২৯০টি আসন সুরক্ষিত করে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভ করে। পুর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ অল পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা – সর্বমোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে।
নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের প্রধান ভিত্তি ছিল তার নিজস্ব ছয় দফা দাবী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবী। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধানত জোর দিয়েছিল নিজেদের ছয় দফা দাবীর উপর যা পূর্ব পাকিস্তানে জনসাধারণের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল ও জনগণ ধৃঢ়ভাবে এর জন্য ভোটও দিয়েছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি চিৎকার শুরু করে যে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সুনিশ্চিতভাবে বারবার ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ও তার দল কখনও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা চাননা কিন্তু বাঙ্গালীর উপর শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য চান দেশের ভবিষ্যত সংবিধান যেন তার দলের ছয় দফা দাবীর উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এ উচ্চাশা করেছিল যে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ শীঘ্রই তার অধিবেশন শুরু করবে, ছয় দফা দাবীর উপর ভিত্তি করে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হবে ও বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত জনতা, বিশেষত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরাও আশা করেছিল যে অতীতের অত্যাচারের দিন বুঝি এবার শেষ হবে ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। বস্তুত পাকিস্তানের সকলেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল গণতন্ত্রের মাধ্যমে একটি পরিবর্তনের।
প্রগতিবিরোধীদের ষড়যন্ত্র
কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ক্ষমতাসিন সামরিক জান্তা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ঘাবরে দিয়েছিল। তারা জনতার রায় ও তাদের আশা আকাঙ্খা খর্ব করার ষড়যন্ত্রে করতে লিপ্ত হয়। পিপল’স পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ চক্রান্তের রাজনৈতিক অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করেন। ভুট্টোর সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও তার ভারতবিরোধী বজ্রধ্বনির মাধ্যমে পিপল’স পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল এসেম্বলিতে সিংহভাগ আসন (১৪৪টার মধ্যে ৮৪টি আসন) নিশ্চিত করেন।
ভুট্টোর পিপল’স পার্টি এ ৮৪টি আসন শুধু পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে লাভ করে কিন্তু সীমান্তবর্তী অঞ্চল (পাঠানল্যান্ড ও বেলুচিস্তান) থেকে একটি আসনও জয় করতে ব্যর্থ হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী ও মুজাফফরের নেতৃত্বে) বেলুচিস্তান অঞ্চলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরা জাতীয় পরিষদে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ৩টি আসন লাভ করে ও প্রাদেশিক পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়।
সুতরাং প্রকৃতপক্ষে ভুট্টো পুরো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেননি কিন্তু সেরকমভাবেই নিজেকে জাহির করেন ও জাতীয় পরিষদের অধিবেষণকে নষ্ট করার জন্য তিনি এই শ্লোগান প্রস্তাব করেন যে “পাকিস্তানের ভবিষ্যত সংবিধানের প্রশ্নে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও পিপল’স পার্টির মধ্যে কোন ধরনের চুক্তির পূর্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়া যাবে না।”
ভুট্টো ও পিপল’স পার্টির কিছু নেতা “সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা করতে” ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সাক্ষাত করেন, আসলে শুধু এটা জাহির করতে যে তারাও “একটি চুক্তি”তে পৌঁছাতে চায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভুট্টো ও তার পার্টি ছয় দফা দাবী ও জাতীগত স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী ছিল। তারা ছয় দফা দাবী বর্জন করার জন্য আওয়ামী লীগকে চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ জনগণকে দেয়া তাদের প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সুতরাং ভুট্টোর খেলা ব্যর্থ হয়ে গেছিল।
প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্র এরপর থেকে পুরোদমে চলছিল। কমিউনিস্ট পার্টি বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল ও জনতাকে এর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিল।
এদিকে ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহবান করেন।
অবিলম্বে ভুট্টো ঘোষণা দেয় যে সে ও তার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেবে না এবং যদি অধিবেশন ঐ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় তবে “পুরো পশ্চিম পাকিস্তানে আগুন জ্বলবে”।
ভুট্টো, যার দলের জাতীয় পরিষদে আসন মাত্র ৮৪টি তার হুমকিতে ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ অনিবার্য কারণবশত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে রেডিওতে একটি বিবৃতি জারি করেন। তিনি সাংবিধানিক বিষয় আলোচনা করার জন্য ১০মার্চ ঢাকায় সকল পার্টির নেতাদের নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা ও গোলটেবিল বৈঠক আহবানের আগে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাথে ইয়াহিয়া খান আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।
সবকিছুর মাধ্যমে এটাই স্পষ্ট হচ্ছিল যে ইয়াহিয়া খান সততা বা গণতন্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী নয় বরং সামরিক শাসন অব্যাহত রাখার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র অনুসারে কাজ করছিলেন।
নব গণজাগরণ
জাতীয় সংসদ অধীবেশনের আকস্মিক স্থগিতাদেশে সকল শ্রেণীর জনগণের উপর রূঢ় আঘাত নেমে এসেছে।জাতীয় সংসদ অধীবেশন স্থগিত করে আরটিসি (RTC)ডাকা উক্ত আঘাতের সাথে অপমান যুক্ত করার নামান্তর। সুতরাং তা তাৎক্ষণিকভাবেই আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ ও আন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি কর্তৃক প্রত্যাখিত হয়েছিল। এমন কি ডানপন্থী পাকিস্তান ড্যামোক্রেটিক পার্টির নেতা নুরুল আমিনও এতে যোগদান করতে অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে জনসাধারণ যখনই রেডিও তে জাতীয় সংসদ অধীবেশনের স্থগিতাদেশ শুনতে পেল, তখনই তারা হাজারে হাজারে স্বতস্ফুর্তভাবে “আমরা স্বাধীন পূ্র্ব বাংলা চাই” শ্লোগান দিতে দিতে পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো শহর ও শহরতলীর রাস্তায় নেমে আসে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বিশেষ করে ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে (১৯৬৬ ও ১৯৬৯) তাদের দূর্ভোগের পর অব্যাহত জাতীগত অবদমন ও গণতন্ত্রের নিশ্পেষনের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অদ্ভুত ভৌগলীক অবস্থান ইতোমধ্যেই জণসাধারণের এক অংশের মধ্যে “স্বাধীন পূর্ব বঙ্গ” এর মানসিকতা গড়ে তুলেছিল। তারপরও তারা আশা করছিল যে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করেও হয়ত গণতন্ত্র ও শায়ত্ত্বশাসণের প্রতি তাদের যে আকাঙ্খা তা বাস্তবায়ণ করা সম্ভব হবে।
অবশেষে তারা তাদের সমস্ত আকাঙ্খা নির্বাচনকে ঘিরে পুঞ্জিভূত করে ও আশা করে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তবে তারা হয়ত সুদিন দেখতে পাবে। এখন তারা এমন কি এও দেখতে পেল যে জনসাধারণ নির্বাচণে যে রায় দিয়েছিল তা রদ করতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের অধীবেশনেও আঘাত হানা হলো। সুতরাং তারা বুঝে গেল যে, পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থাকা অবস্থায় গণতন্ত্র কিংবা শায়ত্ত্বশাসনের কোন সুযোগ নেই। ফলশ্রুতিতে একটি “স্বাধীন পূর্ব বাংলা”র শ্লোগান স্বতঃস্ফুর্তভাবে বেরিয়ে আসে যা তাদের দৃঢ় আত্ম সংকল্পের বহিঃপ্রকাশ বটে।
জাতীয় সংসদ অধীবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ০২ হতে ০৬ মার্চ পর্যন্ত পাঁচদিনের দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের ডাক দিলে এই স্বতস্ফুর্ত জাগরণ সাংগঠনিক বিস্তৃতি লাভ করে গণ সংগ্রামে পরিণত হয়। ধর্মঘটের এই ডাক কমিউনিস্ট, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি সমর্থন জানায়। আরও জানানো হয়েছিল যে ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এক গণ-র্যালীতে কর্ম পরিকল্পণা প্রদান করবেন।
শাসক সামরিক জান্তা, অন্যদিকে, এই স্বতস্ফুর্ত ও জনপ্রিয় গণজাগরণকে মেশীনগান ও বুলেটের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। তারা ২রা মার্চ সন্ধ্যা হতে ১২ ঘন্টার কার্ফ্যু জারী করে ঢাকা শহরকে অকার্যকর করতে সমর্থ হয়েছিল। যখন তারা (জনগণ) কার্ফ্যু অমান্য করে শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে, তখন তাদের উপর মেশিনগান চালানো হয় যার ফলে অসংখ্ং প্রাণ ঝরে যায়। এভাবে ২রা মার্চেই নীরিহ ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করা শুরু হয়ে যায়। এধরণের হত্যা ছাড়াও সামরিক জান্তা বাঙ্গালী ও নন-বাঙ্গালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়ার প্ররোচণা দিতে থাকে এবং এরকম কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চট্টগ্রামে ও রংপুরে রদ করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট, ন্যাশনাল আওয়ামী গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ যার ফলে দাঙ্গা থিতু হয়ে থেমে যায়। এই দলগুলো ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ সর্বদাই জনসাধারণের মধ্যে পরম শান্তি রক্ষার চেষ্টা করে গেছে।
০২ মার্চের নিরস্ত্র মানবহত্যা প্রভৃতি কোনভাবই জনসাধারণকে নীতিভ্রষ্ট করতে পারেনি। ০২ মার্চের ধর্মঘট সম্পুর্ণ সফল হয়। সকল শ্রেণীর জনগণ এমনকি পুলিশ ও সরকারী কর্মকর্তাগণও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি, ০২রা মার্চ এর ধর্মঘটের পর থেকে বাংলাদেশের দেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে সর্বত্র হাজার হাজার মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে মিছিলে অংশগ্রহণ করছিল। বাংলাদেশের সমস্ত জনগণ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব একতা দেখিয়েছে।
ইয়াহিয়া খানের হুমকী
শান্তিপূর্ণভাবে যখন ধর্মঘট চলছিল, তখন ০৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান একটি প্রচারণা চালায়। উক্ত প্রচারণায় ২৫শে মার্চের জাতীয় সংসদ অধীবেশনের বিরোধীতা করেন। একই সাথে তিনি ০২ রা মার্চের দুর্ঘটনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও নেতাদের দায়ী করার পাশাপাশী ভুট্টোকে, যে কিনা সমস্ত বিপর্যয়কে ঘণীভূত করেছিল, সম্পূর্ণ নির্দোশ ঘোষণা করে। তিনি “পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা সুরক্ষায়” সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি্ প্রদান করেন। এই হুমকীর সাথে সাথে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসণে পরিবর্তন আনেন এবং নির্মমতার জন্য কুখ্যাত লেঃ জেঃ টিক্কা খান’কে গভর্ণর ও প্রধান সামরিক প্রশাসণিক কর্মকর্তা (CMLA) হিসেবে ঢাকার প্রেরণ করা হয়।
উপরের জিনিসগুলোই দেখীয়ে দেয় যে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই জনসাধারণের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালানোর প্রকৃত প্রস্ততি শুরু করে। “ক্ষমতা হস্তান্তর” এর জন্য তাদের বৈঠক ছিল কেবলই প্রতারণা মাত্র।
মুজিবের চার দফা ও অসহযোগ আন্দোলন
৭ই মার্চ, শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণ দেন, যেখানে আওয়ামী লীগ প্রধান’কে উৎসাহ প্রদানের জন্য প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ উপস্থিত ছিল। জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল যে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু তাঁর ভাষণে শেখ মুজিব তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেনঃ
i) ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চণার সমাপ্তির লক্ষ্যে তিনি জন সাধারণ’কে তাঁদের অকুতোভয় সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেন।
ii) তিনি চারটি দাবী তুলে ধরেন-এগুলো হচ্ছে: ক) নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর; খ) সামরিক আইন/ মার্শাল ল তুলে নেয়া; গ) সেনা বাহিণীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া; এবং ঘ) ১লা মার্চ হতে সংঘটিত গণ হত্যার তদন্ত।
তিনি আরও বলেন যে এই চারটি দাবী মেনে নেয়া হলে তিনি ও তাঁর দল ২৫শে মার্চের জাতীয় সংসদের অধীবেশনে অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচণা করবেন।
iii) তিনি উপরের দাবীগুলো মেনে না নেয়া পর্যন্ত ৮ই মার্চ হতে সরকার ও সামরিক বাহিণীর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন।
উপরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছাড়াও তিনি এই বলে সতর্ক করেন যে প্রতিক্রিয়াশীলরা ষড়যন্ত্র করছে এবং যদি সেনা বাহিণী পুনরায় এছাড়াও জনসাধারণের উপর আক্রমণ চালায়, তবে যাঁর কাছে যা কিছু আছে তা নিয়েই রুখে দাঁড়াতে হবে।
শেখ মুজিবের বক্তব্য সাধারণভাবেই প্রসংশিত হয়েছিল, যে চারটি দাবী তিনি উত্থাপন করেন তাও কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ সকল গণতান্ত্রিক শক্তি কর্তৃক সমর্থিত হয়েছিল।
উপরের চারটি দাবীর সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে কমিউনিস্ট পার্টিও তাঁদের খোলামেলা বক্তব্য একটি লিফলেট আকারে প্রচার করে এবং একই সাথে জন সাধারণকে সকল ষড়যন্ত্র ও প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে ও যদি তারা কোন রকম আক্রমণ চালায় তা প্রতিহত করতে জন সাধারণকে জানিয়ে দেয়।
৮ই মার্চ হতে আওয়ামী লীগের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনও পূর্ণ সফল হয়েছিল। পুলিশ বিভাগসহ, পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসণ আওয়ামী লীগের নির্দেশণা মেনে চলছিল। বস্তবিক অর্থে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসণ আওয়ামী লীগই পরিচালনা করছিল। জন সাধারণেরও আওয়ামী লীগের উপর নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল ও তাঁরা আশা করছিল যে আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করা উচিৎ।
বিশ্বাস ঘাতকতার আক্রমণ
শান্তিপূর্ণ ও অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় শেখ মুজিবের সাথে বৈঠকের জন্য ইয়াহিয়া খান শীঘ্রই ঢাকা যাবেন বলে কেন্দ্রীয় সরকার হতে ঘোষণা করা হয়। যদি তিনি আসেন তবে যে কোন রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎ ও আলোচনার জন্য তাঁর প্রস্তুতির কথা শেখ মুজিব তাৎক্ষণিকভাবেই ঘোষণা করেন।
ইয়াহিয়া খান ১৪ই মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন এবং ঐদিন থেকেই মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। চার বা পাঁচদিন পর শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান উভয়েই জনসম্মুখে জানান যে আলোচনা “কিছু অগ্রগতি” হয়েছে। ইয়াহিয়া খান জনসম্মুখে আরও জানান যে আওয়ামী লীগ প্রধানের উত্থাপিৎ দাবীসমূহ তিনি “নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছেন”। ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবর রহমানের পরামর্শকদের মধ্যেও বিস্তারিত আলোচনা চলছিল। সুতরাং জন সাধারণও আশা করছিল যে শীঘ্রই একটি রাজনৈতিক সমাধান আসবে ও সঙ্কটের অবসান ঘটবে।
কিন্তু জন সাধারণের বিশ্বাসকে ধোকা দেয়া হয়েছিল। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক/ আলোচনা শেষ হওয়ার পূর্বেই ২৫শে মার্চ মধ্যরাত হতে সামরিক জান্তার নির্দেশে সেনা বাহিণী আকস্মিকভাবে ও বিশ্বাসঘাতকতার সাথে বাংলাদেশের জন সাধারণের উপর হিংস্র সশস্ত্র আক্রমণ চালায়।
শুরু হলো স্বাধীনতার সংগ্রাম
এই অবস্থায় নিজেদের গণতান্ত্রিক ও জাতীয় অধিকার রক্ষায় হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রতিরোধ করা ব্যতীত বাংলাদেশের জন সাধারণের আর কোন বিকল্প ছিল না। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এবং পুলিশ জন সাধারণের সাথে যোগ দেয়, মুক্তি ফৌজ/ বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় অধিকার রক্ষার জন্য মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য সুসজ্জিত পাক সেনা বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা ছাড়া জন সাধারণের আর কোন বিকল্প ছিল না। জন সাধারণের জন্য দ্বিতীয় কোন বিকল্প পথ খোলাও রাখা হয়নি।
এটা এমন ছিল যে গণতন্ত্র ও শায়ত্ব শাসণের জন্য বাংলাদেশের জন সাধারণের সংগ্রাম পরবর্তীতে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার স্বশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়।
আওয়ামী লীগকেও, যারা কিনা বিগত নির্বাচনে জন সাধারণের নিরঙ্কুশ সমর্থণ পেয়েছিল, এই প্রজাতন্ত্রের একটি নতুন সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে স্বাধীনতার সংগ্রাম এই অবস্থায় চালিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়েছিল।
বৃহৎ শক্তির ভুমিকা
এখানে স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন সরকারের মনোভাব সম্পর্কে বলা আছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ইউএসএসআর স্পষ্টত বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করে এবং আরও বলেন বাংলাদেশের সমস্যা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিৎ যা অস্ত্র দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। এটি ইউএসএসআর এর চিঠি যা ইয়াহিয়া খানের প্রতি কমরেড প্রডগরনিযের, যা বাংলাদেশের জনগণ সহ আমাদের পার্টি দ্বারাও প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশের জনগণ ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণসহ কম্যুনিস্টদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যার প্রশংসা করে এবং কম্যুনিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এটাও দেখেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীতা এবং রিপাবলিক অব চায়নার মাওবাদী নেতারা পাকিস্তানের প্রগতিবিরোধী শোষণকে সমর্থন করছে, এই দুই সরকার বস্তুত বাংলাদেশের গণহত্যাকে উপেক্ষা করছিল। এবং ইউএস এর এর সাম্রাজ্যবাদীদের আচরন ছিল সন্দেহজনক।
একটি সংগ্রাম
প্রকৃত ঘটনাগুলো থেকে নিচের বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলঃ
(১) বাংলাদেশের সাম্যবাদের সংগ্রাম তখন তুঙ্গে এবং প্রগতিবিরোধীদের শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সাল থেকে করা স্বায়ত্তশাসন বহন করা যা গনতন্ত্র এবং বিভিন্ন জাতীয় অধিকার এর বিরুদ্ধে ছিল নির্মমভাবে ।
(২) বাংলাদেশের জনগণ কখনই পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা চাইতোনা। কিন্তু তারা সর্বদাই গনতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং ১৯৭০ এর হওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে গনতন্ত্রের এবন জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইতো। এমনকি নির্বাচনে সুদূরপ্রসারী জয় এবং জাতীয় সমাবেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, আওয়ামীলীগ এবং আওয়ামীলীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কখনই ছয় দফা দাবির উপর ভিত্তি করা সংবিধানের থেকে বেশি কিছু চাইতেন না। শেখ মুজিব বারবার সামরিক জান্তা শাসনসভার সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টাও করতেন।
(৩) কিন্ত ইতোপূর্বে হওয়া নির্বাচনে সামরিক জান্তার শাসকগ্ণ জনগনের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়, যার ফলে নিরীহ মানুষের উপর অবিশ্বাস্য হামলা আরম্ভ হয়।এমনকি সৈন্যবাহিনীর ও ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন উদ্দেশ্য ছিল না। ইয়াহিয়া-মুজিব কথোপকথন সৈন্যবাহিনীর আক্রমনএর প্রস্তুতির জন্য সময় লাভ করার ছল ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।
এর পর এটিই ছিল সৈন্যদের সেই আক্রমন যা সাম্যবাদী সংগ্রাম এবং স্বায়ত্তশাসন মাতৃভূমির জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের রুপ নেয়।
(৪) এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একচেটিয়া শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদীদের বিশেষ করে ইউএস এর সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ৭৫ লক্ষ বাঙ্গালীর মৌলিক সংকল্প।
(৫) কোনভাবেই এটি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। বরং বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রাম হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যা পশ্চিম পাকিস্তানে জুলুম নির্যাতনের শিকার মানুষের গণতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনেও ভূমিকা রাখবে।
(৬) স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে মুক্তিফৌজ (লিবারেশন আর্মি) এবং বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা। অতএব, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারের চালানো অপপ্রচার যেমন এটা “ভারতের উস্কানিতে চলা সংগ্রাম”, “ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধ” এবং “ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে” ইত্যাদি, গুজব ছাড়া কিছুই নয়। একইভাবে পিকিংপন্থী কিছু গ্রুপ অপপ্রচার চালাচ্ছে যে এই মুক্তি সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে হচ্ছে যা একটি জঘন্য মিথ্যা।
উপরিউক্ত সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে বিশ্বের সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ নিশ্চিত হতে পারে যে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য চলমান মুক্তি সংগ্রাম হচ্ছে সেইসব দেশী এবং বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যারা মানবতা এবং শান্তির শত্রু।
বাংলাদেশে এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর পরাজয় দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র এবং শান্তির পক্ষে কাজ করা মানুষের শক্তি বৃদ্ধি করবে।
আপীল
অতএব পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বের সকল ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট এবং ওয়ার্কার্স পার্টি এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে নিম্নলিখিত ঐকান্তিক দাবী পেশ করছেঃ-
ক) পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগীতা প্রদান করুন যেন এই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়লাভ করা যায় এবং দেশি ও বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজিত ও মূলোৎপাটন করা যায়।
খ) জোরালো আওয়াজ তুলুন যেন বিশ্বের সকল সরকার, বিশেষ করে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলো বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগ্রাসন মোকাবেলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়।
পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি সবসময়ই বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অপরিহার্য অংশ থেকেছে এবং ১৯৬৯ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব কমিউনিস্ট সম্মেলনে জারিকৃত নথিতে স্বাক্ষর প্রদান করেছে। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি আশা করছে যে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষার এই মুক্তি সংগ্রামে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং বিশ্বের অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম দলগুলো সহযোগিতা করবে। এটি একটি আপাদমস্তক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত নির্মম ও বর্বর সাম্রাজ্যবাদী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই যা চীনা মাওবাদীদের সমর্থন পাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের এই সংগ্রামটি নিঃসন্দেহে একটি ভয়ানক সংগ্রাম। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জনে বিশ্বের সকল প্রগতিশীল এবং কমিউনিস্ট শক্তির সমর্থন এবং সহযোগিতা একান্ত জরুরী।
আমরা এই সহযোগিতার দিকে চেয়ে আছি এবং তা আসবে বলেই আশা করছি।
বিপ্লবী শুভেচ্ছান্তে,
বাংলাদেশ
৩রা মে, ১৯৭১
আবদুস সালাম
সেক্রেটারি, কেন্দ্রীয় কমিটি
পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টি।
<৪,২০৪,৪৪২-৪৪৫>
অনুবাদকঃ জিহাদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৪। পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি মওলানা ভাসানীর আবেদন মওলানা ভাসানীর প্রচারপত্র ৫ মে, ১৯৭১
পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি মওলানা ভাসানীর আবেদন-
দালাল, বিশ্বাঘাতক ও মোনাফেক হইতে সাবধান হউন
গত ২৩ বৎসর যাবত পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকদিগের নির্মম শোষণ ও শাসনে পূর্ববাংলা আজ কঙ্কালসার হইয়া পড়িয়াছে। দীর্ঘকাল নিরবিচ্ছিন্ন এই ধরনের হৃদয়হীন শোষণ, অবিচার ও অন্যাচার কি করিয়া সম্ভব হইল? স্থানীয় পুঁজিদার ও সাহায্যকারী সাঙ্গাৎ না থাকিলে বাহিরের ডাকাত আসিয়া অজানাভাবে এমন নিপুণতার সহিত লুণ্ঠন করিতে পারে না। পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্তবাদী প্রভু, পুঁজিপতি, স্বেচ্ছাচারী সামরিক দানব ও ষড়যন্ত্রকারী আমলাগণ পূর্ব পাকিস্তানে তাহাদের জঘন্য শোষণের উচ্ছিষ্টভোগী একশ্রেণীর বিশ্বাসঘাতক ও দালাল সৃষ্টি করিয়া পাকিস্তানের জনসংখ্যার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীদিগের সর্বপ্রকার ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে এবং তাহাদের উলঙ্গ শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। মুসলীগ লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী দলগুলির পূর্ব পাকিস্তানী দালালেরা ধর্ম, সংহতি, ইসলাম বিপন্ন, কাশ্মীর গেল ইত্যাদির বাহানায় তাহাদের পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুদিগের সহিত এক শ্লোগান তুলিয়া বাংলার বুকের উপর বসিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকদিগকে বাংলার বুকের রক্ত শুষিয়া লইতে সুযোগ করিয়া দিয়াছে এবং নিজেরাও কথাকিঞ্চিৎ উচ্ছিষ্ট পাইয়াছে। ১৯৫১, ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালে পূর্ববাংলার সংগ্রামী জনসাধারণ এই দালালদিগকে বার বার উচ্ছেদ করিয়া দিলেও সমূলে বিনাশ করিতে পারে নাই। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দালালরা সুচতুর চাতুরি দ্বারা বার বার পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সর্বনাশ করিতে সফল হইয়াছে। এই সকল দালালরা পূর্ববাংলার জনতার রুদ্ররোষে জনতার হাতে মার খাইয়া আত্মগোপন করিয়াছে বা ভেক পাল্টাইয়াছে। সুযোগ বুঝিয়া বর্ণচোরারা স্বরূপ ধারণ করিয়াছে। বর্তমান পূর্ব বাংলার টেক্কা-এহিয়ার নরপশু সৈনিকদিগের ছত্রচ্ছায়ায় এই দালালেরা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া বিভিন্ন টালবাহানায় পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের স্থায়ী শোষণদাসে পরিণত করিতে সুচতুর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছে। অথচ আপনারা অবগত আছেন এই মির্জাফরেরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর গণ ও অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে নিজেদের চামড়া বাঁচাইবার জন্য পূর্ব বাংলার এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি জোর গলায় সমর্থন জানাইয়াছিল। এখন যখন টেক্ক-এহিয়ার অভিশপ্ত দানবদিগের হাত পূর্ব বাংলার নারী শিশু বৃদ্ধ অসহায় নিরপরাধ মানুষের ঘর-বাড়ি-স্কুল-কলেজ জ্বালাইয়া দিতেছে, এমন কি মসজিদ-মন্দির কুলষিত করিতেছে, নারীদিগকে ধর্ষণ ও তৎপর খুন করিতেছে তখন এই সকল মুখচেনা দালালেরা ধর্ম, ইসলাম, সংহতি ও ভারত বিরোধী প্রচারণা দ্বারা সংগ্রামকে বানচাল করিয়া দিতেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী নরপিশাচদিগের তবেদার বানিয়া তাহাদিগকে মদদ যোগাইয়া বাঙ্গালীদিগের স্থায়ী সর্বনাশ সাধন করিতেছে।
১৯৬৭ সালে আরব-ইহুদী যুদ্ধের পর ইহুদীরা দখলকৃত আরব এলাকা হইতে আরবী মুসলমানদিগকে জর্ডানে পাঠাইয়া দিয়াছে, জানে মারে নাই। ইহুদীদিগের নিকট মুসলমানদিগের জীবনের যেটুকু মূল্য আছে পাঞ্জাবী মুসলমানদের কাছে বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনের ততটুকু মূল্যও নাই। পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ব্যাপক গণহত্যা তাহা প্রমাণ করিয়াছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান নামধারী এহিয়া-টেক্কার সৈনিকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলের অসংখ্য মুসলমান ছাত্রীদিগকে উলঙ্গ করিয়া তাহাদিগের সতীত্ব নাশ করিয়াছে এবং পরে গুলি করিয়া ও বেয়নেট দিয়া খোঁচাইয়া নির্মমভাবে হত্যা করিয়াছে। এইরূপ নারীধর্ষণ ও হত্যা পূর্ব বাংলার প্রায় প্রতিটি শহর বন্দর ও গ্রামে অনুষ্ঠিত হইয়াছে।
মুসলমান নামধারী এহিয়া-টেক্কার সৈনিকেরা মসজিদে নামাজরত মুসলিমদিগকে হত্যা করিয়াছে ও মসজিদ জ্বালাইয়া দিয়াছে।
মুসলমান নামধারী এহিয়া-টেক্কার সৈনিকেরা লাখ লাখ নিরপরাধ মুসলমান শিশু, বৃদ্ধ ও যুবককে পাইকারীভাবে হত্যা করিতে সামান্যতম কুন্ঠাও বোধ করে নাই।
প্রবল ঘূর্ণিবাত্যায় পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন মারা গিয়াছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের কোন মানুষই কোন প্রকার সাহায্য কিম্বা দুর্গত এলাকা সফর তো দুরের কথা সামান্যতম সহানুভূতিও জানায় নাই। এহিয়া খানের মুসলমানী শাসনে ঘূর্ণিবাত্যায় নিহত ৩ লক্ষ মুসলমানের যথাবিহীত দাফন-কাফন ও কবর দেওয়ার কোন ব্যবস্থা হয় নাই।
এহিয়া-টেক্কার বর্বর সৈনিকেরা পূর্ব বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মুসলমানদিগকে নির্বিচারে হত্যা করিতেছে তাহাদিগকে যথাবিহীত দাফন-কাফন-জানাজা ও কবর দিবার ব্যবস্থা করিতেছে না। এই সকল নরপশুরা যাহাদিগকে হত্যা করিতেছে তাহাদিগকে দিয়া পূর্বে কবর খোঁড়াইয়া লইতেছে।
প্রতিটি মুসলমান জীবনে শেষে কামনা করে তাহার মৃত্যুর পর যেন ধর্মীয় বিধানুযায়ী তাহার সঠিক দাফন, কাফন, জানাজা ও কবর হয়। এহিয়া-টেক্কার বর্বর সৈনিকদিগের পৈশাচিক লীলায় লাখ লাখ মৃত মুসলমানের আত্মা সঠিকভাবে দাফন, কাফন, জানাজা ও কবর না পাইয়া আল্লার দরবারে ফরিয়াদ করিতেছে।
মুসলমান হইয়া পশ্চিম পাকিস্তানী ঐ সকল মুসলমানরা পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষক শ্রমিক মজুর ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষদিগের ধনসম্পদ, ধর্ম, সংহতি ও ইসলামের ছলনায় হরণ করিয়া লইয়া তাহাদিগকে হাড়ে মাংসে জরাজীর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। সোনার বাংলাকে চির দুর্ভিক্ষ-বন্যা-মহামারী দেশে পরিণত করিয়া ফেলিয়াছে।
মুসলমান হইয়া পূর্ব পাকিস্তান নামক দেশের এ অংশে তাহারা প্রয়োজনীয় কলকারখানা গড়ে নাই, কৃষির উন্নতি করে নাই, বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে নাই, পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নাই, চাকুরী ও ব্যবসাতে পূর্ব বাংলাকে দাবাইয়া রাখিয়াছে, মিলিটারীতে পূর্ব বাংলার লোক নেয় নাই প্রভৃতি বহুভাবে পূর্ব বাংলাকে ন্যায্য হিস্যা হইতে বঞ্চিত করিয়াছে।
অথচ পূর্ব বাংলার এই সকল বিশ্বাসঘাতক দালালেরা কোনদিনই তাহার সামান্যতম প্রতিবাদ করে নাই। বরং এই নির্মম শোষণ, অত্যাচার, অবিচার, ধ্বংস-লীলা, গণহত্যায় উহারা সক্রিয় অংশীদার হইয়াছে। আজ তাহারা সুযোগ বুঝিয়া আবার মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে। পূর্ব বাংলার ধ্বংস্পস্তুপের উপর দাঁড়াইয়া আবার নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া ২৩ বৎসরের সেই ঘূণেধরা ধসে পড়া শ্লোগান ধর্ম, সংহতি, ইসলাম ও ভারতীয় বিদ্বেষের নামে তাহাদের প্রভু পশ্চিম পাকিস্তানী দানবদিগকে নানাভাবে মদদ যোগাইতেছে। তাহারা পূর্ববাংলার সংগ্রামী জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া দিতে চেষ্টা করিতেছে। জনসাধারণের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াইতেছে। জনতার সুদৃঢ একতায় ফাটল ধরাইতে চেষ্টা করিতেছে। মুক্তি সংগ্রামীদিগকে ধরাইয়া দিতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য ও অবাঙ্গালীদিগের সাথে হাত মিলাইয়া বাঙ্গালী হইয়া বাঙ্গালীদিগের বাড়িঘরে লুটপাট ও আগুন জ্বালাইবার সহযোগিতা করিতেছে।
গত মহাযুদ্ধের পর আমি ইউরোপ ভ্রমণে গিয়া পৃথিবীর কুখ্যাত অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট হিটলারের শক্তিমত্তা ও তাহার অত্যাচারের বীভৎসতা দেখিয়া আঁতকিয়া উঠিয়াছি এবং ভাবিয়াছি এই সমরদানব হিটলার এত ব্যাপক সৈন্য-সামন্ত অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র লইয়া কি করিয়া পরাজিত হইল? পরে তদন্ত করিয়া দেখিয়াছি- হিটলারের চরম বর্বরোচিত অত্যাচারে কোনক্রমে না ঘাবড়াইয়া ইউরোপের প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষের প্রশংসনীয় অপরূপ মনোবলই হইতেছে হিটলার-মুসোলিনীর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের মূলমন্ত্র। পাকিস্তানের ক্ষুদ্র হিটলার-মুসোলিনী, এহিয়া-টেক্কার অত্যাচার-অবিচার-গণহত্যা হইতে বাঁচিবার আমাদিগের সর্বপ্রথম অস্ত্র হইতেছে সুদৃঢ় মনোবল। অত্যাচারী কোনদিনই স্থায়ী জয়লাভ করিতে পারে না।
পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে এই শিক্ষা দেয় যে সকল বর্বর অত্যাচারীই ধ্বংস হইয়াছে আদর্শে বলীয়ান সুদৃঢ় মনোবলের অধিকারী জনগণের বিরোধিতায়। ফেরাউন, এজিদ, হালাকু খাঁ, হিটলার-মুসোলিনীর মত অত্যাচারীর পতনই আমাদের সম্মুখে টিকাইয়া রাখিতে পারিলেই জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। দেশবাসী সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে আমার আবেদন- কোন অবস্থাতেই ঘাবড়াইবেন না, মনোবল হারাইবেন না। অটুট মনোবলই সব অস্ত্রের বড় অস্ত্র।
এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, ছাত্র, জনতা, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবি ও চাকুরীজীবিদিগের নিকট আমার আকুল আবেদন-
(১) আপনারা বিশ্বাসঘাতক এই সকল দালালদিগের কোন প্রচারণাতেই কান দিয়ে নিজেদের মনোবল ও একতা নষ্ট করিবেন না।
(২) পূর্ব বাংলার ৪ হাজার ইউনিয়নে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়িয়া তুলুন।
(৩) প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টার খুলুন। গেরিলা যুদ্ধের তালিম নিন।
(৪) মুক্তিফৌজদিগকে সর্বতোভাবে সাহায্য করুন।
(৫) জানমাল-ইজ্জত বাঁচাইবার জন্য যাহারা হিজরত করিতে বাধ্য হইতেছে দালালদের অত্যাচার হইতে তাহাদিগকে রক্ষা করুন।
(৬) চাউল ডাইল খড়ি নুন তৈল ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য অথবা রন্ধনকৃত খাদ্যদ্রব্য দিয়ে মুক্তিফৌজদিগকে সাহায্য করুন।
(৭) সকল শ্রেণীর যুবকেরা মুক্তিফৌজে যোগ দিন।
(৮) দালাল ও শত্রুর প্রতি কড়া নজর রাখুন।
(৯) দালালদিগকে সামাজিক বয়কট করুন এবং তাহাদিগের জন্য যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুন।
(১০) সমরদানব এহিয়া-টেক্কার নির্মম অত্যাচারে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাইয়াছে অথচ জীবনের অন্তিম বাসনা অনুযায়ী কাফন-দাফন, জানাজা ও কবরের মাটি পায় নাই সে সকল হতভাগ্য মানুষের এবং গত ঘূর্ণিবাত্যায় যে লক্ষ লক্ষ মানুষের জানাজা ও কবর হয় নাই গ্রামে গ্রামে ও শুক্রবারে সকল মসজিদে মসজিদে জমায়েত হইয়া তাহাদিগের আত্মার মাগফেরাত কামনায় গায়েবানা জানাজার নামাজ আদায় করুন।
(১১) গ্রামে গ্রামে আবালবৃদ্ধবণিতা শপথ গ্রহণ করুন- যত রক্ত দিতে হয় দিব কিন্তু শোষিত, নির্যাতিত, অবহেলিত পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করিয়া ছাড়ব।
(১২) দলমত ভুলিয়া গিয়া সর্বদলীয় ঐক্যমত গড়িয়া তুলুন।
প্রত্যেক দেশেই দেশের যুবকেরা দেশের মুক্তির জন্য জীবন-মান-ধন-রক্ত দিয়া অসীম ত্যাগ করিয়া থাকেন। পূর্ব বাংলার সেই সংগ্রামী যুবশক্তির কাছে ও দেশের সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের কাছে আমার আবেদন- যে জনযুদ্ধ শুরু হইয়াছে তাহা শুধু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সংগ্রাম নহে। ইহা পশ্চিম পাকিস্তানী কুটিল সামন্ত প্রভু, শোষক শিল্পপতি অত্যাচারী সমরদানব ও ষড়যন্ত্রকারী আমলাদিগের শোষণ শাসন অত্যাচার অবিচার হইতে নিপীড়িত নির্যাতিত শ্রমিক কৃষক জেলে তাঁতি প্রভৃতি শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামও বটে। অতএব, গত ২৩ বৎসরের শোষণ-শাসনের ফলে বাঙ্গালীদিগের সর্বশ্রেণীর মানুষের যে চরম দুর্দশা দেখা গিয়াছে এইবার ধ্বংস না করিয়া পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর পৈশাচিক কবল হইতে মুক্তি না পাইলে বাঙ্গালীদিগের অস্তিত্ব চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। তাই প্রতিজ্ঞা করুন যত রক্ত যত জীবন যত কোরবানী করিতে হয় করিব, যুদ্ধ যত কঠিন যত দীর্ঘস্থায়ী হয় হউক। সবকিছুর বিনিময়ে শোষণমুক্ত সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গড়িয়া তুলিব। এই মহান সংগ্রামে আল্লাহ আমাদিগের সহায় হইবেন।
*ছাত্রদিগের ও লেখাপড়া জানা জনসাধারণের নিকট আমার আবেদন- এই প্রচারপত্রটি কার্বনে লিখিয়া কিংবা সাইক্লোষ্টাইলে কপি করিয়া ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করিবেন।
সিলেট
৫/৫৭১
মোঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী
<৪,২০৫,৪৪৬-৪৪৯>
অনুবাদকঃ মাহীন বারী, মুশররাত আলম মৌ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৫। বিশ্বের আন্তর্জাতিক যুব ও ছাত্র সংগঠনের প্রতি স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন চেয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আবেদন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ২০ মে, ১৯৭১
টেলিগ্রামঃ ইয়ং ইন্ডিয়া টেলিফোনঃ ৫৬৭৩৫২২
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
৯২৩, ফায়েজ রোড, কারল বাগ, নিউ দিল্লি-৫
ভারত
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে একটি নিবেদন
(সাবেক পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন)
সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুব ও ছাত্র সংগঠনের প্রতি
প্রিয় বন্ধু ও বিপ্লবীগণ,
আমরা নিশ্চিত যে আপনারা জেনে থাকবেন, আমরা বাংলাদেশের ছাত্র ও জনগন (সাবেক পুর্ব পাকিস্তান) বর্তমানে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য একটি কঠিন কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ লড়াই করছি। দেশের মাটি শহীদদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী আমাদের দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং নিরস্ত্র ও নির্দোষ মানুষদের হত্যা করছে।যে গনহত্যা তারা ঘটিয়েছে এবং যে পরিমাণ বোমাবর্ষন, গোলাবর্ষন, গুলি বর্ষন, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষন ও অন্যান্য অপরাধমূলক কাজ তারা করেছে, মানব ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। আমাদের দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে তারা প্রায় দশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে যাদের মধ্যে নারী, বৃদ্ধ ও শিশু ও আছে।বিশ লক্ষের অধিক মানুষের উপর নির্মম ও অমানবিক নিপীড়ন ও হয়রানি চালিয়ে তাদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। শহর, গ্রাম প্রভৃতির অবাধ ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে আমাদের কয়েক লক্ষ মানুষকে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। অনাহারে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। এবং মহামারীর প্রকোপ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং এটি ছড়িয়ে পড়লে আরও লক্ষ মানুষ এর শিকার হবে।
প্রথম দিন থেকে যখন ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী তাদের “অপারেশন জেনোসাইড” শুরু করেছে ২০ হাজারের অধিক মানুষ শুধুমাত্র আমাদের রাজধানী শহর ঢাকাতেই নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে অনেক শিক্ষক ও ছাত্র আছেন। গুলিবর্ষণ ও গোলাবর্ষণ এর মাধ্যমে রাজধানী শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। হাজার হাজার গ্রাম, বাজার, আমাদের অধিকাংশ শহর যার মধ্যে আছে প্রধান বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এইভাবেই ইয়াহিয়া খানের সামরিক একনায়কতন্ত্র আমাদের জনগনের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে যাদের একমাত্র দোষ ছিল যে তারা গণতন্ত্র, জাতীয় স্বায়ত্তশাসন এবং সামাজিক উন্নয়নের মহৎ উদ্দেশ্যেকে সমুন্নত রাখতে চেয়েছিল।
জনগনের উপর এই নির্মমতা সত্ত্বেও তারা আরও একতাবদ্ধ হয়ে এবং আরও দৃঢ় সংকল্প, উচ্চ মনোবল ও এই আত্মবিশ্বাসের সাথে লড়াই করছে যে তারা তাদের নায্য অধিকার আদায় করে জিতবে।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে আমাদের লোকেরা আমাদের জনগনের প্রাথমিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও আমাদের দেশের একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য লড়াই করছে।আমরা আমাদের অঞ্চলের জন্য জাতীয় স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলাম পাকিস্তানের একটি অখণ্ড অংশ হিসেবে থাকাকালীন অবস্থায়। আমরা পাকিস্তানের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী অঞ্চলগুলোর জন্যও জাতীয় স্বায়ত্তশাসন ও সুষম অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দাবি করেছিলাম। আমাদের দাবি ছিল যে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন আঞ্চলিক অসমতা থাকবে না এবং আমরা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং ভাষার পুর্ণ উন্নয়নের পক্ষে ছিলাম।এই দাবিগুলোর উত্থাপনের ক্ষেত্রে আমরা লড়াই করেছিলাম; এবং এই ক্ষেত্রে ছাত্ররা ছিল অগ্রণী ভুমিকায়।
এর ফলশ্রুতিতে শাসক শ্রেণি, সামরিক গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থ সর্বদাই ছিল ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে।
এই লড়াইয়ে অনেক সময়ে জনগনের রায় ছিল আমাদের দাবির পক্ষে। ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে পুর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জনগন গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে রায় দেয়। একচেটিয়া পুঁজিবাদী, ভুস্বামিদের সমন্বয়ে গঠিত এবং সাম্রাজ্যবাদী সমর্থনপ্রাপ্ত শাসক শ্রেণি জনগনের ইচ্ছাকে অতি নির্লজ্জভাবে অস্বীকার করেছিল। পুনরায় কিছু সময়কাল সংগ্রামের পর ১৯৫৯ সালে একটি নির্বাচন শক্তিশালী জন আন্দোলনের দ্বারা শাসক গোষ্ঠীর উপর জোরপুর্বক ধার্য করা হয়েছিল।যখন পুরো জাতি প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন শাসক চক্র তাদের উন্মত্ত ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সামরিক কৌশল অনুসরণ করল এবং এভাবে আইয়ুব একনায়ক্তন্ত্রের অন্ধকার সময় শুরু হল। দেশকে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক দল এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের গভীর নিবেশে টেনে নিয়ে যাওয়া হল এবং এবং এভাবে আমাদের দুর্ভাগা দেশ বিশ্বের এই অংশে শান্তির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াল।
এক দশকব্যাপী দীর্ঘ সংগ্রাম সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে অব্যাহত ছিল এবং অবশেষে আমাদের একতাবদ্ধ ও শক্তিশালী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে এর পতন ঘটেছিল। এই পতনের পর শুরু হয় ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন। জনগনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সামরিক একনায়ক্তন্ত্রকে বাধ্য করেছিল নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য। এভাবে পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও এটি সামরিক শাসনের আজব শর্ত আরোপের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, জনগন এই নির্বাচনে দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।
তারা গনতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেবং জাতীয় পরিষদে তাদের জন্য পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল যারা জনগনের স্বার্থের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। জাতীয় পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন জিতেছিল।পুর্ব পাকিস্তানের ৯০% এর অধিক মানুষ জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের জন্য ভোট দিয়েছিল। জনগনের রায় এত পরিষ্কার ও ব্যাপক ছিল যে সেটি ইয়াহিয়া খানকেও মেনে নিতে হয়েছিল। যখন তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
কিন্তু যেহেতু এটি ছিল পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য, এই বারও, গনতন্ত্রের সকল নীতিকে লঙ্ঘন করে তারা জনগনের ইচ্ছাকে, চরম নির্লজ্জভাবে ধুলিস্যাত করে দিয়েছিল।
শাসক দল-সামরিক একনায়কতন্ত্র যারা অভ্যন্তরীণভাবে জনগনের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী এবং সামন্তবাদি স্বার্থের মদদপ্রাপ্ত ছিল এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সমর্থনপ্রাপ্ত ছিল, তারা যথাযথভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছিল এবং আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংকট জারি করেছিল।
আমরা সমস্যা সমাধানের জন্য শাসক দলের সাথে আলোচনার শান্তিপুর্ন পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলাম। জনগণ একত্রিত হয়ে শান্তিপুর্ন জন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল নির্বাচিত সংসদের প্রতি তাদের পুর্ন সমর্থন প্রকাশ করার জন্য।
কিন্তু শাসক দল নিকৃষ্ট ও কাপুরোষিত উপায় বেছে নিয়েছিল। ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর রাতে পুর্ব পাকিস্তানের উপর তারা সৈন্যবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল এবং তাদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিল।
এটি ছিল পটভূমি যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি ভিন্ন পন্থা ও কৌশল অবলম্বনে বাধ্য হয়েছিল। আমাদের এমন পরিস্থিতে দাড় করানো হয়েছিল যেখানে আমাদের বিকল্প ছিল শুধুমাত্র আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার এবং মর্যাদার জন্য লড়াই করা অথবা ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের পুর্বোক্ত পথ বেছে নিতে হয়েছিল এবং এভাবে আমাদের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু হল।
বর্তমানে বাংলাদেশকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান এবং জনাব তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয়েছে যেটি একমাত্র বৈধ সরকার, যথাযথভাবে নির্বাচিত এবং জনগনের বিশ্বাসপ্রাপ্ত।
আমাদের জনগণকে নির্মুল এবং ধ্বংস করার এবং কিছু ক্ষেত্রে আমাদের দেশকে দখল করার একটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টায় সামরিক শাসক গোষ্ঠী আমাদের আন্দোলনকে একটি ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে এবং এই যুদ্ধকে ইসলামের স্বার্থের বিরুদ্ধে একটি প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ননা করে একটি আন্তর্জাতিক বিষয় হিসেবে চরিতার্থ করছে। আমরা এখানে কিছু বিষয় স্পষ্ট করতে চাই।
১। গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যাদের অধিকার ছিল পাকিস্তান শাসন করার তারা সামরিক একনায়কতন্ত্রের দ্বারা প্রত্যাখাত হয়েছেন । সামরিক একনায়ক্তন্ত্রের উদ্দশ্য ছিল শাসন এবং সেটি সম্পাদনে সেনাবাহিনীর নির্মম শক্তির প্রয়োগ। আমরা গনতন্ত্রের জন্য লড়ছি। এটিকে ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ হিসেবে বর্ননা করা যায় না।
২। এখানে ইসলামের নামকে বিশ্ব জনমতকে ভ্রান্তিতে ফেলার জন্য টেনে আনা হচ্ছে।পাকিস্তানের সামরিক একনায়কতান্ত্রিক শাসন বাংলাদেশে গনহত্যা চালাচ্ছে যেখানে লাখো মুসলিম এর শিকার। এটি গণতন্ত্র এবং জাতীয় মর্যাদার লড়াই এবং এর সাথে ধর্মের কোন যোগসূত্র নেই।
৩। যখন নির্মম সামরিক শক্তি জনহত্যায় মত্ত তখন কেউ এর প্রতি নির্লিপ্ত আচরন দেখিয়ে বলতে পারেনা এটি একটি নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। গনতন্ত্রের নীতিকে ভঙ্গ করে এবং জনগনের ইচ্ছাকে অস্বীকার করে এবং দেশকে দখল করার জন্য সৈন্য পাঠিয়ে সামরিক শাসনকাল আসলে আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতি শেষ তীর নিক্ষেপ করেছে এবং পুর্বেরমত এখন আর কোন পাকিস্তানের অস্তিত্ত থাকবে না। যা এখন হচ্ছে টা হল ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী শান্তিপ্রিয় জনগণকে আক্রমণ করছে এবং লাখো মানুষকে হত্যা করছে। এটি কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না।
এটি পুরো মানবজাতির বিবেকের প্রতি একটি আহবান। এই যুদ্ধে এটি খুবই স্বাভাবিক যে, ছাত্র এবং যুবারা গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধা হিসেবে আছে, কারখানা এবং খেতে উপকরন উৎপাদন করছে তাদের দেশকে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থ করার জন্য। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন দেশভক্তির পতাকা সমুন্নত রাখছে এবং গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বায়ত্বশাসন এর জন্য লড়ছে।
এই সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন তাদের ৫ লক্ষ কর্মী সমর্থকদের এবং আরও শত সহস্র ছাত্রবন্ধুদের সহযোগিতায় যুদ্ধে অগ্রণী ভুমিকা পালন করতেছেন। ইতোমধ্যে এই মহান সংগ্রামে আমাদের শতাধিক ছাত্র কমান্ডার জীবনদান করেছেন।
আমরা এমন এক শত্রুর মোকাবিলা করছি যাদের পিছনে রয়েছে একচেটিয়া ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, সামন্ত নেতৃবৃন্দ যারা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন পেয়ে চলেছে বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের। পাকিস্তান সরকার সেন্টো এবং সিয়াটো এর মতন সাম্রাজ্যবাদী সেনাদলের সদস্য।
কিন্তু আমরা জিতব এই পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে লড়ে চলেছি। এই লক্ষ্যে আমাদের সমগ্র বিশ্বের ছাত্রবৃন্দ এবং যুবক ভাইবোনদের আকুণ্ঠ সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রয়োজন। এটি আমাদের কমান্ডারদের সম্মুখ সমরে উদ্দীপ্ত করবে।
আমরা সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ছাত্র ও যুব সংগঠনকে এগিয়ে আসবার আহ্বান জানাচ্ছি।
-যাতে করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি লাভ করে এবং আজকে আমরা যে মহৎ উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করছি তার প্রতি প্রাপ্ত সকল রাজনৈতিক, আদর্শিক ও দৈহিক সমর্থনের ঋণশোধ করতে পারি।
-যাতে করে আমাদের যোদ্ধাদের নিকট অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ, ঔষধ সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য, কাপড়চোপড় এবং অন্যান্য বস্তুসামগ্রী প্রেরণ করা সম্ভবপর হয়।
-যাতে করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আপনাদের দেশবাসীর সমর্থন প্রাপ্তি ত্বরান্বিত করণ সম্ভবপর হয়।
আমরা আরও একটিবার যুদ্ধক্ষেত্রে সংগ্রামরত আমাদের ছাত্রজনতার নিকট আপনাদের ত্বরিত শুভেচ্ছা ও বার্তা প্রেরণের আবেদন করছি। আমরা নিশ্চিত আপনাদের প্রেরিত বার্তাসমূহ তাদেরকে অনেক বেশি করে উৎসাহিত করবে।
আমরা আপনাদের নিকট সুবিধাজনক সময়ে প্রেরিত উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। বিপ্লবী শুভেচ্ছা সহকারে,
নয়া দিল্লী
১০ই মে, ১৯৭১
এসডি-/
নুরুল ইসলাম
সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
বিদ্রঃ অনিবার্য কারণবশত আমরা দিল্লীতে একটি অফিস খুলেছি যেখানে সকল ধরণের যোগাযোগ রক্ষা এবং সাহচর্য প্রভৃতি প্রেরণের অনুরোধ করা হল
সভাপতি,
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন,
(পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন)
প্রযত্নে অল ইন্ডিয়া ছাত্র ফেডারেশন
৯২৩, ফায়েজ রোড, ক্যারল বাগ
নয়া দিল্লি-৫, ভারত
<৪,২০৬, ৪৫০>
অনুবাদকঃ মাহীন বারী
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৬। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য মওলানা ভাসানীর প্রস্তাব এশিয়ান রেকর্ডার
জুন ২৫-জুলাই ১,
১৯৭১ ১৭ মে, ১৯৭১
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য মওলানা এ এইচ ভাসানীর প্রস্তাব:
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৭ মে তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য দাবী জানান।
তিনি বলেন পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তা এবং অন্যান্য ভারত বিদ্বেষী গোষ্ঠীগুলো বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা চালাতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে স্বাধীনতা আদায় এখন বাংলাদেশের সকল ছোট চাষি, কর্মী, ছাত্র, যুবক-যুবতী, বুদ্ধিজীবী এবং সকল শ্রেণীপেশার মানুষের গণদাবীতে পরিণত হয়েছে। ভারত কোনভাবেই এসকল দাবিদাওয়া এবং বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারাভিযান যা বংলাদেশে সংঘটিত প্রকৃত ঘটনাবলী দমন করবার জন্য পরিচালিত হচ্ছে এরসাথে জড়িত নয়।
তিনি বলেন যদি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এই বিষয়ে কোন সন্দেহ থেকে থাকে তবে তিনি বিশ্বসভার উপস্থিতিতে একটি গণভোটের আয়োজন করেন। শতকরা ৯১ ভাগ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিবেন এমনটা তিনি দেখতে পাবেন।
<৪,২০৭,৪৫১>
অনুবাদকঃ মাহীন বারী
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৭। মুজিবনগরে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠন এশিয়ান রেকর্ডার
জুন ২৫ – জুলাই ১,
১৯৭১ ১৯ মে, ১৯৭১
বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল ফোরাম
লিপিবদ্ধ বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবীগণ যারা আর্মিদের নৃশংসতা থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছেন তারা গত ১৯ মে মুজিবনগরে একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ এ আর মল্লিককে সভাপতি করে “বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল” গঠন করেন।
এই কাউন্সিলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলঃ
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান, বাস্তুহারা বুদ্ধিজীবী ও প্রযুক্তিবিদদের স্থানান্তরকরণ ও ব্যবহার করণ এবং সাময়িকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ, এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধকে প্রচার করা।
কাউন্সিল আরও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ফিচার ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করবে, সেগুলো বিভিন্ন বৈদেশিক বুদ্ধিজীবী সংগঠনে পাঠানো হবে যাতে করে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য “আন্তর্জাতিক বিবেক” দলগোষ্ঠীর গঠন করা যায় এবং আশ্রিতদের জন্য বিনোদন ও প্রচার ব্যবস্থার আয়োজন সম্ভবপর করে তোলা যায়।
<৪,২০৮,৪৫২-৪৫৫>
অনুবাদকঃ আইনুল ইসলাম বিশাল
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৮। উদ্ভুত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা ভাসানীর প্রেস বিজ্ঞপ্তি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ২২ মে, ১৯৭১
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর প্রেস বিজ্ঞপ্তি,সভাপতি,ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি,বাংলাদেশ,২২শে এপ্রিল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করার জন্য লক্ষ্য লক্ষ্য বাঙ্গালী কারাগারে এবং বন্দী অবস্থায় নির্যাতন ভোগ করে এবং তাদের মধ্যে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এটা একটা দুর্ভাগ্যে যে যদিও তারা ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে,পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও শোষকরা পাকিস্তানের ৭.৫ কোটি সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙ্গালীকে রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।পাকিস্তান সৃষ্টির ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে পূর্ব এবং পশ্চিমে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা বলে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ নির্যাতনের মাধ্যেমে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী অধিস্বামীগণের স্বার্থে তাদের নিয়োগকৃত কিছু এজেন্ট দ্বারা এই আন্দোলন নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে।কিন্তু স্বাধীনতার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণ গত ২৩ বছর ধরে একটানা সংগ্রাম করছে এবং নিজেদের অনেক রক্ত দিয়েছে। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামই এই সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ।
১৯৪৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একটি হাস্যকর সংবিধান প্রনয়নের চেষ্টা করে যা পূর্ব বাংলার জনগণ দ্বারা অঙ্কুরেই প্রত্যাখিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলাকে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস চালায়। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যালট বক্সে আরেকটি ঐতিহাসিক জয় অর্জন করে। তারপর ইস্কান্দার মির্জার শাসন জারি করে এবং তারা পূর্ব বাংলার জনগণের উপর অমানুষিক নৃশংসতা চালায়, পরে গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ জনাব এ.কে.ফজলুল হকের মন্ত্রণালয় বরখাস্ত করে। তারপর, সামরিক একনায়ক আইয়ুব সংবিধান বাতিল এবং পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে এবং সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে।তিনি সব রাজনৈতিক দলের উপর সন্ত্রাসের রাজত্ব চালায়,কিন্তু বাঙালি ভীতু হয়নি, তারা দমে যায়নি। ১৯৬২ সালে ছাত্ররা আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। কিছু এজেন্টের সাহায্যে আইয়ুব বিশ্বকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে এবং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে।বিল্পবী বাঙালিরা আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এবং আইয়ুব সরকারের তথাকথিত আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।১৯৬৯-৭০ সালে ছাত্র,কৃষক,শ্রমিক ও রাজনৈতিক দল গণ আন্দোলন শুরু করলে আইয়ুব আরেক সামরিক একনায়ক ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অবসর নিতে বাধ্য হয়।জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করা হয়,কিন্তু পর্দার আড়ালে সে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে।পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক, পুঁজিপতি ও সামন্তবাদীরা ইসলাম ও অখন্ডতার নামে বিপুল পরিমান টাকা খরচ করে।তারা কিছু বিশ্বাসঘাতক যারা তাদের স্থায়ী শোষণের জন্য এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে এবং তাদের মন জয় করতে সক্ষম হবে। ১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ সার্বজনীনভাবে আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়েছে এবং প্রকাশ করে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ১৯৭০ সালে ৯৯ ভাগের বেশি প্রতিনিধি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের কারন বাঙালির স্বপ্নে আছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ পূর্ব থেকে বুঝে উঠতে পারেনি যে পুর্ব বাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থ,শোষণ এবং নিপীরনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে এমন একটি সম্মিলিত রায় দিবে।এই নির্বাচনের রায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে তাদের একই সংগে চিন্তিত ও ক্রুদ্ধ করে তোলে।
তাই, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৭.৫ কোটি বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার,সমঝোতার দীর্ঘ বন্ধন অস্বীকার করে ২৫ শে মার্চ তার আর্মি জনগণের উপর লেলিয়ে দিয়ে সে মধ্যরাতে ঢাকা থেকে পালিয়ে যায়।টিক্কা খানের নেতৃত্বে ২৫ শে মার্চ রাত ১০.৩০ মিনিটে ঢাকায় সহিংসতা ও হত্যার একটি তান্ডব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর্মি ট্যাংক,কামান,মর্টার,মেশিনগান ও অন্যান্য মরণাস্ত্র নিয়ে ছাত্র,যুবক,শিক্ষক,অধ্যাপক,বুদ্ধিজীবি,ব্যবসায়ী ও অন্যদের হত্যা শুরু করে।তারা স্কুল,কলেজ,মসজিদ,মন্দির,হোটেল,শিল্প এলাকা ধ্বংস করে এবং অসংখ্য ঘর পুড়িয়ে দেয়।
২৬শে মার্চ থেকে তারা যশোর শহরে এই হত্যাকান্ড শুরু করে, রংপুর,পাবনা,কুষ্টিয়া,চুয়াডাজ্ঞা,বগুরা,টাংগাইল,ময়মনসিংহ এবং আরো অনেক জায়গায় নিরীহ মানুষের উপর বোমা ও গোলাবর্ষন শুরু করে। তারা রাস্তার পাশের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং গণহত্যা সংঘটিত করে, নারী এবং শিশুরাও রেহায় পায়নি। মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা হয় এবং প্রচুর পরিমানে খাদ্যসামগ্রী ও প্রানি সম্পদ লুট করা হয়। সৈন্যদের দ্বারা দোকানপাট ও ব্যাংক লুট করা হয়। স্কুল ও কলেজ থেকে নারীদের অপহরণ করা হয়।কে জানে তাদের কি হয়েছে?
কেউ এই ধরনের নৃশংসতা শুনেছে?ইতিহাসে কোনো উদাহরণ আছে?চীনের চিয়াং-কাই-শেক এবং রাশিয়ার কায়জার এবং অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ অত্যাচার অথবা কারবালার জালেম ইয়াজিদের অমানবিক জুলুম নির্মমতার এইসব উদাহরণ সর্বশেষ উদাহরণের সামনে তুচ্ছ স্লান। ইয়াহিয়া সরকার ও তার সমর্থকরা মনে করে যে তারা এই ধরণের নিপীড়ন দ্বারা স্থায়ীভাবে পূর্ব বাংলার জনগণকে শেষ করতে পারবে এবং তারা বাঙালির মেরুদন্ড ভেঙ্গে তাদের শোষণ চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তারা বিশ্বকে বুঝাতে চেয়েছে পাকিস্তানের শত্রু ভারতের দুর্বৃত্তদের একটি থাবা পূর্ব বাংলার এই আন্দোলন সৃষ্টি করেছে, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ বিভ্রান্ত হয়নি। তারা জানত কেন বিদেশী সংবাদদাতাদের ২৬ শে মার্চ পূর্ব বাংলা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য বাংলার জনগণের মহান সংগ্রাম এবং বর্বর হত্যাযজ্ঞ বিশ্বকে জানানোর জন্য বিদেশী সংবাদে প্রকাশ করা হবে ইহাই কি পাকিস্তানী শাসকদের ভয়ের কারন ছিলো না?
বিদেশী সংবাদ প্রতিনিধিরা ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংবাদ সংগ্রহের জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতো। সেখানে ইয়াহিয়ার মত একজন এক নায়ক দেশ থেকে প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করেছে বিশ্ব ইতিহাসে ইহাই একমাত্র উদাহরণ নই,বর্বর সরকার শুধুমাত্র প্রতিনিধিদের আটকায়নি, তারা আন্তর্জাতিক রেডক্রস যারা গৃহহীন ও নিপীড়িত বাংলার জনগণকে সাহায্যের জন্য যেখানে যাচ্ছে সেখানে তাদের প্রতিরোধ করছে।তারা এই কাজ করছে তাদের নিজের অপকর্মের ধামাচাপা দেয়ার জন্য।বাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন দিতে প্রস্তুত তারা বিশ্বকে তা না জানানো নিশ্চিত করতে চেয়েছে।এই গণযুদ্ধ ও ভারতের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।একটি জাতির তার নিজের ইচ্ছে না থাকলে বাইরের সাহায্যে স্বাধীনতা পেতে পারে না।
প্রশ্ন হলো বিশ্বের দেশ গুলির মানুষ ৭.৫ কোটি বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামকে নাকি ঘৃন্য ষড়যন্ত্র ও গণহত্যায় লিপ্ত একনায়কতান্ত্রিক শোষনের শাসনকে সমর্থন করবে।
ইয়াহিয়া, যিনি নিজে মুসলমান ধর্মের নামে নির্দয়ভাবে লক্ষ লক্ষ মুসলিম,হিন্দু,খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধর প্রাণ নাশ করছে।তার সৈন্যরা যারা নিজেদের মুসলিম বলে তারা মুসলিম মহিলাসহ নারীদের ধর্ষণ করছে।যারা নিজেদের মুসলমান বলে তারায় মসজিদ ধ্বংস করছে।যে সব মুসলিম নামাজের আহবান করে তাদেরও হত্যা করছে। মুসলিম বিশ্ব এই সম্পর্কে কি করবে?হয় তারা অনৈসলামিক বর্বর ইয়াহিয়ার ঘৃন্য নীতি সমর্থন করবে অথবা তারা কি সত্য,ন্যয় ও ভালোবাসা সমর্থন করবে যেমনটা ইসলাম বলে।৭.৫ কোটি বাঙালি গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে জানতে চায় তারা কি ইয়াহিয়ার একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করবে। তারা কি নিশ্চুপ থাকবে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার এই অজুহাতে তারা তাকে এই পরিস্থিতির সমর্থন দিয়ে যাবে।পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার হতে পারে না।পশ্চিম পাকিস্তানীরা লাহোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে যা পাকিস্তান আন্দোলনের মূল বিধান যা অবিভক্ত ভারতের ১০ কোটি মুসলমান কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছিল তারা গত ২৩ বছর ধরে পূর্ববাংলাকে তাদের উপনিবেশ বানানোর চেষ্টা করছে।এই গণহত্যা বিষয়ে কি কোনো বিশ্ব মতামত নেই?কিছু অজুহাত অথবা অন্য কোনো কারনে গণতান্ত্রিক বিশ্ব কি এই গণহত্যা সমর্থন করবে।চীনসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সব সময় শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের সাহায্যে করেছে.২৩ বছর শোষিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার ৭.৫ কোটি জনগন যখন স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত তখন বর্তমান হত্যাকান্ডে তারা কি ভূমিকা রাখছে।তারা ইয়াহিয়াকে সমর্থন করে কিভাবে বিশ্ব মতামতকে বোঝাতে পারবে যে তারা নিপীড়িত জনগনের বন্ধু।
পূর্ব বাংলা এশিয়ার একটি অংশ, এই দেশের জনগণ এশিয়ার জাতি গুলির দিকে তাকিয়ে বিশেষ করে আফ্রো এশিয়ান জাতি গুলির দিকে।পূর্ব বাংলার জনগণ মানবতার জন্য একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন রাখে যখন তাদের মহান সংগ্রামকে চিরতরে ধ্বংস করা হচ্ছে ।
নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত প্রাথমিক স্বীকৃতি দিতে সব শান্তিপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষ এবং বিশ্বের সরকার গুলির নিকট বিনীত আবেদন করছি। আমি পূর্ব বাংলার সব মানুষের নিকট আবেদন করছি,আমি কৃষক,শ্রমিক,কামার,মৃত শিল্প শ্রমিক,মাঝি,তাতি,কুটির শিল্প,ছাত্র,ব্যবসায়ী,বুদ্ধিজীবি সমাজ এবং চাকুরিজীবি এবং অন্যান্যদের নিকট একটি ইস্পাতের ন্যায় ঐক্যর আবেদন করছি।পূর্ব বাংলার কিছু সুবিধাবাদী যারা ধর্ম ও অখন্ডতার নামে তোমাদের ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করছে,তারা পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা,শিল্পপতি,সামন্তবাদী,স্বৈরচারী আমলার এজেন্ট।এই পূর্ব বাংলার মীর জাফররা গত ২৩ বছর যাবত পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের এজেন্ট হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে ছোড়া মারছে।এই বিশ্বাস ঘাতকদের কথা শুনো না। কায়েমী স্বার্থের উদ্দেশ্য হলো আপনাদের প্রতিজ্ঞা এবং ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ় ঐক্য বিভক্ত করা। তাহলে আপনারা যুগ যুগ ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক,পুজিপতি, আমলা ও সামন্তবাদীদের দাস থাকবেন।বর্তমান মুহূর্তে ঐক্য,মানসিক শক্তি ও জ্বলন্ত দেশপ্রেম আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অস্ত্র,আমাদের বিজয় নিশ্চিত।সৃষ্টিকর্তা অত্যাচারী এবং বিশ্বাস ঘাতকদের ঘৃণা করে।আমরা আমাদের মহান সংগ্রামে অবশ্যই আল্লাহর সাহায্যে পাবো এবং পূর্ব বাংলায় আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম সুখী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবো।
আল্লাহ আমাদের সহায় হোন ।
<৪,২০৯,৪৫৬-৪৬০>
অনুবাদকঃ জিহাদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২০৯। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণাপত্র
১ জুন, ১৯৭১
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা
সম্প্রতি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে অগ্রসর করিয়া লওয়ার যে আহবান ও নির্দেশ দিয়েছেন তাহাকে অবলম্বন করিয়া বাংলাদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত) কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি (দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে), শ্রমিক-কৃষক কর্মীসংঘ, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি (হাতিয়ার), পূর্ববাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন) এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা এক সম্মেলনে মিলিত হইয়া “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করিয়াছে এবং সর্বম্মতভাবে নিম্নোক্ত ঘোষণা প্রণয়ন করিয়া বাংলাদেশের জনগণের নিকট উপস্থাপিত করিতেছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি
সারা বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতির জীবনে আজ এক চরম মুহূর্ত উপস্থাপিত। পাকিস্তানের ফ্যাসিষ্ট জঙ্গীশাহীর হানাদার বাহিনী ট্যঙ্ক, বোমারু বিমান, মেশিনগান, মর্টার, রকেট, গানবোট প্রভৃতি অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া নিরস্ত্র, নিরীহ, শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের জনগণের উপর সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় শুরু করিয়াছে এমন এক বর্বর হামলা, সভ্য দুনিয়ার ইতিহাসে যাহার তুলনা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ। খ্রিষ্টান, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সমগ্র সাড়ে সাত কোটি জনতাই এই হানাদার দস্যুদের বর্বর নির্যাতনের শিকারে পরিণত হইয়াছে। বাংলাদেশের এমন কোন শহর, গ্রাম বা অঞ্চল নাই যেখানে এই পরদেশ লুন্ঠনকারী দস্যুর দল নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধনসম্পত্তি বিনষ্ট, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতন করে নাই। পাকিস্তানের ফ্যাসিষ্ট জঙ্গীশাহীর এই হামলা অত্যন্ত আকস্মিক ও বর্বর। দীর্ঘ চব্বিশ বছর গোটা বাঙালী জাতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক হইতে চরমভাবে নিপীড়িত হইবার পর এইবারই সর্বপ্রথম জাতীয় মুক্তির আশার আলো দেখিতে শুরু করিয়াছিল। জাতীয় মুক্তি এই সুতীব্র আকাঙ্খা লইয়াই বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি তথা সমগ্র জনতা ইতিপূর্বে বারবার রক্তঝরা সংগ্রামের পথে অগ্রসর হইয়াছিল। এই জনতাই মুক্তির দুর্বার আকাঙ্খা লইয়া হাজার হাজার বীর সন্তানের রক্তের বিনিময়ে সৃষ্টি করিয়াছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের গৌরবোজ্জ্বল সুমহান গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের বির্বাচনে বাংলার জনগণ আবার সেই জাতীয় মুক্তির কামনাকেই বুকে করিয়া একচেটিয়াভাবে আওয়ামী লীগকে ভোটদান করিয়াছিল। তাহারা আশা করিয়াছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে দীর্ঘ চব্বিশ বছরের নিপীড়ন ও নির্যাতনের অবসান করিয়াছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে নিরস্ত্র অপ্রস্তুত জনতার উপর নামিয়া আসিল শাসকগোষ্ঠীর সশস্ত্র হামলা। তবে এই হামলা জনগণের আকাঙ্খা অবদমিত করিতে পারে নাই বরং শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণাকে আরও বেশী করিয়া তীব্র করিয়া তুলিয়াছে। তাই অপ্রস্তুত অবস্থায় হইলেও জনগণ প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করিয়াছে। যে যেভাবেই পারিয়াছে সশস্ত্র আক্রমণের পাল্টা আক্রমণ করিয়াছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর, পুলিশ ও বাংলার অসংখ্য তরুণ হানাদারদের বিরুদ্ধে শুরু করিয়াছে সশস্ত্র অভিযান। বাংলাদেশের জনগণ আজ নির্মম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া এই শিক্ষা লাভ করিয়াছে যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আপসের পথে বাংলার জনগণকে বাঁচিয়া থাকার তাগিদেই আজ হানাদার দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখিতে হইবে।
জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়ার আহবান
বাংলাদেশের এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি বাংলার সমগ্র জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হইত হইবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ, গণ-সংগঠন ও শ্রেণী-সংগঠন এবং প্রতিটি নাগরিকের মহান কর্তব্য পরষ্পরের মধ্যে সমঝোতা রক্ষা করিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের সুমহান ব্রত লইয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করা। কেননা এই যুদ্ধ সমগ্র জাতির যুদ্ধ, সমগ্র জনগণের যুদ্ধ। সমগ্র জনগণের অংশগ্রহন ব্যাতিরেকে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। এই বাস্তব উপলব্ধির ভিত্তিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে আহবান ও নির্দেশ দিয়েছেন তাহাকে অবলম্বন করিয়া ১লা জুন বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, ব্যক্তি, গণ-সংগঠন ও শ্রেণী-সংগঠন একত্রিত হইয়া “বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করিয়াছেন। এই সমন্বয় কমিটির আশু লক্ষ্য হইল সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সরকারের ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য প্রয়োজন সকল দলমত ও ব্যক্তির সমবায়ে গঠিত সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের। তাই এই সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গণ-সংগঠন, শ্রেণী-সংগঠন ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের নিকট এইরূপ একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহবান জানাইতেছি।
চূড়ান্ত লক্ষ্য
এই সমন্বয় কমিটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হইল বাংলাদেশকে হানাদার দস্যুদের হাত হইতে মুক্ত করিয়া বাংলার বুকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী একটি স্বাধীন, সুখী, সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ইহা হইবে এমনই একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে যুগ যুগ ধরিয়া শোষিত কৃষক জোতদারী-মহাজনী শোষণের নাগপাশ হইতে একটি সত্যিকারের মুক্তিলাভ করিবে, যেখানে জমির উপর তাহার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হইবে, যেখানে শ্রমিক পাইবে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিবারসহ মানুষের মতো বাঁচিবার গ্যারান্টি, যেখানে বেকারত্ব অভিশাপ থাকিবে না, যেখানে ছাত্রের জন্য থাকিবে বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে বুদ্ধিজীবির জন্য থাকিবে সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ। প্রতিটি নাগরিকের জন্য থাইবে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। এই সমাজ নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করিবে। উন্নতমানের কৃষিব্যবস্থা ও শিল্পবিকাশের মাধম্যে গড়িয়া তুলিব আত্মনির্ভরশীল অর্থণীতি ও একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। এক কথায় এই সমাজ ব্যবস্থায় সমগ্র জনগণের জন্য থাকিবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রভৃতির নূন্যতম গ্যারান্টি। এই বাংলা হইবে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত, দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণীর বাংলা-জনতার বাংলা।
আশু করণীয়
উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জন করিবার জন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত ও সম্পুর্ণরূপে উৎখাত করিবার কর্মসূচী হইতেছে সমন্বয় কমিটির আশু কর্তব্য। আমাদের এই কর্তব্য মহান ও কঠিন। যেহেতু হানাদারবাহিনী সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী, অন্যদিকে যেহেতু জনগণের হাতে অস্ত্র নাই, সেহেতু এই সমন্বয় কমিটি মনে করে যে গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় ক্রমান্বয়ে শত্রুকে দুর্বল করিয়া এবং নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করিয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়াই অগ্রসর হইতে হইবে। অন্যদিকে যেহেতু হানাদারবাহিনী বিদেশী বর্বর এবং সাড়ে সাত কোটি জনতার তুলনায় তাহাদের লোকবল অত্যন্ত নগণ্য, সেহেতু এই যুদ্ধে জনগণের জয় যে সুনিশ্চিত সে সম্পর্কেও এই সমন্বয় কমিটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এই সমন্বয় কমিটি আরও মনে করে যে, সমগ্র জনগণের শক্তির পূর্ণ ব্যবহারের উপরই যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করে। কোন বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করিয়া নয়, নিজেদের শক্তিতে বলীয়ান হইয়াই এই মুক্তিযুদ্ধ চালাইয়া যাইতে হইবে। জনতার মধ্য হইতে সশস্ত্র গণফৌজ গড়িয়া তোলার লক্ষ্যকে সম্মুখে রাখিয়া আমাদের গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করিতে হইবে। জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকরাই হইবে গণফৌজের মূল শক্তি। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল হইবে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের ঘাঁটি। এই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হইবে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সহিত যোগাযোগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধন।
তাই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি জনগণের নিকট নিম্নলিখিত করণীয় কর্তব্য উপস্থিত করিতেছেঃ
১। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে জনতার বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি সমবায়ে সর্বদলীয় গণ-মুক্তি পরিষদ গঠন করিতে হইবে। এই গণ-মুক্তি পরিষদ গ্রামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সর্বিবিধ কর্তৃত্ব গ্রহণ করিবে, গ্রামরক্ষীবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করিবে এবং গণ-আদালত গঠন করিয়া বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করিবে।
২। পাক-জঙ্গীশাহী সরকারকে দেয়া খাজনা, ট্যাক্স, ঋণ ও সুদ পরিশোধ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখিতে হইবে।
৩। যাহারা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় প্রয়োজনতিরিক্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখিবে গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের সেই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব জনসাধারণের মধ্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিবে।
৪। গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ গ্রামে গরীব-জনসাধারণের উপর নিপীড়নমূলক মহাজনী ব্যবস্থা বন্ধ করিবে।
৫। ক) যাহারা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সহিত কোন প্রকার সহযোগিতা ও সাহায্য প্রদান করিবে অথবা চর হিসেবে কাজ করিবে, গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের কঠোরতম শাস্তি প্রদান করিবে এবং তাহাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করিবে।
খ) যে সকল জোতদার জাতীয় মুক্তির সপক্ষে থাকিবে তাহাদের সহিত পারষ্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে হইবে যাহাতে গরীব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের উপর জোতদারের পূর্বতন শোষণ লাঘব হয়।
৬। বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক বাস্তুহারা হইয়া দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের যাবতীয় সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করিবে।
৭। যথোপযুক্ত বিলিবণ্টন, উৎপাদন বৃদ্ধি, কেনাবেচা, কুটিরশিল্পের বিকাশ সাধন প্রভৃতির মাধম্যে গ্রাম এলাকার আত্মনির্ভরশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়িয়া তুলিতে হইবে। এই ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হইবে পারষ্পারিক সাহায্য ও সহযোগিতা (mutual aid and mutual cooperation)।
৮। শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে জাতীয় ভাবধারা সৃষ্টি করিতে হইবে। প্রচলিত শিক্ষা ও কুলষিত সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করিতে হইবে।
৯। ক) গ্রামে গ্রামে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও অন্যান্য জঙ্গী তরুণদের সমবায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলাদের গঠন করিতে হইবে। এই গেরিলাদল সুযোগ ও সুবিধামত বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত শত্রুকে খতম ও ক্ষতিসাধন করিবে এবং শত্রুর অস্ত্র কাড়িয়া লইয়া নিজেদের অস্ত্রবল বৃদ্ধি করিবে।
খ) হানাদা বাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে যাহাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা, অস্ত্র-শস্ত্র, রসদপত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ করিতে না পারে এবং নির্বিবাদে শাসন ও শোষণ চালাইতে না পারে, তাহার জন্য সকল প্রকার যোগযোগ ব্যবস্থা ও সরবরাহ লাইন ইত্যাদির ক্ষতিসাধন করিতে হইবে।
গ) গেরিলাদলকে জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জনের জন্য
-জনগণকে শ্রদ্ধা করিতে হইবে।
-জনগণকে সাহায্য করিতে হইবে।
-জনগণকে রক্ষা করিতে হইবে।
ঘ) গেরিলা দল সামরিক দায়িত্ব সম্পাদনের সাথে সাথে জনগণের মধ্যে জাতীয় মুক্তির সপক্ষে রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলনও চালাইবে।
ঙ) যে সকল ব্যক্তি হানাদার পাক-সরকার ও পাক বাহিনী অথবা তাহাদের এজেন্টদের সহিত সেচ্ছায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক অথবা যে কোন প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করিবে তাহারা জাতীয় শত্রু বলিয়া পরিগণিত হইবে। পূর্ণ তদন্ত করিয়া সমষ্টিগত ভিত্তিতে তাহাদের খতম অথবা যে কোন প্রকার শাস্তি প্রদান করা হইবে।
১০। যাহারা জনগণের মনোবল নষ্ট করিবার জন্য গোপনে বা প্রকাশ্যে কোন প্রকার প্রচারকার্য চালাইবে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।
১১। যাহারা জনগণের দুরবস্থার সুযোগে ডাকাতি, গুন্ডামি ও অন্যান্য সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত গণ-মুক্তি পরিষদের মাধ্যমে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।
১২। যাহারা মুক্তিসংগ্রামকে বিভক্ত ও বিপর্যস্ত করার জন্য কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক ক্রিয়াকলাপ, উস্কানি অথবা প্রচারণা করিবে তাহাদের কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে।
১৩। শহরাঞ্চলে শত্রুকে বিপর্যস্ত ও ব্যস্ত রখিবার জন্য ”আঘাত করো ও সরিয়া পড়ো” নীতির ভিত্তিতে গেরিলা তৎপরতা চালাইতে হইবে।
১৪। সর্বস্তরের জনগণকে জঙ্গীশাহীর প্রশাসনিক ও সকল প্রকার ব্যবস্থার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া চলিতে হইবে।
১৫। বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি তাহাদের পূর্ব ঐতিহ্য অনুসরণ করিয়া শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির অচলাবস্থা অব্যাহত রাখিবার উদাত্ত আহবান সমন্বয় কমিটি জানাইতেছি।
এই সমন্বয় কমিটি ইহার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সংগঠনের কর্মীদের প্রতি এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব জনগণের সাথে থাকিয়া সুচারুরূপে সম্পন্ন করিবার নির্দেশ প্রদান করিতেছে। এই সমন্বয় কমিটির বহির্ভূত যাহারা অনুরূপভাবে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে কাজ করিয়া যাইতেছে বা ভবিষ্যতে করিবে তাহাদের সহিত পরিপূর্ণ সহযোগিতার ভিত্তিতে উপরোক্ত দায়িত্ব পালন করিয়া যাইতে হইবে।
আমাদের ঘোষণা
এই পরিস্থিতিতে আজিকার এই জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে সামাদের প্রিয় মাতৃভূমি ও জনগণের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ রাখিয়া, “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” বাংলাদেশের এবং পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের নিকট দৃঢ়তার সহিত নিম্নোক্ত ঘোষণা পেশ করিতেছিঃ
● সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া বৃহৎ পূঁজিবাদীগোষ্ঠীর সেবাদাস পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট জঙ্গী শাসকচক্রের হানাদারবাহিনী গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ ও ব্যাপকভাবে নাগরিক বিতাড়নের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করিবার যে সুপরিকল্পিত অভিযান চালাইতেছে তাহা প্রতিরোধ ও প্রতিহত করিয়া “স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ়সংকল্প ঘোষণা করিতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশে যে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম চলিতেছে তাহাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইবার জন্য বলিষ্ঠ শপথ করিতেছে এবং যাহারা অসীম সাহসিকতার সহিত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়া এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতেছেন তাঁহাদের সহিত একাত্মতা ঘোষণা করিতেছে ও তাঁহাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছে।
● সমন্বয় কমিটির সকল প্রকার দেশী-বিদেশী আপসমূলক চক্রান্তকে প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ করিতেছে এবং সুস্পষ্ট ঘোষণা করিতেছে যে, বাংলাদেশের মাটি হইতে হানাদারবাহিনী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম থামিবে না। প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য এবং প্রকৃত জাতীয় মুক্তির জন্য বাংলাদেশের জনগণের রক্ত দিয়েছে, দিতেছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।
● বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে যাঁহারা শহীদ হইয়াছেন, যাঁহারা লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হইয়াছেন, স্বর্বস্য হারাইয়াছেন, এই সমন্বয়কমিটি তাঁহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা প্রকাশ করিতেছে। যাঁহারা চরমভাবে নির্যাতিত হইয়া শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগে বাধ্য হইয়াছেন, এই সংস্থা মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে তাঁহাদের নিরাপদ পুনর্বাসনের জন্য সংগ্রামের সংকল্প ঘোষণা করিতেছে।
● বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুবক, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর, পুলিশ, আনসার, মোজাহিদ এবং সকল স্বেচ্ছাসৈনিকেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হইয়া স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে যে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতেছেন এই সমন্বয় কমিটি তাঁহাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছে।
● বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি এবং বাস্তুহারা শরনার্থীদের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের জনগণ যে সাহায্য ও সহযোগিতা করিয়াছেন তাঁহাদের জন্য এই সমন্বয় কমিটি তাঁহাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি সিন্ধী, বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবী জনগণ বিশেষ করিয়া শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী জনগণের নিকট পাকিস্তানী ফ্যাসিষ্ট জঙ্গী শাসকচক্রের বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সপক্ষে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার আহবান জানাইতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিকট বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তসংগ্রামকে সর্বতোভাবে সাহায্য করিবার আবেদন জানাইতেছে। অফুরন্ত জনবল আমাদের রহিয়াছে, অর্থ রসদ, ঔষদপত্র ও নৈতিক সমর্থন।
● এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লইবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-সংগঠন ও গণ-সংগঠন এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে “জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট” গঠন করিয়া গণ-যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা ও বাংলাদেশের মাটি হইতে উৎখাত করিবার জন্য উদাত্ত আহবান জানাইতেছে। এই সংস্থা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, যেহেতু জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমগ্র জনতার লড়াই, সেই জন্য সমগ্র জনতার আশা আকাঙ্খার পরিপূরক একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টই তাহাকে নিশ্চিতভাবে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইতে পারে।
বাংলার সংগ্রমী জনতা!
সারা বাংলাদেশ ব্যাপী মরণপণ যুদ্ধ চলিতেছে- স্বাধীনতার যুদ্ধ। লাঞ্ছিত অপমান মোচনের, পরাধীন দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের এই জীবন-মরণ লড়াইয়ে আমরা সকলেই শরীক হইয়াছি। বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধের ক্ষান্তি নাই, শ্রান্তি নাই। যে দস্যুর দল আমাদের পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নী, পুত্র-কন্যাকে হত্যা করিয়াছে, মা-বোনের সম্ভ্রম বিনষ্ট করিয়াছে, আসুন, আমরা তীব্র প্রতিহিংসার জ্বালা ও ঘৃণা লইয়া সেই দস্যুর উপর সশস্ত্রভাবে ঝাঁপাইয়া পড়ি। তাহাকে খতম করি। রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করি। আমাদের যুদ্ধ ন্যায়ের যুদ্ধ। তাই জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানী হানাদার দস্যুর পরাজয় অনিবার্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।
-স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
-জনতার সশস্ত্র বিপ্লব জিন্দাবাদ।
১লা জুন
১৯৭১ সাল।
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি
<৪,২১০,৪৬১-৪৬২>
অনুবাদকঃ নন্দন দেব
শিরোনাম সুত্র তারিখ
২১০। বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক নিষ্পত্তির বিরোধিতা করে মওলানা ভাসানির প্রেস বিজ্ঞপ্তি দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস(নয়াদিল্লি) ২ জুন, ১৯৭১
স্বাধীনতা একমাত্র মুক্তির পথঃ ভাসানি
৩১মে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলন নিয়ে জাতীয় আওয়ামী পার্টি লিডার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির সাথে সাংবাদিকের কথোপকথনের প্রতিবেদন
জাতীয় আওয়ামী পার্টি লিডার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি গতকাল ঘোষণা করলেন যে,” পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাঙ্গালির উপর অমানবিক শোষণ” এর থেকে মানুষকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা।
যারা বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির কথা বলেন তিনি তাদের এই মনোভাবের প্রতি আক্ষেপ করেন এবং বলেন যে , বিগত ২৩ বছরের পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম নিপীড়ন ও শোষণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত , বাংলাদেশের মানুষ এখন সার্বিক যুদ্ধে লিপ্ত। তিনি বলেন, সেই কারনে এখন সেখানে কোনরকম রাজনৈতিক সমঝোতার সুযোগ নেই। তাদের জন্য হয় পূর্ণ বিনাশ অথবা পূর্ণ বিজয় অপেক্ষামান কিন্তু ৭.৫ কোটি মানুষের জীবনউৎসর্গ বৃথা যাবে না ।
চলতি মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন নিয়ে সংবাদবাহকের সাথে কথা বলছিলেন অশীতিপর ন্যাপ লিডার ।
মওলানা ভাসানি বলেন , ইহা বিস্ময়কর যে সেসব দেশ , যারা নিপীড়িতদের জন্য অবস্থান নিয়েছিল , বর্তমানে বাংলাদেশে মানুষের জীবনের উপর নজিরবিহীন নির্যাতন এবং কারনরহিত ধ্বংসের সময় নিশ্চুপ।
তিনি বলেন যে, তিনি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জনাব কউসিগিন , চাইনিস সভাপতি জনাব মাও সে তুং , মার্কিন রাষ্ট্রপতি জনাব নিক্সন এবং ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী জনাব হিথ এর নিকট টেলিগ্রাম প্রেরণ করেছিলেন , অনুরুধ করেছিলেন পাকিস্তানি রটনার দ্বারা বিভ্রান্ত হউয়ার পরিবর্তে তাদের গুপ্তচর প্রেরণ করতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ।
ন্যাপ লিডার বলেন যে , ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী নকশা এবং সুয়েজ খালে ফ্রান্স কর্তৃক বোমাবর্ষণ এর বিরুদ্ধে তার দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু ইহা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে , একই মানুষ যাদের জন্য তারা অশ্রুপাত করেছিল তারাই , “ বাংলাদেশের সংগ্রাম একটি বিচ্ছিন্নবাদি আন্দোলন” পাকিস্তান কর্তৃক এই জঘন্য প্রচারনা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে ।
তিনি বলেন তাদের জানা উচিৎ যে , “ইহা দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে শোষিত নিছক কঙ্কালসার ৭.৫ কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধ ” ।
মউলানা ভাসানি বলেন, স্বাধিনতা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি বাংলাদেশের জেলাগুলোর সর্বদল গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
মাওলানা বলেন যে মুস্লিম লীগের একটি অংশ ব্যাতিত সকল দল এখন প্রধান বিষয় মানুষের মুক্তির পক্ষে তাদের সমর্থন দিতে সচেষ্ট ।
শোষিত
চরম্পন্থিদের সর্বদলীয় কমিটিতে যোগদানের সম্ভাবনায় অন্য দলের প্রতি তাদের মনোভাবের প্রেক্ষিতে প্রশ্নের প্রত্যুতরে আওয়ামীলীগ ,ন্যাপ নেতা বিশেষভাবে বলেন : “ আমি মনে করি তারা যেই দলেরি অন্তর্ভুক্ত থাকুক না কেন, মানুষের আগে প্রধান কাজ হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ।“
মাওলানা ভাসানি বলেন যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ ছিল মুসলিমদের দুটি অংশ- শোষক এবং শোষিতদের মধ্যে।
সংবাদবাহকের সাথের এক আলোচনায় ন্যাপ লিডার প্রত্যাখ্যান করেন যে, তার দেশে সাম্প্রতিক বিপ্লব ভারত অথবা অন্য কোন রাষ্ট্র হতে আমদানি করা হয়েছিল । যখনি পাকিস্তানি শাসক কোন সমস্যা সমাধান করতে অসমর্থ হোন, তাদের চামড়া বাচাতে তারা ভারতকে দোষারোপ করেন। যদি ভারত এই বিপ্লবে ইন্দন যোগাত তাহলে এটাকে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাদেশিক সরকার হিসেবে স্বীকৃতি পেত, তিনি আর যোগ করেন যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে “ভারতের চর” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল ।
অশীতিপর নেতা বলেন যে , ব্রিটিশরা যথাসময়ে ভারত ছেড়েছিল এবং ইয়াহিয়া সরকারের বাংলাদেশ ত্যাগ করার এটা ছিল উপযুক্ত সময়। তিনি যুক্ত করেন , যত বিলম্ব হবে তত জটিলতা বাড়বে ।
মউলানা ভাসানি বর্তমানে তার স্ত্রী এবং সন্তানের অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞাত ।
ইয়াহিয়া সরকার দ্বারা তার গ্রেফতারের প্রতিবেদন সম্পর্কে সংবাদদাতার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন , “আমি জানি না আদৌ কি তারা জীবিত না মৃত”।
তিনি বলেন যে , তিনি প্রতিবেদনে শুনেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার কাগ্মারিতে অবস্থিত তার বাড়িটি ধংস হয়েছিল। কিন্তু তার স্ত্রী এবং সন্তান সম্পর্কে তার কাছে কোন তথ্য ছিল না। তত্সত্ত্বেও, তিনি বলেন যাহা তাকে ব্যাক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা করে টা হচ্ছে , পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক তার ছোট গ্রন্থাগারের সমূল ধ্বংসসাধন যার অন্তর্গত ছিল তার জীবৎকাল সংগ্রহ ।
<৪,২১১,৪৬৩>
অনুবাদকঃ নন্দন দেব
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১১। মওলানা ভাসানির সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের বিবরণ ন্যাশনাল হেরাল্ড (নয়াদিল্লি) ৩ জুন, ১৯৭১
কোন রাজনৈতিক সমাধান নয়ঃ ভাসানি
মওলানা ভাসানির বক্তব্যের প্রতিবেদনঃ ২রা জুন, ১৯৭১ বাংলাদেশের কোন এক মুক্ত এলাকায় কিছু স্থানীয় এবং বিদেশী সংবাদদাতাদের সাথে।
অশীতিপর জাতীয় আওয়ামী পার্টি নেতা মউলানা ভাসানি সম্পূর্ণভাবে পরিস্কার করেছেন যে , তারা বাংলাদেশের বিষয়ে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি জন্য কোন প্রকার চর্চা চান না । তিনি তত্সত্ত্বেও, তার পূর্বের অবস্থান পুনরাবৃত্তি করেন যে, বাংলাদেশের জনগনের ইচ্ছা স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। ন্যাপ নেতা বাংলাদেশের কোন এক মুক্ত এলাকায় কিছু স্থানীয় এবং বিদেশী সংবাদদাতাদের সাথে আলাপ করছিল। তিনি জিজ্ঞেস করল, “হানাদারবাহিনির সাথে কিভাবে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হতে পারে যারা কিনা বাংলাদেশের লক্ষাধিক অসহায় মানুষ মেরেছিল এবং একটি আতঙ্কবাহিনিকে লেলিয়ে দিয়েছিল?”
মওলানা বলেন যে, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের দলবলকে শেষ করে দেয়া। তিনি বলেন, “আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করবঃ আমরা হয় বিজয় অর্জন করব অন্যথায় প্রান হারাব” ।
কিছু দিন আগে দেয়া আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতাদের মত তিনিও একি মেজাজে কথা বললেন। সংবাদদাতাদের সাথে কথোপকথনের সময় তিনি চিনাদের প্রতারনার কথা টানলেন এবং বললেন তিনি কখনই কম্যুনিস্ট ছিলেন না ।
আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন ইহা অদ্ভুত যে বিশ্বের দলগুলো নিরব দর্শকের মত ব্যাবহার করছে যখন বাংলাদেশ তার মানুষের রক্তে রঞ্জিত । তিনি বলেন , বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন প্রার্থনার জন্য এমন একটি দেশ বাকি নেই যার শরণাপন্ন তিনি হননি । তারা শুধু সমবেদনা প্রকাশ করেছিল।
লক্ষাধিক শরণার্থীকে খাদ্য এবং আশ্রয় দেয়ার জন্য ভারত সরকারের প্রতি ন্যাপ নেতা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি দুঃখবোধ করেন যে, সমাজতান্ত্রিক হোক বা সাম্রাজ্যবাদী হোক , কোন দেশই বাংলাদেশের মানুষের শোচনীয় দুরবস্থার নিমিত্তে কোন প্রকার নোট গ্রহণ করেন নি ।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে , ইসলামাবাদের সামরিক পরিসদের সাথে চিনাদের বন্ধুত্ব একটি অদ্ভুত রাজনীতি । তিনি আদৌ তার চীন পরিদর্শনের সম্ভাবনা অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন । দীর্ঘদিন ধরে চীনের মিত্র হিসেবে জনপ্রিয় মওলানা বলেন যে বেইজিং ইসলামাবাদকে সমর্থন করার ভুল একদিন বুঝতে পারবে।
মওলানা এই পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ অথবা জাতীয় সরকার গঠনের বিরুদ্ধে , তার মতে এতে নেতৃত্ব সঙ্কট হতে পারে যা তাদের উদ্দেশ্যকে বিপদ্গ্রস্ত করবে। তিনি বলেন তিনি একটি সর্বদলীয় কমিটি পক্ষে যা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘায়িত যুদ্ধের জন্য জনগনকে সংহত করবে।
তিনি জোরালোভাবে বললেন যে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ কখনোই একত্রে সাক্ষাত করতে পারবে না, তিনি ভবিষ্যৎবানী করেন “এই ফাটল সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্ত” ।
<৪,২১২,৪৬৪-৪৬৬>
অনুবাদকঃ তুলি
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১২। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রচারপত্র ৭ জুন,১৯৭১
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে বরিশাল ও অন্যান্য জেলায় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে, একে সমর্থন করুন! জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে সমগ্র পূর্ব বাংলায় গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান! জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করে নিজেদেরকে ঐক্যববদ্ধ করুন! নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে পূর্ব বাংলায় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করুন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক পূর্ব বাংলার জনগনের উদ্দেশ্য প্রচারিত। (পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক ৩রা জুন,১৯৭১ প্রতিষ্ঠিত)
(১)
পূর্ব বাংলার বীর জনগণ পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সুদীর্ঘ তেইশ বৎসরের ঔপনিবেশিক শোষন ও লুন্ঠনের পাহাড় উপরে ফেলার জন্য দেশের অফিস-আদালত -যোগাযোগ-ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ করে দেয় | এভাবে তারা সমগ্র পূর্ব বাংলার পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাষকগোষ্ঠীর লুন্ঠন ও শোষনের যন্ত্রকে বিকল করে দেয় |
ঔপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্টরা জনগনের জাতীয় মুক্তির শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম দমন করার জন্য বাংলার রাজধানী ঢাকার বুকে চরমতম ফ্যাসিবাদী বর্বরতা প্রদর্শন করে এবং অন্যান্য শহরে সৈন্য মোতায়েন করে হত্যা, লুট,অগ্নিসংযোগ ও গ্রেফতার চালায় |
যেখানেই অত্যাচার সেখানেই বিদ্রোহ-বিপ্লব |অহিংস অসহযোগের ভুল পথ পরিত্যাগ করে জনসাধারণ ফ্যাসিবাদী বর্বর হামলার বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতা বিদ্রোহী দেশপ্রেমিক বেঙ্গল রেজিমেন্ট,ইপিআর,পুলিশ, আনসার,সরকারি কর্মচারী,ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক,বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র জনসাধারণ অস্ত্রহাতে রুখে দাঁড়ায় এবং অধিকাংশ জেলা দখল করে নেয়,সামরিক দস্যুদের সেখানে খতম করে এবং ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে|
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্টরা পুনরায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় তাদের দখল কায়েমের জন্য বিরাট শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হত্যা,লুট,অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের তান্ডবলীলা শুরু করে | বিশেষ করে হিন্দু জনসাধারণের উপর তারা যে অত্যাচার চালায় তা হিটলারের ইহুদীবিরোধী তৎপরতাকে ম্লান করে দিয়েছে | এভাবে তারা পৃথিবীর বুকে অত্যাচারের নির্মমতম নজীর স্থাপন করে | সঠিক নেতৃত্ব ও পথে পরিচালিত না হওয়ায় সশস্ত্র দেশপ্রেমিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে,সামরিক দস্যুরা সমগ্র পূর্ব. বাংলাব্যাপী তাদের ফ্যাসিস্ট ঔপনিবেশিক দখল করতে সক্ষম হয়|
(২)
পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন প্রতিনিয়ত আওয়ামীলীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী,সকল দেশপ্রেমিক পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক পথে সংগ্রাম পরিচালনা করতে আহ্বান জানায় | বরিশাল জেলার ঝালকাঠীর মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিকরা আহ্বানে সাড়া দেয় | তাদের অংশগ্রহণসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের নিয়ে স্থানীয় ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা হয় |
ঐক্যবদ্ধ মুক্তিবাহিনী তফসিলী হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার বৃহত্তম পেয়ারা বাগান কুরিয়ানা,ডুমুরিয়া,ভীমরুলী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে|
এই গেরিলা যুদ্ধের রূপ হয় প্রধানত জাতীয় শত্রু খতম করা | অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েকশত জাতীয় শত্রু খতম করা হয়,দুজন পুলিশসহ দুই ইজ্ঞিন বিশিষ্ট একটি স্পীড বোট দখল করা হয়|
মে মাসের প্রথম থেকে শুরু করে প্রায় দেড়মাস সময়কালীন এ অঞ্চলের গেরিলা যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক দস্যুরা এত ভীতসন্ত্রস্ত হয় যে,তারা বরিশাল জেলার প্রায় সমস্ত সৈন্য এবং অনেক থানার পুলিশ নিয়ে এ অঞ্চল ঘেরাও করে |তারা জলপথে কারফিউ জারী করে,গানবোট,সপীডবোট,লঞ্চ দিয়ে দিনরাত পাহারা দেয়,বরিশাল জেলার কয়েক হাজার মুসলিম জনসাধারণকে হত্যার ভয় দেখিয়ে পেয়ারা গাছ কাটা,মুক্তিবাহিনীকে খোঁজ করা,হিন্দুদের বাড়ি লুট করা,তাদেরকে খতমের জন্য নিয়ে আসে|
এ অঞ্চলের সমস্ত ঘরবাড়ি তারা জ্বালিয়ে দেয়,লুট করে,শত শত লোককে হত্যা করে,পেয়ারা গাছ কেটে ফেলে,কিন্তুু মুক্তিবাহিনীর সন্ধান তারা পায়নি | মুক্তিবাহিনী তাদের ঘেলাও পার হয়ে বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে | কোন শক্তিই তাদেরকে ধ্বংস করতে পারবেনা| বরিশালের গেরিলা যুদ্ধের সমর্থনে পূর্ব বাংলার অন্যান্য স্থানে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চলছে |
(৩)
পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে মেতেছে| তারা লুন্ঠন-শোষন বজায় রাখা এবং চীন জনগন কমিউনিজম বিরোধিতার জন্য গোটা পাকিস্তান ও ভারত যৌথ সামরিক জোট বা পূর্ব বাংলা-ভারত যৌথ সামরিক জোট স্থাপনের দ্বিমুখী লক্ষ্য সামনে রেখে, তাদের সমর্থকদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রামকে ব্যবহার করছে |পাকিস্তান যাতে তাদের হাতছাড়া না হয় এ জন্য তারা একে সাহায্য ও সহায়তা করছে|এ উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের মাঝে সহযোগিতা করছে আবার পাকিস্তান-বাংলাদেশের উপর একচেটিয়া প্রভাব স্থাপনের জন্য নিজেদের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও করছে|
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পূঁজিবাদ ও সামন্তবাদ এই চার পাহাড়ের শোষনের প্রতিনিধিত্বকারী ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শাষকগোষ্ঠী তাদের সমর্থকদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন ও সহায়তা করছে| তাদের উদ্দেশ্য হলো পূর্ব বাংলায় এই চার পাহাড়ের শোষন ও লুন্ঠন কায়েম করা এবং চীনবিরোধী জনগন ও কমিনিস্ট বিরোধী বাংলা-ভারত যৌথ সামরিক জোট স্থাপন করা|
● অতীতে নেতাজী সুভাষ বোস ভারতের আনয়নের জন্য জাপানী ফ্যাসিস্টদের সহায়তায় আজাদ হিন্দু ফৌজ ও সরকার গঠন করে এবং জাপান-জার্মান ফ্যাসিস্টদের মিত্র হিসেবে কাজ করে| জাপানী ফ্যাসিস্টদের সহায়তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল আজাদ হিন্দু ফৌজ ও সরকারকে নিজের সাহায্যকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা| দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরাজয় জাপানীদের এ স্বপ্ন নস্যাৎ করে দেয়| এভাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের সহায়তায় ভারতকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়|
অতীত. ও বর্তমান বিশ্বের ঘটনাবলী আমাদের শিক্ষা দেয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সহায়তায় কখনই পূর্ব বাংলা বা বিশ্বের অন্য কোন দেশ,জাতি ও জনগনের সত্যিকার মুক্তি আসতে পারে না এদের সহায়তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে হয় বানচাল করবে বা জাতীয় মুক্তির নামে চার পাহাড়ের শোষন ও লুন্ঠন পূর্ব বাংলায় কায়েম করবে|
পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক জনগন ও বিশ্বের বিপ্লবী জনগন পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদ,সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের এ সকল জঘন্য চক্রান্তকে কখনই সমর্থন করতে পারে না|
কাজেই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাষকগোষ্ঠীকে উৎখাত করার সাথে সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ,সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে ও পূর্ব বাংলা থেকে উৎখাত করতে হবে এবং ভারতীয় সম্প্রসারণআবাদের মাধ্যমে চার পাহাড়ের শোষন কায়েমের বিরোধিতা করতে হবে এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাহায্যের উপর ভিত্তি না করে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে|
(৪)গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা প্রমান করেছে পূর্ব বাংলার জনগনের মহান জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সঠিকপথে পরিচালিত করার জন্য একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির প্রয়োজন | এইরূপ একটি বিপ্লবী পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন গত সাড়ে তিন বৎসর ধরে বিপ্লবী কাজ করে আসছে | এ সময়কার বিপ্লবী অনুশীলনে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক,সাংগঠনিক,সামরিক লাইনের সঠিকতা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমানিত হয়েছে| পক্ষান্তরে মণি সিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী,হক-তোয়াহা নয়া সংশোধন বাদী দেবেন-মতিন-ট্রটস্টিক চে’বাদী,কাজী-রনো ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্র রাজনৈতিক,সামরিক ও তত্ত্বগত ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছে| পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা ও পরিচালনা করার মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছে ; দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়ে তুলেছে ; বিপ্লবী অনুশীলনের প্রক্রিয়ার মতাদর্শগত ক্ষেত্রে পুর্নগঠিত হচ্ছে | এভাবে সর্বহারা রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার যথাযথ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে|
এ কারনে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সমাপ্ত করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছে| ইহা পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেনীর রাজনৈতিক পার্টি এবং এর পথপ্রদর্শক. তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো মার্কসবাদ লেনিনবাদ মাও সেতুঙ চিন্তাধারা| ইহা হচ্ছে বিশ্বের বিপ্লবী সংগ্রামবের অভিজ্ঞতার সার সংকলন, ইহা বিপ্লবের বিজ্ঞান | ইহার প্রয়োগের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার বিপ্লব বাস্তবায়িত হবে|
পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন ;পূর্ব বাংলার সকল সংগ্রাম রু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ধর্মীয়, ভাষাগত উপজাতীয় সংখ্যালঘু,মুক্তিবাহিনী, বিভিন্ন শ্রেণী, স্তর,অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগন ঐক্যবদ্ধ হোন;বরিশালের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করুন; নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে জাতীয় শক্তি খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান;জাতীয় শত্রুর অস্ত্রে নিজেদেরকে সজ্জিত করুন;গ্রামসমূহ থেকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সরকারের দালালদের উৎখাত করুন;গ্রামকে মুক্ত করুন;- এভাবে পূর্ব বাংলার ভূমিতে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে পাকিস্তানী সামরিক দস্যুদের পরাজিত ও ধ্বংস করুন;পূর্ব বাংলাকে মুক্তি করে স্বাধীন গনতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েম করুন|
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ |
জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট-কায়েম করুন| জাতীয় মুক্তিবাহিনী-জিন্দাবাদ |
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ-জিন্দাবাদ|
পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক সামরিক দস্যু ও তাদের দালাল জাতীয় শত্রুদের খতম করুন| মণি সিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী,দেবেন-মতিন ট্রটস্ফি-তে’বাদী,কাজী, রনো ষড়যন্ত্রকারী-ধ্বংস হোক|
<৪,২১৩,৪৬৭-৪৬৯>
অনুবাদক: তুলি, জিহাদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৩। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য শাজাহান সিরাজের বক্তৃতা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দলিল ২৫ জুন,১৯৭১
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
BANGLADESH CENTRAL STUDENT’S ACTION COMMITTEE
বাংলাদেশের মুক্তিকামী ভাই-বোনেরা,
বিশ্বের ইতিহাসের জঘন্যতম গনহত্যাকারী, রক্তলোলুপ, খুনী, লম্পট, মদখোর, পিশাচ ইয়াহিয়া ও তার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বুলেট,বেয়নেট,ট্যাংক, কামান আর পাশবিক অত্যাচারে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের গনজীবন আজ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত| বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর প্রানের চেয়ে প্রিয় বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করার জঘন্য ষড়যন্ত্রকারী খুনী ইয়াহিয়া ও তার হানাদার বাহিনী বিনা নোটিশে বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়াছে|যুদ্ধের সশস্ত্র আইনকানুন উপেক্ষা করে ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত বাংলার শহর,বন্দর, গ্রামের নিরস্ত্র মানুষের উপর অতর্কিতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে| হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা আজও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করছে গ্রামের পর গ্রাম,বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ,মসজিদ-মন্দির,হাট-বাজার,দোকানপাট | বাংলাদেশের একের পর এক তল্লাশি করে সক্ষম যুবকদের মেশিনগানের শিকার পরিনত করেছে|লক্ষ লক্ষ নিরীহ পরিবারকে করেছে গৃহহারা | বর্বর সেনাবাহিনীর অত্যাচার এখানেই শেষ নয়| বাংলাদেশের মা-বোনেরাও রক্ষা পায়নি তাদের পাশবিক অত্যাচারের হাত থেকে| পিতার সামনে যুবতী মেয়েকে,স্বামীর চোখের সামনে স্ত্রীকে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে | শত শত মা-বোনকে ধরে নিয়ে তাদের ইজ্জত নষ্ট করে তাদেরকে উলঙ্গ করে ফেলে রাখছে পথে -প্রান্তরে | প্রতিদিন শত শত যুবকের রক্ত নিয়ে মৃতদেহ নদীতা ভাসিয়ে দিচ্ছে|এই বর্বরতা নিয়ে রেহাই পায়না দুধের শিশু আর বৃদ্ধরাও|
কিন্তুু মাতাল ইয়াহিয়া বাহিনীর এই পাশবিক অত্যাচার পারেনি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে|২৫শে রাতে গ্রেফতারের আগে স্বাধীন বাংলার জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব”স্বাধীন গনতান্ত্রিক বাংলাদেশ ” ঘোষণা করেছেন| নেতার নির্দেশে বাংলার প্রতিটিআনাচে-কানাচে পৌঁছানোর সাথে সাথে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ই পি আর বাহিনী,পুলিশ,আনসার,মুজাহিদ ও মুক্তিবাহিনী এক হয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করতে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে|বাংলার সাড়ে সাত কোটি কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, মেহনতি মানুষও পাকিস্তান উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার নিয়েছে এক ইস্পাতকঠিন শপথ| পৃথিবীর যে কোন বৃহৎ শক্তিকেই বাংলার এক মুক্তিসংগ্রামের কাছে মাথা নত করতে হবে|কারন এ সংগ্রাম বাঙালি জাতির বাঁচার সংগ্রাম,এ সংগ্রাম সত্যের সংগ্রাম |দিনের পর দিন জনতার মুক্তিমিছিল এগিয়ে চলেছে সাফল্যের স্বর্নশিখরের দিকে| আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরবিক্রমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করে চলেছে | প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলাদের আক্রমনে শত শত পাকিস্তানি হানাদার শত্রু নিহত হতে চলেছে|ইতিমধ্যে প্রায় বিশ হাজার পাকিস্তানি শত্রুসেনাকে খতম করা হয়েছে|
বাংলার প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী ভাই-বোনদের মনে রাখতে হবে শেখ মুজিব আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে নাই| ইচ্ছা করলে তিনি বাংলার স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে কুচক্রী ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন |কিন্তুু তা তিনি করেন নি| জালেম ইয়াহিয়ার কাছে মাথা নত করেননি বলেই ২৫শে মার্চের সেই নারকীয় বিভীষিকার রাতে জেল,জুলুম আর মৃত্যুকে হাসিমুখে বরন করে সরাসরি বাংলার স্বাধীনতাপৃষ্ঠা -৪৬৮বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল: চতুর্থ খন্ডঘোষণা করেন| নেতা আজ নরখাদক ইয়াহিয়ার কারাগারে কোথায় কিভাবে আছেন তা আমরা জানিনা| কিন্তুু বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ ও তাঁর বজ্রকন্ঠ আজ প্রতিটি বাঙালির মনে সদাজাগ্রত| যুব সমাজের উপর যে বিশ্বাস স্থাপন করে তিনি স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন আমরা যুবকেরা যেন তা ভুলে না যাই,আমরা যেন বিশ্বাসঘাতকতা না করি,
ভাই-বোনেরা আমার মনে রাখতে হবে আমাদের সকল পরিচয় আজ একটি আমরা মুক্তিযোদ্ধা| অতীতের বিদ্বেষ ভবিষ্যতের মোহ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আজ আমরা লক্ষ লক্ষ যুবক যদি প্রতিটি পাকিস্তানি ফৌজ খতম করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই,পৃথিবীর কোন শক্তিই বাংলার স্বাধীনতাকে রুখতে পারবেনা| বঙ্গবন্ধুকেও আমরা কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনতে পারব| আজ তাই যুবকের যেখানেই যে আছেন নিকটবর্তী ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং নিন| ইতিমধ্যে লক্ষাধিক যুবক ট্রেনিং ক্যাম্পে ভর্তি হয়ে হানাদারদের বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করার কলাকৌশল শিক্ষা গ্রহণ করছে,কিছু দিনের মধ্যেই হানাদার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নিশ্চিত হত্যা করবে|
কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি ভাইয়েরা বাংলাদেশর শতকরা ৮০ জন আপনারা কৃষক ও শ্রমিক |আপনাদেরও আজ শত অত্যাচারের মুখে বাংলার এই মুক্তিযুদ্ধে অংশীদার হতে হবে| আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়| আপনারা আজ নিরস্ত্র | শত্রুর মোকাবিলা করার মত অস্ত্র আজ আমাদের হাতে নেই|কিন্তুু বুলেট বেয়োনেটের চাইতেও আমাদের বড় অস্ত্র আপনাদের হাতে রয়েছে|অসহযোগ ও আত্ননির্ভরশীলতাই আজ আপনাদের বড় অস্ত্র |ইয়াহিয়া সরকারের কোন আইন আপনারা মানবেন না|বাংলাদেশর উপর কোন আইন প্রয়োগ করার অধিকার তাদের নেই|খাজনা,ট্যাক্স দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিন|যদি কেউ খাজনা নিতে আসে তবে তাকে ধরে শাস্তি দিন| আমাদের অর্থ দিয়ে আমাদের ধ্বংস করার গুলি যাতে না কিনতে পারে তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রকার দ্রব্যসামগ্রী কেনা বন্ধ করুন| বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে এমন দ্রব্যাদি যেমন পাট,চা,চামড়া ইত্যাদির উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিন| প্রত্যেকটি গ্রামে আজ সম্পূর্ণ আত্ননির্ভরশীল সমাজ গড়ে তুলুন|খাদ্যের অভাব যাতে দেখা না দেয় তার জন্য ধানের চাষ বৃদ্ধি করুন|মনে রাখতে হবে পরনির্ভরশীলতাইই আপনাদের বড় শত্রু |
আপনাদের আজ সর্বপ্রথম কর্তব্য-যে সকল জামাত-মুসলিম লীগের দালালেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করছে,যারা আপনাদের ধন সম্পদ লুট করছে,যারা শত্রুসেনাদের কাছে খবরাখবর আদান-প্রদান করছে তাদের হত্যা করা| তাদের নামের তালিকা করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দিন| মুক্তিযোদ্ধারা আপনাদের আশেপাশেই আছে|ইতিমধ্যেই শত শত দালালদের হত্যা করা হয়েছে|
প্রত্যেকটি গ্রাম থেকে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা অনায়াসে শত্রুসেনাদের আক্রমণ করতে পারে তার জন্য আপনারা প্রত্যেকটি গ্রামবাসি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়,খাওয়া ও যোগাযোগের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করে দিন|
কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি ভাইয়েরা মনে রাখবেন এ যুদ্ধ শুধু বাংলার ভৌগলিক স্বাধীনতাই এনে দেবেনা|এ যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসাবে আপনাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে এক শোষণহীন সমাজব্যবস্থা |
পাকিস্তানি কুকুর বাহিনীর নৃশংস তাড়নায় বাংলাদেশর ৬০লক্ষ মানুষ আজ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন|শরনার্থী ভাই বোনদের একটি কথা মনে রাখতে হবে|আপনারাও শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন|তাই আপনারাও এ যুদ্ধের অংশীদার |আপনাদের যে সমস্ত ঘরবাড়ি,ধনসম্পদ ফেলে এসছেন তা আবার ফিরে পাবেন|পাকিস্তানি হানাদারদের দয়ার উপর নয়,কোন বৃহৎ শক্তির চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে নয়-হাতে আমরা অস্ত্র নিয়েছি, রক্ত আমরা দিতে জানি তাই যুদ্ধ করেই শত্রুর মোকাবেলা করে বাংলাদেশের মাটিতে আপনাদের ফিরিয়ে নেব|পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশের যে দালালরা আপনাদের ধনসম্পদ কেড়ে নিয়েছে,মনে রাখবেন আপনাদের চোখের সামনেই তাদের একমাত্র শাস্তি
হবে মৃত্যুদন্ড। শরনার্থীদের মধ্যে ঢুকে কেউ যাতে কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য আপনারা অবশ্যই সজাগ থাকবেন। ৬০ লক্ষ শরনার্থীর প্রতি ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ যে মানবতাবোধ দেখিয়েছেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ ও বাংলার জনগণ তা চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। বাংলাদেশে পৈশাচিক ইয়াহিয়ার নরহত্যা আজ যখন পৃথিবীর ইতিহাসকে স্তব্ধ করে দিয়ে এক নতুন কলঙ্কের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তখন বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গ নীরব ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের কোন কোন বৃহৎশক্তি আজ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করছে। আমরা সেইসব বৃহৎশক্তিবর্গকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই আমরা আজ বাংলার স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, কোন প্রকার আপসের মাধ্যমে এর সমাধান করা যাবে না কারণ স্বাধীনতা কোন আপস মানে না। স্বাধীনতা ভিক্ষা করে আসে না। আমরা তাই কারো কাছে ভিক্ষা চাই না। তবে আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা যারা করবেন, বিশ্বের জাগ্রত বিবেকের সামনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করছে দেখেও যারা নীরব আছেন, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না, ইতিহাসের পাতায় তাদেরকেও পাকিস্তানী জালেমশাহীর সমান কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হবে, মানবতার শত্রু হয়ে চিহ্নিত থাকতে হবে।
খুনী ইয়াহিয়া-জানি লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত নিয়েও তোমার পিপাসা আজও মেটেনি। কিন্তু তুমি জেনে রাখ, যেসব পাঞ্জাবী, পাঠান, বেলুচ, সিন্ধী সেনাবাহিনীকে দিয়ে তুমি বাংলার লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ, নিরস্ত্র নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছ বাংলাদেশকে পুড়ে ছারখার করছ, তাদের একটিকেও আমরা বাংলাদেশ থেকে ফিরে যেতে দেব না। একটি একটি করে তাদের হত্যা করব। বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে স্বচক্ষে প্রতিটি পাকিস্তানী সেনার লাশ তোমাকে দেখতে হবে। জানি বাংলাদেশ থেকে তুমি অনেক দূরে আছ। বাংলাদেশ থেকে তোমার পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তোমাকে আর তোমার সেনাবাহিনীকে খতম করব। তোমার সাধের পশ্চিম পাকিস্তানকে ভেঙে চুরমার করে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে পাকিস্তানের নাম নিশানা মুছে ফেলবো।
আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা তাদের একটি দৃঢ় আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। স্বাধীনতা আমাদের ভোগ করার জন্য নয়। আমাদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের উত্তরসূরীদের জন্যই এ স্বাধীনতা। আমরা মায়ের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে এসেছি। হয়তো আমরা কেউ আর মায়ের কোলে ফিরে যাব না কিন্তু যারা আমার বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে, যারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করছে তাদের প্রতিশোধ যদি আমরা নিতে না পারি তাহলে ইতিহাসের পাতায় আমাদের মীরজাফর হয়ে বেঁচে থাকতে হবে- আজীবন পাঞ্জাবের গোমাল হয়ে থাকতে হবে। পিঠে বুলেট খেয়ে আমরা যেন বিশ্বাসঘতকতা না করি। আমরা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা বুকে বুলেটবিদ্ধ হয়ে শহীদ হব। এতে যদি একটি একটি আমাদের সবাইকে শহীদ হতে হয় তাহলেও সে রক্ত বৃথা যাবে না। শহীদের রক্তে রঞ্জিত প্রতিটি ধূলাকণা সেদিন এক একটি বুলেট হয়ে শত্রুদের খতম করবে। বাংলাদেশের মায়েরা-জানি তোমাদের কোল আজ খালি হয়েছে। নিষ্ঠুর হানাদার বাহিনী লাখ লাখ সন্তানকে তোমাদের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করেছে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলার এই স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে যে মায়ের সন্তান শহীদ হয়েছে সে মা কাঁদবে না, সে মায়ের চোখের অশ্রু হবে বারুদ- যে বারুদ পুড়ে ছারখার হবে ইয়াহিয়া ও তার সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে লাখ লাখ সালাম ও শ্রদ্ধা জানাই বীর শহীদদের। জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।
শাজাহান সিরাজ
সাধারণ সম্পাদক,
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ সদস্য
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
<৪,২১৪,৪৭০-৪৭২>
অনুবাদকঃ সাদ্দিউন ফাহাদ জয়, নন্দন দেব
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৪। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের প্রবাসী বুদ্ধিজীবীগণ কতৃক যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের কাছে প্রদত্ত স্মারকলিপি পশ্চিমবঙ্গে প্রবাসী বুদ্ধিজীবী ২৯ জুন,১৯৭১
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধি দলের স্মারকলিপি
মহাশয়েরা,
সরকার মরিয়া প্রচেষ্টা মুখে। পাকিস্তান বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে বাংলাদেশে তাদের জবরদস্ত সামরিক দখলদারিত্ব ন্যায্যতা এবং সেখানের গণহত্যা ঢাকতে চায়। আমরা আপনাদের মূল্যয়ন করছি এই সুযোগে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মাননীয় সদস্য, পরিস্থিতিতে যার অধীনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথে চালিত হয়।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ পাকিস্তান সামরিক জান্তার মধ্যরাতে, পাকিস্তানের তথাকথিত সরকার জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ডিসেম্বর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই নির্বাচনে মানুষ স্পষ্ট দিয়েছেন প্রকাশ পেশ বাংলাদেশ কঠিনভাবে আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট লীগের ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় সংজ্ঞায়িত। আওয়ামী লীগ ৩১৩টি হাউসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১৬৯ টি আসন, যা জাতীয় পরিষদে এটা জন্য একটি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা বোঝানো ১৬৭ জিতেছে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় সফল প্রার্থীরা বাংলাদেশে নিক্ষেপ ভোট ৮0% পেয়েছি।
ইয়াহিয়া খান মধ্য মার্চে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন কিন্তু আসলে শুধুমাত্র বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক প্রস্তুতি এবং সৈন্য প্রেরণের জন্য একটি কভার হিসাবে এই ব্যবহার। এই আলোচনার আশা অবশ্যই একটি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের কাঠামোর যা শেখ শেষ মুহূর্তে পাকিস্তান আর্মি তাড়িত পর্যন্ত চেষ্টা, বিশ্বাসঘাতকতা সমসাময়িক ইতিহাসে অতুলনীয় একটি আইন মধ্যে একটি নিষ্পত্তির জন্য উত্থাপিত হয় যখন। বন্দুক, ট্যাংক এবং প্লেন নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। বাঙালিদের গণহত্যার একটি প্রোগ্রাম চালায়।
শত শত এবং হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে, পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর বাংলা সদস্য এবং পুরুষ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের একটি বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের, যা পরে পুত্র ও বাংলাদেশ কন্যাগণ হাজার হাজার দ্বারা যোগদান করেন ।
এই পটভূমিতে দেখা যায় এটা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ১0 এপ্রিল ১৯৭১,জন্মগ্রহণ করে। এটা জনগণের অবিচ্ছেদ্য নিরাপদে বাস করার অধিকার, যা দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল তার অনুমোদন আহরিত খারাপ বিশ্বাস ও ২৫ মার্চ রাতে আস্থাশীল বাঙালির ওপর সামরিক জান্তার গণহত্যা হামলা। পাকিস্তান এখন মৃত এবং লাশের পাহাড়ের নীচে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা হাজার হাজার মানুষ হত্যার কারনে পশ্চিম পাকিস্তান এবং তাদের জনগনের সাথে এক অভেদ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে। ইয়াহিয়া খান এবং তার জান্তারাই পাকিস্তানের কবর খনন করে।
তাদের আদেশেই পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা অমানষিক বর্বরতা এবং ধর্ষণ করে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের কমান্ডারদের আদেশে সামরিক আইন ভঙ্গ করে এবং হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসের উত্সবে মেতে উঠে যা ইতিহাসে বিরল। বিদেশী সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় যাতে আন্তর্জাতিক মন্ডলে যুদ্ধের খবর না পৌছায়। কিন্তু কিছু সাংবাদিক তবুও থেকে যায় গনহত্যা এবং অমানবিক নৃশংসতার খবর সংগ্রহের জন্য। করাচি থেকে পাকিস্তানি সাংবাদিক এন্টনি মাসকার্নেহাস এর “দ্যা সানডে টাইমস” মাধ্যমে আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জঘন্যতার খবর জানতে পারি। এইসব জঘন্য আচরন পরিস্কারভাবে নির্দেশ করে দুই জাতি এবং দেশের ধারনা অনেক আগে থেকেই ইয়াহিয়া এবং তার সহযোগীদের মনে ছিল যারা তাদের স্বজাতির সাথেও জঘন্য আচরন করতে দ্বিধা করত না। এইটা একটা অস্বাভাবিক সেনাবাহিনী যারা বাংলাদেশের প্রতি বর্ণবাদী ও ঘৃনাপূর্ন মনোভাব নিয়ে তাদের দমন করতে এবং ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এইকারনে বাংলাদেশের অবস্থা আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশের গৃহযুদ্ধ থেকে সম্পূর্ন আলাদা ছিল। এই ক্ষেত্রে দুটি অংশের একাংশ একজাতির একটা ধারনার এখনও উপর পুনর্মিলন অর্জন করতে পারে ভেবে যুদ্ধ করছিল। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান একটি অস্বাভাবিক দেশ হিসাবে আধুনিক ইতিহাসে অনন্য কারন তার দুটি অংশ আন্তর্জাতিক পরিসীমায় ১০০০ মাইলেরও বেশী দুরে। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ন আলাদা।
বাংলাদেশের জনগন এসব সত্ত্বেও পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ফর্মুলার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার জন্য প্রচেষ্টার নামে বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশের উপর গণহত্যা চালায়। কোন কিছুই না পাবার একটি অবস্থানে পৌছায়। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মানচিত্রে সার্বভৌম ও স্বাধীন দেশ। ২৫ মার্চের আগেই সকল সম্ভবনা উড়িয়ে দিল বর্বোরচিত আক্রমণ, জনগণের উপর হত্যাকান্ড যাদের একমাত্র পাপ তারা সাংবিধানিক উপায়ে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক অবস্থার একটি পরিবর্তন দাবিতে ছিল।
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হয়েছে যারা বৈধ, আইনি ও নৈতিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করে।
পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যারা অবৈধ এবং অনৈতিকভাবে বাংলাদেশের শহর দখল করে তারা কখনোই বৈধ সরকার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
মানুষ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের সরকারদের উচিত ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক জান্তার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পাশে দাড়ানো। ব্রিটেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের জনক অবিলম্বে এ ব্যাপারে কাজ করবে এবং অন্যদের পথ দেখাবে। আমরা আপনাকে ও আপনার মাধ্যমে ব্রিটেন সরকারের কাছে নিম্নলিখিত বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে আবেদন করছি,
১. গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন জানানো।
২. শেখ মুজিবুর রহমান সহ বাংলাদেশ এর অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদানে ইসলামাবাদের উপর চাপ প্রয়োগ।
৩. স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বাংলাদেশে সব ধরনের সাহায্য দান।
৪. পাকিস্তানে সব সাহায্য বন্ধ রাখুন।
৫. পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ রাখুন।
৬. ইয়াহিয়াকে গণহত্যা বন্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করুন।
৭. পাকিস্তান সেনা কর্তৃক সংঘটিত গনহত্যা ও ধর্ষণের তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তির জন্য একটি আন্তর্জাতিক বিচার কমিশন প্রতিষ্ঠা করুন।
বনগাঁ
২৯ই জুন, ১৯৭১
আপনার বিশ্বত,
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত
বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবীগণ ।
<৪,২১৫,৪৭৩>
অনুবাদকঃ নন্দন দেব
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৫। পাকিস্তানের সাথে আপোষের বিরোধিতা করে মাওলানা ভাসানী দি হিন্দুস্তানস টাইমস
(নয়াদিল্লি) ৩০ জুন, ১৯৭১
স্বাধীনতার বিষয়ে ইয়াহিয়ার সাথে কোনো সমঝোতা নয় : ভাসানি
জাতীয় আওয়ামী পার্টি লিডার , মাওলানা ভাসানি , আজ জোরালোভাবে পরিস্কার করলেন যে , উল্লেখিত বাংলাদেশ সংক্রান্ত রাজনৈতিক মীমাংসা নিয়ে কোনরকম আপোষ নয়।
একটি সংবাদ সম্মেলনে, মাওলানা ভাসানি পুনরাবৃত্তি করলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যতই গভীর ষড়যন্ত্র হোক না কেন , এত ব্যর্থ হওয়া নিশ্চিত ছিল।
উনি বললেন , বাংলাদেশের জনগন যখন তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে, যখন তাদের নারীদের সম্মানহানি হয়েছে , যখন তারা তাদের স্বাস্থ্য এবং বাড়ি হারিয়েছে এবং তাদের নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে এবং তাদের ১০লক্ষ মূল্যবান জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে, তখন তারা রাজনৈতিক মীমাংসার নামে ধোকামি গ্রহণ করবে না।
আমেরিকার সমালোচনা
“তারা দৃঢ়সঙ্কল্প হয় পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা মৃত্যুবরণ । সেখানে কোনপ্রকার সমঝোতা অথবা বিশৃঙ্খল মীমাংসা নয়। যদি কোন দল পূর্ণ স্বাধিনতাকে উপেক্ষা করে এবং ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলায়, তাহলে উক্ত দল বিদ্রোহী মুসলিম জনতা লীগ থেকেও বেশি নিন্দিত হবে। তাদের রাজনৈতিক মৃত্যু অনিবার্য ।“
আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহর বিষয়ে মাওলানা তিব্র সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন শুধুমাত্র মুক্ত বাংলাদেশের মানুষ নয় এমনকি আমেরিকা সহ বিশ্বের গনতান্ত্রিক এবং শান্তিকামী মানুষ মার্কিন সরকারের কাছে “নিকৃষ্ট ইয়াহিয়া সরকার” এর প্রতি অস্ত্র অথবা আর্থিক সাহায্য বর্ধিত করা থেকে বিরত থাকতে বারংবার আবেদন করেছিল।
তিনি আক্ষেপ করেন যে, মার্কিন সরকার বিশ্ব মতামত উপেক্ষা করেছিল এবং পাকিস্তানকে পূর্বের থেকে বেশি পরিমাণে আধুনিক অস্ত্র এবং বিমান সহযোগিতা করেছিল । মাওলানা ভাসানি আরো যুক্ত করেন “ তারা এভাবে তাদের নিজ চরিত্র উন্মোচন করল যা মানবতা বিরোধী । নিক্সন প্রশাসনকে এই নীতির পরিনাম বহন করতে হবে,”।
শেষ মহাযুদ্ধ থেকে, সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকার একটি ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করছে এবং আফ্রো-এশিয়ান ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর মধ্যে এর কর্তৃত্ব ও শোষণ চিরস্তায়ী করার চেষ্ঠা করছে । কিন্তু আমেরিকা সরকারের এটা অনুধাবন করা উচিত যে , যদিও তারা আগ্রাসী ইয়াহিয়াকে সকল প্রকার অস্ত্র দিতে পারে, কিন্তু শোষকদের হাত থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির তাদের দেশ মুক্ত করার প্রচেষ্ঠা তারা ব্যর্থ করতে পারবে না ।
মাওলানা ভাসানি বলেন বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামের জনগন অনেক কম ছিল । তবুও নিক্সন সরকার সেখানে জনগনের আন্দোলন বিফল করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যদিও এটাতে প্রতিদিনের ব্যয় ছিল ৫ কোটি । “আমেরিকা, চায়না এবং ব্রিটেন সহ যেসব দেশ ইয়াহিয়াকে অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল তার প্রশাসন এই মুক্ত বাংলাদেশে চিরস্থায়ী করার জন্য, একদিন ইতিহাস দ্বারা অভিযুক্ত হবে” ।
<৪,২১৬,৪৭৪>
অনুবাদকঃ আইনুল ইসলাম বিশাল
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৬। বিশ্বের বিদ্যোৎসাহী সমাজের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সাহায্য প্রাত্থনা করে বাংলাদেশের শিক্ষক সমিতির আবেদন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
১লা জুলাই,১৯৭১
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
(বাংলাদেশ শিক্ষকদের সমিতি)
দারভাঙ্গা ভবন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা-২, ইন্ডিয়া
প্রিয় বন্ধু, ১লা জুলাই,১৯৭১
আপনি সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের জনগনের উপর পাকিস্তান আর্মির নজিরবিহীন বর্বরতা সম্পর্কে অবগত আছেন। সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক ভারতে পার হয়েছে। শিক্ষক সম্প্রদায় গত দুই দশক ধরে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং একটি মাত্র সামাজিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্ব পূর্ন ভূমিকা রেখে আসছে, এই জন্য এর সদস্যগন স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশেষ লক্ষ্য বস্তু হয়েছে।অনেক শিক্ষক নিহিত হয়েছে, যারা দখলকৃত জায়গার মধ্যে আটকা পড়ে আছে তারা হয়রানি এবং অত্যাচারিত হচ্ছে, কিছু সংখ্যক বন্ধুকের মুখে পাকিস্তান আর্মির কর্মকান্ডকে সমর্থন করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছে।ফলস্বরূপ, এই হয়রানির শিকার সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রতিদিন ভারতে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ থেকে শিক্ষকরা ভারতে এখন অস্থায়ী নির্বাসিত, তারা নিজেদের একটি সমিতি গঠন করেছে যাদের পক্ষে আমরা আজ আপনার নিকট লিখছি।
প্রায় ১০০ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক,১০০০ কলেজ শিক্ষক এবং ৩০০০ স্কুল শিক্ষক আমাদের সঙ্গে তাদের নাম নিবন্ধন করেছে।ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য গুলোতে আরো কয়েক হাজার এসোসিয়েশনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।অধিকাংশ শিক্ষক তাদের পরিবার নিয়ে এসেছে এবং প্রত্যেকে প্রত্যেককে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যে করছে।
এই সম্প্রদায় অতীতে সমাজের জন্য অবদান রেখেছে এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর সমাজের পুনর্গঠনে সম্ভাব্য ভূমিকার বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা সম্ভাব্য পরিনতি থেকে তাদের রক্ষায় সব প্রচেষ্টা বিবেচনায় রেখেছি।শরনার্থী শিবির গুলোতে শিক্ষকদের অস্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক পেশা-গবেষনা, প্রকাশনা এবং উদ্বাস্তু শিশুদের শিক্ষার জন্য আমরা কিছু পরিকল্পনা গ্রহন করতে সক্ষম হয়েছি। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেসরকারি উৎস থেকে আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন হবে এছাড়াও একটি অবস্থান তৈরিতে ভারত সরকারের ও বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে।
বিশ্ব থেকে আমাদের এসোসিয়েশনের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য প্রতিষ্ঠানের কম্যুনিটির সদস্যেদের পক্ষ থেকে আমরা আপনার কাছে আবেদন করছি।সহযোগিতা বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নিকট পাঠানো যাবে। দারভাঙ্গা ভবন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা-২, ইন্ডিয়া
আপনার স্নেহভাজন
(ড.এ.আর. মল্লিক)
ভাইস চ্যান্সেলর।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এবং
সভাপতি।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
<৪,২১৭,৪৭৫>
অনুবাদকঃ সায়ান
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৭। বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে জহির রায়হানের একটি আবেদন বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ ৬ জুলাই,১৯৭১
বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ
জুলাই ৬,১৯৭১
সুধী,
আপনার সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, সাময়িক কালের জন্য যে সকল বাংলাদেশী শিক্ষক, লেখক, চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিক গোষ্ঠী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের উদ্যোগে ইতোমধ্যেই ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপরে সংযুক্ত আপিলে আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সমূহ বিশদভাবে বর্ণিত আছে। নিম্নোক্ত ঠিকানায় যোগাযোগ করলে আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
সংস্থার বর্তমান অর্থসঙ্কট কাটাতে বিশ্বের অন্যান্য ভ্রাতৃবৎ অঙ্গসংগঠন ও সহানুভূতিশীল ব্যাক্তি বর্গের আর্থিক অনুদান বা যে কোন প্রকারের সাহায্য আমাদের একান্ত প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আমাদের সকল প্রচেষ্টায় ,স্ব -অবস্থান থেকে আপনার সর্বোপরি ও যথাসম্ভব সহযোগিতা কামনা করছি।
যে কোন আর্থিক অনুদান পাঠাতে যোগাযোগ করুনঃ
ডঃ এ. আর. মল্লিক
প্রেসিডেন্ট,
বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ
১৭, সুন্দরী মোহন এভিনিউ
কলকাতা-১৪, ভারত
ইতি,
আপনার একান্ত অনুগত,
জহির রায়হান,
মহাসচিব
<৪,২১৮,৪৭৬-৪৮৫>
অনুবাদকঃ জিহাদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৮। সংসদ সদস্যদের সমাবেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ
বাংলাদেশ সরকার ৬ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশ পরিষদ সদস্যবর্গ সমাবেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ
স্বাধীন বাংলাদেশের মাননীয় পরিষদ সদস্যবর্গঃ
আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পেয়েছি। আজ জাতির ক্রান্তি-লগ্নে আমাদের এই সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মুক্তিফৌজের বীর নওজোয়ানেরা অপূর্ব বীরত্বের সাথে এখন শত্রুর মোকাবেলা করছে। হাজার হাজার যুবক পবিত্র মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আত্মোৎসর্গের মহান আদর্শে তারা বলীয়ান।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আপনারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বিশ্বাস করে তাদের দায়িত্ব আপনাদের অর্পণ করেছিল। আপনারা সবাই বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক বৈ আর কিছু নন। আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের সহচর হিসাবে তাঁর জীবনব্যাপী আদর্শ আর সংগ্রামের আমরা ধারক ও বাহক। আদর্শের জন্য, নীতির জন্য, নেতার কাছে আর বাংলার মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য এই ধরণের অটুট মনোবল আর কোন দেশের জনপ্রতিনিধিরা দেখাতে পেরেছেন কিনা তাঁর নজীর আমার জানা নেই। আপনাদের বীরত্ব, আদর্শনিষ্ঠ, মনোবল ও ত্যাগের জন্য আমি অভিনন্দন জানাই। আপনারা গৃহহারা সর্বহারা হয়ে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন- তাই আপনাদের প্রতি আকুণ্ঠ আন্তরিক সালাম আর অভিনন্দন।
বন্ধুরা আমার, নির্বাচন-উত্তরকালে রমনার রেসকোর্স ময়দানে আমাদের মহান নেতা আপনাদেরকে শপথবাণী উচ্চারণ করিয়েছিলেন। সেদিন সাক্ষী ছিল রেসকোর্স ময়দানের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী জনতা আর বাংলার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ। আমি আজ গর্বের সঙ্গে বলব, মহান নেতার হাত ধরে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে প্রতিজ্ঞায় আমরা অটুট এবং অটল রয়েছি। আপনাদের অসীম মনোবল বিগত কয়েক মাস যাবৎ স্বাধীনতা সংগ্রামকে জিইয়ে রেখেছে। অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে এই কথা বলতে হবে, আমাদের যে সমস্ত বীর সৈনিকেরা, মুক্তিফৌজের যে তরুণ সংগ্রামীরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন তাঁদের অপূর্ব বীরত্ব বাংলার মানুষের জন্য এক গর্বের বস্তু। আর ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য তা এক অপূর্ব বীর গাঁথা।
৬-দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আপনারা জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তা পালন করতে আপনাদের নেতা এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ কী কী প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তা আপনাদের জানা আছে।
জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ জানেন, একটা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে আপনাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। সেই খসড়া শাসনতন্ত্র পর্যালোচনা ও পরীক্ষার জন্য ৩০ সদস্য বিশিষ্ট সাব-কমিটি যখন আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিল, তখনই মার্চ মাসের সেই ১লা তারিখে হঠাৎ জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব ভুট্টো সাহেবের পরামর্শে আর তাঁর অভিমান রক্ষার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দেয়। সারা পৃথিবী জানে, আজকে পাকিস্তান দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার যদি কোন মূল আর সংগত কারণ থাকে, তাহলে সে অবস্থা সৃষ্টি আমরা করি নাই, করেছেন ইয়াহিয়া খান সাহেব আর ভুট্টো সাহেব। আর এর জন্য দায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকেরা, যারা ২৩ বছর পর্যন্ত বাংলার গরীব-চাষী মজুরের শোষণ করে পাহাড় গড়ে তুলেছে।
আওয়ামী লীগের মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আমরা কি অপরাধ করেছি? আমাদের একমাত্র অপরাধ ২ বছর পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, বাংলার মানুষকে শোষণ করে, বাংলার চাষী-মজুরের রক্ত শোষণ করে কায়েমী স্বার্থবাদীরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদীরা যারা বাংলাকে আজ রিক্ত করেছে, তারাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সেই সমস্যার সমাধান করতে চাইলাম বলে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের নেতা নির্বাচন পরবর্তীকালেও একটার পর একটা চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু যারা কায়েমী স্বার্থবাদের দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুজিবাদের দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত প্রভুদের দালাল- আজ যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করে শুধু বিসাল আর ভোগ করতে চায়, তারাই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রচেষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ালো। আওয়ামী লীগের আন্তরিকতারকে তারা দুর্বলতা মনে করে তাকে বানচাল করতে চেষ্টা করলো।
১লা মার্চের পর থেকে প্রতিটি ঘটনা যে কত দ্রুতগাতিতে অগ্রসর হয়েছিল যে আপনারা নিজেদের চোখে দেখেছেন। আমরা স্পষ্ট মনে আছে- যেদিন ইয়াহিয়া খান সাহেব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী ঘোষণা করলেন, সেদিন পূর্বাণী হোটেলে আমরা সম্মেলনে আর একবারের মত বসেছিলাম। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আমি ব্যক্রিগতভাবে একটার পর একটা প্রতিজ্ঞাবাণী উচ্চারণ করেছিলাম। আর আপনারা সেই প্রতিজ্ঞা প্রতিধ্বনিত করে আবার বলেছিলেন বাংলার মানুষের কাছে- আপনারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। দেশবাসী জানে বিশ্বাসঘাতকতা আপনারা করেন নাই। জঙ্গীশাহীর অত্যাচার, ইয়াহিয়ার প্রলোভন কোন কিছুই আপনাদের টলাতে পারে নাই। ইতিহাস এই কাহিনী একদিন স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখবে বলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস।
আপনারা নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন- অসহোযোগ আন্দোলনের বাণী নিয়ে বাংলাদেশের হাটে, মাঠে, ঘাটে, বাংলাদেশের সরকারী আদালতে। বাংলার দেশ-প্রেমিক ছাত্র-জনতার সাহায্যে আপনারা যে অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন, ইতিহাসে তাঁর নজীর নাই। সেই অসহযোগ আন্দোলনের সময় যখন আমরা একটা থেকে একটা সঙ্কটের মুখে উত্তরণ লাভ করেছিলাম, তখন ইয়াহিয়া খান সাহেব ১৫ মার্চ ঢাকায় আলোচনা করতে এসেছিলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা শুরু হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব , আপনি যদি বিন্দু মাত্র সত্য কথা বলেন, আজকে না হোক, কবরে গিয়েও যদি জবাব দেন- তাহলে অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম আলোচনাতেই আপনি স্বীকার করেছিলেন জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, মার্শাল ল’ উঠিয়ে নেবেন এবং ৬ দফার ভিত্তিতে একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র জারী করে ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেবেন। এর ভিত্তিতে আলোচনা হলো। বঙ্গবন্ধুর আদেশে এবং নির্দেশে আমি এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন সাহেব, আলোচনা শুরু করলাম। জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেবের পক্ষে ছিলেন লেঃ জেঃ পীরজাদা, প্রক্তন বিচারপতি কর্নেলিয়াস, আর অর্থনীতিবিদ বাংলার মানুষের চিরশত্রু এম, এম, আহম্মদ। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত আলোচনা হলো। ডকুমেন্টও তৈরী হলো। জাষ্টিস কর্নেলিয়াস সাহেব উপস্থিত ছিলেন। উনি যদি একজন সৎ-খ্রীষ্টান হয়ে থাকেন তাহলে তাকে এ কথা স্বীকার করতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আপনারা বলতে পারেন, নিরস্ত্র মানুষকে কেন গুলি করে মারলো? কেন পরিষদ সদস্যদের বাড়িঘরে কামান চালানো হলো?
সেই ২৫শে মার্চের রাতের আধারে এই বীভৎস ঘটনার প্রতিবাদে আপনারা রুখে দাঁড়ালেন। বাংলার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা মফঃস্বল শহরে, জেলা শহরে, গ্রামে, বন্দরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করবো আমাদের ও বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বীরত্ব আজকের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ই পি আর, আমাদের পুলিশ বাহিনী, আমাদের আনসার, আমাদের মোজাহিদরাও বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়াল। বন্দুক আর কামান তুলে নিল। আজ তারা সংগ্রামের পুরোভাগে। বাংলার গ্রামে, বন্দরে, গঞ্জে আপনারা দাঁড়ালেন। আমি কিভাবে যে আপনাদের শ্রদ্ধা জানাব তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। যে সমস্ত মিথ্যাবাদী বলে আওয়ামী লীগের নেতারা আর সদস্যরা সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল না তাঁদের আমি জবাব দিতে চাই। বাংলার মানুষ জানে আপনারাই আছেন পুরোভাগে। আমি জানি চট্টগ্রামে, ময়মনসিংহে, যশোরে, রংপুরে, খুলনায়, বরিশালে, ঢাকায়, ফরিদপুরে বাংলার সর্বত্র আপনাদের নেতৃত্বেই সংগ্রাম হয়েছে। নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আপনারা গ্রাম-বন্দরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলার সৈনিকদের পাশে পাশে আপনারা রয়েছেন। অকুতোভয় আপনারা লড়েছেন। বাংলার সৈনিকেরা যখন বুকের তাজা রক্ত মাতৃভূমির জন্য ঢেলে দিচ্ছেন এর পরে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা না করে আর কি পথ ছিল? স্বাধীনতার জন্য লড়াই না করে আর কি উপায় ছিল? মূলতঃ এবং বাহ্যত বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী রেখে যান। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার হন, তবে স্বাধীনতা ঘোষণা তিনিই করে যাবেন। আর এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে।
প্রিয় বন্ধুরা আমরা, ২৫শে মার্চের রাতের পরে আমরা বিছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা করতে আমাদের একটু বিলম্ব হয়েছিল।
আমরা যে পাঁচজন শেখ সাহেবের পাশে ছিলাম এবং যাদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকারের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন- ১৩ই এপ্রিল তারিখে বাংলার পূর্ব অঞ্চলে সর্বপ্রথমে একত্রিত হলাম। পরিষদের সদস্যবৃন্দ যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সামনে সেদিন আমি আমার সহকর্মীবৃন্দের তরফ থেকে স্বধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। তখন যোগাযোগহীন অবস্থায় আপনাদের বেশীর ভাগই ছিলেন বাংলাদেশে শত্রুর দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে। তখন একটা সরকার গঠন না করলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। সেইহেতু সেদিনের উপস্থিত বন্ধুদের কাছেই আমরা পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম।
১৯৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আর একটি অম্রকাননে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি।
স্বাধীনতা ঘোষণা করেই ১৭ই এপ্রিল সারা পৃথিবীর মানুষকে যা বলেছিলাম, আমরা বিশ্বাস করি তা অন্তরের বাণী। বিশ্বাস করি- ১৭ই এপ্রিলের এই ঘোষণা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলের মর্মবেদনার এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বিরাট বিস্ফোরণ।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমি আমার সহকর্মী জনাব তাজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তাঁর পরামর্শে এবং বঙ্গবন্ধুর পূর্বতম নির্দেশের বলে আমি জনাম খোন্দকার মোস্তাক আহম্মদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জনাম মনসুর আলী সাহেবকে অর্থমন্ত্রী আর জনাব কামারুজ্জামান সাহেবকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেছিলাম। আমরা জানতাম, আপনারা যে প্রয়োজনে তাঁদেরকে দীর্ঘকাল নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছেন, আমি আপনাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ না করেও নিঃসঙ্কোচে আর বিনা দ্বিধায় তাঁদেরকে সরকারের দায়িত্ব দিতে পারি।
তাঁদেরকে দায়িত্ব দেওয়ার পরে তিন মাস চলে গিয়েছে। এই তিন মাস যাবৎ আমি আপনাদের কাছে অকপটে স্বীকার করব- যা করার ছিল অনেক কিছু করা সম্ভবপর হয় নাই।
কিন্তু আপনাদেরকে আমি একটা কথা বলব, জনাব তাজউদ্দিন আহম্মদ এবং তাঁর মন্ত্রিসভায় সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের সরকারের জন্মমুহূর্ত থেকেই, কর্নেল এ, জি, ওসমানীর মত একজন স্বনামধন্য দেশপ্রেমিক সমরবিশারদকে সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিরূপে পেয়েছি। আপনারা জানেন, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী অসীম বীরত্বের সাথে একটি অসম লড়াই লড়ে যাচ্ছেন।
রণক্ষেত্রে পশ্চাদপসরণ পরাজয় নয়। যুদ্ধের প্রয়োজনে পশ্চাদপসরণ করতে হয় এবং যাতে পুনরায় তীব্র আক্রমণে জয়লাভ করা যায়। যেদিন হিটলারের বাহিনী ফরাসীদেশ আক্রমণ করেছিল সেদিন হাজার হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ফরাসী সরকারও হিটলারের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল। মাত্র ৩ দিনে সব ধ্বংস করে হিটলারের ট্যাংক বাহিনী প্যারিসের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়েছিল। ফরাসী দেশের বীরনায়ক জেনারেল দ্য গল মাত্র মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জেনারেল দ্য গল শক্তি সঞ্চয় করে যেদিন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্সে অবতরণ করেছিলেন সেদিন হিটলারের বাহিনী তাঁর সামনে টিকতে পারেনি।
বৃটিশের মত শক্তিশালী সেনাবাহিনীকেও সিঙ্গাপুর থেকে হটে এসে বর্মা ত্যাগ করতে হয়েছিল। যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করতে হয় যুদ্ধের কলাকৌশল প্রয়োজনে। তাই বাংলার মুক্তিবাহিনী সামরিকভাব যদি কোন রণাঙ্গন থেকে পশ্চাদপসরণ করে তবে তাকে পরাজয় মনে করবেন না। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হওয়ার জন্য রণক্ষেত্রে অস্ত্রধারণ করেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করার জন্যই অস্ত্রধারণ করেছি। জয় আমাদেরই হবে।
আমি জানি, আজকে বাংলার ঘরে ঘরে কী হাহাকার! আমি জানি নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের বুকের কী ক্রন্দনের রোল! আপনারা যখন শোনেন, আপনার শহরে, আপনার গ্রামে, আপনার গঞ্জে যারা একদিন বিশ্বাস করে, ভালবেসে, আপনাদের ভোট দিয়েছিল তাঁদের ঘরবাড়ি আজকে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন কী মর্মবেদনায় আপনারা পীড়িত হন! আপনার প্রতিবেশী নারীদেরকে বর্বর পশুরা ইজ্জতের হানি করছে, জেনে আপনাদের কলিজা ফেটে যায়। এই ধরণের অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সৈন্যবাহিনী কোন দিন করে নাই। নারীরা ইজ্জত লুণ্ঠিত হচ্ছে আজ আবার বাংলাদেশে, হত্যা করা হয়েছে দশ লক্ষ নারী, পুরুষ আর শিশুকে। মসজিদ, মন্দির আর গীর্জা ধ্বংস হয়েছে। বাংলার ফসল আজকে মাঠে মাঠে লুটিয়ে পড়েছে। আমাদের তরুণদের আজকে হত্যা করা হচ্ছে, গুলি করে মারা হচ্ছে।
এই কাহিনীর মর্মবেদনা আপনাদের বুকের ভেতর যেমন বাজে, আমার বুকে যেমন বাজে আর সকলের বুকেও তেমনি বাজে। যদি বঙ্গবন্ধু আজকে আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন, তাঁর প্রিয় দেশবাসীর এই মর্মন্তদ দুঃখে তিনি অধীর হয়ে যেতেন তাঁদের মুক্তির জন্য। তাই বন্ধুরা! আপনাদের ব্যাথা বিশ্ববাসীকে বলার জন্য মন্ত্রীসভার সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁরা কি পর্যন্ত সফল হয়েছেন তাঁর বিচার করবেন আপনারা। কিন্তু একটা জিনিস আপনাদেরকে আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই- আপনারা সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে কাজের অগ্রগতি সম্ভম তাঁর পথ দেখিয়ে দিন।
বিশ্ববাসীর কাছে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা আর কূটনৈতিক কার্যকলাপের দ্বারা আমরা এই কথা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে বাংলাদেশে আজ গণহত্যা চলছে। আজকে আপনাদের মন্ত্রিসভা নিরলস চেষ্টা দ্বারা সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে ইয়াহিয়া ভুল আর ভ্রান্ত, আর আমরা সঠিক পথে চলেছি। আজকে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা তা গ্রহণ করেছে।
আজকে লন্ডনের “অবজারভার” “সানডেটাইম” বা যে-কোন পত্র-পত্রিকা দেখুন, ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিন্দায় তাঁরা মুখর। যে আমেরিকা সারা পৃথিবীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করে, “নিউইয়র্ক টাইম” এবং অন্যান্য সমস্ত প্রভাবশালী পত্রিকাগুলি ইয়াহিয়াকে ধিক্কার দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ফরাসীদেশে, ইটালীতে, জার্মানীতে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এমন কি আরবেরও কোন কোন অঞ্চলে বিশেষ করে বৈরুতের আর সুদানের পত্রিকাগুলি আপনাদের পক্ষে আজকে মত প্রকাশ করে চলেছে।
আপনারা জিজ্ঞাস করতে পারেন যে এখন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের এই সরকারের স্বীকৃতি কেন লাভ করা সম্ভবপর হয় নাই? কূটনৌতিক প্রশ্নে বৃহৎ শক্তিবর্গ পৃথিবীতে নিজস্ব স্বার্থেরত কারণে অনেক কিছু করে।
কিন্তু জেনে রাখুন বিশ্বের জনমত আপনার পক্ষে সেখানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি আপনাকে স্বীকৃতি দিবেই। আমাদের বন্ধু ও প্রতিবেশী ভারতবর্ষ আমাদের লক্ষ লক্ষ শরনার্থীকে শুধু আশ্রয়ই দেয় নাই আমাদের দাবীর ন্যায্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছায় আজকে এগিয়ে এসেছে। সেই জন্য ভারত সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
বন্ধুরা আমার, মুক্তিসংগ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামে একদিকে যেমম সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করতে হয় চরম আঘাত হানার জন্য, তেমনি আর একদিকে কূটনৈতিক আক্রমণের দ্বারা শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে হয়। তৃতীয়তঃ দেশের অভ্যন্তরে মানুষের মনোবলকে শক্ত রাখতে হয়। আর শত্রুর মনোবল ভাঙ্গতে হয়।
বিদেশে কূটনৈতিক প্রচার চালিয়েছেন আপনার সরকার। মুক্তিফৌজকে সুগঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। হাজার হাজার ছেলে আজ মুক্তিফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসছে। সবাইকে সমানভাবে সৈনিকের শিক্ষা দানের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয় নাই। তাঁর একমাত্র কারণ আমাদের সীমিত সামর্থ।
এই সরকারের আয়ের কোনরকম সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত নেই। শুধুমাত্র দান, খয়রাত, ঋণ আর কিছু বান্ধব মারফত টাকা সংগ্রহ করে কোনমতে সরকার চলছে। তাই যারা মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাবার জন্য ট্রেনিং গ্রহণ করতে বিভিন্ন অঞ্চলে এগিয়ে আসছেন, তাঁদের সবাইকে ট্রেনিং-এর সুবন্দোবস্ত করা সম্ভবপর হয় নাই। কি করে এই সীমিত সামর্থের মধ্যে ভাল ট্রেনিং-এর বন্দোবস্ত ও মুক্তিবাহিনীকে আরও জোরদার করা যায় আপনাদের মন্ত্রীসভার সদস্যরা তা আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আমি বিশ্বাস রাখি, দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ব হয়ে আপনারা গঠনমূলক সমালোচনা দ্বারা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। মনে রাখবেন বর্তমান মুহূর্তে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ঐক্যের। সারা পৃথিবীর মানুষ যেন দেখতে পায় আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা, বঙ্গবন্ধুর শিষ্যরা, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়করা এক প্রাণ এক মন হয়ে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ঐক্যে কোনরকম ফাটল ধরলে তাঁর ফল মারাত্মক। কেউ কেউ বাইরে থেকেও নানা প্রকার প্ররোচনায় আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করতে পারে। সেই সমস্ত প্রচেষ্টাকে আমাদের বানচাল করে দিতে হবে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি আমরা মন্ত্রীসভার সদস্যরা মনেপ্রাণে এক। তাঁদের প্রতিনিয়ত চিন্তা মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে কি করে ত্বরান্বিত করা যায়। যে অটুট ঐক্য আজকে সরকারের মধ্যে বজায় আছে সেই অটুট ঐক্য আজকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নির্বাচিত সদস্য ও কর্মীদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের প্রধান সেনাপতির বর্তমান রণকৌশল আমাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। এবং গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় জিনিস হলো জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। আপনারা যারা প্রতিনিধি আপনাদের কাছে আমার আকুল আবেদন গেরিলা যোদ্ধারা যে রণনীতি আর কৌশলে যুদ্ধ করে চলছে, সেই রণনীতি আর কৌশলে আপনারাই তাঁদের সর্বাধিক সাহায্য করতে পারেন- জনগণের মনোবল অটুট রেখে আর সমর্থন বজায় রেখে। বন্দুক নিয়ে যারা লড়াই করছে তারাও যেমন মুক্তিযোদ্ধা, আপনারাও তেমন মুক্তিযোদ্ধা। এই জনযুদ্ধ, ভাড়াটিয়া সৈন্যদের যুদ্ধ নয়। এটা হচ্ছে People’s War- এই People হচ্ছে সবচেয়ে Important factor.
আর সেই People-কে সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব জনসাধারণের প্রিনিধিদের। প্রতিটি সৈনিককে জনতার বন্ধু ভাবতে হবে। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত বাংলার মানুষ যেন ভাবে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, তাঁদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের কর্মীরা, সৈনিকেরা তাঁদের বন্ধু। যদি আমরা জনগণের এই সমর্থনকে বজায় রাখতে পারি তাহলে, আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিতে পারি যে, আপনাদের বীর সৈনিকেরা, পৃথিবী যা ভাবছে তাঁর চেয়ে বহু আগে বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করবে।
বন্ধুরা আমার, জনগণের সমর্থন আদায় করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের কার্যকলাপে জনগণের বন্ধু, জনতার বন্ধু, নির্যাতিত চাষীর বন্ধু বলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। অত্যাচারী মিল মালিকের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতিত শ্রমিকের বন্ধু। বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবির আমরা বন্ধু। এই বন্ধুত্ব প্রকাশের প্রধান উপায় হলো আওয়ামী লীগের প্রণীত ম্যানিফেষ্টোকে বার বার জনগণের সামনে তুলে ধরা। আওয়ামী লীগ ভোট পেলে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে সমস্ত প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করব। এই মুহূর্তে মুক্তিসেনানীর যে অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করবে সেই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা, অর্থনৈতিক, সামাজিক সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি তাকে বাহ্য রূপ দেওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজে নামবেন। মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে যে স্বাধীনতাকে তাঁরা অর্জন করে দিবে, সেই স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পটভূমিকায় রূপ দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।
তাই বন্ধুরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের নীতি আদর্শে আপনারা অটল থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়িকতা বা ‘সেকুলারিজমের’ মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। এই একটা বিষয়ে আপনাদের স্পষ্ট থাকতে হবে। কোন প্রকার সাম্প্রদায়িকতার মালিন্যে যেন আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দের নাম কলঙ্কিত না হয় সে বিষয় আপনাদের লক্ষ রাখতে হবে। গণতন্ত্র অর্থই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। যেখানে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি সেখানে গণতন্ত্র কোনোদিন কার্যকর হতে পারে না।
আজ আমরা গণতন্ত্র বিশ্বাস করি বলেই অসাম্প্রদায়িকতা বা সেকুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতিটি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানেরা মনে প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবারই বন্ধু আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখ আর সমৃদ্ধিকে সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহু পূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারো মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আদর্শের উপর ফাটল যেন না হয়। বাংলার স্বার্থে পৃথিবীর যে দেশের সঙ্গে যে কোন জায়গায় বন্ধুত্ব করা দরকার তা আমরা করব। নিরেপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি আমাদের অবলম্বন। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার জন্য আমরা সেই সমস্ত জাতির পাশেই দাঁড়াব। বহু রক্তের বদলে, বহু দুঃখের রজনী পার করে আমরা জেনেছি স্বাধীনতার লড়াই কি। আমরা জেনেছি সাম্রাজ্যবাদীরা যারা এখনো পৃথিবীর দিকে দিকে বিভিন্ন জাতিকে পদানত করে রেখেছে, সেই সমস্ত পদদলিত জাতির বুকের মর্মজ্বালা কি। একদিন আমেরিকাকে বৃটিশ রাজ্যের অধীন থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। বোস্টনের বন্দরে যেদিন জাহাজ ডুবিয়ে দিল, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এবং জর্জ ওয়াশিংটনের অসি ঝলসে উঠল বোস্টনের তীরে তীরে। আর জেফারসনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ যেদিন মানবতার জয়গান গাইল, সেদিনের আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। তাহলে কেন আজ সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়ার জন্য অস্ত্র আসছে? আমি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে আপনাদের তরফ থেকে মনের বেদনা প্রকাশ করেছি, প্রতিবাদ জানিয়েছি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে। বহু সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে তাঁর জাতীয় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল। জারের অত্যাচার, সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত, পরবর্তীকালে হিটলারের আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বীর রুশ জাতি স্বাধীনতার স্বর্ণশিখরে উপস্থিত হয়েছিল। আপনাদের মাধ্যমে আর একবার আমি মহান রুশ জাতির কাছে আবেদন জানাই, তাঁরা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। চিরকাল বাংলার মুক্তিকামী মানুষ সোভিয়েত রাশিয়ার মানুষকে স্মরণ করবে।
আমাদের প্রতিবেশী চীনের বর্তমান নায়কেরা ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিতালী গড়ে তুলছেন। জানি না পিছনে রাষ্ট্রগত স্বার্থ ছাড়া কি থাকতে পারে। আমরা তো চীনকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি নাই। চীনের সাধারণ নায়করা যাই বলুন না কেন মহান জাতি চীনের প্রতি কোন অবিশ্বাস আমরা পোষণ করি না। চীনের সাধারণ মানুষকে আমরা আমাদের ভালবাসাই দেই। আর আবেদন জানাই, আপনারা আপনাদের নায়কদের বাধ্য করুন- যেখানে কৃষক-শ্রমিক মরছে, যেখানে একটা জাতি নির্যাতনে নিষ্পাষিত হচ্ছে সেখানে একটা অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে তাঁরা সমর্থন যেন না জানায়। একটা সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে কী করে আজকে আপনাদের নায়করা সমর্থন করেছেন। তা একবার আপনারা দেখুন।
বন্ধুরা, মনে রাখতে হবে আমাদের স্বাধীনতা অন্য কেউ এনে দেবে না। নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে। বাইরের কোন রাষ্ট্র স্বাধীনতার ফল এনে দেবে, এ ধারণা ভুল। দশ লক্ষ বাঙ্গালী রক্ত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন রক্ত যখন আমরা দিতে শিখেছি তখন রক্ত আরো দেবো, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। দশ লক্ষ বাঙ্গালী বীর যারা প্রাণ দিয়েছে তাঁদের কসম দিয়ে আপনাদেরকে বলছি, আজকে স্বাধীনতার লড়াই-এ প্রয়োজন পড়লে আরো আমরা প্রাণ বিসর্জন দিব। তবু আপোস করব না। ইয়াহিয়া খান সাহেব তাঁর শেষ বেতার ভাষণে আমাদের হুমকি দিয়েছেন। এই ইয়াহিয়া খান বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের সদস্যপদ বাতিল ব্যবস্থা করেছেন। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমরা নির্বাচিত সদস্য নই। বাংলার মানুষ আমাদেরকে নর্বাচিত করেছে। তাঁদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যই আজ আমরা গৃহহারা, সর্বহারা, আজ আমরা বনে জঙ্গলে ঘুরছি। কে তুমি ইয়াহিয়া? তোমাকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব কে দিয়েছে? পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও তোমাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয় নাই। নির্যাতিত পাঠান, বেলুচ, সিন্ধিদেরকেও তুমি শাসন করে চলেছো। পাঞ্জাবের চাষী-মজুরদের উপর অত্যাচারে তুমি জমিদারদের সহায়তা করেছো। তোমার হুমকি ও ঔদ্ধত্যের উত্তর রণক্ষেত্রে আমাদের বীর সৈনিকেরা দেবে।
সর্বশেষে আপনাদেরকে বলি সংকল্পে অটুট থাকতে হবে! দুর্বলতা কোনভাবে যেন আমাদের মনে স্থান না পায়। পরিপূর্ব স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য। স্বধীন সার্বভৌম বাংলার বিকল্প কোন প্রস্তাব, আপনাদের কাছে, বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তৎসত্ত্বে ইয়াহিয়া খান সাহেবের কাছে বলেছিলাম, আহবান জানিয়েছিলাম যুদ্ধ বন্ধ করুন। আমরা দশ লক্ষ মরেছি, তোমার ২৫ হাজার সৈনিককে তো ইতিমধ্যে মুক্তি বাহিনীর লোকেরা খতম করেছে। ২৫ থেকে ৩০ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। শুধু বাংলার ঘরে ঘরে মা-বোনেরা ক্রন্দন রোল নয়, পাঞ্জাবের ঘরেও তো ক্রন্দনের রোল। সেখানেও বিধবার মর্মভেদী হাহাকার তোমার কানে কি পৌঁছে না? তাই যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান কর।
(১) বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার কর। (২) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দাও। (৩) সমস্ত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার কর। (৪) যে ক্ষতি করেছ তাঁর ক্ষতিপূরণ দাও। এই চারটি শর্ত আমি দিয়েছিলাম শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য। ইয়াহিয়া খান প্রত্যুত্তর দিয়েছেন আটাশে জুন তারিখ। আটাশের পর থেকে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার মাঠে, প্রান্তরে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কূলে যুদ্ধের মাধ্যমে।
আপনাদের সুযোগ প্রধান সেনাপতির নির্দেশে তাঁর সৈন্যবাহিনী রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। তাঁদের সেই তপ্ত লহু আজ আপনাদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করুক। বাংলার যে শত শত সতী তাঁদের ইজ্জত দিয়েছে, তাঁদের ইজ্জতের শপথ- ইয়াহিয়া বাহিনীকে নির্মূল না করা পর্যন্ত, বাংলার স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিশ্রাম নাই। আপনারা সংকল্পবদ্ধ হউন, আপনারা শপথ করুন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোন অবস্থায়, যে কোন অধ্যায়ে আপনারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
দীর্ঘকাল বহু সুখে-দুঃখে আমরা আপনাদের পাশে পাশে ছিলাম। আমরা প্রিয়তম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন, আপনারা দীর্ঘকাল দিয়েছেন, স্নেহ দিয়েছেন, কোনদিন কী আমরা আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি? বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস, আপনাদের স্নেহ-ভালবাসার বিনিময়ে আমরা কি কোনোদিন আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি? ২০-২২ বছরের ইতিহাস যদি একথা বলে সুখে-দুঃখে জয়-পরাজয়ে গৌরবে-অগৌরবে আপনাদের পাশে ছিলাম। আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করি নাই। আজ আপনাদের কাছে আকুল আবেদন জানাব আবার আপনারা বিশ্বাস করুন। দেখুন আমরা কি করতে পারি, যদি না পারি তবে শুধু আপনাদের কাছে নয় অনাগত ভবিষ্যতের কাছে আমাদের কি জবাবদিহি করতে হবে না? আমার বিশ্বাস আমার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এবং আমার প্রধান সেনাপতিও এ সম্বন্ধে সজাগ।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল এই তিন বছর আমি আপনাদের পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু এই তিন বছর কারাগারে ছিলেন। আইয়ুব-শাহীর দাপট আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমি দেখেছি তখনও আপনারা অধৈর্য হন নাই। আমি কোনোদিন ধৈর্য হারাই নাই। বহুবার আপনাদের বলেছি, সংগ্রামে জয়ী হতে হলে ধৈর্যের প্রয়োজন। বহুবার সংগ্রামের বহু কৌশল নিয়ে আপনাদের সাথে আমার মতবিরোধ হয়েছে। আজ আমি গর্বের সাথে বলতে পারি আমার প্রবর্তিত কৌশলের ফলে আমরা ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত তথা আইয়ুব-শাহীকে খতম করেছিলাম।
বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে প্রধান সহ-সভাপতি করেছিলেন। এই বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে জাতীয় পরিষদে ডেপুটি নেতা করেছিলেন। আমি জানি, এই বিশ্বাসের বলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আবার আপনারা আমাকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার ভাগ্য এই যে, আমার নেতা, আমার ভাই, আমার প্রিয়তম বন্ধু শেখ সাহেব যখনই যান, তাঁর অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ে যায়। সেই কাজ চিরকাল আপনাদের পাশে পাশে থেকে করেছি। আজও আপনাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, যদি সংকল্পে কোনরকম মলিনতা দেখেন, যদি আপনাদের নীতি ও আদর্শ থেকে কোনোদিন বিচ্যুত দেখেন, আপনারা আস্তকুড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এই সঙ্কট মুহূর্তে, জাতির স্বাধীনতার এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে আজকে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর সেখানে হাজার হাজার সৈনিক আজকে বনে-প্রান্তরে ইতিহাস লিখে চলছে, সেই মুহূর্তে আর একবার আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। আমার বন্ধু তাজউদ্দিন সাহেব দীর্ঘদিন আপনাদের পাশে পাশে সংগ্রাম করেছেন, বহু জেল খেটেছে। আমার ভাই মোস্তাক সাহেব, মনসুর সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব দীর্ঘকাল সংগ্রামের পরীক্ষিত সেনাপতি। তাঁদের উপর আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। একথা আমি বলব না, নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সমালোচনা আপনারা করবেন না। সমালোচনার উদ্দেশ্য হবে একটা- কী করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করা যায়।
আর যদি বাংলার স্বাধীনতা এই মন্ত্রীসভার নেতৃত্বে একদিন অর্জিত হয়, সেই গৌরব আপনারা নেবেন, আওয়ামী লীগের কর্মীরা নেবেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ নেবেন, মুক্তিযোদ্ধারা নেবেন। আর সেদিন যদি শুধু কিছু ধন্যবাদ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দেন, তবে আমি কৃতার্থ হব। আপনাদের সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
-জয় বাংলা
<৪,২১৯,৪৮৪-৪৮৫>
অনুবাদকঃ ইব্রাহীম
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২১৯। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশের প্রবাসী বুদ্ধিজীবিগণ কর্তৃক কানাডীয় পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের কাছে প্রদত্ত স্মারকলিপি
পশ্চিমবঙ্গে প্রবাসী বুদ্ধিজীবী ৭ জুলাই, ১৯৭১
কানাডায় সফররত বাংলাদেশ উদ্ববাস্তু বুদ্ধিজীবী সংসদ সদস্য
মহাশয়েরা,
বাংলাদেশের জন্য কানাডিয়ান সরকার ও জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতি প্রদানের জন্য আমাদের গভীর অনুভূতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ পেয়েছি।পাকিস্তানি সামরিক অধীস্বামীগনের অস্ত্র সরবরাহের উপর আপনার সরকারের নিষেধাজ্ঞা এবং রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্যস্থতা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। সাত মিলিয়ন এর ও বেশি দুর্ভাগা উদ্বাস্তু যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের জন্য আপনার অবদান আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
১২ এপ্রিল, ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাস্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার কোন সন্দেহ নেই।
জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তান একটি অস্বাভাবিক রাস্ট্র. আধুনিক ইতিহাসে অনন্য যে তার দুটি ডানা বিদেশী একাধিক হাজার মাইল দ্বারা আলাদা করা হয় শুধু কার্যত একটি সাধারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ..পাকিস্তান রেজ্যুলেশন ১৯৪০, যা বানানো হয় অবিভক্ত মুসলমানদের উচ্চাকাঙক্ষা পুরনে. উপমহাদেশের দুটি সংখ্যাগরিস্ট অঞ্চলে সার্বভৌম রাস্ট্র হিসেবে চিন্তা করা।
তাদের আন্তরিক ইচ্ছা ও উদ্দীপনা কে একটি সমন্বিত রাস্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য অধিকার আত্মসমর্পণ দেখানো হয়েছে সেই রেজ্যুলেশনে এবং একটি পাকিস্তান কাঠামো গৃহীত হয়েছে। তারা এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে কিন্তু সফল হতে পারেনি। অগনতান্ত্রিক চালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের লোকজনের সুনামের সুযোগ নিয়েছে. তারা একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে যা বাঙ্গালিদের জন্য নিকৃষ্ট ছিলো।পূর্ব পাকিস্তানের গত ২৩ বছরের বাংলাদেশের মানুষের দুর্বিপাক কষ্ট এবং শোষণ বুঝিয়ে দিয়েছে যদি না অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তারা সন্মান ও মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকতে পারবেনা। পাকিস্তান ১৯৪০ এর রেজ্যুলেশন যা একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা হয়ে ওঠে. পাকিস্তানের একাত্মতা সংরক্ষণে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রনীত আওয়ামীলীগ এর “৬ দফা ” ছিলো আঞ্চলিক শোষণ এর শেষ চাওয়া। এই কর্মসূচিতে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যায়। যা ছিলো তাদের সর্বশেষ চেষ্টা। অবস্থার ভয়াবহতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের শাসক চক্র বুঝতে পেরেছিল কিন্তু সামরিক শাসক রা বাংলাদেশের মানুষের উপর উপনিবেশিক শোষণ ছেড়ে দিতে কিংবা গণতন্ত্র বহাল রাখতে রাজি ছিলো না।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে যে তারা যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার ঘোষণা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা সংগঠিত নৃশংসতা সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, এক জাতি এক দেশ ইয়াহিয়া খান কখনোই মন থেকে গ্রহণ করেন নি। এবং তার সহযোগী দের কারণে এই ধরনের কাজ একটি সেনা দ্বারা কখনোই অনুমতি পেতে পারেনা, একজন সাহায্যকারী ব্যাক্তি ব্যাতিত যে মানুষ কে দমন এবং সন্ত্রস্ত করতে চায়।
আমরা আপনাদের মাধ্যমে কানাডা সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি নিচের পদক্ষেপ গুলো অবিলম্বে গ্রহণ করতে …
১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি।
২. শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য ইসলামাবাদের উপর চাপ সৃষ্টি।
৩. স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় বাংলাদেশ কে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য করুন।
৪. পাইপলাইন সহ পাকিস্তানের সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করুন।
৫. পাকিস্তানের সাথে সব বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক চিন্ন করুন।
৬. এই গণহত্যা বন্ধ করতে ইয়াহিয়া খান কে শক্তি প্রয়োগ করুন।
৭. আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করে পাকিস্তানের সৈন্যদের দ্বারা গনহত্যা ও নারী ট্র্যাফিকিং এর জন্য শাস্তির বিধান নিশ্চিত করুন।
বনগাঁ
জুলাই ৭, ১৯৭১
আপনার বিশ্বস্ত
বাংলাদেশের কূটনীতিবিদ দের পক্ষ থেকে
<৪,২২০,৪৮৬>
অনুবাদকঃ শিপ্রা কর্মকার
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২০। বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি কর্তৃক কানাডীয় পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের কাছে প্রদত্ত স্মারকলিপি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি ৭ জুলাই, ১৯৭১
“কানাডিয়ান সংসদীয় প্রতিনিধি দলের জন্য বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির পক্ষ থেকে স্মারকলিপি ”
মহাশয়েরা,
এই সংক্ষিপ্ত স্মারকলিপি ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ এর পর গঠিত বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির পক্ষ থেকে জমা দেয়া হচ্ছে। ডক্টর, নার্স এবং সেচ্ছাসেবকরা যারা যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিল এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা অব্যাহতি হয়েছে। আজ আমরা এখানে আন্তর্জাতিক শরনার্থী হিসেবে ভারতে, যা দেশের খুব কল্যানকামী অস্থায়ী আশ্রয় ও সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আমরা এখানে অকাতরে সময় এর জন্য অপেক্ষা করছি যখন বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক চাপ, বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং সক্রিয় পাকিস্তান ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। আমরা ফিরে আসবো যখন আমাদের একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা থাকবে অথবা বাংলাদেশ মুক্ত হবে।
স্যার, আজ আমরা এখানে কারন না আমরা “সক্রিয় রাজনীতিরর সঙ্গে বা পাকিন্তানের সামরিক জান্তা বিরুদ্ধে জনগনের গনতান্ত্রিক প্রতিবাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে কিন্তু সহজ কারন হলো আমরা বাঙ্গালী। আমাদের শিক্ষার্থীরারা ১৫ এবং ৩০ বছর বয়সের মধ্যে কুড়ান করা হচ্ছে তারা কাটানো পাকিস্তান অার্মি না কারন তারা তাদের ঘোষিত এবং অঘোষিত প্রবিধানে কোন কর্মদকশূন্য কারন তারা পাকিস্তানের সামরিক শাষনের বিরোধিতা এবং প্রতিরোধের সম্ভাভ্য উপাদান সহজভাবে বাংলাদেশ বিবেচনা করা হয়। বিংশ শতাব্দীর বর্নবাদী আরতি ও পরিকল্পিত গনহত্যা এবং পৃথিবীর এখানো কয়েক সরকারের খারাপ অপরাধমূলক কাজ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে, এটা সম্পর্কে যথেষ্ট উদ্বেগ দেখানো হয়েছে।
আমরা বাংলাদেশের চলমান ভয়াবহ নিপীড়ন সবিস্তারে আর বর্ণনা করছি না, যেহেতু এটা বিশ্ব গ্রন্থ প্রকাশলয়ে বিবৃত ও নথিভুক্ত করা হয়েছে। এটা আমাদের পীড়া দেয় যে, বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে, বিশ্বশক্তি ফলপ্রসূ কিছুই করেনি, অধিকন্তু তাদেরই কেহ না কেহ এটার পোষকতা করেন এবং অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে এটাতে অবদান রাখেন।
আমরা খুব আশা করেছিলাম, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীনতম কানাডিয়ান সরকার নরপশুদের দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনোনীত প্রতিনিধিদের সাপ্রেশান এর নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে না।
আমাদের সবিনয় নিবেদন, আপনি মহাশয়রা চেষ্টা এবং আপনার সরকারকে প্ররোচিত করবেন বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘের মাধ্যমে গণহত্যা সম্মেলনে একজন দস্তখতককারী হিসেবে প্রাথমিক পদক্ষেপ নিতে। আমরা আরো সবিনয়ে অনুরোধ করি সাহায্যের, আমাদের দেশে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমাদের কারন ন্যায়পরতা স্বীকৃতি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর বৈধতা স্বীকার করে, যেহেতু এটি জনগনের ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত।
বনগা
জুলাই ৭, ১৯৭১ আপনার একান্ত
বাংলাদেশ এর পক্ষে
রেডক্রস সোসাইটি
<৪,২২১,৪৮৭-৪৮৯>
অনুবাদকঃ জেসিকা গুলশান তোড়া
শিরোনাম
সূত্র
তারিখ
২২১। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের যৌথ সভার উপর লিখিত আওয়ামী লীগের মুখপাত্রের সম্পাদকীয়
জয় বাংলা
১৬ জুলাই, ১৯৭১
যুক্ত বৈঠকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
চলতি মাসের ৫ই ও ৬ই তারিখে মুজিবনগরে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের যে অধিবেশন হয়ে গেল- তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ইতিমধ্যেই আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। শুধু জাতীয় জীবনে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এই বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও তার গণপ্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের একটা যথার্থ প্রেক্ষিত তুলে ধরবে তাতে সন্দেহ নেই। এতে রণাঙ্গনে সংগ্রামরত আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের মনোবল ও আক্রমণ ক্ষমতা যেমন আরো বাড়বে, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যেসব বন্ধুরাষ্ট্র অকৃপণভাবে সমর্থন জোগাচ্ছেন, তাদের এই সমর্থনের নৈতিক ভিত্তি আরো দৃঢ় হবে। কারণ, রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেমন জানেন তাদের সংসদীয় প্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পাশেই রয়েছেন, তেমনি বিশ্বের মানবতাবাদী ও শান্তিকামী বন্ধু দেশগুলোও জানবে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সকল স্তরের মানুষের ঐক্য অটুট ও অনড় রয়েছে। ভুলভ্রান্তি মানুষ মাত্রেই হয়। বাংলাদেশের মানুষের উপর আকস্মিকভাবে চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধে প্রাথমিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও ক্ষেত্রবিশেষে ভুলভ্রান্তি ঘটতে পারে। বিপ্লবের ইতিহাসে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাথমিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এই ধরনের মানবিক ভুলভ্রান্তি সব দেশে সব যুগেই ঘটতে দেখা গেছে। এই ভুলভ্রান্তি বড় কথা নয়। বড় কথা অটুট গণ ঐক্য, জাতীয় ঐক্য এবং শত্রুর উপর আঘাত হানার ক্রমবর্ধমান মনোবল। গত তিনমাসে বাংলাদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে, তারা নিরস্ত্র এবং অপ্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাঁচ ডিভিশনের এক বিশাল ও বর্বর দস্যু বাহিনীর বিমান, ট্যাঙ্ক ও গানবোটের ত্রিমুখী আক্রমণের সাফল্যের সঙ্গে প্রতিরোধ করে চলেছে। তাদের বড় অস্ত্র অটুট মনোবল ও দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ঐক্য। বাংলাদেশের একজন মানুষ, তিনি বুদ্ধিজীবি, চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী কিংবা গণপ্রতিনিধি হোন, অথবা ক্ষেতের চাষী ও কারখানার মজুর হোন, নিদেন দিনমজুর হোন, আজ একটিমাত্র লক্ষে তারা সকলেই উদ্দীপিত ও অবিচল, তা হল বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্যাটার্নে ইয়াহিয়ার সৈন্যদল বাংলাদেশে যে ঘৃণ্য ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করতে চায়, তার শৃংখল ভেঙ্গে মুক্তির উদয়পথে- নতুন মুক্তিসূর্যের প্রত্যাশায় ভোরের অরুনিমার মত তারা বুকের রক্ত ঢালছে দেশের বীর মুক্তিবাহিনী। এই রক্তদান বৃথা যেতে পারেনা। মুজিবনগরের বৈঠকে সম্মিলিত হয়ে আওয়ামীলীগের সংসদীয় সদস্য ও নেতারা সমস্বরে এ কথাই ঘোষণা করেছেন, বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। এই ঐতিহাসিক বৈঠকে আরো স্পষ্ট করে তুলল, এই মুক্তিযুদ্ধে জনগণের ও জনপ্রতিনিধিদের ঐক্য কত অকৃত্রিম নিবিড়।
ফ্যাসিস্ট আইয়ুবের রাজনৈতিক জারজপুত্র জুয়াড়ি ইয়াহিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন জুয়ার চাল চালতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন বটে, তবে আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যদের সদস্যপদ তিনি নট করেন নি, এমন কি গত ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনকেও তিনি বানচাল করতে চান না। সাধু! সাধু! এ না হলে ‘নির্ভেজাল গণতন্ত্রী’ আর কাকে বলে! দুনিয়া দেখুক, ইয়াহিয়া গণতন্ত্রের কত বড় শুভাকাংখী। তিনি জনগণের দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, কিন্তু দলের সদস্যদের হাতছাড়া করতে চান না। তিনি নির্বাচন বানচাল করতে চান না, চান নির্বাচনে জনগণের রায় বানচাল করে দিতে। তারপর যারা তার হাতে ন্যাস্ত হবে তাদের দিয়ে একটা পুতুল সরকার গঠন করে নিজেদের ইচ্ছামত এমন একটা শাসনতন্ত্র তৈরী করা, যে শাসনতন্ত্র জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা রচিত এই মর্মে অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্ববাসীর চোখে ধুলা দেয়া যাবে এবং অন্যদিকে যে শাসনতন্ত্রে নানা কথার মারপ্যাচে ক্ষমতার চাবিকাঠি রাখা হবে ইয়াহিয়ার বর্বর জঙ্গীচক্রের হাতে, জনগণের অথবা জনপ্রতিনিধিদের হাতে নয়।
যে শাসনতন্ত্র হবে আইউবী শাসনতন্ত্রের চাইতেও ধোকাবাজিপূর্ণ। আর এই ইচ্ছা থেকেই ইয়াহিয়া এদ্দিন তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন। তার এই রাজনৈতিক সমাধানের বটিকা সেবনের জন্য আইউবের দশ বছরের সেবাদাস ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর, ওয়াহিদুজ্জামানের মধ্যে যেমন কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে, তেমনি কাড়াকাড়ি লেগেছে আইউব আমলের গোপন সেবাদাস ফরিদ, খাজা, খয়ের, গোলাম আজম প্রমুখ চামুদের মধ্যে। ইয়াহিয়া আশা করেছিলেন এই চামুদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু পরিষদ সদস্যকে ধরে-বেঁধে এনে যুক্ত করে তিনি তার পার্লামেন্ট ও সরকার দাড়া করবেন। এই দুরাশা নিয়েই তিনি যে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের বাড়িঘর জ্বালিয়েছেন, তাদের পরিবার-পরিজনের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছেন, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ১৪ বছর জেলে দিয়েছেন এমন কি তাদের কাউকে কাউকে খুন করেছেন- হঠাৎ সেই পরিষদ সদস্যদের প্রতিই ‘ক্ষমা প্রদর্শন’ ও জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে প্রচারকার্য চালাতে শুরু করেন। কিন্তু সীমান্তে ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন এবং দালালদের মাধ্যমে অনেক দেনদরবারের পরও দেখা গেছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যরা কেউ ইয়াহিয়ার বশ হতে কিংবা তার পা-চাটা কুত্তাদের দলে ভিড়তে রাজী নয়। যে দু’একজন সদস্যকে বন্দুকের নল দেখিয়ে ইয়াহিয়া কয়েদ করেছেন, ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে তারা কি করবেন, সে সম্পর্কে ইয়াহিয়া চক্র নাকি নিশ্চিত নন। ফলে এলো ২৮শে জুনের বেতার ঘোষণা। তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের প্রহসন শিকায় তুলে রেখে ইয়াহিয়া বাধ্য হয়ে বিশ্ববাসীকে তার আসল চেহারা দেখালেন, বললেন, তিনি বিশেষজ্ঞ দ্বারা তৈরী একটা শাসনতন্ত্র দেশকে উপহার দেবেন। অর্থাৎ নিজেই একটা শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। দেশকে শাসনতন্ত্র দেয়ার নামে আইউব যা করেছিলেন, তার রাজনৈতিক জারজপুত্রেরা তার চাইতে বেশি কি করতে পারেন?
ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা চক্রের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রেরই সমুচিত ও সফল জবাব বর্তমান মাসের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগ দলীয় উভয় পরিষদের সদস্যদের যুক্ত বৈঠক। এই বৈঠকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাড়ে চার আনা সদস্য অংশগ্রহণ করে একথাই দিবালোকের মত ষ্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক সদস্যকে নিয়ে একটা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টায় ইয়াহিয়া সফল হচ্ছেন বা হবেন এই প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইয়াহিয়ার হাতে দু’চারজন বন্দী সদস্যা ছাড়া কেউ নেই। বাংলাদেশের প্রকৃত গণপ্রতিনিধিরা রয়েছেন মুক্তাঞ্চলে, প্রকৃত বৈধ সরকার রয়েছে মুজিবনগরে। দস্যু ইয়াহিয়ার অধিকৃত বাংলাদেশ অবৈধ দখলদার মাত্র। বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করা বা বাংলাদেশের মানুষের নামে কথা বলার কোন অধিকার এই খুনী ও তাদের চক্রের নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের নামে কথা বলবে, তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে একমাত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
মুজিবনগরে বৈঠক ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করে এজন্যই যে, এই বৈঠক বাংলাদেশের মানুষ ও মুক্তিবাহিনীর মনোবল দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের মানুষ জেনেছে তাদের গণপ্রতিনিধিরা দশ লক্ষাধিক জনতার সামনে ৩রা জানুয়ারী তারিখে শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে যে শপথ করেছিল, সে শপথ তারা ভঙ্গ করেনি, বরং অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। আজ মুক্তিবাহিনী জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের যে পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে রণাঙ্গনে, সেই একই দায়িত্ব পালন করছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যেরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। গণমানুষ ও গণপ্রতিনিধিদের ভূমিকায় আজ আর কোন পার্থক্য নেই। একই প্রতিরোধ-চেতনা ও স্বাধীনতা কামনায় তারা উদবুদ্ধ, অনুপ্রাণিত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মুজিবনগর বৈঠকের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমতঃ নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের একটা অংশকে ইয়াহিয়া চক্র করে পেয়েছে এবং তাদের যোগসাজগে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের হয়ে কথা বলতে পারে এই দাবী ও প্ররোচনায় সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বের শান্তিকামী গণতন্ত্রী ও মানবতাবাদী দেশগুলোর কাছে আজ এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন এবং স্বাধীনতার লক্ষ অর্জনে তারা দৃঢ়সংকল্প।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত বৈধ সরকার হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারই তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের দাবীদার। গণপ্রতিনিধিত্বহীন ইয়াহিয়ার গণ-দুশমন চক্র বাংলাদেশে বেআইনী দখলদার, সুতরাং মুজিবনগরের বৈঠকের পর বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরো ত্বরান্বিত হলে এবং বিশ্বের আরো বেশীসংখ্যক রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের সাহায্য ও মৈত্রীর হাত বাড়াবেন, এ বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত। জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামও ব্যর্থ হতে পারে না। স্বাধীনতার রক্ত পতাকা মুক্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে উড়ছে। গণ ঐক্যের অজেয় দুর্গের প্রাকারে বাজছে আসন্ন বিজয়ের দুন্দুতি। পূর্ব দিগন্তে রক্তারুণ উদর ঊষার সুসংবাদ ছড়াচ্ছে। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। মুজিবনগরের বৈঠক এই অবশ্যম্ভাবী বিজয় আরো ত্বরান্বিত করবে।
-জয় বাংলা
<৪,২২২,৪৯০-৪৯২>
অনুবাদকঃ আইনুল ইসলাম বিশাল
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২২। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর বক্তৃতা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের দলিলপত্র ১৭ জুন, ১৯৭১
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ
বাংলাদেশ
৪২ বলাকা ভবন
ঢাকা
বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে দুঃখিনী মায়ের দুরন্ত নির্ভীক ছেলেরা আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, শ্ত্রুর রক্তেস্নাত হয়ে বাংলাকে শত্রুমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়বোধে উদ্বুদ্ধ মুক্তি্যোদ্ধা ভাইয়েরা আমার, আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহন করুন।আজ হতে তিন মাস আগে রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে পশ্চিমা গৃধিনীর দল ধ্বংসের উন্মত্ততায় পাগল হয়ে যখন আমার বাংলার নিরীহ নিরস্ত শান্তিপ্রিয় মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নারীর করুন আর্তনাদে বাংলার মাটি যখন ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, তখন সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, আপনারা প্রতিহিংসার অগ্নিশিখা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, মৃত্যুর নিশ্চিত সম্ভাবনা জেনেও আপনারা দুঃখিনী মায়ের ডাকে সেদিন পাগলের মতো ছুটে আসতে পেরেছিলেন বলেই আজ বাংলার মাটিকে শত্রুর কবলমুক্ত করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ।গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে । স্বাধীনতার এই সংগ্রামে আপনাদের আত্নত্যাগের কথা যখন আমি ভাবি, আর্তের বেদনার মাঝেও সম্ভাবনার বাণী আমাকে উজ্জীবিত করে। বাংলার ছেলেরা স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস নাই, আত্মত্যাগের প্রশ্নে পিছু হটে নাই, নির্যাতনের কাছে মাথা নিচু করে নাই, অত্যাচারীদের ক্ষমা করতে শেখে নাই। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমরা মুজিব ভাইকে কথা দিয়েছিলাম ছয়-দফাকে অস্বীকার করা হলে বাংলার শ্যামল মাটিতে রক্ত ঢেলে স্বাধীনতার জয়গান আমরা লিখে দেব।বাংলার বিভিন্ন রনাজ্ঞনের কথা আমি যখন ভাবি তখন আমার বারবার মনে পড়ে মুজিব ভাই, তুমি এসে দেখে যা, তোমার বাংলার ছেলেরা কি অপূর্ব রণসাজে আজ প্রস্তুত হয়েছে। আমার মনে হয় বরকতকে ডাক দিয়ে বলি, ভাই বরকত, জীবনের ওপার হতে তুমি চেয়ে দেখো, তোমার রক্ত আমাদের বুকে কি প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়েছে। ভাই মনুমিয়া, বুলেট হাতে তোমার সাথীদের আজ তুমি দেখ। তোমার সাথী-সঙ্গীদের হৃদয়ে আজ প্রতিহিংসার প্রচন্ড উন্মত্ততা। সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, মাতৃত্বের ঋণ শোধ করার তাগিদ আজ প্রাণের চেয়ে বড়। তাই জীবণ দিয়ে আমাদের জীবনের সম্ভার সাজাতে হবে। মৃত্যুকে যারা ভয় করে,… ভ্রুকুটি দেখে যারা থমকে দাঁড়ায়, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার কব্জায় যাদের জোর নেই, রক্তের বদলে রক্ত নেওয়ার উন্মাদনায় যাদের অভাব-এ তাদের নয়। এ পথ তাদের যারা প্রতিহিংসার আগুনে আজ জ্বলছে, এ পথ তাদের যারা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে শিখেছে, এ পথ তাদের যারা বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার অক্ষর লিখতে পারে। সংগ্রামী বন্ধুরা আমার-এ পথ তাই তোমাদের। শত অভাব-অভিযোগ, অনটনের প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে তোমাদের এই যুদ্ধ আজ এই কথায় প্রমাণ করে এ যুদ্ধে বিজয়ের মালা তোমরা ছিনিয়ে আনবে। আজ আমাদের শপথ-রক্তে আনো লাল, রাত্রির বৃন্ত হতে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল।
সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, পশ্চিমা শ্ত্রুসেনারা পাশবিকতার জঘন্য প্রবৃত্তিতে উন্মত্ত হয়ে ধ্বংসের যে তান্ডবলীলা চালিয়েছে,তা বর্ণনা করতে আমি পারব না। গতবারেও তা বলেছি। গর্ভবতী মায়ের পেট চিরে তার গর্ভজাত সন্তানকে তারা বের করেছে, কারণ আমাদের উত্তরসূরীদের তারা নির্মমভাবে নিঃশেষ করে দিতে চায়।
মায়ের কোল থেকে শিশুকে টেনে কেড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে তারা হত্যা করেছে। বাপের সামনে ছেলেকে খুন করে মরা ছেলের লাশ বাপকে টানতে বাধ্য করেছে। স্বামীর কোল থেকে সতী- সাধ্বী স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। যে মায়ের গর্ভে আমার জন্ম, যে মায়ের স্তন পান করে আমার বয়ঃ বৃদ্ধি, যে মায়ের বুকভরা স্নেহ আমার মনের সম্ভাবনার আলো জ্বালিয়েছে, যে মা আমার গাল ধরে চুমু খেয়েছে- আজ আমাদের চোখের সামনে সে মায়ের সতীত্ব ভুলুন্ঠিত হয়েছে। মায়ের মাতৃত্ব, বোনের সতীত্বের মর্যাদা পশুরা দেয় নাই। একটি ঘটনা তোমাদের বলতে চাই- যশোরের এক ক্যাম্পে এক মা পাগলিনির মত আর্তনাদ করছিল। তার সমস্ত শরীর, সমস্ত কাপড়ের আঁচল রক্তে ভেজা। মায়ের কাছ যখন গিয়ে শুধালাম, মাগো, তোমার কি হয়েছে- আমার মা তখন আঁচল সরালো। দেখি তার কোলে মাস তিনেকের একটি শিশুর লাশ বয়নেটের আঘাতে আঘাতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। রক্তে রক্তে তার সমস্ত শরীর লাল হয়ে গেছে। আমরা মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি নাই। মা আমার ডুকরে কেঁদে উঠে বললো,” আমার তিনমাসের ছেলে তো কোন অপরাধ করে নাই, আমার দুধের বাচ্চা মাসুম কোন অন্যায় করে নাই- কেন তার এই অবস্থা হলো? কেনো আমার চোখের সামনে বিনা অপরাধে এই নির্মমতার শিকার হতে হলো?” আমার দুঃখিনী মা, আমার সন্তান হারা জননী, আমার শোকার্ত জন্মদাত্রী, আমার গর্ভধারিণী ডুকরে কেঁদে উঠে বললো,” আমি তোমাদের কাছে বিচার চাই, আমার সন্তান হত্যার প্রতিশোধ চাই।” সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, মায়ের কোলে শায়িত ঐ কচি ভাইয়ের লাশ ছুয়ে মায়ের কাছে শপথ করেছ, বাংলাদেশের একটি তরুণ যদি বেঁচে থাকে, বাংলাদেশে একটি মুক্তিফৌজ যদি বেঁচে থাকে, দুঃখিনী মায়ের স্তনপান যদি আমরা করে থাকি তবে এর প্রতিশোধ আমরা নেবই। মা, মাগো আমার, ওদেরকে আমরা ক্ষমা করি নাই তুমি বিশ্বাস কর, ওদের রক্তস্নাত না করা পর্যন্ত তোমার ছেলেরা ঘরে ফিরবে না। ওদের নির্মূল না করা পর্যন্ত বুলেট আমরা ছুড়বো। জীবন দিয়ে হলেও ওদের আমরা নির্মূল করবোই।
সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, যে ঘর আমাদের গপুড়ে গেছে, সৃষ্টির আবীর মাখিয়ে সে ঘর আবার আমরা বাঁধব। যে গ্রাম পুড়ে গেছে- সে গ্রাম আবার গড়ে উঠবে। যে ফসল পুড়ে গেছে- মাটির বুক চিরে সে ফসল আবার আমরা ফলাবো। যে বিশ্ব বিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে,আমার বিশ্বাস, বিদ্যার্থীদের কলগুঞ্জনে আবার সে বিশ্ববিদ্যালয় মুখরিত হয়ে উঠবে। কিন্তু যে মা তার তিন মাসের ছেলেকে বিনা অপরাধে হারিয়েছে, শত্রুর রক্তে হাত না রাঙালে সে মায়ের কোন সান্ত্বনা নাই। যে মা তার সতীত্ব হারিয়েছেন শ্ত্রুকে নিপাত করার আগে সন্তানের দাবী নিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়াতে পারব না। যে বোন সতীত্ব হারানোর বেদনায় আজ গুমরে গুমরে কাদছে, পাকিস্তানী শ্ত্রুদের হত্যা করার পূর্বে সে বোনের সম্মুখে যাবার কোন অধিকার আমাদের নাই।
সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, মাতৃত্বের ঋণ পরিশোধের জন্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।আমি জানি এই যুদ্ধে মুক্তিফৌজরাই লড়ছেন না, যে কৃষক গ্রীষ্মের খর রোদে দাঁড়িয়ে হালচাষ করতো তারাও আজ এই মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার।যে শ্রমিক কারখানায় কাজ করতো, এ যুদ্ধের অনুপ্রেরক আজ তারাও। যারা দিনান্তে অফিস করতো,তারাও এ যুদ্ধের শরীক। যে জ্ঞানতাপস জ্ঞানের নিকুঞ্জে নতুন নতুন সম্ভাবনার ফুল ফুটাতো, সে শিক্ষকও আজ মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক। তাই ওদের মারণাস্ত্র থাকতে পারে, আমাদের হিমাচলের মতো অটল জনতা রয়েছে। ওদের কামান থাকতে পারে- কিন্তু আমাদের ঈমান হিমাচলের মতো অটল। ওরা লড়ছে লোভের উদগ্র নেশায় বুঁদ হয়ে- আমরা লড়ছি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাই বিজয় আমাদের অনিবার্য। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। রণাঙ্গনের ফলাফল সে কথায় তো প্রমাণ করে। পঁচিশ জনার কাছে তিন’শ জন মার খেয়ে হটে যাবে কেনো? এত মারণাস্ত্রের দাম্ভিকতা থাকা সত্ত্বেও শত্রু সেনারা ২৫ হাজার সৈন্য হারাচ্ছে কেনো- একথা বিশ্ববাসী আজ জানে।
সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, এবার রূপসী বাংলা গণ- সমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় পরিণত হয়েছে। বিসুভিয়াসের মতো জ্বলে উঠেছে- তাই তো গর্বে আজ আমাদের বুক ভরে ওঠে। এতো হুমকির কাছেও যে মানুষ মাথা নত করে নাই, যে মানুষ ট্যাক্স দেয় নাই, যে মানুষ অফিসে যায় নাই, যাদের ঐক্য চির ধরে নাই- বিজয় তাদের সুনিশ্চিত, একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
সম্প্রতিকালে মিথ্যার বেসাতী করা যার অভ্যাস, সেই পাকিস্তান বেতারকেন্দ্র হতে বিশ্বাসঘাতক বেঈমান এহিয়া একটি বক্তৃতা করেছেন। তার দৃষ্টতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে, যুদ্ধে মার খেয়ে আজ রক্তপিপাসু শোষক বেসামাল হয়ে গেছে। নইলে আমরা বুঝতে পারি না, বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করার দুঃসাহস এহিয়া পেলো কোথা হতে? এহিয়ার জানা উচিত, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম গ্ণ- প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এহিয়ার জানা উচিত, দশ লক্ষ মানুষের লাশের তলায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে। পাকিস্তান আজ একটা মৃত লাশ ছাড়া কিছুই নয়। হানাদারের একথা বোঝা উচিত বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করার অধিকার তার নাই। বাংলাদেশের মানুষ তার মন্তব্যকে বরদাস্ত করতে আজ প্রস্তুত নয়। বিশবাসঘাতক, বেঈমান, নির্লজ্জ- উপনির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তার জানা উচিত, বাংলাদেশ থেকে উপনির্বাচনে দাঁড়ানোর চেষ্টা কোন দালাল যদি করে- তবে তার শিকড় সমেত উপড়ে ফেলতে মুক্তিবাহিনী জানে। বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের- এই সত্যকে এহিয়া যদি ভুলতে চাও, বুলেটের তীব্র আঘাতেই ভুল আমরা ভাঙব।
হিংসার উন্মত্ততায় দানবিক ইচ্ছাকে চরিতার্থ করার হীনমন্যতায় শোষণের নেশায় বুঁদ হয়ে এহিয়া খান বাংলার উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। শোষক ভেবেছিল দশ লক্ষ মানুষকে খুন করলেই হয়তো বাংলার গণ- আন্দোলন থেমে যাবে। শেখ মুজিবকে বন্দী করলেই স্বাধীনতার কথা বাঙালীরা ভুলে যাবে। পঞ্চাশ লক্ষ লোককে বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দিলেই বাংলার গণ- আন্দোলন মোড় হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু এহিয়া, তুমি বাংলাকে চেনো নাই। বাংলাদেশে শুধু গোলাপ, চামেলী, বকুল ফোটে না- এবার দেখো, সেখানে লাল টকটকে রক্তপলাশ ফুটেছে। চব্বিশ বছরের সন্তান হারিয়ে মায়েরা শুধু কাঁদতো, এবার দেখো টাড়া আপন সন্তানের বুকের রক্তে স্বাধীনতার অর্ঘ্য দিতে শিখেছে। বাংলার বুকে শুধু বসন্তের হিল্লোলই বইতো- এবার দেখো সেখানে কালবৈশাখী কুজঝটিকার ঝড় উঠেছে। তোমাদের কাছে আমরা বার বার মার খেয়েছি- এবার দেখো প্রত্যাঘাত হানতে আমরা শিখেছি। তোমাদের ঔদ্ধত্যের জওয়াব আমরা রণাঙ্গনেই দেবো।
সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার, আবার আমি বলতে চাই- আপনাদের অসুবিধা অনেক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রধানের চেষ্টার অভাব না থাকা সত্ত্বেও, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার অভাব না থাকা সত্ত্বেও, আপনাদের প্রয়োজন মেটাতে তারা পারেন না। কিন্তু এবার আমি বলতে চাই, আজ নেওয়ার দিন নয়- আজ বুকের রক্ত উজাড় করে দিতে হবে। বন্ধুরা আমার, কান পেতে শোন, শহীদের আত্মারা আজও হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়। চোখ মেলে চেয়ে দেখো, মায়ের চোখের অশ্রু আজও শুকায় নাই, বোনের দীর্ঘশ্বাসে বাংলার মাটি আজও বিষিয়ে আছে। তাই বন্ধুরা আমার, এগিয়ে চলো, আঘাত হানো, তোমাদের আঘাতে আঘাতে তাদের ক্ষতবিক্ষত করে ফেলো। তোমাদের আত্মত্যাগে বাংলার দিগন্তে স্বাধীনতার সূর্য আলো বিচ্ছুরিত করে তুলুক, মায়ের ঋণ তোমরা পরিশোধ করো।……
<৪,২২৩,৪৯৩-৪৯৫>
অনুবাদকঃ মাহীন বারী
শিরোনাম সুত্র তারিখ
২২৩। দিল্লীতে আয়োজিত বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সেমিনার উপলক্ষে বাংলাদেশ মিশনে অনুষ্ঠিত সভার বিবরণী সরকারী দলিল ২০ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশ মিশনের হলরুমে আয়োজিত ২০ জুলাই, ১৯৭১ এর মিটিং এর সাথে সম্পর্কিত ১৪-১৬ আগস্ট, ১৯৭১ এ নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনার এর মুহূর্ত সমূহ
নিম্ন উল্লেখিত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেনঃ
১/ প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান
২/ ডঃ আনিসুজ্জামান
৩/ জনাব মতিলাল পল
৪/ ডঃ কে এস মুরশেদ
৫/ ডঃ বেলায়েত হোসেন
৬/ জনাব আলী আনোয়ার
৭/ জনাব মউদুদ আহমদ
৮/ জনাব আর আই চৌধুরী , ফার্স্ট সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মিশন ইন চেয়ার
সেমিনার সম্পর্কিত সকল প্রাসঙ্গিগ বিষয় নিরীক্ষা করাবার পর এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যে নিম্নোক্ত বিষয় সম্পর্কে আমাদের পক্ষ হতে যাকে যে বিষয় দেয়া হয়েছে তাদের দ্বারা কাগজপত্র তৈরি করতে হবে
(ক) “বাংলাদেশ এর বর্তমান অবস্থার ক্রমানুযায়ী বিশেষ বিশেষ ঘটনা”: এই বিষয়ে কাগজ পত্র ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে এবং লিপিবদ্ধকরন ও চূড়ান্ত করণের জন্য প্রফেসর সৈয়দ আহসান আলী কর্তৃক জনাব মউদুদ আহমদকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
(খ) “বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা”ঃ অর্থনীতিবিদ জনাব মতিলাল পল এই বিষয়ে কাগজ পত্র তৈরি করে ফেলেছেন।
(গ) “বাংলাদেশে গণহত্যা”ঃ জনাব সাদেক খান ইতোমধ্যে এই বিষয়ে কাজ আরম্ভ করেছেন। তাঁকে এই বিষয়ে কাগজ পত্র প্রস্তুত করবার জন্যে অনুরোধ জ্ঞাপন করা যেতে পারে।
(ঘ) “বাংলাদেশ হতে ভারতে শরণার্থী গমন এবং তার জনহিতকর সমস্যা” ঃ ডঃ স্বদেশ বস অন্যথায় ডঃ মশারফ হোসেন এই ব্যাপারে কাগজ পত্র তৈরি করবেন।
(ঙ) “আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনীতির দিক হতে স্বাধীন বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা” ঃ কলকাতা হাইকোর্ট এর বিশিষ্ট ব্যারিস্টার জনাব সুব্রত রায় চৌধুরী ইতোমধ্যে এই বিষয়ে কাজ করছেন। তাঁকে এই ব্যাপারে কাগজ পত্র তৈরি করতে অনুরোধ জানানো হবে।
(চ) “বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি” (অর্থনৈতিক নৈরাজ্য, সাংস্কৃতিক আক্রমণ প্রভৃতি হতে আরম্ভ করে অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত সকল পটভূমি আলোচিত হবে) ঃ ডঃ এ আর মল্লিক ইতোমধ্যে এই বিষয়ে কাগজ পত্র তৈরি করবার দায়িত্ব নিয়েছেন।
(ছ) “বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন কানুন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বীকৃতিলাভ” ঃ জনাব মউদুদ আহমদ এই বিষয়ে কাগজ পত্র তৈরি করবেন।
(জ) “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধর্ম” ঃ ডঃ কে এস মুরশেদ এই বিষয়ে কাগজ পত্র তৈরি করবেন।
(ঝ) “স্বাধীনতা দাবী বিষয়ক সকল তাৎক্ষণিক তথ্যাবলী সম্বলিত প্রমাণাদি” ঃ মার্চ ১৯৬৯ হতে এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথাবলী দিয়ে ইতোমধ্যে একটি ভালো সংগ্রহ তৈরি করা হয়েছে। সংগ্রহটি ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে এবং তা ছাপানোর জন্য ছাপাখানায় প্রেরণ করা হয়েছে। সুতরাং, এটিকে এই বিষয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
যাদেরকে যে বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদেরকে কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে জানাতে বলা হচ্ছে যাতে করে ৩১ জুলাই এর মধ্যে সকল কাগজপত্রের চূড়ান্তকরণ ও ছাপানোর প্রক্রিয়া শেষ করে আনা যায়।
এই সম্পর্কে বর্তমানে উপস্থিত সকলে একটি বিষয়ে একমত যে কাজগুলোর ফলে এমন কিছু সাহিত্যকর্ম উঠে আসবে যা ভবিষ্যতে অনেক কাজে লাগবে।
২/ সর্বশেষ মিটিং এর পরিপ্রেক্ষিতে ডঃ এ আর মল্লিক ২০ জনের একটি তালিকা দিয়েছেন। তালিকাটি বর্তমানে পুনর্বিবেচনা করা হয়েছে গ্রহণযোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুসারে। দেখা যাচ্ছে যে যারা অংশগ্রহণ করছে তারা হয় কাগজপত্র পরবেন না হয় সুচারুভাবে লবিং করবেন। ২০জনের মধ্যে ১০জন চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়েছেন।
ক) ডঃ এ আর মল্লিক
খ) প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান
গ) ডঃ কে এস মুরশেদ
ঘ) ডঃ স্বদেশ বোস, অর্থনীতিবিদ
ঙ) ডঃ এ এ জেড আহমদ, চিকিৎসক
চ) ডঃ মতিলাল পল, অর্থনীতিবিদ
ছ) জনাব ওসমান জামাল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জ) জনাব সাদেক খান, সাংবাদিক
ঝ) জনাব মউদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার ইন ল
ঞ) জনাব আলমগির কবীর, সাংবাদিক
৩/ মিটিং এ পার্লামেন্ট এর সদস্য নির্বাচনে সমস্যার সম্মুখীন হয় কেননা প্রবাসী অফিস কর্তৃক সঠিক কর্তৃপক্ষের সাথে বসে সঠিক তালিকা প্রস্তুত সম্ভব হয়নি। কিন্তু কিছু সদস্য কিছু নাম প্রস্তাব করেছে যা নিম্নে দেয়া হলঃ
ক) জনাব আব্দুল মুন্তাকিম চৌধুরী, এম এন এ
খ) জনাব আমিরুল ইসলাম, এম এন এ
গ) জনাব এম এ সুলতান, এম এন এ
ঘ) জনাব এম এ খায়ের, এম এন এ
ঙ) জনাব তাহেরুদ্দিন ঠাকুর, এম এন এ
৪/ যেহেতু কনফারেন্স কর্তৃপক্ষের কিছু শিল্পী প্রয়োজন তাই নিম্নোক্ত নামগুলো প্রস্তাব করা হলঃ
ক) মিসেস সানজিদা খাতুন
খ) মিস কল্যাণী ঘোষ
গ) জনাব সমর দাশ
ঘ) জনাব আব্দুল জব্বার
ঙ) জনাব আপেল মাহমুদ
সব মিলিয়ে ২০টি নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। এরমধ্যে এই ৫তি নাম আমরা প্রস্তাব করছি।
৫/ আরও প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, কনফারেন্স কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নিয়মতান্ত্রিক দাওয়াতপত্র পাঠাবার জন্য এবং যাতায়াত, বাসস্থান ও অন্যান্য খরচাপাতি সম্পর্কে অনুসন্ধান করবার জন্য।
যখন বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারির নিকট সকল কাগজপত্র পৌঁছাবে, ছাপানো অঙ্কানুজায়ী একটি বাজেট প্রণয়ন করা হবে। তাছাড়া, এই সকল কাগজ পত্র অস্থায়ীভাবে ছাপানো হবে।
নং বি ৫/৮০/৭১, ডিটি ২১.৭.৭১ (আর আই চৌধুরী)
ফার্স্ট সেক্রেটারি
কপি পাঠানো হয়েছে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান এর নিকট, ৪/১, পাম এভিনিউ, কলকাতা – ১৬
তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছে যে “বাংলাদেশ এর বর্তমান অবস্থার ক্রমানুযায়ী বিশেষ বিশেষ ঘটনা” শীর্ষক রচনা যা তাঁর দ্বারা রচিত দয়া করে ৩১ আগস্ট, ১৯৭১ এর মধ্যে স্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দিতে যেন তা যথাসময়ে ছাপানো সম্ভবপর হয়।
(আর আই চৌধুরী)
ফার্স্ট সেক্রেটারি
<৪,২২৪,৪৯৬-৪৯৭>
অনুবাদকঃ শেখ মোঃ ইমরান
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৪। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ কতৃক স্বাধীনতা চালিয়ে যাবার সংকল্প ঘোষণা ‘বাংলাদেশ’-বাংলাদেশ সরকার প্রচারিত বুলেটিন ২১ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশের দখলকৃত অঞ্চল মুক্ত করার এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও তার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ অনুসরণে পুনর্বার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তাঁরা ইসলামাবাদের সাথে যেকোন ধরণের রাজনৈতিক সমঝোতা ও সহাবস্থানের ধারণা সম্পূর্ণরুপে প্রত্যাখ্যান করেন।
বাংলাদেশের কোন এক গোপন জায়গায় অনুষ্ঠিত দুইদিনের এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে এই দৃঢ় সংকল্পটি নির্বাচিত সকল ৩৭৪ প্রতিনিধির (বর্তমানে বিলুপ্ত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) কণ্ঠে ধ্বনিত হয়।
১৯৭১ সালের ৬ই জুলাই ১৩৫ জন এমএনএ এবং ২৩৯ জন এমপিএ একটি সম্মেলনে মিলিত হন। সম্মেলনটি ১৯৭১ সালের ৭ই জুলাই শেষ হয়। উল্লেখ্য যে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে সকল মন্ত্রী, যেমন, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব খন্দকার মুশতাক আহমেদ, অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামান সেখনে উপস্থিত ছিলেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম এর স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অধিবেশনটি শুরু হয় এবং কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। প্রধানমন্ত্রী মোঃ তাজউদ্দীন আহমেদ, এবং মুক্তি বাহিনীর (লিবারেশন ফোর্স) সেনাপতি এ. জি. উসমানী, যিনি জাতীয় বিধানসভার সদস্য ছিলেন, উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত হন এবং সেখানে উপস্থিত অনেকের সাথে কথা বলেন।
দুইদিন ব্যাপি এই সম্মেলনের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে উপস্থিত সদস্যগণ শত্রুর মোকাবিলা করার জন্যে সরকারের সাথে থাকার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প গ্রহন করেছেন। বাংলাদেশের উপর ইয়াহিয়া বাহিনী দ্বারা সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর সমঝোতা করার আর কোন পথ যে খোলা নেই তা এই সম্মেলন থেকে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হয়ে যায়। এটাও নিশ্চিত হয় যে ৭৫ মিলিয়ন বাংলাদেশী ও বাংলাদেশের মুক্তি একমাত্র দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়িত করার মধ্যেই নিহিত আছে। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সম্মেলন থেকে “মুক্তিযুদ্ধের” দিকে সর্বশক্তি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।
এই সম্মেলন থেকে বিশ্বের সব দেশের প্রতি বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে ইসলামাবাদের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য আহবান জানানো হয়। এদিকে অপর এক সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদেরকে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারে ইসলামাবাদের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশ, বিশেষ করে, জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। উক্ত সম্মেলনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত একজন নির্বাচিত প্রতিনিধির জন্য শোক প্রকাশ করা হয় এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণকারী সকল শহীদের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়।
সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সকলের আস্থা পুনর্ব্যক্ত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োজনীয় সবধরণের সহযোগীতা করার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়।
অপর একটি সিদ্ধান্তে সম্মেলনে উপস্থিত সকল সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসলামাবাদে অস্ত্র সরবরাহ করে ইয়াহিয়া খানের গণহত্যা চালিয়ে যেতে সহযোগীতা করার জন্য তীব্র নিন্দা জানান।
<৪,২২৫,৪৯৮>
অনুবাদকঃ নাবিলা ইলিয়াস তারিন
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৫। বাংলাদেশের মুক্তি প্রশ্নে অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ-২৫ জুলাই
এশিয়ান রেকর্ডার সেপ্টেম্বর ৩-৯,১৯৭১ ২৫ জুলাই,১৯৭১
বাংলাদেশের আন্দোলনে অধ্যাপক মুজাফফর আহমদঃ
জাতীয় আওয়ামী দলের সভাপতি(মুজাফফর-ওয়ালি গ্রুপ)অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ মুজিবনগরে জুলাই-র ২৫ তারিখে বলেছিলেন,বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট রাস্ট্রের সহানুভূতি রয়েছে।’খুব শীঘ্রই এর সুস্পষ্ট প্রকাশ আমরা দেখতে পাব।”
একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আহমেদ বলেছিলেন যে তাঁর কাছে তথ্য আছে ,পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সময় নিচ্ছে।অপর দুটি রাজ্য সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানে অস্থির অবস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে,’হয়ত খুব শীঘ্রই তারাও স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেবে।’
তিনি আরও বলেছিলেন,আমি জানি তারা কি চায়ঃ’আমরা আসলে একই লড়াইয়ে আছি স্বায়ত্তশাসন এবং গণতন্ত্রের জন্য।’ ফ্যাসিবাদী সরকার জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই তিনটি রাষ্ট্রের জনগনের কাছ থেকে সম্পুর্নভাবে বিচ্ছিন্ন।
তিনি বলেন যে বাংলাদেশের আন্দোলন বায়াফ্রার মত কোন বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরর আন্দোলন নয় । এটি পর্তুগিজের এঙ্গলা ও মোজাম্বিকের মত স্বদেশের মুক্তির লড়াই । পাকিস্তান কখনই এই আন্দোলন দমিয়ে রাখতে পারবে না।তবুও আশু সাফল্যের প্রত্যাশায় সমস্যা সমাধানে গেরিলা যুদ্ধের দ্রির্ঘসুত্রিতার সম্ভাবনা উপেক্ষা করা মুক্তিযোদ্ধাদের উচিত হবে না।’জনগণের ঐক্যের মাঝেই এই আন্দোলনের সফলতা নিহিত।প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে চাপরাসি পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জান্তার বিরুদ্ধে।এমনকি ইন্ডিয়ায় ব্রিটিশ শাসকরাও জনগণের কাছ থেকে এইরকম সম্পুর্নভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল না যতটা বাংলাদেশে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসন ব্যবস্থায়।এই সেই ঐক্য যা পাকিস্থানের পুতুল শাসন প্রয়াসকে হতাশগ্রস্থ করে দিয়েছে।আমাদের আরও একটি জোরদার বিষয় হচ্ছে,ইন্ডিয়ার সমর্থন যারা কিনা আমাদের তিন প্রান্ত ঘিরে রয়েছে।’
তিনি বলেন,আমরা যেমনটি প্রত্যাশা করেছিলাম সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আমাদের সেভাবে সাহায্য করছে না।অন্যদিকে অ্যামেরিকা এবং চায়না প্রকাশ্যভাবে পাকিস্তানকে সহায়তা করছে।আরব দেশগুলোর এইরকম নির্লিপ্ত আচরণ আশা করিনি । আমরা ভেবেছিলাম অন্তত আরব দেশগুলোর মধ্যে প্রগতিশীল দেশগুলো আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করবে।
——————————————
<৪,২২৬,৪৯৯>
অনুবাদকঃ শিপ্রা কর্মকার
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৬। “সার্বভৌম বাংলাদেশ একমাত্র লক্ষ্য”-মাওলানা ভাসানী টাইমস অব ইন্ডিয়া(নয়াদিল্লি) ২৮ জুলাই, ১৯৭১
“সার্বভৌম বাংলাদেশ একমাত্র লক্ষ্য”
মাওলানা ভাসানীর প্রেস বিবৃতি। ২৬ শে জুলাই,১৯৭১
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মাওলানা ভাসানী বলেছেন যে, রাজনৈতিক ছায়া দক্ষিনপন্থী নির্বিশেষে , মধ্যপন্থী এর বামপন্থী ব্যাতীত কয়েক স্ব-সন্ধানীদের লক্ষ্য একটি স্বাধীন বাংলাদেশ অনুমোদন করা আবশ্যক।
মাওলানা একটি প্রেস বিবৃতিতে বলেন যে, ” শুধু মীর জাফর তাদের নিজের ব্যাক্তিগত স্বার্থের জন্য আমাদের পদমর্যাদার একটি বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করবে”। অস্বীকৃতি যে রিপোর্ট করা বামপন্থী দলগুলো একটি যুক্তফ্রন্টের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
মাওলানা বলেন, “পাকিস্তানের শুরু থেকেই আমি বাংলার হিন্দু, মুসলসান, খ্রিস্টান, আদিবাসির অর্থনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য একই থিম উপস্থাপক ,একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং সমাজ তান্ত্রিক বাংলাদেশের উপর একই রয়েছি।”
“আমি আগে কখনও বা পরে ২৫ শে মার্চ এর অবশ্যম্ভাবী সব বামপন্থী দলগুলোর একটি যুক্তফ্রন্ট সৃস্টির জন্য আওয়ামী লীগ ব্যাতীত অন্য কোন দলের আবেদন আছে।“
<৪,২২৭,৫০০-৫০২>
অনুবাদকঃ শিপ্রা কর্মকার, শিরোনামহীন-১
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৭। শ্রমিক লিগের পক্ষ থেকে বিশ্বের শ্রমিক সমাজের কাছে সাহায্যের আবেদন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি ৮ আগস্ত,১৯৭১
“বিশ্বের সকল শ্রমিকদের নিকট আপীল”
বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। একপাশের এই অসমযুদ্ধে হত্যা, লুটপাট ও লুন্ঠন এবং ৭৫ মিলিয়ন মানুষের উপর এবং অন্যদিকে ঐপনিবেশিক ধরে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাংলাদেশের নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের যুদ্ধ হয় ন্যায়বিচার ও সস্বাধীনতার জন্য এবং ইয়াহিয়া খানের আক্রমন সশস্ত্র দলবল হয়ে ওঠে।
মানুষের সংগ্রাম পূর্ন স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য সত্যি হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
নিন্মলিখিত লাইন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শ্রমিক শ্রেনীর বিশেষ অবস্থানে বিশ্ব জুড়ে ব্যাক্তি জ্ঞানগর্ভের জন্য বর্ণিত হচ্ছেঃ- ” বাংলাদেশে চার মিলিয়ন শিল্প শ্রমিক আছে। এই শিল্পে শ্রমিক, যোগাযোগ ও আত্মীয় ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত। ”
পশ্চিম পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠি দ্বারা বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষগুলো চিরস্থায়ী ঐপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছে। গত ২৩ বছরে ভূমিমালিক, একচেটিয়া শিল্প এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকরা তথাকথিত ফিল্ড মার্শাল, জেনারেল এবং সশস্ত্র বাহিনীর এয়ার মার্শাল ধারাক্রমে বাংলাদেশের জনগনকে শোষন করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শোষন ও দীর্ঘ লালিত সতন্ত্র রাজনৈতিক এবং আর্থ সাংস্কৃতিক ধারনা ধ্বংশ করার জন্য ক্রমাগত শয়তানির প্রচেষ্টার সঙ্গে ছিলেন। আমাদের জনগনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেলার জন্য এই আদেশ সম্পন্ন করা হয় যাতে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য একটি স্বজাতি প্রবেশ একত্রীকরন তাদের অধিকার জাহির করতে না পারে। শোষন এবং তার সব গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিপীড়ন ধীরে ধীরে ঐপনিবেশিক শাষনের একটি সর্বোত্তম রুপ নেয়। ১৯৬৬ সালের এই পর্যায়ে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জনগনের আসন্ন বিবিধ লড়াইয়ের জন্য তার ঘোষিত ৬ দফা দাবি গঠন ও প্রনয়ন করেন। ছয়দফা কর্মসূচি বাংলাদেশের জনগনের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি ব্যাপক রাজনৈতিক সূত্র ছিল। শ্রমিক গনের মধ্যে সবচেয়ে সচেতন অধ্যায় হচ্ছে, “জনসাধারন ” অবিলম্বে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এই প্রোগ্রামে অর্থনৈতিক মুক্তির এবং প্রতিশ্রুতি সংঙ্গায়িত হয় এবং পরবর্তী গনআন্দোলন একেবারে পুরোভাগ মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে।
বস্তুত, চরম নির্যাতনের মুখে ষাটের দশকের শেষ দিকে ছয় দফা কর্মসূচি পক্ষে অপ্রতিরোধ্য গনঅভ্যুত্থান তৈরি করে এবং ভীতি প্রদর্শন এবং আইয়ুব শাসনের দ্বারা দিন ক্ষয় এবং পতন এবং অাগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিব মুক্ত হন এবং পরে আওয়ামী লীগ গত সাধারন নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক বিজয় দান করে যাতে বাংলাদেশের শ্রমিক ও ছাত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে!
তারপর আবারও এই শ্রমিক আর ছাত্ররাই ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে শেখের অসহযোগ আন্দোলনের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। এবং পরিশেষে, যখনই ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের নিরাপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অবজ্ঞা করে তাদের ওপর গুলি চালানো শুরু করল, তখনই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী আরও কিছু ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী ও যোদ্ধা হিসেবে শ্রমিকরাই সর্বপ্রথম যোগদান করে।
আজ আমাদের লোকেদের ওপর ইয়াহিয়া খান ও তার সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত এই হত্যাযজ্ঞ, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, নজিরবিহীন গণহত্যা বাংলাদেশের শ্রমিকদের সংকল্প ও দৃঢ়তাকে নষ্ট করতে পারেনি।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রায় ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকার শিল্প শ্রমিকদের আবাসিক কলোনিসমূহ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আদমজী জুট মিল প্রাঙ্গণে হানাদাররা মসজিদের ভেতরে প্রায় শতাধিক শ্রমিককে হত্যা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মিরা এখন নেতৃস্থানীয় শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে চিহ্নিত করে দেখামাত্র হত্যা করে তাদের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিচ্ছে। শুরুতে ট্যাংক আর মর্টারের আক্রমণ থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা এখন আশ্রয় ও খাবারের অভাবে ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক এক মৃত্যুর সাথে লড়ছেন।
সবরকম বাধা আর নির্মমতাসত্ত্বেও শ্রমিকরা এখনও তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শ্রমিক শ্রেণীর লোকেরা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে এখনও সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। হানাদারদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে নষ্ট করতে অসহযোগ আন্দোলন শিল্প ও যোগাযোগকর্মীদের জন্য একটি কার্যকর উপায়। যদিও এই একই উপায়ে দরিদ্র শ্রমিকরা তাদের কাজ ও মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যারা তা খুব সহজেই ইয়াহিয়াকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে অর্জন করতে পারত। কাজেই একথা স্পষ্ট যে, শত্রুদেরকে দূর্বল করতে অসহযোগিতার যে উপায় নিরুপণ করা হয়েছে, তা আসলে যাদের জন্য নিরুপণ করা হয়েছে অর্থাৎ বাংলাদেশে ৪০ লক্ষ শ্রমিককেই ধ্বংস করে দেবে, সারাবিশ্বের মানুষের সহযোগিতায় এই যুদ্ধের সময়ে যদি তারা টিকতে না পারে।
এমতাবস্থায়, আমরা বাংলাদেশের সংগ্রামরত শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বিশ্বের সকল জাতির শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি মানবতা ও সুবিচারের লক্ষ্যে আমাদের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের এই চরম সংকটময় মুহূর্তে সহযোগিতার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
১। আমাদের বিভিন্ন ধরণের আর্থিক ও বস্তুগত সাহায্য প্রয়োজন।
২। আমরা আশা করছি যে, সারাবিশ্বের কর্মজীবী মানুষেরা যার যার নিজস্ব সংগঠনের মাধ্যমে একটি কার্যকর পরিকল্পনা নিরুপণ করে আন্দোলনে নামবেন, যাতে করে তাদের সরকার আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৩। আমরা বিশ্বের অন্যান্য সহকর্মীদেরকে অনুরোধ করছি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলতে। আন্তর্জাতিক নাবিক ভ্রাতৃত্বকে পাকিস্তানি নৌযান কিংবা পাকিস্তানে যাওয়া বা পাকিস্তান থেকে আসা কোন নৌযানে কাজ না করার অনুরোধ করছি।
৪। আমরা সহকর্মীদেরকে আরও অনুরোধ করব সঠিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যাতে করে বিশ্বের দেশগুলো অবিলম্বে পাকিস্তান সরকারকে সবরকম অর্থনৈতিক কিংবা সামরিক সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকে।
৫। আমরা বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা দেয়ার জন্যে একটি আন্তর্জাতিক কর্মজীবী কো-অর্ডিনেশন ফোরাম গঠনের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করছি।
আমরা আমাদের সহকর্মী ভ্রাতৃত্বকে অনুরোধ করছি যে, সময় আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহায্যের ক্ষেত্রে অল্পসময়ের বিলম্বও আমাদেরকে হাজার বছরের ভোগান্তি ও পরাধীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। জয়বাংলা।
বিনীত
ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শ্রমিকবৃন্দ
এসডি/ – মোঃ শাহ জাহান এসডি/ – আব্দুল মান্নান
দায়িত্বরত সভাপতি সাধারণ সম্পাদক
জাতীয় শ্রমিকলীগ এবং আহ্বায়ক, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ওয়ারকারস’
সদস্য, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ওয়ার্কারস’ অ্যাকশন কমিটি অ্যাকশন কমিটি,
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
<৪,২২৮,৫০৩-৫০৪>
অনুবাদকঃ শিরোনামহীন-১
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৮। বাংলাদেশ শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে সিনেটর কেনেডিকে প্রদত্ত স্মারকপত্র
বাংলাদেশ শরণার্থী বুদ্ধিজীবী ১০ আগস্ট, ১৯৭১
বাংলাদেশ শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে
জনাব এডওয়ার্ড এম কেনেডিকে একটি স্মারকপত্র
জনাব,
বাংলাদেশের দূর্যোগে নৈতিক সমর্থন ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের জন্য আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমরা আপনার নিজস্ব উদ্বেগ ও পাকিস্তানকে অস্ত্র ও সামরিক সাহায্য প্রদানের বিরোধিতা এবং বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের প্রশংসা করি। ভারতে আশ্রয় নেয়া সত্তর লক্ষাধিক হতভাগ্য শরণার্থীকে ত্রাণ প্রদানের লক্ষ্যে আপনার অবদানকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করি।
সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে ৮ম বৃহত্তম সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনা সম্পর্কে আপনি অবহিত।
জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান ছিল একটি বিরল রাষ্ট্র, আধুনিক ইতিহাসে যা অনন্য – হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত একটি ভিন্ন অঞ্চল দ্বারা পৃথক ছিল এর দু’টি অংশ, যা কেবলমাত্র একইরকম ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে একজোট হয়েছিল। ১৯৪০ সালের পাকিস্তান ইশতেহারে অবিভক্ত ভারত যাকে উপমহাদেশের দু’টি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার “সার্বভৌম রাষ্ট্র” ধরা হয়, সেখানকার মুসলিমদের আশা-আখাংক্ষার কথা বলা আছে।
একটি একক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে তাদের আন্তরিক ইচ্ছে ও উৎসাহে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের অধিকারকে ইশতেহারে বলা কথা অনুযায়ী সার্বভৌমতা ধরে নিয়ে একক পাকিস্তানের কাঠামো মেনে নিয়ে সমর্পণ করে। স্বপ্নটিকে সত্যি করে তোলার চেষ্টা তারা করেছিল, কিন্তু অগণত্রান্ত্রিক রণকৌশলের কারণে তারা ব্যর্থ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের সুনামের সুবিধা নিয়ে তারা এমন একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে বাঙালিদের অবস্থান ছিল গৌণ। গত ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কারণে যে দুর্দশা, ভোগান্তি আর শোষণ বাংলাদেশের মানুষ সহ্য করতে করতে অবশেষে তারা বুঝতে পেরেছে যে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে তারা বেঁচে থাকতে পারবে না যতদিন না ১৯৪০ সালের পাকিস্তান ইশতেহারে বর্ণিত এলাকাসমূহের স্বায়ত্বশাসন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রণীত আওয়ামিলীগের ছয়দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার পাশাপাশি আঞ্চলিক শোষণ বন্ধ করা। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে এই কর্মসূচির প্রতি বাংলাদেশের জনগণের যে বিপুল পরিমাণ সমর্থন পাওয়া গিয়েছে, তা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝিয়ে দিতে তাদের শেষ মরিয়া চেষ্টা। কিন্তু সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশের ওপর তাদের ঔপনিবেশিক শোষণও ত্যাগ করতে চায়নি আবার গণতন্ত্রকেও তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে তারা তৈরি ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের দুঃখজনক ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, যেকোন উপায়েই সামরিক শাসকগণ তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। কাজেই বাংলাদেশের মানুষদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়াটাই ছিল তখন একমাত্র উপায়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই বর্বরতা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এক জাতি ও এক দেশের ধারণা ইয়াহিয়া খান ও তার সহযোগীরা কখনই মন থেকে গ্রহণ করেনি, কারণ কোন সেনাবাহিনীই এটা সমর্থন করে না যদি না তারা অন্য কোন দেশকে দমিয়ে রেখে ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়।
আমরা আপনাদের কাছে এবং আপনাদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে অনুরোধ করছি যেন নিম্নে উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয় –
১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া।
২। শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
৩। বাংলাদেশকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র আদায়ে সবরকমের সম্ভাব্য সহযোগিতা প্রদান।
৪। পাকিস্তানকে পাইপলাইন সাহায্যসহ যেকোন ধরণের সাহায্য প্রদান বন্ধ করা।
৫। পাকিস্তানের সাথে সমস্ত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা।
৬। ইয়াহিয়াকে তার গণহত্যা বন্ধ করতে বাধ্য করা।
৭। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও নারীপাচার খতিয়ে দেখতে ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে বিচারকদের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন স্থাপন করা।
বনগাঁ
১০ আগস্ট, ১৯৭১
একান্ত অনুগত
পশ্চিম বাংলায় অবস্থানকারী
বাংলাদেশি শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে
<৪,২২৯,৫০৫-৫০৭>
অনুবাদকঃ রায়হান রানা
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২২৯। রাজনীতি ও রণকৌশলগত খসড়া দলিলের সংক্ষিপ্ত সার পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ১০ আগস্ট, ১৯৭১
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতি ও রণকৌশলগত খসড়া দলিলের সংক্ষিপ্ত সারঃ-
অদূর ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসকে সামনে রেখে “পার্টির কংগ্রেস প্রস্তুতি কমিটি’’ কর্তৃক পার্টি সভ্যদের নিকট উপস্থিত করার জন্য পার্টির রণনীতি ও কৌশলগত খসড়া দলিল।
*পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় সামন্তবাদ বিরোধী পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করে তুলুন।
*তিন শত্রু বিরোধী সকল দল, মত,ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তিফ্রন্টগঠনে অগ্রসর হোন।
*“জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের” ও মুক্তিফ্রন্ট গঠনের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করুন।
(১) পূর্ব বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা
(ক) পাকিস্তানী শাসক ও শোষকদের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা উপনিবেশ।
(খ) আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা আধা বা নয়া উপনিবেশ।
(গ) আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদ তথা জোতদারী-মহাজনী প্রথার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা আধা সামন্তরিক।
অতএব, পূর্ব বাংলা বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক এবং আধা সামন্তবাদী।
(২) মূল শত্রুতিনটি
(ক) পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী শক্তি তথা পাকিস্তানী আমলা মুৎসুদ্দী গোষ্ঠী ।
(খ) বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।
(গ) সামন্তবাদ তথা জোতদার মহাজন গোষ্ঠী ।
(৩) প্রধান দন্দ্ব
পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে পূর্ব বাংলার সামন্ত গোষ্ঠী ছাড়া বাকি সকল শ্রেণীর জনগণের বিরোধ হল প্রধান বিরোধ।
(৪) বিপ্লবের চরিত্র
* উপনিবেশবাদ ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তির প্রশ্নে এ বিপ্লব “ জাতীয় মুক্তি বিপ্লব”।
আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদের থেকে কৃষক জনতার মুক্তির প্রশ্নে এ বিপ্লবের চরিত্র হবে “গণতান্ত্রিক”। অতএব এ বিপ্লবের চরিত্র “ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ” ।
*যেহেতু বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকবে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে বিপ্লবী শ্রেনীসমূহের সমবায়ে শ্রমিক-শ্রেনী ও তার পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি , তাই এ বিপ্লবের চরিত্র “ জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব”।
যেহেতু এ বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তবাদের উৎখাত হবে এবং প্রকৃত কৃষকদের হাতে আসবে জমি, তাই এ বিপ্লবের চরিত্র, “ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবও” বটে । অতএব সব মিলে এ বিপ্লব হল “ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব” ।
(৫) বিপ্লবী মুক্তিফ্রন্ট
তিন শত্রুবিরোধী সামন্ত রাজনৈতিক দল, শ্রেনী-সংগঠন ও গণ-সংগঠন, রাজনৈতিক গ্রুপ ও মত এমনকি বিশিষ্ট সমবায়ে গঠিত হবে “জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট”।
(৬) বিপ্লবের নেতৃত্ব
শ্রমিক কৃষক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবিদের মৈত্রীর ভিত্তিতে শ্রমিকশ্রেনী ও তার রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এ বিপ্লব চূড়ান্ত রুপ নেবে।
(৭) বিপ্লবী অভিজ্ঞতা
*কোন প্রকার আপোসের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আসতে পারে না।
* নির্বাচন বা পার্লামেন্টারী প্রথার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মুক্তি আসবে না।
* নিরস্ত্র জনতার ব্যাপক গণ-অভ্যত্থানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা স্বাধীন হতে পারে না।
* ধনিক শ্রেনীর নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লব সফল হতে পারে না।
* উন্নত মানের সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াই-এর কায়দা যে কত ভ্রান্ত তা প্রমাণিত হয়েছে।
* শহর থেকে বিপ্লবের সূচনা ও স্বল্প সময়ে ক্ষমতা দখলের রণকৌশল যে চূড়ান্তভাবে ভ্রান্ত তাও
প্রমাণিত হয়েছে।
(৮) বিপ্লবের সঠিক পথ
* দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামই পূর্ব বাংলার মুক্তির একমাত্র পথ।
* এ সংগ্রাম শুরু করতে হবে গেরিলা কায়দায়, তারপর এটা বিকশিত হবে চলমান ও নিয়মিত
যুদ্ধে।
*এ যুদ্ধের সূচনা গ্রামবাংলা থেকে । সেখানে শত্রু সবচাইতে দুর্বল।
* বিপ্লবের মূল শক্তি গ্রাম্য খেতমজুর, বর্গাচাষী ও গরীব যারা সংখ্যায় শতকরা ৮০-৮৫ জন।
(৯) বিপ্লবে বাঙালী ধনী শ্রেনীর ভূমিকা
* এ বিপ্লবে প্রধান দ্বন্দ্ব পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর সঙ্গে পূর্ব বাংলার উঠতি ধনিক ও জাতীয় ধনিক শ্রেনীর তীব্র বিরোধ রয়েছে তাই তারা বিপ্লবের দোদুল্যমান মিত্র।
* যেহেতু তিন মূল শত্রুর মধ্যে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এ ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে বাঙালী ধনীদের রয়েছে তীব্র সংঘাত সেহেতু শ্রেনী হিসাবে তারা ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের’ দোদুল্যমান মিত্র।
* বাঙালী ধনীদের এ অংশ বিপ্লবের প্রথম দিকে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেবে না। বিপ্লবী শক্তিসমূহ যখন দৃঢ় ঐক্যের ভিত্তিতে সুসংহত ও সবল হয়ে অগ্রসর হবে একমাত্র তখনই এ দোদুল্যমান মিত্ররা ঐক্যফ্রন্টে আসতে বাধ্য হবে ।
* বাঙালী ধনীদের যে অংশ মুৎসুদ্দী তারা সব সময় আপোষকামী। তারা সশস্ত্র শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবীকে যমের মত ভয় করে। এরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।
(১০) কোন পণ? আপোষ না সংগ্রাম ?
পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বর্তমান স্তরে “রাজনৈতিক সমাধানের” অর্থ এক পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলার অবস্থান। এর অর্থ স্বাধীন সার্বভৌম জনগণের গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা নয়। এর অর্থ পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির নিকট আত্মসমর্পন। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনগণ ও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে।
(১১) নমনীয় কৌশল
বাঙালী ধনি যারা কলকারখানার মালিক, বাঙালী, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাক্টর , ধনী কৃষক এবং দেশপ্রেমিক জোতদারদের সম্পদ-বাড়ি গাড়ি ইত্যাদির কোন সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না একটি মাত্র শর্তে যে তারা বিপ্লবের পক্ষে থাকবে। তবে তাদের অধীনে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী ও বর্গাচাষীকে আগের মত নির্মম শোষণ করতে দেওয়া হবে না। এখানে থাকবে মুক্তিফ্রন্টের কঠোর বিধিনিষেধ।
যেসব ধনী, ধনী কৃষক, জোতদার বা যে কেউ শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করবে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। জমি কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হবে। এ কাজে ব্যাপক কৃষক জনতাকে সক্রিয়ভাবে পক্ষে পেতে হবে, যার উপর বিপ্লবের জয় পরাজয় নির্ভর করবে।
পরিশিষ্ট
প্রিয় কমরেডগণ, দীর্ঘ চব্বিশ বৎসর পর ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত বিভিন্ন শ্রেনীসমূহের তীব্র শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার রাজনীতি অনেকগুলি বিতর্কমূলক বিষয়ের অবসান ঘটিয়ে চলছে।
মূলতঃ সে বিষয়গুলি পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে ছিল চূড়ান্ত বাধা। যেমন পূর্ব বাংলা
“উপনিবেশ” কি না? ঔপনিবেশিক মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন আছে কি না? বুজো নেতৃত্বে
জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে পারে কি না? সংগ্রামের কৌশল কি হবে- সম্মুখ সমর না গেরিলা পন্থা? শহর থেকে শুরু না গ্রাম থেকে সূচনা? সর্বোপরি, প্রধান দ্বন্দ্ব কি পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ না সামন্তবাদ? উপরোক্ত সমস্ত পন্ডিতী বির্তকের অবসান ঘটিয়ে আজ পূর্ব বাংলার বিপ্লব সুনির্দিষ্ট রুপ নিতে চলেছে। বাকী রয়েছে শ্রমিক কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে শ্রমিক শ্রেণীর ও তার পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী মুক্তিফ্রন্ট। ইতিমধ্যে এগুলোও দানা বেঁধে উঠেছে। প্রতিটি পার্টিকর্মীর একনিষ্ঠ, ত্যাগ , সাহস, সহনশীলতা ও সংগ্রাম- এগুলো দ্রুত বিকশিত করতে সাহায্যে করবে। গত কয়েক মাসের মধ্যে পার্টি কর্মীরা তার প্রমাণও দিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকে শহীদি মৃত্যবরণ করছে। অনেক নিচুস্তরের কর্মী উচ্চমানের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, অনেক উচ্চস্তরের কর্মী পেছনে হটে যাচ্ছে, দুর্বল জেলা সবল হয়েছে –সবল জেলা দুর্বল হয়েছে।
সবচাইতে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, পার্টি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে ও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং লড়াই-এর মাধ্যমে খাঁটি পার্টি গড়ে উঠছে। এর মাধ্যমে আমাদের পার্টি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা অর্জন করেছে। অতএব, বন্ধুগণ, আজ একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা চলে যে, দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অবশ্যই সাফল্যমন্ডিত হবে। জাতীয় ও আন্তজার্তিক জনমত এবং সংগ্রামী “শক্তি” আমাদের পক্ষে। দুনিয়ার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা আমাদের সহায়ক। মার্কসবাদ-লেলিনবাদ , কমরেড স্ট্যালিন, মহান নেতা মাও সে তুং, কমরেড হো-চি-মনের চিন্তাধারা ও অভিজ্ঞতা আমাদের পাথেয়। জয় আমাদের হবেই।
পূর্ব বাংলার “ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব” জিন্দাবাদ।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘজীবী হোক।
১০-০৮-৭১ ইং
<৪,২৩০,৫০৮-৫০৯>
অনুবাদকঃ রায়হান রানা
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩০। বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটির নিজস্ব ভূমিকা ব্যাখা করে প্রদত্ত বিবৃতি বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটি ১০ আগস্ট, ১৯৭১
১০ই আগস্ট ১৯৭১ “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটি” কর্তৃক নিন্মোক্ত বিবৃতি প্রচারিত হয়ঃ
আজ যখন একদিকে শত শহীদের রক্তস্নানে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম এক নতুন স্তরে উন্নীত হইয়াছে এবং অপরদিকে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও বৃহৎ পুঁজির প্রতিভূ পাক-জঙ্গিশাহী এই মুক্তিসংগ্রামকে নস্যাৎ করিবার জন্য নূতনতন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক সেই মুহুর্তে যে প্রশ্নটি বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রামের সম্মুখে সর্বেপেক্ষা গুরুত্ব লইয়া উপস্থিত হইয়াছে তাহা হইতেছে বাঙালী জাতির ঐক্যের প্রশ্ন। গত ১লা জুন সেদিন বাংলাদেশকে দস্যুকবলমুক্ত এবং পরিপূর্নরুপে স্বাধীন করিবার ব্রত লইয়া কতগুলি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন একত্রিত হইয়া “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করিয়াছিল , সেই দিনই এই ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিয়াছিল। ১লা জুনের ঘোষণায় তাই উল্লেখিত হইয়াছে।
এই সমন্বয় কমিটির আশু লক্ষ্য হইল সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া।
আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংরামকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য প্রয়োজন সকল দল-মত-ব্যক্তির সমবায়ে গঠিত একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের। তাই এই সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে আমরা আওয়ামী লীগ সহ স্বাধীনতাকামী অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গণ-সংগঠন, শ্রেনী-সংগঠন ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের নিকট এইরুপ একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানাইতেছি।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে , যে মুহুর্তে সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রচেষ্টা করা হইতেছে, সেই মুহুর্তে ‘সমন্বয় কমিটি’র গঠনকে কেন্দ্র করিয়া বিভিন্ন মহল বিভ্রান্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি করিতেছে। তাহারা ইহাকে বিভেদাত্নক ও বিভ্রান্তিকর কার্যকলাপ বলিয়া চিত্রটি করিতে প্রয়াস পাইতেছেন।
অথচ আমাদের ঘোষণা হইতে এইরুপ মনে করিবার কোন কারন নাই। ‘সমন্বয় কমিটি’র পূর্নাঙ্গ ঘোষণা সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে বহু পূর্বেই প্রেরণ করা হইয়াছিল। তাহা ছাড়া আমাদের এই বক্তব্য লইয়া গত ১লা জুলাই সমন্বয় কমিটির দুইজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠনের পূর্বে ও পরে সমন্বয় কমিটি পৃথকভাবে ও সমষ্টিগতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের সহিত ব্যক্তিগতভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যের প্রস্তাব লইয়া আলাপ-আলোচনা করিয়াছেন। সুতরাং ‘সমন্বয় কমিটি’কে কেন্দ্র করিয়া কোন প্রকার বিভেদাত্নক কর্মকান্ড আবিষ্কার করা নিছক কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং সমন্বয় কমিটি বিরোধী কোন প্রকার মন্তব্য ঐক্যের ক্ষেত্রই বিনষ্ট করবে।
আমরা মনে করি বাংলা স্বাধীনতা লড়াইয়ে অংশগ্রহনের অধিকার প্রত্যেকটি বাঙালী নাগরিকের আছে। একমাত্র পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মুষ্টিমেয় দালাল ইহার ব্যতিক্রম। কে ছোট, কে বড়, কে ইয়াহিয়া প্রদত্ত ১৯৭০- এর নির্বাচনে অংশগ্রহন করিইয়াছিল কে করে নাই , কে সেই নির্বাচনে জয়লাভ করিয়াছে বা পরাজিত হইয়াছে- সেকথা বড় নয় , বড় হইল বাংলা স্বাধীনতা । সেই স্বাধীনতার উদগ্র আকাংক্ষা লইয়া সমন্বয় কমিটি ইতিমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে নিজের শক্তিও সামর্থ অনুযায়ী জনগণকে সংগঠিত করা, পাকসেনা ও তাহার দালালদের খতম করিবার কাজ শুরু করিয়াছে। সে সকল এলাকায় এইরুপ কাজ ভাল ভাবে করা গিয়াছে সেইখানেই জনগনের মধ্যে নূতন উৎসাহ সৃষ্টি করা সম্ভব হইয়াছে, এবং ফলে আরও কিছু রাজনৈতিক গ্রুপ এবং সংগঠন সমন্বয় কমিটির সহিত সংযোগ স্থাপন করিয়াছে। সমন্বয় কমিটির উদ্যেগে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে কৃষক-শ্রমিক ও জঙ্গী সমবায়ে গড়িয়া উঠিয়াছে ছোট ছোট গেরিলা দল ও গেরিলা এলাকা। এই সকল এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সমন্বয় কমিটি বহির্ভৃত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও সমন্বয় কমিটির সহিত ঐক্যবদ্ধভাবে উক্ত প্রচেষ্টায় অংশগ্রহন করিয়াছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কি ঘটিতেছে এবং সমন্বয় কমিটির কাজগুলি কিভাবে চলিতেছে সে সম্পর্কে যাহাদের নূন্যতম ধারণা আছে , তাহারাই জানেন সমন্বয় কমিটির কাজ দেশের অভ্যন্তরে সংগ্রামরত মানুষের মধ্যে ব্যপক ঐক্যের ক্ষেত্র রচনা করিতেছে। তথাপি যেহেতু সমন্বয় কমিটির বিরুদ্ধে কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করা হইতেছে সেইহেতু কতগুলি প্রশ্নে আমাদের পুনরুক্তি করিতে চাই। প্রথমতঃ সমন্বয় কমিটি কোন জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট নয়। বরং সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহবান জানানো হইয়াছে। সেই ফ্রন্টই হল একটি খাঁটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট যাহা ছোট-বড় সকল সংগ্রামী শক্তিকেই সংঘবদ্ধ করিতে পারে। দ্বিতীয়তঃ সমন্ব্য় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে জনগণকে সংগঠিত করিয়া যে গেরিলা বাহিনী গঠন ও যে গেরিলা যুদ্ধের প্রোগ্রাম উপস্থাপিত করিয়াছে, তাহা কোন ক্রমেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিবাহিনীর বিরোধী নয়। আমাদের ১লা জুনের ঘোষণায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, “ এই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হইবে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সহিত যোগাযোগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে। ’’ তৃতীয়তঃ এই সমন্বয় কমিটি আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন রাজনৈতিক শক্তির বিরোধী কোন শক্তি নয়। সমন্বয় কমিটির ঘোষণায় প্রতিটি ছত্রে ইহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে পারিলেই বিজয়কে সুনিশ্চিত করা যায়। তাই জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা সর্বপ্রকার দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করিবার জন্য সকলের নিকট উদাত্ত আহবান জানাইতেছি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন প্রকার দলীয় সংকীর্ণ মনোবৃতি খুনী ইয়াহিয়ার হাতকেই শক্তিশালী করিবে। আমাদের তাই শ্লোগান-ঐক্য, একমাত্র ঐক্য, বাংলাদেশের মহান জনতার ব্যপক সংগ্রামী ঐক্যই বিজয়ের চাবিকাঠি। এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত কাজ করিয়া যাইতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু আমরা মনে করি, অনুরুপভাবে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী দলগুলিকে আগাইয়া আসিতে হইবে।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা আরও একটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের মতামত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করিতে চাই। কিছুদিন ধরিয়া একটি মহল ‘সমন্বয় কমিটি’কে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জড়িত করিয়া বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করিতে প্রয়াস পাইতেছে। সর্বপ্রকার বিভ্রান্তি নিরসনকল্পে আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করিতে চাই যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সাথে আমরা কোন ভাবেই সম্পর্কিত নই এবং সম্পর্কিত হইতেও চাই না। আমরা চাই, ভারত সরকার, ভারতের জনগণ ও ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ পৃথিবীর সকল স্বাধীনতাকামী গনতান্ত্রিক শক্তিই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রামে আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করুক। যে-কোন মহল হইতে এই ধরনের যে কোন শর্তহীন সাহায্যে আমরা
কৃতজ্ঞতা সহকারে গ্রহন করিব।
<৪,২৩১,৫১০>
অনুবাদকঃ সজীব কুমার সাহা
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩১। বাংলাদেশের গণহত্যায় পাকিস্তানকে সহায়তা না করার জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আবেদন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ২১ আগস্ট, ১৯৭১
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
দুর্ভাংগা ভবন ,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
কলকাতা ১২
মহোদয়,
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তান সরকারকে ক্রমাগত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই ব্যাপারে সচেতন আছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশে গণহত্যার কাজে ব্যাবহার করবে। আমরা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী মানুষ এ গণহত্যার বিপক্ষে যে বিক্ষোভ করছে তা আমেরিকা সরকার কোন তোয়াক্কা করছে না। আমরা আমাদের সমিতি থেকে কয়েক সপ্তাহ আগে একটি স্মারকলিপি দেয় সিনেটর কেনেডির কাছে । সমিতি থেকে আরো একটি কপি কলকাতায় অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো হয়েছিল। একটি খবর ছড়িয়েছে যে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকার অস্ত্র গুলি ইয়াহিয়ার ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে, যেটি গেরিলাদের দমন ও পাকিস্তান সৈন্যদের ট্রেনিং এর জন্য ব্যবহৃত হবে। এই সংবাদে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উদ্বেগ আরো বেড়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বিবেচনা করে দেখেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের গণহত্যা আইন এখন পাকিস্তান আর্মি দ্বারা বাংলাদেশে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। বাংলাদেশের জনগন এটা বিশ্বাস করে না যে আমেরিকার জনগন স্বাধীনতা সংগ্রাম নিস্পেষনের জন্য একটি সামরিক সহায়তা প্রস্তাব করবে।
অত এব, আমাদের সমিতি ন্যায় বিচার, মানবতা ও স্বাধীনতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে আবেদন করছেঃ
আ) ইয়াহিয়া সরকারকে সকল প্রকার সামরিক , অর্থনৈতিক ও চিকিতসা সেবা বন্ধ করে দেয়ার জন্য ।
ব) ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ, যাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নৃশংসতা বন্ধ করে ও নিঃশর্ত ভাবে মহান নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেয়।
চ) সর্বশেষ বাংলাদেশ কে সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়া।
তারিখঃ ২১ শে আগস্ট ১৯৭১ , কলকাতা আপনার বিশ্বস্ত
সাধারণ দূতাবাস
এ কে রায়
জেনারেল সেক্রেটারি
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
<৪,২৩২,৫১১-৫১২>
অনুবাদকঃ সজীব কুমার সাহা
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩২। মার্কিন প্রসাশনের সামালোচনা করে বাংলদেশ শিক্ষক সমিতির বিবৃতি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির পক্ষে ডক্টর এ কে রায় এর সংবাদ বিবৃতি
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক গ্যালব্রেইথ তার কলকাতা আগমনের সময় দমদম বিমানবন্দরে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা ও সমস্যা সমাধানের জন্য দা স্টেটসম্যান পত্রিকা কে যে সাক্ষাতকার দেন তা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে । অধ্যাপক গ্যালব্রেইথ এর সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় বাংলাদেশের সরকার নিজেদের গঠন করতে দেওয়া অথবা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা অথবা এই জাতীয় কোন ব্যাবস্থা করা। স্পষ্টভাবে অধ্যাপক গ্যালব্রেইথ পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চিন্তা করছেন কিন্তু বাংলাদেশ হবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল । অধ্যাপক যদি মনে করে থাকে তার পন্থা টি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে তাহলে এটি অধ্যাপকের একটি ভুল ধারনা । আজ এই পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা ব্যাতীত বাংলাদেশের জনগনের কাছে কোন কিছুই গ্রহনযোগ্য নয় । ইতিমধ্যে আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি এবং আরো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত যতক্ষন পর্যন্ত না পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে উৎখাত করতে না পারছি । বাংলাদেশকে শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ নয় ,এটি আরো উচু স্তরের। কয়েক লক্ষ শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং তাদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তাদের প্রতি মানবিক ও সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য জনগনের মতামত কে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার জন্য নিক্সন প্রশাসন চাপ দেয়ার অনুরোধ করছি। আমরা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি যে আমেরিকার শান্তিপ্রিয় জনগন বাঙালি হত্যার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের নিক্সন এর নীতি সমর্থন দিবে না এবং যদি দেয় তাহলে অস্ত্র সহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে আমেরিকা সরকারের ক্রমাগত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের ব্যাপারে অধ্যাপক গ্যালব্রেইথের দৃষ্টি আকর্ষন করছি । আমেরিকা সরকার এবং আমেরিকার জনগন এ ব্যাপারে সচেতন আছে যে সরবরাহকৃত অস্ত্র বাংলাদেশে গনহত্যার কাজে ব্যাবহার করবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী । আমরা সহ সারা বিশ্বে জনগন আমেরিকার এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে । কিন্তু এখন পর্যন্ত এই প্রতিবাদ আমেরিকা সরকারের উপর কোন প্রভাব ফেলছে বলে মনে হচ্ছে না । আমরা কিছুদিন আগে কলকাতায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কেনেডির নিকট একটি স্মারকলিপি দেয় । সম্প্রতি একটি খবর ছড়িয়েছে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ইচ্ছানুযায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যাবহৃত অস্ত্র বাংলাদেশে গেরিলাদের দমনের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দেয়া হচ্ছে । এই বিষয়ে কলকাতায় আমেরিকার দূতাবাসে কিছুদিন ধরেই স্মারকলিপি আদান প্রদান করা হচ্ছে । চীন সরকারে গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ আমরা একই পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করছি । আমাদের জন্য এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমেরিকার জনগন বাংলাদেশের জনগনকে দমন ও শাসন করা সমর্থন করছে ।
অত এব সমিতির পক্ষ থেকে আমরা ন্যায়বিচার , মানবতা ও স্বাধীনতার জন্য আমেরিকা এবং চীনের জনগনের কাছে আবেদন করছিঃ
ক। ইয়াহিয়া সরকারকে সবধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করা ।
খ। নৃশংসতা কমানোর জন্য পাকিস্তান সরকারকে চাপ দেয়া এবং শেখ মুজিব সহ শিক্ষক , বুদ্ধিজীবি এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে ।
গ। এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌম স্বীকৃতি প্রদান ।
কলকাতা
১১ই সেপ্টেম্বর , ১৯১১ ( এ কে রায় )
জেনারেল সেক্রটারী
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
<৪,২৩৩,৫১৩-৫১৪>
অনুবাদকঃ রায়হান রানা
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৩। আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও কংগ্রেস সমবায়ে সংযুক্ত কমিটি গঠন মুক্তিযুদ্ধ ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
আওয়ামীলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও কংগ্রেস
সমবায়ে সংযুক্ত কমিটি গঠন
সংগ্রামী ঐক্য প্রতিষ্ঠায় পথে শুভ পদক্ষেপ
\ বিশেষ প্রতিনিধি \
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে গত বুধবার পাঁচটি সংগ্রামী দলের প্রতিনিধিদের সমবায়ে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা কমিটি গঠিত হইয়াছে। এই কমিটিতে রহিয়াছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিং,জাতীয় কংগ্রেসের শ্রীমনোরঞ্জন ধর ও ভাসানী ন্যাপের মাওলানা ভাষানী। আওয়ামী লীগের দুইজন প্রতিনিধি এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হইবেন। তাঁহাদের নাম এখনো ঘোষণা করা হয় নাই। জনাব তাজউদ্দিন এই কমিটির আহবায়ক নির্বাচিত হইয়াছেন।
গত বুধবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের আহবানে মুজিবনগরে উপরোক্ত দলগুলির নেতৃবৃন্দের দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে পরামর্শদাতা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বৈঠকে যোগদান করেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মুশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জনাব কামরুজ্জামান ও জনবা আবদুস সামাদ (আওয়ামীলীগ), কমরেড মণি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ , মাওলানা ভাসানী ও শ্রীমনোরঞ্জন ধর।
এখানে উল্লেখ্যযোগ্য যে , বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম আরোও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং সংগ্রামী রাজনৈতিক দলগুলির তৎপরতা সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রথমাবধি দাবি জানাইয়া আসিতেছিল। ‘পরামর্শদাতা কমিটি’ জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট না হইলেও ইহাকে সঠিক পথে একধাপ অগ্রগতি বলা যায়। ঐক্যফ্রন্টের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
বুধবারের সর্বদলীয় বৈঠক খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। আশা করা যায় যে, ইহার ফল সুসূরপ্রসারী হইবে এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে এই দিনটি উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।
প্রস্তাবাবলী
সর্বদলীয় বৈঠকে গৃহীত এক প্রস্তাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানের অবিলম্বে ও বিনাশর্তে মুক্তি দাবি করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আত্মদানকারী নাম জানা না-জানা সকল শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অকুন্ঠ সমর্থন
দান এবং বাংলাদেশের বাস্তত্যাগীদের আশ্রয় ও সাহায্য দানের জন্য ভারতের জনগণ, ভারত সরকার ও অন্যান্য সাহায্য- সমর্থন দানকারী দেশের সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া একটি প্রস্তাব গ্রহন করা হয় । অপর এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ব্যতীত অন্য কোন ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য নয় বলিয়া দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করা হয়। আর একটি প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত জনগনের সহিত সংহতি জ্ঞাপন করা হয় এবং গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তাঁহাদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করিয়া তাঁহাদের প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থন দানের আহবান জানান হয়।
<৪,২৩৪,৫১৫>
অনুবাদকঃ রায়হান রানা
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৪। সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির উপর আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্রের সম্পাদকীয় জয়বাংলা ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি
(সম্পাদকীয়, জয় বাংলা )
বর্তমান মুক্তিযুদ্ধকে সফল সমাপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারকে উপদেশ দানের জন্য বাংলাদেশের চারটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার খবর দেশে বিদেশের সংবাদপত্রে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে এবং এ সম্পর্কে অনেক উৎসাহী আলোচনাও মুদ্রিত হয়েছে। বস্তুতঃ এই সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে জাতির যে নিবিড় ও অটুট ঐক্য আরেকবার প্রমাণিত হল, তাতে বাংলাদেশের ভিতরে মুক্তিসংগ্রামীরা যেমন অনুপ্রাণিত হবেন, তেমনি বাইরে বাংলাদেশের শুভাকাংখী ও বন্ধু দেশগুলোও উৎসাহী হবেন। বস্তুতঃ এই উপদেষ্টা কমিটি গঠনের গুরুত্ব এইখানেই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনৈক্যে সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং উগ্র তত্ত্বসর্বস্বদের সুবিধাবাদী ভেদনীতি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল এবং জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লক্ষ্যে অবিচল চারটি প্রগতিশীল দল বাংলাদেশের জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের প্রতি তাদের ঘোষিত সমর্থন আরো কার্যকর ও সক্রিয় করে তুললেন। এ ব্যাপারে এই দলগুলোর ভুমিকার যেমন প্রশংসা করতে হয় তেমনি, আওয়ামী লীগেরও। আওয়ামী লীগ গত সাধারন নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রায় শতকরা নিরানব্বইটি আসনে জয়লাভ করে জাতিকে নেতৃত্ব দানের অবিসম্বাদিত অধিকার লাভ করা সত্ত্বেও মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনায় অন্যান্য প্রগতিশীল দলের সমর্থন ও উপদেশ গ্রহণে সিদ্ধান্ত দ্বারা দলীয় স্বার্থের উর্ধে জাতীয় স্বার্থের প্রতি তাদের আনুগত্য বলিষ্ঠভাবে প্রমান করেছেন।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটিতে যারা রয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক মত ও পথে পার্থক্য থাকলেও সকলেই পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক। কমিটিতে ভাসানী ন্যাপের প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাওলানা ভাসানী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করছেন শ্রী মণি সিং, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের শ্রী মনোরঞ্জন ধর এবং মোজাফফর ন্যাপের অধাপক মোজাফফর আহমদ। এ ছাড়া এই কমিটিতে আওয়ামীলীগের দুজন সদস্যকে অন্তুভুর্ক্ত করা হবে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এই কমিটিতে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী কমিটির বৈঠক আহবান ও পরিচালনা করবেন।
মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত এই উপদেষ্টা কমিটির প্রথম বৈঠকে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারই যে বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সরকার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা এ সত্যটি অকুন্ঠ অভিব্যক্তি দেখা গেছে। জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির এই সমঝোতা ও অভিন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা।
বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার এবং এই সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির মধ্যে স্বাভাবিক চরিত্রগদ পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু রয়েছে উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যগত ঐক্য। এই লক্ষ্য হল বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা। চরিত্রগত পার্থক্যের ক্ষেত্রে বলা চলে, গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত একমাত্র সংস্থা, জনগণের পক্ষ থেকে সিধান্ত গ্রহণের ও তা কার্যকর করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার তার। অন্যদিকে জনগণের পক্ষ থেকে এই সিধান্ত গ্রহণ ও তা কার্যকর করার ব্যাপারে সাহায্যে ও সুপরামর্শ দান হবে উপদেষ্টা কমিটির কাজ। তাই এই উপদেষ্টা কমিটি গঠনের উদ্যেগ গ্রহণ করা গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করার কাজে একটি বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন বলা চলে। এই ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশের সকল এলাকার স্বাধীনতা এবং হানাদার দস্যুদের চূড়ান্ত পরাজয়ের দিনটি অব্যশই ত্বরান্বিত হবে।
<৪,২৩৫,৫১৬>
অনুবাদকঃ রায়হান রানা
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৫। শিক্ষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য শাজাহান সিরাজের ভাষণ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ
BANGLADESH CENTRAL STUDENT’S ACTION COMMITTEE
সদর দপ্তরঃ ঢাকা HEAD OFFICE: DACCA
বাংলাদেশী সাথী ভাইবোনেরা,
আজ মহান ১৭ই সেপ্টেম্বর। এ দিনটি বাংলার ছাত্রসমাজ ও গোটা বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক ক্রান্তিক্ষণ। এ দিনের গায়ে আমাদের ভাই ওয়াজিউল্লা, বাবুল, গোলাম মোস্তফার তাজা খুনে জড়ানো। আজ থেকে নয় ন’বছর আগে এমনি সারা বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির অঙ্গনে বিদ্রোহের অগ্নিলাভা জ্বলে উঠেছিল। লক্ষ হাতের বজ্রমুঠিতে জ্বলে উঠেছিল রক্তরাতুল লাল ঝান্ডা।
একদিন মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পলাশীর আম বাগানে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য ম্লান হয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকেরা এ দেশে মনিব সাজে। অফিস-আদালত-রাজপথে, সকল শিক্ষা নিকেতনে ওদের ভাষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির দুর্বহ পাথর চেপে বসে। ধীরে ধীরে এই পাথর “অহল্যার অভিশাপে” পরিণত হয়। পঙ্গু করার প্রচেষ্টা বাঙালী জাতীয় ভাষা, সভ্যতা ও কৃষ্টির সতেজ হৃৎপিণ্ডকে। একমাত্র ইংরেজিই রাজভাষার সমাসীন হয়। সাথে সাথে ফিরিঙ্গি শিক্ষা ব্যবস্থা জোঁকের মত চেপে বসে আমাদের অস্থি মাংস হাড়ে হাড়ে।
ভারত ভাগ হয়ে তথাকথিত পাকিস্তানের জন্ম হল। জন্মলাভের শুরু থেকেই বাংলাদেশকে পাঞ্জাবের কলোনি করার হীন ঘড়যন্ত্র শুরু হল। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করার হীন ষড়যন্ত্রে উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বারবার বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের উপর বুলেট, বেয়নেট ব্যবহার করে রাজপথকে লালে লাল করে দিয়েছে। …
শহীদের অতৃপ্ত আত্মার চিৎকার যায় নাই, যেতে পারে না। প্রতিবছর ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে আমরা প্রভাতফেরী , পুষ্প্যমাল্য, সভা, শোভাযাত্রার মাধ্যমে এই মহান দিবস পালন করে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশ আক্রান্ত। পাঞ্জাবী সেনাদের রাইফেল, কামান, মেশিনগান, আর মর্টারের আঘাতে বাংলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত , লাখ লাখ শহীদের রক্তে বাংলার পথ প্রান্তর রক্তাক্ত। সারা বাংলাদেশ জ্বলে-পুড়ে ছারখার। আমরা আজ যুদ্ধে লিপ্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আর বিদেশে ছাত্র-ছাত্রী-যুবকেরা বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজকের এই মহান সুপ্রভাতে তাই কোন প্রভাতফেরী নেই, একগুচ্ছো ফুলের পরিবর্তে একমুঠো বুলেট, ফেষ্টুন-প্ল্যাকার্ডের পরিবর্তে হাতে রাইফেল নিয়ে , মিছিলের পরিবর্তে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা হয়ে ছাত্র-ছাত্রী, ভাইবোনেরা সারা বাংলার গ্রাম-গঞ্জে ওয়াজিউল্লা-বাবুল-মোস্তফার হত্যাকারী পাঞ্জাবী হানাদারদের হত্যা করে শহীদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে মৃতঞ্জয়ী অভিযান চালিয়েছে। অভিযান চালিয়েছে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করতে।
মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা ভাইয়েরা,
বাংলার অবিসাংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাত ধরে শহীদদের নামে শপথ করে , বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে আমরা ওয়াদা করেছিলাম যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে পাঞ্জাবীদের হত্যা করে মাতৃভুমিকে আমরা মুক্ত করবোই। আমরা সে ওয়াদা ভুলে যাই নাই। আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনে আজ পাক সেনাবাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে শত শত হানাদার খুন হতে চলেছে। ১৭ই সেপ্টেম্বরের এই মহান দিনের বিপ্লবী অগ্নিলাভার রঙ চোখে- মুখে ছড়িয়ে পাক হানাদার বাহিনীর দস্যুদের খতম করার কাজে আসুন আমরা আরো কঠোর প্রত্যয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ওয়াজিউল্লা-বাবুল-মোস্তফার মত ব্যাক্তিগত স্বার্থকে বির্সজন দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির স্বার্থে নিজেদের আত্মোৎসর্গ করি।
কৃষক শ্রমিক মেহনতি ভাইয়েরা,
পাঞ্জাবী শত্রুসেনার বুলেটের আঘাতে আজও আপনারা প্রান দিচ্ছেন। রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে আপনাদের গণজীবন আজও বিপর্যস্ত। আপনাদের এ রক্তদান বৃথা যাবে না। আপনাদের সন্তান হয়ে আপনাদের রক্ষা করার জন্য আমরা আজ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি। একটি পাঞ্জাবীদেরও জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে দেব না। রাজাকার বাহিনীতে যারা আছে তাদের কেবল একটি কথাই বলতে চাই, তোমরা অনেকেই বাঙালীর সন্তান। বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে পাঞ্জাবীদের সাহায্য না করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন কর। অন্যথায় তোমাদেরকেও পাঞ্জাবীদের মত একটি একটি করে হত্যা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে হানাদারদের খতম করতে। আপনারা গেরিলাদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করুন। কারণ তারা আপনাদেরই ভাই, আপনাদেরই বন্ধু। কিছু সংখ্যক দুস্কৃতকারী তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সেজে আপনাদের উপর অত্যাচার করছে। তাদের নামের তালিকা নিকতবর্তী মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে পাঠিয়ে দেন।
বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে, সারা বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে, হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করেও যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনে খুনী ইয়াহিয়ার কুকুর বাহিনী বাংলার পথে ঘাটে খুন হচ্ছে ও পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে, ঠিক সেই মুহুর্তে মাতাল ইয়াহিয়া অভিনব পন্থায় স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন শুরু করেছে। জল্লাদ ইয়াহিয়াকে শেষ বারের মত একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- শেখ মুজিবের উপর আঘাত আসলে তুমি টিক্কা বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে যেখানেই যাও না কেন , সেখানেই গিয়ে তোমদের হত্যা করা হবে। পাঞ্জাবের তখতে তাউসকে ভেঙ্গে খান খান করে ইতিহাস থেকে নাম-নিশানা মুছে ফেলা হবে।
সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ যখন খুনী ইয়াহিয়ার এই গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছে তখন বিশ্বের বৃহৎশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের দোসর চীন-মার্কিন সরকার জঙ্গিশাহীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেও কোন ফায়দা না দেখে বাংলাদেশের শত্রু ডঃ মালিককে ক্ষমতায় বসিয়ে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার অভিনব প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছে। আমরা সেই সকল শক্তিকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, হিমালয় পাহাড় ধসে যেতে পাড়ে , বঙ্গোপসাগর শুকিয়ে মরুভুমি হতে পারে , কিন্তু বাংলা সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পাঞ্জাবের গোলাম করে রাখা যাবে না। আমরা তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাই নাই। ভিক্ষা করে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। যুদ্ধ করেই আমরা শত্রুসেনাদের খতম করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করব ।
বাংলার ছাত্রসমাজ ও জনগণের পক্ষ থেকে আজকের এই পবিত্র দিনে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমরা বলতে চাই- বাংলার ভৌগলিক স্বাধীনতার সাথে সাথে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন- আমি কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করব। লক্ষ লক্ষ মানুষের তাজা রক্ত আর ধবংসস্তূপের মধ্যদিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তার অর্থনীতি অব্যশই সমাজতান্ত্রিক হতে হবে। আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে অব্যশই নির্মূল করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুজিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে খান খান করে একটি শ্রেনীশোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বিজ্ঞান ভিত্তিক গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা , যার মাধ্যমে প্রতিটি মায়ের সন্তান একই নীতিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। পাঞ্জাবের ২২ পরিবারকে উৎখাত করে আবার নতুন করে কোন পুঁজিপতি বাংলাদেশে যাতে সৃষ্টি না হয়,
জনগণের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার কোন সুযোগ যাতে না থাকে তার বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তার ভিত্তিতে অব্যশই ভাবী শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে।
ওয়াজিউল্লা, বাবুল, মোস্তফার রক্তে অনুপ্রাণিত আজকের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধের ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা চিশতি শাহ হেলালসহ লাখ লাখ শহীদের উত্তরসূরী হিসাবে বাংলার মাটি ও মানুষকে মুক্ত করার যে মহান দায়িত্ব নিয়ে আমরা ছাত্রসমাজ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি, তা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হবো না। মানব সভ্যতার অবসম্বাদিত খুনী ইয়াহিয়া-টিক্কার বাদিশাহীর হেরেম ভেঙ্গে চুরমার করে আমরা আমাদের জন্মভূমির সকল প্রান্তে স্বাধীনতার বিজয় বৈজয়ন্তী ওড়াবো। বাংলার ছাত্রসমাজ ও জনগণের পক্ষ থেকে সংগ্রামী সালাম জানাই বীর শহীদ ভাইদের। জয় আমাদের হবেই। আফ্রো-এশিয়ার নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর মহান নেতা শেখ মুজিব দীর্ঘজীবি হোক। মহান ১৭ই সেপ্টেম্বর অমর হোক-
জয় বাংলা
<৪,২৩৬,৫১৯-৫২০>
অনুবাদকঃ শওকত ইসলাম রিপন
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৬। উপদেষ্টা কমিটির উপর লিখিত সরকারের কাছে প্রদত্ত একটি প্রতিবেদন সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাদের নিয়ে গঠিত দূতাবাস কমিটি এ সংগ্রামকে জাতীয় যুদ্ধে পরিণত করার ব্যাপারে এগিয়ে ছিলেন।পূর্ববঙ্গের গণমানুষের আন্দোলনের প্রধানতম ধ্বজাধারী হিসেবে আওয়ামীলীগের এ ধরণের কমিটি দরকার ছিল না,কিন্তু জনগণকে আরো উৎসাহিত করতে এটি ভূমিকা রাখে। দূতাবাস কমিটি গঠনের ফলাফল নিম্নরূপ –
১. বাংলাদেশের গণমানুষের নৈতিক শক্তিকে জোরদারের জন্যে মানসিক ভাবে প্রভাবিত করে।
২.দেশের জনগণই যে এ সংগ্রামের প্রধান শক্তি সেটা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং জনগণকে বুঝানো।
৩. ইয়াহিয়া সরকারের উপর মানসিক চাপ তৈরি করা।
এখানে এটা মনে হতে পারে যে ভারতীয় সরকার দূতাবাস কমিটি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। সম্ভাব্য কারণগুলো হল –
১.এটি পশ্চিম বঙ্গের বাম রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দমন করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পছন্দের বিষয় পন্ড করা থেকে বিরত রাখবে,
২.ন্যাপ (মুজাফফর) এবং মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট দলগুলোকে ফ্রন্টে অন্তর্ভূক্ত করার জন্যে রুশ সরকারের চাপ প্রয়োগ,
৩.মাওলানা ভাসানীর কোনো দল না থাকা এবং আওয়ামী লীগের প্রতি তার দায়বদ্ধতা। তার অন্তর্ভুক্তি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই মানসিক ভাবে এগিয়ে নেয়।
আওয়ামীলীগের একটি অংশ মনে করে যে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব ক্রমে বামপন্থীদের হাতে চলে যাবে। কিন্তু দূতাবাস কমিটির কার্যকরী অংশ নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল –
ক) কমিটি স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে কেবলমাত্র বাংলাদেশ সরকারের সাথেই আলোচনা করবে।
খ)প্রধানমন্ত্রী সব ধরণের মিটিং আহবান এবং পরিচালনা করবেন।
এর অর্থ এই যে,দূতাবাস কমিটি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে একটি কমিটি মাত্র। কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী মনে করলেই তারা পরামর্শ করবে। এক দিক দিয়ে এটি আওয়ামীলীগের জন্যে বিজয় বলা যায়। একদিকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে কাছে টানে এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা নিজেদের হাতেই রাখে।
মস্কোপন্থীরা স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ স্বীকৃতি পেয়ে খুশি হয় এবং তারা মনে করে এটি তাদের এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলো।
এ দূতাবাস কমিটি অন্যান্য বামশক্তিগুলোকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে নি। দুবা গ্রুপ সম্ভবত কোন কারণে অংশগ্রহণ করে নি। কিন্তু নয় দল সমন্বিত সংগ্রাম কমিটির অন্যান্য অঙ্গসংগঠনগুলোকে আমন্ত্রণ জানালে হয়তো তারা অংশগ্রহণ করতো। মাও সে তুং এবং চে গুয়েভারা পন্থীদের মতে ও দূতাবাস কমিটি একটি ভাল পদক্ষেপ। কিন্তু তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ অধিকতর জ্ঞানের পরিচায়ক হত।
ক্লাসিক্যাল সেন্সে এটিকে স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে দেখানো যায় নি বলে বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের সমর্থন এবং মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে নি। স্বাধীনতা সংগ্রামকে একটি জাতীয় এবং বিপ্লবী স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে দেখানো যায় নি বলে এটি ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে সাড়া ফেলতে পারে নি। এমনকি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে এ সংগ্রাম উপেক্ষিত হয়।এ থেকে বুঝা যায় যতই আমরা এই সংগ্রামকে সম্প্রসারিত জাতীয় সংগ্রামে রূপ দিতে পারবো,ততই আমরা জনগণের সংগ্রাম সমর্থক বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং জনগনের কাছ থেকে বেশি সাহায্য পাব।
বাস্তবে দূতাবাস কমিটি অকার্যকর হলেও কিংবা গোঁড়া সংগঠনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত না করলেও এতে কিছু লাভ হয়। তারা আরো সহজে চলাফেরা করতে পারবে,সংগঠন কে কর্মক্ষম করবে এবং বাংলাদেশ ও ভারতে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে । অন্যান্যদের সাহায্য করে যুদ্ধে যুক্ত হওয়াকে তারা একটি স্বীকৃতি ভাবতে পারে ।
মূল্যায়ন
আগের কমিটিকে অপরিবর্তিত রেখে বাদ পড়াদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা ( বর্তমানে যে রকম আছে)।
এটি স্বাধীনতা সংগ্রামকে শক্তিশালী করবে এবং অপরপক্ষে, বামপন্থীদের বাদ দেওয়ার মত অনাকাঙ্ক্ষিত সমালোচনা দূর করবে । এভাবে আওয়ামী নেতৃত্ব ঠিক রেখে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ানো যায়।
<৪,২৩৭,৫২১>
অনুবাদকঃ কাজী সাদিকা নূর
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৭। স্বাধীনতা যুদ্ধে আপোষের বিরোধিতা করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিবৃতি সংগ্রামী বাংলা ১৮ অক্টোবর, ১৯৭১
বাংলা আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার,
আমার দেশ
প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু এটাই
বাঙ্গালী জাতির শেষ কথাঃ
বাংলাদেশ জাতীয় আওয়ামী দলের ঘোষণা
মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় আওয়ামী দলের তরফ থেকে সম্প্রতি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে এবং এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করতে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে কোন কোন শক্তির তরফ থেকে আপোষের যূপকাষ্ঠে এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে বলি দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। তবে কি এত রক্ত, এত ত্যাগ, এত সংগ্রামের এই শেষ পরিণতি?
বাংলাদেশ জাতীয় আওয়ামী দলের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণঃ
বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রাম যখন জনযুদ্ধে রুপান্তরিত হতে চলেছে ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংগ্রাম শুরু হয়েছে। তথাকথিত ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ নামে আজ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গতিরোধ করার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই সম্পর্কে বাংলার মুক্তিকামী জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে। বাংলার মুক্তিসংগ্রাম আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে শাসকচক্রের সাথে কোন আপসের চিন্তাও করা যায় না। বাংলার মানুষ আজ নির্মম, নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এটাই বুঝতে পেরেছেন যে, বাংলার মুক্তি আপোষের সরল পথে আসবে না। হানাদার দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রেখেই বাংলার মুক্তি সম্ভব।
বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে নস্যাৎ করে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র চলছে, সে সম্পর্কে বাংলার মজলুম ও প্রবীণ জননেতা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মাওলানা ভাসানী ইতিপূর্বে ২৪ সে জুন দ্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- “বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক সমাধানের নামে ধোঁকাবাজি কিছুতেই গ্রহণ করবে না। তাদের একমাত্র পণ- হয় দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু। এর সঙ্গে গোঁজামিলের কোন স্থান নেই”।
স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি প্রভৃতি চার দফা ছাড়া বাংলাদেশের সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়- এ মর্মে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ৮ই অক্টোবর যে ঘোষণা করেছেন তা সমস্ত বাংলার মানুষের মনোভাবেরই প্রতিধ্বনি।
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারাই রণাঙ্গনে বাংলাদেশের চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন।
*মাওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত পত্রিকা।
<৪,২৩৮,৫২২>
অনুবাদকঃ আল-জাবির মোহাম্মদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৮। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির শিক্ষা ও সমাজসেবা বিভাগের একটি চিঠি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ২১ অক্টোবর, ১৯৭১
শিক্ষা ও সমাজ সেবা বিভাগ
নংঃ পিসি-৭৮ পি-৩ সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ
কলকাতা – ১৭
ডঃ অজয় কে. রয় ২১/২২ অক্টোবর, ১৯৭১
সেক্রেটারী,
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি,
৩৮/২, এলজিন রোড
কলকাতা – ২০।
প্রিয় ডঃ রয়,
আপনি দয়া করে আপনার কাজের ব্যাপারে এখানে দেওয়া ঠিকানায় যদি আমার সাথে দেখা করতে পারেন। অব্যহতি প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা (ছাত্র এবং অ-ছাত্র) এবং অবাঞ্ছনীয় মাতৃত্বের শিকার হওয়াদের জন্যে কিছু প্রশ্ন তৈরী করতে আমাদের আপনার পরামর্শ ও সাহায্য দরকার। আশা করছি এই নোটটি পেয়েই আপনি দেখা করতে আসবেন।
ধন্যবাদান্তে,
আপনার একান্ত,
(কে এম মুরশিদ)
<৪,২৩৯,৫২৩>
অনুবাদকঃ কাজী সাদিকা নূর
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৯। “বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতাই সমস্যা একমাত্র সমাধান”- আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ঘোষণা জয়বাংলা ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১
বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতাই সমস্যার একমাত্র সমাধান
আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাঃ বঙ্গবন্ধু আশু
মুক্তির ব্যবস্থা ও বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের জন্য
বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি আবেদন
গত বৃহস্পতিবার মুলতবী হয়ে যাওয়ার পূর্বে নীতির পুনরুল্লেখ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয় যে, পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশের সমস্যার একমাত্র সমাধান। ওয়ার্কিং কমিটি এই সংগ্রাম ত্বরান্বিত করার জন্য বলিষ্ঠ শপথ গ্রহণ করে।
ওয়ার্কিং কমিটির অপর এক প্রস্তাবে বাঙ্গালী জাতির অবিশম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তির জন্য প্রত্যক্ষ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
ওয়ার্কিং কমিটির জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের সদস্যপদ খারিজ করে তদস্থলে ইয়াহিয়ার উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রচেষ্টাকে ‘ধৃষ্টতার পরিচায়ক ও বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা’ বলে অভিহিত করে এবং এ প্রসঙ্গে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে বাঙ্গালী জাতি ও আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলায় জাতীয় জীবনে তথাকথিত পাকিস্তানীদের কোন হস্তক্ষেপই সহ্য করবে না।
ভারত সহ বিশ্বের যে সমস্ত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করছেন, আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ ও যে সমস্ত সংবাদপত্র প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন দান করেছেন তাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানান হয়। সাথে সাথে ওয়ার্কিং কমিটি বাংলাদেশ ইয়াহিয়া চক্রের নজীরবিহীন গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে মানবতার সাথে সক্রিয় জনমত গঠনের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আকুল আবেদন জানান।
ভারত সরকার ৯০ লক্ষাধিক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে ও তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়ে মানবতার ইতিহাসে যে নজির সৃষ্টি করেছেন তজ্জন্য আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সাথে সাথে ওয়ার্কিং কমিটি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভারতে আশ্রিত প্রতিটি শরণার্থীকে সসম্মানে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যপারে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর।
<৪,২৪০,৫২৪-২২৫>
অনুবাদকঃ মাহীন বারী
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪০। মুক্তিসংগ্রামে ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়কে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ৭ নভেম্বর, ১৯৭১
বরাবর
বার্তা সম্পাদক,
মুজিবনগরঃ ৭ই নভেম্বর, ১৯৭১
প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অনুসারীদের বিপক্ষে সম্মিলিত সংগ্রাম গড়ে তুলবার দেদীপ্য আহবান জানাচ্ছে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের অতন্দ্র প্রহরী, দেশের দুটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
দেশের প্রধান দুইটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিগণ আজকে একত্রে বসেছেন এবং নিম্ন উল্লেখিত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের পক্ষ হতে চূড়ান্ত করা হয়।
স্টেটমেন্টগুলোতে স্বাক্ষর করেনঃ
নুর-এ-আলম সিদ্দিকি নুরুল ইসলাম
সভাপতি সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
শাহজাহান সিরাজ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সাধারণ সম্পাদক সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
এ এস এম আব্দুর রব
সহসভাপতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ
আব্দুল কুদ্দুস মাখন
সাধারণ সম্পাদক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ
প্রকাশকঃ
(শাহজাহান সিরাজ) (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম)
সাধারণ সম্পাদক সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
বক্তব্যঃ
বাঙ্গালী জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নির্দেশিত আদর্শ ও পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরম্ভ হওয়া বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বয়স এখন সাত মাস। মাতৃভূমিকে স্বাধীন করবার লক্ষ্যে আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধারা জিবন-মরণ যুদ্ধ করে চলেছেন এবং বিনা দ্বিধায় রক্ত ঝরাচ্ছেন। বাংলাদেশের আপামর ছাত্রজনতা ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অতীত ঐতিহ্য অনুসারে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ এবারও একসাথে দুর্বার দুর্ধর্ষ আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
ছাত্র এবং যুবক ভাইদের অবশ্যই সামনে এসে এই মহান সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা উচিৎ।
আমাদের অবশ্যই মাথায় রাখা উচিৎ যে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীর শত্রু কসাই ইয়াহিয়া জান্তাকে পেছন থেকে শক্তি যোগাচ্ছে চীনা সরকার। তাদের সাথে আরও রয়েছে আমেরিকান ধণগোষ্ঠী। তাই আমাদের প্রচণ্ড শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
আমাদের সংগ্রাম হচ্ছে জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম যার লক্ষ্য হচ্ছে বাঙ্গালী জাতির মুক্তিলাভ এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপেনিবেশিকতাবাদ থেকে মুক্তি। এটি জনসাধারণের সংগ্রাম। তদুপরি বাংলাদেশের সকল যোদ্ধাগোষ্ঠী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে একত্রিত হয়েছে।
আমরা বাংলাদেশের সকল ছাত্র ও যুবসম্প্রদায়ের নিকট বিশেষ করে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিধিত্য করে এমন মানুষদের কাছে দাবী জানাচ্ছি যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদেরও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া উচিৎ, পাক শাসিত প্রশাসিত এলাকাগুলো একসাথে বয়কট করা উচিৎ এবং হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে ধ্বংস করা উচিৎ। আমরা আরও দাবী জানাচ্ছি যে সকল মুক্তিযোদ্ধাগোষ্ঠীদের বাংলাদেশ সরকারের পতাকাতলে এসে একত্রিত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাতে যাতে করে জনগণের রায়কে প্রতিফলিত করে বিজয় ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয় এবং একই সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্ত করা সম্ভবপর হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা যত উত্তরোত্তর সফলতা পাচ্ছে ততই বিশ্ববাসী আগ্রহ সহকারে আমাদের পক্ষ অবলম্বন করছে। আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ অন্যান্য দেশগুলোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চাই যারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা ও সমর্থন জুগিয়ে চলেছেন। একই সাথে অন্যান্য স্বাধীনতাপ্রেমী গণতন্ত্রী রাষ্ট্র এবং তার জনগণদেরকে, বিশেষ করে বিশ্বের সকল ছাত্র ও যুবসম্প্রদায়কে, আমাদের সংগ্রামের সাথে একত্বতা ও সহায়তা প্রদর্শন করবার আহবান জানাচ্ছি। আমরা বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
একটি স্বতন্ত্র, গণতান্ত্রিক, উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্যে আমরা পরিপূর্ণ শক্তহাতে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি। আমরা এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চলেছি যেখানে সকল প্রকার নৈরাজ্য নির্বাসিত হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যেখানে কর্মজীবী, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র ও যুবক সকল শ্রেণীপেশার মানুষ শান্তিতে ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করতে পারবে।
মাতৃভূমিকে স্বাধীনতা এনে দেবার জন্য নিজ জীবন উৎসর্গ করবার মতন এমন মহৎ কর্ম পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আসুন একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুকে প্রতিহত করি। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।
জয় বাংলা।
<৪,২৪১,৫২৬-৫২৮>
অনুবাদকঃ জিহাদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪১। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দীকির বক্তব্য বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৭ নভেম্বর, ১৯৭১
স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে শুচিশুদ্ধ অনির্বাণ মুক্তিবাহিনী, অকুতোভয় ছাত্র-শ্রমিক ও আমার সংগ্রামী অভিভাবকমন্ডলী।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মহানায়ক মুক্তিপাগল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শে উজ্জীবিত, তার অবিস্মরণীয় প্রেরণায় অনুপ্রাণিত ও তাঁর অমোফহ নির্দেশ পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের ৭ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সংগ্রামের প্রারম্ভ বাংলার নৃশংস আক্রমণের মুখে এক দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। হত্যা, ব্যাভিচার, নৃশংসতা ও পাশবিকতার কাছে বাংলার গণদেবতা মাথা নত করে নাই, আর তাই, আমাদের আন্দোলন ক্রমে ক্রমে প্রতিরোধের মোহনা হতে প্রতিঘাতের প্রচণ্ড উন্মাত্ততায় মোড় নেয়। বাংলার প্রতিটি তরুণ বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শকে সামনে রেহে মায়ের কোল ছেড়ে বেড়িয়ে আসে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাঁরা সামরিক শিক্ষা নিতে থাকে শত্রুর বিষদাঁতগুলো উপড়ে ফেলা আর জননী বাংলাকে মুক্ত করার দৃপাত মানসে। তাই আজ আমরা দেখতে পাই, ২৪ ঘন্টায় বাংলাকে পর্যদুস্ত করার দুঃস্বপ্ন তাদের ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে, আমরা দেখতে পাই সূর্যসেনাদের তীক্ষ্ম আঘাতের বিপর্যস্ত পশ্চিমা পশুদের শায়িত লাশের স্তুপ। ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালীর সংগ্রামের ফলে শুধু পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ প্রকম্পিত হয়ে উঠে নাই, সারাবিশ্ব বুঝতে পেরেছে যে, বাঙ্গালী নিঃস্ব নয়। বাঙ্গালীরা পরাধীনতা মানে না।
আজ সারা বাংলার একটি পথ- সে পথ মুক্তির, সে পথ স্বাধীনতার। তাই মৃত্যুর ভ্রুকুটি নির্যাতনের খড়গাঘাত আমাদেরকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি; বরং শত্রুর পাশবিকতা শত্রু হননের প্রতিহিংসায় আমাদের প্রজ্জ্বলিত করেছে। বাংলার মাটি আজ অপরাজেয়, বাঙ্গালীর প্রতিটি ঘর দুর্ভেদ্য দুর্গ। সমঝোতার প্রলোভন তাদের কাছে প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। আন্দোলনের অনির্বাণ আদর্শ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আর আন্দোলনের সম্পূর্ণ পরিচালনার দ্বায়িত্ব আওয়ামী লীগের। বাংলার সংগ্রামী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গণম্যান্ডেন্টকে উপেক্ষা করার ঔদ্ধত্যের চ্যালেঞ্জ করে যখন স্বাধীনতার উদাত্ত আহবান ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ জানায়, তখন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে মহান জাতির নেতা হিসেবে সামনে রেখেই এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল এবং দালাল ছাড়া বাংলার প্রতিটি মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এ আন্দোলনের পাশে সে দাঁড়িয়েছিল দলমত নির্বিশেষে। আজ স্বাধীনতা আন্দোলনের ৭ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে মুখচেনা দালাল, ডাস্টবিনের আবর্জনাকে তুলে এনে বিশ্বকে যখন বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে, তখন বাংলার প্রতিটি প্রগতিশীল মহলের সম্মিলিত পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে এ দূরভিসন্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা উচিত। বিশ্বের মানুষ জানে বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহল দ্বিধাহীনচিত্তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থা প্রকাশ করে এবং গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে অনুতোভয় সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছেন। এছাড়া আমি গর্বিত এবং আনন্দিত বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আমাদের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিত মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির মহান্যক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, অনুপ্রেরণায় ও নির্দেশে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ মুক্তি আন্দোলনের আহবান জানিয়েছে। তাঁরা সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন গড়ে তোলার দ্বিধাহীন ডাক দিয়ে বিশ্বকে পুনর্বার জানিয়ে দিলেন সমস্ত প্ররোচনার মুখে বাঙ্গালী জাতি এক ও অভিন্ন। স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁরা হিমাচলের মত অটল। আসুন, আমরা রাত্রির বৃন্ত হতে ছিঁড়ে আনি ফুটন্ত সকাল।
সংগ্রামী ভাইয়েরা, দখলকৃত বাংলায় সম্প্রতি উপ-নির্বাচনের নামে বিশ্বে প্রচন্ডতম হাস্যকর প্রহসন সৃষ্টি করা হয়েছে। ২৪ বছরের ইতিহাসে যাদের কুষ্ঠরোগীর মত দালালীর ক্ষতচিহ্নে ভরা, গত নির্বাচনে ঐকবদ্ধ গণচেতনার ভরে যারা রণভঙ্গ দিয়ে বিবি সাহেবের আঁচলের তলায় আশ্রয় নিয়েছিলো, এমন কি বিশ্বাসঘাতক সবুর ও নির্লজ্জ ফ-কা চৌধুরীর মত যারা তওবা করে ক্ষমা ভিক্ষা করে বিবৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করেছিলো- তাদের মত প্রায় ৬৭ জন দালালকে বিনাপ্রতিদ্বন্দিত্তায় নির্বাচিত ঘোষণার স্পর্ধা দেখিয়েছে বিশ্বাসঘাতক জালেম। আমরা জানি জালেম প্রায় সব জায়গায় নির্বাচন এড়িয়ে গেছে। কারণ কালবৈশাখীর ঝড়ের প্রচন্ডতায় বিক্ষুদ্ধ বাংলাকে সে চিনেছে। সে জানত নির্বাচনের ঝুঁকি নেওয়ার শক্তি আর দুঃসাহস তাঁর নাই, তবুও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলায় নাক গলিয়ে যে অপরাধ ইয়াহিয়া করেছে তাঁর প্রতিশোধ হিটলারের দোসব আইকম্যানের মৃদ্যুদন্ডের মতই নেওয়া হবে। আমরা নিঃসংশয় রণাঙ্গনের বুলেট এ প্রশ্নের উত্তর দেব।
গণতন্ত্রমনা বাঙ্গালীর হৃদয়ের ঔদার্যকে এরা কাপুরুষতা ভেবেছিল। গত নির্বাচনের পর প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণের মুখে এদের পিষে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে আমরা পারতাম। এদের জন্য বাংলার আলো-বাতাস-মাটি আজ হারাম। আজ এদের জন্য কোন মায়া নাই, মমতা নাই, দয়া-দক্ষিণ্য নাই, ক্ষমা নাই। আজ এদের একমাত্র প্রাপ্য হল মৃত্যু। মোনেম আর মোএম ঘোষিত এমপিএ আমির হোসেনের পথ ধরেই এদেরকে বাংলার বুক হতে বিদায় নিতে হবে। মাটির বুকেও যদি এরা লুকাতে চায়, মাটি খুঁড়ে এদের বের করে টুকরো টুকরো করে কেটে গাঁয়ে লবণ ছিটিয়ে উন্মুক্ত স্থানে টাঙ্গিয়ে রাখতে হবে। ভবিষ্যতে প্রতিটি দালাল যেন এদের পরিণতির দৃষ্টান্ত দেখে শিউরে কেঁপে ওঠে।
সংগামী ভাইয়েরা আমার,
যেখানে যখন যে অবস্থায় এদের পাওয়া যাবে, মৃত্যুই এদের পাওনা। এদেরকে করায়-গন্ডায় পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। আমাদের ধারণা, ভারতের বিরুদ্ধে এরা যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে, এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য আপনারা প্রস্তুত হোন।
সংগ্রামী ভাই-বোনেরা আমার, আপনারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যতই তীব্রতর হচ্ছে বিশ্ববিবেক আজ ততি স্পষ্ট আমাদের সপক্ষে। বিশ্বের পথে-প্রান্তরে আজ স্বাধীনতার সপক্ষে অশান্ত মিছিল। গণতন্ত্রের পাদপীঠ আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত প্রথম হতেই সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষে কার হৃদয়মথিত সহানুভূতির উজার করে দিয়েছ। আমি আনন্দিত রাশিয়াও আমাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু সংগ্রামী বাংলা এখন মুক্তির সুতীক্ষ্ম আকাংক্ষায় উদগ্রীব। সারা বাংলা এখন প্রচণ্ড শক্তিতে শত্রকে আঘাত হানছে। আর বিশ্ববিবেক যখন চিৎকার করে বলছে বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতে কাঁদতে দেব না, তখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির চোরাগলিতে সমঝোতায় কানাঘুষা আমাদের কানে আসছে। আমরা এই ব্যর্থ প্রয়াসে কেবল মর্মাহতই নই, বিস্ময়াভিভূতও হয়েছি। মানবতার আর্তনাদ তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছে না, অসহায় মানুষের আকুতি এদের হৃদয়কে নাড়া দেয় না। বাৎকে বাৎ এরা গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু গণতন্ত্রের অমোঘ মন্ত্র এদেরকে আকর্ষণ করে নেই, আর তাই ক্ষমতার সতরঞ্জে এরা ষড়যন্ত্রের গুটি চেলে বাজিমাৎ করতে চান। বিশ্ববিবেকের কণ্ঠস্বর হয়ে দৃঢ়চিত্তে সত্যের প্রতিধ্বনি করার কথা ছিল- রাহুচক্রে তিনিও আজ দিশেহারা হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন, নইলে সেলসবারীতে ২৫ জন শ্বেতাঙ্গ হত্যা করার জন্যে যখন জাতিসংঘে মানবতা রক্ষা দিবস পালন করা হয়, তখন পৃথিবীর জঘন্যতম নৃশংসতা, জঘন্যতম পাশবিকতা, ১০ লক্ষ মানুষ হত্যার পরও তাঁরা স্পন্দনহীন নির্বিকার থাকেন কেমন করে। ভাবতে আমি অবাক হয়ে যাই বিশ্বের নির্মমতম নৃশংসতার পরও সমঝোতা, কবরের শান্তি আর ধৈর্য ধারণের স্তূতিবাক্য আওড়ান তাঁরা কোন লজ্জার মাথা খেয়ে। শক্তির প্রচন্ড দাম্ভিকতায় উন্মাদ বলেই কোরিয়া, আলজেরিয়া, কিউবার ইতিহাস এদের চক্ষুকে উন্মোচিত করে নাই। এই সব মূক, ম্লান, বধির শক্তিবর্গকে আমরা নিঃসংশয়চিত্তে জানিয়ে দিতে চাই, এবার আমরা শেষ সমঝোতার জন্যই বৈঠকে বসেছি, তবে সে বৈঠক আন্তর্জাতিক প্রাসাদ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দরবার কক্ষের গোলটেবিলে ঘিরে বসে নাই, বসেছি জননী বাংলার চতুস্পার্শেবর রণাঙ্গনের ট্রেঞ্চে- সে বৈঠকের আলোচনা চালাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত সূর্যসেনা মুক্তিবাহিনীর নির্ভীক সেনানীরা। সে বৈঠকের ভাষা স্বার্থের রাজনীতির পরিভাষায় অনুলিপি নয়- তার ভাষা হল ব্যারেলের অগ্নিবর্ষী বুলেট। সে বৈঠকে সমঝোতা বা আপোষ-মীমাংসা হবে না- স্বাধীনতার চূড়ান্ত সনড লিখিত হবে। আর সে সনদ আমরা কলমের কালো কালিতে লিখতে চাই না, লিখব শত্রুর বুকের তাজা লাল টকটকে উত্তপ্ত রক্তে। আপনারা শুনে রাখুন, শত্রুর রক্ত নিক্তিতে মেপে আমরা পাওনা বুঝে নিতেই বৈঠকে বসেছি। এখানে রাজনৈতিক সওদাগরী ব্যররথতার বেলাভূমিতে গুমরে মরবে।
আজও অসত্যের বুকে বিদীর্ণ করে সত্যের উদ্ভাসিত আলোকরশ্মি যেসব উপনিবেশবাদী শক্তি অবলোকন করতে পারেননি, শোষণ ও অবিচারকে যারা প্রতিবাদ করতে পারেননি, আজও দশ লক্ষ শহীদের আর্তনাদ যারা শোনেননি, সেইসব শক্তির প্রতিভূকে আমি একটিবার জিজ্ঞাস করতে চাই- এই শোষণের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে নিজের দেশ হইতে হিজরত করে আপনাদের জাতির কি জন্ম হয় নি?
বৃহৎ শক্তির প্রতিভূ আপনাকে একটি বার জিজ্ঞাস করতে চাই- দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু নয়, একটিবার আপনার সামনে যদি আমার জওয়ান ছেলেকে বুলেটের নির্মম আঘাতে শত্রুরা খুন করত। একটিবার আপনার চোখের সামনে আপনার অশীতিপর বৃদ্ধের বুক, বেয়নেটের খোঁচায় চৌচির করে দিত, যদি একটিবারের জন্য আপনার চোখের সামনে আপনার মেয়েকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে পাশবিক অত্যাচার করত, যদি আপনার সম্মুখে আপনার গর্ভবতী স্ত্রীর পেট চিরে তার গর্ভজাত সন্তানকে বেয়নেটের খোঁচায় বের করত, যদি আপনার বোনের কোল হতে তার তিন মাসের কচি শিশুলে কেড়ে নিয়ে তার সম্মুখেই টুকরো টুকরো করে খুন করত, যদি আপনার ঘর পুড়িয়ে ঘরছাড়া করে জোর করে পরের দেশে পরবাসী করত- তবে আপনি কি প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠতেন না? আপনি মি ঐ জালেম জল্লাদের কবল হতে মুক্তি চাইতেন না? আপনার স্ত্রীর অঝোরে কেঁদে বলত কিনা- ওগো এর প্রতিশোধ চাই। স্বজন হারানো শ্মশানে ওদের চিতা জ্বালাতে আপনি কি একটিবার চাইতেন না? শিশুর মৃত্যুকান্না ভেদ করে সমঝোতার সস্তা স্তূতিবাক্য কি আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারত? নিশ্চুপ কেন? উত্তর দিন। আপনি কি পারতেন শত্রুর রক্তে না রাঙিয়ে আপনার নিষ্পাপ সতীত্বহারা মেয়ের সামনে পিতৃত্বের অধিকার নিয়ে দাঁড়াতে। বৃহৎশক্তির প্রতিভূ! আপনি যদি না পারেন তবে আমাদের পারতে বলবেন কোন লজ্জায়? কোন স্বার্থের তাগিদে? আজ আমি বিশ্বের উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহের কাছে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই- আমরা আজ কেবল স্বাধীনতার জন্য লড়ছি না, লড়ছি মায়ের অশ্রু, পিতার আর্তনাদ, ভায়ের রক্ত, শিশুরকান্না, বোনের সতীত্ব হননের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য- লড়ছি শত্রুর রক্ত নিক্তিতে মেপে সব পাওনা বুঝে নেয়ার জন্য। এ যুদ্ধ সমঝোতার নয়, এ যুদ্ধ স্বাধীনতার। এ অস্ত্র কেবল বুলেটেই নয়, ন্যায় ও সত্যের মহান আদর্শ এর সঞ্জীবনী শক্তি। এর সেনা কেবল রণাঙ্গনে যোদ্ধারাই নয়, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ।
আমি জানি, শক্তির দাম্ভিকতা যত প্রচন্ড হোক না কেন তারপরাজয় অবশ্যম্ভাবী। নইলে গত বিশ্বযুদ্ধে হিটলার পরাজিত হত না, মুসোলিনী হার মানত না। কোরিয়া, আলজেরিয়া, কিউবা মুক্ত হত না। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত আজকের চীন। আজ চীনের যে বিজয় তা পারমানবিক শক্তির বিজয় নয়, সর্বহারা মানুষের বিজয়। তাই চীন স্বস্তি পরিষদে সর্বহারা ও স্বাধীনতাকামী মানুষেরর সমর্থনে এগিয়ে আসবে আমরা আশা করি।
ইতিহাস তুমি সাক্ষী রবে সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ন্যায়, সত্য ও স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যর্থ হবে না- হতে পারে না। ইনশাল্লাহ আমরা বিজয়ী হবই।
<৪,২৪২,৫২৯-৫৩১>
অনুবাদকঃ জিহাদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪২। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক উপস্থিত রাস্ট্রীয় রূপরেখা ও কর্মসূচী বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ৩০ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের জনগণের সামনে উপস্থিত স্বাধীন সার্বভৌম
জন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা
রূপরেখা ও কর্মসূচী
ভূমিকা
পূর্ব বাংলা পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তি তথা দস্যু হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষতী যুদ্ধ ও লক্ষ লক্ষ নরনারীর জীবন এর বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ মুক্তি। এ মুক্তিসংগ্রামে পূর্ব বাংলার সমগ্র শোষিত মেহনতি মানুষের রয়েছে সক্রিয় অবদান। বিশেষ করে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত মুক্তি ফৌজের সর্বজনস্বীকৃত। বাংলার মায়ের মুক্তিপাগল ঐ সেনানীদের জীবনাহুতি ছাড়া এ সংগ্রাম কিছুতেই সফল হতে পারত না, যদিও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক পশুগুলিকে পরাজিত করার প্রশ্নে ভারত সরকার ও তার সেনাবাহিনীর ভূমিকাও এখানে জড়িত আছে। তবুও এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলা চলে যে, পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণ ও তার সন্তানদের দ্বারা গঠিত মুক্তিবাহিনীই ছিল এ যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি। আগামী দিনেও স্বাধীন-সুখী-সমৃদ্ধিশীল সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে এরাই নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
দেশ আজ হানাদার মুক্ত হলেও শত্রু-মুক্ত নয়, নয় শাসক ও শোষকহীন। কেননা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর কেবলমাত্র পাকিস্তানী শাসকরাই শোষণ চালায়নি- তাঁদের সাথে শোষণের শরিকদার ছিল (ক) দেশের অভ্যন্তরের জোতদার মহাজন বা সামন্তবাদী শ্রেণী (খ) বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, যদিও এ তিনের মধ্যে প্রধান শত্রু ছিল পাকিস্তানী শাসকরা।
বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানী শাসকরা না থাকলেও তাদের বহু কল-কারখানা, ব্যাঙ্ক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে, রয়ে গেছে মার্কিনসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের পুঁজি-পাট্টা; তদুপরি জোতদার-মহাজনরা রয়েছে অক্ষত। অতএব ঐসব দেশী-বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসন ও শোষণ থেকে জনগণকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে, নতুবা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিঘোষিত শোষকহীন সমাজ হবে অর্থহীন।
গত নয় মাসের ঘটনাবলী কি প্রমাণ করে? প্রমাণ করে দেশের অভ্যন্তরের জোতদান-মহাজন ও তাদের দালালরাই ছিল পাকিস্তানী শাসকদের মূল খুঁটি; এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পূর্ব বাংলার অসংখ্য গ্রামে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য ‘মাইলাই’ (ভিয়েতনাম) হত্যাকান্ড। আজো শেষ হয়নি দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্র, ভাঙ্গেনি তাদের শোষণের বিষদাত।
তাছাড়া অর্থনৈতিক ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন, তা পূর্ব বাংলার জনগণ গত চাব্বিশ বছর ধরে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে, উপলব্ধি করেছে বলেই বাংলার সাধারণ মানুষ সর্বাগ্রে স্বাধীনতার দাবী তুলেছে, সকলের আগে ধারণ করেছে অস্ত্র। এ জনগণই গত নয় মাসে সবচাইতে বেশী ত্যাগ স্বীকার করেছে। তাই এ জনগণকে সকল প্রকার শোষণ থেকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। শুধু মুখের কথায় জনগণের মুখে হাসি ফুটবে না, পেটে ভাত জুটবে না, বেকার পাবে না কাজ, ভূমিহীন পাবে না জমি, ঋণগ্রস্থ মানুষ হবে না ঋণমুক্ত, রোগী পাবে না ঔষধপথ্য, শিক্ষার দ্বার হবে না সকলের জন্য খোলা।
এমতাবস্থায় দেশের সকল শ্রেণীর জনগণকে দেশী-বিদেশী সকল শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত করতে হলে সর্ব প্রথম তিনটি কাজের উপর বেশী গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রথমতঃ দেশের সর্ব স্তরের জনগণের মধ্যে আনতে হবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে পূর্ণ আস্থা। দেশের মাটিতে মিত্র বাহিনীর অবস্থানকে জনগণ ভীষণ আশঙ্কার চোখে দেখছে। যেহেতু আমাদের দেশের মানুষ ঘরপোড়া গরুর মত, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলেই তাদের ভয় জাগা স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সরকারকে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে হবে-
পাকিস্তানী শাসক তথা বাইশ পরিবারের, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের এবং দেশীয় জোত-মহাজন শ্রেণীর যাবতীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। এ তিন শোষণের কবল থেকে জনগণ সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
দ্বিতীয়তঃ সকল স্তরের মুক্তি ফৌজকে নিয়ে একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং প্রাপ্তবয়স্ক ও কর্মক্ষম পুরুষদের সামরিক ট্রেনিং দানের জন্য মুক্তি ফৌজের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপন করা।
তৃত্বীয়তঃ দেশের অভ্যন্তরে ছোট-বড় সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতার সমগ্র জাতির উন্নতি ও কল্যাণার্থে একটা সামগ্রিক কর্মসূচী প্রণয়ন করা।
বাংলার কমিইনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আমরা সমগ্র জাতির সামনে বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের নিকট বিবেচনার জন্য উপরোক্ত উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত কর্মসূচী সবিনয়ে উপস্থিত করছি। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, একমাত্র এ কর্মসূচী বাস্তবায়ণের মাধ্যমেই বাংলার সমগ্র শোষিত ও মেহনতি জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আসতে পারে। আমরা এও দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি যে এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের সাথে বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে।
প্রথমতঃ রাষ্ট্রের নাম হওয়া উচিত জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা (People’s Republic of Purba Bangla)। যেহেতু দুই বাংলা ছিল এক বাংলা, তাই ‘বাংলাদেশ’ নামটিতে সমগ্র বাংলাদেশ কে বুঝায় এবং এতে বিভ্রান্তি থেকে যায়।
রাষ্ট্র মূল নীতি সমূহঃ
(১) সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দেশকে অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ হতে উন্নত শিল্প প্রধান দেশ রূপে গড়ে তুলতে হবে। দেশকে শিল্পায়িত দেশরূপে গড়ে তোলার জন্য সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পূর্ব ধাপ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে মূল বাধারূপে তিনটি শত্রু সমাজের উপর পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। এ তিনটি শত্রু হচ্ছে- (১) উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ, (২) দেশীয় সামন্তবাদ এবং (৩) আমলাতান্ত্রিক শোষণ।
পাকিস্তান উপনিবেশবাদ, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বা নয়া-উপনিবেশবাদ, দেশীয় সামন্তবাদ (জোতদার-মহাজন) ও এদের দালালদের সমস্ত সম্পদ এবং দেশীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজি গণতান্ত্রিক সরকার বাজেয়াপ্ত করবে।
(২) রাষ্ট্র হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম। আনুপাতিক ভোট* ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ তাঁদের শ্রেণীভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচন করে পার্লামেন্ট গঠন করবে এবং এ পার্লামেন্ট হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কার্যকরী করার সর্বোচ্চ শক্রিশালী হাতিয়ার। ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের প্রতিটি নর-নারীর ভোটাধিকার থাকবে।
(৩) সকলের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এবং বৃদ্ধকালীন ভাতা প্রদান করার নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) সম্মুখে রেখে সমস্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী করা হবে।
(৪) বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল জাতি, উপজাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে।
(৫) এ রাষ্ট্র দেশের সকল রকমের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চুরি-ডাকাতি-রাহজানি, ভিক্ষাবৃত্তি, ব্যাভিচার, মদ-মাতলামি-জুয়া, ছেলেধরা, কালোবাজারি মজুতদারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র আঞ্চলিকতা প্রভৃতি যেসব সামাজিক অনাচার ও শোষণ-নিপীড়ন মানুষকে যুগ যুগ ধরে পঙ্গু করে এসেছিল- তার পরিপূর্ণ উচ্ছেদ করবে।
উপরোক্ত মূলনীতি সামনে রেখেই বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি জন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিম্নোক্ত কর্মসূচী হাজির করেছে-
১। কৃষক ও কৃষি সমস্যার ক্ষেত্রে
(ক) বাংলাদেশের আধাসামন্তবাদী ব্যবস্থার অবশেষকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করা হবে। “যে চাষ করে জমি তাঁর” এ নীতির ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থার পুনর্গঠন করা হবে। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব তিন শত্রুর এবং তাদের দালালদের সমস্ত বাজেয়াপ্ত জমি ও কৃষি যন্ত্রপাতি ক্ষেতমজুর, বর্গাচাষী ও গরিব কৃষকদের মধ্যে প্রয়োজনের অনুপাতে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।
(খ) বিপ্লব মিত্র শিবিরে অনেক অকৃষক জমির মালিক আছে বা থাকবে যারা কৃষির আয়ের দ্বারা স্বাচ্ছন্দে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে না বলে অন্য পেশা গ্রহণ করেছে- কৃষক হিসেবে এদের ভূমিকা নেই। এদের জমি উচিত মূল্যে সরকারী খরচে ক্রয় করে বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হবে। কিন্তু এদের জমি তখনই নেওয়া হবে যখন এরা নিজ নিজ পেশার আয়ের দ্বারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে, তার আগে না।
(গ) অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান এর মৌলিক প্রশ্নে অসহায় বিধবা ও অন্যান্য অকৃষক মানুষদের হাতে জীবনধারণের মূল উপকরণ হিসেবে যে জমি আছে তা উচিত মূল্যে সরকারী খরচে ক্রয় করে নেওয়া হবে ও বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিলি করা হবে। তবে তা করা হবে ঐ সকল মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, রাষ্ট্র কর্তৃক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করার পর, তার আগে না।
(ঘ) আবাদযোগ্য পতিত জমি ও সরকারী খাস জমিসমূহ কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। ওয়াকফ, দেবোত্তর সম্পত্তি নামে যুগ যুগ ধরে কৃষকদেরকে শোষণ করা হচ্ছে তাকে বিলুপ্ত করা হবে। কিন্তু ধর্মীয় ও সৎ উদ্দেশ্যে যে ওয়াকফ বা দেবোত্তর করা হয়েছিল সে উদ্দেশ্য যাতে ব্যাহত না হয়, তার জন্য সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(ঙ) উন্নত ধরণের বীজ, সার ও বৈজ্ঞানিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কৃষিতে সেচসহ উন্নত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, জরুরী কার্যক্রম হিসেবে বন্যা ও জলস্ফীতি প্রতিরোধের স্থায়ী দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে।
*আনুপাতিক ভোট বলতে বুঝায়ঃ- নির্বাচনে ব্যক্তি না হয়ে পার্টি প্রার্থী হবে। জনগণ পার্টিগুলোকে ভোট দেবে। যে পার্টি সারা দেশে যত বেশী ভোট পাবে তা একত্র করে সম্পূর্ণ প্রদত্ত ভোটের অনুপাতে পার্লামেন্ট ঐ পার্টির প্রতিনিধির সংখ্যা নির্দিষ্ট হবে। তারপর ঐ পার্টি ব্যক্তি নির্দিষ্ট করে দেবে (অর্থাৎ পার্লামেন্ট মনোনিত করে পাঠাবে)। এ অবস্থায় কোন ভোটারের ভোট অপ্রতিনিধিত্বমূলক থাকে না।
(চ) বাংলাদেশের জলসম্পদের যথাযথ উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বিদেশী রপ্তানির উদেশ্যে বনজসম্পদ, বন্যপশু-পক্ষী-কীট্ট-পতঙ্গদের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি সাধন করা হবে এবং মৎসশিল্পে বৈজ্ঞানিক প্রথা প্রবর্তনসহ উহার সার্বিক উন্নতি সাধন কর হবে।
(ছ) কৃষিশ্রমিক বা ক্ষেতমজুরদের জন্যে উপযুক্ত মজুরি পাবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(জ) জাতীয় শত্রু জোতদার-মহাজনদের নিকট যে সমস্ত কৃষক-মজুর ও গরীব কুটিরশিল্প যুগ যুগ ধরে ঋণদায়গ্রস্থ, তাদেরকে ঐ ঋণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করা হবে।
(ঝ) কৃষকদের জন্যে এবং কুটিরশিল্পীদের জন্য বিনাসুদের দীর্ঘিমেয়াদী ঋণ পাবার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাঁহাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির উচিত মূল্য পাবার ব্যবস্থা করা হবে। কৃষকদের মত কুটিরশিল্পীদের্ব প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে।
(ঞ) কৃষক ও কুটিরশিল্পীদের স্বার্থে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সমবায় গঠনের জন্যে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান করা হবে। পর্যায়ক্রমে কৃষি সমবায়, পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ সমবায় প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(ট) জনসাধারণকে যৌথ অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় উদবুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু সংখ্যক আদর্শ যৌথ খামারের প্রবর্তন করা হবে।
২। শ্রমিক ও শ্রম সমস্যার ক্ষেত্রে
(ক) শ্রমিকদের জন্য মানুষের মত বেঁচে থাকার উপযোগী মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
(খ) দৈনিক অনাধিক আট ঘণ্টা শ্রমের রেওয়াজ প্রতিটি শিল্প-ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কড়াকড়িভাবে চালু করা হবে। অবশ্য প্রয়োজনে ৮ ঘণ্টার অধিক শ্রমের জন্য দ্বিগুণ হারে উপরি পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা হবে।
(গ) অবসরপ্রাপ্ত বা কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু বা কার্যে অক্ষম হয়ে গেছে এমন শ্রমিকদের জন্য সরকার ও মালিকদের খরচে বিশেষ মজুরি (গ্রাচুইটি), বীমা ও পেনশনের ব্যবস্থা করা হবে।
(ঘ) শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় বাসস্থান এবং অবসর বিনোদন কেন্দ্রের ব্যবস্থা রাখা হবে।
(ঙ) শ্রমিকদের জীবনধারণের মান ও চাকরির শর্ত উন্নত করার প্রয়োজনে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, মালিকদের সাথে যৌথ দর কষাকষি ও ধর্মঘট করার পূর্ণ অধিকার দেওয়া হবে।
৩। শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে
(ক) কৃষিনির্ভর অবস্থা থেকে দেশকে দ্রুত শিল্পসমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা হবে এবং এ নীতির উপর ভিত্তি করে শিল্পব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা হবে।
(খ) রেল, স্টিমার ও স্টেটবাস ব্যাঙ্ক, বীমা, পোর্ট, ডাক এবং কাগজ, পাঁট, বিদ্যুৎ, তৈল, খনি, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, অস্ত্র কারখানা ও বিআইডিসি, ওয়াপদা ও বিসিক কর্তৃক নির্মিত কারখানা ইত্যাদি মূল শিল্প ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত থাকবে।
(গ) দেশকে দ্রুত আত্মনির্ভরশীল ও শিল্প-সমৃদ্ধ করার নীতিকে ছোট ও মাঝারি শিল্প এবং শিল্পপতিদের সরকারী সহযোগিতা দেওয়া হবে। অল্প সুদে ঋণ প্রদান ও যুক্তিসংগত দামে কাঁচামাল ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা ও বাজারের সুযোগ-সুবিধা লাভে তাদের সাহায্য করা হবে।
(ঘ) রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার ও শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মারফত যৌথভাবে পরিচালনা ব্যবস্থা করা হবে। অন্যথায় আমলাতান্ত্রিক শোষণ হতে শিল্পকে রক্ষা করা যাবে না এবং শিল্প বিকাশের পক্ষে এগুনো যাবে না, যেহেতু আমলারা লুটের মাল হিসেবে শিল্পকে এ যাবৎ ব্যবহার করেছে।
(ঙ) ব্যক্তিগত মালিকানায় শিল্প ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যাধিক মুনাফার ফলে যাতে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ না ঘটে, শ্রমিক যাতে উপযুক্ত মজুরি ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তার জন্য এবং দ্রব্যমূল্যের প্রশ্নে জনসাধারণের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে মুনাফার উপর উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হবে।
(চ) আভ্যন্তরীণ খাদ্য ও পাঁট ব্যবসা এবং সমস্ত প্রকারের বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্যক রাষ্ট্রায়ত্ত করা হবে।
৪। ছাত্র ও শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে
(ক) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থার অমূল পরিবর্তন সাধন করা হবে। সর্বস্তরে বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী শিক্ষার প্রচলন করা হবে। কারিগরী ও বাস্তবমুখী শিক্ষার প্রাধান্য দেওয়া হবে।
(খ) মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক রাখা হবে। এরপর সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। শ্রমিক, কৃষক ও অল্প আয়ের লোকের ছেলেমেয়েদের জন্যে মাধ্যমিক শিক্ষার পরও দশন মান পর্যন্ত সরকারী খরচে শিক্ষা দেওয়া হবে। এদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের জন্য সরকারী খরচে উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(গ) উপরোক্ত শিক্ষাব্যবস্থার জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষালয় এবং তার আনুষঙ্গিক যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(ঘ) বাংলা ভাষার মাধ্যমে যাবতীয় শিক্ষা প্রদানের যথাযথ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন করা হবে।
(ঙ) ধর্মীয় শিক্ষার অবাধ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে।
৫। চিকিৎসা ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে
(ক) চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জনসেবা এবং আরোগ্যের চাইতে প্রতিরোধ শ্রেয়তর (Prevention is better than cure) ঐ নীতিদ্বয়ের উপর ভিত্তি করে পরিচালনা করা হবে।
(খ) নিম্ন আয়ের লোকেরা যাতে সরকারী খরচে উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ লাভ করে তার ব্যবস্থা থাকবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে মাতৃসদন, দাতব্য চিকিৎসালয়, আরোগ্য নিকেতন ও জটিল রোগের চিকিৎসা কেন্দ্র চালু রাখা হবে। বিনা চিকিৎসাইয় একজন লোকও যাতে মারা না যায় তার ব্যবস্থা থাকবে।
(গ) এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী ও হেকিমী বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের যথাযোগ্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে।
(ঘ) সকল মানুষের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু যতদিন পর্যন্ত পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, ততদিন পর্যন্ত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্যে গৃহনির্মাণের প্রয়োজনীয় উপকরণ কম মূল্যে (Subsidized price) সরবরাহ করা হবে। শহর শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্রে স্বল্প ভাড়ায় ঘর পাবার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৬। বিচার ব্যবস্থা ও আইন সম্বন্ধীয় ক্ষেত্রে
(ক) জনসাধারণের স্বার্থের জন্যে আইন, আইনের জন্য জনসাধারণ নহে- ঐ নীতির ভিত্তিতেই আইন ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হবে। বিচার যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, তার জন্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হতে পৃথক করা হবে।
(খ) বিনাবিচারে কাহাকেও শাস্তি দেওয়া বা হয়রানি করা হবে না। যে কোন আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি এমন ব্যক্তির উচ্চতর আদালতে আপীল করার অধিকার থাকবে। অভাবগ্রস্তদের জন্য বিনা খরচে আইনগত সাহায্য ও পরামর্শ লাভের ব্যবস্থা থাকবে।
(গ) ছোটখাট ও প্রাথমিক বিরোধের যাতে শুরুতেই অবসান হয় তাঁর জন্য গণয়াদালতের ব্যবস্থা থাকবে।
(ঘ) বিচার ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচলন করা হবে। প্রতিটি বিচারক জনসাধারণ কর্তৃক যথাযথভাবে নির্বাচিত হবেন। প্রয়োজনবোধে নির্বাচকমন্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিচারককে প্রত্যাহার এবং তদস্থলে নতুন বিচারক নির্বাচিত করতে পারবেন।
(ঙ) অন্যায় অবিচার বা অসদাচরণের দায়ে কোন বিচারককে উচ্চতর আদালতে অভিযুক্ত করা যাবে।
৭। ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে
(ক) রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে। যার যার ধর্ম তার কাছে পবিত্র এবং ধর্মের ব্যাপারে কোনরূপ জবরদস্তি নেই- ধর্ম প্রসঙ্গে এ নীতি কড়াকড়িভাবে কার্যকরী হবে। ধর্মের ব্যাপারে কোন বৈষম্যমূলক আচরণ যাতে না ঘটতে পারে তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখা হবে; অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন জরার সুযোগ পাবে। রাষ্ট্র প্রত্যেক ধর্মের স্বীকৃতি ও ধর্ম পালকদের অবাধ অধিকার থাকবে- কিন্তু ধর্মের নামে কোন প্রকার জোর-জুলুম করা বা করা বা শোষণ চলতে দেওয়া হবে না।
(খ) বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক রাষত্রের সংস্কৃতি বা তমদ্দুনের ভিত্তি-
১) বাঙ্গালী জাতির সংস্কৃতির বিকাশ ও তার উন্নয়ন সাধন;
২) সংস্কৃতি ও সাহিত্য মেহনতি জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে রূপায়িত করা;
৩) গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রের মূলনীতি বা আদর্শেও বিরোধী যাবতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রকাশ, প্রচার ও প্রসার রোধ করা;
৪) কুরুচিপূর্ণ যাবতীয় গান, বাজবা, সিনেমা, থিয়েটার, শিল্পকলা ইত্যাদি তথাকথিত শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর কঠোর বাধানিষেধ আরোপ করা;
৫) জনগণের সর্বস্তর সুন্দর, সুষ্ঠ স্বাভাবিক মননশীলতা ও মানসিকতা যাতে গড়ে ওঠে তার জন্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৮। খাজনা ট্যাক্স ও করের ক্ষেত্রে
(ক) সকল প্রকারের ইজারাদারীসহ প্রচলিত খাজনা প্রথার বিলোপ সাধন করা হবে। সমস্ত বকেয়া খাজনা মওকুফ করা হবে। ‘খাজনা প্রথার স্থলে উৎপাদন অনুসারে কর আদায়ের প্রথা প্রবর্তন করা হবে। নিম্ন আয়ের কৃষক ও গরীব কুটির শিল্পীদে জন্য- যাদের ভরণ পোষণের পর উদ্বৃত্ত থাকে না- তাদেরকে রেহায় দেওয়া হবে।
(খ) শিল্প-কৃষি ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রমিক উচ্চ হারের কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে, অর্থাৎ উচ্চ আয়ের জন্য উচ্চতর হার এবং নিম্ন আয়ের জন্য নিম্নতর হারে কর আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে এবং পরোক্ষ ট্যাক্স প্রথা বিলোপ করা হবে।
৯। নারী সমাজের ক্ষেত্রে
(ক) নারীর যে সমস্ত সামাজিক অব্যবস্থা বা দূর্নীতির দরূন যুগ যুগ ধিরে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হয়ে আসছে সেগুলোর অবসান ঘটানো হবে। সম্পত্তির উত্তরাধিকতার, বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, বৃত্তিগ্রহণ ও চাকুরীতে প্রবেশ প্রভৃতি বিষয়ে নারীরা পুরুষদের সমান অধিকার ভোগ করবে।
(খ) নর ও নারীর সমান অধিকার থাকবে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান কাজের জন্য সমান মজুরির ব্যবস্থা রাখা হবে। গর্ভাবস্থায় সংকটকালীন সময়ে মেহনতকারী নারীকে সর্বোত্তম প্রয়োজনীয় ছুটি ও বিশেষ চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হবে
১০। উপজাতি ও তপসিলীদের ক্ষেত্রে
(ক) বাংলাদেশের যে সমস্ত অনুন্নত উপজাতি আছে তাদের মাতৃভাষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের উন্নয়ন করা হবে।
(খ) চাকরি এবং অন্যান্য সামাজিক ও শিক্ষাগত সুযোগের ক্ষেত্রে উপজাতি, তফসিলী ও অন্যান্য পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।
১১। রাষ্ট্র কাঠামো ও সরকারী প্রশাসনের ক্ষেত্রে
(ক) বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা হবে এককক্ষবিশিষ্ট। ঐ আইনসভা হবে – জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের স্বার্থের রক্ষক ও জনগণের মধ্যে থেকে আসা-গণপ্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ সংস্থা।
(খ) বিপ্লবের তিন শত্রু বা তাদের সাহায্যকারী দালালদের কোনরূপ নাগরিক অধিকার বা ভোটাধিকার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকবে না। ঐ নির্দিষ্ট সময়ে সরকারী শাসন বা প্রশাসন ব্যবস্থায় তাদেরকে কোনরূপ অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু তাঁরা যাতে তাদেরও প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন করে নতুন সমাজের নতুন মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারে- তার জন্য রাষ্ট্র উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(গ) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জেল ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে অপরাধীদের নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নতি সাধন করে তাদের পূনর্বাসন করবে।
(ঘ) পার্লামেন্ট, আইনসভা বা স্থানীয় শাসন বা প্রশাসন সংস্থাগুলোর নির্বাচনে জনসাধারণের মধ্যে যারা আঠার বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এবং মানসিক সুস্থ অবস্থায় আছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের সকলেরই সার্বজনীন, সমান ও প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার থাকবে। সংশ্লিষ্ট নির্বাচকমন্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রয়োজনবোধে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার (Recall) করতে এবং নতুন প্রতিনিধি নির্বাচিন করতে পারবে। গোপন ব্যালট প্রথাত ভোটদান ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে।
(ঙ) দেশে ব্যাপক গণপঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রচলন করা হবে। স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থায় গণপঞ্চায়েতের প্রাধান্য থাকবে।
(চ) সর্বনিম্ন প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত সকল সরকারী প্রশাসক ও পরিচালক জনসাধারণের গোপন, সমান ও প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। প্রধানতঃ স্থানীয় জনসাধারণ থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসক বা পরিচালক নির্বাচিত করা হবে। নির্বাচকমন্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রয়োজনবোধে উপরোক্ত যেকোন প্রশাসক বা পরিচালককে প্রত্যাহার করে নতুন প্রশাসক বা পরিচালক নির্বাচিত করতে পারবে।
(ছ) যে কোন প্রশাসক বা পরিচালকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
(জ) দেশের সামরিক, আধা-সামরিক বা প্যারা-মিলিশিয়া বাহিনীর সর্বত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তাদের ভোটাধিকার থাকবে। আমাদের দেশের সামরিক বাহিনী এ যাবৎ যে দাসত্বমূলক অবস্থায় বা মৌলিক অধিকারবিহীন অবস্থায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়ে এসেছে, তার থেকে তাদের মুক্ত করা হবে। তাদের দেশপ্রেমকে আরও উন্নত করার জন্য এবং গণতন্ত্রের ভাবধারায় তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করার জন্য যথাযথ সরকারী প্রচেষ্টা থাকবে।
(ঝ) দেশরক্ষার কাজে যাতে দেশের সমস্ত নাগরিক বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষক প্রয়োজনবোধে অংশগ্রহণ করতে পারে- তার জন্য উপযুক্ত সামরিক শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
(ঞ) বিপ্লবে অংশগ্রহণের কারণে যারা পঙ্গু বা বিকলঙ্গ ও শহীদ হয়েছেন বা হবেন যথাক্রমে তাদের বা তাদের পরিবারের উপযুক্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকার বহন করবে।
(ট) বিপ্লবে জড়িত থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণের প্রতিটি অংশকে পুনর্বাসন করা হবে। বিল্পব চলাকালে পূর্ব বাংলার যে সকল অধিবাসী দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে তাদের সম্পত্তি ফেরত পাবার ও তাদের পুনর্বাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করবে।
১২। বৈদেশিক ও আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে
(ক) বিশ্বের ধনবাদী-সাম্রাজ্যবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক এই দুই শিবিরের মধ্যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার নিঃসন্দেহে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পক্ষেই থাকবে।
(খ) বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিভিন্ন নিপীড়িত জাতির বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তির ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে থাকবে এবং সামর্থ্য অনুসারে ঐ সমস্ত জাতিকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করবে।
(গ) বিশ্ব সর্বহারার সমর্থনে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হবে। প্রত্যেক জাতির নিপীড়িত জনসাধারণের সাথে আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও সৌহার্দ্যের নীতি সরকার গ্রহণ করবে।
(ঘ) গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ্র রাষ্ট্র প্রতিবেশীদের সঙ্গে- যথা ভারত, বার্মা, নেপাল, সিংহল ও মহাচীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে স্থাপন করে চলবে এবং এই রাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার সাথে পঞ্চশীলার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতি অনুসরণ করে চলবে।
[১৯৭১ সালের ৩০শে, ৩১শে নভেম্বর ও ১লা ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস (দ্বিতীয় বিশেষ) গৃহীত রাজনৈতিক দলিলের ভিত্তিতে রচিত]
বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড আবুল বাশার কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।
<৪,২৪৩,৫৩৭-৫৪১>
অনুবাদকঃ জিহাদ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৩। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কর্তব্য সম্পর্কে পার্টি সার্কুলার বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পার্টি সার্কুলার
(পার্টি সভ্য, কর্মী ও দরদীদের জন্য)
মুক্তিযুদ্ধের নতুন অধ্যায় ও আমাদের করণীয়
আট মাসের কঠোর ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আজ সাফল্যের দ্বারে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। যে নর-পিশাচের দল বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ হত্যা করিয়া, অগণিত অসহায় নারীর মান-সম্মান বিনষ্ট করিয়া এবং এক কোটি নিরপরাধ লোককে দেশ ছাড়া করিয়া বীরত্বের পয়াকাষ্ঠা দেখাইয়াছিল তাহারা আজ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় যৌথ দুর্বার আক্রমণের সম্মুখে প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যেই মুক্ত হইয়াছে এবং আশা করা যায় রাজধানী ঢাকাতে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হইবে।
ভারতের উপর আগ্রাসী আক্রমণ
সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল ইয়াহিয়া সরকারের সেনাবাহিনীর গণহত্যা, গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, নারীধর্ষণ প্রভৃতি বর্বর অত্যাচার চালাইয়া মুক্তিসংগ্রামকে রক্তের বন্যায় ডুবাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তা সম্পূর্ণ ব্যার্থ হইয়াছে। জনগণের ইয়াহিয়া-চক্রবিরোধী লৌহদৃঢ় ঐক্য, দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রামের প্রতি ভারতের জনগণের আকুণ্ঠ সমর্থন, ভারত সরকারের সাহায্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ এবং দুনিয়ার প্রগতিশীল জনগণের সহানুভূতির ফলে ইয়াহিয়া সরকারের চক্রান্ত প্রথম ধাপেই বানচাল হইয়া গিয়াছে। দুর্জয় মুক্তিবাহিনীর নিকট পর্যদুস্ত হইয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ইয়াহিয়া খান পাক-ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত করিয়া সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের হস্তক্ষেপের ষড়যন্ত্র করিতে থাকে।
গত ৩রা ডিসেম্বর অতর্কিতে ভারতের উপর পাকিস্তানের বিমান আক্রমণ এবং ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা ঐ ষড়যন্ত্রেরই অঙ্গ। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এই আক্রমণ প্রকৃতপক্ষে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেই আক্রমণ।
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী
বর্তমান অবস্থায় গত ৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারের স্বীকৃতি একটি সময়োচিত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা এ জন্য ভারতের জনগণ ও ভারত সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতির ফলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী ও চীনের সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ন্যায্য লড়াই ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালিত হওয়ার ভিত্তি রচিত হইয়াছে।
ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিদানের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী একযোগে মিত্রবাহিনী হিসেবে সাধারণ শত্রু ইয়াহিয়া-চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে। এই সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁহাদের বহু ঘাঁটি ছাড়িয়া প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছে। বাংলাদেশের বহু অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে এবং আশা করা যায়, শীঘ্রই বাংলাদেশ পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করিবে। আমরা আজ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াছি।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এবং পার্টির কর্মীরা যে যেখানে আছেন, উক্ত মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সহুযোগিতা করিয়া কাজ করিবেন যাহাতে পাকবাহিনী তাড়াতাড়ি বিধ্বস্ত হইয়া আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। ইহা আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, যদিও ভারতীয় সৈন্যবাহিনী একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী, তবুও এই বাহিনী বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সাহায্যে আগাইয়া আসিয়াছেন এবং পাকবাহিনীর সহিত সম্মুখরণে রক্তও ঢালিতেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থেই এই বাহিনীকে সর্বতভাবে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য এবং এই কাজে জনগণকে উৎসাহিত করিতে হইবে। বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ও মৈত্রী ঘনিষ্টতর করিয়া আমাদের দেশের উপর প্রতিক্রিয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপের পথ রুদ্ধ করিতে সাহায্য করিবে।
মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েতের অবদান
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যে মহান সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে আগাইয়া আসিয়াছে, তাহা অতুলনীয়। ২৫ শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া-চক্রের গণহত্যা প্রভৃতি শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই দুনিয়ার বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ভিতর একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদনগি গণহত্যাড় তীব্র নিন্দা করেন এবং সে নির্যাতন বন্ধ, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, তাঁহার হাতে ক্ষমতা অর্পণ ও বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে একটা সন্তোষজনক রাজনৈতিক মীমাংসা করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেন। তখন হইতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ সম্পর্কে ঐ সমর্থন সূচক নীতি দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করিয়াছে। এই নীতির ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে নিজ দেশের জনগণকে সমাবেশ করিয়াছেন এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দুনিয়াতে একটি প্রবল জনমতও সৃষ্টি করিয়াছেন।
ইয়াহিয়া খান যখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতেছিল তখনই সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই মুক্তি সারা এশিয়াতে শান্তির একটা দৃঢ় রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করিতেছে। উপরন্তু, ইহার ফলে ও বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েতের সমর্থন নীতি হেতু ভারত সরকারও ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী নীতি গ্রহণ করিতে আরও অনুপ্রাণিত ও উতসাহিত হইয়াছেন।
সম্প্রতি পাক-ভারত যুদ্ধ বাধিবার পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ও চীনের মাওবাদী নেতৃত্ব ইয়াহিয়ার পাশে দাঁড়াইয়া নিরাপত্তা পরিষদের মারফত বাংলাদেশ ও এই উপমহাদেশে হস্তক্ষেপ করার চক্রান্ত করে। ইহাতে আমাদের মুক্তির সংগেয়ামের সামনে একটা সংকট উপস্থিত হয়। সেই সংকট সময়ে সোভিএত ইউনিয়নই নিরাপত্তা পরিষদে তাহার ভেটো প্রয়োগ করিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের মাওবাদী নেতৃত্বের চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া দেয় এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যে বিরাট অবদান রাখে।
বস্তুতঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমাবধি ইয়াহিয়া-চক্রের বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়াইয়াছে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমাদের মুক্তি সংগ্রকামকে প্রভূত সাহায্য করিয়াছে ও করিতেছে। দুনিয়ার নীপিড়িত জাতি সমূহ ও জনগণের ন্যায্য অধিকারের সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ার যে নীতি সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই অনুসরণ করিয়াছে, সেই প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকভাবে নীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকিয়াই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়াইয়াছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু। সোভিয়েতের সাহায্য ও সমর্থনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি।
আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নাই
কিন্তু আমাদিগকে আত্মসন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সাম্রাজ্যবাদীরা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের উপর তাহাদের কব্জি শিথিল হইয়া যাওয়ার আশঙ্কায় উন্মাদের মত আচরণ করিতেছে। ইয়াহিয়া-চক্রের ব্যাপক নরহত্যা এবং নানা পাশবিক অত্যাচারের কথা বেমালুম চাপিয়া গিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা এখন ভারতকেই আক্রমণকারী বলিয়া অবিহিত করিতেছে এবং বশংবদ ইয়াহিয়া সরকারকে টিকাইয়া রাখার জন্য পথ খুঁজিতেছে। এ জন্য তাহারা সম্ভবপর হইলে যে কোন ঘৃণ্য পদ্ধতি গ্রহণ করিতে পারে, এমন কি খোলাখুলি হস্তক্ষেপ করিতেও দ্বিধা না করিতে পারে। অন্যদিকে চীনের নেতৃত্ব মার্কসবাদ- লেনিনবাদের পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং সুবিধাভোগী নীতি অনুসরণ করিয়া প্রতিক্রিয়াশীল ইয়াহিয়া সরকারকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন জানাইতেছে, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের বিরুদ্ধাচরণ করিইতেছে এবং ভারত সরকারকে আক্রমণকারী আখ্যা দিয়া নানা প্রকার হুমকি দিতেছে। জাতিসংঘ চীন বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্তের প্রতি সমর্থন দিতেছে। তাই, এইরূপ একটি আশঙ্কাও দেখা দিয়াছে যে, অন্ধ সোভিয়েত বিরোধিতা হইতে চীন-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সহিত সোভিয়েত বিরোধী তথা সমাজতন্ত্রবিরোধী চক্রান্তে শামিল হইয়া চীন-সোভিয়েত সংঘর্ষ সৃষ্টি করিতে পারে। এমন আশঙ্কা আছে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ও চীনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ হইলে বাংলাদেশ প্রশ্নকে ভিত্তি করিয়া বাংলাদেশের বুকে এমন কি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এক প্রলংকারী যুদ্ধের সৃষ্টি হইতে পারে এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ব্যাহত হইতে পারে।
আমাদিগকে এই বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকিতে হইবে এবং সকল প্রকার অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে।
সাম্রাজ্যবাদীদের ও চীনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টি করিতে হইবে এবং মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রতর করিয়া দ্রুত অর্জন করিতে হইবে।
সাফল্যের পথে মুক্তিযুদ্ধ
যদি বাহিরের কোন হস্তক্ষেপ না হয়, তবে বর্তমানে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে, যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সাফল্য অর্জন করিতে পারে। এই সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টি রাখিয়াই আমাদের পার্টির বর্তমান করণীয়গুলি স্থির করিতে হইবে।
করণীয়ঃ
(১) আজ আমাদের স্বাধীনতা সংগাম সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে আসিয়া পৌছিয়াছে। ইহা উপলব্ধি করিয়া মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীতে আমাদের কর্মী ও সমর্থকগণ সুদৃঢ় সক্রিয় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করুন। যাহাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপূর্ণ বিজয় ত্বরান্বিত হয়। বলাবাহুল্য যে, আমাদের কর্মী ও সমর্থকগণ মুক্তিবাহিণি ও মিত্রবাহিনীর সাধারণ কার্যক্রম মানিয়া নিয়া তাহাদের সঙ্গে সহযোগিতা করিয়া সংগ্রাম পরিচালনা করিবন।
(২) মুক্রিযুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় ত্বরান্বিত করা ও অন্যান্য কর্তব্য সম্পর্কে আজ দেশবাসীকে সচেতন, সংগঠিত এবং সক্রিয় করা এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ হিসেবে দেখা দিয়াছে। আমাদের পার্টির যেসব কর্মী ও সমর্থক দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়াইয়া আছে, তাহাদের কর্তব্য হইবে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জনগণকে সক্রিয় করিয়া তুলিতে চেষ্টা করা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যাহাতে জনগণ পরিপূর্ণ সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণ করে তাহার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করিতে হইবে। যে সমস্ত পার্টি সভ্য ও কর্মী প্রবাসে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহারাও অবিলম্বে স্ব স্ব জেলা কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরিয়া আসিতে শুরু করিবেন এবং সেখানে গিয়া উপরোক্ত কাজগুলি শুরু করিয়া দিবেন।
(৩) মুক্তিযুদ্ধকে দ্রুত সাফল্যমন্ডিত করা ও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন, সমৃদ্ধাশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়িয়া তোলার জন্য পার্টিও সমস্ত সদস্য, কর্মী ও সমর্থকগণ প্রতিনিয়ত জনতার স্বার্থে কাজ করিয়া যাইবেন এবং পার্টির নীতি ও কর্মসূচী জনগণের মধ্যে অবিরত প্রচার করিবেন।
(৪) যেসব অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে বা হইতেছে সেসব অঞ্চলের গ্রামে, ইউনিয়নে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলমতের প্রতিনিধিদের লইয়া সর্বদলীয় গণকমিটি (People’s committee) গঠন করার চেষ্টা করিতে হইবে। এই কমিটির উপরেই সেই অঞ্চলের প্রশাসনিক ক্কাজের দায়িত্ব যাহাতে দেওয়া হয়, সে জন্য চেষ্টা করিতে হইবে।
(৫) প্রতিটি মুক্ত অঞ্চল অন্যতম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হইল আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। ইহা করতেই হইবে। জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান করিতে হইবে। অবাঙ্গালীবিরোধী বা কোন প্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা যাহাতে না হয় তার জন্য যথাসাধ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
(৬) মুক্ত এলাকাইয় খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদির সুষ্ঠ বিতরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করিতে হইবে। জনগণের উপর কোন জোর-জুলুম করা চলিবে না। স্কুল, কলেজ, হাটবাজার প্রভৃতি আবার চালু করিয়া তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরাইয়া আনার চেষ্টা করিতে হইবে।
সকলের মিলিত প্রচেষ্টা দরকার
মুক্তিযুদ্ধ সাফল্যমন্ডিত হওয়ার পরপরই আমাদিগকে নানা ধরণের গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইবে। বিপুল সংখ্যক শহরণার্থী পুনর্বাসনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করা, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভাঙ্গাচোরা অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করা, ভবিষ্যতে দেশকে গড়িয়া তোলার জন্য এবং বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করার কাজ আমাদের সামনে উপস্থিত হইতেছে। জনতার পরিপূর্ণ আস্থা ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া উক্ত বিরাট কাজ সুসম্পন্ন করা সম্ভবপর নয়।
এই জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করা ও সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য আমরা প্রথম হইতেই ঐক্যবদ্ধ জাতীত ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব করিয়াছি। বর্তমান জটিল ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং দেশের পুনর্গঠনের কাজ সুচারুরূপে অগ্রসর করার জন্য ঐরূপ ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাইয়াছে। কোন দলকে ছোট মনে করা তাহার প্রভাবকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য নয়, দেশবাসীকে সুদৃঢ় ঐক্য গঠনের জন্য ইহা একান্ত প্রয়োজন। এইরূপ ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট দেশ পুনর্গঠনের উপযোগী একটা কার্যক্রম গ্রহণ করিয়া উহা কার্যকরী করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করিতে পারে। এই কার্যক্রমের মূল কথা হইবে- দেশকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবমুক্ত করিয়া একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উক্ত কার্যক্রমের মূল বিষয় হইবে- কৃষি জমির সিলিং নির্ধারণ করিয়া খোদ কৃষকের হাতে জমি বিতরণ; শ্রমিকদের বাঁচার মত নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ; চাকুরীর নিরাপত্তা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিতকরণ; ব্যাঙ্ক, বীমা, বড় বড় শিল্প, পাঁট ও আমদানী-রপ্তানী ব্যবসা প্রভৃতি জাতীয়করণ; ছোট ও মাঝারি শিল্পপতিদের জাতীয় শিল্প গড়িয়া তোলার ক্ষেত্রে উৎসাহ দান; সোভিয়েত ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সাহায্যে শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প গড়িয়া তোলা; সমতার ভিত্তিতে ভারতের সাথে সন্ধুত্বমূলক অর্থনৈতিইক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়িয়া তোলা; স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি গ্রহণ; সাম্রাজ্যবাদীদের শর্তযুক্ত সাহায্য বর্জন এবং সমাজতান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ দেশগুলির সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা।
গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর হইতেই আমরা ইয়াকে সমর্থন করিয়া আসিয়াছি এবং আমরা এই সরকারকে সমর্থন করি। তবে আমরা মনে করি যে, বর্তমানে দেশের সামনে যে সকল সমস্যাদেখা দিয়েছে, তাহা যথাযথভাবে সমাধান করার জন্য এই সরকারের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সংগ্রামী শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। ইহা দেশবাসীর মনে বিপুল অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি করিবে এবং দেশ গঠনের কাজে প্রতিটি মানুষকে সক্রিয় করে তুলিবে।
দেশ পরিপূর্ণভাবে স্বধীনতা অর্জনের পরে দেশে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রচনার প্রশ্ন দেখা দিবে। এ জন্য অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটে একটি শাসনতান্ত্রিক পরিষদ গঠন করিতে হইবে। এই শাসনতান্ত্রিক পরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্র রচিত হওয়ার পূর্বে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র যাহাতে সারাদেশের নিকট গ্রহণযোগ্য হইতে পারে সে জন্য সকল সংগ্রামী শক্তিগুলোর প্রতিনিধিদের সমবায় একটি সামরিক শাসনতন্ত্র পরিষদ গঠণ করা প্রয়োজন।
ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ফ্রন্ট গঠন, উহার একটি সাধারণ কার্যক্রম গ্রহণ, সম্প্রসারিত অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠন এবং অন্তর্বর্তী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রভৃতি বিষয়ে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা চালাইতে হইবে এবং দেশবাসীর মধ্যেও উহার সপক্ষে জনমত গড়িয়া তুলিতে হইবে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিকাহসের স্তরে তথা দেশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গঠন করার ক্ষেত্রে বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়ার দল আওয়ামী লীগকে আমরা সাধারণভাবে মিত্র বলিয়া গণ্য করি। বর্তমান অবস্থায় দেশবাসীর স্বার্থের অনূকুলে ও দেশ পুনর্গঠনের কাজে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করিয়া চলাই আমাদের সাধারণ নীতি। এই সহযোগিতার ভিতরেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের কাজের সমালোচনা প্রভৃতি মিত্রসুলভভাবেই পরিচালনা করিতে হইবে।
কমরেডগণ,
মাতৃভূমির যে স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের জনগণ গত আট মাস যাবৎ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করিয়া আসিতেছেন, সেই স্বাধীনতা আজ আমাদের স্বারে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। এক দশক আগে আমাদের পার্টি বাঙ্গালী জাতির আমতনিয়ন্ত্রণের যে দাবী ঘোষণা করিয়াছিল আজ সেই দাবী বাস্তবায়িত হইতে চলিয়াছে। ঘৃণ্য দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ও বৃটিশ সাম্রাজুবাদীদের আশীর্বাদে রচিত কৃত্রিম এবং সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র পাকিস্তান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দুর্বার আঘাতে আজ ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভিশাপ হইতে বাঙ্গালী জাতির মুক্তি আজ আসন্ন। দুনিয়ার বুকে জন্ম নিয়াছে এক নবীন গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র-বাংলাদেশ।
আমরা বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়িত জাতিসমূহও শীঘ্রই তাদের ন্যায্য জাতীয় ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য রুখিয়া দাঁড়াইবেন এবং তাহাদের ন্যায্য অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করিবেন। তাঁহাদের এই ন্যায্য সংগ্রামে আমাদের পার্টি সবসময় সাহায্য করিয়াছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
বাঙ্গালী আওয়ামী লীগ জাতির জীবনে আজ এক নূতন দিনের সূচনা হইতেছে। আসুন আমরা সবাই মিলিয়া শপথ গ্রহণ করি যে বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি জনগণকে অতীতের সমস্ত নঞ্চনা, শোষণ ও অত্যাচার হইতে মুক্ত করিব এবং স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এক সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন করিয়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে আগাইয়া যাইব।
কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি
৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১